আবার আফ্রিকার অন্ধকারে – ১

নানিয়ান মন্দির প্যালেসের রাস্তা শুরুর মুখে একটা টিলার ঝোঁপের আড়ালে গাড়ি দাঁড় করাল আহমদ মুসা। এখান থেকে মন্দির প্রাসাদে যাওয়ার আকাঁ বাঁকা রাস্তা কম লম্বা নয়। পাহাড়ের গভীর খাদের উপর তৈরি কয়েকটা ছোট কালভার্ট ধরনের ব্রীজ এবং পাহাড় কেটে তৈরি রেলিং ঘেরা রাস্তা দিয়ে চলতে হবে পায়ে হেঁটে।এই রাস্তায় গাড়ি চলে খুব কম। আহমদ মুসার জন্যে গাড়ি নিয়ে যাওয়া বিপজ্জনক। তিনজনেরই শরীর কালো কাপড়ে আবৃত। লু ঝি ও চেং ঝি দুজনের পোশাক দেখে বলা যাবে না তারা নারী। আহমদ মুসা পাশের সিট থেকে তার ব্যাগটা

টেনে নিল। ব্যাগ খুলে বের করল তিনটা মুখোশ। মুখোশগুলো গ্যাসমাস্ক ও একই সাথে মুখোশের কাজ করতে পারে। দুটো মুখোশ আহমদ মুসা এগিয়ে দিল লু ঝি ও চেং ঝির দিকে। ওরা বসেছিল পেছনের সিটে। আহমদ মুসা পরে নিল তার মুখোশ।

মুখোশ লু ঝিরাও পরে নিল দ্রুত।

পেছনে তাকিয়ে আহমদ মুসা বলল, লু ঝি তোমরা শোন। আমরা এখন প্রবেশ করতে যাচ্ছি নানিয়ান মন্দির প্রাসাদে। শুধু তাদের নয়, গোটা চীনা জনগণের সম্মানিত স্থান এটা। এ পবিত্র স্থানে আমরা যতটা সম্ভব রক্তপাত এড়াতে চাই। আমাদের সকলকেই এটা মনে রাখতে হবে।

গাড়ি থেকে নামল আহমদ মুসা। নামল লু ঝি ও চেং ঝি। আড়াল থেকে তারা বের হয়ে এলো। উঠে এলো রাস্তায়। আলো আঁধারিতে ঢাকা পথটা। পাথুরে অথবা পাথর বিছানো পথ। গাছপালার কারণে রাস্তার প্রান্ত-বরাবর অন্ধকারটা অপেক্ষাকৃত গাঢ়। রাস্তার প্রান্ত ধরে এগিয়ে চলেছে তিনটি কালো মূর্তি। চারদিকে পিনপতন নীরবতা। নৈঃশব্দেরও একটা নীরব শব্দতরঙ্গ আছে। আহমদ মুসার কানে সেই শব্দ তরঙ্গে আকস্মিক একটা ভাঙন সৃষ্টি হলো। সেটা বাম কানটায় আঘাত করল বেশি। আহমদ মুসা বাম দিকে চোখ ফিরিয়েই হার্ড ব্রেক কষার মতো দেহটা স্থির করে ঝুপ করে বসে পড়ল, মাথাটা হাঁটুর সাথে গুটিয়ে নিয়ে।

আহমদ মুসা দুটি দেহকে তার উপর বাঘের মতো লাফিয়ে পড়তে দেখেছিল শেষ মুহূর্তে।

আহমদ মুসা বসে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে তার মাথার উপর দিকে দুটি দেহ রাস্তার পাথরের উপর আছড়ে পড়ল।

আহমদ মুসা ভেবেছিল আঘাতটা হজম করতে ওদের সময় লাগবে। কিন্তু ওরা মাটিতে পড়ে গিয়েই অদ্ভুত দক্ষতার সাথে তাদের দেহকে উল্টে চিৎ হয়েই তাদের একজন দুই পা প্রচণ্ড শক্তিতে পুশ করল আহমদ মুসার মাথা লক্ষে।

আহমদ মুসা চোখের পলকে মাথা সরিয়ে নিল।

এবারও পা দুটি লক্ষে আঘাত করতে ব্যর্থ হয়ে লোকটির দেহ আছড়ে পড়ল।

লোকটি আছড়ে পড়ে স্থির হবার আগেই আহমদ মুসা ডান কনুই দিয়ে তার উরুতে একটা প্রচণ্ড আঘাত করল। তারপরেও লোকটি বাম হাতে ভর দিয়ে তার বাম পা প্রচণ্ড এক ঝাঁকিতে ধনুকের মতো বাঁকিয়ে নিয়ে এলো।

উরুতে আঘাত খেয়ে লোকটার বাম পাটা শিথিল হয়ে পড়েছিল। তার পা রক্ষার কোনো সুযোগ ছিল না। মট করে তার পাটা ভেঙে পড়ল। ব্যথায় ঝাঁকিয়ে উঠল লোকটা। E

দ্বিতীয় লোকটা তখন আহমদ মুসার উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে। ভয়ংকর স্টাইলে উদ্যত তার হাতের ছুরি। মা আহমদ মুসার তখন করার কিছু ছিল না। চোখের পলকে মাথা নিচে নামিয়ে চিৎ হয়ে দুই পা জোড়া করে প্রায় বুক বরাবর তুলে আনল। তখন দ্বিতীয় লোকটা উদ্যত ছুরিসহ তার দেহটা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ছিল আহমদ মুসার উপর। নিমেষে আহমদ মুসার জোড়া পা ছুটল তীব্র গতিতে লোকটার বুক লক্ষে।

লোকটার দেহ উল্টে ছিটকে পড়ল রাস্তার উপর।

সঙ্গে সঙ্গেই আহমদ মুসার দেহ ছিটকে উঠে একই বেগে ঝাঁপিয়ে পড়ল। লোকটার উপর। বাম হাতে কেড়ে নিল তার ছুরি এবং ডান হাতের প্রচণ্ড কারাত চালাল তার বামকানের উপরের সংবেদনশীল জায়গাটায়। এলিয়ে পড়ল তার দেহ।

আহমদ মুসা উঠে দাঁড়িয়ে মুখোশ ঠিকভাবে সেট করে নিয়ে হাতের রিভলবার থেকে দুটি ক্লোরোফরম বুলেট ছুঁড়ল দুইজনের দিকে।

ঘটনাগুলো এতই দ্রুত এবং এমনভাবে ঘটে গেল যে, লু ঝি, চেং ঝি দুজনে কি করবে, কি করবে না তা বুঝেই উঠতে পারল না।

আহমদ মুসা সংজ্ঞাহীন দুজনকে রাস্তার পাশে ঝোঁপের আড়ালে ঠেলে দেয়ার কাজ শুরু করে দিল।

লু ঝিরাও ছুটে এলো।

তারা দুজনে একজনকে চ্যাংদোলা করে ধরে পাশের ঝোঁপের আড়ালে নিয়ে ফেলল।

আরেকজনকে আহমদ মুসা সামাল দিল।

ধন্যবাদ স্যার, শুরুতে রক্তপাত এড়ানো গেছে। বলল লু ঝি আহমদ মুসাকে লক্ষ করে।

হ্যাঁ লু ঝি, আল্লাহর শোকর। তোমার উডাং-এর ফাইটাররা সত্যিই খুব ক্ষিপ্র। আহমদ মুসা বলল।

কিন্তু স্যার, আপনি তার চেয়েও ক্ষিপ্র ও সুকৌশলী। বলল লু ঝি।

আহমদ মুসা লু ঝির কথার দিকে কান না দিয়ে বলল, চল আমরা হাঁটতে শুরু করি।

চলুন স্যার। বলল লু ঝি।

লু ঝি, এবার পরস্পর দূরত্ব নিয়ে হাঁটব। একজন আক্রান্ত হলে, দুজনই তার সাহায্যে যাবে। দুজন আক্রান্ত হলে তৃতীয়জন সাহায্যের জন্যে থাকবে। একই সাথে তিনজন আক্রমণের মুখে পড়া স্বাভাবিক নয়। নতুন ব্যবস্থায় আমি সামনে থাকব। চেং ঝি মাঝে এবং তুমি রিয়ার গার্ড। আহমদ মুসা বলল।

ধন্যবাদ স্যার, ভালো ব্যবস্থা। বলল লু ঝি। হাঁটছে তারা। পরস্পর বেশ দূরত্ব নিয়ে। একশ গজের মতো পথ তারা এগিয়েছে। সামনেই রাস্তার একটা বড় বাঁক। অনেকটাই সমকোণি বাঁক। বাঁকের আড়ালে চলে গেছে আহমদ মুসা ও চেং ঝি। লু ঝি বাঁকের কাছাকাছি পৌঁছেছে। হঠাৎ আহ! ধরনের একটা চিৎকার হলো সামনে থেকে। চমকে উঠল লু ঝি। চিৎকারটা চেং ঝির। তাহলে কি কোনো বিপদে ওরা?

চিন্তার সঙ্গে সঙ্গেই লু ঝি রাস্তার পাশ ঘেঁষে গাছগাছড়ার ছায়ায় হামাগুড়ি দিয়ে দ্রুত এগোলো সামনে।

বাঁকের মাথায় পৌঁছেই লু ঝি দেখতে পেল আহমদ মুসা ও চেং ঝি ফাঁদে আটকা পড়েছে।

এখানে রাস্তাটার ভেতরের পাশটা প্রায় খাড়া। তাতে ছোট বড় গাছ। গাছের আড়াল বা গাছে বসেই ফাঁদ ছুঁড়েছে।

লু ঝি রাস্তার এই প্রান্ত দিয়েই আসছিল।

আহমদ মুসা ও চেং ঝিকে ফাঁদে আটকা পড়তে দেখেই লু ঝি থমকে দাঁড়াল। উডাং-এর ফাঁদকে সে চেনে। খুবই বিপজ্জনক এ ফাঁদগুলো। কোনো মানুষ কিংবা জীবন্ত কিছু ফাঁদে আটকাবার সঙ্গে সঙ্গে ফাঁদকে চোখের পলকে গুটিয়ে নেয়া যায়। ব্যাপারটা দাঁড়ায় আষ্টেপৃষ্টে বেঁধে ফেলার মতো। হাত-পা নাড়ার কোনো সাধ্য থাকে না শিকারের। ফাঁদ থেকে উদ্ধারের একমাত্র পথ ফাঁদের নিয়ন্ত্রণ যাদের হাতে থাকে, তাদের নিষ্ক্রিয় করা। লু ঝি এই চিন্তাই করল। ফাঁদ যাদের হাতে তারা অবশ্যই রাস্তায় নেমে আসবে। শিকারকে তুলে নেয়ার জন্যে। লু ঝি তারই সুযোগ গ্রহণ করবে।

একটু সুবিধাজনক স্থানে অবস্থান নেয়ার জন্যে লু ঝি হামাগুড়ি দিয়ে এগোলো। ছোট একটা ফাঁকা জায়গা পার হচ্ছিল লু ঝি। হঠাৎ একটা কিছু তার উপর পড়লো। চমকে উঠল লু ঝি। কিন্তু কিছু বুঝে উঠার আগেই। একটা ফাঁদের অক্টোপাশে আষ্টেপৃষ্টে বাঁধা পড়ে গেল সে।

লু ঝি আটকে পড়ার মিনিট পাঁচেক সময় পার হয়ে গেল। একদম চুপচাপ সব।

ফাঁসের ফাঁদে লু ঝির আটকে পড়াটা দেখতে পেয়েছিল আহমদ মুসা। বুঝল আহমদ মুসা, তাদের সতর্ক হওয়াটায় কোনো লাভ হলো না। ওরা তিন জন কিংবা তার চেয়ে বেশি সংখ্যায়। ওরা আক্রমণ করতে পারে এমন ধারণা সে করেনি। মৃত ও বন্দী মিলে ওদের প্রচুর লোক ক্ষয় হয়েছে আজ। তাই ওদের ঘাঁটিগুলোতে যথেষ্ট সংখ্যক লোক নেই এমন ধারণা করেছিল আহমদ মুসা।

ফাঁদে আটকে পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই আহমদ মুসা চেষ্টা করেছিল হাঁটু মুড়ে দুপায়ের উপর বসে পড়া এবং দুই হাতকে বুক ও হাঁটুর মাঝখানে নিয়ে আসার জন্য।

আহমদ মুসার এ চেষ্টা সফল হয়। ফাঁদে আটকে পড়ার সময় তার হাতে ক্লোরোফরম রিভলবার ছিল, সেই রিভলবার এখনও তার হাতে, এবং দুই হাতকে সে কিছুটা হলেও মুভ করাতে পারছে।

আহমদ মুসা তার ফাঁদে টান অনুভব করল।

তাকাল সে ফাঁদের গোড়ার দিকে। ঘুটঘুঁটে অন্ধকার। সে কিছুই দেখতে পেল না। তবে মনে হলো ফাঁদ গুটিয়ে নেয়া হচ্ছে।

তিনটি ফাঁদই গুটিয়ে নেয়া হলো। ফাঁদে আটকা পড়া তিনজনকেই তারা টেনে একজায়গায় নিয়ে এলো।

ঝোঁপের আড়াল থেকে একটা গাড়ি বের হয়ে এলো এ সময়। ছোট একটা কাভার্ড ভ্যান।

গাড়ি থেকে একজন চিৎকার করে বলল, তাড়াতাড়ি এদের ভ্যানে উঠাও। এদের সাথে তোমরাও উঠবে কাভার্ড ভ্যানে। এদের একা রাখা যাবে না।

লোকটি কথা বলার পর এগিয়ে এলো ফাঁদে আটকা পড়া আহমদ মুসাদের দিকে। বলল, টর্চের আলো ফেলো সবার মুখের উপর। সেই লোকটিই আবার চিৎকার করে বলল, শালারা তো সবাই মুখোশ পরা। শরীরটাও কালো কাপড়ে ঢাকা। বুঝা যাচ্ছে না এরা কারা। আমরা যাদের অপেক্ষায় বসে আছি তারা কি না?

মুখোশ না খুললে জানা যাবে না এরা কারা? আমাদের সেই টার্গেট লোকটা এর ভেতরে আছে কি না? বলল ফাঁদওয়ালাদের একজন।

যে পরিচয়ই এদের হোক, এরা আমাদের শত্রু। মুখোশ পরে চোরের মতো আসছিল, এটাই তার প্রমাণ। যাক, ওঠাও এদের। আমরা আগে প্রাসাদে যাই, মাইলৰ্ডকে জিজ্ঞাসা করে যা করার তা করা যাবে।

ফাঁদে বেঁধে ফেলা আহমদ মুসাদের ওরা গাড়িতে তুলল। ঠিক তোলা নয়, তাদের দেহকে ছুঁড়ে মারল কাভার্ড ভ্যানের স্টিলের ফ্লোরে।

ফাঁদওয়ালরাও তিনজন উঠে বসল কাভার্ড ভ্যানে। কাভার্ড ভ্যানের একপাশে ছোট বেঞ্চ। তাতেই ওরা তিনজন বসল। চলছে গাড়ি।

ওদের একজন বলল, এই জন্তুদের বয়ে নিচ্ছি কেন? এখানেই তো সব সাঙ্গ করা যেত। সে রকম কথাই তো ছিল।

উপর থেকে বলা হয়েছে মুখোশ খুলে তাদেরকে দেখার পর আগের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করা হবে। আরেকজন বলল।

তাহলে প্রাসাদে নেয়া হচ্ছে কেন? এখানে মুখোশ খুলে দেখে কাজ সমাধা করা যেত। বলল প্রথম জন।

রাস্তায় বসে খোলাখুলির কাজ করা ঠিক মনে হয়নি। সরকার আজ খুব তৎপর। তারা এদিকে আসতে পারে। বলল মাঝের জন।

ফিসফিসিয়ে তাদের কথা চলতেই থাকল।

আহমদ মুসা খুশি হলো এই ভেবে যে, তারা নানিয়ান মন্দির প্যালেসে ঢুকতে পারছে। আরও একটা বিষয় ভেবে খুশি হলো যে, তাদের মুখে মুখোশ থাকায় তাৎক্ষণিক হত্যা বা আক্রমণের হাত থেকে তারা রক্ষা পেয়েছে। মুখোশ খোলা পর্যন্ত তারা নিরাপদ।

এক জায়গায় এসে গাড়ি থেমে গেল।

উঠে দাঁড়াল বেঞ্চে বসে থাকা ফাঁদওয়ালা তিনজন। কাভার্ড ভ্যানের দরজার সামনে নতুন দুজনের কথা শোনা গেল।

খুলে গেল ভ্যানের দরজা। বাইরে থেকে একজন চিৎকার করে বলল, নিচে ফেলে দাও শালাদের।

সঙ্গে সঙ্গেই ভেতরের দুজন ফাঁদে আটকা আহমদ মুসাদের বাইরে ছুঁড়ে ফেলতে শুরু করল।

প্রথমেই সামনের দুজনকে ছুঁড়ে দিল নিচে। ঝাঁকিয়ে উঠল লু ঝি ও চেং ঝির দুটি কণ্ঠ। বাইরে দাঁড়ানো সরদার লোকটা চিৎকার করে উঠল, এ দুজন তো মহিলা!

বলেই সে মোবাইল তুলল মুখের কাছে। বলল, মাই লর্ড, ফাঁদে আটকে পড়া তিনজনকে গাড়ি থেকে নামানো হচ্ছে। দুজনকে এইমাত্র নামানো হলো। তারা দুজনেই মহিলা।

ওপ্রান্তের কথা শুনে বলল, ইয়েস মাই লর্ড, দুজনকে এখনি ওখানে নিয়ে যাচ্ছি। আর কোনো নির্দেশ মাই লর্ড?

ওপ্রান্তের কথা শুনল লোকটি। বলল, অবশ্যই মাই লর্ড, তাদের নিরাপত্তাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়া হবে। উহসেন স্কোয়াডের হংহুয়া তার টীম নিয়ে ভেতরে তাদের সাথে থাকবে। আর বাইরে থাকবে পাহারায় একটা কমান্ডো স্কোয়াড।

বাই মাই লর্ড, বলেই লোকটি মোবাইল পকেটে রেখেই বলল, ভ্যানের গেট লক করে দিয়ে এখানে একজন পাহারায় থাক। আর চারজন এসো। এ দুজনকে ধরাধরি করে নিয়ে চল। এরা ভিভিআইপি বন্দী।

ভ্যানের দরজা আবার লক হয়ে গেল। ভিভিআইপি বন্দীকে নিয়ে ওরা চলে গেল।

খুশি হলো আহমদ মুসা। ওদের সব কথাই শুনতে পেয়েছে সে। ওদের দুজনের ক্ষতি হবার সম্ভাবনা নেই, এটাই আহমদ মুসার খুশির কারণ। ওদের দুজনকে ওরা নিশ্চয় চিনতে পেরেছে। তা না হলে ওরা ভিভিআইপি বন্দী হলো কি করে!

আহমদ মুসা নিজের দিকে মনোযোগ দিল।

আহমদ মুসাকে নিয়ে ওরা কি ভাবছে, কি করতে পারে ওরা? সে তো আগে থেকেই ওদের শট অন সাইট-এর তালিকায় আছে। সে কে হতে পারে, সে সন্দেহ তারা করেছে। কিন্তু না দেখে, নিশ্চিত না হয়ে গুলি করা স্বাভাবিক নয়।

তাই বলে আহমদ মুসাকে নিষ্ক্রিয় থাকলে চলবে না। শুধু নিজের মুক্ত হওয়া নয়, সে একটা মিশন নিয়ে এখানে এসেছে। সে মিশন সফল না হলে সংকট তার জায়গায় থেকেই যাবে। প্রতিশোধে পাগল হয়ে নতুন সংকট তারা সৃষ্টি করতে পারে এবং এই আশঙ্কাই বেশি।

ভ্যান গাড়ির বাইরের কথায় আহমদ মুসার চিন্তা থেমে গেল। কান গেল বাইরের কথায়।

একজন বলছিল, কাজ সহজ হয়ে গেল। ফাঁদ খোলাখুলির কোনো ঝামেলা নেই। লোকটাকে দেখারও আর দরকার নেই। সোজা গাড়ি নিয়ে আমরা যাব হিলটপের মৃত্যু বারান্দায়। সেখান থেকেই ফাঁদসহ আটকা পড়া লোকটাকে ছুঁড়ে দেব গিরিখাদের অতল গহ্বরে।

দ্বিতীয় কণ্ঠ বলল, লোকটা কে ছিল তা কিন্তু দেখা হলো না।

আরেকটা গম্ভীর কণ্ঠ বলল, আর দেখার দরকার নেই, মাই লর্ড তাকে চিনেছেন। চিনেছেন বলেই তাকে কোনোভাবেই নানিয়ান প্রাসাদে ঢুকাতে চান না। তাকেও ফাঁদ থেকে বের করার ঝুঁকি নিতে তিনি নিষেধ করেছেন। সুতরাং আর কোনো কথা নয়, মাই লর্ড-এর কাছ থেকে চ্যাং উ ফিরে এলেই আমরা গাড়ি ছাড়ব।

গম্ভীর কণ্ঠটি থামতেই প্রথম কণ্ঠ বলে উঠল, মেয়ে দুটি কে ছিল, কি হলো ওদের? শোনা গেছে ড্রাগন কেভ আক্রমণের সময়ও দুটি মেয়ে ছিল। এরা তারাই হতে পারে। তাহলে তারা ভিভিআইপি বন্দী হয় কি করে?

যেটুকু বলেছ, আর এগিয়ো না। এসব ব্যাপার মাই লর্ডের। ওদের বন্দী করেই রাখা হয়েছে। মাই লর্ডের হুকুমে এই লোকটার মর্মান্তিক মৃত্যুর কথা বলে এদের সতর্ক করা হয়েছে। এদের সাথে ভালো আচরণ না করলে, কোনো ঝামেলা বাধালে লোকটার চেয়েও মর্মান্তিক মৃত্যু আমাদের জন্যে অপেক্ষা করছে। বলল সেই গম্ভীর কণ্ঠের লোকটা।

শত্রুর কথা শুনেই আহমদ মুসা বুঝে গেল তাকে নিয়ে ওরা কি করতে চাচ্ছে। আহমদ মুসার মন সক্রিয় হয়ে উঠল। এ পর্যন্ত সে আশা করে বসেছিল যে, তাদের প্রাসাদের ভেতরে নেয়া হবে এবং তাদেরকে জানার জন্যে ফাঁদ থেকে মুক্ত করা হবে। কিন্তু তা হচ্ছে না। নিশ্চয় জোয়ান উ এই নানিয়ান প্রাসাদেই আছেন। তিনি আমাকে আহমদ মুসা হিসেবেই সন্দেহ করেছেন এবং যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তাকে হত্যা করার বিধান দিয়েছেন। এটাই তার জন্যে ছিল স্বাভাবিক।

আহমদ মুসার হাতে সময় বেশি নেই। একজন লোকের জন্যে তারা অপেক্ষা করছে। সে এলেই গাড়ি চালিয়ে তাকে নিয়ে যাওয়া হবে পর্বত শৃঙ্গের দিকে এক মৃত্যুর বারান্দায়। সেটা নিশ্চয় পর্বতগাত্রের এমন একটা জায়গা হবে, যেখান থেকে গিরিখাদ খাড়া নেমে গেছে এক অতল তলে। প্রাণদণ্ড দেবার এক নতুন পদ্ধতি এটা ওদের।

নিজের দিকে মনোযোগ দিল আহমদ মুসা।

বিশেষ ইলাস্টিক প্লাস্টিকের তৈরি ফাঁদে আষ্টেপৃষ্টে বাঁধা তার দেহ। তার হাতে রয়েছে ক্লোরোফরম গান। ফাঁদ তাকে জড়িয়ে ধরার সময় হাঁটু মুড়ে খাড়া হয়ে বসে পড়েছিল আহমদ মুসা। দুহাত নিয়ে ছিল দুই হাঁটু এবং বুকের মাঝখানে। তার ফলে দুই হাত কিছুটা নড়াতে পারছে সে। কিন্তু টার্গেট নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে না হলে এবং ক্লোরোফরম গানের টার্গেট সুনির্দষ্ট হলে কোনো কাজ দেয় না।

ফাঁদে পড়ার পর এই প্রথমবারের মতো নিজেকে সত্যিই বিপদগ্রস্ত মনে করল আহমদ মুসা। কাভার্ড ভ্যানের দরজা খোলার আগে যদি সে ফাঁদ থেকে মুক্ত হতে না পারে, তাহলে তার করার কিছুই আর থাকবে না। কিন্তু কীভাবে? দুই উরুর বাইরের প্রান্তে প্যান্টের গোপন পকেটে অত্যন্ত কার্যকরী দুটি ছুরি লুকানো আছে। কিন্তু সেখানে হাত পৌঁছানোর কোনো উপায় নেই। পিঠে আটকানো ব্যাগের দিকে তো হাত যাবেই না। জুতার সুকতলির নিচে আন্ট্রা কাৰ্প ন্যানো মেটালের কাটার আছে। কিন্তু জুতা খোলার কোনো উপায় নেই। জুতার গোড়ালির গোপন কুঠরীতে থাকা ল্যাসার কাটারের কথা মনে পড়ল আহমদ মুসার। মনটা খুশি হয়ে উঠল তার। যদিও ল্যাসার কাটার নরম প্লাস্টিকের উপর খুব কার্যকরী নয়, তবু ল্যাসার কাটারের বীম দিয়ে ফাঁদের একটা একটা করে তার উড়িয়ে দেয়া যাবে। এতে সময় লাগলেও ফাঁদ থেকে বের হবার একটা পথ করা যাবে।

কাজে লেগে গেল আহমদ মুসা।

কনুইয়ে ভাঁজ নিয়ে হাত দুটি আহমদ মুসার ঊর্ধ্বমুখী হয়েছিল। আহমদ মুসা তার ডান হাতের কনুইকে তার উরু ও পাঁজরের মাঝখান দিয়ে জোরের সাথে বাইরের দিকে ঠেলে দিল। তার সাথে হাঁটু পর্যন্ত উরুকে সামনের দিকে ঠেলে দিয়ে উরু ও পাঁজরের মাঝখানে ফাঁক সৃষ্টির চেষ্টা করল। খুব একটা ফাঁক সৃষ্টি করা না গেলেও কনুই কিছুটা সরিয়ে নেয়া গেল। আহমদ মুসা বাম হাঁটুকে জোরের সাথে সামনের দিকে ঠেলে দিয়ে ডান-বাম দুই হাতকেই নিচের দিকে পুশ করল তীব্রগতিতে। দুই হাঁটু ও বুক-পেটের মাঝখানে যে ফাঁকটুকু ছিল তা আরও কিছুটা বড় হয়েছিল। সেই ফাঁক গলিয়ে হাত দুটি পা পর্যন্ত পৌঁছে গেল। এ সময় বাইরে কথা শোনা গেল।

গাড়ির ঝাঁকানিতে বুঝা গেল ওরা তিনজন গাড়িতে উঠল। যার জন্যে ওদের অপেক্ষা, লোকটা তাহলে এসে গেছে। এখনি গাড়ি ছেড়ে দেবে। হিলটপের মৃত্যু বারান্দা নিশ্চয় খুব দূরে হবে না।

আহমদ মুসা তার হাত দুটিকে আরও সক্রিয় করল। জুতার গা লেপটে আছে ফাঁদের জাল।

আহমদ মুসা হাঁটু উঁচু করল। জুতার উপর লেপটে থাকা ফাঁদ ঢিলা করার জন্যে। কিন্তু হলো না। জুতা একটু উপরে ওঠার সাথে সাথে তার গায়ে লেপটে থাকা ফাঁদও উঠে এসেছে।

আহমদ মুসা শক্ত করে বসে ডান পা গাড়ির ফ্লোরের সাথে সেঁটে রেখে বাম পা উপরের দিকে তুলল জোরের সাথে। খুব কঠিন এ কাজ। মাত্র দুতিন ইঞ্চির একটা স্পেস সৃষ্টি হলো বাম পায়ের তলায়। সঙ্গে সঙ্গেই আহমদ মুসা দুই হাত ঢুকিয়ে দিয়েছে জুতার গোড়ালির তলায় এবং বাম হাঁটুকে বাম দিকে সরিয়ে নিয়েছে। এর ফলে বাম পায়ের গোড়ালি একটু কাত হয়ে সামনে এগিয়ে এলো। এতে হাত দুটির কাজ করার সুবিধা হলো।

দ্রুত আহমদ মুসা দুই হাত কাজে লাগিয়ে জুতার গোড়ালি থেকে ল্যাসার কাটার বের করল।

গাড়ি তখন চলতে শুরু করেছে। পাহাড়ের এমন পথে গাড়িটা যেভাবে চলছে তাকে দ্রুতই বলতে হবে। তাদের দণ্ড দেবার সে স্থানটা নিশ্চয় দূরে হওয়ার কথা নয়। প্রাসাদের ধারে কাছেই কোথাও হবে। সময় বেশি পাওয়া যাবে না।।

ল্যাসার কাটার ঠিক করে নিয়ে কাজে লেগে গেল আহমদ মুসা।

প্লস্টিক ফাঁদের প্লাস্টিক রোপগুলোর উপর ল্যাসার কাটারের কার্যকারিতা খুব সুবিধার হলো না। ফাঁদের এ প্লাস্টিক বিশেষ ধরনের রাবার দিয়ে তৈরি। ল্যাসার পরমাণু রাবারমিশ্রণের পরমাণুকে ধ্বংস করতে পারে,

সেটা তুলনামূলকভাবে স্লো। আমি প্লাস্টিক ফাঁদের ঘরগুলোকে একটা একটা করে কাটছে আহমদ মুসা। লম্বভাবে দেড়ফুটের মতো ফাঁদ কাটা হয়ে গেল। মজার ব্যাপার কাটার সঙ্গে সঙ্গে কাটা দুই প্রান্ত সংকুচিত হয়ে গেল। ফলে কাটা দেড় ফুট জায়গায় বেশ বড় স্পেস তৈরি হয়ে গেল।

গাড়ি তখন থেমে গেছে।

সঙ্গে সঙ্গেই ওরা গাড়ি থেকে নামল, গাড়ির ঝাঁকানি থেকে তা বুঝা গেল।

কাটা জায়গায় একটা স্পেস বের হলেও ইলাস্টিক ফাঁদ কিন্তু আহমদ মুসার দেহকে জড়িয়েই রয়েছে।

সময় নেই। এখনই ওরা গাড়িতে ঢুকে পড়বে।

আহমদ মুসা তার দুই হাত জোর করে কাটা স্পেস দিয়ে বের করে দুই পাশের ফাঁদের জালকে দুই বিপরীত দিকে জোরের সাথে পুশ করে চেপে ধরে রাখল। তার ফলে যথেষ্ট বড় স্পেস বেরিয়ে এলো। সঙ্গে সঙ্গেই আহমদ মুসা দেহটাকে গুটিয়ে নিয়ে দুই স্থির হাতের উপর ভর রেখে দেহকে ফাঁদের বাইরে ছুঁড়ে দিল। দুই হাত আগেই ফাঁদের বাইরে এসেছিল।

আহমদ মুসার দেহ ফাঁদের বাইরে এসে পড়ল। বাইরে থেকে দরজা খোলার শব্দ আহমদ মুসার কানে এলো।

আহমদ মুসা গাড়ির মেঝেয় শুয়ে পড়ে ভ্যানের দরজার দিকে তাক করল ক্লোরোফরম রিভলবারের ব্যারেল।

ভ্যানের দরজা খুলে গেল। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে দুই জন।

আহমদ মুসার ক্লোরোফরম রিভলবার দুইজনকে পরপর দুটি গুলি ছুঁড়ল।

বাইরে আবছা অন্ধকার।

গাড়ির ভেতরের অন্ধকারটা গাঢ়। sing য় Eি: ওদের হাতে টর্চ ছিল। জ্বালাবার সুযোগ পায়নি। তিনি। ওরা দুজন সংজ্ঞা হারিয়ে পড়ে গেল গাড়ির দরজার সামনেই।

আহমদ মুসা লাফ দিয়ে গাড়ি থেকে নামতেই একেবারে মুখোমুখি হলো। তৃতীয় লোকটার।

তৃতীয় এই লোকটি গাড়ি থেকে একটু পরে নেমেছিল। সাথী দুজনের কাছাকাছি আসতেই দেখল ওরা মাটিতে পড়ে গেল। কিছু বুঝে উঠার আগেই সে আহমদ মুসার মুখোমুখি হলো।

গাড়ি থেকে নামার সময় আহমদ মুসা পকেট থেকে একটা রিভলবারও হাতে তুলে নিয়েছিল।

তৃতীয় লোকটার মুখোমুখি হয়েই চোখের পলকে তার রিভলবারের নল লোকটির কপালে চেপে ধরে বলল, আমি যে প্রশ্ন করব তার জবাব সঙ্গে সঙ্গে না দিলে মাথা গুঁড়ো করে দেব। বল, নানিয়ান প্যালেসের কোন্ তলায় তোদের লর্ড জোয়ান উ থাকেন?

লোকটি একবার আহমদ মুসার দিকে তাকাল। তার মুখে ভয়ের কোনো চিহ্ন নেই। কোনো কথা সে বলল।

আহমদ মুসা তার রিভলবারের নল একটু সরিয়ে গুলি করল। গুলিটা লোকটার মাথার একপাশের একটা অংশ তুলে নিয়ে বের হয়ে গেল। কিন্তু লোকটি একটুও কাঁপল না। তার বদলে বিদ্যুৎবেগে তার প্রসারিত হাত ছুরির মতো ছুটে গেল আহমদ মুসার ঘাড় লক্ষে।

আহমদ মুসা চোখের পলকে বসে পড়ে নিজেকে রক্ষা করল। সেই সঙ্গে সুযোগ নিল লোকটির মুহূর্তের দুর্বল অবস্থার।

লোকটির ছুঁড়ে দেয়া হাতের তীব্র গতির কারাত ব্যর্থ হবার ফলে তার দেহের ভারসাম্য মুহূর্তের জন্যে ভেঙে পড়ল। আহমদ মুসা দুই হাতের কব্জি দিয়ে লোকটির দুই হাঁটুকে তীব্র বেগে সামনে পুশ করল।

লোকটি দেহের ভারসাম্য সম্পূর্ণভাবে হারিয়ে সামনে আছড়ে পড়ল আহমদ মুসার বামপাশ ঘেঁষে। আহমদ মুসা তার দেহ ডানপাশে একটু সরিয়ে নিয়েছিল।

উপুড় হয়ে আছড়ে পড়েই লোকটি দেহটাকে উল্টিয়ে নিয়ে উঠে দাঁড়াতে যাচ্ছিল।

আহমদ মুসা তার মাথায় রিভলবার চেপে ধরে বলল, ঠিক যেভাবে…।

আহমদ মুসা কথা শেষ করতে পারল না। লোকটির একটি হাত বিদ্যুৎবেগে ছুটে এলো আহমদ মুসার মুখ লক্ষে।

ঘটনাটা এতই আকস্মিকভাবে ঘটল যে, আহমদ মুসা মুখটা সরিয়ে। নেয়ার সুযোগ পেল না। হাতুড়ির মতো আঘাত করল হাতটা গিয়ে আহমদ মুসার ঠোঁট ও নাকের উপর।

আহমদ মুসা তার মুখ সরিয়ে নিতে না পারলেও রিভলবারের ট্রিগার থেকে তর্জনি একটুও সরায়নি। তর্জনিটা তাই অ্যাকশনে আসতে দেরি করেনি। লোকটির মাথা এফোঁড়-ওফোঁড় করে দিল গুলিটা।

দ্রুত উঠে দাঁড়াল আহমদ মুসা।

মনে মনে প্রশংসা করল জোয়ান উ আর্মির এখানকার লোকদের। দারুণ কমিটেড এবং সাংঘাতিক বেপরোয়া এবং ক্ষিপ্র ওরা।

উঠে দাঁড়িয়ে চারদিকে তাকাল আহমদ মুসা।

গাড়ির দুটি হেডলাইট ছাড়া কোথাও কোনো আলো নেই। নির্মল আকাশে তারার মেলা ছিল। কিন্তু পাহাড় জংগলাকীর্ণ হওয়ায় তারার আলো অন্ধকারের উপর কোনো কাজ করেনি।

জায়গাটা কোথায়? নানিয়ান প্যালেস থেকে কতটা দূরে পাহাড়ের এই বিপজ্জনক বারান্দাটা, যা মানুষকে গিরিখাদের অতল তলে ছুঁড়ে ফেলে তার প্রাণদণ্ড কার্যকর করার একটা প্ল্যাটফরম?

আহমদ মুসা চোখ বন্ধ করল। দূর থেকে এবং ইন্টারনেটে দেখা উডাং পর্বতের নানিয়ান প্যালেসের শৃংগটিকে চোখের সামনে আনার চেষ্টা করল। আহমদ মুসা নিশ্চিত হলো, নানিয়ান প্যালেসের কোনো পাশ দিয়েই পর্বত শৃংগে উঠার কোনো পথ নেই। পূর্ব, উত্তর, পশ্চিম সব দিক ঘিরেই গভীর গিরিখাদ। নিশ্চয় পথটা তাহলে হবে নানিয়ান প্যালেসের ভেতর দিয়ে কোনো গোপন প্যাসেজ বা সুড়ঙ্গ।

আহমদ মুসা ঘুরে দাঁড়াল।

তাকাল বেশ কিছুটা নিচে জমাট অন্ধকারের মতো দাঁড়ানো নানিয়ান প্যালেসের দিকে।

অন্ধকারে যতটুকু দেখা যাচ্ছে, গাড়ি যে পথ দিয়ে এসেছে সেটা কোনো পথ নয়, টিলা ও বড় গাছপালা পাশ কাটিয়ে এঁকেবেঁকে উঠে আসা একটা ট্রাক।

আহমদ মুসা গাড়ি নিয়ে এগোনোই নিরাপদ মনে করল।

কাভার্ড ভ্যান গাড়িটার ড্রাইভিং সিটে উঠে বসল আহমদ মুসা। চলতে লাগল গাড়ি ধীর গতিতে। গাড়ির হেডলাইটের শর্টরেঞ্জের আলো জ্বালানো, যা সামনের রাস্তাটুকুকেই শুধু আলোকিত করেছে।

নানিয়ান মন্দির প্রাসাদের খুব কাছাকাছি এসে গেছে আহমদ মুসার গাড়ি।

আহমদ মুসার মনে প্রশ্ন, সুড়ঙ্গ বা প্যাসেজের এ দিকের মুখ কি খোলা আছে? ওখানে কি কোনো পাহারা থাকতে পারে?

আহমদ মুসা পকেট থেকে ক্লোরোফরম গানটা বের করে ডান হাতের পাশেই ড্যাশ বোর্ডে রাখল।

নানিয়ান প্রাসাদের এদিকের দেয়ালটা একেবারে সামনে এসে গেছে। গাছগাছড়াও সামনে তেমন নেই। হেড লাইটের আলোতে দেয়ালের নিচের দিকটা আলোকিত হয়ে উঠেছে।

গাড়ির গতি স্লো করে দেয়ালের গায়ে সন্ধানী দৃষ্টি ফেলল আহমদ মুসা। দরজার মতো কোনো কিছুই চোখে পড়ল না।

গাড়ি থেকে নেমে ভালো করে দেখা দরকার, ভাবল আহমদ মুসা। কিন্তু পরক্ষণেই ভাবল গাড়ি এখন এখানে দাঁড় করানো যাবে না। আড়াল থেকে কেউ যদি পর্যবেক্ষণে থাকে, তাহলে তার সন্দেহ হবে। সে তাদের চোখে পড়ে যেতে পারে। নানিয়ান প্রাসাদে ঢোকার আগে সে আর সংঘর্ষে জড়াতে চায় না। আহমদ মুসা নেই, এটাই তারা জানুক। এ গাড়ি আর একটু সামনে এগোলো। আহমদ মুসা দেখল গাড়ির ট্রাকটা ডান দিকে বাঁক নিয়ে প্রাসাদের দেয়ালের গা ঘেঁষে প্রাসাদের ডান প্রান্তের দিকে এগিয়ে গেছে।

খুশি হলো আহমদ মুসা, ট্রাকের শেষ প্রান্ত তাহলে সামনে।

গাড়ি পশ্চিম দিকে এগিয়ে প্রাসাদের দেয়াল ঘেঁষে দাঁড়ানো একটা উঁচু টিলার গোড়ায় এসে গেল।

গাড়ি সেখানে পৌঁছতেই পাশে দেয়ালের দিক থেকে শিস দেয়ার মতো টানা, চাপা একটা শব্দ ভেসে এলো। আহমদ মুসা দ্রুত চোখ ফেরাল। দেখতে পেল, দেয়ালের একটা অংশ পাশের দেয়ালে ঢুকে গেল এবং একটা প্যাসেজের প্রশস্ত, উঁচু মুখ সামনে এসে দাঁড়াল।

সঙ্গে সঙ্গেই আহমদ মুসা কোনো দ্বিধা-সংকোচ ছাড়াই গাড়ি ঘুরিয়ে নিয়ে ঢুকে গেল ভেতরে। তার বাঁ হাতটা গাড়ির স্টিয়ারিং-এ, আর ডান হাত ধরে আছে ক্লোরোফরম রিভলবারের বাট।

কোনো বাধা এলো না। কাউকে কোনো দিকে দেখতে পেল না। আহমদ মুসা ভাবল, লু ঝি ও চেং ঝি ওদের হাতে পড়া এবং আহমদ মুসাকে ফাঁদে আটকে প্রাণদণ্ড দেবার জন্যে নিয়ে যাবার খবর পাওয়ার পর ওরা নিশ্চয় খুব নিশ্চিন্তে আছে। আর পাহাড়ের এদিকটায় অবাঞ্ছিত কারও আসার কোনো সম্ভাবনা নেই। এজন্যে এই প্যাসেজ এবং নানিয়ান প্রাসাদের পেছন এলাকায় কোনো বাড়তি নিরাপত্তার ব্যবস্থা তারা করেনি।

ঢুকে পড়েছে আহমদ মুসার গাড়ি প্যাসেজে।

দুধারে পাথর কিংবা কংক্রিটের কোনো সীমানা দেয়াল নয়, মনে হচ্ছে ঘরের পার্টিশন দেয়াল। কিন্তু দরজা, জানালা ধরনের কিছু নজরে পড়ছে না। গাড়ির হেড লাইটের আলোতে সামনের দিকটা দেখা যাচ্ছে, কিন্তু পাশটা ততটা আলোকিত নয়। প্যাসেজের ছাদে দুটি বৈদ্যুতিক আলো জ্বলতে দেখা গেছে। সেগুলো প্যাসেজের অন্ধকার তাড়িয়েছে, তবে প্যাসেজকে আলোকিত করতে পারেনি।

হেড লাইটের আলো প্যাসেজের শেষ প্রান্তে গিয়ে বন্ধ একটা দেয়ালে ধাক্কা খেয়েছে। আহমদ মুসার গাড়ি ওখানে পৌঁছলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে দরজা খুলে যেতে পারে এদিকের দরজার মতো, অথবা সেখানে ভিন্ন ব্যবস্থাও থাকতে পারে। নিরাপত্তার জন্যে সামনের দরজাটাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ। দরজাটার ওপাশেই প্রাসাদের সম্মুখভাগ। ওদিক দিয়েই তাকে প্রাসাদে ঢোকার চেষ্টা করতে হবে।

প্যাসেজের মাঝখানটা পেরিয়ে এসেছে আহমদ মুসা।

হঠাৎ পেছন থেকে গুলির শব্দ, তার পর মুহূর্তেই বিস্ফোরণ তার গাড়ির পেছনের দুই টায়ারে।

গাড়ির পেছন দিকটা একটা প্রবল ঝকানি দিয়ে বসে গেল।

আহমদ মুসা দ্রুত বামপাশের জানালার দিকে সরে এসে উঁকি দিয়ে দেখল, প্যাসেজের পূর্ব পাশের দেয়ালের মাঝ বরাবর জায়গায় একটা দরজাক খুলে গেছে। দরজার সামনের প্যাসেজে দুজন লোক। তাদের হাতে উদ্ধত রিভলবার, তার গাড়ির দিকে তাক করা। তারা রিভলবার হাতে নিয়ে বিড়ালের মতো নিঃশব্দে এগিয়ে আসছে আর কিছুটা এগোলেই এই গাড়ির আড়াল তারা পেয়ে যাবে। তা

আহমদ মুসা সে সুযোগ তাদেরকে দিল না। তারা তার ক্লোরোফরম গানের আওতায় এসে গেছে।

আহমদ মুসা চোখের পলকে তার ডান হাত জানালার বাইরে নিয়েই পরপর দুটি ফায়ার করল দুজনকে লক্ষ করে।

লোক দুজনও শেষ মুহূর্তে দেখতে পেয়েছিল আহমদ মুসার হাত। তারা আহমদ মুসার হাত টার্গেট করতে একটু সময় নিয়েছিল। আর আহমদ মুসার হাত দেখতে পেতেও একটু দেরি হলেছিল। এই দুই দেরির সময়েই আহমদ মুসার দুটি গুলি ওদের, আঘাত করেছে। তাদের তর্জনিও রিভলবারের ট্রিগার টিপেছিল, গুলি বের হয়েছিল। কিন্তু ক্লোরোফরম গানের কারণে তাদের গুলি খাওয়া দেহের কম্পিত অবস্থা তাদের নিক্ষিপ্ত গুলিকে লক্ষভ্রষ্ট করে দিল।

আহমদ মুসা গাড়ি থেকে নেমে ছুটল ওদের দিকে। কিন্তু আহমদ মুসা যখন ওদের কাছে পৌঁছল, তখন ওদের সংজ্ঞাহীন দেহ লুটিয়ে পড়েছিল মাটিতে।

আহমদ মুসা ওদের পকেট হাতড়াল। কাগজপত্র কিছুই পেল না। পেল মাত্র দুজনের কাছ থেকে দুটি ওয়ারলেস সেট।

ওয়্যারলেস পকেটে পুরতেই একটা ওয়্যারলেস সেট বিপ বিপ করে সংকেত দিয়ে উঠল।

আহমদ মুসা তাড়াতাড়ি ওয়্যারলেসটি বের করে সামনে নিয়ে এলো। ওয়্যারলেসে একটা যান্ত্রিক কণ্ঠ ধ্বনিত হলো, গাজিন, কাজ সেরে ওদের নিয়ে ফিরবে খুব তাড়াতাড়ি। মেয়ে দুটি সংজ্ঞাহীন হয়েছে-তুমি বলেছ। আমি চাই, আমরা প্রাসাদ থেকে চলে যাওয়া পর্যন্ত তারা যেভাবে আছে। সেভাবেই থাকবে।

কথা শেষ হওয়ার সাথে সাথে লাইনটা কেটে গেল।

যান্ত্রিক কণ্ঠের কথা ঘুরছিল আহমদ মুসার মাথায়। এমন যান্ত্রিক কণ্ঠের কথা কোথায় যেন সে শুনেছে। তাড়াতাড়িই মনে পড়ে গেল। হেংসেন পাহাড়ে নে নুয়ার বাবা জেঝি সেংগ-এর কাছে সে শুনেছিল। তিনি যখন উডাং পাহাড়ে আটক ছিলেন, সেখানে তিনি একবার এই কণ্ঠ শুনেছিলেন। তাঁর কথায় প্রমাণ হয়েছে তিনি জোয়ান উর সন্ত্রাসী দলের হাতেই বন্দী ছিলেন। তার আরও মনে পড়ে গেল, মা ঝু সুলতানদের কাছে জানা গেছে জোয়ান উ বন্দীখানায় এসেছিল, কথা বলেছিল। তার কণ্ঠ ছিল যান্ত্রিক। সুতরাং আহমদ মুসা ওয়্যারলেসে এই মাত্র যার কণ্ঠ শুনল, সে কণ্ঠ নিশ্চয়। তাহলে জোয়ান উর। খুশি হলো আহমদ মুসা। কোনো সন্দেহ আর রইল না যে, জোয়ান উ এই প্রাসাদেই আছে। সে আরও একটা বিষয়ে নিশ্চিত হলো, এই লোকগুলো ফিরে না আসা পর্যন্ত সে প্রাসাদেই থাকবে। এটা ভাবতে গিয়ে হঠাৎ তার মনে প্রশ্ন জাগল, এই লোকগুলো কোনো কাজে যাচ্ছিল? প্রশ্নটি সামনে আসার সাথে সাথে আহমদ মুসা ঘরটির দিকে তাকাল। এই ঘর থেকেই লোক দুজন বের হয়ে এসেছিল।

আহমদ মুসা দ্রুত সংজ্ঞাহীন লোক দুজনকে গাড়িতে তুলে দরজা বন্ধ করে দিল।

ঘরের দিকে এগোলো আহমদ মুসা।

ওরা বেরিয়ে এসেছিল দেয়ালের গায়ের একটা গোপন দরজা দিয়ে। দেয়ালের একটা অংশ পাশের দেয়ালে ঢুকে গিয়ে দরজার সৃষ্টি করেছে।

দরজা এখনও খোলা দেখে আহমদ মুসা বুঝল, দরজা স্বয়ংক্রিয় নয়, রিমোট কনট্রোলড বা ডিজিটাল লকের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত।

ঘরে আলো জ্বলছে। ঘরে প্রবেশ করল আহমদ মুসা।

ঘরে ঢুকেই দেখতে পেল হাত-পা বাঁধা, মাথা-মুখ কালো কাপড়ে আবৃত একজন পড়ে আছে মেঝেতে।।

ঘরের চারদিকে তাকাল আহমদ মুসা। ঘরের ওপাশে একটা দরজা। বন্ধ, কোনো জানালা নেই। একটা ছোট টেবিল, দুটি চেয়ার রয়েছে ঘরে। টেবিলের পাশেই হাতের নাগালের মধ্যে লেটেস্ট মডেলের দুটি ভয়ংকর কারবাইন টাঙানো। মিনিটে পাঁচশ গুলি ছোঁড়া যায় ঐ কারবাইন থেকে। আবার সিংগল গুলিরও অপশন আছে। আহমদ মুসা ভাবল, ঘরটি নিরাপত্তা প্রহরীদের মতো কারও হতে পারে।

নানিয়াল প্যালেসে এই হাত-পা বাঁধা লোকটি কে? লোকটির আচার ও রং দেখে আহমদ মুসার মনে একটা চিন্তা ঝিলিক দিয়ে উঠল। দ্রুত এগোললা লোকটির মাথার কাছে। টান দিয়ে মাথা-মুখের কালো কাপড় খুলে ফেলল। লোকটির মুখের উপর চোখ পড়তেই খুশিতে ভরে গেল আহমদ মুসার মন। শুরুতেই আহমদ ইয়াংকে এভাবে পেয়ে যাবে, তা ভাবেনি আহমদ মুসা।

আহমদ মুসা একটু এগিয়ে আহমদ ইয়াং-এর মুখে লাগানো টেপ খুলে ফেলল।

ভাইয়া, পেছনে…। মুখ থেকে টেপ সরতেই চিৎকার করে উঠল আহমদ ইয়াং।

আহমদ মুসাও তার পেছনে বিপরীত দিকের দরজায় হালকা একটা ধাতব শব্দ শুনতে পেয়েছিল। মনে হলো হাতের আংটি যেন ধাতব কোনো কিছুর সাথে বাড়ি খেল।

আহমদ ইয়াং-এর চিৎকার শুরু হবার সাথে সাথেই আহমদ মুসা তার মাথা পেছনে মেঝের দিকে ছুঁড়ে দিল এবং পা দুটি অর্ধচন্দ্রাকারে ঘুরিয়ে পেছনের দরজা লক্ষে ছুঁড়ে মারল।

একটা কারবাইনও গর্জন করে উঠল সেই সাথে।

পা দুটির জোড়া লাথি নরম কোনো কিছুকে আঘাত করল, অনুভব করল আহমদ মুসা। কিছু একটা পতনের শব্দ হলো।

আহমদ মুসা পড়ে গিয়েছিল উপুড় হয়ে। পা দুটি মাটি স্পর্শ করার সাথেই সে মাথা তুলে দুহাত দিয়ে মেঝেকে জোরের সাথে পুশ করে এক ঝটকায় উঠে দাঁড়াল। দেহটা উঠে দাঁড়িয়ে স্থির হবার আগেই তার হাত শোল্ডার হোলস্টার থেকে রিভলবার বের করে নিয়েছিল। আহমদ মুসা যে গতিতে রিভলবার শোল্ডার হোলস্টার থেকে বের করে নিয়ে এসেছিল সে গতিতেই রিভলবারটি কাঁধের উপর দিয়ে মাথার পাশে উঠিয়ে নিয়ে এলো। সঙ্গে সঙ্গে তর্জনি চেপে বসেছিল রিভলবারের ট্রিগারে। এ

আহমদ মুসার দুটি পা উদ্যত কারবাইন হাতে দাঁড়ানো একজনের বুক লক্ষে ছুটে এসেছিল। লোকটির অবস্থানে আকস্মিক পরিবর্তনে অল্পক্ষণের জন্যে সে বিমূঢ় হয়ে পড়েছিল। পরক্ষণেই তার আঙুল ট্রিগারে এসে দ্রুত সেট হয়েছিল। গুলি করেছিল লোকটি, কিন্তু সেই মুহূর্তেই আহমদ মুসার দুপায়ের জোড়া লাথি তার বুকে এসে পড়েছিল। নড়ে গিয়েছিল কারবাইন ধরা তার হাত এবং চিৎ হয়ে পড়েও গিয়েছিল সে। তার কারবাইনের গুলি একটু ঊর্ধ্বমুখী হয়ে ছড়িয়ে পড়েছিল।

সে পড়ে গিয়েছিল চিৎ হয়ে। কিন্তু কারবাইন তার হাত থেকে খসে পড়েনি। লোকটি পড়ে গিয়ে দ্রুত নিজেকে সামলে নিয়ে কারবাইন তুলে দিল আহমদ মুসা লক্ষে। আঙুলও ট্রিগারে চলে এসেছিল। ঠিক সে মুহূর্তে আহমদ মুসার রিভলবারের দুটি গুলি এসে পরপর বিদ্ধ হলো তার বুকে।

আহমদ মুসা গুলি করেই ফিরে দাঁড়াল।

গুলিবিদ্ধ লোকটিকে সে দেখল। ত্রিশ-পঁয়ত্রিশ বছরের এক যুবক। তখনও সে কাতরাচ্ছে। কিন্তু হাত থেকে কারবাইন ছাড়েনি সে।

আহমদ মুসা ঝুঁকে পড়ল তার মুখের উপর। বলল, অনর্থক এই রক্তারক্তি কেন করছ তোমরা? কেন এভাবে জীবন দিচ্ছ?

লোকটির যন্ত্রণাক্লিষ্ট দুই চোখ থেকে আগুন বেরিয়ে এলো। বলল, জোয়ান উর পবিত্র সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার জন্যে আমরা কাজ করছি, আমাদের এই কাজ অনর্থক নয়, আমাদের মৃত্যুও অনর্থক নয়। শেষে জয় জোয়ান উরই হবে। আর তোমরা, বেইজিং-এর শয়তানরা হবে ধ্বংস।

আহমদ মুসা লোকটির ডান বাহুতে বাঁধা সোনালি ব্যান্ড দেখিয়ে বলল, এটা কিসের চিহ্ন? পবিত্র সাম্রাজ্যের? অন্যদের বাহুতে দেখেছি লাল ব্যান্ড, তোমারটা সোনালি কেন?

পবিত্র সাম্রাজ্যকে বিদ্রূপ করো না। দিন সমান যায় না। নানিয়ান প্রাসাদ রক্ষা স্কোয়াডের আমি প্রধান ছিলাম। পারলাম না, পরাজিত হলাম। দুঃখ নেই। জোয়ান উর পরাজয় নেই। তিনি শেষ হন না, তার রূপ। পরিবর্তন হয়।

জোয়ান উ কী এ প্রাসাদেই আছেন? জিজ্ঞাসা করল আহমদ মুসা।

তার সম্পর্কে আমরা কিছু জানি না, বলিও না। বলল লোকটি ক্ষীণকণ্ঠে।

তুমি তোমার কারবাইন এখনও শক্ত করে ধরে রেখেছ কেন? আহমদ মুসা বলল।

সব শক্তি একত্র করে তোমাকে একটা গুলি করব ভেবেছিলাম। কিন্তু তুমি এতটা কাছে চলে এসেছ, পারলাম না। বলল যুবকটি।

দুঃখ হচ্ছে কি এই পরাজয়ের জন্যে? আহমদ মুসা বলল।

দুঃখ নেই। তুমি অবিশ্বাস্য রকমের ক্ষিপ্র। আমার পরাজয় স্বাভাবিক ছিল। বলল যুবকটি ক্ষীণ কণ্ঠে। তার দুহাত থেকে কারবাইন পড়ে গেল। শিথিল হয়ে পড়েছে তার দুই হাত।

তুমি খুব ভালো মানুষ। তোমার কে আছে, কোথায় থাকে? জিজ্ঞাসা করল আহমদ মুসা আরও একটু ঝুঁকে পড়ে।

যুবকটি চোখ তুলে তাকাল আহমদ মুসার দিকে। দুর্বল দৃষ্টি। বলল, কেন? এ প্রশ্ন কেন?

মানুষ কি মানুষের খোঁজ নিতে পারে না? এক আদমেরই তো আমরা বংশধর।

তুমি খুব ভালো মানুষ। মাই লর্ডের কাছে যার কথা শুনেছি, তাহলে তুমি সেই হবে। অস্পষ্ট কণ্ঠে বলল যুবকটি।

একটু থেমে আবার বলল খুব কষ্ট করে, পরিবারের কথা বলে আমার কষ্টের দরজা খুলে দিলে।

আবার থেমে গেল তার কণ্ঠ। অস্ফুট তার কণ্ঠ আবার ধ্বনিত হলো, আমার মোবাইলটা তোমাকে দিয়ে গেলাম।

নীরব হয়ে গেল তার কণ্ঠ।

স্তব্ধ হয়ে গেল তার জীবনের গতি।

গম্ভীর হয়ে উঠল আহমদ মুসার মুখ। তার চোখটিও মুহূর্তের জন্যে বুজে গিয়েছিল।

যুবকটির জ্যাকেটের পকেটে হাত ঢুকিয়ে মোবাইলটি পেয়ে গেল আহমদ মুসা। যুবকটিকে সার্চ করতে তার মন চাইল না।

উঠে দাঁড়িয়ে দ্রুত ছুটে এলো আহমদ ইয়াং-এর কাছে।

আহমদ ইয়াংকে একটা লম্বা দড়ি দিয়ে পেঁচিয়ে বাঁধা হয়েছে। দুহাতও বাঁধা পড়ে গেছে দেহের সাথে। পেঁচানো বাঁধনটা চলে গেছে পা পর্যন্ত।

আহমদ ইয়াংও শুনছিল যুবকটির সাথে আহমদ মুসার কথা।

আহমদ ইয়াং তুমি ভালো আছ তো?

আহমদ ইয়াংকে প্রশ্নটা করেই আহমদ মুসা পকেট থেকে চাকু বের করে দুই প্রান্তের বাঁধন কেটে দিল।

আহমদ মুসা উঠে বসে আহমদ ইয়াং-এর দেহে পেঁচানো দড়ি খুলতে লেগে গেল।

বাঁধনমুক্ত হয়েই আহমদ ইয়াং জড়িয়ে ধরল আহমদ মুসাকে। বলল, আমার কাছে তাদের পাবার কিছু ছিল না। আমাকে টোপ বানানো হয়েছিল নেইজেনের আব্বাকে ধরার জন্যে। সুতরাং ভালোই ছিলাম এতদিন। কিন্তু আজ ওরা আমাকে প্রাণদণ্ড দিতে নিয়ে যাচ্ছিল। শুনেছি, পাহাড়ের কয়েক হাজার ফিট গভীর খাদে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে ওরা প্রাণদণ্ড কার্যকর করে।

আমাকেও ওরা নিয়ে গিয়েছিল পাহাড়ের ঐ খাদে ছুঁড়ে দেবার জন্যে।

কথাটা শেষ করেই আহমদ মুসা বলল, আহমদ ইয়াং তুমি কি মুভ করতে পারবে? ভালো আছ তো তুমি?

একদম ফিট। যেটুকু অসুবিধা ছিল আপনাকে দেখে সব দূর হয়ে গেছে। কি করতে হবে বলুন। আহমদ ইয়াং বলল।

কথা বলতে গিয়েও আহমদ মুসা থেমে গেল। উৎকর্ণ হলো। ব্রাশ ফায়ারের একটা চাপা শব্দ শুনতে পেয়েছে সে। আবার শব্দ হলো। সেই ধরনের কয়েক সেকেণ্ড স্থায়ী শব্দ। অস্পষ্ট ধরনের শব্দ।

উপর থেকে আসছে বলে মনে হচ্ছে। তাকাল আহমদ মুসা আহমদ ইয়াং-এর দিকে।

হ্যাঁ, ভাইয়া ব্রাশ ফায়ারের শব্দ। উপর থেকেই আসছে। প্রাসাদের উপরের দুটো ফ্লোরের বেশির ভাগ অংশই সাউন্ড প্রুফ। এই কারণে শব্দের অল্পই আমরা শুনতে পাচ্ছি। বলল আহমদ ইয়াং।

আহমদ মুসা মৃত যুবকটির কাররাইন হাতে তুলে নিয়ে আহমদ ইয়াং এর হাতে তুলে দিয়ে বলল, এখান থেকে তিনতলা, চারতলায় উঠার কোনো পথ আছে?

জি ভাইয়া, তিনতলা থেকেই আমাকে নিয়ে আসা হয়েছিল। আমি চিনি পথটা। বলল আহমদ ইয়াং।

এসো। বলে ভেতরের দিকে ছুটল আহমদ মুসা। আহমদ মুসার পাশাপাশিই ছুটল আহমদ ইয়াং।

.

লু ঝি সংজ্ঞা ফিরে পেয়ে চোখ মেলেই দেখতে পেল, ডাক্তারের অ্যাপ্রোনপরা, গলায় স্টেথিসকোপ ঝুলানো ইয়ং মহিলা তার সামনে বসে আছে। তার পেছনে দাঁড়িয়ে আছে কমান্ডো পোশাকের দুজন মহিলা। তাদের কারবাইন লু ঝি ও তার পার্সোনাল সেক্রেটারি চেং ঝির দিকে স্থির তাকিয়ে আছে।

লু ঝি উঠে বসল। সে ও চেং ঝি দুজনেই দুই খাটের উপর পড়েছিল। খাটের উপর থেকে চোখ ফিরিয়ে সে তাকাল চেং ঝির দিকে।

দুজনেরই হাত-পা বাঁধা।

ডাক্তার ও দুই কারবাইনধারীকে আর একবার দেখে নিল লু ঝি। কারবাইনধারী দুজনের একজনকে লক্ষ করে বলল, আমাদের আরেকজন সাথী ছিল। সে কোথায়?

লু ঝি জানে আহমদ মুসাকে তাদের থেকে আলাদা করা হয়েছে। তাদেরকে প্রাসাদে নিয়ে আসা হয়েছে, আহমদ মুসাকে আনা হয়নি। আহমদ মুসাকে কি করা হয়েছে, এ নিয়ে লু ঝি উদ্বিগ্ন। এটা জানার জন্যেই তার এ প্রশ্ন।

লু ঝির জিজ্ঞাসার জবাবে কারবাইনধারী কিছুই বলল না। লু ঝি এবার চিৎকার করে একই প্রশ্ন করল সেই কারবাইনধারীকে। কারবাইনধারী পাথরের মতো স্থির দাঁড়িয়ে রইল। মুখ তুলল ডাক্তার মহিলাটি। লু ঝিকে সে বলল, ম্যাডাম ওরা কিছুই জানে না, কিছুই বলতে পারবে না। আমি যেটুকু শুনেছি, আপনাকে বলছি। ঐ লোকটা নাকি বিদেশি ছিল। তার উপর আমাদের অনেক লোককে সে হত্যা করেছে। এ জন্যে মাই লর্ডের বিচারে তার প্রাণদণ্ড হয়েছে। তার প্রাণদণ্ড এতক্ষণে কার্যকর হয়ে গেছে।

চমকে উঠল লু ঝি। কেঁপে উঠল তার ভেতরটা। কিন্তু দাঁতে দাঁত চেপে নিজেকে সংবরণ করল, প্রকাশ হতে দিল না। আর্তনাদের কণ্ঠেই তার মনটা বলে উঠল, এ খবর ঠিক হতে পারে না। তাঁর মতো একজন মজলুম মানুষের মহানায়কের জীবনের ইতি এখানে এভাবে ঘটতে পারে না!

লু ঝি তাকাল ডাক্তার মহিলার দিকে। বলল অনেকটাই স্বাভাবিক কণ্ঠে, আপনি ঠিক শোনেননি। এটা জেলখানা নয়, প্রাণদণ্ড কার্যকর করার জায়গা এখানে নেই। এ প্রাসাদ তো ধর্মশালা।

ডাক্তার মহিলা একটু হেসে বলল, আমি পাল্টা যুক্তি দেব না ম্যাডাম। মানুষ আশা নিয়ে বাঁচে, আপনি আশাবাদী থাকুন।

ডাক্তার মহিলার স্থির শান্ত কথায় আরেক দফা কেঁপে উঠল লু ঝির মন। মনের এ দুর্বলতা ঝেড়ে ফেলার জন্যেই কথা অন্যদিকে ঘুরিয়ে নেবার জন্যে বলল, আমাকে ম্যাডাম বলছেন কেন? আমি তো বন্দী। আমিও তো আপনাদের অনেক লোক মেরেছি। আমারও তো শাস্তি হওয়া প্রয়োজন।

সেটা ঠিক। কিন্তু আপনি চীনা দেশ প্রেমিক। বংশীয়ভাবে আপনি। একজন কট্টর জাতীয়তাবাদীও। ঐ লোকটিই আপনাকে বিভ্রান্ত করেছিল, ভুল পথে নিয়ে গিয়েছিল। এটাও ছিল তার একটা অপরাধ। বলল ডাক্তার মহিলাটি।

বুকের কোথায় যেন একটা ব্যথা চিন চিন করে উঠল লু ঝির। বলল, আমার সম্পর্কে এসব কথা, যা আমি নিজেই জানি না, আপনি জানলেন কি করে?

হাসল ডাক্তার মহিলাটি। বলল, তিনি তো লেজেন্ডারি সেই জোয়ান উ। গোটা চীনের উপর তার ছায়া বিস্তৃত। তিনি সব চীনাকে চেনেন। তিনি আপনাকেও জানেন।

লু ঝির অবচেতন মনের এক কোণে তার পিতার মুখ ভেসে উঠল। কেঁপে উঠল তার মন থর থর করে। মনের মধ্যে এক ব্যাকুল কণ্ঠ বলে উঠল, তার মন যা বলছে, যুক্তি যা বলছে তা সত্য না হোক। কিছু বলতে যাচ্ছিল লু ঝি ডাক্তারকে। এ সময় দরজা ঠেলে ট্রলি নিয়ে প্রবেশ করল একজন বেয়ারা। ট্রলিতে খাবার।

লু ঝির দুচোখ ছুটে গেল সেদিকে। খোলা দরজা দিয়ে দেখতে পেল আরও চারজন কারবাইনধারী দাঁড়িয়ে আছে বাইরে।

ম্যাডাম খেয়ে নিন। খাবার আসার পর দেরি করা এখানকার নিয়ম বিরোধী। ডাক্তার মহিলা বলল।

কেউ কি খাইয়ে দেবে? কারও হাতের খাবার আমি খাই না। বলল লু ঝি।

ডাক্তার মহিলা তাকাল ট্রলি ঠেলে নিয়ে আসা লোকটির দিকে। বেয়ারা লোকটি দেখতে কমান্ডো সাইজের। তার কোমরে গোজা আছে রিভলবার। বলল ডাক্তার মহিলা তাকে, হোয়াও, ওদের দুজনের বাধন খুলে দাও।

হোয়াও ট্রলিটা ঠিক জায়গায় দাঁড় করিয়ে রেখে এগিয়ে গিয়ে প্রথমে লু ঝির বাঁধন খুলে দিয়ে তাকাল চেং ঝির দিকে এগোতে লাগল।

বাঁধন খোলার সময় লু ঝি উঠে দাঁড়িয়েছিল।

হাতের বাঁধন খোলার পর হাত উল্টিয়ে পাল্টিয়ে স্বাভাবিক করে নিচ্ছিল লু ঝি। দেখল সে কারবাইনধারী দুজন খুব সতর্ক অবস্থায় নয়। খাবারের দিকে এবং চেং ঝির বাঁধন খোলার দিকে তাদের নজর ঘুরে যেতে দেখল।

শক্ত হয়ে উঠল লু ঝির দেহ।

মার্শাল আর্টের এক দক্ষ প্রতিভা লু ঝি দেহটাকে উড়িয়ে নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল কারবাইনধারী এ দিকের লোকটির উপর। কেড়ে নিল কারবাইন তার হাত থেকে এবং সঙ্গে সঙ্গেই কারবাইনের নল ঘুরিয়ে নিয়ে গুলি করল দ্বিতীয় কারবাইনধারীকে। কারবাইনের ব্যারেল সে ঘুরিয়ে নিয়ে এলো প্রথম। কারবাইনধারীর উপর। সে উঠে দাঁড়াচ্ছিল।

লু ঝিকে কারবাইনধারীর উপর ঝাঁপিয়ে পড়তে দেখেই চেং ঝি গড়িয়ে খাটের নিচে নেমে গেল। তার হাতের বাঁধন খোলা হয়েছিল কিন্তু পা তখনো বাঁধা।

চেং ঝির বাঁধন খুলতে যাওয়া দেখে খাবার ট্রলি ঠেলে আনা সেই লোকটি প্রথমটায় হতবুদ্ধি হয়ে পড়লেও দ্রুত নিজেকে সামলে নিয়ে সে রিভলবার তুলল লু ঝির উদ্দেশ্যে।

কিন্তু লু ঝি প্রথম কারবাইনধারীকে গুলি করার পর রিভলবারধারীর হাত তার দিকে উঠে এসেছিল। লোকটির রিভলবার লু ঝি পর্যন্ত উঠে আসার আগেই সে কারবাইনের গুলির শিকারে পরিণত হলো।

রিভলবারধারীকে গুলি করেই লু ঝি লাফ দিয়ে দরজার পাল্লার গোড়ায় গিয়ে পড়ল। খাবার ট্রলি নিয়ে ঘরে ঢোকার পর লোকটি দরজাটা জোরে পুশ করায় দরজাটা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল।

দরজার পাল্লার গোড়ায় গিয়ে দাঁড়াতেই তার চোখ পড়ল মহিলা ডাক্তারের দিকে। দেখল তার রিভলবার হাঁ করে আছে লু ঝির দিকে। লু ঝি তার দিকে তাকাতেই সে বলে উঠল, আপনাকে হত্যা করতে পারবো না ম্যাডাম, কিন্তু আপনাকে নিষ্ক্রিয় করার জন্যে আহত করতে পারি।

লু ঝির উদ্দেশ্যে তাক করা ডাক্তার মহিলার রিভলবার চেং ঝি আগেই দেখতে পেয়েছিল। চেং ঝি অত্যন্ত সন্তর্পণে দেহের উপরের দিক কিছুটা খাটের উপরে তুলে হাত বাড়িয়ে ট্রলি নিয়ে আসা লোকটির রিভলবার কুড়িয়ে নিল এবং সেই অবস্থায় থেকেই গুলি করল ডাক্তার মহিলার রিভলবার ধরা হাত লক্ষ করে। তার হাত থেকে রিভলবার পড়ে গেল এবং সে ঝাঁকিয়ে উঠে বাম হাত দিয়ে আহত ডান হাত চেপে ধরল।

ধনবাদ চেং ঝি। বলে লুঝি কারবাইন ঘুরিয়ে নিল ডাক্তার মহিলার দিকে।

বাইরে থেকে দরজা ভেঙে ফেলার চেষ্টা করা হচ্ছিল। শেষে তারা গোটা লককেই গুলি করে উড়িয়ে দিয়েছে। এখনি ওরা ভেতরে ঢুকবে।

চেং ঝি, তুমি ম্যাডামকে কভার করো, আমি এদিকে দেখছি।

লু ঝির কথা শেষ হতে পারলো না। দরজা প্রচণ্ড বেগে সামনে ঠেলে দিয়ে চারজন ঝড়ের বেগে ঘরে প্রবেশ করল। ( ছুটে আসা দরজার আঘাত লু ঝি হজম করে দরজাটাকে সামনে জোরের সাথে ঠেলে দিয়ে দরজার সাথে সাথে সেও এগোলো। লু ঝি তখন ভেতরে ঢোকা লোক চারজনের পেছনে। কারবাইন উদ্যত করাই ছিল। ট্রিগার চেপে ধরল সে।

ওরাও লু ঝিকে দেখতে পেয়েছিল। কিন্তু ওদের কারবাইন এদিকে ঘুরিয়ে নেবার আগেই লু ঝির কারবাইনের গুলি ওদের হেঁকে ধরল। ওদের চারজনের দেহই লাশ হয়ে পড়ে গেল।

লু ঝি কারবাইনটা ঘাড়ে ঝুলিয়ে নিয়ে মেঝে থেকে ডাক্তার মহিলার পড়ে থাকা রিভলবার তুলে নিয়ে তাকে বলল, দুঃখিত, আপনার কাছ থেকে

জীবনের ভয় ছিল না, তবুও আপনাকে নিষ্ক্রিয় করা জন্যেই গুলি করেছে। চেং ঝি।

চেং ঝি এসে লু ঝির সামনে দাঁড়িয়েছিল।

চেং ঝি, ডাক্তার ম্যাডামকে সার্চ কর। বলল লু ঝি।

চেং ঝি তাকে সার্চ করে তার জ্যাকেটের পকেটে একটা লেজার গান পেল।

লেজার গান দেখেই লু ঝি বিস্ময়ের সাথে বলল, ডাক্তার ম্যাডাম আপনার কাছে লেজার গান! তাহলে তো আপনি শুধু ডাক্তার নন? কে আপনি? আমাকে হত্যা করতে পারবেন না একথা বলেছিলেন কেন?

পবিত্র চীনের যিনি লর্ড, তার একজন নগণ্য খাদেম আমি। ম্যাডাম আপনার সম্পর্কে যতটুকু বলেছি, তার বেশি বলার এখতিয়ার আমার নেই। বলল ডাক্তার মহিলাটি।

যাদের মন পর্বত প্রমাণ হিংসা বিদ্বেষে ভরা, তাদের মুখে পবিত্রতা শব্দ মানায় না। যাক, চলুন, আপনার লর্ড কোথায় দেখি। লু ঝি বলল।

লর্ডকে গিয়ে দেখা যায় না, তিনি নিজ ইচ্ছায় এসে দেখা দেন। বলল ডাক্তার মহিলাটি।

আপনি ঈশ্বরের বৈশিষ্ট্যের কথা বলছেন। কোনো মানুষ কখনো ঈশ্বর হতে পারে না। লু ঝি বলল।

ঈশ্বরের রূপ পেতে পারেন? বলল ডাক্তার।

এসব অন্ধবিশ্বাস। বলেই লু ঝি তাকাল চেং ঝির দিকে। বলল, তুমি একটা কারবাইন নাও। আর ডাক্তার ম্যাডামকে নিয়ে এসো। আমি বাইরেটা দেখি।

বাইরে বেরিয়ে এলো লু ঝি। তার ঘাড়ে ঝুলানো কারবাইন, বাম হাতে রিভলবার এবং ডান হাতে ডাক্তারের কাছ থেকে পাওয়া লেজার গান।

দরজার বাইরে বেরিয়ে কয়েক ধাপ এগোতেই সে আকস্মিকভাবে মুখোমুখি হয়ে গেল চারটি কারবাইনের। কারবাইন চারটি চারজন লোকের হাতে। কালো কাপড়ে ঢাকা তাদের দেহ। বুকে সোনালি কংকাল আঁকা।

চোখ তাদের উপর পড়ার সাথে সাথেই লু ঝির লেজার গান বিদ্যুৎবেগে উঠে চারজনের উপর দিয়েই ঘুরে এসেছিল। দ্বিখণ্ডিত হয়ে পড়ে গেল চারটি দেহ।

লু ঝির মনে বিদ্যুৎবেগে একটা চিন্তা ছুটে এলো, শেষ দুজনের, বিশেষ করে শেষ জনের সুযোগ ছিল লু ঝিকে গুলি করার। কিন্তু গুলি না করে পেছন দিকে তাকাতে যাচ্ছিল কেন?

লু ঝি তাকাল পেছন দিকে। চোখ আছড়ে পড়ল দীর্ঘাঙ্গ এক মানুষের উপর। লাল বর্মাকার পোশাকে ঢাকা তার দেহ। মুখে সোনালি মুখোশ। মাথায় সোনালি মুকুট। তার দুহাতে উদ্যত দুটি বিশেষ গান। রং লাল।

লু ঝি মুহূর্তের জন্যে সম্মোহিত হওয়ার মতো আচ্ছন্নতার মধ্যে পড়ে গিয়েছিল। কিন্তু সংবিত ফিরে পেতেই তার হাতের বেপরোয়া লেজার গান উঠে এলো লোকটির লক্ষে।

পেছন থেকে একটা কণ্ঠ চিৎকার করে উঠল, লু ঝি থাম। কণ্ঠটি আহমদ মুসার। কণ্ঠটি কানে যেতেই এক অদমনীয় আবেগে সর্বাঙ্গ তার শিহরিত হয়ে উঠল। তাকাল সে পেছনে।

আহমদ মুসা চলে এসেছিল তার পাশে।

আহমদ মুসা, তুমিই সব সর্বনাশের মূল। কথাটি উচ্চারিত হবার সাথে সাথেই সেই বর্মাচ্ছাদিত লোকটির ডান হাতের বিশেষ গান উঠে আসছিল আহমদ মুসার লক্ষে।

আহমদ মুসার রিভলবার হাতে বাট, কিন্তু টার্গেটে তোলার সময় তার হাতে ছিল না। বর্মাচ্ছাদিত লোকটির রিভলবারের সামনে সে ছিল একেবারেই অরক্ষিত।

লু ঝি চমকে উঠে বর্মাচ্ছাদিত লোকটির দিকে ফিরে তাকিয়েই ছুটে এসেছিল আহমদ মুসার সামনে তাকে আড়াল করার জন্যে।

আহমদ মুসার দিকে ছুটার সময়েই হাতের লেজার গানটা তুলে ধরেছিল। বর্মাচ্ছাদিত লোকটির লক্ষে।

আহমদ মুসার সামনে দাঁড়িয়ে স্থির হবার মুহূর্তেই একটা গুলি বর্মাচ্ছাদিত লোকটির রিভলবার থেকে এসে লু ঝির বাম পাঁজর বিধ্বস্ত করে দিল।

লু ঝিও ছুটে এসে স্থির হবার পর তার লেজার গানের ট্রিগার টিপেছিল। লেজার গানের ভয়াবহ ছোবল লোকটির বর্ম পুড়িয়ে তার বুকে একটা গবাক্ষ সৃষ্টি করে বেরিয়ে গেল।

পড়ে যাচ্ছিল লু ঝির দেহ।

আহমদ মুসা গিয়ে তাকে ধরে ফেলল। বলল আর্তকণ্ঠে, লু ঝি কি করলে তুমি! আমাকে তুমি বাঁচালে, কিন্তু আমি তোমাকে বাঁচাতে পারলাম না।

স্যার, আমি সামান্য লু ঝি। সবাইকে বাঁচাবার জন্যে আপনার বাঁচা দরকার।

থেমে একটু দম নিয়ে লু ঝি আবার বলল, স্যার, সময় বেশি নেই, আপনি কি দয়া করে সন্ত্রাসীদের লর্ড-এর কাছে। আমাকে নিয়ে যাবেন? পবিত্র চীন-এর ঈশ্বর যে সাজতে চেয়েছিল, নিজের চোখে তাকে একটু দেখতে চাই।

ওটা পরে হবে। এখন তোমাকে হাসপাতালে নিতে চাই।

বলে আহমদ মুসা তাকাল আহমদ ইয়াং-এর দিকে। বলল, তুমি সামনের ঘরগুলো দেখে এসো। কেউ আছে কি না। আমি টেলিফোন করে অ্যাম্বুলেন্স ডাকছি। ওরা বাইরেই আছে।

আহমদ মুসার নির্দেশ পাবার সাথে সাথেই আহমদ ইয়াং ছুটল সামনে। লাউঞ্জের ওপাশের দরজার দিকে।

স্যার, অতটা সময় আমার নেই। প্লিজ, আমাকে ওদের লর্ডের কাছে নিয়ে চলুন। প্লিজ। ক্লান্ত, ক্ষীণকণ্ঠে বলল লু ঝি।

অস্বস্তিতে ভরে গেল আহমদ মুসার মন। আবার ভাবল আহমদ মুসা, সত্যটা লু ঝির সামনে আসাই দরকার।

আহমদ মুসা লু ঝির দিকে একবার চোখ তুলে তাকিয়ে তাকে পাঁজা কোলা করে তুলে নিল।

লু ঝিকে ঐভাবে নিয়েই বসল গিয়ে বর্মাচ্ছাদিত লোকটির সামনে। তার পেছনটা ছিল মেঝের উপর, আর সামনের দিক ছিল দেয়ালে আটকে যাওয়া অবস্থায়।

বসেই আহমদ মুসা তাকাল চেং ঝির দিকে। তার হাতে রিভলবার। ডাক্তার মহিলার দিকে তাক করা। বলল, চেং ঝি, তুমি লু ঝিকে একটু ধর। ওঁর ছদ্মবেশটা আমাকে খুলতে হবে।

স্যার, আমার ইচ্ছা, আমাকে এভাবেই মরতে দিন। ঈশ্বরকে বলতে পারব, তাঁর একজন প্রিয় মানুষের কোলে আমার মৃত্যু হয়েছে। তিনি আমাকে ভালো জানতেন, ভালোবাসতেন বলেই দয়া করে কোলে আশ্রয় দিয়েছিলেন। ভালো কিছু তো আমার জীবনে নেই, অন্তত এ দাবিটুকু করা। থেকে আমাকে বঞ্চিত করবেন না। বলল লু ঝি ক্ষীণকণ্ঠে।

লু ঝি, আল্লাহকে তুমি তো জান। আহমদ মুসা বলল।

ঈশ্বর বলতে আমি আল্লাহকেই বুঝিয়েছি। আমার সর্বজ্ঞ আল্লাহ নিশ্চয়। এটা জানেন। বলল লু ঝি।

শেষ নবী মুহাম্মদ (সা.)-কেও তো তুমি জান। আহমদ মুসা বলল।

চোখ বুজে ছিল লু ঝি। চোখ খুলল। দৃষ্টি তার ঊর্ধ্বমুখী। বলল খুব নরম ও ক্ষীণ কণ্ঠে, শুধু জানি নয়, মানি তাঁকে। স্যার, যে আপনার সান্নিধ্য পায়, সে তার অন্তরের চোখ দিয়ে আল্লাহ ও তার রাসুল (সা.)-কেও দেখতে পায়। দুর্বল কণ্ঠে টেনে টেনে কথা শেষ করল লু ঝি।

আলহামদুলিল্লাহ! লু ঝি, আমি সাক্ষী থাকলাম। শেষ বিচারের সেই কঠিন দিনে মাবুদ চাইলে তোমার জন্যে এই সাক্ষী আমি দেব।

লু ঝির পাণ্ডুর ঠোঁটে একটা রক্তিম আভা ফিরে এলো। মুহূর্তের জন্যে চোখ দুটি তার বুজে গেল। তার স্বতকণ্ঠে উচ্চারিত হলো অস্ফুট উচ্চারণে দুনিয়ায় আমার স-ব পাওয়া শেষ।

আবার চোখ খুলে গেল তার। কষ্ট করে চোখ ফিরিয়ে তাকাল। বর্মাচ্ছাদিত লোকটির দিকে।

ডাক্তার মহিলাটি ছুটে গেল বর্মাচ্ছাদিত লোকটির মাথার কাছে। লু ঝি ম্যাডাম, ইনি আপনার বাবা। বলে সে একটানে মাথার মুকুটসহ মুখের মুখোশ খুলে ফেলল।

ওদিকেই তাকিয়েছিল লু ঝি। পিতার মুখের উপর তার চোখ পড়ল। একটা আবেগের প্রবল ছোবল যেন তার মুখের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। ঠোঁট কামড়ে ধরে আত্মরক্ষার চেষ্টা করল সে। ঠোঁটে দাঁত বসে যাওয়ায় ঝর ঝর করে রক্ত বেরিয়ে এলো ঠোঁট থেকে। তার চোখ দুটি স্থির ছিল পিতার মুখের উপর। সে চোখে ছিল অশ্রুর ঢল। রক্তরাঙা তার ঠোঁট ছাপিয়ে খুব নরম, শান্ত একটা কণ্ঠ বেরিয়ে এলো, স্যার, আমার বাবা খুব ভালো বাবা ছিলেন। আমি তাকে খুব ভালোবাসি স্যার। খুব ভালো মানুষ ছিলেন তিনি। কিন্তু নিজ জাতির খুব ভালোর জন্য ভাবতে গিয়ে তিনি জাতির ঈশ্বর সেজে বসেছিলেন। তার শেষ কথাগুলো বাঁধভাঙা কান্নায় ভেঙে পড়ল।

নিস্তেজ হয়ে পড়ল সে।

তার মাথাটা একপাশে গড়িয়ে পড়ল। এই অবস্থাতেই তার ক্ষীণ কণ্ঠ ধ্বনিত হলো, আমার এবং বাবার কেউ থাকল না। চেং ঝি আমাদের সম্পত্তির একংশ পাবে। অবশিষ্ট সব সম্পত্তির দায়িত্ব আপনার স্যার। যারা আমার বাবার জন্যে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, এই সম্পত্তি তাদের দিয়ে দেবেন। আল্লাহ কি দয়া করে তাকে মাফ করবেন না! বাবার জন্যে করার তো আমার আর কিছু নেই! তার শেষ স্বগত কথা প্রায় শ্রুতির বাইরে হারিয়ে গেল।

তার সাথেই সে যেন ঘুমিয়ে পড়ল। প্রাণহীন হয়ে গেল তার দেহ। ইন্না লিল্লাহ…পড়ে আস্তে আস্তে তার দেহ আহমদ মুসা মেঝেতে নামিয়ে রাখল।

 একটা উদাস কণ্ঠ ধ্বনিত হলো। ডাক্তার মহিলা স্বগতকণ্ঠে বলছিল, দুইজন দুই প্রান্তের কিন্তু অদ্ভুত ভালোবাসা এই বাপ-বেটির মধ্যে। যখন নানিয়ান প্রাসাদে লু ঝির প্রবেশের কথা মাই লর্ড শুনলেন, তখনই তিনি বললেন, যত যাই ঘটুক কিংবা যা কিছুই ঘটুক, লু ঝির কোনো ক্ষতি যেন

হয়। মাই লর্ড এমনভাবে কখনই ভাবতেন না। তার কাছে কাজের স্বার্থ ছিল সবার বড়। কিন্তু সম্প্রতি তিনি বদলে যান। লু ঝির চিন্তাই সর্বক্ষণ তাকে ঘিরে থাকতো। তাঁর সংগঠনে এই যে বিপর্যয়, তা তার এই পরিবর্তনের কারণেও ঘটতে পারে।

লু ঝির পাশে বসে অঝোরে কাঁদছিল চেং ঝি।

আহমদ মুসা অনেকটা স্বগতকণ্ঠে বলল, আমি দুজনকেই বাঁচাতে চেয়েছিলাম। লু ঝিকে সাথে নেয়ার একটা কারণও এটাই ছিল। কিন্তু পার লাম না। হয়তো আল্লাহ এতেই তাদের মঙ্গল রেখেছেন! অশ্রুভেজা নরম কণ্ঠ আহমদ মুসার।

আহমদ মুসা পকেট থেকে মোবাইল বের করে একটা কল তৈরি করে বলল, কর্নেল দেং শিয়াও, আপনারা প্রাসাদে ঢুকুন। জোয়ান উ মারা পড়েছেন। আমাদের লু ঝিও নিহত হয়েছেন। ওদের আরও পনেরো বিশজন লোক মারা গেছে। আমরা এখন চারতলায়।

ইয়েস স্যার, আমি আসছি। বলল কর্নেল।

ধন্যবাদ। বলে আহমদ মুসা উঠে দাঁড়াল।

আহমদ ইয়াং এসে প্রবেশ করল লাউঞ্জে। বলল, স্যার, ওদিকে সব ফাঁকা। তিনতলা, দুতলায় দেখব কি?

দরকার নেই। কেউ আছে বলে মনে হয় না। আর সেনাবাহিনীর লোকরা এখনই প্রবেশ করছে প্রাসাদে।

বলে আহমদ মুসা তাকাল আহমদ ইয়াং-এর দিকে। বলল, আহমদ ইয়াং, ভাই থেকে স্যার সম্বোধনে আসা প্রমোশন, না ডিমোন?

বিব্রত হয়ে উঠল আহমদ ইয়াং-এর মুখ। বলল, স্যরি ভাইয়া, সবার সামনে তো, তাই…।

থাক। তোমার কাছে তো মোবাইল নেই। নাও আমার মোবাইল। নেইজেনকে টেলিফোন কর। বলল আহমদ মুসা।

ওরা তো ভালো আছে ভাইয়া? আহমদ ইয়াং-এর কণ্ঠে উদ্বেগ।

আমি যোগাযোগ করিনি আহমদ ইয়াং। কি বলে সান্ত্বনা দেব, সেটা খুঁজে পাইনি।

বলে আহমদ মুসা মোবাইল তুলে দিল আহমদ ইয়াং-এর হাতে।

আহমদ ইয়াং মোবাইল হাতে সরে গেল ঘরের একপাশে। দুচারটা কথা বলেই দ্রুত সে ছুটে এলো আহমদ মুসার কাছে। বলল, ভাইয়া আমাদের মহামান্য প্রেসিডেন্ট কথা বলবেন। খুব জরুরি।

আহমদ মুসা মোবাইল হাতে নিল। টেলিফোন ধরে হ্যালো এক্সিলেন্সি! বলতেই প্রেসিডেন্টের কণ্ঠ শুনতে পেল, অভিন্দন আহমদ মুসা। এইমাত্র সব জানলাম। তুমি ভালো আছ তো? ভালো মেয়ে লু ঝির জন্যে দুঃখ হচ্ছে।

দুজনকেই বাঁচাতে চেয়েছিলাম এক্সিলেন্সি। পারিনি। বলল আহমদ মুসা। তার কণ্ঠে বেদনার সুর।

কি ঘটেছিল আহমদ মুসা? সংক্ষেপে যদি বলতে পার? বলল প্রেসিডেন্ট।

আহমদ মুসা সঙ্গে সঙ্গে সংক্ষেপে ঘটনার সবটা জানাল।

ও গড! তুমি তো মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসেছ। তোমরা তিনজনই ফাঁদে পড়েছিলে! ভয়ংকর ওরা।

বলে একটু থেমেই আবার বলল, জোয়ান উকে বাঁচাতে গিয়ে তোমার ঐভাবে অসতর্ক থাকা ঠিক হয়নি। আবেগজড়িত কণ্ঠ প্রেসিডেন্টের।

জোয়ান উ নয়, লু ঝির বাবাকে আমি অক্ষতভাবে ধরতে চেয়েছিলাম এক্সিলেন্সি। আর লু ঝি যে এভাবে ছুটে এসে আমার সামনে দাঁড়াবে এবং

সে তার বাবাকে আবারও গুলি করবে এটা আমি ভাবতেই পারিনি। আহমদ মুসা বলল।

লু ঝির কাছে তার বাবা আহমদ মুসার চেয়ে বড় নয়। আমি বিস্মিত আহমদ মুসা। তুমি একটা পরশ পাথর, তোমার সান্নিধ্যে যারা আসে তারা সোনা হয়ে যায়। তুমি এসে দেখবে, আমার মেয়ে, আমার ভাগ্নির পোশাক পাল্টে গেছে। বলল প্রেসিডেন্ট।

এক্সিলেন্সি, আমি পরশ পাথর নই, স্রষ্টার পাঠানো শেষ ধর্ম ইসলাম মানুষের জন্যে পরশ পাথর।

একটু থেমেই আহমদ মুসা আবার বলল, যাক, এখানে আমার কাজ শেষ। কোনো নির্দেশ আছে এক্সিলেন্সি? আহমদ মুসা বলল।

অনুরোধ আছে আহমদ মুসা। তুমি বেইজিং চলে এসো। মা ঝু সুলতান, তার বাবা মা চু ইং এবং উইঘুর নেতা ইরকিন আহমেদ ও অন্য নেতাদের পরামর্শে হুই ও উইঘুর নেতাদের আমি বেইজিং ডেকেছি। তারা কাল এসে পৌঁছবেন। তোমার উপস্থিতিতে তারা বর্তমান সংকট নিয়ে আলোচনায় বসতে চান। তারপর তারা তোমাকে সাথে নিয়ে চীন সরকারের সাথে আলোচনা করবেন। জোয়ান উর মৃত্যুর পর এটা হবে একটা বড় ঘটনা। তোমার জন্যেই এসব কিছু ঘটতে পেরেছে, আমরা তোমার আরও সাহায্য চাই।

ওয়েলকাম এক্সিলেন্সি। আমি আসছি। আমি আমার সাথে লু ঝির লাশ, লু ঝির পিএ চেং ঝি এবং আহমদ ইয়াংকে সাথে নিয়ে আসতে চাই। আহমদ মুসা বলল।

আহমদ ইয়াং উদ্ধার হয়েছে? সুসংবাদ! অবশ্যই তুমি আহমদ ইয়াংসই সবাইকে নিয়ে এসো। আমি ব্যবস্থা করছি। নানিয়ান প্রাসাদ থেকেই সামরিক হেলিকপ্টার তোমাকে বেইজিং নিয়ে আসবে। আর একটা খবর, আহমদ ইয়াং-এর শ্বশুর, আমাদের সাবেক গভর্নর সাহেবকে বেইজিং-এ আনা হচ্ছে। বলল প্রেসিডেন্ট।

ধন্যবাদ এক্সিলেন্সি! এটা সত্যই আমার জন্যে সুখবর। একটু থেমেই আবার বলল, এক্সিলেন্সি, উডাং পাহাড়ের পাদদেশে আমার এক দাদিমা। আছেন। তার সাথে দেখা না করে যাব কি করে? আহমদ মুসা বলল।

তোমার দাদিমাকে আমরা জানি আহমদ মুসা। গোয়েন্দারা তার খোঁজ নিয়েছে ও নিরাপত্তার ব্যবস্থা করেছে। তাকে এবং তার নাতিকে বেইজিং-এ নিয়ে আসতে বলে দিচ্ছি। তোমাদের রাস্তায় আর কোথাও নামা চলবে না।

প্লিজ আরেকটা অনুরোধ এক্সিলেন্সি। নানিয়ান প্রাসাদের রক্ষী স্কোয়াডের একজন কমান্ডার নিহত হয়েছে। আমি তাকে বলেছি, তার পরিবারের কাছে আমি যাব। সে তার মোবাইল আমাকে দিয়েছে তার পরিবারের সন্ধান করার জন্যে। এ সুযোগ আমি চাই। বলল আহমদ মুসা। » আহমদ মুসা তোমাকে ধন্যবাদ। তুমি শুধু মানবিক নও, দায়িত্বশীলও। মানুষের প্রতি তোমার অসীম ভালোবাসা। তুমি এসো। ঐ ব্যবস্থা আমি করে দেব। এ কথা শেষ করেই প্রেসিডেন্ট দ্রুত আবার বলে উঠল, জোয়ান উ তার। সংগঠন ও বাহিনী সম্পর্কে তোমার কোনো পরামর্শ আছে?

আছে কিছু পরামর্শ এক্সিলেন্সি। ওদের সমস্ত অফিস ও লোকেশন চিহ্নিত করা এবং সেখান থেকে ওদের সকলের নামের তালিকা ও পরিকল্পনা সম্পর্কিত দলিলাদি যোগাড় করতে হবে। আজকের রাত এর জন্যে উপযুক্ত সময়। আর এক্সিলেন্সি, নানিয়ান প্রাসাদে আমাদের সাথে একজন লেডি আহত ডাক্তার আছেন। তার সাথে যেন ভালো ব্যবহার করা হয়, তাকে যেন সম্মান প্রদর্শন করা হয়। তিনি খুবই বিবেচক ও ভালো মানুষ। তিনি তার নিজ ইচ্ছাতেই জোয়ান উর সংগঠনের ব্যাপারে মূল্যবান সাহায্য করবেন বলে মনে করি। ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে কোটি কোটি দেশপ্রেমিক চীনাদের মধ্যে তিনিও একজন। আহমদ মুসা বলল।

ধন্যবাদ আহমদ মুসা গুরুত্বপূর্ণ উপদেশের জন্যে। ডাক্তার মহিলা বিশেষ ট্রিটমেন্ট পাবেন, আমি বলে দিচ্ছি। বলল প্রেসিডেন্ট।

ধন্যবাদ এক্সিলেন্সি। আহমদ মুসা বলল।

ওয়েলকাম আহমদ মুসা। আমি তোমার অপেক্ষা করছি। রাখছি।

আহমদ মুসা মোবাইল রাখতেই ডাক্তার মহিলা অঞরুদ্ধ কণ্ঠে বলল, স্যার, আপনি কে আমি জানি না। লু ঝি আপনাকে বাঁচাবার জন্যে জীবন দেয়া থেকে বুঝেছিলাম, লু ঝির খুব আপন কেউ আপনি। কিন্তু প্রেসিডেন্ট আপনাকে টেলিফোন করা থেকে বুঝলাম, আপনি অসাধারণ কেউ। আবার আমার ব্যাপারে প্রেসিডেন্টকে আপনার কথা বলা থেকে বুঝলাম আকাশের মতো উদার হৃদয়ের মানুষই শুধু আপনি নন, মানুষকে জয় করার বিস্ময়কর ক্ষমতা আপনার। আপনার কথার আগ পর্যন্ত আমি ভাবছিলাম, মাই লর্ডের। খুব ঘনিষ্ঠদের মধ্যে আমিই প্রথম ধরা পড়েছি। আমার কাছ থেকে কথা বের করার জন্যে যত রকম পন্থা আছে সবই তারা ব্যবহার করবে। আমি মরে। যাব, তবু একটা কথাও আমি বলব না। কিন্তু আপনার কথা আমার মন ওলটপালট করে দিয়েছে। ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে কোটি কোটি চীনাদের মধ্যে আমিও একজন, এ কথা ভুলেই গিয়েছিলাম। আপনি আমাকে তা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। সঙ্গে সঙ্গে আমার মনও চিৎকার করে উঠেছে, হ্যাঁ, আমি তাই। তাই ছিলাম এবং তাই আছি। এখন আপনি জানতে না চাইলেও বলব আমি সব কথা। শেষদিকে কণ্ঠ তার রুদ্ধ হয়ে গিয়েছিল আবেগে।

ওয়েলকাম ম্যাডাম। আল্লাহ আপনাকে রহম করুন। ম্যাডাম, সুপথে ডাকার চেয়ে সুপথ গ্রহণ অনেক বেশি কঠিন। সেই কঠিন কাজ আপনার মন করেছে। ধন্যবাদ। বলল আহমদ মুসা।

কিছু বলার জন্যে মুখ খুলেছিল ডাক্তার মহিলা।

এ সময় লাউঞ্জে প্রবেশ করল একজন সেনা অফিসার ও কয়েকজন সৈনিক।

অফিসারটি আহমদ মুসাকে স্যালুট দিয়ে বলল, স্যার, আমি কর্নেল লি শিয়াও।

আহমদ মুসা হাত বাড়িয়ে বলল, ওয়েলকাম কর্নেল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *