অক্টোবর রেইন – ১

—‘আপনার তাহলে আমাকে একেবারেই পছন্দ নয়?’ প্রশ্নটা করে তানভীর তার শুকনো ঠোঁটজোড়া জিভ দিয়ে ভেজালো। 

—‘আপনি বুঝতে পারছেন না, আমার পছন্দ-অপছন্দ দিয়ে কিছুই এসে যায় না। আমার বাবা মা আপনাকে কখনোই পছন্দ করবেন না।’ 

—‘কেন বলুন তো? আমি খুব একটা সুপুরুষ নই, এ কারণে কি?’ 

—‘ছিঃ, কী যা তা বলছেন! আপনি তো বেশ লম্বা, ছেলেদের ওরকম হাইট কিন্তু বিয়ের বাজারে বিশাল বড় প্লাস পয়েন্ট। আর আমি নিজেই বা কি এমন অপ্সরী?’ 

এ কথায় তানভীর একটু কাঠ হাসলো, ‘নিজের প্রশংসা শুনতে চাইছেন?’ 

—‘কোন মেয়ে নিজের প্রশংসা শুনতে চায় না বলুন? তবে এই মুহূর্তে আমি প্রশংসা শুনতে চাইছি না। কারণ, আমি জানি প্রতিটি স্তুতিবাক্যে একটু করে ভেজাল মেশানো থাকে। ন্যাকামো থাকে। আমি কোনো ভেজাল চাই না। এ মুহূর্তে আমার খাঁটি কথা শুনতে ইচ্ছে করছে। সত্যি করে বলুন তো ঠিক কেন আপনি আমাকে বিয়ে করার জন্য অমন মরিয়া হয়ে উঠলেন?’ 

তানভীর একটি গভীর প্রলম্বিত নিশ্বাস নিলো। অন্যরকম গলায় বলল, ‘আমি জানি না সকাল, আপনার মাঝে কী দেখেছি, শুধু এটুকু বলবো সেদিন আপনাদের বাড়ির ছাদে শেষ বিকেলের আলোয় আপনাকে যখন নিবিড় মনে বিড়বিড় করতে দেখলাম। মনে হলো, যেন আপনার রূপ অপার্থিব, আপনি এই ধরার মানুষ নন, আপনার নিবাসস্থল এই জরাজীর্ণ পৃথিবী ছেড়ে দূরে, অনেক দূরে! তারপর একটা সময় আপনি যখন আকাশের দিকে চেয়ে হাসলেন, আপনার টোল পড়া হাসিটা আমার বুকের ভেতর এক অদ্ভুত ঢেউ তুললো! 

তানভীর আরো কিছু বলতে যাচ্ছিল, সকালের খিলখিল হাসির শব্দে থমকে গেলো ওর কথা। 

—‘হাসছেন কেন? সস্তা প্রেমের উপন্যাসের ডায়লগ বলে মনে হচ্ছে আমার কথাগুলো?’ 

—‘কিছুটা সস্তা মনে হচ্ছে বৈকি, কিন্তু আমি হাসছি অন্য কারণে। ‘ —‘কী কারণে?’ 

—‘হাসছি, কারণ আপনি তো আমার প্রেমে পড়েননি। সেদিন বিকেলে 

ছাদের ওপর আমি ছিলাম না তো, ছিলো হরিণডাঙ্গার রাজকন্যা!’

তানভীর ভ্যাবাচ্যাকা খাওয়া গলায় বলল, ‘কোন ডাঙ্গার রাজকন্যা?’ ‘হরিণডাঙ্গা!’ 

—‘মানে কী?’ 

সকাল হাসে, খিলখিল করে গা দুলিয়ে, বেণী দুলিয়ে হাসে। বলে, ‘মানে হলো, সেই বাসন্তী বিকেলে আপনি দেখেছেন হরিণডাঙ্গার রাজকন্যেকে। রাজকন্যার কিন্তু আগুনের ন্যায় রূপ! যে দেখে সে দেখিবার মাত্ৰ ভস্ম হইয়া যায় সেই রূপের আগুনে।’ 

—‘আপনি পাগল সকাল, আপনি একদম পাগল, কোনো রাজকন্যা টন্না নয়, আমি আপনাকেই দেখেছি।’ 

.

‘সকাল! এই সকাল! 

ভাবন ঘরের দরজায় হানা পড়তেই বোজা চোখদুটো আলতো করে মেললো সকাল। চাচি কৌতূহল নিয়ে চেয়ে আছেন তার মুখের দিকে। সে চোখ মেলে তাকাতেই বললেন, ‘কাঁদছ কেন? 

সকাল নড়ে চড়ে বসলো। টের পেলো বন্ধ চোখের কোল ছাপিয়ে জলের একটা ধারা নেমে গেছে গলা পর্যন্ত। চকিতে হাতের উল্টো পাশ দিয়ে মুছে নিলো সে অশ্রুধারা। ‘আমি ঠিক আছি চাচি’ বলে গাড়ির জানালা দিয়ে বাইরে তাকাতেই চোখ পড়ল কালো সাইনবোর্ডে সাদা রং দিয়ে বড় বড় অক্ষরে লেখা, ‘ওয়েলকাম টু ভার্জিনিয়া, ভার্জিনিয়া ইজ ফর লাভারস।’ 

শেষের বাক্যটা ঠোঁট নেড়ে উচ্চারণ করলো সকাল। 

‘ভার্জিনিয়া ইজ ফর লাভার্স! বাহ্! 

শুনে চাচি বললেন, ‘হ্যাঁ আমেরিকায় প্রতিটা স্টেটের একটা স্লোগান থাকে। যেমন নিউইয়র্কের আই লাভ নিউইয়র্ক, নিউজারসির লিবার্টি এন্ড প্রস্পারিটি। তোমার কেমন লাগছে সব?’ 

সকাল হা করে জানালার বাইরেটা গিলছিল। তখন গোধূলি। গ্রীষ্মের একটা বিশাল বড় দিনের দায়িত্ব শেষ করে ক্লান্ত সূর্য অস্তাচলে যাচ্ছে। গোটা আকাশ নানা রঙে সেজেছে। ধোঁয়া ধোঁয়া মেঘের গায়ে রূপালি, গোলাপী আর বেগুনী রঙের তুলির আঁচড়। পেলব, পবিত্র আলোয় ছাওয়া স্নিগ্ধ গগনের বুকের ওপর একটা দুটা সাদা দাগ। মনে হচ্ছে যেন কেউ একজন আঙ্গুল দিয়ে ইচ্ছে মতোন আঁকিবুকি করেছে। সকালের মনে হলো এতো বিস্তৃত পরিষ্কার আকাশ সে এর আগে কোনোদিন দেখেনি। চাচির শেষ প্রশ্নটি তার কর্ণকুহরে প্রবেশ করলো না। সে ভাবালু গলায় বলল, 

‘ওই দাগটা কিসের? আকাশের গায়ে?’ 

চাচি বললেন, ‘ওই জায়গাটা দিয়ে একটু আগে উড়োজাহাজ উড়ে গেছে। উড়ে যাওয়া জাহাজের ধোঁয়া ওগুলো।’ 

সকাল আনমনাভাবে বলল, ‘ও … তাই বলুন।’ 

গাড়ির সামনের সিট থেকে রহমান চাচা ঘাড় ঘুরিয়ে প্রশ্ন করলেন, ‘আমেরিকা কেমন লাগছে, সকাল?’ 

সকাল এ প্রশ্নের উত্তরে কী বলবে খুঁজে পেলো না। এয়ারপোর্ট থেকে বেরোনো মাত্র এই গাড়িতে যন্ত্রের মতো ঢুকে পড়ল। আমেরিকা দেখার সুযোগ পেলো কই? গাড়িতে উঠে একটু থিতু হয়ে বসতে না বসতেই দেশের কথা মনে পড়ল। দেশ ছেড়ে, বাবা মা’কে ছেড়ে এই প্রথম তার এতো দূর আসা। তার নিজের ছোট্ট সুন্দর দেশটা রয়ে গেছে পৃথিবীর অন্য গোলার্ধে। ভাবতেই কেমন গা ছমছম করে উঠল তার। বুকের মধ্যে ঘনিয়ে আসলো এক তীব্র ব্যথা। কান্নার একটা ডেলা এসে আটকে গেলো গলায়। চোখ বুজে মায়ের কথা ভাবার চেষ্টা করলো সে। কিন্তু চোখ বন্ধ করতেই মায়ের মুখের বদলে চোখের সামনে ভেসে উঠল তানভীরের মুখ। তারপর মনে পড়ল তানভীরের সাথে সেদিনকার কথোপকথন। মানুষের মন বড় আশ্চর্য বস্তু। নিজের দেশ ছেড়ে এই এতো দূর পাড়ি দেবার পর সব্বার প্রথমে কিনা তার এমন একজন মানুষের কথা মনে পড়ল যে মানুষটার জন্য তার মনের ভেতরে এক রত্তি স্থানও কোনো দিন ছিল না। এ কথা ঠিক তানভীর ভীষণভাবে প্রেমে পড়েছিল সকালের। মাঝে কিছুদিন সকালও চেষ্টা করেছিল তানভীরের প্রেমে পড়ার। কিন্তু চাইলেই কি হয়? তানভীরের সাক্ষাতে, গলার স্বরে কখনোই তার বুকের ভেতর ডঙ্কা বাজেনি। নিশ্বাস ভারি হয়নি। 

ইশশ …! সকাল বড্ড বেশি ভাবে। বড় বেশি আনমনা আর বেখেয়ালী একটা মেয়ে সে। চাচা প্রশ্ন করে তার মুখের দিকে উন্মুখ হয়ে চেয়ে আছেন উত্তরের আশায় আর সে কিনা আকাশ-পাতাল ভেবেই যাচ্ছে! 

—‘এইতো চাচা, ভালোই!’ শুকনো গলায় উত্তর দিলো সকাল। চোখ ঘোরালো। আটকে গেলো গাড়ির ব্যাক মিররে। চালকের চোখ দুটো গ্লাসের ভেতর দিয়ে বড় শান্তভাবে দেখছে তাকে। দুই জোড়া চোখ কয়েক সেকেন্ডের জন্যে আটকে গেলো একে অপরের সাথে। 

এই প্রথম হলো শুভদৃষ্টি। সকাল একটু নার্ভাস। চালককে বিচলিত দেখালো না। স্মার্ট ভঙ্গীতে চোখ সরিয়ে নিতে দেখা গেলো খানিক বাদে। 

নাহ, কই? ডঙ্কাটা বাজলোনা, বুক উদ্বেল হলো না। 

সকালের হবে না… এ জীবনে বোধহয় হবেই না। একটা দীর্ঘ নিশ্বাস বেরিয়ে গেলো বুক থেকে, অজান্তে। 

দূর পাহাড়ের মাথায় দাঁড়িয়ে আছে একটি সুউচ্চ প্রাসাদ। বন্য লতাগুল্মে ছাওয়া সেই প্রাসাদেই হরিণডাঙ্গার রাজকন্যার বাস। অশ্বারোহণ করে মৃগয়ায় যাচ্ছেন রাজা। মহারাজার সঙ্গী হিসেবে শেহজাদী সকালও আছেন। দলে দলে অশ্বারোহীরা খুরের শব্দ তুলে ধূলা উড়িয়ে নেমে আসছে পাহাড় থেকে। রাজকন্যা সকাল বসেছেন হাতির পিঠে। তাকে ঘিরে রেখেছে শত শত সৈন্য আর দাস দাসী। কদিন হলো তিনি তীর ছোঁড়ার দীক্ষা নেয়া শুরু করেছেন। আজই তার জীবনে প্রথম মৃগয়া গমন 

এমনই এক অদ্ভুত যুক্তিহীন অসমাপ্ত স্বপ্ন দেখে ঘুম থেকে জেগে উঠল সকাল। এসব স্বপ্ন অবশ্য সে প্রায়ই দেখে। দেখবেই বা না কেন? আর জন্মে সে যে ওই রাজপ্রাসাদের বাসিন্দা ছিল! সে ছিল হরিণডাঙ্গার রাজকন্যা। তাই হরিণডাঙ্গার স্মৃতি তার পিছু ছাড়ে না। লোকে বিশ্বাস করে না। বাবা মাও বিশ্বাস করে না। না করলেই বা কী? সকালের কিছু এসে যায় না। এই বাস্তব রুক্ষ এবড়োখেবড়ো জীবন ছেড়ে হঠাৎ হঠাৎ দূর দেশের রাজকন্যা হয়ে যেতে তার তো বেশ লাগে। 

চোখ মেলার সাথে সাথে মাথাটা ভীষণ ফাঁকা লাগলো তার। অন্ধকার ঘরের সিলিং এর দিকে তাকিয়ে অনেকক্ষণ বুঝতে পারল না সে কোথায় আছে। ধীরে ধীরে সব মনে পড়ল। একটু একটু করে শূন্য মস্তিষ্ক ভরে গেলো নানাবিধ ঘটনায় আর স্মৃতিতে। মনে পড়ল সে এখন অন্য এক পৃথিবীতে। পৃথিবীর ঠিক উল্টো পাশটায় সে তার বাবা, মা আর প্রিয় দেশটাকে ফেলে এসেছে। 

গায়ের ওপরের চাদরটা হাত দিয়ে পাশে ঠেলে রেখে উঠে বসলো সে। ঘরটা একদম ঘুটঘুটে অন্ধকার। কাল রাতে এই বাড়িতে পৌঁছনো মাত্র ক্লান্তিটা টের পেয়েছিল সে। হাত পা অসাড়, চোখজোড়া টেনে খুলে রাখা দায়। জীবনে এই প্রথম এতো দীর্ঘ যাত্রার অভিজ্ঞতা হলো তার। প্রায় তেইশ ঘণ্টার জার্নি। ঘণ্টার পর ঘণ্টা প্লেনের ভেতর চেয়ারের ওপর আঁটোসাঁটো হয়ে বসে থাকা। পা মেলে আরাম করে বসার পর্যন্ত উপায় নেই। তার ওপর এসির বাতাসে হাত পা জমে বরফ হিম হয়ে যাবার যোগাড়। একেকটা ঘণ্টাকে একেক যুগ বলে মনে হচ্ছিল। ছি! এমনি করে মানুষ কী করে আসা-যাওয়া করে পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত? বাড়ি পৌঁছনোর পর সকালকে দেখতে লাগছিল একদম পাগলের মতো। নিজের এই কুৎসিত দশার জন্যে ভারি লজ্জা হচ্ছিল তার। তবুও ওই ছেলেটা বড় বড় চোখ মেলে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছিল তাকে। যেন এক নজরেই সবটা পরখ করে নিতে চাইছে সে। বুঝতে চাইছে দেশ থেকে কেমনতরো চিড়িয়া ধরে নিয়ে এসেছে তার বাবা মা তার গলায় ঝোলানোর জন্যে। বাড়িতে ঢুকেই বিশাল বসার ঘর। সিলিং থেকে ঝুলছে বড়সড় ঝাড়বাতি। তিন সেট সোফা এঁটে গেছে অনায়াসে। পূব দিকের দেয়ালে একটি ইলেক্ট্রিক অগ্নিচুল্লি। এই অগ্নিচুল্লিতে আগুন দিতে হবে না। বৈদ্যুতিক তারের সংযোগে আপনা-আপনিই আগুন জ্বলবে। ড্রইং রুমের বাম পাশ ঘেঁষেই উঠে গেছে দোতলার সিঁড়ি। ক্লান্তিতে সকাল চোখে মুখে অন্ধকার দেখছিল। রহমান চাচির বুঝি দয়া হলো একটু সকালকে দেখে। তিনি বললেন, ‘সকাল মা, খুব টায়ার্ড দেখাচ্ছে তোমাকে, এসো তোমার ঘরটা দেখিয়ে দি।’ 

সকাল হাঁফ ছাড়লো। দোতলার একটা কোণার ঘরে তাকে নিয়ে আসা হলো। ছোট্ট একটা সাজানো-গোছানো ঘর। পাট করে বিছানা করা। ওই বিছানা দেখলেই সমস্ত দুনিয়া ছেড়েছুড়ে ছুটে যেতে ইচ্ছে হয়। তার ওপর সকালের ক্লান্তির শরীর। শরীর আছেও এখন অন্য টাইম জোনে। অর্থাৎ নিজের দেশে এখন সব ঘুমে কাদা। সকালের আর এক মিনিট দেরি সইলো না। চাচি চলে যেতেই বিছানায় গড়িয়ে পড়ল সে। 

মোবাইলের টর্চলাইট জ্বালালো সকাল। সেই আলোতে হাতড়ে হাতড়ে ওয়ালে খোঁজার চেষ্টা করতে লাগলো লাইটের সুইচ। কিছুতেই খুঁজে পেলো না। ঘরের একটা কোণে বিশাল বড় লম্বা ল্যাম্পশেড আছে। সেটা জ্বালানোর বৃথা চেষ্টা করলো। জ্বললো না। এ কেমন অন্ধকার গুহার মতো ঘরে নিয়ে আসা হলো তাকে? এখন কী হবে? এই মাঝ রাতে ওরা কেউ নিশ্চয়ই কেউ জেগে বসে নেই তার জন্যে। সকাল মোবাইলের আলো ফেলে বাথরুমের দরজাটা খোঁজার চেষ্টা করলো। পাওয়া গেলো এবং আরেকটু চেষ্টা করতে বাথরুমের বাতিও জ্বালানো গেলো। 

আয়নায় নিজের মুখটা দেখলো সকাল। অনেক অনেকক্ষণ বাদে। চোখের কোলে কাজল লেপ্টে ডাইনীর মতো দেখাচ্ছে। ঠোঁট দুটো শুকনো। চুল পাগলের মতো। নিজের চেহারাটা দেখে নিজেরই রাগ হয়ে গেলো। এমনিতে লোকে তাকে সুন্দরীই বলে। বাঙালি মেয়ে হিসেবে তার উচ্চতা ভালো। গায়ের রঙ ফর্সা। নাক খুব একটা তীক্ষ্ণ নয়। ঠোঁট জোড়া পুরন্ত। কেউ কেউ বলে তার চোখ দুটো নাকি ভারি টানা টানা, গভীর। তবে কম বেশি সকলেই তার হাসির প্রশংসা করে থাকে। তাই সকাল অন্তত এটুকু জানে যে হাসলে তাকে ভালো দেখায়। 

ঘটনার সূত্রপাত গত বছরের এপ্রিলে। পহেলা বৈশাখ। খুব সেজেগুঁজে ভার্সিটি গিয়েছিল সেদিন। বাড়ি ফিরে দেখলো অপরিচিত এক দম্পতি বসার ঘরে বসে আছেন। বাবা পরিচয় করিয়ে দিলেন, 

—‘মা, এই হচ্ছে তোমার রহমান চাচা। আমার বন্ধু, অনেক দিন পর দেশে ফিরলেন আমেরিকা থেকে।’ 

সকাল এই ভদ্রলোককে চেনে। ছেলেবেলায় প্রায় বিকেলেই ইনি তাদের বাড়িতে চলে আসতেন বাবার সাথে আড্ডা দিতে। তবে তাঁর স্ত্রীকে ছবির পাতায় ছাড়া সামনাসামনি কখনও দেখেনি সে। এই প্রথম। পারিবারিক এলবামে পুরনো অনেক ছবি আছে মহিলার। কিন্তু আজব ব্যাপার হলো ছবির চেহারার সাথে বাস্তবের চেহারার কোনো মিল নেই। এ যেন সম্পূর্ণ অন্য এক মানুষ। ছবিতে তাকে দেখতে লেগেছিল গ্রাম্য কিন্তু দুর্দান্ত সুন্দরী এক গৃহবধূ। এখন দেখে সেরকম আহামরি কোন সুন্দরী মনে হচ্ছে না। তবে ভীষণ ফ্যাশনেবল এবং স্মার্ট মনে হচ্ছে। আমেরিকার বাতাস লেগে গ্রামের মহিলা মেমসাহেব হয়ে গেছে। ভাবছিল সকাল। ওর ওই একটাই রোগ। বড্ড ভাবে! 

মহিলা একটি স্লিভলেস স্যালোয়ার কামিজ পরেছেন। ফর্সা মোটা সোটা হাত দুটো টিউবলাইটের আলোয় চকচক করছে। বব চুলগুলো ছাড়া ঘাড়ের ওপর। ফ্যানের বাতাসে ভুর ভুর করে উড়ে আসছে দামি বিদেশী পারফিউমের গন্ধ। প্রথম দেখায় মহিলার বয়স ঠাওর করা একটু মুশকিল। প্রথমে মনে হয় পঁয়তাল্লিশ। তারপর একটু ভালো করে তাকালে বোঝা যায় পঞ্চাশ পেরিয়েছে। তবে তাঁর হাসিটা মিষ্টি।

সকাল কিছু বলার আগেই মহিলা আচমকা বসা থেকে উঠে তার দিকে এগিয়ে আসলেন। হাতদুটো ধরে ভারি বিস্মিত গলায় বললেন, ‘ওমা! মেয়েতো ভারি সুন্দর দেখতে!’ 

সকাল একটু অপ্রস্তুত হাসলো। কী বলবে খুঁজে পেলো না। ভদ্রমহিলা সকালের চিবুকটা হাত দিয়ে তুলে ধরে বললেন, ‘কী সুন্দর চোখদুটি! বাব্বাহ! এমনটাইতো চেয়েছিলাম আমার ছেলের জন্যে। ভীষণ পছন্দ হয়েছে মা তোমাকে। তোমাকেই আমি ছেলের বউ করব!’ 

সকাল ভড়কালো। সেই ভড়কানিটা তার চোখের তারায় ভেসে উঠল। মনের ভাব কিছুতেই লুকোতে জানে না সে। চাচি টের পেয়ে বললেন, ‘ভয় পেয়ো না মা, ও আমার বড় ভালো ছেলে। মাথায় করে রাখবে তোমাকে।’ 

ততক্ষণে সকাল মোটামুটি নিশ্চিত যে এই মহিলার মাথা খারাপ। পাগলের প্রলাপ বকছে স্রেফ, অন্য কিছু না। কিন্তু মায়ের মুখের বিগলিত হাসিটা দেখে রাগে গা রি রি করে উঠল। যেন এই প্রস্তাব পেয়ে সে আনন্দে বিহ্বল হয়ে গেছে। মুখে ভাষা নেই কোনো। আছে শুধু গদগদ একখানা ভ্যাবলা ভাঁড়ের মতো হাসি। 

মহিলা বলেই চললেন, ‘তুমি ডাক্তার নও তো? তোমাকে দেখে কেন যেন ডাক্তার ডাক্তার লাগছে।’ 

সকাল বিরস গলায় উত্তর দিলো, ‘জি না আন্টি, আমি ডাক্তার নই।’

-‘ও তাহলে নিশ্চয়ই তুমি ইঞ্জিনিয়ার।’ 

সকাল ঠোঁট বাঁকালো ‘ওসব কিছুই না আমি। 

মহিলা একটু নিভলো। ভারি মন খারাপ করা একটা গলা বানিয়ে বলল, ‘ডাক্তারও নও, ইঞ্জিনিয়ারও নও? 

সকালের মনটা একটু অপমানে টন টন করে উঠল। কথা শুনে মনে হচ্ছে ডাক্তার নাহয় ইঞ্জিনিয়ার এই দুটোর একটা যেন না হলেই নয়। এ দুটি পেশা ছাড়া যেন দুনিয়াতে আর কোনও মানসম্মত পেশা নেই। 

বাবা এতক্ষণে কথা বললেন, ‘আমার মেয়ে ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার না হলেও কিন্তু ছাত্রী ভালো। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইবিএ থেকে পাস করলো।’ 

রহমান চাচা বললেন, ‘বাঃ, বেশ ভালো বেশ ভালো।’ এরপর নিজের স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘কী শুরু করলে তুমি মেয়েটা মাত্র ঘরে ফিরলো। একটু জিরোতে তো দাও! 

সকাল কোনো রকমে পালিয়ে বাঁচলো জায়গাটা থেকে। 

ওরা চলে গেলে মা বললেন, ‘কী ভীষণ ভালো মানুষ দেখেছিস এরা?’

সকাল মুখ গোঁজ করে রইল। কোনো উত্তর দিলো না। 

—‘কী কথা বলছিস না কেন? প্রস্তাবটা কেমন?’ 

এবার ফেটে পড়ল সকাল, ‘তোমাদের কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে? ওই পাগল মহিলার বাড়ির ছেলের বউ হবো আমি? তোমাদের কি বিবেক বলতে কিছু নেই?’ 

বাবা বললেন, ‘নারে মা, ওরা কিন্তু খুব ভালো মানুষ। আমার কাছে কিন্তু প্রস্তাবটা বেশ ভালো বলে মনে হচ্ছে। 

—‘কিন্তু এর ছেলেকে তো আমি কোনোদিন দেখিনি। চিনি না জানি না হুট করে বললেই কি বিয়ে করা যায়?’ 

—‘তোর যদি নিজের কোনো পছন্দ না থাকে তাহলে তো একটা চান্স নিয়ে দেখাই যায়, তাই না? আর যদি বলিস তোর পছন্দ আছে। তুই মনে মনে অন্য কাউকে মনোনীত করে রেখেছিস তাহলে অন্য কথা।’

সকালের সেই মুহূর্তে এতো আফসোস হলো যে বলার মতো না। কেন যে জীবনে একটা প্রেম করতে পারলো না সে। তার ভেতরটা এতটা তরঙ্গহীন, নিথর আর প্রেমহীন হলো কেন কে জানে! এই তানভীরকে ভালোবাসলেও তো পারতো। তাহলে অন্তত আজ বাবার মুখের ওপর বুক ফুলিয়ে বলতে পারতো, ‘আমি এ বিয়ে করতে পারবো না বাবা। আমি অন্য একজনকে ভালোবাসি।’ 

.

সকাল বলল, ‘কেন আমি যাবো? ওদের ছেলেকে আসতে বলো তোমরা। নিজের দেশে নিজে এসে ঘুরে যাক। আমি কেন যাবো? কিছুতেই যাবোনা।’ 

বাবা বললেন, ‘ওমা, এ কেমন কথা? ভিসার জন্য ট্রাই করে দেখ অন্তত। ভিসা হয়ে গেলে নতুন একটা দেশ থেকে বেড়িয়ে আসলি। অভিজ্ঞতার ঝুলিটা ভারি হলো। ওদের ছেলেকে বিয়ে করতেই হবে এমন কোনো কথা নেই। এতে লাভ ছাড়া ক্ষতি কী হবে তাতো আমি বুঝে পাচ্ছি না। এছাড়া তোর তো এমনিতেও দেশের বাইরে পড়াশোনা করতে যাবার ইচ্ছে ছিল। গিয়ে দেখ হয়তো কিছু একটা হিল্লে হলেও হতে পারে।’

এমনই নানারকম বাকবিতণ্ডার পর একটু বুঝি নরম হলো সকালের মনটা। সে জানে তার বাবা-মায়ের মন-মানসিকতা যথেষ্ট আধুনিক। পাত্র পছন্দ না হলে তারা কখনই জোর করে সেই পাত্রের সাথে তাকে বিয়ে দেবার চেষ্টা করবেন না। মা বাবার কাছে তার পছন্দ অপছন্দের দাম আছে। এমতাবস্থায় আমেরিকা থেকে ঘুরে আসার সুযোগটা হাতছাড়া করা বুদ্ধিমানের কাজ হবে বলে মনে হলো না তার কাছে। অবশ্য আমেরিকা যে তার কাছে দিল্লিকা লাড্ডু তা নয়। তার আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব অনেকেই সপরিবারে বসবাস করছে সেখানে। সবচেয়ে কাছের বান্ধবী, নাবিলা গত বছর স্কলারশিপ নিয়ে পাড়ি জমিয়েছে মার্কিন মুলুকে। দেশের বাইরে গিয়ে পড়ালেখা করাটা আজকাল ফ্যাশন হয়ে গেছে। ঢাকা শহরে নামকরা প্রতিষ্ঠানগুলো মুখিয়ে থাকে বিদেশি ডিগ্রিধারী ছেলে-মেয়েগুলোকে চাকরি দেবার জন্য। সকালেরও মনে মনে একটা পরিকল্পনা ছিল উচ্চশিক্ষার জন্য পশ্চিমা দেশগুলোর যেকোনো একটাতে পাড়ি জমাবার। নাবিলা যাবার পর ইচ্ছেটা আরও বেশি জোরদার হয়েছে। আর সবচেয়ে বড় কথা নাবিলা এখন আছে ভার্জিনিয়াতেই। যেখানে বাবার এই বাল্যবন্ধুর আবাসস্থল। 

অতএব, আটলান্টিকের ওপাড়ে যাবার নিমন্ত্রণটি প্রত্যাখ্যান করার আর কোনো যুৎসই কারণ খুঁজে পেলো না সকাল 

ব্যাগ থেকে ফেসওয়াশ বের করে মুখ ধুলো সে। চুল আঁচড়ে নিলো। জামা পাল্টালো। তারপর আবিষ্কার করলো তার বড্ড ক্ষিদে পেয়েছে। অনেকক্ষণ পেটে কিছু পড়েনি। আজ ডিনারও স্কিপ করেছে সে। মোবাইলের ঘড়িতে দেখলো রাত একটা বাজে। কিন্তু এই ঘড়ির সাথে দেহের ঘড়ির এখন কোনো মিল নেই। দেহ চলছে বাংলাদেশের ঘড়ি অনুযায়ী। আরো কয়েকদিন এভাবেই চলবে, জানে সকাল। 

বেডরুমের দরজা খুলে বের হয়ে আসলো সে। ভারি সংকোচ লাগছিল তার। সম্পূর্ণ অচেনা একটা বাড়িতে মাঝ রাত্তিরে খাবারের সন্ধানে ফকিরের মতো ঘুরে বেড়াচ্ছে। এমন দিনও লেখা ছিল কপালে। 

তার ঘরের সামনে ছোট্ট একটি করিডোর। করিডোরের পরে লিভিং রুম। লিভিং রুমে টিভি চলছে। টিভির আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। 

.

ঘরে এসে দেখা গেলো সোফার ওপর একটি আঠারো কি উনিশ বছরের মেয়ে পা তুলে বসে আছে। হাতে রিমোট। মেয়েটির পরনে কালো শর্টস। পা তুলে বসায় ফর্সা উরুর অনেক খানি দেখা যাচ্ছে। চোখ পড়া মাত্র সকালের বাঙালি মনে একটু কেমন অস্বস্তি এসে ভর করলো। চোখ সরিয়ে নিলো সে। মেয়েটি সকালকে দেখতে পেয়েই উঠে দাড়ালো। এক গাল হেসে বলল, ‘হাই দেয়ার! ইউ মাস্ট বি সকাল, রাইট?’ 

সকাল আড়ষ্টভাবে ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানালো। মেয়েটি হাত বাড়িয়ে দিলো সকালের দিকে, ‘আই এম টিলি।’ 

সকাল ধরল টিলির হাতটা। টিলি বলে চললো, ‘ইউ নো, আই হার্ড আ লট এবাউট ইউ। ইউ আর মোর বিউটিফুল দ্যান ইওর পিকচারস।’ 

সকাল হেসে বলল, ‘থ্যাঙ্ক ইউ।’ এরপর কী বলবে খুঁজে পাচ্ছিল না। ক্ষিদের চোটে মনে হচ্ছে পেটের ভেতর যুদ্ধ হচ্ছে। টিলির কাছে কিছু খাবার চাইবে কি? টিলির ইংরেজিটা একটু বেশি দ্রুত। কথা শুনলেই বোঝা যায় এ মেয়ের বেড়ে ওঠা এখানেই। কে জানে হয়তো বাংলা বলতেই পারে না। ঠিক সেই সময় লিভিং রুমের সাথে লাগানো একটি দরজা খুলে গেলো। দরজা দিয়ে বেরিয়ে আসলো গাড়ি চালানো সেই ছেলেটি। এর ছবি দেখেছে সকাল আগে। মা দেখিয়েছেন। এবার ভালো করে চেয়ে দেখলো সকাল। লম্বায় পাঁচ ফুট আটের বেশি হবে না। মায়ের গায়ের রংটাই পেয়েছে। বেশ ফর্সা। মুখটায় একটু ছেলে-মানুষী ভাব আছে এখনও। ক্লিন শেভ করা, চুল পাট করে আঁচড়ানো। বেশ পরিচ্ছন্ন ভাব। পরনে ট্রাউজার আর টি-শার্ট। ছেলেটি ঘরে ঢুকতেই টিলি সকালকে বলল, ‘হ্যাভ ইউ মেট মাই ব্রাদার? 

সকাল ঘাড় নাড়লো, ‘নো, আই হ্যাভ নট মেট হিম ইয়েট।’ 

ছেলেটি সকালের দিকে তাকিয়ে চমৎকার হাসলো। তারপর একটু তাচ্ছিল্যের সুরে বলল, ‘সো …ইউ আর দ্যাট গার্ল!’ 

সকাল প্রথমে বুঝলো না কথাটা, অপ্রস্তুত হয়ে বলল, ‘সরি?’ 

—‘আই সেইড আর ইউ দ্যাট গার্ল হু কেইম অল দ্যা ওয়ে ফ্রম বাংলাদেশ টু মিট দিস হ্যান্ডসাম হাঙ্ক?’ 

অপমানে থমথম করে উঠল সকালের মুখখানা। রাগের চোটে ইংরেজি বলতে ভুলে গেলো সে। ঝাঁঝালো গলায় বলল, ‘মোটেও তা না। আমি নিজের ইচ্ছায় আপনার সাথে দেখা করতে আসিনি। আমি এসেছি কারণ আপনার আব্বা আম্মা ভীষণভাবে চাইছিলেন যে আমি একবার এখানটায় আসি। উনাদের মন রাখতেই আমার এখানে আসা, বুঝেছেন? নাকি বাংলা বোঝেন না? ইংরেজিতে অনুবাদ করে বলবো?’ 

ছেলেটি সকালের তেজের হল্কায় একটু ঘাবড়ে গেলো। ভ্যাবাচ্যাকা খাওয়া গলায় ইংরেজিতে বলল, ‘বাংলা বুঝবো না কেন? বুঝি কিন্তু ভালো বলতে পারি না। তুমি কি রেগে গেছো? আমি তো দুষ্টুমি করলাম।’ 

দুষ্টুমির কথা শুনে সকাল একটু অপ্রতিভ হলো। মনে মনে গাল দিলো নিজেকে। সত্যি সকাল, তুমি একদম আনস্মার্ট। খ্যাত একটা। সেন্স অফ হিউমার বলতে কিচ্ছু নেই তোমার ভেতর। ছেলেটা আসলেই তো মজা করছিল। আর তুমি একটা থিক হেডেড এর মতো রাগ করে বসলে। তোমাকে দিয়ে কিচ্ছু হবে না। 

সকাল যে নিজের মনে কথা বলছে তা শুনতে না পেলেও টের পাওয়া যাচ্ছিল ওকে দেখেই। ভাই বোন পরস্পর চোখাচোখি হলো। হেসে ফেললো টিলি। সকাল পাছে আরো রেগে যায় তাই হাত দিয়ে মুখ চেপে হাসি লুকোনোর চেষ্টা করলো। 

ছেলেটাও হাসলো। হাসি নিয়েই হাত বাড়িয়ে দিলো সকালের দিকে, বলল, ‘ইটস ফাহাদ। 

সকাল হাসার চেষ্টা করলো। ফাহাদের হাতটা ধরে ছোট্ট একটা ঝাঁকুনি দিয়ে বলল, ‘সকাল, সকাল শেহজাদী।’ 

—‘শেহজাদী? ইন্টারেস্টিং নেইম।’ একটু থেমে ফাহাদ আবার বলল, ‘ইউ আর প্রিটি দো, আমার মায়ের পছন্দটা কিন্তু খারাপ না!” 

বলে একটু ফিচেল হাসলো ফাহাদ। সকাল ঠোঁট টিপলো। সেই টেপা ঠোঁটের কোণে হাসি নাকি ভর্ৎসনা তা ঠিক বোঝা গেলো না। 

টিলি ইংরেজিতে বলল, ‘তুমি নিশ্চয়ই ক্ষুধার্ত? 

—‘ভীষণ!’ সকালের নির্ভেজাল স্বীকারক্তি। 

—‘আমি হোয়াইট সস পাস্তা বানিয়েছি, খাবে? অবশ্য তুমি চাইলে ট্রেডিশনাল ডিনারও করতে পারো। ডাল, ভাত, মুরগী। সবই আছে ফ্রিজে। তোমার কোনটা চাই?’ 

সকাল আজকাল একটু ডায়েট করার চেষ্টা করছে। ভাত বেশি খেলেই তার গাল দুটো বেলুনের মতো ফুলে যায়। বিচ্ছিরি লাগে দেখতে। এ কারণে ভাত খাওয়া কমিয়ে দিয়েছে সে। তবে প্রায় তেইশ ঘণ্টার দীর্ঘ যাত্রার পর ভিন দেশের ভিন আকাশের নিচে এসে ভাত ডালের নাম শুনে লোভ সামলাতে পারলো না। লজ্জা শরমের মাথা খেয়ে বলে ফেললো, ‘ভাত চাই।’ 

‘এসো আমার সাথে।’ বলল টিলি। সকাল টিলির পেছন পেছন সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসলো প্রশ্ন করলো, ‘চাচা চাচি ঘুমিয়ে পড়েছেন?’ 

—‘ইয়োপ, মম ড্যাড ওয়াজ সো ফ্রিকিং টায়ার্ড। 

এ দেশে রান্নাঘর আর খাবার ঘর বলতে আলাদা কিছু নেই। যেখানে রান্না হয় সেখানেই খাওয়ার পাট চুকানো হয়। দেখা গেলো রান্নাঘরটা আয়তনে মাঝারি। মাইক্রোওয়েভ, ফ্রিজ, ডাইনিং টেবিল সবই আছে। কিন্তু গ্যাসের চুলার পরিবর্তে ইলেক্ট্রিকের চুলা। চারটা গোল গোল ইলেকট্রিক প্লেট বসানো। চুলোর নিচে একটা বড় ওভেন আছে। বাসন-কোসন ধোয়ার জন্য একটি সিংক আছে। সিংকের নিচে আছে ডিশ ওয়াশার। রান্নাঘরের পাশে একটি ছোট ঘরে ওয়াশিং মেশিন, ড্রায়ার এসব রাখা। 

টিলি ফ্রিজ থেকে খাবারের বক্স বের করে একে একে মাইক্রওয়েভে দিতে লাগলো। সকাল বসল ডাইনিং টেবিলের একটা চেয়ারে। ফাহাদ সকালকে বলল, ‘আমি কিন্তু খুব ভালো কফি বানাই, ট্রাই করবে নাকি? তোমার কি ধরনের কফি পছন্দ, ব্ল্যাক? ক্যাপাচিনো? নাকি রেগুলার?’ 

হ্যাঁ ভাই, এদের ইংরেজিটা বড্ড বেশি দ্রুত। প্রতিটা কথা কান খাড়া রেখে শুনতে হচ্ছে। বুঝতে কষ্ট হচ্ছে। 

সকাল পানসে গলায় বলল, ‘আমি কফি খাই না।’ 

—‘সিরিয়াসলি?’ ফাহাদ বেশ অবাক। যেন কফি না খাওয়ার মতো আশ্চর্য ঘটনা পৃথিবীতে আর দ্বিতীয়টি নেই। 

—‘সিরিয়াসলি, কফি পছন্দ নয় আমার। তবে চায়ের নেশা আছে।’

ফাহাদ ঠোঁট উল্টোলো। কফি বানানোর প্রস্তুতিতে ভাটা পড়ায় সে যেন একটু বিমর্ষ হলো। কিন্তু মুহূর্তেই বিমর্ষ ভাবটা কাটিয়ে ফেললো সে, এক গাল হেসে বলল, ‘নো বিগ ডিল, তুমি কফি খাও না বলে কি আমরা খেতে পারবো না? কি টিলি তোমার চাই?’ 

টিলি ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানালো হ্যাঁ তার চাই। দুই ভাই-বোনকে ভালো লেগে গেলো সকালের। সহজ, সরল, বন্ধুত্বপূর্ণ। এমনটিই তো চাই। নাহ, মার্কিন মুলুকের একটা মাস খারাপ কাটবে বলে মনে হচ্ছে না। 

.

খাওয়া-দাওয়া হয়ে গেলে ওপর তলায় তার ঘরের সাথে লাগোয়া এক টুকরো বারান্দাটায় এসে দাড়ালো সকাল। বারান্দাটা বাড়ির পেছন দিকে। অন্ধকারেও টের পাওয়া যাচ্ছে খুব কাছেই জঙ্গল। আকাশে শুক্লপক্ষের একাদশী চাঁদ। জঙ্গলের গাছগুলোর মাথা তিনতলা দালানের সমান। ঝোপঝাড়ের গায়ে গায়ে জ্বলছে আর নিভছে অসংখ্য জোনাকি। যেন আকাশ থেকে নেমে এসেছে নীল ডানার এক ঝাঁক ছোট্ট পরী। ঝিঁঝিঁ পোকার নিরবচ্ছিন্ন শব্দ ছাড়া আর কোনো কোলাহল নেই এদিকটায়। হঠাৎ রাত্রিকালীন গা ছমছমে নৈঃশব্দ্য ভেদ করে কানে এসে লাগলো একটি করুণ সুর। কেউ একজন বেহালা বাজাচ্ছে করুণ সুরে। শব্দ ভেসে আসছে নিচতলা থেকে। লোক-লোকারণ্য হীন অন্ধকার বন প্রান্তরে সেই সুরটা একদম বুকে গিয়ে লাগলো। কে বাজায়? ফাহাদ নয় তো? 

।ফাহাদ ছেলেটা কিন্তু পাত্র হিসেবে মন্দ নয়। বেশ সপ্রতিভ। পেশায় ইঞ্জিনিয়ার। ভালো চাকরি করছে। সরল, সাদাসিধে এবং অকপট ব্যবহার। এ কথা সত্য ছেলেটাকে দেখে সকালের মনের মধ্যে কোনো প্রেম ভাব জাগ্রত হয়নি কিন্তু প্রেম ছাড়াও জীবনে আরো অনেক বাস্তবতা আছে। বোঝাপড়া আছে, রুজি-রোজগারের ব্যাপার আছে, জীবনযাত্রার মানের ব্যাপার আছে, শরীরের চাহিদা আছে। ওসব বাস্তবিক ভালোলাগা দিয়ে অনায়াসে একটা ছোট জীবন হেসে খেলে পার করা যেতে পারে। 

বাবা মা’কে ফোন করার কথা মনে পড়তেই আবিষ্কার করলো তার ফোনে এই মুহূর্তে ইন্টারনেট নেই। ওয়াইফাইয়ের পাসওয়ার্ডও জানে না। ভাই-বোন নিশ্চয়ই শুয়ে পড়েছে এতক্ষণে। কোথেকে যোগাড় করবে পাসওয়ার্ড এখন? বাবা মা নিশ্চয়ই তার ফোনের অপেক্ষায় আছেন। 

ভায়োলিনের সুর থেমে গেছে। বাতাস নেই, তবে ঠান্ডা একটা ছোঁয়া আছে প্রকৃতিতে। সকালের একটু শীত শীত করছিল। ঢাকা শহরে এমন অন্ধকার নীরব রাত দেখার কোনো সুযোগ নেই। মনে হচ্ছে যেন শহর ছেড়ে দূর কোনো গভীর জঙ্গলের রহস্যময় এক ডাকবাংলোতে বসে আছে সে। জঙ্গল থেকে যে কোনো মুহূর্তে বেরিয়ে আসতে পারে লম্বা দাঁত ওয়ালা ড্রাকুলা কিংবা ভ্যাম্পায়ার। একটু গা ছমছম করে উঠল সকালের। হুহু করে একটা পেঁচা ডেকে উঠল কাছাকাছি কোথাও। ঠিক সেই সময় সকাল লক্ষ্য করলো জঙ্গলের ধারে একটা বিশাল বড় ঝাঁকড়া গাছের নিচে দাঁড়িয়ে আছে বেশ লম্বা একজন মানুষ। অন্ধকারে মুখ দেখা যায় না। শুধু অবয়বটা বোঝা যায়। বোঝা যায় মানুষটা সকালের দিকেই তাকিয়ে আছে মুখ উঁচু করে। টের পায় সকাল। টের পেয়ে গলা শুকিয়ে যায় এক অজানা ভয়ে। নিশ্বাস নিতে ভুলে যায় কয়েক সেকেন্ডের জন্য। 

মানুষই তো ওটা? নাকি অন্য কিছু? 

সকাল দম বন্ধ করে চোখ বুজে ফেলে। আবার খোলে। 

না এখন কেউ নেই। শুধু ঝাঁকড়া গাছের নিচে গজিয়ে থাকা জংলা ঝোপের পাতাগুলো তির তির করে কাঁপছে। 

ভার্জিনিয়ায় সকালের আজ প্রথম সকাল। ঘুম ভাঙলো চাচির ডাকে।

—‘সকাল ওঠো! ফাহাদ তোমাকে নিয়ে বাইরে যাবে। চট করে তৈরি হয়ে নাও।’ 

সকাল একটু অপ্রস্তুত গলায় বলল, ‘বাইরে? আমাকে নিয়ে? কো ….কোথায়?’ 

