অশ্বত্থামা

অশ্বত্থামা

একটা সময় ছিল, যখন ইতিহাস বলতে রাজা-রাজড়ার কাহিনি, তাঁদের শাসন আর ব্যক্তিত্বের বিশ্লেষণ হত। এখন তেমন হয় না, এখন ‘হিস্‌ট্রি ফ্রম বিলো’— নীচতলার সামাজিক দৃষ্টিতে এখন আমরা ইতিহাসের বিচার করি। একটা সময় ছিল, যখন শরীরের ব্যাধির নিরিখেই মানুষের কষ্টের ভাবনা করতাম আমরা, মনের ব্যাধির দিকে তাকাতাম না তেমন করে। এখন আমরা মানুষের মনের ভাবনা বেশি ভাবি। এমনকী মানুষের ব্যক্তিগত ব্যবহার, চরিত্র, ব্যক্তিত্বের বিকাশ— এই সব কিছুর ওপরে পরিবেশ কেমন ছায়া ফেলে, তাঁর বাল্যকালের চাওয়া পাওয়া, সুখ-আড়ম্বর অথবা তাঁর পরিজন, নিকট জনের পাওয়া-না-পাওয়া কীরকম আন্তঃক্রিয়া তৈরি করে— সে-সব আজকের দিনে বিচার করি আমরা। এককালে একটি মানুষ বদরাগি হলে, খিটখিটে হলে, অস্বাভাবিক ব্যবহার করলে, আমরা সেই মানুষকে বদমেজাজের তকমা দিয়ে দিতাম। আজকের দিনে আমরা একটু তবু থামি, দেখার চেষ্টা করি— মানুষটা তাঁর জন্মলগ্ন থেকে এখন পর্যন্ত কী পরিস্থিতির মধ্যে বড় হয়েছে, পরিবেশ, পরিজন এবং সমাজ তাঁকে কীভাবে প্রভাবিত করেছে। এতে আর কিছু নয়, একটা মানুষের বহিরঙ্গের ক্রোধ, লোভ, লালসা অথবা তাঁর যে-কোনও অস্বাভাবিকতাই আমাদের বুদ্ধি বিচার এবং সমব্যথার আধার হয়ে ওঠে, মানুষটাকে আর তখন আমরা আপাত ক্রিয়াকলাপে বিচার করি না, তাঁকে সামগ্রিকভাবে দেখি।

বলতে পারেন, এ-সব তো একেবারেই আধুনিক বিচার-শৈলীর অঙ্গ, মহাভারত-রামায়ণ, পুরাণ-ইতিহাস কি এখনকার ভাবনা-মতো চলেছে, নাকি তা চলতে পারে! উত্তরে বলব— আমরা তেমন ধার্মিক-আহাম্মকও নই যে, ‘সবই বেদে আছে’, এমন মহাতুষ্টিতে ‘সবই মহাভারতে আছে’ অথবা ‘যাহা নাই ভারতে, তাহা নাই ভারতে’— এমন আপ্তবাণী উচ্চারণ করব। সত্যি বলতে কি, মহাভারতের বিশালবুদ্ধি কবি তো আধুনিক চিকিৎসকের মতো মানুষের শরীর-মন ব্যবচ্ছেদ করে মানুষের চিকিৎসা করতে বসেননি। তিনি সামাজিক মানুষকে যেমনটি দেখেছেন, যেমনটি তাঁর হৃদয় এক-একটি মানুষকে অনুভব করেছে, তিনি সেই সব মানুষের জন্ম-বৃদ্ধি-পরিবেশ সব কিছু অনুষঙ্গে বর্ণনা করেছেন চরিত্র সৃষ্টির প্রয়োজনেই। মহাকবি তো এমন করে নিদান হেঁকে বলেন না যে, দেখো বাপু! এই লোকটার এই কারণে মনের রোগ হয়েছে, তিনি সামগ্রিকভাবে মানুষের জীবনচর্যার পরিমণ্ডল বর্ণনা করেন পাকা ঔপন্যাসিকের মতো, আর তাতেই সূর্যের কোমল-কিরণ-সম্পাতে পদ্মের পাপড়ি যেমন একটু একটু প্রস্ফুটিত হয়, মানুষের চরিত্রও তেমনই তাঁর নির্মাণ-লেখনীর শব্দ-সংকেতে একটু একটু করে ফুটে ওঠে।

মহাকাব্যের কবি যে দর্শন, যে ভাবনায় বিশ্বাস করেন, তা কিন্তু তিনি বলেও দেন অন্যত্র, অন্য কোনও প্রসঙ্গে— যেখানে তাঁর সৃষ্ট মানুষের চরিত্রটি উল্লিখিত হয় না একবারও, অথচ সেই দর্শন, সেই ভাবনা তিনি এতটুকু উল্লেখ না করেও সেই দর্শন এবং ভাবনা তিনি ব্যবহার করেন চরিত্রসৃষ্টির কাজে— পাঠক তখন সম্পূর্ণ অচেতন অথবা অসচেতন— কাহিনি এবং বর্ণনায় তিনি তখন অন্যত্র মুগ্ধ এবং ব্যাপৃত। মহাভারতের অন্যতম বিরাট চরিত্র কর্ণের কথা বলার সময়, তাঁর জীবনের বিভিন্ন উন্থানপতন ব্যাখ্যা করার সময় অদ্ভুত সুক্ষ্মতায় কর্ণের ওপর তাঁর পরিবার, পরিজন এবং সমাজের প্রভাব বর্ণনা করেছেন। কুন্তীর গর্ভে ক্ষত্রিয় হয়ে জন্মালেও অধিরথের সংসারে সূতের সংস্কারে বেড়ে ওঠার জন্যই যে কর্ণের মধ্যে কতগুলি হীনম্মন্যতা তৈরি হয়েছিল, গুণবান মানুষের গুণ সহ্য করতে না পারার মৎসরতা তৈরি হয়েছিল— এ সব কথা মহাভারতের কবি উচ্চারণ করেন একেবারে অন্য প্রসঙ্গে। তিনি বুঝিয়ে দেন— মানুষের বেড়ে ওঠার মধ্যে পরিবেশ, পরিজন এবং অন্যতম প্রভাব কীভাবে কাজ করে। একইভাবে মহাকাব্যের কবি অন্য জায়গায় অন্য প্রসঙ্গে বলেছেন যে শরীরের ব্যাধির থেকেও মনের অসুখ অনেক বড়। তবে কিনা শরীরের দুঃখ যে-যে কারণ থেকে হয়, মানসিক দুঃখ এবং জটিলতা সেইসব কারণ থেকে হয় না। মনের দুঃখ বা মানসিক ব্যাধির প্রধান কারণ হল স্নেহ— মনসো দুঃখমূলং তু স্নেহ ইত্যুপলভ্যতে। মানুষ স্নেহের বশেই এমনভাবে জড়িয়ে যায় যে, এক সময় সেটাই তাঁর মানসিক ব্যাধি তৈরি করে।

সত্যি বলতে কী, ‘স্নেহ’ কথাটা এখন, বিশেষত বাংলাভাষায় খুব সংকীর্ণ অর্থে ব্যবহৃত হয়। পুত্র-কন্যার ওপরে পিতা-মাতার যে পরম বাৎসল্য, তাঁকেই আমরা ‘স্নেহ’ বলে থাকি। কিন্তু সংস্কৃতির ধাতুগত মৌলিক অর্থে ‘স্নেহ’ মানে অনুরাগ, আসক্তি। মহাভারত বলেছে— স্নেহ থেকেই মানুষের যত দুঃখ, যত ভয়, শোক, হর্ষ, চেষ্টা, ক্লেশ— সব তৈরি হয় এই স্নেহ থেকেই— শোকহর্ষৌ তথায়াসঃ সর্বং স্নেহাৎ প্রবর্ততে। মানুষের অন্তরশায়ী এই অনুরাগ-বৃত্তি থেকেই বিষয়-রসের উপভোগ-সংকল্প তৈরি হয়, তারপর সেই বিষয়ে প্রীতি তৈরি হয়। মহাভারতের কবি যতখানি কবি ঠিক ততখানি দার্শনিক বলেই এখনকার দিনের মতো ‘ইঁদুর দৌড়’ শব্দটা ব্যবহার করেননি। তিনি বলেছেন— তৃষ্ণা, পিপাসা। বলেছেন— এটার মতো উদ্বেগ তৈরি-করা জিনিস আর দ্বিতীয়— নেই অনাদি, অনন্ত এই তৃষ্ণা মানুষের অন্তর্দেহের মধ্যে এমন আগুন জ্বালিয়ে তোলে যে, সে আগুন মানুষকে পুড়িয়ে শেষ করে ছাড়ে। এ এক প্রাণান্তিক রোগ— যোহসৌ প্রাণান্তিকো রোগঃ… অন্তর্দেহগতা নৃণাম্। মহাভারতের কবি ‘অবদমিত’ আকাঙক্ষার মতো একটা শব্দ জানতেন না বটে, কিন্তু মানুষের অন্তরশায়ী তৃষ্ণার আগুনকে যে মুহূর্তে তিনি, অন্তর্দেহের গোপনে-থাকা কারণহীন আগুন বলেছেন, তখনই বুঝেছি, ‘অবদমিত আকাঙক্ষা’র কথাটা মহাভারতের দার্শনিক কবির কাছে নিতান্তই শব্দ-তন্মাত্র। বস্তুত তিনি এই আকাঙক্ষাকে আরও গভীর দার্শনিকতায় দেখতে পান।

আমি জানি, খাজনার চেয়ে আমাদের বাজনা বেশি হয়ে যাচ্ছে— আমরা অশ্বত্থামার চরিত্র লিখতে বসেছি, সেখানে তাঁর বিচিত্র জীবনের শিক্ষা-দীক্ষা, বীরত্ব, গৌরব— এগুলির আন্তরিক প্রতিবেদনই তো ঈপ্সিত ছিল, সেখানে কেন আবার এই ‘প্রাণান্তিক’ মনোরোগের প্রস্তাবনা! আমরা বলি— অশ্বত্থামাকে তো আজকের মতো করেই বোঝা দরকার। মহাভারতের প্রত্যেক চরিত্রের জাগতিক জীবনের মধ্যে এমন বিচিত্র ইন্ধন লুকিয়ে আছে, যেখানে সেই গাঠনিক উপাদানটুকু বার করে আনতে না পারলে সেই চরিত্রকে সার্বিকভাবে বোঝা যায় না। অশ্বত্থামার বাল্যাবধি জীবনের প্রতিতন্তু-বিশ্লেষণের আগে আমরা তাই মনোময় দেহের কথা তুলতে বাধ্য হয়েছি— যদিও সে-সব কথা মহাভারতে আসে অপ্রসঙ্গে— মহাকবি, মহাকাব্যের কবি কখনও এমন স্থূলভাবে লেখেন না, যেভাবে আমরা বোঝার চেষ্টা করি।

অন্তর্দেহের গোপনে থাকা তৃষ্ণার কথা বলতে গিয়ে বিশালবুদ্ধি ব্যাস দুটি উপমা প্রয়োগ করেছেন। প্রথমে যখন মনোরোগের কারণ হিসেবে ‘স্নেহে’র কথা তুললেন ব্যাস, তখন তিনি বলেছিলেন— স্নেহ থেকে প্রথমে জন্মায় ভাব এবং তারপরে জন্মায় অনুরাগ, বিষয়ে অনুরাগ— স্নেহাদ্‌ভাবোহনুরাগশ্চ প্রজজ্ঞে বিষয়ে তথা— এই ‘ভাব’ এবং ‘অনুরাগ’ দুটোই বড় খারাপ জিনিস, যদিও বিষয়ে অনুরাগের চেয়েও ‘ভাব’ বস্তুটা আরও খারাপ— পূর্বস্তত্র গুরু স্মৃতঃ। আমরা পূর্বে ‘ভাব’ কথাটাকে ভাবনা, সংস্কল্পাত্মক ভাবনা বলেছি এবং তা বলেছি মহাভারতের প্রসিদ্ধ টীকাকার নীলকণ্ঠের মতে। বস্তুত মহামতি নীলকণ্ঠও এই কথাটা তেমন গভীরভাবে দেখেননি, যেমনটি দেখেছেন রসশাস্ত্রের পণ্ডিতেরা অথবা দেখেছেন মহাকবি কালিদাস— যিনি ‘রম্যাণি বীক্ষ্য’ শ্লোক লিখে শেষ পংক্তিতে বলেছিলেন— ভাবস্থিরাণি জননান্তর-সৌহৃদানি।

আসলে প্রত্যেক মানুষের মধ্যেই এক জন্মান্তরীণ বাসনালোক আছে, যা মানুষের অন্তর্দেহে বাসা বাঁধে, সেখান থেকেই মানুষের ভবিষ্যদ্ চারিত্রিক বৃত্তিগুলি প্রকট হয়ে ওঠে, রসশাস্ত্রের মতে বিশিষ্ট বিষয়ে রসগ্রহণের ক্ষমতাও আসে মানুষের বাসনালোকশায়ী সেই ভাব থেকেই। আমাদের দার্শনিকরা বলবেন— প্রত্যেক মানুষের বাসনালোক তৈরি হয় পূর্বকালীন সংস্কার অনুযায়ী, একটু বাড়িয়ে বললে এবং আরও একটু বিশ্বাসী হয়ে বললে সেটা জন্মান্তরীণ সংস্কার। মানুষের দুর্বাসনা, সুবাসনা সব লুকিয়ে থাকে এই সংস্কারাত্মক ভাবের মধ্যেই ফ্রয়েডসাহেবের ‘অবদমিত আকাঙক্ষা’র গর্ভস্থানও আমাদের মতে এই বাসনালোক। মহাভারতের টীকাকার নীলকণ্ঠ প্রথমে তত সচেতন ছিলেন না বলেই ‘ভাব’ কথাটার একটা যেমন-তেমন সরল মানে করেই ছেড়ে দিয়েছেন। এমনকী তিনি এটাও ভাল করে খেয়াল করলেন না যে, মহাকবি এই প্রসঙ্গেই তাঁর প্রথম উপমাটি ব্যবহার করে বললেন— মানুষের ওই ভাব এবং বিষয়ানুরাগ থাকে মানুষের মনের মধ্যেই। গাছের কোটরে আগুন থাকলে, সে-আগুন যেমন সমস্ত গাছটাকেই পুড়িয়ে ধ্বংস করে দিতে পারে, মানুষের মনের মধ্যে যদি বিষয়ের তৃষ্ণার দোষ থাকে, বিষয়ানুরাগে যদি দুর্বাসনার বিষ থাকে, তবে তাও ধ্বংস করে দেয় মানুষকে— ধর্মাথৌ তু তথাল্পোহপি রাগদোষো বিনাশয়েৎ।

ব্যাস তাঁর দ্বিতীয় উপমাটি প্রয়োগ করলেন বিষয়-তৃষ্ণার গতি-প্রকৃতি বোঝানোর পর। তিনি বলেছিলেন— তৃষ্ণা, আকাঙক্ষা, পিপাসার কোনও আদি নেই, অন্ত নেই। অন্তর্দেহে বাসা-বাঁধা এই তৃষ্ণা হল কারণহীন এক আগুন যা মানুষকে ধ্বংস করে দেয়— বিনাশয়তি ভূতানি অযযানিজ ইবানলঃ। এইবারে টীকাকার নীলকণ্ঠ অতিরিক্ত সচেতন হয়ে উঠেছেন, এতক্ষণে তিনি অনুধাবন করেছেন যে, ব্যাস বেশ কঠিন কথা বলছেন, মানুষের অবদমিত আকাঙক্ষা নিয়ে এটা তাঁর দার্শনিক প্রতিবেদন। অতিরিক্ত সচেতনতার ফলে নীলকণ্ঠ এবার বিভ্রান্তও হয়ে পড়েছেন খানিকটা। নীলকণ্ঠ প্রথমে ঠিকই বলেছেন। বলেছেন-এখানে অন্তর্দেহ বলতে মানুষের মন-বস্তুটাকে বুঝতে হবে। দেহ তো দু’রকমের। এক তো বাহ্য এই শরীর, প্রত্যেকটি ইন্দ্রিয়কে খাদ্য দিতে দিতে যে অন্নময় শরীর বেড়ে ওঠে, সেই আমাদের বাহ্য দেহ। আর দ্বিতীয় হল অন্তর্দেহ, যাকে মন বলি আমরা। মনের মধ্যে জন্মান্তরীণ বাসনালোক এই জন্মের ক্রিয়া-কলাপ-অভিজ্ঞতায় ‘ভাব’-রূপে স্ফূরিত হয়। সেখান থেকে জন্মায় রাগ— রম্যবস্তু দর্শন করার পরেই যে চিত্তের উৎফুল্ল ভাব, সেটাই অনুরাগ। অনুরাগ-গ্রস্ত পুরুষ ঈপ্সিত বস্তুর কামনায় তাড়িত হয়, সেটাই কাম। কাম থেকে জন্মায় ইচ্ছা অর্থাৎ কামনার বস্তু পেয়ে গেলে বার বার সেটা পাবার অভিলাষ। আবার পেলেও আবার, এবং আরও পাবার জন্য যে অতৃপ্তি কাজ করে, সেই তৃষ্ণাই সৃষ্টি করে মানসিক সেই প্রাণান্তিক রোগ। কেন না তৃষ্ণার বস্তুটি না পেলেই ক্রোধ তৈরি হয়— শঙ্করাচার্য লিখেছেন এক জায়গায়— কাম এব প্রতিহতঃ ক্রোধরূপেণ পরিণমতে— কাম প্রতিহত হলেই সেটা ক্রোধে পরিণত হয়— কামাৎ ক্রোধোহভিজায়তে। এই তৃষ্ণা, লোভ, ক্রোধই আমাদের অন্তর্দেহের মনে যত মানসিক জটিলতা তৈরি করে। ঠিক এইখানেই মহাভারতের কবি উপমা দিয়ে বললেন— অযোনিজ ইবানলঃ।

অতি-সচেতন টীকাকার নীলকণ্ঠ মহাফাঁফরে পড়েছেন এইখানে। তিনি বলেছেন— এই উপমার দুটি পাঠ আছে এবং গণ্ডগোলটা তৈরি হয়েছে ‘য’-কারের লিপিপ্রমাদে। আমাদের উদ্ধৃত পাঠটি তাঁর দ্বিতীয় প্রকার, যদিও হঠাৎই অতি-সচেতন হয়ে ওঠায় নীলকণ্ঠ এই পাঠের অর্থও অতি-জটিল করে ফেলেছেন। আর প্রথম প্রকারের পাঠ তো আরও অসমীচীন মনে হয়, যদিও সেই পাঠ পঞ্চানন তর্করত্ন তাঁর বঙ্গবাসী সংস্করণে গ্রহণ করেছেন এবং বেশ কিছু হিন্দি, সংস্কৃত সংস্করণও এই পাঠ স্বীকার করেছে। পুরো লাইনটা যদি এইরকম হয়— বিনাশয়তি ভূতানি অয়ো নিজ ইবানলঃ— তা হলে এখানে ‘অয়ঃ’ শব্দের অর্থ লোহা, কিন্তু নীলকণ্ঠ বলেছেন— অয়ঃ হল— ‘তপ্ত লৌহপিণ্ড’, ‘নিজঃ’ শব্দের অর্থ ‘স্বরূপস্থ’, আর অনল মানে বহ্নি। পুরোটা মানে করলে দাঁড়ায়— মনের মধ্যে বাসা-বাঁধা এই তৃষ্ণা হল— নিজের মধ্যে থাকা আগুনে তপ্ত হয়ে ওঠা লৌহপিণ্ড। নীলকণ্ঠ বলেননি— এ আগুন হয়তো কামনার আগুন।

আর দ্বিতীয় পাঠ— ‘অযোনিজ ইবানলঃ— এটাকে টীকাকার শব্দ ভেঙে, নতুন শব্দ এনে এমন জটিল একটা ব্যাকরণ-কুটিল অর্থ করেছেন, যার কোনও প্রয়োজন ছিল না, অতএব তা উদ্ধৃত করারও প্রয়োজন দেখছি না। অথচ এখানে প্রসিদ্ধ শব্দার্থ গ্রহণ করেই মানুষের অন্তর্দেহের জটিলতাটুকু সহজে প্রকাশ করা যায়। ‘যোনি’ মানে কারণ। ‘অযোনিজ অনলের মতো’ এই তৃষ্ণা মানুষকে ধ্বংস করে দেয়— এই পুরো পংক্তির অর্থ— কারণ জানা যায় না এমন আগুন যেমন কাষ্ঠরাশি পুড়িয়ে ছাই বানায়, অন্তর্দেহে মনের মধ্যে অবদমিত এই তৃষ্ণা— যার কারণ ব্যাখা করা যায় না অনেক সময়েই, সেই তৃষ্ণা এমন এক ‘প্রাণান্তিক মনের রোগ’, যা ধ্বংস করে দেয় মানুষকে। এটা তো সত্যিই যে, মানুষের আশা, আকাঙক্ষা, কামনা, তৃষ্ণা, উচ্চাকাঙ্ক্ষার কারণ ব্যাখ্যা করা যায় না সব সময়, বিশেষত মহাভারত যখন এই তৃষ্ণাকে অনাদি এবং অনন্ত বলেছেন, তখন তো এই পাঠই ভাল যে, মনের মধ্যগত এই তৃষ্ণা এমনই এক আগুন, যে আগুন লাগল কেন তার কারণ বোঝা যায় না সব সময়। লক্ষ করে দেখবেন— চাওয়া-পাওয়ার হিসেব কষতে-কষতে যাদের মানসিক জটিলতা তৈরি হয়, সেই জটিলতা থেকে যত ‘ফ্রাস্ট্রেশন, ডিপ্রেশন’ জন্ম নেয় তাঁর কারণ খুঁজে পাওয়া যেমন দুষ্কর, তেমনই মনোজটিল মানুষকে তা বোঝানোও যায় না।

আমরা এত কথা বলতাম না, কিন্তু অশ্বত্থামার জীবন বোঝাতে গিয়ে যে, এত কথা বলছি, তাঁর কারণ— অশ্বত্থামাই বোধহয় মহাভারতের মধ্যে সেই জটিলতম চরিত্র, যিনি এক অদ্ভুত মানসিক জটিলতার শিকার। প্রতিনিয়ত অঙ্গুলী-সংকেত করে মহাভারতের কবি তা বলে দেননি বটে, কিন্তু তাঁর জীবনের জটিলতাগুলি কেন তৈরি হয়েছে, তাঁর একটা সূত্র তিনি দিয়ে দিয়েছেন মহাভারতের অংশাবতরণ অধ্যায়ে, যা পরে পরিস্ফুট হয়েছে চরিত্রের বিস্তারে, ঘটনার ক্রমান্বয়ে। মহাভারতের অংশাবতরণ নামে উপপর্বের মধ্যে মহাভারতের সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রের এমনকী অনেক সাধারণ চরিত্রেরও পূর্বকল্পের বিবরণ আছে। বলা হয়েছে— অমুক দেবতা বা অমুক রাক্ষস, অমুক দৈত্য অথবা কোনও ‘অ্যাবস্ট্রাক্ট’ বিষয় ধর্ম, ধী, মেধা— এঁদের অংশে জন্ম নিয়েছেন মহাভারতের নানান ব্যক্তিত্ব। সাধারণ জন, এমনকী অনেক মহাভারত-পড়া মানুষও এগুলিকে অবতারবাদী ভক্তজনের প্রলাপ মনে করেন। আসলে কোনও চরিত্রের পূর্বজন্মকালীন চরিত্রকল্প ব্যবহার করে মহাভারতের কবি সেই চরিত্রের মৌল উপাদান নির্ধারণ করেছেন— এই কথা বললে অংশাবতরণ-পর্বের অনেক পূর্বকল্পই সার্থক হয়ে ওঠে। শুধুমাত্র দেবকল্পতা বা রাক্ষসকল্পতাই যদি পূর্বকল্প-বর্ণনার মুখ্য উদ্দেশ্য হত, তা হলে ভীম-অর্জুন অথবা দুর্যোধন-শিশুপালের দেবকল্পতা অথবা রাক্ষস-কল্পতার মধ্যেই অংশাবতরণের তাৎপর্য নিহিত থাকত, কিন্তু ধর্ম, ধী, মেধা, মতি, কাম, ক্রোধ, ঈর্ষা ইত্যাদি নীতি অথবা দুর্নীতিবাচক মানসিক বৃত্তির অংশাবতরণ তা হলে ভীষণই নিরর্থক এবং বোকা-বোকা হয়ে পড়ে। আমাদের ধারণা— মহাভারতের কবি অংশাবতরণ-পর্বে এক-একটি চরিত্রের পূর্ব পুরাকল্প নির্দেশ করে সেই চরিত্রগুলির মানসিক গঠন নির্ণয় করে দিয়েছেন।

অশ্বত্থামার ইহজীবন বাইরে থেকে দেখলে তাঁকে কোনও লঘুচরিত্র বলে মনে হয় না। তিনি ব্রাহ্মণ দ্রোণাচার্যের পুত্র, পিতার বৃত্তি গ্রহণ করে তিনি মহাভারতের অন্যতম অস্ত্রবিৎ মহাবীর। কৌরব রাজসভায় তাঁর প্রতিপত্তির সীমা নেই, স্পষ্ট কথা বলেন, এবং অন্য জনে তাঁর কথা শোনে। এ হেন মানুষের মধ্যেও কোথায় যেন এক বিরাট জটিলতা আছে— যে জটিলতা তাঁর জীবন বিশ্লেষণ করলে তবেই বোঝা যায়। কিন্তু সেই জটিলতার বীজ কোথায়, সেটা কেন তাঁর অন্তর্দেহের কোটরে বাসা বাঁধল— এই নিদানটুকু ওই অংশাবতরণ-পর্বের একটিমাত্র শ্লোক থেকে পাওয়া যায় এবং আমাদের ধারণা অশ্বত্থামার জটিল মানস-লোকের এই সূত্র নির্দেশ সেইকালের দিনের মহাকবিকে এক নতুন আধুনিক মাত্রায় দেখতে বাধ্য করে।

কার অংশে অশ্বত্থামার জন্ম— এই পূর্বসত্য জানানোর সময় ব্যাস লিখেছেন— মহাদেবের এবং কালান্তক যমের অংশের সঙ্গে কাম এবং ক্রোধের অংশ একাকার হয়ে অশ্বত্থামার জন্ম হয়েছে— একত্বমুপপন্নানাং জজ্ঞে শুরঃ পরন্তপঃ। এ এক অদ্ভুত ‘কমবিনেশন’— মহাদেবের মধ্যে যেমন শিব বা মঙ্গলের অধিবাস, তেমনই সেই শিব-মহাদেব তো সংহার-মূর্তি রুদ্রেরও প্রতীক। দেখবেন, অশ্বত্থামার কারণেই পাণ্ডবদের শেষ বংশধরেরাও ধ্বংস হয়ে গেলেন। এমনকী তাঁদের শেষ সন্তানবীজ উত্তরার গর্ভস্থ পরীক্ষিৎ পর্যন্ত তাঁর বাণ-দহনে পরিক্ষীণ— তিনি পরিক্ষীণ পাণ্ডব-বংশের পরিক্ষীণ বংশধর। আবার যমের অংশও তাঁর মধ্যে আছে। পুরাণে-মহাভারতে যম মৃত্যুর দেবতা, তিনি মানুষের পুণ্য-পাপের দণ্ড বিধান করেন। অশ্বত্থামাও কাউকে রেয়াত করে চলেন না, অতিপরিচিত জনেরও তিনি দণ্ডবিধান করেন। সর্বশেষে আছে সেই মানসিক জটিলতার কারণ— মহাদেবান্তকাভ্যাঞ্চ কামাৎ ক্রোধাচ্চ ভারত। কামনা— বিষয়ে অনুরাগ, তৃষ্ণা তাঁর মধ্যে বাসা বেঁধেছে বাল্যকাল থেকেই এবং সেই কামনা প্রতিহত হবার ফলে যে সর্বান্তক ক্রোধ জন্ম নিয়েছে তাঁর মধ্যে তাতে অশ্বত্থামার মানসিক গঠন আরও জটিল হয়ে গেছে।

অশ্বত্থামাকে আমাদের বিচার করতে হবে এই নিদান-সূত্র থেকেই; অবশ্য কাম ব্যাপারটাকে ব্যবচ্ছেদ করলে যে অভিলাষ, তৃষ্ণা এবং অর্থলাভের স্কুল শব্দগুলি এসে পড়ে, অশ্বত্থামা এগুলি উত্তরাধিকার-সূত্রে লাভ করেছেন তাঁর পিতার কাছ থেকে, কিন্তু পিতা দ্রোণাচার্যের মধ্যে শম-দমের যে গুণটুকু ছিল, সেটা অশ্বত্থামা পাননি সহজাত উত্তরাধিকারে, আর ঠিক এই জন্যেই তাঁর অন্তর্দেহে তৈরি হয়েছে সেই মানসিক আবর্ত, যে কারণে বেঁচে থাকার সুখ থেকে তিনি বঞ্চিত হয়েছেন অকালে। এ কথা অবশ্য মানতেই হবে যে, নিজের কাম-লোভ-লাঞ্ছিত জীবন-ধারণের জন্য তিনি নিজেই সর্বাংশে দায়ী নন এবং এ-ব্যাপারে তাঁর পিতার দায়ও কিছু কম নয়। কেন না ব্রাহ্মণের ছেলে হওয়া সত্ত্বেও তারা ব্রাহ্মণের নির্লোভ তপস্যার বৃত্তি গ্রহণ করতে পারেননি, তাঁর পিতা বহুকাল আগেই ব্রাহ্মণের যজন-যাজন, অধ্যয়ন-অধ্যাপনা বাদ দিয়ে ক্ষত্রিয়ের অস্ত্রদীক্ষা এবং অর্থভাবনায় মন দিয়েছিলেন। আর পুত্র হিসেবে অশ্বত্থামা জন্ম থেকেই পিতাকে যে বৃত্তিতে প্রতিষ্ঠিত দেখছেন, সেই আজন্ম-দেখা পিতার অস্ত্রবৃত্তি পরিহার করে হঠাৎই তিনি আবার অর্থহীন ব্রাহ্মণ্যের দিকে ঝুঁকে পড়বেন, এটা স্বাভাবিক ছিল না।

তা ছাড়া অস্ত্রবৃত্তি ত্যাগের কোনও কারণও ছিল না। জন্মের পরে অজ্ঞান অবস্থাতেও নয়, যখন তাঁর বেশ জ্ঞান-বোধ জন্মে গেছে তখনও তিনি পিতাকে সম্পন্ন দেখেননি, তাঁর সেই দুগ্ধের পরিবর্তে চাল-বাটা পিটুলি-গোলা খাওয়ার ঘটনাটা তো একটা বড় ঘটনাই বটে। পাণ্ডব-কৌরবের রাজ্যে বৃত্তিলাভের পূর্বাহ্নে দ্রোণাচার্য সবিস্তারে তাঁর দৈন্যদশার কথা জানিয়েছিলেন ভীষ্মকে এবং সেখানে পুত্র অশ্বত্থামা রীতিমতো একটা ‘ইস্যু’। দ্রোণাচার্য ভীষ্মকে দুঃখ করে বলেছিলেন— ধনীজনের ছেলেপিলেরা দুধ খায় বলে আমার ছেলে অশ্বত্থামাও আমার কাছে বায়না ধরেছিল যে, সে গোরুর দুধ খাবে— গোক্ষীরং পিবতে দৃষ্ট্বা ধনিনস্তত্র পুত্ৰকান্‌। দ্রোণাচার্য দুঃখ করে বলেছেন ভীষ্মকে— ছেলের এই সামান্য বায়না মেটানোর জন্য আমি দেশের এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্ত ঘুরে বেড়িয়েছি, কিন্তু কেউ আমাকে একটা গোরু দেয়নি— অন্তাদন্তং পরিক্রম্য নাধ্যগচ্ছং পয়স্বিনীম্‌। দ্রোণাচার্যের এই গোরু খোঁজার চেষ্টা এবং গোরু না-পাওয়া এর জন্য দায়ী সেই বৃত্তিত্যাগ! দ্রোণাচার্য ব্রাহ্মণের বৃত্তি ত্যাগ করে ক্ষত্রিয়ের অস্ত্রবৃত্তি গ্রহণ করেছিলেন বলেই মানুষের কাছে গোদান লাভ করা সম্ভব হয়নি। এটা আমরা বুঝি। কিন্তু সবচেয়ে আশ্চর্য, অশ্বত্থামার কান্না কিন্তু থামল না। দ্রোণ নিজেই বলেছেন— অশ্বত্থামা কেঁদেছিল, এমনই কেঁদেছিল যে, চারদিক অন্ধকার হয়ে গিয়েছিল আমার কাছে— অশ্বত্থামারুদদ্-বালস্তন্মে সন্দেহয়দ্ দিশঃ।

আমাদের জিজ্ঞাসা— কেন এত অন্ধকার সৃষ্টি হয় পণ্ডিত এবং ঋষিপুত্র আচার্যের চোখে। বড়লোকের ছেলেরা দুধ খাচ্ছে বলেই তাঁর ছেলেকেও দুধ খেতে হবে— এমন দুর্বাসনা তো তৎকালীন দিনের সমাজ এবং ধর্ম-দার্শনিকতার পরিপন্থী ভাবনা ছিল। গরিবের ছেলে বড়লোকের ছেলের সঙ্গে মিশবে কেন— এই অহমিকাও তো দ্রোণাচার্যের থাকতে পারত। আসলে মহাভারতের ভূয়োদার্শনিক কবি এই জটিল সামাজিক প্রেক্ষাপট অঙ্কিত করেছেন পৃথিবীর মানুষ দেখেই। এমন মানুষ আছেন এই পথিবীতে যারা অর্থ-বিত্তহীন হওয়া সত্ত্বেও বড়লোকের সঙ্গে অথবা বড়লোকের ছেলের সঙ্গে ওঠা-বসা করতে ভালবাসেন। হয়তো মনের মধ্যেই কারও সেই হীনম্মন্যতা তৈরি হয় অভাবে অথবা স্বভাবে। দ্রোণাচার্যের নিজের জীবন-চর্যাটাই তো সেইরকম। ঋষিপুত্র হওয়া সত্ত্বেও অধিকতর অর্থলাভের চিন্তায় তিনি অস্ত্রবৃত্তি গ্রহণ করেছিলেন। এটার থেকেও বড় কথা, তিনি গুরুকুলে এসে রাজার ছেলে পার্ষত দ্রুপদের সঙ্গে এমন বন্ধুত্ব পাতালেন যে, ভবিষ্যতে অর্ধেক পঞ্চাল-রাজ্য তাঁর হবে— এই বন্ধুত্বের দায় নিয়ে দ্রুপদ গুরুকুল ছাড়লেন। পরিশেষে সেই দায় তাঁকে মেটাতে হয়েছিল অর্ধেক পঞ্চাল ছেড়েই। দ্রুপদের চিরজন্মের শত্রুতা হয়ে গিয়েছিল দ্রোণের সঙ্গে।

সেই বড়লোকের সঙ্গে মেশা কিন্তু অশ্বত্থামার সময়েও চলছে। দ্রোণ অবশ্য তখনও বড়লোক হননি, পঞ্চাল রাজ্যও তখনও তাঁর হাতে আসেনি, হাতে আসেনি হস্তিনাপুরের চাকরিটাও। কিন্তু সেই হত-দরিদ্র অবস্থাতেও— যখন পর্যন্ত একটি গোরুও তাঁর জোটে না, সেই অবস্থাতেও বড়লোকের ছেলের দুগ্ধপান দেখে তাঁর কষ্ট হচ্ছে। শেষে সেইদিন এল— যখন বড়লোকের ছেলেরা অশ্বত্থামাকে পিটুলি-গোলা পান করিয়ে বলল— এটাই দুধ খেলি। অশ্বত্থামা পিটুলি-গোলা খেয়েই দুগ্ধপানের আনন্দে নাচতে থাকলেন— ননর্তোত্থায় কৌরব্য… ক্ষীরং পীতং ময়াপি চ। দ্রোণ দেখেছিলেন— বড়লোকের ছেলেরা তখন তাঁর ছেলেকে ঘিরে উল্লাসে মজায় নেচে বেড়াচ্ছে, আর অশ্বত্থামাও তাঁদের মধ্যে দুধ খেয়েছি ভেবে নেচে যাচ্ছে। এই দৃশ্য দেখে দ্রোণের মাথা কাটা গিয়েছিল এমনকী এই ধিক্কারও তাঁকে শুনতে হয়েছিল যে, তিনি টাকা-পয়সা জোটাতে পারেন না— দ্রোণং ধিগস্ত্বধনিনং যো ধনং নাধিগচ্ছতি— সেইজন্যই আজ তাঁর ছেলে দুধ ভেবে পিটুলিগোলা খাচ্ছে।

দ্রোণাচার্য ভীষ্মের কাছে সদুঃখে জানিয়েছেন যে, ব্রাহ্মণরাও তাঁকে বৃত্তিত্যাগের কারণে ত্যাগ করেছিলেন এবং তারপর ছেলের ওপর ধনী বালকদের এই উপহাস-ভাষণ শুনে এবার তিনি দ্রুপদের কাছে গিয়েছিলেন পূর্বস্মৃতি জাগরিত করার জন্য। কিন্তু একবারের তরেও দ্রোণাচার্য এটা ভাবেননি যে, এইভাবে নিজের গরিবি হঠানো যায় না অথবা এমনও তিনি ভাবেননি যে, তিনি যেমন অবস্থায় আছেন সেই অবস্থায় মানিয়ে নিয়েই তাঁর ছেলেকেও মানুষ হতে হবে। এতএব যে অর্থলিপ্সা এবং যে উচ্চাশা নিয়ে দ্রোণাচার্য জীবন চালাচ্ছিলেন, সেই অর্থলিপ্স এবং উচ্চাশা কিন্তু পুত্র অশ্বত্থামার মধ্যেও সংক্রমিত হয়েছিল পিতার উত্তরাধিকারে। বড়লোকের সঙ্গে মিশে বড়লোকের ধিক্কার শুনে বড়লোক হওয়াটাই যেখানে দ্রোণের কাছে সবচেয়ে কাম্য হয়ে উঠেছিল, সেই কাম্যতা, সেই তৃষ্ণা জন্মলগ্নেই সংক্রমিত হয়েছিল অশ্বত্থামার মধ্যে। গরিব ঘরে জন্মে ক্ষীরপানের বাসনায় যাঁর বাল্যকাল মোহগ্রস্ত হয়েছিল, বড় হয়ে বড়লোকের বাড়ির সংশ্রয়াকাঙক্ষা তাঁর অন্তর্দেহে রয়েই গেল।

অশ্বত্থামার বাল্যকালের একটিমাত্র ঘটনা বলে আমরা তাঁর বেড়ে ওঠার পরিমণ্ডলটুকু বোঝানোর চেষ্টা করেছি, কিন্তু যথাযথ বলতে হলে আরও আগে থেকে দুটো কথা আমার জানানো উচিত ছিল।

অশ্বত্থামার জন্ম হয়েছে কৃপীর গর্ভে দ্রোণাচার্যের ঔরসে এবং জন্মলগ্নেই প্রথম যে ক্রন্দন-ধ্বনি শিশুকণ্ঠে সাধারণ, সেই ক্রন্দনেও খানিকটা অদ্ভুত বিশেষত্ব আছে অশ্বত্থামার, তিনি নাকি অশ্বের হ্রেষার মতো অর্থাৎ ঘোড়ার চিঁহি-চিঁহি শব্দের মতো করে কেঁদে উঠেছিলেন জন্মাবার পরেই— স জাতমাত্রো ব্যনদদ্ যথৈবোচ্চৈঃশ্রবা হয়ঃ। মহাকাব্যের কবি বলেই এই ক্রন্দনধ্বনিকে সাধারণ ঘোড়ার ডাক না বলে ইন্দ্রের বাহন উচ্চৈঃশ্রবার হ্রেষা-শব্দ বলে চিহ্নিত করেছেন ব্যাস। বাস্তবে একান্ত লৌকিকভাবে আমরা পুরাকল্পের অর্থ বুঝি এইভাবে যে, অশ্বত্থামার গলার স্বর হয়তো খানিক সূক্ষ্মতীব্র এবং অনুনাসিক ছিল। কিছু কিছু পুরুষের কণ্ঠ এমন তীব্র এবং সরু হয়, তাঁদের গলার স্বর ঠিক সাধারণ পুরুষের মতো ভারী হয় না, কেমন যেন মনে হয় নারীকণ্ঠ-সমীচীন, অথচ ঠিক মেয়েলিও নয়, বেশ তীব্র— অশ্বত্থামা হয়তো সেইরকম গলায় কথা বলতেন বলেই তাঁর নামটাও রাখা হল ‘কনোটেটিভলি’।

‘স্থাম’ মানে শব্দ, অশ্বের মতো যার ‘স্থাম’ বা গলার স্বর, সেই জন্যেই তাঁর নাম অশ্বত্থামা— অশ্বস্যৈবাস্য যৎ স্থাম নদতঃ প্রদিশো গতম্। প্রশ্ন ওঠে— ‘অশ্ব’-শব্দের সঙ্গে ‘স্থাম’-শব্দের সমাস করলে পুরো শব্দটা হওয়া উচিত ছিল— ‘অশ্বস্থামন্’। টীকাকার নীলকণ্ঠ ‘আগে ভাষা, পরে ব্যাকরণ’ — এই বুদ্ধি মাথায় রেখে বলে দিয়েছেন— এখানে ‘স্থাম’ শব্দের আরম্ভ বর্ণ ‘স’-কারের আদেশ হবে ‘ত’-কার। আসল কথা— প্রায় অব্যবহিত তালব্য-শ-এর পরেই দন্ত্য-স এবং থ-এর যুক্তবর্ণ উচ্চারণ মানুষের উচ্চারণে কঠিন হয়ে ওঠে বলেই ব্যাকরণ শাস্ত্রের এই সহজীকরণ— অশ্বত্থামা— ত্ এবং থ একত্রে এল।

মহাভারত বলেছে— দৈববাণীতে এই নাম, আমরা বলি— অশ্বত্থামার গলার শব্দ শুনে। লোকে তাঁকে এই নামে ডাকতে শুরু করে এবং স্নেহশীল পিতাও সাদরে এই নামটি মেনে নিয়েছেন— অশ্বত্থামৈব বালোহয়ং তস্মান্নান্না ভবিষ্যতি। আমাদের ধারণা— ব্যাকরণের চেষ্টাকৃত আদেশ নয়, লোকের মুখে মুখেই এই স-কার-এর ভ্রষ্ট উচ্চারণ তৈরি হয়ে গেছে। নইলে অন্তরীক্ষের আড়ালে থাকা প্রাণীরা— অন্তরীক্ষেহন্তর্হিতং ভূতং— তাঁরাই বলেছিলেন— অশ্বের হ্রেষার মতো এই যে শিশুর রোদন-ধ্বনি চারিদিকে ছড়িয়ে গেল— অশ্বস্যৈবাস্য যৎ স্থাম নদতঃ প্রদিশো গতম্— এই চারিদিকে ছড়িয়ে যাওয়া মানেই সাধারণ লোকের কথা। দ্রোণ যে পরিবেশে জীবন চালনা করছিলেন সেই পরিবেশের অন্তরে, অন্তরালে-থাকা মানুষেরাই তাঁর ছেলের এই নামকরণ করেছে ভ্রষ্ট উচ্চারণে— বর্ণের সন্নিকর্ষে ‘স’-কার তাই এমনিতেই ‘ত’-কার হয়ে গেছে, পরবর্তী বর্ণ ‘থ’-এর সান্নিধ্যে এসে।

আমরা কিন্তু এই সকার ত-কারের থেকেও বেশি মূল্য দিচ্ছি এই পুরাকল্প-সদৃশ শব্দ-ব্যবহারে। অশ্বত্থামার গলার স্বর horse-shrill, তীব্র, সূক্ষ্ম, অপৌরুষেয়। ঠিক যেমন দুর্যোধনের জন্মলগ্নে তাঁর রাসভ-সদৃশ ক্রন্দনের ব্যাখ্যা আমাদের কাছে একটাই— তাঁর গলার স্বর ছিল খ্যাশখ্যাশে কর্কশ, খানিকটা ভাঙা। রাজবাড়ির ছেলে বলে দুর্যোধনের নামটা অন্তত রাসভের অভিধেয়তায় চিহ্নিত হয়নি, কিন্তু হতদরিদ্র দ্রোণাচার্য যে-ভাবে জীবন কাটাচ্ছিলেন, তাতে সাধারণ মানুষের নামকরণ গুরুত্ব পেয়েছে বেশি। পরবর্তী সময়ে দ্রোণপর্বে তাই আর অন্তরীক্ষের অলৌকিকতাও মুছে দিয়েছেন মহাভারতের কবি। তিনি বলেছেন— আড়ালে থাকা লোকেরা তাঁর গলার শব্দ শুনেই অশ্বত্থামা নাম দিয়েছিল— তচ্ছ্রুত্বান্তর্হিতং ভূতং নাম তস্যাকরোত্তদা।

শিশুপুত্রের গলার স্বর যেমনই হোক, ক্ষীণকেশিনী কৃপীর গর্ভে পুত্র লাভ করে পরম আনন্দ লাভ করেছিলেন দ্রোণাচার্য— সুতেন তেন সুপ্রীতো ভারদ্বাজস্ততোহভবৎ। কেন যে পুত্রলাভ করে দ্রোণ এত আনন্দ পেয়েছিলেন, তারও একটা সচেতন কারণ আছে হয়তো। দ্রোণের স্ত্রী কৃপী খুব সুন্দরী রমণী ছিলেন না। দাম্পত্য জীবনের যৌনতার থেকেও তাই হয়তো দ্রোণের কাছে পুত্রলাভই অনেক বেশি আকাঙিক্ষত হয়ে উঠেছিল। পুত্রের জন্য দ্রোণাচার্য মহেশ্বর শিবের তপস্যা করেছিলেন এবং তাঁর কৃপাতেই ক্ষীণকেশিনী শারদ্বতীর গর্ভে অশ্বত্থামাকে লাভ করেছিলেন— আরাধ্য ত্র্যম্বকং যত্নাদ্ ব্ৰতৈরুগ্রৈর্মহাতপাঃ। ঋষি ভরদ্বাজের ছেলে দ্রোণাচার্য কপালের দোষে যে দরিদ্রতার মধ্য দিয়ে জীবন অতিবাহিত করছিলেন, সেই ক্লিষ্ট জীবনের মধ্যে এই পুত্রজন্ম তাঁর মনে নন্দনের সমস্ত সংবাদ বয়ে এনেছিল। আর গরিবঘরে যেমন হয়, আনন্দের আকূতি তৈরি হলে নিরুপায় হলেও অনর্থক অর্থব্যয় করে লোক খাওয়ায়, ঠিক তেমনই দ্রোণাচার্য পুত্রজন্মের আনন্দে ব্রাহ্মণদের দশ হাজার গোরু দান করেছিলেন— যস্মিন্‌ জাতে দদৌ দ্রোণো গবাং দশশতং ধনম্। সংখ্যাটা দশ হাজার— এটা না হয় মহাকাব্যিক অতিশয়োক্তি, কেননা অদূর ভবিষ্যতে যিনি অশ্বত্থামার দুগ্ধপানের জন্য রাজ্যের এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্ত ঘুরে বেড়াবেন, তিনি পুত্রজন্মের আনন্দে ব্রাহ্মণদের গোদান করছেন শত শত— এটাও একটু বাড়াবাড়ি কথা। তবে কিনা, বাড়াবাড়ি নয়ও একদিকে, কেন না এমন অনর্থক বাড়াবাড়ি গরিবঘরে হয় বলেই মহাভারতের কবির এই টিপ্পনী। কবি আসলে পুত্রের ব্যাপারে দ্রোণাচার্যের আসক্তি, প্রশ্রয় এবং ভালবাসার বাড়াবাড়িটাও বোঝাতে চান।

এটা সত্যিই মানতে হবে যে, ছেলের ব্যাপারে হত-দরিদ্র দ্রোণাচার্যের একটু বেশিই দুর্বলতা ছিল; নইলে এই অবস্থায় ব্রাহ্মণদের গোদান করা যেমন আদেখ্‌লামি হয়ে যায়, ঠিক তেমনই ধনীর ছেলেদের সমতায় ছেলে দুগ্ধপান করতে পারছে না বলে রাজ্যময় গোরু খুঁজে বেড়ানোটাও রীতিমতো আধুনিককালের পুত্র-সর্বস্ব বাবা-মায়ের বাড়াবাড়ির মতো মনে হয়। আসলে যতই দরিদ্র হোন পুত্রের ভরণ পোষণ, তাঁর বিদ্যা-শিক্ষার ব্যাপারে পিতা দ্রোণাচার্যের যত্ন এবং চেষ্টার অন্ত ছিল না। ক্রমাগত কুলবৃত্তি ত্যাগ করে ক্ষত্রিয়ের অস্ত্রবৃত্তি গ্রহণ করলেও ব্রাহ্মণ্যের সংস্কার অনুযায়ী বেদ-বেদাঙ্গ, পুরাণ-ইতিহাস ভালভাবে অশ্বত্থামাকে শেখানোর ব্যবস্থা করেছিলেন দ্রোণ— সাঙ্গাংশ্চ চতুরো বেদান্ সম্যগাখ্যান-পঞ্চমান্। পৃথকভাবে অশ্বত্থামার কোনও গুরুর নাম কীর্তিত হয়নি বলেই আমাদের মনে হয়, দ্রোণই তাঁর পুত্রকে বেদ-বেদাঙ্গের শিক্ষা দিয়েছিলেন। তবে হ্যাঁ, এই শিক্ষা বোধহয় তনেকটাই রুটিন-ব্যাপার। প্রত্যেক পিতাই যেহেতু যে বিদ্যায় আস্বাদন লাভ করেন, সেই বিদ্যা পুত্রের মধ্যেও সংক্রমিত করতে চান, তাই ধনুর্বেদের যত শিক্ষা, সেগুলিতে অশ্বত্থামাকে পারদর্শী করার জন্য উঠে পড়ে লাগলেন দ্রোণ। দরিদ্র ব্রাহ্মণের ঘরে বিদ্যাশিক্ষার অভাব নেই কোনও, কিন্তু দরিদ্রতার দুঃখটুকু থেকেই গেল। পিতা-পুত্র সেই কষ্টের মধ্যেই চলছেন।

পুত্র অশ্বত্থামাকে দুধ খাওয়াতে না পারার ঘটনাটা দ্রোণের মনে এতটাই আঘাত করেছিল যে, এই ঘটনার পরপরই তিনি পঞ্চাল-রাজ্যে সদ্য অভিষিক্ত বাল্যবন্ধু দ্রুপদ-রাজার কাছে চলে যান অর্ধেক পঞ্চাল পাবার আশায়। ভীষ্মকে দ্রোণ বলেছিলেন— আমি ভেবেছিলাম— অর্থের জন্য আর পরের সেবা করব না। আমি তাই ছেলেকে নিয়ে দ্রুপদের কাছে গিয়েছিলাম— ইতি মত্বা প্রিয়ং পুত্রং ভীম্মাদায় ততো হ্যহম্। এর পরের ঘটনা সবার জানা। দ্রোণ প্রত্যাখ্যাত হয়েছিলেন এবং শেষ পর্যন্ত তিনি হস্তিনাপুরের রাজবাড়িতে অস্ত্রশিক্ষকের বৃত্তি লাভ করলেন শ্যালক কৃপাচার্যের সহায়তায়। অবশ্য হস্তিনাপুরের রাজবাড়িতে দ্রোণের বৃত্তিলাভের ব্যাপারে স্বয়ং অশ্বত্থামারও কিছু অবদান আছে বলে আমাদের মনে হয়, অবশ্য সেখানে একটু কৌশলও কাজ করে থাকতে পারে।

॥ ২ ॥

পাঞ্চাল দ্রুপদের কাছে প্রত্যাখ্যাত হবার পর ক্রোধে, দুঃখে, ক্ষোভে দ্রোণাচার্য পঞ্চাল ছেড়ে চলে এলেন কৃপাচার্যের কাছে। কৃপাচার্য বহুকাল হস্তিনায় আছেন। ভীষ্মের পিতা শান্তনু স্বয়ং কৃপ এবং তাঁর বোন কৃপীকে শিশু অবস্থায় তুলে এনে মানুষ করেছিলেন পরম আদরে। কৃপীর বিবাহ হয়ে যায় দ্রোণের সঙ্গে। এদিকে কৃপাচার্য পাণ্ডব-কৌরবের প্রথম অস্ত্রগুরু নিযুক্ত হন সহবাসের পরিচয়-বশত। কৃপাচার্য ব্রাহ্মণ মানুষ, জীবনভর অস্ত্রশিক্ষা নিয়ে থেকেছেন, হস্তিনায় তাঁর অন্য কোনও রাজকার্যও নেই, অতএব ঘরের শিক্ষকের কাছে এমনিই শিক্ষা আরম্ভ হয়েছিল হস্তিনার রাজপুত্রদের। ঠিক এইরকম একটা অবস্থায় কৃপাচার্যের বাড়িতে এসে থাকতে আরম্ভ করেন দ্রোণাচার্য— শ্যালকের বাড়িতে পুত্র-পরিবার নিয়ে দ্রোণের বসবাস। পাণ্ডব-কৌরবেরা হঠাৎই একটি নতুন সমবয়সি ছেলেকে দেখতে পেলেন কৃপাচার্যের সঙ্গে। ছেলেটি দ্রোণাচার্যের পুত্র, অস্ত্রশিক্ষার ভালবাসায় যে দ্রোণ মান-সম্মান এবং নিজের দেশ পর্যন্ত ছেড়ে এসেছেন, তাঁর ছেলে অশ্বত্থামা শিশুকাল থেকেই অস্ত্রবিদ্যা শিখেছেন পিতার কাছে। আর দ্রোণ এমনই এক অস্ত্রবিদ আচার্য, যাঁর শিক্ষায় অস্ত্রবিদ্যা শিল্পীর চাতুর্যে প্রকাশিত হয়। এমন গুণী পিতার পুত্র হিসেবে অশ্বত্থামা ধনুর্বেদের প্রাথমিক শিক্ষাগুলি এমনভাবেই পেয়েছিলেন, যাতে অন্যকে তা শেখানো যায়।

অন্যদিকে কৃপাচার্য হলেন আমাদের পুরাতন গ্রামের সেই চতুষ্পাঠীর সংস্কৃত পণ্ডিতের মতো। তিনি সংসার করেন, চারজনের সমাগমে বক্তৃতা দেন এবং হস্তিনার বড়লোকের বৃত্তিলাভ করে যিনি পরম তৃপ্ত, হৃষ্টপুষ্ট। তাঁর ভিতরে কোনও জ্বালা নেই। মনে আছে, চতুষ্পাঠীর সেই পণ্ডিতমশাই অসুস্থ থাকলে, অন্যত্র যাজনকার্যে ব্যাপৃত থাকলে বা বাড়িতে অতিথি এলে তিনি তাঁর ছাত্র-সমতুল পুত্রকে পাঠিয়ে দিতেন বাড়ির দাওয়ায়। সে পুত্র শাস্ত্র শিক্ষা দিত সমবয়সি ছাত্রদের, পিতার ছাত্রদের। কৃপাচার্যও তাই করতেন। বাড়িতে অশ্বত্থামা আছেন, তিনি তাঁকে নিয়ে যেতেন সঙ্গে, কৌরব-পাণ্ডবদের খানিকক্ষণ শিক্ষা দেবার পরেই তিনি ধরিয়ে দিতেন অশ্বত্থামাকে, অস্ত্রবিদ্যার যতটুকু পাঠ অশ্বত্থামা পিতার কাছে পেয়েছিলেন, সেটুকুই প্রাথমিক শিক্ষার পক্ষে যথেষ্ট ছিল বলেই কৃপাচার্যের পরেই প্রধানত পাণ্ডবদের অস্ত্রাভ্যাসের কার্যে নিযুক্ত হতেন অশ্বত্থামা— ততোহস্য তনুজঃ পার্থান্ কৃপস্যানন্তরং প্রভুঃ।

অশ্বত্থামাকে এইভাবে এগিয়ে দেবার পিছনে ইচ্ছাকৃত কোনও বৃদ্ধি কাজ করছিল কিনা, তা মহাভারতের কবি স্বকণ্ঠে বলেননি। কিন্তু আমাদের কেমন হয়— এর পিছনে একটা বুদ্ধি অবশ্যই কাজ করছে। সাধারণ বাইরের লোকেরা একেবারেই বুঝতে পারছিল না যে, দ্রোণাচার্য প্রচ্ছন্নভাবে আছেন কৃপাচার্যের বাড়িতে। হয়তো দ্রোণও সেটা চাইছিলেন না। কিন্তু দ্রোণকে যেহেতু শেষাশেষি হস্তিনার রাজবাড়িতে বহাল করাই কৃপাচার্যের উদ্দেশ্য, তাই অশ্বত্থামাকে সামনে নিয়ে এসে একদিকে যেমন এই নতুন বালকের সম্বন্ধে এবং তার পিতার সম্বন্ধেও পাণ্ডব-কৌরবদের মনে কৌতূহল জাগানোর কাজটাও হয়ে যাচ্ছে, অন্যদিকে বালক অশ্বত্থামার প্রশিক্ষণে এটাও প্রকট হয়ে উঠবে যে, পিতার শিক্ষায় শিক্ষিত এই বালকই যখন এইরকম অস্ত্রশিক্ষা দিতে পারে, সেখানে তার পিতার অস্ত্রবুদ্ধি কীরকম হতে পারে। আমাদের তাই মনে হয়— হস্তিনাপুরের রাজবাড়িতে বৃত্তিলাভের ক্ষেত্রে অশ্বত্থামা তাঁর পিতার আগমন-পথ প্রশস্ত করেছেন। তবে একই সঙ্গে মনে হয়— এই যে এখনও দ্রোণাচার্য সংবৃত অবস্থায় আছেন, অশ্বত্থামা তাঁর মাতুলের সঙ্গে অস্ত্র-প্রশিক্ষণে আসছেন, এর পরে কোনও এক মুহূর্তে সময়-সুযোগ বুঝে দ্রোণ প্রবেশ করবেন হস্তিনার রাজবাড়িতে— এই সব ভবিষ্যৎ কৌশলের আলোচনা বালক অশ্বত্থামাকে খুব তাড়াতাড়িই সংসার ক্ষেত্রে কঠিন এবং পরিপক্ক করে তুলেছে নিশ্চয়।

লক্ষণীয়, মাতুল কৃপাচার্যের পাশে থেকে এতদিন অশ্বত্থামা পাণ্ডব-ভাইদের অস্ত্রশিক্ষা দিচ্ছেন, কিন্তু তিনি নিজের পরিচয় জানতে দিচ্ছেন না কাউকে। কৃপাচার্যের আদেশে, তিনি প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন এবং পাণ্ডবরাও সেই প্রশিক্ষণ গ্রহণ করছেন কৃপাচার্যের আদেশে, কিন্তু কেউ জানতে পারছেন না এই বালক-বীর কে— অস্ত্রাণি শিক্ষয়ামাস নাবুধ্যন্ত চ তং জনাঃ। এই ঘটনায় পাণ্ডব-কৌরবদের কৌতুহল বৃদ্ধি করা ছাড়া আর কী উদ্দেশ্য থাকতে পারে! শেষে দ্রোণাচার্য যখন পরম আশ্চর্যকর অস্ত্রের ইন্দ্রজাল দেখিয়ে পাণ্ডব-কৌরবদের চমৎকার তৈরি করে ভীষ্মের কাছে পৌছলেন, তখন অশ্বত্থামারও পরিচয় প্রকট হল সবার কাছে।

হস্তিনাপুরে পাণ্ডব-কৌরবদের অস্ত্রশিক্ষা দেবার কালে অশ্বত্থামাও কিন্তু তাঁদের অন্যতম সহাধ্যায়ী। বয়সটা যেহেতু সকলের একই রকম, অতএব পাণ্ডব-কৌরব রাজপুত্রদের সঙ্গে অশ্বত্থামাও অস্ত্রশিক্ষা করছেন দ্রোণাচার্যের কাছে। কিন্তু পিতার হৃদয় কী আশ্চর্যরকমের স্নেহশীল এবং প্রাচীন কালের নৈতিক দায়বদ্ধতাও সেখানে কেমন হার মানে, সেটা দ্রোণাচার্যের ব্যবহারে প্রকাশ হয়ে পড়ে। প্রমাণ হয়ে যায়— মন-ব্যাপারটা চিরকালই এক রকম। আধুনিক কালের এক ইস্কুলমাস্টারমশাইকে আমি টিউশনি করতে দেখতাম। তিনি নিজের ছেলেকে অন্য ছাত্রদের সঙ্গে পড়াতে বসাতেন। তাঁর টিউটোরিয়ালে একটি মেধাবী ছাত্র পড়তে আসত। আমি দেখেছি— মাস্টারমশাই তাঁর প্রশিক্ষণের সমস্ত গূঢ়তাগুলি পাঠন-কালে প্রকাশ করতেন না এবং মেধাবী ছাত্রটি চলে গেলেই তিনি নিজের ছেলেকে নিয়ে আবারও বসতেন এবং পদার্থবিদ্যার কূট রহস্যগুলি তাঁকে আলাদা করে বুঝিয়ে দিতেন। সেই মেধাবী ছাত্রটি ইস্কুলের সাধারণ প্রশিক্ষণের কালেই মাস্টারমশাইয়ের এই কূট পক্ষপাতিত্ব ধরে ফেলেছিল। কেন না গুরুমশাইদের নির্বোধ পুত্র ইস্কুলে সকলের আগে বেশি বেশি উত্তর দেওয়া আরম্ভ করেছিল। অশ্বত্থামা কিন্তু এতটা নির্বোধ নন।

এখানেও প্রায় একই রকম কাণ্ড ঘটল প্রায়। গুরু দ্রোণাচার্যের অস্ত্রশিক্ষার আসর তখন পুরো দমে চলছে। শিষ্যদের মধ্যে কে কতটা বুদ্ধিমান, তাও আস্তে আস্তে প্রকট হয়ে উঠছে গুরু দ্রোণাচার্যের চোখে। খোলা মাঠের মধ্যে অস্ত্রশিক্ষা হয়, সকলেই সকলকে দেখে, এর মধ্যে প্রিয় পুত্রটিকে পৃথকভাবে যে তিনি কোনও অস্ত্রকূট শেখাবেন, সে উপায় থাকে না। অথচ পাণ্ডব-কৌরব রাজপুত্রদের সপ্রতিভ বিদ্যা-গ্রহণের ক্ষমতা দেখে স্নেহশীল পিতার ইচ্ছে হয়— তাঁর পুত্র বাড়তি কিছু শিখুক, অন্তত তাঁর শিষ্যদের চেয়ে নিজের আত্মজ পুত্রের বিদ্যা বেশি হোক— এমন একটা বাসনা কাজ করত দ্রোণাচার্যের মনে। কিন্তু বাসনা সত্ত্বেও কোনও সদুপায় বার করতে না পেরে দ্রোণ শেষপর্যন্ত এক অদ্ভুত কৌশল উদ্ভাবন করলেন। সেকালের দিনে ঘরের মধ্যে জলের কল থাকত না, কিন্তু নানা কারণেই জলের দরকার হত বলে গুরুরা শিষ্যদের বলতেন স্নানের সময়ে নদী বা পুষ্করিণী থেকে স্বপ্রমাণানুরূপ ঘট, কলশ অথবা কমণ্ডলু ভরে জল নিয়ে আসার জন্য। ঠিক এইখানেই দ্রোণ একটা বুদ্ধি করলেন।

অন্যান্য সমস্ত শিষ্যদের দ্রোণ একটি বড় কমণ্ডলু দিতেন জল আনার জন্য। একে তো বালকোচিত বয়স, তাতে নদীর জলের তরলতা, তারল্য আর চাপল্য মিশে এমনিই বিলম্ব সৃষ্টি করে। তাঁর মধ্যে আবার কমণ্ডলুর মুখ যথেষ্টই ছোট— জল ভরতে দেরি হয় এবং দেরি হবে বুঝেই দ্রোণ অশ্বত্থামাকে একখানি মুখ-চেতেলো কলসি দিতেন যাতে জল ভরতে দেরি না হয়— পুত্রায় চ দদৌ কুম্ভম্ অবিলম্বনকারণাৎ— এবং দেরি না করার কারণও তাঁকে নিশ্চয় বলা ছিল। যতক্ষণে, যত সময় নিয়ে অন্য বালকেরা নদীতে বাল্য-চাপল্যে কমণ্ডলু-ভরণ করছেন, তাঁর মধ্যে কলশ ভরে জল নিয়ে চলে আসতেন অশ্বত্থামা এবং যতটুকু অবসর মিলত তাঁর মধ্যেই পুরাতন-নতুন অস্ত্রশিক্ষার মধ্যে বিশেষাধানের শিল্পগুলি পুত্রকে শিখিয়ে দিতে আরম্ভ করলেন দ্রোণাচার্য— যাবত্তে নোপগচ্ছন্তি, তাবদস্মৈ পরাং ক্রিয়াম।

এই ঘটনায় অশ্বত্থামার প্রতি দ্রোণাচার্যের স্নেহাতিশয্য প্রমাণ হয় অবশ্যই এবং এমন স্নেহ মর্ত মানুষের অস্বাভাবিকও নয়, কিন্তু সেই কালে পুত্র এবং শিষ্যের প্রতি সমদৃষ্টির যে গুরুগৌরব নিতান্তই কাম্য ছিল, সেই নিরিখে দ্রোণাচার্যের এই পুত্র-পক্ষপাত তাঁর কীর্তি কিছু ম্লান করে বটে, কিন্তু এই স্নেহটুকু তাঁকে সম্পূর্ণ রক্তমাংসের মানুষ করে তোলে। তিনি হয়তো এটাও বুঝতে পারেন না যে, শিক্ষার ক্ষেত্রে এই লুকোচুরি খেলা তাঁর পুত্রের মনে বা অন্য শিষ্যদের মনে কী প্রতিক্রিয়া করতে পারে। কিছু দিনের মধ্যে তো তিনি অর্জুনের কাছে ধরাও পড়ে গেলেন— দ্রোণ আচষ্ট পুত্রায় তৎ কর্ম জিষ্ণুরৌহত। অশ্বত্থামার এই ক্ষিপ্র আগমন মেধাবী অর্জুনের মনে সন্দেহ জাগাল এবং তিনি বারুণাস্ত্রে আপন কমণ্ডলু ভরে গুরুপুত্র অশ্বত্থামার সমসময়ে উপস্থিত হতে আরম্ভ করলেন দ্রোণের কাছে। দ্রোণের কোনও উপায় থাকল না। মেধাবী শিষ্যের তীক্ষ দৃষ্টি এবং চেষ্টা দেখে তিনি তাঁকে বঞ্চিত করতে পারেননি। অতএব অল্পাবসরে ধনুর্বিদ্যার সবিশেষ কূট, যা তিনি অশ্বত্থামাকে শেখাতেন, তা তিনি অর্জুনকেও শিখিয়ে দিতেন— আচার্যপুত্ৰাৎ তস্মাত্তু বিশেষোপচয়েহপৃথক্।

অনেক সময় এমন হয় যে, অতিরিক্ত মেধাবী পিতার পুত্র তেমন মেধাবী হন না, কিন্তু আধার হিসেবে অশ্বত্থামা যথেষ্টই ভাল, অতএব অর্জুনের মতোই বিশেষ কিছু প্রশিক্ষণ লাভের যথেষ্ট উপযুক্ত ছিলেন তিনি। অর্জুনকে যেমন কোনওভাবেই তাঁর স্নেহাধিক্য এবং পক্ষপাত থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে পারেননি দ্রোণ, একইভাবে পুত্র অশ্বত্থামাকেও তিনি ধনুশ্চালনার সমস্ত কূট রহস্য শিখিয়ে দিয়েছিলেন অন্য অমেধাবী অক্ষম শিষ্যদের অগোচরে। অস্ত্রশিক্ষা-বর্ণনার শেষে কে কোন ধরনের অস্ত্রবিদ্যায় পটু হয়ে উঠলেন— এই ব্যাপারে মহাভারতে যখন মন্তব্য করা হচ্ছে, তখন মহাভারতের নিরপেক্ষ বক্তা মন্তব্য করেছেন যে, ধনুর্বিদ্যার অন্তর্গঢ় রহস্যের জ্ঞান অশ্বত্থামার যত হয়েছিল, দ্রোণের অন্যান্য শিষ্যেরা— একম অর্জুন ছাড়া— তার ধারে-কাছেও যেতে পারেননি— অশ্বত্থামা রহস্যেষু সর্বেস্বভ্যধিকোহভবৎ। এখানে ‘রহস্য’ শব্দটার মধ্যেই যেহেতু এক অন্তরাল-চর্যার ইঙ্গিত আছে, তাতে বুঝতে পারি— পুত্র অশ্বত্থামার জন্য দ্রোণের পৃথক কিছু প্রয়াস এবং চেষ্টা অবশ্যই ছিল, যে-কারণে ধনুর্বেদের গূঢ় রহস্যভেদে অশ্বত্থামা সমস্ত দ্রোণ-শিষ্যদের মধ্যে সর্বাধিক কৃতিমান হয়ে উঠেছিলেন।

পাণ্ডব-কৌরবদের সমবেত অস্ত্রশিক্ষার জগতে অশ্বত্থামার স্থিতি-নিবাস এবং মেলামেশার মধ্যে সহবাস-পরিচয়-বশত এমন কোনও বৃত্তি তাঁর মধ্যে তখনও তৈরি হয়নি, যাতে পাণ্ডব-কৌরবের যে কোনও একজনের সঙ্গেও তাঁর বন্ধুত্বের সমপ্রাণতা তৈরি হয়। নিজেকে তিনি একটু পৃথক দূরত্বে রাখাটাই বেশি পছন্দ করতেন এবং তাঁর স্বভাবটাও খুব মিশুকে একাকার হয়ে যাবার মতো ছিল না। হয়তো বা পঞ্চালরাজ দ্রুপদের সঙ্গে তাঁর পিতার বন্ধুত্বের মাখামাখি এবং তাঁর পরিণাম রাজা এবং রাজপুত্রদের সম্বন্ধে তাঁকে খানিকটা সংশয়ী করে তুলেছিল বলেই অশ্বত্থামা নিজের সম্বন্ধে একটু বেশিই সচেতন ছিলেন। কৌরবদের রাজবাড়িতে বৃত্তিভোগী পিতার আশ্রয়ে বসবাস করলেও নিজের সত্তা বজায় রেখে নিজের চারদিকে একটা বীরোচিত দূরত্বের আবরণ ঘনিয়ে নিয়েছিলেন অশ্বত্থামা। অবশ্য এ-ব্যাপারে তাঁর স্বভাবের চেয়েও বেশি সুবিধে দিয়েছিল তাঁর জাতিগত ব্রাহ্মণ্য এবং তৎকালীন গুরু-শিষ্য সম্বন্ধের পরম্পরাগত সুযোগ।

এ-কথা মানতেই হবে যে, সেকালের দিনে ব্রাহ্মণ ব্রাহ্মণের বৃত্তিত্যাগ করলেও, যজন-যাজন, অধ্যয়ন-অধ্যাপনা বিসর্জন দিলেও তাঁর জাতিগত সম্মান থেকে তাঁকে খুব একটা বঞ্চিত হতে হত না। এ-ব্যাপারে তাঁর নিজের ব্রাহ্মণ-সমাজে নিন্দামন্দ, গর্হণ-তর্জন যতই চলুক, সমাজের অবশিষ্ট বর্ণ ক্ষত্রিয়-বৈশ্য-শূদ্রেরা বৃত্তিত্যাগী ব্রাহ্মণদেরও সম্মান করতেন যথেষ্ট। এ-ব্যাপারে স্বয়ং মনু-মহারাজও খানিকটা দায়ী। বৃত্তিত্যাগী, শুধুমাত্র স্কন্ধলগ্ন উপবীতের সংস্কারে জাতিভুক ব্রাহ্মণদেরও তিনি এমন একটা পৃথক স্থানে বসিয়ে রেখেছিলেন, যাতে অবশিষ্ট বর্ণেরা সেই সব ব্রাহ্মণদের নিজেদের সমান ভাবতেন না। আড়ালে-আবডালে অথবা সাময়িক কোনও আচ্ছন্নতায় এঁরা যে এঁদের কোনও গালাগালি দিতেন না, অথবা তিরস্কার-ভর্ৎসনাও করতেন না, তা নয়। কিন্তু সাধারণভাবে যাঁরা উপবীত-সর্বস্বতায় ব্রাহ্মণের সংজ্ঞা বা ‘ব্রাহ্মণব্রূব’ বলেও চিহ্নিত হতেন, অবশিষ্ট বর্ণের কাছে তাঁদেরও একটা লোক দেখানো সম্মান ছিল। এই সুযোগটা দ্রোণও যেমন ভোগ করতেন, তেমনই ভোগ করতেন অশ্বত্থামা, এবং পাণ্ডব-কৌরবদের কাছে আরও একটা সম্মান তিনি পেতেন, সেটা গুরুপুত্রের সম্মান। শাস্ত্র গুরুপুত্রের জন্য এই সম্মান বিধান করেছে। শাস্ত্র বলেছে গুরুর পুত্র-কন্যাকে গুরুর মতোই মান্য করবে— গুরুবৎ গুরুপুত্রেষু— হয়তো শিক্ষাদাতা গুরুর ঋণটুকু শিষ্যেরা অতিশ্রদ্ধায় স্মরণ করতেন বলেই গুরুর পুত্র-কন্যাদেরও এই সুযোগটুকু ছিল। কিন্তু এটা সুযোগই শুধু নয়, শিষ্য এবং শিষ্যস্থানীয়েরা গুরুর সঙ্গে গুরুপুত্রের সম্মাননার ক্ষেত্রে যথেষ্ট আন্তরিকও ছিলেন। আমাদের প্রকৃত প্রস্তাবে যেটা খুব বেশি লক্ষণীয়, সেটা হল— অশ্বত্থামা এই সমস্ত সামাজিক সংস্কারগুলি সম্বন্ধে যথেষ্ট সচেতন ছিলেন। সুযোগ বললে সুযোগ নেওয়া, অথবা অধিকার যেখানে আছে, তাঁর সুব্যবহার করার মধ্যে আপাত কোনও সামাজিক অন্যায় নেই বলেই অশ্বত্থামা ব্রাহ্মণ্য এবং পিতৃগৌরবের অধিকার— দুটোই খুব সচেতনভাবে ভোগ করেছেন এবং তা খুব ছোট থেকেই।

পাণ্ডব-কৌরবদের অস্ত্রশিক্ষার শেষে যেদিন পরীক্ষা-প্রদর্শনী আরম্ভ হল, সেদিন গুরুর আসনে বসা দ্রোণাচার্য-কৃপাচার্যের সঙ্গে অশ্বত্থামাও কিন্তু নিযুক্ত ছিলেন পরীক্ষাভূমির রঙ্গ-নিয়ন্ত্রণে। অর্থাৎ গুরু হিসেবে দ্রোণ এবং কৃপ যা করছিলেন, অশ্বত্থামাও কিন্তু প্রায় সেই অধিকারেই নিযুক্ত। বয়সে তাঁদের চেয়ে কম হলেও তিনি সমবয়সি আচার্য-শিষ্যদের গতিবিধি নিয়ন্ত্রণ করছিলেন গুরুপক্ষে দাড়িয়ে গুরুপুত্রের গহন সম্মান বহন করেই। অস্ত্রপরীক্ষার রঙ্গভূমিতে ভীম এবং দুর্যোধন যখন পরস্পরের স্পর্ধায় পরীক্ষার বদলে বারবার প্রায় যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ছিলেন, এই অবস্থায় দ্রোণাচার্য পুত্র অশ্বত্থামাকে আদেশ দিলেন— এই দুই মহাবীরকে তাড়াতাড়ি সামলাও, এঁরা দুজনেই সমকক্ষ বীর, এঁদের বারণ করো, নইলে এই পরীক্ষার কেন্দ্রে অবাঞ্ছিত অস্থিরতা তৈরি হবে, তুমি আটকাও এঁদের— বারয়ৈতৌ মহাবীর্যৌ কৃতযোগ্যাবুভাবপি। পিতার আদেশে অশ্বত্থামা উদ্যত-আয়ুধ ভীম এবং দুর্যোধনের সামনে গিয়ে পরস্পরের সন্নিকর্ষ বারণ করে দাড়ালেন। অশ্বত্থামার গম্ভীর ইঙ্গিত এবং মৌখিক আদেশ মানতে বাধ্য হলেন দুই বীর, তারা সম্বরণ করলেন উদ্যত ক্রোধ এবং তা গুরুপুত্র অশ্বত্থামার সম্মানে।

মহাভারতে কুরু-পাণ্ডবদের অস্ত্ররঙ্গদর্শনের সময় স্বভাবতই আমাদের নজর থাকে ভীমের দিকে, দুর্যোধনের দিকে অথবা অর্জুনের দিকে এবং পরীক্ষা-ভূমিতে সদ্য-সমাগত কর্ণের দিকে। এত কিছুর মধ্যে দ্রোণের ওই আদেশ অথবা অশ্বত্থামার ওই যুদ্ধ-নিবারণের দিকে আমাদের দৃষ্টি নিবদ্ধ হয় না— নিতান্ত সাধারণ ঘটনা বলেই। কিন্তু আমাদের ধারণা, এই পরীক্ষা পরিচালনার মধ্যেও গুরুর সঙ্গে গুরুপুত্রের এই ভূমিকাটিকে একটা সামান্য ঘটনা বা গুরুর আদেশমাত্র না ভেবে এটাকে তখনকার কালের সামাজিক তাৎপর্যেই ভাবনা করা উচিত। লক্ষণীয়, এই যে নিজের পুত্রকে ব্রাহ্মণ্য এবং গুরুর পরম্পরায় গুরুর গুরুত্বে পৃথক করে ফেলা, এই অভ্যাসটা কিন্তু পিতা হিসেবে দ্রোণই তৈরি করে দিচ্ছেন, যাতে সেটা অশ্বত্থামারও এক পৃথক অন্তরবোধ সৃষ্টি করে, যাতে তিনি বোঝেন— তিনি এই বিরাট শিষ্যকুলের প্রত্যক্ষ গুরু না হলেও গুরুবৎ মান্যতার স্থানে আছেন। এবং এই পৃথকত্ব আরও এই কারণে যাতে কৌরব-পাণ্ডবের শিষ্য-সমাজও বোঝে যে অশ্বত্থামা তাঁদের সমবয়সি সহাধ্যায়ী হলেও তাঁকে মান্যতা দিতে হবে।

এই তো দেখুন, ভীম এবং দুর্যোধনের মতো স্পর্ধিত দুটি মানুষও পরস্পরের প্রতি উদ্যত ক্রোধ দমন করে অশ্বত্থামার বারণ মেনে নিলেন পরম মান্যতায়— তত স্তাবুদ্যতক্রোধৌ গুরুপুত্রেণ বারিতৌ। আবারও একটু পরেই অশ্বত্থামাকে দেখেছি সেই নিয়ন্ত্রক শাসকের ভূমিকায়। অস্ত্র-পরীক্ষার রঙ্গভূমির দ্বারদেশে এসে দাড়ালেন কর্ণ। অর্জুনের অস্ত্র-প্রদর্শনীর চমৎকার তখন সবেমাত্র শেষ হয়েছে। তাঁকে সম্পূর্ণ সমাহ্বানের ভঙ্গিতেই যখন রঙ্গদ্বারে উপস্থিত হলেন কর্ণ, তখন পাণ্ডবের প্রতিপক্ষতা করার জন্যই দুর্যোধন তাঁর একশো ভাইদের নিয়ে কর্ণকে অভ্যর্থনা করার জন্য দাড়িয়ে উঠে শোরগোল পাকিয়ে তুললেন। এই সময়েও আমরা গুরুপুত্র অশ্বত্থামাকে দেখছি— তিনি এই উচ্চৈঃস্বর উৎসাহ-উদ্যম নিরসন করছেন দুই হাতের নিবারণ-মুদ্রা আস্ফালিত করে— উত্থিতং পৰ্য্যবারয়ৎ। দুর্যোধনের একশো ভাইয়ের সমাজ, তাঁদের সম্মিলিত চিৎকার নিবারণ করা খুব সহজ কথা নয়। কিন্তু গুরুবৎ মান্য গুরুপুত্রের এই তাত্ত্বিক ক্ষমতাই কিন্তু একশো ভাই দুর্যোধনের অভ্যুত্থান সাময়িকভাবে নিবারিত করার পক্ষে যথেষ্ট ছিল— অশ্বত্থামা তু সহিতং ভ্রাতৃণাং শতমুর্জিতম্।

এই যে সমবয়সি এবং সহাধ্যায়ী হওয়া সত্ত্বেও গুরুপুত্রের এই যে মান্যতা, যাকে তাত্ত্বিক বা তত্ত্বগত মান্যতা বলাটাই আমরা বেশি পছন্দ করি— এই তাত্ত্বিকতার কিন্তু বিরাট একটা মিশ্রক্রিয়া আছে; সেই মিশ্ৰক্ৰিয়া গুরুপুত্রের মধ্যেও যেমন কাজ করে, তেমনই কাজ করে শিষ্যদের মনেও। বাস্তব জগতে বিভিন্ন ধর্মসংস্থায় গুরুপুত্রের এই তাত্ত্বিক মান্যতা এবং তাঁর বাস্তব সমস্যা আমি নিজের চোখে দেখেছি! এক দেখেছি, গুরুপুত্রেরা যদি পিতার সদ্‌গুণ সবটাই লাভ করেন, পিতার মতোই যদি তারা সদাচার পালন করেন এবং পিতার মতোই সাত্ত্বিক বিভূতি লাভ করেন, তা হলে গুরুপুত্রেরা পিতার স্থান প্রতিপূরণ করেন অতিসহজেই। কিন্তু গুরুপুত্রের আধার যেখানে ভাল নয়, সদাচার-সংযমও যেখানে অনেকটাই যান্ত্রিকতায় সীমাবদ্ধ, এবং পিতার অধিষ্ঠান-প্রতিষ্ঠান টিকিয়ে রাখাটার পিছনে যখন গুরুপুত্রদের সার্থবুদ্ধি কাজ করে, সেখানেই কিন্তু সেই মিশ্রক্রিয়া এবং জটিলতার সৃষ্টি হয়। গুরুপুত্র নিজেই বুঝতে পারেন যে, তাঁর সম্মান-মান্যতা তাঁর পিতার মতো নয়, অথচ শাস্ত্রীয় তাত্ত্বিকতায় তাঁর সেই সম্মান প্রাপ্য— সেইখানেই জটিলতা আরও বাড়ে। কেন না শিষ্যরা যদি বা কোনও মতে গুরুপুত্রদের সেই তাত্ত্বিক সম্মান প্রদর্শনও করেন, তবে তাঁর মধ্যেও যান্ত্রিকতা থাকে এবং আড়ালে আবডালে কখনও কখনও তাঁদের অসম্মান প্রকটও হয়ে ওঠে, এমনকী কখনও কখনও আক্রোশও। ফলে এখানেও এক ধরনের জটিলতা কাজ করে, যা অনেক সময়েই সঠিক এবং স্বাভাবিক। তবে শিষ্যদের মানসিক এবং সাত্ত্বিক স্থিতিও এখানে খুব গুরুত্বপূর্ণ। শিষ্যদের মানস-আধার যদি প্রত্যক্ষ গুরুর প্রতি অত্যন্ত শ্রদ্ধাপরিপূর্ণ হয়, তবে গুরুপুত্রদের প্রতি বিনয়াবনত মান্যতা অনেক সময়েই গুরুর ঋণ পরিশোধের অপর পর্যায় হিসেবে ব্যবহৃত হয়। কিন্তু অসামান্য মানসিক এবং সাত্ত্বিক গুণে গুরুপুত্র যদি গুরুর সমান বা অধিক না হন, তা হলে জটিলতা উভয়তই তৈরি হয়— গুরুপুত্রের মনেও, শিষ্যের মনেও।

অশ্বত্থামা হস্তিনার রাজবাড়িতে বড় হতে লাগলেন গুরুপুত্রের মর্যাদায়, পিতা দ্রোণাচার্যের ছত্রচ্ছায়ায়। দ্রোণাচার্যের বংশ-পরম্পরাগত ব্রাহ্মণ্য, তাঁর ব্যক্তিত্ব, সততা এবং প্রভাব তাঁকে এতদিনে ধৃতরাষ্ট্রের মন্ত্রিসভার অন্যতম সদস্য করে তুলেছে। কৌরব রাজবাড়ির বৃত্তি এবং ভরণ তাঁকে যেহেতু পুষ্ট করে, তাই গুরুর গৌরব লাভ করলেও সর্বত্র নিরপেক্ষ যুক্তিতে বিচার করা তাঁর পক্ষে সম্ভব হয় না। অশ্বত্থামাও কিন্তু সেই পরিমণ্ডলের মধ্যেই মানুষ হচ্ছেন। কঠিন দারিদ্রের মধ্যে চলতে চলতে হঠাৎ এই সসম্মান বৈভবের আস্বাদন দ্রোণাচার্যকেও যেমন খানিকটা স্থির পরিতুষ্টি দিয়েছে, পুত্র অশ্বত্থামাও সেই পরিপূর্ণতায় তুষ্ট আছেন। বস্তুত বড় রাজবাড়ির রাজনৈতিক জটিলতার একটা মোহ আছে, নইলে দুর্যোধনের কাছে অঙ্গরাজ্যের অভিষেক লাভ করেও কর্ণ যেমন অঙ্গরাজ্যের শাসন-কর্মে ফিরে গেলেন না কোনওদিন, তেমনই দ্রোণও তো দ্রুপদরাজাকে শিষ্যমাধ্যমে হারিয়ে দিয়ে অর্ধেক পঞ্চালের অধিকার লাভ করেছিলেন, কিন্তু তিনিও তো কোনওদিন পঞ্চালে রাজত্ব করতে গেলেন না, এমনকী পুত্র অশ্বত্থামাও এই স্বাধীন বিচরণের মধ্যে যাননি। বোধ করি, স্বাধীন রাজ্যশাসনের জন্য যে পরিশ্রম প্রয়োজন, যে কূটনৈতিক বুদ্ধির প্রয়োজন এবং সর্বোপরি প্রজাকল্যাণকামিতায় যে ত্যাগ-বৈরাগ্যের প্রয়োজন, সেগুলির তুলনায় অতি-সহজলব্ধ হস্তিনাপুরের এই অন্নপান এবং রাজনৈতিক ব্যক্তি-গৌরব অনেক বেশি আস্বাদ্য ছিল বলেই এঁরা সবাই নতুন রাজ্যের সংশয়িত সম্ভাবনা ত্যাগ করে হস্তিনাপুরেই পড়ে রইলেন ধৃতরাষ্ট্র এবং দুর্যোধনের রাজনৈতিক আবর্তের মধ্যে।

কুরু-পাণ্ডবের অস্ত্রগুরু দ্রোণাচার্য, তাঁর পুত্র অশ্বত্থামা— গুরু হওয়ার দূরগত সম্পর্কের কারণেই বারবার তাঁকে খুঁজে পাই না মহাভারতের মৌল ঘটনাগুলির মধ্যে। দ্রৌপদীর স্বয়ংবর-সভায় পাঞ্চাল রাজকুমার ধৃষ্টদ্যুম্ন রাজনামকীর্তনের মধ্যে অশ্বত্থামার নাম করছেন বটে, তিনি বলছেন বটে— তোমার জন্য এঁরা সব উপস্থিত হয়েছেন, পাঞ্চালী— ত্বদর্থম্ আগতা ভদ্রে— কিন্তু অশ্বত্থামা ঠিক বিবাহার্থী হয়ে এসেছেন বলে মনে হয় না আমাদের। দেখতে কম সুন্দর ছিলেন না তিনি। অন্তত তাঁর আকৃতির বর্ণনায় তিনি অতিশয় সুপুরুষ, গোটা রাজ্যের মধ্যে অন্যতম দর্শনীয় পুরুষ— যেষাং রাষ্ট্রে নিবসতি দর্শনীয়ো/ মহেস্বাসো শীলবান্ দ্রোণপুত্রঃ। তাঁর চোখদুটি পদ্মের পাপড়ির মতো— বীরঃ কমলপত্রাক্ষঃ। অশ্বত্থামার দেহের গঠন এত শক্তপোক্ত এবং কঠিন যে, বৃষবাহন শিবের বৃষটির স্কন্ধ, নেত্র, গতি এবং কণ্ঠস্বরের সঙ্গে অশ্বত্থামার এই গুণগুলির তুলনা করা হয়েছে। আসলে বৃষের তুলা হয় কাঠিন্য এবং গম্ভীরতার প্রতীকে— স্থাণোর্বৃষস্য সদৃশং স্কন্ধনেত্রগতিস্বরৈঃ। অশ্বত্থামার শরীরের সমস্ত অঙ্গ খুব সুন্দর বটে, কিন্তু স্থূল দীর্ঘ বাহু, বিশাল বক্ষস্থল এবং অসম্ভব কঠিন ব্যক্তিত্বের সঙ্গে তাঁর মুখখানি ব্যাঘ্রের মতো ভীষণ-দর্শন বলেই— পুষ্টশ্লিষ্টায়তভুজং… ব্যাঘ্ৰাস্যং মেরুগৌরবম্— তাঁর মুখে চাঁদের কাব্যিক স্নিগ্ধতাটুকু তেমন ঠাহর করা যায় না বোধহয়।

এই অসাধারণ রূপ এবং পুরুষালি তেজঃশক্তি থাকা সত্ত্বেও দ্রৌপদীর স্বয়ংবর সভায় অশ্বত্থামার নামমাত্র কীর্তিত হয়েছে এবং তাও হয়তো দুর্যোধনের সঙ্গে আসায়। বস্তুত অশ্বত্থামা বিবাহার্থী হয়ে আসেননি এবং বিবাহ করার কোনও ইচ্ছেও তাঁর ছিল না। সারা জীবন তিনি ব্রহ্মচারীই রয়ে গেছেন। মানসিকতায় ব্রহ্মচারী থাকার এই ভাবনা সত্ত্বেও তিনি দুর্যোধন-ভাইদের সঙ্গে পঞ্চালে এসেছিলেন স্বয়ংবর-রঙ্গ দেখতে, অনুমানটা যে ঠিকই তা প্রমাণ হয়ে যায়, যখন দ্রৌপদীর বৈবাহিক পর্ব শেষ হয়ে গেল এবং দুর্যোধন সকলকে নিয়ে বাড়ি ফিরছেন। বিয়ে করতে এসে মেয়েও পেলেন না, ব্রাহ্মণবেশী অর্জুন-ভীমের সঙ্গে দলবল নিয়ে যুদ্ধেও পেরে উঠলেন না দুর্যোধন। এই অবস্থায় তিনি যখন বিমনা হয়ে ফিরে আসছেন, তখন তাঁর অনুগত বাহিনীর মধ্যে কর্ণ এবং শকুনির সঙ্গে কৃপাচার্য এবং অশ্বত্থামাকেও দেখতে পাচ্ছি— অশ্বত্থাম্না মাতুলেন কর্ণেন চ কৃপেণ চ।

খানিকটা যেন ম্লান, ক্লান্ত, খানিকটা যেন অপমানিত দুর্যোধনের সঙ্গে অশ্বত্থামার এই প্রত্যাবর্তনটা খুব বড় কথা নয়। যেটা খুব বড় বলে মনে হয়, সেটা হল— অশ্বত্থামাকে আমরা দুর্যোধনের পাশাপাশি থাকতে দেখছি। বিবাহার্থী না হয়েও তিনি দুর্যোধনের সঙ্গে পঞ্চাল-নগরে গিয়েছিলেন। আজ দুর্যোধনের দুঃখের দিনেও অশ্বত্থামা তাঁর সঙ্গে সঙ্গেই আসছেন। পরম সখার মতো না হলেও দুর্যোধনের সমস্ত অস্থিরতার পাশাপাশি থাকার এই তো আরম্ভ। দুর্যোধনের সব কিছু যে তিনি খুব সহ্য করতে পারতেন, তা নয়, কিন্তু হস্তিনাপুরের রাজার বৃত্তিভোগী মানুষ হিসেবে দুর্যোধনের বশংবদ গোষ্ঠীতে অন্তর্ভুক্ত থাকাটা এইভাবেই অভ্যাস হয়ে যাচ্ছিল অশ্বত্থামার।

দ্রৌপদীর সঙ্গে বিয়ের পর রাজনৈতিক কারণে যখন পাণ্ডবদের পৃথক ব্যবস্থা করতেই হল ইন্দ্রপ্রস্থে, তখন ব্রাহ্মণ-সজ্জন অনেকেই হস্তিনাপুরের নিবাস ছেড়ে ইন্দ্রপ্রস্থে চলে গিয়েছিলেন। পাণ্ডব-ভাইদের ওপর যথেষ্ট স্নেহ থাকা সত্ত্বেও, এমনকী দুর্যোধনের স্বভাবে বিরক্ত হয়ে রাজসভায় পাণ্ডবদের পক্ষে সওয়াল করলেও দ্রোণাচার্য-কৃপাচার্য কিন্তু ইন্দ্রপ্রস্থে চলে যাননি। ফলত অশ্বত্থামারও কোনও প্রশ্ন আসেনি হস্তিনাপুর ত্যাগ করার। যেটা আশ্চর্য লাগে, সেটা হল— ভীষ্ম না হয় কৌলিক কারণে পিতৃ-পিতামহের পরম্পরাগত রাজ্য ত্যাগ করে ইন্দ্রপ্রস্থে প্রয়াণ করেননি, কিন্তু দ্রোণ-কৃপ-অশ্বত্থামার কী কারণ ছিল দুর্যোধনের সঙ্গ লাভ করার? অবশ্য এ-কথা মানতেই হবে যে, দ্রোণ-কৃপ প্রধানত ভীষ্মের অনুদানেই বৃত্তিলাভ করতেন বলে নিজেরা মনে করতেন এবং সেইজন্যই বৃদ্ধ পিতামহের সাজাত্যে অন্যত্র চলে যাওয়াটা পছন্দ করেননি হয়তো।

কিন্তু আমাদের মনে হয়, ভীষ্মের তথাকথিত অনুদান-মাহাত্ম্যের চাইতেও— কেন না, ভীষ্ম রাজাও নন এবং রাজা দুর্যোধন তাঁর কথা শুনে চলেনও না— অতএব সেই স্ব-ভাবিত আত্মতৃপ্তির চাইতেও পুরাতন আশ্রয়ের নিশ্চিন্ততা এবং এতকালের মন্ত্রী-সমান ক্ষমতার আস্বাদন হঠাৎ করে তাঁদের ইন্দ্রপ্রস্থের সংশয়িত জীবনের দিকে নিয়ে যেতে পারেনি। দ্রোণ-কৃপ পাণ্ডবদের ভালবাসেন, তাঁদের বহুমাননও করেন, কিন্তু দুর্যোধন-কর্ণদের সঙ্গে অশ্বত্থামার একবয়স্যতা এবং সহবাস-বিনোদন অশ্বত্থামাকে পাণ্ডবদের সম্বন্ধে সেই বিশ্বাস এবং সেই মুগ্ধতা দিতে পারেনি, যাতে বাপ-মামা দ্রোণ-কৃপের মতো তাঁর মনে হয় পাণ্ডবরাই সবচেয়ে ভাল, তাঁদের কোনও দোষ নেই এবং কোনও অন্যায় না করেও তাঁরা বারবার শাস্তি ভোগ করেন। অথচ যুবশক্তি এবং যৌব-সততার প্রতীক-ভাবনায় দ্রোণ-কৃপ যা পারেননি, অশ্বত্থামার তাই পারা উচিত ছিল, তিনি পাণ্ডব-রাজধানীতে নাই যান, কিন্তু দ্রোণ-কৃপের মতো পূর্ণ প্রাণে পাণ্ডবদের সমর্থনও কি তিনি করতেন? আমাদের সন্দেহ আছে এবং সেই সন্দেহ শেষে প্রমাণসহ হয়ে উঠবে।

দ্রৌপদীর বিয়ের সময় তিনি যেমন দুর্যোধনের সঙ্গে সঙ্গে ছিলেন, তেমনই ইন্দ্রপ্রস্থে যুধিষ্ঠিরের রাজসূয় যজ্ঞের সময়েও তিনি বাবা-মামা এবং অবশ্যই দুর্যোধনের সঙ্গে পাণ্ডবগৃহে নেমন্তন্ন খেতে গেছেন— অশ্বত্থামা কৃপো দ্রোণঃ সৈন্ধবশ্চ জয়দ্রথঃ। বিশিষ্ট অতিথিদের প্রত্যুদ্‌গমন করে যুধিষ্ঠির যখন ঘরে নিয়ে আসছেন, তখন প্রথমেই সুনির্বাচিত সেই ক্ষুদ্র দলটির মধ্যে আমরা যে গুরুত্বপূর্ণ মানুষগুলিকে দেখতে পাচ্ছি, তারা হলেন— ভীষ্ম, দ্রোণ, কৃপ, অশ্বত্থামা, দুর্যোধন এবং দুর্যোধনের এক ছোট ভাই বিবিংশতি। যুধিষ্ঠির তাঁর যজ্ঞকার্যে এঁদের সহায়তা চেয়েছেন এবং দুর্যোধন-দুঃশাসনের সঙ্গে অশ্বত্থামাকেও তিনি নতুন কর্মভার দিয়েছেন। যজ্ঞস্থলে যত ব্রাহ্মণ-সজ্জন উপস্থিত হবেন, তাঁদের জন্য যত দান নির্দিষ্ট হয়েছিল যুধিষ্ঠিরের তরফ থেকে, সেই দান যাতে ব্রাহ্মণেরা প্রত্যেকেই প্রতিগ্রহণ করেন, একজনও যাতে বঞ্চিত না হন, এই বিষয়ে সুপ্রযুক্ত অধিকার দেওয়া হয়েছিল অশ্বত্থামাকে— পরিগ্রহে ব্রাহ্মণানাম্‌ অশ্বত্থামানম্‌ উক্তবান্‌। অশ্বত্থামা নিজে ব্রাহ্মণ-বংশজ বলে তৎকালীন স্বগন্ধী গোষ্ঠীর দানগ্রহণের ব্যাপারটা তিনি বুঝবেন বলেই যুধিষ্ঠিরের বিশ্বাস হয়েছিল, অন্যদিকে ক্ষত্রিয়ের বৃত্তিগ্রহণ করার ফলে ক্ষত্রিয়ের সহবাস-পরিচয়ে অশ্বত্থামার মধ্যে সেই তীব্র একাগ্রতা থাকার কথা, যাতে কর্তব্য-কর্মে তাঁর কোনও ভুল হবে না বলেই যুধিষ্ঠির তাঁকে এই অধিকারে নিযুক্ত করেছিলেন।

॥ ৩ ॥

যুধিষ্ঠিরের রাজসূয় যজ্ঞ শেষ হয়ে যাবার পর অশ্বত্থামাকে আমরা বহুকাল উল্লিখিত হতেই দেখিনি ব্যাসের লেখনীতে। কুরুবাড়ির ভিতরের রাজনীতির সঙ্গে পাণ্ডবদের প্রতি দুর্যোধনের আক্ষেপ-অধিক্ষেপ এবং বিদ্বেষের মাত্রা এমন পরিমাণে বেড়েছিল, যাতে করে বহিরাগত অথচ ঘরের মানুষ হিসেবে অশ্বত্থামার অংশগ্রহণের কোনও প্রশ্ন ওঠে না। বস্তুত এই সময়টা অশ্বত্থামার কাছে বড় বিভ্রান্তির সময়। এই সময়ে দুর্যোধনের পীড়াপিড়িতে পাশাখেলার কপটতা শুরু এবং সেই সূত্রেই পাণ্ডব কুলবধূ দ্রৌপদীর ওপর চরম অপমান ঘনিয়ে আসে দুর্যোধন-দুঃশাসন-কর্ণের হাতে। বেশ বুঝতে পারি— এই সব সময়ে চরম একটা বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছে অশ্বত্থামার মতো যুব-জনের হৃদয়ে। পিতা দ্রোণাচার্য ধৃতরাষ্ট্রের মন্ত্রিসভায় বসে দুর্যোধনের অন্যায় কার্যগুলি দেখছেন। সময়ে সময়ে ভীষ্মের সঙ্গে গলা মিলিয়ে তিনি বিভিন্ন অন্যায়ের প্রতিবাদ করছেন বটে, কিন্তু সেই প্রতিবাদ কখনও এমন মাত্রায় পৌঁছোতে পারছে না, যাতে করে তিনি কৌরব রাজবংশের আশ্রয় ত্যাগ করে চলে যেতে পারেন।

যুবক অশ্বত্থামা এই পরিস্থিতিগুলি দেখছেন নিশ্চয়। নিশ্চয় তিনি বুঝতে পারছেন যে, তাঁর পিতার অবস্থাটা পিতামহ ভীষ্মের মতো নয়। ভীষ্ম যেহেতু কৌরবের, পাণ্ডবের এক পিতামহ এবং তিনি যেহেতু কুরুবাড়ির প্রাচীনতম মূল, তাই হস্তিনাপুরের প্রাচীন ঘর ছেড়ে যাওয়াটা তাঁর পক্ষে যত কঠিন, দ্রোণাচার্যের কাছে তাই ভীষ্মের অবস্থান অনুকরণীয় হয়ে ওঠে না। অথচ কৌরবদের শত অন্যায় দেখেও, পাণ্ডবদের প্রতি সহমর্মিতা থাকা সত্ত্বেও দ্রোণাচার্যও কৌরবদের নিশ্চিন্ত আশ্রয় ছেড়ে যান না। এই অবস্থাটা নিশ্চয়ই যুবক অশ্বত্থামাকে বড় বিভ্রান্ত করে। অশ্বত্থামা এটাও বোঝেন যে, শুধুমাত্র কৌরবদের অন্নঋণ নয়, এর পিছনে আছে আরও এক ধূসর বিদ্বেষ, যাতে দ্রোণাচার্য পাণ্ডবদের পক্ষে চলে যেতে পারেন না রাতারাতি। পঞ্চালরাজ দ্রুপদ পাণ্ডবদের শ্বশুর, তিনি দ্রোণাচার্যের চিরশত্রু। তাঁর রাজ্যের একাংশ নীতিগতভাবে যতই দ্রোণের হাতে আসুক, দ্রুপদের সঙ্গে শত্রুতা তাঁর কমেনি, বরঞ্চ দ্রুপদের দিক থেকে সেই শত্রুতা আরও বেড়েছে।

অথচ অশ্বত্থামার মতো এক যুবকের হৃদয় যতটুকু বোঝা যায়, তাতে যেমন প্রতিবাদী তিনি যখন-তখন হতে পারতেন, পাণ্ডবদেব অনর্থকালে কিন্তু তেমনটা তিনি হননি। পাণ্ডবদের ওপর দুর্যোধন-শকুনির ওই কপট পাশার অধিক্ষেপ তিনি ভাল মনে নিতে পারেননি। রাজসভায় কুলবধু দ্রৌপদীর অপমান তাঁকে দেখতে হয়েছে তৃতীয় ব্যক্তির ঔদাসীন্যে, কিন্তু তাই বলে এই অসভ্যতা তিনি মন থেকে মেনে নিতে পারেননি এতটুকু। কিন্তু এত ঘটনার মধ্যে একবারও আমরা তাঁর ব্যাঘ্রের মতো কঠিন মুখখানি দেখিনি, একবারও উচ্চারিত হয়নি সেই কঠিন প্রতিবাদ, যা তাঁকে অন্য মাহাত্ম্য দিতে পারত। তাই বলে তিনি প্রতিবাদ করা জানেন না, এমন নয়। বারবার তাঁকে সেই ভূমিকায় আমরা দেখতে পাব, কিন্তু পাণ্ডব-কৌরবদের ঘটনা-দুর্ঘটনার মূল বিবরণের মধ্যে সেইসব প্রতিবাদ নিতান্তই ব্যক্তিগত এবং অহেতুক মনে হয়। আসলে পাণ্ডবদের প্রতি সমস্ত প্রশ্রয় হৃদয়ে পোষণ করেও কৌরবগৃহে পিতা দ্রোণাচার্যের অবস্থানটাই অশ্বত্থামাকে কেমন এক বিভ্রান্ত যুবকে পরিণত করেছে।

এমনিতে অশ্বত্থামা সম্মান কিছু কম পেতেন না। ব্রাহ্মণের জাতিগত সম্মানের সঙ্গে ক্ষত্রিয়ের বৃত্তিই শুধু নয়, তাঁর সম-সময়ের অন্যতম বীর হিসেবে তিনি অর্জুন-কর্ণের সমান ক্ষমতাসম্পন্ন বলে পরিচিত হওয়ায় খোদ রাজসূয় যজ্ঞের আসরেই তিনি প্রশংসিত হয়েছেন, যদিও খুব বিপরীত পরিস্থিতিতে সেই প্রশংসা এসেছে। যজ্ঞভূমিতে মহামতি ভীষ্ম যখন কৃষ্ণকেই যুধিষ্ঠিরের যজ্ঞার্ঘ্য-নিবেদনের উপযুক্ততম ব্যক্তি বলে চিহ্নিত করলেন, তখন কৃষ্ণের জন্মশত্রু শিশুপাল অন্যান্য বহু ব্যক্তিত্বের সঙ্গে অশ্বত্থামারও চরম প্রশংসা করেছেন। ভাবটা এই যে, অশ্বত্থামার মতো এইরকম একটা মহা-মহিম ব্যক্তি সামনে উপস্থিত থাকতে কৃষ্ণের মতো ক্ষুদ্র নীচাশয় ব্যক্তিকে অর্ঘ্য নিবেদন করাটা নিতান্তই বোকামি— অশ্বত্থাম্নি স্থিতে বীরে সর্বশাস্ত্রবিশারদে। শিশুপাল তাঁকে মহাবীর বলছেন, তাঁকে বলছেন— সর্বশাস্ত্রে সুপণ্ডিত— এই কথার মধ্যে সত্যি কিছু আছে নিশ্চয়ই, কিন্তু শিশুপাল যেহেতু কৃষ্ণ ছাড়া তৎকালীন ভারতের সমস্ত ব্যক্তিত্বেরই প্রশংসা উচ্চারণ করেছেন, তাতে বুঝি অশ্বত্থামার গুণগুলিও অতিশয়োক্তির চপলতায় লঘু হয়ে যায়। তবু বলি— বীর হিসেবে তো বটেই, কিন্তু তাঁর চেয়েও বেশি গুরু দ্রোণাচার্যের পুত্রত্ব এবং জাতি-ব্রাহ্মণত্বের নিরিখেই অশ্বত্থামা পাণ্ডব-কৌরব, সকলের কাছেই বহু মানমর্যাদা লাভ করতেন। লক্ষ করে দেখবেন— পাণ্ডবরা যখন কপট-পাশায় হেরে বনে চলে যাচ্ছেন, তখন ভীষ্ম-দ্রোণ-কৃপের সঙ্গে সম-মর্যাদাতেই অশ্বত্থামার কাছ থেকে বিদায় প্রার্থনা করেছেন পাণ্ডবরা— দ্রোণং কৃপং নৃপাংশ্চান্যান্ অশ্বত্থামানমেব চ। প্রায় সমবয়সি হওয়া সত্ত্বেও অশ্বত্থামার এই মর্যাদা প্রধানত সেই সামাজিক এবং শাস্ত্রীয় অনুশাসনবশত, যেটা প্রায় প্রাবাদিক পর্যায়ে পৌঁছেছে। নিশ্চয় এই মর্যাদার কারণেই কুরুক্ষেত্র-যুদ্ধের উদ্যোগ-পর্বে ধৃতরাষ্ট্রের প্রেরিত দূত সঞ্জয়ের কাছে অর্জুন বলেছিলেন— ভীষ্ম, দ্রোণ, কৃপ, অশ্বত্থামা এবং বিদুর এ-বিষয়ে যা বলবেন, তাই হবে। এঁরাও নিশ্চয়ই এই কুলক্ষয়ী যুদ্ধ চাইবেন না— দ্রোণঃ সপুত্রো বিদুরশ্চ ধীমান্‌। এতে সর্বে যদ্‌ বদন্ত্যেতদ্ অস্তু।

পিতা এবং মাতুলের সঙ্গে এই যে সমান মর্যাদা অশ্বত্থামা ভোগ করছেন, এই মর্যাদার তিনি যোগ্য কিনা, সে-কথা পরে আসবে। কিন্তু আগেই বলেছি— গুরুপুত্র যদি গুরুর মতো মানসিক বিভূতি অর্জন করে না থাকেন, তা হলে তাঁর অন্তর্দেহে এমন কিছু মিশ্রক্রিয়া হয়, যাতে করে শিষ্য বা শিষ্যস্থানীয়দের মর্যাদা উপভোগ বা অপভোগ করা ছাড়া নিজস্ব নীতিতে তিনি চলতে পারেন না। পুরোপুরি না হলেও অশ্বত্থামার ক্ষেত্রে কথাটা কিছু খাটে। দ্রোণাচার্য কৌরব রাজার অন্নদাস হওয়া সত্ত্বেও পাণ্ডবদের ব্যাপারে তাঁর যে মমতা এবং সহমর্মিতা ছিল, অশ্বত্থামার তা ছিল না। যুবক বয়সি অর্জুনের প্রতি কথঞ্চিৎ তাঁর দুর্বলতা থাকা সত্ত্বেও এত যে অন্যায়, এত যে পাশাখেলার অত্যাচার পাণ্ডবভাইদের ওপর দিয়ে বয়ে গেল, এত যে বলাৎকার-প্রতিম অসভ্যতা হল পাণ্ডবাণী দ্রৌপদীর সঙ্গে, সে-সব নিয়ে একটি বিরুদ্ধ কথাও উচ্চারিত হয়নি অশ্বত্থামার মুখে। অন্তত কুরুক্ষেত্র-যুদ্ধের প্রাক্‌কাল পর্যন্ত তিনি নিরুচ্চার ঔদাসীন্যেই জীবন কাটিয়েছেন। একবারের তরেও দুর্যোধন, দুঃশাসন, কর্ণ বা শকুনিকে সাবধান করে বলেননি যে তাঁরা অন্যায় করছেন। অথচ শিশুপালের ভাষায় ‘সর্বশাস্ত্র-বিশারদ’ যৌবনোদার অশ্বত্থামার কাছে এই ব্যবহার প্রত্যাশিত ছিল।

অথচ তিনি কথা বলা জানেন না অথবা সময়ে সময়ে তিনি ফোঁস করে উঠতে পারেন না, এমন তো নয়। যেদিন বিরাট-রাজার গোধন হরণ করার জন্য কৌরবরা ভীষ্ম-দ্রোণ, কৃপ-কর্ণ-অশ্বত্থামাকে নিয়ে বিরাট-রাজ্যে উপস্থিত হলেন, সেদিন কারওরই ধারণা ছিল না যে, অর্জুনের মতো মহাবীর বিরাট-পুত্র উত্তরের সহায় হয়ে আসবেন। অর্জুনের ধনুক-টংকার শুনে দ্রোণাচার্য উফুল্ল হয়ে বলেছিলেন— এই শব্দ আমার চেনা, এ গাণ্ডীব ধনুর শব্দ, নিশ্চয় এই যুদ্ধ করতে আসছেন অর্জুন। বস্তুত এতকাল পরে প্রিয় শিষ্যের ধনুকালাপ শুনে দ্রোণাচার্য একটু আপ্লুতই বোধ করেছিলেন এবং সোচ্ছ্বাসে বলে ফেলেছিলেন যে, অর্জুন সব্যসাচী ছাড়া এমনতর ক্ষমতা অন্য কারও হতেই পারে না। দ্রোণাচার্যের এই উচ্ছ্বাস দেখে কর্ণ বেশ কিছু কটু কথা শুনিয়ে দিয়েছিলেন দ্রোণকে। এমন কথাও তিনি বলেছিলেন যে, এইসব বিপন্নতার সময় দ্রোণের মতো কারুণিক পণ্ডিতেরা প্রচুর বড় বড় বুলি কপচাতে থাকেন, অতএব আচার্যকে সেনা-সমূহের পিছন দিকে রেখে যুদ্ধের ‘স্ট্র্যাটিজি’ ঠিক করতে হবে। কর্ণ বলেছিলেন— শৌর্য-বীর্যের এতটুকু রেশ থাকলেও কোনও বীরমানী পুরুষ কি একটা ঘোড়ার ডাক শুনেই এমন অর্জুন, অর্জুন বলে চেঁচিয়ে সবাইকে একেবারে ঘেঁটে-ঘুলিয়ে শেষ করে দিতে পারে— হ্রেষিতং হ্যুপশৃণ্বানে দ্রোণে সর্বং বিঘট্টিতম্।

কর্ণ এইভাবে তিরস্কার-শব্দ উচ্চারণ করার পর দ্রোণের শ্যালক কৃপাচার্য ক্ষোভে ফেটে পড়লেন। আসলে অর্জুনের প্রশংসায় কর্ণের অহংকারে আঘাত লেগেছিল। তিনি এতটাই আত্মশ্লাঘা প্রকাশ করেন যে, শেষ পর্যন্ত কৃপাচার্যের মতো ঠান্ডা মানুষও ক্ষিপ্ত হয়ে পড়েন। ফলত এইরকম একটা তুলনা-প্রতিতুলনা তাঁর মুখে চলেই আসে, যাতে অর্জুন একা ক’টা যুদ্ধ জিতেছেন এবং কর্ণই বা একা ক’টা যুদ্ধ জিতেছেন— একেন হি ত্বয়া কর্ণ কিং নামেহ কৃতং পুরা। শেষপর্যন্ত কৃপাচার্যও অর্জুনের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হলেন এবং সেটা হয়তো কর্ণকে খানিকটা খাটো করার জন্যই। অবশেষে বললেন— তুমি যে একা একা অনেক কিছু করব বলে ভাবছ, তুমি সে-সাহসটা কোরো না, বরঞ্চ বলো— আমরা সবাই মিলে অর্জুনকে প্রতিহত করার চেষ্টা করব— সর্বে যুধ্যামহে পার্থং কর্ণ মা সাহসং কৃথাঃ।

দ্রোণাচার্যের প্রতি কর্ণের কটাক্ষে প্রথমে মুখ খুললেন তাঁর শ্যালক কৃপাচার্য, তারপর মুখ খুললেন দ্রোণপুত্র অশ্বত্থামা। ইতিপূর্বে আমরা অশ্বত্থামাকে দুর্যোধন-কর্ণদের সঙ্গে একত্র থাকতে দেখছি, কোথাও তাঁদের কোনও কাজকর্মের প্রতিবাদও করতে দেখিনি; আজকে যেই মুহূর্তে পিতার ওপর কর্ণের আক্ষেপোক্তি ভেসে এসেছে, ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছেন মাতুল কৃপাচার্য, তখন আমরা অশ্বত্থামাকে বহু পূর্বে আকাঙ্ক্ষিত প্রতিবাদ করতে দেখছি, এমনকী কৃপাচার্য পর্যন্ত এখন যেসব কথা বলেননি, অশ্বত্থামা তা বলছেন। এতে বেশ বুঝতে পারি— কৌরবগৃহের অন্তরে এই যে দুই বহিরাগত আচার্য এবং তাঁদের ঘরের এই ছেলে অশ্বত্থামা— এই তিনজন মিলে পৃথক একটি গোষ্ঠী তৈরি হয়ে গিয়েছিল। অন্নদায়ের কারণে এঁরা সবাই কৌরবগৃহে আছেন বটে, তবে এই তিনজনের ব্যক্তিগত অপমান-বিপন্নতায় একে অপরকে যথেষ্টই দেখেন এবং প্রয়োজনে যথেষ্টই প্রতিবাদ করেন। কৌরবগৃহে নিজেদের অবস্থিতি এবং সম্মান ঠিক রাখার ব্যাপারে দ্রোণ-কৃপ এবং অশ্বত্থামা— এই তিনজনেই কিন্তু এক জায়গায় দাড়িয়ে আছেন, অথচ লক্ষণীয় ব্যাপার হল— পাণ্ডবদের প্রতি, বিশেষত অর্জুনের প্রতি একান্ত মমতার কারণেই হোক, অথবা তাঁর একান্ত নিজস্ব সততার কারণেই হোক, দ্রোণাচার্য পাণ্ডবদের ব্যাপারে যতখানি মার্মিকতা পোষণ করতেন, কৃপ এবং অশ্বত্থামা ঠিক ততখানি আবেগসম্পন্ন ছিলেন না বলেই মনে হয়। অথচ নিজের অন্তরে কিন্তু তারা জানতেন যে, পাণ্ডবদের ওপর অন্যায়-অবিচার হচ্ছে। তবু যদি বা কৃপাচার্য অধিকতর ব্যক্তিত্বময় দ্রোণের অনুবর্তী হয়ে দু’-চারবার দুর্যোধনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেও থাকেন, অশ্বত্থামা কিন্তু নিশ্চুপ ছিলেন এতকাল। কিন্তু আজ যখন অশ্বত্থামার মুখে সেই প্রতিবাদ আদ্যোপান্ত ধ্বনিত হয়ে উঠল, তখন অবশ্যই মনে হয়— নিজেদের গোষ্ঠীরক্ষার প্রেরণাতেই আজ অশ্বত্থামা কথা বলছেন। অর্থাৎ অশ্বত্থামার হৃদয় আমরা সঠিকভাবে বুঝতে পারি না যেন। অর্থাৎ সততা, স্বাতন্ত্র্য এবং যুবকোচিত উদার প্রতিবাদিতার থেকেও পরগৃহে অবস্থানের স্থিতিশীলতা রক্ষা করাটা অশ্বত্থামার কাছে অনেক বেশি জরুরি; স্বগোষ্ঠীর সম্মান বজায় রাখতেই আজ অশ্বত্থামা দুর্যোধন-কর্ণের প্রতিবাদ করছেন।

অশ্বত্থামা কর্ণকে বললেন— বিরাট-রাজ্যে আমরা যে কারণে এসেছি, সেই গোধন এখনও জিতে নিয়ে যাইনি আমরা, কেন না এখনও আমরা মৎস্যরাজ্যের সীমা অতিক্রম করে হস্তিনাপুরে ফিরিনি। অথচ এখনই তোমার বাড়ফাট্টাই আরম্ভ হয়ে গেছে— ন চ তাবজ্জিতা গাবো ন চ সীমান্তরং গতাঃ— বড় মানুষেরা নিজের ক্ষমতা তোমার মতো এমন করে জাহির করে নাকি! সামান্য একটু কথার ভণিতা করেই, সূতপুত্র কর্ণের যেটা দুর্বলতম জায়গা, সেখানে আঘাত দিলেন অশ্বত্থামা। বললেন— আমাদের যে চতুর্বর্ণের কর্ম-বিধান, সে তো আজকের ব্যাপার নয় হে কর্ণ, সে হল বেদের বিধান— চাতুবর্ণ্যস্য কর্মানি বিহিতানি স্বয়ম্ভুবা। এসব কথা শোনামাত্রই কর্ণের মনের মধ্যে জন্মকালীন প্রতিক্রিয়া আরম্ভ হয়ে যায়। ভাবেন বুঝি— এখনই সেই কথাগুলি আরম্ভ হবে— সূতপুত্র! তুমি সৌতকর্ম করো, রথ চালাও, যুদ্ধ তোমার কাজ নয়। কিন্তু না অশ্বত্থামা এই লাইনে গেলেন না, কেন না সেইদিকে কথা বলতে আরম্ভ করলে তিনি নিজেও একই জালে জড়িয়ে পড়বেন। ব্রাহ্মণের বৃত্তি ছেড়ে ক্ষত্রিয়ের যুদ্ধকৰ্মও তো লোভীর বৃত্তি বলে গণ্য হবে। কিন্তু অশ্বত্থামা চতুর্বর্ণের কর্ম-বিধানের কথা তুলে কর্ণের বুকে তাঁর জন্ম-যন্ত্রণার ধুকপুকুনিটুকু ধরিয়ে দিয়েই একেবারে অন্য প্রসঙ্গে চলে গেলেন। বললেন— যাঁরা শাস্ত্র-অনুসারে আপন ক্ষত্রিয়-বৃত্তিতেই বড় বড় রাজ্যলাভ করেছেন, তাঁরাও গুরুজনদের একটু আধটু সম্মান করেন, এমনকী নিজের প্রতিকূল ব্যক্তিও যদি গুরুজন হন, তবুও তাঁকে সম্মান করেন তাঁরা— সৎর্কুবন্তি মহাভাগা গুরূন্‌ স্ববিগুণানপি। অশ্বত্থামা বস্তুত নিজেদের গুরুবৃত্তির শক্ত ভিত্তিটুকুই আগে স্মরণ করিয়ে দিলেন কর্ণকে। পাণ্ডব-কৌরব-নির্বিশেষে কৌরব-গৃহে দ্রোণাচার্যের যে সম্মান, সেই সম্মানটুকুও যে কর্ণ রাখতে পারছেন না এবং তার জন্য কর্ণের ক্ষাত্র-বোধের সংস্কারহীনতাই যে দায়ী— এই কথাটাই অশ্বত্থামা প্রকারান্তরে বুঝিয়ে দিলেন।

এইসব কথার বন্দিশ থেকে প্রমাণ হয়, অশ্বত্থামা কথা বলতে পারেন বেশ গুছিয়ে, পরপক্ষকে আঘাত করতে পারেন বেশ চিবিয়ে চিবিয়ে। অশ্বত্থামা বললেন— কেমন ক্ষত্রিয় তুমি! এমন যে বীরমানী স্বভাব তোমার, তবে বলো— নিকৃষ্ট লোকের মতো কোনও ক্ষত্রিয় পুরুষ এমন কপট পাশায় রাজ্য লাভ করে সন্তুষ্ট থাকে— প্রাপ্য দূতেন কো রাজ্যং ক্ষত্রিয়স্তুষ্টিমৰ্হতি। পাণ্ডবদের সঙ্গে তো কপট ব্যাধের মতো ব্যবহার করেছ তোমরা। বনচারী ব্যাধ যেমন রাতের আঁধারে বনে প্রবেশ করে জালবহুল প্রতারণায় পশুপাখি ধরে, তেমনই প্রতারণায় ধনৈশ্বর্য লাভ করে কোনও বিচক্ষণ ব্যক্তি তোমার মতো আত্মশ্লাঘা করে আবার— নিকৃত্যা বঞ্চনাযৌগেশ্চরন্ বৈতংসিকো যথা?

অশ্বত্থামা এবার কর্ণের ব্যক্তিগত কৃতিত্বের মূল্যায়নে প্রবেশ করলেন পাকা তার্কিকের যুক্তিতে। বললেন— তোমার প্ররোচনায় দুর্যোধন যাদের ধন-সম্পদ হরণ করেছেন, সেই অর্জুন, নকুল অথবা সহদেব— কাকে তুমি কোন দ্বৈরথ যুদ্ধে জয় করেছ— কতমদ্‌ দ্বৈরথং যুদ্ধং যত্রাজৈষীৰ্ধনঞ্জয়ম্? কোন যুদ্ধেই বা যুধিষ্ঠির-ভীমকে জয় করে ওদের রাজধানী ইন্দ্রপ্রস্থ নিজের শাসনে এনেছিলে তুমি? দ্রৌপদীর বিয়ের কাল থেকে অনেক যুদ্ধ তো হয়েছে, সেইরকম কোনও যুদ্ধে তুমি দ্রৌপদীকে ছিনিয়ে আনতে পেরেছিলে পাণ্ডবভাইতের হাত থেকে— তথৈব কতমদ্ যুদ্ধং যস্মিন্ কৃষ্ণা জিতা ত্বয়া। তবে হ্যাঁ, একটা বিরাট এবং সাংঘাতিক যুদ্ধ করে তোমরা কৃষ্ণা দ্রৌপদীকে জিতেছ— তোমরা তাঁকে রজস্বলা অবস্থায় এক কাপড়ে উন্মুক্ত রাজসভায় টেনে আনতে পেরেছিলে। অতিরিক্ত টাকার লোভে ধনলোভী মানুষ যেমন চন্দনগাছের গোড়া পর্যন্ত কেটে ফেলে, তোমরাও তেমনই দ্রৌপদীকে সভায় নিয়ে এসে পাণ্ডবদের সমস্ত বন্ধুত্বের মূলোচ্ছেদ করে দিয়েছ— মূলমেষাং মহৎ কৃত্তং সারার্থী চন্দনং যথা।

দ্যূতক্রীড়ার সময়ে দ্রৌপদীর সঙ্গে যত অসভ্যতা হয়েছে, সেখানে কর্ণের সক্রিয় অবদান থাকায় সেই ঘটনাগুলিকে অশ্বত্থামা পরম অবমাননায় উচ্চারণ করছেন, যাতে কর্ণের আপাত-স্পর্ধিত যুদ্ধজয়ের উদ্যোগটুকু প্রতিতুলনায় অনেক বেশি কাপুরুষোচিত বলে প্রতিভাত হয়। যে ব্যক্তি কৌরব-পাণ্ডবের গুরু দ্রোণাচার্যকে তাঁর যুদ্ধশক্তি নিয়ে প্রশ্ন করছেন, তাঁর সেই আপাত-সমুজ্জ্বল ক্ষাত্ৰতেজ যে বড় বড় যুদ্ধের কোনওটাতেই কাজে আসেনি, সেটা বলতে গিয়ে ক্ষাত্রশক্তির এই হীন পরিণতির কথা অশ্বত্থামা বোঝাচ্ছেন দ্রৌপদীর সঙ্গে অসভ্যতার প্রসঙ্গ তুলে। চিরপরিচিত অথচ সেই গাত্রদাহী সম্বোধন এখন এই মুহূর্তেই প্রয়োগ করে অশ্বত্থামা বলেছেন— সূত! ব্যাটা সারথির পো! তোরা যখন অসভ্যতা করছিলি দ্রৌপদীর সঙ্গে, যখন পাশার চালে পাণ্ডবভাইদের একে একে কর্মকর দাসে পরিণত করেছিলি, তখন বিদুর কী বলেছিলেন মনে আছে তোর— কর্ম কারয়িতা সূত তত্র কিং বিদুরোহব্রবীৎ? বিদুর বলেছিলেন— মানুষ-পশু এমনকী কীট-পিপীলিকার মধ্যেও যে সভ্যতা-সংযমটুকু দেখা যায়, সেটাও এই কর্ণ দুর্যোধনের মধ্যে নেই— অন্যেষামপি সত্ত্বানাম্ অপি কীট-পিপীলিকে।

ব্রাহ্মণ-গুরুর ছেলে অশ্বত্থামা কর্ণকে— ‘সারথির পো’ বলে তাচ্ছিল্যে সম্বোধন করছেন, তখনকার দিনে এটা কোনও আশ্চর্য কথা নয়, কিন্তু মহাভারতের শব্দ-ইঙ্গিত-বোদ্ধা টীকাকারেরা মনে করেন— এইখানে অশ্বত্থামার সূত-সম্বোধনের একটা আলাদা তাৎপর্য আছে। নীলকণ্ঠ বলেছেন— দেবতাদের মধ্যে আদিত্য-সূর্যকে ক্ষত্রিয় দেবতা বলে চিহ্নিত করা হয়েছে— ননুআদিত্যো বৈ দৈবং ক্ষত্রম্‌। তা হলে ক্ষত্রিয় দেবতা আদিত্যের ঔরসে ক্ষত্রিয়াণী কুন্তীর গর্ভে জন্মগ্রহণ করা সত্ত্বেও কর্ণের এই ক্ষত্রিয়-বিগর্হিত আচরণ কেন? তিনি রাজসভার মধ্যে কুলস্ত্রীর সঙ্গে অসভ্যতায় অংশ নেন এবং যুদ্ধক্ষেত্রেও সময়মতো অকুশল, এমনকী পলায়নও করেন। টীকাকারেরা মনে করেন— সার্থক একটা বড় মানুষ হবার জন্য শুধুমাত্র একটা ‘ডিসটিংগুইশড্ ব্রিড’-ই প্রয়োজন নয়, তাঁর সঙ্গে তাঁর বেড়ে ওঠার পরিবেশটাও সমানভাবে প্রয়োজন। নীলকণ্ঠ টীকায় বলেছেন— মানুষের জন্ম দুইরকমের— যোনিজ এবং সংস্কারজ। যেখানে মানুষ জন্মাচ্ছে সে যদি সেখানেই বেড়ে ওঠে, তারই পূর্বজদের সংস্কার লাভ করে, তবে সে হল ‘একজ’— অর্থাৎ জন্ম এবং সংস্কার একই জায়গায় হলে সে তার প্রকৃতি বা স্বভাব থেকে সহজে সরে আসে না। কিন্তু কর্ণ জন্মালেন ক্ষত্রিয় হয়ে, কিন্তু সারথির বাড়ির সংস্কার লাভ করার ফলে তিনি যুদ্ধকালে প্রহার করতে পারেন ভাল, কিন্তু অন্যের প্রহার সহ্য করার তাঁর ক্ষমতা নেই, সেইজন্যেই তিনি সময়ে সময়ে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালিয়ে যান এবং ওই একই কারণে অক্ষত্রিয়োচিত কপট পাশাখেলার পর কুলবধূকে রাজসভায় অপমান করতেও তাঁর বাধেনি।

আচার্য পিতার প্রতি কর্ণের অবমাননাকর মন্তব্যে অশ্বত্থামা আজ সোচ্চারভাবে অর্জুনের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে উঠলেন। বললেন— দ্রৌপদীর সঙ্গে যা ব্যবহার তোরা করেছিস, পাণ্ডবরা তা কোনওদিন ক্ষমা করবে না। বিশেষত ধৃতরাষ্ট্রের ছেলেদের সর্বনাশ করার জন্যই বুঝি আজ অর্জুনকে দেখা যাচ্ছে এখানে। এরপর কর্ণের দিকে তাকিয়ে অশ্বত্থামা বললেন— তোমার থেকে অনেক বেশি ক্ষমতা রাখে অর্জুন। তোমার থেকে অস্ত্ৰক্ষমতা যার বেশি, ধনুক-বাণে ইন্দ্রের সমান যাঁর যুদ্ধকৌশল, কৃষ্ণ-বাসুদেবের মতো যাঁর অস্ত্ৰক্ষমতা, সেই তাঁকে কে না প্রশংসা করবে— বাসুদেব-সমং যুদ্ধে তং পার্থং কোন পূজয়েৎ? অশ্বত্থামার ভাবটা এই— এমন একজন যুদ্ধবীরের প্রশংসা আমার পিতা দ্রোণাচার্য করেছেন, যাকে সবাই প্রশংসা করবে, এই যেমন আমিও করছি। সবচেয়ে বড় কথা, উপযুক্ত শিষ্য তো ছেলের চাইতে কোনও অংশ কম নয় গুরুর কাছে, দ্রোণাচার্য তাই বিরুদ্ধ পক্ষে দাড়িয়ে থাকলেও তাঁর প্রিয় শিষ্যের প্রশংসা করতে পারেন— পুত্ৰাদনবরঃ শিষ্যঃ… প্রিয়ো দ্রোণস্য পাণ্ডবঃ।

অশ্বত্থামার এই কঠিন প্রত্যুক্তিগুলি থেকে বোঝা যায় যে, তিনি সেই দ্যূতসভার অসভ্যতার কালে উপস্থিত ছিলেন সেখানে, কিন্তু অন্যান্য অনেকের মতোই কোনও প্রতিবাদ করেননি কর্ণ-দুর্যোধনের, অথবা দুঃশাসনের। দুর্যোধনের স্বপক্ষতা হয়তো তাঁর প্রয়োজন ছিল পিতা কিংবা মামার মতোই, কিন্তু তিনি তো বৃদ্ধ ছিলেন না। তরুণ বয়সেও তাঁর এই অপ্রতিবাদী আচরণ আমাদের বিভ্রান্ত করে। অথচ আজ যেই নিজের পিতার প্রতি কর্ণের তাচ্ছিল্য শব্দ বর্ষিত হয়েছে, অমনই তিনি আমূল পুরাতন ঘটনাগুলি স্মরণ করিয়ে দিয়ে প্রতিবাদ করছেন অর্জুনের স্বপক্ষতায় এবং প্রশংসায়। অশ্বত্থামার মধ্যে এই দ্বৈত সত্তা এটাই স্পষ্ট করে দেয় যে, তিনি নিজেও এক বিভ্রান্ত যুবক। অস্তিত্ব এবং অস্তিত্বের মান বজায় রাখার জন্য তাঁর গোষ্ঠীপ্রীতি অটুট আছে, কিন্তু যে-পক্ষে তিনি আশ্রিত, সেখানে নিজের ক্ষমতা, ব্রাহ্মণ্য এবং যুদ্ধশক্তির আস্ফালন প্রদর্শন করে আশ্রয়দাতার দাতের গোড়া ভাঙতেও তিনি ছাড়েন না। তার মানে আশ্রিত হলেও স্বকীয় গৌরব বজায় রেখে কীভাবে সসম্মানে থাকতে হয় সেটা তিনি জানেন।

কর্ণের ঔদ্ধত্যে তিনি জলাঞ্জলি নিবেদন করলেন আরও তির্যক ভঙ্গিতে। বললেন— এবার যুদ্ধ করো। যেভাবে তোমরা পাশা খেলেছিলে, যেভাবে পাণ্ডবদের রাজধানী ইন্দ্রপ্রস্থ হরণ করেছিলে, যেভাবে কৃষ্ণাকে সভায় এনে অপমান করেছিলে, সেইভাবে, সেই কৌশলে এবার অর্জুনের সঙ্গে যুদ্ধ করো দেখি— যথানৈষীঃ সভাং কৃষ্ণাং তথা যুধ্যস্ব পাণ্ডবম্‌। আর এই যে আছেন তোমার মহাপ্রাজ্ঞ শকুনি-মামা, ক্ষত্রিয় ধর্মের সমস্ত আদর্শ তাঁর মধ্যে জ্বলজ্বল করছে, কপট পাশায় তিনি সিদ্ধহস্ত, সেই শকুনি-মামাও যুদ্ধ করুন তোমার সঙ্গে। তবে মনে রেখো, অর্জুনের গাণ্ডীব-ধনু থেকে পাশার দান বেরোয় না, তীক্ষ কঠিন বাণ বেরোয়, বাণ। যমের হাত থেকেও কখনও লোকে বেঁচে ফেরে, বেঁচে ফেরে ভয়ংকর ঝড়-জল, এমনকী আগুন থেকেও। কিন্তু ক্রুদ্ধ ক্ষুব্ধ অর্জুনের হাত থেকে বেঁচে ফেরা অত সহজ নয়।

সেই বালক বয়স অবধি অর্জুনকে খুব নিকট থেকে দেখেছেন অশ্বত্থামা। অনেক বিশেষ অস্ত্রের সন্ধান— প্রতিসংহার একই সঙ্গে শিখেছেন পিতার কাছ থেকে। এমনকী শিক্ষান্তকালে অর্জুন এবং অশ্বত্থামা— দু’জনেই গুরু এবং পিতার কাছ থেকে ব্রহ্মাস্ত্র লাভ করেছেন, কিন্তু শিষ্য অর্জুনকে দ্রোণ ব্রহ্মাস্ত্র দিয়েছিলেন তাঁর শিক্ষায় পরম প্রীত হয়ে আর পুত্রকে দিয়েছিলেন অতিস্নেহবশত। অশ্বত্থামা যথেষ্ট বুদ্ধিমান, তিনি স্বয়মর্জিত প্রীতি এবং স্নেহ-মোহের পার্থক্য বোঝেন। কিন্তু অধুনা সেই কারণে নয়, কর্ণকে খানিকটা অপদস্থ করার জন্যই বললেন— আমার পিতা যুদ্ধ করেন করুন, এসব কথা শোনার পরেও তিনি যদি যুদ্ধ করেন করুন, কিন্তু আমি অর্জুনের সঙ্গে যুদ্ধ করব না— যুধ্যতাং কামমাচার্যো নাহং যোৎস্যে ধনঞ্জয়ম্। তবে হ্যাঁ, যদি বিরাট-রাজা এখানে যুদ্ধক্ষেত্রে উপস্থিত হতেন তবে হয়তো যুদ্ধ করতাম।

লক্ষণীয়, দ্রোণের প্রতি কর্ণের কটুক্তি সত্ত্বেও দ্রোণ নিজে কিন্তু একটাও কথা বলেননি। যা বলেছেন, কৃপাচার্য বলেছেন, আরও কঠিন করে বলেছেন অশ্বত্থামা। আসলে দ্রোণ, ভীষ্ম, কৃপ— এঁরা সকলেই রাজাদেশ শিরোধার্য করে বিরাট-রাজ্যে যুদ্ধ করতে এসেছেন। বিরাট-রাজার গোধন হরণ করা বা বিরাট-রাজ্য আক্রমণ করা— কোনওটাই তাঁদের ইচ্ছার মধ্যে ছিল না। যুদ্ধে আসার আগে এ ব্যাপারে তারা নিজেদের অনিচ্ছার কথা জানিয়েও ছিলেন, কিন্তু দুর্যোধন শেষপর্যন্ত নিজের ভাবনায় অনড় থাকায় দ্রোণ, কৃপ সকলেই এসেছেন বিরাট-রাজ্যে যুদ্ধ করতে। এবং কর্ণের অপকথার পরেও যে দ্রোণ যুদ্ধ করবেন, সেটা সেই অন্নদাসত্বের সূক্ষ্ম তর্ক। সেই কারণেই অশ্বত্থামার যুক্তিও সূক্ষ্মভাবে একইরকম। ভাবটা এই— তোমরা বিরাট-রাজার সঙ্গে যুদ্ধ করার জন্য আমাদের নিয়ে এসেছ, আমি তাঁর সঙ্গে যুদ্ধ করতে রাজি আছি, কিন্তু অর্জুনের সঙ্গে যুদ্ধ করব না— মৎস্যো হ্যস্মাভিরাযোধ্যো যদ্যাগচ্ছেদ্‌ গবাং পদম্‌। এই যুক্তিতে কর্ণকেও একেবারে ধরাশায়ী করা গেল, রাজার আদেশের প্রতিও দেখানো গেল মান্যতা।

অশ্বত্থামার তর্কযুক্তির ক্ষমতা কম নয়, কিন্তু সেই তর্কের আগে কিন্তু একটা ভয়ংকর আবেগ কাজ করে এবং সেই আবেগকে তিনি তর্কযুক্তির এমন সূক্ষ্মতম পর্যায়ে পৌঁছে দিতে পারেন, যাতে সেই আবেগটাকেই আপাতদৃষ্টিতে সঠিক বলে মনে হয়। একথা পরে আলোচনা হবে। আপাতত এটা খেয়াল করতেই হবে যে, অশ্বত্থামা তর্কযুক্তির মাধ্যমে যা যা ঘটাতে চেয়েছিলেন, তাই কিন্তু ঘটল। কুরুকুলের বৃদ্ধতম এবং সবচেয়ে সম্মানিত ব্যক্তিত্ব কথা বলতে আরম্ভ করলেন পরিস্থিতি সামাল দেবার জন্য, সকলকে মানিয়ে তোলার জন্য। ভীষ্ম বললেন— আচার্য দ্রোণও ঠিক কথা বলছেন, ঠিক বলছেন কৃপাচার্যও— সাধু পশ্যতি বৈ দ্রোণঃ কৃপঃ সাধ্বনুপশ্যতি। তবে কী জানেন— কর্ণ এতক্ষণ আপনার উদ্দেশে এ-কথা সে-কথা বলেছে বটে, কিন্তু সেটা আসলে আপনাদের উৎসাহ-উদ্যম বৃদ্ধি করার জন্য— কর্ণো যদভ্যবোচত্তে তেজঃ-সংজননায় তৎ।

এই কথাটা ভীষ্ম বললেন অশ্বত্থামার উদ্দেশে এবং বৃদ্ধতম হওয়া সত্ত্বেও একেবারে সাবনত ভঙ্গিতে ভীষ্ম বললেন— আচার্যপুত্র! আপনি ক্ষমা করুন, অনেক বড় কাজ রয়েছে সামনে— আচার্যপুত্র ক্ষমতাং মহৎ কার্যমুপস্থিতম্‌। আপনি দেখতে পাচ্ছেন— অর্জুন প্রায় এসেই পড়েছেন সামনে, এটা কি সেই উপযুক্ত সময় যখন আমরা নিজেদের মধ্যে ঝগড়া করে মরছি। ভীষ্ম তাঁর এতদিনের অভিজ্ঞতায় জানেন যে, এই যুবক অশ্বত্থামাকে শান্ত করে দিলেই দ্রোণ-কৃপরা শান্ত হয়ে যাবেন এবং এঁদের শান্ত করার জন্য এঁদের একটু তোয়াজ করা দরকার, এমনকী একটু খোশামোদিও করা দরকার। ভীষ্ম প্রধানত অশ্বত্থামার দিকে তাকিয়েই বললেন— আপনি সব ক্ষমা করুন, আচার্য দ্রোণ এবং কৃপও সব ক্ষমা করুন। আচ্ছা বলুন তো আপনারা! এইরকম রেগে গেলে চলে? সূর্যের আলো, চাদের সৌন্দর্য যেমন কোনওদিন কমে না, আপনাদের অস্ত্ৰক্ষমতাও তেমনই কমে না কখনও। আপনাদের তিনজনের মধ্যেই ব্রাহ্মণ্য যেমন প্রতিষ্ঠিত ব্রহ্মাস্ত্রও তেমনই আপনাদেরই করতলগত। ব্রাহ্মণ্য এবং ক্ষাত্রশক্তি— এক জায়গাতেই উপস্থিত— এর উদাহরণ শুধু আপনারাই দু’জন, আপনি এবং আপনার পিতা, আর কোথাও এই দুটো শক্তি একাধারে নেই— অন্যত্র ভারতাচার্যাৎ সপুত্রাদিতি সে মতিঃ। তাই বলছিলাম— আচার্যপুত্র! আপনি ক্ষমা করুন, আমরা এই কঠিন সময়ে নিজেদের মধ্যে ঝগড়া করে কি মরতে পারি— আচার্যপুত্র ক্ষমতাং নায়ং কালঃ স্বভেদনে। আসুন আমরা সকলে মিলে এই যুদ্ধ করব।

ভীষ্মের কথায় অশ্বত্থামার কিছু প্রশান্তি হল। কৌরবকুলের সবচেয়ে বয়স্ক মানুষ এবং তিনি নিজেও কম বড় যোদ্ধা নন, সেই ভীষ্মের মুখে এমন স্তুতি-নতি শুনে অশ্বত্থামার রাগ একটু কমল। কিন্তু সেই স্তিমিত মুহূর্তেও তিনি শাস্ত্রবাণীর মতো শেষশব্দ উচ্চারণ করলেন এবং তাও ব্রাহ্মণ-গুরুর মর্যাদায়, সচেতনভাবে। অশ্বত্থামা বললেন— দ্রোণাচার্য এঁদের সকলের গুরু— তিনি অর্জুনের গুণ-প্রশংসা করলেন মানেই তিনি অন্যদের প্রতি ক্রুদ্ধ হয়েছেন অথবা অন্যদের নিন্দা করছেন, তা তো নয়— নৈব… রোষপরীতেন গুরুণা কথিতা গুণা। অশ্বত্থামা পিতার বাক্যের একটা সরল অর্থ করছেন সর্ববোধ্য নৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে এবং তাঁর সেই কথাটা পরবর্তীকালে অন্যতম এক নীতিশ্লোক বলেই কথিত হয়েছে। অশ্বত্থামা বলেছেন— শত্রু হলেও তাঁর যদি গুণ থাকে, তবে সে গুণ গাইতে হবে বই কী। আবার এমনও তো শুনি যে গুরু বা গুরুস্থানীয় ব্যক্তির দোষদর্শন করতে নেই, কিন্তু আমি মনে করি— অন্যায় দোষ করলে গুরুরও দোষকীর্তন করা উচিত— শত্রোরপি গুণা বাচ্যা দোষা বাচ্যা গুরোরপি। সবচেয়ে বড় কথা— ভাল লাগুক চাই মন্দ লাগুক, হিতৈষী পিতা যেমন পুত্রের হিতের জন্য অপ্রিয় হলেও সত্য কথা বলবেন, শিষ্যহিতার্থী গুরুও তেমনই শিষ্যের হিতের জন্য অপ্রিয় হলেও সত্য কথা বলবেন— সর্বথা সর্বযত্নেন পুত্রে শিষ্যে হিতং বদেৎ।

সত্যি বলতে কী, অশ্বত্থামা যদি এই নীতিবাক্যে বিশ্বাস করেন, তবে এটা মানতেই হবে যে, তিনি ভীষণ রকমের স্পষ্টবক্তা, গুরু বা গুরুস্থানীয় মানুষেরও অন্যায় দেখলে তিনি মখ বন্ধ করে থাকবেন না। আবার অন্যদিকে পুত্র এবং শিষ্যকে অপ্রিয় হলেও সত্যি বলতে হবে— এই কথাটার মানে কিন্তু এই দাড়ায় যে, দ্রোণাচার্য যা বলছেন, তা যেমন অপ্রিয় হলেও গুরুস্থানের হিতৈষণায় নেমে আসছে, তেমনই অশ্বত্থামাও কিন্তু মনে করেন যে, তাঁর কথাও গুরু-স্বরূপের অভিন্ন মূর্তি গুরুপুত্রের মুখ থেকে নিঃসৃত হচ্ছে। অশ্বত্থামা এই মর্যাদা সম্বন্ধে সচেতন এবং এই মর্যাদা তখনকার ব্রাহ্মণ-গুরুর সামাজিক অবস্থানের সঙ্গে মিলে যায় বলেই সেই মহুর্তে সামনে উপস্থিত সকলের মধ্যেই এই মর্যাদা সংক্রমিত করতে পেরেছেন। সেটা বোঝা যায় দুর্যোধনের প্রতিক্রিয়ায়। একটু আগে পিতামহ ভীষ্মের মতো বৃদ্ধ পুরুষ সখাপ্রতিম দ্রোণাচার্যকে তোষণ করেছেন, এমনকী অশ্বত্থামার কাছেও তিনি সানুরোধে ক্ষমা চেয়েছেন, আর এখন দুর্যোধনের মতো মানুষ, যিনি কর্ণের প্রতি সদা তুষ্ট, তিনি কিন্তু অশ্বত্থামার কথায় ভীষ্ম, কৃপ এবং দ্রোণাচার্যের কাছেও ক্ষমা চাইলেন কর্ণের কথার জন্য।

বিরাট-রাজ্যে কৌরবদের গো-গ্রহণ প্রয়াস এবং আক্রমণ— দুটোই ব্যর্থ হয়েছিল এবং কর্ণ পালিয়ে গিয়েছিলেন রণক্ষেত্র থেকে। অশ্বত্থামা হয়তো সেদিন আড়ালে হেসেছিলেন, কেন না তাঁর পিতার কথাই শেষ পর্যন্ত ফলেছে, অর্জুন যুদ্ধ জিতেছেন এবং কৌরবপক্ষ পর্যূদস্ত হয়ে ফিরে গেছে হস্তিনাপুরে। এর পরেই তো যুদ্ধের দামামা বেজে উঠল— উদ্যোগ পর্ব। শান্তির প্রচেষ্টা শুরু হল প্রথমে, যদিও স্নেহান্ধ ধৃতরাষ্ট্রের দিক থেকে এই প্রচেষ্টা আন্তরিক ছিল না। তিনি শান্তি চাইছিলেন বটে, কিন্তু পাণ্ডবদের জমি ছাড়তে রাজি হচ্ছিলেন না। সঞ্জয় এসেছিলেন ধৃতরাষ্ট্রের দূত হয়ে; তিনি নিজে মনে মনে ধৃতরাষ্ট্রের সঙ্গে সহমত হতে পারেননি, কিন্তু দূত বলেই মুখস্থ করার মতো তিনি ধৃতরাষ্ট্রের কথা আউড়ে যাচ্ছিলেন পাণ্ডবদের কাছে। পাণ্ডবরা নিজেদের বক্তব্য জানালেন নিঃসংকোচে এবং শেষে অর্জুন যা বললেন, সেখানে কৌরবপক্ষের হিতৈষী এবং মর্যাদাসম্পন্ন মানুষদের পরামর্শ নেবার উপদেশ ছিল দুর্যোধনের প্রতি। আশ্চর্য ব্যাপার হল— এই মর্যাদাময় বৃদ্ধ মানুষদের মধ্যে বয়ঃকনিষ্ঠ অশ্বত্থামার নামও কিন্তু বিপ্রতীপভাবে বড় উজ্জ্বল। অর্জুন বলেছেন— বৃদ্ধ ভীষ্ম, কৃপাচার্য, বিদুর এবং পুত্র অশ্বত্থামার সঙ্গে দ্রোণ যা বলবেন তাই আমরা মাথা পেতে নেব— বৃদ্ধো ভীষ্ম শান্তনবঃ কৃপশ্চ/ দ্রোণঃ সপুত্রো বিদুরশ্চ ধীমান্।

শত্রুপক্ষে থাকলেও অর্জুনের এই মর্যাদাময় মন্তব্য থেকে বোঝা যায় যে, পিতা দ্রোণাচার্যের মতো অশ্বত্থামাও পাণ্ডব অর্জুন এবং অন্যান্য পাণ্ডবদের গুণমুগ্ধ ছিলেন, অন্তত পাণ্ডবরাও তাই জানতেন। কিন্তু সংসর্গ এবং বয়সের ক্ষমতা এমনই এক বস্তু, যা একাকার হয়ে গেলে মানুষের অন্যতর এক নিজস্বতা তৈরি হয় এবং তাঁকে স্বাতন্ত্র বলাই ভাল। আবার যত স্বতন্ত্রতাই থাক, সংসর্গ মানুষের নিজস্বতা ধ্বংস করেও দেয়। দুর্যোধন-কর্ণদের সঙ্গে থেকে থেকে অশ্বত্থামা তাঁর পিতার মতো পাণ্ডবদের প্রাপ্য মিটিয়ে দেবার কথা স্পষ্ট করে বলতে পারেননি। আবার কৌরবদের অন্নভোজী হয়েও পিতা-মাতুলসহ একটি নিজস্ব একান্ত গোষ্ঠীর বৃত্তে প্রায় আবদ্ধ থাকায় দুর্যোধন কোনওদিন অশ্বত্থামাকে কর্ণের মতো বিশ্বাসও করতে পারেননি। সঞ্জয় পাণ্ডবদের খবর নিয়ে ফিরে এলে ধৃতরাষ্ট্র খুব দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে আসন্ন যুদ্ধ থেকে বিরত হতে বলেছিলেন দুর্যোধনকে এবং এটা বলেছিলেন যে, ভীষ্ম, দ্রোণ, অশ্বত্থামা এবং সঞ্জয়— এরা কেউই কিন্তু যুদ্ধ চান না— ন চ ভীষ্মো ন চ দ্রোণো নাশ্বত্থামা ন সঞ্জয়ঃ।

আমরা বুঝি— ভীষ্ম, দ্রোণ এবং কৃপের মতো অশ্বত্থামাও এমন একটা পৃথক অবস্থানে ছিলেন, যেখানে নীতিগতভাবে অশ্বত্থামা চাইতেন না যে, দুর্যোধন পাণ্ডবদের প্রাপ্য ফিরিয়ে না দিয়ে যুদ্ধ করুন তাঁদের সঙ্গে। কিন্তু ভীষ্ম, দ্রোণ, এমনকী কৃপও যে আন্তরিকতা এবং দায়িত্ব নিয়ে এই যুদ্ধ বন্ধ করতে চেয়েছিলেন, অশ্বত্থামা যদি সেই আন্তরিকতা নিয়ে তাঁর সমবয়সের সখ্যটুকু দুর্যোধনের প্রতি ব্যবহার করতেন, তা হলে কাজটা অনেক সহজ হতে পারত। কিন্তু তিনি তা করেননি এবং ঠিক এইখানেই কাজ করে তাঁর সামাজিক বৃত্ত। কৌরবগৃহে তাঁর পিতার যে মর্যাদা, সেই মর্যাদার মহিমাটুকু তিনি গুরুপুত্র হিসেবে ভোগ করতেন, কিন্তু দায়িত্ব বা আন্তরিকতার জায়গায় তিনি খানিকটা উদাসীন বটে, আর ঠিক সেই কারণেই পিতা ধৃতরাষ্ট্রের মুখের ওপর দুর্যোধন জানিয়েছিলেন— আমি আপনার ভরসায় অথবা ভীষ্ম-দ্রোণ-অশ্বত্থামার ভরসায় পাণ্ডবদের প্রতি আমার যুদ্ধাহ্বান জানাইনি— নাহং ভবতি ন দ্রোণে নাশ্বত্থাম্নি ন সঞ্জয়ে— এই লড়াই আমি লড়তে যাচ্ছি নিজের ভরসায় আর আমার বন্ধু কর্ণের ভরসায়।

দুর্যোধনের এই দৃঢ় কঠিন মনোভাবে সমস্ত শান্তিপ্রক্রিয়া ভেস্তে গেল এবং অনিবার্য যুদ্ধ ঘনিয়ে এল খুব তাড়াতাড়ি। কৌরব-গৃহে তখন দুই পক্ষের বলাবল পরিমাপ করা হচ্ছে। কুরুবৃদ্ধ পিতামহ দুই পক্ষেরই শক্তি-ক্ষমতার বিবরণ দিচ্ছেন নিজের মুখে এবং সেখানে একসময় অশ্বত্থামার প্রসঙ্গও উঠল। ভীষ্ম বললেন— দ্রোণের পুত্র অশ্বত্থামা একজন মহারথ যোদ্ধা, যেমন তাঁর হাতে ধনুক-বাণ চলে, তেমনই তিনি যুদ্ধ করতে পারেন বিচিত্র পদ্ধতিতে। এমনই তাঁর ক্ষমতা যে, বিপক্ষ যোদ্ধাদের পক্ষে তাঁর সঙ্গে এঁটে ওঠা খুব কঠিন। ভীষ্ম এইটুকু বলেই থামেননি, বরঞ্চ দুর্যোধনের সার্থক তুষ্টি জুগিয়ে তিনি বলেছেন— অর্জুন যখন ধনুক থেকে বাণ ছাড়েন, তখন এমনই তাঁর হাতের ক্ষিপ্রতা, এমনই তাঁর গতি একটি বাণের সঙ্গে আর একটি বাণের কোনও ব্যবধান থাকে না। অশ্বত্থামাও কিন্তু অর্জুনের মতোই একইরকম অব্যবহিত ক্ষিপ্রতায় বাণ চালাতে পারেন— এতস্য হি মহারাজ যথা গাণ্ডীবধন্বনঃ। ঠিক সেই কারণেই এটা পরিষ্কার বলে দেওয়া যায় যে, অশ্বত্থামা ইচ্ছে করলে এই তিন ভুবনকেই পুড়িয়ে দিতে পারেন।

অনেক বীরের মধ্যে যখন অশ্বত্থামার কথা বলছেন ভীষ্ম, তখন তাঁকে যথেষ্ট উচ্ছ্বসিত দেখাচ্ছিল। হয়তো বা পরে এই মহাবীরের সম্বন্ধে দুই-একটি দোষের কথা বলতে হবে বলেই ভীষ্ম বলছেন— অশ্বত্থামার গুণের কথা বলে শেষ করতে পারব না— নৈব শক্যো ময়া বীরঃ সংখ্যাতুং রথসত্তমঃ। যুদ্ধজয়ের জন্য যে ক্রোধ-দ্বেষের প্রয়োজন হয়, তাঁর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে স্বগত তেজ এবং ঋষিদের তুল্য নিরন্তর প্রয়াস। তাঁর মধ্যে পিতা দ্রোণও তাঁর স্নেহাস্পদ পুত্রকে তাঁর সমস্ত বিদ্যা এবং অস্ত্রসম্ভার দান করেছেন এবং অশ্বত্থামা নিজেও যথেষ্ট বুদ্ধিমান। কিন্তু মুশকিল কী জানো, দুর্যোধন! এই অশ্বত্থামার একটা বড় দোষ আছে, যার জন্যে এই মহাবীরকে আমি শেষ পর্যন্ত ‘রথ’ কিংবা ‘অতিরথ’-এর সংজ্ঞায় ভূষিত করতে পারছি না। এঁর দোষটা কী জানো, দুর্যোধন! অন্য ক্ষত্রির বীরদের কাছে যেমনটা নয়, কিন্তু এই ব্রাহ্মণের কাছে তাঁর জীবন এবং আয়ু বড় প্রিয়— জীবিতং প্রিয়মত্যর্থম্‌ আয়ুষ্কামঃ সদা দ্বিজঃ। যুদ্ধে গেলে অন্য ক্ষত্রিয় পুরুষেরা সেখানে অপলায়নী মনোবৃত্তিতে জীবনের মায়া করেন না, সেখানে এই অশ্বত্থামা, তিনি যতই ভাল যুদ্ধ করুন, কিন্তু সংকটকালে প্রাণের মায়া ত্যাগ করে তিনি যুদ্ধ করবেন না, বেঁচে থাকার ইচ্ছা তাঁর বড় বেশি। একজন যোদ্ধা পুরুষের পক্ষে এটা খুব বড় দোষ— দোষস্ত্বেক মহানেকো… মতঃ পার্থিবসত্তমঃ।

ভীষ্মের এই সংকুচিত বক্তব্যের মধ্যে অশ্বত্থামা-চরিত্রের একটা বিশেষ দিক চকিতে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। ভীষ্ম বেশি কিছু বলতে পারেননি— একে তো অশ্বত্থামা ব্রাহ্মণজাতি, তায় গুরুপুত্র, তাঁর মধ্যেও আছেন আশাবাদী, স্বপক্ষের গুণ-শুশ্রূষু দুর্যোধন, অতএব তাঁর কাছে অতিসংক্ষেপে অশ্বত্থামার একমাত্র দোষ-সংকেত করেই ভীষ্ম আবারও তাঁর সার্বিক প্রশংসায় ফিরে গেছেন। বলেছেন— একটা রথ নিয়েই অশ্বত্থামা দেবসৈন্যও সংহার করতে পারেন, তাঁর ধনুষ্টংকারে পর্বতও বিদীর্ণ করতে পারেন। এঁর শরীরটা যেমন শক্তপোক্ত বিশাল, তাতে তাঁর প্রহার করার ক্ষমতাও সাংঘাতিক, তেজও যথেষ্ট। অতএব তুমি চিন্তা কোরো না, অশ্বত্থামার মতো বীর যেহেতু পাণ্ডব-কৌরব— দুই পক্ষের মধ্যেই দুর্লভ— ন হ্যস্য সদৃশঃ কশ্চিদুভয়ো সেনয়োরপি— তাই বলছিলাম ইনি দণ্ডধারী যমের মতো তোমার বিপক্ষ সৈন্যদের কাছে একেবারে অসহ্য হয়ে উঠবেন। আমার ধারণা— এই মহাবীর এই মহাযুদ্ধের শেষ দিন পর্যন্ত তোমাকে সাহায্য করে যাবেন— এষ ভারত যুদ্ধস্য পৃষ্ঠং সংগময়িষ্যতি।

‘মহাযুদ্ধের শেষ দিন পর্যন্ত’— এই কথাটার মধ্যেও অভিজ্ঞ ভীষ্ম কিন্তু পরোক্ষে সেই ব্যঞ্জনাটুকু রেখে দিয়েছেন, যাতে দুর্যোধন ধারণা করতে পারেন যে, অশ্বত্থামা যত বড় যুদ্ধবীরই হোন, তিনি কিন্তু সময়ের সুযোগ নিয়ে নিজেকে ঠিক বাঁচিয়ে রাখবেন, আত্মপণ করে যুদ্ধে তিনি প্রাণ দেবেন না এবং হয়তো সেই জন্যই দুর্যোধনকে হাজারও সাহায্য করেও তিনি টিকে যাবেন যুদ্ধের অবসানের পরেও।

জীবনের প্রতি অশ্বত্থামার এই যে মায়া, বেঁচে থাকার এই যে অদম্য অভিলাষ— এটা ইঙ্গিতে দুর্যোধন কতটুকু বুঝলেন জানি না, অথবা বলবতী আশায় সব কিছু বুঝেও বুঝতে চাইলেন না হয়তো, কিন্তু অশ্বত্থামার এই যে প্রাণের মায়া, সেটা যে তৎকালীন সমাজের যোদ্ধা-পুরুষদের নীতি-নিয়ম-ভাবনার সঙ্গে একত্তর নয়, সেটা ভীষ্মের কথা থেকে যেমন স্পষ্ট হয়ে যায়, তেমনই এই প্রাণের মায়ার পিছনে যে একটা সামাজিক মূল আছে, সেটা বের করাটাও কঠিন নয়, আর ঠিক সেই সময়েই আমাদের আবার ফিরে তাকাতে হবে অশ্বত্থামার জন্ম-বাহিত সংস্কার এবং তাঁর বেড়ে ওঠার পরিবেশটুকুর দিকে।

মনে রাখতে হবে, সেকালের দিনে ব্রাহ্মণরা বিদ্যাবত্তা এবং আধ্যাত্মিক অনুশীলনের চরম বিন্দুতে পৌঁছলেও, এমনকী সেই বিদ্যাবত্তা এবং পাণ্ডিত্যের জোরে রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে রাজমন্ত্রিত্ব এবং পৌরোহিত্যের কর্ম করলেও ক্ষত্রিয়-কর্মের বাস্তব এবং তৈজসিক ক্ষেত্রে তাঁদের স্বাভাবিক অক্ষমতা ছিল। যুদ্ধক্ষেত্রে যুদ্ধ করাটা যেহেতু তাঁদের স্বভাবজ তথা জাতিগত কর্ম এবং ধর্ম ছিল না, তাই পরম্পরা-লব্ধ মানসিকতায় ব্রাহ্মণেরা শৌর্য-বীর্য প্রকটনের ক্ষেত্রে অথবা রাজশাসনের প্রায়োগিক ক্ষেত্রে খানিকটা পিছিয়ে ছিলেন সব সময়েই। হয়তো এই কারণেই মহামতি কৌটিল্য সৈন্য-সামন্ত বা সেনাপতি নিয়োগের ক্ষেত্রে ব্রাহ্মণদের নির্বাচন করাটা এক্কেবারে পছন্দ করেননি। যুক্তি হিসেবে বলেছেন— ব্রাহ্মণরা স্বভাবতই বড় কারুণিক হন, হাতে-পায়ে ধরলে অথবা খানিকটা স্তুতি-নতি করলেই তারা বিগলিত হয়ে পড়েন। অতএব এমন মানুষ শাসন-দমন-দণ্ডের ক্ষেত্রে তেমন উপযোগী নন। ব্রাহ্মণদের চরম সামাজিক মর্যাদার নিরিখে কৌটিল্য যেটা স্পষ্ট করে বলতে পারেননি, সেটা হল— তৈজসিক ক্ষেত্রে ব্রাহ্মণদের প্রকৃতি স্বভাবতই দুর্বল, কাউকে নৃশংসভাবে প্রাণে মারা বা হত্যা করাটা যেমন তাঁদের স্বাভাবিক কারুণ্যে আঘাত করে, তেমনই প্রাণে মারা যাওয়া অথবা সম্মুখ-যুদ্ধে শেষ রক্তবিন্দু ক্ষয় করে বীরোচিতভাবে প্রাণ দিয়ে দেওয়ার মধ্যেও তাঁদের স্বাভাবিক সংস্কার-লব্ধ ভয় কাজ করে। ঠিক এই রকম একটা সামাজিক এবং জাতিগত ‘ফ্রেমে’র মাঝখানে রেখে অশ্বত্থামার চারিত্রিক বিচার করলে তাঁর প্রাণের মায়া, জীবনে বেঁচে থাকার অভিলাষ— এগুলি সযৌক্তিক হয়ে ওঠে। কুরুক্ষেত্র-যুদ্ধের ফলও আমরা জানি, তাই অগণিত হতাহতি সত্ত্বেও শেষপর্যন্ত অশ্বত্থামার বেঁচে যাওয়াটাও ভীষণই যুক্তিযুক্ত হয়ে ওঠে।

সামাজিক অবস্থান এবং তাঁর বৈশিষ্ট্যের কথা বাদ দিলেও অশ্বত্থামার পারিবারিক পরিস্থিতিটাও এখানে ভীষণ ভাবে বিচার্য হওয়া উচিত। প্রথমেই এ-কথা মেনে নিতে হবে যে, যুদ্ধক্ষেত্রে অথবা সাংগ্রামিক তেজঃপ্রকাশের মধ্যে ব্রাহ্মণোচিত কারুণ্য ব্যাপারটা যতই যুক্তিসিদ্ধ হোক, সেখানে ব্যতিক্রমও থাকবে। অশ্বত্থামার পিতা দ্রোণাচার্যই সেই ব্যতিক্রম। তাঁর পিতা পরম্পরালব্ধ ব্রাহ্মণ্য-বৃত্তি পরিত্যাগ করেছিলেন ক্ষত্রিয়ের তেজোবৃত্তির প্রতি প্রবল আকর্ষণবশত। অস্ত্রশিক্ষা এবং অস্ত্রকৌশলের প্রভুত্ব লাভ করাটা দ্রোণাচার্যের ‘প্যাশন’ ছিল বলেই শত সামাজিক বঞ্চনা এবং নিন্দামন্দ সত্ত্বেও তিনি মহাভারতের আমলে শ্রেষ্ঠ অস্ত্রগুরু এবং অবশ্যই ব্যতিক্রমী ব্যক্তিত্ব। অর্থাৎ কিনা যুদ্ধ করতে গেলে প্রাণের মায়া করলে চলে না— এই কারুণিক স্বভাব তিনি অতিক্রম করেছিলেন। কিন্তু এই ক্ষত্রিয়োচিত অতিক্রমের ফলেই তাঁর জীবনে যে দারিদ্র্য এবং অসাচ্ছন্দ্য এসেছিল তাতে অন্য একটা মাত্রা তৈরি হয়ে গিয়েছিল তাঁর জীবনে এবং পুত্র অশ্বত্থামার জীবন-বোধের ক্ষেত্রেও তাঁর প্রভাব গুরুতর। বেঁচে থাকার জন্য, জীবন-যাপনের জন্য দ্রোণাচার্যকে যুবকোত্তর বয়স্ক পর্যন্ত চরম লড়াই করতে হয়েছে। সেই লড়াই করতে করতেই একদিন জন্মভূমি পঞ্চাল থেকে ভাসতে ভাসতে শ্যালক কৃপাচার্যের বাড়িতে এসেছিলেন দ্রোণাচার্য এবং এই লড়াই এবং অর্থোপার্জনের চরম প্রয়াসের মধ্যেই কিন্তু পুত্র অশ্বত্থামার জন্ম হয়েছে, এটা ভাববার বিষয়।

দারিদ্র্য এবং অর্থোপার্জনের আকুলতার মধ্যেই এই যে নিতান্ত পরাশ্রয় গ্রহণ করতে হল পিতাকে, এই পরাশ্রয় কিন্তু এক শিশু, কিংবা কিশোর মানুষকে শুধু জীবনে বেঁচে থাকার মন্ত্র শেখায়। নিজের প্রতি মায়া এবং আত্মরতিও তৈরি হয় সেই পরাশ্রিত জীবন-ধারণের যন্ত্রণা থেকেই। দ্রোণাচার্য ভীষ্মের সান্নিধ্যে এসে উপার্জনের অনুকূল পরিবেশ পেলেন, শ্যালকের দুর্বল ব্যক্তিগত আশ্রয় থেকে রাজবাড়ির ঋদ্ধ সম্পন্ন পরিবেশে তাঁর গৃহপরিবর্তন ঘটল। কিন্তু তা সত্ত্বেও রাজবাড়ির বৃত্তিভোগিতার পারতন্ত্র্য তাঁর রয়েই গেল। বন্ধু দ্রুপদকে শিষ্যমাধ্যমে পরাজিত করে পঞ্চাল-রাজ্যের একাংশ তিনি লাভ করলেন বটে, কিন্তু সেই রাজ্যে গিয়ে তিনি প্রজার মঙ্গল সাধন কিংবা রাজ্যশাসনের কোনও যন্ত্রণা ভোগ করলেন না। তিনি কিন্তু নিশ্চিন্ত জীবন, নিশ্চিন্ত অর্থোপার্জন বেছে নিলেন বৃহত্তর এবং রাজকীয় পরাশ্রয়েই।

কিন্তু পরাশ্রয় এমনই এক বস্তু যে, তা রাজকীয় হলেও আশ্রয়দাতার ব্যক্তিত্ব সেখানে কাজ করেই। বিশেষত সেই আশ্রয়দাতা যদি দুর্যোধনের মতো ব্যক্তিত্ব হন, তবে অতি বড় আশ্রিতের মনেও আতঙ্ক থেকে যায়। সংশয়িত মুহূর্তে দ্রোণাচার্যের দিকে যখন সোজাসুজি আঙুল উঠেছে, তখন দ্রোণাচার্য হয়তো রাগত স্বরে বলেছেন যে, তিনি দুর্যোধনের তোয়াক্কা করেন না, পিতামহ ভীষ্মের দেওয়া বৃত্তিতে তাঁর জীবন চলে, তবু শেষ জায়গায় দ্রোণের সেই দুঃখ রয়েই গেছে— যাকে কুরু-রাজবাড়ির অর্থদাসত্ব বলে চিহ্নিত করেছেন দ্রোণ, ভীষ্ম, কৃপাচার্য সকলেই। তাঁর মানে কুরুরাজ্যে ধর্মপ্রধান ভীষ্ম, দ্রোণ, কৃপের মতো ব্যক্তির প্রাধান্য থাকলেও সেই রাজ্যটা যেহেতু দুর্যোধনের মতো দুর্নীতি-পরায়ণ মানুষের ভাবনামতোই চলে, তাই তাঁদের বৃত্তিলাভও ঘটে পরোক্ষে সেই দুর্যোধনের অর্থেই। ঠিক এই কারণেই কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের আগে দুর্যোধনের অর্থদাসত্ব কবুল করে নিয়ে ভীষ্ম-দ্রোণ-কৃপ সকলকেই দুর্যোধনের পক্ষে যুদ্ধ করতে হচ্ছে বলে কবুল করেছিলেন তাঁরা।

আমাদের বক্তব্য— দ্রোণপুত্র অশ্বত্থামা লালিত, পালিত এবং বড় হয়ে উঠেছেন এই পারিবারিক পরিমণ্ডলের মধ্যে। তাই দুর্যোধনের বিরুদ্ধে মাঝে মাঝে ব্রাহ্মণ-গুরুর ভূমিকায় ফোঁস করে উঠলেও— যা দ্রোণ করেছেন, অশ্বত্থামাও তাই করেছেন— তবু অশ্বত্থামার বড় হয়ে ওঠার পরিপার্শ্ব-ভূমি দ্রোণের চেয়ে আলাদা। জীবনে বেঁচে থাকার জন্য যে লড়াইটা দ্রোণকে করতে হয়েছিল, সে-লড়াই তাঁর মেরুদণ্ডটাকেও যথোচিতভাবে শক্ত করেছিল। ফলে সত্য কথা বলতে তিনি ভয় পাননি কোনওদিন, বিশিষ্ট সাংগ্রামিকের সামনে দাড়িয়ে পলায়নও করেননি কোনওদিন। কিন্তু অশ্বত্থামা বাল্যকালে অর্থকৃচ্ছ্রতার মধ্যে কাটালেও অস্ত্রশিক্ষার কাল থেকেই অর্থাৎ জ্ঞানবুদ্ধি হওয়ার সময় থেকেই নিশ্চিন্ত আরামে লালিত, পরাশ্রয়ের পরিপোষণায় পালিত। এই অবস্থায় বিঘ্ন উপস্থিত হলেই নিজেকে কীভাবে বাঁচিয়ে রাখা যায়, এই কৌশল তাঁর ভালভাবে শেখা আছে। লক্ষণীয়, কৌরব দুর্যোধনের কোনও ন্যায়-অন্যায়ের ব্যাপারে কিংবা পাণ্ডবদের প্রতি কোনও অবিচারের ব্যাপারে সময়মতো কোনও বক্তব্য প্রকাশ করেননি অশ্বত্থামা। খানিক আগে যে তিনি বিস্তর চেঁচিয়েছেন, সেটা অনেকটাই পরাশ্রিত জনের নিজস্ব বা পারিবারিক ‘আইডেনটিটি’ ঠিক রাখার জন্য। যুদ্ধক্ষেত্রে তিনি দুর্যোধনের পক্ষে যত সংগ্রাম করেছেন, সেখানেও কঠিন সময়ে অনেকবার তিনি পালিয়ে বেঁচেছেন এবং তাঁর সর্বশেষ পলায়নটুকু যখন নির্দেশ করব, তখন দেখব— সত্যিই জীবনের ওপর তাঁর খুব মায়া, বেঁচে থাকার জন্য তাঁর বড় অভিলাষ।

এই কথাগুলো আগে বলে ফেলার ফলে এই দাড়াল যেন পরাশ্রিত অশ্বত্থামার শক্তি-তেজ-ক্ষমতা কিছু নেই, যেন যুদ্ধ দেখলেই তিনি পালাবার সুযোগ খোঁজেন। এ-রকমটা কিন্তু কিছু নয়। ভীষ্ম যেটা সন্তর্পণে বলেছেন এবং আমরাও যেটা আধুনিক মানসিকতায় বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করেছি, সেটা কিন্তু অশ্বত্থামার চরিত্রের একটা মৌলিক অন্তরাল-রেখা, যেটা আপ্রবন্ধ স্থির এবং সময়মতো যেটা বিভিন্ন ঘটমানতার মধ্যে ফুটে উঠবেও বটে, তবে তাতে ঘটমান এবং চলমান একটা চরিত্র পুরোপুরি পালটে যায় না। সমাজ, ব্যক্তি, লৌকিকতার মধ্যে অশ্বত্থামা নিজের মতোই চলেছেন তাঁর স্বার্থ এবং আয়ুষ্কামনার আবরণ ভঙ্গ করে। ঠিক এই কারণেই মহামতি ভীষ্ম একবার মাত্র অশ্বত্থামার জীবন-প্রিয়তার উল্লেখ করেই বারবার তাঁর তেজ, প্রহার-শক্তি এবং অপরিমেয় গুণের কথা উল্লেখ করেছেন। এমনকী দুর্যোধন যখন সংশয়িতভাবে সকলকে জিজ্ঞাসা করছেন যে, তাঁর পক্ষের কোন যোদ্ধা কত দিনের মধ্যে পাণ্ডবদের সমস্ত ধ্বংস করে দিতে পারেন, তখন কিন্তু অনেক বড় বড় যোদ্ধার সঙ্গে অশ্বত্থামা সদম্ভে জানিয়েছিলেন— আমি মাত্র দশ দিনে সমস্ত পাণ্ডব-সৈন্য ধ্বংস করে দিতে পারি— দ্রৌণিস্তু দশরাত্রেণ প্রতিজজ্ঞে বলক্ষয়ম্।

অশ্বত্থামার এই প্রতিজ্ঞার মধ্যে দম্ভ আছে, আত্মশ্লাঘা আছে, অতিশয়োক্তিও আছে, কিন্তু এসব সত্ত্বেও যেটা বোঝাতে চাই, সেটা হল— জীবনে বেঁচে থাকার অভিলাষ যথেষ্ট থাকা সত্ত্বেও প্রত্যক্ষত অশ্বত্থামা দুর্যোধনের অন্যতম সঙ্গী, তাঁর সমস্ত কাজকর্মেই তিনি আছেন, এমনকী তাঁর অন্যায়গুলিতেও তিনি তেমন প্রত্যক্ষ কোনও প্রতিবাদ করেন না এবং তাঁর জন্য অন্যদের মতোই তিনি যুদ্ধ করতে প্রস্তুত হয়েছেন। হয়তো যে পরাশ্রয়ের বৃত্তি অশ্বত্থামার মধ্যে যেভাবে হোক জীবনে বেঁচে থাকার বুদ্ধি জুগিয়েছে, আমাদের মতে হয়তো সেই পরাশ্রয়ের বৃত্তিই তাঁকে প্রায় সব সময়েই দুর্যোধনের অনুকূলে থাকতে শিখিয়েছে। ভবিষ্যতে আমরা এর প্রমাণ পাব তাঁর নিজের স্বীকারোক্তিতে। আর যেখানে দেখব— তিনি দুর্যোধনের অনুকূলে নেই বা তাঁর বিরুদ্ধে অশ্বত্থামা কথা বলছেন, সেখানেও বুঝতে হবে, তিনি ফোঁস করে উঠছেন তাঁর একান্ত সেই আশ্রিত-গোষ্ঠীর ওপরে আক্ষেপ নেমে আসছে বলে। বিরাটের গো-গ্রহণকালে যেমন এই সত্য প্রমাণিত হয়েছে, তেমনই পরেও এই সত্য প্রমাণিত হবে।

কুরুক্ষেত্রের মহাযুদ্ধে অশ্বত্থামার দায়িত্ব কম ছিল না, দুর্যোধনের আস্থাও তাঁর প্রতি যথেষ্ট ছিল বলেই অশ্বত্থামার অধিকারে এক অক্ষৌহিণী সৈন্য স্থাপন করে দুর্যোধন নিশ্চিন্ত ছিলেন। যুদ্ধ আরম্ভ হল ভীষ্মের সেনাপতিত্বে এবং আপনারা জানেন যে, যে কোনও চরিত্র বিশ্লেষণের সময়েই প্রতিপক্ষের বিশিষ্ট যোদ্ধাদের সঙ্গে যে যুদ্ধটা হয়, তাঁর অনুপুঙ্খ বর্ণনা দেবার কোনও মানে নেই। আর এটাও তো ভাবতেই হবে যে, অশ্বত্থামা প্রতিপক্ষের প্রতি ক’টা ভয়ংকর বাণ নিক্ষেপ করলেন এবং কয়েক গোছা বাণের প্রহার তিনি ভোগ করলেন নিজে— এটা যে-কোনও যুদ্ধেরই সাধারণ অঙ্গ, অথবা সাধারণ ছন্দ। সেই যুদ্ধ নিয়ে আমরা বেশি কথা বলতে চাই না। চাই না, কারণ ওই যুদ্ধ আর যুদ্ধশক্তি দিয়ে অশ্বত্থামাকে এতটুকুও চেনা যায় না— তাঁর চরিত্র এতটাই জটিল।

যেমন অশ্বত্থামার এইটুকু বহিরঙ্গ জানালে কী হয়? কী হয় যদি বলি যে, সমগ্র মহাভারতের মধ্যে অশ্বত্থামার আকৃতি বা চেহারার কোনও বর্ণনা পাওয়া যায় না। একজন মহামান্য পণ্ডিতই এ কথা বলেছেন এবং তিনি এতটাই পণ্ডিত যে, আমরা সকলে মিলে তাঁর কাছে বসলেও আমরা তাঁর পায়ের নখের যুগ্যি নই। তবে কিনা, মহাভারতের কবি তো সব কথা এক জায়গায় বলেন না, কোথায় কোন অপ্রসঙ্গে তিনি বহিরঙ্গের বর্ণনা দিয়ে দেবেন, তাঁর কোনও ঠিক নেই। যেমন অশ্বত্থামার সবচেয়ে জুৎসই বর্ণনা আছে মহাভারতের শল্যপর্বে, যখন শল্যকে সেনাপতি করার উদ্যোগ চলছে অশ্বত্থামার সামনেই। সেখানে দুর্যোধন অশ্বত্থামার কাছে যাচ্ছেন, আর তখনই তাঁর বহিরাকৃতির বর্ণনায় দেখি— অশ্বত্থামা অসাধারণ সুপুরুষ এবং মাথাটা তিনি উন্মুক্ত রাখেন না, বামুন বলেই হয়তো মাথাটা আবৃত করে রাখেন কাপড় দিয়ে। গলায় শাঁখের মতো ত্রিবলি এবং সাধারণ মুহূর্তে কথাও বলেন ভারী মধুর স্বরে— স্বঙ্গং প্রচ্ছন্নশিরসং কম্বুগ্রীবং প্রিয়ম্বদম্‌। তবে হ্যাঁ, এত সুন্দর চেহারা হলেও তাঁকে প্রথম দেখলে বোধহয় একটু রাগি লোক মনে হয়। মনে হয় সব যেন ইনি ধ্বংস করে দিতে পারেন— অন্তকপ্রতিমং ভুবি। এর কারণ তাঁর মুখটার মধ্যে কোথায় যেন একটা বাঘের মুখের ভাব আছে। অতিরিক্ত ফর্সা রঙের মধ্যে এইরকম মনুষ্যচর্মে ব্যাঘ্রমুখের প্রতিচ্ছবি সকলের মনে যেন ভয় ধরিয়ে দেয়।

বীরের যেমন চেহারা হয় তেমনই পুষ্ট-শ্লিষ্ট বাহু, দৃঢ় বৃষস্কন্ধ, চওড়া বুক, হাত, পা, ঊরু, নখ সবই খুব পুরুষালি, যদিও তাঁর চেহারার মধ্যে একটা স্নিগ্ধতাও আছে আবার একটা আগুনপানা ভাবও আছে। মহাভারতের কবি লিখেছেন— বিধাতা অনেক ভাবে শনৈঃ শনৈঃ চিন্তা করে সমস্ত গুণ একত্র করে সযত্নে গড়ে তুলেছেন অশ্বত্থামাকে— স্মৃত্বা স্মৃত্বা তু গুণান্ ধাত্রা যত্নাদ্ বিনির্মিতম্। আসলে রূপের বর্ণনা আমরা আগেও করেছি, কিন্তু এখানে যেটা গুরুত্বপূর্ণ মনে করি, সেটা হল— তাঁর রূপের সঙ্গে গুণের বর্ণনাও কিছু কম নেই। তিনি বেদ-বেদান্ত, পুরাণ-ইতিহাস পড়েছেন, সেটাও খুব বড় কথা নয়, বড় কথা হল, তাঁর যুদ্ধবিদ্যার জ্ঞান। যুদ্ধক্ষেত্রে পরপক্ষের বীরযোদ্ধাদের যত রকম ভাব-ভাবনা অভিপ্রায় থাকে, সেগুলি অশ্বত্থামা খুব ভাল বোঝেন। আর ধনুর্বেদের যে প্রথাগত জ্ঞান, যা নাকি ঐতিহ্য অনুসারে চারটে পা আর দশটা অঙ্গের ওপর দাঁড়িয়ে আছে, সেসব নাকি অশ্বত্থামার অধিগত— দশাঙ্গং যশ্চতুপাদম্‌ ইষ্বস্ত্রং বেদ তত্ত্বতঃ। হয়তো সেকালের সমস্ত বীর যোদ্ধাই এই দশাঙ্গ এবং চতুষ্পাদ ধনুর্বিদ্যা জানতেন এবং আমাদের কৌতুহল হয়— কী এই দশটা অঙ্গ এবং চারটে পাই বা কীরকম। পণ্ডিত টীকাকার জানিয়ে দিয়েছেন— ধনুর্বিদ্যার দশটা অঙ্গ হল— ব্রত, প্রাপ্তি, ধৃতি, পুষ্টি, স্মৃতি, ক্ষেপণ, অরিভেদন, চিকিৎসা, উদ্দীপন এবং কৃষ্টি। অর্থাৎ গুরুর কাছে নাড়া বেঁধে নিয়মের মধ্যে চলে আসাটাই এখানে ব্রত, তারপর বিদ্যাপ্রাপ্তি, বিদ্যাধারণ, বিদ্যার পুষ্টি, বার বার অভ্যাসে বিদ্যা মনে রাখা। অস্ত্ৰক্ষেপ এবং শত্রুনাশ করার কৌশল পর্যন্ত অরিভেদন কর্মের শেষ। ধরেই নিতে হবে শত্রুর সঙ্গে যুদ্ধে নিজে যেমন আক্রমণ করতে হবে, তেমনই প্রত্যাক্রমণে তাঁর শরীরের কিছু ক্ষতিও হবে, অতএব তাঁর চিকিৎসাও নিজেই শিখতে হবে। চিকিৎসিত হবার পর পুনরায় যুদ্ধের জন্য উদ্দীপিত হওয়া এবং অন্যকে উদ্দীপিত করে শত্রুসৈন্য কর্ষণ করার ক্ষমতাই ধনুর্বেদের শেষ অঙ্গ।

এই দশাঙ্গ ধনুর্বেদ, যা অশ্বত্থামা খুব ভালভাবে জানেন, সেটা দাড়িয়ে আছে চারটে স্তম্ভের ওপর— দীক্ষা, শিক্ষা, আত্মরক্ষা এবং আত্মরক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় সাধন অর্থাৎ অস্ত্রশস্ত্র। দীক্ষা, শিক্ষা, আত্মরক্ষার ব্যাপারটা সার্বিক, কিন্তু অস্ত্রসাধনের ক্ষেত্রে অশ্বত্থামার বৈশিষ্ট্য হল— তিনি পিতা এবং গুরু দ্রোণাচার্যের সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ অস্ত্ররাশির উত্তরাধিকার লাভ করেছিলেন— বিশেষত সেই ব্রহ্মশিরা, সর্বধ্বংসী অলৌকিক অস্ত্র। যে অশ্বত্থামা এইভাবে অস্ত্রবিদ্যায় দীক্ষিত এবং শিক্ষিত হয়েছেন, তিনি যে যুদ্ধকালে তাঁর বিশাল বীরত্ব দেখাতে পারবেন তাতে আশ্চর্য কিছু নেই। এর আগেও আমরা দেখেছি সেই বিরাট রাজ্যের গোগ্রহণের কালে— ভীষ্ম যখন সৈন্য সাজালেন, তখন কর্ণকে তিনি সকলের সামনে রেখেছিলেন কেন না তিনি অর্জুনকে আমল দিতে চাননি একটুও। কর্ণ পালাতেও বাধ্য হয়েছিলেন, আমরা জানি। কিন্তু এই যুদ্ধের সময় মাঝখানে রাখা হয়েছিল দ্রোণাচার্যকে এবং অশ্বত্থামাকে রাখা হয়েছিল ঠিক তাঁরে বাঁয়ে। যুদ্ধসজ্জায় অশ্বত্থামার এই অবস্থান খুব কম সম্মানের নয়।

কিন্তু তবু বলি— এও খুব সামান্য কথা কারণ, অশ্বত্থামার মতো বীর যোদ্ধার কাছে বাম কি দক্ষিণ ভাগে থেকে মূল যোদ্ধাকে রক্ষা করাটা কোনও কঠিন কাজ নয়। বরঞ্চ আমরা তাঁর আত্মজীবনের জটিলতাগুলি অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে করি। একটু আগেই আমরা তাঁকে কর্ণের প্রতিপক্ষতায় অর্জুনের প্রশংসা করতে দেখেছি, অথবা বলা উচিত, অর্জুনের সপক্ষতায় কর্ণের উদ্দেশে তিনি ভয়ংকর তিরস্কার-বাণী উচ্চারণ করেছেন। এটা বুঝতে পারি যে, কর্ণ মাঝে মাঝেই বৃদ্ধ দ্রোণাচার্য এবং তাঁর একান্ত গোষ্ঠীভুক্ত লোকজনদের ব্যাপারে নানা রকম হীন মন্তব্য করতেন বলে অশ্বত্থামার খুব রাগ ছিল কর্ণের ওপর। তা ছাড়া অর্জুনের ওপর দ্রোণাচার্যের চিরন্তন পক্ষপাত এবং নিজেও সহাধ্যায়ী হিসেবে অর্জুনের শক্তি এবং অস্ত্রকৌশল জানতেন বলে অর্জুনের ব্যাপারে অশ্বত্থামার একটা দুর্বলতাও ছিল। কিন্তু একই সঙ্গে ভাবতে হবে যে, অশ্বত্থামার নিজের সম্বন্ধেও গর্ববোধ কম ছিল না। সব কিছু মিলে অবশ্য বিরাট-রাজার গোগ্রহণের সময় অদ্ভুত এক মজার ঘটনা ঘটল।

ধরে নিতে পারি যে, দ্রোণাচার্যের সামনে কর্ণ বেশি আস্ফালন করেছিলেন বলে তাঁকেই অগ্রবর্তী করে সামনে রাখা হয়েছিল ভীষ্মের বুদ্ধিতে এবং আমরা জানি যে কর্ণ পালিয়ে বেঁচেছিলেন সেদিন। কর্ণ পালাতেই অর্জুন বিপক্ষীয় বীরদের পরিচয় দিচ্ছিলেন কুমার উত্তরের কাছে। কথা বলতে বলতে দ্রোণাচার্যের কথা এল এবং এল আচার্যপুত্র অশ্বত্থামার কথাও। আচার্য-সম্বন্ধে আচার্য-পুত্রকেও কতটা সম্মান করতেন অর্জুন যে, অশ্বত্থামার প্রসঙ্গ উঠতেই অর্জুন তাঁর বীরত্ব এবং গুরুমর্যাদা একত্রিত করে বললেন— এই যে দেখছ যে-মানুষটির রথের ধ্বজায় ধনুক আঁকা আছে— ধনুর্ধ্বজাগ্রে যস্য দৃশ্যতে— তিনি হলেন দ্রোণপুত্র অশ্বত্থামা। আমি তোমাকে বলে দিচ্ছি, কুমার! তুমি যদি আমার রথ নিয়ে কোনওভাবে অশ্বত্থামার সামনে পৌছে যাও, তবে তুমি তোমার রথ ফিরিয়ে নেবে, বারবার যদি এই ঘটনা ঘটে তবু ফিরিয়ে নেবে— এতস্য ত্বং রথং প্রাপ্য নিবর্তেথাঃ পুনঃপুনঃ।

রথের ধ্বজায় ধনুকের প্রতীক দেখিয়ে অর্জুন বুঝিয়ে দিয়েছেন যে, বামুনের ছেলে হলেও যুদ্ধ-ব্যাপারটা অশ্বত্থামার ‘প্যাশন’, তাই এত অভিধেয় ভাবনায় রথধ্বজায় ধনুকের প্রতিলিপি অঙ্কন করেছেন অশ্বত্থামা। অন্যদিকে অশ্বত্থামার রথ দেখলেই তোমার রথ ফিরিয়ে নেবে— এই কথায় বোঝা যায় যে, অর্জুন তাঁর এই আচার্যপুত্রটির সঙ্গে পারতপক্ষে যুদ্ধ করতে চান না। হয়তো বা আচার্য দ্রোণের প্রতি সম্মানবশত তাঁর মমতাস্পদ পুত্রকে তিনি আঘাত করতে চান না কোনও। অথবা বহুকাল গুরুগৃহবাসে একান্তশিক্ষার কালে সহবাস-পরিচয়ের কারণে অশ্বত্থামার প্রতি অর্জুনেরও হয়তো একটা দুর্বলতা ছিল। সহসা তিনি অশ্বত্থামাকে আঘাত করতে চাইতেন না।

তবে এই সময় ঘটনা ঘটল অন্যরকম। কর্ণের সঙ্গে প্রথম যুদ্ধ, কর্ণ পালালে কৃপাচার্য এবং কৃপাচার্যের পরেই দ্রোণের সঙ্গে যুদ্ধ আরম্ভ করলেন অর্জুন। কঠিন যুদ্ধের পর দ্রোণাচার্যের রং এবং শরীর অর্জুনের শরজালে আকীর্ণ হল। কৌরব সৈন্যদের মধ্যে হাহাকার উঠল কী হয়, কী হয়। ঠিক এই সময়ে অনুযায়ী রথবাহিনী নিয়ে অশ্বত্থামা আক্রমণ করলেন অর্জুনকে। স্বয়ং আক্রমণের অর্থ হল— দ্রোণের দিক থেকে অর্জুনের নজর ঘুরিয়ে দেওয়া। দ্রোণাচার্যের মতো অসাধারণ যোদ্ধার সঙ্গে অর্জুনের অস্ত্রযুদ্ধের ক্ষমতা দেখে মনে মনে অর্জুনের তারিফ করছিলেন অশ্বত্থামা— পূজয়ামাস পার্থস্য… হৃদয়েন মহাত্মনঃ-মুখে অবশ্য তাঁর হিংসার প্রতিচ্ছবি, তিনি অর্জুনকে আক্রমণ করেছেন। অর্জুন এমনভাবেই অশ্বত্থামার সঙ্গে যুদ্ধ আরম্ভ করলেন যাতে দ্রোণ পালিয়ে যাবার স্বচ্ছন্দ অবকাশ পেয়ে যান। এর পরেই অশ্বত্থামার সঙ্গে তুমুল যুদ্ধ আরম্ভ হল অর্জুনের এবং দেখা গেল কেউ কম যান না। এক সময় এমনও হল যে, অশ্বত্থামা অর্জুনের অমোঘ গাণ্ডীব-ধনুর ছিলাটা কেটে দিলেন হঠাৎ। নতুন ছিলা লাগিয়ে অর্জুনের যুদ্ধ আরম্ভ হল বটে, কিন্তু অধিক আক্রমণের উচ্ছাসে অতিরিক্ত বাণমোক্ষণ করার ফলে অশ্বত্থামার বাণই ফুরিয়ে গেল এক সময়, ফলে অর্জুন এবার ভয়ংকর হয়ে উঠলেন— জগ্মুঃ পরিক্ষয়ং শীঘ্রম্ অভূত্তেনাধিকোহর্জুনঃ। এই সময়ে হঠাৎ করে কর্ণ এসে উপস্থিত না হলে অশ্বত্থামার বিপন্নতা বাড়ত, যদিও অশ্বত্থামার প্রতি অর্জুনের যে মনোভাব, তাতে চরম কিছু ঘটার সম্ভাবনা ছিল না।

বিরাট-রাজ্যে গো-গ্রহণকালের এই সম্পূর্ণ ঘটনা উল্লেখ করে আমরা যেটা বোঝাতে চাই— সেটা হল সেই জটিল অন্তরলোক যেখানে অশ্বত্থামাকে অদ্ভুত বিভ্রান্ত মনে হয়। পাণ্ডবদের প্রতি তাঁর পিতার পক্ষপাত, মমতা এবং স্নেহের কারণ তিনি জানেন, সে-কারণে তাঁর হৃদয়ও দুর্বল হয়ে ওঠে মাঝে মাঝে। কিন্তু দুর্যোধনের প্রতিও তাঁর দায়বদ্ধতা তিনি হারিয়ে ফেলেন না, যদিও বৃত্তিদাতা দুর্যোধনকে তিনি ফেলতে না পারলেও তাঁর বুদ্ধিদাতা কর্ণ এবং শকুনিকে তিনি একেবারেই সহ্য করতে পারেন না। মনোলোকের এই পরস্পর-বিরুদ্ধ বৃত্তিগুলি নিয়েই কিন্তু অশ্বত্থামা কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছেন এবং তা পাণ্ডবদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ।

যদি সার্বিক একটা দৃষ্টিতে দেখি, তা হলে দেখবেন— জীবনের স্বতোবিভিন্ন স্রোতের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে থাকলেও মানুষের মনের মধ্যে কতগুলো নির্দিষ্ট প্রবণতা তৈরি হয়, তৈরি হয় নির্দিষ্ট ভাবনালোক। অশ্বত্থামারও তা হয়েছে। সেই প্রবণতা বা সেই ভাবনালোক কিন্তু অশ্বত্থামাকে পাণ্ডবদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে প্ররোচিত করে না। ধৃতরাষ্ট্র নিজে দুর্যোধনকে বলেছেন— ভীষ্ম, দ্রোণ, অশ্বত্থামা, কেউ যুদ্ধ চান না— ন চ ভীষ্মো ন চ দ্রোণো নাশ্বত্থামা ন সঞ্জয়ঃ— তুমি এই যুদ্ধ থেকে বিরত হও। আমি জানি তোমাকে সব করাচ্ছে ওই কর্ণ-শকুনি-দুঃশাসন! অতএব তোমাকেই বলছি, তুমি এবার যুদ্ধ থেকে বিরত হও। দুর্যোধন শোনেননি এবং তাচ্ছিল্য করে বলেছিলেন— ওই ভীষ্ম-দ্রোণ-অশ্বত্থামার ভরসায় আমি যুদ্ধ করতে নামিনি। কিন্তু যুদ্ধের যে বাস্তব জায়গাটা, যেখানে দুর্যোধন খুব ভালই জানেন যে, ভীষ্ম-দ্রোণের মতো অশ্বত্থামারও একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে। বিশেষত অশ্বত্থামা ভীষ্ম-দ্রোণের চেয়েও তাঁর অনেক কাছের লোক। অন্যদিকে এত কাছের লোক হওয়া সত্ত্বেও নীতিগত প্রশ্নে অশ্বত্থামাও যে পাণ্ডবদের সঙ্গে দুর্যোধনের যুদ্ধ চাইতেন না, তা বারবার উঠে এসেছে ধৃতরাষ্ট্রের আকুতিতে এবং অবশেষে দুর্যোধনের প্রতি কৃষ্ণের শেষ অনুরোধেও। কৃষ্ণ বলেছেন— ভীষ্ম, দ্রোণ, অশ্বত্থামা, সঞ্জয়, যুযুৎসু সকলেই শান্তির পক্ষে, দুর্যোধন! তুমি এই প্রাণঘাতক যুদ্ধ বন্ধ করো। এঁরা সকলেই, এমনকী তরুণ অশ্বত্থামাও যে এই যুদ্ধের বিপক্ষে, তা বোঝা যায়— যখন এঁরা সবাই যুদ্ধোন্মুখ ক্রুদ্ধ দুর্যোধনকে অবহেলা করেই শান্তির দূত কৃষ্ণকে তাঁর রথ পর্যন্ত অনুগমন করলেন।

শান্তির এই উন্মুখতা মনঃস্থ রেখেই অশ্বত্থামাকে যুদ্ধে নামতে হল দুর্যোধনের স্বপক্ষেই। আর যুদ্ধ যখন করতে হবে, তখন যে তিনি বীরোচিতভাবেই যুদ্ধে নামবেন, সেটা বলাই বাহুল্য। তবু পাণ্ডবপক্ষীয়রা তেমন করে ধরেননি অশ্বত্থামাকে, তারা ধরেই নিয়েছিলেন যে, গুরুপুত্র তেমন কোনও ক্ষতি করবেন না তাঁদের। ফলত সেইজন্যই উদ্যোগ পর্বে পাণ্ডবদের ঘরোয়া আলোচনায় পাণ্ডব-চতুর্থ নকুলের মতো মধ্যম-মানের বীরকে সমস্ত যুদ্ধকাল ধরে অশ্বত্থামাকে ঠেকিয়ে রাখতে বলেছেন শুধু। দুর্যোধনের কাছে অশ্বত্থামা অবশ্য গর্ব করেই বলেছিলেন যে, দশ দিনের মধ্যেই তিনি পাণ্ডবদের সমস্ত নিকেশ করে দিতে পারেন, কিন্তু পাণ্ডবভাইদের উজ্জ্বল উপস্থিতির মধ্যেও তাঁদের এই সমস্ত সৈন্য মেরে ফেলা সম্ভব কিনা, সেটা অবশ্য বীরোচিত গর্বোক্তির পরিহাস বলে মনে হয়।

ভীষ্মের সেনা-নায়কত্বে যুদ্ধ যখন আরম্ভ হল, তখন অশ্বত্থামার যুদ্ধ করা এবং যুদ্ধ-বিক্রম অনেকটাই ‘রুটিন ওয়ার্ক’ বলে মনে হয়। যেমন, প্রথম দিনের যুদ্ধে অশ্বত্থামা প্রতিপক্ষ হলেন পাণ্ডবপক্ষের শিখণ্ডী। তারপরেই অর্জুনের সঙ্গে ভীষ্মের যুদ্ধে ভীষ্মকে খানিকটা সহায়তা করা। অথবা দ্বিতীয় দিন ধৃষ্টদ্যুম্নের সঙ্গে একবার এবং একবার অভিমন্যুর সঙ্গে যুদ্ধ, তৃতীয় দিন ভীষ্মকৃত গরুড় ব্যূহের সামনে থেকে যুদ্ধ করা। এইভাবে কখনও অর্জুন, কখনও ধৃষ্টদ্যুম্ন, কখনও বিরাট-দ্রুপদ-ঘটোৎকচ সকলের সঙ্গেই কখনও না কখনও যুদ্ধ হল অশ্বত্থামার। এতে পাণ্ডবপক্ষের প্রভূত ক্ষয়ক্ষতি কিছু হয়নি অথবা যুদ্ধের নয় দিনের দিন সাত্যকির প্রহারে একবার যে তিনি মুর্ছিত হয়ে পড়লেন, এবং তাতে যে কৌরবপক্ষের খুব বড় কোনও হানি ঘটল, তাও নয়। পরবর্তী সময়ে ভীষ্ম যখন মারা গেছেন, দ্রোণের সেনাপতিত্বকালে যুদ্ধের তোড় যখন বেড়েছে, সেই সময়ে পাণ্ডবদের শক্তিক্ষয়ে খানিকটা অংশীদার হয়েছেন অশ্বত্থামা। অভিমন্যুকে যে নৃশংসভাবে মারা হল, সেই হন্তারক সপ্তরথীর মধ্যে অশ্বত্থামাও কিন্তু অন্যতম হন্তা।

লক্ষণীয়, দ্রোণের সেনাপতিত্বকালেই অশ্বত্থামাকে অনেক বেশি যুদ্ধ করতে দেখছি। হয়তো আচার্য পিতার সম্মান-রক্ষা, তাঁর ভরণ-পোষণের দায়, এগুলো স্মরণ করেই অশ্বত্থামাও পাণ্ডবদের যথাসম্ভব ক্ষতি করার চেষ্টা করেছেন অশ্বত্থামা। অভিমন্যু-হত্যার ব্যাপারে যেমন অশ্বত্থামার একটা বড় অবদান ছিল, তেমনই ভীমপুত্র ঘটোৎকচের সঙ্গেও তিনি ভয়ংকর যুদ্ধ করেছেন সারা রাত ধরে, তাঁর ছেলেটিকেও তিনি মেরে ফেলেছেন এবং দ্রুপদ-বিরাট-রাজার সঙ্গেও তাঁর যুদ্ধ হয়েছে। এত যুদ্ধের পর স্বর্গ থেকে সিদ্ধ-গন্ধর্বরা পর্যন্ত তাঁর শেীর্যের প্রশংসা করেছেন, কিন্তু দুর্যোধন-কর্ণ সেই প্রশংসা করলেন না। এরপর যুদ্ধের চোদ্দো দিনের দিন অর্জুন যখন সবিক্রমে ঝাপিয়ে পড়লেন কৌরব-বাহিনীর ওপর, সব যখন আস্তে আস্তে ধ্বংসোন্মুখ হয়ে উঠল, তখন দুর্যোধন কিন্তু অশ্বত্থামার ওপর ভরসা করলেন না। তিনি প্রাণের বন্ধু কর্ণের কাছে গিয়ে বললেন— বাঁচাও আমাদের, বাঁচাও— ত্ৰায়স্ব সমরে কর্ণ সর্বান্ যোধান্ মহারথান্। সুযোগ পেয়ে কর্ণ তো এমনভাবেই ভরসা দিলেন দুর্যোধনকে যেন, এখনই তিনি যুদ্ধ জয় করে সমস্ত হস্তিনাপুরের আধিপত্য দিয়ে দিচ্ছেন দুর্যোধনকে। একই সঙ্গে কর্ণ এমন সব আকাশ-পাতাল গর্বোক্তি করতে আরম্ভ করলেন, যা সামনে দাড়ানো কৃপাচার্য, অশ্বত্থামাকে অস্থির করে তুলল।

অদ্ভুত লাগে মহাভারতের এই জায়গাগুলো। কত সূক্ষ্ম এবং মরমি পক্ষপাতে এই জীবনগুলো নিরীক্ষণ করেছেন মহাভারতের কবি। অশ্বত্থামা, দ্রোণাচার্য, কৃপাচার্য যথেষ্ট বীর হওয়া সত্ত্বেও যেহেতু তারা দুর্যোধনের মনের মতো করেই যুদ্ধ চাননি এবং পাণ্ডবদের ওপরে যেহেতু তাঁদের কথঞ্চিৎ দুর্বলতাও ছিল, ফলে শেষ জায়গায় ক্রাইসিস মোমেন্টে দুর্যোধন তাঁদের বিশ্বাস করতে পারেন না। দুর্যোধনের এই মনোভাব কর্ণ প্রকাশ করেও ফেলেছিলেন কৃপাচার্যের মুখের ওপর। কর্ণ বলেছিলেন— আচার্য! আপনি বামুন, আপনি বৃদ্ধ, আর যুদ্ধেও আপনি তেমন পটু নন। সবচেয়ে বড় কথা, ওই পাণ্ডবদের ওপর আপনাদের কিছু স্নেহ-মোহও আছে— কৃতস্নেহশ্চ পার্থেষু মোহান্মাম্ অবমন্যসে— যার জন্য আমাকে আপনি এই অপমান করছেন। দুর্যোধন-কর্ণের এই মনোভাবের বিপরীত কৃপাচার্য-অশ্বত্থামাদের প্রতিক্রিয়াও লক্ষ করুন। তারা আশ্রিত, তারা বড় যোদ্ধা, কিন্তু দুর্যোধনকে তারা সাহায্য করেছেন নিজেদের সীমাবদ্ধতার মধ্যে থেকে, বিশেষত নিজেদের গোষ্ঠীতন্ত্রে আঘাত না লাগে, সে ব্যাপারে তারা সম্পূর্ণ সচেতন। দুর্যোধনের আশ্রয়ে থেকেও তাঁদের এই সচেতনতা এসেছে তাঁদের সামাজিক গ্রন্থি থেকেই— তাঁরা ভূমিদেব বলে পরিচিত, তারা ব্রাহ্মণ। তাঁর মধ্যে কৃপাচার্য, দ্রোণাচার্য দু’জনেই কৌরব-পাণ্ডবের গুরু। এই সমস্ত সচেতনতার মধ্যে অশ্বত্থামা, দ্রোণ, কৃপ নিশ্চয়ই আবার ভাবেন যে, তারা যুদ্ধের সহায়তা দিয়ে দুর্যোধনকে অপার সাহায্য করছেন। এই যে ভাবনালোক— এতে যখন কর্ণের মতো অহংমানী মানুষের কটূক্তি আঘাতের মতো নেমে আসে— যেমনটি ওই কৃপাচার্যের ওপরে নেমে এল একটু আগেই কিন্তু এমন আঘাত নামলে আচার্য-গোষ্ঠীর অন্যতম কনিষ্ঠ অশ্বত্থামা খড়্গ নিয়ে তেড়ে যান কর্ণের দিকে— খড়্গমুদ্যম্য বেগেন দ্রৌণিরভ্যপতদ্ ভৃশম্।

কর্ণকে কৃপাচার্য, দ্রোণ, অশ্বত্থামা কেউই সহ্য করতে পারেন না, কিন্তু কার্যকালে দ্রোণ-কৃপ যেখানে মৌখিকতার মধ্যেই আবদ্ধ রাখেন নিজেদের, সেখানে অশ্বত্থামা তারুণ্যের প্রজ্বলনে খড়্গ নিয়ে তাড়া করেন কর্ণকে এবং সেটা স্বয়ং কুরুরাজ দুর্যোধনের সামনেই। তবে হ্যাঁ, অশ্বত্থামা গিয়েই তাঁর গলা কেটে ফেলেননি, চরম আঘাতের আগে খানিক শাসানি দেওয়ার জন্য অশ্বত্থামা বললেন— আমার মাতুল সঠিক কারণেই অর্জুনের সার্থক গুণের কথা বলেছিলেন। তাতে তোর এত ক্ষতি কী হল, যাতে আমার মামাকে তুই এতগুলো খারাপ কথা বললি এবং তা বললি শুধু অর্জুনের সঙ্গে তুই কখনও পারিস না বলে— শূরং দ্বেষাৎ সুদুর্বুদ্ধে ত্বং ভর্ৎসয়সি মাতুলম্। এত তোর অহংকার যে, তুই কাউকেই গ্রাহ্য করিস না, তা আমি বলি— এই যে সেদিন জয়দ্রথ মারা গেলেন, সেদিন কোথায় ছিল তোর এই গর্ব, কোথায় ছিল এত ক্ষমতা, তোকে যুদ্ধে হারিয়ে দিয়ে তোর চোখের সামনেই তো অৰ্জুন মেরে রেখে গেল জয়দ্রথকে— গাণ্ডীবধন্বা হতবান্ প্রেক্ষতস্তে জয়দ্রথম্‌। আরে! যে-লোকটা আগে দেবদেব মহাদেবের সঙ্গে যুদ্ধ করেছে, সেই অর্জুনকে তুই সারথির পো! মনে মনেই এত দিন হারিয়ে চলেছিস যুদ্ধে। অর্জুন সামনে এলে তোর এই মুখ থেকে আর কথা বেরোবে না— তমিচ্ছসি বৃথা জেতুং সূতাধম মনোরথৈঃ।

এই তিরস্কারের পরেও মাতুল কৃপাচার্যের ওপর কর্ণের কটূক্তি স্মরণে রেখে অশ্বত্থামা এবার বেগে এগিয়ে চললেন কর্ণের দিকে এবং বললেন— এই দ্যাখ, কীভাবে তোর ধড় থেকে গলাটা নামিয়ে দিই, দ্যাখ এবার— এষ তেহদ্য শিরঃ কায়াদুদ্ধরামি সুদুর্মতে। এমন বেগবলোৎফুল্ল অশ্বত্থামাকে এবার কোনও মতে ধরে রাখলেন দুর্যোধন এবং অবশ্যই বৃদ্ধ কৃপাচার্য। কর্ণ বললেন— ওকে ছেড়ে দাও তো দুর্যোধন! দেখি ওর কত ক্ষমতা! ব্যাটা প্রচুর কপ্‌চাচ্ছে— কত বড় বীর সে, কত যুদ্ধ জিতেছে, একবার আমি একটু দেখে নিই— আসাদয়তু মদ্‌বীর্যং মুঞ্চেমং কুরুসত্তম। দুর্যোধন অশ্বত্থামাকে ছাড়েননি, কৃপাচার্যও নয়— নিজেদের মধ্যে এই মারামারি দু’জনেই চাননি। নিরুদ্ধ-বেগ, অবরুদ্ধ আবেগ, দুর্যোধন আর কৃপাচার্যের অর্গলাবদ্ধ বাহুডোরের মধ্যে অশ্বত্থামা নাচার হয়ে বলে উঠলেন— ঠিক আছে, আজকে আমরা তোকে ক্ষমা করে দিলাম সারথির পো! কিন্তু তোর এই তেজ আর বিষদাঁত ভেঙে দেবে ওই অর্জুন— দর্পম্‌ উৎসিক্তম্‌ এতত্তে ফাল্গুনো নাশয়িষ্যতি।

দুর্যোধন অশ্বত্থামাকে অনেক বুঝিয়ে তুষ্ট করার চেষ্টা করলেন। এমনও বললেন যে, অশ্বত্থামা! তুমি, কর্ণ, দ্রোণ, কৃপ, শল্য— এঁদের সবার ওপরে অনেক দায়িত্ব রয়েছে। এমন ঝগড়া, মারামারি করলে চলবে! এই দ্যাখো না, পাণ্ডবরা কর্ণের দিকেই এগিয়ে আসছে দলবল নিয়ে। আমাদের যুদ্ধে নামতে হবে এবার। দুর্যোধনের কথায় অশ্বত্থামা, কৃপ, কর্ণ সবাই যুদ্ধে নামলেন আবার। হয়তো দুর্যোধনের দিকে তাকিয়েই অশ্বত্থামা পূর্বাপমান মনে রাখেননি এবং যুদ্ধ করতে নেমেছেন দুর্যোধনের সঙ্গে পূর্ববদ্ধ বন্ধুত্বের টানে অথবা দুর্যোধনের অন্নদায় মেটানোর জন্য।

কিন্তু মহাভারতের মধ্যে অশ্বত্থামার সঙ্গে কর্ণের এই যে ঝগড়া, মনোমালিন্য, কথা-কাটাকাটি— যা বারবার ঘটছে এবং কোনওক্রমে দুর্যোধন সেটা মিটিয়ে রাখছেন— যুদ্ধোন্মুখ দুর্যোধনের ঘরের মধ্যে তাঁরই আশ্রিত-গোষ্ঠীর এই দ্বন্দ্ব মহাভারতে এতটাই বিখ্যাত হয়ে গিয়েছিল যে, পরবর্তী কালে সংস্কৃতের এক বিখ্যাত নাট্যকার ভট্টনারায়ণ তাঁর বেণী-সংহার নাটকের মধ্যে অশ্বত্থামা আর কর্ণের উক্তি-প্রত্যুক্তি আরও নাটকীয়ভাবে গ্রন্থনা করেছেন। মহাভারতের উৎস অবলম্বন করলেও নাট্যকারের নিজস্ব স্বাধীনতা থাকে ‘প্লট সাজানোর। এই স্বাধীনতার সুযোগ নিয়ে বেণী-সংহার যেভাবে অশ্বত্থামাকে দেখতে চেয়েছে, তাতে বোঝা যায় যে, আশ্রিত জনও যদি গুণ-কর্ম-জাতিতে প্রভাবশালী হন, তা হলে তারও ‘চাট’ কিছু কম হয় না। বিশেষত অশ্বত্থামা যে ক্রুদ্ধ হলে কতটা তাঁর মাথা গরম হয়, এই চারিত্র-বৃত্তি যে অশ্বত্থামার একান্ত একটা বৈশিষ্ট্য এটা প্রমাণ হয় বেণী-সংহারের কথোপকথনে। আমরা পরে আসছি সে-সব কথায়।

পাণ্ডবদের উদ্যত আগমন রুদ্ধ করার জন্য কর্ণ অনেক গর্বোক্তি করেই প্রস্থান করলেন। অশ্বত্থামা এবং কৃপাচার্যের যুগ্ম কশাঘাতেও তিনি গর্বোক্তি থামালেন না। এমনও বলে গেলেন যে, অর্জুনকে মেরেই আজ তিনি ফিরবেন এবং এই যুদ্ধে তিনি ছাড়া আর দ্বিতীয় কোনও ব্যক্তির প্রয়োজন নেই। অবস্থা দেখে বৃদ্ধ কৃপাচার্য হাসবেন না কাঁদবেন! তিনি কর্ণের এই নিষ্ফল গর্জনে বিশ্বাস করেন না। সবচেয়ে মুশকিল হয়ে গেছে, কর্ণের পিছন পিছন দুর্যোধনও যুদ্ধে যাবার জন্য প্রস্তুত হয়েছেন, এদিকে অর্জুনের হৃদয়ে তখনও অভিমন্যুর মৃত্যুশোক চিতার আগুনের মতো জ্বলছে। জয়দ্রথকে মেরেও তাঁর প্রতিশোধ-স্পৃহা স্তিমিত হয়ে যায়নি, এই অবস্থায় কর্ণ তাঁর সামনে পড়লে অনেক দুর্ঘটনাই ঘটতে পারে এবং তাতে অন্নদাতা দুর্যোধনের কাছে দায়টুকু পালিত হয় না— এই ভাবনা থেকেই কৃপ শারদ্বত অশ্বত্থামাকে বললেন— খুব তো রাগ দেখিয়ে কর্ণ চলে গেল যুদ্ধ করতে, পিঁপড়ের পাখা উঠেছে, আগুনে ঝাঁপ দিতে গেল। কিন্তু আমাদের চিন্তা কর্ণকে নিয়ে নয়, রাজা দুর্যোধন যাতে এই মুহূর্তে অর্জুনের কবলে না পড়েন, সে-ব্যাপারে তুমি একটু চেষ্টা নাও, ভাগনে! আমরা যেখানে বেঁচে রয়েছি, সেখানে স্বয়ং দুর্যোধন-রাজার এই অসহায় যুদ্ধযাত্রা আমাদের দেখা উচিত নয়— অযুক্তমিব পশ্যামি তিষ্ঠৎস্বস্মাসু মানদ।

কৃপ অশ্বত্থামাকে সম্বোধন করেছেন ‘মানদ’ বলে, অর্থাৎ উপযুক্ত স্থানে মান দিতে জানেন অশ্বত্থামা। কৃপাচার্যের কথায় অশ্বত্থামা উপস্থিত হলেন দুর্যোধনের কাছে। অশ্বত্থামা বললেন— আমি বেঁচে থাকতে তোমাকে যুদ্ধে যেতে হবে না দুর্যোধন! ময়ি জীবতি গান্ধারে ন যুদ্ধং গন্তুমর্হসি। তুমি এটা জানো কিনা জানি না— আমি কিন্তু সব সময় তোমার ভাল চাই। অর্জুন আসছে যুদ্ধে, তাতে ভয় পাবার কিছু নেই, আমি অবশ্যই তাকে আটকে দেব, তুমি নিশ্চিন্তে থাকো এখানে— অহমাবাররিষ্যামি পার্থং তিষ্ঠ সুযোধন। অশ্বত্থামার কথার মধ্যে আন্তরিকতার ছোঁয়া ছিল অবশ্যই, বিশেষত দুর্যোধনের পরম বন্ধু কর্ণকে যথেচ্ছ গালাগালি দেবার পর এবং তিনি একা অর্জুনের সঙ্গে লড়াই করতে যাবার পর অশ্বত্থামা একটু বিবেকের দংশনে ভুগছেন। হয়তো সেই কারণেও খানিকটা আন্তরিকতা ছোঁয়া লেগেছিল অশ্বত্থামার মনে।

দুর্যোধন অবশ্য এই আন্তরিকতা এবং অশ্বত্থামার চিত্তদৌর্বল্যের সম্পূর্ণ সুযোগ নিয়ে বললেন— আচার্য দ্রোণ সত্যি পাণ্ডবভাইদের সকলকে পুত্রবৎ দেখেন বলেই এখনও তাঁদের একজনকেও প্রাণে মারেননি। আর তোমার কথাও বলি ভাই, তুমিও এক ধরনের উদাসীনতায় তাঁদের ব্যাপারে উপেক্ষাই করে আসছ— ত্বমপ্যুপেক্ষাং কুরুষে তেষু নিত্যং দ্বিজোত্তম। এইটুকু পর্যন্ত দুর্যোধনের কথার মাত্রা বোঝা যায়, কিন্তু এর পরে বেশ খারাপ কথাই বলেছেন দুর্যোধন, কিন্তু ভাষার কৌশল এবং বহ্বারম্ভে সরল অশ্বত্থামা সে-কথা ধরতে পারেননি। দুর্যোধন বলেছেন— আচার্য দ্রোণের কথা তবু আমি বুঝি, কিন্তু আমার হিতৈষী তোমাকে আমি বুঝি না। তুমি কেন এদের ছেড়ে দিচ্ছ। আমার মন্দভাগ্য নাকি এটা, নইলে কেন তোমার পরাক্রম এমন শিথিল পাণ্ডবদের প্রতি? নাকি এইভাবে তুমি ধর্মরাজ যুধিষ্ঠিরের প্রিয়সাধন করার চেষ্টা করছ, অথবা কৃষ্ণা দ্রৌপদীর প্রিয়সাধন— আমি বুঝি না, সত্যিই বুঝতে পারি না ঠিক কী কাজ করছে তোমার মনে— ধর্মরাজ-প্রিয়ার্থং বা দ্রৌপদ্যা বা ন বিদ্ম তৎ।

আজন্ম ব্রহ্মচারী অশ্বত্থামা কোনও দিন কোনও স্ত্রীলোকের কটাক্ষে বা কারণে দুর্বল হয়েছেন বা সেই রমণীর কারণে কোনও কার্যে ব্রতী হয়েছেন, এ-কথা তাঁর অতি বড় শত্রু কর্ণও বলতে পারবেন না। অথচ দুর্যোধন-কর্ণের হাতে দ্রৌপদীর অপমান যে অশ্বত্থামা নীতিগতভাবে একেবারেই পছন্দ করেননি, সেই নৈতিক দুর্বলতাকেই যেন দুর্যোধন অশ্বত্থামার বিরুদ্ধে কাজে লাগালেন— তবে কি দ্রৌপদীর প্রিয়-কামনাতেই অশ্বত্থামা পাণ্ডবদের বিরুদ্ধে যুদ্ধজয়ে মনোযোগী নন তত। কথাটা যে সত্য প্রকাশ করার জন্য নয় অথবা তা নিতান্তই খোঁচা দেওয়া, যেটা দুর্যোধনের বাক্যভঙ্গি থেকেই বোঝা যায়— জানি না বাবা, কী ব্যাপার, যুধিষ্ঠিরের জন্য নাকি দ্রৌপদীর ভাল লাগার জন্য এমন উদাসীন তুমি— দ্রৌপদ্যা বা ন বিদ্ম তৎ। এই যে স্বয়ং ধর্মরাজ যুধিষ্ঠিরের সঙ্গেই এক বিতর্কমূল রমণীর প্রিয়সাধনের উচ্চারণ— তার মধ্যে দুর্যোধনের বচন-চাতুরী যতই থাকুক, অশ্বত্থামার মতো প্রেমহীন ‘ও-রস-বঞ্চিত’ যুবকের প্রতি এই উচ্চারণ দুর্যোধনের আপন কুটিল হৃদয় উদ্ঘাটিত করে।

অশ্বত্থামা এই আক্ষেপোক্তিতে ক্রুদ্ধ হননি, এতটাই অপ্রাসঙ্গিক এবং অপাত্রে স্খলিত হয়েছে এই দোষ দেওয়া যে, অশ্বত্থামা এতটুকুও তাতে বিচলিত হননি। সঙ্গে সঙ্গে দুর্যোধনও বুঝেছেন যে, এইসব কদর্থনা একবার উচ্চারণ করেই স্তবকুসুমাঞ্জলি রচনা করতে হয়। দুর্যোধন সাক্ষেপে বলেছেন— আমার জন্যই তোমাদের এত দুঃখ, কষ্ট, যন্ত্রণা। নইলে অশ্বত্থামা! শিবের সমান তোমার অস্ত্ৰক্ষমতা। আর সেই ক্ষমতা নিয়েও আমার সমস্ত শত্ৰু ক্ষয় না করে তুমি উদাসীন থাকো কী করে— শত্ৰুং ন ক্ষপয়েচ্ছক্তো যো ন স্যাদ্‌ গৌতমীসুতঃ। আমি এটা জানি, অশ্বত্থামা! আমি জানি যে, দেবতা, দানব, মানব কেউ তোমার সামনে দাঁড়াতে পারবে না, তাই বলছিলাম— আমার ওপর তুমি যদি খুশি হয়ে থাকো, তা হলে আমার অহিতকামী শত্রুদের তুমি শেষ করে দাও— অশ্বত্থামন্‌ প্রসীদস্ব নাশয়ৈতান্‌ সমাহিতান্‌। তুমি যদি এই পাঞ্চাল আর সোমকদের ঝাঁকটাকে শেষ করে দিতে পারো, তবে পরেরগুলোকে আমি বুঝে নেব। দুর্যোধন সুচতুরভাবে পাঞ্চাল এবং সোমকদের উল্লেখ করেছেন, কেন না সোমকদের অধস্তন পুরুষ হলেন দ্রুপদ এবং ধৃষ্টদ্যুম্ন, যাঁদের সঙ্গে দ্রোণাচার্যের পূর্বকালীন শত্রুতা ছিল। পিতার কারণে তাঁরা আশ্বত্থামারও আজন্ম-চিহ্নিত শত্রু। ফলত দুর্যোধন এখন আর পাণ্ডবদের বধ করার কথা বলছেন না। বলছেন— দ্যাখো না, পাঞ্চাল-সোমকরা আমার সৈন্যদের মধ্যে কেমন দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। অথচ বিধাতা তোমাকে সৃষ্টিই করেছেন পাঞ্চালদের শেষ করার জন্য— ত্বমুৎপন্নো, মহাবাহো পাঞ্চালানাং বধং প্রতি। অতএব তোমার আজকের কাজ হল এই পৃথিবীটাকে পাঞ্চালহীন কোনও স্বর্গে পরিণত করা। আর তাতেই পাণ্ডবরা ঠান্ডা হয়ে যাবে। তুমি সেই চেষ্টাটাই করো, তাতেই আমাকে সম্মান দেখানো হবে যথেষ্ট— নিগ্রহে পাণ্ডুপুত্ৰাণাং পাঞ্চালনাঞ্চ মানদ।

কর্ণের কথায় আহত হয়েই হোক অথবা দুর্যোধনের স্তুতিগুণেই হোক অথবা দুয়েরই বিপরীত এবং পরোক্ষ প্রতিক্রিয়ায়— অশ্বত্থামা কিন্তু অনেক যুদ্ধ করলেন দুর্যোধনের জন্য। পাঞ্চাল-কুমার পাণ্ডব-সেনাপতি ধৃষ্টদ্যুম্ন হেরেও গেলেন অশ্বত্থামার কাছে। পাঞ্চাল-সৈন্যরাও হত এবং আহত হল প্রচুর। ভীমপুত্ৰ ঘটোৎকচের হাতে অবশ্য খানিক মার খেলেন অশ্বত্থামা, কিন্তু এক সময়ে সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়ে গেলেও আবারও তিনি ফিরে এসেছেন যুদ্ধে। ঘটোৎকচ অবশ্য শেষপর্যন্ত মারা গেলেন কিন্তু অশ্বত্থামার পক্ষেও শেষ সংবাদটা শুভ হল না। সেই ভয়ংকর মৃত্যুর খবর তাঁর কানে এসে পৌঁছল। পিতা দ্রোণাচার্য মারা গেছেন। অস্ত্রত্যাগী অবস্থায় পাঞ্চাল ধৃষ্টদ্যুম্ন দ্রোণের মাথা কেটে ফেলেছেন— এই নৃশংস হত্যার খবর প্রথমেই অশ্বত্থামাকে কেউ দিতে পারেনি। সেনা-প্রধান রাজারা, কৌরবপক্ষের মুখ্য যোদ্ধারা একে একে ছত্রভঙ্গ হয়ে গেছেন। দ্রোণাচার্যের মতো সেনাপতির মৃত্যু আসলে সূর্যপতনের মতো অবাস্তব লাগে, সমুদ্র-শোষিত হবার মতো কাল্পনিক লাগে— ভাস্করস্যেব পতনং সমুদ্রস্যেব শোষণম্‌— আর সেই জন্যই এ-ঘটনায় ত্রস্ত-বিমূঢ় কর্ণ, শল্য, কৃতবর্মা, দুঃশাসন সকলেই যুদ্ধ ত্যাগ করে চলে এসেছেন। কৃপাচার্য এই খবর শুনে শুধু হায়-হায় করে যাচ্ছেন।

অশ্বত্থামা তখন অনেক দূরে। সৈন্যদের কাছে ততক্ষণে কথায় কথায় খবর চলে এসেছে। তারা একে-অপরকে খবর জানিয়ে যুদ্ধের বর্ম-কবচ খুলে দ্রুত ফিরতে লাগল স্রোতোধারার মতো। অদ্ভুত লাগে এই সময় অশ্বত্থামার মানসিকতা দেখে, তাঁর একাগ্রতা দেখেও। সমস্ত সৈন্য ছত্রভঙ্গ হয়ে গেছে, ত্রস্তভাবে পলায়ন করছে, এই দৃশ্য দেখেও অশ্বত্থামা তাদের ভিতর দিয়ে একা ছুটে যাচ্ছেন শত্ৰুসংহার করার জন্য। মহাভারতের কবি অসাধারণ উপমা দিয়ে বলেছেন— বলবান একটি কুমির যেমন স্রোতের উলটো দিকে চলতে থাকে কিছু গ্রাহ্য না করে, অশ্বত্থামাও তেমনই প্রতিস্রোতে ধাবমান সৈন্যদের মাঝখান দিয়ে একা দৌড়চ্ছেন শত্ৰুসংহার করার জন্য— প্রতিস্রোত ইব গ্রাহঃ দ্রোণপুত্র পরানিয়াৎ। অশ্বত্থামা যুদ্ধ করেই চলছিলেন, কিন্তু সৈন্য-সামন্তের এমন অদ্ভুত পলায়ন দেখে তিনি শেষপর্যন্ত দুর্যোধনের কাছে উপস্থিত হয়ে বললেন— কী ঘটেছে ব্যাপারটা? সমস্ত সৈন্য-সামন্ত ভয়ে যেন উলটো দিকে দৌড়চ্ছে এবং এরা যে সব পালাচ্ছে তাঁদের তুমি আটকানোরও চেষ্টা করছ না, স্থির রাখারও চেষ্টা করছ না— কিমিয়ং দ্রবতে সেনা ত্রস্তরূপেব ভারত। অদ্ভুত লাগছে আমার এই সব ব্যবহার। তুমি কেমন যেন তোমার স্বভাবে প্রতিষ্ঠিত নেই আজ, শুধু তুমি কেন, কর্ণ, শল্য কিংবা অন্যান্য যোদ্ধারা কেউই আজ আপন স্বাভাবিক আচরণ করছে না। কী হয়েছে, কোন অসাধারণ মানুষটি আজ মৃত্যুর কবলে পড়েছেন যার জন্য আজ সকলের এই অবস্থা— এতামবস্থাং সম্প্রাপ্তং তন্মামাচক্ষ্ব কৌরব।

দুর্যোধন সত্য কথা বলতে পারলেন না। দ্রোণের মৃত্যু-সংবাদে তিনি শোকাচ্ছন্ন, তাঁর চোখে জল আসছে মাঝেমাঝেই। তিনি কৃপাচার্যকে বললেন এই ভয়ংকর সংবাদ অশ্বত্থামাকে শোনানোর জন্য। কৃপাচার্য এক ঝটকায় সংবাদটা দিতে পারলেন না। তিনি স্তিমিত আর্ত মুখে অশ্বত্থামার কাছে ভণিতা আরম্ভ করলেন— আমরা দ্রোণকে সামনে রেখে পাঞ্চালদের সঙ্গে যুদ্ধ আরম্ভ করেছিলাম— প্রাবর্তয়াম সংগ্রামং পাঞ্চালৈরেব কেবলম্‌। তারপর যুদ্ধ ভাল করে লাগলে কৌরব-পাঞ্চাল-সোমকেরা মারামারি করতে করতে যেন একাকার হয়ে গেল। তোমার পিতা দ্রোণাচার্যকে তখন দেখলাম— তিনি ব্রহ্মাস্ত্র প্রয়োগ করে প্রচুর শত্রুসৈন্য বধ করে যাচ্ছেন। পাণ্ডবরা, পাঞ্চালেরা কেউ তাঁর সামনে দাঁড়াতে পারছে না। ওদের সৈন্য মরছে কাতারে কাতারে। এই ভয়ংকর অবস্থা দেখে মধুসূদন কৃষ্ণ পাণ্ডবদের বুদ্ধি দিয়ে বললেন— দ্যাখো বাপু! ধর্ম রক্ষা করে আমরা কিন্তু দ্রোণাচার্যকে কিছুতেই পরাজিত করতে পারব না। আর পরাজয় করা দূর অস্ত আমরা নিজেরা যদি দ্রোণের হাত থেকে বাঁচতে চাই, তা হলে একটু মিথ্যাচরণ আমাদের করতেই হবে।

কৃপাচার্য দ্রোণাচার্যের যুদ্ধবিক্রমের কথা শোনাচ্ছেন অশ্বত্থামাকে। এখনও পর্যন্ত তাঁর তেমন বিরুদ্ধ প্রতিক্রিয়া দেখানোর সময় আসেনি। কৃপাচার্য কৃষ্ণের উক্তি উদ্ধার করে অশ্বত্থামাকে বললেন— কৃষ্ণ পাণ্ডবদের বুদ্ধি দিলেন— বৃদ্ধ দ্রোণাচার্য যদি কোনও ক্রমে একবার শোনেন যে, তাঁর পুত্রটি মারা গেছে, তা হলে সঙ্গে সঙ্গে তিনি অস্ত্রত্যাগ করবেন— অশ্বত্থাম্নি হতে নৈষ যুধ্যেদিতি মতি মর্ম। অতএব কাউকে দিয়ে দ্রোণাচার্যের কানে এই মিথ্যেটুকু প্রবেশ করিয়ে দিতে হবে যে, অশ্বত্থামা মারা গেছে। কৃষ্ণের এই প্রস্তাব পাণ্ডবপক্ষের কে কীভাবে নিলেন, কৃপাচার্য সেটাও অশ্বত্থামাকে জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন— অর্জুন কিছুতেই এই প্রস্তাব মেনে নিতে পারেননি, আর যুধিষ্ঠির কোনও মতে এটা মেনে নিতে বাধ্য হলেন উপস্থিত বিপন্নতা কাটিয়ে ওঠার জন্য। কৃপাচার্য বললেন— কথাটা অবশ্য তোমার পিতার কানে প্রথম উচ্চারণ করেন ভীম, কিন্তু দ্রোণ সে কথা বিশ্বাস না করে ধর্মরাজ যুধিষ্ঠিরকে জিজ্ঞাসা করেন এবং তিনি অতি-লজ্জায়, অতীব সংকোচে অশ্বত্থামা-নামের একটি হাতির মরণ-সংবাদ দিয়ে তোমার নামটা জোরে উচ্চারণ করলেন যুধিষ্ঠির। শুধু তাই নয়, তিনি এমন কথাও বলেছেন— যে ছেলের জন্য আপনি অস্ত্র ধারণ করেন, যে ছেলের দিকে তাকিয়ে আপনি বেঁচে থাকার কথা ভাবেন, সেই প্রিয় পুত্র আপনার, অশ্বত্থামা মারা গেছেন— পুত্ৰস্তে দয়িতো নিত্যং সোহশ্বত্থামা নিপাতিতঃ।

যুধিষ্ঠির জানতেন, এমনকী কৃপাচার্য এবং অন্যান্যরাও এ-খবর শুনেছেন যে, এই কথা বলার সময় ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির স্বস্তি বোধ করেননি। অথচ অন্যায় হচ্ছে জেনেও তিনি পুত্রের মৃত্যু সংবাদ দিয়ে মিথ্যাবাচন থেকে বাঁচার জন্য অশ্বত্থামা নামে এক হাতির মারা যাবার খবর বললেন মনে মনে। কিন্তু তোমার পিতা তোমার শোকে আকুল হয়ে সমস্ত দিব্য অস্ত্র সংযত করলেন এবং যুদ্ধ বন্ধ করে দিলেন। জীবনে আর তাঁর বাঁচার ইচ্ছে ছিল না এবং সেই জন্যই তিনি প্রায় আত্মসমাহিত ছিলেন সেই সময়ে। ঠিক এই অবস্থায় পাঞ্চালরাজ দ্রুপদের পুত্র ধৃষ্টদ্যুম্ন মুক্ত তরবারি হাতে এগিয়ে গেলেন দ্রোণের দিকে। ত্রাসে, লজ্জায়, আকস্মিকতায় অর্জুন রথ থেকে নেমে ধৃষ্টদ্যুম্নের দিকে দৌড়ে যাচ্ছিলেন তাকে বারণ করতে, পাণ্ডব-কৌরবদের সকলে হায়-হায় করছে, বলছেন— ন হন্তব্যঃ ন হন্তব্যঃ— মেরো না ধৃষ্টদ্যুম্ন! ন্যস্তশস্ত্র সমাহিত দ্রোণকে মেরো না— তবু ধৃষ্টদ্যুম্ন কারো কথা না শুনে বাঁ-হাতে দ্রোণের পক্ক কেশ ধরে তাঁর মাথা কেটে ফেললেন— হত এব নৃশংসেন পিতা তব নরর্ষভ।

পিতার এই নৃশংস মৃত্যুর কথা শুনে অশ্বত্থামার ক্রোধ চরমে উঠল। তিনি পা দিয়ে ভূমিতে আঘাত করতে লাগলেন, এক হাতে আর এক হাত দিয়ে মুচড়ে দিতে লাগলেন, দাঁতে দাঁত লাগিয়ে ঘষতে আরম্ভ করলেন— ইন্ধনে যেমন আগুন জ্বলে তেমনই ধৃষ্টদ্যুম্নের কথা ভেবে তাঁর ক্রোধাগ্নি উদ্দীপিত করলেন অশ্বত্থামা। অশ্বত্থামার রাগ কতটা হয়েছিল, কেমন হয়েছিল সে-ব্যাপারে মহাভারতীয় বর্ণনা আছে প্রায় এক অধ্যায় জুড়ে। নিষ্কর্ষে যা বুঝতে পারি, তাতে অশ্বত্থামার সমস্ত রাগ গিয়ে পড়ল ধৃষ্টদ্যুম্ন এবং পাঞ্চালদের ওপর। ধর্মরাজ যুধিষ্ঠিরের ওপরেও তিনি কম ক্রুদ্ধ হলেন না, তবে ক্রোধের চেয়ে সেখানে ক্ষোভ অনেক বেশি ছিল। যুধিষ্ঠিরকে তিনি ধর্মরাজ বলতে পারছেন না, বলছেন— ধর্মের ধ্বজাধারীরা যে অন্যায় করে যুধিষ্ঠির তাই করেছেন,— ধর্মধ্বজবতা পাপং কৃতং তদ বিদিতং মম— বড় অনার্যোচিত, বড় নৃশংস কাজটি তিনি করেছেন। যুদ্ধে জয় এবং পরাজয় দুইই আছে, এমনকী হত্যা কিংবা মৃত্যুও আছে, কিন্তু সেই হত্যার মধ্যেও তো একটা নীতি থাকবে! এই মিথ্যাবাদী পাণ্ডব যুধিষ্ঠিরকে এবার দেখব কে রক্ষা করে? মিথ্যে বলে যে আমার পিতাকে অস্ত্র ফেলে দিতে বাধ্য করেছে, এবার সেই যুধিষ্ঠিরের রক্ত খাবে এই মেদিনী— তস্যাদ্য ধর্মরাজস্য ভূমিঃ পাস্যতি শোণিতম্‌।

যুধিষ্ঠিরের ওপর যতই রাগ করুন অশ্বত্থামা, তবু তিনি জানেন যে, এই সব ছল-চাতুরি, ছদ্ম, আচরণ যুদ্ধক্ষেত্রে চলে। কিন্তু তিনি সবচেয়ে ক্রুদ্ধ হচ্ছেন হত্যার ‘অ্যাটিটুড’ দেখে। পক্ককেশ বৃদ্ধ দ্রোণাচার্যকে পাঞ্চাল ধৃষ্টদ্যুম্ন চুলের মুঠি ধরে গলা কেটেছেন— এখানে বীরের ধর্মে গলা কাটা গেলেও দুঃখিত হতেন না অশ্বত্থামা, কিন্তু সর্বজনমান্য অস্ত্রত্যাগী আচার্য-পুরুষকে সাধারণ সৈন্যদের সামনে এইভাবে চুলের মুঠি ধরে গলা কেটে ফেলা— এই অপমান অশ্বত্থামা সহ্য করতে পারছেন না— পশ্যতাং সর্বসৈন্যানাং… কেশগ্রহণমাপ্তবান্‌। অশ্বত্থামা বারবার নিঃশেষে পাঞ্চালদের মেরে ফেলার প্রতিজ্ঞা করতে লাগলেন। বারবার এই বলে দুঃখ করতে লাগলেন যে, তাঁর মতো উপযুক্ত একটা ছেলে থাকতে আচার্য দ্রোণের এই অবস্থা হওয়াটা, এমন অপমানিত মৃত্যু বরণ করাটা ছেলে হিসেবে তাঁরই অমর্যাদা, তাঁরই অক্ষমতা— যৎ স্ম দ্রোণঃ সুতং প্রাপ্য কেশগ্রহণমাপ্তবান্‌। অশ্বত্থামা বলেছেন— এমন বিপন্ন সময়ের জন্যই তো মানুষ পুত্র চায়, আমার মতো একটা পাহাড়প্রমাণ দামড়া ছেলে থাকতে, এমনকী আমি তাঁর অস্ত্রশিষ্যও বটে, সে-দিক দিয়েও আমিও তাঁর বিদ্যাবংশের উত্তরাধিকারী, সেই আমি বেঁচে থাকতে— মম শৈলপ্রতীকাশে পুত্রে শিষ্যে চ জীবতি— আমার মতো একটা ছেলে থাকতে আমার বাবার চুলের মুঠি ধরে মারল ওই নরাধম ধৃষ্টদ্যুম্ন। আমি ছাড়ব না, ওই ধৃষ্টদ্যুম্নের আমি শেষ দেখে ছাড়ব, শেষ করে ছাড়ব ওই পাঞ্চালদের গুষ্টি— পাঞ্চালানাং বধং কৃত্বা শান্তিং লব্ধাস্মি কৌরব!

অশ্বত্থামা প্রথমে ধিক্কার দিচ্ছিলেন নিজেকে, নিজের অস্ত্রশিক্ষাকে, এমনকী অস্ত্রগুলিকেও, কেন না সময়মতো সেগুলো তিনি কাজে লাগাতে পারেননি। কিন্তু এই ধিক্কার এই আত্মাবমাননা এক সময় চরম স্বাভিমানে পরিণত হল, পিতার মৃত্যু-সময়ে তাঁর অক্রিয়াকারিতা এই মুহূর্তে তাঁর মধ্যে চরম ক্রোধ এবং অহংকার তৈরি করল। তিনি বললেন— ভদ্রলোকের কাজ নয় এটা যে, সে নিজের ক্ষমতা নিজেই বড়াই করে বলে, কিন্তু পিতার এই সাপমান মৃত্যুর কথা মনে ক্ষোভ সৃষ্টি করছে বলেই আজ বলছি— আজকে আমি কৃষ্ণ সহ পাণ্ডবদের দেখিয়ে দেব যুদ্ধক্ষেত্রে আজ আমি কীভাবে সৈন্য ক্ষয় করি— অদ্য পশ্যন্তু মে বীর্য্যং পাণ্ডবাঃ সজনার্দনাঃ। দেব-দানব-মানব-রাক্ষস কারও সাধ্য নেই আজ আমাকে বাধা দেয়। আমি জানি, কৌরব-পাণ্ডব কোনও পক্ষেই একমাত্র অর্জুন ছাড়া আর কোনও ধনুর্ধর বীর নেই যে আমার মতো অস্ত্রকৌশল জানে— মদন্যো নাস্তি লোকেহস্মিন্ অর্জুনাদ্‌ বাস্ত্রবিৎ ক্কচিৎ— কিন্তু আজকে যে অস্ত্র নিয়ে আমি ধ্বংসযজ্ঞে নামব, সে অস্ত্র ঠেকানো অর্জুনেরও কাজ নয়, এমনকী কৃষ্ণও সেখানে কিচ্ছু করতে পারবেন না— ন হি জানাতি বীভৎসুস্তদস্ত্রং ন জনার্দনঃ।

অশ্বত্থামা ‘নারায়ণ’ নামে এক ভয়ংকর অস্ত্রের কথা বলছেন, যে নারায়ণাস্ত্র তাঁর পিতা পেয়েছিলেন নারায়ণের উপাসনা করে। সেই নারায়ণাস্ত্র এখন অশ্বত্থামার হাতে। তিনি সেই অস্ত্র দিয়ে শত্রুপক্ষের সার্বিক বিপর্যয় ঘটিয়ে ছাড়বেন, এমনই প্রতিজ্ঞা তিনি সকলের সামনে করলেন এবং তাঁর এই মারণ-অভিযানে পাণ্ডব-পাঞ্চালরা কেউ যে তাঁকে কিচ্ছু করতে পারবে না, সেই প্রত্যয়টাও তিনি বুঝিয়ে দিলেন দুর্যোধনকে। এই প্রত্যয় এবং প্রতিজ্ঞা কতটা কঠিন এবং সাড়ম্বর ছিল তা সবচেয়ে ভাল ধরা পড়েছে ভট্টনারায়ণের বেণী-সংহার নাটকে। সেখানে একটি চতুষ্পদী শ্লোকের অন্তত তিনটি চরণের আরম্ভে বারবার ‘যো যঃ’ অর্থাৎ যে-যে আমার সঙ্গে, আমার পিতার সঙ্গে এই-এই ব্যবহার করেছে— এই পুনরুক্ত শব্দগুলির এমন বীররসের সঞ্চার হয়েছে যে, সংস্কৃত সাহিত্যের আলংকারিকেরা পর্যন্ত অশ্বত্থামার এই ক্রোধোক্তিটি বীররসের অন্যতম প্রকৃষ্ট উদাহরণ হিসেবে গ্রহণ করেছেন।

বেণী-সংহারে অশ্বত্থামা বলছেন— পাণ্ডব-সেনাদের মধ্যে যে-যে লোক অস্ত্রের গুরুত্বে নিজেদের বাহু-দুটিকে সাহংকারে স্ফীত বলে মনে করছে, আর ওই পাঞ্চালদের মধ্যে জোয়ান, খোকা এমনকী এখনও যারা মায়ের গর্ভে শুয়ে আছে, সেইরকম একজনও আমার হাত থেকে রেহাই পাবে না— যো যঃ পাঞ্চালগোত্রে শিশুরধিকবয়া গর্ভশয্যাং গতো বা। বিশেষত যারা তাঁর পিতার ওপর নৃশংস মরণাঘাতের সাক্ষী হয়ে আছেন, তাঁরা যে কেউই অশ্বত্থামার কবল থেকে বেঁচে ফিরবেন না, তাঁদের সকলের সামনে যে কালান্তক যমের নৃত্য শুরু হবে এবং সে-যম যে অশ্বত্থামাই— সেটাই ছিল অশ্বত্থামার সার্বিক সতর্কীকরণ।

মহাভারতে অশ্বত্থামার ক্রোধের যে বিচ্ছুরণ ঘটেছে, তাতে সঙ্গে-সঙ্গে কৌরবপক্ষের ত্রস্ত-বিমুখ সেনাবাহিনী আবার নতুন উদ্যমে রে-রে করে এগিয়ে চলল পাণ্ডব-পাঞ্চালদের দিকে— তচ্ছ্রুত্বা দ্রোণপুত্রস্য পর্য্যবৰ্তত বাহিনী। এই যে বিরাট ভয়ংকর এক যুদ্ধের সূচনা হল অশ্বত্থামার সর্বধ্বংসী কল্পনায় তার একটা বর্ণনা আছে মহাভারতে। এই বর্ণনার মধ্যে অবধারিতভাবে সেই ‘মহাকাব্যিক প্যাটার্ন’ আছে, যা শুনলে একটা সামগ্রিক বিনাশের চিত্র ভেসে আসে— সেনাবাহিনীর পদভরে মেদিনী কম্পিত হচ্ছে, পাহাড় বিদীর্ণ হচ্ছে— এই সব চিরাচরিত বর্ণনার পাশাপাশি অশ্বত্থামার ক্রোধান্ধ রূপের বর্ণনা যুক্ত হবার ফলে যেটা দাঁড়াল, সেটা হল— পাণ্ডবপক্ষে সকলের মধ্যে একটা ত্রাসের আবহ তৈরি হয়ে গেল। নৃশংসভাবে ধৃষ্টদ্যুম্ন যেভাবে দ্রোণকে মেরেছিলেন, তাতে তাঁকে প্রথমত সুরক্ষা দেবার প্রশ্ন উঠল। অবশ্যই সেখানে অর্জুনের ডাক পড়ল এবং অর্জুন সেখানে যুধিষ্ঠির এবং ধৃষ্টদ্যুম্ন কাউকেই তেমন রেয়াত করলেন না। যুধিষ্ঠিরের মিথ্যা উচ্চারণ এবং ধৃষ্টদ্যুম্নের নৃশংসতা— এই দুটোই অর্জুনের চোখে এই মুহূর্তে এত ঘৃণ্য হয়ে উঠেছে যে, শত্রুপক্ষের এই সরোষ প্রত্যাবর্তন এবং অশ্বত্থামার প্রতিহিংসাবৃত্তি তাঁর কাছে সঠিক বলে মনে হচ্ছে। এমনকী অশ্বত্থামার হাত থেকে কীভাবে ধৃষ্টদ্যুম্ন বাঁচেন এবার, সে-ব্যাপারে যুধিষ্ঠিরকেই ভয় দেখাচ্ছেন অর্জুন— রক্ষত্বিদানীং সামাত্যো যদি শক্তোহসি পার্ষতম্‌।

এই সময়ে পাণ্ডবদের নিজেদের মধ্যে বেশ বড় একটা ঝগড়াই হয়ে গেছে। এই অন্তঃকলহে স্বয়ং ভীম ধৃষ্টদ্যুম্নের সমর্থক এবং যুধিষ্ঠিরের মিথ্যাশ্রয়ে তিনি কোনও দোষ দেখতে পাচ্ছেন না। এমনকী যুধিষ্ঠির বহুক্ষণ অর্জুনের মুখে উলটো-সিধে কথা শুনে সংক্ষেপে এবং সক্ষোভে কিছু কথা বলেছেন যা থেকে পিতা-পুত্র দ্রোণ-অশ্বত্থামার সম্বন্ধে স্বভাবত নিস্তরঙ্গ যুধিষ্ঠিরের মনোভাবটুকু বোঝা যায় এবং বোঝা যায় পিতা-পুত্রের চরিত্রও। যুধিষ্ঠির বলেছেন— এত কথা শোনার পর পাঞ্চালদের প্রতি আমার পরামর্শ— তোমরা সবাই মিলে পলায়ন করো, বৃষ্ণি-অন্ধকদের নিয়ে চলে যান কৃষ্ণ। আর আমি ভাইদের নিয়ে আগুনে ঝাঁপ দিই। আমার বড় ঘাট হয়েছে, আমি নাকি মিথ্যে কথা বলে গুরুর প্রাণ নিয়েছি। তা কোথায় ছিল এই ন্যায়বোধ যেদিন গুরু দ্রোণ যুদ্ধে অপটু অভিমন্যুকে যুদ্ধনিপুণ হিংস্র সপ্তরথীকে দিয়ে বধ করিয়েছিলেন। আমাদের কল্যাণবৃত্তি আচার্য সেই বালকটিকে রক্ষা করেননি কিন্তু— যেন বালঃ স সৌভদ্রো… ঘাতিতা নাভিপালিতঃ। তারপর যেদিন সেই দ্রৌপদী দ্যূত সভায় এসে নিজের দাসীত্ব নিবারণের জন্য প্রশ্ন করেছিল, সেদিন কিন্তু আচার্য-পিতা দ্রোণ এবং তাঁর ছেলে অশ্বত্থামা দু’জনই তাঁকে এড়িয়ে গেছেন, তাঁকে বাঁচানোর কোনও চেষ্টা তিনি করেননি— উপেক্ষিতা সপুত্রেণ দাসীভাবং নিযচ্ছতী। অভিমন্যুবধের মূল কারণ জয়দ্রথকে কীভাবে দ্রোণ বাঁচিয়েছেন, সে-কথা ছেড়েই দিলাম, কিন্তু ব্রহ্মাস্ত্র প্রয়োগ করে পাঞ্চালদের কীভাবে তিনি বিনাশ করেছেন, সে-কথা কে বলবে! আর যেদিন আমরা কৌরবদের অন্যায়ে বনবাসের পথে বেরিয়েছিলাম, সেদিন দ্রোণ একবার বারণমাত্র করেছিলেন, কিন্তু তিনি আমাদের সঙ্গে আসেননি, অথচ আমরা চেয়েছিলাম যে, তিনি আমাদের সঙ্গে চলুন। অতএব দ্রোণ অনেক সৌহার্দ্য দেখিয়েছেন আমাদের ওপর, আর আমি যা করেছি তাতে মরাই উচিত আমার।

আমরা বলব, দ্রোণের ব্যাপারে যুধিষ্ঠিরের যে ভাবনা, তা যেমন অশ্বত্থামার ব্যাপারেও খাটে, তেমনই দ্রোণের ব্যাপারে অর্জুনের যে অনুযোগ-অভিমান, সেই অনুযোগও কিন্তু অশ্বত্থামার ব্যাপারেও খাটে। অর্জুনের ব্যক্তিগত মনোভাব যাই থাকুক, অশ্বত্থামার ব্যাপারে অন্যান্য পাণ্ডব-ভাইদের ধারণা মোটেই ভাল নয়। এবং শেষপর্যন্ত সেই অশ্বত্থামা সকলকে সমূলে ধ্বংস করার প্রতিজ্ঞা নিয়ে এসেছেন।

শেষপর্যন্ত অশ্বত্থামা এসে গেছেন তাঁর কালান্তক যুদ্ধে, পাণ্ডবসেনাদের মধ্যে হাহাকার তৈরি হয়ে গেল। সময় বুঝে অশ্বত্থামা সেই নারায়ণাস্ত্ৰ সন্ধান করলেন। কৃষ্ণের বুদ্ধিতে পাণ্ডব-সৈন্যরা সেই মুহূর্তে অস্ত্র ত্যাগ করেছিলেন সকলে, ভীম-অর্জুন সকলে রথ থেকে নেমে পড়েছিলেন ভূতলে। এই বিনম্র প্রণিপাতের ফলেই অশ্বত্থামার নারায়ণাস্ত্র বিফল হয়ে গেল। অশ্বত্থামার অস্ত্র শান্ত হয়ে যাবার সঙ্গে সঙ্গেই একদিকে যেমন পাণ্ডব-পাঞ্চালেরা পুনরায় অশ্ব-রথে ফিরে এলেন, তেমনই বিফলরোষ সর্পের মতো দুর্যোধনের জিঘাংসার রূপটাও ফিরে এল। তিনি সঙ্গে সঙ্গে অশ্বত্থামাকে বললেন— কী হল এটা? তুমি তোমার ধনুকে আবার যোগ করো ওই অস্ত্র, ওই নারায়ণাস্ত্র— অশ্বত্থামন্‌ পুনঃ শীঘ্রমস্ত্রমেতৎ প্রয়োজয়। অশ্বত্থামা বিমূঢ় মানুষের মতো হতচকিত স্বরে বললেন— আর হবে না, দুর্যোধন! আর হবে না। এই নারায়ণাস্ত্র আর ফিরে আসবে না আমার তূণে, আর এই অস্ত্র ব্যবহারও করা যায় না দ্বিতীয়বার— নৈতদাবর্ততে রাজন্ অস্ত্রং দ্বির্নোপদদ্যতে। কৃষ্ণ এই অস্ত্রের প্রতিঘাত জানতেন বলেই বিফল হয়ে গেল আমার নারায়ণাস্ত্র। দুর্যোধন বললেন ঠিক আছে, ঠিক আছে! যদি ওই অস্ত্র আর না প্রয়োগ করা যায়, তা হলে আরও যে-সব বড় বড় ভয়ংকর অস্ত্র আছে তোমার, সেইগুলো চালাও ওই পাঞ্চাল-পাণ্ডবদের ওপর। তুমি তো অনেক কিছু জানো।

পুরাতন ক্রোধ আবার ফিরে এল অশ্বত্থামার হৃদয়ে। তিনি ভীষণ যুদ্ধ আরম্ভ করলেন। পাণ্ডবপক্ষে ক্ষয়-ক্ষতি হল অনেক। বড় বড় বীরেরা রণে ভঙ্গ দিলেন। এই অবস্থায় আমরা অর্জুনকে কৃষ্ণ-সারথি-সহ উপস্থিত হতে দেখছি। অর্জুন একটু আগে যে-ভাবে অশ্বত্থামার ব্যাপারে সামান্য অনুকূল কথা বলছিলেন, এখন তার বিপরীতে ঘুরে গিয়ে অশ্বত্থামাকে প্রায় চ্যালেঞ্জ জানিয়ে বললেন— অশ্বত্থামা! তোমার যত শক্তি আছে, ধনুক-বাণে যত তোমার জ্ঞান; তোমার পৌরুষ, তোমার মনের বল যা আছে, সব তুমি আমার ওপর প্রয়োগ করো। তা ছাড়া যদি মানসিক প্রবৃত্তির কথা বলো, ধরো যদি দুর্যোধন এবং তার ভাই-বন্ধুদের ওপর তোমার বেশি ভালবাসা থাকে এবং আমাদের ওপর তোমার গভীর বিদ্বেষ থাকে, সেটা প্রকাশ করার জন্যও যে তেজ তুমি দেখাতে চাও, সেটা আমার ওপর দেখাও— যচ্চ ভূয়োহস্তি তে তেজঃ তৎসর্বং ময়ি দর্শয়। ঘটনা যাই ঘটে থাকুক, দ্রোণহন্তা ধৃষ্টদ্যুম্নই তোমার অহংকার চুর্ণ করবে। সেই ধৃষ্টদ্যুম্ন আছে এবং কৃষ্ণের সঙ্গে আমিও এসে গেছি, তোমার যত গর্ব সব আজ ধুলোয় মিশিয়ে দেব— দর্পং নাশয়িতাস্ম্যদ্য তবোদ্‌বৃত্তস্য সংযুগে।

অর্জুনের মুখে অশ্বত্থামার প্রতি এই আক্ষেপ সত্যি খুব আশ্চর্য ছিল। ধৃতরাষ্ট্র পর্যন্ত অবাক হয়ে সর্বদর্শী সঞ্জয়কে জিজ্ঞাসা করেছেন— হলটা কী সঞ্জয়? অশ্বত্থামা অর্জুনের গুরুপুত্র, অশ্বত্থামা যথেষ্ট বলবান, তবুও অর্জুন তাঁকে খারাপ কিছু বললেন, এটা তবু মানতে পারি। কিন্তু অর্জুনের ওপর অশ্বত্থামার যথেষ্ট প্রীতি আছে এবং অর্জুনও অশ্বত্থামাকে যথেষ্ট ভালবাসেন— প্রীতির্ধনঞ্জয়ে চাস্য প্রিয়শ্চাপি মহাত্মনঃ। এমনকী অর্জুন এর আগে কোনওদিন অশ্বত্থামার সম্বন্ধে এমন রুক্ষ কথা কখনও বলেনি। তা হলে আজকে হঠাৎ কী হল যে, সখা-সমান অশ্বত্থামাকে এমন কটুভাবে অর্জুন বলছেন— অথ কস্মাৎ স কৌন্তেয়ঃ সখায়ং রুক্ষমুক্তবান্।

ধৃতরাষ্ট্রের এই প্রশ্ন খুব স্বাভাবিক। এই একটু আগেই অশ্বত্থামা রণক্ষেত্রে এলে যুধিষ্ঠিরের কাছে অর্জুন তাঁর সপ্রশংস বিবরণ দিচ্ছিলেন। তাঁর শক্তি-ক্ষমতা, প্রভাব এমনকী তাঁর নামকরণের সার্থকতা নিয়েও অর্জুন তাঁর সপক্ষেই কথা বলেছেন যেন। অর্জুন বলেছিলেন— হ্যাঁ, মত্তহস্তীর মতো নিশ্চিন্ততায় যিনি হাঁটেন, উগ্রকর্মা, নৃশংসভাবে হত্যা করতে পারেন, কৌরবদের অভয়বাহক সেই অশ্বত্থামা এসেছেন যুদ্ধ করতে। যিনি জন্মাবার সঙ্গে সঙ্গে পিতা দোণাচার্য গোদান দিয়েছিলেন ব্রাহ্মণদের, যিনি জন্মেই অশ্বের হ্রেষার মতো কেঁদে উঠেছিলেন, সেই অশ্বত্থামা আজ গর্জন করছেন আমাদের সামনে— অশ্বত্থামেতি সোহদ্যৈব শূরো নদতি পাণ্ডবঃ। সত্যি বলতে কী, অশ্বত্থামার ব্যাপারে এই বহু মাননের বিপরীতে অর্জুন যে এখন এসে তাঁকে চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছেন, তার কারণ হিসেবে সঞ্জয় যা জানিয়েছেন, তা হল— এক দিকে অশ্বত্থামা প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি করেছেন পাণ্ডবদের, দু’-তিনজন মধ্যম-শক্তি বীরদের নিধন করা ছাড়াও সাত্যকি, ধৃষ্টদ্যুম্ন, ভীমের মতো মহাবীরদের হারিয়ে দিয়েছেন, আর অন্যদিকে দাদা যুধিষ্ঠিরের দুঃখটুকু এবার তিনি অনুভব করছেন। সত্যিই তো দ্রৌপদীর অপমান, তাঁদের বনবাস— এ-সব ক্ষেত্রে পিতা-পুত্র দ্রোণ-দ্রৌণি কোনও কার্যকরী ভূমিকা গ্রহণ করেননি। বিশেষ অভিমন্যু-বধের ক্ষেত্রে দ্রোণ এবং অশ্বত্থামার প্রত্যক্ষ ভূমিকা ছিল— যুধিষ্ঠিরস্য তৈর্বাক্যৈঃ… দুঃখং সংস্মৃত্য চ প্রভো। অতএব অর্জুন ভয়ংকরভাবে যুদ্ধে ফিরে এলেন। এবং অবশ্যই অশ্বত্থামাও।

ঘোর যুদ্ধ হল। অশ্বত্থামা বহুতর অস্ত্রের প্রয়োগ-নৈপুণ্য দেখালেন। তাতে চরম ফল যা হল, সেটা অশ্বত্থামার পক্ষে এবং কৌরবদের পক্ষে পর্বতের মুষিক-প্রসব। পাণ্ডবপক্ষের এক অক্ষৌহিণী নিরীহ সৈন্য মারা গেল। অশ্বত্থামা ভেবেছিলেন— তাঁর অস্ত্র-তেজে অর্জুন এবং কৃষ্ণ দু’জনেই মারা গেছেন। কিন্তু আপন কৌশলে কৃষ্ণ এবং অর্জুন দু’জনকেই অক্ষত দেখে অশ্বত্থামা ধনুর্বাণ ত্যাগ করে নিজেকে ধিক্কার দিতে লাগলেন এবং রণস্থল থেকে দ্রুত প্রস্থান করলেন— ধিক্ ধিক্ সর্বমিদং মিথ্যেতুক্ত্বা সংপ্রাদবদ্‌ রণাৎ। এই সময়ে অশ্বত্থামার সঙ্গে দ্বৈপায়ন ব্যাসের দেখা হল। অশ্বত্থামা কাতরভাবে তাঁকে জিজ্ঞাসা করলেন যে, এমন মোক্ষম সব অস্ত্র প্রয়োগ করেও আমি কৃষ্ণার্জুনের বিরুদ্ধে সাফল্য পেলাম না কেন? ব্যাস তাঁকে অলৌকিক কাহিনি শোনালেন কৃষ্ণার্জুনের পূর্ব-জন্মের নর-নারায়ণতা ব্যাখ্যা করে। কিন্তু আমরা লৌকিকভাবে যেটা বুঝি, সেটা হল— অর্জুন এবং কৃষ্ণের সেই অমানুষী শক্তি, যাতে অশ্বত্থামার মতো ক্রোধান্ধ যোদ্ধাকে বিফল করে দেওয়া তাঁদের পক্ষে অসম্ভব হয়নি। দ্বিতীয়ত, অশ্বত্থামা নিজেকে যত বড় যোদ্ধা ভাবছেন, সেই ভাবার পিছনে তাঁর পিতারও প্রশ্রয় আছে। গুরু দ্রোণাচার্য তাঁকে অর্জুনের চেয়েও বড় যোদ্ধা বানাতে চেয়েছিলেন, কিন্তু অর্জুনের চেষ্টার নিরিখেই, তা তিনি পারেননি। গুরুতর অস্ত্রলাভ বা বিদ্যা, যা অর্জুনকে নিরলস চেষ্টায় লাভ করতে হয়েছিল, তা অশ্বত্থামা পেয়েছিলেন পিতার বৎসলতায়, বদান্যতায়। নইলে কোনওভাবেই তিনি অর্জুনের সমকক্ষ নন।

ঠিক এইখানেই দু’-একটা কথা আমার বলা দরকার এবং সেই প্রসঙ্গে আমাদের পুরাতন কথার জের টেনে আমরা আবারও ভট্টনারায়ণের নাটক বেণীসংহারে ফিরে যাব। যা বলতে চাই, সেটা হল— অশ্বত্থামা অসমসাহসী বীর এবং বিরাট যোদ্ধা হলেও তাঁর কিছু মানসিক প্রশিক্ষণের প্রয়োজন ছিল এবং এই প্রশিক্ষণ তিনি পিতার কাছে পাননি তাঁর অতিবাৎসল্যের কারণে। এই যে দ্রোণাচার্য মারা যেতেই তিনি পিতৃহত্যার প্রতিশোধ নেবার জন্য রণক্ষেত্রে ছুটলেন, এমন প্রতিজ্ঞা করলেন যাতে মনে হবে যেন পাণ্ডব-পাঞ্চালদের কেউ অবশিষ্ট থাকবে না, অথচ যখন যুদ্ধ শেষ হল, তখন দেখা গেল— নিরীহ কিছু সৈন্যমর্দন ছাড়া তিনি আর কিছুই করতে পারেননি এবং তাতে নিজেকে সামান্য ধিক্কার দিয়ে আমতা-আমতা করা ছাড়া আর কোনও তীব্র অনুশোচনাও তাঁর কিছু নেই— এই দিশেহারা অবস্থাটা মহাভারতের কবি ঘটনা বলতে বলতে প্রকাশ করেন, তিনি কিন্তু মন্তব্য করেন না সময়মতো।

সত্যি বলতে কী, অশ্বত্থামার এই ক্রোধান্ধতা নিতান্তই ব্রাহ্মণোচিত। শত্রুদমনের জন্য যে ক্ষত্রিয়োচিত সংযমটাও লাগে, ক্রোধান্ধ হলেও যে মস্তক স্থির রেখে আপন লক্ষ্যে এগিয়ে যেতে হয়, এই মানসিক প্রশিক্ষণ তিনি পাননি। বেণী-সংহার নাটক মহাভারত থেকেই তার উপাদান সংগ্রহ করেছে বটে, কিন্তু অতি অদ্ভুত কৌশলে অশ্বত্থামার এই দিশেহারা বিভ্রান্ত স্বরূপটি তুলে ধরেছে আগের ঘটনা পরে, পরের ঘটনা আগে বর্ণনা করে। এইটুকু কবিজনোচিত স্বাধীনতা নাট্যকারের থাকবেই। এখানেও পর্দা ওঠার খানিক পরে দ্রোণের মৃত্যু হয়েছে, এবং অশ্বত্থামা ক্রোধে পৃথিবীকে নিষ্পাণ্ডব এবং নিষ্পাঞ্চাল করার শপথ নিচ্ছেন বীরোচিত ভাষায়। স্মরণীয়, এর আগের দৃশ্যেই কুরুরাজ দুর্যোধন দ্রোণের মৃত্যুর খবর পেয়েছেন এবং তিনি কর্ণের কাছে দুঃখ করছেন এই বলে যে, পুত্রের মৃত্যুর খবর শুনেই আচার্য অস্ত্রত্যাগ করলেন, আর সেই সুযোগে পাঞ্চাল ধৃষ্টদ্যুম্ন তাঁকে মেরে ফেলল। কর্ণ তাঁর বন্ধু দুর্যোধনের এই শোক-ভাবনায় বিরক্ত বোধ করছেন, কেননা কোথা-থেকে-না-কোথা-থেকে এইভাবে অশ্বত্থামার মৃত্যুসংবাদ শুনেই— তিনি কোনও বিচার করলেন না, কোনও খবর নিলেন না, এমনকী অশ্বত্থামার আত্মরক্ষার ক্ষমতা সম্বন্ধেও একবারও না ভেবে শোকার্ত হৃদয়ে অস্ত্রত্যাগ করে বসলেন— কর্ণ এই ব্যবহারকে মোটেই সহানুভূতি নিয়ে বিচার করতে রাজি নন। তিনি সুযোগ বুঝে দুর্যোধনের মন বিষিয়ে দিচ্ছেন এবং মহাভারতের কবি যা বলতে পারেননি সোচ্চারে, নাট্যকার সেই সত্যটা উচ্চারণ করাচ্ছেন কর্ণের মুখ দিয়ে।

দুর্যোধন বলেছিলেন— অভিজ্ঞ বিদ্বান লোকেরা ঠিকই বলে— বলে নাকি, জন্মজাত স্বভাব নাকি কিছুতেই যায় না। নইলে এমন হয়? মনের মধ্যে ছেলের শোক উথলে উঠল, আর সঙ্গে সঙ্গে ক্ষত্রিয়ের যুদ্ধ-কার্কশ্য ত্যাগ করে বামুনদের মতো নরম হয়ে গেলেন দ্রোণ। ভাবটা এই— কেন যে তিনি বামুন হয়েও অস্ত্রশিক্ষা করেছিলেন? দুর্যোধনের এই মন্তব্য শুনেই বোঝা যায় যে, বিষিয়ে যাবার উপকরণ তাঁর মনের মধ্যেই ছিল। এই অবস্থায় কর্ণ বলছেন— তুমি যেমন বলছ দুর্যোধন, ব্যাপারটা তার চেয়েও গভীর। এই যে বৃদ্ধ দ্রোণাচার্য, এ সব সময় ভাবত— আমার ছেলেকে আমি রাজা করে যাব এই পথিবীতে। কিন্তু সেই ছেলেই যখন থাকল না, তখন এই বুড়ো বামুনের আর বেঁচে থেকে কী লাভ! অতএব তিনি অস্ত্রত্যাগ করে বসলেন। কর্ণের এই সিদ্ধান্ত দুর্যোধন হ্যাঁ-হুঁ বলে খানিক মেনে নিতেই কর্ণ যুক্তি দিয়ে বললেন— এই যে কৌরব-পাণ্ডবদের এত বড় যুদ্ধ হচ্ছে, সমস্ত রাজারা দুই ভাগে ভাগ হয়ে গেছে। অথচ আমাদের দ্রোণাচার্যকে খেয়াল করে দ্যাখো— রাজারা পরস্পর পরস্পরের ক্ষয় সাধন করতে থাকুন, এই বুদ্ধিতে তিনি কিন্তু মোটামুটি হাত গুটিয়ে বসে আছেন। আমাদের ভীষ্ম, জয়দ্রথ সব একে একে মারা গেল, অথচ জয়দ্রথ মারা যাবার আগে এই দ্রোণ কত বড় বড় কথা বলেছিলেন। বলেছিলেন— জয়দ্রথকে তিনি কিছুতেই অর্জুনের হাতে মরতে দেবেন না। কিন্তু কী হল শেষ পর্যন্ত?

দুর্যোধন এমনিতেই সন্দেহগ্রস্ত মানুষ। দ্রোণকে তিনি নিজেই কতবার বলেছেন— আপনি পাণ্ডবদের কিছুই করছেন না, তাদের সবাইকে ছেড়ে ছেড়ে দিচ্ছেন— সেই মানুষকে কর্ণ যুক্তি দিয়ে বোঝাচ্ছেন যে, স্বার্থপরতার কারণেই দ্রোণ কৌরব-প্রধানদের মৃত্যুও উপেক্ষা করেছেন। দ্রোণের ইচ্ছা ছিল— রাজারা সব কামড়া-কামড়ি করে মরুক, তারপর তাঁর ছেলে রাজা হবে। কর্ণের ধারণা— এই ব্যাপারটা পাঞ্চাল দ্রুপদ বুঝতে পেরেছিলেন বলেই পুরনো বন্ধু হওয়া সত্ত্বেও তিনি তাঁর রাজ্যে ঠাঁই দেননি— অন্যচ্চ রাজন্‌ দ্রুপদেনাপ্যস্য বাল্যাৎ প্রভৃতি অভিপ্রায়বেদিনা ন স্বরাষ্ট্রে বাসো দত্তঃ।

অতিকথ্য ভাষা ব্যবহার করলে বলতে হয়— দুর্যোধন কর্ণের তর্কযুক্তি-সিদ্ধান্ত বেশ ভালভাবে খেয়ে গেলেন। কথাগুলি তাঁর মনে ধরল। এরই মধ্যে কৃপাচার্য শোকার্ত অশ্বত্থামাকে নিয়ে উপস্থিত হলেন দুর্যোধনের সামনে। প্লটটা এইভাবেই সাজানো হচ্ছে— যখন পিতার মৃত্যুর প্রতিশোধ নেবার জন্য নানান রকম প্রতিজ্ঞা-বচন উচ্চারণ করে যাচ্ছেন অশ্বত্থামা এবং কৃপাচার্য তাঁকে বলে যাচ্ছেন— তোমার পক্ষে সব কিছুই সম্ভব, অশ্বত্থামা! তোমার সামনে আজ কেউ দাঁড়াতে পারবে না, যুধিষ্ঠির আর পাণ্ডবরা তো তুচ্ছ কথা। আর আমার ধারণা, কৌরবরাজ দুর্যোধনও তোমাকে অচিরেই সেনাপতিত্বে নিযুক্ত করবেন, তিনি নিশ্চয়ই অভিষেকের উপকরণ নিয়ে প্রস্তুত হয়েই আছেন এবং অপেক্ষা করছেন তোমার জন্য— তদেবং মন্যে পরিকল্পিতাভিষেকোপকরণঃ কৌরবরাজো ন চিরাত্ত্বামেব অভ্যপেক্ষমাণঃ তিষ্ঠতি। অবস্থাটা এইরকম— কৃপের কথা শুনে অশ্বত্থামাও মনে মনে সেনাপতিত্ব-পদের আকাঙ্ক্ষা পুষছেন মনে মনে, কেন না তাতেই শোকার্ত, দহ্যমান তাঁর হৃদয় শান্ত হবে।

নতুন প্লটে নাট্যকার ভট্টনারায়ণের উদ্ভাবনী শক্তিটা মন্দ নয় কিন্তু। আমরা তো বলব— ‘স্ট্র্যাটিজি’র দিক থেকে এটা দুর্যোধনের মস্ত বড় একটা ভুল যে, দ্রোণের তাদৃশ মৃত্যুর পরেও যেখানে অশ্বত্থামা চূড়ান্ত ক্রুদ্ধ হয়ে আছেন, সেই অবস্থায় অশ্বত্থামাকে ‘স্ট্রাটিজিক্যালি’ যুদ্ধের কাজে না লাগানো। তাতে অনেক পরিকল্পিতভাবে— অন্তত অশ্বত্থামা যেমন অদ্ভুত একটা বিচ্ছিন্ন খণ্ডযুদ্ধ করে এলেন এবং কিছু সৈন্যধ্বংস ছাড়া কোনও আর লাভ তাতে হল না— তার চেয়ে অনেক পরিকল্পিতভাবে কর্ণ, দুর্যোধন-কৃতবর্মাদের নিয়ে সেনাপতি অশ্বত্থামা অনেক বেশি সফল হতে পারতেন তাঁর প্রতিশোধ-স্পৃহা পরিপূরণের দ্বিগুণ ইচ্ছায়। অভিজ্ঞ বৃদ্ধ কৃপাচার্যের ধারণাটা তাই সঠিকই ছিল এবং নাট্যকারের নবোন্মেষশালিনী বুদ্ধিটাও তাই একেবারেই সঠিক।

সে যাই হোক, কৃপ এবং অশ্বত্থামা যখন দুর্যোধন-কর্ণের সামনে উপস্থিত হলেন, তখন শোকার্ত অশ্বত্থামাকে যথাযথভাবেই সান্ত্বনা দিয়েছেন দুর্যোধন। কিন্তু অশ্বত্থামা যখন বিলাপ করে বললেন— আমার মতো ছেলে বেঁচে থাকতে আমার পিতার চুলের মুঠি ধরে অপমান করে তাঁকে মারল— তখন কর্ণ কিন্তু টুক করে নিজের হৃদয়টুকু ব্যক্ত করে বললেন— কী আর করা যাবে! আর কীই বা করতেন আচার্য! তিনিও ওইভাবে নিজের অস্ত্র ত্যাগ করে বসলেন, নইলে ওই অব্যর্থ অস্ত্র দিয়েই তো সকলকে বাঁচানো যেত। অশ্বত্থামা ফুঁসে উঠলেন— কী আর করা যাবে মানে? এখানে আমার ক্রোধান্ধ বক্তব্য আমি আগে নিবেদন করেছি— অর্থাৎ সেই— পাণ্ডবদের মধ্যে যাঁরা নিজেদের বাহুদুটিকে ভারী মনে করে, তাঁদের আমি দেখে নেব, পাঞ্চালদের মধ্যে শিশু-বালক-তরুণ সবাইকে আমি যমের বাড়ি পাঠাব ইত্যাদি। এসব শুনে দুর্যোধন বলেছিলেন— আচার্যপুত্র! তুমি যা বলছ এবং তোমার যা শক্তি, তাতে সবই সম্ভব তোমার পক্ষে। দুর্যোধনের কথাটা শুনেই কৃপাচার্য সঙ্গে সঙ্গে তাঁকে বললেন— রাজা! অশ্বত্থামা এখন এই যুদ্ধের সমস্ত গুরুতর ভার বইবার সবচেয়ে উপযুক্ত লোক। তাই আমি বলছিলাম কী, তুমি সপরিবারে অশ্বত্থামাকে এখন সেনাপতিত্বে নিযুক্ত করো— অতোহভিষিচ্যতাং সৈনাপত্যৈ।

অশ্বত্থামার জন্য কৃপের এই সেনাপতিত্ব-প্রসঙ্গের উত্থাপন আসলে নাট্যকারের উদ্ভাবন। এ-বিষয়ে বলার বিষয় একটাই— মহাভারত যা স্পষ্ট করে বলে না, অথচ ব্যাপারটা অন্তঃক্রিয়ার মধ্যে আছে, সেটাই বলে দেওয়া। আমরা আগেও বলেছি— দুর্যোধনের বিরাট কৌরবগৃহের মধ্যে আরও কতগুলি লোক— তাঁরা আশ্রিত, তাঁরা মহাবীর এবং মহাবীর বলেই আশ্রিত হওয়া সত্ত্বেও তাঁরা নিজেদের গোষ্ঠীবৃত্তিতে নিজেদের স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখার চেষ্টায় নিজেদের উচ্চাকাঙ্ক্ষাও পূরণ করার চেষ্টা করেন। অসংখ্য ঘটনার মধ্যে মহাভারত এই কথাগুলি স্পষ্ট করে বলে না, সে শুধু ঘটনার বর্ণনা করে যায়, কিন্তু কথার বাঁধুনি থেকে জীবন এবং সমাজের এই সত্যগুলি বেরিয়ে আসতে চায় বলেই নিপুণ নাট্যকার সেটা ধরতে পারেন এবং মহাভারতকে সম্মান দিয়েই এ-হেন প্লট উদ্ভাবন করেন, যা গবেষণার দৃষ্টিতে সঠিক বলে মনে হয়।

কৃপাচার্য যখন অশ্বত্থামার জন্য সেনাপতিত্বের প্রস্তাব পেশ করলেন, তখন কর্ণের ভাবনা-কষায়িত দুর্যোধন তাঁর রাজোচিত মৃদু হাসিটি বজায় রেখেই আপন আকার-ইঙ্গিত-চেষ্টা নিয়ন্ত্রণে রেখে কৃপাচার্যকে বললেন— কথাটা তো বেশ ভালই বলেছেন আচার্য, কিন্তু আমি তো আগেই অঙ্গরাজ কর্ণকে সেনাপতি হবার আমন্ত্রণ জানিয়ে ফেলেছি, এখন তো আর কিছু করা যাবে না— সুষ্ঠু যুজমানম্ অভিহিতং যুস্মাভিঃ। কিন্তু প্রাক্‌প্রতিপন্নোহয়মর্থো অঙ্গরাজস্য। লক্ষণীয় দুর্যোধনের হাজারও চিন্তার মধ্যেও এটা তাঁর মাথায় আছে যে, বীরমানী আশ্রিতগোষ্ঠীর উচ্চাকাঙক্ষা তিনি সম্পূর্ণভাবে প্রশ্রয় দেন না, চূড়ান্ত জায়গায় সেটা তিনি আটকে দেন। বিশেষত অশ্বত্থামার মাথার ঠিক নেই, দ্রোণাচার্যের মতো তিনি সমর্পণ করে থাকেন না, কখন তিনি মত পরিবর্তন করবেন কোনও ঠিক নেই। অতএব প্রথমেই তাঁর সেনাপতি হবার বাসনায় কোপ বসিয়ে দিলেন। কৃপাচার্য অবশ্য তবুও বলে গেলেন, তবুও বললেন— অঙ্গরাজ কর্ণের স্বার্থে এমন শোকসাগরে নিমগ্ন ব্যক্তিটিকে কিন্তু অবহেলা করাটা ঠিক হবে না মনে হচ্ছে। একই শত্রু অঙ্গরাজ কর্ণকেও দমন করতে হবে, অশ্বত্থামাকেও দমন করতে হবে, সেখানে অশ্বত্থামাকে সেনাপতি করলে একটা অন্তত সান্ত্বনা আসত তাঁর মনে। অন্তত তাঁর মনের পীড়াটা এখানে থাকত না।

অশ্বত্থামা একটু উদাসীনভাবে শুনছিলেন এই কথোপকথন। কর্ণের সেনাপতিত্বের ব্যাপারটা দুর্যোধন প্রথমেই নিশ্চিত করে দেওয়ায় অশ্বত্থামা সেই ব্রাহ্মণোচিত উদাসীনতা বজায় রেখেই বললেন— এখন আর উপযুক্ত-অনুপযুক্ত বিচার করে কী হবে? আজকে রাজা দুর্যোধন ভাল করে ঘুমোন রাত্রিটুকু। আর কালকে বন্দিজনের স্তুতিতে আস্তে আস্তে ঘুম ভাঙলেও চলবে? কেন না ততক্ষণে আমি এই পৃথিবীকে নিষ্কৃষ্ণ, নিষ্পাণ্ডব এবং নিষ্পাঞ্চাল করে ছাড়ব— অকেশবম্‌ অপাণ্ডবং ভুবনমদ্য নিঃসোমকম্‌— পৃথিবীর সব ভার হালকা হয়ে যাবে। অর্থাৎ এগুলো অশ্বত্থামার সেই প্রতিজ্ঞাগুলোর কথা, যা মহাভারতে শেষপর্যন্ত তিনি পূরণ করতে পারেননি, আর পারেননি বলেই নাট্যকার সেই সুযোগে মহাভারতের প্রতি বশংবদ থেকে অদ্ভুত প্লট তৈরি করেছেন, যেখানে কর্ণের সেই পায়ে-পা-বাধানো চিরাচরিত ঝগড়াটুকু নিবদ্ধ হয়েছে অদ্ভুত পটুতায়।

কর্ণ অশ্বত্থামার প্রতিজ্ঞা শুনে বললেন— অকেশব, অপাণ্ডব, আর নিষ্পাঞ্চাল! কথাগুলো বলা যত সহজ, করাটা ততটাই কঠিন। আর এই কাজটা যদি তুমি মানে, তুমিই যদি করতে পারো, অশ্বত্থামা, তা হলে কৌরবপক্ষের অনেকেই সেটা পারবে— বক্তুং সুকরং দুষ্করম্‌ অধ্যবসাতুম্‌। বহবঃ কৌরববলে অস্য কর্মণঃ শক্তাঃ। অর্থাৎ কর্ণ বুঝিয়ে দিলেন অশ্বত্থামা সেনাপতি হিসেবে অপরিহার্য নন। পিতৃশোকে কাতর, অতএব সেই কারণেই ক্রোধান্ধ হয়ে তিনি যা করতে পারেন, অন্য সেনাপতিও সেই কাজ করতে পারে। কর্ণ নিজের সেনাপতিত্বের ‘স্টেক্‌টাও’ ঠিক রাখলেন এই কথা বলে।

অশ্বত্থামা একটু অস্বস্তিতেই পড়লেন। বললেন— আমি কাউকে খাটো করতে চাইনি। কিন্তু মনের মধ্যে অশেষ দুঃখ থাকার ফলেই ওই সব কথা বলেছি। নইলে সত্যিই তো, কৌরবদের মধ্যে অনেকেই আছেন, যিনি এই কাজ করতে পারেন। কর্ণ পায়ে পা বাধিয়ে বললেন— দুঃখ! দুঃখ হলে বসে বসে চোখের জল ফ্যালো। আর ক্রুদ্ধ হলে তুমি ছাড়া আর যেটি আছে সেটা তোমার অস্ত্র, সেখানে এসব দুঃখের প্রলাপ মানায় না। অশ্বত্থামা এবার ভীষণ রেগে গেলেন। একেতেই কর্ণের ওপর তাঁদের গুষ্টির ক্রোধ জমা হয়ে আছে। তার ওপরে এই কর্ণ তাঁর পিতাকেও কম অপমান করেনি একসময়। অতএব সেই মহাভারতীয় ভাব উপজীব্য করেই নাট্যকার অশ্বত্থামার মুখ দিয়ে বললেন— ওরে রাধামায়ের গর্ভভার! আমার দুঃখের প্রতিক্রিয়া চোখের জল না ক্রোধ— সে-উপদেশ কি আমি তোর কাছ থেকে নেব। ব্যাটা! আমার অস্ত্রগুলো কি তোর মতো গুরুর অভিশাপে সময়মতো ভোঁতা হয়ে যায়, নাকি তোর মতো আমি যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালিয়ে এসেছি। তা ছাড়া আমি কি তোর মতো সূত-মাগধ-স্তুতিপাঠকের ঘরের ছেলে, সারথির পো, যে আমি তোর কাছে শিখব— কখন আমি কাঁদব, আর কখন আমি অস্ত্রধারণ করব!

কর্ণ ছাড়বার পাত্র নন, এমন সুযোগে বাপ তুলে কথা বলাটাই তিনি শ্রেয় মনে করলেন। কর্ণ বললেন— আরে-রে-বাচাল! ব্যাটা বামুন! থেমে থাক। গুরুর অভিশাপে আমার অস্ত্র নিস্তেজই হয়ে যাক, আর তেজিই থাকুক, আমি তো তোর বাপের মতো পাঞ্চাল ধৃষ্টদ্যুম্নের ভয়ে অস্ত্র ছেড়ে হাত গুটিয়ে নিইনি কখনও। তা ছাড়া সারথিই হই, আর সারথির পো’ই হই, অথবা যে হই, সে হই, তুই দৈব-দুর্ঘটনায় কপালগুণে বামুন হয়ে জন্মেছিস, আর আমি সারথির পো, কিন্তু পৌরুষ বস্তুটা আমার হাতের মুঠোয়, ওটা কপালে হয় না। অশ্বত্থামা এবার চূড়ান্ত রেগে কর্ণের জাত নিয়ে অসংখ্য গালাগাল দিয়ে বললেন— তুই আমার বাপ তুলে কথা বলছিস, এত বড় সাহস? আমার বাবা ভীরু না মহাবীর তা এই সারা পৃথিবী জানে, আর তিনি অস্ত্র ত্যাগ করেছিলেন কেন সেটা ধর্মপুত্তুর যুধিষ্ঠিরকে জিজ্ঞেস করগে যা। তা ছাড়া আমার বাবা না হয় অস্ত্রত্যাগ করেছিলেন, তুই ভীতু! কোথায় ছিলি তখন যুদ্ধক্ষেত্র ছেড়ে— পৃথাসূনুঃ সাক্ষী ত্বমসি রণভীরো ক্ক নু তদা?

কর্ণ বললেন— বটে! আমি ভীতু! তবে তোর বাপকে দেখে আমার বীরত্ব ব্যাপারটাতেই সন্দেহ হয়। আরে! অস্ত্র ফেলে দিয়েছিলি একবার, ঠিক আছে। কিন্তু যখন দেখলি তরোয়াল নিয়ে ধেয়ে আসছে তোর শত্রু, তখন অস্ত্রটা তুলে নিতে দোষ কী ছিল? আর তোর বাপ কী করল? অতটা সময় পেল, কিন্তু হাজারও রাজা-রাজড়ার সামনে মেয়েছেলের মতো বসে রইল ঘাড় কাত করে। মাঝখান থেকে শত্রু এসে গলা কেটে দিয়ে গেল, তিনি টেরও পেলেন না— যদনেন মৌলি-দলনেহপ্যুদাসিতং/সুচিরং স্ত্ৰিয়েব নৃপচক্রসন্নিধৌ— এই নাকি বীরত্ব? অশ্বত্থামা একেবারে রাগে ফেটে পড়লেন এবার। ছোট লোক, ছোট জাত, বাচাল, রাজার লাই পাওয়া লোক— ইত্যাদি যত রকম ছোট-বড় গালাগাল আছে সব উগরে দিয়ে অশ্বত্থামা বললেন— ছেলের মৃত্যুশোক সহ্য করতে পারেননি বলেই হোক, অথবা ভীরুতাবশতই হোক, আমার পিতা পাঞ্চাল ধৃষ্টদ্যুম্নকে আটকাননি, কিন্তু তুই কর্ণ! যে মেজাজটা দেখাচ্ছিস, নিজের শক্তি নিয়ে যে বৃথা গর্ব করে মরছিস, সেই তোর মাথার ওপরে আমি আমার এই বাঁ পা’টা রাখলাম, তোর ক্ষমতা থাকে তো আমাকে আটকা— তব ভুজবলদর্পধ্‌মায়মানস্য বামঃ/শিরসি চরণ এষ ন্যস্যতে বারয়ৈনম্‌।

অশ্বত্থামা বসেছিলেন, দাঁড়িয়ে পড়লেন চকিতে, নিজের বাঁ পা মাটিতে ঠুকলেন এমন ভঙ্গিতে যেন সে পা রাখা হল কর্ণের মাথার ওপর। কৃপাচার্য এবং দুর্যোধন দু’জনের এই উদ্যত সংঘাত বন্ধ করতে চেষ্টা করছেন এবং তার আগেই কর্ণ বলে উঠলেন— ব্যাটা! তুই শুধু জাতিতে বামুন বলে বেঁচে গেলি, কেন না শত অপরাধেও ব্রাহ্মণকে প্রাণে মারতে নেই। নইলে, যদি তুই বামুন না হতি, তা হলে আমার এই খড়্গাঘাতে তোর বাঁ পা’টা এতক্ষণ মাটিতে কাটা পড়ে থাকত, দেখতিস— অনেন লূনং খড়্গেন পতিতং বেৎস্যতি ক্ষিতৌ। পুরাকালের এই মহাকাব্যিক কলহ যে কোন জায়গায় পৌঁছোতে পারে তারই একটা দৃষ্টান্ত দিয়েছেন নাট্যকার। শুধু বামুন বলে কর্ণ তাঁকে ছেড়ে দিচ্ছেন, এ কথা সইতে না পেরে অশ্বত্থামা বললেন— কী বললি, বামুন বলে আমাকে মারতে পারছিস না তুই। তা হলে নে, এই আমি আমার জাতি ত্যাগ করলাম।

অশ্বত্থামা নিজের পৈতেটাই কেটে ফেলে দিলেন তরবারি দিয়ে। তারপর বললেন— এবার আয় তুই আমার সামনে। অর্জুন তোকে বধের প্রতিজ্ঞা করেছিল, বেচারা অর্জুন! তার প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ হয়ে গেল। আমিই তোকে শেষ করব আজ। হয় তুই অস্ত্র নিয়ে যুদ্ধ কর আমার সঙ্গে, নইলে হাত জোড় করে মাথায় ঠ্যাকা, অপরাধ স্বীকার কর— শস্ত্রং গৃহাণ বা ত্যক্ত্বা মৌলৌ বা রচয়াঞ্জলিম্‌। কর্ণও খড়্গ উঁচিয়ে এগিয়ে এলেন অশ্বত্থামার দিকে, মারামারি লাগে আর কী। কৃপাচার্য আটকানোর চেষ্টা করলেন কর্ণকে, দুর্যোধনও চেষ্টা করতে লাগলেন দু’জনকে আটকানোর, কথা তবু হয়েই চলল, পরস্পরের কাদা ছোড়াছুড়ি। শেষে অশ্বত্থামা বললেন— এই ব্যাটা সারথির পো যতদিন সেনাপতি হয়ে যুদ্ধ করবে, ততদিন আমি অস্ত্র ছোঁব না। শেষমুহূর্তেও কর্ণ ছেড়ে দিলেন না। বললেন— ওটা তো বাপ-ঠাকুর্দার পরাম্পরাগত ঐতিহ্য— সময়কালে অস্ত্র ফেলে দেয়। অশ্বত্থামা বললেন— আর তোর যদি হাতে অস্ত্র থাকেও তো সেটা না থাকারই সমান, কেন না সে-অস্ত্র কোনও কাজে লাগবে না।

নাটকের প্লট এর পরে পালটে গেছে, তবু আমরা যে বেণী-সংহার নাটকের এই অংশ উদ্ধার করেছি, তা শুধু এই জন্য যে, মহাভারতের অন্যতম প্রতিপক্ষ নায়ককে একজন প্রথিতযশা নাট্যকার কীভাবে দেখছেন, তাঁর চরিত্রটা তিনি কীভাবে ফুটিয়ে তুলছেন। একজন ক্রুদ্ধ যুবক, পিতৃশোকে কাতর হওয়া সত্ত্বেও তিনি শোকে সংযত হন না। মহাভারতে তিনি একটা অসংবদ্ধ যুদ্ধ করতে গেছেন, আর এই নাট্যকারের দৃষ্টিতে অশ্বত্থামা তাঁর পিতৃ-বিয়োগ-স্তব্ধ মুহূর্তেও নিজের ‘আইডেনটিটি’ নিয়ে তিনি ব্যস্ত, তিনি যখন-তখন কলহে প্রবৃত্ত হন, অযথা দম্ভ প্রকাশ করেন এবং অন্নদাতা দুর্যোধনের ‘ইনটারেস্ট’ নিয়ে তিনি যতখানি চিন্তিত তার চেয়ে তিনি অনেক বেশি চিন্তিত নিজেকে নিয়ে। আর কর্ণের সঙ্গে অশ্বত্থামার এই যে কলহ, এ-কলহ মহাভারতে বারবার এসেছে, নাট্যকার ভট্টনারায়ণ তার একটা চূড়ান্ত রূপ দেখিয়েছেন মাত্র। বিশেষত রাজবাড়ির আশ্রিতগোষ্ঠীর মধ্যে কর্ণ যেহেতু দুর্যোধনের অনেক বেশি আস্থাভাজন, তাই সেটা ব্রাহ্মণ্য এবং গুরুগৌরব-ভাবিত অশ্বত্থামাকে সুখে রাখে না বলেই কর্ণের ওপর তাঁর এত রাগ। দুর্যোধনকে তিনি বলেও বসেন— এই সারথির ছেলে কর্ণ কীভাবে যে তোমার মতো রাজগুণসম্পন্ন ব্যক্তির ভালবাসা পায় সেটা আমি বুঝিনে বাপু। বাস্তবে দুর্যোধনের বন্ধুত্বভাবনায় কর্ণের যে সমর্পণটুকু আছে, অশ্বত্থামার তা নেই। ফলত সেখানে তিনি একা।

মহাভারতে অবশ্য অশ্বত্থামার সেনাপতিত্বের প্রশ্ন ওঠেনি, কোনও ‘ক্রাইসিস’ও তৈরি হয়নি সেখানে এবং এই কারণেই তা হয়নি যেহেতু অশ্বত্থামা এটা বুঝেই গিয়েছিলেন যে, দুর্যোধন কর্ণকেই সেনাপতিত্বে বরণ করবেন। ফলে সভাস্থলে যেরকমটা অনেক সময় হয়, সভার অধিকাংশের মত এবং গতি বুঝে যেভাবে বিরোধীগোষ্ঠীর প্রমুখ ব্যক্তিটিই তাঁর প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বীর নাম প্রস্তাব করেন, এখানেও তাই হল। দ্রোণের মৃত্যুর পর যেদিন সেনাপতি-নির্বাচনের সভা বসল, সেদিন সমবেত রাজাদের ইঙ্গিত, সবার মুখ এবং দুর্যোধনের মুখের দিকে তাকিয়ে অশ্বত্থামাই বললেন— তেযাং নিশাম্যেঙ্গিতানি …সমুদ্‌বীক্ষ্য মুখং রাজ্ঞো বালাকসমবৰ্চসম্— যদিও তাঁর বলার মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বীর অন্তঃশোণিতে থাকা সেই ব্যঙ্গোক্তি ছিল, তবু বললেন— স্বামী রাজা, অধিকারী প্রভুর ওপর ভক্তি, দুর্যোধনের দেশ-কাল-পাত্রের অপেক্ষা, যুদ্ধ-দক্ষতা এবং রাজনীতি— এই চারটে উপায়ের সঙ্গে দৈব যোগ হলেই কাজ সফল হয়— রাগো যোগস্তথা দাক্ষ্যং নয়শ্চেত্যর্থসাধকাঃ। আমাদের মধ্যে এইরকম রাজনীতির সাধক, রাজভক্ত এবং দক্ষ লোক কিছু ছিলেন, তবে তাঁরা স্বর্গত হয়েছেন। কিন্তু তাই বলে নিরাশ হবার কিছু নেই। রাজনীতি যদি সঠিক পথে চলে তবে প্রতিকূল দৈব পর্যন্ত অনুকূল হয়ে যায়। আমার তো মনে হয়— আমরা যদি এখন সর্বগুণশালী এই কর্ণকে সেনাপতিপদে নিযুক্ত করি, তবে আমরা আরও একবার চেষ্টা করে দেখতে পারি— কর্ণং সেনাপতিং কৃত্বা প্রযতিষ্যামহে বয়ম্‌। কর্ণ বীর, অতিরথ যোদ্ধা এবং যুদ্ধটাকে তিনি ভালবাসেন, তাই কর্ণকেই আমরা সেনাপতি করব।

প্রস্তাব সমর্থিত হল মুহূর্তে এবং মনের সঙ্গে ব্যাপারটা খুব মিলে গেল বলেই দুর্যোধন ভারী খুশি হলেন— ততো দুর্যোধনঃ প্রীতঃ প্রিয়ং শ্রুত্বাস্য তদ্‌বচঃ। আর সত্যিই তো অশ্বত্থামার কী প্রয়োজন আগ বাড়িয়ে হ্যাংলার মতো সেনাপতি হতে চাওয়ার? কর্ণের ওপর তাঁর অনেক রাগ এবং ক্ষোভ থাকলেও তাঁকে সেনাপতি পদে বরণ করতেও তাঁর বাধেনি অথবা তাঁর অধীনে তৈরি মকরব্যূহের শীর্ষস্থানে যুদ্ধ করতেও তাঁর বাধেনি। বেণী-সংহার নাটকে কর্ণের সাহচর্যে যুদ্ধে না-করার সিদ্ধান্ত অশ্বত্থামার চূড়ান্ত অস্থিরতা বোঝানোর জন্য। ভাবটা এই, বিভ্রান্ত যুবকের এই দিশাহীন ভাবনা ‘হইলেও হইতে পারিত।’ কিন্তু মহাভারত এমন করে ঘটনার বর্ণনা করে না বলেই বিভ্রান্ত তথা অপরিশীলিত গোষ্ঠীবৃত্তে আবদ্ধ নায়কের চরম বিভ্রান্তি বোঝানোর জন্য অন্যতর মহাকাব্যিক সম্ভবনা জীইয়ে রাখে। ফলত কর্ণের সেনাপতিত্বে অশ্বত্থামা তার শক্তি প্রদর্শন করেন বটে, কিন্তু দ্রোণবধের পর তাঁর প্রতিজ্ঞাত শৌর্যপ্রদর্শনের ‘জোশ’ কেমন অর্থহীন হয়ে পড়ে। বীর হিসেবে প্রথিত হওয়া সত্ত্বেও যা তিনি বলছেন, তা যে তিনি করতে পারেন না, সেটা মহাকাব্য দেখায় মহাকাব্যিক মন্থরতায়। ভীমের সঙ্গে যুদ্ধ করতে গিয়ে ভীম-অশ্বত্থামা দু’জনেই মূর্ছিত হয়ে পড়েন অথবা অর্জুন যখন সংশপ্তক বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধ করছেন, তখন অশ্বত্থামা মাঝখান ধেয়ে এসে অর্জুনের হাতে পরাজিত হয়ে কর্ণের সৈন্যবাহিনীর মধ্যে আশ্রয় নেন— মহাভারতের এই কর্ণপর্বীয় ঘটনাগুলো বুঝিয়ে দেয়— অশ্বত্থামা বীর বটে, তিনি অসাধারণ আক্রমণ রুখতে পারেন, কিন্তু আপন আক্রমণে ভয়ংকর যুদ্ধ জিততে পারেন না।

এই কর্ণপর্বেই দেখছি— অশ্বত্থামা পাণ্ডবপক্ষে যুদ্ধরত পাণ্ড্যদেশের রাজাকে মারতে পারেন, সাত্যকির মতো যোদ্ধার সারথিকে বধ করতে পারেন, কিন্তু অনেক কাম্বোজ-দেশীয় সৈন্য বধ করতে করতে যখন অর্জুনের হাতে এসে পড়েন, তখনই তাঁকে এমন আহত হতে হয় যে, তাঁর সারথি তাঁকে যুদ্ধস্থল থেকে সরিয়ে নিয়ে যেতে বাধ্য হন। লক্ষণীয়, এই যে ভীষণ যুদ্ধটা আরম্ভ হয়েছিল, এখানে প্রাথমিক পর্যায়ে দ্রৌণি অশ্বত্থামাকেই কিন্তু যুদ্ধোজ্জ্বল দেখতে পাই। অর্জুন এবং কৃষ্ণকে তিনি শরবর্ষণে ছেয়ে ফেলেছিলেন প্রায়। যুদ্ধদ্রষ্টা সঞ্জয় ধৃতরাষ্ট্রের কাছে বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেছেন— আমি অশ্বত্থামার এমন পরাক্রম আগে দেখিনি কখনও— ন ময়া তাদৃশো রাজন্‌ দৃষ্টপূর্বো পরাক্রমঃ— তার ধনুকের টংকার-শব্দেই শত্রুদের মধ্য ত্রাসের সঞ্চার হচ্ছে। আর একবার ডান হাতে একবার বাঁ-হাতে ধনুকের ছিলাটা যেভাবে অনবরত টানছে, তাতে মনে হচ্ছে যেন ঘন মেঘের মধ্যে বিদ্যুৎ ঝিলিক দিচ্ছে— বিদ্যুদম্বুজ-মধ্যস্থা ভ্ৰাজমানেব সাভবৎ।

অশ্বত্থামার এই যুদ্ধদুর্মদ অবস্থা দেখে অর্জুন একটু দমেই রইলেন। হয়তো বা একটু উদাসীনও। এই দুর্মদ আচার্যপুত্রটির ওপরে এমনিতেই একটু প্রশ্রয় ছিল, সহজে তিনি তাঁকে পরাজিত করতে অথবা তাঁকে আহত করতে চাইতেন না। বিশেষত দ্রোণের মৃত্যুর পর এই আচার্যপুত্রের দুর্মদ আক্রমণ হয়তো বা একটু প্রশ্রয়ের চোখেই দেখতেন তিনি। কিন্তু যুদ্ধক্ষেত্রে ভীষণ বিপর্যয়ের মুখে দাঁড়ানো অর্জুনের এই উদাসীন অবস্থা তাঁর পারিপার্শ্বিকেরা মেনে নেবেন কেন? কৃষ্ণ বললেন— অদ্ভুত লাগছে কিন্তু অর্জুন! দ্রৌণি অশ্বত্থামা কেমন তোমাকে মেরে দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। তোমার হাতে কি আর শক্তি নেই কোনও? নাকি গাণ্ডীবটা আর হাতে নেই তোমার, নাকি রথ থেকে তুমি নেমে পড়েছ ভুঁয়ে— কচ্চিত্তে গাণ্ডীবং হস্তে রথে তিষ্ঠসি চার্জুন। একটা কথা তোমাকে বলে রাখি অর্জুন! অশ্বত্থামা তোমার গুরুপুত্র বলে তুমি তাকে ছেড়ে দিয়ো না যেন। কারণ এই সময়টাকে তুমি যদি বয়ে যেতে দাও, তা হলে আমাদের অনেক ক্ষতি হয়ে যাবে— গুরুপুত্র ইতি হ্যেনং… নায়ং কাল উপেক্ষিতুম্‌।

কৃষ্ণের কথা শুনে সমস্ত শক্তি নিয়ে উঠে দাঁড়ালেন অর্জুন এবং অস্ত্র-শস্ত্রে অশ্বত্থামাকে তিনি এমনভাবেই থামিয়ে দিলেন যে, তাঁর সারথি তাঁকে অচৈতন্য অবস্থায় রণক্ষেত্র থেকে সরিয়ে নিয়ে যেতে বাধ্য হলেন— অপোবাহ রণাৎ সূতো রক্ষমাণো ধনঞ্জয়াৎ। এমন একটা লজ্জাকর অবস্থা তৈরি হলেও দুর্যোধনের উদ্দীপনায় আবারও যেই সেনা সাজালেন কর্ণ, তখনই অশ্বত্থামা প্রতিজ্ঞা করে বসলেন আবার। এখন আর তিনি পাণ্ডবদের কথা বলছেন না। বলছেন— ধৃষ্টদ্যুম্ন পাঞ্চাল আমার পিতাকে মেরেছে, অতএব তাকে না মেরে আমি কিছুতেই জ্বালামুক্ত হব না— ধৃষ্টদ্যুম্নম্ অহত্বাহং ন বিমোক্ষ্যামি দংশনম্‌। আর আমার এই কাজে যদি ভীম-অর্জুন কেউ বাধা দেয়, তবে তাদের আমি ঠান্ডা করে দেব। বাস্তব ঘটনা হল— ধৃষ্টদ্যুম্নের সঙ্গে অশ্বত্থামার যুদ্ধ-সাক্ষাৎকার ঘটেছে, পরস্পর হানাহানিও হয়েছে অনেক, কিন্তু ধৃষ্টদ্যুম্নের সঙ্গে অর্জুনও শেষপর্যন্ত যুদ্ধে মিলিত হওয়ায় অশ্বত্থামা অবশেষে পরাজিত হয়ে ফিরে আসেন। বলা ভাল, এই তাঁর শেষ পরাজয় নয়, অর্জুনের হাতে এর পরেও তিনি বার বার পরাজিত হয়েছেন কর্ণের সেনাপতিত্বকালেই। হয়তো এই পরাভব এবং প্রতিজ্ঞাত সত্যপালনের ক্রমিক অক্ষমতা কখনও তাঁর মধ্যে শুভবুদ্ধির উদ্রেক ঘটিয়েছে। তিনি চোখের সামনে দুঃশাসনকে মরতে দেখেছেন ভীমপ্রহারে, মরতে দেখেছেন কর্ণের ছেলেকে। অশ্বত্থামা আর মৃত্যু চান না, রাজা দুর্যোধনকে তিনি ভালবাসেন বলেই এক সময় তাঁকে বলেছেন— দুর্যোধন! প্রসন্ন হও তুমি, এই রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ এবার বন্ধ হোক। আমার পিতা শেষ হয়ে গেছেন এই যুদ্ধে, গেছেন পিতামহ ভীষ্ম। এখনও সময় আছে, এই ঝগড়া-মারামারি বন্ধ হোক— প্রসীদ দুর্যোধন শাম্য পাণ্ডবৈঃ/অলং বিরোধেন ধিগস্তু বিগ্রহম্‌।

নিজের এতকালের মর্যাদা, ব্রাহ্মণত্ব এবং গুরুপুত্রের উচ্চতা— এগুলি তাঁকে তরুণতর বয়সেই এই অভিমানটুকু দিয়েছে, যাতে দ্রোণাচার্যের প্রত্যক্ষ প্রয়োজন হয় না। তিনি দুর্যোধনকে বলেছেন— তুমি যদি যুদ্ধ বন্ধ করো, তা হলে পাণ্ডবদের থামিয়ে দিতে পারব আমি। তারা যুদ্ধোন্মুখ হলেও আমি যদি বারণ করি, তবে অর্জুনের মতো মহাবীরও থেমে যাবে, এবং জনার্দন কৃষ্ণ এমনিতেই যুদ্ধ চান না— ধনঞ্জয়ঃ শাম্যতি বারিতো ময়া/জনার্দনো নৈব বিরোধমিচ্ছতি। অশ্বত্থামা পাণ্ডবপক্ষের সকলের কথা বলে শেষে বলেছেন— এই এতদিনের যুদ্ধে অনেকটাই দেখা হয়ে গেছে আমাদের। বেড়েছে অভিজ্ঞতার সঞ্চয়। এই সমস্ত জগৎ দেখেছে, তুমি দেখেছ, আমি দেখেছি যে, একা ধনঞ্জয় অর্জুন কতটা ক্ষতি করে ফেলতে পারে— ইদঞ্চ দৃষ্টং জগতা সহ ত্বয়া/কৃতং যাদেকেন কিরীটমালিনা— এর পরেও যদি তুমি আমার কথা না শোন, তবে ভবিষ্যতে তোমাকে অনুতাপ করে মরতে হবে।

এটাই বোধহয় শেষ এবং গুরুপরম্পরাগত চেষ্টা ছিল অশ্বত্থামার। অর্জুনের হাতে বার বার পরাজিত হয়ে তিনি এতদিনে বুঝেছেন— দুর্যোধন ভুল করে ফেলেছেন। আরও একটা কথা, অর্জুনের হাতে পরাজিত হলেও তাঁর সম্বন্ধে অশ্বত্থামার একটা অদ্ভুত মর্যাদাবোধ আছে, যাতে তিনি বলতে পারেন— এত এত মহান গুণ এবং বীরত্ব থাকা সত্ত্বেও অর্জুন কিন্তু আমার কথা অতিক্রম করবে না— অতোহপি ভূয়াংশ্চ গুণৈর্ধনঞ্জয়ো/ন চাতিবর্তিষ্যতে মদ্‌বচোহখিলম্‌। আবার অন্যদিকে দুর্যোধনের সঙ্গে এতদিনের তাঁর সহবাস-পরিচয়, তাঁকে তিনি সত্যিই ভালবাসেন বলেই আজ তাঁর হয়ে যুদ্ধ করছেন তিনি। মুখে বলেছেন— তোমাকে আমি সম্মান করি দুর্যোধন, কিন্তু আজকে তোমাকে যে যুদ্ধ বন্ধ করার কথা বলছি, সেটা তোমার ওপর পরম বন্ধুত্ববশত— মমাপি মানঃ পরমাঃ সদা ত্বয়ি/ব্রবীম্যতস্ত্বাং পরমাচ্চ সৌহৃদাৎ।

অশ্বত্থামার নিজের কথা থেকেই বোঝা যায় যে, পাণ্ডবদের ব্যাপারে তিনি গুরুপুত্রের সম্পূর্ণ অধিকার বোধ করেন বটে, কিন্তু দুর্যোধনকে তিনি সত্যিই ভালবাসেন। এই ভালবাসার মধ্যে অন্নদাতার প্রতি ঋণশোধের যত বোধ ছিল, তার চেয়ে অনেক বেশি ছিল অপরিণত এক অন্ধ বিশ্বাস, যে বিশ্বাসের মই বেয়ে তিনি আপন গোষ্ঠীর বৈশিষ্ট্য রক্ষা করতে চেয়েছেন এবং চেয়েছেন গোষ্ঠীশত্রু পাঞ্চালদের সর্বনাশ ঘটাতে।

অশ্বত্থামা নিজে দুর্যোধনকে বলেছিলেন— দ্যাখো! বিচক্ষণ লোকেরা চারভাবে বন্ধুত্বের কথা স্মরণ করেছেন। যেমন সহজ মিত্র, জন্মলগ্নেই আত্মীয়তা-নিবন্ধন যে বন্ধুত্ব হয়। আবার বন্ধুত্ব জন্মে মিষ্টি কথায়, দিনে দিনে। টাকা-পয়সা ছড়িয়েও বন্ধুত্ব আদায় করা যায়। আর বন্ধুত্ব হয় দমন-নীতিতে, নিজের ক্ষমতায় অপরকে শুইয়ে দিয়ে বন্ধুত্ব আদায় করা। অশ্বত্থামা বলেছিলেন— এই চারভাবেই পাণ্ডবরা দুর্যোধনের বন্ধু হয়ে যেতে পারেন, কিন্তু অশ্বত্থামা বা দ্রোণাচার্য কোন মাত্রায় বন্ধু হয়েছিলেন দুর্যোধনের— সহজ আত্মীয় নন দুর্যোধন, প্রতাপেও তিনি বশ করেননি দ্রোণাচার্যকে, মিষ্টি কথাতেও নয়। একমাত্র বিকল্প থাকে ধনার্জিত বন্ধুত্ব— দ্রোণাচার্য থেকে অশ্বত্থামা দু’জনেই অন্ন আর অর্থঋণে আবদ্ধ দুর্যোধনের কাছে। কিন্তু এই ধনার্জিত বন্ধুত্বের মধ্যে একটা পারস্পরিক প্রত্যাশা থাকে— ধনান্নের বিনিময়ে এই যে প্রত্যাশা, এই প্রত্যাশা গোষ্ঠীস্বার্থ পূরণের কাজে লাগে, কিন্তু এখানে যে বাধা আসলেই বিভ্রান্তি আসে। অশ্বত্থামা তাই এক এক সময় এক এক কথা বলেন। পিতার মৃত্যুর পর অবশ্যই পাণ্ডবদের ব্যাপারে তাঁর দুর্বলতা কমেছে, কিন্তু যে প্রতিশোধ-স্পৃহায় দুর্যোধনের সহায় হয়ে যুদ্ধ করছেন তিনি, সেই স্পৃহাও একবার চূড়ান্ত বিন্দুতে পৌঁছে কেমন ভিন্ন খাতে বয়, এমনই বিভ্রান্ত তিনি।

দুর্যোধন অশ্বত্থামার সাধু অনুরোধ শোনেননি, দুঃশাসনের মৃত্যুর পর তিনি আরও বেশি করে কর্ণের ওপর বিশ্বাস করছেন। অতএব দ্বিগুণ তেজে কর্ণ যখন আবারও যুদ্ধে গেছেন, অশ্বত্থামাকেও তখন যুদ্ধে যেতে হয়েছে। এই যাওয়া একেবারেই ‘রুটিন’ যাওয়া ছিল এবং এর শেষপর্যায়ে ছিল কর্ণের মৃত্যু। অশ্বত্থামা বোধহয় এই পরিণতিগুলি বুঝে গিয়েছিলেন, ফলত এইসময়ে তাঁকে যেন কেমন বৃদ্ধতরের ভূমিকায় দুর্যোধনকে সান্ত্বনা দিতে দেখি। এমনকী পরবর্তী সেনা-নির্বাচনের ক্ষেত্রেও অশ্বত্থামাকে প্রায় আচার্যের ভূমিকায় লক্ষ করি। সত্যি বলতে কী, দুর্যোধনের চির-অভীষ্ট সেনাপতি কর্ণের মৃত্যুর পর অশ্বত্থামারই সেনাপতি নির্বাচিত হবার কথা। দুর্যোধনও বোধ করি সেই মনোভাব নিয়েই সোজা তাঁর কাছেই এসেছিলেন সেনাপতি ঠিক করার জন্য। কর্ণের মৃত্যু হতাশ করেছিল দুর্যোধনকে, সেদিন অশ্বত্থামাকে তিনি বলেছিলেন— এখন তুমিই আমাদের সকলের সর্বশেষ গতি— গুরুপুত্রোহদ্য সর্বেষাম্‌ অস্মাকং পরমা গতিঃ— তুমিই বলো আজ কার নায়কত্বে আমরা পাণ্ডবদের জয় করে আসতে পারি।

অশ্বথামা বলতেই পারতেন, কোনও ভয় নেই, আজ আমিই তোমাদের নেতৃত্ব দেব। পরিস্থিতিও অনুকূল ছিল, কেন না কর্ণ নেই, দুঃশাসন নেই এবং মহাভারতের কবি এই প্রথম আট পর্ব মহাভারত রচনা কররার পর, এই প্রথম অশ্বত্থামার রূপ, গুণ, শৌর্য দীর্ঘ সময় ধরে বহুতর শ্লোকে বর্ণনা করছেন। ভবিষ্যতে ব্যবহারের সম্ভাবনা মাথায় রেখেই বস্তুর বা ব্যক্তির রূপ, গুণ, ক্রিয়াকারিতা বর্ণনা করা মহাকাব্যের রীতি। কিন্তু অশ্বত্থামার গুণ বর্ণনা করে মহাভারতের কবি যে সম্ভাবনা তৈরি করলেন, সেখানে জল ঢেলে দিয়ে অশ্বত্থামা মদ্ররাজ শল্যের গুণকীর্তন করে তাঁকেই সেনাপতি নির্বাচন করার পরামর্শ দিলেন দুর্যোধনকে। হয়তো কোনও দুরন্ত অভিমান কাজ করেছে অশ্বত্থামার মনে, হয়তো কেন, অবশ্যই তাই। কেন না পিতার মৃত্যুর পর যে শোকোদ্ভিন্ন ক্রোধ তাঁর মধ্যে তৈরি হয়েছিল, তা প্রতপ্ত লৌহের মতো সেনাপতিত্বের দায়িত্ব এবং মর্যাদার অভিঘাতে আদর্শ রূপ পেতে পারত। কিন্তু সেই শোক-ক্রোধ-উদ্দীপনা কতগুলি বিচ্ছিন্ন এবং ব্যক্তিগত আক্রমণের সংকীর্ণতায় নষ্ট হয়ে গেছে। অশ্বত্থামা এখন বুঝে গেছেন সম্মুখযুদ্ধে ভীম-অর্জুনকে কোনও দিন শেষ করা যাবে না বিশেষত তাঁদের সহায় যখন জনার্দন কৃষ্ণ। অশ্বত্থামা ঝিমিয়ে গেছেন, অন্তত আপাতত তাই মনে হচ্ছে। কিন্তু পরাশ্রিত ব্যক্তি আপন স্বার্থ, গোষ্ঠী-স্বার্থ, পরিবারের স্বার্থ, এবং আপন স্বাতন্ত্রের জন্য যে লড়াই চালায় প্রতিনিয়ত, সে কিছু ভোলে না, সে পরাজিত অবস্থায় অপেক্ষা করে।

শল্যের সেনাপতিত্ব-কালেও অশ্বত্থামা যুদ্ধ করেছেন, সম্পূর্ণ সহায়তা দিয়ে। ভীম, অর্জুনের সঙ্গে তাঁর যুদ্ধ হয়েছে, পাঞ্চাল-বীর সুরথ মারা গেছেন তাঁর হাতে। আর বারবার যেটা দেখছি, এই শল্যপর্বীয় যুদ্ধে তিনি বৃষ্ণিবীর কৃতবর্মার কাছাকাছি চলে এসেছেন অনেকটা। কৃতবর্মাকে বারবার তিনি রক্ষা করছেন, শত্রুর হাত থেকে বাঁচানোর জন্য তাঁকে নিজের রথে উঠিয়ে নিয়েছেন— অশ্বত্থামা চ হার্দিক্যম্‌ অপোবাহ যশস্বিনম্‌। লক্ষণীয়, কৃতবর্মা কৃষ্ণের দেশের লোক, দুর্যোধনের অনুরোধে তিনি তাঁর পক্ষে যোগ দিয়েছেন, এটাই সরলার্থ নয়, কৃষ্ণের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক ভাল ছিল না, ফলত অর্জুনের সঙ্গেও তাঁর সম্পর্ক ভাল নয়। এদিকে দুর্যোধনের পক্ষেও আর তেমন মহাবীর নেই, যার সহায়তায় অশ্বত্থামার ঈপ্সিত পূরণ হতে পারে। হয়তো এই কারণেই অশ্বত্থামা এখন কৃতবর্মার পক্ষপাতী হয়ে উঠেছেন।

শল্য সেনাপতি হিসেবে বেশি সময় কাটাতে পারেননি। অর্ধেক দিন মাত্র। তিনি যুধিষ্ঠিরের হাতে মারা গেছেন। তারপরেই মারা পড়েছেন শকুনি মামা এবং তাঁর ছেলে উলূক! শল্যের পতন ঘটতেই দুর্যোধনকে বিমনা লাগছিল, অস্থিরতা গ্রাস করছিল তাঁকে। মাঝেমাঝেই তিনি রণস্থল থেকে আড়াল করছিলেন নিজেকে। অশ্বত্থামা, কৃপাচার্য এবং কৃতবর্মা তাঁকে খুঁজে বেড়াচ্ছিলেন, কিন্তু তাঁকে পাচ্ছিলেন না কিছুতেই। রণস্থলের মধ্যেই কৃষ্ণ লক্ষ করছিলেন যে, অশ্বত্থামা, কৃপ এবং কৃতবর্মা যোগ-বিচ্ছিন্ন হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন, দুর্যোধনকে তাঁরা পাচ্ছেন না— দুর্যোধনমভিত্যজ্য ত্রয় এতে ব্যবস্থিতাঃ। এই সুযোগে দুর্যোধনকে একা পেয়ে যদি মারা যায়, তার জন্য পাণ্ডবরা ছুটলেও পথে শকুনির জন্য দেরি হয়ে গেল। দুর্যোধন ততক্ষণে পালিয়ে গিয়ে নিশ্চিন্ত আশ্রয় নিয়েছেন স্তব্ধনীর দ্বৈপায়ন হ্রদে।

অশ্বত্থামা, কৃপ এবং কৃতবর্মা— কৌরবপক্ষে এই তিন অবশিষ্ট বীর। কৌরববাহিনী বিধ্বস্ত হয়ে গেছে, যুদ্ধশিবিরগুলি পরিত্যক্ত, অশ্বত্থামা-কৃপ-কৃতবর্মা তিনজন ভীষণ উদ্‌বিগ্ন বোধ করছেন দুর্যোধনের জন্য— বিদ্রুতে শিবিরে শূন্যে ভৃশোদ্বিগ্নাস্ত্ৰয়ো রথাঃ। পাণ্ডবদের জয়ধ্বনি শোনা যাচ্ছে দিকে দিকে— আর স্বয়ং পাণ্ডবরা দুর্যোধনকে খুঁজছেন। এমনিতেই সারা দিনের যুদ্ধে পরিশ্রান্ত ছিলেন সকলে, শ্রান্ত ছিল অশ্ব, হস্তী, বাহন। বৃথা অন্বেষণের ক্লান্তিতে শেষপর্যন্ত বাহনগুলি ক্লান্ত হয়ে পড়ায় পাণ্ডবরা প্রত্যাবৃত্ত হয়ে শিবিরে অবসন্ন হলেন। তাঁদের এইভাবে ক্ষান্ত, বিশ্রান্ত এবং শিবিরে নিবিষ্ট দেখেই অশ্বত্থামা, কৃপ এবং কৃতবর্মা এবার খুঁজতে বেরোলেন দুর্যোধনকে। ধীরে ধীরে তাঁরা উপস্থিত হলেন দ্বৈপায়ন হ্রদের সামনে। তখন সন্ধ্যা গড়িয়ে নামছে মন্থরে— সায়াহ্ণে রাজগৃদ্ধিনঃ।

হয়তো অশ্বত্থামা-কৃপরা জানতেন, হয়তো বা জানতেন না, হয়তো বা অনেকক্ষণ ধরেই দুর্যোধনের গতিবিধির ওপর সংগোপনে পাণ্ডবদের অজান্তেই লক্ষ রাখছিলেন বলে পাণ্ডবরা শিবিরে শান্ত হয়ে বসতেই তাঁরা ধীরে ধীরে চলে এসেছেন দ্বৈপায়ন হ্রদের ধারে। শান্ত জলের মধ্যে দুর্যোধনকে নিশ্চেষ্ট দেখে কৃপাচার্যরা সকলে মিলে বললেন— তুমি উঠে এসো জল থেকে দুর্যোধন! আমরা সকলে মিলে তোমার সঙ্গে যুদ্ধ করব। ওরা আমাদের অনেক ক্ষতি করেছে ঠিকই, কিন্তু আমরাও ওদের কম ক্ষতি করিনি, ওদেরও সৈন্য-সামন্ত সব শেষ। এই অবস্থায় আমরা তোমাকে বাঁচিয়ে চললে তোমার প্রচণ্ড আক্রমণ ওরা সহ্য করতে পারবে না। তুমি উঠে এসো। দুর্যোধন উঠলেন না, জলের মধ্যে থেকে তিনি বললেন— এই বিরাট যুদ্ধের শেষে আপনারা যে তিনজন বেঁচে আছেন, এটাই আমাদের ভাগ্য। কিন্তু আপনারা যা বলছেন, সেখানে আমাদের বক্তব্য হল— আজকে কোনও যুদ্ধ নয়। আপনারাও যথেষ্ট ক্লান্ত হয়ে রয়েছেন, আর আমারও শরীর ক্ষত-বিক্ষত হয়ে আছে। অন্তত আজকের রাতটুকু বিশ্রাম করে কাল আমরা সকলে মিলে যুদ্ধ করব— বিশ্রাম্যৈকাং নিশামদ্য ভবদ্ভিঃ সহিতো রণে।

এতক্ষণ তিনজনেই সমস্বরে দুর্যোধনকে বলছিলেন, এবারে অশ্বত্থামা নিজের দায়িত্বে দুর্যোধনকে বললেন— তুমি জল থেকে উঠে এসো রাজা! উঠে এসো। আমার সমস্ত পুণ্যের শপথ নিয়ে বলছি যে, আজই আমি সমস্ত পাঞ্চালদের নিঃশেষ করে দেব— শপে রাজন্‌ যথা হ্যদ্য নিহনিষ্যামি সোমকান্— কাল সকালেই যদি এদের আমি না মারতে পারি, তা হলে পরলোকে যেন আমার শুভ গতি না হয়। একটা কথা আমি পরিষ্কার জানিয়ে রাখি— এবার যুদ্ধের জন্য আমি যে বর্ম পরব, পাঞ্চালদের বধ না-করে আমি সেই যুদ্ধবর্ম মুক্ত করব না বুক থেকে— নাহত্বা সর্বপাঞ্চালান্‌ বিমোক্ষ্যে কবচং বিভো।

দুর্যোধন কী শুনতে চান, আর কী শুনছেন! অশ্বত্থামা পাঞ্চালদের মারতে চান, আর আশৈশব যাদের সঙ্গে শত্রুতা সেই পাণ্ডবরা তো সব অক্ষত দেহে বেঁচে রইল। হ্যাঁ, পাঞ্চালরা পাণ্ডবদের সহায় বলেই তাঁর শত্রু বটে, কিন্তু শুধু পাঞ্চালদের মেরে তাঁর কী লাভ? আমাদের অবশ্য আর একটা জায়গায় খটকা আছে। খানিক আগেও অশ্বত্থামাকে আমরা ‘ফ্রাসট্রেটেড’ দেখেছি, বিশেষত অর্জুন তাঁর সমস্ত পরিকল্পনা ভ্রান্ত করে দেওয়ায় অশ্বত্থামা যথেষ্টই হতাশ হয়ে গিয়েছিলেন, এমনকী যুদ্ধ বন্ধ করার কথাও বলছিলেন তিনিই। কিন্তু আজ অশ্বত্থামার কী পরিবর্তন ঘটল? তিনি দুর্যোধনের জন্য একা লড়তে চাইছেন! এই পরিবর্তনের কারণ বোঝা খুব দুঃসাধ্য নয়।

মনে রাখা দরকার, দুর্মদ যুদ্ধ এখন শেষ হয়ে আসছে, অথচ তাঁর পিতৃহন্তা ধৃষ্টদ্যুম্ন বেঁচে রইলেন, বারংবার ধৃষ্টদ্যুম্ন-বধের প্রতিজ্ঞা নিয়েও শেষপর্যন্ত সফল হননি অশ্বত্থামা। এদিকে হঠাৎ করে তিনি দেখছেন শল্যবধের পর, সৌবল শকুনির মৃত্যুর পর যুদ্ধের সমস্ত উৎসাহ-অধ্যবসায় স্তিমিত হয়ে গেছে। এমনকী কুরুরাজ দুর্যোধনও আজ প্রায় পালিয়ে দ্বৈপায়ন হ্রদে গিয়ে লুকিয়েছেন। অথচ ধৃষ্টদ্যুম্ন বেঁচে রয়েছেন। হয়তো ধৃষ্টদ্যুম্নের এই সজীব পরিণতি অশ্বত্থামা সহ্য করতে পারেননি এবং সেই কারণেই আজ তিনি উঠে-পড়ে লেগেছেন— পাঞ্চালদের নিঃশেষে ধ্বংস করবেন তিনি, শেষ করবেন পিতৃহন্তা ধৃষ্টদ্যুম্নের জীবন।

তথ্য হিসেবে জানানো দরকার, বিশেষত পরে যখন পাণ্ডবরা দুর্যোধনকে ধরবার জন্য সকলে মিলে দৌড়চ্ছেন, তখন দেখেছি সেখানে পাঞ্চাল-রাজপুত্র ধৃষ্টদ্যুম্নের সঙ্গে হতাবশিষ্ট সৈন্য যারা বেঁচেছিল, তারা সবাই পাঞ্চাল দেশের সৈন্য এবং ছিলেন শিখণ্ডী— তিনিও দ্রুপদের পুত্র এবং কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের অন্যতম হন্তারক ব্যক্তিত্ব। পাণ্ডবপক্ষের অনেকেই হতাহত হবার পর এই সম্পূর্ণ পাঞ্চাল-গোষ্ঠী এখন অশ্বত্থামার কাছে বিপরীতভাবে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে, এখনও মরেনি সেইসব পাঞ্চাল এই মুহূর্তে তারা তাঁর চক্ষুশূল। অশ্বত্থামা দুর্যোধনের সঙ্গে বেশিক্ষণ কথা বলার সময় পেলেন না। কারণ গুপ্তচরেরা দেখে গিয়ে খবর দিয়েছে যুধিষ্ঠির-ভীমকে যে, দুর্যোধন লুকিয়ে আছেন দ্বৈপায়ন হ্রদে। কিন্তু গুপ্তচরেরা উৎসাহের আতিশয্যে অশ্বত্থামা বা অন্য দুইজনের খবর দিল না। সবচেয়ে আশ্চর্য হল, খবর পেয়ে পাণ্ডব-পাঞ্চালেরা যখন দ্বৈপায়ন-হ্রদে এসে উপস্থিত হলেন, তখন তাদের গলার স্বর, উৎসাহের স্ফীতি এবং সর্বশেষ শত্রু নিধনের যে সাহংকার ঘোষণা— সেটা কানে যেতেই অশ্বত্থামা, কৃপাচার্য এবং কৃতবর্মা একযোগে বললেন দুর্যোধনকে— ওই পাণ্ডবরা শত্রু-বিজয়ের বাসনা নিয়ে সবাই আসছে এদিকে। অতএব আমরা এখন এখান থেকে যাই, তুমি অনুমতি দাও— অপযাস্যামহে তাবদ্‌ অনুজানাতু নো ভবান্‌।

দুর্যোধন ছেড়ে দিলেন অশ্বত্থামাদের— তাঁরা যথেষ্ট তাড়াহুড়োই করছিলেন— তেযাং তত্র তরস্বিনাম্‌। দুর্যোধন আবার হ্রদে প্রবেশ করলেন, অশ্বত্থামা চলে গেলেন তাঁর সঙ্গীদের নিয়ে। মনে তাঁদের দুঃখ রইল— দুর্যোধনকে একা রেখে যেতে হল এবং তাও আসন্ন যুদ্ধের সম্ভাবনার মুখে। তাঁরা বেশ একটু দূরেই চলে গেলেন এবং তা নিশ্চয়ই পাণ্ডব এবং পাঞ্চালদের দৃষ্টি এড়ানোর জন্যই। অনেক দূরে গিয়ে পথশ্রান্ত, রণ-ক্লান্ত অশ্বত্থামা তাঁর মাতুল কৃপাচার্য এবং অন্তিম সঙ্গী কৃতবর্মাকে নিয়ে একটি বিশাল বটবৃক্ষের তলায় বসলেন— আর ভেবে চললেন দুর্যোধনের নিয়তির কথা।

ঠিক এই সময় থেকে অশ্বত্থামার সম্বন্ধে আমাদের নতুন জিজ্ঞাসা উদয় হয়। অশ্বত্থামার নানা বিভ্রান্তি আছে জানতাম, এখন এক কথা বলছেন, পরে আর এক কথা বলছেন অথবা যে কথা বলছেন, কাজে সেটা করছেন না— এমনটা আমরা জানি। কিন্তু আজ দুর্যোধনের এই সংকট মুহূর্তে অশ্বত্থামা এলেন এবং তাঁর কথা শুনে তো এমন মনে হচ্ছিল যেন এখনই দুর্যোধনকে জল থেকে উঠিয়ে নিয়ে জল গায়েই তাঁর সঙ্গে যুদ্ধ করতে যাবেন। তিনি এমন আশা দিয়েছিলেন যেন দুর্যোধন সঙ্গে থাকলে এই মুহূর্তেই পাঞ্চাল-পাণ্ডবদের সঙ্গে যুদ্ধ আরম্ভ করতে পারেন এবং সকলকে পর্যুদস্ত করতে তাঁরা চারজনেই যথেষ্ট। অথচ যে মুহূর্তে পাণ্ডব-পাঞ্চালদের পদশব্দ শুনতে পেলেন অশ্বত্থামা, সেই মুহূর্তেই সাঙ্গোপাঙ্গ নিয়ে বৃক্ষান্তরালে লুকিয়ে পড়লেন সকলে, দুর্যোধনকে তাঁরা একা ফেলে আসলেন জয়োৎসিক্ত পাণ্ডবদের সামনে। অশ্বত্থামা, কৃপ, কৃতবর্মা কারও কোনও লজ্জা হল না, শুধু একটু পরান পুড়ল, এইমাত্র।

আমরা জানি, দুর্যোধনকে সেদিন বাক্যবেগে জল থেকে উঠিয়ে ছেড়েছিলেন পাণ্ডবরা এবং শেষপর্যন্ত সেই ভয়ংকর শেষযুদ্ধ হয়েছিল ভীম এবং দুর্যোধনের মধ্যে। ভীষণ গদার আঘাতে উল্লম্ফমান দুর্যোধনের ঊরু দুটি ভেঙে দিয়েছিলেন ভীম। তাঁকে প্রায় সহায়হীন মৃত অবস্থায় রেখে পাণ্ডবরা জয়ধ্বনি উচ্চারণ করতে করতে চলে গিয়েছিলেন সেদিন। কৃষ্ণ হস্তিনাপুরীতে ধৃতরাষ্ট্র-গান্ধারীকে সান্ত্বনা দিতে গিয়েও ফিরে এসেছিলেন তাড়াতাড়ি। অশ্বত্থামা-কৃপদের তিনি অনেকক্ষণ কোথাও ধারে কাছে দেখতে পাননি বলেই তাঁর মনে সন্দেহ তৈরি হয়েছিল যে, অশ্বত্থামা পাণ্ডবদের কোনও ক্ষতি করতে পারেন। তিনি তাই চলে এসেছিলেন তাড়াতাড়ি, পাণ্ডব-ভাইদের নিয়ে সাত্যকি সহ সেদিন কৃষ্ণ বিশ্রাম করছিলেন শিবিরের বাইরে, নদীর ধারে। ওদিকে দুর্যোধন মৃত্যুযন্ত্রণা সহ্য করতে করতেও অর্ধশায়িত অবস্থায় অর্ধেক উঠে স্তুতিপাঠক-বন্দিদের বলেছিলেন অশ্বত্থামাকে যেভাবে হোক খবর দিতে। তিনি অশ্বত্থামাকে জানাতে বলেছিলেন কীভাবে ভীম অন্যায়-যুদ্ধে তাঁর ঊরুযুগল ভঙ্গ করেছে এবং কীভাবেই বা অন্যান্য কুরুবীরদের অন্যায়ভাবে মারা হয়েছে। দুর্যোধনের পরিচর স্তুতিপাঠকেরা দুর্যোধনের সমস্ত কথা, সমস্ত ক্ষোভ-দুঃখ অশ্বত্থামার কাছে এসে জানাল— তে দ্রোণপুত্রমাসাদ্য যথাবৃত্তং ন্যবেদয়ন্‌।

বার্তাবাহকদের কাছে সমস্ত পরিস্থিতি শুনে অশ্বত্থামা, কৃপাচার্য এবং কৃতবর্মা দ্রুতগামী অশ্বে চড়ে রণস্থলে এসে পৌঁছলেন। তাঁদের নিজেদের শরীরও তখন একেবারেই ঠিক নেই, আঠেরো দিনের উপর্যুপরি যুদ্ধে তাঁদের শরীর ক্ষত-বিক্ষত, বিধ্বস্ত। তবু এইরকম মর্মান্তিক খবর শুনে তাঁদের মনের মধ্যে অসম্ভব গতি তৈরি হল এবং সেই গতি অশ্বের গতির রূপ পরিগ্রহণ করল খানিকটা। তাঁরা এসে দেখলেন— ভূপাতিত নরপতি দুর্যোধন রক্তাক্ত দেহে দারুণ বেদনায় ছটফট করছেন, ধূলিধূসর দেহে এপাশ-ওপাশ করছেন, তাতে যন্ত্রণা যদি কিছু কমে— বিবর্তমানং বহুশো রুধিরৌঘ-পরিপ্লুতম্‌। তবু এ অবস্থাতেও তাঁর অহংকার যায়নি অথবা ক্রোধ চলে যায়নি। স্বার্থলোভী ধনলোভীরা রাজাকে মারবার জন্য যেমন ঘিরে দাঁড়ায়, রক্তমাংসলোভী পশুরা সেইভাবেই ঘিরে দাঁড়িয়েছিল অপেক্ষায়। কিন্তু তবু তারা তাঁর শরীরের কাছাকাছি আসার সাহস পাচ্ছিল না, তার কারণ ওই অর্ধশায়িত অবস্থাতেও তাঁর মুখমণ্ডলে ক্রোধের ভ্রুকুটি প্রকট হয়ে উঠছিল। অসহ্য বেদনায় এবং অসহ্য ক্রোধে তাঁর চোখদুটিও ওপরে উঠে যাচ্ছিল বারবার— ভ্রুকুটি কৃত-বক্ত্রান্তং ক্রোধাদুদ্‌বৃত্তচক্ষুষম্‌।

সম্রাট দুর্যোধনের এই আকস্মিক দুর্দশা দেখে হতবাক অশ্বত্থামা রথ থেকে নামলেন। সঙ্গে শারদ্বত কৃপাচার্য এবং হার্দিক্য কৃতবর্মা। তাঁরা দুর্যোধনের কাছে গিয়ে বসলেন ভূতলে। অশ্বত্থামার চোখ ফেটে জল এল। বললেন— কী করে এমনটা হয়, বন্ধু! যিনি এই পৃথিবীর রাজা ছিলেন, যাঁর আজ্ঞায় সবকিছু চলত— ভূত্বা হি নৃপতিঃ পূর্বং সমাজ্ঞাপ্য চ মেদিনীম্‌— সেই মানুষটা আজ নির্জন একাকী পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে! কী করে হয় এটা? এই পৃথিবীতে মানুষের ভাগ্য কী এমনই হয়। কোথায় তোমার কর্ণ, দুঃশাসন, অন্যান্য বন্ধুরা! কোথায় তোমার রাজছত্র, চামর, অথবা কোথায় সেই বিশাল সৈন্যবাহিনী! ক্ক তে তদমলং ছত্রং ব্যজনং ক্ক চ পার্থিব। অশ্বত্থামা বিলাপ করতে থাকলেন স্বগত উক্তিতে। দুর্যোধন তাঁর সাড়া পেয়ে কোনওরকমে চোখ কচ্‌লে মুছে বললেন— কালের গতি, কী আর করা যাবে। তবে হ্যাঁ, যুদ্ধে আমি কোনও সংকটেই পিছিয়ে আসিনি, বদমাশরা আমাকে অন্যায়ভাবে মেরে গেছে। তবু ভাল, তোমরা এখনও বেঁচে আছ। আমার জন্য তোমরা কোনও দুঃখ কোরো না। আমি ক্ষত্রিয়ের ধর্ম থেকে চ্যুত হইনি, এমনকী স্বয়ং কৃষ্ণও সেটা আমাকে দিয়ে করাতে পারেনি। কিন্তু দৈবকে শেষপর্যন্ত এড়ানো গেল না। তাই আজ এই দশা!

দম্ভী দুর্যোধনের মুখে এমন হতাশার কথা শুনে অশ্বত্থামা একেবারে জ্বলে উঠলেন। হাতে হাত ঘষটে, দাঁতে দাঁত ঘষে তিনি দুর্যোধনকে সাশ্রুকণ্ঠে বললেন— অসভ্য পাঞ্চালেরা আমার বাবাকে মেরেছিল, তাতেও আমি যত দুঃখ পাইনি, কিন্তু ছলনা করে এইভাবে তোমাকে মারায় আমি তার থেকে বেশি দুঃখ পেয়েছি। আমি আমার সমস্ত পুণ্যসঞ্চয়ের শপথ নিয়ে বলছি, তুমি আদেশ করো, আমি কৃষ্ণের সামনেই সমস্ত পাঞ্চালদের শেষ করে ছাড়ব— সর্বোপায়ৈর্হি নেষ্যামি যমরাজ-নিবেশনম্‌। অশ্বত্থামার মুখে আবারও সেই জন্মশত্রু পাঞ্চালদের কথা, তিনি পাণ্ডবদের কথা বলেন না, হয়তো বা বুঝে গিয়েছিলেন যে, কোনওভাবেই অর্জুন-ভীমকে মেরে ফেলা বা শায়েস্তা করা তাঁর পক্ষে সম্ভব নয়। এই পাঞ্চাল-বধের ক্ষেত্রেও দুর্যোধনের একটা অঙ্ক মেলে। সেই ভীষ্ম থেকে আরম্ভ করে শল্য পর্যন্ত যতগুলি সেনাপতি দুর্যোধন স্থির করেছেন, তাঁরা সকলে মারা গেছেন, কিন্তু পাণ্ডবপক্ষে প্রথম যিনি সেনাপতি নিযুক্ত হয়েছিলেন, সেই পাঞ্চাল ধৃষ্টদ্যুম্ন কিন্তু এখনও অক্ষত শরীর অর্থাৎ এখনও তিনি সেনাপতি। অন্তত তাঁকে হত্যা করতে পারলেও যে পাণ্ডবদের বেশ একটা ক্ষতি করা যাবে, সেটাও দুর্যোধনের বড় কাম্য। তা ছাড়া এই মুহূর্তে অশ্বত্থামা দুর্যোধনের কষ্টে এবং ক্রোধে এতটাই একাত্ম যে, পাঞ্চালদের সঙ্গে দু’-একজন পাণ্ডবকে বধ করাটাও অশ্বত্থামার পক্ষে অসাধ্য নয়, অন্তত মৃত্যুপথগামী দুর্যোধন এখনও এই আশা করেন হয়তো।

যাই হোক, যে মুহূর্তে অশ্বত্থামা পাণ্ডবপক্ষীয়দের বধের ব্যাপারে শেষবারের মতো উৎসাহী হয়েছেন, সেই মুহূর্তেই দুর্যোধনও নতুনভাবে উৎসাহিত হলেন। লক্ষণীয়, অশ্বত্থামা তাঁর বন্ধুকৃত্য করার জন্য দুর্যোধনের অনুমতিমাত্র চেয়েছিলেন— অনুজ্ঞান্তু মহারাজ ভবান্‌ মে দাতুমর্হতি। কিন্তু তার উত্তরে দুর্যোধন যা করলেন এবং অশ্বত্থামা সেটাকে যেভাবে গ্রহণ করলেন, তাতে দুইজনেরই বিচিত্র মনস্তত্ত্ব ধরা পড়ে। অশ্বত্থামা অনুমতি প্রার্থনা করতেই দুর্যোধন কৃপাচার্যকে বললেন— আচার্য! আপনি খুব তাড়াতাড়ি এক কলসি জল এনে দিন আমাকে। সব বুঝে বিনা-বাক্যব্যয়ে আচার্য জল আহরণ করলেন সুশোভিত কুম্ভে। দুর্যোধন বললেন— আচার্য! আপনি যদি আমার প্রিয়-সাধন করতে চান, তা হলে আমার আদেশে অশ্বত্থামাকে সেনাপতি-পদে অভিষিক্ত করুন— সৈনাপত্যেন ভদ্রং তে… দ্রোণপুত্রোহভিসিচ্যতাম্‌। দুর্যোধনের আদেশ মেনে কৃপাচার্য অশ্বত্থামার মাথায় অভিষেকের জল ঢেলে দিলেন। অভিষেকের কোনও মন্ত্র উচ্চারিত হল না হয়তো, বন্দিরা আবেগে গাইল না স্তুতি-গান, একটি তুরী-ভেরীরও শব্দ হল না আচম্বিতে— অশ্বত্থামা, অভিষেক-আর্দ্রশির আলিঙ্গন করলেন অর্ধশায়িত দুর্যোধনকে, কৃতজ্ঞতায়— সোহভিষিক্তো মহারাজ পরিষ্বজ্য নৃপোত্তমম্‌— উপর্যুপরি সিংহনাদে দশদিক আরাবিত করে অশ্বত্থামা এগিয়ে চললেন স্বকার্য সাধনের জন্য। কৃপাচার্য এবং কৃতবর্মা দুর্যোধনকে দেখে দুঃখিতচিত্তে অনুসরণ করলেন অশ্বত্থামাকে।

কুরুক্ষেত্র-যুদ্ধের সবচেয়ে অনুচ্চারিত অথচ কী গুরুত্বপূর্ণ এই অভিষেক! কত আগেই এই তরুণ অশ্বত্থামাকে অভিষিক্ত করা যেত, অথচ রাজকীয় সংবরণ-ক্ষমতায় অথবা ইচ্ছাকৃতভাবেই দুর্যোধন তাঁকে কোনও সুযোগ দেননি দ্রোণবধের পর। অথচ কী উপযুক্তই না ছিল সেই সময়। তারপর অশ্বত্থামার সেই উৎসাহ হারিয়ে গেছে, হারিয়ে গেছে কত উন্মাদনা, অথচ অন্তরে-অন্তরে কত বাসনা সুপ্ত ছিল সেনাপতি হবার। আর ছিন্নশয়নে অর্ধশায়িত অবস্থাতেও রাজা দুর্যোধন কতখানি মনস্তত্ত্ব বোঝেন, তিনি অশ্বত্থামার সুপ্ত বাসনালোক থেকে আকর্ষণ করে আনলেন সেই অহংকার, যা ধ্বংস করতে পারে সব কিছু। দুর্যোধন জানেন বা তিনি বুঝেছেন— যে মানুষটা তাঁর সঙ্গে গোপনে দেখা করে তখনই একত্রে যুদ্ধ করতে চাইছিল, সেই মানুষটা পাণ্ডব-পাঞ্চালদের পদশব্দ শোনামাত্রেই অন্যত্র লুকাল। আবার যখন সে ফিরে এল, তখন তো দুর্যোধন নিজেই শেষ হয়ে গেছেন। কিন্তু এই অবস্থাতেও সেই মৃতপ্রায় মানুষটির মুখ থেকে সেনাপতির উপাধিটি কত অপেক্ষিত অশ্বত্থামার কাছে। সৈন্য-সামন্ত নেই, ঢাল-তরোয়াল নেই— দুর্যোধন বুঝেছেন— অশ্বত্থামা সম্মুখ-যুদ্ধে যাবেন না, কেন না তা হলে পাণ্ডব-পাঞ্চালদের গলার স্বর শুনেই তিনি পালিয়ে যেতেন না, তখনই সম্মুখ যুদ্ধ করতেন। কিন্তু আজ অশ্বত্থামা গোপনে তাঁর যুদ্ধাভিসার সম্পন্ন করবেন বলেই বিনা-কোনও-আড়ম্বরে নির্জন বনের মধ্যে মুমূর্ষু অবস্থাতেও অশ্বত্থামার সুচিরকাঙ্ক্ষিত সেনাপতি পদে তাঁকে অভিষিক্ত করলেন দুর্যোধন। আর অশ্বত্থামা! আকস্মিক সিংহনাদে বনস্থান আকম্পিত করে যুদ্ধে চললেন— প্রযযৌ সিংহনাদেন দিশঃ সর্বা নিনাদয়ন্‌।

দুর্যোধন পড়ে রইলেন রক্তক্ষরিত রক্তশয্যায়। রাতের আঁধার নেমে এল চারিদিকে। অশ্বত্থামার সিংহনাদ স্তব্ধ হতে সময় লাগল না। অশ্বত্থামা তাঁর দুই সঙ্গীর সঙ্গে সঙ্গে চলতে চলতে শিবিরের কাছাকাছি এসে উপস্থিত হলেন। বেগবান অশ্বের গতিতে শব্দ হয় বলেই পাণ্ডবদের ভয়ে ভীত হয়ে অশ্বগুলি ছেড়ে দিয়ে তাঁরা একটি বনের কাছাকাছি এসে গুপ্তভাবে অবস্থান করতে আরম্ভ করলেন— বিমুচ্য বাহাংস্ত্বরিতা ভীতা সমভবংস্তদা। শরীর তাঁদেরও ভাল নেই, সারা অঙ্গে অস্ত্রের ক্ষত এবং পরিশ্রান্তিতে ততোধিক বেদনা। কিন্তু দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই যখন পাণ্ডবদের জয়-কোলাহল শুনতে পেলেন তখনই তাঁদের শঙ্কা তৈরি হল মনে— যদি কোনওভাবে শত্রুশঙ্কায় পাণ্ডবরা তাঁদের অনুসরণ করেন— অনুসার-ভয়াদ্‌ভীতাঃ প্রাঙ্‌মুখাঃ প্রাদ্রবন্‌ পুনঃ— সেই ভয়ে তাঁরা আগে দক্ষিণ দিকে যেতে থাকলেও এখন পুবদিকে দৌড় লাগালেন ঘোড়ায় চড়ে। ঘোড়াগুলি আগে থেকেই ক্লান্ত হয়েছিল। একটু পথ দোড়েই তারা ফের ক্লান্ত হয়ে পড়ল। আর এই তিন যোদ্ধাও তখন শ্রান্ত, পিপাসার্ত। তাঁরা আবারও দাঁড়ালেন সেখানে— মৃত্যুপথযাত্রী দুর্যোধনের কথা ভেবে কিছুতেই তাঁদের ক্রোধ প্রশমিত হল না।

বৃক্ষ-লতায় আবৃত বনের মধ্যে নিজেরা জল খেয়ে এবং ঘোড়াদের জল খাইয়ে অশ্বত্থামা, কৃপ এবং কৃতবর্মা খানিকটা সুস্থ হলেন যেন। কিন্তু এই সন্ধ্যা-উত্তীর্ণকালে একবারও সেনাপতি অশ্বত্থামা নিজেকে প্রশ্ন করলেন না যে, সেনাপতিত্ব লাভের এই কি তাৎপর্য! কীভাবে তাঁরা যুদ্ধ করবেন, তাঁরা তো সম্মুখ যুদ্ধ অথবা পাণ্ডব-পাঞ্চালদের দৃষ্টিপাত বাঁচিয়ে প্রায় পালিয়ে বেড়াচ্ছেন, অথচ রাগটাও তাঁদের ষোলো আনা আছে। সেই বনের মধ্যে এক বিশাল বটগাছের তলায় তাঁরা চারদিক দেখলেন ভাল করে। এর মধ্যেই রাতের আঁধার গভীর গভীরতর হয়ে উঠল। আকাশে চাঁদ-তারার মেলা বসল। দিবসচর পশুপাখি ঘুমিয়ে পড়ল, আর রাত্রিচর পশু-পাখিরা স্বকর্ম সাধনে ব্যস্ত হয়ে উঠল। অশ্বত্থামা-কৃপাচার্যরা খানিকক্ষণ পাণ্ডব-কৌরবের ক্ষয়-ক্ষতির আলোচনা করতে থাকলেন, ইতোমধ্যে পরিশ্রান্ত বৃদ্ধ দেহে ঘুম নেমে আসল কৃপাচার্যের এবং তাঁকে দেখেই বোধহয় কৃতবর্মাও ঘুমিয়ে পড়লেন সেই বটবৃক্ষের তলায়— ততো নিদ্রাবশং প্রাপ্তৌ কৃপভোজৌ মহারথৌ।

কিন্তু ক্রোধ এবং অসহিষ্ণুতা যাঁর অন্তর অধিকার করে আছে, সেই অশ্বত্থামা কিন্তু ঘুমোতে পারলেন না— ন লেভে স তু নিদ্রাং বৈ দহ্যমাননা হি মন্যুনা। রাতজাগা অনিমেষ চোখে অশ্বত্থামা বনভূমির চতুর্দিকে দৃষ্টিপাত করতে আরম্ভ করলেন। হঠাৎই খেয়াল হল— অসংখ্য কাক এই বটবৃক্ষকে আশ্রয় করে রাত্রি কাটায়। একটু আগেই শত শত কাককে তিনি দেখেছেন আসন্ন সন্ধ্যায় কুলায়ে ফিরে আসতে। এখনও রাতের প্রথম আঁধারে কাকেদের কর্কশ কা-কা শোনা যাচ্ছে মাঝে মাঝেই। অশ্বত্থামা দেখলেন— যুদ্ধশ্রম আর পথশ্রমে কৃপাচার্য আর কৃতবর্মা খানিকক্ষণ কথার বলার পরেই ভূমিতে গা এলিয়ে দিলেন এবং মুহূর্তের মধ্যে গভীর নিদ্রায় আচ্ছন্ন হলেন। অথচ তাঁর চোখে ঘুম না থাকায় শেষে অসংখ্য বায়স-কুলের গতিবিধি লক্ষ করে অসহিষ্ণু মনটাকে কিছু শিথিল করার চেষ্টা করলেন অশ্বত্থামা।

অশ্বত্থামা দেখলেন— রাত যত গভীর হল, কাকেরা ততক্ষণে নিশ্চেষ্ট নিদ্রিত হয়ে গেল। এই অবস্থায় হঠাৎই অন্ধকারের আবরণ ভেঙে কোথা থেকে একটি বড়সড় কালো পেঁচা উড়ে এল বটগাছের ডালে। পেঁচাটি কাকেদের নিশ্চিন্ত নিদ্রার ব্যাপারে নিশ্চিত হয়ে এক ডাল থেকে আর এক ডালে গিয়ে কাকগুলিকে মারতে লাগল— সুপ্তান্‌ জঘান সুবহূন্‌ বায়সান্‌ বায়সান্তকঃ। শুধু প্রাণে মারাই নয়, সে কতগুলি কাকের পাখা কেটে দিল তীক্ষ্ণধার চঞ্চুতে, কতগুলির পা ভেঙে দিল, আর কতগুলির গলা কেটে নীচে ফেলে দিল। কাককুলের অধিকাংশ ধ্বংস করে বিশাল পেচক শত্ৰুসংহারের আনন্দ লাভ করল।

অন্ধকার বনস্থলীর মধ্যে কৃপ-কৃতবর্মা যখন গভীর ঘুমে অচেতন, তখন এই পেঁচার শত্ৰুসংহার-কৌশল অশ্বত্থামার মনে বিদ্যুতের ঝিলিক দিয়ে গেল। এই রাত্রিচর পেচক তাঁকে চির-অপেক্ষিত প্রতিশোধ-বৃত্তির ইন্ধন জুগিয়ে দিল— উপদেশঃ কৃতোহনেন পক্ষিণা মম সংযুগে। অথচ এই সংকট মুহূর্তে অশ্বত্থামা যেন নিজেকেও চিনলেন অনেক সহজ করে। তিনি ভাবলেন— কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের এই বিরাট জয় এখন পাণ্ডবদের উত্তপ্ত করে রেখেছে। এখন যে কোনও শত্রুই তাঁদের কবলে পড়লে তাঁর মৃত্যু অনিবার্য। অতএব ন্যায়যুদ্ধে পাণ্ডবদের কিছু করা যাবে না, অন্যায়ের পথেই যেতে হবে। অশ্বত্থামা মনে মনে স্বীকার করলেন যে, দুর্যোধনের কাছে আমি প্রতিজ্ঞা করেছি বটে, কিন্তু পাখা-ওঠা পিঁপড়ে যদি আগুন-নাশের প্রতিজ্ঞা করে আগুনে ঝাঁপায়, তা হলে যেমন নিজের বিনাশ ডেকে আনে, তেমনই পাণ্ডব-বিনাশের প্রতিজ্ঞাতেও আমার নিজের বিনাশের সম্ভাবনাই বেশি— পতঙ্গাগ্নি-সমাং বৃত্তিমাস্থ্যাত্মবিনাশিনীম্‌।

অশ্বত্থামার এই বাস্তব-বোধ আমাদের মতে আজকে তৈরি হয়নি। দ্রোণাচার্য বধের পর ভীষণ প্রতিজ্ঞা নিয়ে যুদ্ধ করতে গিয়েও তিনি কতগুলি সাধারণ সৈন্য ধ্বংস করে চলে এসেছেন, পাণ্ডবদের তিনি কিছুই করতে পারেননি। হয়তো কিছুই করতে পারেননি বলে তাঁর আক্রোশ এবং হতাশাও অনেক বেড়েছে। একসময় তিনি যুদ্ধ বন্ধ করার কথাও বলেছিলেন দুর্যোধনকে এবং সেটা অবশ্যই হতাশায়। আবার অবশ্য পাণ্ডব-বধের প্রতিজ্ঞাও করেছিলেন এবং সেটা অবশ্যই আক্রোশে। আজ তিনি অনুধাবন করছেন— আক্রোশ, হতাশা সব অতিক্রম করে তাঁকে কার্যসাধন করতে হবে এবং সেটা ন্যায়ের পক্ষে নয়, অন্যায় এবং ছল দিয়েই করতে হবে— ছদ্মনা তু ভবেৎ সিদ্ধিঃ শত্রূণাঞ্চ ক্ষয়ো মহান্‌— না হলে নিজেরই প্রাণসংশয়।

কার্যসাধনের মধ্যে যদি প্রত্যক্ষতঃ কোনও অন্যায় থাকে, তা হলে স্বযুক্তি সম্প্রসারণ করে মানুষ নিজের মনেই একটা বুঝ নিতে থাকে। অশ্বত্থামার ক্ষেত্রেও এটা হল। তিনি মনে মনে নীতিশাস্ত্র, যুদ্ধশাস্ত্র এবং পরপক্ষের অন্যায় আচরণের কথাগুলি ভাবতে লাগলেন নিজেকে সমর্থন করার জন্য। সত্যিই তো, নীতিশাস্ত্র বলে— যে-কাজের ফল সন্দেহ আছে, আর যার ফল নিশ্চিত, সেখানে নিশ্চিত কাজটাই করা উচিত। যুদ্ধের নীতি-নিয়মেও কতগুলি নীতি-নিয়ম শাস্ত্ৰপরম্পরায় নেমে এসেছে, কিন্তু সেসব নিয়ম মানে ক’জন। এমন শাস্ত্রও প্রসিদ্ধ আছে যে, শত্রু পরিশ্রান্ত হোক অথবা খাওয়া-দাওয়াই করুক, পালাচ্ছে হোক, ঘুমোচ্ছে হোক, অথবা গুহায় ঢুকেছে এমন হোক, সেই অবস্থাতেও তাদের মারো। তা ছাড়া পাণ্ডবরাই বা ক’টা নীতি-নিয়ম মেনেছে, তারাও তো প্রতিপক্ষ-বধের জন্য পদে পদে অন্যায় করেছে— নিন্দিতানি চ সর্বাণি কুৎসিতানি পদে পদে। এতরকম যুক্তি মনের মধ্যে নিরন্তর চর্চা করতে করতে অশ্বত্থামা ঠিক করে ফেললেন— পাঞ্চালদের সঙ্গে পাণ্ডবদের তিনি রাতের আঁধারে নিদ্রিত অবস্থায় গুপ্তহত্যা করবেন— ইত্যেবং নিশ্চয়ং চক্রে সুপ্তানাং নিশি মারণে।

রাতের অন্ধকারে যখন রাত্রিচর পশুপাখির শব্দ ছাড়া আর সব নিস্তব্ধ, তখন অশ্বত্থামা গা ঝাঁকিয়ে কৃপাচার্য এবং কৃতবর্মাকে ঘুম থেকে জাগালেন। ঘুম-চোখে অশ্বত্থামার পরিকল্পনার কথা শুনে কৃপ এবং কৃতবর্মা কোনও কথাই বলতে পারলেন না। অশ্বত্থামা দুর্যোধনের ওপর পাণ্ডবদের অন্যায় ব্যবহার এবং অবশেষে পাঞ্চালদের বাঁধনহীন জয়োচ্ছ্বাসের কথা বারবার বলে কৃপ-কৃতবর্মার ক্রোধ উদ্ৰিক্ত করার চেষ্টা করলেন। শেষে বললেন— পাণ্ডবরা যে মহামারী ঘটিয়েছে তাতে আমরা তিনজন মাত্র বেঁচে আছি এবং সময়টা এখন পরিবর্তিত হয়েছে বলেই আমাদের হাতেই এই যুদ্ধের শেষঅঙ্কের দৃশ্য-রচনা হবে। কৃপাচার্য তিনজনের মধ্যে বৃদ্ধতম এবং ধীর ব্যক্তিও বটে। তিনি খানিকটা বোঝানোর চেষ্টা করলেন অশ্বত্থামাকে। দৈব এবং পুরুষকারের সার্থক সংমিশ্রণেই যে কার্যসিদ্ধি হয় সে-কথা বোঝাতে বোঝাতে কৃপাচার্য বললেন— দুর্যোধন কোনওদিন কারও কথা শোনেনি, একটা অভিজ্ঞ লোকের পরামর্শ শোনেনি এবং আমরা হাজারবার বারণ করা সত্ত্বেও অধিগুণসম্পন্ন পাণ্ডবদের সঙ্গে পদে পদে শত্রুতা আচরণ করেছে। অথচ আমরা কিন্তু বদমাশ লোকটারই অনুসরণ করে এসেছি, ফলে আমাদের অবস্থাটাও কিন্তু খারাপ হয়ে গেছে। তা ছাড়া এই সময়ে আমার বুদ্ধিও বিকল হয়ে গেছে, আমার মাথায় কিছু আসছে না।

অশ্বত্থামার এই পরামর্শ পছন্দ হল না। তিনি বললেন— প্রত্যেকের নিজের নিজের বুদ্ধি নিজের নিজের কাছে; প্রত্যেকেই নিজের বুদ্ধির প্রশংসা করে এবং পরের বুদ্ধির নিন্দে করে— পরবুদ্ধিঞ্চ নিন্দন্তি স্বাং প্রশংসন্তি চাসকৃৎ। তা ছাড়া এটাও তো ঠিক যে, মানুষের মনের পরিবর্তন এবং স্থান-কাল-পাত্রের পরিবর্তনে মন এবং বুদ্ধিরও পরিবর্তন হয়। অশ্বত্থামার ইঙ্গিতটা বোঝা যায়। পিতা দ্রোণ এবং পাঞ্চাল দ্রুপদের সম্পর্কের নিরিখে পাঞ্চাল-মাএেই তাঁর ক্রোধ থাকতেই পারে, কিন্তু পাণ্ডবদের নানান সংকটে তাঁর বাহ্যিক ঔদাসীন্য থাকলেও, তিনি তাঁদের ওপর ক্ষুব্ধ-ক্রুদ্ধ ছিলেন না, বরঞ্চ অনেক ব্যাপারে তাঁদের সমব্যথীই ছিলেন। অথচ কাল, ঘটনা এবং অশ্বত্থামার মনের আমূল পরিবর্তন ঘটল পিতা দ্রোণাচার্যের মৃত্যুর পর। ধৃষ্টদ্যুম্ন পাঞ্চাল দ্রোণের মৃত্যু ঘটিয়েছেন প্রত্যক্ষভাবে কিন্তু তিনি পাণ্ডবপক্ষের লোক, তাঁদের সেনাপতি। বিশেষত ভীম, যুধিষ্ঠির এবং কৃষ্ণও দ্রোণাচার্যের মৃত্যুর জন্য পরোক্ষভাবে দায়ী। আর আজ দুর্যোধনের অসহায় করুণ অবস্থা দেখে অশ্বত্থামা যুক্তি দিয়ে বলছেন— আজকের যে বিপন্নতা সেই বিপন্নতা থেকেই আমার এই বুদ্ধি তৈরি হয়েছে যে, পাণ্ডব-পাঞ্চালদের আমি ছাড়ব না— উপজাতা ব্যসনজা সেহয়ম্‌ অদ্য মতির্মম। আমি বামুনের ঘরে জন্মেছি কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত ক্ষত্রিয়ের ধর্ম পালন করি, অতএব পিতার মৃত্যু দেখেও আমি যদি তার প্রতিশোধ না নিই তা হলে জনসমাজে কী বলে আমি আমার কর্মপন্থা সমর্থন করব— পিতরং নিহতং দৃষ্ট্বা কিং নু বক্ষ্যামি সংসদি।

অশ্বত্থামা শেষপর্যন্ত নিজের অন্যায় পরিকল্পনাতেই স্থিত থাকলেন। পাঞ্চাল-রাজপুত্র এবং পাণ্ডবদের ছেলেরা যে শ্রান্ত ক্লান্ত হয়ে নিজেদের শিবিরে ভূতলে শয়ন করেছেন, এ-খবর তাঁর কাছে আগে থেকেই আছে। তিনি কৃপাচার্য-কৃতবর্মাকে জানালেন যে, রাতের আঁধারে শিবিরে ঢুকে তিনি এঁদের প্রত্যেককে যমের বাড়ি পাঠাবেন— অদ্য তান্‌ সহিতান্‌ সর্বান্‌ ধৃষ্টদ্যুম্ন-পুরোগমান্‌। কৃপাচার্য যখন দেখলেন যে, অশ্বত্থামা তাঁর অন্যায় পরিকল্পনা থেকে কিছুতেই সরে আসবেন না, তখন তিনি একটু সময় কাটাতে চাইলেন। বললেন— ঠিক আছে, পিতার মৃত্যুর প্রতিশোধ নিতে চাইছ তুমি। আজ রাত্তিরটা শুধু বিশ্রাম করো। কাল সকালে আমি, তুমি, কৃতবর্মা সবাই মিলে প্রচণ্ড বিক্রমে ঝাঁপিয়ে পড়ব পাণ্ডব-পাঞ্চালদের ওপর। আর অশ্বত্থামা যদি যুদ্ধ করে এবং কৃপ-কৃতবর্মা যদি পাশ থেকে তাকে রক্ষা করে, তবে দেবরাজ ইন্দ্র আসলেও অশ্বত্থামাকে কিছু করতে পারবে না— কো দ্রৌণিং যুদ্ধসংবব্ধং যোধয়েদপি দেবরাট্‌— অতএব আজকের রাতটুকু শুধু বিশ্রাম করো, ভাল করে ঘুমোও, কাল সকালে সব হবে। কৃপাচার্যের এই শান্ত বিচার, সম্মুখ-যুদ্ধের পরিকল্পনা যতই ক্ষাত্রোচিত শুনতে লাগুক, অশ্বত্থামার সেটা পছন্দ হল না। বিশেষত উদ্যত অবস্থায় যদি কাউকে থামিয়ে দেবার চেষ্টা করা হয়, তবে তার রাগ আরও বাড়ে। অশ্বত্থামারও তাই হল। তিনি রেগে বললেন— ঘুম! আমার ঘুম আসবে কোত্থেকে? যে বিপন্ন আতুর, যে লোক ক্রুদ্ধ, যে মানুষ প্রয়োজন-সিদ্ধির কথা নিরন্তর ভাবছে এবং যে লোকের মনে মারণ-ভাবনাটাই একান্ত অভীষ্ট হয়ে দাঁড়িয়েছে, সে লোক ঘুমোবে কী করে। এর যে কোনও একটা হলেই ঘুম আসবে না, আর আমার তো চারটেই হয়েছে।

অশ্বত্থামা তাঁর সমস্ত যুক্তি দিয়ে আবারও বোঝালেন যে, পিতার মৃত্যুর জন্য শেষ আঘাত যার কাছ থেকে এসেছিল, সেই ধৃষ্টদ্যুম্ন তাঁর প্রধানতম শত্রু। তিনি বেঁচে থাকতেও পিতার এই নৃশংস মৃত্যু এবং তিনি বেঁচে থাকতেই তাঁর মিত্রপক্ষের সর্বাধিনায়ক দুর্যোধনের করুণ ভগ্নদশা কিছুতেই তিনি সহ্য করবেন না। কিন্তু এই বিধ্বস্ত, ক্রোধরক্ত অবস্থাতেও অশ্বত্থামার এই বাস্তব জ্ঞান একেবারে টনটনে। তিনি বলছেন— সকালবেলায় ঘুম থেকে উঠলে কৃষ্ণ আর অর্জুন যখন আমার শত্রুদের সুরক্ষিত রাখবে, তখন তাঁদের মারার সাধ্য হবে না কারও। অতএব আজ এখুনি আমি যুদ্ধে যাব এবং নিদ্রিত অস্থাতেই আমি সংহারলীলা চালাব। আমার ক্রোধ আমি সংযত করতে পারছি না— ন চাম্মি শক্তঃ সংযন্তুং কোপমেতং সমুত্থিতম্‌।

এটাই অশ্বত্থামার চরিত্রের প্রধানতম বৈশিষ্ট্য— তাঁর ক্রোধ তিনি কিছুতেই দমন করতে পারেন না। কৃপাচার্য নিজেই বলেছেন এবং বুঝেছেন যে, অশ্বত্থামার যে সামাজিক অবস্থান, যে পিতার তিনি পুত্র এবং যেভাবে তিনি বড় হয়ে উঠেছেন, তাতে বড়দের হিতবাক্য তাঁর শোনার কথা, কিন্তু তাঁর স্বভাব-গঠনের পিছনে দ্রোণাচার্যের প্রশ্রয় ছিল, তাঁর প্রবণতার নির্মাণ-চক্রে দারিদ্র-দুঃখ-দহনের জ্বালা থেকে আরম্ভ করে যে পরাশ্রয়টুকু ঘটেছে, সেই পরাশ্রয়ের মধ্যেও অভিমান ছিল। ফলত বুদ্ধিমান হয়েও তিনি নম্রতার শিক্ষা পাননি, সংযমের শিক্ষাও নয়। কৃপাচার্য বুঝতে পারছেন— ক্ষত্রিয়ে যুদ্ধজয় নয়, ব্রাহ্মণের ক্ষমাও নয়, অশ্বত্থামা এক দুরন্ত যশোহানির পথে এগিয়ে চলেছেন। সারাজীবন প্রায় আচার্যের ভূমিকায় অবস্থিত থেকে আজ সেই চরিত্রে মসীবিন্দুর কলঙ্করোপণ ঘটবে লোকনিন্দায়— শুক্লে রক্তমিব ন্যস্তং ভবেদিতি মতির্মম।

অশ্বত্থামা জানালেন— মাতুল! আপনি যেসব কথা বলছেন, সেসব খুব ভাল কথা, ন্যায় এবং ধর্মের কথা। কিন্তু সেই ন্যায়, সেই ধর্ম তো পাণ্ডবরা আগেই ভেঙে খান খান করে দিয়েছে— তৈস্তু পূর্বময়ং সেতুঃ শতধা বিদলীকৃতঃ। অশ্বত্থামা আবারও ভীষ্ম, দ্রোণ, কর্ণ এবং দুর্যোধনের মৃত্যুর পিছনে অন্যায়ের স্থূল হস্তগুলি চিহ্নিত করলেন এবং সিদ্ধান্ত দিলেন— আমি ঘুমন্ত অবস্থাতেই ওদের মারব এবং আমাকে ফেরাতে পারে এমন লোক জন্মায়নি এবং জন্মাবেও না— ন স জাতঃ পুমাল্লোকে কশ্চিন্ন স ভবিষ্যতি। কথাটা বলেই অশ্বত্থামা কৃপ এবং কৃতবর্মার দিক থেকে মুখ ঘুরিয়ে ঘোড়া যুতে নিলেন রথে, তাঁদের উন্মুখ কোনও প্রতিক্রিয়ার অপেক্ষা করলেন না তিনি— একান্তে যোজয়িত্বাশ্বান্‌ প্রায়াদ্‌ অভিমুখঃ পরান্‌। অশ্বত্থামার এই আকস্মিক অভিযাত্রায় হতচকিত কৃপাচার্য এবং কৃতবর্মা পিছন থেকে চেঁচাতে থাকলেন— এটা কী করছ, অশ্বত্থামা! রথে ঘোড়া যুতে নিচ্ছ কেন? আমাদের স্বার্থ এক, একই উদ্দেশ্য নিয়ে আমরা দুর্যোধনের কাছে কথা দিয়ে এসেছি, আমাদের সুখ-দুঃখও সমান, আমাদের সন্দেহ করছ কেন তুমি? অশ্বত্থামা কথা বাড়ালেন না, পুনশ্চ শত্ৰু-সংহারের শপথ করে কৃপ-কৃতবর্মাকে যুদ্ধসজ্জায় সজ্জিত হয়ে তাঁর জন্য প্রতীক্ষা করতে বললেন।

অশ্বত্থামা রথ চালিয়ে দিতে কৃপাচার্য এবং কৃতবর্মা তাঁর অনুসরণ করলেন শুভৈষণায়। আস্তে আস্তে পাণ্ডব-শিবিরের সামনে এসে উপস্থিত হলেন তিনজন। সম্মুখেই শিবিরে প্রবেশ করার দ্বারদেশ। অশ্বত্থামা সকলের আগে গিয়ে দ্বার-সম্মুখে দাঁড়াতেই দেখলেন এক ভীষণ-দর্শন পুরুষ দ্বার রক্ষা করছেন শিবিরের। এখানে একটি অলৌকিক ঘটনার বিবরণ আছে মহাভারতে। অশ্বত্থামা এই ভীষণ পুরুষকে সরিয়ে দেবার জন্য অস্ত্র নিক্ষেপ করছিলেন এবং পুরুষটি সমস্ত অস্ত্র গিলে ফেলছিল। হতাশ অশ্বত্থামা এইসময় কৃপাচার্যের হিতবচন স্মরণ করছিলেন বটে, কিন্তু তিনি নিবৃত্ত হলেন না। সেই ভীষণ পুরুষকে পরাস্ত করতে না পেরে অশ্বত্থামা দেবদেব মহাদেবের স্মরণ গ্রহণ করলেন এবং তাঁকে তুষ্ট করার জন্য স্তব উচ্চারণ করলন। তুষ্ট হয়ে শিব দেখা দিলেন এবং অশ্বত্থামাকে একটি ধারালো তরবারি উপহার দিয়ে আপন তেজ নিবেশ করলেন অশ্বত্থামার মধ্যে।

এই ঘটনার মধ্যে অলৌকিকতা থাকুক, আমাদের মতো বিশ্বাসী ব্যক্তিরা তা বিশ্বাসও করুক তাতে অসুবিধে কী? কিন্তু অবিশ্বাসীর কাছে গবেষণার মর্ম জানিয়ে বলি— এ হল সেই সর্বশেষ ধ্বংসের সময় যার প্রতীক হলেন রুদ্র-শিব। তাঁর সংহার মূর্তি অশ্বত্থামা দর্শন করেছেন এবং সেই সংহার-মূর্তি আবিষ্ট হয়েছেন অশ্বত্থামার মধ্যে। লক্ষণীয়, অশ্বত্থামাকেও রুদ্র শিবের অংশ বলা হয়, হয়তো বা শেষে তিনি পাণ্ডবদের সন্তান-বীজ বিনাশ করে দিয়েছিলেন বলেই তাঁকে রুদ্রশিবের অংশ বলা হয়। আমরা এই অলৌকিকতার নিষ্কর্য এই বুঝি যে, অশ্বত্থামা মানসিকভাবে অস্থির ছিলেন, অতএব দেবদেব মহাদেবের সাকার মূর্তির ধ্যানে নিজেকে তিনি এমনভাবেই যুক্ত করেছিলেন যে, তিনি আত্মাহুতি দিতেও প্রস্তুত ছিলেন। ইন্দ্রিয়-মনোবুদ্ধির এই একতান সমন্বয়ই তাঁকে শেষপর্যন্ত নিজের কর্ম করার চরম শক্তি জুগিয়েছে— এটাকে আমরা আত্মভাবনার মধ্যে নিজের রুদ্র-সংকল্প জাগ্রত করার সাধন বলতে পারি, যে সাধনে রুদ্রশিব আবিষ্ট হন অশ্বত্থামার মধ্যে এবং তিনি জ্বলে ওঠেন স্বকর্ম সাধন করার জন্য— অথাবিষ্টো ভগবতা ভূয়ো জজ্বাল তেজসা।

পাণ্ডব-শিবিরের দ্বারে একটা ছোট্ট পরিকল্পনা হল। অশ্বত্থামা আগে থেকেই ঠিক করেছেন যে, তিনি ভিতরে প্রবেশ করে সুপ্ত বীরদের কুপিয়ে মারবেন, কিন্তু অশ্বত্থামার ব্যগ্রতা দেখেই হোক অথবা তাঁর সুরক্ষার জন্যই হোক এখন কিন্তু কৃপাচার্য এবং কৃতবর্মাও খানিকটা প্রস্তুত হয়ে গেছেন যুদ্ধের জন্য। তাঁরা প্রবেশ-দ্বারে দাঁড়াতেই অশ্বত্থামা বললেন— আমি এই শিবিরের ভিতরে ঢুকে আজ যমের খেলা খেলব, তোমরা শুধু খেয়াল রেখো যে দু’-একজন আমার হাত ছুটে এই দরজা দিয়ে বেরোবে, তারা যেন তোমাদের হাত থেকে মুক্তি না পায়— যথা ন কশ্চিদপি বাং জীবন্‌মুচ্যেত মানবঃ। শিবিরের দ্বার অপ্রশস্ত, অশ্বত্থামা লাফ দিয়ে ভিতরে প্রবেশ করলেন। এই শিবিরের কোথায় কে থাকবেন, সেটা আগে থেকেই গুপ্তচরের মাধ্যমে জানা ছিল অশ্বত্থামার। তিনি প্রথমেই ধৃষ্টদ্যুম্নের ঘরের ভিতরে প্রবেশ করলেন এবং দেখলেন ভূতলে প্রসারিত গদিওয়ালা বিছানায় অঘোরে ঘুমোচ্ছেন পাঞ্চাল-রাজকুমার ধৃষ্টদ্যুম্ন।

অশ্বত্থামার এতদিনের সঞ্চিত ক্রোধ, এত দিনের আক্রোশ, একজন নিশ্চেষ্ট যোগযুক্ত মানুষকে যিনি মেরেছিলেন, তাঁকেও লোকে ভাবে যেন ধৃষ্টদ্যুম্ন দ্রোণাচার্যকে যুদ্ধে জয় করে মেরেছেন— এই সঞ্চিত অপমান, অশ্বত্থামা বুকে বয়ে বেড়াচ্ছেন। অতএব প্রথমেই কষে তিনি একটি লাথি মারলেন ধৃষ্টদ্যুম্নের পিছনে— প্রাবোধয়ত পাদেন শয়নস্থং মহীপতে— ধৃষ্টদ্যুম্নকে জাগালেন অশ্বত্থামা। সেই পরিশ্রান্ত নিদ্রাবেশের মধ্যেও পাঞ্চাল-কুমারের বুঝতে বাকি রইল না যে, এটা অশ্বত্থামা দ্রৌণি। ধৃষ্টদ্যুম্ন উঠে বসতে যাচ্ছিলেন, সেই অবস্থায় পিছন থেকে তাঁর আস্কন্ধলম্বিত কেশ দুই হাতের মুষ্টির মধ্যে ধরে ধৃষ্টদ্যুম্নকে মাটিতে আছড়াতে লাগলেন অশ্বত্থামা— কেশেষ্বালম্ব্য পাণিভ্যাং নিষ্পিপেষ মহীতলে। ঘটনার আকস্মিকতা এবং অকাল-বোধনে সুখনিদ্রার আবেশ কেটে গেল, তার ওপরে এই আছাড়— ধৃষ্টদ্যুম্ন ভয়ে, শিথিলতায় নিজের কোনও অঙ্গই সঞ্চালন করতে পারলেন না। এর মধ্যে অশ্বত্থামা তাঁর গলা টিপে ধরছেন সবলে, কখনও বুকে মারছেন লাথি। ধৃষ্টদ্যুম্ন চিৎকার করতে লাগলেন খেসো গলায়, ছটফট করতে লাগলেন যন্ত্রণায়। কোনও মতে অস্পষ্ট স্বরে বললেন— আপনি আমাকে এইভাবে মারবেন না, হাতে অস্ত্র নিন, অস্ত্র দিয়ে মারুন আমাকে। কিন্তু অশ্বত্থামা এই সম্মানটুকু তাঁকে মোটেই দিতে রাজি নন, তিনি পশুর মতো মারতে লাগলেন ধৃষ্টদ্যুম্নকে— নদন্তং বিস্ফুরন্তঞ্চ পশুমারম্ অমারয়ৎ।

অশ্বত্থামা বললেন— অস্ত্রের আঘাতে ক্ষত্রিয়ের যে সম্মানিত মৃত্যু, তার যোগ্য নোস তুই। যেভাবে তুই গুরুহত্যা করেছিস তাতে এই লাথি-কিল-আর চড়েই তোর জীবন যাওয়া উচিত। কথাটা বলেই অশ্বত্থামা তাঁর পায়ের গোড়ালি দিয়ে চেপে ধরলেন ধৃষ্টদ্যুম্নের কণ্ঠনালি— মর্মস্বভ্যবধীৎ ক্রুদ্ধঃ পাদাষ্ঠীলৈঃ সুদারুণৈঃ। ধৃষ্টদ্যুম্নের কণ্ঠহীন অস্পষ্ট আর্তনাদে ততক্ষণ ঘরের মেয়েরা জেগে উঠেছে, জাগরিত হয়েছে রক্ষক পুরুষেরা। কিন্তু অশ্বত্থামা যেভাবে গোড়ালির চাপে ধৃষ্টদ্যুম্নকে নিথর করে দিয়েছেন, তাতে রক্ষী পুরুষদের মুখ দিয়ে কথা বেরোল না, অস্ত্রচর্চা তো দূরের কথা। ধৃষ্টদ্যুম্নের দেহ নিথর হয়ে গেল। অশ্বত্থামা রথে উঠলেন, রক্ষী পুরুষেরা কী হয়েছে, কী হয়েছে বলে অশ্বত্থামাকে ঘিরে ধরতেই তারা কচুকাটা হলেন অশ্বত্থামার তরবারিতে। পাণ্ডবপক্ষের অন্যতম যোদ্ধা উত্তমৌজা এবং যুধামন্যু— মধ্যম মানের যোদ্ধা হলেও— তাঁরা কোনও প্রতিরোধই গড়ে তুলতে পারলেন না অশ্বত্থামার বিরুদ্ধে। তাঁরা বেঘোরে প্রাণ দিলেন। অদ্ভুত একটা উপমা দিয়েছেন মহাকবি, বলির পশুকে যূপকাষ্ঠে বাঁধলে যখন সে কঁপতে থাকে এবং তার অঙ্গগুলি এক এক জায়গায় কুণ্ডলী পাকিয়ে স্ফূরিত হতে থাকে, তখন পশুহন্তার খড়্গের কোপ পড়ে তার গলায়। অশ্বথামা ঠিক সেইভাবেই মারতে লাগলেন শিবিরের ভাগে ভাগে থাকা প্রতিরোধী যোদ্ধাদের— স্ফূরতে বেপমানাংশ্চ শমিতেব পশূন্‌মখে।

অশ্বত্থামাকে অদ্ভুত দেখাচ্ছিল। ছিন্ন এবং ছিদ্যমান মানুষদের হাত-নাড়া, খড়্গ উঁচোনো এবং খড়্গ জোগাড় করার চেষ্টা এবং এইসব কিছুর মধ্যে অশ্বত্থামার উত্তাল বিচরণ— তাতেই খোঁচা খেয়ে খেয়ে অশ্বত্থামার শরীরটা চেহারাটা রক্তভোজী রাক্ষসের মতো হয়ে গিয়েছিল; ফলত তাঁকে দেখেই সকলে ভয় পাচ্ছিল, প্রতিরোধ করার কোনও শক্তি তাদের ছিল না। অশ্বত্থামা শেষপর্যন্ত খুঁজে পেলেন সেই শিবির, যেখানে দ্রৌপদীর পুত্রেরা ছিলেন, ছিলেন ভীষ্ম-হত্যার নিমিত্ত কারণ শিখণ্ডী এবং অন্যান্য পাঞ্চালরা। এরা ধনুকবাণে সজ্জিত হয়েছিলেন চকিতে, বাইরে আর্ত কোলাহল শুনেই তাঁরা অশ্বত্থামাকে চারিদিক থেকে আক্রমণ করলেন বটে, কিন্তু অশ্বত্থামার তরবারির আঘাতে পাণ্ডবদের ঔরসজাত দ্রৌপদীর পঞ্চ পুত্র একে একে নৃশংসভাবে কাটা পড়লেন। শিখণ্ডীর দেহ থেকে ছিন্ন হল শির, অবশিষ্ট পাঞ্চাল-সৈন্যরাও অনেকেই অশ্বত্থামার কবল থেকে রেহাই পেল না। অন্যদিকে পাণ্ডব এবং পাঞ্চাল-সৈন্যদের মধ্যে যারা কেউ কারও অপেক্ষা না করে শিবিরের বাইরে পালাতে গেল, তারা দ্বারদেশে দাঁড়ানো কৃপাচার্য এবং কৃতবর্মার অস্ত্রাঘাতে মারা গেল— কৃতবর্মা কৃপশ্চৈব দ্বারদেশে নিজঘ্নতুঃ।

সুখশয়নের যোগ্য রাত্রিতে অশ্বত্থামা যা করলেন, তাতে লোকেরা মরতে মরতেও এইরকম বলে গেল যে, ধৃতরাষ্ট্রের ছেলেরা, তাঁদের বন্ধু-সহায়রা আঠেরো দিনের যুদ্ধে যা করতে পারেনি, এক রাত্রে অশ্বত্থামা সেটা করে দিল। রাতে ঘুমের মধ্যে নিদ্রিত লোকেদের গলা কাটতে কাটতে বীর হওয়া, এমন নৃশংস হত্যাকাণ্ড রাক্ষসরাও কোনওদিন করেনি, অশ্বত্থামা সেটা করল— যৎ কৃতং ন প্রসুপ্তানাং রক্ষোভিঃ ক্রূরকর্মভিঃ। নিজে বেঁচে থাকতে লোকমুখে এই নিন্দাবাদ অশ্বত্থামা নিজের কানেই শুনলেন এবং এই লোকটি তো আরও তাঁর তরবারির কোপ থেকে রেহাই পেল না। মহাভারতের কবি অদ্ভুত কাব্যময়তায় বীর-বীভৎস রসকে করুণ রসে পরিণত করলেন একটিমাত্র বাক্যে— অনেক লোক আর্তনাদ করছিল একসঙ্গে, অনেক লোক কাতরকণ্ঠে অব্যক্ত রব করছিল যন্ত্রণায়, কিন্তু মুহূর্তের মধ্যে সেই তুমুল এবং বিশাল শব্দরাশি স্তব্ধ হয়ে গেল। শিবিরের সকলেই মারা গেছে— ততো মুহূর্তাৎ প্রাশাম্যৎ স শব্দস্তুমুলো মহান্‌। ‘রজঃ’ শব্দটি ‘শ্লেষ’ হিসেবে ব্যবহার করে— যার অর্থ রজো গুণোদ্রিক্ত হত্যাকাণ্ডও হতে পারে অথবা ধূলিজালও হতে পারে— সেই ‘রজঃ’ শব্দটির শ্লেষে মহাকবি বললেন— অশ্বত্থামার ক্ষিপ্ত বিচরণ এবং বেগবলোৎফুল্ল দুর্বার পদন্যাসে পাণ্ডব-শিবিরে যে বিশাল ধূলিজাল বিকীর্ণ হয়েছিল অথবা তাঁর রজোগুণোদ্দীপ্ত হিংসায় যে বিশাল চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছিল, শিবিরভূমি রক্তপ্লাবিত হওয়ায় সেই ভীষণ, তুমুল ধূলিরাশি মুহূর্তের মধ্যেই শান্ত হয়ে গেল— তদ্‌রজস্তুমুলং ঘোরং ক্ষণোনান্তরধীয়ত। রাত্রির অর্ধকালের মধ্যেই পাণ্ডব-শিবিরের সমস্ত প্রতিপক্ষতা শান্ত হয়ে গেল।

কৃপাচার্য এবং কৃতবর্মা অন্তত তিনটি শিবিরে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিলেন, অশ্বত্থামা খুশি হবেন বলেই দিয়েছিলেন। যিনি খানিক আগেই অশ্বত্থামাকে এই অন্যায় থেকে বিরত করার চেষ্টা করছিলেন, ধবংস এবং হত্যা করার মোহ কীভাবে নিশ্চেষ্ট মানুষকেও ধ্বংসে প্রবৃত্ত করে যে, কৃপাচার্য এবং কৃতবর্মা একটি মানুষকেও এখন আস্ত রাখলেন না। শিবির থেকে হাত জোড় করে বেরোচ্ছে, জীবন ভিক্ষে চাইছে অথচ একটা লোকও কৃপাচার্য, কৃতবর্মার আঘাত থেকে বাঁচল না— নামুচ্যত তয়োঃ কশ্চিৎ নিষ্ক্রান্তঃ শিবিরাদ্‌ বহিঃ। তার ওপর শিবিরে আগুনে দিয়ে তাঁরা যেন প্রতিপক্ষের শেষকৃত্য করে দিলেন। অশ্বত্থামা যখন পাণ্ডব-শিবিরে প্রবেশ করেছিলেন, তখন শিবির সুপ্তিতে নিস্তব্ধ ছিল, তারপর মাঝখানের এই তুমুল তাণ্ডবের অংশ বাদ দিলে, অশ্বত্থামা যখন শিবির থেকে বেরিয়ে গেলেন তখন চিরসুপ্তিতে চিরনিস্তব্ধ হল পাণ্ডব-শিবির— তথৈব হত্বা নিঃশব্দে নিশ্চক্রাম নরর্ষভ।

অশ্বত্থামা বেরিয়ে কৃপাচার্য এবং কৃতবর্মার সঙ্গে মিলিত হলেন। পিতার মৃত্যুর প্রতিশোধ যেভাবে নিয়েছেন তাতে পূর্ণ-তৃপ্ত অশ্বত্থামা মহানন্দে নিজের কর্মকলাপ বলতে আরম্ভ করলেন দু’জনের কাছে— অচখৌ কর্ম তৎ সর্বং হৃষ্টঃ সংহর্ষয়ন্‌ বিভো। পরস্পর পরস্পরকে আলিঙ্গন করে নিজেদের কার্যসিদ্ধির ব্যাপারে নিশ্চিন্ত হবার পর অশ্বত্থামা বললেন— আমি সমস্ত পাঞ্চাল, দ্রৌপদীর সবগুলি পুত্র এবং বিরাট-রাজার অবশিষ্ট সৈন্যদের মেরে এসেছি। অতএব আর বিলম্ব নয়, এখনও যদি কুরুরাজ দুর্যোধন বেঁচে থাকেন, তবে এই প্রিয়ংসংবাদ তাঁকে জানানো দরকার— যদি জীবতি নো রাজা তস্মৈ সংশামহে প্রিয়ম্‌।

দুর্যোধনের জীবন তখনও আছে, বাকি আছে প্রাণ যাওয়া। মহাকবি মর্মান্তিক বর্ণনা করে বলেছেন— দুটি ঊরু সম্পূর্ণ ভেঙে যাবার ফলে দুর্যোধনের কষ্ট এতটাই হচ্ছিল যাতে প্রাণ গেলেই উপশমটা বেশি হত, বেঁচে থাকার জন্যই তাঁর কষ্ট হচ্ছিল। এই অবস্থায় অশ্বত্থামা, কৃপ এবং কৃতবর্মা তাঁকে এসে ঘিরে ধরলেন তিন জনে। দুর্যোধনের অবস্থা দেখে বৃদ্ধ কৃপাচার্য বিলাপ করলেন খানিক, তারপরেই অশ্বত্থামা। দুর্যোধনের অপ্রতিরোধ্য যুদ্ধশক্তি সত্ত্বেও ভীম কীভাবে তাঁকে এমন অন্যায় প্রহার করার ফাঁক খুঁজে পেলেন, সে-সব কথা বলে স্বগত বিলাপ করলেন অনেক। এই বিলাপের মধ্যে পাণ্ডবদের প্রতি অশ্বত্থামার অকুণ্ঠ ধিক্কার ছিল। ভীমের অন্যায় স্মরণ করে তাঁকে তো যথেচ্ছ তিরস্কার তিনি করছিলেনই, কিন্তু যে অর্জুনের সম্বন্ধে তিনি কখনওই প্রায় কটু বাক্য উচ্চারণ করেননি, সেই অর্জুনের সঙ্গে কৃষ্ণের প্রতি ধিক্কার উচ্চারণ করাটা বুঝিয়ে দেয় যে, খানিক আগে একটা একক হত্যাকাণ্ড চালিয়ে তিনি এমন এক আত্মমহিমায় নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেছেন, যাতে অর্জুন কিংবা কৃষ্ণও তাঁর কাছে বড় হেয় জন— ধিগস্তু কৃষ্ণং বার্ষ্ণেয়ম্‌ অর্জুনঞ্চাপি দুর্মতিম্‌।

দুর্যোধনের কোনও দুষ্কর্মের কথাই এখন তাঁর মনে পড়ছে না। তাঁকে দেখে এখন শুধু তাঁর গুণের কথাই আকুল করে দিচ্ছে তাঁর মন। মরণ বুঝি সাময়িকভাবে মানুষকে এমন নির্দোষ করে দেয়, অপরপক্ষে বন্ধ আত্মীয়কে সত্যি কথা বলতেও শেখায় কখনও। অশ্বত্থামা দুর্যোধনকে বললেন— আমাকে, কৃতবর্মাকে এবং কৃপাচার্যকে ধিক্‌ যেহেতু আমরা তোমাকে সামনে রেখে যুদ্ধ করতে যাইনি। পাণ্ডবদের পদশব্দে পালিয়ে গিয়েছিলেন অশ্বত্থামা, অথচ এখন সেই তাশ্বত্থামা নিজেকে ধিক্কার দিয়ে বলছেন— আমরা তোমার পোষ্য আশ্রিত ছিলাম, মহারাজা! তোমার দানের অর্থে আমার, আমার পিতার এবং আমার মাতুলের ঘরে ধন-রত্নের অভাব নেই— সভৃত্যানাং নরব্যাঘ্র রত্নবন্তি গৃহানি চ। তোমার ঘরের যাগ-যজ্ঞেও আমরা দান-দক্ষিণা অনেক পেয়েছি। যেভাবে তুমি আমাদের প্রতিপালন করে স্বর্গে যাচ্ছ, তাতে কীভাবে বেঁচে থাকব জানি না।

এতদিন বেঁচে থাকতে দুর্যোধনের ঋণস্বীকার এমন করে করেননি অশ্বত্থামা। পরাশ্রিত ব্যক্তি পরের অর্থে সম্ভৃত হয়েও নিজের ক্ষমতার অভিমান যেভাবে জিইয়ে রাখে, সেইভাবেই এতকাল ছিলেন তাঁরা। আজ অশ্বত্থামা কঠিন বাস্তবটুকু সলজ্জে জানিয়ে বলছেন— এখন থেকে আমরা যে তোমার সংসর্গ থেকে বঞ্চিত হব, তার সবচেয়ে বড় সমস্যা হল— আমরা আর তোমার দেওয়া অর্থ পাব না, আর সেই জন্যই তোমার উপকারের কথা বেশি করে মনে পড়ছে— ত্বৎসঙ্গহীনা হীনার্থাঃ স্মরন্তঃ সুকৃতস্য তে। আজ থেকে এই পৃথিবীতে আমাদের অনেক কষ্ট করেই থাকতে হবে, কেন না তুমি না থাকায় আমাদের সুখ এবং শান্তি দুটোই বিঘ্নিত হবে।

ভারী আশ্চর্য লাগে এই সব বিলাপোক্তির মর্মকথায়। বিপরীতভাবে ভাবতে ইচ্ছে করে, সেদিন যদি অশ্বত্থামারা দ্বৈপায়ন হ্রদের তীরে দুর্যোধনের পাশ থেকে পালিয়ে না যেতেন, তা হলে কি দুর্যোধনের মরণ অত সহজে হত। অশ্বত্থামার মতো বীর যদি সেদিন প্রতিপক্ষতার কাঠিন্য নিয়ে দাঁড়াতেন, তা হলে দুর্যোধনের মরণ অন্তত দীর্ঘায়িত না হোক, বিলম্বিত হত। অশ্বত্থামা বুঝি নিজেও বোঝেন না যে, নিজেকে বাঁচাতে বাঁচাতে মানুষের সার্থক বাঁচাটাই নষ্ট হয়ে যায়। অশ্বত্থামা অনেক আত্মধিক্কার দিয়ে এবার জানালেন যে, তিনি ধৃষ্টদ্যুম্নকে মেরে ফেলেছেন। অশ্বত্থামা বললেন— এখন যা বলছি, তাতে তোমার কানের সুখ হবে। জেনে রেখো— পাণ্ডবপক্ষে এখন সাতজন মাত্র বেঁচে আছে— পাঁচ পাণ্ডব-ভাই, সাত্যকি এবং কৃষ্ণ আর কৌরবপক্ষে আমরা তিনজন— অহঞ্চ কৃতবর্মা চ কৃপঃ শারদ্বতস্তথা।

অন্তিম মুহূর্তেও দুর্যোধনের মুখে হাসি ফুটেছিল কিনা জানি না। কিন্তু কৌরবপক্ষে যে তিনজন বেঁচে রইলেন, তাঁরা কেউ দুর্যোধনের একান্ত পরিবার ভুক্ত নয়। পাণ্ডবরা নিজেরা সবাই বেঁচে আছেন, তবু দুর্যোধনের হৃদয়কর্ণ-রসায়ন যে কথা, সেটা অশ্বত্থামা বললেন এবার— গতরাত্রে পাণ্ডব-শিবিরে প্রবেশ করে আমি দ্রৌপদীর সব ছেলেগুলোকে মেরে ফেলেছি, মেরে ফেলেছি ধৃষ্টদ্যুম্ন এবং তার ছেলেগুলিকেও— দ্রৌপদেয়া হতাঃ সর্বে ধৃষ্টদ্যুম্নস্য চাত্মজাঃ। আমরা হলফ করে বলতে পারি— ধৃষ্টদ্যুম্ন মারা যাওয়ায় যত খুশি হয়েছেন দুর্যোধন, তার চেয়ে অনেক বেশি খুশি হয়েছেন পাণ্ডবদের পুত্রেরা মারা যাওয়ায়। কেন না, ধৃষ্টদ্যুম্ন যত বড় পাণ্ডবপক্ষীয় শত্রু হোক, সে পাঞ্চাল, অতএব সে অশ্বত্থামার একান্ত শত্ৰু, কিন্তু পাণ্ডবদের বংশবীজ একটিও সন্তান থাকল না উষর যুদ্ধক্ষেত্রে। এই ঘটনা হতচেতন দুর্যোধনের চৈতন্য ফিরিয়ে আনল।

মনের সুখ ফিরিয়ে আনে এমন কথা শুনেই দুর্যোধনের সংজ্ঞা ফিরে এল কয়েক মুহূর্তের জন্য— প্রতিলভ্য পুনশ্চেতঃ… নিশাম্য মনসঃ প্রিয়াম্‌। অথচ কী রাজোচিত সংবরণ এখনও, দুর্যোধন একবারও দ্রৌপদীর পুত্রদের মৃত্যু নিয়ে আনন্দ প্রকাশ করলেন না। মাছের মতো স্থির-শীতল দৃষ্টিতে অশ্বত্থামার দিকে চেয়ে দুর্যোধন বললেন— তুমি, কৃপাচার্য এবং কৃতবর্মা মিলে আজ আমার যা করলে, ভীষ্ম, দ্রোণ এবং কর্ণও তা পারেননি— ন মেহকরোদ্‌ গাঙ্গেয়ো ন কর্ণো ন চ তে পিতা। পাণ্ডবপক্ষের ওই ক্ষুদ্রাশয় সেনাপতিটা, ওই শিখণ্ডীটা, ওদের তুমি মেরে ফেলেছ, এতে আমি নিজেকে ইন্দ্রের মতো মনে করছি। তোমরা যেতে পার এখন, তোমাদের ভাল হোক, পুনরায় তোমাদের সঙ্গে দেখা হবে সেই স্বর্গলোক— স্বস্তি প্রাপ্নুত ভদ্রং বঃ স্বর্গে নঃ সঙ্গমঃ পুনঃ।

দুর্যোধন মারা গেলেন। তাঁর জাগতিক দেহ নিথর হয়ে ভূতলে পড়ে রইল। অশ্বত্থামা, কৃপাচার্য এবং কৃতবর্মা দুর্যোধনের নিশ্চেষ্ট দেহটি শেষবারের মতো আলিঙ্গন করে তাঁর দিকেই বার বার তাকাতে তাকাতে নিজেদের রথে আরোহণ করলেন। এদিকে সকাল বেলায় ধৃষ্টদ্যুম্নের সারথি, একমাত্র লোক যে, শত লোকের ঠেলাঠেলি বাঁচিয়ে, অশ্বত্থামা-কৃপ-কৃতবর্মার তরবারির কোপ বাঁচিয়ে যুধিষ্ঠিরের কাছে এসে শোক-সংবাদ জানাল— ধৃষ্টদ্যুম্ন, শিখণ্ডী মারা গেছে, মারা গেছে পাণ্ডবদের বংশবীজ পুত্রেরা। সংবাদ শুনে যুধিষ্ঠির প্রায় অজ্ঞান হয়ে গেলেন, ভাইরা তাঁকে কোনও মতে ধরে স্বস্থানে বসিয়ে দিতে তিনি একটু স্থির হয়ে বললেন— দৈবদোষে এইরকমই হয়, কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে আমরা যে খুব বড় জয় পেলাম বলে ভাবছি, আসলে সেটা পরাজয়ে পরিণত হল। খানিক বিলাপোক্তির পর যুধিষ্ঠির দ্রৌপদীর জন্যই সবচেয়ে বেশি চিন্তা করতে লাগলেন। গর্ভজাত সবগুলি পুত্র নিহত দেখার পর দ্রৌপদীর কী প্রতিক্রিয়া হবে। দ্রৌপদীকে সঙ্গে সঙ্গে নিয়ে আসা হল উপপ্লব্য থেকে। পুত্রদের ভাইদের এমন নৃশংস মৃত্যু দেখে প্রাথমিক শোক কাটিয়ে উঠেই তিনি যুধিষ্ঠিরকে বললেন— তুমি যদি এই অশ্বত্থামাকে ধরে মেরে না ফেলো, অশ্বত্থামা যদি তার অন্যায় কর্মের প্রতিফল না পায়, তবে এই আমি খাদ্য-জল ত্যাগ করে বসলাম আমার স্বামীদের সামনে, আমি আত্মহত্যা করব— ইহৈব প্রায়মাসিষ্যে তন্নিবোধত পাণ্ডবাঃ।

একটা হত্যার প্রতিশোধ আর একটা হত্যা নয়— এই ভাবনা থেকেই যুধিষ্ঠির বলেছিলেন— কোথায় কোন বনের মধ্যে সেই অশ্বত্থামা লুকিয়ে আছে, এখন কোথায় তাঁকে পাই। দ্রৌপদী এবার ভীমসেনের দিকে তাকালেন। তিনি জানেন কাকে দিয়ে কাজ হবে এবং কার হাতে পড়লে কীভাবে পাওয়া যাবে অশ্বত্থামাকে। দ্রৌপদী বললেন— মধ্যম পাণ্ডব! এই বিপন্ন সময়ে তোমার মতো উপযোগী মানুষ আর কে আছে? তুমি যাও, অশ্বত্থামাকে এক্ষুনি মেরে ফেলো— জহি তং পাপকর্মাণং শম্বরং মঘবানিব। ভীম দেরি করলেন না, সঙ্গে সঙ্গে নকুলকে সারথি করে ধনুক-বাণ হাতে রওনা দিলেন অশ্বত্থামাকে ধরার জন্য।

অশ্বত্থামার বিরুদ্ধে ভীমের এই একাকী যাওয়াটা কৃষ্ণ একেবারে পছন্দ করলেন না। অশ্বত্থামার যুদ্ধ-ক্ষমতা, তাঁর নিবিড় অস্ত্রকৌশল যতই থাকুক, ভীমসেনের মতো বিরাট যোদ্ধার পাশে তিনি যে খুব দাঁড়াতে পারবেন তা নয়। কিন্তু কৃষ্ণের কাছে সবচেয়ে সন্দেহজনক অশ্বত্থামার ‘অ্যাটিটুড’। যে মানুষ রাতের অন্ধকারে এতগুলি নিদ্রিত মানুষকে হত্যা করে আসতে পারে সেই অপরিণত মানুষটির কাছে, দ্রোণাচার্যের দেওয়া একটা বিধ্বংসী অস্ত্র আছে যার নাম ‘ব্রহ্মশির’। অর্জুনের অস্ত্রশিক্ষাতে আপ্লুত হয়েও দ্রোণাচার্য এই ব্রহ্মশির অস্ত্রের প্রয়োগ এবং সংবরণের কৌশল শিখিয়ে দিয়েছিলেন অর্জুনকেও। অশ্বত্থামা এই অস্ত্রলাভের যোগ্য ছিলেন না, কিন্তু হয়তো বা অর্জুনের প্রতি ঈর্ষাবশত, হয়তো কেন তাই, এই অস্ত্র তিনি দ্রোণাচার্যের কাছে চেয়ে বসেছিলেন। পিতার একমাত্র ছেলে বলে এই যাচনার মধ্যে অসহ্যতার বায়নাটুকু বেশি বড় হয়ে উঠেছিল— তং পুত্রোহপ্যেক এবৈনমন্বযাচদমর্ষণঃ।

নিজের ছেলে হলেও দ্রোণাচার্য এই প্রার্থনায় খুশি হননি। অন্তত আচার্য হিসেবে শিক্ষার এই গৌরব এবং সততা তাঁর ছিল, যাতে তিনি বুঝেছিলেন যে, স্বার্থ, লোভ এবং মাৎসর্য যে মানুষের হৃদয় এবং বুদ্ধি অধিকার করে, তিনি বিধ্বংসী মারণাস্ত্র কাছে রাখার যোগ্যতা হারান। ফলে ব্রহ্মশির অস্ত্রের প্রয়োগ অশ্বত্থামাকে শিখিয়ে দেবার পরেই দ্রোণাচার্য পুত্রকে উপদেশ দিয়ে বলেছিলেন— তুমি যদি যুদ্ধে তেমন বিপন্নও হও তবু এই তাস্ত্র তুমি প্রয়োগ করবে না, মানুষের ওপর তো কখনওই নয়— ইদমস্ত্রং প্রযোক্তব্যং পরমাপদ্‌গতেনাপি ন। আমরা জানি, এই উপদেশ অর্জুনকেও করেছিলেন দ্রোণাচার্য, কিন্তু পুত্র অশ্বত্থামা যেহেতু মাৎসর্য এবং ক্রোধবশতই এই অস্ত্র যাচনা করেছে, তাই এই অস্ত্রের অধিকার তাকে যে ভাল পথে থাকতে দেবে না, সেটা দ্রোণাচার্য বুঝেছিলেন বলেই দ্রোণ তাঁকে বলেছিলেন— এই অস্ত্র নিয়ে তুমি সৎপথে থাকতে পারবে না, বাছা— ন ত্বং জাতু সতাং মার্গে স্থাতেতি পুরুষর্ষভ। পিতার এই অপ্রিয় সত্য উচ্চারণ অশ্বত্থামা ভাল ভাবে নেননি, সামান্য হতাশাও তাঁর ছিল এই কারণে যে, অর্জুনকে দ্রোণ এ-কথা বলেননি। কিন্তু দ্রোণের কথাটা যে কতটা ঠিক, তা বোঝা যায় অশ্বত্থামার অস্ত্রগ্রহণের ‘অ্যাটিটুড’ দেখে। তিনি ব্রহ্মশির অস্ত্রপ্রয়োগের মন্ত্র-কৌশলটুকু শিখলেন বটে, কিন্তু অস্ত্র-সংবরণের উপায় মন দিয়ে শিখলেন না। কেন না বিপন্ন হলে অথবা শত্রু-ধ্বংস করার জন্য অস্ত্রটা প্রয়োগ করতে পারলেই হল, তাতে পরপক্ষের কী হল-না-হল তাতে তাঁর কিছু এসে যায় না। আমরা পরে দেখব— এই কথাটা সত্য এবং দ্রোণাচার্য অত্যন্ত স্নেহপ্রবণ হলেও পুত্রকে তিনি চিনতেন।

অশ্বত্থামার স্বভাবের কথায় ঝুলি থেকে বেড়াল বেরিয়ে পড়ল কৃষ্ণের কথায়! ব্রহ্মশির অস্ত্র দেবার পর দ্রোণাচার্য পিতা অশ্বত্থামা সম্বন্ধে যে মন্তব্য করেছিলেন, তা কৃষ্ণের কাছে জানতে পারার সঙ্গে সঙ্গে তাঁর চরিত্রের অক্ষম অথচ মৎসর দিকটি যেমন ধরা পড়ে যায়, তেমনই তাঁর চরিত্রের বাহ্য আবরণের মধ্যে তথাকথিত ঋজুতা, এবং স্পষ্ট কথা বলার শক্তি সম্বন্ধেও সন্দেহ তৈরি হতে আরম্ভ করে। কৃষ্ণ অশ্বত্থামার পূর্বজীবনের একটি বিশেষ ঘটনার উল্লেখ করে তাঁর খল-স্বভাবের চিত্রটা এমনভাবেই তুলে ধরলেন, যাতে বোঝা যায়— অশ্বত্থামা খুব সোজা-সরল মানুষ নন এবং আরও চিন্তা হয়— এই মুহূর্তে ভীম যে অশ্বত্থামার পিছনে একাকী দৌড়লেন, সেখানেও কিছু বিপরীত ঘটনা ঘটতে পারে। অন্তত এটা বোঝা দরকার যে, অশ্বত্থামা কী করবেন, তার কোনও ঠিক নেই।

পুরনো একটা ঘটনা জানিয়ে কৃষ্ণ যুধিষ্ঠিরকে বললেন— তখন তোমরা সব পাশায় হেরে বনবাসে চলে গেছ, সেই সময়ে অশ্বত্থামা এল আমাদের দ্বারকা-নগরীতে। আমাদের গুষ্টির লোকেরা বৃষ্ণি-অন্ধক-ভোজেরা সব খুব খাতির যত্ন করতে লাগল অশ্বত্থামাকে এবং সেও সেটা বেশ উপভোগ করছিল। এইরকম সময়ে একদিন হঠাৎ অশ্বত্থামা একা আমার সঙ্গে দেখা করে বলল— শোনো কৃষ্ণ! আমার পিতা দ্রোণ, কৌরব-পাণ্ডবদের গুরু, কঠোর তপস্যা করার সময় মহর্ষি অগস্ত্যের কাছ থেকে যে ভীষণ অস্ত্রটি পেয়েছিলেন, দেব-দানব পূজিত সেই ‘ব্রহ্মশির’ অস্ত্রটি এখন আমার হেফাজতে আছে। তা আমি বলছিলাম কী, কৃষ্ণ! ওই ব্রহ্মশির অস্ত্রটা তুমি আমার কাছ থেকে নিয়ে তোমার ওই সুদর্শন চক্রটা আমায় দাও— মমাপ্যস্ত্রং প্রযচ্ছ ত্বং চক্রং রিপুহণং রণে।

অশ্বত্থামা হাতজোড় করে এই একান্ত প্রার্থনা জানালে— কৃষ্ণ বলছেন— আমি একটু অবাকই হলাম এবং বেশ মেজাজ নিয়েই বললাম— দেব-দানব-গন্ধর্বরা সব যদি এক জায়গায় হয়, তবু তারা শক্তিতে আমার একশো ভাগের এক ভাগও হবে না— ন সমা মম বীর্যস্য শতাংশেনাপি পিণ্ডিতাঃ। কৃষ্ণ এবার রেগেই বললেন— তা বেশ তো! এই আমার ধনুক রইল, এই শক্তি, এই গদা এবং এই চক্র— এগুলোর মধ্যে যেটা যেটা তুমি চাও আমি দেব তোমাকে। তবে কিনা এই অস্ত্রগুলির মধ্যে যেটা যেটা তুমি শুধু হাত দিয়ে তুলতে পারবে, অথবা যুদ্ধে প্রয়োগ করতে পারবে মনে করো, সেটা সেটাই আমি তোমাকে দিয়ে দেবো— যচ্ছক্নোষি সমুদ্‌যন্তুং প্রয়োক্তুমপি বা রণে। কিন্তু তুমি যে বিনিময়ে ব্রহ্মশির অস্ত্র আমাকে দিতে চাইছ, সেটা তোমায় দিতে হবে না।

কঠিন পরিশ্রম এবং তপস্যার দ্বারা যে অস্ত্র লাভ করতে হয়, তার যে বিনিময় হয় না অথবা বিনিময় করার ইচ্ছেটা যে নিজকৃত তপস্যাকেই লঘু করে, সেটা অশ্বত্থামা বোঝেন না বলেই, তপস্যালব্ধ অস্ত্রের মূল্যও বোঝেন না। বস্তুত ব্রহ্মশির অস্ত্রলাভের পিছনে তাঁর কোনও কৃচ্ছ্রসাধনও নেই, তপস্যাও নেই, নেহাৎই পুত্রজনোচিত আবদার এবং আচার্য দ্রোণের স্নেহান্ধ বাৎসল্য। ফলত অস্ত্র এবং অস্ত্রলাভের পিছনে অশ্বত্থামার কোনও কৃতজ্ঞতা বা মূল্যবোধ নেই, যা তাঁর পিতার ছিল আর ঠিক সেই কারণেই ব্রহ্মশির নিতে চাননি কৃষ্ণ। যাই হোক, কৃষ্ণের কথা শুনে অশ্বত্থামা লোভে, মৎসরতায় কাল বিলম্ব না করে ঠিক করলেন— ধনুক, শক্তি, গদা নয়, চক্রটিই তিনি নিয়ে যাবেন। কৃষ্ণ বললেন— নিয়ে যাও, তুলে নিয়ে যাও। অশ্বত্থামা লাফ দিয়ে চক্র গ্রহণ করতে গেলেন অন্যের গুণের প্রতি তাচ্ছিল্যবশত, সুদর্শন চক্র ওঠাতে গেলেন বাঁ হাতে— জগ্রাহোৎপত্য সহসা চক্রং সব্যেন পাণিনা।

অশ্বত্থামা বাঁ হাত দিয়ে চক্রখানি যখন এক চুলও নড়াতে পারলেন না, তখন বাঁ হাত ছেড়ে ডান হাত লাগালেন। ডান হাতেও যখন কিছু করতে পারলেন না, তখন দুই হাত দিয়ে চেষ্টা করলেন। অবশেষে কিছুই করতে পারলেন না দেখে ক্ষান্তি দিলেন প্রয়াসে— কৃত্বা যত্নং পরিশ্রান্তঃ সংন্যবৰ্ত্তত ভারত। না পারার জন্য অক্ষমতায় বিষণ্ণ এবং অপমানের জন্য অস্থির, অশ্বত্থামাকে কৃষ্ণ বললেন— এ-জগতে যাঁর থেকে বেশি প্রিয় আমার কেউ নেই, শিতিকণ্ঠ মহাদেবকে দ্বন্দ্বযুদ্ধে যিনি পরাজিত করে সন্তুষ্ট করেছিলেন, আমার সেই পরম বন্ধু অর্জুন পর্যন্ত আমার কাছে এমন প্রস্তাব করেনি যে, তোমার সুদর্শন চক্রটি আমাকে দাও। আর শুধু অর্জুন কেন, আমার ছেলে প্রদ্যুম্ন অথবা আমার ভাই গদ, আমার দাদা বলরাম— এরাও তো কোনও দিন কেউ আমার কাছে সুদর্শন চক্র চায়নি। খানিকক্ষণ এইভাবে অশ্বত্থামাকে দাগা দেবার পর অতি আকস্মিকভাবে কৃষ্ণ জিজ্ঞাসা করলেন— সবই তো বুঝলাম অশ্বত্থামা! তুমি এইবার বলো তো, তুমি কার সঙ্গে এই চক্র নিয়ে যুদ্ধ করতে চাও— চক্রেণ রথিনাং শ্রেষ্ঠ কং নু তাত যুযুৎসসে?

কৃষ্ণ যুধিষ্ঠিরকে বললেন— আমার প্রশ্ন শুনে অশ্বত্থামা বলল— তোমার সমস্ত সম্মান মাথায় রেখেই বলছি, এই চক্র দিয়ে আমি তোমার সঙ্গেই যুদ্ধ করতে চাই— যোৎস্যে কৃষ্ণ ত্বয়া সহ। চক্রটা চেয়েছিলাম এই কারণে যাতে কেউ আর আমাকে হারাতে না পারে। সমস্যা এটাই হয়েছে যে, আরও একটা মহাভয়ংকর বীর অথবা তোমার মতোই আর একটা চক্রধারী নেই। ইঙ্গিতটা খুব পরিষ্কার— কৃষ্ণের চক্র যদি কোনও প্রতিচক্র দিয়ে উলটে দেওয়া যেত এবং সেই মহাভয়ংকর ব্যক্তিটি যদি অশ্বত্থামা হতেন, তাহলে কৃষ্ণ এতটা অপ্রতিরোধ্য মহাবীর হয়ে উঠতে পারতেন না। অশ্বত্থামা বললেন— কিন্তু সেটা আর সম্ভব হল না, তোমার চক্রটাই তাই সর্বশক্তির আধার হয়ে থেকে গেল— চক্ৰমপ্রতিচক্রেণ ভুবি নান্যোভিপদ্যতে। অতএব আমি চলে যাচ্ছি। অশ্বত্থামা হতাশ হয়ে চলে গেলেন দ্বারকা ছেড়ে।

ঘটনাটা বলেই কৃষ্ণ বললেন— অশ্বত্থামা এইরকম লোক। সে ক্ৰোধী, তার মনটাও দুষ্ট, স্বভাবটা নিষ্ঠুর এবং ভীষণ চঞ্চল, অতএব কখন কী করবে কিছুই বলা যায় না। এখন অশ্বত্থামাকে ধরার জন্য ভীমকে একা পাঠালে হবে না, তাঁর মতো বীর মানুষের সুরক্ষার জন্য আমাদের সেখানে যাওয়া দরকার। কথাটা বলেই অর্জুন এবং যুধিষ্ঠিরকে নিয়ে রথে উঠলেন কৃষ্ণ এবং খুব জোরে রথ চালালেন ভীমকে তাড়াতাড়ি ধরার উদ্দেশে।

অশ্বত্থামার সম্বন্ধে কৃষ্ণের এই মূল্যায়ন আমাদের যেন আধুনিক যুগে পৌঁছে দেয়। এমন একজন পিতার পুত্র অশ্বত্থামা, যিনি তৎকালীন সমাজে জাতিগত বৃত্তিরোধের ফলে স্বোপার্জনে অক্ষম। রাজপ্রদত্ত বৃত্তিতে মানুষ হয়ে নিজে রাজাকে পুরোপুরি মেনেও নিতে পারেন না, আবার অনুগত হবার সময় পূর্বের জাতিস্মৃতি কাজ করে। ব্যক্তিগত জীবনে স্বগত পরিশ্রম-তপস্যায় তাঁর প্রতিরোধ-শক্তি বেড়ে ওঠে না, অথচ ব্যক্তি-স্বাতন্ত্র্যের ভাবনাটা পুরোপুরি মনের মধ্যে কাজ করে; ফলত এমন এক বিভ্রান্তি তাঁর মনের মধ্যে কাজ করে, যেখানে প্রতিশোধ-স্পৃহাটা সুযোগ পেলেই কেমন নির্মম হয়ে ওঠে এবং নিজের পুরোপুরি অপ্রতিরোধ্য হবার ক্ষমতা নেই বলেই সাফল্য-কামনার প্রকৃতিটা তাঁর কাছে যেন-তেন-প্রকারেণ। এমন একটা মারণাস্ত্র তাঁর কাছে রয়ে গেছে, যা ধারণ করা বা প্রয়োগ করার মতো উপযুক্ত ধারণশক্তি তাঁর নিজের মধ্যেই নেই এবং সেই অস্ত্র এতদিন কোনও বৃহত্তর স্বার্থে, এমনকী বৃত্তিদাতা কৌরবদের জন্যও ব্যবহৃত হয়নি, অথবা যুদ্ধ থামানোর মতো কূটনৈতিক ঠান্ডা লড়াইয়ের জন্যও তা ব্যবহার করা হয়নি, অথচ সেটা তিনি রেখে দিয়েছেন এবং বুদ্ধিমান কৃষ্ণ আশঙ্কা করছেন— এই বিধ্বংসী মারণাস্ত্র এখন ব্যবহৃত হবে নিতান্ত ব্যক্তিগত প্রয়োজনে, ব্যক্তিস্বার্থে শুধু নিজে বাঁচবার জন্য। অশ্বত্থামা এতটাই বিভ্রান্ত।

খুব দ্রুত রথ চালিয়ে এসে কৃষ্ণের রথ ভীমকে ধরে ফেলল প্রায়। কিন্তু ক্রোধাগ্নি-তাড়িত ভীমকে তাঁরা আটকাতে পারলেন না। ভীম স্থানীয় লোকদের জিজ্ঞাসাবাদ করে খবর পেয়েছিলেন যে, অশ্বত্থামা গঙ্গার দিকে গেছেন এবং হয়তো বা গঙ্গার তীরেই অবস্থান করছেন। ভীম তাঁর রথের ঘোড়া ছোটালেন গঙ্গাতীরের দিকে, পিছনে পিছনে কৃষ্ণ, অর্জুন, যুধিষ্ঠির। ভীম সত্যিই দেখতে পেলেন অশ্বত্থামাকে, তিনি মহর্ষি দ্বৈপায়ন ব্যাসের শিষ্য-সামন্তের সঙ্গে বসে আছেন। রাজ্যপাট হারিয়ে, দুর্যোধনের মতো বৃত্তিদাতার আশ্রয় হারিয়ে তিনি তখন এতই উদাসীন, সাময়িক কাতরতায় এতই বৈরাগ্যবান যে, তিনি সাধক শিষ্যের মতো কুশের কৌপীন ধারণ করে গায়ে ঘি মেখে ধূলিধূসর দেহে ব্যাসশিষ্যদের সঙ্গে বসে আছেন অশ্বত্থামা। ওদিকে ভীম অশ্বত্থামাকে তদবস্থ দেখেও ধনুক-বাণ হাতে ধেয়ে গেলেন এবং বলতে লাগলেন— এই ব্যাটা। দাঁড়া, যাচ্ছিস কোথায়— ভীমসেনো মহাবাহু স্তিষ্ঠ তিষ্ঠেতি চাব্রবীৎ।

ভীম ধেয়ে আসছেন ধনুক নিয়ে, তার পিছনে আবার অর্জুন-কৃষ্ণ। অশ্বত্থামা রীতিমতো ভয় পেয়ে গেলেন এবং এতটুকুও না ভেবে সেই মহাস্ত্র ‘ব্রহ্মশির’ স্মরণ করলেন। অলৌকিক অস্ত্রক্ষেপণের মন্ত্র উচ্চারণ করেই অশ্বত্থামা তাঁর মারণাস্ত্রের লক্ষ্যও উচ্চারণ করে বললেন— নিপাত যাক যত পাণ্ডবরা। ব্রহ্মশির নিক্ষিপ্ত হবার পূর্বমূহূর্তে অশ্বত্থামার মুখমণ্ডলে যে ক্রোধের চিহ্ন ফুটে উঠেছিল, যে মুখভঙ্গি ধ্বংসের ভাবনা স্মরণ করায়, সেই মুখ একবার দেখেই কৃষ্ণ তাঁর অভিপ্রায় বুঝে গেছেন এবং সঙ্গে সঙ্গে অর্জুনকেও নির্দেশ দিয়ে বলেছেন— গুরু দ্রোণাচার্য তোমাকেও যে মহাস্ত্র দান করেছিলেন, তা নিক্ষেপ করার এই হল সময়— দ্রোণোপদিষ্টং তস্যায়ং কালঃ সম্প্রতি পাণ্ডব। নিজেকে এবং ভাইদের বাঁচানোর জন্য নিক্ষেপ করো সেই মহাস্ত্র ‘ব্রহ্মশির’। অর্জুন রথ থেকে নেমে সশ্রদ্ধচিত্তে তাঁর আপন মহাস্ত্র স্মরণ করলেন, অথচ এই বিপন্ন মুহুর্তেও, যেখানে পূর্বাহ্নেই অশ্বত্থামার নিন্দিত ব্যবহার শেষ করে দিয়েছে দ্রৌপদীর পুত্রদের, সেই মুহূর্তেও বাণের লক্ষ্য উচ্চারণ করার সময় তিনি গুরুপুত্র এবং অন্যান্য সকলের মঙ্গল কামনা করে শুধু অশ্বত্থামার মারণাস্ত্রটিকে নিবৃত্ত করা বা রুখে দেবার উদ্দেশ্য উচ্চারণ করলেন মনে-মনে। অশ্বত্থামার ক্রোধান্ধ অস্ত্রক্ষেপণের বিপরীতে অর্জুনের কী অসম্ভব দায়িত্বপূর্ণ এই উচ্চারণ!

আপনাদের মনে থাকবে, আমাদের সমকালীন রাষ্ট্রীয় ভাবনার মধ্যে যে ঠান্ডা লড়াইয়ের একটা ভাবনা ছিল, মহাভারতের এই দুই যুযুধান বীরের মধ্যে মারণাস্ত্র-ধারণের বা ক্ষেপণের প্রবৃত্তিটা তার সঙ্গে খানিক মেলে। বে-মিল এইটুকুই যে, দায়িত্বজ্ঞানহীন অশ্বত্থামা তাঁর অস্ত্রের বিভীষিকাটুকু জীইয়ে রেখে জীবন কাটাতে পারলেন না এবং নিতান্ত অস্থানে অসময়ে এবং নিতান্ত আত্মপ্রিয় একক জীবন বাঁচানোর জন্য মারণাস্ত্র প্রয়োগ করে ফেললেন। বিপরীতে অর্জুন যে অস্ত্রপ্রয়োগ করছেন সেখানে হিংসার যোগ্য প্রথম পুরুষটির মঙ্গল কামনা করছেন তিনি— পূর্বমাচার্যপুত্ৰায়… স্বস্তীত্যুত্ত্বা পরন্তপ। এই বৈপরীত্য বিপ্রতীপ কৌশলে অশ্বত্থামার ব্যক্তি-চরিত্র তথা তাঁর আপন জীবনপ্রিয়তা আলোর পাশে অন্ধকারের মতো প্রকট করে তোলে।

অশ্বত্থামার মারণাস্ত্র নিবৃত্ত করার জন্য অর্জুনের মারণাস্ত্র প্রযুক্ত হলেও ব্যাস-নারদের মতো অমিত প্রভাবশালী ঋষিরা জানালেন— যেখানে যে-রাজ্যে এক ব্রহ্মশির দ্বারা অন্যতর ব্রহ্মশির প্রতিহত হয়, সেই রাজ্যে বারো বৎসর পর্যন্ত বৃষ্টি হয় না। এতএব তোমরা আপন আপন মারণাস্ত্র ফিরিয়ে নাও। মারণাস্ত্র কীভাবে দেশের-দশের ক্ষতি করে তা আমরা আমাদের সমকালেই প্রত্যক্ষ করেছি; প্রাচীন কালের এই মারণাস্ত্রের মধ্যেও আধুনিক উপাদানগুলি ছিল কিনা, সে তর্কে না গিয়েও আমরা ব্যাস-নারদের ভূয়োদৃষ্টির চরম প্রশংসাটুকু এই মর্মে করতে পারি যে, তাঁরা শীতল-যুদ্ধের ভাবনাটুকু যেমন বুঝতেন, তেমনই বুঝতেন রাষ্ট্র বা রাষ্ট্রবাসীর ওপর মারণাস্ত্র-প্রয়োগের সর্বধ্বংসী প্রভাবের কথা, যেখানে প্রকৃতি বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে বহুতর সময়ের জন্য।

ব্যাস এবং নারদ অস্ত্রদ্বয়ের মধ্যবর্তী হলেন দেখেই অর্জুন তাঁর মারণাস্ত্র কথঞ্চিৎ উপসংহার করে, তার গতি কমিয়ে রেখে ঋষিদের উদ্দেশে জানালেন— অশ্বত্থামার অস্ত্রটি নিবৃত্ত করা ছাড়া অন্য কোনও উদ্দেশ্য আমার নেই এবং এই অস্ত্র উপসংহৃত করলে অশ্বত্থামা কিন্তু আমাদের সবাইকে মেরে ফেলবে। আপনারা সেটা চিন্তা করবেন। কথাটা বলেই অর্জুন তাঁর অস্ত্র ফিরিয়ে নিলেন। মহাভারতের কবি এবং তাঁর জবানে নারদ-ব্যাস এই সময়ে অর্জুনের ব্রহ্মচর্যের কথা, তাঁর তপস্যার কথা সপ্রশংসভাবে উচ্চারণ করেছেন। আধুনিক দৃষ্টিতে আমরা বুঝি যে, ব্রহ্মচর্য কথাটি সেই রূপকে ব্যবহৃত হয়, যার অর্থ হল— আপন প্রকৃতির মধ্যে সেই নিসর্গ-সংযম না থাকলে মারণাস্ত্র ধারণ করার উপযুক্ততা জন্মায় না এবং সেই সংযম অর্জুনের আছে, কিন্তু অশ্বত্থামার নেই।

অশ্বত্থামা বিনা পরিশ্রমে, বিনা তপস্যায় স্বাত্মসাধনের জন্য নিজের দৌর্বল্য প্রকট করে পিতার দুর্বলতার সুযোগ নিয়েছিলেন। তাঁর সংযম যে কতটা কম, তা ঋষিদের কাছে তাঁর স্বীকারোক্তি থেকেই বোঝা যায়। অর্জুনের মতো ঋষিরাও যখন তাঁকে ব্রহ্মশির প্রত্যাহার করতে বললেন, তখন তাঁর প্রত্যুত্তর বড় তুচ্ছ শোনায়। তিনি বললেন— আমি ভাবলাম, আমার আজ বড় বিপদ, আমাকে বাঁচতে হবে। আর ভীম যেভাবে আমার দিকে ধেয়ে আসছিল, আমি সেই ভয়েই মহাস্ত্র ব্রহ্মশির ছেড়ে দিয়েছি— ময়ৈতদ্‌ অস্ত্রমুৎসৃষ্টং… প্রাণ ত্রাণমভীপ্সুনা, ভীমসেন-ভয়ান্মুনে। আর আমি সত্যি কথাই বলছি, আমার মন, আমার ইন্দ্রিয়গুলি রাগদ্বেষশূন্য নির্মোহ নয়, তাই দুর্যোধনকে ভীম যেভাবে মেরেছে এবং আমার দিকেও যেভাবে সে তেড়ে আসছিল, তাতেই আমি এই অস্ত্র মুক্ত করেছি ক্রোধে— অতঃ সৃষ্টমিদং ব্রহ্মন্ ময়াস্ত্রম্ অকৃতাত্মনা।

অশ্বত্থামা বলেছিলেন— আমি পাণ্ডবদের শেষ করে দেবার জন্য আজ এই অস্ত্র মুক্ত করেছি। হয়তো ক্রোধবশে রোষাবিষ্টচিত্তে পাণ্ডবদের সমূলে বিনাশ করার জন্য এই অস্ত্র নিক্ষেপ করে অন্যায় পাপকর্ম করেছি আমি— কৃতং পাপমিদং ব্রহ্মন্ রোষাবিষ্টেন চেতসা— কিন্তু পাণ্ডবদের ধ্বংসটা তো অনিবার্য। ব্যাস দ্বৈপায়ন প্রত্যুত্তরে অশ্বত্থামাকে যেটা বোঝাতে চাইলেন, সেটা হল— তুমি একাই শুধু এই অস্ত্রের প্রয়োগ জানো, তা তো নয়, অশ্বত্থামা! এই অস্ত্রের প্রয়োগ তো অৰ্জুনও জানেন— অস্ত্রং ব্রহ্মশিরস্তাত বিদ্বান্ পার্থো ধনঞ্জয়ঃ। ভাবটা এই যে, তোমার ব্রহ্মশিরে যদি পাণ্ডবদের বিনাশ হয়, তবে অর্জুনের ব্রহ্মশিরে তোমার বিনাশও অনিবার্য। যিনি দূর থেকে ভীমকে তেড়ে আসতে দেখেই ব্রহ্মশিরের মতো সর্বধ্বংসী মারণাস্ত্র প্রয়োগ করেন, তাঁর নিজের জীবনের প্রিয়তা কতখানি তা বেদব্যাস বোঝেন। একই সঙ্গে তিনি এটাও বুঝিয়ে দিলেন যে, তোমার যত হিংসাই থাক না কেন, অর্জুন তো ক্রোধবশত তোমাকে হত্যা করার জন্য সেই ব্রহ্মশির মুক্ত করেননি— উৎসৃষ্টবান ন রোষেণ ন নাশায় তবাহবে। এরই মধ্যে তিনি যখন নিজের অস্ত্র প্রতিসংহার করেই নিয়েছেন, তা হলে এমন ভাবনা তোমাকে করতেই হবে যাতে পাণ্ডবরাও বাঁচে, তুমিও বাঁচ এবং এই রাজ্যও বাঁচে। এটা তোমারই দায়িত্ব— পাণ্ডবাস্ত্বঞ্চ রাষ্ট্রঞ্চ সদা সংরক্ষ্যমেব চ।

এবারে সেই বোঝাপড়ার ব্যাপারটা এল। দ্রৌপদী প্রথমে অশ্বত্থামার প্রাণ চেয়েছিলেন, কিন্তু এই বিভ্রান্ত গুরুপুত্রের জন্য যুধিষ্ঠির এবং অর্জুন, দু’জনেরই মায়া থাকায় অশ্বত্থামার সমস্ত মর্যাদার আধার সেই মস্তকমণিটির কথাই এসে পড়ল, এই বিকল্পে সব দিকই রক্ষা পায়। ব্যাস-নারদ অতএব প্রস্তাব দিলেন— তুমি তোমার সহজাত মস্তকমণিটি পাণ্ডবদের হাতে দাও আর তার বিনিময়ে নিজের প্রাণ বাঁচাও— এতমাদায় তে প্রাণান্‌ প্রতিদাস্যন্তি পাণ্ডবাঃ। প্রাণপ্রিয় অশ্বত্থামা, নিজের আয়ুকে যিনি ভালবেসেছেন চিরকাল, তিনি মণি ছাড়তে রাজি হলেন। অবশ্য এজন্য তাঁর দুঃখ কম ছিল না। জীবনে সমস্ত মর্যাদার প্রতীক যে মণি, অলৌকিকতার প্রশ্রয়ে যে-মণি সহজাত নাই হোক, কিন্তু শৈশবের অজ্ঞাত মুহূর্তে এই মণি হয়তো দ্রোণাচার্য বেঁধে দিয়েছিলেন অশ্বত্থামার মাথায়, আর সেই থেকেই এই মণি তাঁর জীবনেরও প্রতিরূপ।

অশ্বত্থামা মণি দিতে রাজি হলেন এবং ঋষিদের কথা মেনে নিয়ে বললেন— আপনারা যা বলেছেন তা তো আমাকে করতেই হবে। এই মারণাস্ত্র প্রতিসংহরণের ক্ষমতা আমার নেই, তবে হ্যাঁ, এইটুকু আমি করতে পারি যে, এই অস্ত্র পাণ্ডবদের কাউকে না মেরে পাণ্ডবদের শিশু সন্তানটিকে নষ্ট করবে। অজাত পুত্রের গর্ভ ধ্বংস হওয়া বরং ভাল— এই ভাবনায় ঋষিরা মেনে নিলেন অশ্বত্থামার কথা। আমরা জানি না— সেকালের ‘মিসাইল’ মুক্ত হবার পরেও তার ‘টারগেট’ পরিবর্তন করা যেত কিনা, কিন্তু ভাবনাটা ছিল, এটাই মোটামুটি আধুনিকতার দিকে উত্তরণ ঘটায়। আর অশ্বত্থামার যে চরিত্রটা এখানে প্রকট হয়ে ওঠে, সেটা হল— অশ্বত্থামা দ্রৌপদীর পুত্রদের বিনাশ ঘটিয়েছেন, এখন তিনি কৌরব-পাণ্ডবের একমাত্র সন্তানবীজটিকেও ধ্বংস করতে উদ্যত হয়েছেন— সন্তানবীজং কুরুপাণ্ডবানাম্‌। অর্থাৎ নিজের প্রাণের ভয়ে পাণ্ডবদের গায়ে তিনি মারণাস্ত্রের আঁচটুকুও লাগাতে পারলেন না, কিন্তু পাণ্ডব-কিশোর এবং গর্ভশয্যায় শায়িত শিশুটিকে আঘাত করতে তাঁর দ্বন্দ্ব হল না কোনও।

তবু সকলে মেনে নিলেন অশ্বত্থামার কথা, বিশেষত কৃষ্ণ। তিনি তো বেশ খুশিই হলেন। অভিমন্যুর পুত্র উত্তরার গর্ভে যে শিশু সন্তানটি অশ্বত্থামার অস্ত্রের লক্ষ্য হয়ে উঠল, তার সুরক্ষার ব্যাপারে কৃষ্ণ আগে থেকেই সতর্ক ছিলেন। প্রথমে তো সহাস্যে বলেই দিলেন অশ্বত্থামাকে— দ্যাখো বাপু! উত্তরার গর্ভ যদি তোমার লক্ষ্য হয়, তা হলে বলি— এক প্রসিদ্ধ গণকঠাকুর বলেই দিয়েছেন— উত্তরার এই ছেলে বাঁচবে এবং পাণ্ডবদের বংশও রক্ষা করবে। অশ্বত্থামা বললেন— আমার অস্ত্র উত্তরার গর্ভেই আঘাত করবে এবং পাণ্ডবদের ওপর ভালবাসায় যতই তুমি গণকঠাকুরের বিধান উচ্চারণ করো, আমার কথা মিথ্যে হবে না, আমার অস্ত্রও মিথ্যে হবে না— পতিষ্যতি তদস্ত্রং হি গর্ভে তস্যা ময়োদ্যতম্‌। তার মানে, এখনও অশ্বত্থামার মধ্যে সেই আক্রোশ রয়ে গেছে, রয়ে গেছে সেই অহংকার, যাতে একটি গর্ভোদশায়ী শিশুর মৃত্যুও তাঁর কাছে অধিকতর কাম্য, তবু তাঁর কথা, তাঁর অস্ত্র সফল হওয়াটাই যেন বেশি জরুরি।

সারা জীবন ধরে অশ্বত্থামার অনেক রঙ্গ দেখেছেন কৃষ্ণ, বিশেষত যুদ্ধশেষে পাণ্ডবদের ঘরে শিশু-কিশোরদের অপমৃত্যু এবং মৃত্যুর আশঙ্কা কৃষ্ণকে এই মুহূর্তে বিরক্ত করে তুলেছে। তিনি বললেন— অশ্বত্থামা! তোমার অস্ত্র ব্যর্থ হবে না জানি, হয়তো উত্তরার গর্ভস্থ সন্তানটিও মরবে, কিন্তু সে আবার বেঁচেও উঠবে, আমি তাকে বাঁচাব। কিন্তু শেষ কথা আমি তোমাকে বলি— তোমার মতো কাপুরুষ এই দুনিয়ায় নেই, তুমি বাচ্চা-বাচ্চা ছেলেদের মেরে সুখ পাও— ত্বান্তু কাপুরুষং পাপং… বালজীবিত ঘাতকম্‌। তোমার এই কাজের ফল তুমি পাবে। তোমাকে এই লোকালয় ছেড়ে যেতে হবে, হাজার বছর বাঁচলেও একটি লোকের সঙ্গে তোমাকে আলাপ করার সুযোগ দেব না আমি— অপ্রাপ্নুবন্‌ ক্কচিৎ কাঞ্চিৎ সংবিদং জাতু কেনচিৎ— তুমি অসহায় হয়ে নির্জন জায়গায় ঘুরে বেড়াবে, কারও কাছে মনের কথা বলবার সুযোগ পাবে না। যা তুমি আজ করলে, তাতে মানুষের মধ্যে তোমাকে থাকতে দেব না কিছুতেই— ভবিত্রী ন হি তে ক্ষুদ্র জনমধ্যেষু সংস্থিতিঃ। তোমার অস্ত্র আঘাত করুক উত্তরার গর্ভে, আমি বলছি, আমি তাকে বাঁচাব।

অশ্বত্থামা বেঁচে রইলেন। কৃষ্ণের কথা সম্পূর্ণ সমর্থন করলেন ব্যাস। তিনি বললেন— তুমি আমাদের কারও কথা শুনলে না, বামুনের ঘরে জন্মেও তোমার এই অকরুণ চরিত্র, অতএব কৃষ্ণ যেটা বলছেন, এটাই তোমার শাস্তি হওয়া উচিত— যস্মাদনাদৃত্য কৃতং ত্বয়াস্মান্‌ কর্ম দারুণম্‌। ব্যাস বোঝাতে চাইলেন— তুমি যখন পাণ্ডবদের ওপর অস্ত্রলক্ষ্য পরিবর্তন করতে পারলে, তখন আবারও মন পরিবর্তন করে এই শিশুটিকেও মুক্ত করা যেত অস্ত্রের লক্ষ্য থেকে। নিজের বাক্য এবং অস্ত্র অব্যর্থ করার জন্য কোনও অকিঞ্চিৎকর বস্তুকেও তো গ্রহণ করা যেত। বিশেষত ব্রাহ্মণের যে শম-দম-ক্ষমা-দয়ার গুণ তা এতটুকুও তোমার মধ্যে দেখলাম না। অতএব কৃষ্ণ তোমাকে যে শাস্তি দিয়েছেন, তাই ঠিক হয়েছে তোমার— তস্মাদ্‌ যদ্‌ দেবকীপুত্র উক্তবান্ উত্তমং বচঃ।

অশ্বত্থামা এই শাস্তি মাথায় নিয়েও বাঁচতে চান। এতকাল কারণে-অকারণে বিভ্রান্ত পুরুষকার দেখিয়ে শেষে যখন এক লোকালয়হীন, সহায়-সঙ্গীহীন বন্যজীবন তাঁর নিয়তি হয়ে দাঁড়াল, তখনও কী নির্লজ্জভাবে তিনি বলছেন— আমি যখন এই লোকালয়ে কিংবা অন্যত্রও কারও সঙ্গে থাকতে পারব না, তখন হে মহর্ষি ব্যাস, আমি আপনার সঙ্গেই থাকব— সহৈব ভবতা ব্রহ্মন্ স্থাস্যামি পুরুষেষ্বিহ। তাতে কৃষ্ণের কথাও থাকবে আর আমিও বাঁচব। কথাটা বলেই অশ্বত্থামা তাঁর মস্তকস্থিত মণিটি পাণ্ডবদের হাতে দিয়ে চললেন বনের পথে, ব্যাসের তানুগামিতায় চিত্তশোধনের পথে। ব্যাস তখনই তাঁকে হাতে ধরে নিয়ে যাননি বনে, তবে তিনি ব্রাহ্মণোচিত ক্ষমায় অনুমোদন করেছেন অশ্বত্থামার শেষ উপরোধ।

ভীষ্ম মহামতি কতকাল আগেই অশ্বত্থামাকে দেখে বলেছিলেন— জীবন তাশ্বত্থামার বড় প্রিয়, যেভাবে হোক তিনি বেঁচে থাকতে চান— জীবিতং প্রিয়মত্যর্থমায়ুষ্কামঃ সদা দ্বিজঃ। ব্রাহ্মণ হয়ে জন্মে ক্ষত্রিয়ের বৃত্তি গ্রহণ করে, সারা জীবন পরাশ্রয়ে থেকে, নীতিহীন পুরুষকার প্রকট করে শুধু বেঁচে রইলেন অশ্বত্থামা। ভারতবর্ষের নীতি-প্রবচনে অদ্ভুত একটা শ্লোক পাওয়া যায়। সেই শ্লোক বলে— ভারতীয় জীবনে সাত জন মানুষের মরণ হয়নি, তাঁরা চিরজীবী। এই সাত জন হলেন— অশ্বথামা, দানবরাজ বলি, মহাভারতের কবি ব্যাসদেব, রামায়ণের হনুমান, বিভীষণ, আর কৃপাচার্য এবং পরশুরাম—

অশ্বত্থামা বলির্ব্যাসো হনূমাংশ্চ বিভীষণঃ।
কৃপঃ পরশুরামশ্চ সপ্তৈতে চিরজীবিনঃ॥

এই সাতজনের চিরজীবিতার কারণ একরকম নয় এবং সময়ে, অবসরে সেই জীবন বিচার করতে পারি। কিন্তু শ্লোকের মধ্যে চরিত্রের বিপরীত-সংঘট্ট দেখেই বোঝা যায় যে দানবরাজ বলি কিংবা হনুমান অথবা বেদব্যাসের চেয়ে অশ্বত্থামার চরিত্র কত বিপরীত, এমনকী অশ্বত্থামার অন্যতম সহায় কৃপাচার্যের চরিত্রও কতটা পৃথক তাঁর চেয়ে। আমরা অশ্বত্থামার জীবন এবং জীবনের ঘটনাগুলি ক্রমান্বয়ে বলেছি। অন্যান্য চিরজীবী জনের সঙ্গে তাঁর বিশিষ্টতা কোথায়, সেটাও নিশ্চয়ই প্রকট হয়ে উঠেছে ভালভাবেই। শুধু এইটুকু বলার যে, সাত-সাত জন এই চিরজীবী চরিত্রের মধ্যে অশ্বত্থামা বোধহয় সবচেয়ে নিকৃষ্ট, কেন না লক্ষ্য সাধনের ক্ষেত্রে অশ্বত্থামার কোনও নীতি ছিল না, এমনকী তাঁর লক্ষ্যটা যে ঠিক কী, তা বোধহয় তিনি নিজেও জানতেন না। তাঁর পাশেই দুর্যোধনের কর্ম-বিন্যাসের কথা ভাবুন। সারা জীবন তিনি অন্যায় করেছেন একটার পর একটা, তবু তাঁকে আমরা পূর্ণমাত্রিকে চিনতে পারি। কিন্তু অন্যায়ের হিসেব না করলেও এ-কথা স্পষ্ট বলা যায় যে, অশ্বত্থামাকে পরিষ্কার চেনা যায় না। কখন কোথায় তাঁর পক্ষপাত তৈরি হবে তা যেমন আগে থেকে বলা যায় না, তেমনই নৈতিক বিচারের ক্ষেত্রটাও তাঁর স্পষ্ট নয়। তাঁর সমর্থনযোগ্য রাজনীতিও যতখানি তাঁর স্বার্থসাধনের উদ্দেশে ব্যবহৃত, ঠিক ততখানি ‘ডেডিকেশন’ সেখানে নেই, এমনকী স্বার্থলাভের জন্য সেবার মধ্যে যে অনুগতি দরকার, তাও অশ্বত্থামার নেই। ফলত শেষপর্যন্ত তিনি কিছুই পান না, নিজেকে বাঁচিয়ে চলতে-চলতে শেষপর্যন্ত তিনি বেঁচেই থাকেন, সঙ্গীহীন, সহায়হীন, অন্যের দ্বারা নিন্দিত জুগুস্পিত হয়ে অশ্বত্থামা শুধু বেঁচেই থাকেন। কী অদ্ভুত অর্থহীন এই চিরজীবিতা! অনেক কাল বেঁচে থেকে এমন চিরজীবন লাভ করা অথবা এইভাবে লোকস্মৃতিতে বেঁচে থাকার মধ্যে যে যন্ত্রণা আছে, অশ্বত্থামা সেইরকম এক চিরজীবী মানুষ।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *