৮. আধুনিক কাল

৮. আধুনিক কাল

সপ্তদশ শতাব্দী নাগাদ ইউরোপিয়রা যুক্তির কালে পা রেখেছিল। পবিত্র ট্র্যাডিশনের উপর নির্ভর করার বদলে বিজ্ঞানী, পণ্ডিত ও দার্শনিকগণ ভবিষ্যৎমুখী হয়ে উঠছিলেন, অতীতকে ছুঁড়ে ফেলে নতুন করে শুরু করতে প্রস্তুত ছিলেন তাঁরা। তাঁরা আবিষ্কার করছিলেন যে সত্যি কখনও পরম ছিল না, কেননা নতুন নতুন আবিষ্কার স্বভাবগতভাবে প্রাচীন নিশ্চয়তাসমূহকে তুচ্ছ করে তুলছিল। ক্রমবর্ধমানহারে সত্যিকে প্রায়োগিক ও বস্তুনিষ্ঠভাবে প্রদর্শনযোগ্য হয়ে উঠতে হচ্ছিল, বাহ্যিক বিশ্বে এর কার্যকারিতা ও আনুগত্য দিয়ে একে পরিমাপ করা হচ্ছিল। পরিণামে অধিকতর স্বজ্ঞামূলক চিন্তন প্রক্রিয়া সন্দেহের বিষয়ে পরিণত হয়। অর্জিত সাফল্যকে সংরক্ষণের পরিবর্তে পণ্ডিতগণ অগ্রদূত ও বিশেষজ্ঞে পরিণত হচ্ছিলেন। ‘রেনেইসাঁ পুরুষগণ’ সর্বব্যাপী জ্ঞান নিয়ে অতীতের বাসিন্দা হয়ে পড়েন। অচিরেই কোনও এক ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞের অন্য ক্ষেত্রে প্রকৃত যোগ্যতা রাখা কঠিন হয়ে উঠবে। আলোকন নামে পরিচিত দার্শনিকদের যুক্তিবাদ চিন্তার বিশ্লেষণমূলক পদ্ধতিকে উৎসাহিত করে; বস্তুকে সমগ্র হিসাবে দেখার বদলে লোকে একটি জটিল বাস্তবতাকে ব্যবচ্ছেদ করতে শিখছিল, সংযুক্ত অংশসমূহ পরীক্ষা নিরীক্ষা করছিল। বাইবেল পাঠের পদ্ধতির উপর এসবেরই গভীর প্রভাব পড়বে।

পরবর্তী বিকাশের ভিত্তি সূচক নিবন্ধ অ্যাডভান্সমেন্ট অভ লার্নিং (১৬০৫)-এ ইংল্যান্ডের রাজা প্রথম জেমস-এর পরামর্শক ফ্রান্সিস বেকন (১৫৬১-১৬২৬) প্রথমবারের মতো যুক্তি তুলে ধরেছিলেন যে, এমনকি পবিত্রতম মতবাদকেও অভিজ্ঞতালব্ধ বিজ্ঞানের কঠোর পদ্ধতির অধীনে আনতে হবে, তিনি ছিলেন এইমতের পক্ষপাতীদের অন্যতম। এইসব বিশ্বাস আমাদের ইন্দ্রিয়জ প্রমাণের বিরোধিতা করলে সেগুলোকে বিদায় নিতে হবে। বিজ্ঞানের কারণে রোমাঞ্চিত ছিলেন বেকন, তাঁর জোরাল বিশ্বাস ছিল এটা বিশ্বকে রক্ষা করে মিলেনিয়াল রাজ্যের উদ্বোধন ঘটাবে, পয়গম্বরগণ যার ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন। সুতরাং এর অগ্রযাত্রাকে কোনওভাবেই ঠাণ্ডা স্বভাবের সরল মনের যাজকদের কারণে বিঘ্নিত হতে দেওয়া যাবে না। তবে বেকন নিশ্চিত ছিলেন, বিজ্ঞান ও ধর্মের ভেতর কোনও বিরোধ সৃষ্টি হতে পারে না, কারণ সব সত্যিই এক। অবশ্য বিজ্ঞান সম্পর্কে বেকনের দৃষ্টিভঙ্গি আমাদের চেয়ে ভিন্ন ছিল। বেকনের চোখে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির মানে ছিল প্রামাণিক তথ্যকে একত্রিত করা, তিনি বৈজ্ঞানিক গবেষণায় আঁচ-অনুমান ও প্রকল্পের গুরুত্ব উপলব্ধি করতে পারেননি। ‘কেবল আমাদের পঞ্চ ইন্দ্রিয়জাত জ্ঞানকেই আমরা বিশ্বাস করতে পারি; বাস্তবক্ষেত্রে প্রয়োগ অসম্ভব যেকোনও কিছু-দর্শন, অধিবিদ্যা, ধর্মতত্ত্ব, শিল্পকলা, অতীন্দ্রিয়বাদ ও মিথলজি-অপ্রাসঙ্গিক। সত্য সম্পর্কিত তাঁর সংজ্ঞা দারুণভাবে প্রভাবশালী হয়ে উঠবে, বাইবেলের অধিকতর রক্ষণশীল প্রবক্তাদের ভেতরও কম না।

নতুন মানবতাবাদ ক্রমবর্ধমানহারে ধর্মের প্রতি বৈরী ভাবাপন্ন হয়ে উঠছিল। ফরাসি দার্শনিক রেনে দেকার্তে (১৫৯৬-১৬৫০) বলেছেন যুক্তি যেহেতু ঈশ্বর সম্পর্কে আমাদের প্রচুর তথ্য যোগায়, সুতরাং ঐশীগ্রন্থের কোনওই প্রয়োজন নেই। ব্রিটিশ গাণিতিক আইজ্যাক নিউটন (১৬৪২-১৭২৭) তাঁর বিশাল রচনায় খুব কমই বাইবেলের উল্লেখ করেছেন, কারণ মহাবিশ্বের নিবিড় পাঠ থেকে তিনি ঈশ্বর সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করেছিলেন। বিজ্ঞান অচিরেই প্রথাগত ধর্মবিশ্বাসমূহের অযৌক্তিক ‘রহস্যগুলো’র পর্দা উন্মোচন করবে। আলোকনের অন্যতম উদ্গাতা জন লকের (১৫৩২-১৭০৪) ডেইজম- এর নতুন ধর্ম কেবল যুক্তিতে প্রোথিত ছিল। ইম্যানুয়েল কান্ট ( ১৭২৪- ১৮০৪) বিশ্বাস করতেন, ঐশী প্রত্যাদিষ্ট বাইবেল মানবজাতির স্বায়ত্বশাসন ও স্বাধীনতাকে লঙ্ঘিত করেছে। কোনও কোনও চিন্তাবিদ আরও অগ্রসর হয়েছেন। স্কটিশ দার্শনিক ডেভিড হিউম (১৭১১-৭৬) যুক্তি দেখিয়েছেন যে, আমাদের ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য অভিজ্ঞতার অতীতে আর কিছুর অস্তিত্ব বিশ্বাস করার কোনও কারণ নেই। দার্শনিক, সমালোচক ও ঔপন্যাসিক ডেনিস দিদেরো (১৭১৩-৮৪) ঈশ্বরের থাকা না থাকায় কোনও পরোয়া করতেন না, অন্যদিকে হলবাখের পল হেইরিখ ব্যারন (১৭২৩-৮৯) যুক্তি দেখান যে, একজন অতিপ্রাকৃত ঈশ্বরে বিশ্বাস কাপুরুষতা ও হতাশার ব্যাপার।

কিন্তু তারপরেও যুক্তির কলের বহু লোক গ্রেকো-রোমান অ্যান্টিকুইটির ক্লাসিকের ভক্ত রয়ে গিয়েছিল যা ঐশীগ্রন্থের বহু কাজ পালন করেছে বলে মনে হয়। দিদেরো ক্লাসিক পাঠ করার সময় ‘সমীহের আবহ…আনন্দের রোমাঞ্চ…স্বর্গীয় উৎসাহ’ পেয়েছেন। জাঁ-জাক রুশো (১৭১২-৭২) ঘোষণা করেছিলেন, তিনি গ্রিক ও রোমান লেখকদের লেখা বারবার পড়বেন। “আগুন পেয়েছি আমি!’ পুতার্ক পড়ে চিৎকার করে উঠেছিলেন তিনি। ইংরেজ ইতিহাসবিদ এডওয়ার্ড গিবন (১৭৩৭-৯৪) প্রথমবারের মতো রোম সফর করার সময় আবিষ্কার করেছিলেন যে, ‘জোরাল আবেগে’ ‘বিক্ষুব্ধ’ থাকায় তিনি অগ্রসর হতে পারছেন না এবং এক ধরনের প্রায় ধর্মীয় ‘ঘোর’ ও ‘উৎসাহ’-এর অভিজ্ঞতা লাভ করেছিলেন। তাঁরা সবাই এইসব প্রাচীন কর্মকাণ্ডকে তাদের মনের গভীরতম আকাঙ্ক্ষায় স্থান দিয়েছিলেন, অন্তস্থ জগৎকে অবগত করেছেন ও বিনিময়ে টেক্সট তাদের দুয়ের মুহূর্ত দিয়েছে বলে আবিষ্কার করেছেন।

+

অন্য পণ্ডিতগণ বাইবেলে তাদের সংশয়ী, সমালোচনামূলক দক্ষতা প্রয়োগ করেছেন। উদার শহর আর্মস্টারডামে জন্মগ্রহণকারী স্প্যানিশ বংশোদ্ভূত সেফার্দিক ইহুদি বারুচ স্পিনোযা (১৬৩২-৭৭) গণিত, পদার্থবিদ্যা ও জ্যোতির্বিজ্ঞানে পড়াশোনা করেছেন, এসবকে ধর্মীয় বিশ্বাসের সাথে বেমানান আবিষ্কার করেছেন তিনি।৫ ১৬৫৫ সালে তিনি তাঁর সম্প্রদায়কে বিচলিত করে তোলা সন্দেহ প্রকাশ করতে শুরু করেন: বাইবেলের প্রকাশিত বৈপরীত্য প্ৰমাণ করে যে, এটা ঐশী উৎসজাত হতে পারে না; প্রত্যাদেশের ধারণা নেহাত বিভ্রম এবং অতিপ্রাকৃত কোনও উপাস্যের অস্তিত্ব নেই-আমরা যাকে ঈশ্বর বলি সেটা স্রেফ খোদ প্রকৃতি। ১৬৫০ সালের ২৭শে জুলাই স্পিনোযাকে সিনাগগ থেকে বহিষ্কার করা হয়; তিনি প্রতিষ্ঠিত ধর্মের বাইরে বসবাসকারী প্রথম ইউরোপিয় হিসাবে সফলভাবে জীবন যাপন শুরু করেন। স্পিনোযা প্রচলিত ধর্মবিশ্বাসকে ‘অর্থহীন রহস্যের তন্তু’ বলে নাকচ করে দিয়েছেন; তিনি যুক্তির অবাধ চর্চা থেকে তাঁর ভাষায় ‘পরম সুখ’ পেতে পছন্দ করতেন। স্পিনোযা নজীরবিহীন বস্তুনিষ্ঠতার সাথে বাইবেলের ঐতিহাসিক পটভূমি ও সাহিত্যিক ঘরানা গবেষণা করেছেন। ইবন এযরার সাথে তিনি একমত প্রকাশ করেছেন যে, মোজেসের গোটা পেন্টাটিউক লিখতে পারার কথা নয়, তিনি দাবি করেছেন এ কাজটি বেশ কয়েকজন লেখকের। তিনি ঐতিহাসিক সমালোচনামূলক পদ্ধতির অগ্রপথিকে পরিণত হন, পরে যাকে তিনি বাইবেলের হাইয়ার ক্রিটিসিজম বলে আখ্যায়িত করবেন।

দাসাও, জার্মানির এক দরিদ্র তোরাহ পণ্ডিতের মেধাবী ছেলে মোজেস মেন্দেলসন (১৭২৯-৮০) অতখানি রেডিক্যাল ছিলেন না। তিনি আধুনিক স্কলার শিক্ষার প্রেমে পেড়েছিলেন, কিন্তু লকের মতো একজন উদার ঈশ্বরের ধারণা মেনে নিতে তাঁর কোনও অসুবিধা ছিল না, একে তাঁর কাছে সাধারণ জ্ঞানের ব্যাপার মনে হয়েছে। তিনি হাসকালাহ নামে একটি ইহুদি ‘আলোকন’ সৃষ্টি করেছিলেন যা আধুনিকতার সাথে ভালোভাবে মানানসই ও ইহুদিবাদকে যৌক্তিক ধর্মবিশ্বাস হিসাবে তুলে ধরেছিল। সিনাই পর্বতচূড়ায় ঈশ্বর কতগুলো মতবাদের প্রকাশ ঘটাননি, বরং আইনের মাধ্যমে নিজেকে প্রকাশ করেছিলেন, সুতরাং ইহুদি ধর্ম কেবল নীতিমালা নিয়েই ভাবিত ও মনকে সম্পূর্ণ মুক্ত রাখে। বাইবেলের কর্তৃত্ব মেনে নেওয়ার আগে ইহুদিদের অবশ্যই এর দাবি সম্পর্কে যৌক্তিকভাবে নিশ্চিত করতে হবে। একে ইহুদি ধর্মমত হিসাবে শনাক্ত করা কঠিন। মেন্দেলসন একে আধ্যাত্মিকতার পক্ষে অচেনা একটি যৌক্তিক ছাঁচে ফেলার প্রয়াস পেয়েছেন। তা সত্ত্বেও মাসকিলিম (‘আলোকিতজন’) নামে পরিচিত হয়ে ওঠা বহু ইহুদি তাঁকে অনুসরণ করতে প্রস্তুত ছিল। তারা ঘেটোর বুদ্ধিবৃত্তিক প্রতিবন্ধকতা থেকে পালাতে চেয়েছে, জেন্টাইল সমাজে মিশতে চেয়েছে, নতুন বিজ্ঞান পড়তে চেয়েছে এবং ধর্মবিশ্বাসকে ব্যক্তিগত পর্যায়ে সীমিত রাখতে চেয়েছে।

কিন্তু পোল্যান্ড, গালিশিয়া, বেলারুশিয়া ও লিথুয়ানিয়ার ইহুদিদের ভেতর এক অতীন্দ্রিয়বাদ এই যুক্তিবাদকে ভারসাম্য দিয়েছিল, যা কিনা আধুনিকতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহের শামিল ছিল।’ ১৭৩৫ সালে এক দরিদ্র সরাইখানা মালিক ইসরায়েল বেন এলিযার (১৬৯৮–১৭৬০) বা’ল শেম-’নামের পণ্ডিত’-এ পরিণত হন; তিনি ছিলেন ফেইথ হিলারদের একজন, পূর্ব ইউরোপের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ঘুরে বেরিয়ে ঈশ্বরের নামে প্রচারণা চালিয়েছেন। পোলিশ ইহুদি সম্প্রদায়ের জন্যে এটা ছিল এক অন্ধকার কাল। অভিজাত সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে এক কৃষক বিদ্রোহের সময় (১৬৪৮–৬৭) ইহুদিদের ব্যাপক সংখ্যায় হত্যা করা হয় এবং তারা তখনও নাজুক ও অর্থনৈতিকভাবে বঞ্চিত অবস্থায় ছিল। ধনী-দরিদ্রের ব্যবধান ক্রমশঃ বেড়ে উঠছিল, র‍্যাবাইদের অনেকে স্রেফ তোরাহ পাঠে ফিরে গিয়েছিলেন, তাঁদের সমাবেশকে অবহেলা করে গেছেন। ইসরায়েল বেন এলিযার এক সংস্কার আন্দোলনের সূচনা করেন ও বা’ল শেম তোভ-বা বেশ্ট-ভিন্ন প্রকৃতির পণ্ডিত-নামে পরিচিত হয়ে ওঠেন। তাঁর জীবনের শেষ নাগাদ হাসিদিমের (‘ধার্মিক জন’) সংখ্যা দাঁড়িয়েছিল চল্লিশ হাজার।

বেশট দাবি করেছিলেন যে, তালমুদ পাঠ করার কারণে ঈশ্বর তাঁকে বেছে নেননি, বরং তিনি এমন উৎসাহ ও মনোযোগের সাথে প্ৰচলিত প্ৰাৰ্থনা মন্ত্র উচ্চারণ করেছিলেন যে ঈশ্বরের সাথে পরমানন্দময় সংহতি লাভ করেছিলেন। তালমুদিয় কালের র‍্যাবাইদের বিপরীতে-যাঁরা মনে করতেন তালমুদ পাঠ প্রার্থনা চেয়ে উপরে’-বেশট জোরের সাথে ধ্যানের গুরুত্বের কথা বলেছেন।o একজন র‍্যাবাইয়ের বইয়ের পাতায় ডুবে গিয়ে দরিদ্রদের অবহেলা করা ঠিক হবে না। হাসিদিম আধ্যাত্মিকতা ইসাক লুরিয়ার স্বর্গীয় স্ফুলিঙ্গের বস্তুগত জগতে আটকা পড়ার মিথের উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে, কিন্তু বেশট এই ট্র্যাজিক দর্শনকে ঈশ্বরের সর্বব্যাপীতার উপলব্ধির এক ইতিবাচক দর্শনে পরিণত করেছেন। স্বর্গীয় স্ফুলিঙ্গ যেকোনও বস্তুতেই পাওয়া যেতে পারে, তা সে যত তুচ্ছই হোক, কোনও কাজ-খাওয়া, পান করা, ভালোবাসা বা ব্যবসা করা-খারাপ নয়। দেভেকুতের (‘সংশ্লিষ্টতা’) অবিরাম চর্চার ভেতর দিয়ে একজন হাসিদ ঈশ্বরের উপস্থিতির চিরস্থায়ী উপলব্ধি গড়ে তোলে। হাসিদিম এই বর্ধিত সচেতনতাকে পরমান্দময়, শোরগোলে পূর্ণ ও কম্পিত প্রার্থনার সাথে বাড়াবাড়ি রকম অঙ্গভঙ্গি দিয়ে প্রকাশ করেছে: যেমন দৃষ্টিভঙ্গির সম্পূর্ণ পরিবর্তনকে প্রতীকায়িত করা ডিগবাজি-এটা তাদের সম্পূর্ণ সত্তাকে উপাসনায় নিক্ষেপ করতে সাহায্য করেছে।

ঠিক হাসিদিমরা যেভাবে একেবারে মামুলি বস্তুতে লুকানো স্বৰ্গীয় স্ফুলিঙ্গকে দেখার জন্যে বস্তুর পর্দা ভেদ করে দৃষ্টি দিয়েছে, তেমনি তারা বাইবেলের শব্দ ভেদ করে উপরিতলের নিচে লুকানো ঐশী সত্তাকে দেখার প্রয়াস পেয়েছে। তোরাহর শব্দ ও হরফগুলো এন সফের আলোকে ধারণ করে রাখা পাত্র, সুতরাং একজন হাসিদকে অবশ্যই টেক্সটের আক্ষরিক অর্থের উপর মনোসংযোগ করলেই চলবে না, বরং এর সাথে সংশ্লিষ্ট আধ্যাত্মিক অর্থের দিকেও নজর দিতে হবে।” তাকে অবশ্যই এক ধরনের গ্রাহী মনোভাব গড়ে তুলতে হবে ও মানসিক ক্ষমতার লাগাম টেনে ধরে বাইবেলকে নিজের সাথে কথা বলতে দিতে হবে। একদিন

একদিন বিজ্ঞ কাব্বালিস্ট দোভ বার (১৭১৬-৭২)-শেষ পর্যন্ত তিনি হাসিদিম আন্দোলনে বেশটের উত্তরাধিকারী হবেন–দেখা করতে এলেন বেশটের সাথে। একসাথে তোরাহ পাঠ করেন ওরা। দেবদূতদের নিয়ে একটি টেক্সটে মগ্ন হয়ে যান। দোভ বার অনেকটা বিমূর্ত ঢঙে টেক্সটের প্রতি অগ্রসর হয়েছিলেন, বেশট তাঁকে দেবদূতদের প্রতি দাঁড়িয়ে সম্মান জানাতে বললেন। তিনি উঠে দাঁড়ানোমাত্র ‘গোটা বাড়ি আলোতে ভরে উঠল, চারপাশে জ্বলে উঠল আগুন, এবং ওরা [দুজনই] দেবদূতদের উপস্থিতি অনুভব করলেন।’ ‘আপনার কথা মতো সহজ পাঠ, ‘ দোভ বারকে বললেন বেশট, ‘কিন্তু আপনার পড়ার ভঙ্গিতে প্রাণের ঘাটতি ছিল।’১১ প্রার্থনার প্রবণতা ও ভঙ্গিবিহীন সাধারণ পাঠ অদৃশ্যের ছবি ফুটিয়ে তুলবে না।

এধরনের প্রার্থনা ছাড়া তোরাহ পাঠ অর্থহীন। দোভ বারের একজন শিষ্য যেমন ব্যাখ্যা করেছেন, হাসিদিমকে অবশ্যই ঐশীগ্রন্থকে ‘জ্বলন্ত অন্তরের উৎসাহের সাথে সব রকম আনন্দ থেকে ভিন্ন হয়ে অটলভাবে সকল মানুষের মনস্তাত্ত্বিক ক্ষমতা নিয়ে ঈশ্বরের পরিষ্কার ও খাঁটি ভাবনায় তোরাহ পাঠ করতে হবে।১২ বেশট তাদের বলেছিলেন, তারা এভাবে সিনাই পর্বতের কাহিনীর দিকে অগ্রসর হলে ‘সব সময়ই ঈশ্বরের কণ্ঠস্বর শুনতে পাবে, সিনাইয়ের চূড়ায় প্রত্যাদেশের সময় যেভাবে তিনি কথা বলেছিলেন, কারণ মোজেসের ইচ্ছা ছিল যে সমগ্র ইসরায়েল তাঁর মতো একই স্তরে পৌঁছাক।১৩ কথা হচ্ছে সিনাই নিয়ে পাঠ নয়, বরং খোদ সিনাইকে অনুভব করা।

দোভ বার হাসিদিক নেতা হওয়ার পর তাঁর শিক্ষার খ্যাতির কারণে বহু র‍্যাবাই ও পণ্ডিত এই আন্দোলনের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলেন। তবে তাঁর ব্যাখ্যা তখন আর শুষ্ক, একাডেমিক ছিল না। তাঁর একজন শিষ্য স্মৃতিচারণ করেছেন যে, ‘তিনি সত্যি কথা বলার জন্যে যখন মুখ খুলতেন, মনে হতো যেন তিনি মোটেই এই জগতের নন, স্বর্গীয় সত্তা তাঁর কণ্ঠে কথা বলছেন।১৪ অনেক সময় কোনও কথার মাঝখানে থমকে যেতেন তিনি, কিছুক্ষণ নীরবে অপেক্ষা করতেন। হাসিদিমরা তাদের নিজস্ব লেকশিও দিভাইনা গড়ে তুলছিল, অন্তরে ঐশীগ্রন্থের জন্যে একটা নিরিবিলি স্থান তৈরি করছিল। কোনও টেক্সটকে বিশ্লেষণ করে ছিন্নভিন্ন করার বদলে হাসিদকে সমালোচনামূলক গুণকে স্থির করতে হতো। ‘তোমাকে তোরাহ পাঠের সেরা উপায় শিক্ষা দেব আমি, ‘ বলতেন দোভ বার, ‘মোটেই নিজেকে অনুভব [সচেতন হয়ে ওঠা] করার জন্যে নয়, বরং মনোযোগী কান হয়ে উঠতে সাহায্য করা-যার কান শব্দের কথা শোনে কিন্তু নিজে কথা বলে না।’১৫ ব্যাখ্যাকারের নিজেকে স্বর্গীয় সত্তার জন্যে পাত্রে পরিণত করতে হবে। তোরাহকে অবশ্যই তার কাজ করতে দিতে হবে যেন তিনি একটি উপকরণ। ১৬

অর্থডক্স ইহুদির তরফ থেকে হাসিদিমদের বিরুদ্ধ ভীষণ বিরোধিতার সৃষ্টি হয়েছিল, তারা বেশটের তোরাহর পণ্ডিতসুলভ পাঠের আপাত পদচ্যুতিতে ভীত হয়ে উঠেছিল। এরা মিসনাগদিম (‘বিরোধী’) নামে পরিচিত হয়ে ওঠে। তাদের নেতা ছিলেন লিথুয়ানিয়ার একাডেমি অভ ভিয়েনার প্রধান (গাওন) এলিযাহ বেন সোলোমন যালমান (১৭২০-৯৭)। তোরাহ পাঠ ছিল গাওনের প্রধান প্যাশন, তবে তিনি জ্যোতির্বিজ্ঞান, শারীরতত্ত্ব, গণিত ও বিদেশী ভাষায় দক্ষ ছিলেন। হাসিদিমদের চেয়ে ঢের বেশি আগ্রাসীভাবে ঐশীগ্রন্থ পাঠ করলেও গাওনের পদ্ধতি ছিল অতীন্দ্রিয়বাদীই। তিনি তাঁর ভাষায় পাঠের ‘প্রয়াস’-কে উপভোগ করতেন, এক নিবিড় মানসিক কর্মকাণ্ড যা তাকে সচেতমতার এক নতুন স্তরে তুলে দিত এবং সারারাত বইয়ের সাথে আটকে রাখত; ঘুমে ঢলে পড়ার হাত থেকে বাঁচতে বরফ শীতল পানিতে পা ডোবানো থাকত তাঁর। নিজেকে যখন ঘুমোতে দিতেন, তোরাহ তাঁর স্বপ্নে প্রবেশ করত; তিনি স্বর্গে আরোহণের অভিজ্ঞতা লাভ করতেন। ‘যে তোরাহ পাঠ করে সে ঈশ্বরের প্রতি অঙ্গীকারাবদ্ধ হয়,’ দাবি করেছে তাঁর একজন শিষ্য। ‘কারণ ঈশ্বর ও তোরাহ একই।১৭

+

অবশ্য পশ্চিম ইউরোপে ঐশীগ্রন্থে ঈশ্বরকে খুঁজে পাওয়া ক্রমেই কঠিন হয়ে উঠছিল। আলোকনের রীতিনীতি আরও বেশি সংখ্যায় পণ্ডিতদের সমালোচনা- মূলকভাবে বাইবলে পাঠে অনুপ্রাণিত করে তুলছিল। কিন্তু প্রার্থনার ভঙ্গি ও অবস্থান ছাড়া দুর্ভেয় মাত্রাকে অনুভব করা ছিল অসম্ভব। ইংল্যান্ডে রেডিক্যাল ডেইস্টদের কেউ কেউ বাইবেলকে খাট করার জন্যে নতুন পণ্ডিতি পদ্ধতি ব্যবহার করেছে।১৮ গণিতবিদ উইলিয়াম হুইস্টন (১৬৬৭–১৭৫২) বিশ্বাস করতেন, আদি কালের ক্রিশ্চান ধর্ম অনেক বেশি যৌক্তিক ছিল। ১৭৪৫ সালে তিনি নিউ টেস্টামেন্টের একটি নতুন ভাষ্য প্রকাশ করেন যেখান থেকে ট্রিনিটি ও ইনকারনেশনের প্রতিটি উল্লেখ মুছে ফেলেন। তাঁর দাবি, এইসব মতবাদ ফাদার অভ দ্য চার্চ কর্তৃক বিশ্বাসীদের উপর চাপিয়ে দেওয়া। আইরিশ ডেইস্ট জন টোলান্ড (১৬৭০-১৭২২) কথিত দীর্ঘকাল নিখোঁজ থাকা বারনাবাসের ইহুদি-ক্রিশ্চান পাণ্ডুলিপি দিয়ে নিউ টেস্টামেন্টকে প্রতিস্থাপিত করতে চেয়েছিলেন, ক্রাইস্টের ঐশ্বরিকতা অস্বীকার করা হয়েছিল এতে। অন্য সংশয়বাদীরা যুক্তি দেখিয়েছে যে নিউ টেস্টামেন্টের টেক্সট এতটাই বিকৃত হয়ে গেছে যে বাইবেল আসলে কী বলেছে সেটা বের করাই দুরূহ হয়ে গেছে। কিন্তু বিশিষ্ট ক্লাসিসিস্ট রিচার্ড বেন্টলি (১৬৬২–১৭৪২) বাইবেলের পক্ষে এক পণ্ডিতি প্রচারণা চালু করেছিলেন। বর্তমানে প্রযুক্ত গ্রেকো-রোমান সমালোচনা কৌশল ব্যবহার করে তিনি দেখান যে, পরিবর্তনসমূহকে পাশাপাশি রেখে বিশ্লেষণ করে মূল পাণ্ডুলিপি তৈরি করা সম্ভব।

জার্মানিতে পিয়েটিস্টরা বিতর্কে লিপ্ত বিভিন্ন প্রটেস্ট্যান্ট গোত্রের শুষ্ক মতবাদগত যুক্তিকে অতিক্রম করে যেতে চেয়েছে, তারা বাইবেলকে পুনঃস্থাপিত করার লক্ষ্যে এইসব বিশ্লেষণমূলক পদ্ধতি আঁকড়ে ধরেছিল। তারা বিশ্বাস করত, বাইবেলের সমালোচকদের গোষ্ঠীগত আনুগত্যের ঊর্ধ্বে উঠতে হবে।১৯ পিয়েটিস্টদের লক্ষ্য ছিল ধর্মকে ধর্মতত্ত্ব থেকে মুক্ত করে ঐশী সত্তার অধিকতর ব্যক্তিগত উপলব্ধি লাভ করা। ১৬৯৪ সলে তারা গোষ্ঠী নিরপেক্ষ চেহারায় নতুন মনীষা সাধারণ জনগণের কাছে পৌঁছে দিতে হালে একটি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করে; হাল বাইবেলিয় বিপ্লবের কেন্দ্রে পরিণত হয়। ১৭১১ সাল থেকে ১৭১৯ সালের ভেতর এখানকার প্রেসে ১০০,০০০ কপি নিউ টেস্টামেন্ট ও ৮০,০০০০ কপি পূর্ণাঙ্গ বাইবেল ছাপানো হয়। হালের পণ্ডিতরা ঐশীগ্রন্থের আন্তঃগোষ্ঠী পাঠ উৎসাহিত করতে বিবলিয়া পেন্তাপ্লাও প্রকাশ করেছিলেন: পাঁচটি ভিন্ন ভিন্ন অনুবাদ পাশাপাশি রাখা হয় যাতে লুথারান, কালভিনিস্ট ও ক্যাথলিকরা যার যার পছন্দমতো ভাষ্য পড়তে পারে, আবার কোনও সমস্যা পড়লে অন্যটির শব্দ বিন্যাসও দেখতে পারে। অন্যরা বাইবেলকে সম্পূর্ণ আক্ষরিকভাবে অনুবাদ করে এটা দেখাতে যে এমনকি মাতৃভাষায়ও ঈশ্বরের বাণী একেবারেই স্পষ্ট নয়। ধর্মবেত্তাদের আরোপিত ধর্মতত্ত্বীয় ব্যাখ্যার ভার বহনে অক্ষম ‘প্রুফ টেক্সট’ ব্যবহারের ক্ষেত্রে অনীহা দেখানো উচিত। মূলকে অভিজাত জার্মানে প্রকাশ করা না গেলে বাইবেল অদ্ভুত ও অচেনা মনে হবে এবং এটা ঈশ্বরের বাণী বোঝা যে সব সময়ই কঠিন তারই স্বাস্থ্যকর স্মারক।২১

অষ্টম শতাব্দীর শেষের দিকে জার্মান পণ্ডিতগণ বাইবেলিয় পাঠের পথে নেতৃত্ব গ্রহণ করেন এবং স্পিনোযার ঐতিহাসিক সমালোচনামূলক পদ্ধতিকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যেতে থাকেন। তাঁরা মত প্রকাশ করেন যে, মোজেস নিশ্চিতভাবেই পেন্টাটিউক রচনা করেননি, এর বেশ কয়েক জন ভিন্ন ভিন্ন রচয়িতা ছিলেন বলে মনে হয়, যাদের প্রত্যেকেই ভিন্ন ভিন্ন কায়দায় লিখেছেন। একজন স্বর্গীয় পদবী ‘ইলোহিম’ পছন্দ করেছেন; অন্য একজন ঈশ্বরকে ডেকেছেন ‘ইয়াহওয়েহ’। নিশ্চিতভাবেই বিভিন্ন জনের লেখা অবিকল বর্ণনাও রয়েছে, যেমন জেনেসিসের দুটি সৃষ্টি কাহিনী।২২ তো প্যারিসের একজন চিকিৎসক জন আশ্রু (১৬৮৪-১৭৬৬) ও জেনা ইউনিভার্সিটির অরিয়েন্টাল ল্যাঙ্গোয়েজ-এর প্রফেটসর ইয়োহান একহর্ন (১৭৫২–১৮২৭) যুক্তি দেখিয়েছেন যে, জেনেসিসে দুটি প্রধান দলিল রয়েছে: ‘ইয়াহওয়েহবাদী’ ও ‘ইলোহিমবাদী’। কিন্তু ১৭৯৮ সালে একহর্নের উত্তরসুরি কার্ল ডেভিড ডিইউট (১৭৮০-১৮৪০) বিশ্বাস করতেন, এটা বড় বেশি সরলীকরণ: পেন্টাটিউক অসংখ্য বিচ্ছিন্ন অংশ দিয়ে তৈরি কোনও একজন মঠবাসী যেগুলোকে একত্রিত করেছেন।

উনবিংশ শতাব্দীর দিকে হাইয়ার ক্রিটিসিজমের পণ্ডিতদের মোটামুটি ঐক্যমত সৃষ্টি হয়েছিল যে পেন্টাটিউক চারটি আদি ভিন্ন উৎসের সন্নিবেশ। ১৮০৫ সালে ডিউইট যুক্তি তুলে ধরেন যে, ডিউটেরোনমি (‘D’) পেন্টাটিউকের সর্বশেষ গ্রন্থ এবং খুব সম্ভব সেফার তোরাহ জোসায়াহ আমলে আবিষ্কৃত হয়েছিল। হালের প্রফেটসর হারমান হাপফেল্ড (১৭৯৬-১৮৬৬) আইগেনের সাথে একমত হন যে ‘ইলোহিমবাদী’ উৎস দুটো ভিন্ন দলিলের সমষ্টি: ‘E-1’ (প্রিস্টলি রচনা) এবং ‘E-2’ ‘J’ এবং ‘D’ এই পর্যায়ক্রমে। কিন্তু কার্ল হেইনরিখ (১৮১৫–৬৯) প্রিস্টলি দলিল (‘E-1’) আসলে চারটি উৎসের ভেতর সর্বশেষ যুক্তি দেখিয়ে গুরুত্বপূর্ণ সাফল্য লাভ করেন।

জুলিয়াস ওয়েলহসেন (১৮৪৪-১৯১৮) গ্রাফের তত্ত্বকে আঁকড়ে ধরেন, কারণ এটা দীর্ঘদিন ধরে মোকাবিলা করে আসা একটা সমস্যার সমাধান দিয়েছিল। পয়গম্বরগণ কেন কখনওই মুসায়ী আইনের উল্লেখ করেননি? এবং ডিউটেরোনমিস্টরা ইয়াহওয়েহবাদী ও ইলোহিমবাদীদের কাজ সম্পর্কে এতটা ওয়াকিবহাল হয়েও প্রিস্টলি দলিল সম্পর্কে অজ্ঞ ছিলেন? এর সবই ব্যাখ্যা করা সম্ভব যদি প্রিস্টলি উৎস (‘E-1’) সত্যিই শেষের সংকলন হয়ে থাকে। ওয়েলহসেন আরও দেখান যে চার দলিলের তত্ত্ব বড় বেশি সরলীকৃত: একক বিবরণে সমন্বিত করার আগে সবগুলোতেই সংযোজনের ঘটনা ঘটেছে। সমসাময়িকদের কাছে এই কাজ সমালোচনামূলক পদ্ধতির চূড়ান্ত রূপ বলে বিবেচিত হয়েছে, কিন্তু ওয়েলহসেন স্বয়ং বুঝতে পেরেছিলেন যে আসলে গবেষণার কেবল সূচনা ঘটেছে-এবং সত্যিই আজও তা অব্যাহত রয়েছে।

ইহুদি ও ক্রিশ্চানদের ধর্মীয় জীবন এইসব আবিষ্কারের ফলে কীভাবে প্রভাবিত হবে? কোনও কোনও ক্রিশ্চান আলোকনের অন্তর্দৃষ্টিকে আলিঙ্গন করেছিল। ফ্রেডেরিখ শ্লেইয়ারম্যাচার (১৭৬৮-১৮৩৪) প্রথম দিকে বাইবেলকে এমন ভ্রান্তিময় দলিল মনে হওয়ায় বিব্রত বোধ করেছিলেন।২৩ তার প্রতিক্রিয়া ছিল সকল ধর্মের ক্ষেত্রে মৌল অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে একটি আধ্যাত্মিকতার বিকাশ ঘটানো, ক্রিশ্চান ধর্ম যাকে আলাদাভাবে প্রকাশ করেছে। তিনি এই অভিজ্ঞতাকে ‘পরম নির্ভরতার অনুভূতি” হিসাবে সংজ্ঞায়িত করেছেন। এটা কোনও তুচ্ছ দাসত্ব নয়, বরং জীবনের রহস্যের কাছে সমীহ ও ভীতির এক বোধ, আমাদের যা মনে করিয়ে দেয় যে আমরা মহাবিশ্বের কেন্দ্রে নেই। গস্পেল দেখিয়েছে যে, জেসাস সম্পূর্ণভাবে এই বিস্ময় ও সমর্পণকে ধারণ করেছিলেন। এবং নিউ টেস্টামেন্ট আদি চার্চ প্রতিষ্ঠাকারী শিষ্যদের উপর তাঁর ব্যক্তিত্বের প্রভাব বর্ণনা করেছে।

সুতরাং ঐশীগ্রন্থ ক্রিশ্চানদের জীবনে গুরুত্বপূর্ণ ছিল, কারণ এটা আমাদের জেসাসের কাছে পৌঁছানোর একমাত্র পথের যোগান দেয়। কিন্তু এর লেখকরা যেহেতু তাঁরা যে সময়ে বাস করেছেন সেই সময়ের ঐতিহাসিক পরিস্থিতির শর্তাধীন ছিলেন, সুতরাং তাদের সাক্ষ্যকে সমালোচনামূলক পরীক্ষার অধীনে আনা বৈধ। জেসাসের জীবন ছিল ঐশী প্রকাশ, কিন্তু যেসব লেখক এর নথি করেছেন তাঁরা ছিলেন সাধারণ মানবসন্তান, পাপ ও ভুল করাটা ছিল তাঁদের পক্ষে স্বাভাবিক। তাঁরা ভুল করেছেন, এটা খুবই সম্ভব। কিন্তু পবিত্র আত্মা চার্চকে অনুশাসনমূলক পুস্তক নির্বাচনের ক্ষেত্রে পথ নির্দেশ দিয়েছেন, সুতরাং ক্রিশ্চানরা নিউ টেস্টামেন্টের উপর আস্থা রাখতে পারে। পণ্ডিতের কাজ হচ্ছে ভেতরের সময়ের অতীত শাঁস বের করে আনার লক্ষ্যে সাংস্কৃতিক খোলস খসানো। ঐশীগ্রন্থের প্রতিটি শব্দই কর্তৃত্বমূলক নয়, তো ব্যাখ্যাকারকে অবশ্যই গস্পেলের মূল গুরুত্ব থেকে প্রান্তিক ধারণাসমূহকে পৃথক করতে হবে।

আইন ও প্রফেটস ছিল নিউ টেস্টামেন্ট লেখকদের ঐশীগ্রন্থ। কিন্তু শেইয়ারম্যাচার বিশ্বাস করতেন, ক্রিশ্চানদের জন্যে ওল্ড টেস্টামেন্ট নিউ টেস্টামেন্টের মতো কর্তৃত্বপূর্ণ নয়। ঈশ্বর, পাপ, মহত্ব সম্পর্কে এর ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে এবং আত্মার চেয়ে বরং আইনের উপর নির্ভর করেছে। সময়মতো ওল্ড টেস্টামেন্টকে এমনকি পরিশিষ্টেও নমিত করা যাবে। শেইয়ারম্যাচারের বাইবেলিয় ধর্মতত্ত্ব লিবারিলিজম নামে এক নতুন ক্রিশ্চান আন্দোলনের জন্ম দিয়েছিল যা গস্পেলের সর্বজনীন ধর্মীয় বার্তার সন্ধান করেছে, যা কিছু প্রান্তিক মনে হয়েছে তাকে বাদ দিয়েছে ও এমনভাবে এসব আবশ্যিক বিশ্বাসকে প্রকাশ করতে চেয়েছে যা আধুনিক শ্রোতাকে আকর্ষণ করবে।

১৮৫০ সালে চার্লস ডারউইন (১৮০৯-৮২) অন দ্য অরিজিন অভ স্পিসিজ বাই মিন্স অভ ন্যাচারাল সিলেকশন প্রকাশ করেন, বিজ্ঞানের ইতিহাসে এই গ্রন্থটি এক নতুন পর্যায় সূচিত করে। বেকনিয় কায়দায় কেবল তথ্য সংগ্রহের পরিবর্তে ডারউইন একটা প্রকল্প খাড়া করেন: পশু, পাখি ও মানুষকে পূর্ণ রূপে সৃষ্টি করা হয়নি, বরং এসব পরিবেশের সাথে অভিযোজিত হয়ে বিবর্তনমূলকভাবে দীর্ঘ প্রক্রিয়ায় ধীরে ধীরে বিকাশ লাভ করেছে। পরবর্তী সময়ের রচনা ডিসেন্ট অভ ম্যান-এ তিনি উল্লেখ করেন যে, হোমো সেপিয়ন্সরা আসলে গরিলা ও শিম্পাঞ্জির মতো একই আদিরূপ থেকে বিবর্তিত হয়েছে। অরিজিন ছিল বৈজ্ঞানিক তত্ত্বের সযত্ন সৌজন্যমূলক প্রকাশ, বিপুল সংখ্যক শ্রোতাকে তা আকৃষ্ট করেছিল: প্রকাশের দিন ১,৪০০ কপি বিক্রি হয়েছিল।

ধর্মকে আক্রমণ করতে চাননি ডারউইন, প্রথম দিকে ধর্মীয় সাড়া ছিল চাপা। কিন্তু পরে অ্যাংলিকান গির্জার যাজকরা এসেজ অ্যান্ড রিভিউ (১৮৬১) প্রকাশ করলে বিরাট হৈচৈ শুরু হয়ে যায়। এটি হাইয়ার ক্রিটিসিজমকে সাধারণ পাঠকের কাছে পৌঁছে দিয়েছিল।২৫ সাধারণ লোক এবার জানতে পারে যে, মোজেস পেন্টাটিউক রচনা করেননি, তেমনি ডেভিডও শ্লোক রচনা করেননি। বাইবেলিয় অলৌকিক কাণ্ডকারখানা স্রেফ সাহিত্যিক উপমা, আক্ষরিকভাবে বোঝার কথা নয়; বাইবেলে বর্ণিত বেশির ভাগ ঘটনা স্পষ্টভাবেই ঐতিহাসিক নয়। এসেজ অ্যান্ড রিভিউ’র লেখকগণ যুক্তি দেখান, বাইবেলকে বিশেষ সম্মান দেখানো উচিত নয়, বরং অন্য যেকোনও প্রাচীন টেক্সটের মতোই কঠোর সমালোচনামূলক দৃষ্টিতে একে দেখতে হবে।

উনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে ডারউইনবাদ নয়, বরং হাইয়ার ক্রিটিসিজমই উদার ও রক্ষণশীল ক্রিশ্চানদের বিরোধের মূল কারণে পরিণত হয়েছিল। উদারবাদীদের বিশ্বাস ছিল দীর্ঘ মেয়াদে সমালোচনামূলক পদ্ধতি বাইবেলের গভীর উপলব্ধির দিকে নিয়ে যাবে। কিন্তু রক্ষণশীলদের চোখে প্রাচীন নিশ্চয়তাকে ঝেঁটিয়ে বিদায় করা আলোকন পরবর্তী বিশ্বের যা কিছু ভ্রান্তি তারই প্রতীক ছিল হাইয়ার ক্রিটিসিজম। ২৬ ১৮৮৮ সালে ব্রিটিশ ঔপন্যাসিক মিসেস হাফ্রি ওয়ার্ড হাইয়ার ক্রিটিসিজমের বিশ্বাস হারানো তরুণ যাজকের কাহিনী রবার্ট এলসমেয়ার বের করেন। বেস্টসেলারে পরিণত হয় তা, এতে বোঝা যায় যে বহু লোকই রবার্টের দোদুল্যমানতায় সহানুভূতিশীল ছিল। তার স্ত্রী যেমন বলেছে, ‘গস্পেলগুলো ইতিহাসের সত্য না হলে, আমি এগুলোকে মোটেই সত্যি মানতে পরছি না, বা এর কোনও মূল্যও দেখছি না।২৭ এই অনুভূতি এখনকার দিনেই অনেকেই লালন করবেন।

আধুনিক বিশ্বের যৌক্তিক প্রবণতা অসম্ভব না হলেও উল্লেখযোগ্য সংখ্যাক পাশ্চাত্য ক্রিশ্চানের পক্ষে মিথলজির ভূমিকা ও গুরুত্ব উপলব্ধি কঠিন করে তুলেছে। সুতরাং ধর্মের সত্যিগুলোকে অবশ্যই বাস্তবভিত্তিক হতে হবে, এমন একটি বুদ্ধিমান বোধ দেখা দিয়েছে ও হাইয়ার ক্রিটিসিজম বিপজ্জনক শূন্যতা সৃষ্টি করবে বলে ভীতির সৃষ্টি হয়েছিল। একটা অলৌকিক ঘটনাকে বাতিল করা হলে সামঞ্জস্যতা দাবি করে যে আপনাকে সবগুলোই বাতিল করতে হবে। জোনাহ যদি তিন দিন তিন রাত তিমির পেটে না কাটিয়ে থাকেন, প্রশ্ন করেছেন এক লুথারান প্যাস্টর, জেসাস কি আদৌ সমাধি থেকে উত্থিত হয়েছিলেন?২৮ যাজকগোষ্ঠী হাইয়ার ক্রিটিসিজমের বিরুদ্ধে ব্যাপক মাতলামি, ধর্মহীনতা ও অপরাধ ও তালাকের সংখ্যা বৃদ্ধির অভিযোগ তোলেন। ২৯ ১৮৮৬ সালে আমেরিকান পুনর্জাগরণবাদী যাজক ডিউইট মুডি (১৮৩৭-৯৯) শিকাগোতে হাইয়ার ক্রিটিসিজমের বিরুদ্ধে লড়াই করার লক্ষ্যে মুডি বাইবেল ইন্সটিটিউট প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁর লক্ষ্য ছিল জাতিকে-তাঁর মতে-ধ্বংসের দোর গোড়ায় নিয়ে আসা বিভিন্ন মিথ্যা ধারণার বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্যে প্রকৃত বিশ্বাসীদের একটা ক্যাডার তৈরি করা। দ্য বাইবেল ইন্সটিটিউট এক ঈশ্বর বিহীন বিশ্বে নিরাপদ ও পবিত্র আশ্রয় হিসাবে গুরুত্বপূর্ণ মৌলবাদী ঘটনা হয়ে দাঁড়াবে।

গোষ্ঠীর অভ্যন্তরে রক্ষণশীলরা উদারপন্থীদের কাছে সংখ্যার দিকে দিয়ে পরাস্ত হয়ে যাচ্ছে মনে করে সমবেত হতে শুরু করে। উনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকের বছরগুলোতে বাইবেল কনফারেন্স-যেখানে রক্ষণশীলরা আক্ষরিক, হেলাফেলাবিহীন ঐশীগ্রন্থ পাঠ করতে পারত-এবং মন থেকে হাইয়ার ক্রিটিসিজমকে দূর করে দিতে পারত-মার্কিন যুক্তরষ্ট্রে ক্রমবর্ধমান হারে জনপ্রিয়তা অর্জন করতে শুরু করে। নিশ্চয়তার জন্যে ব্যাপক বিস্তৃত আকাঙ্ক্ষা বিরাজ করছিল। লোকে এখন বাইবেল থেকে সম্পূর্ণ নতুন কিছু আশা করছিল-এপর্যন্ত যা দেওয়ার মতো ভাব করেনি তা। মেনি ইফ্যালিবল প্রুফস বাঙ্ময় শিরোনামের গ্রন্থে আমেরিকান প্রটেস্ট্যান্ট আর্থার পিয়ারসন বাইবেলকে ‘সত্যিকার নিরপেক্ষ ও বৈজ্ঞানিক চেতনায়’ আলোচিত হতে দেখতে চেয়েছেন:

আমি সেই বাইবেলিয় ধর্মতত্ত্ব পছন্দ করি…যা একটি প্রকল্প দিয়ে শুরু হয়ে আমাদের ডগমার ভাঁজে খাপ খাওয়ার জন্যে তথ্যকে দর্শন দিয়ে আবৃত করে না, বরং বেকনিয় পদ্ধতি, যা প্রথমে ঈশ্বরের শিক্ষার বাণীসমূহের শিক্ষাকে একত্রিত করে এবং তারপর তথ্যকে সমন্বিত করার জন্যে কিছু সাধারণ বিধি বের করে আনার প্রয়াস পায়

অসংখ্য প্রচলিত বিশ্বাস যখন ক্ষয়ে যাচ্ছিল এমন একটা সময়ে এটা বোধগম্য আকাঙ্ক্ষা ছিল, কিন্তু বাইবেলের মিথসমূহ সম্ভবত পিয়ারসনের প্রত্যাশিত বৈজ্ঞানিক নিশ্চয়তা যোগাতে পারত না।

প্রিন্সটন, নিউ জার্সির প্রেসবিটারিয়ান সেমিনারি এই ‘বৈজ্ঞানিক প্রটেস্ট্যানিজমের ঘাঁটিতে পরিণত হয়েছিল। ‘ঘাঁটি’ কথাটি জুৎসই, কারণ বাইবেলের সম্পূর্ণ যৌক্তিক ব্যাখ্যার এই তালাশকে মারাত্মক প্রতিরক্ষামূলক মনে হয়েছে। ‘ধর্মকে জীবনের জন্যে বৈজ্ঞানিকদের বিশাল দলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে হবে,’ লিখেছেন প্রিন্সটনের প্রফেটসর অভ থিওলজি চার্লস হজ (১৭৯৭–১৮৭৮)। ৩১ ১৮৭১ সালে হজ সিস্টেমেটিক থিওলজি’র প্রথম খণ্ড প্রকাশ করেন। খোদ শিরোনামই বইয়ের বেকনিয় পক্ষপাত তুলে ধরে। হজ যুক্তি দেখান, ধর্মবেত্তাদের ঐশীগ্রন্থের বাণীর অতীতে খোঁজার প্রয়োজন নেই, তাঁদের বরং বাইবেলের শিক্ষাগুলোকে সাধারণ সত্যির একটা পদ্ধতিতে সাজাতে হবে–এমন এক প্রকল্প যেখানে বিপুল পরিমাণ বেমানান প্রয়াস নিয়োজিত হয়েছে–কারণ এই ধরনের পদ্ধতি বাইবেলের ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ নতুন ছিল।

১৮৮১ সালে চার্লসের ছেলে আর্চিবল্ড এ. হজ তাঁর অনুজপ্রতীম সহকর্মী বেঞ্জামিন ওয়ারফিল্ডের সাথে বাইবেলের আক্ষরিক সত্যের পক্ষে একটি রচনা প্রকাশ করেন। এটা ক্লাসিকে পরিণত হয়: ‘ঐশীগ্রন্থসমূহ কেবলই ঈশ্বরের বাণীই ধারণ করে, এবং সেকারণে তাদের সকল উপাদান ও সকল নিশ্চয়তা সম্পূর্ণ ভ্রান্তিহীন এবং ধর্মবিশ্বাস ও মানুষের জন্যে অবশ্য পালনীয়।’ প্রতিটি বাইবেলিয় বিবৃতি-যেকোনও বিষয়ের উপর- তথ্যের পরম সত্যি। বিশ্বাসের প্রকৃতি পাল্টে যাচ্ছিল। এটা আর ‘আস্থা’ ছিল না, বরং কতগুলো বিশ্বাসে বুদ্ধিবৃত্তিক আত্মসমর্পণে পরিণত হয়েছিল। কিন্তু হজ ও ওয়ারফিল্ডের বেলায় এতে অবিশ্বাসের কোনও সন্দেহের প্রয়োজন পড়েনি, কারণ ক্রিশ্চান ধর্ম সম্পূর্ণই যৌক্তিক। কেবল যুক্তির উপর ভিত্তি করেই এটা এতদূর এসেছে,’ পরবর্তী কালের এক নিবন্ধে যুক্তি দেখিয়েছেন ওয়ারফিল্ড, ‘এবং কেবল যুক্তির মাধমেই এটা শত্রুদের পায়ের নিচে পিষে ফেলবে।

এটা ছিল সম্পূর্ণ নতুন স্থান বদল। অতীতে কোনও কোনও ব্যাখ্যাকার বাইবেলের আক্ষরিক অর্থকে অগ্রাধিকার দিয়েছেন, কিন্তু তারা কখনও এটা বিশ্বাস করেননি যে ঐশীগ্রন্থের প্রতিটি শব্দ বাস্তবসম্মতভাবে সত্যি। অনেকেই স্বীকার গেছে যে, আমরা অক্ষরের দিকে মনোযোগ নিবদ্ধ করলে বাইবেল অসম্ভব টেক্সট হয়ে দাঁড়ায়। ওয়ারফিল্ড ও হজের সূচিত বাইবেলের ভ্রান্তি হীনতায় বিশ্বাস ক্রিশ্চান মৌলবাদে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে এবং উল্লেখযোগ্য অস্বীকৃতি জড়িত হবে। হজ ও ওয়ারফিল্ড আধুনিকতার চ্যালেঞ্জের প্রতি সাড়া দিচ্ছিলেন, কিন্তু মরিয়া অবস্থায় তাঁরা যে ঐশী ট্র্যাডিশনকে রক্ষা করতে চাইছিলেন তাকেই বিকৃত করছিলেন।

উনবিংশ শতাব্দীর শেষে দিকে রক্ষণশীল আমেরিকান প্রটেস্ট্যান্টদের আঁকড়ে ধরা নতুন প্রলয়বাদী দর্শনের ক্ষেত্রেও একই কথা সত্যি। এটা ছিল জন নেলসন ডার্বি (১৮০০-৮২) নামে এক ইংরেজের সৃষ্টি, যিনি ব্রিটেনে অল্প সংখ্যাক অনুসারী পেলেও ১৮৬৯ ও ১৮৭৭ সালের ভেতর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সফরের সময় ব্যাপক প্রশংসা লাভ করেন। প্রত্যাদেশের আক্ষরিক পাঠের ভিত্তিতে তিনি নিশ্চিত ছিলেন, ঈশ্বর অচিরেই এক নজীরবিহীন ভয়ঙ্কর বিপর্যয়ের ভেতর দিয়ে ইতিহাসের বর্তমান যুগের অবসান ঘটাবেন। প্রলয়ের আগে সেইন্ট পল যার আগমনের পূর্বাভাস দিয়েছিলেন সেই অ্যান্টিক্রাইস্টকে– মিথ্যা উদ্ধারকর্তা-প্রাথমিকভাবে স্বাগত জানানো হবে এবং সে অসতর্কদের প্রতারণা করবে। তারপর মানবজাতির উপর সাত বছর মেয়াদী হতাশা, যুদ্ধবিগ্রহ ও হত্যাকাণ্ডের কালের সূচনা করবে সে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত জেসাস পৃথিবীতে নেমে এসে জেরুজালেমের বাইরে আর্মাগেদনের প্রান্তরে পরাস্ত করবেন তাকে। হাজার বছর পৃথিবীতে রাজত্ব করবেন ক্রাইস্ট, যতক্ষণ না শেষ বিচার ইতিহাসের অবসান ঘটায়। এই তত্ত্বের আকর্ষণ হচ্ছে সত্যিকারের বিশ্বাসীদের ছাড় দেওয়া হবে। সেইন্ট পলের এক চকিত উক্তির উপর ভিত্তি করে-যিনি বলেছিলেন যে ক্রিশ্চানদের দ্বিতীয় আগমনে জেসাসের সাথে সাক্ষাতের জন্যে ‘ক্রিশ্চানদের মেঘের উপর নেওয়া হবে’‍–ডারবি উল্লেখ করেছেন যে, অস্থিরতার অল্প আগে ক্রিশ্চানদের নবজন্মের ‘আনন্দ’ ও ‘হরণ’- এর অনুভূতি ঘটবে, তাদের নিমেষে স্বর্গে নিয়ে যাওয়া হবে, এবং এভাবে অন্তি ম মুহূর্তের ভোগান্তি থেকে রেহাই মিলবে।

যেমন অদ্ভুত শোনাচ্ছে, এই পরমান্দ তত্ত্বটি উনবিংশ শতব্দীর ভাবধারার অনুগামী ছিল। ডারবি ঐতিহাসিক যুগ বা ‘ডিসপেনসেশন’-এর কথা বলেছেন, যার প্রতিটিই ধ্বংসের ভেতর দিয়ে শেষ হয়েছে; এটা ভূতত্ত্ববিদদের পাওয়া পাথর ও ক্লিফের বিভিন্ন স্তরে ফসিল আকারে ধারাবাহিক মহাকালের চেয়ে ভিন্ন নয়-যার প্রতিটি, অনেকের ধারণা, বিপর্যয়ের ভেতর দিয়ে শেষ হয়েছিল। আধুনিকতার চেতনার ধারায় ডারবি’র তত্ত্ব আক্ষরিক ও গণতান্ত্রিক। কেবল শিক্ষিত অভিজাতগোষ্ঠীর কাছে বোধগম্য কোনও সত্যি নেই। যা বলেছে বাইবেল ঠিক তাই বুঝিয়েছে। সহস্রাব্দের মানে এক হাজার বছর। পয়গম্বরগণ ‘ইসরায়েলে’র কথা বলে থাকলে তাতে ইহুদিদের কথা বুঝিয়েছেন, চার্চ নয়। প্রত্যাদেশ জেরুজালেমের বাইরে যুদ্ধের ভবিষ্যদ্বাণী করে থাকলে, ঠিক তাই ঘটবে।৩৭ ঐশীগ্রন্থের এমনি পাঠ স্কোফিল্ড রেফারেন্স বাইবেল (১৯০৯) প্রকাশিত হওয়ার পর আরও সহজ হয়ে উঠবে, নিমেষে বেস্টসেলারে পরিণত হয়েছিল তা। সাইরাস আই. স্কোফিল্ড বিস্তারিত টীকাসহ পরমান্দ তত্ত্ব ব্যাখ্যা করেছেন-একটি ব্যাখ্যা, যা বহু মৌলবাদী ক্রিশ্চানের পক্ষে খোদ বাইবেলের মতোই কর্তৃত্বমূলক হয়ে উঠেছে।

+

ইহুদি জগৎও যারা আধুনিকতাকে আলিঙ্গন করতে চায় ও যারা এর বিরুদ্ধে লড়াই করতে অঙ্গিকারাবদ্ধ, এই দুই শিবিরে বিভক্ত ছিল। জার্মানিতে আলোকনকে আলিঙ্গনকারী মাসকিলিমরা বিশ্বাস করত যে, তারা ঘেটো ও আধুনিক বিশ্বের ভেতর একটা সেতুবন্ধের কাজ করবে। উনবিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকের বছরগুলোয় কেউ কেউ খোদ ধর্মকেই নতুন করে আকার দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। সংস্কৃত ইহুদিবাদ, জার্মানে কোরাল সঙ্গীত ও মিশ্র কয়ারে এর উপাসনার কাজটি সম্পাদিত হতো, ইহুদিসুলভ না হয়ে বরং অনেক বেশি প্রটেস্ট্যান্ট মনে হতো। অর্থডক্স র‍্যাবাইদের বিতৃষ্ণা জাগিয়ে হামবুর্গ ও বার্লিনে সিনাগগ–এখন ‘মন্দির’ নামে আখ্যায়িত-প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। আমেরিকায় নাট্যকার আইজাক হারবি চার্লসটনে একটি সংস্কারবাদী মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। ১৮৭০ সালে নাগাদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে দুইশো সিনাগগের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক জনগণ অন্তত কিছু পরিমাণে সংস্কারমূলক অনুশীলন বেছে নিয়েছিল।৩৮

সংস্কারকগণ ছিলের আধুনিক বিশ্বের নাগরিক। অযৌক্তিক, অতীন্দ্রিয় বা রহস্যময় কোনও কিছুর ফুরসত তাঁদের ছিল না। ১৮৪০-র দশকের দিকে ইহুদি ইতিহাসের সমালোচনামূলক পদ্ধতিতে আলিঙ্গনকারী কোনও কোনও সংস্কার পণ্ডিত একটি মতবাদের প্রতিষ্ঠা করেন যার নাম জুৎসইভাবেই সায়েন্স অভ জুদাইজম রাখা হয়েছিল। তারা কান্ট ও জর্জ উইলহেম ফ্রেডেরিখ হেগেলের (১৭৭০-১৮৩১) দর্শনে প্রভাবিত ছিলেন। হেগেল দ্য ফিলোসফি অভ মাইন্ড-এ (১৮০৭) যুক্তি দেখিয়েছেন যে, ঈশ্বর-তিনি বলেছেন সর্বজনীন আত্মা–কেবল জমিনে নেমে এলেই পূর্ণতা লাভ করতে পারেন ও মানুষের মাঝেই তাঁর সম্পূর্ণ প্রকাশ বাস্তবায়িত হতে পারে। হেগেল ও কান্ট উভয়ই ইহুদিবাদকে খারাপ ধর্মের প্রতীক হিসাবে দেখেছেন: হেগেল যুক্তি দেখিয়েছেন, ইহুদি ঈশ্বর স্বৈরাচারী যিনি তাঁর অসহনীয় আইনের প্রতি প্রশ্নাতীত আনুগত্য দাবি করেন। জেসাস মানবজাতিকে এ জঘন্য অবস্থা থেকে মুক্ত করার প্রয়াস পেয়েছিলেন, কিন্তু ক্রিশ্চানরা ফের পুরোনো স্বৈরাচারের কাছে ফিরে গেছে।

সায়েন্স অভ জুদাইজমের পণ্ডিতরা সকলেই হেগেলিয় পরিভাষায় বাইবেলিয় কল্পকাহিনীগুলোকে কুসংস্কার থেকে মুক্ত করার জন্যে নতুন করে লিখেছেন। তাঁদের রচনায় বাইবেল আধ্যাত্মিকায়নের প্রক্রিয়া উল্লেখ করেছে যার মাধ্যমে ইহুদিবাদ আত্মসচেতনতা অর্জন করেছে। দ্য রিলিজিয়ন অভ দ্য স্পিরিট-এ (১৮৪১) সোলোমান ফর্মস্তেচার (১৮০৮-৮৯) যুক্তি দেখিয়েছেন যে, ইহুদিরাই সবার আগে ঈশ্বরের হেগেলিয় ধারণা গ্রহণ করেছিল। হিব্রু পয়গম্বগণ গোড়ার দিকে কল্পনা করেছিলেন যে তাঁদের অনুপ্রেরণা বাহ্যিক উৎস থেকে এসেছে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাঁরা বুঝতে পারেন সেটা সম্ভব হয়েছে ওদের নিজস্ব আত্মা-প্রকৃতির কারণে। নির্বাসন ইহুদিদের বাহ্যিক অলংকার ও নিয়ন্ত্রণের বাইরে নিয়ে গেছে ফলে তারা এখন মুক্তভাবে ঈশ্বরের দিকে অগ্রসর হতে পারছে। স্যামুয়েল হার্শ (১৮১৫-৮৯) যুক্তি দেখান, আব্রাহাম ছিলেন প্যাগান অদৃষ্টবাদ ত্যাগ করে নিজের উপর পূর্ণাঙ্গ নিয়ন্ত্রণ নিয়ে একাকী কেবল ঈশ্বরের সত্তার উপর নির্ভরকারী প্রথম মানুষ, অথচ ক্রিশ্চান ধর্ম বিশ্বাস হিদেনবাদের কুসংস্কার ও অযৌক্তিকতার দিকে ফিরে গেছে। নাখমান ক্রোচমাল (১৭৮৫-১৮৪০) ও যাকারিয়াহ ফ্রাংকেল (১৮০১-৭৫) একমত হয়েছিলেন যে, সম্পূর্ণ লিখিত তোরাহ সিনাই পর্বতে মোজেসের উপর অবতীর্ণ হয়েছিল, কিন্তু মৌখিক আইনের স্বর্গীয় অনুপ্রেরণাকে অস্বীকার করেছেন, সেটা সম্পূর্ণ মানব রচিত, বর্তমানের দাবি মেটানোর লক্ষ্যে পরিবর্তনযোগ্য। আপাদমস্তক যুক্তিবাদী আব্রাহাম গেইগার (১৮১০–৭৪) বিশ্বাস করতেন, বাইবেলিয় কালে সূচিত ইহুদি ইতিহাসের আনাড়ী, সৃজনশীল ও স্বতঃস্ফুর্ত কালের অবসান ঘটেছে। আলোকনের ফলে ধ্যানের এক উচ্চতর পর্যায়ের সূচনা ঘটতে যাচ্ছে।

কিন্তু এই ইতিহাসবিদদের কেউ কেউ ফিলাক্টিরি পরা বা খাদ্যবিধি পালন করার মতো প্রাচীন আচারের ভেতর মূল্য খুঁজে পান-সংস্কারকগণ যেগুলোকে বাতিল করতে চেয়েছিলেন। ফ্রাংকেল ও লেপল্ড যানয (১৭৯৪-১৮৮৬) বিশ্বাস করতেন, ট্র্যাডিশনের পাইকারী বিনাশে বিপদ রয়েছে। এইসব অনুশীলন ইহুদি অভিজ্ঞতার আবশ্যক অংশে পরিণত হয়েছে, এগুলো বাদে ইহুদিবাদ কতগুলো বিমূর্ত প্রাণহীন মতবাদের একটা ব্যবস্থায় পরিণত হতে পারে। বিশেষ করে যানয সংস্কার আবেগের সাথে সম্পর্ক হারাচ্ছে বলে ভীত ছিলেন: কেবল যুক্তি সর্বোচ্চ অবস্থায় ইহুদিবাদের বৈশিষ্ট আনন্দ ও ফূর্তি তৈরি করতে পারে না। এটা গুরুত্বপূর্ণ যুক্তি ছিল। অতীতে বাইবেলের পাঠের সাথে বিভিন্ন আচার সংশ্লিষ্ট ছিল-লিটার্জি, মনোনিবেশের সাথে অনুশীলন, নীরবতা অবলম্বন, উপবাস পালন, গান গাওয়া এবং আবেগপ্রসূত অঙ্গভঙ্গি-জীবনের পবিত্র পাতা উন্মোচন করত তা। এই আচার বাদে বাইবেল এমন একটা দলিলে পর্যবসিত হতে পারে যা তথ্য যোগাতে পারে, কিন্তু আধ্যাত্মিক অভিজ্ঞতা নয়। শেষ পর্যন্ত সংস্কার ইহুদিবাদ যানযের সমালোচনার সত্যি উপলব্ধি করতে পারবে ও নাকচ করে দেওয়া কিছু আচার নতুন করে প্রতিষ্ঠা করবে।

সতীর্থ ইহুদিদের সমাজে মিশে যেতে দেখে বহু ইহুদি তাদের ঐতিহ্য খোয়া যাওয়ার কারণে গভীরভাবে উদ্বিগ্ন ছিল। অধিক সংখ্যায় অর্থডক্সরা নিজেদের ক্রমবর্ধমান হারে সংঘাতের মাঝে রয়েছে মনে করেছে। ১৮০৩ সালে সালেভিয়েনার গাওনের শিষ্য আর. হাঈম ফলোযেইনার লিথুয়ানিয়ার ফলোঝিনে এতয্ হাঈম ইয়েশিভা প্রতিষ্ঠা করার ভেতর দিয়ে এক চূড়ান্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন। উনবিংশ শতাব্দীতে ইউরোপের অন্যান্য অংশেও এক রকম ইয়েশিভা গড়ে উঠেছিল, আমেরিকান বাইবেল কলেজের ইহুদি সমগোত্রের হয়ে দাঁড়ায় তা। অতীতে সিনাগগের পেছনে তোরাহ বা তালমুদ পাঠ করার জন্যে কেবল অল্প কয়েকটি কামরা নিয়ে ইয়েশিভা গঠিত হতো। এতয হাঈম যেখানে বিশেজ্ঞদের কাছে পড়াশোনার জন্যে সারা ইউরোপের শত শত মেধবী ছাত্র সমবেত হয়েছিল-এটা ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের। আর. হাঈম গাওনের কাছে শেখা পদ্ধতিতে তোরাহ ও তালমুদ শিক্ষা দিতেন, যুক্তি দিয়ে টেক্সট বিশ্লেষণ করতেন বটে, কিন্তু এমনভাবে যাতে আধ্যাত্মিক অভিজ্ঞতা সৃষ্টি করে। ছাত্ররা সেখানে তোরাহ সম্পর্কে জানতে আসত না, মুখস্থ বিদ্যা, প্রস্তুতি ও প্রাণবন্ত, উত্তপ্ত আলোচনা ছিল আচার যেগুলো শ্রেণীতে পৌঁছুনো যেকোনও উপসংহারের মতোই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। এক ধরনের প্রার্থনা ছিল পদ্ধতিটি। এর প্রাবল্য গাওনের আধ্যাত্মিকতাকে প্রতিফলিত করে। শিক্ষাক্রম ছিল অত্যন্ত কঠিন, কয়েক ঘণ্টাব্যাপী, তরুণদের পরিবার ও বন্ধুদের থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলা হতো। কাউকে কাউকে সেক্যুলার বিষয়ে অল্প সময় কাটানোর অনুমতি দেওয়া হতো, কিন্তু এসব ছিল গৌণ, তোরাহ থেকে সময় চুরি মনে করা হতো একে এতয হাঈমের আদি উদ্দেশ্য ছিল হাসিদিমকে ঠেকানো ও তোরাহর প্রবল পাঠকে ফিরিয়ে আনা। কিন্তু উনবিংশ শতাব্দী পেরিয়ে যাওয়ার সাথে সাথে ইহুদি আলোকনের হুমকি বিদায়ী বিপদে পরিণত হতে শুরু করে। হাসিদিম ও মিসনাগদিম মাসকিলিমের বিরুদ্ধে একাট্টা হয়, একে তারা এক ধরনের ট্রোজান হর্স মনে করেছিল, সেক্যুলার সংস্কৃতির অশুভকে ইহুদি জগতে পাচার করছে। ধীরে ধীরে নতুন ইয়েশিভোথ আসন্ন বিপদকে ঠেকাতে অর্থপ্র্যাক্সির ঘাঁটিতে পরিণত হয়। ইহুদিরা তাদের নিজস্ব ধরনের মৌলবাদ গড়ে তুলছিল, বাহ্যিক শত্রুর সাথে বিরল ক্ষেত্রে লড়াই হিসাবে সূচনা হয়, বরং এক ধরনের অভ্যন্তরীণ সংগ্রাম যেখানে মৌলবাদীরা সতীর্থ ধর্মবিশ্বাসীদের বিরুদ্ধে লড়ে। মৌলবাদী প্রতিষ্ঠানসমূহ খাঁটি ধর্মবিশ্বাসের ছিটমহল সৃষ্টি করে আধুনিকতার প্রতি সাড়া দিয়ে থাকে- ইয়েশিভা বা বাইবেল কলেজ-যেখানে বিশ্বাসীরা তাদের জীবনকে নতুন করে আকার দিতে পারে। এটা আত্মরক্ষামূলক পদক্ষেপ। ভবিষ্যতের পাল্টা আক্রমণ হানার ক্ষমতা এর রয়েছে। ইয়েশিভা, মাদ্রাসা বা বাইবেল কলেজের ছাত্ররা একই ধরনের প্রশিক্ষণ ও আদর্শ নিয়ে তাদের স্থানীয় সম্প্রদায়ে ক্যাডারে পরিণত হতে পারে।

+

উনবিংশ শতাব্দীর শেষ নাগাদ বিশ্বকে প্রকৃতই ঈশ্বর বিহীন জায়গা মনে হচ্ছিল। অতীতের মতো অপদস্থ সংখ্যালঘু হওয়ার বদলে নাস্তিকরা উন্নত নৈতিক ভিত্তি অর্জন করতে শুরু করেছিল। হেগেলের ছাত্র লুদভিগ ফয়েরবাখ (১৯০৪-৭২) যুক্তি দেখিয়েছেন যে, ঈশ্বরের ধারণা মানবতাকে হ্রাস ও অবমূল্যায়িত করেছে।

+

কার্ল মার্ক্সের (১৮১৮–৮৩) চোখে ধর্ম অসুস্থ সমাজের লক্ষণ। এটা এমন এক ধরনের মাদক সামগ্রি যা রোগাক্রান্ত সামাজিক ব্যবস্থাকে সহনীয় করে তোলে ও এর প্রতিষেধক খোঁজার ইচ্ছা নষ্ট করে। রেডিক্যাল ডারউইনবাদীরা ঐশীগ্রন্থ ও বিজ্ঞানের ভেতর আজও অব্যাহত থাকা এক যুদ্ধে প্রথম গুলি বর্ষণ করে। ইংল্যান্ডে টমাস এইচ. হাক্সলি (১৮২৫-৯৫) ও মহাদেশে কার্ল ফোগট (১৮২২–৯৩), লুদভিগ বাকনার ( ১৮২৪-৯৯), জ্যাকব মোলেশট (১৮২২-৯৩) এবং আর্নস্ট হেইকেল (১৮৩৪-১৯১৯) ধর্ম ও বিজ্ঞান সম্পূর্ণ বিপরীতমূখী প্রমাণ করার জন্যে বিবর্তনবাদকে জনপ্রিয় করে তোলেন। হাক্সলির চোখে বিজ্ঞান ও প্রচলিত ধর্মের ভেতর কোনও আপস হতে পারে নাঃ ‘এক অজ্ঞাত মেয়াদের লড়াই শেষে যেকোনও একটিকে বিদায় নিতে হবে।

বিংশ শতাব্দী নাগাদ ধার্মিকরা নিজেদের যুদ্ধে নিয়োজিত ভেবে থাকলে তার কারণ তারা প্রকৃতই আক্রমণের ভেতর ছিল। ইহুদিরা এক নতুন ধরনের ‘বৈজ্ঞানিক’ বর্ণবাদে বিপদাপন্ন হয়ে পড়েছিল। এই মতবাদে ইউরোপের মানুষের জেনেটিক ও জীববিদ্যা মূলক বৈশিষ্ট্যগুলোকে এমন সংকীর্ণতার সাথে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছিল যে ইহুদিরা পরিণত হয়েছিল ‘অপর’-এ। পূর্ব ইউরোপের বিংশ শতাব্দীর সূচনায় এক নতুন হত্যালীলার জোয়ার অধিকতর ধার্মিক ইহুদিদের প্যালেস্তাইনে ইহুদি স্বদেশভূমি প্রতিষ্ঠার রাজনৈতিক আন্দোলন যায়নবাদ প্রতিষ্ঠিত করার পথে চালিত করে। ল্যান্ড অভ ইসরায়েলের বাইবেলিয় প্রতীক ব্যবহার করে থাকলেও যায়নিস্টরা ধর্মে নয়, বরং জাতীয়তাবাদ, উপনিবেশবাদ ও সমাজতন্ত্রের আধুনিক চিন্তাভাবনায় অনুপ্রাণিত ছিল।

নানাভাবে সেক্যুলার আধুনিকতা উদার ছিল, কিন্তু আবার সহিংস ও সশস্ত্র সংগ্রামকে রোমান্টিসাইজ করার প্রবণতা বিশিষ্টও ছিল। ১৯১৪ সাল থেকে ১৯৪৫ সালের মাঝে ইউরোপ ও সোভিয়েত ইউনিয়নে পঁচাত্তর মিলিয়ন মানুষ যুদ্ধ ও বিরোধের ফলে প্রাণ হারায়।৪৩ দুটো বিশ্বযুদ্ধ, নিষ্ঠুর রকম দক্ষ জাতিগত শুদ্ধি অভিযান ও গণহত্যার ঘটনা ঘটেছে। ইউরোপের সবচেয়ে সংস্কৃত সমাজ গঠনকারী জার্মানদের হাতে নৃশংসতার বেশ কিছু ঘটনা ঘটেছে। এটা আর অনুমান করা সহজ নয় যে যৌক্তিক শিক্ষা বর্বরতাকে দূর করতে পারবে। নাৎসি হলোকাস্ট ও সোভিয়েত গুলাগের চরম মাত্রাই তাদের আধুনিক উৎস তুলে ধরেছে। এর আগের কোনও সমাজেরই এমন ব্যাপক মাত্রার নিশ্চিহ্নকরণের প্রকল্প চালানোর মতো প্রযুক্তি ছিল না। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের বিভৎসতা (১৯৩৯-৪৫) জাপানের হিরোশিমা ও নাগাসাকি শহরের উপর প্রথম অ্যাটম বোমা বিস্ফোরণের ভেতর দিয়ে শেষ হয়েছিল। শত শত বছর ধরে নারী-পুরুষ ঈশ্বর নির্ধারিত এক চূড়ান্ত প্রলয়ের স্বপ্ন দেখেছে। এবার তারা নিজেরাই সে কাজটি দক্ষতার সাথে শেষ করার উপায় বের করতে নিজেদের মেধাবী শিক্ষাকে কাজে লাগিয়েছে। মৃত্যু-শিবির, মাশরুম মেঘ ও-বর্তমানে-পরিবেশের ব্যাপক ধ্বংস আধুনিক সংস্কৃতির অভ্যন্তরে এক নিশ্চিহ্নতাবাদী নিষ্ঠুরতার অবস্থান তুলে ধরে। বাইবেলের ব্যাখ্যা সব সময়ই ঐতিহাসিক পরিস্থিতি দিয়ে প্রভাবিত হয়েছে। বিংশ শতাব্দীতে ইহুদি, ক্রিশ্চান এবং মুসলিমরা ঐশীগ্রন্থভিত্তিক আধ্যাত্মিকতা গড়ে তুলতে শুরু করে যা আধুনিকতার সহিংসতাকে আত্মস্থ করেছে।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রক্ষণশীল প্রটেস্ট্যান্ট মতবাদে সন্ত্রাসের উপাদান প্রবেশ করেছিল: অমন ভয়াবহ মাত্রায় হত্যাকাণ্ড, যুক্তি দেখিয়েছে তারা, নিশ্চয়ই এটা রেভেলেশনের ভবিষ্যদ্বাণীর সেই লড়াই। কারণ রক্ষণশীলরা তখন বিশ্বাস করছিল যে, বাইবেলের প্রতিটি শব্দ আক্ষরিকভাবে সত্যি, তারা চলমান ঘটনাপ্রবাহকে নির্ভুল বাইবেলিয় ভবিষ্যদ্বাণীর বাস্তবায়ন হিসাবে দেখছিল। হিব্রু পয়গম্বরগণ ঘোষণা করেছিলেন যে, ইহুদিরা প্রলয়ের আগেই স্বদেশ ভূমিতে ফিরে যাবে, তো ব্রিটিশ সরকার প্যালেস্তাইনে ইহুদি বসতি স্থাপনের প্রতি সমর্থনের অঙ্গীকার করে বেলফোর ডিক্লারেশন (১৯১৭) জারি করলে ক্রিশ্চান মৌলবাদীরা এক ধরনের মিশ্র ভীতি ও প্রীতির অনুভূতিতে তাড়িত হয়েছিল। সাইরাস স্কোফিল্ড আভাস দিয়েছিলেন, রাশিয়াই ‘উত্তরের শক্তিoo যা ইসরায়েলকে আর্মাগেদনের আগেই আক্রমণ করবে: নাস্তি ক্যবাদী কমিউনিজমকে রাষ্ট্রীয় আদর্শে পরিণতকারী বলশেভিক বিপ্লব (১৯১৭) যেন এই ভবিষ্যদ্বাণীকেই নিশ্চিত করছে বলে মনে হয়েছে। যুদ্ধের অব্যবহিত পরে লীগ অভ নেশনসের সৃষ্টি অবশ্যই রেভেলেশনের ভষ্যিদ্বাণী ১৬: ১৪-এর বাস্তবায়ন ছিল। এটাই পুনরুত্থিত রোমান সাম্রাজ্য, অচিরেই অ্যান্টিক্রাইস্ট যার নেতৃত্ব দেবে। এক সময় যা ছিল উদারপন্থীদের সাথে কেবলই মতবাদগত বিরোধ, সেটাই সভ্যতার ভবিষ্যৎ নিয়ে যুদ্ধে রূপান্তরিত হচ্ছিল। বাইবেল পাঠ করার সময় ক্রিশ্চান মৌলবাদীরা নিজেদের অচিরেই পৃথিবীকে ধ্বংস করে দেবে এমন শক্তির বিরুদ্ধে নিয়োজিত দেখেছে-এখনও দেখে। যুদ্ধের সময় ও যুদ্ধের পরে ছড়ানো জার্মান নিষ্ঠুরতার ভয়ঙ্কর সব কাহিনী যেন হাইয়ার ক্রিটিসিজমের জন্ম দানকরী জাতির উপর ক্ষয়কর প্রভাব প্রমাণ করছিল।৪৫

এটা ছিল গভীর ভীতি জাগানো দর্শন। ক্রিশ্চান মৌৗলবাদীরা এখন গণতন্ত্র সম্পর্কে অনিশ্চিত অবস্থায় ছিল, যা ‘এই পৃথিবীর প্রত্যক্ষ করা সবচেয়ে শয়তানসুলভ শাসনের’ দিকে টেনে নিয়ে যেতে পারে। ৬ লীগ অভ নেশনস-এর মতো শান্তিরক্ষী প্রতিষ্ঠানসমূহ–বর্তমানে জাতিসংঘ-সব সময়ই পরম অশুভের সাথে সম্পর্কিত হয়ে থাকবে: বাইবেল বলেছে যে, শেষ আমলে শান্তি নয়, যুদ্ধ সংঘটিত হবে, তো লীগ বিপজ্জনকভাবে ভুল পথে রয়েছে। প্রকৃতপক্ষেই অ্যান্টিক্রাইস্ট স্বয়ং, পল যাকে বিশ্বাসযোগ্য মিথ্যাবাদী বলে বর্ণনা করেছিলেন, সম্ভবত শান্তিস্থাপনকারীই হবে। জেসাস আর প্রিয় উদ্ধারকারী ছিলেন না, বরং রেভেলেশনের যুদ্ধংদেহী ক্রাইস্টে পরিণত হয়েছিলেন, যিনি, বলেছেন অন্যতম নেতৃস্থানীয় পরমান্দমূলক মতবাদের সমর্থক আইসাক হালদেমান, ‘এমন একজন হিসাবে আবির্ভূত হয়েছেন যিনি আর বন্ধুত্ব বা ভালোবাসার আকাঙ্ক্ষী নন…তাঁর পোশাকে রক্তের ধারা, অন্যের রক্ত। মানুষের রক্তপাত ঘটাতেই নেমে এসেছেন তিনি।’৪৮ অতীতে ব্যাখ্যাকারগণ বাইবেলকে সামগ্রিকভাবে দেখার চেষ্টা করেছেন। এখন অন্য টেক্সটের বিনিময়ে একটি বিশেষ টেক্সট বাছাই করা–মৌলবাদী, ‘অনুশাসনের ভেতরে অনুশাসন’–গস্পেলের ভীষণ ধ্বংসের দিকে নিয়ে গেছে।

১৯২০ সালে গণতান্ত্রিক রাজনীতিক উইলিয়াম জেনিংস ব্রাইয়ান (১৮৬০-১৯২৫) নিজস্ব পাবলিক স্কুলে বিবর্তনবাদের বিরুদ্ধে ক্রুসেড শুরু করেন। তাঁর দৃষ্টিতে দুটো সম্পর্কিত হলেও হাইয়ার ক্রিটিসিজম নয়, বরং ডারউইনজমই মহাযুদ্ধের নৃশংসতার জন্যে দায়ী।৪৯ ব্রাইয়ানের গবেষণা তাঁকে নিশ্চিত করেছিল যে, ডারউইনপন্থীদের কেবল শক্তিশালীদেরই টিকে থাকার বিশ্বাস ‘ইতিহাসের সবচেয়ে রক্তাক্ত ঘটনার ভিত্তি নির্মাণ করেছিল।’ এটা কোনও দুর্ঘটনা নয় যে সেই একই বিজ্ঞান সৈনিকদের শ্বাসরোধ করে হত্যার জন্যে বিষাক্ত গ্যাস তৈরি করে সেটাই প্রচার করছে যে মানুষের বর্বর পূর্বপুরুষ ছিল, এবং বাইবেল থেকে অলৌকিক ও অতিপ্রাকৃত বাদ দিচ্ছে।৫০ ব্রাইয়ানের চোখে বিবর্তন আধুনিকতার নিষ্ঠুর সম্ভাবনা প্রতীকায়িতকারী অশুভ দিয়ে আচ্ছন্ন ছিল।

ব্রাইয়ানের উপসংহার আনাড়ী ও অশুদ্ধ ছিল, কিন্তু লোকে তাঁর কথা শুনতে প্রস্তুত ছিল। যুদ্ধ বিজ্ঞানের সাথে মধুচন্দ্রমার কালের অবসান ঘটিয়েছিল। একে তারা নির্দিষ্ট সীমানার ভেতর রাখতে চেয়েছে। যারা সহজ- সরল বেকনিয় দর্শনকে আলিঙ্গন করেছিল তারা ব্রাইয়ানের মাঝে এর দেখা পেয়েছিল, যিনি একাকী বিবর্তনের বিষয়টিকে মৌলবাদী এজেন্ডায় ঠেলে দিয়েছিলেন, সেখানেই রয়ে গিয়েছিল সেটা। কিন্তু তা কোনওদিনই হয়তো হাইয়ার ক্রিটিসিজমকে প্রতিস্থাপন করতে পারত না যদি টেনেসির নাটকীয় পরিবর্তন ঘটত।

দক্ষিণাঞ্চলীয় রাষ্ট্রগুলো এ আন্দোলনে যোগ দেয়নি, তবে তারা বিবর্তনবাদের শিক্ষার ব্যাপারে উদ্বিগ্ন ছিল। ফ্লোরিডা, মিসিসিপি, লুইসিয়ানা ও আরকান-স’র রাজ্য সভায় ডারউইনিয় বিবর্তনবাদী শিক্ষা নিষিদ্ধ করার লক্ষ্যে বিল উত্থাপন করেছিল। টেনেসিতে বিবর্তনবাদ বিরোধী আইন বিশেষভাবে কঠোর ছিল। ছোট শহর ডেয়টনের এক স্কুল টিচার জন স্কোপস বাক স্বাধীনতার স্বার্থে আঘাত হানার সিদ্ধান্ত নিলেন, প্রিন্সিপালের বদলে জীবদ্যিার ক্লাস নেওয়ার সময় আইন ভঙ্গ করার স্বীকারোক্তি দিলেন তিনি। ১৯২৫ সালের জুলাই মাসে বিচারের সম্মুখীন করা হয় তাঁকে। নতুন আমেরিকান সিভিল লিবার্টিজ ইউনিয়ন (এসিএলইউ) তাঁর পক্ষে লড়াই করার জন্যে একদল আইনবিদ পাঠায়, এর নেতৃত্বে ছিলেন যুক্তিবাদী প্রচারকারী ক্লারেন্স ডাররো। ব্রাইয়ান আইনের পক্ষে দাঁড়াতে সম্মত হন। সাথে সাথে বিচারটি বাইবেল ও বিজ্ঞানের ভেতর এক প্রতিযোগিতায় পরিণত হয়।

কাঠগড়ায় রীতিমতো পর্যুদস্ত হন ব্রাইয়ান। ডাররো যৌক্তিক চিন্তাধারার পতাকাবাহী হিসাবে আদালত থেকে বের হয়ে আসেন। পত্রপত্রিকাগুলো উৎসাহের সাথে মৌলবাদীদের আধুনিক বিশ্বে অংশ নেওয়ার যোগ্যতাহীন অর্থহীন পশ্চাদপন্থী হিসাবে প্রত্যাখ্যান করে। এর একটা প্রভাব ছিল আজকের দিনে যা আমাদের জন্যে একটা নজীরের মতো। আক্রমণ করা হলে মৌলবাদী আন্দোলনসমূহ সাধারণত আরও চরম হয়ে ওঠে। ডেয়টনের আগে রক্ষণশীলরা বিবর্তনবাদের তত্ত্বের বেলায় সতর্ক ছিল, কিন্তু খুবই অল্প সংখ্যক ‘সৃষ্টিবিজ্ঞানে’র পক্ষে কথা বলেছে। যেখানে বলা হয়েছে যে, জেনেসিসের প্রথম অধ্যায় আসলে সব দিক থেকেই যথার্থ সত্য। স্কোপস-এর পর অবশ্য তারা ঐশীগ্রন্থের ব্যাখ্যায় আরও প্রবলভাবে আক্ষরিক হয়ে ওঠে, এবং সৃষ্টি বিজ্ঞান তাদের আন্দোলনের ফ্ল্যাগশিপে পরিণত হয়। স্কোপসের আগে মৌলবাদীরা সামাজিক সংস্কারের পক্ষে বামপন্থী লোকদের সাথে কাজ করতে ইচ্ছুক ছিল, কিন্তু স্কোপসের পর রাজনৈতিক বর্ণালীর ডানদিকে সরে যায়, সেখানেই রয়ে গেছে তারা।

+

হলোকাস্টের পর অর্থডক্স ইহুদিরা ছয় মিলিয়নের উদ্দেশে ধার্মিকতার একটা কাজ হিসাবে নতুন করে নতুন ইহুদি রাষ্ট্র ইসরায়েল ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে হাসিদিক দরবার ও মিসনাগদিক ইয়েশিভা পুনর্নির্মাণ করার বাধ্যবাধকতা বোধ করে।৫১ তোরাহ পাঠ আজীবন, পূর্ণসময়ের কাজে পরিণত হলো। পুরুষরা বিয়ের পর ইয়েশিভায় বসবাস করতে শুরু করে; স্ত্রীরা তাদের অর্থ দিয়ে সাহায্য করত, বাইরের জগতের সাথে বলতে গেলে তাদের কোনও সম্পর্কই থাকত না।৫২ হেরেদিম (‘কম্পিতজন’) নামে পরিচিত এই আল্ট্রা-অর্থডক্স ইহুদিরা আগের যেকোনও সময়ের চেয়ে কঠোরভাবে তোরাহ পালন করত, খাবার ও পবিত্র থাকার নতুন নতুন কায়দা খুঁজে বের করত। হলোকাস্টের আগে বাড়াবাড়ি রকমের কঠোরতাকে বিভাজনকারী হিসাবে নিরুৎসাহিত করা হতো। কিন্তু এখন হেরেদিমরা ছয় মিলিয়ন ইহুদিকে হত্যায় সাহায্যকারী যৌক্তিক দক্ষতার একেবারে বিপরীত মেরুর বাইবেল ভিত্তিক পাল্টা সংস্কৃতি গড়ে তুলছিল। ইয়েশিভা গবেষণার সাথে আধুনিকতার বাস্তববাদীতার কোনও মিলই ছিল নাঃ পাঠ করা অনেক আইনই–যেমন মন্দির সেবার আইন-অনুসরণ করা সম্ভব ছিল না। সিনাইয়ের চূড়ায় ঈশ্বরের উচ্চারিত হিব্রু শব্দের পুনরাবৃত্তি স্বর্গের সাথে সম্পর্ক স্থাপনের একটা ধরণ ছিল। আইনের খুঁটিনাটি অনুসন্ধান করা প্রতীকীভাবে ঈশ্বরের মনে প্রবেশ করার উপায় ছিল। মহান র‍্যাবাইদের হালাখার সাথে পরিচিত হয়ে ওঠা ছিল প্রায় ধ্বংস করে দেওয়া ঐতিহ্য পালনের একটা উপায়।

আদিতে যায়নবাদ ছিল ধার্মিক ইহুদিবাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ হিসাবে সেক্যুলার আদর্শ, অর্থডক্সরা ইহুদিবাদের সবচেয়ে পবিত্রতম প্রতাঁকের অন্যতম ইসরায়েল ভূমিকে অপবিত্র করার দায়ে যাকে পরিহাস করত। কিন্তু ১৯৫০ ও ১৯৬০-র দশকে এক দল ধার্মিক তরুণ ইসরায়েলি বাইবেলের আক্ষরিক ব্যাখ্যার উপর ভিত্তি করে এক ধার্মিক ইহুদিবাদ গড়ে তুলতে শুরু করে। ঈশ্বর আব্রাহামের বংশধরদের দেশ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, এতে করে ইহুদিরা প্যালেস্তাইনের বৈধ অধিকার লাভ করেছে। সেক্যুলার যায়নবাদীরা কখনও এই দাবি তোলেনি; তারা বাস্তব কূটনীতি, জমিনে পরিশ্রম করে বা যুদ্ধ করে দেশকে নিজের করে নিতে চেয়েছে। কিন্তু ধার্মিক যায়নবাদীরা ইসরায়েলে জীবনকে আধ্যাত্মিক সুযোগ হিসাবে দেখেছে। ১৯৫০-র দশকের শেষ দিকে তারা আর. ইয়াহুদা কুকের (১৮৯১–১৯৮২) মাঝে এক নেতার দেখা পায়। তখন তাঁর বয়স প্রায় সত্তর বছর। কুকের মতে সেক্যুলার ইসরায়েল রাষ্ট্র ঈশ্বরের রাজ্য, তোউত কোর্স; এর জমিনের প্রতিটি ধূলিকণা পবিত্র। ক্রিশ্চান মৌলবাদীদের মতো তিনি আক্ষরিকভাবে ইহুদিদের দেশে প্রত্যাবর্তন করে আরবদের অধিকারে থাকা জমিনে বসতি গড়ার হিব্রু ভবিষ্যদ্বাণীর ব্যাখ্যা করেছেন, যা চূড়ান্ত নিষ্কৃতিকে ত্বরান্বিত করবে এবং ইসরায়েলের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশ গ্রহণ পবিত্রতার সর্বোচ্চ শিখরে আরোহন করার শামিল।৫৬ যেভাবে বাইবেলে নির্দিষ্ট করে দেওয়া আছে ঠিক সেভাবে ইহুদিরা গোটা ইসরায়েল ভূখণ্ড অধিকার না করলে নিষ্কৃতির ঘটনা ঘটবে না। আরবদের অধিকারে থাকা এলাকা অধিকার করে নেওয়া এক পরম ধর্মীয় দায়িত্ব।৫৭

১৯৬৭ সালের যুদ্ধে ইসরায়েল বাহিনী পশ্চিত তীর, সিনাই পেনিনসুলা, গাযা স্ট্রিপ ও গোলান মালভূমি দখল করে নিলে যায়নবাদীরা ঐশীগ্রন্থের এই আক্ষরিক বাস্তবায়নকে অন্তিমকাল শুরুর প্রমাণ হিসাবে দেখেছে। শান্তির বিনিময়ে আরবদের অধিকৃত এলাকা ফিরিয়ে দেওয়ার কোনও উপায় নেই। রেডিক্যাল কুকবাদীরা হেব্রনে অবস্থান করে নিকটস্থ কিরিয়াত আরবায় একটা শহর গড়ে তোলে, যদিও এটা বৈরী সময়ের দখল করা অঞ্চলে বসতি স্থাপন নিষিদ্ধকারী জেনিভা কনভেনশনের বরখেলাপ ছিল। ১৯৭৩ সালের অক্টোবর যুদ্ধের পর বসতি স্থাপনের এই প্রয়াস আরও জোরাল হয়ে ওঠে। ধার্মিক যায়নবাদীরা যেকোনও শান্তি চুক্তির বিরোধিতা করতে সেক্যুলার ডানপন্থীদের সাথে হাত মেলায়। সত্যিকারের শান্তির মানে ভূখণ্ডগত অখণ্ডতা ও গোটা ইসরায়েল অধিকারে রাখা। কুকবাদী র‍্যাবাই এলিয়েযার ওয়াল্ডম্যান যেমন ব্যাখ্যা করেছেন, ইসরায়েল অশুভের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত রয়েছে, যার উপর গোটা বিশ্বের শান্তির সম্ভাবনা নির্ভরশীল। ৫৮

এই নিরাপোষ মনোভাব বিকৃত মনে হয়, কিন্তু তা সেক্যুলারিস্ট রাজনীতিকদের চেয়ে ভিন্ন নয়, যারা স্বভাবগতভাবেই যুদ্ধ অবসানের জন্যে যুদ্ধের কথা ও বিশ্ব শান্তি রক্ষার লক্ষ্যে যুদ্ধে যাবার অনিবার্য কারণের কথা বলে থাকে। অন্য আরেক ক্ষেত্রে ইহুদি মৌলবাদীদের একটি ছোট দল প্যালেস্তাইনিদের ঈশ্বর যাদের নির্দয়ভাবে হত্যা করার জন্যে ইসরায়েলিদের নির্দেশ দিয়েছিলেন সেই নিষ্ঠুর জাতি আমলাকাইটদের সাথে তুলনা করে বিংশ শতাব্দীর এক গণহত্যার রীতির বাইবেলিয় ভাষ্য গড়ে তোলে।৫৯ ঠিক একই রকম প্রবণতা লক্ষ করা যায় আর. মেয়ার কাহানের প্রতিষ্ঠিত আন্দোলনে। তাঁর ঐশীগ্রন্থ পাঠের কায়দা এতটাই রিডাকশনিস্ট ছিল যে তা ইহুদিবাদের মারাত্মক ক্যারিকেচারে পরিণত হয়েছিল, জাতিগত শুদ্ধি অভিযানের পক্ষে তা বাইবেলিয় যুক্তির যোগান দিয়েছিল। আব্রাহামকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি এখনও বহাল আছে, তো আরবরা দখলদার, তাদের বিদায় নিতে হবে। ‘ইহুদিবাদে বহু বার্তা নেই,’ জোর দিয়ে বলেছেন তিনি। ‘বার্তা একটাই…ঈশ্বর চেয়েছেন আমরা যেন বিচ্ছিন্নভাবে আমাদের নিজেদের দেশে বাস করি, যাতে বিদেশীদের সাথে আমাদের যোগাযোগের কোনওই সম্ভাবনা না থাকে।

১৯৮০-র দশকের গোড়ার দিকে কুকবাদীদের একটা ছোট দল হারাম আল-শরীফের মুসলিম উপাসনালয় ধ্বংস করার পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিল। সলোমনের মন্দিরের স্থানে ইসলামি বিশ্বের তৃতীয় পবিত্রতম স্থান এই উপাসনালয়টি নির্মিত হয়েছিল। পবিত্র স্থান অপবিত্র থাকা অবস্থায় কীভাবে ফিরে আসবেন মেসায়াহ? কাব্বালিয় নীতিমালার সম্পূর্ণ অক্ষরিক ব্যাখ্যা- পার্থিব ঘটনাপ্রবাহ ঐশী ঘটনাকে প্রভাবিত করতে পারে-মোতাবেক চরমপন্থীরা ধরে নিয়েছিল যে মুসলিম বিশ্বের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক যুদ্ধের ঝুঁকি নিয়ে মেসায়াহকে ইসরায়েলে পাঠাতে ঈশ্বরকে ‘বাধ্য’ করতে পারবে তারা।৬২ এই ষড়যন্ত্র বাস্তবায়িত হলে সেটা কেবল ইহুদি রাষ্ট্রের জন্যেই মারাত্মক পরিণতি ডেকে আনত না বরং ওয়াশিংটনের স্ট্র্যাটেজিস্টদের বিশ্বাস, ঠাণ্ডা লড়াইয়ের পরিপ্রেক্ষিতে সোভিয়েতরা আরব বিশ্বকে সমর্থন করার ফলে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধও শুরু হয়ে যেতে পারত। তারপরেও প্রতিপক্ষকে পরাস্ত করার জন্যে পরাশক্তিসমূহ তাদের নিজেদের জনগণকেই পারমানবিক নিশ্চিহ্নতার দিকে ঠেলে দিতে প্রস্তুত, এমন এক বিশ্বে এই নৈরাজ্যকর প্রকল্প অমূলক ছিল না।

অনেক সময় ঐশীগ্রন্থের এইসব ভীষণ ক্ষতিকর ব্যাখ্যা নৃশংসতার সূচনা ঘটায়। কাহানের আদর্শ কিরিয়াত আরবার এক বসতি স্থাপনকারী বারুচ গোল্ডস্টেইনকে ২৫শে ফেব্রুয়ারি, ১৯৯৪ তারিখে হেব্রনে কেভ অভ দ্য প্যাট্রিয়ার্কস-এ উনত্রিশ জন প্যালেস্তাইনি উপাসককে হত্যায় অনুপ্রাণিত করেছিল। ৪ঠা নভেম্বর, ১৯৯৫ এর যায়োনিস্ট ইয়েশিভার সাবেক ছাত্র ইগাল আমির তেল আভিবে এক শান্তি মিছিলের সময় প্রধানমন্ত্রী ইতযহাক রাবিনকে হত্যা করে। পরে সে বলেছে ইহুদি আইন পাঠ তাকে নিশ্চিত করেছে যে অসলো চুক্তিরে মাধ্যমে পবিত্র ভূমি বিলিয়ে দিয়ে রাবিন রোদেফে (‘লঙ্ঘনকারী’) পরিণত হয়েছেন, ইহুদি জীবনকে বিপদাপন্ন করে তুলেছেন তিনি, সেজন্যে শাস্তি তাঁর প্রাপ্য ছিল।

+

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রোটেস্ট্যান্ট মৌলবাদীরা এক ধরনের ক্রিশ্চান যায়নবাদ গড়ে তুলেছিল। বিপরীতমূলকভাবে তা ছিল অ্যান্টি-সেমিটিক। ইহুদি জাতি জন ডারবি’র ‘পরমানন্দ’ দর্শনের কেন্দ্রিয় অবস্থানে ছিল। ইহুদিরা পবিত্র ভূমিতে বাস করতে সক্ষম না হওয়া পর্যন্ত জেসাসের পক্ষে ফিরে আসা সম্ভব হবে না।[৬৫] ১৯৪৮ সালে ইসরায়েল রাষ্ট্রের সৃষ্টিকে মৌলবাদী দার্শনিক জেরি ফলওয়েল জেসাস ক্রাইস্টের প্রত্যাবর্তনের সবচেয়ে মহান পূর্বাভাস হিসাবে দেখেছেন। ইসরায়েলকে সমর্থন জানানো বাধ্যতামূলক। কিন্তু ডারবি শিক্ষা দিয়েছিলেন যে, অ্যান্টিক্রাইস্ট শেষ আমলে প্যালেস্তাইনে বাসকারী ইহুদিদের দুই তৃতীয়াংশকে হত্যা করবে, তো মৌলবাদী লেখকগণ এক হত্যাকাণ্ডের অপেক্ষা করছিলেন যেখানে ইহুদিরা বিপুল সংখ্যায় নিহত হবে।৬৭

কুকবাদীদের মতো ক্রিশ্চান মৌলবাদীরা শান্তিতে আগ্রহী ছিল না। ঠাণ্ডা লড়াইয়ের সময় তারা ‘উত্তরের প্রতিপক্ষ’ সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে যেকোনওরকম দাঁতাতের প্রবল বিরোধী ছিল। শান্তি, বলেছেন জেমস রবিনসন, ‘ঈশ্বরের বাণীর বিরোধী। পারমানবিক বিপর্যয় নিয়ে তাঁরা এতটুকু ভাবিত ছিলেন না। সেইন্ট পিটার এর ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন। ৬৯ কোনওভাবেই তা প্রকৃত বিশ্বাসীকে প্রভাবিত করবে না, গোলমালের আগেই পরমনান্দ লাভ করবে তারা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিতে পরমানন্দ এখনও একটি ক্ষমতাশালী শক্তি। ক্রিশ্চান রাইটের সমর্থনের উপর নির্ভরশীল বুশ প্রশাসন অনেক সময়ই পরমানন্দের কথায় ফিরে গেছে। সোভিয়েত ইউনিয়নের অবসানের পর কিছু সময় সাদ্দাম হুসেইন ‘উত্তরের প্রতিপক্ষে’র ভুমিকা পালন করেছেন, এবং অচিরেই সিরিয়া বা ইরান তাঁর স্থান দখল করেছে। এখনও ইসরায়েলের পক্ষে ব্যাখ্যাতীত সমর্থন রয়েছে, যা ক্ষতিকর হয়ে উঠতে পারে। ২০০৫ সালের জানুয়ারি মাসে প্রধানমন্ত্রী আরিয়াল শ্যারন প্রচণ্ড হৃদরোগে আক্রান্ত হলে মৌলবাদী নেতা প্যাট রবিনসন দাবি করে বসেন যে, এটা গাযা থেকে ইসরায়েলি বাহিনী প্রত্যাহারের কারণে ঈশ্বরের তরফ থেকে শাস্তি।

জেরি ফলওয়েলের মরাল মেজরিটির চেয়েও চরম এক ধরনের ক্রিশ্চান মৌলবাদের সাথে জড়িত প্যাট রবিনসন। টেক্সান অর্থনীতিবিদ গ্যারি নর্থ ও তাঁর শ্বশুর জন রাশদুনি কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত রিকন্সট্রাকশন মুভমেন্ট বিশ্বাস করে ওয়াশিংটনের সেক্যুলার প্রশাসন অভিশপ্ত।[৭০] ঈশ্বর অচিরেই কঠোরভাবে বাইবেলিয় ধারায় পরিচালিত ক্রিশ্চান সরকার দিয়ে একে প্রতিস্থাপিত করবেন। পুনর্গঠনবাদীরা এভাবে ক্রিশ্চান কমনওয়েলথের পরিকল্পনা করছে যেখানে গণতন্ত্রের আধুনিক ধর্মদ্রোহীতা উৎখাত হবে ও বাইবেলের প্রতিটি বিধান অক্ষরে অক্ষরে পালিত হবে: দাস প্রথা পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হবে, জন্মনিয়ন্ত্রণ রহিত করা হবে, ব্যাভিচারী, সমকামী, ধর্মদ্রোহী ও জ্যোতিষীদের হত্যা করা হবে ও অবাধ্য ছেলেমেয়েদের পাথর ছুঁড়ে হত্যা করা হবে। ঈশ্বর দরিদ্রদের পক্ষে নন: প্রকৃতপক্ষে, ব্যাখ্যা করেছেন নর্থ, ‘নষ্টামি ও দারিদ্র্যের ভেতর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে।’৭১ করের টাকা অবশ্যই কল্যাণের জন্যে ব্যয় করা যাবে না, কারণ ‘অলসদের সাহায্য করা আর শয়তানকে সাহায্য করা একই কথা।’৭২ বাইবেল উন্নয়নশীল বিশ্বে সকল সাহায্য নিষিদ্ধ করেছে: এর পৌত্তলিকতা, অনৈতিকতা ও দানো উপাসনার প্রতি আসক্তিই অর্থনৈতিক সমস্যার কারণ। ৭৩ অতীতে ব্যাখ্যাকরগণ বাইবেলের অধিকতর কম মানবিক অংশগুলো এড়িয়ে যাবার চেষ্টা করেছেন বা সেগুলোর কোনও উপমামূলক ব্যাখ্যা দিয়েছেন। পুনর্গঠনবাদীরা যেন এই অনুচ্ছেদগুলো ইচ্ছা করে খুঁজে বের করে সেগুলোকে অনৈতিহাসিক ও আক্ষরিকভাবে ব্যাখ্যা করেছে। অন্য মৌলবাদীরা যেখানে আধুনিকতার সহিংসতাকে আত্মস্থ করেছে, পুনর্গঠনবাদীরা সেখানে উগ্র পুঁজিবাদের ধর্মীয় ভাষ্য তৈরি করে বসেছে।

মৌলবাদীরা পত্রিকার শিরোনাম আঁকড়ে ধরে, কিন্তু অন্য বাইবেলিয় পণ্ডিতগণ আরও বেশি শান্তিবাদী চেতনায় ঐতিহ্যবাহী বাইবেলিয় আধ্যাত্মিকতার পুনর্জাগরণ ঘটানোর চেষ্টা করেছেন। ১৯৪০-এর দশকের লিখছিলেন ইহুদি দার্শনিক মার্টিন বুবের (১৮৭৮-১৯৬৫); তিনি বিশ্বাস করতেন, বাইবেল এমন এক সময়ে ঈশ্বরের উপস্থিতি প্রত্যক্ষ করেছে যখন তাঁকে অনুপস্থিত মনে হয়েছে। ব্যাখ্যাকারগণ কখনওই স্থির থাকতে পারেননি, কেননা বাইবেল ঈশ্বর ও মানবজাতির ভেতর এক চলমান সংলাপ তুলে ধরে। বাইবেলের পাঠ অবশ্যই এক দুর্ভেয় জীবনযাত্রার দিকে নিয়ে যেতে হবে। আমরা যখন বাইবেল খুলি, তখন যা শুনছি তার মাধ্যমে অবশ্যই মৌলিকভাবে বদলে যেতে প্রস্তুত থাকতে হবে। বুবের র‍্যাবাইরা ঐশীগ্রন্থকে যা বলতেন সেই মিকরা, ‘বাইরের আহবান’-এ বেশি আকৃষ্ট হয়েছিলেন। এটা এমন এক আহবান যা পাঠককে জাগতিক সমস্যাদি থেকে নিজেকে বিমূর্ত করে তুলতে দেয় না, বরং তাদের দৃঢ়তার সাথে দাঁড়িয়ে ঘটনাপ্রবাহের অন্তস্থ স্রোত শোনায় সক্ষম করে তোলে।

তাঁর বন্ধু ফ্রান্য রোজেনভিগ (১৮৮৬-১৯২৯) একমত প্রকাশ করেছেন যে, বাইবেল আমাদের সময়ের আর্তচিৎকার শুনতে বাধ্য করে। পাঠকদের অবশ্যই পয়গম্বরদের মতোই মিকরা’র প্রতি সাড়া দিতে হবে, চিৎকার করে বলতে হবে: ‘হিনেনি!” ‘আমি হাজির’-কায়েমোনবাক্যে-…বর্তমান বাস্তবতায়।’৭৫ বাইবেল কোনও পূর্বনির্ধারিত চিত্রনাট্য নয়। আমাদের দৈনন্দিন জীবন বাইবেলকে আলোকিত করে তোলা উচিত, তাহলে বাইবেল আমাদের দৈনন্দিন জীবনের পবিত্র মাত্রা আবিষ্কারে সাহায্য করবে। ঐশীগ্রন্থ পাঠ এক অন্তবীক্ষণিক প্রক্রিয়া। রোজেনভিগ জানতেন আধুনিক মানুষ পূর্ববর্তী প্রজন্মগুলোর মতো বাইবেলের প্রতি সাড়া দিতে পারবে না। আমাদের প্রয়োজন জেরেমিয়াহর কাছে বর্ণনা করা নতুন কোভেন্যান্ট, যখন আইন আমাদের অন্তরে লিখিত হবে।৬ টেক্সটকে অবশ্যই ধৈর্যশীল সুশৃঙ্খল পাঠের ভেতর দিয়ে উপলব্ধি ও আত্মস্থ করতে হবে এবং ইহজগতে কর্মে পরিণত করতে হবে।

ইউনিভার্সিটি অভ শিকাগোর বর্তমান প্রফেটসর অভ জুইশ স্টাডিজ মাইকেল ফিশবেন বিশ্বাস করেন, ব্যাখ্যাসমূহ আমাদের পবিত্র টেক্সটের ধারণা পুনরুদ্ধারে সাহয্য করতে পারে। বাইবেলের ঐতিহাসিক সমালোচনা এখন আমাদের পক্ষে সময়ের ভিন্ন পর্যায়ের বিভিন্ন অনুচ্ছেদকে সমন্বিত করে ঐশীগ্রন্থ সামঞ্জস্যপূর্ণভাবে পাঠ করা অসম্ভব করে তুলেছে। কিন্তু আধুনিক সাহিত্যিক সমালোচনা স্বীকার করে যে, আমাদের অভ্যন্তরীণ জগৎ বহু ভিন্ন ভিন্ন টেক্সটের টুকরো দিয়ে গড়ে উঠেছে, আমাদের মনে সেগুলো একসাথে অবস্থান করে, একটি অন্যটিকে নির্দিষ্ট করে। আমাদের নৈতিক বিশ্ব কিং লিয়ার, মবি ডিক ও মাদাম বোভারির পাশাপাশি বাইবেল দিয়েও গঠিত। আমরা বিরল ক্ষেত্রে সমগ্র টেক্সট আত্মস্থ করি: বিচ্ছিন্ন ইমেজ, বাগধারা ও টুকরো এক বিপুল তরল দলে অবস্থান করে পরস্পরের সাথে ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া করে চলে। একইভাবে বাইবেলও আমাদের মনে সামগ্রিকভাবে অবস্থান করে না, বরং বিচ্ছিন্নভাবে থাকে। আমরা আমাদের নিজস্ব ‘অনুশাসনের ভেতরে অনুশাসন’ সৃষ্টি করি এবং ইচ্ছাকৃতভাবেই আমাদের নির্বাচন যাতে কতগুলো উদার টেক্সট হয় সেটা নিশ্চিত করি। বাইবেলের ঐতিহাসিক পাঠ দেখায় যে, প্রাচীন ইসরায়েলে বহু পরস্পর বিরোধী দৃষ্টিভঙ্গি ছিল, প্রতিটি নিজেকে– প্রায়শই আগ্রাসীভাবে-ইয়াহওয়েহবাদের আনুষ্ঠানিক ভাষ্য দাবি করেছে। আজকের দিনে আমরা আমাদের ভীষণভাবে অর্থডক্সিতে ভরা পৃথিবীতে বাইবেলকে এক ভবিষ্যদ্বাণীসুলভ ধারাভাষ্য হিসাবে পাঠ করতে পারি; এটা আমাদের এই কঠোর ডগম্যাটিজমের বিপদ উপলব্ধি করার মতো স্বস্তিকর দূরত্ব যোগাতে পারে এবং একে পরিশুদ্ধ বহুত্ববাদ দিয়ে প্রতিস্থাপিত করতে পারি।

ফিশবেনের কাজের মুল চাপ ছিল কীভাবে বাইবেল অবিরাম নিজেকে ব্যাখ্যা ও সংশোধন করেছে সেটা দেখানো। ইসায়াহ সকল জাতিকে যায়ন পাহাড়ের পথে এগিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন দেখেছেন, শান্তির শহর, বলছে, ‘বলিবে, চলো আমরা ইয়াহওয়েহর পর্ব্বতে…তিনি আমাদিগকে আপন পথের বিষয়ে শিক্ষা দিবেন…কারণ সিয়ন হইতে ব্যবস্থা ও যিরূশালেম হইতে ইয়াহওয়েহ বাক্য নির্গত হইবে।’৮ মিকাহ এইসব উদ্ধৃত করার সময় এক সর্বজনীন শান্তির কথা ভেবেছেন যখন জাতিসমূহ পরস্পরের সাথে কোমল স্বরে কথা বলবে। কিন্তু তিনি এক বিস্ময়কর বেপরোয়া উপসংহার যোগ করে দিয়েছিলেন। ইসরায়েলসহ প্রত্যেক জাতি ‘সামনে অগ্রসর হবে, তাদের প্রত্যেকের নিজস্ব ঈশ্বরের নামে।’ এ যেন মিকাহ একটি সাধারণ সত্যকে ঘিরে আবর্তিত বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গির একত্রিত হওয়ার আমাদের এই সময়টিকেই দেখতে পেয়েছিলেন; ইসরায়েলের জন্যে যেটা তাদের ঈশ্বরের ধারণা দিয়ে প্রকাশিত হয়েছিল।৭৯

ক্রিশ্চান ব্যাখ্যাকারগণ ক্রাইস্টকে বাইবেলের প্রাণ হিসাবে দেখা অব্যাহত রেখেছিলেন। বাইবেলিয় ধর্মতত্ত্বে সুইস জেস্যুইট হান্স উরস বালতাসার (১৯০৫-৮৮) অবতারবাদের ধারণার উপর নির্ভর করেছেন। ঐশীগ্রন্থের মতো জেসাস ছিলেন মানবীয় রূপে ঈশ্বরের বাণী। ঈশ্বরকে জানা সম্ভব, নিজেকে তিনি আমাদের বোধগম্য ভাষায় প্রকাশ করার ক্ষমতা রাখেন। তবে আমাদের অবিরাম এইসব কঠিন কিন্তু অপরিহার্য টেক্সট নিয়ে সংগ্রাম করতে হবে। বাইবেল ঈশ্বর ও মানবজাতির সাক্ষাতের আদি রূপের কাহিনী তুলে ধরেছে, যা পাঠককে ঐশী সত্তাকে নিজেদের জীবনের আদর্শ মাত্রা হিসাবে দেখতে সাহায্য করেছে। তারা কিং লিয়ার বা মিকেলেঞ্জোলোর ডেভিডের মতো একইভাবে কল্পনাকে আঁকড়ে ধরতে পারে। তবে বাইবেলে ঈশ্বরের প্রকাশের নির্দিষ্ট ‘আবশ্যক’ বা ‘মৌলিক’ কিছু বের করে আনা অসম্ভব। ধর্মতত্ত্ব ‘কখনওই শব্দ ও ধারণার একটা প্রতিফলনের অতিরিক্ত কিছু হতে পারবে না, কখনওই এক নিবিড় দূরত্বে নিয়ে যেতে পারবে না…কখনওই সম্পূর্ণভাবে স্থির করা যাবে না। কিন্তু তারপরেও ঐশীগ্রন্থ কর্তৃত্বমূলক এবং পোপ ও মর্যাদাক্রমসহ প্রত্যেকে সমন ও সমালোচনার অধীন। চার্চকে গস্পেলের আদর্শ থেকে বিচ্যুত হতে দেখলে ক্যাথলিকদের তাকে চ্যালেঞ্জ করার দায়িত্ব রয়েছে।

হান্স ফ্রেই (১৯২২-৮৮) ইহুদিবাদ থেকে ধর্মান্তরিত হয়ে এপিস্কোপাল প্রিস্ট ও ইয়েলে প্রফেটসর হয়েছিলেন, তিনি উল্লেখ করেছেন যে প্রাক ক্রিটিকাল আমলে অধিকাংশ পাঠক ধরে নিতেন যে বাইবেলিয় কাহিনীসমূহ ঐতিহাসিক, যদিও তারা প্রধানত সংখ্যাতাত্ত্বিক ধরনের ব্যাখ্যায় উদ্বিগ্ন ছিলেন। ৮১ কিন্তু অষ্টাদশ শতাব্দীতে আলোকনের পর এই ঐকমত্য নষ্ট হয়ে যায়। কেউ কেউ বাইবেলিয় বিবরণকে সম্পূর্ণ সত্য ভাবতে থাকে, ভুলে যায় যে এগুলো গল্প হিসাবে লেখা হয়েছিল। লেখকের বাক্যগঠন ও শব্দ চয়ন এইসব গল্প আমাদের বোঝার ধারাকে প্রভাবিত করে বলে মনে করা হতো। জেসাস নিশ্চিতভাবেই ঐতিহাসিক চরিত্র ছিলেন, কিন্তু আমরা যখন পুনরুত্থানের গস্পেল বিবরণসমূহ পরীক্ষা করি, তখন আসলে কী ঘটেছিল স্থির করা অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। ইহুদি ব্যাখ্যাকারদের মতো ফ্রেই বিশ্বাস করতেন, বাইবেলকে অবশ্যই আমাদের কালের প্রচলিত বানানধারা অনুযায়ী পাঠ করতে হবে। গস্পেল ও চলমান ঘটনাপ্রবাহের পাশাপাশি স্থাপন কোনও ফাঁপা ব্যাখ্যার দিকে নিয়ে যাবে না, বরং আমাদের প্রতিটির আরও গভীরে যেতে সক্ষম করে তুলবে। বাইবেল বিদ্রোহী। গল্পগুলোকে অবশ্যই প্রতিষ্ঠানের আদর্শ সমর্থন করার কাজে ব্যবহার করা যাবে না, বরং আমাদের উচিত গস্পেলের কাহিনীতে আমাদের সময়ের আশা, দাবি ও প্রত্যাশাকে প্রকাশ করা ও সে অনুযায়ী সেগুলোকে পরীক্ষা, বিনির্মাণ ও নতুন করে সাজানো।

অতি সাম্প্রতিক কালে হার্ভার্ডের তুলনামূলক ধর্মতত্ত্বের সাবেক প্রফেটসর উইলফ্রেড ক্যান্টওয়েল স্মিথ (১৯১৬-২০০০) বাইবেলের ঐতিহাসিক উপলব্ধির উপর জোর দিয়েছেন। ৮২ বাইবেলের প্রতিটি পঙক্তির যেখানে নানাভাবে ব্যাখ্যা হয়ে থাকতে পারে সেখানে বাইবেল ‘আসলে’ কী বুঝিয়েছে বলা মুশকিল। ধার্মিক লোকজন নির্দিষ্ট স্থান ও সময়ের সীমাবদ্ধতায় তাদের নিষ্কৃতি খুঁজে বের করেছে। ইতিহাসের বিভিন্ন পর্যায়ে বাইবেল ইহুদি ও ক্রিশ্চানদের কাছে ভিন্ন অর্থ বয়ে এনেছে। তাদের ব্যাখ্যাকারগণ নিশ্চিতভাবেই বিশেষ পরিস্থিতিতে রঞ্জিত ছিলেন। কোনও ব্যাখ্যা কেবল বাইবেলিয় লেখকগণ কী বলেছেন তার উপরই কেন্দ্রিভূত হয়ে অন্য প্রজন্মের ইহুদি ও ক্রিশ্চানগণ কীভাবে তা উপলব্ধি করেছে তাকে অগ্রাহ্য করলে বাইবেলের তাৎপর্য বিকৃত হয়ে পড়ে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *