৪
হেনরি বুফোর্ট মুহিজী চ্যাম্পিয়নশীপ পুরস্কার নিয়ে এসে বসল তার কক্ষে। গা এলিয়ে দিল চেয়ারে।
হেনরি বুফোর্ট মুহিজী পোপ ভিক্টর ইউনিভার্সিটি অব সেন্ট্রাল আফ্রিকার অনার্স তৃতীয় বর্ষের ছাত্র।
অ্যাথলেটিকসহ সব রকম খেলাধুলায় সে ভালো। সে এবার আরও ভালো করেছে। সাতটি আইটেমে প্রথম হয়ে আন্ত:বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিযোগিতায় সে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে।
পুরস্কারগুলো তার টেবিলে।
সে তাকিয়ে আছে পুরস্কারের দিকে। তার মনে আনন্দের বন্যা। টেবিলে সাজানো পুরস্কারগুলো তার কাছে বড় নয়। চ্যাম্পিয়নশীপ পুরস্কারের তলায় চাপা দিয়ে রাখা লম্বা একটা সোনালি ইনভেলাপ। এ ইনভেলাপের দিকেই তার দুই চোখ নিবদ্ধ। তার আনন্দের কেন্দ্র ঐ ইনভেলাপটাই। ওতে রয়েছে এক লাখ ডলারের একটা চেক। তার মনে হচ্ছে ঐ চেকটাই তার দরিদ্র পরিবারের জীবন ঘুরিয়ে দেবে। হাসি ফুটবে তার পিতা-মাতা, ভাই-বোনের মুখে। কত প্রয়োজন, কত অপূর্ণ সাধ। ছড়িয়ে আছে তাদের সংসারে, তার গ্রামের মানুষের জীবনে। একটা পথ হলো সেসব পূরণের। চরম হতাশার মধ্যে তার যাত্রা শুরু হয়েছিল এই বিশ্ববিদ্যালয়ে। আজ তার মনে হচ্ছে হতাশার যাত্রাও আলোর জগতে পৌঁছে দিতে পারে।
হেনরি বুফোর্ট-এর দরজায় নক হলো। সেই সাথে একটা কণ্ঠ বলল, আমি সারা। সারা সুসান রোজ।
হেনরি বুফোর্ট উঠে দরজা খুলে দিয়ে একপাশে সরে গিয়ে ভেতরে। আসার জন্যে স্বাগত জানাল সারা সুসান রোজকে।
সারা সুসান হেনরি বুফোর্টের মতোই বাইশ-তেইশ বছরের তরুণী। চেহারায় ইউরোপিয়ান, কিন্তু রং শ্যামলা। শ্যামলা রঙে মানুষ যে কত সুন্দর হতে পারে তার এক দৃষ্টান্ত যেন সারা সুসান। তার দাদা ছিলেন। আফ্রিকান, দাদি ছিলেন বেলজিয়ান। আবার তার মা বেলজিয়ান মায়ের ও আফ্রিকান বাপের সন্তান।
হেনরি বুফোর্ট ও সারা সুসান একই গ্রামের। বন্ধু তারা গ্রামের স্কুল জীবন থেকেই।
একসাথেই তারা ভর্তি হয়েছে পোপ ভিক্টর ইউনিভার্সিটিতে। তবে সারা সুসান বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সাথে সাথে খণ্ডকালীন একটা চাকরিও করে। সে ভাইস-চ্যান্সেলরের অফিসে চারটা থেকে সাতটা পর্যন্ত কাজ করে। গোটা দিনে ভাইস-চ্যান্সেলর যা করেন, যা বলেন, তার একটা ব্রিফ তাকে তৈরি করতে হয় ভিসির দুই পিএর ফাইল দেখে। এই চাকরিটা তার সংসারের জন্যে প্রয়োজন।
সারা সুসান হেনরি ফোর্টকে ধন্যবাদ দিয়ে হেনরির পড়ার চেয়ারে গিয়ে বসল। এ হেনরি বুফোর্ট দরজা বন্ধ করে ফিরে এসে তার ঘরের একমাত্র সোফাটায় গিয়ে বসল।
গোটাটা সময় হেনরি বুফোর্ট তাকিয়েছিল সারা সুসানের দিকে। বসেই বলল, কি ব্যাপার সুসান? তোমাকে অসুস্থ লাগছে? কি হয়েছে। তোমার? হেনরি বুফোর্টের কণ্ঠে মমতার সুর।
সারা সুসান হাসার চেষ্টা করে বলল, না কিছু হয়নি। দিন শেষের ক্লান্তি এটা হতে পারে। যারা খেলে, তাদের চেয়ে যারা দেখে তাদের টেনশন বেশি হয়।
ঠিক বলেছ সুসান। কিন্তু যারা দেখে তাদের চেয়ে তোমার টেনশন অনেক বেশি ছিল। বলল হেনরি বুফোর্ট। তার মুখে হাসি।
হারবে এমন চিন্তা থাকলে টেনশন হতো। কিন্তু তোমার সম্পর্কে এ চিন্তা আমি করি না।
একটু থেমে সঙ্গে সঙ্গেই আবার বলে উঠল, শোন, যে জন্যে আমি এসেছি, ভাইস-চ্যান্সেলর স্যার তোমার জন্যে অপেক্ষা করছেন।
শুনেই সোজা হয়ে বসল হেনরি বুফোর্ট। বলল, ডেকেছেন? এখনি?
হ্যাঁ, ভিসি স্যারের বোধ হয় একটু তাড়া আছে। কোথাও যেন একটু বেরুবেন। বলল সারা সুসান।
সঙ্গে সঙ্গেই উঠে দাঁড়াল হেনরি বুফোর্ট। এগোলো আলমিরার দিকে। আলমিরা থেকে জুসের একটা ক্যান বের করে সারা সুসানের হাতে দিয়ে বলল, তুমি ক্লান্ত। এটা খেয়ে নাও
আমি ওয়াশ রুম থেকে ফ্রেশ হয়ে আসি।
হেনরি বুফোর্ট চলে গেল ওয়াশ রুমের দিকে। সারা সুসান ক্যানটি ওপেন করল।
তিন চার মিনিটের মধ্যেই হেনরি বুফোর্ট ফিরে এলো ফ্রেস হয়ে। হাতের তোয়ালেটা বারান্দায় শুকাতে দিয়ে এসেই বলল, আমি প্রস্তুত সুসান।
সুসান তার হাতের জুসের ক্যানটা হেনরি বুফোর্টের হাতে দিয়ে বলল, আমি অর্ধেকটা খেয়েছি, বাকিটা তুমি খেয়ে নাও।
এতটুকু ক্যান, তা থেকে আবার অর্ধেক রেখেছ? বলল হেনরি বুফোর্ট।
এই জুস এখন আমার চেয়ে তোমার বেশি দরকার। সারা সুসান। বলল।
আমার জন্যে আরও আছে। কথাটা বলতে গিয়েও মিথ্যা বলতে পারল না হেনরি বুফোর্ট। জুসের এই ক্যানটা খেলার মাঠে কেউ একজন। তাকে দিয়েছিল, সেটা সারা সুসান দেখে থাকতে পারে। তাছাড়া বিদেশি ব্রান্ডের এমন দামি জুস কেনার সুযোগ যে আমার নেই, সেটা সুসান তার চেয়ে ভালো জানে। অল্প যে টাকাটা বেতন হিসাবে সুসান পায়, তা থেকে তার নাশতার জন্যে রাখা টাকা যতদিন তার পকেটে থাকে, ততদিন সে ই হেনরি বুফোর্টকে খাওয়ায়, অনেক সময় নিজে না খেয়েও খাওয়ায়। কোনো নিষেধ, প্রতিবাদই সে মানে না। হেনরি বিফোর্ট-এর মনটা নরম হয়ে গেল। খেয়ে নিল ক্যানের বাকিটা জুস।
ক্যানটা বাস্কেটে ফেলে দিয়ে বলল, চল সুসান।
দুজন ঘর থেকে বেরিয়ে এলো। নিচে নামার জন্যে সিঁড়িতে পা দিয়েও সুসান পা তুলে নিল বারান্দায়।
হেনরি বুফোর্টও থমকে দাঁড়াল। সারা সুসান দাঁড়াল হেনরি বুফোর্ট-এর মুখোমুখি। বলল, তোমাকে আমার একটা অনুরোধ।
বল। বলল হেনরি বুফোর্ট।
ভিসি স্যার যাই বলুন, মেনে নিও। সারা সুসান বলল খুব নরম। কণ্ঠে, অনুরোধের সুরে।
হেনরি বুফোর্টের দৃষ্টি চঞ্চল হয়ে উঠল। বলল দ্রুত কণ্ঠে, তুমি কি জান স্যার কি বলবেন?
আমি ঠিক জানি না উনি কি বলবেন। তবে আমার মনে হয়েছে। গুরুত্বপূর্ণ কিছু বলবেন তিনি। বলল সারা সুসান।
না জেনেই মেনে নিতে বলছ তুমি? বলল হেনরি বুফোর্ট।
ভিসি স্যার তার পিএস-কে বলছিলেন, কার্ডিনাল আসছে, হেনরি বুফোর্ট-এর সাথে আমার কথা হওয়া দরকার। এ থেকে আমি বুঝেছি কার্ডিনাল-এর সাথে সংশ্লিষ্ট কোনো কথা তিনি তোমাকে বলবেন বা কোনো দায়িত্ব তোমাকে দেবেন। সারা সুসান বলল।
সেটা কী হতে পারে? কার্ডিনাল তো কাল আসছেন। বলল হেনরি বুফোর্ট।
কার্ডিনাল আসার সাথে রিলেটেড কিছু হতে পারে। এ ব্যাপারে যাই। বলুক, তুমি হা করে দিও। সারা সুসান বলল।
না করার মতো কি কিছু বলতে পারেন তিনি? বলল হেনরি বুফোর্ট।
সে রকম কিছু তিনি বলবেন, এজন্যে আমি এ কথাটা বলছি না। আসলে তুমি মাঝে মাঝে ছোটখাটো নীতিগত বিষয় নিয়েও সাংঘাতিক গোঁ ধরে বস। সে রকম কিছু না করার জন্যে আমি তোমাকে অনুরোধ করছি। সারা সুসান বলল।
তোমার কথা আমি বুঝেছি সুসান। তুমি বললেই তো হলো, অনুরোধের কথা বলছ কেন? বলল হেনরি বুফোর্ট।
বলছি কারণ আমার অনেক ভয়। এবার তুমি আন্ত:বিশ্ববিদ্যালয় চ্যাম্পিয়ন হওয়ায় বিশ্ববিদ্যালয়ের সবাই হাসছে। কিন্তু আমার বুক কাঁপছে। নাম যত বড় হয়, সে নাম তত বেশি ফোকাসে আসে। দায়িত্ব। এবং ঝুঁকিও তত বাড়ে। অথচ আমাদের প্রয়োজন নিরিবিলি দিন গুজরান করা। সারা সুসান বলল। তার হৃদয় ছুঁয়ে আসা কথাগুলো খুবই নরম, যেন অশ্রু ভেজা।
কথাগুলো হেনরি বুফোর্ট-এর হৃদয় স্পর্শ করেছিল। কিন্তু হেনরি বুফোর্ট মনটাকে একটা ঝাঁকুনি দিয়ে হাসতে চেষ্টা করে বলল, এত ভেব না। ভাবনা ভাবনাকেই ডেকে আনে। চল এগোই।
বলে সিঁড়ির দিকে পা বাড়াল। কিছু না বলে হেনরি বুফোর্টের পাশাপাশি হাঁটতে লাগল সারা সুসানও।
ভাইস-চ্যান্সেলর ফাদার স্টিফেন ফেবিয়ানের পিএস-এর দরজায় পৌঁছে দিয়ে সারা সুসান বলল, আমি আমার রুমে আছি। একসাথে খাব।
হেনরি বুফোর্ট পিএস-এর ঘরে ঢুকতেই পিএস বলল, এস হেনরি, স্যার তোমার অপেক্ষা করছেন।
উঠে দাঁড়াল পিএস। ইন্টারকম অন করে বলল, স্যার, হেনরি এসেছে। নিয়ে আসব?
হ্যাঁ, নিয়ে এসো। একটু বাইরে বেরুব, তাড়া আছে। বলল ভাইস চ্যান্সেলর ফাদার স্টিফেন ফেবিয়ান।
পিএস তাড়াতাড়ি হেনরি বুফোর্টকে ভাইস-চ্যান্সেলরের কক্ষে পৌঁছে দিয়ে এলো।
হেনরি বুফোর্ট গিয়ে দাঁড়াল ভাইস-চ্যান্সেলরের টেবিলের সামনে।
সামনে ল্যাপটপের স্ক্রিনে চোখ ছিল ভাইস-চ্যান্সেলরের। চোখ ফিরিয়ে তাকাল সে হেনরি বুফোর্টের দিকে। হাসিভরা মুখে বলল, কনগ্রাচুলেশন হেনরি, বস।
একটা চেয়ারে জড়সড় হয়ে বসল হেনরি বুফোর্ট।
তুমি তো চ্যাম্পিয়নশীপ-এর জন্যে এক লাখ ডলার পেয়েছ। আর একটা সুখবর আছে তোমার জন্যে। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তোমার এই অভাবিত সাফল্যের জন্যে প্রাইজমানি হিসাবে এক লাখ বুরুন্ডি ফ্রাঙ্ক তোমাকে দিয়েছেন। চার্চ কাউন্সিলের ক্যাথলিক এডুকেশন ট্রাস্ট অফিস থেকে এইমাত্র চেকটা আমি পেলাম।
বলে ভাইস-চ্যান্সেলর একটা ইনভেলাপ এগিয়ে দিল হেনরি বুফোর্ট এর দিকে।
হেনরি বুফোর্ট উঠে দাঁড়িয়ে ধন্যবাদ স্যার বলে ইনভেলাপটি নিল। আবার বসল সে।
হ্যাঁ, তোমাকে যে জন্যে ডেকেছি। আগামীকাল রোম থেকে হিজ এক্সিলেন্সি কার্ডিনাল লিও ম্যাগনাস আসছেন। আফ্রিকার এলাইড চার্চের বুরুন্ডি শাখার মেহমান হবেন তিনি। কিন্তু তিনি থাকবেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিআইপি রেস্টহাউজে। তিনি আগামী পরশু সকালে বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন চার্চের উদ্বোধন ও প্রথম প্রার্থনা পরিচালনা করবেন। এখানে কিছু দায়িত্ব তোমাকে দেয়া হয়েছে তোমার জনপ্রিয়তাকে সম্মান দেখাবার জন্যে। আগামীকাল সন্ধ্যার মধ্যে আমাদের চার্চ সাজানো কমপ্লিট করতে হবে। আমাদের মহান কার্ডিনাল লিও ম্যাগনাস ঈশ্বরপুত্র, যিশুর একটা ইমেজ রোম থেকে এনেছেন। আগামীকাল বিকালে সেটা তুমি চার্চ কাউন্সিল থেকে আমাদের চার্চে নিয়ে আসবে এবং ইমেজকে তার স্থানে বসাবে। তোমাকে সহায়তা করার জন্যে একটা অভিজ্ঞ টিম তোমার সাথে থাকবে।
আর আগামী পরশু প্রার্থনার আগে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের পক্ষ থেকে তুমি মহান কার্ডিনালকে স্বাগত জানিয়ে কিছু বলবে। তোমার সেই বক্তব্য বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে লিখে দেয়া হবে। প্রার্থনার সময় ছাত্রদের পক্ষ থেকে তুমি মহান কার্ডিনালের আশেপাশে থাকবে তার টিমের একজন হিসেবে।
একটু থামল ভাইস-চ্যান্সেলর। তাকাল হেনরি বুফোর্টের দিকে। বলল, আমার কথা এটুকুই।
এরপর কথা বলার কথা হেনরি বুফোর্টের। কিন্তু তার অবস্থা তখন অবর্ণনীয়। সে মাথা নিচু করে স্থিরভাবে বসে আছে ঠিকই, তার ভেতরটা কিন্তু তখন দারুণ অস্থির। তার মনে হচ্ছে, প্রচণ্ড এক ভূমিকম্প তার জীবনটাকে ওলটপালট করে দিল। পড়তে এসে সে অনেক কিছু হারিয়েছে। ভিসি স্যার যা চাচ্ছেন, সেটা যদি করা হয়, তাহলে তার জীবনে আর কিছুই থাকে না।
পল পল করে সময় বয়ে যাচ্ছে। ভিসি স্যার কথা শেষ করেছেন, এখন তো তাকে কথা বলতে হবে।
ধীরে ধীরে মুখ তুলল হেনরি বুফোর্ট মুহিজী। কম্পিত ঠৈাটকে জোর করে শক্ত করল।
একটা ঢোক গিলে গলাটাকে পরিষ্কার করার চেষ্টা করল। বলল সে, স্যার, আপনি জানেন আমি খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করিনি। এই কাজগুলো তাহলে আমি কীভাবে করব?
কে বলল তুমি খ্রিস্টান নও? তোমার ন্যাশনাল আইডি, তোমার সব সার্টিফিকেট, ভোটার লিস্ট, আদম শুমারী- সব জায়গায় তুমি খ্রিস্টান। সবাই জানে তুমি খ্রিস্টান। তুমি খ্রিস্টান নও কেমন করে? বলল ভাইস চ্যান্সেলর। তার মুখে স্বচ্ছ এক টুকরো হাসি।
কিন্তু স্যার, খ্রিস্টধর্ম আমি গ্রহণ করিনি। ঈমান, বিশ্বাসে আমি মুসলমান। আমি নামাজ নিয়মিত পড়ি না, কিন্তু মসজিদের সাথেই আমার সম্পর্ক। মাঝে মাঝে এবং জুমার দিন আমি মসজিদে যাই। গির্জায় কখনও যাইনি। হেনরি বুফোর্ট বলল।
হাসল ভাইস-চ্যান্সেলর। বলল, তোমার মনের ঈমান বিশ্বাস তো মানুষ দেখতে পাচ্ছে না। জান তোমার হেনরি বুফোর্ট নামটি খ্রিস্টান ইতিহাসের একজন শ্রেষ্ঠ কার্ডিনালের নাম। এ নাম গ্রহণ করে তো তোমার কোনো অসুবিধা হয়নি, বরং তুমি শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিতে পরিণত হচ্ছে। আসন্ন অলিম্পিকে তুমি যাবে। কমপক্ষে পাঁচ খেলায় তুমি সবার সেরা হবে, সেটা নিশ্চিত করা হবে। সুতরাং নাম পরিবর্তনের মতো এ কাজগুলোও যদি তুমি করে ফেল, তাতে তোমার ভবিষ্যত আরও নিশ্চিত হবে। থামল ভাইস-চ্যান্সেলর।
হেনরি বুফোর্টের দুচোখ থেকে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে। বলল সে, স্যরি
স্যার, আপনি যা করতে বলেছেন, আমি তা পারবো না স্যার।
হাসলো ভাইস-চ্যান্সেলর আবার। বলল, ইমোশনাল নয়, বাস্তববাদী হও। যে সিদ্ধান্ত হয়েছে, তা নড়াবার ক্ষমতা আমারও নেই। যেভাবে বলা হয়েছে, সেভাবেই কাজ হবে। পেছন ও আশপাশের সব চিন্তা ঝেড়ে ফেলে দিয়ে সামনে এগোও। আমার কথা শেষ।
হেনরি বুফোর্ট উঠে দাঁড়িয়েছিল। তার পা দুটি চলছিল না, যেন হাজার মণ ভারি।
শরীরের রক্ত যেন জমাট হয়ে গেছে, অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ হারিয়ে ফেলেছে গতি।
চোখ দুটিতে নেমে আসছে অন্ধকার। মনের সমস্ত শক্তি একত্র করে হাঁটছে হেনরি বুফোর্ট। ভিসি স্যারের কক্ষ থেকে বেরিয়ে এলো সে বারান্দায়। তাড়া খাওয়া অন্ধের মতো সে হাঁটছিল।
এক সময় সে হাঁটাও তার বন্ধ হয়ে গেল। এক গভীর অন্ধকার এসে তাকে ঘিরে ধরল। সেই অন্ধকারে হারিয়ে গেল তার চেতনা।
চেতনাহীন তার দেহটা আছড়ে পড়ল লাল পাথরের একটা রাস্তার উপর।
.
অনেকদিন পর হেনরি বুফোর্ট মসজিদে গিয়ে জামায়াতের সাথে মাগরিবের নামাজ পড়েছে। নামাজ পড়তে গিয়ে বারবার তার চোখে অশ্রুর বান ডাকছিল। তার মনে হয়েছিল এ অশ্রু, এ কান্না তার ঘরে ফেরার আনন্দ।
নামাজ শেষে হেনরি বুফোর্ট পার্কের একটা বেঞ্চিতে এসে বসেছে। হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসা সারা সুসান এসে হেনরি বুফোর্টের পাশে বসল। বলল হাঁপাতে হাঁপাতে, ভিসি স্যার যে প্রোগ্রাম তোমাকে দিয়েছিলেন, সে প্রোগ্রামে তুমি গেলে না কেন? সাত সকালে হাসপাতাল। থেকে বেরিয়ে কোথায় গিয়েছিলে? কাল তোমার যে অবস্থা ছিল, কিছু বলতে পারিনি। আমি সকালে উঠেই হাসপাতালে গিয়েছিলাম। সারা দিন গেল আমাকে টেলিফোনও করনি। আমি পাগলের মতো চারদিকে তোমাকে খুঁজছি। তোমার বাড়ির লোকরাও কিছু বলতে পারেনি। তারাও সারাদিন চারদিকে ছুটাছুটি করেছে। এইমাত্র এসে শুনলাম তুমি মসজিদে এসেছ। ছুটে এলাম এদিকে। বিশ্ববিদ্যালয়ে যা শুনে এলাম, তা উদ্বেগজনক। তুমি নাকি ভিসিকে অপমান করেছ, তার আদেশ পদদলিত করেছ। কার্ডিনালের প্রোগ্রাম পণ্ড করার জন্যে ষড়যন্ত্র করেছ।
উদ্বেগ-উত্তেজনায় তার কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে গিয়েছিল।
হেনরি বুফোর্টের মুখ ভাবলেশহীন নির্বিকার। তার শূন্য দৃষ্টি সামনে রাতের আলো-ছায়ার দিকে। ধীরকণ্ঠে সে বলল, আমি ভিসি স্যারকে টেলিফোনে তো জানিয়ে দিয়েছি, আমার ঈমান, বিশ্বাসের বিরুদ্ধে এই কাজ আমি করতে পারব না। আমার অপারগতার জন্যে আমি তার কাছে ক্ষমা চেয়েছি।
সেই যে স্কুলে ভর্তি হবার সময় খ্রিস্টান নাম নিয়েছিলে, আমিও নিয়েছিলাম, তারপর তো অভিনয় করছিই, আর একটু অভিনয় করতে পারলে না? বলল সারা সুসান।
আরও অভিনয়ের কথা বলছ? আমার হোসাইন মুহিজী নাম অভিনয়ের জন্যে নেয়া হেনরি বুফোর্ট নামের মধ্যে হারিয়ে গেছে। আজ যিশুর মূর্তি বহন ও গির্জার প্রার্থনায় অংশ নিলে আমার ঈমান, বিশ্বাসের আত্মার মৃত্যু ঘটত। আমি হোসাইন মুহিজী মুছে যেতাম আর অভিনয়ের হেনরি বুফোর্ট বাস্তব হয়ে উঠতো। আমি এটা পারিনি, পারব না কোনো অবস্থাতেই। তুমিও পারবে না। বলল হেনরি বুফোর্ট।
আমি এ ব্যাপারে কখনও নিজের মুখোমুখি হইনি। তবে আমাদের ও চারপাশে অনেকেই তো মেনে নিচ্ছে। নীরব থেকে সব সুযোগ-সুবিধা আদায় করে নিচ্ছে। সারা সুসান বলল।
তবে সবাই সমান নয়। অনেকেই ভয়-ভীতি ও চাপের কাছে বাধ্য হয়ে নতি স্বীকার করছে, অনেকে আবার দারিদ্র্য থেকে বাঁচার জন্য কৌশলে এটাকে একটা সুযোগ-সুবিধা হিসেবে গ্রহণ করে নিচ্ছে। হেনরি বুফোর্ট বলল।
একটু থেমে আবার হেনরি বুফোর্ট বলে উঠল, থাক এসব। এখন বল, সেদিন আমাকে কোথায় কীভাবে পেয়েছিলে? কীভাবে হাসপাতালে নিয়েছিলে? ভিসি স্যারের বারান্দা থেকে নামার পর আমার তেমন কিছু মনে নেই।
তোমাকে পিএস-এর ওখানে রেখে আমি অফিসে গিয়েছিলাম। অফিসে রুটিন ওয়ার্ক করেছি বটে, কিন্তু মনটা পড়েছিল তোমার কাছে। খুব অস্থির লাগছিল। সাতটার আগেই আমি অফিস থেকে বেরিয়ে আসি।
যাচ্ছিলাম পিএস-এর অফিসের দিকে।
বারান্দা ঘুরে না গিয়ে লন দিয়ে কোনাকুনি রাস্তাটা ধরে যাচ্ছিলাম। মাঝখানে যে ঝাউ গাছটা আছে, সেখানেই তোমাকে পেয়ে গেলাম সংজ্ঞাহীনভাবে রাস্তার উপর পড়ে থাকা অবস্থায়।
আমার তখন শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা। তোমাকে কেউ মেরে ফেলে রেখে গেছে কি না? তুমি বেঁচে আছ কি না? এই উদ্বেগ আমাকে ঘিরে ধরেছিল।
তাড়াতাড়ি নিশ্বাস পরীক্ষা করে বুঝলাম তুমি বেঁচে আছ। নতুন আতঙ্ক তখন আমাকে ঘিরে ধরল, তোমাকে বাঁচাব কি করে? নিরাপদে সেখান থেকে তোমাকে নিয়ে যাব কি করে? যারা তোমাকে মেরে ফেলে রেখে গেছে, তারা দেখতে পেলে তো রক্ষা নেই।
আতঙ্ক নিয়ে চারদিকে তাকালাম।
দেখলাম একটা ট্যাক্সি আমার অফিসের গেট থেকে ফিরে যাচ্ছে। ট্যাক্সির অন হায়ার সিগন্যাল অন করা।
আমি ছুটে গিয়ে আটকালাম গাড়িটাকে।
ট্যাক্সিওয়ালার সাথে যখন আমি কথা বলছিলাম, পোক্টর স্যার পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন। তিনি আমার অবস্থা দেখে ছুটে এলেন।
অন্য কোনো কথায় না গিয়ে তুমি সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়েছ, এ কথা তাঁকে বললাম। তিনি আমার সাথে এলেন। ট্যাক্সিওয়ালাসহ তিনজনে ধরাধরি করে তোমাকে গাড়িতে তুললাম। তোমাকে নিয়ে এলাম হাসপাতালে। প্রোক্টর স্যার তাঁর মানিব্যাগ হাতড়ে আমাকে পাঁচশ ফ্রাংক দিয়েছিলেন। সত্যি ট্যাক্সি ভাড়া দেবার মতো টাকা তখন আমার পকেটে ছিল না। যখন পোক্টর স্যারের কাছ থেকে টাকা পেলাম, আমি নিশ্চিত হলাম তোমার বিরুদ্ধে কোনো ষড়যন্ত্রে তিনি নেই।
ধন্যবাদ সুসান। যখন আমার অবস্থা বুঝলাম, তখন আমি অবচেতন মনে চেষ্টা করছিলাম যতটা পারি তোমার কাছাকাছি হতে। বলল হেনরি বুফোর্ট।
তোমার এ অবস্থা কে করল, কেন করল? এ কথা আমি জানতে পারিনি। সারা সুসান বলল।
না সুসান, আমাকে কেউ কিছু করেনি। ষড়যন্ত্রের কথা বললে। আমার বিরুদ্ধে সেরকম ষড়যন্ত্রের কথা তো আমি জানি না। বলল হেনরি বুফোর্ট।
তাহলে তোমার এই অবস্থা হলো কি করে? সারা সুসান বলল।
ভিসি স্যার যে নির্দেশ যেভাবে দিয়েছিলেন, তা আমি সহ্য করতে পারিনি। মনে হয়েছিল আমাকে শেষ করে ফেলা হচ্ছে। শেষ হয়ে যাচ্ছি। আমি। চারদিকের দুনিয়া সংকীর্ণ হয়ে সবদিক থেকে এসে আমাকে চেপে ধরছে। ভিসি স্যার কথা শেষ করলে দেহটাকে টেনে নিয়ে কোনো রকমে তার কক্ষ থেকে বেরিয়ে এসেছিলাম। তারপর দেহটাকে টেনে নিয়ে অন্ধের মতোই ছুটছিলাম। কখন কোথায় সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়ে গিয়েছিলাম তা আমি জানি না। বলল হেনরি বুফোর্ট।
সারা সুসানের একটা হাত উঠে গিয়েছিল বেঞ্চিতে রাখা হেনরি বুফোর্টের একটা হাতের উপর। হাতটা দিয়ে হেনরি বুফোর্টের হাত আঁকড়ে ধরে বলল সারা সুসান, ভিসির কথায় এতটা ইমোশনাল হওয়া তোমার ঠিক হয়নি।
এটা আমার ইমোশন নয় সুসান, বহু বছর ধরে চাপিয়ে রাখা আমার, আমির এক বেপরোয়া উত্থান ছিল এটা। আমার বিশ্বাসের শিকড় যখন উপড়ে ফেলা হচ্ছে, তখন এই বিদ্রোহ-বিস্ফোরণ স্বাভাবিক ছিল। বলল হেনরি বুফোর্ট।
আমার ভয় করছে হেনরি বুফোর্ট, এরপর কি হবে? যে আলোচনা শুনলাম, সেটা মনে হচ্ছে সামনে আরও বাড়বে, কমবে না। ওদের কথা বার্তার টোন হিংসাত্মক। তুমি যেতে পারছ না, এটা ভিসি স্যারকে তুমি বলেছ, মাফও চেয়ে নিয়েছ, এ কথা কেউ জানে বলে মনে হয়নি। তার মানে যারা তোমার বিষয়ে কথা ছড়াচ্ছে, তারা উদ্দেশ্যমূলকভাবেই। ঘটনার একাংশ গোপন করছে। বলল সারা সুসান।
মিথ্যা ওরা কতদিন আর প্রচার করবে। ভিসি স্যার তো সব জানেন। আমি কোনো অন্যায় করিনি। আমি কারও সাজানো কথার পরোয়া করি না। হেনরি বুফোর্ট বলল।
কিন্তু আমি শুনলাম ভিসি স্যারের পিএসই তোমার বিরুদ্ধে বেশি সোচ্চার। ভিসি স্যার তোমাকে কি বলেছেন, সেটা পিএস ও অন্যরা জানল কি করে? নিশ্চয় ভিসি স্যারই বলেছেন। তুমি টেলিফোনে ভিসি স্যারকে যা বলেছ, সেটা ভিসি স্যার কাউকে বলেছেন বলে মনে হয় না। এটা যদি সত্য হয়, তাহলে তো বলতে হবে তোমার বিরুদ্ধে যা হচ্ছে। তার গোড়া স্বয়ং ভিসি স্যারই। বলল সারা সুসান।
হতে পারে সুসান। ভিসি স্যার কাজের কথাগুলো বলছিলেন, আমি বলেছিলাম আমি খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করিনি। আমি মসজিদে যাই, গির্জায় যাই না। কিন্তু তিনি আমার কথার বিন্দুমাত্র গুরুত্ব না দিয়ে বলেছিলেন, নাম, আইডি কার্ড, এনআইডি কার্ড, ভোটার লিস্ট সব জায়গায় তুমি খ্রিস্টান। তোমার মন তো কেউ দেখে না। অতএব সেটা কোনো প্রমাণ নয়। এই কথার পর তিনি আমার মতামতের অপেক্ষা করেননি। কথা শেষ করে দিয়ে তিনি অন্য কাজে, অন্য প্রসঙ্গে চলে যান। তাঁর কথাগুলো নরম ছিল, মুখে হাসি ছিল, তবে ভেতরটা অত্যন্ত কঠোর ছিল বলে মনে হয়। হেনরি বুফোর্ট ওরফে হোসাইন মুহিজী বলল।
এজন্যে তো আমার ভয়, ঘটনা যদি খারা…। কথা শেষ করতে পারল না সারা সুসান।
পার্কের গেটে হৈ চৈ শোনা গেল।
কণ্ঠ শোনা গেল হেনরি বুফোর্টের ছোট ভাই আলী ওবামের, ভাইয়া পালাও…।
একজন মুখোশধারী লোক লাথি মেরে আলী ওবামকে মাটিতে ফেলে দিল। আর চারজন মুখোশধারী ছুটে এলো হেনরি বুফোর্ট ওরফে হোসাইন মুহিজীর দিকে। তাদের চারজনের হাতেই উদ্যত রিভলভার। তারা ঘিরে ফেলল হেনরি বুফোর্টদেরকে। একজনের রিভলভার দ্রুত উঠে এলো হেনরি বুফোর্ট লক্ষে।
হেনরি বুফোর্ট এবং সারা সুসান দুজনেই উঠে দাঁড়িয়েছে।
আতঙ্কে বিস্ফারিত সারা সুসানের দুই চোখ। সে চিৎকার করে বলল, তোমরা কে? কি চাও? আমরা তো কোনো কিছুতে নেই! কারও কোনো ক্ষতি করিনি আমরা?
মুখোশধারীরা কোনো কথা বলল না। একজনের রিভলভার দ্রুত উঠে এলো হেনরি বুফোর্টের দিকে।
সারা সুসান ছুটে গিয়ে হেনরি বুফোর্টকে আড়াল করে দাঁড়াল। চিৎকার করে বলল, হেনরি কি দোষ করেছে? সে খ্রিস্টান নয়, এ সত্য কথাই তো সে বলে…।
কথা শেষ হলো না সারা সুসানের। একটা বুলেট এসে মাথা গুঁড়িয়ে দিল তার। পড়ে যাচ্ছিল সারা সুসান। পেছন থেকে হেনরি বুফোর্ট তাকে ধরতে যাচ্ছিল।
পরপর দুটো গুলি এসে থামিয়ে দিল হেনরি বুফোর্টকে। একটা তার বুকে, আরেকটা গুলি এসে তার মাথায় বিদ্ধ হলো।
পড়ে গিয়েছিল সারা সুসান। তার লাশের উপরই পড়ে গেল হেনরি বুফোর্ট। জীবনকালে মিলনের তাদের সময় ও সুযোগ হয়নি, মৃত্যু সেটাই যেন করে দিল।
পাঁচজন মুখোশধারী পার্কের ভিন্ন এক গেট দিয়ে পালিয়ে গেল। এদিকের গেটে লোক জমে গিয়েছিল। চিৎকার করে কাঁদছিল আলী ওবাম।
সে ছুটে এলো। আছড়ে পড়ল বড় ভাই হেনরি বুফোর্ট ওরফে হোসাইন মুহিজীর লাশের উপর।
আলী ওবামের পেছনে পেছনে সবাই ছুটে এলো। গুলির শব্দ পেয়ে পুলিশও এলো। এলো হেনরি বুফোর্ট এবং সারা সুসানের বাড়ির লোজন এবং আত্মীয়-স্বজনও।
আরও পরে এলো পুলিশের বড় কর্তারা। তাদের সাথেই এলো বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস-চ্যান্সেলর ফাদার স্টিফেন ফেবিয়ান ও তার লোকরা।
পুলিশ প্রধান কিজা রজার তার অধস্তন অফিসারের সাথে আলোচনা করছিল। তার হাতে একটা কাগজের টুকরো। তাদের চোখে-মুখে উত্তেজনা।
পোপ ভিক্টর ইউনিভার্সিটির ভাইস-চ্যান্সেলর এসে পৌঁছতেই পুলিশ প্রধান তার কাছে ছুটে গেল। তার হাতের কাগজখণ্ডটি ভাইস চ্যান্সেলরকে দিল।
কাগজ খণ্ডে মাত্র একটা লাইন লেখা। সে লাইনটা হলো : M23 গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র কংগোর সরকারবিরোধী একটা সশস্ত্র আন্দোলন। এর পুরো নাম মার্চ ২৩ আন্দোলন। এরা কংগো সরকারের বিরুদ্ধে সশস্ত্র লড়াই করে আসছে। একটা চুক্তির পর এখন অবশ্য তা বন্ধ আছে। দক্ষিণ আফ্রিকা, তানজানিয়া ও অন্যান্য আফ্রিকান রাষ্ট্রের মতো বুরুন্ডিও। কংগো সরকারকেই নীরব সমর্থন দেয়। অন্যদিকে রুয়ান্ডা ও উগান্ডা M23-কে সমর্থন দেয়। কিন্তু এ পর্যন্ত M23 বুরুন্ডিতে প্রবেশ করেনি এবং তাদের নিয়ে আমাদের দেশে এমন কোনো ঘটনাও ঘটেনি। এই…।
ভিসি ফাদার স্টিফেন ফেবিয়ান পুলিশকে থামিয়ে দিয়ে বলে উঠল, এসব তো ইতিহাসের কথা, সবাই জানে। বলুন, এই ঘটনার সাথে। তাদের সম্পর্কের কথা। এ নিয়ে আপনি কি ভাবছেন?
পুলিশ প্রধান রজারের চোখে-মুখে অপ্রস্তুত ভাব ফুটে উঠল। চোখ নিচু করে ব্যাপারটা সামলে নিয়ে বলল, এখনও কিছু ভাবছি না। বিষয়টা আমাদের কাছে একেবারেই নতুন, সে কথাটাই বলছিলাম। হঠাৎ করে তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ছাত্রের ব্যাপারে আগ্রহী হলো কেন, তাও আবার সে আন্ত:বিশ্ববিদ্যালয় ক্রীড়ায় চ্যাম্পিয়ন হবার পর। ঘটনাটা সাধারণ হিসাবে মিলছে না। তাই তদন্ত না করে কিছু বলা যাবে না।
তদন্ত করুন। কিন্তু আমি মনে করি, এই ছাত্ৰ-হত্যায় এম-২৩ জড়িত, এ কথা বাইরে প্রকাশ করা ঠিক হবে না। মানুষের মধ্যে বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের মধ্যে প্যানিক সৃষ্টি হোক আমরা চাই না। বলল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস-চ্যান্সেলর ফাদার স্টিফেন ফেবিয়ান।
একটু ভাবল পুলিশ প্রধান। সংবাদ মাধ্যমসহ বাইরে আমরা প্রকাশ করব না, কিন্তু সরকারকে তো জানতেই হবে, সেখান থেকে নিউজটা লিক হবার সম্ভাবনা থাকবে। পুলিশ প্রধান রজার বলল।
ওটা সম্ভাবনার কথা। লিক নাও হতে পারে, এ সম্ভাবনাও আছে আর গুজব তো রটতেই পারে। সরকারি বক্তব্য এ ব্যাপারে না আসুক, সেটা হলেই চলবে।
দুই লাশের কাছে দাঁড়িয়েছিল ভাইস চ্যান্সেলর ও পুলিশ প্রধান। চারদিকে উৎসুক মানুষের ভিড় বাড়ছিল। পুলিশদের কাছেই দাঁড়িয়েছিল হেনরি বুফোর্টের ভাই আলী ওবাম। সে এখন কাঁদছে না। চোখের পানিও মুছে ফেলেছে। সে যে হেনরি বুফোর্টের ভাই, এ কথা সে পুলিশের কাছে প্রকাশ করতে চায় না।
মেয়েটা ওদের টার্গেট ছিল না। শুনলাম, হেনরি ছেলেটাকে রক্ষা করতে গিয়েই সে মরেছে। স্যার, কালকে আমি একটু বিশ্ববিদ্যালয়ে যাব। ছেলেটা সম্পর্কে তথ্য আমাদের দরকার। বলল পুলিশ প্রধান রজার।
আমার অফিস আপনাদের সব রকম সহযোগিতা করবে। আপনি আমার অফিসে যাবেন। এর ওর সাথে কথা বলে লাভ নাই। কত গুজব যে ইতিমধ্যেই রটেছে। সব শুনলে আপনি বিভ্রান্ত হবেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের যারা হেনরি সম্পর্কে তথ্য দিতে পারবে, সেটা আমরাই বলে দেব। দুজনেই আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের খুব ভালো ছাত্র ছিল। আর হেনরির তো কোনো তুলনাই নেই। সে আন্ত:বিশ্ববিদ্যালয় স্পোর্টস-এ চাম্পিয়ন হয়েছিল শুধু নয়, তাকে অলিম্পিকের জন্যেও আমরা, বাছাই করেছিলাম। বলল ভাইস-চ্যান্সেলর।
শুধু বিশ্ববিদ্যালয় নয়, দেশও আমাদের ক্ষতিগ্রস্ত হলো। কালপিটদের খুঁজে বের করতেই হবে। লাশ পাঠিয়ে দিয়ে আমি আজই। যাব ছেলেটার বাড়িতে। আমি সেখানে পুলিশ পাঠিয়েছি। বাড়ির লোকদের নিরাপত্তার দরকার আছে বলে আমার মনে হয়েছে। পুলিশ প্রধান বলল।
পুলিশ প্রধানের শেষের কথাগুলো শুনে কেমন একটা অস্বস্তির ছায়া খেলে গেল ভাইস-চ্যান্সেলরের চোখে-মুখে। বলল, তাহলে তো আপনার অনেক দেরি হবে। ঠিক আছে, আপনি আপনার কাজ করুন। আমরা চলি। কাল তো আপনি যাচ্ছেন, দেখা হবে।
ঠিক আছে স্যার। আমি কাল আসছি। আপনাদের অনেক সাহায্য প্রয়োজন।
ভিসি বিদায় নিয়ে তার গাড়ির দিকে হাঁটা শুরু করল। তার সাথে। চলল তার পিএস এবং অন্যরাও।
গাড়িতে উঠেই ভিসি পিএসকে বলল, প্রোক্টরকে ফোন লাগাও। প্রোক্টরকে ফোন লাগিয়ে মোবাইলটি ভাইস-চ্যান্সেলরকে দিল।
আসার সময় আপনাকে আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে পাইনি। এদিকের সব তো শুনেছেন? বলল ভিসি।
শুনেছি স্যার। শ্বাসরুদ্ধ হবার মতো খবর। ভাবছি আমি আসব কিনা, আমি আপনার কলেরই অপেক্ষা করছিলাম স্যার। প্রোক্টর বলল।
তোমার এসে কাজ নেই। আমরা ফিরছি। পুলিশ প্রধান স্বয়ং এসেছেন। কাল ওরা আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে আসবেন। ওখানেই কথা হবে। বলল ভিসি।
পুলিশ ভালো সিদ্ধান্ত নিয়েছে। অবশ্যই আমরা তাদের সব রকম সাহায্য করব। প্রোক্টর বলল।
সাহায্য আমরা করব অবশ্যই। কিন্তু শোন, হেনরি বুফোর্টকে যে গতকাল সংজ্ঞাহীন অবস্থায় পাওয়া গেছে, এখান থেকেই যে তাকে হাসপাতালে নেয়া হয়েছে, এ তথ্য পুলিশের কাছে যাওয়া চলবে না। আমরা কোনো ঝামেলায় জড়াতে চাই না। কোনো অবস্থাতেই বিশ্ববিদ্যালয়ের সুনামের কোনো ক্ষতি করা যাবে না। বলল ভাইস চ্যান্সেলর।
ঠিক আছে স্যার, বিষয়টা আমি দেখছি। কিন্তু সমস্যা হবে হাসপাতালের রেকর্ড নিয়ে। প্রোক্টর বলল।
কোন্ হাসপাতাল? জিজ্ঞাসা ভাইস-চ্যান্সেলরের।
রাজধানীর দক্ষিণ অংশে বুজুমবুরা ইভানজেলিক্যাল হাসপাতাল। পোক্টর বলল।
চিন্তা নেই প্রোক্টর। তুমি এখনি হাসপাতালে যাও। গিয়ে হাসপাতালের রেসিডেন্ট ডিরেক্টর জোসেফ অ্যারনকে আমার রেফারেন্স দিয়ে বল, গতকাল ইমারজেন্সি এবং যে ওয়ার্ডে হেনরি বুফোর্টের চিকিৎসা হয়েছে, সেখানকার সংশ্লিষ্ট দুই রেজিস্টার আজ সকাল থেকে মিসিং। এর একটা জিডি পুলিশ স্টেশনে করে যেন এখনই। তুমি এ দুটি বিষয় নিশ্চিত করে আমাকে টেলিফোন করবে। তারপর হাসপাতাল থেকে আসবে। বলল ভাইস-চ্যান্সেলর ফাদার স্টিফেন ফেবিয়ান।
আমি এখনই যাচ্ছি স্যার। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রোক্টর বলল।
ধন্যবাদ, গড় ব্লেস ইউ। বলল ভাইস-চ্যান্সেলর।
কথা শেষ করে একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে গাড়ির সিটে গা এলিয়ে দিল ভাইস-চ্যান্সেলর।
গাড়ি ছুটছে তখন। গন্তব্য পোপ ভিক্টর বিশ্ববিদ্যালয়।
.
দারোয়ানের চিৎকারে ঘুম ভেঙে গেল আবিদ চাওসিকোর। উঠে বসল সে।
এক চিৎকারের পর দারওয়ানের দিক থেকে কিংবা অন্য দিক থেকে কোনো শব্দ নেই।
আবিদ চাওসিকো নিশ্চিত ভাবল, কিছু ঘটেছে। কিন্তু আর কোনো সাড়াশব্দ নেই কেন? কি ব্যাপার দেখতে হবে-এই চিন্তা করে আবিদ চাওসিকো উঠে দাঁড়িয়ে দ্রুত এগোলো গেটের দিকে।
গেটের পাশেই সীমানা প্রাচীরের ভেতরে দারোয়ানের ঘর। ঘরের বারান্দায় বসেই সে পাহারাদারির কাজ করে। বারান্দার বাইরের প্রান্তে। প্রাচীরে একটা ছোট জানালা।
দারোয়ানের ঘরের পরে ছোট একটা চত্বর। চত্বরের প্রথমেই বড় একটা গেস্টরুম। গেস্টরুমটি বাড়ির বর্ধিত এক অংশ। গেস্টরুমের পরেই বাড়ির মূল অংশ। বাড়িতে অনেক আত্মীয়-স্বজন আসায় গেস্টরুমে শুয়েছিল আবিদ চাওসিকো। এ ঘর থেকে বেরিয়ে আবিদ চাওসিকো গেট লাগানো দেখতে পেল। ছুটল দারোয়ানের ঘরের দিকে। ঘরের বারান্দায় উঠতে গিয়েই চোখ পড়ল বারান্দায় পড়ে থাকা একজন মানুষের উপর।
উদ্বিগ্ন আবিদ চাওসিকো চারদিকে তাকাল। না, কেউ কোথাও নেই। দারোয়ানের ঘরের দিকে তাকাল। দেখল দরজা খোলা। ঘরে কম পাওয়ারের আলো জ্বলছে। আবিদ চাওসিকো নিঃশব্দে দ্রুত এগোলো পড়ে থাকা লোকটির দিকে। লোকটি যে দারোয়ান তা বারান্দায় উঠেই দেখতে পেয়েছে। পড়ে আছে কেন সে? সে কি…আর চিন্তা করতে পারেনি আবিদ চাওসিকো। ছুটে গেল দারোয়ানের কাছে। সে ঝুঁকে পড়ছিল দারোয়ানের মাথার উপর তার অবস্থা দেখার জন্যে।
ঠিক এই সময়েই পায়ের শব্দ পেল ঘরের দরজার দিক থেকে।
মুখ ঘুরিয়ে আবিদ চাওসিকো সেদিকে তাকাতে যাচ্ছিল। তাকানো হলো না। কয়েকজন লোক এসে ঝাঁপিয়ে পড়ল তার উপর। রডের মতো ভারি একটা কিছুর আঘাত এসে পড়ল তার মাথায়।
মাথা তোলার চেষ্টা করেও পারল না আবিদ চাওসিকো। আলো হারিয়ে গেল তার চোখের সামনে থেকে। অন্ধকারে ডুবে গেল তার পৃথিবী। সংজ্ঞা হারিয়ে লুটিয়ে পড়ল আবিদ চাওসিকো।
তার সংজ্ঞা ফিরল তাকে যখন গাড়িতে তোলা হচ্ছিল হাসপাতালে নেবার জন্যে।
সংজ্ঞা ফেরার পর প্রথমেই তার কানে প্রবেশ করল অনেক কান্নার শব্দ। তার সাথে তার মনে পড়ল কয়েকজন তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়া এবং মাথায় প্রচণ্ড আঘাত পাওয়ার কথা। আর কিছু মনে নেই তার। ওই লোকগুলোই কি দারোয়ানকে মেরেছে? দারোয়ান কি বেঁচে আছে? এত কান্নার শব্দ কেন? চোখ মেলেই দেখতে পেল কান্নারত মা, ভাবী ও চাচিদের।
আবিদ ইব্রাহিম চাওসিকো মায়ের দিকে ফিরতে চেষ্টা করল। পারল না। আঘাত পেল মাথায়। যন্ত্রণায় ঝাঁকিয়ে উঠল।, মা, চাচা, ভাবীরা ছুটে এলো আবিদ চাওসিকোকে ধরার জন্যে। কিন্তু তার আগেই নার্স ছুটে এসে আস্তে আস্তে আবিদ চাওসিকোর মাথা ঠিক করে দিয়ে বলল, সবে সংজ্ঞা ফিরেছে, এই মুহূর্তে মাথায় সামান্য আঘাতেও বড় ধরনের ক্ষতি হয়ে যেতে পারে।
স্যরি সিস্টার। বলল আবিদ চাওসিকোর চাচা।
অবস্থা আমাদেরকে দিশেহারা করে দিয়েছে সিস্টার। স্যরি। বলল আবিদ চাওসিকোর মা নকুয়া ফারিদা।
আবিদ চাওসিকো ফর্সা! তবে আবিদ চাওসিকোর ফর্সা রঙের মধ্যে শ্যামলিমার এক অপরূপ দীপ্তি আছে। যা একজনকে অনন্য করে তুলতে পারে।
কিন্তু সে তার মার মতো নয়। তার মা নকুয়া ফারিদা খুবই ফর্সা। আবিদের ভাবীরাও ফর্সা, কিন্তু তার মা তাদের থেকে অনেক ভিন্ন। অন্যদিকে তার চাচিরা একবারেই আফ্রিকার কালো মানিক।
আবিদ চাওসিকোদের পরিবার আফ্রিকান ও আরবীয় নিয়ে মিশ্র পরিবার। আবিদ চাওসিকোর বাবা তার দাদার সাথে মানুষ হয়েছে। তানজানিয়া উপকূলের জাঞ্জিবার দ্বীপে। তার দাদা-দাদী ছিল বুরুন্ডির রাজধানী বুজুমবুরার অধিবাসী, পিওর আফ্রিকান। দাদা ছিল ব্যবসায়ী। বেশিরভাগ সময় তাকে জাঞ্জিবারেই থাকতে হতো। আবিদ চাওসিকোর বাবা জাঞ্জিবারেই ইসলামিক স্কুলে লেখাপড়া করেছে, সেই সাথে ব্যবসায়টাও দেখেছে এবং ব্যবসায়ী হিসেবে গড়ে উঠেছে। জাঞ্জিবারেই এক আরবীয় পরিবারে আবিদ চাওসিকোর বাবা বিয়ে করে। আবিদ চাওসিকোর মা নকুয়া ফারিদা আরব পরিবারের সেই মেয়ে। পিতার বাড়িতে তার নাম ছিল ফারিদা সাইয়েদী। সাইয়েদী আরবের ওমান অঞ্চলের এক বিখ্যাত সুলতান-পরিবার। এই বংশ আফ্রিকার পূর্ব উপকূলে স্টেট অব জাঞ্জিবার বা জাঞ্জিবার সালতানাত নামে এক মুসলিম সাম্রাজ্যের পত্তন করেছিল। যার মধ্যে শামিল ছিল তানজানিয়া, উগান্ডা, বুরুন্ডি, মালাবী, মোজাম্বিক, যুপিয়া ও কংগোর একটা অংশ। এই সাইয়েদী সুলতানরা এক সময় তাদের রাজধানী জাঞ্জিবারে নিয়ে এসেছিল।
ফারিদা সাইয়েদী বিয়ের পর নাসিরউদ্দিন চিসোমোদের পরিবারে এসে নামের শেষে সাইয়েদী বাদ দিয়ে নামের আগে আফ্রিকান, নকুয়া শব্দ গ্রহণ করে। নকুয়া ফারিদা নামের অর্থ হলো বিখ্যাত মূল্যবান মুক্তা। নিত।
আবিদ চাওসিকোরা ছিল খুবই সচ্ছল একটা পরিবার। কিন্তু যুদ্ধ, রাজনৈতিক উত্থান পতনে তারা প্রায় সবকিছু হারিয়ে ফেলে। বিশ শতকের ষাটের দশকে (১৯৬৩) তানজানিয়া উপকূলের পেম্বা ও জাঞ্জিবার দ্বীপ জাঞ্জিবার সালতানাত হিসাবে বৃটিশের কবল থেকে মুক্তি লাভ করে। স্বাধীনতা লাভের এক সপ্তাহের মধ্যে তানজানিয়া এই সালতানাত দখল করে নেয়। দুই দ্বীপের ৭০ হাজার মুসলমানকে তারা হত্যা করে। আবিদ চাওসিকোর দাদা তার ব্যবসায় জীবনের শুরুতেই আরবীয় বণিকদের সংস্পর্শে এসে ইসলাম গ্রহণ করে। কালক্রমে তারা জাঞ্জিবার এলাকার উল্লেখযোগ্য মুসলিম পরিবার হয়ে উঠেছিল। তানজানিয়ানদের আক্রমণের সময় কোনো রকমে প্রাণে বেঁচে আবিদ চাওসিকোর দাদা, বাবারা আবার নিজ জন্মভূমি বুরুন্ডিতে ফিরে আসে।
.
নার্স আবিদ চাওসিকো ও তার মা নকুয়া ফারিদাকে ধন্যবাদ দিয়ে তার জায়গায় ফিরে গেল। ঘরে প্রবেশ করল আবিদ চাওসিকোর বাবা নাসিরউদ্দিন চিসোমো, তার চাচারা এবং বড় দুই ভাই।
আবিদ চাওসিকোরা চার ভাই। সবার ছোট আবিদ চাওসিকো। বড় দুই ভাই ও চাচারা পরিবারের কর্তা নাসিরউদ্দিন চিসোমোর সাথে কৃষি কাজ ও ব্যবসায় করে। সেজ ভাই আজিজ বোসানী বুরুন্ডি ইসলামিক স্কুলে পড়ার পর দি আফ্রিকান মুসলিম অ্যাসোসিয়েশন-এ, একজন ভ্রাম্যমান শিক্ষক হিসাবে কাজ করে।
– পিতা ও চাচা-ভাইদের দেখতে পেয়েই আবিদ চাওসিকো তাদেরকে সালাম দিয়ে বলল, আলহামদুলিল্লাহ, আমি ভালো আছি বাবা।
আল্লাহর হাজার শোকর যে, তোমার মুখ থেকেই কথাটা আমরা শুনতে পেলাম। কিন্তু একটু ভালো আছ বলেই নড়া-চড়া করা যাবে না। তুমি ভালো আছ কিন্তু তোমার মাথাটা অনেক অসুস্থ। মনে রেখো এক বড় ক্ষতি থেকে তোমার মাথা সামান্যের জন্যে বেঁচে গেছে। কিন্তু মাথাটাকে পূর্ণ বিশ্রামে না রাখলে নতুন ক্ষতির আশঙ্কা আছে। বলল। আবিদ ইব্রাহিম চাওসিকোর বাবা নাসিরউদ্দিন চিসোমো।
ধন্যবাদ বাবা। কিন্তু সেদিন কি ঘটেছিল? আমাকে আক্রমণ করেছিল ওরা কারা? আমাদের দারোয়ানের খবর কি? সে কি মারা গেছে। আবিদ চাওসিকো বলল।
বেটা তুমি অনেক প্রশ্ন করেছ। এর জবাবে অনেক কথা হবে। কিন্তু তোমার কথা বলা, শোনা কোনোটাই এখন চলবে না। তোমার মাথা সুস্থ হোক। এটুকু জেনে রাখ, আমাদের বাড়িতে সেদিন ডাকাত পড়েছিল। বলল আবিদ চাওসিকোর বাবা।
ডাকাত পড়েছিল? আমাদের দারোয়ানকে ওরা মেরে ফেলেছে? আর কি ঘটেছে? আবিদ চাওসিকো বলল।
আবিদ চাওসিকোর কথা শেষ হতেই তার মা ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। বড় দুই ছেলে ছুটে এলো মায়ের কাছে। বলল, মা, আবিদের কাছে। কান্নাকাটি করা নিষেধ। সবে তার সংজ্ঞা ফিরেছে। চল, বাইরে চল।
বলে বড় দুই ছেলে তাদের মাকে ধরল।
তাদের মা নকুয়া ফারিদা চোখ মুছে বলল, আর কাঁদব না বাছারা, আমাকে আবিদের কাছ থেকে নিও না।
বলতে গিয়ে আবার কেঁদে উঠল নকুয়া ফারিদা।
আম্মা চল, বাইরে থেকে একটু ঘুরে এসো। ভালো লাগবে। বলে বড় দুই ছেলে তাদের মা নকুয়া ফারিদাকে বাইরে নিয়ে গেল।
আবিদ চাওসিকোর চোখে-মুখে উদ্বেগের ছায়া। সে তাকিয়ে আছে তার পিতার দিকে। বলল, বাবা, মা এমনভাবে কাঁদছে কেন? তিনি এভাবে ভেঙে পড়েছেন কেন? তোমাদের সকলের চেহারাতেই মুষড়ে পড়ার ভাব! আসলে কি ঘটেছে বাবা? সেজ ভাই আজিজ বোসানিকে দেখছি না কেন? তিনি তো বাড়িতেই ছিলেন?
দুহাতে মুখ ঢাকল আবিদের বাবা নাসিরউদ্দিন চিসোমো। কান্না সামলে নিয়ে ছুটে এসে আবিদ চাওসিকোর পাশে এসে বসল।
আবিদ চাওসিকোর একটা হাত টেনে নিয়ে বলল, বাবা তোমার মনকে শক্ত করতে হবে, ধৈর্য ধরতে হবে। বড় ঘটনা ঘটে গেছে বেটা।
থামল নাসিরউদ্দিন চিসোমো। একটা ঢোক গিলল। বলল, তোমার সেজ ভাই আজিজ বোসানী নেই বেটা।
কি বলছ বাবা, ডাকাতরা তাকে মেরে ফেলেছে! আর্তনাদ করে উঠল। আবিদ চাওসিকোর কণ্ঠ।
হ্যাঁ বেটা। তোমাদের ওখান থেকে ওরা খোলা দরজা দিয়ে বাড়িতে ঢুকেই অনেক ফায়ার করে ও চিৎকার বলে, যে ঘর থেকে বেরুবে, তাকেই হত্যা করা হবে। তোমার ঘর ছিল তাদের পাশেই। সে ঘরে ঢুকে। তারা ভাঙচুর করে। তোমার বই-পুস্তক, খাতাপত্র সব ছিঁড়ে এবং ছড়িয়ে ছিটিয়ে নষ্ট করে। তোমার টেবিলের ড্রয়ার, আলমিরা ভেঙে ফেলে। আমরা জানতে পারিনি, এই সময়ই মনে হয় আজিজ ঘরে ঢোকে তাদের বাধা দিতে। দুটি গুলির শব্দ পাই আমরা, তারপরেই তাদের চলে যাওয়ার শব্দ পাই। আমরা ছুটে আসি তোমার ঘরে। এসে আজিজকে মুমূর্ষ অবস্থায় দেখতে পাই, কিন্তু তোমাকে দেখতে পাই না। সবাই আমরা ভাবলাম, তোমাকে ওরা ধরে নিয়ে গেছে। আমি তোমার চাচাঁদেরকে বলি অ্যাম্বুলেন্সে টেলিফোন করে আজিজকে নিয়ে হাসপাতালে আসতে আর আমি তোমার দুই ভাইকে নিয়ে ছুটে বেরিয়ে যাই তোমার সন্ধান করতে। গেটের কাছাকাছি হতেই গেটরুমের বারান্দায় দুইজনকে পড়ে থাকতে দেখি। আমি গেটের দিকে অনেকখানি। এগিয়েছিলাম। তোমার দুই ভাই প্রথম তোমাদের পড়ে থাকতে দেখে। তারা ছুটে যায়। তোমাকে রক্তাক্ত নিশ্চলভাবে পড়ে থাকতে দেখে ওরা চিৎকার করে উঠে, বাবা আমাদের আবিদের কি হয়েছে দেখ। তাড়াতাড়ি এসো। আমি ছুটে গেলাম। দেখতে পেলাম তোমার রক্তে ভাষা নিশ্চল দেহ। তাড়াতাড়ি তোমার পালস দেখলাম। পালস পেলাম, কিন্তু খুব দুর্বল।
আমি অ্যাম্বুলেন্স অ্যাম্বুলেন্স বলে চিৎকার করে উঠলাম। এর মধ্যে তোমার চাচারা আজিজকে ধরাধরি করে নিয়ে গেটে এলো। চাচারা আগেই কল দিয়েছিল অ্যাম্বুলেন্সে।
কয়েক মিনিটের মধ্যেই এসে পৌঁছল অ্যাম্বুলেন্স।
আমরা হাসাপাতালে এলাম। কিন্তু তখন আজিজ আর নেই। সেই থেকে তোমার মার এবং সবার কান্না আর থামছে না। তারপরও আল্লাহর হাজার শোকর। একজনকে নিয়ে আল্লাহ আরেকজনকে ফেরত দিয়ে…। কান্নায় রুদ্ধ হয়ে থেমে গেল নাসিরউদ্দিন চিসোমোর কণ্ঠ।
নীরব কান্নায় ভাসছিল তখন আবিদ চাওসিকো। দুই চোখ দিয়ে নামছিল এক অসহনীয় অশ্রুর বিগলিত ধারা। কাঁপছিল তার ঠোঁট দুটি।
আবিদ চাওসিকো দুই হাত দিয়ে ফেসিয়াল টিস্যুর বক্স খুঁজছিল।
তার বাবা তাড়াতাড়ি টিস্যুর বক্সটি আবিদ চাওসিকোর হাতে ধরিয়ে দিল।
আবিদ চাওসিকো টিস্যু নিয়ে চোখ ও মুখ মুছে ফেলল।
এ সময় প্রবেশ করল তাদের মাকে নিয়ে তার বড় দুই ভাই। তাদের সঙ্গে এলো চাচা ও চাচিরা।
কি বাছা! চোখ মুছছ কেন? কি হয়েছে? বলল আবিদ চাওসিকোর মা।
মা, ভাইয়ার জন্যে কাঁদলাম। এখন চোখ মুছে ফেলছি। আবিদ চাওসিকো বলল।
আবিদের মা নকুয়া ফারিদা তার স্বামী নাসিরউদ্দিন চিসোমোর দিকে তাকাল। তার চোখে-মুখে প্রশ্ন।
হ্যাঁ, ফারিদা আমি আবিদকে সব বলেছি। শিক্ষিত, বুদ্ধিমান ছেলে তার সেজ ভাইকে এখানে না দেখে নিজেই আন্দাজ করে নিয়েছিল। তাই সব বলে দিয়েছি। নাসিরউদ্দিন বলল।
আবিদের মা তার পাশে বসল। ছেলের একটা হাত নিজের হাতে তুলে নিয়ে বলল, ধন্যবাদ বেটা, তুমি নিজেই অশ্রু মুছে ফেলেছ। তুমি কাঁদলে তো আমি মরে যাব। কান্নারুদ্ধ কণ্ঠ আবিদের মার।
.
শহীদের জন্য আর কেঁদো না মা। গর্ব কর। তুমি শহীদের মা। বলল আবিদ চাওসিকো।
কিন্তু বেটা ডাকাতরা মারলেও কি সে শহীদের দরজা পাবে? আবিদের মা নকুয়া ফারিদা বলল।
ডাকাতরা তাকে মারেনি মা। আমাদের বাড়িতে যেটা ঘটেছে, সেটা ডাকাতি নয়। বলল আবিদ চাওসিকো।
কি বলছ আবিদ! ডাকাতি নয় কেন? তাদের বাবা নাসিরউদ্দিন চিসোমো বলল।
না বাবা, ওরা ডাকাত নয়। ওরা ডাকাত হলে তো টাকা-পয়সা ও মূল্যবান কিছুর জন্যে তোমাদের ঘরে ঢুকত, একজন ছাত্রের ঘর তছনছ করতো না। আমি মনে করি, আমার এবং আমার ঘরই ওদের মূল টার্গেট ছিল। বলল আবিদ চাওসিকো।
কেন তুমি ওদের টার্গেট। কারা ওরা? বলল বলল আবিদ চাওসিকোর মা, নকুয়া ফারিদা।
ওরা মুখোশ পরা ছিল, চিনতে পারিনি। জানি না ওরা কারা। আবিদ চাওসিকো বলল।
তাহলে নিশ্চিত হচ্ছ কি করে যে, তুমি আর তোমার ঘর ওদের মূল টার্গেট? আবিদের মা-ই বলল।
আমার বই-পুস্তক, খাতা-পত্রের উপর ছিল ওদের ক্রোধ। তার মানে ওদের ক্রোধ আমার লেখাপড়ার প্রতি। আমার মনে হচ্ছে, আমার পাসপোর্ট, বিমানের টিকিট, ভর্তির কাগজপত্র, ডলার- সবই ওরা নিয়ে গেছে। বলল আবিদ চাওসিকো।
হ্যাঁ বেটা আবিদ, তোমার স্যুটকেস, ব্যাগ সবই লন্ড-ভন্ড দেখেছি। তাহলে এসব ওলটপালট করে তারা কি ওগুলোই খুঁজেছে? আবিদের বাবা নাসিরউদ্দিন বলল। তার গলার স্বর কান্নাজড়িত, চোখে-মুখে উদ্বেগ।
আমি তাই মনে করি বাবা। আমাকে মেরে ফেলা ওদের টার্গেট ছিল। মেরে ফেলার টার্গেট থাকলে ওরা আমাকে আরও মারত মৃত্যু নিশ্চিত করার জন্যে। কিংবা তারা রিভলভার ব্যবহার করতে পারতো। একটা গুলিই তো যথেষ্ট ছিল। তাদের টার্গেট যা ছিল, তারা নিয়ে গেছে। বলল। আবিদ চাওসিকো।
ওগুলো নিয়ে তারা কি করবে, কি কাজে লাগবে ওদের? আমি কিছুই বুঝতে পারছিনে বেটা। আবিদের মা নকুয়া ফারিদা বলল। তার কান্নাজড়িত কণ্ঠ।
বড় কাজে লাগবে মা। একজন আফ্রিকান মুসলিমের উচ্চ শিক্ষালাভ ও বড় কিছু করার চেষ্টাকে ওরা বন্ধ করে দিল। এটাকে তারা খুব বড় কাজ মনে করে। বলল আবিদ চাওসিকো।
আবিদ চাওসিকো বুরুন্ডি সরকার পরিচালিত কলেজ অব সায়েন্স এন্ড টেকনোলজির একজন প্রতিভাবান ছাত্র। স্পেস ফিজিক্স, স্পেস ইঞ্জিনিয়ারিং-এই দুই বিষয়ে প্রথম স্থান অধিকার করে কলেজ-ফাইনাল উত্তীর্ণ হয়েছে সে। এই দুই বিষয়ে অনার্স পড়ার জন্যে বেলজিয়ামের একটা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সে অফার পায়। অনেক চেষ্টা করে এই অফার যোগাড় হয়েছে। আজ বিকেলেই তার ফ্লাইট ছিল বেলজিয়াম যাওয়ার।
কেঁদে উঠল আবিদ চাওসিকোর মা। বলল, তাহলে কি তোমার বেলজিয়াম যাওয়া হবে না! পড়া হবে না?
কেঁদো না মা, আল্লাহ যেটা চান, সেটাই হবে। চেষ্টার তো আমরা কোনো ত্রুটি করিনি।
হেড নার্স প্রবেশ করল কক্ষে।
সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলল, স্যার আসছেন। রোগী দেখার সময় এখন। প্লিজ, আপনারা সবাই বাইরে যান। কুইক প্লিজ।
সবাই কক্ষের বাইরে এলো।
সিনিয়র ডাক্তার আরও দুজন জুনিয়র ডাক্তার আবিদ চাওসিকোর কক্ষে প্রবেশ করল।
.
আমি থাকছি, তোমরা সকলে বাসায় যাও। পুলিশ যদি অনুমতি দেয়, তাহলে আবিদ চাওসিকোর ঘরটাকে গোছগাছ করে রাখবে। গেস্টরুমসহ বাড়ি-ঘর পরিষ্কার করার ব্যবস্থা করাবে। আত্মীয়-স্বজন আসবে, তাদেরকেও দেখাশোনা করতে হবে। সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলল নাসিরউদ্দিন চিসোমো।
ঠিক আছে। তবে বড় ছেলেও তোমাদের সাথে থাক। কখন কি দরকার হয়। আর কোনো সময়ই আবিদকে কক্ষে একা রাখা ঠিক হবে, না। বলল আবিদদের মা নকুয়া ফারিদা।
এত ভয় না করলেও পার ফারিদা। নাসিরউদ্দিন বলল।
আবিদের কথা শুনে আমার আতঙ্ক আরও বেড়েছে। বাড়িতে নিছক ডাকাতি হয়েছে, এটা সত্য হলে আমি খুশি হতাম। কিন্তু যা সত্য হয়ে দাঁড়াচ্ছে, তা ভয়াবহ। বলল আবিদের মা। তার কণ্ঠ কাঁপছিল।
আল্লাহ ভরসা। যাও তোমরা। বেলাল আমার সাথে থাকুক। নাসিরউদ্দিন চিসোমো বলল।
বেলাল নাসিরউদ্দিনের বড় ছেলে। সালাম দিয়ে নকুয়া ফারিদা সবাইকে নিয়ে বেরিয়ে এলো হাসপাতাল থেকে।
স্ত্রী নকুয়া ফারিদার শেষ কথা নাসিরউদ্দিন চিসোমোর কানে সাইরেনের মতো বাজছিল, মনে বিঁধছিল কাঁটার মতো। তার মনেও এমন কথারই তোলপাড় হচ্ছে। সে কথাই সে ফারিদার কাছে শুনল। তার। মনের যে আশঙ্কা ভাষা পাচ্ছিল না, তাকেই ভাষা দিয়েছে ফারিদা। পাশে এমন স্ত্রী পেয়ে স্বস্তিতে ভরে উঠল তার মন।
ফারিদা জাঞ্জিবারের বিশ্ববিদ্যালয়-পড়ুয়া মেয়ে। আরবি, সুহাইলি, ইংরেজি ও বেলজিয়াম ভাষায় সে সমান পারদর্শী। জাঞ্জিবারের ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক পরিবারের মেয়ে হওয়ায় রাজনীতি ও বিশ্বপরিস্থিতির ব্যাপারে খুবই সচেতন।
নাসিরউদ্দিন চিসোমমা তার হাতঘড়ির দিকে তাকাল। ঘুরে দাঁড়াল আবিদ চাওসিকোর কক্ষের দিকে। পা বাড়াল তার কক্ষে যাবার জন্যে।
.
আবিদ চাওসিকোদের পারিবারিক বৈঠকখানায় একটা সোফায় বসে আবিদদের বাবা নাসিরউদ্দিন চিসোমো কণ্ঠ একটু উঠিয়ে খবরের কাগজ থেকে একটা খবর পড়ছিল। আর সবাই তাকে ঘিরে বসে-দাঁড়িয়ে সেই খবর শুনছিল।
বৈঠকখানায় প্রবেশ করল আবিদ চাওসিকো। সালাম দিল।
সবাই তার দিকে তাকিয়ে সালাম নিল।
কি খবর বাবা? এভাবে সবাইকে নিয়ে কি পড়ছ? বলল আবিদ চাওসিকো।
হেনরি বুফোর্ট মুহিজীর হত্যাকাণ্ডের পুলিশ তদন্ত রিপোর্ট জমা দিয়েছে। তার ভিত্তিতে পত্রিকা রিপোর্ট করেছে। বলল আবিদের বাবা চিসোমো।
হত্যার মোটিভ সম্পর্কে কি বলেছে বাবা? কারা ঘটিয়েছে এই জোড়া হত্যাকান্ডের ঘটনা? আবিদ চাওসিকো বলল।
কে বা কারা ঘটিয়েছে, তা পরিষ্কারভাবে বলা হয়নি। বলা হয়েছে মামলার স্বার্থে এখন সবকিছু প্রকাশ করা যাবে না। তবে পরিচিতদের মধ্যেই ঘটনা ঘটেছে বলে উল্লেখ করেছে। মেয়েঘটিত বিষয় নাকি ঘটনার কারণ। বলল নাসিরউদ্দিন চিসোমো।
আবিদ চাওসিকো আর সঙ্গে সঙ্গে কথা বলল না। ভাবছিল সে। একটু পরে বলল, পুলিশের তদন্তে সত্য উদ্ধার হয়েছে বলে আমার মনে হয় না। হেনরি বুফোর্ট এবং সারা সুসানের বিয়ে হচ্ছে, এটা বিশ্ববিদ্যালয় এবং তাদের এলাকার সকলে জানে অনেক দিন ধরে। সুতরাং বিষয়টা কোনোভাবেই সংঘাতের ছিল না। আর হেনরি বুফোর্ট তার এলাকা এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে খুব জনপ্রিয় ছিল। তার শত্রু থাকার কথা কল্পনাই করা যায়। না। হেনরি বুফোর্ট আন্তঃবিশ্ববিদ্যালয় প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ন হওয়া তার বিশ্ববিদ্যালয় ও গোটা বুমবাসা আনন্দে উত্তাল, তখন তাকে হত্যার ঘটনা ঘটা বিস্ময়কর! আরেকটা বিষয়। যেখানে যে অবস্থায় হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে, তা সাধারণের পক্ষে সম্ভব নয়। হত্যাকারীরা প্রথমে হেনরি বুফোর্টের বাড়িতে তাকে সন্ধান করেছে, পায়নি বুফোর্টকে। এরপর খোঁজ নিয়ে সরাসরি এসে তাকে হত্যা করেছে। পুলিশকেও তোয়াক্কা করে না। এমন হত্যাকারীদের পক্ষেই এমন হত্যাকাণ্ড ঘটানো সম্ভব।
তুমি ঠিক বলেছ বেটা। পুলিশেরও তো এসব বিষয় বিবেচনা করা উচিত ছিল। তাদের রিপোর্ট এমন সাদামাটা হলো কেন? বলল নাসিরউদ্দিন চিসোমো।
এই প্রশ্নের জবাব এখন আমাদের কেউ দেবে না। তবে এক সময় এর জবাব সবাইকে দিতে হবে। যাক এসব কথা, তোমাকে বাইরে বেরুবার পোশাকে দেখছি, কোথাও বেরুচ্ছ নাকি? বলল আবিদের মা নকুয়া ফারিদা।
হ্যাঁ মা, আমি পোপ ভিক্টর ইউনিভার্সিটিতে যাচ্ছি। আবিদ। চাওসিকো বলল।
কেন? এই তো দুদিন আগে গিয়েছিলে? বলল আবিদের মা।
সেদিন আরও খোঁজখবর নিয়ে এসেছি। আজ ফরম আনতে যাচ্ছি।
খোঁজখবর নিতে বলেছিলাম। কিন্তু ভর্তির সিদ্ধান্ত তুমি নিয়ে ফেলেছ? বলল নকুয়া ফারিদা।
স্যরি মা, ভর্তির মাত্র আর এক দিন বাকি আছে। বাবার সাথে কথা বলেছিলাম। আর বাইরে যাবার বিষয়টা এখন কঠিন হয়ে গেছে। আর তোমাদের ছেড়ে যাবার ইচ্ছাও আমার নেই। আবিদ চাওসিকো বলল।
কেন, বাইরে যাবার বিষয়টা কঠিন হয়ে গেছে কেন? আরও কি কিছু ঘটেছে? বলল নকুয়া ফরিদা, আবিদের মা।
প্লেনের টিকিট, টাকা-পয়সার ব্যবস্থা কোনোভাবে হয়তো করা যেত, কিন্তু বিস্ময়ের ব্যাপার হলো, বেলজিয়ামের বিশ্ববিদ্যালয় আমার ভর্তির প্রস্তাব বাতিল করেছে। তারপর ইউরোপের যে কয়টি পরিচিত বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার সাবজেক্টটা আছে, সেগুলোতেও খোঁজ নেয়া হয়েছে। তারাও নেতিবাচক জবাব দিয়েছে। এই…।
কি বলছ আবিদ, বেলজিয়াম বিশ্ববিদ্যালয় তো তোমার অ্যাকাডেমিক রেকর্ড দেখে নিজেরাই আগ্রহী হয়ে তোমাকে স্কলারশিপসহ ভর্তির অফার দিয়েছিল! তাহলে এই আচরণ তারা কেন করল? বলল নকুয়া ফারিদা।
আমার কলেজ কর্তৃপক্ষও অবাক হয়েছে। তারা ওদের সাথে কথা বলেছে। আমাদের রেক্টর আমাকে বলেছেন, কি করতে বলবো! ওদের কথা শুনে মনে হয়েছে, ওরাও অসহায়। আবিদ বলল।
অসহায় কেন? ওদের তাহলে কি কেউ চাপ দিয়েছে? বলল নকুয়া ফারিদা।
হতে পারে মা। দুনিয়াতে রাজনীতি যেমন আছে, তেমনি বিশ্ববিদ্যালয়েও রাজনীতি আছে। আবিদ চাওসিকো বলল।
সেটা বুঝি বেটা। কিন্তু তোমাকে নিয়ে রাজনীতি করার মতো কেউ বেলজিয়াম বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকার কথা নয়। তাহলে কি যারা এখানে তোমার পড়ার জন্যে বিদেশযাত্রা বন্ধ করতে চেয়েছে, তারাই কি ওখানে সক্রিয়? বলল নকুয়া ফারিদা।
আবিদ চাওসিকো ও তার বাবা নাসিরউদ্দিন চিসোমো দুজনেরই চোখে-মুখে বিস্ময় ফুটে উঠল। বলল আবিদ চাওসিকো, সত্যি এমনটা ঘটতে পারে মা?
পারে বেটা। এমন শক্তি আজকের দুনিয়ায় এক নয়, একাধিক আছে। বলল নকুয়া ফারিদা।
তারা কে মা? আবিদ চাওসিকো বলল।
শোনার দরকার নেই, জানবে তাদের তুমি? থাক এ প্রসঙ্গ। এখন বল, পোপ ভিক্টর বিশ্ববিদ্যালয়ে কাদের সাথে তোমার কতদূর কথা হয়েছে? খn = বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক অফিসের ভর্তি সেকশনের সাথে কথা হয়েছে। ফরম পূরণ করে সার্টিফিকেটসহ টাকা জমা দিলেই ভর্তি হওয়া যাবে। তবে এটা চূড়ান্ত হবে ভাইস-চ্যান্সেলরের সাথে সাক্ষাৎকারের পর। বলল আবিদ চাওসিকো।
ভিসির সাথে ভর্তিচ্ছুদের সাক্ষাৎ করা কী রীতি? বলল নকুয়া চাওসিকো।
না, রীতি নয় মা। কিন্তু কোনো কোনো ক্ষেত্রে ভিসি চাইলে সাক্ষাৎকার হয়। আবিদ চাওসিকো বলল।
তাহলে আগেই তোমার সাক্ষাৎকারের বিষয় উঠলো কি করে? জিজ্ঞাসা নকুয়া ফারিদার।
কথায় কথায় তারা এ কথা বলেছে। আবিদ চাওসিকো বলল। আবিদের মা নকুয়া ফারিদা তার স্বামী নাসিরউদ্দিন চিসোমোর দিকে তাকিয়ে বলল, ঠিক আছে, লেখাপড়া বন্ধ হওয়ার চাইতে পোপ ভিক্টর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়াই ভালো।
তুমি ভেবো না ফারিদা। পোপ ভিক্টর বিশ্ববিদ্যালয় আফ্রিকার একটা শ্রেষ্ঠ বিশ্ববিদ্যালয়। এখানে নীরবে কতকগুলো মৌল বিষয়ে গবেষণা চালানো হচ্ছে। সুতরাং আমাদের আবিদের জন্যে এই বিশ্ববিদ্যালয়। একটা ভালো জায়গা হতে পারে। বলল নাসিরউদ্দিন চিসোমো।
ইনশাআল্লাহ, তাই যেন হয়। আবিদের মা নকুয়া ফারিদা বলল। আবিদ ইব্রাহিম চাওসিকো উঠে দাঁড়াল। বাবা-মাকে উদ্দেশ্য করে বলল, তাহলে আমি চলি।
চলি নয়, বল আসি। বলল আবিদের মা নকুয়া ফারিদা।
আসি মা, আসি বাবা। আস্সালামু আলাইকুম। বলে ঘুরে দাঁড়িয়ে চলা শুরু করল।
ভর্তি ফরম জমা দেয়ার পর দিনই টেলিফোন পেল আবিদ চাওসিকে। বলা হলো তাকে, সেদিনই বিকেলে ভাইস-চ্যান্সেলরের সাথে দেখা করতে হবে।
খুশি হলো আবিদ চাওসিকো। তার ভর্তি হওয়ার বিষয়টা গুরুত্ব। পেয়েছে। তবে একটা চিন্তা তার মনে অস্বস্তির ভাব সৃষ্টি করল। সেটা হলো তাকে কি জিজ্ঞাসা করবে বা কি তারা জানতে চাইবে। সবই তো ভর্তি ফরমে লিখে দেয়া হয়েছে। হতে পারে, রেজাল্ট বা ভর্তি ফরমে যা লেখা হয়, তা দিয়ে মেধা যাচাইয়ের সব হয় না। হয়তো মেধার দিকটা আরেকটু বাজিয়ে দেখতে চায় বিশ্ববিদ্যালয়।
সাক্ষাতের সময় বিকাল পাঁচটার আগেই আবিদ চাওসিকো বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিসির অফিসে গিয়ে পৌঁছল।
বসল ভিসির পিএস-এর ওয়েটিং রুমে।
কয়েক মিনিট পরেই ভিসির পিএস বেরিয়ে এসে বলল, তুমিই তো আবিদ চাওসিকো?
আবিদ চাওসিকো উঠে দাঁড়িয়ে বলল, জি, আমি আবিদ চাওসিকো।
তুমি এসো। বলে দরজা খুলে দাঁড়াল।
আবিদ চাওসিকো পিএস-এর কক্ষে প্রবেশ করল।
পিএস এসে বসল তার সিটে। বসতে বলল আবিদ চাওসিকোকে।
তোমরা তো বুজুমবুরার স্থায়ী বাসিন্দা? জিজ্ঞাসা পিএস-এর।
জি আমরা বুজুমবুরার স্থায়ী বাসিন্দা। ব্যবসায়ী পরিবার আমাদের। মাঝখানে কয়েক বছর আমার বাবা ব্যবসায় নিয়ে জাঞ্জিবারে বাস করেছেন। বলল আবিদ চাওসিকো।
পিএস তার হাতঘড়ির দিকে তাকাল। বলল, স্যার এখনি তোমাকে ডাকবেন।
একটু থামল পিএস। কথা শুরু করল আবার। বলল, শোন, তুমি তো বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে চাও। স্যার যা বলেন তার উপর কোনো কথা বলা তোমার ঠিক হবে না।
পিএস কথা শেষ করার আগেই তার ইন্টারকম কথা বলে উঠল, আবিদ চাওসিকো তো তোমার কাছে। নিয়ে এসো তাকে।
ইয়েস এক্সিলেন্সি। আমি নিয়ে আসছি তাকে। বলল পিএস। ভিসির অফিসকক্ষে আবিদ চাওসিকোকে পৌঁছে দিয়ে পিএস চলে এলো।
ভিসির টেবিলের সাথে দাঁড়িয়েছিল আবিদ চাওসিকো।
ভিসির চোখ ছিল একটা ফাইলের উপর। মুখ না তুলেই বলল, বস আবিদ চাওসিকো।
আবিদ চাওসিকো বসল।
ফাইল থেকে মুখ তুলে ভিসি তাকাল আবিদ চাওসিকোর দিকে। বলল, আবিদ ভালো ছিল তোমার বেলজিয়াম বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির উদ্যোগ। শেষ পর্যন্ত ওখানে ভর্তি হলে না কেন?
স্যার, আমাদের বাড়িতে ডাকাতি হয়। টাকা-পয়সা সমেত বেলজিয়াম বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সমস্ত কাগজ-পত্র, পাসপোর্ট সবকিছুই আমার ব্রিফকেস-ব্যাগ থেকে ডাকাতরা নিয়ে যায়। এই ক্ষতি পুষিয়ে নেবার শক্তি ও সময় আমাদের হাতে ছিল না। তার উপর শেষ মুহূর্তে বেলজিয়াম বিশ্ববিদ্যালয় আমার ভর্তির ব্যাপারে নেতিবাচক অবস্থান নেয়। বলল আবিদ চাওসিকো।
কিছু কী জানতে পেরেছ, কেন বেলজিয়াম বিশ্ববিদ্যালয় এভাবে নেতিবাচক স্ট্যান্ড নিল? ভিসি ফাদার স্টিফেন ফেবিয়ান বলল।
না স্যার, জানতে পারিনি। হতে পারে, নির্দিষ্ট সময়ে ভর্তি হতে পারবো না, এই কারণে নেতিবাচক সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকতে পারে। বলল। আবিদ চাওসিকো।
যাক, ওদিকের প্রসঙ্গ। এখন বল সবদিক বিবেচনা করেই তো তুমি আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সিদ্ধান্ত নিয়েছ? ভিসি বলল।
জি স্যার। বলল আবিদ চাওসিকো।
বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন দিকটা তোমার ভালো লেগেছে? ভিসি বলল।
আমার যে সাবজেক্ট, সেটার জন্যে আফ্রিকার মধ্যে শ্রেষ্ঠ বিশ্ববিদ্যালয় এটা। বলল আবিদ চাওসিকো।
তোমার সিদ্ধান্ত সঠিক মাই বয়। শিক্ষার চেয়ে বড় কিছু নেই।
একটু থামল ভিসি। ফাইল থেকে কয়েক শিট কাগজ বের করল। সেগুলো আবিদ চাওসিকোর দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, ভর্তি হবার জন্যে এই ভর্তি ফরমে দস্তখত কর।
স্যার, দস্তখত করেই তো ভর্তি ফরম জমা দিয়েছি। বলল আবিদ চাওসিকো।
ওটাও আমাদের কাছে থাকবে। এটাতেও দস্তখত কর। ভিসি বলল।
আবিদ চাওসিকো হাত বাড়িয়ে ফরমটা নিল। চোখ বুলাল ফরমটার উপর। 9 ) শুরুতেই তার চোখে-মুখে বিস্ময় ফুটে উঠল। পুরো ফরম দেখা শেষ করে মুখ তুলল সে।
চোখে-মুখে তার বিব্রত ভাব। বলল সে ভিসিকে লক্ষ করে, স্যার, ফরমের সবই ঠিক আছে। শুধু দুই জায়গায় ভুল আছে। আমার…।
আবিদ চাওসিকো কথা শেষ করতে পারল না। তার কথার মাঝখানেই ভিসি বলে উঠল, এক, তোমার আবিদ ইব্রাহিম চাওসিকো নাম তুমি ফরমে দেখছ না, দুই. তোমার ধর্মীয় পরিচয় লেখা হয়নি, ওটা ফাঁকা আছে। এইতো?
জি স্যার। বলল আবিদ চাওসিকো।
ভিসি হাসল। বলল, তুমি আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের রীতি-নীতি সম্পর্কে জান, ইউনিফরম পোশাকের মতো এখানে নামও ইউনিফরম করা হয়েছে। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে যারা ভর্তি হয়, তাদের পশ্চিমী নাম গ্রহণ করতে হয়। তোমাকে একটা ভালো নাম দেয়া হয়েছে, যা তোমার নামের কাছাকাছি। দেখ তোমার নতুন নাম অ্যাডাম আব্রাহাম চাওসিকোর সাথে শুধু অ্যাডাম তোমার নামের প্রথম অংশ আবিদ এর অর্থের সাথে মিলে না। কিন্তু এই অ্যাডাম বা আদম নাম তোমাদের মুসলিম সমাজেও প্রচুর আছে। আর তোমার নামের মাঝের অংশ ইব্রাহিমকে পশ্চিমী ধারায় আব্রাহাম করা হয়েছে। ইব্রাহিম ও আব্রাহাম একই নাম। আর তোমার নামের শেষ অংশ চাওসিকো তো ঠিকই আছে। সুতরাং তোমার নাম পরিবর্তন নিয়ে আপত্তি থাকার কথা নয়।
মাফ করুন স্যার। আপনার যুক্তি ঠিকই আছে। তবে শুধু আফ্রিকা নয়, দুনিয়ার মানুষ একবাক্যে আবিদ ইব্রাহিম চাওসিকো নামকে মুসলিম নাম বলবে এবং অ্যাডাম আব্রাহাম চাওসিকো নামকে খ্রিস্টান বলবে। আমার এখানেই আপত্তি স্যার। আমার নতুন নাম শুনলে কেউ আমাকে …।
আবারও আবিদ চাওসিকোর কথার মাঝখানেই ভিসি বলে উঠল, মুসলিম বলবে না- এই তো? অতি গুরুত্বপূর্ণ একটি বিজ্ঞান বিষয়ের ছাত্র তুমি, তুমি পৃথিবীর অজ্ঞ, মূর্খ লোকদের কথা কেন শুনবে? তাদের নাম কেন ধরে রাখবে? এতে তোমার ক্যারিয়ারের ক্ষতি হবে! নতুন নাম গ্রহণ করলে তোমার কোনো কিছুতেই পরিবর্তন আসছে না। এমনকি বিশ্বাসেও! তুমি বিনা কারণে চিন্তা করছ।
আপনি ঠিকই বলেছেন স্যার, নতুন নাম আমার বিশ্বাসে কোনো পরিবর্তন আনবে না। কিন্তু স্যার, নতুন নামে আমি খ্রিস্টানদের মধ্যে। গণ্য হয়ে যাব। স্যার আমি এটা মানতে পারছি না। বলল আবিদ চাওসিকো বিনীত কণ্ঠে।
কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে হলে তোমাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিধান মানতে হবে। আর ধর্মীয় পরিচয়ের কলামটা যে খালি আছে, তার কারণ সিদ্ধান্ত হয়েছে এখন থেকে জাতীয় পরিচয় একটাই লেখা হবে। যারা বুরুন্ডির নাগরিক, তাদের সবার জাতীয় পরিচয় লেখা হবে বু রুন্ডিয়ান। এখানে আপত্তি করার কিছুই নেই।
স্যার, আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে বিধি-বিধান, রীতি-নীতি সবই মানব। শুধু একটি ক্ষেত্রেই আমি আমার সংশয়ের কথা তুলেছি। বলল আবিদ চাওসিকো।
আবিদ ইব্রাহিম চাওসিকো লেখাপড়া তোমার, ভর্তি হবে তুমি। তোমাকে এখনি এই মুহূর্তে সিদ্ধান্ত নিতে হবে, তুমি সামনে যাবে, না পিছু হটবে। তবে তোমাকে এজন্যে কোনো সময় দেয়া যাবে না। যা সিদ্ধান্ত নেবার তোমাকে এখনই নিতে হবে। ভিসি বলল। শক্ত কণ্ঠ তার।
আবিদ ইব্রাহিম ভিসির শক্ত হয়ে ওঠা মুখের দিকে তাকাল। হৃদয়টা তার মোচড় দিয়ে উঠল। তার লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যাবে, এটা সে চিন্তাই করতে পারে না। মনে পড়ল তার তাদের মসজিদের একটা অনুষ্ঠানে মেহমান হয়ে আসা দক্ষিণ আফ্রিকার এক বুজুর্গ আলেম তার বিজ্ঞান মেধার পরিচয় পেয়ে বলেছিল, দুনিয়ার মুসলমানদের আজ তোমাদের মতো ছেলে দরকার। যত কষ্টই হোক, যত বাধাই আসুক লেখাপড়া বন্ধ করবে না। বাবা-মা, প্রতিবেশীরাও এটাই চায়।
মুখ তুলল আবিদ চাওসিকো। বলল, স্যার, আমি সামনে এগোতে চাই। তবে একটা কথা, আমার লেখা-রেকর্ডে যাই থাক, আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার আসল পরিচয়ই দেব।
একটা সূক্ষ্ম হাসি ফুটে উঠল ভিসির ঠোঁটে। তা যেন ছুরির মতো ধারাল। বলল, তুমি মুখে কি বলবে সেটা তোমার ব্যাপার। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের সব রেকর্ডে তোমার নতুন নাম থাকবে অ্যাডাম আব্রাহাম চাওসিকো।
ভিসি একটু থেমেই আবার বলে উঠল, হ্যাঁ, দস্তখত করে ফরমটা দিয়ে দাও আমাকে।
আবিদ চাওসিকো দস্তখত করে ভর্তি ফরম ভিসির হাতে তুলে দিল।
ভিসি ফরমটি গ্রহণ করে আবিদ চাওসিকোকে ধন্যবাদ দিয়ে বলল, তুমি লেখাপড়াকে অগ্রাধিকার দিয়েছ, এজন্যে আমি খুশি আবিদ। তোমার সিদ্ধান্তে উপকৃত হবে মানুষ।
ধন্যবাদ স্যার, আমাকে কি আর কিছু বলবেন? বলল আবিদ চাওসিকো।
না আর কিছু নয়, এসো। ভিসি ফাদার স্টিফেন ফেবিয়ান। আবিদ চাওসিকো উঠে দাঁড়াল।
বেরিয়ে এলো ভিসির ঘর থেকে। তার হৃদয়ে যে উথাল-পাথাল ঝড় উঠেছিল তা থামেনি। নিজেকে খুব দুর্বল মনে হচ্ছে তার। যেন পরাজয়ের এক দুর্বহ ভার তার বুকে।
এসব চিন্তা থেকে বাঁচার জন্যে মনটাকে একটা ঝাড়া দিয়ে দ্রুত, পা চালাল।
তার লক্ষ বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরি কক্ষ।