—‘আজ তো স্যাটারডে। ছুটির দিন। সারাদিন ঘুরতে পারবে। কথা না বাড়িয়ে তৈরি হয়ে নাও। ও বলেছে তোমাকে বাইরে ব্রেকফাস্ট করাবে।’ 

দারুণ কথা। যে কোনো জায়গায় বেড়াতে যাবার প্রস্তাব সকালের কাছে সর্বদা লোভনীয়। তার ওপর সঙ্গী যদি হয় একজন সুদর্শন ব্যক্তিত্ববান পুরুষ তবে তো সোনায় সোহাগা। খুশিতে তো সকালের ঝুম ঝুম করে ওঠার কথা। কিন্তু খুশির পরিবর্তে চাচির প্রস্তাব কেমন একটা বিরক্তির উদ্রেক করলো তার মনের ভেতর। ঘুম কাটেনি এখনো। শরীর ম্যাজ ম্যাজ করছে। মাথার ভেতর ভোঁতা যন্ত্রণা। শরীরেরই বা দোষ কী? সে তো এখনও আছে বাংলাদেশের সময় অঞ্চলে। মাত্র গত রাতে এলো এতটা পথ পাড়ি দিয়ে। একটা দুটা দিন বিশ্রাম নিয়ে কি বেড়ানোর পালা শুরু করা যেতো না? কিন্তু চাচির ঝলমল করা মুখটার দিকে তাকিয়ে সকাল কোনো আপত্তি করতে পারলো না। 

বেরোবার আগে ওয়াইফাইয়ের পাসওয়ার্ড চেয়ে নিয়ে বাবা মার সাথে কথা বলে নিলো। সাদা ফতুয়া আর ব্লু জিন্স পরলো। চোখে কাজল দিলো এবং বরাবরের মতোই আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে ওর বিচ্ছিরি কুৎসিত দেখতে মনে হলো। সাজগোজ শেষে পায়ে খয়েরী বুট জুতো পরে নিচে নেমে আসলো। 

বসার ঘরে চাচা-চাচি বসে আছেন। চাচা সকালকে দেখে বললেন, ‘তোমার বাবা মায়ের সাথে কথা হয়েছে তো?’ 

—‘জি চাচা, এইতো কথা বললাম একটু আগে।’ 

—‘ভালো হয়েছে গত রাতে বাড়ি পৌঁছেই আমি ফোন দিয়েছিলাম তোমার আব্বাকে। তুমি শুয়ে পড়েছিলে বলে আর ডাকিনি।’ 

।চাচি বললেন, ‘দাঁড়িয়ে রইলে কেন? বাইরে তোমার জন্য অপেক্ষা করছে ফাহাদ। 

সকাল অপ্রতিভ হলো। তার কেমন লজ্জা লজ্জা করছে। ঘাড়টা একটু কাত করে সে কোনো রকমে বলল, ‘ঠিক আছে চাচি। আসছি আমি।’ 

চাচি মুখ ভর্তি হাসি নিয়ে বললেন, ‘ওকে, হ্যাভ আ ওয়ান্ডারফুল ডে মাই চাইল্ড!’

বের হয়ে আসার সময় সকালের মনে হলো চাচি মানুষটা কিন্তু দারুণ! এতো হাসিখুশি আর উচ্ছ্বল মহিলা সচরাচর খুব কমই দেখা যায়। এই মহিলাটি তার শাশুড়ি হলে মন্দ হবে না। উড়তে উড়তে বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসলো সে। মনটা ঝরঝরে লাগছিল। 

বাইরে প্যাটিওর চেয়ারে ফাহাদ আর টিলি বসে ছিল। আজকের দিনটি রৌদ্রকরোজ্জ্বল। ঘড়িতে সকাল দশটা। রোদে তেজ আছে। তবে আদ্রতা কম বলে ঘাম হয় না খুব একটা। সকালকে দেখেই ফাহাদ হাত নাড়লো। হেসে বলল, ‘হাই সানশাইন! গুড মর্নিং।’ 

—‘মর্নিং’ সকাল বলল ছোট করে। 

বাগানের ফুলগুলো দেখে চোখ জুড়িয়ে গেলো। গোলাপ, হোয়াইট ম্যাগনোলিয়া, পার্পল মিল্কউইড এবং আরো তিন চার জাতের অচেনা ফুল। হলদে রোদের নিচে কী যে সুন্দর লাগছে দেখতে থোকায় থোকায় ফুটে থাকা নানা রঙের ফুলগুলো। বাগানের বাম পাশে মাটি ঢালু হয়ে সাত-আট ফিট নিচে নেমে গেছে। নেমে গিয়ে মিশেছে রাস্তার সাথে। রাস্তাটা খুব বেশি চওড়া নয়। রাস্তার ও পাড়েই জঙ্গল। কাছাকাছি আর কোনো বাড়ি চোখে পড়ছে না। গ্যারাজের গা ঘেঁষে বাঁশ দিয়ে পার্টিশন দেয়া। হয়তো পার্টিশনের ওপারে বাড়ি থাকলেও থাকতে পারে। কিন্তু আপাতদৃষ্টিতে মনে হয় যেন জংলা পাহাড়ি উপত্যকার মাঝে একটি মাত্র দোচালা বাড়ি মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে। এমন জায়গায় থাকতে ভয় করে না এদের? হঠাৎ মনে পড়ল গতরাতের ঘটনা। আঁধার জঙ্গলের সামনে গভীর রাতে কে দাঁড়িয়ে ছিল অমন ভূতের মতো? সত্যিই কেউ ছিল কি? নাকি সকালের চোখের ভুল? 

ফাহাদ গ্যারাজ থেকে গাড়ি বের করলো। কালো রঙের ভোক্স ওয়াগন ইয়স গাড়ি। টিলি সকালকে বলল, ‘তুমি সামনে বসো ভাইয়ার পাশে।’ 

টিলিকে এতক্ষণে খেয়াল করলো সকাল। একটা গোলাপি টি শার্ট আর ব্লু জিনসের শর্টস পরেছে। টিলিটা কিন্তু একটু মোটার দিকে। হৃষ্টপুষ্ট গায়ে গোলাপি জামা আঁটসাঁট হয়ে লেগে আছে। 

ফাহাদের পাশে উঠে বসলো সকাল। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল রাস্তার ধারে সাইনবোর্ডে ঘণ্টায় স্পিড লিমিট বিশ মাইল বেঁধে দেয়া হয়েছে। ফাহাদ বিশে রেখেই গাড়ি টান দিলো। দিনের আলোয় রাস্তাঘাট রূপোর মতো চকচক করছে। সামনের রাস্তা উঁচু হয়ে পাহাড়ের মতো উঠে গেছে অনেকখানি। রাস্তার দু’ ধারে ছবির মতো বাড়িঘর। কোথাও এক রত্তি ধূলো নেই। অরণ্য আর পাহাড়ের সাথে মিলেমিশে মানুষ যে এতো সুন্দর সাজানো-গোছানো হয়ে থাকতে পারে তা নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না। 

নেইবারহুড ছেড়ে বড় রাস্তায় এসে দেখা গেলো গাড়িঘোড়ার সংখ্যা নিছক কম নয়। সব বয়সের নারী-পুরুষ গাড়ি চালাচ্ছে। বড় আট চাকা ওয়ালা ট্রাকও আছে। ফুটপাত ধরে কেউ কেউ দৌড়োচ্ছে। খালি গায়ে হাফ প্যান্ট আর জুতো পরে। মেয়েদের শুধু স্পোর্টস ব্রা, হাফ প্যান্ট বা লেগিংস পরনে। কানে হেডফোন। ধ্যানমগ্ন হয়ে দৌড়াচ্ছে তারা। কেউ কারো দিকে অযথা তাকিয়ে নেই। সবাই যে যার কাজে ব্যস্ত। 

সকাল হা করে গিলছিল সব। এখানে সবচেয়ে বিস্ময়কর ব্যাপার হলো প্রকৃতির সাথে মানুষের সংযোগ। ইট পাথরের ইমারতের মধ্যে সবুজ প্রকৃতি নিশ্চিন্তে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে। নগরায়নের পাশাপাশি সবুজ প্রকৃতির প্রতি কী গভীর ভালোবাসার নিদর্শন সারাটা পথ জুড়ে! বিশাল বড় চার লেনের রাস্তাগুলোর দু’ ধারেই জঙ্গল। কোথাও আবার শুধু খালি জায়গা। সকাল দেখলো পথচারীদের রাস্তা পার হবার জন্যেও সিগন্যাল আছে। হাতের ছবি দেয়া থাকলে বুঝতে হবে ক্রস ওয়াক সিগন্যালে এখন পথচারীকে দাঁড়িয়ে থাকার নির্দেশ দেওয়া হচ্ছে। একটু পর সেই ছবিটি পরিবর্তিত হয়ে মানুষের ছবিতে রূপান্তরিত হলে পথচারীরা রাস্তা পার হওয়া শুরু করবে। রাস্তা পার হওয়া কালীন সময়ে গাড়ি থেমে থাকবে। ক্রস ওয়াক সিগন্যাল, নির্দিষ্ট সময় বেঁধে দেবে পথচারীদের জন্য। সেই সময়ের মাঝে রাস্তা পার হতে হবে। 

যে রেস্টুরেন্টটিতে ওরা এসে থামলো তার নাম আই হপ- ইন্টারন্যাশনাল হাউজ অফ প্যানকেকস। ঢোকার মুখে রিসিপশনে এক শ্বেতাঙ্গিনী তাদের অভ্যর্থনা জানালো। অতিথিদের তালিকায় নাম লেখাতে হলো প্রথমেই। টেবিল খালি হলে নাম ধরে ডাকা হবে। 

সকাল দেখলো ওদের সাথে আরো তিন চারটা দল দাঁড়িয়ে আছে। এরা সবাই অপেক্ষা করছে টেবিল খালি হওয়ার জন্য। কেউ কেউ বসেছে সোফায়। সবগুলো গদি দখলকৃত। বসার জায়গা না পাওয়ায় ওদেরকে দাঁড়িয়ে থাকতে হলো। বোঝা গেলো এই রেস্তোরাঁ বেশ জমজমাট। 

ফাহাদই কথা বলল প্রথম, ‘তারপর তোমার প্ল্যান কী? কোথায় কোথায় ঘুরবে ঠিক করেছ?’ 

সকাল ঠোঁট দুটো মুখের ভেতরের দিকে চেপে ধরে চোখ নাচিয়ে কিছু একটা চিন্তা করলো, তারপর বলল, ‘নিউইয়র্ক তো যাবোই, এছাড়া নায়াগ্রা ফলস দেখার ইচ্ছে আছে।’ 

—‘ব্যাস এটুকুই? এ দেখতে তো দুই এক সপ্তাহও সময় লাগবে না। তুমি কত দিনের ভ্যাকেশনে এসেছো?’ 

—‘খুব বেশি হলে দু’ মাস।’ 

—‘এতো কম সময়? টুরিস্ট ভিসায় তুমি ছ মাস থাকতে পারবে।’ 

—‘অত দিন মন টিকবে না।’ 

টিলি একটু দূরে দাঁড়িয়ে মোবাইল টেপাটিপি করছিল। সকালের কথা তার কান-অবধি পৌঁছুতেই হৈ হৈ করে বলে উঠল, ‘কিসের দুই মাস? পাঁচ মাসের আগে তোমাকে যেতে দেয়া হচ্ছে না। তোমাদের এনগেজমেন্ট হবে, তারপর যাবে।’ 

শেষ কথাটায় সকাল অস্বস্তিতে পড়ল। অস্ফুটে বলল, ‘কী যে বলো!’

বোনের কথায় ফাহাদ শব্দ করে হেসে উঠে বলল, ‘আমার ফ্যামিলি মনে হয় তোমাকে আর ছাড়ছে না। তুমি চাও বা না চাও বিয়েটা মনে হয় তোমাকে করতেই হচ্ছে।’ 

সকাল কিছু না বলে লাজুক হাসল এবং অবাক হলো এই ভেবে যে ফাহাদ কত সহজে কথাগুলো বলে ফেলল। একটুও সংকোচ নেই, জড়তা নেই। 

টেবিল খালি হতেই শ্বেতাঙ্গিনী ডাকলো ওদের ভেতরে। চার চেয়ারের একটা টেবিলে গিয়ে বসলো ওরা। 

মেনু হাতে দিয়ে বলল, ‘তোমাদের কি একটু সময় লাগবে?’

ফাহাদ ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানালো, হ্যাঁ সময় কিছু লাগবে। 

মেনু দেখে শুনে সকাল একটা প্যান কেক কম্বো অর্ডার করলো। এতে আসবে প্যান কেক, ডিম পোচ আর হ্যাশ ব্রাউন। সাথে রুটি। 

আশেপাশে একটি টেবিলও খালি নেই। নানা রঙের, নানা জাতের মানুষে কল কল করছে চারপাশ। সাদা আছে, কালো আছে, বাদামি আর শ্যামবর্ণের মানুষও আছে। এমন হরেক জাতের মানুষ একই মঞ্চে এর আগে কখনো দেখেনি সকাল। ভালো লাগছিল ওর। 

মিনিট না গড়াতেই একটি সাদা চামড়ার মেয়ে এসে ওদের সাথে যোগ দিলো। চতুর্থ চেয়ারটি দখল করতে করতে বলল, ‘সরি, দেরি করে ফেললাম।’ 

বলাই বাহুল্য সকাল একে চেনে না। এর আসার কথা ছিল কি ছিল না এ ব্যাপারেও কোনো ধারণা নেই তার। মেয়েটি বসেছে ফাহাদের পাশের চেয়ারে। বসেই ফাহাদকে আলতো ভাবে আলিঙ্গন করলো সে। ফাহাদ পরিচয় করিয়ে দিলো সকালের সাথে। বলল, ‘এ আমার অনেক পুরনো বন্ধু। নাম লারা।’

সকাল হাসলো। হাসলে ওর দু ঠোঁটের কোণে একটা ধারালো ভাঁজ তৈরি হয়। সেই ভাঁজ গাল পর্যন্ত গড়ায়। টোল পড়ে। সুন্দর দেখায়। 

খাবার আসতেই সবাই খাওয়া নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। টিলি আর লারাই কথা বলছিল বেশি। ফাহাদ বলতে গেলে একদম চুপচাপ হয়ে ছিল। খানিক বাদে বাদে শুধু সকালকে দেখছিল। সকালের চোখ, নাক, চিবুক, চুল, গলা ….সব কিছু আলাদা আলাদা করে। চোখে চোখ পড়ে গেলে মিষ্টি একটা হাসি দিচ্ছিল। 

খাওয়া শেষ হয়ে গেলে টিলি সকালকে বলল, ‘আমার ভাই তো কফি খাবে, সো তুমি আর ভাইয়া আরেকটু সময় থাকো। আমি লারাকে নিয়ে একটু ঘুরে আসছি।’ 

—‘কোথায় যাবে?’ সকালের সাদাসিধে প্রশ্ন। 

—‘এইতো, কাছাকাছিই। লারার স্মোক করার অভ্যেস আছে।’ বলে হাসলো টিলি। সকাল বুঝতে পারে ওদের দুজনকে একটু আলাদা সময় দেয়ার জন্যেই এ ব্যবস্থা। আর কিছু বলল না সে। টিলি আর লারা বেরিয়ে গেলো। 

ওরা চলে গেলে ফাহাদ পরিপূর্ণ চোখে তাকালো সকালের দিকে। একটু বেকায়দায় হাসলো সকাল। বলেই ফেললো, 

—‘এভাবে তাকিয়ে তাকিয়ে কী দেখছ সেই তখন থেকে? 

—‘তোমাকেই দেখছি। দেখতে ভালো লাগছিল তাই। তুমি কি মাইন্ড করলে নাকি? 

—‘না না, মাইন্ড করিনি।’ 

—‘লিসেন সকাল, তোমাকে খুব জরুরি কিছু কথা বলবার আছে। আমার মনে হয় কথাগুলো শুরুতেই বলে ফেলা উচিত।’ 

সকাল একটু নড়েচড়ে বসে বলল, 

‘বল। আমি শুনছি।’ 

—‘লাস্ট উইকে আমার গার্লফ্রেন্ডের সাথে ব্রেকআপ হয়েছে।’

-‘তাই?’ 

—‘হুম এবং সে ছিল আমার তিন নম্বর গার্লফ্রেন্ড।’ 

স্বাভাবিক ভাবেই হোঁচট খেলো সকাল। সেই মনের হোঁচটের ছাপ চোখের তারায় স্পষ্টভাবে ধরা পড়ে গেলো। তার ওই এক দোষ। মনের ভাব লুকোতে জানে না একদম। 

কফি চলে এসেছে ততক্ষণে। ফাহাদ কফি সিপ করতে করতে বলল, 

—‘আমি জানি কথাটা শুনতে তোমার ভালো লাগেনি। আমি এও জানি তুমি বাংলাদেশে বড় হয়েছ। দেশে তোমরা যেরকম মূল্যবোধ নিয়ে বড় হও এখানে আমরা ঠিক একইরকম মানসিকতা বা মূল্যবোধ নিয়ে বেড়ে উঠি না।’ 

সকাল সহজ হবার চেষ্টা করলো, ‘এটা কোনো ব্যাপার না, গার্লফ্রেন্ড থাকতেই পারে। দেশের ছেলে-মেয়েরাও অত ধোয়া তুলসী পাতা নয়। তোমার ধারণা ভুল।’ 

ফাহাদ হাসলো, ‘তাই বলছো? তাহলে তোমারটা শুনি?’

—‘আমার আবার কী?’ 

—‘তোমার বয়ফ্রেন্ড আছে?’ 

—‘না।’ 

—‘নেই?’ 

—উঁহু’ 

—‘আচ্ছা ছিল তো, তাই না?’ 

—‘নাহ কখনো ছিল না।’ 

ফাহাদ বিস্মিত গলায় বলল, ‘এটা কী করে সম্ভব?’ 

—‘আসলে ওভাবে কখনো কারোকে পছন্দ হয়নি। মানে ফোনে কথা বলেছি কয়েকজনের সাথে কিন্তু খুব বেশিদূর গড়ায়নি।’ 

ফাহাদ এতটাই অবাক হলো যে ওর ঠোঁট দুটো অনেকটাক্ষণ পর্যন্ত হা হয়ে থাকলো। একটা সময় সে বলতে পারল, ‘এর মানে তুমি এখনো ভার্জিন?’ বলেই নিজের মনে হেসে ফেললো, ‘হ্যাঁ তুমি নিশ্চয়ই ভার্জিন। খুব আশ্চর্য ব্যাপার!’ 

সকাল কী বলবে খুঁজে পেলো না। চুপ করে রইল। 

—‘ইউ নো হোয়াট, আই লস্ট মাই ভার্জিনিটি হোয়েন আই ওয়াজ অনলি সেভেন্টিন।’ দ্বিধাহীন কণ্ঠে বলে ফেললো ফাহাদ। 

সকাল কৃত্রিম হাসল। কেন যেন এই আলোচনাটা ভালো লাগছিল না তার। যে ছেলেটার পা থেকে মাথা পর্যন্ত আষ্টেপৃষ্ঠে গেঁথে আছে পাশ্চাত্য সংস্কৃতির ছাপ। যে বাংলা ভাষায় টানা পাঁচটা মিনিট কথা বলতে জানে না। জন্মের পর থেকে যার নাকের ডগার উপর দিয়ে অষ্ট প্রহর ঘুরে বেড়িয়েছে ডানাকাটা সব সোনালি চুলের পরীরা। তার জীবনে ঠিক এরকম কিছু ঘটনা ঘটে থাকাটাই কি স্বাভাবিক নয়? চাচা-চাচি দেশ থেকে বাঙালি ঘরোয়া মেয়েকে ছেলের বউ করে নিয়ে আসার জন্য বদ্ধপরিকর। এদিকে নিজের কীর্তিমান ছেলে তলে তলে কত কাহিনি ঘটিয়ে রেখেছে সে খবর কি তারা জানেন? ফুরফুরে ভাবটা একটু একটু করে কেটে যাচ্ছিল সকালের মন থেকে। কেমন যেন কষ্ট কষ্ট ভাব। কিন্তু এই কষ্টের কারণ কী তা সে জানে না। এমন তো নয় যে এই ছেলেটির সাথে তার বিয়ের সব কথা পাকাপাকি হয়ে গেছে। আজ বাদে কাল উড়োজাহাজে করে নিজের দেশে ফিরে গিয়ে বিয়ের সম্বন্ধটা নাকচ করে দিলেই মামলা ডিসমিস। অতো দুশ্চিন্তার তো কিছু নেই! কিন্তু সকাল বিস্মিত হয়ে আবিষ্কার করলো তার দুশ্চিন্তা এবং মন খারাপ, দুটোই হচ্ছে। দারুণ একটা সুখস্বপ্ন দেখতে থাকা অবস্থায় হঠাৎ ঘুম ভেঙে যাবার পর যখন বোঝা যায় যে সুন্দর ঘটনাটি আসলে ঘটেছে স্বপ্নে, বাস্তবে নয়। তখন বুকের মধ্যে যেমন হালকা একটা সংজ্ঞাহীন, যুক্তিহীন ব্যথা চিন চিন করে ওঠে সকালের এই মুহূর্তে ঠিক সে রকম একটা ব্যথা হচ্ছে। 

অথচ সে ফাহাদের প্রেমে পড়েনি। ভালোও বাসেনি। হ্যাঁ, হয়তো প্রেমে পড়ার স্বপ্ন দেখেছিল। নাকি এটাই প্রেম? নাকি প্রেমে পড়ার মতো মনটাই আসলে সকালের নেই? 

সবার থাকে না …সব কিছু। 

সকাল একটু কেশে গলা পরিষ্কার করে নিয়ে বলল, ‘ওদের তিনজনকেই ভালোবেসেছিলে তুমি?’ 

ফাহাদ অকপটে বলল, ‘একজনকেও ভালোবাসিনি!’

—‘বল কী?’ 

—‘হ্যাঁ এটাই সত্যি।’ 

—‘মানে পুরো ব্যাপারটা শুধু শারীরিক ছিল?’ 

—‘না না ওটা শুধু একজনের সাথেই হয়েছিল।’ ফাহাদের নির্ভেজাল স্বীকারোক্তি। একটু থেমে সে আবার বলল, 

—‘শোনো সকাল, আমি কিন্তু আমার মা’কে অনেক ভালোবাসি।’

—‘প্রতিটা সন্তানই তার মা’কে ভালোবাসে।’ 

—‘হ্যাঁ তা বাসে। কিন্তু আমি কথাটা এ কারণে বলছি যে আমার মা তোমাকে ভীষণ পছন্দ করে। আমার কাছে মায়ের পছন্দের দাম অনেক বেশি।’ 

সকাল কিছু না বলে সরাসরি চেয়ে রইল ফাহাদের দিকে। বোঝার চেষ্টা করলো এইমাত্র বলা কথাগুলোর ভেতরের কথাটা আসলে কী? 

ফাহাদ বলে চললো, ‘অতএব আমি হান্ড্রেড পার্সেন্ট চেষ্টা করব আমাদের সম্পর্কটা যেন হয়। পাস্ট ইজ পাস্ট। আমি আমার সমস্ত অতীতকে পেছনে ঠেলে দিয়ে তোমার সাথে নতুন করে সব শুরু করতে চাই। সত্যি বলতে তোমাকে আমার অপছন্দ হয়নি।’ 

সকাল কিচ্ছু বলল না। চুপ করেই থাকলো। 

—‘মনে হয়, তুমি আমার পাস্ট মেনে নিতে পারছো না।’ অসহিষ্ণু গলায় বলে ফাহাদ। 

সকাল একটা দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে বলল, ‘না আসলে ব্যাপারটা শুধু তোমার পাস্ট নিয়ে নয়। তোমাকে বুঝতে হবে যে তোমার মায়ের চাওয়াটাই পৃথিবীর শেষ সত্য নয়। আমারও একটা আলাদা পৃথিবী আছে। আমার পরিবারের চাওয়া-না-চাওয়ারও ব্যাপার আছে। আর সবচেয়ে বড় কথা হলো আমি চাই তুমি তোমার মায়ের ইচ্ছের কারাগার থেকে বের হয়ে এসে শুধু মাত্র নিজের ইচ্ছেটাকে প্রাধান্য দিয়ে দেখো একবার। তোমার বাড়ির বউ নয়, নিজের জীবনসঙ্গী হিসেবে যদি তুমি আমাকে চাও তবে সেটাই আমার কাছে সবচেয়ে বেশি গ্রহণযোগ্য হবে। আমাদের হাতে প্রচুর সময়। তাড়াহুড়ার তো কিছু নেই। সময় নাও।’ 

ফাহাদ একটুক্ষণ কী যেন ভাবলো। যেন হৃদয়ঙ্গম করতে চাইলো সকালের বলা প্রতিটি শব্দ। তারপর বলল, 

—‘এন্ড হোয়াট এবাউট ইউ? আমাকে তোমার পছন্দ হয়েছে?’ 

সকাল একটু দ্বিধাগ্রস্ত গলায় বলল, ‘সত্যি বলতে আমারও তোমাকে অপছন্দ হয়নি ফাহাদ। কিন্তু আমি আমার ভেতর থেকে একটা সাড়া পাবার অপেক্ষায় আছি। একটা সংকেত, একটা ইঙ্গিত। হয়তো পেয়ে যাব কদিনের মধ্যেই। একটু সময় দাও আমাকে। ঠিক আছে?’ 

ফাহাদ হাসলো। প্রসঙ্গ পাল্টে বলল, ‘সে যাকগে, এখন বলো কোথায় যেতে চাও? শপিং টপিং কিছু করবে? তোমাকে ভার্জিনিয়ার সবচেয়ে বড় মলে নিয়ে যেতে পারি যদি চাও।’ 

—‘শপিং করার মতো বিশেষ কিছু নেই, তবে ঘুরতে যাওয়া যায়।’

—‘তাই চলো, যাওয়া যাক।’ 

টিলিকে ফোন করে জানা গেলো আপাতত সে এমুখো হচ্ছে না। লারাকে নিয়ে কোনো এক কনসার্ট দেখতে গেছে। অতএব এখন শুধুই সকাল আর ফাহাদ। 

গাড়িতে উঠে যাত্রা শুরুর আগেই গাড়ির জিপিএস অভ্যর্থনা জানালো, ‘উই আর অল সেট, লেটস গো। হ্যাভ আ সেফ ড্রাইভ।’ শুধু তাই নয় একটু বাদে বাদে নানা রকম হুঁশিয়ারি দিতে লাগলো, যেমন ‘ভেহিক্যাল স্টপড শোল্ডার এহেড’ বা ‘পুলিশ রিপোর্টেড এহেড’, ইত্যাদি। 

সকাল জিপিএস ডিভাইসের ম্যাপে দেখলো এখন যে রাস্তাটা দিয়ে তাদের গাড়ি চলছে তার নাম মেপল এভিনিউ। মাথার ওপর বিস্তৃত পরিষ্কার নীল আকাশ। যেতে যেতে চোখে পড়ল খোলা মাঠ, বনভূমি, নীল জলের জলাশয়, সুইমিং পুল, টেনিস কোর্ট আর সুন্দর ছবির মতো বাড়িঘর। প্রতিটি বাড়ির সামনেই পর্যাপ্ত পরিমাণে খালি জায়গা, সবুজ ঘাসের লন। কোথাও কোথাও ঝকঝকে রূপালি রাস্তা পাহাড়ের মতো উঁচু হয়ে উঠে মিশে গেছে আকাশের সাথে। সেই উঁচু টিলার মতো রাস্তা আধ মাইল দূর থেকে দেখা যায়। মনে হয় গাড়ি চলতে চলতে বুঝি এখুনি উঠে যাবে আকাশে। আশেপাশে কোথাও উঁচু বিল্ডিং এর বাঁধ নেই, ধোঁয়ার কুণ্ডলী নেই। অনেক দূর দিগন্ত অবধি চোখ রাখা যায়। সকালের মনে হলো এই শহরের প্রতিটি আনাচে-কানাচে একটা উঁচুদরের শিল্পের ছোঁয়া লেগে আছে। কোনো নামি-দামি শিল্পী যেন মাত্র ছবিগুলো এঁকে শেষ করে গেছে! 

—‘এ জায়গাটা খুব পাহাড়ী, তাই না?’ প্রশ্ন সকালের। 

—‘হুম, এখানে বেশিরভাগ শহরই পাহাড় কেটে তৈরি করা। আর এই ভূখণ্ড সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে কিন্তু অনেক উঁচুতে, প্রায় ৯৫০ ফিট।’ 

— ভার্জিনিয়ার ক্যাপিটাল কোনটা? 

— রিচমন্ত। 

.

সন্ধ্যার আগেই ফিরে এলো ওরা বাসায়। এখানে দিন কাটলেও সকালের বস্তুত কাটলো নির্ঘুম রাত্রি। কারণ দূর দেশে এখন ফিকে হচ্ছে রাত। সকালের দেহ এখনো সেই দেশের টাইম জোনেই আছে। রাতের খাবারের পর সে বসলো বাড়ির পেছন বারান্দায়। বারান্দাটির মেঝে কাঠের। খালি পায়ে ঠান্ডা কাঠের উপর হাঁটতে বেশ লাগে। বাথরুম আর বারান্দা বাদে পুরো বাড়িটাই কার্পেটে মোড়ানো। মেঝের সাথে স্থায়ীভাবে লাগানো সেই কার্পেট। 

সামনে নিঝুম অরণ্য আর মাথার ওপর তারকাখচিত আকাশ নিয়ে সকাল যখন বারান্দার রেলিঙে হেলান দিলো, তখন গত রাতের মতোই বাজছে বেহালা। সেই একই সুর। ঝিঁঝিঁ পোকার কলরবের সাথে ভায়োলিনের সুর মিশে একটা মায়াবী আবেশ তৈরি হয়েছে চারপাশে। কে বাজায় এমন মনকাড়া সুরে এই বাদ্য? রোজ রাতে? 

একলা থাকার সময়টায় সকাল শুধু আর সকাল থাকে না। সে হয়ে যায় হরিণডাঙ্গার রাজকন্যা। তার সাথে থাকে একান্ত নিকটতম বিশ্বস্ত দাসী বিন্দুবাসিনী। আজকেও বিন্দুবাসিনী আছে তার সাথে। বিন্দুবাসিনীর গায়ে সাদা সুতির শাড়ি। খোঁপায় বেলি ফুলের মালা। সকাল কল্পনায় বেলি ফুলের ঘ্রাণ পাচ্ছে। আর ঝাপটা বাতাসে হঠাৎ হঠাৎ পাচ্ছে আতরের খুশবু। 

—‘বিন্দু, আতরের খুশবু পাচ্ছো?’ 

—‘আতর নয় শেহজাদী, এটা বেলি ফুলের গন্ধ।’

—‘বেলি ফুলের গন্ধ তো আছেই। কিন্তু সাথে একটা অন্য খুশবুও আছে। 

—‘হতে পারে শেহজাদী, আমি পাচ্ছি না।’ 

—‘আচ্ছা বিন্দু, ফাহাদ ছেলেটা কেমন?’

—‘ভালো, বেশ ভালো।’ 

—‘কেমন ভালো?’ 

—‘যতটা ভালো হওয়া যায়।’ 

—‘তাহলে আমি কেন প্রেমে পড়তে পারছি না?’ 

—‘হয়তো পড়বেন, এতো তাড়াহুড়ার কী আছে?’ 

—‘না, আমার মনে হয় আমি কোনোদিনই কারো প্রেমে পড়বো না।’

—‘না পড়লে নেই। আপনি হলেন রাজকন্যা, শেহজাদী সকাল। আপনার যোগ্য কি কেউ আছে এ রাজ্যে? 

এ কথা শুনে সকাল খিলখিল করে হেসে উঠল। হাসতে হাসতে হঠাৎ চোখ পড়ল জঙ্গলের সামনে বিশাল বড় সিডার গাছটার দিকে। গাছের নিচে অন্ধকার গায়ে মেখে দাঁড়িয়ে আছে গতরাতের সেই লোকটি। অন্ধকারে চেহারা বোঝা যায় না, শুধু অবয়ব বোঝা যায়। হাসি থেমে গেলো সকালের। আজকে ভয় পেয়ে চোখ সরিয়ে নিলো না সে। সরাসরি তাকালো মানুষটার দিকে। কয়েক সেকেন্ড কাটলো। খানিক বাদে মানুষটা ধীরে ধীরে হেঁটে চলে গেলো জঙ্গলের ভেতর। কে ও? এমন গভীর অন্ধকারে জঙ্গলের ভেতর কেন যায়? 

ভায়োলিনের সুর থেমে গেছে তখন। ঝাপটা বাতাসে শুধু আতরের খুশবু। 

ভোরে ঘুম ভাঙলো নাবিলার ফোনে। সকাল ঘুম চোখেই ফোন ধরলো। 

—‘শেহজাদী! তুমি ঘুমাচ্ছো?’ 

শেহজাদী নামটা তার বাবার দেয়া। বাবা আর নাবিলা ছাড়া সচরাচর কেউ তাকে শেহজাদী বলে ডাকে না। অন্তত বাস্তবে ডাকে না। হ্যাঁ কল্পনায় তার প্রজা, ভৃত্য, রাজ্যের উজির নাজির সবাই তাকে শেহজাদী বলেই সম্বোধন করে। 

—‘কী ব্যাপার, এতো সকালে?’ 

—‘তুই ইউ এস এ এসে বসে আছিস এক সপ্তাহ হয়ে গেলো, এখনো আমার সাথে দেখা করলি না?’ 

—‘মোটেও এক সপ্তাহ হয়নি, একদিন হয়েছে মনে হয়।’ 

—‘কথা না বাড়িয়ে এখনই তোর বাসার এড্রেস পাঠা। আমি আসছি তোকে পিক করতে।’ 

—‘পিক করতে মানে? কোথায় যাবো?’ 

—‘তুই দেশ দেখতে এসেছিস? নাকি ঘুমাইতে এসেছিস?’ 

সকাল গম গম করে বলল, ‘ধুর ভাই, আমার জেটল্যাগ কাটেনি এখনো। ঘুমাতে দে।’ 

বলে ফোন কেটে দিলো সে। কী মনে করে আবার এড্রেসটা পাঠিয়েও দিলো নাবিলার ফোনে। খানিক পরেই নাবিলার টেক্সট আসলো, আই এম অন মাই ওয়ে, গেট রেডি। 

ব্যাস আর ঘুমোনোর কোনো চান্স নেই। 

.

নাশতার টেবিলে আজ সবাইকে এক সাথে পাওয়া গেলো। টিলি মাত্র ওয়াক করে এসেছে। তার পরনে ব্যায়ামের পোশাক। হাত-মুখ ধুয়ে নিয়ে পোশাক না পাল্টেই খেতে বসে গেছে সে। ফাহাদের হাতে একটা খবরের কাগজ। খুব মনোযোগ দিয়ে কিছু পড়ছে সে। চাচা সকালকে দেখে এক গাল হেসে বললেন, ‘কী কেমন লাগছে সব? আজকের প্ল্যান ব? কী করছ সারাদিন?’ 

সকাল চেয়ার টেনে নিয়ে বসতে বসতে বলল, ‘চাচা আমার এক ফ্রেন্ড আছে। কাছাকাছিই থাকে, এখানে জর্জ মেসনে মাস্টার্স করছে। তো আজকে ওর সাথেই বাইরে যাব।’ 

—‘বেশ তো, খুব ভালো। নেক্সট উইকেন্ডে আমরা নিউইয়র্ক যাবো বুঝলে? সো অন্য কোনো প্রোগ্রাম করো না আরকি। তাই আগে থেকে বলে রাখলাম।’ 

—‘ঠিক আছে চাচা। আমার অন্য কোনো প্রোগ্রাম নেই।’ 

নাস্তার মেনু পরোটা, ডিম ভাজা আর সুজির হালুয়া। এ বাড়ির ছেলে- মেয়েরা ছুরি কাটাচামচ ছাড়া খাবার খায় না। চাচা অবশ্য হাত দিয়েই খাবার খাচ্ছেন। সকাল হাত ধুয়ে এসে বসলো চেয়ারে। 

ফাহাদ নিউজপেপার থেকে মুখ তুলে চাইলো সকালের দিকে। হেসে ছোট করে বলল, ‘মর্নিং!’ 

—‘মর্নিং।’ উত্তর দিলো সকাল। 

টেবিলে সকালের মুখোমুখি একটা চেয়ার খালি পড়ে আছে। চাচা সেই শূন্য চেয়ারটির দিকে তাকিয়ে একটু বিষণ্নভাবে বললেন, 

—‘ছেলেটা হালুয়া খেতে ভালোবাসে, একটু ডাকলে কি হতো না? সবার সাথে বসে নাশতা করতো?’ 

সকাল অবাক হলো। ফাহাদ তো সামনেই বসা। ছুরি, কাটাচামচ দিয়ে টুং টাং শব্দ তুলে মনের আনন্দে ডিম ভাজা আর পরোটা খাচ্ছে। চাচা আবার কোন ছেলের কথা বলছেন? চাচি একটু চাপা গলায় বললেন, ‘তোমার ছেলে, তুমিই ডাকো।’ 

সকাল কৌতূহলের চোখ নিয়ে একবার টিলির দিকে আরেকবার ফাহাদের দিকে তাকালো। ফাহাদ নির্বিকার। টিলিকে একটু অপ্রস্তুত দেখালো। 

চাচা নিজের স্ত্রীর দিকে একটি কঠোর দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন। টিলির দিকে মুখ ফিরিয়ে বললেন, ‘যাও তোমার ভাইকে ডেকে নিয়ে এসো 

সকালের জানামতে চাচা চাচির দুটিই মাত্র সন্তান। টিলি আর ফাহাদ। এই তৃতীয় জন আবার কে? মাটি ফুঁড়ে বেরোলো নাকি এক রাত্তিরের মধ্যে? বাতাসে রহস্যের গন্ধ পাচ্ছিল সকাল। কৌতূহল চাপানোটা মুশকিল হয়ে পড়ছিল তার জন্য। 

টিলি উঠে পড়ল। রান্নাঘরের পাশের ছোট্ট করিডোরের দেয়াল সংলগ্ন দরজাটা ধরে হ্যাঁচকা টান দিলো। দরজার ওপাশটা অন্ধকার। সে বাতি জ্বালালো। খাবার টেবিলের চেয়ারে বসে থেকেই দরজার চৌকাঠের ওপাশের এক টুকরো সিঁড়ি ঘরটা দেখতে পেলো সকাল। সরু একটা সিঁড়ি নেমে গেছে, নিচে। বোঝা গেলো এটা বেজমেন্টের প্রবেশ পথ। 

টিলি ডাকলো, ‘আরশান ভাইয়া! 

কোনো সাড়া শব্দ নেই। দ্বিতীয় বার ডাকলো টিলি। এবার পাতালপুরী থেকে ঊর্ধ্বমুখী হয়ে একটা ভরাট গলার স্বর ভেসে আসলো। 

—‘কী হয়েছে? সব ঠিকঠাক?’ 

—‘ড্যাড ডাকছে তোমাকে। উপরে এসো একবার।’ টিলি বলল। বলেই সরে আসলো দরজাটা থেকে। এসে মায়ের দিকে একটা চোরা নজর দিলো। সকাল লক্ষ্য করলো চাচির মুখে একটা চাপা রাগের আভাস টলমল করছে। সকালের ওই এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকাটা নজরে পড়ল চাচির। চকিতে চাইলেন তিনি সকালের দিকে। সকাল একটু অপ্রস্তুত হাসলো। চাচি পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার চেষ্টা করে বললেন, ‘কী ব্যাপার তুমি হাত গুটিয়ে বসে রইলে কেন? শুরু করো?’ 

সকাল যেন এতক্ষণ অনুমতির অপেক্ষা করছিল। চাচি কথাটি বলার সাথে সাথে সে পরোটার ডিশটা টেনে নিলো কাছে। নাশতা সেরেই তাকে তৈরি হয়ে নিতে হবে। নাবিলা চলে এলো বলে। 

চাচি বললেন, ‘সকাল শোনো আগামীকাল আমার বড় দুই বোন বেড়াতে আসবে এ বাড়িতে। তোমাকে দেখতেই আসবে। তুমি কিন্তু কোথাও যেওনা। বাড়িতেই থেকো।’ 

শুনে সকাল মুখে ‘জি আচ্ছা’ বললেও মনে মনে একটু অসন্তুষ্ট হলো। বিয়ে-শাদীর এখনো কিছুই ঠিক ঠিকানা নেই। এর আগেই এদের আত্মীয় স্বজনের সামনে যদি রঙ মেখে সং সেজে নিজেকে উপস্থাপন করতে হয় তাহলে ব্যাপারটা একটু বাড়াবাড়ি হয়ে যাবে। এই সুদূর আমেরিকায় এসেও এসব সামাজিক চাপের মুখোমুখি হতে হবে বলে ধারণা ছিল না তার। সকাল নিজের চেহারা লুকোতে মুখ নিচু করে মুখে পরোটা আর হালুয়া পুরতে থাকলো। তার চোখ দেখলেই চাচি বিরক্তিটা টের পেয়ে যাবেন। 

কেউ একজন চোখের সামনের চেয়ারটা হাত দিয়ে ধরে টান দিলো। 

—‘বাবা, ডেকেছেন আমাকে?’ পরিষ্কার বাংলায় কথা বলল আগুন্তুক। 

সকাল মুখ তুলে চাইলো। 

সবল চেহারা। শ্যামলা গায়ের রঙ। শক্ত চোয়াল। ঘন বড় আঁখি পল্লব। লম্বায় প্রায় ছয় ফিট। নিঃসন্দেহে ভিড়ের মাঝে নজরকাড়ার মতো চেহারা। সকালের মনে হলো এরকম পরিপূর্ণ পুরুষমানুষ সে এর আগে কোনোদিন দেখেনি। একটা অদ্ভুত সেনসেশন কাজ করলো তার ভেতর। 

—‘তোমার পছন্দের হালুয়া তৈরি হয়েছে আজ। বসো, আমাদের সাথে নাশতা করো। ‘ চাচা বললেন। 

মানুষটা ফাহাদের পাশে বসলো। ফাহাদ পাঁচ আঙ্গুল তুলে হাই ফাইভ দিয়ে বলল, ‘হেই বিগ ব্রো, হোয়াটস আপ! 

—‘গ্র্যান্ড! কিন্তু আজ এতো আয়োজন? কী ব্যাপার?’ সকাল লক্ষ্য করলো ছেলেটার কথার ভঙ্গীতে, চোখের চাউনিতে একটা কেমন গাম্ভীর্য আর নাক উঁচু ভাব আছে। চাচা সকালকে ইঙ্গিত করে বললেন, ‘আজকের আয়োজন ওর জন্যে। ওর নাম সকাল, আমার বন্ধুর মেয়ে। আর সকাল এ আমার বড় ছেলে, আরশান।’

আরশান চাইলো সকালের দিকে, একটু কেমন অবহেলায়। ঠোঁট টেনে হাসার চেষ্টা করে ছোট করে বলল, ‘হ্যালো!’ 

এটুকু বলে সকালকে পাল্টা কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই নিজের বাবার দিকে মুখ ফিরিয়ে নিলো, ‘বাবা, লিজটা আগামী মাসেই কার্যকর হয়ে যাবে। তবে ট্যাক্স ফ্যাক্স নিয়ে এখনো বেশ কিছু ঝামেলা আছে। আগামী সপ্তাহে একটা মিটিং ডেকেছি আমি। আপনি পারলে একটু সময় দিয়েন।’ 

সকাল মাথা নেড়ে হেসে ওর ‘হ্যালো’-র প্রত্যুত্তরে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল কিন্তু সেই উত্তরের জন্য কেউ অপেক্ষা করে নেই বুঝতে পেরে চুপ করে গেলো। হালকা একটা অপমানের ব্যথা চিনচিন করলো বুকে। মাথা নিচু করে খাবারে মনোযোগ দেয়ার চেষ্টা করলো। চাচার বলা ‘বড় ছেলে’ শব্দটা কানে বাজছে। চাচার যে আরেকজন পুত্র আছে বাবা কি তা জানতেন? জেনে থাকলে সকালকে এ ব্যাপারে কিছুই বলা হয়নি কেন? আর এই ছেলে পরিবারের সবার সাথে থেকেও এমন ব্যতিক্রম কেন? মূল বাড়িতে না থেকে ওই পাতালপুরীতে বাস করার পেছনেই বা যুক্তি কী হতে পারে? আর এর প্রতি চাচির আচরণই বা এমন বিরোধপূর্ণ কেন? 

অনেকগুলো প্রশ্ন মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল। এ বাড়ির সাথে তার একটা সম্পর্ক হবার কথা চলছে। চাচা চাচির উচিত ছিল প্রতিটি খুঁটিনাটি তথ্য সকালকে জানানো। কেন এতো লুকোচুরি? 

খাবার শেষ করতে পারলো না সকাল। গলা দিয়ে নামছিল না কিছু। সে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে সবিনয়ে বলল, ‘পার্ডন মি, আমি উঠছি। খাওয়া হয়ে গেছে। আমার ফ্রেন্ড আসছে তো, তৈরি হতে হবে।’ 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *