আমি গাধা বলছি – ১২

বার

শেঠ ভুসুরিমল প্রায় আঁৎকে উঠে বলল,

‘গুরুজী; আপনি ধ্বংস হয়ে যাবে। একাজে হাত দিবেন না।’ ‘ধ্বংস হব কেমন করে? ধূমল আমাকে সবকিছু বাৎলে দিয়েছে, মাত্র আটচল্লিশ টাকায় ফিল্ম কোম্পানি খোলা যায়, মাত্র আটচল্লিশ টাকা।’

‘আপনার মাথাতো খারাপ হয়নি

গুরু?

‘শেঠ আমাকে অত গাধা মনে করো না। আমি সব বুঝে শুনে করছি। দাদা ধূমল আমাকে সবকিছু বুঝিয়ে দিয়েছে। সে বলছে মাত্র আটচল্লিশ টাকা দাও, আমি তোমাকে ফিল্ম কোম্পানি খুলে দেব। আমি তাকে একশ টাকা দিয়েছি। রাতারাতি সে ফিল্ম কোম্পানির সবকিছু বন্দোবস্ত সেরে কাল সকালে এখানে আসবে।’

‘ফিল্ম কোম্পানি কি ঘরের কথা যে, ইচ্ছা করলাম আর হয়ে গেল?’

‘তুমি বুঝতে পারছ না শেঠ, দাদা ধূমল আমাকে সবকিছু বুঝিয়ে দিয়েছে। তাছাড়া আমাদের এতে তেমন লোকসানই বা কি যাচ্ছে ? নগদ আটচল্লিশ টাকা আর তেমন কি? আটচল্লিশ টাকাতে যদি আটচল্লিশ লাখ টাকা মুনাফা পাওয়া যায় দোষ কি?’

‘এত টাকা লাভ কে দেবে আপনাকে?’

‘কি লাভ হবে আমি সব বুঝে নিয়েছি। তোমাকেও বুঝিয়ে দেব। কাল সকালে দাদা ধূমল আসলেই সব বুঝতে পারবে।’

পরদিন দাদা ধূমল তার বিজনেস ম্যানেজার সুমনকে নিয়ে এসে হাজির। সুমন দাদা ধূমলের চেয়েও হালকা পাতলা। তার চকচকে চোখ দু’টো চারিদিকে ঘনঘন ঘুরঘুর করছিল। চেহারায় চিরস্থায়ী একটা ক্ষুধার ছাপ কিন্তু মাথা বড় পরিষ্কার। তার চোখের শ্যেন জ্যোতি সবাইকে যেন কাতুকুতু দিচ্ছিল। শেঠ ভুসুরিমল বলল,

‘মাত্র আটচল্লিশ টাকায় ফিল্ম কোম্পানি, আবার তাতে আটচল্লিশ লাখ টাকা লাভ কি করে হয়?’ দাদা ধূমল একটা প্যাকেট খুলল। আমি বললাম, ‘এগুলো কি?’

‘এগুলো আপনার কোম্পানির লেটার প্যাড, এগ্রিরিমেন্ট ফরম আর রসিদ বই। আমার বিজনেস ম্যানেজার সুমন রাতারাতি এগুলো ছাপিয়ে নিয়েছে।’

‘দশ টাকাতো এতেই চলে গিয়েছে।’

‘নিজেদের পকেট থেকে এক পাই পয়সা যাবে না জনাব। সুমন বলল,

‘আমি প্রেসে কন্ট্রাক্ট করে নিয়েই এগুলো ছাপিয়েছি। আমাদের কোম্পানির সব কিছুই এখানে ছাপানো হবে। বড় বড় রঙিন পোস্টার ছাপান হবে। পাবলিসিটিতে যে পঁচিশ হাজার টাকা খরচ হবে, তার সবকিছু ওখানে ছাপা হবে।’

‘কিন্তু আটচল্লিশ টাকায়?’

‘আগে পুরোটা শুনে নাও ৮না শেঠ। চল্লিশ হাজার টাকার এক পয়সাও আমাদের দিতে হবে না, সব টাকা দেবে ডিস্ট্রিবিউটর।’

‘ডিস্ট্রিবিউটর আবার কারা?’ আমি জিজ্ঞেস করলাম,

‘তারাও আমাদের মত শেঠ। তারা আমাদের ছবি ডেলিভারী নেবে।’ ‘কিন্তু টাকা পয়সা ছাড়া ছবি হবে কেমন করে? ছবিতে নাকি বড় বড় অভিনেতারা কাজ করে। লাখো লাখো টাকা দিতে হয় তাদেরকে।

শুধু আটচল্লিশ টাকা দিয়ে তুমি কেমন করে ছবি তৈরি করবে?’

কেমন করে হবে তাইত বলছি, ‘অশনি কুমার বাল্যবন্ধু। সে আমাকে দাদা ধূমল ডাকে, আমিও তাকে দাদা গুনী বলি। গতরাতে আমি তার সাথে দেখা করেছি।’ আমি বললাম, ‘দাদা গুনী, আমার ছবিতে কাজ করবে? সে বলল, ‘এখন আমার হাতে গোটা বিশেক ছবি আছে। তোমারটাও তালিকাভুক্ত করে নেবো দোষ কি?’ আমি বললাম, ‘প্রথম দশদিন কিন্তু এক পয়সাও দিতে পারব না। আর অন্যান্যদের তুলনায় পয়সা কম দেব।’ সে বলল, ‘তুই হলি আমার বাল্যবন্ধু। তুই যদি এক পয়সাও না দিস, আমি কি করতে পারি? তবে আমি সচরাচর আড়াই লাখ টাকা নিয়ে থাকি। তুই না হয় দুই লাখ দিবি।’ আমি বললাম, ‘দু’লাখ টাকা দেব না, পৌনে দুলাখ দেব’। সে বলল, ‘তাই হোক, পয়সা দিয়ে আমাদের কি কাজ।

বন্ধুত্বই আমাদের বড় জিনিস’। সুমন বলল, ‘আর আমিও বিজেন্দ্র কুমার এর কাছে গিয়েছিলাম। এককালে আমরা দু’জন একই পরিচালকের অধীনে সহকারী হিসাবে কাজ করেছিলাম। সেকালে আমরা কত দুঃখ কষ্ট সহ্য করেছি। ভগবান আজ তাকে কত বড় বানিয়ে দিয়েছে। কিন্তু ধন্যবাদ দিতে হয় তাকে, বড় হয়েও সে বন্ধুদের ভুলে যায়নি। আমি যখন আমাদের ছবির কথা পাড়লাম, সে ভাবে গদগদে হয়ে আমার হাত চেপে বলল, শুয়োর, তোর ছবিতে কাজ করবোনা তো কার ছবিতে করব?’

‘সে তোমাকে শুয়োর বলল?

‘শুয়োর বলেছে আদর করে। কারণ, আমাদের মত এমন নিবিড় বন্ধুত্ব আর হয় না। আমি তাকে জিন্নি বলে ডাকি।’ আমি বললাম, ‘জিন্নি প্রথম দশদিন কিন্তু তোকে এডভান্স না নিয়েই কাজ করতে হবে। আর পয়সা-কড়িও কম দেব। সে বলল, ‘শুয়োর পয়সা দিয়ে কি হবে? অন্যের কাছ থেকে চার লাখ নিয়ে থাকি। তুই না হয় দু’লাখ দিবি, এইতো শেষে দু’লাখে সে রাজী হয়ে গেল।’

‘দু’লাখ, পৌনে দু’লাখে রাজী করালে ভাল হতো। অশনি মনে মনে কি বলবে?’ দাদা ধূমল বলল,

‘অসুবিধা হবে না, পৌনে দু’লাখেও রাজী করিয়ে নিতে পারব, ওতো আমার হাতের মানুষ।’

‘পৌনে দু’আর পৌনে দু’মিলে সাড়ে তিনলাখ টাকা হচ্ছে, এ টাকা কে দেবে?’ ‘দশদিনে তো আমাদের ছবির এক তৃতীয়াংশ শেষ হয়ে যাবে। তারপর, ডিস্ট্রিবিউটরদেরকে ছবি দেখিয়ে তাদের কাছ থেকে পয়সা নিয়ে নেব। একজন একলাখ দিলে দু’জন দু’লাখ দেবে। ব্যস, ওদিক থেকে চেক আসবে আর এদিকে দিয়ে দেব, নিজেদের পকেট থেকে এক পাই পয়সাও যাবে না। তাছাড়া ছবিও জনি ভাই-এর স্টুডিওতে তৈরি হবে। সে সেট তৈরি করবে। ফার্নিচার এবং পোশাক-আশাকও সে সাপ্লাই দেবে। চা পানি তার কেন্টিনে হবে, তার ল্যাবরেটরিতে ছবি প্রিন্ট হবে। মোটকথা, স্টুডিওর সব খরচ সে বহন করবে।’

‘সে কেন বহন করতে যাবে এসব খরচ?’

‘কারণ; ছবি তৈরি শেষ হলে আমরা তাকে দু’লাখ টাকা দেব।’ ‘কোত্থেকে দেব দু’লাখ টাকা আমরা?’

‘সে টাকাতো ডিস্ট্রিবিউটর দেবে। কারণ তারাই তো ছবি বাজারে ছাড়বে।’ ‘যাক, বুঝলাম ৷ নায়িকা?’

‘তারও বন্দোবস্ত হয়ে গেছে। এইমাত্র প্রেমবালার সাথে কথা পাকা-পাকি করে এলাম। আমিই প্রেমবালাকে প্রথম ছবিতে চান্স দিয়েছিলাম। সে আমার খুব অনুগত। সেও দশদিন পয়সা নেবে না।’

‘পয়সা যখন কোথাও লাগছে না, আটচল্লিশ টাকারইবা কি দরকার?’

‘মহরতের সময় কিছু চা পানি হবে। আমি হিসেব করে দেখেছি তাতে আটচল্লিশ টাকার মতন খরচ হবে।’ সুমন বলল।

‘ইচ্ছা করলে তারও বাকী বন্দোবস্ত করে নিতে পারি। এক দোকানের সাথে আমার জানাশোনা আছে। আমি বাধা দিয়ে বললাম,

‘না, দরকার নেই। মহরতের পয়সা বাকী রাখা ঠিক হবে না।’ শেঠ বলল,

‘কিন্তু কোম্পানির জন্য একটা ছোট-খাটো অফিসের তো দরকার। কেরানী টাইপিস্ট রাখতে হবে। একটা টাইপরাইটার না হলেও চলবে না।’ সুমন বলল,

‘শেঠ, কোম্পানির অফিস আপনার ওখানেই বানিয়ে নেবো। কোম্পানির জন্য এতটুকু কাজতো করতেই হবে। এরপর থাকে কেরানী ও টাইপিস্টদের চিন্তা। আমি নিজেই না হয় তা সামলে নেব। সামান্য হিসাবপত্র আমি নিজেই মেনটেন করতে পারব। আর টাইপও কোন রকমে চালিয়ে নিতে পারব। স্পীড মন্দ হয় না। শুধু পয়সা ব্যয় করে কি লাভ?’

‘ঠিকই এসব কাজ সুমনই চালিয়ে নিতে পারবে। আমাদের খরচ করতে হবে না। দাদা ধূমল বলল, আমি এবং শেঠ ভুসুরীমল পরস্পর মুখ চাওয়া-চাওয়ি করলাম। আমরা সবকিছু স্বীকার করে নিতে বাধ্য হয়ে যাচ্ছি। সত্যি, কোম্পানি খুলতে আটচল্লিশ টাকার বেশি খরচ হচ্ছে না। কিন্তু আটচল্লিশ লাখ কথাটা কেন যেন বেখাপ্পা মনে হচ্ছে। আমাদের মনের ভাব বুঝে দাদা ধূমল আবার শুরু করল,

‘শেঠ টেকনিক্যালারে ছবি তৈরি করবো। বেশি মাপের স্ক্রীন দেব। এমন হাইক্লাস ছবি বানাব যে, লোকেরা সিসিল ভি, ডি, মিলের কথাও ভুলে যাবে।’ ‘নাগিন’ ছবি তিন কোটি টাকার বিজনেস করেছে। মোগলে আজম ২৬ কোটি টাকার বিজনেস করেছে। শালার, আমার আটচল্লিশ লাখ না হয়ে তার কম বিজনেস হলেও আমাদের ক্ষতি কি? আমাদের পকেট থেকে তা এক পয়সাও যাচ্ছে না।’ সুমন বলল।

‘কোম্পানির নাম কি হবে?’ আমি লেটার প্যাডের প্যাকেট খুলতে খুলতে জিজ্ঞেস করলাম।

‘ডাংকিলা প্রডাকশন ৷’ সুমন বলল ৷ ‘ডাংকিলা প্রডাকশন।’ ধূমল বলল ৷ বলে দু’জনেই খুশি হয়ে আমার দিকে তাকাল। আমিও খুব খুশি হলাম। কারণ, বড় বড় হরফে চমৎকার টাইপে কোম্পানির নাম এবং তার উপরে ছোটোমতো একটা গাধার ছবি। দাদা ধূমল ছবিটি দেখিয়ে বলল,

‘শেঠ, এ হচ্ছে আমাদের কোম্পানির মনোগ্রাম। ছবিতেও সবার আগে পর্দায় এ মনোগ্রাম দেখা যাবে। ব্যস, এখন মুখ মিষ্টি করে মহরতটা চুকিয়ে ফেলো।’

কিন্তু এরপর ব্যাপারটা অন্যরকম হয়ে গেল। মহরতের সময় কেউ কেউ কোকাকোলা চাইল। শেষে এক গাড়ি কোকাকোলা আনতে হলো। আবার ওদিকে পান সিগারেটের কথা তা মনেই ছিল না। মহরতের যে জ্যোতিষী এসেছিল সে টাকা চেয়ে বসল। তারপর চারিদিকের দৌড়াদৌড়িতে বেশ পয়সা খরচ হচ্ছে দেখে আমরা একটা স্টেশন ওয়াগন কিনে নিলাম। গাড়িটা নতুনই কিনতে হল। কারণ, দাদা ধূমল বলল,

‘গাড়িতো খুবই জরুরী। এসব হল শো। শো না থাকলে বিজনেস হয় না। নতুন গাড়ি না থাকলে ডিস্ট্রিবিউটরদের থেকে টাকা বেশি গলানো যায় না। তাছাড়া আপনাদের মতো শেঠদেরকে আর এসব বুঝিয়ে বলতে হয়। শেঠদের নতুন মডেলের গাড়ি থাকতেই হয়। দশদিন পরে ডিস্ট্রিবিউটর থেকে ছ’লাখ টাকা এলে গাড়ির দাম আর ড্রাইভারের পয়সাকড়ি তা থেকে খসিয়ে নেয়া যাবে।

মহরতে সত্যিকারভাবে আটচল্লিশ টাকার মতো খরচ হয়েছিল। কিন্তু গাড়ী কেনা থেকে আরম্ভ করে চারিদিকে খরচ পত্র যখন হিসাব করা হলো, দেখা গেল আটচল্লিশ হাজার টাকার মত নেমে গেছে। শুধু মহরতে এত টাকা খরচ? আমি ভাবছিলাম সবকিছু বন্ধ করে দেব কিনা। কিন্তু শেঠ ভুসুরীমল বলল,

‘আমি এদ্দিন ধরে একটা জিনিস ভাবছিলাম। দাদা ধূমল আর সুমন অত্যন্ত ভাল লোক। কিন্তু ওরা বিজনেস বুঝে না। যদি আপনি বলেন কোম্পানির পরিচালনার ভারটা আমি নিয়ে নিই।’

‘সেটাতো বেশ ভাল কথা।’ আমি বললাম। শেঠকে কোম্পানি পরিচালনার কাজের জন্য চার আনা পার্টনারশিপেরও বন্দোবস্ত করে দিলাম আমি। শেঠ বলল, ‘পার্টনারশিপের আবার কি দরকার ছিল?

‘না সাহেব, আমি কারো হক মেরে খেতে চাই না। যে পরিশ্রম করবে তার পাওনাটা আজ হোক কাল হোক, পেয়ে যাওয়া দরকার। আর এতে আমারই বা অসুবিধাটা কোথায়? ডিস্ট্রিবিউটররা চেক পাঠাবে আর তা সবাইকে দিয়ে দেয়া হবে। নিজের পকেট থেকে তো পয়সা যাচ্ছে না।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *