অপহরণ-১.৫

পাঁচ

রিভারসাইড ড্রাইভ-এর একটা অ্যাপার্টমেন্টে রানাকে তুলে দিয়ে গেল ডানিয়েল। প্রচুর জায়গা আর রুচিসম্মত ফার্নিচার রয়েছে, চেয়ারগুলোয় বসে বেশ আরাম পাওয়া যায়। সি.আই.এ-র এটা একটা নিরাপদ আস্তানা, আন্দাজ করল রানা, ক’দিন গা ঢাকা দিয়ে থাকার জন্যে আদর্শ জায়গা। রানার ইচ্ছে ছিল রিজেন্সিতে উঠবে, তবে হোটেলে ওঠার চেয়ে এ-ই বরং ভাল হয়েছে। এখানে প্রাইভেসি-র কোন অভাব নেই।

কিচেনটা স্বয়ংসম্পূর্ণ, রান্নাবান্নার আয়োজনে কোন খুঁত নেই। খুদে একটা বার-ও রয়েছে, দিন সাতেক মাতাল থাকার জন্যে যথেষ্ট বোতল দেখল রানা। জিনিস-পত্র বেডরূমে রেখেছে ও, এখনও কাপড় ছাড়েনি। ছোট্ট একটা গ্লাসে নিয়ে এক ঢোক হুইস্কি ঢালল গলায়, এই সময় আওয়াজটা কানে এল। কার্পেটের নিচে মৃদু ক্যাচ ক্যাচ করে উঠল কাঠের পাটাতন।

পেশীতে টান পড়ল, কোমরের কাছে রিভলভারে পৌঁছে গেল একটা হাত। কিন্তু ঘুরল না রানা। স্থির দাঁড়িয়ে বার-এর ওপর লটকানো অয়েলপেইণ্টিং দেখছে। তারপরই ঢিল পড়ল পেশীতে, বোতল থেকে আরেকটু হুইস্কি ঢালল গ্লাসে। ‘আগের সেই নিঃশব্দ বিড়ালের পা আর নেই আপনার,’ পিছন দিকে না তাকিয়েই বলল ও।

ওর পিছনে এসে দাঁড়াল লোকটা। ‘কি করে বুঝলেন আমি?’

‘সেই দৃষ্টিও নেই,’ বলল রানা। ইঙ্গিতে তৈলচিত্রটা দেখাল। কাঁচের গায়ে দু’জনের প্রতিবি’ পড়েছে। এবার ঘুরল রানা। রঙ-চটা জিন্স পরে আছে লোকটা, নীল ক্যাপ, মুখে একদিনের না-কামানো দাড়ি। হাতের গ্লাসটা একটু উঁচু করল রানা। ‘চলবে, কর্নেল?

‘প্লীজ, মেজর!’

লিভিং রূমে বসল ওরা, জানালার বাইরে বৃষ্টি ভেজা বিষণ্ণ দিন। সোফায় বসার আগে সবগুলো জানালার পর্দা টেনে দিল কর্নেল উইলিয়াম অবসন। ল্যাম্প থেকে কোমল আলো বেরুল।

মুখে হাসি ধরে রাখার চেষ্টা করছে কর্নেল। রানা নির্লিপ্ত পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করে অফার করল কর্নেল, মাথা নাড়ল রানা। হাতের গ্লাসটা মাঝখানের নিচু তেপয়ে রাখল ও। ‘কেন?’

মুখ থেকে হাসি মিলিয়ে গিয়ে চোয়াল ঝুলে পড়ল অবসনের। ‘আই বেগ ইওর পার্ডন?’

‘আপনি আমাকে দিয়ে প্রেসিডেন্ট কনওয়ের মেয়েকে কিডন্যাপ করাতে চান,’ বলল রানা, ‘কেন?’

‘জানতাম প্রশ্নটা জিজ্ঞেস করতে পারেন।’ তেপয় থেকে নিজের গ্লাসটা তুলল অবসন, কিন্তু হুইস্কির স্বাদ নিল না। ‘সব কথা আপনাকে বলা সম্ভব নয়। সে ক্ষমতা আমাকে দেয়া হয়নি।

‘ক্ষমতা নেই, নাকি আমার ওপর বিশ্বাস নেই?’

‘না, প্লীজ, ছি-ছি!’ যেন খুবই লজ্জা পেয়েছে অবসন। ‘বিশ্বাস না থাকলে এত থাকতে আপনাকে কেন কাজটা দেব, বলুন?’

‘তাহলে? আমাকে বলতে অসুবিধে কি?’

‘ব্যাপারটা রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার সাথে জড়িত,’ বলল অবসন। ‘ফাঁস হয়ে গেলে আমেরিকার সর্বনাশ ঘটে যাবে। আপনাকে আমি শুধু এটুকু বলতে পারি, আমরা একটা বিষাক্ত কাঁটা তোলার প্ল্যান করেছি।

‘আমার সময়ের দাম আছে,’ বিরক্ত হলো রানা। ‘যোগাযোগ করার পর থেকে আপনারা শুধু হেঁয়ালি করে চলেছেন। আর কেউ না জানুক, আপনি অন্তত জানেন, আমি এতটা বোকা নই যে কিছু না জেনে অন্ধকারে ঝাঁপ দেব। সব কথা যদি বলা সম্ভব না হয়, আর কারও সাথে যোগাযোগ করেননি কেন?’

সত্যি কথাটাই বলল অবসন, ‘আর কাউকে এই কাজের উপযুক্ত বলে মনে হয়নি, তাই। শুধু গবেষকরাই নয়, কমপিউটরও আপনার নাম সাজেস্ট করেছে। পারলে আপনিই পারবেন।’ রানা কিছু বলতে যাচ্ছে দেখে হাত তুলল সে। ‘সব জানলে আপনার ঝুঁকির পরিমাণ অনেক বেড়ে যাবে। তাছাড়া, আমাকে বিশ্বাস করুন, কাজটা করার জন্যে সব কথা জানার দরকারও নেই।

এককথায় জানিয়ে দিল রানা, এ-সব কথায় চিড়ে ভিজবে না, ‘আমি আপনার সাথে একমত নই।

অবসনের চেহারা কঠিন হয়ে উঠল। ‘কাজটা কি আপনি জেনে ফেলেছেন, কাজেই…’

‘ভয় দেখিয়ে কোন লাভ হবে না,’ অবসনকে বাধা দিল রানা।

হাতের গ্লাসটা ঠকাস করে তেপয়ে নামিয়ে রেখে সটান দাঁড়িয়ে পড়ল অবসন। ‘আলোচনাটা এভাবে আপনি ভেঙে দিতে পারেন না, মি. রানা।’

কথা না বলে রানা শুধু কাঁধ ঝাঁকাল।

‘আমার ক্ষমতা সম্পর্কে আপনি জানেন, মি. রানা,’ রাগের সাথে বলল কর্নেল। ‘আমি সি.আই.এ-র ডেপুটি ডিরেক্টর। আমার কথা অনেকেই শুনবেন, তার মধ্যে প্রেসিডেন্টও একজন। আমি রানা এজেন্সির সমস্ত লাইসেন্স বাতিল করে দিতে পারি।’

রানার মধ্যে কোন বিকার দেখা গেল না। ‘কি অভিযোগে?’

‘রাষ্ট্রীয় গোপন তথ্য জানার অপচেষ্টা!’

‘শুধু আপনার একার নয়, কর্নেল,’ বলল রানা, ‘প্রেসিডেণ্টের আরও বন্ধু-বান্ধব আছেন, তাঁদের কথাও তিনি শোনেন। অভিযোগটা যে মিথ্যে সেটা তাঁর কানে তুলতে পারব আমি।’

অস্থিরভাবে পায়চারি শুরু করল অবসন। মনে মনে নিজেকে তিরস্কার করল সে, শুরুটা ভুলভাবে করা হয়েছে। জেদ ধরে রানার সাথে পারা সম্ভব নয়। প্রথমেই তার নরম সুরে কথা বলা উচিত ছিল। মিথ্যে ভয় দেখিয়ে ওকে পথে আনা সম্ভব নয়। তবে, রানা পাল্টা যে হুমকিটা দিল, তাতে ভয়ের কিছু নেই। রানা বা ওর বস্ মেজর জেনারেল রাহাত খান যাতে প্রেসিডেন্টের নাগাল না পায় তার ব্যবস্থা করা আছে। যাদের মাধ্যমে প্রেসিডেন্টের কাছে ধর্না দেবে ওরা, তাদের কাছে পৌঁছুতে চেষ্টা করলে একের পর এক বাধা আসবে। পায়চারি থামিয়ে রানার দিকে কটমট করে তাকাল সে। বলল, ‘আমি ভেবেছিলাম, এই কাজের মধ্যে যে চ্যালেঞ্জ রয়েছে, আপনাকে রাজি করানোর জন্যে সেটাই যথেষ্ট।’

‘কেউ যদি বলে, তোমাকে চ্যালেঞ্জ করা হলো, দেখি তো নিজের পায়ে কুড় ল মারতে পারো কিনা—চ্যালেঞ্জটা আপনি গ্ৰহণ করবেন?’

‘কিন্তু আপনাকে কেউ নিজের পায়ে…’

বাধা দিল রানা, ‘বুঝব কিভাবে?’

আবার পায়চারি শুরু করল অবসন। তারপর আবার রানার সামনে থামল। ‘ফি-র অঙ্ক বাড়িয়ে দিন, যত খুশি টাকা নিন-কিন্তু ফর গডস সেক সব কথা জানতে চাইবেন না, প্লীজ!’

উত্তরে হাতঘড়ি দেখল রানা।

সামনের সোফায় ধপাস করে বসে পড়ল অবসন। এরই মধ্যে বিধ্বস্ত হয়ে গেছে চেহারা।

ঝাড়া এক মিনিট কেটে গেল। চোখ বুজে ধ্যানে বসেছে অবসন।

রানা বলল, ‘আমি অনন্তকাল অপেক্ষা করতে পারি না।’

‘আমরা একটা সিকিউরিটি লিক আবিষ্কার করেছি,’ হঠাৎ শুরু করল অবসন। ‘কেউ একজন ক্লাসিফায়েড ডাটা পাচার করছে সোভিয়েত ইউনিয়নে। সি.আই.এ-র লোক সে, হাই অফিশিয়ালদের একজন।’ রানার দিকে সরাসরি তাকাল সে। ‘খুবই হাই অফিশিয়ালদের একজন। পাচার হওয়া তথ্যের ধরন দেখে ব্যাপারটা আমরা বুঝতে পারি।’

মাথা ঝাঁকাল রানা, কিন্তু কোন মন্তব্য বা প্রশ্ন করল না। এ-ধরনের ঘটনা কিছুদিন পর পর ঘটে। আর ঘটে বলেই সি.আই.এ. বিশেষ ধরনের কিছু এজেণ্ট পোষে যাদের কাজই হলো ঘরের শত্রু বিভীষণদের খুঁজে বের করা। শুধু সি.আই.এ-তে নয়, প্রায় সব ইন্টেলিজেন্সেই এ-ধরনের এজেন্ট থাকে।

উঠে গিয়ে নিজের গ্লাসটা আবার ভরে নিল অবসন। এরপর আর বসল না, ঘরের মাঝখানে হাঁটাহাটি করতে লাগল। ‘প্ৰথম দিকে,’ আবার মুখ খুলল সে, ‘চারজনকে সন্দেহ করি আমরা। প্রত্যেককে আলাদাভাবে পরীক্ষা করা হয়। সবাই তারা উতরে যায়। মাথায় যেন বাজ পড়ে আমাদের। তাহলে কে? পঞ্চম একজন লোককে সন্দেহের তালিকায় আনতে হয়-সে এমন একজন, তার পদ মর্যাদার জন্যে তাকে আমরা প্রথমেই বাদ দিয়ে রেখেছিলাম। ব্যাপারটা অবিশ্বাস্য! তার মত লোক ডাবল এজেণ্ট…কেন, কেন!’ আঙুল দিয়ে মাথার চুল খামচে ধরল সে। ‘তার ক্ষমতার কোন সীমা-পরিসীমা নেই। যে-কোন মুহূর্তে, ইচ্ছে করলেই, ওভাল অফিসে ঢুকতে পারে। প্রেসিডেন্টের পরেই তার স্থান…’

পাথর হয়ে বসে আছে রানা। শুধু চোখ দুটো অনুসরণ করছে অবসনকে। চেহারায় খানিকটা কৌতুক, খানিকটা অবিশ্বাস। ‘আপনি ঠাট্টা করছেন।’

ধীর ভঙ্গিতে এদিক ওদিক মাথা নাড়ল অবসন।

রানার চেহারা থেকে কৌতুকের ভাব অদৃশ্য হয়ে গেল। ‘জেফ রিকার্ড?’

‘জেফ রিকার্ড,’ ফিসফিস করে বলল অবসন, প্রচণ্ড রাগে গ্লাস ধরা হাতটা কাঁপছে। ‘জেফ রিকার্ড, সি.আই.এ-র ডিরেক্টর।

সোফায় হেলান দিয়ে বড় করে একটা শ্বাস টানল রানা। চমকটা হজম করতে সময় লাগছে। অবিশ্বাস্য বটে, কিন্তু আগেও এ ধরনের ঘটনা ঘটেছে, অবাস্তব বলে উড়িয়ে দেয়া যায় না। ডাবল রেড অ্যালার্টের কারণটা বোঝা গেল। বোঝা গেল কেন অবসন পাগলপারা হয়ে আছে। ওরা সবাই যার অধীনে কাজ করে, সি.আই.এ-র চীফ। এটুকুই যথেষ্ট খারাপ। কিন্তু জেফ রিকার্ড শুধু সি.আই.এ-র চীফ নয়, আরও অনেক কিছু। গত নির্বাচনে প্রেসিডেন্টের প্রধান মুখপাত্র ছিল সে। চীফ পলিসি অ্যাডভাইজার।

আরও বেশি। প্রেসিডেন্টের সচেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধু লোকটা। প্রেসিডেণ্ট তার মত আর কাউকে বিশ্বাস করেন না।

‘বিপদ,’ বলল রানা।

‘বিপদ? বলুন, ডিনামাইট!’ গ্লাসটা ঘন ঘন নাড়ল অবসন, ভেতরে লালচে হুইস্কি ঘুরতে লাগল। তার চেহারা রাগে, ক্ষোভে, দুঃখে লাল হয়ে আছে। জানালার কাঁচে বৃষ্টির ফোঁটা পড়ছে, শব্দটাকে চাপা দিল গ্লাসের গায়ে টুকরো বরফের ধাক্কা খাওয়ার আওয়াজ। এক চুমুকে হুইস্কিটুকু গিলে ফেলল সে। আবার যখন রানার দিকে তাকাল, প্রায় শান্ত হয়ে গেছে চেহারা। ভাবাবেগের লাগাম টেনে ধরেছে। ‘বলাই বাহুল্য প্রেসিডেণ্ট নিরেট প্রমাণ চাইবেন। আমি বললেই তিনি বিশ্বাস করবেন না। সে-জন্যেই তাঁর মেয়ের কথা উঠছে।

যোগাযোগটা কোথায়, রানা আন্দাজ করতে পারল। এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব নয় এরকম একটা টোপ দিয়ে ফাঁদ পাতা হবে।

‘হ্যা,’ বলল অবসন, যেন রানা কি ভাবছে বুঝতে পেরেছে, ‘কিডন্যাপিংটা হবে জেফ রিকার্ডের পরীক্ষা। প্রেসিডেন্টের মেয়ে টিউলিপ শত্রুদের হাতে। যেভাবে হোক তাকে খুঁজে বের করতে হবে রিকার্ডের।’ অবসনের চোখে ক্ষীণ হাসি ফুটল। ‘একের পর এক সূত্র পাবে সে। আমরাই দেব, নিজেদের তৈরি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত দেখা যাবে, সবগুলো সূত্র ভুয়া, কোথাও পৌঁছুনো যায় না। কোন কোন সূত্র হবে গোলমেলে, একটার সাথে আরেকটা মিলবে না। আবার কোনটা হবে ধ্বংসাত্মক। মরিয়া হয়ে উঠবে রিকার্ড, কিন্তু এগোবার কোন পথ পাবে না। তাকে আমরা অসহায় অবস্থায় ফেলব। কোণঠাসা হয়ে পড়বে সে। এ-সবই একটি মাত্র কারণে করা হবে…।’

‘সে যাতে অপর পক্ষের সাথে যোগাযোগ করে।’ ধীরে ধীরে ওপর-নিচে মাথা ঝাঁকাল রানা। ‘কৌশলটা মন্দ নয়। সেণ্ট পার্সেন্ট সম্ভাবনা, ফাঁদে পা দেবে রিকার্ড। কিন্তু বিপজ্জনক। সত্যি কথা বলতে কি, এরচেয়ে বিপজ্জনক আর কিছু হতে পারে না।

‘এটাই একমাত্র কৌশল,’ জোর দিয়ে বলল অবসন। ‘ব্যাপারটা এমন কিছু হওয়া চাই যার সাথে প্রেসিডেন্ট সরাসরি এবং ব্যক্তিগতভাবে জড়িত। নিজের মেয়ে নিখোঁজ, কাজেই তিনি উদাসীন থাকতে পারেন না, কাজেই তাকে উদ্ধার করা যার দায়িত্ব তার ওপর তিনি নির্ভর করবেনই। হোয়াইট হাউসের স্টাফরা প্রতি ঘণ্টায় রিপোর্ট দেবে, কোনটাতেই পরিষ্কার কিছু থাকবে না। জানা কথা, ওগুলো তিনি মানবেন না। জেফ রিকার্ডের কাছ থেকে সরাসরি তথ্য ও রিপোর্ট চাইবেন তিনি।

‘এবং কোন অজুহাতও তিনি শুনবেন না।’

‘না।’

‘ভুল করারও কোন অবকাশ নেই।’

‘নেই। পরিপূর্ণ সাফল্য ছাড়া কিছুই তিনি মানবেন না। জেফ রিকার্ডের এ-সব কথা জানা থাকবে। সূত্রগুলো যখন ভুয়া প্রমাণিত হবে, প্রেসিডেন্টের কাছে ফিরে গিয়ে এ-কথা বলতে পারবে না যে কপাল খারাপ তাই কাজটায় ব্যর্থ হলাম, এর পরের বার আরও ভাল করার চেষ্টা করব। নো, নেভার,–এই একটা কাজে ব্যর্থ হওয়া চলবে না তার। জীবনে যা কিছু মূল্যবান মনে করে সে, সব হারাবার আশঙ্কা দেখা দেবে। তার চাকরি। প্রেসিডেন্টের সাথে তার বন্ধুত্ব। তার ক্ষমতা।’

‘পামেলা কনওয়ের সাথে তার সম্পর্কের কথা নাহয় বাদই দেয়া গেল।

‘হ্যাঁ, ফার্স্ট লেডির সাথে তার যে মধুর সম্পর্ক রয়েছে, ব্যর্থ হলে সেটাও তাকে হারাতে হবে। মোট কথা, সূত্রগুলোয় কোন কাজ না হলে,–কাজ যাতে না হয় সেদিকটা আমরা দেখব-আর মাত্র একটা পথ খোলা থাকবে তার সামনে। লৌহ যবনিকার অন্তরালে বন্ধুদের শরণাপন্ন হওয়া। ওদের সাহায্য তার চাইতেই হবে।’

মাথা ঝাঁকাল রানা। চমৎকার প্ল্যান। প্রেসিডেন্ট সরাসরি জড়িত, কাজেই সবকিছুর ঊর্ধ্বে স্থান দিতে হবে ব্যাপারটাকে।

কিন্তু জেফ রিকার্ডের সমস্যা আর রানার সমস্যা এক নয়।

রানাকে বলা হচ্ছে প্রেসিডেন্টের মেয়েকে কিডন্যাপ করো। প্রায় অসম্ভব একটা কাজ। অসম্ভব এই জন্যে যে কাজটায় কোন খুঁত থাকা চলবে না। খুঁত থাকলেই জেফ রিকার্ড টের পেয়ে যাবে, টিউলিপকে টোপ হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে, এটা তার জন্যে একটা ফাঁদ। তা যদি বুঝে ফেলে, সব ভণ্ডুল হয়ে যাবে। প্রেসিডেণ্টের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেবে সে, টিউলিপকে কিডন্যাপ করতে সাহায্য করেছে সি.আই.এ-রই কিছু অফিসার। কিডন্যাপার এবং সহায়তাকারীদের গ্রেফতার করার নির্দেশ দেবেন প্রেসিডেণ্ট। কিংবা রিকার্ড হয়তো পালিয়ে সোভিয়েত ইউনিয়নে চলে যাবে। সবার চোখকে ফাঁকি দিয়ে কিভাবে পালাতে হয় নিশ্চই তা সে জানে।

তারমানে, বাইরের তেমন কোন সাহায্য ছাড়াই কাজটা রানাকে একা করতে হবে। গায়ের রোম দাঁড়িয়ে গেল ওর, অদ্ভুত একটা চ্যালেঞ্জ অনুভব করল। এত বড় ঝুঁকি আগে কখনও নেয়নি ও। উঠে গিয়ে গ্লাসে আরও খানিকটা হুইস্কি নিল। মোটিভ বাদ দিয়ে অপারেশন নিয়ে ভাবছে। ‘কেন’ গুরুত্ব হারাল, গুরুত্ব পেল ‘কিভাবে’। কে কার পক্ষ নিয়ে কাজ করছে সেটা জানা দরকার, কিন্তু এই মুহূর্তে জরুরী মনে হলো না।

ঠেকায় পড়ে সাহায্য চাইছে সি.আই.এ-র ডেপুটি ডিরেক্টর, মোটা টাকা আয় হবে রানা এজেন্সির। আর অনুমতি তো বস্ আগেই দিয়ে রেখেছেন। কিন্তু কাজটা রানার করার ইচ্ছে অন্য কারণে। চ্যালেঞ্জটা নিতে চায় ও। টিউলিপকে কিডন্যাপ করা অসম্ভব, তাই করবে। রহস্যের ভেতর রহস্য থাকতে পারে, সেটাও একটা কারণ। কিন্তু তা নিয়ে পরে মাথা ঘামালেও চলবে।

‘যদি করি,’ অবসনকে বলল ও, ‘প্ল্যানটা আমার নিজের হবে।’

‘স্বভাবতই,’ সাথে সাথে জবাব দিল অবসন। ‘আমি পারলে আপনাকে দরকার হত না। রানার সামনে সোফায় বসল সে।

‘মেয়েটার কোন ক্ষতি হওয়া চলবে না।’

‘বলাই বাহুল্য। ক্ষতি তো দূরের কথা, তাকে সত্যিকার কোন ঝুঁকির মধ্যেই রাখা চলবে না। শুধু টিউলিপ কেন-পরিবারের অন্যান্য সদস্য, চাকরবাকর, স্টাফ, সিক্রেট সার্ভিস, কারও কোন ক্ষতি করা যাবে না। কেউ যেন আহত না হয়।’

মুচকি হেসে রানা বলল, ‘আপনি বলতে চাইছেন, প্রেসিডেণ্টকে যেন খুন না করে ফেলি, এই তো?’

গম্ভীর হতে গিয়েও হেসে ফেলল অবসন। ‘নিজের ভাল চাইলে না করাই উচিত হবে।’

কিন্তু শিরিন ওর হাত দেখে কি যেন বলেছিল? স্মরণ করার চেষ্টা করল রানা। মনে পড়তেই ছ্যাৎ করে উঠল বুকের ভেতরটা-দুই সুপার পাওয়ারের যে কোন একটার সরকার প্রধান আপনার হাতে খুন হবেন।

রুশ সরকার-প্রধান, নাকি মার্কিন সরকার-প্রধান?

‘কিডন্যাপ করলেন, তারপর? তারপর কি হবে?’

‘বলুন।’

‘হোয়াইট হাউস থেকে বের করার পর টিউলিপকে আপনি দেশ থেকে বের করে নিয়ে যাবেন,’ বলল কর্নেল।

চিন্তিত হয়ে উঠল রানা। চোখের সামনে হোয়াইট হাউসের ছবি ভেসে উঠল। বাইরে থেকে দেখা যায় না, ভেতরে কাঁটাতারের বেড়া আছে-ইলেকট্রিফায়েড। ইলেকট্রনিক সিকিউরিটি সিস্টেমের কিছু কিছু রহস্য জানে ও, বেশিরভাগই জানে না। সিক্রেট এজেণ্ট আর স্পেশাল পুলিস গিজ গিজ করছে চারদিকে। এ-সব বাধা টপকে প্রেসিডেন্টের মেয়েকে চুরি করে আনতে হবে। এখানেই শেষ নয়। এরপর আবার সুরক্ষিত মার্কিন বর্ডার পেরোতে হবে। ক্ষীণ একটু হাসি দেখা গেল ওর ঠোঁটে ‘খুব সহজ করে দেবেন না,’ হালকা সুরে বলল ও। ‘আমার একঘেয়ে লাগতে পারে।’

ঠোঁট টিপে হাসল অবসন। ‘দেখতে পাচ্ছি চ্যালেঞ্জটা আপনি উপভোগ করছেন!

রানা গম্ভীর হলো। ‘কাজটা কঠিন।’

‘জানি। এত কঠিন যে আপনার সাহায্য চাইতে হলো। একটা কথা…,’ বলে চুপ করে গেল অবসন।

প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল রানা। একটা চুরুট ধরাল অবসন, তারপর আবার বলল, ‘গোটা ব্যাপারটাকে আন্তর্জাতিক বলে মনে হতে হবে। তবেই জেফ রিকার্ড বিশ্বাস করবে যে রাশিয়ানরা সাহায্য করতে পারবে তাকে।’

মাথা ঝাঁকাল রানা।

‘টিউলিপকে…’

ভুলটা শুধরে দিল রানা, ‘গোলাপ কুঁড়ি।’

‘ও, ইয়েস, সরি! ওকে আপনি যেখানে খুশি নিয়ে যেতে পারেন, মানে গ্রীসের যে কোন জায়গায়।

‘গ্রীসে কেন?’

‘কারণ আপনার যদি সাহায্য দরকার হয়, ওখানে আমার বিশ্বস্ত লোক আছে।’

কাঁধ ঝাঁকাল রানা। ‘ঠিক আছে, গোলাপ কুঁড়ি গ্রীসে পৌঁছুল। তারপর?’

‘ওখানে আপনি আমার সিগন্যাল না পাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করবেন,’ বলল অবসন। ঠোঁটের কোণ থেকে ধীরে ধীরে ধোঁয়া ছাড়ল সে, সরাসরি তাকিয়ে আছে রানার চোখে। ‘তারপর আমাদের দেখা হবে। আপনার কাছ থেকে গোলাপ কুঁড়ি ডেলিভারি নেব আমি। তার আগে পর্যন্ত, কিছুই আপনি করবেন না। স্রেফ সবার চোখের আড়ালে লুকিয়ে রাখবেন ওকে। কমপক্ষে দু’হপ্তা লুকিয়ে রাখতে হবে-বেশিও হতে পারে, নির্ভর করে পরিস্থিতির ওপর।’

দু’হপ্তা! ডানিয়েল ঠিকই বলেছিল, গোলাপ কুঁড়ি সম্পর্কে বিস্তারিত সব জানা দরকার ওর।

গ্রীসের কোথাও ওকে নিয়ে যেতে হবে, রানা জানে। জানে না শুধু প্রেসিডেন্টের মেয়েকে নিয়ে কিভাবে ওখানে পৌঁছুনো যায়। ‘ভুয়া সূত্র সম্পর্কে বলুন এবার।’

‘ওসব ডানিয়েল সামলাবে। ও এখানে এলেই আপনার কি কি লাগবে আলোচনা করব আমরা। ভাল কথা, ও-ই আপনার সাথে আমার যোগাযোগ। আজ আমি এখান থেকে চলে যাবার পর, গোলাপ কুঁড়িকে ঘরে ফিরিয়ে আনার সময় না হওয়া পর্যন্ত চাই না আপনার সাথে আমার আবার দেখা হোক।’

মাথা ঝাঁকাল রানা। গ্লাসটা ভরার জন্যে আবার উঠল।

‘ও, হ্যাঁ, ভাল কথা—ভুলে যাবেন না, আপনি মারা গেছেন।’

‘কেউ ভোলে?’ অবসনের দিকে পিছন ফিরে বোতল থেকে হুইস্কি ঢালল রানা। বোতলের ছিপি বন্ধ করল। ফিরল অবসনের দিকে। ‘শুধু দুঃখ এই যে আগে খবর পাইনি, তা না হলে মাটি দিতে অবশ্যই যেতাম।’

‘গোটা ব্যাপারটা প্রায় চুপিসারে সারা হয়েছে,’ বলল অবসন। ‘বলতে গেলে প্রায় কেউই উপস্থিত ছিল না।’

‘তাহলে বলব, আপনাদের কাজে একটা খুঁত থেকে গেছে।’

‘কি রকম?’

‘আমাকে কবর দেয়া হলো, অথচ সেখানে আমার বস্ উপস্থিত ছিলেন না,’ বলল রানা, ‘অনেকেই ব্যাপারটাকে অবিশ্বাসের চোখে দেখবে।’

অবসনের চেহারা উজ্জ্বল হয়ে উঠল। ‘উনি ছিলেন।’

‘হোয়াট!’

‘তাঁর ছদ্মবেশ নিয়ে অন্য এক লোক।’

কঠিন সুরে রানা জিজ্ঞেস করল, ‘ওঁর অনুমতি নিয়েছেন?’

হাসল অবসন, বলল, ‘অবশ্যই।’ কলিং বেল বেজে উঠল। ‘ডানিয়েল পৌঁছে গেছে।’ সোফা ছেড়ে দরজার দিকে এগোল সে। তাকে বাধা দিল রানা, ঠেলে একপাশে সরিয়ে দিয়ে নিজেই এগোল। নিঃশব্দে দরজার পাশে দাঁড়াল রানা, পিপহোলের ঢাকনি সরিয়ে চোখ রাখল ফুটোয়। ডানিয়েলই, এখনও আগের সেই জ্যাকেটটা পরে আছে, হাতে একটা অ্যাটাচি কেস। তালা খুলে কবাট উন্মুক্ত করল রানা। কব্জায় তেল দেয়া হয়েছে, কোন শব্দ হলো না।

ভেতরে ঢুকে দরজা বন্ধ করল ডানিয়েল। ‘অ্যাপার্টমেন্ট পছন্দ হয়েছে?’ রানাকে জিজ্ঞেস করল সে।

লোকটা রানার চেয়েও লম্বা, শক্তিশালী গঠন। মুখের বাঁ দিকে, চোখের নিচ থেকে জুলফি পর্যন্ত পুরানো একটা কাটা দাগ। চিন্তাটা আরেকবার খেলে গেল রানার মাথায়-আর লোক পেল না অবসন, এরকম একটা দাগী লোক দু’জনের মাঝখানে যোগাযোগ হিসেবে থাকবে? ‘ভালই,’ জবাব দিল ও।

খুশি হলো ডানিয়েল। ‘চেষ্টা করছি আপনার সব প্রয়োজন যেন মেটে এখানে।’ রানার হাতের গ্লাসটা লক্ষ করল সে। ‘দুঃখের বিষয়, পাশের অ্যাপার্টমেন্টের লালচুলো সুন্দরী মেয়েটা হপ্তা কয়েকের জন্যে চলে গেছে…’

‘নিশ্চই স্বইচ্ছায় নয়।’

‘না। বেচারি পায়ে আঘাত পেয়েছে। স্কিইং করছিল, আরেকজনের সাথে ধাক্কা লেগে পড়ে যায়।’ ডানিয়েলের চোখে উল্লাসের নগ্ন নীল আলো নাচতে লাগল। সাবধান, নিজেকে সতর্ক করল রানা, লোকটা ভয়ঙ্কর। ধূসর চুল আর ফর্সা গায়ের রঙের সাথে মুখের কাটা দাগটা মেলেনি, ওটা লালচে। চোখ ফিরিয়ে নিল রানা।

একটা চেয়ারের পাশে অ্যাটাচি কেস নামিয়ে রাখল ডানিয়েল, চেয়ারটায় বসল। অবসনের দিকে তাকাল সে। কিন্তু অবসন তাকিয়ে আছে রানার দিকে।

‘যা যা চান সব আপনি পাবেন,’ বলল অবসন। ‘আক্ষরিক অর্থেই বলছি-যে-কোন জিনিস। লোকবল, ভুয়া কাগজ-পত্ৰ, টেকনিক্যাল সার্ভিস, সমস্ত।’

‘টাকা?’

‘আগের কাজটায় সি.আই.এ. আপনাকে এক বিলিয়ন টাকা দিয়েছিল,’ বলল অবসন। ‘কারণ, মেরিলিন চার্টের দাম ছিল কয়েকশো বিলিয়ন ডলার। এই কাজটা আরও কঠিন। আমরা সফল হলে লাভ কি হবে সেটা হিসেব করা সম্ভব নয়। আমেরিকা রাহুমুক্ত হবে, কাজেই লাভ হিসেব করা কিভাবে সম্ভব! সমস্ত খরচ আমাদের, আপনার ফি ধরা হয়েছে দুই বিলিয়ন ডলার। যদি আপত্তি করেন…’

মাথাটা ঘুরে উঠল রানার। ‘কত বললেন?’

‘ঠিক আছে, আড়াই বিলিয়ন,’ তাড়াতাড়ি বলল অবসন। ‘এতেও যদি সন্তুষ্ট না হন আমাকে তাহলে প্রেসিডেন্টের সাথে আলাপ করতে হবে…।’

বলে কি! আড়াই বিলিয়ন ডলার? ওদের কি মাথা খারাপ হয়েছে! মনটা খুঁত খুঁত করতে লাগল। অঢেল টাকা দিয়ে কি কিনতে চাইছে ওরা? ওর সার্ভিস, নাকি ওর আনুগত্য? রহস্যের ভেতর রহস্য?

নিজের অজান্তেই লোভ জাগল মনে। বি.সি.আই-এর অনেকদিনের একটা অভাব পূরণ হতে পারে দুই বিলিয়ন ডলার হাতে এলে। সেকেণ্ড হ্যাণ্ড একটা সাবমেরিন কিনতে পারে ওরা।

মাথা ঝাঁকাল রানা। ‘ঠিক আছে।’

‘হাত খরচের জন্য আপাতত এক লাখ ডলার হলে চলবে?’ জিজ্ঞেস করল অবসন, রানা আড়াই বিলিয়নে রাজি হওয়ায় ভারি খুশি সে।

‘চলবে,’ বলল রানা। ‘পরে আরও লাগলে বলব। এক লাখ ডলার ছোটবড় নোটে মিলিয়ে দেবেন। নতুন টাকা নয়। কোন মার্ক থাকা চলবে না। পুরো টাকাটা যেন মানি বেল্টে ধরে।’

ডানিয়েলের দিকে তাকাল অবসন। ডানিয়েল মাথা ঝাঁকাল। সম্ভব।

‘টাকা ছাড়াও অনেক জিনিস দরকার হবে আমার,’ বলল রানা।

ঝুঁকে অ্যাটাচি কেসটা কোলের ওপর তুলল ডানিয়েল। তালা খুলে ডালা তুলল। একটা ফাইল বের করল ভেতর থেকে। ‘টিউলিপ কনওয়ের ফাইল…।’

খুক করে কাশল অবসন।

‘দুঃখিত, গোলাপ কুঁড়ি,’ বলল ডানিয়েল। ‘সকালে ঘুম থেকে ওঠার পর থেকে রাতে ঘুমাতে যাবার আগে পর্যন্ত যা যা করে, সমস্ত কিছুর বিস্তারিত বিবরণ পাবেন এতে। তার যে-সব বন্ধু বা আত্মীয়রা হোয়াইট হাউসে বেড়াতে আসে বা আসবে, সবার নাম-ঠিকানা আছে। তার ডাক্তার আর ডেন্টিস্টও বাদ যায়নি। মাত্র চার বছর বয়স, ব্যক্তিগত অভ্যাস কি আর থাকতে পারে, তবু কিছু কিছু ব্যাপার নোট করা আছে।’ রানার দিকে সরাসরি তাকাল সে। ‘সিকিউরিটি সম্পর্কে আলাদা ফাইল। পারমানেন্ট অ্যাসাইনমেণ্টে রয়েছে ছ’জন এজেন্ট। দরকার হলে আরও অনেকে মুহূর্তের নোটিশে হাজির হবে। ওরা ছ’জন পালা করে ডিউটি দেয়।’

ফাইলগুলো নিয়ে চোখ বুলাল রানা। ‘আপনাদের ভাল সোর্স আছে দেখছি।’

‘তা আছে।’

‘এসব তথ্য নিখুঁত কিনা…’

‘সম্পূৰ্ণ।

একবার চোখ বুলিয়ে ফাইলগুলো আপাতত একপাশে সরিয়ে রাখল রানা। পরে মন দিয়ে পড়বে সব। ‘আর কি দরকার বলছি। মেয়েটা আমার জন্যে কোন সমস্যা নয়। সমস্যা হলো তার চারপাশে যারা রয়েছে। ওদের সবার ফাইল দরকার হবে আমার।’

‘বেশ।’ মাথা ঝাঁকাল অবসন।

‘প্রতিদিন সিক্রেট সার্ভিস নানা রকম তথ্য পায়, তাই না?’ জিজ্ঞেস করল রানা। ‘ওগুলো আমাকেও জানতে হবে। আর পরিবারের প্রত্যেকের শিডিউল আগেভাগে পেতে হবে।’

ডানিয়েলের দিকে না তাকিয়েই অবসন বলল, ‘পাবেন।’

‘হোয়াইট হাউসে প্রচুর চিঠিপত্র আসে, যায়ও,’ বলল রানা। ‘সবগুলো কপি দরকার আমার।’

মাথা ঝাঁকাল অবসন। ‘আর কিছু?’

‘পুরানো চিঠিগুলো দরকার,’ বলল রানা। ‘যত পুরানো সম্ভব।’

অবাক হলো অবসন। ‘কেন?’

কাঁধ ঝাঁকাল রানা। ‘তা জানি না। জানলে তো বলেই দিতাম, অমুক দিনের চিঠিগুলো শুধু নিয়ে আসবেন। সব পেলে ঘাঁটতে ঘাঁটতে হয়তো এমন কিছু চোখে পড়বে, হোয়াইট হাউসে ঢোকার একটা উপায় পেয়ে যাব।’

‘লম্বা অর্ডার,’ চিন্তিতভাবে বলল অবসন। ‘একটু ছোট করে আনা যায় না? হোয়াইট হাউসে প্রতি হপ্তায় পঁচাত্তর হাজার চিঠি আসে।’

খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে রানা বলল, ‘এক কাজ করুন। ভক্ত আর খ্যাপাদের চিঠি বাদ দিন। ফটো, অটোগ্রাফ, ইত্যাদি চেয়ে লেখা চিঠিগুলোও দরকার নেই। বিল, মেমো, এ-সবও বাদ।’

কয়েক সেকেণ্ড রানার দিকে তাকিয়ে থাকল অবসন, তারপর ডানিয়েলের দিকে ফিরে ছোট্ট করে মাথা ঝাঁকাল।

‘খবরের কাগজ,’ বলল রানা। ‘ওয়াশিংটনের সবগুলো দৈনিক। সেদিনেরটা সেদিনই।’

‘ওটা কোন সমস্যা নয়,’ বলল অবসন।

‘গোলাপ কুঁড়ি কত বড় জানতে হবে আমাকে।’

অবসন শ্রাগ করল। ‘বয়সের তুলনায় ছোটই বলা চলে তাকে।’

‘সঠিক মাপ, ওজন ইত্যাদি জানতে হবে,’ বলল রানা। ‘কতটা লম্বা? ক’বছর ক’মাস ক’দিন বয়স?’

‘আর কিছু?’ সোফায় নড়েচড়ে বসল অবসন।

‘হ্যা, আরেকটা জিনিস। ব্যাপারটা আমার জন্যে একান্ত দরকার।’ সোফায় হেলান দিয়ে সিগারেট ধরাল রানা। ঝুঁকি নিয়ে ভাবছে ও। জীবনের ঝুঁকি নয়, সেটা তো প্রতিদিন প্রতি মুহূর্তে আছে। ওর এই পেশায় মৃত্যু একটা স্বাভাবিক সম্ভাবনা। মৃত্যুর চেয়ে বেশি ভয় করে রানা ব্যক্তিগত পরাধীনতাকে। আমেরিকার প্রেসিডেন্টের মেয়েকে নিয়ে পালাবার সময় ধরা পড়ে গেলে কত যুগ জেলে পচতে হবে কে জানে!

সত্যি বটে, খোদ সি.আই.এ. তাকে আইন ভাঙার অধিকার দিচ্ছে। সেদিক থেকে ভাবলে কোন হুমকি নেই। কিন্তু এবারের অ্যাসাইনমেণ্ট সম্পূর্ণ অন্য ধরনের। কোন সন্দেহ নেই, সি.আই.এ. তার সীমা লংঘন করতে যাচ্ছে। এর চেয়ে বিপজ্জনক কাজে আর কখনও রানাও হাত দেয়নি। অথচ অনুরোধটা সি.আই.এ. চীফ জেফ রিকার্ডের কাছ থেকে আসছে না। ঠিক উল্টো, গোটা ব্যাপারটাই পরিচালিত হবে তার বিরুদ্ধে।

সরাসরি অবসনের চোখে তাকাল রানা। ‘এই অ্যাসাইনমেণ্ট অথোরাইজ করছে কে?’

মাথা নাড়ল অবসন। ‘সেটা আপনাকে আমি বলতে পারি না।’

শ্রাগ করল রানা। ‘তারমানে রানা এজেন্সির সার্ভিস আপনি প্রত্যাখ্যান করছেন। শুধু আপনার একার কথায় কেন ঝুঁকি নিতে যাব আমি?

পরস্পরের দিকে একদৃষ্টে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকল ওরা। বাইরে আরও চেপে এল বৃষ্টি, ফোঁটাগুলো তেরছাভাবে পড়ছে। জানালার কাঁচে। ঘরে আর কোন আওয়াজ নেই।

অবশেষে, অবসনই প্রথম কথা বলল, ‘হ্যাঁ, আপনার কথায় যুক্তি আছে। কি ধরনের প্রোটেকশন পাচ্ছেন সেটা জানার অধিকার আপনার আছে।’

‘বলুন।’

‘সম্ভাব্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রোটেকশন-প্রেসিডেন্টের তরফ থেকে।

থ হয়ে গেল রানা। আর যাই আশা করুক ও, এটা আশা করেনি। ‘প্রেসিডেন্ট? তিনি তাঁর নিজের মেয়েকে কিডন্যাপ হতে দিতে রাজি হয়েছেন? তাও, সি.আই.এ-র দ্বারা?’

‘প্রেসিডেন্ট জানেন, লোকটাকে হাতেনাতে ধরতে না পারলে মহা সর্বনাশ ঘটে যাবে।’

‘মাই গড!’ বিস্ময়ের ঘোর রানার যেন কাটতেই চায় না। ধীরে ধীরে আবার সোফায় হেলান দিল ও। টিউলিপ কনওয়ে মহামূল্যবান একটা শিক্ষা পেতে যাচ্ছে, ভাবল ও-দুনিয়ায় কাউকে বিশ্বাস কোরো না।

‘বলুন,’ জিজ্ঞেস করল অবসন, ‘এবার আপনি সন্তুষ্ট? ব্যাপারটা যদি কোনভাবে কেঁচে যায়, খোদ প্রেসিডেণ্ট আপনাকে প্রোটেকশন দেবেন। কি বলেন, যথেষ্ট নয় কি?’

‘আমি লিখিত আশ্বাস চাই,’ মৃদু কণ্ঠে বলল রানা।

‘পাবেন, তবে খানিক সময় দিতে হবে,’ আশ্বস্ত করল অবসন। তারপর গাল ফুলিয়ে হাসল সে। ‘আপনি খুব সতর্ক, মি. রানা।

কাঁধ ঝাঁকাল রানা। ‘যতটা ভাবছেন, ততটা নই। হলে এতক্ষণে পালিয়ে যেতাম।’

কেন যেন খুঁতখুঁতে ভাবটা থেকেই গেল রানার মনে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *