৩
প্রেসিডেন্টের অফিস বিল্ডিং-এর গেটে পৌঁছতেই গেটে দাঁড়ানো প্রেসিডেন্টের সামরিক সেক্রেটারি জেনারেল জিয়াও জি স্যাংগ এগিয়ে এলো।
স্যার, প্রেসিডেন্ট অফিসে আপনাকে স্বাগত। এক্সিলেন্সি প্রেসিডেন্ট আপনার জন্যে অপেক্ষা করছেন। প্লিজ আসুন।
চলতে শুরু করল আহমদ মুসা।
আহমদ মুসার একধাপ পেছনের অবস্থানে থেকে পাশাপাশি হাঁটতে লাগল প্রেসিডেন্টের মিলিটারি সেক্রেটারি।
গেটের ভেতরে ঢুকে গেটের একপাশে টু সিটের একটা অটো ক্যাপসুল দেখতে পেল। ক্যাপসুলের একদম সামনে ক্যাপসুল কেবিনে একটা চেয়ার। সেখানে ড্রাইভার বসে। মাঝে একটা ভিআইপি সিট, তার পরে আরেকটা সিট বসানো।
প্রেসিডেন্টের মিলিটারি সেক্রেটারি টিউবের মাঝের দরজা খুলে দিয়ে বলল, স্যার, উঠুন প্লিজ।
আহমদ মুসা ধন্যবাদ দিয়ে উঠে বসল।
পেছনের সিটে উঠল মিলিটারি সেক্রেটারি। চলতে শুরু করল টিউব। গতি বেশ দ্রুত।
টিউবের চলার রাস্তা ভিন্ন।
টিউবটি এঁকেবেঁকে, চড়াই-উত্রাই-এর মতো কখনও নিচে নেমে, কখনও উপরে চলতে লাগল। প্রেসিডেন্টের অফিস বেশ বড় ধরনের চারতলা বিল্ডিং। চীনের ঐতিহ্যবাহী প্রাচীন স্টাইলে তৈরি। চারতলায় উঠতে এত বেশি সময় লাগার কথা নয়। আহমদ মুসা বুঝল টিউবের রুটটা ক্যামোফ্লেজ করা। এটা নিরাপত্তার জন্যেই।
অবশেষে ফাইনাল এক উত্রাইয়ের পর টিউব একটা করিডোরে ঢুকে একটা দরজায় এসে থামল।
নামল মিলিটারি সেক্রেটারি জেনারেল জিয়াও জি স্যাংগ। বলল, স্যার, আমরা অফিসে এসে গেছি। আসুন।
আহমদ মুসা টিউব থেকে নামতে নামতে ভাবল, এই অফিস বিল্ডিং-এর কয় তলায় হতে পারে প্রেসিডেন্টের অফিস? আহমদ মুসা অনুমান করতে পারলো না, এই অফিস কয় তলায় হতে পারে। প্রেসিডেন্টের অফিস নিশ্চয় এই ফ্লোরেই হবে। তবে অফিস যে তলাতেই হোক, সেটা পাঁচতলায় নয়, চারতলাতেও না হতে পারে।
আহমদ মুসাকে নিয়ে মিলিটারি সেক্রেটারি তার অফিস রুমে ঢুকল। একটা চেয়ার টেনে আহমদ মুসাকে বসতে দিল।
মিলিটারি সেক্রেটারি তার চেয়ারে বসেই ইন্টারকমের একটা বোতামে চাপ দিল। একটা নারী কণ্ঠ ভেসে এলো ইন্টারকম থেকে। বলল, আদেশ করুন স্যার।
মিলিটারি সেক্রেটারি বলল, এক্সিলেন্সি মি. প্রেসিডেন্টের লাইন আমাকে দাও।
লাইন পেতেই মিলিটারি সেক্রেটারি বলল, এক্সিলেন্সি মি. প্রেসিডেন্ট মেহমানকে নিয়ে আমি এসে গেছি। তিনি এখন আমার অফিসরুমে। আপনার আদেশ এক্সিলেন্স।
ধন্যবাদ জেনারেল স্যাংগ। মিস লিয়ান যাচ্ছে। ইন্টারকমে প্রেসিডেন্টের কণ্ঠ।
এক দেড় মিনিটের মধ্যেই প্রেসিডেন্টের প্রাইভেট সেক্রেটারি মিস লিয়ান এলো। তার পরনে সামরিক পোশাক।
ঘরে ঢুকে সে স্যালুট দিল জেনারেল জিয়াও স্যাংগকে। আর আহমদ মুসাকে একটা বাউ করে বলল, ওয়েলকাম এক্সিলেন্সি। এক্সিলেন্সি মি. প্রেসিডেন্ট আমাকে পাঠিয়েছেন। তিনি আপনার জন্যে অপেক্ষা করছেন।
আহমদ মুসা উঠে দাঁড়িয়ে প্রেসিডেন্টের মিলিটারি সেক্রেটারিকে বলল, আসি মি, জেনারেল। বাই।
ফিরে দাঁড়াল আহমদ মুসা প্রেসিডেন্টের প্রাইভেট সেক্রেটারির দিকে। বলল, চলুন মিস লিয়ান।
হাঁটতে লাগল মিস লিয়ান। আহমদ মুসা হাঁটছে তার পাশাপাশি
বেশ কয়েকটি দরজা, করিডোর, কক্ষ পার হয়ে একটি সুসজ্জিত অফিস কক্ষে এলো। মিস লিয়ানের অফিস।
এক্সিলেন্সি, একটু বসুন প্লিজ। বলে মিস লিয়ান একটি চেয়ার এগিয়ে দিল। বসল আহমদ মুসা।
মিস লিয়ান তার চেয়ারে না বসেই তাড়াতাড়ি এগোলো ইন্টারকমের দিকে।
ইন্টারকমের বোতাম টিপল সে।
মিস লিয়ানের গলা পেতেই প্রেসিডেন্ট তার কথার মধ্যেই বলে উঠল, মেহমানকে নিয়ে এসো।
ইয়েস এক্সিলেন্সি। বলে মিস লিয়ান আহমদ মুসার দিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে বলল, আসুন এক্সিলেন্সি, প্লিজ।
বলে কক্ষের অন্য একটা দরজার দিকে হাঁটতে লাগল মিস লিয়ান। তার সাথে আহমদ মুসাও।
মিস লিয়ানের কক্ষ থেকে তারা আরেকটি কক্ষে পৌঁছল। কক্ষটি বসার সোফা ও ফুলদানিতে সুন্দর করে সাজানো।
কক্ষটির সামনের দেয়ালে একটা বড় দরজার মতো। তিন পাশের ওয়ালের সাথে একেবারে মিলানো। শুধু দেয়ালের চেয়ে সামান্য গাঢ় সূক্ষ্ম একটা রেড লাইনিং।
মিস লিয়ান গিয়ে সেই রেড লাইনিং সামনে রেখে দাঁড়াল। আহমদ মুসা তার পেছনে দাঁড়াল।
মুহূর্তকাল দাঁড়িয়েই মিস লিয়ান সামনে এগিয়ে দুপাশের রেড লাইনিং এর মাঝখানে হাত রাখল। চোখের পলকে রেড লাইনিং-এর ভেতরের অংশটা দেয়ালের ভেতরে হারিয়ে গেল। বেরিয়ে এলো একটা দরজা।
মিস লিয়ান দ্রুত দরজার সামনে থেকে সরে এলো। বলল, এক্সিলেন্সি প্লিজ এগোন। ভেতরে এক্সিলেন্সি মি. প্রেসিডেন্ট।
ধন্যবাদ মিস লিয়ান। বলে আহমদ মুসা এগোলো দরজার দিকে। দরজায় গিয়ে একটু দাঁড়াল আহমদ মুসা। ভেতরে নজর পড়ল তার। লাল কার্পেটে মোড়া সুসজ্জিত বেশ বড় ঘর।
এ দরজাটা ঘরের পূর্ব দেয়ালের একেবারে দক্ষিণ প্রান্তে। ঘরের মাঝামাঝি উত্তর দেয়ালের সামনে চীনের পতাকার মতো লাল টেবিলের ওপাশে অ্যান্টিকস ধরনের একটি লাল চেয়ারে বসে আছে প্রেসিডেন্ট। ঘরের দেয়ালের কার্পেটসহ সব ফার্নিচারই লাল।
আহমদ মুসাকে দেখতে পেয়েই উঠে দাঁড়াল প্রেসিডেন্ট। আহমদ মুসাও দ্রুত প্রেসিডেন্টের দিকে এগোলো।
প্রেসিডেন্ট চেয়ার থেকে উঠে টেবিল ঘুরে আহমদ মুসার দিকে এগিয়ে এলো স্বাগত জানানোর জন্যে।
আহমদ মুসা তখন টেবিলের সামনে পৌঁছে গেছে। প্রেসিডেন্ট ও আহমদ মুসা মুখোমুখি।
আহমদ মুসা মুখ খুলেছিল প্রেসিডেন্টকে গুড মর্নিং বলার জন্যে। কিন্তু বলার সুযোগ হলো না।
ওয়েলকাম মি. আহমদ মুসা! বলে জড়িয়ে ধরল প্রেসিডেন্ট আহমদ মুসাকে। বলল, গোটা চীন তোমার প্রতি কৃতজ্ঞ আহমদ মুসা।
আহমদ মুসাকে চেয়ারে বসিয়ে প্রেসিডেন্ট গিয়ে তার সিটে বসল।
এক্সিলেন্সি মি. প্রেসিডেন্ট, আমাদের মিটিং-এর কথা তো এখনও আপনি শোনেননি। মিটিং-এ কি হয়েছে তাও আপনি জানেন না। আমি মিটিং-এ কি ভূমিকা রেখেছি, সেটাও আপনার সামনে আসেনি। তাহলে আমার প্রতি চীনের কৃতজ্ঞতার প্রশ্ন আসছে কি করে?
প্রেসিডেন্ট হাসল। বলল, আমি মিটিংটাকে সীমাহীন গুরুত্ব দিয়েছি। এই মিটিংটা অনুষ্ঠিত হওয়া আমার কাছে যেমন ছিল আনন্দের, তেমনি ছিল ভীষণ উদ্বেগের। মিটিং-এর ফলাফলের জন্যে মিটিং-এর শেষ পর্যন্ত অপেক্ষা করা আমার পক্ষে সম্ভব ছিল না। এজন্যে মিটিং-এর প্রসেডিংস আমার টেবিলে মনিটর করার ব্যবস্থা করি। যদিও এটা করা আমার বিবেকেও বেধেছে।
প্রেসিডেন্ট মুহূর্তকালের জন্যে থেমেই আবার বলে উঠল, আমি এজন্যে দুঃখ প্রকাশ করছি আহমদ মুসা। তবে আমি মনে করি, মিটিং-এর কথাগুলো প্রকাশ হলেই ভালো হতো। চীনে মুসলমানদের মর্যাদা আরও বাড়ত। ইসলাম সম্পর্কে বড় একটা সুধারণার সৃষ্টি হতো।
এক্সিলেন্সি, রাষ্ট্রের প্রতি দায়িত্বানুভূতি থেকে আপনি এটা করেছেন। আর রাষ্ট্রের জন্যে এটা স্বাভাবিকও। এ প্রসেডিংসটা বাইরে প্রকাশ হোক, এটা যথার্থভাবেই আশা করেছেন। সেটা হবে বলেই আমার মনে হচ্ছে। কারণ, আমাদের মিটিং-এর প্রসেডিংস দুটি ভিন্ন ভিন্ন চ্যানেলে মনিটর করা হয়েছে। বলল আহমদ মুসা।
প্রেসিডেন্টের চোখ-মুখ বিস্ময়ে ছেয়ে গেল। সোজা হয়ে বসল চেয়ারে। বলল, বলছ কি আহমদ মুসা! গোয়েন্দা বিভাগ আমাকে বলেছে, একটি চ্যানেলে মানে শুধু মাত্র প্রেসিডেন্টের টেবিলেই এটা মনিটরের ব্যবস্থা করা হয়েছে। তুমি কি নিশ্চিত আহমদ মুসা, ডবল চ্যানেলে মিটিংটি মনিটর করা হয়েছে?
আমি নিশ্চিত এক্সিলেন্সি। বলল আহমদ মুসা।
আমি বলতে পারি কোনো গোয়েন্দা বিভাগ এটা করতে পারে না। তাহলে কে করতে পারে? প্রেসিডেন্ট বলল।
আপনাদের মিডিয়া খুব শক্তিশালী। বলা যায় তারা সরকারেরই অংশ। সরকারের গোয়েন্দা বিভাগের মতোই তারা জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ নানা তথ্য যোগাড়ে তৎপর। প্রায় সর্বত্রই ওদের পকেট আছে। ওদের জন্যে এটা অসম্ভব নয়। বলল আহমদ মুসা।
স্তম্ভিত প্রেসিডেন্ট সঙ্গে সঙ্গে কোনো কথা বলল না। চিন্তা করছিল।
একটু পরে বলে উঠল, ওদের এ শক্তি থাকতে পারে। বিদেশে কাজ করার জন্যে ওদের এভাবে তৈরিও করা হয়েছে। কিন্তু এই মিটিং তারা এভাবে মনিটর করতে আসবে কেন?
হতে পারে কোনো মহল আশা করেছে, মিটিং-এর কথা-বার্তা থেকে মুসলিম বিরোধী প্রপাগান্ডার কোনো উপকরণ পাওয়া যাবে। বলল আহমদ মুসা।
কিন্তু মি. আহমদ মুসা, আমাদের মিডিয়া সরকারি ইচ্ছার বাইরে গিয়ে এমন কাজ তো করতে পারে না। কোনো মহল বলতে কাকে তুমি বুঝাতে চাচ্ছ? প্রেসিডেন্ট বলল।
আমি নিশ্চিত নই, তবে মিডিয়ার মধ্যে জোয়ান উর বাহিনীর কোনো পকেটও তত থাকতে পারে! বলল আহমদ মুসা।
প্রেসিডেন্টের ভ্রু কুঞ্চিত হলো। চিন্তা করল। একটু সময় নিয়ে বলল, তোমার চিন্তা গুরুত্বপূর্ণ আহমদ মুসা। আমি গ্রহণ করছি। আজকের দ্বিতীয় চ্যানেলে মনিটর করার ঐ ঘটনার আমি বিস্তারিত তদন্তের নির্দেশ দিচ্ছি। তোমাকে অনেক ধন্যবাদ আহমদ মুসা।
একটু থামল প্রেসিডেন্ট। টেবিল থেকে সরে তার দেহটা সোজা হলো। বলল, সত্যিই আহমদ মুসা তুমি অনন্য, এ কারণেই তুমি অজেয়।
মনিটর হওয়ার বিষয় আমি জেনেছি, এতে আমার কোনো কৃতিত্ব নেই এক্সিলেন্সি মি. প্রেসিডেন্ট। আপনাদের গোয়েন্দা প্রধান মি, ডাই ডিং জিয়াং আমি উডাং পর্বতে যাওয়ার সময় রেডিও ওয়েভ ডেটোনেটর বিশিষ্ট একটা হাতঘড়ি আমাকে উপহার দিয়েছিলেন, এটা তাঁরই কীর্তি। আহমদ মুসা বলল।
প্রেসিডেন্ট হাসল। বলল, মিডিয়ার বিশেষ পকেট মিটিংটা মনিটর। করেছে, এটা কিন্তু ঐ হাতঘড়ি বলে দেয়নি।
এই বোধটা আমার মধ্যে আল্লাহর তরফ থেকে এসেছে এক্সিলেন্সি। বলল আহমদ মুসা গম্ভীর কণ্ঠে।
গাম্ভীর্য প্রেসিডেন্টেরও চোখে-মুখে। বলল, আমি তোমার সাথে দ্বিমত করবো না। আমার মধ্যে এ বোধ এখন অনেকটাই স্পষ্ট হয়েছে, মানুষের জন্যে আল্লাহর সাহায্য এভাবে আসে। কিন্তু একটা বিষয় আমি বুঝতে পারছি না, আল্লাহই তো সবকিছু করছেন, তাহলে মানুষের ভূমিকা কি? তার ভূমিকা পালনের জায়গা কোথায়?
মানুষের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ এক্সিলেন্সি। মানুষকে আল্লাহর দেয়া শক্তি সামর্থ্য কাজে লাগিয়ে চিন্তা করতে হবে, সন্ধান করতে হবে, জ্ঞান-গবেষণার আশ্রয় নিতে হবে এবং এই ক্ষেত্রে তাকে আন্তরিক হতে হবে। এই পর্যায়েই মানুষের জন্যে আল্লাহর সাহায্য আসে। অলস, নিষ্ক্রিয় মাথা অধিকাংশ ক্ষেত্রে হয়ে থাকে শয়তানের আড্ডাখানা, আল্লাহর সাহায্য এখানে আসে না। আহমদ মুসা বলল।
বুঝেছি আহমদ মুসা, ধন্যবাদ।
একটু থামল প্রেসিডেন্ট। কথা বলে উঠল আবার সঙ্গে সঙ্গেই, আহমদ মুসা, তোমাদের মিটিং-এর মূল প্রস্তাবের একটা সংক্ষেপ আমি পাঠিয়ে দিয়েছি সরকারের যারা মিটিং-এ বসবে সেই নেগোশিয়েটিং কমিটির কাছে। বিষয়টি নিয়ে মন্ত্রিসভাও বসেছে।
আপনার মত কি এক্সিলেন্সি মি. প্রেসিডেন্ট? জিজ্ঞাসা আহমদ মুসার।
আমরা যা চাই তা পুরোপুরিই তোমার প্রস্তাবে আছে। আবার বর্তমান অবস্থায় মুসলমানদের পক্ষ থেকে যা চাওয়া স্বাভাবিক তাও আছে তোমার প্রস্তাবে। আমরা প্রস্তাব পুরোপুরিই মেনে নিচ্ছি আহমদ মুসা। বলল প্রেসিডেন্ট।।
ধন্যবাদ এক্সিলেন্সি মি. প্রেসিডেন্ট! চীন রাষ্ট্র ও মুসলমান উভয়ের জন্যেই এটা হবে শান্তি ও অগ্রগতির একটা ঐতিহাসিক পদক্ষেপ। আল্লাহ আমাদের এই সিদ্ধান্ত কবুল করুন। আহমদ মুসা বলল। তার কণ্ঠ আবেগে ভারি।
আহমদ মুসা, চীন সরকার তোমার প্রতি কৃতজ্ঞ। তুমি জোয়ান উদের ধ্বংস ও তাদের ষড়যন্ত্র জনসমক্ষে এনে এবং মুসলিমদের প্রতিনিধি সম্মেলনে চীনের মুসলমানদের যে পরিচয় ও ইসলামের যে জীবনদর্শন সামনে এনেছ, তাতেই এই অসাধ্যসাধন সম্ভব হয়েছে। আহমদ মুসা। তোমার হাতে যুদ্ধের অস্ত্র যতটা তেজি, তার চেয়ে অনেক বেশি তেজি তোমার হাতের শান্তির অস্ত্র। অনেক ধন্যবাদ তোমাকে।
এক্সিলেন্সি, আমার হাতের যুদ্ধের অস্ত্র এবং শান্তির অস্ত্র কোনোটাই আমার নয়। যুদ্ধ ও শান্তির এই অস্ত্র আল্লাহর মনোনীত ধর্ম ইসলামের। ইসলামের যুদ্ধ শান্তির জন্যে, আল্লাহর বান্দাদের উপর দুঃখ-কষ্ট চাপিয়ে দেবার জন্যে নয় কিংবা কোনো রাজা-বাদশা, ব্যক্তি বা গ্রুপের সাম্রাজ্য। বিস্তার, সমৃদ্ধি বা লুণ্ঠনের জন্যে নয়। ইসলামের যুদ্ধ চরিত্রগতভাবেই। রক্ষণাত্মক, আক্রমণাত্মক নয়। বলল আহমদ মুসা।
আমি জানি না আহমদ মুসা, তুমিই ইসলামকে এতটা সুন্দর করেছ, না। ইসলাম তোমাকে এত সুন্দর করেছে। তবে তোমার ইসলামের এই রূপ। আমাকে বিমোহিত করেছে।
গম্ভীর কণ্ঠে প্রেসিডেন্ট এ কথা বলার পর একটু থামল।
পাশের ডেস্ক থেকে পানির গ্লাস তুলে নিয়ে একটু পানি খেয়ে বলল, আর অল্পক্ষণের মধ্যেই আমার মন্ত্রিসভা ও পলিটব্যুরো একসাথে মুসলিম প্রতিনিধিদের সাথে বসছে। বৈঠকের পরই সাংবাদিকদের ব্রিফ করা হবে। আপনি কি মিটিং-এ যেতে চান?
না, এক্সিলেন্সি মি. প্রেসিডেন্ট। আমার সেখানে কোনো কাজ নেই। আমি সাংবাদিকদের চোখে পড়তে চাই না। তবে একটা টেলিফোন করতে হবে মা চু ইং অথবা ইরকিন আহমেদ ওয়াংকে। বলল আহমদ মুসা।
ঠিক আছে। তাহলে আপনি কথা বলেন। আমাকেও একটু কথা বলতে হবে আমার মিলিটারি সেক্রেটারির সাথে।
বলে প্রেসিডেন্ট উঠে গেল পাশের কক্ষে।
আহমদ মুসা কথা বলল চু ইং এবং ইরকিন আহমেদ ওয়াং দুজনের সাথেই।
প্রেসিডেন্টও দুমিনিট পর ফিরে এলো তার কম্যুনিকেশন রুম থেকে।
প্রেসিডেন্ট বসেই বলল, মি. আহমদ মুসা, তোমাকে বোধ হয় এখনও জানানোই হয়নি। প্রেস ব্রিফিং-এর পর সবাই আসবে প্রেসিডেন্ট অফিসের অ্যান্টিকস হলে। সেখানে লাঞ্চের আয়োজন করা হয়েছে মুসলিম। প্রতিনিধিদের সম্মানে। তুমি সেখানে বিশেষ অতিথি। আমিও সেখানে থাকছি। এখান থেকে আমরা সেখানে যাব। অ্যান্টিকস হলটা নিচের তলায়।
বেশ সময় হাতে আছে। এতটা সময় এক্সিলেন্সিকে এনগেজ রাখা বোধ হয় আমার ঠিক হবে না। আমি কি…।
আহমদ মুসা কথা শেষ করতে পারল না। আহমদ মুসার কথার। মাঝখানেই প্রেসিডেন্ট বলে উঠল, তোমার সাথে একান্তে থাকার এই সময় পাওয়ায় আমি খুব খুশি। জোয়ান উদের মানসিকতার আর যাতে উত্থান না। ঘটে এবং চীনের মুসলমানদের সাথে আজ যে চুক্তি হচ্ছে, সমঝোতা হচ্ছে, তাকে কি করে ভবিষ্যতে আরও সংহত করা যায়, এ নিয়ে তোমার সাথে আমার গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা আছে। আমি তোমার সহযোগিতা চাই। বলল প্রেসিডেন্ট।
ধন্যবাদ এক্সিলেন্সি, আমিও খুশি হবো এ ধরনের আলোচনার সুযোগ পেলে। আমি যেখানেই থাকি, চীন আমার মাতৃভূমি এক্সিলেন্সি। আহমদ মুসা বলল।
প্রেসিডেন্টের মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। বলল, আমরা তোমার জন্যে গর্বিত আহমদ মুসা।
কথা বলার সাথে সাথেই প্রেসিডেন্ট তার টেবিলের ডান পাশ থেকে চামড়ার একটা সুদৃশ্য ফোল্ডার টেনে নিয়ে উঠে দাঁড়াল।
উঠে দাঁড়াল আহমদ মুসাও।
ফোল্ডারটি প্রেসিডেন্ট আহমদ মুসার দিকে এগিয়ে ধরে বলল, তোমার জন্মভূমি চীনের পক্ষ থেকে তোমার জন্যে ক্ষুদ্র একটা উপহার আহমদ মুসা।
আহমদ মুসা ফোল্ডারটি গ্রহণ করে বলল, কি আছে এতে এক্সিলেন্সি?
তোমার উপযুক্ত বড় কিছু নেই। কিন্তু এর সাথে জড়িয়ে আছে তোমার। জন্মভূমির একান্ত আদর, প্রাণছোঁয়া ভালোবাসে ও অনুতাপ দগ্ধ হৃদয়ে এক হারানো মানিককে বুকে ফিরে পাওয়ার অফুরান আবেগের ছোঁয়া। খুলে দেখতে পার। বলল প্রেসিডেন্ট আবেগজড়িত কণ্ঠে।
গম্ভীর আহমদ মুসার চোখ-মুখ ভারি হয়ে উঠেছিল। বেদনার্ত এক আবেগের ফুরণ তাতে।
ধীরে ধীরে খুলল আহমদ মুসা ফোল্ডারটি।
বেরিয়ে এলো আহমদ মুসার জন্যে এবং তার পরিবারের সকল সদস্যের জন্যে চীনের ভিভিআইপি পাসপোর্ট। বেইজিং-এ ওর জন্মস্থান কানশুতে দুটি বাড়ির দলিল আহমদ মুসার জন্যে। আর রয়েছে ইন্টারন্যাশনাল ব্যাংক অব চায়নার উন্মুক্ত অঙ্কের একটা ক্রেডিট কার্ড।
আহমদ মুসা একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল জিনিসগুলোর দিকে। বেদনার্ত তার মুখ। দুচোখের কোনায় অশ্রুবিন্দু। তার দুচোখ ফোল্ডারের জিনিসগুলোর উপর নিবদ্ধ থাকলেও দৃষ্টি তার চলে গেছে অনেক বছর আগে হারিয়ে ফেলা কানশুর তার নিজ পল্লীর দিকে। মনে পড়ল, পরিবার নিয়ে আনন্দমুখর তার বাল্যকাল, বিতাড়িত হবার রক্তাক্ত দৃশ্য, মাতা-পিতা, ভাই, স্বজন, প্রতিবেশীদের হারাবার মর্মন্তুদ অভিজ্ঞতার কথা। ফিরে এলো তার দৃষ্টি ফোল্ডারের দিকে। সব হারাবার পর কিছু তো ফিরিয়ে দিল তার মাতৃভূমি আজ তার হাতে। বাবাকে, মাকে, ছোট ভাইকে, পরিবার পরিজনকে এই খবরটা যদি সে দিতে পারতো! দুচোখ ছাপিয়ে ঝর ঝর করে অশ্রু নেমে এলো তার দুগণ্ড বেয়ে। ধীরে ধীরে সে মাথা নিচু করে চুমু খেল ফোল্ডারটিকে। অশ্রুধোঁয়া মুখ তুলে বলল, ধন্যবাদ এক্সিলেন্সি।
কান্নায় জড়িয়ে গেল তার কথা।
প্রেসিডেন্ট উঠে এলো তার চেয়ার থেকে। সান্ত্বনার হাত রাখল আহমদ মুসার মাথায়।
আহমদ মুসা উঠে দাঁড়াল। প্রেসিডেন্ট তাকে জড়িয়ে ধরল। বলল, তোমার অতীতকে ফিরিয়ে দিতে পারবো না আমরা আহমদ মুসা। কিন্তু কথা দিচ্ছি, বর্তমান দিয়ে অতীতের কালো দাগ যতটা সম্ভব মুছে ফেলার চেষ্টা করব। প্রেসিডেন্টের কণ্ঠ নরম, তাতে মমতার সুর।
আহমদ মুসা চোখ মুছে বলল, অনেক ধন্যবাদ এক্সিলেন্সি। আমি এবং মুসলিম কম্যুনিটি কৃতজ্ঞ আপনার কাছে।
ওয়েলকাম আহমদ মুসা। আমি যেটা করেছি, সেটা তুমিই আমাকে দিয়ে করিয়েছ। তুমি না এলে, তোমার দেখা না পেলে, তোমার কথা শোনার সুযোগ আমার না হলে আমার এই পরিবর্তন আসত না, চীনেও এই পরিবর্তন আনা অসম্ভব ছিল।
কথা বলার সাথে সাথে প্রেসিডেন্ট গিয়ে বসল তার আসনে। বসেই বলল, এবার তাহলে শুরু করি আমার কথা।
প্রেসিডেন্ট তার চেয়ার একটু টেনে নিয়ে সামনের একটা ফাইল ওপেন করল। তাকাল আহমদ মুসার দিকে। শুরু করল তাঁর কথা।
.
খাওয়া প্রায় শেষের দিকে।
প্রেসিডেন্টের টেবিলে বসেছে মা চু ইং, ইরকিন আহমেদ ওয়াং, লি ইউয়ান, সশস্ত্র বাহিনী কমিশনের প্রধান, সশস্ত্র বাহিনী প্রধান, পলিটব্যুরোর সিনিয়র সদস্য, পার্লামেন্ট বা গণপরিষদের প্রধান এবং আহমদ মুসা।
খাওয়ার সাথে চলছে গল্প। চুক্তি, সমঝোতার বিভিন্ন দিক নিয়েই আলোচনা। সবাই খুশি।
আলোচনার চাইতে অ্যান্টিকস হলটির প্রাচীন শো-পিস ও কারুকাজই আহমদ মুসার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে বেশি। আহমদ মুসা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে বিভিন্ন জিনিস দেখছে। খাওয়া হয়ে গেছে।
।চাইনিজ ঐতিহ্যবাহী গ্রিন টি খাচ্ছে সবাই ধীরে সুস্থে গল্পের সাথে সাথে।
আহমদ মুসাকেও মাঝে মাঝে গল্পে যোগ দিতে হচ্ছে। কিন্তু মনোযোগ তার প্রাচীন শো-পিস ও নানা অ্যান্টিকস-এর দিকে।
সামনে দেয়ালে একটা প্রাচীন শো-পিস-এর উপর আটকে গেল আহমদ মুসার চোখ। একটা গাছের সিম্বল। বেশ দীর্ঘ। গাছের গোড়া থেকে আগা পর্যন্ত গাছ, শাখা-প্রশাখা ও পাতা চারটি আলাদা লেয়ারে বিভক্ত। শাখা প্রশাখা-পাতার লেয়ার চাকতির মতো গোলাকার। শাখা-প্রশাখা-পাতার সেই চাকতির মতো গোলাকৃতির-একদম মাঝ বরাবর দিয়ে পিলার আকারের কাণ্ড গাছের শীর্ষ থেকে বটম পর্যন্ত নেমে গেছে। বটমে গুচ্ছাকার শিকড় বেশ অনেকখানি নিচে নেমে গেছে। শিকড়ের গুচ্ছ দেখে বিস্মিত হলো আহমদ p মুসা। শিকড়গুলো যেন সুশৃঙ্খলভাবে সাজানো আরবি ক্যালিওগ্রাফিক বর্ণমালা। তার নিচে অস্পষ্ট করে শিকড় দিয়েই চাইনিজ বর্ণমালার মতো কিছু লেখা। গুচ্ছাকার শিকড়ে জটিল স্টাইলে লেখা হলেও দূর থেকেও আরবির ক্যালিওগ্রাফি বর্ণগুলো ও চাইনিজ তিনটি বর্ণ বোঝা যাচ্ছে। বুঝতে পেরেই চমকে উঠল আহমদ মুসা। বর্ণমালা পরিষ্কার হবার পর শব্দের অর্থ সামনে এলে এক শ্বাসরুদ্ধকর চিন্তা আহমদ মুসাকে ঘিরে ধরল। শো পিসের বিস্ময়কর গাছের শিকড়ে সম্পদ অর্থাৎ ধনভাণ্ডারের কথা বলা হচ্ছে কেন? হঠাৎ আহমদ মুসার মনে পড়ল জোয়ান উর কুবলাই খানের ধনভাণ্ডার খোঁজার কথা।
আহমদ মুসার দৃষ্টি আরও তীক্ষ্ণ হলো। গাছের সর্বত্র খুঁজতে লাগল কুবলাই খানের কোনো চিহ্ন। শিকড়ের দিকে চোখ ফেলতে গিয়ে মনে মনে হেসে উঠল- গোটা শিকড়ের আকারই তো কুবলাই খানের দাড়ি। কিন্তু পরক্ষণেই তার মনের হাসি বিস্ময়ে রূপান্তরিত হলো। এটা তাহলে কোনো শো-পিস নয়, সম্রাট কুবলাই খানের ধনভাণ্ডারের সংকেত ধাঁধার স্টোনপ্লেট। দেখেই মনে হচ্ছে কোথাও লাগানো ছিল। তুলে আনা হয়েছে। গোটা শরীরে তার রোমাঞ্চের একটা স্রোত বয়ে গেল।
এক্সকিউজ মি এক্সিলেন্সি! বলে আহমদ মুসা সম্মোহিতের মতো উঠে দাঁড়াল। ধীরপায়ে সে গিয়ে দাঁড়াল দেয়ালে সেট করা বিস্ময়কর গাছের শো-পিসটার নিচে- সবটা বিষয় আরো ভালো করে দেখতে চায়, বুঝতে চায়, নিশ্চিত হতে চায় আহমদ মুসা।
অনেক আগেই আহমদ মুসার ভাবান্তর ও শো-পিসটার উপর তার দৃষ্টি প্রেসিডেন্টের চোখে পড়েছিল। প্রথমে প্রেসিডেন্টের মনে কৌতূহলের সৃষ্টি হয়েছিল। কিন্তু আহমদ মুসা যখন প্রেসিডেন্টকে এক্সকিউজ মি বলে সম্মোহিতের মতো উঠে দেয়ালের শো-পিসটার সামনে দাঁড়াল, প্রেসিডেন্টের কৌতূহল তখন বিস্ময়ে রূপান্তরিত হলো। টেবিলের অন্যদের কাছেও বিস্ময়টা ধরা পড়েছিল। কিন্তু মানুষটি আহমদ মুসা বলেই তার সম্পর্কে তাদের চিন্তা কৌতূহলের গণ্ডি পেরুতে পারেনি।
প্রেসিডেন্ট মাঝে মাঝেই তাকাচ্ছিল আহমদ মুসার দিকে। প্রেসিডেন্টের ব্যক্তিত্ব ও প্রটোকলের কারণে এর চেয়ে বেশি প্রতিক্রিয়া সে দেখাতে পারছিল না। হল-এ এখন অনুষ্ঠান ও লোকজন না থাকলে প্রেসিডেন্ট যেত আহমদ মুসার কাছে।
আহমদ মুসা ফিরে এলো টেবিলে। তার চোখে-মুখে বিস্ময় ও আনন্দ দুই-ই।
আহমদ মুসা তার সিটে বসতেই প্রেসিডেন্ট বলল, মি. আহমদ মুসা, এই শো-পিস খুবই আনকমন ও মজার, তাই না?
অবশ্যই এক্সিলেন্সি। কিন্তু এক্সিলেন্সি, এই শো-পিস এখানে কোত্থেকে এলো, এ শো-পিস কোথায় ছিল? আহমদ মুসা বলল।
আহমদ মুসার কথায় প্রেসিডেন্টের চোখে-মুখে বিস্ময় মিশ্রিত জিজ্ঞাসার সৃষ্টি হলো। বলল, এই অ্যান্টিকস হলো এ ধরনের শো-পিসের জন্যে ভালো জায়গা। এখানে না হলে অন্য আর কোথাও কি থাকা উচিত বলে তুমি মনে। কর?
যেখানে এটা ছিল, সেখানেই এটা থাকা উচিত ছিল। বলল আহমদ। মুসা।
ভ্রু কুঞ্চিত হলো প্রেসিডেন্টের। গভীর একটা গাম্ভীর্য নামল প্রেসিডেন্টের। চোখে-মুখে।
প্রেসিডেন্ট তাকাল হল-এর মাঝামাঝি একটা টেবিলের দিকে। চোখ ফিরিয়ে তাকাল সে পেছনে দাঁড়ানো তার পিএর দিকে। বলল, মাঝের ঐ। টেবিলে দেখ ড. ডা। ওঁকে আমার সালাম দাও। আর এ টেবিলের পাশে। একটা চেয়ার দাও।
পিএ ছুটে গিয়ে চেয়ার এনে টেবিলের পাশে দিয়ে ড. ডার দিকে ছুটল।
ড. ডা এলো। প্রেসিডেন্ট তাকে ইঙ্গিতে চেয়ারে বসতে বলল।
ড. ডা, আহমদ মুসার সাথে গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয়ে আমি আলাপ করছি। এখানে আপনার উপস্থিতি দরকার।।
থামল একটু প্রেসিডেন্ট। পরে ড. ডাকে দেয়ালে রাখা গাছের প্রাচীন শো-পিসটি দেখিয়ে বলল, মি. আহমদ মুসা বলছেন, এখানে শো-পিসটা থাকার কথা নয়। যেখানে এটা ছিল, সেখানেই থাকা উচিত ছিল। আমি বিষয়টা তো জানি না। আমাদের অ্যান্টিকস যাদুঘরের কিউরেটর সি চ্যাং আন্টিকসগুলো সিলেকশন করেছে এবং আপনাকে দেখিয়ে আপনার অনুমতি নিয়ে এগুলোর স্থানান্তর করেছে। প্রেসিডেন্ট অফিসের চীফ ডিজাইনার তা থেকে কিছু পছন্দ করে প্রেসিডেন্ট অফিসের জন্যে নিয়ে এসেছে। শো-পিস নিয়ে মি. আহমদ মুসার বিস্ময় দেখে আমার বিস্ময় লাগছে। বিশেষ করে
অন্য কোথাও থেকে তুলে আনা হয়েছে শো-পিসটা, আহমদ মুসার এই কথা। আমাকে দারুণ অবাক করেছে। এ নিয়ে তার সাথে কথা বলার জন্যে। আপনিই উপযুক্ত ব্যক্তি। আমাদের বিস্ময় দূর করুন। আহমদ মুসা অহেতুক কোনো বিষয় নিয়ে মাথা ঘামায় না। আহমদ মুসার কথার মধ্যে বড় কিছু থাকতে পারে। প্রেসিডেন্ট থামল।
ইয়েস এক্সিলেন্সি, এটাই ঘটনা। বলল ড. ডা।
কথাটা বলেই ড. ডা তাকাল আহমদ মুসার দিকে। বলল, মি, আহমদ মুসা গাছের শো-পিসটি অন্য কোথাও থেকে তুলে আনা হয়েছে, এ কথা আপনার মনে হলো কেন?
স্যার, এ শো-পিসে এমন সব কথা আছে, এমন বিষয় আছে যা এই হল-এর সাথে মিলে না এবং যাকে শো-পিস বলা হচ্ছে তা আসলে শো-পিস নয়। আর এই স্টোনপ্লেটটি যেখানকার জন্যে তৈরি হয়েছে, সেটা এই হল। নয়। আহমদ মুসা বলল।
আপনার কথিত এ স্টোনপ্লেটটি কোথাও থেকে তুলে আনা হয়েছে বলে সত্যিই আপনি মনে করেন? বলল ড. ডা।
এই স্টোনপ্লেটটির বক্তব্য তাই বলে স্যার। আহমদ মুসা বলল।
ভ্রু কুঞ্চিত হলো ড. ডার। তার চোখে-মুখে কিছুটা বিব্রত ভাবও। টেবিলের সবার উপর একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে তাকাল সে প্রেসিডেন্টের দিকে।
এখানে আমরা সবাই নিজেরা। আপনি অগ্রসর হোন ড. ডা।
টেবিলের সবার চোখে একরাশ কৌতূহল, বিস্ময়। তাদের সবারই ভাবনা, শো-পিসটার মধ্যে বড় কোনো রহস্য আছে। তা না হলে প্রেসিডেন্ট ও ড. ডা এতটা সিরিয়াস হবেন কেন! আর শো-পিসটা সে রকম কিছু আহমদ মুসা ধরতে পারলেন কেমন করে? এটা যে অন্য কোথাও থেকে তুলে লাগানো হয়েছে, এটা আহমদ মুসা অতটা নিশ্চিত হয়ে বললেন কেমন। করে?
প্রেসিডেন্ট বলার পর ড. ডা তাকাল আহমদ মুসার দিকে। বলল, মি. আহমদ মুসা, আমি ভালো করে জানি, আপনি শতভাগ নিশ্চিত না হয়ে এভাবে কথা বলেন না। আপনি নিশ্চয় বুঝতে পেরেছেন স্টোনপ্লেটটি কোথা থেকে তুলে আনা হয়েছে? সেটা কোন স্থান বলে আপনি মনে করেন?
হ্যাঁ স্যার। এ স্টোনপ্লেট ফরবিডেন সিটির খনন করে উদ্ধার করা কুবলাই খান প্রাসাদের কোনো ঘর বা সিঁড়িমুখের দরজার পাশের দেয়াল অথবা সিঁড়ির দেয়াল থেকে তুলে আনা হয়েছে। বলল আহমদ মুসা।
রাজ্যের বিস্ময় নেমে এলো ড. ডার চোখে-মুখে। তাকাল সে প্রেসিডেন্টের দিকে। বলল, এক্সিলেন্সি মি. প্রেসিডেন্ট! মি. আহমদ মুসা একদম ঠিক বলেছেন। এ স্টোনপ্লেটটি কুবলাই খানের তিনতলা প্রাসাদের বটম ফ্লোর বা শেষ ফ্লোরের সিঁড়ির দরজার পাশের দেয়াল থেকে তুলে আনা হয়েছে।
বিস্ময় নেমে এলো প্রেসিডেন্টের চোখে-মুখে। তাকাল প্রেসিডেন্ট আহমদ মুসার দিকে। বলল, মি, আহমদ মুসা। আমি নিশ্চিত হয়েছি, আপনি ঘরে-বাইরে সবখানেই বলা যায় অজেয়। এর সাথে এখন বুঝছি। অদৃশ্য, অদেখা বিষয়েও আপনি যাদুকরী শক্তির অধিকারী।
এক্সিলেন্সি মি. প্রেসিডেন্ট, এই বিষয়ে আমার কোনো কৃতিত্ব নেই। স্টোনপ্লেটটি থেকে আমি যা জেনেছি, তাই আমি বলেছি।
কথাটা বলেই আহমদ মুসা তাকাল ড. ডার দিকে। বলল, স্যার কুবলাই খানের প্রাসাদ তিনতলা নয়, চারতলা। আর সিঁড়িমুখের দরজার পাশের যে দেয়াল থেকে স্টোনপ্লেটটা তুলে আনা হয়েছে, সেই দেয়ালটা সি ডিমুখের দরজা সংলগ্ন দেয়াল নয়। দেয়ালটা সিঁড়িমুখের আড়াই বা তিন ফুট ডান বা বামে চার পাঁচ ফুট ভেতরে ঢুকে যাওয়া। ঐ দেয়াল থেকে স্টোনপ্লেট খুলে আনা হয়েছে। থামল আহমদ মুসা।
ড. ডা এবং প্রেসিডেন্টের মুখ বিস্ময়ে হাঁ হয়ে গেছে। বিস্ময়ভরা কণ্ঠে প্রেসিডেন্ট বলল আহমদ মুসাকে, এটাও কি স্টোনপ্লেট আপনাকে বলেছে?
না এক্সিলেন্সি, স্টোনপ্লেটটির বিষয় এবং ড. ডার বক্তব্য থেকে এটা আমি অনুমান করেছি। বলল আহমদ মুসা।
ড. ডার চোখ-মুখ তখনও বিস্ময়-পীড়িত। বলল আহমদ মুসাকে, আমরা খনন করে কুবলাই খানের তিনতলা প্রাসাদটি পেয়েছি, ইতিহাসও তাই বলে। কিন্তু মি. আহমদ মুসা আপনি চারতলা বলছেন কেমন করে?
স্টোনপ্লেটটা থেকে আমি এটা জেনেছি। আর আমি মনে করি স্টোনপ্লেটটির কথাটাই ঠিক। বলল আহমদ মুসা।
প্রেসিডেন্ট, ড. ডাসহ টেবিলের সবারই চোখে-মুখে অপার বিস্ময়। তাকিয়ে আছে তারা আহমদ মুসার দিকে।
আসলে স্টোনপ্লেটটা কি? কি আছে তাতে? কেন এত গুরুত্ব দিচ্ছেন শো-পিস স্টাইল স্টোনপ্লেটটাকে আপনি? বলল ড. ডা।
আহমদ মুসা তাকাল প্রেসিডেন্টের দিকে।
বুঝল প্রেসিডেন্ট, আহমদ মুসা যা বলবে, সেটা বলার অনুমতি চায়। বলল প্রেসিডেন্ট, এখানে যারা আছেন, সবাই দেশের শীর্ষ ও দায়িত্বশীল ব্যক্তিত্ব। দেশের সবকিছু জানার অধিকার তাদের আছে।
এক্সিলেন্সি মি. প্রেসিডেন্ট, স্টোনপ্লেটটি নিছক একটা শো-পিস জাতীয় কিছু নয়। এটা আসলে অতি গুরুত্বপূর্ণ, অতি মূল্যবান একটা সংকেত-ধাঁধা।
একটু থামল আহমদ মুসা।
আহমদ মুসা থামতেই প্রেসিডেন্ট বলে উঠল, সংকেত ধাঁধা? কিসের সংকেত ধাঁধা?
এক্সিলেন্সি মি. প্রেসিডেন্ট, আপনি ভাগ্যবান। বিরাট এক পুরস্কার আল্লাহ আপনাকে, আপনার রাষ্ট্রকে দিয়েছেন। শত শত বছর আগে মাটির তলায় রেখে যাওয়া কুবলাই খানের অঢেল ধনভাণ্ডার আপনার হাতে আসছে। ঐ সংকেত ধাঁধাটি কুবলাই খানের ধনভাণ্ডারের রাজ্যে পৌঁছার এক সুস্পষ্ট আহব্বান। বলল আহমদ মুসা। ১ টেবিলে বজ্রপাত হলেও মনে হয় টেবিলের কেউ এতটা চমকে উঠতে, যতটা তারা চমকে উঠল আহমদ মুসার কথা শুনে। সবাই প্রবাদের মতো শুনেছে forbidden সিটিতে কুবলাই খানের বিশ্বের সর্ববৃহৎ ধনভাণ্ডারের মাটির তলায় চাপা পড়ে থাকার কথা। একে একটা মিথ বা রূপকথা বলে মনে করেছে সবাই। সেই রূপকথাই বাস্তবরূপে হাজির করল আহমদ মুসা!
প্রেসিডেন্টসহ সবাই বাকরুদ্ধ। তাদের সবার বিশ্বাস-অবিশ্বাসে ভরা দৃষ্টি আহমদ মুসার উপর নিবদ্ধ। কিছু সন্দেহের দোলায় সকলের মন দুললেও আহমদ মুসাকে অবিশ্বাস করা অসম্ভব মনে করছে সবাই।
নীরবতা ভেঙে প্রেসিডেন্টই বলল, সত্যিই আহমদ মুসা, তুমি যা বলছ। সেটা কি সত্য ঘটনা? জোয়ান উরা এবং যুগে যুগে মানুষ যা শুনে এসেছে, যা পাবার জন্যে মানুষ পাগলপারা হয়েছে, সেই ধনভাণ্ডার কি অবশেষে তোমার হাত দিয়ে চীনের মানুষের হাতে এসে ধরা দিল? প্রেসিডেন্টের কণ্ঠ যেন আবেগে কাঁপছিল।
প্রেসিডেন্ট থামতেই ড. ডা বলল, মি. আহমদ মুসা, আপনি যাকে সংকেত-ধাঁধা বলছেন, সেটা আমি ভালো করে দেখেছি। দেখার পরেই আমি যাদুঘর কিউরেটর ও অন্যদের উপস্থিতিতে প্রাচীন শো-পিস হিসাবে তুলে এনেছি। আমি ওতে একটা মজার গাছের প্রতিকৃতি ছাড়া তো আর কিছুই পাইনি। আপনি কী দেখে এত বড় সিদ্ধান্ত নিলেন বুঝতে পারছি না।
স্যার, আমি যা বুঝেছি তার সবটা আপনার বুঝতে পারার কথা নয়। কারণ কুবলাই খান যাদের দিয়ে সংকেত-ধাঁধা তৈরি করেছিলেন, তারা মুসলিম ছিলেন। তাই ধাঁধার সংকেত হিসাবে মুসলিম মাধ্যম ব্যবহৃত হয়েছে। কিন্তু কিছু তো আপনার বোঝার কথা ছিল। কারণ সংকেতে চাইনিজ মাধ্যমও ব্যবহার করেছে তারা। তবে সেটা জটিল আরবি ক্যালিওগ্রাফিক স্টাইলে। আহমদ মুসা বলল।
ড. ডার মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। বলল, মি. আহমদ মুসা আমার কৌতূহল সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে বিষয়গুলো জানার জন্যে।
আহমদ মুসা তাকাল প্রেসিডেন্টের দিকে। বুঝল প্রেসিডেন্ট আহমদ মুসার কথা। বলল, মূল কথাটাই এসে গেছে। আর কতটুকু বাকি আছে? বলতে পার। আমি মনে করি।
ধন্যবাদ এক্সিলেন্সি।
বলে একটু থামল আহমদ মুসা। পরক্ষণেই শুরু করল আবার, ধাঁধার সংকেতের যে নির্দেশনা সেটা আমি বলব সংকেত-ধাঁধার প্লেটটি তার জায়গায় সেট হবার পর। তখন সেটা বুঝা সহজ হবে। এখন আমি বলছি, এটা যে কুবলাই খানের ধনভাণ্ডারের সংকেত সেটা আমি কি করে বুঝলাম। গাছের শিকড়গুলোর দিকে ভালো করে দেখুন। অনেকটা জায়গা জুড়ে বহু শিকড় গুচ্ছাকারে একে অপরের সাথে জড়াজড়ি করে আছে আর বটমটা। ক্রমশ সরু হয়ে নিচে নেমে গেছে। শিকড়ের জড়াজড়িটা নিরর্থক নয়। শিকড়গুচ্ছের মাঝামাঝি স্থানে শিকড়গুলো জড়াজড়ি করে দুটি আরবি শব্দ তৈরি করেছে। শব্দ দুটি হলো মাল ও লিল্লাহ। একত্র করলে দাঁড়ায় মালে লিল্লাহে। যার অর্থ সম্পদ আল্লাহর। শিকড়গুচ্ছের আরও একটু নিচের দিকে, যেখানে শেকড়গুচ্ছ সরু হয়ে নিচে নামতে শুরু করেছে। সেখানে দুটি চাইনিজ শব্দ ক্যালিওগ্রাফিক স্টাইলে লেখা আছে। শব্দ দুটির একটি ছাইফু (Caifu), অন্যটি হলো শামিয়েন। দুই শব্দ একত্রিত করলে অর্থ দাঁড়ায় সম্পদ নিচে। আর একটি জিনিস খেয়াল করে দেখুন, গোটা শিকড়গুচ্ছটাই কুবলাই খানের দাড়ি। কুবলাই খানের দাড়ি বাস্তবিকই শিকড়গুচ্ছের বটমের মতোই সরু হয়ে তারের আকারে নিচে নেমে যাওয়া।
আহমদ মুসা থামল।
প্রেসিডেন্ট, ড. ডাসহ টেবিলের সকলের চোখ গাছের শিকড়গুচ্ছের উপর নিবদ্ধ। আরবি ও চাইনিজ শব্দের আকার তারা ক্যালিওগ্রাফিক জটিলতার মধ্যে বুঝতে পারছে না, কিন্তু কুবলাই খানের দাড়ির আকার তারা শিকড়গুচ্ছে সহজেই ধরতে পারল।
প্রেসিডেন্ট হেসে উঠে বলল, ঠিক মি. আহমদ মুসা, কুবলাই খানের মজার দাড়ির আকারের সাথে শিকড়গুচ্ছের আকার হুবহু মিলে যাচ্ছে। কিন্তু আরবি ও চাইনিজ শব্দ তোমার ক্যালিওগ্রাফিক জটিলতা থেকে উদ্ধার করা দেখছি আমার চোখের কাজ নয়। যাক মি, আহমদ মুসা, কুবলাই খানের ধনভাণ্ডার যে এই স্টোনপ্লেট, এ নিয়ে আর কোনো সন্দেহ নেই।
প্রেসিডেন্ট থামতেই ড. ডা বলে উঠল, আপনি আহমদ মুসা সত্যিই এক মিরাকল। বিধাতা যেন সব গুণ, সব যোগ্যতা আপনার মধ্যে ঢেলে দিয়েছেন। আপনার চোখের তারিফ করি এতটা দূর থেকে শো-পিসকে আপনি সন্দেহ করলেন কি করে? প্রশ্ন জাগল কি করে আপনার মনে?
ড. ডার কথা চলার সময় গোয়েন্দা প্রধান ডাই ডিং জিয়াং প্রেসিডেন্টের পেছনে এসে দাঁড়াল। তার হাতে একটা কাগজের শিট।
প্রেসিডেন্ট তার দিকে তাকাল। ড. ডার কথাও শেষ হয়ে গেল। বলুন মি. ডাই জিয়াং। প্রেসিডেন্ট বলল গোয়েন্দা প্রধানকে। গোয়েন্দা প্রধান ডাই ডিং জিয়াং এগিয়ে এসে তার হাতের কাগজটি প্রেসিডেন্টের দিকে তুলে ধরে বলল, এক্সিলেন্সি, আজকের চুক্তি সংক্রান্ত নিউজ রেডিও-টিভি চ্যানেলগুলোতে প্রচার হওয়ার পর দেশব্যাপী প্রাথমিক প্রতিক্রিয়ার একটা সার-সংক্ষেপ এতে আছে।
প্রেসিডেন্ট কাগজের শিটটি হাতে নিয়ে গোয়েন্দা প্রধান ডাই ডিং জিয়াংকে ধন্যবাদ দিয়ে বলল, আমি এটার জন্যে অপেক্ষা করছিলাম মি. ডাই জিয়াং।
গোয়েন্দা অ্যাটেনশন হয়ে একটা স্যালুট দিয়ে পেছনে সরে গেল!
প্রেসিডেন্ট কাগজের শিটটিতে নজর বুলিয়ে সকলের দিকে চেয়ে বলল, ঈশ্বরকে ধন্যবাদ। আমাদের সকলের জন্যে একটা বড় সুখবর যে, হুই উইঘুরদের সাথে চীন সরকারের চুক্তি ও একে সংবিধানের অন্তর্ভুক্ত করাকে দেশবাসী আনন্দের সাথে গ্রহণ করেছে। আমার মধ্যে একটু চিন্তা ছিল হানরা একে কতটা আন্তরিকতার সাথে গ্রহণ করে। দেশের সর্বত্র হানরা, নিউজটিকে আগ্রহের সাথে শুনেছে এবং নিউজ শোনার পর তাদেরকে আনন্দিত ও হাস্যোজ্জ্বল দেখা গেছে।
একটু থামল প্রেসিডেন্ট। তাকাল মা চু ইং ও ইরকিন আহমেদ ওয়াং এর দিকে। বলল, মি, মা চু ইং, মি. ওয়াং নিউজটি প্রচারিত হবার পর হুই ও উইঘুর অঞ্চলে তো আনন্দ মিছিল বেরিয়েছে। কোথাও কোথাও মিষ্টি বিতরণ হয়েছে।
আলহামদুলিল্লাহ! এক্সিলেন্সি, আমাদের মুসলিম জনগণের চাওয়া খুব বেশি নয়। নাগরিক হিসাবে তারা অন্য সকলের মতো সম্মান ও অধিকার চায় এবং চায় ধর্মীয় সংখ্যালঘু হিসাবে স্বাধীনভাবে নিজেদের ধর্ম পালন এবং স্বীয় ধর্মমত প্রকাশ-প্রচারের অধিকার। সেটা তারা পেয়েছে। এজন্যেই তাদের মধ্যে বাঁধভাঙা আনন্দ। এক্সিলেন্সি, ধন্যবাদ আপনাকে এবং আমাদের চীন সরকারকে। বলল উইঘুর নেতা ইরকিন আহমেদ ওয়াং।
ধন্যবাদ আমাকে নয় মি. ওয়াং। ধন্যবাদ দিন মি. আহমদ মুসাকে। এই অসাধ্যসাধন ও সাফল্য তার অনেক কষ্টের ফল। কতবার সে আহত হয়েছে, বারবার সে মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসেছে। অপরিশোধ্য এক ঋণে সে চীনকে বেঁধে ফেলেছে! প্রেসিডেন্টের কণ্ঠ আবেগ জড়িত।
তিনি আমাদের অংশ। আমরা গর্বিত তাঁর জন্যে। আল্লাহ তাঁকে দীর্ঘ হায়াতে কামেলা দান করুন। দুনিয়ার নির্যাতিত মানুষের খুব বেশি প্রয়োজন তাঁকে। বলল মা চু ইং। তার কণ্ঠ ভারি।
এক্সিলন্সি মি. প্রেসিডেন্ট, আমি অন্য একটা বিষয়ের দিকে আপনার দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। কুবলাই খান ধনভাণ্ডারের এই সংকেত-ধাঁধাটি এখনি সরিয়ে নেয়া দরকার। আর সংকেত-ধাঁধা নিয়ে যা করার তাড়াতাড়ি করলে ভালো হয়। আপনাদের কাউকেই আমি এখনও বলতে পারিনি এক্সিলেন্সি, আমাকে কালকেই চলে যেতে হচ্ছে। আহমদ মুসা বলল।
শেষ বাক্যটি আহমদ মুসার মুখ থেকে বের হবার সঙ্গে সঙ্গে সবার বিস্ময় দৃষ্টি আহমদ মুসার দিকে ছুটে এলো।
বলছ কি মি. আহমদ মুসা? এটা কি করে সম্ভব! তুমি আজ পর্যন্তও লড়াই-এর ময়দানে ছিলে। আমাদেরকে সময় দেবে না তুমি? বলল প্রেসিডেন্ট। একটা বিব্রত ভাব তার চোখে মুখে।
এক্সিলেন্সি, আকস্মিকভাবে এমন কথা বলা যৌক্তিক নয়। কথাটা তুলতে আমিও বিব্রত বোধ করেছি। কিন্তু একটা প্রয়োজনকে স্বীকৃতি দিতে গিয়েই কথাটা আমাকে এখন বলতে হয়েছে। আমি দুঃখিত এক্সিলেন্সি। আহমদ মুসা বলল।
ঠিক আছে মি. আহমদ মুসা। আমার বাসায় ফেং-এর সন্ধ্যার অনুষ্ঠানে তুমি যাচ্ছ। সেখানেই সব কথা হবে। এখন বল, এই মুহূর্তে সংকেত-ধাঁধা নিয়ে আমাদের করণীয় কি? বলল প্রেসিডেন্ট।
এ বিষয়টা ঠিক করা আপনাদেরই দায়িত্ব এক্সিলেন্সি। আহমদ মুসা বলল।
এক্সিলেন্সি মি. প্রেসিডেন্ট, অনুমতি দিলে আমি এ বিষয়ে কিছু বলতে চাই। বলল ড. ডা।
প্লিজ ড. ডা। প্রেসিডেন্ট বলল।
সংকেত-ধাঁধার কোড ভাঙা, ধনভাণ্ডার খুঁজে পাওয়া খুব জটিল বিষয়। এ ব্যাপারে আমরা যদি এগোতে চাই, তাহলে মি. আহমদ মুসার সাহায্য দরকার। অন্যদিকে আহমদ মুসার হাতে বেশি সময় নেই। সুতরাং আমি মনে করি, এ সময় অন্য কোনো জরুরি বিষয় যদি না থাকে এবং এক্সিলেন্সি যদি মনে করেন, তাহলে এখন আমরা সংকেত-ধাঁধার প্লেট কুবলাই খানের খনন করে পাওয়া প্রাসাদের যথাস্থানে নিয়ে রাখতে পারি। পরবর্তী কাজ মি. আহমদ মুসার নির্দেশনাতেই হবে। ড. ডা বলল।
ধন্যবাদ ড. ডা। আপনার পরামর্শ খুবই যৌক্তিক। আপনারা কাকে সাথে নিবেন, সেটা ড. ডা ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ঠিক করে ওখানে যাত্রা করুন। এ অভিযানের নেতৃত্ব দেবে মি. আহমদ মুসা। প্লিজ মি. আহমদ মুসা চীন সরকার তোমার সহযোগিতা চায়। বলল প্রেসিডেন্ট।
এক্সকিউজ মি এক্সিলেন্সি। আমার বিনীত একটা পরামর্শ, যেহেতু এটা অদেখা, অজানা, বেহিসাব ধনভাণ্ডার উদ্ধারের বিষয়, তাই এ অভিযান, কার্যক্রম দেখার জন্যে আপনার পুরো মন্ত্রিসভা ও পলিটব্যুরোর সদস্য হাজির থাকা উচিত। আহমদ মুসা বলল।
মনোযোগের সাথে শুনল প্রেসিডেন্ট আহমদ মুসার কথা।, কুঞ্চিত হয়ে উঠল তার।
মুখ তার গম্ভীর হয়ে উঠেছে। স্থির দৃষ্টি তার আহমদ মুসার দিকে। নীরব প্রেসিডেন্ট।
অন্য কারো মুখে কোনো কথা নেই। আহমদ মুসার প্রস্তাব নিয়ে তাদের মনে দোদুল্যমানতা। প্রস্তাবটি প্রেসিডেন্টের কাছে অবাঞ্ছিত মনে হতে পারে।
অবশেষে নীরবতা ভাঙল প্রেসিডেন্ট। প্রেসিডেন্টের ভাবলেশহীন গম্ভীর মুখ থেকে কথা বেরিয়ে এলো। বলল, মি. আহমদ মুসা, তুমি এত দূর পর্যন্ত চিন্তা করতে পার এবং এত দ্রুত? এই চিন্তাটা আমার করার কথা ছিল। কিন্তু মাথায় আসেনি। এখন মনে হচ্ছে বিরাট বাঁচা তুমি আমাকে বাঁচিয়েছ। তুমি যাকে বলেছ অদেখা, অজানা ও বেহিসাব ধনভাণ্ডার, সে ধনভাণ্ডার যদি কেন্দ্রীয় দায়িত্বশীলদের কাছে হঠাৎ হাজির করা হয়, তাহলে প্রকাশ্যে না হলেও তাদের মনের কোণে এমন জিজ্ঞাসা জাগতে পারে যে, বিশাল ধনভাণ্ডারের কিছুটা এদিক-সেদিক হয়নি তো!
একটু থেমেই প্রেসিডেন্ট আবার বলল, মি. আহমদ মুসা হঠাৎ তোমার মাথায় এই চিন্তাটা আসল কি করে?
হঠাৎ আসেনি এক্সিলেন্সি! এ বিষয়টা আমার মাথায় ছিল আমাদের প্রফেট মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর একটা ঘটনা থেকে। একদা আমাদের রাসুল (সা.) যুদ্ধলব্ধ অথবা রাষ্ট্রীয় কোষাগারের অর্থ বা সম্পদ প্রাপকদের মধ্যে বন্টন শেষে থলেটি তাদের সামনে ঝেড়ে দেখিয়েছিলেন। রাসুল (সা.)-এর উপর সব বিষয়েই সকলের অনড় আস্থা ছিল। তবুও তিনি সকলের সামনে থলে ঝেড়ে জানিয়ে দিয়েছিলেন যে, থলেতে কিছু অবশিষ্ট নেই। এটা তিনি এজন্যেই করেছিলেন যাতে শয়তান তাদের কারো মনে কোনো দিক দিয়েই কোনো প্রশ্ন সৃষ্টির সুযোগ না পায়।
প্রেসিডেন্টের চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। বলল, আহমদ মুসা, অনেক ধন্যবাদ তোমাকে। আমি আজ এক বিরাট শিক্ষা লাভ করলাম তোমার রাসুলের কাছ থেকে। জনগণের সম্পদ ম্যানেজমেন্টের অমূল্য এক দর্শন আমি পেয়ে গেলাম তাঁর কাছে।
এক্সিলেন্সি, তিনি মাত্র আমাদের রাসুল নন। এই পৃথিবীতে শেষ বার্তাবাহী হিসেবে তিনি সকল কালের সব মানুষের রাসুল। বলল আহমদ মুসা।
হাসল প্রেসিডেন্ট। বলল, আর এগোবে না আহমদ মুসা। ধীরে ধীরে খেলে ভালো হজম হয়।
বলেই প্রেসিডেন্ট তাকাল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দিকে। বলল, আপনি মন্ত্রিসভা ও পলিটব্যুরো সদস্যদের সবাইকে বলুন এখান থেকেই আমরা এখনি ফরবিডেন সিটির কুবলাই খান প্রাসাদে যাব। সবাই যেন প্রস্তুত থাকে। নি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে কথাটা বলেই প্রেসিডেন্ট তাকাল আহমদ মুসার দিকে। বলল, বলে তো ফেললাম এখনি যাব। তোমার কোনো অসুবিধা নেই তো?
আপনি সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছেন এক্সিলেন্সি। আমার কোনো অসুবিধা নেই। বলল আহমদ মুসা।
ধন্যবাদ মি. আহমদ মুসা।
বলেই প্রেসিডেন্ট তাকাল মা চু ইং ও ইরকিন আহমেদ ওয়াং-এর দিকে। বলল, মি. মা চু ও মি. ওয়াং যারা এখন কুবলাই খানের প্রাসাদে যাচ্ছেন, তাদের সাথে আপনারাও শামিল।
এক্সিলেন্সি মি. প্রেসিডেন্ট, ধনভাণ্ডারের বিষয় নিয়ে ওখানে আমাদের যাবার প্রয়োজনীয়তা কোনো দিক থেকেই আমরা দেখছি না। তবে প্রেসিডেন্টের আহবানকে আমরা নির্দেশ বলে মনে করি। ধন্যবাদ মি. প্রেসিডেন্ট। বলল মা চু ইং ও আহমেদ ওয়াং।
ওয়েলকাম। বলল প্রেসিডেন্ট। তারপর সকলের দিকে তাকিয়ে বলল প্রেসিডেন্ট, চলুন, আমরা উঠি।
আধাঘন্টার মধ্যে সবাই জমায়েত হলো প্রেসিডেন্টের মন্ত্রিসভা কক্ষে। সেখান থেকে সবাই যাত্রা করল বেইজিং-এর প্রায় মধ্যস্থলে অবস্থিত ফরবিডেন সিটিতে।
সবাইকে নিয়ে প্রেসিডেন্টের গাড়িবহর বিকেল তিনটায় গিয়ে পৌঁছল প্রাচীর ঘেরা প্রাচীন বেইজিং নগরীর মাঝখানে অবস্থিত ফরবিডেন সিটির কেন্দ্রবিন্দু খনন এলাকায়। এই ফরবিডেন বা নিষিদ্ধ নগরী তৈরি হয়েছে। মিং ডাইনেস্টির সময়ে। ১৪০৬ সালে নির্মাণ শুরু হয়ে শেষ হয় ১৪২০ সালে। ১৪ বছরে নির্মাণ শেষ হয়। ১৮০ হেক্টর জায়গার উপর তৈরি হয় ৯৮০টি বিল্ডিং। মিং ও কিং ডাইনেস্টিসহ দুই ডজনেরও বেশি সম্রাটের রাজধানী ছিল এই নিষিদ্ধ নগরী। এই নিষিদ্ধ নগরীর নিচেই ছিল কুবলাই খানের রাজধানী এবং তার প্রাসাদ। কুবলাই খান চীনের ইউয়ান ডাইনেস্টির প্রতিষ্ঠাতা। ত্রয়োদশ শতকে তার রাজধানী ও প্রাসাদ নির্মিত হয়। সে ছিল মোংগল বংশোদ্ভূত। মধ্য এশিয়ার মুসলমানদের সাথে ছিল তার গভীর সম্পর্ক। তার শাসনকালে সে ৪০ লাখ মুসলমানকে চীনে নিয়ে আসে। তার রাজধানী ও প্রাসাদ নির্মাণের প্রধান দায়িত্ব পালন করে মুসলিম স্থপতিরাই। তাঁর রাজধানীর নাম ছিল খান বালিক যা এখন বেইজিং নগরীর কেন্দ্রে অবস্থিত নিষিদ্ধ নগরী। তার খান বালিকের বাড়িগুলো এবং প্রাসাদের ডিজাইন করে ঈদগার (Idgar) ওরফে ইখতিয়ার আলদিন। ২০১৪ সালে নিষিদ্ধ নগরীর নির্মাণশৈলীর ইতিহাস সংগ্রহ করার জন্যে খনন কাজ করতে গিয়ে কুবলাই খানের প্রাসাদ ও তার রাজধানী আবিষ্কৃত হয়।
প্রেসিডেন্ট তার মন্ত্রিসভা, পলিটব্যুরোসহ সবাইকে নিয়ে হাজির করল খনন করে বের করা কুবলাই খানের প্রাসাদে। তাদের গাইড করছিল, পথ দেখচ্ছিল ড. ডা।
আহমদ মুসা আগেই বলেছিল, সংকেত-ধাঁধাটি যেখান থেকে তোলা হয়েছে, সেখান থেকেই প্রাসাদের বটম লেয়ার শুরু এবং যে দেয়ালে সংকেত-ধাঁধাটি লাগানো ছিল, সেটাই বটম লেয়ারে নামার সিঁড়ির দরজা বলে আমি মনে করি।
ড. ডা সবাইকে নিয়ে পৌঁছল সংকেত-ধাঁধা তোলা হয়েছে যেখান থেকে, সেই স্থানটায়।
সংকেত-ধাঁধা, যেখান থেকে তোলা হয়েছে আহমদ মুসা ভালোভাবে পরীক্ষা করল দেখার জন্যে যে, সেখানে দরজা খোলা বা দেয়াল সরানোর কোনো কৌশল আছে কি না। কিন্তু কিছুই পেল না।
বটম লেয়ারের টপে নেমে আসা সিঁড়ির পাশে মূল দেয়ালের চার পাঁচ ফিট ভেতরে ঢুকে পড়া যে ৭ ফুট উঁচু ও পাঁচ ফিট প্রশস্ত দেয়ালে সংকেত ধাঁধার প্লেট লাগানো ছিল, সে গোটা দেয়াল পরীক্ষা করল আহমদ মুসা। সেখানেও সন্দেহ করার মতো কিছু পেল না।
সবাই আহমদ মুসার কাজ দেখছে।
প্রেসিডেন্টসহ তাদের চোখে-মুখে কৌতূহলের সাথে উদ্বেগও। আহমদ মুসা যা খুঁজছে যে পাচ্ছে না, সবাই তা বুঝতে পারছে।
আহমদ মুসা দেয়ালটা দেখা শেষ করে পেছনে তাকিয়ে ড. ডাকে বলল, স্যার, ত্রয়োদশ শতকে নিশ্চয় দরজা খোলা ও বন্ধের কোনো স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থা চালু হয়নি?
অবশ্যই না, মি. আহমদ মুসা। বটম লেয়ারে নামার দরজা এখানেই আছে বলে কি আপনি মনে করেন? বলল ড. ডা।
হিসাব তাই বলে স্যার। বলে আহমদ মুসা ফিরল দেয়ালটার দিকে আবার। আহমদ মুসার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ঘুরতে লাগল দেয়ালটির উপর বারবার।
দেয়ালটি পাথরে পাথরে জোড়া লাগানো এবং দেয়ালটিকে মজবুত ও দীর্ঘস্থায়ী করার জন্যে কোনো বিশেষ উপাদান যোগ করা হয়েছে কিনা তা বলা মুশকিল, তবে হাত দিয়েই বুঝতে পারল আহমদ মুসা দেয়াল যথেষ্ট শক্ত। কিন্তু সংকেত-ধাঁধার প্লেট সাইজ অনুসারে ভারি নয়। হতে পারে দেয়াল এমন উপাদানেই তৈরি, যা মজবুত, কিন্তু সেই অনুসারে ভারি নয়।
আহমদ মুসার চোখ তখন ঘুরছিল দেয়ালটির টপ বরাবর। হঠাৎ তার চোখ আটকে গেল টপ-শীর্ষের একই সমান্তরালে সমদূরত্বে থাকা এক ডলার কয়েন-এর সমান গোলাকার তিনটি স্থানের উপর। তিনটি স্থানের দুটি টপ-শীর্ষের দুই প্রান্তে এবং তৃতীয়টি উপ-শীর্ষের ঠিক মধ্যখানে। গোলাকৃতির মধ্যকার ধরনটা ঠিক দেয়ালের গায়ের মতো নয়, সরু কোনো টিউব। বালি ভর্তি করলে যেমন হয় ঠিক সেই রকম।
আহমদ মুসার চোখ দুটি উজ্জ্বল হয়ে উঠল।
পেছন ফিরল সে। চারদিকে তাকাল। তার চোখ কিছু খোঁজ করছিল। অবশেষে ড. ডার দিকে চেয়ে বলল, স্যার, দুই ফুট উঁচু পাথর বা কোনো কিছু আমার দরকার।
ড. ডা কিছু বলার আগেই প্রেসিডেন্ট তাকাল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দিকে। বলল, দেখুন, কাউকে পাঠান এ ধরনের কিছু নিয়ে আসতে।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ছুটল।
প্রেসিডেন্ট তাকাল আহমদ মুসার দিকে। বলল, মি. আহমদ মুসা, কিছু কি পাওয়া গেছে? প্রেসিডেন্টের চোখে আশার আলো।
পাইনি এক্সিলেন্সি, তবে অনুমান করছি। বলল আহমদ মুসা।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ফিরে এলো দেড় দুই ফুট উঁচু একটা সুন্দর পাথরখণ্ড নিয়ে। বলল, কাছেই পেয়ে গেছি এক্সিলেন্সি।
আপনি কষ্ট করতে গেলেন কেন? উপরে লোক তো রয়েছেই। বলল প্রেসিডেন্ট স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে লক্ষ করে।
ডাকাডাকি করতে গেলে দেরি হবে এক্সিলেন্সি। আমি সময় নষ্ট করতে চাইনি। বলল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।
আহমদ মুসা পাথরটি তুলে নিতে যাচ্ছিল। ছুটে গেল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। পাথরটি নিজে তুলে নিয়ে বলল, আপনার অনেক পরিশ্রম হচ্ছে। আমাদের কিছু করতে দিন।
ধন্যবাদ মি. নিকোলাস লিয়াংগ। বলল আহমদ মুসা।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পাথরটি নিয়ে দেয়ালের গোড়ায় ভালোভাবে সেট করল।
আহমদ মুসা তার ব্যাগের পকেট থেকে ৬ ইঞ্চির মতো লম্বা ভাঁজ করা শক্ত, মোটা একটা তামার তার বের করে পাথরের উপর গিয়ে দাঁড়াল। মাঝের বালি ভর্তি টিউবের মতো স্থানটিতে ঢুকিয়ে দিল তামার তার। অনুভব করল ভেতরটা বালি ভরা মনে হলেও বেশ শক্ত। আবার ভাবল, লক্ষ লক্ষ বছরের ব্যবধানে বালি পাথর হয়ে যায়, শত শত বছরের ব্যবধানে বালি তো কিছু শক্ত হবেই। তামার তারের শক্ত ও অব্যাহত আঘাতে বালির ছোট ছোট দলা বেরিয়ে আসতে লাগল। এক সময় সব বালিই বেরিয়ে এলো। তামার শক্ত তার কিছুতে গিয়ে আঘাত করল। চমকে উঠল আহমদ মুসা, এই আঘাত বালি কিংবা কংক্রিটের উপর আঘাতের মতো নয়! আহমদ মুসা টিউবের মতো ছিদ্রের গোটা তলটা ভালোভাবে পরিষ্কার করার চেষ্টা করল। আরও কিছু বালি বেরিয়ে এলো। এবার আহমদ মুসা তামার তারের ভেতরের প্রান্তটাকে খুব আস্তে শক্ত বস্তুটার উপর ঘুরিয়ে নিতে লাগল। আহমদ মুসা অনুভব করল শক্ত বস্তুর মসৃণ তলটা মসৃণ নয়। মাঝে মাঝেই তামার তারের শীর্ষটা আটকে যাচ্ছে। এই আটকে যাওয়ার ব্যাপারটা আহমদ মুসা আরও সুস্পষ্টভাবে বুঝার জন্যে শক্ত বস্তুটার একটা স্থানকে স্টার্ট পয়েন্ট ধরে তারের মাথা আস্তে আস্তে ঘুরিয়ে স্টার্ট পয়েন্টে নিয়ে গেল। এবার নিশ্চিত বুঝল আটকে যাওয়ার স্থান চারটি। হঠাৎ একটা চিন্তা আহমদ মুসার মাথায়। ঝিলিক দিয়ে উঠল, শক্ত বস্তু কি কোনো বড় ধরনের পেরেকের মাথা? এই চিন্তা মাথায় আসতেই আনন্দে মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল আহমদ মুসার। পেছনে ফিরে তাকিয়ে বলল প্রেসিডেন্টকে, এক্সিলেন্সি, ডলার কয়েন আকারের এই ছিদ্রে ঢুকতে পারে এমন ক্রু-ড্রাইভার প্রয়োজন।
প্রেসিডেন্ট তাকাল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দিকে, তারপর ড. ডার দিকে।
এক্সিলেন্সি, ইঞ্জিনিয়ারিং টুলস কিটসে সবই পাওয়া যাবে। আমাদের প্রজেক্ট অফিসেই এটা আছে। আমি টেলিফোন করে দিচ্ছি। বলল ড. ডা। ক ধন্যবাদ ড. ডা। প্রেসিডেন্ট বলল।
প্রেসিডেন্টকে একটা বাউ করে টেলিফোন করল। বলল প্রেসিডেন্টকে, এক্সিলেন্সি, টুলস কিটস এখনি আসছে।
এদিকে আহমদ মুসা টপ-শীর্ষের দুই প্রান্তের বালি ভর্তি ছিদ্র থেকে বালি বের করা শুরু করে দিয়েছে।
টুল কিটস আসার আগেই দুটি প্রান্তের ছিদ্র থেকে বালি বের করা হয়ে গেল। আহমদ মুসা নিশ্চিন্ত হলো যে, দুই প্রান্তের ছিদ্রের তলাতেও নিশ্চয় পেরেকের মতো খাঁজ কাটা শক্ত মাথার বস্তু রয়েছে।
আহমদ মুসার মাথায় এখন নতুন চিন্তা। সংকেত-ধাঁধার এ দেয়ালের মাথায় একই সমান্তরালে তিনটি পেরেক কেন? পেরেক তিনটি কি এ দেয়াল কোনো কিছুকে আটকে রেখেছে? পেরেক তো খোলার জন্যেই। পেরেক খুললে দেয়াল এখান থেকে সরে যাবে বা পড়ে যাবে? এ দেয়ালটি কি সিঁড়ি মুখে? দেয়াল সরলেই কি বটম লেয়ারে পৌঁছার সিঁড়ি পাওয়া যাবে? আহমদ মুসার এই চিন্তার বাইরে আর কোনো বিকল্প পেল না। টুলস কিটস নিয়ে এলো প্রজেক্টের চীফ ইঞ্জিনিয়ার।
আহমদ মুসা তাকে ডেকে নিয়ে দেয়ালের শীর্ষে তিনটি ছিদ্র দেখিয়ে বলল, ছিদ্রগুলোর তলায় পেরেক আছে বলে অনুমান করছি। পেরেক তিনটি খুলে নেয়া দরকার। সে রকম ক্রু-ড্রাইভার আপনার কিটসে আছে। কি না।
ইঞ্জিনিয়ার পাথরের উপরে উঠে ছিদ্র পরীক্ষা করল।
বলল ইঞ্জিনিয়ার, স্যার, এই ছিদ্রে প্রবেশ করানোর মতো ভ্রু-ড্রাইভার আছে। কিন্তু ভেতরের পেরেকের মাপ এবং পেরেকের খাঁজগুলোর মাপ জানতে হবে সঠিক ভ্রু ড্রাইভার সিলেকশনের জন্যে।
মি, ইঞ্জিনিয়ার, আপনি ঠিকই বলেছেন। তবে আমার মনে হয়, শত শত বছর আগে যারা আগামীর কোনো এক সময়ের কথা চিন্তা করে এই প্রকল্পের জন্যে পেরেক তৈরি করেছিলেন, তারা পেরেকগুলোর খাজকে নিশ্চয় ফ্রি সাইজ করেছেন। সুতরাং ছিদ্র দিয়ে যে ক্রু-ড্রাইভার ঢুকবে, সে
ক্রু-ড্রাইভার দিয়েই কাজ চলবে। বলল আহমদ মুসা।
ইঞ্জিনিয়ারের চোখে বিস্ময় দৃষ্টি! বলল, ধন্যবাদ স্যার। আপনি একদম ঠিক বলেছেন। অতটা গভীর চিন্তা আমি করিনি স্যার।
প্লিজ, আপনি এখন স্কু-ড্রাইভার দিয়ে পেরেকটাকে একটু পরীক্ষা করে দেখুন। কিন্তু তার আগে ছিদ্রপথে আলো ফেলে ভেতরের পেরেকটাকে দেখা প্রয়োজন। আমার মনে হয়, অনির্দিষ্ট কাল ব্যবহারের জন্যে যে পেরেক ব্যবহৃত হয় তা লোহার হয় না। বলল আহমদ মুসা।
ঠিক স্যার।
বলে একটু থামল ইঞ্জিনিয়ার। ভাবল। আহমদ মুসার দিকে তাকিয়ে বলল, স্যার এখানে আমার কাছে বা টুল কিটস-এ টর্চ নেই। আমাকে তাহলে ফিরতে হবে আমার অফিসে।
দরকার নেই ইঞ্জিনিয়ার, আমার ব্যাগে আছে।
বলে আহমদ মুসা ব্যাগ থেকে বের করে একটা পাওয়ারফুল পেন্সিল টর্চ ইঞ্জিনিয়ারের হাতে দিল।
থ্যাংকস স্যার! বলে পেন্সিল টর্চ ও স্ক্রু ড্রাইভার নিয়ে দৌড় দিল তিন ছিদ্রের মাঝের ছিদ্রটার দিকে।
আহমদ মুসাও এগোলো তার পেছনে পেছনে। ছিদ্রে আলো ফেলে পরীক্ষা করার পর আহমদ মুসার দিকে তাকিয়ে বলল, স্যার, আপনি ঠিকই বলেছেন, পেরেক লোহার নয়, পিতলের।
আলহামদুলিল্লাহ। এখন মি. ইঞ্জিনিয়ার আপনি আল্লাহর নাম নিয়ে ক্রু-ড্রাইভার দিয়ে পেরেকটাকে ট্রাই করুন। আমার মনে হয় পেরেকটাকে খুব হার্ড করে নয়, লুজ করেই রাখা হয়েছে।
থেমেই আবার সঙ্গে সঙ্গে কথা বলে উঠল আহমদ মুসা, আরেকটা কথা ইঞ্জিনিয়ার প্রথমে ডান প্রান্তের ছিদ্রে হাত দেন। তারপর বাম প্রান্ত এবং শেষে মাঝের ছিদ্রে কাজ করবেন।
ডান প্রান্তের ছিদ্রে কাজ শুরু করল ইঞ্জিনিয়ার।
পেরেকের উপর ভ্রু-ড্রাইভার ভালোভাবে সেট করার পর পরীক্ষামূলকভাবে ক্রু-ড্রাইভারকে বামদিকে চাপ দিল জোরের সাথে। অনড় হলে বা খুব শক্ত হলে ভ্রু-ড্রাইভার ধরা হাত যতটা ধাক্কা খায়, এক্ষেত্রে তা হলো না। মনে হলো, পেরেকটা যেন শতশত বছরের নিদ্রা থেকে জেগে উঠল। একটু স্থানচ্যুতও হলো যেন। দ্বিতীয় চেষ্টাতেই ঘুরে। গেল পেরেক।
আহমদ মুসা আলহামদুলিল্লাহ বলে আল্লাহর শুকরিয়া জানাল এবং ধন্যবাদ দিল ইঞ্জিনিয়ারকেও।
স্যার, আপনার অনুমান শতভাগ সত্য হয়েছে। আমার মনে হচ্ছে। স্যার, ওরা পেরেক প্রথমবার লাগিয়ে খুলে ফেলে দ্বিতীয়বার লাগায় এবং প্রথমবার যে পর্যন্ত পেরেক ঢুকিয়েছিল, দ্বিতীয় বার পেরেক সে পর্যন্ত পৌঁছায়নি। ফলে গোটা পেরেকটাই লুজ অবস্থায় ছিল। বলল ইঞ্জিনিয়ার।
মি, ইঞ্জিনিয়ার এই পেরেক তো খোলার জন্যেই লাগানো হয়েছে। বলে আহমদ মুসা তাকাল প্রেসিডেন্টের দিকে। বলল, এক্সিলেন্সি, আমরা আমাদের কাজের বিপজ্জনক পর্যায়টা বোধ হয় অতিক্রম করতে যাচ্ছি। খুব ভয় ছিল পেরেকগুলো খোলা শেষ পর্যন্ত যাবে কিনা। আল্লাহ আমাদের সাহায্য করেছেন। একইভাবে সবগুলো পেরেকই খুলে যাবে ইনশাআল্লাহ।
প্রেসিডেন্ট সহ সকলেরই মুখ উজ্জ্বল হলো খুশিতে।
ধন্যবাদ আহমদ মুসা। আমরা শুধু আপনার কাজ দেখছি, তেমন। কিছুই বুঝতে পারছি না। পেরেকগুলো খুললে কি দেয়াল সরে যাবে, দরজা উন্মুক্ত হয়ে যাবে? আমরা নিচে নামার সিঁড়ি পেয়ে যাব? বলল প্রেসিডেন্ট।
আমি তাই মনে করছি এক্সিলেন্সি। আহমদ মুসা বলল।
আরেকটা কথা মি, আহমদ মুসা, আপনি প্রথমে দুই প্রান্তের, শেষে মাঝের পেরেক খুলতে বললেন কেন? বলল প্রেসিডেন্ট।
এক্সিলেন্সি, যদি দেয়ালটা দরজা হয়, তাহলে পেরেক খোলার পর দরজা বা এই দেয়াল না বামে সরবে, না নিচে পড়বে আমরা জানি না। ডানে কিংবা বামে যদি সরে, তাহলে যেকোনো পেরেক আগে-পিছে। খুললে ক্ষতি নেই। কিন্তু যদি নিচে পড়ে, তাহলে একপাশের দুই পেরেক খুললে দরজা বা দেয়াল স্কুলে যেতে পারে। তাতে নতুন কোনো সমস্যা সৃষ্টি হতে পারে। আর..।
আহমদ মুসার কথার মধ্যেই প্রেসিডেন্ট বলে উঠল, বুঝেছি আহমদ মুসা, দুই প্রান্তের পেরেক যদি আগে ভোলা হয়, তাহলেও হয়তো দেয়াল পড়বে না, মাঝের পেরেকে ভর করে সমানভাবে দাঁড়িয়ে থাকবে।
হাসতে হাসতেই বলল প্রেসিডেন্ট। একটু থামল প্রেসিডেন্ট। তার মুখ গম্ভীর হলো। বলল, ধন্যবাদ আহমদ মুসা। এত সূক্ষ্ম, এত দূরের কথা চিন্তা করার লোক ঈশ্বর পৃথিবীতে দুচারজনই সৃষ্টি করেন।
এক্সিলেন্সি, আল্লাহ তার সেরা সৃষ্টি প্রতিটি মানুষকে অসীম সম্ভাবন মিয় করে সৃষ্টি করেছেন। তাদের পছন্দ ও অনুশীলনের উপর এই সম্ভাবনার প্রকাশ অনেকটাই নির্ভরশীল। বলল আহমদ মুসা।
বলেই আহমদ মুসা তাকাল ইঞ্জিনিয়ারের দিকে।
দুই প্রান্তের পেরেক খোলা হয়ে গেছে।
আহমদ মুসা তাকাল মাঝের পেরেকের দিকে এবং তাকাল দেয়ালের দুই প্রান্তের মাথার দিকে। দেখল, দেয়ালের দুই প্রান্তই কিঞ্চিৎ নেমে। গেছে। চাপ বেড়ে গেছে মাঝের পেরেকটার উপর। দেয়ালে হাত দিয়ে চাপ দিলেই বোঝা যাচ্ছে দেয়ালটি ঝুলন্ত।
মি. ইঞ্জিনিয়ার, আপনি মাঝের পেরেকটার মাঝামাঝি পর্যন্ত আসার আগেই খুব আস্তে খুলতে থাকুন। আমার মনে হয়, এই দেয়াল বা দরজার ওপারে যে শেলটারে পেরেক আটকে আছে, সেটা থেকে পেরেক বেরিয়ে আসার আগেও পেরেক ভেঙে নিয়ে দেয়াল পড়ে যেতে পারে।
ধন্যবাদ স্যার, এটাই ঘটবে। বলল ইঞ্জিনিয়ার। মাঝের পেরেকটা ভোলা চলছিল।
আহমদ মুসা ইঞ্জিনিয়ারের পেছনে গিয়ে দাঁড়াল। পেরেকের অর্ধেকটা তখনও খোলা হয়নি। অকস্মাৎ বজ্র পতনের মতো, কিন্তু অনেকটা নিঃশব্দে, দেয়ালটি নিচে পড়ে গেল। ভ্রু-ড্রাইভার তখনও দেয়ালের ভেতরে এবং তার বাট ইঞ্জিনিয়ারের ডান হাতে। তার বাম হাতটি ছিল ছিদ্রের পাশে দেয়ালে। দেয়াল পড়ার সাথে ইঞ্জিনিয়ারের দেহটিও দুলে উঠেছিল। সঙ্গে সঙ্গেই আহমদ মুসা তাকে দুহাত দিয়ে পেছনে টেনে নিয়েছিল।
ইঞ্জিনিয়ারের চোখে-মুখে তখন আতঙ্কের চিহ্ন। সে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে গিয়ে আহমদ মুসাকে একটা লম্বা বাউ করে বলল, স্যার, নিশ্চিতই আমি পড়ে যেতে লেগেছিলাম। এতটা আকস্মিকভাবে ঘটনা ঘটবে আমি বুঝতে পারিনি। ঘটনার এই আকস্মিকতায় আমি দেহের ভারসাম্য হারিয়ে ফেলছিলাম। আমাকে টেনে নিয়ে পতন থেকে আপনি আমাকে রক্ষা করেছেন।
ইঞ্জিনিয়ারের কথা আহমদ মুসার কানে যাচ্ছিল। কিন্তু তার চোখ ছিল সামনে, মনোযোগও ছিল সামনে।
দেয়ালটা যতটা প্রশস্ত ততটাই প্রশস্ত একটা সিঁড়ি সামনে, নিচে অন্ধকারের দিকে নেমে গেছে।
সবার কৌতূহল ভরা চোখ সামনে, সিঁড়ির দিকে, অন্ধকারের দিকে।
ড. ডা এসে হ্যান্ডশেক করল আহমদ মুসার সাথে। বলল, মি. আহমদ মুসা, আপনি সত্যিই অনন্য।
প্রেসিডেন্ট বলল, ধন্যবাদ মি. আহমদ মুসা। বল, এখন কি। করণীয়।
এক্সিলেন্সি, এখন গ্যাস মাস্ক পরে আলো নিয়ে ভেতরে নামা যায়। অথবা ভেতরের বাতাস, গ্যাস বের করে দিয়ে ফ্রেশ বাতাস ভেতরে নিয়ে তারপরে প্রবেশ করা যায় নিচের বটম লেয়ারে। বলল আহমদ মুসা।
প্রেসিডেন্ট তাকাল ড. ডা এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দিকে।
আমি ব্যবস্থা করছি এক্সিলেন্সি। বলে ইঞ্জিনিয়ারকে ডেকে সাথে নিয়ে বাইরে ছুটল ড. ডা।
আধাঘন্টার মধ্যে চতুর্থ লেয়ারের বাতাস ক্লিন হয়ে গেল। বাইরে থেকে বিদ্যুৎ সংযোগ নেয়া হলো চতুর্থ লেয়ারে।
বহু শতাব্দীর জমাট অন্ধকারের বুকে আলো জ্বলে উঠল। প্রেসিডেন্টসহ সবাই তখন আলোকোজ্জ্বল সিঁড়িতে। সকলের চোখ নিচে বটম লেয়ারের বিশাল হলঘরে ঘুরছে। সিঁড়ি থেকে হলঘরের একটা অংশ দেখা যাচ্ছে। দেখা যাচ্ছে, হলঘরে সারি সারি বিশাল বিশাল সিন্দুক।
হলঘরের মধ্যে এখন নামা যেতে পারে এক্সিলেন্সি মি. প্রেসিডেন্ট। বলল আহমদ মুসা।
ইয়েস এক্সিলেন্সি, কোনো অসুবিধা নেই, আমি হলঘরটা চেক করেছি। বলল ইঞ্জিনিয়ার।
মি. আহমদ মুসা তুমি ড. ডাকে নিয়ে এ ঐতিহাসিক অভিযানে নেতৃত্ব দাও, প্লিজ। তোমার ভাগ্য আমাদের সৌভাগ্যবান করেছে। প্রেসিডেন্ট বলল।
ড. ডাকে নিয়ে আহমদ মুসা পা বাড়াল সামনে। হল-এ নেমে এলো সবাই।
দেখা গেল সিঁড়িটা বিশাল হলঘরের মাঝে। সিঁড়ির চারদিকেই বিস্তৃত। হলঘর। আর হলভর্তি শত নয়, হাজারো সিন্দুকের অসংখ্য সারি।
এক্সিলেন্সি মি. প্রেসিডেন্ট, হলঘরটা নিষিদ্ধ নগরীর বিশাল সাইট জুড়ে রয়েছে। বলল ড. ডা।
তাই হবে ডক্টর। পিলারই দেখছি কয়েক শত হবে। প্রেসিডেন্ট বলল।
আহমদ মুসা তখন হলঘরের দেয়ালের এখানে-সেখানে কিছু পরীক্ষা করছিল। হল-এর চারদিকের পাথরের দেয়ালে বড় বড় বর্গক্ষেত্র তৈরি করা। বুঝা যায় পাথরের দেয়াল কেটে এ সব বর্গাকার নকশা তৈরি করা হয়েছে। কিন্তু আহমদ মুসার মনে শুরুতেই প্রশ্ন জেগেছিল, শুধুই কি দেয়ালের গায়ে বর্গাকার নকশা তৈরির জন্যে এত পরিশ্রম করা হয়েছে? আহমদ মুসা বাস্তব হিসাবে একে মেনে নিতে পারেনি। মনের এই অস্বস্তি দূর করার জন্যেই আহমদ মুসা দেয়াল পরীক্ষা করছিল। প্রথম বর্গক্ষেত্রটি পরীক্ষা করতে গিয়েই আহমদ মুসা দেখতে পেল, বর্গক্ষেত্রের টপের মাঝ বরাবর হাফ ইঞ্চি নিচে এবং বটম রেখার মাঝ বরাবর হাফ ইঞ্চি উপরে কালো দেয়ালে ক্ষুদ্র গোলাকার দুটি জায়গা, যা মূল দেয়ালের অংশ নয়। মনে হচ্ছে, দেয়ালে কোনো খুঁত থাকায় পরে পাস্টার করে তা বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। কিন্তু আহমদ মুসা তখন পাশের বর্গক্ষেত্রে। তার পাশের বর্গক্ষেত্রেও যখন একই দৃশ্য দেখল, তখন তার সন্দেহ দানা বেঁধে উঠল। দেয়ালের অন্য এক স্থানের বর্গক্ষেত্র পরীক্ষা করে একই জিনিস পেল আহমদ মুসা। বিপরীত দিকের দেয়ালে গিয়েও আহমদ মুসা একই দৃশ্য দেখল। আরেকটা ব্যাপার আহমদ মুসা লক্ষ করল, বর্গক্ষেত্রের মাঝ বরাবরে এক্সট্রা প্লাস্টারের মতো গোলাকার বস্তুটা শুধু হল-এর বটমের। বর্গক্ষেত্রেই রয়েছে। সে নিশ্চিত হলো, এগুলো পরিকল্পিতভাবে তৈরি। কিন্তু এগুলো বর্গক্ষেত্রের টপ ও বটম রেখার মাঝ বরাবর কেন? আহমদ মুসার মাথায় ছুটে এলো চিন্তা, তাহলে এগুলো কি কোনো কিছুর কভার, উপরে-নিচে পেরেক দিয়ে যা আটকে রাখা হয়েছে? সঙ্গে সঙ্গে আহমদ মুসা চারিদিকে তাকিয়ে ভারি কিছু খুঁজল। পেল না। আহমদ মুসা ব্যাগ থেকে চাইনিজ ছুরি বের করে নিল। ছুরি দিয়ে বাড়ি দিল নিচের ও তার উপরের বর্গক্ষেত্রে। দুইয়ের শব্দে বড় রকমের পার্থক্য বোঝা না গেলও নিচের অর্থাৎ মেঝের সমান্তরাল বর্গক্ষেত্রের শব্দ উপরের বর্গক্ষেত্র থেকে। হালকা।
উজ্জ্বল হয়ে উঠল আহমদ মুসার মুখ।
আহমদ মুসা ডাকল প্রেসিডেন্ট ও ড. ডাকে। প্রেসিডেন্ট ও অন্যরা আহমদ মুসার কাছে এলো।
হ্যাঁ, মি. আহমদ মুসা, তোমার মুখ উজ্জ্বল দেখাচ্ছে। অবশ্যই কোনো সুংসবাদ আশা করি। বলল প্রেসিডেন্ট।
এক্সিলেন্সি, আমি মনে করছি চারদিকের দেয়ালের বটম বরাবর চার ফিট বাই চার ফিট যে বর্গক্ষেত্রের সারি দেখছি, তাতেও সম্পদ বোঝাই রয়েছে। আহমদ মুসা বলল।
কিন্তু এগুলোকে তো সলিড দেয়ালের অংশ দেখা যাচ্ছে। তুমি
অনুমান কীভাবে করলে? বলল প্রেসিডেন্ট।
আহমদ মুসা ইঞ্জিনিয়ারকে ডাকল। ছয় ইঞ্জিনিয়ারকে সামনের বর্গক্ষেত্রে টপ ও বটমের এক্সট্রা প্লাস্টারের গোলাকার স্থান দেখিয়ে বলল, প্লিজ, আপনার কোনো টুলস দিয়ে আলগা এই প্লাস্টার তুলে ফেলুন।
তুলে ফেলা হলো আলগা প্লাস্টার। বেরিয়ে গেল পিতলের পেরেকের খাজকাটা মাথা।
ধন্যবাদ আহমদ মুসা। তুমি একদম ঠিক অনুমান করেছ।
প্রেসিডেন্ট থামল। তাকাল আহমদ মুসার দিকে। বলল, উপর ও নিচের দুই পেরেক খুলে দেখা যাক। দেখা যাক পাথরটা সরে কিনা। আর দেখা যাক ভেতরে কি আছে।
ঠিক আছে মি. ইঞ্জিনিয়ার। খুলে ফেলুন দুই পেরেক। আহমদ মুসা বলল।
দুই পেরেক খোলার সঙ্গে সঙ্গেই পড়ে যাচ্ছিল পাথরের ঢাকনাটি। ধরে ফেলল ইঞ্জিনিয়ার। মুখ থেকে সরে এলো ঢাকনা।
উন্মুক্ত হয়ে পড়ল ভেতরটা।
সবার চোখ গিয়ে আছড়ে পড়ল সেখানে।
দেখতে পেল সবাই থরে থরে সাজানো স্বর্ণমুদ্রার স্তূপ। দেয়ালের গায়ে ৪ ফুট বাই ৪ ফুট স্পেসের ২ ফুট গভীর ৬টি শেলফে সাজিয়ে রাখা হয়েছে স্বর্ণমুদ্রাগুলো। নীরব সবাই।
সবার বিস্ফারিত চোখ স্বর্ণমুদ্রার দিকে।
ধন্যবাদ আহমদ মুসা, তুমি রূপকথাকে বাস্তব রূপ দিলে। একটা মিথকে বাস্তবে টেনে নিয়ে এলে। কুবলাই খানের অবিশ্বাস্য বড় এক ধনভাণ্ডার তোমার হাত ধরে উন্মোচিত হলো। নিশ্চয় কুবলাই খান ধ্বংস, রক্তপাতের মধ্যেও বড় কোনো পুণ্য করেছিলেন, যার জন্যে তার ধনভাণ্ডার বহু শতাব্দী পর তোমার পুণ্যময় হাতের পরশ নিয়ে বাইরের। দুনিয়ায় পা রাখল। ধন্যবাদ তোমাকে। বলল প্রেসিডেন্ট। আবেগে ভারি হয়ে উঠেছিল তার কণ্ঠ।
এক্সিলেন্সি, এসবই আল্লাহর পরিকল্পনা। আল্লাহর পরিকল্পনায় এটাও ছিল চীনের মহামান্য প্রেসিডেন্ট লিউ জোয়ান কুবলাই খানের অতুল ধনভাণ্ডারের সম্মানিত অভিভাবক হবেন।
মি. আহমদ মুসা, এত পুণ্য আমি করিনি। তোমার আল্লাহর কিংবা কোনো ঈশ্বরের মন্দিরে ঢুকে তাঁর সামনে আমি কখনো মাথা নত করে দাঁড়াইনি।
বলল প্রেসিডেন্ট। তার অশ্রুসিক্ত কণ্ঠস্বর।
এক্সিলেন্সি, দাঁড়াননি বলে কখনই দাঁড়াবেন না, তা তো নয়।
কথাটা বলে আহমদ মুসা একটু থামল। সঙ্গে সঙ্গেই আবার বলে উঠল, এক্সিলেন্সি, আপনি চাইলে দেয়ালের একটা শেলফ যেমন ভোলা। হলো, তেমনি একটা সিন্দুকও খোলা যেতে পারে।
তোমার প্রস্তাব ঠিক মি. আহমদ মুসা। একটা সিন্দুক খোলা হোক। সিন্দুক খোলা হলো লক ভেঙে।
খোলা হলো সিন্দুকের ঢাকনা।
সিন্দুকের ঢাকনা খোলার সাথে সাথে একটা শ্বেতনিলাভ আলোর ছটা ছড়িয়ে পড়ল বাইরে।
সোনা, মণি-মুক্তা, হীরা-জহরতের অলংকারে ভরা সিন্দুক। সবাই নির্বাক বিস্ময়ে তাকিয়ে আছে সেদিকে। একটা সিন্দুকের হিরা-জহরতই যেখানে সাত রাজার ধন হতে পারে, সেখানে শত শত সিন্দুক আছে!
প্রেসিডেন্টও অনেকটাই নির্বাক। নীরবতা ভাঙল আহমদ মুসা। বলল, এক্সিলেন্সি, আপনার একটা অনুমতি চাই।
তাকাল প্রেসিডেন্ট আহমদ মুসার দিকে। প্রেসিডেন্টের চোখে কৌতূহল। বলল, কিসের অনুমতি মি. আহমদ মুসা?
এক্সিলেন্সি, এখানে আমার কাজ শেষ। আমার একটা প্রোগ্রাম বিকেল ৪টায়। আবার সন্ধ্যায় তো ফেন ফ্যাং-এর প্রোগ্রামে যেতে হবে।
আমি এখন চলে যেতে চাই। বলল আহমদ মুসা।
প্রেসিডেন্টের চোখে বিস্ময় ফুটে উঠল। বলল, তুমি এখানে না থাকলে চলবে কি করে?
এক্সিলেন্সি, আর কোনো সমস্যা নেই। আপনি এখন সম্পদগুলোকে নিরাপদ আশ্রয়ে নেয়ার ব্যবস্থা করুন। তাহলেই তো এখানকার কাজ শেষ। বলল আহমদ মুসা।
প্রেসিডেন্ট তাকাল ডক্টর ডার দিকে। ড. ডাও তাদের কথা শুনছিল। প্রেসিডেন্ট তাকে বলল, ড. ডা, আহমদ মুসা চলে যেতে চাচ্ছে। কিন্তু আমি মনে করি তার এখানে উপস্থিত থাকা দরকার।
এক্সিলেন্সি মি. প্রেসিডেন্ট, আমিও চাই আহমদ মুসা আমাদের সাথে থাকুন। কিন্তু আহমদ মুসাকে আমি এ পর্যন্ত যতটা চিনেছি, তাতে আমি মনে করি তার পরিকল্পনা মতো তাকে চলতে দেয়াই ভালো। সে চিন্তা না করে কোনো কথা বলে না। ড. ডা বলল।
মি. আহমদ মুসা, তুমি বয়সে অনেক ছোট। কিন্তু ছোট হয়েও অনেক বড়। এত বড় যে, তোমাকে আটকাবার সাধ্য আমাদের নেই। ড. ডার কথা আমি মেনে নিলাম। কিন্তু তুমি কি কোনো প্রোগ্রামে যাবে? কমান্ডো টিম অবশ্যই তোমার সাথে থাকবে। বলল প্রেসিডেন্ট।
আমি যাদুঘরে যাব। আহমদ মুসা বলল।
সঙ্গে কে থাকছে? বলল প্রেসিডেন্ট।
মা ঝু থাকছে। লিয়েন হুয়া ও ফেন ফ্যাং-ও থাকার কথা। আহমদ মুসা বলল।
মা ঝু অসুস্থ। লিয়েন হুয়া ও ফেন অবশ্যই যেন যায়। আমিও বলে দিচ্ছি। ভালোই হলো লিয়েন, ফেন তোমার সাথে থাকলে সন্ধ্যার প্রোগ্রামে ঠিক সময়ে পৌঁছতে পারবে।
ধন্যবাদ এক্সিলেন্সি। আমি তাহলে চলছি। বলল আহমদ মুসা। আহমদ মুসা ড. ডাসহ সবার কাছ থেকে বিদায় নিল। যাবার সময় ইঞ্জিনিয়ারের সাথে হ্যান্ডশেক করে বলল, আপনাকে অনেক পরিশ্রম করতে হয়েছে।
স্যার, আপনি সাথে থাকলে কষ্ট আনন্দে পরিণত হয়, অল্প সময়ে এটুকু আমি বুঝেছি স্যার। ইঞ্জিনিয়ার বলল।
আহমদ মুসা দ্রুত উঠে গেল খনন এলাকা থেকে। উপরে তার জন্য সিকিউরিটি কমান্ডোরা অপেক্ষা করছিল।
.
আহমদ মুসার গাড়ি ছুটছিল বেইজিং-এর সামরিক বিমানবন্দরের দিকে। তার পাশে মা ঝু ও আহমদ ইয়াং। পিছনে ফা জি ঝাও, নেইজেন এবং লিয়েন হুয়া। আর গাড়ি চালাচ্ছে ফেন ফ্যাং।
সামনের গাড়ি কমান্ডোদের।
পেছনের একটা গাড়িতে প্রেসিডেন্টের প্রতিনিধি হিসেবে আসছেন প্রেসিডেন্টের উপদেষ্টা টিমের প্রধান লি চৌ। চীনা সশস্ত্র বাহিনীর পক্ষ থেকে আসছেন সশস্ত্র বাহিনীর গোয়েন্দা প্রধান চাও চেন।
সবার পেছনে রয়েছে কমান্ডোদের আরেকটা গাড়ি।
আহমদ মুসার প্রথম পরিকল্পনায় ছিল সিংকিয়াং-এর উরুমুচি থেকে প্লেনে যাবে তাসখন্দ, মদিনা হয়ে যাবে আফ্রিকায় তানজানিয়ান দারুস-সালামে। কিন্তু পরিকল্পনাটা টেকেনি। শুধু টেকেনি তা নয়। অনেক কিছুরই উলট-পালট ঘটেছে।
সেদিন যাদুঘর থেকে ফেরার পথে আহমদ মুসাকে ডেকে নেয়া হয় মন্ত্রিসভা ও পার্টি পলিটব্যুরোর জরুরি বৈঠকে। আহমদ মুসার সোজা চলে যাওয়ার কথা ছিল প্রেসিডেন্ট হাউজে। ফেন ফ্যাং-এর অনুষ্ঠানটি সন্ধ্যায় শুরু হবার কথা ছিল। অনুষ্ঠানের পরই ডিনারের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। আহমদ মুসা মন্ত্রিসভার বৈঠকে যাওয়ায় এবং প্রেসিডেন্ট মন্ত্রিসভার বৈঠকে আটকে পড়ায় তা আর হতে পারেনি। ফেন ফ্যাং কাঁদো কাঁদো কণ্ঠে বলেছিল, তার প্রোগ্রাম আদৌ হবে কি! মা ঝু ও লিয়েন হুয়া বিব্রত হয়ে পড়েছিল। আহমদ মুসা ফেন ফ্যাংকে সান্ত্বনা দিয়ে বলেছিল, আমি তো আছি, তোমার প্রোগ্রামের কোনো ভয় নেই।
ফেন ফ্যাং তার চোখের অশ্রুসিক্ত কোণ মুছে বলেছিল, বাবাও আমাকে সান্ত্বনা দিয়েছেন। বলেছেন, তোমাদের সকলের জন্যে একটা সারপ্রাইজ আছে। দেখবে, দুঃখ তখন আর থাকবে না।
এক্সিলেন্সি মি. প্রেসিডেন্ট, মানে মামা আমাদের সারপ্রাইজ দেবেন? তিনি এ কথা সত্য বলেছেন? এভাবে কথা বলা তার বহু দিন শুনিনি। বলেছিল লিয়েন হুয়া।
আসলেই বাবা খুব সিরিয়াসলি কথাটা বলেছেন। আমাকে বলেছেন আর কারও সাথে এ নিয়ে আলোচনা না করতে। কিন্তু কথাটা তো আমি বলেই ফেললাম। ফেন ফ্যাং বলেছিল।
বিস্ময় নেমেছিল লিয়েন হুয়ার চোখে-মুখে। তার মনে হয়েছিল, তাহলে বিস্ময়টা ফেন-এর সাথে সম্পর্কিত নয়। কার সাথে সম্পর্কিত হতে পারে? কি সেই বিস্ময়? কোনো উত্তর খুঁজে পায়নি লিয়েন হুয়া। তবে এ নিয়ে তার খুব একটা মাথাব্যথা নেই। বিকেল থেকেই লিয়েন হুয়ার মনটা খুব ভালো আছে। প্রথমবারের মতো মামা তাকে ফেনকে নিয়ে মা ঝুর সাথে যাদুঘরে যেতে বলেছে। মা ঝু যেহেতু অসুস্থ, সেজন্যে তারাও তার সাথে থাকবে যাতে আহমদ মুসার কোনো অসুবিধা না হয়, এ চিন্তা তারা আগেই করেছিল। তবে মামা মা ঝুর সাথে যেতে বলায় লিয়েন হুয়ার খুব ভালো লেগেছিল।
মন্ত্রিসভা ও পার্টি পলিটব্যুরোর জরুরি যৌথ বৈঠকে আহমদ মুসাকে যেতে বলায় বিস্মিত হয়েছিল আহমদ মুসা। এ ব্যাপারে তাকে আগে কিছুই বলা হয়নি। হতে পারে জরুরি বৈঠকের সিদ্ধান্ত আকস্মিকভাবে হয়েছে। মিটিং-এ যাওয়ার পরেই আহমদ মুসার কাছে পরিষ্কার হয় যে, কুবলাই খানের ধনভাণ্ডারই বৈঠকের এজেন্ডা।
প্রেসিডেন্ট আসার সাথে সাথেই মিটিং-এর কাজ শুরু হয়।
প্রেসিডেন্ট বসেই বলেন, বুঝতে পারছি সবাই আজ ক্লান্ত। এরপরও জরুরি বিষয় বলেই মন্ত্রিসভা ও পলিটব্যুরোর এই যৌথ অধিবেশনের আয়োজন করা হয়েছে।
কথা শেষে প্রেসিডেন্ট তাকাল অর্থমন্ত্রীর দিকে। বলেছিল কুবলাই খানের যে ধনভাণ্ডার আজ উদ্ধার হলো, প্লিজ, তার সম্পর্কে একটা ব্রিফ আপনি দিন। তারপরই আমরা ফরমালি মিটিং-এর কাজ শুরু করব।
অর্থমন্ত্রী তার সামনে ফাইলটি খুলে সবার উদ্দেশ্যে বলে, এক্সিলেন্সি মি. প্রেসিডেন্ট ও মহান চীনের সম্মানিত নেতৃবৃন্দ, কুবলাই খানের যে ধনভাণ্ডার উদ্ধার করা হয়েছে, তার পরিকল্পনাকেও হার মানিয়েছে। ঈশ্বর মহান চীনের প্রতি কৃপা করেছেন। ঠিক উপযুক্ত সময়ে মহান চীনের হাতে এ সম্পদ এসেছে। সম্পদের মোটামুটি একটা খসড়া হিসাব দাঁড় করানো হয়েছে। নিষিদ্ধ নগরীর তলদেশ জুড়ে বিস্তৃত বিশাল হলঘর থেকে বিশাল বিশাল দেড় হাজার সিন্দুক উদ্ধার করা হয়েছে এবং দেয়ালের গায়ে পাওয়া গেছে এক হাজার ভোল্ট। প্রাথমিক এস্টিমেটে বলা হয়েছে হিরা জহরত-স্বর্ণালংকারের পরিমাণ একশ টন এবং স্বর্ণমুদ্রার পরিমাণ দুই হাজার টন। স্বর্ণমুদ্রার মধ্যে এশিয়ার সব রাজা-বাদশাহদের প্রচলিত স্বর্ণমুদ্রা রয়েছে।
অর্থমন্ত্রী থামতেই কথা বলে ওঠে প্রেসিডেন্ট, মন্ত্রী ও আমার পলিটব্যুরোর প্রিয় সদস্যবৃন্দ, আমার কাছে, এখনও এটা বিস্ময়ের যে, আমাদের নিষিদ্ধ নগরীর মাটির তলায় এত সম্পদ লুকানো ছিল এবং কুবলাই খানের সে সম্পদ এখন আমাদের হাতে। আমি মনে করি। আমাদের মহান চীনের মহান জনগণের এটা ভাগ্য যে, মাটির তলার বিশাল এক সম্পদ বহু শতাব্দী পাড়ি দিয়ে আজ তাদের হাতে এসে পড়েছে। এটা আমাদের মহান চীনের সৌভাগ্য এবং বিস্ময়করভাবে এই সৌভাগ্য তাদের হাতে এসেছে চীনের হারানো এক মুসলিম সন্তানের হাত ধরে, যে বিশ্বের এক অতুলনীয় ব্যক্তিত্ব, যাকে নিয়ে চীন গর্ব করতে পারে।
থামল প্রেসিডেন্ট। সামনে পানির গ্লাস টেনে নিয়েছিল।
এই ফাঁকে উঠে দাঁড়ায় পলিটব্যুরোর প্রভাবশালী সদস্য ও গুরুত্বপূর্ণ তিয়ানজিন প্রদেশের অবিসংবাদিত ও জনপ্রিয় নেতা জিন শিয়াং শাও। বলল, এক্সিলেন্সি মি. প্রেসিডেন্টের সব কথার সাথে আমি একমত। তার কথার সাথে যুক্ত করে স্পষ্ট করে বলতে চাই, মি, আহমদ মুসা চীনে না এলে এই সম্পদ আমরা খুঁজে পেতাম না। অন্যদিকে তিনি আসায় তারই সাহায্যে আমরা চীনের আত্মবিনাশী আগ্রাসী এক শক্তির উত্থানকে ধ্বংস করতে পেরেছি। আমাদের মহান চীনের জন্যে এ দুটি ঘটনা মি. আহমদ মুসার এক অমূল্য উপহার। মহান চীন স্মারক হিসেবে যতই ক্ষুদ্র হোক একটা গিফট কি আহমদ মুসাকে দিতে পারে না? থামে জিন শিয়াং শাও।
আবার মুখ খোলে প্রেসিডেন্ট। বলে, ধন্যবাদ মি. জিন শিয়াং শাও। মন্ত্রিসভা ও পলিটব্যুরোর এই জরুরি মিটিং ডাকা হয়েছে ধনভাণ্ডার সংক্রান্ত সর্বশেষ অবস্থা জানাবার জন্যে। আরও একটা বিষয় আছে। সেটা আহমদ মুসাকে নিয়ে। আপনি জানেন, সন্ধ্যার আগে আমাদের যে বৈঠক হয়েছে, সেখানে সবাই একমত হয়ে একটা প্রস্তাব দিয়েছেন, সেটা আহমদ মুসাকে জানাবার জন্যে তাকে কষ্ট দিয়ে ডেকে এনেছি।
বলে একটু থামে প্রেসিডেন্ট।
তাকায় আহমদ মুসার দিকে। বলে, মি. আহমদ মুসা, আমাদের মন্ত্রিসভা এবং পলিটব্যুরো মনে করে তোমার হাত ধরে যে ধনভাণ্ডার উদ্ধার হয়েছে, তাতে তোমার হক আছে। এজন্যেই স্থির করা হয়েছে, বিভিন্নজন এ ব্যাপারে যে প্রস্তাব দিয়েছেন, সেগুলোর প্রত্যেকটি আলাদা আলাদা কাগজে লেখা হয়েছে। এগুলো নিয়ে লটারি হবে। তুমি বা তোমার পক্ষ থেকে কেউ একজন একটি কাগজ তুলবে। সে কাগজে যা লেখা থাকবে সেটাই তোমার জন্যে চীনা জনগণের উপহার। সেই লটারি এখনই অনুষ্ঠিত হবে। থামে প্রেসিডেন্ট।
আমি কিছু কি বলতে পারি এক্সিলেন্সি! আহমদ মুসা বলেছিল প্রেসিডেন্টকে।
অবশ্যই মি. আহমদ মুসা। বলে প্রেসিডেন্ট।
আহমদ মুসা উঠে দাঁড়াল। সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলেছিল, এক্সিলেন্সি মহামান্য প্রেসিডেন্ট, উদ্ধারকৃত ধনভাণ্ডারে আমার হক আছে। বলেছেন। প্রকৃতই কোনো হক বা অধিকার এ সম্পদে আমার নেই। ইসলামী আইন অনুসারে কোনো দেশে গুপ্তধন, খনি ইত্যাদি ধরনের কোনো সম্পদ কেউ পেলে, সে সম্পদের মালিক হবে রাষ্ট্র, রাষ্ট্রের জনগণ। প্রেসিডেন্টের পক্ষ থেকে জনগণের গিফট আমি পেয়েছি। আমি তা সাদরে গ্রহণও করেছি। অতএব নতুন কোনো গিফটের আর প্রয়োজন। নেই। থামে আহমদ মুসা।
সঙ্গে সঙ্গেই উঠে দাঁড়ায় পলিটব্যুরোর আরেকজন সদস্য। বলে, যে। গিফট দেয়া হয়েছে সেটা আমরা জানি। এরপরও নতুন প্রেক্ষাপটে নতুন প্রস্তাব আমরা দিয়েছি। আমাদের অনুরোধ, আমাদের আবেগ ও আশাকে আহত করবেন না।
এরপর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী উঠে দাঁড়ায় এবং বলে, প্লিজ মি, আহমদ মুসা, আমাদেরকে কাজ শেষ করতে দিন। আমাদের অনুরোধ, এক্সিলেন্সি মি. প্রেসিডেন্ট আহমদ মুসার পক্ষ থেকে লটারির কাগজ তুলবেন।
ছোট একটা স্বচ্ছ পাত্রে দশটি প্রস্তাবের দশটি কাগজ খণ্ড লিখে মুড়িয়ে রাখা হয়েছে। সেটা এনে প্রেসিডেন্টের টেবিলে রাখে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। বলে, এক্সকিউজ মি এক্সিলেন্সি, আপনি আমাদের একটু সাহায্য করুন। এ থেকে আপনি প্লিজ যেকোনো একটা কাগজ তুলুন এবং তাতে কি আছে তা প্লিজ সকলকে জানান।
প্রেসিডেন্ট আহমদ মুসার দিকে একবার তাকিয়ে বলে, মি. আহমদ মুসা, তোমার আল্লাহর নাম নিয়ে একটা কাগজ তুলছি।
প্রেসিডেন্টর কথা শেষ হতেই আহমদ মুসা বলে উঠল, এক্সিলেন্সি, স্রষ্টা শুধু আমার নয়, সকলের, গোটা সৃষ্টিকুলের। সুতরাং আল্লাহ সবার।
প্রেসিডেন্ট প্রসন্ন মুখে তাকাল আহমদ মুসার দিকে। বলল, ধন্যবাদ আহমদ মুসা।
প্রেসিডেন্টের মনোযোগ পাত্রের কাগজের দিকে। একটা কাগজ তুলে নিল পাত্র থেকে। খুলল কাগজের ভাঁজ।
প্রেসিডেন্টের মুখ গম্ভীর হলো। বলল, আহমদ মুসারই জয় হলো। তিনি নিতে চান না, তাই বোধ হয় আল্লাহ মিনিমামটাই তার জন্যে মঞ্জুর করেছেন। এই কাগজের প্রস্তাবে বলা হয়েছে, এক টন হিরা জহরতের অলংকার এবং এক টন স্বর্ণমুদ্রা আমাদের ভাই আহমদ মুসাকে দেয়া হোক।
এক্সিলেন্সি মি. প্রেসিডেন্ট ঠিক বলেছেন। পরিমাণটা বেশি হলে জনাব আহমদ মুসার নিশ্চয় আপত্তি থাকতো। এ ক্ষুদ্র পরিমাণ নিয়ে তিনি নিশ্চয় আপত্তি তুলবেন না।
আহমদ মুসা উঠে দাঁড়ায়। বলে, আমার প্রতি আপনাদের এই ভালোবাসাই আমার সম্পদ। এই সম্পদই আমি চাই। যে সম্পদ আমাকে দেয়ার কথা বলা হয়েছে, তা রাখার জায়গা আমার নেই। মদিনার উপকণ্ঠে সৌদি আরব সরকার আমাকে একটা সুন্দর বাড়ি দিয়েছেন। শুভেচ্ছার নিদর্শন হিসাবে বাৎসরিক একটা অনারিয়াম আমাকে তাঁরা দেন। এতেই আমার সংসার ভালোভাবে চলে যায়। আসলেই আমার তেমন কোনো প্রয়োজন নেই।
মি. আহমদ মুসা, এ সম্পদের প্রয়োজন তোমার পরিবারের আছে। পরিবারের ভবিষ্যতের জন্য এর প্রয়োজন রয়েছে। আমাদের অনুরোধ, তুমি এ নিয়ে কথা বাড়িয়ে না আহমদ মুসা, প্লিজ। বলেছিল প্রেসিডেন্ট।
এক্সিলেন্সি মি. প্রেসিডেন্ট, আপনার অনুরোধ আমার উপর আপনার নির্দেশের মতো। হীরা-জহরতের অলংকারের মধ্য থেকে ৮টি নেকলেস। কেউ একজন সিলেক্ট করে আমাকে দেবেন। আমি সেগুলো নেব। আর অবশিষ্ট সম্পদ যদি আমাকে নিতেই হয়, তাহলে আমি প্রস্তাব করছি সরকারের তত্ত্বাবধানে বেইজিং-এ একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হোক। যার নাম হবে ডিভাইন ফেইথ : গাইডেন্স ফর ম্যান। গবেষণা প্রতিষ্ঠানের পরিচালনায় থাকবেন ড. ডা ডেমিংগো ও লু ঝির মামা ভাষা বিজ্ঞানী প্রফেসর হুয়াং ফু। এ ছাড়া সদস্য থাকবেন হান, হুই ও উইঘুরদের একজন করে। প্রেসিডেন্টের অনুরোধের উত্তরে আহমদ মুসা বলেছিল।
আহমদ মুসার কথা শেষ হলেও সবাই নীরব। বিস্ময় সবার চোখে-মুখে।
সম্পদ যে এভাবে পায়ে ঠেলা যায়, তা তারা ভাবতেই পারছে না। চীনে এসে চীনের জন্যে যা করেছে তা অমূল্য। এরপরও তার মধ্যে কোনো আকাক্ষা নেই। কোনো মানুষ এতটা নিঃস্বার্থ হতে পারে!
নীরবতা ভেঙেছিল পলিটব্যুরোর প্রবীণ সদস্য জিন শিয়াং শাও। বলেছিল, আপনি ধন্য আহমদ মুসা। এজন্যেই আপনি অনন্য, অজেয়। মানুষের জন্যে ঈশ্বর আপনাকে দীর্ঘজীবী করুন। এর বাইরে কিছু বলার ভাষা আমার নেই। ভারি কণ্ঠে কথা শেষ করল জিন শিয়াং শাও।
প্রেসিডেন্টর গম্ভীর মুখের আড়ালে যেন অপার্থিব এক আনন্দ। বলেছিল প্রেসিডেন্ট অনেক ধন্যবাদ আহমদ মুসা! তুমি যা চেয়েছ, যেভাবে চেয়েছ সেভাবেই হবে। তুমি একটা মহৎ গবেষণার কথা বলেছ। এ ধরনের প্রতিষ্ঠান চীনে নেই। আমি খুব খুশি। আমি আজই ড. ডাকে বলব পরিচালনা কমিটি গঠনের কাজ শুরু করতে।
একটু থামে প্রেসিডেন্ট। সঙ্গে সঙ্গেই আবার বলে উঠেছিল, আহমদ। মুসার জন্যে নেকলেস কে চয়েস করবে?
আমার মনে হয় মি. জিন শিয়াং শাও এ কাজটি করুন। পুরুষানুক্রমে তাঁদের মণি-মাণিক্যের ব্যবসায় ছিল। তিনি এ কাজটি ভালো পারবেন। বলেছিল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।
সবাই হাততালি দিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে সমর্থন করে।
আমি এ কাজটিকে আমার জন্যে গৌরবের বলে মনে করি। গ্রহণ। করলাম এ দায়িত্ব। জিন শিয়াং শাও বলেছিল।
আমার একটা প্রস্তাব আছে, এক্সিলেন্সি মি. প্রেসিডেন্ট, অনুমতি দিলে বলতে পারি। বলেছিল আহমদ মুসা।
বলুন মি. আহমদ মুসা। প্রেসিডেন্ট বলেছিল।
ধনভাণ্ডার উদ্ধারের সময় সেখানে যারা উপস্থিত ছিলেন, তারা একটি ঐতিহাসিক ঘটনার সাক্ষী। তাঁদের এই স্মৃতিকে ধরে রাখার জন্যে, আমি একটা প্রস্তাব করছি। তাঁরা প্রত্যেকেই সুভেনীর হিসাবে নিজের পছন্দমত তিনটি করে জিনিস নেবেন এখান থেকে, সেটা স্বর্ণমুদ্রা বা অলংকার যেটাই হোক। বলেছিল আহমদ মুসা।
আহমদ মুসার প্রস্তাব সত্যিই একেবারে নতুন ধরনের। যার সাথে সকলেরই একটা সম্পর্ক জড়িত হয়ে পড়েছে। সুতরাং সঙ্গে সঙ্গে কোনো মন্তব্য কারও কাছ থেকে আসেনি। নীরব ছিল সবাই।
অবশেষে কথা বলেছিল প্রেসিডেন্ট। বলেছিল, তোমার প্রস্তাবটি মজার মি. আহমদ মুসা। কিন্তু এর পক্ষে যে যুক্তি দিয়েছ, এ ছাড়া আর কি যুক্তি আছে?
এটাই সবচেয়ে বড় যুক্তি এক্সিলেন্সি! মালিকহীন কোনো সম্পদ বা
বস্তু যারা কোথাও খুঁজে পায়, তখন সেটার উপর তাদের স্বাভাবিক একটা অধিকার জন্মে যায়। রাষ্ট্র সেটা তার কাছ থেকে নিয়ে নেয়ার সময় তাকে কিছু উপহার দেয়া সৌজন্যের মধ্যে পড়ে। এ ব্যাপারে আমাদের রাসুল। হযরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর একটা নির্দেশ বা পরামর্শ আছে। তিনি বলেন, তোমরা ফল-ফুল কিনে বাসায় নেয়ার সময় আশেপাশের ছেলেমেয়েরা তা যদি দেখতে পায়, তাহলে তাদেরকেও কিছু দিও। রাসুল (সা.) এ কথা বলেছেন কারণ এটাই সৌজন্যবোধের দাবি। এর আরেকটা তাৎপর্য এই হতে পারে যে, যেহেতু ফল খাবার জিনিস এবং তা তখন ঐ ছেলেদের হাতে নেই, তাই তাদের দেখা ফলের প্রতি তাদেরও একটা অধিকার বনে যায়। তারা না দেখলে তাদের এ অধিকার জন্মাত না। আমাদের রাসুল (সা.)-এর কথায় পরবর্তী অংশ এ যুক্তিকে সমর্থন করে। তিনি বলেন, কাউকে দেবার মতো বাড়তি ফল কেনার সাধ্য কারও যদি না থাকে, তাহলে যেন সে তার কেনা ফল গোপনে তার বাড়িতে নিয়ে যায়। সুতরাং আমি মনে করি ধনভাণ্ডার উদ্ধারের সময় যারা তা দেখেছেন, তাদেরকে টোকেন হিসাবে গিফট করা রাষ্ট্রীয় সৌজন্যের মধ্যে পড়ে এবং এটা মানবমনের প্রতি স্বাভাবিক সুবিচারেরও দাবি। এই সুবিচার এজন্যেই যে, যেন কোনোভাবেই কারও মধ্যে কোনো বঞ্চনাবোধের সৃষ্টি না হয়। ছেলেদেরকে ফল দিতে বলা হয়েছে তাদের মনে বঞ্চনা বোধ সৃষ্টি রোধের জন্যেই। বলেছিল আহমদ মুসা।
সবাই নীরবে আহমদ মুসার কথা শুনছিল। প্রথমে তারা একে মজার একটা আলোচনা মনে করলেও শেষদিকে সবাই গম্ভীর হয়ে উঠেছিল।
প্রেসিডেন্টের চোখে-মুখে বিস্ময়! বলেছিল প্রেসিডেন্ট, মি. আহমদ মুসা, তুমি ছোট এক প্রসঙ্গ নিয়ে অনেক ভারি, অনেক বড় কথা বলেছ। তোমাদের প্রফেট খুব বড় এক মনোবিজ্ঞানী ও সুক্ষ্মদর্শী এবং একজন সুবিচারকও ছিলেন। তুমি ঠিকই বলেছ, স্বাভাবিক সৌজন্যের দাবি পুরণ না হলে মনে স্বাভাবিকভাবেই বঞ্চনার ভাব সৃষ্টি হতে পারে। ধন্যবাদ আহমদ মুসা।
আহমদ মুসাকে কথাগুলো বলেই প্রেসিডেন্ট তাকিয়েছিল সকলের দিকে। বলেছিল, মি. আহমদ মুসা যে প্রস্তাব দিয়েছে, তাকে আমি যুক্তিযুক্ত মনে করছি। আপনাদের মত বলুন।
সবাই বলে উঠেছিল, এক্সিলেন্সি মি. প্রেসিডেন্টের মতই আমাদের মত। আহমদ মুসাকে ধন্যবাদ যে তিনি মানবিক সম্পর্ক ও সুবিচারের একটা বিষয়কে সুন্দরভাবে তুলে ধরেছেন।
একটু নীরবতা নামতেই পলিটব্যুরোর সবচেয়ে প্রবীণ সদস্য ড. ওয়াং বলে উঠেছিল, ধন্যবাদ আহমদ মুসা, আমার মনের কথাই আপনি তুলে ধরেছেন। সত্যি আমার মনের অবচেতন কোণে একটা অপ্রাপ্তির বেদনা এইভাবে ছিল যে, কুবলাই খানের লেজেন্ডারি হিরা-জহরতের একটা নিদর্শন যদি আমার ঘরে থাকতো!
ড. ওয়াং-এর কথা শেষ হতেই আরেকজন তরুণ সদস্য বলে উঠেছিল, শুধু আপনার নয় স্যার, আমিসহ মনে হয় সবার মনেই এই লেজেন্ডারি। ধনভাণ্ডারের স্মারক হিসাবে একটা সুভেনীর পাবার আকাঙ্ক্ষা ছিল।
সঙ্গে সঙ্গেই আরও কয়েকজন বলে উঠেছিল, মি. আহমদ মুসার প্রফেটের মতো মি. আহমদ মুসাও একজন মনোবিজ্ঞানী। মনের দাবি মেটাতে আমরা হয়তো অন্যভাবে ধনভাণ্ডার থেকে কিছু পাবার চেষ্টা করতাম। মি. আহমদ মুসা সে দরজা বন্ধ করে একটা বৈধ দরজা খুলে। দিয়েছেন। এইভাবে সুবিচারের সূক্ষ্ম সব দিক দেখা হলে সমাজ থেকে সব দুর্নীতি, সব বঞ্চনার অবসান ঘটতে পারে। ধন্যবাদ আহমদ মুসা।
ধন্যবাদ সকলকে।
বলেই তাকিয়েছিল প্রেসিডেন্ট আহমদ মুসার দিকে। প্রেসিডেন্টের মুখে হাসি। প্রশংসাসূচক কিছু বলতে গিয়েছিল আহমদ মুসাকে।
কিন্তু তার আগেই আহমদ মুসা বলে উঠেছিল, এক্সিলেন্সি, আরেকটি কথা। ধনভাণ্ডারের সম্পদ স্টেট ট্রেজারিতে লিস্টেড হবার আগেই সুভেনীর বন্টনের কাজ হয়ে যাওয়া উচিত।
আহমদ মুসার কথা শুনেই প্রেসিডেন্ট তাকিয়েছিল অর্থমন্ত্রীর দিকে। বলেছিল, মি. আহমদ মুসা ঠিকই বলেছে। গিফট সুভেনীর যাবে মালিকহীন ধনভাণ্ডার থেকে, স্টেট ট্রেজারি থেকে নয়।
প্রেসিডেন্ট তাকিয়েছিল ঘড়ির দিকে।
ঘড়ি থেকে মুখ তুলে নিচু কণ্ঠে আহমদ মুসাকে বলেছিল, আহমদ মুসা ওদিকে ওরা কি বসে আছে?
সকলকে ধন্যবাদ দিয়ে প্রেসিডেন্ট উঠে দাঁড়িয়েছিল। আহমদ মুসাও। সকলেই উঠে দাঁড়ায়।
.
কমান্ডোরা যখন আহমদ মুসাকে প্রেসিডেন্টের প্রাসাদে পৌঁছে দিল, তখন রাত নটা।
প্রেসিডেন্ট তার আগেই তার প্রাসাদে পৌঁছার কথা।
আহমদ মুসার সাথে ছিল প্রেসিডেন্টের প্রাইভেট সেক্রেটারি মিসেস শি হাও। সে আহমদ মুসাকে পৌঁছে দিয়েছিল প্রেসিডেন্ট ভবনের। রেসিডেন্সিয়াল উইং-এ।
রেসিডেন্সিয়াল উইং-এর গেটে আহমদ মুসাকে স্বাগত জানিয়েছিল ম্যাডাম প্রেসিডেন্ট এবং ফেন ফ্যাং।
এস বাবা। বিজয়ী সন্তানকে কীভাবে স্বাগত জানাতে হয়, আমি তো
জানি না। তবে আমি জানি, স্নেহ-মমতার চেয়ে বড় কিছু নেই মায়ের কাছে সন্তানকে দেবার। বলেছিল ম্যাডাম প্রেসিডেন্ট লি চিন ওয়া। অঞছোঁয়া, কণ্ঠ তার।
হা মা, মায়ের মমতার চেয়ে বড় কিছু দুনিয়াতে নেই। কিন্তু মা, আমি তো কোনো যুদ্ধ জয় করিনি! আহমদ মুসা বলেছিল।
বাছা তুমি কাজ কর। তোমার কাজকে তুমি দেখ না। কারণ আত্মগরিমা তুমি ঘৃণা কর। জান, চীনের আভ্যন্তরীণ একটা ভয়ংকর যুদ্ধে। চীনকে তুমি জিতিয়ে দিয়েছ। আর চীন যাকে রূপকথা ভেবেছে, যা কোনো দিন বিশ্বাস করেনি, সেই কুবলাই খানের শত রাজার রাজভাণ্ডার তুমি চীনকে পাইয়ে দিয়েছ।
ম্যাডাম প্রেসিডেন্ট একটু থেমেই আবার বলে উঠে, এস বাবা, ফেন
এর বাবা তোমার জন্যে অপেক্ষা করছে। নার
ভেতরে প্রবেশ করে চোখ ছানাবড়া আহমদ মুসার। ভেতর বাড়িকে সাজানো হয়েছে বিশাল কোনো উৎসবের সাজে।
ফেন-এর দিকে তাকিয়ে নিচু গলায় বলেছিল আহমদ মুসা। কি। ব্যাপার ফেন, বিয়ে বাড়ির সাজ দেখছি যে!
হেসে উঠেছিল ফেন ফ্যাং। বলেছিল, চলুন বাবার কাছে ভাইয়া। প্রেসিডেন্ট ভবনের রেসিডেন্সিয়াল ব্লকে বিশাল ফ্যামিলি ড্রয়িং রুম। চোখ ধাঁধানো রূপে সাজানো হয়েছে ড্রয়িং রুমকে। ড্রয়িং রুমের হোস্ট চেয়ারে বসে আছে প্রেসিডেন্ট। আহমদ মুসাকে নিয়ে ড্রয়িং রুমে প্রবেশ করেছিল ম্যাডাম প্রেসিডেন্ট ও ফেন ফ্যাং।
ড্রয়িং রুমের দরজায় গিয়ে ভেতরে তাকাতেই প্রেসিডেন্ট ছাড়া আর যাদের উপর নজর পড়েছিল। তাদের দেখে বিস্মিত হলো আহমদ মুসা। মা চু ইং, ফা জি ঝাও, লি ইউয়ান, নেইজেন, আহমদ ইয়াং, ইরকিন আহমেদ ওয়াং সবাই দেখেছিল এক যুবক এবং সম্ভ্রান্ত চেহারার প্রবীণ এক মহিলাকে।
আহমদ মুসারা ভেতরে ঢুকতেই প্রেসিডেন্ট ছাড়া সবাই উঠে দাঁড়াল। এগিয়ে আসে মা চু ইং আহমদ মুসার দিকে। বলে, জনাব আহমদ মুসা, আমাদের সবাইকে তো আপনি চেনেন। দুজনই মাত্র এখানে নতুন।
একটু থেমে মহিলাকে দেখিয়ে বলেছিল, ইনি আমার স্ত্রী, মা ঝুদের মা। আর যুবকটিকে দেখিয়ে বলল, এ আমার বড়..।
আহমদ মুসা মা চু ইং-এর কথার মাঝখানেই বলে উঠেছিল, ইনি। আপনার বড় ছেলে, মা ঝু ও ম্যাডাম ফা জি ঝাওদের বড় ভাই জেনারেল হু ফেং।
বলে আহমদ মুসা মহিলাকে সালাম দিয়ে যুবকটিকে জড়িয়ে ধরে বলেছিল, বড় ভাই সাহেব, আপনার কথা আমি শুনেছি। ধন্যবাদ আপনাকে।
আপনার সাথে দেখা হওয়ার সৌভাগ্যের জন্যে আমি অপেক্ষা করছিলাম। আমার সেই সৌভাগ্য হয়েছে। আপনি..।
আহমদ মুসা জেনারেল হু ফেংকে থামিয়ে দিয়ে বলেছিল, থাক জেনারেল, স্বজনরা স্বজনদের সম্পর্কে এত কথা বলতে নেই।
বলে আহমদ মুসা প্রেসিডেন্টের দিকে ফিরেছিল। কয়েক ধাপ এগিয়ে যায় প্রেসিডেন্টের দিকে। বলে, যাবার সময় আবার সবার সাথে দেখা করিয়ে দেবার জন্যে ধন্যবাদ এক্সিলেন্সি।
প্রেসিডেন্টের সোফার অন্য পাশে গিয়ে বসেছিল ম্যাডাম প্রেসিডেন্ট এবং পিতা-মাতার মাঝখানে বসেছিল-ফেন ফ্যাং। তার মুখে হাসি ধরছে না। বলেছিল, খুশি শেষ করে ফেলবেন না ভাইয়া, খুশি আরও আছে।
খুশি শেষ হয় না। খুশিতে খুশি আরও বাড়ে। বলেছিল আহমদ মুসা।
প্রেসিডেন্টের মুখে হাসি।
পরে একটু গম্ভীর হয়ে উঠেছিল প্রেসিডেন্ট। বলেছিল, ফেন, সত্যি বলেছে আহমদ মুসা, তোমার জন্যে বড় একটা সারপ্রাইজ আমি রেখেছি।
প্রেসিডেন্ট থামতেই ফেন ফ্যাং বলে উঠেছিল, ভাইয়া, আপনি গোয়েন্দাদের বাবা গোয়েন্দা, বলুন তো ভাইয়া সারপ্রাইজটা কি?
সত্যি আহমদ মুসার মনেও প্রবল কৌতূহল জাগল। হঠাৎ চিন্তাটা ছুটে এলো আহমদ মুসার মনে। এত সাজগোজের ঘনঘটা, এত মেহমান। বাড়িতে। এ সময় তো সবার সামনে থাকার কথা লিয়েন হুয়ার। সে কোথায়? আর মা ঝুর পরিবারের সবাই এসেছে। মা ঝু আসেনি কেন?
কপাল কুঞ্চিত হলো আহমদ মুসার। আনন্দের একটা বন্যা যেন ঝিলিক দিয়ে উঠল আহমদ মুসার মনে।
লিয়েন হুয়া কোথায় ফেন? ফেনকে প্রশ্ন করেছিল আহমদ মুসা। হাততালি দিতে উঠে দাঁড়িয়েছিল ফেন ফ্যাং। বলে উঠেছিল আনন্দের এক প্রবল উচ্ছ্বাসের মধ্যে, ভাইয়া ড্রয়িং রুমের ডান গেটের দিকে তাকান ভাইয়া।
সেদিকে তাকায় আহমদ মুসা। দেখতে পেয়েছিল, বধূবেশী লিয়েন হুয়া ও বর বেশি মা ঝুকে দুপাশে নিয়ে দরজা দিয়ে প্রবেশ করছিল হাস্যোজ্জ্বল এক যুবতি মহিলা।
প্রবল আনন্দ সয়লাবের আকস্মিক ধাক্কায় কয়েক মুহূর্তের জন্যে বিমূঢ় হয়ে পড়েছিল আহমদ মুসা।
ম্যাডাম প্রেসিডেন্ট এগিয়ে গিয়ে বর-কনেকে তাদের আসনে বসায়। ফেন ছুটে গিয়ে লিয়েন হুয়ার পাশে গিয়ে বসেছিল।
আহমদ মুসা আলহামদুলিল্লাহ, আল্লাহু আকবর বলে প্রেসিডেন্টের দিকে ফিরেছিল। বলেছিল, ধন্যবাদ এক্সিলেন্সি, আমি সত্যি সারপ্রাইজড, আমি খুব খুশি।
আহমদ মুসা, আমি তোমার উপর এত খুশি যে, কোনো কিছুর মধ্য দিয়েই এর প্রকাশ ঘটানো সম্ভব ছিল না। অবশেষে আমি এদের বিয়েকে তোমার জন্যে উপহার হিসেবে আয়োজন করেছি। আমি বুঝতে পেরেছিলাম, নানা কারণেই তুমি এই দুইজনের মিলন আন্তরিকভাবে চেয়েছ। আমি তা পূরুণ করতে পেরে নিজেকে ধন্য মনে করছি। বলেছিল প্রেসিডেন্ট।
ধন্যবাদ এক্সিলেন্সি। আমার জীবনে এত বড় সারপ্রাইজ কখনও ঘটেনি, এমন আনন্দও কোনো কিছুতে আমি কখনও পাইনি। অনেক ধন্যবাদ এক্সিলেন্সি আপনাকে। দোয়া করি আমার এ দুভাই-বোনের এই মিলন আমাদের নবী-নন্দিনী মা ফাতিমা ও আলী (রা)-এর মতো যেন। হয়। বলেছিল আহমদ মুসা।
প্রেসিডেন্টের ড্রয়িং রুমেই বিয়ের কাজ সমাধা হয়েছিল। দুজন। কর্মজীবনে প্রবেশ না করা পর্যন্ত বাইরের জগতে বিয়ের বিষয়টি সম্পূর্ণ গোপন রাখার সিদ্ধান্ত হয়। বিয়ে পড়ায় আহমদ মুসা। দোয়া করে ইরকিন আহমেদ ওয়াং।
বিয়ের পর ডিনারের অনুষ্ঠান হয়। আর ডিনারের পর হয় আহমদ মুসার সংবর্ধনা।
আহমদ মুসার সংবর্ধনা ছিল খুবই ছোট আকারের, কিন্তু ছিল খুবই আবেগপূর্ণ। ছোট একটা মানপত্র পড়ে ফেন ফ্যাং, প্রেসিডেন্টের মেয়ে। মানপত্রে আহমদ মুসার উপর, তার পরিবারের উপর, মুসলিম জনগোষ্ঠীর উপর যে অবিচার হয়, তা স্মরণ করা হয় এবং বলা হয় অত্যাচারী সে সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর পতন হয়েছে, চীনে তাদের উত্থান আর কখনই ঘটবে
আমরা সকলে সকলের তরে-আহমদ মুসার এই শিক্ষা, আহমদ মুসার মহান ধর্মের এই আদর্শ আহমদ মুসার মাধ্যমেই আমাদের মহান। চীনে মৈত্রী, সহমর্মিতা, সহযোগিতার এক নতুন দিনের সূচনা করেছে। আহমদ মুসার কাছে এটা আনন্দের, কিন্তু তার চেয়ে বড় আনন্দের আমাদের কাছে। আমাদের ভাবতে ভালো লাগছে তিনি আমাদের, আমাদের মহান চীনের মানুষকে মাফ করেছেন। মাফ করেছেন বলেই তো ফিরে এসেছেন। আবার তার হারিয়ে যাওয়া, দূরে সরে যাওয়া আমাদের জন্যে হবে অসহনীয় কষ্টের। পড়তে গিয়ে বারবার কান্নায় আটকে গেছে। ফেন ফ্যাং-এর কণ্ঠ। ফেনের সাথে সবাই কেঁদেছে।
আহমদ মুসাও অশ্রু রোধ করতে পারেনি।
প্রেসিডেন্ট বলেছিল, মা ফেন আনন্দের অনুষ্ঠান করতে গিয়ে তুমি কাঁদলে, সবাইকেই কাঁদালে! প্রেসিডেন্টের কণ্ঠও ছিল অশ্রুসিক্ত।
আহমদ মুসার বিদায়ের ক্ষণটি হয়ে উঠেছিল আরও অশ্রুসিক্ত।
মা চু ইং ও ইরকিন আহমেদ ওয়াং দুজনেই এক সাথে আহমদ মুসাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলেছিল। বলেছিল, আমরা আমাদেরকে চিনতাম না, চীনকেও চিনতাম না। তুমি অসাধ্যসাধন করে গেলে বাবা।
সিংকিয়াং-এর সাবেক গভর্নর ও নেইজেনের বাবা লি ইউয়ান আহমদ মুসাকে বুকে টেনে নিয়ে বলেছিল, তোমাকে বলার মতো আমার কিছু নেই। তুমি যা তাই করেছ। শুধু আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করি যে, তিনি দয়া করে চীনে তোমাকে পাঠিয়েছিলেন।
আহমদ মুসা তাকে কানে কানে বলেছিল, স্যার, পলিটব্যুরোর একজন প্রবীণ সদস্যকে সিংকিয়াং-এর গভর্নর বানাবেন। আপনি ডেপুটি গভর্নরের পদ নিতে অস্বীকার করবেন না।
বলে তুমি ভালো করেছ। বলেছিল লি ইউয়ান। পিতার পাশেই দাঁড়িয়েছিল নেইজেন ও আহমদ ইয়াং। দুজনেরই চোখে জল। আহমদ মুসা ওদের দিকে এগিয়ে গিয়ে হেসে বলেছিল, পুরনো ভাইকে চেনার পরেও কাঁদছ কেন?
দুহাতে মুখ ঢেকে কেঁদে উঠেছিল নেইজেন।
বিদায়ের সময় স্বজনদের কাঁদতে নেই। বলেছিল আহমদ মুসা।
নেইজেন তাড়াতাড়ি হাত সরিয়ে ওড়না দিয়ে চোখ মুছে বলল, মানুষকে শুধু কাঁদান, হাসতে দেন না আপনি মানুষকে।
আল্লাহকে বল, আমাকে নয়। তাহলে দেখবে একদিন কোনো সুখবর পেলে এসে হাসিয়ে যাব।
বলে আহমদ মুসা এগোলো বর ও কনেবেশী মা ঝু ও লিয়েন হুয়ার দিকে। ওদেরও চোখে অশ্রুর প্রবাহ।
অশ্রু মুছে ফেল মা ঝু, লিয়েন হুয়া। তোমরা সমাজ বিনির্মাণের সৈনিক। জনগণের জন্য নতুন চীন গড়ার তোমরা সিপাহসালার। কান্না তোমাদের জন্যে নয়। বলেছিল আহমদ মুসা আদর ভরা শক্ত কণ্ঠে।
আমাদের আরেকটু বকে দিন ভাইয়া। এমন বকার জন্যে আর আপনাকে পাব না। কান্নারুদ্ধ কণ্ঠে বলেছিল লিয়েন হুয়া।
ভাইয়া, আমাদের এ নতুন জীবন আপনার দান। একটু সময়ও আমাদের দিলেন না। বলেছিল মা ঝু। কান্নাজড়িত কণ্ঠ তারও।
হেসেছিল আহমদ মুসা। বলেছিল, এসব নিয়ে ভেব না। জীবনের গোটা সময় তো সামনে। আর পৃথিবীটা তো গোল। দেখা হয়েই যাবে এক-সময়।
হঠাৎ চোখ পড়ল ফা জি ঝাও-এর উপর। কানশুর উৎসবের পোশাক তার পরনে। সে মা ঝুদের পাশেই দাঁড়িয়েছিল। অন্যদের মতো তার চোখে অশ্রু নেই। কিন্তু তার মুখ আষাঢ়ে মেঘের মতো জলে ভরা।
আহমদ মুসা একধাপ এগিয়ে তাকে সালাম দিয়েছিল। বলেছিল, কেমন আছেন? সেদিন আপনি দোয়া করে এসেছিলেন। আল্লাহ সাহায্য করেছেন।
ফা জি ঝাও-এর চেহারায় কেমন একটা আপনহারা ভাব। আহমদ মুসার কথা সে শুনতে পেয়েছিল কিনা বোঝা যায়নি। আহমদ মুসার কথার দিকে না গিয়ে সে বলেছিল, সবাইকে তো কিছু বলছেন, আমার জন্যে কি কিছু বলার আছে?
অবশ্যই ম্যাডাম ফা জি ঝাও। আমি আপনাকে খুঁজছিলাম। আমার বলার বিষয় হলো, আপনি চীনের বিজ্ঞানী কিন্তু আমার কাছে মুসলিম দুনিয়ার আপনি সবচেয়ে মূল্যবান ব্যক্তি। আপনাকে আল্লাহ যা দিয়েছেন, তা সম্ভবত আর কাউকে দেননি। এজন্যে আপনার প্রতিটি মুহূর্ত মূল্যবান। মূল্যবান সময়ের সদ্ব্যবহার আপনাকে করতে হবে। বলেছিল। আহমদ মুসা।
ফা জি ঝাও কিছুক্ষণ চুপ করেছিল। পরে বলল, আর কিছু স্যার?
আহমদ মুসা একটু চিন্তা করে বলেছিল, আমার মন বলছে যদি আপনার কাছ থেকে সব সময় আপনার কাজের প্রতিটি অগ্রগতি সম্পর্কে জানতে পারতাম! কিন্তু তা হবার নয়, রাষ্ট্রের সিক্রেট আইনে আপনি বাঁধা।
শুনে কিছুক্ষণ নীরব ছিল ফা জি ঝাও। পরে বলেছিল, আপনার চাওয়ার চেয়ে বড় কিছু আমার কাছে নেই। গম্ভীর কণ্ঠ ফা জি ঝাও-এর।
আহমদ মুসা কিছু বলতে যাচ্ছিল। তখন সামনে এসে দাঁড়ায় জেনারেল হু ফেং।
আহমদ মুসা সেদিকে তাকিয়ে এগোলো তার দিকে।
জেনারেল হু ফেং এসে জড়িয়ে ধরল আহমদ মুসাকে। বলেছিল, জনাব আহমদ মুসা, আপনার সম্পর্কে আগেও শুনেছি। এবার দেখার সৌভাগ্য হলো। আপনি কী যাদু জানেন আমি জানি না। অন্য অনেক স্থানের মতো চীনে এসে আপনি অসাধ্যসাধন করেছেন, আপনি শুধু চীনের মানুষকে জয় করেননি, তার আগে প্রেসিডেন্ট ভবনও জয়। করেছেন। ধন্যবাদ আপনাকে, অনেক ধন্যবাদ।
ধন্যবাদ আমাকে নয়, আল্লাহকে দিন। বলেছিল আহমদ মুসা।
আলহামদুলিল্লাহ।
বলে একটু থেমেছিল জেনারেল হু ফেং। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই আবার বলে ওঠে, আপনি করে গেলেন, তা রক্ষা করা এখনকার সবচেয়ে বড় কাজ। আমার জন্যে আপনার কোনো পরামর্শ আছে?
আপনি আল্লাহর সৈনিক হোন। তাহলে সব মানুষ আপনার কাছ থেকে সুবিচার পাবে। এখন সুবিচার সবচেয়ে বড় প্রয়োজন। বলেছিল আহমদ মুসা।
ধন্যবাদ স্যার। বলেছিল জেনারেল হু ফেং।
প্রেসিডেন্ট ও ম্যাডাম প্রেসিডেন্টের কাছে বিদায় নিতে গিয়েছিল আহমদ মুসা। হঠাৎ তার মনে পড়ল ফেন ফ্যাংকে তো সে কোথাও দেখছে না। ১ ম্যাডাম প্রেসিডেন্টের দিকে চেয়ে বলল, মা ফেনকে তো দেখছি না! ঘুমিয়ে গেল না তো।
হাসল ম্যাডাম প্রেসিডেন্ট। ইশারা করে আহমদ মুসাকে পাশের রুম দেখিয়ে দিল। পাশের রুমে গেল আহমদ মুসা।
দেখল, দুই হাতে মুখ ঢেকে সোফায় হেলান দিয়ে বসে আছে ফেন ফ্যাং।
আহমদ মুসা গিয়ে তার সামনে দাঁড়াল। দুই হাত টেনে নিল তার মুখ থেকে। অশ্রুর প্লাবন তার দুই গণ্ডে।
আহমদ মুসা নরম সান্ত্বনার কণ্ঠে বলল, ভাইয়াকে বিদায় দিতে এভাবে কাঁদতে নেই ফেন।
ফেন সোফা থেকে উঠেই ছুটে এসে জড়িয়ে ধরল আহমদ মুসাকে। কান্নায় ভেঙে পড়ে বলল, ভাইয়া চলে যাচ্ছেন, আর দেখা হবে না, এটা সহ্য করতে পারছি না। আমার চারদিকের পৃথিবীটা ছোট হয়ে যাচ্ছে, এক অন্ধকার আষ্টেপৃষ্ঠে ঘিরে ধরছে। দম যেন আমার বন্ধ হয়ে আসছে ভাইয়া।
আহমদ মুসা নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে ফেনকে সোফায় বসিয়ে দিয়ে বলেছিল, ফেন, আমি কি খুব দূরে যাচ্ছি? তোমাদের কাশগড় থেকে পূর্ব আফ্রিকা তো খুবই কাছে। আমার বাড়ি মদিনা, সেটা তো আরও কাছে। সুতরাং ভাবার কি আছে। টেলিফোন, মোবাইল ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রতিদিন প্রতি মিনিটেই তো যোগাযোগ করা যায়।
আমি আপনাকে কল করে পাব? যোগাযোগ মাধ্যমে পাব? রাগ করবেন না তো? কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেছিল ফেন ফ্যাং।
হেসেছিল আহমদ মুসা। বলেছিল, এসব কি কোনো প্রশ্ন হলো! চল, উঠ।
উঠে দাঁড়িয়েছিল ফেন ফ্যাং। এসেছিল আহমদ মুসার সাথে।
প্রেসিডেন্ট ও ম্যাডাম প্রেসিডেন্ট যে রুমে বসেছিল, সেখানে এলো আহমদ মুসা ও ফেন ফ্যাং।
আহমদ মুসা তোমার জিনিস পৌঁছে গেছে।
বলে প্রেসিডেন্ট একটা সুদৃশ্য প্যাকেট আহমদ মুসার হাতে তুলে দিল।
প্যাকেটটি নিয়ে আহমদ মুসা প্রেসিডেন্টকে উদ্দেশ্য করে বলল, এক্সিলেন্সি, আপনার একটা অনুমতি চাই।
কিসের অনুমতি? বলেছিল প্রেসিডেন্ট।
এক্সিলেন্সি, আমি কুবলাই খানের ধনভাণ্ডার থেকে এই যে আটটি নেকলেস পেয়েছি, সেটা আমি নিয়েছি আমার আট স্নেভাজনকে দেব। বলে। আপনার অনুমতি চাই এক্সিলেন্সি। বলেছিল আহমদ মুসা।
রাজ্যের বিস্ময় এসে আছড়ে পড়ল প্রেসিডেন্টের চোখে-মুখে। কিছুক্ষণ স্তম্ভিত দৃষ্টিতে আহমদ মুসার দিকে তাকিয়ে থেকে বলেছিল প্রেসিডেন্ট, তার মানে আহমদ মুসা, কুবলাই খানের ধনভাণ্ডার থেকে তুমি কিছুই নেবে না?
চীন ও চীনের জনগণ যা পেল, সেই পাওয়ার সাথে তো আমিও শামিল আছি। এক্সিলেন্সি। বলেছিল আহমদ মুসা।
আহমদ মুসা, তোমাকে চিনতে আমাদের আরও বহু সময় দরকার। তুমি এতটা নিঃস্বার্থ, এতটা নির্লোভ, সব মানুষকে এতটা আপন ভাবতে পার বলেই তাদের জন্যে জীবন বাজি রেখে কাজ কর এবং এ কারণেই তুমি অজেয় আহমদ মুসা। জানি না এটাই মুসলিম চরিত্র কিনা। যদি তা হয় তাহলে মুসলমানরাই হবে দুনিয়াতে অজেয়। বলেছিল প্রেসিডেন্ট।
এক্সিলেন্সি, শুধু মুসলিম চরিত্রের নয়, এ গুণগুলো মুলত মানব চরিত্রের। এগুলো মানব চরিত্রের মৌলিক গুণ বলেই এ গুণগুলো আবার মুসলিম চরিত্রেরও। আহমদ মুসা বলেছিল।
তার মানে তুমি বলতে চাচ্ছ, প্রকৃত মানব চরিত্রই আসলে মুসলিম চরিত্র। বলেছিল প্রেসিডেন্ট।
ইয়েস এক্সিলেন্সি। কোনো মানব চরিত্র যখন এ গুণগুলো গ্রহণ করে, তখন তার পরিচয়সূচক বিশেষ নাম হয় মুসলিম। আর এই মুসলিম নামকরণ আমাদের প্রফেট-এর সময় তা তার দ্বারা হয়নি, প্রফেট আব্রাহাম (ইবরাহিম আ.) এই মুসলিম নামকরণ করেন। বলেছিল আহমদ মুসা।
বিস্ময় ফুটে উঠেছিল প্রেসিডেন্টের চোখে মুখে। বলেছিল, তাহলে তো প্রফেট মোসেস, জেসানসহ বনি ইসরাইলের সব প্রফেটের অনুসারীরা মুসলিম ছিল?
ইয়েস এক্সিলেন্সি। বলেছিল আহমদ মুসা।
ধন্যবাদ আহমদ মুসা। অনেক বিষয় আজ জানা হলো। অনেক ধন্যবাদ তোমাকে।
থেমেছিল একটু প্রেসিডেন্ট। বলেছিল আবার, তোমার সেই স্নেহভাজন আটজন কে আহমদ মুসা?
এক্সিলেন্সি, তাদের একজন হলো আমার এই বোন ফেন ফ্যাং। আরেকজন সদ্যবিবাহিতা লিয়েন হুয়া। আপনার বাড়িতে আজ হাজির অন্য দুজন হলো আহমদ ইয়াং-এর স্ত্রী নেইজেন এবং মা ঝুর বড় বোন বিজ্ঞানী ফা জি ঝাও। অবশিষ্ট চারজন এখানে হাজির নেই এক্সিলেন্সি। তাদের একজন লু ঝির পিএ চেং ঝি। অন্য তিনজন হলো হেংসেন পাহাড়ে বসবাসকারী প্রাচীন পরিবারের প্রধান জি ঝি সেংগ-এর মেয়ে নে নুয়া এবং হেংসেন পাহাড়ে উইঘুর উদ্বাস্তু লোকদের প্রধান ওয়াং আলীর মেয়ে উম্মে খাওলা হুই ফেং এবং সর্বশেষ মানে চতুর্থজন হলো, নানিয়ান প্রাসাদ রক্ষা স্কোয়াডের প্রধানের প্রথম সন্তান সদ্যভূমিষ্ট পিতৃহারা মেয়ে জি জিয়ান। বলেছিল আহমদ মুসা।
প্রেসিডেন্ট হাসল। বলল, তুমি এত ব্যস্ত মানুষ, এদের সকলের কথা, তোমার মনে পড়ল কি করে? প্রেসিডেন্ট বলেছিল।
এক্সিলেন্সি, এদের মধ্যে কয়েকজন আছে যারা ভবিষৎ চীনের একটি করে উজ্জ্বল প্রতিভা। কয়েকজন আছে যারা আমার স্বজনের চেয়েও স্বজন। তাদের কাছে এ উপহার রাখতে চাই আমার স্নেহ ও শুভেচ্ছার নিদর্শন হিসাবে। আর হিরার নেকলেসটি জি জিয়ানের কাছে যাবে তার বাবার উপহার হিসাবে, যে বাবাকে দেখার তার সৌভাগ্য হয়নি। বলেছিল আহমদ মুসা।
ধন্যবাদ আহমদ মুসা, মনটা তোমার খুবই সেনসেটিভ, খুবই স্নেহপ্রবণ। তোমার মতো একজন সৈনিকের এমন মন খুবই বিস্ময়কর! সত্যিই অতুলনীয় এক মানুষ তুমি! আমি ওদের ডাকছি। তুমি চারজনকে দিয়ে যাও। অবশিষ্টদের ব্যবস্থা আমি করব। প্রেসিডেন্ট বলেছিল।
প্লিজ এক্সিলেন্সি, আমি শুধু ফেনকে দিচ্ছি। ওদের আপনি দিয়ে দেবেন। হাতে সময় বেশি নেই। সবাইকে ডাকলে অনেক কথা হবে।
বলেই আহমদ মুসা ম্যাডাম প্রেসিডেন্টের হাতের মোড়ক থেকে একটা হিরার নেকলেস তুলে নিয়ে এগোলো ফেন ফ্যাং-এর দিকে। নেকলেসটি তুলে ধরেছিল ফেন-এর দিকে। বলেছিল, ভাইয়ের এ উপহারটি গ্রহণ করো ফেন।
ফেন-এর অশ্রুভরা দুই চোখ। অশ্রু গড়াচ্ছিল দুগণ্ড দিয়ে। সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে মাথাটা একটু ঝুঁকিয়ে এগিয়ে দিয়েছিল আহমদ মুসার দিকে। বলেছিল, পরিয়ে দিন।
বোন ফেন, আজ নয়, আমি চাই তোমার জীবনের এক শুভ দিনে এ নেকলেসটা তুমি পরবে। বলেছিল আহমদ মুসা।
আজ আমার জীবনের শুভ দিন। বলেছিল ফেন ফ্যাং।
দিন শুভ হলে চোখে অশ্রু থাকে না। আহমদ মুসা বলেছিল।
সব অঞই দুঃখের হয় না, আনন্দেরও হয়। প্লিজ, পরিয়ে দিন। বলেছিল ফেন ফ্যাং।
আহমদ মুসা ফেনকে পরিয়ে দিয়েছিল হিরের নেকলেসটি। সঙ্গে সঙ্গেই অঞরুদ্ধ ফেন আছড়ে পড়েছিল আহমদ মুসার পায়ের উপর।
এটা কি করলে ফেন? এটা চীনা রীতি নয়, মুসলিম রীতিও নয়। বলেছিল আহমদ মুসা।
উঠে দাঁড়িয়েছিল ফেন। বলে ওঠে সে, আমি জানি ভাইয়া। আমি এটা ভারতীয় ফিল্মে দেখেছি। আমার এক শুভ দিনে জীবনে মাত্র একবারের জন্যেই তাদের কপি করলাম।
ধন্যবাদ ফেন।
বলে আহমদ মুসা তাকিয়েছিল প্রেসিডেন্টের দিকে।
হ্যাঁ, আহমদ মুসা। সব রেডি আছে। তোমার জন্যে সবাই অপেক্ষা করছে।
অনেক অশ্রু মাড়িয়ে প্রেসিডেন্ট ভবন থেকে বেরিয়ে এসেছিল আহমদ মুসা।
গাড়ি ছুটে চলছিল বিমানবন্দরের দিকে।
এয়ার চায়নার এক সামরিক বিমান আহমদ মুসাকে পৌঁছে দেয় করাচি বিমানবন্দরে। সেখান থেকে আহমদ মুসার নতুন গন্তব্যে যাত্রা, তানজানিয়া এয়ারলাইনসের একটা বিমানে, বুরুন্ডির বুজুমবুরার উদ্দেশ্যে।
আহমদ মুসার জন্যে কষ্টকর বিদায়ের শেষ দৃশ্যটার পরে আহমদ মুসা প্রবেশ করছিল বিমান-এর গ্যাংওয়েতে।
বিদায় দেয়ার জন্যে দাঁড়ানো সকলকে সরিয়ে দিয়ে ছুটে এলো ফেন ফ্যাং। দাঁড়াল আহমদ মুসার সামনে পথ রোধ করে। বলল, বোনকে তো আপনি দিয়েছেন, কিন্তু বোনের তো কিছু দেয়া হয়নি, মনেই পড়েনি।
বলে এদিকওদিক তাকিয়ে ছুটে গেল যাত্রীদের স্বাগত জানানোর জন্যে দাঁড়ানো এয়ার লাইন্সের দুই মেয়ের দিকে।
মেয়ে দুটোর হাতে ফুলের গুচ্ছ। ফুলগুলো সুন্দর, কিন্তু গন্ধহীন।
একটাও গোলাপ কুঁড়ি নেই? বলল দ্রুত কণ্ঠে ফেন ফ্যাং।
মেয়েটি একটু মাথা নুইয়ে সম্ভ্রমযুক্ত কণ্ঠে বলল, স্যরি ম্যাডাম, এই সিজনে গোলাপ খুব কম পাওয়া যায়।
ধন্যবাদ। ওদের হাতে রাখা ফুলের গুচ্ছ থেকে বাছতে লাগল ফেন। কিন্তু পছন্দ হচ্ছে না একটাও।
ম্যাডাম আপনার কোটের পিন হোলে কিন্তু একটা গোলাম কুঁড়ি দেখছি। একটি মেয়ে হেসে বলল।
কোটের পিন-হোলের দিকে তাকিয়ে উজ্জ্বল হয়ে উঠল ফেন-এর মুখ।
পিন-হোল থেকে গোলাপ কুঁড়িটি খুলে নিয়ে মেয়েটিকে একটা ধন্যবাদ দিয়ে ছুটল আহমদ মুসার কাছে। গিয়ে দাঁড়াল আহমদ মুসার সামনে। ডান হাতে ধরা ফুলটা আহমদ মুসার দিকে বাড়িয়ে ধরে মাথাটা একটু সামনে ঝুঁকিয়ে বলল, চীনের এক সামান্য মেয়ের পক্ষ থেকে তার ভাইয়ার জন্যে অসামান্য এক উপহার।
ফেনের এই পাগলামিতে বিব্রত বোধ করছিল আহমদ মুসা। তবে আহমদ মুসা ভেবে নিয়েছিল যে, তাকে বাধা দিলে সে আরও কোনো পাগলামি করে বসতে পারে। সে বড় হয়েছে, কিন্তু বয়স বাড়েনি।
আহমদ মুসা ফেন-এর গোলাপ কুঁড়িটা নিয়ে ধন্যবাদ দিল।
কোথায় রাখবেন ভাইয়া এ উপহারটা? বলল ফেন।
স্মৃতিতে। হেসে বলল আহমদ মুসা।
না, না, তা চলবে না। আপনার স্মৃতি সহস্র সহস্র অধ্যায়ের। মহাকাব্য।
একটু থামল ফেন ফ্যাং। তাকাল আহমদ মুসার দিকে। বলল, এটা রাখবেন আপনার খুব জরুরি একটা বইয়ের ভেতর। যখনই বইটা খুলবেন, তখনই বিরক্ত হয়ে বইয়ের মধ্যে এভাবে কি রাখা আছে তা দেখার জন্যে পাতা উল্টাবেন। দেখবেন, শুকিয়ে যাওয়া ফুলকলির কিছু। ঝরে যাওয়া পাপড়ি তখন মনেও পড়ে যেতে পারে চীনা এই মেয়েটাকে না, মনে পড়লেও ক্ষতি নেই, শুকনো পাপড়িরা কষ্ট পাবে না। কারণ ওতে প্রাণ থাকবে না।
কান্নারুদ্ধ কণ্ঠে কথা শেষ করেই মাথা নিচু করে ছুটে পালাল ফেন ফ্যাং।
লিয়েন হুয়া কয়েক ধাপ এগিয়ে এসে ফেনকে ধরে বুকের কাছে টেনে নিয়ে পিছু হটে সবার সাথে গিয়ে দাঁড়াল।
উনি যত কাজ করেছেন এবং যত মানুষকে কাঁদিয়েছেন, মাপে তার কোন পাল্লাটা বেশি ভারি হবে আমি জানি না! বলল নেইজেন। তার কণ্ঠ ভারি।
ওঁর দিকটাও ভাব বোন। যিনি কাঁদেন, তিনিই কাঁদাতে পারেন। বলল ফা জি ঝাও। তার চোখে একটা অন্তহীন শূন্য দৃষ্টি।