অক্টোবর রেইন – ৫

‘মা, রহমান চাচার ছেলে মেয়ে আসলে কয়জন? তুমি জানো?’

আই ফোন টেন এসের ভিডিও ক্যামেরায় মায়ের বিস্মিত মুখটার দিকে চেয়ে আতঙ্কিত গলায় প্রশ্ন করলো সকাল।’ 

—‘কেন? দুই ছেলে-মেয়ে?’ 

সকাল একটু সতর্ক দৃষ্টি বুলিয়ে নিলো চারপাশে। তারপর খাদে নামানো গলায় প্রায় ফিসফিস করে বলল, 

—‘মিথ্যে কথা! উনাদের আরেকটা ছেলে আছে। এই একটু আগে দেখা হয়েছে আমার সাথে। চাচা বলেছেন সে উনার বড় ছেলে।’ 

—‘বলিস কী? আমরা তো কিছু জানি না! তোর চাচার আগে এক বউ ছিল। ডিভোর্স হয়ে গিয়েছিল সেই বউয়ের সাথে। তাহলে কি ওই ঘরে কোনো ছেলে-মেয়ে হয়েছিল? এ ব্যাপারে তো আমার সঠিক ধারণা নেই।’ 

—‘উনার আগে আরেকটা বউ ছিল নাকি? বলনি কেন তোমরা আমাকে? আশ্চর্য তো! তুমি বাবাকে ফোনটা দাও, এক্ষুণি।’ উত্তেজিতভাবে বলল সকাল। 

—‘দাড়া তোর বাবা এশার নামাজে গেছে, মসজিদে। আসলেই আমি তার সাথে কথা বলে তোকে জানাচ্ছি। তুই চুপচাপ থাক, কোনো রিয়্যাক্ট করিস না।’ 

—‘আরে না, আমার রিয়্যাক্ট করার কি আছে? কিন্তু এইসব দুই নাম্বারি তো ভালো না মা বুঝছ? বিয়ের সম্বন্ধ করতে চায়, পুরা ফ্যামিলির হিস্ট্রি জানাবে না? আজিব!’ 

—‘হুম তা তো ঠিক, আচ্ছা শোন ওই ছেলেটা কেমনরে?’ বিগলিত গলায় প্রশ্ন করলেন মা। 

—‘কোন ছেলে?’ বুঝেও না বোঝার ভান করলো সকাল। এখানে আসার পর থেকে মা সুযোগ পেলেই কারণে অকারণে ফাহাদের কথা তোলার চেষ্টা করছেন। গতকাল তো ভয়ঙ্কর কাণ্ড বাঁধিয়ে বসলেন। ফোন দিয়ে সরাসরি বলে ফেললেন, ‘আমাদের জামাই বাবাজি কেমন আছে? দে না একটু কথা বলি!’

সকাল ধমক দিয়ে মা’কে চুপ করিয়ে দিয়েছিল। মা মানুষটা একটু বেশি সহজ-সরল। হালকা বোকাও মনে হয়। বোকামীর জন্য বাবার কাছে বকা খায় হর হামেশা। তবুও যদি বুদ্ধিটা একটু খুলতো! 

সকাল আজকে তেমন রেগে গেলোনা। ঠান্ডা মাথায় বলল, ‘মা তোমাকে না আমি বলেছি যে তুমি ওই ছেলেকে নিয়ে বেশি একসাইটেড হইয়ো না? এখনো কিছুই বলা যাচ্ছে না।’ 

—‘বলা যাবে না কেন? ছেলে দেখতে তো রাজপুত্র!’ 

মায়ের কাছে জগতের সকল পাত্রই রাজপুত্র এবং বাবার কাছে হিরো। গেলো মাসে স্কয়ার হসপিটালের এক ডাক্তার সাহেব তার ছেলের স্ত্রী হিসেবে সকালকে মনোনীত করলেন। বাবা ডাক্তার সাহেবের নিয়মিত রোগী। সকাল একবার বাবাকে নিয়ে তাঁর চেম্বারে গিয়েছিল। সেই প্রথম দেখায়ই তিনি সকালকে পছন্দ করে ফেললেন। তার ছেলে ডেন্টিস্ট। তো বাবাতো খুশিতে ঝুমঝুম। ডেন্টিস্টদের নাকি আজকাল অনেক টাকা, ব্রাইট ফিউচার ইত্যাদি ইত্যাদি। এক সন্ধ্যায় বাবা মা বসুন্ধরা সিটির ফুডকোর্টে গিয়ে ডাক্তার সাহেব এবং ডাক্তার পুত্র দুজনের সাথেই দেখা করে আসলেন। আসার পরে বাবা গালভর্তি চন্দ্রাকৃতির হাসি ফুটিয়ে বললেন, ‘ছেলেতো হিরো! গায়ের রং দুধে আলতা!’ 

মা গদ গদ হয়ে বললেন, ‘একদম সাক্ষাৎ রাজপুত্র! তুই তো দেখলি না, দেখলে মাথা ঘুরে যেতো!’ 

সকাল ছবি দেখতে চাইলে বাবা বললেন ছবি তো নেই তবে ফেসবুকের আই ডি এড্রেস আছে, তুই সার্চ দিয়ে দেখতে পারিস। সার্চ দিয়ে সকাল যা দেখলো তাতে সত্যিই মাথা ঘুরে গেলো। টেকো একটা ফর্সা লোক যার বয়স কোনো মতেই চল্লিশের নিচে হবে না। মা-বাবার মতে এই টেকো লোকটা হলো একাধারে রাজপুত্র এবং হিরো! 

—‘তোমার কাছে তো সবাইই রাজপুত্র মা।’ 

—‘অন্য সবার সাথে কি এই ছেলের তুলনা আছে? শোন তুই আর এতো চিন্তা না করে মন স্থির করে ফেল। ভদ্রলোকের আগের ঘরে কোনও ছেলে মেয়ে থাকলেও সমস্যা নেই। তোর বিয়ে তো আগের ঘরের ছেলের সাথে হচ্ছে না। তোর যার সাথে বিয়ের কথা হচ্ছে সে তো নিট এন্ড ক্লিন! 

—‘আগের ঘরে সন্তান থাকা তো পাপ না। কিন্তু ব্যাপারটা উনাদের প্রথমেই আমাদের জানিয়ে দেয়া উচিত ছিল। আর জানো মা এ বাড়িতে ভূত আছে। রোজ রাতে আমি ভূত দেখি জঙ্গলের কাছে।’ 

—‘কী বলছিস? হাবিজাবি কথা বলিস না।’ 

—‘হুম ঠিক বলছি।’ 

—‘তুই আয়াতুল কুরসী পড়ে, বুকে ফুঁ দিয়ে ঘুমাতে যাবি।’ 

—‘হুম তা তো করিই।’ 

—‘সাথে তিন বার সূরা ইখলাস পড়বি।’ 

—‘আচ্ছা পড়বো, বাবা কই? বাবা আসছে?’ 

—‘না আসেনাই।’ 

নাবিলার টেক্সট আসলো। সে লিখেছে ‘ওয়েটিং আউটসাইড।’ 

—‘মা নাবিলা আসছে বুঝছ? তুমি বাবার সাথে কথাটা বলে রাখো, আমি রাতে ফোন দিবো। মানে তোমাদের কাল সকালে। এখন একটু বাইরে যাব।’ 

—‘আচ্ছা সাবধানে থাকিস, ফি আমানিল্লাহ।’ 

—‘ফি আমানিল্লাহ। খোদা হাফেজ।’ 

জানালা দিয়ে উঁকি দিল সকাল। যেহেতু ঘরটা বাড়ির পেছন দিকে তাই দেখে লাভ হলো না কিছুই। জানালার ওপাশে শুধুই জঙ্গল। ফোন করলো নাবিলাকে, মেসেঞ্জারে। 

—‘কই তুই?’ 

—‘তোর বাড়ির সামনে।’

—‘ভিতরে আয়, আমি দরজা খুলছি।’ 

নিচে নেমে আসলো সকাল। দেখা গেলো দরজা হাট করে খোলা। চাচি বাগানে কাজ করছেন। হাতে গ্লাভস পরে কাস্তে, নিড়ানি আর কোদাল দিয়ে মাটি খুঁড়ছেন। চাচিকে আর বিরক্ত করলো না সকাল। নাবিলাকে 

য়ে সোজা উপরে চলে এলো নিজের ঘরে। নাবিলা একটা সাদা কালো ডোরাকাটা ব্লাউজ আর থ্রি কোয়ার্টার প্যান্ট পরেছে। তার মাথায় ক্যাপ। কাঁধে ব্যাগপ্যাক। শ্যামবর্ণ, ছিপছিপে, ঢেউ খেলানো চুলের নাবিলাকে ওয়েস্টার্ন জামায় দারুণ স্মার্ট লাগছে। 

—‘কিভাবে আসলিরে? তুই কি ড্রাইভ করিস?’ সকালের প্রশ্ন। 

—‘লার্নারস হয়ে গেছে। কিন্তু ড্রাইভিং পরীক্ষাটা দেইনাই এখনো, ভয় লাগে।’ 

—‘লার্নারস কী?’ 

—‘মানে ড্রাইভিং লাইসেন্স নেয়ার জন্যে একটা লিখিত পরীক্ষা দিতে হয়, ঐটাকে লার্নারস বলে।’ 

—‘ও, তা তুই আসলি কিভাবে এখানে?’ 

—‘আসলাম বাসে, ট্রেইনে আর হেঁটে। তোকে দেখার জন্যে জান হাতে নিয়ে বের হয়ে আসলাম। আর তুই তো পড়ে পড়ে ঘুমাচ্ছিস। রেডিও হোসনি এখনো।’ 

সকাল হাসলো। সত্যি নাবিলাকে দেখে কী যে ভালো লাগছে! মনে হচ্ছে যেন কত শত বছর পর নিজের কোনো আপন লোকের সাথে দেখা হলো। ওর উপস্থিতিতে চারপাশটা কেমন আপন আপন গন্ধে ছেয়ে গেছে। গত দু’ তিনদিনের ক্লান্তি, অস্বস্তি, একঘেয়েমী, সমস্ত কিছু এক মুহূর্তে উবে গেলো নাবিলার সান্নিধ্যে। 

—‘এখন কোথায় নিয়ে যাবি আমাকে?’ 

—‘তুই ডিসি গিয়েছিস? ওয়াশিংটন ডিসি?’ 

—‘না যাইনি এখনো।’ 

—‘তাহলে চল উবার নিয়ে ডিসি চলে যাই। উবার অবশ্য একটু এক্সপেন্সিভ হয়ে যায়। লেট মি চেক মেট্রোর কী অবস্থা। মেট্রোতে উঠে গেলে এক টানে চলে যেতে পারব। ‘বলে নাবিলা মোবাইল বের করলো ব্যাগ থেকে। আবার বলল, ‘তুই রেডি হয়ে নে।’ 

সকাল জিনসের প্যান্টের সাথে হাতে আর বুকে কুচি দেয়া হালকা বেগুনী রঙের একটা টপ পরলো। কানে বেগুনী দুল পরলো। সিল্কের মতো রেশমি চুলগুলো ছেড়ে দিলো ঘাড়ের ওপর। নিজেকে তার কাছে কখনোই তেমন সুন্দর দেখতে লাগে না। তবে আজ আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে মনে হলো অন্যান্য দিনের তুলনায় ভালো দেখাচ্ছে। 

নাবিলা মিনিট পাঁচেক সময় মোবাইল ঘাঁটাঘাঁটি করে বলল, ‘শোন মেট্রো স্টেশন পর্যন্ত উবারে যাবো। তারপর মেট্রো করে সোজা ডিসি।’ 

—‘তারপর ডিসি গিয়ে কী করব? হোয়াইট হাউজে দাওয়াত আছে নাকি তোমার?’ 

—‘হ, ট্রাম্প মামার সাথে লাঞ্চ করব। ট্রাম্প মামা টুইট করেছে যে আজকে নাবিলা আর সকাল যদি তার সাথে দেখা করতে না যায় তাহলে সে লাঞ্চই করবে না। আমরা কি ট্রাম্প মামাকে অভুক্ত রাখতে পারি?’ 

সকাল হেসে ফেললো। ভালো লাগছিল তার। 

রেডি হয়ে নিচে নামতেই বসার ঘরে চাচাকে দেখা গেলো। চাচা বললেন, ‘তোমরা যাচ্ছ কোথায়?’ 

—‘ডিসি যাচ্ছি চাচা। হোয়াইট হাউজ দেখে আসি।’ হেসে উত্তর দিলো সকাল। 

—‘বেশ, তা যাচ্ছ কী করে? রাইড আছে? গাড়ি নিয়ে এসেছো তুমি?’ শেষের প্রশ্নটা নাবিলার জন্য। 

নাবিলা ন্যাতানো গলায় বলল, ‘না চাচা আমি আসলে এখনো ড্রাইভ করি না।’ 

শুনে চাচা বেশ আফসোসের গলায় বললেন, ‘বলো কী? তাহলে যাবে কী করে অতদূর? আচ্ছা দাড়াও আমার ছেলে ডিসিতেই যাচ্ছে। তোমাদেরকে লিফ্ট দিয়ে দেবে ও।’ 

সকাল ব্যস্ত গলায় বলে উঠল, ‘না না চাচা! লাগবে না। আমরা বাস, মেট্রো এগুলোতেই যেতে পারবো।’ 

—‘শোনো মেয়ে, তোমাকে আমি নিজ দায়িত্বে তোমার বাবা মায়ের কাছ থেকে এতো দূরে নিয়ে এসেছি। এই কটা মাস তোমার ভালো-মন্দের ভার সম্পূর্ণ আমার হাতে। অতএব তোমাকে আমি কোনোভাবেই একা ছাড়ছি না।’ এটুকু বলে তিনি পাঞ্জাবির পকেট থেকে ফোন বের করে একটা নম্বরে ডায়াল করলেন। নাবিলা সকালের কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলল, ‘উনার ছেলে মানে কি তোর ফিয়ন্সে?’ সকাল একটা রাম চিমটি কাটলো নাবিলার বাহুতে, ‘আস্তে বল, শুনবে। ফিয়ন্সে হয়েছে নাকি এখনো?’ চাচা ফোনে কথা বলা শেষ করে জরুরি ভাবে বললেন, ‘যাও যাও, ও বাইরেই আছে। আরেকটু দেরি হলেই মিস করে ফেলতাম।’ বের হতে হতে নাবিলা প্রশ্ন করলো, ‘কেমন ছেলেটা? মানে যার সাথে তোর বিয়ের কথা হচ্ছে?’ 

—‘ভালোই।’

—‘হ্যান্ডসাম?’ 

—‘হ্যাঁ হ্যান্ডসাম তো বটেই।’ 

বাসা থেকে বেরিয়ে দেখা গেলো ড্রাইভ ওয়েতে একটা কালো রঙের টয়োটা কনভার্টিবল গাড়ি দাড়ানো। কিন্তু এটা তো ফাহাদের গাড়ি নয়। সকাল ঘাড় ঘুরিয়ে এদিক সেদিক চাইতে লাগলো। ফাহাদ কোথায়? 

মিনিট দুয়েকের মাথায় টয়োটা গাড়িটা তারস্বরে হর্ন বাজাতে লাগলো। বোঝা গেলো ড্রাইভার কারো দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করছে। তিন-চারবার হর্ন বাজানোর পর অধৈর্য ড্রাইভার সশরীরে গাড়ি থেকে বেরিয়ে এসে পরিষ্কার বাংলায় প্রশ্ন করলো, ‘আপনারা কি ডিসি যাচ্ছেন?’ 

সকাল বিস্মিত হয়ে আবিষ্কার করলো গাড়ির ড্রাইভার ফাহাদ নয়, আরশান। কেন জানে না, ওকে দেখা মাত্র একটু কেমন নার্ভাস হয়ে গেলো সে। 

নাবিলাই কথা বলল, ‘জি, আমরা ডিসি যাচ্ছি।’ 

আরশান মাথা নুইয়ে দাঁড়িয়ে সবিনয়ে বলল, ‘আসুন আপনাদের খেদমতে এই অধমকে নিয়োগ দেয়া হয়েছে।’ 

ব্যবহার দেখে নাবিলা অভিভূত। সে মুগ্ধ গলায় সকালকে বলল, ‘বাহ্! তোর পছন্দের প্রশংসা করতেই হয়। দারুণ মানাবে দুজনকে! 

নাবিলার কথা শুনে আরশানের পুরু ভ্রু দুটো সূচালো হয়ে উঠল। চোখ নাচিয়ে একবার সকালের দিকে আরেকবার নাবিলার দিকে তাকালো সে। 

সকালের মুখ খানা ফাটা বেলুনের মতো চুপসে গেলো। এতো লজ্জা বোধ হয় সে জীবনে আর কখনো পায়নি। কান ঝাঁ ঝাঁ করে উঠল রাগে। তেজের আগুনে ঝলসে উঠে সে নাবিলার বাহুতে আজকের দ্বিতীয় চিমটিটা কাটলো। এবারেরটা একটু বেশি জোরেই হয়ে গেলো। নাবিলা ব্যথায় ককিয়ে উঠল ‘উফ’ বলে। 

আরশান ঠোঁট টিপে হেসে ফেললো সকালের বেগতিক অবস্থা দেখে। আর ওই টেপা ঠোঁটের নাক উঁচু হাসিটা সকালের সর্বাঙ্গে জ্বালা ধরিয়ে দিলো। মাথা হয়ে উঠল আগুন গরম। 

আরশানকে একটুও বিচলিত দেখালো না। তার চোখে কৌতুক খেলছে। 

সকাল আরশানের ওই কৌতুকভরা ড্যামকেয়ার দৃষ্টি দেখে আর চুপ থাকতে পারলো না, হঠাৎ ফেটে পড়ল আগ্নেয়গিরির মতো, ‘দেখুন ওভাবে তাকানোর কিছু নেই। আপনি যেটা ভাবছেন সেটা সত্য নয়।’ 

আরশান সকালের কথা শুনে যেন বেশ অবাক হলো। নির্দোষ গলায় প্রশ্ন করলো, ‘ও! তাই নাকি? কিন্তু আমি ঠিক কী ভাবছি বলুন তো? আমি নিজেই জানি না আমি কী ভাবছি।’ এটুকু বলে নাবিলার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আপনি কি জানেন আমি কী ভাবছি?’ 

সকাল আরশানের ঠাট্টাটা ধরতে পারলো, এবং ধরতে পেরে তার মুখখানা অপমানে থম থম করে উঠল। মনে পড়ল খাবার টেবিলেও আজ খুব একটা ভদ্র ব্যবহার করেনি এই যুবকটি তার সাথে। 

মেজাজ বিগড়ে গেলো। মুড অফ হয়ে গেলো। তাল কেটে গেলো। সকাল কটমট করে আরশানের দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে নাবিলাকে ঝাঁঝের সাথে বলল, ‘তুই যা নাবিলা, আমি যাবো না।’ 

বলেই ঘুরে দাড়ালো। 

নাবিলা তখন একটু হকচকিয়ে গেছে। তার যে বিশাল বড় কোনো ভুল হয়ে গেছে তা সে একটু একটু আঁচ করতে পারছে। সে শশব্যস্ত হয়ে সকালের হাত ধরে ফেললো পেছন থেকে, ‘দোস্ত আমি জানি না কী হইছে, বাট আমি সরি যদি আমি কোনো দোষ করে থাকি। কিন্তু প্লিজ তুই এভাবে চলে যাস না।’ 

সকাল নাবিলার হাতটা এক ঝাড়ন দিয়ে সরিয়ে দিলো। দ্রুত পায়ে হেঁটে বাড়ির ভেতর ঢুকে গেলো সে। বসার ঘরে চাচা চাচি বসে ছিলেন। সকালের অমন অগ্নিমূর্তি দেখে চাচি হতভম্ব গলায় প্রশ্ন করলেন, ‘কী হয়েছে? সব ঠিক আছে তো?’ 

সকাল কোনো রকমে বলল,’ শরীরটা ভালো লাগছে না চাচি। আজ বেরোবো না।’ 

সকালের ওই আকস্মিক প্রস্থান দেখে আরশান একেবারে হতভম্ব হয়ে গেলো। অবাক গলায় বলল, ‘ইজ শী মেন্টালি সিক অর সামথিং? আই মিন দ্যাট ওয়াজ রিয়েলি উইয়ার্ড, রাইট? আই ডোন্ট ইভেন নো, হোয়াট ডিড আই ডু রংগ! 

নাবিলার মুখটা বিস্ময়ে হা হয়ে ছিল। এই সকালকে সে চেনে না। এত তুচ্ছ একটা ঘটনায় সকাল যে এমন ন্যাকা নাটক করতে পারে এটা তার বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে। সকাল এতো পাল্টালো কখন? 

নাবিলা ভীষণ বিনীত গলায় আরশানকে বলল,’ আই এম সো সরি, আপনার সময় নষ্ট করলাম। প্লিজ মাফ করে দিবেন।’ 

বলে সে দৌড় দিলো বাড়ির দিকে। 

সকাল নিজের ঘরে এসে বিছানায় ঝাঁপিয়ে পড়েছে। সে জানে না কেন তার খুব কান্না পাচ্ছে। ভীষণ কান্না। 

নাবিলার পায়ের আওয়াজ পেতেই চোখ মুছলো সকাল। নাবিলা ঘরের ভেতর ঢুকে একটু কড়া ভাবে বলল, 

—‘তুই এরকম নাটক করতে শিখলি কবে থেকেরে? 

সকাল কিছু বলল না। যেমন বালিশে মুখ চাপা দিয়ে উপুড় হয়ে শুয়ে ছিল তেমনিই শুয়ে রইল। নড়লোও না। 

—‘তুই কাঁদছিস?’ সকাল নিশ্চুপ। 

—‘শেহজাদী! লিসেন টু মি। তুই কাঁদছিস? কাহিনি কি? আমাকে একটু খুলে তো বলবি।’ 

সকাল মুখ খুলল না। নাবিলা অধৈর্য গলায় বলল, ‘প্রব্লেম কী? এমন ইমোশনাল হয়ে যাওয়ার মতো তো কিছু ঘটে নাই তাই না? তুই কি ওই ছেলের প্রেমে পড়ে গেছিস?’

সকাল চকিতে ঘুরে তাকালো নাবিলার দিকে। ফোলা চোখ আর ভারি গলা নিয়ে ত্যাড়া ভাবে বলল,’ কার প্রেমে পড়েছি? কী বলতে চাস তুই?’ 

—‘না মানে, ঐযে ঐ ছেলেটার।’ 

—‘কোন ছেলে?’ 

—‘যার সাথে আমাদের ডিসি যাওয়ার কথা ছিল। যে টেকনিক্যালি তোর ফিয়ন্সে। কিন্তু আমি বুঝতে পেরেছি যে আমার কোথাও ভুল হচ্ছে। 

—‘ওই ছেলেটা মোটেও টেকনিক্যালি আমার ফিয়ন্সে না। সে যে কে তা আমি এখন পর্যন্ত ঠিক মতো জানি না। তবে যতটুকু শুনেছি তাতে মনে হয় সে ফাহাদের ভাই হয় সম্পর্কে।’ 

—‘ফাহাদ কে?’ 

—‘যার সাথে আমার বিয়ে হওয়ার কথা।’ 

নাবিলা মাথায় হাত দিয়ে বলল, ‘মাই গড! এতো দেখি রহস্যের উপর রহস্য!’ একটু থেমে সে আবার বলল, ‘কিন্তু আমার তো একেই পছন্দ হয়েছিল।’ 

—‘এক নজর দেখেই পছন্দ হয়ে গেলো তোমার।’ ঠেস দেওয়া গলায় বলল সকাল। 

—‘এক নজর দেখে পছন্দ হওয়ার মতোই তো ছেলেটা। আর জানি না কেন যেন আমার মনে হয়েছে তোদের দুজনকে পাশাপাশি খুব মানাবে। তাই ফট করে কথাটা বলে বসেছি। সরি দোস্ত। কিন্তু তুই অমন নাটক করলি কেন? তুই তো এতো খ্যাত না। তুই মনে হয় ওর প্রেমে পড়ে গেছিস।’ 

সকাল একটা বড় ধমক দিলো নাবিলাকে, ‘ফালতু কথা বন্ধ কর তো! আমি কোনোদিন কারো প্রেমে পড়িনাই বুঝছিস? আমার ভিতরে ঐসব নাই। তোকে তো আগেও বলেছি। আর এই ব্যাটাকে দেখছি আমি আজকে ব্রেকফাস্টের টেবিলে। কোন দুঃখে আমি ওর প্রেমে পড়ব? এতো সোজা?’ 

নাবিলা জমানো গলায় বলল, ‘বাট হি ইজ হ্যান্ডসাম! আমার মনে হয় তোর উচিত ফাহাদকে ডাম্প করে একে ধরা।’ 

—‘ওয়েল ফাহাদও গুডলুকিং, তোর কি ধারণা যেন তেন কোনো ছেলের সাথে আমার বিয়ের কথা হতে পারে? আর বাইরের আবরণটাই সব না। এই ব্যাটা দাম্ভিক, অহংকারী। কথা বলার ঢংটা কেমন দেখিস না?’ 

নাবিলা হাসে, ‘কেন আমার তো ভালোই লাগল। বেশ পারসোনালিটি আছে।’ সকাল নাবিলার কথায় হাসতে পারলো না। বুকের মাঝে কী যেন একটা শেলের মতো বিঁধছিল তার। ওই ছেলেটা সামনে এলেই সে অমন আতরের খুশবু পায় কেন? সে কি পাগল হয়ে যাচ্ছে? 

দরজায় করাঘাত করছে কেউ একজন। 

ভেতর থেকে সকাল চেঁচিয়ে প্রশ্ন করলো, ‘কে?’ 

—‘আমি’ ফাহাদের গলা শোনা গেলো ওপাশ থেকে। সকাল চিনতে পারলো গলাটা। নাবিলাকে চাপা গলায় বলল, ‘ফাহাদ!’ 

নাবিলা বিছানায় আধশোয়া হয়েছিল। নামটা শুনে সোজা হয়ে নড়েচড়ে বসলো। সকাল উঠে গিয়ে খুললো দরজা। দুহাত হাফ প্যান্টের পকেটে ঢুকিয়ে সটান দাঁড়িয়ে আছে ফাহাদ। সকাল দরজা খুলতেই বলল, ‘হেই, সানশাইন! হোয়াটস আপ?’ 

—‘এইতো আমার ফ্রেন্ড এসেছে।’ 

ফাহাদ উঁকি দিয়ে দেখলো ঘরের ভেতরটা। নাবিলা হাত নেড়ে ‘হাই’ দিলো। উত্তরে হাসল ফাহাদ। তারপর বলল, 

—‘ভাবছিলাম আজ তো সানডে। আমার অফ। সো তুমি কোথাও যেতে চাইলে আমি তোমাকে সঙ্গ দিতে পারি। কাল থেকে আবার অফিস শুরু। নেক্সট উইকএন্ডের আগে আর টাইম পাওয়া যাবে না।’ 

প্রস্তাবটা পেয়ে সকাল সত্যি খুশি হলো। 

—‘খুব ভালো হয়, আমরা এমনিতেই ডিসি যাওয়ার প্ল্যান করছিলাম। তুমি আমাদের নিয়ে যাবে?’ 

—‘শিওর থিংগ! জাস্ট পাঁচ মিনিট দাও আমি তৈরি হয়ে আসছি।’ ফাহাদ চলে যেতেই নাবিলা কলকল করে বলে উঠল, ‘ওয়াও! জোশ তো। তুই কাকে রেখে কাকে চুজ করবি দোস্ত?’ 

—‘ধুর, আজাইরা কথা বলিস নাতো, গাধী! এখন দেরি না করে বের হ, লেটস হিট দ্যা রোড।’ 

নাবিলা ঝপাং করে উঠে দাড়ালো বসা থেকে, ‘ইয়াহ, লেটস হিট দ্যা রোড। দিনটা মাটি হতে হতে বেঁচে গেলো। থ্যাংকস টু ফাহাদ। 

—‘থ্যাংকসটা ওকে সরাসরি দেয়াই উচিত হবে বলে মনে করি।’

—‘হ্যাঁ তা তো দিবোই।’ 

মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই সবাই তৈরি হয়ে নিচে নেমে এলো। সকাল ড্রাইভিং সিটের পাশে বসে সিট বেল্ট বেঁধে নিলো। সামনের সিটে সিট বেল্ট বাঁধা এ দেশে আবশ্যিক। 

নেইবারহুড ছেড়ে আই (ইন্টার স্টেট) ফোর নাইন্টি ফাইভের রাস্তা ধরে ষাট মাইল বেগে ছুটলো মার্কিন মুলুকের রাজধানীর উদ্দেশ্যে ফাহাদের কালো রঙের ভোক্স ওয়াগন ইয়স গাড়ি। এ রাস্তার সর্বচ্চ গতি ঘণ্টায় পঁয়ষট্টি মাইল। রাস্তার ধারে সাইনবোর্ডে বড় বড় করে লেখা আছে স্পিড লিমিট। গাড়ির গতি এর সামান্য বেশি হতে পারে কিন্তু মাত্রাতিরিক্ত বাড়িয়ে ফেললেই পুলিশ তাড়া করবে। রাস্তায় পুলিশের গাড়ি খুব একটা চোখে না পড়লেও এরা আড়ালে আবডালে ঘাপটি মেরে বসে থাকে। কেউ নিয়ম ভঙ্গ করলেই পুলিশি গাড়ির মাথার লাল নীল বাতি জ্বালিয়ে তাড়া করা শুরু করে। আলো জ্বালিয়ে তাড়া করার মানে হলো তোমাকে এখন থামতে হবে। থামানোর পর লাইসেন্স যাচাই করে ইচ্ছেমতো মোটা অংকের টিকেট ধরিয়ে দেয়। ফাহাদের গাড়ির জিপিএস একটু বাদে বাদে সতর্ক বার্তা দিচ্ছে। আশেপাশে পুলিশ থাকলেই সে জানিয়ে দিচ্ছে, ‘পুলিশ রিপোর্টেড এহেড।’ 

সকাল ডুবে গিয়েছিল বিস্তৃত নীল আকাশের মাঝে, সূর্য কিরণে সমুদ্ভাসিত মসৃণ রূপালি রাস্তা আর রাস্তার ধারের সবুজ অরণ্যের মাঝে। সারাটা বন জুড়ে চলছে আলো ছায়ার লুকোচুরি খেলা। গাছের পাতার ফাঁকে ফাঁকে ঝিকোচ্ছে রোদ। কত রকমের গাছ! কোনওটা ঝোপাকৃতির, কোনওটা লম্বা, কোনওটা বেটে। এর মাঝে একটা গাছ আমগাছ নয় কিন্তু আমগাছেরই মতো দেখতে। ঝোপালো গাছগুলোর গায়ে সাদা সাদা বন্য ফুল ধরে আছে। চলন্ত গাড়ির ভেতর থেকে যতটা সম্ভব পুলকভরে দেখে নেয়ার চেষ্টা করলো সকাল। এর মাঝে কিছু গাছ লম্বায় প্রায় তিন চারতলা বিল্ডিঙের সমান হবে। এতো লম্বা গাছ সে এর আগে কোনোদিন দেখেনি। বিস্মিত হয়ে ফাহাদকে প্রশ্ন করলো, ‘এইযে লম্বা গাছগুলো, এগুলোর নাম কী?’

ফাহাদ জানালা দিয়ে তাকালো সকাল ঠিক কোন গাছের কথা জানতে চাইছে তা বোঝার জন্য। ভালোমতো চেয়ে দেখে, বুঝে শুনে আমতা আমতা করে সে বলল, ‘সঠিক জানি না। ট্রিইজ আর ট্রিইজ। রাইট?’ 

অর্থাৎ গাছ তো গাছই এতো নাম জেনে কী হবে? 

উত্তরটা পছন্দ হলো না সকালের। একটু মন খারাপ হলো এই ভেবে যে মানুষটার বুঝি প্রকৃতিতে মনোযোগ নেই। সুন্দরের মাঝে ভাসতে ভাসতে সে সুন্দরের দাম দিতে ভুলে গেছে। এ পৃথিবী যে কী আশ্চর্য রূপবতী এই সত্যটা মন দিয়ে অনুভব করতে না পারলে একজন মানুষের গোটা জন্মটাই বৃথা বলে ধারণা সকালের। মানুষের বুকের ভেতরেও তো একটা পৃথিবী আছে! ভেতরের সেই পৃথিবীর সাথে বাইরের পৃথিবীর সংযোগ ঘটানোর মাঝেই বেঁচে থাকার চরম সার্থকতা। 

ফাহাদ এভাবে কখনো ভেবেছে কি? ভাববার সময়ই বোধহয় পায় না। এই কেজো দেশে অত ভাবনা-চিন্তা করার অবকাশ কোথায়? 

হাইওয়েগুলো বিরতিহীন। হাইওয়ে থেকে বেরোতে হলে একজিট নিতে হবে। প্রায় তিরিশ মিনিট টানা যাত্রার পর একজিট ফিফটি সেভেন ধরে ওরা হাইওয়ে থেকে বেরোলো। কিছুটা যেতেই চোখে পড়ল স্বচ্ছ নীল জলের পটোম্যাক নদী। জলের ওপর ভাসছে ছোট বড় নানা আকারের বোট। নদীর পাড় ঘেঁষে শেষ গ্রীষ্মের কমলা রোদ গায়ে মেখে শত বছরের ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে মার্কিন রাজধানী ওয়াশিংটন ডিসি। সিনেমায় দেখেছে সকাল। এরকম রাস্তা, বাড়িঘর, গাড়ি ঘোড়া, নদী, নদীর স্বচ্ছ জল। নিজের চোখে দেখে বিশ্বাস হচ্ছিল না এটা বাস্তব নাকি সিনেমার পর্দা। গাড়ি উঠে গেলো ব্রীজের ওপর। ব্রীজের একপাড়ে ভার্জিনিয়া, অন্য পাড়ে ডিসি। ওয়াশিংটন ডিসট্রিক্ট অব কলোম্বিয়া মূলত ভার্জিনিয়া এবং মেরিল্যান্ডের কিছু অংশ নিয়ে গঠিত। এটি যুক্তরাষ্ট্রের পঞ্চাশটি অঙ্গরাজ্যের কোনওটির অংশ নয়। সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র একটি ফেডারেল ডিসট্রিক্ট। 

ডিসিতে ঢুকতেই শহর শহর একটা ভাব ছড়িয়ে গেলো হাওয়ায়। বিশ্বের সবচেয়ে উন্নত দেশের রাজধানীটি যেন ঠিক এমনই হওয়ার কথা ছিল। রাস্তা ঘাট ছিমছাম। গাড়ি চলছে ধীরে ধীরে। পথচারীরা সুশৃঙ্খল ভাবে হাঁটছে ফুটপাথ ধরে। সিগন্যাল দেখে দল বেঁধে রাস্তা পার হচ্ছে। এদের সাজ পোশাক এবং চলন বলন দেখেই বোঝা যাচ্ছে এরা রাজধানীর বাসিন্দা কিংবা রাজধানীর কোনও দপ্তরে কর্মরত পেশাদার মানুষ। পুরো রাস্তাজুড়ে ব্যস্ত মানুষের ভিড়। এ তল্লাটে যেন কেউ থেমে নেই, বসে নেই, সবাই ছুটছে যার যার জীবিকার সন্ধানে। এ শহর পুরনো। তাই দালান কোঠা, অফিস বিল্ডিং সব কিছুতে একটা রাজকীয় ছোঁয়া আছে। আধুনিকতার চেয়ে আভিজাত্যের উপস্থিতিটাই প্রবল বলে মনে হলো তার। 

মনে হলো ঢাকা শহরে এই সুবিন্যস্ত, পরিচ্ছন্ন ভাবটিরই বড় অভাব। সে চোখ বন্ধ করে তার প্রাণের শহরকে কল্পনা করার চেষ্টা করল। সেখানে এখন রাত দশটা। তাদের মিরপুরের তিনতলা বাড়িটি আর একটু বাদেই ঘুমে ঢলে পড়বে। দারোয়ান আসাদ চাচা টুলে বসে বসে ঝিমোবে। বাবা মা নিশ্চয়ই এখন খাবার টেবিলে। খাওয়া-দাওয়ার পাট চুকিয়ে মা রোজকার মতো বেশি করে জর্দা দিয়ে পান বানিয়ে মুখে দেবে। বাবা ঘুমোতে যাবার আগে কিছুক্ষণ টিভির সামনে বসে খবর শুনবে। দেশের কথা মনে পড়তেই বুকটা কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগতে লাগলো। 

ডিসি শহরে গাড়ি নিয়ে চলাচল করা দুষ্কর বলে জানালো ফাহাদ। যেখানে সেখানে পার্কিং করা যায় না। একটু এদিক-সেদিক হলেই গাড়ি টো হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে। টো হওয়া গাড়ি ছাড়ানোর জন্য আবার গচ্চা দিতে হয় শ খানেক ডলার। যেকোনো একটি নিরাপদ জায়গায় গাড়ি পার্ক করে রেখে হেঁটে অথবা উবার নিয়ে গোটা শহর দেখতে হবে। 

—‘তো গাড়ি কোথায় পার্ক করতে হবে? পার্কিং ফি আছে? মানে টাকা দিতে হয়?’ সকালের প্রশ্ন। 

—‘হ্যাঁ টাকা দিয়েই পার্ক করতে হয়। নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা দিয়ে সীমিত সময়ের জন্য পার্ক করতে পারবে তুমি। তবে আমার ফ্রি পার্কিং এর একটা ব্যবস্থা আছে। দেখি ওখানে করতে পারলে তো হয়েই গেলো। না হলেও সমস্যা নেই। টাকা দিয়েই পার্ক করবো।’ 

ধীরে ধীরে অলিগলি পার করে গাড়ি এসে দাড়ালো একটি উঁচু ভবনের সামনে। ফাহাদ সেলফোন বের করে ডায়াল করলো একটা নাম্বারে। ওপাশ থেকে কেউ ফোন ধরল না। 

‘ফোন তো ধরছে না। ভেতরে গিয়ে দেখি।’ স্বগতোক্তি করলো ফাহাদ। উঁচু ভবনটির গেট পার হয়ে গাড়ি নেমে গেলো সোজা নিচে আন্ডারগ্রাউন্ড পার্কিং লটে। জায়গা খুঁজে পেতে খুব একটা বেগ পেতে হলো না। ছুটির দিন বলে আজ এই অফিস ভবনটায় গাড়ির সংখ্যা একেবারে কম বললেই চলে। গাড়ি প্যারালাল পার্কিং করলো ফাহাদ। তারপর নামতে নামতে বলল, ‘চল উপরে যাই, এই বিল্ডিং এ আমার ভাইয়ের অফিস। তো ওর কাছ থেকে একটা স্টিকার নিয়ে এসে গাড়ির সামনে লাগিয়ে দিতে হবে। স্টিকারটা থাকলে আর কেউ ঝামেলা করবে না।’ 

সকাল স্টিকারের কাহিনি ঠিক মতো বুঝে উঠতে পারলো না তবে তার কানে ‘ভাইয়ের অফিস’ শব্দটা ছুরির মতো বিধলো। 

ভেতরে অস্বস্তি দানা বাঁধছে। সেই অস্বস্তির ছাপ পড়ছে মুখে। কিন্তু কাউকে কিছু বুঝতে দিতে চাইছে না সে। যার কথা ভাবছে সত্যিই কি আবার তার সামনে গিয়েই পড়তে হবে? কিন্তু কেন? একই দিনে এতবার কেন তার মুখোমুখি হতে হচ্ছে? 

.

লিফটে উঠে তিন নম্বর বোতাম চাপলো ফাহাদ। নাবিলা বলল, ‘তোমার ভাই কী করেন? কীসের অফিস এটা?’ 

—‘সে আর্কিটেক্ট।’ 

—‘ও আচ্ছা।’ বলে নাবিলা তাকালো সকালের দিকে। সকালের কপালে কুঞ্চিত রেখা। নাকের ডগায় বিন্দু বিন্দু ঘাম। 

লিফটের দরজা খোলার পর করিডোর দিয়ে অনেক খানি হেঁটে আসতে হলো ওদের। সে সময়টায় সকাল একবার ভাবলো বলে, আমি নিচে অপেক্ষা করি তোমরা কাজ সেরে এসো। অফিসে কাজের সময় এতো হৈ হট্টগোল করাটা কি ঠিক হচ্ছে? কিন্তু অনেকটা পথ চলে আসার পর এমনটা বলা সমীচীন হবে না ভেবে সে চুপ করে গেলো। 

পাশাপাশি সারিবদ্ধ ভাবে কয়েকটা ঘর। বাইরে ওয়েটিং রুমে সোফার ওপর বসে আছেন দুজন অপেক্ষারত ব্যক্তি। একজন মাঝবয়সী সাদা চামড়ার ভদ্রলোক। তার হাতে পত্রিকা। অপরজন অল্প বয়সী চাইনিজ একটি মেয়ে। সে বিরতিহীনভাবে স্মার্টফোন ঘাঁটছে। কেউ অযথা বসে নেই। একটা মুহূর্তও এরা বিনা কাজে ব্যয় করতে চায় না যেন। সকালরা যে সোফার ওপর বসলো তার ঠিক নয়, দশ কদম সামনেই কাচের একটি দরজা। দরজার ওপাশে আরো তিন চারজন নারী পুরুষ সঙ্গে নিয়ে একটা গোল টেবিলের চেয়ারে বসে আছে ছেলেটা। কথা বলছে হাত নেড়ে। তার সামনে টেবিলের ওপর ল্যাপটপ আর কফির মগ রাখা। বোঝা যাচ্ছে কোনও জরুরি মিটিং চলছে। ছেলেটির পরনে সাদা ফুলহাতা শার্ট, কালো টাই। নাকের ডগায় রিমলেস রিডিং গ্লাস। সুন্দর পরিপাটিভাবে চুল ছাটা। গালে দাড়ি নেই। বেশ ফিটফাট ভাব। সকাল মনোযোগ দিয়ে দেখছিল। দেখতে দেখতে তার হঠাৎ মনে হলো, কাজ করার সময়ই বুঝি পুরুষ মানুষকে সত্যিকার অর্থে সুন্দর দেখায়। কর্মরত, গম্ভীর আরশানকে ঠিক এই মুহূর্তে যতটা সুন্দর দেখাচ্ছে, ওই ফুল হাত সাদা শার্ট, কালো টাই আর রিমলেস চশমায়, ঠিক এতটা সুন্দর পুরুষ সে এর আগে কোনোদিন দেখেনি। 

কফির মগ হাতে নিয়ে সিপ করতে গিয়ে আরশানের চোখ পড়ল কাচের দরজায়। ওপাশে দাড়ানো মেয়েটাকে দেখে সে থমকে গেলো। 

পুরু ভ্রু দুটোকে ত্রিভুজ বানিয়ে নাকের ডগা থেকে রিডিং গ্লাস নামিয়ে রাখল সে টেবিলের ওপর। চোখ বড় করে তাকালো মেয়েটার দিকে। এটা আজ সকালবেলার সেই উইয়ার্ড মেয়েটা না? যে অযথা হৈ চৈ বাঁধিয়ে দিয়ে নাটক ফাটক করে একটা তুলকালাম কাণ্ড বাঁধালো? এই মেয়ে এখানে কী করছে? আর এভাবে তার দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে কী? সমস্যা কী মেয়েটার? 

চোখে চোখ পড়তেই সকাল বেশ ঘাবড়ে গেলো। কয়েক সেকেন্ড থ মেরে ব্যাক্কলের মতো চেয়ে থাকল সে আরশানের দিকে। এরপর দ্রুত চোখ সরিয়ে নিলো নিজের পায়ের দিকে, জুতোর দিকে, মেঝের কার্পেটের দিকে। ভাব দেখালো যেন হারিয়ে যাওয়া কোনো জিনিস খুঁজতে ব্যস্ত সে। 

সকালের পাশে ফাহাদ আর নাবিলাকে দেখা গেলো। ওদের দেখতে পেয়েই ঘটনা বুঝতে পারলো আরশান। ডিসি আসলে ফাহাদ এই বিল্ডিং এই গাড়ি পার্ক করে সচরাচর। মিটিং শেষ হতে আরও মিনিট দশেক সময় লাগলো। 

ড্রয়ার থেকে একটা পার্কিং পারমিট বের করে নিয়ে অফিস ঘর থেকে বেরিয়ে আসলো আরশান। ফাহাদ আরশানকে দেখতে পেয়েই কাছে এগিয়ে এসে ওর পিঠ চাপড়ে বলল, ‘কী ব্যাপার ব্রো, সানডেতেও তুমি অফিস করছ? এতো কাজ করলে তো মারা যাবা।’ 

আরশান পার্কিং পারমিট ফাহাদের হাতে তুলে দিয়ে বলল, ‘এই প্রজেক্টটা একটু তাড়াতাড়ি শেষ করতে চাইছি। তুমি তো জানো অক্টোবরে আমার একটা ভ্যাকেশন চাই আর অক্টোবর আসতে তো খুব বেশি দেরি নেই। তাই এর আগেই কাজটা শেষ করতে হবে।’ 

ফাহাদ পারমিটটা হাতে নিয়ে সকালদের বলল, ‘তোমরা থাকো। আই উইল বি ব্যাক ইন ফাইভ মিনিটস।’ 

ফাহাদ চলে গেলে আরশান নাবিলার দিকে তাকালো। নাবিলা হেসে বাংলায় বলল, ‘কী ভাগ্য দেখুন না! আবার আপনার সাথে দেখা হয়ে গেলো।’ 

—‘হুম তাই তো দেখছি। যাক, অবশেষে আপনাদের ডিসি আসা হলো। আমার সাথে আসতে আপত্তি থাকলেও কোনো না কোনো ভাবে আসা তো হলো’ কথা শেষ করে আরশান আড়চোখে চাইলো সকালের দিকে। মেয়েটার চোখ তখনও মেঝের দিকে নিবদ্ধ। এই মেয়ের মাথায় নির্ঘাৎ ছিট আছে। হ্যাঁ ঠিক তাই। আরশান দেখেছে মেয়েটা গভীর রাতে বারান্দায় একলা বসে আপন মনে কথা বলে, গান করে, খিল খিল করে হেসে ওঠে। বারান্দার এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে নবাবী চালে পায়চারী করে। হাঁটার ধরন দেখলে মনে হয় যেন সে কোনো এক অচিনপুরের রাজকন্যা। কিন্তু এখন তো দেখে মনে হচ্ছে ভাজা মাছটা উল্টে খেতে জানেনা। 

সকালের কাণ্ড দেখে নাবিলার অস্বস্তি হচ্ছিল। একে তো আজ সকালেই কেমন বাজে একটা কাণ্ড করে বসলো ছেলেটার সাথে। তার ওপর এখন ভাবটা এমন দেখাচ্ছে যেন সামনে দাড়ানো আস্ত জ্বলজ্যান্ত ছয় ফিট লম্বা সুঠাম দেহের মানুষটা তার চোখেই পড়ছে না। মাটির দিকে তাকিয়ে আপন মনে কী যেন ভাবছে। সকালটা এমন গেঁয়ো হয়ে গেলো কবে থেকে আল্লাহ জানে। 

নাবিলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার চেষ্টা করে বলল, ‘এটা আপনার অফিস?’ 

—‘হুম এই ফার্মেই আপাতত কাজ করছি। আপনারা দাঁড়িয়ে কেন? বসুন না। চলুন এক সাথে লাঞ্চ করা যাক।’ আরশান কথা বলছে নাবিলার সাথে। কিন্তু তাকিয়ে আছে সকালের দিকে। তার চোখে একরাশ কৌতূহল। আজ পর্যন্ত কোনো মেয়ে তাকে এরকম এড়িয়ে চলার চেষ্টা করেনি। এই মেয়েটা কেমন যেন একটু অন্যরকম। বলতে কি নাশতার টেবিলে একে তেমন একটা লক্ষ্য করেনি সে। খানিক বাদে যখন গাড়িতে উঠতে গিয়ে সিন ক্রিয়েট করলো, তারপর থেকে একটু একটু মেয়েটাকে নিয়ে ভাবছে সে। নাম কী এই মেয়ের? বাবা বলেছিলেন নাশতার টেবিলে। কিন্তু এখন মনে পড়ছে না। 

সকাল তখন ব্যাগ থেকে সেলফোন বের করে টেপাটেপি করছে। লাঞ্চের কথা শুনে সে মনে মনে প্রমাদ গুণলো। আজ কার মুখ দেখে ঘুম থেকে উঠেছিল কে জানে! এই লম্বু সুন্দর শয়তানটা পিছুই ছাড়ছে না। লাঞ্চ করবে! মানে মেয়ে দেখলে এদের মাথা ঠিক থাকে না। কাজ টাজ সব ফেলে রেখে দুইটা মেয়ে দেখতে পেয়ে নাচতে নাচতে চলে আসছে লাঞ্চ করতে! সব ছেলেরাই একই রকম। হ্যাংলা আর ছ্যাচড়া। বিড় বিড় করছিল সকাল। 

—‘কিছু বললেন?’ আরশান এই প্রথম সরাসরি কথা বলল সকালের সাথে। সকাল মাথা তুলে চাইলো। ওই লম্বা ঘন পল্লবঘেরা গভীর চোখ দুটির দিকে চাইতেই তার বুকে কিসের যেন এক ধাক্কা লাগলো। হঠাৎ নাকে এসে লাগলো আতরের খুশবু 

কী ভীষণ অসহায় যে দেখালো তখন সকালের মুখ খানা। সে অনেক কষ্টে বলল, ‘না কিছু বলিনি! একটু ওয়াশরুম হয়ে আসছি।’ বলে সকাল হাঁটা ধরলো। আরশান বাঁধা দিয়ে বলল, ‘ওয়াশরুম ঐদিকে নয়, এইদিকে।’ 

বিচলিত সকাল ঘুরে উল্টোপথে চললো এবার। 

ওয়াশরুমে এসে চোখে মুখে পানি ছিটালো। চোখের কাজল, মেকআপ সব লেপ্টে গিয়ে ছড়িয়ে পড়ল সারা মুখে। আয়নায় ভূতের মতো চেহারার নিজেকে দেখে কান্না পেয়ে গেলো সকালের। টিস্যু পেপার দিয়ে ঘষে মেজে তুলতে লাগলো লেপ্টে যাওয়া কাজলের দাগ। ঠিক সেই সময় বেসিনের ধারে সে বিন্দুবাসিনীকে দেখতে পেলো। বিন্দুবাসিনী গম্ভীর গলায় বলল, 

—‘শেহজাদী, আতরের খুশবুর ব্যাপারটা পুরোই আপনার মেন্টাল। ওটা নিয়ে ঘাবড়াবেন না।’

সকাল কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, ‘প্রব্লেম শুধু ওটা না বিন্দু। মেইন প্রব্লেম হচ্ছে, এই ছেলেটার সামনে আমি কিছুতেই স্বাভাবিক হতে পারছি না। আমি ওর মুখোমুখি হতে চাইছি না। অথচ ফাহাদের সাথে বিয়ে হলে এই মানুষটা আমার ফ্যামিলি মেম্বারদের একজন হবে। এর সাথে স্বাভাবিক আচরণ করাটা আমার জন্য খুব জরুরি। শুধুমাত্র এই একটা মানুষের জন্য তো আমি ফাহাদকে রিজেক্ট করতে পারি না তাইনা? ফাহাদের মতো একটা এ গ্রেড ছেলেকে রিজেক্ট করার জন্য আরো যুৎসই কারণ চাই।’ 

—‘শেহজাদী! আপনি ধীরে ধীরে বড় একটা নিশ্বাস নিন। নিজেকে কন্ট্রোল করার চেষ্টা করুন। অতি তুচ্ছ কারণে আপনি অস্থির হয়ে উঠছেন। আপনি হরিণডাঙ্গার রাজকন্যা। আপনাকে এইসব তুচ্ছ অকারণ অস্থিরতা একদম মানায় না!’ 

বিন্দুবাসিনীর মুখে শেহজাদী ডাকটা শুনলে সকাল বল পায়। মনের ভেতর একটা আত্মবিশ্বাস তৈরি হয় ধীরে ধীরে। সত্যিই তো সে কোনো সাধারণ মামুলি মেয়ে নয়। সে গোটা এক রাজ্যের রাজকন্যা। তাকে কি এমন তুচ্ছ ব্যাপার নিয়ে বিচলিত হলে মানায়? সকাল আয়নায় নিজের দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘ নিশ্বাস নিলো। 

বের হয়ে দেখলো ফাহাদ ফিরে এসেছে। সকালকে দেখতে পেয়েই বলল, ‘চলো লাঞ্চটা সেরে ফেলি। লাঞ্চের পর ঠান্ডা মাথায় এক্সপ্লোর করা যাবে।’ 

সকালকে এখন স্বাভাবিক দেখাচ্ছে। সে হাসিমুখে বলল, ‘নিশ্চয়ই।’

—‘লাঞ্চ কোথায় করবে? কোনো পছন্দ আছে?’ 

—‘নাহ, কোনো পছন্দ নেই। তোমাদের যেখানে খুশি যেতে পারো।’

—‘এখানে কাছেই একটা স্টেক হাউজ আছে, যাবে?’ 

—‘কেন নয়? যাওয়া যাক।’ 

রেস্টুরেন্টে এসে চারজনের একটা টেবিলে বসলো ওরা। বেশ প্রশস্ত 

জায়গা। লাঞ্চের সময় বলে ভিড় আছে বেশ। রেস্টুরেন্টের সাথে লাগোয়া একটি বার দেখা যাচ্ছে। বারের সামনে উঁচু টুলে বসে মদ্যপান করছেন বেশ কিছু সাদা চামড়ার নারী-পুরুষ। 

আরশান বসলো সকালের মুখোমুখি। সকাল এখন যথেষ্ট সপ্রতিভ তবুও ঠোঁটের কোণে কেমন যেন একটা অস্বস্তি লেগে আছে। আরশান এই প্রথম খেয়াল করলো সকালের ঠোঁটজোড়া। মনে হয় যেন পেন্সিলে আঁকা। লিপস্টিকের রঙ নেই। দুটো ঠোঁটই এতো নির্ভুল ছাঁচে গড়া যে দেখে মনে হয় যেন কোনো পাকা শিল্পীর হাতের কাজ। সেই তো, স্রষ্টার চেয়ে বড় শিল্পী আর কে আছে? 

ভাবতে ভাবতে হাত বাড়িয়ে মেনু টেনে নিলো আরশান। চোখ বুলাতে বুলাতে বলল, ‘আপনাদের কি এই প্রথম ডিসি আসা?’ 

—‘আমার নয়, তবে সকালের এই প্রথম। ওর জন্যই আসা।’ নাবিলা বলল। 

—‘সকাল কে?’ প্রশ্ন আরশানের। ফাহাদ ততক্ষণে ওয়েটার ডেকে খাবার অর্ডার দেয়া শুরু করে দিয়েছে। 

নাবিলা অবাক গলায় বলল, ‘সকালকে চেনেন না আপনি? এই যে এই ম্যাডামের নাম সকাল। সকাল শেহজাদী।’ 

—‘শেহজাদী?’ আরশান বিস্ময়ে নামটা আওড়ালো। 

—‘হ্যাঁ শেহজাদী।’ নাবিলা বলল। 

সকাল আরশানের দিকে পরিপূর্ণ দৃষ্টি দিল, বুক কাঁপলো খানিকটা তবে বিচলিত হল না এবার। বলল, ‘অবাক হলেন মনে হয়?’ 

আরশান চাইলো। ওর বড় বড় পাঁপড়ির গভীর চোখদুটো সকালের চোখে রেখে বলল, ‘অবাক হইনি, তবে নামটা একটু কেমন যেন 

—‘কেমন?’ 

—‘না মানে শেহজাদী কারো নাম হতে পারে না। অবশ্য আদর করে বা ভালোবেসে ডাকাই যায়, সেদিক থেকে ইটস ওকে। কিন্তু একটু উইয়ারড। 

বলে আরশান হাসলো, ওর দাম্ভিক নাক উঁচু হাসিটা। 

এই হাসিটা দেখলেই সকালের রাগ ধরে যায়। সে কড়া ভাবে বলল, —‘তা আপনার নামটাও তো অদ্ভুত। আর… শান’ নামটা টেনে টেনে অনেক সময় নিয়ে বলল সকাল, ‘এটা কোনো নাম হলো?’ 

—‘হবে না কেন?’ 

—‘এসব আরশান ফারশান কারো নাম হতে পারে না।’ 

আরশানের ভ্রু তীক্ষ্ণ হলো, গম্ভীর গলায় বলল, ‘আপনি বলার কে? আরশান ইজ আ পার্শিয়ান নেইম। এটার মানে হলো স্ট্রং এন্ড ব্রেভ ম্যান। অবশ্য এটার এরাবিক মিনিংও আছে।’ 

—‘সো হোয়াট? আপনি তো বাঙালি। বাংলা নামের কি অভাব পড়েছে?’ 

—‘আচ্ছা!বাংলা নাম হতে হবে। মানে আপনার নাম তো সকাল, সো আমার নাম হওয়া উচিত ছিল বিকাল। আর ফাহাদের নাম দুপুর, আপনার ফ্রেন্ডের সন্ধ্যা। ওয়াও!’ 

ফাহাদ আর নাবিলা হেসে ফেলল আরশানের কথার ধরন দেখে। টেবিলের পাশে সোনালি চুলের ব্লন্ড ওয়েট্রেস দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে। ফাহাদ সকালদের থামিয়ে দিয়ে বলল, ‘আচ্ছা ঝগড়া তোমরা পরে করতে পারবে, এখন অর্ডারটা দিয়ে আমাকে উদ্ধার করো।’ 

খাবার অর্ডার করা হয়ে গেলে সকাল হঠাৎ তার পায়ের কাছে একটা স্পর্শ অনুভব করলো। টেবিলের তলায় মাথা নিচু করে তাকিয়ে দেখার চেষ্টা করলো ঘটনা কী। বুঝতে সময় লাগলো না। ফাহাদ জুতো পরা পা দিয়ে সকালের পা ঠেলছে। চকিতে তাকালো সে ফাহাদের দিকে ফাহাদের মুখে ফিচেল হাসি। সকাল তাকাতেই একটা চোখ টিপে দিলো । ঠিক কী বোঝাতে চাইলো সকাল তার মাথামুণ্ডু কিছুই ধরতে পারলো না। একটু লজ্জা পেয়ে শুধু চোখ নিচে নামালো। 

নাবিলা ব্যাগ থেকে সেলফোন বের করে সকালকে বলল, ‘চল কয়েকটা সেলফি তুলে ফেলি। ফেসবুকে চেকইন দিতে হবে না? 

শুনে আরশান বাঁকা হাসলো। ত্যাড়া গলায় বলল, ‘খাবার আসুক, খাবার সহ চেকইনটা দিলে ভালো করতেন।’ 

নাবিলা খুশিতে ঝলমলিয়ে উঠে বলল, ‘একদম ঠিক বলেছেন। খাবার সহই চেকইন দিব।’ 

সকাল চোখ বড় করে তাকালো নাবিলার দিকে। এতো গাধা মেয়ে সে জীবনে দেখেনি, আরশানের খোঁচাটা তো ধরতে পারলোই না বরং খুশিতে বেকুবের মতো লাফ দিয়ে উঠল। 

নাবিলা নিজের দোষ কোথায় বুঝতে না পেরে মিনমিন করে বলল, ‘আমি আবার কী করলাম, এভাবে তাকাচ্ছিস কেন? 

উত্তরটা আরশান দিলো, ‘এ প্রশ্নের উত্তর আপনি কোনোদিন পাবেন না। বুঝতেই পারবেন না আপনার দোষ কোথায়? ঠিক যেমন আমি বুঝতে পারছি না আজ সকালে আমার দোষটা কী ছিল। কেন আমার গাড়িতে আসা হলো না কিন্তু ঘণ্টা খানেকের মধ্যে আমার ভাইয়ের সাথে ঠিকই আসা হলো।’ 

ফাহাদ শুনে কৌতূহলী হয়ে বলল, ‘মানে? কিসের কথা বলছ? আমি তো কিছুই জানি না।’ 

সকাল অপ্রতিভ হলো। সে জানে না এ ধরনের পরিস্থিতি ঠিক কিভাবে নিয়ন্ত্রণে আনতে হয়। প্রসঙ্গ পাল্টানোর জন্য সে নাবিলাকে বলল, ‘চল চল সেলফি তুলি।’ 

ওরা সেলফি তুলতে ব্যস্ত হয়ে গেলে আরশান ফাহাদকে বলল, ‘তোমার কী খবর?’ 

—‘হুম, এই তো চলছে। 

একই বাড়িতে বসবাস করলেও ভাইয়ে ভাইয়ে দেখা সাক্ষাৎ হয় কদাচিৎ। আরশান বয়সে ফাহাদের বছর তিনেকের বড়। টিলি এসেছে আরো অনেক পরে। তিন ভাই-বোনের মাঝে সুসম্পর্ক বজায় আছে ঠিকই কিন্তু ওদের খুব ঘন ঘন মেলামেশাটা ফাহাদের মা ভালো চোখে দেখেন না। কোনো এক অজানা, অব্যক্ত কারণে আরশানকে তিনি আজ এতগুলো বছর পরেও স্বাভাবিক ভাবে মেনে নিতে পারছেন না। আরশান তাঁর সুখের স্বর্গতুল্য সংসারে একটি মাত্র বহিরাগত বিপদজনক কীট। তিনি চান না এই কীটের সাথে তাঁর সন্তানদের কোনো রকম আনাগোনা থাকুক। 

খাবার চলে এসেছে ততক্ষণে। স্টেক এনড সি ফুড প্ল্যাটার। আরশান প্লেটে খাবার তুলে নিতে নিতে বলল, ‘শোনো ফাহাদ, তোমার একটা কাজ করতে হবে।’ 

—‘কী কাজ?’ 

—‘তুমি মাদারকে বলবে যে শ্যান্টেলির জায়গাটা লিজ নেয়ার ব্যবস্থা হয়ে গেছে। তিনি সেখানে নিশ্চিন্তে ডে কেয়ার খুলতে পারবেন। যা ইচ্ছা করতে পারবেন। আমাদের বাড়ির পেছনের জংলা জায়গার চাইতে শ্যান্টেলির জায়গাটা এ ধরনের বিজনেসের জন্য অনেক বেশি উপযুক্ত। হাইওয়ের কাছাকাছি।’ 

—‘কিন্তু ভাই, সমস্যাটা অন্য জায়গায়। মম তোমার ঐ জায়গাটাই চাইছে।’

—‘কিন্তু কেন?’ 

এ প্রশ্নের উত্তরে ফাহাদ চুপসে গেলো। 

আরশান বলল, ‘আজ প্রায় সাত আট বছর হয়ে গেলো জায়গাটা আমার দখলে আছে। হঠাৎ কী এমন হয়ে গেলো যে মাদারের ঐ স্পেসিফিক প্লটটাই লাগছে?’ 

ফাহাদ চুপ। তার চোখে এ মুহূর্তে একটা অপরাধী ভাব ভর করেছে। ভাইয়ের প্রতি মায়ের মনোভাব যে কতটা বিরূপ তা সে কিছুটা হলেও টের পায়। মাঝে মাঝে মা’কে খুব নিষ্ঠুর মনে হয় তার। 

আরশান বলল, ‘আমি তো বলেই দিয়েছি ঐ জায়গা আমি ছাড়ছি না। এরপরেও যদি তিনি এটা নিয়ে বাড়াবাড়ি করেন তাহলে হয়তো আমার বাড়ি ছেড়েই চলে যেতে হবে। আর আমি বাড়ি ছেড়ে চলে গেলে তুমি তো জানোই বাবা কতটা কষ্ট পাবেন।’ 

ফাহাদকে চিন্তিত দেখালো। আমেরিকায় প্রায় তিন দশক সময় টানা বসবাস করলেও বাবা সর্বদাই চেয়েছেন তাঁর সন্তানরা যেন বাঙালি সংস্কৃতি বুকে নিয়েই বড় হয়। এখানকার ছেলে-মেয়েরা আঠারোর পরেই আলাদা একক ভাবে বসবাস করা শুরু করে। বাবা-মায়ের আর কোনো দখল থাকে না তাদের জীবনে। আরশানের আঠারো বছরের জন্মদিনের রাতে বাবা তাদের দু’ ভাইকে ডেকে বলেছিলেন, দেখো প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে যাওয়ার মানে এই না যে আজ থেকে তোমরা যা খুশি করতে পারবে। আমি চাই আমার জীবদ্দশায় তোমরা ভাই-বোনরা প্রত্যেকে আমার সাথে থাকো। ভুলেও অন্য কোথাও শিফট হওয়ার কথা ভাববে না। মনে থাকবে? 

তারা দুজন বাধ্য ছেলের মতো মাথা নেড়ে বলেছিল, মনে থাকবে। নাবিলা বলল, ‘তোমরা পারিবারিক আলাপ-সালাপ বাড়ি গিয়ে করো। এখন এসব বাদ দাও।’ 

শুনে দু ভাই মুচকি হাসলো। নাবিলা জানে না যে বাড়ি গিয়ে তাদের দেখা হওয়ার এবং কথা বলার সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ। জরুরি কথাগুলো এখানেই সেরে নিতে হবে। মূলত ফাহাদের সাথে কয়েকটা জরুরি কথা বলার জন্যই আরশান হুট করে লাঞ্চের প্রোগ্রামটা করে ফেললো। সে জানে আজকের পরে ফাহাদকে আবার অনেকদিনের জন্য পাওয়া যাবে না। সময়ই বা কোথায়? 

পায়ের গোড়ালির কাছে সেই সুড়সুড়ি ভাবটা আবার টের পেলো সকাল। চকিতে তাকালো ফাহাদের দিকে। ফাহাদ মনোযোগ দিয়ে ছুরি কাঁটা চামচে টুংটাং শব্দ তুলে খেয়ে যাচ্ছে। পাশে বসা আরশানের দিকে তাকালো। আরশান তার দিকেই তাকিয়ে ছিল। 

তাহলে কি এটা আরশানের কাজ? 

এতো বড় সাহস ছেলেটার? এতটা নির্লজ্জ বেহায়া আর অভদ্র? 

সকালের চোখের দৃষ্টি ক্রুর থেকে ক্রুরতর হয়ে যাচ্ছিল। তা দেখে আরশান হতবাক হয়ে বলল, 

—‘কী হলো আপনার?’ 

—‘আপনি কী করছেন?’

–‘কী করছি? স্টেক খাচ্ছি! দেখতে পারছেন না? চোখ নেই আপনার?’ 

নাবিলা আর ফাহাদ একটু থতমত খেয়ে গেছে সকালের ব্যবহারে। এই মেয়েটার কী হয়েছে আজ? দিনের শুরু থেকেই এহেন অদ্ভুত আচরণ করছে কেন? 

আরশান খাওয়া থামিয়ে থ-মেরে তাকিয়ে আছে সকালের দিকে। সে বুঝতে পারছে না তার দোষটা কোথায়। মেয়েটা দেখি আস্ত একটা পাগল। সবার নিষ্পলক চেয়ে থাকা দেখে সকাল একটু বিব্রত বোধ করলো। প্রথমে ঠিক করলো কিছু বলবে না। চুপ করে যাবে। কিন্তু সাত-পাঁচ ভেবে বলেই ফেললো কথাটা। 

—‘আপনি পা দিয়ে আমার পা ঠেলছেন কেন?’ 

কথাটা আরশানের কানে ঢোকা মাত্র সে যেন বজ্রাহত হলো। বিস্ময়ের ঠ্যালায় অনেকক্ষণ কিছু বলতে পারলো না। এদিক-সেদিক ঘাড় ঘুরিয়ে চাইলো। মনে মনে ঠাওর করে ওঠার চেষ্টা করলো সে কি ঠিক শুনেছে নাকি ভুল। 

ফাহাদ অবাক চোখে একবার ভাইকে দেখছে আরেকবার সকালকে। 

আরশান দাঁতে দাঁত চেপে বলল, ‘সিরিয়াসলি, ইউ নিড আ সাইক্রিয়াটিস্ট। পা দিয়ে পা ঠ্যালা? ছিঃ এসব কী বলছেন আপনি? আমি কেন? মানে …. আমার তো মাথায় কিছুই ঢুকছে না।’ 

নাবিলা ভীষণ অপ্রস্তুত হয়ে গেছে। সে সকালের কানের কাছে মুখ নিয়ে বলল, ‘সকাল, দোস্ত! ওটা আমার পা ছিল।’ 

সকালের মুখখানা রক্তশূন্য হয়ে গেলো। কোনও মতে বলল, ‘আচ্ছা বাদ দিন। লেটস এনজয় দ্যা লাঞ্চ।’

 আরশান তখন বেশ ক্ষেপে গেছে ভেতরে ভেতরে। ভেতরকার রাগটা তার চোখে মুখে আঁচ ফেলছে। আগুন গরম গলায় বলল, 

—‘আপনি কেন এ কথাটা বললেন? আমি কেন আপনার সাথে … আই মিন কী ভাবেন আপনি নিজেকে?’ 

ফাহাদ ভারি বিব্রত বোধ করছে। একদিকে তার বড় ভাই অন্য দিকে তার ভবিষ্যতে হলেও হতে পারে গার্লফ্রেন্ড বা স্ত্রী। সে ঠিক কী করে এদের মধ্যকার বিরোধটা মীমাংসা করবে তা বুঝতে পারছে না। আরশানকে সে যতটা চেনে কোনো অপরিচিতা, অর্ধ পরিচিতা মেয়ের পায়ে সুড়সুড়ি দেবার মতো সস্তা রসিকতা সে মরে গেলেও করবে না। অন্যদিকে সকাল, স্বল্প পরিচিতা হলেও এই দুদিনে সে বুঝে গেছে মেয়েটার ব্যক্তিত্বে একটা গভীর দিক আছে। সম্পূর্ণ যুক্তিহীন লেইম কোনো ব্যাপার নিয়ে অযথা হাঙ্গামা বাঁধানোর মতো মেয়ে সে না। 

সকাল কিছু বলতে পারছিল না আর। নিজের বোকামি দেখে সে নিজেই স্তব্ধ হয়ে গেছে। মনে হচ্ছে মাটির তলায় গর্ত খুঁড়ে ঢুকে যেতে। 

আরশান কাটাচামচ আর ছুরি প্লেটের দু’পাশে রেখে, রুমাল দিয়ে মুখ মুছে নিয়ে বলল, ‘আই এম ডান। ফাহাদ, আমি বিলটা দিয়ে দিচ্ছি। তোমরা সময় নিয়ে খাবার শেষ করো।’ 

আরশান আর বসলো না। কাউকে কিছু বললও না। সোজা কাউন্টারে গিয়ে বিল পরিশোধ করে বেরিয়ে আসলো রেস্টুরেন্ট থেকে 

দশ মিনিট হেঁটে অফিস যেতে হবে। তারপর গ্যারাজ থেকে গাড়ি নিয়ে সোজা বাড়ির দিকে। তার মাথা ঠিক মতো কাজ করছিল না। এই আটাশ বছরের সুদীর্ঘ জীবনে এমন অদ্ভুত, কাণ্ডজ্ঞান হীন, হিতাহিত জ্ঞান শূন্য মেয়ে সে আর কোথাও দেখেছে বলে মনে পড়ল না। খুব ছোট বেলায় সে যখন হঠাৎ একদিন আবিষ্কার করতে পেরেছিল যে তার মায়ের চলে যাওয়াটা আসলে কোনো দুর্ঘটনা ছিল না। ছিল ঠান্ডা মাথার সুনিপুণ একটি সিদ্ধান্ত, ঠিক সেদিন থেকে পৃথিবীর সমগ্র নারী জাতির উপর একটি তীব্র ঘৃণা বা বিতৃষ্ণা তার অন্তরের অন্তর্দেশে তিলে তিলে গড়ে উঠে মহিরুহুর আকার ধারণ করেছে। শৈশবে মায়ের ভালোবাসা পায়নি বলেই তার ভেতরটা সর্বদা শুষ্ক, রুক্ষ মরুভূমির মতো। মেয়েদের সম্পর্কে শঙ্কা এবং সংকোচ দুটোই কাজ করে তার। নারী জাতটাকে সে বিশ্বাস করে না। নারীরা শুধু খেলতে জানে, আর খেলাতে। 

মা যখন চলে গিয়েছিল অন্য পুরুষের হাত ধরে আরশান তখন দুধের শিশু। মায়ের চেহারা মনে পড়ে না তার। মায়ের কোনও স্মৃতি নেই তার সাথে। যে সত্ত্বার কখনও কোনও অস্তিত্বই ছিল না তার আবার স্মৃতি কীসের? 

হ্যাঁ মাদার মা হয়ে এসেছিল তার জীবনে। মনে হয় ভালোও বেসেছিল। কিছু ভালোবাসার স্মৃতির কথা আজও মনে পড়ে আরশানের। নিজের মায়ের অভাব অনেকটাই পূরণ হয়েছিল মাদারের আগমনে। কিন্তু কিছু দিন পর…. ফাহাদ যখন আসলো। ধীরে ধীরে দৃশ্যপট পাল্টাতে থাকলো। একটু বড় হতে হতেই সে বুঝতে পারলো মাদার আসলে তার মা নয়, ফাহাদের মা, টিলির মা। আর সত্য কথাটি হলো তার নিজের কোনো মা নেই। 

আরশান চলে যাবার সঙ্গে সঙ্গে নাবিলা সকালকে রাগী গলায় বলল, ‘এটা কী ছিল? তোর কি কমনসেন্স বলতে কিছু নাই? ওই ছেলেটাকে কিছু বলার আগে নিজে একবার শিওর তো হয়ে নিবি যে ঘটনা কী ঘটছে।’ 

ফাহাদ বলল, ‘নাবিলা ঠিকই বলছে, তোমার কিছু না জেনে বুঝে এমন আচরণ করাটা ঠিক হয়নি।’ 

নিজের ওপর প্রচণ্ড রাগ আর ঘেন্নায় চোখে জল চলে আসলো সকালের। অনেকটা কাঁপা গলায় সে নাবিলাকে বলল, ‘তুই আমার পায়ে সুড়সুড়ি দিচ্ছিলি কেন? ঝামেলাটা তো তুই বাঁধিয়েছিস।’ 

—‘আরে গাধা তখন আমি নোটিস করলাম যে ফাহাদ তোর সাথে এই কাজটা করছে। তাই আমিও একই কাজ করে একটু মজা নিচ্ছিলাম। তুই কোনো ক্লু ছাড়া আরশানকে কেন সন্দেহ করে বসলি? তোর উচিত আরশানকে সরি বলা। আজকেই।’ 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *