বিশ্বভারতী

বিশ্বভারতী

কবি, শিল্পী–স্রষ্টমাত্ৰই স্পর্শকাতর হয়ে থাকেন। এবং সেই কারণেই আর পাঁচজনের তুলনায় এ জীবনে তারা এমন সব বেদনা পান যার সঙ্গে আমাদের কোনো পরিচয় নেই। রাজনৈতিক কিংবা ব্যবসায়ী হতে হলে গণ্ডারের চামড়ার প্রয়োজন—গণ্ডারের চামড়া নিয়ে কোনো কবি আজ পর্যন্ত সার্থক সৃষ্টি করে যেতে পারেন নি।

জীবনের বহু ক্ষেত্রে রবীন্দ্ৰনাথ বহু অপ্রত্যাশিত আঘাত পেয়েছিলেন। তরুণ বয়সে রবীন্দ্রনাথ বঙ্কিমচন্দ্রের আশীর্বাদ পান; তৎসত্ত্বেও বাঙলাদেশ বহুদিন ধরে তাকে কবি বলে স্বীকার করতে চায় নি। শুধু তাই নয়, তার বিরুদ্ধে বহু গণ্যমান্য লোক এমন সব অন্যায় আক্রমণ এবং আন্দোলন চালান যে রবীন্দ্রনাথকে হয়তো অল্প বয়সে কীটসের মতো ভগ্নহৃদয় নিয়ে ইহলোক পরিত্যাগ করতে হত। রবীন্দ্ৰনাথ যে বহু বেদনা পেয়েও কীটসের মতো ভেঙে পড়েন নি তার অন্যতম প্রধান কারণ, ধর্মে তার অবিচল নিষ্ঠা ছিল এবং দ্বিতীয়টি মহর্ষি স্বহস্তে রবীন্দ্ৰনাথের নৈতিক মেরুদণ্ডটি নির্মাণ করে দিয়েছিলেন।

এ জীবনে রবীন্দ্ৰনাথ বহু বেদনা পেয়েছেন এবং তার খবর বাঙালিমাত্রই কিছু না কিছু রাখেন। আমি স্বচক্ষে দেখেছি, বিশ্বভারতীয় নবপ্রতিষ্ঠান উপলক্ষে, তারই একটি নিবেদন করি।

১৯২১ সালে রবীন্দ্ৰনাথ বিশ্বভারতীর’ প্ৰতিষ্ঠা করেন কিংবা বলতে পারি। যে ইস্কুলটি (পূর্ব বিভাগ) প্রায় কুড়ি বৎসর ধরে বাঙলা বা বাঙলার বাইরে প্রচুর খ্যাতি অর্জন করেছিল তার সঙ্গে একটি কলেজ (উত্তর বিভাগ) যোগ দিয়ে দেওয়া হল। সঙ্গে সঙ্গে প্ৰাচ্য-প্রতীচ্যের নানাপ্রকার জ্ঞান-বিজ্ঞানের গবেষণা করারও ব্যবস্থা হল।

তাই গুরুদেবের বাসনা ছিল, পূর্ব-পশ্চিমের গুণীজ্ঞানীরা যেন শাস্তিনিকেতনে সম্মিলিত হয়ে একে অন্যের সহযোগিতায় বৃহত্তর ও ব্যাপকতর সাধনায় নিযুক্ত হন।

সেই মর্মে রবীন্দ্ৰনাথ আমন্ত্রণ জানালেন প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয়ের খ্যাতনামা পণ্ডিত অধ্যাপক সিলভা লেভিকে। ভারতীয় সংস্কৃতির সর্ববিষয়ে লেভির অসাধারণ পাণ্ডিত্য ছিল তো বটেই, তদুপরি বৌদ্ধধর্মে বোধ করি তখনকার দিনে পশ্চিমে এমন কেউ ছিলেন না। যিনি তার সামনে সাহস করে দাঁড়াতে পারতেন।

শান্তিনিকেতনে তখন বহুতর পণ্ডিত ছিলেন। শ্ৰীযুত বিধুশেখর শাস্ত্রী, শ্ৰীযুত ক্ষিতিমোহন সেন শাস্ত্রী, শ্ৰীযুত হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়, স্বর্গীয় এভুজ এবং পিয়ার্সন, শ্ৰীযুত নিতাইবিনোদ গোস্বামী, অধ্যাপক কলিনস বাগদানফ বেনওয়া, ক্রামরিশ, শ্ৰীযুত মিশ্রজী, শ্ৰীযুত হিডজিভাই মরিস, শ্ৰীযুত প্রভাত মুখোপাধ্যায় ও আরো বহু খ্যাতনামা লোক তখন শান্তিনিকেতনে অধ্যয়ন অধ্যাপনা করতেন।

সঙ্গীতে ছিলেন প্ৰাতঃস্মরণীয় দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুর।

অপেক্ষাকৃত অল্পবয়স্কদের ভিতর ছিলেন শ্ৰীযুত অমিয় চক্রবতী, শ্ৰীযুত প্রমথনাথ বিশী।(১)

এবং আশ্রমের সঙ্গে সাক্ষাৎভাবে সংযুক্ত না হয়েও এক ঋষি আশ্রমটিকে আপন আশীৰ্বাদ দিয়ে পুণ্যভূমি করে রেখেছিলেন। বাংলাদেশ তাকে প্রায় ভুলে গিয়েছে। ইনি রবীন্দ্রনাথের সর্বজ্যেষ্ঠ ভ্রাতা স্বর্গীয় দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর। পরর্বতীকালে লেভি এর পদপ্রান্তে বসবার সুযোগ পেয়েছিলেন।

শান্তিনিকেতন তখন পণ্ডিত এবং পাণ্ডিত্যের কিছুমাত্র অনটন ছিল না। রবীন্দ্রনাথ সে ব্যবস্থা করেছিলেন তাঁর সর্বশেষ কপর্দক দিয়ে-এবং এস্থলে ভক্তিভারে একথাও স্মরণ রাখা উচিত যে এই সব বড় বড় পণ্ডিতেরা যে দক্ষিণা নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতেন সে দক্ষিণা আজকের দিনে দিতে গেলে অনেক অপণ্ডিতও অপমান বোধ করবেন।

কিন্তু ছাত্র ছিল না। বিশ্বভারতী তখন পরীক্ষা নিত না, উপাধিও দিত না।

এখনো আমার স্পষ্ট মনে আছে, তখনকার দিনে বিশ্বভারতীর অন্যতম প্রধান নীতি ছিল : ‘দি সিস্টেম অব এগজামিনেশন উইল হ্যাভ নো প্লেস ইন বিশ্বভারতী, নর উইল দ্যার বী। এনি কনফারিং অব ডিগ্ৰীজ।’

এ অবস্থায় বিশ্বভারতীতে অধ্যয়ন করতে আসবে কে?

তবে এই যে এত অর্থব্যয় করে বিদেশ থেকে পৃথিবীবরেণ্য পণ্ডিত লেভিকে আনানো হচ্ছে, ইনি বক্তৃতা দেবেন। কার সামনে, ইনি গড়ে তুলবেন কোন ছাত্রকে।

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে শান্তিনিকেতনে তখন কোনো যোগসূত্র ছিল না। তবু রবীন্দ্রনাথ ব্যবস্থা করলেন যাতে করে কলকাতার ছাত্ররা শান্তিনিকেতনে এসে সপ্তাহে অন্তত একটি বক্তৃতা শুনে যেতে পারে। শাস্তিনিকেতনে রবিবার অন্যধ্যায় নয় কাজেই শনিবার বিকেল কিংবা রবির সকালের ট্রেন ধরে যে কোনো ছাত্র কলকাতা থেকে এসে লেভির বক্তৃতা শোনবার সুযোগ পেল।

যেদিন প্রথম বক্তৃতা আরম্ভ হওয়ার কথা সেদিন রবীন্দ্রনাথ খবর নিয়ে জানতে পারলেন। কলকাতা থেকে এসেছেন মাত্র দুটি ছাত্র: তারও একজন রসায়নের ছাত্র আর পাঁচজন যে রকম ‘বোলপুর দেখতে’ আসে এই সুযোগে সেও সেই রকম এসেছে!

বিশ্বভারতীর ছাত্রছাত্রী সংখ্যা তখন বারো জনও হবে না। তার মধ্যে সংস্কৃত পড়তেন জোর চারজন।

এই ছটি ছাত্রের সামনে (অবশ্য পণ্ডিতরাও উপস্থিত থাকবেন)। বক্তৃতা দেবেন। সাত সমুদ্র তের নদী পার হয়ে এসে ভুবনবিখ্যাত পণ্ডিত লেভি! রবীন্দ্রনাথ বড় মর্মাহত হয়েছিলেন।

তাই প্রথম বক্তৃতায় ক্লাসের পুরোভাগে খাতকলম নিয়ে বসলেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ। লেভির আর কোনো খেদ না থাকারই কথা।

——-
(১) সিংহলের শ্রমণ পণ্ডিতদ্বয় এবং আরও কয়েকজনের নাম ভুলে যাওয়ার জন্য তাদের কাছে লজিজত আমি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *