মপাসাঁ
বাঙালায় বলি, ‘গেঁয়ো যোগী ভিখ পায় না’, ‘পদ্মার ওপারে বলি,–
‘পীর মানে না দেশে-খেশে,
পীর মানে না ঘরের বউয়ে,’
আর পশ্চিমারা বলেন, ‘ঘরকী মুর্গী দল বরাবর’ অর্থাৎ পরে পোষা মুর্গী মানুষ এমনি তাচ্ছিল্য করে খায়, যেন নিত্যকার ডাল-ভাত খাচ্ছে।
কিন্তু একবার গায়ের কদর পাওয়ার পর আবার যে মানুষ গেঁয়ো যোগী হতে পারে, সে সম্বন্ধে কোনো প্ৰবাদ আমার জানা নেই। কিন্তু তাই হয়েছে, স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি মপাসাঁর বেলায়।
মাস তিনেক পূর্বে মপাসাঁর কয়েকখানা চিঠি পুস্তকাকারে প্রকাশিত হয়েছে। তারি সমালোচনা করতে গিয়ে ফরাসী একাডেমির সদস্য-অর্থাৎ তিনি অতিশয় কেষ্ট-বিষ্টু জন-মাসিয়ো আঁদ্রে বিইঈ (Billy) মপাসাঁ সম্বন্ধে মিঠে-কড়া দু-চারটি কথা বলেছেন।
এক ফরাসী সাহিত্য-প্রচারক নাকি বিইঈকে বললেন, ‘কেন্ত্রিজের ছেলে-মেয়েরা আজকাল যে মপাসাঁ পড়ে, সে শুধু অস্বাস্থ্যকর কৌতূহল নিয়ে।’ (অর্থাৎ মপাসাঁর যৌন গল্পগুলোই তারা পড়ে বেশি)। উত্তরে বিইঈ বললেন, ‘বিদেশীরা, বিশেষত কেন্ত্ৰিজ অক্সফোর্ডের লোক আজকাল আর মপাসাঁ পড়ে না, তারা পড়ে প্রস্ত, ভালেরি, মালার্মে, র্যাবো। মপাসাঁর কদর এখনো আছে জর্মনি এবং রাশায়। খুদ ফ্রান্সে ছোকরার দল তো মপাসাঁকে একদম পাঁচের বাদ দিয়ে বসে আছে। ভুল করেছে না ঠিক করেছে? কিছুটা ভুল কিছুটা ঠিক-কারণ মপাসাঁ একদিক দিয়ে যেমন অত্যাশ্চর্যকলাসৃষ্টি করেছেন, অন্যদিকে আবার অত্যন্ত যাচ্ছেতাইও লিখেছেন।’
এ সম্পর্কে মপাসাঁর চিঠি প্ৰকাশ করতে গিয়ে সম্পাদক মেনিয়াল(১) বলছেন, ‘আমেরিকার লোকে মপাসাঁ পড়ে উঁচুদরের ক্লাসিক হিসেবে। মপাসাঁর সর্বাঙ্গসুন্দর ভাষাকে সেখানকার ফরাসী পড়ুয়া মাত্রই আদর্শরূপে মেনে নেয়। তাঁর ভাষার স্বচ্ছতার জন্যই (সে স্বচ্ছতার উচ্ছসিত প্ৰশংসা করেছেন আনতোঁল ফ্রাসের মত গুণী আমেরিকাতে মপাসাঁর লেখা উদ্ধৃত করে অন্তত কুড়িখানা পাঠ্য বই বেরিয়েছে।’
উত্তরে বিইঈ সাহেব অবিশ্বাসের সুরে বলেছেন, ‘জানতে ইচ্ছে করে, এখনো কি মার্কিন পাঠক মপাসাঁকে এতটা কদর করে? আর ইংলন্ডের অবস্থা কি? মেনিয়াল তো কিছু বললেন না; আমার মনে হয়, মপাসাঁর লেখাতে যেটুকু খাঁটি ফরাসি ইংরেজ সেটা এড়িয়ে চলে।’
চলতে পারে, নাও চলতে পারে। সে কথা উপস্থিত থাক। এর পর কিন্তু বিইঈ সায়েব যেটা বলেছেন সেটা মারাত্মক। সকলেই জানেন, মপাসাঁ ছিলেন ফ্লবেরের অতি প্রিয় শিষ্য-ফ্লবের তাঁকে হাতে ধরে লিখতে শিখিয়েছিলেন। বিইঈ বলেছেন, ফ্রাবের তার প্রিয় শিষ্যের কোনো দোষই দেখতে পেতেন না। কিন্তু তিনি পর্যন্ত বেঁচে থাকলে মপাসাঁর অত্যধিক (Surabondant = Superabundant) লেখার নিন্দা করতেন।’
এ কথাটা আমি ঠিক বুঝতে পারলুম না, তবে এ সম্পর্কে হিটলারের একটা মন্তব্য মনে পড়ল। হিটলার বলতেন, ‘আজকালকার ছোকরার বড্ড বেশি বই পড়ে আর তার শতকরা নব্বই ভাগ ভুলে যায়। তার চেয়ে যদি দশখানা বই পড়ে ন’খানা মনে রাখতে পারে, তবে সেই হয় ভালো।‘ মাস্টার হিসেবে আমার জানা আছে, দশখানা বই পড়লে ছেলেরা ভুলে মেরে দেয় ন’খানা। কিম্বা বলতে পারেন, পাঁচ দুগুণে দশের শূন্য নেমে হাতে রাইবে পেন্সিল!
মপাসাঁ যদি তাঁর লেখার ত্রিশ ভাগ কমিয়ে দিতেন, তবে সে ত্রিশ ভাগে কি শুধু তার খারাপ লেখাগুলিই-বিইঈর বিচারে-পড়ত? কাটা পড়ত দুইই। তাহলে অন্তত শতকরা কুড়িটি উত্তম গল্প আমরা পেতুমই না! ইংরেজিতে বলে, টিবের নোংরা জল ফেলার সময় বাচ্চাকেও ফেলে দিয়ে না।’ ফেলা যায় বলেই এ সতর্কবাণী!
ভাল লেখা বার বার পড়ি। খারাপ লেখা একবার পড়ে না পড়লেই হল।
কিন্তু মোদ্দা কথায় আসা যাক।
ইংরেজ, জর্মন, রাশান, স্পেনিশ, এমন কি আরবী, ফারসী বাঙলা, উর্দু নিন এমন কোন সাহিত্য আছে যে মপাসাঁর কাছে ঋণী নয়? ছোট গল্প লেখা আমরা শিখলুম কার কাছ থেকে? উপন্যাসের বেলা বলা শক্ত কে কার কাছ থেকে শিখল, কিন্তু ছোট গল্প লেখা সবাই শিখেছেন মপাসাঁর কাছ থেকে। কিম্বা দেখবেন রাম যদি শ্যামের কাছ থেকে শিখে থাকেন, তবে শ্যাম শিখেছেন মপাসাঁর কাছ থেকে। স্বয়ং রবীন্দ্ৰনাথ মপাসাঁর কাছে ঋণীযদিও জানি অসাধারণ প্রতিভা আর অভূতপূর্ব সৃষ্টিশক্তি ধারণ করতেন বলে রবীন্দ্রনাথ বহুতর গল্পে মপাসাঁকে ছাড়িয়ে বহুদূরে চলে গিয়েছেন। গীতিরস ছিল রবীন্দ্রনাথের হস্তস্তলে-মপাসার যেখানে ছিল কিঞ্চিৎ অনটন-তাই ছোট গল্পে গীতিরস সঞ্চার করে তিনি এক নতুন রসবস্তু গড়ে তুললেন, কবিতাতে সুর দিয়ে যে রকম ঐন্দ্ৰজালিক গান সৃষ্টি করেছিলেন।
শেষ কথা, কার ভাণ্ডার থেকে মানুষ সবচেয়ে বেশি চুরি করেছে? যে কোনো একখানা হেজিপোঁজি মাসিক হাতে তুলে নিন। দেখবেন ভালো গল্পটি মপাসাঁর লোপাট চুরি—দেশকলপাত্র বদলে দিয়ে। আর আশ্চর্যামপাসাঁর বেলাই এ জিনিসটা করা যায় সব চেয়ে বেশি, কারণ তাঁর অধিকাংশ গল্পই সব কিছুর সীমানা ছাড়িয়ে যায়।
এত চুরির পরও যাঁর ভাণ্ডার অফুরন্ত তিনি প্ৰাতঃস্মরণীয়।
——-
(১) M. Edouard Mayniai এবং Artine Artinian কর্তৃক প্রকাশিত Correspondence inedite.