রোমিও অ্যান্ড জুলিয়া
এক সন্ধ্যায় গানের স্বরলিপি হাতে বাড়ি ফিরে উচ্ছ্বসিত স্বামী তাঁর স্ত্রীকে বললেন,
–চল আজ রাতের খাবারের পর আমরা গান করি!
–হুম! তা না-হয় হল; কিন্তু তোমার হাতে ওটা কী?
স্বামী গর্বের সাথে ঘোষণা করলেন,
–‘রোমিও অ্যান্ড জুলিয়া’র পিয়ানো ভার্সন। চেনো এটা?
–“অবশ্যই! কিন্তু কাউকে কখনো বাজাতে শুনেছি বলে মনে পড়ছে না।”
স্বামী এবারে আরও উচ্ছ্বসিত হলেন–“ওহহহ! তুমি জানো না কী অসাধারণ এটা! এক সময় এটা ছিল আমার স্বপ্নের মত, আমার ঘোরের মত। কিন্তু মজার ব্যাপার কি জানো, আমি মাত্র একবারই এটা শুনেছি, তাও প্রায় কুড়ি বছর আগে।
রাতের খাবারের পর বাচ্চাদের ঘুমাতে পাঠানো হল। পুরো বাড়িতে একরকম নিস্তব্ধতা নেমে এল। এর মাঝেই পিয়ানোর ওপর এক চিলতে আলো দেখা গেল। লিথোগ্রাফের কাগজে ছাপানো শিরোনামে চোখ বোলালেন স্বামী,
–‘রোমিও অ্যান্ড জুলিয়া! গাউনড এর সেরা সৃষ্টি। এটা গাওয়া আমাদের জন্য খুব মুশকিল হবে বলে মনে হয় না।
স্বামী গলা খাকারি দিলেন, আর স্ত্রী উচ্চগ্রাম থেকে বাজাতে শুরু করলেন। ডি মেজর’ থেকে গাওয়া শুরু হল।
–“ওয়াও! অসাধারণ! তাই না?” স্বামীর চোখে-মুখে খুশির ঝিলিক।
–“হুম, হবে হয়তো!” স্ত্রীকে খুব একটা উচ্ছ্বসিত মনে হল না।
–এখন কিন্তু যুদ্ধের বাজনা বাজাতে হবে! এই অংশটুকুর কোন তুলনাই হয় না। আমার মনে আছে, রয়েল থিয়েটারে একটা কোরাসে এটা শুনেছিলাম।
পিয়ানোতে এবার যুদ্ধংদেহী আওয়াজ বাজল।
–“বলেছিলাম না! এখানে যুদ্ধের মার্চ বাজবে।” স্বামী এমনভাবে বলছেন যেন ‘রোমিও অ্যান্ড জুলিয়া তিনি নিজেই লিখেছেন!
–“জানি না!” স্ত্রীর খাপছাড়া উত্তর। “আমার কাছে তো নিছক পিতলের ঝনঝনানি মনে হচ্ছে!”
স্বামী বেচারা এখনো সুরের তালে মগ্ন আছেন। চতুর্থ দৃশ্যে অপেরা অংশটা শুনতে কেমন লাগবে তা-নিয়ে ভাবছেন। দীর্ঘক্ষণ পর অপেরার অংশ পাওয়া গেল।
–এইতো, এইতো এখানে অপেরা বাজবে।
বড় করে দম নিয়ে তিনি অপেরায় গলা মেলালেন। ট্র্যাম, ট্রাম, ট্রা ট্যাম-ট্যা ট্র্যাম, ট্রাম বেজ বাজতে থাকলো।
বাজনা শেষ হবার পর স্ত্রী মন খারাপ করে বললেন, “কিছু মনে না করলে একটা কথা বলবো? আমার কিন্তু এটাকে খুব বিশেষ কিছু মনে হল না।” এইবেলা স্বামী হতাশ হলেন। স্বীকার করতেই হল, বাজনা শুনে তাঁর নিজের কাছেও ফাঁপা কলসির আওয়াজের মত মনে হয়েছে।
–“বাজানোর সময়ই আমি বুঝেছি” স্ত্রীর সরল স্বীকারোক্তি। “সত্যি বলতে কি, এগুলোকে বেশ পুরনো মনে হল!”
–“ভাবতে অবাক লাগছে, এর মধ্যেই গাউন্ড পুরনো হয়ে গেল!” স্বামীও সহমত পোষণ করলেন। তারপর, একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে স্ত্রীকে অনুরোধ করলেন, “তুমি কি আর কিছুক্ষণ বাজাতে পারো?” পরক্ষণেই তাঁর চোখ-মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল: “তারচেয়ে বরং চল তিন তালের ‘ক্যাতিনা বাজানো যাক। মনে আছে? উহ! উঁচু স্কেলের অংশটুকু একেবারে যেন স্বর্গীয়!”
কিন্তু এবারে বাজনা শেষ হবার পর স্বামীকে আগের চেয়েও বেশি বিষণ্ণ মনে হল। স্বরলিপিগুলো একপাশে সরিয়ে রাখলেন তিনি, যেন এভাবে অতীতের দরজাকে বন্ধ করতে চাচ্ছেন। “চল একটু বিয়ার খাওয়া যাক”, বিমর্ষ স্বামীর প্রস্তাব। দুজন দুটো চেয়ার টেনে টেবিলের পাশে বসে বিয়ার খেতে লাগলেন।
কিছুক্ষণ পর স্বামী প্রথম মৌনতা ভঙ্গ করলেন।
–“মানতে কষ্ট হচ্ছে, আমরা বুড়ো হয়ে গেছি। এতক্ষণ যেন আমরা ‘রোমিও অ্যান্ড জুলিয়া’র সঙ্গে পাল্লা দিলাম, কে আগে বুড়িয়ে যেতে পারি! কুড়ি বছর আগে প্রথম শুনেছিলাম। তখন আমি টগবগে যুবক। চারপাশে কত বন্ধুবান্ধব ছিল, কত হাসি-আনন্দ-উচ্ছ্বাস। ঠোঁটের ওপর সে-বার প্রথম গোঁফের রেখা দেখা দিল, কলেজের নতুন ক্যাপ মাথায় কী গর্ব হচ্ছিল আমার! মনে হয় যেন, এইতো সেদিন–ফ্রীড, ফিল আর আমি মিলে অপেরায় গেলাম। তার মাত্র কিছুদিন আগে আমরা ‘ফস্ট’ শুনেছিলাম, আর সেবার ‘গাউন্ড’ শুনেতো রীতিমত ভক্ত বনে গেলাম। কিন্তু রোমিও আমাদের সব প্রত্যাশাকে ছাড়িয়ে গেল। এক বুনো উদ্দামতা যেন গ্রাস করেছিল আমাদের! আর এখন…?” স্বামীর বুক থেকে একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল।
“ওরা দুজনেই এখন মৃত। মারা যাবার সময় ফ্রিড ছিল প্রাইভেট সেক্রেটারি। খুব উচ্চাভিলাষী ছিল। ফিল ছিল মেডিকেলের ছাত্র। আর হতভাগ্য আমি! স্বপ্ন দেখেছিলাম মন্ত্রী হবার, অথচ এখন রেজিমেন্টের বিচারকগিরি করি। সময় যে কত দ্রুত বয়ে চলে, চোখেই পড়ে না। তবে আমার চোখের নিচের কালি যে আরও গম্ভীর হয়েছে, কানের পাশের চুলে যে পাক ধরেছে, তা কিন্তু বেশ ভালোভাবেই চোখে পড়ে! কবরের দিকে এতটা পথ পাড়ি দিয়েছি কখনো লক্ষই করিনি।”
–হুম! আসলেই তাই। আমরা বুড়িয়ে গেছি। আমাদের সন্তানদের দেখেই সেটা বোঝা যায়। তোমার লক্ষণগুলো যে আমার মধ্যেও দেখা দিয়েছে, তা নিশ্চয় খেয়াল করেছ? তুমি অবশ্য সব সময়ই এসব এড়িয়ে যেতে চাও।
–না-না ওভাবে বলো না।
–“এটাই যে সত্যি, কী করব বলো? আমি খুব ভালোভাবেই জানি, আমার সৌন্দর্য হারিয়ে যাচ্ছে, চুল পাতলা হয়ে যাচ্ছে; খুব শীঘ্রই হয়তো সামনের দাঁতও পড়ে যাবে।” স্ত্রীর এমন বিষণ্ণতার মাঝে স্বামী একটু বাধা দিলেন,
–চিন্তা করে দেখ, সবকিছু কেমন দ্রুত বয়ে যায়। আমার কী মনে হয় জানো? ইদানীং মানুষগুলো খুব দ্রুত বুড়িয়ে যাচ্ছে, আগে এমনটা হত না। বাবার বাড়িতে দেখেছি, হরহামেশা ‘হেইডেন’ আর ‘মোজার্ট’ বাজানোনা হত, অথচ বাবার জন্মেরও বহু আগে এরা মারা গেছেন। আর এখন দেখ! এই ক’দিনেই গাউন্ড সেকেলে হয়ে গেল! ছেলেবেলার পছন্দগুলোকে পুরনো হয়ে যেতে দেখা যে কত কষ্টের, বলে বোঝানো যাবে না। তার চেয়েও বেশি কষ্ট হয় যখন মনে হয়, আমি নিজেই পুরনো হয়ে যাচ্ছি।”
কথাগুলো বলে, স্বামী একবার একটু দাঁড়িয়ে আবার পিয়ানোতে বসলেন। স্বরলিপিটা হাতে নিয়ে এমনভাবে পাতা ওল্টাতে থাকলেন যেন টেবিলের ড্রয়ারে সযত্নে রাখা কোন প্রিয় জিনিস, প্রিয়জনের একগোছা চুল, শুকিয়ে যাওয়া ফুল কিংবা সুতোর কাঠিম খুঁজছেন। স্বরলিপির কাগজটার কালো অক্ষরগুলো তাঁর দুচোখ আটকে দিল–ওগুলো যেন অক্ষর নয়, যেন কতগুলো ছোট্ট পাখি দোল খাচ্ছে! কিন্তু বসন্তের গান কেন শোনা যাচ্ছে না? সেই তারুণ্যের উদ্বেলতা, ভালবাসার গোলাপ ফোঁটা গান, কোথায় হারিয়ে গেল?
হঠাৎ করেই অক্ষরগুলো যেন ঝাপসা হয়ে এল–খুব অদ্ভুত, অপরিচিত ঠেকলো ওদের। যেন জীবন-বসন্তের সাজানো বাগান আগাছায় ছেয়ে গেল! হ্যাঁ, তাই-ই হয়েছে–পিয়ানোর গায়ে ধূলো জমেছে, কাঠের বোর্ড শুকিয়ে গেছে, আর স্বামী-স্ত্রীর অনুভূতিগুলো ভোঁতা হয়ে গেছে। সমস্ত রুমটায় একটা দীর্ঘশ্বাস প্রতিধ্বনিত হল। শূন্য-হৃদয় নিংড়ানো ভীষণ ভারী একটা দীর্ঘশ্বাস, একটা ভীষণ নীরবতা আচ্ছন্ন করল রুমটাকে।
-”তবুও সবকিছুই এক! কী অদ্ভুত!” কী মনে করে যেন, স্বামী হঠাৎ করেই কথাগুলো বলে উঠলেন। “আমাদের গানে, আমাদের বাজনায় সেই ‘ভূমিকা’র অংশটুকু করা হয়নি। আমার স্পষ্ট মনে আছ, হার্প আর কোরাসের সাথে চমৎকার একটা ভূমিকা’র অংশও ছিল। সুরটা অনেকটা এরকম…” গুনগুন করে সুর ভাজলেন তিনি। মনে হচ্ছে, যেন কোন সংকীর্ণ উপত্যকা বেয়ে শীর্ণ এক নদীর ধারা নেমে আসছে। নোটের পরে নোট আসছে ঠোঁটের কিনারায়। ধীরে-ধীরে সেই নোট বেয়ে এক চিলতে হাসির রেখাও উঁকি দিয়ে গেল। স্বামীর চেহারার আচ্ছন্নতা উধাও হতে থাকল। পিয়ানোতে হাত লাগলো তাঁর। সেই হাতের ছোঁয়ায়, যত্নে-বেড়ে ওঠা প্রাণবন্ত তারুণ্য যেন সুরের খাঁদ থেকে উঠে এসে পিয়ানোর বুকে ভালোবাসার বান জাগালো। বেশ জোরালো গলায় তিনি বেজ এর অংশটুকু গাইলেন।
স্ত্রীও এবারে কষ্ট-কল্পনার রাজ্য থেকে নেমে এলেন। কান্না-ভেজানো চোখে তন্ময় হয়ে কিছুক্ষণ স্বামীর গান শুনলেন। তারপর, চোখ-ভরা আনন্দাশ্রু নিয়ে ধরা গলায় জিজ্ঞেস করলেন–কী গাইছ তুমি?
–কেন ‘রোমিও অ্যান্ড জুলিয়া’। আমাদের রোমিও অ্যান্ড জুলিয়া।
স্বামীর ওপর হঠাৎ যেন কিছু একটা ভর করল। লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে স্বরলিপিটাকে স্ত্রীর দিকে ঠেলে দিলেন,
–দেখ! এই দেখ, এই রোমিও আমাদের বাবা-দাদার, এই রোমিও আমাদেরও! পড়ে দেখ, এই আমাদের বেলিনি। ওহ, আমরা আসলে অতটা বুড়িয়ে যাইনি!
স্ত্রী তাঁর স্বামীর ঘন-চকচকে চুলের দিকে তাকালেন। দেখলেন স্বামীর জ্বলজ্বলে চোখ আর দৃপ্ত ভুরু। তাঁর মনের কোণে কোথায় যেন একটু হাওয়া লাগলো।
–“তুমি! তোমাকেও এক অনিন্দ্যসুন্দরী তরুণী মনে হচ্ছে!” স্বামীর বাঁধভাঙা উচ্ছ্বাস। “বুড়ো বেলিনিকে দেখে আমরা নিজেরাও ধোঁকায় পড়ে গিয়েছিলাম। আসলে কিন্তু আমরা অতটা বুড়ো হইনি। আমার আগেই কিছুটা সন্দেহ হয়েছিল।”
–“উঁহু! আমি আগে সন্দেহ করেছি” ঠোঁট উল্টে স্ত্রীর প্রতিবাদ।
–হতেই পারে! তোমার বয়স তো আমার চেয়ে কম।
–না-না-না, তুমিই আগে সন্দেহ করেছ….
আর এভাবেই, স্বামী-স্ত্রী একজোড়া নিষ্পাপ শিশুর মত নিজেদের মধ্যে খুনসুটি করতে লাগলেন–“দুজনের মধ্যে কে বড়?” এই প্রশ্ন নিয়ে। তাদের দেখে বোঝার উপায় নেই, কীভাবে কিছুক্ষণ আগেও তাঁরা ‘বুড়িয়ে যাওয়া নিয়ে আফসোস করে কাঁচা চুল পাকিয়ে ফেলছিলেন!