‘নেভা’র রাধা
অনেক প্রেমের কাহিনী পড়েছি, এমন সব দেশে বহু বৎসর কাটিয়েছি যেখানে প্রেমে না। পড়াতেই ব্যত্যয়—তাই চোখের সামনে দেখেছি প্রেমের নিত্য নব প্যাটার্ন-কিন্তু একটা গল্প আমি কিছুতেই ভুলতে পারি নে। তার প্রধান কারণ বোধ হয়। এই যে গল্পটি বলেছেন ওস্তাদ তুৰ্গেনিয়েফ। এবং শুধু তাই নয়-ঘটনাটি তার নিজের জীবনে সত্য সত্যই ঘটেছিল।
দস্তয়েফস্কি, তলস্তয়ের সৃজনীশক্তি তুৰ্গেনিয়েফের চেয়ে অনেক উঁচুদরের, কিন্তু তুৰ্গেনিয়েফ যে স্বচ্ছসলিল ভঙ্গিতে গল্প বলতে পারতেন, সেরকম কৃতিত্ব বিশ্বসাহিত্যে দেখাতে পেরেছেন অতি অল্প ওস্তাদাই! তুৰ্গেনিয়েফের শৈলীর প্রশংসা করতে গিয়ে এক রুশ সমঝদার বলেছেন, ‘তাঁর শৈলী যেন বোতল থেকে তেল ঢালা হচ্ছে-ইট ফ্লোজ লাইক অয়েল।’
তুৰ্গেনিয়েফ ছিলেন খানদানী ঘরের ছেলে-তলস্তয়েরই মত। ওরকম সুপুরুষও নাকি মস্কো, পিটার্সবুর্গে কম জন্মেছেন। কৈশোরে তাঁর একবার শক্ত অসুখ হয়। সেরে ওঠবার পর ডাক্তার তাঁকে হুকুম দেন নেভা নদীর পারে কোনো জায়গায় গিয়ে কিছুদিন নির্জনে থাকতে। নেভার পারে এক জেলেদের গ্রামে তুৰ্গেনিয়েফ পরিবারের জমিদারি ছিল। গ্রামের এক প্রান্তে জমিদারের একখানি ছোট্ট বাঙলো-চাকর-বাকর নিয়ে ছোকরা তুৰ্গেনিয়েফ বাঙলোয় গিয়ে উঠলেন।
সেই ছবিটি আমি যেন চোখের সামনে দেখতে পাই। জমিদারের ছেলে, চেহারাটি চমৎকার আর অসুখ থেকে উঠে সে চেহারাটি দেখাচ্ছে করুণ, উদাস-উদাস, বেদনাতুর। তার উপর তুৰ্গেনিয়েফ ছিলেন মুখচোরা এবং লাজুক, আচরণে অতিশয় ভদ্র এবং নম্র। আমি যেন চোখের সামনে দেখতে পাই, গ্রামে হুলস্থূল পড়ে গিয়েছে—জেলে-মেয়েরা দূর থেকে আড়নয়নে দেখছে তুর্গনিয়েফ মাথা নিচু করে, দুহাত পিছনে একজোড় করে নদীর পারে পইচারি করছেন। জরাজীর্ণ গ্রামে হঠাৎ যেন দেবদূত নেমে এসেছেন।
মেয়েরা জানে এরকম খানদানী ঘরের ছেলে তাদের কারো দিকে ফিরেও তাকবে না, কিন্তু তা হলে কি হয়, তরুণ হৃদয় অসম্ভব বলে কোনো জিনিস বিশ্বাস করে না। সে রবিবারে জেলে-তরুণীরা গির্জয় গেল দুরুদুরু বুক নিয়ে—বড়দিনের ফ্রক-ব্লাউজ পরে।
তরুণীদের হৃদয় ভুল বলে নি। অসম্ভব সম্ভব হল। তুৰ্গেনিয়েফ মেয়েদের দিকে তাকালেন। তার মনও চঞ্চল হল।
তুৰ্গেনিয়েফ পক্টাপষ্টি বলেন নি, কিন্তু আমার মনে হয় মস্কো পিটার্সবুর্গের রঙমাখানো গয়না-চাপানো লোক-দেখানো সুন্দরীদের নখরা-ককেস্ট্ররি তাঁর মন বিতৃষ্ণায় ভরে দিয়েছিল বলে তিনি জেলে-গ্রামের অনাড়ম্বর সরল সৌন্দর্যের সামনে মুগ্ধ হয়েছিলেন। আমার মনে হয়, তুর্গেনিয়েফের কবিহৃদয় অতি সহজেউ হীরা ফুল অনাদর করে বুনো ফুল আপন বুকে গুঁজে নিয়েছিল।
কিন্তু আশ্চর্য, গ্রামের সুন্দরীদের পয়লানম্বরি কাউকে তিনি বেছে নিলেন না। এই উল্টো স্বয়ম্বরে যাকে তিনি হৃদয় দিলেন সে স্বপ্নেও আশা করতে পারে নি, এই প্রিয়দর্শন তরুণটি সুন্দরীদের অবহেলা করে তাকেই নেবে বেছে। সত্য বটে মেয়েটি কুৎসিত ছিল না, এবং তার স্বাস্থ্যও ছিল ভালো; কিন্তু তাই দিয়ে তো আর প্রেমের প্রহেলিকার সমাধান হয় না ।
মেয়েটির মনে যে কী আনন্দ, কী গর্ব হয়েছিল সেটা কল্পনা করতে আমার বড় ভালো লাগে। তুৰ্গেনিয়েফ তার অতি সংক্ষিপ্ত বৰ্ণনা দিয়েছেন-নিজের জীবনে ঘটেছিল। বলে হয়ত তিনি এ ঘটনাটিকে বিনা অলঙ্কারে বর্ণনা করেছেন। আমার কিন্তু ভারি ইচ্ছে হয়, মেয়েটির লজ্জা-মেশানো গর্ব যদি আরো ভালো করে জানতে পারতুম—তুৰ্গেনিয়েফ যদি আরো একটুখানি ভালো করে তার হৃদয়ের খবরটি আমাদের দিতেন।
শুধু এইটুকু জানি মেয়েটি দেমাক করে নি। ইভানকে পেয়ে সে যে-লোকে উঠে গিয়েছিল সেখানে তো দেমাক দম্ভের কথাই উঠতে পারে না। আর তুৰ্গেনিয়েফ হিংসা, ঈর্ষা থেকে মেয়েটিকে বাঁচিয়ে রেখেছিলেন অন্য মেয়েদের সঙ্গে অতি ভদ্র মিষ্টি আচরণ দিয়ে–কোনো জমিদারের ছেলে নাকি ওরকমধারা মাথা থেকে হ্যাট তুলে নিচু হয়ে জেলেনীদের কখনো নমস্কার করেনি।
কৈশোরের সেই অনাবিল প্রেম কিরূপে আস্তে আস্তে তার বিকাশ পেয়েছিল, তুৰ্গেনিয়েফা তার সবিস্তার বর্ণনা দেন নি।–তাই নিয়ে আমার শোকের অন্ত নেই।
দুজনে দেখা হত। হাতে হাত রেখে তারা নদীর ওপারের ঘনায়মান অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে থাকত। চাঁদ উঠত। সন্ধ্যার ঠাণ্ডা হাওয়া বইতে আরম্ভ করলে তুৰ্গেনিয়েফ তার ওভারকেট দিয়ে মেয়েটিকে জড়িয়ে দিতেন। সে হয়ত মৃদু আপত্তি করত—কিন্তু নিশ্চয়ই জানি ইভানের কোনো ইচ্ছায় সে বেশিক্ষণ বাধা দিতে পারত না।
তুৰ্গেনিয়েফ সম্পূর্ণ সেরে উঠেছেন। বাড়ি থেকে হুকুম এসেছে প্যারিস যেতে।
বিদায়ের শেষ সন্ধ্যা এল। কাজ সেরে মেয়েটি যখন ছুটে এল ইভানের কাছ থেকে বিদায় নিতে, তখন সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে।
অঝোরে নীরবে কেঁদেছিল। শুধু মেয়েটি। তুৰ্গেনিয়েফ বারে বারে সাত্বনা দিয়ে বলেছিলেন ‘তুমি এরকম ধারা কাঁদিছো কেন? আমি তো আবার ফিরে আসব-শিগগিরই। তোমার কান্না দেখে মনে হচ্ছে, তুমি ভাবছি, আমি আর কখনও ফিরে আসব না।’
কিন্তু হায়, এসব কথায় কি ভাঙা বুক সান্ত্বনা মানে? জানি, তুৰ্গেনিয়েফের তখনো বিশ্বাস ছিল তিনি ফিরে আসবেন, কিন্তু যে ভালোবসেছে সমস্ত সত্তা সর্বৈব অস্তিত্ব দিয়ে তার হৃদয় তো তখন ভবিষ্যৎ দেখতে পায়-বিধাতা পুরুষেরই মত।
তুৰ্গেনিয়েফ বললেন, ‘তোমার জন্য প্যারিস থেকে কি নিয়ে আসব?’
কোনো উত্তর নেই।
‘বল কি নিয়ে আসব?’
‘কিচ্ছু না–শুধু তুমি ফিরে এসো।’
কিছু না? সে কি কথা? আর সবাই তো এটা, ওটা, সেটা চেয়েছে। এই দেখো, আমি নোটবুকে সব কিছু টুকে নিয়েছি। কিন্তু তোমার জন্য সব চেয়ে ভালো, সব চেয়ে দামী জিনিস আনতে চাই। বলো কি আনব?’
‘কিচ্ছু না।’
তুৰ্গেনিয়োফকে অনেকক্ষণ ধরে পীড়াপীড়ি করতে হয়েছিল, মেয়েটির কাছ থেকে কোন একটা কিছু একটার ফরমাইশ বের করতে। শেষটায় সে বললে, ‘তবে আমার জন্য সুগন্ধি সাবান নিয়ে এসো।’
তুৰ্গেনিয়েফ তো অবাক। এই সামান্য জিনিস! কিন্তু কেন বলে তো, তোমার আজ সাবানে শখ গেল? কই তুমি তো কখনো পাউডার সাবানের জন্য এতটুকু মায়া দেখাও নি—তুমি তো সাজগোজ করতে পছন্দ কর না।’
নিরুত্তর।
‘বলো।‘
‘তা হলে আনবার দরকার নেই।’ তারপর ইভানের কেলৈ মাথা রেখে কেঁদে বলল, ‘ওগো, শুধু তুমি ফিরে এসো।’
‘আমি নিশ্চয়ই সাবান নিয়ে আসব। কিন্তু বল, তুমি কেন সুগন্ধি সাবান চাইলে?’
কোলে মাথা গুঁজে মেয়েটি বলল, ‘তুমি আমার হাতে চুমো খেতে ভালোবাসো আমি জানি। আর আমার হাতে লেগে থাকে সব সময় মাছের আঁশটে গন্ধ। কিছুতেই ছাড়াতে পারি নে। প্যারিসের সুগন্ধি সাবানে শুনেছি সব গন্ধ কেটে যায়। তখন চুমো খেতে তোমার গন্ধ লাগবে না।’
অদৃষ্ট তুৰ্গেনিয়োফকে সে গ্রামে ফেরবার অনুমতি দেন নি।
সে দুঃখ তুৰ্গেনিয়েফও বুড়ো বয়স পর্যন্ত ভুলতে পারেন নি।