৬. প্যারালাল কোয়ান্টাম মহাবিশ্ব
আমি নিশ্চিতভাবে বলতে পারি, কোয়ান্টাম মেকানিকস কেউ বোঝে না।
—রিচার্ড ফাইনম্যান
কোয়ান্টাম তত্ত্বের মাধ্যমে কেউ যদি প্রচণ্ড ধাক্কা না খায়, তাহলে তত্ত্বটা আসলে সে বোঝেইনি।
—নীলস বোর
এক সেকেন্ডের ভগ্নাংশ সময়ের মধ্যে বিপুল আন্তনাক্ষত্রিক দূরত্ব পাড়ি দেওয়ার জন্য ইনফিনিট ইমপ্রোবাবিলিটি ড্রাইভ দুর্দান্ত একটা পদ্ধতি। এতে হাইপারস্পেসের বিরক্তিকর নোংরামি নেই।
—ডগলাস অ্যাডামস
.
ডগলাস অ্যাডামসের লেখা বেস্টসেলিং, ব্যঙ্গাত্মক আর উদ্ভট বিজ্ঞান কল্পকাহিনি দ্য হিচহাইকার’স গাইড টু দ্য গ্যালাক্সি। নক্ষত্রে ভ্রমণের জন্য সবচেয়ে বুদ্ধিদীপ্ত এক পদ্ধতি আবিষ্কার করেছিল এ উপন্যাসের নায়ক। এক গ্যালাক্সি থেকে আরেক গ্যালাক্সিতে যাওয়ার জন্য সে কোনো ওয়ার্মহোল, হাইপারড্রাইভ কিংবা ডাইমেনশনাল পোর্টাল ব্যবহার করত না। বিপুল আন্তনাক্ষত্রিক দূরত্ব এক লহমায় অতিক্রম করতে অনিশ্চয়তার নীতি ব্যবহারের চিন্তা করেছিল সে। আমরা যদি কোনোভাবে নির্দিষ্ট অসম্ভাব্য ঘটনার সম্ভাবনা নিয়ন্ত্রণ করতে পারি, তাহলে যেকোনো কিছু আলোর চেয়ে বেশি বেগে চলা সম্ভব। এমনকি এভাবে টাইম ট্রাভেলও করা যাবে। দূরের কোনো নক্ষত্রে পৌঁছানো খুবই অসম্ভব। কিন্তু কেউ যদি ইচ্ছেমতো কোয়ান্টাম সম্ভাবনা নিয়ন্ত্রণ করতে পারে, তাহলে অসম্ভব ব্যাপারগুলোও তার কাছে স্রেফ জলভাত হয়ে যাবে।
কোয়ান্টাম তত্ত্ব এক সম্ভাবনার ধারণার ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। অর্থাৎ সব সম্ভাব্য ঘটনা, তা যত অবিশ্বাস্য বা অর্থহীন মনে হোক না কেন, তা ঘটা হয়তো সম্ভব। এর পরিণতিতে দেখা যায়, এটা স্ফীতিশীল মহাবিশ্ব তত্ত্বের ঠিক কেন্দ্রস্থলে বসে রয়েছে। আদি মহাবিস্ফোরণ ঘটনার সময় সেখানে নতুন অবস্থার একটা কোয়ান্টাম সন্ধিকাল ছিল। সেখানে হুট করে বিপুল বেগে ফুলে উঠতে শুরু করে মহাবিশ্ব। এতে দেখা গেল, আমাদের গোটা মহাবিশ্ব হয়তো অসম্ভব কোনো কোয়ান্টাম লাফ দিয়ে আবির্ভূত হয়েছে। বলা বাহুল্য, ডগলাস অ্যাডামস এগুলো কৌতুক করে বলেছেন। তবে আমরা পদার্থবিদেরা বুঝতে পারি, কোনো উপায়ে এসব সম্ভাবনা নিয়ন্ত্রণ করা গেলে, এমন সব কাজ করা সম্ভব, যাকে ম্যাজিক থেকে আলাদা করা কঠিন। তবে বর্তমান সময়ে ঘটনার সম্ভাবনা বদলে দেওয়া আমাদের প্রযুক্তির পক্ষে কোনোভাবেই সম্ভব নয়।
বিশ্ববিদ্যালয়ে মাঝেমধ্যে আমাদের পিএইচডি শিক্ষার্থীদের আমি কিছু সহজ- সরল প্রশ্ন জিজ্ঞেস করি। যেমন তোমাদের এমন সম্ভাবনা গণনা করো, যাতে তোমরা হঠাৎ বিলীন হয়ে যাবে এবং তারপর দেয়ালের অন্য পাশে আবারও মূর্ত হয়ে উঠবে। কোয়ান্টাম তত্ত্ব অনুসারে, এখানে ছোট হলেও একটা গণনাযোগ্য সম্ভাবনা থাকে, যাতে এমন ঘটনা ঘটতে পারে। কিংবা এ ক্ষেত্রে আমরা নিজেদের ঘরের ভেতরেই শূন্যে উবে বা মিলিয়ে যেতে পারি, তারপর আবার হয়তো উদয় হতে পারি সুদূর মঙ্গল গ্রহে। কোয়ান্টাম তত্ত্ব বলে, তাত্ত্বিকভাবে এভাবে যে কেউ হঠাৎ ওই লাল গ্রহে মূর্ত হয়ে উঠতে পারে। এই সম্ভাবনা অবশ্য খুব অল্প। তাই হয়তো মহাবিশ্বের জীবনকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করে বসে থাকতে হতে পারে। ফলে দৈনন্দিন জীবনে আমরা এ ধরনের অসম্ভব ঘটনাগুলোকে নাকচ করে দিতে পারি। কিন্তু অতি পারমাণবিক পর্যায়ে এ ধরনের অসম্ভাব্য ঘটনা ইলেকট্রনিকস, কম্পিউটার ও লেজারের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ।
আসলে আপনার পিসি আর সিডির উপাদানগুলোর ভেতরে ইলেকট্রন নিয়মিতভাবে উবে যায়। তারপর দেয়ালের অন্য পাশে আবারও মূর্ত হয়ে ওঠে। ইলেকট্রন যদি এভাবে একই সময়ে দুই জায়গায় থাকার অনুমতি না পেত, তাহলে আধুনিক সভ্যতা ভেঙে পড়ত তাসের ঘরের মতো! (এই উদ্ভট নীতি ছাড়া আপনার দেহের অণুগুলোও ভেঙে যাবে। নিউটনের মহাকর্ষ সূত্র মেনে মহাকাশে দুটি সৌরজগতের সংঘর্ষ হচ্ছে বলে কল্পনা করুন। সংঘর্ষরত সৌরজগৎ দুটো গ্রহ আর গ্রহাণুদের একটা তালগোল পাকানো বিশৃঙ্খলার মধ্যে পড়বে। একইভাবে পরমাণুও যদি নিউটনের এই সূত্র মেনে চলত, তাহলে অন্য পরমাণুর সঙ্গে তাদের ধাক্কা লাগলেই তারা ভেঙে চুরমার হয়ে যেত। দুটি অণুকে যেটি স্থিতিশীল রাখে, সেটা হলো ইলেকট্রন একই সময়ে অনেকগুলো জায়গায় থাকতে পারে। এর মাধ্যমে তারা ইলেকট্রন মেঘ গঠন করে। এটাই পরমাণুগুলোকে একত্রে বেঁধে রাখে। কাজেই অণুর স্থিতিশীল হওয়ার কারণ এবং মহাবিশ্ব ভেঙে না পড়ার কারণ হলো, ইলেকট্রন একই সময়ে বিভিন্ন জায়গায় অবস্থান করতে পারে।)
কিন্তু ইলেকট্রন যদি সমান্তরাল অবস্থায় টিকে থাকতে পারে, অর্থাৎ অস্তিত্ব আর অনস্তিত্বের মধ্যে থাকে, তাহলে মহাবিশ্ব কেন পারবে না? সর্বোপরি, একটা জায়গায় মহাবিশ্ব একটা ইলেকট্রনের চেয়েও ছোট ছিল। সম্ভাবনার কোয়ান্টাম নীতি একবার মহাবিশ্বে প্রয়োগ করা হলে, আমরা প্যারালাল বা সমান্তরাল মহাবিশ্বের কথা ভাবতে বাধ্য হব।
ঠিক এই সম্ভাবনা অনুসন্ধান করেছিলেন ফিলিপ কে. ডিক তাঁর লেখা দ্য ম্যান ইন দ্য হাই ক্যাসলনামের গোলমেলে সায়েন্স ফ্যান্টাসি গল্পে। ওই বইতে একটা বিকল্প মহাবিশ্বের কথা বলা হয়েছে। গুরুত্বপূর্ণ এক ঘটনার কারণে ওই মহাবিশ্বটা আমাদেরটা থেকে একেবারেই আলাদা। ১৯৩৩ সালে প্রেসিডেন্ট রুজভেল্ট ক্ষমতায় বসার প্রথম বছরে আততায়ীর গুলিতে নিহত হন। এরপর এই মহাবিশ্বের বিশ্ব ইতিহাস পাল্টে যায়। এরপর ক্ষমতা গ্রহণ করেন ভাইস প্রেসিডেন্ট গার্নার। একটা বিচ্ছিন্ন নীতি প্রতিষ্ঠা করার কারণে সামরিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ে যুক্তরাষ্ট্র। ফলে পার্ল হারবারে আক্রমণের সময়েও অপ্রস্তুত ছিল তারা। আবার গোটা মার্কিন নৌবাহিনীকে ধ্বংস থেকে উদ্ধার করতে ব্যর্থ হয় দেশটি। এ কারণে ১৯৪৭ সালে জার্মান আর জাপানিদের কাছে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয় যুক্তরাষ্ট্র। তার পরিণতিতে যুক্তরাষ্ট্র ভেঙে তিন টুকরো হয়ে যায়। পূর্ব উপকূলের নিয়ন্ত্রণ নেয় জার্মান রাইখ, জাপানি বাহিনী নিয়ন্ত্রণ দখল করে পশ্চিম উপকূলের। আর এ দুটোর মাঝখানে রকি পর্বত এলাকাকে রাখা হয় বাফার স্টেট হিসেবে। এই সমান্তরাল মহাবিশ্বে এক রহস্যময় ব্যক্তি বাইবেলের একটা লাইনের ওপর ভিত্তি করে একটা বই লেখেন। যার নাম দ্য গ্র্যাসহপার লাইস হেভি। নাৎসিরা বইটিকে নিষিদ্ধ করে। বইটিতে একটা বিকল্প মহাবিশ্বের কথা বলা হয়। সেখানে রুজভেল্ট আততায়ীর হাতে নিহত হননি। আবার নাৎসি বাহিনীকে পরাজিত করে যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেন। গল্পটির নায়িকার মিশন ছিল, এ রকম বিকল্প কোনো মহাবিশ্বের অস্তিত্ব সত্যিই আছে কি না, যেখানে অত্যাচার ও বর্ণবাদের পরিবর্তে গণতন্ত্র আর স্বাধীনতা বিরাজ করছে—তা অনুসন্ধান করা।
টোয়াইলাইট জোন
দ্য ম্যান ইন দ্য হাই ক্যাসল-এর বিশ্ব এবং আমাদের বিশ্ব আলাদা হয়ে গিয়েছিল ছোট্ট এক দুর্ঘটনার কারণে। মাত্র একজন আততায়ীর গুলির কারণে। তবে একটা সমান্তরাল বিশ্বও হয়তো আমাদের থেকে ক্ষুদ্র কোনো সম্ভাব্য ঘটনার কারণে পৃথক হয়ে যেতে পারে। সেটা হতে পারে একটা কোয়ান্টাম ঘটনা, কোনো কসমিক রশ্মির প্রভাবে।
টেলিভিশন সিরিজ টোয়াইলাইট জোন-এর একটি পর্বে একটা লোক ঘুম থেকে জেগে দেখে, তার নিজের স্ত্রী তাকে চিনতে পারছে না। তাকে দেখে আর্তচিৎকার করে ওঠে তার স্ত্রী। তারপর হন্তদন্ত হয়ে ফোন দেয় পুলিশকে। শহরে ঘুরতে গিয়ে সে আবিষ্কার করে, তার আজীবনের বন্ধুরাও তাকে চিনতে পারছে না। ভাবটা এমন, যেন তার কোনো অস্তিত্বই আগে ছিল না আগে কখনো। আরও আজব ব্যাপার, তার মা-বাবাও দাবি করে, তারাও কম্মিনকালেও দেখেনি তাকে। এমনকি তাদের নাকি কোনো ছেলেই নেই। বন্ধুবান্ধব, পরিবার ও গৃহহারা হয়ে শহরের চারদিকে উদ্দেশ্যহীনভাবে ঘুরতে থাকে লোকটি। একসময় একটা পার্কের বেঞ্চে শুয়ে গভীর ঘুমে তলিয়ে যায় আশ্রয়হীন ভবঘুরে এক মানুষের মতো। পরের দিন ঘুম ভেঙে নিজেকে আরামদায়ক উষ্ণ এক বিছানায় আবিষ্কার করে। নিজের স্ত্রীর সঙ্গে শুয়ে থাকতে দেখতে পায় লোকটি। কিন্তু স্ত্রী তার দিকে মুখ ফেরাতেই প্রচণ্ড ধাক্কা খায়। এই মেয়েটি কিছুতেই তার স্ত্রী হতে পারে না। অজানা-অচেনা এক নারী। তাকে আগে কখনো দেখেনি সে।
এ রকম অযৌক্তিক আর উদ্ভট গল্প কি আদৌ বাস্তবে সম্ভব? হয়তো সম্ভব। দ্য টোয়াইলাইট জোন-এর মুখ্য চরিত্র যদি তার মাকে কিছু গোপন প্রশ্ন জিজ্ঞেস করত, তাহলে সে হয়তো জানতে পেত, তার মায়ের একবার গর্ভপাত হয়েছিল। সে কারণেই তার কোনো ছেলে নেই। কখনো কখনো মহাকাশ থেকে আসা কসমিক রে বা মহাজাগতিক রশ্মি ও একটা কণাও ভ্রূণের ডিএনএর গভীরে আঘাত হানতে পারে। তাতে ঘটতে পারে জেনেটিক মিউটেশন। তার কারণে গর্ভপাত হওয়াও সম্ভব। এ রকম ক্ষেত্রে একটা একক কোয়ান্টাম ঘটনা দুটি মহাবিশ্বকে আলাদা করে ফেলতে পারে। এর একটাতে আপনি স্বাভাবিকভাবে সৃষ্টিশীল নাগরিক হিসেবে বসবাস করবেন। কিন্তু আরেকটা বিশ্বে সবকিছু হুবহু একই থাকবে, শুধু আপনারই জন্ম হবে না।
বিশ্বের মধ্যে এসব ত্রুটিবিচ্যুতি হওয়ার এই ব্যাপারটা পদার্থবিজ্ঞানের সূত্রের মধ্যেই সম্ভব। কিন্তু সেটা চরমভাবে অসম্ভব ঘটনা। এ ঘটনার সম্ভাবনা খুব অল্প। কিন্তু আপনি দেখতে পাবেন, কোয়ান্টাম তত্ত্ব মহাবিশ্ব সম্পর্কে আমাদের এমন এক চিত্র দেয়, যা আইনস্টাইনের দেওয়া চিত্রের চেয়ে খুবই অদ্ভুত। আপেক্ষিকতায় জীবনের যে মঞ্চে আমরা চলাফেরা বা সবকিছু করি, সেটা হয়তো রাবারের তৈরি। আর এই সেটের ভেতর দিয়ে চলাফেরা করার সময় এখানে সব অভিনেতা বক্রপথ অনুসরণ করে। নিউটনের বিশ্বে, আইনস্টাইনের বিশ্বের অভিনেতারা স্ক্রিপ্ট থেকে তোতা পাখির মতো সব লাইন উদ্ধৃত করে। আর সেই স্ক্রিপটা তাদের কপালে আগে থেকেই লেখা থাকে। কিন্তু কোয়ান্টামের নাটকে, অভিনেতারা হঠাৎ করে স্ক্রিপ্ট ছুড়ে ফেলে নিজেদের মতো করে অভিনয় করেন। এখানে পাপেটগুলোর সঙ্গে লাগানো সুতাগুলো কেটে ফেলা হয়। স্বাধীন ইচ্ছা প্রতিষ্ঠিত হয় এখানে। কলাকুশলীরা মঞ্চ থেকে হারিয়ে যেতে এবং আবারও উদয় হতে পারে। আরও অদ্ভুত ব্যাপার হলো, একই সময়ে নিজেদের দুটি জায়গায় আবির্ভূত হতে দেখতে পারে তারা। অভিনেতারা তাদের সংলাপ বলার সময় নিশ্চিতভাবে কখনোই জানতে পারেন না, তাঁরা যাঁর সঙ্গে কথা বলছেন, তিনি হুট করে আরেক জায়গায় হারিয়ে যাবেন এবং আবারও উদয় হবেন।
বিশাল হৃদয় : জন হুইলার
কোয়ান্টাম তত্ত্বের উদ্ভটত্ব আর সফলতা নিয়ে সম্ভবত আইনস্টাইন এবং নীলস বোর ছাড়া আর কেউ এত বেশি লড়াই চালাননি। একমাত্র ব্যতিক্রম জন হুইলার। সব ভৌত বাস্তবতা কি শুধুই বিভ্রম? সমান্তরাল কোয়ান্টাম মহাবিশ্বের কি অস্তিত্ব আছে? অতীতে একসময় দুর্ধর্ষ কোয়ান্টাম প্যারাডক্স নিয়ে কোনো মাথাব্যথা ছিল না হুইলারের। তখন এসব সম্ভাবনা তিনি ব্যবহার করছিলেন পারমাণবিক আর হাইড্রোজেন বোমা বানানোর ক্ষেত্রে। কৃষ্ণগহ্বরসংক্রান্ত গবেষণাতেও অগ্রদূত ছিলেন তিনি। জন হুইলার হলেন জায়ান্টদের মধ্যে সর্বশেষ জন কিংবা বলা যায় যাঁর হৃদয়টা বিশাল বা দানবীয়। একসময় কোয়ান্টাম তত্ত্বের পাগলাটে সিদ্ধান্তগুলোকে যাঁরা শক্ত করে আঁকড়ে ধরে ছিলেন, তাঁদের একদা এই নামেই সম্বোধন করেছিলেন তাঁর ছাত্র রিচার্ড ফাইনম্যান।
জন হুইলারই ‘ব্ল্যাকহোল’ শব্দটা প্রথম চালু করেন। প্রথমবার পালসার আবিষ্কারের পর, ১৯৬৭ সালে নিউইয়র্ক শহরে নাসার গডার্ড ইনস্টিটিউট ফর স্পেস স্টাডিজে আয়োজিত এক সম্মেলনে শব্দটি প্রথম ব্যবহার করেন তিনি।
যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডার জ্যাকসনভিলে ১৯১১ সালে জন্মেছিলেন জন হুইলার। তাঁর বাবা লাইব্রেরিয়ান হলেও ইঞ্জিনিয়ারিং মিশে ছিল তাঁদের পারিবারিক রক্তে। তাঁর তিন কাকা ছিলেন খনির ইঞ্জিনিয়ার। তাঁদের কর্মক্ষেত্রে প্রায়ই বিস্ফোরক ব্যবহার করতে হতো। ডিনামাইট ব্যবহারের আইডিয়া তাকে বেশ মুগ্ধ করেছিল। বিস্ফোরণের ঘটনা দেখতে পছন্দও করতেন তিনি। (একদিন অসাবধানে তিনি এক টুকরো ডিনামাইট নিয়ে পরীক্ষা করে দেখতে গিয়েছিলেন। এমন সময় তাঁর হাতে বিস্ফোরিত হয় সেটা। তাঁর বুড়ো আঙুল ও আরেকটি আঙুলের মাথা উড়ে যায়। কাকতালীয়ভাবে, আইনস্টাইন যখন কলেজশিক্ষার্থী, তখনো অসাবধানতার কারণে প্রায় একই ধরনের একটা বিস্ফোরণ তাঁর হাতেও ঘটেছিল। সে জন্য অবশ্য বেশ কয়েকটা সেলাই দিতে হয়েছিল তাঁর হাতে।)
বালক বয়সে হুইলার ছিলেন সত্যিকার অর্থে এক ইঁচড়ে পাকা। তখন থেকেই ক্যালকুলাসে দক্ষ ছিলেন তিনি। একবার নতুন একটা তত্ত্ব নিয়ে নিজেদের মধ্যে ফিসফিস করে আলোচনা করেছিল তাঁর বন্ধুরা। সে তত্ত্বটা সম্পর্কে জানতে হাতের কাছে যতগুলো বই পান, সব আঁতিপাঁতি করে খুঁজে দেখেন তিনি। সেই তত্ত্বটা ছিল কোয়ান্টাম মেকানিকস। তাঁর ঠিক চোখের সামনে, ইউরোপে নীলস বোর, ওয়ার্নার হাইজেনবার্গ এবং আরউইন শ্রোডিঙ্গারের হাতে নতুন একটা তত্ত্ব গড়ে উঠতে শুরু করেছিল। পরমাণুর গুপ্ত রহস্য হঠাৎ করে ফাঁস করে দিতে শুরু করেছিল এ তত্ত্বটাই। অথচ এর মাত্র কয়েক বছর আগে খোদ পরমাণুর অস্তিত্ব নিয়ে ব্যঙ্গবিদ্রূপ করেছিলেন দার্শনিক আর্নেস্ট মাখ। তিনি বলেছিলেন, গবেষণাগারে পরমাণুকে কখনো দেখা সম্ভব নয়। সম্ভবত এটা বানোয়াট ব্যাপার। তিনি দাবি করেন, যে জিনিস চোখে দেখা যায় না, তার সম্ভবত কোনো অস্তিত্বও নেই। তাপগতিবিদ্যার বিধিগুলো সূত্রবদ্ধ করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন মহান জার্মান দার্শনিক লুডভিগ বোলজম্যান। কিন্তু দুঃখের ব্যাপার হলো, ১৯০৬ সালে আত্মহত্যা করেন তিনি। এর পেছনে আংশিক কারণ হলো, পরমাণুর ধারণা প্রচার করতে গিয়ে একসময় তীব্র উপহাসের পাত্র হতে হয়েছিল বোলজম্যানকে।
এরপর ১৯২৫ থেকে ১৯২৭ সালের স্মরণীয় কয়েক বছরে একে একে উন্মোচিত হয়ে গেল পরমাণুর গুপ্ত রহস্য। আধুনিক ইতিহাসে এত অল্প সময়ে এ রকম বড় ধরনের অগ্রগতি আর কখনো হতে দেখা যায়নি (ব্যতিক্রম শুধু ১৯০৫ সালে আইনস্টাইনের গবেষণা)। হুইলারও মনেপ্রাণে এই বিপ্লবের অংশ হতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তিনি বুঝতে পারেন, পদার্থবিজ্ঞানে অনেক অনেক পিছিয়ে আছে যুক্তরাষ্ট্র। সে সময় এই স্তরে বিশ্বমানের কোনো পদার্থবিদও সে দেশে ছিল না। তাঁর আগে জে রবার্ট ওপেনহাইমার দেশ ছেড়ে ইউরোপে পড়তে চলে যান। একই পথ অনুসরণ করে হুইলারও ডেনমার্কের কোপেনহেগেন যাত্রা করলেন। মনে মনে আশা, শিক্ষক নীলস বোরের কাছ থেকে শিখবেন তিনি।
ইলেকট্রন নিয়ে আগের পরীক্ষাগুলোতে দেখা গেছে, সেগুলো একই সঙ্গে কণা ও তরঙ্গের মতো আচরণ করে। কণা ও তরঙ্গের এ অদ্ভুত দ্বৈততার জটিল প্যাচ শেষ পর্যন্ত সমাধান করেন কোয়ান্টাম পদার্থবিদেরা। অচিরেই দেখা গেল, পরমাণুর চারপাশে নৃত্যরত ইলেকট্রনকে একটা কণা হিসেবে ব্যাখ্যা করা যায়। তবে এর সঙ্গে জড়িয়ে থাকে রহস্যময় একটা তরঙ্গও। ১৯২৫ সালে অস্ট্রিয়ান পদার্থবিদ আরউইন শ্রোডিঙ্গার এক সমীকরণ প্রস্তাব করেন (নামকরা শ্রোডিঙ্গার ওয়েভ ইকুয়েশন বা তরঙ্গ সমীকরণ)। ইলেকট্রনের সঙ্গে জড়িত থাকা এ তরঙ্গকে সঠিকভাবে ব্যাখ্যা করতে পারল তাঁর এ সমীকরণ। এ তরঙ্গকে গ্রিক বর্ণ সাই দিয়ে প্রকাশ করা হলো। তরঙ্গটি পরমাণুর আচরণ সম্পর্কে অবিশ্বাস্য রকম নিখুঁত ভবিষ্যদ্বাণী করল। সেটাই আচমকা এক বিপ্লব ঘটিয়ে দিল পদার্থবিজ্ঞানে। হঠাৎ করে প্রায় প্রথম নীতি থেকে পরমাণুর গভীরে উঁকি দিয়ে নিজ নিজ কক্ষপথে ইলেকট্রনগুলো কীভাবে নৃত্য করে, এক অবস্থা থেকে আরেক অবস্থায় পরিবর্তন ঘটায় এবং পরমাণুগুলোর মধ্যে পারস্পরিক বন্ধন তৈরি করে অণু গঠন করে—সেসব গণনা সম্ভব হলো।
কোয়ান্টাম পদার্থবিদ পল ডিরাক গর্বভরে বলেন, পদার্থবিজ্ঞান শিগগিরই সব রসায়নকে নিছক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে সীমিত করে ফেলবে। তিনি ঘোষণা করেন, ‘পদার্থবিদ্যার বড় একটা অংশের এবং গোটা রসায়নের গাণিতিক তত্ত্বের জন্য পদার্থবিদ্যার অন্তর্নিহিত দরকারি সূত্রগুলো এখন জানা হয়ে গেছে। এখন প্রধান অসুবিধাটা হলো, এসব সূত্রের প্রয়োগের ফলে যেসব সমীকরণ পাওয়া যায়, সমাধানের পক্ষে সেগুলো খুব জটিল।’ সাই ফাংশন যেমন আকর্ষণীয়, তেমনি তা দিয়ে আসলে ঠিক কী বোঝায়, তা রহস্যময়ও বটে।
অবশেষে ১৯২৮ সালে একটা আইডিয়া পেশ করেন পদার্থবিদ ম্যাক্স বর্ন। তাঁর আইডিয়াটি ছিল, যেকোনো বিন্দুতে ইলেকট্রন খুঁজে পাওয়ার সম্ভাবনা প্রকাশ করে ওয়েভ বা তরঙ্গ ফাংশন। অন্য কথায়, আপনি কখনো সঠিকভাবে বলতে পারবেন না যে একটা ইলেকট্রন ঠিক কোথায় ছিল, শুধু ইলেকট্রনের ওয়েভ ফাংশন গণনা করা যাবে। ওয়েভ ফাংশন শুধু ইলেকট্রনের একটা জায়গায় থাকার সম্ভাবনার কথা বলে। কাজেই পারমাণবিক পদার্থবিজ্ঞান যদি একটা ইলেকট্রন এখানে, নাকি ওখানে—শুধু তার সম্ভাবনার তরঙ্গে সীমিত করে ফেলে এবং একটা ইলেকট্রনকে যদি আপাতদৃষ্টে একই সময়ে দুটি জায়গায় থাকতে পারে—তাহলে আমরা কীভাবে নির্ধারণ করব যে ইলেকট্রনটি আসলে কোথায়?
ক্রমান্বয়ে একটা কোয়ান্টাম কুকবুকে একগুচ্ছ পরিপূর্ণ রেসিপি সূত্রবদ্ধ করে ফেলেন নীলস বোর এবং হাইজেনবার্গ। পারমাণবিক পরীক্ষায় অবিশ্বাস্য নির্ভুলতার সঙ্গে চমৎকার কাজ করল সেগুলো। ওয়েভ ফাংশন শুধু বলবে, ইলেকট্রনটা এখানে, নাকি ওখানে অবস্থান করছে। একটা নির্দিষ্ট বিন্দুতে ওয়েভ ফাংশন যদি অনেক বড় হয়, তার মানে ইলেকট্রনটি সেখানে থাকার সম্ভাবনা অনেক অনেক বেশি। (সেখানে ওয়েভ ফাংশন ছোট হলে সেখানে ইলেকট্রন পাওয়াও অসম্ভব।) যেমন আমরা যদি কোনো লোকের ওয়েভ ফাংশন দেখতে পেতাম, তাহলে সেটা দেখতে লক্ষণীয়ভাবে ওই লোকটির মতোই হতো। তবে তার ওয়েভ ফাংশন ধীরে ধীরে মহাকাশে বেরিয়ে যেত, তার মানে, লোকটিকে চাঁদে খুঁজে পাওয়ার খুব ছোট এক সম্ভাবনাও থাকে। (আসলে লোকটির ওয়েভ ফাংশন বাস্তবে গোটা মহাবিশ্বে ছড়িয়ে থাকে।)
এর আরেকটি মানে হলো, একটা গাছের ওয়েভ ফাংশন আপনাকে এই সম্ভাবনার কথা বলতে পারবে যে গাছটা দাঁড়িয়ে আছে নাকি মাটিতে ভেঙে পড়ে গেছে। কিন্তু গাছটা আসলে কোনো অবস্থায় আছে, তা নিশ্চিতভাবে বলতে পারবে না ওয়েভ ফাংশন। কিন্তু সাধারণ কাণ্ডজ্ঞান আমাদের বলে যে যেকোনো বস্তু নির্দিষ্ট একটা অবস্থায় থাকে। আপনি যখন একটা গাছের দিকে তাকান, তখন গাছটা নিশ্চিতভাবে আপনার সামনে থাকে—সেটা সোজা দাঁড়িয়েও থাকতে পারে। অথবা পড়ে থাকতে পারে মাটিতেও। কিন্তু দুটোই একসঙ্গে কখনো হতে পারে না।
অস্তিত্ব সম্পর্কে সম্ভাবনা আর আমাদের সাধারণ কাণ্ডজ্ঞানের মধ্যে এই খাপছাড়া ব্যাপারটার সমাধান করতে চেষ্টা করেন নীলস বোর ও ওয়ার্নার হাইজেনবার্গ। সে জন্য তাঁরা অনুমান করে নিলেন, বাইরের কোনো পর্যবেক্ষণ একটা কিছু পরিমাপ করার পর তার ওয়েভ ফাংশন জাদুর মতো ভেঙে পড়ে। তখন ইলেকট্রন একটা নির্দিষ্ট অবস্থায় পড়ে যায়। অর্থাৎ গাছটার দিকে তাকানোর পর, আমরা দেখি যে সেটা সত্যি সত্যিই দাঁড়িয়ে আছে। অন্য কথায়, আসলে ইলেকট্রনের চূড়ান্ত অবস্থা নির্ধারণ করে পর্যবেক্ষণ প্রক্রিয়া। অস্তিত্বের জন্য পর্যবেক্ষণই খুব গুরুত্বপূর্ণ। ইলেকট্রনের দিকে তাকানোর পর, তার ওয়েভ ফাংশন কলাপস করে বা ভেঙে পড়ে। কাজেই ইলেকট্রনটা তখন একটা নির্দিষ্ট অবস্থানে থাকবে। তখন আর ওয়েভ ফাংশনের কোনো দরকার নেই।
কাজেই মোটা দাগে বললে, নীলস বোরের কোপেনহেগেন স্কুলের স্বতঃসিদ্ধগুলোর সারমর্ম হলো :
ক. সব শক্তি বিচ্ছিন্ন প্যাকেট হিসেবে ঘটে, যাকে বলা হয় কোয়ান্টা। (যেমন
আলোর কোয়ান্টামকে বলে ফোটন। দুর্বল পারমাণবিক বলের কোয়ান্টাকে বলে ডব্লিউ ও জেড বোসন। শক্তিশালী পারমাণবিক বলের কোয়ান্টাকে বলা হয় গ্লুয়ন। অন্যদিকে মহাকর্ষের কোয়ান্টাকে বলে গ্র্যাভিটন। অবশ্য গ্র্যাভিটনকে এখনো গবেষণাগারে দেখা যায়নি।) খ. পদার্থ প্রকাশিত হয় বিন্দু কণা দিয়ে। কিন্তু কণা খুঁজে পাওয়ার সম্ভাবনা দেয় একটা তরঙ্গ। এই তরঙ্গ একটা নির্দিষ্ট তরঙ্গ সমীকরণ মেনে চলে (যেমন শ্রোডিঙ্গারের তরঙ্গ সমীকরণ)।
গ. কোনো পর্যবেক্ষণের আগে, একটা পদার্থ একই সময়ে সম্ভাব্য সব অবস্থায় থাকতে পারে। পদার্থটি কোন অবস্থায় আছে, তা নির্ধারণ করতে আমাদের একটা পর্যবেক্ষণ করতে হবে। এর ফলে তরঙ্গ ফাংশনের পতন হবে বা ভেঙে পড়বে। তাতে পদার্থটি একটি নির্দিষ্ট অবস্থায় চলে যাবে। পর্যবেক্ষণের এই কাজটি তরঙ্গ ফাংশনকে ধ্বংস করে দেয় এবং পদার্থটি তখন একটি নির্দিষ্ট বাস্তবতা ধারণ করে। তরঙ্গ ফাংশন তার উদ্দেশ্য মেটায় : ওই পদার্থটি নির্দিষ্ট অবস্থায় কোথায় খুঁজে পাওয়া যাবে, আমাদের তার একটা নির্দিষ্ট সম্ভাবনার জোগান দেয় এটা।
নিয়তিবাদ নাকি অনিশ্চয়তা
পদার্থবিজ্ঞানের সর্বকালের সফল তত্ত্বগুলোর প্রধান একটি হলো কোয়ান্টাম তত্ত্ব। স্ট্যান্ডার্ড মডেল হলো কোয়ান্টাম তত্ত্বের সর্বোচ্চ সূত্রবদ্ধ করা একটি মডেল। কয়েক দশক ধরে পার্টিকেল অ্যাকসিলারেটরে পরীক্ষার ফলাফলের প্রতীক হলো এ তত্ত্বটি। এই তত্ত্বের কিছু অংশ যাচাই করে দেখা হয়েছে। যদি কোনোটিতে নিউট্রিনোর ভর অন্তর্ভুক্ত করা হয়, তাহলে কোনো ব্যতিক্রম ছাড়াই পারমাণবিক কণাদের সব পরীক্ষায় উতরে যাবে স্ট্যান্ডার্ড মডেল।
কিন্তু কোয়ান্টাম তত্ত্ব কতটা সফল, তাতে কিছু যায় আসে না। পরীক্ষামূলকভাবে এটা যেসব স্বতঃসিদ্ধের ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে, তা দার্শনিক ও ধর্মীয় দিক দিয়ে ৮০ বছর ধরে বিতর্কের ঝড় তুলেছে। বিশেষ করে, দ্বিতীয় স্বতঃসিদ্ধটি ধর্মীয় দিক থেকে তোপের মুখে পড়েছে। কারণ, এটা জিজ্ঞেস করে, কে আমাদের ভাগ্য নির্ধারণ করবে। যুগ যুগ ধরে দার্শনিক, ধর্মতত্ত্ববিদ ও বিজ্ঞানীরা ভবিষ্যৎ নিয়ে কৌতূহলী। কোনোভাবে যদি আমাদের নিয়তি জানা যায়, সেদিকে সবার আগ্রহ। শেক্সপিয়ারের ম্যাকবেথ-এ, আমাদের নিয়তির ওপর মেঘের মতো ঢেকে দেওয়া পর্দা সরাতে মরিয়া হয়ে উঠেছিল ব্যানকোয়া। এতে স্মরণযোগ্য কিছু সংলাপ বলেছিল সে :
থাকে যদি দৃষ্টি তব সময়ের বীজে
কিবা হবে অঙ্কুরিত কি যাবে শুকায়ে,
সম্ভাষ আমায়
(অঙ্ক ১, দৃশ্য ৩)
(অনু : গিরিশ ঘোষ)
শেক্সপিয়ার এই কথাগুলো লেখেন সেই ১৬০৬ সালে। এর ৮০ বছর পর আরেক ইংরেজ বিজ্ঞানী আইজ্যাক নিউটন দুঃসাহস নিয়ে দাবি করে বসলেন, প্রাচীন এই প্রশ্নের উত্তরটা জানেন তিনি। নিউটন এবং আইনস্টাইন দুজনই যে মতবাদে বিশ্বাস করতেন, তাকে বলা ডিটারমিনিজম বা নিয়তিবাদ। এই মতবাদ অনুসারে, ভবিষ্যতের সব ঘটনা তাত্ত্বিকভাবে নির্ধারণ করা সম্ভব। নিউটনের চোখে, মহাবিশ্ব ছিল প্রকাণ্ড একটা দানবীয় ঘড়ির মতো। কালের শুরুতে এই ঘড়ির চাবি টেনে দিয়েছেন স্বয়ং ঈশ্বর। এরপর থেকে তাঁর আবিষ্কৃত গতির তিনটি সূত্র মেনে ঘড়িটি চলছে একটা নিখুঁতভাবে ভবিষ্যদ্বাণী করার মতো করে।
নেপোলিয়নের বৈজ্ঞানিক উপদেষ্টা হিসেবে এককালে দায়িত্ব পালন করেছেন ফরাসি গণিতবিদ পিয়েরে সাইমন ডি ল্যাপ্লাস। নিউটনের সূত্রগুলো ব্যবহার করে তিনি লিখলেন, ভবিষ্যৎকে আগাম অনুমান করা সম্ভব। অতীতকে আমরা যেমন নিখুঁতভাবে দেখতে পাই, তেমনি ভবিষ্যৎকেও আগাম জানা সম্ভব। তিনি আরও লিখলেন, কোনো জীব যদি মহাবিশ্বের প্রতিটি কণার অবস্থান ও গতিবেগ জানতে পারে, তাহলে ‘এ রকম বুদ্ধিমান প্রাণীর জন্য কোনো কিছুই অনিশ্চিত থাকবে না। তার চোখের সামনে অতীতটা যেমন ভবিষ্যৎটাও ঠিক সে রকম দেখাবে।’ ল্যাপ্লাস তাঁর জীবনের সেরা কাজ সেলেসটিয়াল মেকানিকস বইটা নেপোলিয়নকে উপহার দেওয়ার পর সম্রাট বললেন, ‘তুমি স্বর্গীয় ব্যাপারগুলো সম্পর্কে এই বিশাল কাজ লিখে ফেলেছ, ঈশ্বরের কথা একবারও উল্লেখ না করে।’ জবাবে ল্যাপ্লাস বলেছিলেন, ‘স্যার, এই হাইপোথিসিসের আমার কোনো দরকার নেই।’
নিউটন ও আইনস্টাইনের কাছে স্বাধীন ইচ্ছার ধারণা বা আমরাই আমাদের নিয়তির প্রভু হওয়ার ধারণাটি ছিল একটা বিভ্রম বা মায়া। সাধারণ কাণ্ডজ্ঞানে বাস্তবতার ধারণা হলো, আমরা যখন কোনো দৃঢ় বস্তুকে স্পর্শ করি, তা বাস্তব ও একটা নির্দিষ্ট অবস্থায় বিরাজ করে। আইনস্টাইন একে বলতেন ‘অবজেক্টিভ রিয়েলিটি’ বা বস্তুগত বাস্তবতা। তিনি তাঁর দৃঢ় অবস্থানকে উপস্থাপন করেছেন এভাবে :
আমি নিয়তিবাদী। স্বাধীন ইচ্ছার অস্তিত্ব থাকার মতো করে আচরণ করতে বাধ্য হই। কারণ, আমি যদি কোনো সভ্য সমাজে বাস করতে চাই, তাহলে আমাকে অবশ্যই দায়িত্বের সঙ্গে কাজ করতে হবে। দর্শনগতভাবে জানি, একজন খুনি তার অপরাধের জন্য দায়ী নয়। কিন্তু আমি তার সঙ্গে চা পান করতে রাজি নই। আমার ক্যারিয়ার বিভিন্ন বলের মাধ্যমে নির্ধারিত হয়েছে, যাদের ওপর আমার কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। প্রাথমিকভাবে ওই রহস্যময় গ্রন্থি, যেখানে প্রকৃতি জীবনের নির্যাস প্রস্তুত করে রেখেছে—তার ওপর কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই আমার। হেনরি ফোর্ড হয়তো একে বলতে পারেন, তাঁর ভেতরের স্বর, সক্রেটিস একে তাঁর দানব বলে অভিহিত করবেন : প্রত্যেকেই তার নিজের মতো করে ব্যাখ্যা করবেন…মানুষ যে স্বাধীন নয়…সবকিছু নির্ধারিত…পোকামাকড় থেকে শুরু করে একইভাবে নক্ষত্রের জন্যও তা সত্যি…এমন কোনো শক্তির খেলা, যার ওপর আমাদের কোনোরকম নিয়ন্ত্রণ নেই। মানুষ, শাকসবজি কিংবা মহাজাগতিক ধূলিকণা—আমরা সবাই বহুদূরের কোনো এক অদৃশ্য শক্তির সংগীতে একটা রহস্যময় কালের প্রতি নৃত্যরত।
ধর্মতত্ত্ববিদেরাও এই প্রশ্ন নিয়ে মল্লযুদ্ধে অবতীর্ণ। বিশ্বের বেশির ভাগ ধর্ম নিয়তিতে বিশ্বাস করে। তাদের ধারণা, ঈশ্বর শুধু সর্বশক্তিমান আর সর্বব্যাপীই (সর্বত্র বিরাজ করেন) নন, তিনি সর্বজ্ঞ (তিনি সবকিছু জানেন, এমনকি ভবিষ্যত্ত)। কিছু কিছু ধর্মে এর মানে হলো ঈশ্বর জানেন আমরা স্বর্গ, নাকি নরকে যাব। এমনকি আমাদের জন্মের আগেই তা জানেন তিনি। সংক্ষেপে বলা যায়, স্বর্গের কোনো এক জায়গায় নিয়তিবিষয়ক একটা বই আছে। বইটার ভেতর আমাদের সবার নাম তালিকাভুক্ত করা। সেখানে জন্মতারিখ, আমাদের ব্যর্থতা, অর্জন, আমাদের আনন্দ, আমাদের পরাজয়, এমনকি আমাদের মৃত্যুর তারিখ এবং আমরা স্বর্গে নাকি কোনো চিরকাল নরকে থাকব—তা-ও লেখা আছে ওই বইতে।
(১৫১৭ সালে ক্যাথলিক চার্চকে বিভক্ত করতে কিছুটা সহায়তা করেছিল নিয়তির সূক্ষ্ম ধর্মতাত্ত্বিক প্রশ্নটি। মার্টিন লুথার জার্মানির ভিটেনবার্গের এক গির্জার দেয়ালে ৯৫টি থিসিস ঝুলিয়ে দেন। এতে গির্জার বিরুদ্ধে প্রশ্রয় দেওয়ার, বিশেষ করে ধনীদের স্বর্গে যাওয়ার রাস্তা দেখাতে ঘুষ নেওয়ার অভিযোগ তোলেন তিনি। লুথার হয়তো বলতে চেয়েছিলেন, সময়ের সামনে আমাদের ভবিষ্যৎ কী হবে, তা ঈশ্বর ভালোই জানেন, আমাদের নিয়তিও পূর্বনির্ধারিত। কিন্তু গির্জাকে মোটা অঙ্কের দান করলেই ঈশ্বরের মন বদলানো সম্ভব নয়। )
কিন্তু যেসব পদার্থবিজ্ঞানী সম্ভাবনার ধারণাটি মেনে নিয়েছেন, তাঁদের কাছে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বিতর্কিত স্বতঃসিদ্ধটি হলো তৃতীয়টি। সেটিই মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে কয়েক প্রজন্মের পদার্থবিদ আর দার্শনিকদের। ‘পর্যবেক্ষণ’ হলো আলগা ও বাজেভাবে সংজ্ঞায়িত একটা ধারণা। আবার এটা এমন সত্যের ওপর নির্ভর করে যে এখানে আসলে দুই ধরনের পদার্থবিজ্ঞান আছে : প্রথমটি উদ্ভট অতিপারমাণবিক জগতের জন্য। ইলেকট্রনকে একই সময়ে দুই জায়গায় থাকতে দেখা যায় এখানে। অন্যটি ম্যাক্রোস্কোপিক বা বৃহৎপরিসরের জগৎ। এই জগতেই আমাদের বসবাস। এটি সাধারণ কাণ্ডজ্ঞানের নিউটনের সূত্র মেনে আমাদের সামনে হাজির হয়।
নীলস বোরের মতে, আমাদের পরিচিত দৈনন্দিন ম্যাক্রোস্কোপিক জগৎ থেকে পারমাণবিক জগতের মাঝখানে একটি অদৃশ্য দেয়াল আছে। আসলে দুটো জগৎকে আলাদা করে রেখেছে এই দেয়াল। কোয়ান্টাম তত্ত্বের বিচিত্র নিয়ম মেনে চলা অতিপারমাণবিক জগৎ থেকে আমরা দেয়ালের বাইরে বাস করি। আমাদের গ্রহ ও নক্ষত্র সুসংজ্ঞায়িত এই জগতে, তরঙ্গগুলো এরই মধ্যে ভেঙে গেছে।
জন হুইলার কোয়ান্টাম মেকানিকস শিখেছিলেন এ তত্ত্বের স্রষ্টাদের কাছ থেকে। এই প্রশ্নে দুই দলের চিন্তাভাবনাকে সংক্ষিপ্ত আকারে প্রকাশ করতে পছন্দ করতেন তিনি। এ ক্ষেত্রে বেসবলের সূক্ষ্ম বিষয়গুলো নিয়ে একটা বেসবল গেমে আলোচনারত তিন আম্পায়ারের উদাহরণ টানতেন হুইলার। সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য আম্পায়ার তিনজন বলছেন :
প্রথম জন : আমি তাদের ডেকেছি, যেন আমি তাদের দেখেছি।
দ্বিতীয় জন : তারা যে রকম আমি সেভাবেই তাদের ডেকেছি।
তৃতীয় জন : আমি তাদের না ডাকা পর্যন্ত তারা আসলে কিছুই ছিল না।
হুইলারের মতে, এখানে দ্বিতীয় আম্পায়ার হলেন আইনস্টাইন। কারণ, তিনি বিশ্বাস করতেন, মানুষের অভিজ্ঞতার বাইরে একটা পরম বাস্তবতা আছে। আইনস্টাইন একে বলতেন বস্তুগত বাস্তবতা বা অবজেক্টিভ রিয়েলিটি। তাঁর ধারণাটা এ রকম, মানুষের হস্তক্ষেপ ছাড়াই বস্তুরা নির্দিষ্ট অবস্থায় থাকতে পারে। আর এখানে তৃতীয় আম্পায়ার হলেন নীলস বোর। তিনি যুক্তি দেখাতেন, কোনো পর্যবেক্ষণ করার পরই কেবল বাস্তবতা অস্তিত্ব লাভ করে।
বনের ভেতর গাছ
দার্শনিকদের মাঝেমধ্যে বেশ তাচ্ছিল্যের চোখে দেখেন পদার্থবিদেরা। এ ক্ষেত্রে তাঁরা রোমান দার্শনিক সিসেরোর একটা কথা প্রায়ই উদ্ধৃত করেন। এই দার্শনিক একবার বলেছিলেন, ‘দার্শনিকেরা যে কথা বলেননি, তার চেয়ে উদ্ভট কিছু আর হতেই পারে না।’ অর্থহীন ধারণাগুলোকে গালভরা নাম দেওয়া খুবই অপছন্দ করতেন গণিতবিদ স্টানিসল উলম। তিনি একবার বলেছিলেন, ‘পাগলামি হলো বিভিন্ন ধরনের অর্থহীনতা বা আবোলতাবোলের মধ্যে সূক্ষ্ম পার্থক্য করার ক্ষমতা।’ খোদ আইনস্টাইনও একবার লিখেছিলেন, ‘দর্শনের সবকিছু কি মধুর ভেতর লেখা হয়নি? কেউ যখন এটা ভাবে, তখন দেখতে বেশ লাগে। কিন্তু সে যখন সেটা আবারও দেখে, তখন সবকিছু নাই হয়ে যায়। সেখানে পড়ে থাকে শুধু থকথকে মণ্ড।
পদার্থবিদেরা একটা সন্দেহজনক গল্প বলতেও পছন্দ করেন। গল্পটা কোনো এক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান বলেছিলেন বলে কথিত আছে। পদার্থবিদ্যা, গণিত আর দর্শন বিভাগের বাজেট দেখে বেশ ক্রুদ্ধ হয়ে ওঠেন তিনি। অনেকের ধারণা, এরপর তিনি বলেছিলেন, ‘পদার্থবিদদের কেন সব সময় দামি দামি যন্ত্রপাতির দরকার হয়? এই দেখুন, গণিত বিভাগের শুধু কাগজ, পেনসিল আর ওয়েস্ট পেপার বাস্কেট ছাড়া আর কিছুই লাগে না। আর দর্শন বিভাগ তো সবার সেরা। তাদের ওয়েস্ট পেপার বাস্কেটেরও দরকার হয় না।’
কিন্তু এত কিছুর পরও শেষ হাসিটা এখনো হয়তো হাসতে পারেন ওই দার্শনিকেরাই। কারণ, কোয়ান্টাম তত্ত্ব এখন দাঁড়িয়ে আছে একটা অসম্পূর্ণ ও নড়বড়ে দার্শনিক ভিত্তির ওপর। এই কোয়ান্টাম বিতর্কের কারণে বিশপ বার্কলির মতো দার্শনিকদের কাজ নতুন করে যাচাই করতে বাধ্য করে। আঠারো শতকের এই দার্শনিক দাবি করেছিলেন, বস্তু শুধু একটা কারণেই থাকে, যাতে মানবজাতি তাদের পর্যবেক্ষণ করতে পারে। এই দর্শনকে বলা হয় সলিসিজম বা আইডিয়ালিজম (আত্মজ্ঞানবাদ বা আদর্শবাদ)। তাঁদের দাবি, একটা বনের ভেতর একটা গাছ যদি ভেঙে পড়ে যায়, কিন্তু সেখানে ওটা দেখার মতো যদি কেউ না থাকে, তাহলে গাছটা আসলে পড়ে যায়নি।
বনের মধ্যে গাছ পড়ে যাওয়ার এই ব্যাপারটার জন্য আমাদের কাছে এখন কোয়ান্টামের একটা নতুন ব্যাখ্যা বা অর্থ রয়েছে। কোনো পর্যবেক্ষণের আগে, আপনি কোনোভাবে জানতেও পারবেন না, গাছটা পড়ে গেছে, নাকি পড়েনি। আসলে গাছটা সম্ভাব্য সব অবস্থায় একই সঙ্গে বিরাজ করে। সেটা হয়তো পুড়ে যেতে পারে কিংবা ভেঙে পড়ে যেতে, জ্বালানি কাঠ হতে, করাতকলে গুঁড়ো হয়েও যেতে পারে। এ রকম আরও অনেক কিছুই হতে পারে গাছটার ভাগ্যে। একবার কোনো পর্যবেক্ষণ করা হলে, গাছটা হুট করে একটা নির্দিষ্ট অবস্থায় লাফ দিয়ে বসে পড়বে। তখন আমরা হয়তো শিগগিরই দেখতে পাব যে গাছটা আসলে ভেঙে মাটিতে পড়ে গেছে।
আপেক্ষিকতার ও কোয়ান্টাম তত্ত্বের দার্শনিক জটিলতা তুলনা করে ফাইনম্যান একদা বলেন, ‘একসময় খবরের কাগজে লেখা হতো, মাত্র ১২ জন মানুষ আপেক্ষিকতার তত্ত্ব বোঝে। আমার বিশ্বাস হয় না, এ রকম কোনো সময় কখনো ছিল…। আমার ধারণা, আমি নিশ্চিতভাবে বলতে পারি, কোয়ান্টাম মেকানিকস কেউই বোঝে না।’ তিনি লিখেছেন, কোয়ান্টাম মেকানিকস ‘প্রকৃতিকে সাধারণ কাণ্ডজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে, তা উদ্ভটভাবে ব্যাখ্যা করে। আর পরীক্ষার সঙ্গে বেশ ভালোভাবেই মিলে যায় সেটা। কাজেই আমি আশা করি, প্রকৃতি যে রকম উদ্ভট, তাকে সেভাবে গ্রহণ করতে পারবেন।’ মন্তব্যটা বেশ অস্বস্তিতে ফেলে দেয় অনেক পদার্থবিদকে। তাদের মনে হয়, তাঁরা যেন ঝুরঝুরে বালু দিয়ে গোটা বিশ্বটা গড়ে তুলেছেন। স্টিভেন ওয়াইনবার্গ লিখেছেন, ‘স্বীকার করছি, একটা তাত্ত্বিক কাঠামোয় সারা জীবন কাজ করতে গিয়ে আমি কিছু অস্তিত্বতে ভুগেছি। সেটা হলো কেউই পুরোপুরি বুঝতে পারে না।’
প্রচলিত বিজ্ঞানে যতটা সম্ভব বিশ্ব থেকে নিজেকে পক্ষপাতহীনভাবে বিযুক্ত বা নির্লিপ্ত থাকার চেষ্টা করেন একজন পর্যবেক্ষক। (যেমন এক রসিক লোক একবার বলেছিল, ‘কোনো স্ট্রিপ ক্লাবে একজন বিজ্ঞানীকে সর্বদা আলাদা করে চিহ্নিত করা যায়। কারণ, একমাত্র তিনিই কেবল দর্শকদের পরীক্ষা করতে থাকেন।) কিন্তু এখন প্রথমবারের মতো আমরা দেখতে পাচ্ছি, কোনো পর্যবেক্ষণ থেকে একজন পর্যবেক্ষককে আলাদা করা অসম্ভব। ম্যাক্স প্লাঙ্ক একবার মন্তব্য করেছিলেন, “বিজ্ঞান প্রকৃতির চূড়ান্ত রহস্য উদ্ঘাটন করতে পারে না। কারণ, সর্বশেষ বিশ্লেষণে গিয়ে দেখা যায়, আমরা যেটা সমাধানের চেষ্টা করছি, নিজেরাও সেই রহস্যেরই অংশ।’
বিড়াল সমস্যা
ওয়েভ ইকুয়েশন বা তরঙ্গ সমীকরণের সঙ্গে প্রথম পরিচয় করিয়ে দেন বিজ্ঞানী আরউইন শ্রোডিঙ্গার। তিনি মনে করতেন, এটা অনেক দূর চলে গেছে। বোরের কাছে তিনি স্বীকার করেছেন, তরঙ্গের ধারণাটি যদি পদার্থবিজ্ঞানে সম্ভাবনার ধারণা প্রবর্তন করে থাকে, তাহলে এটা পেশ করার জন্য তিনি চিরকাল আফসোস করে যাবেন।
তাই সম্ভাবনার ধারণা ধূলিসাৎ করতে এক পরীক্ষার প্রস্তাব করেন তিনি। কল্পনা করা যাক, এক বাক্সের ভেতর একটা বিড়াল আটকে রাখা হয়েছে। বাক্সের মধ্যে আছে বিষাক্ত গ্যাসের একটা বোতল। তার সংযুক্ত করা একটা হাতুড়ি। হাতুড়িটা আবার এক টুকরো ইউরেনিয়ামের পাশে একটা গাইগার কাউন্টারের সঙ্গে যুক্ত করা। ইউরেনিয়াম পরমাণুর তেজস্ক্রিয় ক্ষয় যে একটা কোয়ান্টাম ঘটনা, যা আগে থেকে ভবিষ্যদ্বাণী করা যায় না—তা নিয়ে কারও কোনো বিতর্ক নেই। ধরা যাক, পরের সেকেন্ডেই ইউরেনিয়াম পরমাণু ক্ষয় হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা ৫০ ভাগ। কিন্তু একটা ইউরেনিয়াম পরমাণু ক্ষয় হয়ে গেলে, তার ফলে গাইগার কাউন্টারকে চালু হয়ে যাবে। সেটা আবার চালু করবে হাতুড়িটাকে। ফলে বিষাক্ত গ্যাসের বোতলটা ভেঙে ফেলে বিড়ালটিকে মেরে ফেলবে। কিন্তু বিড়ালটি মারা গেছে নাকি জীবিত আছে—বাক্সটা খোলার আগে তা বলা অসম্ভব। আসলে বিড়ালটির বর্ণনার জন্য মৃত বিড়াল ও জীবিত বিড়ালের তরঙ্গ ফাংশন যোগ করেন পদার্থবিদেরা। অর্থাৎ বিড়ালটিকে একই সঙ্গে ৫০ ভাগ মৃত ও ৫০ ভাগ জীবিত থাকার এক জগতে রাখা হয়।
এবার বাক্সটা খোলা যাক। বাক্সের ভেতর উঁকি দিলে, একটা পর্যবেক্ষণের ঘটনা ঘটবে। তাতে ওয়েভ ফাংশন ভেঙে পড়বে। তখন দেখা যাবে, বিড়ালটি বেঁচে আছে (ধরা যাক)। শ্রোডিঙ্গারের কাছে এটা অর্থহীন। একটা বিড়াল একই সঙ্গে কীভাবে জীবিত ও মৃত হতে পারে? সেটা কি শুধু এই কারণে যে আমরা তাকে দেখিনি? এই ব্যাখ্যায় অসন্তোষ প্রকাশ করেন স্বয়ং আইনস্টাইনও। কোনো অতিথি তাঁর বাসায় বেড়াতে এলে, তিনি বলতেন : চাঁদের দিকে একবার তাকান তো। একটা ইঁদুর ওটার দিকে তাকিয়েছে বলেই কি হঠাৎ করে ওটা লাফ দিয়ে অস্তিত্বশীল হয়েছে? আইনস্টাইন বিশ্বাস করতেন, এর উত্তরটা হলো, না। কিন্তু কিছু অর্থে, এই উত্তরটা ‘হ্যাঁ’ও হতে পারে।
বিষয়গুলো অবশেষে উঠে আসে ১৯৩০ সালে সলভে কনফারেন্সে। আইনস্টাইন ও বোরের মধ্যে এক ঐতিহাসিক লড়াইয়ের ভেতর দিয়ে। হুইলার একে পরে বলেছেন, তাঁর জানামতে, বুদ্ধিবৃত্তিক ইতিহাসে সেটাই ছিল সর্বসেরা বিতর্ক। মহাবিশ্বের কোনো বিষয় বুঝতে গভীর পরিণতির সঙ্গে একটা গভীর বিষয় নিয়ে দুই মহান ব্যক্তির মধ্যে বিতর্কের কথা বিগত ত্রিশ বছরে কখনো শোনেননি তিনি।
আইনস্টাইন সব সময় ছিলেন দুর্দমনীয়, সাহসী, চরম বাকপটু। কোয়ান্টাম তত্ত্বকে গুঁড়িয়ে দিতে গোলাবর্ষণের মতো একের পর এক চিন্তন পরীক্ষার প্রস্তাব দিতে থাকেন তিনি। ওদিকে বরাবরই অস্পষ্ট স্বরে মিন মিন করে কথা বলতেন নীলস বোর। কিন্তু তারপরও আইনস্টাইনের কাছ থেকে আসা একের পর এক আক্রমণ অবলীলায় ঠেকিয়ে দিতে লাগলেন তিনি। পদার্থবিদ পল অ্যারেনফাস্টের পর্যবেক্ষণে, ‘বোর আর আইনস্টাইনের মধ্যকার সেই সংলাপে উপস্থিত থাকাটা আমার জন্য ছিল দুর্দান্ত অভিজ্ঞতা। আইনস্টাইন ছিলেন দাবা খেলোয়াড়ের মতো। প্রতিবারই একেবারে আনকোরা নতুন উদাহরণ নিয়ে হাজির হতেন তিনি। একধরনের ভ্রাম্যমাণ অবিরাম গতিযন্ত্রের মতো অনিশ্চয়তার মধ্য দিয়ে গুঁড়িয়ে দেওয়ার ইচ্ছায় উদাহরণগুলো বর্ষণ করতেন আইনস্টাইন। কিন্তু দার্শনিক ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন মেঘ থেকে সযতনে নিজেকে সরিয়ে রেখে সব সময় একটার পর একটা উদাহরণ গুঁড়িয়ে দেওয়ার হাতিয়ার খুঁজতেন বোর। আইনস্টাইন ছিলেন বাক্সের ভেতর স্প্রিং আঁটা সেই ভুতুড়ে পুতুলের মতো। প্রতি সকালেই চট করে সজীব হয়ে বেরিয়ে আসতেন। ওহ্, সেটা আনন্দদায়ক অভিজ্ঞতা। কিন্তু আমি প্রায়ই অকপটে বোরের পক্ষে আর আইনস্টাইনের বিপক্ষে থাকতাম। তিনি তখন বোরের সঙ্গে যেমন আচরণ করেছেন, খাঁটি চ্যাম্পিয়নরাও তাঁর প্রতি সে সময় ঠিক তেমন আচরণ করেছিল।’
শেষ পর্যন্ত একটা পরীক্ষার প্রস্তাব দেন আইনস্টাইন। তিনি ভেবেছিলেন, সেটা কোয়ান্টাম তত্ত্বের জন্য হবে শেষ অস্ত্র, কফিনের শেষ পেরেক। কল্পনা করা যাক, একটা বাক্সের ভেতর বেশ কিছু ফোটন আছে। বাক্সটাতে যদি একটা শাটার থাকে, তাহলে সেটা শিগগিরই একটা একটা করে ফোটন ছেড়ে দিতে পারবে। বাক্সের শাটার স্পিড নিখুঁতভাবে মাপা সম্ভব। সেই সঙ্গে মাপা সম্ভব ফোটনের শক্তিও। তাই পরম নির্ভুলতার সঙ্গে ফোটনের অবস্থা নির্ধারণ করা যাবে। তাতে অনিশ্চয়তার নীতি লঙ্ঘিত হয়।
এরেনফাস্ট লিখেছেন, ‘বোরের জন্য সেটা ছিল বিশাল এক ধাক্কার মতো। ঠিক সেই মুহূর্তে আঁতিপাঁতি করে খুঁজেও কোনো সমাধান পেলেন না তিনি। সন্ধ্যাজুড়ে চরম দুঃখের মধ্যে কাটালেন। একজনের কাছ থেকে আরেকজনের কাছে বারবার হেঁটে যাচ্ছিলেন বোর। তাঁদের সবাইকে বোঝানোর চেষ্টা করছিলেন, ওটা কোনোভাবেই সঠিক হতে পারে না। কারণ, আইনস্টাইন যদি সঠিক হন, তার মানে হবে, পদার্থবিজ্ঞান ওখানেই শেষ। কিন্তু সেটা খণ্ডন করার মতো কোনো পাল্টা যুক্তি খুঁজে পাচ্ছিলেন না তিনি। সেদিন দুই প্রতিপক্ষের বিশ্ববিদ্যালয় ক্লাব থেকে চলে যাওয়ার সেই দৃশ্য আমি কোনো দিন ভুলতে পারব না। আইনস্টাইন রাজকীয় ভঙ্গিতে শান্তভাবে বীরদর্পে হেঁটে চলে গেলেন। তাঁর মুখে মৃদু কৌতুকভরা হাসি। ঠিক তাঁর পাশে দুলকি চালে হাঁটতে লাগলেন চরম হতাশায় বুঁদ হওয়া নীলস বোর।’
এরপর এরেনফাস্ট যখন বোরের মুখোমুখি হলেন, তখনো তিনি নির্বাক। শুধু একটি কথাই তিনি বিড়বিড় করে বারবার বলে যাচ্ছিলেন, ‘আইনস্টাইন…আইনস্টাইন…আইনস্টাইন।’
পরদিন একটা ভয়াবহ, নিদ্রাহীন রাত শেষে, আইনস্টাইনের যুক্তিতে অবশেষে একটা ছোট্ট খুঁত খুঁজে পান বোর। ফোটন নিঃসরণের পর বাক্সটা কিছুটা হালকা হয়ে যাচ্ছে। কারণ, বস্তু আর শক্তি তো সমতুল্য। তার মানে, মহাকর্ষের অধীনে বাক্সটা কিছুটা ওপরে উঠে যাবে। কারণ, আইনস্টাইনের নিজের মহাকর্ষ তত্ত্বমতে, শক্তিই তো ভর। তাই এতে ফোটনের শক্তিতে একটা অনিশ্চয়তা এনে দেবে। তখন যদি ভরের অনিশ্চয়তা, শাটার স্পিডের অনিশ্চয়তা গণনা করা হয়, তাহলে দেখা যাবে বাক্সটা অনিশ্চয়তার নীতি পুরোপুরি মেনে চলছে। আসলে আইনস্টাইনকে হারাতে আইনস্টাইনের নিজের মহাকর্ষ তত্ত্বই ব্যবহার করেন বোর। এভাবে সেবার শেষ হাসি হাসলেন বোর। পরাজিত হলেন আইনস্টাইন।
এরপর আইনস্টাইন যখন অভিযোগ করলেন, ‘মহাবিশ্বের সঙ্গে ঈশ্বর পাশা খেলেন না।’ বোরও পাল্টা গুলি চালালেন, ‘ঈশ্বরকে উপদেশ দেওয়া বন্ধ করুন।’ শেষ পর্যন্ত আইনস্টাইন স্বীকার করতে বাধ্য হন, তাঁর যুক্তি সফলভাবে খণ্ডন করতে পেরেছেন বোর। পরে আইনস্টাইন লিখেছেন, ‘আমি নিশ্চিত, এই তত্ত্ব নিঃসন্দেহে চূড়ান্ত সত্যের একটা টুকরো মাত্ৰ।’ (তবে কোয়ান্টাম তত্ত্বের ভেতর সহজাতভাবে জটিল প্যারাডক্সগুলো সঠিকভাবে মূল্যায়ন করতে যেসব পদার্থবিদ ব্যর্থ হতেন, তাঁদের অপছন্দ করতেন আইনস্টাইন। তিনি একবার লিখেছিলেন, ‘এখন প্রত্যেক বদমাশই মনে করে, সে উত্তরগুলো জানে, কিন্তু সে আসলে নিজেকেই প্রতারিত করছে।’)
কোয়ান্টাম পদার্থবিদদের সঙ্গে এ বিতর্কসহ আরও তুমুল বিতর্কের পর আইনস্টাইন শেষ পর্যন্ত পরাজিত হন। কিন্তু ভিন্ন উপায়ের আশ্রয় নেন তিনি। তিনি স্বীকার করেন, কোয়ান্টাম তত্ত্ব সঠিক, কিন্তু সেটা কেবল এক নির্দিষ্ট ক্ষেত্রের ভেতর। সেটা শুধু বাস্তব সত্যের একটা আসন্নতা হিসেবে। আপেক্ষিকতা তত্ত্বে নিউটনের তত্ত্বকে যেভাবে সাধারণীকরণ (কিন্তু ধ্বংস করেনি) করা হয়েছিল, সেভাবে কোয়ান্টাম তত্ত্বকে একটা সাধারণ, আরও শক্তিশালী তত্ত্ব, অর্থাৎ একটা একীভূত ক্ষেত্র তত্ত্বের মধ্যে ঢুকিয়ে দিতে চেয়েছিলেন তিনি।
(এই বিতর্কের এক পক্ষে ছিলেন আইনস্টাইন আর শ্রোডিঙ্গার। আরেক পক্ষে বোর আর হাইজেনবার্গ। কিন্তু তা সহজেই খারিজ করা যায়নি। কারণ, এই চিন্তন পরীক্ষা এখন পরীক্ষাগারে যাচাই করে দেখা যায়। অবশ্য একটা বিড়ালকে একই সঙ্গে জীবিত ও মৃত বানাতে পারেননি বিজ্ঞানীরা। তবে এখন ন্যানো টেকনোলজি ব্যবহার করে আলাদা পরমাণু নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন তাঁরা। সম্প্রতি এই বিস্ময়কর পরীক্ষাগুলো ৬০টি কার্বন পরমাণু দিয়ে বানানো একটা বাকিবল দিয়ে করে দেখা হয়েছে। তাতে বোরের কল্পিত বড় বস্তু আর কোয়ান্টাম পদার্থকে আলাদা করা সেই ‘দেয়াল’ এখন এক লহমায় ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গেছে। কয়েক হাজার পরমাণু সমন্বিত একটা ভাইরাসকে একই সময়ে দুটো জায়গায় দেখাতে চাইলে কী কী দরকার, সেটাই এখন গভীরভাবে চিন্তাভাবনা করছেন পরীক্ষক পদার্থবিদেরা।)
বোমা
দুর্ভাগ্যের ব্যাপার হলো, এসব উপভোগ্য প্যারাডক্স নিয়ে আলোচনায় বাধা পড়ে ১৯৩৩ সালে। হিটলারের উত্থানের পর। তারপর পারমাণবিক বোমা বানাতে চারদিকে যেন হুড়োহুড়ি লেগে গেল। আইনস্টাইনের বিখ্যাত সমীকরণ E = mc^2-এর কারণে অনেক বছর ধরে জানা হয়ে গিয়েছিল, পরমাণুর ভেতর বিপুল শক্তির ভান্ডার আটকে পড়ে আছে। কিন্তু এই শক্তিতে আদৌ লাগাম পরানো যাবে কি না, সে ব্যাপারে সন্দিহান ছিলেন বেশির ভাগ পদার্থবিজ্ঞানী। এমনকি যে মানুষটি পরমাণুর নিউক্লিয়াস আবিষ্কার করেছিলেন, সেই আর্নেস্ট রাদারফোর্ডও একবার বলেছিলেন, ‘পরমাণু ভেঙে সেখান থেকে শক্তি তৈরি খুব ত্রুটিপূর্ণ ব্যাপার। এসব পরমাণু রূপান্তর করে যাঁরা শক্তির উৎস পাওয়ার আশা করছেন, তাঁরা আসলে মরীচিকার পেছনে ছুটছেন।’
,
নীলস বোর ১৯৩৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রে এক অবশ্যম্ভাবী ভ্রমণ করেন। তাঁর ছাত্র জন হুইলারের সঙ্গে দেখা করতে অবতরণ করেন নিউইয়র্কে। সঙ্গে করে এক অশুভ খবর নিয়ে গিয়েছিলেন তিনি। খবরটা হলো, অটো হান আর লিজ মেইটনার প্রমাণ করেছেন, ইউরেনিয়াম নিউক্লিয়াসকে অর্ধেক ভাগে বিভাজন করা যায়। আর তার মাধ্যমে শক্তিও বেরিয়ে আসে। এসব ঘটে ফিশন বা বিভাজন নামের একটি প্রক্রিয়ায়। নিউক্লিয়ার ফিশন বা পারমাণবিক বিভাজনের কোয়ান্টাম গতিবিদ্যা নির্ণয় করতে শুরু করলেন বোর ও হুইলার। কোয়ান্টাম তত্ত্বে সবকিছু সম্ভাবনা আর দৈব ঘটনার ব্যাপার। সে কারণে তাঁরা সম্ভাবনা হিসাব করে দেখলেন, ইউরেনিয়াম নিউক্লিয়াসের একটা নিউট্রন ভেঙে গিয়ে তার ভেতর থেকে বের করে আনবে দুটি বা তারও বেশি নিউট্রন। এভাবে ক্রমেই আরও নিউট্রন বেরিয়ে আসতে থাকবে। তাতে এমন এক চেইন রিঅ্যাকশন ঘটতে থাকবে, যা একটা আধুনিক শহরকে স্রেফ ধ্বংসস্তূপে পরিণত করতে সক্ষম। (কোয়ান্টাম বলবিদ্যায় কখনোই জানা সম্ভব নয়, কোনো নির্দিষ্ট নিউট্রন একটা ইউরেনিয়াম পরমাণুকে বিভক্ত করবে। কিন্তু তবু এর মাধ্যমে অবিশ্বাস্য নির্ভুলতার সঙ্গে এ সম্ভাবনা গণনা করা যাবে যে একটা বোমাতে কোটি কোটি ইউরেনিয়াম পরমাণু বিভক্ত হয়ে যাবে। এটাই কোয়ান্টাম মেকানিকসের শক্তি।)
তাদের কোয়ান্টাম গণনায় ইঙ্গিত পাওয়া গেল, একটা পারমাণবিক বোমা বানানো সম্ভবও হতে পারে। দুই মাস পর, প্রিন্সটনে আইনস্টাইনের পুরোনো অফিসে দেখা করলেন বোর, ইউজিন উগনার, লিও জিলার্ড এবং হুইলার। তাদের উদ্দেশ্য, পারমাণবিক বোমার সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা। বোর মনে করতেন, এ রকম একটা বোমা বানাতে একটা জাতির গোটা সম্পদের দরকার হবে। (এর কয়েক বছর পর, একটা পারমাণবিক বোমা বানানোর আরজি জানিয়ে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট রুজভেল্টকে সেই ভাগ্য নির্ধারণী চিঠিটি লিখতে আইনস্টাইনকে রাজি করান জিলার্ড।)
ঠিক ওই বছর ইউরেনিয়াম পরমাণু এই বিপর্যয়কর শক্তি নিঃসরণের কথা জানতে পারে হিটলারের নাৎসি বাহিনী। এর মাধ্যমে অপরাজেয় একটা অস্ত্র বানানো সম্ভব মনে করে তারা হিটলারের জন্য একটা বোমা বানিয়ে দিতে বলে বোরের ছাত্র হাইজেনবার্গকে। রাতারাতি ফিশনের কোয়ান্টাম সম্ভাবনা নিয়ে জল্পনাকল্পনা মারাত্মকভাবে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। তাতে মানব ইতিহাসের ভাগ্য একেবারে খাদের কিনারায় চলে যায়। জীবন্ত বিড়াল খুঁজে পাওয়ার সম্ভাবনার আলোচনা হুট করে পাল্টে যায়। তার জায়গায় আলোচিত হতে থাকে ইউরেনিয়াম ফিশনের সম্ভাবনা নিয়ে।
ইউরোপের অধিকাংশ এলাকা নাৎসি বাহিনীর দখলে আসে ১৯৪১ সালে। এরপর গোপন এক যাত্রায় নিজের গুরু বোরের সঙ্গে কোপেনহেগেনে দেখা করতে যান হাইজেনবার্গ। তাদের আলোচনার প্রকৃতি আসলে কী ছিল, তা এখনো রহস্যের চাদরে ঢাকা। এ সম্পর্কে নাটকও লেখা হয়েছে। পুরস্কারও পেয়েছে সেগুলো। কিন্তু তাদের আলোচ্য বিষয় নিয়ে এখনো বিতর্ক করেন ইতিহাসবিদেরা। হাইজেনবার্গ কি নাৎসিদের পারমাণবিক বোমার নাশকতার প্রস্তাব দিয়েছিলেন? নাকি নাৎসি বোমার জন্য বোরকে রিক্রুট করার চেষ্টা করেছিলেন হাইজেনবার্গ? ছয় দশক পর ২০০২ সালে, হাইজেনবার্গের উদ্দেশ্য নিয়ে জমে থাকা রহস্যের অনেকখানি শেষ পর্যন্ত উন্মোচিত হয়েছে। সে বছর হাইজেনবার্গকে লেখা বোরের এক চিঠি প্রকাশ করে বোরের পরিবার। সেটা লেখা হয়েছিল ১৯৫০-এর দশকে। কিন্তু কখনোই পাঠানো হয়নি চিঠিটা। সে চিঠিতে বোর স্মরণ করেছেন, হাইজেনবার্গ ওই আলোচনায় তাঁকে বলেছিলেন, নাৎসিদের বিজয় অনিবার্য। নাৎসি বাহিনীর অগ্রযাত্রা ঠেকানোর মতো কিছু না থাকায় নাৎসিদের পক্ষে কাজ করাটাই হবে বোরের জন্য একমাত্র যৌক্তিক।
বোর স্রেফ হতবাক হয়ে গেলেন, অন্তরাত্মা কেঁপে উঠল তাঁর। থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে তিনি সে প্রস্তাব নাকচ করলেন। কোয়ান্টাম তত্ত্ব নিয়ে তাঁর গবেষণা নাৎসিদের হাতে পড়ুক, তা কিছুতেই মানতে পারছিলেন না। কারণ, ডেনমার্ক তখন নাৎসিদের নিয়ন্ত্রণে। একটা বিমানে চড়ে সেখান থেকে গোপনে পালানোর পাঁয়তারা করলেন তিনি। সেবার স্বাধীনতার স্বাদ পাওয়ার জন্য সেই বিমানযাত্রায় অক্সিজেনের অভাবে তিনি প্রায় দমবন্ধ হয়ে মারাই যেতে বসেছিলেন।
এদিকে কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের এনরিকো ফার্মি প্রমাণ করলেন, নিউক্লিয়ার চেইন রিঅ্যাকশন বাস্তবে ঘটানো সম্ভব। এ সিদ্ধান্ত আসার পর তিনি নিউইয়র্ক শহরের দিকে একপলক উঁকি দিয়ে দেখলেন। বুঝতে পারলেন, একটা মাত্র বোমা দিয়েই দিগন্তরেখা পর্যন্ত যা কিছু দেখছেন, তার সবকিছুই ধ্বংসস্তূপে পরিণত করা সম্ভব। ওদিকে ঝুঁকিটা কত বড় হতে পারে, তা উপলব্ধি করতে পারলেন হুইলারও। তাই স্বেচ্ছায় প্রিন্সটন ছেড়ে শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের স্ট্যাগ ফিল্ডে মাটির নিচে ফার্মির সঙ্গে যোগ দেন। সেখানে দুজন মিলে প্রথম নিউক্লিয়ার রিঅ্যাক্টর বানান তাঁরা। এভাবে আনুষ্ঠানিকভাবে সূচনা হয় পারমাণবিক যুগের।
পরের দশকে, পারমাণবিক যুদ্ধের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কিছু ঘটনার সাক্ষী হন হুইলার। যুদ্ধের সময়, যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন অঙ্গরাজ্যে বিশাল আকৃতির হ্যানফোর্ড রিজারভেশন বানানোর তদারক করতে সহায়তা করেন তিনি। এখানে বোমা বানানোর জন্য প্রয়োজনীয় অপরিশোধিত প্লুটোনিয়ামের জোগান আসত। এগুলোই পরে জাপানের নাগাসাকি শহরকে স্রেফ একটা ধ্বংসস্তূপে পরিণত করেছিল। এর কয়েক বছর পর, হাইড্রোজেন বোমা তৈরিতে কাজ করেন তিনি। ১৯৫২ সালে চোখের সামনে প্রথম হাইড্রোজেন বোমা বিস্ফোরণ হতে দেখেন। প্রশান্ত মহাসাগরের বুকে ছোট্ট একটা দ্বীপে এক টুকরো সূর্য ছড়িয়ে পড়ে ধ্বংস হয়ে যেতে দেখেন তিনি ওই বিস্ফোরণে। কিন্তু কয়েক দশকের বেশি সময় ধরে বিশ্ব ইতিহাসের সর্বাগ্রে থাকার পর, শেষ পর্যন্ত তিনি ফিরে আসেন নিজের প্রথম প্রেমের কাছে। তাঁর সেই প্রেম ছিল কোয়ান্টাম তত্ত্বের রহস্যের প্রতি।
পথের যোগফল
যুদ্ধের পর হুইলারের বিশাল শিক্ষার্থী দলের মধ্যে একজন ছিলেন রিচার্ড ফাইনম্যান। কোয়ান্টাম তত্ত্বের জটিলতার সারসংক্ষেপ করতে তিনিই সম্ভবত সবচেয়ে সরল, কিন্তু গভীরতম এক উপায় খুঁজে পান। (এই আইডিয়ার কারণে ১৯৬৫ সালে নোবেল পুরস্কার পান ফাইনম্যান।) ধরা যাক, আপনি ঘরের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে হেঁটে যেতে চান। নিউটনের মতে, সে জন্য আপনাকে A বিন্দু থেকে B বিন্দু পর্যন্ত সবচেয়ে সংক্ষিপ্ত পথটি বেছে নিতে হবে। একে বলে চিরায়ত পথ। কিন্তু ফাইনম্যানের মতে, এ রকম ক্ষেত্রে প্রথমে আপনাকে A বিন্দু থেকে B বিন্দু পর্যন্ত সম্ভাব্য সব পথ বিবেচনায় আনতে হবে। তার মানে, আপনাকে বিবেচনায় রাখতে হবে মঙ্গল গ্রহ হয়ে বৃহস্পতি ঘুরে, সবচেয়ে কাছের নক্ষত্র পেরিয়ে যেসব পথ আছে, এমনকি সময়ের পেছন দিকের পথ, যেটা মহাবিস্ফোরণের কালে ফিরে গেছে—সেসব পথও। এই পথগুলো যত খ্যাপাটে আর উদ্ভট লাগুক না কেন, আপনাকে তা অবশ্যই বিবেচনা করতে হবে। ফাইনম্যান এরপর প্রতিটি পথকে একটা সংখ্যা দিয়ে চিহ্নিত করলেন। এক সেট নিখুঁত বিধিও দিলেন, যা দিয়ে এসব সংখ্যা গণনা করা যায়। অবিশ্বাস্য ব্যাপার হলো, সব সম্ভাব্য পথের এসব সংখ্যা যোগ করে প্রমিত কোয়ান্টাম মেকানিকসের মাধ্যমে A বিন্দু থেকে B বিন্দু পর্যন্ত হেঁটে যাওয়ার সম্ভাবনা পাওয়া যাবে। সেটা সত্যিই অসাধারণ ব্যাপার।
ফাইনম্যান দেখতে পান, এসব পথের সংখ্যাগুলোর যোগফল উদ্ভট। আবার সেগুলো নিউটনের গতির সূত্রও মানে না। আর যোগফলটা সাধারণত পরস্পর বাতিল হয়ে সবশেষে একটা ছোট মান পাওয়া যায়। এখান থেকেই কোয়ান্টাম ফ্ল্যাকচুয়েশন বা হ্রাস-বৃদ্ধির জন্ম। অর্থাৎ যার যোগফল সবচেয়ে কম, সেই পথের প্রতিনিধিত্ব করে তারা। কিন্তু সেই সঙ্গে তিনি এটাও দেখেন, সাধারণ কাণ্ডজ্ঞানের নিউটোনিয়ান পথ হলো সেটাই, যা বাতিল হয় না এবং যার যোগফল সবচেয়ে বেশি। এটাই সবচেয়ে বেশি সম্ভাবনার পথ। কাজেই আমাদের ভৌত মহাবিশ্বের নিদর্শন হিসেবে সাধারণ কাণ্ডজ্ঞান হলো, অসীমসংখ্যক অবস্থার মধ্যে সরলভাবে সবচেয়ে বেশি সম্ভাব্য অবস্থাটা। কিন্তু আমরা একই সঙ্গে অন্যান্য সম্ভাব্য অবস্থার সঙ্গেও সহাবস্থান করি। এদের মধ্যে বেশ কিছু অবস্থা আমাদের অতীতের ডাইনোসর যুগে, সুপারনোভার কাছে ও মহাবিশ্বের একেবারে প্রান্তেও নিয়ে যায়। (সাধারণ কাণ্ডজ্ঞানের নিউটোনিয়ান দৃষ্টিকোণের পথ থেকে এসব উদ্ভট পথ ক্ষুদ্র এক বিচ্যুতি তৈরি করে। সৌভাগ্যের ব্যাপার হলো, তার সঙ্গে খুব নিম্ন সম্ভাবনা যুক্ত থাকে।)
অন্য কথায়, একে দেখতে যতই আজগুবি লাগুক না কেন, আপনি যতবার ঘরের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে হেঁটে যান, ততবার আপনার দেহ কোনো না কোনোভাবে সময়ের আগে গিয়ে সব সম্ভাব্য পথে ‘শুঁকে দেখে’ খুঁজে দেখে)। এমনকি যেসব পথ বহুদূরের কোয়াসার ও মহাবিস্ফোরণ পর্যন্ত বিস্তৃত সেগুলোও যাচাই করে দেখে। তারপর সব যোগ করে। ফাংশনাল ইন্টিগ্রাল নামের শক্তিশালী গণিত ব্যবহার করে ফাইনম্যান প্রমাণ করলেন, নিউটোনিয়ান পথ সরলভাবে সবচেয়ে সম্ভাব্য পথ। কিন্তু সেটাই একমাত্র পথ নয়। গাণিতিক কৌশলের মাধ্যমে ফাইনম্যান প্রমাণ দেখাতে সক্ষম হন যে এই ছবি যতই বিস্ময়কর মনে হোক না কেন, তা নিখুঁতভাবে সাধারণ কোয়ান্টাম মেকানিকসের সমতুল্য। (আসলে এ পদ্ধতি ব্যবহার করে শ্রোডিঙ্গারের তরঙ্গ সমীকরণের একটা উৎসমূলের জোগান দিতে পেরেছিলেন ফাইনম্যান।)
ফাইনম্যানের ‘সাম ওভার পাথস’ বা ‘পথের যোগফল’ বেশ শক্তিশালী। বর্তমানে GUT তত্ত্ব, স্ফীতি, এমনকি স্ট্রিং তত্ত্ব সূত্রবদ্ধ করতে আমরা ফাইনম্যানের পাথ ইন্টিগ্রাল ব্যবহার করি। এই পদ্ধতি এখন শেখানো হয় বিশ্বের সব গ্র্যাজুয়েট স্কুলে। আর কোয়ান্টাম তত্ত্ব সূত্রবদ্ধ করতে এটিই এখন পর্যন্ত সবচেয়ে শক্তিশালী ও সুবিধাজনক উপায়।
(আমার নিজের গবেষণাকাজেও প্রায় প্রতিদিন ফাইনম্যানের পাথ ইন্টিগ্রাল ব্যবহার করি আমি। প্রতিদিন যেসব সমীকরণ লিখি, তার প্রতিটি এসব সাম ওভার পাথের নিরিখে লেখা হয়। গ্র্যাজুয়েট ছাত্র হিসেবে আমি প্রথম যখন ফাইনম্যানের দৃষ্টিকোণটা শিখি, তখন মহাবিশ্ব সম্পর্কে আমার গোটা মানসিক চিত্র বদলে যায়। বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে, আমি কোয়ান্টাম তত্ত্ব এবং সাধারণ আপেক্ষিকতার বিমূর্ত গণিত বুঝি। কিন্তু এই আইডিয়াটা অনুসারে, এক অর্থে ঘরের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে হেঁটে যেতে মঙ্গলগ্রহ বা আরও দূরের কোনো নক্ষত্রের পাশের পথও আমাকে যাচাই করতে হয়। আর সেটাই বিশ্ব সম্পর্কে আমার দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টে দিয়েছে। হঠাৎ করে আমার মনের মধ্যে আমি যে কোয়ান্টাম বিশ্বে বাস করি, তার একটা অদ্ভুত মানসচিত্র ফুটে উঠল। বুঝতে শুরু করলাম, মনকে অভিভূত করা আপেক্ষিকতার চেয়েও কোয়ান্টাম তত্ত্ব অনেক বেশি ভিনদেশি ও অচেনা।)
ফাইনম্যান যখন এই উদ্ভট সূত্রটা প্রণয়ন করছিলেন, তখন প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ে ছিলেন জন হুইলার। একদিন তাঁর অফিসের পাশেই ইনস্টিটিউট অব অ্যাডভান্সড স্টাডিতে আইনস্টাইনের কাছে ছুটে গেলেন। উদ্দেশ্য, নতুন এই চিত্রের আভিজাত্য আর শক্তি সম্পর্কে তাঁকে বোঝানো। আইনস্টাইনের কাছে পাথ ইন্টিগ্রাল সম্পর্কে ফাইনম্যানের নতুন তত্ত্বটি বেশ উত্তেজিত হয়ে ব্যাখ্যা করতে লাগলেন হুইলার। কিন্তু একবার বুঝতেও পারলেন না যে সেটা আইনস্টাইনের কাছে কতটা আজগুবি বলে মনে হচ্ছিল। সব শোনার পর আইনস্টাইন মাথা নাড়লেন। আগের সেই কথা আবারও উল্লেখ করলেন। তিনি এখনো বিশ্বাস করেন না যে বিশ্ব নিয়ে ঈশ্বর পাশা খেলেন। হুইলারের কাছে আইনস্টাইন স্বীকার করেছেন, তাঁর হয়তো ভুলও হতে পারে। কিন্তু এটাই বেশ দৃঢ় কণ্ঠে বলেছিলেন, এই ভুল করার অধিকার তিনি অর্জন করেছেন।
উইগনারের বান্ধবী
কোয়ান্টাম মেকানিকসের মন আচ্ছন্ন করা প্যারাডক্সের মুখোমুখি হলে বেশির ভাগ পদার্থবিদ কাঁধ ঝাঁকিয়ে হতাশায় ডুবে যান। বেশির ভাগ বিজ্ঞানীর কাছে কোয়ান্টাম মেকানিকস হলো রান্নার বইয়ের একগুচ্ছ নিয়মকানুন। এটা সঠিক সম্ভাবনার ফসল ঘরে তুলতে পারে অবিশ্বাস্য নির্ভুলভাবে। পদার্থবিদ থেকে পুরোহিত বনে যাওয়া জন পোলকিংহর্ন একবার বলেছিলেন, ‘গড়পড়তা কোয়ান্টাম মেকানিক বা কারিগর আসলে দার্শনিক হিসেবে বা জ্ঞানের অন্বেষক হিসেবে গড়পড়তা মোটর মেকানিকের চেয়ে বেশি কিছু নয়। তবে এসব প্রশ্ন নিয়ে সংগ্রাম করে যাচ্ছেন পদার্থবিদ্যার গভীরতম কয়েকজন চিন্তাবিদ। যেমন শ্রোডিঙ্গারের বিড়াল সমস্যার সমাধানের অনেকগুলো উপায় আছে। প্রথমটির প্রস্তাবক নোবেল বিজয়ী ইউজিন উইগনার ও অন্যরা। সেটি হলো চেতনাই আসলে অস্তিত্ব নির্ধারণ করে। উইগনার লিখেছেন, ‘একটা চেতনার (পর্যবেক্ষকের) বরাত না দিয়ে কোয়ান্টাম মেকানিকসের সূত্রগুলো একটা সম্পূর্ণ মানানসই উপায়ে প্রণয়ন করা সম্ভব ছিল না…বহির্বিশ্বের গবেষণার উপসংহার হলো, চেতনার ধারকই চূড়ান্ত বাস্তবতা।’ কিংবা কবি জন কিটস একবার লিখেছেন, ‘অভিজ্ঞতা না নেওয়া পর্যন্ত কোনো কিছুই বাস্তব হয়ে উঠতে পারে না।’
কিন্তু আমি যদি কোনো পর্যবেক্ষণ করি, তাহলে আমি নিজে কোন অবস্থার মধ্যে আছি, তা কীভাবে নির্ধারিত হবে? তার মানে, আমাকে পর্যবেক্ষণ করতে হবে অন্য কাউকেও, যাতে আমার তরঙ্গ ফাংশন ভেঙে যায়। এই অন্য কাউকে বলা হয় উইগনারের বান্ধবী। কিন্তু এর আরেক মানে হলো, উইগনারের বান্ধবীকেও আবার পর্যবেক্ষণ করবে আরেকজন। তারপর উইগনারের বান্ধবীর বন্ধুকে পর্যবেক্ষণ করবে আরেকজন, এভাবে ক্রমান্বয়ে চলতেই থাকবে। তাহলে কি মহাজাগতিক কোনো চেতনার অস্তিত্ব আছে, যিনি পুরো মহাবিশ্ব পর্যবেক্ষণ করার মাধ্যমে বন্ধুদের এই গোটা ক্রমের অবস্থা নির্ধারণ করে দেন?
চেতনার এই কেন্দ্রীয় ভূমিকা কঠোরভাবে বিশ্বাস করা পদার্থবিদদের মধ্যে অন্যতম হলেন আন্দ্রেই লিন্দে। স্ফীতিশীল মহাবিশ্বের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা তিনি। লিন্দে বলেন :
একজন মানুষ হিসেবে আমি কিছুতেই বুঝতে পারি না, যার মাধ্যমে দাবি করা যায় একজন পর্যবেক্ষকের উপস্থিতি ছাড়াই মহাবিশ্ব এখানে টিকে আছে। আমরা একসঙ্গে, মহাবিশ্ব এবং আমাদের। যে মুহূর্তে আপনি বলবেন, একজন পর্যবেক্ষক ছাড়া এই মহাবিশ্ব বিরাজ করছে, তা থেকে আমার মাথায় কিছুই ঢুকবে না। চেতনাকে নাকচ করে দিয়ে একটা সংগতিপূর্ণ থিওরি অব এভরিথিংয়ের কথা আমি ভাবতেও পারি না। কোনো রেকর্ডিং যন্ত্র একজন পর্যবেক্ষকের দায়িত্ব নিতে পারে না। কারণ, রেকর্ডিং যন্ত্রটিতে কী লেখা আছে, তা তাকে পড়তে পারতে হবে। আমাদের কোনো কিছু ঘটতে দেখার জন্য এবং একজন আরেকজনকে এ ঘটনা ঘটার কথা বলার জন্য আপনার একটা মহাবিশ্ব লাগবে, একটা রেকর্ডিং ডিভাইস লাগবে এবং সেখানে আমাদেরও থাকা দরকার…একজন পর্যবেক্ষক ছাড়া আমাদের মহাবিশ্ব আসলে মৃত।
লিন্দের দর্শন অনুযায়ী, আপনি চোখে না দেখা পর্যন্ত ডাইনোসরের ফসিলের আসলে কোনো অস্তিত্বই থাকে না। কিন্তু আপনি যখন ওগুলো দেখে ফেলেন, তখন তারা লাফ দিয়ে কোথা থেকে যেন হুট করে অস্তিত্বশীল হয়। যেন কয়েক লাখ বছর আগে তাদের অস্তিত্ব ছিল। (এই দৃষ্টিভঙ্গিতে বিশ্বাসী পদার্থবিদেরা বেশ সাবধানে বিষয়টি উল্লেখ করেন, যাতে এই চিত্রের সঙ্গে পরীক্ষামূলকভাবে একটা বিশ্ব খাপ খায়, যেখানে ডাইনোসরের ফসিল সত্যিই কয়েক লাখ বছরের পুরোনো।)
(পদার্থবিজ্ঞানে চেতনার সূচনা অপছন্দ করেন অনেকে। তাঁদের দাবি, একটা ক্যামেরা একটা ইলেকট্রন পর্যবেক্ষণ করতে পারে। কাজেই সচেতন জীব ছাড়াই ওয়েভ ফাংশন কলাপস করতে পারে। কিন্তু এ ক্যামেরার যে অস্তিত্ব আছে, সে কথা কে বলবে? সে জন্য আরেকটা ক্যামেরার দরকার, প্রথম ক্যামেরাটিকে পর্যবেক্ষণ করতে এবং তার ওয়েভ ফাংশন ভেঙে দিতে তাহলে প্রথম ক্যামেরাকে পর্যবেক্ষণ করতে দ্বিতীয় আরেকটা ক্যামেরার দরকার হচ্ছে। তৃতীয় আরেকটা ক্যামেরার দরকারও হবে দ্বিতীয় ক্যামেরা পর্যবেক্ষণে, এভাবেও আগের মতোই অসীম পর্যন্ত যেতে হবে। সুতরাং ক্যামেরা এনে ওয়েভ ফাংশনের পতনের প্রশ্নের উত্তর দেওয়া যায় না।)
অসংগতি
এসব দার্শনিক প্রশ্নের আংশিক সমাধানের একটা উপায়কে বলা হয় ডিকোহেরেন্স বা অসংগতি। পদার্থবিদদের মধ্যে বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছে এটা। ১৯৭০ সালে এটি প্রথম সূত্রবদ্ধ করেন জার্মান পদার্থবিদ ডিটার জেহ। তিনি খেয়াল করেন, বাস্তব জগতে আপনি একটা বিড়ালকে পরিবেশ থেকে আলাদা করতে পারবেন না। বিড়ালটা বাক্সের ভেতরের বাতাসের অণুগুলোর নিবিড় সংস্পর্শে থাকে। এমনকি এই পরীক্ষা চলাকালে এর ভেতর দিয়ে কোনো মহাজাগতিক রশ্মিও চলে গেলে, তারও সংস্পর্শ থাকে বিড়ালটির সঙ্গে। এ মিথস্ক্রিয়া যত ক্ষুদ্রই হোক, তা আমূলে ওয়েভ ফাংশনের ওপর প্রভাব ফেলে। অর্থাৎ ওয়েভ ফাংশনটি যদি সামান্যতমও বিঘ্নিত হয়, তাহলে তা হঠাৎ করে জীবিত ও মৃত বিড়ালের দুটি আলাদা ওয়েভ ফাংশনে ভেঙে যাবে। এরপর সেটা আর কোনো মিথস্ক্রিয়ায় জড়াবে না। বিজ্ঞানী জেহ প্রমাণ দেখালেন, বাতাসের একটা মাত্র অণুর সঙ্গে সংঘর্ষ এটি ভেঙে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট। ফলে মৃত ও জীবিত বিড়ালের ওয়েভ ফাংশনে চিরস্থায়ীভাবে আলাদা হতে বাধ্য করে। সেগুলো পরস্পরের সঙ্গে আর কোনো যোগাযোগ করতে পারে না। অন্য কথায়, বাক্সটি খোলার আগেও বিড়ালটি বাতাসের অণুগুলোর সংস্পর্শে আসতে পারে। ততক্ষণে সে মৃত অথবা জীবিত।
জেহের মূল যে পর্যবেক্ষণটি ছিল, তা উপেক্ষা করা হয়েছিল। সেটি ছিল : জীবিত ও মৃত উভয় বিড়ালের জন্যই, মৃত বিড়ালের ওয়েভ ফাংশন এবং জীবিত বিড়ালের ওয়েভ ফাংশন অবশ্যই প্রায় একই রকম ছন্দে স্পন্দিত হয়। এ অবস্থাকে বলা হয় কোহেরেন্স বা সংগতি। কিন্তু পরীক্ষামূলকভাবে, এটা পাওয়া প্রায় অসম্ভব। একই ছন্দে স্পন্দিত হওয়া কোনো বস্তু গবেষণাগারে বানানো খুব কঠিন। (বাস্তবে একই ছন্দে কম্পিত পরমাণু পাওয়া অসম্ভব, কারণ বাইরের জগতের হস্তক্ষেপ।) বাস্তব জগতে বস্তুরা পরিবেশের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়া করে। আবার বাইরের জগতের সঙ্গে সামান্য পরিমাণে মিথস্ক্রিয়া দুটি ওয়েভ ফাংশনকে বিঘ্নিত করতে পারে। এতে তাদের মধ্যে আর কোনো সংগতি থাকে না। অর্থাৎ তাদের ছন্দ নষ্ট হয়ে যায় এবং তারা আলাদা হয়ে যায়। এবার দুটি ওয়েভ ফাংশন আর পরস্পরের সঙ্গে একই দশায় কম্পিত না হলে, দুটি ওয়েভ ফাংশনও আর নিজেদের মধ্যে মিথস্ক্রিয়া করে না বলে দেখিয়েছেন জেহ।
বহু জগৎ
প্রথম দিকে ডিকোহেরেন্স বেশ সন্তোষজনক ব্যাপার বলে মনে হয়েছিল। কারণ, এখন ওয়েভ ফাংশন কলাপস করার জন্য কোনো চেতনার প্রয়োজন হচ্ছে না, বরং সে জন্য বাইরের জগতের সঙ্গে এলোমেলো মিথস্ক্রিয়াই যথেষ্ট। কিন্তু এটা আইনস্টাইনকে বিরক্ত করা সেই মৌলিক প্রশ্নটির সুরাহা করতে পারে না : কোন দশায় ভেঙে যেতে হবে, প্রকৃতি সেটা কীভাবে বাছাই করে? একটা বাতাসের অণু যখন বিড়ালটির সংস্পর্শে আসে, কে বা কোন জিনিসটা বিড়ালটির চূড়ান্ত দশা নির্ধারণ করে দেয়? এই প্রশ্নের ক্ষেত্রে ডিকোহেরেন্স থিওরি বা অসংগতি তত্ত্ব শুধু এটাই বলে যে দুটি তরঙ্গ ফাংশন আলাদা হয়ে যায় এবং তারা আর মিথস্ক্রিয়া করে না। কিন্তু এটা আসল প্রশ্নটির কোনো জবাব দেয় না। প্রশ্নটা হলো : বিড়ালটি কি জীবিত নাকি মৃত? অন্য কথায়, কোয়ান্টাম মেকানিকসে চেতনাকে অপ্রয়োজনীয় করে তোলে ডিকোহেরেন্স, কিন্তু মূল প্রশ্নের কোনো সুরাহা করতে পারে না এটা। এই প্রশ্নটিতে বিরক্ত হয়েছিলেন আইনস্টাইন : বিড়ালটির চূড়ান্ত দশা প্রকৃতি কীভাবে বাছাই করে? এই প্রশ্নের বেলায় ডিকোহেরেন্স থিওরির ভূমিকা নীরব
তবে ডিকোহেরেন্সের একটা প্রাকৃতিক সংযোজন আছে, যেটা প্রশ্নটির সুরাহা করে। এটা পদার্থবিদদের কাছেও বর্তমানে বেশ গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে। দ্বিতীয় এই পদ্ধতির প্রবর্তক জন হুইলারের আরেক ছাত্র তৃতীয় হিউ এভারেট। তিনি আরেকটা সম্ভাবনার কথা বলেন। সেটা হলো বিড়ালটি হয়তো একই সঙ্গে জীবিত ও মৃত হতে পারে, কিন্তু তা দুটি আলাদা মহাবিশ্বে। ১৯৫৭ সালে এভারেটের পিএইচডি থিসিস সম্পন্ন হওয়ার পর তা তেমন কারও নজরে পড়তে ব্যর্থ হয়। তবে বছর গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে মেনি ওয়ার্ল্ড বা বহু জগতের ব্যাখ্যার প্রতি সবার আগ্রহ বাড়তে থাকে। বর্তমানে কোয়ান্টাম তত্ত্বের প্যারাডক্সগুলোতে নতুন করে আগ্রহের জোয়ার বাড়িয়ে দিতে সহায়তা করেছে এটা।
একেবারে আনকোরা এই ব্যাখ্যায় বিড়ালটি জীবিত ও মৃত দুটোই হতে পারে। কারণ, তখন মহাবিশ্ব দুটি ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। এক মহাবিশ্বে বিড়ালটি জীবিত থাকে এবং আরেকটি থাকে মৃত। আসলে প্রতিটি কোয়ান্টাম সংযোগে মহাবিশ্ব অর্ধেক ভাগে বিভক্ত হয়। আর তা বিভক্ত হয় মহাবিশ্বের অশেষ ক্রমানুসারে। প্রতিটি মহাবিশ্বে বসবাসরত মানুষেরা হয়তো জোরালো প্রতিবাদ জানাবে যে তাদের মহাবিশ্বটাই আসল ও বাকিগুলো কাল্পনিক বা নকল। এসব সমান্তরাল মহাবিশ্ব আসলে ভুতুড়ে জগৎ নয়, ক্ষণজীবীও নয়। প্রতিটি মহাবিশ্বে আমরা নিরেট বস্তুর উপস্থিতি পাই। আবার সেখানকার সুদৃঢ় ঘটনাগুলোও যেকোনো বস্তুর মতোই বাস্তব।
এ ব্যাখ্যার সুবিধাটা হলো, আমরা তৃতীয় নম্বর শর্তটি এখানে আরোপ করতে পারি। অর্থাৎ ওয়েভ ফাংশনের পতন (বোরের কোপেনহেগেন স্কুলের তৃতীয় স্বতঃসিদ্ধ)। ওয়েভ ফাংশন কখনো কলাপস করে না, তারা বিকশিত হতে থাকে এবং চিরকালের জন্য অন্য ওয়েভ ফাংশনে বিভক্ত হয়ে যায়। প্রক্রিয়াটি এমন একটা অসমাপ্ত গাছের মতো, যার প্রতি শাখা গোটা একটা মহাবিশ্বের প্রতীক। বহু বিশ্ব তত্ত্বের সবচেয়ে বড় সুবিধাটি হলো, এটা কোপেনহেগেন ব্যাখ্যার চেয়ে অনেক বেশি সরল : এর জন্য ওয়েভ ফাংশনের ভেঙে যাওয়ার বা পতনের দরকার হয় না। তবে সে জন্য আমাদের অন্য একটা মূল্যও দিতে হয়। সেটা হলো, আমাদের এখন অসংখ্য মহাবিশ্ব আছে, যেগুলো অবিরামভাবে লাখো লাখো শাখা-প্রশাখায় বিভক্ত হচ্ছে। (অনেকে মনে করেন, এসব দ্রুত বংশবৃদ্ধি করা মহাবিশ্ব বোঝা খুব কঠিন। তবে শ্রোডিঙ্গারের তরঙ্গ সমীকরণ সেটা স্বয়ংক্রিয়ভাবে করে। শুধু তরঙ্গ সমীকরণের বিবর্তন খেয়াল করে বেশ দ্রুতই তরঙ্গটির বিপুল শাখা-প্রশাখার হিসাব রাখা যায়। )
এ ব্যাখ্যা সঠিক হলে, এই মুহূর্তে আপনার দেহ আর মরণযুদ্ধে নিয়োজিত ডাইনোসরদের ওয়েভ ফাংশনের সঙ্গে সহাবস্থান করছে। আপনি যে ঘরে আছেন, ঠিক সেখানে সহাবস্থান করছেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বিজয়ী জার্মানদের কোনো জগতের ওয়েভ ফাংশনের সঙ্গে, সেখানে হয়তো বাইরের মহাকাশ থেকে আসা এলিয়েনরাও ঘোরাফেরা করছে, সেখানে আপনার হয়তো এখনো জন্মই হয়নি। দ্য ম্যান ইন দ্য হাই ক্যাসল এবং দ্য টোয়াইলাইট জোন-এর জগৎগুলো আপনার ঘরে বিরাজ করা মহাবিশ্বের মধ্যেও থাকতে পারে। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো, আমরা তাদের সঙ্গে কোনোভাবে মিথস্ক্রিয়া করতে পারি না। আসলে তাদের সঙ্গে আমাদের ডিকোহেরেন্স বা অসংগতির কারণে এ রকম হয়।
অ্যালান গুথ বলেন, ‘এমন কোনো মহাবিশ্ব থাকতেও পারে, যেখানে এলভিস এখনো বেঁচে আছেন।’ পদার্থবিদ ফ্রাঙ্ক উইলজেক লিখেছেন, ‘আমরা এই সচেতনতায় ভুগছি যে আমাদের চেয়ে কিছুটা ভিন্ন রকম অসীমসংখ্যক আমাদের কপিগুলো তাদের সমান্তরাল জীবনযাপন করছে। আবার প্রতি মুহূর্তে আরও কিছু নকল বিশ্বের উদয় হচ্ছে। এমনকি সেখানে আমাদের অসংখ্য বিকল্প ভবিষ্যৎ গ্রহণ করছে।’ তিনি উল্লেখ করেছেন, গ্রিক সভ্যতার ইতিহাস ও তার ফলে পশ্চিমা বিশ্বের ইতিহাস হয়তো ভিন্ন হতে পারত, যদি ট্রয়ের হেলেনের এমন নজরকাড়া সৌন্দর্য না থাকত। সৌন্দর্যের বদলে তার নাকে যদি বিশ্রী একটা আঁচিল থাকত। ‘মিউটেশনের মাধ্যম কোষে আঁচিল গজাতে পারে। সূর্যের অতিবেগুনি রশ্মির সংস্পর্শেও সেটা ঘটতে পারে। এভাবে এগিয়ে গিয়ে তিনি আরও লিখেছেন, ‘উপসংহারে বলা যায়, এমন অসংখ্য, অগণিত মহাবিশ্ব থাকতে পারে, যেখানে ট্রয়ের হেলেনের হয়তো নাকের একেবারে ডগায় একটা আঁচিল আছে।’
ওলাফ স্টেপলডনের ক্ল্যাসিক সায়েন্স ফিকশন স্টার মেকার-এর একটা অংশ মনে করিয়ে দিই, ‘কোনো প্রাণী যখন বিভিন্ন সম্ভাব্য ক্রিয়াকাণ্ডের মুখোমুখি হয়, সেটা তাদের সবগুলো গ্রহণ করে। ফলে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের অনেক…আলাদা ইতিহাস তৈরি হয়। বিশ্বজগতের প্রতিটি বিবর্তনের ক্রমে অগণিত জীবজন্তু ও প্রতিটি অনবরত অনেক সম্ভাব্য পথের মুখোমুখি হয়। তাদের সবগুলো পথের যোগফল অগণনীয়। তাই প্রতিটি অস্থায়ী ক্রমের প্রতিটি মুহূর্ত থেকে অসীমসংখ্যক আলাদা মহাবিশ্ব স্তরে স্তরে আবির্ভূত হয়।
কোয়ান্টাম মেকানিকসের এই ব্যাখ্যা অনুযায়ী, সবগুলো বিশ্ব আমাদের সঙ্গে সহাবস্থান করতে পারে—এটা বুঝতে হয়তো মাথা ঘুরে উঠবে। এ রকম বিকল্প বিশ্বের নাগাল পেতে হয়তো ওয়ার্মহোলের প্রয়োজন হতে পারে। তবে আমরা যে ঘরে থাকি, এসব কোয়ান্টাম বাস্তবতা সহাবস্থান করতে পারে সেখানেও। আমরা যেখানেই যাই, এসব সহাবস্থানও ছায়ার মতো আমাদের পিছু পিছু যায়। এখানে মূল প্রশ্ন হলো, এটা সত্য হলে, আমরা নিজেদের ঘরে এসব বিকল্প মহাবিশ্ব থাকতে দেখি না কেন? ঠিক এখানেই আসলে ডিকোহেরেন্সের কথা আসে। আমাদের সঙ্গে ওই সব মহাবিশ্বের ওয়েভ ফাংশনের কোনো রকম সংগতি নেই। (অর্থাৎ এই তরঙ্গ আর পরস্পরের সঙ্গে একই দশায় থাকে না)। তাই তাদের কোনো রকম সংযোগ নেই আমাদের সঙ্গে। তার মানে, পরিবেশের সঙ্গে অতিসামান্য দূষণও বিভিন্ন ওয়েভ ফাংশনকে পরস্পরের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়া করতে বাধা দেয়। (১১ অধ্যায়ে এই নিয়মের একটা সম্ভাব্য ব্যতিক্রমের কথা আলোচনা করা হবে। সেখানে আমরা দেখতে পাব, বুদ্ধিমান কোনো প্রাণী হয়তো এসব কোয়ান্টাম বিশ্বের মধ্যে ভ্রমণ করতেও সক্ষম হবে। )
এটা দেখে সম্ভব হওয়ার জন্য খুবই উদ্ভট বলে মনে হচ্ছে? এই মাল্টিপল ইউনিভার্স থিওরিকে রেডিওর সঙ্গে তুলনা করেছেন নোবেল বিজয়ী স্টিভেন ওয়াইনবার্গ। দূরের কোনো স্টেশন থেকে আপনার চারপাশে শত শত বিভিন্ন রকম রেডিও তরঙ্গ সম্প্রচারিত হচ্ছে। যেকোনো মুহূর্তেই আপনার অফিস, গাড়ি বা বসার ঘরে এসব রেডিও তরঙ্গে ভরে থাকে। তবে আপনি যখন একটা রেডিও চালু করেন, শুধু তখনই কেবল একটা সময়ে একটামাত্র ফ্রিকোয়েন্সি শুনতে পারবেন। এ সময় অন্য ফ্রিকোয়েন্সিগুলো ডিকোহেরেন্স দশায় থাকে। আবার পরস্পরের সঙ্গেও একই দশায় থাকে না সেগুলো। প্রতিটি স্টেশনের একটা আলাদা শক্তি, একটা আলাদা ফ্রিকোয়েন্সি থাকে। ফলে আপনার রেডিও একটা সময়ে শুধু একটা সম্প্রচারই চালু করতে বা শুনতে পারে।
তেমনিভাবে আমাদের মহাবিশ্বে আমরা এমন ফ্রিকোয়েন্সিতে টিউন করা, যা ভৌত বাস্তবতার জন্য উপযুক্ত। কিন্তু একই ঘরে আরও অসীম সংখ্য সমান্তরাল বাস্তবতা আমাদের সঙ্গে সহাবস্থান করলেও, সেগুলো টিউন করা যায় না। এসব বিশ্ব অনেক ক্ষেত্রেই একই রকম হলেও প্রতিটির শক্তি আলাদা। আবার প্রতিটি বিশ্বে ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন পরমাণু ধারণ করার কারণে এই শক্তির পার্থক্য অনেক বড় হয়ে উঠতে পারে। এসব তরঙ্গের ফ্রিকোয়েন্সি তার শক্তির সমানুপাতিক (প্ল্যাঙ্কের সূত্রানুসারে)। সে কারণে প্রতিটি বিশ্বের তরঙ্গ ভিন্ন ভিন্ন ফ্রিকোয়েন্সি বা কম্পাঙ্কে কম্পিত হয়। আবার সেগুলো পরস্পরের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়াও করে না। সবগুলো কারণে এসব বিভিন্ন বিশ্বের তরঙ্গগুলো পরস্পরের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়া কিংবা প্রভাবিত করে না।
বিস্ময়কর ব্যাপার হলো, বিজ্ঞানীরা এই অদ্ভুত দৃষ্টিকোণ অবলম্বন করে কোপেনহেগেন পদ্ধতির সবগুলো ফলাফল নতুন করে পান, যেখানে ওয়েভ ফাংশনকে আর ভেঙে পড়ার দরকার হয় না। অন্য কথায়, কোপেনহেগেন ব্যাখ্যা কিংবা বহু জগতের ব্যাখ্যা নিয়ে করা পরীক্ষাগুলোতে নির্দিষ্টভাবে একই ধরনের পরীক্ষামূলক ফলাফল পাওয়া গেছে। বোরের ওয়েভ ফাংশনের ভেঙে পড়া গাণিতিকভাবে পরিবেশের দূষণের সমতুল্য। সহজভাবে বললে, শ্রোডিঙ্গারের বিড়াল একই সময়ে মৃত ও জীবিত হতে পারে। সেটা সম্ভব হতে পারে, যদি আমরা কোনোভাবে বিড়ালটিকে প্রতিটি পরমাণু বা মহাজাগতিক রশ্মির সম্ভাব্য দূষণ থেকে আলাদা করে রাখতে পারি। বাস্তবে এটা নিঃসন্দেহে অসম্ভব একটা ব্যাপার। বিড়ালটা মহাজাগতিক রশ্মির সংস্পর্শে এলে, মৃত ও জীবিত বিড়ালের ওয়েভ ফাংশন ডিকোহেরেন্স হয়ে পড়ে। আর এটাই আমাদের কাছে মনে হবে, যেন তার ওয়েভ ফাংশন ভেঙে পড়েছে।
বিট থেকে ইট
কোয়ান্টাম তত্ত্বে এই পরিমাপ সমস্যায় একসময় নতুন করে কৌতূহল জেগে ওঠে। তাই একসময় হুইলার হয়ে উঠলেন কোয়ান্টাম পদার্থবিজ্ঞানের একজন বটবৃক্ষের মতো। ঘন ঘন সম্মেলনের আয়োজন করতে দেখা গেল তাঁর সম্মানে। এমনকি নতুন যুগের সমর্থকেরা তাঁকে একরকম গুরু হিসেবেও অভিহিত করতে লাগল। পদার্থবিজ্ঞানের চেতনার প্রশ্নে বেশ মুগ্ধ ছিলেন তিনি। (তবে সব সময় তিনি এ ধরনের সমর্থনে খুশি হতেন না। একবার একটা অনুষ্ঠানে গিয়ে তিনি আবিষ্কার করলেন, সেখানে তিনজন প্যারাসাইকোলজিস্টকেও ডাকা হয়েছে। তাতে বেশ ক্ষুব্ধ হয়ে দ্রুত একটা বিবৃতি লিখে বসলেন তিনি। ওই বিবৃতিতে এই লাইনটাও ছিল, ‘যেখানে ধোঁয়া থাকে, সেখানে ধোঁয়াই থাকে।’
কোয়ান্টাম তত্ত্বের এসব প্যারাডক্স নিয়ে প্রায় ৭০ বছর চর্চা করার পর, জন হুইলারই প্রথম স্বীকার করলেন, তাঁর কাছে সবগুলো প্রশ্নের জবাব নেই। তিনি সব সময় নিজের অনুমানকে প্রশ্ন করে বসতেন। কোয়ান্টাম মেকানিকসে পরিমাপ সমস্যা নিয়ে জিজ্ঞেস করা হলে জবাবে তিনি বললেন, ‘এসব প্রশ্নে আমি প্রায় পাগল হয়ে গেছি। স্বীকার করছি, এই ধারণাগুলো আমি ১০০ ভাগ গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছিলাম যে বিশ্ব একটা কল্পনায় বানানো এবং অন্য সময় বিশ্ব আমাদের কাছ থেকে বাইরে স্বাধীনভাবে বিরাজ করে। তবে আমি লিবনিজের কথা অনুযায়ী, ওই সব বিশ্বকে মন থেকে মেনে নিয়েছি, ‘এই বিশ্বে হয়তো ছায়াশরীর এবং এর অস্তিত্ব হয়তো কোনো নিছক স্বপ্নের ভেতর হতে পারে। কিন্তু কার্যকারণ ব্যবহার করে যদি আমরা কখনো এর মাধ্যমে প্রতারিত না নই, তাহলে এই স্বপ্ন বা ছায়াশরীরের বাস্তবতাই আমার জন্য যথেষ্ট।’
বর্তমানে এই বহুবিশ্ব বা ডিকোহেরেন্স তত্ত্ব পদার্থবিদদের কাছে জনপ্ৰিয় হয়ে উঠতে শুরু করেছে। তবে হুইলার কিছুটা বিরক্ত এই কারণে যে এর জন্য ‘অনেক বেশি লটবহর’ দরকার হয়। শ্রোডিঙ্গারের বিড়াল সমস্যার আরেকটা ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করছেন তিনি। এই তত্ত্বের নাম দিয়েছেন ‘ইট ফ্রম বিট’। এটা একটা গোঁড়ামিমুক্ত তত্ত্ব। এর শুরুতেই অনুমান করা হয়েছে যে তথ্যই সব অস্তিত্বের মূল। তাঁর দাবি, আমরা যে চাঁদ, ছায়াপথ কিংবা একটা পরমাণুর নির্যাসের দিকে তাকাই, তার ভেতর তাদের তথ্যও সংরক্ষিত থাকে। কিন্তু এই তথ্য শুধু তখনই অস্তিত্বশীল হয়, যখন মহাবিশ্ব নিজেই নিজেকে পর্যবেক্ষণ করে। একটা বৃত্তাকার রেখাচিত্র এঁকে মহাবিশ্বের ইতিহাস উপস্থাপন করেছেন তিনি। শুরুতে হঠাৎ অস্তিত্বে ছড়িয়ে পড়েছিল মহাবিশ্ব। কারণ, তাকে পর্যবেক্ষণ করা হয়েছিল। এর মানে, ‘ইট’ (মহাবিশ্বের পদার্থ) অস্তিত্বে ছড়িয়ে পড়েছিল, যখন মহাবিশ্বের তথ্য (বিট) পর্যবেক্ষণ করা হয়েছিল। তিনি একে বলেন পার্টিসিপেটরি ইউনিভার্স বা অংশগ্রহণমূলক মহাবিশ্ব। এ ধারণা অনুযায়ী, আমাদের কাছে মহাবিশ্ব এমনভাবে মানিয়ে নিয়েছে ঠিক যেভাবে আমরা এই মহাবিশ্বকে মানিয়ে নিয়েছি। অর্থাৎ আমাদের উপস্থিতিই মহাবিশ্বকে সম্ভব করে তুলেছে। (কারণ, এখানে কোয়ান্টাম মেকানিকসের পরিমাপ সমস্যার কোনো সর্বজনীন ঐকমত্য নেই। ইট ফ্রম বিটের প্রতি বেশির ভাগ পদার্থবিদের মনোভাব ‘অপেক্ষা করে দেখি কী হয়’ টাইপের।)
কোয়ান্টাম কম্পিউটার ও টেলিপোর্টেশন
এ ধরনের দার্শনিক আলোচনা হয়তো হতাশাজনকভাবে অবাস্তব বা অযৌক্তিক মনে হতে পারে। কারণ, এতে আমাদের জগতের সঙ্গে বাস্তবে প্রয়োগের কোনো উপায় নেই। পিনের ডগায় কতগুলো দেবদূত নাচানাচি করতে পারে—তা নিয়ে মধ্যযুগের সেই বিতর্কের বদলে কোয়ান্টাম পদার্থবিদেরা এখন বিতর্ক করছেন, একটা ইলেকট্রন একই সময়ে কতগুলো জায়গায় থাকতে পারে।
তবে এগুলো শুধু জনবিচ্ছিন্ন হয়ে অলসভাবে গবেষকদের খাতার পাতাতেই বন্দী থাকবে না। কোনো একদিন সেগুলো হয়তো সবচেয়ে ব্যবহারিকভাবেও প্রয়োগ করা হবে : বিশ্বের অর্থ-বাণিজ্য পরিচালনায়। একদিন হয়তো শ্রোডিঙ্গারের বিড়ালের সূক্ষ্মতা ও জটিলতার ওপর নির্ভর করবে সব জাতির সম্পদ। তখন সমান্তরাল মহাবিশ্বগুলোতে হয়তো হিসাব-নিকাশ করবে আমাদের কম্পিউটারগুলো। বর্তমানে আমাদের প্রায় সব কম্পিউটারের অবকাঠামো গড়ে উঠেছে সিলিকন ট্রানজিস্টারের ওপর ভিত্তি করে। মুরের সূত্রমতে, প্রতি আঠারো মাসে কম্পিউটারের ক্ষমতা দ্বিগুণ হয়ে যায়। মুরের সূত্র কার্যকর হওয়া সম্ভব হচ্ছে; কারণ, অতিবেগুনি বিকিরণের রশ্মি ব্যবহার করে ক্ষুদ্র থেকে অতিক্ষুদ্রতর ট্রানজিস্টারের সিলিকন চিপে আঁচড় কাটার আমাদের ক্ষমতার সীমাবদ্ধতা। অবশ্য প্রযুক্তিগত ক্ষেত্রে মুরের সূত্র বিপ্লব ঘটালেও চিরকাল এটা এভাবে চলতে পারে না। সবচেয়ে উন্নত পেন্টিয়াম চিপের স্তর আড়াআড়ি ২০টি পরমাণুর সমান। আগামী ১৫ থেকে ২০ বছরের মধ্যে বিজ্ঞানীরা হয়তো পাঁচটি পরমাণুর সমান স্তরে পৌঁছে গণনা করতে শুরু করবেন। এই অবিশ্বাস্য ছোট দূরত্বে আমাদের নিউটনের বলবিদ্যা নাকচ না করে উপায় থাকে না। তখন কোয়ান্টাম বলবিদ্যা ব্যবহার করতে হয়, যেখানে হাইজেনবার্গের অনিশ্চয়তার নীতির আধিপত্য। ফলে নিশ্চিতভাবে বলা যায় না, ইলেকট্রনটার অবস্থান ঠিক কোথায়। এর মানে, ইলেকট্রন ইনস্যুলেটর ও সেমিকন্ডাক্টরের ভেতরে না থেকে তাদের বাইরে ঘোরাফেরা করলে শর্টসার্কিট হতে পারে।
ভবিষ্যতে সিলিকন ওয়েফারের ওপর আঁচড় কাটার শেষ সীমায় পৌঁছে যাব আমরা। ফলে শিগগিরই সমাপ্ত হবে সিলিকন যুগ। হয়তো এই সমাপ্তিই কোয়ান্টাম যুগের সূচনা করবে। তাতে জং ধরা এক শহরে পরিণত হবে আজকের ঝাঁ-চকচকে সিলিকন ভ্যালি। কম্পিউটেশনে নতুন প্রকৌশলের সূচনা করে একদিন আমরা হয়তো পরমাণুতে হিসাব করতে বাধ্য হব। এখন বাইনারি সিস্টেমের ওপর ভিত্তি করে দাঁড়িয়ে আছে কম্পিউটার। এখানে প্রতিটি সংখ্যা শূন্য আর এক-এর নির্ভর করে। তবে পরমাণু একই সঙ্গে তাদের স্পিনের আপ, ডাউন ও পাশের দিকে থাকতে পারে। কম্পিউটারের বিট (শূন্য ও ১) কিউবিটে (শূন্য থেকে ১-এর মাঝখানে যেকোনো কিছু) প্রতিস্থাপিত হয়ে সাধারণ কম্পিউটারের চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী হয়ে উঠবে ভবিষ্যতের কোয়ান্টাম কম্পিউটেশন।
যেমন একটা কোয়ান্টাম কম্পিউটার আন্তর্জাতিক নিরাপত্তার ভিত নাড়িয়ে দিতে পারে। বর্তমানে বড় ব্যাংক, বহুজাতিক করপোরেশন ও শিল্পোন্নত দেশগুলো তাদের গোপনীয়তা রাখে জটিল কম্পিউটার অ্যালগরিদমের দিয়ে। অনেক গোপন কোডের ভিত্তি হলো বড় বড় সংখ্যার ফ্যাক্টর। ১০০ অঙ্কের একটা সংখ্যার ফ্যাক্টর ভাঙতে একটা সাধারণ কম্পিউটারের কয়েক শতাব্দী লাগতে পারে। কিন্তু কোয়ান্টাম কম্পিউটারের কাছে তা জলভাত। এ রকম গণনা অনায়াসে করতে পারে কোয়ান্টাম কম্পিউটার। এগুলো দিয়ে যেকোনো দেশের গোপন কোড সহজেই ভাঙা সম্ভব।
কোয়ান্টাম কম্পিউটার কীভাবে কাজ করে, এবার তা দেখা যাক। ধরে নিই, কিছু পরমাণু সারিবদ্ধ করে সাজানো আছে। তাদের স্পিনগুলো একটা চুম্বকীয় ক্ষেত্রের দিকে মুখ করে রয়েছে। এরপর তাদের ওপর লেজার রশ্মি ফেলে আলোকিত করা হলো। পরমাণুগুলোতে লেজার রশ্মি প্রতিফলিত হলে তাদের অনেকগুলোর স্পিন উল্টে যাবে। প্রতিফলিত লেজার আলো পরিমাপ করে আমরা একটা জটিল গাণিতিক কাজ রেকর্ড করতে পারব। অর্থাৎ পরমাণু থেকে কতটুকু আলো বিক্ষিপ্ত হয়েছে, তার হিসাব। যদি এই প্রক্রিয়া ফাইনম্যানের মতো কোয়ান্টাম তত্ত্ব ব্যবহার করে পরিমাপ করি, তাহলে পরমাণুদের সবকটির সম্ভাব্য অবস্থান, সবগুলো দিকে তাদের সম্ভাব্য স্পিন একসঙ্গে যোগ করতে হবে। একটা সরল কোয়ান্টাম গণনা শেষ হতে এক সেকেন্ডের ভগ্নাংশ সময় লাগবে। অথচ যতই সময় দেওয়া হোক না কেন, কোনো সাধারণ কম্পিউটারে তা সম্পন্ন করা প্রায় অসম্ভব।
অক্সফোর্ডের ডেভিড দেচ যেমন বলেছেন, তাত্ত্বিকভাবে এর মানে, আমরা যখন কোয়ান্টাম কম্পিউটার ব্যবহার করব, তখন সম্ভাব্য সব সমান্তরাল মহাবিশ্বের যোগফল করতে হবে। অবশ্য ওই সব বিকল্প মহাবিশ্বের সঙ্গে সরাসরি কোনো যোগাযোগ করা যাবে না। তবে একটা পারমাণবিক কম্পিউটার সমান্তরাল মহাবিশ্বগুলোতে থাকা স্পিনের অবস্থা ব্যবহার করে সেগুলো গণনা করতে পারবে। (আমাদের সবার ঘরে যদিও অন্য মহাবিশ্বগুলোর সঙ্গে সংগতি রাখতে পারছি না, কিন্তু একটা কোয়ান্টাম কম্পিউটারের পরমাণুগুলো সংগতিপূর্ণভাবে একযোগে স্পন্দিত হবে।)
কোয়ান্টাম কম্পিউটারের সম্ভাবনা চোখধাঁধানো হলেও বাস্তবে সমস্যাগুলোও বিশাল। বর্তমানে সবচেয়ে বেশি পরমাণু ব্যবহার করে যে কোয়ান্টাম কম্পিউটার বিশ্ব রেকর্ড গড়েছে, তাতে ব্যবহৃত পরমাণুর সংখ্যা মাত্র সাতটি। কোয়ান্টাম কম্পিউটারে আমরা সর্বোচ্চ ৩-এর সঙ্গে ৫ গুণ করে ১৫ পেতে পারি, যা মোটেও সুখকর নয়। একটা সাধারণ ল্যাপটপের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকতে গেলেও কোয়ান্টাম কম্পিউটারে হয়তো কয়েক শ পরমাণু কিংবা হয়তো কয়েক লাখ পরমাণুকে সংগতিপূর্ণভাবে কম্পিত হতে হবে। বাতাসের একটামাত্র পরমাণুর সঙ্গে সংঘর্ষেও পরমাণুগুলোতে অসংগতি বা ডিকোহেরেন্স তৈরি হয়। তাই পরিবেশ থেকে বিশেষভাবে পরিষ্কার অবস্থায় পরমাণুগুলো পরীক্ষা করতে হয়। (বর্তমানের কম্পিউটারের গতি ছাড়িয়ে যেতে হলে এমন কোয়ান্টাম কম্পিউটার বানাতে হবে, যার জন্য হয়তো কয়েক কোটি পরমাণু দরকার। কাজেই কোয়ান্টাম কম্পিউটার আরও কয়েক দশক পরের ব্যাপার।)
কোয়ান্টাম টেলিপোর্টেশন
পদার্থবিদদের কাছে এর আরেকটা ব্যবহারিক প্রয়োগ থাকতে পারে। আপাতদৃষ্টে প্যারালাল কোয়ান্টাম ইউনিভার্সের আলোচনায় একে অর্থহীন বলে মনে হতে পারে। সেটি হলো কোয়ান্টাম টেলিপোর্টেশন। স্টার ট্রেক কিংবা অন্য বিজ্ঞান কল্পকাহিনিগুলোতে মহাকাশের ভেতর দিয়ে মানুষ ও মালামাল ট্রান্সপোর্ট করতে একধরনের ট্রান্সপোর্টার ব্যবহার করা হয়। এ যন্ত্র দিয়ে বিপুল দূরত্ব অতি সহজে কমিয়ে আনতে দেখা যায়। কিন্তু দেখতে লোভনীয় মনে হলেও পদার্থবিদেরা এ ট্রান্সপোর্টেশন পদ্ধতির আইডিয়ায় বিভ্রান্ত। কারণ, তাদের ধারণা, অশ্চিয়তার নীতি লঙ্ঘন করে এটা। একটা পরমাণুর কোনো কিছু পরিমাপ করলে, পরমাণুটির অবস্থা বিশৃঙ্খলার মধ্যে পড়ে। তাতে পরমাণুটির হুবহু কপি বানানো সম্ভব নয়।
কিন্তু বিজ্ঞানীরা ১৯৯৩ সালে দেখতে পান, কোয়ান্টাম এনটেঙ্গেলমেন্ট নামে পরিচিত এ যুক্তির মধ্যে একটা ফাঁক আছে। এর ভিত্তি একটা পুরোনো পরীক্ষা। এ পরীক্ষার প্রস্তাব করেছিলেন আইনস্টাইন এবং তাঁর সহকর্মী বোরিস পোডলক্সি ও নাথান রোজেন (তাই এটি ইপিআর নামে বিখ্যাত)। আসলে ইপিআর পরীক্ষার মাধ্যমে কোয়ান্টাম তত্ত্ব কতটা উদ্ভট, সেটাই দেখাতে চেয়েছিলেন এই তিন বিজ্ঞানী। ধরা যাক, কোথাও একটা বিস্ফোরণ হলো এবং দুটি ইলেকট্রন আলোর কাছাকাছি গতিতে বিপরীত দিকে ছুটে গেল। ইলেকট্রনের স্পিন লাটিমের মতো হওয়ার কারণে ধরে নেওয়া যাক, তাদের স্পিনগুলো পরস্পর সম্পর্কযুক্ত। এর মানে, একটা ইলেকট্রনের ঘূর্ণন বা স্পিন যদি তার অক্ষের ওপরের দিকে থাকে (আপ), তাহলে অপর ইলেকট্রনটির স্পিন হবে নিচের দিকে বা ডাউন (ফলে তাদের মোট স্পিন হবে শূন্য)। তবে মাপার আগপর্যন্ত আমরা জানি না যে কোন ইলেকট্রনটি কোন দিকে ঘুরছে।
এবার বেশ কয়েক বছর অপেক্ষা করুন। তত দিনে ইলেকট্রন দুটো অনেক দূর আলোকবর্ষ পথ পাড়ি দিয়ে পরস্পরের কাছ থেকে বহুদূর চলে যাবে। এখন একটা ইলেকট্রনের স্পিন মাপা যাক। যদি তার স্পিন আপ পাওয়া যায়, তাহলে সঙ্গে সঙ্গেই জানা যাবে যে অন্য ইলেকট্রনটির স্পিন ডাউন (কিংবা বিপরীতভাবেও কথাটা সত্য)। এখানে আসল ব্যাপারটা হলো, যে ইলেকট্রনটির স্পিন আমরা আপ দেখতে পাই, সেটি অন্য ইলেকট্রনটির স্পিন ডাউন হতে বাধ্য করে। মানে, অনেক আলোকবর্ষ দূরের একটা ইলেকট্রন সম্পর্কে আমরা তাৎক্ষণিকভাবে কিছু একটা জানতে পারলাম। (এতে মনে হয়, তথ্য আলোর চেয়েও দ্রুত বেগে চলাচল করতে পারে, যা আইনস্টাইনের বিশেষ আপেক্ষিকতা মানে না।) এক জোড়ার ওপর ক্রমাগত পরিমাপ করে, সূক্ষ্ম যুক্তি দেখিয়ে আইনস্টাইন দেখাতে পারতেন, এভাবে অনিশ্চয়তা নীতির লঙ্ঘন প্রমাণ করা যায়। কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো, তিনি দেখান যে আগের চিন্তাভাবনার তুলনায় কোয়ান্টাম মেকানিকস অনেক অনেক বেশি উদ্ভট।
তখন পদার্থবিদেরা বিশ্বাস করতেন, এই মহাবিশ্ব স্থানীয়। অর্থাৎ মহাবিশ্বের এক অংশে কোনো বিশৃঙ্খলা দেখা গেলে তা শুধু উৎস থেকে স্থানীয়ভাবে ছড়িয়ে পড়ে। আইনস্টাইন প্রমাণ করেন, কোয়ান্টাম মেকানিকস অনিবার্যভাবে অস্থানীয়। অর্থাৎ একটা উৎস থেকে কোনো বিশৃঙ্খলা তাৎক্ষণিকভাবে মহাবিশ্বের দূরপ্রান্তে প্রভাব ফেলে। আইনস্টাইন এর নাম দেন স্পুকি অ্যাকশন অ্যাট আ ডিসটেন্স বা দূর থেকে ভুতুড়ে কাণ্ড। একে তিনি আজগুবি বলে মনে করতেন। কাজেই আইনস্টাইন মনে করতেন, কোয়ান্টাম তত্ত্ব অবশ্যই ভুল।
(আইনস্টাইন-পডোলক্সি-রোজেন প্যারাডক্স একটা অনুমানের মাধ্যমে সমাধান করতে পারতেন কোয়ান্টাম মেকানিকসের সমালোচকেরা। সেটা হলো, আমাদের যন্ত্রপাতি যদি পর্যাপ্ত সংবেদী হয়, তাহলে সেগুলো দিয়ে ইলেকট্রনের স্পিনের দিক নির্ধারণ করা সম্ভব। ইলেকট্রনের স্পিন ও অবস্থানের আপাত-অনিশ্চয়তা একটা কল্পকাহিনির মতো। সেটা হয়তো আমাদের যন্ত্রপাতি অতি ত্রুটিপূর্ণ হওয়ার কারণে। পদার্থবিদেরা নতুন একটা ধারণার প্রবর্তন করেন, যার নাম হিডেন ভেরিয়েবল বা গুপ্ত চলক। এখানে নিঃসন্দেহে গুপ্ত কোনো সাবকোয়ান্টাম তত্ত্ব আছে, যার মধ্যে কোনো অনিশ্চয়তা নেই। এ সাবকোয়ান্টাম তত্ত্বের ভিত্তি হলো নতুন কিছু চলক। একেই গুপ্ত চলক বলা হয়।)
কিন্তু বিপদ ব্যাপকভাবে বেড়ে গেল ১৯৬৪ সালে। সেবার এই ইপিআর প্যারাডক্স ও গুপ্ত চলক পরীক্ষা করে দেখেন পদার্থবিদ জন বেল। এর মাধ্যমে তিনি দেখালেন, ইপিআর এক্সপেরিমেন্ট করার সময় কোন তত্ত্বটি ব্যবহার করা হচ্ছে, তার ওপর নির্ভর করে দুটো ইলেকট্রনের স্পিনের মধ্যে একটা সংখ্যাগত সম্পর্ক থাকবে। সংশয়বাদীরা বিশ্বাস করেন, গুপ্ত চলক তত্ত্ব সঠিক হলে স্পিনগুলোর একদিকে সম্পর্ক থাকা উচিত। কোয়ান্টাম মেকানিকস সঠিক হলে স্পিনগুলোর সম্পর্ক থাকা উচিত আরেক দিকে। অন্য কথায়, একটামাত্র পরীক্ষার ওপর নির্ভর করবে আধুনিক পরমাণু পদার্থবিজ্ঞানের ভিত্তি বা কোয়ান্টাম মেকানিকসের উত্থান ও পতন।
কিন্তু চূড়ান্ত সিদ্ধান্তমূলক পরীক্ষায় আইনস্টাইনকেই ভুল বলে প্রমাণিত হতে দেখা গেল। ১৯৮০-এর দশকের প্রথম দিকে ফ্রান্সে ১৩ মিটার দূরে থাকা দুটি ডিটেক্টর দিয়ে ইপিআর এক্সপেরিমেন্ট করে দেখেন অ্যালান অ্যাসপেক্ট আর তাঁর সহকর্মীরা। এতে ক্যালসিয়াম পরমাণু থেকে নিঃসৃত ফোটনের স্পিন মাপা হয়। আবার ইপিআর এক্সপেরিমেন্ট করে দেখা হয় ১৯৯৭ সালে। সেবার ডিটেক্টর দুটি রাখা হয়েছিল ১১ কিলোমিটার দূরে। মজার ব্যাপার হলো, প্রতিবারই জিতে গেল কোয়ান্টাম তত্ত্ব। কাজেই দেখা যাচ্ছে, নির্দিষ্ট ধরনের জ্ঞান আলোর চেয়েও দ্রুতবেগে চলাচল করতে পারে। (অবশ্য ইপিআর এক্সপেরিমেন্টের ক্ষেত্রে আইনস্টাইন ভুল হলেও, আলোর চেয়ে দ্রুত যোগাযোগের ক্ষেত্রে বড় প্রশ্নটিতে সঠিক ছিলেন তিনি। ইপিআর এক্সপেরিমেন্ট আপনাকে ছায়াপথের আরেক পাশ সম্পর্কে তাৎক্ষণিকভাবে কোনো কিছু জানাতে পারবে না। তবে এভাবে কোনো তথ্য পাঠানোর অনুমোদন করে না। যেমন আপনি ইচ্ছা করলেই এভাবে মোর্স কোড পাঠাতে পারবেন না। আসলে ইপিআর ট্রান্সমিটার শুধু এলোমেলো সংকেত পাঠায়। কারণ, যেসব স্পিন মাপা হবে, তা-ও যখনই মাপতে যাবেন তখন তা এলোমেলো হবে। ইপিআর এক্সপেরিমেন্ট আপনাকে ছায়াপথের অন্য পাশের তথ্য সংগ্রহের অনুমোদন করে, কিন্তু দরকারি কোনো তথ্য বা এলোমেলো নয় এমন কোনো তথ্য এভাবে পাঠানোর অনুমোদন দেয় না।)
বারটেলসম্যান নামের এক গণিতবিদের উদাহরণ টেনে এ প্রভাবকে বর্ণনা করতে পছন্দ করেন জন বেল। তাঁর অদ্ভুত এক স্বভাব ছিল। তিনি প্রতিদিন এক পায়ে সবুজ আর আরেক পায়ে নীল মোজা পরতেন। তা-ও পরতেন এলোমেলোভাবে। কোনো দিন যদি খেয়াল করেন যে তিনি বাঁ পায়ে নীল মোজা পরেছেন, তাহলে আলোর চেয়েও দ্রুতবেগে জেনে যাবেন যে তাঁর আরেক পায়ের মোজার রং সবুজ। কিন্তু এটা জেনেও এভাবে কোনো তথ্য পাঠাতে পারবেন না। তথ্য পাঠানোর চেয়ে তথ্য উদ্ধার করা ভিন্ন জিনিস। ইপিআর এক্সপেরিমেন্টের মানে এই নয় যে আমরা টেলিপ্যাথির মাধ্যমে তথ্য দিয়ে আলোর চেয়ে দ্রুতবেগে যোগাযোগ করতে পারছি কিংবা টাইম ট্রাভেল করতে পারছি। বরং এর মানে, মহাবিশ্বের এককত্ব থেকে সম্পূর্ণভাবে আমাদের আলাদা করে ফেলা অসম্ভব।
এর কারণে আমাদের মহাবিশ্ব সম্পর্কে ভিন্ন ধরনের চিত্র ধারণ করতে বাধ্য হই। আমাদের দেহের প্রতিটি পরমাণু ও বহু আলোকবর্ষ দূরের পরমাণুগুলোর মধ্যে একটা মহাজাগতিক এনটেঙ্গেলমেন্ট আছে। সব পদার্থ যেহেতু একই বিস্ফোরণ বা মহাবিস্ফোরণ থেকে আসার কারণে কিছু অর্থে আমাদের দেহের পরমাণুগুলো মহাবিশ্বের অন্য প্রান্তের কিছু পরমাণুর সঙ্গে কোনো এক ধরনের কসমিক কোয়ান্টাম ওয়েভের মাধ্যমে সংযুক্ত। যমজ শিশু যেভাবে মায়ের নাড়ির সঙ্গে সংযুক্ত থাকে, তেমনি কোনো একভাবে এনটেঙ্গেলড কণা বহু আলোকবর্ষ দূরে থেকেও সংযুক্ত থাকতে পারে (তাদের ওয়েভ ফাংশন)। তাই এক সদস্যের ক্ষেত্রে কিছু ঘটলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে আরেকজন প্রভাবিত হয়। এভাবে একটি কণার কোনো জ্ঞান মুহূর্তেই তার সঙ্গীজোড়ার আরেক সদস্যের কাছে চলে যায়। এনটেঙ্গেলড জোড়া এমন আচরণ করে যেন তারা একটা মাত্ৰ বস্তু। অবশ্য তারা বহুদূরে আলাদা থাকতে পারে। (আরও সঠিকভাবে বললে, এই কণাদের ওয়েভ ফাংশন মহাবিস্ফোরণের সময় একবার সংযুক্ত ও সংগতিতে এসেছিল। তারপর মহাবিস্ফোরণের কয়েক কোটি বছর পরও তাদের ওয়েভ ফাংশন হয়তো এখনো আংশিকভাবে সংযুক্ত। কাজেই ওয়েভ ফাংশনের এক অংশে কোনো বিশৃঙ্খলা দেখা গেলে, তা আরেক অংশের ওয়েভ ফাংশনে প্রভাবিত করতে পারে। )
১৯৯৩ সালে বিজ্ঞানীরা ইপিআর এনটেঙ্গেলমেন্টের ধারণা ব্যবহার করে কোয়ান্টাম টেলিপোর্টেশনের একটা কৌশল প্রস্তাব করেন। ১৯৯৭ সালে প্রথমবারের মতো পরীক্ষামূলকভাবে কোয়ান্টাম টেলিপোর্টেশনের প্রমাণ করেন ক্যাল টেক, ডেনমার্কের আরহাস বিশ্ববিদ্যালয় এবং ওয়েলস বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীরা। সেবার একটা টেবিলের ওপর দিয়ে একটা ফোটনকে টেলিপোর্ট করা হয়েছিল। এ পরীক্ষক দলের এক সদস্য ছিলেন ওয়েলস বিশ্ববিদ্যালয়ের স্যামুয়েল ব্রায়ানস্টেন। এনটেঙ্গেলড জোড়াকে তিনি প্রেমিক যুগলের সঙ্গে তুলনা করে বলেন, ‘তারা দুজন দুজনকে এতই ভালোমতো জানে যে তাদের প্রেমিক বা প্রেমিকা বহু দূরে আলাদা অবস্থায় থাকলেও তার সম্পর্কে উত্তর দিতে পারে।’
(কোয়ান্টাম টেলিপোর্টেশন পরীক্ষার জন্য তিনটি বস্তু দরকার। এদের বলা হয় A, B, ও C। ধরা যাক, B ও C দুটি যমজের সদস্য, যারা একটেঙ্গেলড। B ও C অনেক দূরে আলাদা থাকলেও, তারা পরস্পরের সঙ্গে এখনো এনটেঙ্গেলড। এখন ধরা যাক, A-এর সংস্পর্শে এল B। এই A-কে আমরা টেলিপোর্ট করব। A-কে স্ক্যান করল B। ফলে A-এর মধ্যে থাকা সব তথ্য B-এর মধ্যে স্থানান্তরিত হলো। এখন এই তথ্য স্বয়ংক্রিয়ভাবে C-এর মধ্যে স্থানান্তরিত হবে। কাজেই C হবে A-এর হুবহু নকল। )
কোয়ান্টাম টেলিপোর্টেশনের অগ্রগতি এরপর জোরকদমে বাড়তে থাকে। ২০০৩ সালে ফাইবার অপটিক কেবলের মধ্য দিয়ে ১.২ মাইল দূরে ফোটন টেলিপোর্ট করেন সুইজারল্যান্ডের জেনেভা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীরা। এক গবেষণাগারের আলোর ফোটন (১.৩ মিমি তরঙ্গদৈর্ঘ্যের) একটা লম্বা তারের মধ্য দিয়ে আরেক প্রান্তের একটা গবেষণাগারে ভিন্ন তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলোর ফোটনে (১.৫৫ মিমি) টেলিপোর্ট করা হয়। এই প্রজেক্টের গবেষক পদার্থবিদ নিকোলাস গিসিন বলেন, ‘আমার জীবদ্দশাতেই হয়তো একটা অণুর মতো বড় ধরনের কিছু টেলিপোর্ট করা যাবে। কিন্তু নিকট ভবিষ্যতে প্রযুক্তি ব্যবহার করে অনেক বড় বস্তু টেলিপোর্ট করা সম্ভব নয়।’
আরেকটি বড় ধরনের ঘটনা ঘটে ২০০৪ সালে। সেবার শুধু আলোর এক কোয়ান্টামই নয়, গোটা একটা পরমাণু টেলিপোর্ট করেন ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব স্ট্যান্ডার্ড অ্যান্ড টেকনোলজি বা এনআইএসটির বিজ্ঞানীরা। তাঁরা সফলভাবে তিনটি বেরিলিয়াম পরমাণুকে এনটেঙ্গেলড করেন। এরপর একটা পরমাণুর ধর্ম আরেকটিতে স্থানান্তর করতেও সক্ষম হন। নিঃসন্দেহে এটা গুরুত্বপূর্ণ একটা সফলতা।
কোয়ান্টাম টেলিপোর্টেশনের ব্যবহারিক প্রয়োগের সম্ভাবনার ক্ষেত্রটা বিরাট। তবে কোয়ান্টাম টেলিপোর্টেশনে যে বেশ কিছু প্রায়োগিক সমস্যাও রয়েছে, সেগুলো বলে রাখা দরকার। প্রথমত এ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে আসল বা আদি বস্তুটি ধ্বংস হয়ে যায়। কাজেই আপনি যে বস্তুটি টেলিপোর্ট করতে চান, তার হুবহু কার্বন কপি তৈরি করতে পারবেন না। বরং বস্তুটির একটা সম্ভাব্য কপি তৈরি করা যাবে। দ্বিতীয়ত, আলোর চেয়ে দ্রুতবেগে কোনো কিছু টেলিপোর্ট করা যাবে না। কোয়ান্টাম টেলিপোর্টেশনেও আপেক্ষিকতার ব্যাপারটি সত্য। (A বস্তুকে C বস্তুতে টেলিপোর্ট করতে চাইলে মধ্যবর্তী একটা বস্তু B দরকার। এটিই ওই দুটোকে সংযুক্ত করবে, যা আলোর চেয়ে কম বেগে চলাচল করবে।) তৃতীয়ত, সম্ভবত কোয়ান্টাম টেলিপোর্টেশনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সীমাবদ্ধতা। কোয়ান্টাম কম্পিউটিংয়ের ক্ষেত্রেও এটা দেখা যায়। সেটা হলো : বস্তুগুলোকে অবশ্যই সংগতিপূর্ণ বা কোহেরেন্ট হতে হবে। পরিবেশের সামান্যতম বিঘ্নতা বা দূষণও কোয়ান্টাম টেলিপোর্টেশনকে ধ্বংস করে দিতে পারে। কিন্তু একবিংশ শতাব্দীর মধ্যে প্রথমবারের মতো একটা ভাইরাসকে হয়তো টেলিপোর্ট করা যাবে বলে আশা করা যায়।
একজন মানুষকে টেলিপোর্ট করার ক্ষেত্রে আরও কিছু সমস্যার মুখে পড়তে হবে। বিজ্ঞানী ব্রায়ানস্টেনের পর্যবেক্ষণে, ‘এখন এর মূল বিষয় হলো, এতে বিপুল পরিমাণ তথ্য জড়িত থাকে। আমাদের সবচেয়ে ভালো যোগাযোগব্যবস্থার মধ্য দিয়ে যদি এই মুহূর্তে সব তথ্য পাঠানোর কথা কল্পনা করি, তাহলে তার জন্য মহাবিশ্বের বয়সের সমান সময় লাগবে।
মহাবিশ্বের ওয়েভ ফাংশন
কোয়ান্টাম মেকানিকস যখন শুধু একটা ফোটন নয়, বরং গোটা মহাবিশ্বের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা হবে, তখনই হয়তো কোয়ান্টাম তত্ত্বের চূড়ান্ত উপলব্ধিটা আসবে। স্টিফেন হকিং রসিকতা করে একবার বলেছিলেন, তিনি বিড়ালের সমস্যার কথাটি শুনলেই বন্দুকের খোঁজে হাত বাড়ান। এ সমস্যার জন্য নিজেই একটা সমাধানের প্রস্তাব করেছেন তিনি। সেটা হলো, গোটা মহাবিশ্বের একটা ওয়েভ ফাংশনের। পুরো মহাবিশ্ব যদি ওয়েভ ফাংশনের অংশ হয়, তাহলে একজন পর্যবেক্ষকের আর কোনো প্রয়োজন হয় না (তিনি অবশ্যই মহাবিশ্বের বাইরে থাকেন)।
কোয়ান্টাম তত্ত্বমতে, প্রতিটি কণার সঙ্গে একটা তরঙ্গ জড়িত থাকে। ওই তরঙ্গটি যেকোনো বিন্দুতে ওই কণাটি পাওয়ার সম্ভাবনার কথা জানায়। তবে মহাবিশ্বের বয়স যখন অনেক কম ছিল, তখন সেটা ছিল একটা অতিপারমাণবিক কণার চেয়েও অনেক ছোট। কাজেই মহাবিশ্বের নিজেরও হয়তো একটা ওয়েভ ফাংশন থাকতে পারে। ইলেকট্রন একই সময়ে বিভিন্ন অবস্থায় থাকতে পারার কারণে ইলেকট্রনের চেয়েও ছোট হওয়ার কারণে মহাবিশ্বও হয়তো একই সময়ে বিভিন্ন অবস্থায় টিকে থাকতে পারে। একে একটা সুপার ওয়েভ ফাংশন হিসেবে ব্যাখ্যা করা হয়।
এটা বহু জগৎ বা মেনি ওয়ার্ল্ড তত্ত্বের একটা সংস্করণ। এখানে গোটা মহাবিশ্বকে একই সঙ্গে দেখতে পান এমন কোনো মহাজাগতিক পর্যবেক্ষকের হস্তক্ষেপের আর দরকার হয় না। কিন্তু হকিংয়ের ওয়েভ ফাংশন আর শ্রোডিঙ্গারের ওয়েভ ফাংশন বেশ আলাদা। শ্রোডিঙ্গারের ওয়েভ ফাংশনে, স্থান-কালের প্রতিটি বিন্দুতে একটা ওয়েভ ফাংশন থাকে। অন্যদিকে হকিংয়ের ওয়েভ ফাংশনে, ওয়েভ ফাংশন থাকে প্রতিটি মহাবিশ্বের জন্য। শ্রোডিঙ্গারের সাই ফাংশন ইলেকট্রনের সম্ভাব্য সব অবস্থা বর্ণনা করে। কিন্তু হকিং এমন একটা সাই ফাংশনের প্রবর্তন করেন, যা মহাবিশ্বের সবগুলো সম্ভাব্য অবস্থার প্রতীক। সাধারণ কোয়ান্টাম মেকানিকসে ইলেকট্রন সাধারণ স্থানে থাকতে পারে। তবে মহাবিশ্বের ওয়েভ ফাংশনের ক্ষেত্রে, এই ওয়েভ ফাংশন সুপার স্পেসে টিকে থাকে। মহাবিশ্বের সম্ভাব্য সব স্থানই হলো সুপার স্পেস, যা চালু করেছিলেন হুইলার।
এই মাস্টার ওয়েভ ফাংশন (সব ওয়েভ ফাংশনের জননী) শ্রোডিঙ্গারের সমীকরণ মেনে চলে না (যা শুধু একক ইলেকট্রনের ক্ষেত্রে কাজ করে), বরং হুইলার-ডিউইটের সমীকরণ মেনে চলে। এ সমীকরণ কাজ করে সম্ভাব্য সব মহাবিশ্বের ক্ষেত্রে। ১৯৯০-এর দশকের শুরুর দিকে হকিং লিখেছিলেন, তিনি মহাবিশ্বের জন্য তাঁর এই ওয়েভ ফাংশন আংশিক সমাধান করতে পেরেছেন। এর মাধ্যমে তিনি দেখান, এর মধ্যে সবচেয়ে বিশ্বাসযোগ্য মহাবিশ্ব হলো যার মধ্যে একটা বিলুপ্ত মহাজাগতিক ধ্রুবক থাকে। তাঁর এই পেপারটি কিছুটা বিতর্ক উসকে দেয়। কারণ, এটি সম্ভাব্য সব মহাবিশ্বের যোগফলের ওপর নির্ভরশীল। হকিং এ যোগটি সম্পন্ন করেন আমাদের মহাবিশ্বের সঙ্গে সম্ভাব্য অন্য মহাবিশ্বগুলোর মধ্যে সংযুক্তকারী ওয়ার্মহোলসহ। (কল্পনা করুন, একটা সীমাহীন সাগরে সাবানের ফেনার বুদ্বুদ বাতাসে ভাসছে। সেগুলো পাতলা ফিলামেন্ট বা ওয়ার্মহোল দিয়ে পরস্পরের সঙ্গে সংযুক্ত। এরপর সেগুলোকে একসঙ্গে যোগ করুন।)
সবশেষে হকিংয়ের এই উচ্চাভিলাষী পদ্ধতি নিয়ে সন্দেহ দানা বাঁধতে থাকে। এটি ইঙ্গিত করে যে সম্ভাব্য সব মহাবিশ্বের যোগফল গাণিতিকভাবে একটা অনির্ভরযোগ্য। অন্তত যতক্ষণ না একটা থিওরি অব এভরিথিং আমাদের সঠিক পথটা দেখাচ্ছে। সমালোচকেরা যুক্তি দেখান, থিওরি অব এভরিথিং সূত্রবদ্ধ না করা পর্যন্ত টাইম মেশিন, ওয়ার্মহোল, মহাবিস্ফোরণের শুরুর মুহূর্ত এবং মহাবিশ্বের ওয়েভ ফাংশন নিয়ে কোনো গণনায় আসলে বিশ্বাস করা উচিত নয়।
তারপরও বেশ কয়েকজন পদার্থবিদ দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেন, আমরা শেষ পর্যন্ত একটা থিওরি অব এভরিথিং বা সার্বিক তত্ত্ব খুঁজে পাব। হয়তো শেষ পর্যন্ত সেটা স্ট্রিং থিওরি বা এম-থিওরি না-ও হতে পারে। প্রশ্ন হলো, সেই সার্বিক তত্ত্ব দিয়ে কি আইনস্টাইনের বিশ্বাস অনুযায়ী আমরা ঈশ্বরের মন পড়তে পারব?
তথ্যনির্দেশ
হাইজেনবার্গের অনিশ্চয়তার নীতি : বিজ্ঞানী হাইজেনবার্গ সূত্রবদ্ধ করেছিলেন অনিশ্চয়তার নীতি (Uncertainty principle)। এ নীতি অনুযায়ী, কোনো কণার অবস্থান ও গতিবেগ একই সঙ্গে নির্ভুলভাবে পরিমাপ করা সম্ভব নয়। একটি বৈশিষ্ট্য যত বেশি নির্ভুলভাবে জানা যাবে, অন্যটির নির্ভুল হওয়ার সম্ভাবনা তত কমতে থাকবে।
টেলিপোর্টেশনের বাস্তব চিত্র : সায়েন্স ফিকশন মুভির মতো সত্যিকার কোনো মানুষকে টেলিপোর্ট করার ব্যাপারে কোনো তাত্ত্বিক বাধা না থাকলেও এ ক্ষেত্রে কঠিন সব যান্ত্রিক সমস্যার মুখোমুখি হতে হবে। একটি হিসাব দিলে বিষয়টি পরিষ্কার বোঝা যাবে। হিসাবে দেখা গেছে, সামান্য এককোষী একটি E. coli ব্যাকটেরিয়ায় পরমাণুর সংখ্যা ৯×১০^১০। মানুষের দেহে কোষের পরিমাণ প্রায় ৩২ ট্রিলিয়ন (৩২-এর পর ১২টি শূন্য)। হিসাবটা বুঝতে সুবিধা হবে, যদি বলি, আমাদের এখন পর্যন্ত জানা মহাবিশ্বে যে পরিমাণ নক্ষত্র আছে, তার চেয়ে মানুষের দেহের কোষ ৩১২ ট্রিলিয়ন বেশি। একটি কোষে যদি ব্যাকটেরিয়ার সমান পরমাণু থাকে, তাহলে মানুষের দেহের মোট পরমাণুর সংখ্যা হিসাব করে দেখুন। যুক্তরাজ্যের লেচেস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণায় দেখা গেছে, মানুষ টেলিপোর্ট করতে গেলে তার প্রতিটি কোষ ভেঙে ডেটায় রূপান্তর করলে তার পরিমাণ হবে প্রায় ২৬×১০^৪২ বিট। ফাইবার অপটিক কেবলে এ বিপুল ডেটা পাঠাতে দরকার অতি শক্তিশালী ব্যান্ডউইডথ আর ১০ ট্রিলিয়ন গিগাওয়াট ঘণ্টা বিদ্যুৎশক্তি। মজার ব্যাপার হলো, এই শক্তি দিয়ে পুরো যুক্তরাজ্যে ১০ লাখ বছর বিদ্যুৎ সরবরাহ করা যাবে। এভাবে আস্ত একটা মানুষ টেলিপোর্ট করতে লাগবে কয়েক কোটি বছর।
মুরের সূত্র : এ সূত্রমতে, প্রতি আঠারো মাসে কম্পিউটারের ক্ষমতা আগের তুলনায় দ্বিগুণ হয়ে যাবে। কিন্তু এ ঘটনা অনির্দিষ্টকালের জন্য চলতে পারে না।
নিউক্লিয়ার ফিউশন : যে প্রক্রিয়ায় দুটি নিউক্লিয়াসের সংঘর্ষে তারা একত্র হয়ে একটি একক, ভারী নিউক্লিয়াস গঠন করে।
নিউক্লিয়ার ফিশন : যে প্রক্রিয়ায় একটি নিউক্লিয়াস ভেঙে বা বিভাজিত হয়ে দুটি বা তার চেয়ে বেশি ছোট নিউক্লিতে পরিণত হয়। এর পরিণতিতে বিপুল শক্তি বেরিয়ে আসে।
ম্যাক্রোস্কোপিক : খালি চোখে দেখার জন্য যথেষ্ট বড় কোনো বস্তু। সাধারণত ০.০১ মিলিমিটারের নিচের স্কেলে ব্যবহার করা হয়। এ আয়তনের নিচের স্কেলগুলোকে বলা হয় মাইক্রোস্কোপিক বা অতিক্ষুদ্র।
প্রোগ্রাম : কম্পিউটারকে সঠিকভাবে চালানোর জন্য আগে থেকে দিয়ে রাখা কিছু তথ্য, উপাত্ত ইত্যাদির সংকেতাবদ্ধ নির্দেশনা। কোনো কাজ করার আগে কম্পিউটার প্রথমে এই প্রোগ্রামের পাঠোদ্ধার করে। পরে সেই অনুযায়ী কাজ সম্পাদন করে।
ফাইনম্যান : মার্কিন পদার্থবিদ রিচার্ড ফাইনম্যান (১৯১৮-১৯৮৮ খ্রি.)। পাথ ইন্টিগ্রাল ফরমুলেশন, কোয়ান্টাম ইলেকট্রোডাইনামিকস, অতি শীতল তরল হিলিয়ামের অতিপরিবাহিতার ক্রিয়াকৌশল ব্যাখ্যা ও কণাপদার্থবিজ্ঞানে কাজের জন্য তিনি সুপরিচিত। কোয়ান্টাম ইলেকট্রোডাইনামিকসে অবদানের জন্য ১৯৬৫ সালে নোবেল পুরস্কার পান।
বোলজম্যান : প্রখ্যাত অস্ট্রীয় পদার্থবিজ্ঞানী, দার্শনিক ও গণিতজ্ঞ বোলজম্যান (১৮৪৪-১৯০৬ খ্রি.) প্রথম বলেছিলেন, পরমাণুকে না দেখলেও কিছু পরিসাংখ্যিক সমীকরণের মাধ্যমে তাদের গতিবিধি বর্ণনা করা সম্ভব। এভাবেই তিনি পরিসাংখ্যিক গতিবিদ্যার জন্ম দেন। বোলজম্যানের গবেষণা আধুনিক কোয়ান্টাম পদার্থবিজ্ঞান জন্যও বেশ দরকারি।
পেশাগত জীবনে আর্নস্ট মাখ-এর মতো বিজ্ঞানীদের সক্রিয় বিরোধিতায় তিনি হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়েন। পরমাণু পর্যবেক্ষণ করা যায় না বলে মাখ ও তাঁর সমর্থকেরা তা বিশ্বাস করতেন না, বরং সবকিছু শক্তি দিয়ে ব্যাখ্যার চেষ্টা করতেন। আজীবন এই তত্ত্বের বিরোধিতা করেছেন বোলজম্যান। অন্যদিকে ব্যক্তিগত জীবনে তাঁর মা এবং ১১ বছরের ছেলের মৃত্যুতে তিনি ভেঙে পড়েন। মনস্তত্ত্ববিদদের মতে, তিনি বাইপোলার ডিজঅর্ডার রোগে ভুগছিলেন। জার্মানির লিপজিগে একবার আত্মহত্যার চেষ্টা করেন। পরে ১৯০৬ সালে ইতালির ত্রিয়েস্তের আত্মহত্যার মাধ্যমেই এই মহান বিজ্ঞানীর জীবনাবসান ঘটে।