৬. লেকশিও দিভাইনা

৬. লেকশিও দিভাইনা

জীবনের শেষ বছর, ৪৩০ সালে হিপ্পো শহরে ভ্যান্ডালদের অবরোধ প্রত্যক্ষ করেছিলেন অগাস্তিন, রোমান সাম্রাজ্যের পশ্চিম প্রদেশগুলো তখন অসহায়ভাবে আগ্রাসী বর্বর গোত্রগুলোর কাছে খোয়া যাচ্ছিল। শেষের এই বছরগুলোয় অগাস্তিনের রচনা গভীর বিষাদ ঘিরে রেখেছিল। আদম ও ইভের পতনের ব্যাখ্যায় এটা বিশেষভাবে স্পষ্ট। রোম পতনের ট্র্যাজিডি অগাস্তিনকে দৃঢ়ভাবে নিশ্চিত করেছিল যে আদি পাপ মানবজাতিকে চিরন্তন শাস্তিতে পতিত করেছে। ক্রাইস্ট কর্তৃক আমাদের নিষ্কৃতি সত্ত্বেও আমাদের মানব সত্তা যৌন আকাঙ্ক্ষা, ঈশ্বরের বদলে প্রাণীর মাঝে সুখ খোঁজার অযৌক্তিক আশায় বাধাগ্রস্ত। আদি পাপের অপরাধবোধ আদমের বংশধরদের মাঝে যৌনক্রিয়ার মাধ্যমে প্রবাহিত হয়েছে, যখন আমাদের যুক্তির ক্ষমতা তীব্র আবেগে ভেসে যায়। ঈশ্বর বিস্মৃত হন এবং নারী-পুরুষ নির্লজ্জভাবে পরস্পরের মাঝে আনন্দ লাভ করে। শিহরণের শোরগোলে হারিয়ে যাওয়া যুক্তির ইমেজ পশ্চিমের শৃঙ্খলার উৎস রোমের ভোগান্তি তুলে ধরেছে, বর্বররা যাকে ধসিয়ে দিয়েছে। জেনেসিসের তৃতীয় অধ্যায়ের ব্যাখ্যা পাশ্চাত্য ক্রিশ্চান ধর্মে অনন্য। রোমের পতন প্রত্যক্ষ করেনি বলে ইহুদি বা গ্রিক অর্থডক্সির কেউই এই করুণ দৃষ্টিভঙ্গিকে সমর্থন করেনি। সাম্রাজ্যের পতন পশ্চিম ইউরোপকে কয়েক শো বছরের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক স্থবিরতায় ঠেলে দিয়েছিল। এই দীর্ঘস্থায়ী আঘাত অধিকতর শিক্ষিত ক্রিশ্চানদের মনে বদ্ধমূল ধারণা জাগিয়েছিল যে, নারী-পুরুষ সত্যিই আদমের আদি পাপের কারণে স্থায়ীভাবে ক্ষতিগ্রস্ত। তারা আর মানুষের উদ্দেশে ঈশ্বর কী বলেছিলেন শুনতে পাচ্ছে না, ফলে তাদের পক্ষে ঐশীগ্রন্থ উপলব্ধি করা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে।

পাশ্চাত্য প্যাগান বর্বর ভূমিতে পরিণত হয়েছিল। পঞ্চম থেকে নবম শতাব্দী পর্যন্ত ক্রিশ্চান ট্র্যাডিশনসমূহ বাইবেল পাঠের মতো স্থিতিশীলতা ও নির্জনতা যোগানোর একমাত্র জায়গা বিভিন্ন মঠে সীমাবদ্ধ ছিল। মঠচারী ধারণা পশ্চিমে নিয়ে এসেছিলেন জন কাসিয়ান (৩৬০-৪৩৫)। তিনি পশ্চিমের ক্রিশ্চানদের আক্ষরিক, নৈতিক ও উপমাগত অর্থ অনুযায়ী অরিগেনের ঐশীগ্রন্থের তিন দফা ব্যাখ্যার সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন, কিন্তু তার সাথে চার নম্বর একটিও যোগ করেছিলেন তিনিঃ আনাগোগিকাল বা অতীন্দ্রিয়বাদী অর্থ, যা টেক্সটের পরলোক সংক্রান্ত তাৎপর্য প্রকাশ করে। উদাহরণ স্বরূপ, পয়গম্বরগণ জেরুজালেমের ভবিষ্যৎ মাহাত্ম্য বর্ণনা করার সময় তা নিগূঢ়ভাবে প্রত্যাদেশের স্বর্গীয় জেরুজালেমের কথা বুঝিয়েছে। কাসিয়ান তাঁর সন্ন্যাসীদের শিখিয়েছেন যে, ঐশীগ্রন্থের পাঠ জীবন মেয়াদী কাজ। মানবীয় ভাষার আড়ালে লুকোনো অনির্বচনীয় বাস্তবতাকে বিচ্ছিন্ন করার জন্যে তাদের পতিত স্বভাবকে সংশোধন করতে হবে-মনোসংযোগের শক্তিকে শক্তিশালী করে তুলতে হবে, উপবাস ও রাত্রি জাগরণের মাধ্যমে শরীরকে শৃঙ্খলিত করতে হবে এবং অন্তর্মুখীনতার স্বভাবের চর্চা করতে হবে।

লেকশিও দিভাইনা (‘পবিত্র পাঠ’) সেইন্ট বেনেডিক্ট অভ নারসিয়ার ও (এডি ৪৮০-৫৪৩) বিধির কেন্দ্রিয় বিষয় ছিল। বেনেডিক্টিয় সাধুরা দিনে অন্তত দুই ঘণ্টা ঐশীগ্রন্থ ও ফাদারদের রচনাবলী পাঠ করার পেছনে ব্যয় করতেন। অবশ্য ঐশীগ্রন্থসমূহকে তখনও একক গ্রন্থ হিসাবে দেখা হয়নি। বহু সাধু বাইবেলকে একটি একক গ্রন্থ হিসাবে কখনওই দেখেননি। একে তারা ঐশীগ্রন্থের পাণ্ডুলিপি আকারে পাঠ করেছেন। বাইবেলিয় বেশির ভাগ জ্ঞানই লিটার্জি বা ফাদারদের রচনার মাধ্যমে তাদের হস্তগত হয়েছে। খাবারের সময় জোরে বাইবেল পাঠ করা হতো। স্বর্গীয় কার্যালয়ে ফাদারগণ সারাদিনই সবিরতিতে সুর করে আবৃত্তি করতেন। বাইবেলের ছন্দ, ইমেজারি ও শিক্ষা দিনের পর দিন, বছরের পর বছর নীরব নিয়মিত ধ্যানের ভেতর দিয়ে ক্রমবর্ধমান হারে ও অনাটকীয়ভাবে বেড়ে উঠে তাদের আধ্যাত্মিকতার একটা অন্তস্থ স্তরে পরিণত হয়েছিল।

লেকশিও দিভাইনা-য় আনুষ্ঠানিক বা পদ্ধতিগত কোনও ব্যাপার ছিল না। প্রতি অধিবেশনে সাধুদের একটা নির্দিষ্ট সংখ্যক অধ্যায় শেষ করার কোনও বাধ্যবাধকতা ছিল না। লেকশিও ছিল টেক্সট পাঠ করার শান্তিপূর্ণ ও আরামপ্রদ কায়দা, সাধু তাতে মনের ভেতর বাণীকে ধারণ করার জন্যে একটা শান্তিপূর্ণ জায়গা খুঁজে পাওয়া শিখতেন। বাইবেলিয় বিভিন্ন কাহিনী ঐতিহাসিক ঘটনা হিসাবে পাঠ করার বদলে সমসাময়িক বাস্তবতা হিসাবে অনুভূত হতো। কাল্পনিকভাবে কর্মে তৎপর হওয়ার জন্যে অনুপ্রাণিত হতেন সাধুগণ– সিনাইয়ের চূড়ায় মোজেসের পাশে, জেসাস সারমন অন দ্য মাউন্ট প্রদান করার সময়ে দর্শক সারিতে, কিংবা ক্রসের পায়ের কাছে নিজেদের প্রত্যক্ষ করতেন। পালা করে তাদের চারটি অর্থেই দৃশ্যকে বিবেচনা করতে হতো: এমন এক প্রক্রিয়ায় আক্ষরিক অর্থ থেকে আধ্যাত্মিক অর্থে যা ঈশ্বরের সাথে অতীন্দ্রিয় মিলনে উর্ধ্বারোহণ প্রকাশ করে।

পশ্চিমে গঠনমূলক প্রভাব ছিল বেনেডিক্টাইন সন্ন্যাসী গ্রেগরি দ্য গ্রেটের (৫৪০-৬০৪)। পোপ নির্বাচিত হয়েছিলেন তিনি। গ্রেগরি লেকশিও দিভাইনায় মগ্ন ছিলেন, কিন্তু তাঁর বাইবেলিয় ধর্মতত্ত্ব রোমের পতনের অব্যবহিত পরে পাশ্চাত্যকে তাড়া করে ফেরা ছায়া তুলে ধরেছে। আদি পাপের মতবাদ সম্পূর্ণ আতস্থ করেছিলেন তিনি এবং মানব মনকে শোধনাতীতভাবে ক্ষতিগ্রস্ত ও জটিল হিসাবে দেখেছেন। এখন ঈশ্বর দুর্গম হয়ে পড়েছেন। তাঁর সম্পর্কে আমরা আর কিছুই জানতে পারি না। আমাদের স্বভাবজাত উপাদান অন্ধকারে লুটিয়ে পড়ার আগে ধ্যানের মাধ্যমে মুহূর্তের আনন্দ লাভ এখন বিরাট পরিশ্রম সাপেক্ষ কাজে পরিণত হয়েছে। বাইবেলে ঈশ্বর পাপে নিমজ্জিত হয়ে আমাদের তুচ্ছ মানসিকাবস্থার পর্যায়ে নেমে এসেছেন, কিন্তু মানবীয় ভাষা ঐশী চাপে খান খান হয়ে গেছে। সেকারণে জেরোমের ভালগাতের ব্যাকরণ ও শব্দভাণ্ডার ক্লাসিকাল লাতিন প্রয়োগ থেকে বিচ্যুত হয়েছে, এবং এজন্যেই প্রথম পাঠে কোনও কোনও বাইবেলিয় কাহিনীতে ধর্মীয় মূল্য খুঁজে পাওয়া কঠিন হয়ে পড়েছে। অরিগেন, জেরোমে ও অগাস্তিনের বিপরীতে আক্ষরিক অর্থ নিয়ে সময় নষ্ট করতে যাননি গ্রেগরি। শাদামাঠা অর্থে ঐশীগ্রন্থ পাঠ করার মানে অনেকটা কারও অন্তরে কী আছে না জেনেই তার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকার মতো। অক্ষরিক টেক্সট পাহাড় দিয়ে ঘেরাও সমতল ভূখণ্ডের মতো। পাহাড় ‘আমাদের বিধ্বস্ত মানবীয় ভাষার অতীতে নিয়ে যাওয়া আধ্যাত্মিক বোধের প্রতিনিধিত্ব করে।

একাদশ শতাব্দী নাগাদ ইউরোপ অন্ধকার যুগ থেকে বের হয়ে আসতে শুরু করেছিল। প্যারিসের নিকটবর্তী ক্লুনির বেনেডিক্টাইনগণ সাধারণ জনগণকে আলোকিত করে তোলার লক্ষ্যে সংস্কারের সূচনা করেছিলেন, ক্রিশ্চান ধর্ম সম্পর্কে যাদের জ্ঞান নিদারুণ অপর্যাপ্ত ছিল। অশিক্ষিত জনগণ অবশ্যই বাইবেল পড়তে জানত না, কিন্তু তাদের প্রতীকীভাবে সমাবেশকে জেসাসের জীবনকে পুনর্গঠিত করে তোলা জটিল অ্যালেগোরি হিসেবে ভাববার শিক্ষা দেওয়া হয়েছিল: লিটার্জির প্রথম অংশ থেকে ঐশীগ্রন্থ পাঠ তাঁর মঠের কথা মনে করিয়ে দেয়, রুটি ও মদের পর্বের সময় তারা তাঁর উৎসর্গের মরণ নিয়ে ধ্যান করত এবং কমিউন বিশ্বাসীদের মনে তাঁর পুনরুত্থানকে তুলে ধরত। সাধারণ মানুষ লাতিন ভাষা বুঝতে না পারায় তাতে রহস্যময়তা আরও বেড়ে উঠত, সমাবেশের অধিকাংশ বিষয়ই চাপা কণ্ঠে পুরোহিতের কণ্ঠে উচ্চারিত হতো, নীরবতা ও পবিত্র ভাষা আচারকে সম্পূর্ণ ভিন্ন স্থানে নিয়ে যেত, সভাকে গস্পেলের সাথে শক্তিতে পরিপূর্ণ ঘটনা মিস্তেরিয়ামের সাথে পরিচিত করে দিত। কাল্পনিকভাবে গস্পেলের কহিনীসমূহে প্রবেশে সক্ষম করে তুলে সভা সাধারণের লেকশিও দিভাইনায় পরিণত হয়েছিল।৺ ক্লুনিয়রা সাধারণ জনগণকে জেসাস ও তাঁর সাধুদের সাথে সম্পর্কিত বিভিন্ন জায়গায় তীর্থযাত্রা করতে উৎসহিত করেছেন। খুব বেশি লোক অবশ্য পবিত্রভূমির দূর যাত্রায় যেতে পারেনি, তবে বলা হয়ে থাকে যে, অ্যাপসলদের কেউ কেউ ইউরোপ গিয়েছিলেন এবং সেখানেই কবরস্থ হয়েছেন: পিটার রোমে, গ্লাস্টনবারিতে জোসেফ অভ আরিমথিয়া আর স্পেনের কোম্পোস্তেলায় জেমস। যাত্রার সময় তীর্থযাত্রী ক্রিশ্চান মূল্যবোধ শিখেছে, কিছু সময়ের জন্যে সন্ন্যাসীর মতো জীবন যাপন করে সেক্যুলার জীবনধারাকে পেছনে ফেলে অন্য তীর্থযাত্রীদের সাথে একক সমাজে বাস করত এবং মারপিট বা অস্ত্র বহনে তাদের উপর নিষেধাজ্ঞা বজায় থাকত।

কিন্তু ইংল্যান্ড তখনও বিপজ্জনক, বিরান এলাকা ছিল। মানুষ খুব সহজে চাষাবাদ করতে পারত না, সব সময় দুর্ভিক্ষ ও রোগের প্রকোপ লেগে থাকত, যুদ্ধ ছিল নৈমিত্তিক, অভিজাত গোষ্ঠী অন্তহীনভাবে পরস্পরের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লেগে ছিল, প্রত্যন্ত অঞ্চল ছারখার করে অন্যান্য গ্রাম ধ্বংস করে ফেলছিল। ক্লুনিয়রা সাময়িক সন্ধি আরোপের প্রয়াস পেয়েছিলেন। কেউ কেউ ব্যারন ও রাজাদের সংস্কারেরও প্রয়াস পান। কিন্তু নাইটরা ছিল সৈনিক, তারা আগ্রাসী ধর্ম চাইছিল। অন্ধকার যুগ থেকে বের হয়ে আসার সময় নতুন ইউরোপের প্রথম সাম্প্রদায়িক সহযোগিতার কাজটি ছিল প্রথম ক্রুসেড (১০৯৫-৯৯)। ক্রুসেডারদের কেউ কেউ রাইন উপত্যকার ইহুদি সম্প্রদায়ের উপর আক্রমণ হেনে পবিত্র ভূমির উদ্দেশে যাত্রা শুরু করেছিল; তারই পরিণতিতে ক্রুসেডাররা জেরুজালেমে অন্তত তিরিশ হাজার ইহুদি ও মুসলিমকে হত্যা করেছিল। ক্রুসেডিয় রীতি গস্পেলে দেওয়া জেসাসের সতর্কবাণীর আক্ষরিক ব্যাখ্যা ভিত্তিক ছিল: ‘যে কেহ নিজের ক্রুশ বহন না করে ও আমার পশ্চাৎ পশ্চাৎ না আইসে, সে আমার শিষ্য হইতে পারে না।’ ক্রুসেডাররা পোশাকে ক্রস এটে জেসাসের পদচিহ্ন অনুসরণ করে তিনি যেখানে জীবন যাপন করেছেন, মারা গেছেন সেই ভূমিতে গেছে। করুণ পরিহাসের সাথে ক্রুসেডিংকে ভালোবাসার ক্রিয়া হিসাবে প্রচার করা হয়েছে। ক্রাইস্ট ছিলেন ক্রুসেডারদের সামন্ত প্রভু। অনুগত প্রজা হিসাবে তারা তাঁর জন্মগত অধিকার উদ্ধার করতে বাধ্য ছিল। ক্রুসেডে ক্রিশ্চান ধর্ম বিশ্বাস ইউরোপের সামন্ত সহিংসতাকে ব্যাপ্টাইজ করেছিল।

নিকট প্রাচ্যে কিছু সংখ্যক ক্রিশ্চান যখন মুসলিমদের বিরুদ্ধে লড়াই করছিল অন্যরা তখন স্পেনের পণ্ডিতদের সাথে গবেষণায় যোগ দিয়েছিল, অন্ধকার যুগে হারিয়ে ফেলা সংস্কৃতির সিংহভাগ পুনরুদ্ধারে তাদের সাহায্য করেছিলেন যারা। মুসলিম রাজ্য আন্দালুসে পাশ্চাত্য পণ্ডিতগণ ইসলামি বিশ্বে সংরক্ষিত ও উন্নত করে তোলা ওষুধ, গণিত ও ধ্রুপদী গ্রিসের বিজ্ঞানের আবিষ্কার করেছেন প্রথমবারের মতো আরবি ভাষায় অ্যারিস্টটল পাঠ করে এবং তাঁর কাজ লাতিনে অনুবাদ করে। এক বুদ্ধিবৃত্তিক রেনেইসাঁয় পা রাখে ইউরোপ। অ্যারিস্টটলের যৌক্তিক দর্শন-ফাদার অভ দ্য চার্চের কাছ থেকে তাদের গৃহীত প্লেটোবাদের চেয়ে ঢের বেশি বাস্তববাদী ছিল-বহু পাশ্চাত্য পণ্ডিতকে উত্তেজনায় ভরে দিয়ে তাদের নিজস্ব যুক্তি প্রয়োগের শক্তিকে কাজে লাগাতে অনুপ্রাণিত করেছে।

এটা অনিবার্যভাবে বাইবেল পাঠের ধরনকে প্রভাবিত করেছে। ইউরোপ আরও সংগঠিত হওয়ার সাথে সাথে যৌক্তিক আদর্শ শেকড় গড়ে বসলে পণ্ডিত ও সাধুগণ উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া বিশৃঙ্খল ট্র্যাডিশনে কোনও ধরনের পদ্ধতি আরোপের প্রয়াস পান। ভালগাতের টেক্সট বহু প্রজন্মের সাধু-অনুলিপিকারদের হাতে বেড়ে ওঠা ভ্রান্তিতে আকীর্ণ হয়ে উঠেছিল।” অনুলিপিকাররা সাধারণত জেরোমে বা অন্য কোনও ফাদারের ধারাভাষ্য দিয়ে ভুমিকা দিতেন। একাদশ শতাব্দী নাগাদ সবচেয়ে জনপ্রিয় পুস্তকগুলোয় বেশ কয়েকটি ভূমিকা যোগ হয়েছিল যেগুলো আবার পরস্পর বিরোধী ছিল। তো ফরাসি পণ্ডিতদের একটা দল সমবেতভাবে গ্লোসা অর্ডিনারিয়া নামে একটা প্রমিত ধারাভাষ্য সংকলিত করেন। এই কাজের সূচনাকারী আনসেল্ম অভ লোন (মৃ. ১১১৭) শিক্ষকদের বাইবেলের প্রতিটি পঙক্তির একটি স্পষ্ট ব্যাখ্যা যোগাতে চেয়েছিলেন। পাঠক কোনও সমস্যার মুখে পড়লে পাণ্ডুলিপির মার্জিন বা মাঝখানে লেখা টীকা দেখে নিতে পারবেন, যা তাকে জেরোমে, অগাস্তিন বা গ্রেগরির ব্যাখ্যা যোগাবে। গ্লোসা ছিল আক্ষরিক অনুবাদের চেয়ে সামান্য বেশি কিছু। টীকাসমূহ আবিশ্যিকভাবেই সংক্ষিপ্ত ও মৌলিক হতো, সূক্ষ্ম বিষয়ের বিস্তারিত ব্যাখ্যার কোনও অবকাশ ছিল না। তবে পণ্ডিতকে তা প্রাথমিক জ্ঞান যোগাত যার উপর ভিত্তি করে তাঁরা অগ্রসর হতে পারতেন। আনসেল্ম সবচেয়ে জনপ্রিয় পুস্তকসমূহের উপর ধারাভাষ্য সম্পূর্ণ করেছিলেন: সাল্মস, পলের চিঠি এবং জনের গস্পেল। তিনি সেন্তেনতিয়াও– ফাদারদের ‘মতামত’-এর সংকলন- সংগ্রহ করেছিলেন, প্রসঙ্গ অনুযায়ী তা বিন্যাস করা হয়েছিল। আনসেল্মের ভাই রাল্ফ ম্যাথ্যুর গস্পেল নিয়ে কাজ করেছেন, এবং তাঁর ছাত্র গিলবার্ট অভ পয়তিয়ার্স ও পিটার লোম্বার্ড শেষ করেছিলেন প্রফেটস।

শ্রেণীকক্ষে শিক্ষক ছাত্রদের উদ্দেশে ব্যাখ্যাত টেক্সট পাঠ করার সময় প্রশ্ন করার সুযোগ পেত তারা এবং আরও আলোচনায় মিলিত হতো: পরে, জিজ্ঞাসার সংখ্যা পূঞ্জীভূত হলে কুয়েশ্চেয়নেসের জন্যে একটা ভিন্ন অধিবেশন অনুষ্ঠিত হতো। ছাত্ররা অ্যারিস্টটলিয় যুক্তি ও ডায়ালেক্ট নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু করলে আলোচনা আরও তীব্র হয়ে ওঠে। অন্যরা ব্যাকরণের নতুন বিজ্ঞান বাইবেলিয় টেক্সটে প্রয়োগ করে: ভালগাতের লাতিন কেন ধ্রুপদী লাতিনের মৌল বিধি লঙ্ঘন করেছে। ধীরে ধীরে মঠ ও ধ্রুপদী মতামতের ভেতর একটা বিভেদ সৃষ্টি হয়। মঠের শিক্ষকগণ লেকশিও দিভাইনা-য় মনোযোগ দেন; তাঁরা চেয়েছিলেন নবীশরা যেন ধ্যানমূলকভাবে বাইবেল পাঠ করে আধ্যাত্মিকতাকে উন্নত করে তোলে। কিন্তু ক্যাথেড্রাল স্কুলে শিক্ষকগণ নতুন শিক্ষা ও বস্তুনিষ্ঠ বাইবেলিয় সমালোচনার প্রতি বেশি আগ্রহী ছিলেন।

উত্তর ফ্রান্সের র‍্যাবাইদের হাতে সূচিত বাইবেলের আক্ষরিক অর্থের প্রতিও ব্যাপক আগ্রহের সৃষ্টি হয়েছিল। রাশি নামে পরিচিত র‍্যাবাই শ্লোমো ইত্যহাক (১০৪০-১১০৫)-এর অ্যারিস্টটলে কোনও আগ্রহ ছিল না। তাঁর প্রিয় বিষয় ছিল দর্শন; সবার উপরে ঐশীগ্রন্থের সহজ অর্থের ব্যাপারে ছিল তাঁর সব উদ্বেগ।১০ তিনি হিব্রু বাইবেলের টেক্সটের উপর একটি চলতি ধারা বিবরণী লিখেছিলেন, প্রতিটি শব্দের উপর এমনভাবে মনোযোগ দিয়েছেন যাতে টেক্সটের উপর নতুন আলোকপাত হয়। উদাহরণ স্বরূপ তিনি উল্লেখ করেন, জেনেসিসের প্রথম অধ্যায়ের প্রথম শব্দ বেরেশিত ‘সূচনায়… বোঝাতে পারে; সুতরাং বাক্যটি এভাবে পড়া উচিত হবে: ‘ঈশ্বরের স্বর্গ ও পৃথিবী সৃষ্টির সূচনায় পৃথিবী ছিল আকারহীন শূন্যতা (তোহু বহু)।’ এর মানে দাঁড়ায়, ঈশ্বর তাঁর সৃজনশীল কাজ শুরু করার সময়ই এর কাঁচামালসমূহের অস্তিত্ব ছিল, তিনি কেবল তোহু বহু-র মাঝে শৃঙ্খলা এনেছেন। রাশি আরও উল্লেখ করেন, এক মিদ্রাশিয় ব্যাখ্যায় বেরেশিত-কে ‘শুরুর কারণ’ হিসাবে বোঝা হয়েছে এবং বাইবেল ইসরায়েল ও তোরাহ উভয়কেই ‘সূচনা’ আখ্যায়িত করেছে। এর মানে কি ঈশ্বর ইসরায়েলকে তোরাহ দান করার জন্যেই বিশ্ব সৃষ্টি করেছিলেন? রাশির পদ্ধতি পাঠককে নিজস্ব মিদ্রাশ আরোপ করার আগেই নিবিড়ভাবে টেক্সট পাঠে বাধ্য করে: তাঁর ধারাভাষ্য পেন্টটিউকের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও প্রভাবশালী গাইডে পরিণত হবে।

রাশি তাঁর আক্ষরিক ব্যাখ্যাকে ট্র্যাডিশনাল মিদ্রাশের সম্পূরক হিসাবে দেখেছেন, কিন্তু তাঁর উত্তরসুরিরা অনেক বেশি রেডিক্যাল ছিলেন। জোসেফ কারা (মৃ. ১১৩০) যুক্তি দেখিয়েছেন যে, সহজ অর্থে মনোনিবেশ করেনি এমন কেউ খড়কুটো আঁকড়ে ধরা ডুবন্ত মানুষের মতো। রাশি’র পৌত্র আর. শেমুয়েল মেয়ার রাশবাম নামে পরিচিত ছিলেন (মৃ. ১১৭৪), মিদ্রাশের প্রতি অনেক বেশি নমনীয় ছিলেন তিনি, কিন্তু তারপরেও অধিকতর যৌক্তিক ব্যাখ্যা পছন্দ করতেন। আক্ষরিক অর্থ ব্যাখ্যা করার পদ্ধতি তাঁর নিজস্ব বলয়ে প্রবল গতিতে অগ্রসর হচ্ছিল; তিনি বলেছিলেন, ‘রোজই নতুন নতুন নজীর হাজির হচ্ছে।১১ রাশবামের ছাত্র জোসেফ বেখোর শোর সবচেয়ে বিস্ময়কর বাইবেলিয় গল্পেরও একটা স্বাভাবিক ব্যাখ্যা খোঁজার প্রয়াস পেতেন সব সময় উদাহরণ স্বরূপ, লোতের স্ত্রীর মৃত্যুতে কোনও রহস্য ছিল না, তিনি স্রেফ সোদোম ও গোমরাহকে ধ্বংস করে দেওয়া আগ্নেয়গিরির লাভার নিচে চাপা পড়ে গিয়েছিলেন। জোসেফ ভবিষ্যতের মহান স্বপ্ন দেখেছেন তার কারণ স্রেফ তিনি ছিলেন উচ্চাভিলাষী তরুণ, ফারাও’র স্বপ্ন ব্যাখ্যা করার সময় তাঁর ঈশ্বরের সাহায্যের কোনওই প্রয়োজন ছিল না; সামান্য বুদ্ধিশুদ্ধি আছে এমন যে কারও পক্ষেই তা সম্ভব ছিল।

ক্রুসেড সত্ত্বেও ফ্রান্সে ইহুদি ও ক্রিশ্চানদের ভেতর সম্পর্ক তখনও তুলনামূলকভাবে ভালো ছিল। আক্ষরিক অর্থের বিষয়ে ক্রমশ উৎসাহী হয়ে ওঠা সীন নদীর বাম তীরবর্তী অ্যাবি অভ সেইন্ট ভিক্টরের পণ্ডিতগণ স্থানীয় র‍্যাবাইদের সাথে পরামর্শ করে হিব্রু শিখছিলেন। ভিক্টোরিয়ানরা প্রচলিত লেকশিও দিভাইনাকে ক্যাথেড্রাল মতবাদের অধিকতর শিক্ষামূলক গবেষণার সাথে সমন্বয়ের প্রয়াস পেয়েছিলেন। সেইন্ট ভিক্টরের হিউ, যেখানে তিনি ১১৪১ সালে পরলোকগমনের আগ পর্যন্ত পড়িয়েছেন, প্রখর ধ্যানী ছিলেন, কিন্তু সেটা তাঁর যৌক্তিক শক্তির সাথে বিরোধে জড়াতে পারেনি। অ্যারিস্টটলিয় ব্যাকরণ, যুক্তি, দ্বান্দ্বিক ও প্রকৃতিক বিজ্ঞান ছাত্রদের বাইবেল উপলব্ধিতে সাহায্য করতে পারে। হিউ বিশ্বাস করতেন, ইতিহাসের পাঠ তাঁর ভাষায় ‘ব্যাখ্যার আধার’-এর ভিত্তি। মোজেস ও ইভাঞ্জেলিস্টগণ সবাই ইতিহাসবিদ ছিলেন। ছাত্রদের উচিত হবে ইতিহাসের বইয়ের সাথে বাইবেল পাঠ শুরু করা। বাইবেলের সঠিক আক্ষরিক অর্থ ছাড়া অ্যালেগোরি ব্যর্থতায় পর্যবসিত হতে বাধ্য। হাঁটার আগেই ছাত্রদের ছোটা শুরু করা ঠিক হবে না। তাদের অবশ্যই ভালগাতের বাক্যবিন্যাস ও শব্দচয়ন পরীক্ষার মাধ্যমে শুরু করতে হবে যাতে বাইবেলিয় লেখকগণ কী বোঝাতে চেয়েছিলেন সেটা আবিষ্কার করা যায়। ‘আমাদের নিজস্ব অর্থ (সেন্তেনিশিয়া) পড়ব না অবশ্যই, বরং ঐশীগ্রন্থের অর্থকে আপন করে নেব।’১৩

হিউর মেধাবী শিষ্য অ্যান্ড্রু অভ সেইন্ট ভিক্টরি (১১১০-৭৫) ছিলেন প্রথম ক্রিশ্চান পণ্ডিত যিনি হিব্রু বাইবেলের সম্পূর্ণ আক্ষরিক ব্যাখ্যা করার প্রয়াস পেয়েছিলেন।১৪ অ্যালেগোরির বিরুদ্ধে তাঁর কোনও বক্তব্য ছিল না, কিন্তু এতে তাঁর আগ্রহও ছিল না। র‍্যাবাইদের কাছে থেকে অনেক কিছু শিক্ষা পেয়েছিলেন তিনি, ‘হিব্রু ভাষায় ঐশীগ্রন্থ ঢের বেশি স্পষ্টভাবে পাঠ করা যায়,’ বলে আবিষ্কার করেছিলেন।১৫ আক্ষরিক অর্থের প্রতি একাডেমিক অঙ্গীকার কখনওই ব্যর্থ হয়নি, এমনকি ওল্ড টেস্টামেন্টের ক্রিশ্চান উপলব্ধির জন্যে আবশ্যক বিভিন্ন ব্যাখ্যা ছেটে ফেলার পরেও। হিব্রু টেক্সট প্রচলিত ক্রিশ্চান ব্যাখ্যাকে–যা পঙক্তিসমূহকে জেসাসের ভার্জিন বার্থের ভবিষ্যদ্বাণী মনে করে-সমর্থন করে না জানার পর অ্যান্ড্রু রাশির ইসায়াহর অরাকলের ব্যাখ্যা গ্রহণ করেন: ‘দেখ, এক তরুণী (আলমাহ) অন্তসত্তা হয়ে এক শিশুকে গর্ভে ধারণ করবে।’ (রাশি ভেবেছিলনে, ইসায়াহ তাঁর নিজের স্ত্রীর কথা বুঝিয়েছেন)। দাস সঙ্গীতের ব্যাখ্যায় অ্যান্ড্রু এমনকি ক্রাইস্টের কথা উল্লেখ পর্যন্ত করতে যাননি, বরং দাস দিয়ে ইহুদি সম্প্রদায়কে বোঝানো হয়েছে, এমন ইহুদি দৃষ্টিভঙ্গি মেনে নিয়েছিলেন। ইযেকিয়েলের দিব্যদৃষ্টির ‘মনুষ্য পুত্রের মতো’ অবয়বকে জেসাসের আবির্ভাবের পূর্বাভাস হিসাবে দেখার বদলে অ্যান্ড্রু স্রেফ জানতে চেয়েছেন ইযেকিয়েল ও তাঁর নির্বাসিতদের কাছে এই ইমেজারির কী মানে ছিল। তিনি সিদ্ধান্তে পৌঁছান, যেহেতু ‘মনুষ্য পুত্র’ এক অদ্ভুত ভীতিকর থিওফ্যানির একমাত্র মানবীয় উপাদান, সেকারণে নির্বাসিতরা এই ভেবে আশ্বস্ত হয়েছিল যে ঈশ্বর তাদের নিজস্ব সঙ্কটে আগ্রহী অ্যান্ড্রু ও তাঁর ইহুদি বন্ধুরা বাইবেলের আধুনিক ঐতিহাসিক সমালোচনার পথে প্রথম পদক্ষেপ নিয়েছিলেন, কিন্তু বিষণ্ন, ক্যারিশমাবিহীন মানুষ অ্যান্ড্রুর তাঁর আমলেই অনুসারীর সংখ্যা ছিল মুষ্টিমেয়। দ্বাদশ শতাব্দীতে সময়ের মানুষ ছিলেন দার্শনিকগণ, এক নতুন ধরনের যুক্তিবাদী ধর্মতত্ত্ব গড়ে তুলতে যাচ্ছিলেন যেখানে তাঁরা বিশ্বাসকে ধরে রাখতে ও এপর্যন্ত অনির্বচনীয় ভেবে আসা বিষয়সমূহকে স্পষ্ট করার জন্যে যুক্তি প্রয়োগ করেছেন। আনসেল্ম অভ বেক (১০৩৩-১১০৯), যিনি ১০৮৯ সালে আর্চ বিশপ অভ ক্যান্টারবারি হবেন, ভেবেছিলেন সবকিছুই প্রমাণ করা সম্ভব।১৬ সাধু হিসাবে লেকশিও দিভাইনা তাঁর আধ্যাত্মিক জীবনের পক্ষে আবশ্যক ছিল, কিন্তু ঐশীগ্রন্থের উপর কোনও ধারাভাষ্য লিখেননি তিনি, খুব কমই তাঁর ধর্মতাত্ত্বিক রচনায় বাইবেল থেকে উদ্ধৃতি দিয়েছেন। কিন্তু কবিতা বা শিল্পকলার মতো ধর্মেও সম্পূর্ণ যৌক্তিক দৃষ্টিভঙ্গির চেয়ে বরং এক ধরনের স্বজ্ঞামূলক দৃষ্টিভঙ্গির প্রয়োজন হয়, আনসেল্মের ধর্মতত্ত্ব এর সীমাবদ্ধতা তুলে ধরেছে। উদাহরণ স্বরূপ, কার দিউস হোমো শীর্ষক নিবন্ধে তিনি সকল ঐশীগ্রন্থের সাথে সম্পর্কহীন অবতারের যৌক্তিক বর্ণনা দেওয়ার প্রয়াস পেয়েছেন: যেকোনও বাইবেলিয় উদ্ধৃতিই স্রেফ যুক্তিকে টেনে নিয়ে যাবে। গ্রিক অর্থডক্সরাও এমন এক ধর্মতত্ত্ব তৈরি করেছিলেন যা ঐশীগ্রন্থ হতে স্বাধীন ছিল, কিন্তু আনসেল্মের অবতারের যৌক্তিক ব্যাখ্যায় ম্যাক্সিমাসের আধ্যাত্মিক অন্তর্দৃষ্টির ঘাটতি রয়েছে। তিনি যুক্তি দেখিয়েছেন, আদমের পাপের প্রায়শ্চিত্তের প্রয়োজন ছিল, কারণ ঈশ্বর ন্যায়বিচারক, একজন মানব সন্তানকে অবশ্যই প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে; কিন্তু পাপ এতটাই কঠিন ছিল যে কেবল ঈশ্বরের পক্ষেই তার প্রায়শ্চিত্ত করা সম্ভব ছিল। সুতরাং ঈশ্বরকে মানুষ হতে হয়েছে।১৭ আনসেল্ম ঈশ্বরকে দিয়ে ব্যাপারটা এমনভাবে বিবেচনা করিয়েছেন যেন তিনি সামান্য মানুষ। এখানে বিস্ময়ের কিছু নেই যে, এই সময়ে গ্রিক অর্থডক্স লাতিন ধর্মতত্ত্ব বড় বেশি মানবরূপী ভেবে ভীত হয়ে উঠেছিল। আনসেল্মের প্রায়শ্চিত্তের তত্ত্ব অবশ্য পশ্চিমে নিয়মাত্মকে পরিণত হয়, আর গ্রিক অর্থডক্স ম্যাক্সিমাসের ব্যাখ্যাকেই ধরে রাখে।

ফরাসি দার্শনিক পিটার আবেলার্দ (১০৭৯-১১৪২) নিষ্কৃতির এক ভিন্ন ভাষ্য গড়ে তোলেন, ঐশীগ্রন্থের কাছে যার ঋণ সামান্যই, বরং ফাদারদের চেতনারই কাছাকাছি ছিল তা।১৮ কোনও কোনও র‍্যাবাইর মতো তিনি বিশ্বাস করতেন, ঈশ্বর তাঁর সৃষ্টির সাথে কষ্ট সয়েছেন এবং যুক্তি দেখিয়েছেন যে, ক্রুসিফিকশন মুহূর্তের জন্যে আমাদের ঈশ্বরের চিরন্তন বেদনা দেখিয়েছে। আমরা যখন জেসাসের স্খলিত দেহের কথা কল্পনা করি, করুণায় আমাদের মন আলোড়িত হয়, সহানুভূতির এই ভঙ্গিই আমাদের রক্ষা করে-জেসাসের উৎসর্গের মরণ নয়। আবেলার্দ তাঁর প্রজন্মের বুদ্ধিবৃত্তিক তারকা ছিলেন, ছাত্ররা সারা ইউরোপ থেকে তাঁর বক্তব্য শোনার জন্যে ভীড় করত। আনসেল্মের মতো তিনিও বিরল ক্ষেত্রে ঐশীগ্রন্থ থেকে উদ্ধৃতি দিয়েছেন, সমাধান না দিয়েই প্ৰশ্ন তুলতেন। আসলে দর্শনেই বেশি আগ্রহী ছিলেন আবেলার্দ, তাঁর ধর্মতত্ত্ব বলা চলে গঠনমূলক ছিল। কিন্তু তাঁর প্রতিমাবিরোধিতা ও আগ্রাসী মনোভাবের কারণে মনে হয়েছে যেন তিনি উদ্ধতভাবে তাঁর মানবীয় যুক্তিকে ঈশ্বরের রহস্যের বিপরীতে স্থাপন করছেন এবং তা তাঁকে সেই সময়ের অন্যতম শক্তিশালী চার্চ অধিকর্তার সাথে মুখোমুখি সংঘাতের মুখে নিয়ে এসেছিল।

বারগান্ডির সিস্টারসিয়ান মনেস্টারি অভ ক্লেয়ারভঅর অ্যাবট বার্নার্ড (১০৯০-১১৫৩) পোপ দ্বিতীয় ইউজিন ও ফ্রান্সের রাজা চতুর্থ লুইসের উপর প্রাধান্য বিস্তার করেছিলেন; অ্যবেলার্দের মতোই নিজের কায়দায় ক্যারিশম্যাটিক ব্যক্তিত্ব ছিলেন তিনি। অসংখ্য তরুণ তাঁর বেনেডিক্টাইন মঠবাদের সংস্কৃত রূপ নতুন ক্রিশ্চান বিশ্বাসে তাঁকে অনুসরণ করেছে। তিনি আবেলার্দের বিরুদ্ধে ‘ক্রিশ্চান ধর্মবিশ্বাসকে অর্থহীন করে তোলার অভিযোগ তোলেন। কারণ তিনি ধরে নিয়েছেন যে, মানবীয় যুক্তি ঈশ্বরকে অনুভব করতে পারবে’।১৯ পলের চ্যারিটির হাইম উদ্ধৃত করে তিনি দাবি করেছেন যে, আবেলার্দ ‘কোনও কিছুকেই হেঁয়ালি মনে করেন না, কোনও কিছুকেই আয়নার প্রতিবিম্ব হিসাবে দেখেন না, বরং সব কিছুকে সামনাসামনি দেখেন। ১১৪১ সালে আবেলার্দকে কাউন্সিল অভ সেন্সে তলব করেন বার্নার্ড, ততদিনে তিনি পারকিনসন’স রোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন, সেখানে তাঁকে এত প্রবলভাবে আক্রমণ করেছিলেন যে আবেলার্দ ভেঙে পড়েন এবং পরের বছর মারা যান।

বার্নার্ডকে একজন দয়াময় মানুষ হিসাবে বর্ণনা করা না গেলেও তাঁর ব্যাখ্যাসমূহ ও আধ্যাত্মিকতা ঈশ্বরের প্রতি ভালোবাসার উপর ভিত্তি করে প্রণীত। তাঁর সবচেয়ে বিখ্যাত কাজ ছিল সং অভ সংস-এর উপর ব্যাখ্যা, ১১৩৫ সাল থেকে ১১৫৩ সাল পর্যন্ত সময় কালে ক্লেয়ারভঅর সাধুদের উদ্দেশে অষ্টাশিটি সারমন প্রদান করা হয়েছিল যা লেকশিও দিভাইনার চূড়ান্ত সমাপ্তি নির্দেশ করে।২১ ‘আকাঙ্ক্ষাই আমাকে চালিত করে,’ বলেছেন তিনি, ‘যুক্তি নয়।’২২ লোগোসের অবতার রূপে ঈশ্বর আমাদের পর্যায়ে নেমে এসেছিলেন যাতে আমরা স্বর্গে আরোহণ করতে পারি। সং-এ ঈশ্বর আমাদের দেখাচ্ছেন যে তিনটি স্তরে আমরা এই আরোহণ করে থাকি। কনে যখন চিৎকার করে বলে ওঠে: ‘রাজা আমাকে তাঁর ঘরে নিয়ে এসেছেন,’ তখন তা উপমিতভাবে ঐশীগ্রন্থসমূহের প্রতি নির্দেশ করে। তিনটি ‘ঘর’ রয়েছে, উদ্যান, গুদাম ঘর ও শোবার ঘর। ‘ধরা যাক উদ্যান…ঐশীগ্রন্থের সহজ অলঙ্কারবিহীন অর্থ তুলে ধরছে,’ প্রস্তাব রেখেছেন বার্নার্ড, ‘গুদাম ঘর হচ্ছে নৈতিক বোধ আর শোবার ঘর হলো স্বর্গীয় ধ্যানের রহস্য। ২৩ আমরা সৃষ্টি নিষ্কৃতির সাধারণ কাহিনী হিসাবে বাইবেল পাঠ শুরু করি, কিন্তু আমাদের অবশ্যই এর পর গুদাম ঘর অর্থাৎ নৈতিক অর্থের দিকে অগ্রসর হতে হবে যা আমাদের আচরণ পরিমার্জিত করার শিক্ষা দেয়। ‘গুদাম ঘরে’ আত্মা দয়ার চর্চার মাধ্যমে পরিশুদ্ধ হয়। তখন সে অন্যদের কাছে ‘প্রীতিকর ও স্থির’ হয়ে ওঠে; ‘ভালোবাসার ক্রিয়ার জন্যে এক উদগ্র উৎসাহ’ তাকে নিজের প্রতি নিরাসক্ত ও স্বার্থপরতার প্রতি নিস্পৃহ হওয়ার পথে চালিত করে।২৪ কনে যখন শোবার ঘরে ‘রাতে’ তার বরকে দেখে, তখন সে আমাদের সৌজন্যের গুরুত্বই তুলে ধরে। লোক দেখানো ধার্মিকতা এড়িয়ে নিজের অন্দর মহলে প্রার্থনা করাই শ্রেয় কারণ, ‘অন্যদের উপস্থিতিতে প্রার্থনা করলে, তাদের স্বীকৃতি আমাদের প্রার্থনার ফল কেড়ে নিতে পারে।২৫ নিয়মিত লেকশিও দিভাইনা ও দয়ার চর্চার মাধ্যমে আকস্মিক আলোকনের কোনও ব্যাপার ঘটবে না, সাধু ধীর অলক্ষণীয় ও ক্রমবর্ধমান অগ্রগতি অর্জন করবেন।

শেষ পর্যন্ত আত্মা হয়তো বরের ‘শোবার ঘরে’ ঢোকার অনুমতি লাভ করবে ও ঈশ্বরের দর্শন পাবে, যদিও বার্নার্ড স্বীকার করেছিলেন যে এই চূড়ান্ত পর্যায়ের ক্ষণিকের আভাস পেয়েছিলেন তিনি। সং যৌক্তিকভাবে উপলব্ধি করা সম্ভব ছিল না। এর অর্থ একটা ‘রহস্য’ যা টেক্সটে ‘লুকানো’ ছিল–এক অভাবনীয় দুৰ্জ্জেয় যা সব সময়ই আমাদের ধারণাগত শক্তিকে ছাড়িয়ে যাবে। ২৭ যুক্তিবাদীদের বিপরীতে বার্নার্ড অব্যাহতভাবে ঐশীগ্রন্থ থেকে উদ্ধৃতি দিয়েছেন সং-এর উপর তাঁর ধারাভাষ্যে জেনেসিস থেকে রেভেলেশন পর্যন্ত বিভিন্ন জায়গা থেকে ৫,৫২৬ টি উদ্ধৃতি রয়েছে। বাইবেলকে তিনি বস্তুনিষ্ঠ একাডেমিক চ্যালেঞ্জের বদলে ব্যক্তিগত আধ্যাত্মিক অনুশীলন হিসাবে দেখেছেন। ‘আজ আমরা টেক্সট পাঠ করতে যাচ্ছি তা আমাদের অভিজ্ঞতার গ্রন্থ,’ সাধুদের বলেছিলেন তিনি, ‘সুতরাং তোমাদের অবশ্যই অন্তরের দিকে পছন্দকে ফেরাতে হবে, প্রত্যেককেই অবশ্যই বস্তু সম্পর্কে তার ব্যক্তিগত বিশেষ সচেতনতার বিষয়টি লক্ষ করতে হবে।’২৯

উনবিংশ শতাব্দীতে স্পেনিয়ার্ড দোমিনিক কাসম্যান (১১৭০-১২২১) প্রতিষ্ঠিত নতুন অর্ডার অভ প্রিচারস বিভিন্ন মতবাদের যুক্তিবাদের সাথে পুরোনো লেকশিও দিভাইনার সমন্বয় সাধনে সক্ষম হয়। দোমিনিকানরা একাধারে দার্শনিক ও সেইন্ট ভিক্টরের পণ্ডিতদের বুদ্ধিবৃত্তিক উত্তরাধিকারী ছিলেন। তাঁরা আধ্যাত্মিক ব্যাখ্যা নাকচ করে দেননি, তবে আক্ষরিক অর্থের দিকে বেশি নজর দিয়েছেন। তাঁরা ছিলেন পদ্ধতিগত শিক্ষাবিদ, তাদের লক্ষ্য ছিল অ্যারিস্টটলিয় দর্শনকে ক্রিশ্চান ধর্মের সাথে অভিযোজিত করা। ফাদারগণ অ্যালেগোরিকে ঐশীগ্রন্থের ‘আত্মা’ বা ‘প্রাণে’র সাথে তুলনা করেছেন, কিন্তু অ্যারিস্টটলের কাছে আত্মা দেহ থেকে অবিচ্ছেদ্য ছিল, এটা আমাদের শারীরিক বৃদ্ধিকে সংজ্ঞায়িত ও আকার দেয় এবং ইন্দ্রিয়জ প্রমাণের উপর নির্ভর করে। তো দোমিনিকানদের পক্ষে ঐশীগ্রন্থের ‘আত্মা’ টেক্সটের নিচে লুকানো ছিল না, বরং আক্ষরিক ও ঐতিহাসিক অর্থেই তার সন্ধান মিলত।

সুম্মা থিওলজিয়ায় তমাস আকিনাস (১২২৫-৭৪) নতুন দর্শনের সাথে প্রাচীনতর আধ্যাত্মিক পদ্ধতির সমন্বয় সাধন করেন। অ্যারিস্টটলের মতে ঈশ্বর ছিলেন ‘ফার্স্ট মুভার’ যিনি বিশ্বজগতকে গতিশীল করেছিলেন। ঈশ্বর বাইবেলেরও ‘প্রথম লেখক’ ছিলেন বলে এই ধারণাকে প্রসারিত করেন তমাস। স্বর্গীয় বাণীকে যেসব মানবীয় লেখক পার্থিব বাস্তবতায় পরিণত করেছেন, তারা ঈশ্বরেরই যন্ত্র ছিলেন। তিনি তাদেরও চালিত করেছিলেন, কিন্তু টেক্সটের ধরণ ও আক্ষরিক আকারের জন্যে তাঁরা সম্পূর্ণ দায়ী। সরল অর্থকে অবজ্ঞা করার বদলে ব্যাখ্যাকারগণ পদ্ধতিগত ও বৈজ্ঞানিক উপায়ে এইসব লেখকের রচনাকে পাঠ করে স্বর্গীয় বার্তা সম্পর্কে অনেক কিছু আবিষ্কার করতে পারেন। দ্বাদশ শতাব্দীর যুক্তিবাদীদের মতো, স্কলাস্টিকসরা, এই নামেই ডাকা হতো এই মতবাদের ধারকদের, ব্যাখ্যা থেকে ধর্মতত্ত্বীয় আঁচ-অনুমানকে বিচ্ছিন্ন করার ক্ষেত্রে যুক্তির ক্ষমতার প্রতি যথার্থ আত্মবিশ্বাসী ছিলেন। কিন্তু স্বয়ং আকিনাস অধিকতর রক্ষণশীল অবস্থান গ্রহণ করেছিলেন। ঈশ্বর কোনও মানুষ লেখকের মতো ছিলেন না, কেবল কথার মাধ্যমেই বার্তা প্রদান করতে পারেন যিনি। নিষ্কৃতির সত্যকে উন্মোচিত করতে ঈশ্বর ঐতিহাসিক ঘটনাবলীও সংগঠিত করতে পারেন। ‘ওল্ড টেস্টামেন্টে’র আক্ষরিক অর্থ মানুষ লেখকদের ব্যবহৃত শব্দ থেকে বের করা যেতে পারে, কিন্তু এর আধ্যাত্মিক অর্থ এক্সোডাসের বিভিন্ন ঘটনা ও পাসকল ল্যাম্বের রীতি থেকে বের করা যেতে পারে, ক্রাইস্টের নিষ্কৃতির কাজের পূর্বাভাস দিতে ঈশ্বর যা ব্যবহার করেছেন।

+

এদিকে ইসলামি বিশ্বে বসবাসরত ইহুদিরা ধ্রুপদী গ্রিক সংস্কৃতিকে বাইবেলে প্রয়োগের প্রয়াস পেয়েছিল। তারা আবিষ্কার করেছে যে অ্যারস্টটল ও প্লেটোর বর্ণিত উপাস্যের সাথে ঐশীগ্রন্থের প্রকাশিত ঈশ্বরকে খাপ খাওয়ানো কঠিন, যিনি কিনা সময়হীন, দুরাতিক্রম্য, জাগতিক ঘটনাপ্রবাহর দিকে দৃষ্টিপাত করেন না, বিশ্ব জগৎ সৃষ্টি করেননি-স্বয়ং ঈশ্বরের মতোই তা চিরন্তন-সময়ের শেষে তিনি তার বিচার করবেন না। ইহুদি দার্শনিকগণ জোর দিয়ে বলেছেন, বাইবেলের সবচেয়ে মানবরূপী অনুচ্ছেদসমূহকে উপমাগতভাবে ব্যাখ্যা করতে হবে। হাঁটেন, কথা বলেন সিংহাসনে বসেন, ঈর্ষাপরায়ণ, ক্রুদ্ধ হন ও মত পাল্টান, এমন একজন ঈশ্বরকে তাঁরা মেনে নিতে পারেননি।

বিশেষ করে ঈশ্বরের এক্স-নিহিলো ‘শূন্য থেকে’ বিশ্ব সৃষ্টির ধারণায় বেশি উদ্বিগ্ন বোধ করেছিলেন তাঁরা। সা’দিয়া ইবন জোসেফ (৮৮২-৯৪২) জোর দিয়েছেন যে, ঈশ্বর যেহেতু সকল কথা ও ধারণার অতীতে অবস্থান করেন, কেউ কেবল তিনি ‘আছেন’–এইটুকুই বলতে পারে।১ সা’দিয়া সৃষ্টির এক্স- নিহিলো মতবাদ মেনে নিতে বাধ্য হয়েছিলেন, কারণ তা এখন ইহুদি ট্র্যাডিশনে গভীরভাবে প্রোথিত ছিল, তবে তিনি যুক্তি দেখিয়েছেন যে, একজন স্বর্গীয় স্রষ্টাকে মেনে নিলে তখন তাঁর সম্পর্কে যুক্তি দিয়ে অন্যান্য বিবৃতি দেওয়া যেতে পারে। যেহেতু তাঁর সৃষ্ট জগৎ বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে পরিকল্পিত এবং এর প্রাণ আছে, সুতরাং তার মানে দাঁড়ায় স্রষ্টার অবশ্যই প্রজ্ঞা, প্রাণ ও শক্তির গুণাবলী রয়েছে। সম্পূর্ণ আধ্যাত্মিক ঈশ্বরের কাছ থেকে বস্তুগত বিশ্বের সৃষ্টির যৌক্তিক ব্যাখ্যা দেওয়ার প্রয়াসে অন্য ইহুদি দার্শনিকগণ সৃষ্টিকে ঈশ্বরের কাছ থেকে দশটি উৎসারণের বিবর্তনমূলক প্রক্রিয়া হিসাবে কল্পনা করেছেন যেগুলো ক্রমাগত অধিকতর বস্তু হয়ে উঠেছে। প্রতিটি উৎসারণ টলেমিয় বিশ্বের একটি বলয়ের জন্ম দিয়েছে: স্থির নক্ষত্র, শনি গ্রহ, বৃহস্পতি, মঙ্গল, সূর্য, শুক্রগ্রহ, বুধ এবং সবশেষে চাঁদ। অবশ্য আমাদের মর্ত্য জগৎ উল্টো পথে বিকশিত হয়েছে: এর সূচনা হয়েছিল জড় বস্তু হিসাবে তারপর গাছপালা ও পশুপাখি হয়ে মানুষের দিকে অগ্রসর হয়েছে, যাদের আত্মা স্বর্গীয় যুক্তিতে অংশ গ্ৰহণ করেছে, কিন্তু যার দেহ তৈরি করা হয়েছে পৃথিবীর মাটি থেকে।

মায়মোনাইদস (১১৩৫-১২০৪) অ্যারিস্টটল ও বাইবেলের বিরোধে উদ্বিগ্ন ইহুদিদের সান্ত্বনা দেওয়ার প্রয়াস পেয়েছেন।২ দ্য গাইড টু দ্য পাপ্লেক্সড-এ তিনি যুক্তি দেখিয়েছেন যে, সত্য যেহেতু এক, ঐশীগ্রন্থকে তাই অবশ্যই যুক্তির সাথে সমন্বিত হতে হবে। এক্স-নিহিলো সৃষ্টি তত্ত্বেও তাঁর কোনও সমস্যা ছিল না, কারণ তিনি অ্যারিস্টটলের বস্তুর অবিনাশীতার যুক্তিকে বিশ্বাসযোগ্য মনে করেননি। মায়মোনাইদস বাইবেলে ঈশ্বরের মানবরূপী বর্ণনা অবশ্যই আক্ষরিকভাবে ব্যাখ্যা করার বিষয়টি মেনে নিয়েছিলেন; তিনি বাইবেলের আরও অধিকতর অযৌক্তিক আইনের পক্ষে যুক্তিভিত্তিক কারণ বের করার প্রয়াস পেয়েছেন। কিন্তু জানতেন, ধর্মীয় অভিজ্ঞতা যুক্তিকে ছাপিয়ে যায়। ভীষণ আতঙ্কের সাথে অর্জিত পয়গম্বরদের স্বজ্ঞাপ্রসূত জ্ঞান আমাদের যৌক্তিক ক্ষমতায় লাভ করা জ্ঞানের চেয়ে অনেক উঁচু পর্যায়ের।

স্পেনের অন্যতম মহান কবি ও দার্শনিক আব্রাহাম ইবন এযরা (১০৮৯-১১৬৪) ছিলেন আধুনিক ঐতিহাসিক সমালোচনাবাদের আরেকজন মধ্যযুগীয় অগ্রগামী। ব্যাখ্যাসমূহকে অবশ্যই আক্ষরিক অর্থকে অগ্রাধিকার দিতে হবে, অন্যদিকে কিংবদন্তীর (আন্নাদাহ) আধ্যাত্মিক মূল্য রয়েছে, একে কোনওভাবেই সত্যির সাথে গুলিয়ে ফেলা যাবে না। তিনি বাইবেলিয় টেক্সটে ত্রুটি খুঁজে পেয়েছেন: জেরুজালেমের ইসায়াহ তাঁর নামে প্রচলিত পুস্তকের দ্বিতীয় অংশ লিখতে পারেন না, কারণ এখানে এমন সব ঘটনার উল্লেখ আছে যা তাঁর মৃত্যুর অনেক পরে ঘটেছে। তিনি সতর্কতা ও আভাসে এমন ইঙ্গিত দিয়েছেন যে মোজেস গোটা পেন্টাটিউকের লেখক ছিলেন নাঃ উদাহরণ স্বরূপ, তিনি নিজের মৃত্যুর বর্ণনা দিতে পারেন না, এবং মোজেস যেহেতু কখনওই প্রতিশ্রুত ভূমিতে প্রবেশ করেননি, কেমন করে তিনি ডিউটেরোনমির সূচনা পঙক্তিসমূহ রচনা করতে পারেন, যা তাঁর চূড়ান্ত ঠিকানার স্থানকে ‘যৰ্দ্দনের পূর্ব্বপারস্থিত প্রান্তরে স্থান দিয়েছে।” নিশ্চয়ই জোশুয়া ইসরায়েল দেশ দখল করে নেওয়ার পর সেখানে বাসকারী কেউ লিখে থাকবেন।

দার্শনিক যুক্তিবাদ স্পেন ও প্রোভেন্সে এক অতীন্দ্রিয়বাদী পাল্টা হামলাকে অনুপ্রাণিত করেছিল। ক্যাস্তিলের একজন প্রভাবশালী ইহুদি সম্প্রদায়ের সদস্য ও অনন্য সাধারণ তালমুদ বিশেষজ্ঞ নাহমানাইদস (১১৯১-১২৭০) বিশ্বাস করতেন যে, মায়মোনাইদস যুক্তিবাদী ব্যাখ্যা তোরাহর প্রতি সুবিচার করেনি। পেন্টাটিউকের উপর এক প্রভাবশালী ধারাভাষ্য লিখেছিলেন তিনি যা প্রবলভাবে এর সহজ অর্থকে আলোকিত করেছে, কিন্তু পাঠ পরিক্রমায় তিনি আক্ষরিক অর্থকে সম্পূর্ণ অতিক্রম করে যাওয়া এক ঐশ্বরিক তাৎপর্যের মুখোমুখি হয়েছিলেন। ত্রয়োদশ শতাব্দীর শেষের দিকে ক্যাস্তিলের একটি ছোট অতীন্দ্রিয়বাদী দল একে আরও সামনে নিয়ে যায়। তাদের ঐশীগ্রন্থ পাঠ কেবল টেক্সটের গভীরতর স্তরের সাথে পরিচিত করিয়ে দিত না বরং ঈশ্বরের অন্তস্থ জীবনের কাছে নিয়ে যেত। এই নিগূঢ় অনুশীলনকে তাঁরা বলতেন কাবাল্লাহ (‘উত্তারিধারসূত্রে পাওয়া ঐতিহ্য’), কারণ তা গুরু থেকে শিষ্যের কাছে হস্তান্তরিত হয়েছে। নাহমানাইদস-এর বিপরীতে এই কাব্বালিস্টগণের- আব্রাহাম আবুলাফিয়া মোজেস দে লিয়ন, ইসাক দে লতিফ ও জোসেফ জিকাতিল্লাহ-তালমুদের কোনও অভিজ্ঞতা ছিল না, কিন্তু তাঁরা সবাইই এর দুর্বল ঈশ্বর ধর্মীয় উপাদান রহিত আবিষ্কার করার আগ পর্যন্ত দৰ্শনে আগ্রহী ছিলেন।৩৬ পরিবর্তে তাঁরা এক হারমেনেউটিক পদ্ধতি নিয়ে কাজ করেছিলেন সম্ভবত তা ক্রিশ্চান প্রতিবেশিদের কাছ থেকেই শিখেছিলেন।

অতীন্দ্রিয়বাদী মিদ্রাশ ‘উদ্যানে’ (পারদেস) প্রবেশকারী চারজন সাধুর তালমুদিয় কাহিনীর উপর ভিত্তি করে রচিত। কেবল আর. আকিবাই এই বিপদসঙ্কুল আধ্যাত্মিক পরীক্ষায় রক্ষা পেয়েছিলেন, কাব্বালিস্টগণ দাবি করেছেন পারদেস নামে আখ্যায়িত তাদের ব্যাখ্যা তাঁর কাছ থেকে প্রাপ্ত এবং সেকারণে অতীন্দ্রিয়বাদের একমাত্র নিরাপদ ধরণ। তাদের তোরাহ পাঠের পদ্ধতি রোজ তাদের ‘স্বর্গে’ নিয়ে যাচ্ছে বলে আবিষ্কার করেছিলেন তাঁরা। পারদেস (PaRDeS) ঐশীগ্রন্থের চারটি অর্থের অ্যানাগ্রাম ছিল: পেশাত, আক্ষরিক অর্থ; রেমেস, অ্যালেগোরি; দারাশ, নৈতিক হোমিলিয় অর্থ; এবং সদ, তোরাহ পাঠের অতীন্দ্রিয় পুঞ্জীভূতকরণ। পারদেস ছিল পেশাত দিয়ে শুরু হওয়া একটা চলার ধরণ যা সদের অনির্বচনীয় উচ্চতায় পৌঁছেছে। আদি পারদেস কাহিনী যেমন স্পষ্ট করে দিয়েছে, এই অভিযাত্রা সবার জন্যে নয়, বরং সঠিকভাবে প্রশিক্ষিত অভিজাত গোষ্ঠীর জন্যে। মিদ্রাশের প্রথম তিনটি ধরণই-পারদেস, রেমেস ও দারাশ ফিলো, র‍্যাবাই ও দার্শনিকদের হাতে ব্যবহৃত হয়েছে; তো কাব্বালিস্টরা বোঝাতে চেয়েছে যে তাদের আধ্যাত্মিকতা ট্র্যাডিশনের অনুগামী, আবার একই সময়ে তাদের নিজস্ব বিশেষত্ব–সদ-এর পূর্ণাঙ্গতা। তাদের অভিজ্ঞতা সম্ভবত এতটাই সুস্পষ্টভাবে ইহুদিসুলভ মনে হয়েছিল যে তারা হয়তো সম্পূর্ণই মূলধারার সাথে কোনও রকম বিরোধের ব্যাপারে অসতর্ক ছিল।৪০

কাব্বালিস্টরা এক শক্তিশালী সংশ্লেষ সৃষ্টি করেছিল।৪১ র‍্যাবাই এবং দার্শনিকগণ যেসব প্রাচীন ইসরায়েলি ট্র্যাডিশনকে খাট বা নিশ্চিহ্ন করতে চেয়েছিলেন সেগুলোকে পুনরুজ্জীবীত করেছিল। মুসলিম বিশ্বের বিভিন্ন অতীন্দ্রিয়বাদী আন্দোলনে আবার জেগে ওঠা নস্টিক ট্র্যাডিশনেও অনুপ্রাণিত হয়েছিল তারা, সম্ভবত এর সাথে পরিচিতি ছিল তাদের। সবশেষে, কাব্বালিস্টরা দার্শনিকদের কল্পিত দশটি উৎসারণের শরণ নিয়েছে যেখানে সত্তার ধারায় প্রত্যেকটা উপাদান সংযুক্ত। প্রত্যাদেশ আর অস্তিত্বের গহ্বরে সেতু তৈরির প্রয়োজন ছিল না, বরং প্রতিটি সত্তার মাঝে স্বয়ংক্রিয়ভাবে তা সৃষ্টি হতে থাকে। সৃষ্টি কেবল সুদূর অতীতে একবার ঘটেনি, বরং এটা সময়ের অতীত একটা ঘটনা যেখানে আমরা সবাই অংশ নিতে পারি।

কাব্বালাহ সম্ভবত অন্য যেকোনও অতীন্দ্রিয়বাদের চেয়ে অনেক বেশি ঐশীগ্রন্থ ভিত্তিক। এর ‘বাইবেল’ ছিল যোহার, ‘দ্য বুক অভ স্প্লেন্ডর।’ সম্ভবত মোজেস অভ লিয়নের কাজ ছিল এটা, কিন্তু অতীন্দ্রিয়বাদী বিপ্লবী আর. সাইমন বেন ইয়োহাইয়ের উপর রচিত দ্বিতীয় শতাব্দীর উপন্যাসের ধরণ নিয়েছিল, যিনি প্যালেস্তাইনে ঘুরে বেড়িয়ে তোরাহ্ আলোচনার জন্যে সঙ্গীদের সাথে মিশেছেন, তাদের ব্যাখ্যার ফলে তা প্রত্যক্ষভাবে স্বর্গীয় জগতে ‘উন্মুক্ত’ হয়েছিল। ঐশীগ্রন্থ পাঠ করার মাধ্যমে কাব্বালিস্ট টেক্সট ও নিজের মাঝে স্তরে স্তরে অবতরণ করে আবিষ্কার করত যে একই সময়ে সে সত্তার উৎসে আরোহণ করছে। কাব্বালিস্টরা দার্শনিকদের সাথে একটা বিষয়ে একমত ছিল যে শব্দ দুৰ্জ্জেয় দুর্বোধ্য ঈশ্বরকে প্রকাশ করতে পারে না, তবে বিশ্বাস করত, ঈশ্বরকে জানা না গেলেও ঐশীগ্রন্থের প্রতাঁকের ভেতর তাঁকে অনুভব করা সম্ভব। তাদের বিশ্বাস ছিল ঈশ্বর বাইবেলিয় টেক্সটে তাঁর অন্তস্থ জীবনের আভাস দিয়ে গেছেন। অতীন্দ্রিয় ব্যাখ্যায় কাব্বালিস্টরা এর উপর ভিত্তি করেই অগ্রসর হয়েছে, পৌরাণিক কাহিনী ও নাটক সৃষ্টি করেছে যেগুলো পেশার টেক্সটকে ভেঙে উন্মুক্ত করে। তাদের অতীন্দ্রিয় ব্যাখ্যা ঐশীগ্রন্থের প্রতিটি পঙক্তিতে স্বর্গীয় সত্তার রহস্য বর্ণনাকারী এক নিগূঢ় অর্থ আবিষ্কার করে।

কাব্বালিস্টরা ঈশ্বরের অন্তস্থ সত্তাকে বলত এন সফ (‘অন্তহীন’)। এন সফ বোধের অতীত এবং এমনকি বাইবেল বা তালমুদে তাঁর নাম পর্যন্ত উল্লেখ করা হয়নি। এটা কোনও ব্যক্তিসত্তা নয়, তো এন সফকে ‘সে’ বা ‘তিনি’ না বলে ‘এটা’ বলাই যুক্তিসঙ্গত হবে। কিন্তু বোধের অতীত এন সফ বিশ্ব জগৎ সৃষ্টি করার সময়ই নিজেকে মানব জাতির কাছে প্রকাশ করেছিলেন। অনেকটা বিশাল কোনও বৃক্ষের ঠেলে বের হয়ে আসা কাণ্ড, ডালপালা ও পাতার মতো দুর্ভেদ্য আড়াল থেকে আবির্ভূত হয়েছিল এটা। স্বর্গীয় জীবন সমস্ত কিছুকে ধারণ না করা পর্যন্ত সর্বকালের যেকোনও সময়ের চেয়ে বিস্তৃত বলয়ে প্রসারিত হয়েছে, কিন্তু এন সফ স্বয়ং আড়ালে রয়ে গেছেন। বৃক্ষের শেকড়, স্থায়িত্ব ও প্রাণশক্তির উৎস ছিল এটা, কিন্তু সব সময়ই অদৃশ্য। দার্শনিকরা যাকে ঈশ্বরের গুণাবলী বলে থাকেন-তাঁর ক্ষমতা, প্রজ্ঞা ও বুদ্ধি-এভাবে প্রকাশিত হয়েছে, কিন্তু কাব্বালিস্ট এইসব বিমূর্ত গুণাবলীকে গতিশীল তৎপরতায় পরিণত করেছে। দার্শনিকদের দশ উৎসারণের মতো এগুলো অন্তহীন এন সফের বৈশিষ্ট্য উন্মোচিত করেছে এবং বস্তুগত বিশ্বের কাছাকাছি আসার সাথে ক্রমেই বেশি করে জমাট ও বোধগম্য হয়ে উঠেছে। কাব্বালিস্টরা এর দশটি ক্ষমতাকে, স্বর্গীয় মনের অন্তস্থ মাত্রাগুলোকে সেফিরদ (‘সংখ্যায় রূপান্তর) নামে আখ্যায়িত করেছে। প্রতিটি সেফিরার নিজস্ব প্রতীকী নাম রয়েছে এবং তা এন সফের উন্মোচনের আত্মপ্রকাশের একেকটি পর্যায় তুলে ধরে, কিন্তু সেগুলো ঈশ্বরের ‘অংশ’ নয়, বরং এক সাথে মিলে মানবজাতির কাছে অজ্ঞাত একক মহান নামের সৃষ্টি করেছে। প্রত্যেক সেফিরা একটা বিশেষ শিরোনামে ঈশ্বরের সমগ্র রহস্যকে ধারণ করে।

কাব্বালিস্টরা জেনেসিসের প্রথম অধ্যায়কে সেফিরদের আবির্ভাবের উপমা হিসাবে ব্যাখ্যা করেছে। বেরেশিত (‘সূচনা’), বাইবেলের সর্বপ্রথম শব্দ সেই মুহূর্ত তুলে ধরে যখন কেদার এলিয়ন (‘পরম মুকুট’), প্রথম সেফিরাহ ‘কৃষ্ণ’ শিখা হিসাবে এন সফের অন্তহীন রহস্য ভেদ করে বের হয়ে এসেছিলেন। তখনও পর্যন্ত কোনও কিছুই প্রকাশিত হয়নি, কারণ এই প্রথম সেফিরাহর মানুষের বোঝার মতো কোনও কিছু ছিল না। ‘এটাকে শনাক্ত করার কোনও উপায়ই ছিল না,’ ব্যাখ্যা করেছে যোহার, যতক্ষণ না একটা গুপ্ত, স্বর্গীয় বিন্দুতে চূড়ান্ত ফাটলের ভেতর দিয়ে বের হয়ে এসেছিল। এই ‘বিন্দু’ ছিল দ্বিতীয় সেফিরাহ, হোখমাহ (‘প্রজ্ঞা’), সৃষ্টির মহাপরিকল্পনা যা মানুষের বোধের সীমাবদ্ধতা তুলে ধরে। ‘এর অতীতের কোনও কিছুই জানা সম্ভব নয়,’ বলে গেছে যোহার। সেকারণে একে বলা হয় রেশিত, সূচনা।’ এরপর হোখমাহ তৃতীয় সেফিরাহ বিনাহ, অর্থাৎ বুদ্ধিমত্তাকে ভেদ করে, যার ‘জ্ঞানের অতীত বিচছুরণ’-এর আদি বিন্দু থেকে কিছুটা নিচু মাত্রার সূক্ষ্মতা ও দুজ্ঞয়তা ছিল।’ ‘সূচনা’র পর সাতটি নিম্নতর সেফিরদ একের পর অনুসরণ করে, ‘বিস্তারের উপর বিস্তার, প্রতিটি অন্যটির উপর মগজের পর্দার মতো আরেকটা আস্তরণ তৈরি করতে থাকে।

জ্ঞানের অতীত ঈশ্বর কীভাবে মানবজাতির কাছে নিজেকে প্রকাশ করলেন ও বিশ্বব্রহ্মাণ্ডকে অস্তিত্ব দান করলেন সেই বর্ণনাতীত প্রক্রিয়ার উপর আলোকপাত করার লক্ষ্যেই এই মিথটির পরিকল্পনা করা হয়েছে। কাব্বালাহ সব সময়ই জোরাল যৌন উপাদানের অস্তিত্ব ছিল। বিনাহ আবার স্বর্গীয় মাতা হিসাবেও পরিচিত, যার জঠর ‘আদিম বিন্দু’ কর্তৃক ছিন্ন হওয়ার পর নিম্ন পর্যায়ের সেফিরদের জন্ম দিয়েছে, যা ঈশ্বরের সেইসব বৈশিষ্ট্য তুলে ধরেছে যেগুলো মানুষের কাছে অনেক বেশি বোধগম্য। জেনেসিসের প্রথম অধ্যায়ে এগুলো সৃষ্টিকর্মের সাত দিনে প্রতীকায়িত হয়েছে। মানুষ ঈশ্বরের এইসব ‘শক্তি’ জগৎ ও ঐশীগ্রন্থে আবিষ্কার করতে পারে। রুখামিন (‘সহানুভূতি’)- তিফেরেদ (‘মহত্ম’) নামেও আখ্যায়িত; দিন (‘কঠোর বিচার’) যাকে সব সময়ই হেসেদ (‘করুণা’), নেতসাখ (‘ধৈর্য’), দিয়ে ভারসাম্য আনতে হয়। হোদ (‘আভিজাত্য’), ইয়েসেদ (‘স্থিতিশীলতা’) ও সবশেষে মালকুদ (‘রাজ্য’), শেখিনাহ নামেও পরিচিত, কাব্বালিস্টরা যাকে নারী ব্যক্তিত্ব হিসাবে কল্পনা করেছে।

সেফিরদকে গডহেড ও মানবজাতিকে সংযুক্তকারী মই হিসাবে বিচার করা ঠিক হবে না। এগুলো আমাদের জগৎকে অবহিত ও আবৃত করে, যাতে আমরা এই গতিশীল ও বহুমাত্রিক ঐশী কর্মকাণ্ডের আলিঙ্গন ও পরিব্যপ্ততা লাভ করতে পারি। মানুষের মনেও উপস্থিত থাকায় সেফিরদ মানবীয় চেতনার বিভিন্ন পর্যায়ও তুলে ধরে যার ভেতর দিয়ে অতীন্দ্রিয়বাদী গডহেডের দিকে আরোহণ করে। সেফিরদের উৎসারণ এমন এক প্রক্রিয়ার বর্ণনা করেছে যার মাধ্যমে নৈর্ব্যক্তিক এন সফ বাইবেলের ব্যক্তিক ঈশ্বরে পরিণত হয়েছেন। তিনটি ‘উচ্চতর’ সেফিরদ আবির্ভূত হওয়ার সময় এন সফের ‘এটা’ পরিণত হয় “তিনি-তে। পরবর্তী ছয়টি সেফিরদে ‘তিনি’ পরিণত হন — তুমি-তে; মানুষের সাথে সম্পর্কিত হওয়ার মতো এক বাস্তবতা। আমাদের জগতে স্বর্গীয় উপস্থিতি শেখিনাহয় ‘তুমি’ পরিণত হয় ‘আমি’-তে, কারণ ঈশ্বর প্রত্যেক ব্যক্তির মাঝে উপস্থিত। পারদেস ব্যাখ্যার পরিক্রমায় কাব্বালিস্ট ধীরে ধীরে তার মনের গভীর কন্দরে স্বর্গীয় উপস্থিতি সম্পর্কে সজাগ হয়ে ওঠে।

কাব্বালিস্টরা শূন্য হতে সুষ্টির মতবাদকে খুবই গুরুত্বের সাথে নিলে একে সম্পূর্ণ উল্টে দিয়েছে। এই ‘কিছু না’ গডহেডের বাইরের কিছু হতে পারে না, গোটা বাস্তবতা যিনি গঠন করেছেন। মহাগহ্বর এন সফের অভ্যন্তরেই ছিল-কোনওভাবে-সৃষ্টির কালে তাকে অতিক্রম করা গেছে। কাব্বালিস্টরা কৃষ্ণ শিখা যা বিবর্তন/সৃজনশীল প্রক্রিয়া শুরু করেছিল সেই প্রথম সেফিরাহকে ‘কিছু না’ও বলে থাকে, কারণ আমরা ধারণা করতে পারি এমন কোনও বাস্তবতার সাথে তা মেলে না। সৃষ্টি প্রকৃতই ‘শূন্যতা হতে’ সম্পন্ন হয়েছে। কাব্বালিস্টরা লক্ষ করেছিল যে আদমের সৃষ্টির দুটি বিবরণ রয়েছে। জেনেসিসের প্রথম অধ্যায়ে ঈশ্বর আদমকে (‘মানবজাতি’) সৃষ্টি করেছেন, অতীন্দ্রিয়বাদীরা যাকে সৃজনশীল প্রক্রিয়ার ক্লাইমেক্স, ঈশ্বরের অনুরূপে তৈরি আদিম মানবজাতি(আদম কাদমান) বলে ধরে নিয়েছিলেন: ঈশ্বর আদি আদর্শ মানব সত্তায় প্রকাশিত হয়েছিলেন, সেফিরদ তার দেহ ও অঙ্গ প্রত্যঙ্গ তৈরি করেছিল।

দ্বিতীয় অধ্যায়ে যখন ঈশ্বর আদমকে ধূলি থেকে তৈরি করলেন, আমাদের চেনা পৃথিবীমুখী মানুষকে সৃষ্টি করেছিলেন তিনি। এই জাগতিক আদমের প্রথম সাব্বাথে গডহেডের গোটা রহস্য নিয়ে ধ্যান করার কথা ছিল, কিন্তু তিনি সহজ পথ বেছে নিয়ে কেবল সবচেয়ে কাছের ও সুগম সেফিরাহ শেখিনাহ নিয়ে ধ্যান করেন। এটা-অবাধ্যতার ব্যাপারটি নয়-আদমের পতনের কারণ ছিল, যার ফলে স্বর্গীয় জগতের একতা ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়, জীবন বৃক্ষ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় জ্ঞান বৃক্ষ থেকে, যে ফল গাছে ঝোলার কথা ছিল সেটা পেড়ে ফেলা হয়। শেখিনাহকে সেফিরদের গাছ থেকে ছিঁড়ে ফেলা হয়, স্বর্গীয় জগৎ থেকে নির্বাসিত অবস্থায় রয়ে যায় তা।

কাব্বালিস্টদের অবশ্য আদমকে দেওয়া দায়িত্ব পালন করে শেখিনাহকে অবশিষ্ট সেফিরদের সাথে মিলিত করার শক্তি ছিল। পারদেস ব্যাখ্যায় তারা সম্পূর্ণ জটিলতাসহই গোটা স্বর্গীয় রহস্য নিয়ে ধ্যান করতে পারে এবং সমগ্র ঐশীগ্রন্থই সেফিরদের ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে একটা সাঙ্কেতিক সূত্রে পরিণত হয়। ইসাকের উপর আব্রাহামের বন্ধন দেখিয়েছে যে কীভাবে দিন ও হেসেদকে- বিচার ও করুণা-অবশ্যই একসাথে কাজ করতে হবে, একে অন্যকে মজবুত করে তুলবে। যৌন প্রলোভন প্রতিহত করে ক্ষমতায় আরোহণকারী জোসেফ, যিনি মিশরের খাদ্যের যোগানদারে পরিণত হয়েছিলেন, তার কাহিনী দেখিয়েছে যে স্বর্গীয় মনস্তত্ত্বে প্রতিরোধ (দিন) সব সময়ই মহত্ম (তিফেরেদ) দিয়ে ভারসাম্য পেয়েছে। সং অভ সংস অস্তিত্বের সমস্ত পর্যায়ে অনুরণিত ছন্দ ও একতার জন্যে আকাঙ্ক্ষাকেই প্রতীকায়িত করেছে।

ঠিক এন সফ যেভাবে সেফিরদের প্রগতিশীল উৎসারণে নিজেকে নমিত, প্রকাশিত ও সঙ্কুচিত করেছিলেন ঠিক সেভাবে গডহেডও তোরাহয় মানুষের সীমাবদ্ধ ভাষায় নিজেকে প্রকাশ করেছেন। কাব্বালিস্টরা যেভাবে ঐশ্বরিকতার বিভিন্ন স্তরে অনুসন্ধান চালাত ঠিক একইভাবে বাইবেলেরও বিভিন্ন স্তরে অনুসন্ধান চালাতে শিখেছিল। যোহারে তোরাহকে অপরূপ সুন্দরী নারীর সাথে তুলনা করা হয়েছে, এক নির্জন স্থানে বিচ্ছিন্ন অবস্থায় আছে সে, গোপন প্রেমিক আছে তার। সে জানত চিরকাল ঘরের বাইরে রাস্তার এমাথা থেকে ওমাথায় হেঁটে বেড়াচ্ছে তাকে দেখার আশায়, তো একটা দরজা খুলে তাকে নিজের চেহারা দেখায় সে-মাত্র সেকেন্ডের জন্যে-তারপরই সরে আসে। কেবল প্রেমিকই ওর ক্ষণিকের আবির্ভাবের তাৎপর্য বুঝতে পেরেছে। তোরাহ ঠিক এভাবেই অতীন্দ্রিয়বাদীর কাছে নিজেকে তুলে ধরে। প্রথমে তাকে ইশারা দেয়, তারপর কথা বলে তার সাথে ‘পর্দার আড়াল থেকে, নিজের কথার সামনে যেটা টেনে দিয়েছে সে, যাতে তার সামনে অগ্রসর হওয়ার মতো করে বোধ শক্তির সাথে খাপ খেয়ে যায়।[৪৪] খুব ধীরে কাব্বালিস্ট ঐশীগ্রন্থের এক স্তর থেকে আরেক স্তরে আগ্রসর হয়-দারাশের নৈতিক ভাবনা ও রেমেসের হেঁয়ালি ও উপমার ভেতর দিয়ে। ক্রমে পর্দাটা পাতলা ও কম অস্বচ্ছ হয়ে ওঠে, অবশেষে সে সোদের-প্রিয়তম-পুঞ্জীভূত অন্তর্দৃষ্টিতে পৌঁছানোর পর ‘উন্মুক্ত অবস্থায় মুখোমুখি দাঁড়ায়, তার সাথে সকল গোপন রহস্য এবং স্মরণাতীতকাল থেকে তার মাঝে লুকিয়ে থাকা সমস্ত গোপন উপায় নিয়ে কথা বলে।’৪৫ অতীন্দ্রিয়বাদীকে অবশ্যই বাইবেলের উপরিগত অর্থ ছিন্ন করতে হবে-সমস্ত কাহিনী, আইন ও বংশলতিকা-যেভাবে প্রেমিক প্রিয়তমকে তুলে ধরে এবং কেবল তার দেহই নয় বরং আত্মাও শনাক্ত করতে শেখে।

উপলব্ধিহীন মানুষ কেবল বর্ণনা দেখতে পায়, যেগুলো পোশাকমাত্র; যারা আরও সমঝদার তারা দেহও দেখে। কিন্তু যারা সত্যিকারের জ্ঞানী, যারা সর্বেশ্বর রাজার সেবা করে ও সিনাই পর্বতে আরোহণ করে তারা সমস্ত কিছুর মৌল নীতি প্রকৃত তোরাহর একেবারে আত্মা পর্যন্ত দেখতে পায়।

বাইবেলকে ‘বর্ণনা ও দৈনন্দিন বিষয়আশয় তুলে ধরা বই’ হিসাবে স্রেফ আক্ষরিকভাবে পাঠকারী কেউ এই বিষয়টি খেয়াল করেনি। আক্ষরিক তোরাহর কোনও বিশেষত্ব নেই: এরচেয়ে ভালো বই যে কেউ লিখতে পারে-এমনকি জেন্টাইলরাও এরচেয়ে মহান কাজ করেছে।

কাব্বালিস্টরা রাত্রি জাগরণ, উপবাস ও অবিরাম আত্মপরীক্ষার ভেতর দিয়ে ঐশীগ্রন্থে অতীন্দ্রিয়বাদী ধ্যান যুক্ত করেছে। স্বার্থপরতা, অহমবোধকে দমন করে একসাথে বাস করতে হতো তাদের, কারণ ক্রোধ অশুভ আত্মার মতো মনের ভেতর প্রবেশ করে আত্মার স্বর্গীয় ছন্দ ধ্বংস করে দেয়। এমনি বিভক্ত অবস্থায় সেফিরদের ঐক্য অনুভব করা অসম্ভব কাব্বালাহ’র এক্সতাসিস-এর পক্ষে বন্ধুর প্রতি ভালোবাসা মৌল বিষয় ছিল। যোহারে সফল ব্যাখ্যার অন্যতম লক্ষণ হচ্ছে ব্যাখ্যাকারীর সহকর্মীরা যখন আনন্দে চিৎকার করে ওঠে, যখন তারা যাকে স্বর্গীয় অভিজ্ঞতা হিসাবে অনুভব করেছিল সেটাকেই শুনতে পায় বা যখন ব্যাখ্যাকারীরা অতীন্দ্রিয় যাত্রা শুরু করার আগে পরস্পরকে চুম্বন করে।

কাব্বালিস্টদের বিশ্বাস ছিল যে, তোরাহ ভ্রান্তিময়, অসম্পূর্ণ এবং পরম সত্য নয় বরং তা আপেক্ষিক সত্যকেই তুলে ধরেছে। কেউ কেউ ভেবেছিল আমাদের তোরাহ থেকে দুটো পূর্ণাঙ্গ পুস্তক হারিয়ে গেছে বা আমাদের বর্ণমালায় একটা হরফের ঘাটতি রয়েছে, ফলে খোদ ভাষাই হয়ে পড়েছে স্থানচ্যুত। অন্যরা সেভেন এজেস অভ ম্যানের মিথ সৃষ্টি করেছে, যার প্রতিটি যুগ সাত শো বছর দীর্ঘ ছিল এবং একজন ‘নিম্ন’ পর্যায়ের সেফিরদের হাতে শাসিত হয়েছে। প্রথম যুগ শাসিত হয়েছিল রেখামিম|তিফেরেদের (‘মহত্ম ও সহানুভূতি’) হাতে। সকল প্রাণী একসাথে ছন্দময়ভাবে বাস করেছে এবং তাদের তোরাহ কখনওই সাপ, জ্ঞানবৃক্ষ বা মৃত্যুর কথা বলেনি, কারণ এইসব বাস্তবতার অস্তিত্ব ছিল না। কিন্তু আমরা দিনের কঠোর বিচার যা ঈশ্বরের অন্ধকার দিক প্রকাশ করে-দ্বিতীয় যুগে বাস করছিলাম, তো আমাদের তোরাহ শুভ ও অশুভের ভেতর অব্যাহত বিরোধের কথা বলেছে; আইন, রায় ও নিষেধাজ্ঞায় পরিপূর্ণ ছিল এবং এর গল্পগুলো প্রায়শই সহিংস ও নিষ্ঠুর ছিল। কিন্তু তৃতীয় চক্রে, হেসেদের (করুণা) অধীনে তোরাহ আবারও ভালো ও পবিত্র হয়ে উঠবে

ক্ষুদ্র নিগূঢ় আন্দোলন হিসাবে শুরু হয়েছিল কাব্বালাহ, কিন্তু ইহুদিবাদে তা গণআন্দোলনে পরিণত হয়; এর মিথলজি অতীন্দ্রিয়বাদের মেধা নেই এমন লোকজনকেও প্রভাবিত করবে। ইতিহাস আরও করুণ হয়ে ওঠার সাথে সাথে ইহুদিরা অতীন্দ্রিয়বাদীদের গতিশীল ঈশ্বরকে দার্শনিকদের দূরবর্তী ঈশ্বরের চেয়ে অনেক বেশি সহানুভূতিসম্পন্ন আবিষ্কার করে এবং ক্রমবর্ধমানহারে ঐশীগ্রন্থের শাদামাঠা অর্থ অসন্তোষজনক বলে উপলব্ধি করতে থাকে যা উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া ট্র্যাডিশনের (কাব্বালাহ) ব্যাখ্যা ছাড়া কোনও আলোই ফেলতে পারে না।

+

ইউরোপে অবশ্য ক্রিশ্চানরা উল্টো উপসংহারে পৌঁছাচ্ছিল। ফ্রান্সিস্কান পণ্ডিত নিকোলাস অভ লিরে (১২৭৯-১৩৪০) ব্যাখ্যার প্রাচীন পদ্ধতির সাথে স্কলাস্টিকসদের নতুন কৌশল সমন্বিত করেন। তিনি বাইবেলের তিনটি ‘আধ্যাত্মিক অর্থে’র পক্ষাবলম্বন করলেও ঐতিহাসিক ব্যাখ্যার সহজ অর্থকেই বেছে নিয়েছেন। তিনি হিব্রু শিখেছিলেন, রাশির রচনার সাথে পরিচিত ছিলেন ও অ্যারিস্টটলিয় দর্শনে ছিলেন দক্ষ। তাঁর সম্পূর্ণ বাইবেলের আক্ষরিক ব্যাখ্যা পোস্তিলে একটি প্রমিত গ্রন্থে পরিণত হয়েছিল।

অন্যান্য বিবর্তন প্রচলিত ব্যাখ্যার প্রতি ক্রমবর্ধমান অসন্তোষ তুলে ধরেছে। ইংরেজ ফ্রান্সিস্কান রজার বেকন (১২১৪-৯২)-এর স্কলাস্টিকেস ধর্মতত্ত্ব নিয়ে মাথা ঘামানোর অবকাশ ছিল না, তিনি পণ্ডিতদের মূল ভাষায় বাইবেল পাঠ করার তাগিদ দিয়েছেন। মারসিল্লো অভ পাদুয়া (১২৭৫-১৩৪২) প্রতিষ্ঠিত চার্চের ক্রমবর্ধমান ক্ষমতায় ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন। তিনি বাইবেলের পরম অভিভাবক হিসাবে পাপাল দাবিকে চ্যালেঞ্জ করেন। এর পর থেকে সকল সংস্কারক ব্যাখ্যার চূড়ান্ত সিদ্ধান্তদাতা হিসাবে পোপ, কার্ডিনাল ও বিশপদের অপছন্দ করার সাথে তাদের ব্যাখ্যার সিদ্ধান্তদাতা হিসাবে প্রত্যাখ্যানের দাবিও জুড়ে দেবেন। অক্সফোর্ডের পণ্ডিত জন ওয়াইলিফে (১৩২৯-৮৪) চার্চের দুর্নীতিতে মহাক্ষিপ্ত হয়ে যুক্তি দেখিয়েছিলেন যে, বাইবেলকে মাতৃভাষায় অনুবাদ করা উচিত যাতে সাধারণ মানুষকে পৌরহিততন্ত্রের উপর নির্ভর করতে না হয় বরং তারা নিজেরাই ঈশ্বরের বাণী পাঠ করতে পারে। ‘ক্রাইস্ট বলেছেন সারা বিশ্বে গস্পেল পাঠ করতে হবে,’ জোরের সাথে বলেছেন তিনি, ‘পবিত্র আদেশ শিষ্যদের ঐশীগ্রন্থ, কারণ এতে বলা হয়েছে সকল শিষ্যকে এটা জানতে হবে।’৪৯ বাইবেলের ইংরেজি তর্জমাকারী উইলয়াম টিন্ডেল ও (c. ১৪৯৪-১৫৩৬) একই প্রশ্ন তুলেছিলেন: চার্চের কর্তত্ব কি গস্পেলের চেয়েও বেশি নাকি গস্পেলকে চার্চের উপরে স্থান দিতে হবে? অষ্টাদশ শাতব্দী নাগাদ এই অসন্তোষ এমন এক বাইবেলিয় আন্দোলনে বিস্ফোরিত হয়েছিল যা বিশ্বাসীকে কেবল ঐশীগ্রন্থের উপর নির্ভর করার জন্যে তাগিদ দিয়েছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *