অপহরণ-১.১৪

চোদ্দো

অস্ট্রিয়ান সীমান্তে পৌঁছুল ওরা।

নীল ফোক্সওয়াগেনকে অন্যান্য গাড়ির সাথে এক লাইনে দাঁড় করাল জিনা। সীমান্ত পেরিয়ে ইটালিতে যাবে গাড়িগুলো।

টিমোথি উইলিয়ামসের মার্কিন পাসপোর্ট কাগজ-পত্রের সাথে গ্লাভ কমপার্টমেন্টে রয়েছে। পাকাপোক্ত ভাবে তৈরি করা হয়েছে কাহিনী, নিশ্ছিদ্র। এখন সেটাকে কাজে লাগাবার সময়।

‘ওঠো,’ জরুরী সুরে তাগাদা দিল জিনা। ‘বর্ডারে পৌঁছে গেছি আমরা।’

তার পাশে বসা লোকটা নড়েচড়ে সিধে হলো, চোখ রগড়ে সামনে তাকাল। প্রায় ঊনত্রিশ বছর বয়স তার, তাজা আমেরিকান অবয়ব, গরম-কোট পরে আছে। ছুটিতে সপরিবারে ইউরোপে বেড়াতে এসেছে।

চোখ মেলেই সতর্ক হয়ে গেল সে। ঘাড় ফিরিয়ে ব্যাক সীটে তাকাল, টনি উইলিয়ামস নড়াচড়া করছে না। বেচারা অসুস্থ। চিকেন পক্স। এত থাকতে এই সময়!

একজন কাস্টমস ইন্সপেক্টরকে এগিয়ে আসতে দেখে স্ত্রীর উদ্দেশে মাথা ঝাঁকাল টিমোথি।

‘আপনাদের পাসপোর্ট।

মিষ্টি করে হাসল জিনা, জানালা দিয়ে গলিয়ে পাসপোর্টগুলো ধরিয়ে দিল ইন্সপেক্টরের হাতে।

একটা পাসপোর্টে চোখ বুলাল ইন্সপেক্টর, তারপর ঝট্ করে জিনার দিকে তাকাল। নিচু হলো লোকটা, পাশে বসা টিমোথি কে দেখল। সবশেষে নজর ফেলল ব্যাক সীটে।

এবার বাকি দুটো পাসপোর্টে চোখ বুলাল ইন্সপেক্টর। ‘ইটালি ভিজিট করার উদ্দেশ্য, ম্যাডাম জিনা?’

ইন্সপেক্টরের চোখে নগ্ন সন্দেহ দেখতে পেল জিনা। এবং হঠাৎ করে মাথার ভেতরটা একেবারে ফাঁকা হয়ে গেল তার। চেষ্টা করল, কিন্তু মনে পড়ল না কিছু-সব ভুলে গেছে। রানার সাথে প্রশ্ন আর উত্তরের রিহার্সেল দিয়েছে, কিন্তু কিছুই স্মরণ করতে পারল না। কোথায় যাচ্ছে জানে না। কেন যাচ্ছে তাও মনে নেই।

ভাগ্যই বলতে হবে, ঠিক এই সময় একটা পিক-আপ ট্রাক দ্বিতীয় লাইনে এসে দাঁড়াল, ঘোঁৎ ঘোঁৎ আওয়াজ শুনে বিরক্তির সাথে সেদিকে তাকাল ইন্সপেক্টর।

শুধু আওয়াজ নয়, সেই সাথে উৎকট দুর্গন্ধও।

ট্রাক ভর্তি এক পাল শুয়োর।

বড় করে শ্বাস টেনে সীটের গায়ে হেলান দিল জিনা।

কটু একটা মন্ধ্য করে ঘাড় ফেরাল ইন্সপেক্টর, পাসপোর্টগুলো আবার একবার পরীক্ষা করল। ‘হ্যাঁ, ম্যাডাম জিনা, ইটালি ভিজিটের উদ্দেশ্য কি আপনাদের?’

‘বেড়ানো,’ শাল্ভাবে উত্তর দিতে পারল জিনা, মুখ টিপে একটু হাসলও। ‘ছুটি কিনা, তাই বেরিয়ে পড়েছি। দক্ষিণে গাড়ি ছোটাব-ফ্লোরেন্স দেখব, রোম দেখব…।’

পিক-আপ ট্রাককে ঘিরে হৈ-চৈ শুরু হয়েছে। কাস্টমস অফিসাররা সবাই খুব বিরক্ত। দুর্গন্ধ কার সহ্য হয়! ভ্যাকসিনেশন সার্টিফিকেট কই? কোয়ারানটাইন পেপারস?

থোঃ করে এক দলা থুথু ফেলল ইন্সপেক্টর। ‘আর গাড়িটা?’ জানতে চাইল সে। ‘আপনাদের?’

‘ভিয়েনা থেকে ভাড়া করেছি।’

‘কাগজগুলো দেখান।’

ট্রাকের ড্রাইভার ক্যাব থেকে নামল। লোকটা ইটালিয়ান কৃষক, প্রৌঢ়। নোংরা ক্যাপের ভেতর থেকে ততোধিক নোংরা কাঁচাপাকা চুল বেরিয়ে আছে। পরনের কাপড়ে চিমটি দিলে নখে ময়লা ঢুকবে। ট্রাকের পিছনে চলে গেল সে, খপ্ করে একটা শূকরছানাকে ধরল। তিনজন কাস্টমস অফিসার ছেঁকে ধরেছে তাকে। ছানার পায়ে একটা মেটাল ট্যাগ রয়েছে, অফিসারদের দেখাল সেটা।

কিন্তু ঘোঁৎ ঘোঁৎ আওয়াজ আর তর্ক বিতর্ক চলতেই থাকল। উইলিয়ামসদের পাসপোর্ট হাতে ইন্সপেক্টর এবার রেগে গেল। ধমকের সুরে জিজ্ঞেস করল সে, ‘এত দেরি হচ্ছে কেন?’

একজন সাব-ইন্সপেক্টর দ্রুত কথা বলতে শুরু করল।

তাকে থামিয়ে দিয়ে ইন্সপেক্টর জানতে চাইল, ‘কাগজ-পত্র সব ঠিক আছে?’

‘জ্বী, স্যার।’

‘ট্যাগ লাগানো আছে?’

‘জ্বী।’

‘তাহলে বিদায় করো। জলদি!’

সাব-ইন্সপেক্টর ড্রাইভারকে লক্ষ্য করে হাত ঝাপটাল। কাঁধ ঝাঁকাল প্রৌঢ় কৃষক, গজর গজর করতে করতে উঠে পড়ল ক্যাবে। জিনার দিকে ফিরল ইন্সপেক্টর। ‘প্লীজ, আপনার গাড়ির কাগজ।’

গ্লাভ কমপার্টমেণ্ট থেকে কার রেন্টাল ফর্ম বের করে বাড়িয়ে দিল জিনা। ‘বোধহয় ঠিকঠাকই আছে সব,’ বলে আবার মিষ্টি করে হাসল সে।

কিন্তু ইন্সপেক্টরের মেজাজ ভাল নেই। ‘দেখা যাক।’ খুঁটিয়ে কাগজগুলো দেখছে সে, তার পিছন থেকে চলে গেল পিক-আপ ট্রাক। হঠাৎ করে চারদিক বড় বেশি নিস্তব্ধ হয়ে গেল। আবার ঝুঁকল ইন্সপেক্টর, গাড়ির ভেতরটা ভাল করে দেখছে। এবার ঘুমন্ত বাচ্চাটার ওপর অনেকক্ষণ স্থির হয়ে থাকল দৃষ্টি।

টি-শার্ট আর জিনস পরে আছে বাচ্চা। আমেরিকান টেনিস জুতো। মুখে লাল লাল দাগ।

‘আপনার ছেলের মুখে ওগুলো কি, ম্যাডাম জিনা?’

‘চিকেন পক্স।’

‘চিকেন পক্স?’ গলার আওয়াজেই বোঝা গেল, ইন্সপেক্টর বিশ্বাস করেনি। গাড়ির ওপাশের দরজা খুলে ফেলল সে। কাছ থেকে ভাল করে দেখল। তারপর আলতো করে হাত বুলাল টনি উইলিয়ামসের মুখে।

হঠাৎ সিধে হলো ইন্সপেক্টর। থমথম করছে চেহারা। ‘দুঃখিত, ম্যাডাম। আপনাদের আমার সাথে আসতে হবে।’

চট্ করে একবার কাস্টমস বিল্ডিঙের দিকে তাকাল জিনা। তারপর ইন্সপেক্টরের কঠিন চোখে চোখ রাখল। ‘কেন, কোথাও গোলমাল আছে?’

‘এগুলো চিকেন পক্স নয়। আসুন আমার সাথে। আপনিও, স্যার। প্লীজ, বাচ্চাটাকেও সাথে নিন।’

.

রিসিভার আরও শক্ত করে চেপে ধরায় জেফ রিকার্ডের মুঠো সাদা হয়ে গেল। ‘কি বলছ, অ্যারো মারা গেছে!

‘ইয়েস স্যার, অ্যারো ইজ ডেড,’ আবার বলল পিকেরিং। ‘কেউ যেন প্ল্যানটাই করেছিল এভাবে, প্রকাশ্যে বের করে আনিয়ে খুন করবে অ্যারোকে।

‘কিন্তু কে? রাশিয়ানরা তাকে মারবে না। তার আগে তারা জানার চেষ্টা করবে কি কি তথ্য ওর কাছ থেকে পেয়েছি আমরা।’

‘তাছাড়া, এভাবে প্রকাশ্যেও ওরা তাকে মারবে না।’

‘তাহলে কে? অ্যারোর মৃত্যু আর কে চাইতে পারে?’

উত্তরটা সহজ। কেউ না।

রাগে, ক্ষোভে ডেস্কের ওপর দুম করে একটা ঘুসি মেরে বসলেন সি.আই.এ. চীফ। এমনকি বিস্ফোরিত কাভার নিয়ে দেশে ফিরে এলেও অমূল্য একটা সম্পদ হতে পারত অ্যারো। কিন্তু এখন সে লাশ, সি. আই. এ-র ডেপুটি ডিরেক্টর আর এক ডজন ক্র্যাক এজেন্টের চোখের সামনে খুন করা হয়েছে তাকে অজ্ঞাত কারণে। অ্যারো মারা গেল, কিন্তু তারা কি প্রেসিডেন্টের মেয়ে সম্পর্কে কিছু জানতে পারল?

না।

বড় করে নিঃশ্বাস ফেললেন রিকার্ড। ‘তুমি ঠিক জানো মারা যাবার আগে কেউ তার সাথে যোগাযোগ করেনি?’

‘জানি, করেনি,’ বলল পিকেরিং। ‘পুরোটা সময় ওখানে আমি নিজে ছিলাম। ওয়েটার ছাড়া কেউ তার কাছাকাছি যায়নি।’

‘ওয়েটার! ফর গডস সেক, হেনরি, বিষ যদি ভদকাতেই ছিল…’

‘জানি,’ কথার মাঝখানে শুকনো গলায় বলল পিকেরিং। ‘ওয়েটার গায়েব। পালিয়েছে।’

হিস হিস করে উঠলেন রিকার্ড। ‘ঠিক ভিয়েনায় যা ঘটেছে। অস্ট্রিয়া পুলিস বা আমাদের এজেন্টরা হার্স-এর ড্রাইভারকে এখনও খুঁজে পায়নি।’

‘একেও পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না। নামটা পর্যন্ত জানা যায়নি, স্যার।’

‘কেন, গোল্ডেন বারের লোকেরা চেনে না?’

‘কিভাবে! কিচেনে ঢুকে বলল, আজ অমুকের ডিউটি, কিন্তু সে অসুস্থ, তার বদলে আমি কাজ করব—সেই আমাকে পাঠিয়েছে।’

‘অমুকটি কোথায়? সে-ও কি…?’

‘জ্বী, স্যার। তারও কোন খবর পাওয়া যাচ্ছে না।’

‘খবর হয়তো পাওয়া যাবে,’ রিকার্ড গম্ভীর সুরে বললেন। ‘কিন্তু মরা মানুষ কথা বলে না।’

‘জ্বী, স্যার।’

‘শোনো, হেনরি, দরকার হলে গোটা আর্মি ব্যবহার করো। ওয়েটার লোকটাকে চাই আমি। আর, জার্মানদের সাথে সারাক্ষণ যোগাযোগ রাখো। কিডন্যাপাররা যদি বার্লিনে থাকে, ওদের সাথে টিউলিপও থাকতে পারে। আমরা যতই সতর্ক থাকি, ওরা সীমান্ত পেরোতে পারেনি এ-কথা জোর দিয়ে বলা যায় না। আমি বলতে চাইছি, একই ঘটনা আবার যেন না ঘটে।’

.

‘না, আসলে চিকেন পক্স নয়,’ বলল জিনা। নার্ভাস হয়ে পড়েছে সে। উদ্বিগ্ন দৃষ্টিতে স্বামীর দিকে তাকাল, তারপর দু’জনের মাঝখানে দাঁড়িয়ে থাকা বাচ্চার দিকে। হঠাৎ ঘুম ভেঙে যাওয়ায় টনি উইলিয়ামস এখনও ঢুলছে।

একটা ভুরু উঁচু করল ইন্সপেক্টর। ‘চিকেন পক্স তাহলে নকলও হয়?’

‘বলতে পারেন ছেলেমানুষি কৌতুক,’ ব্যাখ্যা করল জিনা। টনি নিজেই ওগুলো নিজের মুখে এঁকেছে। পাকা রঙ, ধুলে যায় না। বিশ্বাস করুন, চেষ্টার কোন ত্রুটি রাখিনি আমরা…

‘কিন্তু আমি যখন জিজ্ঞেস করলাম, সত্যি কথা বলতে কি হয়েছিল?’

‘সুযোগ দিলেন কোথায়! আমি তো বলতেই যাচ্ছিলাম…’

‘ম্যাডাম জিনা,’ ইন্সপেক্টর চটে উঠে বলল, ‘এখানে আমাদের কৌতুক করার মত সময় নেই। আপনি জানেন, গোটা সীমাকে সতর্কাবস্থায় রাখা হয়েছে? পুলিস আপনার ছেলের বয়েসী নিখোঁজ একটা বাচ্চাকে খুঁজছে। আমাদের বলা হয়েছে, সন্দেহ হলে সাথে বাচ্চা আছে এমন যে-কোন লোককে গ্রেফতার করতে হবে। নকল চিকেন পক্স অবশ্যই একটা সন্দেহজনক ব্যাপার!

বিস্ময়ে, উদ্বেগে বিস্ফারিত হয়ে উঠল জিনার চোখ।

এতক্ষণে টিমোথি উইলিয়ামস ডেস্কের ওপর ঝুঁকে বলল, ‘ঠিক কি বলতে চাইছেন, ইন্সপেক্টর? নিজেদের বাচ্চা কিডন্যাপ করেছি আমরা?’

‘কি করেছেন না করেছেন তদন্ত্রে পর জানা যাবে, স্যার, ‘ ইন্সপেক্টর ঝাঁঝের সাথে বলল। ‘আমি শুধু বলতে চাইছি, আপনাদের আইডেনটিটি ভেরিফাই না হওয়া পর্যন্ত কোথাও যেতে পারবেন না।’

টিমোথি কয়েক সেকেণ্ড চুপ করে থাকল। তারপর সে বলল, ‘দেশে এ-ধরনের সমস্যায় পড়লে ফোন করার অধিকার থাকত আমাদের।

‘সে অধিকার এখানেও আপনার আছে।’

‘তাহলে সবচেয়ে কাছের আমেরিকান দূতাবাসের লাইন পাইয়ে দিন।’

.

অভ্যস্ত হয়ে গেছে রানা, শুয়োরগুলোর গায়ের গন্ধ তেমন আর নাকে লাগছে না। ইটালির ভেতর দিয়ে দক্ষিণ দিকে চলেছে ও, একটা চোখ রেখেছে রিয়ার ভিউ মিররে, অপেক্ষা করছে পিছনের রাস্তায় কখন দেখা যাবে জিনাকে।

ট্রাক ভর্তি শুয়োর নিয়ে এক ঘণ্টা হলো সীমান্ত পেরিয়েছে রানা, অথচ এখনও ফোক্সওয়াগেনের কোন দেখা নেই। গাড়ি মোটেও জোরে চালাচ্ছে না ও, এতক্ষণে ওকে ধরে ফেলা উচিত ছিল জিনার।

সন্দেহ নেই, সীমান্তে আটকানো হয়েছে ওদের।

আপন মনে হাসল রানা। ব্যাপারটা প্ল্যান মতই ঘটছে। জিনাকে নিয়ে ওর কোন দুশ্চিন্তা নেই, নিজেকে রক্ষা করতে পারবে সে। মার্কিন দূতাবাস ওদেরকে আইডেনটিফাই করবে। জিনার সাথের লোকটা আসলেও টিমোথি উইলিয়ামস্-সেণ্ট লুইস, মিশৌরির লোক। সি. আই.এ-তে চাকরি করে সে। বাচ্চাটা, টনি উইলিয়ামস, তারই সন্তান। অভিনয় যা শুধু খানিকটা জিনাকেই করতে হবে। রানার ধারণা, ভালই উতরে যাবে সে।

ট্রাকের গতি বাড়িয়ে দিল রানা। দেখতে ঝক্কড়মার্কা হলেও, ইঞ্জিনটা প্রায় নতুন, শক্তিশালী। এবার অন্ধ সময়ে অনেক দূর চলে যেতে পারবে ও।

ভেনিসের দক্ষিণে পৌঁছে হাইওয়ে ছেড়ে আঁকাবাঁকা মেটো পথে নামল ট্রাক, মাঠ আর খেতের মাঝখান দিয়ে ছুটে চলল। সামনে পাহাড় দেখা গেল, কাছেই একটা ঢালে খামারটা। খামারের সামনে সদ্য চষা জমি, বেড়া দিয়ে ঘেরা। স্বয়ংসম্পূর্ণ একটা খামার, কিন্তু নির্জন।

গাড়ি নিয়ে গোলায় ঢুকে মাথা থেকে ক্যাপ আর পরচুলা খুলে ফেলল রানা। মুখে লাগানো পাতলা রাবারের আবরণ বয়সটা ত্রিশ বছর বাড়িয়ে দিয়েছে, টেনে টেনে সেগুলো খুলল ও। জোঁক স্বভাবের অ্যাডহেসিভ সরাতে খানিকটা তুলো আর এক বোতল অ্যালকোহলের সাহায্য নিতে হলো। আয়নায় নিজের দিকে তাকাল ও-আগের চেহারার অন্য এক সংস্করণ—ইটালিয়ান কৃষকই আছে ও, তবে যৌবন ফিরে পেয়েছে। পিঠ সিধে, স্যাম গ্রেসনের মত কালো চুল।

সীট থেকে নেমে লুকানো একটা বোতামে চাপ দিল রানা। কফিন যেভাবে উন্মুক্ত হয়, খুলে গেল সীট।

ভেতরে লক্ষ্মী মেয়ের মত ঘুমাচ্ছে টিউলিপ। মাথার চুল কোঁকড়ানো নয়, ছোট ছোট কুণ্ডলী পাকানো। কুণ্ডলে ঢাকা পড়েনি কান আর কপাল। প্রেসিডেন্টের মেয়েকে এখন ছেলের মত দেখাচ্ছে। পরনে রানার মতই চাষার পোশাক, মাথায় কালো চুল।

আপন মনে মাথা ঝাঁকাল রানা। টিউলিপকে যারা দেখেছে তাদের বোকা বানানো যাবে না। তবে ওকে যদি ট্রাক থেকে বের করতে হত, অচেনা কেউ দেখে টের পেত না আসলে ও ছেলে নয়, মেয়ে।

টিউলিপের শ্বাস-প্রশ্বাস আর পালস চেক করল রানা, তারপর বন্ধ করে দিল সীটের ঢাকনি। পনেরো মিনিট পর ট্রাক নিয়ে বেরিয়ে এল গোলা থেকে। ট্রাকে নতুন লাইসেন্স প্লেট। পকেটে নতুন কাগজ-পত্র। এবার আর শুয়োরগুলো সঙ্গী হলো না। ওরা এখন মুক্ত স্বাধীন।

.

বার্লিনে যা ঘটেছে, প্রেসিডেন্টকে তার ব্যাখ্যা দিচ্ছেন জেফ রিকার্ড। শুনতে শুনতে ক্রমশ ঠাণ্ডা হয়ে এল প্রেসিডেন্টের চোখ। ডেস্কের পিছনে চেয়ারে বসে আছেন তিনি, কোন নড়াচড়া নেই। উঁচু হয়ে আছে কাঁধ জোড়া, চোয়াল শক্ত, ঠোঁট দুটো পরস্পরের সাথে চেপে আছে। সি.আই.এ. চীফ, থামলেন। চেয়ার ছেড়ে পায়চারি শুরু করলেন প্রেসিডেন্ট। ‘ড্যাম ইট!’ এক সময় বিস্ফোরিত হলেন তিনি। ‘এ তুমি কি ধরনের অপারেশন চালাচ্ছ? আমার মেয়ে আজ ছ’দিন নিখোঁজ! এই অফিসের সমস্ত ক্ষমতা তোমার হাতে তুলে দেয়া হয়েছে, বিনিময়ে কি করতে পেরেছ? কিছুই না!’ দ্রুত আধ পাক ঘুরলেন তিনি। ‘অথচ তোমার এক পাল লোকের সামনে টপ-সিক্রেট, ডীপ-কাভার একজন এজেন্ট খুন হয়ে গেল!’ হাত দুটো মুঠো করে ঝাঁকালেন তিনি, ক্রোধ সংবরণ করার চেষ্টা করলেন। ‘মাই গড! গুড-ফর নাথিং-এর দল ঘিরে আছে আমাকে! সবাই সব কিছু লেজে-গোবরে করে ছাড়ছে। প্রথমে সিক্রেট সার্ভিস, তারপর তুমি। তুমি, জেফ, এত থাকতে তুমি! ভেবেছিলাম অন্তত তোমার ওপর আমি বিশ্বাস রাখতে পারি!’

চোখের পাতা না ফেলে তাকিয়ে থাকলেন রিকার্ড। ‘তুমি জানো আমার ওপর বিশ্বাস রাখা যায়।

প্রেসিডেন্ট দাঁড়িয়ে থাকলেন, চোখে আগুন ঝরছে। তারপর, ধীরে ধীরে, নরম হলো তাঁর দৃষ্টি, ঝুলে পড়ল চিবুক, ক্লান্ত ভঙ্গিতে শরীরের দু’পাশে নেমে গেল হাত জোড়া। ডেস্কের পিছনে গিয়ে ধপাস করে চেয়ারে বসে পড়লেন। ‘কি চায় ওরা বলে না কেন! অ্যারো? বেশ তো, তাকে ওরা বাগে পেয়ে সরিয়ে দিয়েছে।

এদিক ওদিক মাথা নাড়লেন সি.আই.এ. চীফ। ‘উঁহু, অ্যারো মোটিভ হতে পারে না।’

‘নয় কেন? তুমি বলেছ অ্যারো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, ভাইটাল…’

‘বলেছি। কথাও সত্যি। অ্যারোর আসল পরিচয় জানার জন্যে অনেক বড় ঝুঁকি নিতে পারে রাশিয়ানরা-এমনকি টিউলিপকে কিডন্যাপ করার ঝুঁকিও। কিন্তু রাশিয়ানরা হলে গোল্ডেন বারে ওরা শুধু অ্যারোকে আইডেনটিফাই করত। অ্যারোকে তারা বার থেকে বেরোতে দিত, ঘরে ফিরতে দিত। তারপর গভীর রাতে ঘুম থেকে তুলে দযেরঝিনস্কি স্ট্রীটে, কে.জি.বি. হেডকোয়ার্টারে নিয়ে যেত-তাকে আর সেখান থেকে ইহজন্মে বেরুতে হত না। না, রিচার্ড, কাজটা রাশিয়ানদের নয়। কিন্তু আমি বুঝতে পারছি না, অ্যারোর মৃত্যু আর কারা চাইতে পারে। আরও একটা জিনিস আমার মাথায় ঢুকছে না। অ্যারোকে সরাতে চাইলে আরও হাজারটা উপায় ছিল, তবু এ-ধরনের জমকালো আয়োজনের দরকার পড়ল কেন? এ-সবের কোন অর্থই আমি খুঁজে পাচ্ছি না।’

প্রেসিডেন্টের ডেস্কে মৃদু শব্দে বেল বেজে উঠল। প্রেসিডেন্ট সামনের দিকে ঝুঁকলেন। ‘ইয়েস?’

‘সিক্রেট সার্ভিস ডিরেক্টর আপনার সাথে দেখা করতে এসেছেন, মি. প্রেসিডেণ্ট।’

তিনি মুখ তুললেন, জেফ রিকার্ডের সাথে দৃষ্টি বিনিময় হলো। ‘পাঠাও।’

নিজের পিছনে দরজা বন্ধ করলেন কীথ বিউমণ্ট, এক মুহূর্ত স্থির ভাবে দাঁড়িয়ে থাকলেন। তাঁর কাঁধ দুটো ক্লান্তিতে ঝুলে পড়েছে। ওখানে অসহায় ভাবে দাঁড়িয়ে তিনি যেন দম ফিরে পাবার চেষ্টা করছেন। তাঁর চোখে নগ্ন হয়ে ফুটে আছে পরাজয়ের গ্লানি। হাতে করে একটা বাক্স নিয়ে এসেছেন তিনি। ‘আজকের ডাকে এসেছে এটা,’ ধীর পায়ে এগিয়ে এসে বললেন। ‘জোহান্সবার্গ, দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে।’ আস্তে করে ডেস্কের ওপর রাখলেন বাক্সটা।

রিচার্ড কনওয়ে বাক্সের ঢাকনি খুললেন। এক জোড়া পা’জামা। ছোট্ট।

‘মিসেস কেনটারকি ওটা চিনতে পেরেছে,’ বললেন বিউমণ্ট। ‘কিডন্যাপড হওয়ার সময় ওটাই পরে ছিল টিউলিপ।’

মাথা নিচু করে আছেন প্রেসিডেণ্ট। বাক্সের ভেতর থেকে পা’জামা জোড়া বের করলেন, হাতে নিয়ে ভাল করে দেখছেন। তীক্ষ্ণ ব্যথার ছাপ ফুটে উঠল তাঁর চেহারায়।

ঝুঁকে, বাক্সের ভেতর থেকে এক টুকরো কাগজ বের করে আনলেন জেফ রিকার্ড। এক কোণ থেকে উঁকি দিচ্ছিল ওটা। কাগজের লেখাটা পড়ে আবার হেলান দিলেন চেয়ারে।

কাগজে এবার চারটে শব্দ টাইপ করা। ‘এগম্যান। ওল্ড সাউথ চার্চ।’

সেই একই ঘটনা আবার নতুন করে!

কাগজটার দিকে বিস্ফারিত দৃষ্টিতে চেয়ে রইলেন সি.আই.এ. চীফ।

(আগামী খণ্ডে সমাপ্য)

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *