২. ঐশীগ্রন্থ

২. ঐশীগ্রন্থ

যায়ন পাহাড়ের চূড়ায় ইসরায়েলিরা মন্দির নির্মাণের কাজ শেষ করার পর ধরেই নিয়েছিল জীবন বুঝি আগের মতোই চলতে থাকবে। কিন্তু আধ্যাত্মিক অস্থিরতায় আক্রান্ত হয়ে পড়ে তারা। অনেকেই নতুন মন্দির নিয়ে হতাশ বোধ করে, সলোমনের কিংবদন্তীর জাঁকাল মন্দিরের ধারে-কাছেও যায়নি সেটা। নির্বাসিতদের বাবিলোনিয়ায় অবস্থানের সময় জুদাহয় বসতি স্থাপনকারী গোলাহরা বিদেশীদের কাছ থেকে প্রবল বিরোধিতার মুখে পড়ে। বাবিলোনিয়দের হাতে দেশান্তরী না হওয়া ইসরায়েলির কাছে এরা তেমন একটা উষ্ণ সংবর্ধনা পায়নি। পুরোহিতরা অলস ও স্থবির হয়ে পড়েছিলেন, নৈতিক কোনও নেতৃত্বই’ দিতে পারছিলেন না তাঁরা। কিন্তু চতুর্থ শতাব্দীর গোড়ার দিকে বিসিই ৩৯৮ সাল নাগাদ পারসিয় রাজা ইহুদি বিষয়াদির তত্ত্বাবধানের দায়িত্বে নিয়োজিত মন্ত্রী এযরাকে দেশের আইন হিসাবে মোজেসের তোরাহকে প্রতিষ্ঠিত করার ক্ষমতা দিয়ে জেরুজালেমে প্রেরণ করেন।’ এযরা এপর্যন্ত বিক্ষিপ্ত বিভিন্ন শিক্ষাকে পরম মূল্য প্রদান করবেন যাতে তা তোরাহয় পরিণত হয়।

পারসিয়রা সমস্ত প্রজা সাম্রাজ্যের নিরাপত্তার সাথে খাপ খাচ্ছে, নিশ্চিত করার জন্যে তাদের আইনী ব্যবস্থা পরীক্ষানিরীক্ষা করছিল। তোরাহর বিশেষজ্ঞ এযরা সম্ভবত মোজেসিয় আইন ও পারসিয় জুরিসপ্রুডেন্সের ভেতর একটা সন্তোষজনক সাময়িক ঐক্য সৃষ্টি করতে পেরেছিলেন। জেরুজালেমে পৌঁছানোর পর তিনি যা আবিষ্কার করেন তাতে রীতিমতো ভীত হয়ে উঠেছিলেন। লোকে ‘P’র বিধানমতো গোয়িমদের সাথে পবিত্র বিচ্ছিন্নতা বজায় রাখছে না, কেউ কেউ এমনকি বিদেশীদের স্ত্রী হিসাবেও গ্রহণ করেছে। জেরুজালেমবাসীরা সারা দিন প্রবল ভীতির সাথে রাজার প্রতিনিধিকে পরনের পোশাক ছিঁড়ে সাধারণের রাস্তায় গভীর শোকের ভঙ্গিতে বসে থাকতে দেখল। গোটা গোলাহ সম্প্রদায়কে এক সভায় তলব করলেন এযরা। কেউ যোগ দিতে অস্বীকার গেলে তাকে সমাজচ্যুত করার পাশাপাশি তার সম্পত্তিও বাজেয়াপ্ত করার ঘোষণা দেওয়া হলো।

নববর্ষের দিনে ওয়াটার গেইটের সামনের চত্বরে তোরাহ হাতে উপস্থিত হলেন এযরা। উঁচু কাঠের মঞ্চে দাঁড়িয়ে চড়া গলায় টেক্সট পাঠ করলেন তিনি, ‘তরজমা করে অর্থ যোগ করলেন যাতে তিনি কী পড়ছেন লোকে সেটা বুঝতে পারে’, এই সময় ভীড়ের মাঝে তোরাহর হাফেজ লেডাইরা নির্দেশনার সম্পূরক ব্যাখ্যা যোগাল। এই উপলক্ষ্যে কোনও আইন ঘোষিত হয়েছিল কিনা আমাদের জানা নেই, তবে সেগুলো যাই হয়ে থাক, লোকে স্পষ্টতই তার কথা এর আগে কখনও শোনেনি। এইসব অজানা চাহিদা জানতে পেরে কান্নায় ভেঙে পড়েছিল তারা। ‘কাঁদবে না!” জোরের সাথে বলেন এযরা। ওরা ‘এখন ওদের কাছে কী ঘোষণা করা হয়েছে বুঝতে পেরেছে।’ সেটা ছিল উৎসবের ঋতু শুকোসের মৌসুম। এযরা ইসারায়েলিদের পূর্বপুরষের বুনো প্রান্তরে ঘুরে বেড়ানোর সময়ের প্রতি সম্মান দেখিয়ে পবিত্র এই মাসে বিশেষ ‘বুদে’ (সুক্কো) অবস্থান করার নির্দেশ দিলেন। সাথে সাথে লোকজন জলপাই, সুগন্ধি, পাইন আর তালের শাখা যোগাড় করার জন্যে পাহাড়ের দিকে ছুটে গেল। সারা শহরে পাতাময় কুঁড়ে আবির্ভূত হলো। উৎসব মুখর একটা পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছিল তখন। প্রতিদিন সন্ধ্যায় লোকজন এযরার ভাষণ শোনার জন্যে সমবেত হতে শুরু করেছিল।

পবিত্র টেক্সটের উপর ভিত্তি করে এক আধ্যাত্মিক শৃঙ্খলা গড়ে তুলতে শুরু করেছিলেন এযরা। তোরাহকে অন্যান্য রচনার চেয়ে ঊর্ধ্বে স্থান দেওয়া হয়েছিল এবং প্রথম বারের মতো একে ‘মোজেসের আইন’ বলে অভিহিত করা হচ্ছিল। তবে আর পাঁচটা টেক্সটের মতো পাঠ করা হলে তোরাহকে চাহিদা সম্পন্ন ও বিচ্ছিন্নকারী মনে হতে পারত। একে অবশ্যই সাধারণ দৈনন্দিন জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন করা আচারের প্রেক্ষিতে শুনতে হবে যা শ্রোতাকে এক ভিন্ন মানসিক অবস্থায় স্থাপন করে। সাধারণ লোক একে ভিন্নভাবে দেখতে শুরু করেছিল বলেই তোরাহ ‘পবিত্র ঐশীগ্রন্থে’ পরিণত হচ্ছিল।

সম্ভবত এই তোরাহ ঐশীহগ্রন্থের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান ছিলেন এযরা স্বয়ং। তিনি যাজক ছিলেন, ‘মোজেসের তোরাহর একজন পরিশ্রমী লিপিকার,’ এবং ঐতিহ্যের ধারক।’ তবে তিনি আবার সম্পূর্ণ নতুন ধরনের ধর্মীয় কর্মকর্তা ছিলেন: এমন একজন পণ্ডিত যিনি ‘ইয়াহওয়েহর তোরাহর সুলুক সন্ধানে (লি-দ্রোশ) নিজের প্রাণ নিয়োজিত করেছেন ও ইসরায়েলে আইন ও বিধিসমূহ শিক্ষা দিতে চেয়েছেন।” তিনি সাধারণ উৎসবের উপকথার বাইরে একটা কিছু তুলে ধরছিলেন। বাইবেলিয় রচয়িতারা আমাদের একথা বলতে চাইছেন যে, ‘ইয়াহওয়েহর হাত তাঁর উপর স্থাপিত ছিল’- ঐতিহ্যগতভাবে পয়গম্বরদের উপর অবতীর্ণ অনুপ্রেরণার ভার বোঝাতে ব্যবহৃত বাগধারা।ঐ নির্বাসনের আগে যাজকগণ ইয়াহওয়েহর সাথে ‘পরামর্শ’ (লি-দ্রোশ) করার ব্যাপারে অভ্যস্ত ছিলেন। উরিম ও তুম্মিম নামে পরিচিত পবিত্র বস্তু তীর ছুঁড়ে এই কাজ করতেন তারা। কিন্তু নতুন পয়গম্বর গণক ছিলেন না, তিনি ছিলেন পণ্ডিত যিনি ঐশীগ্রন্থ ব্যাখ্যা করবেন। মিদ্রাশের (ব্যাখ্যাকরণ) চর্চা সব সময়ই প্রত্যাশিত তদন্তের ক্ষেত্রে টিকে থাকবে।” তোরাহ পাঠ কোনও শিক্ষামূলক অনুশীলন নয়, বরং আধ্যাত্মিক অনুসন্ধান।

কিন্তু তারপরেও এযরার পাঠ বহিষ্কার ও সম্পত্তির বাজেয়াপ্ত করার হুমকির মাধ্যমে নিপূণ হয়ে উঠেছিল। মন্দিরের সামনের চত্বরে আরও ভাবগম্ভীর সমাবেশের মাধ্যমে এটা অব্যাহত ছিল, যেখানে লোকে দাঁড়িয়ে কাঁপতে থাকত; এই সময় মৌসুমি শীতের বৃষ্টি গোটা শহরকে উৎফুল্ল করে তুলত, তারা এযরার মুখে বিদেশী স্ত্রীদের ফেরত পাঠানোর নির্দেশ শুনেছিল।১২ ইসরায়েলের সদস্যপদ এখন গোলাহ ও নিজেদের যারা জুদাহর সরকারী বিধান তোরাহয় সমর্পণ করেছে তাদের ভেতর সীমাবদ্ধ হয়ে গেছে। ঐশীগ্রন্থের প্রতি বাড়তি উন্মাদনায় বর্জনবাদী বিভক্তিমূলক ও সম্ভাব্য নিষ্ঠুর অর্থডক্সির বিকাশ ঘটানোর সম্ভাবনা রয়ে যায়।

এযরার পাঠ ধ্রুপদী ইহুদিবাদের সূচনা নির্দেশ করে- এমন এক ধর্ম যা কেবল প্রত্যাদেশ গ্রহণ ও তা সংরক্ষণ নয়, বরং অবিরাম ব্যাখ্যার সাথে সম্পর্কিত। এযরার পাঠ করা আইন স্পষ্টতই সাধারণ জনগণের অজানা ছিল। প্রথমবারের মতো শুনে ভয়ে কাঁদছিল তারা। টেক্সট প্রচার করার সময় ব্যাখ্যাকারী সুদূর অতীতে মোজেসের কাছে তুলে ধরা মূল তোরাং নতুন করে তুলে ধরছিলেন না, বরং নতুন ও অপ্রত্যাশিত কিছু সৃষ্টি করছিলেন। বাইবেলিয় রচয়িতাগণ একইভাবে কাজ করেছেন। উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া টেক্সটের ব্যাপক পরিবর্তন সাধন করেছেন তাঁরা। প্রত্যাদেশ কেবল একবার চিরকালের জন্যে হয়নি, বরং এটা একটা চলমান প্রক্রিয়া, কখনও শেষ হবার নয় এবং নতুন শিক্ষা সব সময়ই আবিষ্কারের অপেক্ষায় রয়েছে।

এই সময় নাগাদ ঐশীগ্রন্থের দুটি প্রতিষ্ঠিত ধরণ সৃষ্টি হয়েছিল: তোরাহ ও প্রফেটস (নেভিন)। কিন্তু নির্বাসনের পরবর্তী সময় আরেক ধরনের টেক্সট উপস্থাপিত হয়, যা কেসুভিম বা ‘লিপি’ নামে পরিচিত হয়ে উঠবে, অনেক সময় একে স্রেফ প্রাচীন গ্রন্থ হিসাবে অনুবাদ করা হয়ে থাকে। এভাবে প্রিস্টলি রচয়িতাদের লিখিত ঐতিহাসিক বিবরণ ক্রনিকলস আবিশ্যিকভাবে সামুয়েল ও কিংস-এর ইতিহাসের ডিউটেরোনমিয় ধারাভাষ্য। এই দুটি গ্রন্থ গ্রিকে রূপান্তরিত করার সময় এদের নাম দেওয়া হয়েছিল পারালিপোমেনাঃ ‘যেসব বিষয় বাদ পড়েছিল। লেখকগণ বিভিন্ন লাইনের ফাঁকে ফাঁকে আগের বিবরণীতে তাদের মতে ঘাটতি মনে হওয়া বিষয়সমূহ লিখে রাখছিলেন। তাঁরা ‘J’র সমন্বয়ের আদর্শের পক্ষে ছিলেন ও নির্বাসনে যায়নি ও এখন যারা উত্তরের অধিবাসী, এমন ইসরায়েলিদের সাথে সেতুবন্ধ গড়ে তুলতে চেয়েছেন। সুতরাং উত্তরের রাজ্যের বিরুদ্ধে ডিউটেরোনমিস্টদের কর্কশ যুক্তি বাদ দিয়ে গেছেন তাঁরা।

রচনার একটা তাৎপর্যপূর্ণ অংশ আইন বা প্রফেটসের চেয়ে ভিন্ন একটি গোষ্ঠীর অধিকারভুক্ত ছিল। প্রাচীন নিকট প্রাচ্যে শিক্ষক বা পরামর্শক হিসাবে দরবারের সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিগণ গোটা বাস্তব জগতকে অন্তস্থ স্বৰ্গীয় নীতিমালার মাধ্যমে গঠিত বলে ধারণা করতে চাইতেন। হিব্রু সাধুরা একে বলতেন হোখমাহ-’প্রজ্ঞা’-সমস্ত কিছু-প্রাকৃতিক আইন, সমাজ ও ব্যক্তি বিশেষের জীবনের বিভিন্ন ঘটনা–এই স্বর্গীয় নীল নকশার অধীন, কোনও মানুষের পক্ষেই কোনও দিন এর নাগাল পাওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু প্রজ্ঞার ধ্যানে নিয়োজিত সাধুরা বিশ্বাস করতেন যে, মাঝে মাঝে তাঁরা এর একটা আভাস লাভ করেন। কেউ কেউ এমন সূক্ষ্ম বিষয়ে তাদের অন্তর্দৃষ্টিকে এমনি বাগধারায় প্রকাশ করেছেন: ‘রাজা ন্যায়বিচার দ্বারা দেশ সুস্থির করেন; কিন্তু উৎকোচপ্রিয় তাহা লণ্ডভণ্ড করে।’ বা ‘যে ব্যক্তি আপন প্রতিবাসীর প্রতি তোষামোদ করে, সে তাহার পায়ের নিচে জাল পাতে।’১৫ ‘প্রজ্ঞা’ ট্র্যাডিশনের সাথে মোজেস বা সিনাইয়ের তেমন একটা সম্পর্ক ছিল না, বরং এর সাথে সম্পর্ক ছিল রাজা সলোমনের, যাঁর প্রখর মেধাবী হিসাবে সুনাম ছিল১৬ এবং কেসুভিমের তিনটি উপাদানকে তাঁর উপর আরোপ করা হতো: প্রোভার্বস, এক্লেসিয়াস্তেস ও সং অভ সংস। প্রোভার্বস ছিল উপরের উল্লেখিত দুটির মতো সাধারণ কাণ্ডজ্ঞান সম্পর্কিত উপমার সংকলন। এক্লেসিয়াস্তেস, দারুণভাবে সিনিকাল ধ্যান, সমস্ত বিষয়কে ‘অহম’ হিসাবে বিবেচনা করে সম্পূর্ণ তোরাহ ঐতিহ্যকে যেন খাট করতে চেয়েছে বলে মনে হয়, অন্যদিকে সং অভ সংস আপাত আধ্যাত্মিক বিষয়বস্তু ধারণ করা আদিরসাত্মক কাব্য।

অন্যান্য প্রজ্ঞা রচনা এক ন্যায়বিচারক ঈশ্বরের শাসনাধীন বিশ্বে নিরীহ লোকদের সমাধানের অতীত ভোগান্তির সমস্যা অনুসন্ধান করেছে। বুক অভ জব প্রাচীন লোককাহিনীর উপর ভিত্তি করে রচিত। ঈশ্বর স্বর্গীয় সভার প্রধান কৌশুলী শয়তানকে একেবারে অনাকাঙ্ক্ষিত সব দুর্যোগ দিয়ে আক্রান্ত করার ক্ষমতা দিয়েছেন। জব সুস্পষ্টভাবে শাস্তির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়ে তাঁকে সান্ত্বনা দিতে বন্ধুদের সব ধরনের প্রচলিত ব্যাখ্যা মেনে নিতে অস্বীকার করেছেন। শেষ পর্যন্ত ইয়াহওয়েহ জবের ডাকে সাড়া দেন, এক্সোডাসের ঘটনাপ্রবাহের প্রতি ইঙ্গিত করে নয়, বরং সৃষ্টিকে পরিচালনাকারী অন্তস্থ নীলনকশা নিয়ে চিন্তা করতে বাধ্য করার মাধ্যমে। জব কি যেখানে বরফ রাখা হয় সেখানে যেতে পারবেন, প্লেইয়াদেসের লাগাম বাঁধতে পারবেন, বা মানুষের সেবা করার জন্যে বুনো ষাঁড় চিৎকার করছে কেন তার কারণ ব্যাখ্যা করতে পারবেন? জব স্বীকার করতে বাধ্য হলেন যে তিনি এই স্বর্গীয় প্রজ্ঞা উপলব্ধি করতে অক্ষম। ‘এ কে যে জ্ঞান বীনা মন্ত্রণাকে গুপ্ত রাখে? সত্য, আমি তাহাই বলিয়াছি, যাহা বুঝি নাই, যাহা আমার পক্ষে অদ্ভুত, আমার অজ্ঞাত।’১৭ তোরাহ পাঠ করে নয় বস্তু জগতের বিস্ময় নিয়ে ধ্যান করে প্রজ্ঞার অধিকারী হন সাধু।

বিসিই দ্বিতীয় শতাব্দী নাগাদ কিছু কিছু প্রজ্ঞা রচয়িতা তোরাহর কাছাকাছি আসতে শুরু করেন। জেরুজালেমবাসী একজন ধর্মপ্রাণ সাধু বেন সিরাহ প্রজ্ঞাকে আর বিমূর্ত নীতি বলে মানতে পারছিলেন না, তিনি একে নারী চরিত্র ও অন্যান্য উপদেষ্টার মতোই একজন মনে করেছিলেন।১৮ তিনিই সেই বাণী যার মাধ্যমে ঈশ্বর সমস্ত কিছুকে অস্তিত্ব দিয়েছেন। তিনি ছিলেন স্বৰ্গীয় আত্মা (রুয়াচ), সৃজনশীল প্রক্রিয়া চলার সময় আদিম সাগরের উপর ভেসে বেড়িয়েছেন। ঈশ্বরের বাণী ও নীল নকশা হিসাবে স্বর্গীয় হলেও তিনি প্রভু থেকে ভিন্ন, পৃথিবীর সর্বত্র বিরাজমান। কিন্তু ঈশ্বর তাঁকে ইসরায়েল জাতির সাথে তাঁবু খাটানোর নির্দেশ দিয়েছেন, সমগ্র ইতিহাস জুড়ে তাদের সঙ্গ দিয়েছেন তিনি। বুনো প্রান্তরে ওদের পথ দেখানো মেঘের স্তম্ভ ছিলেন তিনি, ছিলেন মন্দিরের বিভিন্ন আচারে; স্বর্গীয় শৃঙ্খলা প্রকাশকারী আরেকটি প্রতীক। তবে সবার উপরে প্রজ্ঞা ছিলেন সেফার তোরাহর হুবহু প্রতিরূপ, ‘মোজেস আমাদের উপর যে বিধান আরোপ করেছেন।’১৯ তোরাহ আর স্রেফ একটা আইনি বিধান রইল না, সর্বোচ্চ প্রজ্ঞা ও সবচেয়ে দুর্ভেয় শুভের প্রকাশ হয়ে দাঁড়িয়েছিল তা।

মোটামুটি একই সময়ে রচনায় নিয়োজিত আরেকজন লেখক প্ৰায় একইভাবে প্রজ্ঞাকে ব্যক্তিরূপ দিয়েছিলেন, কিন্তু তারপরেও তাঁকে ঈশ্বরের সত্তা থেকে বিচ্ছিন্ন রেখেছেন। ‘ইয়াহওয়েহর নিজ পথের প্রারম্ভে আমাকে প্রাপ্ত হইয়াছিলেন, তাহার কর্মসকলের পূর্ব্বে, পূৰ্ব্বাবধি,’ ব্যাখ্যা দিয়েছেন প্রজ্ঞা।

তাঁর পাশে ছিলেন তিনি-’তাঁহার কাছে কার্য্যকরী’ ছিলেন-তিনি বিশ্বজগৎ সৃষ্টি করছিলেন যখন, ‘আমি দিন দিন আনন্দময় ছিলাম, তাহার সম্মুখে নিত্য আহ্লাদ করিতাম, মনুষ্যসন্তানগণে আমার আনন্দ হইত। এক নতুন ধরনের আলোক ও জাঁক প্রবেশ করে ইয়াহওয়েহর মাঝে। তোরাহ পাঠ এমন সব আবেগ ও কামনা জাগিয়ে তুলতে শুরু করেছিল যা প্রায় যৌনাবেদনময়ী। প্রজ্ঞা সাধুদের প্রেমিকের মতো আহ্বান করছেন এমনভাবে বর্ণনা করেছেন বেন সিরাহ: ‘আমার কাছে এসো, আমাকে কামনা করো, আমার ফলের স্বাদ প্রাণ ভরে গ্রহণ করো। কারণ আমার স্মৃতি মধুর চেয়েও মিষ্টি, আমাকে উত্তরাধিকার হিসাবে পাওয়া মৌচাকেরও চেয়েও মিষ্টি।’২১ প্রজ্ঞার অনুসন্ধানের কোনও শেষ নেই। ‘আমাকে যারা আহ্বান করে তারা আরও পেতে চায়, আমাকে যারা পান করবে তারা আরও তৃষ্ণার্ত হবে।২২ বেন সিরাহ’র হাইমের সুর ও ইমেজারিগুলো সং অভ সংসের অনেক কাছাকাছি, এ থেকে হয়তো ব্যাখ্যা মিলতে পারে কেন এই প্রেমসঙ্গীত শেষ পর্যন্ত রচনায় অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল। এটা যেন সেফার পণ্ডিতের গীতিময় আবেগপ্রবণ অভিজ্ঞতা তুলে ধরে যিনি তোরাহ পাঠ করার সময় এক ধরনের উপস্থিতি অনুভব করেছিলেন, ‘সাগরের চেয়েও বিস্তৃত,’ যার নকশা, ‘মহাগহ্বরের চেয়েও গভীর।

বেন সিরাহ সেফার পণ্ডিত ঐশীগ্রন্থের সকল ধরনে অবগাহন করেছেন বলে উল্লেখ করেছেন: তোরাহ, প্রফেটস ও লিপি। আইভরি টাওয়ারে অবস্থান করে বাকি দুনিয়া থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করেননি তিনি, বরং রাষ্ট্রীয় কর্মকাণ্ডে নিয়োজিত ছিলেন। তাঁর ব্যাখ্যা সম্পূর্ণভাবে প্রার্থনায় ভরপুর: ‘ভোরে সমস্ত আন্তরিকতা দিয়ে তিনি তাঁকে সৃষ্টিকারী প্রভুর আশ্রয় গ্রহণ করেন,’ এবং তার ফলে প্রজ্ঞা ও উপলব্ধির এক ধারা গ্রহণ করেন” যা তাঁকে পরিবর্তিত করে এই বিশ্বে শুভের পক্ষের শক্তিতে পরিণত করে। ২৫ খুবই গুরুত্বপূর্ণ এক বাগধারায় বেন সিরাহ দাবি করেছেন যে, সাধুর শিক্ষা ‘ভবিষ্যদ্বাণীর মতো, সকল আগামী প্রজন্মের উত্তরাধিকার।’২৬ পণ্ডিত কেবল পয়গম্বরদের সম্পর্কে জানছেন না, ব্যাখ্যা তাকেও পয়গম্বরে পরিণত করেছে।

বুক অভ দানিয়েলে এই বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে এসেছে। বিসিই দ্বিতীয় শতাব্দীতে প্যালেস্তাইনে এক রাজনৈতিক সংকট কালে লিখিত হয়েছিল এটা।২৭ এ সময় বিসিই ৩৩৩ সালে পারসিয়ার সাম্রাজ্য বিজয়ী মহান আলেকজান্দারের উত্তরাধিকারীদের হাতে প্রতিষ্ঠিত গ্রিক সাম্রাজ্যের প্রদেশে পরিণত হয়েছিল জুদাহ। গ্রিকরা হেলেনিজিম নামে পরিচিত অ্যাথেনিয় ধ্রুপদী সংস্কৃতির কিছুটা শিথিল ধরন নিয়ে নিকট প্রাচ্যে এসেছিল। কিছু কিছু ইহুদি গ্রিক আদর্শে বিমোহিত হয়ে গিয়েছিল, কিন্তু বিসিই ১৬৭ সালের পর অধিকতর রক্ষণশীল ইহুদিদের মাঝে হেলেনিজম বিরোধিতা প্রবল হয়ে ওঠে; এই সময় মেসেপোটেমিয়া ও প্যালেস্তাইনের সেলুসিয় সাম্রাজ্যের শাসক আন্তিওকাস এপিফেনেস জেরুজালেম মন্দির লঙ্ঘন করে সেখানে হেলেনিস্টিক কাল্ট প্রতিষ্ঠা করেন। এই শাসকের বিরোধিতাকারী ইহুদিদের উপর নির্যাতন চালানো হয়। জুদাস ম্যাকাবিয়াস ও তাঁর পরিবার ইহুদি প্রতিরোধে নেতৃত্ব দেন; ১৬৪ সালে টেম্পল মাউন্ট থেকে গ্রিকদের উৎখাত করতে সক্ষম হন তারা, কিন্তু ১৪৩ সাল পর্যন্ত যুদ্ধ অব্যাহত থাকে; এই পর্যায়ে ম্যাকাবিরা সেলুসিয় শাসন ছিন্ন করে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসাবে জুদাহ প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হন, বিসিই ৬৩ সাল পর্যন্ত তাদের হাসমোনিয় রাজবংশের হাতে দেশটি শাসিত হয়েছিল।

ম্যাকাবিয় যুদ্ধের সময় বুক অভ দানিয়েল রচিত হয়। নির্বাসনকালের পটভূমিতে সাজানো ঐতিহাসিক উপন্যাসের চেহারা পেয়েছে এটা। বাস্তবে দানিয়েল ছিলেন অধিকতর গুণবান নির্বাসিতদের অন্যতম,২৮ কিন্তু এই কাল্পনিক কাহিনীতে তিনি নেবুচাঁদনেযার ও সাইরাসের দরবারের সরকারী পয়গম্বর। আন্তিওকাসের অপবিত্রকরণের আগে রচিত প্রথম দিকের অধ্যায়ে দানিয়েলকে আর দশজন মধ্যপ্রাচ্যীয় দরবারের সাধু হিসাবে তুলে ধরা হয়েছে: ‘সমস্ত দর্শন ও স্বপ্নকথায় বুদ্ধিমান। তবে আন্তিওকাসের মন্দির ধ্বংসের পর ম্যাকাবিদের চূড়ান্ত বিজয়ের আগে রচিত পরবর্তী অধ্যায়ে দানিয়েল একজন অনুপ্রাণিত ব্যাখ্যাকারে পরিণত হন, যার ঐশীগ্রন্থের পাঠ তাঁকে পয়গম্বরসুলভ অন্তর্দৃষ্টিতে পুষ্ট করেছে।

অনেকগুলো বিভ্রান্তিকর দিব্যদৃষ্টির অভিজ্ঞতা লাভ করেন দানিয়েল। পর পর চারটি ভীত সাম্রাজ্য (অবিশ্বাস্য পশু রূপে তুলে ধরা হয়েছে) দেখেন তিনি, একটি অন্যটির চেয়ে ঢের ভয়ঙ্কর। চতুর্থটি-সেলুসিয়দের পরিষ্কার উল্লেখ- অবশ্য নষ্টামীর সম্পূর্ণ ভিন্ন অবস্থায় রয়েছে। এর শাসক ‘পরম প্রভুর বিরুদ্ধে কথা বলবেন, পরম প্রভুর সাধুদের হয়রানি করবেন। ৩১ দানিয়েল মন্দিরে আন্তিওকাসের হেলেনিস্টিক কাল্টের ‘প্রলয়ঙ্করী ঘৃণা’র আভাস পেয়েছিলেন। তবে আশার একটা ঝলকও ছিল। দানিয়েল ‘স্বর্গীয় মেঘের উপর’ ম্যাকাবিকে বোঝানো অবয়ব ‘মনুষ্যপুত্রের মতো কারও আগমন’ও দেখেছিলেন, যিনি রহস্যজনকভাবে মানুষ হলেও কোনওভাবে মানুষেরও চেয়েও বেশি কিছু। ঈশ্বরের সত্তায় প্রবেশ করলেন ত্রাণকর্তা, যিনি তাঁর উপর ‘কর্তৃত্ব, মহিমা ও রাজত্ব” অর্পণ করেছেন। এই ভবিষ্যদ্বাণীগুলো পরে দারুণ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে, যেমনটা আমরা পরের অধ্যায়ে দেখতে পাব। তবে এখন আমাদের বিবেচনার বিষয় দানিয়েলের অনুপ্রাণিত ব্যাখ্যাসমূহ।

দানিয়েল আরও কিছু দিব্যদৃষ্টির অভিজ্ঞতা লাভ করেছিলেন, যেগুলো তিনি বুঝতে সক্ষম হননি। আলোকনের জন্যে ঐশীগ্রন্থের শরণাপন্ন হন তিনি এবং বিশেষ করে ‘জেরুজালেমের লাগাতার ধ্বংসের অবসান ঘটার আগে জেরেমিয়াহর অনুমিত কাল যেমন সত্তর বছর অতিক্রান্ত হওয়ার ভবিষ্যদ্বাণী নিয়ে বেশ ভারাক্রান্ত হয়ে পড়েছিলেন। ৪ দ্বিতীয় শতাব্দীর লেখক স্পষ্টই টেক্সটের মূল অর্থ নিয়ে মোটেই ভাবিত ছিলেন না। জেরেমিয়াহ অবশ্যই পূর্ণ সংখ্যায় বাবিলোনিয় নির্বাসনের মেয়াদের ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন। ম্যাকাবিয় যুদ্ধের পরিণাম জানতে অধীর অপেক্ষায় থাকা ইহুদিদের পক্ষে স্বস্তি বয়ে আনবে এমনভাবে প্রাচীন অরাকলের সম্পূর্ণ নতুন তাৎপর্যের সন্ধান করছিলেন। এটা ইহুদি ব্যাখ্যাকরণের সাধারণ বৈশিষ্ট্যে পরিণত হবে। ঐতিহাসিক অর্থ উন্মোচনের লক্ষ্যে অতীতে দৃষ্টি ফেরানোর বদলে তরজমাকারী টেক্সটকে বর্তমান ও ভবিষ্যতের সাথে খাপ খাওয়াতে বাধ্য করেছেন। জেরেমিয়াহয় সুপ্ত অর্থ খুঁজে বের করতে নিজেকে এক কঠিন নিগূঢ় কর্মসূচির ভেতর দিয়ে যেতে বাধ্য করলেন দানিয়েল: ‘পরে আমি উপবাস, চট পরিধান ও প্রার্থনার ও বিনতির চেষ্টায় প্রভু ঈশ্বরের প্রতি দৃষ্টি করিলাম।’৫ অন্য এক উপলক্ষ্যে তিনি বলেছেন, ‘সেই পূর্ণ তিন সপ্তাহযাবৎ সাঙ্গ না হইল, তাবৎ সুস্বাদু খাদ্য ভোজন করিলাম না, মাংস কি দ্রাক্ষারস আমার মুখে প্রবেশ করিল না, এবং আমি তৈল মৰ্দ্দন করিলাম না। ৩৬

এইসব আধ্যাত্মিক অনুশীলনের ফলে এক স্বর্গীয় অনুপ্রেরণার গ্রহীতায় পরিণত হন তিনি। প্রত্যাদেশের দেবদূত গাব্রিয়েল উড়ে আসেন তাঁর কাছে এবং সঙ্কটকালের এক নতুন অর্থ আবিষ্কারে সক্ষম করে তোলেন।

তোরাহ পাঠ এক পয়গম্বরসুলভ বিষয়বস্তুতে পরিণত হচ্ছিল। ব্যাখ্যাকারী এখন নিজেকে পরিশুদ্ধ করণের আচার পালনের ভেতর দিয়ে এইসব প্রাচীন টেক্সটের শরণাপন্ন হতে প্রস্তুত হচ্ছিলেন। যেন কোনও পবিত্র স্থানে পা রাখতে যাচ্ছেন তিনি, নতুন অন্তর্দৃষ্টি দানকারী এক নতুন বিকল্প মানসিক অবস্থায় নিজেকে স্থাপন করছেন। দ্বিতীয় শতাব্দীর লেখক পরিকল্পিতভাবেই দানিয়েলের আলোকনকে এমনভাবে তুলে ধরেছেন যাতে ইসায়াহ ও ইযেকিয়েলের অভিজ্ঞতার কথা মনে পড়ে যায়।৩৭ কিন্তু ইসায়াহ যেখানে মন্দিরে পয়গম্বরসুলভ অনুপ্রেরণা লাভ করেছিলেন, সেখানে দানিয়েল সেটা পেয়েছিলেন পবিত্র টেক্সটে। তাঁকে ইযেকিয়েলের মতো পুস্তক খেতে হয়নি, বরং ঐশীগ্রন্থের শব্দাবলীর সাথে বাস করেছেন, সেগুলোকে আত্মস্থ করেছেন এবং নিজেকে পরিবর্তিত অবস্থায় আবিষ্কার করেছেন– ‘পরীক্ষাসিদ্ধ, পরিষ্কৃত ও শুক্লীকৃত।৮ সবশেষে দ্বিতীয় শতাব্দীর এই লেখক জেরেমিয়াহর বাণীতে সম্পূর্ণ নতুন এক বার্তা আবিষ্কার করার ভেতর দিয়ে দানিয়েলকে দিয়ে ম্যাকাবিয় যুদ্ধের পরিণতির পূর্বাভাস দিয়েছেন। হেঁয়ালিময়, ধাঁধাসুলভ কথায় গাব্রিয়েল ইঙ্গিত দিয়েছেন যে, ‘সত্তর সপ্তাহ’ বা ‘সত্তর বছর’ যাই লাগুক না কেন, ম্যাকাবি বিজয় লাভ করবেনই। টেক্সট পরিস্থিতির প্রতি প্রত্যক্ষভাবে সাড়া দিয়ে এর পবিত্রতা ও স্বর্গীয় রূপের প্রমাণ করেছে যেটা মুল লেখক আঁচ করতে পারেননি। ৩৯

দুঃখজনকভাবে হাসমোনিয় রাজবংশ ম্যাকাবিয় যুদ্ধকে এক বিরাট হতাশাব্যঞ্জক ঘটনা হিসাবে আবিষ্কার করে। রাজারা ছিলেন নিষ্ঠুর ও দুর্নীতিবাজ, তারা ডেভিডের উত্তরাধিকারী ছিলেন না। অধিকতর ধার্মিক ইহুদিদের শঙ্কিত করে পুরোহিত বংশের লোক না হয়েও তাঁরা প্রধান পুরোহিতের কার্যালয়ের দায়িত্ব নিয়ে মন্দিরের পবিত্রতা লঙ্ঘন করেন। এমনি অপবিত্রতায় বিক্ষুব্ধ হয়ে ইহুদি জাতির ঐতিহাসিক কল্পনা নিজেকে ভবিষ্যতে স্থাপন করেছে। দ্বিতীয় শতাব্দীর শেষের দিকে এক ধরনের প্রলয়বাদী ধার্মিকতার জোয়ার সৃষ্টি হয়েছিল। নতুন টেক্সটে ইহুদিরা পরকালতাত্ত্বিক দর্শন তুলে ধরে যেখানে ঈশ্বর জোরালভাবে মানবীয় বিষয়ে হস্তক্ষেপ করেন, চলমান দূষিত শাসকগোষ্ঠীকে ধ্বংস করে ন্যায় বিচার ও পবিত্রতার যুগের সূচনা ঘটান। সমাধানের প্রয়াস পাওয়ার সময় জুদাহর জনগণ অসংখ্য উপদলে ভাগ হয়ে পড়েছিল। প্রত্যেকেই নিজেকে প্রকৃত ইসরায়েল দাবি করেছে। তবে এটা ছিল অসাধারণ সৃজনশীল একটা সময়। বাইবেলের অনুশাসন তখনও সম্পূর্ণ হয়নি। তখনও কোনও কর্তৃত্বপূর্ণ ঐশীগ্রন্থ ছিল না, কোনও অর্থডক্সিও না। বিভিন্ন গোষ্ঠীর খুব অল্পসংখ্যকই আইনের প্রচলিত পাঠ ও প্রফেটস অন্ধ অনুসরণ করা বাধ্যতামূলক মনে করেছে। কোনও কোনওটা এমনকি সম্পূর্ণ নতুন ঐশীগ্রন্থ রচনায় স্বাধীন মনে করেছে। বিধ্বস্ত দ্বিতীয় মন্দির কালের বৈচিত্র্য ১৯৪২ সালে কামরান সম্প্রদায়ের গ্রন্থাগার আবিষ্কৃত হলে উন্মোচিত হয়।

কামরান এই সময়ের প্রতিমাবিরোধী চেতনা তুলে ধরেছে। উগ্রপন্থীরা জেরুজালেম থেকে মৃত সাগরের উপকূলে প্রত্যাহৃত হয়ে গিয়েছিল। সেখানে তারা মঠচারি বিচ্ছিন্নতায় বাস করছিল। আইন ও প্রফেটসকে তারা শ্রদ্ধা করত, কিন্তু ভাব করত যেন কেবল তারাই তাদের উপরব্ধি করতে পারে। ১ তাদের নেতা ন্যায়ের গুরু এক প্রত্যাদেশ লাভ করেছিলেন যা তাকে ঐশীগ্রন্থে

‘গোপন বিষয়’ থাকার বিষয়ে নিশ্চিত করেছিল, যা কেবল একজন বিশেষ পেশার (অর্থউদ্ধার)-ব্যাখ্যাকারীর সাহায্যেই উন্মোচিত করা যেতে পারে। আইন ও প্রফেটসের প্রতিটি শব্দ এই শেষের দিনগুলোতে নিজস্ব গোষ্ঠীর দিকে চোখ ফিরিয়েছে। কামরান ছিল ইহুদি ইতিহাসের সামগ্রিকতা,

প্রকৃত ইসরায়েল। অচিরেই ঈশ্বর এক নতুন বিশ্বব্যবস্থার উন্মেষ ঘটাবেন, আলোর সন্তানদের চূড়ান্ত বিজয়ের পর মানুষের হাতে এর আগে কখনও নির্মিত হয়নি এমন এক বিশাল মন্দির নির্মিত হবে এবং মোজেসিয় কোভেন্যান্ট নতুন করে লিখিত হবে। এই অবসরে খোদ কামরান সম্প্রদায়ই একটা খাঁটি প্রতীকী মন্দির, জেরুজালেমের অপবিত্র মন্দিরকে যা প্রতিস্থাপিত করেছে। এর সদস্যরা পুরোহিতসুলভ আইন মেনে চলে, পোশাক পবিত্র করে এবং এমনভাবে খাবার ঘরে ঢোকে যেন মন্দিরের সীমানায় পা রাখছে।

কামরান ছিল এসীন আন্দোলনের একটা চরমপন্থী শাখা, বিসিই প্ৰথম শতাব্দী নাগাদ এর সদস্য সংখ্যা চার হাজারেরও বেশি ছিল।৪৩ বেশির ভাগ এসীনই মরুভূমির বদলে গ্রাম ও শহরে নিবিড় সমাজে বাস করত, তারা বিয়ে করত এবং তাদের সন্তান ছিল, তবে এমনভাবে জীবন যাপন করত যেন সময়ের সমাপ্তি এরই মধ্যে শুরু হয়ে গেছে। তারা শুদ্ধতার বিধি মেনে চলত, সবকিছু ছিল এজমালি সম্পত্তি, তালাক ছিল নিষিদ্ধ। ৪৪ সমবেতভাবে খাওয়াদাওয়া করত তারা, এই সময় আসন্ন রাজ্যের কল্পনা করত; কিন্তু মন্দিরের ধ্বংস আঁচ করতে পারলেও সেখানেই উপাসনা চালিয়ে গিয়েছে।

জনসংখ্যার ১.২ শতাংশ সদস্য সংখ্যা বিশিষ্ট আরেকটি গোষ্ঠী ফরিজিরা দারুণ সম্মানের অধিকারী ছিল। আইন ও প্রফেটসের প্রতি তাদের দৃষ্টিভঙ্গি অনেক বেশি প্রচল ধারার হয়ে থাকলেও গণ পুনরুত্থানের মতো নতুন ধারণার প্রতি উন্মুক্ত ছিল, যখন ন্যায়নিষ্ঠ মৃতরা ঈশ্বরের চূড়ান্ত বিজয়ে অংশ গ্রহণ করার জন্যে সমাধি থেকে জেগে উঠবে। তাদের অনেকেই ছিল সাধারণ মানুষ, এরা নিজেদের ঘরে পরিশুদ্ধতার বিধান পালন করে পুরোহিতসুলভ জীবন যাপনের প্রাণান্ত প্রয়াস পেয়েছিল যেন মন্দিরেই বাস করছে। অধিকতর রক্ষণশীল সাদুসিদের বিরোধিতার সম্মুখীন হয়েছিল এরা, যারা লিখিত টেক্সটের কঠোর ব্যাখ্যা করত এবং ব্যক্তিগত অমরত্বের নতুন ধরনের ধারণা মেনে নেয়নি।

লোকে মন্দিরের প্রতি গুরুত্ব আরোপ করেছিল, কারণ এটা তাদের ঈশ্বরের নৈকট্য দান করেছিল; এটা ব্যর্থ হলে ধর্ম তার যৌক্তিকতা হারাত। ঐশী সত্তায় প্রবেশের নতুন পথ আবিষ্কারের, একটি নতুন ঐশীগ্রন্থ প্রাপ্তি ও ইহুদি হওয়ার নতুন পথ আবিষ্কারের এক মরিয়া প্রয়াস চলছিল।৪৬ কোনও কোনও গোত্র প্রাচীন টেক্সট সম্পূর্ণ নতুনভাবে লিখেছে। ফার্স্ট বুক অভ ইনোকের লেখক কল্পনা করেছেন যে ঈশ্বর সম্পূর্ণ নতুনভাবে সব শুরু করার জন্যে সিনাই পাহাড় চূড়ায় মোজেসের আইন ও জমিন বিদীর্ণ করছেন। সিই দ্বিতীয় শতাব্দী পর্যন্ত ব্যাপকভাবে পঠিত জুবিলির লেখক কিছু কিছু পূর্ববর্তী রচনার নিষ্ঠুরতায় বিচলিত হয়ে ‘J’ ‘E’ ও ‘P’ বিবরণ সম্পূর্ণ নতুনভাবে পরিমার্জনা করেছেন। ঈশ্বর কি সত্যিই মহাপ্লাবনের মাধ্যমে মানবজাতিকে নিশ্চিহ্ন করতে চেয়েছেন, আব্রাহামকে তাঁর পুত্রকে হত্যার নির্দেশ দিয়েছেন ও সী অভ রীডসে মিশরিয় সেনাদলকে ডুবিয়ে মেরেছিলেন? তিনি স্থির করেন, ঈশ্বর প্রত্যক্ষভাবে মানুষের কর্মকাণ্ডে হস্তক্ষেপ করেন না; আমাদের চারপাশে আমরা যে দুঃখকষ্ট দেখি তার সবই শয়তান ও তার স্যাঙ্গাতদের কাজ।

সিই প্রথম শতাব্দীর আগে ‘মনোনীত ব্যক্তি’ মেসায়াহ জগতকে সঠিক পথে ফিরিয়ে আনতে আবির্ভূত হবেন এমন কোনও ব্যাপকভাবে গৃহীত প্রত্যাশা ছিল না।৪৭ এমন একজন ব্যক্তির কথা মাঝে মাঝে উল্লেখ সত্ত্বেও এটা ছিল একটা প্রান্তিক অবিকশিত ধারণা। বিধ্বস্ত দ্বিতীয় মন্দির কালের প্রলয়বাদী দৃশ্যপট সাধারণত ঈশ্বর মানুষের সহায়তা ছাড়াই এক নতুন বিশ্ব গড়ে তুলছেন বলে কল্পনা করেছে। পরে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে এমন কিছু ধারণার বিক্ষিপ্ত উল্লেখ ছিল। ‘ঈশ্বরের রাজ্য’ উদ্বোধনকারী’ ডেভিডিয় রাজার উল্লেখ ছিল, যিনি ‘গোয়িমদের বিচারের জন্যে বসবেন। আরেকটি টেক্সট এমন এক শাসকের কথা বলেছে যাকে ‘ঈশ্বরের পুত্র বলে ডাকা হবে’ এবং… ‘সবচেয়ে পরমের পুত্র ও বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠা করবেন, –স্পষ্টতই ইসায়াহর ভবিষ্যদ্বাণীর ইম্যানুয়েলের নস্টালজিক প্রত্যাশা। কিন্তু এইসব বিচ্ছিন্ন মতামত কোনও সামঞ্জস্যপূর্ণ দর্শন গড়ে তুলতে পারেনি।

বিসিই ৬৩ সালে রোমান জেনারেল পম্পেই প্যালেস্তাইন দখল করার পর তা সাম্রাজ্যের একটি প্রদেশে পরিণত হলে এর পরিবর্তন ঘটে। কোনওভাবে রোমান শাসন উপকারী ছিল। বিসিই ৩৭ থেকে ৪ বিসিই সাল পর্যন্ত জেরুজালেম শাসনকারী রোমের পৃষ্ঠপোষকতা লাভকারী রাজা হেরোদ বিশাল আকারে জেরুজালেম মন্দির পুনর্নির্মাণ করেছিলেন। বিভিন্ন উৎসবে যোগ দিতে তীর্থযাত্রীরা সেখানে ভীড় জমাত। কিন্তু রোমানরা অজনপ্রিয় ছিল। প্রিফেক্টদের কেউ কেউ, বিশেষ করে পন্তিয়াস পিলেত (২৬-৩৬ সিই) ইহুদি অনুভূতিতে আঘাত দেওয়ার জন্যে উঠে পড়ে লেগেছিলেন। পয়গম্বরদের এক সদস্য গণঅভ্যুত্থান সৃষ্টির প্রয়াস পেয়েছিলেন। জনৈক থিওদাস চারশো লোককে মরুভূমিতে নিয়ে গিয়েছিলেন ঈশ্বর তাদের সেখানেই মুক্তি দেবেন প্রতিশ্রুতি দিয়ে। ‘ইজিপ্টশিয়ান’ নামে পরিচিত এক পয়গম্বর মন্দিরের পাশেই উস্কানীমূলকভাবে দাঁড়ানো রোমান দুর্গে হানা দিতে কয়েক হাজার লোককে মাউন্ট অভ অলিভসে সমবেত হতে রাজি করিয়েছিলেন। এইসব অভ্যুত্থানের বেশিরভাগই নিষ্ঠুরভাবে দমন করা হয়। একবার রোমানরা জেরুজালেমের বাইরে অন্তত দুই হাজার বিদ্রোহীকে ক্রুশবিদ্ধ করে হত্যা করে। সিই ২০-এর দশকের সময় এক নিগূঢ় সাধক জন দ্য ব্যাপ্টাইজার, যিনি সম্ভবত এসীন আন্দোলনে জড়িত থেকে থাকবেন, জুদাহর মরুভূমিতে বিশাল সমাবেশের আয়োজন করেছিলেন। এখানে তিনি শিক্ষা দেন যে, ‘স্বর্গরাজ্য সন্নিকট হইল।’৫১ এক ব্যাপক বিচার অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে; ইহুদিদের পাপ স্বীকার করে, জর্দান নদীতে অবগাহন করে ও গ্লানিহীন সৎ জীবন যাপনের প্রতিজ্ঞা করে সেই বিচারের জন্যে প্রস্তুত থাকতে হবে।৫২ যদিও জন রোমান শাসনের বিরুদ্ধে প্রচারণা চালাচ্ছেন বলে মনে হয়নি, কর্তৃপক্ষ তাঁকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিল।

জন কোনওভাবে মোটামুটি একই সময়ে অত্যাসন্ন ঈশ্বরের রাজ্যর আগমনের ঘোষণাদানকারী গালিলিয় হীলার ও ওঝা নাযারেথের জেসাসের সাথে সম্পর্কিত ছিলেন মনে হয়।৫৩ বিশেষ করে ব্যাপকভাবে উদযাপিত জাতীয় উৎসবে রোমান বিরোধী অনুভূতি প্রবল হয়ে উঠত। আনুমানিক সিই ৩০ সালের দিকে পন্তিয়াস পিলেত কর্তৃক জেসাসের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়েছিল। তিনি এই সময় পাসওভার উদযাপনের লক্ষ্যে এখানে এসেছিলেন। কিন্তু তাতে জেসাস আন্দোলনের অবসান ঘটেনি। তাঁর কিছু সংখ্যাক অনুসারী নিশ্চিত ছিল যে তিনি সমাধি থেকে পুনরুজ্জীবীত হয়েছেন, তারা দিব্যদৃষ্টিতে তাঁকে দেখার দাবি করে, তাঁর ব্যক্তিগত পুনরুত্থান কলিকালের সূচনা ঘটিয়েছে, যখন ন্যায়নিষ্ঠভাবে মৃত্যুবরণকারীরা কবর থেকে পুনরুত্থিত হবে। অচিরেই রাজ্যের উদ্বোধন করা জন্যে প্রতাপের সাথে আবির্ভূত হবেন জেসাস। জেরুজালেমে তাদের নেতা ছিলেন জেসাসের ভাই জেমস, ইনি যাদ্দিক- ন্যায়বান–হিসাবে পরিচিত ছিলেন। ফারিজি ও এসীনদের সাথে ভালো সম্পর্ক ছিল তাঁর। কিন্তু আন্দোলন ডায়াসপোরার গ্রিকভাষী ইহুদিদেরও আকৃষ্ট করেছিল। সবচেয়ে বিস্ময়করভাবে অ-ইহুদি ‘গডফিয়ারারদের’ একটা উল্লেখযোগ্য অংশ (সিনাগগের সম্মানিত সদস্য ছিল তারা) কে আকৃষ্ট করে।

জেসাস আন্দোলন প্যালেস্তাইনে ছিল অস্বাভাবিক, যেখানে অনেক গোষ্ঠীই জেন্টাইলদের প্রতি বৈরী ছিল, কিন্তু ডায়াসপোরায় ইহুদি আধ্যাত্মিকতার অপেক্ষাকৃত কম বর্জনবাদী প্রবণতা ছিল ও হেলেনিস্টিক ধারণার প্রতি বেশ উন্মুক্ত। আলেকজান্দার দ্য গ্রেট প্রতিষ্ঠিত মিশরের আলেকজান্দ্রিয়া শহরে এক বিশাল ইহুদি সম্প্রদায় বাস করত। শিক্ষার অন্যতম প্রধান পাদপীঠে পরিণত হয়েছিল শহরটি। আলেকজান্দ্রিয়ার ইহুদিরা জিমনাসিয়ামে পড়াশোনা করত, কথা বলত গ্রিক ভাষায় এবং গ্রিক ইহুদি সংস্কৃতির কৌতূহলোদ্দীপক সংশ্লেষ ঘটাতে সক্ষম হয়েছিল। কিন্তু তাদের অল্প কয়েকজনই ধ্রুপদী হিব্রু পাঠ করতে পারত বলে তোরাহ বুঝতে পারত না। প্রকৃতপক্ষে এমনকি প্যালেস্তাইনেও ইহুদিরা হিব্রুর বদলে বরং আমামিয় ভাষায় কথা বলত; সিনাগগে আইন ও প্রফেটস উঁচু গলায় পাঠ করার সময় তাদের অনুবাদ (তারগাম) প্রয়োজন হতো।

আলেকজান্দ্রিয়া উপকূলের অল্প দূরে ফারোস দ্বীপে বিসিই তৃতীয় শতাব্দীতে ইহুদিরা তাদের ঐশীগ্রন্থ অনুবাদ শুরু করেছিল।৫৪ খোদ আলেকজান্দ্রিয় ইহুদিদের হাতেই সম্ভবত এই প্রকল্পের সূচনা হয়েছিল, কিন্তু বছর পরিক্রমায় তা এক পৌরাণিক আভা লাভ করে। বলা হয়ে থাকে, মিশরের গ্রিক রাজা টলেমী ফিলাদেলপাস ইহুদি ঐশীগ্রন্থে এতটাই বিমোহিত হয়েছিলেন যে তিনি লাইব্রেরির জন্যে এর অনুবাদ চেয়ে বসেন। তো জেরুজালেমের প্রধান পুরোহিতকে বার গোত্রের প্রতিটি গোত্র থেকে ছয়জন করে প্রবীন ব্যক্তিকে ফারোসে পাঠানোর নির্দেশ দেন তিনি। তাঁরা সমবেতভাবে টেক্সট নিয়ে কাজ করে এমন নিখুঁত এক অনুবাদ তৈরি করেছিলেন যে সবাই একমত হয়েছিল একে চিরকালের জন্যে অবশ্যই ‘ধ্বংসের অতীত ও অপরিবর্তনীয়ভাবে’৫৫ সংরক্ষণ করতে হবে। সত্তর জনেরও বেশি অনুবাদকের সম্মানে এটা সেটূজিন্ট নামে পরিচিত হয়ে ওঠে। আরেকটা কিংবদন্তী নতুন তোরাহর আধ্যাত্মিকতার উপাদান আত্মস্থ করেছিল বলে মনে হয়। সত্তর জন অনুবাদক ‘রহস্যের পুরোহিত ও গুরু’ প্রমাণিত হয়েছিলেন: ‘বিচ্ছিন্ন অবস্থায় বসে…তাঁরা, বলা হয়ে থাকে, আচ্ছন্ন হয়ে পড়েন এবং অনুপ্রাণিত হয়ে লিখতে থাকেন, প্রত্যেক ভিন্ন লিপিকার ভিন্ন কিছু লিখেননি, বরং হুবহু একই কথা লিখে গেছেন।’৫৬ ব্যাখ্যাকারদের মতো অনুবাদকগণও অনুপ্রাণিত ছিলেন এবং খোদ বাইবেলিয় লেখকদের মতোই ঈশ্বরের বাণী উচ্চারণ করেছেন।

এই শেষ কাহিনীটি বলেছেন বিখাত আলেকজান্দ্রিয় ব্যাখ্যাকার ফিলো (বিসিই ৭০ থেকে সিই ৪৫০)। আলেকজান্দ্রিয়ার এক ধনী ইহুদি পরিবারে জন্ম হয়েছিল তাঁর।৫৭ ফিলো জন দ্য ব্যাপ্টাইজার, জেসাস দ্য হিলার ও হিল্লেলের (আদি ফারিজিদের ভেতর অন্যতম উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিত্ব) সমসাময়িক হলেও একেবারেই ভিন্ন বুদ্ধিবৃত্তিক বিশ্বে বাস করতেন। প্লেটোবাদী ফিলো জেনেসিস ও এক্সোডাসের উপর বিপুল পরিমাণ ধারাভাষ্য রচনা করেছিলেন, সেগুলোকে এসব স্বর্গীয় লোগোসের (যুক্তি) উপমায় পরিণত করেছিল। এটা ছিল ত্রান্সলেতিও’র আরেকটা নজীর। ফিলো সেমিটিক কাহিনীগুলোর মূল সুরকে অন্য এক সংস্কৃতির বাগধারায় ‘স্থানান্তর’ বা ‘বহন করে’ নিয়ে যেতে চাইছিলেন ও সেগুলোকে বিদেশী ধারণাগত কাঠামোয় স্থাপিত করার প্রয়াস পাচ্ছিলেন।

ফিলো নীতিকথামূলক পদ্ধতির আবিষ্কার করেননি। আলেকজান্দ্রিয়ার গ্রামাতিকোইরা ইতিমধ্যে হোমারের মহাকাব্যসমূহকে দার্শনিক পরিভাষায় ‘অনুবাদ’ করছিলেন যাতে প্লেটো ও অ্যারিস্টটলের যুক্তিবাদে প্রশিক্ষিত গ্রিকরা তাদের প্রজ্ঞার অনুসন্ধানের অংশ হিসাবে ইলিয়াদ ও ওডিসি-কে কাজে লাগাতে পারে। তাঁরা তাদের নীতিকথাগুলোকে সংখ্যাতত্ত্ব ও শব্দবিজ্ঞানের উপর বিস্তৃত করেছেন। এর দৈনন্দিন উচ্চারণের বাইরে প্রত্যেক নামের এক গভীর প্রতীকী অর্থ ছিল যা এর চিরন্তন প্লেটোনিয় আকৃতি প্রকাশ করে। ধ্যান ও গবেষণার মাধ্যমে সমালোচক এই গভীর তাৎপর্য আবিষ্কার করতে পারেন ও এভাবে হোমারিয় গল্পগুলোকে নৈতিক দর্শনের নীতিকথায় পরিণত করতে পারেন। ইহুদি ব্যাখ্যাকাররা ইতিমধ্যে বাইবেলের ক্ষেত্রে এই পদ্ধতি ব্যবহার শুরু করেছিলেন, গ্রিকদের প্রশিক্ষিত মনের কাছে একে বর্বোরোচিত ও বোধের অগম্য মনে হয়েছে। তারা হিব্রু নামের গ্রিক অনুবাদ সরবরাহকারী ম্যানুয়েল পর্যালোচনা করেছে। উদাহরণ স্বরূপ, আদম পরিণত হয়েছেন নাউসে (স্বাভাবিক যুক্তি), ইসরায়েল সাইকি (আত্মা) এবং মোজেস সোফিয়ায় (প্রজ্ঞা)। এই পদ্ধতি বাইবেলিয় বর্ণনায় সম্পূর্ণ নতুন আলো ফেলে। চরিত্রগুলো কি তাদের নামের সাথে খাপ খায়? একটা বিশেষ কাহিনী মানুষের টানাপোড়েন সম্পর্কে কী তুলে ধরে? পাঠক তাঁর নিজস্ব অন্তর্দৃষ্টির সন্ধানে কেমন করে একে কাজে লাগাতে পারে?

বাইবেলিয় বিবরণে এই পদ্ধতি প্রয়োগ করে ফিলো মৌলিক কিছু আবিষ্কার করছেন বলে ভাবেননি। এইসব গল্পের আক্ষরিক অর্থকে খুবই গুরুত্বের সাথে নিয়েছিলেন তিনি,৫৮ কিন্তু দানিয়েলের মতো তিনিও নতুন কিছুর খোঁজ করছিলেন। আক্ষরিক অর্থের চেয়ে গল্পের ভেতর বেশি কিছু আছে। প্লেটোবাদী ফিলো বিশ্বাস করতেন যে, বাস্তবতার সময়হীন মাত্রা এর ভৌত বা ঐতিহাসিক মাত্রার চেয়ে ঢের বেশি ‘বাস্তব’। তো জেরুজালেম মন্দির সন্দেহাতীতভাবে সত্যিকারের দালান হলেও এর স্থাপত্য মহাবিশ্বকে প্রতীকায়িত করে; সুতরাং মন্দির ঈশ্বরের এক চিরন্তন প্রকাশও ছিল, যিনি খোদ সত্যি। ফিলো দেখাতে চেয়েছিলেন যে বাইবেলিয় কাহিনীগুলো গ্রিকরা যাকে মিথোস বলে ঠিক তাই: এক বিশেষ মুহূর্তে বাস্তব পৃথিবীতে যেসব ঘটনা ঘটেছে, কিন্তু এসবের সময়কে অতিক্রম করে যাওয়া একটা মাত্রাও রয়েছে। এগুলোকে ঐতিহাসিক পরিপ্রেক্ষিত থেকে মুক্ত করা না হলে এবং বিশ্বাসীর জীবনে আধ্যাত্মিক বাস্তবতায় পরিণত না হলে তাদের কোনও ধর্মীয় কার্যকারিতা থাকবে না। অ্যালিগোরিয়ার প্রক্রিয়া এইসব কাহিনীর গভীরতম অর্থকে পাঠকের অন্তস্থ জীবনে ‘অনুবাদ’ করেছে।

তাত্ত্বিকগণ কোনও একটা বয়ানের উপরিতলের অর্থের চেয়ে ভিন্ন কোনও অর্থ বোঝাতে অ্যালিগোরিয়া পরিভাষা ব্যবহার করেছেন। ফিলো এই পদ্ধতিকে হাইপোনোইন ‘উচ্চতর/গভীর চিন্তা’ বলতে পছন্দ করতেন। কারণ সত্যির আরও মৌলিক স্তরে পৌঁছানোর প্রয়াস পাচ্ছিলেন তিনি। তিনি তাঁর ব্যাখ্যাকে টেক্সট ও তরজমাকারী উভয়েরই ‘পরিবর্তন’ হিসাবে বোঝাতে চাইতেন। টেক্সটকে অবশ্যই ‘ঘুরিয়ে নিতে’ (ত্রেপেইন)৫৯ হয়েছে। তরজমাকারী কোনও দুবোর্ধ্য রচনা নিয়ে সংগ্রাম করার সময়, যেমন বলা হয়েছে, এটাকে এভাবে ঘোরাতে হবে যাতে আরও পরিষ্কারভাবে দেখার জন্যে তাকে আলোর কাছে নিয়ে আসা যায়। অনেক সময় তাকে টেক্সটের সাথে সঠিক সম্পর্কে দাঁড়াতে অবস্থান বদলাতে হয় এবং ‘মনের অবস্থা পরিবর্তন’ করতে হয়।

ত্রেপেইন কোনও কাহিনীর বহু ভিন্ন ভিন্ন স্তর তুলে ধরে, কিন্তু ফিলো জোর দিয়ে বলেছেন, ব্যাখ্যাকারকে অবশ্যই তাঁর পাঠের সমগ্র জুড়ে বহমান একটা কেন্দ্রিয় সূত্র খুঁজে বের করতে হবে। অন্তর্নিহিত দার্শনিক তাৎপর্য আবিষ্কারের লক্ষ্যে কেইন ও অ্যাবেলের কাহিনীর উপর চারটি থিসিস রচনা করেন তিনি। শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছান যে, এর মূল ভাব হচ্ছে আত্মপ্রেম ও ঈশ্বরের প্রতি ভালোবাসার ভেতরকার যুদ্ধ। ‘কেইন’ মানে ‘অধিকার’: যে সমস্ত কিছু নিজের অধিকারে রেখে দিতে চেয়েছিল, তাঁর মূল লক্ষ্য ছিল নিজের স্বার্থ রক্ষা। ‘আবেল’ মানে ‘সব কিছু যে ঈশ্বরকে দান করে।’ এইসব বৈশিষ্ট্য প্রতিটি মানুষের সমাজেই আছে এবং ব্যক্তির মাঝে অবিরাম লড়াই করে যচ্ছে। অন্য এক ‘পরিবর্তনে’ কাহিনীটি প্রকৃত ও মিথ্যা বাগ্মীতার ভেতরের বিরোধকে তুলে ধরেছে। আবেল কেইনের ঘোরাল যুক্তির উত্তর দিতে পারেননি, কিন্তু ভাই তাঁকে হত্যা না করা পর্যন্ত মুখ বন্ধ করে অসহায় অবস্থায় ছিলেন। ফিলো ব্যাখ্যা করেছেন, অহমবাদ নাগালের বাইরে গিয়ে আমাদের মাঝে ঈশ্বরের প্রতি ভালোবাসাকে ধ্বংস করে দিলে এমনটা ঘটে। ফিলো যেমন ইঙ্গিত করেছেন, জেনেসিস আলেকজান্দ্রিয়ার গ্রিক শিক্ষিত ইহুদিদের কাছে একটা কাঠামো ও প্রতীকীবাদ দিয়েছিল যা তাদের আধ্যাত্মিক জীবনের কঠিন কিন্তু মৌল সত্যি সম্পর্কে চিন্তা ভাবনা করতে সক্ষম করে তুলেছিল। ঈশ্বরের বাইবেলিয় ধারণাকেও পরিমার্জিত করেছিলেন ফিলো, প্লেটোবাদীর কাছে যাঁকে ভয়াবহভাবে মানুষরূপী মনে হতে পারে। ‘আমার উপলব্ধি মানবীয় প্রকৃতির চেয়ে ভিন্ন কিছু, হ্যাঁ, গোটা স্বর্গ ও মহাবিশ্ব যাকে ধারণ করতে পারবে,’ ঈশ্বরকে দিয়ে মোজেসকে বলিয়েছেন তিনি।৬১ ফিলো মানুষের কাছে সম্পূর্ণ দুর্বোধ্য ঈশ্বরের অউসা, সত্তা ও জগতে আমাদের উপলব্ধিযোগ্য তাঁর কর্মকাণ্ড (এনারজিয়াই) ও শক্তি (দিনামিক্স)-এর দুস্তর পার্থক্য সৃষ্টি করেছেন। ঐশীগ্রন্থে ঈশ্বরের অউসা সম্পর্কে কিছুই উল্লেখ করা হয়নি, আমরা কেবল তাঁর শক্তি সম্পর্কে পাঠ করি, যার একটা হচ্ছে মহাবিশ্বকে আকার দানকারী যৌক্তিক পরিকল্পনা ঈশ্বরের বাণী বা লোগোস।৬২ বেন সিরাহর মতো ফিলো বিশ্বাস করতেন, সৃষ্টি ও তোরাহয় আমরা যখন লোগোসের আভাস পাই, তখন এলোমেলো যুক্তির ঊর্ধ্বে চলে যাই এমন এক পরমানন্দের স্বীকৃতিতে যে ঈশ্বর ‘ভাবনার চেয়ে উর্ধ্বে, স্রেফ ভাবনা চিন্তার মতো কোনও কিছুর চেয়ে অনেক বেশি মূল্যবান।৬৩

ফিলো যুক্তি দেখিয়েছেন যে, আক্ষরিকভাবে জেনেসিসের প্রথম অধ্যায় পাঠ করা ও বিশ্ব ছয় দিনে সৃষ্টি হয়েছে কল্পনা করা বোকামি হবে। ‘ছয়’ সংখ্যাটি ছিল পূর্ণতার প্রতীক। তিনি লক্ষ করেছিলেন, জেনেসিসে দুটো সম্পূৰ্ণ ভিন্ন সৃষ্টি-কাহিনী রয়েছে। তিনি স্থির করেছিলেন, প্রথম অধ্যায়ে ‘P’র বিবরণ মহাবিশ্বের মহাপরিকল্পনা লোগোসের সৃষ্টিকে বর্ণনা করেছে, যা ঈশ্বরের ‘প্রথম জন্ম’৬৪ ছিল; এবং দ্বিতীয় অধ্যায়ে ‘J’র অধিকতর পার্থিব বিবরণ দেমিঅউরগোসদের-প্লেটোর তিমাইউসে’র স্বর্গীয় ‘কারিগর’দের হাতে বস্তুগত জগতের বিন্যাস প্রতীকায়িত করেছে, যারা সুশৃঙ্খল মহাবিশ্ব নির্মাণ করতে কাঁচামাল যোগাড় করেছিল।

ফিলোর ব্যাখ্যা কেবল নাম ও সংখ্যার চতুর খেলায় মেতে ছিল না, বরং তা ছিল আধ্যাত্মিক অনুশীলন। যেকোনও প্লেটোবাদীর মতোই জ্ঞানকে স্মরণ করা হিসাবে অনুভব করেছেন তিনি, সত্তার কোনও গভীর স্তরে আগে থেকেই যা তাঁর জানা। বাইবেলিয় বিবরণের আক্ষরিক অর্থের গভীরে অবস্থান করার সময় এর গভীর দার্শনিক নীতিমালা আবিষ্কার করে শনাক্তকরণের একটা ধাক্কা অনুভব করেছেন। সহসা কাহিনী তাঁরই সত্তার অংশ সত্যির সাথে মিশে গেছে। অনেক সময় তিনি বই নিয়ে গম্ভীরভাবে সংগ্রাম করেছেন, মনে হয়েছে কোনও রকম অগ্রগতিই হচ্ছে না, কিন্তু তারপর প্রায় কোনও রকম পূর্বাভাস ছাড়াই কোনও রহস্য কাল্টের পুরোহিতের মতো পরমানন্দ অনুভব করেছেন:

আমি…সহসা পরিপূর্ণ হয়ে উঠলাম, ধারণাগুলো তুষারপাতের মতো নেমে আসছে, যার ফলে স্বর্গীয় প্রভাবে আমি করিব্যান্টিক উন্মাদনায় ভরে উঠলাম এবং স্থান-কাল-পাত্র, বর্তমান, নিজেকে কী বলা হয়েছে, কী লেখা হয়েছে, সবকিছু সম্পর্কে সম্পূর্ণ অজ্ঞ হয়ে গেলাম। কেননা আমি অভিব্যক্তি, ধারণা, জীবনের আনন্দ, বস্তুর স্পষ্ট স্বচ্ছলতা অতিক্রম করে যাওয়া তীক্ষ্ণ দর্শন, যা সবচেয়ে স্পষ্ট উপস্থাপনের ফলে চোখের সামনে উপস্থিত হতে পারে তা অর্জন করলাম।

ফিলোর মৃত্যুর বছরে আলেকজান্দ্রিয়ার ইহুদিদের বিরুদ্ধে হত্যাকাণ্ড পরিচালিত হয়েছিল। গোটা রোমান সাম্রাজ্যে সৃষ্টি হয়েছিল ইহুদি অভ্যুত্থানের ব্যাপক ভীতি। সিই ৬৬ সালে একদল ইহুদি উগ্রপন্থী প্যালেস্তাইনে এক বিদ্রোহ ঘটাতে সক্ষম হয়, ঘটনাক্রমে তা রোমান সেনাবাহিনীকে টানা চার বছর ঠেকিয়ে রাখে। বিদ্রোহ ডায়াসপোরার ইহুদি সম্প্রদোেয়র মাঝে ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কায় কর্তৃপক্ষ নিষ্ঠুরভাবে একে দমন করতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ ছিল। ৭০ সালে সম্রাট ভেসপাসিয়ান অবশেষে জেরুজালেম অধিকার করে নেন। রোমান সৈনিকরা মন্দিরের অভ্যন্তরীণ দরবারে জোর করে প্রবেশ করার সময় সেখানে ছয় হাজার ইহুদি উগ্রপন্থীকে দেখতে পায়। যুদ্ধ করে প্রাণ দিতে প্রস্তুত। মন্দিরে আগুন ধরতে দেখার পর আকাশ ফাটানো কান্নার আওয়াজ ওঠে। কেউ কেউ নিজেদের রোমানদের তলোয়ারের নিচে সঁপে দেয়, অন্যরা ঝাঁপ দেয় আগুনে। মন্দির ধ্বংস হয়ে যাবার পর ইহুদিরা হাল ছেড়ে দেয়, তারা আর শহরের অবশিষ্ট অংশের প্রতিরক্ষা নিয়ে মাথা ঘামায়নি, বরং অসহায়ভাবে তিতু’র সৈন্যদের শহরের যা কিছু অবশিষ্ট ছিল তা ধ্বংস করে দিতে দেখেছে।৬৬ শত শত বছর ধরে মন্দির ইহুদি বিশ্বের হৃদয়ে অবস্থান করেছে, এটা ছিল ইহুদি ধর্মের কেন্দ্রবিন্দু। আরও একবার তাকে ধ্বংস করে ফেলা হলো, কিন্তু এবার আর তা নতুন করে নির্মিত হবে না। বিধ্বস্ত দ্বিতীয় মন্দির কালে সমৃদ্ধি লাভ করা ইহুদি গোত্রের ভেতর মাত্র দুটি সামনে অগ্রসর হওয়ার পথ খুঁজে পেয়েছিল। প্রথম যারা এমন করেছে তারা ছিল জেসাস আন্দোলন, যা বিপর্যয়ের ফলে এক সম্পূর্ণ নতুন ঐশীগ্রন্থের সংকলন লিখতে অনুপ্রাণিত হয়েছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *