অপহরণ-১.১

এক

দু’পা হাঁটছে, থামছে-একে ঠিক পায়চারি বলে না। অস্থির, আড়ষ্ট একজন লোক। এখন বেশ ভালই ফুটেছে ভোরের আলো, গবাক্ষ, গরাদহীন জানালা, চওড়া কার্নিস, ঝুল-বারান্দা, মিনার আর গম্বুজ আকৃতির ছাদ, কামান বসাবার সার সার চৌকো গর্ত, ইত্যাদি নিয়ে আকাশ ছোঁয়া দুর্গটা ধীরে ধীরে উন্মোচিত হলো তার পিছনে। নারেসবরো গ্রাম থেকে বাঁক নিয়ে ক্রমশ ওপর দিকে উঠতে শুরু করে দুর্গের সামনে পৌচেছে রাস্তাটা, সেদিকে বার বার তাকাল রিচার্ডসন।

ভাঙাচোরা নিষ্প্রাণ দুর্গ, এপ্রিলের ভেজা ভেজা ভোরের আকাশে হেলান দিয়ে মুখ ভেঙচে আছে। বলা চলে পরিত্যক্ত ধ্বংসাবশেষ। ভারী, গম্ভীর চেহারার ফটকগুলোয় কোন্ কালে এক একটা আধমণ ওজনের তালা ঝোলানো হয়েছিল, শুধু মরচেই ধরেনি, চাবি ঢোকাবার ফুটোগুলো ধুলো ঢুকে বুজে গেছে। দুর্গটার ঐতিহাসিক গুরুত্ব খুব সামান্যই, ব্রিটিশ পর্যটন পুস্তিকায় খুঁজলে পরিচয় ইত্যাদি সম্পর্কে দু’একটা লাইন পাওয়া গেলেও যেতে পারে। কাছ থেকে দেখলে নিঃসঙ্গ মনে হয় দুর্গটাকে, সময়ের সীমানা পেরিয়ে এসে বোবা পাথর বনে গেছে। এক সময় ভয়াবহ রক্তপাত ঘটেছে এখানে, পদাতিক সৈন্যরা ঝাঁক বেঁধে আসা-যাওয়া করেছে, খটাখট খটাখট ঘোড়ার খুরের আওয়াজে ঘুম ভেঙে গেছে দুর্গরক্ষীদের, কামানের মুহুর্মুহু গর্জনে কেঁপে কেঁপে উঠেছে গোটা এলাকা। একদিন সবই ছিল, আজ কিছুই নেই। কিন্তু রিচার্ডসনের তা মনে হলো না। অশুভ কিছু দেখতে পাচ্ছে, ঠিক তা নয়। ভূতুড়ে দুর্গের ছাদে কোন পেত্নীর কালো ছায়া হাঁটাচলা করছে না। বিদেহী কোন আত্মার করুণ বিলাপও শোনা যায়নি। এটা স্রেফ তার একটা অনুভূতি—যেন ভাঙা দেয়ালগুলোর কাছাকাছি এখুনি কিছু একটা নড়ে উঠতে পারে, হঠাৎ করে শোনা যেতে পারে আহত সৈনিকের আর্তনাদ। গোটা পরিবেশটা রোমাঞ্চকর আর রহস্যময় লাগল তার। মনে হলো, এখানে সে একা নয়। কালো জানালাগুলো থেকে উঁকি দিয়ে অশরীরী কারা যেন দেখছে তাকে।

বাস্তবে ফিরে এসে আবার রাস্তার বাঁকে তাকাল সে। গাড়ির আওয়াজ শোনার জন্য খাড়া করল কান। পাথরের ওপর দিয়ে পানি ছুটছে কলকল ছলছল-মৃদু, মধুর, কোমল একটা শব্দ। রাতের লণ্ডন থেকে একাকী গাড়ি চালিয়ে ভোর হবার খানিক আগেই এখানে পৌঁচেছে সে, নিশ্চয়ই এই পানির আওয়াজ শোনার জন্যে নয়। কোটের কলার খাড়া করল সে,

ঠাণ্ডা বাতাস থেকে ঘাড়টা বাঁচল। তারপর পকেটে হাত ভরল গোলাপ কুঁড়ি বের করার জন্যে।

জোড়া গোলাপ কুঁড়ি হতে হবে, উইলিয়াম অবসন পরিষ্কারভাবে বলে দিয়েছে তাকে। অন্য কোন ফুলের কুঁড়ি হলে চলবে না। এটা একটা সঙ্কেত, দেখলেই যাতে চিনতে পারে রিচার্ডসনকে। যে সাবজেক্টকে নিয়ে এত কাঠ-খড় পোড়ানো তার কোড নেমও তাই-রোজ বাড, গোলাপ কুঁড়ি।

সেলোফেনের মোড়ক খুলে কুঁড়ি জোড়া বের করল রিচার্ডসন। অনেক নিচে, রাস্তার দিকে আরেকবার তাকাল। না গাড়ি, না গাড়ির শব্দ, কিছুই নেই। একটা কুঁড়ি থেকে পাপড়ি ছিঁড়ে দাঁত দিয়ে কাটল সে। ভেতরে একটা অস্থিরতা বোধ করছে।

রিচার্ডসন যথেষ্ট লম্বা, কিন্তু এত লম্বা নয় যে আড়াই মণ ওজন মানিয়ে যাবে। বছরের পর বছর চেয়ারে বসে থেকে গায়ে চর্বি জমিয়ে ফেলেছে বেচারা। টকটকে লাল ফোলা মুখে চোখ দুটো চিকন একজোড়া ফাটল। বয়সের ভাঁজ পড়েছে চোখের চারপাশে, তবে সরু ফাটল জোড়ার ভেতর থেকে ঝিলিক দেয় তীক্ষ্ণ দৃষ্টি। কালো বোলার হ্যাট পরেছে সে, স্যুটটাও কালো, এ-ধরনের দেখাসাক্ষাতের জন্যে এটাই বোধহয় ঠিক রঙ। কোটের ভেতর তার কাঁধ দুটো সামনের দিকে একটু ঝুঁকে আছে, এত বছর ধরে এত সব গুরুদায়িত্ব কাঁধে নেয়ার ফলশ্রুতি। চর্বিবহুল হলেও, তার ম্লান আঙুলগুলো লম্বা আর সরু। এই আঙুলে ধরা লাল গোলাপ কুঁড়ি বেমানান নয়।

মুখের সামনে একটা হাত এনে হাই তুলল সে। সব কাজ শেষ হলেও, রিপোর্টটা টাইপ করা বাকি ছিল। সন্ধে থেকে শুরু করে রাত আড়াইটা পর্যন্ত টাইপ করতে হয়েছে। সাথে সাথে রওনা হতে পারেনি, তার আগে সমস্ত প্রমাণ, চিহ্ন ইত্যাদি নষ্ট করতে হয়েছে। এক কাপ চা খাওয়ার বা পাঁচ-সাত মিনিটের জন্যে চোখ বোজার সুযোগ মেলেনি। ক্লান্ত বটে, কিন্তু বিষণ্ণ নয়। বগলের নিচে কালো লেদার ব্যাগে নিরাপদে রয়েছে রিপোর্টটা, খোলা আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে এই মুহূর্তে গর্ব অনুভব করছে রিচার্ডসন। কর্নেল উইলিয়াম অবসন সময়টা ভালই বেছেছেন, দিনের আরম্ভ। রিচার্ডসনের বিশ্বাস তার জীবনে আজকের দিনটা নতুন সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দেবে।

দুর্গের ভাঙাচোরা পাঁচিলের মাঝখানে পাথুরে গেটটা এখনও কোন রকমে খাড়া হয়ে আছে। খোলা গেট দিয়ে রাস্তার অপর দিকটা দেখা যায়। এদিকে লোকবসতি নেই বললেই চলে, কাফেটা খুললেও বেলা আটটার আগে সম্ভাবনা কম। রাস্তার দু’পাশে গাছের সারি, ঝাঁকড়া মাথাগুলো ঘন সবুজ। ক্রমশ উঁচু হয়ে উঠে আসা রাস্তাটায় সর্বশেষ পিচ ঢালার পর কয়েক যুগ পেরিয়ে গেছে, খানা-খন্দে ভরা। পুব আকাশ রাঙা হয়ে উঠছে দেখে আবার বাঁকের দিকে তাকাল রিচার্ডসন। গাছের পাতা ছাড়া কোথাও কিছু নড়ছে না। গোটা এলাকা নির্জন আর নিস্তব্ধ। কর্নেল আসছে না কেন?

কর্নেল উইলিয়াম অবসনের সাথে সাক্ষাৎ পরিচয় নেই রিচার্ডসনের। কিন্তু লোকটা যে সি.আই.এ-র দ্বিতীয় ব্যক্তি, এটুকু তার ভাল করেই জানা আছে। এর আগে সম্ভবত প্রকাশ্যে বাইরে বেরিয়ে এসে নিজের পরিচয় ফাঁস করার ঝুঁকি নেয়নি সে। কর্মকর্তারা এই সুযোগটা ভোগ করে-নেপথ্যে থাকে তারা, বিপদ থেকে নিরাপদ দূরত্বে। কর্নেলের মত রিচার্ডসনের চাকরিটাও নিরাপদ। ডেস্কে, প্রতিপক্ষের চোখের আড়ালে বসে কাজ করে সে। তবে কর্মকর্তারা রিভলভিং চেয়ারে বসে হুকুম দিয়েই খালাস, কাজের আসল ধকল সামলাতে হয় তার মত লোকদের। ডাটা সংগ্রহ করা, উপযুক্ত লোককে অ্যাসাইনমেণ্ট দেয়া, রিপোর্ট লেখা, সম্ভাবনার নতুন দিক আবিষ্কারের জন্যে গবেষণা করা, সবই তাদের করতে হয়। কর্তারা পলিসি নির্ধারণ করে, পলিসি বাস্তবায়িত করে তারা। অতি মূল্যবান খুঁটিনাটি তথ্য কর্তাদের গোচরে আনার দায়িত্বও তাদেরই ওপর।

বগলের নিচে লেদার ব্যাগটা আরও জোরে চেপে ধরল রিচার্ডসন। একটা অসম্ভব অ্যাসাইনমেন্টের বিশদ রূপরেখা রয়েছে এই রিপোর্টে। অসম্ভব, তাতে কোন সন্দেহ নেই। কাজেই এই রূপরেখা কাজে লাগতেও পারে, নাও পারে। কিন্তু সেটা বড় কথা নয়, বড় কথা কাজটা করার দায়িত্ব এত থাকতে শুধু তাকেই দেয়া হয়েছে। এই পেশায় এটাই সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ পুরস্কার। কর্তারা তার কাজে দীর্ঘদিন ধরে সন্তুষ্ট, সেটাই প্রমাণিত হয়। এবার অনেক দিনের প্রাপ্য সম্মান জুটবে কপালে। না, সে কোন প্রচার পাবে না, জানে রিচার্ডসন। প্রশ্নই ওঠে না। কারণ গোটা ব্যাপারটা এক্কেবারে টপ সিক্রেট। সহকারী সহকর্মীরাও ব্যাপারটা সম্পর্কে কিছু জানতে পারবে না। তবে সবাই তার পদোন্নতি দেখতে পাবে, দেখতে পাবে ঘন ঘন কর্তাদের দফতরে ডাক পড়ছে তার। নতুন মর্যাদা পাবে সে, সবাই তাকে অন্য চোখে দেখবে। এতবছর ধরে যারা তাকে এড়িয়ে গেছে, অবহেলা করেছে, দেখেও না দেখার ভান করেছে, এরপর থেকে তারাই তার পরামর্শ পাবার জন্যে ভিড় জমাবে। খুশি হবে খাতির করার সুযোগ পেলে।

কর্নেলেরও যে কৃতিত্ব নেই, তা নয়, ভাবল রিচার্ডসন। এত লোকের ভেতর থেকে তাকে খুঁজে বের করেছে কর্নেল, এ-ও কম কথা নয়। নিজের প্রশংসা করা পছন্দ নয় তার, কিন্তু কর্নেল যে সেরা রিসার্চ অ্যানালিস্ট-কে খুঁজে বের করেছে, তাতে কোন সন্দেহ নেই। এই কাজের জন্যে তারচেয়ে উপযুক্ত লোক আর কই! তাছাড়া, শুধু উপযুক্ত হলেই তো হয় না, বিশ্বস্ততাও থাকতে হয়। কেউ বলতে পারবে তার রেকর্ডে কোন লাল কালির আঁচড় আছে?

হঠাৎ থেমে পায়ের কাছে মাটির দিকে ভুরু কুঁচকে তাকাল রিচার্ডসন। এটা কিভাবে সম্ভব হলো? হাতের গোলাপ কুঁড়ির দিকে তাকাল সে। এটা কি অশুভ কোন লক্ষণ? ঝুঁকল সে, মাটি থেকে তুলে নিল অক্ষত, প্রায় তাজা একটা পাপড়ি। কোন্ অসতর্ক মুহূর্তে কে জানে তার হাত লেগে কুঁড়ি থেকে খসে পড়েছিল। আগের পাপড়িটা থো থো করে মুখ থেকে ফেলে দিল সে, দ্বিতীয়টা দাঁতের মাঝখানে আটকাল। নিজের চারপাশে মাটিতে ভাল করে তাকাল, না, আর পড়েনি। সিধে হতে যাবে, চোখের কোণে কি যেন নড়তে দেখে স্থির হয়ে গেল সে।

ডান দিকে।

দুর্গের নিচের ঢাল থেকে আসছে লোকটা। গোটা দুর্গটাকেই ঘিরে আছে ঢাল, পায়ে হাঁটা সরু পথ ধরে প্রশস্ত লনে উঠে আসছে সে। কোন তাড়া নেই, ধীর পায়ে, অলস ভঙ্গিতে। এতটা দূর থেকেও মনে মনে প্রভাবিত হলো রিচার্ডসন। আগন্তুককে মোটেও সি.আই.এ-র হোমরাচোমরা কেউ বলে মনে হলো না। পরনে দামী কোন স্যুট নয়, জুতো জোড়া ইটালিয়ান চামড়া দিয়েও তৈরি নয়। রঙ চটা জিনসের ট্রাউজার পরে আছে, পায়ে সাধারণ একজোড়া ম্লান রঙের জুতো, মাথায় নীল নাবিকের ক্যাপ, ভুরু পর্যন্ত নেমে এসেছে। এরচেয়ে নিখুঁত ছদ্মবেশ আর কি হতে পারে? একজন নাবিক, প্রাতঃভ্রমণে বেরিয়েছে। আশ্চর্য, রিচার্ডসন ধারণাও করেনি, এত থাকতে ওদিক থেকে আসবে কর্নেল।

গোলাপ কুঁড়ির বোঁটা দুটো দু’আঙুলের মাঝখানে আটকে নিয়ে এগোল রিচার্ডসন। পায়ে হাঁটা দুর্গের যেখানে সবচেয়ে কাছাকাছি পৌঁচেছে, সেখানে থামল। আগন্তুক দশ হাতের ভেতর চলে এল। সবিনয় হাসির সাথে মাথা ঝাঁকাল সে, বলল, ‘প্রাতঃভ্রমণ স্বাস্থ্যের জন্যে ভাল।

‘ভাগ্যিস সবাই সেটা বোঝে না!’ জবাব দিল কর্নেল।

সরু পথটা ধরে দু’জন পাশাপাশি হাঁটতে লাগল। দুর্গটাকে পাশ কাটিয়ে এল ওরা, ঢাল বেয়ে নামল নিচের লনে। লনের কিনারা থেকে ঝপ্ করে নেমে গেছে মাটি, নিচে নদী। লনে এক মুহূর্ত দাঁড়াল কর্নেল, নদীর ওপারে তীক্ষ্ণ চোখে তাকাল। গ্রাম বলতে দু’চারটে কুঁড়ে ঘর, নদীর দিকে পিছন ফিরে আছে, লোকজন দেখা যায় না।

‘বলুন,’ মৃদু কণ্ঠে, কিন্তু কর্তৃত্বের সুরে অবশেষে জানতে চাইল কর্নেল।

কর্নেলের বয়স তার চেয়ে কম, লক্ষ করে অস্বস্তিবোধ বেড়ে গেল রিচার্ডসনের। পঁয়তাল্লিশ, বড়জোর পঞ্চাশ। সরু মুখে উদ্বেগের ছিটেফোঁটাও নেই, চেহারায় নগ্নভাবে ফুটে আছে অনভিজ্ঞতার ছাপ। ‘সমস্যাটা নিয়ে দিনের পর দিন মাথা ঘামিয়েছি…,’ শুরু করল রিচার্ডসন।

কিন্তু কর্নেল অবসন তাকে থামিয়ে দিল। ‘টেকনিক সম্পর্কে নয়, আমি ফলাফল জানতে চাই। কাজটা সম্ভব?’

‘জ্বী, স্যার,’ তাড়াতাড়ি বলল রিচার্ডসন। ‘জ্বী, কাজটা করা সম্ভব।’

নদীর দিকে পিছন ফিরল কর্নেল, ধীর পায়ে দ্বিতীয় ঢালের দিকে এগোল, যেদিক থেকে এসেছে সে। সসম্ভ্রমে খানিকটা পিছনে থেকে তাকে অনুসরণ করল রিচার্ডসন। ঢাল পেরিয়ে এল ওরা। প্রায় খাড়া পাড় বেয়ে নদীর দিকে নামতে শুরু করল। ‘কিভাবে?’ জানতে চাইল কর্নেল।

ঠিক সময়টাতে কোত্থেকে শুরু করবে ভেবে ইতস্তত করতে লাগল রিচার্ডসন। কর্নেল সংক্ষেপে শুনতে চাইবেন, বাহুল্যবর্জিত এবং বোধগম্য হওয়া চাই। তার জানা আছে, সতর্কতার সাথে মুখ খুলতে হবে তাকে, শব্দ নির্বাচনে ভুল করা চলবে না। হাঁটার গতি বাড়িয়ে দিয়ে কর্নেলের পাশে চলে এল সে। ‘হোয়াইট হাউস থেকে এটা চুরি দিয়ে শুরু করব আমরা।’ কর্নেলের হাতে এক টুকরো ভাঁজ করা কাগজ গুঁজে দিল সে, সংবাদপত্রের কাটিং।

মুহূর্তের জন্যে কর্নেল অবসনের নির্লিপ্ত চেহারা উল্লাসিত হয়ে উঠল। আইডিয়াটা তার পছন্দ হয়েছে। কিন্তু তারপরই ভুরু কোঁচকাল সে।

সন্দেহগুলো কর্নেল মুখ ফুটে প্রকাশ করার আগেই রিচার্ডসন তাড়াহুড়ো করে বলল, ‘সম্ভাব্য সবচেয়ে যোগ্য লোককে দিয়ে কাজটা করাব আমরা। সেরা প্রফেশন্যালদের একজন হতে হবে তাকে। এমন একজন, যে পিছনে কোন প্রমাণ বা সূত্র রেখে আসে না, সব মুছে পরিষ্কার…’

‘হ্যাঁ, বুঝলাম,’ ঝাঁঝের সাথে বলল কর্নেল। ‘এ-সব আমি জানি।’ কাগজের ভাঁজ খুলে ফটোটা আবার একবার দেখল সে। ‘কিন্তু তারপর কি হবে? হোয়াইট হাউস থেকে ওটা চুরি করা হলো, তারপর কি ঘটবে? কিভাবে ঘটবে?’ গোটা প্ল্যানটা শুনতে চাইছে সে।

‘চুরি করার পর, উদ্ধারের জন্যে আমরাই সূত্র যোগান দেব, স্যার,’ বলল রিচার্ডসন। গুরুত্ব বোঝাবার জন্যে শব্দগুলো থেমে থেমে উচ্চারণ করল সে। তার হাবভাবে দক্ষ সিভিল সার্ভেন্টের পরিচয় প্রকট হয়ে উঠল। হাত দুটো পিছনে, ধীর পায়ে হাঁটছে, বগলের নিচে লেদার ব্যাগ। ‘দুনিয়ার যে সব জায়গায় গোলমেলে হয়ে উঠেছে পরিবেশ, বিশেষ করে যে-সব জায়গায় আমেরিকার মর্যাদা এখনই যায়-যায় অবস্থা, সূত্রগুলো সে-সব জায়গায় ছাড়া হবে। প্রয়োজনে গোপন তৎপরতা চালিয়ে পরিবেশ আরও গরম করে তোলা যাবে। প্ল্যানটা যদি সতর্কতার সাথে করি, ছোট বড় মিলিয়ে গোটা কয়েক বিষাক্ত কাঁটাও তোলা সম্ভব হবে—এগুলো উপরি পাওনা। সূত্রগুলো এমন হবে, চুরি যাওয়া আইটেম উদ্ধারে কোন সাহায্যে আসবে না। যাতে উদ্ধার করতে না পারে তার জন্যে কাজ করব আমরা।’

‘হুঁ। ভাল। কি বলতে চাইছেন বুঝতে পারছি,’ বলল কর্নেল। তার চেহারা আবার উল্লাসিত হয়ে উঠল। ‘তারপর, সবশেষে, সাবজেক্টকে জায়গা মত পৌঁছে দিয়ে পুরস্কার জিতে নেব।

‘জ্বী, স্যার। কিন্তু যার প্রাপ্য তার ঘাড়ে সমস্ত দায় না চাপিয়ে নয়।’

কয়েক মুহূর্ত কথা বলল না কর্নেল। পাড় বেয়ে নামল সে। তীর ঘেঁষে এগোল। অন্যমনস্ক। তারপর বিড় বিড় করে বলল, ‘খুবই ভাল। কাজটা আপনাকে দিয়ে সত্যি ভুল করিনি দেখছি আমি সন্তুষ্ট।’

‘ধন্যবাদ, স্যার।’ মুহূর্তের জন্যে চোখ বুজে প্রশংসাটুকু উপভোগ করল রিচার্ডসন।

‘কিন্তু এসবই জন্ধনাকন্ধনা মাত্র। এবার বলুন, যে সাবজেক্টের কথা ভাবছেন, তাকে কি চুরি করা সম্ভব?’

‘জ্বী স্যার, এটাই আসল প্রশ্ন,’ বলল রিচার্ডসন। ‘আমার ধারণা, সম্ভব। আসলে, স্যার, আপনি জানেন, কোন কাজই অসম্ভব নয়।’

হঠাৎ থমকে দাঁড়িয়ে রিচার্ডসনের দিকে ফিরল কর্নেল অবসন, কটমট করে তাকাল। ‘আমি আপনাকে সম্ভাবনা নিয়ে মাথা ঘামাতে বলিনি। আমি বলেছিলাম ফ্যাক্টস যোগাড় করে…’

একটুও ঘাবড়াল না রিচার্ডসন। মনে মনে নিজেকে শক্ত করল সে, তিক্ত হলেও সত্যি কথাটা বলতে হবে তাকে। ধীরে ধীরে মাথা নাড়ল সে। ‘জ্বী না, এই কাজের উপযুক্ত লোক আমি পাইনি। নেই।’

‘হোয়াট!’ চাপা স্বরে গর্জে উঠল কর্নেল। ‘নেই?’

শান্তভাবে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকল রিচার্ডসন।

‘সি.আই.এ. এত বড় একটা প্রতিষ্ঠান, দুনিয়ার যে-কোন প্রান্তে যে-কোন মুহূর্তে আমরা তুলকালাম কাণ্ড বাধিয়ে দিতে পারি, কোটি কোটি ডলার খরচ করে হাজার হাজার এজেণ্ট পোষা হচ্ছে, আর আপনি বলছেন এই কাজের উপযুক্ত লোক পাওয়া যাবে না?’

‘সি.আই.এ.-তে যোগ্য লোকের অভাব আছে তা আমি বলিনি, স্যার। কাজটা করতে পারবে এমন লোক বেশ কয়েকজনই আছে। কিন্তু তাদেরকে বিশ্বাস করে কাজটা আমরা দিতে পারি না। এই জন্যে যে, কাজটা কি জানার পর ওদের বেশিরভাগেরই হয় মাথা খারাপ হয়ে যাবে, নয়তো ভয়ে গা ঢাকা দেবে-যদি খবরের কাগজে বেনামা-চিঠি পাঠিয়ে সব ফাঁস করে দেয় তাতেও আমি আশ্চর্য হব না। উপযুক্ত লোক নেই অর্থে আমি বলতে চেয়েছি সব দিক থেকে যোগ্য লোক নেই। কেউ কেউ খুবই ভাল, কিন্তু পুরোপুরি বিশ্বস্ত নয়। কারও মধ্যে রয়েছে আনুগত্যের অভাব। কেউ আবার অতি চালাক, ঘোড়া ডিঙিয়ে ঘাস খেতে চাইবে। এই কাজের গুরুদায়িত্ব মাথায় নেয়া চাট্টিখানি কথা নয়…’

‘তাহলে?’

রিচার্ডসন চুপ করে থাকল।

রাগে প্রায় অন্ধ হয়ে গেল কর্নেল। ‘আপনি অসম্পূর্ণ একটা রিপোর্ট তৈরি করে এনেছেন?’ হাত দুটো শক্ত মুঠো হয়ে গেল তার। ‘আপনাকে আমি বলেছিলাম…’

সময় বুঝে মুখ খুলল রিচার্ডসন, ‘সব দিক থেকে উপযুক্ত লোক একজনই আছে, স্যার। কিন্তু…’

‘কে সে?’ মারমুখো হয়ে জানতে চাইল কর্নেল।

‘সি.আই.এ-র কেউ নয়,’ বলল রিচার্ডসন। ‘এমন কি আমেরিকানও নয়। আপনি তাকে চেনেন।

আবার গর্জে উঠতে গিয়ে থমকে গেল কর্নেল। স্মরণ করার চেষ্টা করল সে। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে রিচার্ডসনের মুখের প্রতিটি ভাঁজ লক্ষ করছে। ‘নাম কি?’

‘মাসুদ রানা।’

তাই তো—হ্যাঁ, অবশ্যই। মাসুদ রানা। অদ্ভুত একটা উত্তেজনা বোধ করল কর্নেল, প্রায় পুলকের মত একটা অনুভূতি ছড়িয়ে পড়ল সারা শরীরে। চিন্তিতভাবে নদীর দিকে তাকাল সে, চট করে একবার রিচার্ডসনের নির্লিপ্ত চেহারাটা দেখে নিল। ব্যাটাচ্ছেলে গণক নাকি? মাসুদ রানার কথা তার পেটে ছিল, কিন্তু বেরুল ওর মুখ দিয়ে। কর্নেলের মনে পড়ল, কাজটা কি তা না বললেও, তার সাহায্য দরকার হবে এ-কথা কিছুদিন আগে রানাকে জানিয়েছে সে।

অন্যমনস্ক হয়ে পড়ল কর্নেল। গোটা দুনিয়ার এসপিওনাজ জগতের ছবি ভেসে উঠল তার চোখের সামনে। যখনই দেখা যায় কোন কাজের জন্যে মাত্র একজন উপযুক্ত লোক আছে, সেই লোকটা কেন সব সময় মাসুদ রানা হতে বাধ্য? এর কারণ অনেকে অনেকভাবে ব্যাখ্যা করে। কেউ বলে রানা সুপারম্যান, কেউ বলে রানা অজেয়, আবার অনেকে না জেনেই বলে রানা কখনও ব্যর্থ হয় না। এ-সব কোনটাই বিশ্বাস করে না কর্নেল। শুধু সাফল্যের খবর নয়, রানার ব্যর্থতার খবরও জানা আছে তার। তবু মুক্ত কণ্ঠে স্বীকার করতে হবে এসপিওনাজ জগতে মাসুদ রানা সত্যিই একজন নির্ভরযোগ্য এজেণ্ট। কর্নেলের বিশ্বাস, শুধু একটিমাত্র অতিরিক্ত গুণ থাকায় আর সব এজেণ্টদের চেয়ে অনেক আলাদা রয়েছে রানা। একশো এজেন্টকে যদি ডেকে বলা হয়, নয় কোটি ত্রিশ লক্ষ মাইল পেরিয়ে সূর্য থেকে নমুনা সংগ্রহ করে আনতে হবে, হেসেই খুন হবে নিরানব্বুই জন। শুধু একজন, হাসির আওয়াজ থামার অপেক্ষায় বসে থাকবে, তারপর জিজ্ঞেস করবে, এ-ব্যাপারে সম্ভাব্য কি কি সাহায্য করা হবে তাকে। অর্থাৎ এই একজন কোন কাজকেই অসম্ভব বলে মনে করে না। কাজটা যত কঠিনই হোক, সম্ভাব্যতা যাচাই করে দেখতে চায়। এবং, আশ্চর্য, সম্ভাবনা যেখানে শূন্য, সেখানে ও হাল ছেড়ে দেয় না—জানে চেষ্টা করাটাই পাগলামি, তবু চেষ্টা করে দেখতে চায়। এ সেই, মাসুদ রানা-শয়ে বা হাজারে নয়, লক্ষ-কোটিতে একজন।

রানা সম্পর্কে প্রায় সবই জানা আছে কর্নেলের। তবু রিচার্ডসনের ধারণা কি জানতে পারলে ভাল হয়। ‘হ্যাঁ, রানাকে আমি চিনি। কিন্তু এই কাজের জন্যে আমি তাকে বিশ্বাস করতে পারি না। এত থাকতে শুধু রানাকেই আপনি উপযুক্ত ভাবলেন, কারণটা কি?’

কেশে গলা পরিষ্কার করল রিচার্ডসন। ‘ওর কোন ভয় নেই,’ এক কথায় জবাব দিল সে।

‘মানে?’

‘সত্যি কথা বলতে কি, স্যার, আপনার এই কাজ কেউ নিতে চাইবে না-ভয়ে। কিন্তু মাসুদ রানার মধ্যে ওই জিনিসটা প্রায় নেই বলেই আমি জানি

‘আপনি বলছেন কাজটা রানা করে দেবে?’

মাথা নাড়ল রিচার্ডসন। ‘করতে পারবে, এটুকু জানি। করে দেবে কিনা সেটা সম্পূর্ণ আলাদা প্রসঙ্গ। আপনি ব্যক্তিগতভাবে তাকে অনুরোধ করে দেখতে পারেন। তবে ওকে রাজি করাবার আগে ওর বসকে যদি রাজি করাতে পারেন, সবচেয়ে ভাল হয়।’

‘ব্যস? ভয় নেই এটাই ওর একমাত্র যোগ্যতা?’

মাথা নাড়ল রিচার্ডসন। ‘সেরা এজেন্টদের যে-সব গুণ থাকা দরকার তার সবগুলোই আছে রানার মধ্যে।’ এরপর তিন মিনিট রানার গুণের সংক্ষিপ্ত ফিরিস্তি দিল সে। সবশেষে বলল, ‘ওর একটা ইনভেস্টিগেটিং ফার্ম আছে, কাজেই আমরা ওর মক্কেল হতে পারি। অবশ্য অসম্ভব ফি চাইবে ও।’

‘টাকা কোন সমস্যা নয়,’ বিড়বিড় করে বলল কর্নেল।

‘তাহলে রানাই আমাদের উদ্ধার-কর্তা,’ বলল রিচার্ডসন।

‘ও আমেরিকান নয়, তাতে কি সুবিধে হবে?’

‘অবশ্যই। যদি নেয়, কাজটাকে স্রেফ একটা কেস হিসেবে নেবে ও,’ বলল রিচার্ডসন। ‘ইমোশন্যালি ইনভলভড হবে না।’

‘ভয় নেই, যখন যা খুশি সাজতে পারে, গায়েব হয়ে যাওয়ার ব্যাপারে জুড়ি নেই, অনেকগুলো ভাষা জানে, বুদ্ধিমান-আপনার ভাষায় এই হলো রানা। ও কি…?

‘দুঃখিত, স্যার,’ তাড়াতাড়ি বলল রিচার্ডসন, ‘ওর আরও একটা গুণ আছে। ‘

‘ইয়েস?’

‘চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে ভালবাসে রানা, বলতে পারেন এটা তার একটা নেশার মত।’

‘সন্দেহ নেই, আপনি লোকটার ওপর প্রচুর রিসার্চ করেছেন।’

‘জ্বী, স্যার।’

‘তাহলে বলুন, রানাকে নিয়ে অসুবিধে কি?

গম্ভীর হলো রিচার্ডসন। ‘নীতির প্রশ্নে আপোষ করতে জানে না লোকটা। বড় বেশি স্বাধীনচেতা। যদি টের পায় তাকে দিয়ে কোন অন্যায় কাজ করিয়ে নেয়া হয়েছে, প্রতিশোধ নিতে ছাড়বে না।’

‘আপনি আমাকে ভয় পাইয়ে দিচ্ছেন,’ বলল কর্নেল। রানা এমন একটা চরিত্র, যার সম্পর্কে কোন ভবিষ্যদ্বাণী করা সম্ভব নয়। অথচ এই কাজের জন্যে সে-ই একমাত্র উপযুক্ত লোক। ‘কাজটা যাকে দিয়েই করাই, তাকে সব কথা বলা সম্ভব নয়। অন্ধকারে থেকে কাজ করতে রানা কি রাজি হবে?’

‘না।

‘সব কথা বলতে হবে ওকে?’

‘সব কথা, স্যার।

ধ্যানমগ্ন হয়ে পড়ল কর্নেল উইলিয়াম অবসন। সিদ্ধান্তে আসার চেষ্টা করছে। সে-ও জানে, রানা পারবে। কিন্তু ও যদি নিষিদ্ধ এলাকায় নাক গলাতে চেষ্টা করে? ভাবল, চিন্তা কি, তারও তো ওষুধ আছে। ‘জানেন সে এখন কোথায়?’

‘জ্বী, স্যার। ব্রাসেলসে। রিচার্ডসনের হৃদস্পন্দন একটু দ্রুত হলো। কালো লেদার ব্যাগটা খুলল সে। ‘এই নিন, স্যার,’ বলল সে। ‘রানার সম্পূর্ণ ডোশিয়ে।’

অবসন কিছু বলল না। রিচার্ডসনের হাতে ধরা ডকুমেন্টের দিকে শ্যেন দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল। ব্যাপারটা রিচার্ডসন লক্ষ করল না।

‘আপনার জন্য আরও একটা জিনিস নিয়ে এসেছি, স্যার,’ বলল সে, আবার ব্যাগের ভেতর হাত ভরে দিল। ‘যে প্ল্যানটা নিয়ে আলোচনা করছি, তার বিশদ রূপরেখা তৈরি করেছি আমি। সম্ভাব্য কয়েকটা জায়গার নাম দেয়া আছে, যে-সব জায়গায় সূত্র রেখে আসতে পারব আমরা। ক্লাইমেক্সের ধরন আর দোষ চাপাবার কায়দা কি রকম হবে তাও আমি ব্যাখ্যা করেছি।’ খানিক ইতস্তত করল রিচার্ডসন, তারপর আবার বলল, ‘আপনি আমাকে সব কথা খুলে বলেননি। শূন্য স্থানগুলো নিজেকেই আমার পূরণ করে নিতে হয়েছে-বলতে পারেন, অভিজ্ঞতার আলোকে আন্দাজ করে নিয়েছি। তবে আপনি যদি পড়েন এটা, আমার ধারণা, স্যার, প্রচুর মালমশলা দেখতে পাবেন।’

এবার আর হতাশা গোপন রাখার চেষ্টা করল না কর্নেল। স্তম্ভিত চেহারায় নগ্ন ক্রোধ ফুটে উঠল। ‘আহাম্মকের মত সব আপনি কাগজে লিখে ফেলেছেন!’

গালি খেয়েও হাসল রিচার্ডসন। ‘কোন ভয় নেই, স্যার। রাতের বেলা কাজ করেছি আমি, কোথাও কেউ ছিল না। সমস্ত কাগজ ছিঁড়ে পুড়িয়ে ফেলেছি-সমস্ত। থাকার মধ্যে আছে শুধু এই কাগজ কটা।’

রিচার্ডসনের হাতের কাগজগুলোর দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকাল কর্নেল। দ্রুত চিন্তা করছে সে। ছিঁড়ে পুড়িয়ে ফেলা কাগজে কি লেখা ছিল কেউ তা জানতে পারবে না। কিন্তু টাইপরাইটারের ক্যারিজে অক্ষরের ছাপ রয়ে গেছে। অবশ্য বুড়োর অফিস আর শোবার ঘরে ভাল করে তল্লাশি চালাবার প্রচুর সময় পাওয়া যাবে। না, অফিসে বা বাড়িতে দু’একটা প্রমাণ যদি থেকেও থাকে, সেগুলো মুছে ফেলা কোন সমস্যা নয়। কাগজগুলোর দিকে চোখ রেখেই জিজ্ঞেস করল সে, ‘আর কোন কফি?’

‘মাত্র দুটো। একটা আপনার জন্যে, আরেকটা আমার জন্যে। দুটোই রয়েছে এখানে।’

স্বস্তির হাসি ফুটল কর্নেলের চেহারায়। ‘চমৎকার, রিচার্ডসন। আমি খুশি। দিন দেখি কি করেছেন আপনি।’

রিপোর্টটা নিয়ে পড়তে শুরু করল কর্নেল। নদীর তীর ঘেঁষে এগোল ওরা, তারপর একটা কাঠের বেঞ্চে বসল। কর্নেলের পাশেই বসল রিচার্ডসন। মাঝে মধ্যে ঘাড় ফিরিয়ে পিছনে, দুর্গের দিকে তাকাল সে। না, দেখা যায় না। দুর্গটা নদীর উঁচু পাড়ে সম্পূর্ণ ঢাকা পড়ে আছে। নদীর বাঁকের কাছে রাস্তার ওপর কাফেটা দেখা যায়, কিন্তু অনেক দূরে। নদীর ওপারে ঘরগুলো ঢাকা পড়েছে গাছপালার আড়ালে। গরমের দিন, আকাশে মেঘ নেই, সদ্য ওঠা সূর্য এখনও তেতে ওঠেনি। পকেটে হাত ভরল রিচার্ডসন, তারপর ইতস্তত করতে লাগল। কর্তাব্যক্তির সামনে কি সিগারেট খাওয়া উচিত হবে?

সিগারেট নয়, গোলাপ কুঁড়ি জোড়া বের করল সে। দাঁত দিয়ে একটা পাপড়ি কাটল।

আড়চোখে ব্যাপারটা লক্ষ করল কর্নেল অবসন, কিন্তু মনোযোগ পড়ার দিকে। শেষ পাতাটা পড়া হতে মুখ তুলল সে, কিন্তু রিচার্ডসনের দিকে নয়।

নদী ছুটে চলেছে। স্রোত তেমন বেশি নয়, কিন্তু ঢেউ আছে। তীরের কাছাকাছি পানি থেকে উঁকি দিচ্ছে অসংখ্য পাথর। ঢেউগুলো তেড়ে এসে সেগুলোর ওপর সশব্দে ভাঙছে। সাদা ফেনায় ফুলে আছে পানির গা। নদীর দিকে তাকিয়ে আছে বটে, কিন্তু রিচার্ডসন আর নিজের প্ল্যানের কথা ভাবছে সে।

রিচার্ডসনকে বেছে নিয়ে ভুল করেনি সে। লোকটা বিশ্বস্ত এবং কঠোর পরিশ্রমী। সবচেয়ে বড় কথা, সন্দেহ প্রবণ নয়। সব অর্থেই, নির্ভেজাল কেরানী-যা করতে বলা হয় তা করতে পারে, কিন্তু কন্ধনাশক্তি খাটাতে উৎসাহী নয়। থাকলে তো! এই ব্যাপারটার সাথে তার সম্পর্ক আছে, এরকম ভাবার কোন কারণ নেই কারও। কিন্তু কর্নেল তাকে খুব ছোট করে দেখেছিল, সেজন্যেই অনেক বেশি তথ্য যোগান দিয়েছিল সে। ব্যাপারটা হুমকি হয়ে দেখা দিতে পারে, কারণ সবটুকু না হলেও গোটা ব্যাপারটার অনেকটাই আন্দাজ করে নিয়েছে রিচার্ডসন-ঘটনা ঘটতে শুরু করলে বাকিটুকু, মূল রহস্য, জেনে ফেলবে সে। অথচ এই প্ল্যানের কথা বড়জোর দু’জন জানতে পারে, তিনজনের জানা চলে না।

তবে, হ্যাঁ-প্ল্যানটা চমৎকার।

কর্নেল রিচার্ডসনের দিকে তাকাল। ‘এর মধ্যে সবই আছে।

‘বললাম না!’

‘আপনি ঠিক জানেন, আর কোন কপি নেই? ভুল করে কিছু ফেলে রাখেননি ডেস্কে? কিংবা ওয়েস্টপেপার বাস্কেটে কিছু রয়ে যায়নি?’

‘স্যার, আমাকে দেখে কি মনে হয় আপনার-গর্দভ? বত্রিশ বছর কাজ করছি, কোন্ কাজের কি গুরুত্ব আমি বুঝি না?’

‘তা ঠিক,’ বলল কর্নেল। পকেট থেকে একটা ঝর্ণা কলম বের করল সে। অলসভঙ্গিতে ক্যাপ খুলল। রিচার্ডসনের দিকে তাক করল সেটা। সূর্যের কিনারা থেকে গোত্তা দিয়ে নেমে এল একটা সোনালি ডানার চিল, নদীর কাছাকাছি নেমে এসে ডানা ঝাপটাতে শুরু করল। মনে হলো গাছগুলোর মগডালে বসবে। কিন্তু না, গাছের মাথা ছাড়িয়ে উড়ে গেল সেটা, হারিয়ে গেল চোখের আড়ালে। এই সোনালি ডানার চিলটাকেই শেষ দেখা দেখল রিচার্ডসন। তীক্ষ্ণ, সংক্ষিপ্ত একটা চিৎকার বেরিয়ে এল তার গলা থেকে, নদীর ছলছল কলকল আওয়াজে চাপা পড়ে গেল সেটা। ঝাঁকি খেয়ে হাত দুটো উঠে এল মুখে, কিন্তু ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে।

দ্রুত হাতে লাশের পকেটগুলো সার্চ করল কর্নেল। নদীর পাশে ঝোপ গজিয়েছে, তার আড়ালে টেনে নিয়ে গেল লাশটা। আজ কোন এক সময় কেউ যখন লাশটা দেখতে পাবে, বিষের সমস্ত চিহ্ন গায়েব হয়ে যাবে ততক্ষণে। সবাই জানবে, ছুটি কাটাতে এসে সরকারি কেরানী ভদ্রলোক হার্ট অ্যাটাকে মারা গেছেন।

রিচার্ডসনের রিপোর্টটা কালো লেদার ব্যাগে ভরে নিল কর্নেল উইলিয়াম অবসন। তারপর ঝোপ-ঝাড় পেরিয়ে নদীর কিনারা ঘেঁষে খানিকদূর হেঁটে জঙ্গলে ঢুকে পড়ল। পিছনে পড়ে থাকল সেলোফেনের খোলা মোড়কটা, আর একজোড়া গোলাপ কুঁড়ি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *