জয়হে ভারতভাগ্যবিধাতা

জয়হে ভারতভাগ্যবিধাতা

ম্যাট্রিক পাশের লিস্টে নাম দেখে। যেমন ইয়া আল্লা’ বলে ছেলে-ছোকরার লম্ফ দিয়ে ওঠে আমাদের অখণ্ড স্বরাজলাভের আনন্দোল্লাস তার সঙ্গে তুলনীয়। এমন কি, ম্যাট্রিকেও যদি পাঠকের মন সন্তুষ্ট না হয় তাহলে বি.এ. এম.এ. পি.এইচ. ডি. ডি. লিট যা খুশি বলতে পারেন তাতেও কোনো আপত্তি নেই। শুধু তাই নয়-এ স্বাধীনতা পাশের আনন্দ অন্য সব পাশের চেয়ে অনেক, অনেক বেশি। কারণ অন্য যে-কোনো পরীক্ষায় দু-একজনের ইয়ারবক্সী ফেল মারেনই মারেন— নিতান্ত পরশ্ৰীকান্তর এবং বিয়-সন্তোষী ব্যক্তি ভিন্ন অন্য কারোরই কোনো পরীক্ষা পাশ নিরঙ্কুশ আনন্দদায়ক হয় না—এ-পরীক্ষায় কিন্তু সবাই পাশ, সবাই রাজা। চক্রবর্তী রাজাগোপালাচারী আজ স্বাধীন হলেন, আপনিও হলেন, আমিও হলুম!

কিন্তু প্রশ্ন অতঃ কিম? অবশ্য বলতে পারেন। পরীক্ষা পাশ করে জ্ঞানার্জন হল এবং জ্ঞানার্জন স্বয়ংসম্পূর্ণ, আপন মহিমায় স্বপ্রতিষ্ঠিত। এর পর কিছু না করলেও কোনো আপত্তি নেই। এটা একটা উত্তর বটে কিন্তু কোনো জিনিস একদম কোনো কাজে লাগল না। এ-কথাটা ভেবে কেমন যেন সুখ পাওয়া যায় না। প্রবাদ আছে, ইট ইজ বেটার টু ব্রেক দি হার্ট ইন লাভ দেন ডু নাথিং উইথ ইট’–স্বাধীনতাটা কোনো কাজে লাগাব না একথা ভেবে মন কেমন যেন সুখ পায় না; বাসনা হয়, দেখাই যাক না, রাজনৈতিক স্বরাজের মই চড়ে আরো পাঁচ রকমের স্বরাজ হস্তগত হয় কি না; এ লোভ সকলেরই থাকবে সে-কথা হলপ করে বলা যায় না, কিন্তু অন্ততপক্ষে এ তত্ত্বটা স্বীকার করে নিতে হবে যে, পাশের পর লেখা-পড়া বন্ধ করে দিলে জ্ঞান যে রকম কপূরের মতো বিনা কারণেই উবে যেতে থাকে, স্বাধীনতাটাকেও তেমনি চালু না রাখলে ক্ৰমে ক্ৰমে সেও তার রূপ বদলাতে থাকে। স্বাধীনতা লাভের পরমুহূর্তেই যদি বেধড়ক ধর-পাকড় আরম্ভ করে দেন, মনে মনে ভাবেন পাঁচটা লোকের স্বাধীনতা কেড়ে নিলেই পাঁচশ লোকের স্বাধীনতার বাঁচা তো হয়ে যাবে। কিংবা যদি ব্যক্তি-স্বাধীনতার দোহাই দিয়ে কালোবাজারীদের ল্যাম্পপোস্টে না ঝোলান। তবে শেষ পর্যন্ত আমাদের স্বরাজ লাভটা ঠিক কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে আগেভাগে হলফ করে কিছু বলা যায় না।

হিটলারের পূর্বেও জর্মনি স্বাধীন ছিল কিন্তু জর্মনিকে সর্বাঙ্গসুন্দর স্বাধীনতা দিলেন হিটলার। লেনিনের পূর্বে রাশার জনসাধারণ স্বাধীনতার স্বাদ পায় নি, লেনিন এক ধাক্কায় গোটা দেশটাকে অনেকখানি এগিয়ে দিলেন। এখন আবার স্তালিন দেশটাকে এমন এক জায়গায় নিয়ে এসেছেন যে এর পর কি হয় না হয় বলা কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। শেষ পর্যন্ত তিনিও হিটলারের গতি লাভ করবেন নাকি?

কাজেই ধরে নেওয়া যেতে পারে, আমাদের চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকবার কোনো উপায় নেই-কিছু একটা করতেই হবে। স্বাধীনতার ঘোড়া চড়ি আর নাই চড়ি সেটাকে অন্তত বাঁচিয়ে রাখার জন্য দানা-পানির খর্চা হবেই হবে।

আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলনের অনেকখানি বিলিতি ছিল বলে আমাদের স্বরাজলোভও অনেকখানি বিলিতি কায়দায় হয়েছে। এখনও আমাদের লাটবেলাটরা বিলিতি কায়দায় লঞ্চ-ডিনার খাওয়ান, পেরটি দেখেন, সেলুট নেন, এডিসি ফেডিসি কত ঝামেলা, কত বখেড়া। তাই স্বাধীনতা নিয়ে কি করব কথাটা উঠলেই গুণীরা বলেন, ‘ইয়োরোপ কি বলছে, কান পেতে শোনো তো; তারপর বিবেচনা করে ভালো-মন্দ যা হয় একটা কিছু করব।’

ইয়োরোপ কি বলছে সে বিষয়ে কারো মনে কোনো ধোঁকা নেই। ইয়োরোপ বলছে, ‘হয় মার্কিন ইংরেজের ডিমোক্রেসি গ্রহণ করে তাদের দলে যোগ দাও, নয়। লালরক্ত মেখে রুশের সঙ্গে এক হয়ে যাও। এ ছাড়া অন্য কোনো পথ নেই।’

ক্ষীণকণ্ঠে কেউ কেউ বলেন, ‘কেন? টিটো?’

উত্তরে শুনি অট্টহাস্য। টিটো ইংরেজ বন্দুক-কামান কেনা-বেচার সমঝওতাও নাকি হয়ে গিয়েছে কিংবা হব-হব করছে। টিটো মিয়ার তৃতীয় পন্থা’ তিতুমীরের বাঁশের কেল্লার মতো তিন দিনও টিকল না। তাকেও আস্তে আস্তে মার্কিন-ইংরেজের আস্তিন পাকড়ে এগোতে হচ্ছে।

এর পর আর কোন সাহসে ফ্রান্স, সুইজারল্যান্ডের কথা তুলি?

এবং তার চেয়েও মারাত্মক হয়ে দাঁড়িয়েছে ইয়োরোপীয় সাহিত্যিক, চিত্রকর, কবি, দার্শনিকদের নিরঙ্কুশ নৈরাশ্যবাদ। ইংরেজি, ফরাসি, জর্মন, ইতালি যে কোনো মাসিক খুললেই দেখতে পাবেন ইয়োরোপের চিন্তাশীল ব্যক্তিই মাথায় হাত দিয়ে বলেছেন, ‘কোনো পন্থাই তো দেখতে পাচ্ছি নে-মার্কিনের দেখানো পথ মনঃপূত হয় না, রুশের পথই বা ধরি কি প্রকারে? মার্কিন ইংরেজের ‘ডিমোক্রেসি’ এমনিতেই শোষণ-পহী, তার উপর আমরা যদি তাদের সঙ্গে যোগ দিয়ে কমুনিজমকে নির্মূল করে দি তাহলে এখনো তারা রুশ জুজুর ভয়ে যেটুকু সমঝে চলত, চাষামজুরকে দুমুঠো অন্ন দিত। তাও আর দেবে না। আর রুশের কলমা পড়ে যদি মার্কিন ইংরেজকে সাবড়ে দিই তাহলে স্তালিনকে ঠেকাবে কে? যুগ যুগ সঞ্চিত ইয়োরোপের তাবৎ সভ্যতা তাবৎ সংস্কৃতিকে তো তিনি ‘বুর্জেয়া’ বলে নাকচ করে দিয়েছেন, এমন কি তাঁরা আপনজন ভাৰ্গ, ভাভিলফ, কলৎসফ হয় ‘পেনশনে’ নয় নির্বাসনে কিংবা মাটির নীচে। স্তালিন যদি বিশ্বজয় করতে পারেন তবে এ-দুনিয়াতে বাইবেল-কুরান, বেদ-পুরাণ তো থাকবেনই না, প্লাতো-শেকসপীিয়র থাকবেন। কিনা তাই নিয়ে অনায়াসে জল্পনা-কল্পনা করা যেতে পারে। আণ্ডা-মাখনের ছয়লাফ হয়তো হবে, কিন্তু এই পৃথিবীর লোক প্লাতে শেকস্পীয়র পড়তে পাবে না। শুনে স্তালিনী কলম পড়তে কিছুতেই মন মানে না।’

এবং তার চেয়েও মারাত্মক হয়ে দাঁড়িয়েছে খ্ৰীষ্টধর্মের প্রতি এদের নৈরাশ্যের অনুযোগ। একমাত্র পেশাদারী পাদ্রি-পুরোত ছাড়াইয়োরোপের চিন্তাশীল ব্যক্তিরা আজ আর এ-বিশ্বাস করেন না যে প্ৰভু যীশুর সাম্যের বাণী বিশ্বসমস্যার সমাধান করতে পারবে। একদিন সে-বাণী দাসকে মুক্তি দিয়েছিল, অত্যাচারকে শান্ত করতে পেরেছিল, জড়লোক থেকে অধ্যাত্মলোকের অনির্বাণ দীপশিখার চিরন্তন দেওয়ালির উৎসব প্রাঙ্গণে নিয়ে যেতে চেয়েছিল, কিন্তু আজ সে বাণী ভার্টিকানের আপনি দেশেই লুণ্ঠন অগ্নিবর্ষণ বন্ধ করতে পারছে না।

ইয়োরোপ মরা ঘোড়ার মতো পড়ে আছে। ধর্মের চাবুকে সে আর খাড়া হবে না। অতএব? অতএব কোনো দিকেই যখন আর কোনো ভরসা নেই তখন যা-খুশি একটা বেছে নাও। আর দয়া করে আমাদের শাস্তিতে মরতে দাও, আর তাও যদি না করতে দাও তবে আত্মহত্যা করতে দাও। রুশিয়া এবং পশ্চিম-ইয়োরোপে আত্মহত্যার প্রচেষ্টা চিন্তাশীল ব্যক্তিদের ভিতরই আজ বেশি।

***

আমরা যদি হটেনটট হাতুম তাহলে আমাদের কোনো দুর্ভাবনা থাকতো না। আত্মহত্যা ছাড়া—অসভ্যদের ভিতর আত্মহত্যার সংখ্যা অতি নগণ্যও বটে—অন্য যে-কোনো দুটো পন্থার ভিতরে একটা বেছে নিয়ে দুৰ্গা’ বলে ঝুলে পড়তুম। তারপর যা-হবার মত। (কিছুটা যে হয়েছে সে-কথা অস্বীকার করা যায় না। কম্যুনিস্টরা তো আছেনই, আরেক দল যে রুশের বিরুদ্ধে ঝটপট শক্ৰতা জানিয়ে মার্কিন কল-কব্জা হাতিয়ে এ-দেশটা শোষণ করতে চান সে তত্ত্বটাও আমাদের অজানা নয়।)

‘ধন্য সেই জাত, যার কোনো ইতিহাস নেই।’ সে নিৰ্ভয়ে যা-কিছু একটা বেছে নিতে পারে।

কিন্তু দুৰ্ভাগ্যই বলুন, আর সৌভাগ্যই বলুন আমাদের ঐতিহ্য রয়েছে। সে ঐতিহে্যু আমরা শ্ৰদ্ধা হারাই নি-হয়তো তার প্রধান কারণ এই যে, বিদেশী শাসনের ফলে আমরা সে ঐতিহ্য অনুযায়ী চলবার সুযোগ এ যাবৎ পাই নি।

কিন্তু যতদিন সে-শ্রদ্ধা আমাদের মনে রয়েছে ততদিন তো আমরা বিগত যৌবনা অরক্ষণীয়ার মতো নিরাশ হয়ে গিয়ে মার্কিন কিংবা রুশের গলায় মালা পরিয়ে দিতে পারি। নে। স্বরাজের জন্য যারা জেল খাটল, প্ৰাণ দিল তাদের অনেকেই তো মনে মনে স্বপ্ন দেখেছিল ভারতবর্ষের লুপ্ত ঐতিহ্য উদ্ধার করে তারই আলোকে ভবিষ্যতের পথ বেছে নেব, এমন কি গোপনে গোপনে হয়তো এ দম্ভও পোষণ করেছিল যে বিশ্বজনকেও সেই ‘আলোকমাতাল স্বৰ্গসভার মহাঙ্গনে’ নিমন্ত্রণ করতে পারবে। কৃষ্ণের দেশ, বুদ্ধের দেশ, চৈতন্যের দেশ আজি কপৰ্দকহীন, দেউলে, একথা মন তো সহজে মেনে নিতে চায় না।

কিন্তু সেখানে আরেক বিপদ। ঐতিহ্যের কথা তুললেই আরেক দল উল্লসিত হয়ে বলেন, ‘ঠিক বলছি, চলো, আমরা বেদ-উপনিষদের সত্যযুগে ফিরে যাই।’

কোনো বিশেষ সত্যযুগে ফিরে যাওয়ার অর্থই মেনে নেওয়া যে, আমাদের ভবিষ্যৎ বলে কোনো জিনিস নেই, সেই যুগকে প্রাণপণ আঁকড়ে ধরার অর্থই হল এ-কথা মেনে নেওয়া যে আমরা যুগ যুগ ধরে শুধু অবনতির পথেই চলে আসছি এবং নূতন জীবন, নবীন ভবিষ্যৎ গড়ে তোলবার মতো কোনো ক্ষমতা আমাদের নেই। তাই এঁরা তখন সেই বিশেষ ‘সত্যযুগে’র আচার-ব্যবহার, ক্রিয়াকর্ম (এমন কি কুসংস্কার পর্যন্ত, কারণ আমরা বিশেষ কোনো সর্বাঙ্গসুন্দর সত্যযুগে বিশ্বাস করিনে বলে সব যুগেই কিছু না কিছু কুসংস্কার মুঢ়তা ছিল বলে ধরে নিই) পদে পদে অনুসরণ অনুকরণ করতে লেগে যান, তখন জিগির ওঠে, ইয়োরোপীয় সব কিছু বর্জন করো, মার্কিন রুশের গা ছুঁয়েছ কি প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে, ছড়াও চতুর্দিকে গোবরের জল, ঠেকও তাই দিয়ে শুদ্ধ ‘ভারতীয়-সংস্কৃতি’–কে ‘অস্পৃশ্যের পাপস্পর্শ থেকে’।

এঁরা গড়ে তুলতে চান আবার সেই অচলায়তন’ যার অন্ধ প্রাচীর ভেঙে ফেলবার জন্য কবিগুরু জীবনের শেষদিন পর্যন্ত লাঞ্ছিত, অপমানিত হয়েছিলেন। তিনি চেয়েছিলেন নবযুগের প্রতীক নূতন ‘ডাকঘর’ যার ভিতর দিয়ে রুগ্ন অমলকে বাণী পাঠাবেন প্রাচীন রাজা, যিনি জনগণের অধিনায়ক, ভারতভাগ্য-বিধাতা।

মার্কিন না রুশ না, এমন কি ভারতীয় কোন বিশেষ সত্যযুগ’ও না-এসব এড়িয়ে বাঁচিয়ে ভারতীয় ঐতিহ্যের চলিষ্ণু সদাজাগ্রত শাশ্বত সত্যধর্মের পথে আমাদের চালাবেন কে? সর্বব্যাপী দ্বন্দ্ব, আদর্শে আদর্শে সংঘাত, ঐতিহ্যে ঐতিহ্যে সংগ্রাম, এর মাঝখানে শান্তসমাহিত হয়ে ধ্রুব সত্যের সন্ধান দেবেন কে?

তিনি এলে আমরা তাকে চিনতে পারব তো? আমরা মনে হয়। পারব। কারণ তিনি কোন ভাষায় তার বাণী প্রচার করবেন তার কিছুটা সন্ধান আমরা পেয়ে গিয়েছি—তিনি স্বীকার করে নেবেন প্রথমেই জনগণমন-অধিনায়ক ভারত-ভাগ্যবিধাতাকে, তার উদার বাণীতেও অহরহ প্রচারিত থাকবে সেই আহ্বান যে আহ্বানে সাড়া দেবে হিন্দু-বৌদ্ধ-শিখজৈন-পারসিক-মুসলমান-খ্ৰীষ্টান, তার কণ্ঠে শুনতে পাবো সেই চির-সারথির রথচক্ৰঘর্ঘর, যিনি পতন অভ্যুদয়ের বন্ধুর পন্থার উপর দিয়ে নিয়ে এসেছেন আমাদিগকে এই নবযুগের অরুণোদয়ের সামনে।

শত মূঢ়তার মাঝখানে যে আমরা আজ কোটিকণ্ঠে ভারত-ভাগ্যবিধাতাকে স্বীকার করে নিলুম-জাতীয়-সঙ্গীত নির্বাচনে পথভ্রান্ত হইনি-এ বড় কম আশার কথা নয়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *