মুখবন্ধ / ভূমিকা / কৃতজ্ঞতা

এ ডলস্ হাউস (ইবসেনের পুতুল যেখানে ব্রাত্য হয়ে রয়)
মূল: অগাস্ট স্ট্রিনডবার্গ / অনুবাদ : মাহবুব সিদ্দিকী
প্রথম প্রকাশ : একুশে গ্রন্থমেলা ২০১৯ ফায়ূন ১৪২৫ বঙ্গাব্দ
উৎসর্গ : ডাহুক নদীকে

মুখবন্ধ

সময়টা নারী অধিকার আন্দোলনের মোটামুটি গোড়ার দিকের। হেনরিক ইবসেনের ‘এ ডলস হাউস’(১৮৭৯) চারদিকে ভীষণ সাড়া ফেলেছে তখন। নারীনেত্রীরা এবং অতি অবশ্যই নারীবাদীরা একে যেন রাতারাতি নিজেদের আন্দোলনের ম্যানিফেস্টো বানিয়ে ফেললেন। নোরার গৃহত্যাগ যেন গোটা ইউরোপীয়-নারী-সমাজের আদর্শ হয়ে উঠল। সেই সাথে নারী অধিকার আন্দোলনেও যোগ হতে থাকল নতুন নতুন মাত্রা। সমাজ, সংসার, বিয়ে সবকিছুকে কাঠগড়ায় দাঁড় করালেন তাঁরা; নানা অসংগতি আর জটিলতা খুঁজে বের করতে থাকলেন। কিন্তু এ পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণের কখন যে তাঁরা ‘এক্সট্রিমিস্ট’ হয়ে উঠলেন, তা নিজেরাও বুঝতে পারলেন না। ফলে, জগৎ সংসারের সমস্ত দোষ গিয়ে পড়ল পুরুষের ঘাড়ে! আর, নারীর অবস্থান হল যাবতীয় সমালোচনার উর্ধ্বে। ফলে, এ আন্দোলনে বস্তুত নিরপেক্ষতা বলতে কিছু রইল না, এবং স্বাভাবিকভাবেই নারী-পুরুষকে পরস্পরের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে দাঁড় করানো হল। বাড়তে থাকল বিবাহ-বিচ্ছেদ আর সাংসারিক অশান্তি…

কিন্তু আসলেই কি সব দোষ পুরুষের? কিংবা, সব দোষ নারীর বললেও কি তা যথার্থ হবে? নাকি, দোষ-ত্রুটিগুলো সম্পূর্ণ মানবিক এবং প্রাকৃতিক? এ প্রশ্নগুলোই অগাস্ট স্ট্রিনডবার্গ তুললেন তাঁর ছোটগল্পের মাধ্যমে। ঐ সময় অবশ্য কোন বই আকারে তিনি গল্পগুলো লেখেননি, বরং, প্রতিটি গল্প আলাদাভাবে প্রকাশিত। পরবর্তীতে, ১৮৮৪ সালে এরকম বেশ কতগুলো গল্পকে ‘গেটিং ম্যারেড’ নামে দু’মলাটে আবদ্ধ করা হয়। যে-কারণে কতগুলো গল্পের কাহিনিতে কিছুটা সাদৃশ্য পাওয়া যায়। অবশ্য, এর অন্য কারণও ছিল–ঐ সময়ে নারীবাদীরা উঠেপড়ে লেগেছিলেন ‘বিয়ে’ সম্পর্কটাকে ‘মালিক-দাসী’ সম্পর্ক হিসেবে দেখাতে। স্ট্রিনডবার্গের কাছে একে নিতান্ত অমূলক মনে হয়েছে। তিনি দেখাতে চেয়েছেন, স্বামী-স্ত্রী একে অন্যের পরিপূরক; কেউ কারো মালিক বা দাসী নয়, বরং, ক্ষেত্রভেদে একে-অন্যের ওপর নির্ভরশীল। এ নির্ভরশীলতা মানে অক্ষমতা নয়, ভালোবাসার পূর্ণতা। নারী-পুরুষকে নারীবাদীরা যেখানে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নামিয়েছেন, স্ট্রিনডবার্গ সেখানে খুঁজে পেয়েছেন সহযোগিতা।

এ ডলস্ হাউস গল্পটি স্ট্রিনবার্গ লিখেছিলেন হেনরিক ইবসেন লিখিত ঐ একই নামের বিখ্যাত নাটকটির প্রতিক্রিয়া হিসেবে। যদিও অতি সাম্প্রতিককালে নাটকটির বিষয়বস্তু নিয়ে কিছুটা বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে; প্রশ্ন উঠেছে–ইবসেন নিজে নোরাকে অধিকারবঞ্চিত দেখাতে চেয়েছেন, নাকি নারীবাদীরা নিজেদের মত ব্যাখ্যা দাঁড় করিয়ে নিয়েছেন? (কাজল বন্দ্যোপাধ্যায়ের Female Power and Some Ibsen Plays ago দ্রষ্টব্য) কিন্তু ঐ সময়ের প্রচলিত ব্যাখ্যায় (নারীবাদী ব্যাখ্যা) স্ট্রিনবার্গ ভীষণ বিরক্ত হয়েছিলেন। সে-কারণেই, ঐ নামের ছোটগল্প লিখে দেখাতে চাইলেন–নারীর অধিকার নিয়ে কথা বলা মানেই নারীদের প্রতি কোন অন্ধ পক্ষপাতিত্বে পৌঁছানো নয়। সংসারে ভুল-ত্রুটি সবারই থাকে, একে যেকোন একপক্ষের বিরুদ্ধে ঠেলে দেয়ার চেষ্টা করাটা আসলে এক ধরনের গোড়ামি।

পরিবর্তনের প্রচেষ্টায়, দেনা-পাওনা, বিবাহিত এবং অবিবাহিত, এবং প্রাকৃতিক প্রতিবন্ধকতা গল্পগুলোতে স্ট্রিনবার্গ ঐ সময়ের তথাকথিত নারী আন্দোলনকে ব্যাঙ্গ করেছেন। নারীবাদীরা কীভাবে ভীষণ অযৌক্তিক আচরণ করেছেন সেটাই দেখাতে চেয়েছেন। ফলে, এ গল্পগুলোর কাহিনি মোটামুটি একই রকম–প্রতিটি গল্পে তিনি নারীবাদীদের ‘আদর্শ সংসার’ কে প্লট হিসেবে নিয়েছেন; অতঃপর বাস্তবতার আলোকে সে ‘আদর্শ সংসার’ ধারণার ত্রুটিগুলো দেখিয়েছেন।

স্ট্রিনডবার্গের নিরপেক্ষ অবস্থানে থাকার প্রচেষ্টা ফুটে ওঠে ক্ষতিপূরণ, বিবাহ অনিবার্য এবং ফিনিক্স গল্পগুলো পড়লে। এ গল্পগুলোতে, তিনি পুরুষের দোষগুলো সামনে এনে নারীর অবস্থানের মাহাত্ম্য বর্ণনা করেছেন। সেইসঙ্গে, সামনে এনেছেন এক নির্মম সত্যকে নারী-পুরুষের অবস্থানগত দ্বন্দ্ব যদি থেকেই থাকে, তবে তার দায় এককভাবে নারী বা পুরুষ কারোরই নয়, বরং, চিরায়ত এ অবস্থান তৈরিতে পরিবার এক বিরাট ভূমিকা রাখে, যেখানে নারীর প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে প্রকট হয় নারীরই আরেক রূপ (বউ-শাশুড়ি, ননদ-ভাবী ইত্যাদি)। তাই, সত্যিকার পরিবর্তন চাইলে, পরিবর্তনটা আনতে হবে পরিবার সম্পর্কিত সামগ্রিক চিন্তা-ভাবনায়, শুধুমাত্র পুরুষের দিকে আঙুল তুললে সেটা অন্যায় হবে।

অপ্রাকৃতিক নির্বাচন এবং রোমিও অ্যান্ড জুলিয়া গল্প দুটোর প্লট সম্পূর্ণ ভিন্ন। প্রথমটিতে উঠে এসেছে শ্রেণি-বৈষম্য, এবং সেইসাথে আবারও প্রমাণিত হয়েছে, স্ট্রিনডবার্গ সবসময়ই নির্যাতিতের পক্ষে ছিলেন। তাঁর কলম সব সময় ন্যায়ের পক্ষেই অবস্থান নিয়েছে। দ্বিতীয় গল্পটি একটি মধুর দাম্পত্য সম্পর্কের গল্প। হয়ত, এটাই স্ট্রিনডবার্গের ‘আদর্শ দাম্পত্য সম্পর্ক, যেখানে ভালোবাসা আছে, আবার ভিন্নমতও আছে; রোমন্থন আছে, খুনসুটিও আছে, এবং দিনশেষে অবশ্যই দুজনের মুখে হাসি আছে।

যাহোক, প্রতিটি গল্পে স্ট্রিনর্গের বিশ্লেষণী ক্ষমতা নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবি রাখে। গল্পগুলোতে হয়ত কিছু বিষয়ের পুনরাবৃত্তি লক্ষণীয়; কিংবা, কিছু গল্পে হয়ত হেনরিক ইবসেনকে একটু বেশিই খোঁচানো হয়েছে; তবু মানতেই হয়, নারী অধিকারের দোহাই দিয়ে যে ‘এক্সট্রিমিজম’ শুরু হয়েছিল তা থেকে বেরিয়ে এসে কিছুটা হলেও স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলার সুযোগ করে দেয় অগাস্ট স্ট্রিনবার্গের ‘গেটিং ম্যারেড’।

“এক ভাষার সাহিত্যকর্ম অন্য ভাষায় পুরোপুরি ফুটিয়ে তোলা কখনোই সম্ভব নয়” কথাটা হয়ত আংশিক সত্য। পুরো সত্যটা হচ্ছে, সাহিত্যরস আস্বাদনের ক্ষমতা যার রয়েছে তার জন্য ভাষা কোন বাধা নয়। ব্যক্তিগত জীবনে অগাস্ট স্ট্রিন্ডবার্গ মানুষটা ছিলেন ক্ষ্যাপাটে প্রকৃতির। তাঁর লেখাতেও সে ছাপ বেশ গাঢ়ভাবেই পাওয়া যায়। তাঁর লেখা পড়তে গিয়ে আমি তাই দেখার চেষ্টা করেছি সেই ক্ষ্যাপাটে মানুষটাকে, বুঝতে চেয়েছি তাঁর বোধকে। গল্পগুলো অনুবাদ করতে গিয়েও এ-স্বাধীনতাটুকু আমি অক্ষুণ্ণ রেখেছি–পাঠকের সামনে স্ট্রিন্ডবার্গকে মূর্তিমান করতে তাঁর গল্পের বক্তব্যকেই অনুবাদ করেছি, লাইনকে করিনি। আশা করি, পাঠক একে সুদৃষ্টিতে দেখবেন। তবুওততা একদিনে ‘মেঘনাদবধ হয় না–গল্পগুলোর অনুবাদে কোথাও কোন অসঙ্গতি চোখে পড়লে নির্দ্বিধায় জানাবেন। পরবর্তী অনুবাদকে আরও সমৃদ্ধ করতে আপনাদের পরামর্শগুলো পথনির্দেশনা হিসেবেই গৃহীত হবে।

মূল বইয়ের সবগুলো গল্পের অনুবাদ এখানে নেই। বাছাইকৃত দশটি গল্প নেয়া হয়েছে। ফলে মূল নামটিও–গেটিং ম্যারেড–এখানে ব্যবহার করা হয়নি। বরং বইয়ের সবচেয়ে আলোচিত–এ ডলস্ হাউস–গল্পটিই বইয়ের শিরোনাম হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। পাঠকের গ্রহণ/অগ্রহণই বলে দেবে অবশিষ্ট গল্পগুলোর পরিণতি কী হবে…

মাহবুব সিদ্দিকী
ঢাকা
২২ আগস্ট ২০১৬ ইং

ভূমিকা

অগাস্ট স্ট্রিনবার্গ বাংলাদেশী পাঠক মহলে খুব বেশি পরিচিত না হলেও বিশ্বসাহিত্যে অত্যন্ত সমাদৃত একজন সৃজনশীল মানুষ। গল্প, কবিতা, উপন্যাস, নাটক প্রভৃতি শাখায় বিচরণ থাকলেও মূলত নাট্যকার হিসেবেই তাঁর গ্রহণযোগ্যতা বেশি। এ বইতে অবশ্য পাঠক তাঁর গল্পকার সত্তার সঙ্গেই পরিচিত হবেন। তবে, আমার কাছে অগাস্ট স্ট্রিনড়বার্গ সবসময়ই একজন প্রতিবাদী মানুষের প্রতিভূ। সে অর্থে আমাদের নজরুলের সঙ্গে তাঁর ভীষণ সাযুজ্য খুঁজে পাই, যিনি সকল প্রতিকূলতার মাঝেও সাম্যের গান গেয়েছেন, বলেছেন–“বিশ্বে যা-কিছু মহান সৃষ্টি চির-কল্যাণকর/ অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।” কিন্তু সাম্যের নামে যখন নারী-পুরুষকে পরস্পরের বিরুদ্ধাচারী দেখিয়ে স্বামী-স্ত্রীর ভালোবাসা, দায়িত্ব-কর্তব্য, সমঝোতাকে দাঁড়িপাল্লায় তোলা হতে লাগলো, হেনরিক ইবসেনের তথাকথিত ‘নারীবাদী নাটকগুলোর দোহাই দিয়ে সম্পর্কগুলো সংজ্ঞায়িত হতে লাগলো এককভাবে নারীর দৃষ্টিকোণ থেকে, তখনই অগাস্ট স্ট্রিনবার্গ তাঁর চিরচেনা প্রতিবাদী মূর্তিতে আবির্ভূত হলেন। পাঠকের সামনে উপস্থাপন করলেন এমন কিছু সূক্ষ্মাতিসূক্ষ বিষয়কে যেগুলো এড়িয়ে গিয়ে কতিপয় গত্বাঁধা স্থূল-বিষয় নিয়ে সে সময় নারী আন্দোলন দানা বাঁধছিল। স্ট্রিনডবার্গ মনে করতেন, আন্দোলন ব্যাপারটি নিরপেক্ষ; এর শুরুতে ‘নারী বা ‘পুরুষ যেকোন শব্দ জুড়ে দেয়ার অর্থ হচ্ছে সেটিকে একপাক্ষিক করে ফেলা, আর এ ধরনের আন্দোলনের নিরপেক্ষতা নিয়ে সংশয় পোষণের যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। যদিও স্ট্রিনড়বার্গের ব্যক্তিগত জীবন পর্যালোচনায় দেখা যায়, জীবনের এক পর্যায়ে তিনি ভীষণ নারী-বিদ্বেষী হয়ে গিয়েছিলেন কিন্তু এটাও মনে রাখা প্রয়োজন যে, সেসময় তিনি পুরোপুরি মানসিক বিকারগ্রস্থ ছিলেন এবং তাঁর গল্পগুলো সে সময়ের অনেক আগে লেখা। যাহোক, আমার মনে হয় বাংলাদেশেও বর্তমানে স্ট্রিনর্গের সময়ের মত একটি একপেশে ধারা চলছে। অনেকটা বোধহয় জোর করেই নারী-পুরুষ সম্পর্কটাকে বারবার আতশি কাঁচের নিচে আনা হচ্ছে এবং পুরুষ কিংবা পুরুষতান্ত্রিক শব্দগুলোকে ঋণাত্বক হিসেবে দাঁড় করানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। এ চেষ্টার চালিকাশক্তি হিসেবে গতানুগতিকভাবেই হেনরিক ইবসেনের নাটকগুলোকে ব্যবহার করা হয়। অথচ ইবসেনের বক্তব্য যে ভিন্ন আঙ্গিক থেকেও উপস্থাপন সম্ভব, কিংবা নাটকগুলোর সূক্ষতর বিশ্লেষণ যে অনেক ক্ষেত্রেই নারীদের বিপক্ষে যেতে পারে এই চিন্তাটি কিন্তু করা হয় না। আমি অবশ্য মনে করি, কোন বিষয়ে নারী বা পুরুষ যে কারো ভুল দেখতে পাওয়া মানেই তার অবস্থান নিচু বা ঋণাত্বক হয়ে যাওয়া নয়। এতে বরং এটাই প্রমাণিত হয় যে, তারা মনুষ্যত্বের সীমার মধ্যেই রয়েছেন, কারণ, “মানুষ মাত্রই ভুল হয়।” কিন্তু এই ভুলগুলোকে যারা খুব বেশি বড় করে তোলেন তারা বুঝতে চান না–বিপরীতপ্রান্তে দাঁড়ানো মানুষটিকে ক্রমাগত অসহনীয় হিসেবে উপস্থাপনের চেষ্টা প্রকারান্তরে নিজের অবিবেচকতাকেই প্রকট করে তোলা। তাই, সময় এসেছে ‘জেন্ডার বিষয়টিকে নতুনতর আলোকে চিন্তা করার; এবং তার অংশ হিসেবে স্ট্রিনবার্গ-পাঠ যথেষ্ট ফলদায়ী হবে বলেই আমার ধারনা। সে হিসেবে স্ট্রিনবার্গের গল্প নিয়ে বই প্রকাশ করা একটি সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত বলে মনে করছি।

আমাদের দেশে অনুবাদ-সাহিত্য দীর্ঘদিন ধরেই একটি বিকাশমান মাধ্যম। বলা হয়ে থাকে, মৌলিক লেখার চেয়ে অনুবাদের ক্ষেত্রে মেধা, মনন আর শ্রমের খরচ বেশি হয়। অনুবাদ কেবলমাত্র ভাষান্তর নয়, এর সঙ্গে ভাবেরও প্রয়োজন। এজন্য অনুবাদকের সাহিত্যজ্ঞান প্রখর হওয়া আবশ্যক। অন্যথায়, এক ভাষা থেকে অন্য ভাষায় লেখা রূপান্তরিত হবে ঠিকই, কিন্তু লেখার মাঝে প্রাণ খুঁজে পাওয়া দুষ্কর হয়ে উঠবে। একটি সার্থক অনুবাদ তার শিল্পগুণে হয়ে ওঠে একটি স্বতন্ত্র সাহিত্যকর্ম। তাই স্বপ্রণোদিত হয়ে অনুবাদের দীর্ঘযাত্রার মধ্যে দিয়ে যাওয়ার অভিলাষে যারা উদ্যোগী হন, তাদের সাধুবাদ জানানো প্রত্যেক সচেতন বইপ্রেমির নৈতিক দায়িত্ব হওয়া উচিত। অনুবাদক শুধু বিদেশী সাহিত্যটিকে নয়, সেদেশের সংস্কৃতি, জীবনযাত্রা, ব্যক্তিসম্পর্ক, প্রতিবেশের সাথে নিজ ভাষার পাঠককে পরিচিত করানোর ভূমিকাটিও পালন করেন। সে বিবেচনায় অনুবাদক আদতে একজন ভ্রমণ প্রদর্শক। পাঠকের প্রশান্তিই অনুবাদকের পরিতৃপ্তি।

মাহবুব সিদ্দিকী বয়সে তরুণ, নিজে ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্র ছিলেন এবং পেশাগত জীবনেও তার ছাপ বজায় রাখতে শিক্ষকতাকেই পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছেন। পেশাদার অনুবাদক তিনি নন, আমি বলবো এটি একটি শুভবার্তা। কারণ, পেশাদার অনুবাদক মানে এই কাজটির মাধ্যমেই তার জীবিকার সংস্থান হয়। ফলে, যত বেশি সম্ভব অনুবাদ তাকে করতে হয় একটি সীমিত ব্যবধিতে। সেক্ষেত্রে কোয়ালিটি বনাম কোয়ান্টিটি এর চিরন্তন সংঘাতে তাকে মধ্যবর্তী একটি সমঝোতায় আসতে হয়। মাহবুব সিদ্দিকীর সেই বাস্তবতা নেই, তিনি অনুবাদ করেছেন গভীর আন্তরিকতা থেকে। ফলে, যত্ন এবং নিষ্ঠার সমন্বয়ে গুণগত উৎকর্ষের একটি মাত্রায় পৌঁছতে তাঁর প্রচেষ্টা লক্ষণীয়। আমার সুযোগ ঘটেছিল তাঁর অনুবাদের প্রাথমিক পাণ্ডুলিপিটি পড়বার। পাঠ পরবর্তীতে অনুবাদের কিছু অংশের ব্যাপারে তাঁকে মতামত দিই যেখানে আরেকটু উন্নতির সুযোগ রয়েছে। সেই পরিক্রমায় জানতে পারি, শুধু আমি একা নই, তাঁর পাণ্ডুলিপি পাঠকের তালিকায় ছিলেন আরও বেশ ক’জন সাহিত্যানুরাগী, যাদের প্রত্যেকের মতামতের ব্যাপারে শ্রদ্ধাশীল থেকে অনুবাদে প্রয়োজনীয় পরিমার্জনার কাজটি করা হয়েছে। একটি অনুবাদ প্রকল্পে এতজন মানুষের মতামত নিয়ে সেই অনুযায়ী সংশোধনের পদক্ষেপ নেয়া কাজটির প্রতি অনুবাদকের শতভাগ নিবেদনকেই স্বতঃসিদ্ধ করে। তাই, মাহবুব সিদ্দিকী ভবিষ্যতেও অনুবাদের কাজটি অব্যাহত রাখলে আমাদের অনুবাদ-সাহিত্য যে আরও সমৃদ্ধ হবে এ ব্যাপারে নিঃসংশয়েই অভিমত ব্যক্ত করা যায়। প্রতিক্রিয়া একজন শিল্পীর কাজের সবচেয়ে বড় স্বীকৃতি। অনুবাদকও তো একজন শিল্পীই বটে।

যেহেতু এটি তাঁর প্রথম কাজ, পাঠক যদি উৎসাহসূচক মতামত দেন সেটি হয়তো তাঁর অন্তর্নিহিত শিল্পচেতনাকে আরও তেজোদ্দীপ্ত করবে। আমাদের দেশে অভিযোগ করা মানুষের সংখ্যা অগণিত, তুলনায় উৎসাহ দেবার মানুষের সংখ্যা কম। এই সরলীকৃত প্রবণতার বাইরে থেকেই পাঠক তরুণ অনুবাদকের প্রয়াসকে মূল্যায়ন করুক, এটিই প্রত্যাশা। অগাস্ট স্ট্রিনর্গের প্রতি আরও একবার শ্রদ্ধা জানাই, এবং সেই সাথে মাহবুব সিদ্দিকীর জন্যও শুভকামনা রইলো।

ড. কাজল বন্দ্যোপাধ্যায়
অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান
ইংরেজি বিভাগ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

কৃতজ্ঞতা

শ্রদ্ধেয় ড.কাজল বন্দ্যোপাধ্যায় স্যার, যার সুবাদে অগাস্ট স্ট্রিনডবার্গকে চিনেছি। স্যার না-থাকলে হয়ত স্ট্রিনবার্গ আমার কাছে ‘স্ট্রেঞ্জার থেকে যেত। সেই সঙ্গে, আরও একজন মানুষের নাম না করলেই নয়–শ্রদ্ধেয় শেখ আলাউদ্দিন স্যার। গল্পগুলো ছাপার অক্ষরে পাঠকের হাতে পৌঁছানোর আগে স্যার পড়ে না-দিলে বুঝতেই পারতাম না, ‘আ-কার, ‘এ-কার’, ‘হ্রস্ব ই কার’, ‘দীর্ঘ ঈ-কার’ নিয়ে আমার দীর্ঘদিনের বিভ্রান্তি রয়েছে।

ভাইয়া (মাহফুজ সিদ্দিকী) কে আনুষ্ঠানিকভাবে কৃতজ্ঞতা জানালে সেটা ন্যাকামো হবে কি না জানি না, ভাইয়া হয়ত পাকামোও বলতে পারে; তবুও, গল্পগুলো পড়ে দিয়ে, দরকার মতো মন্তব্য করে এবং আরও নানাবিধ উপায়ে সহযোগিতা করে এগুলোর কাঠামো দাঁড় করাতে ভাইয়া যে ভূমিকা রেখেছে সেজন্য আমার পক্ষ থেকে যেকোনো রকম অনুভূতি প্রকাশ পেলে দিনশেষে তার নাম কৃতজ্ঞতা-ই হবে।

মাহবুব সিদ্দিকী
ঢাকা
২৩ আগস্ট, ২০১৬

অগাস্ট স্ট্রিনডবার্গ

অগাস্ট স্ট্রিনডবার্গকে বলা হয় আধুনিক সুইডিশ সাহিত্যের জনক। ১৮৪৯ সালের ২২ জানুয়ারি সুইডেনের স্টকহোমে জন্মগ্রহণ করা এ মানুষটি ছিলেন বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী। একাধারে তিনি নাট্যকার, গল্পকার, চিত্রকর, ঔপন্যাসিক এবং কবি। চার দশকেরও বেশি সময়জুড়ে সুইডিশ সাহিত্যাঙ্গন দাপিয়ে বেড়িয়েছেন। আজও তাঁর সৃষ্টিকর্ম তাঁর সময়ের মতই প্রাণবন্ত এবং যুগোপযোগী। দাপিয়ে বেড়ানো’ কথাটা আক্ষরিক অর্থেই স্ট্রিনডবার্গের সঙ্গে ভীষণভাবে মানানসই। কারণ, প্রচলিত বিশ্বাস আর ধ্যানধারণাকে তিনি অনবরত আঘাত করেছেন তাঁর কলম আর তুলির আঁচড়ে। ব্যক্তিজীবনেও ছিলেন একগুঁয়েরকম স্বাধীনচেতা। নিজেকে প্রচলিত বিশ্বাসের বিরুদ্ধাচারী ঘোষণা করে তিনি বলতেন–“জীবনের জটিলতার জালে আমরা এত বিশ্রীভাবে জড়িয়ে পড়েছি যে, এ থেকে পুরোপুরি মুক্ত হওয়া কখনোই সম্ভব নয়। সবকিছু জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে ছারখার করে দিয়ে সম্পূর্ণ নতুনভাবে, সুন্দর করে শুরু করতে হবে।” এ অনুভূতি থেকেই হয়তো জীবনব্যাপী সাহিত্যকর্ম নিয়ে নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন। গল্প, নাটক আর কবিতার বিষয়বস্তুকে বিভিন্ন সময়ে ভিন্নতর আঙ্গিকে প্রকাশ করেছেন। তবে, তিনি সব সময়ই ‘প্রাকৃতিক নিয়ম’(Natural Law) কথাটায় বিশ্বাস করতেন। বিশ্বাস করতেন, আরোপিত কোন মতামত বা বক্তব্য কখনোই মানুষের কল্যাণ বয়ে আনতে পারে না। একে উল্লেখ করেছেন ‘বৃহত্তর প্রাকৃতিকতাবাদ’ (Greater Naturalism) হিসেবে। নারী-পুরুষের সমতায় বিশ্বাস করতেন, কিন্তু সে সমতার অর্থ এই নয় যে, নারী-পুরুষকে একই কাজ করতে হবে। নারী-পুরুষের মিলন নিয়েও প্রশংসনীয় দৃষ্টিভঙ্গি ছিল তাঁর। “দৈহিক মিলন কখনোই ‘কাম-নিয়ন্ত্রিত হওয়া উচিত নয়, বরং, মানব মনের সুকুমার প্রবৃত্তি দ্বারা পরিচালিত হওয়া উচিত।” স্ট্রিনবার্গ আরোপিত নারী স্বাধীনতায় বিশ্বাস করতেন না। ফলে, তথাকথিত নারী আন্দোলন’ বা ‘নারী অধিকার’ শব্দগুলোর প্রতি ভীষণ বিরক্ত ছিলেন। উপরন্তু, এগুলোকে মানবজাতির মধ্যে বিভেদ-সৃষ্টিকারী মতবাদ মনে করতেন। কিন্তু মানুষ হিসেবে নারী এবং পুরুষ উভয়েরই যথাযোগ্য মর্যাদা পাওয়া উচিত বলে বিশ্বাস করতেন। এ বিশ্বাস থেকেই, ১৮৮৪ সালে সুইডিশ নারীদের ভোটাধিকার আদায়ে তিনি রীতিমত আন্দোলন করেছেন। অনেক সমালোচক স্ট্রিনবার্গকে ‘নারী-বিদ্বেষী’ বলে রায় দিলেও বাস্তবতার নিরিখে একে খারিজ করে দেওয়াই সমীচীন। কারণ, যে সময়ে তিনি নারীদের প্রতি প্রকাশ্য বিদ্বেষ প্রদর্শন করেছেন সে সময়ে তিনি মানসিক ভারসাম্যহীন হয়ে পড়েছিলেন। অথচ তাঁর বিখ্যাত কাজগুলোর প্রায় সবই ঐ ভারসাম্যহীনতার আগে করা। সর্বোপরি, ‘নিরপেক্ষ অবস্থান বলে কিছু হয় না। লেখকের বক্তব্যকে কালের কষ্টিতে যাচাই করে নেওয়ার দায়িত্ব পাঠকের ওপর বর্তায়।

স্ট্রিনডবার্গের বক্তব্যে ছিল ক্ষুরধার তীক্ষ্ণতা। ঘুরিয়ে ফিরিয়ে কিছু বলাকে কখনোই বরদাস্ত করতে পারতেন না। ফলে, নরওয়ের বিখ্যাত নাট্যকার হেনরিক ইবসেনের বর্ণনাবহুল নাটকগুলোকে ভীষণ অপছন্দ করতেন, সেগুলোর বিষয়বস্তু নিয়েও বিরক্তি প্রকাশ করেছেন। এ-নিয়ে দুজনের মধ্যে ব্যক্তিগত পর্যায়েও শত্রুতার সৃষ্টি হয়েছিল–একে-অন্যকে খোঁচা দিলে বেশকিছু লেখালেখি করেছেন। তবে, স্ট্রিনবার্গের অনুসারীর সংখ্যাও কিন্তু নেহাত কম নয়। টেনিস উইলিয়ামস, এডওয়ার্ড অ্যালবি, ম্যাক্সিম গোর্কি, জন অসবর্নসহ অসংখ্য কবি-সাহিত্যিক নিজেদের লেখালেখিতে স্ট্রিনবার্গের প্রভাব স্বীকার করেছেন। আমেরিকান নাট্যকার ইউজিন ও’নিল ১৯৩৬ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তির পর স্ট্রিনডবার্গকে নিজের অনুপ্রেরণা হিসেবে স্বীকার করে তাঁকে ‘সবচাইতে প্রতিভাধর আধুনিক নাট্যকার’ (The greatest genius of all modern dramatists) হিসেবে আখ্যায়িত করেন। যদিও তার বহু আগেই স্টিনডবার্গ চলে গেছেন না-ফেরার দেশে। ১৯১১-তে নিউমোনিয়ায়। আক্রান্ত হন। সেরে ওঠার আগেই ‘কোলন ক্যান্সার’ ধরা পড়ে। বেশ কয়েক মাস শয্যাশায়ী থেকে ১৯১২ সালের ১৪ মে স্ট্রিনবার্গ শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।

সুইডিশ সাহিত্য এবং বিশ্বসাহিত্য আজও তাঁকে গভীর শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *