তেরো
পথ দেখিয়ে রানাকে দোতলায় নিয়ে এল কালোকেশী। ঘরে ঢুকে ডবল খাটের ওপর নরম বিছানা, বিছানার পাশে টেবিলে একটা ল্যাম্প দেখল রানা। বিছানার এক ধারে শুয়ে রয়েছে পা’জামা পরা ছোট্ট একটা ছেলে। তার হাতে সূচ বেঁধানো, টিউবের আগায় ফিট করা, টিউবটা একটা ঝুলন্ত বোতলে গিয়ে ঢুকেছে। তরল গ্লুকোজের সাথে ভিটামিন আর মিনারেলস মেশানো হয়েছে, অজ্ঞান হলেও, টিউলিপ কনওয়ের খোরাক দরকার।
রানার পিছন থেকে উঁকি দিল কালোকেশী। ‘বলুন।’
উত্তর না দিয়ে টিউলিপকে খুঁটিয়ে দেখল রানা। বোঝার উপায় নেই এই মেয়েকেই মিশিগান থেকে চুরি করা হয়েছে। কোঁকড়ানো কালো চুল গায়েব হয়েছে। চুলগুলো এখন সমান, ছেলেদের মত করে কাটা, লম্বা হয়ে নেমে এসে বেশ খানিকটা ঢেকে ফেলেছে কপাল।
‘কি হলো?’
‘চমৎকার,’ মন্তব্য করল রানা। ছেলের কাপড় পরালে অনায়াসে নিজের ছেলে বলে চালানো যাবে টিউলিপকে। পালস আর নিঃশ্বাস পরীক্ষা করার জন্যে ঝুঁকল রানা। তারপর সিধে হয়ে বলল, ‘ওকে আরও একটা ইঞ্জেকশন দিতে হবে।’
ইঙ্গিতে টেবিলটা দেখাল কালোকেশী। টেবিলে একটা হাইপোডারমিক কিট দেখল রানা।
‘এভাবে কত দিন ওষুধ দিয়ে রাখা যাবে?’ কালোকেশী জিজ্ঞেস করল।
‘আরও দু’চার দিনে কোন অসুবিধে হবে না।’ ঘুরে মেয়েটার দিকে তাকাল রানা। ডাগর নীল চোখ, লাবণ্যমাখা তাজা মুখ, হলুদাভ মাখনের মত রঙ গায়ের। তার মাথা থেকে পা পর্যন্ত চোখ বুলিয়ে আজ আবার ভাবল রানা, ৩৬-২৪-৩৬?
‘কি দেখছেন?’ ঠোঁট নয়, যেন কমলার কোয়া-নড়ে উঠল। চেহারায় সারল্য, যেন কিছুই বোঝে না। রানা জানে, ওটা ভান।
‘কি নামে ডাকব তোমাকে?’ জিজ্ঞেস করল রানা।
‘জিনা,’ মধুর হেসে বলল কালোকেশী। ‘জিনা উইলিয়ামস।’
‘পাসপোর্টগুলো তোমার কাছে?’
‘নিচের তলায়। দেখতে চান?’
‘হ্যাঁ।’
সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে এল ওরা। হলরূমে ঢুকল। পাথুরে ফায়ারপ্লেসে আগুন নিভু নিভু। আলো জ্বালল জিনা। দেরাজ থেকে একটা ম্যানিলা এনভেলাপ বের করে রানার হাতে ধরিয়ে দিল।
এনভেলাপের ভেতর তিনটে পাসপোর্ট পেল রানা। বাবা, মা, এবং ওদের চার বছরের পুত্র সন্মনের জন্যে। উইলিয়ামস পরিবার সেণ্ট লুই, মিসৌরি-তে বাস করে। সুখী একটা পরিবার, ইউরোপে ছুটি কাটাতে এসেছে।
এনভেলাপের ভেতর থেকে আরও কাগজ বের করল রানা। সেগুলোর মধ্যে ফোক্সওয়াগেনের রেন্টাল ফর্ম-ও আছে। সব পরীক্ষা করে আবার এনভেলাপে ভরে রাখল ও। ‘আমার জিনিস-পত্ৰ?’
‘যা যা দরকার সব আপনি বেডরূমে পাবেন,’ বন্ধ একটা দরজার দিকে তাকাল জিনা।
‘বেডরূম কি…
‘হ্যাঁ,’ রানাকে থামিয়ে দিয়ে বলল জিনা, লালচে হয়ে ওঠা মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে অন্য দিকে তাকাল। ‘একটাই।’
‘গুড…।’
ঝট্ করে ফিরল জিনা। ‘জ্বী?’
‘রঁদেভো?’ জবাব না দিয়ে জিজ্ঞেস করল রানা।
‘কাল বাদে পরশু, সেমেরিং পাস-এর কাছে।
‘গুড,’ বলল রানা। ‘তারমানে সীমান্ত না পেরোনো পর্যন্ত আমাদের কিছু করার নেই?’
‘না।’
‘তোমার বুঝি তাই ধারণা?’
মুচকি হেসে জিজ্ঞেস করল রানা।
‘তারমানে?’ গলা একটু রানার দিকে লম্বা করল মেয়েটা, চোখে শাসন।
‘দুটো দিন অপেক্ষা করতে হবে, বাইরে মুখ দেখানো চলবে না, একটাই বেডরূম, আমার বয়স একশো দশ নয়, তুমিও কচি খুকী নও, কাছে-পিঠে আইনের লোক নেই-তারপরও তুমি ভাবো আমাদের কিছু করার থাকবে না?
প্রথম কয়েক সেকেণ্ড বোকার মত তাকিয়ে থাকল জিনা, তারপর খিলখিল করে হেসে উঠল। সমস্ত ভান উবে গেল চেহারা থেকে। নাচের ভঙ্গিতে জ্যান, অস্থির হয়ে উঠল শরীর। হাসি থামতে ছোট্ট একটা মব্য করল সে, ‘দুই পাজিতে জমবে কিন্তু ভাল।
.
সরকারি শবাগারের পরিচালক সসম্মানে বো করল, সরে গিয়ে পথ করে দিল আমেরিকান অফিসারকে। মনে মনে ভাবল, লোকটা শিন্ধীর ব্যক্তিগত বন্ধু কিনা কে জানে। আমেরিকান অফিসারের পরিচয় জানা নেই তার। পররাষ্ট্র দফতর থেকে এক লোক এসে তাকে শুধু বলে গেছে, মার্কিন সরকারের গুরুত্বপূর্ণ একজন কর্মকর্তা হের ভ্যানডেরবার্গকে দেখতে আসবেন, তার সাথে যেন সম্পূর্ণ সহযোগিতা করা হয়।
চ্যাপেল্ থেকে বেরিয়ে গেল পরিচালক। দরজাটা ভেতর থেকে বন্ধ করে দিল হেনরি পিকেরিং। বড়সড় কামরা, র্য্যাকে মোমবাতি জ্বলছে। বোতাম টিপে ইলেকট্রিক আলো জ্বালল সে। দ্রুত পায়ে কাস্কেট-এর এক ধারে এসে দাঁড়াল। ওয়ালনাট আর ব্রোঞ্জ দিয়ে তৈরি কারুকাজ করা কাস্কেট, হফ ভ্যানডেরবার্গের শেষ বিশ্রামের জন্যে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের উপহার। বৃদ্ধ ওস্তাদের দিকে তাকাল সে। ম্লান মুখ, চোখ বন্ধ, সাদা সাটিনে মোড়া কুশনে আড়ষ্ট হয়ে আছে শরীর। শুধু বেহালাটা বাস্তব মনে হলো, সতর্কতার সাথে নিষ্প্রাণ একজোড়া হাতে ধরিয়ে দেয়া হয়েছে।
নিজেকে কফিন চোর বলে মনে হলো পিকেরিঙের, একজন মানুষের সবচেয়ে অসহায় অবস্থাটা লুকিয়ে দেখতে এসেছে। চিটা ঝেড়ে ফেলল সে। এখানে তার কাজ আছে।
কফিনের মেঝে পরীক্ষা করার জন্যে ঝুঁকল সে। পালিশ করা কাঠে আঙুল বুলাল। কোথাও কোথাও ভাঁজ করা আঙুলের গিঁট দিয়ে টোকা মারল। কই, কিছু না। এমন কিছু নেই যা দেখে ধারণা করা চলে টিউলিপ কনওয়ে এখানে এক সময় ছিল।
অথচ ছিল তাতে কোন সন্দেহ নেই। তার জানা আছে। এই কাস্কেটের সাথেই কোনভাবে ছিল। তবে নিরেট প্রমাণ যোগাড় করে নিয়ে যেতে হবে তাকে। এমন কিছু, জেফ রিকার্ড যা সাথে করে ওভাল অফিসে নিয়ে যেতে পারেন।
আপনমনে মাথা নেড়ে পিছিয়ে এল পিকেরিং, আরেক কোণ থেকে কাস্কেটের দিকে তাকাল। হঠাৎ করেই চোখে পড়ল খুদে আঁচড়ের দাগটা। কাস্কেটের তলায় ব্রোঞ্জের সরু বর্ডার রয়েছে, দাগটা সেই বর্ডারের ওপর। ভাল করে পরীক্ষা করল পিকেরিং। একটা নয়, কয়েকটা দাগ। প্রতিটি দাগ পরস্পরের কাছ থেকে সমান দূরত্বে। মাপল সে। আঠারো ইঞ্চি পর পর একটা করে আঁচড়ের দাগ।
চোখ দুটো উজ্জ্বল হলো তার, ক্ষীণ হাসি ফুটল চেহারায়। পকেট থেকে ক্যামেরা বের করে ছবি তুলতে শুরু করল সে।
.
সামনের দিকে ঝুঁকে পড়লেন জেফ রিকার্ড, উত্তেজিত। ‘ওয়েল ডান, হেনরি!’ ফোনে কথা বলছেন তিনি। ‘যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ফটোগুলো আমার কাছে নিয়ে এসো।’
‘কাজ আমি মোটেও দেখাতে পারিনি, স্যার,’ ভিয়েনা থেকে বলল পিকেরিং। ‘অনেক খুঁজেও ড্রাইভারের কোন হদিস বের করা যায়নি। মানে, যে লোকটা কফিন সহ গাড়িটা এয়ারপোর্ট থেকে…
রিকার্ড তার ডেপুটিকে থামিয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘একটা ব্যাপারে তুমি শিওর তো? টিউলিপকে হার্স-এর ভেতর…’
‘নিশ্চয়ই তাই। হাতব্যাগ নিয়ে কয়েকজন অফিসার আর কফিন ছাড়া প্লেন থেকে কিছুই নামেনি। আরেক মাথায় কফিন রিসিভ করেছে সরকারী শবাগারের পরিচালক, তার সাথে আরও ত্রিশজন লোক ছিল। আমার এখানে পৌঁছুবার আগে পর্যন্ত কফিনের কাছে একা থাকার সুযোগ হয়নি কারও। কোন সন্দেহ নেই হার্স-এর ভেতরই সরিয়ে ফেলা হয়েছে মেয়েটাকে, স্যার, কিন্তু ড্রাইভার লোকটা স্রেফ বাতাসে মিলিয়ে গেছে।’
এক মুহূর্ত চুপ করে থেকে জেফ রিকার্ড নির্দেশ দিলেন, ‘দেশটার সীমান্ত সীল করো, পিকেরিং। ওখানে আমাদের লোক আছে, প্রতিবেশী দেশগুলো থেকে সবাইকে ডেকে নাও। ওদের ব্রিফিং করো, কি খুঁজতে হবে আভাস দাও।’
‘জ্বী, স্যার। এরইমধ্যে ইউরোপে আমাদের মিলিটারি ইন্টেলিজেন্স এজেণ্ট যারা আছে তাদের অর্ধেকের বেশি লোককে ব্রিফ করেছি আমি। টেলিফোনে, অবশ্যই।’
‘অস্ট্রিয়ান?’
‘সম্ভাব্য সবরকম সহযোগিতা করতে রাজি হয়েছে।’
‘বর্ডার?’
‘ওয়াশিংটন থেকে রওনা হবার আগেই সতর্ক করে দিয়েছি।’
‘গুড, আবার সতর্ক করো। কোথাও কোন ত্রুটি থাকুক আমি চাই না। এয়ারপোর্ট আর রেইল রোড?’
‘লোক আছে পাহারায়।’
‘গুড।’ রিভলভিং চেয়ারে হেলান দিলেন জেফ রিকার্ড। বললেন, ‘মেয়েটাকে নিয়ে অস্ট্রিয়ায় হয়তো ঢুকতে পেরেছে ওরা, কিন্তু বাই গড, বেরুবার কোন রাস্তা পাবে না!’
.
অতিথি বরণ অনুষ্ঠানের শেষ পর্বটা বাগান থেকে চাক্ষুষ করলেন জেফ রিকার্ড।
ভাষণ পর্ব শেষ হলো, মেরিন ব্যাণ্ড বেজে উঠল, প্রথমটার পর বাজল দ্বিতীয় জাতীয় সঙ্গীত। রঙচঙে একটা গার্ড দু’দেশের পতাকা বয়ে নিয়ে গেল। প্লাটফর্ম থেকে নেমে এলেন প্রেসিডেণ্ট, পথ দেখিয়ে বেলজিয়ান প্রধানমন্ত্রীকে নিয়ে এলেন। অতিথিদের ছোট্ট একটা দলের কাছে। ডিপ্লোম্যাটিক এন্ট্রান্সের সামনে কালো একটা লিমুসিন অপেক্ষা করছে।
প্রধানমন্ত্রীর সাথে করমর্দন করার সময় আরিক হাসিতে উল্লাসিত হয়ে উঠল প্রেসিডেণ্টের চেহারা। দু’জনের মধ্যে বৈঠক হবে, তবে বিশ্রামের জন্যে এখন ব্লেয়ার হাউসে গিয়ে উঠবেন প্রধানমন্ত্রী। পিছিয়ে এলেন প্রেসিডেন্ট, মুখের হাসি আগের মতই উজ্জ্বল। মিলিটারি ব্যাণ্ড বেজে উঠল, সঙ্কেত পেয়ে সচল হলো লিমুসিন। অনুষ্ঠান শেষ হলো। ঘুরে বাগানের দিকে পা বাড়ালেন প্রেসিডেণ্ট।
বাগানে ঢুকে থমকে দাঁড়ালেন তিনি, মুখের হাসি নিভে গেল। যেন খসে পড়ল মুখোশ। ‘জেফ, তুমি এখানে!’
প্রেসিডেন্টের সাথে হাঁটতে শুরু করে মৃদু হাসলেন জেফ রিকার্ড। রোজ গার্ডেন থেকে ওভাল অফিসের দিকে হাঁটছেন ওঁরা। ‘আগেই আমি রওনা হয়ে গেছি, এই সময় তোমার মেসেজ পেলাম,’ সি.আই.এ. চীফ বললেন। ‘কিছু ভাল খবর বোধহয় দিতে পারব।’
দ্রুত মুখ তুলে তাকালেন প্রেসিডেন্ট।
‘আমরা জানি, টিউলিপ অস্ট্রিয়ায় আছে।’
দাঁড়িয়ে পড়লেন প্রেসিডেণ্ট। ‘কিভাবে জানলে?
দ্রুত, সংক্ষেপে ব্যাখ্যা করলেন রিচার্ড। প্রতিটি মুহূর্ত রিচার্ড কনওয়ের চেহারায় কি পরিবর্তন হয় লক্ষ করছেন। বন্ধুর চোখে তিনি আশার আলো দেখতে চান। একটু কৃতজ্ঞতার ছায়া। কিন্তু দেখলেন শুধু বিমূঢ় ভাব।
‘লাভ এইটুকু যে,’ ব্যাখ্যা শেষ করলেন রিকার্ড, ‘এখন আমরা জানি কোথায় খুঁজতে হবে। আয়ত্তের মধ্যে যত ক্ষমতা আছে সব ওখানে প্রয়োগ করব আমরা।’
এক সেকেণ্ডের জন্যে চোখ বুজলেন প্রেসিডেণ্ট। ‘আমার তা মনে হয় না,’ বলে প্যাসেজ ধরে আবার হাঁটতে লাগলেন। ‘আমি তোমাকে ডেকেছি, কারণ ওরা যোগাযোগ করেছে।’
এবার দাঁড়িয়ে পড়লেন জেফ রিকার্ড। ‘ওরা…কিডন্যাপাররা?’
‘হ্যাঁ।’
‘হোয়াট? কোথায়? ভিয়েনা থেকে?’
‘বার্লিন থেকে।’
‘বার্লিন?’
কাঁচের দরজা ঠেলে সরাসরি নিজের অফিসে ঢুকলেন প্রেসিডেণ্ট। ভেতরে এক ভদ্রলোক অপেক্ষা করছেন। চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন তিনি। কীথ বিউমণ্ট, সিক্রেট সার্ভিস চীফ
‘দেখান ওকে,’ প্রেসিডেণ্ট বললেন।
প্রেসিডেন্টের ডেস্ক থেকে কি যেন একটা তুলে রিকার্ডের দিকে বাড়িয়ে দিলেন কীথ বিউমণ্ট। একটা লকেট। সরু কাজ করা সরু সোনার চেইনের সাথে আটকানো। লকেটের গায়ে টি হরফটা এনগ্রেভ করা রয়েছে। ধীরে ধীরে চেপে রাখা নিঃশ্বাস ছাড়লেন রিকার্ড। দেখামাত্র চিনতে পেরেছেন লকেটটা। তৃতীয় জন্মদিনে মার্গারেট দিয়েছিল টিউলিপকে। মুখ তুলে কীথ বিউমণ্টের দিকে তাকালেন তিনি। ‘টিউলিপ কি এটা পরে ছিল…?’
মাথা ঝাঁকালেন সিক্রেট সার্ভিস চীফ
‘এখানে ফেরত এল কিভাবে?’
‘ডাকযোগে, প্রেসিডেন্টের নামে। মেইলরূম থেকে আমার কাছে পাঠানো হয়। এয়ার স্পেশাল, দু’দিন আগে ওয়েস্ট বার্লিন থেকে পোস্ট করা হয়।’
‘প্যাকেটে শুধু এটাই ছিল? শুধু লকেটটা?’
‘না, এটাও ছিল।’
লকেটটা প্রেসিডেন্টের ডেস্কে রেখে দিয়ে কীথ বিউমন্টের হাত থেকে এক টুকরো কাগজ নিলেন রিকার্ড। কাগজের লেখাটা পড়লেন তিনি, সাথে সাথে সমস্ত রক্ত নেমে গেল মুখ থেকে। ধপাস করে একটা চেয়ারে বসে পড়লেন তিনি।
কাগজে তিনটে মাত্র শব্দ টাইপ করা। ‘অ্যারো। গোল্ডেন বার।’
‘লেখাটার কি মানে আমি জানি না,’ বললেন বিউমণ্ট। ‘বোঝা যাচ্ছে, আপনি জানেন।
ধীরে ধীরে ওপর-নিচে মাথা দোলালেন রিকার্ড। তারপর ঝট্ করে প্রেসিডেন্টের দিকে মুখ তুললেন। ‘তোমার সাথে একা কথা বলতে পারি? দুঃখিত, মি. বিউমণ্ট, এর সাথে জাতীয় নিরাপত্তা জড়িত।’
ছোট্ট করে মাথা ঝাঁকালেন প্রেসিডেণ্ট, কীথ বিউমণ্ট নিঃশব্দে বেরিয়ে গেলেন কামরা থেকে। ডেস্ক ঘুরে এগোলেন প্রেসিডেন্ট, নিজের চেয়ারে বসলেন। উত্তেজনা আর হতাশায় পরিশ্রান্ত হয়ে পড়েছেন। ‘কোথায় ও?’ শান্ত গলায় জিজ্ঞেস করলেন তিনি। ‘অস্ট্রিয়ায়, না জার্মানীতে?’
কথা না বলে রিকার্ড শুধু এদিক ওদিক মাথা নাড়লেন।
‘কিন্তু ওটার মানে কি তুমি জানো!’ রিকার্ডের হাতে ধরা কাগজটার দিকে তাকালেন প্রেসিডেণ্ট।
‘হ্যাঁ, জানি বৈকি।’ সিধে হয়ে বসলেন রিকার্ড। ‘গোল্ডেন বার পশ্চিম বার্লিনের একটা নাইটক্লাব,’ শুরু করলেন তিনি। ‘নামটা যুদ্ধের সময় আমেরিকান সৈনিকদের দেয়া।’
‘আমেরিকান সৈনিকরা ছাড়া আর কে ওটা চিনবে?’
‘বার্লিনে একবার যে গেছে গোল্ডেন বার চিনবে সে।’
‘আর অ্যারো?’
‘সোভিয়েত সেক্টরে অ্যারো আমার এজেন্টদের একজন, ‘ ধীরে ধীরে বললেন রিকার্ড। ‘ধারণা করছি, মেসেজে বলা হয়েছে, গোল্ডেন বারে অ্যারো-কে পাঠাব আমরা, তারপর ওরা পরবর্তী চাল না দেয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করব।’
প্রেসিডেণ্ট সামনের দিকে ঝুঁকলেন। ‘ফর গডস সেক, তাহলে এত রাখ রাখ ঢাক ঢাক কেন? পাঠিয়ে দাও তাকে!’
‘ব্যাপারটা অত সহজ নয়, রিচার্ড। অ্যারো একটা কোড নেম। নিশ্ছিদ্র কাভার নিয়ে আছে সে। রাশিয়ানদের ইস্ট জার্মান কমাণ্ডে হাই র্যাঙ্কিং মিলিটারি অফিসার।’
‘গড, জেফ! একজন রাশিয়ান?’
‘কম-বেশি। তার জন্ম ওমাহায়, বহু বছর আগে সি.আই.এ. তাকে রাশিয়ায় পাঠিয়েছে। আমরা তার ব্যাকগ্রাউণ্ড তৈরি করে দিই। কোন কাজে লাগানো হয়নি, কাজেই কারও সন্দেহভাজনও হয়নি। বলতে পারো, সম্পূর্ণ রাশিয়ান হয়ে ওঠে সে। সোভিয়েত মিলিটারিতে ঢোকে, একটু একটু করে ওপরে ওঠে। প্রমাণ করে, তার রাশিয়া-প্রেমে কোন খাদ নেই। শুধু ট্রেনিং পেয়ে এত ওপরে ওঠেনি, অনেকগুলো যুদ্ধেও প্রাণ বাজি রেখে লড়তে হয়েছে তাকে। যখন দেখলাম সন্দেহের ঊর্ধ্বে উঠে গেছে, পদটাও ভারি গুরুত্বপূর্ণ, ঘরে ফসল তুলতে শুরু করলাম আমরা। হের, রিচার্ড, পূর্ব জার্মানীতে রুশ তৎপরতা সম্পর্কে খবর পাবার সে-ই আমাদের প্রধান উৎস। তার কাভার নষ্ট হবার ঝুঁকি আমরা নিতে পারি না।’
চেয়ারে হেলান দিলেন প্রেসিডেণ্ট। ‘আমার তো মনে হচ্ছে তার কাভার এরই মধ্যে নষ্ট হয়ে গেছে।’
‘নট নেসেসারিলি,’ রিকার্ড বললেন। ‘অ্যারো সম্পর্কে কেউ হয়তো জানতে পারে, এই কোড নেম ব্যবহার করছি আমরা। কিন্তু ওরা হয়তো জানে না অ্যারো কে।’
‘গোল্ডেন বারে গেলে জানবে।’
‘হ্যাঁ।
ডেস্কের ওপর দিয়ে পরস্পরের দিকে তাকিয়ে থাকলেন ওঁরা। ঘরের ভেতরটা নিস্তব্ধ। অবশেষে প্রেসিডেন্ট বললেন, ‘ঝুঁকিটা আমাদের নিতে হবে।’
মাথা ঝাঁকালেন রিকার্ড।
অ্যারোর কপাল মন্দ! ওঁদের সামনে বিকন্ধ কোন পথ খোলা নেই।
পশ্চিম বার্লিনের পুরানো রাইখস্ট্যাগ বিল্ডিং। টপ ফ্লোরের লাউঞ্জে ঢুকল পিকেরিং। প্রাইভেট লেখা দরজাটা বন্ধ করল সে। কামরার আরেক প্রান্তে জানালার সামনে চলে এল। স্ত্রী নদী আর বার্লিন প্রাচীর একটা কোণ তৈরি করেছে, বিল্ডিংটা থেকে পরিষ্কার দেখতে পাওয়া যায়। বার্লিন প্রাচীরের ওপারে সোভিয়েত সেক্টরও দেখা যায় খানিক দূর। গার্ড টাওয়ারের মাথায় ইস্ট জার্মান সৈনিকরা সাবমেশিন গান নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
ঝুলন্ত রশি টেনে জানালার পর্দা একটু নামাল পিকেরিং।
সঙ্কেত পেয়ে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব যোগাযোগ করবে অ্যারো।
ঘর থেকে বেরিয়ে এল পিকেরিং, তার পিছনে দরজায় তালা লাগল।
.
গোল্ডেন বার একটা এলাহি ব্যাপার। প্রায় অন্ধকার গুহা বলা চলে। দুশো টেবিল, প্রতিটি টেবিলে একটা করে টেলিফোন আর ভয়েস পাইপ রয়েছে, বাইরে কারও সাথে কথা বলতে হলে টেবিল ছাড়তে হয় না, বা ওয়েটারের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্যে গলা ফাটাবার দরকার নেই। ভিতরটা লোকে লোকারণ্য।
গোপন সাক্ষাতের জন্যে খুব বাজে একটা জায়গা, ভাবল অ্যারো। কেউ যে তার সাথে দেখা করবে, এ-ব্যাপারে প্রায় নিশ্চিত সে। এখানে তাকে আসতে বলার পিছনে আর কি কারণ থাকতে পারে?
মনে মনে সাংঘাতিক অস্বস্তিবোধ করছে অ্যারো। পূর্ব জার্মানীর একজন কর্নেল, পশ্চিম বার্লিনের একটা বারে বসে কি করছে?
তবু কাভার ভাঙার ঝুঁকি নেয়নি অ্যারো। কাভারটা অটুট রাখার একটা সুযোগ এখনও আছে তার।
ভাগ্যগুণে খালি একটা টেবিল পাওয়া গেছে। ভদকার অর্ডার দিয়েছে অ্যারো।
বিশাল একটা ড্যান্স ফ্লোরের সামনে অর্ধবৃত্ত আকৃতিতে ফেলা হয়েছে টেবিলগুলো। অর্কেস্ট্রা বাজছে ফ্লোরে, পিছনে সঙ্গীতের তালে তালে নাচছে ঝলমলে ঝর্না। বয়স্ক, যুবক, সব ধরনের লোক রয়েছে বারে, প্রায় অর্ধেকই মেয়ে। ট্যুরিস্টের সংখ্যাও কম নয়।
ড্যান্স ফ্লোরের উল্টো দিকের একটা টেবিলে গিনিপিগকে দেখতে পেল অ্যারো। জানে, ছড়িয়ে ছিটিয়ে আরও অন্ত দশ-বারো জন এজেণ্ট আছে সি.আই.এ-র। কে কোথায় দেখার কোন চেষ্টা করল না সে। মনে মনে ভাবল, গিনিপিগ আসলে আমার কোড নেম হওয়া উচিত ছিল।
অপেক্ষা।
কি জন্যে? কার জন্যে?
গভীর একটা শ্বাস টেনে চেয়ারে হেলান দিল অ্যারো। ডিনারটা আজ এড়িয়ে যেতে পারলে শরীরের ওপর রহম করা হত। মনে হচ্ছে পেটটা যেন সীসায় ভর্তি হয়ে আছে।
ড্রিঙ্ক নিয়ে এল ওয়েটার, সাথে সাথে বিল মিটিয়ে দিল অ্যারো। হঠাৎ বেরিয়ে পড়ার দরকার হলে তখন আর সময় নষ্ট হবে না। ভদকার গ্লাসে চুমুক দিয়ে কামরার চারদিকে চোখ বুলাল সে।
সম্ভাবনা নিয়ে দীর্ঘ এক ঘণ্টা আলোচনা হয়েছে তার হেনরি পিকেরিঙের সাথে। পশ্চিম জার্মানী? না। ইউরোপে আমেরিকার সবচেয়ে শক্তিশালী মিত্র পশ্চিম জার্মানী, অন্ত অর্থনৈতিক দিক থেকে তো বটেই। না, পশ্চিম জার্মানী টিউলিপ কনওয়েকে কিডন্যাপ করবে না।
মাথার পিছনে ভোঁতা একটা ব্যথা অনুভব করল অ্যারো। ঠিক ব্যথা নয়, একটু যেন চাপ। উত্তেজনা, ভাবল সে। গ্লাস তুলে আরেক ঢোক ভদকা খেলো।
কুখ্যাত কোন টেরোরিস্ট অর্গানাইজেশন? উদ্ভট কাজ করার প্রবণতা আছে ওদের, ঝুঁকি নেয়ার দুঃসাহস আছে। কিন্তু জার্মান টেরোরিস্ট গ্রুপগুলো সূক্ষ্ম কোন কাজ বোঝে না। মার্কিন প্রেসিডেন্টের মেয়েকে কিডন্যাপ করার জন্যে কমাণ্ডো স্কোয়াড পাঠাত ওরা, সামনে যে ক’জনকে পেত খুন করে রেখে আসত।
টেরোরিস্টদের ধৈর্যও খুব কম। আরও অনেক আগেই দাবিটা কি জানিয়ে দিত। সামান্যতম সাফল্য চেপে রাখার লোক ওরা নয়।
না, ওরা নয়।
বাকি থাকে পূর্ব জার্মানী। পূর্ব জার্মানী একা এ-ধরনের কাজে হাত দেবে, ভাবা যায় না। অবশ্য রাশিয়ার প্ররোচনা আর সাহায্য পেলে করতে পারে। কিন্তু করেনি। করলে জানতে পারত সে। নাকি পাঁচিলের ওপারের বন্ধুরা বিশেষ কোন কারণে ব্যাপারটা গোপন রেখেছে তার কাছে?
ধ্যেৎ, এসব কি ভাবছি! এমনিতেই কি আর মাথা ধরেছে! চাপটা বাড়ছে। এখন ব্যথাই বলা যায়। মাথার পিছন থেকে সামনের দিকে, কপালে ছড়িয়ে পড়েছে। চোখের পিছনটা ও কেমন যেন দপ্ দপ্ করছে তার। ওয়েটারকে ডেকে একজোড়া অ্যাসপিরিন আনতে বলবে নাকি? ভয়েস পাইপে কথা বলল সে, কিন্তু ওর ওয়েটার সাড়া দিল না।
গোল্ডেন বারের কিচেন থেকে পিছনের দরজা দিয়ে সরু গলিতে বেরিয়ে এল এক লোক। গলির মুখে অপেক্ষা করছিল তার গাড়ি। ভেতরে ঢুকে ওয়েটার’স কস্ট্যুমের ওপর একটা কোট চাপাল সে। স্টার্ট নিল গাড়ি, চলতে শুরু করল। রাতের অন্ধকারে হারিয়ে গেল লোকটা।
.
মারাত্মক কিছু একটা ঘটে গেছে।
দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে অ্যারোর। কামরার উল্টো দিকে বসা গিনিপিগের দিকে তাকাল সে, কিন্তু দেখতে পেল না মেয়েটাকে। কাউকেই সে দেখতে পাচ্ছে না আর। যেদিকেই তাকাল, ছোপ ছোপ রঙ আর আলো ছাড়া কিছুই দেখল না। অর্কেস্ট্রার আওয়াজ হাতুড়ির বাড়ি মারছে মাথার ভেতর।
যোগাযোগ করতে হবে। গিনিপিগ অন্ত জানুক। ভাঙে ভাঙুক কাভার। জানানো দরকার মারাত্মক কিছু একটা ঘটে গেছে।
টেবিলের টেলিফোন হঠাৎ যেন নড়ে উঠে ধরা দিল দৃষ্টিতে, তারপরই কাঁপতে কাঁপতে অদৃশ্য হয়ে গেল। হাত বাড়াল অ্যারো, হাতড়াতে গিয়ে গ্লাস ওল্টাল। আঙুল ঠেকল রিসিভারে, খপ্ করে ধরে ফেলল সেটা।
রিসিভার কানে তোলার চেষ্টা করল অ্যারো। গিনিপিগ কোথায়, তার টেবিলের ন’র কত?
মাথার প্রচণ্ড ব্যথায় কিছুই মনে করতে পারল না সে। চিন্ন করতে পারছে না, ইচ্ছেও করছে না। ঘুম! হ্যাঁ, ঘুমাতে চায় সে। শুধু যদি টেবিলে রাখতে পারত মাথাটা, তারপর ঘুমিয়ে যেত….।
কামরার ওদিক থেকে গিনিপিগ দেখল টেবিলের ওপর ঢলে পড়ল অ্যারো, অতিরিক্ত মদ খাওয়া মাতালের মত। কয়েক সেকেণ্ড অপেক্ষা করল সে, কিন্তু অ্যারো নড়ল না।
শান্তভাবে চেয়ার ছাড়ল গিনিপিগ, মুখে মিটিমিটি হাসি নিয়ে এগিয়ে এল। দু’একটা টেবিলে থামল সে, এর-তার সাথে কুশলাদি বিনিময় করল, একটা মেয়েকে তার প্রেমিকের সাথে দেখে চোখ টিপল। গিনিপিগ সুন্দরী, বয়স এখনও ত্রিশ পেরোয়নি, অনেকেই তার দিকে তাকিয়ে আছে।
অ্যারোর টেবিলের কাছে পৌঁছে গেল সে। টেবিলটাকে পাশ কাটিয়ে চলে গেল। তারপর, যেন কৌতূহলবশত ঘুরে দাঁড়াল। ‘এই যে ভাই, হ্যালো,’ চাপা হাসির সাথে বলল সে, ‘আপনার কি হয়েছে বলুন তো?’
অ্যারো নড়ল না।
‘আপনি কি অসুস্থ?’ অ্যারোর দিকে ঝুঁকে তাকাল গিনিপিগ। তার ঘাড়ে হাত রাখল একটা। তারপর, হঠাৎ সিধে হয়ে একজন ওয়েটারকে ডাকল সে। ‘এই, ভদ্রলোকের একটা অ্যাম্বুলেন্স দরকার!’
ওয়েটার অ্যারোর দিকে ঝুঁকল, এক পা পিছিয়ে এল গিনিপিগ। গলায় হাত দিল সে। এই সঙ্কেতটা সবাই ওরা ব্যবহার করে। অর্থটা বুঝতে কারও অসুবিধে হবে না।
অ্যারো মারা গেছে।