অক্টোবর রেইন – ১৫

১৫

নিউইয়র্ক কখনো ঘুমায় না। টাইমস্কয়ার, ম্যানহাটনের রাস্তায় সারারাত বইতে থাকে আলোর বন্যা। আকাশ ছোঁয়া বিল্ডিং গুলোর গায়ে গায়ে ঝলমল করতে থাকে বিজ্ঞাপনের বাহার। সর্বত্র একটা আলোকময় অত্যাধুনিক প্রাণের স্পন্দন। কোথাও কিছু থেমে নেই। অবিরত ছুটে চলেছে এই ঝাঁ চকচকে নগরজীবন। 

রাতের বেলা একলা একলা এ শহরের রাস্তায় ঘুরে বেড়াতে ভালো লাগে আরশানের। তার মনে হয় প্রতিটা শহরের একটা নিজস্ব গল্প আছে। প্রতিটা শহর আসলে এর বাসিন্দাদের কোনো না কোনো গল্প বলতে চায়। কিছু গোপন সুখ দুঃখ ভাগ করে নিতে চায়। সে যদিও এ শহরের বাসিন্দা নয়। তবে জায়গাটার প্রতি তার আলাদা একটা টান কাজ করে। এতো ঘন ঘন এখানে আসা হয় যে এই শহরটা একরকম তার সেকেন্ড হোম হয়ে গেছে। নিউয়র্কের মতো পুরনো শহরগুলোর হরেক রকম গল্প থাকে। সেইসব গল্প চুপ করে চেয়ে চেয়ে, দেখে দেখে অনুধাবন করতে হয়। 

খুব একটা রাত হয়নি। সাড়ে নয়টার মতো বাজে। রাস্তার ফুটপাথ ধরে হাঁটছে অগণিত মানুষ। এদের মাঝে টুরিস্টদের সংখ্যাই বেশি। বাঙালি বা বাংলাদেশিদের সংখ্যাও নিছক কম নয়। একটা কালো পাতলা গোছের ছেলে তার পিছু নিয়েছে কিছুক্ষণ হলো। ভাবসাব দেখে ঠিক ঠাওর করে ওঠা যাচ্ছে না তার মতলবটা আসলে কী। তবে ফলো যে করছে এ ব্যাপারে আরশান শত ভাগ নিশ্চিত। 

ঘটনা বোঝার জন্য আরশান ওল্ড নেভির বিশাল বড় একটা শো রুমের সামনে আচমকা দাঁড়িয়ে পড়ল। পকেট থেকে সিগারেট বের করে লাইটার জ্বালিয়ে সময় নিয়ে আগুন ধরালো। দেখা গেলো, এক গাদা মানুষের ভিড়ের ভেতর ছেলেটাও দাঁড়িয়ে পড়েছে। ভাবটা এমন দেখানো হচ্ছে যেন আরশানকে সে লক্ষ্যই করছে না। এর পোশাক-আশাক দেখে ঠিক ছিনতাইকারী মনে না হলেও বোঝা যাচ্ছে খুব একটা ভদ্র গোছের মানুষ সে না। গাঁজা খাওয়া রগরগে চেহারা। কিন্তু কথা হলো হাজার মানুষের ভিড়ে এই গাঁজাখোর কেন আরশানের মতো সাধারণ ছা-পোষা মানুষের পিছু নেবে? আরশান এতটা গুরুত্বপূর্ণ ঠিক কবে থেকে হয়ে উঠল? 

সিগারেট শেষ করে আবার হাঁটা ধরলো সে। বিপদে পড়লে বা প্রয়োজনের সময় মানুষের মাথার পেছনে অলৌকিক ভাবে দুটো চোখ জন্ম নেয়। আরশানের এ মুহূর্তে মাথার পেছনের চোখ দুটো কাজ করছে। সে বুঝতে পারছে ছেলেটা ঠিক তার পেছন পেছন হেঁটে আসছে। 

এবার ঘুরে দাড়ালো সে। দুই হাত দূরত্বে দাঁড়িয়ে আছে ছেলেটা। আরশান দাড়াতে সেও দাঁড়িয়ে পড়ল। ঘাড় ঘুরিয়ে এদিক সেদিক দেখা শুরু করলো। আরশান এগিয়ে গেলো ছেলেটার কাছে। ছেলেটার গায়ে একটা ঢোলা সাদা শার্ট আর জোড়া তালি মারা রিপড জিন্স। মাথায় ক্যাপ। 

—‘তুমি কি আমাকে ফলো করছো?’ কোনো ভূমিকা ছাড়াই প্রশ্নটা করলো আরশান। 

আরশানের দীর্ঘকায় পেটানো দেহখানা এবং ক্রূর চোখের চাউনি দেখে ছেলেটা মনে হয় একটু ভয়ই খেলো। অবাক হওয়ার ভান করে বলল, ‘না! আমি কেন তোমাকে ফলো করবো?’ 

—‘তুমি নিশ্চয়ই আমাকে ফলো করছো। আমি কি জানতে পারি কেন করছো?’ 

—‘তুমি ভুল বলছ। আমি মোটেও তোমাকে ফলো করছি না।’ আরশান পকেট থেকে ফোন বের করে এবার একটু কড়া গলায় বলল, ‘আমি নাইন ওয়ান ওয়ানে কল করছি। তোমার গতিবিধি সন্দেহজনক।’ 

কথাটা শোনা মাত্র ছেলেটা দু’ পা পেছনে হটে গিয়ে দৌড়নো শুরু করলো। ভিড়ের মাঝে মানুষের গায়ে গায়ে লেগে, ধাক্কা দিয়ে, ধাক্কা খেয়ে ঝড়ের গতিতে ছুটতে লাগলো সে। ছুটলো আরশানও। 

ছুটতে ছুটতে এক পর্যায়ে ছেলেটা হুমড়ি খেয়ে পড়ল ফুটপাথের ওপরে। আরশান পেছন থেকে গিয়ে ধরে ফেললো ওকে। শার্ট ধরে যখন টেনে তুললো তখন দেখল ছেলেটার হাত কাঁপছে। পা টলছে। বোঝা যায় সে স্বাভাবিক অবস্থায় নেই। নেশা করেছে। বেশ চড়া নেশা। 

আরশান ওর শার্টের কলার চেপে ধরে চিবিয়ে চিবিয়ে বলল, ‘কী চাই তোমার আমার কাছে? কেন ফলো করছিলে? বলো, নইলে আমি পুলিশ ডাকবো।’ 

ছেলেটা ফোঁস ফোঁস করে নিশ্বাস ফেলতে ফেলতে বলল, ‘দেখো প্লিজ তুমি পুলিশ ডেকো না। আমার কোনো দোষ নেই। এক মহিলা আমাকে বলেছে তোমাকে ফলো করে তোমার পকেট থেকে ফোন বা ওয়ালেট কিছু একটা হাতিয়ে নেবার জন্য। ওই মহিলার তোমার ইনফরমেশন দরকার। তোমার ফোন নাম্বার, তোমার ঠিকানা ইত্যাদি। কাজটা করতে পারলে আমাকে দুই’শ ডলার দেবে বলেছে।’ 

শার্টের কলার থেকে ধীরে ধীরে হাত সরিয়ে নিয়ে আরশান ভারি অবাক গলায় বলল, ‘কোন মহিলা? কোথায় পেয়েছো তুমি তাকে?’ 

—‘আমি তেমন কিছুই জানি না তার ব্যাপারে। রাস্তায়ই দেখা হয়েছে। সে আমাকে নিজ থেকে ডেকে প্রস্তাবটা দিয়েছে।’ 

—‘তোমার কাছে তার ঠিকানা বা ফোন নম্বর আছে? 

—‘ঠিকানা নেই, ফোন নম্বর আছে। কাজ শেষ হলে তাকে ফোন করে জানানোর কথা ছিল।’ 

—‘আমাকে ফোন নম্বরটা দাও।’ 

ছেলেটা পকেট থেকে মোবাইল বের করলো। কিছুক্ষণ টেপাটেপি করে ফোন নম্বরটা খুঁজলো। তারপর উচ্চারণ করলো নাম্বারটা। 

আরশান ফোন নম্বর নেয়া হলে বলল, ‘ঠিক আছে তোমার আর তার সাথে যোগাযোগ করার দরকার নেই। 

ছেলেটা একটু আমতা আমতা করে বলল, ‘আমি তো তোমাকে সব কিছু বলেই দিলাম। তুমি আমাকে কিছু দেবে না?’ 

—‘কী দেব?’ 

—‘কিছু ডলার দাও।’ 

—‘নেশা করার জন্যে?’ 

ছেলেটা হলুদ দাঁত বের করে হেসে বলল, ‘আমি যাই করি না কেন, তোমার কী?’ 

—‘তোমাকে আমি একটা পয়সাও দেবো না। কারণ, তুমি একজন ক্রিমিনাল। তুমি আমার পকেট মারতে যাচ্ছিলে। এটা জানার পর আমি যে তোমাকে পুলিশে ধরিয়ে দেইনি এখনো তাতেই তোমার কৃতজ্ঞ থাকা উচিত। যাও ভাগো!’ 

আরশান আর দাড়ালো না। ঘটনাটা তাকে বিস্মিত করেছে। তার ঠিকানা, ফোন নম্বর এবং যাবতীয় বৃত্তান্ত কেন হঠাৎ অচেনা একজন মানুষের কাছে এতো গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠল? কে এই মহিলা? 

ফোন নম্বরটা আরেক নজর দেখলো আরশান। নম্বরের নিচে এম ডি লেখা। মেরিল্যান্ডের নাম্বার। 

ফোনটা রেখে দিলো পকেটে। হোটেলে ফিরতে হবে। আজ রাতেই রওয়ানা হওয়ার কথা ভার্জিনিয়ার উদ্দেশ্যে। 

১৬

হরিণডাঙ্গার আকাশে মেঘের ঘনঘটা। একটু বাদেই ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামবে। রাজকন্যা সকাল মনস্থির করেছেন তিনি আজ বৃষ্টি-জলে স্নান করবেন। কুঞ্জবনে চলছে তার স্নানের আয়োজন। প্রাসাদের বারান্দায় দাঁড়িয়ে থেকে শেহজাদী আসন্ন বৃষ্টিভেজা আকাশটার দিকে তাকিয়ে আছেন। ঠিক সেই সময় তাঁর কানে এসে লাগলো ভারি এক মধুর সুর। 

ঘুম ভেঙে গেলো গভীর রাতে। ঘুমটা ভাঙার পর সকাল অনেকক্ষণ অবধি ঠাওর করে উঠতে পারলো না যে সে স্বপ্ন দেখছে? নাকি যা শুনছে তা বাস্তবেই শুনছে। তার বুক কাঁপতে থাকলো। সারা শরীরের রক্তে রক্তে ছড়িয়ে পড়ল এক অন্যরকম উত্তেজনা। 

বেহালা বাজছে। জানালা দিয়ে হাওয়ায় হাওয়ায় ভেসে আসছে করুণ আবেগী সুরটা। 

উঠে পড়ল সে। ছুটে আসলো বারান্দায়। শেষ রাত। পশ্চিমের আকাশে ডুবতে বসেছে চাঁদ। মেঘের গায়ে গায়ে চাঁদনী রঙের প্রলেপ। বাতাসে একটু ঠান্ডা ভাব। কয়েকটা জোনাকী উড়ছে এলোমেলোভাবে বারান্দার রেলিঙের ওপাশে। 

এতো খুঁটিনাটি যেহেতু চোখে পড়ছে তার মানে এটা স্বপ্ন নয়। মানুষটা ফিরে এসেছে! সত্যি ফিরে এসেছে! 

এতো আনন্দ তার বহু দিন হয়নি। বেহালার সুর শুনতে শুনতে তার বুকের ভেতরটা শুভ্র শিউলি ফুলের মতো সুগন্ধি এক ঝরঝরে অনুভূতিতে ছেয়ে গেলো। একটা উষ্ণ তৃপ্তিতে ভরে গেলো মন। চোখের কোণ ভিজে উঠল। 

পরক্ষণেই একটা বোবা অভিমানে পেয়ে বসলো তাকে। 

বারে, চলেই তো গিয়েছিল। কিছু না বলে। একটা বার দেখা পর্যন্ত না করে। এর মধ্যে যদি সকাল ফিরে যেত দেশে? কিংবা খারাপ কিছু হয়ে যেত তার? তাহলে কি আর কোনো দিন দেখা হওয়া সম্ভব হতো? 

নাহ, সকালও অতো হ্যাংলা নয়। দেখা করবে না। কথাও বলবে না। 

১৭

ঘুম ভাঙলো ভোরে। এন্ড্রিয়ানার ভয়েস মেইল পেয়ে। সে বলে পাঠিয়েছে, ‘ভীষণ মিস করছি তোমাকে শওন! কতটা ভালোবাসি তা প্রতিবার ছেড়ে আসার পর বুঝতে পারি।’ 

আরশান মেসেজটা একবার শোনার পরে দ্বিতীয়বার শুনলো। মেয়েটা কি সত্য কথা বলছে? বস্তুগত বা ভাবগত যে কোনও কিছুই অভ্যাসে পরিণত না হলে, পরোক্ষ বা প্রত্যক্ষ ভাবে কোনো উপকারে না আসলে, মানুষ কি অকারণে তাকে মিস করতে পারে? কোনো দৃশ্যমান বা অদৃশ্য বস্তুকে পরিপূর্ণভাবে আত্মস্থ করার আগপর্যন্ত কি তার অনুপস্থিতি মানুষের জন্য পীড়াদায়ক হতে পারে? মানুষ কেবল মাত্র তার অভ্যস্ত উপাদানকেই মিস করতে পারে। বাড়ির বাইরে গেলে আরশান নিজের শোবার ঘরের বিছানা আর প্রাণের চেয়ে প্রিয় বাদ্য যন্ত্রটিকেই মিস করে। এন্ড্রিয়ানার সাথে তো কাটিয়ে আসলো চারটা দিন। কই মিস তো করছেনা! কোনো অনুভূতিই হচ্ছে না ভেতরটায়। এমনকি বাড়ি ফেরার পর থেকে একটা বার ওর কথা মনেও আসেনি! 

তার ভেতরটা কি ধীরে ধীরে একদম আবেগশুন্য হয়ে যাচ্ছে? নারীরা কেন চিরকাল শুধুমাত্র তার চোখ ভরায় কিন্তু মন ভরায় না? কিংবা ভাবায় না? 

বস্তুত, তার মনে হয় মানুষে মানুষে সম্পর্ক রচনার চাইতেও বেশি জরুরি এবং দামি হলো পৃথিবীর সাথে সম্পর্ক রচনা করা। মানুষ আসে, মানুষ যায়। নিজের প্রয়োজনে কাছে আসে, নিজেরই প্রয়োজনে দূরে চলে যায়। কিন্তু এ পৃথিবী মৃত্যুর আগ পর্যন্ত কোথাও যাবে না। শুধু মৃত্যু ছাড়া অন্য কোনো অরি বা দুশমন তাকে এ পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন করতে পারবে না। 

নিজের যা আছে, তাই দিয়ে এ পৃথিবীরই ঋণ শোধ করে যেতে হবে সারা জীবনব্যাপী। এর মানে এই নয় যে পৃথিবীকে ভালোবাসতে হলে মানুষকে ভালোবাসা যাবে না। মানুষগুলো তো পৃথিবীরই অংশ। কিন্তু নিজের মানুষ আর পরের মানুষ বলে কিছু নেই। পৃথিবীর কাছে সবাই সমান। ভালোবাসলে প্রতিটা মানুষকে ভালোবাসো। পৃথিবীকে ভালোবেসে ভালোবাসো। 

আজকে ছুটির দিন। কোনো তাড়া নেই। আরো খানিকক্ষণ বিছানায় গড়াগড়ি করে ধীরে সুস্থে উঠল সে। 

ফ্রেশ ট্রেশ হয়ে দৌড়নোর উদ্দেশ্যে বাইরে বেরিয়ে আসলো। আকাশ মেঘলা। আবহাওয়া পূর্বাভাসে বলা হয়েছে ঘণ্টা খানেকের মাঝেই বৃষ্টি নামবে। হাওয়ায় বেশ জোর আছে। বোঝা যাচ্ছে বৃষ্টি আটঘাট বেঁধেই নামবার পরিকল্পনা করছে। ঘর থেকে বেরোতে নিজের অজান্তে চোখ চলে গেলো দোতলার বারান্দায়। মেয়েটা নেই। ঘরের জানালায় ব্লাইন্ড টানা ভেতরটা দেখা যাচ্ছে না। 

গতকাল রাতেও সে ছিল না বারান্দায়। অথচ প্রথম দিকে গভীর রাত পর্যন্ত বারান্দায় বসে থাকতো। নিজের মনে কথা বলতো। আরশান অন্ধকারে গাছের আড়ালে লুকিয়ে থেকে সেইসব পাগলামো দেখে মনে মনে হাসতো। 

কোথায় গেলো মেয়েটা? চলে যায়নি তো আবার? 

চলেই গেলো? একদম কিচ্ছু না বলে? 

ভাবতে ভাবতে বাড়ির সামনের দিকে চলে আসলো সে। প্যাটিওতে বাবা বসে আছেন। তার পাশের চেয়ারে মাদার। উল্টো দিকের চেয়ারে ফাহাদ আর সকাল। 

না যায়নিতো! একটা স্বস্তির নিশ্বাস আপনা আপনি বেরিয়ে গেলো বুক চিরে। নিজের ভাবনায় নিজেই অবাক হলো আরশান। গেলেই বা কী ক্ষতি হতো? কেউ কি চিরদিনের জন্যে আসে? এসেছে যেহেতু যেতে তো হবেই আজ নয় কাল! কী এসে যায়? 

আরশানকে দেখে বাবা খুশি হয়ে বললেন, ‘আরে তুমি? কখন এলে?’

—‘এইতো বাবা, কাল রাতে এসে পৌঁছলাম।’

—‘বসো বসো। চা খাও। আজকে সকাল আমাদের জন্যে চা বানিয়েছে। 

ফাহাদ বলল, ‘ট্রাই করে দেখো ভাই। সত্যি ভালো হয়েছে। আমি তো চা খাই না। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে এটা না খেলে দারুণ মিস করতাম।’ 

মাদার বললেন, ‘বসো বসো। দাঁড়িয়ে কেন?’ 

আরশান বাবার পাশের চেয়ারটা হাত বাড়িয়ে টেনে নিলো। বসতে বসতে সকালের দিকে একবার পরিপূর্ণ চোখে তাকালো সে। হালকা বেগুনী রঙের স্যালোয়ার কামিজ পরেছে। চুলগুলো একটু অন্যরকম ভাবে বাঁধা 1 সচরাচর যে রকম থাকে সেরকম নয়। কানে বেগুনি রঙের দুল। খুব মনোযোগ দিয়ে নিজের ডান হাতের আঙ্গুলগুলো দেখছে। যেন পৃথিবীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাটি এ মুহূর্তে তার পাঁচ আঙ্গুল চত্বরে ঘটছে।

আরশান একটা ঘন নিশ্বাস ফেললো। মেয়েটাকে সুন্দর লাগছে!

মাদার বললেন, ‘তোমার কনফারেন্স কেমন ছিল?’ 

—‘ভালো। বেশ ভালো।’ টেবিলের ওপরে রাখা একটা খালি চায়ের কাপ হাতে নিয়ে নাড়াচাড়া করতে করতে তির্যক চোখে সকালের দিকে তাকিয়ে থেকেই উত্তরটা দিলো আরশান। মেয়েটা তার দিকে মুখ তুলে তাকাচ্ছে না কেন? সমস্যাটা কী? 

বাবা বললেন, ‘এবার কি তুমি অক্টোবরে ছুটি নিচ্ছো?’ 

—‘জি বাবা, নিচ্ছি। ইন শা আল্লাহ।’ 

আশ্চর্য! পরিচিত জনের সাথে দেখা হলে লোকে কুশল বিনিময় করে, হাই হ্যালো বলে। এই নূন্যতম শিষ্টাচার ও সৌজন্যবোধ টুকুও কি মেয়েটির জানা নেই? 

সকাল উঠে পড়ল। বলল, ‘আমি একটু আসছি।’ 

বাড়ির ভেতরে যেতে যেতে নিজের হৃৎপিণ্ডের ধুকপুক স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছিল সকাল। মানুষটা যে তার দিকে তাকিয়ে ছিল চোখা ভাবে তা সে চোখ না তুলেই টের পাচ্ছিল। একটা বার ওকে পুলক ভরে দেখবার জন্যে মরমে মরে যাচ্ছিল। কিন্তু ভয় হচ্ছিল যদি চোখ তুলে তাকানো মাত্র তার মনের অবস্থাটা চোখের তারায় ভেসে ওঠে? সে যে কিচ্ছু লুকোতে জানে না। তার যে বড় ধরা পড়ার ভয়! 

বাড়ির ভেতরে ঢুকে কাচ তোলা জানালা দিয়ে বাইরে তাকালো সকাল। ওই তো বসে আছে সোজা হয়ে চেয়ারে হেলান দিয়ে। পা দুটো সামনের দিকে ছড়ানো। গায়ে সাদা টি শার্ট, কালো ট্রাউজার। এখান থেকে তার মুখের একটা পাশ দেখা যাচ্ছে। লম্বা ঘন পাঁপড়ির ছায়া পড়েছে চোখের কোলজুড়ে। মুখ বাঁকিয়ে, ঠোঁট বাঁকিয়ে, হাত নেড়ে নেড়ে কী সব ভারি গুরুত্বপূর্ণ কথা বলছে সে। আজকে হঠাৎ সকালের মনে হলো ওর ওই মুখ বাঁকানোর ভঙ্গিটায় আসলে আলাদা একটা ভাব আছে, আকর্ষণ আছে। 

—‘কী করছো?’ টিলির প্রশ্নে ঘোর ভাঙলো। হালকা চমকে উঠল সে। বলল, ‘এইতো, বৃষ্টি নামবে। আকাশ মেঘলা।’ 

—‘হুম, আজ সারাদিন বৃষ্টি হবে। আজ তো ছুটি। তোমার প্ল্যান কী?’

—‘জানি না। আমার তো কোনো প্ল্যান নেই।’ 

—তোমার উচিত প্ল্যান করে এগোনো। সময় তো অল্প। কিছুই দেখা হলো না তোমার এখন পর্যন্ত! 

—‘হুম, দেখা তো হলো না।’ 

—‘অবশ্য সমস্যা নেই। একবারে বিয়ের পরেই সব দেখতে পারবে। তোমার তো কোনো তাড়া নেই।’ 

সকাল একথার প্রত্যুত্তরে কিছু বলল না। হালকা হাসলো শুধু। 

টিলি বেরিয়ে গেলে বসলো সোফায়। ভালো লাগছে না। কেমন একটা ঘোর কাজ করছে তার ভেতরে। দূরে থাকলে মানুষটাকে কাছে পেতে কী ভীষণ ইচ্ছে করে! আর কাছে আসলে, সারা পৃথিবী আলো করে চোখের সামনে এসে দাড়ালে তখন মুখ তুলে চাইতে পর্যন্ত ভয় হয়। কোত্থেকে রাজ্যের আড়ষ্টতা এসে ভর করে। 

কী হয়ে গেলো তোমার সকাল? সারাক্ষণ কেন নির্লজ্জের মতো, বেহায়ার মতো ওর কথা ভাবছো? তোমার কি ব্যক্তিত্ব বলতে কিছু নেই? লাজ শরমও নেই? কেন তুমি পথভ্রষ্ট হলে জীবনের এই ঘোর অসময়ে? কেন হলে এমন জড়বুদ্ধি? তুমি তো বয়ঃসন্ধিতে পা দেয়া অবুঝ বালিকা নও! তোমার যে চোখ কান খোলা রেখে, হিসেব কষে জীবনটাতে এগুতে হবে। কোথায় গেলো তোমার এতকালের শিক্ষা? নীতিবোধ আর বিবেক? কোথায় গেলো তোমার মেয়েলি অহংকার? 

একটু বাদেই টিলি দৌড়ে এলো। উপচে পড়া খুশি নিয়ে বলল, ‘কালকে আমরা পিকনিক করবো। মম ড্যাড রাজি। ইনফ্যাক্ট সবাই রাজি! কালকে ওয়েদার থাকবে ফ্যান্টাস্টিক। 

—‘বাহ্! বেশ তো! পিকনিকটা হবে কোথায়?’ 

—‘সেটা এখনো ঠিক হয়নি। ওরা দুই ভাই মিলে ঠিক করছে’ 

—‘দুই ভাই মানে …..সবাই যাবে?’ সাবধানে প্রশ্নটা করলো সকাল। 

 —‘যাবে না কেন? এটা ফ্যামিলি পিকনিক! 

—‘ও আচ্ছা।’ বুক কাঁপে। ওই মানুষটা সারাদিন চোখের সামনে থাকবে? এতটা সইতে পারবে তো? 

—‘কেন? তোমার কোনো আপত্তি আছে? 

—‘না না। আপত্তি কিসের? আমি ভাবছি আমার ফ্রেন্ডকে বলবো কিনা। মানে নাবিলা। বেচারি একা একা থাকে। পারিবারিক জীবন বলতে ওর কিছু নেই এখানটায়।’ 

—‘অফকোর্স বলবে। কেন বলবেনা? এখনই বলে দাও তুমি।’ 

—‘নাহ, এখন নয়। চাচির সাথে আলাপ করে তারপর বলি।’ 

—‘মম ডেফিনিটলি ইয়েস বলবে।’ 

—‘তা জানি।’ 

খানিক বাদে চাচি এসে বললেন, ‘বাজারে যাবো। তুমি যাবে আমার সাথে?’ 

—‘জি চাচি। চলুন। ঘরে বসে থেকে কী করবো? কোনো কাজ তো নেই।’

তৈরিই ছিল সে। ওপরে গিয়ে হ্যান্ড ব্যাগটা নিয়ে বেরিয়ে পড়ল। চাচি গাড়ি ভালোই চালান। বলতে গেলে তিনি একজন অভিজ্ঞ চালক। 

—‘ড্রাইভিংটা শিখে নিও। নইলে পরে ঝামেলায় পড়তে হবে।’ চাচি বললেন। 

—‘জি চাচি।’ 

—‘আচ্ছা এখন বলো তো, ফাহাদের ভাবসাব তোমার কেমন মনে হচ্ছে?’ 

সকাল একটু থতমত খেলো, ‘ভাবসাব …মানে ঠিক বুঝলাম না।’

—‘মানে তোমার প্রতি ওর মনোভাবটা কী রকম বলে মনে হচ্ছে? আমি সরাসরিই জিজ্ঞেস করে ফেললাম। কিছু মনে করো না যেন।’

—‘না না। মনে করার কী আছে? আসলে চাচি, আমি এখনো ঠিক বুঝতে পারছি না।’ 

—‘কী বুঝতে পারছো না? 

—না মানে, আমার মনে হয় সে এখনো কনফিউজড। আমিও।’

—‘কনফিউশন কী ব্যাপারে?’ 

সকাল আড়ষ্টতা নিয়ে বলল, ‘বিয়ের ব্যাপারে।’ 

চাচির মুখে একটা মেদুর রঙের ছায়া পড়ল, ‘কেন? আমার ছেলেকে কি তোমার পছন্দ হয়নি? 

সরাসরি এমন একটা প্রশ্ন যে করে বসতে পারেন চাচি সকালের তা ধারণাতেও ছিল না। সে হতভম্ব হয়ে গেলো। কোনো রকমে বলল, ‘অপছন্দ হবে কেন? অপছন্দ করার মতো ছেলে তো সে নয়। কিন্তু আমার মনে হয় আমাদের দুজনেরই একটু সময় দরকার। আর দেখুন চাচি, আপনি আমাকে পছন্দ করেছেন বলেই তারও আমাকে পছন্দ হবে এমন তো কোনো কথা নেই।’ 

—‘আমার ছেলে আমার পছন্দের ওপরে কোনো কথাই বলবে না।’

—‘কিন্তু সবারই তো একটা নিজস্ব মতামত থাকে।’ 

—‘আমার ছেলেকে আমি চিনি। আমি যা বলবো ও তাই করবে।’ বেশ দাপট নিয়েই কথাগুলো বললেন চাচি। 

সকালের বুকের ভেতরটা হঠাৎ কেমন ভয়, শঙ্কা এবং গ্লানিতে দুমড়ে মুচড়ে উঠল। এ কী করছে সে? কেন মিথ্যে বলে যাচ্ছে দিনের পর দিন এই মানুষগুলোকে? সত্য কথাটি হলো ফাহাদকে সে কোনও দিন নিজের জীবন সঙ্গী করতে পারবে না। আরশান যে এই পরিবারের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ! এ পরিবারের সঙ্গে থাকা মানে আরশানের সঙ্গেই থাকা কোনো একভাবে। বিয়ে করবে একজনকে আর মনে মনে চাইবে অন্যজনকে। তাও আবার যারা কিনা একই পরিবারের সদস্য। এমন একটা বিদঘুটে, বাজে, বিশ্রী ব্যাপার তার চিন্তা করেই গা ঘিন ঘিন করছে। 

ফাহাদের তো কোনো দোষ নেই। চাচা চাচিরও কোনো দোষ নেই। এমন কি আরশানও নির্দোষ। দোষ যা করার সে নিজে করেছে। হ্যাঁ সব দোষ তার। মানুষ হিসেবে নিজেকে অত্যন্ত নিকৃষ্ট জাতের বলে মনে হচ্ছে এই মুহূর্তে। ছিঃ সকাল ছিঃ লোকে জানতে পারলে তোমার মুখে থুতু দেবে। সেটারই যোগ্য তুমি! 

নিজেকে নিজে ভর্ৎসনা করতে থাকলো সে। ইচ্ছেমতো গালাগাল দেয়া শেষ করে বরাবরের মতোই সিদ্ধান্ত নিলো দেশে ফিরে যাবে। খুব দ্রুত। এ সম্পর্ক এমনিতেই হওয়ার নয়। অযথা লেবু কচলে তেতো বানানোর আর প্রয়োজন নেই। 

এতো শত চিন্তার পরেও লাভ কিছুই হলো না। বিশাল গ্রোসারি শপটায় ঢোকার সময় মনে হচ্ছিল জিনিস পত্রের ভিড়ে ডুবে যাবে একদম। দোজাহানের কোনো চিন্তা আর মাথায় রাখবে না। কিন্তু কী কাণ্ড! ছাইপাশ মনটা বারে বারে চোখের সামনে সেই মানুষটির মুখচ্ছবিই টেনে নিয়ে আসছে। একটা লম্বা দেখতে ছেলেকে তো পেছন থেকে একদম ওর মতো লাগলো। কাঁপা বুক নিয়ে সামনে এগিয়ে যেয়ে নিশ্চিত হলো যে না, এ অন্য ব্যক্তি। 

১৮

একটু আগে ঝেঁপে বৃষ্টি নামলো। কৃষ্ণ মেঘে মেঘে ছেয়ে আছে বিষণ্ণ আকাশ। তেজি হাওয়া গর্জন তুলে চষে বেড়াচ্ছে সারা বনভূমি। আরশান বসে আছে তার ছাউনিতে। গাছ লতা পাতার ছাউনি। নিজেরই তৈরি। ছাদটা খুব একটা শক্ত নয়। বাতাসে মনে হচ্ছে এক্ষুনি খসে পড়বে। পাতার ফাঁক ফোঁকর দিয়ে বৃষ্টির পানি গড়াচ্ছে। বৃষ্টির পানি থেকে বাঁচাতে নিজের আঁকা ছবি আর পোস্টারগুলো প্লাস্টিক ক্লথ দিয়ে ঢেকে রেখেছে সে। এখানে প্রায় গোটা বিশেক ছবি আছে। 

একটু একটু করে ভিজে যাচ্ছে ছবি আঁকার সরঞ্জাম। ভিজে যাচ্ছে সে নিজে। নাহ ছাউনিটা এবার ভালো মতো মেরামত করতে হবে। আজ কালের মধ্যেই নেমে পড়তে হবে কাজে। 

ঘাস আর আগাছার ওপরে রাখা একটা চেয়ার ছাড়া এ ঘরে আর কোনো আসবাব নেই। আছে শুধু একগাদা আর্ট পেপার আর রঙ তুলি, বোর্ড। 

পাতার ফাঁক দিয়ে বৃষ্টি দেখছে আরশান। দেখছে বৃষ্টির তোড়ে চোখের সামনে ঝাপসা হয়ে আসা এরিকের ছোট্ট কাঠের নড়বড়ে ঘরটা। এরিক তার সোনালি কেশর ওয়ালা মেটে রঙের লম্বাটে মাথা জানালা দিয়ে বের করে রেখেছে। বৃষ্টিতে ভিজে যাচ্ছে তার মুখ, কেশর, গলা। সে নির্বিকার। মনে হচ্ছে আরশানের মতো সেও বৃষ্টিটা বেশ মন দিয়ে উপভোগ করছে। গত বছর এ সময় একদম পানির দামে কিনতে পেরেছিল সে এরিককে বন্ধু জর্জের কাছ থেকে। একটা ঘোড়া পালার শখ তার বহুদিনের। জর্জ সপরিবারে কানাডায় মুভ করেছিল। আসবাব থেকে শুরু করে যাবতীয় সমস্ত সাংসারিক জিনিস সে বিলি করে দিয়ে গেছে। বিলি করার সামগ্রীর মধ্যে তার দুটো পোষা প্রাণীও অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল। একটি কুকুর এবং একটি ঘোড়া। কুকুরটি কোনো এডপশন সেন্টারে দিয়ে দেবে বলে ঠিক করেছিল। কিন্তু শেষমেশ মায়া কাটাতে পারলো না। ঘোড়াটিকে রেখে যাবার সিদ্ধান্তে অটল থাকলেও কুকুরটিকে কিছুতেই কাছছাড়া করতে পারলো না। সেই সুযোগে একদম পানির দামে এরিককে কিনে নিলো আরশান। কিন্তু ঘোড়া পালা খুব একটা সহজ কাজ নয়। সময় এবং টাকা দুটোই সমান পরিমাণে খরচ করতে হয় এর পেছনে। সবচেয়ে বড় ব্যাপার হলো ঘোড়া একলা থাকতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে না। সে পছন্দ করে কোম্প্যানিওন শিপ একটা প্রাণীকে জঙ্গলের ভেতর ফেলে রাখাতে আরশানের আজকাল ভেতরে ভেতরে কেমন একটা অপরাধ বোধ কাজ করে। যদিও নিজে যথাসাধ্য চেষ্টা করে ওকে সময় দেবার, আদর যত্ন করার, তবুও মনে হয় কোথায় যেন একটা খুঁত থেকে যাচ্ছে। অবহেলা থেকে যাচ্ছে। 

ইদানীং ভাবছে এরিককে আর বেঁধে রাখা ঠিক হবে না। দান করে দেবে কাউকে। বিক্রি করবে না। আদরের, ভালোবাসার বন্ধুকে বিক্রি করতে নেই। 

আচ্ছা মেয়েটা তার দিকে তাকালো না কেন? সামনে একটা জ্বলজ্যান্ত মানুষ কি সে দেখতেই পেলো না? এটাও কি সম্ভব? 

মেয়েটা কি ছিটিয়াল? একটু তারছেঁড়া? একটু অন্যরকম? 

ঠিক কী রকম? 

একটা সাধারণ মুখ। সেই মুখে স্নিগ্ধ দুটি টানা চোখ। ছোট কিন্তু চোখা নাক। নাকের পরেই নিখুঁত সুন্দর দুটি ঠোঁট। এতো সুন্দর ঠোঁট আরশান এর আগে কখনো বুঝি দেখেনি। আর সবচেয়ে বেশি সুন্দর ওর হাসিটা। 

টুপটাপ বৃষ্টির মাঝেই হঠাৎ হাত বাড়িয়ে একটা আর্ট পেপার টেনে নিলো আরশান। চট করে লাগিয়ে নিলো বোর্ডে। তারপর পেন্সিল দিয়ে ঘষে ঘষে ধীরে ধীরে যত্ন করে সাদা কাগজে ফুটিয়ে তুলতে লাগলো একটি চেনা মুখ। 

একটা নয়। পর পর অনেকগুলো ছবি আঁকলো আরশান। একটাই চেহারা। কিন্তু ঘুরিয়ে ফিরিয়ে নানাভাবে, নানা ভঙ্গীতে। 

আঁকার পর নিজের সৃষ্টির দিকে তাকিয়ে থেকে মনে হলো, নাহ, সত্যিকারের মুখটা আরো অনেক বেশি স্নিগ্ধ। যে স্নিগ্ধতাটুকু শুধুমাত্র দোজাহানের স্রষ্টা ছাড়া আর কারো পক্ষেই গড়া সম্ভব নয়। স্রষ্টার চেয়ে বড় চিত্রশিল্পী আর কে আছেন? 

ছবিগুলোর দিকে কিছুক্ষণ নির্বিকার চেয়ে রইল সে। কেন আঁকলো মেয়েটাকে? কী দরকার ছিল? 

ভেতর থেকে আরেকটা আরশান বলে উঠল, কেন আবার? সময় কাটানোর জন্য। 

ঠিক তাই। সে একজন আর্টিস্ট। ছবি এঁকে সময় কাটানো, মনের আশ মেটানোই হলো তার কাজ। ছবির বিষয়বস্তু কী তা দিয়ে কিছু এসে যায় না। 

সন্ধ্যের দিকে জঙ্গল থেকে বাড়ি ফিরলো সে। এরিককে খাইয়ে দাইয়ে তারপর। লিভিং রুমের দরজাটা মেরামত করার মেকানিক আসার কথা। চলেও আসলো কিছুক্ষণের মাঝে। ছেলেটার নাম হোজে। স্প্যানিশ। অনেক দিনের চেনা। বাড়ির খুঁটিনাটি কাজ গুলো ওকে দিয়েই সারানো হয়। আরশান নানা কাজে-কর্মে প্রায়ই ছেলেটাকে ডাকে। স্টেটের বাইরে যে কটা দিন থাকে সে কটা দিন হোজেই এরিকের দেখাশোনা করে। 

খানিক বাদে ওপরে ডাক পড়ল। টিলি ডাকছে। 

—‘আরশান ভাইয়া, ওপরে এসো। পিকনিকের প্ল্যান করবো।’ 

পিকনিক জিনিসটা তার বিরক্ত লাগে। অযথা বনের মধ্যে গিয়ে খড় পাতা পুড়িয়ে রান্না করে সবাই মিলে হইচই করে খাওয়া-দাওয়া করার মাঝে কোনো আনন্দের স্বাদ পায় না সে। কিন্তু যেতে হবে বাবার জন্যে। ফ্যামিলি গেট টুগেদারগুলোতে বাবা ভীষণভাবে তার উপস্থিতি কামনা করে এটা আরশান বোঝে। সকালে কথাটা যখন উঠল তখন বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে না করতে পারলো না। 

বসার ঘরে বাবা, ফাহাদ আর টিলি বসে আছে। টিলির পাশে সকাল। আরশান এসে বসলো বাবার পাশে। 

ঠিক হলো সকাল আটটার মধ্যে বেরিয়ে পড়বে ওরা। মাটির চুলায় রান্না করা ঝামেলার ব্যাপার তাই বারবিকিউ হবে। কাছাকাছি একটা পার্কেই পিকনিক স্পট ঠিক করা হলো। 

আলোচনা শেষে ফাহাদ উঠে পড়ল ফোন ধরার বাহানায়। ঠিক বাহানা নয়, তার সেলফোনটা আসলেই ভাইব্রেট হচ্ছিল। বাবাও উঠে পড়লেন। বাবার দেখাদেখি টিলিও। সকাল কী করবে বুঝে না পেয়ে কয়েক সেকেন্ড থ-মেরে বসে রইল। তারপর টিভির রিমোটটা হাতে নিলো। টিভি ছেড়ে রিমোট টিপতে লাগলো। 

আরশান গালে হাত দিয়ে একবার সকালের দিকে আরেকবার টিভির দিকে তাকালো। 

সকাল কোনো চ্যানেলেই স্থির হতে পারছে না। তাকে দেখে মনে হচ্ছে টিভি দেখা নয়, রিমোট টেপাটেপি করাই তার মূল উদ্দেশ্য। তাকে নার্ভাস দেখাচ্ছে। নিশ্বাস এলোমেলো। 

‘আপনি ভালো আছেন?’ একটু রয়ে সয়ে প্রশ্ন করলো আরশান। সকাল টিভির দিক থেকে মুখ না ফিরিয়েই বলল, ‘আমাকে বলছেন?’ 

আরশান একটা বিরক্তির নিশ্বাস ফেললো, ‘এ ঘরে আর কে আছে আপনি ছাড়া?’ 

—‘আমি ভালো আছি।’ 

—‘আপনি শিওর?’ 

—‘মানে?’ ঘুরে তাকালো সকাল। 

—‘মানে আপনাকে দেখে মনে হচ্ছে কিছু একটা ঠিক নেই।’ 

—‘অত দেখছেন কেন? না দেখলেই হয়।’ 

আরশান ঠোঁট উল্টে বলল, ‘চোখের সামনে একজন জীবন্ত, দৃশ্যমান মানুষের উপস্থিতি আমি টের পাবো না, অতটা অন্ধ আপনি হতে পারেন কিন্তু আমি নই।’ 

—‘আমি এরকমই।’ 

—‘ইগনর করতে চাইছেন নাকি আমাকে?’ 

—‘ইগনর করলে করছি তাতে আপনার কী?’ 

আরশান ভ্রু কুঁচকে বলল, ‘কেন ইগনর করবেন? মেয়েরা তো আমাকে ইগনর করে না।’ 

এ কথা শুনে সকাল চোখ বড় বড় করে বলল, ‘ও আচ্ছা! তবে কি মেয়েরা আপনাকে দেখলেই হালুম হালুম করে গিলে খেতে আসে?’ 

আরশান হেসে ফেললো, ‘অনেকটা তাই।’ 

সকাল টিভির দিকে মুখ ঘুরিয়ে নিলো, ‘আমি ওরকম মেয়ে নই।’

—‘তা আপনি কী রকম মেয়ে? একটু শুনি?’ 

—‘কেন বিরক্ত করছেন আমাকে?’ 

—‘বিরক্ত করছি?’ 

—‘করছেন তো!’ 

আরশান কিছুক্ষণ হতভম্ব হয়ে চেয়ে রইল সকালের দিকে। তারপর একটু গাঢ় ভাবে বলল, ‘ঠিক আছে। আমি দুঃখিত।’ 

বসা থেকে উঠে পড়ল। যেতে যেতে হুমকী দেয়ার ঢঙে বলে গেলো, ‘আপনিও আমাকে আর বিরক্ত করতে আসবেন না আশা করি। মনে থাকে যেন!’ 

কথাগুলো কানে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সকাল যেন ধরাধামে অবতীর্ণ হলো। যা! কী করে বসলো সে এই মাত্ৰ? 

সকাল! কী করলে তুমি? কী সর্বনাশ করলে? 

বিড় বিড় করতে করতে রাগে দুঃখে মাথার চুল ছিঁড়তে লাগলো সে। সত্যি সত্যি একটা দুটা চুল ছিঁড়ে চলেও আসলো আঙুলের ফাঁকে। মানুষটা নিজ থেকে কথা বলতে এসেছিল! যাও একটু কথা বলার সুযোগ হয়েছিল এতদিন পর সেই সুযোগটাও তুমি বোকামির বশে হাতছাড়া করলে। ওকে দেখলে কী হয়ে যায় তোমার সকাল? কেন অমন অদ্ভুত আচরণ করো? তুমি কি পাগল? বোকা? নাকি অসুস্থ? 

কী তুমি আসলে? 

নিজের ঘরে দৌড়ে গিয়ে নাবিলাকে ফোন করলো সে। 

হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, ‘নাবিলা,আমি আবার একটা ঝামেলা করে ফেলছি।’ 

—‘কী হয়েছে?’ 

সকাল ঘটনা খুলে বলল। শুনে নাবিলা থ বনে গেলো। 

—‘তোমার প্রব্লেমটা কী শেহজাদী? সারাদিন ওর নামে ধ্যান করতেছ আর দেখা হইলে তুমি ভাবটা এমন দেখাও যেন দুই পয়সার পাত্তা দাও না ওরে। তোমার এইসব ইগো কবে যাবে বলো তো? ইগো ধুইয়া ধুইয়া পানি খাও তুমি। তোমার আর কিছু করা লাগবে না। তুমি জীবনে কোনোদিন প্রেম করতে পারবা না। জিনিসটাই নাই তোমার মধ্যে।’ 

সকাল একদম কাঁদো কাঁদো হয়ে গিয়ে বলল, ‘কী করবো এখন, বল না!’

—‘কী করবা আর। মুড়ি খাও। তোর মাথা খারাপ হয়ে যায় কেন ওর সামনে গেলে? এরকম করিস কেন?’ 

—‘আমি জানি না দোস্ত। কেন যেন আমি ওর চোখে চোখে তাকাতে পারি না। ওকে খুব অহংকারী বলে মনে হয়। মনে হয় আমাকে বুঝি অবহেলা করছে, কিংবা দাম দিতে চাচ্ছে না। সারাক্ষণ কেমন গম গম করে কথা বলে।’ 

—‘ইট ডাজ নট মেক এনি সেন্স। আর শোন যেটাকে তুই অহংকার ভাবছিস সেটা ওর পার্সোনালিটি। তোকে পাত্তা না দিলে সে গায়ে পড়ে তোর সাথে কথা বলতে আসতো না। এতটুকু কেন বুঝতে পারছিস না? কেন তুই সব সময় এমন হীনমন্যতায় ভুগিস বল তো?’ 

—‘জানি না, আমি কিচ্ছু জানি না। এখন কী করবো?’

—‘যা গিয়া পা ধইরা মাফ চা।’ 

—‘মরে গেলেও না!’ 

—‘তাহলে ওকে ভুলে যা।’ 

—‘সম্ভব হচ্ছে না।’

নাবিলা নিজের গলার স্বরে আলগা একটা ঢং এনে বলল, ‘শেহজাদী শোনো, তোমাকে আগে নিজের কাছে ক্লিয়ার হতে হবে। তুমি নিজে ঠান্ডা মাথায় চিন্তা করো যে তুমি আসলে কী চাও। যদি তোমার মনে হয় যে তুমি সত্যিই ওকে ভালোবেসে ফেলেছো তাহলে তুমি ওর কাছে যাও, গিয়ে কথা বলো। দেখো তোমরা যদি ঠিক থাকো তাহলে ফ্যামিলি কোনো ব্যাপার না। ফাহাদ যথেষ্ট ম্যাচিওরড একটা ছেলে। আমার মনে হয় না ও কোনো ঝামেলা করবে। আর তোমার শাশুড়িকে হাত করা কোনো ব্যাপারই না। সো তুমি আগে ডিসাইড করো যে তুমি কী চাও।’ 

—‘নাবিলা কী যে আমি চাই তা কিছুতেই বুঝতে পারছি না। শুধু এটা বুঝতে পারছি যে ও সামনে থাকলে আমার অসম্ভব ভালো লাগে আবার একই সাথে অসম্ভব অস্থির লাগে। চোখের সামনে থেকে চলে যাবার পর মনে হয় আরেকটা বার দেখি। যদি আজকে বাদে কালকে মরে যাই তাহলে তো আর কক্ষনো একটা নজর দেখতেও পারবো না। কিন্তু মানুষটা সামনে আসলেই আমি শুধু উল্টাপাল্টা করতে থাকি। আমি মনে হয় পাগল হয়ে যাচ্ছি।’ 

—‘লিসেন টু ইয়োর হার্ট। তোর যদি ওকে দেখতে মন চায় দেন গো এন্ড টক টু হিম। এই সুযোগটা হয়তো কাল আর নাও আসতে পারে।’ 

সকাল একটা বড় নিশ্বাস ফেললো। চুপ থাকলো দুজনেই খানিকটা ক্ষণ। তারপর সকাল একটু জরুরি গলায় বলল, ‘শোন নাবিলা কাল আমরা একটা পিকনিকে যাচ্ছি। চাচি বলেছেন তোকেও ইনভাইট করতে। তুই সকাল আটটার মধ্যে চলে আসিস এখানটায়।’ 

—‘আমি আবার কেন তোদের ফ্যামিলি গেট টুগেদারের মধ্যে?’ 

—‘তুই আমার ফ্যামিলি। আমি চাই আমার ফ্যামিলির কেউ একজন অন্তত থাকুক আমার সাথে। ক্লিয়ার?’ 

নাবিলা হাসলো, ‘আচ্ছা ঠিক আছে। তুই আর চিন্তা না করে গিয়ে কথা বল। দেখবি ভালো লাগবে।’ 

—‘হুম। আচ্ছা ছাড়ছি।’ বলে ফোনের লাইন কাটলো সকাল। 

পাতালঘরে নামার দরজাটার সামনে কয়েক সেকেন্ড মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে রইল সে। বুকের ভেতর ঢেউ ভাঙছে। ছোটবেলা থেকেই তার আত্মসম্মান বোধ প্রবল। অবহেলা সে সইতে পারে না। যারা তাকে একজন মানুষ হিসেবে নূন্যতম সম্মানটুকু দেখিয়ে এসেছে, শুধু মাত্র তাদের কাছেই ঘেঁষেছে সে চিরকাল। নিজের জন্যে কারো চোখে বিন্দু পরিমাণ করুণা বা তাচ্ছিল্য দেখে সে অভ্যস্ত নয়। আজকে নেহাত ভাগ্যের ফেরে এই মানুষটার কাছে বারে বারে ছোট হতে হচ্ছে। এ অপমানের জ্বালা সে রাখবে কোথায়? 

সকাল একটা প্রলম্বিত নিশ্বাস নিলো। সময় নিয়ে। 

তারপর দরজার নব ঘুরিয়ে সিঁড়ি ঘরে ঢুকলো। সিঁড়ি ঘরটা অন্ধকার। দেয়াল হাতড়ে বাতির সুইচ পাওয়া গেলো। বাতি জ্বললো। কাঁপা অন্তর নিয়ে সিঁড়ি ভেঙে নিচে নেমে এসে দরজায় করাঘাত করলো। পর পর কয়েকবার। একটু বাদে লম্বা মানুষটা এগিয়ে আসলো। সকালকে দেখে প্রথমটায় অবাক হলো। তারপর তীক্ষ্ণ ফলার মতো একটা ধারালো দৃষ্টি ওর ওপর নিক্ষেপ করে পকেটে হাত রেখে সটান দাঁড়িয়ে রইল কয়েক মুহূর্ত। 

সকাল চোখ নামিয়ে নিলো। লজ্জায় আর অস্বস্তিতে কাদা হয়ে যাচ্ছিল সে। 

একটা সময় আরশান ওর নিজস্ব কায়দায় মুখ বাঁকিয়ে বলল, ‘আসুন। ভেতরে আসুন।’ 

মেকানিক হোজে এখনো কাজ করছে। দরজার মেরামত চলছে। মেঝের ওপর নানারকম যন্ত্রপাতি রাখা। দেখে সকাল আরশানকে বলল, ‘ওহ আপনি মনে হয় ব্যস্ত, সত্যিই ডিস্টার্ব করে ফেললাম।’ 

—‘বসুন। কাজ শেষ হয়ে যাবে এক্ষুনি।’ একটু গম্ভীর শোনালো আরশানের গলা। 

সকাল বসলো, ডাইনিং টেবিলের চেয়ারে। হোজে ওর দিকে তাকিয়ে হাসলো। হাসলো সকালও। অচেনা ভাষায় কিছু একটা প্রশ্ন করলো হোজে আরশানকে। আরশান তেরছা ভাবে সকালের দিকে একটু তাচ্ছিল্য ভরা চোখে তাকালো একবার। তারপর উত্তর দিলো। সকাল কিছুই বুঝে উঠতে পারলো না। উৎকণ্ঠা নিয়ে প্রশ্ন করলো, ‘কী বলছে? এটা কী ভাষা?’ 

—‘স্প্যানিশ।’ 

 হোজে তখন হেসে হেসে সকালকে বলল, ‘আবলা স্পানিওল?’

সকাল নিরুপায় হয়ে আরশানকে প্রশ্ন করলো, ‘কী বলছে?’

—‘জানতে চাইছে আপনি স্প্যানিশ বলতে পারেন কিনা?’ 

সকাল বিরক্ত হয়ে বলল, ‘না, স্প্যানিশ কেন পারব আমি!’ 

হোজেকে দেখে মনে হচ্ছে সে সকালের কথা শুনে বেশ মজা পাচ্ছে। তার গায়ের রং হলুদ। চোখ, নাক ছোট ছোট। শরীরটাও আকারে খুব ছোট। সে হাসিমুখে আরশানকে আবার কিছু একটা বলল। উত্তরে আরশান নিজের চিবুক হাতড়াতে হাতড়াতে রহস্যময় হাসি হাসলো। 

সকাল এবার একদম তেড়ে উঠে বলল, ‘আপনারা আমাকে নিয়ে খারাপ কথা বলছেন?’ 

আকাশ থেকে পড়ল আরশান, ‘খারাপ কথা? মাই গড! ইউ আর রিডিকিউলাস।’ 

—‘কেন আপনি এই লোকটার সাথে আমার নামে বদনাম করছেন? আপনার কি কোনো আক্কেল নেই?’ 

আরশান দিশাহারা হয়ে বলল, ‘কী দোষ করলাম বুঝতে পারছি না তো!’

—‘ওই লোকটা আমার নামে কী বলেছে আপনাকে? আর আপনি কী বলেছেন?’ 

—‘আপনি যদি স্প্যানিশ ভাষা না বোঝেন তাহলে তো আমার কিছু করার নেই, তাই না?’ 

—‘অবশ্যই করার আছে, আপনি অনুবাদ করে দিতে পারেন আমাকে।’ আরশান একটু বিরক্তি নিয়ে চুপ করে রইল খানিকক্ষণ। তারপর কোনো দিকে না তাকিয়ে একটু গম্ভীর ভাবে বলল, ‘ও ভেবেছে আপনি আমার গার্লফ্রেন্ড।’ 

সকাল লাল হলো, ‘ও… তারপর? আপনি কী বললেন?’ 

—‘কী আর বলবো, অভিয়সলি আপনি আমার গার্লফ্রেন্ড নন। সেটাই বলেছি।’ 

—‘এর পরে কী বলেছে?’ 

আরশান নীরস গলায় বলল, ‘বলেছে আপনি দেখতে সুন্দর।’ 

সকালের ঠোঁটে না চাইতেও একটা চিলতে হাসির রেখা ফুটে উঠল, বলল, ‘ও। সে তো আমি জানিই।’ 

আরশান ঘুরে তাকালো ‘কী জানেন?’ 

—‘জানি যে আমি সুন্দর!’ 

—‘তাই নাকি? কী করে জানেন?’ 

—‘লোকে বলে।’ 

—‘লোকে তো কত কিছুই বলে। লোকের কথা অতো বিশ্বাস করেন কেন?’ 

সকালের মুখটা ফাটা বেলুনের মতো চুপসে গেলো। কড়াভাবে বলল, ‘দেখুন, আপনি কিন্তু চান্স পেলেই আমাকে ইনসাল্ট করার চেষ্টা করেন। সেদিন বলেছেন আমার ফ্যাশন সেন্স ভালো না। আজকে বলছেন আমি দেখতে সুন্দর নই। এসব ঠিক না। আল্লাহ যাকে যেমন বানিয়েছেন। মানুষের চেহারা ছবি নিয়ে খারাপ কথা বলতে নেই।’ 

আরশান অনেক কষ্টে হাসি চেপে বলল, ‘তাই নাকি? কেন চেহারা ছবি নিয়ে খারাপ কথা বললে কী হয়?’ 

—‘খুব পাপ হয়!’ 

—‘আপনার চেহারা খারাপ তা তো আমি বলিনি কখনো। 

এটুকু বলে থেমে একবার সকালকে আগাগোড়া দেখে নিয়ে সে আবার বলল, ‘আপনি দেখতে অতটা খারাপ না। চলে, মানে চলনসই। 

শুনে সকাল দাঁত কিড়মিড় করে বলল, ‘আপনার মতামত কেউ জানতে চায়নি।’ 

—‘এতো ঝগড়াটে কেন আপনি? সারাক্ষণ ঝগড়া করার জন্য মুখিয়ে থাকেন কেন?’ 

—‘কারণ, আপনি সব সময় বাজে কথা বলেন।’ 

—‘মোটেও না। আমার সব কথাই কেন যেন আপনার কাছে বাজে বলে মনে হয়।’ 

হোজে আবার কিছু একটা বলে উঠল। মুখে পূর্বের হাসিটা বজায় রেখেই। সকাল আগের মতো কিছুই বুঝলো না শুধু দেখলো আরশানকে একটু লাল হতে। আরশান হাত পা নেড়ে স্প্যানিশ ভাষায় কথা চালিয়ে গেলো হোজের সাথে। সকাল মুখ ঝামড়ে উঠে বলল, ‘কী বলল লোকটা?’ 

—‘ইশ, প্রতিটা ব্যাপারে আপনার নাক গলানো চাই তাই না?’ 

—‘আমি শিওর ওই ব্যাটা আমাকে নিয়ে কিছু বলেছে। এক্ষুনি বলুন কী বলেছে।’ 

—‘সরি, বলতে পারবো না।’ 

ভীষণ রাগ ধরে গেলো সকালের, ‘কেন? কেন বলবেন না? খারাপ কিছু বলেছে?’ 

—‘মহা ঝামেলায় পড়া গেলো তো!’ 

—‘তাহলে আপনি বলছেন না কেন লোকটা কী বলেছে?’ 

—‘বললাম তো বলতে পারবো না।’ 

সকালের মুখটা ভার হয়ে গেলো। দেখে আরশান বলল, ‘মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ার মতো কিছু ঘটেনি। এতো চিন্তার কিছু নেই। 

সকাল এ পর্যায়ে অধৈর্য হয়ে হোজেকে ইংরেজিতে প্রশ্ন করলো ‘তুমি একটু আগে কী বললে ওকে?’ 

হোজে ভারি সরল হেসে ভাঙা ইংরেজিতে বলল, ‘কখন কী বলেছি?’

সকাল নিরাশ হয়ে চুপ করে গেলো। এর সাথে কথা চালানো যাবে না।

মিনিট পাঁচেকের মধ্যে হোজের কাজ শেষ হলো। টাকা-পয়সা বুঝে নিয়ে বেরিয়ে গেলো সে। 

আরশান বলল, ‘কী খাবেন? কফি?’ 

—‘নাহ, আমি কফি খাইনা। চা খাই।’ 

—‘ও, চায়ের তো ব্যবস্থা নেই। দুঃখিত।’

—‘সমস্যা নেই।’ 

সকাল উঠে এসে সোফায় বসলো। দেয়ালে লাগানো ক্যাবিনেট থেকে একটা কাচের বোতল বের করতে করতে আরশান বলল, ‘ওয়াইন চলবে?’ 

সকাল আঁতকে উঠল, ‘না আমি ওসব খাই না।’ 

—‘কফি না, ওয়াইন না। খান কী আপনি? বাতাস খেয়ে থাকেন নাকি?’

আরশান বোতল আর গ্লাস নিয়ে এসে সেন্টার টেবিলে রাখলো। বলল, ‘ট্রাই করবেন?’ 

সকাল একটু আমতা আমতা করলো, ‘নাহ… থাক!’ 

—‘তাহলে কী খাবেন? জুস?’ 

—‘নাহ।’ 

—‘মিল্ক?’ 

—‘না।’ 

—‘হরলিক্স কিংবা মাইলো?’ 

—‘ফাজলামো হচ্ছে?’ 

—‘ফাজলামোর কী দেখলেন? ড্রিংক করবেন না, কফি খাবেন না, জুস তো খেতে পারেন। আপনি ছোট মানুষ আপনাকে আমার প্রথমেই জুস অফার করা উচিত ছিল। 

কথা বলতে বলতে আরশান সকালের উল্টো পাশের সোফায় এসে বসলো। হেলান দিয়ে। পায়ের ওপর পা তুলে। 

সকাল মুখ বাঁকা করে বলল, ‘আমি মোটেও ছোট মানুষ না।’ 

আরশান গ্লাসে ওয়াইন ঢালতে ঢালতে বলল, ‘এবার বলতে পারেন।’

—‘কী বলব?’ 

—‘যা বলতে এসেছিলেন। 

—‘কী বলতে এসেছিলাম?’ 

—‘তা তো আপনিই জানেন।’ 

সকাল একটু ব্যাক্কল বনে গেলো। কী বলতে এসেছিল সে? আদৌ কিছু বলার ছিল কি? নাতো! কিছুই বলার ছিল না তার। সে এসেছে মানুষটাকে আর এক নজর দেখবে বলে। মানুষটার কাছাকাছি কিছুটা সময় থাকবে বলে। এটাই ছিল এই পাতাল ঘরে ছুটে আসার পেছনের এক এবং অভিন্ন উদ্দেশ্য। কিন্তু এই কথাগুলো তো মুখ ফুটে বলতে পারবে না মরে গেলেও। তাহলে বলবে কী এখন? 

সে কেশে গলা পরিষ্কার করে নিলো। কপালের চুল কানের পেছনে সময় নিয়ে সরালো। তারপর যথাসাধ্য স্বাভাবিক গলায় বলার চেষ্টা করলো, 

—‘কিছু বলতে আসিনি। ভাবলাম আপনি হয়তো মাইন্ড করেছেন। তাই…!’ 

—‘তাই?’ 

—‘তাই …তাই কথা বলতে আসলাম!’ 

আরশান চোখ বড় করে বলল, ‘ওয়াও! সো কাইন্ড অফ ইউ।’ 

খোঁচাটা বুঝতে পেরে চুপ করে গেলো সকাল। শয়তান একটা। এতো মিচকা শয়তান পুরুষ মানুষ সকাল মনে হয় দুনিয়াতে আর দ্বিতীয়টি দেখেনি। 

এখন শয়তানটা বসে বসে পা নাড়াচ্ছে। নিবিড় চোখে চেয়ে আছে সকালের দিকে। সকালের পরনে সকালবেলার সেই বেগুনি স্যালোয়ার কামিজ। চুলগুলো ছাড়া। সাজ একই। কানের দুলটা শুধু নেই। আরশানের ওই নিরবচ্ছিন্ন চেয়ে থাকার কবলে পড়ে সকাল বরাবরের মতোই অস্বস্তিতে কাঁটা হয়ে উঠল। কিছু বলার খুঁজে পাচ্ছে না সে। মাথার ভেতর কোনো শব্দ খেলছে না। 

বেশ তো, তুমি কোনো কথা না বলে শুধু হাভাতের মতো চেয়ে থাকতে চাও? তবে আমিও চেয়েই থাকবো। আর ভয় পাবো না। নিজের মনে কথা গুলো বলে নিয়ে তাকালো সকাল আরশানের দিকে। তীক্ষ্ণ চোখে। 

আর তাকাতেই…কী আশ্চর্য! মানুষটা এতো সুন্দর কেন? 

সকাল পারলো না। ঐ মুখের দিকে বেশিক্ষণ চেয়ে থাকলে তার দম বন্ধ হয়ে আসে ভালো লাগায়। 

—‘কেমন লাগছে আপনার?’ 

—‘কিসের কথা বলছেন?’ 

—‘আমেরিকা কেমন লাগছে?’

—‘মোটামুটি।’ 

—‘মোটামুটি কেন?’ 

—‘আসলে এখনো ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না। আমার কাছে আমার দেশই বেস্ট।’ 

—‘হুম। দেশে আপনাদের বাসা কোথায়?’ ওয়াইনের গ্লাসে চুমুক দিয়ে প্রশ্নটা করলো আরশান। 

—‘মিরপুর।’ 

—‘বেশ। আপনি কি আমেরিকায় শুধু বেড়াতেই এসেছেন? নাকি অন্য কোনও ধান্ধা আছে?’ 

প্রশ্নটা বেশ অপমানজনক বলে মনে হলো সকালের কাছে। সে ত্যাড়া ভাবে বলল, 

—‘ধান্ধা বলতে কী বোঝাচ্ছেন আপনি?’ 

—না মানে, থার্ড ওয়ার্ল্ড কান্ট্রির মানুষ জন এই দেশে একবার আসলে তো খুঁটি গেড়ে বসে যায়। যাবার নাম নিতে চায় না আর।’ 

—‘সবাইকে নিজের মতো মনে করেন কেন?’ 

—‘আমি তো এখানে নিজের ইচ্ছেয় আসিনি। আমার বাবা নিয়ে এসেছিল জোর করে।’ 

—‘ফিরে গেলেই পারেন। এ বয়সে তো আর বাবার জোর চলবে না। তাই না?’ 

—‘অভ্যস্ত হয়ে গেছি পশ্চিমা জীবনে। এখন ফিরে গিয়ে বেশি সুবিধা করতে পারবো না।’ 

—‘ইচ্ছে থাকলেই উপায় হয়।’ 

বলল সকাল। বলার পর দুজনেই কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। কয়েকটা সেকেন্ড নীরবে কাটার পর সকাল হঠাৎ দৃঢ় গলায় আরশানের চোখে চেয়ে বলে উঠল, 

—‘আপনি আমার ঠোঁটের দিকে কী দেখছেন বার বার?’ 

আরশানের সুন্দর চোখজোড়া তখন সত্যিই সকালের সুন্দর ঠোঁটজোড়ায় নিবদ্ধ ছিল। কিন্তু প্রশ্নটায় একটুও অপ্রস্তুত হলো না আরশান। ভারি নির্বিকার গলায় বলল, ‘সুন্দর জিনিসের দিকে চোখ যায়। এটাই চোখের ধর্ম।’ 

বলেই বাতাস গিললো সে। সঙ্গে সঙ্গে প্রসঙ্গ পাল্টালো, ‘আপনি কি টিভি দেখতে চান?’ 

সকাল সন্দিহান হয়ে বলল, ‘আপনি কী বললেন?’ 

—‘বলেছি টিভি দেখবেন নাকি?’ 

—‘তার আগে কী বলেছেন?’ 

আরশান ওয়াইনের গ্লাস টেবিলের ওপর রেখে শ্রাগ করে বলল, ‘কই? কিছুতো বলিনি! 

—‘বলেছেন।’ 

—‘উঁহু!’ 

আরশান উঠে পড়ল বসা থেকে,’ ডিনারে কী খাবেন?’ 

সকাল নাছোড়বান্দা হয়ে বলল, ‘আপনি কথা এড়াচ্ছেন কেন? আপনি স্পষ্ট বলেছেন সুন্দর জিনিসের দিকে চোখ যায়। আমি নিজ কানে শুনেছি।’ 

—‘আরে নাহ! কী শুনতে কী শুনেছেন। স্বপ্ন দেখছেন নাকি?’ বলতে বলতে আরশান হেসে ফেললো। তার চোখ দুটিতে তখন হালকা লাজুক ভাব। 

হেসে ফেললো সকালও। বলল, ‘আপনি কিন্তু ভীষণ অসভ্য!’ 

আরশান ফ্রিজ থেকে কাঁচা সবজি, পেঁয়াজ এসব বের করতে করতে বলল, ‘আমি খুবই সভ্য একজন মানুষ।’ 

ঠিক সেই মুহূর্তে ফাঁকা ময়দানে বোমা পড়ার মতো অকস্মাৎ ওপর থেকে তীরের বেগে ছুটে আসলো টিলির গলা। 

—আরশান ভাইয়া! তুমি কি সকাল আপুকে দেখেছ কোথাও? ওকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।’ 

সকাল চমকে উঠে আরশানকে ইশারা করে বলল, ‘বলুন আমি নেই এখানে।’ 

আরশান চোখ ছোট করে কৌতূহল নিয়ে প্রশ্ন করলো, ‘কেন মিথ্যে বলবো?’ 

সকাল নিশ্বাস বন্ধ করে বলল, ‘যা বলতে বলেছি, তাই বলুন।’ 

আরশান বলল টিলিকে, ‘না আমি দেখিনি।’

চলে গেলো টিলি। আতঙ্কে সকালের মুখটা সাদা হয়ে গেছে। আরশান ভারি অবাক হয়ে বলল, ‘মিথ্যে কথা বলতে বললেন কেন? 

ঠিক সেই সময় সকালের মাথায় প্রথম বারের মতো চিন্তাটা এলো। চাচি যে তাকে ফাহাদের স্ত্রী হিসেবে মনোনীত করে রেখেছেন। ফাহাদের সাথে যে তার বিয়ের কথাবার্তা চলছে এই ঘটনাটা সম্পর্কে অবগত থাকলে কি আরশান যতটা সহজ ভাবে তার সাথে এখন মিশছে, ততটা সহজভাবে মিশতে পারতো? ভাবনাটা মাথায় আসতেই তার বুক দুরু দুরু করে উঠল 

আর কোনো কথা না বলে সকাল স্লাইডিং ডোরটা খুলে দ্রুত বেরিয়ে পড়ল। সামনের দিক দিয়ে ঢুকতে হবে বাড়িতে। চাচিকে বলতে হবে হাঁটতে গিয়েছিল। 

১৯

‘আচ্ছা নাবিলা, আমার ঠোঁট কি দেখতে সুন্দর?’ সকাল বলল একটু লাজুক গলায়। 

নাবিলা বিস্মিত, ‘ওমা তোর তো চোখ, নাক, মুখ সবই সুন্দর। ঠোঁটের কথা আসছে কেন?’ 

সকাল খুশিতে ডুবো ডুবো হয়ে বলল, ‘কারণ, আমি একটা কমপ্লিমেন্ট পেয়েছি গতরাতে হি হি হি।’ 

—‘বাহ বাহ! লুক এট ইউ। ইউ আর ব্লাশিং! ঘটনা কী? আমিও একটু শুনি?’ 

ওরা দাঁড়িয়ে আছে লনের সামনে। আকাশ রৌদ্রকরোজ্জ্বল। গ্রীষ্মের শেষ বলে সেই রোদে তেজ নেই। আছে একটা কোমল ভাব। শান্তির ছোঁয়া আছে ঝিরঝির করে বয়ে যাওয়া হাওয়াটায়। চাচা চাচি গাড়ির ব্যাকডালায় পিকনিকের সরঞ্জাম তুলছেন। জিনিস তোলা হয়ে গেলেই রওয়ানা দেয়ার কথা। সকাল একটু দুলে দুলে তারিয়ে তারিয়ে বলল, ‘ওয়েল কমপ্লিমেন্টটা ইন্ডিরেক্ট ছিল তবে আমি বুঝে নিয়েছি।’ 

নাবিলা তর সইতে না পেরে সকালের হাতে চিমটি কেটে বলল, ‘এতো প্যাঁচাস কেন? বলে ফ্যাল না!’ 

সেই মুহূর্তে আরশানকে দেখা গেলো দৃশ্যপটে। সে হনহন করে দ্রুত পায়ে হেঁটে এসে বাবার সামনে দাঁড়িয়ে বলল, ‘বাবা আপনারা স্টার্ট করে দিন। আমার এক কলিগ এসেছে। মে বি ও আমাদের সাথে পিকনিকে জয়েন করবে। সো আমি ওর সাথেই যাচ্ছি।’ 

—‘কখন আসবে তুমি?’ বাবার প্রশ্ন। 

—‘এইতো কিছুক্ষণের মধ্যেই আসছি।’ 

—‘ঠিক আছে।’ 

আরশানের গায়ে একটা কালো রঙের টি শার্ট। বুকের ওপর সাদা কালি দিয়ে বড় করে ইংরেজিতে লেখা ‘গ্যাপ’। চোখে রোদ চশমা। নাবিলা ওকে দেখতে পেয়ে বলল, ‘তোর বরটা আসলেই দেখতে একদম সিনেমার নায়কের মতো। কিন্তু একটু বেশি লম্বা রে। তোর চুমু খেতে সমস্যা হবে। নাগাল পাবি না।’ 

সকাল রাঙা হয়ে উঠল শুনে, ‘ধ্যাৎ নাবিলা ফাজিল কথা বলিস না।ও আমার বর না। হবেও না কোনো দিন। যত সব আজাইরা কথা তোর।’ 

আরশান যেমন দ্রুত পায়ে এসেছিল তেমন দ্রুততার সাথেই প্ৰস্থান করলো। অন্য কোনোদিকে ফিরেও চাইলো না। 

চাচি ডাকলেন, ‘এসো এসো, উঠে পড়ো তোমরা গাড়িতে। সব তৈরি।’ সকালরা গাড়ির পেছনে উঠে বসলো। এই গাড়িতে শুধু চাচা চাচি আর তারা দুজন। ফাহাদ আর টিলি অন্য গাড়িতে আসছে। 

সকাল একটা অফ হোয়াইট কামিজের সাথে সি গ্রীণ ওড়না পরেছে। কানে সি গ্রীণ ঝোলানো দুল। চুলগুলো কাঁটা দিয়ে খোঁপার মতো মুড়ে রেখেছে। নাবিলা গাড়িতে উঠতে উঠতে বলল, ‘চুলটা ছেড়ে দে। ভালো লাগবে।’ 

সকাল ফিসফিস করলো, ‘আর ভালো লাগা। দেখলি তো একটা বার ফিরেও তাকালো না।’

—‘এতো অস্থির হস কেন বল তো? সে হয়তো ব্যস্ত ছিল। একটু বুঝতে হবে তো তোকে।’

—‘যা বোঝার বুঝে গেছি। আসলে কি জানিস মেয়েদের দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকা মনে হয় ওর অভ্যাস। পছন্দ-টছন্দ কিছু করে না আমাকে। এমনিই চেয়ে থাকে। 

—‘চেয়ে থাকে নাকি?’ 

—‘হ্যাঁ খুব চেয়ে থাকে। সুযোগ পেলেই।’ 

নাবিলা ফিক করে হেসে দিলো, ‘তাহলে নিশ্চিত থাক সে তোকে পছন্দই করে। মেয়েদের দিকে মোটেও তাকায় না। কই আমার দিকে তো চোখ তুলে চাইতে দেখলাম না একদিনও। 

—‘তুই মিশেছিস কয় দিন? মিশে দেখ না।’

—‘আচ্ছা কমপ্লিমেন্টের কথা কী বলছিলি?’

—‘পরে বলব। ভালো লাগছে না।’ 

চাচা চাচি উঠে বসলেন গাড়িতে। চাচা ড্রাইভ করছেন। 

চাচি সিট বেল্ট বাঁধতে বাঁধতে অনেকটা চাপা গলায় বললেন, ‘কলিগ মানে কি ওই মেয়েটা নাকি? যার সাথে তোমার ছেলে ঘুরে বেড়ায়?’ 

—‘হতে পারে।’ গাড়ি স্টার্ট দিলেন চাচা। 

—‘তোমার ছেলের কাণ্ড জ্ঞান দেখে আমি অবাক না হয়ে পারি না। এটা একটা ফ্যামিলি গেট টুগেদার। ও কোন আক্কেলে ওর গার্লফ্রেন্ডকে এমন একটা ঘরোয়া জায়গায় নিয়ে আসছে? আমার বান্ধবী রিনাও তো আসছে ওখানে তুমি জানো। ওরা কী মনে করবে বলো তো?’ 

পেছনে বসে চাচা চাচির কথোপকথন শুনতে শুনতে সকালের মুখের রং পাল্টে যাচ্ছিল। নাবিলা সেই পাল্টে যাওয়াটা স্পষ্ট টের পেলো। শক্ত করে চেপে ধরলো সে সকালের হাতখানা। 

চাচা গম্ভীর গলায় বললেন, ‘ছেলেরা বড় হয়েছে এখন। ওদের পছন্দের গুরুত্ব তো দিতেই হবে তাই না? একটা এডাল্ট ছেলেকে তো আমি এখন উঠতে বসতে নীতি জ্ঞান শেখাতে পারবো না।’ 

—‘শেখানোর সময় যখন ছিল তখন তুমি কিছুই শেখাওনি। আমার ফাহাদকে দেখো। একবার বলে দিয়েছি যে আমার ছেলের বউ হবে বাংলাদেশি মুসলিম ঘরের মেয়ে। আমার ছেলে মেনে নিয়েছে। তুমি কী শিখিয়েছো তোমার ছেলেকে?’ 

—‘এর দায়ভার তো কিছুটা তোমার ওপরেও বর্তায় তাই না? আরশান কি তোমারও ছেলে নয়? বিয়ের পর তো সন্তান হিসেবে ওকেই তুমি প্রথম পেয়েছিলে তাই না? তুমি কতটা পালন করতে পেরেছো তোমার দায়িত্ব? আমার ছেলেটা বলতে গেলে মা ছাড়াই বড় হয়েছে এক রকম। ওর বুকের ভেতর একটা কষ্ট আছে, আমি তা টের পাই। তাই ওর পছন্দ-অপছন্দের ওপর কোনো কথা বলতে চাই না। ওর যেভাবে ভালো লাগে থাকুক।’ 

—‘বাহ্, এর মানে কি তুমি বলতে চাইছো আমি ওর জন্য কিছুই করিনি? মা ছাড়া বড় হয়েছে বলতে তুমি কী বোঝাতে চাইছ? আমি কি ওর মা নই?’ চাচির গলা চড়ছিল। চাচা অনেকটা শান্ত ভাবে বললেন, ‘যদি মা হতেই তাহলে তো বারবার তোমার ছেলে, তোমার ছেলে কথাটা বলতে না তাই না? বলতে আমাদের ছেলে। যাক গে। এখন বাদ দাও।’ 

—‘ঠিক আছে ওকে আমি শেষ বারের মতো বোঝাবো যে বাড়ির বউ হবে বাঙালি এবং মুসলিম। বিধর্মী ছেলের বউ আমি কখনো মেনে নেবো না। ছি ছি লোকে কী বলবে?’ 

—‘আমার মনে হয় না ও এখন বিয়ের শাদীর কথা কিছু ভাবছে।’ 

—‘বিয়ে করবে না কিন্তু মেয়ে মানুষ নিয়ে ফ্যা ফ্যা করে ঘুরে বেড়াবে। এ কেমন কাণ্ড?’ 

—‘তোমার ছেলেরা উন্নত বিশ্বে বড় হয়েছে। এতটা রক্ষণশীল মনোভাব তোমাকে মানায় না ফাহাদের আম্মা।’ 

সকালরা যে একদম মূর্তি বনে গেছে চাচা মনে হয় তা এতক্ষণে লক্ষ্য করলেন। ঘাড় পেছনে ঘুরিয়ে বললেন, ‘তোমরা ঠিক আছো তো?’ 

সকাল আর নাবিলা হাসলো। হেসে বোঝাতে চাইলো ঠিক আছে ওরা।

দুই বান্ধবী চোখে চোখে চাইলো। সকালের বুক থেকে বেরিয়ে গেলো একটা হতাশাজনিত ভারি নিশ্বাস। চোখের ওপর পড়ল দুশ্চিন্তার ছায়া। সত্যিই তো, আরশানটা যেন কেমন। কী দরকার ছিল পারিবারিক একটা আয়োজনের মাঝে সাদা চামড়ার গার্লফ্রেন্ড সাথে করে নিয়ে আসার? এতো প্রেম? এতো ভালোবাসা? বেশ, চমৎকার! 

যে ফুরফুরে ভাবটা নিয়ে আজকের দিনটা শুরু হয়েছিল সেই ভাবটা মুহূর্তে ডানা মেলে উড়াল দিলো শূন্যে। সকালের আর কিছুই ভালো লাগছিল না। পৃথিবী ধূসর লাগছে। এই কমলা রোদের চকচকে উজ্জ্বল দিনটি তার চোখেই পড়ছে না। চারিদিকে এক বিষাদ মাখা কালো ছায়া। 

গাড়ি পার্কিং লটে রেখে পিকনিক স্পট খুঁজে পেতে বেশি সময় লাগলো না। দেখা গেলো ফাহাদরা আগেই পৌঁছে গেছে। গাড়ি থেকে মালামাল নামাতেই যা একটু সময় লাগলো। 

ছুটির দিন বলে কথা। অনেকেই পিকনিক করতে এসেছে সপরিবারে কিংবা বন্ধুদের সাথে। মাটির চুলায় কাউকে রান্না করতে দেখা গেলো না। যারা রান্না করছে তাদের প্রত্যেকের সাথে আছে গ্রিল অথবা কেনা খাবার। মাঠের ওপর চাদর বিছিয়ে বসে গেছে একেকটা দল। কেউ কেউ গাছের ডালে ঝুলিয়ে রেখেছে হ্যামক। হ্যামকে শুয়ে দোল খেয়ে খেয়ে বই পড়ছে বা মোবাইল দেখছে ছেলে-মেয়েরা। বাচ্চারা বল খেলছে। একটি ভারতীয় পরিবার এর মাঝে ক্রিকেটের ব্যাট বল নিয়ে নেমে গেছে মাঠে। 

অথিতিদের বসার জন্য কাঠের টেবিল আর বেঞ্চির ব্যবস্থা আছে। ফাহাদ আর টিলি সেরকম একটা বেঞ্চিতেই বসে ছিল। 

সকালদের দেখে ফাহাদ দৌড়ে আসলো। সকালের হাত থেকে মালামাল নিজের হাতে তুলে নিয়ে বলল, ‘আমাকে দাও। তুমি কষ্ট করছ কেন?’ 

সকাল নরম চোখে তাকালো ফাহাদের দিকে। ফাহাদ ছেলেটা সত্যি মিষ্টি। আর কী ভদ্র! ইশ কেন যে একে ভালোবাসতে পারলো না সে? 

ফাহাদ নাবিলাকে দেখে বলল, ‘ওয়াও! হোয়াট আ সারপ্রাইজ। আমি জানতাম না তুমি আসছ।’ 

নাবিলা হাসলো, ‘জানলে তো সারপ্রাইজটা আর সারপ্রাইজ হতো না, তাই না?’ 

—‘দ্যাটস! যাক ভালো হয়েছে তুমি এসেছো। কথা আছে তোমার সাথে।’ 

বারবিকিউ গ্রিল বসানো হলো। মাছ মাংস থলে থেকে বের করে নিয়ে চাচি কাজে লেগে গেলেন। সকালরাও বসে থাকলো না। নাবিলা পেঁয়াজ কাটলো। সকাল শশা, গাজর, লেটুস কেটে সালাদ তৈরি করলো। 

খানিক বাদে চাচির বান্ধবী এসে পৌঁছুলেন। সপরিবারে। 

কাঠের বেঞ্চিতে সকাল আর নাবিলা বসল পাশাপাশি। চাচির বান্ধবীটি হিজাব পরা হাসিখুশি মহিলা। একটি মাত্র কন্যা সন্তান। হাই স্কুলে উঠেছে মাত্র। টিলির সাথে ভালোই খাতির আছে বোঝা যাচ্ছে। দেখা হওয়া মাত্ৰ ফুসুর ফাসুর গল্প শুরু করে দিয়েছে। 

চাচির বান্ধবী সকালকে অনেকক্ষণ ধরে লক্ষ্য করছেন। মাথা থেকে পা পর্যন্ত আগাগোড়া খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছেন। দেখা শেষ হলে তিনি বললেন, ‘তুমি মা নিশ্চয়ই গান জানো। তোমাকে দেখেই আমার মনে হয়েছে তুমি খুব ভালো গান গাইতে পারো।’ 

সকাল ঢোঁক গিলে বলল, ‘না আন্টি আমি গান গাইতে পারি না। আমার গলায় একেবারেই সুর নেই।’ 

চাচির বান্ধবীর চোখে হতাশার ছায়া পড়ল। মিইয়ে যাওয়া গলায় বললেন, ‘ও!’ 

সকাল নাবিলাকে ইঙ্গিত করে বলল, ‘আমার এই ফ্রেন্ড কিন্তু খুব ভালো গান করে। ও আপনাদের গান শোনাতে পারবে।’ 

নাবিলা চমকে উঠল, ‘সেকি! আমি গান ছেড়ে দিয়েছি অনেক দিন হলো। সরি আন্টি এখন আর আমি গান করি না।’ 

মিনিটও গড়ালো না। চাচা, চাচি, টিলি সব্বাই নাবিলার গান শোনার বায়না ধরে বসলো। নাবিলা লজ্জায় একদম গুটিশুটি হয়ে গেলো। কী বিপদে ফেলে দিলো তাকে সকালটা। গান ছেড়ে দিয়েছে কত বছর হয়ে গেলো। এখন হুট করে গান গাইতে বললেই কি গাওয়া যায়? 

সব শেষে ফাহাদ বলল, ‘কাম অন নাবিলা। সবাই তোমার গান শুনতে চাইছে। একটা গান গেয়ে ফেলে মানুষগুলোকে উদ্ধার করো না! প্লিজ!’ 

অগত্যা, নাবিলাকে গাইতেই হলো। বড় বড় কয়েকটা দম নিয়ে একটু কাঁপা গলায় সে একটি রবীন্দ্র সংগীত ধরলো। প্রথম দিকে গলা একটু কাঁপলেও খানিকবাদে কিন্তু দারুণ শোনাচ্ছিল। 

চারিদিকে কমলা রোদ ঝিকমিক করছে। হালকা শীত ছোঁয়া বাতাস বইছে। নাবিলা পরেছে একটা সাদার ওপরে সাদা কাজের স্যালোয়ার কামিজ। তার খোলা চুলগুলো হাওয়ায় তির তির করে উড়ছে। সে গাইছে, 

“কতবার ভেবেছিনু আপনা ভুলিয়া, 
তোমার চরণে দিব হৃদয় খুলিয়া …” 

সেই সময় সকালের চারিপাশের বিষাদ মাখা ছায়া কাটিয়ে দিয়ে আলোর জোয়ার নিয়ে আরশান এসে পৌঁছল ওখানটায়। সে একা নয়। তার পাশে একটি আশ্চর্য সুন্দর মেয়ে। মেয়েটির সিল্কের মতো সোনালি রঙের চুল, চক্ষু দুটি নীল, গায়ের রং সাদা। লম্বায় আরশানের কাঁধ বরাবর। তার পরনে একটি হাতাকাটা লাল রঙের হাঁটু পর্যন্ত জামা। 

এই মেয়ে নির্ঘাত পরী। মানুষ নয়! 

.

কমলা রঙা রোদ্দুরের নিচে দাড়ানো পরীর মতো সুন্দর মেয়েটার দিকে চেয়ে থাকতে থাকতে সকালের চোখের কোণ সিক্ত হয়ে উঠল। ওদের 

দুজনকে সত্যিই, কী দারুণ মানিয়েছে! 

নাবিলা গাইছে, 

কতবার ভেবেছিনু আপনা ভুলিয়া 
তোমার চরণে দিব হৃদয় খুলিয়া 
চরণে ধরিয়া তব কহিব প্ৰকাশি 
গোপনে তোমারে, সখা, কত ভালোবাসি… 

আরশান আর এন্ড্রিয়ানা গানের পরিবেশ নষ্ট করলো না। ইশারায় হাত নেড়ে সবার সাথে কুশল বিনিময় করলো। নিঃশব্দে এসে বসলো কাঠের বেঞ্চিতে। যেটুকু খালি জায়গা ছিল তাতেই বসলো। দুজনে পাশাপাশি। 

সকাল দুহাত দিয়ে মুখ ঢেকে ফেললো। তার বুক জ্বালা করছে। খাঁ খাঁ করছে ভেতরটা। 

নাবিলার গান শেষ হলে হাত তালির ফোয়ারা উঠল। 

ফাহাদ বলল, ‘নাবিলা তুমি তো অসম্ভব সুন্দর গান করো! আরেকটা গাও প্লিজ।’ 

—‘আমার পালা শেষ, এবার অন্য কেউ গাইবে।’ 

টিলি বলল, ‘নাবিলা আপু, তোমার মতো ভালো আর কেউ গাইতে পারেনা এখানে।’

হঠাৎ আরশান বলে উঠল, ‘আমার এই বন্ধুটি কিন্তু খুব ভালো গান গায়। তোমরা শুনে দেখতে পারো।’ 

এন্ড্রিয়ানার চন্দন রঙের মুখটা রাঙা হয়ে উঠল, ‘না না আমি অত ভালো পারি না। তুমি বাড়িয়ে বলছ শওন! 

—‘মোটেও বাড়িয়ে বলছি না। তুমি গাইলেই সবাই টের পাবে যে আমি কতটা সত্য বলেছি।’ 

ফাহাদ বলল, ‘এন্ড্রি, আমি জানি তুমি ভালো গান করো। লাস্ট ইয়ার থ্যাংকস গিভিং এ তুমি গান গেয়েছিলে আমার মনে আছে। প্লিজ শুরু করো।’ 

এন্ড্রিয়ানা হেসে বলল, ‘ঠিক আছে, গাইছি।’ 

সকাল চোখ থেকে হাত সরিয়ে নিলো। একই রো-তে বসেছে বলে এখান থেকে এন্ড্রিয়ানাকে সরাসরি দেখা যায় না। আরশানকেও না। ঘাড় ঘুরিয়ে ঝুঁকে দেখতে হয়। ঝুঁকে ঘাড় ঘুরিয়েই তাকালো সে ওদের দিকে। 

এন্ড্রিয়ানা গাইছে লানা ডেল রে’র সামার টাইম স্যাডনেস। দারুণ গায়! আরশান কী মুগ্ধ হয়েই না শুনছে! 

সকালের গলায় আল্লাহ সুরটাও দিলেন না। আজকে জীবনে প্রথম বারের মতো গান গাইতে পারে না বলে তার আফসোস হতে লাগলো। কী আশ্চর্য, তার ঘটে এমন কোনো গুণ নেই যা দিয়ে কোনো মানুষকে মুগ্ধ করা যায়। সৃষ্টিকর্তার এ কেমন অবিচার। কেউ কেউ সব কিছু পেয়ে গেলো আবার কেউ কিছুই পেলো না। না পাওয়ার দলেই তার নামটা লেখা হয়ে গেলো আজীবনের জন্য। 

সেই সময় হঠাৎ আরশানের চোখজোড়া পড়ল ওর চোখে। আরশান হেসে হাত নাড়লো। 

হাত নাড়লো সকাল। চোখ সরিয়ে নিলো চকিতে। তার চোখ যে কেউ পড়তে পারে। সে একটা মস্ত বোকা মানুষ। হ্যাঁ বোকা বলেই তো আজ তার এহেন নাজেহাল অবস্থা। 

চোখ আবার ভিজে আসছে। সন্তর্পণে উঠে পড়ল সে। তার চোখের কাজল লেপ্টে গিয়েছে। এমন এলোমেলো অবস্থায় কি বসে থাকা যায় এতো লোকের সামনে? ওয়াশ রুমটা কোন দিকে খুঁজে বের করতে হবে। 

ওয়াশরুম একটু দূরে হলেও খুঁজে পাওয়া গেলো। একলা হবার পর অনেকক্ষণ ইচ্ছে মতো কাঁদলো সে। উপস্থিত হলো বিন্দুবাসিনী। কিন্তু সকাল বিন্দুকেও চায় না এ মুহূর্তে। সে কান্নাজড়ানো গলায় বলল, ‘তুমি যাও বিন্দু। আমি একলা থাকতে চাই। একা থাকতে দাও আমাকে। প্লিজ!’ বিন্দু কিছু না বলে মুখে একটা দুঃখ ভাব নিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। একটা সময় শান্ত গলায় বলল, 

—‘নিজের প্রতি এ আপনার কেমন অবিচার শেহজাদী? ভুলে যান না ওই মানুষটাকে।’ 

—‘যদি পারতাম!’ 

মোবাইল বাজছে। নাবিলার ফোন। কেটে দিলো। চোখে মুখে সময় নিয়ে পানি ছিটালো। ন্যাপকিন দিয়ে ঘষে ঘষে সাজসজ্জা সব মুছে নিলো চুলে করলো হাত খোঁপা। 

কী মনে করে বাবার নম্বরে ডায়াল করলো। ভাইবারে। বাবা ফোনটা ধরেও ফেললেন মুহূর্তের মাঝে। 

—‘কী খবর? আমার শেহজাদী কেমন আছে?’ 

সকাল কম্পনময় গলাটা যথা সম্ভব স্বাভাবিক করার চেষ্টা করে বলল, ‘বাবা আমার এখানে ভালো লাগছে না। তুমি টিকেট করে দাও। আমি ফিরে আসবো।’ 

বাবা আতঙ্কিত হয়ে বললেন, ‘কী হয়েছে? সব ঠিক আছে তো?’ 

—‘ঠিক আছে বাবা। আমার এখানে আর মন টিকছে না। তোমাদের জন্য খারাপ লাগছে।’ 

—‘ও এই কথা। এমনি কোনো ঝামেলা হয়নি তো?’ 

— ‘ঝামেলা হয়নি।’ 

—‘আচ্ছা ঠিক আছে। ফিরে আসতে চাইলে ফিরে আসবি। আমি দেখি আগামী সপ্তাহের দিকে টিকেট কাটার ব্যবস্থা করব। তুই চিন্তা করিস না।’ 

—‘মা কেমন আছে?’ 

—‘তোর মা ভালো আছে। আমাদেরকে নিয়ে একদম চিন্তা করিস না।’

—‘আচ্ছা বাবা ছাড়ছি তাহলে।’ 

.

ঝোপের মাথায় ফুটে আছে কয়েকটা নীল রঙা জংলী ফুল। ভার্জিনিয়া ব্লুবেলস। দুলছে হাওয়ায় তির তির করে। কয়েকটা ফুল আঙ্গুল দিয়ে টেনে ছিঁড়ে নিলো আরশান। কেন ছিঁড়লো কে জানে! এন্ড্রিয়ানা অবাক গলায় বলল, ‘তুমি ফুলগুলো কেন ছিঁড়লে? আমাকে দেবে কি? 

—‘নাহ, এই ফুলগুলো অন্য একজনকে দেব। যার এই ফুলগুলো খুব প্ৰিয়। 

—‘কে সে?’ 

আরশান মিট মিট করে হাসলো। কিছু বলল না। 

ওরা চারজন ঘাসের ওপর বসে আছে। ফাহাদ, নাবিলা, আরশান আর এন্ড্রিয়ানা। হাওয়ায় শীতল ভাবটা বেড়েছে খানিকটা। রোদ থাকলে উষ্ণ একটা ভাব ছড়িয়ে থাকে চারপাশে। কিন্তু রোদটা একটু ফাঁকি মেরে অন্য দিকে পালিয়ে গেলেই চারপাশে কেমন হিম হিম ভাব ছড়িয়ে যায়। 

সকাল ফিরে এসে ওদের চারজনকে এক জায়গায় দেখতে পেলো। মেজাজটা আরো বিগড়ে গেলো তার। নাবিলা আর কাজ পেলো না। ওদের দলে গিয়ে জুটেছে। সে এই দলটাকে এড়িয়ে যেতে চাইছিল। দেখেও না দেখার ভান করে পাশ কাটিয়ে হেঁটে আসছিল। একটু দূরেই চাচিরা বসে আছেন। সবার সাথে একত্রে না থেকে এখানে আলাদা দল করার কোনো মানে আছে? 

নাবিলা চেঁচিয়ে ডাকলো, ‘এই সকাল! আমরা এইদিকে।’ 

সকালকে ঘুরে তাকাতেই হলো। চুপচাপ ধীর পায়ে হেঁটে এগিয়ে আসলো সে। বসলো নাবিলার পাশে। আরশান আর এন্ড্রিয়ানার মুখোমুখি। তার চেহারায় তখনো একটা থমথমে ভাব বিরাজ করছে। কপাল কুঁচকানো। চোখ ফোলা। ফাহাদ ওকে দেখে বলল, 

—‘তোমার কী হয়েছে?’ 

—‘কিছু হয়নি। 

—‘ইউ লুক পেইল।’ 

—‘আমার চেহারাটাই এমন।’ একটু কাটা কাটা শোনাচ্ছিল সকালের কথাগুলো। 

এন্ড্রিয়ানা বলল, ‘ওর সাথে তো পরিচয় হলো না। ও কে?’ 

সকাল বুঝতে পারলো তাকেই ইঙ্গিত করা হয়েছে। চোখ তুলে এন্ড্রিয়ানার দিকে তাকালো সে। হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল, ‘হাই আমি সকাল।’ 

এন্ড্রিয়ানা ধরলো ওর হাতটা, ঝাঁকুনি দিয়ে বলল, ‘আমি এন্ট্রি। নাইস টু মিট ইউ।’ 

—‘নাইস টু মিট ইউ টু।’ 

সকাল ব্যাগ থেকে মোবাইল বের করে মোবাইলের পর্দায় ডুব দিল। কেন যেন তার মনে হচ্ছিল আরশান ওর দিকেই তাকিয়ে আছে। চোখ তুললো। হ্যাঁ ঠিকই টের পেয়েছে সে। 

চোখে চোখ পড়ল। আরশান চোখ সরালো না। হাতে ধরে থাকা ফুলগুলোর দিকে ইঙ্গিত করে বলল, ‘আপনার এই ফুল পছন্দ, তাই না?’ 

সকাল দেখলো আরশানের হাতে এক থোকা নীল জংলী ফুল। তার ঠোঁটজোড়া প্রসারিত হলো। মুখ থেকে ধীরে ধীরে সরতে লাগল মেঘের ছায়া। 

‘হ্যাঁ পছন্দ তো। কোথায় পেয়েছেন?’ 

—‘কুড়িয়ে পেলাম।’ বলে আরশান ফুলগুলো এগিয়ে দিলো সকালের দিকে। সকাল হাত বাড়িয়ে নিলো। তার বুক কাঁপছিল ঢিপ ঢিপ করে। 

গভীর ভাবে বলল, ‘ধন্যবাদ।’ 

তারপর ফুলগুলো কোলের ওপর ছড়িয়ে রাখলো। অনেকক্ষণ বাদে তার মুখ থেকে হাসি উপচে উপচে পড়ছে। কত ছোট্ট একটা ঘটনা। অথচ কতটা মোহময়, কতটা মধুর! এক মুহূর্তে পুরো দুনিয়া পাল্টে গেলো। 

এদিকে ফাহাদের চোখ থেকে বিস্ময় ঠিকরে বেরোচ্ছে। আর এড্রিয়ানা কিছুটা হতভম্ব হয়ে একবার আরশানের দিকে আরেকবার সকালের দিকে তাকাচ্ছে। সে বাংলা কথা বুঝতে পারছে না। কিন্তু ধারণা করতে পারছে কথোপকথনের মূল ভাব। 

আরশান অত্যন্ত স্বাভাবিক গলায় বলল, ‘রেখে দিলেন যে? চুলে গুঁজবেন না? সেদিনের মতো?’ 

কথাটা শুনে সকাল একটা আহ্লাদী হাসি হাসল। তাকে দেখে মনে হলো এই মুহূর্তে সে পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষটা। সে ফুলগুলো হাতে নিয়ে যত্ন করে কানের পাশে গুঁজলো। আরশান ঠোঁট উল্টে বলল, 

—‘উঁহু, সেদিন আপনার চুল খোলা ছিল।’ 

সকাল বিবশ হয়ে চেয়ে রইল কিছুক্ষণ আরশানের দিকে। মানুষটার সব মনে আছে। 

তারপর আস্তে করে নিজের চুলগুলো খুলে দিলো। 

—‘পারফেক্ট।’ আরশান বলল। 

ফাহাদ একটু অপ্রস্তুত ভাবে নাবিলাকে বলল, ‘নাবিলা, তোমার সাথে একটু কথা বলতে পারি?’ 

—‘হ্যাঁ বলো।’ 

ফাহাদ উঠে দাড়ালো বসা থেকে, বলল, ‘একটু এদিকে এসো।’ 

নাবিলা উঠল। হেঁটে দূরে একটু সরে আসলো ওরা। ফাহাদের কপালে চিন্তার রেখা খেলছে। নার্ভাস দেখাচ্ছে তাকে। সে উত্তেজিত ভাবে নাবিলাকে প্রশ্ন করলো, ‘আমি যা দেখেছি, তুমিও কি তা দেখেছ নাবিলা?’ 

নাবিলা বিপন্ন গলায় বলল, ‘কীসের কথা বলছো?’ 

—‘আমার ভাই আর সকাল।’ এটুকু বলে ভ্রু কুঁচকে গম্ভীর হয়ে কী যেন ভাবলো ফাহাদ। এদিক-সেদিক এলোমেলো ভাবে চোখ ঘোরালো। তারপর নিশ্বাস বন্ধ করে বলল, ‘ওদের ভেতর কি কিছু চলছে?’ 

নাবিলাকে ফ্যাকাশে দেখালো। তাকে যেন কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হয়েছে। অনেক কষ্টে বলল, 

—‘আমি তো কিছু জানি না।’ 

ফাহাদ তীক্ষ্ণ চোখে তাকায় নাবিলার দিকে, ‘তুমি সত্যি কথা বলছো?’

নাবিলা চোখ সরিয়ে নিলো, ‘আমি যা জানি না তা নিয়ে তোমাকে কী বলবো ফাহাদ? এসব বিষয়ে কি হুট করে কিছু বলা যায়?’ 

এদিকে ফাহাদ আর নাবিলা উঠে যাবার পর এন্ড্রিয়ানাও উঠে পড়ল। তার মাথা টলছে। গলা শুকিয়ে কাঠ। এই মুহূর্তে তার ঢক ঢক করে এক গ্লাস পানি গিলে ফেলা খুব প্রয়োজন। 

সবাই চলে গেলে আরশান শুয়ে পড়ল ঘাসের ওপরে চিৎ হয়ে। ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো সকালের দিকে। তারপর তাকিয়েই থাকলো নির্ণিমেষ। সকালের আজ আর অস্বস্তি লাগলো না বরং একটা স্নিগ্ধতায় ক্রমশ ছেয়ে যেতে লাগলো মন প্রাণ। মনে হচ্ছে ওই চোখজোড়া এতক্ষণ তাকে দেখেনি বলেই তার পৃথিবী অমন মেঘে ঢাকা ছিল। এখন সে দেখছে আর তার দুনিয়াটা সূর্য কিরণে ভাসছে। 

সকাল একটা সময় বলল, ‘সেই তখন থেকে তাকিয়ে তাকিয়ে কী দেখছেন?’ 

—‘আপনাকেই তো দেখছি।’ 

—‘আমাকে অত দেখার কী আছে?’ 

আরশান ঠোঁট উল্টে বলল, ‘তা তো জানি না! দেখতে ভালো লাগছে, তাই দেখছি।’ 

কথাটা শুনে সকাল হাসলো। গালে পড়ল টোল। ঝরলো মায়া। আরশান একটু আচ্ছন্ন ভাবে বলল, ‘আপনার হাসিটা… আপনার হাসিটা অক্টোবরের মতো।’ 

সকাল ভ্রু কুঁচকে ফেললো, ‘কী? কীসের মতো?’ 

—‘অক্টোবর!’ 

সকাল তার সুন্দর ঠোঁট দুটোকে সুন্দর ভাবে উল্টে বলল, ‘এটা কোনো কথা হলো? মানুষের হাসি আবার অক্টোবরের মতো হয় নাকি?’ 

ততক্ষণে এন্ড্রিয়ানা আরশানের পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে। সে বলল, ‘শওন, আমি চলে যাচ্ছি।’ 

আরশান শোয়া থেকে উঠে বসতে বসতে বলল, ‘এখনই চলে যাবে? খেয়ে যাও। আর তুমি না বলেছিলে ফুটবল খেলবে?’ 

এন্ড্রিয়ানা শুকনো গলায় বলল, ‘বলেছিলাম, কিন্তু এখন ইচ্ছে করছেনা। টায়ার্ড লাগছে।’ 

আরশান এগিয়ে এসে বলল, ‘ঠিক আছে, চলো তোমাকে গাড়ি পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে আসি।’ এরপর সকালকে বলল, ‘থাকুন। আমি আসছি।’ 

সকাল উঠে বসেছে। এন্ড্রি যাবার সময় ওকে কিছু বলে গেলো না। হাঁটতে হাঁটতে এন্ড্রি হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ল। ঘুরে তাকালো আরশানের দিকে। ধারালো ভাবে বলল, 

—‘হেই শওন! দ্যাট গার্ল। ডু ইউ হ্যাভ আ থিংগ ফর হার?’ 

আরশান প্রথমটায় বুঝলো না। চোখ ছোট করে ভ্রু কুঁচকে বলল, ‘হুইচ গার্ল?’ 

এন্ড্রিয়ানা চোখ দিয়ে ইশারা করে সকালকে দেখালো। আরশান বিস্ময়ে ডুবে গিয়ে নিজের মনে নিজে বিড়বিড় করে বলে উঠল, ‘হোয়াট?’ 

তারপর অত্যন্ত জোর গলায় বলল, ‘না না। সেরকম কিছুই না। তুমি ভুল বুঝেছো।’ 

এন্ড্রিয়ানা ভারি ঘোলাটে একটা হাসি হাসলো। তার মায়াবী নীল চোখদুটোতে টলমল করে উঠল কয়েক বিন্দু জল। সে হাত বাড়িয়ে আরশানের গাল ছুঁয়ে বলল, ‘ওহ শওন! লুক এট ইউ! ইউ আর সো নাইভ। তুমি নিজেকে নিজে একদম বোঝো না। কিন্তু আমি বুঝেছি।’ 

আরশান সন্দিহান হয়ে বলে, ‘তুমি কী বুঝেছ?’ 

এন্ড্রিয়ানা হাতের আঙ্গুল দিয়ে আরশানের কপালে পড়ে থাকা চুলগুলো নেড়ে দেয়। আদুরে গলায় বলে, ‘ওই মেয়েটার জন্য তোমার ফিলিংস আছে।’ 

—‘হেল নো!’ আরশান প্রতিবাদ করতে গিয়ে দু’ পা পিছিয়ে যায়। এক ঝটকায় সরিয়ে দেয় নিজের কপাল থেকে এন্ড্রিয়ানার হাত। 

এন্ড্রিয়ানার চোখ উপচে জল উঠে আসে। কাঁপা কাঁপা গলায় বলে, ‘হেল ইয়েস। কারণ, তুমি ওর দিকে আজ যেভাবে তাকালে, সেভাবে কোনো মেয়ের দিকে তাকাওনি কোনো দিন।’ এটুকু বলে সে একটু থামলো। আবার ফিসফিস করে কান্না জড়ানো গলায় বলল, ‘আমার দিকেও না।’ 

আরশান হতভম্ব হয়ে চেয়ে ছিল এন্ড্রিয়ানার দিকে। এন্ড্রি আরো একটু কাছে এগিয়ে এসে নিজের পায়ের আঙুলে ভর দিয়ে একটু উঁচু হলো। তারপর আরশানের ঠোঁটে প্রগাঢ় ভাবে একটা চুমু খেয়ে বলল, ‘বেস্ট অফ লাক!’ 

ও আর দাড়ালো না। একটু এলোমেলো পায়ে এগিয়ে গেলো সামনের দিকে। আরশান প্রস্তরীভূত হয়ে নির্বাক চেয়ে রইল ওর চলে যাওয়া পথটির দিকে। সকাল ওদেরকেই দেখছিল। কথা শুনতে পাচ্ছিল না কিন্তু ভাবভঙ্গী লক্ষ্য করছিল। আচমকা ওই চুম্বন দৃশ্যটা তাকে নাড়িয়ে দিলো। একটা প্রবল ধাক্কা এসে লাগলো হৃৎপিণ্ডে। চকিতে ফিরে আসলো বুকের জ্বালা। উঠে দাড়ালো সে। তার চোখ মুখ কাগজের মতো সাদা হয়ে গেছে। 

আরশান ঘুরে দাড়ালো। চোখ ফেললো সকালের চোখে। কয়েক সেকেন্ড নিভৃতে কাটলো। 

তারপর সকাল এক মুহূর্তও দেরি না করে ছুট দিলো। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *