দিস ইয়োরোপ

দিস ইয়োরোপ

গিরিজা মুখুজ্জে দেশে থাকতে বার দুই জেলে যান—সে কিছু না, নস্যি। (কেন বলছি, বাকিটুকু পড়লেই বুঝতে পারবেন)। তারপর ছিটকে গিয়ে লন্ডন, সেখান থেকে প্যারিস। দিব্য আছেন, সরবন যান, ফরাসী গুণীদের সঙ্গে যোগাযোগ হয়েছে, দু পয়সা কামানও বটে। এমন সময় দেখা গেল, জর্মনরা প্যারিসের ঘাড়ে এসে পড়ল বলে। মুখুজ্জে গুটিকয়েক ফরাসী আত্মজনের সঙ্গে আরো সব লক্ষ লক্ষ ফরাসিদের মতো দক্ষিণের পথ ধরলেন। পায়ে হেঁটে, মালবোঝাই বাইসিকেল কিংবা হাত-গাড়ি ঠেলে ঠেলে যখন ক্ষুধাতৃষ্ণা, ক্লান্তিতে ভিরমি যাবার উপক্রম (ওদিকে মনে মনে ভাবছেন, জর্মনদের হাত থেকে রেহাই পেয়েছেন), তখন হঠাৎ মালুম হল, জর্মন বাহিনী তাঁকে পিছনে ফেলে রাতারাতি অনেকখানি এগিয়ে গিয়েছে। তখন সামনে পিছনে সবই সমান; ফিরে এলেন প্যারিস।

মুখুজ্জে ভারতীয়, কাজেই ইংরেজের দুশমন। কিন্তু তাহলে কি হয়-পাসপোর্ট যে পাকাপোক্ত ইস্টাম্পো মারা রয়েছে, মুখুজ্জে ব্রিটিশ প্রজা, অর্থাৎ তিনি জার্মানির শত্রু। কাজেই যদিও পাদমেকং ন গচ্ছমি করে আপনি কুঠুরিতে সুবো।–শাম ঘাপটি মেরে বসে থাকেন, তবু।

একদা কেমনে জানি ভারতীয় মহাশয়
পড়িলেন ধরা, আহা, দূরদৃষ্ট অতিশয়।(১)

জর্মন পুলিশের তদারকিতে ফরাসী জেলখানায় মুখুজ্জে তখন ইস্টদেবতার নাম জপ। করতে লাগলেন। সে-জেলে ইংরেজের শত্ৰু-মিত্র বিস্তর ব্রিটিশ’ প্রজার সঙ্গে তার যোগাযোগ হল। তার বর্ণনাটি মনোরম।

কিছুদিন পর জেল থেকে নিষ্কৃতি পেলেন।

তখন নাম্বিয়ার তাকে বললেন, তার সঙ্গে বার্লিন যেতে। সেখানে গিয়ে দেখেন, সুভাষচন্দ্ৰ ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য হরেক রকম তরিকত-তত্ত্বতাবাশ আরম্ভ করে দিয়েছেন। মুখুজ্জেকে ‘আজাদ হিন্দ’ বেতারে বেঁধে দেওয়া হল নানা প্রকারের ব্রডকাস্টের জন্যে। সুভাষের সঙ্গে তার সাক্ষাৎ যোগাযোগ হল। গ্র্যান্ড মুফতির সঙ্গেও বিস্তর দহরম মহরাম হল।

সুভাষ সম্বন্ধে মুখুজ্জে অনেক কিছু লিখেছেন। উপাদেয়।

তারপর সুভাষ দেখলেন, বার্লিনে থেকে কাজ হবে না। ওদিকে ইংরেজ সিঙ্গাপুরে শিঙে ফুঁকেছে। জাপানীরা বর্মায় ঢুকছে। সুভাষ চলে গেলেন জাপান। এদিকে ‘আজাদ হিন্দ’ বেতার দাঁড়কচা মেরে গেল। মুখুজ্জেরা কিন্তু ক্ষান্ত দেন নি।

তারপর জর্মনির পতন আরম্ভ হল। বোমার ঠেলায় বার্লিনে কাজ করা দায়। তাবৎ ভারতীয়কে সরানো হল হল্যান্ডে; সেখান থেকে ‘আজাদ হিন্দ’র বেতোরকর্মচালু থাকল বটে, কিন্তু মুখুজ্জেরা বুঝলেন, সময় ঘনিয়ে এসেছে। তারপর প্রায় সবাই একে একে ফিরে এলেন বার্লিন। সেখান থেকে মুখুজ্জে গেলেন দক্ষিণ-জার্মনিতে। ইতিমধ্যে রাশানরা ঢুকল বার্লিনে।

এবারে তিনি আইনত রাশার শত্রু। কারণ রাশার মিত্র ইংরেজদের বিরুদ্ধে তিনি বিস্তর বেতার বক্তৃতা ঝেড়ে বসে আছেন। আইনত তিনি অ্যামেরি, হো হো’র সমগোত্র। কাজেই পালাতে হলে নিরপেক্ষ’ সুইটজারল্যান্ডে। এক দরদী জর্মন সীমান্ত পুলিশই তাকে বাতলে দিলে কি করে নিযুতি রাতে রাইন নদী সাঁতরে ওপারে যাওয়া যায়।

আমরা ভাবি সুইসরা বড়ই নিরপেক্ষ মোলায়েম জাত। মুখুজ্জে সেখানে যে বেইজাতি আর লাঞ্ছনার ভিতর দিয়ে গেলেন, তার বর্ণনা আমি আর এখানে দিলুম না।

সুইসরা মুখুজ্জেকে আত্মহত্যার দরজায় পৌঁছিয়ে হঠাৎ একদিন প্রায় ‘কানে ধরে’ ধাক্কা মেরে ঢুকিয়ে দিল জর্মনিতে। জর্মনির যে অঞ্চলে তাঁকে ফেরত-ডাকে পাঠানো হল, সেটি ফরাসীর তীবেতে। কাজেই তাকে পত্রপাঠ গ্রেপ্তার করা হল। কিন্তু মুখুজ্জে যখন কমান্ডান্টিকে বুঝিয়ে দিলেন, তিনি জর্মনিতে যা কিছু করেছেন সে শুধু ‘পাত্রি’র (দেশের) জন্য, তখন ফরাসীরা-আর এ শুধু ফরাসীরাই পারে—মুখুজ্জের বিগত জীবনটা যেন বেবাক ভুলে গেল। শুধু তাই নয়, খেতে পরতে দিল। বলল, ‘তুমি যখন দিব্য ফরাসিজর্মন জানো, তখন আমাদের সঙ্গে থেকে কাজ করো না কেন?’ তাই সই। ব্যবস্থাটা স্থানীয় জর্মনদেরও মনঃপূত হল—অবিশ্যি বিজয়ী ফরাসীরা তখন তার থোড়াই পরোয়া করতকারণ মুখুজ্জে তাদের সামনে ‘দম্ভী বীরে’র মূর্তিতে দেখা দেন নি।

তারপর সেই ফরাসী রেজিমেন্ট দেশে চলে গেল। মুখুজ্জের আবার জেল। ইংরেজ তখন অ্যামেরি হো হো’র মতো মুখুজ্জেকে পেলে তাঁকেও ঝোলায়।

কিন্তু ঝোলাবার সুযোগ পায় নি। ফরাসীরা মুখুজ্জেকে ইংরেজের হাতে তুলে দেয় নি। তারপর স্বরাজ হয়ে গেল। দেশের ছেলে দেশে ফিরে এল।

***

কিন্তু বইখানা মুখুজ্জের আত্মজীবনী নয়। বইটিতে মুখুজ্জে ইয়োরোপ দেখেছেন নানা দৃষ্টিকোণ থেকে, নানা পটপরিবর্তনের সামনে, পয়লা সারিতে বসে। উত্তম বই।(২)

——-
(১) সুকুমার রায়ের অচলিত কবিতা।

(২) S. Girija Mukherjee, This Europe. Saraswaty library, Calcutta.

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *