• Skip to main content
  • Skip to header right navigation
  • Skip to site footer

Bangla Library

Read Bengali Books Online (বাংলা বই পড়ুন)

  • সব বই
  • লেখক
  • সিরিজ
  • বইয়ের ধরণ
  • Login/Register
  • My Account →
  • সব বই
  • লেখক
  • সিরিজ
  • বইয়ের ধরণ
  • Login/Register
  • My Account →
  • বাংলা ডিকশনারি
  • বাংলা কৌতুক
  • বাংলা লিরিক্স
  • বাংলা রেসিপি
  • হেলথ টিপস এন্ড নিউজ

বাংলা নতুন/পুরাতন বইয়ের পিডিএফ ডাউনলোড/সন্ধান করতে আমাদের বাংলা পিফিএফ সাইটে ক্লিক করুন।

Bangla PDF

মহাভারতের প্রতিনায়ক – নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ী

লাইব্রেরি » নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ী » মহাভারতের প্রতিনায়ক – নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ী
মহাভারতের প্রতিনায়ক - নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ী

সূচিপত্র

  1. মহাভারতের প্রতিনায়ক – নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ী
  2. কথামুখ

মহাভারতের প্রতিনায়ক – নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ী

মহাভারতের প্রতিপক্ষ নায়ক এবং এক উদাসীন

প্রথম সংস্করণ: জানুয়ারি ২০০৯
প্রকাশক: আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড
প্রচ্ছদ: সুব্রত চৌধুরী

যাঁর মধ্যে ‘আত্মবৎ পরেষু’ অনুভব-সংবেদন
দেখেছি চিরকাল, সেই অনুভবী
সুধেন্দু সরকারের জন্য

কথামুখ

আমাদের দেশই বোধহয় একমাত্র দেশ, যে-দেশের শাস্ত্র নিরঙ্কুশ ধর্মের কথা বলে না, বরঞ্চ মানুষের প্রবৃত্তি বুঝে সমানুপাতিক ধর্মের উপদেশ দেয়। যে মনু-মহারাজকে এ-দেশের অর্বাচীন পণ্ডিতেরা নিরবচ্ছিন্ন গালি দেন, তাঁরা জানবেন, মনুই কিন্তু এ-দেশের পুরাতন রাজনীতি-শাস্ত্রের প্রণেতা এবং সে-রাজশাস্ত্রের নীতি-নৈতিকতা এখনও এত সময়োপযোগী যে, তা বুঝে ফেললে এটাই প্রথম মনে আসবে যে, আমাদের গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রশাসন এখনও প্রাচীন রাজতন্ত্রের ইতরবিশেষ প্রতিরূপমাত্র। সবার আগে এটাই মনে রাখুন যে, এই মনুই কী অসম্ভব বাস্তব দৃষ্টিতে এ-কথা বলেছিলেন যে, দ্যাখো— মাংস খাওয়াতেও দোষ নেই, মদ খাওয়াতেও দোষ নেই, এমনকী স্ত্রী-পুরুষের মৈথুনেও নয়। কেননা এগুলোই মানুষের প্রবৃত্তি, তবে কিনা এসব থেকে নিবৃত্ত হওয়াটাই সবচেয়ে ভাল।

আমি এই ধরনের একটা আক্রোশ থেকে যে এই পুস্তকের ভূমিকা লিখতে বসলাম, তার কারণ আমাদের শাস্ত্র এবং সাহিত্য মানুষকে বড় বাস্তবদৃষ্টিতে দেখেছে। আমার সেদিন বড় ভাল লেগেছিল, যেদিন পুরাণশাস্ত্রের মধ্যে অন্যতম প্রাচীন মৎস্যপুরাণে দেখলাম— ভগবান ব্রহ্মা নিজের আদলে কতগুলি মানসপুত্র সৃষ্টি করে একেবারে বোকা বনে গেলেন। তিনি দেখলেন— তাঁর ছেলেগুলির কোনও কামনা-বাসনা নেই, বিয়েসাদিতে মন নেই, তারা কেবলই তপস্যা করতে চায়। ব্রহ্মার সৃষ্টি-বাসনা মনে রেখে যদি বা তাঁরা সৃষ্টি করলেন, তাঁরা সব অমর্ত্য জীব, তাঁদের জরা নেই, মরণ নেই, কেমন যেন স্থাণু পদার্থের মতো। ব্রহ্মা শেষে রেগে গিয়ে বামদেবকে বললেন, তুমি ক্ষমা দাও বাপু! তোমাকে আর সৃষ্টি করতে হবে না— ব্রহ্মণা বিনিবারিতঃ। তিনি বললেন, এ কেমনধারা সৃষ্টিকর্ম হে তোমার! জরা নেই, মরণ নেই। এটা সৃষ্টি হচ্ছে? এরকম সৃষ্টি হলে চলবে না— নৈবংবিধা ভবেৎ সৃষ্টিৰ্জরামরণবর্জিতা।

আমরা ভগবান ব্রহ্মার ভবিষ্যৎ-দৃষ্টি দেখে অবাক হয়েছি। এমনিতে এটা শুনতে খুব ভালই লাগে— জরামরণহীন অমরত্ব। কিন্তু ভেবে দেখুন একবার— মানুষ-পশু-পাখি-গাছ— কেউ যদি বুড়ো না হত, কেউ যদি না মরত, তা হলে বেচারা ম্যালথাস-এর কথা ছেড়েই দিন, আমরাই হয়তো একদিন আমাদের পিতা-মাতাদের হত্যা করতুম। তবু এটা তো সাধারণ কথা। ব্রহ্মা বললেন, দ্যাখো বাপু! সৃষ্টিকার্যে শুধু নিরঙ্কুশ ভাল আর শুভটুকু থাকবে, এমনটি ভাবলে সৃষ্টির ভাবনাটাই মিথ্যে হয়ে যাবে। সৃষ্টির মধ্যে ভালও থাকতে হবে মন্দও থাকতে হবে, শুভকেও থাকতে হবে, অশুভকেও থাকতে হবে। ভাল-মন্দ মিশিয়ে যে সৃষ্টিকর্ম, সেটাই সবচেয়ে আনন্দের, নইলে শুধুই ভাল অথবা শুধুই মন্দ— দুটোই অনাসৃষ্টি। পুরাণগম্ভীর ভাষায়— যাহা শুভ এবং অশুভাত্মিকা সৃষ্টি, তাহাই প্রশস্ত— শুভাশুভাত্মিকা যা তু সৈব সৃষ্টিঃ প্রশস্যতে।

মৎস্য মহাপুরাণের এই অসাধারণ দৃষ্টিতে আমি ভাবতেও চাই এবং এটা ভাবাতেও চাই যে, পৃথিবীর আর কোনও দেশ কি এমন অমলিন বাস্তব দৃষ্টিতে এমন ভাল-মন্দের আঁধার-আলোয় এই সুন্দরী পৃথিবীকে দেখেছে? আমাদের শাস্ত্রকারেরা কখনও এমন অন্ধ দৃষ্টিতে ভাবেননি যে, এই জগতে সকলে পরম সাধু হয়ে থাকবে, সদা সত্য কথা বলবে এবং সমস্ত অন্যায় থেকে বিরত থাকবে। বাস্তবিক এরকম যদি একটা সমাজ হত, যেখানে সত্য, ন্যায়, ধর্ম এবং মহত্ত্ব সর্বদা বিরাজ করছে, তা হলে সেই সমাজের চেয়ে জরদ্গব স্থাণু সমাজ আর কিছু হত না। আমাদের পৌরাণিক পিতামহ তাই সোচ্চারে বলে দিয়েছেন— ভাল এবং মন্দ দুই-ই থাকতে হবে এই পৃথিবীতে। হয়তো এই কারণেই যুধিষ্ঠিরের মতো এক আদর্শ ধর্মরাজ সৃষ্টি করার সময়েও মহাকাব্যের কবি তাঁর মধ্যে পাশাখেলার নেশাটুকু ধরিয়ে দেন অথবা যুধিষ্ঠিরের ধর্মভাবনার অনন্ত প্রয়াসের মধ্যেও একবার মিথ্যাবাদিতার চান্দ্ৰকলঙ্ক লেপন করেন। সত্যি বলতে কী, মহাভারতের কবির কোনও প্রিটেনশনও নেই এ ব্যাপারে। গ্রন্থারম্ভেই তিনি ঘোষণা করে দেন— আমার এই গ্রন্থ ধর্মশাস্ত্রও বটে, আবার অর্থশাস্ত্রও বটে, আবার এটাকে কামশাস্ত্রও বলতে হবে—

অর্থশাস্ত্ৰমিদং প্রোক্তং ধর্মশাস্ত্ৰমিদং মহৎ।
কামশাস্ত্ৰমিদং প্রোক্তং ব্যাসেনামিতবুদ্ধিনা॥

লক্ষণীয়, ভারতবর্ষের চরম সাধন যে মোক্ষ-ভাবনা, তার সম্বন্ধে কোনও উচ্চারণই হল না প্রথমে। বরঞ্চ যা নিয়ে মানুষ থাকে, যার পিছনে মানুষ ছোটে প্রতিনিয়ত, সেই ধর্ম, অর্থ এবং কাম যে কোনও বিগর্হিত বস্তু নয়, বরঞ্চ এইগুলিই যে সাধারণ জীবনের ধর্ম, সেটা ঘোষণা করে দিয়ে অমিতবুদ্ধি ব্যাস বুঝিয়ে দিলেন যে, তিনি কোনও অলৌকিক কল্পকথা বলতে বসেননি। বরঞ্চ কামনা-বাসনা, রাজৈশ্বর্য-লাভের স্বাভাবিক আর্থিক তাড়না যে কতদূর যেতে পারে এবং তার প্রতিস্থানে ধর্ম অথবা নীতি-নিয়ম-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করতে গেলেও যে একটা বিরাট যুদ্ধের প্রয়োজন হয়ে পড়ে, সেটা দেখানোই মহাভারতের ঐতিহাসিক উদ্দেশ্য।

ঠিক এইরকম একটা দৃষ্টিতে দেখতে গেলে, অথবা ইংরেজিতে যাকে বলি ‘ফ্রেম অব রেফারেন্স’— অর্থাৎ ধর্মার্থকামের ঘোষিত অঙ্গীকারই মহাভারতের বিশিষ্টতা— এটা ধরে নিয়েই যদি মহাভারতের বিভিন্ন চরিত্র বিচার করি, তা হলে দেখব— যুধিষ্ঠির কিংবা বিদুর অথবা ধর্মশীলা গান্ধারী মহাভারতের চরম উদ্দেশ্য সাধন করলেও তাঁরাই মহাভারতের সর্বাঙ্গ তৈরি করেন না। এমনও বলতে পারি যে, এমন চরিত্র বেশি আরও বেশি থাকলে মহাভারত একটি বিশেষ ধার্মিক সম্প্রদায়ের পাঠ্যে পরিণত হত। মহাভারতের প্রথম থেকেই অন্ধ ধৃতরাষ্ট্রের যে তীব্র রাজ্যলোভ তৈরি হতে থাকে, এই ‘স্ট্রাকচারটা তৈরি করার জন্য প্রতিনায়ক-সংস্থায় যেমন দুর্যোধন-দুঃশাসন এবং কর্ণ-শকুনির মহাকাব্যিক মিশ্রণ ঘটতে থাকে, তেমনই নায়ক-সংস্থায় ভীমের মতো একটা উপাদান এবং অবশেষে কৃষ্ণের অন্তর্ভুক্তি মহাকাব্যের পানক-রসটাকে একেবারে জারিয়ে দেয়। ঘটনা হল, দুর্যোধন, কর্ণ অথবা শকুনির চরিত্র বিশ্লেষণ করলে কোনওভাবেই এঁদের খলনায়ক বলতে পারবেন না। কেননা দুর্যোধন অথবা কর্ণের দিক থেকেও কিছু নায়কোচিত প্রতিযুক্তি আছে, কিন্তু সেগুলি শুভ এবং মঙ্গলের পথ ধরে চলে না বলেই শেষ পর্যন্ত মহাকাব্যের আদি-মধ্যান্তঃস্থায়ী শুভৈষণার বিপরীতে স্থাপিত হয়। অন্যদিকে লোভ, মোহ, আকাঙ্ক্ষা এবং হিংসা এখানে জীবনের ধর্ম অতিক্রম করে না বলেই, এমনকী কোথাও কোথাও সেই আকাঙক্ষা এবং হিংসা ধর্মসম্মিত আকাঙ্ক্ষা এবং হিংসার অনুকৃতি বহন করে বলেই দুর্যোধন-কর্ণ-দুঃশাসনদের আমরা খলনায়ক বলতে পারি না। বরঞ্চ প্রতিনায়ক বলতে পারি অথবা প্রতিপক্ষ নায়ক বলতে পারি।

সম্পূর্ণ ব্যাপারটাকে ভারতীয় রসশাস্ত্রের দৃষ্টি থেকে আরও সূক্ষ্মভাবে দেখা যায় এবং তাতে প্রতিনায়কের শক্তি-গাম্ভীর্য এবং চরিত্র-মাহাত্ম্যও অনেক বেশি তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে ওঠে। ভারতীয় মানুষ এবং শাস্ত্র-কাব্যে তাঁদের স্বভাব-ব্যবহার খেয়াল করে ভরত মুনি থেকে সাহিত্যদর্পণকার বিশ্বনাথ সকলেই চাররকম নায়কের কথা বলেছেন। সেই ভাগটা হল এইরকম— ধীরোদাত্ত, ধীরোদ্ধত, ধীরললিত এবং ধীরপ্রশান্ত। ‘ধীর’ শব্দটা সবরকম নায়কের সঙ্গেই যুক্ত, অর্থাৎ ধৈর্য, ধীরতা, ধারণ-ক্ষমতা এবং উদ্দেশ্য-সাধনে নিশ্চল যে স্বভাবটুকু, সেটা সব নায়কেরই ‘সামান্য’ গুণ। যে এদের মধ্যে ভেদ ঘটায়, সেটা হল— কোনও নায়ক উদাত্ত স্বভাবের, কেউ উদ্ধত, কেউ ললিত গুণসম্পন্ন আবার কেউ বা প্রশান্ত স্বভাবের। উদাত্ততা নিয়ে আমাদের খুব ভাবনা নেই। কেননা, ভারতবর্ষের মহাকাব্যে এমন অধিগুণসম্পন্ন নায়কের অভাব নেই, যিনি ক্ষমতা থাকতেও আত্মশ্লাঘা করেন না; তিনি এমনই এক মহাসত্ত্ব পুরুষ যাঁকে হর্ষ-শোক অভিভূত করতে পারে না। তাঁদের মান-গর্ব বাইরে প্রকাশ হয় না, অথচ অঙ্গীকার করলে সে কাজটা শেষ পর্যন্ত করবেনই। রসশাস্ত্রকারেরা এমন ধীরোদাত্ত নায়কের উদাহরণ দিতে গিয়ে রামচন্দ্র আর যুধিষ্ঠিরের কথা বলেছেন। আমরা এই দুই মহাসত্ত্ব নায়কের গুণ-বিশ্লেষণের মধ্যে যাব না। কিন্তু যতটুকু বলেছি, তা না বললে নয় এইজন্য যে, তাঁদের বিপরীত গুণসম্পন্ন হওয়া সত্ত্বেও সেইসব নায়কদের আমরা রসশাস্ত্র-সম্মতভাবেই অন্যতর নায়কবর্গের মধ্যেই স্থাপন করতে পারি এবং বিপরীত বলেই তাঁদের প্রতিনায়ক বা প্রতিপক্ষ নায়ক বলা যায় না। বরঞ্চ তাঁদের অন্য নায়ক বলা উচিত।

আসলে, প্রশ্ন ওঠে ধীরোদ্ধত নায়কদের নিয়ে। তাঁদের লক্ষণ করার সময় প্রথমেই বলা হয়েছে যে, তাঁরা নাকি অন্যকে প্রতারণা করার ব্যাপারে যথেষ্টই পটু। এমনিতে তাঁরা অত্যন্ত উগ্ৰস্বভাবের মানুষ, তাঁদের প্রকৃতিটাও খুব স্থির নয়। অহংকার, দর্প, আত্মশ্লাঘা করাটা ধীরোদ্ধত নায়কের অন্যতম গুণ— মায়াপরঃ প্রচণ্ডশ্চপলঃ অহংকার-দর্প-ভূয়িষ্ঠঃ আত্মশ্লাঘানিরতো ধীরোদ্ধতঃ! ধীরোদ্ধত নায়কের এরকম একটা রসশাস্ত্রীয় লক্ষণ শোনার পর রসশাস্ত্রীয় কাব্যসমালোচকদের মধ্যেই নানান প্রশ্ন উঠেছে। বিশেষত ধীরোদ্ধত নায়কের উদাহরণ হিসেবে যখন মধ্যম পাণ্ডব ভীমের নাম এল, তখন সমালোচকেরা বললেন, মহাভারতে আমরা ভীমকে যেমন দেখেছি, তাতে তিনি শত্রুদের সঙ্গে খুব কপট আচরণ করছেন অথবা তাঁদের সঙ্গে খুব প্রতারণা করছেন মায়াবী আচরণে, এমনটা আমাদের মনে হয়নি। বরঞ্চ উল্টোদিকে রামচন্দ্র যে ধরনের কপটতায় বালী-বধ করেছেন অথবা ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির যেভাবে অশ্বত্থামার মিথ্যা মৃত্যুসংবাদ দিয়ে দ্রোণাচার্যের মৃত্যুর পথ পরিষ্কার করেছিলেন, তাতে তো তাঁদের ওপরেই প্রতারণার দায় আসে বেশি।

পণ্ডিতেরা এই প্রশ্ন তুলেও শেষ পর্যন্ত রসশাস্ত্রের মৌল লক্ষণ সমর্থন করে বলেছেন, ব্যাপারটা ওইভাবে ধরলে হবে না। ধীরোদ্ধত নায়কের লক্ষণে শত্রুকে প্রতারণা করার একটা বৈশিষ্ট্য থাকলেও তাঁর মূল লক্ষণ হল, তিনি অহংকারী, মানী এবং খানিকটা অবিনয়ী পুরুষ, ঠিক যেমন উলটোদিকে রাম-যুধিষ্ঠিরের কপটতার সাময়িক ছায়া পাওয়া গেলেও আসলে তাঁরা ধীর-গম্ভীর স্বভাবের উদাত্ত পুরুষ। এরপরেই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কথাটা বলেছেন পণ্ডিতেরা। তাঁরা বলেছেন, প্রতারণা বা ছলের স্বভাব যতটুকুই থাকুক ধীরোদ্ধতের বৈশিষ্ট্যের মধ্যে প্রধান হচ্ছে তার গর্বোদ্ধত সাহংকার স্বভাবটাই। এবং এই দৃষ্টিতে দেখলে পরে একদিকে যেমন ভীমসেনের মতো মহাবীর অথচ উদ্ধত পুরুষের নায়কত্ব সিদ্ধ হয়, তেমনই মহাকাব্যের প্রতিনায়ক যাঁরা, যাঁদের মধ্যে এই ঔদ্ধত্য আত্মশ্লাঘা প্রকাশ পায় বেশি, তাঁদেরকে সরাসরি নায়ক না বললেও প্রতিনায়কেরও ধীরোদ্ধত স্বভাব প্রমাণসহ তো হয়ই, এমনকী তা সাধুজনের সমর্থনযোগ্যও হয়ে ওঠে।

এই আলোচনা থেকে এটা বোঝা যায় যে, প্রতিপক্ষ নায়কের মধ্যেও কাম্য নায়ক-স্বভাবগুলি সবই পূর্ণ পরিমাণে থাকতে পারে, কিন্তু পরিস্থিতি, পরিবেশ বিপরীত হওয়ার দরুন, বিশেষত ন্যায়, ধর্ম এবং সুনীতির বিপ্রতীপ ভূমিতে থাকার ফলেই অধিগুণসম্পন্ন প্রতিনায়কও মহাকাব্যিক নিন্দার বিষয় হয়ে ওঠেন। অন্তত দুর্যোধন-কর্ণের ক্ষেত্রে তাই হয়েছে। ওই যে একটু আগে ধীরোদ্ধত নায়কের রসশাস্ত্রীয় লক্ষণ বললাম, তা তো দুর্যোধনের সঙ্গে সম্পূর্ণ মিলে যায় এবং মিলে যায় বলেই চিন্তাশীল পণ্ডিতেরা প্রতিনায়কের লক্ষণ হিসেবেও ধীরোদ্ধত নায়কের বৈশিষ্ট্যগুলি মেনে নিয়েছেন। তার মানে আমরা বুঝতে পারি নায়কের সমান গুণ প্রতিনায়কের মধ্যেও থাকতে পারে। ভেবে দেখুন একবার রামায়ণের রাবণকে। তাঁর শৌর্য-বীর্য, সাহস, রণহুংকার, আত্মশ্লাঘা, দর্প, মান, বিরাটত্ব— এগুলি রামায়ণ মহাকাব্যের এমন এক সমুজ্জ্বল প্রতি-আঙ্গিক রচনা করেছে যার প্রতিতুলনায় মহানায়ক রামচন্দ্র তাঁর অলোক সামান্য ধীরোদাত্ত গুণগুলি নিয়েও কেমন এক স্নিগ্ধ নরচন্দ্রমা হয়ে ওঠেন। দুর্যোধনের প্রতিতুলনায় যেমন যুধিষ্ঠিরও।

ভাগ্যবশত পাণ্ডবভাইদের মধ্যে ভীমও ছিলেন এবং অবশ্যই অর্জুন। কিন্তু এঁদের সকলকে ম্লান দেয় দুর্যোধনের আগ্রাসী স্বভাব। কপট আচরণ অথবা মায়াবী আচরণ, যা নাকি ধীরোদ্ধত নায়কের অন্যতম বৈশিষ্ট্যের মধ্যে পড়ে সেটা প্রতিপূরণ করে দেন শকুনিমামা এবং দুর্যোধনের হয়েই তিনি তা সুসম্পন্ন করায় এই দায়টা দুর্যোধনের ঘাড়েই পড়ে। কিন্তু কপট পাশাখেলার এই অংশটুকু বাদ দিলে আর সবটাই দুর্যোধনকে বিপ্রতীপভাবে উজ্জ্বল করে তোলে। যাঁরা কবিজনোচিত মহাকাব্যিক বেদনাবোধে মহাভারতের প্রতিপক্ষ নায়কদের চরিত্র বিচার করবেন, তাঁদের ভিতরে দুর্যোধন-কর্ণের জন্য একটা মায়াও তৈরি হবে প্রথম থেকে। এটা তো ঠিকই যে, জ্যেষ্ঠ হওয়া সত্ত্বেও শুধু অন্ধত্বের কারণে পিতা রাজ্য পেলেন না বলে পরম্পরাক্রমে পুত্র দুর্যোধনও রাজত্ব পেলেন না— এই ক্ষোভই তাড়িত করেছে তাঁর অহংকার, দর্প, মান এবং উচ্চাশা। আর সেই উচ্চাশায় তাঁর কতগুলি সঙ্গী আছে— কর্ণ, দুঃশাসন, শকুনি— তাঁরা শুধু দুর্যোধনকে ভালবাসেন বলেই আপন স্বার্থ বলি দিয়ে দুর্যোধনের শক্তি বর্ধন করেন। শক্তি এবং ক্ষমতার ঔদ্ধত্য ছাড়াও শকুনির কূটবুদ্ধি মহাকাব্যের প্রসারিত ভূমির মধ্যে এমন একটা মশলাদার চটক তৈরি করে যেখানে মহাভারতের কাহিনী কেমন যেন অপ্রতিরোধ্যভাবে জটিল হয়ে ওঠে।

বস্তুত এই জটিলতা রাজনীতির অঙ্গ। মহাকাব্যের সম্বন্ধে এক সরল ‘রোমান্টিক’ ধারণা বরাবরই চলে এবং এই রোমান্টিকতা পাশ্চাত্যের অনুগুণী মনোভাবে তৈরি হয়েছে এইভাবে যে বীর নায়কের প্রতিপক্ষে বীরত্ব এবং বীরত্বের মহত্ত্ব এবং তিব্রতা তার প্রতিভূমি তৈরি করে। সেখানে আমরা বলব, মহাভারতের মধ্যে এই বীরত্বের আখ্যান কোনও কল্পলোক তৈরি করে না, বরঞ্চ বাস্তব জীবনে যে সামাজিক এবং রাজনৈতিক সত্যগুলি আছে যেখানে নীচতা, শঠতা, কপটতাও এক ভীষণরকমের সামাজিক সত্য, যেগুলি মহাভারতের শৌর্য-বীর্য-মহত্ত্বের ক্ষৌমবসনে নতুন নতুন নকশা এবং ‘টেকস্‌চার’ তৈরি করে। আমি আমার ক্ষুদ্রবুদ্ধিতে সবসময় বলে থাকি যে, মহাভারত শুধুমাত্র মহাকাব্য নয়, ধীর এবং উদার বীরত্বে ভরা কোনও রোমান্টিক কাহিনীও নয়, এটি সমাজ-সচেতন ঐতিহাসিকের গড়া এক মহাকাব্যিক নির্মাণ।

এই কারণেই এখানে ভীম-অর্জুন অথবা দুর্যোধন-কর্ণের উদার বীরত্বের পাশাপাশি শকুনির দ্যূতচাতুরীও আছে। আরও লক্ষণীয়, শৌর্য-বীর্য-ক্ষমতার পরিমাণ এখানে দু’পক্ষেই এত বেশি যে, অবতারপ্রমাণ পুরুষোত্তম কৃষ্ণের সাহায্যপুষ্ট পাণ্ডবদের কথা না হয় ছেড়েই দিলাম, প্রতিনায়ক দুর্যোধন এবং তাঁর পক্ষে দাঁড়ানো অন্যান্য প্রতিপক্ষ নায়ক কর্ণ, জয়দ্রথ, অশ্বত্থামা কাউকেই ছল-কপটতা ছাড়া পর্যুদস্ত করা যায় না। ঠিক এইরকম একটা অবস্থায়, যেখানে প্রতিপক্ষ শত্রুকেও মহাকাব্যিক বীরত্বে বধ করা যাচ্ছে না এবং তাঁদের হত্যা করার জন্য মায়া-কপটতার আশ্রয় নিতে হচ্ছে, সেখানে সেইসব প্রতিনায়কও যে স্বীকৃত মহাকাব্যিক নায়কদের মতোই অনুগুণসম্পন্ন এবং সেই নিরিখে মহাভারতও যে সাধারণ মহাকাব্যের লক্ষণ অতিক্রম করে, একথা আমাদের দ্বিতীয়বার ভাবতে হবে।

লক্ষণীয় ঘটনা হল, প্রতিপক্ষ নায়কদের বিরাটত্ব এবং মহত্ত্ব টের পাই সেইসব ক্ষণে যেখানে স্বীকৃত যুদ্ধ-নায়কদের হাতে তাঁদের মৃত্যু ঘটছে এবং তা ঘটছে অন্যায়ভাবে। কর্ণ কিংবা দুর্যোধনকে মারার জন্য যতটুকু অন্যায়ের আশ্রয় নিতে হচ্ছে, সেই অন্যায়ের জন্য তাঁদের কৃতকর্ম, কিংবা তাঁদেরই পূর্বকৃত অন্যায়গুলি স্মরণ করিয়ে দিতে হচ্ছে ‘জাস্টিফিকেশন’ হিসেবে। এমনকী এই অন্যায়গুলির দায়ও মিত্রবাহিনীর নায়কেরা নিতে পারছেন না, সেই দায় নিতে হচ্ছে অবতার-প্রমাণ পুরুষোত্তম কৃষ্ণকে। মহাকাব্যের নায়কদের তিনি স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন বারবার যে, দুর্যোধন, কর্ণ, জয়দ্রথের মতো মহাবীরদের তাঁরা হত্যাই করতে পারতেন না, যদি না কৃষ্ণ তাঁদের সময়মতো অন্যায়-বুদ্ধি দ্বারা প্ররোচিত করতেন। কালান্তক দুর্যোধনের পতন ঘটার পর কৃষ্ণ সোচ্চারে পাণ্ডবদের জানাচ্ছেন— দ্যাখো বাপু! এই আঠেরো দিন মাত্র যুদ্ধ হয়েছে, আর এই সামান্য সময়ের মধ্যে এতগুলি মহাবীর যোদ্ধাকে সোজাসুজি বীরত্ব দেখিয়ে তোমাদের পক্ষে মারা সম্ভব ছিল না— ঋজুযুদ্ধেন বিক্রান্তা হন্তুং যুস্মাভিরাহবে।

দুর্যোধন, কর্ণ, জয়দ্ৰথ, শকুনি— এইসব চিহ্নিত প্রতিপক্ষ নায়ক ছাড়াও আরও দুই প্রকার প্রতিপক্ষ ছিল পাণ্ডবদের। একপ্রকার হলেন ভীষ্ম-দ্রোণের মতো মানুষেরা। তাঁরা কৌরব দুর্যোধনকে পছন্দ করছেন না, বরঞ্চ পাণ্ডবদের প্রতিই তাঁদের সহানুভূতির ধারা, অথচ তাঁরা যুদ্ধ করছেন কৌরব দুর্যোধনের পক্ষে এবং তাঁরা ভয়ংকর যোদ্ধা। প্রতিপক্ষ নায়ক হিসেবে এঁদেরই গৌরব সবচেয়ে বেশি, সোজাসুজি সম্মুখ যুদ্ধে এঁদের ভূমিশায়িত করা কোনওভাবেই সম্ভব ছিল না ফলত অন্যায়ের আশ্রয় নিতেই হয়েছে এখানে, কিন্তু তবু এই অন্যায়কে তেমন বড় করে দেখতে চাই না এখানে। কেননা মৌল নায়কদের প্রতি সহানুভূতিশীল থাকায় এঁরা নিজেরাই নিজেদের মৃত্যুর উপায় পাণ্ডবদের বলে দিয়েছিলেন, ফলত সঠিক প্রতিপক্ষ বলে এঁদের চিহ্নিত করতে পারি না। কিন্তু তেমন প্রতিপক্ষ না হলেও এঁদের পতনের জন্য যে উপায় গ্রহণ করতে হয়েছে, সেখানেও সমস্ত প্ররোচনা কৃষ্ণের দিক থেকেই এসেছে, নইলে সময়কালে অর্জুন-যুধিষ্ঠিরের মতো ব্যক্তিত্বরা এই হত্যার ব্যাপারে দ্বিধাগ্রস্ত ছিলেন। অর্থাৎ এখানেও দায় গ্রহণ করেছেন কৃষ্ণই এবং সেটা তিনি নিজের মুখে বলেওছেন।

অন্যতর আরও এক প্রতিপক্ষ মহাভারতের প্রসারিত ভূমির মধ্যে অপ্রত্যক্ষভাবে বিরাজমান। মহাভারতের মধ্যে ইতিহাসের বুনোট আছে, সেখানে জরাসন্ধ-শিশুপালের মতো বিরাট ব্যক্তিত্ব ছিলেন, যাঁরা রাজনৈতিকভাবে ভয়ংকর প্রতিপক্ষ হতে পারতেন, এমনকী সামরিক দিক থেকেও তাই। এই শেষ প্রসঙ্গে নৈষাদি একলব্যের কথাও এসে পড়বে। তবে কিনা পাণ্ডবদের রাজনৈতিক জীবনের শুরুতেই এইসব প্রতিপক্ষের পক্ষশাতন ঘটে গিয়েছিল। এটা অবশ্যই ঠিক যে, জরাসন্ধ-শিশুপাল যতখানি পাণ্ডবদের প্রতিপক্ষ ছিলেন, তার চেয়ে অনেক বেশি ছিলেন কৃষ্ণের প্রতিপক্ষ, কিন্তু পাণ্ডবদের রাজনৈতিক জীবনের সঙ্গে কৃষ্ণের রাজনৈতিক জীবন মিশে যাওয়ায় তাঁরাও একভাবে পাণ্ডবদের প্রতিপক্ষ হয়ে উঠেছিলেন। জরাসন্ধ, শিশুপাল এবং নেষাদি একলব্য সম্বন্ধে কৃষ্ণ পাণ্ডবদের বলেছিলেন, এঁরা যদি আগে না মারা পড়তেন, অথবা বিভিন্ন উপায়-কৌশলে এঁদের যদি আগে মারা না হত, তা হলে এই এখন কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধকালে এঁরাও ভয়ংকর প্রতিপক্ষ হয়ে উঠতেন— যদি স্যুর্ন হতাঃ পূর্বম্‌ ইদানীং স্যুর্ভয়ঙ্করাঃ।

জরাসন্ধ এবং শিশুপাল খানিক সুদূর প্রতিপক্ষ বলেই এই সংগ্রহের মধ্যে তাঁদের নাম আসেনি। কিন্তু একলব্যকে আমরা ধরেছি। ধরেছি এই কারণে যে, আঙুল থাকা অবস্থায় তিনি দেবতা, দানব, মানব সকলেরই অপরাজেয় ছিলেন, বলেছেন কৃষ্ণ— একলব্যং হি সাঙ্গুষ্ঠম্‌ অশক্তা দেবদানবাঃ।… বিজেতুং যুধি কর্হিচিৎ। তিনি যে ভবিষ্যতে অর্জুনের ভয়ংকর প্রতিযোদ্ধা হয়ে উঠতেন, সেটা অর্জুন নিজেই সবচেয়ে ভাল বুঝেছিলেন। মহাভারতের একটি জায়গায় একলব্যের ভয়ংকর হয়ে ওঠার কথা বলতে গিয়ে কৃষ্ণ ‘ক্লেইম’ করেছেন যে, এ ব্যাপারে তিনিই নাকি অবস্থা খারাপ বুঝে ছন্ন উপায়ে দ্রোণাচার্যকে দিয়ে একলব্যের অঙ্গুষ্ঠ-কর্তনের ব্যবস্থা করেছিলেন অর্জুনের হিতের জন্য— তদ্ধিতার্থঞ্চ নৈষাদি রঙ্গুষ্ঠেন বিযোজিতঃ। কৃষ্ণের এই দাবীটা ঠিক নয় বলেই মনে হয়, কেননা মহাভারতের ঐতিহাসিক প্রমাণে কৃষ্ণের সঙ্গে পাণ্ডবদের তখনও সেইভাবে দেখাই হয়নি।

তবে হ্যাঁ, যুক্তি হিসেবে বলতে পারি যে, ভীষ্ম-দ্রোণ, জরাসন্ধ, শিশুপাল অনেকের কথাই তো বলছিলেন কৃষ্ণ এবং যেসব জায়গায় কৃষ্ণের বুদ্ধিযোগ অথবা বুদ্ধিকে কার্যে পরিণত করার প্ররোচনা কৃষ্ণেরই ছিল। একলব্যের ক্ষেত্রে কৃষ্ণের দাবীটুকু অসার বটে, কিন্তু অনেকজনের কথা বলতে গিয়ে একলব্যের কথাটাও তাঁর হিতৈষণার তালিকায় চলে এসেছে। আবার এমনও হতে পারে যে, এসব কথা বলবার সময় কৃষ্ণ প্রায় ভগবৎস্বরূপে বিষ্ণু-নারায়ণের মতো কথা বলেন। ভক্তবৎসল প্রভুর মতো বলতে থাকেন— আমি এই করেছি, সেই করেছি এবং তোমার হিতের জন্যই তা করেছি। ঠিক এইরকম একটা তোড়ে বলবার সময় কৃষ্ণ বলে ফেলেছেন— দ্রোণকে আচার্য করে আমিই প্রচ্ছন্নভাবে একলব্যের অঙ্গুষ্ঠ-বিয়োগ ঘটিয়েছি— দ্রোণেনাচার্যকং কৃত্বা ছদ্মনা সত্যবিক্রমঃ। আর এটা তো একভাবে ঠিকই— সবই তিনিই করছেন এবং করাচ্ছেন এক-একজনের মাধ্যমে করাচ্ছেন। এখানে দ্রোণের মাধ্যমে করিয়েছেন তিনিই, তবে ইতিহাসের তথ্যভাবনার মধ্যে অলৌকিকতা কিছু এসেছে এবং কৃষ্ণের দিক থেকে সেটা উক্তির বদলে অতিশয়োক্তি হয়ে উঠেছে।

কৃষ্ণের কথার সত্যতা যাচাই করা আমাদের উদ্দেশ্য নয়। আমরা শুধু বলতে চাই— একলব্যও সেই ভয়ংকর প্রতিপক্ষ নায়ক, যাঁকে ছন্ন উপায়ে প্রতিরোধ করতে হয়েছে গুরু দ্রোণাচার্যের মাধ্যমে এবং তা একেবারেই প্রথমে, অর্জুনের সার্থক যুদ্ধজীবন শুরু হবার আগেই। এখানে বলে রাখা ভাল— কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে যে ফরাসি বিশেষজ্ঞ মানুষটি পড়ান, সেই চিন্ময় গুহের পিতাঠাকুর প্রয়াত প্রশান্তকুমার গুহ চিন্ময়ের মাধ্যমেই একদা একলব্য সম্বন্ধে কিছু প্রশ্ন করেছিলেন আমাকে। আমি তখনও একলব্য সম্বন্ধে কিছু লিখিনি। একলব্য লেখার সময় তাঁর প্রশ্নগুলি আমার মাথায় ছিল বটে, কিন্তু ওই সর্বগ্রাসী বিশেষজ্ঞ পাঠক যেভাবে একলব্যকে দেখতে চেয়েছিলেন, আমি হয়তো সেইভাবে লিখিনি, কেননা মহামতি ব্যাসের সূত্র ধরেই আমাকে চলতে হয়েছে এবং আমার বিশ্লেষণ-বিপাকও তৈরি হয়েছে মহাভারতের কবির অনতিক্রম্যতায়। তবে এটা বলতেই হবে যে, একলব্য লেখার পিছনে অধুনা প্রয়াত প্রশান্তকুমারই আমার অনুপ্রেরণা। তিনি এই লেখাটি দেখে যেতে পারলেন না, সেজন্য আমার অনুতাপ আছে।

পূর্ব-প্রসঙ্গে ফিরে এসে বলি, এখানে দুর্যোধন, দুঃশাসন, শকুনির কথা নথিবদ্ধ হয়েছে তাঁদের প্রতিনায়কত্বের স্বতঃসিদ্ধতায়। কর্ণও অবশ্যই এই দলে পড়েন, কিন্তু পূর্বে কুন্তী-পুত্রদের কথা লিখতে গিয়ে ‘কৃষ্ণা কুন্তী এবং কৌন্তেয়’ নামের বইটিতে কর্ণের চরিত্র আমি লিখে ফেলেছি। এদিকে মহাভারতের প্রতিপক্ষ নায়কের মধ্যে যদি কর্ণের চরিত্র আলোচিত না হয়, তবে দুর্যোধন-দুঃশাসনেরা সম্পূর্ণ হন না। মহাভারতের মধ্যে বিরাট কৌরবসভার অন্তরালে আরও যে এক অন্তরঙ্গ-সভা বসত, সেখানে এই চারটি নাম বারবার এসেছে— দুর্যোধনশ্চ কর্ণশ্চ শকুনিশ্চাপি সৌবলঃ! দুঃশাসন-চতুর্থাণাম্‌…। তার মানে এই প্রতিনায়ক-চতুষ্টয়ই মহাভারতের চিহ্নিত প্রতিপক্ষ নায়ক। এখানে কর্ণ না থাকলে গ্রন্থগ্রন্থি সম্পূর্ণ হয় না বলেই কর্ণের চরিত্রটি এখানে কিঞ্চিৎ পরিমার্জনে এবং পরিবর্ধনে পুনরায় প্রদত্ত হল। এই চরিত্রকে প্রতিপক্ষ নায়কের নিরিখে এবং আদলে পুনরায় লিখিনি বা লিখতে চাইনি, কেননা যে চরিত্রই যখন লিখেছি, তখন সেটাকে স্বয়ংসম্পূর্ণভাবেই দেখতে চেয়েছি, মহাকাব্যের ভাবনাগুলিই এমন সার্বিক এবং সর্বাশ্লেষী যে, সময় বুঝে, অবস্থা দেখে ঘটনার বিপরিণামে সেগুলিকে ‘মোল্‌ড্‌’ করা উচিত নয়। অতএব, সময়াভাব নয়, মহাকাব্যের মানস-চিন্তা থেকেই কর্ণ চরিত্রকে খানিকটা সংস্কার করে এখানে নিয়ে আসতে হল। আমার সহৃদয় পাঠককুল আমার সমান-হৃদয় হবেন বলেই আমি অন্য কোনও যুক্তি দিচ্ছি না।

দুর্যোধন-দুঃশাসন এবং কর্ণ-শকুনির বলয়ের বাইরে ভীষ্ম, দ্রোণ এবং কৃপের মতো অন্তরে-বাইরে দ্বিধাদীর্ণ প্রতিনায়ক ছাড়াও আরও বেশ কিছু পাণ্ডব-প্রতিপক্ষ ছিলেন, যাঁরা দুর্যোধনের সমর্থনে প্রাণ পর্যন্ত দিতে পারতেন। এঁদের মধ্যে অন্যতম হলেন অশ্বত্থামা। শুধু প্রতিপক্ষ নায়ক বলেই নয়, আরও বহুতর কারণে অশ্বত্থামা আমার কাছে বড় প্রিয় চরিত্র। পূর্বকালের একান্নবর্তী পরিবারগুলিতে নিজের জ্ঞাতিগুষ্টি ছাড়াও অন্যান্য বহিরাগত পরিবারেরও স্থান হয়ে যেত। এমনকী জ্ঞাতিগুষ্টির মধ্যেও অনেকেই এমন বহিরাগতভাবে থাকতেন যাঁরা উপার্জনক্ষম ছিলেন না সবসময়, কিন্তু বয়স এবং আত্মীয়তার সূত্রে ঘরের মধ্যেই আরও একটা ঘর গড়ে তুলতেন। তাঁদের অন্তরালবাহিনী উচ্চাশা এবং নানান ক্রিয়াকর্ম কখনও কখনও দ্বিতীয় একটি কেন্দ্র তৈরি করত। অশ্বত্থামা এই দ্বিতীয় কেন্দ্রের জাতক, যিনি অনেক ক্ষেত্রেই বড় বিভ্রান্ত। শৌর্য-বীর্যের সঙ্গে বিভ্রান্তির মিশ্রণ এই চরিত্রটিকে প্রতিপক্ষ নায়কদের মধ্যে অন্যতম জটিল চরিত্র হিসেবে স্থাপন করেছে।

এই অর্থে আরও এক জটিল অথচ বাইরে ভীষণ রকমের সরল চরিত্র হলেন শল্য। মহাভারত পড়তে গিয়ে শল্য সম্বন্ধে পৃথক কোনও সচেতনতা তৈরি হয় না বটে, কিন্তু পাণ্ডবদের মামা হওয়া সত্ত্বেও তিনি দুর্যোধনের পক্ষে যোগ দিয়ে এমন এক-একটা কাণ্ড ঘটিয়েছেন যে, তাঁকে নদীর ভিতরে-থাকা ভয়ংকর কুমীরের সঙ্গে তুলনা করেছেন পরম্পরাবাহী বিদ্বানেরা। এই সূত্রে কৃতবর্মা চরিত্রটা এখানে খানিকটা অসমঞ্জস লাগতে পারে, কেননা তিনি বাইরে থেকে আসা ভাড়াটে যোদ্ধার মতো। কিন্তু আমরা দেখাতে চেয়েছি যে, প্রতিপক্ষতার ধরন সবসময় একরকম হয় না এবং বিভিন্নরকম সামাজিক তথা ব্যক্তিগত স্বার্থৈষণাও কেমন প্রতিপক্ষতা তৈরি করে। শত্রুর বন্ধুর প্রতি শত্রুতাও কীভাবে দুর্যোধনে শক্তিবৃদ্ধি করে এবং কীভাবে তিনি একসময় প্রতিপক্ষের কুচক্রী প্রতিনায়ক হয়ে ওঠেন কৃতবর্মা তার উদাহরণ। তিনিও এখানে স্থান পেয়েছেন তাই।

কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে পাণ্ডবদের সঙ্গে কৃষ্ণকে যদি রাজনৈতিক শৃঙ্খলা স্থাপনের উপযোগী গোষ্ঠী মনে করি তা হলে প্রতিযোগী প্রতিপক্ষ নায়কদের মধ্যে আরও একজনের নাম আসার কথা, যদিও তাঁকে আমরা কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রীয় ভাষায় ‘উদাসীন’ বলতে পছন্দ করি। তিনি কৃষ্ণ-জ্যেষ্ঠ বলরাম। কৃষ্ণের কারণে তিনি অনেক ক্ষেত্রে পাণ্ডবদের ওপর সমব্যথী হলেও বলরাম দুর্যোধনেরই গুণগ্রাহী ছিলেন আগাগোড়া। তা ছাড়া মহাভারতে একাধিক জায়গা পাওয়া যাবে, যেখানে বলরাম সোজাসুজি পাণ্ডবদের বিরোধিতা করেছেন এবং তাঁর ক্রোধ প্রশমিত হয়েছে কৃষ্ণের মধ্যস্থতায়। আর উদ্যোগপর্বে পাণ্ডবদের বনবাস-মুক্তির পর তাঁদের ভবিষ্যৎ কর্মপদ্ধতি নির্ধারণের জন্য যে সভা বসেছিল, সেখানে দুর্যোধনের প্রতি তাঁর স্পষ্ট পক্ষপাত প্রকট হয়ে উঠেছে। কুরুক্ষেত্রের প্রত্যক্ষ যুদ্ধে তিনি অংশগ্রহণ করলেন না প্রধানত এই কারণেই যে, পাণ্ডবদের সঙ্গে তিনি আত্মীয়তার সূত্রে আবদ্ধ এবং সেখানে কৃষ্ণ আছেন, অথচ তিনি তাঁদের পক্ষপাতী নন, অন্যদিকে কৃষ্ণের মতো ব্যক্তিত্বকে এড়িয়ে অথবা তাঁর বিরুদ্ধে গিয়ে দুর্যোধনের পক্ষেও যোগ দেওয়া সম্ভব ছিল না তাঁর পক্ষে।

অতএব দুই পক্ষকেই এড়িয়ে হঠাৎই তীর্থযাত্রায় মন দিলেন বলরাম। কিন্তু তাই বলে শেষটায় ধৈর্য রাখতে পারলেন না, প্রিয়শিষ্য দুর্যোধনের শেষ যুদ্ধ দেখার জন্য তিনি সমন্তপঞ্চকে উপস্থিত হয়েছেন এবং ভীমের গদাঘাতে দুর্যোধন যখন মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন, তখন দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণ, ভীমের প্রতিজ্ঞা— এসব তাঁর স্মরণে আসেনি, তিনি ভীমের অন্যায়টাই বড় করে দেখেছেন। কৃষ্ণের হস্তক্ষেপে তাঁকে থামতে হয়েছে বটে, কিন্তু তাঁর ক্রোধ শান্ত হয়নি। তিনি স্থানত্যাগ করেছেন। বলরামের এই ক্রিয়াকর্মগুলি মনে রাখলে তাঁকে প্রতিপক্ষ নায়কই বলতে হয়, কিন্তু সরাসরি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেননি বলেই তাঁকে উদাসীন প্রতিপক্ষ হিসেবেই চিহ্নিত করতে চাই। কিন্তু উদাসীন হলেও সারাজীবন ধরে তাঁর নৈতিক সমর্থন দুর্যোধনের পক্ষেই ছিল বলে এখানে তাঁর অন্তর্ভুক্তি ঘটেছে।

মহাভারতের প্রতিপক্ষ নায়কের সংগ্রহণ-বিসর্জনের ক্ষেত্রে আরও যেসব নাম অন্তর্ভুক্ত হতে পারত, তাঁরা নেহাৎই ক্ষুদ্র চরিত্র। এমনকী আমরা যে-সব চরিত্র এখানে আলোচনা করেছি, সেগুলিও মহাকাব্যের কবির অস্পষ্ট উচ্চারণে চিহ্নিত। এমনিতে ওই যে চারজন দুর্যোধন-দুঃশাসন এবং কর্ণ-শকুনি, এই চারজনই দুর্যোধন-রূপ প্রতিপক্ষ-বৃক্ষের স্কন্ধ, শাখা-প্রশাখা এবং পুষ্পফল। পিতা ধৃতরাষ্ট্র এই মহাবৃক্ষের মূল। মহাভারতের প্রারম্ভে এইভাবেই তাঁদের পরিচয় ঘটেছে—

দুর্যোধনো মন্যুময়ো মহাদ্রুমঃ/স্কন্ধঃ কর্ণঃ শকুনিস্তস্য শাখা।
দুঃশাসনঃ পুষ্পফলে সমৃদ্ধে/মূলং রাজা ধৃতরাষ্ট্রোহমনীষী॥

এই দৃষ্টিতে দেখলে ধৃতরাষ্ট্রও মহাভারতীয় প্রতিপক্ষ নায়কদের অন্যতম। কিন্তু অন্ধ ধৃতরাষ্ট্র সারাজীবনই দ্বিধাদীর্ণ চরিত্র। কখনও কখনও পাণ্ডব-ভাইপোদের ওপরে তাঁর স্নেহও আছে। কখনও কখনও ভাল কথাও বলেন, সবচেয়ে বড় কথা, পুত্রদের দ্বারা প্ররোচিত হয়েও তিনি কিন্তু অন্যায়টাকে অন্যায় বলে বোঝেন। অনেক সময় তাঁকে আমরা কৃতকর্মের জন্য অনুতাপ করতেও দেখেছি এবং অবশেষে, হয়তো তা সম্পূর্ণ ধ্বংসের পরেই— ধৃতরাষ্ট্র তাঁর ভুলও বুঝতে পারেন। এইসব বিশিষ্টতার নিরিখেই ধৃতরাষ্ট্রকে আমরা চিহ্নিত প্ৰতিনায়কদের মধ্যে রাখিনি।

পরিশেষে জানাই, শতসহস্র ভারতীয়দের মধ্যে এই নিয়ম ছিল যে, ভগবদ্‌গীতা পড়বার আগে কতগুলি শ্লোক উচ্চারণ করে গীতার ধ্যান করতে হয়। এই শ্লোকগুলির মধ্যে একটিতে কোন কোন প্রতিপক্ষ-মহাবীরদের বাধা অতিক্রম করতে হয়েছিল, সে-কথা বলার সময় কুরুক্ষেত্রের মহাযুদ্ধটাকে পাণ্ডবদের দৃষ্টিতে একটি নদীর রূপকে ধরা হয়েছে। ভগবদ্‌গীতায় ভগবৎস্বরূপ কৃষ্ণই যেহেতু সাধনতত্ত্বের কেন্দ্রস্থানে অবস্থিত, তাই এই শ্লোকের মধ্যে কৃষ্ণকে নদীপারের নাইয়া-মাঝি বা পাটনি হিসেবে দেখা হয়েছে। শ্লোককর্তা কবি লিখেছেন— কৃষ্ণকে নৌকোর মাঝি করে পাণ্ডবরা যে ভয়ংকরী রণনদী পার হয়েছিলেন, সে-নদীর দুই তীর হল আসলে ভীষ্ম এবং দ্ৰোণ। জয়দ্রথ হলেন এই নদীর জল। গান্ধাররাজ শকুনি এই প্রবাহিনী নদীর মাঝখানে থাকা কৃষ্ণনীল প্রস্তরখণ্ড। শল্যের মতো মানুষ এই নদীর মধ্যে থাকা হাঙরের মতো, অশ্বত্থামা-বিকর্ণ কুমীরের মতো। কৃপাচার্য এই রণনদীর অনুকূলবাহিনী হাওয়া। দুর্যোধন যদি এই নদীর জল তোলপাড় করে তোলেন, তো কর্ণ আছড়ে পড়েন এই রণনদীর বেলাভূমিতে। এমন একটা প্রতিপক্ষ-সমাকুল যুদ্ধনদীও পাণ্ডবরা অতিক্রম করতে পেরেছিলেন শুধু কৃষ্ণের জন্য। কেননা তিনি ছিলেন তাঁদের নৌকোর মাঝি— অশ্বত্থামা-বিকর্ণ-ঘোরমকরা দুর্যোধনাবর্তিনী/সোত্তীর্ণা খলু পাণ্ডবৈ রণনদী কৈবর্তকে কেশবে।

ভগবদ্‌গীতার এই বিরাট শ্লোকটি বেশি ব্যাখ্যা করার প্রয়োজন নেই, কিন্তু লক্ষণীয়— রণ-নদীর নাইয়া কৃষ্ণ এখানে অন্তিম পংক্তিতে চরম এবং পরমভাবে আসছেন বটে, কিন্তু প্রতিপক্ষের নামেই শ্লোকটি ভরে গেছে। বহুকাল আগে আমাকে একজন প্রশ্ন করে বলেছিলেন যে, মহাভারতে কৃষ্ণই বেশি কুটিল, নাকি শকুনি বেশি কুটিল! এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়া সম্ভব নয়, যাঁরা কৃষ্ণকে অথবা শকুনিকে সঠিকভাবে চেনেন, তাঁদের কাছে এটাই ক্রমে ক্রমে বোধ্য হয়ে ওঠে যে, কৃষ্ণ এক বিরাট রাজনৈতিক প্রজ্ঞাশীল মানুষ, পাণ্ডবদের সমস্যা ছাড়াও তাঁর জীবনে আরও হাজারও সমস্যা ছিল, যেগুলির সমাধান তাঁকে করতে হয়েছে অমানুষী প্রজ্ঞায় এবং কখনও বা সেইসব সমস্যা সমাধান করতে হয়েছে সমান্তরালভাবে। সেখানে শকুনি কী? একজন স্বার্থপর উচ্চাভিলাষী মানুষ, যিনি রাজনীতি বোঝেন সবচেয়ে কম, অথচ সবসময় ফাঁক খোঁজেন ছলনার, প্রতারণার এবং কপটতার। ছলনা, প্রতারণা— এগুলি কোনও প্রাজ্ঞ মানুষের গুণ নয়, তাতে সাময়িক আত্মতৃপ্তি এবং অন্যের ক্ষতিসাধন ঘটে বলে এই খল স্বভাব অনেকের মনেই এক ধরনের ক্ষুদ্র চমৎকার তৈরি করে। এই ক্ষুদ্রতার অবভাস ক্ষুদ্রচেতা সহৃদয়ের হৃদয় অধিকার করে বলেই শকুনিকে তাঁরা কৃষ্ণের প্রতিপক্ষ এবং প্রায় সমকক্ষ এক প্রতিনায়ক বলে ভাবতে থাকেন। আমাদের দূরদর্শনে শ্রীচোপরা-কৃত মহাভারত-চিত্রেই এই সরলীকরণ দেখেছি।

আমরা এটা স্বীকার করি যে, শকুনি এক বিরাট অক্ষশৌণ্ড বা বড় মাপের পাশাড়ে বটে, কিন্তু মহাভারত যেখানে এক প্রসারিত রাজনীতির প্রাঙ্গণ, সেখানে দুর্যোধনের পক্ষে থেকে তিনি পাণ্ডবদের বহুল ক্ষতিসাধন করে অন্যতম এক প্রতিনায়কের মর্যাদা পেতে পারেন বটে, কিন্তু শকুনি নিতান্তই এক খলতার উদাহরণ, কৃষ্ণের বিরুদ্ধে কোনও প্রতিপক্ষ নায়ক নন! জয়দ্রথের কথাও এখানকার প্রতিনায়ক-কল্পে এসেছে বটে, তবে প্রতিনায়ক হিসেবে তিনিও এক প্রান্তিক চরিত্র। জয়দ্রথ সমস্ত মহাভারতের শরীর জুড়ে অবস্থান করছেন না, কিন্তু যেটুকু তিনি আছেন, সেটুকু ভীষণভাবে এবং ভীষণ প্রতিপক্ষতায় আছেন। ফলত প্রতিনায়ক-সংস্থায় তাঁকে গ্রহণ করতেই হবে।

পরিশেষে দুর্যোধনের কথা আরও একটু না বললেই নয়। বলতে গেলে দুর্যোধনের অনেক দোষ। তিনি দুর্বিনীত, গুরুজনের ভাল কথা তিনি শোনেন না; তবে এই গুরুজনের মধ্যে পিতা ধৃতরাষ্ট্র পড়েন না, কেননা অনেক ক্ষেত্রেই তিনি যে-সব অন্যায় কাজ করছেন, সেগুলি ধৃতরাষ্ট্রেরও পরম ঈপ্সিত। দুর্যোধন সব সময়েই প্রায় সমর্থন পান পিতার কাছে। কিন্তু পিতার ঈপ্সিত এবং নিজের স্বার্থ সাধন করতে গিয়ে তিনি যেখানে যেখানে বাধা পাচ্ছেন, সেখানে পরম গুরুজনদেরও অপমান করতে তাঁর বাধে না। অথচ তিনি মানুষ ভাল, গুরুজনেরা সকলেই তাঁকে ছেড়ে চলে যান, এও তিনি চান না, বন্ধুদের তিনি চরম সুখ দেন, ভাই দুঃশাসনের প্রতি তাঁর স্নেহের অন্ত নেই, জননী গান্ধারীকেও তিনি কম শ্রদ্ধা করেন না। কিন্তু সমস্যা এই যে, জন্ম থেকেই তিনি এক ধরনের পরম্পরাবাহী প্রবৃত্তি নিয়ে বড় হয়েছেন, সেটাকে তিনি এড়াতে পারেন না। মহাভারতের কবি বোঝাতে চান— এমন মানুষ পৃথিবীতে অনেক আছেন, যাঁরা যথেষ্ট উদ্যোগী পুরুষ এবং জীবনের পুরুষার্থ সাধনের জন্য এইরকমই উদ্যোগ প্রয়োজন, কিন্তু উদ্যোগ গ্রহণ করার মধ্যে একটা বিপরীত বুদ্ধি সবসময় কাজ করে, সাধ্য বস্তু যেন তেন প্রকারে সহজে লাভ করার জন্য এক ধরনের দুষ্টতা অল্পসত্ত্ব মানুষকে গ্রাস করে কখনও কখনও। যাঁদের ক্রোধ-মোহ-লোভ এবং মাৎসর্য যাঁরা অতিক্রম করতে পারেন না, তাঁদের অন্তঃকরণের সঙ্গে উপরি উক্ত দুষ্টতা একাত্মক একভাব হয়ে ওঠে। দুর্যোধনের তাই হয়েছে।

তাঁর বীরত্ব, ব্যক্তিত্ব, সাহস এবং কার্য সাধনের তৎপরতা তাঁকে এমন এক মর্যাদার স্থানে পৌঁছে দিয়েছিল যাতে সমস্ত রাজকীয় গুণগুলি যেন দুর্যোধনের মতো মানুষের পক্ষে বেশি শোভন হয়ে উঠেছিল, অন্তত যুধিষ্ঠিরের প্রতিতুলনায়। এমন কোনও একটা জায়গা নেই মহাভারতে, যেখানে দুর্যোধন তাঁর কথায়, ভাবভঙ্গীতে অথবা কাজে রাজকীয় উচ্চতা থেকে সামান্যও অবতরণ করেছেন। ওই যে নীতিকথায় চিরকাল পড়ে এলাম ‘অতিদর্পে হতা লঙ্কা অতিমানে চ কৌরবাঃ– অর্থাৎ কোনও কিছুরই বাড়াবাড়ি ভাল নয়, অতিদর্পে রাক্ষস রাবণ শেষ হয়ে গিয়েছিলেন, আর অতি-অভিমানে কৌরব দুর্যোধন। আমাদের চিরন্তন বৃদ্ধরা অতি অল্প বয়স থেকে সামান্য আত্মস্ফীতি লক্ষ করলেই এই শ্লোক উচ্চারণ করে আমাদের গুঁড়িয়ে দিতেন ব্যক্তিত্বে আঘাত করে। কিন্তু ওই নীতিশ্লোকের সবচেয়ে বড় স্ববিরোধিতা লুকিয়ে আছে শ্লোকটির তৃতীয় চরণে যেখানে বলা হয়েছ— দৈত্যরাজ বলি অতিরিক্ত দান করতে গিয়ে রাজ-ঐশ্বর্য তথা সর্বস্ব খুইয়েছিলেন।

লক্ষণীয় ব্যাপার হল— দান করে সব খোয়ালেও বলির মহিমা বেড়েছে। স্বয়ং বিষ্ণু তাঁর দানমাহাত্ম্যে নিজের লঘুতা প্রকট করে ছলনা করে বামন রূপ ধারণ করতে বাধ্য হয়েছিলেন। এবং শুধু তাই নয়, তাঁর সুরাসুরবন্দিত তৃতীয় চরণ বলির মস্তকে স্থাপন করার পর তিনি নিজে বলির পাতালরাজ্যের দ্বারপাল হবার লঘুতা অঙ্গীকার করেছিলেন। অতএব নীতি শ্লোকটির প্রাথমিক লক্ষণায় বিনীত হবার উপদেশ আছে বটে, কিন্তু শ্লোকার্থের পূর্ণ অভিব্যক্তিতে রাবণ, দুর্যোধন বা বলি-মহারাজের মহাকাব্যিক উচ্চতাও প্রমাণ হয়ে ওঠে তর্কাতীতভাবে। রাবণ কিংবা দুর্যোধনের রাজসিক এবং রাজকীয় অভিব্যক্তি ছাড়া রামায়ণ-মহাভারতও নীতিকথায় পর্যবসিত হত। রামায়ণে রাবণবধের পর রাবণের যে মর্যাদা ফুটে ওঠে, মহাভারতেও গদাঘাতে অর্ধশায়িত দুর্যোধনের মাথায় ভীম লাথি মারতে গেলে যুধিষ্ঠির-কৃষ্ণের দ্বৈত উচ্চারণে দুর্যোধনেরও মহাকাব্যিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হয়। দুর্যোধনের মৃত্যুতে স্বর্গের মন্দারমঞ্জরী ঝরে পড়ে তাঁর মাথায়।

আমরা এই মর্যাদা থেকেই মহাভারতের প্রতিপক্ষ নায়কদের চরিত্র ভাবনা করেছি, যদিও প্রত্যেকটি চরিত্রকে পৃথকভাবে তার নিজস্ব অভিজ্ঞানে সম্পূর্ণ করার জন্য পুনরুক্তি দোষও ঘটেছে কোথাও কোথাও, সহৃদয় পাঠক তা ক্ষমা করবেন। রসিক-পণ্ডিত রূপ গোস্বামী তাঁর নাটকে লিখেছেন— শালগ্রাম শিলাকে কুয়োর জলে স্নান করালেও সেই জল ভগবানের চরণামৃতের মর্যাদা লাভ করে। তেমনই আমার লেখা বলেই নয়, মহাভারতের কথা বলেই এ-লেখা সহৃদয় পাঠককুলের আস্বাদন-যোগ্যতা লাভ করবে বলে আশা করি।

পরিশেষে জানাই— এই গ্রন্থ অন্তত এক বছর আগেই প্রকাশিত হতে পারত, কিন্তু বিলম্ব হওয়ার কারণ-কদম্বে আমার সাংসারিক জাল যতখানি দায়ী, তেমনই আমার কর্মস্থল একটি কলেজ হবার কারণে সেখানে নীতিগত শৃঙ্খলার শৃঙ্খলিত যন্ত্রণাও কিছু কম নয়। তার মধ্যে দু-চারটে বই বেরনোয় নৃসিংহপ্রসাদের সামাজিক মর্যাদা কিছু বেড়েছে, ফলে এখানে-ওখানে তার বক্তৃতার ডাক আসে। বিভিন্ন স্থলে বিষয়ের নতুনত্ব এবং নিজের মূর্খতার জন্য পড়াশোনা করতে হয় নতুনভাবে, তাতেও সময় যায়। এইরকম নানাবিধ প্রতিবন্ধকতার মধ্যেও আনন্দ পাবলিশার্সের পরম বন্ধুরা সবসময় আমার বই রচনায় উৎসাহ দিয়েছেন।

আমাদের প্রত্যেকের গার্হস্থ্য জীবন এখন এমনভাবে চলে, যেখানে নিজেদের এবং অন্যদের কারুরই কোনও সময় আছে বলে মনে হয় না। যেমন আমার পুত্র অনির্বাণ তার বৈদ্যুতিন ব্যস্ততার মধ্যেও মাঝে মাঝে আওয়াজ দিয়ে বলে— কী হল? বইটই তো আর কিছুই বেরোচ্ছে না। এটাকে আমি অবশ্য পিতৃকল্পে গ্রহণ করি। আমার স্ত্রী মাঝখানে শারীরিকভাবে খুব অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। এখন অনেকটাই সুস্থ এবং তাঁর এই সুস্থতা এই গ্রন্থের গ্রন্থিবন্ধনেও সুস্থতা দিয়েছে। আমার মূল লেখাগুলিতে কাটাকুটি হয়, এখানকার কথা লালদাগে সবুজদাগে এদিকে ওদিকে স্থানান্তরিত হয়। সেই লেখা সর্বাংশে ‘প্রেজেন্টেবল’ করে দেন আমার সহকর্মী বন্ধু এবং ছাত্রী শ্রীমতী তাপসী মুখোপাধ্যায়। আমি তাঁর স্বামী অধ্যাপক সুশান্ত মুখোপাধ্যায়কে এ-বাবদে ধন্যবাদ জানাই— তিনি তাঁর স্ত্রীর এই অপব্যয় সহ্য করেন বলে। শেষে আমার ছোট্ট, একেবারে ছোট্ট দু’ বছরের ভোম্বা ডুলু— সে না হলে সকালবেলায় এত কুসুম ফুটবে কি!

নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ী

Book Content

একলব্য নিষাদ
দুর্যোধন
কর্ণ
শকুনি
দুঃশাসন
জয়দ্রথ
অশ্বত্থামা
কৃতবর্মা
শল্য
বলরাম সঙ্কর্ষণ
লেখক: নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ীবইয়ের ধরন: প্রবন্ধ ও গবেষণা
বাল্মীকির রাম ও রামায়ণ - নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ী

বাল্মীকির রাম ও রামায়ণ – নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ী

চৈতন্যদেব - নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ী

চৈতন্যদেব – নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ী

কৃষ্ণা কুন্তী এবং কৌন্তেয় - নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ী

কৃষ্ণা কুন্তী এবং কৌন্তেয় – নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ী

মহাভারতের ভারত যুদ্ধ এবং কৃষ্ণ - নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ী

মহাভারতের ভারতযুদ্ধ এবং কৃষ্ণ – নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ী

Reader Interactions

Leave a Reply Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

ডিকশনারি

কৌতু্ক / জোকস

লিরিক

রেসিপি

বিবিধ রচনা

হেলথ

Download PDF


My Account

Facebook

top↑

Login
Accessing this book requires a login. Please enter your credentials below!

Continue with Google
Lost Your Password?
egb-logo
Register
Don't have an account? Register one!
Register an Account

Continue with Google

Registration confirmation will be emailed to you.