পরিবর্তনের প্রচেষ্টায়
ব্যাপারটা তার মধ্যে বেশ ক্ষোভের জন্ম দিয়েছে। দীর্ঘদিন বিচার-বিশ্লেষণ করে আমাদের গল্পের নায়িকার মনে হয়েছে–মেয়েদের আসলে দেখাশোনা করে বড় করা হয় শুধুমাত্র তাদের ভবিষ্যৎ স্বামীদের গৃহপরিচারিকা হবার জন্য! তাই, এ-জাতীয় পরিস্থিতি এড়াতে সে এখন থেকেই একটা ছোটখাটো ব্যবসা শুরু করেছে, যাতে যেকোন পরিস্থিতিতে নিজের পায়ে ভর করে থাকা যায়। ব্যবসাটি ছোট হলেও চমৎকার–কৃত্রিম ফুল বানিয়ে বিক্রি করা। এর যাবতীয় যোগাড়যন্ত্র সে নিজেই করে।
অন্যদিকে, আমাদের নায়কও একটা বিষয় নিয়ে বেশ হতাশ। সে লক্ষ করেছে, মেয়েরা অপেক্ষাই করে থাকে যেন স্বামীর হাতে নিজেকে সঁপে দিয়ে হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকা যায়। এই-নিয়ে তার আক্ষেপেরও শেষ নেই। তাই সে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, এমন মেয়েকে বিয়ে করবে যে নিজে রোজগার করে, যে স্বাধীনচেতা, আত্মমর্যাদায় বিশ্বাসী। এমন কোন মেয়েকেই সে গ্রহণ করবে জীবনসঙ্গী হিসেবে, গৃহপরিচারিকা হিসেবে নয়। অতএব, দুজনের সাক্ষাৎ হওয়াটা বোধহয় ভাগ্যই ঠিক করে রেখেছিল।
এবারে চলুন বিস্তারিত জানা যাক–আমাদের নায়ক পেশায় একজন চিত্রকর, আর নায়িকার কথাতো আগেই বলেছি। এ বিপ্লবী চিন্তাভাবনা করার সময়টা তারা দুজনেই প্যারিসে থাকতো। অর্থাৎ, একই শহরনিবাসী। শীঘ্রই ভাগ্য তাদের সাক্ষাৎ ঘটালো, এবং পরিচয় থেকে পরিণয়ে গড়াতে খুব বেশি সময় লাগলো না। তবে, তাদের বিয়ে এবং বিয়ে-পরবর্তী জীবন বেশ ভিন্নরকম হল–তিন রুমের একটা ঘর ভাড়া নিয়ে মাঝের রুমটা ঠিক। করা হল স্টুডিও হিসেবে। ডানদিকে স্বামী, আর বামদিকে স্ত্রীর রুম। অর্থাৎ, স্বামী-স্ত্রীর এক-রুমে, এক-খাটে থাকার রীতিকে ঝেটিয়ে বিদায়। করা হল–“উহ! জগতে এমন জঘন্য রীতি বোধহয় আর দ্বিতীয়টি নেই! এই একসাথে থাকার রীতি থেকেই দুনিয়ার যত পাপাচার, যত দুষ্কর্মের শুরু!” স্বামী-স্ত্রী পৃথক রুমে থাকায় আরেকটা বিশ্রী ব্যাপারের অবসান
হলো–একই রুমে জামা-কাপড় পরা কিংবা খোলার সমস্যা আর রইল না। এসব ব্যাপারে দুজনেরই অভিন্ন মত–“স্বামী-স্ত্রীর পৃথক রুম থাকাই ভালো। যার-যার মত স্বাধীনভাবে থাকা যায়। বিশেষ দরকারে দেখা করার জন্য নিরপেক্ষ স্থান হিসেবে স্টুডিওতো আছেই!”
*** *** ***
বাড়িতে কোন কাজের লোক ছিল না। বেশিরভাগ কাজ দুজন মিলেমিশে করে ফেলত। সকাল-সন্ধ্যায় এক বুড়ি ঠিকা-ঝি এসে টুকিটাকি কাজগুলো করে দিয়ে যেত। সবমিলিয়ে বেশ ভালোই সময় কাটছিল ওদের।
নিন্দুকেরা বলে,”কিন্তু ছেলেপুলে হলে কী করবে, বাছাধন?”
–আহাম্মক! ছেলেপুলে কখনো হবেই না!
স্বামী-স্ত্রী এভাবেই দিন গুজরান করছিলো। স্বামী সকালবেলা বাজারে গিয়ে সদাইপাতি করে, ঘরে ফিরে কফি বানায়। স্ত্রী ঘরদোর গোছগাছ করে রাখে। তারপর বেলা হলে যে-যার কাজে লেগে পড়ে। কাজ করতে-করতে ক্লান্ত হয়ে পড়লে নিজেদের মধ্যে খানিক গল্পগুজব করে নেয়। কোনও আজেবাজে বিষয় নিয়ে তারা কখনোই গল্প করে না; বরং, বেশ উচ্চমার্গীয় আলাপ চলে তাদের মধ্যে, একে-অন্যকে নানা উপদেশ দেয়। মাঝে হয়তো কিঞ্চিৎ হাসি বিনিময়। দুপুরে স্বামী গিয়ে চুলা জ্বালায়, স্ত্রী শাকসবজি কাটে। যেদিন গরুর গোশত থাকে, সেদিন স্বামী রান্না করে, আর স্ত্রী মুদি দোকানে গিয়ে টুকিটাকি জিনিস কিনে আনে। ঘরে ফিরে স্ত্রী খাবার টেবিল গোছায়, স্বামী খাবার পরিবেশন করে।
নিন্দুকেরা যা-ই বলুক, ওদের মধ্যে স্বামী-স্ত্রীসুলভ ভালোবাসাও কিন্তু আছে–রাত্রিবেলায় ওরা একে-অন্যকে ‘শুভরাত্রি জানিয়ে যে-যার রুমে চলে যায়! দরজায় তালা দেয়ার কোন বন্দোবস্ত নেই। ফলে, স্বামীকে মাঝে মাঝেই রাত্রিবেলায় স্ত্রীর রুমে যেতে দেখা যায়। তবে, খাটগুলো দুজন থাকার অনুপযুক্ত হওয়ায়, ভোরবেলায় স্বামীকে আবার তার নিজের রুমেই পাওয়া যায়! সকালে স্ত্রীর রুমের দরজায় স্বামীর মৃদু কড়াঘাত–“ওগো! শুভ সকাল। আজ কেমন লাগছে গো?”
–বেশ ভাল গো! তোমার কেমন লাগছে?
সকালে নাস্তার টেবিলে দেখলে মনে হয়, যেন আজই ওদের প্রথম দেখা হল!
সন্ধ্যাবেলায় সাধারণত ওরা বেড়াতে বের হয়। আশেপাশের মানুষজনের বাসায় যায়, গল্প করে। দুজনের বোঝাপড়াটা চমৎকার। একজন-অন্যজনের জন্য ছোটখাটো অনেক কিছুই ছাড় দেয়। যেমন, স্বামী যেদিকেই বেড়াতে নিয়ে যাক স্ত্রী তাতে সায় দেয়, সিগারেটের গন্ধ নিয়ে কোন অভিযোগ করে না। আবার, স্বামীও স্ত্রীর অনেক ছোটখাটো বদ অভ্যাসকে মেনে নেয়। এভাবে, সবার কাছে ওরা ‘আদর্শ দম্পতি’ বলে স্বীকৃত হল। এমন সোনায়-সোহাগা জুটি খুঁজে পাওয়া ভার! তবে, স্ত্রীর বাবা-মা কিন্তু এসব নিয়ে বেশ নাখোশ। তারা শহরের অদূরে গ্রামে থাকেন, মাঝে মাঝে মেয়েকে চিঠি লিখেন। চিঠিগুলোর বক্তব্য আপাতদৃষ্টিতে খানিকটা অশোভন বলেই মনে হয় তারা নাতি-নাতনীর মুখ দেখতে চান প্রতিটি চিঠিতেই তারা লুইসাকে মনে করিয়ে দেন, বিয়ে নামক সামাজিক প্রথাটি টিকে থাকে সন্তান জন্মদানের কারণেই; সন্তানের সুখই বাবা-মায়ের সুখ, সন্তানাদি না-থাকলে বাবা-মা কিছুতেই সুখী হতে পারেন না। কিন্তু লুইসার এতে ভীষণ আপত্তি। তার মতে, এসব ধ্যানধারণা এখন সেকেলে হয়ে গেছে। তবে মা-ও দমবার পাত্রী নন। তিনি উল্টো বলে বসেন, “তোমাদের নতুন ধ্যানধারণাতো বাপু মানব প্রজাতিটিকেই বিলুপ্ত করে দেবে!” এসব কথায় লুইসার বিশেষ কোন ভাবান্তর হয় না। সে এগুলোকে পাত্তাই দেয় না। সে আর তার স্বামী সুখে আছে, এই প্রথম জগৎ কোন সুখী দম্পতি দেখল–এ নিয়ে জগতের তো হিংসা হবেই।
জীবন বয়ে চলে মসৃণভাবে। কেউ কারো প্রভু নয়, দাসও নয়; তারা সমান-সমান। সংসারের খরচাপাতি দুজনে সমানভাবে বহন করে। আজ হয়ত স্বামী বেশি রোজগার করল, তো কাল স্ত্রী বেশি করে; কিন্তু শেষ পর্যন্ত সংসার খরচে তাদের অবদান ঐ সমান-সমান।
*** *** ***
লুইসার জন্মদিন!
সকালবেলা ঠিকা-ঝি এসে এক হোড়া ফুল, আর নানান আঁকিবুকি করা নকশাদার একটা চিঠি হাতে দিয়ে ঘুম থেকে ডেকে তুলল। চিঠিতে লেখা–
“আমার ভালোবাসার ফুলকুঁড়িকে অনেক অনেক শুভেচ্ছা। অনাবিল আনন্দের এই দিনটি প্রতি বছর বয়ে আনুক আরও বেশি প্রশান্তি। আশা করি, আমার ফুলকুঁড়ি তার আনাড়ি আঁকিয়েকে চমৎকার একটা ব্রেকফাস্টে সঙ্গ দিয়ে ধন্য করবে–এখনই।”
চিঠি পেয়ে খুশিতে ডগমগ হয়ে স্বামীর রুমের দরোজায় কড়া নাড়ল লুইসা।
–কাম ইন…
খাটের ওপর নাস্তা সাজিয়ে দুজন একসাথে নাস্তা করল। ঠিকা-ঝিকে আজ সারাদিনের জন্য বাসায় রেখে দিয়ে নিজেদের মত করে দিনটা কাটাবে ওরা। “আহ! কী চমৎকার একটা দিন!”
এভাবেই দুটি বছর কেটে গেল। তবে, ওদের দেখে কিন্তু তা বোঝার উপায় নেই। এই দু’বছরে ওদের সংসারে কখনোই সুখের কমতি হয়নি। কে বলেছে বিবাহিত জীবন সুখের হয় না? আগের প্রজন্মের সবাই ভুল কথা বলেছে! মনীষীদের বাণী সব বানোয়াট! ওদের বিয়েই হচ্ছে আসল বিয়ে।
*** *** ***
দু’বছরেরর মাথায় স্ত্রী হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ল। বারবার বমি করতে থাকল। তার ধারনা, হয় কোন খাবার, না-হয় কোন জিনিসপত্র থেকে জীবাণু সংক্রমণ হয়েছে। স্বামীও সায় দিল,”হ্যাঁ, হ্যাঁ জীবাণুই হবে।” কিন্তু তারপরেও কী যেন কী ঠিক নেই বলে মনে হচ্ছে। তাহলে কি ঠান্ডা লাগল? সর্দিগর্মি? নানান সন্দেহে স্বামী-স্ত্রীর দিনাতিপাত। এদিকে, স্ত্রীর পেটটা দিনদিন একটু-একটু ফুলে যাচ্ছে যেন মনে হচ্ছে! তবে কি? …
–তবে কি পেটে টিউমার হলো?
ভয়ে আতঙ্কে ঘুম হারাম হলো।
স্ত্রী অবশেষে ডাক্তারের শরণাপন্ন হল। কিন্তু ডাক্তারের কথা শুনে কান্না করতে-করতে বাড়ি ফিরল। হ্যাঁ, ঠিকই আছে, পেটের ভেতরের জিনিসটা দিন-দিন বড় হচ্ছে। সময়ে আরও বড় হবে। তারপর, একদিন আলোর মুখ দেখবে সেটা। ধীরে ধীরে পরিণত হবে। এরপর, একদিন হয়তো বংশধরও সৃষ্টি করবে–“মা হতে চলেছে লুইসা!”
স্বামীর অনুভূতি কিন্তু সম্পূর্ণ ভিন্ন হল। একরকম অদ্ভুত আনন্দ হল তার। ক্লাবে গিয়ে বন্ধুদের কাছে খুব গর্ব করে বেড়ালো। তবে স্ত্রীর কান্না যেন থামতেই চায় নাঃ নিজেকে নিয়ে ভীষণ দুঃশ্চিন্তা হল, এখন তার অবস্থান নীচু হয়ে যাবে যে! কিছুদিন পর থেকেই তো আর উপার্জন করতে পারবে না। তখন যে তাকে স্বামীর ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়তে হবে! তাছাড়া, কাজ করতে পারবে না বলে কাজের লোকও তো রাখতে হবে। অর্থাৎ, কাজের লোকের ওপরও এরকম নির্ভরশীলতা আসবে। “উফ! এত দিনের সমস্ত চিন্তা-চেতনা, ধ্যানধারণা এভাবে ধ্বংস হয়ে যাবে?”
ওদিকে, খবর পাওয়ার পর থেকে অনবরত মায়ের চিঠি আসতে লাগলো। প্রতিটি চিঠিতে তিনি ঘুরেফিরে একই কথা ববাঝাতে চেষ্টা করেন–“বিয়ে হচ্ছে ঈশ্বরের আশীর্বাদ, সন্তান প্রতিপালনে সেটা পূর্ণতা পায়। পিতা-মাতার নিজেদের সুখ এখানে বিশেষ ধর্তব্য নয়।” হুগোও (স্বামী) বারবার অনুরোধ করতে থাকল, স্ত্রী যেন আয়-উপার্জনের ব্যাপারে কখনো মন ছোট করে না থাকে। শিশুর দেখাশোনার জন্য সে যা করবে তা কি কাজ নয়? একে কি টাকা দিয়ে মূল্যায়ন করা সম্ভব, না উচিত? টাকা-পয়সাতো কাজের মাধ্যমেই আসে। তাহলে কি এ-সংসারে তার অবদানকে কোনভাবে খাটো করা যায়? কখনোই না; বরং আগের মত তারা সমানে-সমানই থাকবে।
তারপরও স্বামীর ওপর নির্ভরশীলতার কথাটা লুইসা কোনওভাবেই মানতে পারছিল না। কিন্তু কোল আলো করে আসা শিশুর কান্না কানে যাওয়ামাত্র অন্য সব কিছুই সে ভুলে গেল।
*** *** ***
আগের মত ‘স্ত্রী’ আর ‘বন্ধু’ দুই পরিচয়েই রইলো লুইসা। সেইসাথে একটা নতুন পরিচয় যোগ হল–সে এখন সন্তানের মা! হুগোর কাছে মনে হল, শেষের পরিচয়টিই সবচেয়ে বেশি মূল্যবান!