বিবাহিত এবং অবিবাহিত

বিবাহিত এবং অবিবাহিত

হেমন্তের এক চমৎকার সন্ধ্যায় স্টকহোমের হোপ গার্ডেনের পথে পায়চারি করছিল ব্যারিস্টার তরুণটি। পাশের প্যাভিলিয়ন থেকে টুকরো-টুকরো গানের সুর ভেসে আসছিল। সেই সাথে মস্ত জানালার ফাঁক গলে আলোর বন্যা আছড়ে পড়ছিল রাস্তার ওপরের গাছটায়। সে-গাছে তখন হলদে ফুলের ছড়াছড়ি। আলো আর ফুল মিলে এক অপূর্ব প্রতিচ্ছবির সৃষ্টি হয়েছে।

তরুণটি প্যাভিলিয়নের মধ্যে প্রবেশ করল। নিরিবিলি দেখে একটা টেবিলে বসে এক গ্লাস পাঞ্চ অর্ডার দিল। ইতোমধ্যে, সেখানে এক গায়কের অবির্ভাব ঘটল। একটা মৃত ইঁদুরকে নিয়ে লেখা খুব করুণ একটা গান গাইল সে। তাঁর পর এল এক তরুণী। উজ্জ্বল-গোলাপী-রঙের-জামা পরা তরুণীটি এসে একটা ড্যানিস গান গাইতে শুরু করল :

“জ্যোৎস্না ভরা রাতের চমৎকার যে ভ্রমণ
কোনকিছুই হয় না আনন্দের তেমন”

তরুণীটিকে দেখে সহজ-সরল বলেই মনে হল। গানটা সে ব্যারিস্টার তরুণটিকে উদ্দেশ করে গাইল। তাকে নিয়ে আলাদা করে এভাবে গান গাওয়ায়, তরুণটি বেশ লজ্জা পাচ্ছিল। তবে, খানিক গর্ববোধও হচ্ছিল তার। বলা যায়, একরকম ভালোই লাগছিল। যাহোক, কিছুক্ষণের মধ্যে তাদের মধ্যে আলাপ জমে উঠল। এ আলাপের শুরু হয়েছিল এক বোতল মদ দিয়ে, আর শেষ হল দুই রুমের ঝাঁ চকচকে এক ফ্ল্যাটে গিয়ে। তরুণের অনুভূতি কেমন ছিল, কিংবা, ফ্ল্যাটের মধ্যে কী কী আসবাব আর সুযোগ-সুবিধা ছিলো তা পুরোপুরি বর্ণনা করা এ ছোটগল্পের সাধ্যাতীত। তবে, সর্বোপরি বলা যায়, ঐ দিনের পর থেকে তারা খুব ভালো বন্ধু হয়ে গেল। অধুনা সমাজতান্ত্রিকতায় উদ্বুদ্ধ হয়ে, আর বান্ধবীকে সব সময় চোখে। চোখে রাখার বাসনায় তরুণটি সিদ্ধান্ত নিল, এখন থেকে সে ঐ ফ্ল্যাটেই থাকবে। আর ঘরদোর গুছিয়ে রাখতে তার বান্ধবী থাকবে ফ্ল্যাটের। তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে। বান্ধবীকে এতে বেশ খুশি বলেই মনে হল।

তরুণটির পরিবার কিন্তু এতে বাধ সাধল। তাদের মতে, সে অনৈতিক কাজ করে সবার মুখে চুনকালি দিয়েছে। অতএব, তাকে বকাঝকা করার জন্য বাবা-মা-ভাই-বোনদের সামনে তলব করা হল। কিন্তু তরুণের মনে হলো, সে এখন নিজে সিদ্ধান্ত নেবার মত যথেষ্ট বড় হয়েছে। সুতরাং, পরিবারের কথায় সে কোন রকম কর্ণপাত করলা না। ফলাফল যা হবার তা-ই হল: ‘পরিবারের সাথে সম্পর্কচ্ছেদ।

কিন্তু তরুণের জীবনে এর প্রভাব পড়ল উল্টোভাবে। ছোট্ট ফ্ল্যাটটিকে নিয়েই সে তার জগৎ কল্পনা করতে শুরু করল। একেবারে আদর্শ ঘরকুনো স্বামীতে(!), দুঃখিত, প্রেমিকে পরিণত হল। দুজনে বেশ সুখে সময় পার করছিল। একে অন্যকে প্রচণ্ড ভালোবাসত তারা, অথচ তাদের মধ্যে কোন আনুষ্ঠানিক বন্ধন ছিল না। ফলে, হারানোর ভয়টা সব সময়ই কাজ করত। আবার, এই হারানোর ভয় ছিল বলেই নিজেদের ভালোবাসাকে অটুট রাখতে সর্বাত্মক চেষ্টা করত। বস্তুত, তারা ছিল দুই দেহ এক আত্না।

একটা জিনিসের অভাব অবশ্য ছিল–তাদের কোন বন্ধু ছিল না। সমাজের কারও তাদের প্রতি কোন আগ্রহ ছিল না। ফলে, তারা কখনো কোথাও নিমন্ত্রিতও হত না।

*** *** ***

ক্রিসমাসের ঠিক আগের দিন।

যাদের এক সময় পরিবার ছিল, অথচ এখন নেই, তাদের জন্য এ দিনটা খুবই বেদনাদায়ক। সকালবেলা নাস্তার টেবিলে বসে তরুণটি একটা চিঠি হাতে পেল। বোনের চিঠি। ক্রিসমাসের দিনটা বাড়িতে বাবা-মার সঙ্গে কাটানোর জন্য অনুরোধ করেছে সে। চিঠি পড়ে তরুণ ব্যারিস্টার ভীষণ আবেগাপ্লুত হয়ে উঠল, আগেকার দিনগুলোর কথা মনে পড়ে গেল। কিন্তু পরমুহূর্তেই আবার মেজাজ খারাপ হয়ে গেল–সে কি বান্ধবীকে একা ফেলে যাবে নাকি? অবশ্যই না। বাবা-মা এর আগেও বেশ ক’বার তাকে ছাড়া ক্রিসমাস পালন করেছে। অতএব, এবার বান্ধবীকে একা ফেলে যাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না।

যা-হোক, মনের মধ্যে এ-জাতীয় নানা ঘাত-প্রতিঘাত নিয়ে সে কোর্টে চলে গেল।

লাঞ্চের বিরতির সময় এক সহকর্মী এসে পাশে বসল। বেশ শান্তভাবে জিজ্ঞেস করল, “ক্রিসমাসে বাড়ি যাচ্ছ নাকি?”

প্রশ্ন শুনে তরুণ ব্যারিষ্টার দপ করে জ্বলে উঠল। তার মানে, সহকর্মীরা তার অবস্থান সম্পর্কে জানে? যদি না-জানে, তাহলে এই লোক এই প্রশ্ন দিয়ে কী বোঝাতে চাইল?

সহকর্মীটি লক্ষ্য করল, তরুণ ব্যারিষ্টার কিছু না বলে রাগ-রাগ হয়ে একটা ভুট্টা ছাড়াচ্ছে; তাই উত্তরের আশা না-করেই তড়িঘড়ি করে বলল “না, মানে বলছিলাম যে, যদি না যাও, তাহলে তুমি চাইলে দিনটা আমাদের সঙ্গে কাটাতে পারো। তুমি বোধহয় জানো না, আমার একটা খুব আদরের বন্ধু আছে। অবশ্য, বন্ধু না বলে আমার আত্মা বলাটাই ভালো।”

কথাগুলো শুনতে খুব ভালো লাগছিল তরুণের। নিমন্ত্রণ সে গ্রহণ করতে পারে, তবে এক শর্তে–তাদের দুজনকেই নিমন্ত্রণ করতে হবে।

সে-তো বটেই। নিমন্ত্রণ করলে তো দুজনকেই করবে। সে আবার ভিন্নকিছু আশা করেছিল নাকি? যাহোক, এভাবেই তাদের বন্ধু না-থাকার সমস্যা, আর ক্রিসমাস দিনের সমস্যা দুই-ই মিটে গেল।

ঠিক ছয়টার সময় ওরা নতুন বন্ধুদের ফ্ল্যাটে পৌঁছল। সবার ব্যবহার বেশ আন্তরিক। পুরুষ দুজন যখন ‘পাঞ্চ’ পান করল, নারী দুজন তখন রান্নাঘর সামলালো। খাবার সময় হলে চারজনে ধরাধরি করে টেবিল পাতলো। কিন্তু টেবিলটা একসাথে চারজন বসে খাবার মত যথেষ্ট বড় ছিল না। এটা-ওটা জোড়া দিয়ে বড় করার চেষ্টা করেও যখন লাভ হল না, তখন পুরুষ দুজন হাঁটু মুড়ে মেঝেতে বসল।

নারী দুজন কিন্তু ইতোমধ্যে বেশ ভালো বন্ধু হয়ে গেছে। দুজনের মধ্যে চমৎকার বোঝাপড়া হয়েছে। কারণ, তারা দুজনেই এক অদৃশ্য বন্ধনে আবদ্ধ। তাদের প্রতি সমাজের করা অভিন্ন কটুক্তিই এই বন্ধনের মূল। তারা নিজেরা অবশ্য একে-অন্যকে বেশ সম্মান দিয়ে কথা বলল, অন্যের অনুভূতিগুলোর যথার্থ মূল্যায়ণ করল। সেইসঙ্গে, সতর্কতার সাথে সব রকম বিতর্কিত প্রসঙ্গ পাশ কাটিয়ে গেল। সাধারণত ছেলেমেয়েরা আশেপাশে না-থাকলে স্বামী-স্ত্রী যেসব বিষয়ে কথা বলে, বিবাহিত হওয়ার সুবাদে যেসব বিষয়ে কথা বলাকে নিজেদের অধিকার বলে মনে করে, সেসব বিষয়ও এরা সযত্নে এড়িয়ে গেল। এভাবে বেশ গুছিয়ে খাওয়াদাওয়া শেষ করল ওরা।

খাওয়ার পর্ব শেষে যখন পুডিং আনা হল, তখন তরুণ ব্যারিস্টার কিছু বলার জন্য উঠে দাঁড়ালো–এই সমস্ত আয়োজনের জন্য ধন্যবাদ জানালো। প্রশংসার সুরে বলল, “সেটাই হচ্ছে প্রকৃত আনন্দ, যা-কিনা দুনিয়ার সমস্ত মানুষ ছেড়ে, সমস্ত ঝামেলা থেকে বের হয়ে এসে, প্রকৃত বন্ধুদের সাথে করা হয়। কিন্তু কেন জানি হঠাৎ করে মেরী লুইসা(তরুণের বান্ধবী) কাঁদতে শুরু করল। কারণ জানতে চাইলে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে বলল, সে স্পষ্ট বুঝতে পারছে ব্যারিস্টার তার মা-বোনদের মিস করছে। লুইসার কথায় ব্যারিস্টার কিন্তু মোটেও খুশি হতে পারল না। সে জোর দিয়ে বললো, মা বোনদের সে মিস-ততা করছেই না, উপরন্তু, তারা যদি সবকিছু মেনেও নিত, তবুও সে আশা করত, এই সময় তারা দূরে থাকবে।

আচ্ছা! তাই যদি হবে, তবে সে লুইসাকে বিয়ে করছে না কেন?

অদ্ভুত! এর মধ্যে আবার বিয়ের কথা এল কোত্থেকে? তারা কি বিয়ের চেয়ে খারাপ আছে নাকি?

না, তা নয়। কিন্তু তারা যে সমাজ-স্বীকৃতভাবে বিয়ে করেনি সেটাও তো সত্য।

সমাজ-স্বীকৃত বিয়ে? মানে, পুরোহিতের দেয়া বিয়ে? ছিঃ! তরুণটি মনে করে, ও-বিয়ে কোন বিয়েই নয়; কারণ একটা মানুষ কতগুলো পরীক্ষা পাশ করে পুরোহিতের কাজ নিলেই তার মধ্যে কোন আধ্যাত্মিকতা ভর করে না। বিয়ে পড়ানোর সময় পুরোহিত যে মন্ত্রগুলো পড়ে, ওগুলো আসলে অর্থহীন-যুক্তিহীন নিছক কতগুলো বাজে কথা! আর এই বাজে কথাগুলোর জোরেই বিয়ে পবিত্র হয়ে যাবে?

তা না-হয় ঠিক আছে, লুইসাও হয়তো তা-ই মনে করে, কিন্তু তার মন যে মানতে চায় না। মনে হয় যেন কোথায় কী একটা গণ্ডগোল আছে! মানুষজন তার দিকে আঙ্গুল তুলে কথা বলে যে!

–বলুক, যার যা খুশি বলুক!

কিছুক্ষণ পর তরুণ ব্যারিস্টারের সাথে সোফিও গলা মেলালো। সে ইতোমধ্যে জেনে গেছে, ব্যারিস্টারের পরিবারের লোকজন তাদের সম্পর্ককে ভালো চোখে দেখে না। অতএব, সে মন্তব্য করল, “পরিবার পরিবারের জায়গাতেই থাকুক। প্রত্যেকের একটা নিজস্ব অবস্থান থাকে, সে অবস্থানের গণ্ডি অতিক্রম করা কারো জন্যই সমীচীন নয়।” ব্যারিস্টার এবং তার প্রেমিকা যেন খানিকটা সান্ত্বনা পেল এতে। আরও কিছুক্ষণ সেখানে। থেকে, গল্পগুজব করে, বেশ রাত্রি করে তারা নিজেদের ফ্ল্যাটে ফিরল।

ওরা এখন আগের চেয়েও বেশি সুখী। কারণ, এখন নতুন বন্ধু হয়েছে। সবকিছু নিয়ে ওরা এমন গোছালোভাবে থাকতে লাগলো যে, সমাজ-স্বীকৃত উপায়ে গঠিত অনেক পরিবারের চেয়ে ওদের সুখ বেশি বলে মনে হয়। দুজনের সেই বন্ধনহীন ভালোবাসা আগের মতই অটুট রয়েছে। প্রেমিক প্রেমিকার মত করেই দিন পার হয়। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বিবাহজনিত কারণে যেসব ঝামেলা হয়, যেমন: একে-অন্যের সাথে রাগারাগি করা, ঝগড়াঝাটি করা, সেগুলো কখনোই ওদের মধ্যে হয় না।

*** *** ***

দু’-এক বছর একসাথে থাকার পর তাদের মিলন এক পুত্রসন্তানে আশীর্বাদপুষ্ট হল। অতএব, প্রেমিকার পদোন্নতি হল এবার সে এখন মা, এবং এই পরিচয়ের বাইরে অন্য সব কিছু সে মন থেকে মুছে ফেলল। সন্তান জন্মদানের সময় যে যন্ত্রণা তাকে সহ্য করতে হয়েছে, আর জন্মদানের পর যে পরম মমতায় সন্তানকে লালন করতে হচ্ছে, সে অনুভূতিগুলোর গভীরতায় আগেকার স্বার্থপর অনুভূতিগুলো নিমজ্জিত হল। আগে সে মনে করত, জগতের সব ভাল জিনিস শুধু তার একার জন্য, অথচ, এখন স্বামীর(!), দুঃখিত, প্রেমিকের ভালোবাসায় ভাগীদার আসাতেও সে মোটেই দুঃখিত হল না। নতুন ভূমিকায় নিজেকে সে বন্ধুদের। চেয়ে অনেক বেশি দায়িত্ববান বলে ভাবতে শুরু করল। প্রেমিকের সঙ্গে আচার-আচরণ, মিলন, সবকিছুতে যেন আগের চেয়ে বেশি প্রত্যয় ফুটে উঠল।

স্বামী(!) একদিন এক আনন্দের সংবাদ নিয়ে এল রাস্তায় বড় বোনের সঙ্গে দেখা হয়েছিল। দেখা গেল, বোন তাদের সব খোঁজ-খবরই জানে। ছোট্ট ভাতিজাটাকে দেখার জন্য সে ভীষণ আগ্রহ প্রকাশ করেছে। কথা দিয়েছে, খুব শীঘ্রই একদিন তাদের বাসায় আসবে। খবরটা শুনে লুইসা বেশ অবাক হলেও তৎক্ষণাৎ ঘরদোর পরিষ্কার করতে লেগে গেল। এ উপলক্ষে একটা নতুন ড্রেসেরও বায়না ধরল।

পুরো সপ্তাহ জুড়ে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা অভিযান চলল। পদাগুলো। লণ্ডিতে পাঠানো হল, চুলা-দরজার হাতল সব ঘষে-মেজে ঝকঝকে করা হল। আসবাবপত্রের ওপরও একপ্রস্থ নতুন রঙ চড়ল। বোন এসে দেখুক, তার ভাই পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন-মার্জিত রুচির একজনের সাথেই থাকে!

অবশেষে সেই দিনটা এল। বেলা ১১টায় বোনের আসার কথা। তার আগেই কফি বানিয়ে রাখলো লুইসা। যথাসময়ে বোনের আগমন ঘটল। থমথমে ভাবলেশশূন্য মুখে সে লুইসার সাথে হাত মেলালো। এরপর ঘরের আসবাবপত্রগুলো বেশ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলো। কিন্তু কিছু খেতে রাজি হল না। এ-ঘর ও-ঘরে উঁকি দিল; কিন্তু ভাইয়ের বউয়ের(!) দিকে আর ফিরেও তাকালো না। তবে বাচ্চাটা নিয়ে সে বেশ আগ্রহ দেখালো। ওকে নিয়ে কিছুক্ষণ খেলা করল। তারপর, যেভাবে এসেছিল সেভাবেই আবার গটগট করে চলে গেল। পুরো সময়টা জুড়ে লুইসাও কিন্তু বোনকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখেছে। তার কোট, জামা-কাপড়-গহনার দাম কী রকম হতে পারে ইত্যাদি সব হিসাব করা হয়ে গেছে। সেই সাথে, চুল কাটার একটা নতুন ধরনও শিখেছে। পরবর্তীতে ওভাবে চুল কাটানো যেতে পারে! যা-হোক, বোনের কাছ থেকে খুব আন্তরিক ব্যবহার সে নিজেও আশা করেনি; প্রথমবারের মত যে এসেছে সেটাই যথেষ্ট। অতএব, লুইসাকে সর্বোপরি খুশিই মনে হল। প্রচার করে বেড়ালো, স্বামীর(!) বোন তাদের সংসার দেখতে এসেছিল।

*** *** ***

দিন দিন ওদের ছেলেটা বড় হয়ে উঠছে। ইতোমধ্যে, লুইসা আবার গর্ভবতী হল। এবার ফুটফুটে এক কন্যাসন্তানের জন্ম হল। তার পর থেকে, লুইসা আগের চেয়েও গম্ভীর হয়ে গেল। বাচ্চাদের ভবিষ্যত নিয়ে সবসময় দুশ্চিন্তা হয়। বাচ্চাদের বাবাকে প্রতিদিন বোঝানোর চেষ্টা করে তাদের বৈধ বিয়ে না-হলে বাচ্চাদের ভবিষ্যত কখনোই সুরক্ষিত হবে না। ওদিকে, ব্যারিস্টারের বোনও ইঙ্গিত দিয়েছিল, তাদের একসঙ্গে থাকাকে যদি তারা বিয়ের মাধ্যমে বৈধতা দেয়, তবে পরিবারের সঙ্গে পুনর্মিলনের একটা সমূহ সম্ভাবনা আছে।

সবদিক বিবেচনা করে, এবং লুইসার দুই বছরের ক্রমাগত চেষ্টার ফলে, অবশেষে তার প্রেমিক বিয়ে করতে রাজী হল। সন্তানদের মঙ্গলের স্বার্থে ওই যুক্তিহীন মন্ত্রগুলোর মাধ্যমে পড়ানো বিয়ে সে মেনে নেবে।

কিন্তু ছোট্ট একটা সমস্যা–“বিয়েটা হবে কোথায়?”

লুইসা চার্চের জন্য জোরাজুরি করল। কিন্তু সেটা কীভাবে সম্ভব? চার্চে বিয়ে হলে তো সোফিকে নিমন্ত্রণ করা যাবে না। ওকে তো নিশ্চয়ই চার্চে ঢোকার অনুমতি দেবে না। “ইস! সোফির মত একটা মেয়ে!” কিন্তু লুইসা এতে দমল না। সে বরং বলল, “সন্তানের মঙ্গলের জন্য বাবা-মাকে ব্যক্তিগত অনেককিছুই ত্যাগ করতে হয়।” অতএব, শেষ পর্যন্ত তারই জয় হল।

বিবাহ সম্পন্ন হল! কিন্তু ব্যারিস্টারের বাবা-মার থেকে কোন নিমন্ত্রণ এলো না। এলো সোফির কাছ থেকে একটা চিঠি। এমন একটা কাজ করার জন্য, বিশেষত, তাকে নূন্যতম কিছু না-জানিয়ে করার জন্য সে ভীষণ মনঃক্ষুণ্ণ হয়েছে। লুইসাদের সঙ্গে সে আর কোন সম্পর্ক রাখতে চায় না জানিয়ে দিয়েছে।

লুইসা অবশ্য এতে খুব একটা দুঃখিত হল বলে মনে হল না। সে এখন একজন বিবাহিতা নারী’, এটাই সবচেয়ে বড় কথা! কিন্তু কেন জানি নিজেকে তার আগের চেয়ে অনেক বেশি একাকী মনে হয়। অবশ্য, এক ধরনের স্বস্তিও আছে–তাদের সম্পর্কটা এখন বৈধ।

আর, এই স্বস্তিবোধ থেকেই সে সবরকম স্বাধীনতা ভোগ করতে শুরু করল। সেই-সব স্বাধীনতা, যেগুলোকে বিবাহিত মানুষ নিজেদের অধিকার বলে মনে করে। এক সময় যেগুলোকে সে স্বেচ্ছায়প্রাপ্ত উপহার বলে ভাবত, এখন সেগুলোকে নিজের প্রাপ্য বলে মনে করতে শুরু করল। প্রথমেই সে নিজেকে ‘সন্তানের মা পরিচয়ের আড়ালে ঢেকে ফেলল। আর, এখান থেকেই যেন তার নবযাত্রা সূচিত হল।

ওদিকে, স্বামী বেচারার মাথায় কিছুতেই ঢুকল না, ‘সন্তানের মা এই পরিচয়ের বিশেষ কী মাহাত্ম আছে! তাছাড়া, তার সন্তানেরা তো আর দশটা স্বাভাবিক সন্তানের মতই। তারা এমনকিছু নয় যে, তাদের মা হওয়াটা বিরাট গর্বের কোন ব্যাপার হয়ে দাঁড়াবে! পুরো ব্যাপারটা স্বামীর কাছে একটা ধাঁধার মত হয়ে রইল। তবে, তার নিজের স্বভাবেরও খানিকটা পরিবর্তন হয়েছে আজকাল। মনে কিছুটা খচখচানি থাকা সত্ত্বেও, সে আগের মত আবার বাইরের জগতের কাজকর্ম নিয়ে ব্যস্ত হতে শুরু করেছে। অবশ্য, এর পেছনে যুক্তিও আছে–“সন্তানদের তো তখন একজন বৈধ মা রয়েছে। সুতরাং, বাইরের জগতের যে ব্যস্ততাগুলো সে প্রায় ভুলেই গিয়েছিল, সেগুলো আবার শুরু করতে বাধা-তো নেই। মাঝে এগুলো ভুলে যাওয়ার কারণ ছিল প্রথমত, সন্তান হবার আগে সে প্রেমের মায়ায় বিভোর থাকত; দ্বিতীয়ত, সন্তান হবার পর প্রেমিকা আর সন্তানদের রেখে কোথাও যাওয়ার ব্যাপারটাকে সে রীতিমত ঘৃণা করত। এখন যেহেতু সব অনিশ্চয়তা কেটে গেছে, এখন বাইরে যাওয়াই যায়।

স্বামীর এই অবাধ স্বাধীনতা স্ত্রীর কিন্তু মোটেও পছন্দ হল না। আগে থেকেই সে ছিল স্পষ্টবাদী স্বভাবের, আর এখনতো এমনিতেই গোপন করার কিছু নেই। অতএব, যা কিছু মনে হয় সবকিছু চটপট স্বামীকে বলে বসে। স্বামী কোনরকমে ব্যাপারগুলোকে মোটামুটি ম্যানেজ করে নেয়। ওকালতির পাঁচ ভালোই জানা আছে তার। স্ত্রীর উল্টাপাল্টা কথাবার্তায় বিব্রত না হয়ে, বরং বেশ বুদ্ধিদ্বীপ্ত উত্তর দেয় সে।

একদিন স্ত্রী হঠাৎ জিজ্ঞেস করলো, “ঘরে বউ রেখে বাইরে-বাইরে ঘোরাটা কি ঠিক?”

“হুম! কিন্তু সে-জন্য তোমরা আমাকে মিস কর বলে তো মনে হয়!” স্বামী কোনমতে প্রাথমিক ধাক্কাটা সামলাল।

–তোমাকে মিস করি কি না? বর যখন ঘর-সংসার দেখাশোনার টাকা মদ খেয়ে ওড়ায়, বউ তখন ঘরে অন্য আরও অনেক জিনিস মিস করে।

–আচ্ছা! তাই নাকি? তবে শোন, প্রথমত, আমি মদ খাই না; মাঝে মাঝে বাইরে থেকে এটা-ওটা কিনে খাই, আর কিঞ্চিৎ কফি পান করি। দ্বিতীয়ত হচ্ছে, আমি ঘর-সংসার দেখাশুনার টাকা ওড়াইনা; কারণ, সেটা। তোমার কাছেই সযত্নে গচ্ছিত থাকে। পানভোজনের টাকার জন্য আমার। অন্য তহবিল আছে।”

শেষের কথাগুলো স্বামী ঠাট্টাচ্ছলে স্ত্রীর সুর নকল করে বলল।

দুর্ভাগ্যবশত, মেয়েরা কখনোই ঠাট্টা ব্যাপারটা বোঝেনা। ফলে, মজার। ছলে স্বামী যে ফাঁস তৈরি করেছিল, কিছুক্ষণ পর সেটা তার নিজের গলায়ই এসে পড়লো।

–‘পানভোজন!’ তার মানে তুমি স্বীকার করছ, তুমি মাঝে মাঝে মদ খাও?

–মোটেও না। তোমাকে নিয়ে একটু মজা করার জন্য অমন করে বলেছি।

–আমাকে নিয়ে মজা করার জন্য? তার মানে, তুমি তোমার স্ত্রীকে নিয়ে মজা করছ? কই, আগেতো কখনো এমন করতে না!

–আরে বাবা! তুমি নিজেই তো বিয়ে করতে চেয়েছিল; এখন আবার সবকিছু আগের চেয়ে আলাদা করে দেখছ কেন?

–আলাদা করে দেখছি, কারণ আমরা এখন বিবাহিত!

–এটা আংশিক কারণ। পুরো কারণটা হচ্ছে, তোমার মোহ এখন কেটে গেছে।

–আমাদের সেই সময়গুলোকে তোমার কাছে মোহ মনে হচ্ছে?

–শুধু আমার কাছে নয়, তোমার কাছেও; এবং জগতের সবার কাছেই। আসলে আগে-পরে যখনই হোক, এই মোহ একসময় কেটে যাবেই।

–আচ্ছা! তার মানেটা দাঁড়ালো এই যে, যখনই পুরুষের ঘাড়ে দায়িত্ব আসে, তখনই ভালোবাসা তার কাছে মোহ মনে হয়। তাই না?

–হুম! নারীর ঘাড়ে দায়িত্ব এলে তার কাছেও তা-ই মনে হয়।

“মোহ! শুধুই মোহ?” স্ত্রী বিড়বিড় করে বলতে লাগল।

এবারে স্বামী ঝটকা মেরে বলল, “তবে তার মানে এই নয় যে, দুজনের মধ্যে বন্ধুত্ব থাকা যাবে না।”

“অর্থাৎ, বিয়ের প্রয়োজন নেই। তাই বলতে চাইছ তো?” স্ত্রী বেশ রেগে গেল ।

“ঠিক তাই। আমি তোমাকে ঠিক এই কথাটাই সব সময় বোঝাতে চেয়েছি।” স্বামীর স্পষ্ট জবাব ।

“কিন্তু তুমি নিজে কি চাওনি আমাদের বিয়ে হোক?” স্ত্রীকে আবেগী দেখালো ।

–চেয়েছি। তার একমাত্র কারণ, তিন-তিনটা বছর ধরে তুমি এ-নিয়ে আমার মাথা নষ্ট করে ছেড়েছ।

–কিন্তু এটাতো সত্য, তুমি চেয়েছিলে আমরা বিয়ে করি।

–কারণ, তুমি চেয়েছিলে; আর, শেষ পর্যন্ত সেটা পেয়েছ সে-জন্য তোমার কৃতজ্ঞ থাকা উচিত।

–তুমি তোমার সন্তানদের মাকে ফেলে বাইরে বাইরে ঘুরে বেড়াও, এই জন্য আমাকে কৃতজ্ঞ থাকতে বলছ?

–মোটেই না; বরং, তোমাকে বিয়ে করেছি এই জন্য কৃতজ্ঞ থাকতে বলছি।

–তুমি কি সত্যিই মনে কর, আমার সে জন্য কৃতজ্ঞ থাকা উচিত?

–হ্যাঁ, মানুষ নিজের পথ খুঁজে পেলে যেভাবে কৃতজ্ঞ থাকে, তোমারও। সেভাবে কৃতজ্ঞ থাকা উচিত।

“বেশ! তাহলে তুমিও শুনে রাখ, আমাদের এই বিয়ে কোন বিয়েই নয়। এ-বিয়েতে কোন সুখ নেই। তোমার পরিবার আমাকে স্বীকার করে না।” স্ত্রী রাগে ফেটে পড়ল।

–এর মধ্যে আবার আমার পরিবার এল কেথেকে? আমিতো কখনো তোমার পরিবার নিয়ে মাথা ঘামাইনি।

–মাথা ঘামাওনি, কারণ, তোমার মনে হয়েছে আমার পরিবার নিয়ে কখনো কোন চিন্তা-ভাবনা না করলেও চলবে।

–আচ্ছা! তোমার কথা শুনে মনে হচ্ছে যেন, আমার পরিবার নিয়ে সবসময় তোমার ব্যাপক চিন্তা-ভাবনা ছিল! এমনকি তারা যদি মুচি চামারও হত, তবুও তাদের নিয়ে তুমি সুখে থাকতে!

–এমনভাবে কথা বলছ যেন মুচি-চামাররা মানুষ না। অন্যদের মত ওদের বাঁচার অধিকার নেই?

–অবশ্যই আছে। তবে আমার মনে হয় না, মুচিদের প্রতি দরদ দেখিয়ে, তুমি ওদের সাথে গিয়ে থাকতে রাজি হতে…

কথা কাটাকাটির এই পর্যায়ে স্ত্রী চিৎকার করে উঠল–“ঠিক আছে! সব ঠিক আছে! তুমি তোমার মত থাক, আমি আমার মত থাকবো।”

আসলে কিন্তু সব ঠিক ছিল না। আসলে, আর কখনোই সব ঠিক হয়নি।

*** *** ***

আচ্ছা, এই সমস্ত সমস্যার মূল কারণ কি তবে বিয়ে? নাকি অন্য কিছু?

লুইসা শেষ পর্যন্ত স্বীকার না করে পারেনি, তাদের আগের সময়টাই ভালো ছিল। সে সময় তারা সুখী ছিল।

স্বামীরও মাঝে মাঝে মনে হয়, তাদের সম্পর্কের বৈধতা দেয়ায়, অর্থাৎ, বিয়ে করার কারণেই অশান্তিটা হয়েছে। কারণ, সে যত বিবাহিত দম্পতি দেখেছে, তাদের সবাই-ই অসুখী। তবে, সবচেয়ে কষ্টকর বিষয়টি সে বুঝতে পারল যখন সেই পুরনো বন্ধু আর সোফির ব্যাপারে জানলো। বিয়ের পর প্রায়ই সে স্ত্রীকে না-জানিয়ে ওদের বাড়িতে যেত। তেমনি একদিন ওদের বাড়িতে গিয়ে জানতে পারল, ওদের ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে। “অথচ ওরা কখনো বিয়েই করেনি!”

তার মানেটা দাঁড়ালো এই, সত্যিকার দোষটা আসলে বিয়ের নয়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *