ক্ষতিপূরণ

ক্ষতিপূরণ

কলেজের সবাই ‘জিনিয়াস’ বলে জানত। একদিন যে নিজেকে আলাদা করে চেনাবেই সে ব্যাপারে কারো বিন্দুমাত্র সন্দেহ ছিল না। কিন্তু পরীক্ষায় পাশ করার পর ছেলেটি স্টকহোমে ফিরে যেতে বাধ্য হল। সেখানে জাহাজ জেটিতে কাজ নিতে হলো। ডক্টরেট ডিগ্রি পাবার জন্য যে গবেষণা-প্রবন্ধ তৈরি করছিল, সেই কাজও আপাতত বন্ধ রাখতে হলো। কামাই-রুজির বন্দোবস্ত খুব একটা ভালো না-হলেও মনে মনে সে ভীষণ উচ্চাভিলাষী। চিন্তা করে দেখলো, এই উচ্চাভিলাষ বাস্তবায়নে বিয়ে করাটা খুব কাজে দেবে। কারণ, যুতসই একটা বিয়ে করতে পারলে টাকা-পয়সার জন্য আর ফিরে তাকাতে হবে না। তাই সে বেছে বেছে নামী-দামী পরিবারগুলোর সঙ্গেই বেশি খাতির জমাতো। উপছালা (এখানে সে আইনে পড়েছে) এবং স্টকহোম দু জায়গাতেই তার একই রকম পরিকল্পনা ছিল। উপছালায় পড়াকালীন সব সময় সে তক্কে তক্কে থাকতো কারা নতুন ভর্তি হল। কোন অভিজাত ঘরের সন্তান ভর্তি হবার খবর পাওয়ামাত্র তার সঙ্গে ভীষণ ভাব জমিয়ে ফেলত। সেই অভিজাত সন্তানটিও খুব শীঘ্রই তার চাটুকারিতাকে পছন্দ করতে শুরু করত। এভাবে অনেকের সাথেই তার সুসম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। প্রয়োজন মেটানোর মত সুসম্পর্ক। গ্রীষ্মের ছুটিতে সে এসব অভিজাত বন্ধুদের গ্রামের বাড়িতে বেড়াতে যাওয়ার নিমন্ত্রণ পেত।

এই গ্রামের বাড়িতে যাওয়ার উপলক্ষটা ছিল উদ্দেশ্য পূরণের একটা মোক্ষম সুযোগ। প্রকৃতিগতভাবেই ওর মধ্যে সব ধরনের সামাজিক গুণাবলীর বিকাশ ঘটেছিল। সবার সঙ্গে খুব সুন্দর করে মিশতে পারত, গানের গলাও ছিল চমৎকার। বিভিন্ন খেলাধুলায় পারদর্শিতার পাশাপাশি মেয়ে পটানোর কাজটাও বেশ ভালোই জানা ছিল। ফলে নারীমহলে ও ছিল এক জনপ্রিয় চরিত্র। পকেটের অবস্থা যা-ই-হোক না কেন, কাপড়-জামা দেখে তা বোঝার উপায় নেই। দামী পোশাকআশাক পড়ে ফুলবাবুটি সেজে চলাফেরা করত! অবশ্য, এজন্য ও কখনোই বন্ধুবান্ধব বা অন্য কারো থেকে টাকা ধার করত না। কীভাবে কীভাবে যেন ম্যানেজ করে ফেলত। নিজের। ফুটানি জাহির করার সম্ভাব্য সবগুলো উপায়ই ও ব্যবহার করত। যেমন, হয়ত খুব আজেবাজে দুটো কোম্পানির শেয়ার কিনল, তারপর যখনই সুযোগ পাবে তখনই বলে বেড়াবে যে, তাকে শেয়ারহোল্ডারদের বাৎসরিক মিটিংয়ে যেতে হবে!

গত দু’বছর যাবত ছেলেটিকে এক সম্ভ্রান্ত ঘরের মেয়ের পেছনে সময় দিতে দেখা যাচ্ছে। মেয়ের বাপের টাকা-পয়সা বিস্তর, এবং সেগুলো হস্তগত করাটাই যে তার প্রধান উদ্দেশ্য, সে ব্যাপারে কারো দ্বিমত নেই। কিন্তু হঠাৎ এক অভাবনীয় ঘটনা ঘটল! যাবতীয় জাঁকজমক থেকে হুট করে কোথায় যেন হাওয়া হয়ে গেল ছেলেটা। কিছুদিন পর জানা গেল, এক দরিদ্র কুমোরের মেয়ের সাথে তার সম্পর্ক হয়েছে, এমনকি বাগদানও হয়ে গেছে। বন্ধুরা কিছুতেই হিসাব মিলাতে পারল না। ওর মত উচ্চাভিলাষী ছেলে কীভাবে এ-কাজ করল তার কোন আগাপাছতলা খুঁজে পেল না। তারা–“ওর সব পরিকল্পনাইতো গোছালো ছিল। ও এত সূক্ষ্ম চাল চেলে এগুলো যে সাফল্য ধরা দেয়া শুধু কটা দিন সময়ের ব্যাপার ছিল মাত্র। চামচে খাবার তুলে নেয়া হয়েছে, এখন শুধু সেটা গলাধঃকরণ বাকি, অথচ…!” অবশ্য ও নিজেও বুঝতে পারল না কীভাবে কী হয়ে গেল। স্টিমারে ফেরার সময় ছোটখাটো একটা মেয়েকে দেখে সবকিছু এলোমেলো হয়ে গেল, এতদিনের পরিকল্পনা সব ভেস্তে গেল। মেয়েটাকে দেখার পর। থেকেই মনে হচ্ছিল, কেমন যেন মোহাচ্ছন্ন হয়ে পড়ছিল, হাত-পা অবশ হয়ে আসছিল। যাহোক, নিজেকে প্রবোধ মানানোর জন্যই হয়ত বন্ধুদের। জিজ্ঞেস করল, “তোদের মনে হয় না মেয়েটা সুন্দরী?”

বন্ধুরা অকপটে স্বীকার করল, তাদের সে রকম কিছু মনে হয়নি!

“কিন্তু ও ভীষণ বুদ্ধিমতী। একবার ওর চোখের দিকে তাকিয়ে দেখিস, ওর চোখের তারায় এক দুর্বোধ্য অভিব্যক্তি চোখে পড়বে তোদের!”

বন্ধুরা এবারেও তাকে হতাশ করল। মেয়েটির চোখের দিকে তাকিয়ে তাদের বিশেষ কিছু মনে হয়নি। আর, বুদ্ধির কথা বলা যাচ্ছে না; কারণ তারা কখনোই মেয়েটিকে মুখ খুলতে দেখেনি!

তবে, বন্ধুরা যা-ই বলুক, প্রতি সন্ধ্যায়ই ছেলেটি কুমোরের বাড়িতে হাজির হয়। কুমোর ব্যাটা ভারী চালাক, কখন কাকে মত দিয়ে ফেলে বলা শক্ত। সন্ধ্যাগুলো তাই কুমোরের পরিবারের সাথেই কাটে–ভালোবাসাকে হারাতে দেবে না সে। আশেপাশে কেউ না-থাকলে, মেয়েটার সামনে হাঁটু গেড়ে বসে প্রেম নিবেদন করে। এ অভ্যাস অবশ্য আগে থেকেই তার রপ্ত করা ছিল। তবে, এসবের বাইরেও মেয়েটাকে খুশি করার জন্য সে নানারকম চেষ্টা করে–মেয়েটার সুই-সুতো নিয়ে খেলা করে, গান শোনায়, ধর্মীয় নানা কাহিনি বলে, নাটকের গল্প শোনায়। আর, এ সবকিছুতেই সে মেয়েটার চোখে মৌনসম্মতি দেখতে পায়। ফলে তার উচ্ছ্বাস আরও বেড়ে যায়–মেয়েটাকে ভালোবাসার কবিতা লিখে উপহার দেয়, পড়ে শোনায়। আর… আরও অনেককিছু। এভাবেই ধীরে ধীরে ছেলেটি তার ভালোবাসার মন্দিরে নিজের গর্ব, অহংকার, বোধ, উচ্চাভিলাষ সবকিছু উৎসর্গ করল, এমনকি নিজের গবেষণা-প্রবন্ধটিও। কিছুদিন পর তাদের বিয়ে হল।

বিয়ের দিন কুমোরের খুশি যেন আর ধরে না। গলা অব্দি মদ পান করল। মদ্যপ অবস্থায় নারীজাতি সম্পর্কে নানা অশালীন মন্তব্য, আর চটুল রসিকতা করে এক বক্তৃতা দিল। কুমোরের জামাই কিন্তু তাতে মোটেও অসন্তুষ্ট হল না। সে বরং এগুলোকে একরকম সহজ-সরল, খোশমেজাজি আচরণ বলে ধরে নিয়ে শ্বশুরকে আরও প্ররোচিত করতে থাকল। তার মনে হল, এই সাধারণ মানুষগুলোর মধ্যে নিজেকে আজ খুব হালকা লাগছে।

ওদিকে বন্ধুরা বলল–“ভালোবাসা, এরই নাম ভালোবাসা! ভালোবাসায় সবই সম্ভব!”

*** *** ***

এতদিনে দুজন-দুজনার। আর কোন দূরত্ব বা বাধা নেই। এক মাস গেল, দু’মাস গেল। সময় যে কোন দিক দিয়ে যাচ্ছে তার কোন গাছ-পাথর নেই…

ছেলেটি খুশিতে আত্মহারা–কী ছেড়ে কী করবে তা-ই ভেবে পায় না। সন্ধ্যার সময়টা দুজন একসাথে কাটায়। ছেলেটি মেয়েটিকে গান গেয়ে শোনায়, মেয়েটির প্রিয় ‘বুনো গোলাপ ফুলের গান। গান শেষ হলে ধর্মকাহিনি আর নাটকের গল্প বলে। মেয়েটি বেশ আগ্রহ নিয়ে সব গল্প শোনে। কিন্তু কখনোই কোন মন্তব্য করে না। চুপচাপ শুনে যায়, আর কাপড়ের ওপর সুঁই-সুতোয় ফুল তোলে।

বিয়ের তৃতীয় মাসে স্বামী-স্ত্রীর অভ্যাসে খানিকটা পরিবর্তন লক্ষ করা গেল–স্বামী তার বিকেলবেলা ঘুমানোর পুরনো অভ্যাসে ফেরত গেল। স্ত্রীর কিন্তু একা থাকতে মোটেই ভালো লাগে না, স্বামীর পাশে বসে খুঁটখাঁট করে। স্বামী তাতে খানিকটা বিরক্তই হয়। নিজের চিন্তা-ভাবনাগুলো গুছানোর জন্য কিছুটা একাকীত্ব প্রয়োজন তার। স্ত্রী মাঝে মাঝে স্বামীর অফিস ফেরার পথে দাঁড়িয়ে থাকে। এ সময়টা তার খুব গর্ব হয়। সহকর্মীদের ছেড়ে, রাস্তা পার হয়ে এসে স্বামী তার হাত ধরছে, এই চিন্তাটা ভীষণ আনন্দ দেয়। বিজয়িনীর বেশে স্বামীকে নিয়ে বাড়ি ফেরে।

চতুর্থ মাসে স্ত্রীর প্রিয় গানটার ওপর স্বামী পুরোপুরি বিরক্ত হয়ে উঠল। এক গান আর কত গাওয়া যায়! সে বরং একটা বই টেনে নিয়ে পড়তে থাকে। দুজনের মধ্যে তেমন কথাবার্তা হয় না।

*** *** ***

এক সন্ধ্যায় স্বামীকে একটা মিটিংয়ে অংশগ্রহণের জন্য যেতে হল। সেখানে রাতের খাবারের আয়োজনও ছিল। বিয়ের পর এই প্রথম সে দীর্ঘ সময়ের জন্য রাতে বাড়ির বাইরে থাকতে যাচ্ছে। স্ত্রীর বেশ মন খারাপ। স্বামী তাকে অনেক করে বোঝালো। বলল, সন্ধ্যার সময়টা যেন সে আশেপাশের কোন বান্ধবীর সাথে গল্প করে কাটায়, আর রাতে যেন তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়ে। কারণ, সব কাজ শেষ করে বাড়ি ফিরতে হয়ত গভীর রাত হয়ে যাবে।

সন্ধ্যায় স্ত্রীর এক বান্ধবী এল। রাত্রি নয়টা পর্যন্ত তারা নানা গল্পগুজব করল। সময় যেন কাটতেই চায় না। বান্ধবী এক সময় চলে গেল। সময় এবার আরও শভুকগতিতে চলছে। কিন্তু স্ত্রীও প্রতিজ্ঞা করেছে, স্বামী না ফেরা পর্যন্ত ঘুমুতে যাবে না। ড্রইংরুমে সোফার ওপর এককোণায় বসে রইল। শরীরে ক্লান্তি এলেও মনের অস্থিরতার কারণে ঘুম আসছে না। অতএব, ওভাবেই বসে থাকতে হল। কিন্তু এভাবে কতক্ষণ বসে থাকা যায়? সময়তো কাটছেই না! কী করা যায়? কাজের লোকের ঘরে উঁকি দিয়ে। দেখল–অঘোরে ঘুমুচ্ছে। পুরনো ঘড়িটা টিক-টক শব্দ করছে। কী করা যায়? সুইসুতো নিয়ে বসল কিছুক্ষণ। তাতেও মন বসাতে পারল না। ঘড়িতে তাকিয়ে দেখলো মাত্র দশটা বাজে। নাহ্! আরতো ভালো লাগছে না। এবার শুরু হল ঘরময় অস্থির পায়চারি। আসবাবপত্র টানাটানি করে। এপাশ-ওপাশ করল। এতসব করেও যখন কিছুতেই সময় যাচ্ছে না, স্ত্রী। তখন রীতিমত অসহিষ্ণু হয়ে উঠল। আচ্ছা! বিয়ের মানে তাহলে এই? একটা মেয়েকে তার পরিবার-পরিজন থেকে দূরে সরিয়ে এনে তিন রুমের একটা ঘরে বন্দী করে রাখা হবে, আর মেয়েটি স্বামী না-ফেরা পর্যন্ত ঘুম ঘুম চোখে অপেক্ষা করবে, তাই না? উহ! অসহ্য!

কিন্তু এটাতো ভুলে গেলে চলবে না যে, স্বামী তাকে ভালোবাসে, যথেষ্ট ভালোবাসে। সে তো অযথা বাইরে গিয়ে ঘোরাঘুরি করছে না; গেছে। অফিসের কাজে। এসব নিয়ে স্বামীর ওপর রাগ করাটা কি নিছক বোকামি নয়? হুম! কিন্তু স্বামী কি সত্যিই এখনো তাকে ভালোবাসে? এইতো দু’একদিন আগেই স্ত্রী যখন তাকে সুতার কাঠিমটা ধরে থাকতে বলল কই স্বামীতে রাজি হল না। অথচ বিয়ের আগে সুতার কাঠিম ধরে রাখাটা তার প্রিয় কাজ ছিল! আরও আছে, গতকাল লাঞ্চের আগে স্বামীর সাথে একবার দেখা করতে যাওয়ায় স্বামী ভুরু কুঁচকে ছিল, না? হ্যাঁ, স্পষ্ট দেখেছে সে! তবুও, সব কিছু না-হয় ছাড়া গেল, কিন্তু এই যে আজ সে মিটিংয়ে গেল, মিটিংয়ের পর রাতে সেখানে খাওয়ার দরকারটা কী?

স্ত্রীর চিন্তা-ভাবনা যখন এই পর্যায়ে পৌঁছাল রাত্রি তখন সাড়ে দশটা। হঠাৎ করেই তার মনে হল–আচ্ছা, এমন চিন্তাতো আগে কখনো করিনি! সাথে সাথে আবার মন খারাপ হয়ে গেল। এবার আগের চেয়ে বেশি খারাপ হল। একে-একে নানা অসংগতি চোখে ধরা পড়তে লাগল: আরে! স্বামীকে আর আগের মত মধুরভাবে কথা বলে না, আগের মত গান গায় না, পিয়ানো বাজায় না। সর্বোপরি, স্বামী তার কাছে মিছে কথাও বলছে আজকাল। এইতো সেদিনই বলল, বিকালে না-ঘুমালে নাকি তার চলেই না; অথচ, কয়েকদিন ধরে সব সময়ই সে একটা ফ্রেঞ্চ নভেল পড়ছে; এমনকি বিকেলেও! ওফ! স্বামী তাকে মিথ্যা বলেছে!

এতসব চিন্তা করতে করতে রাত সাড়ে এগারোটা বাজল। চারদিকের সুনসান নীরবতা এখন গায়ে কাঁটা হয়ে ফুটছে। কেমন যেন দমবন্ধ লাগছে। স্ত্রী উঠে গিয়ে জানালা খুলে রাস্তায় তাকালো। দুটো লোক দুটো মেয়ের সাথে দর কষাকষি করছে। হুম! এটাই তাহলে পুরুষের আসল চরিত্র! আচ্ছা, তার স্বামী যদি কখনো এমন করে? ভাবতেই গা শিউরে উঠল। স্বামী এমন করলে সে নিশ্চিত আত্নঘাতি হবে! ঝট করে জানালা বন্ধ করে দিয়ে সোফার ওপর বসে পড়লো স্ত্রী। মনে পড়ল, স্বামী একবার তাকে বলেছিল: “যে যেমন ভাবে, সে তেমনই দেখে।” সঙ্গে সঙ্গেই সবকিছু যেন পরিবর্তিত মনে হল। চারপাশের সবকিছু কেমন নতুন, ঝা চকচকে দেখাচ্ছে! বিছানার ওপর সবুজ চাদরটাকে মনে হচ্ছে যেন সবুজে ছাওয়া কোন নির্মল মাঠ, আর তার ওপর রাখা বালিশ দুটো যেন ঘাসের ওপর শুয়ে থাকা ছোট্ট দুটো আদুরে বেড়ালছানা! ঘরের সব আসবাবের রোশনাই যেন দ্বিগুন হয়ে গেছে, দেয়ালে ঝোলানো আয়নাটার ওপর যে ছোপ-ছোপ দাগ ছিল সেগুলোও আজ উধাও! চিরুনি, পাউডার বক্স আর টুথব্রাশের গোড়ায় লাগানো রূপার প্রলেপ যেন আজ সোনার মত ঝকঝক করছে! এমনকি ঘরে পড়ার জুতো জোড়াও এমন নতুন আর চমৎকার লাগছে যে, ভাবাই যাচ্ছে না ওগুলো পায়ে পরার জিনিস! ওহ্! চারপাশে সবকিছু কত সুন্দর, কত নতুন, কিন্তু… কিন্তু প্রাণের ছোঁয়াটা যেন একটু কম। স্বামীর সবগুলো গান তার জানা, সব কথা, এমনকি সব চিন্তাও তার পরিচিত। খেতে বসার আগে স্বামী কী বলবে, সন্ধ্যাবেলায় ঘুরে বেড়ানোর সময় কী বলবে, সব তার বোঝা হয়ে গেছে। একই কথা, একই সবকিছু দেখতে দেখতে সে ক্লান্ত। আচ্ছা, কখনো কি সে ঐ লোকটির প্রেমে পড়েছিল? হ্যাঁ, অবশ্যই পড়েছিল। তাহলে কি এই কথাগুলো, এই আচরণগুলোরই প্রেমে পড়েছিল? একটা মেয়ে হিসেবে সে যে স্বপ্নগুলো দেখেছিল সেগুলো মনে করার চেষ্টা করলো। হ্যাঁ, তার স্বপ্নগুলোও মোটামুটি এমনই ছিল। তাহলে কি মৃত্যু পর্যন্ত এই বৃত্তাকার পথেই জীবন চলতে থাকবে? হয়তো তাই। কিন্তু… কিন্তু… ইয়ে,… মানে,… তাদের বাচ্চা-কাচ্চা তো হবে এক সময়, তাই না? স্ত্রীর মুখটা জ্বলজ্বল করে উঠল। যদিও এখনও পর্যন্ত এমন কোন সম্ভাবনা দেখা যায়নি, তবু হবেতো এক সময়। তখন তাকে আর এমন একাকী সময় কাটাতে হবে না। স্বামী তখন যখন খুশি বাইরে যাক, যখন খুশি ফিরুক, তাতে কিছু যায়-আসে না; তার নিজের তো কথা বলার, সময় কাটানোর একজন থাকবেই। হয়তো মাতৃত্বই তাকে সুখী করতে পারবে। একজন পুরুষের বৈধ প্রেমিকা হয়ে থাকার চেয়ে মাতৃত্বের ব্যাপারটা অনেক বেশি মর্যাদাপূর্ণ। ঐ সময়টা স্বামী তাকে ভালো না-বেসে পারবেই না। অথচ, এখন সে আর আগের মত ভালোবাসে না!

এসব চিন্তা করতে করতে স্ত্রীর চোখ ছলছল করে উঠল, ঝুরঝুরিয়ে কাঁদতে শুরু করে দিল।

স্বামী বাড়ি ফিরল রাত একটায়। এতক্ষণ কান্নাকাটি করে স্ত্রী এখন অনেকটা শান্ত। কিন্তু তাকে এত রাত পর্যন্ত জেগে থাকতে দেখে স্বামী বেশ রেগে গেল। তার প্রথম কথাটাই হল এমন–“এত রাত হয়েছে তবু ঘুমাতে যাওনি কেন?”

–দেখতেইতো পাচ্ছ, তোমার জন্য অপেক্ষা করছিলাম। অপেক্ষা করা মানুষ ঘুমায় কীভাবে?

–বাহ! চমৎকার যুক্তি, তো আমি কি তাহলে বাইরেও যেতে পারবো?

এ কথা জিজ্ঞেস করেই স্ত্রীর দিকে ভালো করে তাকালো স্বামী–“তুমি কি এতক্ষণ কান্না করছিলে?”

“হুম! করবো না কেন? তুমিতো আমাকে আর আগের মত ভালোবাসো না।” স্ত্রীর গলায় স্পষ্ট অভিমান।

–মানে কী? আমাকে অফিসের কাজে বাইরে যেতে হয়েছিল বলেই কি তোমার মনে হল তোমাকে আর আগের মত ভালোবাসি না?

“রাতে বাইরে খাওয়াটা অফিসের কাজ হতে পারে না” ঠোঁট উল্টে স্ত্রীর প্রতিবাদ।

–হায় ঈশ্বর! তাহলে কি আমি বাইরেই যাবো না? উহ! মেয়েরা কেন। যে এত অনধিকারচর্চা করে!

–অনধিকারচর্চা? তোমার প্রতি আমার অনুভূতিকে অনধিকারচর্চা মনে হল তোমার? আমার আগেই খেয়াল করা উচিত ছিল। গতকালও তোমার অফিসে গিয়ে দেখা করার সময় এমন সন্দেহ হচ্ছিল। আর কখনোই তোমার সাথে দেখা করতে যাবো না।

স্বামী এবারে একটু হকচকিয়ে গেল–“ভুল বুঝোনা, সোনা! আমিতো আমার প্রধান…

উঁহু হু হু হু! স্ত্রী হাত-পা ছুঁড়ে কান্না জুড়ে দিল।

স্বামী বেচারা কী করবে ভেবে না-পেয়ে হৈচৈ করে কাজের লোককে ডেকে গরম পানির বোতল নিয়ে আসতে বলল। অথচ, আনার পর ধমক দিয়ে রুম থেকে বের করে দিল। তারপর, বোতল হাতে করেই হতভম্বের মত দাঁড়িয়ে স্ত্রীর কান্না দেখতে থাকলো। কিছুক্ষণ পর নিজেও অশ্রু বিসর্জন শুরু করল। গভীর, তিক্ত-বেদনাজাত অশ্রু। নিজের আচরণ, হৃদয়ের কঠিনতা, নানারকম শয়তানি, আর সর্বোপরি ভালোবাসার মোহময়তার কথা চিন্তা করে অশ্রু বিসর্জন করল সে। কিন্তু সূক্ষ বিচারে তার ভালোবাসাকে হয়তো ঠিক মোহ বলা যাবে না; কারণ সে তো সত্যিই স্ত্রীকে ভালবাসে, তাই না? হু! তা অবশ্য ঠিক। ওদিকে আবার স্বামী যখন হাঁটু মুড়ে বসে গোমড়ামুখো স্ত্রীর চোখের ওপর চুম্বন করছিল তখন স্ত্রীও তো বলছিল সে স্বামীকে ভালোবাসে, তাহলে? তাহলে কিছু না, তারা নিশ্চয়ই একে অপরকে ভালোবাসে। এতক্ষণ যেসব হচ্ছিল সেগুলো নিতান্তই কিছু কালো মেঘ। সে মেঘ এখন কেটে গেছে। আসলে, একাকী থাকার কারণেই এসব আজেবাজে চিন্তার উদ্রেক হয়। অতএব, স্ত্রী মনে মনে সিদ্ধান্ত নিল, সে আর কখনোই একাকী থাকবে না। দুর্যোগের ঘনঘটা কাটিয়ে তারা একে অপরের বাহুলগ্ন হয়ে ঘুমিয়ে পড়ল। স্ত্রীর গালে মিষ্টি হাসির টোল দেখা গেল।

পরদিন স্ত্রী আর স্বামীর অফিসে দেখা করতে গেল না। স্বামী কিন্তু দুপুরে খেতে এসে এ নিয়ে একটা কথাও বলল না। তবে, অন্যান্য প্রসঙ্গ নিয়ে অন্য দিনের চেয়ে অনেক বেশি কথা বলল। কথা বলার সময় স্ত্রীর দিকে খুব একটা মনোযোগ ছিল না তার, বরং কিছুক্ষণ পর মনে হল যেন সে একা-একাই কথা বলছে। সন্ধ্যার সময় ‘যসতালম’ প্রসাদের জীবন যাপনের লম্বা বর্ণনা দিয়ে স্ত্রীকে আনন্দ দেবার চেষ্টা করল স্বামী। তরুণীরা ব্যারনের সঙ্গে কীভাবে কথা বলে তা অভিনয় করে দেখালো, কাউন্টস এর ঘোড়াগুলোর নাম একে-একে বলে গেলো। কিন্তু এসবের কিছুতেই স্ত্রীকে বিশেষ উৎসাহিত মনে হলো না।

পরের দিন সন্ধ্যায় স্ত্রীকে নিজের গবেষণা প্রবন্ধের ব্যাপারে বলল স্বামী। এরপর থেকে ধীরে ধীরে সন্ধ্যায় তাদের গল্পের সময়টা খুব গুরুগম্ভীর বিষয় নিয়ে কথা বলার সময়ে পরিণত হয়ে গেল।

*** *** ***

একদিন বিকেলে স্বামী ভীষণ ক্লান্ত হয়ে বাড়ি ফিরল। স্ত্রী এতক্ষণ ড্রইংরুমে বসে অপেক্ষা করছিল, আর উল দিয়ে কাপড় বুনছিল। হঠাৎ, উলের বলটা হাত থেকে পড়ে গেল। স্বামী সে সময় সামনে দিয়ে যাচ্ছিল। উলের সুতা ছড়িয়ে তার পায়ে জড়িয়ে গেল। ভীষণ রেগে গিয়ে স্ত্রীর হাত থেকে উলে বোনা-কাপড় টেনে নিয়ে সবকিছুসমেত উলের বলটাকে লাথি দিয়ে বাইরে ফেলে দিল। এমন নির্দয় ব্যবহারে স্ত্রী চিৎকার করে উঠল। স্বামীর রাগ যেন পড়ছেই না। গলা চড়িয়ে বলল, এসব জঞ্জাল নিয়ে মাথা ঘামানোর মত সময় তার নেই। স্ত্রীকে উপদেশ দিল লাভজনক কোন কাজ করতে। পেশাজীবনে উন্নতি করতে চাইলে নিজের গবেষণা-প্রবন্ধটা যেকোন মূল্যে এবার সম্পূর্ণ করতেই হবে। সেক্ষেত্রে, স্ত্রীর উচিত হবে এসব জঙ্গল নিয়ে বসে না-থেকে কীভাবে সংসারের খরচ কমানো যায় সে চিন্তা করা।

বোঝা যাচ্ছে, পানি বেশ দূর অব্দি গড়িয়েছে।

পরদিন জলভরা চোখে স্বামীর জন্য মোজা বানাচ্ছিল স্ত্রী। স্বামী বলে বসল, “ওগুলো আরও কমদামে রেডিমেড কিনতে পাওয়া যায়। স্ত্রীর চোখে এবার জলের বাঁধ ভেঙ্গে পড়ল। সে করবেটা কী তাহলে? কাজের মেয়েটাতো বলতে গেলে বাড়ির সব কাজই করে দেয়। রান্নাঘরে গিয়ে ওর সাথে হাত লাগানোর মত যথেষ্ট কাজ রান্নাঘরে নেই। তবুও, সে সবসময় নিজের গরজেই সব ঘরদোর ঝাড় দিয়ে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে রাখে। তাহলে, তার কাছে স্বামী চায়টা কী? সে কি চায় কাজের মেয়েটাকে বিদায়। করে দেয়া হোক?

না-না তা নয়।

তাহলে সে কী চায়?

আসলে সে যে কী চায়, তা নিজেও ভালো করে জানে না। তবে, সে নিশ্চিত, কোথাও একটা কিছু গন্ডগোল হচ্ছে। না-হলে সংসার-খরচ এত বেশি হবার কথা না। বর্তমানে যেভাবে চলছে সেভাবে চলা তাদের পক্ষে। খুব বেশিদিন সম্ভব হবে না। আর, তাছাড়া এতসব চিন্তায় নিজের গবেষণা প্রবন্ধের জন্যও সে তেমন একটা সময় দিতে পারছে না। এইসব চিন্তা করতে করতেই কিছুদিন যাবৎ মাথাটা একটু গরম হয়ে আছে।

যাহোক, স্বামীর স্বীকারোক্তির পর আবারও চোখের জল আর চুম্বন পরবর্তী শান্তি স্থাপিত হল। তবে, এরপর থেকে স্বামী ঘরের বাইরে অনেক বেশি সময় দিতে থাকল। সপ্তাহে বেশ কয়েকদিন সন্ধ্যার অনেক পর পর্যন্ত বাইরে থাকে। কারণ হিসেবে ঐ একটাকেই দাঁড় করানো হয় প্রতিবার ‘অফিসের কাজ। স্বামী অবশ্য ব্যাপারটাকে ইতিবাচকভাবেই দেখে–পুরুষ মানুষের নিজের ঠাঁট বজায় রেখে চলা উচিত; ঘরে বেশি থাকলে নিজের দাম থাকে না, সবাই তখন সস্তা মনে করে এক সময় অবজ্ঞা করতে শুরু করে।

এভাবেই একটি বছর পার হল। তখনও পর্যন্ত তাদের সন্তান হবার কোন লক্ষণ দেখা যাচ্ছিল না। স্বামীর আজকাল একটা কথা প্রায়ই মনে হয়: আগে যে বিভিন্ন মেয়ের সাথে পরিচয় ছিল এখন স্ত্রীর সাথে সম্পর্কটা অনেকটা সেরকমই হয়ে গেছে। তবে, পার্থক্য শুধু একটাই–যেটাকে নিয়ে সংসার করছে সেটা নিতান্ত নিবোধ, আর বেশি খরুচে।

স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে এখন বলতে গেলে কোন কথাই হয় না। যতটুকু হয়। সেটা নিতান্তই প্রয়োজনীয় সাংসারিক কথাবার্তা। স্বামীর মনে হয়, “এর। মাথায় বুদ্ধি বলতে কিছু নেই। এর সঙ্গে কথা বললে মনে হয়, যেন নিজের সাথেই কথা বলছি!” স্ত্রীর চোখের সৌন্দর্য, যেটা নিয়ে একসময় খুব উচ্ছ্বাস। ছিল, সেই সৌন্দর্যেরও সে একটা ব্যাখ্যা দাঁড় করিয়েছে, “ওটা আসলে মনের ভুল। ওর চোখের তারাগুলো একটু বড় বলেই ও রকম মনে হয়; আদতে, ওর চোখে কোন গভীরতাই নেই, যেমন নেই বুদ্ধিতেও।”

স্বামী একসময় প্রকাশ্যেই স্ত্রীর প্রতি তার এমন অনুভূতির কথা বলতে শুরু করল। স্ত্রীর প্রতি ভালোবাসার কথাগুলো এমনভাবে বলত যেন সেটা বহু আগেই ক্ষয়ে গিয়েছে। অবশ্য, যখনই এমন কথা বলত তখনই সে হৃদয়ে একরকম যন্ত্রণা অনুভব করত। একটা অস্বস্তিকর, নির্মম, অনুশোচনাহীন-যন্ত্রণা; যে যন্ত্রণার কোন নাম নেই।

তবে, এসব নিয়ে সে বেশ গভীরভাবে চিন্তা করেছে। একদিন সব কিছুই শেষ হয়ে যায়, এই হলো চিন্তা-পরবর্তী উপলব্ধি। তথাপি, সে আরও চিন্তা করতে থাকলো। সবকিছুই যদি একসময় রংহীন হয়ে যায়, তাহলে স্ত্রীর প্রিয় গানগুলোর ব্যাপারেই বা তার ব্যতিক্রম হবে কেন? “ঐ একই গান কাউকে যখন বছরে তিনশ পয়ষট্টি দিন শুনতে হয়, তখন তা পুরনো হতে বাধ্য। কিন্তু তাহলে কি এ কথাও সত্য যে, আমাদের ভালোবাসাও মারা গেছে?” স্ত্রীতো সে রকমই বলে। “না-না-না কিছুতেই না… অবশ্য…, হতেও পারে। আমাদের বিয়েটাতো এখন শুধু একটা বিশ্রী চুক্তি হয়েই আছে। আমাদেরতো কোন সন্তানই নেই।”

এ রকম নানা সাত-পাঁচ ভেবে, স্বামী একদিন এক বিবাহিত বন্ধুর সাথে এসব নিয়ে কথা বলার সিদ্ধান্ত নিল। হাজার হলেও তারা একই গোত্রভুক্ত!

–বিয়ে করেছ কতদিন হল?

–ছ’ বছর।

–আচ্ছা! এই দীর্ঘ সময়ে বৈবাহিক বিষয়ে কখনো বিরক্ত হওনি?

–হতাম, প্রথম দিকে হতাম। ছেলেপুলে হবার পর সেসব কেটে গেছে।

–তাই নাকি? তাহলে তো ছেলেপুলে না-থাকায় আমরা বেশ দুর্ভাগা মানতে হবে।

–উঁহু! এ তোমাদের দোষ নয় দোস্ত! বউকে বলো ডাক্তার দেখাতে।

বন্ধুর সঙ্গে আলাপ শেষে বাড়ি ফিরে বহুদিন পর স্ত্রীর সঙ্গে আন্তরিকভাবে কথা বলল স্বামী। স্ত্রীকে সবকিছু বুঝিয়ে বলার পর সে ডাক্তার দেখাতে রাজি হল।

দু’সপ্তাহ পর বাড়িতে এক বিরাট পরিবর্তন দেখা গেল।

পুরো বাড়িতে যেন কী এক চঞ্চলতা ভর করেছে। ড্রইংরুমের টেবিলের ওপরে, এখানে-ওখানে, বাচ্চাদের পোশাক আলুথালু হয়ে পড়ে থাকে। হঠাৎ করে কেউ ঘরে ঢুকলে সেগুলো গোছানোর জন্য হুড়োহুড়ি পড়ে যায়। পরে যখন দেখা যায়, মানুষটা অন্য কেউ নয়, তার স্বামী, তখনই সেগুলো আবারও যথাস্থানে ফিরে আসে! শুরু হয় নানা জল্পনা-কল্পনা। বাচ্চার জন্য নাম ঠিক করতে হবে। ওরা মোটামুটি নিশ্চিত, ছেলে সন্তানই হবে। সুতরাং, ছেলেদের নামের তালিকা তৈরি করা হল। অবশ্য, আরও অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ এর মধ্যে করতে হবে–স্ত্রীকে নিয়মিত ডাক্তার দেখাতে হবে, মেডিকেল বই বানাতে হবে, বাচ্চার খেলনা-দোলনা কিনতে হবে, আরও কত কি…

*** *** ***

অবশেষে সন্তানের আগমন ঘটল। সত্যিই একটা ছেলে হল। স্বামী যখন দেখল তার ছোট্ট বানরছানাটি(!) স্ত্রীর বুকের দুধ পান করছে তখন একরকম শ্রদ্ধার দৃষ্টিতে তাকিয়ে স্ত্রীর মধ্যে মাতৃত্ব আবিষ্কার করল সে। যখন দেখল, স্ত্রীর বড় বড় চোখ দুটি পরম মমতায় সন্তানের দিকে তাকিয়ে আছে তখন মনে হল, স্ত্রী যেন সন্তানের মুখে চেয়ে ভবিষ্যত দেখতে পাচ্ছে। আর ঠিক তখনই সে নতুন করে অনুভব করল, আসলেই স্ত্রীর চোখে গভীরতা আছে। সে গভীরতা এতটাই বেশি যে স্বামীর সমস্ত ধর্মকাহিনি আর নাটক দিয়েও তা পরিমাপ করা সম্ভব নয়। স্বামীর সমস্ত পুরনোভালাবাসা, প্রিয় পুরনো ভালবাসা, নতুন স্ফুলিঙ্গের মধ্য দিয়ে জ্বলে উঠল যেন। নতুন সে স্কুলিঙ্গে নতুনতর একটা কিছু যোগ হয়েছে, যার খানিকটা সে অনুভব করেছে মাত্র, পুরোপুরি এখনও বুঝে উঠতে পারেনি!

“ইস! স্ত্রী যখন এটা-সেটা নিয়ে ঘরের মধ্যে ছুটোছুটি করে তখন ওকে কী চমৎকার দেখায়! আর, বাচ্চার যেকোন সমস্যা কী অসাধারণ বুদ্ধিমত্তার সাথেই না সমাধান করে!” সত্যি, তার স্ত্রী বুদ্ধিমতী বলতে হবে!

ওদিকে স্বামীর মধ্যেও কিছু পরিবর্তন দেখা গেছে। ইদানিং সে নিজেকে একজন দায়িত্ববান পুরুষ বলে ভাবে। ব্যারনের ঘোড়া আর কাউন্টসদের ক্রিকেট খেলার গল্প না-করে বরং সারাক্ষণ ছেলের গল্পই করে; সম্ভবত একটু বেশিই করে! মাঝে মাঝে সন্ধ্যার সময় যখন বাইরে যেতে হয়, সেই পুরো সময়টা মন পড়ে থাকে ঘরের মধ্যে। অবশ্য, এই কারণে নয় যে স্ত্রী বসে তার জন্য অপেক্ষা করছে, বরং, এই ভেবে যে, স্ত্রী এখন আর একা বসে অপেক্ষা করে না! বাড়িতে ফিরে দেখে মা-ছেলে দুজনেই পরম নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়েছে। বাচ্চাটাকে মাঝে মাঝে একটু ঈর্ষাই হয়। নিজে বাইরে থাকার সময় কেউ একজন বাড়িতে একা বসে অধীরভাবে অপেক্ষা করছে এই চিন্তাটার মধ্যে এক ধরনের অদ্ভুত আনন্দ আছে, যে আনন্দটা থেকে সে এখন বঞ্চিত। তার কারণতো ওই বাচ্চাটাই।

যা হোক, স্বামী এখন চাইলে বিকেলে ঘুমাতে পারে। কারণ, তার ঘুমানো বা না-ঘুমানোতে কারো কিছু যায় আসে না। সে অফিসের কাজে বাইরে যাওয়ামাত্র পিয়ানো বের করে আনা হয়। সেই পুরনো ‘বুনো গোলাপ’ গানটা বাজানো হয়। সে গানে আবার নতুনত্ব এসেছে; কারণ, ছোট্ট হারল্ডতো এ গান আগে শোনেনি। তাছাড়া, অনেক দিন বাদে শোনার কারণে হারল্ডের মায়ের কাছেও গানটা এখন নতুন বলে মনে হয়।

স্ত্রীর এখন উল দিয়ে জামাকাপড় বোনার মত যথেষ্ট সময় নেই। ঘরে। এখন এমনিতেই রেডিমেড কেনা অসংখ্য ছোট-ছোট জামাকাপড় রয়েছে। ওদিকে, স্বামীও তার গবেষণাপ্রবন্ধে অতটা সময় দেয় না–“থাক, ওটা না হয় হারল্ড বড় হয়ে করবে।” প্রায় সন্ধ্যাতেই স্বামী-স্ত্রীকে পাশাপাশি বসে গল্প করতে দেখা যায়। তবে, এটাকে এখন আর গল্প না বলে আলোচনা। বলাটাই ভালো। কারণ, স্ত্রীও এখন কথা বলায় অংশগ্রহণ করে। সে জানে, কোন্ বিষয় নিয়ে কীভাবে কথা বলতে হবে। আর, এটাও স্বীকার করে, আগে সে নিতান্ত বোকাসোকা একটা মেয়ে ছিল–ধর্মকাহিনি কিংবা নাটক সম্পর্কে কোন জ্ঞান না-থাকায় চুপচাপ বসে থাকত। স্বামীকে বহুবার বলারও চেষ্টা করেছে, কিন্তু স্বামী সে কথায় কান দেয়নি। স্বামী অবশ্য এখনও কান দেয় না!

স্বামী-স্ত্রী এখন একসাথে তাদের প্রিয় গানটা গায়। ফোকলা দাঁতের হাসি দিয়ে ছোট্ট হারল্ডও তাতে অংশ নেয়। সে হাসি যেন নতুন ছন্দ যোগায়। ছন্দের তালে ওরা গা এলিয়ে দেয়, সেই তালেই দোলা দেয় দোলনাতে। পুরনো গানটা যেন ভীষণ জীবন্ত হয়ে উড়ে বেড়ায় ঘরময়…

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *