আবার আফ্রিকার অন্ধকারে – ৫

আনা আরিয়া কোথায়? বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুষ্ঠানে তাকে দেখলাম না। প্রতিযোগিতায় দ্বিতীয় পুরস্কার সে পেয়েছে। তাও নিতে সে যায়নি। কোথায় সে? বলল পোপ ভিক্টর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস-চ্যান্সেলর ফাদার স্টিফেন ফেবিয়ান তার স্ত্রী শিলা সান্ড্রা স্টিফেনকে লক্ষ করে।

বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফিরে ওয়াশরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে তার শোবার ঘরে এসে বসেছে।

আজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠান ছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ে দ্য এন্ড ইস্টার্ন রিভাইভাল শীর্ষক বিষয়ে একটা প্রতিযোগিতার আয়োজন করেছিল। প্রতিযোগিতার রেজাল্ট দেয়া হয়েছে আজ সকালে। বিকেলে পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠান।

আনা আরিয়া ভাইস-চ্যান্সেলর ও ম্যাডাম ভাইস-চ্যান্সেলরের মেয়ে। সিভিলাইজেশন অব ম্যান বিষয়ের সে অনার্সের প্রথম বর্ষের ছাত্রী। অসাধারণ মেধাবী মেয়ে। এ পর্যন্ত কোনো সময়ই তার নাম দুনম্বরে যায়নি। প্রথম স্থান তার জন্যে অবধারিত। তার বিজ্ঞান পড়ার কথা ছিল, কিন্তু তার ভিসি পিতা তাকে বিজ্ঞানী নয়, সমাজকর্মী বানাতে চায়। এজন্যেই তাকে পড়ানো হচ্ছে সভ্যতার ইতিহাস। এই প্রতিযোগিতায় সেও একজন প্রতিযোগী ছিল। প্রতিযোগিতার বিষয়ে তার সাবজেক্টেরও মিল আছে। কিন্তু সবাইকে অবাক করে দিয়ে সে প্রতিযোগিতায় দ্বিতীয় হয়েছে। এই খবরে তার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে। সে আজ বিশ্ববিদ্যালয়েও যায়নি। পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানেও সে ছিল না।

ভিসির কথা শেষ হলে আনা আরিয়ার মা, ভিসির স্ত্রী ধীরে ধীরে এসে ভিসির পাশে বসল। তার মুখ গম্ভীর। বলল, আনার বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়ার কথা বলছ? সে তো সারাদিন কিছু খায়নি। শুধুই কাঁদছে।

একটু থামলো। বলে উঠল আবার সঙ্গে সঙ্গেই, ঐ হিদেন ছেলের কি দরকার ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকতে দেয়ার! তার কাছে পরাজয় তোমার মেয়ে মানবে কি করে? মানতে পারে না।

ও এই কথা।

শান্ত কণ্ঠে ছোট্ট কথাটা বলে থামল ভিসি ফাদার স্টিফেন। ঘুরে বসল স্ত্রীর দিকে। বলল, তোমার সেন্টিমেন্ট আর আনার সেন্টিমেন্ট-এর সাথে আমি পুরোপুরি একমত। কিন্তু শিলা, আমরা এটা করেছি পরিকল্পনা করেই। সে অতি সম্ভাবনাময় অসাধারণ একটা প্রতিভা। দেখ, প্রতিযোগিতার বিষয়টি তার সাবজেক্ট ও পড়াশুনার মেলে না। এরপরও প্রতিযোগিতায় যোগ দিয়েছে এবং প্রথম হয়েছে। জান না তুমি, অনেক চেষ্টায় আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করে তাকে আমাদের হাতে মুঠোয় এনেছি। এজন্যে আমরা যা করা দরকার তাই করেছি।

কি করেছ? জিজ্ঞাসা করল শিলা, ভিসির স্ত্রী।

কি করিনি! ডাকাতির মতো ঘটনা ঘটিয়ে মানে তার বাসায় সন্ত্রাসী। পাঠিয়ে তার পাসপোর্ট, বেলজিয়াম বিশ্ববিদ্যালয়ের কাগজপত্র, টাকা পয়সা সব ছিনিয়ে নিয়ে এসেছি, যাতে করে সময়মতো সে বেলজিয়াম বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতেই না পারে। সময় চেয়ে যাতে বেলজিয়াম বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির ব্যবস্থা না করতে পারে সেটাও বন্ধ করার জন্যে বেলজিয়ামের ইভ্যানজেলিস্ট নেতৃবৃন্দকে দিয়ে বেলজিয়াম বিশ্ববিদ্যালয়ে তার ভর্তির অফারকেও আমরা বাতিল করে দেবার ব্যবস্থাও করিয়েছি। তাছাড়া ইউরোপের যেসব বিশ্ববিদ্যালয়ে তার সাবজেক্ট আছে, সেসব বিশ্ববিদ্যালয়ে তার ভর্তির পথও আমরা বন্ধ করে দিয়েছি। আমাদের এসব চেষ্টা ফল দিয়েছে। ইউরোপের কিংবা বাইরের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়েই সে ভর্তি হতে পারেনি। এর ফলেই তো সে আটকা পড়েছে আমাদের জালে। বলল ভিসি ফাদার স্টিফেন।

এভাবে ছেলেটাকে আনলে তোমাদের হাতের মুঠোয়। কি করতে চাও তাকে নিয়ে? শিলা স্টিফেন বলল।

সবাইকে যা করা হয়েছে মানে অস্ত্রটি হয় আমাদের হাতিয়ারে পরিণত হবে, নয়তো অস্ত্রটিই ধ্বংস হয়ে যাবে। আমাদের আদেশ অমান্য করার কারণে কয়েকদিন আগে চ্যাম্পিয়ন সুপার স্টার খেলোয়াড় হেনরি বুফোর্ট-এর যে দশা হয়েছে, সেও যদি আমাদের কথামতো কাজ না করে তারও একই রকম কিছু হবে। বলল ভিসি ফাদার স্টিফেন।

অর্থাৎ হয় আমাদের হও। নয় তো জাহান্নামে যাও, এই তো? শিলা স্টিফেন বলল।

একদম তাই। যাও আনাকে ডেকে নিয়ে এস। বলল ভিসি ফাদার স্টিফেন।

ভিসির স্ত্রী, আনার মা শিলা স্টিফেন উঠে দাঁড়িয়েছিল মেয়ে আনাকে ডেকে আনার জন্যে।

ঠিক তখনি আনা আরিয়া ঘরে প্রবেশ করল।

অষ্টাদশী আনা আরিয়া ফুলের মতো স্বচ্ছ, সুন্দর এক কিশোরী। কিন্তু চোখ-মুখের উপর দিয়ে যেন ঝড় বয়ে গেছে। তার মুখ অশ্রুধোঁয়া।

মা শিলা স্টিফেন এগিয়ে গিয়ে মেয়েকে জড়িয়ে ধরে নিয়ে এলো তার বাবার কাছে। বলল, দেখ তো, তোমরা মেয়েটির কি হাল করেছ।

ভিসি বাবা, ফাদার স্টিফেন ফেবিয়ান, মেয়েকে টেনে নিয়ে পাশে বসাল।

কান্নায় ভেঙে পড়ল আনা আরিয়া। বলল, একজন শয়তান হিদেনের নাম আমার নামের উপর উঠেছে, এটা সহ্য করতে পারছি না বাবা। তোমার জাজরা নিশ্চয় সুবিচার করেনি।

ভিসি ফাদার স্টিফেন মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, না মা, সে রকম কিছু হয়নি। আর্টিকেলের নাম বিচারকদের দেয়া হয়নি। প্রত্যেকের আর্টিকেলকে একটা করে আলাদা নাম্বার দেয়া হয়েছিল। সুতরাং বিচারকরা প্রতিযোগীর নাম পাননি।

তার মানে একজন হিদেনের কাছে আমি পরাজিত হয়েছি? কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলল আনা আরিয়া।

না মা, তুমি হিদেন আবিদ ইব্রাহিম চাওসিকোর কাছে পরাজিত হওনি, তুমি পরাজিত হয়েছ অ্যাডাম আব্রাহাম চাওসিকোর কাছে। কিন্তু মা, এর আগে সে তোমার চেয়ে অনেক, অনেক বড় একটা পরাজয় বরণ করে নিয়েছে। তার নাম, তার ধর্মীয় পরিচয় তাকে পরিত্যাগ করতে হয়েছে, যা সে চায়নি। সুতরাং আজ যে বিজয় সে লাভ করেছে, সে রকম কিছু বিজয় দিয়ে তাকে অন্ধ বানিয়ে রাখতে হবে। বলল ফাদার স্টিফেন।

তুমি যা বলেছ ঠিক বাবা। কিন্তু সেটা ভেতরের ব্যাপার। বাইরে আমি তার কাছে পরাজিত হয়েছি। আমি অপমান বোধ করছি বাবা। কিন্তু আমার বন্ধু-বান্ধবরা ভীষণ ক্ষুব্ধ। তারা কিন্তু তোমার অ্যাডামকে হিট করতে পারে। আনা আরিয়া বলল।

আকস্মিক এক চিন্তার ছায়া নামল ভিসি স্টিফেনের চোখে-মুখে। তাড়াতাড়ি মেয়েকে কাছে টানল। তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল, না মা, এমনটা করা যাবে না। তোমরা যা চাও সে রকম কিছুই হবে। কিন্তু তার জন্যে সময় প্রয়োজন। সে যদি হিদেন থেকে মা মেরীর ছায়ায় এসে পবিত্র না হয়, তাহলে হেনরি বুফোর্টের ক্ষেত্রে যা ঘটেছে, তার ক্ষেত্রেও তেমনটাই ঘটতে পারে।

এসব ঝামেলার কি দরকার ছিল। তাকে বিশ্ববিদ্যালয়ে না ঢুকালেই হতো। বলল আনা আরিয়া।

আমরা তার ভালোর জন্যে এটা করিনি।

আমরা এটা করেছি মুসলমানদের একজন অসাধারণ প্রতিভাকে ধ্বংস করার জন্যে। আনা, এজন্য তোমার সহযোগিতাও চাই আমরা। বলল আনার বাবা ভিসি ফাদার স্টিফেন।

আমি আবার কি সহযোগিতা করব? আনা আরিয়া বলল।

তার সাথে একটু ভালো ব্যবহার করে আমাদের কমুনিটির প্রতি তার আকর্ষণ বাড়ানো- এটা তোমার কাজ। আমাদের ক্যুনিটির প্রতি, আমাদের ধর্মের প্রতি তার আকর্ষণ যদি সৃষ্টি করা যায়, তাহলে সে তার অজান্তেই আটকা পড়ে যাবে আমাদের মধ্যে। তখন আমাদের কাজ সহজ হয়ে যাবে। বলল ভিসি ফাদার স্টিফেন, আমার বাবা।

এখানে আমার বা আমাদের কি করণীয়? আমাদের কম্যুনিটি, আমাদের ধর্মীয় পরিমণ্ডলের মধ্যেই তো সে আছে। ধীরে ধীরে, আপনাতেই তার মধ্যে আমরা যা চাচ্ছি, সেই আকর্ষণ সৃষ্টি হবে। আনা আরিয়া বলল।

তাই হয়ে থাকে, তার ক্ষেত্রেও তা হবে হয়তো কিন্তু আমি তার সাথে কথা বলে দেখেছি, সে আর দশজনের মতো নয়। বিজ্ঞানের মধ্যে তার মন-প্রাণ ডুবে আছে বটে, কিন্তু মুসলিম হিসাবে খুব নিষ্ঠাবান, সচেতন। খুব ভালোবাসে সে তার ধর্মকে। তার ভালোবাসার এ কেন্দ্রবিন্দু নষ্ট না করলে বা অন্যদিকে ঘুরিয়ে দিতে না পারলে, তাকে তার ধর্ম থেকে সরিয়ে আনা কঠিন হবে। বলল আনার বাবা ভিসি ফাদার স্টিফেন।

কীভাবে তাকে সরিয়ে আনা যাবে বা তার চেতনা নষ্ট করা যাবে, যদি আমাদের কমুনিটি ও আমাদের খ্রিস্ট ধর্মের দিকে তাকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে আকৃষ্ট না করা যায়? আনা আরিয়া বলল।

গম্ভীর হলো ভিসি ফাদার স্টিফেনের মুখ। বলল, একটা সহজ পথ হলো, ব্যক্তির মাধ্যমে সমষ্টির প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি করা। বিষয়টা এই রকম, কেউ যখন কারও বন্ধুত্বের প্রতি আন্তরিকভাবে আকৃষ্ট হয়, তখন বন্ধুর ভাবনা, বন্ধুর সমাজ-সংস্কৃতি, বন্ধুর ভালো লাগা, মন্দ লাগা- সব কিছুর প্রতি তার আকর্ষণ ও একাত্মতার সৃষ্টি হয়। আমাদের খ্রিস্টীয় মিশন সবচেয়ে ভালো ফল পেয়েছে এই ক্ষেত্রে।

বুঝেছি বাবা। তোমরা তার পেছনে এ ধরনের উপযুক্ত কাউকে লাগাও। আনা আরিয়া বলল। তার চোখে-মুখে একটা অসন্তুষ্টির ভাব।

সে চিন্তা আমরা করছি। তবে এই সাথে তোমার কাছ থেকেও আমরা এটুকু আশা করি মা, তুমি তার সাথে স্বাভাবিক ও সুআচরণ করবে। বলল ভিসি ফাদার স্টিফেন।

আনা আরিয়া সঙ্গে সঙ্গেই বলে উঠল, বাবা সে আমার ডিপার্টমেন্টের ছাত্র নয়, তাকে চিনিও না, তাকে দেখিওনি। সুতরাং তার সাথে স্বাভাবিক-অস্বাভাবিক, সুআচরণ-কুআচরণ কোনো কিছুরই আমার দরকার হবে না। আর চেষ্টা করব তাকে যেন না চিনি, না দেখি এবং তার সামনেও যেন কখনো না পড়ি।

একজন অচেনার প্রতি এতটা বিতৃষ্ণা, বৈরিতা ভালো নয় মা। সে। মানুষ হিসেবে একজন ভালো ছেলে তাকে বলতেই হবে। বলল ভিসি ফাদার স্টিফেন।

ধন্যবাদ বাবা। তুমি জান, তোমার মেয়ে এমন নয়। কিন্তু হিদেনদের কথা ভিন্ন। ভিন্নমতের মানুষের জন্যে ওরা হিংস্র নেকড়ে।

বলেই উঠে দাঁড়াল আনা আরিয়া। বলল, আমি তাহলে আসি বাবা।

এসো মা। সস্নেহে বলল পিতা ফাদার স্টিফেন।

আসি মা। বলেই ছুটে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে আনা আরিয়া।

খাবার টেবিলে যাও, তোমাকে খেতে দেবে। আমি আসছি। বলল আনা আরিয়ার মা শিলা সাম্রা স্টিফেন।

ধন্যবাদ স্টিফেন, মেয়ের কান্না তুমি থামিয়েছ। স্বামী ভিসি স্টিফেনের দিকে চেয়ে বলল শিলা সান্ড্রা স্টিফেন।

কান্না থামালাম, কিন্তু আমাদের শিকার ছেলেটার প্রতি তার বৈরিতা ও ঘৃণার মাত্রা কমাতে পারলাম না। সামনে পড়লে কি করে বসে এটা একটা চিন্তার বিষয়। বলল ভিসি ফাদার স্টিফেন।

মেয়ের দোষ কি আমরাই এই প্রজন্মকে গড়ে তুলছি মুসলিম বিদ্বেষী হিসাবে। সন্ত্রাসী, খুনি, হিংস্র, ধর্মান্ধ ইত্যাদি পরিচয়ে মুসলমানদের পরিচিত করছি তাদের কাছে। শিলা সান্ড্রা বলল।

সে পরিচয় তো তাকে ভুলতে বলা হচ্ছে না। কিন্তু আমাদের ছাত্র অ্যাডাম আব্রাহাম-এর সে পরিচয় নেই। সে তো মুসলিম নাম পাল্টেছে, গোড়া এক খ্রিস্টান বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছে। তাকে একটু ভিন্ন দৃষ্টিতে দেখতে হবে। বলল ভিসি ফাদার স্টিফেন।

যাক ওসব। আমি তোমার মতো চিন্তা করছি না। আমাদের মেয়ে বুদ্ধিমান, সচেতন, মানবিক। তার দ্বারা বিবেক বিরোধী কোনো কাজ হতে পারে, তা আমি মনে করি না।

বলতে বলতেই উঠে দাঁড়াল শিলা সাম্ৰা। বলল স্বামীকে উদ্দেশ্য করে, চল নাশতা দেয়া হয়েছে।

উঠে দাঁড়াল ভিসি ফাদার স্টিফেন।

দুজনেই ঘর থেকে বেরুল।

.

বাইরে প্রবল ঝড়-বৃষ্টি।

ঘরের দরজা, জানালা বন্ধ করে বসে আছে আবিদ ইব্রাহিম চাওসিকো। তার মনে হচ্ছে, গত কয়েক বছরে এমন ঝড় সে দেখেনি। তার সাথে অব্যাহত প্রবল বৃষ্টি তার জন্যে ভীতিকর অবস্থার সৃষ্টি করেছে। এরই মধ্যে তাদের ফার্ম-ল্যান্ডের ভেতর থেকে টিনের ঘর ভেঙে পড়ার শব্দ হলো। তাহলে কি তাদের কেয়ারটেকারের বাড়িটা ভেঙে পড়ল?

তার মনের চাঞ্চল্য আরও বাড়ল।

সে একা এই বাড়িতে। বাড়ি তো নয়, অফিস কাম শোবার কক্ষসহ এটাড ওয়াশরুম এবং তার সাথেই একটা কিচেন। একটা বড় ঘরে পার্টিশন দিয়ে অফিস ও শোবার ঘর আলাদা করা হয়েছে। দুইয়ের মধ্যে একটা সংযোগ দরজা। দরজায় পর্দা, কপাট নেই। শোবার ঘরের পাশে কিচেন। বারান্দা দিয়ে ও শোবার ঘর থেকেও কিচেনে যাওয়া যায়। কিচেনেই খাবার-দাবারের ব্যবস্থা আছে।

শীত শীত করায় শোবার ঘর থেকে জ্যাকেট এনে গায়ে দিল। ঝড়-বৃষ্টির প্রাবল্য আরও বেড়েছে।

এপ্রিল, মে মাসে বুজুমবুরা ও বুরুন্ডিতে এমনিতেই ঝড়-বৃষ্টি বেশি হয়। কিন্তু আজকের ঝড়-বৃষ্টি মাত্রা ছাড়িয়ে গেছে বলে তার মনে হচ্ছে।

এ বাড়িটা আবিদ ইব্রাহিমদের ফার্ম-হাউজ।

জায়গাটা রোমেঙ্গি প্রাকৃতিক রিজার্ভ ল্যান্ড-এর পূর্বপাশ ঘেঁষে। দুই হাই-ল্যান্ডের মাঝখানে ছোট একটা উপত্যকা। উপত্যকার দশ একরের মতো জমি নিয়ে আবিদ ইব্রাহিমদের ফার্মল্যান্ড। ব্যবসায়ের বাইরে এই জমি থেকে পাওয়া শস্য তাদের পরিবারের স্থায়ী আয়। একজন। কেয়ারটেকার ফার্মল্যান্ডের ভেতরে পরিবার নিয়ে বাস করে এবং ফার্মল্যান্ডের সার্বক্ষণিক দেখাশুনা করে। বাড়িতে কি এক বিপদের কারণে তারা দেশের বাড়ি গেছে তিন দিন হলো। এ সময় আবিদ ইব্রাহিমকেই ফার্ম হাউসে থাকতে হচ্ছে। প্রহরীরাও আছে। তবে তারা ভেতরে তাদের ব্যারাকে থাকে। ঝড়-বৃষ্টি বলেই তারা কেউ বাইরে নেই।

ফার্ম হাউসের এ অফিস ঘরটা তাদের ফার্ম-ল্যান্ডের একদম দক্ষিণ। মাথায়। অফিস ঘরের দক্ষিণ পাশ দিয়ে পুব-পশ্চিমে প্রলম্বিত ১৬ নং রিজিওনাল হাইওয়ে। এই হাইওয়েটি একটু পশ্চিমে উত্তর-দক্ষিণে। প্রলম্বিত রিজিওনাল হাইওয়ে নং ৩ থেকে বেরিয়ে এসেছে।

মুষলধারে অব্যাহত বৃষ্টি আবিদ ইব্রাহিমের মনে আরেকটা ভাবনার সৃষ্টি করল।

এই বৃষ্টির সাথে পুবের উচ্চভূমি থেকে নেমে আসা পানির স্রোত রাস্তা-ঘাটে বলা যায় বন্যার সৃষ্টি করে। এ পানি তাড়াতাড়ি লেক ট্যাঙ্গরিকায় নেমে যায়। কিন্তু তার আগেই বিশেষ করে গাড়ি চলাচলে বিপর্যয়ের সৃষ্টি করে।

বাইরে গাড়ি বারান্দায় লাইট আছে।

জানালা একটু ফাঁক করে বাইরে উঁকি দিল আবিদ ইব্রাহীম। আঁৎকে উঠল বাইরের পরিস্থিতি দেখে। গাড়িবারান্দার নিচে ও রাস্তায় অনেক পানি জমে গেছে, যদিও রাস্তা বেশ উঁচু।

জানালা থেকে আবিদ ইব্রাহিম ফিরে এলো সোফায়। অফিসে তেমন কিছু নেই। ঘরের পশ্চিম দেয়ালে একটা আলমারি। তার পাশে এক বড় চেয়ারের সামনে একটা বড় টেবিল। টেবিলের সামনে গোটা কয়েক চেয়ার।

ঘরের চার দিক সোফায় সাজানো। এ আবিদ ইব্রাহিম সোফায় গা এলিয়ে দিল। তার চোখ দুটি বন্ধ। বাইরে ঝড়ের একটানা শোঁ শোঁ শব্দ আর বৃষ্টির বিচিত্র ভারি ও অব্যাহত কোরাশের মধ্যে ডুবে গেল তার মন। অন্য সব চিন্তা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে আনমনা হয়ে পড়েছিল আবিদ ইব্রাহিম চাওসিকো।

বাইরে এক মেয়েকণ্ঠের চিৎকার ও দরজায় করাঘাতের শব্দে তড়াক করে উঠে দাঁড়াল আবিদ ইব্রাহিম।

কৌতূহল ও ভয়ের মিশ্রণ তার চোখে মুখে।

মেয়েটি চিৎকার করেই চলেছে, কে আছেন, প্লিজ দরজা খুলুন। একদম ভিজে গেছি। ঝড়-বৃষ্টিতে দাঁড়াতে পারছি না।

ভাবছিল আবিদ ইব্রাহিম। ঝড়-বৃষ্টিতে মেয়েটি নিশ্চয় বিপদে পড়েছে। আবার কিছুদিন আগে নিজেদের বাড়িতে ডাকাতি পড়ার মতো বিপদের কথাও ভাবল সে। সাথে সাথে নিজের বিপদের কথাও ভাবল। সাংঘাতিক শত্রুদের কোনো কৌশল নয় তো এটা!

কিন্তু মেয়েটির চিৎকার এখন কান্নায় পরিণত হয়েছে।

এবার সব ভয়, বিপদের কথা মাথা থেকে উবে গেল তার। একজন বিপদগ্রস্তকে বাঁচানোই তার এখন দায়িত্ব বলে মনে করল।

এগিয়ে গিয়ে দরজা খুলে দিল আবিদ ইব্রাহিম। দরজায় একজন তরুণী। আপাদমস্তক ভিজা। মাথার চুল এবড়ো-থেবড়ো হয়ে কিছু মুখের উপর এসেও পড়েছে। দেখেই বুঝল, শ্বেতাংগ কিশোরী।

দরজা খোলার সঙ্গে সঙ্গে আবিদ ইব্রাহিমের দিকে একবার তাকিয়েই ছুটে ঘরের ভেতর ঢুকে পড়ল মেয়েটি। তার হাতে মাত্র ছোট একটা হ্যান্ড। ব্যাগ।

ঝড়-বৃষ্টির প্রবল ঝাঁপটা দরজা দিয়ে ঘরে প্রবেশ করছিল।

আবিদ ইব্রাহিম চাওসিকো তাড়াতাড়ি ঘরের দরজা বন্ধ করে ঘুরে দাঁড়াল।

মেয়েটিও ঘরে ঢুকে ঘুরে দাঁড়িয়েছে।

তার পরনে কালো প্যান্ট। গায়ে সাদা শার্ট। তার উপর পাতলা হাল্কা গোলাপি একটা জ্যাকেট।

সবকিছু ভিজে গায়ের সাথে লেপ্টে গেছে। তার গা থেকে পানি ঝরে পড়ে মুহূতেই ভিজে গেল ঘরের মেঝে।

মেয়েটি ভীষণ বিপর্যস্ত। তার সাথে তার চোখে-মুখে দারুণ বিব্রত ভাব। বলল সে, আমি লিভিংস্টোন মনুমেন্টের একটা অনুষ্ঠানে এসেছিলাম। সেখান থেকেই আমি ফিরছিলাম। রাস্তা ডুবে যাওয়ায় ৩ নং হাইওয়ে দিয়ে এগোতে না পেরে এদিক উঁচ ভেবে ১৬ নং হাইওয়ে ধরে এদিকে আসি। সংরক্ষিত এলাকার মাঝখানে আমার গাড়িতে পানি ঢুকে গিয়ে ইঞ্জিন বন্ধ হয়ে যায়। গাড়ি ছেড়ে দিয়ে আশ্রয়ের খোঁজে রাস্তা দিয়ে এদিকে চলে আসি। দেখলাম এদিকে তো কোনো বাড়ি-ঘর নেই। প্রথম এখানেই আলো দেখতে পেলাম।

হ্যাঁ, এ এলাকায় জনবসতি নেই। এটাও আমাদের বাড়ি নয়। ফার্ম হাউস এটা আমাদের। বলল আবিদ ইব্রাহিম।

মেয়েটার চোখে-মুখে অস্বস্তি বেড়ে গেল। কিন্তু ভেতরটা কেঁপে উঠল ভয়ে। ফার্ম হাউজে বাড়িও থাকে, ফ্যামিলিও থাকে। কিন্তু এখানে আর কেউ আছে বলে তো মনে হচ্ছে না। এই ভাবনা তার ভেতরটাকে আতঙ্কিত করে তুলল। তার মুখে আর কোনো কথা আসছিল না। > আবিদ ইব্রাহিম কথা শেষ করে কিছুটা সময় নিয়ে আবার বলে উঠল, আপনি অনেকটা সময় ধরেই এভাবে ভিজে আছেন। আপনি একটু দাঁড়ান।

আবিদ ইব্রাহিম পর্দা ঠেলে পাশের বেডরুমে ঢুকে গেল। আলমারি থেকে নিজের ভোলাই করা একটা প্যান্ট, নতুন গেঞ্জি, তার ছোট সাইজের একটা শার্ট ও টি-শার্ট নিয়ে এলো একটা হ্যাংগারে করে।

হ্যাংগারটি মেয়েটির দিকে এগিয়ে ধরে ওয়াশরুম দেখিয়ে বলল, আপনি গিয়ে কাপড় পাল্টে নিন। গরম পানির ব্যবস্থা আছে, গোসলও করতে পারেন।

মেয়েটা মুখ তুলে পরিপূর্ণ দৃষ্টিতে আবিদ ইব্রাহিমের দিকে তাকাল।

আবিদ ইব্রাহিম তার চোখ নামিয়ে নিয়েছিল।

মেয়েটি হ্যাংগারটি আবিদ ইব্রাহিমের হাত থেকে নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে গেল।

মেয়েটি ওয়াশরুমে ঢুকে গেলে আবিদ ইব্রাহিম কিছুটা সহজ হলো। খালি ঘরে একটা মেয়ে এভাবে আসায় কম বিব্রত হয়নি সে। তবে আবিদ ইব্রাহিম নিশ্চিত হয়েছে যে, মেয়েটি আসলেই বিপদগ্রস্ত। তার জন্যে কোনো ট্র্যাপ এটা নয়। ট্র্যাপ না হলেও তার জন্যে এটা সম্পূর্ণ নতুন একটা পরিস্থিতি। টিভিতে ফোরকাস্ট দেখেছে, এই আবহাওয়া সারারাত একই রকম থাকবে। তার মানে সারারাতের এক বিব্রতকর অবস্থা হবে তার জন্যে।

আল্লাহ নেগাহবান-এই চিন্তা করে গা ঝাড়া দিয়ে উঠে দাঁড়াল, আবিদ ইব্রাহিম। যা তার জন্যে এখন করণীয়, সেই কাজে লেগে গেল

কিচেন থেকে স্পঞ্জ ক্লিনার নিয়ে এসে মেঝে পরিষ্কার করল। বেডরুমের বিছানার চাদর, বালিশের কভার পাল্টে ফেলে বেডটা ঠিকঠাক করল। শেষে কিচেনে গিয়ে কফি তৈরির ব্যবস্থা করল।

এসব কাজে অনেক সময় গেল। কিচেন থেকে এলো সে অফিস-কাম-ড্রয়িংরুমে। মেয়েটি ওয়াশ রুম থেকে এসেছে, বসেছে সোফায়। আবিদ ইব্রাহিমকে ঘরে ঢুকতে দেখে সে উঠে দাঁড়াল।

বসুন। মেয়েটির দিকে মুহূর্তের জন্যে তাকিয়ে বলল আবিদ ইব্রাহিম চাওসিকো।

মেয়েটি বসতে বসতে বলল, ধোঁয়া কাপড় ওয়াশরুমে আছে। ওগুলো শুকাতে দিতে চাই।

ওর ব্যবস্থা হবে। আপনি একটু বসুন। আমি আসছি। বলে আবিদ ইব্রাহিম এলো কিচেনে।

মেয়েটি তাকিয়েছিল আবিদ ইব্রাহিমের চলার পথের দিকে। তার চোখে-মুখে বিস্ময়! ছেলেটা ওদিক থেকে এলো, আবার চলে গেল, কিন্তু তার চোখে সে একবারও চোখ ফেলেনি। অনেকটা নির্লিপ্তের মতো এলো। আর গেল! একি আশ্চর্য!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *