জয়দ্রথ

জয়দ্রথ

একটি অসংগঠিত শুভশক্তির বিরুদ্ধে একটি সংগঠিত অশুভশক্তি যখন লড়াই চালায়, তখন একা সেই কাজ করা যায় না। যাঁরা নিরন্তর অপরাধ করেন— তাঁরা যদি গুন্ডা, বদমাশ বা পাকা অপরাধীও হন, তিনি তাঁর ব্যক্তিগত অপরাধের সাফল্য ধরে রাখার জন্য নেতৃত্ব দিতে পারেন অবশ্যই, কিন্তু তাঁরও নিজস্ব একটা দল থাকে, গোষ্ঠী থাকে এবং তাদের মধ্যেও কিছু মানুষ থাকে, যাদের দিয়ে তিনি ছোটখাটো অপরাধগুলো করিয়ে নেন যাতে তাঁর অপরাধ কররা ধারাটুকু ঠিক থাকে। পাণ্ডবদের বিরুদ্ধে দুর্যোধন যে-ভাবে তাঁর অন্যায় অত্যাচারগুলি চালিয়েছিলেন, সেগুলি সবটাই তাঁর নিজকৃত নয়। সেই কৈশোর-যৌবনের প্রথম সন্ধিতে দুর্যোধন ভীকে বিষ দিয়েছিলেন খাবারের সঙ্গে মিশিয়ে কিন্তু তারপর আরও এক অপরাধ ঘটেছে তাঁর দিক থেকে, আরও অনেক বার দুর্যোধনের কৌশলে বিপাকে পড়তে হয়েছে পাণ্ডবদের, কিন্তু সব জায়গাতেই তিনি সরাসরি অংশগ্রহণ করছেন না। পাণ্ডবদের তিনি পাশাখেলায় হারিয়ে দিয়ে বনে পাঠালে, বটে, কিন্তু তাঁর হয়ে পাশা খেলেছিলেন শকুনি-মামা। অর্থাৎ তাঁকে দিয়ে তিনি পাণ্ডবদের রাজ্যহরণের ব্যবস্থা করেছেন। আবার কৌরব-সভর একবস্ত্রা রজস্বলা দ্রৌপদীকে টেনে এনে যে অপখান-অত্যাচার করা হল, সেখানে বিরাট ভুমিকা ছিল কর্ণ এবং দুঃশাসনের। অর্থাৎ এঁরা দু’জন দুর্যোধনের কৃত্য করে দিয়েছে।

কর্ণ, দুঃশাসন, শকুনি এঁদের কথা বোঝা যায়, এঁরা দুর্যোধনের জন্য সরাসরি কর্মে নিযুক্ত। আর এক ধরনের মানুষ দুর্যোধনের পাশে ছিলেন যাঁরা আজও আছেন অন্য নামে। এই যে মাফিয়া-চক্রের গুরুরা থাকেন, এই যে বড় বড় দলের দুষ্ট নেতারা থাকে, তাঁদের প্রত্যক্ষ সহচরেরা ছাড়াও আরও অনেক হৃষ্টপুষ্ট সমর্থক থাকেন, তাঁর গুরু এবং নেতাদের মন বোঝেন এবং মন বুঝে কাজ করে তাঁদের মনস্তুষ্টি ঘটান। এঁদের ‘প্রোফাইল’ খুব ‘হাই’ হয় না কখনও, ‘হাই’ থাকেও না, কিন্তু অন্য কালে অন্য স্থানে নিজের মতো করেই এক-একটা কাজ এঁরা করেন, যাতে একভাবে নেতা-গুরুদের সুবিধে হয়ে যায়। এ-সব ক্ষেত্রে সব সময়েই নেতা-গুরুদের তরফ থেকে যে প্রত্যক্ষ কোনও আদেশ থাকে তা নয়, কিন্তু এই সব ছোট্ট ছোট্ট বালখিল্য অপরাধীরা তাদের শ্রদ্ধাস্পদ মানুষদের অভীষ্ট সাধন করে দিয়ে নিজেরাই ধন্য বোধ করেন এবং তা বোধ করেন এই ভেবে যে, নেতা-গুরুরা তাঁদের কর্মকাণ্ডে ভারী খুশি হবেন এবং সত্যি বলতে কী, এই অকারণ বশংবদতায় তাঁরা খুশি হনও!

মহাভারতে এইরকম একটা ক্ষুদ্র চরিত্র হলেন জয়দ্রথ। তাঁর রাজনৈতিক শক্তি, তাঁর নিজস্ব শক্তি এবং মাহাত্ম্যের বিচারে কখনওই তাঁকে মহাভারতের প্রতিনায়কের ভূমিকায় টেনে আনা যায় না। কিন্তু সময় বুঝে মানুষ দেখে প্রধান প্রতিনায়কের অভীষ্ট বিষয় সম্পন্ন করাটা তাঁর কর্তব্যের মধ্যে পড়েছে। এই বিশেষত্বই দুর্যোধনের মতো বিশাল প্রতিনায়কের সঙ্গে দ্রথের সাহিত্য গড়ে তুলেছে। তা নইলে জয়দ্রথের কোলিক ঐতিহ্য, বংশমর্যাদা অথবা নিজস্ব শক্তি-প্রভাব এমন কিছু নয় যে, প্রসিদ্ধ কুরুবংশের ধারে-কাছেও তাঁর জায়গা হতে পারে। তবে হ্যাঁ, এটা তো ঠিকই, কুরুরাজ দুর্যোধনের সঙ্গে তাঁর অন্তরঙ্গ যোগাযোগ গড়ে ওঠাব একমাত্র কারণ তো সেই দুঃশলা— কৌরব-বাড়ির একশো ভাইয়ের একমাত্র বোন, এমনকী ধৃতরাষ্ট্র-জ্যাঠার এই মেয়ে তো পাণ্ডব-ভাইদেরও একমাত্র বোন— সে-কথা পাণ্ডবরাও যথেষ্ট মনে রাখতেন, এটা মানতেই হবে।

জননী গান্ধারী একশত পুত্র লাভ করেও একটি কন্যা সন্তানের জন্য মনে মনে আকুল ছিলেন। একটি মেয়েকে মাতৃস্নেহে মানুষ করে বিয়ে দেবেন, ঘরে জামাই আসবে, একশো ভাই তাদের বোনকে আদরে রাখবে— এই মধুর ভাবনা থেকেই পরমর্ষি ব্যাসের কাছে একটি কন্যা চেয়েছিলেন জননী গান্ধারী। কিন্তু আশ্চর্য লাগে দেখে— কন্যা সন্তানের জন্য গান্ধারীর এত যে মধুর কল্পনা, তা পরবর্তী কালে তেমন সাড়ম্বরে বর্ণিত হয়নি। এ-কথা অবশ্যই ঠিক যে, কুরু-পাণ্ডবের বিচিত্র ইতিহাস রচনার সময় একশো ভাইয়ের একটিমাত্র বোন দুঃশলার জীবন কাহিনি উপেক্ষিতই থেকে গেছে মহাকবির অন্যাখ্যান-বিচরণের অনীহায়, অতএব অনিবার্যতায়। যে-কারণে দুঃশলার জন্মকালেই মহাকবি যখন সংক্ষেপ-নিপুণ বর্ণনায় জানাচ্ছেন যে, জননী গান্ধারী এক শত পুত্রের পরেও ব্যাসের করুণায় দুঃশলা নামের কন্যাটিকে লাভ করেছেন— দুঃশলা চ শতাধিকা— ঠিক তখনই প্রায় অধ্যায়শেষের বাক্যটিতে দুঃশলার বিবাহ-পর্বও এক কথায় শেষ করে ফেলতে হচ্ছে— মহারাজ ধৃতরাষ্ট্র তাঁর বিবাহযোগ্যা কন্যাটিকে ঠিক সময়মতোই জয়দ্রথের হাতে তুলে দিলেন— দুঃশলাঞ্চাপি সময়ে… জয়দ্রথায় প্রদদৌ বিধিনা ভরতৰ্ষভ।

কে জয়দ্ৰথ, কোন মান্য দেশের রাজা তিনি, কেমন করেই বা তাঁর বিয়ে ঠিক হল দুঃশলার সঙ্গে— এই সব সংবাদ এই মুহূর্তে মহাভারতের কবি দেননি। তবে ওই একটি কথা ‘বিধিনা’— অর্থাৎ শাস্ত্রীয় বিধি-নিয়ম অনুসারেই ধৃতরাষ্ট্র কন্যাদান করেছিলেন জয়দ্রথের কাছে— তার মানে, রাজবাড়ির বিয়েতে যে আড়ম্বর-উদ্দীপনা হওয়া উচিত, সেগুলি সবই হয়েছিল বটে, তবে মহাভারতের কবির সে-কথা বর্ণনা করার সুযোগ নেই, অবসরও নেই, কেন না তাঁকে মহাভারতের মূল চলমান কাহিনি নিয়ে ব্যস্ত থাকতে হচ্ছে। তা ছাড়া এই ধরনের পার্শ্বচরিত্র বর্ণনা করার সময় মহাকাব্যের কবি একেবারেই চান না যে, পুনরুক্তি ঘটুক কোথাও। তিনি জানেন— যখন জয়দ্রথের কথা পরে আসবে তখনই তাঁর রাজ্য, বংশ এমনকী তাঁর স্বভাব-চরিত্রও কাহিনির ফাঁকে ফাঁকে বলে নেওয়া যাবে।

নিজের রচনার ছক ধরেই এগিয়েছেন মহাভারতের কবি। সেই যখন পাণ্ডবরা বনবাসের কালে কাম্যক বনে বাস করছেন। সবে যেখানে দুর্বাসা ঋষির বিশাল ঝামেলা শেষ হয়েছে। ঝামেলা মানে সেও কিন্তু দুর্যোধনেরই তৈরি ঝামেলা। ওই যে বলেছিলাম— অপরাধ-প্রবণ নেতা-গুরুরা নিজেরাই সব সময় অপরাধ করেন না, তাঁরা অন্যের মাধ্যমেও অপরাধ সম্পন্ন করেন। এমনকী এই অপরাধ করার জন্য মুনি-ঋষিদের মতো সত্তম ব্যক্তিদেরও যে ব্যবহার করা যায়, তা দুর্যোধন বুঝিয়ে দিয়েছেন দুর্বাসা ঋষিকে অপব্যবহার করে। দ্রৌপদীর সেই সূর্যমার্কা থালার দৌলতে সবার খাওয়া শেষ হয়ে দ্রৌপদীর খাওয়া শেষ হবার পর দুর্বাসা এসেছিলেন পাণ্ডবদের বিপদ বাড়াতে। কিন্তু কৃষ্ণের হস্তক্ষেপে দুর্বাসা নিজে কিছু করতে না পেরে শিষ্যদের নিয়ে পালিয়ে গিয়েছিলেন। ঠিক এর পরেই জয়দ্রথের আবির্ভাব ঘটে কাম্যক বনে। এই আমরা প্রথম জয়দ্রথের সুষ্ঠু পরিচয় জানতে পারছি।

মহাভারতের সেই আদিপর্বে দুঃশলার জন্ম ঘোষণা করেই জয়দ্রথের সঙ্গে তাঁর বিবাহের ঘটনা উল্লেখ করেছিলেন মহাভারতের কবি। আর একবার দ্রৌপদীর স্বয়ংবর-পর্বে বিবাহেচ্ছু রাজাদের বিচিত্র সমাবেশের মধ্যেও আমরা জয়দ্রথকে একবার দেখেছি, তবে সেখানে তাঁর পিতা বৃহৎক্ষত্রকেও দেখেছি এবং সেখানে তাঁদের দেশনামটিও সচেতনভাবে উচ্চারিত— ভগীরথো বৃহৎক্ষত্রঃ সৈন্ধবশ্চ জয়দ্রথঃ। দ্রৌপদীর স্বয়ংবর-পর্বে কুমার ধৃষ্টদ্যুম্ন যেহেতু দ্রৌপদীর সামনে রাজাদের পরিচয় দিচ্ছিলেন তাই রাজনামের সঙ্গে দেশনামেরও প্রয়োজন ছিল। অতএব দ্রৌপদীর সঙ্গে আমরাও এই প্রথম জানলাম যে জয়দ্রথ সিন্ধু-দেশের রাজা— সৈন্ধবশ্চ জয়দ্রথঃ— যদিও তাঁর পিতার নাম যে বৃহৎক্ষত্র তাঁর পরিচয় পেয়েছি সেই কাম্যক বনের ঘটনায়— একটু আগেই যার সূত্রপাত করেছিলাম আমরা। দ্রৌপদীর স্বয়ংবরে জয়দ্রথ পিতার সঙ্গে এসেছিলেন এবং অন্যান্য মহারথীদের মতো তাঁকে ধনুক তুলে মৎস্যচক্ষু ভেদ করার অপচেষ্টা করতেও দেখিনি। তাতেই মনে হয়— স্বয়ংবরে এই অংশগ্রহণ নেহাতই রাজা-রাজড়াদের ‘প্রোটোকল’ অথবা বলা উচিত স্বয়ংবর-সভার বিচিত্র ঘটনারাশি দেখার কৌতূহল।

কাম্যক বনে জয়দ্রথ যে ঘটনাটা ঘটিয়েছিলেন, সে ঘটনাটা না ঘটতেও পারত। কারণ জয়দ্রথ কিন্তু জেনে-বুঝে কোনও উদ্দেশ্য নিয়ে পাণ্ডবদের কোনও বিপদ ডেকে আনার জন্য প্রস্তুত হননি। অথচ ঘটনাটা তিনি ঘটালেন আর সেইজন্যই মহাভারতের কবিকে নতুন করে তাঁর পরিচয় দিতে হল— তারপর সিন্ধুদেশের রাজা বার্দ্ধক্ষত্রি জয়দ্রথ রওনা হলেন কাম্যক বনের পথ বেয়ে— ততস্তু রাজা সিন্ধুনাং বার্দ্ধক্ষত্রির্মাহাযশাঃ।

বার্দ্ধক্ষত্রি মানে বৃদ্ধক্ষত্রের ছেলে জয়দ্রথ, তিনি সিন্ধুদের রাজা। সিন্ধুদের— এই বহুবচন প্রয়োগ করার সঙ্গে সঙ্গে বুঝতে হবে যে, সিন্ধু নামের দেশটিতে যাঁরা থাকতেন তাঁরাও সিন্ধু বা সৈন্ধব নামে পরিচিত ছিলেন। প্রাচীন ভারতে সিন্ধু-দেশের অবস্থান বুঝতে গেলে বলতে হবে যে, সাধারণত সিন্ধুনদীর জল-ধোয়া অঞ্চল, যেটাকে এখন পাকিস্তানে ‘সিন্দ্’ বলা হয়, সেটাই সিন্ধু। ইতিহাসকে ভূগোলের ভাবনায় ভাবলে নিম্ন-সিন্ধু উপত্যকার অঞ্চলটাকেই মহাভারতের কালে সিন্ধু-সৌবীর বলে চিহ্নিত করা হত। সিন্ধু উপত্যকা যেহেতু বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর অধিকারে ছিল, তাই এক সময় এই জায়গাটাকে হয়তো দেশের প্রাচীনতম অধিবাসী ‘সুবীর’দের নামে চিহ্নিত করাটাই প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল। খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতাব্দীতে পাণিনি সৌবীরদের উল্লেখ করেছেন এক বিশেষ জনগোষ্ঠীর নাম হিসেবেই আর গবেষক মানুষেরা এমন উল্লেখও করেছেন যে এখনকার বণিকগোষ্ঠীর সাধারণ নাম ‘শাউ’ বা ‘সওদাগর’ কথাটা এই ‘সৌবীর’দের নাম থেকেই এসেছে— কেন না বণিক হিসেবে সৌবীরদের খ্যাতি আছে বৌদ্ধ গ্রন্থগুলিতে।

ভৌগোলিক দৃষ্টিতে নিম্নসিন্ধু উপত্যকায় মূলতান শহর থেকে একেবারে সমুদ্র পর্যন্ত তখনকার সিন্ধু-দেশের বিস্তৃতি ছিল, অর্থাৎ এখনকার দিনের সম্পূর্ণ ‘বালুচিস্তান’কে নিয়ে মূলতান থেকে সমুদ্র পর্যন্ত দেশই তখনকার সিন্ধু। পর্যটক হিউয়েন সাঙ যে সিন্ধুদেশকে দেখেছিলেন তার বিস্তৃতি ছিল পাকিস্তানের শিকারপুর থেকে সমুদ্র পর্যন্ত বিস্তৃত ভূমি। জয়দ্রথ ছিলেন সিন্ধু-সৌবীরদের রাজা।

সিন্ধুপতি জয়দ্রথ নিজের দেশ থেকে শাল্বদের দেশে যাচ্ছেন। শাল্ব-দেশটা তখন কুরু-পঞ্চাল দেশের কাছাকাছি অঞ্চলেই অবস্থিত ছিল। ঋগবেদের মন্ত্রপাঠ দেখে পণ্ডিতেরা কেউ কেউ যমুনার কাছাকাছি জায়গায় শাল্বদেশের স্থান-নির্ণয় করেছেন। সেই সিন্ধুদেশের উপত্যকাভূমি ছেড়ে জয়দ্রথ বিশাল কোনও জন-কল্যাণের জন্য শাল্বদেশে যাচ্ছেন না, তিনি যাচ্ছেন বিয়ে করতে। বধূ সে-দেশের রাজপুত্রী কিনা, সেটা মহাভারতের কবি বলেননি। তবে যেভাবেই হোক, তিনি শাম্বদের দেশে তাঁর বিবাহযোগ্যা কোনও রমণীর সন্ধান পেয়েছেন, যে-কারণে রাজ্যপাট ছেড়ে অনুচর-পার্ষদদের নিয়ে তিনি শাল্বদেশে রওনা হয়েছেন বিয়ের ইচ্ছে মনে নিয়ে— বিবাহকামঃ শাল্বেয়ান্ প্রয়াতঃ সোহভবত্তদা। বিয়েটা তাঁর মনে মনে এবং আনুষ্ঠানিকভাবেও হয়তো এতটাই ঠিক হয়ে আছে যে, শুধু অনুচর-পার্ষদবর্গ নয়, তিনি রীতিমতো একটা বরযাত্রীর দল নিয়ে চলেছেন— মহতা পরিবর্হেণ। সেই বরযাত্রীর মধ্যে প্রিয় অনুচর যত আছে তার থেকেও বেশি আছেন রাজা-রাজড়ারা এবং রাজার সঙ্গে বিবাহসভায় যাবার মতো রাজযোগ্য অভিজন মানুষেরা— রাজভির্বহুভিঃ সার্ধম্… রাজযোগ্যেন সংবৃতঃ।

বিবাহের এই আয়োজন থেকেই আমরা জয়দ্রথের পত্নীস্থান অনুমান করতে পারি। গান্ধারী-জননী তাঁর অত সাধের মেয়ে দুঃশলার মাধ্যমে যে জামাই-লাভের আনন্দ পেতে চেয়েছিলেন— অধিকা কিল নারীণাং প্রীতিৰ্জামাতৃজা ভবেৎ— সেই জামাই আবার নতুন একটা বিয়ে করতে যাচ্ছেন। এই ভাবনা থেকে একশো ভাইয়ের এক বোন দুঃশলার অন্তর-স্থিতি অনুমান করে নিতে অসুবিধে হয় না। একই সঙ্গে সিন্ধু-সেবীরদের রাজা জয়দ্রথের কামুকতার পরিমাণ বুঝতেও অসুবিধে হয় না। এ-কথা অবশ্য বলাই যেতে পারে যে, তৎকালীন দিনের সামাজিক পরিস্থিতিতে পুরুষ মানুষ, বিশেষত রাজা-রাজড়াদের একাধিক বিবাহ অপ্রচলিত ছিল না। স্বয়ং যুধিষ্ঠির-ভীম-অর্জুনেরাও একাধিক বিবাহ করেছেন। কিন্তু বিবাহ করার সামাজিক প্রচলন অনুসারে একাধিকতা এক জিনিস আর কামুকতা আর এক জিনিস। একাধিক বিবাহের সামাজিক অনুমতি ছিল, অথচ জয়দ্রথ একা দুঃশলাকে বিবাহ করে বসেছিলেন এবং এই এখন আর একটি মাত্র বিবাহ করতে চলেছেন, তা তো নয়; অনেক বিবাহ করাটা আগেই তার হয়ে গেছে, এখন সেই সমস্ত বিবাহের সরসতা ছেড়ে, বিশেষত দুঃশলার ভাবনা এতটুকুও মাথায় না রেখে জয়দ্রথ নতুন আরও একটি বিবাহের উদ্যোগ নিয়ে মূলতান-বালুচিস্তানের রাজ্য ছেড়ে শাল্বরাজ্যে রওনা দিয়েছেন। আগেই বলেছি— এক মতে শাল্বদেশ যমুনা নদী এবং কুরু-পাঞ্চাল দেশের কাছাকাছি, এখনকার পণ্ডিতেরা অবশ্য রাজস্থানের আলোয়ার অঞ্চলের কোনও জায়গাকে শাল্ব-রাজ্য বলতে চান। যদিও পাণ্ডবদের অজ্ঞাতবাসের আবাসভূমি জয়পুর-ভরতপুর এবং আলোয়ার অঞ্চল তৎকালীন বিরাট-রাজ্য বলে পরিচিত ছিল, তবু আলোয়ার জায়গাটাকে আরও একটু বিস্তৃতভাবে বোঝাই ভাল।

জয়দ্রথ এই শাল্বদেশে আসার জন্য অনেকটা পথই পেরিয়ে এসেছেন, কিন্তু আসার পথেই সরস্বতী নদীর পুণ্যতীরবাহী কাম্যক বনে তিনি প্রবেশ করেছেন। এখান থেকে তাঁর বিবাহযোগ্য গন্তব্যস্থল খুব দূরে নয়, কিন্তু এইখানেই তিনি আটকে গেলেন এবং আটকে যাবার পিছনে সেই কামুকতা এবং নাশকতার আভাস আছে যা সমাজ-সচল বহুবিবাহপ্রথার অস্তিত্বের চেয়েও নিন্দনীয়; আরও নিন্দনীয় কারণ, জয়দ্রথ জেনে-বুঝে দুর্যোধনের অভীষ্ট সাধন করছেন বিনা তাঁর নির্দেশে, বিনা কোনও প্ররোচনায়।

পাণ্ডবদের তখন বনবাসের কাল। তখন তাঁরা দ্বৈতবন ছেড়ে কাম্যক বনে এসে বাস করছেন। পাণ্ডবদের অরণ্যবাসের পর্ণকুটীরে বয়স্ক লোক বলতে আছেন শুধু দু’জন— এক কুলপুরোহিত ধৌম্য, অন্য জন হলেন মহর্ষি তৃণবিন্দু। তৃণবিন্দু আগন্তুক ঋষি, আর ধৌম্য পাণ্ডবদের সঙ্গে সঙ্গেই থাকেন সব সময়। পাণ্ডবরা যেখানে থাকেন, সেখানে অনেক সময়েই ব্রাহ্মণ-সজ্জনের সমাগম হয়। তাঁরা অনেক সময়েই থেকেও যান পাণ্ডবদের অরণ্য আবাসে। আর এখানে যেহেতু রাজোচিত সম্ভার নেই অতিথি আপ্যায়ন করার, অতএব পাঁচ ভাই পাণ্ডবেরা সকলেই সেদিন তৃণবিন্দু এবং ধৌম্যের অনুমতি নিয়ে মৃগয়ায় বেরিয়েছে— মৃগয়াং পুরুষব্যাঘ্রা ব্রাহ্মণার্থে পরন্তপাঃ। বয়স্ক মানুষ হিসেবে তৃণবিন্দু এবং ধৌম্য দু’জনেই যেহেতু অরণ্য-কুটিরে উপস্থিত আছেন, অতএব পঞ্চপাণ্ডবপ্রিয়া দ্রৌপদীকে নিশ্চিন্তে ধৌম্যপুরোহিতের জিম্মায় রেখে পাণ্ডবরা বিভিন্ন দিকে মৃগয়ায় বেরিয়ে পড়লেন— দ্রৌপদীম্ আশ্রমে ন্যস্য তৃণবিন্দোরনুজ্ঞয়া।

ঠিক এই রকমই একটা সময়ে, যখন পুরোহিত ধৌম্য অথবা মহর্ষি তৃণবিন্দুও অন্য কর্মে ব্যস্ত অছেন অথবা তাঁরা এতটাই নিশ্চিন্তে যে, দ্রৌপদী তো নিরাপদেই আছেন অরণ্য-আশ্রমে, সেই সময়ে সিন্ধুপতি জয়দ্রথ এই পথ বেয়েই শাল্ব-দেশে যাচ্ছেন বিয়ে করতে।

এই পথ কোনও বণিক-পথ নয়, কোনও রাজপথও নয়। অর্থাৎ তেমন কোনও প্রশস্ত পথ নয় যেখান দিয়ে নিত্য মানুষ জন যাতায়াত করে। কাম্যক বন যথেষ্ট গভীর বন, তবে কিনা পূণ্যা সরস্বতী নদীর তীরবর্তী বলেই এই বনের মধ্য দিয়ে মুনি-ঋষি-ব্রাহ্মণদের যাতায়াত ছিল, এতেই একটা পথের আকার তৈরি হয়েছে বটে, তবে নিশ্চয়ই এই সংকীর্ণ পথ দিয়ে। শাল্ব-দেশে যাওয়াটা সহজ হয় এবং সময়ও কম লাগে। বিবাহ-কৌতুহলী জয়দ্রথ তাড়াতাড়ি শাল্বদেশে যাবার জন্যই কাম্যক বনের মধ্য দিয়ে এই সংকীর্ণ পথ ধরেছেন। পাণ্ডবরা যে অরণ-আশ্রম তৈরি করেছেন, তা এই পথ থেকে খানিকটা দূরে, অর্থাৎ পথচারী মানুষের সামান্য কোলাহল, কৌতূহল যাতে তাঁদের অরণ্যবাসের শান্তি বিঘ্নিত না করে, আবার প্রয়োজনে এই পথের সুবিধে থেকেও যাতে তাঁরা বঞ্চিত না হন, সেইজন্য এই কৃত্রিম পথের সামান্য দূরেই গাছ-গাছালিতে ঢাকা তাঁদের সাময়িক আবাস তৈরি হয়েছে।

স্বামীর বাড়িতে নাই, পুরোহিত ধৌম্যও হয়তো হোমকর্মের জন্য বনের মধ্যেই কোথাও সমিদাহরণ ব্যস্ত, পাণ্ডব-ঘরনি দ্রৌপদী অরণ্য-আশ্রমের দ্বারের কাছেই দাড়িয়ে ছিলেন নির্জন বনের মধ্যে। অরণ্যের উদাসী হাওয়ায় তাঁর কেশপাশ যেমন বিস্রস্ত করে তুলছে, তেমনই এলোমেলো করে তুলেছে তার মন। আশ্রমের দ্বারে দাঁড়িয়ে কত কথাই না তিনি ভাবছেন— কৌরবদের অপমানের কথা, পঞ্চ স্বামীর প্রতিক্রিয়ার কথা, ইন্দ্রপ্রস্থের রাজলক্ষ্মী ছেড়ে অরণ্য-আশ্রমে এই অদ্ভুত জীবন-যাপনের কথা। এরই মধ্যে জয়দ্রথ তাঁর সাঙ্গোপাঙ্গ নিয়ে অরণ্যের এই সংকীর্ণ পথ ধরে চলেছেন শাল্বদেশের ঠিকানায়।

অরণ্যপথে চলতে চলতে পথের পাশে, কাছে দূরে মানুষের আবাস দেখলে পথচারীরও কৌতূহল হয়, কিন্তু তাতে সাধারণ পথচারী তাঁর চলার মূল লক্ষ্য থেকে ভ্রান্ত হয় না। কিন্তু জয়দ্রথ সাধারণ পথচারী নন। দুঃশলার মতো অভিজনবতী রমণীকে বিবাহ করার পরেও তিনি আরও বিবাহ করেছিলেন এবং আবারও তিনি বিবাহের গন্ধে শাল্বদেশে চলেছেন। এই রকম চরিত্রের পথচারী যখন অরণ্য-পথের পাশে পর্ণ-আবাসের দ্বারের ওপর হাত-রাখা কোনও মহিলাকে দেখতে পান তখন তাঁর মানসলোকে প্লাবন বয়ে যায়। পাণ্ডব রনি দ্রোপদী কালো মেয়ে বটে, তবে তাঁর ব্যক্তিত্ব, প্রভাব এবং শারীরিক অঙ্গ-সংস্থান এখনও এই বয়সেও এমনই যে তাঁর দিকে না তাকিয়ে উপায় নেই— বিভ্রাজমানাং বপুষা বিভ্রতীং রূপমুওমম্। বিশাল বনভূমির মধ্যে এক পর্ণাশ্রমের দ্বারদেশে তিনি দাড়িয়ে আছেন, তবু তাঁর দিকে দূর থেকে পথচারী জয়দ্রথের চোখ পড়ে গেল— ঘন নীল মেঘে আবৃত আকাশের মধ্যে হঠাৎ চকিত বিদ্যুতের আলোক দেখতে পেলে সেদিকে যেমন চোখ পড়েই যায়, সেইভাবেই জয়দ্রথের চোখ পড়ে গেল রূপোজ্জ্বলা দ্রৌপদীর ওপর— তিষ্ঠন্তীম্ আশ্রমদ্বারি দ্রৌপদীং নির্জনে বনে!

শুধু জয়দ্রথ নন, তাঁর সাঙ্গোপাঙ্গ সকলেই অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল দ্রৌপদীর দিকে। এই নির্জন বনভূমির মধ্যে একাকিনী বিদ্যুৎপ্রভার মতো এ রমণীর অবস্থান! সবাই ভাবল— ইনি কি স্বর্গসুন্দরী অপ্সরা, নাকি দেবতার ঘরের মেয়ে, কী কারণে স্বর্গ থেকে নেমে এসেছে ভুঁয়ে। অথবা এই বনভূমির নির্জনতায় কোনও রমণীর অবস্থান এতটাই অস্বাভাবিক যে সকলেই ভাবল— এটা কোনও মায়াও হতে পারে, দেবতারা তাদের ভ্রান্ত করার জন্য এমন মায়া তৈরি করেছেন— অপ্সরা দেবকন্যা বা মায়া বা দেবনির্মিতা। কিন্তু জয়দ্রথের সাঙ্গোপাঙ্গরা যাই ভাবুন মনে, সিন্ধুপতি জয়দ্রথ ঠিক বুঝেছেন। বুঝেছেন যে, রমণী রীতিমতো রক্তমাংসের মানুষ এবং তাঁর সমস্ত প্রত্যঙ্গসংস্থান জয়দ্রথের মনে যতখানি বিস্ময় জাগাল, তার থেকে বেশি জাগিয়ে তুলল কামনা— বিস্মিতস্তু অনবদ্যাঙ্গীং দৃষ্ট্বা তাং দুষ্টমানসঃ।

ভূয়োদর্শী কবি, মহাকাব্যের কবি এই অসাধারণ পথচারীকে ঠিক চিনেছেন। যেখানে অন্য মানুষেরা এই নির্জন বনোদ্দেশে অপরূপা রমণীকে দেখে অপ্সরা না দেবমায়া— এই তর্কে ভাবিত ছিলেন, সেখানে মহাকবি জয়দ্রথের আখ্যা দিলেন ‘দুষ্ট মনের মানুষ’। আর তাঁর মনটা এমন দুষ্ট হল কী করে? তার কারণ দেখিয়ে মহাকবি বলেছেন— দ্রৌপদীর রমণী-শরীরের সংস্থানে এতটুকুও খুঁত না দেখে অর্থাৎ শুধু শরীর দেখেই তাঁর মন দুষ্ট কল্পনায় মেতে উঠল— অনবদ্যাঙ্গীং দৃষ্ট্বা তাং দুষ্টমানসঃ। এ-রকম পুরুষ মানুষ তো সত্যিই অনেক আছে, যারা রমণীর মন দেখে না, গুণ দেখে না, রমণীর চাওয়া-পাওয়া, ইচ্ছা-অনিচ্ছা দেখে না, শুধুই শরীর দেখে প্রাপ্তির ভাবনা করে। বার্ধক্ষত্রি জয়দ্রথও এই রকমই এক পুরুষ। দ্রৌপদীর শরীর দেখা মাত্রই তিনি কামনায় তাড়িত হয়ে বন্ধু রাজা কোটিকাস্যকে বললেন— এমন নিখুঁত চেহারা যে, মানুষ বলে মনে হয় না একে। যাও তো একবার, জেনে এসো এ কার মেয়ে অথবা কার বউ— কস্য ত্বেষানবদ্যাঙ্গী যদি বাপি ন মানুষী?

কার মেয়ে, কার বউ— এই পরিচয় জানা জয়দ্রথের কাছে খুব প্রয়োজনীয় ছিল না। এমনও নয় যে, তিনি বিয়ে করতে চলেছিলেন, অতএব পথিমধ্যে এমন সুন্দরী এক মহিলাকে দেখে খুশি হয়ে তাঁর কৌলীন্য বিচার করছেন বিবাহের জন্যই। কেন না পরিচয় জানতে যাবার আগেই তিনি বন্ধু কোটিকাস্যের কাছে বলেছেন— এমন একটা সুন্দরী মেয়ে দেখার পর আর আমার অন্য কোনও পাত্রীর প্রয়োজন নেই— বিবাহার্থো ন মে কশ্চিদিমাং প্রাপ্যাতিসুন্দরীম। আমি একেই বিয়ে করে ঘরে তুলতে চাই। একবার শুধু যাও তাড়াতাড়ি জেনে এসো— এ কাদের ঘরের মেয়ে আর কোথা থেকেই বা এখানে এসে উপস্থিত হয়েছে, এই কাঁটা-লতায় ঘেরা বন, এখানে এমন একটা সুন্দরী মহিলা এসে জুটল কী করে— কিমর্থমাগতা সুভ্রূরিদং কন্টকিতং বনম্?

আবারও বলছি— জয়দ্রথের এই জিজ্ঞাসা অপরিচিতা এই রমণীর কৌলীন্য-বিচারের জন্য নয়। কবে সেই পঞ্চালের রাজসভায় স্বয়ংবর-বধূ হিসেবে ‘আপ্লুতাঙ্গী সুবসনা সর্বাভরণভূষিতা’ দ্রৌপদীকে ক্ষণকালের তরে তিনি দেখেছিলেন, এখন সে চেহারা তাঁর মনে নেই। তার পরে অনেক কাল কেটে গেছে, দ্রৌপদীও এখন আর সেই তরুণীটি নেই। তিনি কয়েক ছেলের মা, প্রায় মহিলা বটে। হ্যাঁ, অবশ্যই ঠিক, বয়স যতই বাড়ুক, এখনও তাঁর সৌন্দর্য ম্লান হয়নি এবং তাঁর কালো শরীরের বাঁধুনী এতটাই এখনও মজবুত যে, সেই সৌন্দর্যই জয়দ্রথের মনে এই অসামান্যা রমণীর প্রাপ্যতা অথবা সুখলভ্যতার ব্যাপারে প্রশ্ন জাগিয়ে তুলছে। কৌলীন্য নয়, বংশপরিচয় নয়, জয়দ্রথ কোটিকাস্যের কাছে বলছেন— এই অসাধারণ সুন্দরী ‘বরারোহা’— যার ইংরেজি অর্থ— a good mount for man— আমাকে ঠিক আমার মতো করেই চাইবে তো— অপি নাম বরাবরাহা মামেযা লোকসুন্দরী? দ্রৌপদীকে দেখে যেভাবে সৌন্দর্যের পরিমাপ করেছেন, তাঁর মধ্যে যে ক’টি শব্দ তাঁর মানসিক ব্যবহারের মাধ্যম হয়ে উঠেছে, তা কোনও মানসিক আপ্লুতির পরিচয় দেয় না, সেই সব শব্দের মধ্যে দ্রৌপদীর রমণী-শরীরের যৌন আবেদনটুকুই বড় হয়ে ওঠে। ‘বরারোহা’ কথাটা না হয় ছেড়েই দিলাম, জয়দ্রথের কাছে বড় হয়ে উঠেছে দ্রৌপদীর আয়ত অপাঙ্গদৃষ্টি, তাঁর দাত এবং তাঁর ক্ষীণ কটি— যা পরোক্ষে তাঁর স্তন-জঘনের আয়তনের প্রতি দুষ্ট সংকেত সৃষ্টি করে। জয়দ্রথ ভাবছেন— এমন চেহারা সত্ত্বেও এই রমণী তাঁকে তেমন করে চাইবেন কিনা— ভজেদদ্যায়তাপাঙ্গী সুদতী তনুমধ্যমা?

জয়দ্রথের সন্দেহ-প্রশ্ন নিয়ে বন্ধু কোটিকাস্য রথ থেকে মাটিতে নেমে দ্রৌপদীর কাছে গেলেন— মহাভারতের কবি উপমা দিয়ে বলেছেন— যেন কোনও শেয়াল বাঘের বউয়ের খবর নিচ্ছে, বাঘের বউকে শেয়ালের মনে ধরেছে বলে— উপেত্য প্রপ্রচ্ছ তদা ক্রোষ্টা ব্যাঘ্রবধূমিব। কোটিকাস্য যা জানতে এসেছেন এবং প্রধানত জয়দ্রথের যা জানার প্রয়োজন, তা হল— এই নির্জন বনে দ্রৌপদীর অভিভাবক বা রক্ষক পুরুষটি কে— কো ন্বস্যা নাথ ইত্যেব— অর্থাৎ তা হলে জয়দ্রথ বুঝবেন যে, এই রমণীকে কত সহজে এখান থেকে তুলে নেওয়া যাবে অথবা তুলে নিয়ে যেতে কতটা অসুবিধে হবে।

কোটিকাস্য, জয়দ্রথের দুষ্টমনের বন্ধু, কোটিকাস্য আসছেন দ্রৌপদীর কাছে। দ্রৌপদী দেখছেন। আচ্ছা, বাস্তবেও এমন একটা চিত্র কল্পনা করুন তো। গভীর অরণ্যের পথ বেয়ে বরযাত্রীর দল চলেছে, তার মধ্যে অন্য এবং অন্যতমেরা যখন বনের পর্ণকুটিরের দুয়ারে দাড়ানো এক সুন্দরী রমণীকে সোজা চোখে লজ্জাহীনভাবে দেখছে, তখন তাদের দিকেও কি দ্রৌপদীর চোখ পড়বে না? বিশেষত যে রমণী প্রতিনিয়তই শত-চক্ষুর বস্ত্রভেদী দৃষ্টিপাতে বারবার ছিন্নভিন্ন হয়েছেন, সেই রমণীর ষষ্ঠ-ইন্দ্রিয় হয়ে ওঠে তো সেই চোখ, যা পরিস্থিতি বুঝিয়ে দেয়। জয়দ্রথ বলেছেন— আয়তাপাঙ্গী— অপাঙ্গ তো চোখের সেই তিরশ্চীন দৃষ্টিপাত— তেমন করে দেখা ছাড়া দ্রৌপদীর উপায়ই বা কী ছিল? তিনিও কি জয়দ্রথের দিকে সোজাসুজি আহ্বানের দৃষ্টি নিয়ে তাকাবেন!

তবে হ্যাঁ, দ্রৌপদীর দিক থেকেও সামান্য মনস্তত্ত্বের বিচার তো সমূহ প্রয়োজন এখানে। এটা তো মানতেই হবে, দ্রৌপদী যত বড় বিদগ্ধা রমণীই হোন না কেন, সুন্দরী রমণীর সাধারণ এবং অসাধারণ বৃত্তিগুলি তিনি অতিক্রম করবেন কী করে? এটা মানতেই হবে যে, দ্রৌপদীর এখন কিছু বয়স হয়েছে, তিনি বিবাহিতা এবং সন্তানের জননী। কিন্তু বিবাহিতা অথচ কথঞ্চিৎ বয়সেও যথেষ্ট যৌবনবতী যে রমণী, তার একটা বিচিত্র জটিল প্রবণতা থাকে। মহিলারা আমার দোষ নেবেন না, কিন্তু আমি যে দেখেছি— কিঞ্চিৎ বয়স্কা বিবাহিতা রমণীও— হয়তো কিঞ্চিৎ বয়স্কা বলেই— নিজের পরিণত যৌবনও মাঝে মাঝে পুরুষের চোখে যাচাই করে নিতে চান। এমন রমণীরা কেউ একটু বেশি কথা বলেন, কেউ বা একটু বেশি সাজেন, কেউ বা সামান্য ছলা-কলাও করেন, কেউ বা অন্তর্ভেদী গভীরতায় নিজেকে সম্পূর্ণ সংবৃত রেখেও এমন বিদগ্ধ পরিবেশ তৈরি করতে পারেন, তাতেও তারই দিকে নজর পড়ে সব সময়।

রকম যেমনই হোক না কেন, কোনওটাই আমি খারাপ ভাবি না, অস্বাভাবিকও মনে করি না। ওই যে আমাদের কলিগ পরিমল সেনগুপ্ত প্রৌঢ়াদের উদ্দেশে বলেছিলেন— আরে! ছুঁড়িদের যেমন ছোঁড়ারা আছে, বুড়িদের জন্যে তেমনই বুড়োরা আছে। আমি অন্যায় দেখি না, কেন না। যে রমণী পূর্বে সুন্দরী ছিলেন, ঘনায়মান বয়সের মেদুর আঘাত তাঁকে ভাবিত করে বলেই নিজেকে প্রতিকামীর চোখে বিপন্নতা বাঁচিয়ে যাচাই করে নেওয়ার প্রবণতাটুকু স্বাভাবিক নয়। নইলে কেন দ্রৌপদীর অপাঙ্গ-দৃষ্টি এখনও এতখানি আয়ত, আর কেনই বা এই কোটিকাস্য যখন আসছেন দ্রৌপদীর কাছে— তখনও তিনি উদ্বাহু হয়ে কদমগাছের একটি ডাল নামিয়ে ধরে দাঁড়িয়ে আছেন। যতই মনে করি— এ তো কিছুই নয়, কোনও অসভ্য আচরণ তো করিনি— সত্যিই এ এতটুকুও অসভ্যতা নয়,— যেমনটি আজও মুগ্ধ প্রৌঢ়া রমণীরা মনে করেন— এ তো কিছু নয়, তবুও দ্রৌপদীর মতো অনিন্দ্যসুন্দরী যখন সামান্য উদ্বাহু হয়ে নীপশাথায় আকর্ষণ রচনা করেন, তখন যে নিজের অজান্তেই তাঁর শরীরের সমস্ত সৌন্দর্য প্রকট হয়ে ওঠে, এমন অবস্থায় কোটিকাস্যের চোখ, জয়দ্রথের চোখ কেমন করে এড়িয়ে যাবেন সুন্দরী দ্রৌপদী। এই চোখ এড়িয়ে যাওয়াটুকু কি সত্যিই চেয়েছিলেন দ্রৌপদী, নাকি এর পিছনেও ছিল ক্ষণিকের ঈপ্সিত সেই আস্বাদন, যাতে নিজেকে এই বয়সেও পুরুষের চোখে যাচাই করে নেওয়া যায়।

ওই ক্ষণটুকু হয়তো মিথ্যে নয়, কিন্তু মুগ্ধা, প্রায়প্রৌঢ়া রমণী যখনই পুরুষের দুষ্ট-চক্ষু অনুমান করতে পারেন, সেই মুহূর্তেই তিনি সংযত হন। যেমন কোটিকাস্য এসেই তো জিজ্ঞাসা করল— কে তুমি গো মেয়ে! এমন সুন্দর করে কদমফুলের ডালটি নামিয়ে ধরে দাঁড়িয়ে আছ? তুমি তো এই আশ্রয়ে একাই আছ, তাই না— কা ত্বং কদম্বস্য বিনাম্য শাখাম্‌ একাশ্রমে তিষ্ঠসি শোভমানা। কোটিকাস্যও রাজার ঘরের ছেলে, একজন রমণীকে স্বানুকূল করার জন্য যে-যে প্রশংসা বাক্য উচ্চারণ করতে হয়, তা সে জানে। কিন্তু তার বচন-কোশল এতটাই যে, দ্রৌপদীর প্রতি শংসা-বাক্যের সঙ্গে সঙ্গে সে নিজের পরিচয়, জয়দ্রথের অনুগামী অন্য রাজাদের পরিচয় এবং সবার সঙ্গে মিশিয়ে স্বয়ং জয়দ্রথেরও কৌলীন্য-ঘটক কথাগুলি বলে গেল।

কদমফুলের ডাল নুইয়ে-ধরা দ্রৌপদীকে ঠিক লক্ষ করেছিল কোটিকাস্য। লম্পট পুরুষের কার্যসাধন করার জন্য যে ব্যক্তি রমণীর মন জানতে যায়, তার মধ্যেও লাম্পট্যের অবিশুদ্ধি থাকে। সে দ্রৌপদীকে সোজাসুজি বলল— তোমায় কেমন লাগছে জান, সুন্দরী! রাতের বেলায় লেলিহান আগুনে হাওয়া লাগলে যেমন সুন্দর দেখায়, তুমিও ঠিক সেই রকম— দেদীপ্যমানাগ্নিশিখেব নক্তং ব্যাধূয়মানা পবনেন সুভ্রূঃ। কোনও স্বর্গসুন্দরী তুমি, কোথা থেকে এসেছ, তাও জানি না, অবশ্য আমরাও যেমন জানি না তোমার অভিভাবক কে, তেমনই তুমিও কিন্তু আমাদের পরিচয় জিজ্ঞাসা করোনি— ন হ্যেব নঃ পৃচ্ছাসি যে বয়ং স্ম/ ন চাপি জানীম তবেহ নাথম্।

কোটিকাস্য যে যে-সে লোক নয় এবং অন্যেরাও যে যথেষ্ট হোমরা চোমরা— সে-বিষয়ে বিশদ আভিজাত্যের পরিচয় দিল সে। একের পর এক রাজাদের নাম করে, তাদের রাজ্যপাট, পিতৃপরিচয় দেবার পর একেবারে শেষে সে বলল— সিন্ধু-সৌবীর দেশের রাজা জয়দ্রথের নাম তোমার শোনাও থাকতে পারে, তাঁরই অনুগামী হয়ে আমরা শত-সহস্র রাজারা তাঁর সঙ্গে চলেছি, সঙ্গে যাচ্ছে হাতি ঘোড়া রথের বিশাল বাহিনী।

কোটিকাস্য অনেক বিবরণ, অনেক পরিচয় দিল বটে কিন্তু এক বারের তরেও বলল না যে, কেন জয়দ্রথ কোন উদ্দেশে কোন দেশে যাচ্ছেন। এবং এই বিশদ পরিচয়-দানের মধ্যেও তার প্রধানতম জিজ্ঞাসা ছিল— তোমার জন্মদাতা পিতা কে, তোমার অভিভাবকই বা কে— পৃচ্ছাম ভদ্রে প্রভবং প্রভুঞ্চ! তোমার আত্মীয়-স্বজন-বন্ধু-বান্ধবের কথাও বল। সবচেয়ে বড় কথা তুমি এখানে একা একা কী করতে এসেছ— তত্ত্বেন যচ্চেহ করোযি কার্যম। অর্থাৎ সমস্ত জিজ্ঞাসার মধ্যে এই এক জিজ্ঞাসায় কোটিকাস্য পরিমাপ করে নিতে চাইছে— দ্রৌপদী কতটা সুরক্ষিত এবং তাঁর পিতা, পতি, আত্মীয়-স্বজনেরা কতদূর কী করতে পারেন, কতটাই বা তাঁরা সুরক্ষা দিতে পারেন এই রমণীকে।

সামনে কোটিকাস্য এবং দূর থেকে জয়দ্রথের চোখ দেখেই অভিজ্ঞা দ্রৌপদী সব বুঝেছেন, কদমফুলের নুইয়ে-রাখা শাখাটিকেও ছেড়ে দিয়েছেন সঙ্গে সঙ্গে। কোটিকাস্যের কথাবার্তার ধরন, তার ‘অ্যাটিচুড’ দেখেই দ্রৌপদী কদমগাছের ডাল ছেড়ে তাঁর উতলা আঁচল ভাল করে ঘনিয়ে নিয়েছেন নিজের গায়ে। তিনি মন্দ বঝেছেন লোকটিকে— অবেক্ষ্য মন্দং প্রবিমচ্য শাখাং/ সংগৃহ্লতী কৌশিকমুত্তরীয়ম্। তবু মনে মনে যা ভাবছেন, তেমন করে প্রকাশ না করেও প্রসিদ্ধ রাজবংশের কুলবধুর মর্যাদা বজায় রেখে দ্রৌপদী বললেন— আমার বুদ্ধি যেমন সায় দিচ্ছে, তাতে আপনার সঙ্গে আমার কথা বলাই উচিত নয়— বুদ্ধ্যাভিজানামি নরেন্দ্রপুত্র/ ন মাদৃশী ত্বামভিভাষ্টুমহা। তবু কীই বা আমি করতে পারি। এখানে পুরুষ-নারী এমন কেউই নেই যে আপনার কথার উত্তর দেয়। আমি এই মুহূর্তে এই নির্জন অরণ্যের মধ্যে একা রয়েছি, আমার মতো রমণীর একটা ধর্মও আছে, তাই একা এখানে দাঁড়িয়ে আপনার সঙ্গে আলাপ করছি, এটা মোটেই ঠিক হচ্ছে না— অহং হ্যরণ্যে কথমেকমেকা/ ত্বামালপেয়ং নিরতা স্বধর্মে। কিন্তু তবু আর কেউ নেই বলেই আমাকেই তো কথা বলতে হবে।

দ্রৌপদী এই সামান্য ভণিতা করেই বুঝিয়ে দিলেন যে, তিনি তেমন সহজলভ্যা নন, বিশেষত কথা বলা নিয়েই তিনি এত কথা বললেন যে, তাতে পথিক প্রশ্নকর্তাকে পাঁচ বার চিন্তা করতে হবে। দ্রৌপদী বললেন— হ্যাঁ, আমি জানলাম যে, আপনি সুরথ রাজার ছেলে, শিবি-রাজার বংশে আপনার জন্ম, এটাও শুনলাম লোকে আপনাকে কোটিকাস্য বলে ডাকে। সেই সূত্র ধরেই জানাচ্ছি— আপনি আমার পরিচয়টাও শুনুন— আমি দ্রুপদ রাজার মেয়ে, লোকে আমাকে কৃষ্ণা নামে ডাকে। আর বোধহয় শুনে থাকবেন যে, ইন্দ্রপ্রস্থের অধিবাসী পাঁচ পাণ্ডব-ভাইকে আমি পতিত্বে বরণ করেছি। হ্যাঁ, তাঁদের নাম যুধিষ্ঠির, ভীম, অর্জুন, নকুল এবং সহদেব। তাঁরা আপাতত আমায় এই আশ্রমে রেখে কেউ পুবদিকে, কেউ দক্ষিণ দিকে, কেউ বা পশ্চিম-উত্তরে মৃগয়া করতে গেছেন। তবে হ্যাঁ, এখন তাঁদের ফিরে আসবারও সময় হয়ে গেছে বলেই মনে হচ্ছে— মন্যে তু তেষাং রথসওমানাং/ কালোহভিতঃ প্রাপ্ত ইহোপযাতুম্।

দ্রৌপদী অসাধারণ ব্যঞ্জনায় বুঝিয়ে দিয়েছেন যে, আপাতত তিনি একা এই আশ্রমে অরক্ষিতা বলে মনে হলেও তাঁর পঞ্চ বীর স্বামী যখন তখনই এসে পড়তে পারেন। আর ঠিক সেই কারণেই দ্রৌপদী নির্ভয়ে কোটিকাস্যকে জানালেন— এই নির্জন অরণ্যের মধ্যেও আমাদের আতিথেয়তার বোধ কিছু কম নেই। ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির অতিথি-প্রিয় মানুষ, তিনি আপনাদের দেখলে অত্যন্ত খুশি হবেন। অতএব আপনি সকলকে যান-বাহন ছেড়ে দিয়ে আমাদের আতিথেয় সৎকার গ্রহণ করতে বলুন। সত্যিই ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির আপনাদের দেখলে খুশি হবেন— প্রিয়াতিথির্ধর্মসুতো মহাত্মা/ প্রীতো ভবিষ্যত্যভিবীক্ষ্য যুম্মান্।

দ্রৌপদী সরল মনেই ভেবেছেন যে, যতটুকুই তিনি আপন পরিচয় দিয়ে থাকুন, তাতেই এঁরা আর কোনও ক্ষতি করার কথা ভাববেন না। বরঞ্চ বহুদূরের যাত্রী হবার কারণে রাস্তার মাঝখানে একটু ভাল-মন্দ খেতে পেলে সবাই বেশ খুশিই হবেন। ঠিক এমন একটা সরল কল্পনাতেই দ্রৌপদী কোটিকাস্যকে যা বলার বলে আশ্রম-পর্ণশালার ভিতরে প্রবেশ করলেন যথাসম্ভব অতিথি-তর্পণের জোগার-যন্তর করার জন্য— বিবেশ তাং পর্ণশালাং প্রশস্তাং/সঞ্চিন্ত্য তেষামতিথিত্বধর্মম্।

জয়দ্রথ এবং তাঁর সঙ্গিসাথী রাজারা তখনও দূরে দাঁড়িয়ে আছেন, কেউ বা বসে তখনও, আপন রথে। এরই মধ্যে কোটিকাস্য জয়দ্রথের কাছে দ্রৌপদীর বক্তব্য নিবেদন করার জন্য চলে এল। ব্যাপারটা জয়দ্রথের একেবারেই পছন্দ হল না। সম্পূর্ণ পরিচয় না শুনেই তিনি কোটিকাস্যকে বললেন— এই সুন্দরী রমণীটি যখন তোমার সঙ্গে কথা বলছিল, তখনই আমার মন অভিভূত হয়ে গেছে— যদা বাচং ব্যাহরন্ত্যামস্যাং সে রমতে মনঃ। কেন তুমি কথাবার্তা শেষ না করে চলে এলে? জয়দ্রথ ভাবছেন— কোটিকাস্য যখন দ্রৌপদীকে সঙ্গে করে আনেনি, অতএব কথাবার্তাও শেষ হয়নি। কিন্তু রমণী যে অরক্ষিত কোনও যে-সে রমণী নন, সে-কথা শোনার ধৈর্যও তাঁর নেই। তিনি আকুল প্রশ্ন করে নিজের কামমুগ্ধ অবস্থা বোঝাতে চাইছেন কোটিকাস্যকে। বললেন— কেন তুমি শেষ কথা না বলেই ফিরে এলে— বিনিবৃত্তঃ কথং ভবান্‌? তুমি কি জানো আমার অবস্থা কী? এই রমণীকে দেখা ইস্তক আমার বিয়ে করা যত স্ত্রী আছে, তাদের বানরীর মতো মনে হচ্ছে আমার— এতাং দৃষ্ট্বা স্ত্রিয়ো মেহদ্য যথা শাখামৃগস্ত্রিয়ঃ। একে দেখার পর থেকেই আমি পাগল হয়ে গিয়েছি, এবারে বলো শুনি— এতক্ষণ কী কথা হল?

এই তিনটি মাত্র কথা জয়দ্রথ বলেছেন— এক, আমি এই মহিলাকে কথা বলতে দেখেই অভিভূত; আর দুই, তুমি কাজ না গুছিয়েই ফিরে এলে কেন? তৃতীয় কথাটাই সাংঘাতিক, দ্রৌপদীকে দেখার পর থেকেই অন্য সমস্ত স্ত্রীকে তিনি বানরীর মতো দেখছেন। জয়দ্রথের এই তিনটি কথা থেকেই যে সাধারণ সিদ্ধান্তটি প্রকট হয়ে পড়ে, সেটা হল— দ্রৌপদীর রূপের মহিমা এখানে যতখানি গুরুত্বপূর্ণ, তার চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ হল জয়দ্রথের কামদীর্ণ মানসিকতা। দুর্যোধনের ভগিনী দুঃশলাকে বিবাহ করার পরেও তিনি একে-একে কয়েকটি বিবাহ করে ফেলেছেন, এমনকী তাতেও তাঁর মন শান্ত হয়নি, তিনি আবারও বিবাহ করতে চলেছেন শাম্বদেশে। আর এখন তো দেখছি, বিধিসম্মত বিবাহ তাঁর পক্ষে লোক দেখানো অজুহাতমাত্র, এখন পথিমধ্যে অজানা-অচেনা এক রমণীর রূপ দেখে তিনি স্তম্ভিত হয়ে আছেন এবং সে-রূপের মোহ এমনই যে, সব ক’টি বিবাহিত স্ত্রীকে এখন বানরী বলে মনে হচ্ছে তাঁর কাছে॥

সাধারণ পৌরুষেয়তার মনস্তত্ত্বেই এটা বোঝা যায় যে, বিবাহিত বধূ কালে কালে যখন প্রৌঢ়া এবং পরিণাম-রমণীয়া হতে থাকেন, তখন অনেক পুরুষই মনে মনে কিছু বিমনা এবং নির্বিকারও হয়ে পড়েন, আর বেশ কিছু পুরুষ খানিকটা নির্মমও। জয়দ্রথ এই শেষ প্রজাতির অন্তর্ভুক্ত। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে কামুকতা তাঁকে এমনভাবেই গ্রাস করেছে যে, পরিণীতা পত্নীদের ওপর তাঁর মায়া-মোহ যেমন সর্বাংশে লুপ্ত হয়েছে তেমনই এতটাই তিনি নির্মম যে, তাঁদের তিনি বন্ধুবর্গের কাছে ‘বানরী’র স্বরূপে বর্ণনা করছেন। গান্ধারী-নন্দিনী এবং দুর্যোধন-দুঃশাসনের মতো একশো ভাইয়ের এক বোন দুঃশলা এমনিতেই তো মহাকাব্যের পরম উপেক্ষিতা নায়িকা, সারা মহাভারতে তাঁর নাম প্রায় অনুচ্চারিত, তাঁর মধ্যে যে গান্ধারী জামাই-লাভের সুখের জন্য মেয়ে চেয়েছিলেন, সেই সাধের মেয়েও আজ তাঁর জামাইয়ের মুখে তাঁর অন্যান্য সাধারণী স্ত্রীর সঙ্গে ‘বানরী’র অভিধা লাভ করল।

তবে এতে দুঃশলার ভাগ্য নিয়ে আমরা যতটা না আহত হই, তার চেয়ে বেশি আশ্চর্য হই জয়দ্রথের নির্মম পৌরুষেয়তায়, আজকের দিনে বহুবিবাহের নিষিদ্ধতার কথা মনে রাখলেও এই পৌরুষেয়তার প্রকাশ আরও বিচিত্রভাবে নির্মম— অন্তত বেশ কিছু স্থানে। এখনকার দিনে যেখানে বহুতর রমণীকেও বিবাহ করা যায় না, অথচ পুরুষের মধ্যে যদি একটা অকুণ্ঠিত মন থাকে, তা হলে এমন তো হতেই পারে যে, দিনগত অভ্যাস, অনুদিন বিবর্তন এবং ব্যবহার-অপব্যবহারে নিতান্ত গৃহপ্রাণা রমণী একদিন বড় বেশি দৈনন্দিন হয়ে পড়েন, কিন্তু তাই বলে যদি পুরুষের মধ্যে জয়দ্রথের মন জাগ্রত হয় এবং যদি মনে হয় যে, আমার স্ত্রীটি নেহাতই ‘বানরী’ হয়ে গেছে অতএব নূতন, নূতনতর শারীরিক আবেদন প্রয়োজন, তবে সেটা নিতান্তই নির্মমতা। নূতন আলোয় নূতন সিন্ধুপারে দেখা হতেই পারে কারও সঙ্গে, তিনি হয়ে উঠতেই পারেন নূতনতর কোনও বাস্তব, কিন্তু শুধুই শারীরিক সাধনের জন্য যদি সেই বাস্তব প্রাণ লাভ করে ভালবাসার নামমাত্র গন্ধ নিয়ে, তবে সেও পুরাতন হলেই আবারও জয়দ্রথের মন জাগ্রত হবে নূতন অন্বেষণে।

জয়দ্রথ একটু স্থিত হতেই কোটিকাস্য দ্রৌপদীর পরিচয় জানিয়ে বললেন— যার কথা ভেবে ভেবে আপনি সারা হলেন তিনি দ্রুপদরাজনন্দিনী কৃষ্ণা, পঞ্চপাণ্ডব ভাইয়ের পরসম্মতা মহিষী। সবচেয়ে বড় কথা— পাঁচ পাণ্ডব ভাইই তাঁকে যথেষ্ট ভালবাসেন— সর্বেযাঞ্চৈব পার্থানাং প্রিয়া বহুমতী সতী। কোটিকাস্য বোকা নন এবং দ্রৌপদী এবং পাণ্ডবরাও কম বিখ্যাত নন, যাতে তাঁর এতটুকুও বোঝার বাকি থাকে যে, জ্ঞাতিসম্বন্ধে দ্রৌপদী জয়দ্রথের শ্যালক-পত্নী। এমন একটা নিকট সম্বন্ধের মধ্যে যে অসভ্য প্রস্তাব জয়দ্রথের মনে আসছে, সেটা না আসাটাই যে উচিত, সেই ততটুকু সদ্‌বুদ্ধিতেই কোটিকাস্য বললেন— তুমি তোমার— শ্যালক-পত্নী দ্রৌপদীর সঙ্গে কথা বলা শেষ করে চলো, আবার সিন্ধু-সৌবীর দেশে ফিরে যাই— তয়া সমেত্য সৌবীর সৌবীরাভিমুখং ব্রজ।

নাকি, বন্ধু কোটিকাস্যের মনটা জয়দ্রথের মতোই দুষ্ট। তিনি কি এই কথা বলতে চাইলেন যে, কৃষ্ণা দ্রৌপদী পঞ্চপাণ্ডবের আদরের পাত্রী, তাঁরা এখন বাড়িতে নেই, অতএব এই সুযোগে দ্রৌপদীকে নিয়ে তুমি দেশে ফিরে চলো, শাল্বদেশে আর বিয়ে করতে যাবার দরকার নেই। কথায় বলে— বন্ধু-বান্ধবের মনের মধ্যে সমভাব থাকে, সমপ্রাণতা থাকে, অতএব কোটিকাস্যও জয়দ্রথের সেই রকম বন্ধু ধরে নিয়েই জয়দ্রথ কোটিকাস্যকে বললেন— আমি দেখতে চাই দ্রৌপদীকে, আগে ভাল করে দেখতে চাই— এবমুক্তঃ প্রত্যুবাচ পশ্যামো দ্রৌপদীমিতি। এই দেখতে চাওয়ার মধ্যে যে ভালবাসার মুগ্ধতা এতটুকুও ছিল না, প্রতিপক্ষে শুধুই মানসিক বিকার ছিল, সেটা মহাভারতের কথক ঠাকুর বৈশম্পায়নের মন্তব্য থেকেই বোঝা যায়। তিনি বলেছেন— দুষ্টভাবো জয়দ্রথঃ— অর্থাৎ দ্রৌপদীর ব্যাপারে জয়দ্রথের মনে কু আছে, সেই কুদৃষ্টিতেই তিনি দেখতে চাইছেন দ্রৌপদীকে— পতিঃ সৌবীরসিন্ধুনাং দুষ্টভাবো জয়দ্রথঃ।

জয়দ্রথ পাণ্ডবদের আশ্রম-পর্ণশালায় প্রবেশ করলেন— আবারও সেই মহাকাব্যিক উপমা এসেছে— যেন ছোট্ট একটি কেঁদো বাঘ সিংহের গোষ্ঠীর মধ্যে এসে পড়ল— স প্রবিশ্যাশ্রমং পুণ্যং সিংহগোষ্ঠং বৃকো যথা। কোটিকাস্য যখন দ্রৌপদীর কাছে জয়দ্রথের দূত হয়ে এসেছিল, তখন মহাভারতের কবি মন্তব্য করেছিলেন— যেন শেয়াল গেল বাঘের বউয়ের সঙ্গে কথা বলতে— ক্রোষ্টা ব্যাঘ্রবধূমিব। এবারে যেহেতু ব্যক্তি হচ্ছেন জয়দ্ৰথ, তাঁর নিজস্ব কিছু শক্তি আছে যেহেতু, অতএব শেয়ালের মান বেড়ে কেঁদো বাঘ জয়দ্রথের উপমান। কিন্তু যখন দ্রৌপদীর পরিবর্তে পাণ্ডবদের উপমা আসছে, তাঁরা এখন আশ্রমে নেই, তৎসত্ত্বেও সেই অদৃশ্য মাহাত্ম্যই বড় হয়ে উঠছে উপমার অঙ্গুলি সংকেতে। সিংহের গোষ্ঠীতে প্রবেশ করছে কেঁদো বাঘ।

আরও একটা কথা— মহাকবি লিখেছেন— গণনা করলে এমন দাঁড়ায় যে, জয়দ্রথ হলেন নিজেকে নিয়ে সপ্তম পুরুষ মানুয যিনি দ্রৌপদীর আশ্রমে ঢুকে কথা বলছেন— আত্মনা সপ্তমঃ কৃষ্ণমিদং বচনমব্রবীৎ। এই ধরনের শব্দ ব্যবহার মহাকাব্যে খুব প্রসিদ্ধ এবং প্রিয় ব্যবহার নিজেকে ছাড়া অন্য যারা থাকে তাদের নাম না করে যার কথা হচ্ছে তাঁকে দ্বিতীয়-তৃতীয় অথবা পঞ্চম-সপ্তম যাই বলা হোক না কেন, সংখ্যাটা বুঝিয়ে দেয় আরও কয় জন সেই স্থানে উপস্থিত আছেন অথবা কয় জনের সেখানে উপস্থিত থাকার কথা। জয়দ্রথের ক্ষেত্রে ‘আত্মনা সপ্তমঃ’ বলার সঙ্গে সঙ্গে জয়দ্রথ ছাড়া আরও ছয় জনের উপস্থিতি অস্পষ্ট হয়ে যাওয়ায় প্রসিদ্ধ টীকাকার নীলকণ্ঠ জানালেন— জয়দ্রথের আরও ছয় ভাই ছিলেন, তাঁদের প্রথম জনের নাম বলাহক; জয়দ্রথ তাঁদের নিয়ে দ্রৌপদীর কাছে গেলে সপ্তম জন হন জয়দ্রথ। এদিকে সিদ্ধান্তবাগীশ হঠাৎ ভাইদের নিয়ে আসার পক্ষপাতী নন; তাঁর মতে— জয়দ্রথ তাঁর ছয় অনুগামীর সঙ্গে দ্রৌপদীর অরণ্যকুটিবে প্রবেশ করেছিলেন। এই দুই পণ্ডিতের মধ্যে অবশ্য সিদ্ধান্তবাগীশের মতই অধিক যুক্তিযুক্ত, কেন না জয়দ্রথ যে মন নিয়ে দ্রৌপদীর কাছে আসছিলেন, সেখানে ভাইদের থেকে অনুগামী মানুষদেরই সরসতা বেশি প্রয়োজন ছিল। জয়দ্রথের কাছে।

আমরা অবশ্য এই দুই মতব একটিও পোষণ করি না। কেননা, কামনা-ড়িত পুরুষ কখনওই কামনার পূর্তিস্থলে ভাই বা অনুগামী কাউকেই পছন্দ করে না। তাই ভাবছিলাম এখানে জয়দ্রথকে নিয়ে আরও একটা ব্যাখ্যা দেওয়া যেতে পারে যা মহাভারতের কবির প্রকৃত আশয় বলে চিহ্নিত হতে পারে। একবার ভেবে দেখুন, পঞ্চস্বামীগর্বিতা দ্রৌপদীর ঘরে অন্য কোনও পুরুষ প্রবেশ করেন না তাঁর পঞ্চস্বামী ছাড়া। পঞ্চস্বামী এখন বাড়িতে নেই বটে, কিন্তু অদৃশ্য হলেও তাঁরা আছেন। এই পাঁচ জনকে ধরলে দ্রৌপদী হলেন আশ্রমে ষষ্ঠ জন, আর তা হলেই জয়দ্রথ হয়ে পড়েন সপ্তম ব্যক্তি, যিনি এই এখনই দ্রৌপদীর আশ্রমে প্রবেশ করছেন। জয়দ্রথকে এইভাবে যে সপ্তম হিসেবে গণ্য করছি, তার কারণ, কথা-চালাচালির আগে, মাঝে এবং শেষে কোথাও সেই ছয় জন ভাই অথবা তাঁর ছয় অনুগামীকে দেখতে পাইনি! কাজেই এইটাই ঠিক দ্রৌপদীর আশ্রম পর্ণকুটিরে তিনিই সেই সপ্তম মানুষ, যিনি দুঃসাহসে কথা বলতে এসেছেন পাণ্ডব-সিংহদের ঘরনির সঙ্গে।

কোটিকাস্য দ্রৌপদীর বিবরণ দেবার পরেও জয়দ্রথ যখন সম্পূর্ণ না-জানার ভান করে বলেছিলেন— আমি দ্রৌপদীকে দেখতে চাই— পশ্যামো দ্রৌপদীমিতি— তখনই বুঝতে পারি সেই গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তটি হয়ে গেছে। আমরা তো জানি— জয়দ্রথ দ্রৌপদীকে বহু আগেই দেখেছিলেন, সেই পঞ্চালরাজ্যের স্বয়ংবর সভায়। হয়তো বিবাহ এবং স্বয়ংবরের প্রাক্‌মুহূর্তে তাঁর বধুবেশ, সেই ‘আপ্লুতাঙ্গী সুবসনা সর্বাভরণভূষিতা’-র মহাকাব্যিক আভরণের মধ্যে জয়দ্রথ যেমন দেখেছিলেন দ্রৌপদীকে, এখন হয়তো তিনি তেমন নেই। কাজেই দ্রৌপদীকে দেখার কৌতুহল তাঁর থাকতেই পারে। কিন্তু দ্রৌপদীর নাম শোনা-মাএই তো জয়দ্রথের এই ধারণা সৃষ্টি হবার কথা যে, পাঁচ পাণ্ডব ভাইয়ের বিবাহিত স্ত্রী এই দ্রৌপদী। বস্তুত এই সব খবর তিনি জানেন। জয়দ্রথ দুর্যোধন-দুঃশাসনদের ঘরের জামাই। তিনি অবশ্যই জানেন যে, তাঁর অভিজাত শ্যালকেরা তাঁর জ্ঞাতিভাইদের পাশাখেলার পণজালে আবদ্ধ করে বনবাসে পাঠিয়েছেন। সব জানা সত্ত্বেও এখন এই মুহূর্তেই যে অরক্ষিতা দ্রৌপদীকে দেখার জন্য উদ্বিগ্ন হয়ে উঠলেন জয়দ্রথ— তার পিছনে সেই অদ্ভুত কারণটা আছে, যেটা আমরা প্রথমে উচ্চারণ করেছিলাম। আমরা বলেছিলাম— জয়দ্রথ সরাসরি মহাভারতের খলনায়ক নন, কিন্তু আজকের দিনেও বড় বড় সমাজবিরোধীদের অভীষ্ট-সাধন করার জন্য যেমন বালখিল্য অপরাধী থাকে, জয়দ্রথও সেই রকম ছোটখাটো অপরাধী। সরাসরি অপরাধ করার জন্য আদিষ্ট না হয়েও তিনি অপরাধে নিযুক্ত হয়েছেন প্রভুশক্তির অভীষ্ট সাধন করে ধন্য হবার জন্য।

দ্রৌপদী তো স্বপ্নেও ভাবতে পারেননি যে, তাঁর জ্ঞাতি-ঘরের জামাইবাবু তাঁকে এসে শারীরিক কু-প্রস্তাব দেবেন। তিনি কোটিকাস্য-বন্ধুকে বলে দিয়েছেন— আপনি সকলকে বলুন, — যানবাহন ছেড়ে আমাদের ঘরে আসতে, আমার স্বামীরা এখনই এসে পড়বেন বন্য পশু শিকার করে। আমি আপনাদের খাবার ব্যবস্থা করছি। দ্রৌপদী এই কথা বলে পরম বিশ্বস্তভাবে তাঁর পর্ণকুটিরের রন্ধনশালায় প্রবেশ করেছেন স্বামীদের আতিথেয় সদ্‌ভাবনা মাথায় রেখে— বিবেশ তাং পর্ণশালাং প্রশস্তাং/সঞ্চিত্য তেষাম্ অতিথিত্বধর্মম্। রন্ধনের উপযুক্ততা এবং তার পরিকল্পনা বিচারের জন্য যিনি প্রশস্ত মনে রন্ধনশালায় প্রবেশ করেছেন, এমন সময় তাঁর উদ্দেশে এ কেমন আহ্বান ভেসে আসল বাইরে থেকে। জয়দ্রথ ডাকলেন— বরারোহে— অর্থাৎ ইংরেজি করলে সেই অশ্লীলপ্রায় সম্বোধন— a good mount for men. লম্পট পুরুষ যেমন প্রথমে ভাল থাকার খবর চায়, স্বামীর কুশল জিজ্ঞাসা করে, জয়দ্রথ সেইভাবেই বললেন— তোমার স্বামীরা সব নীরোগ অবস্থায় কুশলে আছেন তো? তুমি ভাল আছ তো— কুশলং তে বরারোহে ভর্তারস্তেহপ্যনাময়াঃ। অথবা স্বামীদের কথা ছেড়ে দাও, যাদের কুশল তুমি চাও তাঁরা সব কুশলে আছেন তো— যেষাং কুশলকামাসি তেহপি কচ্চিদনাময়াঃ? জয়দ্রথ যেন ধরেই নিয়েছেন— দ্রৌপদীর মতো রমণীর আরও স্তাবক থাকবে স্বামীরা ছাড়াও। এবং দ্ৰৌপদী যেহেতু একাধিক পঞ্চপতির বিলাস-রসজ্ঞা, অতএব তাঁর স্তাবক-চক্রের প্রতিও তিনি ইতস্তত এবং ন্যূনাধিক প্রেম বিতরণ করবেন। নইলে কেন এই আগাম আকুতি— যাদের কুশল তুমি আকাঙক্ষা করো, তারা সবাই কুশলে আছেন তো?

দ্রৌপদী বিদগ্ধা রমণী। তিনি জানেন— এ-সব কথার উত্তরে কতটুকু বলতে হয়। তিনি স্বামীদের ছাড়া অন্য কোনও নামই উচ্চারণ না করে বললেন— কুরুবংশের অধস্তন কুন্তীপুত্র যুধিষ্ঠির কুশলেই আছেন, কুশলে আছি আমি এবং তাঁর ভাইরাও। আর অন্য যাদের কথা আপনি জিজ্ঞাসা করতে চাইছেন, সকলেই ভাল আছেন তাঁরা— অহঞ্চ ভ্রাতরশ্চাস্য যাংশ্চান্যান পরিপৃচ্ছসি। এবারে আপনার কথা বলুন, আপনার রাজ্যপাট, রাজকোশ এবং সৈন্য-সামন্ত সব কিছু ঠিকঠাক আছে তো? আপনি একাই আপনার সমৃদ্ধ সিন্ধু-সৌবীর রাজ্য তথা শিবি-রাজ্য এবং অন্যান্য যে-সব জায়গায় আপনার অধিকার কায়েম করেছেন, সেই সমস্ত জায়গাতেই আপনি ধর্মানুসারে একাই শাসন চালাতে পারছেন তো?

দ্রৌপদীর এই সব কথা অন্য সাধারণ রমণীর মতো নয়। তিনি রাজার মেয়ে রাজার ঘরের বউ, কিন্তু শুধু সেই কারণেই নয়, তিনি রাজনীতি এবং রাষ্ট্রের গতি-প্রকৃতি ভাল বুঝতেন বলেই এমন রাজকোশ এবং সৈন্য-সামন্ত নিয়েও প্রশ্ন করতে পারেন। কিন্তু মুহূর্তের মধ্যে তিনি ফিরে এসেছেন পাণ্ডব-বধূর সংস্কারে। রাজ্য-রাজনীতির সামান্য প্রশ্ন সেরেই দ্রৌপদী বলেছেন— আরে! আপনি দাঁড়িয়ে আছেন কেন? এই নিন আপনার পা ধোয়ার জল, এই নিন আপনার বসার আসন— পাদ্যং প্রতিগৃহাণেদম্‌ আসনঞ্চ নৃপাত্মজ— পা ধুয়ে ভাল করে বসুন, আপনার প্রাতরাশের জন্য অন্তত পঞ্চাশটা হরিণ দেব। দ্রৌপদী বোঝাতে চাইছেন যে, তিনি জয়দ্রথ এবং তাঁর অনুগামী রাজাদের আতিথ্য সমাধান করার জন্য যথোচিত ব্যবস্থা করছেন। অরণ্য-আশ্রম বলে তিনি যেন না ভাবেন যে, তাঁর স্বামীরা এই রাজকীয় ব্যবস্থা করতে অক্ষম। ঠিক এই কারণেই প্রাতরাশের ‘মেনু’-তে কী কী ধরনের মাংসের ‘প্লেট’ থাকবে, তার বিচিত্র একটা বিবরণ দিলেন দ্রৌপদী। বিভিন্ন প্রজাতির মৃগমাংস ছাড়াও সেই সকালবেলার ‘মেনু’-তে খরগোশের মাংস, শজারুর মাংস, শূকর মাংস, মহিষ মাংস, এমনকী ভল্লুকের মাংসেরও ব্যবস্থা আছে। এখানে শেষ বক্তব্যে কিন্তু নিজের কর্তৃত্ব অতিক্রম করে পঞ্চস্বামীর প্রতীক হিসেবে সর্বজ্যেষ্ঠ যুধিষ্ঠিরকে ব্যবহার করে দ্রৌপদী বলেছেন— এই সমস্ত খাবার ব্যবস্থা করবেন কুন্তীপুত্র যুধিষ্ঠির— প্রদাসতি স্বয়ং তুভ্যং কুন্তীপুত্রো যুধিষ্ঠিরঃ।

এই যে প্রাতরাশের পরিকল্পনার মাঝখানেও দ্রৌপদী স্বামীদের কথা বলছেন, দুষ্ট জয়দ্রথ এই সংকেত বুঝতে পারেন। তিনি আর দেরি করতে চাইছেন না। অতএব দ্রোপদীর আতিথেয় উচ্ছ্বাসমুহূর্তে স্তব্ধ করে দিয়ে জয়দ্রথ বললেন— ধন্যবাদ রইল তোমার প্রাতরাশের ভাবনাতে, তুমি যে এতটা ভেবেছ, এটাই যথেষ্ট— কুশলং প্রাতরাশস্য সর্বং মে দিৎসিতং তুয়া। জয়দ্রথ এবার কাল বিলম্ব না করে নিজের কামুক পরিকল্পনাটুকু প্রকাশ করে বললেন— ওসব প্রাতরাশের কথা ছেড়ে তুমি এবার আমার রথে উঠে বসো, আমি কথা দিচ্ছি— তুমি এবার থেকে সুখে, চরম সুখে থাকবে— এহি মে রথমারোই সুখমাপ্নুহি কেবলম্।

আগে বলেছিলাম— দলকর্তার মন বুঝে ছোট অপরাধীরা অপরাধ করে। জয়দ্রথ সব জানেন— তাঁর শ্যালক-শ্বশুরেরা পাণ্ডবদের সঙ্গে কতটা খারাপ করেছেন, জয়দ্রথ সব জানেন, এমনকী বনবাসে আসার আগে দুর্যোধন-দুঃশাসনেরা দ্রৌপদীকে যা বলেছিলেন, তিনিও প্রায় সেই কথা বলেই প্রলোভন দেখাচ্ছেন দ্রৌপদীকে। তিনি সোজা বললেন— কী দেখেছ তুমি এই পাণ্ডব স্বামীদের মধ্যে। রাজ্য নেই, সমৃদ্ধি তো দূরের কথা; আর তোমার কথা এতটুকুও ভেবেছে নাকি ওরা? এমন ক্ষুব্ধ হৃদয়হীন বনবাসী স্বামীদের জন্য তোমার এই অপেক্ষা মানায় না তোমাকে— হৃতরাজ্যান্ গতশ্রীকান্… নানুরোদ্ধুম্ ইহার্হসি। যদি ভাবা যায়— দ্রৌপদী সতী সাধ্বী, স্বামীদের অনুব্রতা, তা হলে জয়দ্রথের যুক্তি হল— বিবাহিতা স্ত্রীর সম্যক ভরণ-পোষণ করা স্বামীর একান্ত ধর্ম, সেটা যদি স্বামীরা না পারে, তবে তেমন স্বামীর সঙ্গে বাস করা বুদ্ধিমতী স্ত্রীদের পোষায় না— ন বৈ প্রাজ্ঞা গতশ্রীকং ভর্তারম্ উপযুজ্যতে।

জয়দ্রথ যে রমণীদের ‘প্রাজ্ঞা’ বুদ্ধিমতী বলছেন, তেমন বুদ্ধি হলে দ্রৌপদী অনেক আগেই স্বামী-ত্যাগ করে দুর্যোধনের কণ্ঠলগ্না হতেন। জয়দ্রথ ভেবেছেন— তখনও দ্রৌপদীর মধ্যে সেই আগুন ছিল, এখন এই বনবাসের গ্লানি সহ্য করতে করতে দ্রৌপদীর মানসিকতা অন্যরকম হয়ে যাবার কথা। জয়দ্রথ সেই দুর্বলতার জায়গায় আঘাত করেই বললেন— যারা এতকাল সম্পত্তি হারিয়ে, রাজ্য হারিয়ে একেবারে শেষ জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে সেই পাণ্ডবদের ওপরে অতিরিক্ত ভক্তি দেখিয়ে তোমার এই কষ্ট ভোগ করার কোনও মানে হয় না অলং তে পাণ্ডুপুত্ৰাণাং ভক্ত্যা ক্লেশমুপাসিতুম্। তার চেয়ে দেখ এই ভাল হবে, তুমি এদের ছেড়ে আমার সঙ্গে চলো, আমার সিন্ধু-সৌবীর রাজ্যের সমস্ত শাসন-সম্পত্তির অধিকার তুমি আমারই সঙ্গে ভোগ করবে। তুমি আমার স্ত্রী হও, ত্যাগ করো এই হতদরিদ্র পাণ্ডবদের— ভার্যা মে ভব সুশ্রোণি ত্যজৈনান্ সুখমাপ্নুহি।

অনেক কামতপ্ত পুরুষ আমি দেখেছি, তাঁরা অনেকে অভিজাত, এমনকী বেশ ভাল কথাও বলেন, কিন্তু মেয়েদের সামনে কথা বলবার সময়েও খুব ‘ব্লেটান্টলি মেয়েদের শরীর সংস্থান, এমনকী সৌন্দর্যের প্রশংসার সঙ্গেও মাঝে মাঝে স্ত্রীলোকের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের কথা উল্লেখ করে ফেলেন। আমি কোনওদিন বুঝতে পারিনি— এটা কি তাঁরা ইচ্ছা করেই করেন অনুরূপ কামুকতার অন্বেষণ-প্রণালীতে, নাকি এইসব শব্দ উচ্চারণে পুরুষের অন্তর্গত কামুকতা তৃপ্ত হয়! এই যে দ্রৌপদীর মতো বিগন্ধা রমণীকে একবার ‘বরারোহা’, একবার তাঁর সুনিতম্বের সংশ্লিষ্ট সম্বোধন— এও কী অভিজাত রমণীর হৃদয়গ্রাহী হতে পারে? জয়দ্রথ যেমন বোঝেন না, জয়দ্রথের মতো হাজার তপ্ত মানুষেরাও তেমনটি বোঝেন না।

এই ধরনের কথা দ্রৌপদীর মতো অভিজাত মহিলার কাছে কেমন লাগতে পারে, তার একটা জুৎসই বর্ণনা দিয়েছেন মহাভারতের কথক ঠাকুর বৈশম্পায়ন। তিনি বলেছেন— সিন্ধুরাজ জয়দ্রথের কথাগুলি ভিতরে ভিতরে দ্রৌপদীর হৃদয় কাঁপিয়ে দিল— ইত্যুক্তা সিন্ধুরাজেন বাক্যং হৃদয়কম্পনম্। কিন্তু বিদগ্ধা রমণী কামতপ্ত পুরুষের এই আবেদন শুনে বাইরে ভীতি প্রকাশ না করে ঘৃণা প্রকাশ করেন। ফলত জয়দ্রথের কথা শোনার সঙ্গে সঙ্গে দ্রৌপদীও ক্রুদ্ধ-ঘৃণিত ভ্রূকুটিভঙ্গে কয়েক পা পিছিয়ে সরে গেলেন সেখান থেকে— কৃষ্ণা তস্মাদপাক্রামদ্দেশাৎ সা ভ্রূকুটীমুখী। জয়দ্রথের সমস্ত গোগ্রাস কাম-নিবেদনের ওপর অন্তরের কুৎসা জানিয়ে দ্রৌপদী শুধু সধিক্কারে এইটুকু জানালেন— ছিঃ জয়দ্রথ! ছিঃ! আপনি এই ধরনের কথা আর একটাও বলবেন না, লজ্জা বলে কি কোনও জিনিস নেই আপনার, লজ্জা করে না এসব কথা বলতে— মৈবমিত্যব্রবীৎ কৃষ্ণা লজ্জসে নেতি সৈন্ধবম্!

মুখে যতই ঘৃণা বর্ষিত হোক, হৃদয়ে যতই ক্রোধ উদ্‌গত হোক, দ্রৌপদী তাঁর পূর্ব অভিজ্ঞতা জানেন যে, এর পর কী ঘটতে চলেছে। তিনি পাশাখেলার পর কৌরবসভায় দুর্যোধন-দুঃশাসন-কর্ণদের অভিব্যক্তি দেখেছিলেন, অভিজাত পুরুষেরাও অরক্ষিতা রমণীর প্রতি কী অন্যায় আচরণ করতে পারেন দ্রৌপদী তা সবিশেষ জানেন। আরও জানেন যে, শত্রুপক্ষ এখানে প্রত্যক্ষভাবে উপস্থিত না থাকলেও জয়দ্রথ সেই বর্গেরই মানুষ। তিনি এক ঢিলে দুই পাখি মারতে চাইছেন— নিজের কামতর্পণের সঙ্গে দুর্যোধনের অভীষ্টসাধন, সুবিধার দিকে দ্রৌপদীর শুধু এইটুকু সুবিধা যে, পূর্বে তাঁর স্বামীরা সত্যবদ্ধ থাকায় কিছু করতে পারেননি তাঁর জন্য, এবারেও স্বামীরা এই মুহূর্তে ঘরে নেই বটে, কিন্তু তাঁরা এ-দিকে ও-দিকে কাছেই আছেন এবং তাঁদের ফিরে আসবারও সময় হয়েছে প্রায়।

স্ত্রীজনোচিত ক্ষণিক প্রক্রিয়াতেই দ্রৌপদী বুঝেছেন— খানিকটা সময় নষ্ট করে দিতে হবে জয়দ্রথের; সে ঝগড়া করে হোক, ভয় দেখিয়ে হোক, জয়দ্রথের বীরম্মন্য ভাবনায় আঘাত দিয়ে হোক, অথবা শুধু তর্ক করেই খানিকটা সময় কাটিয়ে দিতে হবে। দ্রৌপদী তাঁর স্বামীদের প্রত্যাগমনের আশা মাথায় রেখে কথার ওপর কথা সাজিয়ে জয়দ্রথের মানসিক চাপ তৈরি করতে আরম্ভ করলেন— বিলোভয়ামাস পরং বাক্যৈর্বাক্যানি যুঞ্জতী। জয়দ্রথের বিলোভন এবং সন্ত্রাসন একত্র তৈরি করার জন্য দ্রৌপদীর সুন্দর মুখমণ্ডল ক্রোধে রক্তিম এবং বিকৃত হয়ে উঠল। নয়নযুগল রক্তিম এবং ভ্রূ-যুগল নতোন্নত ভঙ্গিতে আস্ফালন করে দ্রৌপদী জয়দ্রথকে বললেন— মূর্খ! তুমি একেবারেই মূর্খ। কাদের নিন্দে করছ তুমি? পাণ্ডবদের যুদ্ধযশ তোমার জানা থাকার কথা। দেবতা-রাক্ষসেরাও তাঁদের যুদ্ধে এড়িয়ে চলেন, আর তাঁদের নিন্দে করছ তুমি! যাঁরা প্রশংসা পাবার যোগ্য মানুষ, তাঁরা বনেই থাকুন আর ঘরেই থাকুন, কেউ তাঁদের নিন্দে করে না। কিন্তু কিছু মানুষ আছে, যারা কুকুরের মততা, বিদ্যাবলে বলীয়ান তপস্বীদের উদ্দেশেও তারা ঘেউ ঘেউ করে— তপস্বিনং সম্পরিপূর্ণবিদ্যং/ভষন্তি হৈবং শুনরাঃ সুবীর। সবচেয়ে দুঃখের কথা কী জানো— বিশাল গর্তের মধ্যে পড়লেও কখনও কখনও হাত ধরে তোলবার মতো বন্ধু জুটে যায়, কিন্তু তোমার এমন কোনও বন্ধু দেখছি না এই ক্ষত্রিয়-সমাজে, যে তোমাকে পাতালের মুখ থেকে তুলে আনবে— যস্ত্বদ্য পাতালমুখে পতন্তং/ পাণৌ গৃহীত্ব প্রতিসংহরেত।

দ্রৌপদী এবার তাঁর পঞ্চস্বামীর প্রতিতুলনায় জয়দ্রথকে ভয় দেখিয়ে বললেন— পাহাড়ের মতো দেখতে যে মদস্রাবী হস্তী হিমালয়ের বনে বনে ঘুরে বেড়ায়, কেউ যদি ভাবে যে, একটা লাঠি দিয়েই ওই হাতিটাকে তার দলের মধ্যে থেকে বার করে আনব— ঠিক সেই রকম হবে যদি তুমি ভেবে থাক যে, ধর্মরাজ যুধিষ্ঠিরকে জয় করে তুমি আমাকে নিয়ে পালাবে। তোমার সবচেয়ে বড় মূর্খতা বোধহয় এইখানে যে, তুমি ভাবছ— নিদ্রিত সিংহের গায়ে পদাঘাত করে জাগিয়ে দিয়ে তুমি তার মুখ থেকে দাড়ির লোম উপড়ে নেবে— তুমি এখনও সিংহস্বরূপ ভীমকে দেখোনি, অর্জুনকেও দেখোনি, সিংহের গায়ে লাথি মারলে কী হয়, তুমি বুঝতে পারবে, যখন এঁদের দেখবে— বাল্যাৎ প্রসুপ্তস্য মহাবলস্য/ সিংহস্য পাণি মুখাল্লুনাসি।

দ্রৌপদী অনেক ভয় দেখালেন। যুধিষ্ঠির, ভীম, অর্জুন এমনকী নকুল-সহদেবের বীরত্বের কথাও উল্লেখ করলেন সসম্ভ্রমে। দ্রৌপদীকে নিয়ে পালাবার মতলবের মধ্যে যে জয়দ্রথের মৃত্যুর ভাবনা অথবা মৃত্যুর স্বয়ংবরা ভাবনা কাজ করছে, সেটা দ্রৌপদী বুঝিয়ে দিলেন বিদগ্ধ কাব্যময়তায়। দ্রৌপদী বললেন, বাঁশ গাছ, কলা গাছ আর নলবনের নলখাগড়ার গাছে যদি ফল ধরে, তবে সেসব গাছ আর বাঁচে না। আমাকে নিয়ে যাবার ফলাকাঙক্ষাও তোমার সেই রকম। জানো তো স্ত্রী-কাকড়া মরবে বলেই গর্ভবতী হয়, তুমি সেইভাবে স্বেচ্ছামৃত্যুর পথ বেছে নিতে চাইছ— তথৈব সাং তৈঃ পরিরক্ষ্যমাণাম্ আদাস্যসে কর্কটকীব গর্ভম্— আমাকে আমার রক্ষক স্বামীদের মাঝখান থেকে বার করে নিয়ে যাবার পরিকল্পনাটা ওই কাঁকড়ানির গর্ভধারণের মতো।

কামুক জয়দ্রথ দ্রৌপদীর কথা এতটুকুও গায়ে মাখলেন না। বরং খুব সপ্রতিভভাবে একটু ব্যঙ্গ করেই দ্রৌপদীর কথার উত্তর দিয়ে বললেন,— জানি, জানি, সব জানি। তোমার স্বামীরা যে খুব তালেবর লোক, তা আমার যথেষ্ট জানা আছে। তবে কী জানো, আমাকে এসব ভয়-টয় দেখিয়ে কোনও লাভ হবে না— ন ত্বেবমেতেন বিভীষণেন/শক্যা বয়ং ত্রাসয়িতুং ত্বয়াদ্য। আসলে জয়দ্রথ ভাবছেন— পাণ্ডবরা যদি রাজ্যপাটে অবস্থিত থাকতেন, তা হলে রাজযন্ত্র ব্যবহারের সুযোগ থাকায় তাঁদের শক্তি অনেক বেশি থাকত, কিন্তু বনের মধ্যে এদের কী করার ক্ষমতা থাকবে! বরঞ্চ সে-দিক দিয়ে সানুগামী জয়দ্রথের শক্তি অনেক বেশি। বস্তুত জয়দ্রথ বাস্তব বোঝেন না, পাণ্ডব-ভাইদের ব্যক্তিগত ক্ষমতার প্রসার সম্বন্ধেও তাঁর অভিজ্ঞতা নেই। ফলত রাষ্ট্রবিজ্ঞানের তাত্ত্বিকতার দ্বারা প্রযুক্ত হয়ে তিনি দ্রৌপদীকে বললেন— স্বরাষ্ট্রীয় শক্তি এবং পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে যা যা প্রয়োজন, সব আমাদের আছে, সেখানে পাণ্ডব-স্বামীরা তোমার একেবারেই ন্যুব্জ হয়ে আছে। আর এত কথা তোমার সঙ্গে আলোচনা করার কোনও প্রয়োজন নেই আমার। তুমি তাড়াতাড়ি করো— হাতিতে ওঠ অথবা রথে ওঠ, তোমার স্বামীদের সম্বন্ধে বড় বড় কথা বলে বৃথা বাক্যব্যয় করে কোনও লাভ হবে না— সা ক্ষিপ্রমাতিষ্ঠ গজং রথং বা/ন বাক্যমাত্রেণ বয়ং হি শক্যাঃ। তবে হ্যাঁ, তুমি এইটুকু করতে পারো— ওইসব ভয়-টয় না-দেখিয়ে গলবস্ত্রে হাতজোড় করে আমার কাছে অনুনয়-বিনয় করতে পারো এবং আমার করুণাও ভিক্ষা চাইতে পারো।

পঞ্চস্বামীগর্বিতা দ্রৌপদী এমন প্রস্তাব জীবনে কখনও শোনেননি। বিশেষত তিনি মুগ্ধা গৃহবধূর পেলব চরিত্র বহন করেন না। ফলত জয়দ্রথের কাছে সানুনয়ে করুণা-ভিক্ষার প্রস্তাব শুনে তাঁর ক্ষুব্ধ হৃদয় আরও বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠল। তিনি সগর্বে জয়দ্রথের দিকে তাকিয়ে বললেন— আমাকে কি দুর্বল বলে মনে হচ্ছে নাকি? সবলা হওয়া সত্ত্বেও সৌবীররাজ জয়দ্রথ যে আমাকে নিতান্তই দুর্বল ভাবছেন, এটা তোমারই মনের ভুল। এটা মনে রেখো— আমি নিজের শক্তি এবং ক্ষমতার ওপরেই সমধিক বিশ্বাস করি। অতএব এটা ভেব না যে, তুমি আক্রমণ করবে, আর সেই ভয়ে তোমার মতো লোকের কাছে আমি নিজেকে বাঁচানোর জন্য কাতরোক্তি করব। আমাকে এত দুর্বল ভেবে নিয়ো না— নাহং প্রমাথাদিহ সম্প্রতীতা/ সৌবীররাজস্য কৃপণং বদেয়ম্।

দ্রৌপদী বলেছেন, ইহ সম্প্রতীতা— অর্থাৎ আমি লোকের কাছে নিজের ক্ষমতার জন্যই খ্যাত। এমন করে বোধহয় কোনও মেয়েও পুরুষের কাছে নিজের আত্মশক্তি প্রকাশ করেনি। রামায়ণ মহাকাব্যে হৃত হবার পূর্বে সীতাও রাবণকে রাম-লক্ষ্মণের ভয় দেখিয়েছেন অনেক, কিন্তু কোনও সময়েই এমন কথা বলেননি যে, আমি নিজেই নিজের নিয়ন্ত্রী হতে পারি। বস্তুত এই আত্মশক্তি বা ব্যক্তিত্ব কখনওই তো দৈহিক শক্তির পরাকাষ্ঠা বোঝায় না, কেন না দৈহিক শক্তিতে দ্রৌপদী জয়দ্রথের সঙ্গে পারবেন কেন! কিন্তু সপ্রতিভতা এবং ব্যক্তিত্ব এমনই এক বস্তু যার সামনে দৈহিক শক্তি ম্লান হয়ে যায়। এই ব্যক্তিত্ব দ্রৌপদীর এতটাই ছিল যে, তাঁর কথা এবং যুক্তি শুনলে পরপক্ষ যতই বলীয়ান হোন তাঁর স্নায়ু শিথিল হতে থাকবেই।

দ্রৌপদী কিন্তু এখনও রাজনৈতিক প্রবক্তার মতোই নিজের অঙ্ক শোনাচ্ছেন। বললেন, তোমার আক্রমণের ভয়ে আমি তোমার কাছে কাতরোক্তি করব, এটা তুমি ভাবছ কী করে? যদি একরথে অর্জুন এবং কৃষ্ণ মিলিতভাবে তোমার পিছনে ধাওয়া করেন, তবে তুমি তো কোন ছাড়, ছেলেমানুষ! দেবরাজ ইন্দ্রেরও ক্ষমতা নেই আমাকে হরণ করে নিয়ে যায়— ইন্দ্রোহপি তাং নাপহরেৎ কথঞ্চিৎ/ মনুষ্যমাত্রং কৃপণঃ কুতোহন্যঃ। দ্রৌপদীর কথা শুনেই বোঝা যায়— তিনি প্রায়াহ্নে হরণের আশঙ্কা করছেন, কিন্তু রামায়ণের সীতার মতো তিনি বিহ্বল হচ্ছেন না। বার বার বললেন— বেশি কিছু করলে তোমাকে বড় পস্তাতে হবে, জয়দ্রথ! গরমকালে শুকনো ঘাসের ওপর আগুন পড়লে যেমন হয়, ঠিক তেমনি করেই তোমার সৈন্যদের মধ্যে প্রবেশ করবেন অর্জুন। পিছনে অনুসরণ করবে কৃষ্ণের যুদ্ধবাহিনী। ভাবটা এই, জরাসন্ধ যদি ভেবে থাকেন যে, পাণ্ডবরা রাজ্যপাট হারিয়ে বসে আছেন, অতএব আর কেউ নেই তাঁদের পিছনে দাঁড়াবার, তবে সেটা বিরাট ভুল। পাণ্ডবদের নিজস্ব রণনৈপুণ্য ছাড়াও অন্ধক, বৃষ্ণি, কেকয় রাজাদের মিত্রশক্তি যে শুধু দ্রৌপদীর জন্যই জয়দ্রথকে অনুসরণ করবে— এই রাজনৈতিক অঙ্কটা দ্রৌপদী পরিষ্কার করে বুঝিয়ে দিলেন জয়দ্রথকে— এতে হি সর্বে মম রাজপুত্রাঃ/প্রহৃষ্টরূপা পদবীং চরেয়ুঃ। একই সঙ্গে অর্জুন-ভীমের ব্যক্তিগত শক্তির প্রশংসা করলেও দ্রৌপদী যে কোনও অর্থেই দুর্বল নন, সেটা জয়দ্রথকে বুঝিয়ে দিয়ে বললেন— আমি আমার স্বামীদের অতিক্রম করে তোমার বশে আসব— এটাও যেমন ভেব না, তেমনই এটাও ভেব না যে, আমাকে তুমি জোর করে টেনে নিয়ে গেলেই আমি একেবারে ভয়ে আকুল হয়ে পড়ব— ন সম্ভ্রমং গন্তুমহং হি শক্ষ্যে/ত্বয়া নৃশংসেন বিকৃষ্যমানা। কেন না আমি জানি— আমাকে তুমি যেখানেই নিয়ে যাও, আমি ঠিক আবার এই কাম্যক-বনে ফিরে আসব।

জয়দ্রথ বোধহয় জন্মে এরকম মহিলা দেখেননি। তবু তিনি দ্রৌপদীর চরম বিদগ্ধতা বুঝতে পারেননি। বোঝেননি যে, দ্রৌপদী কথা বলতে বলতেই তাঁর অমূল্য সময় নষ্ট করে দিয়েছেন। এখন তাঁর স্বামীদের ফেরবার সময় হয়ে গেছে, হয়তো বা জয়দ্রথও সেটা বুঝলেন এবং সেই জন্যই অনুগামীদের সঙ্গে নিয়ে তাড়াহুড়ো করে দ্রৌপদীকে ধরবার চেষ্টা করলেন। জয়দ্রথের চেষ্টা প্রক্রিয়া দেখে দ্রৌপদী একদিকে তাঁকে বলতে লাগলেন— একদম ছোঁবে না আমাকে, গায়ে হাত দেবার চেষ্টাও কোরো না, অন্য দিকে সভয়ে ধৌম্য পুরোহিতের উদ্দেশে তারস্বরে চেঁচাতে আরম্ভ করলেন— প্রোবাচ সা মাং স্মৃশতেতি ভীতা/ ধৌম্যং প্রচুক্রোশ পুরোহিতং যা। জয়দ্রথ এসব পাত্তাই দিলেন না, তিনি সবলে দ্রৌপদীর আঁচল ধরে টান দিলেন— আর জানেনই তো, সেই পূর্বঘটনায় কৌরব-সভার মধ্যে দুঃশাসনের আঁচল-টানাটানিতে দ্রৌপদীর মনে যে অবচেতন তৈরি হয়েইছিল, তারই প্রতিক্রিয়ায় দ্রৌপদী ঘরে গিয়েই জয়দ্রথকে একটি বিশাল ধাক্কা দিলেন— জগ্রাহ তাম্ উত্তরবস্ত্রদেশে/জয়দ্ৰথস্তং সমবাক্ষিপৎ সা।

কোনও রমণীর কাছে এমন ধাক্কা খাবেন, জয়দ্রথ বোধহয় এতটুকুও প্রস্তুত ছিলেন না। এক ধাক্কাতেই সিন্ধুসৌবীর দেশের রাজা ছিন্নমূল বৃক্ষের মতো লুটিয়ে পড়লেন ভুঁয়ে— পপাত শাখীব নিকৃত্তমূলঃ। অবশ্য সঙ্গে সঙ্গেই চলচ্চিত্রের খলনায়কের মতো লাফিয়ে উঠলেন জয়দ্রথ এবং দ্বিগুণিত বেগে দ্রৌপদীকে ধরে টানতে আরম্ভ করলেন। দ্রৌপদী বুঝলেন— শারীরিক বলে আর তিনি এই কামদুষ্ট পুরুষের সঙ্গে পেরে উঠবেন না, তবে এও ঠিক— এই টানাটানিতে তাঁর শরীরে অসতীত্বের কোনও ফোসকা পড়েছে বলেও মনে হয়নি তাঁর। বরঞ্চ কোনও অর্থেই শরীর নষ্ট না করে সামনে উপস্থিত ধৌম্য পুরোহিতের উদ্দেশে প্রণামের দ্বারাই সমস্ত প্রতিকারের ইঙ্গিত জানিয়ে দ্রৌপদী জয়দ্রথের রথে উঠে পড়লেন— সা কৃয্যমানা রথমারুরোহ/ধৌম্যস্য পাদাবভিবাদ্য কৃষ্ণা।

জয়দ্রথ দ্রৌপদীকে নিয়ে সবেগে রথ চালিয়ে দিতেই অসহায় ধৌম্যপুরোহিত রথের পিছনে যেতে যেতে নিস্ফল আক্রোশেই যেন বলে উঠলেন— পারবে না হে জয়দ্রথ! পারবে না। পাঁচ পাণ্ডব-ভাইকে না জিতে এইভাবে তুমি তাঁদের স্ত্রীকে নিয়ে পালাতে পারবে না— নেয়ং শক্যা ত্বয়া নেতৃমবিজিত্য মহারথান্। তা ছাড়া এই কি তোমার ধর্ম, জয়দ্রথ! তুমি না ক্ষত্রিয়! এত খারাপ কাজটা তুমি করতে চলেছ, এর ফল তুমি পাবেই। পাণ্ডবদের সঙ্গে একবার দেখা হোক তোমার, তখন বুঝবে কী করেছ তুমি— ক্ষুদ্রং কৃত্বা ফলং পাপং ত্বং প্রাপ্স্যসি ন সংশয়ঃ।

জয়দ্রথকে বুঝিয়ে অথবা তখনকার মতো ভয় দেখিয়ে কোনও লাভ ছিল না। কেন না, প্রথমত, দ্রৌপদীর বক্তিত্ব এবং রূপ দেখে তিনি পাগল হয়ে গিয়েছিলেন। দ্বিতীয়ত, এই ব্যক্তিত্বকে যদি একবার জয়দ্রথ বশীভূত করতে পারেন— ছলে, বলে, কৌশলে, তা হলে তাঁর বিখ্যাত শ্যালকগোষ্ঠীর কাছে তাঁর মর্যাদা কোথায় গিয়ে পৌছতে পারে, সেটাও তাঁর মাথায় ছিল অবশ্যই। ধৌম্য পুরোহিত জয়দ্রথকে কথা দিয়ে নিবৃত্ত করতে পারলেন না, অগত্যা অসহায়তা এবং বিহ্বলতায় বিমূঢ় পুরোহিত জয়দ্রথের পদাতি সৈন্যদলের পাশাপাশি খানিকক্ষণ হাঁটলেন, বিনা কারণেই হেঁটে চললেন— হয়তো বা জয়দ্রথের যাত্রাপথ খেয়াল রাখার জন্য— অন্বগচ্ছত্তদা ধৌম্যঃ পদাতিগণমধ্যগঃ।

অতঃপর পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ধনুর্ধর বলে যাঁরা স্বীকৃত, সেই পাণ্ডবরা চারদিকের বন দাপিয়ে শিকার করলেন মৃগ, বরাহ, বন্য মহিষ। তারপর সকলে এসে মিলিত হলেন একটি বিশেষ জায়গায়, কেন না পূর্বাহ্নেই সেই স্থান হয়তো নির্দিষ্ট ছিল— ধনুর্ধরাঃ শ্রেষ্ঠতমাঃ পৃথিব্যাং পৃথক্ চরন্তঃ সহিতা বভূবুঃ।

অরণ্যের প্রকৃতির মধ্যে মানুষের শ্বাপদ-সঞ্চার ঘটলে মৃগ-পশু-পক্ষীদের মধ্যে একটি বিকৃত আলোড়ন সৃষ্টি হয়। জয়দ্রথ তাঁর রথে দ্রৌপদীকে নিয়ে হুড়মুড়িয়ে পালাচ্ছিলেন অপ্রচলিত পথে নিশ্চয়ই; সঙ্গে অনুগামীরা ছিলেন, আর পদাতি সৈন্যদের আমরা তো সঙ্গে সঙ্গেই চলতে দেখেছি। বনের মধ্য এতগুলি মানুষের রথশব্দ, পদশব্দ এবং কোলাহল-কৌতূহলে যে বিচিত্র আলোড়ন তৈরি হয়েছিল, তাতে অরণ্যের পশু-পক্ষী-সমাজের মধ্যে একটা অদ্ভুত বিকার তৈরি হল, পাখিরা নিকৃষ্ট শব্দে চেঁচাতে লাগলে— মহাবনং তদ্ বিহগোপঘুষ্টম্। যুধিষ্ঠির ব্যাপারটা লক্ষ করে সামান্য গবেষণার পরেই ভাইদের বললেন— কাম্যক-বনের পশু-পাখিরা পুব দিকে চেপে গিয়ে এমন অদ্ভুত শব্দ করছে। যাতে মনে হচ্ছে শত্রুরা প্রবেশ করেছে এই বনে— আয়াসমুগ্রং প্রতিবেদয়ন্তঃ/ মহাবনং শত্ৰুভির্বাধ্যমানম্।

যুধিষ্ঠির প্রথমে এই ধন্দে ছিলেন বোধহয় যে— তাঁরা চারদিকে মৃগয়া করতে বেরিয়েছেন, সেই শিকারের ছোটার কারণেও পশু-পাখিদের মধ্যে কোনও বিকার লক্ষিত হতে পারে। হয়তো সেই কারণেই প্রথমে তিনি শিকার ধরা বন্ধ করতে বলেছেন। তার পরেই তিনি নিশ্চিন্ত হয়েছেন, যে, না, মৃগয়া নয়, আরও অন্য কিছু, আরও কোনও দুর্ঘটনা। দ্রৌপদী একা রয়েছেন, পর্ণকুটিরে এবং তারা সকলেই মৃগয়ায় ব্যস্ত, এমন অবস্থায় দুর্যোধনের কাছের কেউ যদি তাঁর বন্ধুকৃত্য করে! যুধিষ্ঠির ভাইদের বলেছেন— আমার ভাল লাগছে না মোটেই। একজন সুরাপায়ী নিঃশেষে মদ্যপান করলে মদ্যভাণ্ডের যে অবস্থা হয়। আমাদের এই কাম্যক-বনটা সেইরকম, ফাঁকা ফাঁকা লাগছে— এবংবিধং মে প্রতিভাতি কাম্যকং/শৌন্ডের্যথা পীতরসশ্চ কুম্ভঃ— চল শিগ্‌গির ফিরে যাই।

যেখানে এসে পাণ্ডবরা মিলিত হয়েছিলেন, সেখান থেকেই ঘোড়ায় চড়ে রওনা হলেন বাড়ির দিকে। সেই পুবদিকের দুর্লক্ষণের কথাটা যুধিষ্ঠির যেমন ধরেছিলেন, ফেরার পথে সেটা ছিল সকলেরই বাঁ-দিক। বাঁ-দিকটাও তখনও পাখিদের হতাশ্বাস আকুলি-বিকুলি চলছে। যুধিষ্ঠির এবার কৌরব দুর্যোধনের দুরভিসন্ধির কথাই ভাবতে ভাবতে বললেন— বাঁদিকে শেয়ালগুলো ডেকেই চলেছে, ডেকেই চলেছে। মনে হচ্ছে, কৌরবরা আমাদের অরণ্য-আশ্রমের ওপরেই চড়াও হয়েছে— কৃতোহভিমর্দঃ কুরুভিঃ প্রসহ্য।

নানা ইঙ্গিত, দুর্লক্ষণ আর দুর্ভাবনার পথ পেরিয়ে অরণ্য কুটিরে ফিরতেই দ্রৌপদীর গাৰ্হস্থ কর্মের সহায়িকা তাঁর কাজের মেয়ের অবরুদ্ধ ক্রন্দনধ্বনি শোনা গেল। যুধিষ্ঠিরের সারথি ইন্দ্রসেন চলমান রথ থেকেই লাফিয়ে নেমে এলেন ধাত্রেয়িকা কাজের মেয়েটির কাছে। তাঁকে আর্তস্বরে কাদতে দেখে প্রথমেই দ্রৌপদীর কথা জিজ্ঞাসা করলেন ইন্দ্রসেন। জিজ্ঞাসা করলেন— তাঁকে কেউ বিরক্ত করেনি তো— ক্কচিন পাপৈঃ সুনৃশংসকৃপ্তিঃ/প্রমাথিতা দ্রৌপদী রাজপুত্রী? দ্রৌপদীকে যে হরণ করেছে, তাকে পাণ্ডবরা কী কী করতে পারেন— তার সম্বন্ধে সামান্য বীরোদগার-শব্দ প্রয়োগ করতেই ধাত্রী জানাল— জয়দ্রথ পাঁচ পাণ্ডব-ভাইদের অবমাননা করেই দ্রৌপদীকে উৎপীড়ন সহকারে তুলে নিয়ে গেছে— জয়দ্রথেনাপহৃতা প্রমথ্য/পঞ্চেন্দ্রকল্পান্ পরিভূয় কৃষ্ণা। ধাত্রী পাণ্ডবদের শৌর্য-বীর্যের চেহারা জানে, অতএব বাগ্‌-বিস্তার না করেই সমাধান জানাল— তোমরা রথের মুখ ঘোরাও, জয়দ্রথ এবং তার অনুগামীরা নতুন পথে গেছে গাছপালা ভেঙে দিয়ে। সেইসব গাছপালা এখনও শুকিয়ে নুয়ে পড়েনি এতটুকু— তিষ্ঠন্তি বর্ত্মানি নবান্যমূনি/বৃক্ষাশ্চ ন ম্লান্তি তথৈব ভগ্নাঃ।

নতুন অপরিচিত পথে গাছপালা মাড়িয়ে রথ চালাতে হচ্ছে বলেই দ্রৌপদীর ধাত্রীবধূর ধারণা— দ্রৌপদীকে নিয়ে খুব বেশি দূর যেতে পারেনি জয়দ্রথ। পরিস্থিতির গুরুত্ব এমনই যে, সে পাণ্ডবদের উদ্দেশে আদেশ উচ্চারণ করে বলছে— শিগগির রথ চালান আপনারা, রাজপুত্রী দ্রৌপদী এখনও খুব দূরে চলে যাননি— আবর্তয়ধ্বম্ অনুযাত শীঘ্রং/ন দূরযাতৈব হি রাজপুত্রী। দ্রৌপদীর ধাত্রী পর্যন্ত পাণ্ডবদের ধনুক-বাণ শাণিত করে এগোতে বলল জয়দ্রথের উদ্দেশে। ধাত্রী এর পরেও কতগুলি কথা বলে গেল পর পর, নাকি ধাত্রীর জবানিতে মহাভারতের কথক ঠাকুর বৈশম্পায়ন জয়দ্রথের চরিত্রটা পাঠকের সামনে তুলে ধরলেন দ্রৌপদীর অসহায়তা দেখাতে গিয়ে। আসলে, বিমূঢ়া ধাত্রী নিজের মতো করেই বলতে চাইছে, যে এমন অবস্থায় দ্রৌপদী কত দূর পর্যন্ত করতে বাধ্য হবেন। ধাত্রী বলল— জয়দ্রথের কথায় এবং কাজে দ্রৌপদী একেবারে বিমূঢ়া হয়ে গেছেন। তাঁকে যেমন করে ভয় দেখানো হয়েছে, তাতে কতক্ষণ তিনি নিজেকে সুরক্ষিত রাখতে পারবেন জানি না। আমার তো ভয় হচ্ছে— ঘিয়ে ভরা হোমযজ্ঞের পাত্র শেষে ভস্মে গিয়ে না পড়ে, কোনও অযোগ্য পুরুষকে শেষে দেহদান করতে না হয় তাঁকে— দদাতি কস্ম্যৈচিদনর্হতে তনুম্।

বেশ বোঝা যায়— দ্রৌপদীর কাজের মেয়েটি, যাকে কখনও আমরা ধাত্রী’ বলেছি অথবা ‘ধাত্রেয়িকা’, সেও কিন্তু নিজের মতো করে এটা বোঝে যে, জয়দ্রথের চরিত্রটাই এমন যাতে এক সময় তিনি দ্রৌপদীর ইচ্ছার বিরুদ্ধেও বলাৎকারের পথে যাবেন। আর সেই মুহূর্তে দ্রৌপদীর মতো তেজস্বিনী রমণীও পৌরুষেয় শক্তির কাছে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হবেন, শুধুমাত্র শারীরিক শক্তিতে তিনি জয়দ্রথের থেকে হীন বলে। আসলে ক্ষুদ্রা এই ধাত্রেয়িকাও ধর্ষক পুরুষের চোখের ভাষাটুকু পড়ে ফেলতে পেরেছে। অদ্ভুত উপমা দিয়ে সে ধর্ষক পুরুষের দুনির্বার মন এবং ধর্ষিতা রমণীর অসহায়তা বর্ণনা করে বলেছে— তুষের আগুনে যেমন ঘিয়ের আহুতি, শ্মশানে যেমন ফুলের মালা ছুড়ে দিতে হয়, তেমনই কিন্তু দ্রৌপদীর মতো রমণীর আত্মসমর্পণ জয়দ্রথের কাছে। বাস্তবে এটাই হতে যাচ্ছে— পুরা তুষাগ্নাবিব হূয়তে হবিঃ/পুরা শ্মশানে স্রগিবাপবিধ্যতে।

দ্রৌপদীর দাসী হলেও দ্রৌপদীর স্বামীদের ওপর সে দোষারোপ করছে না। কেন না তাঁরা যে বনের মধ্যেও জীবিকার জন্য ব্যস্ত থাকবেন, সেটা স্বাভাবিক। সে বলেছে— যাজ্ঞিক ব্রাহ্মণরা অসতর্ক থাকলে যেমন কুকুর এসে যজ্ঞের জন্য প্রস্তুত সোমরস পান করে চলে যায়, তেমনই অযোগ্য জয়দ্রথের মতো পুরুষও কিন্তু তোমাদের ব্যস্ততার সুযোগ নিয়ে দ্রৌপদীকে উপভোগ করতে চাইবে। দুষ্ট পুরুষের ধর্ষণ-মনস্কতা মাথায় রেখে ধাত্রী জয়দ্রথের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনাটুকুও বলে দিল। বলে দিল— ধর্ষক পুরুষ পরে কেমন সুন্দর হাত ধুয়ে ফেলে, অথচ যে রমণীকে সে তাঁর পাপ-স্পর্শ দেয়, সেই রমণীটি তার স্বামীর কাছে কিন্তু সেই যজ্ঞীয় হবি বা আহূতিযোগ্য বস্তু যা কুকুরে এসে চেটে দিয়ে গেছে— আর যেন তা যজ্ঞের কাজে লাগে না। ধাত্ৰেয়িকা দাসী সাধারণ একটি উপমা দিয়ে পাণ্ডবদের বলেছে, দেখুন! শেয়াল অরণ্যের মধ্যে মৃগয়া করার পর পদ্ম-দিঘিতে স্নান করে এমন করেই বসে থাকবে যেন রক্তমাংস কোনওদিন ছোঁয়নি। ধূর্ত জয়দ্রথও একইভাবে স্ত্রীলোকের মৃগয়া করতে এসে দ্রৌপদীকে ধরে নিয়ে গেছে, এর পর সে সাধু সাজবে। তাই বলছিলাম— যাতে এখনও পথের কুকুর যজ্ঞের আহুতি-দ্রব্য চেটে না দেয়, যাতে এখনও জয়দ্রথ তোমাদের সুন্দরী প্রিয়া দ্রৌপদীর সুন্দর শরীর পঙ্কিল না করে— মা বঃ প্রিয়ায়াঃ বদনং প্রসন্নং/ স্পৃশ্যাচ্ছুভং কশ্চিদকৃত্যকারী— তাই এখনও আপনারা তাড়া করে জয়দ্রথকে ধরে ফেলুন, দ্রৌপদী এখনও তেমন দূরগতা নন। শিগগির যান, আর সময় নষ্ট করবেন না— মা বঃ কালঃ ক্ষিপ্রমিহাত্যগাদ্ বৈ।

ধর্ষককারী পুরুষের ভাবনা অথবা তার হাতে আপন স্ত্রীর অনুমানযোগ্য লাঞ্ছনার কথা আর শুনতে পারছিলেন না যুধিষ্ঠির। জয়দ্রথের ওপর রাগে ধাত্রীকেই তিনি বললেন— সরে যাও তুমি, চুপ করো, আমাদের সামনে আর এ-সব কুৎসিত কথা বোলো না— ভদ্রে প্রতিক্রম নিযচ্ছ বাচং/মাস্মৎসকাশে পরুষাণ্যবোচঃ। রাজা-রাজড়ারা, রাজপুত্রেরা নিজেদের ঐশ্বর্যমওতায় এই ধরনের কাজ মাঝে মাঝে করে ফেলে বটে, কিন্তু এখানে তারা পার পাবে না।

যুধিষ্ঠিরের ইঙ্গিতে পাণ্ডব-ভাইরা ধনুক-বাণ হাতে খানিক দূর এগোতেই দেখলেন— জয়দ্রথের অশ্বারোহী সৈন্যরা ঘোড়ার খুরে ধুলো উড়িয়ে তীব্রবেগে চলেছে, আর অপেক্ষাকৃত শ্লথগতি পদাতিসৈন্যের মধ্যে থেকে ধৌম্য পুরোহিত কোনওরকমে হাত উঁচিয়ে ভীমকে ডেকে বলছেন— এই দিকে গেছে ভীম! এই দিকটা দিয়ে ধাওয়া করো— পদাতীনাং মধ্যগতঞ্চ ধৌম্যং/বিক্রোশম্ভং ভীমমভিদ্রবেতি। পাণ্ডবরা ধৌম্যকে আশ্বস্ত করে বললেন আপনি বেরিয়ে আসুন ওখান থেকে। নিশ্চিন্তে ঘরে যান। আমরা দেখছি।

আর কী, শকুন যেমন লোলুপ দৃষ্টিতে মাংসখণ্ড লক্ষ্য করে একদৃষ্টে উড়ে যায়, পাণ্ডবরা তেমনি করেই চললেন জয়দ্রথের দিকে। জয়দ্রথ পাণ্ডবদের ভয়েই পরিচিত মসৃণ পথে যাননি। ফলে অপ্রচলিত পথে অরণ্যের গাছপালা ভেঙে তাঁর রথ বেশি দূর এগোতে পারেনি। পাণ্ডবরা জয়দ্রথকে দেখতে পেলেন সহজেই। যত না জয়দ্রথকে দেখে, তাঁর চেয়ে অনেক বেশি তাঁর রথে দ্রৌপদীকে দেখে— পাণ্ডবরা একেবারে জ্বলে উঠলেন। আর ওদিকে দ্রৌপদী! প্রিয় স্বামীদের দেখে দ্রৌপদী মনে মনে একেবারে উৎফুল্ল হয়ে উঠলেন, তবে তাঁর এই আনন্দ স্বামীর গরবে গরবিনী মুগ্ধা স্ত্রীর আনন্দ নয়। তাঁর মতো ব্যক্তিত্বসম্পন্না নারী যখন শুধুমাত্র শারীরিক শক্তির অভাবে জঘন্য পরপুরুষের বশে আসতে বাধ্য হন, সেই নারী আপন মুক্তির আভাস পাওয়ামাত্র আনন্দে মুগ্ধা হন না, তিনি আনন্দের মধ্যেও জ্বলে ওঠেন। মহাভারতের কবি বিদগ্ধা রমণীর এই ভাবনাটুকু মাথায় রেখেই মন্তব্য করেছেন— পাণ্ডবদের রথের ধ্বজা দেখামাত্রই দুরাত্মা জয়দ্রথের তেজ নষ্ট হয়ে গেল এবং দ্রৌপদীর তেজ বৃদ্ধি হল।

পাঁচ পাণ্ডব-ভাই দূর থেকেই জয়দ্রথকে যুদ্ধে আহ্বান জানালেন এবং ঘটনার আকস্মিকতায় জয়দ্রথ কীরকম ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে রথস্থিত দ্রৌপদীকেই জিজ্ঞাসা করলেন— পাঁচ-পাঁচটা বিশাল রথে করে এই যে এদিকেই আসছে, মনে হচ্ছে— এরাই তোমার স্বামীরা। তা আমি তো এদের তেমন চিনি না, তুমি একটু চিনিয়ে দেবে নাকি? দ্রৌপদী অসীম সাহস দেখিয়ে বললেন— মূর্খ! তুমি তোমার মৃত্যুকে ডেকে এনেছ, এখন আর এঁদের পরিচয় শুনে কী করবে? তবে কি না হ্যাঁ, যে মানুষ মরার মুখে দাড়িয়ে আছে, সে যদি তার শেষইচ্ছা প্রকাশ করে কিছু জানতে চায়, তবে মুমূর্ষ ব্যক্তির শেষইচ্ছা পূরণ করাটা আমার ধর্ম— আখ্যাতব্যা ত্বেব সর্বং মুমূৰ্ষো/ময়া তুভ্যং পৃষ্টয়া ধর্ম এষঃ। তা ছাড়া বলতে আমার খারাপও লাগছে না। আমাকে হরণ করা হয়েছিল বলে মনের মধ্যে আমার যতটুকু কষ্ট ছিল বা ভয় ছিল, সেসব আমার কেটে গেছে। যে মুহূর্তে ভাইদের সঙ্গে আমি ধর্মরাজ যুধিষ্ঠিরকে দেখতে পেয়েছি, সেই মুহূর্ত থেকেই আমার কষ্ট-ভয় সব দূর হয়ে গেছে।

দ্রৌপদী সানন্দে এবং সগর্বে জয়দ্রথের কাছে আপন স্বামী পরিচয় দিতে আরম্ভ করলেন। বললেন— ওই যে দেখছ, রথের মাথায় দুটো মাদল, যেন বেজে চলেছে বলে মনে হচ্ছে, ওই মাদল দুটোর নাম নন্দ আর উপনন্দ, ওগলোই আমার জ্যেষ্ঠ স্বামী যুধিষ্ঠিরের রথের ধ্বজা। ক্ষত্রিয়ের পুরুষার্থ ধর্ম এবং অর্থকে অত্যন্ত সূক্ষ্মভাবে বিচার করতে পারেন বলে যাঁর কাছে লোকেরা সব সময় আসে— এতং স্বধর্মার্থবিনিশ্চয়জ্ঞং সদা জনাঃ কৃত্যবন্তোহনুযান্তি— তিনি আমার জ্যেষ্ঠ স্বামী যুধিষ্টির। এঁর চেহারাটার দিকেও একবার তাকাও, জয়দ্রথ! সোনার মতো গায়ের রং, চোখগুলো টানা টানা, চোখা নাক, আর শরীরের আদল একেবারে মেদহীন, অস্থূল, ইনিই কুরুকুলের শ্রেষ্ঠ পুরুষ যুধিষ্ঠির।

খানিকক্ষণ আগে জয়দ্রথ দ্রৌপদীকে তাঁর কাছে করুণা ভিক্ষা করতে বলেছিলেন। দ্রৌপদী জয়দ্রথের করুণা চাননি; হয়তো এই ভেবেই চাননি যে, তখনকার মতো তাঁর স্ত্রীশরীর বাঁচানোর জন্য দুষ্কৃতীর কাছে কাকুতি-মিনতি করেও কামুক জয়দ্রথ এবং দুর্যোধনের জামাইবাবু জয়দ্রথ পরে অন্য ব্যবহার করতে পারেন, কেন না কামুক পুরুষেরা কথার দাম রাখে না। জয়দ্রথের সেই উক্তি ফিরিয়ে দিয়ে দ্রৌপদী তাঁর জ্যেষ্ঠ স্বামীর চরিত্র বর্ণনা করলেন জয়দ্রথের প্রতিতুলনায়। দ্রৌপদী বললেন— যুধিষ্ঠির ধর্মচারী ব্যক্তি, শরণাগত শত্রুকেও তিনি প্রাণদান করে থাকেন। আর তুমি তো মূর্খ— আমি জানি তুমি বললেও শুনবে না— তুমি যদি এখনও বাঁচার আশা রাখ, তবে অস্ত্রশস্ত্র মাটিতে ফেলে রেখে হাত জোড় করে খুব তাড়াতাড়ি যুধিষ্ঠিরের শরণ নাও, বেঁচে যাবে— পরৈহ্যেনং ভূয়ো জবেন ভূতয়ে/ ত্বমাত্মনঃ প্রাঞ্জলির্ন্যস্তশস্ত্রঃ।

জয়দ্রথ এখনও নতজানু না হলে কী ঘটতে পারে দ্রৌপদী এবার তা বুঝিয়ে দিলেন তাঁর দ্বিতীয় স্বামীর বর্ণনায়। দ্রৌপদী বললেন— ওই যে দেখছ শালখুঁটির মতো চেহারা, রাগের চোটে ঠোঁট কামড়ে চলেছে নিজের, ভ্রূকুটির কুটিলতায় ভুরু দুটো জোড়া লেগে গেছে বলে মনে হচ্ছে— ইনি হচ্ছেন আমার দ্বিতীয় স্বামী ভীমসেন। অপরাধ করলে এঁর কাছে পার পাবার উপায় নেই, সে মরবেই, কারণ ইনি কখনও কারো অপরাধ ভুলে থাকতে পারেন না। একবার অন্যায় করলে ভীম তার শেষ না দেখে ছাড়েন না, এমনই ভয়ংকর এই ভীম— বৈরস্যান্তং সংবিধায়োপযাতি/ পশ্চাচ্ছান্তিং ন চ গচ্ছত্যতীব।

দ্রৌপদী পর পর অর্জুন এবং নকুল সহদেবেরও গুণ বর্ণনা করলেন, অবশ্যই অর্জুনের যুদ্ধ-বিক্রমের কথা সেখানে প্রধান বিষয় ছিল, কিন্তু নকুল-সহদেবের কথাতেও এখানে এমন উচ্ছ্বাস ছিল, যাতে মনে হয় জয়দ্রথকে দ্রৌপদী কথা দিয়েই বিভ্রাসিত করে দিয়েছেন। দ্রৌপদীর কথায় অবশ্য জয়দ্রথ বিনীত হলেন না, কৃতাঞ্জলিও হলেন না যুধিষ্ঠিরের কাছে। ফলত যুদ্ধ একটা হলই। যুদ্ধে জয়দ্রথের অনুগামী রাজারা এবং সৈন্য-সামন্তেরা এইটুকু বীরত্ব দেখাতে পেরেছিল যাতে একসময় যুধিষ্ঠিরকে নিজের ভগ্ন রথখানি ফেলে রেখে লাফিয়ে সহদেবের রথে উঠতে হয়েছিল, অন্যদিকে নকুলের রথটাকে হাতি দিয়ে গুঁড়িয়ে দেওয়ায় তাঁকেও উঠতে হয়েছিল মহাবল ভীমসেনের রথে। যুধিষ্ঠির, নকুল এবং সহদেবকে নিয়ে ভাবার কোনও কারণ নেই, কেন না, ওদিকে ভীমসেন আছেন। তাঁর গদার বহির্দেশে বিভিন্ন জায়গায় বহুতর শিক উঁচু করে লাগানো ছিল। সেই গদার আঘাতে জয়দ্রথের সৈন্য হত্যা করতে করতে এমনই তাঁর নেশা ধরে গিয়েছিল যে, তিনি খেয়ালই করলেন না যে, জয়দ্রথ দ্রৌপদীকে রথ থেকে নামিয়ে দিয়ে নিজে গভীর বনের মধ্যে পলায়ন করেছেন।

ঘটনাটা প্রথম নজরে আসে অর্জুনের। যুদ্ধনায়কের সার্বিক সর্বতোগামী দৃষ্টি তাঁর ছিল বলেই তিনি লক্ষ করেছিলেন— ভীমসেন জয়দ্রথের সেই বন্ধু কোটিকাস্যকে সবলে হত্যা করার পর জয়দ্রথের পলায়ন-পর সৈন্যগুলিকে পলায়নে বাধা দিয়ে একের পর এক হত্যা করছেন। ওদিকে জয়দ্রথকে অর্জুন আর দেখতেই পেলেন না, অথচ দেখলেন— গভীর অরণ্যদেশের আরম্ভভাগে দ্রৌপদী দাঁড়িয়ে আছেন একা। সৈন্য-সংকুল রণভূমির মধ্যে জয়দ্রথ তাঁর রথ থেকে দ্রৌপদীকে নামিয়ে দিয়ে অন্যের অলক্ষ্যে গভীর বনের মধ্যে পলায়ন করেছেন— স তস্মিন্ সংকুলে সৈন্যে দ্রৌপদীমবতাৰ্য তাম্। হঠাৎই জয়দ্রথকে দেখতে না পেয়ে অর্জুন ভীমকে বললেন— তুমি কী করে চলেছ, দাদা! একটা একটা খুচরো সৈন্য বধ করে চলেছ? যার জন্য এত কাণ্ড, সেই জয়দ্রথকেই তো চোখে দেখতে পাচ্ছি না, তুমি তাঁকে খোঁজো। এগুলোকে মেরে কী হবে— তমেবান্বিষ ভদ্রং তে কিং তে যোধৈর্নিপাতিতৈঃ।

অর্জুনের কথা শুনে ভীম থামলেন। নিজের শক্তির ওপরে তাঁর এতটাই বিশ্বাস যে, তিনি কখনওই খুব একটা উদ্বিগ্ন হন না। যুধিষ্ঠিরকে লক্ষ্য করে তিনি নিশ্চিন্তে বললেন— মহারাজ! শত্রুপক্ষের বড়সড় প্রধান ব্যক্তিরা সকলেই মারা পড়েছে, যাও বা কিছু ছিল পালিয়েছে এদিক-ওদিক। আপনি দ্রৌপদীকে নিয়ে আমাদের কুটিরে ফিরে যান। সঙ্গে নিয়ে যান নকুল, সহদেব এবং ধৌম্য পুরোহিতকে। প্রিয়া দ্রৌপদীর ওপর দিয়ে যে ঝড় বয়ে গেছে, এখন তাঁকে সকলে মিলে আশ্বস্ত করাটাই সবচেয়ে বড় প্রয়োজন, আপনি ফিরে যান— প্রাপ্যাশ্রমপদং রাজন দ্রৌপদীং পরিসান্ত্বয়। আর জয়দ্রথের কথা বলল অর্জুন— ও যদি পাতালেও গিয়ে লুকিয়ে থাকে এবং দেবরাজ ইন্দ্রও যদি তাঁর সহায় হন তবে জীবিত অবস্থায় আমার হাত থেকে তার বেঁচে ফেরার আশা নেই— ন হি মে মোক্ষ্যতে জীবন্ মূঢ় সৈন্ধবকো নৃপঃ।

ভীমের এই নিরুদ্বিগ্ন ক্রোধের আক্রোশ যুধিষ্ঠির জানেন। তিনি এমনই এক মানুষ যে, চরম শত্রু হলেও নিজের কোমল সম্পর্কগুলো ভুলে যান না। ভীমের ভাব-সাব দেখে তাঁর ভয় হল। তিনি জয়দ্রথকে যা করতে পারেন, সেই শেষ কথা ভেবে শুধু এইটুকু সাবধানবাণী উচ্চারণ করলেন— আমি জানি, জয়দ্রথ কত বড় অন্যায় করেছে, তবু তুমি ভগিনী দুঃশলার কথা মনে রেখো, জয়দ্রথ মারা গেলে সে বিধবা হবে। আর মনে রেখো জননী গান্ধারীর কথা। বড় আদরের মেয়ে তাঁর দুঃশলা। মেয়ে বিধবা হলে কোন জননী তা সইতে পারে— দুঃশল্যমভিসংস্মৃত্য গান্ধারীঞ্চ যশস্বিনীম্।

এক-একটা ঘটনা এইরকম ঘটে যায় যাতে মানুষের অন্তনির্হিত চরিত্রের বিশেষ বিশেষ দিকগুলো কেমন প্রকট হয়ে ওঠে। নিজের স্ত্রীকে পরপুরুষ ধরে নিয়ে গেছে, এমনকী তাতে ধর্ষণের সম্ভাবনাও আছে, এইরকম একটা মানুষকেও যুধিষ্ঠির খানিকটা ক্ষমা করতে চান ভগিনী দুঃশলার কথা ভেবে এবং জননী গান্ধারীর কথা মনে রেখে। যখন প্রথম তিনি জয়দ্রথের অসভ্য আচরণের কথা শোনেন এবং দ্রৌপদীর অনুচরী ধাত্ৰেয়িকা যখন দ্রৌপদীর শরীরে জয়দ্রথের ধর্ষণ-স্পর্শের সম্ভাবনা উচ্চারণ করেছিল, তখন সাক্ষেপে যুধিষ্ঠির বলেছিলেন— তুমি সরে যাও এখান থেকে, আমাদের সামনে এই কুৎসিত শব্দ আর উচ্চারণ কোরো না— ভদ্রে প্রতিক্ৰাম নিযচ্ছ বাচং/ মাস্মাৎসকাশে পরুষাণ্যবোচঃ। সেদিন সেই মুহূর্তে যুধিষ্ঠির ঠিকই করে নিয়েছিলেন যে, জয়দ্রথকে সহজে ছেড়ে দেওয়া যাবে না এবং এই শাস্তির কথা তিনি উচ্চারণ করেছিলেন দার্শনিক কুটিলতায়। তিনি বলেছিলেন— রাজা-রাজড়ারা রাজপুত্রেরা এইভাবেই নিজের বলোন্মত্ততায় প্রতারিত হয়— বলেন মত্তা বঞ্চনাং প্রাপ্নুবন্তি।

কীভাবে জয়দ্রথ আপন পাপকর্মের জন্য প্রতারিত হবেন, তা ঠিকই করে ফেলেছিলেন যুধিষ্ঠির। পাঁচ ভাই মিলে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন জয়দ্রথ এবং তাঁর অনুগামীদের ওপর। তিনি নিজেও যথেষ্ট যুদ্ধ করেছেন। কিন্তু যুদ্ধশেষে যখন দ্রৌপদীকে বিপন্মুক্ত অবস্থায় পাওয়া গেছে এবং যখন জয়দ্রথকে চরম শাস্তি দেবার কথা বেরিয়ে আসছে ক্রোধরক্ত ভীমসেনের মুখ থেকে, তখন কিন্তু মহামতি যুধিষ্ঠির তাঁর সর্বতোগামী প্রসারিত দৃষ্টি থেকে জয়দ্রথের বিচার করছেন। শেষ পর্যন্ত যখন দ্রৌপদীর মতো প্রিয়া পত্নীর ওপর ধর্ষণের লাঞ্ছনা জোটেনি এবং তাঁকে তিনি পূর্বাবস্থায় ফিরে পেয়েছেন তখন তিনি কিন্তু আরও দুটি স্ত্রীলোকের মন নিয়ে চিন্তা করছেন— একজন ভগিনী দুঃশলা, দ্বিতীয়জন জননী গান্ধারী।

দুঃশলাও তাঁর নিজের ভগিনী নন, গান্ধারীও তাঁর নিজের জননী নন, কিন্তু তাঁদের জীবন এবং মনের সঙ্গে একাত্মক সমান-হৃদয়তা না থাকলে যুধিষ্ঠির দুঃশলা এবং গান্ধারীর সম্ভাব্য যন্ত্রণাটুকু বুঝতেন না। এমন তো বলাই যেতে পারে যে, যুধিষ্ঠির দ্রৌপদীর কষ্ট কতটুকু বুঝলেন? না হয় শেষ পর্যন্ত বিপন্মুক্ত হয়েছেন তিনি, কিন্তু জয়দ্রথ যখন আপন বলোন্মত্তায় দ্রৌপদীকে জোর করে রথে তুলেছিলেন, তখন যে অনিশ্চয়তা এবং অসহায়তা দ্রৌপদীর মনে কাজ করেছিল, তার পঞ্চস্বামী-প্রিয় হৃদয়ে যে আঘাত লেগেছিল, তাঁর কতটুকু অনুভব করতে পেরেছেন যুধিষ্ঠির। এখনকার দিনে যে স্ত্রী-স্বাধীনতা-কামিনী দৃষ্টি, তাতেও তো সেই প্রশ্নটাই আসে এবং এই প্রশ্ন যে আসতে পারে, তা কিন্তু মহাভারতের বৃদ্ধ কবিও তাঁর অভিজ্ঞতায় জানেন। কেন না যুধিষ্ঠির যখন ভগিনী দুঃশলা এবং জননী গান্ধারীর কথা মনে রেখে জয়দ্রথের জীবন বাঁচিয়ে রাখার অনুরোধ করছেন ভীমকে, তখন যুধিষ্ঠিরের মুখের ওপরেই কিন্তু ভীম এবং অর্জুনের উদ্দেশে দ্রৌপদী চেঁচিয়ে বলেছেন— যদি তোমরা আমার ভাল লাগার জন্য কিছু করতে চাও তবে সেই নরাধম জয়দ্রথকে এক্কেবারে মেরে ফেলবে, এক্কেবারে মেরে ফেলবে— কর্তব্যং চেৎ প্রিয়ং মহ্যং বধ্যঃ স পুরুষাধমঃ।

আপনারা যদি মহাকাব্যের বিশাল-বিশদ পটভূমি বোঝেন, যদি মহাকাব্যের কবির ধীর-গম্ভীর হৃদয়টুকু বোঝেন, তা হলে দেখবেন— এই মুহূর্তে এবং আধুনিক রোম্যান্টিক দৃষ্টিতে দ্রৌপদীর আর্ত অনুরোধ রক্ষা করাটা যতই সযৌক্তিক মনে হোক, তবু যুধিষ্ঠিরের সার্বত্রিকী ভাবনাটাই মহাভারতের সাবমাঙ্গলিক ধর্মবোধের সঙ্গে মেলে। যুধিষ্ঠির দ্রৌপদীর অপমানের জন্য যতখানি ক্ষুব্ধ, সেই ক্ষুব্ধতার মধ্যেও তিনি জ্ঞাতিভগিনী দুঃশলার সিন্দুরবিহীন সীমন্তের কথা স্মরণ করতে পারেন, সেই ক্ষব্ধতার মধ্যেও মনে রাখতে পারেন জননী গান্ধারীর করুণ হৃদয়, যা বিধবা কন্যার দুঃখে বিদীর্ণ হয়ে যাবে। দ্রৌপদীর ওপর যে অন্যায় আচরণ করেছেন জয়দ্ৰথ, তার জন্য শাস্তি চান যুধিষ্ঠির। তিনি চান— জয়দ্রথের উচিত শিক্ষা হোক, কিন্তু জয়দ্রথের জীবন, যা তিনি কিংবা অন্য কেউ দিতে পারেননি, সেই জীবন নিয়ে নিলে আরও দুটি জীবনের জিয়ন্তে মরণ ঘটবে— এতটা শাস্তি তিনি চান না। বিশেষত দ্রৌপদীকে ফিরে পাওয়া গেছে, তিনি হৃতা হলেও শেষ পর্যন্ত ধর্ষিতা হননি— নিয়তির এই আনুকূল্যটুকু মেনে নিয়েই যুধিষ্ঠিরের বিশাল ব্যাপ্ত মহাকাব্যিক হৃদয় সার্বিক কল্যাণের জন্য করুণায় দীর্ণ হয়। রোম্যান্টিক সংকোচনের বিপরীতে এই যে মহাকাব্যিক উদার উন্মোচন— এটাই মহাভারতের ব্যাপ্ত দৃষ্টি, যা আধুনিক ভিক্টোরিয়ান রোম্যান্টিকতায় শুধু পত্নী বা প্রেমিকার জন্যই শৌর্যদীপ্ত হয় না, বরঞ্চ তা অন্যতর এক সার্বত্রিকী আত্মীয়তায় দীপ্র হয়— তাঁকে অতিক্রম করা যায় না।

দ্রৌপদী বলেছিলেন— যদি আমার প্রিয় কাজ করতে হয়, তবে মহামতি যুধিষ্ঠির নয়, আমার কথাই মনে রেখো, জয়দ্রথকে মেরেই ফেলো। কেন না, যে নরাধম অন্যের স্ত্রীকে হরণ করে, যে লোক রাজ্যাপহারী, আমাদের শত্রু, সে যদি যুদ্ধে মুক্তি-প্রার্থনাও করে, তবু তাকে মুক্ত করা উচিত নয়— ভার্যাপহর্তা যো বৈরী যশ্চ রাজ্যহরো রিপুঃ। দ্রৌপদী শুধুমাত্র নিজের অপমানের কথা বলেই ক্ষান্ত হননি, তিনি বুঝিয়ে দিয়েছেন যে, জয়দ্রথ দুর্যোধনের অনুগামী— সে পাণ্ডবভার্ষাকে হরণ করে রাজ্যাপহারী দুর্যোধনের অভীষ্টসাধন করেছে। অতএব কোনও দিক থেকেই তাঁর বেঁচে ফেরার যৌক্তিকতা নেই, এখন বিপন্ন হয়ে আকুল প্রার্থনা জানালেও তাকে ছেড়ে দেওয়া উচিত নয়— যাচমানো’পি সংগ্রামে ন মোক্তব্যঃ কথঞ্চন। দ্রৌপদীর এই তীব্র প্রতিশোধ-যুক্তি দুটি ভয়ংকর লোকের কানে পৌছল— একজন ভীম— দ্রৌপদীর নিজের ভাবনায় যিনি শত্রুতা ভোলেন না কখনও। আর একজন হলেন অর্জুন– দ্রৌপদীর নিজস্ব পরিচয়ে যিনি যুধিষ্ঠিরের ভাই যতখানি, ঠিক ততখানিই তিনি যুধিষ্ঠিরের শিষ্য। সবচেয়ে বড় কথা তিনি কখনও ইচ্ছা হয়েছে বলেই অথবা রাগ হয়েছে বলেই অথবা ভীত হয়ে আত্মরক্ষা করতে হবে বলেই নৃশংস কাজ করেন না–যো বৈ ন কামান্ন ভয়ান্ন কোপাত্/ ত্যজেদ্ধর্মং ন নৃশংস্যঞ্চ কুৰ্য্যাৎ। অথচ ভীম তা করতে পারেন, ইচ্ছে হলে, ভয় হলে কিংবা ক্রোধ হলে ভীম যা কিছু করে ফেলতে পারেন। তার মানে জয়দ্রথকে ধরবার জন্য যে দু’জন মহাবীর রওনা হলেন তাঁদের একজন যদিবা দ্রৌপদীর কথায় জয়দ্রথের ওপর প্রতিহিংসা চরিতার্থ করেনও, সেখানে যুধিষ্ঠিরের ভাই তথা শিষ্যও রইলেন সাবমাঙ্গলিক ওদার্য সাধন করার জন্য। হিংস্র রাজনীতির ‘কনট্রোল এলিমেন্ট’ হিসেবে ভীমের সঙ্গে রইলেন অর্জুন। ভীম এবং অর্জুন রওনা হলেন সেই দিকে যেদিকে জয়দ্রথ গেছেন আর দ্রৌপদী এবং ধৌম্যকে নিয়ে যুধিষ্ঠির ফিরে এলেন অরণ্য-আশ্রমে।

অপরিচিত বন্যপথে বৃক্ষ-লতা দলিত করে জয়দ্রথ ততক্ষণে এক ক্রোশ পথ চলে গিয়েছেন। ভীম এবং অর্জুন সেইরকমই একটা খবর পেলেন অরণ্য-প্রান্তিক বিরলচারী মানুষের কাছে ভীমার্জুনাবপি শ্রুত্বা ক্রোশমাত্রগতং রিপুম্‌। তাঁরা বুঝলেন— রথের থেকে ঘোড়া অনেক বেশি কার্যকরী হবে, অতএব দু’জনে দুটি ঘোড়া নিয়ে জয়দ্রথের গতিপথ অনুরসণ করলেন। অনেক দূর থেকে জয়দ্রথকে দেখতে পেয়েই অর্জুন একটা অদ্ভুত কাজ করলেন। মহাভারতের কবি লিখেছেন— অর্জুন স্বর্গীয় দিব্য অস্ত্রের প্রয়োগ জানতেন, অতএব মন্ত্রের দ্বারা অস্ত্রকে অভিমন্ত্রিত করে তিনি দূর থেকেই জয়দ্রথের অশ্বগুলিকে মেরে ফেললেন। আমরা লৌকিক দৃষ্টিতেও এই অশ্ববধের সমাধান পাই। আমরা অস্ত্রশিক্ষার সময় দেখেছি— সচল বস্তুর ওপর অস্ত্রপ্রয়োগ, এমনকী শব্দমাত্র শুনে তার ওপরে অস্ত্রপ্রয়োগ করে সার্থকতা লাভ করার ব্যাপারে অর্জুন ছিলেন অদ্বিতীয়। অতএব ঘোড়ার পিঠে চলতে চলতেই বহু দূর থেকে বাণ ছুড়ে অর্জুন জয়দ্রথের রথবাহী অশ্বগুলিকে মেরে ফেললেন— ক্রোশমাত্রগতান্ অশ্বান্ সৈন্ধবস্য জঘান তৎ।

অশ্বগুলি মারা পড়তেই জয়দ্রথ প্রচণ্ড ভয় পেয়ে গেলেন। এবার তাঁকে হেঁটে পালাতে হবে, কারণ ভীম এবং অর্জুন তাঁকে তাড়া করছেন ঘোড়ায় চড়ে এবং তাঁরা তাঁকে দেখতে পেয়েছেন। জয়দ্রথ পালাতে লাগলেন এবং তীব্রবেগে তাঁকে পালাতে দেখে পরিশীলিত রাজশক্তির প্রতীক অর্জুন ক্ষত্রিয় ধর্মের উদাহরণ দিয়ে জয়দ্রথের উদ্দেশে বললেন— হ্যাঁ হে রাজার ছেলে! তুই এই শক্তি নিয়ে পরের বউকে নিয়ে পালানোর চেষ্টা করেছিলি— অনেন বীর্যেন কথং স্ক্রিয়ং প্রার্থয়সে বলাৎ— তুই নিজের অনুচরদের শত্রুর মাঝখানে ছেড়ে দিয়ে পালাচ্ছিস, এটা কেমন কথা! তুই ফিরে আয়, পালাচ্ছিস কেন? জয়দ্রথ আর ফেরেন? তিনি তখন প্রাণভয়ে দৌড়োচ্ছেন বনের গাছ-গাছড়া মাড়িয়ে। এ-রকম একটা অবস্থায় দোষী এবং অপরাধীর সঙ্গে যে পরিশীলিত ক্ষত্রিয় ধর্মের কথা বলে কোনও লাভ নেই, সেটা সবচেয়ে ভাল বোঝেন ভীম। অতএব কাল বিলম্ব না করে তিনি জয়দ্রথকে বললেন— দাঁড়া ব্যাটা। দাঁড়া, আমি আসছি। এই বলেই তিনি ঘোড়া ছুটিয়ে দিলেন তাঁর দিকে— তিষ্ঠ তিষ্ঠেতি তং ভীমঃ সহসাভ্যদ্রবদ্ বলী। মধ্যম পাণ্ডব ক্রোধী ভীমসেনের এই তেড়ে যাবার অর্থ যে কী, তা অৰ্জুন ভালমতোই জানেন। জয়দ্রথের শেষ ভয়ংকরতম পরিণতির কথা স্মরণ করেই অর্জুন শুধু দাদা যুধিষ্ঠিরের সতর্কবাণী উচ্চারণ করলেন ভীমের উদ্দেশে। তিনি ভীমের চেয়ে বয়সে ছোট হওয়া সত্ত্বেও রাজনৈতিক পরিশীলনের চরম আদেশ উচ্চারণ করলেন— জয়দ্রথকে একেবারে মেরে ফেলো না যেন— মা বধীরিতি পার্থস্তং দয়াবান্ প্রত্যভাষত।

প্রাণের ভয়ে হতাশ জয়দ্রথ পালাচ্ছেন তখনও, ভীম এবার তাঁর কাছাকাছি এসে ঘোড়া থেকে নেমেই দৌড়ে এসে জয়দ্রথের চুলের মুঠি ধরে ফেললেন পিছন থেকে— অভিদ্রুত্য নিজগ্রাহ কেশপক্ষে হ্যমৰ্ষণঃ। তারপর তাঁকে পাঁজাকোলা করে তুলে নিয়েই মাটিতে আছাড় দিয়ে ফেললেন ভীমসেন, জয়দ্রথের ওপরে উঠে তাঁকে মাটিতে পিষতে পিষতে তাঁর মাথাটা বার কয়েক ঠুকে দিলেন মাটিতে— শিরো গৃহীত্বা রাজানং নিষ্পিপেষ মহীতলে। যুধিষ্ঠির এবং অর্জুন, দু’জনেরই উপর্যুপরি সাবধানবাণী থাকায় ভীম এটা বুঝে গিয়েছিলেন যে জয়দ্রথকে প্রাণে মেরে ফেলাটা যাবে না। অথচ অপরাধীকে যদি চরম শাস্তি দিতে হয় তবে তাকে প্রায় আধমরা করে ফেলাটা নিতান্তই প্রয়োজন এই যুক্তিতেই ভীম তাঁকে মারতে আরম্ভ করলেন হিন্দি চলচ্চিত্রের নায়কের মতো— ‘ভিলেইন’কে যিনি শেষ মার মারছেন। জয়দ্রথ মার খেয়ে একটু নির্জীব গোছের হয়ে পড়ে থেকেই আবার উঠতে যাচ্ছিলেন— পুনঃ সঞ্জীবমানস্য তস্যোৎপতিতুমিচ্ছতঃ— ঠিক এই অবস্থাতেই ভীম তাঁর মাথায় লাথি কষালেন। তারপর আবার চিত হয়ে পড়া জয়দ্রথের বুকের ওপর উঠে পর পর মুষ্টির আঘাত— জয়দ্রথ প্রায় অজ্ঞান হয়ে পড়লেন। এই সময়ে আবারও অর্জুনের মুখে উচ্চারিত হল সেই সাবধানবাণী— জয়দ্রথকে প্রাণে মেরে ফেলো না দাদা, ভগিনী দুঃশলার কথা স্মরণে রাখতে বলেছেন যুধিষ্ঠির— দুঃশলায়াঃ কৃতে রাজা যত্তদাহেতি কৌরবঃ।

এমনিতেই ক্রোধী এবং হিংসাপরায়ণ ব্যক্তি যখন প্রতিশোধের সুযোগ পায়, তখন তাকে ধরে রাখা যায় না, তাকে আটকে রাখলেও আটকে থাকতে চায় না। সেখানে ভীম— তাঁকে অবশ্য কোনও মতেই হিংসাপরায়ণ বলতে পারি না— কিন্তু তিনি অসীম শক্তিধর মহাবীর বটে এবং তাঁকে যদি ক্রোধের চরম সীমায় নিয়ে যাওয়া যায় তবে তাঁর প্রতিশোধবৃত্তিও এমন চরম হয়ে ওঠে যে, তাঁকে নিবৃত্ত করা কঠিন হয়ে পড়ে। এমনকী নিবারণ করতে গেলে নিবারক ভাল মানুষটির ওপরেই তখন তাঁর রাগ হয়ে যায়, ঠিক যেমন একটা সাধারণ মারামারির ক্ষেত্রেও ক্রোধী পুরুষকে আটকাতে গেলে তার ধাক্কা ঝাপটা এবং নিবৃত্ত না হবার প্রতিক্রিয়া, পার্শ্বক্রিয়া নিবারণকারীর ওপরেই এসে পড়ে। ভীমকে দ্বিতীয়বার যুধিষ্ঠিরের সাবধান-শব্দ শোনানোর পর অর্জুনের উদ্দেশেই তাই ভীমের গর্জন শুরু হল। বললেন— এই বদমাশ জয়দ্রথ যখন আমার হাতে পড়েছে, তখন আর তার বাঁচার আশা নেই। ভাবতে পারো— কৃষ্ণা দ্রৌপদীকে আমাদের স্ত্রী হয়ে এই ধরনের বদমায়েশি সহ্য করতে হয়েছে, তাঁকে এই নরাধম বিরক্ত করেছে এইভাবে— কৃষ্ণায়া স্তদনর্হায়াঃ পরিক্লেষ্টা নরাধমঃ— না, আমি একে কিছুতেই ছাড়ব না।

ক্রোধাবেশ ঘটলে ভীমের কী রূপ হয় অভিজ্ঞ অর্জুন জানেন, আবার দাদা যুধিষ্ঠিরের সেই অনতিক্রম্য আদেশ— যা অতিক্রমও করা যায় না অথচ সহ্যও করা যায় না— এই অবস্থায় ভীম যে তাঁরই ওপরে ঝাল ঝেড়ে যুধিষ্ঠিরের সম্মানটুকু রাখবেন— তাও অর্জুন জানেন। অতএব যে জয়দ্রথকে দ্রৌপদীর জন্য মেরেই ফেলতে চাইছিলেন ভীম, তিনি খানিকটা সংবৃত হয়ে অর্জুনকে বললেন— কীই বা করতে পারি আমি, রাজা যুধিষ্ঠির! তাঁর তো দয়ার শরীর। তিনি এই বদমাশকে হাতে পেয়েও বাঁচার ব্যবস্থা করে রেখেছেন— কিন্নু শক্যং ময়া কর্তুং যদ্‌রাজা সততং ঘৃণী— আর তিনি যা বলেছেন, বলতে দাও। তাঁর দয়ার শরীর, আপন ভার্যাপহারীকেও তিনি না হয় ক্ষমা করলেন। কিন্তু অর্জুন! তুমিও তো একটি গণ্ডমূর্খ, অপরাধীকে শাস্তি দেবার মুহূর্তে তুমিও তো বারবার আমাকে নিবৃত্ত করছ— ত্বঞ্চ বালিশয়া বুদ্ধ্যা সদৈবাস্মান্ প্রবাসে।

ভীম যতই তর্জন-গর্জন করুন, দাদা যুধিষ্ঠিরের আদেশ এবং অর্জুনের গম্ভীর নিবারণ শব্দ— এর কোনওটাই অতিক্রম করবার ক্ষমতা ভীমের ছিল না। কিন্তু নিজের রাগটাও তেমন প্রশমিত না হওয়ায় ভীম ঠিক করলেন— এমন একটা কিছু করা দরকার যাতে ধর্মরাজ যুধিষ্ঠিরের সর্বকল্যাণী ইচ্ছাটুকুও বজায় থাকে আবার জয়দ্রথের কাছেও সেটা এমন অপমান-জনক হবে, যা একেবারে মৃত্যুর মতো লাগে, কেন না দ্রৌপদী এই পাপিষ্ঠের চরম শাস্তি চেয়েছিলেন মৃত্যু। জয়দ্রথকে ধরতে যাবার আগে দ্রৌপদী যেভাবে তাঁর জ্যেষ্ঠ স্বামী যুধিষ্ঠিরের কথা অতিক্রম করেও তাঁর নারীত্বের সম্মানটুকু প্রার্থনা করেছিলেন তাঁর বীর স্বামীদের কাছেই, তাতে মৃত্যুই হয়তো সঠিক শাস্তি ছিল। একজন বিবাহিতা স্ত্রী হিসেবে দ্রৌপদীর এই প্রার্থনা অমূলক নয়, কেন না তাঁকে অনেকক্ষণ ধরে নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে এক চরম অভীষ্ট পুরুষের অর্ধেক বলাৎকার সইতে হয়েছে। জয়দ্রথের দিক থেকে ভবিষ্যৎ-ধর্ষণের সমস্ত ইঙ্গিতই ছিল এবং দ্রৌপদীর স্বামীরা আকস্মিকভাবে উদয় না হলে হয়তো তাই ঘটত। সেখানে ভীমের প্রতিশোধ-স্পৃহা যথেষ্টই যুক্তিযুক্ত।

যুধিষ্ঠির এবং অর্জুন— দু’জনের অ্যাটিচুড ব্যাখ্যা করলেই বোঝা যায়— আত্মসর্বস্ব প্রেম নয়, এরা ত্যাগ করে ভোগ করতে জানেন, যে ভোগের মধ্যে অন্যের জন্যেও চিন্তা আছে। এখানেও যে যুধিষ্ঠির এবং অর্জুন জয়দ্রথের প্রাণটুকুর রাখার পক্ষে দাঁড়িয়ে আছেন, তার প্রথম কারণ যদি হয় দ্রৌপদীকে অধর্ষিতা অবস্থায় পাওয়া গেছে, তার দ্বিতীয় কারণ অবশ্যই সেই ব্যাপ্ত বিশাল হৃদয় যেখানে প্রিয়া পত্নী ছাড়াও অন্যতরা এক পত্নীর সীমন্ত-সিন্দুর দেদীপ্যমান হয়ে ওঠে। এরই বিপরীতে ভীমকে দেখুন, তিনি ত্যাগী পুরুষ নন, দ্রৌপদীর এক পঞ্চমাংশ পতিত্বই তাঁকে সেই সর্বগ্রাসী প্রেম দিয়েছে, যাতে দ্রৌপদীর অপমান তিনি কিছুতেই সহ্য করবেন না। যুধিষ্ঠির এবং অর্জুনের কথায় তিনি থেমেছেন বটে, তবে দুঃশলা-টুঃশলা তাঁর মাথায় নেই, তিনি শুধু দ্রৌপদীর কথার মূল্য দিতে চাইছেন। একেবারে মেরে না ফেলেও তাঁর চরম শাস্তির উপায় বার করলেন ভীম।

হাজার হলেও জয়দ্রথ রাজার ছেলে। মৃত্যু ছাড়াও তাঁর চরম শাস্তি হল তাঁর ক্ষত্রিয় ধর্মের অপমান। ভীম জয়দ্রথের মাথার সুবিন্যস্ত কেশরাশির মধ্যে অর্ধচন্দ্র বাণের ধারালো প্রান্ত দিয়ে পাঁচ জায়গায় চেঁছে দিয়ে অবশিষ্ট চুলগুলি জটা পাকিয়ে দিলেন— এবমুক্ত সটাস্তস্য পঞ্চ চক্রে বৃকোদরঃ– জয়দ্রথ নীরবে মাথা নিচু করে রইলেন। এবারে ভীম জয়দ্রথকে বললেন— যদি বাঁচতে চাস ব্যাটা! তবে কড়ার করতে হবে তোকে। এর পর তুই যেখানে যাবি— সেটা ভদ্রলোকের সভাতেই হোক অথবা সাধারণ লোকসমাজেই হোক, সব জায়গাতেই যখন লোকে বলবে— তোর মাথার পাঁচ জায়গায় এমন চেঁছে দিয়েছে কে, তখন বলবি— আমি পাণ্ডবদের দাস— ওঁরাই আমাকে এই চিহ্ন করে দিয়েছেন— দাসোহস্মীতি সদা বাচ্যং সংসৎসু চ সভাসু চ। শর্ত দিয়েই ভীম জয়দ্রথকে ধরে হেঁচড়ে নিয়ে চললেন— তাঁর রাগের ঝাল শুধু কথায় অথবা শর্তে মেটে না। জয়দ্রথ অবশ্য তখন প্রাণের ভয়ে ভীমের কথা মেনে নিয়ে বললেন— যা বলছেন, আমি তাই করব।

তবু এই আধমরা জয়দ্রথকে বিশ্বাস করলেন না ভীম, তাঁকে ছেড়েও দিলেন না। পর্যুদস্ত ধরা পড়ে যাওয়া অপরাধীকে সবার সামনে নিয়ে গিয়ে অপমান না করলে শক্তিধরের মনের জ্বালা শান্ত হয় না। ধূলিধূসর জয়দ্রথের উঠবার শক্তি না থাকলেও ভীম তাঁকে বেঁধে নিয়ে রথের ওপর চাপালেন জড় পিণ্ডের মতো— রথমারোপয়ামাস বিসংজ্ঞং পাংশুগুণ্ঠিতম। অর্জুন সামনে সামনে চলতে লাগলেন রথ নিয়ে, পিছন পিছন প্রায়-সংজ্ঞাহীন জয়দ্রথকে নিয়ে যুধিষ্ঠিরের অরণ্য আশ্রমের দিকে চললেন ভীম। আশ্রমে পৌঁছতে সময় বেশি লাগল না এবং যুধিষ্ঠিরের সামনে এসে রজ্জুবদ্ধ জয়দ্রথকে দেখিয়ে সদর্পে দাঁড়ালেন ভীম। দ্রৌপদীও দাঁড়িয়ে ছিলেন কাছাকাছি, কিন্তু তাঁর দিকে ভীম কোনও পুলকিত দৃষ্টিপাত করেছিলেন কিনা— মহাভারতের কবি তা স্বকণ্ঠে বলেননি।

রথের ওপর এমন আবদ্ধ অবস্থায় অর্ধমৃত জয়দ্রথকে দেখে যুধিষ্ঠির মনে মনে বেশ খানিকটা হেসে নিলেন। মনে মনে হাসলেন এইজন্য যে, প্রথমত যুধিষ্ঠির এখনও তাঁর গম্ভীরতা ভেঙে ভীমের কাছে অত সহজ হতে চান না। কেন না তাঁর কাজ এখনও বাকি আছে। দ্বিতীয়ত, মনে মনে হাসলেন ভীমের কাজ দেখে— তিনি মেরে ফেলতে না করেছেন, অতএব ভীম জয়দ্রথের প্রাণটুকুই শুধু অবশিষ্ট রেখেছেন এবং যে-মানুষ মার খেয়ে নড়তে চড়তে পারছে না, তাঁকে আবার বেঁধে আনায় যুধিষ্ঠির একটু মজাই পেয়েছেন। জয়দ্রথের এতখানি মার খাওয়াটা যুধিষ্ঠিরের অনভীষ্ট নয় এতটুকু, কেন না কৃতকার্যের জন্য এই আঘাত জয়দ্রথের প্রাপ্য বলেই এখনও যুধিষ্ঠির মনে মনে হাসতে পারছেন। যাই হোক, জয়দ্রথকে এক নজরে খানিকক্ষণ দেখেই মনে মনে হাসতে যতটুকু সময় গম্ভীর থাকতে হয় ততটুকু দেখিয়েই যুধিষ্ঠির ভীমকে বললেন— এবার এঁকে ছেড়ে দাও ভাই— তং রাজা প্ৰাহসদ্ দৃষ্ট্বা মুচ্যতামিতি চাব্রবীৎ— আর নয়, ছেড়ে দাও এঁকে।

মুহূর্তের মধ্যে ভেসে এল সেই অতিক্রান্ত শব্দের উচ্চারণ, যা একমাত্র ভীমই করতে পারেন যুধিষ্ঠিরের কাছে অথবা পারেন দ্রৌপদী, যুধিষ্ঠিরের স্ত্রী হবার সুবাদে। ভীম যুধিষ্ঠিরের কথা কানেই নিলেন না, যুধিষ্ঠিরকে তিনি বুঝিয়ে দিলেন যে, জয়দ্রথকে ধরা-মারা অথবা ছেড়ে দেবার ব্যাপারে তিনি কেউ নন, এ-ব্যাপারে কথা বলার-অধিকার একমাত্র সেই নারীর, যাঁর নারীত্বের অবমাননা করেছেন জয়দ্রথ। ভীম পরিষ্কার বলে দিলেন— আপনি নন, জয়দ্রথকে কী করব না-করব, সে ব্যাপারে যা বলার দ্রৌপদীই বলুন, আপনি তাঁকে জিজ্ঞাসা করুন— রাজানং চাব্রবীদ্ ভীমো দ্রৌপদ্যাঃ কথ্যতামিতি। মহাবলী ভীমসেন ঠিক আমাদের লৌকিক দৃষ্টিতে ভাবছেন, ঠিক আমরা যেভাবে ভাবি— স্ত্রীর অপমান, পরিবারের অপমান, ব্যক্তিস্বাতন্ত্র— সব আমরা যেভাবে ভাবি। এখানে সেই লৌকিক সংকোচনটুকু আছে; আছে। সেই স্বতন্ত্রতা— ভীম মনে করেন— যার কাছে অন্যায় হয়েছে, ক্ষমা পেতে গেলে তাঁরই অনুমতি লাগবে।

কিন্তু এই মুহূর্তে ভীম যখন যুধিষ্ঠিরকে অতিক্রম করে দ্রৌপদীর সম্মান রাখতে চাইছেন, তখনও যুধিষ্ঠির দ্রৌপদীর দায়িত্ব গ্রহণ করে বোঝাতে চাইছেন যে, দ্রৌপদীর সম্মান নিয়ে তিনি কম চিন্তিত নন, তবুও সামগ্রিক পরিস্থিতির বিচার করলে আরও কিছু ভাবার আছে। যুধিষ্ঠির তাঁর সমস্ত ব্যক্তিত্ব সমাহৃত করে ভীমকে বললেন— আমাদের কথা যদি তোমার গ্রাহ্য বলে মনে হয়, তবে এই অধম পাপিষ্ঠকে ছেড়ে দাও— মুঞ্চেমম্ অধমাচারং প্রমাণা যদি তে বয়ম্।

প্রায় আদেশের মতো যুধিষ্ঠিরের এই ধীর-গম্ভীর নির্দেশনার মধ্যে এমন কিছু বৃহত্ত্বের ভাবনা নিহিত ছিল, যা দ্রৌপদীর পক্ষে অতিক্রম করা সম্ভব ছিল না। বিশেষত যুধিষ্ঠিরের মতো বিশাল ব্যক্তিত্বকে অতিক্রম করে ভীম যখন জয়দ্রথের মুক্তির ব্যাপারে দ্রৌপদীর মত চাইছেন, তখন দ্রৌপদী একটু বিব্রতই হলেন এবং সব বুঝে তিনি যুধিষ্ঠিরের দিকে তাকিয়ে থেকে ভীমের উদ্দেশে বললেন— আপনি এই লোকটার মাথায় পাঁচ জায়গায় ক্ষুর দিয়ে চেঁছে দিয়েছেন এবং এ যখন পাণ্ডবদের দাস, অতএব এই জয়দ্রথকে মুক্তি দিয়ে দিন— দাসোহয়ং মুচ্যতাং রাজ্ঞ স্তয়া পঞ্চসটঃ কৃতঃ।

ভীম এবার জয়দ্রথের গায়ের বাঁধন খুলে দিলেন, জয়দ্রথ মুক্ত হয়ে রাজা যুধিষ্ঠিরকে অভিবাদন করলেন এবং অভিবাদন করলেন আশ্রমে উপস্থিত মুনিদের— তাঁদের সামনে জয়দ্রথের দাড়াতে লজ্জা করছিল। জয়দ্রথকে এমন বিব্রত দেখে অর্জুন তাঁর হাত ধরলেন। পরিবেশ অনেকটাই অনুকূল দেখে যুধিষ্ঠির জয়দ্রথকে বললেন— তুমি একেবারে অধম মনের মানুষ। মন কতটা ছোট হলে এমন করে স্ত্রীলোক ধরবার আশায় তুমি ঘুরে বেড়াও। তাও যদি তেমন রাজ্যপাটের শক্তি থাকত, অনেক সহায় থাকত তোমার— তোমাকে ধিক্— স্ত্রীকামঞ্চ ধিগস্তু ত্বাং ক্ষুদ্রঃ ক্ষুদ্র-সহায়বান্। তোমার মতো নরাধম না হলে এত নিকট আত্মীয়ের স্ত্রীকে কেউ এইভাবে হরণ করে?

যুধিষ্ঠিরের সব কথা জয়দ্রথের কানে ঢুকছিল না। ভীমের হাতে মার খেয়ে তাঁর তখন এমন অবস্থা যে, চলাফেরাও করতে পারছেন না ভাল করে। শরীর প্রায় সংজ্ঞাহীন, কোনও মতে প্রাণ বয়ে নিয়ে চলেছেন। দয়ালু যুধিষ্ঠির জয়দ্রথকে বললেন— যাও তুমি, দাসত্ব থেকে মুক্ত হয়েই যাও; আমরা আত্মীয় এবং স্বজন ব্যক্তিকে দাসভাবে দেখতে চাই না, তবে এটাও মনে রেখো— কোনও দিন এমন কাজ আর করতে যেয়ো না— অদাসো গচ্ছ মুক্তোহসি মৈবং কার্ষীঃ পুনঃ ক্কচিৎ— তোমার ধর্মবুদ্ধি জাগ্রত হোক এবং তোমার অশ্ব-রথ-পদাতি যা অবশিষ্ট আছে, সেগুলো নিয়েই তুমি স্বস্তিমতো বাড়ি ফিরে যাও— সাশ্বঃ সরথপাদাতঃ স্বস্তি গচ্ছ জয়দ্ৰথ।

দাসত্ব থেকে মুক্তি পাবার পর জয়দ্রথের মনে কতটা জ্বালা হতে পারে আমরা অনুমান করতে পারি। ইনি তো এমন মানুষ নন যে, ক্ষণিকের ভুলে পরস্ত্রী হরণ করতে বেরিয়েছিলেন। যে মানুষ পূর্বে পরিকল্পনা করে বিবাহ করতে যাবার পথে অধিকতর রূপ-গুণ-ব্যক্তিত্ব দেখে পরস্ত্রী-হরণে ব্যবসিত হন, যিনি দুর্যোধনের মতো ব্যক্তিত্বের প্রীতি-সাধনের জন্য ব্যক্তিগত শত্রুতাহীন মানুষের স্ত্রীকে হরণ করতে চেয়েছিলেন, তিনি ভীমের মতো লোকের কাছে মার খেয়ে মৃতপ্রায় হলেও আপন অপরাধবোধে ভূলুণ্ঠিত হন না, বরঞ্চ তিনি আরও প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে ওঠেন। যুধিষ্ঠির তথা অন্যান্য পাণ্ডবদের সামনে জয়দ্রথ যতই লজ্জিতভাব দেখিয়ে অবনতমস্তকে বিদায় নিয়ে থাকুন, সেই মুহূর্তে অশ্ব-রথ-পদাতি সঙ্গে নিয়ে তিনি নিজের দেশে ফিরে গেলেন না। মনের দুঃখে এবং অপমানে সৈন্য-সামন্ত সব সিন্ধু-সৌবীরে পাঠিয়ে দিয়ে গঙ্গাদ্বারের কাছে চলে এলেন— জগাম রাজা দুঃখার্তো গঙ্গাদ্বারায় ভারত।

মহাভারত জানিয়েছে— জয়দ্রথ গঙ্গাদ্বারে এসে উমাপতি মহাদেবকে তুষ্ট করার জন্য কঠিন তপস্যা আরম্ভ করেন। তপস্যায় পরিতুষ্ট মহাদেব নিজেই এসে জয়দ্রথের পূজার উপচার গ্রহণ করেন এবং তাঁকে বর দিতে চান। জয়দ্রথ তখন বর চান— আমি যেন যুদ্ধে রথারোহী পাণ্ডব-ভাইদের সবাইকেই জয় করতে পারি— সমস্তান্ সরথান্ পঞ্চ জয়েয়ং যুধি পাণ্ডবান্। যত সন্তুষ্টই হয়ে থাকুন, মহাদেব সঙ্গে সঙ্গে সপাটে বললেন— না, তা হবে না— নেতি দেবস্তমব্রবীৎ। তিনি বললেন— মহাবাহু অর্জন ছাড়া আর সমস্ত পাণ্ডবদেরই তুমি যুদ্ধে আটকে দিতে পারবে, কিন্তু তাঁদের জয়ও করতে পারবে না, বধও করতে পারবে না— অজয্যাংশ্চাপ্যবধ্যাংশ্চ বারয়িষ্যসি তান্ যুধি। এই আদেশের পর মহাদেবের মুখে ভগবন্নারায়ণের অবতার স্বরূপগুলি বর্ণিত হয়েছে এবং কৃষ্ণ তথা অর্জুনের অলৌকিক মাহাত্ম্য স্থাপন করার সঙ্গে সঙ্গে মহাদেব তাঁর বরদানের পরিসর আর একটু বাড়িয়ে দিয়ে বলেছেন— তুমি অর্জুন ছাড়া আর সমস্ত পাণ্ডবদের একদিন-মাত্র জয় করতে পারবে— চতুরঃ পাণ্ডবান রাজন্ দিনৈকং জেষ্যসে রিপূন্।

মহাদেবের এই বরদানের ঘটনাটি মহাভারতের কবির অপূর্ব-নির্মাণক্ষমত্বের নিরিখে নিতান্ত লৌকিকভাবেই ব্যাখ্যা করা যায় কিনা, তা পরে দেখাব, আপাতত আমাদের খেয়াল রাখতে হবে যে, দ্রৌপদীর সঙ্গে জয়দ্রথের এই জঘন্য ঘটনার পর কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের পূর্ব পর্যন্ত আমরা তাঁর কোনও সংবাদই আর পাই না। একেবারে যুদ্ধের উদ্যোগপর্বে দুর্যোধন যখন ভীষ্মের সঙ্গে বসে নিজেদের যুদ্ধশক্তির পরিমাপ করছেন, তখন ভীষ্ম জয়দ্রথের শক্তিমত্তা প্রকাশ করে বলেছিলেন— সিন্ধুরাজ জয়দ্রথ আমার মতে দ্বিগুণ রথ। তিনি তোমার হয়ে অনেক যুদ্ধ করবেন। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য— রথ, অতিরথ, মহারথ— এগুলি যুদ্ধশক্তির তারতম্যভেদে বড় বড় যুদ্ধনায়কের সাধারণ সংজ্ঞা। এই নিরিখে ‘দ্বিগুণ রথ’ খুব হীনশক্তির যুদ্ধনায়ক নন। তবে এই যুদ্ধশক্তির সংজ্ঞা যে আক্ষরিক অর্থে যথাযথ নয়, সেটা ভীষ্ম বুঝিয়ে দিয়েছেন দুটি আগন্তুক গুণের কথা বলে। ভীষ্ম বলেছেন— দ্রৌপদীকে হরণ করতে গিয়ে জয়দ্রথ বড্ড হেনস্থা সয়েছিলেন পাণ্ডবদের হাতে, তাঁকে প্রচুর অপমানিত হতে হয়েছিল— দ্রৌপদী হরণে রাজন্ পরিক্লিষ্টশ্চ পাণ্ডবৈঃ। সেই হেনস্থা, সেই চরম অপমান জয়দ্রথ মনে রেখে দিয়েছেন বলেই তিনি সর্বশক্তি প্রয়োগ করে যুদ্ধ করবেন পাণ্ডবদের সঙ্গে— সংস্মরন্তং পরিক্লেশং যোৎস্যন্তে পরবীরহা। হয়তো এই অপমানের অনুগুন থাকার ফলেই জয়দ্রথ ‘দ্বিগুণ রথ’ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছেন ভীষ্মের মুখে। ভীষ্ম অবশ্য জয়দ্রথের শক্তি হিসেবে মহাদেবের বরদানের কথাও উল্লেখ করেছেন, তবে সেটা তো ওই পাণ্ডবদের হাতে অপমানের সঙ্গে জড়িত। অপমানের সংস্মরণ এবং মহাদেবের বরদান দুটোই একাত্মকভাবে জয়দ্রথকে দ্বিগুণ শক্তিতে উপস্থিত করেছে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে, তিনি প্রাণ দিয়ে যুদ্ধ করবেন দুর্যোধনের জন্য— প্রতিহিংসার আগুনে জ্বলতে জ্বলতে— যোৎস্যতে পাণ্ডবৈস্তাত প্রাণাংস্তত্ত্বা সুদুস্ত্যজান্।

দুর্যোধনের পীড়াপীড়িতে ভীষ্ম পাণ্ডবদের বিরুদ্ধে জয়দ্রথের যুদ্ধ করবার মানসিকতা বিবৃত করলেন বটে, কিন্তু যে রমণীর শরীরে জয়দ্রথের কামুক স্পর্শ লেগেছিল তিনিও সম্পূর্ণ ভুলে গিয়েছিলেন জয়দ্রথের কথা, নাকি ভুলে গিয়েছিলেন মধ্যম পাণ্ডব ভীম— যিনি অপরাধীর চরম শাস্তি না হওয়া পর্যন্ত অপরাধীকে ভোলেন না। বারবার এসেছে জয়দ্রথের কামুকতার প্রসঙ্গ, সেই যখন বিরাট-রাজ্যে অজ্ঞাতবাসের সময় কীচক দ্রৌপদীকে পাবার জন্য উপদ্রব করছেন, সেখানে দ্রৌপদী ভীমকেই স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলেন জয়দ্রথের কথা এবং তা স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলেন দুর্যোধনের নানান অত্যাচারের প্রসঙ্গেই। দ্রৌপদী বলেছিলেন— আর কত সইব? রাজসভার মধ্যে দুর্যোধন-দুঃশাসন-কর্ণ মিলে ওইরকম অপমান করল, বনবাসে এসেও তাঁর শান্তি হয়নি, সেখানে জুটল জয়দ্রথ— দ্বিতীয়বার সেই কামুকতার অপমান— বনবাস-গতায়াশ্চ সৈন্ধবেন দুরাত্মনা— এখন আবার এই কীচক। দ্রৌপদী সেই পুরাতন প্রতিশোধ-স্পৃহায় ভীমকে বলেছেন— তুমিই তো সব সময় আমাকে বাঁচিয়েছ, এখনও বাঁচাও এই কীচকের কামুকতার স্পর্শ থেকে যেমন করে আগে তুমি জয়দ্রথকে শাস্তি দিয়েছিলে, তেমন করেই আবারও একে শাস্তি দাও— জয়দ্রথং তথৈব ত্বমজৈর্ষীর্ভ্রাতৃভিঃ সহ। কাজেই সেই মুহূর্তে যুধিষ্ঠির যতই ক্ষমা করে দিন, জয়দ্রথ যদি পাণ্ডবদের ওপর প্রতিশোধ-স্পৃহায় এক অক্ষৌহিণী সৈন্য নিয়ে দুর্যোধনের পক্ষে যোগ দিয়ে থাকেন, তবে সেই প্রতিশোধস্পৃহা পাণ্ডবদেরও আছে। জয়দ্রথ নিজের প্রতিশোধ-স্পৃহায় এবং দুর্যোধনের হিতকামনায় এক অক্ষৌহিণী সৈন্য নিয়ে কৌরবপক্ষে যোগ দিলেন বটে, কিন্তু যুদ্ধের উদ্যোগপর্বে যে-সব যুদ্ধনায়কদের বিরুদ্ধে ভীম কিংবা অর্জুনের চরম আক্রোশ শোনা যাচ্ছে, জয়দ্রথ তাঁদের মধ্যে অন্যতম। অর্থাৎ জয়দ্রথ আগে যে ক্ষমাটুকু পেয়েছিলেন, দুর্যোধনের পক্ষে যোগ দিয়ে তিনি আর সেই ক্ষমার যোগ্য থাকলেন না। প্রতিশোধ-স্পৃহা উদ্দীপিত হয়ে রইল দু’পক্ষেই।

এক অক্ষৌহিণী সেনা নিয়ে জয়দ্রথ কৌরবপক্ষে যোগ দেবার পর দুই পক্ষের বলাবল নিয়ে যত কথা হয়েছে এবং প্রকৃত যুদ্ধও যখন আরম্ভ হয়েছে, তখন বীর হিসেবে জয়দ্রথের কথা উচ্চারিত হয়েছে বারবার। এমনকী কৌরবপক্ষে তাঁকে মহাবীর অর্জুনের বিরুদ্ধে যুদ্ধযোগ্য ব্যক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। ব্যাপারটা একটু বাড়াবাড়ি হলেও পাণ্ডবপক্ষ থেকেও তাঁকে খুব ছোট করে দেখা হয়নি, সাত্যকির মতো মহাবীরকে যখন জয়দ্রথকে সামলানোর দায়িত্বে রাখা হয়েছে, তখন বুঝতেই হবে যুদ্ধবীর্যে জয়দ্রথ খুব নগণ্য মানুষ ছিলেন না।

তবু যুদ্ধক্ষেত্রে এখানে ওখানে পাণ্ডবদের সঙ্গে জয়দ্রথের যুদ্ধ ব্যাপারটাকে আমরা কোনও আমলই দিতে চাই না। যে কারণে জয়দ্রথ বিখ্যাত হয়ে আছেন সেটা হল সেই অন্তিম যুদ্ধ, যেদিন অর্জুন ছাড়া আর সমস্ত পাণ্ডবদের, এমনকী ভীমকেও তিনি যুদ্ধ করে আটকে রেখেছিলেন এবং তাঁদের অগ্রগতি রোধ করে দিয়েছিলেন। সম্পূর্ণ মহাভারতের মধ্যে জয়দ্রথ স্মরণীয় হয়ে আছেন জীবনের এই অন্তিম যুদ্ধটির জন্যই— যে যুদ্ধ একদিকে পাণ্ডবদের চরমতম এক ক্ষতি করেছে অন্য দিকে ডেকে এনেছে জয়দ্রথের আকস্মিক মৃত্যু। ঘটনাটা একটু আগে থেকেই বলতে হবে।

ভীষ্মের শরশয্যার পর দ্রোণাচার্যের সেনাপতিত্বের সময় দুর্যোধনের তাড়না খেয়ে দ্রোণাচার্য সেদিন চক্রব্যূহ রচনা করেছিলেন। সেই চক্রব্যুহের সম্মুখভাগে দাঁড়িয়ে ছিলেন স্বয়ং দ্রোণাচার্য এবং তাঁর পরেই জয়দ্রথ। জয়দ্রথকে খানিক ‘গার্ড’ দিচ্ছিলেন দ্রোণপুত্র অশ্বত্থামা এবং ধৃতরাষ্ট্রের তিরিশটি ছেলে। ‘স্ট্র্যাটিজি’-টাই এইরকম ছিল যে, অর্জুনকে অন্য জায়গায় ভয়ংকর যুদ্ধ করে আটকে রাখা হবে, আর এদিক থেকে দ্রোণাচার্য তাঁর দলবল নিয়ে এমন আক্রমণ শানাবেন যে, পাণ্ডবদের একটা বড় আঘাত পেতেই হবে। যেমন ভাবা গিয়েছিল, তেমনই কাজ হল— দ্রোণাচার্যের সামনে তো সেদিন পাণ্ডবদের কেউ দাঁড়াতেই পারল না, উপরন্তু দ্রোণ তাঁর সম্পূর্ণ সৈন্যব্যূহ নিয়ে এমনভাবে এগোতে লাগলেন যে, যুধিষ্ঠির বুঝলেন— রক্ষণশীল প্রবণতায় অনেক ক্ষতি হয়ে যাবে— তিনি বুঝলেন আক্রমণ করা দরকার— তমায়ান্তম্ অতিক্রুদ্ধং দ্রোণং দৃষ্টা যুধিষ্ঠিরঃ॥ দ্রোণের চক্রব্যূহ ভেদ করা দরকার।

কিন্তু এই ব্যূহ কে ভেদ করবে? তিনি বুঝলেন না যে, অর্জুনকে ‘স্ট্র্যাটিজিক্যালি’ ব্যস্ত রাখা হয়েছে সংশপ্তক বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধ করার জন্য। অর্জুনের অনুপস্থিতিতে যুধিষ্ঠির শেষ পর্যন্ত কুমার অভিমন্যুকে প্রস্তাব দিলেন চক্রব্যূহ ভেদ করার জন্য। কারণ অর্জুন ছাড়া একমাত্র এই বালক-বীরই জানে যে, কীভাবে চক্রব্যূহে প্রবেশ করতে হয়; আর যারা জানেন, তারা হলেন কৃষ্ণ এবং তাঁর ছেলে প্রদ্যুম্ন— তিনি এই যুদ্ধে আসেননি। বালক অভিমন্যু পিতাকল্প যুধিষ্ঠিরের ইচ্ছা মান্য করে চক্রব্যূহে প্রবেশ করতে রাজি হলেন, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গেই জানালেন যে, চক্রব্যূহে প্রবেশের উপায় জানলেও বেরিয়ে আসার কৌশল তিনি জানেন না। যুদ্ধানভিজ্ঞ যুধিষ্ঠির ভরসা দিয়ে বললেন— তুমি যদি একবার ব্যূহ ভেদ করে ঢুকতে পারো, তবে ধৃষ্টদ্যুম্ন, সাত্যকি এবং অন্যান্যদের নিয়ে আমরা তোমার পিছন পিছন ঢুকে যাব এবং কৌরবদের মধ্যে অন্যতম প্রধান শত্রুদের আমরা বিধ্বস্ত করে দেব— অহং ত্বাহনুগমিষ্যামি ধৃষ্টদ্যুম্নোহথ সাত্যকিঃ।

অভিমন্যু যুধিষ্ঠিরের ভাবনায় কতটা বিশ্বাস করলেন, জানি না। তবে নিজের বীরত্বের মর্যাদা রেখে তিনি চক্রব্যূহে প্রবেশ করে গেলেন। ওদিকে যেমন তিনি কথা দিয়েছিলেন, সেই নীতিতেই যুধিষ্ঠির যাঁদের নিয়ে অভিমন্যুকে অনুসরণ করা আরম্ভ করলেন, তাঁরা হলেন— ভীম, নকুল, সহদেব, সাত্যকি, শিখণ্ডী, ধৃষ্টদ্যুম্ন, বিরাট, দ্রুপদ এবং আরও অনেকে। নামগুলো খুব নগণ্য নয়, বিশেষত ভীম, সাত্যকি, বিরাট, দ্রুপদ ইত্যাদি। ওদিকে অভিমন্যুর সঙ্গে তখন কৌরব-পক্ষের প্রধানেরা সকলেই যুদ্ধে ব্যস্ত— দ্রোণ থেকে আরম্ভ করে দুর্যোধন, কর্ণ, দুঃশাসন সকলের সঙ্গেই পালা করে যুদ্ধ চলছে অভিমন্যুর। চক্রব্যূহের চক্র তখন বালক-বীরকে আস্তে আস্তে ঘিরে ফেলছে। এরই মধ্যে যুধিষ্ঠির-ভীমেরা যখন অভিমন্যুর পথ ধরে এগোচ্ছেন, তখন কৌরব-পক্ষের সৈন্যরাও সভয়ে সরে গেছে। ঠিক এই সময়ে চক্রব্যূহের সম্মুখে-থাকা জয়দ্রথ কৌরব-সৈন্যদের এমন ভয়-তাড়িত হতে দেখে নিজের সমস্ত শক্তি জড়ো করে উদয় হলেন পাণ্ডবপক্ষের প্রধান প্রধান বীরদের সামনে। তাঁর একটাই লক্ষ্য— পাণ্ডবদের সবাইকে তিনি আটকে দেবেন, অভিমন্যুর কাছে যেতে দেবেন না— সঞ্জয় ধৃতরাষ্ট্রকে বলেছেন— জামাতা তব তেজস্বী তিস্তম্ভয়িষুরাদ্রবৎ।

জয়দ্রথের যুদ্ধকৌশল বর্ণনার সময় অপূর্ব একটা উপমা দিয়েছেন মহাভারতের কবি। বলেছেন— হাতীর একটা অভ্যাস আছে, বনের মধ্যে খাবার জোগাড় করার সময়েও যেমন সে নীচের দিক থেকে ওপরে যায়, যুদ্ধের সময়েও সে রথ-অশ্ব আগে ধ্বংস করে তারপর রথারোহী, অশ্বারোহীকে আক্রমণ করে। আবার সাধারণ ক্ষেত্রে পদাতিক সৈন্যের মধ্যে যুদ্ধোন্মত্ত হাতি ছেড়ে দিয়ে প্রাথমিক সুবিধেটুকু পাবার পরেই হস্তীযুদ্ধকারীরা বিশেষ দিকে এগোয়। হাতির এই প্রবণতাকে পারিভাষিক ভাবেও বলে ‘প্রবণ’। যুদ্ধদর্শী সঞ্জয় বলেছেন— জয়দ্রথ ঠিক হাতির কৌশলে পাণ্ডবদের সঙ্গে যুদ্ধ আরম্ভ করলেন— বার্ধক্ষত্রিরুপাসেধৎ প্রবণাদিব কুঞ্জরঃ।

সেদিন জয়দ্রথের যুদ্ধসজ্জার চমকটাও ছিল অসাধারণ। এমনিতেই সিন্ধুদেশের ঘোড়াগুলির খুব সুনাম, আর জয়দ্রথ সেই দেশের রাজা বলেই সর্বোত্তম চারখানি ঘোড়া নিজের রথে যুতে নিয়েছিলেন। তাঁর রথের মাথায় রুপোয়-মোড়া একটা বরাহ-চিহ্ন, তাঁর ওপরে সাদা ছাতা, পাশে পাশে চামর লাগানো— রথ চললেই সেগুলো দুলতে থাকে। রথের বহিরাবরণের মধ্যেও সোনা-মণি-মুক্তো-হিরের ছড়াছড়ি। জয়দ্রথ এখন দ্রোণাচার্যের জায়গাটাই পূরণ করে দিয়েছেন। অভিমন্যু চক্রব্যূহ ভেদ করার ফলে যে জায়গাটা খালি হয়ে গিয়েছিল, সেই জায়গাটা পূরণ করে দিয়েছেন জয়দ্রথ— তৎ খণ্ডং পূরয়ামাস। যদার্জুনি-রদারয়ৎ। তাঁর রথ, রথসজ্জা, তাঁর তেজি ঘোড়াগুলি দেখেই বোঝা যাচ্ছিল, আজই তাঁর দিন বটে। যে অভিমন্যু এই খানিকক্ষণ আগে চক্রব্যূহে প্রবেশ করেছেন, সেই অভিমন্যর সঙ্গেও জয়দ্রথের যুদ্ধ হয়েছিল। তবে সেটা বেশ খানিকক্ষণ আগে। জয়দ্রথ অভিমন্যুর সঙ্গে যুদ্ধে এঁটে উঠতে পারেননি। তিনি পরাজিত হয়েছিলেন— সিন্ধুরাজং পরাজিত্য সৌভদ্রঃ পববীরহা। কিন্তু অভিমন্যু চক্রব্যূহে ঢোকার পর এই মুহূর্তে কী যে হল জয়দ্রথের, তিনি অদ্ভুত বিক্রমে ব্যূহমুখ অধিকার করে দাঁড়ালেন এবং অভিমন্যুর পিছন পিছন যুধিষ্ঠির-ভীম-সাত্যকিরা যখন ঢুকতে যাবেন চক্রব্যূহে, তখনই জয়দ্রথ পথ আগলে দাঁড়ালেন।

এদিন জয়দ্রথের দিন ছিল। এমনটা হয় মাঝে-মাঝে। একটি অক্ষম মানুষও এক-একদিন এমন অদ্ভুত শক্তি দেখিয়ে ফেলে, এমন বুদ্ধির পরিচয় দেয় যে, মনে সন্দেহ হয়— এই লোকটার মধ্যে কী এত শক্তি ছিল, কী করে এই মানুষ এমন অসামান্য কাজ করে ফেলল। বেশ ধরা যাক, যুধিষ্ঠির কিংবা নকুল-সহদেব, এঁরা যত বড় পাণ্ডবই হোন, এঁরা ভীম-অর্জুনের মতো অত বড় যোদ্ধা ছিলেন না। অথবা ধরা যাক, দ্রুপদ কিংবা বিরাট যথেষ্টই বৃদ্ধ হয়ে গেছেন, তারা আর তেমন ক্ষিপ্রতায় ধনুক কিংবা অসি চালনা করতে পারেন না, কিন্তু সাত্যকি, ধৃষ্টদ্যুম্ন অথবা ভীমের মতো অত বড় যোদ্ধা, যাঁরা চিরকাল সম্মুখ-শত্রুকে পরাজিত করে এসেছেন, তারাও সেদিন জয়দ্রথের সামনে দাড়াতে পারলেন না। আর জয়দ্রথ যুদ্ধ করছেন কীভাবে? একেবারে সমান্তরালভাবে সকলের সঙ্গে যুদ্ধ করছেন। তিন বাণে সাত্যকিকে, আট বাণে ভীমকে, দশ বাণে বিরাটকে— এমনি করে পর পর সবাইকে আটকে রাখলেন জয়দ্রথ।

কারও ওপরেই যে একটা বিরাট পরাজয় নেমে এল এর ফলে, তা নয়, কিন্তু কেউই আর তেমন এগোতে পারলেন না। সেদিন পাণ্ডবপক্ষে সবচেয়ে বড় যোদ্ধা যারা ছিলেন, সেই সাত্যকি অথবা ভীমকে জয়দ্রথ যে ভীষণভাবে জখম করে নাকানিচোবানি খাওয়ালেন, তা মোটেই নয়, কিন্তু এমন একটা অবস্থার সৃষ্টি করলেন জয়দ্ৰথ, যাতে মহাবলী ভীমের মতো যোদ্ধারও অশ্ব এবং ধনুক কাটা পড়ল, তিনি নিজের রথ ছেড়ে লাফিয়ে সাত্যকির রথে উঠতে বাধ্য হলেন। সবাইকে এইভাবে ব্যতিব্যস্ত করে দিয়ে জয়দ্রথ যে বিরাট কাজটা করে দিলেন, সেটা এক কথায় এই যে, চক্রব্যূহে প্রবেশ করার সময় অভিমন্যু অশ্বারোহী এবং হস্তীগুলিকে মেরে পশ্চাৎস্থিত পাণ্ডবদের জন্য যে পথ তৈরি করে দিয়েছিলেন, সেই পথ অবরুদ্ধ করে স্তম্ভের মতো দাঁড়িয়ে রইলেন জয়দ্রথ। পাণ্ডবরা কেউ অভিমন্যকে বাঁচানোর জন্য এগিয়ে যেতে পারলেন না— পান্ডূনাং দর্শিতঃ পন্থাঃ সৈন্ধবেন নিবারিতঃ। আমরা জানি— চক্রব্যূহে একাকী পরিবৃত অভিমন্যুকে অসহায় অবস্থায় একেবারে নৃশংসভাবে হত্যা করলেন কৌরবেরা এবং হত্যার নিমিত্ত কারণ হয়ে রইলেন জয়দ্রথ। ভীম-যুধিষ্ঠির-সাত্যকি— সকলেই অসম্ভব চেষ্টা করেছিলেন অভিমন্যুর সহায়তা করার জন্য। কিন্তু সেদিন কী ক্ষমতা ভর করল জয়দ্রথের ওপর, কেউ তাঁকে টপকে যেতে পারলেন না পাণ্ডবাশ্চাম্বপদ্যন্ত প্রতিশেকুর্ন সৈন্ধবম্।

ওই যে বললাম— সেদিন কী ক্ষমতা, কী শক্তি ভর করেছিল জয়দ্রথের ওপর! ভীম কিংবা সাত্যকির চেয়ে অনেক ছোট মাপের যোদ্ধা হওয়া সত্ত্বেও যে জয়দ্রথ সবাইকে একযোগে রুখে দিলেন— এই বিস্ময়ের মধ্যেই মহাদেবের বরের প্রসঙ্গ এসে পড়ে। দৈব ঘটনায় বিশ্বাস থাকলে দৈবদৃষ্টিতে এ-কথা যথেষ্টই বিশ্বাসযোগ্য যে, মহাদেবের বর-প্রভাবেই জয়দ্রথ সেদিন অর্জুন-ভিন্ন সকলেরই যুদ্ধগতি রুদ্ধ করে দিতে পেরেছিলেন। দেবদেব মহাদেবের নিগ্রহ-অনুগ্রহ-বৃত্তির ওপর আমার এতটুকু অবিশ্বাস নেই, কিন্তু এই ঘটনাটা লৌকিকভাবেও বুঝি ব্যাখ্যা করা যায় এবং সে ব্যাখ্যা অতি-সাধারণ। আমি আগেই বলেছি— অতি সাধারণ এবং ক্ষুদ্র ব্যক্তিও এক-একদিন, এক-এক সময়ে এমন বড় কাজ করে ফেলে, যেদিন সব কিছুই তাঁর অনুকূলে ঘটে এবং যেটা ভাল করে বিশ্লেষণ করলে সাধারণভাবে মনে হবে এই ব্যক্তির পক্ষে এমন কাজ অসম্ভব। অথচ তা ঘটে, আজও ঘটে এবং এমন ঘটনার মধ্যে একটা বিস্ময়-চমৎকার আছে বলেই মহাকাব্যিক প্রয়োজনে এখানে ঈশ্বারানুগ্রহের কাহিনি আসে।

বস্তুত মহাকাব্যের মধ্যে এবং অন্যান্য পুরাণের মধ্যে অনেক সময়েই এমন ঘটেছে, যেখানে ঘটনা ঘটে যাবার পর তাঁর সদর্থকতা বোঝানোর জন্য ঈশ্বরের বরদান অথবা উলটো দিকে মুনি-ঋষির অভিশাপের কথা এসেছে। এখানেও হয়তো তাই। দেখুন, সেইদিন ‘স্ট্র্যাটিজিক্যালি’ অর্জুন ব্যস্ত ছিলেন সংশপ্তক বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধে এবং সেই দিনই অদ্ভুত শক্তিকৌশলে জয়দ্রথ পাণ্ডবপক্ষের সবগুলি লোককে অগ্রগতি থেকে ঠেকিয়ে রেখেছেন শুধু, তাঁদের কারও ক্ষতিও করতে পারেননি, মারতেও পারেননি। তা ছাড়া দ্রৌপদীহরণের পর যে অপমানটুকু হয়েছিল, সেটাও তাঁর তেজ এবং একাগ্রতা বাড়িয়ে দিয়েছিল হয়তো। কিন্তু দ্বিগুণ রথের সম্মানে চিহ্নিত জয়দ্রথ আর বেশি কী করেছেন? শুধু ঠেকিয়ে রেখেছেন অর্জুনভিন্ন অন্য পাণ্ডবদের। কিন্তু ভীম-সাত্যকির মতো মানুষকে ঠেকিয়ে রাখার কাজটাও যথেষ্ট বিস্ময়সূচক বলেই মহাকাব্যের কবিকে অপূর্বনির্মাণ-নিপুণতায় মহাদেবের বরদান প্রসঙ্গ অবতারণা করতে হয়েছে। আর এই বিস্ময় খানিকটা আছে বলেই অর্জুনকে অভিমন্যুর মৃত্যুসংবাদ দেওয়ার সময় যুধিষ্ঠিরকে বলতে হয়েছে— আমরা নিজেরাই কেমন বোকা বনে গিয়েছি, নইলে আমরাই তাঁর পিছন-পিছন যাব বলে তাঁকে চক্রব্যূহ ভেদ করতে পাঠালাম, অথচ আমাদের গতি রুদ্ধ করে দিল ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র জয়দ্রথ— ততঃ সৈন্ধবকো রাজা ক্ষুদ্রস্তাত জয়দ্রথঃ। মহাদেবের বরাভয় ছিল বলেই সে আমাদের সবাইকে আটকে দিয়েছে— সর্বান্ নঃ সমবারয়ৎ।

প্রিয় পুত্র অভিমন্যুর মৃত্যু-সংবাদ অর্জুন পেয়েছিলেন সন্ধ্যার সময়। ভীষ্ম তখন শরশয্যায়, কৌরবদের যুদ্ধনায়কত্ব করছেন দ্রোণাচার্য। জয়দ্রথ ভীম-যুধিষ্ঠিরদের আটকে দিয়ে যে বিরাট কাজটা কৌরবদের করে দিলেন, সেটা হল অভিমন্যু-বধ। সপ্তরথীর নৃশংসতার মধ্যে তিনি একজন না হলেও তিনিই হলেন সেই মানুষ, যিনি পরোক্ষে অভিমন্যুকে হত্যার সুযোগ করে দিয়েছেন তাঁর সহায়-সরবরাহের গতি রুদ্ধ করে দিয়ে। অর্জুন যখন বুঝলেন যে, সপ্তরথী নন, জয়দ্রথই অভিমন্যু-বধের প্রধানতম কারণ, তখন ক্রোধে তাঁর মুখমণ্ডল রক্তবর্ণ হয়ে উঠল। হাতে হাত পিষে চক্ষু দুটি বিস্ফারিত করে অর্জুন উন্মত্তের মতো প্রতিজ্ঞা করলেন— আমি কালই জয়দ্রথই বধ করব, আমার হাত থেকে তাঁর মুক্তি নেই— সত্যং বঃ প্রতিজানামি শ্বোহস্মি হন্তা জয়দ্রথম্।

অর্জুনের সত্য-প্রতিজ্ঞা যে কী, তা যারা জানে, তারাই জানে। তবু অর্জুন দয়ালু যুধিষ্ঠিরের ভাই এবং শিষ্য। প্রিয় পুত্রের মৃত্যু বুকে নিয়েও তিনি জয়দ্রথকে শেষ করে দিতে চাননি, তাঁকে ছাড়ও দিয়েছেন কিছু। বলেছেন— আমার হাতে তাঁর মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী জেনেও জয়দ্রথ যদি এখনও কৌরবদের ছেড়ে না যায়— ন চেদ্ বধভয়াদ্ ভীতো ধার্তরাষ্ট্রান্ প্রহাস্যতি। অর্জুন যুধিষ্ঠিরের পূর্ববাক্য স্মরণে রেখেছেন, এমন শোকার্ত অবস্থাতেও তাই জয়দ্রথের প্রাণ রাখতে চেয়ে যুধিষ্ঠিরের উদ্দেশে বলেছেন— যদি সে আপনার কাছে অথবা আমার কাছে, অথবা পুরুষোত্তম কৃষ্ণের কাছে আত্মসমর্পণ করে প্রাণ ভিক্ষা না চায়, তবে কালই তাঁকে আমি হত্যা করব। অর্জুনের মনে পড়ছে— এই সেই লোকটা, যে দ্রৌপদীহরণের পর ভীমের হাতে বেদম মার খেয়ে যুধিষ্ঠিরের কৃপায় আজীবন দাসত্ব থেকে মুক্ত হয়েছিল। সেই মুহূর্তে এই লোকটার সঙ্গে ঘৃণায় কেউ কথা পর্যন্ত বলছিল না। অথচ অর্জুন সেদিন তাঁর লজ্জা ঢেকে দেবার জন্য ধীরোদাত্ত নায়কদের মতো তাঁর হাত দুটি নিজের হাতে ধরে সকলের সামনে তাঁকে সহজ করে দিয়েছিলেন। অথচ সেই লোকটা আজ তাঁরই প্রিয় পুত্রের মৃত্যু ঘটিয়ে দিল। অর্জুন প্রতিজ্ঞা করে বলেছেন— আজকে জয়দ্রথ দুর্যোধনের প্রিয় সাধন করছে, আমার সৌহার্দ্যটুকু সে ভুলে গেছে এবং তা এতটাই ভুলে গেছে যে আমারই ছেলের মৃত্যুর কারণ হয়ে উঠল সে। আর আমি তাঁকে ছাড়ব না। কালকেই ওকে শেষ করব আমি— পাপং বালবধে হেতুং… ময়ি বিস্মৃতসৌহৃদম্‌। অর্জুন রেহাই দেননি তাঁদেরও যারা জয়দ্রথকে সাহায্য করবেন। বলেছেন— কালকের যুদ্ধে যারা জয়দ্রথের সহায়তা করবেন, তারা যদি দ্রোণ-কৃপের মতো আমার আচার্যস্থানীয় ব্যক্তিও হন, তবু তাঁদেরও সইতে হবে আমার বাণের গুরুভার— অপি দ্রোণকৃপৌ রাজন্ ছাদয়িষ্যামি তান্ শরৈঃ।

অর্জুনের মতো ক্ষত্রিয় বীর যখন প্রতিজ্ঞা করেন, তখন শুধু ইতিবাচকভাবে প্রতিজ্ঞা করেই ক্ষান্ত হন না, প্রতিজ্ঞাপূরণ না করতে পারলে তিনি কী কী আত্মপীড়ন করবেন সেগুলিও তিনি বলতে থাকলেন। অনেক বলার পর শেষ বার চরম শব্দ উচ্চারণ করে বললেন— কালকে সকাল হবার পর সারা দিনের মধ্যে যদি আমি জয়দ্রথকে বধ না করতে পারি, তা হলে আমার আরও একটি প্রতিজ্ঞা শুনুন— আগামী কাল সূর্যাস্তের আগে যদি জয়দ্রথ আমার হাতে মারা না যায়— যদ্যস্মিন্নহতে পাপে সূর্যোহস্তমুপযাস্যতি— তা হলে এইখানে এই শিবিরেই আমি জ্বলন্ত অগ্নিতে প্রবেশ করব। অর্জুন এমনই সংকল্প নিয়ে জয়দ্রথ-বধের প্রতিজ্ঞা করলেন, যাতে বোঝা গেল— জয়দ্রথ স্বর্গ-মর্ত্য-পাতাল যেখানেই থাকুন অথবা যিনিই তাঁকে রক্ষা করার চেষ্টা করুন, অর্জুনের হাত থেকে জয়দ্রথের মুক্তি নেই। অর্জুনের প্রতিজ্ঞা শুনে কৃষ্ণ তাঁর সুবিখ্যাত পাঞ্চজন্য শঙ্খ বাজিয়ে দিলেন সোৎসাহে, ক্রুদ্ধ অর্জুন তাঁর প্রতিধ্বনি করলেন দেবদত্ত শঙ্খ বাজিয়ে। শঙ্খনাদে দিগদিগন্ত মুখরিত হল, পাণ্ডবপক্ষের সৈন্য-সামন্তেরা সিংহনাদ করে উঠল, বাজাতে লাগল শিঙে-কাঁড়া-নাকাড়া– ততো বাদিত্র ঘোষাশ্চ প্রাদুরাসন্ সমন্ততঃ।

অভিমন্যুর মরণোত্তর শোকের সময় হঠাৎ গাণ্ডীব-ধনুক টংকার, শঙ্খঘোষ এবং বাদ্যবাদনের শব্দে কৌরবদের গুপ্তচর এসে খবর নিয়ে গেল পাণ্ডবশিবিরের কাছাকাছি এসে। জয়দ্রথের কাছে সংবাদ পৌঁছল— অর্জুন জয়দ্রথ-বধের প্রতিজ্ঞা করেছেন। জয়দ্রথের মুখ শুকিয়ে গেল। আগের দিন পাণ্ডবপক্ষের সকলকে আটকে দিয়ে তিনি কৌরবপক্ষের সবার কাছে যখন ‘হিরো’ হয়ে উঠলেন, তখন অভিমন্যু-বধের পরোক্ষ কৃতিত্ব অনেকটাই উপভোগ করেছিলেন জয়দ্রথ। তাঁর পরিবর্তে আজ অর্জুনের মুখে নিজেরই বধের প্রতিজ্ঞা শুনে জয়দ্রথ প্রমাদ গণলেন, দুঃখে তাঁর হৃদয় ভরে উঠল। উদীৰ্ণ ভয় থেকে রেহাই পাবার আশায় জয়দ্রথ কৌরবশিবিরে যুদ্ধকালীন সভায় উপস্থিত হলেন— সেখানে তখন পরবর্তী দিনের যুদ্ধ-পরিকল্পনা চলছে দ্রোণাচার্যের সভাপতিত্বে।

শিবির-সভায় যাবার আগে জয়দ্রথ অর্জুনের ভয়ে ভীত হয়ে ঠিকই করে ফেলেছিলেন যে, তিনি পালিয়ে যাবেন নিজের দেশে। এতে তাঁর ক্ষত্রিয় সুলভ অহংকারে বেশ আঘাত লাগছিল বলে মনে-মনে একটু লজ্জিতও ছিলেন। কিন্তু সভায় আসার পর ওই লজ্জা-টজ্জা সব ঝেড়ে ফেলে দিয়ে তাঁর ভীতিপ্রদ ভয়ানক শত্রু সম্বন্ধে কী বিচ্ছিরি ভাবে কথা বলতে আরম্ভ করলেন জয়দ্রথ। বললেন— এই যে পাণ্ডুর স্ত্রীর পেটে লম্পট ইন্দ্রটা যে ছেলেটার জন্ম দিয়েছে— যোহসৌ পাণ্ডোঃ কিল ক্ষেত্রে জাতঃ শক্রেণ কামিনা— সেই ছেলেটা যে এখন একাই আমাকে যমের বাড়ি পাঠাতে চাইছে। তাই বলছিলাম— আপনারা সব ভাল থাকুন, আমি মানে মানে ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে চাই, আমাকে তো বেঁচে থাকতে হবে অন্তত— তৎ স্বস্তি বোহস্তু যাস্যামি স্বগৃহং জীবিতেপ্সয়া।

মুখে পালিয়ে যাবার কথা বললেও জয়দ্রথ কিন্তু একবার যাচাই করে নিতে চাইছেন যে, কৌরবপক্ষীয়েরা— যাঁদের জন্য তিনি এত করলেন, তারা কতটা করবেন তাঁর জন্য। সাধারণ ক্ষেত্রে অনেক সময় তো এমন হয়ই যে, দলপতি তাঁর সহায়ক ক্ষুদ্র শক্তিকে ব্যবহার করার পর তাঁকে ভুলে যান। এক্ষেত্রে জয়দ্রথ সেই বুদ্ধিতেই যাচাই করতে এসেছেন যুদ্ধশিবিরের আলোচনাসভায়। পালিয়ে যাবার কথা বলে সঙ্গে সঙ্গে বিকল্পের সন্ধান করছেন জয়দ্রথ। জয়দ্রথ বললেন— দ্রোণ, দুর্যোধন, কৃপ, কর্ণ, শল্য— এঁরা তো তেমন লোককেও বাঁচাতে পারেন, মৃত্যু যাদের কেশ স্পর্শ করেছে। ও পক্ষে একা অর্জুন— যতই জিঘাংসা থাক তাঁর মধ্যে— আপনারা সকলে মিলে আমাকে একা অর্জুনের হাত থেকে বাঁচাতে পারবেন না— ন ত্রায়েয়ুৰ্ভবন্তো মাং সমস্তাঃ পতয়ঃ ক্ষিতেঃ। কথাটা বলেই জয়দ্রথ নিজের দুর্বলতা স্বীকার করলেন— বিপদে পড়লে জয়দ্রথ তাই করে থাকেন। জয়দ্রথ বললেন— তবে হ্যাঁ, আমার বেশ ভয় করছে। পাণ্ডব-শিবিরে আনন্দের কোলাহল শুনতে পাচ্ছি। অর্জুন আমাকে হত্যা করার প্রতিজ্ঞা করেছে এবং তাতে এই শোকের সময়েও তাঁদের শিবিরে উৎসাহের চিৎকার শোনা যাচ্ছে— তথাহি হৃষ্টাঃ ক্রোশন্তি শোককালে হি পাণ্ডবাঃ। আমার সত্যি মনে হচ্ছে— আপনারা ভাল থাকুন, আমি অন্তত তেমন করেই চলে যেতে চাই যাতে পাণ্ডবরা আর আমাকে চোখে না দেখতে পায়— অদর্শনং গমিষ্যামি ন মাং দ্রক্ষ্যন্তি পাণ্ডবাঃ

জয়দ্রথের কথা শুনে দুর্যোধন তাঁকে অভয় দিয়ে বললেন— কী সব আজে-বাজে বকছ তুমি। যুদ্ধক্ষেত্রে তোমার মতো মহাবীরের সঙ্গে কে দাড়াতে পারবে? তা ছাড়া আমরা সবাই তো আছি— আমি, কর্ণ, দ্রোণ, দুঃশাসন, অশ্বত্থামা, আর আমার এগারো অক্ষৌহিণী সেনা তোমাকে বাঁচানোর জন্য যুদ্ধ করবে। তোমার কোনও ভয় নেই। দুর্যোধন নিজের কথার মূল্য বোঝানোর জন্য সেই রাত্রেই জয়দ্রথকে সঙ্গে করে যুদ্ধনায়ক দ্রোণের কাছে উপস্থিত হলেন। যথোচিত অভিবাদন করার পর জয়দ্রথ একটা অদ্ভুত প্রশ্ন করলেন দ্রোণকে। বললেন— আচ্ছা! একটা কথা বলুন তো! অস্ত্রের সঠিক নিশানা ঠিক করা, দ্রুত অস্ত্রচালনা, অনেক দূরের লক্ষ্যে অস্ত্র হানা অথবা তীব্র অস্ত্রপ্রহার— এ সব ব্যাপারে আমার সঙ্গে অর্জুনের শক্তি এবং কৌশলগত পার্থক্য কতটা বলে আপনার মনে হয়— মম ব্রবীতু ভগবন্ বিশেষং ফাল্গুনস্য চ।

এতক্ষণ যিনি পলায়নের কথা বলেছেন, তিনি দুর্যোধনের সুরক্ষাবাণীতে উত্তেজিত হয়ে নিজেকে মাপতে চাইছেন। অপরাধ জগতের গুরুরা ছোটখাটো শাকরেদদের নিজের প্রভাব দেখিয়ে যেভাবে ভরসা দেয় হয়তো সেই ভরসাতেই জয়দ্রথ আজ নিজেকে যাচাই করতে চাইছেন। কিন্তু দ্রোণাচার্যের মতো পক্ক বৃদ্ধ মানুষকে তিনি কিছুই বোঝেননি। অভিজ্ঞ মাস্টার যেমন মাঝারি ছাত্রকে পুরোপুরি নিরুৎসাহ করেন না, সেইভাবেই দ্রোণ বললেন— দেখো বাছা! আমি তোমাকে এবং অর্জুনকে সমানভাবেই শিক্ষা দিয়েছিলাম, কিন্তু যে কোনও বিদ্যার বিষয়ে নিরন্তর লেগে থাকার যে অধ্যবসায় এবং তাঁর পিছনে যে অক্লান্ত কষ্টকর পরিশ্রম— এগুলোতে অর্জুন তোমার থেকে অনেক এগিয়ে গেছে— যোগাদ্ দুঃখোষিতত্বাচ্চ তস্মাত্ত্বত্তোহধিকোহর্জুনঃ।

এই প্রথম আমরা জানলাম যে দ্রোণগুরুর অস্ত্রশিক্ষার আসরে জয়দ্রথও একজন ছাত্র ছিলেন এবং তিনি অর্জুনেরও সহাধ্যায়ী। অথচ সেদিন তাঁর নামও শুনিনি আমরা। এটা শুধুই এই কারণে নয় যে, কৌরব-পাণ্ডবদের অস্ত্রশিক্ষাকালে দূরাগত অন্যান্য রাজপুত্রদের সঙ্গে জয়দ্রথের নাম উচ্চারণ করার ব্যাপারে মহাকাব্যের কবির কোনও শব্দানুশাসনের পরিমিতি ছিল। আসলে তিনি কোনও প্রয়োজনই বোধ করেননি অর্জুন-ভীম, দুর্যোধন-কর্ণের পাশে তাঁকে উল্লেখ করার। কিন্তু কোনও ছাত্রকেই যেহেতু নিরুৎসাহ এবং অপ্রতিভ করতে নেই, তাই জয়দ্রথকে তিনি ওইভাবে পার্থক্যটা দেখিয়ে দিলেন— তোমাদের দু’জনকেই তো আমি সমান অস্ত্রশিক্ষা দিয়েছিলাম, তবে ওই অর্জুন একটু এগিয়ে গেছে— সমমাচাৰ্যকং তাত তব চৈবাৰ্জুনস্য চ।

অর্জুনের সঙ্গে জয়দ্রথের অদ্ভুত বিষমতা দেখিয়েও আচার্য অনেক অভয় দিলেন জয়দ্রথকে। আবার অনেক অভয় দিয়েও কথার ফাঁকিতে অদ্ভুতভাবে বুঝিয়ে দিলেন যে, জয়দ্রথ অর্জুনের হাত থেকে রেহাই পাবেন না। দ্রোণাচার্য বললেন— তুমি এতটুকুও ভয় পেয়ো না অর্জুনকে, আমি বাঁচাব তোমাকে, তুমি বিশ্বাস রাখো আমার ওপর— অহং হি রক্ষিতা তাত ভয়াত্ত্বাং নাত্র সংশয়ঃ। একটা জিনিস মনে রেখো তুমি— আমার বাহু যাকে রক্ষা করে, সেখানে দেবতারাও ছায়া ফেলতে পারে না। তা ছাড়া আমি কাল এমন ব্যূহ রচনা করব যে, সে ব্যূহ ভেদ করা অর্জনের পক্ষে সম্ভবই হবে না। অতএব পিতৃপিতামহের ক্ষত্রিয়ধর্ম স্মরণ করে তুমি যুদ্ধে অবতীর্ণ হও, তোমার কোনও ভয় নেই— পিতৃপৈতামহং মার্গমনুযাহি নরাধিপ।

এত অভয় দেওয়া সত্ত্বেও দ্রোণাচার্য কিন্তু খুব দার্শনিক কৌশলে বুঝিয়ে দিলেন যে, যে কোনও সময় যা-কিছু ঘটতে পারে। দ্রোণ বললেন, ভয় পাবার কী আছে বাছা! এই যে দেখছ আমি, এই কৌরবেরা, পাণ্ডব, বৃষ্ণি এমনকি আমার ছেলেও তো একদিন এই পৃথিবী ছেড়ে চলে যাবে। অতএব সবাই যখন এই পৃথিবীতে এত অনিশ্চিত, সেখানে তোমার ক্ষত্রিয়ের ধর্ম এই যুদ্ধ ছেড়ে যাবে কেন। আমরা আমাদের উপযুক্ত কাজটি করে পরলোকে যাব— পরলোকং গমিষ্যামঃ স্বৈঃ স্বৈঃ কর্মভিরন্বিতাঃ।

দ্রোণাচার্যের আশ্বাস শুনে জয়দ্রথ অনেকটাই ভরসা পেলেন এবং অর্জুনের ভয় ঝেড়ে ফেলে দিলেন মন থেকে। কিন্তু দ্রোণাচার্যের এই আশ্বাস এবং জয়দ্রথের এই নির্ভয় আচরণ— দুটিই কিন্তু সামান্য আশঙ্কার সৃষ্টি করল পাণ্ডবশিবিরে। অর্জুনের প্রতিজ্ঞা শুনে যে কৃষ্ণ পাঞ্চজন্য শঙ্খ বাজিয়ে ছিলেন, সেই কৃষ্ণই কিন্তু অর্জুনকে দোষারোপ করলেন এমন আকস্মিক এবং প্রকট প্রতিজ্ঞার জন্য। আসলে কৃষ্ণের গুপ্তচরেরা কৌরবশিবির ঘুরে এসে সমস্ত ঘটনা আদ্যোপান্ত জানাল। জয়দ্রথের সঙ্গে দুর্যোধনের কথা, তাঁর পালানোর ইচ্ছে, শেষ পর্যন্ত দ্রোণাচার্যের সঙ্গে তাঁর দরবার এবং দ্রোণের অভয়দান— এই সমস্ত ঘটনা গুপ্তচরের মুখ শোনার পর কৃষ্ণ অর্জুনকে বললেন— আসলে অন্য কিছুই নয়, তোমার প্রতিজ্ঞা শুনে কৌরবরা বড় বেশি সচেতন হয়ে গেল এমনকী জয়দ্রথকে বাঁচানোর জন্য ওরা এখন থেকেই ব্যূহ সাজানোর পরিকল্পনা নিয়েছে। কর্ণ, অশ্বত্থামা, কৃপ এবং শল্যকে নিয়ে অন্তত ছয় জন বড় যোদ্ধা জয়দ্রথের সামনে থাকবেন। ব্যুহের সামনের দিকটা হবে শকটাকার, পিছন দিকটা হবে পদ্মের মতো। তারপর পদ্মের মাঝখানটায় যে কোশের মতো থাকে, সেখানে একটি সূচিব্যূহ রচনা করে তাঁর মধ্যে জয়দ্রথকে রাখা হবে বলে আমি গুপ্তচরদের মুখে খবর পেয়েছি। তা হলে যা দাঁড়াল— সমস্ত বড় বড় যোদ্ধাদের সঙ্গে তাঁদের অনুগামীদের জয় না করা পর্যন্ত তো জয়দ্রথের নাগালই পাওয়া যাবে না— এতা অজিত্বা সগণান, নৈব প্রাপ্যো জয়দ্রথঃ।

কৃষ্ণের আশঙ্কায় অর্জুন এতটুকুও ঘাবড়ালেন না এবং পুনরায় তাঁর অস্ত্ৰক্ষমতার বিবরণ দিয়ে কৃষ্ণকে যথাসম্ভব নিশ্চিন্ত করলেন। এমনও বলে দিলেন যাতে রাত্রি প্রভাত হবার সঙ্গে সঙ্গেই তাঁর রথ প্রস্তুত থাকে— যথা প্রভাতাং রজনীং কল্পিতঃ স্যাদ্ রথো মম। শোকে, দুঃখে, ক্রোধে অর্জুন এবং কৃষ্ণ সে-রাত্রে ঘুমোতে পারলেন না। অর্জুন কৃষ্ণকে একবার বললেন— অভিমন্যুর মা সুভদ্রা এবং পুত্রবধূ উত্তরার কাছে গিয়ে তাঁদের শান্ত করার জন্য। জয়দ্রথের মৃত্যুর প্রতিশোধ যদি তাঁদের শোকস্তব্ধ হৃদয় এতটুকু উজ্জীবিত করে। শোকার্তা জননী এবং বিধবা বধূর কাছে গিয়ে সান্ত্বনা দেওয়া সহজ কাজ নয়, কৃষ্ণ চরম অস্বস্তি নিয়ে সে কাজ করে এলেন।

সকালবেলায় স্নান এবং নিত্যকর্ম সমাধা করে কৃষ্ণের সারথ্যে অর্জুন রওনা হলেন। লক্ষ্য, জয়দ্রথ-বধ। মহাভারতে জয়দ্রথ-বধের এই অংশ সবচেয়ে দীর্ঘ। অর্থাৎ অবশিষ্ট দশ অক্ষৌহিণী কৌরব-সেনা এবং বিরাট বিরাট যুদ্ধবীরদের যুদ্ধে অতিক্রম করে জয়দ্রথের কাছাকাছি যখন পৌঁছলেন অর্জুন, তখন সন্ধ্যা হয়ে গেছে। অনেক যুদ্ধ হয়ে গেছে এর মধ্যে, অনেক জয়-পরাজয়, আশা এবং হতাশা। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে, সূর্যাস্তের আগে জয়দ্রথকে বধ না করতে পারলে অর্জুন আপন প্রতিজ্ঞাভঙ্গের জন্য অগ্নিতে আত্মাহুতি দেবেন। অন্তরায় অনেক থাকা সত্ত্বেও সে-সব নিজের অসম্ভব বীরত্বে এমন ভাবেই উত্তীর্ণ হয়েছেন অর্জুন যে, দুর্যোধনকে ভাবতে হয়েছে যে, কী করে তাঁর বিরাট সেনাব্যূহ ভেদ করে অর্জুন উপস্থিত হয়েছেন জয়দ্রথের কাছে— তস্মিন বিলুলিতে সৈন্যে সৈন্ধবায়ার্জুনে গতে। কিন্তু এতটা পথ আসতে যে সময় চলে গেছে, তাঁর জন্য অর্জুনও এখন চিন্তিত হয়ে পড়েছেন। তিনি এখন কৃষ্ণকে তাড়া দিচ্ছেন যাতে তিনি অতিশীঘ্র জয়দ্রথের কাছে পৌঁছতে পারেন।

এদিকে অর্জুনকে দেখামাত্রই দুর্যোধন, কর্ণ, অশ্বত্থামা এবং কৃপাচার্যের মতো বীরেরা, এমনকী জয়দ্রথও এক লাফে এগিয়ে এলেন অর্জুনের দিকে। দুর্যোধন কর্ণকে উত্তেজিত করলেন যথেষ্ট, কিন্তু কিছুক্ষণ আগে মধ্যম পাণ্ডব ভীম এত অস্ত্রাঘাত করেছেন কর্ণকে যে, খানিকটা হতোদ্যম ছিলেন যুদ্ধের ব্যাপারে। যদিও দুর্যোধনের কথায় তিনি মরণ-পণ যুদ্ধ আরম্ভ করলেন। কিন্তু কোনও লাভ হল না। কর্ণ এবং অন্যান্য বীরদের নিবারিত করে অর্জুন ঠিক এসে পৌঁছলেন জয়দ্রথের কাছে— ব্যাকুলীকত্য কৌন্তেয়ঃ সর্বাংশ্চ রথিনো রণে। জয়দ্রথ নিজেও বেশ ভাল যুদ্ধ করতে আরম্ভ করলেন বটে, কিন্তু অশ্বত্থামা, কৃপ, কর্ণ এমনভাবে তাঁকে ঘিরে রেখে অর্জুনের সঙ্গে যুদ্ধ করতে আরম্ভ করলেন যে, কৃষ্ণ পর্যন্ত অর্জুনকে বললেন— সূর্য কিন্তু একেবারে ঢলে পড়েছে পশ্চিম আকাশে— এতস্মিন্ এব কালে তু দ্রুতং গচ্ছতি ভাস্করে— অথচ খেয়াল করে দেখ, জয়দ্রথ কিন্তু প্রাণের ভয়ে অন্তত ছয় জন মহাবীর যোদ্ধার সুরক্ষায় নিজেকে আড়াল করে রেখেছে। এই অবস্থায় তোমার করণীয় বিকল্প দুটোমাত্র। এক, তুমি এই ছয় মহারথীকে মেরে তারপর জয়দ্রথকে মারো, নয়তো দ্বিতীয় বিকল্প— কোনো ছলনার আশ্রয় ছাড়া এই ছয়ের আবরণ ভেদ করে তুমি জয়দ্রথকে এই সময়ের মধ্যে মারতেই পারবে না— ন শক্যঃ সৈন্ধবো হন্তুং যত্তো নির্ব্যাজমর্জুন। আমি তোমাকে একটা কথা বলি— আমি যোগবলে এমন একটা মোহ সৃষ্টি করব, যাতে সিন্ধুরাজ জয়দ্রথ এমনই দেখবেন যেন সূর্য অস্ত গেছে— অস্তং গতমিবাব্যক্তং দ্রক্ষত্যর্কং স সিন্ধুরাট্। আর জয়দ্রথ তো শুধু বাঁচার জন্যই চেষ্টা করছে এখন। সূর্য অস্ত গেছে ভেবেই জয়দ্রথ মনে করবে তোমার আত্মহত্যার সময় এসে গেছে। এই কারণে সে আর ছয় মহারথীর অন্তরালে লুকিয়ে থাকবে না–ন গোপ্স্যতি দুরাচারঃ স আত্মানং কথঞ্চন। সে তখন প্রকাশ্যেই মুখ তুলে সূর্যের অবস্থান লক্ষ্য করবে এবং তুমিও অবসর বুঝে জয়দ্রথের মাথাটা কেটে ফেলবে শাণিত অস্ত্রাঘাতে।

সময় আর নেই ভাববার মতোও। অর্জুন কৃষ্ণের প্রস্তাবে রাজি হলেন এবং মহাভারত বলেছে— যোগীগণের অধীশ্বর কৃষ্ণ আপন যোগে আস্থিত হয়ে যোগের দ্বারা সূর্যের আবরণ তৈরি করলেন অদ্ভুত এক অন্ধকার সৃষ্টি— করে যোগী যোগেন সংযুক্তো যোগিনামীশ্বরো হরিঃ। যোগের ধারণাটা এখনকার কালে অবিশ্বাস্য মনে হবে, কিন্তু যোগের মাধ্যমে নিশ্বাস-প্রশ্বাস স্তব্ধ করা থেকে আরম্ভ করে আরও যে বহু কিছু করা যায় তা বিশিষ্ট যোগী মহাপুরুষদের জীবনেই দৃষ্ট হয়। প্রশ্ন আসে, যোগের প্রধানতম মাধ্যম প্রবল ইচ্ছাশক্তির ক্ষমতায় অন্যকে ‘হিপনোটাইজ’ করে তিনি নিজে যেমনটি চাইছেন সেইরকমই অন্যদের বা অন্য কাউকে দেখানো যায় কিনা। দেখুন, ‘হিপনটিজম’ নিয়ে অনেক গবেষণা হয়েছে, বাস্তববাদিতায় এই জিনিস অস্বীকার করা গেলেও প্রবল ব্যক্তিত্বময় মানুষ অপেক্ষাকৃত দুর্বলচিত্ত ব্যক্তিকে যে অন্য রকম ভাবাতে পারেন বা অন্যথা-ভাবিত করতে পারেন, তাঁর প্রমাণ তো ভূরি-ভূরি আছে। যাই হোক, যোগের কার্যকারিতা বোঝবার জন্যও প্রথমত যোগী হওয়া দরকার, আর ‘হিপনটিজম’ বুঝতে গেলেও সে বিষয়ে বিশ্বাস থাকা চাই, এই যন্ত্রসভ্যতার যুগে সেই প্রবল মানসিক তথা ইচ্ছাশক্তির ক্ষমতা নির্ণয় করা তেমন প্রমাণসহ নয় বলেই নিতান্ত নির্মোহভাবে জানাই— কৃষ্ণের মতো ব্যক্তিত্বের পক্ষে সব সম্ভব। যিনি আপন প্রভাবে শতগোপীর মনোহরণ করেও সেখান থেকে বন্ধনমুক্ত হয়ে মথুরায় চলে আসতে পেরেছিলেন এবং রাজনীতির বিস্তারিত ক্ষেত্রে যিনি একটি পদক্ষেপও ভুল করেননি, তিনি জরাসন্ধের মতো সাধারণ মানুষকে মোহগ্রস্ত করে ফেলতে পারেন, এর মধ্যে বেশি কথা নেই কিছু।

যাই হোক, কৃষ্ণকৃত মোহাবরণ-সৃষ্টির সঙ্গে সঙ্গেই কৌরবপক্ষে আনন্দের কোলাহল উঠল। সকলেই ভাবল সূর্য অস্ত গেছে, এবার অর্জুন আত্মহত্যা করবেন। আকাশের দিকে তাকিয়ে সবাই যখন নিশ্চিন্ত হবার চেষ্টা করছে যে, সত্যিই সূর্য ডুবে গেছে কিনা, তখন জয়দ্রথও তাঁর সুরক্ষার আবরণ— অশ্বত্থামা-কৃপ-কর্ণের পিছন থেকে সামনে এলেন এবং অন্যদের মতোই আকাশপানে তাকিয়ে সূর্য দেখতে লাগলেন। জয়দ্রথকে এমন উৎসুকভাবে গলা তুলে সূর্যের দিকে দৃষ্টিপাত করতে দেখে কৃষ্ণ অর্জুনকে বললেন— দ্যাখো, জয়দ্রথ সূর্য দেখছে, বদমাশটাকে মারতে হলে এই কিন্তু শ্রেষ্ঠ সময়। এই মুহূর্তেই ওর গলা কেটে ফেলো এবং নিজের সাফল্য প্রমাণ করার চেষ্টা করো— অয়ং কালো মহাবাহো বধস্যাস্য দুরাত্মনঃ।

কৃষ্ণ এই কথা বলার সঙ্গে সঙ্গেই যে অর্জুন মুহূর্তের মধ্যেই অসতর্ক কৌরব-বাহিনীর মধ্যস্থ অসতর্ক জয়দ্রথকে মেরে ফেলতে পারলেন, এ-কথা কিন্তু ঠিক নয়। অর্থাৎ সেই যে কথাটা— কৃষ্ণ অন্ধকার সৃষ্টি করলেন, সবাই তখন অর্জুনের আত্মহত্যার প্রত্যাশায় সূর্যের দিকে তাকিয়ে আছে এবং জয়দ্রথও তাই, অতএব সকলের অসতর্কতার সুযোগে অর্জুন জয়দ্রথের গলা কেটে ফেললেন, এমন ম্যাজিক কিন্তু মহাভারতের বাস্তবে ঘটেনি। কেন না কৃষ্ণ সাবধান করার সঙ্গে সঙ্গেই অর্জুনকে দেখছি— তিনি তাঁর দিনান্তের শেষ ভয়ংকর যুদ্ধ আরম্ভ করছেন এবং তাঁর প্রধান প্রতিপক্ষ সেই মহাবীরদের আবরণ— কৃপ, কর্ণ, শল্য, দুর্যোধন, কর্ণপুত্র বৃষসেন এবং স্বয়ং জয়দ্রথের সঙ্গেও অন্তিম যুদ্ধ আরম্ভ করছেন।

বস্তুত দিবসের শেষ সূর্য তখন নিতান্তই অস্তাচল অবলম্বন করেছেন। সৈন্য-সামন্তের ভিড়, দিগন্তের অরণ্যরাজিতে পশ্চিমে ঢলে-পড়া সূর্যের শেষ গতি মালুম হচ্ছে না ভাল। অর্জুন তাঁর শেষ শক্তি দিয়ে যুদ্ধ আরম্ভ করেছেন এবং কৃপ-কর্ণ-দুর্যোধন-শল্যেরা একত্রে আক্রান্ত হওয়ায় জয়দ্রথের শেষ রক্ষীবাহিনী একেবারে আকুল হয়ে উঠলেন। অর্জুনের অস্ত্রসন্ধানের শীঘ্রতায় তারা বিমূঢ় বোধ করছেন— ছাদয়ামাস তীব্রেণ শরজালেন পাণ্ডবঃ। অর্জুনের তীব্র-শীঘ্র অস্ত্রচালনার নৈপুণ্যে কৰ্ণ-অশ্বত্থামা, কৃপ-শল্য অথবা বৃষসেন-দুর্যোধনেরা না পারছেন নতুন অস্ত্র গ্রহণ করতে, না পারছেন অস্ত্র সন্ধান করতে, অস্ত্রমোক্ষণ তো দূরের কথা— ন গৃহ্নন্ ন ক্ষিপন্ রাজন্ ন মুঞ্চন্ নাপি সন্দধন্। তা হলে আর অলৌকিক কাণ্ডটা কী ঘটল? মহাভারতের কবি সূর্যাচ্ছাদনের মন্ত্রণায় একবার মাত্র কৃষ্ণের ঐশী শক্তির প্রতিজ্ঞা করেই বাস্তবে নেমে এসেছেন। জয়দ্রথের আবরণ ছয় মহারথীর চক্রভেদ করার জন্য যে অসম্ভব মানসিক শক্তি দরকার হয়, সূর্যাস্তের প্রাক্‌কালে সেই মানসিক শক্তিটুকু অর্জুনের মধ্যে চেতিয়ে তুলেছেন কৃষ্ণ। ছয়জন মহাবীরকে আক্রমণে প্রতিহত করে— এবং এমনই সেই প্রতিহনন, যাতে পিতা-পুত্র কর্ণ-বৃষসেনের ধনুক ছিন্ন হয়ে পড়ে গেল শেষ মুহূর্তে, মামা-ভাগনে কৃপ-অশ্বত্থামা অস্ত্রাঘাতে ভীষণ আহত হয়ে পড়লেন শেষ মুহূর্তে এবং শল্যের সারথি ভল্লের আঘাতে মারা পড়লেন শেষ মুহূর্তে। জয়দ্রথ এবার একেবারে সামনে— অর্জুনের শেষ লক্ষ্য।

যুগপৎ অথবা একত্রে যদি প্রতিপক্ষের মহাবীরদের প্রতিহত করতে হয়, তবে এই তো নিয়ম— সবাইকে একসঙ্গে মেরে ফেলাও যায় না, অথবা সবাইকে জিতেও আসা যায় না, কিন্তু সবাইকেই নিবারণ করা যায়। অর্জুন সবাইকে যুদ্ধে প্রতিহত এবং তাড়িত করে একেবারে জয়দ্রথের সামনে এসে পৌঁছেছেন এবং গাণ্ডীবে-ধনুকে সেই ভয়ংকর বজ্রতুল্য অস্ত্র যোজনা করেছেন দিব্যমন্ত্রে অভিমন্দ্রিত করে। কৃষ্ণও চেঁচিয়ে উঠলেন— আর দেরি নয়, অর্জুন! মাথা কেটে ফেলো জয়দ্রথের। এই কথা বলার সঙ্গে সঙ্গেই একটা বিষয় অর্জুনকে মনে করিয়ে দিলেন কৃষ্ণ। কৃষ্ণ বললেন— জয়দ্রথের পিতা বৃদ্ধক্ষত্র অনেক ত্যাগ-বৈরাগ্যে দেবতার আরাধনা করে জয়দ্রথকে পেয়েছিলেন। কিন্তু পুত্রের জন্মকালে দৈববাণী হল যে, জয়দ্রথ খুব বড় যুদ্ধবীর হিসেবে পরিচিত হবেন বটে, কিন্তু জীবনের শেষ যুদ্ধে কোনও ক্রুদ্ধ শত্রু তাঁর চোখের সামনেই তাঁর মাথা কেটে ফেলবে। তপস্বী পিতা বৃদ্ধক্ষত্র এই দৈববাণী শুনে আত্মীয়-স্বজনের সামনেই পুত্রস্নেহে আকুল হয়ে বললেন— তাই যদি হয়, তবে যে-শত্রু আমার ছেলের মাথা কেটে মাটিতে ফেলবে, তাঁরও মাথা ফেটে চৌচির হয়ে যাবে— তস্যাপি শতধা মূর্ধা ফলিষ্যতি ন সংশয়ঃ।

জয়দ্রথের শত্রুর গুণাগুণ বিচার না করেই পুত্রস্নেহে এই অদ্ভুত বিকট অভিশাপ বিনা কারণে উচ্চারণ করলেন বৃদ্ধক্ষত্র। তারপরে যথাসময়ে জয়দ্রথের বয়স বাড়লে তাঁকে রাজপদে অভিষিক্ত করে কুরুক্ষেত্রের অদূরেই কঠিন তপস্যা করতে আরম্ভ করলেন। বৃদ্ধক্ষত্রের কথা মনে রেখে কৃষ্ণ অর্জুনকে বললেন— আজকে তুমি তোমার অস্ত্রচালনার কৌশল দেখাও— তুমি এমনভাবেই জয়দ্রথের মস্তক ছেদন করো, যাতে তাঁর মাথা মাটিতে না পড়ে এবং তা গিয়ে পড়ে তপস্যারত বৃদ্ধক্ষত্রের কোলের ওপর— যাতে নিজপ্রদত্ত অভিশাপের প্রতিক্রিয়া তিনি নিজেই ভোগ করেন। তা নইলে তোমারই বিপদ, তোমার মাথাটাই যাবে, অর্জুন!

বৃদ্ধক্ষত্রের পুত্রলাভ এবং পুত্রস্নেহে তাঁর প্রতিপক্ষের উদ্দেশে অভিশাপ উচ্চারণ, এটা যতই অলৌকিকতার গন্ধ নিয়ে পরিবেশিত হোক, এর পিছনে লৌকিক যুক্তিও কিছু থাকতে পারে। তবে হ্যাঁ, সেই লৌকিক যুক্তি প্রতিষ্ঠা করাটা অবশ্যই খুব কঠিন। আমরা যা বুঝি, তাতে এই দাঁড়ায় যে, সিন্ধুরাজ বৃদ্ধক্ষত্র অনেক সাধ্যসাধনা করে পুত্রলাভ করেছিলেন এবং হয়তো বা তা উচিত বয়সের থেকে অনেক দেরিতে। সেই কারণেই পুত্রস্নেহের আতিশয্য তাঁর হৃদয় এতটাই অধিকার করে ছিল যাতে এইরকম অভিশাপ দিয়েছিলেন যে, রণক্ষেত্রে যে ব্যক্তি তাঁর পুত্রের মৃত্যুর কারণ হবে, সেও মারা পড়বে একইভাবে। ভূমিতে মস্তক পাতিত হলে প্রতিপক্ষের মস্তকও শতধা বিদীর্ণ হবে— এটা হয়তো অভিশাপের বৈচিত্র্য-গৌরব বহন করে। কিন্তু আমাদের মনে হয়— বৃদ্ধক্ষত্র পুত্রের মৃত্যু হলে নিজেও বৃদ্ধ বয়সে যুদ্ধ করতে রাজি ছিলেন, পুত্রের মৃত্যুর প্রতিশোধ-স্পৃহায়। হয়তো সেই কারণেই তাঁকে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধভূমির অতিনিকটে সমন্তপঞ্চকে দেখা যাচ্ছে তপস্যারত অবস্থায়।

কৃষ্ণ অর্জুনকে বলেছিলেন— তুমি জয়দ্রথের মাথাটা তির দিয়ে এমনভাবেই ছিন্ন করো যাতে সেটি তাঁর বাবার কোলের ওপরে গিয়ে পড়ে। আর সেটা তোমার মতো ধনুর্ধরের কাছে এমন কিছু কঠিন কাজ নয়, কেন না তিনি এই সমন্তপঞ্চকের বাইরে বসেই গাঢ় তপস্যা করছেন— সমন্তপঞ্চকাদ্ বহির্বানরকেতন। দেখুন, সমন্তপঞ্চক আর কুরুক্ষেত্র প্রায় একই জায়গা। সেই যুদ্ধভূমির ঈষৎ বাইরে তিনি বসে আছেন। একটাই প্রশ্ন জাগে— যিনি সিন্ধু-সৌবীরের রাজা তিনি তপস্যার জন্য যদি দূর দেশেই যান, তবে সমন্তপঞ্চকে আসবেন কেন, তপস্যার জন্য তো হিমালয় পাহাড় বা গঙ্গাদ্বার অথবা বারাণসী সেকালেও বিখ্যাত ছিল। ঠিক যুদ্ধভূমির বাইরেই জয়দ্রথের পিতা তপস্যা করছেন— এই কথাটা তাঁর তপস্যার বিষয়ে আমাদের সন্দেহান্বিত করে তোলে। তা ছাড়া তপস্যা করার অর্থ শুধু দেবভাব সাধনা করাই নয়, তপস্যা করা মানে গাঢ় ভাবে কোনও বিষয়ে চিন্তা করা বা ভেবে চলাও হয়। পুত্র জয়দ্রথ মহাবীর অর্জুনের সঙ্গে যুদ্ধ করছে, অতএব যুদ্ধভূমির বাইরে দাড়িয়ে তিনি সেই বিষয়ে চিন্তা করছেন, পুত্রস্নেহাতুর পিতার পক্ষে এটা অনেক স্বাভাবিক যুক্তি হয়। তাঁর ওপরে কৃষ্ণ জয়দ্রথকে মারার কথা বলেই তাঁর তপস্বী পিতার কোলে পুত্রের কাটা-মুন্ডুটি স্থাপন করার কথা বলছেন, যাতে সেই তপস্বী সঙ্গে সঙ্গে মারা যান— এই ব্যবহার তখনকার সামাজিক চেতনার সঙ্গে মেলে না। একজন নির্দোষ তপস্যারত ব্যক্তির এমন আকস্মিক হত্যাকাণ্ড সে-কালের সামাজিক রীতিতে একেবারেই গ্রহণযোগ্য হবার কথা নয়। কৃষ্ণের রাজনৈতিক অন্যায় এবং চতুরতা নিয়ে অনেক অপযশ মহাভারতেই কীর্তিত হয়েছে শত্রুপক্ষের মুখে, কিন্তু কৃষ্ণের র্দুবৃদ্ধিতে একজন তপস্বী মহাজনকে অর্জুন হত্যা করেছেন, এ-কথা কেউ বলেননি। এই বিচার থেকে মনে হয়— জয়দ্রথের মস্তক-ছেদনের সঙ্গে সঙ্গে তাঁর পিতাকেও হত্যা করাটা হয়তো তখনকার ব্যবহারিক তথা বাস্তব প্রয়োজনে এসে দাঁড়িয়েছিল। অতএব।

কৃষ্ণ অর্জুনকে বললেন— অস্ত্রচালনায় তোমার অসাধ্য কিছু নেই। তুমি অসাধারণ দিব্য অস্ত্রে জয়দ্রথের মাথা কাটার সঙ্গে সঙ্গে তাঁর পিতার কোলে নিয়ে ফেল সেই মাথা— ন হ্যসাধ্যম্ অকার্য্যং বা বিদ্যতে তব কিঞ্চন। কৃষ্ণের কথা শুনে অর্জুন সরোষে ওষ্ঠপ্রান্ত লেহন করে অভিমন্দ্রিত অস্ত্র ত্যাগ করলেন জয়দ্রথের উদ্দেশে। একসঙ্গে অনেকগুলি বাণ ছেড়ে লক্ষ্যভেদ করার ক্ষমতা অর্জুনের অভ্যস্ত বিদ্যা। সকলে আশ্চর্য হয়ে দেখল— অর্জুনের ছোড়া বাণগুলি জয়দ্রথের কর্তিত সকুণ্ডল মস্তকখানি ঊর্ধ্বে বহন করে নিয়ে চলল সমন্তপঞ্চকের প্রান্তভূমিতে— যেখানে জয়দ্রথের পিতা পদ্মাসনে সন্ধ্যাবন্দনা করছিলেন। হঠাৎই জয়দ্রথের কৃষ্ণকেশযুক্ত সকুণ্ডল মস্তকখানি এসে পড়ল বৃদ্ধক্ষত্রের কোলের ওপর— তস্যোৎসঙ্গে নিপতিতং শিরস্তচ্চারুকুণ্ডলম্।

বৃদ্ধক্ষত্র তেমন করে খেয়ালও করেননি, অলক্ষিতেই হঠাৎ একটি কর্তিত রক্তাক্ত নরমুণ্ড এসে কোলের ওপর এসে পড়ল, তাই হঠাৎ করেই তিনি লাফ দিয়ে উঠে পড়লেন বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে— প্রোত্তিষ্ঠতস্তৎ সহসা শিরোহগচ্ছদ্ধরাতলম্— সঙ্গে সঙ্গেই জয়দ্রথের মাথাটা গিয়ে পড়ল মাটিতে এবং সঙ্গে সঙ্গেই বৃদ্ধক্ষত্রের মাথা ফেটে গেল চৌচির হয়ে। বৃদ্ধক্ষত্র মারা গেলেন।

ঠিক এইভাবেই বৃদ্ধক্ষত্র মারা গেলেন কিনা, তাতে লৌকিক সন্দেহ থাকতেই পারে, এমন হতেই পারে যে, পুত্রের কর্তিত মস্তকটি দেখে বৃদ্ধক্ষত্র আকস্মিক আঘাতেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছেন। কিন্তু কী কারণে, কোন অবস্থায় জয়দ্রথের মরণ হল— এই সংবাদ-বৈচিত্র্যের চেয়েও বড় কথা হল— জয়দ্রথ তাঁর পিতা সহ অর্জুনের বাণে মারা পড়লেন। সন্ধ্যার অন্ধকার ঘনিয়ে আসছিল বলে যারা একটু আগেই অর্জুনের আত্মহত্যা-বিষয়ে নিশ্চিত হচ্ছিলেন, তারা দেখল— জয়দ্রথই মারা পড়লেন অর্জুনের হাতে এবং সেই মৃত্যুর পরেই সূর্যের আবরণ-অন্ধকার দূর হয়ে গেল। অর্থাৎ সূর্য তখনও অস্তমিত নয়, অর্জুন তাঁর প্রতিজ্ঞা রেখেছেন। হঠাৎ সেই আকস্মিক অন্ধকার নিতান্তই এমন কোনও মায়া, যা কৃষ্ণের পক্ষেই সৃষ্টি করা সম্ভব ছিল এবং তাতে সাময়িকভাবে পরপক্ষ একেবারেই বিমূঢ় হয়ে গিয়েছিল— বাসুদেব-প্রযুক্তেয়ং মায়েতি নৃপসত্তম।

জয়দ্রথ মারা গেলে দুর্যোধন এবং তাঁর ভাইয়েরা কিছু চোখের জল ফেললেন বটে, কিন্তু জয়দ্রথ মারা যাওয়ায় সবচেয়ে বড় সর্বনাশ যার হল, সেই দুঃশলার কথা একবারও প্রসঙ্গত এল না এখানে। তাঁর বৈধব্য-বেদনার একাংশও এখানে বর্ণিত হয়নি, এমনকী সেই বনবাসপর্বে যে ভগিনীর কথা মনে রেখে যুধিষ্ঠির পর্যন্ত জয়দ্রথকে হত্যা করতে দেননি, সেই দুঃশলার কথা তাঁর ভাইরাও একবার উচ্চারণ করলেন না আর মহাভারতের কবিও সংসারের এই বিচিত্র ব্যবহারে আশ্চর্য হয়ে নিজেও বর্ণনায় বিরত রইলেন। আসলে একশো ভাইয়ের এক বোনের সঙ্গে যতই বিবাহ হোক জয়দ্রথের, দুর্যোধন-ভাইরা ভগিনীর ব্যাপারে অনেকটাই উদাসীন ছিলেন। আর জয়দ্রথের সঙ্গে তাঁদের যে সম্পর্কটুকু গড়ে উঠেছিল, সেটাও অনেকটা রাজনৈতিক এবং সামরিক প্রয়োজনবশে। জয়দ্রথ বিখ্যাত হয়ে উঠেছেন অভিমন্যুর মতো বীরবধের কারণ হয়ে ওঠায়। ওই একদিনই তিনি অসাধারণ যুদ্ধ করেছিলেন এবং ওই একদিনের জন্যই কৌরবপক্ষে তাঁর সম্মান যেমন বেড়ে গিয়েছিল, তেমনই ওই একদিনের বীরত্ব দেখাতে গিয়েই বিপক্ষের হাতে তিনি মৃত্যু বরণ করলেন। নইলে জয়দ্রথের যা চরিত্র, যেমন তাঁর রুচিবিগর্হিত কামনা, যেমন স্বার্থান্বেষিতায় কৌরবপক্ষে তাঁর যোগদান— সব কিছুই এমন যে, মহাকাব্যের কবি তাঁকে প্রথম থেকে মহাভারতের কাহিনি-পরম্পরায় প্রবেশ করাতে পারেননি, বরঞ্চ অভিমনু-বধের বিপরীত পটভূমিতে দাঁড় করিয়ে দিয়েই মহাভারতের কবি জয়দ্রথের গৌরব চিহ্নিত করেছেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *