আবার আফ্রিকার অন্ধকারে – ২

বেইজিং প্রেসিডেন্ট প্রাসাদের ফ্যামিলি গেস্ট রুমের বেডে ঘুমিয়েছিল আহমদ মুসা।

হেলিকপ্টারেই আহমদ মুসা ফজরের নামাজ পড়ে নিয়েছিল। দরজায় নক হওয়ার শব্দ আহমদ মুসাকে জাগিয়ে দিল। চোখ মেলে আহমদ মুসা ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল সকাল ৯টা।

দুবার নক হয়েছিল দরজায়। আবার নক হলো।

ভ্রু কুঞ্চিত হলো আহমদ মুসার। কে নক করছে। এ নক তো তার প্রটোকল অফিসার কিংবা গেস্ট উইং-এর প্রধান মাদাম চেন হুয়ার নয়। মাদাম চেন হুয়া সকাল ৯টায় আসতে চেয়েছিলেন, এটা ঠিক।

প্রেসিডেন্টের এ ফ্যামিলি গেস্ট রুমে আহমদ মুসা এসে পৌঁছেছে ভোর। সাড়ে পাঁচটায়।

হেলিকপ্টারেই একজন সেনা অফিসার তাকে জানিয়েছিল, স্যার। প্রেসিডেন্টের অতিথি হিসাবে যাচ্ছেন তার প্রাসাদে। ম্যাডাম চেং ঝিকে নেয়া হচ্ছে রাষ্ট্রীয় গেস্ট রুমে। আর লু ঝির লাশ এখান থেকে আপাতত যাবে সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে। আহমদ মুসা বিস্মিতই হলো, দরজায় নকটা মাদাম চেন হুয়া অথবা প্রোটোকল অফিসারের নয় কেন?

শোবার আগে সর্বশেষ তার দেখা হয়েছিল প্রোটোকল অফিসারের সাথে। ওয়াশ রুম থেকে ফ্রেশ হয়ে এসে তোয়ালে দিয়ে হাত মুখ মুছে আহমদ মুসা বেডের দিকে একবার তাকিয়ে দরজায় এসে দাঁড়ানো প্রোটোকল অফিসারকে লক্ষ করে বলেছিল, ধন্যবাদ, তুমি যাও। আমি এখন বিশ্রাম নেব।, তখনই সে বলেছিল, স্যার, সাড়ে নটায় প্রেসিডেন্টের সাথে আপনার নাশতা। সাড়ে দশটায় চীনের মুসলিম নেতৃবৃন্দের সাথে আপনার বৈঠক। নয়টার দিকেই আপনাকে উঠতে হবে।

সুতরাং কোনো কারণে মাদাম চেন হুয়া না এলে তার মেসেজ নিয়ে প্রোটোকল অফিসারের আসাই স্বাভাবিক ছিল।

তিনবার নক হবার পর আহমদ মুসা দ্রুত বেড থেকে নেমে এলো। তার পরনে ঘুমানোর পোশাক। কিন্তু পাল্টানোর সময় নেই। তিনবার নক হওয়ার পর আর দেরি করা ঠিক নয়। জরুরি কোনো বিষয় হতে পারে।

আহমদ মুসা দরজার দিকে এগোতে গিয়েও ফিরে এসে বালিশের তলা থেকে রিভলবার নিয়ে শোবার পোশাকের পকেটে রাখল। ডান হাত আহমদ মুসার রিভলবারের সাথে পকেটেই থাকল।

স্লাইডিং ডোর।

বাম হাত দিয়ে আহমদ মুসা দরজার লক খুলে ফেলল। লক খোলার সাথে সাথেই অটোডোর ধীরে ধীরে খুলে যেতে লাগল।

আহমদ মুসার সামনে থেকে দরজা সরে যেতেই তিন ফুট সামনে দাঁড়ানো প্রেসিডেন্ট প্রাসাদের স্টাফ অফিসারের ইউনিফরম পরা একজন যুবক বলে উঠল, গুড মর্নিং স্যার। সঙ্গে সঙ্গে তার ডান হাতও আহমদ মুসার দিকে উঠে এলো হ্যান্ডশেকের ভঙ্গিতে।

আহমদ মুসার সন্ধানী চোখ যুবকটিকে দেখছিল।

যুবকটির ডান হাতের দিকে চোখ পড়তেই আহমদ মুসা তার হাতে ছোট। একটা কলম দেখতে পেল।

মুহূর্তেই আহমদ মুসার রক্ত ও ধমনি জুড়ে একটা বিপদের সাইরেন বেজে উঠল। সঙ্গে সঙ্গেই আহমদ মুসা তার দেহকে পেছন দিকে ছুঁড়ে দিল।

মাটিতে পড়ে যাবার আগেই তার ডান হাত পকেট থেকে রিভলবার নিয়ে বেরিয়ে এসেছিল। আহমদ মুসার দেহটি যখন মাটিতে পড়ল তার আগেই তার তর্জনি রিভলবারের ট্রিগারে চেপে বসেছিল। বুকে গুলি খেয়ে সিটকে পড়ে গেল লোকটির দেহ মাটিতে। গুলিবিদ্ধ হওয়ার আগেই যুবকটির কলমাকৃতির ভয়ংকর গান থেকে আলপিন ধরনের বিষাক্ত বুলেট ছুঁড়েছিল। আহমদ মুসা পেছন দিকে ছিটকে না পড়লে পিন বুলেটটি তার বুকে ঢুকে যেত। পিন বুলেটটি টার্গেটে আঘাত করতে ব্যর্থ হয়ে বিপরীত দিকে দেয়ালের কাছের কভারে গিয়ে বিদ্ধ হয়েছে।

আহমদ মুসা বুলেটটির দিকে একবার তাকিয়ে বাইরে ছুটে গেল যুবকটির কাছে। গুলির শব্দে ছুটে এসেছে সিকিউরিটি পারসোনালরা এবং প্রেসিডেন্ট প্রাসাদের এ অংশের দায়িত্বশীল কর্নেল নে উইন।

আহমদ মুসা যুবকটির পাশে বসে পরীক্ষা করে দেখল সে বেঁচে আছে।

আহমদ মুসা তার পালস দেখার জন্যে তার গলায় হাত রাখতেই লোকটি দ্রুত চোখ মেলল এবং তার ডান হাতটি আহমদ মুসার লক্ষে তুলে আনার চেষ্টা করল। কিন্তু পারল না। কয়েক ইঞ্চি উঠে ধপ করে তা পড়ে গেল। তার সেই হাতে তখনও ধরা ছিল সেই ভয়ংকর কলমাকৃতির গানটি।

যুবকটির চোখে-মুখে তখন মৃত্যুর কষ্ট নয়, হিংসার আগুন দাউ দাউ করে জ্বলছে। চিৎকার করে বলল যুবকটি আহমদ মুসাকে লক্ষ করে, তুমি মাই লর্ডকে হত্যা করেছ, সর্বনাশ করেছ জোয়ান উর আন্দোলনের, জোয়ান উর বাহিনীর। তুমি আসছ জেনেই আমি প্রতিশোধ নেবার জন্যে তৈরি হয়েছিলাম। আমার কাজকে সহজ ও নির্বিঘ্ন করার জন্যে নির্দোষ, গোবেচারা মাদাম চেন হুয়াকে হত্যা করতে হয়েছে তবুও পারলাম না তোমাকে…।

কিন্তু কথা শেষ করতে পারল না সে। সব শক্তি একত্র করেই যেন কথাগুলো বলছিল যুবকটি। প্রবল এক ঝকানি দিয়ে তার দেহ নীরব হয়ে গেল। তার মুখ ঢলে পড়ে গেল একপাশে।

কর্নেল নে উইন ইতিমধ্যেই সব জায়গায় খবর পৌঁছিয়ে দিল। ছুটে এলো প্রেসিডেন্ট হাউজের গোয়েন্দা প্রধান উ ক্যাংগ এবং প্রেসিডেন্ট হাউজের নিরাপত্তা বাহিনীর প্রধান ব্রিগেডিয়ার জি ঝেং জেমিন।

তাদের দেখেই আহমদ মুসর পাশ থেকে উঠে দাঁড়াল কর্নেল নে উইন এবং স্যালুট দিয়ে তাদের স্বাগত জানাল।

আহমদ মুসাও উঠে দাঁড়িয়েছিল।

ব্রিগেডিয়ার জি ঝেং জেমিন আহমদ মুসার দিকে এগিয়ে এলো। তার চোখে-মুখে উদ্বেগ, উত্তেজনা। বলল, স্যার, কিছু বুঝতে পারছি না। এ যুবকটি ছিল মাদাম চেন হুয়ার ডিপুটি মি. লিন জিং, একজন দায়িত্বশীল অফিসার। এসব কি ঘটিয়ে ফেলল সে!

মি. জি ঝেং আপনি কর্নেল নে উইনকে জিজ্ঞাসা করুন। সে সব শুনেছে। যা মি. লিনজিং মৃত্যুর আগে চিৎকার করে বলেছেন। বলল আহমদ মুসা।

ব্রিগেডিয়ার জি ঝেং জেমিন তাকাল কর্নেল নে উইনের দিকে।

কর্নেল নে উইন স্যালুট দিয়ে ইয়েস স্যার বলে মি. লিং জিং মৃত্যুর আগে আহমদ মুসার উদ্দেশ্যে চিৎকার করে যা বলেছিল তা বলল।

ও গড! আমরা প্রেসিডেন্ট হাউজকে এখনও তাহলে পরিষ্কার করতে পারিনি! ষড়যন্ত্রকারীরা এখনও রয়ে গেছে। ব্রিগেডিয়ার জি ঝেং-এর কণ্ঠ আর্তনাদ করে উঠল।

প্রেসিডেন্ট হাউজের গোয়েন্দা প্রধান উ ক্যাংগ কিছু বলতে যাচ্ছিল।

তখন ব্রিগেডিয়ার জি ঝেং-এর অয়্যারলেস বেজে উঠল।

অয়্যারলেসের স্ক্রিনের দিকে একবার তাকিয়েই অ্যাটেনশন হয়ে উঠল। বলল, ইয়েস এক্সিলেন্সি, আমি মি. লিন জিং-এর লাশের কাছে।

ইয়েস এক্সিলেন্সি, আহমদ মুসা স্যারও এখানে আছেন। ওপারের কথা।

শুনে বলল ব্রিগেডিয়ার জি ঝেং।

এক্সিলেন্সি, মি. লিন জিং আহমদ মুসা স্যারকে হত্যা করতে এসেছিল। মৃত্যুর আগে নিজেই সে স্বীকার করেছে, জোয়ান উকে হত্যা এবং জোয়ান উর আন্দোলন ও তার বাহিনীকে শেষ করার অপরাধেই আহমদ মুসা। স্যারকে সে হত্যা করতে এসেছিল। বলল জি ঝেং।

ইয়েস এক্সিলেন্সি, আমি, স্যারকে বলছি। তিনি এখনও শোবার পোশাকেই আছেন। জি ঝেং বলল।

ইয়েস এক্সিলেন্সি। আমি এদিকের সব দেখছি। মি, উ ক্যাংগও এখানে আছেন। জি ঝেং বলল।

গুড মর্নিং এক্সিলেন্সি। জি ঝেং বলল।

অয়্যারলেসে কথা শেষ করেই ব্রিগেডিয়ার জি ঝেং আহমদ মুসাকে লক্ষ করে বলল, স্যার, এক্সিলেন্সি প্রেসিডেন্ট নাশতার টেবিলে আপনার জন্য অপেক্ষা করছেন। আপনাকে নিয়ে যাবার জন্যে ম্যাডাম লিয়েন হুয়া ও ম্যাডাম ফেং আসছেন।

মি. জি ঝেং আপনি মি. লিন জেং-এর কলার ব্যান্ডের উল্টো পিঠ পরীক্ষা করে দেখলেন চীনের প্রাচীন হানজু ভাষার আদি বর্ণ উল্কীর্ণ আছে। এটা প্রমাণ করে মি. লিন জেং জোয়ান উর সন্ত্রাসী দলের সদস্য। এই লোক নিহত হয়েছে এটা প্রকাশ হওয়ার আগে এর বাড়ি সার্চ করা ও এর মোবাইল

পরীক্ষা করা প্রয়োজন। এই লোক আমাকে লক্ষ করে নিডল বুলেট ছুঁড়েছিল, ২ সেই বুলেট দরজার বিপরীত দিকের দেয়ালের কাঠ-কভারে বিদ্ধ আছে।

আহমদ মুসার কথা শেষ হবার আগেই এসে পৌঁছল লিয়েন হুয়া এবং ফেন ফ্যাং। লিয়েন হুয়ার মুখ গম্ভীর। চটুল ফেন ফ্যাং-এর মুখও বিমর্ষ।

হাসিমুখে আহমদ মুসা ওদের স্বাগত জানিয়ে বলল, তোমরা এখানে একটু দাঁড়াও কিংবা আমার ড্রয়িং রুমে গিয়ে বস। কয়েক মিনিট লাগবে আমার তৈরি হতে।

কথা শেষ করে তার কক্ষের দিকে ফিরতে যাবে, এমন সময় দেখল প্রোটোকল অফিসার আসছে। তার হাতে ফুলের তোড়া। তার দৃষ্টি আহমদ মুসার দিকে।

আহমদ মুসা থমকে দাঁড়াল।

প্রোটোকল অফিসার আহমদ মুসার কাছাকাছি হয়ে বলল, স্যার, মাদাম চেন হুয়ার লাশ এই মাত্র পাওয়া গেছে তার অফিস কক্ষের পেছনের বাগানে।

প্রোটোকল অফিসারের কথা শেষ হতেই প্রেসিডেন্ট হাউজের গোয়েন্দা প্রধান উ ক্যাংগ বলল, ইয়েস মি. আহমদ মুসা। এই মুহূর্তে আমরাও খবরটা পেলাম। বিষাক্ত নিডল বুলেটে তাকে হত্যা করা হয়েছে।

সত্যিই অসহনীয় একটা খবর। আল্লাহ তার উপর সদয় হোন। মনে হয়, তাকে হত্যা করার পর তাঁর ডেপুটি আমাকে হত্যা করতে এসেছিল। বলল আহমদ মুসা।

স্যার, মাদাম চেনের টেবিলে এই ফুলের তোড়া পাওয়া গেছে। এই ফুলের তোড়া নিয়েই তিনি আপনার কাছে আসতে চেয়েছিলেন। ফুলের তোড়ার পেপার ব্যান্ডে লেখা আছে গুড মর্নিং মি. আহমদ মুসা। এটা দেখেই আমি নিয়ে এলাম।

কথা শেষ করার সাথে সাথেই ফুলের তোড়াটি আহমদ মুসার দিকে তুলে ধরল প্রোটোকল অফিসার।

আহমদ মুসা ফুলের তোড়াটা হাতে নিল।

ফুলের তোড়াটা হাতে নিতেই তার সতর্ক হাত অনুভব করল, ফুলের তোড়াটা স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি ভারি।

ভ্রু-কুঞ্চিত হলো আহমদ মুসার। প্রশ্ন ফুটে উঠল তার চোখে-মুখে। তাকাল সে ফুলের তোড়ার উপরের পেপার ব্যান্ডের লেখার দিকে।

তাকাল আহমদ মুসা প্রোটোকল অফিসারের দিকে। বলল, অফিসার, দেখুন তো পেপার ব্যান্ডের লেখা কি মাদাম চেনের হাতের?

প্রোটোকল অফিসার দ্রুত তাকাল লেখাটার দিকে। বলল, না স্যার, এটা মাদাম চেনের হাতের লেখা নয়।

তার আশেপাশের কারো লেখা বলে মনে হয়? বলল আহমদ মুসা।

না স্যার, এ লেখা এখানকার আমাদের কারো বলে মনে হচ্ছে না। স্টাইলটা প্রাচীন ধাঁচের। প্রোটোকল অফিসার বলল।

আহমদ মুসার মনের কোণের সন্দেহটা বাস্তব রূপ নিয়ে তার সামনে এসে দাঁড়াল। দ্রুত কণ্ঠে সে বলল, মি. নে উইন, মি. ক্যাংগ এ ফুলের তোড়ায় বোমা আছে।

আর্তনাদ করে মি. উ ক্যাংগ ছুটে এলো। বলল, স্যার, দিন তাড়াতাড়ি, সুইমিং পুলের পানিতে ফেলে দিয়ে আসি।

না মি. ক্যাংগ, ভয় নেই। ফুলের তোড়ার পেপার ব্যান্ডের সাথে বোমার পিনের যোগ আছে। পেপার ব্যান্ড না টানার আগে এর বিস্ফোরণ ঘটবে না। বলল আহমদ মুসা।

ও গড! আমি তো একবার পেপার ব্যান্ড তুলে নিয়ে নতুনভাবে সেট করতে চেয়েছিলাম। বলল প্রোটোকল অফিসার। তার কণ্ঠে আর্তনাদ।

ব্রিগেডিয়ার নে উইন তার অয়্যারলেসে প্রেসিডেন্টকে সব জানিয়ে প্রেসিডেন্ট হাউজের বিস্ফোরক ম্যানেজমেন্ট টিমকে ডেকেছিল। তারা এসে গেল। উ ক্যাংগ-এর হাত থেকে ফুলের তোড়াটা নিয়ে নিরাপদ দূরত্বে সরে গিয়ে বোমাটি নিষ্ক্রিয় করে সেটা হাতে করে নিয়ে এসে টিমের ইনচার্জ বলল ব্রিগেডিয়ার নে উইনকে, অকল্পনীয় ক্ষমতাসম্পন্ন এ বোমা স্যার। পিং পং বল আকারের এ বোমা আণবিক বোমা নয়, কিন্তু আণবিক বোমার ধ্বংস ক্ষমতা এর আছে। এ বোমা সম্পর্কে আমরা পড়েছি, কিন্তু দেখিনি। এ বোমার এখানে বিস্ফোরণ হলে প্রাসাদের এই অংশ সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে যেত।

আঁৎকে উঠল সবাই। শুকিয়ে গেল ব্রিগেডিয়ার নে উইন এবং উ ক্যাংগ এর মুখ। আতঙ্কে চুপসে গেছে লিয়েন হুয়া ও ফেন ফ্যাং। তাদের বিস্ময় দৃষ্টি আহমদ মুসার দিকে।

ঠিক আছে মি. নে উইন, আল্লাহ আমাদের সবাইকে বাঁচিয়েছেন। যাক, আপনারা এদিকের ব্যবস্থা করছেন। আমি পোশাক পাল্টে আসছি।

কথা শেষ করেই তাকাল লিয়েন হুয়া ও ফেন ফ্যাং-এর দিকে। বলল, তোমরা এখানেই দাঁড়াও।

আহমদ মুসা চলে গেল তার কক্ষের দিকে।

.

আহমদ মুসা, লিয়েন হুয়া ও ফেন ফ্যাং নাশতার টেবিলে পৌঁছার পরপরই প্রেসিডেন্ট প্রবেশ করল।

প্রেসিডেন্টকে শুভেচ্ছা জানিয়ে আহমদ মুসা উঠে দাঁড়াল। বলল, দুঃখিত এক্সিলেন্সি, আমার ঝামেলায় আপনাদের নাশতার অস্বাভাবিক দেরি হয়ে গেল।

আহমদ মুসা এবং সবাইকে স্বাগত জানিয়ে বসল প্রেসিডেন্ট তার আসনে। তার মুখ গম্ভীর, কপাল কুঞ্চিত।

কারও মুখে কোনো কথা নেই। নীরবতা ভাঙল প্রেসিডেন্ট।

আহমদ মুসার দিকে তাকিয়ে বলল, আহমদ মুসা, আজ চীনের প্রেসিডেন্ট প্রাসাদে সকালে সংঘটিত দুটি ঘটনা আমাকে যতটা উদ্বিগ্ন করেছে, অতীতের কোনো কিছুতেই আমি এতটা উদ্বিগ্ন হইনি। বিশেষ করে তুমি কতটা বিপদে আছ তা আমি জানি বলেই তোমাকে আমার প্রাসাদে নিয়ে এসেছি। কিন্তু এখানেও তোমার উপর এই ভয়াবহ আক্রমণ আমাকে, সত্যিই হতভম্ব করেছে। এত দ্রুত কীভাবে এটা সম্ভব হলো? তুমি এসেছ এখানে ভোর পাঁচটায়। তার পরেই সব পরিকল্পনা হয়েছে। কীভাবে হতে পারল? তোমার বাঁচাটাও মিরাকল। দুই আক্রমণ থেকে তুমিই তোমাকে বাঁচিয়েছ, আমাদের সিকিউরিটি এবং দায়িত্বশীলরা কোনো সাহায্যেই। আসতে পারেনি।

 প্রেসিডেন্ট থামতেই আহমদ মুসা বলে উঠল, এক্সিলেন্সি, খুব বেশি উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই। আমি মনে করছি, আক্রমণের ব্যাপারটা তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত, বাইরের কোনো হাত বা পরিকল্পনা এতে নেই। উডাং পাহাড়ের ঘটনা ও জোয়ান উর মৃত্যুর খবর জানার পর সে বা তারা যখন দেখল আমি এখানে এসেছি তখন বেপরোয়া হয়েই সে বা তারা আমাকে হত্যার সিদ্ধান্ত নেয়।

এই আক্রমণ পরিকল্পনায় বাইরের কেউ নেই, এ কথা তুমি বলছ কি করে? জিজ্ঞাসা প্রেসিডেন্টের।

এক্সিলেন্সি, আমার প্রথম কথা হলো, এত অল্প সময়ে, এই পরিকল্পনা হওয়া স্বাভাবিক নয়। দ্বিতীয় বিষয়টা এই যে, এ পরিকল্পনায় বাইরের সংশ্লিষ্টতা থাকলে শুধু একজনের উপর এর দায়িত্ব ছেড়ে দিত না। তৃতীয় যে কথা বলব সেটা হলো, পরিকল্পনাটা সুপরিকল্পিত ছিল না। প্রথমে পরিকল্পনা করা হয় ফুলের তোড়ার মধ্যে বোমা রেখে লক্ষ হাসিল করা হবে। এর ফল নিশ্চিত ছিল না মনে করে প্রত্যক্ষ আক্রমণের পদক্ষেপ নেয়। আমি মনে করি আপনার প্রাসাদের গেস্ট উইং-এর ডেপুটি প্রধান মি. লিন জিং এর নিজস্ব উদ্যোগ ছিল এটা। সে ছিল জোয়ান উ বাহিনীর একজন নিবেদিত কর্মী। রাতেই সে জানতে পারে জোয়ান উর মৃত্যু এবং তাদের বিপর্যয়ের কথা এবং জানতে পারে সবকিছুর জন্যে আমিই দায়ী। তারপর সে যখন দেখল সেই আমিই ভোর পাঁচটায় প্রেসিডেন্ট প্রাসাদে তার নাগালের মধ্যে এসেছি, তখন ডু অর ডাই-এর শপথ নিয়ে সে এই কাজ করে। থামল আহমদ মুসা।

ধন্যবাদ আহমদ মুসা, তোমার যুক্তি আমি গ্রহণ করলাম এবং সেই সাথে একটু স্বস্তি পেলাম যে, এই ঘটনার সাথে প্রাসাদের আর কেউ জড়িত নেই। কিন্তু বিস্মিত হচ্ছি, ভয়াবহ ধরনের নিডল বুলেট ও ক্ষুদ্র আকারের, কিন্তু মারাত্মক ধ্বংসকারী ঐ বোমা মি. জেং-এর কাছে ছিল তাহলে? গোয়েন্দা যে রিপোর্ট এই মাত্র পেলাম, তাতে দেখলাম নিডল গানটা এতই ভয়াবহ যে, এই নিডল বুলেট দেহে বিদ্ধ হওয়ার প্রয়োজন হয় না, দেহের চামড়া স্পর্শ করতে পারলেই কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে টার্গেটের মৃত্যু হবে। আর ফুলের তোড়ার বোমাটা পিং পং বল সাইজের বিশেষ ধরনের বোমা, যাতে পারমাণবিক বোমার কিছু চরিত্র আছে। এই বোমা ২০ গজ রেডিয়াসের মধ্যকার সমস্ত স্থাপনা মাটির সাথে মিশিয়ে দেয়, আর ৫০ গজ রেডিয়াসের মধ্যে কোনো প্রাণী বেঁচে থাকে না। এ রকম…।

ও গড! বলে আর্তনাদ করে উঠল আহমদ মুসা ছাড়া উপস্থিত সকলেই।

প্রেসিডেন্ট থেমে গিয়েছিল। বলে উঠল, হ্যাঁ, আঁৎকে ওঠারই কথা। প্রচলিত বোমার এ চরিত্র নেই। কোথায় পেল তারা এ বোমা? আমি উদ্বিগ্ন আহমদ মুসা। আর কি অস্ত্র আছে ওদের অস্ত্রাগারে?

এক্সিলেন্সি, আপনার নির্দেশেই রাত ৩টা থেকে জোয়ান উ বাহিনীর গোটা দেশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা ঘাটি, আড্ডাখানা, অফিসে অভিযান চলছে। জোয়ান উর কম্পিউটার থেকে ওদের সক্রিয় জনশক্তি এবং তাদের ঘাঁটি অফিসের বিস্তারিত তালিকা পাওয়া গেছে। অভিযান শেষ হলে ওদের অস্ত্রের হিসাবও পাওয়া যাবে। আমার বিশ্বাস বহু বিজ্ঞানীকে তারা বহুদিন থেকে ধরে রেখেছিল। তার মধ্যে পরমাণু বিজ্ঞানীও রয়েছেন। আপনি যে। বোমার কথা বললেন, সেটা সেই বিজ্ঞানীদের কারও তৈরি আণবিক বোমার। নিরাপদ কোনো ক্ষুদ্র সংস্করণ হতে পারে। বলল আহমদ মুসা।

দোয়া কর আহমদ মুসা, দেশজোড়া অভিযান যেন আমাদের সফল হয়। এ অভিযানের কৃতিত্বও তোমার। আমি এ অভিযান একদিন দেরিতে, করতে চেয়েছিলম জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদকে গোটা বিষয় অবহিত করার পর? কিন্তু উডাং থেকে দায়িত্বশীল জেনারেল যখন জানাল যে, তাৎক্ষণিক এ অভিযানের প্রতি তুমি জোর দিয়েছ, তখনই তা আমি মেনে নিয়েছি এবং অভিযানের নির্দেশ দিয়েছি। প্রেসিডেন্ট বলল।

এক্সিলেন্সি, এই স্বীকৃতি আপনার উদার হৃদয়ের পরিচায়ক। অধস্তন থেকে নানা পরামর্শ, প্রস্তাব আসবে, তা বাছাই ও গ্রহণ করা আপনার দায়িত্ব। বলল আহমদ মুসা।

প্রেসিডেন্ট কিছু বলতে যাচ্ছিল, তাকে বাধা দিয়ে ফেন ফ্যাং বলল, এক্সকিউজ মি বাবা। একটা জরুরি কথা। স্যার, কীভাবে নিজেকে নিডল গান থেকে রক্ষা করলেন, কীভাবে তিনি বুঝতে পারলেন ফুলের তোড়ায় বোমা আছে, এটা না জানলে আমরা নাশতা খেতে পারবো না।

প্রেসিডেন্টের ঠোঁটে হাসি ফুটে উঠল। বলল, এ জিজ্ঞাসা আমারও ফেন।

বেটা আহমদ মুসা বল। ঘটনা শোনার পর থেকে আমি উন্মুখ হয়ে আছি। বল, কি করে বুঝলে, কি করে বাঁচলে? বলল মাদাম প্রেসিডেন্ট লি চিন হুয়া।

আহমদ মুসা সংক্ষেপে দুই ঘটনা কেন, কীভাবে ঘটেছিল, তা বলল।

প্রেসিডেন্ট, মাদাম প্রেসিডেন্ট, ফেন, লিয়েন হুয়া সকলেরই চোখে-মুখে। বিস্ময়! আহমদ মুসার কথা শেষ হতেই মাদাম প্রেসিডেন্ট লি চিন হুয়া বলল, তুমি লিয়েন হুয়া, ফেন, প্রোটোকল অফিসার ও মাদাম চিন হুয়া সকলেরই দরজায় নক করার ধরন আলাদা করে চেন কীভাবে?

প্রত্যেকটা শব্দেরই একটা নিজস্ব চরিত্র আছে, সেটা খেয়াল করলেই শব্দকে আলাদাভাবে চিনতে পারা যায়। আহমদ মুসা বলল।

ও গড! এটা কি করে সম্ভব! ঈশ্বর তোমার প্রতি অসম্ভব সদয় বেটা। বলল মাদাম প্রেসিডেন্ট লি চিন হুয়া।

ঠিক বলেছ লি চিন। বলেই প্রেসিডেন্ট লি চিন থেকে চোখ ফিরাল আহমদ মুসার দিকে। বলল, নিডলগানের গুলির মুখে সেকেন্ডের মধ্যে কীভাবে তুমি নিজেকে পেছনে মাটিতে ছুঁড়ে দিলে এবং সেই সাথে নিউলগানের দ্বিতীয় গুলি ঠেকাবার জন্যে গুলি করলে লোকটিকে।

আহমদ মুসা হাসল। বলল, এক্সিলেন্সি, যিনি আমাকে বাঁচাতে চান, এটা সেই স্রষ্টা, প্রতিপালক, দয়াময় প্রভুরই কাজ। আমার মাথায় এসেছিল বাঁচার জন্যে কি করতে হবে, কিন্তু কীভাবে করলাম সেটা আমি জানি না।

মাদাম লি চিন-এর কথাই আমি আবার বলছি, তোমার আল্লাহ তোমাকে। অসম্ভব ভালোবাসেন। বলল প্রেসিডেন্ট। তার কণ্ঠ আবেগজড়িত।

এক্সিলেন্সি, আল্লাহ সব মানুষকেই অসম্ভব ভালোবাসেন। কে তাকে মানল, কে মানল না- এসব বিবেচনা না করেই তিনি সব মানুষকে আলো দেন, বাতাস দেন, পানি দেন, শক্তি ও সুস্থতা দেন, আহার দেন, বাসস্থান। দেন, সন্তান-সন্ততি পরিবার দেন, সম্মান-সমৃদ্ধি দেন তার প্রাকৃতিক বিধান অনুসারে। তিনি কষ্ট পান মানুষ যখন পথভ্রষ্ট হয়ে নিজের ক্ষতি করে, অন্যের ক্ষতি করে। যুগে যুগে তিনি নবী, রসুল, ধর্ম পাঠিয়েছেন মানুষ যাতে পথভ্রষ্ট না হয়। বলল আহমদ মুসা।

প্রেসিডেন্ট, মাদাম প্রেসিডেন্টসহ সবারই এবার মুগ্ধ দৃষ্টি আহমদ মুসার দিকে। বলল মাদাম প্রেসিডেন্ট, বেটা তুমি ধর্মনেতা নও, ধর্মবেত্তা পণ্ডিতও নও, ধর্মপ্রচারকও নও, কিন্তু একটা, দুইটা বাক্যে তুমি স্রষ্টা ও তার ধর্মের যে রূপ তুলে ধরলে, তা আমার কাছে শুধু নতুন নয়, অপরূপ। হৃদয়টা সত্যি শীতল হয়ে গেছে। তোমার কথায় দুইটা সত্য আজ আমি জানলাম। এক, আল্লাহ নিঃশর্তভাবে সকলের জন্যে দয়াময় এবং দুই. ধর্ম আল্লাহর, কিন্তু তা সর্বতোভাবে মানুষের উপকারের জন্যে, কল্যাণের জন্যই। ধন্যবাদ বেটা।

আমাদেরও ধন্যবাদ স্যারকে। এ বিষয়ে আরও কথা আছে। কিন্তু সেটা থাক। স্যারকে আমার জিজ্ঞাসা ফুলের তোড়ার পেপারব্যান্ডের লেখাকে আপনি সন্দেহ করেছিলেন কেন? কাগজের ব্যান্ডে যেকোনো কাউকে দিয়ে লিখিয়ে নেয়া যায়। ঐ লেখাকে আপনার সন্দেহজনক মনে হয়েছিল কেন? লিয়েন হুয়া বলল।

আমার উপর আক্রমণ হবার পর সন্দেহ করার মতো নয়, এমন জিনিসও সন্দেহজনক হয়ে উঠে। তাছাড়া ফুলের তোড়া স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি ভারি হওয়া এবং পেপারব্যান্ডের লেখার অ্যালফাবেট প্রাচীন হানজু ভাষার স্টাইলে হওয়া, এই দুটি বিষয় একত্রিত হওয়ার কারণে সন্দেহজনক হয়ে উঠেছিল। বলল আহমদ মুসা।

ধন্যবাদ স্যার। ঐ ধরনের বিপদে পড়লে মানুষের বুদ্ধি লোপ পায়, কিন্তু স্যার, আপনার বুদ্ধি আরও তীক্ষ্ণ হয়ে উঠে। লিয়েন হুয়া বলল।

কারণ তিনি আহমদ মুসা। আজ দুনিয়াতে…

ফেন ফ্যাংকে থেমে যেতে হলো। তার মা মাদাম প্রেসিডেন্ট তাকে বাধা দিয়ে বলল, তোমার স্যার, বেটা আহমদ মুসা বিব্রত হয় প্রশংসার মধ্যে পড়লে। এখন এসো আমরা নাশতা শুরু করি। চাইলে খেতে খেতেও কথা হতে পারে।

ধন্যবাদ লি চিন। আমরা সবাই ক্ষুধার্ত। তাহলে নাশতা শুরু করা যাক। বলল প্রেসিডেন্ট।

নাশতা শেষ হলো, প্রেসিডেন্ট চায়ের কাপটা পিরিচে রাখতে রাখতে বলল আহমদ মুসাকে লক্ষ করে, আহমদ মুসা এসসিএফ (স্পেশাল কমান্ডো ফোর্স) তোমাকে রাষ্ট্রীয় অতিথিভবন পিপলস প্যালেসে নিয়ে যাবে। দেখবে, ওখানেই আমাদের সম্মানিত অতিথিরা আছেন। ওঁদের সভাটা ওখানেই হবে। এখন থেকে তোমার চলাফেরা ও নিরাপত্তা এসসিএফই ম্যানেজ করবে।

কথা শেষ করেই সবাইকে ধন্যবাদ দিয়ে উঠে দাঁড়াল প্রেসিডেন্ট।

আহমদ মুসাও সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়াল। বলল, এক্সকিউজ মি এক্সিলেন্সি, আমি প্রহরীবেষ্টিত না থাকলেই কি বেশি ভালো হতো না। জোয়ান উ বাহিনীর জনশক্তি ও ঘাঁটিগুলোর প্রায় সবই আপনার সরকারের নিয়ন্ত্রণে এসে গেছে। মি. লিন জেং-এর মতো যারা বাইরে আছে, তাদের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ যারা তাদের সন্ধান পাওয়া দরকার। আমি প্রহরী ছাড়া থাকলে আমার কাছে আসা তাদের জন্যে সহজ হবে।

প্রেসিডেন্ট হাসল। সত্যিই আহমদ মুসা তুমি অনন্য। পরার্থে তোমার যে ত্যাগ স্বীকার তার তুলনা নেই। কিন্তু আমরা তোমাকে টোপ বানিয়ে তাদের ধরতে চাই না। এতে যে লাভ, তার চেয়ে ক্ষতির আশঙ্কা অনেক বেশি। একটু থামল প্রেসিডেন্ট।

সঙ্গে সঙ্গেই আবার বলে উঠল, আসি আহমদ মুসা। সবাইকে শুভেচ্ছা। চলে গেল প্রেসিডেন্ট।

প্রেসিডেন্ট চলে যেতেই ফেন ফ্যাং বলে উঠল, স্যার, এখনি তো আপনি চলে যাবেন। আমাদের সময় দেয়ার ওয়াদা আমি আপনাকে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি।

আহমদ মুসা হাসল। বলল ওয়াদা থেকে সরিনি। কিন্তু যদি না পারি তাহলে অবশ্যই তুমি আমাকে মাফ করে দেবে, যেমন দুনিয়ার অনেকে আমাকে মাফ করে দিয়েছে।

হঠাৎ চোখ-মুখ ভারি হয়ে উঠল ফেন ফ্যাং-এর। বলল, মানুষের হৃদয় ভাঙা আপনার অভ্যেস। কিন্তু আমি আপনাকে মাফ করবো না। আবেগে রুদ্ধ হয়ে উঠেছে ফেন ফ্যাং-এর কণ্ঠ।

ম্লান হাসি আহমদ মুসার ঠোঁটে। বলল, ফেন, শুধু একপক্ষ দেখো না। নিজের হৃদয় না ভেঙে কারও হৃদয় ভাঙা যায় না।

আপনার হৃদয় আর আমি ভাঙতে দেব না। বলল ফেন ফ্যাং। কণ্ঠে একরাশ ক্ষোভ ও জেদের সুর।

মিষ্টি হাসল আহমদ মুসা। বলল, ছোট বোনের উপযুক্ত কথা তুমি বলেছ।

সঙ্গে সঙ্গে ফেন ফ্যাং উঠে দাঁড়াল। আহমদ মুসার উদ্দেশ্যে দীর্ঘ বাউ করল। বলল, অনেক ধন্যবাদ, আমার বড় ভাই ছিল না ভাইয়া। অশ্রু জড়ানো কণ্ঠ ফেন ফ্যাং-এর।

মাদাম প্রেসিডেন্টের পিএ দরজায় এসে দাঁড়াল।

এসসিএফ-এর লোকেরা কি এসেছে? জিজ্ঞাসা মাদাম প্রেসিডেন্টের।

ইয়েস ম্যাডাম। বলল পিএ মেয়েটা।

তাহলে উঠছি। মাদাম প্রেসিডেন্টকে লক্ষ করে বলল আহমদ মুসা।

এসো বেটা।

বলেই মাদাম প্রেসিডেন্ট লি চিন তাকাল ফেন ও লিয়েন হুয়ার দিকে। বলল, তোমরা যাও, ভাইকে এগিয়ে দিয়ে এসো।

লিয়েন হুয়া ও ফেন উঠে দাঁড়াল। বেরিয়ে এলো আহমদ মুসাকে নিয়ে।

ভাইয়া: খেয়াল করেছেন, লিয়েন হুয়া আপার মুখে কথা নেই। ফেন। বলল আহমদ মুসাকে।

ফেন সত্যি বলেছে, লিয়েন তুমি অসুস্থ নও তো? আহমদ মুসা বলল। লিয়েন হুয়া কথা বলার জন্যে মুখ খুলেছিল। তার আগেই ফেন বলল, রাতে মা ঝু ভাইয়ার সাথে দেখা হওয়ার পর থেকেই লিয়েন হুয়া আপার এই অবস্থা।

আহমদ মুসা তাকাল লিয়েন হুয়ার দিকে। বলল, উদ্বেগের কিছু নেই লিয়েন হুয়া। আমি মা ঝুর বুলেটবিদ্ধ স্থান পরীক্ষা করেছি। হাড় কিংবা দেহের কোনো বেসিক অর্গানের তেমন ক্ষতি হয়নি। শীঘ্রই সেরে উঠবে।

ধন্যবাদ। অনেক দুর্বল আমাদের মন স্যার।

একটু থেমেই আবার বলে উঠল, আপনাকে অনেক ধন্যবাদ স্যার। লিয়েন হুয়ার কণ্ঠ অঞরুদ্ধ।

আগের ধন্যবাদ-এর অর্থ আছে, পরের এই ধন্যবাদটা কেন? বলল আহমদ মুসা।

স্যার, আমি মা ঝুর কাছে সব শুনেছি, আপনার পৌঁছতে দুএক মিনিটও দেরি হলে সে…। কথা শেষ করতে পারলো না লিয়েন হুয়া। কান্নায় জড়িয়ে গেল তার গলা।

দুই হৃদয়কে এত গভীর ভালোবাসায় জড়িয়েছেন আল্লাহ! খুশি হলো আহমদ মুসা। মনে মনে দোয়া করল, ওদের জীবনকে আল্লাহ আলী (রা.) ও ফাতিমা (রা.)-এর মতো সুন্দর ও সফল করুন।

লিয়েন হুয়ার মনটাকে আহমদ মুসা অন্যদিকে ঘুরিয়ে নেবার জন্যে। বলল, মা ঝুর খবর কখন পেয়েছিলে লিয়েন হুয়া?

মুক্ত হবার পর উডাং পাহাড়ে থাকতেই মা ঝু আমাকে টেলিফোন করেছিল। মোবাইলটা আপনিই তাকে যোগাড় করে দিয়েছিলেন স্যার। বলল লিয়েন হুয়া। তার কণ্ঠ আবারও রুদ্ধ হয়ে উঠেছিল।

স্যার, কাল মা ঝুর খবর পাওয়ার পর থেকেই সে কাঁদছে। ওকে একটু বকে দিন স্যার আপনি। ফেন ফ্যাং বলল।

এমনিই সে কাঁদছে, তার উপর তুমি তাকে বকতে বলছ?

কথা শেষ করেই লিয়েন হুয়াকে লক্ষ করে আহমদ মুসা বলল, আচ্ছা লিয়েন হুয়া, এক্সিলেন্সি প্রেসিডেন্ট মানে তোমার মামা মা ঝু মুক্তির ব্যাপারে তোমাকে কিছু বলেন নি?

স্যরি স্যার, বলতে ভুলে গেছি। আমরা গতরাতে কেউ ঘুমাইনি। আপনি যখন বন্দীদের উদ্ধারের জন্যে ড্রাগন কেভ প্রাসাদে প্রবেশ করেন, তখনই মামা আমাকে ডেকে সেই কথা বলেছিলেন। এরপর মা ঝুর টেলিফোন পাবার কিছুক্ষণ পরে মামাই আমার ঘরে ছুটে এসেছিলেন। বলেছিলেন, লিয়েন মা মা ঝুসহ বন্দীরা মুক্ত হয়েছে। মা ঝু আহত, কিন্তু সিরিয়াস কিছু নয়। ওরা বেইজিং আসছে।

আলহামদুলিল্লাহ। আহমদ মুসার মুখে উচ্চারিত হলো।

ভাইয়া, আলহামদুলিল্লাহর অর্থ আমি শিখেছি। লিয়েন আপার কথা শুনে আল্লাহর প্রশংসা করলেন কেন? বলল ফেন ফ্যাং।

লিয়েন ও মা ঝুর রিলেশনকে তোমার বাবা কীভাবে নেবেন? এ ব্যাপারে আমার উদ্বেগ ছিল। বুঝলাম উনি ভালোভাবেই নিয়েছেন, তাই আল্লাহর প্রতি আমি কৃতজ্ঞতা জানালাম। আহমদ মুসা বলল।

এ ক্ষেত্রে আপনার কৃতিত্ব বেশি ভাইয়া স্যার। বলল ফেন ফ্যাং।

কেমন? আহমদ মুসা বলল।

আপনি চীনের অনেককে, অনেক কিছুকে বদলে দিয়েছেন। সবচেয়ে বেশি বদলে দিয়েছেন আমার মা বাবাকে। জানেন না, মা আপনার ধর্মকে সরাসরি জানার জন্যে কোরআনের চীনা ভাষার অনুবাদ আনিয়ে নিয়েছেন। বলল ফেন।

আলহামদুলিল্লাহ। আহমদ মুসা বলল।

আলহামদুলিল্লাহ। বলল ফেনও।

আমি আলহামদুলিল্লাহ আগেই বলেছি। লিয়েন হুয়া বলল।

আমরা এসে গেছি ভাইয়া স্যার। ঐ তো গেটে গাড়ি দাঁড়িয়ে। গাড়ি ঘিরে রেখেছে কমান্ডোরা। বলল ফেন ফ্যাং।

ফেন, এই ভাইয়া স্যার-এর অর্থ কি? এ তো অসংলগ্ন মিলন। আহমদ মুসা বলল।

হাসল ফেন। বলল, স্যার থেকে ভাইয়াতে উঠার ট্রানজিশন পিরিয়ড চলছে আমার। এ সময় অনর্থক কিছু ঘটতেই পারে। বলল ফেন।

মেনে নিলাম। তবে পরামর্শ, ল পড়ে সুপ্রীম কোর্টে যোগ দাও। যুক্তিবাদিতা কাজে লাগবে। আহমদ মুসা বলল।

না, কথা বেচার কাজ আমি করব না। বলল ফেন।

ঠিক আছে, সুপ্রীম কোর্টের বিচারক হবে। আহমদ মুসা বলল।

না, তা হব না। আইনে আমি হাত দিতে পারব না। কিন্তু আইন আমাকে কলুর বলদের মতো ঘুরাবে। বলল ফেন।

তাহলে কি হবে? আহমদ মুসা বলল।

আমি আপনার মতো হবো। বলল ফেন।

তাহলে গোয়েন্দা হও। আহমদ মুসা বলল।

ওটা অন্ধকারের জীবন। ওখানে চরিত্র, নৈতিকতা বলে কিছু থাকে না। বলল ফেন।

হাসল আহমদ মুসা। বলল, তাহলে রাজনীতিক হও।

ওটা লিয়েন আপার জন্যে মানায় বেশি। বলল ফেন।

তুমি তো লিয়েনের রাইট হ্যান্ড। আহমদ মুসা বলল।

স্যার, সে আমার রাইট ও লেফট হ্যান্ড, সেই সাথে আমার মাথাও। বলল লিয়েন হুয়া।

তাহলে হয়ে গেল ফেন। আর কোনো কথা নেই। আহমদ মুসা বলল। আহমদ মুসারা গাড়ির কাছে পৌঁছে গিয়েছিল।

লিয়েন আপা বলার পর তো কথা আর থাকবেই না। আপনি তো লিয়েন আপার দলে। বলল ফেন।

কারণ তুমিও লিয়েনের দলে। আহমদ মুসা বলল। হেসে উঠল ফেন। কিছু বলতে যাচ্ছিল।

আহমদ মুসা ঠোঁটে তর্জনি ঠেকিয়ে আর কথা বলতে নিষেধ করল। এগোলো গাড়ির দিকে।

একজন কমান্ডো গাড়ির দরজা খুলে ধরে দাঁড়িয়ে ছিল।

.

বেইজিং।

বিশাল রাষ্ট্রীয় অতিথিভবন পিপলস প্যালেস।

একুশ তলা বিল্ডিং-এর প্রশাসন, খাবার দাবার, সমাবেশ হল ইত্যাদির জন্যে পাঁচটি ফ্লোর বাদ দিয়ে অবশিষ্ট ফ্লোরগুলো ভিআইপি, ভিভিআইপি স্যুটে বিভক্ত।

দশ তলার সাউথ ব্লকের লাউঞ্জ।

মাঝখানের একটা সোফায় পাশাপাশি বসে গল্প করছিল সিংকিয়াং-এর সাবেক গভর্নর লি ইউয়ান এবং সিংকিয়াং-এর শীর্ষ উইঘুর নেতা ইরকিন আহমেদ ওয়াং।

কথা বলছিল তারা।

কিন্তু হঠাৎ করে মিটিং-এর সময় এক ঘন্টা পিছিয়ে দেয়া হলো কেন? বলল ইরকিন আহমেদ ওয়াং।

আপনি শোনেননি ব্যাপারটা? সিংকিয়াং-এর সাবেক গভর্নর, নেইজেনের পিতা, লি ইউয়ান বলল।

কি ব্যাপার? কিছু ঘটেছে স্যার? বলল ইরকিন আহমেদ ওয়াং।

বড় ঘটনা ঘটেছে। আজ সকালে আহমদ মুসার উপর দুইবার হত্যা প্রচেষ্টা হয়েছে। সিংকিয়াং-এর সাবেক গভর্নর লি ইউয়ান বলল।

হত্যা প্রচেষ্টা! দুইবার! শুনেছিলাম প্রেসিডেন্টের মেহমান হিসাবে প্রেসিডেন্ট প্রাসাদেই তাকে নেয়া হয়েছে! বলল ইরকিন আহমেদ ওয়াং।

লি ইউয়ান কথা বলতে যাচ্ছিল। একটা হুইল চেয়ার ঠেলে লাউঞ্জে প্রবেশ করল আহমদ ইয়াং। হুইল চেয়ারের পেছনে হুই নেতা চীনের প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব মা চু ইং। তার পিছনে গায়ে বড় চাদর মাথায় স্কার্ফ পরা একজন মহিলা। হুইল চেয়ারে মা ঝু সুলতান।

মা ঝু সুলতান বেইজিং-এর সামরিক হাসপাতালে ছিল। আহমদ ইয়াং তাকে হাসপাতাল থেকে নিয়ে আসছে।

লি ইউয়ান ও ইরকিন আহমেদ ওয়াং উঠে দাঁড়িয়ে হুই নেতা মা চু ইং এবং অন্যদের স্বাগত জানাল।

সবাই বসল।

মা চু ইং হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলল, আমাদের মিটিং শুরু হতে আর মাত্র দশ মিনিট। আমরা কি হল-এর দিকে এগোবো? বাইরে থেকে আসা অন্য সবাই তো চলে গেছে। মিটিং আমাদের এক ঘন্টা পিছাল কেন বুঝতে পারছি না।

জনাব মা চু ইং, আমরা এ বিষয় নিয়েই আলাপ করছিলাম। সম্মানিত সাবেক গভর্নর স্যার লি ইউয়ানের কাছে শুনলাম আজ সকালে আহমদ মুসা দুইবার হত্যা-প্রচেষ্টার শিকার হয়েছিলেন।

মা চু ইং, আহমদ ইয়াং, মা ঝু সকলের কণ্ঠই যেন আর্তনাদ করে উঠল, উনি ঠিক আছেন তো? উনি তো প্রেসিডেন্ট হাউজে ছিলেন। সেখানে কীভাবে এটা ঘটতে পারে?

মহিলাদের একজন মা চু ইং-এর মেয়ে, মা ঝুর বোন ফা জি ঝাও বলল মুখের নেকাব একটু সরিয়ে, প্রেসিডেন্টের ভাগিনি লিয়েন হুয়াও টেলিফোনে। এ খবরই আমাকে দিয়েছিলেন। তিনি আরও বলেছিলেন, হত্যা প্রচেষ্টাকারীকে আহমদ মুসা স্যারই হত্যা করেছেন এবং বিস্ফোরণ ঘটার আগেই ভয়ানক বোমাও তিনিই ডিটেক্ট করেন। এই দুই ঘটনার পর আহমদ মুসা সবার সাথে নাশতা করেছেন এবং তিনি ভালো আছেন।

আলহামদুলিল্লাহ। আল্লাহ রাব্দুল আলামিন তাঁর অপার রহমত দিয়ে তাকে ঘিরে রাখুন। মুসলমানদের দুঃসময়ে এই মহান ভাইকে যেন আমরা না হারাই। বলল ইরকিন আহমেদ ওয়াং। তার কণ্ঠ শেষদিকে আবেগে রুদ্ধ হয়ে গিয়েছিল।

আমিন। বলল মা চু ইং, মা ঝু, আহমদ ইয়াং, লি ইউয়ান, ফা জি ঝাও ও নেইজেন সকলেই।

মা চু ইং তাকাল লি ইউয়ানের দিকে। বলল, স্যার, আপনি খবর কি করে পেলেন?

বেলা দশটার দিকে প্রেসিডেন্ট হাউজের একজন ঊর্ধ্বতন গোয়েন্দা অফিসার আমাকে বিষয়টা জানায়। আহমদ মুসা এখানে আসছেন, এখানকার সিকিউরিটি অ্যারেঞ্জমেন্ট তিনি দেখতে এসেছিলেন। লি ইউয়ান বলল।

ঘটনা কি ঘটেছিল, সে সম্পর্কে কি তিনি কিছু বলেছিলেন? জিজ্ঞাসা মা চু ইং-এর।

হ্যাঁ, ঘটনা তিনি বলেছেন। তিনি যা বলেছিলেন তার সারাংশ হলো মহান ভাই আহমদ মুসা প্রেসিডেন্ট প্রাসাদে পৌঁছেন ভোর পাঁচটায় এবং তিনি ঘুমিয়ে পড়েন। সকাল নটায় তার ওঠার কথা। ঠিক নটাতেই তার দরজায় নক হয়। তিনবার নক হওয়ার পর আহমদ মুসা উঠে দরজা খুলে দেন। দরজায় দাঁড়িয়েছিল প্রেসিডেন্ট প্রাসাদের গেস্ট উইং-এর ডেপুটি প্রধান। তিনি আহমদ মুসাকে গুড মর্নিং জানিয়ে হ্যান্ডশেক করার ভঙ্গিতে ডান হাতে লুকানো ভয়ংকর নিডল গান দিয়ে আহমদ মুসাকে গুলি করেন। আহমদ মুসা নিজের দেহকে পেছনে মেঝের দিকে ছুঁড়ে দিয়ে পকেট থেকে রিভলবার বের করে গুলি করে গেস্ট উইং-এর ডেপুটি প্রধানকে হত্যা করে তার পরবর্তী আক্রমণ রোধ করেন। শুনেছি নিডলগানের বিষাক্ত পিন কোনো মানুষের দেহ স্পর্শ করার সাথে সাথেই তার মৃত্যু ঘটে।

একটু থামল লি ইউয়ান। সঙ্গে সঙ্গেই আবার শুরু করল, দ্বিতীয় ঘটনায় আহমদ মুসাকে শুভেচ্ছা জানানোর জন্যে ফুলের একটা তোড়া তৈরি হয়েছিল। ফুলের তোড়ার মধ্যে ছিল পিংপং বল আকৃতির ভয়ংকর বিধ্বংসী বোমা। ফুলের তোড়ার উপর দিয়েছিল আহমদ মুসাকে শুভেচ্ছা উপহার লেখা সংবলিত কাগজের একটা ব্যান্ড। আহমদ মুসা ফুলের তোড়াটি হাতে নিয়েই বলেন, এর মধ্যে বোমা আছে। এভাবে আহমদ মুসা বোমার হাত থেকে রক্ষা পান। থামল লি ইউয়ান।

সবাই রুদ্ধশ্বাসে শুনছিল ঘটনার বিবরণ।

আলহামদুলিল্লাহ। আল্লাহ আহমদ মুসাকে রক্ষা করেছেন। বলল ইরকিন আহমেদ ওয়াং।

আলহামদুলিল্লাহ! আল্লাহ আহমদ মুসাকে বিস্ময়কর গুণাবলি দিয়ে সৃষ্টি করেছেন। আমাদের কাছে যা চিন্তা-কল্পনাতেও আসে না, আহমদ মুসার কাছে তা স্বাভাবিক ব্যাপার। ফা জি ঝাও বলল।

আল্লাহর হাজারো শুকরিয়া আদায় করছি। মহান ভাই আহমদ মুসাকে তিনি খাস সাহায্য দিয়েছেন। আজ চীনে আমাদের জন্যে তাকে খুব বেশি প্রয়োজন। বলল মা চু ইং।

মা চু ইং-এর কথা শেষ হতেই একজন কমান্ডো অফিসার লাউঞ্জে প্রবেশ করল। সে লাউঞ্জের চারদিকে তাকিয়ে, সবার দিকে চোখ বুলিয়ে বলল, আপনারা এখানে আছেন জেনে এক্সিলেন্সিআহমদ মুসা এখানে আসছেন। মিটিং-এর কিন্তু সময় হয়ে গেছে।

তার কথার পরপরই আহমদ মুসা লাউঞ্জে প্রবেশ করল। সবাই সালাম দেবার জন্য প্রস্তুত থাকলেও আহমদ মুসাই আগে সবাইকে সালাম দিল।

আহমদ মুসা মা ঝু সুলতান, আহমদ ইয়াংদের কুশল জিজ্ঞাসা করে হুই নেতা মা চু ইং এবং উইঘুর নেতা ইরকিন আহমেদ ওয়াংদের লক্ষ করে বলল, দুঃখিত স্যার, অনেকটা সময় আপনাদের নষ্ট হলো। দশটার মিটিং এগারোটায় হচ্ছে।

মহান ভাই আহমদ মুসা, আপনি আমাদেরই সন্তান। আপনার হৃদয় এত বড় হলো কি করে! আমাদের সময় নষ্ট হওয়াটাকে দেখছেন, আপনার উপর আকাশ ভেঙে পড়েছিল সেটা ভাবছেন না। আবেগরুদ্ধ কণ্ঠে বলল ইরকিন আহমেদ ওয়াং। তার চোখ দুটি ভিজে উঠেছিল।

স্যার, নিজেকে নিয়ে সব সময় ভাবি। বলে আহমদ মুসা হাসিমুখে এগোলো লি ইউয়ানের দিকে। বলল, স্যার, আপনাকে দেখে খুব খুশি হয়েছি। ভেবেছিলাম আপনার সাথে দেখা করেই এবার চীনে কাজ শুরু করব। কিন্তু ঘটনাস্রোত আমাকে ভিন্ন দিকে নিয়ে গেছে।

সেটাই তো হবার কথা। তোমার পরিচালক তো তুমি নও, তোমার আল্লাহ। ওয়েলকাম আহমদ মুসা। বলে হাত বাড়িয়ে আহমদ মুসাকে জড়িয়ে ধরল।

সাবেক গভর্নর লি ইউয়ানকে ধন্যবাদ দিয়ে আহমদ মুসা একটু দূরে আলদা একটা সোফায় বসা দুজন মহিলার দিকে তাকাল। বলল, আমার ভুল না হলে আপনাদের একজন ম্যাডাম বিজ্ঞানী ফা জি ঝাও, অন্যজন নেইজেন। বিজ্ঞানী ফাও জি ঝাও স্বাভাবিক কারণেই মিটিং-এ আসার কথা। কিন্তু সরকার নেইজেনকেও যে এখানে এনেছে, এজন্যে আমি চীন সরকারের কাছে কৃতজ্ঞ। আমি এবার সিংকিয়াং যাচ্ছি না। অতএব সিংকিয়াং-এর পরিচিত জনদের এখানে পাওয়া আমার জন্যে সৌভাগ্যের।

আহমদ মুসা কথা শেষ করতেই উঠে দাঁড়াল নেইজেন। বলল, স্যরি ভাইজান, আপনি তো কথা শেষ করে ফেললেন, কিন্তু আমার ঝগড়া আছে আপনার সাথে। আমাদের এক চরম দুঃসময়ে আপনি চীনে এসেছেন। আপনি এসেছেন, এটা জানারও হক কি আমাদের ছিল না? আপনি এসেছেন এটা যখন আমরা জানতে পারি, তখন আমরা খুবই আনন্দিত হই। কিন্তু এবার আনন্দ যতটা আমরা অনুভব করেছি, ততটাই যন্ত্রণা আমাদের মনকে পীড়িত করেছে।

হাসল আহমদ মুসা। পরক্ষণেই গম্ভীর হয়ে উঠল তার মুখ। বলল, এখন আমার যে জবাব হবে সেটা তোমার বাবা দিয়ে দিয়েছেন। আমি প্লেনে যে ঘটনার সাথে জড়িয়ে পড়ি, সে ঘটনাই আমাকে উডাং পর্বতে নিয়ে যায়। চীনে আসার পর এ পর্যন্ত আমি একজনের অয়্যারলেসে প্রেসিডেন্টের সাথে কথা বলা ছাড়া কাউকে টেলিফোন করিনি।

আমি দুঃখিত ভাইজান, আপনাকে অভিযুক্ত আমি করতে চাইনি। আপনার কথা শতভাগ সত্য। কিন্তু ভাইজান, আমাদের কষ্ট ও বিক্ষোভও সত্য। বলল নেইজেন। তার কণ্ঠ অবরুদ্ধ কান্নায় ভারি।

আহমদ মুসা কিছু বলার আগে নেইজেনের বাবা সিংকিয়াং-এর সাবেক গভর্নর লি ইউয়ান বলল, সবাইকে কষ্ট করতে হয়েছে। মা, তোমরাও কষ্ট করেছ। কিন্তু আহমদ মুসা চীনে আসার পর থেকে যে কষ্ট করছে, তার সাথে কারও কষ্টেরই তুলনা হয় না। কতবার সে আহত হয়েছে, কতবার সে মৃত্যুর মুখ থেকে বেঁচেছে! আজ সকালেও দুবার তাকে হত্যার চেষ্টা করা হয়।

স্যরি বাবা। আমরা খুব ক্ষুদ্র, খুব সামান্য, তাই নিজের কথাই আমরা আগে ভাবি। আমাকে …। কথা শেষ করতে পারলো না নেইজেন। কান্নায় রুদ্ধ হয়ে গেল তার কথা।

লাউঞ্জের পরিবেশ একটু ভারি হয়ে উঠেছিল।

লাউঞ্জে প্রবেশ করল আজকের মিটিং-এর আয়োজক কর্মকর্তা। সরকারের স্বরাষ্ট্র বিভাগের সেক্রেটারি মাও ওয়াং।

লাউঞ্জের প্রান্তে দাঁড়িয়ে বাউ করে সে বলল, সম্মানিত জাতীয় নেতৃবৃন্দ এবং অতিথিবর্গ, সকাল এগারোটা বাজতে দুই মিনিট দেরি আছে। সম্মেলন হলে যাবার জন্যে সকলকে অনুরোধ করছি।

ধন্যবাদ, আপনার আহবানের জন্যই আমরা অপেক্ষা করছিলাম। চলুন, আমরা সকলে প্রস্তুত। বলল প্রবীণ হুই নেতা মাচু ইং। সবাই চলল সমাবেশ হল-এর দিকে।

.

বর্গাকার হলরুম। হল জুড়ে গোল করে এক সারিতে টেবিল সাজানো। টেবিলে সবার নেম কার্ড। সবাই বসেছে।

গোলাকৃতি টেবিল সারির গোড়ায় তিনটি চেয়ার ও দুটি চেয়ার পাশাপাশি। দুই বড় চেয়ারের সামনে একটা বড় টেবিল। অন্য বড় চেয়ারটি গোলাকার সারির ডানদিকের প্রথম টেবিলে সেট করা।

সবাই বসলেও দাঁড়িয়ে আছে মা চু ইং, ইরকিন আহমেদ ওয়াং এবং আহমদ মুসা।

চীনের স্বরাষ্ট্র সেক্রেটারি মাও ওয়াং দুই বড় চেয়ারের মাঝখানে গিয়ে দাঁড়াল। সামনের দিকে তাকিয়ে সবাইকে স্বাগত জানিয়ে ও শুভেচ্ছা জ্ঞাপন করে বলল, সম্মানিত নেতৃবৃন্দ, মহান ভাই আহমদ মুসার পরামর্শক্রমে সম্মানিত উইঘুর নেতা ইরকিন আহমেদ ওয়াং এবং সম্মানিত হুই নেতা মা চু ইং-এর সাথে আলোচনা করে এই মিটিং-এর আয়োজন করা হয়েছে। আনন্দের বিষয় যে, নেতৃবৃন্দের সাথে পরামর্শ করে ৩২টি প্রদেশ থেকে যাদেরকে আসার অনুরোধ করা হয়েছিল তারা সকলেই এসেছেন। সবাইকে আবারও স্বাগত জানাচ্ছি। আজকের মিটিং-এ দুজন কো-চেয়ারম্যান। একজন সম্মানিত উইঘুর নেতা ইরকিন আহমেদ ওয়াং এবং সম্মানিত প্রবীণ হুই নেতা মা চু ইং। আমি তাদেরকে তাদের জন্যে নির্দিষ্ট চেয়ারে বসতে অনুরোধ জানাচ্ছি। আর আমাদের মহান ভাই, সম্মানিত মেহমান আহমদ মুসা তারই ইচ্ছায় আপনাদের সারিতে বসছেন।

আহমদ মুসা এগিয়ে এসে হুই নেতা মা চু ইং এবং উইঘুর নেতা ইরকিন আহমেদ ওয়াংকে তাদের স্ব স্ব চেয়ারে বসাল।

তারা দুজন বসার পর স্বরাষ্ট্র সেক্রেটারি মাও ওয়াং সকলের উদ্দেশ্যে বলল, সম্মানিত নেতৃবৃন্দ, আমি এখন বিদায় নিচ্ছি। আপনাদের এ বৈঠক রুদ্ধদ্বার হবে। আমি যাবার পর দরজা বন্ধ হয়ে যাবে। হলটি সাউন্ড প্রুফ।

বলে মাও ওয়াং সকলের উদ্দেশ্যে দীর্ঘ বাউ করল এবং আহমদ মুসা, মা চু ইং ও ইরকিন আহমেদ ওয়াং-এর সাথে হ্যান্ডশেক করে বেরিয়ে গেল। তার সাথে সাথে বন্ধ হয়ে গেল দরজা।

উঠে দাঁড়াল ইরকিন আহমেদ ওয়াং। বলল, দুজন কো-চেয়ারম্যান হওয়ার ধারণা মহান ভাই আহমদ মুসার। তাই আমি মেনে নিয়েছি। এই মিটিং-এ সভাপতিত্ব করার জন্যে আমাদের প্রবীণ নেতা মা চু ইং যথেষ্ট ছিলেন।

বসল ইরকিন আহমেদ ওয়াং। ফিসফিস করে পরামর্শ করল মা চু ইং এর সাথে। পরামর্শটা একটু দীর্ঘই হলো।

উঠে দাঁড়াল হুই নেতা মা চু ইং। হামদ, ছানা পাঠ করার পর সকলকে স্বাগত জানিয়ে সে বলল, উপস্থিত ভাইয়েরা, চীনের মুসলমানদের আজ কি করণীয় এই বিষয়ে আলোচনার জন্যই আজকের এই বৈঠক। সৌভাগ্যক্রমে আমাদের মধ্যে উপস্থিত মহান ভাই আহমদ মুসার আগ্রহেই বৈঠক ডাকা হলেও বন্দীদশা থেকে সদ্যমুক্ত উইঘুর নেতা ভাই ইরকিন ওয়াং এবং মা ঝু সুলতান অবিলম্বে এই ধরনের বৈঠক অনুষ্ঠানের জোর দিয়েছেন। সব ইচ্ছার ফল হিসেবেই আমাদের আজকের এই বৈঠক। আমি বৈঠকের উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলার জন্যে ভাই ইরকিন ওয়াংকে অনুরোধ করছি।

মা চু ইং-এর কথা শেষ হতেই গোটা হল থেকে কয়েকজন উঠে দাঁড়াল। সমস্বরে বলতে লাগল, আমরা আমাদের উইঘুর নেতার কথা শুনব, কিন্তু। তার আগে আহমদ মুসা সম্পর্কে প্রকৃত সত্য জানতে চাই। সরকারি রেডিও, টিভি ও সংবাদ মাধ্যমে সন্ত্রাসবাদী নেতা চীনের লেজেন্ডারি হিরোর নাম ব্যবহারকারী জোয়ান উর সন্ত্রাস সম্পর্কে অনেক কথা বলা হচ্ছে। বলা হচ্ছে এই সন্ত্রাসী গ্রুপ সেনাবাহিনী ও পুলিশ বাহিনীতেও অনুপ্রবেশ করেছিল, তারাই সন্ত্রাসী গ্রুপের হয়ে দেশের অভ্যন্তরে নানা নিপীড়ন নির্যাতন চালিয়েছে। সেনা ও পুলিশ বাহিনী এই সন্ত্রাসী গ্রুপের নেতাসহ ওদের শীর্ষ নেতৃত্বকে হত্যা করেছে এবং দেশ থেকে তাদের নির্মূল করার কাজ চলছে। সরকারি এই বক্তব্যের পাশাপাশি দেশে জোর গুজব যে বন্দীদের উদ্ধার ও সন্ত্রাসীদের শীর্ষ নেতাকে হত্যাসহ সব কাজ আহমদ। মুসাই করেছেন। এই বিষয়ে মহান ভাই আহমদ মুসার কথা শুনতে চাই। তার সম্পর্কে আমরা হাজারো কথা শুনেছি। তিনি মুসলমানদের গৌরবের ধন। তিনি আমাদের মাঝে উপস্থিত, এটা আমাদের কাছে স্বপ্নের মতো মনে। হচ্ছে। প্লিজ, তাকে কথা বলতে দিন।

ইরকিন আহমেদ ওয়াং ও মা চু ইং দুজনেই হাসছে। বলল আহমদ মুসাকে, আমাদেরকে সামনে ঠেলে দিয়ে পেছনে থাকতে চেয়েছিলেন। তা আর হলো না। প্লিজ আহমদ মুসা উঠুন, জবাব দিন তাদের জিজ্ঞাসার।

আহমদ মুসা উঠে দাঁড়াল। বলল, প্রিয় ভাই-বোনেরা, সত্য হলো সন্ত্রাসীদের দমনের কাজটা আল্লাহ আমাকে দিয়ে করিয়েছেন। চীন সরকারও আমাকে সব রকম সহযোগিতা করেছেন। থামল আহমদ মুসা।

কীভাবে আল্লাহ করালেন, কেন চীন সরকার একজন মুসলিম বিপ্লবী। নেতাকে সাহায্য করল? প্রশ্ন উঠল চারদিক থেকে।

আগেও দুইবার সিংকিয়াং-এ এসেছি। মুসলমানদের বিপদ লাঘবের চেষ্টা করেছি। চীনে বড় আকারে আবারও মুসলমানদের উপর অত্যাচার নিপীড়ন চলছে, এ খবর আমার কাছে ছিল। তার সাথে জানতে পারলাম সিংকিয়াং থেকে আহমদ ইয়াং আটক ও নিখোঁজ হয়েছে। সে আমার ছোট ভাইয়ের মতো। তাকে উদ্ধার এবং বেইজিং-এর সাথে কথা বলে। মুসলমানদের অত্যাচার নিপীড়ন বন্ধ করা যায় কি না, এই উদ্দেশ্যেই এবার আমার চীনে আসা। এসেই আমাকে সন্ত্রাসীদের সাথে সংঘাতে জড়িয়ে পড়তে হয়।

এই ভূমিকা দেয়ার পর সংক্ষেপে আহমদ মুসা প্লেন থেকে উডাং পর্বত পর্যন্ত কি ঘটেছিল তার বিবরণ দিল।

পিনপতন নীরবতার মধ্য দিয়ে সবাই আহমদ মুসার শ্বাসরুদ্ধকর কাহিনী, শুনল।

আহমদ মুসা থামলেও কিছুক্ষণ কেউই কথা বলতে পারল না।

অনেক ধন্যবাদ স্যার আপনাকে। স্যার, আপনি অনেক কষ্ট করেছেন। পদে পদেই আপনাকে জীবন বাজি রেখে কাজ করতে হয়েছে। কিন্তু স্যার। আপনার এই কষ্ট, এই কাজ এদেশে ইসলামকে, আমাদের ভাগ্যকে অনেক দূর এগিয়ে নিয়ে গেছে। প্রেসিডেন্টের ভাগ্নি তুখোড় ছাত্রনেতা লিয়েন হুয়া। প্রেসিডেন্টের মেয়ে প্রতিভাদীপ্ত ছাত্র ফেন ফ্যাং ইসলামের পথে এসেছে, প্রেসিডেন্টের পত্নী কোরআনের অনুবাদ পড়ছেন, খোদ প্রেসিডেন্ট এবং তার শীর্ষ সাথী ও আমলারা ইসলামের শুভাকাঙ্ক্ষী হয়েছেন, জোয়ান উ ওরফে কিন শি হোয়াং-এর মতো চীনের শীর্ষ পরিবারের শীর্ষ ও প্রভাবশালী ব্যক্তির মেয়ে লু ঝির ইসলাম গ্রহণ, চীনের শীর্ষ বিজ্ঞান-ব্যক্তিত্ব ড. ডা ডোমিংগ এর ইসলামের দিকে আসাকে বলা যায় ইসলামের পক্ষে একটা। মাইলস্টোন। যে প্রবল ঝড় চীনে ইসলামের অস্তিত্ব বিলীন করে দিতে উদ্যত হয়েছিল, সেই ঝড়কে আপনি ইসলামের পক্ষে ঘুরিয়ে দিয়েছেন। আর কি চাই আমরা স্যার? চীনের মুসলমানরা সব পেয়েছে আপনার কাছ থেকে। আজকের এই সম্মেলন আমাদের পাওয়াকে পূর্ণতা দিতে…। বলল ফা জি ঝাও। কথা শেষ করতে সে পারল না। কান্নায় ভেঙে পড়ল তার কথা।

গোটা হল-এ আবার সেই পিনপতন নীরবতা।

নীরবতা ভাঙল তারিম বেসিন অঞ্চলের প্রবীণ ও সংগ্রামী উইঘুর নেতা। আবু যিয়াদ যুবায়ের আওয়াং। উঠে দাঁড়িয়ে সে বলল, বিজ্ঞানী ফা জি ঝাও আমার মেয়ের মতো। তার কথায় আমাদের মতো প্রবীণদের সব কথাই প্রতিধ্বনিত হয়েছে। তার আবেগ আমাদেরই আবেগ, তার অশ্রু আমাদেরই অশ্রু। মহান ভাই আহমদ মুসার কাছ থেকে আমরা চীনা মুসলিমরা যা পেয়েছি, তা আমাদের সাধ্যের অতীত। আজকের এই বৈঠক তার একটা প্রমাণ। এক যাদুরকাঠির স্পর্শে যেন রাতারাতি পুলিশ, আমলা, সৈনিক সকলের আচরণ আমাদের প্রতি বদলে গেছে। কেউ না বললেও আমি জানি চীনা মুসলিম নেতৃবৃন্দের আজকের এই বৈঠকে আমাদের পারস্পরিক সম্পর্ক এবং সরকারের সাথে, চীন রাষ্ট্রের সাথে আমাদের স্থায়ী সম্পর্ক কি হবে, তা আমরা ঠিক করব। আমাদের সকলের মা ফা জি ঝাও এই সম্মেলনে আমাদের চাওয়া পাওয়ার পূর্ণতা চেয়েছেন। আমিও এটাই চাই আমাদের শীর্ষ নেতৃবৃন্দের কাছে, বিশেষ করে আমাদের মহান ভাই আহমদ মুসার কাছে।

কথা শেষ করল আবু যিয়াদ যুবায়ের আওয়াং। তার কণ্ঠ আবেগরুদ্ধ হয়ে উঠেছিল।

আবু যিয়াদ আওয়াং-এর কথা শেষ হবার সাথে সাথে সম্মেলন হল-এর সবাই টেবিল চাপড়ে তার কথাকে স্বাগত জানাল।

আবার নীরবতা নামল।

এই নীরবতার মধ্যে উইঘুর নেতা ইরকিন আহমেদ ওয়াং কানে কানে হুই নেতা মা চু ইং-এর সাথে কথা বলল।

উঠে দাঁড়াল মা চু ইং। সবাইকে সালাম জানিয়ে ধন্যবাদ জানাল ফা জি ঝাও এবং প্রবীণ ও সংগ্রামী উইঘুর নেতা আবু যিয়াদ আওয়াংকে। তার সাথে আরও ধন্যবাদ দিল যারা স্বতঃস্ফূর্তভাবে সমর্থন করল আবু যিয়াদ আওয়াংকে।

একটু থামল মা চু ইং।

থেমেই আবার সঙ্গে সঙ্গে বলল, প্রবীণ নেতা আবু যিয়াদ আওয়াং ঠিকই বলেছেন। আমাদের আজকের আলোচনা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের বিষয় হলো আমাদের হুই উইঘুরদের ঐক্য এবং চীন রাষ্ট্রের সাথে আমাদের স্থায়ী সম্পর্ক। এই আলোচনা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ আমরা দুইভাবে করতে পারি। এক. সবাই দীর্ঘ আলোচনা করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা, দুই. মহান ভাই আহমদ মুসা হুই ও উইঘুরদের সব ব্যাপার জানেন, চীন সরকার সম্পর্কেও তিনি ভালোভাবে অবগত আছেন। আমাদের আলোচ্য বিষয়ে তাকেই আমরা একটা প্রস্তাব পেশের জন্যে অনুরোধ করতে পারি। আপনাদের সবার মত নিয়ে তা চূড়ান্ত করা হবে। থামল মা চু ইং।

মা চু ইং থামতেই মিটিং-এ উপস্থিত সবাই হাত তুলে সমস্বরে বলল, দ্বিতীয় মাধ্যমকে আমরা গ্রহণ করলাম।

সবাইকে ধন্যবাদ জানিয়ে বসল মা চু ইং। ইরকিন আহমেদ ওয়াং ও মা চু ইং-কিছু কথা বলল। তারপর উঠে গেল আহমদ মুসার কাছে ইরকিন আহমেদ ওয়াং।

আহমদ মুসা উঠে দাঁড়াল।

ভাই আহমদ মুসা, সবাই আপনাকে একটা গুরুদায়িত্ব দিয়েছে। দায়িত্ব আপনাকে গ্রহণ করতেই হবে। অন্যান্য দেশের মতো চীনের জন্যে, চীনের মুসলমানদের জন্যে অনেক কিছু আপনি করেছেন। সর্বশেষের এ বড় কাজটাও আপনাকেই করতে হবে। বলল ইরকিন আহমেদ ওয়াং।

জি জনাব, সবাই চেয়েছেন। আমি আমার কথা বলব।

ইরকিন আহমেদ ওয়াং আহমদ মুসাকে জড়িয়ে ধরে ধন্যবাদ জানিয়ে তার জায়গায় ফিরে গেল।

আহমদ মুসা ঘুরে দাঁড়াল হল জুড়ে গোল হয়ে বসা চীনের আঞ্চলিক নেতৃবৃন্দের দিকে।

আহমদ মুসা সকলকে সালাম দিল। হামদ ও সানা পাঠের পর বলল, শ্রদ্ধেয় গুরুজন এবং ভাই ও বোনেরা! আমাকে বোনদের পক্ষ থেকে দুটি বিষয়ে মত বা প্রস্তাব পেশ করতে বলা হয়েছে। তার একটি হলো, হুই উইঘুরদের ঐক্যের বিষয়। অপরটি চীন রাষ্ট্রের সাথে সিংকিয়াংসহ চীনের মুসলমানদের সম্পর্ক। এই দুই বিষয়ে বলার আগে আরও দুএকটি কথা বলব।

বলে একটু থামল আহমদ মুসা। একটা দম নিয়ে আবার বলতে শুরু করল, পৃথিবী যেমন এক, তেমনি পৃথিবীর সব মানুষ নিয়ে একটাই জাতি। চীনা, আরব, রুশ, ইউরোপিয়ান, আমেরিকান, আফ্রিকান, মুসলমান, খ্রিস্টান হিন্দু, বৌদ্ধ, জুদাইজম সবাই মিলে আমরা এক মানবজাতি। মানবজাতির জন্যে আল্লাহ জীবনাদর্শ হিসেবে পথও একটাই দিয়েছেন, কিন্তু সেই পথ তিনি মানবজাতির উপর চাপিয়ে দেননি। এই পথ গ্রহণ এবং গ্রহণ না করার স্বাধীনতা তিনি মানুষের জন্যে উন্মুক্ত রেখেছেন। এটা এজন্যে যে, মানুষ পথ, না বিপথ গ্রহণ করে, তা তিনি দেখতে চান। এই পৃথিবীতে মানুষের জন্যে এটাই পরীক্ষা। পরীক্ষার ফলের ভিত্তিতেই মানুষের জন্যে চিরন্তন জান্নাত অথবা চিরন্তন জাহান্নাম নির্ধারিত হবে। অতএব জীবনপথ বা জীবনাদর্শ নিয়ে বিরোধ ও হানাহানি হবার কোনো কারণ নেই। যেখানে আল্লাহ জীবনাদর্শ মানুষের উপর চাপিয়ে দিতে চাননি, সেখানে মানুষ, বিশেষ করে মুসলমানরা তা কারও উপর চাপিয়ে দিতে অবশ্যই যাবে না। কিন্তু যেহেতু প্রায় সকল জীবনাদর্শই প্রচারমুখী, তাই একের প্রচারে অন্যের বাধা দেয়া থেকে হানাহানি, সংঘাত বাধে, বাধতে পারে। এ ক্ষেত্রে সত্য। পথের অনুসারী হিসাবে মুসলমানদেরকে অবশ্যই সাবধান হতে হবে, যাতে তারা কোনো সংঘাতের নিমিত্ত না হয়। কারণ সত্য পথের সন্ধান সব মানুষের সামনে আনার জন্যে দুনিয়ায় শান্তি ও সহাবস্থান প্রতিষ্ঠিত থাকা মুসলমানদের জন্যেই বেশি প্রয়োজন। রাসুল (সা.)-এর নবুওতের (৬১০ খ্রিস্টাব্দ) পর হুদাইবিয়ার সন্ধির পূর্ব পর্যন্ত ১৮ বছরে ইসলামের প্রচার ও প্রসার মক্কা ও মদিনার বাইরে কোথাও হতে পারেনি। কিন্তু (৬২৮ খ্রি.) হুদায়বিয়ার সন্ধির পর মাত্র দুই বছরে সমগ্র আরবে ইসলামের প্রচার ও প্রসারসহ রক্তপাতহীনভাবে মক্কা বিজয় (৬৩০ খ্রি.) সম্ভব হয়। রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর মৃত্যুর (৬৩২ খ্রি.) পুর্বেই এই শান্তির সময়ে ইসলামের প্রচার পারস্য, রোমান ও আবিসিনিয়া সম্রাটের দরবারসহ আঞ্চলিক রাজাদের দরবার পর্যন্ত পৌঁছে যায়। সুতরাং হুদায়বিয়ার সন্ধির মতো ত্যাগ স্বীকার করে হলেও শান্তির পরিবেশ মুসলমানদের বজায় রাখা দরকার। তবে অহিংস প্রচারের পথে বাধা এলে ধৈর্য ও প্রতিরোধ- এ দুই শক্তির মাধ্যমে বাধাদানকারীদের মোকাবিলায় কোনো বাধা নেই।

থামল একটু আহমদ মুসা। পিনপতন নীরবতার মধ্য দিয়ে সবাই আহমদ মুসার কথাগুলো যেন গোগ্রাসে গিলছিল। আহমদ মুসা থামতেই শীর্ষ নেতৃবৃন্দসহ সকলেই টেবিল চাপড়ে আনন্দ প্রকাশ করল।

প্রিয় মুরব্বিগণ এবং ভাই ও বোনেরা। আবার বলতে শুরু করল আহমদ মুসা, কোনো দেশেই কাউকে বহিরাগত বলে গালি দেয়া যাবে না, যদি সে বৈধভাবে আসে এবং আইনানুগ নাগরিক হিসাবে বাস করে। চীনে মুসলমানদের আগমন বৈধ ও সম্মানজনক পথে হয়েছে। তবে এখানে হানদের আগমন অনেক আগে, প্রাগৈতিহাসিক সময়ে ঘটেছে। এদিক থেকে তাদেরকে চীনের আদিবাসী বলে মানতে হবে। হানদেরকেও মানতে হবে। মুসলমানরা চীনের স্থায়ী ও সমঅধিকারী অধিবাসী। এটাই পৃথিবীর মানব কালচার। পৃথিবীর সব দেশেই এমন নতুন পুরাতন সবাইকে সমভাবে নিয়ে জাতি গঠন হয়েছে। সম্মানিত নেতৃবৃন্দ এবং ভাই ও বোনেরা, আপনারা হুই ও উইঘুরদের সম্পর্কে আমার চেয়ে অবশ্যই ভালো জানেন। আমি মাত্র আপনাদের স্মরণ করিয়ে দেবার জন্যেই কিছু বলব। হুই ও উইঘুররা এক আল্লাহর বান্দা এবং এক নবী (সা.) ও এক কিতাবের অনুসারী। মুসলিম হিসাবে তাদের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। তবে চীনে আগমনের দিক দিয়ে তাদের ইতিহাস ও মনন কিছু ভিন্ন হয়ে গেছে। সাধারণভাবে এটা ধরে নেয়া হয়, রাসুল (সা.)-এর সময় ৬১৬/১৭ সাল থেকে সাদ বিন আবি ওয়াক্কাস (রা.), জাফর ইবনে আবি তালিব (রা.) এবং জাহাশদের (রা.) মতো মুসলিম মিশনারী যারা চট্টগ্রাম, কামরূপ-মনিপুর হয়ে কিংবা ইন্দোনেশিয়া ঘুরে পূর্ব চীন সাগর হয়ে চীনের গোয়াংজুসহ চীনের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে প্রবেশ করে, তারাই হুইদের উত্তর-পুরুষ। এরা বৈধভাবেই চীনে আসে। চীনের ট্যাং ডাইনেস্টির সম্রাট গাওজং ৬৫১ সালে খলিফা ওসমান (রা.)-এর প্রতিনিধিদলকে সাদরে দরবারে গ্রহণ করেন। ট্যাং ডাইনেস্টির রেকর্ডে এই আরব মুসলমানদের তা-শি বলে উল্লেখ করা হয়েছে। তা-শি আসলে তা-জি শব্দের অপভ্রংশ। তাজি পারসিকদের ব্যবহৃত আরব-এর প্রতিশব্দ। আরবদের সাথে কিছু পারসিকরাও চীনে আসে। ট্যাং ডাইনেস্টির গোটা সময়কালে (৬১৮-৯০৭ খ্রিস্টাব্দ) চীনের পূর্ব উপকূলের গোয়াংঝু বন্দর দিয়ে অব্যাহতভাবে মুসলমানরা চীনে আসে। গোয়াংঝু শহরেই প্রথম। মুসলিম বসতি এবং প্রথম মসজিদ হোয়াই শেং নির্মিত হয়।

চীনে মুসলমানদের আরেকটি প্রবাহ চীনের উত্তর-পশ্চিম পাহাড়ি পথে এবং সিল্ক রোড দিয়ে আসা শুরু হয়। আব্বাসীয় খলিফাঁদের গোটা শাসন আমলে আরব, পারসিক ও তুর্কি মুসলমানদের আগমন অব্যাহত থাকে। এই মুসলমানরা সামরিক পরিচয় নিয়ে চীনে আসে। ৭৫৬ খ্রিস্টাব্দে আব্বাসীয় খলিফা আরব, পারসিক মুসলমানদের একটি গ্রুপকে ট্যাং সম্রাট সু-সুং-এর সাহায্যে কানশুতে পাঠান। ট্যাং ডাইনেস্টির পর সুং ডাইনেস্টির (৯৬০ ১২৭৯ খ্রিস্টাব্দ) সময়েও মুসলমানদের এই সামরিক আগমন অব্যাহত থাকে। সুং সম্রাট শেন সুং ১০৭০ খ্রিস্টাব্দে বোখারা থেকে ৫৩০০ মুসলমানকে আমন্ত্রণ করে চীনে নিয়ে আসে এবং সুং-এর রাজধানী। কাইফেংগ ও ইয়ান চিং (বেইজিং)-এর মধ্যবর্তী স্থানে নিরাপত্তার শক্তি হিসাবে মোতায়েন করে। এই জায়গাটা ছিল চীনা সম্রাজ্য ও লিয়াও। শাসকদের এলাকার মধ্যে একটা বাফার অঞ্চল। এখানেই বোখারা থেকে আনা সৈনিক মুসলমানদের বসতি গড়ে উঠে। ১০৮০ সালে ১০ হাজার ঘোড় সওয়ার মুসলমান চীনের উত্তরাঞ্চলে বসতি স্থাপন করে। সামরিক শক্তি হিসাবে মুসলমানদের চীনে প্রবেশের কয়েকটা দৃষ্টান্ত এজন্যেই উল্লেখ করলাম যে, উত্তর-পশ্চিমের পাহাড়ি পথে ও সিল্ক রোড দিয়ে সেই সময় আসা মুসলমানদের মধ্যে সামরিক চরিত্র প্রধান ছিল এবং তারা স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় প্রত্যাশী ছিল। আমাদের উইঘুর মুসলমানদের পূর্বসূরি এরাই। এদের স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার চেতনা উইঘুরদের মধ্যে এখনও আছে। বিশ শতকের বিশ-এর দশকে তারা একটা ক্ষণস্থায়ী স্বাধীন রাষ্ট্রের মালিকও হয়েছিল, কিন্তু টিকেনি। উইঘুরদের স্বাধীন রাষ্ট্র চেতনা ও চেষ্টা চীনের মেজরিটি মানুষ ও শাসকদের সাথে তাদের দূরত্ব ও সংঘাত বাড়িয়েছে। এর ফলে তাদের উপর জুলুম নির্যাতন বেড়েছে।

আহমদ মুসা একটু থামল।

গোটা হল-এ নিঃশব্দ নীরবতা। নির্বাক লোকদের স্থির চোখের অনড় দৃষ্টি আহমদ মুসার মুখের উপর নিবদ্ধ। আহমদ মুসা থামলেও তারা স্থির, অচঞ্চল।

গ্লাস থেকে একটু পানি খেয়ে নিয়ে প্রিয় নেতৃবৃন্দ এবং ভাই ও বোনেরা, বলে আহমদ মুসা শুরু করল আবার, আমার উপরের আলোচনা থেকে পরিষ্কার আজ উইঘুররা জুলুম নির্যাতনের শিকার, সেটা তাদের সামরিক চরিত্র ও স্বাধীন চেষ্টার কারণে, কোনো অপরাধের কারণে নয়। অন্যদিকে হুইরা যে এ থেকে মুক্ত আছে সেটা এই কারণে যে, তাদের মধ্যে শান্তিবাদী ও মিশনারী চরিত্র প্রধান। তারা তাদের ঈমান-আকিদা মেজরিটির কাছে বিকিয়ে দিয়েছে এই কারণে তারা রক্ষা পাচ্ছে, সত্য এটা নয়। তবে এ কথা ঠিক যে, হুইরা চীনের মেজরিটি মানুষের মূলস্রোতে যতটা মিশে গেছে, উইঘুররা ততটা যায়নি। মিং ডাইনেস্টির (১৩১৮-১৬৪৪ খ্রিস্টাব্দ) সময়ে চীনে মুসলমানদের চীনাকরণ শুরু হয়। চীনা মুসলমানরা চীনা ভাষা ও পোশাক গ্রহণ করে। চীনা নামও তারা গ্রহণ করে নেয়। বাড়িও তাদের চীনা রীতিতে তৈরি হতে থাকে। চীনা খাদ্যও তারা গ্রহণ করে। কিন্তু এর মধ্যেই চীনা মুসলমানরা তাদের স্বাতন্ত্র চিহ্নিত করে। যেমন তারা খাদ্যে হালাল হারাম মেনে চলে সকলকে জানান দিয়েই। মেজরিটি হানদের বাড়ি থেকে মুসলমানদের বাড়ি আলাদাভাবে চিহ্নিত করার জন্যে প্রতিটি মুসলিম বাড়িই প্রকাশ্য স্থানে আরবিতে নানা ধর্মীয় ও পরিচয়মূলক বিষয় খোদাই করা হয়। পোশাকের ক্ষেত্রে চীনা পোশাকেই মুসলমানরা হিজাবের অনুশাসন মেনে চলে, যা তাদেরকে অন্যদের থেকে আলাদাভাবে চিহ্নিত করে। মুসলমানরা চীনা নাম গ্রহণ করলেও তাতে মুসলিম পরিচয় প্রকাশ করে। নামের সাথে তারা কিছু শব্দ সংকেত যোগ করে যা হয় তাদের মুসলিম পরিচয়জ্ঞাপক। যেমন এখানে উপস্থিত আছেন মা চু ইং ও মা ঝু সুলতান। তাদের নামের আগের মা শব্দ আসলে মমাহাম্মদ। সুতরাং তাদের নাম হলো মোহাম্মদ চু ইং ও মোহাম্মদ ঝু সুলতান। অনুরূপভাবে এখানে উপস্থিত বিজ্ঞানী বোন ফা জি ঝাও এর কথা বলি। তার নামের প্রথম ফা শব্দ সংকেতের অর্থ ফাতিমা। সুতরাং তার নাম দাঁড়াচ্ছে ফাতিমা জি ঝাও। আমি আগেই বলেছি, এই চীনাকরণ উইঘুরদের চেয়ে হুইরা বেশি গ্রহণ করেছে এবং এটা কোনোভাবেই দোষের নয়। ইসলামের ইতিহাস হলো মুসলমানরা যে দেশেই গেছে, সে দেশের দেশজ সংস্কৃতি তারা গ্রহণ করেছে, কিন্তু ধর্মীয় সংস্কৃতি নয়। দেশজ সংস্কৃতি ও ধর্মীয় সংস্কৃতির মধ্যে পার্থক্য হলো, দেশজ সংস্কৃতি হলো দেশের সেই সব ক্রিয়া-কর্ম যার সাথে ধর্মীয় কোনো আচার, আদর্শ ও মূল্যবোধ যুক্ত নয়, অন্যদিকে যেসব ক্রিয়া-কর্মের সাথে ধর্মীয় বিশ্বাস ও আচার-আচরণ যুক্ত থাকে, সে ধর্মীয় সংস্কৃতির মধ্যে পড়ে। চীনের মুসলমানরা চীনাকরণের মধ্য দিয়ে চীনের দেশজ সংস্কৃতিই গ্রহণ করে, ধর্মীয় সংস্কৃতি নয়। সুতরাং চীনা মুসলমানরা যা করেছে, তা পুরোপুরি ইসলামের মধ্যে থেকেই করেছে এবং এটা অবশ্য করণীয় বিষয়ও। কারণ ইসলাম বিশ্বধর্ম। পৃথিবীর প্রতিটি দেশের দেশজ সংস্কৃতি ইসলামেরই সংস্কৃতি। থামল আহমদ মুসা।

আহমদ মুসা থামতেই পিনপতন নীরবতা ভেঙে দিয়ে চারদিক থেকে টেবিল চাপড়ানোর শব্দ উচ্চকিত হয়ে উঠল। দেখা গেল, সবার আগে টেবিল চাপড়ানো শুরু হয়েছিল উইঘুর নেতা ইরকিন আহমেদ ওয়াং ও আবু যিয়াদ যুবায়ের আওয়াং-এর টেবিল থেকে।

প্রিয় হুই ও উইঘুর মুসলিম ভাই ও বোনেরা, আবার শুরু করল আহমদ মুসা, উইঘুর মুসলিমরা আজ রাজনৈতিক কারণে জুলুম নির্যাতনের শিকার হয়েছে। এ বিষয়টা নতুন নয়। চীনের ইতিহাসে বিভিন্ন সময় মুসলমানরা রাজনৈতিক জুলুম-নির্যাতনের শিকার হয়েছে, এমনকি গণহত্যার শিকার হয়েছে হুই উইঘুর নির্বিশেষে বিশেষ করে মিং ডাইনেস্টি ও কিং ডাইনেস্টির দ্বন্দ্বে লক্ষ লক্ষ মুসলমান নিহত হয়। দুঃখজনক দুই পক্ষেই বড় বড় মুসলিম জেনারেল ছিলেন। মুসলিমরা মুসলিমদের হত্যা করেছে মিং বা কিং সম্রাটদের স্বার্থ রক্ষার জন্যে। মুসলিম জেনারেল মা ডাহান, মা ইয়াংলিন, মা কিং, নানতিং প্রমুখ কিং ডাইনেস্টির জেনারেল জো-জোনট্যা-এর পাশে দাঁড়িয়ে মুসলমানদের নির্বিচারে হত্যা করে। এই মুসলিম জেনারেলরা ডানগান বিদ্রোহের সময় কিংপন্থী মুসলিম জেনারেল মা ডাহান, মা ইয়াংলিন। এবং মা ওয়াংফুর নেতৃত্বাধীন মুসলমানদের উপর গণহত্যা চালায়। এই সময় কয়েক মিলিয়ন মুসলমান নিহত হয়। এই সব যুদ্ধে হুইদের ছিল ব্যাপক অংশগ্রহণ। সেদিনও কখনো হুইরা উইঘুরদের উপর, উইঘুররা হুইদের উপর হত্যাকাণ্ড চালায়। মনে করা হচ্ছে আজও হুইদের রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করা হচ্ছে উইঘুরদের বিরুদ্ধে। তেমনি আজ চীনের বাইরেও ব্যাপক ধারণা যে, উইঘুরদের বিক্ষোভ-বিদ্রোহকে আমেরিকা তার রাজনৈতিক স্বার্থে চীনের বিরুদ্ধে ব্যবহার করে আসছে কৌশলে। হুই উইঘুরদের মধ্যে বিভেদ-বিরোধ বাধানোর চেষ্টা রাজনৈতিক স্বার্থে এবং উভয় সম্প্রদায়কে ধ্বংস করার জন্যে। জোয়ান উ বাহিনীর অন্তর্ভুক্ত চীনের সৈনিক, পুলিশ, আমলারা চীন সরকারের নাম ভাঙিয়ে আজ দেশ জুড়ে এই কাজই করছিল, তার প্রমাণ এবার হাতে-কলমে পাওয়া গেছে।

একটু থামল আহমদ মুসা। চারদিকে সকলের দিকে একবার তাকাল। এবং সঙ্গে সঙ্গেই আবার বলল, হুই ও উইঘুরদের নিয়ে আমার কথা এ পর্যন্ত। এর চেয়ে বিস্তারিত কিছু আমি বলতে চাই না।

আহমদ মুসার এ কথার সাথে সাথেই চারদিক থেকে টেবিল চাপড়ে তাকে স্বাগত জানানো হলো। সবচেয়ে দীর্ঘক্ষণ টেবিল চাপড়ালো উইঘুর নেতা ইরকিন আহমেদ ওয়াং।

আহমদ মুসা কথা আবার শুরু করল, আমার শেষ কথা চীন রাষ্ট্রের সাথে। মুসলমানদের সম্পর্ক নিয়ে। এ সম্পর্ক হবে কি জিহাদের-সংঘাতের, না শান্তি, সহযোগিতা ও সমঝোতার? এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার আগে আমি একটা ছোট গল্প বুলব। এ গল্প আমি অনেকবার অনেক জায়গায় বলেছি। গল্পটা হলো : আফগানিস্তানের খোরাসান অঞ্চল তখন এক নিপীড়ক শাসকের অধীনে। সেই সময় খোরাসান থেকে একদল প্রতিনিধি গেল ইমাম আবু হানিফা (রহ.)-এর কাছে। তারা ইমাম আবু হানিফার কাছে তাদের অত্যাচারী শাসকের বিরুদ্ধে জিহাদ করার অনুমতি চাইল। ইমাম আবু হানিফা (রহ.) অনুমতি দিলেন না। ফিরে গেল প্রতিনিধি দলটি। কিছুদিন পর প্রতিনিধি দলটি আবার ফিরে এলো ইমাম আবু হানিফা (রহ.)-এর কাছে। আগের মতোই জিহাদের অনুমতি চাইল। ইমাম আবু হানিফা (রহ.) অনুমতি দিলেন না। ফিরে গেল দলটি আবার। তৃতীয়বার প্রতিনিধি দলটি আবার এলো ইমাম আবু হানিফার কাছে এবং আগের মতোই জিহাদের অনুমতি চাইল। অনুমতি দিলেন না ইমাম আবু হানিফা (রহ.)। প্রতিনিধি দলটি এবার প্রবল প্রতিবাদ তুলে বলল, আল্লাহ অনুমতি দিয়েছেন, আপনি দেবেন না কেন? উত্তরে ইমাম আবু হানিফা (রহ.) বললেন, ইসলামে আত্মহত্যা নিষিদ্ধ, এই কারণে আমি অনুমতি দেব না। প্রতিনিধিদল বলল, আমরা তো আত্মহত্যা করতে যাচ্ছি না, জিহাদ করতে চাচ্ছি। ইমাম আবু হানিফা (রহ.) বিষয়টা তাদের বুঝিয়ে দিয়েছিলেন। বুঝিয়ে দেয়ার বিষয়টা এই ছিল যে, জিহাদের জন্যে কমপক্ষে প্রয়োজন একটা স্বাধীন ভূখণ্ড, একটা বৈধ কর্তৃত্ব এবং একটা অনুগত জনগোষ্ঠী। এসব ছাড়া প্রতিষ্ঠিত, সুসংগঠিত, জনসমর্থনসমৃদ্ধ শক্তিমান একটা সরকার বা রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে জিহাদে নামা আত্মহত্যাই বটে। তৃতীয়বারও প্রতিনিধিদলটি ফিরে গিয়েছিল। খোরাসানে জিহাদ আর হয়নি।

ইমাম আবু হানিফা (রহ.) যা করেছেন, জিহাদ শুরু করা সম্পর্কে এটাই ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি। আল্লাহর রাসুল (সা.) মক্কায় শতভাবে নির্যাতিত হয়েছেন, নির্যাতিত অনেককে দেশ ত্যাগের অনুমতি দিয়েছেন, কিন্তু প্রতিরোধ তো দূরে থাক, সরব বিক্ষোভ-প্রতিবাদও করেননি। জিহাদের অনুমতি আসে মদিনায় স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের পর। তাই বলে কি রাসুল (সা.) এর মক্কার জীবন ব্যর্থ? না, ব্যর্থ নয়। নির্যাতিত-নিপীড়িত হওয়াও এক ধরনের দাওয়াত, প্রচার এবং জিহাদও। এই দাওয়াত ও প্রচারের মাধ্যমেই মক্কায় ইসলামের প্রসার ঘটেছিল, একটা মুসলিম কম্যুনিটির জন্ম হয়েছিল, তৈরি হয়েছিল সোনার মানুষ, যারা মদিনা-রাষ্ট্রের হাল ধরেছিল। আমি আমার বক্তব্যের শুরুতেই বলেছি, হুদায়বিয়ার সন্ধি-উত্তর শান্তির পরিবেশে। ইসলামের যে বিস্তার ঘটে, হুদায়বিয়ার সন্ধি-পূর্ব, যুদ্ধ ও অশান্তির পরিবেশে তা ঘটেনি। সে সময়ের জিহাদের প্রায় সবই ছিল আত্মরক্ষামূলক। শক্তির বিরুদ্ধে মুসলিম জাতির অস্তিত্ব ও স্বাধীনতা টিকিয়ে রাখার জন্যেই ছিল। ইসলামের দাওয়াত ও প্রচারের সুযোগ এ সময় কম ছিল। হুদায়বিয়ার সন্ধি-উত্তর সময়ে আল্লাহ রাসুল (সা.)-কে এ সুযোগ দিয়েছিল।

তরবারি, বন্দুক বা শক্তির চেয়ে তাওহিদের বিপ্লবী ডাক ও মানবিক আহব্বান ইসলামের প্রসারের জন্যে অনেক গুণ বেশি শক্তিশালী। ভারতের ইতিহাসে এক বিস্ময়কর জিনিস আমি দেখেছি। দিল্লী আটশত বছর মুসলিম শাসনের কেন্দ্র ছিল। কিন্তু দিল্লী ও এর চারদিকের এলাকায় মুসলমানরা দারুণভাবে সংখ্যালঘু ছিল। কিন্তু দিল্লী থেকে সবচেয়ে দূরে বাংলাদেশে। মুসলমানরা বিপুলভাবে সংখ্যাগুরু। এর কারণ, বাংলাদেশে শক্তি নয়, আলেম ও মুসলিম নারীদের মাধ্যমে ইসলামের মানবিক রূপ বাংলাদেশের মানুষ দেখেছে, ফলে দলে দলে তারা ইসলামের ছায়ায় আশ্রয় নিয়েছে। আমি মনে করি অমুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশে ইসলামের মূলমন্ত্র তাওহিদের মানবিক দাওয়াতই বড়। জিহাদ নয়। দেড়শ কোটি লোকের দেশ চীনে। পাঁচ কোটি মুসলমানের দাওয়াত ও প্রচারের জিহাদই আজ বেশি প্রয়োজন। এর চেয়ে ভালো বিকল্প আর নেই। থামল আহমদ মুসা।

তাকাল মা চু ইং ও ইরকিন আহমেদ ওয়াং-এর দিকে। বলল, সম্মানিত নেতৃবৃন্দ, আমার সব কথা বলেছি। চীন রাষ্ট্রের সাথে মুসলমানদের সম্পর্ক কেমন হওয়া উচিত, সে বিষয়ে মৌল বা নীতিকথা আমি বলেছি। এর চেয়ে

স্পষ্ট কথা কি আমার বলার প্রয়োজন আছে? মনে করি নেই। কার্যকর স্থায়ী সম্পর্কের জন্যে লেন-দেনের যে বিষয়টা, সেটা আপনাদের কাছ থেকে এলেই ভালো হয়।

কথা শেষ করে আহমদ মুসা বসল।

হুই নেতা মা চু ইং এবং উইঘুর নেতা ইরকিন আহমেদ ওয়াং নিচু গলায় কিছুক্ষণ আলোচনা করল।

পরে দুজন সোজা হয়ে তাদের চেয়ারে বসল।

উঠে দাঁড়াল ইরকিন আহমেদ ওয়াং। সকলের দিকে একবার তাকিয়ে নিয়ে বলল, উপস্থিত চীনের মুসলিম নেতৃবৃন্দ, আমাদের মহান ভাই আহমদ মুসাকে হুই-উইঘুর সম্পর্ক এবং চীন রাষ্ট্রের সাথে মুসলমানদের সম্পর্ক বিষয়ে সমাধান বা করণীয় সূচক দুটি প্রস্তাব পেশ করার জন্যে দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল। আলহামদুলিল্লাহ, তিনি উক্ত দুই বিষয়েই তার সুন্দর স্টাইলে তার কথা ও মত আমাদের কাছে তুলে ধরেছেন। তার কথা ও মত বোঝার ক্ষেত্রে আপনাদের কারও কাছে কোনো অস্পষ্টতা বা প্রশ্ন আছে কিনা?

ইরকিন আহমেদ ওয়াং-এর কথা শেষ হওয়ার সাথে সাথে সবাই একসঙ্গে আল-হামদুলিল্লাহ ধ্বনি দিয়ে উঠল। বলল, না আমাদের কাছে। কোনো অস্পষ্টতা নেই। তিনি ইতিহাস ও দৃষ্টান্ত সামনে এনে অপরূপ দক্ষতার সাথে জটিল বিষয়কে সরল-সোজা করে আমাদের বুঝিয়ে দিয়েছেন। আল্লাহ আমাদের মহান ভাইটাকে সফল দীর্ঘজীবন ও উত্তম জাযাহ দান করুন।

উঠে দাঁড়াল ইরকিন আহমেদ ওয়াং। সকলকে ধন্যবাদ দিয়ে বলল, আপনারা ঠিকই বলেছেন। আমরা চীনে বাস করি, চীনের ইতিহাস আমরা জানি, কিন্তু মহান ভাই আহমদ মুসা আজ চীনের ইতিহাসকে, হুই উইঘুরদের ইতিহাসকে নতুনভাবে আমাদের শিখিয়েছেন। এই শিক্ষা, এই জানা আমাদের ছিল না।

থামল ইরকিন আহমেদ ওয়াং। তার কণ্ঠ আবেগে রুদ্ধ হয়ে গিয়েছিল।

একটু থেমেই ইরকিন আহমেদ ওয়াং আবার শুরু করল, প্রিয় ভাই আহমদ মুসা হুই ও উইঘুরদের জীবন ও বৈশিষ্ট্যের বাস্তবতা তুলে ধরে ইসলামী জীবনাদর্শের শিক্ষা সামনে এনে তিনি হুই-উইঘুরদের একসাথে মিলিয়ে দিয়েছেন এবং তাদের ঐক্য অবধারিত করে তুলেছেন। এখন ভাবতে আমার লজ্জাবোধ হচ্ছে, ইগো প্রভাবিত আবেগ এবং অবাস্তব রাজনৈতিক স্বার্থ ও শক্তিকে বড় করে দেখতে গিয়ে আমরা চীনে ইসলামের বৃহত্তর স্বার্থকে ক্ষতিগ্রস্ত করার চেষ্টা করেছি। আল্লাহ আমাদের মাফ করুন। আমার খুবই দুঃখ হচ্ছে মাত্র কয়েকদিন আগে আমি আমার বড় ভাই ও মুরব্বি সম্মানিত হুই নেতা সাইয়েদ ইমাম মা চু ইং-এর সাথে রাজনৈতিক প্রশ্নে অকথ্য ভাষায় কথা বলেছি।

কথা থেমে গেল ইরকিন আহমেদ ওয়াং-এর। কান্নায় রুদ্ধ হয়ে গিয়েছিল তার কণ্ঠ। এ মা চু ইং উঠে দাঁড়িয়ে জড়িয়ে ধরল ইরকিন আহমেদ ওয়াংকে। এ চারদিক থেকে টেবিল চাপড়ানোর আনন্দ ধ্বনি গর্জন করে উঠল। সকলের মুখে স্বস্তি ও শান্তির হাসি। সম্মেলনের এক প্রান্ত থেকে উঠে দাঁড়াল কাশগড়ের উইঘুর নেতা জিয়ান জি জাব্বার এবং সাথে সাথে আনন্দে চিৎকার করে বলে উঠল, আল্লাহ অশেষ করুণায় আমাদের মিলন হোক চিরদিনের। মহান নেতা আহমদ মুসা জিন্দাবাদ।

হলটা সহাস্য কথা, গুঞ্জনে ভরে গিয়েছিল।

এবার সামনে দাঁড়াল হুই নেতা মা চু ইং। হাত তুলে সবাইকে নীরব। হতে বলল।

নিমিষেই নীরবতা নেমে এলো ঘরে।

সবাইকে উদ্দেশ্য করে মা চু ইং বলল, চীনের প্রিয় মুসলিম নেতৃবৃন্দ, আমাদের মহান ভাই আহমদ মুসা বললেন, চীন রাষ্ট্রের সাথে আমাদের স্থায়ী ও কার্যকর সম্পর্কের জন্যে চীন সরকারের সাথে আমাদের লেনদেনের হিসাব আমাদেরকেই করতে হবে। এ বিষয়ে আপনাদের মত কি?

দ্রুত উঠে দাঁড়াল চীনে মুসলমানদের আদি ভূমি গোয়াংঝুর হুই প্রতিনিধি যুবায়ের জোয়ান জু। বলল, আমাদের সম্মানিত বোন ফা জি ঝাও তাঁর বক্তব্যে বলেন, মহান ভাই আহমদ মুসা হুই ও উইঘুর তথা চীনের মুসলমানদের সমস্যা জানেন এবং চীন সরকারকেও বোঝেন। আমিও তাই মনে করি, সুতরাং মহান ভাই আহমদ মুসা এই ব্যাপারে একটা আউট লাইন দিন। বিস্তারিত আমাদের নেতৃবৃন্দ ঠিক করবেন।

যুবায়েরের কথা শেষ হবার আগেই হল-এর সবাই টেবিল চাপড়ে সমর্থন জানাল যুবায়ের জোয়ান জুকে।

মা চু ইং এবং ইরকিন আহমেদ ওয়াং তাকাল আহমদ মুসার দিকে। আহমদ মুসা একটু হেসে উঠে দাঁড়াল।

মাথা নিচু করে মুহূর্তকাল একটু চিন্তা করে মুখ তুলে সবার দিকে তাকিয়ে সবাইকে ধন্যবাদ দিয়ে বলল, প্রিয় নেতৃবৃন্দ, আমি আমার প্রতি আপনাদের ভালোবাসা ও আস্থাকে সম্মান করি। আমার জ্ঞান, বিবেক অনুসারে আমার কথা আমি বলছি। বলে একটু থেমেই আবার শুরু করল, আমি যা ভাবছি। তা হলো : এক. সিংকিয়াংসহ চীনের মুসলমানরা চীনের অন্যান্য নাগরিকের মতোই বিশ্বস্ত ও দায়িত্বশীল নাগরিক। তারা চীনের সংবিধান মেনে চলবে ও একে রক্ষা করবে। চীনের সংবিধানে সংশোধনী এনে চীনের ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ধর্মীয় অধিকার স্বাধীনভাবে মেনে চলার অধিকার দেয়া হবে। দুই. সিংকিয়াং আগের মতোই স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল থাকবে। এখানে একটা পার্লামেন্ট ও সরকার থাকবে। সব প্রদেশের মতোই এখানে কেন্দ্র নিয়োজিত গভর্নর থাকবে। সরকারপ্রধান হবেন প্রধানমন্ত্রী। পার্লামেন্টের এক তৃতীয়াংশ সদস্য হবেন হান কমুনিটি থেকে। এক-তৃতীয়াংশ মন্ত্রীর পদও তারা পাবেন। স্বায়ত্তশাসিত সরকারের হাতে থাকবে স্থানীয় সরকারগুলো। আয়কর, ভূমিকর, শুল্ক কেন্দ্রীয় সরকার পাবে। কিন্তু উন্নয়ন ও ভ্যাট জাতীয় কর পাবে স্বায়ত্তশাসিত সরকার। তিন, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কেন্দ্রের হাতে থাকবে। তবে স্থানীয় পুলিশ বা কম্যুনিটি পুলিশ নামে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষায় সহায়তা দানকারী ও সেবাধর্মী একটা বাহিনী স্বায়ত্তশাসিত সরকারের থাকবে। অন্যান্য প্রদেশের মতোই সিংকিয়াং কেন্দ্রীয় পার্লামেন্টে প্রতিনিধিত্ব। করবে। চার. অন্যান্য প্রদেশের মুসলমানরা সংখ্যাগুরুদের মতোই। রাজনৈতিক ও অন্যান্য অধিকার ভোগ করার সুযোগ পাবে। আগামী পাঁচ। বছর পর্যন্ত চীনের ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা সকল চাকরি বাকরিতে উপযুক্ত একটা কোটা বরাদ্দ লাভ করবে। দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় প্রাথমিক স্তর পর্যন্ত ধর্মীয়। শিক্ষার ব্যবস্থা থাকবে। এ ধর্মীয় শিক্ষার সিলেবাস তৈরির দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট ধর্মীয় গ্রুপকে দেয়া হবে, যা কেন্দ্রীয় সরকার চূড়ান্ত করবে। সরকারি শিক্ষার বাইরে ধর্মীয় গ্রুপগুলো স্বপরিচালিত স্বনিয়ন্ত্রিত ধর্মীয় স্কুল প্রতিষ্ঠা করতে পারবে। পাঁচ. মুসলমানদের ধর্মীয় ও পারিবারিক সমস্যা ও অপরাধের বিচারের জন্যে সরকারি বিচারব্যবস্থার অধীনেই ফ্যামিলি বা কম্যুনিটি কোর্ট থাকবে। এর বিচারক হবেন একজন মুসলিম। ছয়, চীনের কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনে সকল ধর্মের প্রতিনিধি নিয়ে একটা ধর্মীয় উপদেষ্টা বোর্ড থাকবে। এই বোর্ড ধর্ম বিষয়ক সিদ্ধান্তের ব্যাপারে সরকারকে সহায়তা করবে।

আহমদ মুসা একটু থামল। সঙ্গে সঙ্গেই আবার বলে উঠল, আমার কথা এখানেই শেষ। আমার মনে হয়, প্রয়োজনীয় বিষয়গুলো আমার কথায় চলে এসেছে। আর বিস্তারিত…।

আহমদ মুসা কথা শেষ করতে পারলো না। হল-এর সবাই উঠে দাঁড়াল। এবার টেবিল চাপড়ানো নয়, সবাই হাততালি দিয়ে উঠল। চলল হাততালি বেশ কিছুক্ষণ। হাততালির মধ্যেই তারিম বেসিন আঞ্চলের উইঘুর নেতা আবু যিয়াদ যুবায়ের আওয়াং উচ্চকণ্ঠে বলল, আর বিস্তারিত দরকার নেই। আপনি যা বলেছেন, সেটুকু পেলেই আমাদের ষোল আনা পাওয়া হবে। আপনাকে ধন্যবাদ মহান ভাই আহমদ মুসা। ঠিক প্রয়োজনীয় চাওয়াগুলোই আপনার মুখ থেকে বেরিয়ে এসেছে। মহান রাব্দুল আলামিনের অশেষ শুকরিয়া যে তার দয়ায় আপনাকে আমরা পেয়েছি।

সবাই আরেক দফা হাত দিয়ে আবু যিয়াদ যুবায়ের আওয়াংকে স্বাগত জানাল।

আহমদ মুসা বসে পড়েছে।

উঠে দাঁড়াল ইরকিন আহমেদ ওয়াং। বলল, ভাই আবু যিয়াদ যুরায়ের আওয়াং ঠিক বলেছেন। আমাদের প্রধান চাওয়ার কোনোটাই বাদ পড়েনি। সব প্রশংসা আল্লাহ রাব্বল আলামিনের। একজন সফল মানুষের যা প্রয়োজন তা সবই তিনি মহান ভাই আহমদ মুসাকে দিয়েছেন। যুদ্ধের ময়দানে তিনি যেমন অজেয়, তেমনি তিনি শান্তির বৈঠকেও অবিস্মরণীয়। আমরা…।

মাফ করবেন জনাব। আমাদের হাতে বোধ হয় খুব সময় নেই। আমাদের যে মতামত হবে তা চূড়ান্ত করতে হবে এবং তা চীনের নেতাদের সাথে বৈঠকে পেশ করতে হবে। সেই বৈঠকে কারা যাবে সেটাও ঠিক করতে হবে। আমাদেরকে আমাদের প্রতিটি কথার ব্যাপারে সিরিয়াস হতে হবে। আজ আমরা যা বলব, তা কয়েক বছর নয়, কয়েক যুগ নয়, কয়েক শতাব্দীর জন্যে আমাদের ভাগ্য নির্ধারণকারী হতে পারে।

বলল আহমদ মুসা উঠে দাঁড়িয়ে। বৈঠক-কক্ষে ফিরে এলো আবার পিনপতন নীরবতা।

ধন্যবাদ মহান ভাই আহমদ মুসা। বিষয়টি নিয়ে আমাদের সিরিয়াস। হওয়া প্রয়োজন। এ বলে ইরকিন আহমেদ ওয়াং ফিরে তাকাল সকলের দিকে। বলল, প্রিয় ভাইসব, আহমদ মুসা দুটি বিষয় স্পষ্টভাবে তুলে ধরেছেন। এক, হুই, উইঘুর আমরা নিজেরা আলাদা মনে করলেও, শত্রুরা আমাদের আলাদা করে দেখে না। তারা হুই-উইঘুর, হান এমনকি মুসলিম সবারই ধ্বংস চায়। এর কারণ হুই-উইঘুররা কিছু বৈশিষ্ট্যের দিক দিয়ে আলাদা বটে। কিন্তু ইসলামী আদর্শ ও ঈমানিয়াতের ক্ষেত্রে আমাদের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। আসুন, আমরা আল্লাহর নামে শপথ গ্রহণ করি আমরা দুই সম্প্রদায় শিশা ঢালা প্রাচীরের মতো হবো।

ইরকিন আহমদের কথার মধ্যেই সকলে টেবিল চাপড়ে ইরকিন আহমেদ ওয়াংকে সমর্থন জানাল।

ইরকিন আহমেদ ওয়াং থেমে গিয়েছিল। আবার শুরু করল তার কথা। বলল, মহান ভাই আহমদ মুসার দ্বিতীয় কথা হলো, দেড়শ কোটি মানুষের দেশে সিংকিয়াং-এর দেড় কোটি মানুষের স্বাধীনতার লড়াই ইসলামের দৃষ্টিতে অবাস্তব শুধু নয়, চীনে ইসলামের ভবিষ্যতের জন্যে ক্ষতিকর। সুতরাং আমরা মুসলমানরা চীন-রাষ্ট্রের বিশ্বস্ত ও অনুগত নাগরিক হিসেবে ধর্মীয় সংখ্যালঘুর অধিকার ও স্বাধীনতা নিয়ে শান্তি ও সমঝোতার পথে চলে চীনের উন্নয়ন অগ্রগতিসাধনসহ শান্তি সংরক্ষণে অংশ আমাদের নিতে হবে। ধর্মীয় সংখ্যলঘু হিসাবে আমাদের ধর্মীয় অধিকার আমরা সর্বনিম্ন যা চাই, সেটাও আহমদ মুসা তুলে ধরেছেন এবং সেটা আপনারা সকলে শুনেছেন। এখন আমরা চাই, সবাই একে একে উঠে আপনাদের মত বলুন। মনে রাখবেন, মহান ভাই আহমদ মুসা বলেছেন, আমরা আজ এখানে যে সিদ্ধান্ত নেব, তা কয়েক বছর, কয়েক যুগ নয়, কয়েক শতাব্দী পর্যন্ত আমাদের ভাগ্য নির্ধারণকারী হতে পারে। প্লিজ, আপনারা মত দিতে শুরু করুন।

অখণ্ড নীরবতা সমাবেশ কক্ষে।

গোলাকার সারির ডান প্রান্তের প্রথম ব্যক্তি রাজধানী বেইজিং যে প্রদেশের মধ্যে সেই হুবেই প্রদেশে বসবাসকারী প্রবীণ ও প্রভাবশালী উইঘুর নেতা আহমেদ লিউ চি (যাকে কিছুদিন আগে সিংকিয়াং-থেকে বিদ্রোহ তৎপরতার কারণে বহিষ্কার করলে সে হুবেই প্রদেশে বেইজিং-এর উপকণ্ঠে এসে বাস করছে) উঠে দাঁড়াল। বলল, আমি আল্লাহর অশেষ শুকরিয়া আদায় করছি। তিনি দয়া করে আমাদের পথ দেখানোর ব্যবস্থা করেছেন। আজকের দুনিয়ায় ঈমান ও কল্যাণের পরশ পাথর, আল্লাহর এক দয়া মহান। ভাই আহমদ মুসার মাধ্যমে আল্লাহ আমার ও আমাদের সকলের চোখ খুলে দিয়েছেন। আমি…।

কথা শেষ করতে পারলো না আহমেদ লিউ চি। কান্নায় রুদ্ধ হয়ে গেল। তার কথা।

স্যরি বলে সে পকেট থেকে রুমাল বের করে চোখ মুছে নিল। সবার দিকে তাকিয়ে আবার স্যরি বলে কথা শুরু করল। বলল, আমি আল্লাহকে হাজির-নাজির মেনে, আমার সব বুদ্ধি-বিবেচনা সামনে রেখে সর্বনিয়ন্তা আল্লাহর সন্তুষ্টি বিধান, ইসলামের স্বার্থ সংরক্ষণ, আমাদের সকলের কল্যাণ এবং আমার প্রিয় মাতৃভূমি চীনের শান্তি, শক্তি ও সমৃদ্ধির জন্যে উপস্থাপিত দুই মতকে আমি আমার মত হিসাবে গ্রহণ করছি। মহান ভাই আহমদ মুসা ধর্মীয় সংখ্যালঘু হিসাবে রাষ্ট্রের কাছ থেকে অধিকারের যে দফাগুলো দিয়েছেন তাকে আপাতত আমাদের জন্যে আমি যথেষ্ট মনে করছি। আল্লাহর কাছে আমি কায়মনোবাক্যে প্রার্থনা করছি, দয়াময় আমাদের সিদ্ধান্তকে বরকত দান করুন, প্রিয় মাতৃভূমি চীনে শান্তি ও সমৃদ্ধি দিন, মহান ভাই আহমদ মুসাকে রাব্বল আলামিন দীর্ঘ নেক হায়াত করুন এবং আমাদের মতো অন্ধদের পথ দেখাবার জন্যে তার শক্তি, সাহস, বুদ্ধি বিবেচনা ও ঈমান লক্ষ গুণ বাড়িয়ে দিন। আমাদের ভাই আহমদ মুসা চীনে পা রাখার আগ থেকে গোটা সময়- কত রাত জীবন বাজি রেখে যে লড়াই করেছেন, বারবার মৃত্যুর মুখে পড়েছেন, সীমাহীন দুঃখ-কষ্ট স্বীকার করেছেন, তা আমাকে দুঃখের অশ্রু নয়, গর্বের অশ্রুতে ডুবিয়ে দিয়েছে।

থেমে গেল আহমদ লিউ চির কণ্ঠ। শেষে তার কণ্ঠ আবেগে ভেঙে পড়েছিল। কথা শেষ হওয়ার পর সেই আবেগ কান্নায় রূপ নিল। সে কান্না আটকাবার জন্যে মুখে রুমাল চাপা দিয়ে সে বসে পড়ল।

হল জুড়ে নীরবতা। কারও চোখ শুকনো নেই। কেউ চোখ মুছছে।

কারও চোখ দিয়ে অশ্রু গড়াচ্ছে। সবাই আবেগে উদ্বেলিত।

আহমদ লিউ চির পর সবাই একে একে তার মত প্রকাশ করল। কথা বলার সময় সবাই ছিল দায়িত্বশীল, তার সাথে আবেগতাড়িত।

উপস্থাপিত দুই মতকে সবাই দায়িত্বশীলতার সাথে গ্রহণ করল।

সবার কথা বলা শেষ হলে হুই নেতা মা চু ইং এবং উইঘুর নেতা ইরকিন আহমেদ ওয়াং সবাইকে ধন্যবাদ দিল। হুই নেতা মা চু ইং তার সমাপনী বক্তব্যে আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করল, মহান ভাই আহমদ মুসা প্রস্তাবিত, ইরকিন আহমেদ ওয়াং পেশকৃত দুই মত সিদ্ধান্ত আকারে সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হলো। আমি আমাদের ভাই সিংকিয়াং-এর সাবেক গভর্নর লিউ ইউয়ানকে অনুরোধ করছি সিদ্ধান্ত দুটি এবং রাষ্ট্র ও মুসলমানদের সম্পর্ক বিষয়ক ভাই আহমদ মুসার প্রস্তাবগুলো লিখে ফেলার জন্যে। এটা খুব জরুরি। পরে এর উপর সবার দস্তখত নেয়া হবে। সময় বেশি আমাদের হাতে নেই। এই মিটিং এর পনেরো মিনিট পরেই সরকারের সাথে আমাদের প্রতিনিধিদলকে বসতে হবে।

মা চু ইং কথা শেষ করে ইরকিন আহমেদ ওয়াং-এর সাথে পরামর্শ করে। সকলের দিকে চেয়ে বলল, সবাইকে অসংখ্য ধন্যবাদ। মিটিং-এর কাজ এখানেই শেষ করছি। তবে এই পনেরো মিনিট কেউ কোথাও যাবেন না। সরকারের সাথে আলোচনার জন্যে যে প্রতিনিধিদল গঠন করেছেন আপনারা, তাদের সাথে আলোচনা, কথা বলার সুযোগ আপনারা নিন, এটা আমরা চাই।

কথা শেষ করল মা চু ইং।

সবাই উঠে দাঁড়িয়ে হাততালি দিয়ে অভিনন্দিত করল তাকে। মিটিং শেষ হলো। হলভরা নেতৃবৃন্দের সবাই এসে ঘিরে ধরল আহমদ মুসাকে। হ্যান্ডশেক আর কোলাকুলি চলল বেশ কিছুক্ষণ ধরে। সবার সাথে কুশল বিনিময় করে আহমদ মুসা বেরিয়ে এলো হলঘর থেকে।

হল থেকে বেরুতেই স্পেশাল কমান্ডো ফোর্স আহমদ মুসার চারদিক

ঘিরে দাঁড়াল। তাদের অফিসার আহমদ মুসাকে বাউ করে বলল, এক্সিলেন্সি, প্রেসিডেন্সিয়াল অফিসে মি. প্রেসিডেন্ট আপনার জন্যে অপেক্ষা করছেন।

কমান্ডো অফিসারের কথা শেষ হতেই মা চু ইং বলল, ভাই আহমদ মুসা, মিটিং-এর আগে তো আপনার সাথে আর আমাদের দেখা হচ্ছে না। ড্রাফটা চূড়ান্ত…।

জনাব যাকে ড্রাফট করার দায়িত্ব দিয়েছেন, তিনি এসব ব্যাপারে আমার চেয়ে শতগুণ অভিজ্ঞ। আপনি চিন্তা করবেন না। বলল আহমদ মুসা।

মা চু ইং-এর পাশেই দাঁড়িয়েছিল লি ইউয়ান, মা ঝু সুলতান, ফা জি ঝাও, ইরকিন আহমেদ ওয়াং এবং আহমদ ইয়াং ও নেইজেন।

আহমদ মুসা, তুমি শত্রুর মোকাবিলায় পাথরের মতো শক্ত, আর বিনয়ে তুমি মোমের মতো নরম। তোমাকে যিনি সৃষ্টি করছেন সেই আল্লাহর সমস্ত প্রশংসা। বলল সিংকিয়াং-এর সাবেক গভর্নর লি ইউয়ান।

স্যার, আপনি কি মিটিং-এ থাকছেন? বলল ফা জি ঝাও।

আমি তো কোনো পক্ষেরই নই। হেসে বলল আহমদ মুসা।

আপনি আল্লাহর পক্ষের। বলল ফা জি ঝাও।

তাহলে তো কোনো কথা নেই। আল্লাহর ইচ্ছা হলে তো অবশ্যই থাকব। আহমদ মুসা বলল।

আহমদ মুসার কথা শেষ হতেই কমান্ডো অফিসার বিনীত কণ্ঠে বলল, এক্সিলেন্সি প্লিজ।

হ্যাঁ, চল। বলে আহমদ মুসা সবাইকে সালাম জানিয়ে বিদায় নিল। চলে গেল আহমদ মুসারা।

মা ঝু সুলতানের চোখ দিয়ে অশ্রু গড়াচ্ছিল। চোখ মুছে সে বলল, গর্বে বুক ভরে যাচ্ছে। আমাদেরই এক ভাইকে চীন সরকার এত মূল্য, এত সম্মান দিচ্ছে!

মা ঝু, তাঁকে সম্মান দিচ্ছে না। সম্মান দিচ্ছে তার যোগ্যতা, জ্ঞান-বুদ্ধি ও মানবিকতাকে। অদ্ভুত এক পরশ পাথর সে। ড. ডা, লু ঝি থেকে শুরু করে প্রেসিডেন্টসহ চীন সরকারের যারাই তার সংস্পর্শে এসেছে, তাদের সবাইকে সে জয় করে নিয়েছে। জানি, আজ সন্ধ্যায় প্রেসিডেন্ট প্রাসাদে প্রেসিডেন্টের মেয়ে ফেন ফ্যাং-এর উদ্যোগে আহমদ মুসাকে সংবর্ধনা দেয়া হচ্ছে কানশুতে জন্মগ্রহণকারী, চীনের এক জগৎজয়ী সন্তান হিসেবে। বলল লি ইউয়ান। তার কণ্ঠও আবেগে ভরা।

পরম দয়ালু আল্লাহর সমস্ত প্রশংসা। তার দয়া না হলে তার মতো স্বপ্নের এক মানুষকে এইভাবে আমরা পেলাম কী করে! আলহামদুলিল্লাহ। মা চু ইং-এর কথা আবেগে জড়িয়ে গেল। তার চোখের কোনায় অশ্রু।

 কথা শেষ করে মা চু ইং ঘুরে দাঁড়াল লি ইউয়ানের দিকে। বলল, চলুন ভাইসাহেব আমরা গিয়ে বসি। বেশ সময় লাগবে।

সবাই এগোলো লাউঞ্জের দিকে। বসল গিয়ে সবাই লাউঞ্জের সোফাগুলোতে।

লি ইউয়ানের পিএ ফোল্ডার থেকে কাগজ-কলম বের করে টেবিলে। রাখল।

কলম হাতে নিল লি ইউয়ান। টেনে নিল কাগজ। বলল, আহমদ মুসা যা বলেছেন তার বাইরে আর কোনো কথা নেই। অডিও-প্রিন্ট থেকে কথাগুলো টুকে নিয়ে সাজিয়ে নিলেই চলবে।

বলে কাজ শুরু করে দিল লি ইউয়ান। নেতৃবৃন্দ সবাই তাকে ঘিরে বসেছে।

1 Comment
Collapse Comments

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *