বলরাম সঙ্কর্ষণ

বলরাম সঙ্কর্ষণ

জগন্নাথ-ধাম শ্রীক্ষেত্রে রথযাত্রার উৎসব আরম্ভ হয়েছে। সেই মহাপ্রভু চৈতন্যের সময় থেকে গৌড়-বঙ্গের শত শত আমোদী ভক্ত রথযাত্রা উপলক্ষে পুরীতে যান রথের রশি টানতে। পণ্ডিত-মূর্খ, ধনী-দরিদ্র, ব্রাহ্মণ-চণ্ডাল, স্ত্রী-পুরুষ— সকলেই রথের দিনে রথোপরি জগন্নাথ-দর্শন করে পরম আনন্দ লাভ করেন। সেবারে ভারত-খ্যাত পণ্ডিত জগন্নাথ তর্কপঞ্চাননও পুরীতে এসেছেন রথযাত্রায়।

তুর্কপঞ্চানন তো কম লোক নন, স্বয়ং উইলিয়াম জোন্স তাঁর কাছে সংস্কৃত ভাষা এবং সাহিত্যের পাঠ নিয়েছেন, তখনকার কলকাতা হাইকোর্টের শ্বেতচর্ম ন্যায়াধীশেরা তাঁর সঙ্গে সদাসর্বদা যোগাযোগ রাখেন হিন্দু আইন সঠিক বুঝে নেবার জন্য। এ-হেন জগন্নাথ তর্কপঞ্চানন, যাঁর পাণ্ডিত্যের খ্যাতি উৎকল-কাশী-কান্যকুব্জের মতো বিদ্যাকেন্দ্রগুলির সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে, তিনি আজ রাজপথে এসে দাঁড়িয়েছেন রথের রশি আকর্ষণ করার জন্য। মান্য পণ্ডিত বলে তাঁর আশেপাশে পণ্ডিত-সজ্জন এবং গজপতি-রাজবংশের অধস্তন মহারাজ চলদ্‌বিষ্ণু এবং রাজপরিবারের অন্যান্য লোকজন ভিড় করে দাঁড়িয়ে আছেন। সকলে অপেক্ষা করছেন— কখন জগন্নাথ-বলরাম-সুভদ্রাকে রথগর্ভে দর্শন করা যাবে॥

আপনারা যাঁরা স্বচক্ষে রথযাত্রা দেখেছেন, তাঁরা জানেন যে, জগন্নাথ, বলরাম এবং সুভদ্রা— শ্রীক্ষেত্রের এই তিন মূর্তিকে মন্দির-চত্বর থেকে বাইরে রাজপথে দাঁড়ানো রথের ওপরে তোলা খুব সোজা কর্ম নয়। আর উড়িয়া পাণ্ডা-পুরোহিতেরা যেভাবে, যে অদ্ভুত বিমাননায় এই তিন ভগবদ্-বিগ্রহকে রথের ওপরে তোলেন, তাতে রসিক সজ্জন ছাড়া অন্য যে কোনও অল্পগ্রাহী, অল্পবোধী মানুষের সচন্দন-তুলসীর ভক্তিদর্পে আঘাত লাগতে পারে। বস্তুত এই তিন দেবমূর্তির সঙ্গে শ্রীক্ষেত্রবাসী উড়িয়াদের এতটাই প্রিয়ত্বের সম্বন্ধ, জগন্নাথ-বলরাম-সুভদ্রাকে তাঁরা এতটাই আপন মনে করেন যে, পূজা-বিধির সমস্ত কঠিন আচার-প্রক্রিয়া সত্ত্বেও রথে ওঠানোর সময় জগন্নাথ-বলরামকে নিয়ে তাঁরা রীতিমতো লৌকিক ব্যবহারে মত্ত হয়ে ওঠেন। এই দেবমূর্তিদের ঝাঁকিয়ে, নাড়িয়ে, কথা বলে, এমনকী তীব্র গালাগালি দিয়েও জগন্নাথপ্রেমী উড়িষ্যাবাসীরা পরম প্রশ্রয়ে রথে তোলেন জগন্নাথ-বলরাম-সুভদ্রাকে।

যেবার পণ্ডিত জগন্নাথ পঞ্চানন সাঙ্গোপাঙ্গে দাঁড়িয়ে জগন্নাথ-বলরামের এই রথারোহণ-লীলাকৌতুক দর্শন করছেন, সেবার একটা কাণ্ড ঘটল। জগন্নাথ-সুভদ্রা-বলরামের মধ্যে সম্বন্ধ-মর্যাদায় বলরামই সবার বড়। তো পুরীর পাণ্ডারা তাঁকে ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে রথে ওঠাচ্ছেন, সঙ্গে চলছে কাঁসি-করতালের শব্দছন্দে অন্যান্য উড়িয়া পাণ্ডাদের নিতম্বোদ্ভেদী কীর্তন। পুরীর গজপতি মহারাজ চলদ্‌বিষ্ণু দূরে করজোড়ে দাঁড়িয়ে আছেন, দাঁড়িয়ে আছেন পণ্ডিত জগন্নাথ পঞ্চানন ভক্তিনম্র দৃষ্টিতে। এরই মধ্যে হঠাৎ সেই ভয়ংকর কাণ্ড ঘটল। সম্ভবত পাণ্ডাদের বজ্রঝাঁকানির মাঝে পড়ে প্রভু বলভদ্রের বিগ্রহমূর্তি রথ থেকে মাটিতে পড়ে গেল। চারিদিকে সকলের বুক কেঁপে উঠল অদৃষ্ট আশঙ্কায়— কী অমঙ্গল ঘটবে কে জানে! স্বয়ং মহারাজ চলদ্‌বিষ্ণু কপালে করাঘাত করে চেঁচিয়ে উঠলেন— কী অমঙ্গল! কী অকল্যাণ! কী ঘটবে আজ, প্রভু বলভদ্র মাটিতে পড়ে গেলেন, কী হবে আজ!

ভারতজয়ী পণ্ডিত জগন্নাথ তর্কপঞ্চানন সবটাই দেখছিলেন এতক্ষণ, নিবিষ্ট মনে। মহারাজ চলদ্‌বিষ্ণুর বিলাপকল্প খেদোক্তি থেকে পণ্ডিত বুঝতে পারছিলেন— মহারাজ চলদ্‌বিষ্ণু সমস্ত উড়িষ্যাবাসীর প্রতিনিধি হয়েই খেদোক্তি করছেন যেন। অজানা অমঙ্গলের আশঙ্কায় রথযাত্রার মতো এই বিরাট আনন্দ উৎসব মুহূর্তে ম্রিয়মাণ হয়ে উঠবে— তিনি বুঝতে পারছিলেন। একথাও তাঁর মনে হল যে, ভারতবর্ষের নানান জায়গা থেকে তাঁর কাছে মানুষ আসে নানান সমস্যার বিধান চাইতে, বিপন্ন মানুষকে তিনি শাস্ত্রের বিচিত্র বিধান শুনিয়ে কত সহজ করে তোলেন তাঁদের সমস্যা, অথচ এখানে এত বড় আনন্দ উৎসবের ওপর যেন এক বিরাট আঘাত নেমে এসেছে— ভগবান বলভদ্র পাণ্ডাদের হাত ফসকে মাটিতে পড়ে গেছেন। পণ্ডিত তার পরিশীলিত শাস্ত্রবোধ থেকেই একথা বোঝেন— যে এটা নেহাতই একটা আকস্মিক ঘটনা। নইলে উড়িয়া পাণ্ডারা ভগবান বলভদ্রের ভগবত্তার উচ্চতার ওপরেও তাঁকে প্রাণের চাইতেও বেশি ভালবাসেন। তাই শ্রীমূর্তি পড়ে যাবার পিছনে নেহাতই এক আকস্মিকতা আছে এবং আর কিছুই নেই।

পণ্ডিত জগন্নাথ পঞ্চানন কুসংস্কারমুক্ত মানুষ, সবচেয়ে বড় কথা, তিনি মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্যের দেশের লোক, তিনি বাঙালি। মহাপ্রভু যেমন এই রথাগ্রে কীর্তন করে উড়িয়া-গৌড়িয়া ভক্তজনের মন মাতিয়েছিলেন এককালে, আজ ঠিক সেইখানে দাঁড়িয়ে আছেন ত্রিবেণীর জগন্নাথ তর্কপঞ্চানন। কী করে চির-পরিচিত উড়িষ্যাবাসীদের এমন অমঙ্গল-আশঙ্কায় দুশ্চিন্তিত দেখে খুশি হবেন তিনি? তা ছাড়া ভারতবর্ষের প্রান্ত-উপান্ত থেকে দুনিয়ার লোক সমস্যায় পড়লেই যখন তাঁর কাছে বিধান চাইতে আসে, তখন সেই বিধান দেবার সময় শাস্ত্রের শুষ্ক আচার-প্রক্রিয়ার চেয়েও বিধান-দাতা ব্রাহ্মণের মার্মিক সহৃদয়তার প্রয়োজন বেশি হয়। অন্তত ত্রিবেণীর জগন্নাথ পঞ্চানন তেমনই এক সহৃদয়। ঠিক সেই কারণেই গজপতি চলদ্‌বিষ্ণু এবং রথাগ্রে উপস্থিত সকল জনতার হৃদয় বুঝে পণ্ডিত জগন্নাথ বিচিত্র এক বিধান উচ্চারণ করলেন, যাতে এক মুহূর্তে সব শান্ত হয়ে গেল।

বলরামের বিগ্রহ মাটিতে পড়ে যেতেই মহারাজ চলদ্‌বিষ্ণু বলেছিলেন— এ কী অমঙ্গল! যার সংস্কৃত প্রতিশব্দটি ছিল ‘ঔৎপাতিক’— কথাটা ‘উৎপাত’ থেকেই এসেছে। তর্কপঞ্চানন সেই অমঙ্গল-উৎপাতের কথাটা ধরেই বলতে আরম্ভ করলেন। বললেন— আপনি অকারণে বিব্রত হচ্ছেন, মহারাজ। কোনও ভয়ংকর অমঙ্গল ‘ঔৎপাতিক’ কিছু ঘটে যায়নি। তবে হ্যাঁ, আপনি অমঙ্গল অকল্যাণের কথা বলতে পারতেন, যদি এখন মহাপ্রভু জগন্নাথ অথবা সুভদ্রা পড়ে যেতেন রথ থেকে— নারায়ণো যদি পতেদ্‌ অথবা সুভদ্রা। কিন্তু তা তো হয়নি, পড়ে গেছেন বলরাম, তাঁর পড়ে যাওয়াটা একান্তই স্বাভাবিক। মহারাজ চলদ্‌বিষ্ণু অবাক চোখে তাকিয়ে রইলেন পণ্ডিত জগন্নাথ তর্কপঞ্চাননের চোখের দিকে। পণ্ডিত বললেন— দেখুন— ভগবান বলভদ্র সর্বক্ষণ মদ্য পান করেন। মদের ঘোরে তাঁর চক্ষু দুটি সদাই আরক্ত হয়ে থাকে, মাথাটাও ঘুরছে সব সময়। তার মধ্যে কাঁধে অত বড় একখানা লাঙল তাঁর অস্ত্র। তা এমন টল-টলায়মান অবস্থায় তিনি যদি মাটিতে পড়ে গিয়ে থাকেন, তার মধ্যে অস্বাভাবিক কিছু নেই— যুক্তং হি লাঙ্গলভৃতঃ পতনং পৃথিব্যাম্‌— আপনি বিব্রত হবেন না, মহারাজ!

কৃষ্ণ-জ্যেষ্ঠ বলরাম সম্বন্ধে এই যে অসাধারণ শ্লোকটি উচ্চারণ করলাম তার কারণ এই নয় যে, বিশাল মাপের এই মানুষটিকে আমরা এক মদ্যপের ছকে বেঁধে ফেলতে চাইছি। বরঞ্চ বলতে চাই— বলরামের কথা মনে হলেই মদ্যপ-সুজনের মতোই এক দরাজহৃদয়, ভোলেভালা, নিতান্তই সরল এক ব্যক্তিত্বের কথা মনে আসে এবং সেখানে এই মদের ঘোরটুকু তাঁর অতি-সরল চরিত্রের প্রতীক হয়ে ওঠে। কবি কালিদাস লিখেছিলেন— চাঁদের মধ্যে যে কলঙ্কের মালিন্যটুকু থাকে তা চাঁদের শোভা আরও বাড়িয়ে দেয়। বলরামের ক্ষেত্রেও তাই, তাঁর চরিত্রের সব দোষগুলি— তাঁর মদ খাওয়া, তাঁর অসহনীয়তা, তাঁর রাগ— এই সমস্ত কিছু তাঁর চরিত্রের স্বচ্ছতা এবং আহ্লাদিনী শক্তিগুলি আরও শতগুণ বাড়িয়ে দেয়। কবিদের মধ্যে বলরামের এই সরল প্রতিভাস এমনই যে, তাঁর কাছে আশীর্বাদ প্রার্থনা করবার সময়েও ভাসের মতো নাট্যকার মহাকবি চেয়েছেন— সংসারভীত মনুষ্যকুলকে সুরক্ষা এবং অভয় দেবার কালেও বলরামের চন্দ্রসবর্ণ বাহুদুটি যেন মদ্যপানে অবশ থাকে— আসবদত্তৌ অবলৌ ভুজৌ। কবি এই অবশতা চান এই কারণে যে, বলরাম যাঁকে প্রিয় মনে করেন তার প্রতি তিনি মুক্তহক্ত। মদবিহ্বল পুরুষ যেমন কারণ-অকারণ কিছুই না জেনে, কিছুই না বুঝে অকপটে সর্বস্ব দান করতে পারে, মহাকবি বলরামের কাছেও সেইরকম মদবিহ্বল বিপুল আশীর্বাদ চেয়েছেন। বলরাম খুশি হলে প্রার্থীর কাছে কিছু অপ্রাপ্য থাকে না। তাঁর কাছে যুক্তি, তর্ক, বিচার— এগুলি খুব বড় কথা নয়, মদ্যপের নির্বিচার নির্বিকার মনোভাবটুকুই বলরামের প্রধানতম চরিত্র-ভাবনা। এই নিরিখেই তাঁর সার্বিক বৈশিষ্ট্য। কবি-পণ্ডিত জগন্নাথ তর্কপঞ্চানন ঊনবিংশ খ্রিস্টাব্দে বলরামকে যেমন বুঝিয়েছিলেন, খ্রিস্টীয় দ্বিতীয়-তৃতীয় শতাব্দীতেও ভাসের মতো বিখ্যাত নাট্যকার বলরামকে একইভাবে উপলব্ধি করেছেন। অতএব বলরামকে আমাদের বুঝতে হবে যুক্তি, তর্ক, বিচারের অন্তরাল কাটিয়ে উঠে, তাঁকে চিনতে হবে তর্কাতীত সহনশীলতা দিয়ে, আবেগ দিয়ে। কেন না, বলরাম মানুষটাই বড় আবেগপ্রবণ, আর আবেগপ্রবণ মানুষকে আবেগ দিয়েই বুঝতে হয়, নইলে সহৃদয়তা, সমানহৃদয়তা বলে যে কথাগুলি আছে, সম-আলোচকের কাছে সে-সব শব্দের আবেদন নিরর্থক হয়ে উঠবে।

॥ ২ ॥

বলরামকে ভগবত্তার স্বরূপে ভগবান বলে চিহ্নিত করব কিনা, সে তর্কে প্রবেশ করে লাভ নেই। কেন না তার মধ্যে অলৌকিকের যতটুকু অভিসন্ধি ঘটবে, তাতেই বস্তুপ্রমাণবাদী জনতা হইহই করে উঠবেন। বলবেন— আহা! এ কত বড় রূপকথা সেকালের ঠাকুরমার ঝুলি থেকে বেরিয়ে এসেছে। মনে হতেই পারে এমন কথা, কারণ পুরাণকাহিনি হরিবংশ, বিষ্ণুপুরাণ, ভাগবতপুরাণ সকলে একযোগে বলেছে— মথুরাধিপতি কংস যখন একের পর এক দেবকীর ছয়টি ছেলে হত্যা করে ফেললেন, তখন দেবলোকে বিষ্ণু ভগবান, ভগবতী যোগমায়াকে আদেশ দিলেন— দেবকীর সমারূঢ় সপ্তম গর্ভ টেনে নিয়ে গিয়ে বসুদেবের অন্য পত্নী রোহিণীর গর্ভে স্থাপন করতে হবে। যোগমায়া বিষ্ণুর আদেশ পালন করলেন এবং কৃষ্ণজ্যেষ্ঠ বলরামের অন্য নাম হল সঙ্কর্ষণ। যেহেতু দেবকীর গর্ভ সম্যকভাবে আকর্ষণ করা হয়েছিল, তাই এই নাম। আজকের দিনে যোগমায়ার অঘটন-ঘটন-পটীয়সী মহাশক্তির কথা তেমন কোনও প্রত্যয় জাগাবে না— সেকথা বেশ বুঝি। কিন্তু বাস্তবের দৃষ্টিতে, ইতিহাসের দৃষ্টিতে পৌরাণিক কাহিনির নির্মোক ছাড়িয়ে নিলেও খুব অসুবিধে হবার কথা নয়।

মনে রাখা দরকার, বলরামের জন্মের পিছনে কৃষ্ণের মতোই একটা রহস্য আছে এবং সে রহস্যের কারণ ছিল তাঁদের জন্মকালীন রাজনৈতিক পরিস্থিতি, যার ফলে কৃষ্ণও যেমন সুস্থ এবং স্বাভাবিকভাবে লালিত হবার মতো একটা জন্মভূমি লাভ করতে পারেননি, তেমনই বলরামও একটা বিশ্বস্ত জন্মভূমি লাভ করেননি। বলরামের জন্মের সময়ে মথুরা-শূরসেন অঞ্চলের অধিপতি ছিলেন কংস এবং অধিকাংশ পুরাণমতে কৃষ্ণ-বলরামের পিতা বসুদেব তখন কংসের কারাগারে বন্দি ছিলেন অথবা অতটা না ভাবলেও নজরবন্দি ছিলেন।

ইতিহাস মনে রাখলে দেখবেন— অন্যান্য মহাজনপদের মতো মথুরা-শূরসেন অঞ্চলে রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত ছিল না। এখানে রাষ্ট্রের প্রকৃতি ছিল সংঘরাষ্ট্রের। সংঘরাষ্ট্রের প্রকৃতি মহাভারত এবং কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে যেমন উল্লিখিত আছে, তাতে রাজতন্ত্রের একনায়কের মতো শাসন এখানে চলত না। উৎসাহী ঐতিহাসিকদের মধ্যে কোনও কোনও পণ্ডিত-সুজন সংঘরাষ্ট্রগুলিকে ‘রিপাবলিক’ পর্যন্ত বলতে চেয়েছেন, আমরা হয়তো অতটা বলতে চাই না। কেন না এই সংঘরাষ্ট্রগুলি অনেক সময়ে পরিচালিত হত এক-একটি বিখ্যাত বংশের বিভিন্ন জ্ঞাতি-শরিকদের প্রধানদের দ্বারা। এমনও হতে পারত যে, বিভিন্ন কুলসংঘের প্রধানেরা মিলেই একটি সংঘরাষ্ট্র পরিচালনা করতেন। কৌটিল্য নিজে সংঘরাষ্ট্রের আলোচনায় পূর্বকালে যদু-বৃষ্ণি সংঘের কথা উল্লেখ করেছেন এবং মহাভারতের প্রমাণে আমরা জানি যে, কৃষ্ণ-বলরাম যে বংশে জন্মেছিলেন, সেই বংশে অন্তত আঠেরো জন কুলপ্রধান ছিলেন— কুলৈরষ্টাদশাবরৈঃ। এঁরা সিদ্ধান্ত নিতেন একত্রে বসে এবং সেইসব সিদ্ধান্তে অধিকাংশের বিবেচনা বেশি মূল্যবান ছিল।

মনে রাখা দরকার, এই যে কুলপ্রধানদের রাজত্ব, এটাকে আমরা ‘অলিগার্কি’ বলি বা অন্য কোনও সংজ্ঞা থাকুক তার, এই কুলসংঘের প্রকৃতি নষ্ট করে দিয়েছিলেন কংস। তিনি তাঁর শ্বশুর মগধরাজ জরাসন্ধের বলে বলীয়ান হয়ে নিজের পিতা উগ্রসেনকে বন্দি করে কারাগারে নিক্ষেপ করেছিলেন এবং কৃষ্ণ-বলরামের পিতা বসুদেব যেহেতু কংসের বিরোধী গোষ্ঠীর মানুষ ছিলেন, তাই কংসের কোপে পড়ে তিনি পুরোপুরি কারাগারে নিক্ষিপ্ত না হলেও নজরবন্দি ছিলেন অবশ্যই। তবে নজরবন্দি থাকলেও কৃষ্ণপিতা বসুদেবের নিজস্ব প্রভাব কম ছিল না। হরিবংশের প্রমাণে তিনি অন্যতম সংঘমুখ্য এবং কংসের রাজসভায় তাঁর পক্ষে কথা বলবার লোকও যথেষ্ট ছিল। কিন্তু কংস যেহেতু সমস্ত সংঘমুখ্যদের ক্ষমতা নষ্ট করে দিয়ে রাজনৈতিক শক্তির কেন্দ্রায়ন ঘটিয়েছিলেন নিজের মধ্যে, তাই নিজের বহুতর প্রভাব থাকা সত্ত্বেও বসুদেব অনেকটাই অক্ষম ছিলেন নিজের ইচ্ছেতে জীবন পরিচালনা করতে। তিনি বেশ বুঝতে পারছিলেন যে, কংসের প্রতিপক্ষতা করতে গিয়ে তিনি যেমন তাঁর নিজের জীবন বিপন্ন করে তুলেছেন, তেমনই বিপন্নতা তৈরি হয়েছে তাঁর পুত্র, পরিবার এবং স্বজনদের জীবনেও। পুরাণগুলিতে দেখতে পাবেন যে, কৃষ্ণের আবির্ভাব বর্ণনা করতে গেলেই কথকঠাকুর বলছেন— বসুদেবের আর এক স্ত্রী রোহিণী বৃন্দাবনে গোকুলে থাকতেন— গোকুলে বসুদেবস্য ভার্যা বৈ রোহিণী স্থিতা। আমরা জানি— রোহিণী বসুদেবের অন্যতমা স্ত্রী এবং কৃষ্ণমাতা দেবকী ছাড়াও বসুদেবের আরও অনেক স্ত্রী ছিলেন। কিন্তু দেবকী সহ অন্য সব স্ত্রীকে বসুদেব মথুরাতেই রেখে দিতে পারলেন, অথচ রোহিণীকে হঠাৎ অনেক আগেই বৃন্দাবনে নন্দগোপের আশ্রয়ে রেখে আসতে গেলেন কেন!

এই প্রশ্নের উত্তর যদি লৌকিক এবং বাস্তব দৃষ্টিতে খুঁজতে হয়, তা হলে বলরাম এবং কৃষ্ণের জন্মকালীন সময়ে বসুদেবের নিজস্ব বিপন্নতাগুলি বুঝতে হবে। এটা ধরেই নিতে পারি যে, কংস বসুদেবের রাজনৈতিক প্রভাব মাথায় রেখে সরাসরি তাঁর জীবনহানির চেষ্টা না করে তাঁর সদ্যোজাত পুত্রগুলিকে মেরে ফেলার কূট পদ্ধতি অবলম্বন করেছিলেন। বসুদেব সেটা বুঝেই প্রথমত গর্ভবতী রোহিণীকে বৃন্দাবনে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন নির্বিঘ্ন প্রসবের জন্য। আমরা যারা কৃষ্ণ-বলরামের পূর্ণ ভগবত্তায় বিশ্বাস করি, তাদের কাছে ভগবতী যোগমায়া কর্তৃক দেবকী-গর্ভ আকর্ষণ করে রোহিণীর গর্ভে স্থাপন করার কাহিনি অবিশ্বাসের বস্তু নয় কখনওই। কিন্তু যাঁরা যোগমায়ার অঘটন-ঘটন-পটীয়সী শক্তিতে বিশ্বাস করেন না, তাঁরা লৌকিক দৃষ্টিতেও এই কথাটা বুঝতে পারবেন যে, দেবকীর পুত্র-জন্মের দশ মাস সময়টুকু কিন্তু ঠিকই ধরা আছে পুরাণগুলির মধ্যে। ভগবান বিষ্ণু যোগমায়াকে আদেশ দিচ্ছেন— দেবকীর গর্ভ সাত মাসে পড়লেই তুমি সপ্তম মাসেই সেই গর্ভ আকর্ষণ করে রোহিণীর গর্ভে স্থাপন করবে— স সংক্রাময়িতব্যস্তে সপ্তমে মাসি রোহিণীম্‌।

আমাদের ধারণা— এই পঙ্‌ক্তিটিই লোকিক আর অলৌকিক দৃষ্টির মিলনস্থল। আসলে বোধহয় রোহিণীর গর্ভলক্ষণ লোকচক্ষুতে প্রকট হবার অনেক আগেই, অর্থাৎ বসুদেব যে মুহূর্তে বুঝেছেন, রোহিণী অন্তঃসত্ত্বা, সেই মুহূর্তেই কংসের ভাবী আক্রমণ সম্ভাবনায় বসুদেব তাঁকে বৃন্দাবনে পাঠিয়ে দিয়েছেন। সেই জন্যই পুরাণগুলিতে সর্বত্র এই প্রচার যে, রোহিণী পূর্ব থেকেই বৃন্দাবনে অবস্থান করছেন। অলৌকিকী কথায়— যোগমায়া দেবীর ওপর আদেশ ছিল— দেবকীর সপ্তম গর্ভ সপ্তম মাসে পড়তেই তিনি তাকে আকর্ষণ করে নিয়ে রোহিণীর গর্ভে স্থাপন করবেন, আর কংসের কাছে এই প্রচার করা হবে যে, দেবকীর সপ্তম গর্ভ বিস্রস্ত হয়ে গেছে। আমরা বলি— এই অলৌকিক প্রচারটুকু তো অন্যভাবেও বিশ্লেষণ করা যায়। বস্তুগতভাবে দেখতে গেলে এটা বলা যায় যে, সাত মাসের গর্ভ আসলে ছয় মাসের পূর্ণতা বোঝায়, সপ্তম মাস এখানে বাড়ন্ত কথা। আর ছয় মাসের গর্ভ অনেক সময়েই ভাল ঠাহর করা যায় না, তেমন অঙ্গসাযুজ্যে সেটা আরও বোঝা অসম্ভব। আর একথা দেবকীর ক্ষেত্রেও সত্য, রোহিণীর ক্ষেত্রেও সত্য। অতএব দেবকীর গর্ভধারণের ঘটনাটুকু সত্য হোক বা নাই হোক— সময়ে প্রচারিত হল— দেবকীর গর্ভপাত ঘটে গেছে— অহো বিস্রংসিতো গর্ভ ইতি বাচঃ বিচুক্রুশুঃ।

দেবকীর গর্ভপাতের এই ঘটনার পর রোহিণীকে আমরা বৃন্দাবনে যেমনটি দেখতে পাচ্ছি, তার একটা নমুনা পাওয়া যাবে হরিবংশ-ঠাকুরের জবানিতে। হরিবংশে দেখছি— রাত্রির অন্ধকারে বসুদেব-পত্নী রোহিণী নিজের শরীরে উদ্‌গত গর্ভলক্ষণ দেখে কেমন যেন উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছিলেন, তাঁর এই উদ্বিগ্ন ভাব কেটে গেল নিদ্ৰাস্বরূপিণী যোগমায়া দেবীর কথায়। তিনি বলেছিলেন— রোহিণী! তোমার উদরের মধ্যে নিবিষ্ট এই গর্ভ আকর্ষণ করে নিয়ে আসায় এই পুত্র সঙ্কর্ষণ নামে প্রসিদ্ধ হবে। কথাটা শুনে রোহিণী খুব খুশি হলেন, কিন্তু তাঁর কেমন যেন লজ্জাও হল। লোকলজ্জা, উদ্‌গত গর্ভলক্ষণ সকলের সামনে প্রকাশিত হওয়ায় লজ্জায় তাঁর মুখ অধোগামী হল। বিশেষত বসুদেব এখানে উপস্থিত নেই অনেকদিন, সেই কারণেই লজ্জা হল একটু— কিন্তু অবশ্যই তা পুত্রলাভের আনন্দের সঙ্গে মিশ্রিত এক বিচিত্র লজ্জা— সা তং পুত্রমবাপ্যেবং হৃষ্টা কিঞ্চিদ্‌ অবাঙ্‌মুখী— তিনি ভাল করে সবার সামনে কথা বলতে পারছিলেন না।

আমরা মিশ্রিত কাহিনির মধ্যে থেকে যদি যোগমায়ার অলৌকিক কর্মটুকু বিশ্বাসী মানুষদের জন্য ওপরে তুলে রাখি, তা হলেও কিন্তু ঘটনার বাস্তবতা প্রমাণিত হয়। আগেই বলেছি— খুব বেশি হলে ছ’মাসের সম্পূর্ণ গর্ভও কোনওমতে চেপে-চুপে থাকা যায়, যদি শরীরের গড়ন তেমন হয়, যদি গর্ভবতী রমণীও তেমন কৌশলবতী হন। আমরা বলেছি— রোহিণী গর্ভবতী হওয়া মাত্রই বোধহয় নিশ্চিন্ত প্রসূতির জন্য বসুদেব কর্তৃক স্থানান্তরিতা হন। হরিবংশ লিখেছে— তাঁর উদরে গর্ভ সংস্থাপিত হওয়ায় রোহিণী ভীষণ সুন্দরী হয়ে উঠেছিলেন, তাঁকে চন্দ্রপ্রিয়া রোহিণী নক্ষত্রের মতো সুন্দর লাগছিল— রোহিণীব সোমস্য বসুদেবস্য ধীমতঃ। আমরা বলি— ছয় মাসের গর্ভধারণ করার পর এই সৌন্দর্যায়ন যে কোনও রমণীর শরীরেই ঘটে, রোহিণীও তাই দেখতে সুন্দরী হয়ে উঠছিলেন। আর তিনি যে উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছিলেন— সংবিগ্নাং নৈশে তমসি রোহিণীম্‌— তার কারণ তো খুব স্পষ্ট। অনেকদিন তিনি ব্রজভূমিতে আছেন, সন্তানের পিতা বসুদেব কাছে নেই, অথচ গর্ভলক্ষণ এখন বেশ প্রকট হয়ে উঠছে, লোকসমক্ষে এবার জানাজানি হবে এবং ঠিক সেই কারণেই তিনি খানিক লজ্জাবতী, লোকসমক্ষে তাঁর মাথাটা একটু নিচু হয়, যদিও পুত্রলাভের আনন্দের তুলনায় সে লজ্জা সামান্যই, কেন না তিনি নিজের কাছে নিজে ঠিক আছেন— হৃষ্টা কিঞ্চিদ্ অবাঙ্‌মুখী।

আমাদের আরও একটি বক্তব্য আছে। সংস্কৃত ‘কৃষ্‌’ ধাতুটির অর্থ হল আকর্ষণ করা। এই ক্রিয়াপদ থেকে সঙ্কৰ্ষণ (সম— কৃ+ অনট্‌) নামটা যেমন এসেছে তেমনই ওই ‘কৃষ্‌’ ধাতু থেকে কৃষ্ণ (কৃষ+) শব্দটাও এসেছে। ‘কৃষ’-এর আকর্ষণ অর্থটা মাথায় রেখে প্রায় সকলেই এই অর্থ করেন যে কৃষ্ণ তাঁর অসাধারণ রূপ-গুণ-মাধুর্যে এই তিন ভুবনের নিখিল-চিত্ত আকর্ষণ করেন। আমরা বলি— তা হলে সঙ্কর্ষণ বলরাম কী দোষ করলেন, তাঁর নামও তো ওই একই ক্রিয়াপদের পরিপাক। আমাদের ক্ষুদ্র বুদ্ধি এই জাগতিক প্রেরণা তৈরি করেছে যে, এঁদের দুই ভাইয়ের নামের পিছনে ‘কৃষ্‌’ ক্রিয়াপদটির সদর্থকতা একই রকম। এঁরা দু’জনেই অথবা এঁদের দু’জনকেই কংসের সমূহ অত্যাচার থেকে রক্ষা করার জন্য মথুরা-পুরী থেকে বৃন্দাবনের ব্রজভূমিতে আকর্ষণ করে নিয়ে আসা হয়েছে। হয়তো সেই কারণেই একজনের নাম সঙ্কর্ষণ, অন্যজন কৃষ্ণ। এই অর্থ-ভাবনা মাথায় থাকলে এটাও যথার্থভাবে প্রমাণসহ হয়ে উঠবে যে কৃষ্ণকে যেমন বর্ষারাতে সংগোপনে শিশু অবস্থায় বৃন্দাবনে নিয়ে এসেছিলেন বসুদেব, তেমন সঙ্কর্ষণ বলরাম মাতৃগর্ভের গোপন ছায়ায় জন্মের বহু আগেই বৃন্দাবনে এসে পৌঁছেছিলেন ‘প্রি-নেটাল’ স্টেজে। অর্থাৎ যোগমায়া দেবীর অঘটন-ঘটন-পটীয়সী শক্তিকে সবিনয়ে প্রণাম জানিয়েও বলি— মাতা রোহিণী গর্ভ-সম্ভাবনা মাত্রেই বসুদেবের বুদ্ধিতে বৃন্দাবনে অবস্থান করছিলেন। যার জন্য স্বামী কাছে না থাকায় গর্ভলক্ষণ প্রকট হবার পর তিনি পরিজনবর্গের সামনে কথঞ্চিৎ লজ্জাবতী কিঞ্চিৎ অবাঙ্‌মুখী। তাই বলে রোহিণীকে কেউ সন্দেহের চোখেও দেখেনি এবং বসুদেবের বিপন্ন অবস্থা মাথায় রেখে সকলেই রোহিণীর সমুদ্ভিন্ন গর্ভলক্ষণ অনুমান করেছিলেন সদর্থক ভাবনাতেই।

আমাদের এই বিশ্লেষণ যে ভিত্তিহীন নয় তার প্রমাণ মিলবে হরিবংশ থেকেই। তখন কৃষ্ণের জন্ম হয়ে গেছে এবং তাঁকে নিরাপদ আশ্রয়ে নন্দগোপের কাছে রেখে আসাও হয়ে গেছে। আর বলরাম তো আগেই জন্মে গেছেন। এইরকম একটা অবস্থায় নন্দগোপ একদিন যশোমতীকে নিয়ে মথুরায় এসেছেন। এই আসার পিছনে বাইরের কারণটা নিতান্তই ‘অফিসিয়াল’। কারণ ব্রজভূমি বৃন্দাবন, যেখানে কংসের পশুসম্পদ বৃদ্ধি হত (সেকালে যে কোনও রাজ্যেই ‘কাউ-ব্রিডিং’, ‘হর্স-ব্রিডিং’-এর জন্য ‘ব্রজ’ নামে একটি চারণভূমি থাকত), সেই ব্রজ থেকে রাজকর দেবার জন্য নন্দগোপ এসেছিলেন মথুরায়। যাবার আগে বন্ধু বসুদেবের সঙ্গে তিনি গোপনে রাতের অন্ধকারে দেখা করতে এসেছিলেন। বসুদেবের দু’-দুটি ছেলে তাঁর ঘরে মানুষ হচ্ছে। যশোদার শিশু কন্যার পরিবর্ত হিসেবে কৃষ্ণকে যশোমতীর কোলে রেখে এসেছিলেন বলে কৃষ্ণের ব্যাপারে নন্দগোপ যতখানি দায়িত্ব বোধ করছেন, বলরামের ব্যাপারে দায়িত্ব বোধ করছেন তার চেয়ে বেশি। নন্দগোপ তো জানেন আসল সত্যটা— দুটি ছেলেই তো বসুদেবের। রাজধানীর প্রভাবশালী ব্যক্তি বসুদেবের ছেলে বলেই নন্দগোপ তাঁদের কীভাবে আপন গ্রাম্য কুটিরে মানুষ করবেন, সেই পরামর্শ করতেই তিনি সস্ত্রীক এসেছিলেন বসুদেবের কাছে।

হরিবংশে এই কথোপকথন আরম্ভ হবার আগেই কথকঠাকুর বৈশম্পায়ন খবর দিচ্ছেন— বসুদেব পূর্বেই শুনেছিলেন যে, তাঁর স্ত্রী রোহিণী অনেক আগেই চাঁদের চেয়েও সুন্দর এক শিশুর জন্ম দিয়েছেন ব্রজভূমিতে— প্রাগেব বসুদেবস্তু ব্ৰজে শুশ্রাব রোহিণীম্‌। প্রজাতাম্‌ পুত্রমেবাগ্রে……! এই শ্লোকের অনুবাদ করতে গিয়ে পণ্ডিত শ্রীজীব ন্যায়রত্ন একটু ভণিতা করে লিখেছেন— ‘বসুদেব প্রসবের পূর্বেই রোহিণীকে ব্রজে পাঠাইয়া দিয়াছিলেন।’ আমরা জানি— আমরা যে সংস্কৃত শ্লোকটি উপরে উদ্ধার করেছি, তার অনুবাদ এটা নয়, এটা অনুবাদের মুখপাত। আসলে অনুবাদ করার সময় পণ্ডিত বুঝেছেন এ কথাটা না বললে অনুবাদের অর্থ পরিষ্কার হবে না। কিন্তু যে বুদ্ধিতেই তিনি এই কথাগুলি লিখে থাকুন, কথাটা ঠিক এবং তাতে আমাদের অনুমানটাও আরও দৃঢ় হয় যে, বসুদেব গর্ভবতী অবস্থাতেই রোহিণীকে ব্রজে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন।

হরিবংশে দেখতে পাচ্ছি— বসুদেব নন্দকে বলছেন— তুমি আর এখানে থেকো না, তাড়াতাড়ি ব্রজভূমিতে ফিরে যাও। সেখানে দুই শিশুপুত্রের জাতকর্মাদি সংস্কার সম্পন্ন করো। এরপরেই বলরামের সম্বন্ধে বসুদেব নিজের সংশয় এবং ভয় প্রকাশ করছেন। কারণ কৃষ্ণের পরিবর্তে যেহেতু তিনি যশোমতীর শিশুকন্যাটিকে নিয়ে এসেছিলেন এবং যেহেতু কংস তাকে মাটিতে আছড়ে ফেলে তথাকথিত হত্যার চেষ্টা করেছিলেন, তাই কৃষ্ণের ব্যাপারে তিনি আপন সত্ত্ব অনেকটাই ত্যাগ করেছিলেন। মনস্বী জনের পক্ষে হয়তো এটাই স্বাভাবিক, সদ্যোজাত শিশুটিকে বাঁচিয়ে রাখতে পেরেছেন, এখানেই তাঁর আত্মতুষ্টি ঘটেছে। কিন্তু রোহিণীর গর্ভজাত পুত্রটির সম্বন্ধে তাঁর প্রণিধান আপাতত লক্ষ করার মতো। বসুদেব নন্দগোপকে বললেন— ব্ৰজপুরে রোহিণীর গর্ভজাত আমার যে শিশু পুত্রটি আছে, তাকে তুমি সর্বতোভাবে রক্ষা করো— রৌহিণেয়ঞ্চ পুত্ৰং মে পরিরক্ষ শিশুং ব্রজে। বসুদেব নিজে তার অন্যতম প্রিয়া পত্নী রোহিণীর গর্ভজাত পুত্রটির প্রতি কোনও দায়িত্ব পালন করতে পারছেন না, এতে যে তিনি দুঃখিত হয়ে কষ্ট পাচ্ছেন, তা এতে কোনও আশ্চর্য নেই। আশ্চর্য ঘটনা হল— পুত্রের কথা বলবার সময় বসুদেব ধরেই নিয়েছেন যে, কৃষ্ণকে নিয়ে কোনও চিন্তা নেই। জননী যশোমতী এবং নন্দরাজ তাঁকে নিজের মতো করে কোলের মধ্যে পেয়েছেন বলে কৃষ্ণকে তাঁরা মাতা-পিতার অধিক আদরে মানুষ করবেন। কিন্তু তবু কৃষ্ণ তো বসুদেবেরই পুত্র, অথচ দুশ্চিন্তা ব্যক্ত করার সময় বসুদেব নন্দকে বলছেন— দেখো, আমার ভাগ্যটা দেখো! আমাকে লোকে কী বলবে? আমি তো পিতার দায়িত্ব এতটুকু পালন করতে পারলাম না। আমি এতটাই দুর্ভাগ্য-পীড়িত যে, আমি আমার একমাত্র পুত্রের চাঁদ মুখটুকুও দেখতে পেলাম না এতদিনেও— যোহহম্ একস্য পুত্রস্য ন পশ্যামি শিশোর্মুখম্।

‘একমাত্র পুত্র’— এই কথাটা সঙ্কর্ষণ বলরামের সম্বন্ধে পিতা বসুদেবের উক্তি। আশ্চর্য নয় কি? এই কথাটা থেকে বলরামের জন্মকালীন ঐতিহাসিকতা ধরা পড়ে। অর্থাৎ গর্ভধারণের সঙ্গে সঙ্গেই বসুদেব রোহিণীকে বৃন্দাবনে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন এবং স্বাভাবিকভাবেই সঠিক সময়েই রোহিণী পুত্রলাভ করেন। আর সুখপ্রসূতা রোহিণীর পুত্রজন্মের কথা জানলেও বসুদেব এখনও তাঁর ছেলের মুখ দেখতে পাননি। বসুদেব আরও বললেন— দেখো বন্ধু নন্দরাজ! হৃদয়হীন কংসের ব্যাপারে আমার সব সময় ভয় আছে। মনে হচ্ছে এই শিশুটিকে সে মেরেই ফেলবে, এ ব্যাপারে ওর কোনও দয়া-মায়া নেই— অস্মাদ্ধি মে ভয়ং কংসান্‌-নির্ঘৃণাদ্‌ বৈ শিশোর্বধে। তাই বলছিলাম কী, বন্ধু আমার! যে কোনও উপায়ে হোক আমার রোহিণীর ছেলেটিকে বাঁচিয়ে রেখো— তদ্‌ যথা রৌহিণেয়ং ত্বং নন্দগোপ মমাত্মজম্‌।

রোহিণীর গর্ভজাত পুত্রটির কথা শুধুই উচ্চারণ করলে কৃষ্ণের ব্যাপার লঘু হয়ে যায় একেবারেই, তাই এবার দুঁজনের কথাই বলতে লাগলেন বসুদেব এবং বলার মধ্যে তাঁর কৌশলটুকু যেমন লক্ষণীয়, তেমনই লক্ষণীয় যে আমাদের অনুমান-খণ্ড প্রায় নির্ভুল। বসুদেব বললেন— আমার এই পুত্র অর্থাৎ রোহিণীর গর্ভজাত ছেলেটি বড় আর তোমার ছেলেটি হল আমার ছোট ছেলে— স চ পুত্রো মম জ্যায়ান্‌ কণীয়াংশ্চ তবাপ্যয়ম্। তুমি দু’জনকেই সমান দৃষ্টিতে, সমান স্বভাবে দেখো। কারণ একটা কথা মনে রেখো, দু’জনের নামের অর্থ কিন্তু সমান— কৃষ্ণ নামের অর্থ আকর্ষণ করা আর সঙ্কর্ষণ নামের অর্থও আকর্ষণ করা— অতএব উভয়ের ওপর বাৎসল্যও যেন তোমার সমান হয়— উভাবপি সমং নাম্না নিরীক্ষস্ব যথাসুখম্।

আমি আগেই বলেছিলাম— সঙ্কর্ষণ বলরাম এবং কৃষ্ণ— দু’জনকেই কংসের অত্যাচার থেকে বাঁচানোর তাগিদে পাঠানো হয়েছিল বৃন্দাবনের ব্রজভূমিতে, যেটা সংস্কৃতের ধাতুগত প্রক্রিয়ায় আকর্ষণ বলা যেতেই পারে, তবে হ্যাঁ, এই আকর্ষণের প্রক্রিয়া দুই পুত্রের ক্ষেত্রে দুইরকম— একজন জন্মের পূর্বে মাতৃগর্ভে থাকতেই অন্যত্র স্থানান্তরিত, অন্যজন জন্মের পরে শিশু অবস্থায় স্বয়ং পিতা কর্তৃক প্রেরিত। অতএব সঙ্কর্ষণ বলরামের ক্ষেত্রে আকর্ষণ কথাটা যদি স্থানান্তরীকরণ অর্থে ব্যবহৃত হয়, এবং কৃষ্ণের ক্ষেত্রে আকর্ষণ বস্তুটা যদি রূপগত বা গুণগত হয়, তবে সে অর্থ আলংকারিকের গৌরব এবং অতিশয়োক্তি। মূল এবং বস্তুগত অর্থ যে নিতান্তই সরল এবং সহজ, তা হরিবংশে বসুদেবের কথা থেকেই প্রমাণিত হয়ে যায়॥

আরও একটা কথা। ওই যে বলা হল— দেবকীর গর্ভ সাত মাসে পড়া মাত্রেই সেই গর্ভ টেনে এনে রোহিণীর গর্ভে সংস্থাপিত করা হল এবং দেবকীর গর্ভপাত প্রচারিত হতেই তিনি পুনরায় অষ্টম গর্ভ ধারণ করলেন কৃষ্ণজন্মের প্রস্তুতিতে— এই কথার আর এক অর্থ হল বলরাম সঙ্কর্ষণ বৈমাত্রেয় কৃষ্ণের চেয়ে মাত্র মাস পাঁচেকের বড় হবেন বয়সে। রোহিণীর গর্ভকালের সপ্তম মাসে দেবকী আবার গর্ভধারণ করলেন। কিন্তু গর্ভের সময় পূর্ণ হবার আগেই যেহেতু অষ্টম মাসেই কৃষ্ণ জন্মেছিলেন— গর্ভকালেত্বসম্পূর্ণে অষ্টমে মাসি তে স্ত্রিয়ৌ— অতএব রোহিণীর গর্ভকালের বাকি তিন মাস এবং দেবকীর গর্ভকালের সম্পূর্ণ আট মাস ধরে নিয়ে হিসেব করলে বলরাম কৃষ্ণের চেয়ে মাত্র পাঁচ মাসের বড়। পাঁচ মাসের বড় হওয়াটা যে খুব বেশি বড় দাদার মর্যাদা বহন করে না, সেটা বুঝিয়ে দিয়েই বসুদেব নন্দগোপের স্নেহ এবং সুরক্ষা ভিক্ষা করে বলেছেন— এই দুই ভাই বয়সে প্রায় সমান এবং তারা যেহেতু একসঙ্গেই বড় হচ্ছে, অতএব দু’জনেই যাতে তোমার সমান সমান স্নেহ-সুরক্ষা পায়, সেটাই তুমি দেখো— বর্ধমানাবুভাবেতৌ সমানবয়সৌ যথা। নন্দগোপ বসুদেবের কথা শুনে রাত ফুরোবার আগেই বেরিয়ে পড়লেন। প্রতিপক্ষ কংসের হাতে অথবা তন্নিযুক্ত রাজপুরুষ তথা শিশুঘাতী গুপ্তচরদের হাতে বসুদেবের এই দুই সন্তান যখন তখন আক্রান্ত হতে পারে, সেটা যথার্থভাবেই অনুধাবন করেছেন নন্দগোপ। বিশেষত রাত্রের আঁধারে বসুদেবের সঙ্গে নন্দগোপের এই সাক্ষাৎকারটুকু যাতে একেবারেই জানাজানি হয়, সেই কারণেই বসুদেব খুব তাড়াতাড়ি নন্দগোপকে চলে যেতে বলেছেন এবং তা দিনের আলো ফুটে ওঠার আগেই— নন্দগোপ গতা রাত্রিঃ শীঘ্রযানো ব্রজাশুগঃ। যমুনার তীরগামী পথ ধরে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে পড়লেন নন্দরাজ।

॥ ৩ ॥

সহৃদয় পাঠক আমার, আমি জানি আপনারা আমার ওপর বিরক্ত হয়েছেন। এতক্ষণ ধরে বলরাম সঙ্কর্ষণের জন্ম-রহস্য, জন্ম সময় নিয়ে পুরাণ বিচার করলে ঘটনা-কৌতুকী পাঠক কতক্ষণ ধৈর্য ধরে বসে থাকবেন। তবে এও তো ঠিক, আমরা সুপ্রাচীন কালের এক বিশাল ব্যক্তিত্বের আত্মসন্ধানে ব্যস্ত আছি। তাঁর জন্মকাল এবং জন্ম-ব্যাপারটাই এক অদ্ভুত রহস্যে আবৃত ছিল। সেটাকে অলৌকিকতার নির্মোক ছাড়িয়ে সঠিকভাবে উপস্থিত না করতে পারলে পুরাবিদ ঐতিহাসিকের কাছে বলরামের জীবনটাও অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়বে। তা ছাড়া সব কিছুকেই তো আর অলৌকিক-অলৌকিক বলে উড়িয়ে দিলে চলবে না। একটা বিরাট চরিত্র যখন জনসমক্ষে উপস্থিত করতেন সূত-মাগধ-কথকঠাকুরেরা, তখন সেই চরিত্রের অতিশয়িনী দিকগুলি বোঝাবার জন্য অলৌকিকতার কিছু আবরণ সৃষ্টি করতেন তাঁরা। সেগুলো বাইরে থেকে যেরকমই লাগুক, এমনকী তার মধ্যে দার্শনিক এবং ধর্মীয় তাত্ত্বিকতাও কিছু আছে, কিন্তু সেগুলিকে সম্পূর্ণ উড়িয়ে দিলে মহাভারতীয় পৌরাণিক চরিত্রের মূল কাঠামোটাই তো নষ্ট হয়ে যাবে। এই যে এতক্ষণ ধরে বলরামের জন্মরহস্য বিচার করলাম, তাতে এটুকু নিঃসন্দেহে প্রমাণ হল যে, বলরাম অন্য পাঁচটা মানুষের মতো স্বাভাবিক একটা জীবন পাননি। জন্মকালীন রাজনৈতিক চক্র তখন এমনই ছিল যে, তাঁকে জন্মভূমি থেকে বিতাড়িত হয়ে শিশু বয়সেই পৈতৃক সুরক্ষা হারাতে হয়েছিল এবং তাঁকে মানুষ হতে হচ্ছিল অতি-সাধারণভাবে, নাগরিক বৃত্তির সমস্ত সমীচীন আচরণ থেকে বাইরে, একেবারে গ্রাম্য পরিবেশে। একইভাবে ভাবতে হবে তাঁর অবতার-তত্ত্বের কথাও। সেখানেও এক বিরাট রহস্য লুকিয়ে আছে এবং রহস্যের থেকে বড় কথা— বলরামের বৃহত্ত্ব প্রমাণ করার ক্ষেত্রে এই অবতার-তত্ত্বও এক বিশাল আবরণ। কেন না সেখানে মিশে আছে সুবিশাল কৃষ্ণের ছায়া— কৃষ্ণের অবতার-মহিমায় কলরামের মহিমা তো বেশ খানিকটা আবৃতও বটে, আবার প্রায় সমবয়সি হবার ফলে বলরাম এবং কৃষ্ণের অবতার-প্রযুক্তি সবসময় হাত ধরাধরি করে চলে— বলরাম সেখানে কৃষ্ণের সহায়ক ভূমিকা পালন করেন। অতএব পাঠক আমার! এখনই ধৈর্য হারালে কেমন করে এতসব বড় বড় কথা প্রমাণসহ করে তুলব?

প্রথমেই একটা কথা জানিয়ে রাখা ভাল যে, মানুষ যেখানে জন্মায় এবং যেখানে বড় হতে থাকে, সেই সহচর পরিবেশ থেকেই মানুষ তার প্রবৃত্তি, কর্ম এবং ধর্মের রসদ সংগ্রহ করে। সেই মানুষের মধ্যে বুদ্ধি, বল, ঐশ্বর্য যাই থাকুক, সেগুলি পরিপার্শ্বের সঙ্গে তাল রেখেই আস্তে আস্তে প্রকাশিত হয়। যেকোনও বড় মানুষের ক্ষেত্রেও এ-কথা খাটে বলে বলরাম বা কৃষ্ণের সম্বন্ধেও আমরা একই কথা বলছি। আরও একটা কথা হল, বারবার আমরা বলছি বটে যে, বলরাম এবং কৃষ্ণকে বৃন্দাবনে রেখে আসা হয়েছিল, কংসের রাজনৈতিক প্রত্যাঘাত থেকে তাঁদের রক্ষা করার জন্য, কিন্তু প্রথমেই বোধহয় তাঁদের বৃন্দাবনের গ্রামটিতে নিয়ে যাওয়া হয়নি। তাঁরা কংসের ব্রজভূমিতে বাস করছিলেন। এ-কথাও আগে বলেছি যে, তখনকার দিনের যেকোনও শক্তিশালী রাজার একটা ব্রজভূমি থাকত, যেখানে কাউ-ব্রিডিং, হর্স-ব্রিডিং করে সে-কালের অন্যতম বাণিজ্যিক সংস্থান পশুসম্পদ বৃদ্ধি করা হত। এই বিরাট ব্রজভূমি, যেখানে ব্রজবাসী মাত্রেই গোচারণে অংশ নিতেন, এখানেই বলরাম এবং কৃষ্ণকে মথুরা থেকে এনে রাখা হয়েছিল নন্দঘোষের কাছে। এটা ঠিক বৃন্দাবন নয়, তার প্রমাণ আছে।

যেখানে বলরাম প্রথমে বড় হচ্ছিলেন, সেই ব্রজভূমির পরিবেশ নিতান্তই গ্রাম্য, তবে তা আরণ্যক প্রকৃতির সজ্জায় বড় শোভন এবং সুন্দর। জায়গাটা গোবর্ধন পর্বত থেকে খুব দূরে নয়। গোরু চরানোর জায়গাগুলো যথেষ্টই সমতল, তবে আশেপাশেই হিংস্র জন্তুর বাস ছিল বলে গাছ-গাছড়া, লতা-বল্লীর শোভা নষ্ট হয়নি, কেন না বন্য জন্তুর ভয়ে গাছ কাটার সুযোগ ছিল না। পাশেই প্রবাহিনী যমুনা, তবে মাঝে মাঝে জলাশয়ও আছে। পাশের অরণ্যভূমিতে হিংস্র জন্তুর উৎপাত আছে বলেই এখানকার লোকেরা বড় বড় গাছের গুঁড়ি ফেলে ব্রজভূমির প্রান্তে একটা প্রাচীরের মতো তৈরি করেছে— পর্যন্তেষ্বাবৃতং বন্যৈর্বৃহদ্ভিঃ পাতিতৈর্দ্রুমৈঃ। তার এদিকে ওদিকে লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে কাঁটাগাছ। বাড়িগুলো কোনওটাই নগরের অট্টালিকার মতো নয়। মাদুর আর চাটাই দিয়ে বেশিরভাগ বাড়ির আবরণ-আচ্ছাদন তৈরি করা হয়েছে— কটচ্ছন্নকুটীমঠম্‌। কংসরাজার এই ব্রজভূমির সবচেয়ে মজাদার ব্যাপার বোধহয় এটাই যে, সর্বত্র গো-বিষয়ক একটা ভাবনা কাজ করে এখানে। এখানে-সেখানে খুঁটি পোঁতা, গোরুর গলার দড়ি, শকটবাহী বলদ, আর ঘরে ঘরে দুধ, দই অথবা দুধ থেকে ঘি তৈরি করার, দই থেকে ঘোল, মানে তক্র তৈরি করার আয়োজন চলছে সবসময়।

এইরকম একটা জায়গায় সঙ্কর্ষণ বলরাম বেশ ভালই বাল্যসুখে দিন কাটাচ্ছিলেন। সামান্য বড় হয়ে ওঠার পর খেলার বয়সটা এখানেই খানিকটা কেটে যায় বলরামের, সঙ্গে কৃষ্ণেরও। কারণ বয়সে প্রায় সমান কৃষ্ণই তাঁর প্রধান খেলার সাথী। অন্যান্য ব্রজবালকেরাও অবশ্য ছিল। হরিবংশ যদিও বলেছে যে দুই ভাইয়েরই বয়স তখন সাত বছর পুরে গিয়েছিল, কিন্তু আমাদের ধারণা তাঁদের বয়স আরও একটু বেশিই ছিল। সঙ্কর্ষণ বলরামের বালক-সুলভ ক্রীড়া বর্ণনার সময় পৌরাণিকদের একটা অদ্ভুত মুদ্রা চোখে পড়ে। ওঁরা বলেন— এই দুই ভাইয়ের সবই একরকম, এমনকী নাম দুটিও। নাম রাখার সময় নন্দগোপ বড়ভাইয়ের নাম দিলেন সঙ্কর্ষণ, আর ছোটভাইয়ের নাম দিলেন কৃষ্ণ— জ্যেষ্ঠঃ সঙ্কর্ষণো নাম কণীয়ান্‌ কৃষ্ণ এব তু। তার মানে, আমরা কৃষ্ণের দাদা যাঁকে বলরাম বলে চিনি, সে নাম এসেছে অনেক পরে।

বলা হয়েছে— ছোট বয়স থেকেই এই দুই ভাইয়ের ক্রিয়া, কর্ম, ভাব-সাব একইরকম ছিল, এতটাই একরকম যে মনে হত যেন এঁরা পরস্পর পরস্পরের অন্তর্ভুত— একমূর্তিধরৌ কান্তৌ… বাল্যাদেবৈকতাং গতৌ। দুই ভাই শুতেন এক বিছানায়, খাওয়া-দাওয়াও প্রায় একইরকম এবং কাপড়-জামাও পরতেন একই ধরনের— শুধু কাপড়ের রংটাই যা আলাদা। বলরাম নীল কাপড় পরেন, আর ছোটভাই কৃষ্ণ হলুদ কাপড় পরেন। এই নীল এবং হলুদ কাপড় পরার মধ্যে অবশ্য একটা পৌরাণিক রহস্য আছে, হয়তো বা বহিরঙ্গে নিজেদের একত্ব বোঝানোর উপায়ও নিশ্চয়ই এটাই। পৌরাণিক লিখেছেন— বলরামের গায়ের রং সুবর্ণ চূর্ণের মতো হলদেটে আর কৃষ্ণের গায়ের রং কাজল-চূর্ণের মতো ঘন-কৃষ্ণ অথবা নীল সুবর্ণাঞ্জন-চূর্ণাভৌ অন্যোন্যসদৃশাম্বরৌ। অতএব সঙ্কর্ষণ বলরামের গায়ের রং নিজের মধ্যে অন্তর্ভূত করার জন্যই কৃষ্ণ সুবর্ণ-চূর্ণের মতো হলুদ কাপড় পরতেন, আর কৃষ্ণের অঙ্গকান্তি অঙ্গীকার করে বলরাম পরতেন নীল কাপড়।

একজনের গায়ের রং মিলিয়ে আর একজন সেই রঙের কাপড় পরেন— এটার মধ্যেও এক চিরন্তন দার্শনিক রহস্য আছে। তবে সেটাও এখানে বিস্তারিতভাবে দেখানো মুশকিল, কারণ তাতেও আমার পাঠকের ধৈর্যচ্যুতি ঘটবে। তবে যেটা ন-বললে নয়, সেটা হল— এই নীল আর হলুদ কাপড়ের বিপৰ্যাস তো কৃষ্ণ আর রাধার মধ্যেও ঘটেছে এবং তাতে দার্শনিক রহস্য আরও বেশি ঘনীভূত হয়ে ওঠে। ভাবুন একবার, কথাটা বলছেন জীব গোস্বামীর মতো বিশালবুদ্ধি দার্শনিক এবং তা লিখছেন গোপালচম্পূর মতো স্বলিখিত কঠিন গ্রন্থে। কৃষ্ণ এবং রাধা— একজন কালো মানুষ, অন্যজন হেমাঙ্গিনী— কিন্তু ইনি রাধার দেহকান্তি অঙ্গে নিয়ে পীতবসন পরেন, অন্যজন কৃষ্ণের গায়ের রং অঙ্গে ধারণ করে হয়েছেন নীলাম্বরী। দেহকান্তির সঙ্গে পরিধানের এই বিপর্যাস ব্যাখা করার সময় শ্রীজীব লিখেছেন— শক্তি আর শক্তিমান পরস্পরের মধ্যে অনুপ্রবেশ করে, একজনের মন আর একজনের ভিতরে আছে। যার বাইরে শ্যামবর্ণ তিনি অন্তরে গৌরী রাধাকে ধারণ করে আছেন, আর হেমাঙ্গিনী রাধা অন্তরে নিয়ে আছেন কৃষ্ণকে। এই প্রেম আর মনের ভাবটুকু বোঝানোর জন্যই তাঁরা পরস্পরের অঙ্গকান্তি অনুকরণ করে বিপরীত বসন পরিধান করেন— কৃষ্ণ পরেন পীতবসন, আর রাধা পরেন নীলবসন।

তত্ত্বের দিক থেকে সঙ্কর্ষণ বলরাম এবং কৃষ্ণ একইরকম নন বটে, কিন্তু আর একভাবে একরকমও বটে। অবতারতত্ত্বের মূলে চলে গেলে দেখা যাবে সঙ্কর্ষণ হচ্ছেন মহাবিষ্ণুর চিৎশক্তি— তা বিষ্ণুরই আরও এক রূপ— চৈতন্যচরিতামৃতের ভাষায়— তাঁর নিজ রূপ এক মহাসঙ্কর্ষণ। এইবার কৃষ্ণকে যদি মহাবিষ্ণুর পূর্ণ অবতার বলি, তা হলে সঙ্কর্ষণ বলরাম তাঁর চিৎশক্তির বিলাস। তত্ত্বত এক হওয়া সত্ত্বেও কৃষ্ণ এবং সঙ্কর্ষণ বলরাম পৃথক রূপে আছেন বলে একে অন্যের বৈশিষ্ট্য নিজের মধ্যে ধারণ করার জন্য প্রতীকীভাবে পরস্পরের দেহকান্তি অঙ্গীকার করেন বিপরীত রঙের বসন পরিধান করে। জীব গোস্বামী রাধার ব্যাপারে যা লিখেছেন— স্ফরত্তত্তৎ বস্ত্রাবিতি বুধজনৈনিশ্চিতমিদম্‌— বলরাম সঙ্কর্ষণের তত্ত্বেও তা আর একভাবে খাটে।

জীব গোস্বামী লিখেছিলেন— রাধা এবং কৃষ্ণ মনেতেও বিপরীত, বাইরেও বিপরীত— ইমৌ গৌরীশ্যামৌ মনসি বিপরীতৌ বহিরপি— আর ঠিক সেইজন্যেই এই পরিধান বসনের বৈপরীত্য। লক্ষণীয়, সঙ্কর্ষণ বলরাম এবং কৃষ্ণ— এঁরাও মনের দিক থেকে বিপরীত, বহির্বসনেও বিপরীত, কিন্তু তবু এঁরা একে অন্যের ভিতরে আছেন, একে অন্যের ব্যাপারে পরম শ্রদ্ধাশীল। মহাভারত-পুরাণ ভাল করে অনুধাবন করলে দেখা যাবে সঙ্কর্ষণ বলরাম আগাগোড়া কৃষ্ণের সঙ্গে জড়িয়ে আছেন, কিন্তু তাঁদের ভাব এবং ভাবনা প্রায় বিপরীত, যদিও কৃষ্ণ যা করবেন, সেটাই তাত্ত্বিকভাবে চরম বলে বলরাম সেখানে বিপরীত ভাবনায় থাকলেও সব সময়ই তিনি কৃষ্ণের সহায়ক।

সত্যি কথা বলতে কী, এত তত্ত্বের মধ্যে না-গিয়ে যদি সাধারণ সামাজিক ঐতিহাসিকের দৃষ্টি থেকে বিচার করি, তা হলে বলব— রঙের বাহার কতরকম হয়, ভারতবর্ষ তা নিশ্চয় জানত, কিন্তু সেই রং বস্ত্রশিল্পের সুতোয় সুতোয় কীভাবে ছুপিয়ে রাঙিয়ে তুলতে হয়, তা বোধহয় সেইকালে জানত না। আমরা হরিবংশের যে প্রমাণ থেকে বলরাম এবং কৃষ্ণের বসন-বর্ণ উল্লেখ করেছি, সেই হরিবংশে জানা যাবে যে ব্রজভূমির সাধারণ মানুষেরা প্রধানত নীল আর হলুদ কাপড়ই পরত, আর পরত লাল কাপড়। ওই যে নন্দগোপ মথুরা থেকে ব্রজভূমিতে আসছিলেন, সেদিন তাঁর পথের মধ্যে যত অলংকৃতা তরুণীদের দেখা গিয়েছিল, সেই তরুণীরা সবাই নীল আর পীত বসনে সজ্জিতা ছিলেন— নীল-পীতাম্বরাভিশ্চ তরুণীভিরলঙ্কৃতম্‌। আবার কয়েক অধ্যায় পরে যখন ওই উদ্ভিন্নযৌবনা গোপরমণীদের মাথায় দধি-দুগ্ধের ভার এবং কোমরে ঘট নিয়ে চলতে দেখেছি, তখন হরিবংশ ঠাকুর সকৌতুকে লক্ষ করেছেন যে, তাঁদের নীল, পীত এবং রক্তবর্ণের বস্ত্রগুলি স্তনের অগ্রভাগের তাড়নায় উঁচু হয়ে উঠেছিল— নীল-পীতারুণৈস্তাসাং বস্ত্রৈরগ্রস্তনোচ্ছ্রিতৈঃ।

তার মানে, নীল, হলুদ আর লাল— প্রধানত এই তিন রঙের কাপড়ই ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে পরতেন সেকালের শৌখিন মানুষেরাও। সেখানে দুই ভাই বলরাম আর কৃষ্ণ যদি আপন গাত্রবর্ণের বিপরীত একটু ‘কনট্রাস্ট কালার’ ব্যবহার করে থাকেন লোকসংগ্রহের জন্য, তারমধ্যে দার্শনিকতার অন্বেষণ না-থাকলেও ক্ষতি নেই কোনও। হরিবংশ ঠাকুর বলছেন— শুধু একে অপরের বিপরীত বর্ণের বসনই নয়, এঁদের অন্য সাজ-সজ্জার মধ্যে এই ‘কনট্রাস্ট’ ব্যাপারটা ছিল। সাজা বলতে সেকালে চন্দনের অলকা-তিলকা আর অঙ্গরাগ। মেয়েদের ক্ষেত্রে কুঙ্কুমের পত্রলেখা যতই সৌন্দর্য রচনা করুক, কঠিন-পরুষ পুরুষেরা কুঙ্কুমের ধার ধারতেন না। অতএব ‘সিম্পল’ চন্দন, তবে হ্যাঁ, চন্দনের রকমফের আছে, কৃষ্ণ পরতেন শ্বেতচন্দনের অঙ্গরাগ, বলরাম সেখানে পীত চন্দন— নীল-পীতাম্বরধরৌ পীত-শ্বেতানুলেপনৌ। দুই ভাইই চুলে কিঞ্চিৎ ‘জুল্‌ফি’ রাখতেন, অথবা বলা উচিত— পুরুষদের বড় বড় চুল রাখাটাই তখনকার দিনের আদত ছিল বলে চুলে ঝুঁটি-বাঁধা বা কানের পাশে চুল বড় হয়ে যাওয়াটা স্বাভাবিক ছিল।

আমরা বারবারই দেখানোর চেষ্টা করেছি, অন্তত যখনই আমরা এই ধরনের প্রবন্ধ লিখেছি, তখনই বলেছি যে, কোনও মানুষের পরিধান, সাজসজ্জা, অভ্যাস অথবা প্রবৃত্তিগুলি প্রাথমিকভাবে তার সমাজকে বাদ দিয়ে হতে পারে না। বিখ্যাত ভারততত্ত্ববিদ এইচ এইচ ইঙ্গলস সাহেব হরিবংশের ওপর যে বিখ্যাত প্রবন্ধটি লিখেছেন, তাতে তিনি দেখিয়েছেন— হরিবংশীয় সমাজের মানুষেরা প্রত্যেকেই এক ধূসর জগতের অধিবাসী। ব্রজভূমির যে সমাজের কথা এই হরিবংশে চিত্রিত, সে-সমাজ নাগর-সভ্যতার ধার ধারে না। এই যে বলরাম এবং কৃষ্ণ— এঁরা যখন বাল্যকালে বেড়ে উঠছেন, তখন ধুলো-মাটি গায়ে মেখে ঘুরে বেড়ানোটাই তাদের সাধারণ অভ্যাস ছিল— রেজতুঃ পাংসুদিগ্ধাঙ্গৌ দৃপ্তৌ কলভকাবিব। আবার ব্রজভূমিতে যেহেতু গোরু-বলদের অধিকার এবং সমাহার, অতএব রাস্তাঘাটে চলার সময় শুকনো গোবর আর ধুলোয় তাদের গা-হাত-পা মাখামাখি হয়ে যেত। ছোট ছোট বাচ্চারা খেলা করবার সময় প্রায়ই চলে যেত বৎসশালায়, অর্থাৎ যেখানে বাছুরগুলো বাঁধা থাকে। সেখানে গেলে বলরাম এবং কৃষ্ণের গায়ে-মাথায় লেগে যেত কাঁচা গোবর— ক্রীড়ন্তৌ বৎসশালাসু শকৃদ্‌দিগ্ধাঙ্গমূর্ধজৈঃ।

অতএব যাঁরা ভাবেন শিশু কৃষ্ণ অথবা বলরাম সকালবেলায় উঠেই মাথায় ময়ূরপুচ্ছটি লাগিয়ে হাতে বাঁশি নিয়ে জননীর ক্রোড়ে বসে ক্ষীর পান করতেন, তাঁরা মনোহর এক কাব্যধর্মের জগতে আছেন, সেকথা হলফ করে বলতে পারি, কিন্তু বাস্তব যে ব্রজভূমির সমাজ, সেখানে গোরু-বাছুরের সঙ্গে গোবরও আছে, আর শিখিপুচ্ছও কোনও আশ্চর্য কথা নয়। কংস-রাজার ব্রজভূমি যেখানে, সেখানে ময়ূর ছিল প্রচুর, অতএব প্রাচুর্যের ফল যা হয়, শুধু কৃষ্ণ নন এবং শুধু তাঁর মাথায় নয়, কৃষ্ণ এবং বলরাম দু’জনেই ময়ুরপুচ্ছের অঙ্গদ পরতেন ঊর্ধ্ববাহুর শোভার জন্য, আবার কখনও তা হত কৰ্ণভূষণ। মাথায় ময়ূর-পুচ্ছের সঙ্গে গাছের পাতা দিয়ে তৈরি মুকুট— ময়ূরাঙ্গদকর্ণৌ তু পল্লবাপীড়ধারিণৌ। কোনওদিন গাছের পাতা ইচ্ছে না হলে প্রফুল্লহাস পদ্মফুলের মুকুটও পরতেন দুই ভাই। আর যে বাঁশিটি একান্তভাবেই কৃষ্ণের সঙ্গে যুক্ত হয়ে আছে, আশ্চর্য লাগবে শুনলে যে, তেমন বাঁশি বলরাম সঙ্কর্ষণও অনেক বাজিয়েছেন ছোটবেলায়। অবশ্য শিঙা বা লাউখোলের একতারা বাজাতেও এই দুই ভাই কম ওস্তাদ ছিলেন না— সশিক্যতুম্বীকরকৌ গোপবেণুপ্রবাদকৌ।

আসলে এই শিঙা আর বাঁশি বাজানোটা ব্রজভূমির বিশেষত্ব, রাখাল বালকদের একান্ত বিনোদন। দুই ভাইকেই যেহেতু গোরু চরাতে যেতে হত, অতএব বাঁশি বাজানোর সঙ্গে একই বংশদণ্ড দিয়ে গোরু তাড়িয়ে নিয়ে যাবার মধ্যে একটা কৌতুক কাজ করত বটে। আর শিঙে-ফোঁকাটাও গোরু চরানোরই অন্যতম অঙ্গ। রাখাল-রাজ্যে বাঁশি বাজায় প্রায় সবাই কিন্তু বহুদিন কৃষ্ণ সেটাকে ধরে রাখতে পেরেছিলেন বলেই কৃষ্ণের সঙ্গে মোহন বাঁশি যুক্ত হয়ে গেছে, কিন্তু ছোটবেলায় অনেক বাঁশি বাজিয়েও সঙ্কর্ষণ বলরাম সেটাকে ধরে রাখতে পারলেন না। তাঁর ব্যক্তিসত্তা অন্যভাবে তৈরি হল। ছোটবেলায় যতই ব্রজভূমির পল্লবশয্যায় শুয়ে থাকুন, তিনি যে কৃষ্ণের চেয়ে বয়সে সামান্য বড়, একথা তাঁকে ভুলতে দেওয়া হয়নি। আসলে জননী যশোমতীর অপত্যস্নেহ এতটাই আগ্রাসী ধরনের যে, তা কৃষ্ণকে অধিক বয়স পর্যন্ত শিশুই করে রেখেছিল, অন্তত তিনি সেই ছোট-ছোট ভাবটা দেখাতেনও বটে। হয়তো অতিশয় চতুর এবং বুদ্ধিমান বলেই এটা দেখাতেন। যদুকুলের রাজবাড়ির বড়গিন্নি রোহিণী কিন্তু রাজোচিতভাবেই খানিকটা পৃথক চরিত্রের মানুষ বলে ছেলে সঙ্কর্ষণকে তিনি অত তোলা-তোলা করে রাখেন না। জীবনের বিস্তীর্ণ ক্ষেত্রে, যেখানে ঝুঁকি নিতে হয়, দায়িত্ব নিতে হয়, সেখানে সামান্য বয়োজ্যেষ্ঠতার জেরেই বলরাম কৃষ্ণের দায়িত্বভাগী হয়ে গিয়েছিলেন।

কথাটা একটু খোলসা করে বললে হয়তো কারও কৃষ্ণভক্তিতে আঘাত লাগতে পারে; কিন্তু জেনে রাখুন, কৃষ্ণকে আপনারা যত ভক্তি করেন, আমি তার চেয়ে বেশি করি, অতএব আমার কথাটা একটু ভেবে দেখবেন। এটা তো মানবেন, যে প্রত্যেক জননী আপন পুত্রস্নেহে এতটাই আতুর থাকেন যে, দূর থেকে দেখলে তাঁদের একটু স্বার্থপরই মনে হয়। তার উপরে ইনি হলেন জননী যশোমতী, নিজের ছেলেকে তিনি এমন চোখেই দেখেন যে, রোহিণীনন্দন বলরামের ওপরেও যেন একটু অবিচার হয়ে যায়। জিনিসটা অতিসংবেদনশীল পদাবলিকারদেরও নজর এড়ায়নি। পদাবলির বিষয়বস্তু একইরকম ছিল— কিশোরবয়সি কৃষ্ণ তাঁর সখা-বন্ধুদের নিয়ে গোচারণে যাচ্ছেন, কিন্তু কৃষ্ণের এই গোচারণের বিষয়টি জননী যশোমতীর কাছে অত্যন্ত সাহসের কাজ। অতএব গোচারণে যাবার সময় তিনি বালক কৃষ্ণের উদ্দেশে প্রচুর সাবধান-বাণী উচ্চারণ করছেন। যশোমতী তাঁর মাথার দিব্যি দিয়ে কৃষ্ণকে ধেনুপালের সামনাসামনি যেতে বারণ করছেন, সারাক্ষণ বাঁশি বাজাতে বলছেন, যাতে ঘরে বসেও তিনি বাঁশির আওয়াজ শুনতে পান এবং বোঝেন— কৃষ্ণ সুস্থ আছেন। কিন্তু জননীর স্বার্থ এবং কিঞ্চিদধিক বয়সি বলরামের দায়িত্ব সম্বন্ধে কৌতুককর কথাটা এসেছে এর পরেই। কী সাংঘাতিক ভয়ংকর এই মাতৃস্বার্থ, ভাবলে অবাক হই— যশোমতী বলছেন— গোপাল আমার! তুমি যেন বেশি উৎসাহ দেখিয়ে সবার আগে আগে যাবার চেষ্টা কোরো না। সবার আগে যাবে তোমার দাদা বলরাম। তাঁর সঙ্গে থাকবে তোমার অন্য রাখাল-বন্ধুরা তোমার বাম-ভাগে। আবার সকলের পিছনেও তুমি থাকবে না। পিছনে যাবে তোমার প্রাণের বন্ধুরা— শ্রীদাম, সুদাম, দাম, বসুধাম— এরা সব। আর তুমি থাকবে ঠিক মাঝখানে।

আমরা জানি— জননী যশোমতীর মায়ের মন, কত তাঁর দুশ্চিন্তা— গোরুগুলি পা ছুঁড়তে পারে, রাস্তায় কংস রাজার গুপ্ত ঘাতকেরা আছে— অঘাসুর, বকাসুর, আরও কতরকম অসুর-নামধারী কংসের চর আছে। অতএব জননীর স্নেহ এই বিশাল সর্বগ্রাসী সুরক্ষা দাবি করে, যাতে আর যা হয় হোক, কৃষ্ণের যেন কোনও ক্ষতি না হয়। বালক কৃষ্ণকে সর্বথা সুরক্ষিত রাখার জন্য তিনি তাই কৃষ্ণকে শুনিয়ে বলরামকে বলেন—

বলাই ধাইবে আগে আর শিশু বাম ভাগে

শ্রীদাম সুদাম সব পাছে।

তুমি তার মাঝে যাইও সঙ্গছাড়া না হইও

পথে বড় রিপুভয় আছে।

জননী যশোমতীর মনে একবারেরও তরেও কি এই ভাবনা এল না যে, রৌহিণেয় বলরাম, তিনিও তো কৃষ্ণের মতোই ছোট, তো তাঁর গায়েও তো গোরুর পায়ের চাট লাগতে পারে, কংসের গুপ্তঘাতকেরাও তাঁকেও তো হত্যা করতে পারে। না, এরকম কোনও দুর্ভাবনা জননী যশোমতীর মনে হয়নি এবং রৌহিণেয় বলরামও এমন সরলভাবেই এই ভাবনায় অভ্যস্ত এবং বিশ্বস্ত হয়েছিলেন যে, তিনি দায়িত্বশীল বড়ভাই। অতএব অনেক কিছুই তাঁকে চিন্তা করতে হবে। কংসের গুপ্তঘাতকেরা বলরামের ওপরেও কম আক্রমণ চালায়নি, কৃষ্ণের ওপর আক্রোশ মেটানোর জন্য কংস-নিযুক্ত শিশুঘাতী অসুরের দল যত চেষ্টা করেছে, রাজনীতির সেইসব অপচেষ্টা বলরামেরও ওপরেও একইভাবে নেমে এসেছে। অবশ্য এরই মধ্যে তাঁদের থাকার জায়গাটা সামান্য পরিবর্তিত হয়েছে। হরিবংশে খবর পাচ্ছি— প্রথমে ব্রজভূমির যে জায়গায় কৃষ্ণ-বলরাম বড় হয়ে উঠছিলেন, সেখানে বনসম্পদ ধ্বংস হয়ে যাচ্ছিল এবং তার ফলে হিংস্র জন্তুর উৎপাত বেড়ে উঠছিল। অতএব এইস্থান ত্যাগ করে সামান্য কিছু দূরে বৃন্দাবনে নিজেদের মতো করে আবাসন গড়ে তুললেন ব্রজভূমির গোপালক জনজাতীয় মানুষেরা। অবশ্যই কৃষ্ণের পালকপিতা নন্দগোপ তাঁদের মধ্যে প্রধান। অতএব নন্দগোপের সঙ্গে বলরামের মা রোহিণী এবং রৌহিণেয় বলরামও উঠে এলেন নতুন পাড়াতে। আমাদের ধারণা, বৃন্দাবনের সঙ্গে সদা উচ্চারিত মধুরপ্রবাহিনী যমুনা নদী তখনও বৃন্দাবনের কোল ঘেঁষে বইত না, যমুনা-নদীর খাত-পরিবর্তিত হবার পরেই তা বৃন্দাবনের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে এবং এই ঘটনার সঙ্গেও বলরাম সঙ্কর্ষণের পুরাকল্প যোজিত হয়েছে। তবে সেকথা পরে আসবে।

সঙ্কর্ষণ বলরামের বাল্যজীবন প্রসঙ্গে একথা অবশ্যই বলতে হবে যে, যদুমুখ্য বসুদেবের সঙ্গে বিরোধিতা করতে গিয়ে কংস প্রধানত কৃষ্ণকে যেমন শিশু অবস্থাতেই হত্যা করতে চেয়েছিলেন, তেমনই তিনি চেয়েছিলেন যাতে রৌহিণেয় বলরামকেও এই পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেওয়া যায়। আবার অন্যদিকে পূর্বস্থলী ছেড়ে কিছুটা দূরে এই বৃন্দাবনে যখন ব্রজবাসীদের নতুন আবাসন গড়ে উঠল, তখন সেখানেও স্থানীয় একটা বিরোধিতা তৈরি হয়েছিল। যেমন হয় আর কী, নতুন লোক পাড়ায় এলে স্থানীয় অধিবাসীরা যেমন সংশয়ে কঠিন হয়ে ওঠে তেমনই। পৌরাণিকেরা স্বাভাবিকভাবেই সকলকেই সাধারণ উপাধি দিয়ে অসুর বানিয়ে দিয়েছেন; ফলে একজন এখানে ধেনুকাসুর, অন্যজন প্রলম্বাসুর। ধেনুকাসুরের কথাই আগে হোক, কেন না বৃন্দাবনে উঠে আসার পর স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে এই প্রথম ‘এনকাউন্টার’। তবে তার চেয়েও বড় কথা, এ হল নতুন জায়গায় এসে এলাকা বাড়ানোর চেষ্টা। পাণ্ডব অর্জুনকে যেমন খাণ্ডব-প্রস্থের নতুন জায়গায় নাগ জনজাতিকে উৎখাত করে বন পুড়িয়ে বসতি বিস্তারের সাহায্য করতে হয়েছিল ধেনকাসুরের ব্যাপারটাও বোধ করি সেইরকম কোনও প্রয়াস বটে।

ব্রজভূমিতে যেমন হয়, বলরাম এবং কৃষ্ণ গোরু চরাতে বেরিয়েছেন এবং তাঁরা ঘুরতে ঘুরতে গোবর্ধন পর্বতের উত্তরদিকে চলে এসেছেন। এখানে বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে এক বিশাল তালবন, সারি সারি তালগাছে ভর্তি। জায়গাটার ভূতাত্ত্বিক পরিচিতিও আছে। গোবর্ধনের কাছাকাছি হলেও জায়গাটায় পাথুরে ভাব নেই, মাটি ঈষৎ কালো রঙের, ঘাসজাতীয় কুশগাছে ভর্তি হয়ে রয়েছে সমস্ত এলাকা এবং বনভূমির সবুজে স্নিগ্ধতা বিরাজ করছে সর্বত্র— দর্ভপ্রায়ঃ স্থলীভূতঃ সুমহান্‌ কৃষ্ণমৃত্তিকঃ। আর আছে তালগাছ; এত তালগাছ যে মানুষজন সেভাবে এখানে ঢোকে না, ঢুকতে ভয় পায়। পৌরাণিক জানিয়েছেন— এই তালবনের এপার থেকে ওপারে যাওয়া মানুষের পক্ষে সোজা কাজ ছিল না— তত্তু তালবনং নৃণাম্‌ অসেব্যং দুরতিক্রমম্‌।

বলরাম এবং কৃষ্ণ এই তালবনের মধ্যে ঢুকে পড়েছেন যদৃচ্ছায় চলতে চলতে। এক জায়গায় এত তালগাছ এবং সেগুলিতে প্রচুর পাকা তাল-ফল। বনভূমির মধ্যে এমন খাদ্যের আয়োজন দেখে ছোটভাই কৃষ্ণ দাদা বলরামকে বললেন— কী মিষ্টি গন্ধ বেরোচ্ছে দ্যাখো, সমস্ত জায়গাটা একেবারে ম-ম করছে— অহো তালফলৈঃ পক্বৈর্বাসিতেয়ং বনস্থলী। নিশ্চয়ই তালগুলো রসালো আর স্বাদু হবে।

আমাদের নাগরিক সভ্যতায় অভ্যস্ত মানুষ— চিকেন প্যাটিস আর বার্গারে যাদের রসনা ভোঁতা হয়ে গেছে, তাঁরা ভাববেন কী লোভী ছেলে রে বাবা! বনের মধ্যে তালের মতো একটা জঘন্য ফল দেখে কারও খাবার লোভ হয়! সলজ্জে জানাই— হয়। আজ থেকে ষাট-সত্তর বছর আগে যাঁরা গ্রামের বাড়িতে থাকতেন, যেখানে উদার আম-কাঁঠালের বাগান ছিল, অথবা স্থান-বিশেষে যেখানে তাল-সুপারির ভরা-ভরা গাছ ছিল, তাঁরা জানেন— সেইসব গাছ-গাছালি আর ফলের মাহাত্ম্য। ভাত-ডাল আর নিজের জমিতে হওয়া অপ্রতুল তরি-তরকারি খেয়ে যাঁরা জীবন কাটাতেন এবং এক-পয়সায় বড় রাজভোগ-রসগোল্লা খাবার জন্য যাঁদের আট ক্রোশ পথ হেঁটে হাটে যেতে হত, তাঁদের কাছে প্রতি ঋতুর এক-একটা ফল যে কী মাধুর্য নিয়ে আসত, সেটা এখনকার নগরায়িত গ্রাম্য মানুষের পক্ষে ধারণা করা অসম্ভব। আর এ তো খ্রিস্ট-পূর্ব শতাব্দীরও বহুপূর্ব ঘটনা। কাজেই গাছের ওপর পাকা তালের ঝোলা দেখে মায়া-মনুষ্য কৃষ্ণের পক্ষে দাদা বলরামের কাছে উত্তাল উচ্ছ্বাস প্রকাশ করাটা আমাদের কাছে কোনও আশ্চর্য ঘটনা নয়। ছোটবেলায় বাঁশের ঝুড়িতে তালের আঁটি ঘষে ফেলার পর সেই নিদৃষ্ট তালের আঁটি আমরা চুষে সাদা করে দিতাম— মনে আছে। কাজেই গ্রামের ছেলের ক্ষুধা-তৃষ্ণা-আস্বাদন নাগরিক-জনে বুঝবেন না বলেই এই দুই রাখাল-বালক বলরাম এবং কৃষ্ণের তাল-বিষয়ক কথোপকথনটুকু আমাদের মতো গ্রাম্যজনের জন্যই রসালো হয়ে উঠুক।

কৃষ্ণ বলরামদাদাকে বললেন— কেমন পাকা টোপা টোপা তাল গো দাদা! সমস্ত বন জুড়ে যেমন গন্ধ বেরুচ্ছে, তাতে মনে হচ্ছে পাকা পাকা তালগুলো বেশ রসালো আর স্বাদু হবে— স্বাদুনি আর্য সুগন্ধীনি শ্যামানি রসবন্তি চ। কাজেই আর দেরি নয়, দাদা! আমরা দুই ভাই আজ লাফিয়ে লাফিয়ে ফলগুলো মাটিতে ফেলব আর খাব,— পক্ক-তালানি সহিতৌ পাতয়াবো লঘুক্ৰমৌ। দাদা বলে কথা, তাতে অল্প-বয়সের বড় দাদা, তাতে দায়িত্ববোধ যত বাড়ে, দায়িত্ব-পালনের আড়ম্বর তার চেয়েও বেশি হয়। বলরাম হাসতে হাসতে দুই হাত দিয়ে লম্বা লম্বা তালগাছগুলো এক এক করে ঝাঁকাতে আরম্ভ করলেন— পাতয়ন্‌ পক্বতালানি চালয়ামাস তাংস্তরূন্‌। পাকা তাল একটা-দুটো করে মাটিতে পড়তে লাগল ঝুপ ঝুপ করে, আর তাল পড়ার শব্দ যাঁরা শুনেছেন, তাঁরা জানবেন, শব্দটা বেশ জোরেই হয়।

আগেই বলেছিলাম— এই তালবন তেমন সুবিধের জায়গা নয়, মানুষ-জন এখানে তেমন আসে না। কিন্তু মানুষ-জন যে আসে না, তার কারণ শুধু এই দুর্ভেদ্য জঙ্গলের অগম্যতা নয়, তার কারণ এখানে এক দৈত্য থাকে তার নাম ধেনুকাসুর। সে আবার গর্দভ বা গাধার রূপ ধারণ করে ধাকে— দারুণো ধেনুকো নাম দৈত্যো গর্দভরূপধৃক্‌। আশ্চর্য ব্যাপার, তার সাঙ্গোপাঙ্গ, অনুচর-পরিচরেরাও সবাই গর্দভের আকৃতি-প্রকৃতি অনুকরণ করে। এই ঘন-সন্নিবিষ্ট তালবনের প্রত্যন্ত ভূমিতে সে থাকে এবং এই তালবন যেন তার নিজস্ব অধিকার। বলরাম গাছ ঝাঁকিয়ে সুপক্ব তাল ফেলছেন মাটিতে, তার ঝপ্‌-ধপাধপ্‌ শব্দ শুনে ধেনুকাসুর রেগে অস্থির হয়ে উঠল— তালশব্দং স তং শ্রুত্বা সংঘুষ্টং ফলপাতনাৎ।

ধেনুকাসুর ক্রুদ্ধ হয়ে বলরামের কাছে পৌঁছনোর আগেই তার সম্বন্ধে দুটো কথা বলা দরকার, এমনকী এই তালবন সম্বন্ধেও দুটো কথা আছে। প্রথমে জানাই— অসুর-রাক্ষস-দৈত্য-দানোর পুরাকল্পের খোলস ছাড়িয়ে যদি নিতান্ত লৌকিকভাবে ব্যাপারটা দেখেন, তা হলে এই কথাটাই মেনে নিতে হবে যে, বৃন্দাবন-ব্রজভূমিতে এই প্রথম বসতি স্থাপন করা হচ্ছে এবং অঞ্চলেব আদি-নিবাসী যেসব জন-জাতি বাস করতেন, তাঁরা যে খুব সভ্য মানুষ ছিলেন, তা নাও হতে পারে। বিশেষত এই যে বলা হল— ধেনুকাসুর গর্দভের রূপ ধারণ করে থাকত, তার অর্থ এই যে, ধেনুকাসুর গর্দভের ‘টোটেম’ ব্যবহার করত এবং হয়তো বা গর্দভের আকৃতি-প্রকৃতিও অনুকরণ করত। এমনটি তার যে অনুচর-পরিচর, তারাও সব গর্দভের ‘টোটেম’ ব্যবহার করত এবং ওই গর্দভের আকৃতি-প্রকৃতি অনুকরণ করেই তাদের প্রভু ধেনুকাসুরকে রক্ষা করত— খরযূথেন মহতা বৃতঃ সমনুসেবতে।

ধেনুকাসুরের মধ্যে গর্দভের ভাবনা অনুপ্রবিষ্ট হওয়ায় পৌরাণিককে সেইভাবেই তার যুদ্ধের উপক্রম বর্ণনা করতে হয়েছে। বলরামের তালগাছ ঝাঁকানো এবং সবেগে তালপাতনের শব্দ শুনে ধেনুকাসুর মাথা ঝাঁকিয়ে গর্দভের মতো বিকট রব করতে করতে বলরামের দিকেই ধেয়ে গেল। বলরামের গায়ে দুই-একটা গর্দভোচিত দংশন করা ছাড়াও তার পিছনের দুই পা দিয়ে বলরামকে দারুণ আঘাত করল— পদ্ভ্যামুভাভ্যাঞ্চ পুনঃ পশ্চিমাভ্যাং পরাঙ্‌মুখঃ। লৌকিকভাবে আবারও ভাববার চেষ্টা করুন— আমরা কিন্তু ধেনুকাসুরকে চতুস্পদবিশিষ্ট কোনও গর্দভ মনে করি না। সে যে গর্দভোচিতভাবে পেছনের দুই পা দিয়ে বলরামকে আঘাত করছে, তার কারণ পৌরাণিক তার ওপরে গর্দভের ব্যবহার আরোপ করেছেন এবং আপাতত তার হাত দুটোকে সামনের দুই পা ভেবে নিতে হবে। অপিচ দুই হাতে ভূমিতে ভর রেখে পা দিয়ে ঘুরিয়ে আঘাত করাটা যে অসম্ভব শিল্পকর্ম নয় তা আজকালকার হিন্দি সিনেমায় অক্ষয়কুমারের মার দেবার কায়দা দেখলেই সহজবোধ্য হবে।

বলরাম ধেনুকাসুরের সঙ্গে যুদ্ধে প্রবৃত্ত হলেন এবং তিনি যে আপাতত নায়কের মতোই তাকে মৃত্যুমুখে পাতিত করবেন, এ তো স্বাভাবিক কথা। বলরাম ধেনুকাসুর এবং তার দলবলকে হাড়-গোড় ভেঙে তালগাছের ওপরে ছুড়ে ফেলে দিলেন। কিন্তু আমরা আধুনিকমনা বিদ্যাবিলাসী জনেরা এই অসুর-মারণের মাহাত্মে পৌরাণিক সিদ্ধিটুকু অনুভব করি বটে, কিন্তু তেমন কিছু আশ্চর্য হই না। কেন না ধেনুকাসুর-বধের পর যে সংবাদটুকু পৌরাণিক মনে করে দিয়েছেন, গবেষণার ক্ষেত্রে বলরামের সেই ভূমিকাটাই অনেক বেশি জরুরি। পৌরাণিক লিখেছেন— অনুচরদের সঙ্গে ধেনুকাসুর মারা গেলে সেই তালবনে মানুষের যাতায়াতের ভয় আর থাকল না, এই ব্রজভূমিতে গোচারণও সম্ভব হয়ে উঠল সহজভাবেই— বিপ্রমুক্তভয়ং শুভ্রং বিবিক্তাকারদর্শনম্‌। চরন্তি স্ম সুখং গাবঃ…। খবর পাচ্ছি— এখন বলরাম-কৃষ্ণের সহচর গোপজনেরা নিশ্চিন্তে সেই তালবনের মধ্যে বিচরণ করতে লাগলেন, যত্রতত্র, আর কোনও ভয়-ত্রাস রইল না তাদের— বীতশোক-ভয়ত্ৰাসা…গোপাঃ বন-বিচারিণঃ।

আমরা মনে করি, বৃন্দাবনের মতো একটা নতুন জায়গায় এসে বসতি স্থাপন করার পর সাধারণভাবে স্থানীয় মানুষদের দিক থেকে সে প্রতিরোধ তৈরি হয়, অথবা যে দৃঢ় প্রতিরোধ পূর্বাহ্নেই থাকে, আগন্তুক জনজাতিকে যে প্রতিরোধ দূর করে নিজেদের আবাস এবং বিচরণযোগ্য স্থান তৈরি করে নিতে হয়, এখানেও তাই ঘটেছে। লক্ষ করে দেখুন, পূর্বে কালীয়নাগকে দমন করে নতুন করে তার অভিবাসন ঘটিয়েছেন কৃষ্ণ। তাতে যমুনা নদীর মতো সুরম্য একটি নদী সকলের কাছে অধিগম্য তথা ব্যবহারযোগ্য হয়ে উঠেছে। অতঃপর তালবন এবং এর পর ভাণ্ডীর বনের মতো জায়গাও ব্রজভূমির বিস্তারিত আবাসনে পরিণত হল বলরামের ক্ষমতায়। একই ভাবে তালবন পেরিয়ে ভাণ্ডীর বনে বলরামের সঙ্গে দেখা হবে প্রলম্বাসুরের। তবে বসতি বিস্তারের সঙ্গে এখানে আরও একটা কথাও বলতে হবে এবং সেটা হল— কংস রাজার গুপ্তচর-বৃত্তির কথা। বলরাম অথবা কৃষ্ণের বিপক্ষ বলেই এদের অসুর বা দৈত্য নামটি সুপ্রযুক্ত।

প্রলম্বাসুরের অভিযানের মধ্যে কংস-চালিত গুপ্তহত্যার একটা সম্পর্ক যে আছে তা আরও ভাল বোঝা যায় পৌরাণিকের ইঙ্গিতপূর্ণ কথাবার্তা থেকে। প্রথমত প্রলম্বাসুর স্থানীয় গোপবালকের বেশ অনুকরণ করে গোপবেশ ধারণ করেই কৃষ্ণ-বলরাম এবং অন্যান্য গোপবালকদের সঙ্গে ঘুরে বেড়াচ্ছিল এবং তার ইচ্ছে ছিল— কৃষ্ণকেই অপহরণ করার। কিন্তু কৃষ্ণকে দেখে, যে কোনও কারণেই হোক, তার মনে হল— একে ঠিক সইতে পারা যাবে না, অতএব সে ঠিক করল— বলরামকেই তুলে নিয়ে যাবে অথবা তাকে মেরে ফেলবে— অবিষহ্যং ততো মত্বা কৃষ্ণম্‌-অদ্ভুতবিক্ৰমম্‌। রৌহিণেয়-বধে যত্নমকরোদ্দানবোত্তমঃ।

চেহারার যেমন বর্ণনা পাই, তাতে কৃষ্ণকে বলরামের থেকে বেশি শক্তিমান মনে হওয়ার কোনও কারণ নেই। বরঞ্চ বলরামকেই শক্তিমত্তর মনে হবার কথা, কেননা ভবিষ্যতে যিনি প্রসিদ্ধ গদাবীর হিসেবে চিহ্নিত হবেন, তাঁকে দেখলেই পরম বিক্রান্ত মনে হবার কথা— ঠিক যেমন মহাভারতীয় ভীম বা দুর্যোধনকে মনে হত। আসলে ওই যে পৌরাণিক লিখেছেন না— কৃষ্ণম্‌-অদ্ভুতবিক্রমম্‌— তার মানে কৃষ্ণের বিক্রম যে ঠিক কোথায়, তা ঠাহর করা যায় না, বিশেষত তাঁর বুদ্ধি। মনে রাখা দরকার— গোপবালক সেজে এই প্রলম্ব দানব কিন্তু বহু সময় ধরে কৃষ্ণ এবং বলরামের ওপর কড়া নজর রেখেছিল— দৃষ্টিং প্রণিদধে কৃষ্ণে রৌহিপেয়ে চ দারুণাম্‌। এই বিশেষ প্রণিধানের ফলেই প্রলম্বাসুর বুঝে গিয়েছিল যে, অদ্ভুত-স্বভাবের কৃষ্ণকে মারার লক্ষ্য নিয়ে এগোলে সে ধরা পড়ে যাবে, অতএব সরল, সাদা-সিধে বলরামকে মারাটাই তার লক্ষ্য হয়ে উঠল॥

এই মারামারিটা খেলার মধ্যেই হয়ে গেল। গোপবেশে থাকার ফলে অন্যান্য গোপ-বালকেরা তাকে বেশ বিশ্বাস করে ফেলেছিল— গোপালবপুষং গোপা মন্যমানা সবান্ধবম্‌। সেদিন খেলাটাও চলছিল বিচিত্র কায়দায়। খেলার নাম ‘হরিণাক্রীড়ন’। প্রাচীন খেলা, গ্রাম্যজনের খেলা। এ-খেলা দু’জনে দু’জনে খেলতে হয়— একটা নির্দিষ্ট লক্ষ্য ঠিক করে দু’জন বালক হরিণের মতো লাফ দিতে দিতে এগোবে, দু’জনের মধ্যে যে প্রথম লক্ষ্যস্থলে পৌঁছবে, সে জয়ী হবে। পরাজিত বালক তখন জয়ী বালককে পিঠে বয়ে নিয়ে পুরনো জায়গায় ফিরে আসবে। অতএব এ খেলা খেলতে হবে একসঙ্গে দু’জনে— প্রক্রীড়িতাস্তু তে সর্বে দ্বৌ দ্বৌ যুগপদুৎপতন্‌— গোপ-বালকেরা দুই-দুই করে জোড় বাঁধতেই কৃষ্ণ পড়লেন শ্রীদামের জোড়ায়। আর বলরামকে বেছে নিল প্রলম্বাসুর। খেলা আরম্ভ হল, নির্দিষ্ট লক্ষ্য ছিল ভাণ্ডীর-বৃক্ষের ছায়তল। কৃষ্ণ শ্রীদামকে হারিয়ে দিলেন খেলায়, শ্রীদাম তাঁকে পিঠে করে বালকোচিত হর্ষে রওনা দিলেন আরম্ভ-স্থলে। ওদিকে বলরামও জিতে গেলেন বটে, কিন্তু প্রলম্ব তাঁকে পিঠে করে বয়ে আনার সময় দৌড় মারল উলটো দিকে, তীব্রগতিতে এবং অবশ্যই কৃষ্ণের অলক্ষ্যে, কারণ কৃষ্ণকে নিয়ে শ্রীদাম তখন ছুটছেন।

পৌরাণিক তাঁর অতিশয়িনী কথকতায় বলেছেন বটে যে, বলরামকে কাঁধে-পিঠে নিয়ে সে আকাশে উঠে গেল আপন মায়ায় অথবা সে নিজের শরীরটা বিশাল-বিরাট করে ফেলল। আপনাদের বিশ্বাসের জন্য বলি— হয়তো এ সব কিছুই হয়নি। কিন্তু বলরামকে নিয়ে ওইভাবে ক্ষিপ্রগতিতে ছোটার ফলে, তিনি বেশ হতভম্বই হয়ে গেলেন প্রথমে এবং অবশ্যই খানিকটা কিংকর্তব্যবিমূঢ়— স সন্দিগ্ধম্‌ ইবাত্মানং মেনে সঙ্কৰ্ষণস্তদা— তবু প্রলম্ব তাঁকে নিয়ে ছুটছে দেখে নিরুপায় তথা অসহায় বোধ করে বলরাম এবার কৃষ্ণের নাম ধরে চেঁচাতে আরম্ভ করলেন। ঘটনাটা কোনওরকমে কৃষ্ণকে জানিয়ে বলরাম বললেন— আরে! আমাকে যে এই দৈত্যটা তুলে নিয়ে পালাচ্ছে, আমি যে ঠিক কী করব, তাও তো ভাল করে বুঝতে পারছি না, এটাকে এখন ঠান্ডা করি কী করে— কথমস্য ময়া কাৰ্য্যং শাসনং দুষ্টচেতসঃ। আসলে ঘটনার আকস্মিকতায় বলরাম এতটাই বিভ্রান্ত হয়ে গেছেন যে, তিনি দানব-প্রমাণ প্রলম্বের পিঠের ওপর মোটামুটি চালকের আসনে বসেও কিছুই করতে পারছেন না।

ছোটভাই কৃষ্ণ দাদা বলরামের চরিত্র ঠিক বোঝেন, এমনকী দেখতে দেখতে ক্রান্তদর্শী পৌরাণিকও বুঝে গেছেন তাঁর চরিত্র। হঠাৎ বিপদ উপস্থিত হলে বলরাম হঠাৎই ভীষণ রেগে যান অথবা তিনি কখনও ভয়ংকর নির্বিকার— এই অদ্ভুত চরিত্র আছে বলেই পৌরাণিক লিখলেন— বলরামের চরিত্র এবং শক্তির কথা মাথায় রেখে কৃষ্ণ তাঁকে আস্তে আস্তে চেতিয়ে তুললেন এমনভাবে যাতে প্রলম্বকে ঠান্ডা মাথায় মেরে ফেলা যায়।

বলরামের উদ্দেশ্যে কৃষ্ণের বক্তব্য হিসেবে পৌরাণিকেরা যা লিখেছেন, সেটাকে এক কথায় একটা দার্শনিক তথা তাত্ত্বিক স্তব-রচনা বলা যায়, কিন্তু ওই স্তব-খণ্ডের মধ্যে কৃষ্ণের সঙ্গে বলরামের তাত্ত্বিক অভিন্নতা প্রমাণিত হয়। বস্তুত মহাভারতের মধ্যেও এই তাত্ত্বিক অভিন্নতার প্রমাণ আছে। মহাভারতে বলা হয়েছে— বিষ্ণুর অবতার-কল্পে ভগবান শ্রীহরি নাকি তাঁর দুটি চুল— একটি সাদা চুল এবং একটি কালো চুল উপড়ে দিয়েছিলেন। তাঁর সাদা চুলটি অর্থাৎ সেই শুভ্র কেশ রোহিণীর গর্ভে প্রবেশ করল আর কৃষ্ণ কেশটি প্রবেশ করল দেবকীর গর্ভে— তৌ চাপি কেশৌ নিবিশেতা যদূনাং/ কূলে স্ত্রিয়ৌ দেবকীং রোহিণীঞ্চ।

মহাভারত পরিষ্কার জানিয়েছে— ভগবান শ্রীহরির যে শ্বেত কেশগাছিটি, সেইটাই রোহিণীর গর্ভে শ্বেতশুভ্র বলদেব হয়ে জন্মাল— তয়োরেকো বলদেবো বভূব/ যৌহসৌ শ্বেতস্তস্য দেবস্য কেশঃ। আর ওদিকে দেবকীর গর্ভে কৃষ্ণ কেশ থেকে জন্মালেন কৃষ্ণকান্তি কৃষ্ণ। শ্রীহরির কেশ থেকে এই আবির্ভাব বলে তাত্ত্বিকরা বলরাম এবং কৃষ্ণকে ভগবান বিষ্ণুর ‘কেশাবতার’ বলে আখ্যাত করেছেন। চৈতন্যপন্থী বৈষ্ণবরা এই কেশাবতারের তত্ত্ব মানবেন না, আমরাও সে আলোচনায় প্রবেশ করব না। কিন্তু এই দুই কেশ উৎপাটনের মহাভারতীয় সংবাদ দিয়ে আমরা শুধু এইটুকুই বোঝাতে চাই যে, তত্ত্বের দৃষ্টিতে কৃষ্ণ এবং বলরাম খুব বিভিন্ন নন। সৃষ্টিতত্ত্বের প্রক্রিয়ায় ভগবান বিষ্ণু যে প্রলয়-সলিলে অনন্তনাগের কুণ্ডলীর ওপর শয়ন করে থাকেন অথবা যে শেষনাগ পৃথিবী ধারণ করে আছেন, সেই অনন্ত, সেই শেষ— এঁরাও তত্ত্বগতভাবে সঙ্কর্ষণ বলরামের সঙ্গে একই স্বরূপে পরিকল্পিত হয়েছেন। আর ভগবান বিষ্ণুরই একাংশ থেকে অনন্ত এবং শেষনাগের ভাবনা উৎসারিত হয়েছে বলে বলরাম এবং কৃষ্ণকে প্রায় একাত্মক করে দেখা হয়েছে পুরাণে।

সত্যি কথা বলতে কী, এসব তত্ত্ব বড় কঠিন, বড়ই কঠিন। এক কথায় বলতে গেলে অলৌকিক সৃষ্টিপ্রক্রিয়ায় ভগবান বিষ্ণুর বসতিস্থান বৈকুণ্ঠের কর্মভার সামলান সঙ্কর্ষণ, প্রলয়কালীন সময় এবং প্রলয়োত্তর কালের নতুন সৃষ্টিতেও সমধিক অবদান আছে সঙ্কর্ষণ বলরামের। আর ঠিক সেই জন্যই এঁরা দৈহিকভাবে ভিন্ন হলেও স্বরূপত অভিন্ন। আর লৌকিক দৃষ্টিতে— বলরাম এবং কৃষ্ণ অভিন্ন-হৃদয় বন্ধুর মতো দুই ভাই বলেই হয়তো এই নৈকট্যসূচক তত্ত্বগুলি তাঁদের ওপর চেপে গেছে। এই যে বলরাম কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে কৃষ্ণের কাছে পরামর্শ চাইলেন, তখন কৃষ্ণ যে-কথাগুলি বলে বলরামকে উদ্দীপ্ত করলেন, সেই কথাগুলি কিন্তু এই তত্ত্বকথা। কৃষ্ণ বললেন— তোমার সঙ্গে আমার ভেদ নেই কোনও, অতএব আমি যা পারি তুমিও তা পারো। তুমি তাই তোমার সেই জগদ্‌-ব্যাপক স্বরূপটি চিন্তা করে প্রলম্ব দৈত্যকে উপযুক্ত শাস্তি দাও।

আমরা আমাদের পাঠকের সুবিধার্থে জানাই— এইসব তত্ত্বকথা ছেড়ে দিন। শুধু এইটুকু বুঝুন– কৃষ্ণ তাঁর দাদা বলরামকে একটু চেতিয়ে না দিলে তিনি নিজের বুদ্ধিমতো খুব একটা বড় কাজ করতে পারেন না। আবার যেখানে তিনি নিজের বুদ্ধি বা শক্তিমতো কাজ করেছেন, সেসব কাজে কিছু গণ্ডগোলও হয়েছে। আপাতত দেখছি— প্রলম্বাসুর যেভাবে বলরামকে পিঠে করে নিয়ে পালাচ্ছিল, তাতে এতটাই সে কৃষ্ণের আওতা থেকে দূরে ছিল (পৌরাণিক তাকে এমনই আকাশে উঠিয়ে দিয়েছেন) যে, কৃষ্ণের তখন কিছু করার ছিল না। অতএব দূর থেকে শব্দ-শক্তি সঞ্চার করে কৃষ্ণ যেই বলরামকে আত্মশক্তিতে বিশ্বস্ত করে তুলতে পেরেছেন, সেই মুহূর্তেই বলরাম কিন্তু দৈত্যের পিঠে বসেই তার মাথার ওপর প্রবল আঘাত করেছেন নিষ্করুণভাবে। প্রলম্বাসুরের মৃত্যু হতে দেরি হয়নি। কৃষ্ণের কথায় যখনই বলরাম বুঝেছেন যে, তিনিও কৃষ্ণের মতোই শত্ৰুসংহার করতে পারেন, তখন সেই আত্মবিশ্বাসই তাঁকে কৃষ্ণের সমকক্ষ করে তোলে। নইলে নিজে তিনি মানুষটা বড়ই ভোলেভালা, বড়ই বেখেয়ালি, এমনকী নিজেকেও তিনি ভাল করে চেনেন না, কৃষ্ণ তাঁকে চিনিয়ে দেন নিজেকে। প্রলম্বাসুর মারা যাবার পর সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ সংবাদ যেটা দিতে হবে, সেটা হল— আমরা যে এতক্ষণ রৌহিণেয় সঙ্কর্ষণকে বলরাম বলে ডাকছিলাম, সেই ‘বলরাম’ নামটাই এসেছে প্রলম্বাসুরকে মারার পর। প্রচণ্ড বলপ্রয়োগ করে প্রায় বালক অবস্থাতেই দুর্জয় দৈত্যকে বধ করেছেন বলেই— বলেনায়ং হতো দৈত্যো বালেনাক্লিষ্টকর্মণা— সঙ্কর্ষণ এখন থেকে ‘বলদেব’ নামে বিখ্যাত হলেন। এই বলপ্রয়োগে ব্রজভূমির সরল সাধারণ মানুষের মনোরঞ্জন করেছিলেন বলে সেই বলদেব কিন্তু বলরামও বটে, ‘রাম’ কথাটার মধ্যে রঞ্জনের ভাব আছে।

॥ ৪ ॥

সঙ্কর্ষণ বলরামের বাল্যজীবন অথবা বাল্যজীবনেই তাঁর বহুতর বিক্রমের ঘটনা অনেকানেক লিপিবদ্ধ করা যায় না, কেন না ইতিহাস-পুরাণের কথকঠাকুরেরা কৃষ্ণকে নিয়েই এত ব্যস্ত যে, বলরামের জীবনচর্যা সেখানে অবহেলিত থেকে যায়। এই যে ধেনুকাসুর আর প্রলম্বাসুর মারা গেল, এর পরে যতই বিক্রম এবং শক্তি প্রকাশের ঘটনা আছে, তা সবই কৃষ্ণের মাহাত্মে এমনই মুখরিত যে, বলরাম সেখানে চাপা পড়ে যান। অথচ কৃষ্ণ যেখানে যেখানে আছেন, বলরামও সেখানে সেখানে আছেন। এই যে একটু আগে প্রলম্বাসুরকে মারবার সময় কৃষ্ণ বলরামকে তাঁর আত্মশক্তি স্মরণ করিয়ে দিলেন, এই পারস্পরিক উদ্দীপনের তাত্ত্বিকতা কিন্তু উলটো দিকেও আমরা দেখেছি। বলরাম কর্তৃক অসুর-নিধনের আগে আমরা কালীয়-দমন দেখেছি। যমুনা নদীতে কালীয়-নাগের ফণাজালে কৃষ্ণ যখন প্রায় আটকে গেছেন, তখন দেখছি— একই রকমভাবে বলরাম সঙ্কর্ষণ তাঁকে উত্তেজিত করছেন এবং বলরামের কথাতেই কৃষ্ণ আপন শক্তি প্রকাশ করে কালীয়-নাগকে চরম শাস্তি দিলেন— তচ্ছ্রুত্বা রৌহিণেয়স্য বাক্যং সংজ্ঞা-সমীরিতম্।

দুই বৈমাত্রিক ভাইয়ের এই মধুর পারস্পরিকতার উদাহরণ দিয়ে আমি শুধু এইটুকুই বোঝাতে চাইছি যে, হরিবংশ এবং পুরাণগুলি অতঃপর কৃষ্ণের কথাই বেশি করে বলবে, কিন্তু একক কৃষ্ণের কথা যতই হোক, মনে রাখবেন, সেখানে সবার অলক্ষ্যে বলরামও আছেন। বলরামকে তাঁর শক্তি এবং প্রভাবের জন্য কৃষ্ণের মতোই মর্যাদা দিতে হবে, সে কথা প্রমাণিত হয়ে যায় কৃষ্ণের সঙ্গে যখন বলরামকেও কংস আমন্ত্রণ জানালেন তাঁর সুচিন্তিত মল্লযুদ্ধের আসরে। বারবার কংস কিন্তু ঘোষণা করছেন যে, কৃষ্ণই তাঁর প্রধানতম শত্রু, কিন্তু কংস-নিযুক্ত যত গুপ্তঘাতক কৃষ্ণকে মারতে গেছে, তাদের কেউ কেউ বলরামকেও ‘টারগেট’ করেছে এবং কোনও ভাবেই যখন দুই ভাইয়ের কাউকেই মারতে পারলেন না কংস, তখন তিনি ঠিক করলেন— অক্রূরকে বৃন্দাবনে পাঠিয়ে দুই ভাইকেই মথুরায় নিয়ে আসবেন এবং তারপর বলবান মল্লযোদ্ধাদের দিয়ে দু’জনকেই শেষ করে দেবেন।

অক্রূর কৃষ্ণপিতা বসুদেবের জ্ঞাতিগোষ্ঠীর একজন। কংস মথুরায় নিজের হাতে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করার পর যদু-বৃষ্ণিকুলের অন্যান্য প্রধান-পুরুষেরা অনেকেই বেশ ক্ষুব্ধ হয়েই ছিলেন, যদিও বসুদেবের মতো তাঁরা কেউই কংসের প্রত্যক্ষ এবং স্পষ্ট বিরোধিতা করতে পারেননি। এঁদের মধ্যে অক্রূর আরও একটু অন্যরকম। কংস তাঁকে অনেকটাই হাত করে ফেলেছিলেন, ফলে কংস তাঁকে খানিকটা বিশ্বাসও করতেন বলেই শেষ পর্যন্ত অক্রূরকে আদেশ দিলেন। প্রথমে বললেন— আমার সঙ্গে কৃষ্ণের যে চরম শত্রুতা তৈরি হয়েছে, তাতে যে কোনও একজন না মরলে আমি কিংবা কৃষ্ণ— কারুরই শান্তি নেই, শান্তি হবে না যাদবদেরও— শান্তিমেকতরে শান্তিং গতে যাস্যন্তি যাদবাঃ।

কংস বললেন বটে যে, কৃষ্ণের সঙ্গে তাঁর একান্ত শত্রুতা, কিন্তু অক্রূরকে আদেশ দেবার সময় তিনি বললেন— অক্রূর! আমার আদেশে বসুদেবের ওই দুটি ছেলে কৃষ্ণ এবং বলরামকে এখানে নিয়ে আসার জন্য তোমাকেই একবার যেতে হবে। তুমি গিয়ে ব্রজভূমির প্রধান পুরুষ নন্দগোপকেও এখানে আসতে বলবে, কেন না বচ্ছরকার খাজনা সব বাকি পড়ে আছে। আর কৃষ্ণ আর বলরামকে বলবে যে, রাজা কংস তাঁদের একবার দেখতে চান— কৃষ্ণ-সঙ্কর্ষণৌ চৈব বসুদেব-সুতাবুভৌ। কংস বেশ ভাল ভাল কথা বললেন, বটে, কিন্তু তাঁর অন্তরের ইচ্ছা ছিল— কোনও অছিলায় যদি কৃষ্ণ-বলরামকে একবার মথুরায় এনে ফেলা যায়, তবে অন্য অছিলায় তাঁদের মেরে ফেলাটা কিছু কঠিন নয়। নন্দগোপ এবং অন্যান্য সাধারণ জনকেও যে তিনি জোর করেই একই সময়ে বার্ষিক রাজকরের অছিলায় মথুরায় নিয়ে আসতে চাইলেন, তার কারণ কৃষ্ণ-বলরামের নিকটজন, অনুচর-সহায়ক, সবাইকেই শেষ করে দিতে চান কংস। কিন্তু যত মানুষই আসুন, কৃষ্ণ এবং বলরামই যে কংসের প্রধানতম লক্ষ্য, তা দুটো টুকরো খবর থেকে বোঝা যায়। এক, কৃষ্ণ এবং বলরামকেই শুধু রাজধানীতে নিয়ে আসার জন্য অক্রূরকে পাঠিয়েছেন কংস, অন্য সকলকে মথুরার নিকটবর্তী বনভূমিতে থাকতে বলেছেন— সন্নিকৃষ্টে বনে তে তু নিবসন্তু যথাসুখম্‌। দুই, অক্রূরকে কংস বলেছিলেন যে, কোনও ভাবে যদি কৃষ্ণ-বলরাম না আসতে চান মথুরায়, তবে যেন তাঁদের বন্দি করে আনা হয়— নাগচ্ছেতাং যথাকালং নিগ্রাহ্যাবপি তৌ মম। অর্থাৎ যে কোনও ভাবেই কৃষ্ণ এবং বলরামকেই চাই।

অক্রূর বৃন্দাবনে এলেন। নন্দগোপ এবং অন্যান্যদের সঙ্গে কথা বলেই তিনি একান্তে কৃষ্ণের সঙ্গে কথা বলতে থাকলেন। লক্ষণীয়, অক্রূরকে কংস যতই বিশ্বাস করে থাকুন, যাদব রাজনীতির চক্রে তিনি কিন্তু কংসের বিশ্বস্ত জনের মধ্যে থেকেও তাঁর প্রতিকূল আচরণ আরম্ভ করেছিলেন। অতএব কৃষ্ণ-বলরামকে মথুরায় নিয়ে গিয়ে কংস আসলে কী করতে চান, সেটা অক্রূর বুঝিয়ে দিয়েছিলেন কৃষ্ণকে। কৃষ্ণের সঙ্গে কথা বলতে বলতে অক্রূরের সারারাত কেটে গিয়েছিল, কিন্তু খেয়াল করতে হবে, সারারাত যে এই একান্ত বৈঠক চলল, তাতে কৃষ্ণ আর অক্রূর ছাড়া তৃতীয় যে ব্যক্তিটি একই সঙ্গে রাত্রিভর জেগে সব কথাবার্তা শুনলেন, তিনি, কিন্তু রৌহিণেয় বলরাম— রৌহিণেয়-তৃতীয়স্য সা নিশা ব্যত্যবর্তত।

রাতের আঁধার কেটে গেলে সমস্ত ব্রজভূমি নিজের মতো করেই আবার ব্যস্ত হয়ে উঠল। অক্রূরও পূর্ব সিদ্ধান্ত মতো কৃষ্ণ এবং বলরামকে নিয়ে রথে উঠলেন। ব্রজভূমির দুই যৌবন-সন্ধিলগ্ন বালক তাঁদের ওপর কংসের মৃত্যু-পরোয়ানা নিয়েই অক্রূরের সঙ্গে রওনা হলেন মথুরায়। দুই ভাই রথে উঠতে ব্রজভূমিতে যে শোকের ছায়া নেমে এসেছিল, আমরা সেই বর্ণনায় যাচ্ছি না, তবে খানিকটা বিরক্তিকর হলেও মথুরার পথে যেতে অক্রূরের একটা সামান্য অভিজ্ঞতা আমাদের বলতেই হবে।

বৃন্দাবন ছেড়ে মথুরার পথে খানিকটা গেলেই যমুনা নদীর তীর ঘেঁষেই একটি হ্রদের সৃষ্টি হয়েছে। সেখানকার মানুষেরা এই বৃহৎ জলাশয়কে শেষ হ্রদ বা অনন্ত হ্রদ বলে। অক্রূর এখানে রথ থামিয়ে রথের ঘোড়াগুলিকে ঘাস-জল, দানাপানি দিয়ে কৃষ্ণ-বলরামকে বললেন অপেক্ষা করতে। তিনি ওই হ্রদের জলে পুণ্যস্নান করে ভগবান অনন্তদেব অর্থাৎ শেষনাগের স্তব করতে চান। অক্রূর জলে নামলেন এবং জলে ডুব দিয়ে স্তব করতে করতেই ভগবান অনন্তদেবের সমস্ত বিভূতি দেখতে পেলেন। অনন্তদেব অথবা শেষ পৌরাণিক দৃষ্টিতে সর্পশরীর। তাঁর সহস্র মুখ এবং সহস্র ফণা, কিন্তু তাঁর পরিধানে নীলবাস— সহস্ৰশিরসং দেবম্ অনন্তং নীলবাসসম্‌। তাঁর গায়ের রং শ্বেতশুভ্র, তিনি এই পৃথিবীকে ধারণ করে আছেন। বাসুকি এবং অন্যান্য নাগ-প্রধানেরা তাঁর সেবায় নিযুক্ত। শেষনাগ তাঁর বিশাল সৰ্পশরীর কুণ্ডলিত করে যে কোল তৈরি করেছেন তারই মধ্যে পরম আলস্যময়তায় বসে আছেন পীতাম্বরধারী বিষ্ণু— পীতাম্বরধরং বিষ্ণুং সূপবিষ্টং দদর্শ হ৷

অক্রূরের স্তবের মধ্যে ভগবান অনন্তদেব এবং তার ক্রোড়শায়ী বিষ্ণুর বহু বর্ণনা আছে, আমরা তার মধ্যে যাচ্ছি না। কিন্তু এখানে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সংবাদটি হল— অক্রূর দেখলেন সেখানে অনন্তদেবের বিভূতিসার সংগ্রহ করে যে গৌরবর্ণ দেবতাটি আসন ছাড়াই বসে আছেন, তাঁর সঙ্গে বলরামের অদ্ভুত মিল আছে— সঙ্কৰ্ষণমিবাসীনং… তুল্যসংহননং প্রভুম্‌।

সহৃদয় পাঠক আমার! ভাবছেন— আবারও সেই বকবকানি শুরু হল। আমি কী করি বলুন, শুধু বলরামের কাহিনি শুনলেই তো আর বলরামকে বোঝা যায় না, তাঁকে তত্ত্বত না বুঝলে তাঁর কাহিনিগুলোও যেমন অর্থহীন হয়ে পড়বে, তেমনই কৃষ্ণের সঙ্গে তাঁর সম্পর্কটাও অন্তরঙ্গভাবে বোঝা যাবে না। মহাভারতের শেষে একেবারে মৌষলপর্বে গিয়ে দেখবেন— যদুবংশের ধ্বংসশেষে বলরামেরও শেষ যাত্রার সময় হয়েছে। সেই অন্তিম সময়ে স্বয়ং কৃষ্ণ দেখছেন— যোগস্থিত বলরামের মুখ থেকে এক বিশাল শ্বেতসর্প বেরিয়ে যাচ্ছে সমুদ্রের দিকে— তথাপশ্যদ্‌ যোগযুক্তস্য তস্য/ নাগং মুখাগ্নিশ্চরন্তং মহান্তম্‌। এই মহাসর্পের গায়ের রং সাদা, চক্ষু-দুটি রক্তবর্ণ, সহস্রমুখ। সে সাগরে পৌঁছনোর আগেই নাগ-কুলের প্রধান পুরুষেরা বাসুকি, কর্কোটক, বরুণ ইত্যাদি— তাঁরা সব প্রত্যুদ্‌গমন করে নিয়ে গেলেন সেই মহাসর্পকে, তাদের স্বাগত অভিবাদন আর অভিনন্দনের মধ্য দিয়েই মহানাগ মিলিয়ে গেলেন সমুদ্রের মধ্যে।

বলরামের মুখ থেকে যে মহাসর্প বেরিয়ে গেল, সেই কিন্তু বলরামের তাত্ত্বিক শরীর, সেই অনন্তনাগ, শেষনাগ যিনি প্রলয়কালে জলে জলাকার মহাসমুদ্রের মধ্যে কুণ্ডলী পাকিয়ে ভাসতে থাকেন এবং আপন কুণ্ডলিত আসনের মধ্যে ভগবান বিষ্ণুকে ধারণ করে থাকেন। সৃষ্টি-প্রক্রিয়ার আরম্ভে এই বিষ্ণু-নারায়ণের নাভি-কমল থেকেই ব্রহ্মার উদ্ভব। ভগবান অনন্তদেব অথবা শেষনাগ ওই বিষ্ণু-নারায়ণেরই অন্যতর এক রূপ।

ছোটবেলায় যখন এই তত্ত্বগুলি পড়তাম, তখন একেবারে ধন্দে পড়ে যেতাম। শাস্ত্রকারদের ভাবনা দেখেও অবাক লাগত— বিষ্ণু কিংবা নারায়ণও এক রকম নয়, কারণার্ণবশায়ী বিষ্ণু, গর্ভোদশায়ী বিষ্ণু, পয়োদ্ধিশায়ী বিষ্ণু— কতরকম! এত সব আমার বোঝার দরকার নেই এখানে, আমার পাঠক-কুলও কান বন্ধ করে থাকুন। তবে এইটে শুধু বুঝতে হবে যে, এই বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ডের মূলে এক মহাশক্তিমান ঈশ্বর আছেন, তাঁকে যদি ‘সেন্ট্রাল ফিগার’ হিসেবে ধরে নিই এবং শাস্ত্রমতে তিনিই যদি কৃষ্ণ বা বিষ্ণু হন, তবে বলতে হবে বিষ্ণু তাঁর জগৎ-প্রতিপালনের কাজটি করার জন্যই অনন্ত বা শেষনাগের মধ্যে আবিষ্ট হন। অনন্তদেব বিষ্ণুর আবেশ অবতার। বিশাল সমুদ্রের মধ্যে তাঁর নিস্তরঙ্গ অবস্থিতির মধ্যে তাঁর একটা নিঃসঙ্গতা এবং নিঃস্পৃহতা কাজ করে, জগতের অনন্ত কর্মের মধ্যে তিনি পদে পদে মাথা গলান না; মাথা গলান যিনি, তিনি তাঁকে ধারণ করে থাকেন। খেয়াল করে দেখবেন— মহাভারতের রঙ্গমঞ্চে কৃষ্ণ কিন্তু নাটের গুরু, সর্ব-বিষয়ে তাঁর উপস্থিতি আছে, অন্যদিকে বলরামকে দেখুন, তিনি যুদ্ধে কোনও অংশ নিলেন না এবং যে কোনও ‘ক্রুসিয়াল’ ব্যাপারে তিনি নিজেকে সরিয়ে রাখেন। অথচ কৃষ্ণের সঙ্গে তিনি সব সময় আছেন, তিনি আলাদা নন কখনও। মহাভারতেও যে সেই ভগবান শ্রীহরির পক্ব কেশ আর কৃষ্ণ কেশ-এর কথা আছে, ওই পলিত কেশ ওই একই নিঃস্পৃহতা আর নিঃসঙ্গতার তত্ত্বটি বুঝিয়ে দেয়। পণ্ডিত জনে লিখেছেন— Their almost twin nature is brought out in the passage. Inherent in the concept of these two brothers is the idea of the one remaining semi-neutral and the other more active.

বলরাম এবং কৃষ্ণের স্বরূপগত তত্ত্বের আরও একটা কৌতুককর দিক আছে, সেটা আধুনিক পণ্ডিতেরা ধরেছেন। ইংরেজি পঙ্‌ক্তিতে ওই যে ‘twin’ কথাটা বলা হল, এই যমজ ভাবনাটুকু কিন্তু চেহারার মিলে নয়, এমনকী স্বভাবের মিলেও নয়। বলরাম এবং কৃষ্ণের চেহারাতেও মিল নেই, স্বভাবেও মিল নেই। মিলটা আছে ওই তত্ত্বে, মূল-স্বরূপের মধ্যে। পালনকর্তা বিষ্ণু যে শেষশয্যায় ‘রিক্লাইন’ করে আছেন, তাঁর যে মর্যাদা বা তাঁর যে অলৌকিক স্বরূপ, সেটা কিন্তু তাঁর সঙ্গে একই রকম— যিনি আপন কুণ্ডলী-ক্রোড়ে তাঁকে ধারণ করে আছেন। বস্তুত এই জায়গাটাতেই তাঁর যমজ-স্বভাব, অন্যত্র নয়। পণ্ডিত-জনে আরও একটু বিশদর্থে এই যমজ স্বভাবের তাৎপর্যটুকু কৃষ্ণ-বলরামের ওপর প্রয়োগ করতে চান, যদিও আমাদের শাস্ত্রকারদের তাত্ত্বিক ভাবনাগুলি সেখানে লঘু হয়ে যায়।

ওঁরা বলেন— ভারতবর্ষে যমজ দেবতা বা যুগ্ম দেবতার একটা স্থান আছে বহুকাল ধরে, একেবারে বৈদিক কাল থেকে। অশ্বিনীকুমার-দ্বয়ের মতো আকৃতি এবং প্রকৃতিতে একাত্মক যুগল-দেবতার কথা না হয় ছেড়েই দিলাম। স্বভাবত ভিন্ন, কার্যত ভিন্ন, অথচ স্বরূপে এক রকম মাহাত্ম্যের দেবতা হলেন মিত্রাবরুণ। মিত্র এবং বরুণ, বৈদিক দেবমণ্ডলে এঁরা ‘হাই গডস্‌’, যদিও এঁদের প্রভাব এবং কার্যকর্মও আলাদা। স্বরূপত এক অথচ কার্যত ভিন্ন হওয়া সত্ত্বেও মিত্রাবরুণ যুগ্ম দেবতা হিসেবে চিহ্নিত হয়েছেন বেদে এবং হয়তো সেই বৈদিক পরম্পরা মাথায় রেখেই হরিবংশ পুরাণ রোহিণীর কথা পূর্বে উল্লেখ করেও যেই মুহূর্তে বলরাম এবং কৃষ্ণ দেবকীর সম্মুখে উপস্থিত হয়েছেন, তখনই দেবমাতা অদিতির সঙ্গে তুলনা করে বলেছেন— মিত্র এবং বরুণকে যুগ্মভাবে লাভ করে অদিতি-মাতা যেমন শোভা ধারণ করেছিলেন, কৃষ্ণ এবং বলরামের সঙ্গে দেবকীর শোভাও তেমনই— অদিতির্দেবমাতেব মিত্রেণ বরুণেন চ।

আমরা এই বৈদিক পরম্পরার থেকেও ইতিহাস-পুরাণের পরম্পরা খুঁজতে ভালবাসি। কেন না তত্ত্বের মাহাত্ম্য বজায় রেখেও ইতিহাস-পুরাণ সমস্ত ঘটনা অনেক লৌকিকভাবে বুঝিয়ে দেয়। পৌরাণিক কথকঠাকুর শুধু যুগ্ম-দেবতার খবর দেন না, শক্তি-ক্ষমতায় সমান অথচ কার্যক্রমে ভিন্ন এমন দেবতার কথা ছেড়েই দিলাম, এরকম যুগল-রাক্ষস, যুগল-মুনি এমনকী যুগল অবতারের কথাও তো পৌরাণিকরাই জানিয়েছেন। মহাভারতে মিত্রাবরুণের দেবত্ব হারিয়ে গেছে, তাঁরা সেখানে ঋষি হয়েছেন। আরও এক ‘সেট’ যুগল-মুনি হলেন নর-নারায়ণ— অর্জুন এবং কৃষ্ণ নাকি তাঁদেরই প্রতিরূপ। এ ছাড়া দৈত্য-অসুরদের মধ্যে স্বনামধন্য সুন্দ-উপসুন্দ, বিরাট রাজার বদমাশ শালাদের মধ্যে কীচক-উপকীচকদের কথা বাদই দিলাম, যুগ্ম অবতার ব্যাপারটাও তো অশেষ কৌতুকপ্রদ। নায়ক-প্রতিম অবতারদের মধ্যে কৃষ্ণ-বলরামের যুগল আছে যেমন, তেমনই তাঁদের পূর্ব অবতারের যুগল হলেন রাম-লক্ষ্মণ। অবতার-কাহিনিতে রাম-লক্ষ্মণ অথবা কৃষ্ণ-বলরামের প্রতিনায়কেরাও যুগল হিসেবে আছেন। যেমন রাবণ-কুম্ভকর্ণ অথবা দন্তবক্র-শিশুপাল; আরও পুরনো জায়গায় গেলে হিরণ্যাক্ষ-হিরণ্যকশিপু— যাঁরা মারা পড়েছিলেন বরাহ এবং নৃসিংহ অবতারের হাতে।

ভারতবর্ষের ঐতিহ্যগত ধারণায় রাম-লক্ষ্মণই পরবর্তী অবতারে কৃষ্ণ-বলরাম। একটু ধন্দ আছে শুধু বয়সের বিনিময়ে— আগের অবতারে যিনি ছোটভাই ছিলেন, পরের বারে তিনি বড়ভাই বলরাম হলেন কী করে? এটা তো সত্যি কথাই এবং আগেও বলেছি এ কথা যে, অনন্তনাগ অথবা শেষনাগ যেমন বিষ্ণুর পালন কার্যে সহায়তা করেন, সেই মৌলিক সহায়ক ভাবটুকু কিন্তু লক্ষ্মণের মধ্যে বেশ আছে। আজীবন তিনি রামচন্দ্রের সমস্ত কর্মে সহায়তা করেছেন, কিন্তু বলরাম কি লক্ষণের মতো তেমন সহায়ক, তেমন আজ্ঞা-মাত্রেই বা ইচ্ছামাত্রেই কি কৃষ্ণের আদেশ পালন করেন তিনি?

আমাদের যে এমন সন্দেহ হবে পৌরাণিক তা জানতেন, আর সেই জন্যই কী অসাধারণ এক কাহিনি শুনিয়েছেন তিনি। কথাটা অবশ্য পুরাণ-সাহিত্যে তেমন স্পষ্ট করে পাইনি, এমনকী খুব ধ্যান দিয়ে এটা আমি ভাল করে দেখারও সময় পাইনি পুরাণগুলি ঘেঁটে ঘেঁটে, কিন্তু এ বিষয়ে প্রাচীন ইঙ্গিত আছে এবং তা স্পষ্ট করে দিয়েছেন ষোড়শ শতাব্দীর নবজাগরণের কবি কৃষ্ণদাস কবিরাজ, যিনি চৈতন্য-চরিতামৃতের মধ্যে কৃষ্ণ-বলরামের কথা বলতে গিয়ে রাম-লক্ষ্মণের প্রসঙ্গটা টেনে এনেছেন। অবতারবাদের কল্প নির্দেশ করতে গিয়ে কবিরাজ যা বলেছেন, তাতে এটা বেশ বোঝা যায় যে, আধুনিক গবেষকেরা যাকে দেবতাদের ‘twin’-তত্ত্ব বলে নির্দেশ করেন সেটা এই প্রাচীন কবিরাজ জানতেন। কবিরাজ লিখেছেন— পূর্ব অবতারে বলরাম ছিলেন রামচন্দ্রের ছোটভাই এবং ছোট বলেই সব সময় অগ্রজের আজ্ঞা-অনুজ্ঞা মেনে নিতে হয়েছে। বিশেষত রামচন্দ্রের দুঃখময় জীবনে, যেখানে বিমাতা কৈকেয়ীর কূট মন্ত্রণায় তথা পিতা দশরথের স্ত্রৈণ আচরণে রামচন্দ্রের সমস্ত জীবনটাই বিপর্যস্ত হয়ে গিয়েছিল, সেখানে লক্ষ্মণ অনেক কিছুই মেনে নিতে পারেননি। কখনও সখনও প্রতিবাদ তিনি করেছেন বটে, কিন্তু রামচন্দ্র কখনওই সে প্রতিবাদ বাড়তে দেননি অথবা তাঁকে অনুমোদন করে পিতামাতার অমর্যাদা করেননি। লক্ষ্মণকে সব সইতে হয়েছে নির্বিচারে।

একদিকে রামচন্দ্রের সত্য-প্রতিপালনের কাঠিন্যও সহ্য করতে পারেননি লক্ষণ, অন্যদিকে তাঁর বনবাস-দুঃখও সহ্য করতে পারেননি। সবটাই তাঁকে সহ্য করতে হয়েছে অগ্রজ রামচন্দ্রের মুখ চেয়ে কবিরাজ লিখেছেন—

নিষেধ করিতে নারে যাতে ছোট ভাই।

মৌন করি রহে লক্ষ্মণ মনে দুঃখ পাই॥

প্রতিবাদ করার বিষয় বিনা প্রতিবাদে মেনে নেবার মধ্যে চরম কষ্ট আছে, অন্যদিকে রামচন্দ্রের বনবাস-দুঃখের অংশীদার হবার সঙ্গে সঙ্গে লক্ষ্মণ নিজেও বহুতর কষ্ট পেয়েছেন অগ্রজের সেবায়। এই সহনশীলতার একটা মূল্য আছে এবং আমাদের ঐতিহ্যে দেবতারাও কর্মফল ভোগ করেন এবং মুখ বুজে সওয়ার একটা পুণ্যফল তো আছেই। অতএব আবারও যখন অবতার-গ্রহণের সময় এল, তখন ছোটভাই লক্ষ্মণ এবার বড়ভাই হতে চেয়েছেন— কবিরাজের ভাষায়— কৃষ্ণাবতারে জ্যেষ্ঠ হইলা সেবার কারণ। ভাবটা এই— আগের জন্মে ছোটভাই হয়ে শুধু আজ্ঞা পালন করে গিয়েছি, এবারে আমি আজ্ঞা দেব, প্রতিবাদ করব, যখন যা ইচ্ছে হয় বলব সেই লোকটাকে, যাঁর কথা শুনে শুনে জন্মের কষ্ট পেয়েছি। এর পরেই দার্শনিক কবির সেই বিখ্যাত উক্তি— রাম-লক্ষ্মণ কৃষ্ণ-রামের অংশবিশেষ। অবতারকালে দোঁহার দোঁহাতে প্রবেশ। অর্থাৎ সেই যমজ-দেবতার তত্ত্ব— রাম-লক্ষ্মণের যুগল এবার বলরাম-কৃষ্ণ হয়ে জন্মালেন, এবারে বড়ভাই হয়ে তিনি ছোটভাইয়ের লীলা-সহায়তা করবেন। পূর্বজন্মের সেবা-সুকৃতির পুণ্যে এবার তিনি অগ্রজ রূপে আজ্ঞাদাতার ভূমিকায়।

লক্ষণীয় ঘটনা হল, যতই বড়ভাই হয়ে আজ্ঞাদানের পদবি লাভ করুন, তাত্ত্বিকভাবে বৃহৎ শক্তির অনুবর্তিতা বলরামের মধ্যে কিন্তু থেকেই গেছে। ছোটভাই হওয়া সত্ত্বেও কৃষ্ণ কিন্তু এখনও শক্তির কেন্দ্রভূমিতে অবস্থিত। বলরাম মাঝে মাঝে খুবই রেগে যেতে পারেন, পরবর্তীকালে দেখব— কৃষ্ণকে তিনি অনেক আদেশ-আজ্ঞাও দিচ্ছেন বটে, কিন্তু অবতারবাদের মৌল সত্তায় তিনি যেহেতু সেবকের ভূমিকায় আছেন, তাই বড়ভাই হওয়া সত্ত্বেও তাঁর মধ্যে অদ্ভুত এক অনুবর্তিতা আছে, যেখানে কৃষ্ণকে কিছুতেই তিনি অতিক্রম করতে পারবেন না।

মূল প্রস্তাবে ফিরে আসি। অক্রূর কংসের আদেশে বলরাম এবং কৃষ্ণকে নিয়ে যেতে এসেছেন মথুরায়। পথে যমুনার কোল-ঘেঁষা অনন্ত হ্রদে স্নান করতে নেমে অনন্তনাগের স্বরূপ-বিভূতির সঙ্গে বলরামের রূপ একাকার হয়ে গেল তাঁর মনে। অনন্ত বা শেষনাগের সঙ্গে শেষনাগের একত্ব তথা মহাপ্রয়াণের সময় বলরামের মুখ থেকে মহাসর্পের নির্গমন এবং সমুদ্র থেকে আসা বাসুকি-কর্কোটক ইত্যাদি প্রসিদ্ধ নাগদের প্রত্যুদ্‌গমন দেখে পণ্ডিতেরা বলেন— প্রাচীন নাগজাতির সংশ্লিষ্ট বিশ্বাসের সঙ্গে বলরাম-অনুগামীদের সম্পর্ক আছে— পণ্ডিতানী সুকুমারী ভট্টাচার্যর ভাষায়— মহাভারতে উল্লিখিত বলরামের প্রয়াণকালে তাঁর শরীর থেকে শ্বেত-সর্পের উদ্‌গমনের ঘটনাটা বস্তুত এই যে— This identifies Balarama with the Sesanaga and perhaps establishes the connection between naga-worshippers and the Balarama sect.

বলরামের অনুগামী কোনও সম্প্রদায় তৈরি হয়েছিল কিনা, সেই কৌতুককর খবর পরে দেব, তবে এটুকু আপাতত জানাতেই হবে যে, শুধু বলরাম কেন, নাগ জন-জাতির সঙ্গে সম্পর্ক— তা বিদ্বেষেরই হোক, সৌহার্দ্যেরই হোক, অথবা মানিয়ে নেবার মতোই হোক— এ সম্পর্ক মহাভারতের বহুতর মৌল চরিত্রের সঙ্গেই তৎকালীন নাগগোষ্ঠীর ছিল। মহাভারতের আরম্ভ হচ্ছে সর্পযজ্ঞ দিয়ে, আবার বিদ্বেষের আগুন এড়িয়ে সর্পযজ্ঞ বন্ধও হয়ে যাচ্ছে আস্তিকের অনুপ্রবেশে কৌরব-পাণ্ডবদের রাজধানী হস্তিনাপুরের নামটাই নাগসাহ্বয়— অবশ্য এখানে নাগ অর্থ সর্প না হস্তী, সে ব্যাপারে বিবাদ আছে। থাক সে কথা, অর্জুনের খাণ্ডববন দহন করার ঘটনায় নাগ জনজাতির উচ্ছেদের ঘটনা আছে। আবার এদিকে যমুনার জল কলুষিত করার অপরাধে কালীয় নাগকে যেমন শাস্তি পেতে হয়েছিল কৃষ্ণের কাছে, তেমনই তাঁকে পুনর্বাসন দিয়ে, তাঁর মাথায় কৃপাপদচিহ্ন এঁকে দিয়ে নাগ জনজাতির সঙ্গে আপন সম্পর্ক ঘনীভূত করেছিলেন কৃষ্ণ।

এইরকম একটা জায়গা থেকে যদি সুকুমারী ভট্টাচার্যের ভাষা বিচার করি— অর্থাৎ এইরকম একটা কথা যা ‘নাগ’ শব্দের উচ্চারণ-মাত্রেই অথবা ‘নাগ’-দের সংশ্লেষ মাত্রেই পণ্ডিতমহলে সরলোক্তি হিসেবে ব্যবহৃত হয়, তাতে ব্যাপারটা এই রকম দাঁড়ায়— As a personification of Seasanaga he was probably a god of naga-worshippers and in Samkarsana-Vasudeva we perhaps have an amalgamation of the Naga and Krishna cults.

লক্ষণীয়, এই একটি পঙ্‌ক্তির উদ্দেশ্য-বিধেয়, কোনও অংশেই কোনও নিশ্চয়তা নেই, এক জায়গায় Probably, আর এক জায়গায় perhaps, আর cult কথাটা এতই প্রগতিশীলভাবে ধোঁয়াটে যে, তার সম্যক একটা বঙ্গানুবাদ করা না গেলেও কঠিন বাংলায় নাগ-সম্বন্ধী ধর্মবিশ্বাস আর কৃষ্ণ-সম্বন্ধী ধর্মবিশ্বাসের মিলনই সঙ্কৰ্ষণ-বাসুদেবের তত্ত্ব— এ কথা আধুনিকতম গবেষণাকর্মের অতিসরলীকৃত অভিব্যক্তি বলে আমার মনে হয়। ‘নাগ’ শব্দ উচ্চারণমাত্রেই এই যে অভিধা-তাড়িত ধর্মবিশ্বাসের সন্ধান— এটা অবশ্যই শব্দসন্ধানী পাশ্চাত্য গবেষণার অঙ্গ এবং পাশ্চাত্য তথা আধুনিক এবং প্রগতিশীল বলেই তা অতি অশ্রদ্ধেয়, তাও আমরা মনে করি, কিন্তু কোথায় যেন এমন গবেষণার মধ্যে গভীরতার অভাব আছে। দেখুন, সুকুমারী ভট্টাচার্য আমার গুরুও বটে, গুরুপত্নীও বটে, লেখাপড়া এবং গবেষণা কেমন করে করতে হয় এও তাঁর কাছেই শেখা। তবু এই প্রসঙ্গে তাঁর সঙ্গে এবং তাঁরই মতো অন্যান্য গবেষকদের সঙ্গে আমাদের মত তেমন মিলতে চায় না। আমাদের ধারণা— বলরামের সঙ্গে শেষনাগ বা অনন্তনাগের যে একাত্মতার সৃষ্টি হয়েছে অথবা মহাভারতে যে শ্বেত-শুভ্র সর্পরাজ বলরামের শরীর থেকে বেরিয়ে গেল, তা থেকেই এমন ধারণা করা কঠিন যে, বলরামী সাধক সম্প্রদায়ের সঙ্গে নাগ-পূজকদের গভীর সম্পর্ক ছিল— Connection between Naga-Worshippers and the Balarama sect.

পৌরাণিক গ্রন্থের আন্তর আলোচনা থেকে আমরা এখনও কোনওভাবে বলরামের সঙ্গে নাগ-সম্প্রদায় বা জনজাতির সংশ্লেষ দেখতে পাই না। আর নাগ-শব্দের উচ্চারণমাত্রেই অথবা শেষনাগের সঙ্গে একাত্মতার কারণেই যদি নাগ-জনজাতির প্রসঙ্গ আসে, তবে সপ্রমাণে বলা যায় যে, কৃষ্ণ, শিব এবং অবশ্যই বুদ্ধও নাগ জনগোষ্ঠীর সঙ্গে সম্পর্কিত ছিলেন এবং ওঁরা তাই বলবেনও। আমাদের মনে হয়, প্রতীচ্যের এই সরলীকৃত জনগোষ্ঠীর সচেতন ধারণা বাদ দিয়ে প্রাচীন পৌরাণিক সূত্রগুলি বিশ্লেষণ করলে আমাদের বলরাম-সঙ্কর্ষণকে আমরা আমাদের মতো করেই আরও ভাল করে বুঝতে পারব। নাগ-জনজাতির সঙ্গে বলরামের যে সম্পর্ক, তা আমরাও মেনে নেব, কিন্তু তা অত সরলভাবে মানব না।

প্রথমেই মনে রাখতে হবে— অক্রূর যমুনার তীরভূমিতে কৃষ্ণ-বলরামের হাতে রথ-অশ্বের জিম্মা দিয়ে অনন্ত-হ্রদে স্নান করতে নেমে ধরণীধারী অনন্তনাগের প্রলয়কালীন রূপ দেখলেন, যা তীরস্থিত বলরামের সঙ্গে একাকার হয়ে গেল। মথুরা-রাজ কংস যাঁকে আনবার জন্য এবং মারবার জন্য অক্রূরকে পাঠালেন, তিনিই যে এক প্রলয়কালীন ধ্বংসমূর্তি— এইখানেই বলরামের সঙ্গে অনন্ত বা শেষনাগের একাত্মতার তাৎপর্য আছে। এ কথাটা যদি তেমনভাবে এবং আমাদের ঐতিহ্যগত ধারণায় বুঝতে হয়, তবে রসিকশেখর ‘পরশুরাম’ অর্থাৎ রাজশেখর বসুর ছোটভাই গিরীন্দ্রশেখর বসুকে সাক্ষী মানতে হবে। রাজশেখর এবং গিরীন্দ্রশেখর দুই জনেই বিজ্ঞানের ছাত্র ছিলেন, ফলত বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিতে পুরাণগুলির বিষয় বিবেচনা করলেও কথকঠাকুরদের কথার রহস্যটুকু অন্তর দিয়ে বুঝতেন। গিরীন্দ্রশেখরের সাধুভাষা এখানে সর্বত্র হুবহু তুলে দিচ্ছি না এবং দরকার মতো তাঁর শব্দপ্রযুক্তিও বুঝিয়ে বলতে হবে। কিন্তু তার আগে আরও একটা পৌরাণিক সংবাদ আপনাদের জানিয়ে রাখতে হবে।

ওই যে অক্রূরমশায় জলের মধ্যে ডুবে অনন্তনাগের মূর্তি দেখতে পেলেন, সেখানে কতকগুলি বিশেষত্ব আছে। প্রথমত, অক্রূর দেখলেন— ভগবান অনন্তদেবের পাশে সোনার তালের চিহ্ন দেওয়া ধ্বজা উড়ছে। অর্থাৎ তিনি তালধ্বজ, ওটাই তাঁর রথের চিহ্ন। অক্রূর আরও দেখলেন— সেই অনন্তমূর্তির এক হাতে হল অর্থাৎ লাঙল, আর এক হাতে মুষল, যা তাঁর পেটের কাছাকাছি ধরা আছে— লাঙ্গলাসক্ত-হস্তাগ্রং মুষলোপাশ্রিতোদরম্‌। আরও একটা খবর হল— অক্রূর যখন তাঁকে দেখেছেন, তখন তিনি মদ্যপান করে ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। আর তাঁর স্টাইলের কথা কী বলব— এক্কেবারে আধুনিক যুবকের মতো তাঁর এক কানে দুল-পরা— কুণ্ডলৈকধরং মত্তং সুপ্তমম্বুরুহেক্ষণম্‌।

এতগুলো বিচিত্র ‘ক্লু’ পেলে পরে আর কোন আধুনিক পণ্ডিতের মস্তক স্থির থাকে। বলরামের অস্ত্রও যেহেতু হল আর মুষল, অতএব পণ্ডিতেরা অবশ্যই এটা বলবেন যে, কৃষির সঙ্গে তাঁর যোগ আছে, এমনকী সঙ্কর্ষণ নামটির মধ্যেও ভূমি-কর্ষণের সম্যক একটা রূপ ধরা পড়ে বলে গ্রামীণ জীবন এবং চাষবাসের সঙ্গে বলরামের নিত্য সংযোগ দেখতে পেয়েছেন পণ্ডিতেরা— he is a sort of bucolic deity connected with agriculture and harvests. বলরাম মদ্য পান করেন এবং হয়তো একটু বেশিই পান করতেন বলে এ বিষয়ে তাঁর সুনাম-দুর্নাম অনেকটাই ছড়িয়ে পড়েছিল এবং আশ্চর্যের ব্যাপার— আধুনিক পণ্ডিতেরা তাঁর তালধ্বজের কথাটা তুললেনই না। যেভাবে তাঁর হাতে হল-লাঙল-মুষলের অস্ত্র-সমাহার দেখে কৃষির সঙ্গে বলরামের যোগ দেখতে পেয়েছেন পণ্ডিতেরা, সেখানে তালধ্বজ রথটির ব্যাপারেও রীতিমতো তথ্যপ্রমাণ ছিল এবং তাঁর মদ্যপানের ব্যাপারটাও অনেক সপ্রমাণ হয়ে উঠত তাতেই। সেই যে ধেনুকাসুর বধের পূর্বে সুপক্ব তালের গন্ধে মোহিত হয়ে টপাটপ তাল পাড়তে আরম্ভ করেছিলেন বলরাম, তাতে জীবনের প্রথম দৈত্যবধের চিহ্ন হিসেবেই হয়তো তিনি তালধ্বজ এবং হয়তো সেই প্রথম তালের গন্ধ থেকেই ‘তাড়ি’— মদ্যের আবাহন ঘটেছিল বলরামের জীবনে।

না, পণ্ডিতেরা এমন ইঙ্গিত দেননি, কিন্তু দিতেই পারতেন, তা হলে কৃষিভিত্তিক সভ্যতার সঙ্গে বলরামের যেমন সংযোগ ঘটেছে, তেমনই তাঁর মদ্যপানের নিদানটুকুও ধরা যেত। সত্যি কথা বলতে কী আমি এত-শত বুঝি না, অথবা বুঝতে পাই না। নামের মধ্যে কর্ষণ-এর সোঁদা গন্ধ থাকলেই, আর অস্ত্রটি লাঙল হলেই কৃষিকর্মের সঙ্গে তাঁর সংযোগ গড়ে তুলতে হবে এবং তা তুলতে পারলেই সার্থক আধুনিক গবেষণা হবে, এমনটা ভাবতে আমার ভাল লাগে না। আমার মনে হয়, যে হেতু ধর্ম-বিশ্বাসের আধার থেকেই দেবতাদের অথবা লোকোত্তর পুরুষের রূপকল্পনা এবং ধর্মবিশ্বাসও যেহেতু মানুষের পার্শ্ব-পরিবেশ থেকেই উৎপন্ন হয়, তাই সবার আগে ওই বিশ্বাসের জায়গাটাই বিশ্লেষণ করা দরকার।

যে সভ্যতায় বলরামের মতো বৃহৎ পুরুষের উৎপত্তি ঘটেছে, সেটা কৃষিভিত্তিক সমাজ তো বটেই, কিন্তু সেই কৃষিকর্মের সঙ্গে তার যোগ কতটা ছিল, তাতে আমাদের সন্দেহ আছে, কারণ হালচাষের সঙ্গেও তিনি যুক্ত ছিলেন না, অন্য কোনও কৃষিকর্মের সঙ্গেও নয়, বরঞ্চ ওই ‘bucolic’ কথাটা ভাল, যেহেতু গোপসমাজ বা গ্রামীণ গোপপল্লীর মধ্যেই বলরামের প্রথম জীবন কেটেছিল। তা ছাড়া শুধু বলরাম কেন, কৃষ্ণ, অর্জুন, যুধিষ্ঠির, ভীম, এমনকী কংস জরাসন্ধও তো ওই কৃষিভিত্তিক সমাজের সৃষ্টি। তাঁরা অস্ত্র হিসেবে গ্রামের জীবন থেকে তাঁদের লাঙলটি তুলে আনতে পারেননি বলে তাঁদের সঙ্গে আর যেন কৃষির সম্পর্ক নেই। কাজেই আমরা এসব জল্পনার মধ্যে না গিয়ে গিরীন্দ্রশেখরের সত্য উপলব্ধিটুকু জানাতে চাই। তবে এখনও আমাদের প্রবন্ধ সেই রহস্য-উপলব্ধির সম্পূর্ণ যোগ্য হয়ে ওঠেনি। কারণ এখনও পর্যন্ত বলরামের সম্বন্ধে অনেক সংবাদই পাওয়া যায়নি।

আমরা অক্রূরের প্রসঙ্গে ছিলাম। অনন্ত-হ্রদে অনন্তমূর্তি দেখে অক্রূরের নিশ্চয়ই অলৌকিক এক অনুভূতি হল এবং তিনি আরও আশ্চর্য হলেন সেই অলৌকিক মূর্তির সঙ্গে বলরামের মিল দেখে। এবারে তিনি হ্রদের জল ছেড়ে ওপরে মাথা তুললেন। দেখলেন— তাঁর ছেড়ে যাওয়া রথের ওপর বলরাম এবং কৃষ্ণ দু’জনে দু’জনের দিকে তাকিয়ে কথা বলে যাচ্ছেন। অক্রূর তাঁর অলৌকিকতার ঘোরে আবার ডুব দিলেন জলে, আবারও সেই অনন্তদেবের মূর্তি, পরিধানে সেই নীল বসন, মুখখানি সেই উজ্জ্বল গৌরবর্ণ, ঠিক বলরামের মতো এবং তাঁর কুণ্ডলিতে ক্রোড়ের মধ্যে সেই কৃষ্ণের চেহারা— দদর্শ কৃষ্ণম্‌ অক্রূরঃ পূজ্যমানং তদা প্রভুম্‌। অক্রূর এবার নিশ্চিত হয়ে ওপরে উঠে এলেন রথের কাছে। কৃষ্ণ বললেন— মহাশয়! আপনি জলের মধ্যে এতক্ষণ ধরে কী করছিলেন, অদ্ভুত কিছু দেখলেন নাকি। সমস্ত উচ্ছ্বাস গোপন করে অক্রূর বললেন— সত্যি আশ্চর্য কিছু দেখেছি। সবচেয়ে আশ্চর্য— ওখানে জলের মধ্যে যা দেখেছি, এখানেও তাই দেখছি এবং তাতেই বড় আনন্দ হচ্ছে— তদিহাপি যথা তত্র পশ্যামি চ রমামি চ। চলুন আর দেরি নয়, আমাদের মথুরায় পৌঁছতে হবে সন্ধ্যার আগে।

এই সম্পূর্ণ ঘটনাটাই অলৌকিক এক বিশ্বরূপ-দর্শনের সাহায্যে রচিত হলেও এর লৌকিক অংশ এইটুকুই যে অক্রূর বুঝলেন— কৃষ্ণ এবং বলরাম খুব সাধারণ মানুষ নন এবং এঁদের দেখে যতই ‘আনঅ্যাজিউমিং’ লাগুক কংসের মতো মানুষকে মেরে ফেলতে এঁদের সমস্যা হবে না। বলরাম-কৃষ্ণ এবং অক্রূর তিন জনেই মথুরায় পৌঁছলেন সন্ধ্যার আগে। অক্রূর নিজের বাড়িতে তাঁদের বাসস্থান নির্দেশ করলেও দুই ভাই-ই বেরিয়ে পড়লেন নগর দেখতে। নগরদর্শনের ব্যাপারটা নিতান্তই অছিলা, আসলে খুব তাড়াতাড়ি তাঁরা, কংসভবনে উপস্থিত হবার পরিকল্পনা করছিলেন। পথে বেরিয়ে যেসব ক্রিয়াকর্মে লিপ্ত হলেন দুই ভাই, সেখানে প্রায়শই বলরামের ভূমিকা সহায়কের। মুখ্য ভূমিকায় সব সময়ই কৃষ্ণ।

যেমন পথে যে রজক কংসরাজের বসন রাঙিয়ে পাট পাট করে রাখছিল, তার কাছ থেকে কাপড় চেয়ে গালাগালি খেয়ে তাকেই মেরে ফেলাটা কৃষ্ণেরই কাজ, বলরাম শুধু দেখছেন। একইভাবে মথুরার নগরীর সৈরিন্ধ্রী কুব্জার সঙ্গে দেখা হবার পর তার কাছ থেকে চন্দন-অঙ্গরাগ চেয়ে দুই ভাইই মাখলেন বটে, কিন্তু কুব্জার শরীর স্পর্শ করে তাকে সোজা করে দিতেই সে যখন কৃষ্ণের কাছে প্রেম নিবেদন করে বসল, তখন শুধু দাদা বলরাম সামনে আছেন বলেই— কৃষ্ণো রামস্য পশ্যতঃ— কৃষ্ণ কিন্তু সাময়িক প্রত্যাখ্যান করলেন কুব্জাকে। এর পরের যেসব ঘটনা— কংস কবুলয়াপীড় নামের যে মত্ত হস্তীটিকে প্ররোচিত করলেন কৃষ্ণ-বলরামকে মেরে ফেলার জন্য, সেখানেও সেই হস্তী-নিধনের ব্যাপারে প্রধান ভূমিকা কৃষ্ণেরই। হাতিটিকে বাগে আনার জন্য কৃষ্ণ যখন প্রচুর আয়াস করছেন, তখন কৃষ্ণের আয়াস লাঘব করার জন্য ও অনায়াস প্রহার করার জন্য বলরাম শুধু সেই হাতির ল্যাজ ধরে টেনে রাখছিলেন— লাঙ্গুলং চাস্য বেগেন নিশ্চকর্ষ হলায়ুধঃ। সত্যি কথা বলতে কী, কংসের রাজভবনে প্রবেশ করে যজ্ঞধনু ভেঙে ফেলা থেকে আরম্ভ করে মল্লযুদ্ধের আগে পর্যন্ত বলরামের কোনও ভূমিকাই নেই। শুধু মল্লযুদ্ধের সময় কংসের পক্ষে যে দুই মল্লবীর যুদ্ধ করতে এসেছিল, তাদের একজন চাণূর নামে মল্লটির সঙ্গে যুদ্ধ করলেন কৃষ্ণ এবং অপর মল্লবীর মুষ্টিক-এর সঙ্গে লড়াই করলেন বলরাম। দুই মল্লবীরই ভয়ংকর অন্ধ্রমল্ল বলে বর্ণিত হয়েছে হরিবংশ-পুরাণে। অন্ধ্র বলতে অবশ্য এখানে আধুনিক অন্ধ্রপ্রদেশ বোঝায় না, কেন না চাণূর হল করূষ দেশের জাতক, যেটা মোটামুটি এখনকার বিহারের সাহাবাদ-বক্সার অঞ্চল। যাই হোক, চাণূর মারা পড়ল কৃষ্ণের হাতে, আর মুষ্টিক-মল্লের সঙ্গে যুদ্ধটা একটু বেশিক্ষণ সময় ধরেই করলেন বলরাম। গোপ-সমাজে মল্লযুদ্ধের একটা বিশেষ ভূমিকা ছিল এবং বলরাম সেই মল্লযুদ্ধ শিখেছিলেন যথেষ্ট যত্ন সহকারেই। অতএব কংসের রঙ্গমঞ্চে উপবিষ্ট বিরাট দর্শককুলের সামনে বলরাম যে একটু খেলিয়ে খেলিয়ে প্রতিপক্ষকে কাবু করবেন, এটাই স্বাভাবিক, আর বলরামের মতো সরল মানুষের পক্ষে এটা আরও স্বাভাবিক। অতএব মুষ্টিকের সঙ্গে মল্লযুদ্ধ করার সময় বলরাম একাধারে মুষ্টিক এবং সমবেত দর্শককে মল্লযুদ্ধের কসরত দেখাতে দেখাতে মেরে ফেললেন মুষ্টিককে।

এই সময়ে মথুরা-পুরীর সবচেয়ে বড় ঘটনা হল কংসবধ। সত্যি কথা বলতে কী, এই বৃহৎ কর্মকাণ্ডে বলরামের কোনও ভূমিকাই নেই। আমি অবশ্য বলব— কৃষ্ণের ভূমিকাও এখানে কম এবং কম এই অর্থে যে এখানে মারামারি, রক্তারক্তির কাণ্ড-কারখানা তত নেই। কেন না, কংসের অপসারণের পূর্বে নিতান্ত রাজনৈতিকভাবেই কৃষ্ণ মোকাবিলা করেছিলেন কংসের। পূর্বতন রাষ্ট্রের সংঘচরিত্র যতই বদলে ফেলার চেষ্টা করুন কংস, সংঘ-প্রধানেরা সকলেই কৃষ্ণের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে চলেছিলেন এবং তার ফলে এক সময়ে কংস একেবারে নির্বান্ধব হয়ে পড়েন। প্রত্যাশিতভাবেই কংসকে মারবার সময় কৃষ্ণকে কোনও বেগই পেতে হয়নি। উন্মুক্ত রঙ্গমঞ্চের মধ্যে তাঁকে সিংহাসন থেকে নামিয়ে এনে অতি সহজেই কৃষ্ণ মেরে ফেলেছিলেন কংসকে। আর কৃষ্ণজ্যেষ্ঠ বলরাম! তিনি কৃষ্ণের সহায়ক বলেই শুধু এই পৌরাণিক মন্তব্য শুনেছি যে, বলরাম কংসের তেজস্বী ভাই সুনামাকে দুই হাত দিয়েই সবেগে নিষ্পেষণ করে মেরে ফেলেছিলেন— বলদেবোহপি ধর্মাত্মা… সুনামানম্‌ অপোথয়ৎ।

॥ ৫ ॥

কংসের মৃত্যুর পর থেকেই মথুরানগরীতে স্থায়ী ঠিকানা গড়ে উঠল কৃষ্ণের সঙ্গে বলরামেরও। প্রথাগত এবং ঐতিহ্যগত নিয়মে কৃষ্ণ এবং বলরাম দুইজনেই গুরুকুলে উপস্থিত হলেন। বিদ্যাশিক্ষার জন্য। গুরু সান্দীপনি মুনি, তিনি কাশী দেশের জাতক হলেও তাঁর বিদ্যাশ্রম অবন্তীপুরে উজ্জয়িনীতে— গুরুং সান্দীপনিং কাশ্যম্ অবন্তীপুরবাসিনম্। যথানিয়মে যেভাবে গুরুসেবা করতে হয়, সেই ভাবেই সেবা করে বৈদিক শিক্ষা গ্রহণ করার সঙ্গে সঙ্গে ধনুর্বেদও শিক্ষা করলেন যথাযথভাবে। গুরুদক্ষিণা দেবার সময় আমরা জ্যেষ্ঠ বলরামকেই কথা বলতে দেখলাম। তিনিই সান্দীপনি মুনির কাছে জানতে চাইলেন— কী দক্ষিণা চান গুরুদেব। সান্দীপনি মুনির ছেলেকে পঞ্চজন নামে এক দৈত্য হরণ করে নিয়ে গিয়েছিল, তাকেই ফিরিয়ে দেবার জন্য দুই ভাই বলরাম এবং কৃষ্ণের কাছে আর্জি জানালেন গুরু। কথা শেষ হতেই বলরামের অনুমতি নিয়ে কৃষ্ণ চলে গেলেন গুরুর পুত্রোদ্ধারে, বলরামকে আর যেতে হল না, হয়তো জ্যেষ্ঠ হওয়ার এই সুবিধে, বিশেষত কৃষ্ণের মতো বিরাট কনিষ্ঠের জ্যেষ্ঠ হওয়ার। গুরুর কার্য সম্পন্ন করলেন কৃষ্ণ, কিন্তু প্রশংসা এবং সাধুবাদ দেবার সময় সান্দীপনি মুনি কিন্তু কৃষ্ণের সঙ্গে বলরামেরও ভূরি ভূরি প্রশংসা করলেন— সমেত্য মুমুদে রাজন্‌ পূজয়ন্‌ রাম-কেশবৌ।

যাই হোক, গুরুর কাছে বিদ্যালাভ, দক্ষিণা-দানের পর বলরাম এবং কৃষ্ণ যখন অবন্তীপুর থেকে মথুরার দেশে ফিরলেন, তখন পুরবাসীরা তাঁদের জয়ধ্বনি দিয়ে অভ্যর্থনা জানাল; এমনভাবেই যেন এই দুই ভাইই মথুরাবাসীদের ত্রাতার ভূমিকায় আছেন। কংসের মৃত্যুর পর কংসপিতা উগ্রসেন, যাঁকে কংস বন্দি করে রেখেছিলেন, তিনি কিন্তু সাময়িক বৈরাগ্যে কৃষ্ণকেই রাজ্যের হাল ধরতে বলেছিলেন, কিন্তু কৃষ্ণ তাতে রাজি হননি এবং বলরাম সেখানে একটি কথাও বলেননি। ফলত মথুরা-প্রদেশের রাজনৈতিক ক্ষমতা এককভাবে আর কারও হাতে কেন্দ্রীভূত হয়নি। যদু-বৃষ্ণি কুলের প্রধানেরা যেভাবে ‘অলিগার্কি’ চালাচ্ছিলেন মথুরায়, সেই কুলশ্রেষ্ঠদেরই রাজত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। কিন্তু কৃষ্ণ যেহেতু পরম কৌশলে প্রায় বিনা যুদ্ধে কংসকে শেষ করে দিতে পেরেছিলেন, অতএব সমগ্র যাদব-গোষ্ঠীর মধ্যে কৃষ্ণের যেহেতু প্রচণ্ড গৌরব বেড়ে গিয়েছিল, একইভাবে কৃষ্ণের একান্ত সহায়কের ভূমিকায় বলরাম থাকায় তাঁরও গৌরববৃদ্ধি হয়েছিল।

মথুরাপুরীর তন্তঃরাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে যতই বৃদ্ধি সূচিত হোক কংসের মৃত্যুর সূত্র ধরে বহিরাগতের আক্রমণ ঘটল কিছুদিনের মধ্যেই। কংসের দুই স্ত্রী অস্তি এবং প্রাপ্তি ছিলেন মগধরাজ জরাসন্ধের মেয়ে। বিধবা কন্যাদের সান্ত্বনার্থে জরাসন্ধ মথুরা আক্রমণ করলেন বিশাল সৈন্যবাহিনী নিয়ে। যাদব-বৃষ্ণি-অন্ধক গোষ্ঠীর সকলে কৃষ্ণ-বলরামের নেতৃত্বে মুখোমুখি হলেন জরাসন্ধের। এই যুদ্ধারম্ভের মুহূর্তে, এই প্রথম দেখলাম— অন্তরীক্ষ লোক থেকে নেমে এল বলরামের সেই বিখ্যাত অস্ত্র— হল এবং মুষল। এই ঘটনার মধ্যে অলৌকিকতার গন্ধ আছে, বলরামের দিব্য অস্ত্রের দিব্য নামও আছে— তাঁর লাঙলের নাম হল সংবর্তক, মুষলের নাম সৌনন্দ। অক্রূর অনন্ত হ্রদের মধ্যে যে দিব্য অস্ত্র দেখেছিলেন ভগবান অনন্তের হাতে, সেই দিব্য অস্ত্র আজ নেমে এল বলরামের হাতে, জরাসন্ধকে দমনের জন্য।

এই দৈব অস্ত্রকে আমরা লৌকিকভাবেই ব্যাখ্যা করতে চাই। সত্যি কথা বলতে কী, গোপসমাজে এতকাল থাকার সময় থেকে একেবারে কংস-বধ পর্যন্ত আমরা বলরাম কিংবা কৃষ্ণ— কারও হাতেই তেমন কোনও অস্ত্র দেখিনি, যুদ্ধও যা দেখেছি, তা মল্লযুদ্ধ, আর কংস-বধের সময় মূল রঙ্গমঞ্চে ঢোকার মুহূর্তে কৃষ্ণের হাতে একটি মৃত হস্তীর দন্তমাত্ৰ অস্ত্র হিসেবে দেখেছি। এর বেশি কিছু নয়। কিন্তু এখন শহর মথুরায় এসে যখন জরাসন্ধের মতো বিরাট শক্তির মুখোমুখি হতে হচ্ছে, তখন বিশেষ কিছু অস্ত্র তো দরকারই। লক্ষণীয়, এরই মধ্যে গুরু সান্দীপনির কাছে তাঁদের অস্ত্রশিক্ষার ট্রেনিং-ও হয়ে গেছে। আরও লক্ষণীয়, মহাভারতে দেখবেন— প্রত্যেক মহাবীরই প্রথাগত অস্ত্রশিক্ষার পরে একটি বিশেষ অস্ত্রে নিজের পারদর্শিতা লাভ করেছেন এবং বিশেষ অস্ত্রটি সব সময়েই দৈব চিহ্নে চিহ্নিত হয়। যেমন অর্জুনের গাণ্ডীব, কৃষ্ণের সুদর্শন চক্র। কৃষ্ণ সুদর্শন চক্র পেয়েছেন অনেক পরে, অর্জুনের গাণ্ডীব লাভও অনেক পরের ঘটনা। কিন্তু বলরাম যে এখনই তাঁর বিখ্যাত লাঙলটি পেয়ে গেলেন, তাতে বুঝি গাণ্ডীব-ধনুর মতো কঠিন ধনুক এবং সুদর্শন চক্রের মতো আয়াস-সাধ্য অস্ত্র নিজের মতো করে বানিয়ে নিতে এবং তা আয়ত্ত করতে অনেক সময় লেগেছে। সেদিক দিয়ে দেখতে গেলে হল এবং মুষল ব্যবহার করা তুলনামূলকভাবে অনেক সহজ, কিন্তু বলরাম সেটাকে নিজস্ব কৌশলে আয়ত্ত করেছেন। আমাদের লৌকিক ধারণা এই রকমই যে, ‘জাপানিজ মার্শাল আর্টে’ যেমন অনেকে হাত-পা ছাড়াও নিজের মতো করে এক-একটি অস্ত্রপ্রযুক্তি আয়ত্ত করে, তেমনই এই সুদর্শন চক্র এবং এই বলরামের লাঙল। নেহাতই কৃষিকর্মের সঙ্গে যুক্ত বলে সামাজিক ঐতিহাসিকেরা বলরামের লাঙলের সঙ্গে বলরামকেও কৃষির সঙ্গে জুড়ে দিয়েছেন। যদি লাঙলটিকে বাদ দেন, তা হলে মুষলটিকে নিয়ে অথবা কৃষ্ণের সুদর্শন চক্র দিয়ে কৃষিকর্মের কোন্‌ যৌক্তিকতা প্রকাশ পেত! বলরাম ডান হাতে ব্যবহার করতেন লাঙল আর বাঁ হাতে ব্যবহার করতেন মুষল— সব্যেন সাত্বতাং শ্রেষ্ঠো জগ্রাহ মুষলোত্তমম্‌। সাপ যেরকম এঁকে বেঁকে এসে কোথা দিয়ে ছোবল মারবে বোঝা যায় না, তেমনই লাঙলটাকেও বলরাম এমনভাবেই চালাতেন যে, এই অদ্ভুত বিশেষ, স্বায়ত্ত অস্ত্রখানি কেমনভাবে যুদ্ধক্ষেত্রে শত্রুকে আঘাত করবে, তা বোঝা যেত না— সৰ্পন্তমিব সৰ্পেন্দ্রং দিব্যমালাকুলং মৃধে।

জরাসন্ধ এবং জরাসন্ধ বাহিনীর সঙ্গে যুদ-বৃষ্ণিদের এই প্রথম যুদ্ধে বলরামের ভূমিকা দেখবার মতো। লাঙল দিয়ে হাতি-ঘোড়া এবং বিপক্ষীয় সৈন্যদের তিনি এমন পর্যুদস্ত করে ফেলেছিলেন— হলমুদ্যম্য রামস্তু সার্পেন্দ্রমিব কোপিতঃ— যে, জরাসন্ধ নিজে বলরামের সঙ্গে যুদ্ধ করতে বাধ্য হয়েছিলেন। যুদ্ধ চলতে থাকলে এক সময় আমরা বলরাম এবং জরাসন্ধ দুইজনকেই গদাযুদ্ধ আরম্ভ করতে দেখলাম। বলা হয়েছে— বলরাম এবং জরাসন্ধ দুই জনেই জগতে গদাযুদ্ধের আচার্য হিসেবে চিহ্নিত ছিলেন এবং পৌরাণিক বলরামের সমস্ত অলৌকিক বিভূতি জানা সত্ত্বেও বাস্তবতার বোধে এটা লিখতে বাধ্য হয়েছেন যে, দু’জনেই তাঁরা বহুক্ষণ ধরে গদাযুদ্ধ করেছিলেন, কিন্তু এক সময় বলরাম বুঝলেন যে, গদাযুদ্ধে জরাসন্ধের কৌশল তাঁর নিজের চেয়েও বেশি— অথাপশ্যদ্‌ গদাযুদ্ধে বিশেষং তস্য বীর্যবান্‌। ফলে অপেক্ষাকৃত লঘু এবং কার্যকরী মুষল নিয়ে শেষ আঘাত হানার জন্য প্রস্তুত হলেন বলরাম। কিন্তু এই মুহূর্তে যুদ্ধের চেয়েও রাজনীতিতে বেশি প্রবীণ কৃষ্ণ বলরামকে আঘাত করতে বারণ করলেন, কারণ নাকি— জরাসন্ধের হত্যা তাঁর হাতে হবে না, তাঁর মৃত্যু অন্যের হাতে হবে।

এই কথা যতটাই দৈববাণীর মতো শোনাক কৃষ্ণের মুখে, আসলে এর মধ্যে গভীর রাজনীতির গন্ধ আছে। পৌরাণিক কথকঠাকুর বলরামের মাহাত্ম্য মাথায় রেখে যতই তাঁর হাতে মরণান্তিক মুষল তুলে দিন, যুদ্ধের পর্যায়ে দেখা গেছে যে, যুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী হয়েছে এবং বলরাম জরাসন্ধকে পর্যুদস্ত করতে পারেননি। যিনি নিজে বুঝতে পারছেন যে, গদাযুদ্ধে তাঁর নিজের চেয়ে শত্রুর ক্ষমতা বেশি, তাঁকে হঠাৎ একটা মুষল নিয়ে আঘাত করলেই যে তিনি একেবারে জানু ভেঙে মাটিতে বসে পড়বেন, এমন ভাবনা অমূলক। এটা কৃষ্ণ বুঝেছিলেন বলেই তিনি বলরামকে আঘাত করতে বারণ করেছেন এবং সে যুদ্ধ তখনই বন্ধ হয়ে যায়। হয়তো এর পিছনে রাজনৈতিক কারণ ছিল আরও গভীর। লক্ষণীয়, জরাসন্ধ এই যুদ্ধ বন্ধ করে চলে গেলেও এবং আপাতদৃষ্টিতে এই চলে-যাওয়াটা বৃষ্ণি-বীরদের কাছে উল্লাসপ্রদ হলেও তাঁরা কেউ ভাবতে পারলেন না যে, জরাসন্ধকে তাঁরা জয় করেছেন— জরাসন্ধং তু তে জিত্ব মেনিরে নৈব নির্জিতম্‌। দ্বিতীয়ত, এই যুদ্ধের পরেই দেখা গেল— যাদবদেব বৃদ্ধ মন্ত্রীদের পরামর্শে কৃষ্ণ-বলরাম মথুরা ছেড়ে চলে যান, কারণ সকলে এটা জানতেন মথুরা-পুরীতে জরাসন্ধের প্রধান ‘টারগেট’ কৃষ্ণ এবং বলরাম। কিন্তু জরাসন্ধের সৈন্যবাহিনীর তুলনায় যাদব-বৃষ্ণিদের সৈন্য অপ্রতুল এবং জরাসন্ধ যেভাবে প্রথমে নগর অবরোধ করে বসে থাকেন তাতে মথুরার নগর-দুর্গের ভিতরে জমানো খাদ্যসঞ্চয়ে টান পড়ে যায়। বিশেষত দুর্গের প্রাচীনত্ব হেতু তা জরাসন্ধের আক্রমণের ভার সইতে পারবে না। অথচ কৃষ্ণ-বলরাম সেখানে থাকলে মথুরার ওপর আক্রমণ হবেই। অতএব দুই ভাই-ই সাময়িকভাবে মথুরা ছেড়ে পালিয়ে গেলেন খানিকটা দক্ষিণের দিকে, আর এইখানেই সেই বিখ্যাত ঘটনা ঘটল॥

বলরামের মতো বিরাট পুরুষের যে ভাল রকম মদ্যপানের অভ্যাস ছিল, সেটা সাধারণ্যে মেনে নেওয়া যেমন কষ্টকর, ভগবৎ-স্বরূপ হিসেবে তাঁর এই পানাসক্তি বৈষ্ণবদের পক্ষে সহ্য করাও কষ্টকর। অতএব কথকঠাকুর এই বলরামী অভ্যাসের পিছনে দৈব কারণ প্রতিষ্ঠা করেছেন। ঘটনাটা এইরকম— মথুরা নগরী থেকে বেরিয়ে দাক্ষিণাত্যের দিকে যেতে পরশুরামের সঙ্গে তাঁদের দেখা হল এবং তাঁরই পরামর্শে তাঁরা করবীরপুর পেরিয়ে গোমন্ত-পর্বতে উপস্থিত হলেন। এ পর্বত খুব উঁচু নয় এবং চেষ্টা করলেই এ পর্বতের ওপরে ওঠা যায়। পর্বতের উপত্যকা এবং অধিত্যকা নিবিড় বনস্থলী, যেখানে বিচিত্র বৃক্ষের সমারোহ। সেদিন কী হল, বলরাম একা একাই ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন, প্রকৃতি এখানে এতটাই মধুর এবং মুখর যে, আজ কৃষ্ণকেও সঙ্গী হিসেবে তেমন প্রয়োজন হয়নি বলরামের।

হেথায়-সেথায় ঘুরতে ঘুরতে বলরাম এক ছায়াশীতল কদম গাছের তলায় বসে পড়লেন। ঠিক পরিশ্রান্ত নয়, কিন্তু অলসগতি ভ্রমণের মধ্যে মানুষ যেমন কখনও এটা ছুঁয়ে যায়, ওটা নাড়িয়ে দেয়, তেমনই এক অলস অনির্দেশ উপবেশন এই কদম্বমূলে। মৃদু-মন্দ হাওয়া বইছিল, এই হাওয়াতেই অদ্ভুত এক মেদুর গন্ধ ভেসে আসছে, গন্ধটা খুব সাধারণ নয়, বলরামের কাছে এটা খুব চেনা গন্ধ, মদের গন্ধ— মদ্যসংস্পর্শজো গন্ধঃ সংস্পৃশন্‌ ঘ্রাণমাগতঃ।

পৌরাণিক কথক ঠাকুর খুব ধীর পায়ে এগোচ্ছেন। ঋগবেদের দেবতা ইন্দ্র অথবা বায়ুর মদ্যপানের ঘটনা তাঁর জানা আছে, এবারে মনুষ্যস্বরূপ বিষ্ণুর মদ্যপানের বিবরণ তাঁকে বলতে হবে— সাধারণ্যের দৈব-ভাবনাতে আঘাত না লাগে এইভাবে কৃষ্ণজ্যেষ্ঠ বলরামের পানাসক্তির কথা তাঁকে জানাতে হবে। অতএব সেটাও বর্ণনা করতে হবে অলৌকিক দৈব ঘটনার স্পর্শ দিয়েই। হ্যাঁ, এই পর্যন্ত একেবারে ঠিক আছে, যেমন একজন সুরা-রসিক মানুষ উৎকৃষ্ট মদ্যের গন্ধ পেলেই মদ্যপানের আশায় নিজের রসনা শুষ্কবোধ করেন, ঠিক এমন একটা বাস্তব বলরামের মতো বিরাট পুরুষের ক্ষেত্রেও ঘটল, আর এটা ঠিক সাধারণ সুরা-রসিকজনের সঙ্গে মিলে যায়— মদ্যপানের আশায় বলরামের মুখ শুকিয়ে গেল— শুশোষ চ মুখং তস্য মত্তস্যেবাপরেহহনি। ঠিক এই পর্যন্ত সাধারণের সঙ্গে মিলে যায় আর এতটা মিলে যায় বলেই পৌরাণিক কথক-ঠাকুরকে লিখতে হল— বলরামের মনে অদ্ভুত এক তৃষ্ণা জন্মাল, মদ্যপানের তৃষ্ণা— তৃষ্ণা চৈন্যং বিবেশাশু বারুণী-প্রভবা যথা। প্রভু বলরামের পূর্ব কথা স্মরণ হল। সেই পুরাকালে অমৃত-মন্থনের পর বিষ্ণুস্বরূপে তিনি যে অমৃতপান করেছিলেন, উৎকৃষ্ট মদ্যগন্ধে সেই পুরাবৃত্ত স্মরণ হল বলরামের— স্মরিতঃ স পুরাবৃত্তম্‌ অমৃতপ্রাশনং বিভুঃ।

এ হল অনেকটা সেই গৌরচন্দ্রিকার ভাবনা। অবতারবাদী বিশ্বাসে মনুষ্যরূপী লীলাগুলি যেমন একসূত্রে বাঁধা, যেমন গৌরাঙ্গ মহাপ্রভুর বিভিন্ন ক্রিয়াকর্মের ক্ষেত্রে পূর্বের কৃষ্ণলীলার অনুরূপ সংক্রমণ ঘটেছে চরিতকার এবং পদাবলীকারদের হাতে, ঠিক তেমনই এই অমৃত-পানীয়ের স্মরণ। আমার তো মনে হয়, এই বাস্তবতা স্বীকার করে নেওয়াই ভাল। স্বীকার করাই ভাল যে, বলরাম এবং কৃষ্ণ— দু’জনেই ক্ষত্রিয়ের ছেলে এবং সেকালের ক্ষত্রিয় কুমারেরা মদ্যপান করবেন, তার মধ্যে আশ্চর্য হবার মতো কিছু নেই। আমরা মহাভারতে কৃষ্ণকেও মদ্যপান করতে দেখেছি এবং সেই আসরে কৃষ্ণের বন্ধুবর অর্জুনকে অন্তত এতটুকু বেসামাল অবস্থায় দেখেছি যাতে তিনি কৃষ্ণুপ্রিয়া সত্যভামার কোলে পা তুলে দিয়েছিলেন মদ্যপানের সরসতায়।

তবুও এটা কিছুই অপূর্ব নয়, সেকালের ক্ষত্রিয় বীরেরা শাক-মুলো খেয়ে থাকতেন না, মদ্য পানও তেমন পরিহার করতেন না; তবে কিনা অর্জুন, কৃষ্ণ, ভীম— এঁদের সবার ক্ষেত্রেই মদ্যপানের তথ্য যত সত্য হোক, মাত্রাতিরিক্ত মদ্যপান এঁদের জীবন পদ্ধতি ব্যাহত করেনি কখনও অতএব এ ব্যাপারে তাঁদের সুনাম-দুর্নাম পৃথকভাবে দেখানোরও প্রশ্ন আসেনি কখনও, কিন্তু বলরামের ক্ষেত্রে মদ্যপানের এই মাত্রা ঠিক থাকেনি, মহাভারতে এবং পুরাণে বারংবার এই অতিরিক্ত পানাসক্তির কথা কারণে অকারণে বলরামের বিশেষণ হিসেবে প্রযুক্ত হয়েছে। বিশেষত মহাভারতের মৌষলপর্বে যখন যদুকুল ধ্বংস হয়ে গেল, সেখানেও এই মদ্যপান বংশ-ধ্বংসের নিদান হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। দুঃখের ব্যাপার, অনেক মদ্যপ যাদবদের সঙ্গে বলরামও সেখানে উল্লিখিত। অবশ্য এটা ঠিক যে অন্যান্য যাদব-বৃষ্ণি বীরেরা মদ্যপান করে যে অনর্থ তৈরি করেছিলেন বলরাম তা করেননি; কিন্তু সেই ধ্বংসের মধ্যেও— হতে পারে, অতি সহজ সরলভাবেই নিজের পানাসক্তি মেটানোর জন্যই বলরাম অন্যদের সঙ্গে মদ্যপান করেছিলেন, কিন্তু মহাভারতের কবি একটু তির্যকভাবেই লিখেছেন যে, কৃষ্ণের সামনে, কৃষ্ণের মহান গুরুত্ব লঙঘন করেই বলরাম কৃতবর্মার সঙ্গে মদ্যপান করলেন— কৃষ্ণস্য সন্নিধৌ রামঃ সহিতঃ কৃতবর্মনা— এবং তারপরেই যদুকুলে অনর্থক কথা-কাটাকাটি এবং হানাহানি আরম্ভ হল। বলরাম এ সবের মধ্যে ছিলেন না বটে, তবে প্রথম যৌবন থেকে জীবনের শেষদিন পর্যন্ত তাঁর এই সরল পানাসক্তি তাঁকে অন্য এক মাত্রায় চিহ্নিত করেছে।

কিন্তু বলরামের মতো এক বিরাট পুরুষ, যিনি মহাভারত-সূত্ৰধার কৃষ্ণের জ্যেষ্ঠ হবার বিরল সম্মান লাভ করেছেন, তেমন এক বিরাট মানুষকে যদি মদ্যপানের মতো এক প্রবল ব্যসন রিপুর মতো আক্রান্ত করে থাকে, তবে তাঁর জন্য পৌরাণিক কথকঠাকুরকে যুক্তির তপস্যায় বসতে হয়। অর্থাৎ সাধারণ ভাষায় যাকে বলি ‘জাস্টিফিকেশন’, সেই জাস্টিফিকেশন দিতে হয় বড় মানুষের চরিত্র সমাধানের জন্য। আমাদের দেশে সাধারণ্যে তো এই সমস্যা আছেই, বারবার আমাকে নিজেই এই প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়েছে যে— মশাই! আপনাদের মুনি-ঋষি, ভগবান— সবার মধ্যেই কত দোষ, কেউ উর্বশী-রম্ভা-মেনকার মায়ানৃত্যে ধৈর্য হারিয়ে ফেলেন, কেউ মদ্যপান করেন, কেউ যুধিষ্ঠিরের মতো পাশা খেলেন, কেউ বা দশটা বিয়ে করেন, কেউ বা এমন আচরণ করেন, যা সাধারণ্যে বিগর্হিত, জুগুষ্পিত। আমি সব সময় বলে থাকি যে, আমাদের শাস্ত্র কিছু লুকোয় না। বড় মানুষ যিনি হন, তিনিও মানুষ, মানুষের ধর্ম তিনি অতিক্রম করেন না। জীবনের ধর্মে কোথাও যদি সেই বড় মানুষের মধ্যে এই রকম ধৈর্যচ্যুতি বা কামজ, ক্রোধজ দোষ দেখা যায়ও, তবু সেটাই তাঁর জীবনে একমাত্র চর্চার বিষয় হতে পারে না। বস্তুত তাঁর মধ্যে যে মহান এবং আদরণীয় গুণগুলি আছে— তপস্যা, ধর্ম, শিক্ষা, পরোপকার— এইগুলিই চরিত্র বিচারে ‘ক্রাইটেরিয়া’ হিসেবে কাজ করা উচিত।

বস্তুত ‘চরিত্র’ জিনিসটা দুধের মতো সাদা এবং দুধের মতোই যেন তা সামান্য অম্লপাতেই নষ্ট না হয়, এমনই ধারণা আমরা চিরকাল পোষণ করে এসেছি। কিন্তু জীবন তো কখনও দুধের মতো কোনও একধর্মী বস্তুপিণ্ড নয়, এখানে মায়া, মোহ, বিষণ্ণতা, বিপন্নতা— নানান রসায়ন একাধারে আবর্তিত হতে থাকে। সেই আবর্তনে কখনও চ্যুতি, বিচ্যুতি, ত্রুটি, পক্ষপাতিত্ব, এমনকী কামনা-বাসনারও বিচিত্র ভূমিকা থাকে— তা যেমন সাধারণ ক্ষুদ্র মনুষ্যের জীবন রঞ্জিত করে, তেমনই তা বড় মানুষের জীবনও। আজকে একবিংশ শতাব্দীর মুক্তমঞ্চে দাঁড়িয়ে আমরা যখন পৌরাণিক চরিত্র বিচার করতে যাই, তখন এই ধারণাই সবচেয়ে যুক্তিসহ হওয়া উচিত যে, আমাদের দেবতা, আমাদের ভগবান, আমাদের মুনি-ঋষিরা যেহেতু মানুষের স্বরূপেই আমাদের মধ্যে জীবন কাটিয়ে গেছেন, তাই তাঁদের জীবনকেও জীবনের ধর্ম থেকে, জীবনের পরিপাকগত বিচিত্র রসায়ন থেকে পৃথক করে দেখা উচিত নয়। আরও স্পষ্ট করে বলি— জীবনের ধর্মে যাকে আপাতদৃষ্টিতে অন্যায়, বিচ্যুতি বা অধর্ম বলেও মনে হয়, সেইগুলির ওপর অধিক দৃষ্টি না দিয়ে, ব্যক্তিজীবনের প্রতি বিশিষ্ট গুণগুলির ওপরেই আমাদের দক্ষিণ দৃষ্টিপাত ঘটা উচিত।

আমি জানি, এইসব বড় বড় কথায় কোনও কাজ হয় না। বড় মানুষ কিংবা অবতারপ্রমাণ পুরুষের কাছে আমরা আদর্শ আশা করি, আদর্শ জীবন আশা করি। স্বয়ং তিনিও ভগবদ্‌গীতায় উপদেশ দিয়েছেন যে, বড় মানুষ যে আদর্শ কাজটা করে, সাধারণ মানুষ সেটা আদর্শ হিসেবে অনুবর্তন করে— স যৎ প্রমাণং কুরুতে লোকস্তদনুবর্ততে। কিন্তু কৃষ্ণের নিজের জীবন দেখুন, সাধারণ লোকন্যায়ে সেখানে ত্রুটি আছে আপাতদৃষ্টিতে, আর শুধু কৃষ্ণ কেন, মুনি-ঋষি, অবতার, সাধু, সবার জীবনেই এমন ত্রুটি আমাদের চোখে পড়বে। এবং ত্রুটি চোখে পড়লেই সাধারণ ব্যবহারে আমরা আদর্শের কথা তুলে সেখানে সংশয়িত হয়ে পড়ি। ফলত এখন কেউই আর দোষমুক্ত নন, সকলের ওপরেই এখন একবিংশ শতাব্দীর তিরশ্চীন ক্রোধ এসে পড়েছে।

এখন রামচন্দ্রের বিচার হয় শুধুমাত্র সীতা-পরিত্যাগের নিরিখে, কৃষ্ণের বিচার হয় গোপীকুল-সাহচর্যের নিরিখে অথবা ভারতযুদ্ধে তাঁর পাণ্ডব-পক্ষপাতী দোষদৃষ্টিতে, মুনি-ঋষিদের বিচার হয় উর্বশী-রম্ভার কদলীস্তম্ভসদৃশ উরুযুগলের বিনিময়ে। এঁরা কেউ সম্পূর্ণ রামায়ণ পড়েন না, অথবা পড়লেও রামচন্দ্রের অন্য কোনও গুণের ওপর তাঁদের নজর থাকে না। কেউ সম্পূর্ণ মহাভারত পড়েন না, অথবা পড়লেও বিচারধারা তৈরি হয় ভিকটোরিয়ান রোমান্সের কল্পনায়, কেউ পুরাণও তেমন করে পড়েন না, অথবা পড়লেও দৃষ্টি থাকে উর্বশী-রম্ভার দিকে— বশিষ্ঠ-বিশ্বামিত্র-অত্রি-নারদদের আদরণীয় গুণের দিকে তাঁদের আকর্ষণ ঘটে না। সবচেয়ে বড় কথা— সেকালের সমাজটাকেও যদি বিংশ-একবিংশ শতাব্দীর পরিশীলিত তর্কে বিচার করি, তা হলে ইতিহাসটাও তো হারিয়ে যায়।

বরঞ্চ থাক এ-সব কথা। এতক্ষণ যে আমি জীবনের ধর্মের কথা বলছি, যার মধ্যে ক্ষুদ্র-বৃহৎ সকলেই একাকার, সেই জীবনের শত শত বিচিত্র সরসতার প্রতি যদি একবিংশ শতাব্দীর উদার দৃষ্টিপাত ঘটে, তা হলে বুঝবেন— ছোটখাট আদর্শগত ত্রুটি-বিচ্যুতির ওপরেও আরও বড় কিছু আছে, যা দিয়ে ঈশ্বর পুরুষ, মুনি-ঋষি, সাধু-মহাত্মার বিচার করা যায়। সত্যি কথা বলতে কী, সাধারণ্যে আদর্শ বড় মানুষের স্খলন-পতন-ত্রুটিগুলিই তো বড় হয়ে চোখে পড়ে, যেমনটি আমাদের মতো একবিংশ শতাব্দীর আচরণহীন মৌখিকা-সর্বস্ব মানুষের কাছেও। সবচেয়ে বড় কথা, দোষ-ত্রুটি থাকলেও তার ঊর্ধ্বে উঠে গুণটুকু দেখার জন্য প্রাচীন সমালোচক নিজেদের মধ্যেই যে ওজর তৈরি করার সাহস দেখাতে পারতেন, আমরা তাও পারি না। এই যে পুরাণে-মহাভারতে এত অভিশাপের কথা শোনেন, পূর্বজন্মে কৃত দোষের কথা শোনেন সেগুলি অনেক ক্ষেত্রেই বড় মানুষের দোষটুকু ঢাকা দেবার জন্য। আপনারা বলবেন— এ তো বেশ দ্বিচারিতা, বড় মানুষ দোষ করবে, তা বলা যাবে না কেন, আর সে-দোষ ঢাকতেই বা যাব কেন। আমাদের বিশ্বাস— সামান্য বা অসামান্য যে সব দোষ বড় মানুষেরা করে থাকেন, বা করে ফেলেন, সেগুলিকে আমরা সইতে পারব না বলেই অথবা সেই দোষ নিয়েই বেশি মাথা ঘামাব বলে পুরাণকারেরা ঋষি-মুনি-ভগবানের জীবনেও পূর্বজন্মকৃত পাপ বা দোষ এবং তার জন্য অভিশাপের কথা বলে রাখেন। যাতে বড় মানুষ যখন অন্যায় করে, তখন যেন একটা ‘জাস্টিফিকেশন’ খুঁজে পাই, যেন ভাবি— ওই অমুক মুনির অভিশাপ ছিল তো, তাই এমন ঘটল মহান এই জীবনে।

শুধু অভিশাপই নয়, এমন অনেক ওজর, অনেক রকমের উপায় বার করেছেন, যাতে বড় মানুষের দোষ আমাদের চোখে তেমন বড় করে না ধরা পড়ে। আমরা বলরামের মদ্যপানের প্রসঙ্গে পৌরাণিকের অবতারবাদী উদ্ভাবনের কথা বলেছিলাম। পৌরাণিক বলেছিলেন— গোমন্ত পর্বতের শিখর-দেশে উঠে এক বিরাট কদম গাছের ছায়ায় বসেছিলেন বলরাম। মহুয়া ফুলের গন্ধ বেরোলে মদ্যসন্ধানী ব্যক্তি যেমন তৃষ্ণায় আকুল হন কদম ফুলের গন্ধে তেমনই বলরামও মদ্যতৃষ্ণায় ব্যাকুল হয়ে উঠলেন— মদ্যসংস্পর্শজো গন্ধঃ সংস্পৃশন্‌ ঘ্রাণমাগতঃ। দেখুন আমাদের তুলনায় পৌরাণিক অনেক বেশি আধুনিক, অনেক বেশি ‘স্মার্ট’। তিনি অন্তত মদ্যকে মদ্যই বলেন, আধুনিক যুগে বসে এই পঙ্‌ক্তির অনুবাদ করতে গিয়ে আমাদের শ্রদ্ধেয় পণ্ডিতমশায়রা ভয় পেয়েছেন, সংস্কৃতের মূলে ‘মদ্য’ কথাটা থাকলেও বাংলা অনুবাদে মধু শব্দের মতো একটা দ্ব্যর্থক শব্দ ব্যবহার করেছেন, যার অর্থটা অনেক মোলায়েম, অন্তত এই শব্দের শ্রবণে জনমনে প্রথমেই মদ্যের আভাস আসে না। তার মানে বলরামের ভগবত্তা এবং বিরাটত্বের মর্যাদা রক্ষার জন্য আমরা মদের বদলে মধু লিখছি। পণ্ডিতমশাই জানেন যে, এতে করে শেষরক্ষা হবে না। মদ্যপান করার সময় বলরামের পানীয়কে মদ্যই বলতে হবে। তার চেয়ে পৌরাণিকের পদ্ধতি অনেক ভাল, তিনি বিরাটত্বের মর্যাদা রাখেন নির্জ্ঞান মনের মধ্যে পুরাকল্পের স্মরণ ঘটিয়ে দিয়ে। পুরাকালে ভগবান নারায়ণ-বিষ্ণু অমৃতপান করেছিলেন, অতএব ভগবৎ-প্রতিম বলরামের তৃষ্ণা জাগলে তিনি মদ্যপানের ইচ্ছায় অমৃতের কথা স্মরণ করেন— স্মারিতঃ স পুরাবৃত্তম্‌ অমৃতপ্রাশনং বিভুঃ— সঙ্গে সঙ্গে পৌরাণিক কিন্তু অনর্থক ভড়ং না করেও স্পষ্ট বলে দেন— পরের দিন কিন্তু বলরাম আর থাকতে পারলেন না, মদ্যপ পুরুষের যেমন মদ্যগন্ধী বস্তুর গন্ধ নাকে গেলেই মদের জন্য গলা শুকোয়, তেমন বলরামেরও তাই হল— শুশোষ চ মুখং তস্য মত্তস্যৈব অপরেহহনি।

বলরামের মতো বিরাট পুরুষ ভবিষ্যতে মদ্যপানে অভ্যস্ত হবেন, অতএব তাঁকে সাধারণ ব্যসন-দোষ থেকে উদ্ধার করার জন্য পৌরাণিকের উপায় একটা নয়। তিনি লিখেছেন— পুরাকালে বারুণী মদ্যের জন্য ভগবন্নারায়ণের যেমন ইচ্ছা হয়েছিল, বলরামের এই পিপাসাও সেই রকম— তৃষ্ণা চৈনং বিবেশাশু বারুণীপ্রভবা। ‘নারায়ণ’ এবং ‘বারুণী’— একটু ‘রিলেট’ করতে পারছেন কি? সঙ্গে বলরামকেও কি বোঝা যাচ্ছে? আগে বলেছি— পৌরাণিকেরা বলরামকে প্রলয়-পয়োধির জলে শোয়া নারায়ণের সঙ্গে একাত্মতায় দেখেছেন। জলে তো বরুণদেবের অধিষ্ঠান, মদ্যও তো জলের একটি প্রকার বটে, অতএব এই মদ্যের নামও বারুণী, হয়তো জলশায়ী সুপ্ত নারায়ণের উদ্দীপন অমৃতের প্রতীক এই বারুণী। পুরাণে এমন কাহিনি আছে যে, সমুদ্রমন্থনের সময় বরুণদেবের পরিকল্পনায় চার দেবাঙ্গনা অমৃতের সহযাত্রিনী হয়ে উঠে আসেন সমুদ্র থেকে। এই চার দেবাঙ্গনা হলেন সুলক্ষ্মী, বারুণী, কামোদা এবং শ্রেষ্ঠা। এই চারজনের মধ্যে বারুণী-দেবীকে বিবাহের জন্য বরণ করে নেন সমস্ত দেবতারা। আমরা মনে করি— এখানেও সেই প্রতীক আছে, দেবতারা প্রত্যেকেই সুরাপায়ী অতএব সমুদ্রমন্থনজাত অমৃততাপম সুরার সঙ্গে এই বিবাহ দেবতাদের মদ্যপানের সিদ্ধি ঘটায় পৌরাণিক মহিমায়।

একইভাবে দেখুন, কৃষ্ণজ্যৈষ্ঠ বলরাম যখন মদ্যপানের জন্য তৃষিত হন, তখন পৌরাণিকের উপায় থাকে না। সাধারণভাবে দুই ভাণ্ড মদ এনে বলরামের সামনে উপস্থিত হয়ে তিনি বলতে পারেন না— এই যে মহাশয়! আপনার পানের ব্যবস্থা হয়ে গেছে, দু’-পাত্তর চড়িয়ে নিন। মদ্যপানে বলরামের অভ্যস্ততা বোঝাবার জন্য পৌরাণিককে সযত্নে পুরাকাহিনির উল্লেখ করতে হয়েছে। বড় মানুষের কামজ দোষ আড়াল করার জন্য এটুকু তাঁকে করতেই হয়। ঘটনাটা এইরকম দাঁড়াল— কদম গাছের ছায়ায় বসে বলরাম যখন তৃষিত নয়নে ইতি-উতি চাইছেন, তখনই তাঁর নজর পড়ল কদম গাছের দিকে— তৃষিতো মদিরান্বেষী ততস্তং তরুমৈক্ষত। তখন প্রথম বর্ষার জল কদম গাছের ওপর পড়েছে। ফুল-ফোটা কদম গাছের কোটরে বর্ষার জল। পৌরাণিক বললেন— বৃক্ষের কোটরে জমা জলই সেদিন উৎকৃষ্ট মদ্যসুধায় পরিণত হল। তৃষিত বলরাম মদ্যপিপাসু ব্যক্তির মতোই প্রাণের সুখে মদ্যপান করলেন॥

হ্যাঁ মদ্যই তো, বলরাম মদ্যই পান করলেন। পুরাণ একে মধু বলুক, সজ্জন অনুবাদক একে সুধা বলুন, কিন্তু হরিবংশ ঠাকুর জানিয়েছেন যে কদম গাছের কোটরের জমা জল মদিরায় পরিণত হল— তৎকোটরস্থং মদিরা সঞ্জায়ত মনোহরা। সত্যি বলতে কী, কদম গাছ যেমন খাড়া হয়ে ওঠে এবং যেরকম সোজা-সরল ডাল ছড়ায়, তাতে তার মধ্যে কোটর গড়ে ওঠা খুব স্বাভাবিক নয়। আর কোটরে জমা জলও হঠাৎ মদিরায় পরিণত হয় না। অতএব অলৌকিকতার এই আচ্ছাদন থেকে লৌকিক দৃষ্টি থেকে এমন কথাই বোঝা ভাল যে, মহুয়া গাছের পুষ্পের উপাদান সংগ্রহ করে যেমন সুরা তৈরি হয়, তেমনই কদম গাছের পুষ্প কিংবা বৃক্ষত্বক অথবা ফলের অন্তরুপাদান সংগ্রহ করে হয়তো উৎকৃষ্ট মদ্য তৈরি হত। হয়তো কেন হতই, কেন না কদম্ব-বৃক্ষের উপাদান থেকে বেশ কড়া-জাতীয় যে মদ তৈরি করতেন প্রাচীনেরা, তার নামই ছিল কাদম্বরী অর্থাৎ বৃক্ষের নামেই মদের ‘ব্র্যান্ড-নেম’। এই মদ্যের এতটাই আস্বাদান যে, বাণভট্টের মতো বিশালবুদ্ধি কাব্যকার তাঁর অন্যতমা নায়িকার নাম রেখেছেন কাদম্বরী; তার বিখ্যাত গদ্যরচনার নামও তাই। আর পরবর্তীকালের সহৃদয়-সাহিত্যিকেরা শ্লোক রচনা করে বলেছেন— একবার যে মানুষ কাদম্বরী-সুরার রস পান করেছে, তার আর অন্য খাবার খেতে ইচ্ছে করে না— কাদম্বরী-রসজ্ঞানাম্‌ আহারোহপি ন রোচতে। অন্য অর্থে, যে একবার বাণভট্টের কাদম্বরী-কথাকাব্য পড়েছে সে আর অন্য কাব্য পড়তে চাইবে না।

যাই হোক গোমন্ত-পর্বতে কদম গাছের ছায়ায় একা-একা বসে পিপাসু জনের মতো বলরাম প্রচুর পরিমাণ কাদম্বরী-সুধা পান করলেন। এখানে বৃক্ষের মানে সেই বিশাল পত্র-পাত্র, যেখানে কাদম্বরী-সুরার সঞ্চয়টুকু সুরক্ষিত ছিল বলরামের জন্য। একবার নয়, সেই কোটরবৎ পাত্র থেকে বারবার সুরা পান করলেন বলরাম। ফলটা এই হল— তিনি আর দাঁড়াতে পারছেন না, তাঁর সারা শরীর টলছে— মোহাচ্চ চলিতাকারঃ সমজায়ত স প্রভুঃ। তাঁর মুখখানি উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে, চোখের তারাগুলি মদ্যপানের প্রমত্ততায় এদিক-ওদিক ইতস্তত ঘুরছে, সমস্ত পৃথিবীটাও এখন তাঁর কাছে সমানতালে ঘুরছে, কিন্তু তার শ্বেতশুভ্র সুন্দর চেহারায় মুখখানি শরৎকালের চাদের মতো উজ্জ্বল— ঘূৰ্ণিতাকারম্‌ অভবচ্ছরৎকালেন্দু-সপ্রভম্‌।

দেখুন, সুরাপানের ফলে প্রভু বলরামের এই মদঘূর্ণিত নয়ন, মদস্খলিত বচন, আর টলটলায়মান পৃথিবীকে নিয়ে পরবর্তীকালের মহাকবিরা যে কত সুন্দর সুন্দর শ্লোক বেঁধেছেন, তা এখানে আর কত বলব। বললে বিপদও আছে, নিম্বসেবী সাধু পণ্ডিতেরা বলবেন— নৃসিংপ্রসাদ বিষয় পেয়েছে ভাল, ভদ্র-সভ্য তত্ত্বকথা নেই, এইসব অপ-কথা বলে বেড়াচ্ছে। আমি কী করি! এর সঙ্গে তত্ত্বকথা মিলিয়ে দিতে আমার কোনও অসুবিধে নেই, কিন্তু সে আমার রসিক পাঠকের সইবে কেন। আর আমিই কি ছাই তাত্ত্বিক নাকি, রসিক ঠাকুর আর রসিক জনের সেবা করতে-করতে আমার দেবতার রসের উপাদানটুকুই ভাল লাগে। সবচেয়ে বড় কথা, আমাদের দেবতারা এমন বিচিত্র রকমের হলেও তাঁদের শ্রদ্ধা করতে বা ভালবাসতেও আমাদের অসুবিধে হয় না। আমাদের দেবতা, আমাদের ভগবান শুধুমাত্র তত্ত্বসঞ্জাত তত্ত্বপিণ্ড নন, তাঁর রসস্বরূপ, আমাদের জন্য তাঁরা লীলায়িত হন বলেই আমরা কৃষ্ণের মুখে বাঁশি দিয়েছি, তাকে শতকোটি সহচরী গোপিনী দিয়েছি; আমরা শিবের গায়ে ভস্ম মাখিয়েছি, তাঁকে ভিখারি সাজিয়ে তাঁর হাতে ভিক্ষাপাত্র দিয়েছি, নেশা দিয়েছি ভাঙ-ধুতুরার বীজ। জগজ্জননীর সঙ্গেও আমাদের কম খেলা নেই, সৃষ্টির মহত্তত্ব প্রতিষ্ঠার সঙ্গে-সঙ্গে তাঁকে দিগম্বরী করে তাঁকে মুণ্ডমালার সামান্য বসন দিতে আমাদের লজ্জা হয়নি। তাত্ত্বিকতা আর রসিকতার মেলবন্ধন করতে পারি বলেই শ্রীমদ্ভাগবতের মহাকবি আমাদের বলেছেন— ভাবুক বটে তোমরা, রসিকও বটে— মুহুরহো রসিকা ভুবি ভাবুকাঃ।

আমাদের বিশাল তাত্ত্বিক-গম্ভীরতার আড়ালে রসের নিদান আছে বলেই জগন্নাথ তর্কপঞ্চাননের মতো অমন মহাসত্ত্ব পণ্ডিত জগন্নাথের রথের সামনে দাঁড়িয়ে বলরামের উদ্দেশে বলতে পেরেছিলেন— পাণ্ডাদের হাত থেকে বলভদ্র ভগবানের পড়ে যাওয়াটা কোনও অস্বাভাবিক, অসম্ভব ব্যাপার নয়। কাদম্বরী পান করে তিনি সর্বদাই মস্তকে ঘূর্ণন অনুভব করেন, অতএব তিনি পড়েই যেতে পারেন, মহারাজ। এতে অমঙ্গলের ভয় কিছু নেই। বলরামের মদ্যপানবিলাস নিয়ে পণ্ডিত জগন্নাথ তর্কপঞ্চানন তো এই সেদিন রসিকতা করেছেন। তখন ব্রিটিশ আমল চলছে, উইলিয়াম জোনস কেবল সংস্কৃত শিখছেন, সেই সময় জগন্নাথ তর্কপঞ্চানন গজপতি রাজবংশের অধস্তন পুরুষের সামনে দাঁড়িয়ে অমঙ্গলাশঙ্কী রাজার ভয় দূর করছেন। আমার তো মনে হয়, গজপতি চলদ্‌বিষ্ণু তাঁর পূর্বপুরুষদের সরসা ভক্তির কথা জানতেন না। তাঁরা যে তাঁদের প্রাণের ঠাকুর জগন্নাথ-বলরামকে সর্বাধিক শ্রদ্ধা করেও ঠাকুরের সঙ্গে রসিকতা করতে ছাড়েননি, সে-কথা মহারাজ চলদ্‌বিষ্ণু জানতেন না বোধহয়।

যাঁর কথা বলছি, তিনি চৈতন্য মহাপ্রভুর সমসাময়িক গজপতি প্রতাপ রুদ্রও নন, ইনি তাঁর পিতা গজপতি পুরুষোত্তম-দেব। তিনি যেমন বড় কবি ছিলেন, তেমনই সংস্কৃত শব্দকোষ রচনাতেও পণ্ডিত ছিলেন। তিনি প্রভু বলরামের মদ্যপান-ভঙ্গি নিয়ে অসাধারণ একটি শ্লোক লিখেছেন সংস্কৃতে। আপনারা জানেন— মদ্যপানে মত্ত ব্যক্তির নিজের সম্বন্ধেও হুঁশ থাকে না। তার কাছে কিছু চাইলে সে উদার হস্তে সর্বস্ব বিতরণ করে। পুরুষোত্তম-দেব কবি, তিনি প্রভু বলরামের এই পানোন্মত্ত অবস্থার সুযোগ নিয়ে সমস্ত জগতের মঙ্গল চেয়ে নিয়েছেন। বলেছেন— হলধর বলরাম যতক্ষণ মদস্খলিত স্বরে যা ইচ্ছে তাই বলছেন, এই অবস্থায় তিনি যেন সকলের মঙ্গল বিধান করেন— মদস্খলিতমালপন্‌ হলধরঃ শিয়ং বঃ ক্রিয়াৎ।

যতটুকু বলেছি, এর মধ্যে কিছুই নেই। নিজের ঠাকুর, দেশের ঠাকুর সকলের কল্যাণ করবেন, এর মধ্যে আর রসিকতা কোথায়? এইবার দেখবেন গজপতি রাজার কবিত্বের মুনশিয়ানা। মদে মাতাল হলে সাধারণ মানুষ কথ্য শব্দের এক-একটা বর্ণ দু’বার-তিনবার উচ্চারণ করে, অনেকটা তোতলানো লোকের কথার মতো। সেইভাবে দুই-তিন বার বর্ণ-পুনরুক্তি ঘটিয়ে সংস্কৃতের ছন্দ মেলানো অত সহজ কথা নয়; যিনি পারেন, তিনিই পারেন, অন্তত পুরুষোত্তম-দেব পারেন।

কবি লিখছেন— বলরাম বিপুল মদ্যপান করে স্খলিত স্বরে ছোটভাই কৃষ্ণকে ডেকে বলছেন— কৃষ্ণ! এটা কী হল আমার। সমস্ত পৃথিবীটা কেমন যেন দু-দু-দুল্‌ছে, আকাশের চাঁদ কেমন যেন ঝু-ঝু-ঝুল্‌ছে আমার নাকের ডগায়। এই কথাগুলোই সংস্কৃতের ছন্দে কী অসাধারণ— ভ-ভ-ভ্রমতি মেদিনী ললল-লম্বতে চন্দ্রমাঃ। এর পরেই বলরাম বলছেন— আচ্ছা, কৃ-কৃষ্ণ। তাড়াতাড়ি ব-বল তো, আমারই বংশের লোক সব, আমার স্বজন বৃষ্ণিরা এ-রকম আমার দিকে তাকিয়ে হা-হা-হাসছে কেন— কৃ-কৃষ্ণ ব-বদ দ্রুতং হ-হ-হসন্তি কিং বৃষ্ণয়ঃ। তুমি একবার আমার এই প-প-পানপাত্র থেকে একটু ম-মদ ঢ্‌-ঢেলে দাও তো, আমি বোঝার চেষ্টা করি— ব্যাপারটা কী— শি-শীধু মু-মু-মুঞ্চ মে প-প-প-পান-পাত্রস্থিতম্‌ কবি বলছেন এই রকম মদ-বিহ্বলতায় যিনি কথা বলছেন, সেই হলধর বলরাম তোমাদের সকলের মঙ্গল সাধন করুন।

এমন মদ-স্খলিত দেবতার কাছেও আমরা কল্যাণ ভিক্ষা করি, এখানেই আমাদের বিশেষত্ব। নিজেদের আদলে গড়া এই দেবতার প্রতি সাধারণের অশ্রদ্ধা হতে পারে ভেবেই পৌরাণিক কথক ঠাকুর বিস্তারিতভাবে দৈব বিভূতি যোগ করেছেন বলরামের চরিত্রে; উঠে আসছে সমুদ্রমন্থনের প্রসঙ্গ। আমরা কোন কথা থেকে কোন কথায় চলে এসেছিলাম। দৈব বিভূতি থেকে একেবারে পুরুষোত্তম-দেবের লৌকিক রসিকতায় চলে এসেছিলাম। আবারও তাই ফিরে যেতে হবে দৈবকল্পে।

কথক-ঠাকুর বলরামের ‘ব্র্যান্ড’ চিহ্নিত করে দিয়েছেন এক কথায়— কাদম্বরী— কদম ফুলের উপাদান বহন করে কাদম্বরী সুরা— কদম্ব-কোটরে জাতা নাম্নী কাদম্বরীতি সা। কিন্তু কাদম্বরীর পরিচয় কী? দৈবকল্পে তার সমাধান— দেবতাদের অমৃত-রসায়ন যিনি তুলে আনতে সাহায্য করেছিলেন, সেই বারুণী সুধারূপ ধারণ করে প্রকটিত হলেন কাদম্বরীর সুরায়। কৃষ্ণাগ্রজ বলরাম তখন কাদম্বরী সেবন করে আর কথা বলতে পারছেন না, সেই অবস্থায় তিনজন দেবাঙ্গনা বলরামের সামনে এসে দাঁড়ালেন। তাঁদের একজন বারুণী মদিরা, অন্যজন চাঁদের জ্যোৎস্নারূপিনী কান্তি-দেবী, আর তৃতীয়া লক্ষ্মীর স্বরূপ-সমৃদ্ধা শ্ৰী, যাঁকে শোভা বা সৌন্দর্য বলা যায়।

বারুণী মদিরা বলরামকে বললেন— আমি তো তোমাকে আমার প্রভু বলেই জানি। আমার সেই অনন্ত-শয়ান বিষ্ণু! কবে তুমি সমুদ্রের শয্যাসন ছেড়ে পৃথিবীতে অবতার গ্রহণ করে চলে এসেছ, আমি সেই অবধি তোমায় খুঁজেই চলেছি, খুঁজেই চলেছি— যেন আমার সমস্ত পুণ্য ক্ষয় হয়ে গেছে। আমি বনের মধ্যে ফুলের মধু হয়ে থেকেছি, থেকেছি বসন্তের মাধবীলতায় অনন্ত পুষ্পকেশরে— অতিমুক্তেষু চাক্ষোভ্য পুষ্পস্তবকবৎসু চ। আমি জানি— আমি যেমন তোমাকে নিরন্তর খুঁজে চলেছি, তেমনই তুমিও আমাকে খুঁজে চলেছ। আজ আমি তোমাকে তৃষ্ণার্ত দেখে এই কদম গাছের মধ্যে নিজের রূপ আচ্ছাদন করে লুকিয়ে ছিলাম— অহং কদম্বমমালীনা…স্বেন রূপেন ছাদিতা। আমি আগে যেমন বিষ্ণুস্বরূপে তোমার তৃষ্ণা মিটিয়েছি অমৃতের রূপে, আজও তেমনই থাকতে চাই তোমার কাছে আছে, তোমার সেবায় নিযুক্ত হয়ে।

বারুণীর মুখে এই স্তব-স্তুতি বস্তুত বলরামের মদ্যপানের অভ্যাসকে দৈব মদ্যের সংস্কারে ‘লেজিটিমাইজ’ করে নেওয়া। নইলে দেখুন, ওই যে কথাটা— আমি ফুলে ফুলে, বসন্তের মাধবীলতায় বাস করেছি— এ-কথাটা আসলে সুরা-উৎপাদনের সাধারণ উপাদান। সেকালে লেখা কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র এবং এই ধরনের গ্রন্থ অনুসন্ধান করলেই বোঝা যাবে যে, কত রকম গাছের ছাল, গাছের ফল, পুষ্পরেণু, বৃক্ষবীজ এমনকী কোনও কোনও গাছের পাতাও ব্যবহার হত মদ তৈরির কাজে। আর বারুণী তো মদই। মদনদহনের পর কালিদাস যে রতিবিলাপসংগীত রচনা করেছেন, সেখানে বারুণী মদিরাকে সাধারণী রমণীর ভোগ্য সুরা হিসেবেই দেখানো হয়েছে। রতি বিলাপ করে বলেছেন— জগতে ভালবাসার দেবতাই যদি তাঁর বৃত্তিটুকু হারিয়ে বসেন তবে যে সমস্ত রমণীরা বারুণী মদিরা সেবন করে প্রমত্ততায় চোখ ঘুরিয়ে-ঘুরিয়ে পথ চলে, মদ-স্খলিত স্বরে কথার খেই হারিয়ে ফেলে— নয়নান্যরুণানি ঘূর্ণয়ন্‌ বনানি স্খলয়ন্‌ পদে পদে— সেই সমস্ত রমণীদের বারুণী-পানের কোনও সার্থকতা থাকবে না— ভালবাসাহীন পৃথিবীতে সুরাপানের কোনও স্থান নেই— অসতি ত্বয়ি বারুণীমদঃ/প্রমদানাম্ অধুনা বিড়ম্বনা।

সাধারণ সুরা হিসেবেই যে বারুণী পরিচিত ছিল, তার প্রমাণ আরও অনেক আছে। মহামতি মোনিয়ার উইলিয়ামস তার শব্দাভিধানে বারুণী সম্বন্ধে লিখেছেন— a kin of wine on spirit (prepared from hogweed ground with the juice of date or palm and then distilled); আর পণ্ডিতজনেরা কালিদাসের শ্লোকের টীকা করতে গিয়ে লিখেছেন— মদ খেলে আস্তে আস্তে স্ত্রীলোকের গালে লালিমার ছোয়া আসে, চোখের কোণে ফুটে ওঠে রক্তিম আভা, সে-সব শোভা পুরুষের ভালবাসার উন্মত্ততা বাড়িয়ে তোলে। আমার বিশ্বাস— ওই যে হরিবংশে বারুণীদেবীর সঙ্গে কান্তিদেবী এবং শ্রী অর্থাৎ শোভাদেবীর উৎপত্তি ঘটল, তাঁরা সব বারুণী মদিরারই বিভূতি। কেন না মদ্যপান করলে মুখে যে উজ্জ্বল কান্তি বিলুলিত হয়, সমস্ত বদন-মণ্ডলে যে ঢল-ঢল লাবণি আসে, অতএব মদিরার সঙ্গজাত বলেই হরিবংশ ঠাকুরের কীর্তনে তিন দেবাঙ্গনা হলেন বারুণী, কান্তি আর শোভাশ্রী, যারা সকলেই ভগবান অনন্ত দেবের সঙ্গছাড়া হয়েছিল একদিন, এবং এতদিনে বলরামের আস্বাদ্য কাদম্বরী-সুরায় আপন আপন স্থান করে নিল। এই সম্পূর্ণ মদিরাস্বাদনের কাহিনি বলরামের পানাভ্যাসের গৌরচন্দ্রিকা। কথক ঠাকুর মনুষ্যস্বরূপ বলভদ্রের ঈষদুষ্ট মদ্যপানের অভ্যাসের মধ্যে দৈব বারুণীর একাত্মতা ঘটিয়ে আমাদের মতো সাধারণ মানুষের শ্রদ্ধা জাগ্রত করে রাখলেন বলরামের উদ্দেশে।

॥ ৬ ॥

বলরামের মদ্যাভ্যাসের প্রসঙ্গে আমরা এতটাই অকাণ্ডে তর্পণ করছিলাম যে, তার জীবনের সূত্রগুলি হারিয়ে গেছে। মনে করুন— কংসের মৃত্যুর পর মগধরাজ জরাসন্ধের আক্রমণের কথা। কৃষ্ণ-বলরাম স্বজন-পরিজন ছেড়ে স্বদেশ ত্যাগ করে সরে এসেছিলেন ঈষৎ দক্ষিণের দিকে। তাঁরা ভেবেছিলেন— তাঁরা মথুরায় উপস্থিত থাকলে নিছক তাঁদের ওপর আক্রোশেই জরাসন্ধ মথুরা আক্রমণ করবেন এবং তাতে নির্দোষ স্বজন-পরিজনেরা অনর্থক কারণে যুদ্ধের কুফলগুলি ভোগ করবেন। এটাকে পালিয়ে আসা বলতেও কোনও আপত্তি নেই, কেন না তাতে কৃষ্ণের কিছু আসে-যায় না। যাই হোক, কৃষ্ণ-বলরাম গোমন্ত পর্বত আশ্রয় করে আছেন, যদু-বৃষ্ণিদের সৈন্য-সামন্ত সেখানে কিছু ছিল এবং কৃষ্ণের আশঙ্কামতো জরাসন্ধ বিশাল সৈন্যবাহিনী নিয়ে গোমন্ত পর্বত অবরোধ করে বসে রইলেন। এখানেই শেষ হল না, গিরি দুর্গে আশ্রিত দুই ভাইকে বাইরে যুদ্ধক্ষেত্রে টেনে আনার জন্য তিনি অনেক ইন্ধন জোগাড় করে আগুন ধরিয়ে দিলেন গোমন্ত পর্বতের চার দিকে।

আগুনের দাপটে গোমন্ত পর্বতের কোথায় কী হল তার মধ্যে বিস্তারিত না গিয়ে শুধু এইটুকুই বলি যে, কৃষ্ণ-বলরাম দুর্দান্ত লম্ফ-ঝম্ফ করে নেমে এলেন যুদ্ধক্ষেত্রে। যুদ্ধ আরম্ভ হবার আগে আবারও মূল প্রস্তাব থেকে একটু সরে আসতে হবে। উপায় কী। মানুষ ভাবুন, বড় মানুষ ভাবুন অথবা দেবতাই ভাবুন, তাঁদের সাঙ্গোপাঙ্গ, জামা-কাপড়, সু-অভ্যাস— কু-অভ্যাস। এবং অস্ত্র-শস্ত্র না বুঝলে তাঁদের সম্পূর্ণ বোঝা যাবে না। আবার সেই দৈব অলৌকিক কথা আসবে এবং সঙ্গে-সঙ্গে আসবে লৌকিক গবেষণাও।

পৌরাণিকের দিক থেকে এই কথাই বলা স্বাভাবিক যে যুদ্ধ আরম্ভ হবার আগেই চারটি দৈব অস্ত্র নেমে এল ভুঁয়ে— হল, মুষল, চক্র এবং গদা। সুদর্শন চক্র এবং কৌমোদকী গদাকে আমরা চিনতে পারি সে তো ভগবান বিষ্ণু-নারায়ণের দিব্য অস্ত্র, তাঁরা বিষ্ণু-স্বরূপ কৃষ্ণের হাতে নেমে আসবে, তাতে আশ্চর্য কী। কিন্তু পুরাণ বলেছে— সংবর্তক নামের একটি হল, সৌনন্দ নামে মুষল আর অন্যদিকে সুদর্শন চক্র আর কৌমোদকী গদা— এই চারটি দিব্য অস্ত্র নেমে এল কৃষ্ণ-বলরামের সাহায্যার্থে— চত্বার্য্যেতানি তেজাংসি বিষ্ণুপ্রহরণানি বৈ। সুদর্শন চক্র এবং কৌমোদী গদা ভগবান্নারায়ণ বা বিষ্ণুর অস্ত্র প্রহরণ, এটা বুঝি। এটাও বুঝি যে, যুদ্ধক্ষেত্র বলেই বিষ্ণুর অপর দুই হস্তালংকার শঙ্খ এবং পদ্মের আবির্ভাব এখানে ঘটেনি, কিন্তু হল-লাঙল অথবা মুষল— এই দুটি কিন্তু সনাতন বিষ্ণুর প্রসিদ্ধ প্রাচীন প্রহরণ নয়। অনন্ত বা শেষশায়ী বিষ্ণুর হাতেও এই অস্ত্র আমরা তেমন দেখি না। শুধু পুরাণগুলিতেই বলরামের অস্ত্র হিসেবে এই হল-লাঙল আর মুষলের জয়-জয়কার।

বিদেশি পণ্ডিত-গবেষক এবং আধুনিকমনা এ-দেশি বিদ্বজ্জনের কাছে বলরামের এই দুই অস্ত্রের অনন্ত মাহাত্ম্য। আগেও বলেছি— বলরামের হাতে লাঙল-এর মতো একটা বিচিত্র প্রহরণ দেখে আধুনিক গবেষকেরা বলরামের সঙ্গে তৎকালীন কৃষি-সভ্যতার যোগ দেখতে পেয়েছেন। এটাও ঠিক, যদি সনাতন বৈদিক পরম্পরায় বৈদিক দেবতাকুলের অস্ত্র-মাহাত্ম্য বিচার করি, তা হলে ইন্দ্রের বজ্র অথবা বরুণের পাশের তুলনায় হল-লাঙল আর মুষল নিতান্তই অর্বাচীন, অবশ্য অর্বাচীন মানে এই নয় যে, বলরাম সেদিনকার মানুষ। তাঁর হল-লাঙল-মুষল দেখে বরঞ্চ এইটাই ভাবা দরকার যে, তাঁর সমকাল নয়, তাঁর পূর্বকালেই কৃষিভিত্তিক উৎপাদনের ব্যবস্থা নির্দিষ্ট মাত্রায় পৌঁছেছে, বিশেষত লাঙলের ফলাগুলি যেহেতু লোহা দিয়ে তৈরি হয়, অতএব ধাতু হিসেবে লোহার প্রচলনও তখন প্রযুক্তি-কর্মের নিতান্ত সহায়ক হয়ে পড়েছে।

বলরামের হাতে এই প্রায় অপ্রচলিত লাঙলের প্রহরণ দেখে বিদেশি গবেষকেরা বহু গভীরে তার তাৎপর্য ব্যাখ্যা করেছেন। বস্তুত ভারতবর্ষের দশ অবতারের প্রতীকী তাৎপর্য নিয়ে যে সব পণ্ডিতরা বিচার বিবেচনা করেছেন, তাঁদের কাছে ভারতীয় সভ্যতার বিবর্তনের ধারাটি ভীষণভাবে প্রণিধানযোগ্য হয়ে উঠেছে— জলময় পৃথিবীর মধ্যে মীন-মৎস্যের অবতারের পরেই উভচর প্রাণী কূর্ম যেমন তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে উঠেছে সভ্যতার বিকাশে, তেমনই একশৃঙ্গী বরাহ অবতারে তার শৃঙ্গটিকে একাধারে কৃষিসভ্যতা এবং প্রজননের প্রতীক হিসেবে চিহ্নিত করেছেন পণ্ডিতেরা। বরাহ যে-ভাবে তার শৃঙ্গ দিয়ে নরম পল্বল-ভূমি চিরে-খুঁড়ে দেয়, সেটা প্রায় লাঙলের কাজ। আর ইয়াং খণ্ডা (J. Gonda)-র মতো মহাপণ্ডিত গ্রিম-সাহেবের ‘ডয়েটসে মিথলজি’র প্রমাণ দেখিয়ে বলেছেন— Of greater relevance is a tradition recorded by Grimm, The boar by rooting up the soil taught the art of plouging to man.

‘লাঙ্গল’ চালনার শিক্ষা যদি বিষ্ণুর বরাহ অবতারের প্রতীকী তাৎপর্য হয়ে থাকে, তবে সেই লাঙল বলরামের প্রহরণ হিসেবে চিহ্নিত হওয়াটা অবশ্যই সভ্যতা এবং শস্যোৎপাদনশীলতার চরম অভিজ্ঞান হওয়া উচিত। একই সঙ্গে মনে রাখতে হবে যে, পৃথিবীর ক্ষেত্র-কর্ষণ এবং প্রজনন-ক্রিয়া অনেক সময়েই একই শব্দের দ্বারা চিহ্নিত, এবং তা পৃথিবীর সর্বদেশে এবং সর্বকালে। সংস্কৃতে ‘ক্ষেত্র’ বলতে যেমন কর্ষণযোগ্য ভূমি বোঝায়, তেমনি কর্ষণযোগ্য স্ত্রী-অঙ্গও বোঝায়, আর সেটা সংস্কৃত ভাষায় আছে বলে আমাদের সভ্যজনেরা সংস্কৃত ভাষা এবং সংস্কৃতি নিয়ে উদ্বিগ্ন হবেন না, কেন না ক্ষেত্র বলতে এমন অর্থ-দ্বৈরথ আছে বলেই লাঙলের পৌরুষ এবং গুরুত্ব আরও বেড়েছে। খোদ গ্রিক ভাষায় যে শব্দটির অর্থ plougher বা কর্ষক, তারই আর এক অর্থ হল পিতা এবং গ্রিক ভাষায় ধাতু-বীজ ধরলে ওই শব্দ থেকেই সন্তান-উৎপাদন এবং প্রজননের অঙ্গ-বোধক শব্দগুলিও সৃষ্টি হয়েছে। আর শুধু গ্রিক কেন অত্যাধুনিক ইংরেজি ভাষার কুৎসিত প্রয়োগে I ploughed her… এ-সব শব্দ অপশব্দ হতে পারে, কিন্তু প্রয়োগটা সার্থকভাবে এখনও চলছে।

পণ্ডিত-গবেষকেরা কৌতুকের সঙ্গে লক্ষ করেছেন যে, সংস্কৃত ভাষায় ‘লাঙ্গল’ শব্দটি ঋগ্‌বেদের সমবয়সি, এটা কোনও বড় কথা নয়। কিন্তু কথাটার মানে একদিকে যেমন জমির লাঙল, তেমনই অন্যদিকে পুরুষের লিঙ্গও বটে। কথাটা বাংলা ভাষায় তেমন পরিষ্কার করে বলা যাচ্ছে না বলে পণ্ডিতোচিতভাবে জার্মান গবেষকের উদ্ধৃতি দিয়ে বলি— In Sanskrit word ‘Langala’ designates the plough as well as the penis…because the primitive plough was and sometime still is, a pointed branch or stick…. Words for the penis on the other hand, often sprung from words meaning “rod, stalk, club, pointed object etc. and the sexual act itself is often denoted by verbs originally and properly meaning “thrusting, pricking, beating, scratching etc.”

এই প্রসঙ্গে বলরামের কথা এইভাবেই বলতে হবে যে, লাঙ্গলী, হলধর, হলায়ুধ— এগুলি বলরামের নাম বটে, তবে তিনিও কর্ষক,— সঙ্কর্ষণ তাঁর আর এক নাম। মহাভারতে যখন বলা হচ্ছে— আমি কৃষ্ণবর্ণের লৌহজাত ‘লাঙ্গল’ ধারণ করে সমগ্র পৃথিবীকে চষে ফেলি, তখন লাঙ্গলী বলরামের সম্বন্ধে জার্মান পণ্ডিত মন্তব্য করেন— the plough, the implement typical of Krishna’s brother Balarame… club and plough point to association with agriculture and with the fertility of the soil.

আমার পাঠককুল! সাহেব-পণ্ডিতদের এইসব তর্ক-বিতর্ক, প্রতীকী তাৎপর্য, tilling, fertilising আর generative activity— পণ্ডিতেরা এ সব নিয়ে খুব চুলচেরা বিচার করেন, আমরাও সে সব কথা উল্লেখ করছি, বলরামের সম্বন্ধে দেশি-বিদেশি গবেষকদের ধারণাটা না বলে দিলেই নয় বলে; কিন্তু বাস্তবে কী জানেন— এসব গবেষণায় আমি অন্তত বড় ক্লান্ত বোধ করি। আধুনিক প্রত্যভিজ্ঞায় বলরাম অথবা বলরামের অস্ত্র পর্যন্ত ভারতীয় প্রাচীন সভ্যতার ক্রমবিকাশের তাৎপর্যে জড়িত, কিন্তু সত্যি বলছি— এসব আলোচনা করে একটু পণ্ডিত-পণ্ডিত ভাব দেখাই বটে, তবে এতে আমার প্রভু বলরামের আসল জীবনচর্যা যায় হারিয়ে। আমি বরং বলতে চাই— বলরামের লাঙল জিনিসটাকে একটা ‘ইউনিক’ অস্ত্র হিসেবে ভাবতে ক্ষতি কী। আর এমন তো নয় যে, ইন্দ্রের বজ্রও যেখানে ওই গবেষকের চিন্তায় পুরুষাঙ্গের প্রতীকেই গৃহীত, অথচ ইন্দ্রের জীবনে যত স্ত্রীলোক এসেছেন, এমনকী কৃষ্ণের জীবনেও যত— তাতে ওই কর্ষণ— tilling, fertility এবং generative activity বেশ ভাল করেই ব্যাখ্যা করা যায়, কিন্তু আমার সরল সাধাসিধে প্রভু বলরাম তো এমন নন। তাঁর স্ত্রী-বিষয়িনী চিন্তায় রৈবত ককুদ্মীর কন্যা রেবতী ছাড়া রমণী নেই, আর মাঝে-মাঝে মদ্য পান করতে করতে তিনি অত্যুৎসাহে তাঁর এই প্রথম এবং শেষতমা রমণীর বদন চুম্বন করে ঢুলু-ঢুলু চোখে তাকিয়ে থাকবেন— এটাই আমাদের সুচিন্তিত বলরাম—

ঘূর্ণয়ন্‌ মদিরাস্বাদ-মদ-পাটলিতদ্যুতিঃ।

রেবতী-বদনোচ্ছিষ্ট পরিপূত-তটে দৃশৌ॥

তবে হ্যাঁ, একতমা রমণী হলেও বলরামের সমগ্র জীবনে রেবতীর আবেশ এতটাই বেশি যে, কাব্য-মহাকাব্য সর্বত্র যেখানেই বলরামের উল্লেখ আছে, সেখানেই প্রত্যক্ষে এবং পরোক্ষে রেবতীর উপস্থিতি আমরা অনুভব করতে পারি। এমনকী কালিদাস তাঁর মেঘদূতে সাময়িকভাবে সংসারবিরক্ত বলরামের স্বভাব বলতে গিয়ে বলেছেন— সুরাপাত্রে টলটলে সুরার মধ্যেও বলরাম রেবতীর ঈষদ্ৰক্ত চক্ষু দুটি দেখতে পেতেন— অভিমতরসাং রেবতীলোচনাঙ্কাম্‌। অতএব বলি— বলরামের বহুকামিতা নাই থাকুক, কিন্তু একের মধ্যেই তাঁর প্রেমাবেশ এতই যে, সেখানে লাঙল-মুষলের প্রতীকী ভাবনা ভাবতে মানা কী? তবু বলি, বলরামের অস্ত্রের কথা বলছিলাম আমরা।

ওই যে বলছিলাম অস্ত্র— বলরামের লাঙল আর মূষল, জরাসন্ধের সঙ্গে প্রথম যুদ্ধে যে দুটিকে দৈব অস্ত্র হিসেবে নেমে আসতে দেখেছি, সে দুটিকে অত্যন্ত সাধারণভাবেই ভাবা যায়। এমনকী নামটিও। বলরামের লাঙলের নাম সংবর্তক। আমাদের পরম্পরায় বলরাম হলেন রুদ্র সঙ্কর্ষণ, তিনি ধ্বংসের দেবতা। আর পুরাণে দেখবেন— মহাপ্রলয়ের সময় যে বিধ্বংসী মেঘ উড়ে আসে তারও একটি অন্তত সংবর্তক মেঘ। হয়তো সেই প্রলয়কালীন মেঘের নামেই বলরামের লাঙল, যা ধ্বংসের প্রতীক। জরাসন্ধের সঙ্গে প্রথম একক যুদ্ধের সূচনায় বলরাম এবং কৃষ্ণ দু’জনেই যে যুদ্ধে প্রবৃত্ত হলেন, সেই যুদ্ধের বিস্তারিত বর্ণনায় আমরা যাব না। কেন না, ইতিহাস এবং বাস্তব রাজনীতির প্রয়োগ যতটা আমরা মহাভারত থেকে মিলিয়ে নিতে পারি, তাতে বলরাম এবং কৃষ্ণের দিক থেকে যতই বীরত্ব প্রকাশিত হোক, আমরা জানি— জরাসন্ধ এই যুদ্ধে পরাজিত হননি। হ্যাঁ, পৌরাণিকের শ্রদ্ধা-পুলকিত বর্ণনায় বলরাম এখানে যথেষ্ট বীরত্বের পরিচয় দিয়েছেন। সংবর্তক হলের চালনা, মুষল-নিক্ষেপের নৈপুণ্য অথবা গদাযুদ্ধের বিশিষ্টতায় বলরাম এখানে নিতান্তই সমুজ্জ্বল। তবুও এক সময় বলরামের সঙ্গে জরাসন্ধের প্রবল গদাযুদ্ধ আরম্ভ হয়েছে যখন, তখন কিন্তু পৌরাণিক একান্তই সংযত— বলরাম যদি গদাযুদ্ধের মণ্ডলাকার আবর্তনে দক্ষিণভাগ দিয়ে আক্রমণ শানিয়ে তোলেন, সেখানে জরাসন্ধও যুদ্ধের নিয়ম-নীতি মেনেই বাঁ দিক থেকে আক্রমণ করতে থাকেন— সব্যং মশুলামাশ্রিত্য বলদেবস্তু দক্ষিণম্।

পৌরাণিক এর আগে বলরামের অনেক যুদ্ধ শৌর্য প্রকাশ করেছেন, কিন্তু জরাসন্ধের মতো প্রবল প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে বলরাম সমান-দক্ষতায় চিহ্নিত, কেন না তিনি জানেন যে, ইতিহাসের কঠিন সত্য বলতে হলে বলরাম এখানে জিতবেন না। অতএব বহুতর অতিশয়িনী যুদ্ধবর্ণনার মধ্যেও তিনি বলরামকে জরাসন্ধের বিষম প্রতিপক্ষতায় শ্রেষ্ঠতর বলে দেখাতে পারছেন না। তাঁকে বলতে হচ্ছে— গদাযুদ্ধে এঁরা দু’জনেই বিখ্যাত আচার্যের মতো— তাবুভৌ পরমাচার্যৌ লোকে খ্যাতৌ মহাবলৌ। এমনকী গদা-সম্প্রহারের সময়েও একবার যদি কথক ঠাকুর বলেন— জরাসন্ধের গদাঘাত বলরামকে কম্পিত করতে পারল না— তখন পরের ক্ষণেই তাঁকে বলতে হয়— শিক্ষার কৌশলে জরাসন্ধ বলরামের গদাঘাত বিফল করে দিলেন— সেহে ধৈর্যেণ মহতা শিক্ষয়া চ ব্যপোথয়ৎ। এই বিশাল সমকক্ষতার মধ্যেই সুস্বরে আকাশবাণী নেমে এসেছে এই মর্মে— বলরাম! তোমার হাতে জরাসন্ধ মৃত্যুবরণ করবেন না এবং তার জন্য তুমি দুঃখও কোরো না— ন ত্বয়া রাম বধ্যোহয়ম্‌ অলং খেদেন মানদ। আমি জরাসন্ধের মৃত্যু বিধান করে রেখেছি অন্য সময়ে, অন্য লোকের হাতে।

এই ‘সুস্বরা লোকসাক্ষিণী’ দৈববাণীর পরেই আমরা জরাসন্ধকে বিমনা হয়ে সসৈন্যে যুদ্ধ ছেড়ে পালিয়ে যেতে দেখছি বটে কিন্তু এ কথা আমাদের সত্য মনে হয় না। বস্তুত জরাসন্ধের বহুবার আক্রমণের মধ্যে এটি অন্যতম এবং মহাভারতে কৃষ্ণ যুধিষ্ঠিরকে যেহেতু বলেছিলেন— তিনশো বছর ধরে জরাসন্ধের সঙ্গে যুদ্ধ করলেও আমরা তাঁর সঙ্গে পেরে উঠব না— ন হন্যামো বয়ং তস্য ত্রিভির্বর্ষশতৈর্বলম্‌— সেই নিরিখে এটাই ঐতিহাসিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হয় যে, বলরাম যতই যুদ্ধ করুন জরাসন্ধের সঙ্গে, এই যুদ্ধে জরাসন্ধ পালিয়ে যাননি, বরং বলা উচিত— কৃষ্ণ-বলরামকে সাক্ষাৎ ধরতে না পেরে তিনি চলে গিয়েছিলেন।

সত্যি কথা বলতে কী, এই যুদ্ধ নিয়ে আমার কোনও মাথাব্যথা নেই, বরঞ্চ বলরাম তাঁর সংবর্তক হল আর সৌনন্দ মুষল নিয়ে যেভাবে প্রথমদিকে যুদ্ধ করছিলেন, সেটা নিয়ে আমার কৌতূহল আছে। ওই যে বলছিলাম— অস্ত্র হিসেবে লাঙল জিনিসটাকে বলরামের একটা ‘ইউনিক ইমপ্লিমেন্ট’ বলা যায় কিনা, সেটাই আমাদের ভাবা উচিত। ভাবা উচিত বলরামের অত্যাধুনিকতা নিয়েও। একটা খবর পাচ্ছি— সেই যে বরুণা দেবী, কান্তি আর শোভাদেবীর কথা বলেছিলাম, তাঁরা নাকি বলরামের পরিধেয় বসন হিসেবে নীল রঙের রেশমি কাপড় নিয়ে এসেছিলেন উপহার হিসেবে। আর একটা উপহার এনেছিলেন— এক কানে পরার জন্য বজ্ৰমণির হিরে বসানো একটি সোনার দুল— জাতরূপময়ং চৈকং কুণ্ডলং বজ্রভূষিতম্‌। আমার কথা হল— আপনারা আজকাল ছেলেপিলেদের গালাগালি দেন বিকট স্টাইল করছে বলে। তো সেই কোন প্রাচীনকালে এঁরা কম যান কীসে। ওঁরা দিলেন, আর ইনি নিলেন, নিয়ে রেখে দিলেন তাও যদি হত, জরাসন্ধের সঙ্গে ওই বিরাট যুদ্ধের কালে বলরাম যখন যুদ্ধে নামার প্রস্তুতি নিচ্ছেন, তখন তাঁর পরনে নীল বাস, গলায় বনমালা, যুদ্ধের উন্মাদনায় কিঞ্চিৎ কাদম্বরী সেবন করে তিনি উত্তেজিত— কাদম্বরীমদক্ষীবো নীলবাসা সিতাননঃ।

হ্যাঁ, যুদ্ধের আগে সেকালের যুদ্ধ-নায়কেরা একটু সাজতেন ভাল করে, এমনকী সুরা-মদ্যের প্রাগায়োজনও অস্বাভাবিক নয়, কিন্তু বলরাম এই সময়েও অতি-আধুনিক অথবা তখনকার কালের কালাতীত ‘পোস্ট-মডার্ন’ স্টাইল-টুকু বাদ দেননি— তিনি এক কানে বজ্ৰমণিখচিত হিরের দুল পরে রওনা দিয়েছেন রণাঙ্গনে। গোমন্ত পর্বত থেকে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার সময়েও তাঁর দক্ষিণ হাতে সংবর্তক হল আর বাঁ হাতে সৌনন্দ মুষল। এক শত যুদ্ধ-বীরের সঙ্গে যুদ্ধ করার সময়েও তাঁর একটি কানে সেই বজ্ৰমণি হিরের দুল— কান্তৈককুণ্ডলধরশ্চারুমৌলিরবাঙ্‌মুখঃ।

আরও যেটা লক্ষ করার বিষয় এবং যেটা আমি বার-বার বলছি— সেটা হল— বলরাম তাঁর লাঙলটিকেই ‘ইউনিক’ অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতেন, হয়তো এতেই তিনি সব থেকে সুবিধে পেতেন। অন্যেরা যেখানে ধনুক-বাণ অথবা গদার মতো পরিচিত অস্ত্র ব্যবহার করতেন, সেখানে এই বলরামের মতো কেউ কেউ থাকতেন যাঁরা নিজের মতো করে একটা বস্তুকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতেন। পরশুরামের কুঠারটির কথাই ভাবুন না। তিনি তো অসাধারণ ধনুর্বিদ্যা জানতেন, ভীষ্ম-দ্রোণ-কর্ণের মতো বিরাট যুদ্ধ নায়কেরা তাঁর ধনুর্বেদের শিষ্য, অথচ পরশুরাম নিজে কিন্তু কুঠারকেই তাঁর ‘ইউনিক’ অস্ত্র হিসেবে বেছে নিয়েছেন।

আমাদের ধারণা— বলরামও সেই রকম একজন ব্যক্তিত্ব। তিনি যতই সান্দীপনি মুনির কাছে গদাযুদ্ধের নিপুণ শিক্ষা নিয়ে থাকুন এবং এ কথা ঠিক যে, তাঁর আমলে গদাযুদ্ধে এত শৈলীসম্পন্ন ব্যক্তি হয়তো দ্বিতীয় ছিলেন না, কিন্তু তৎসত্ত্বেও ছোটবেলা থেকে ব্রজভূমিতে বড় হয়ে, হাজারো গোপজনের সঙ্গে মিশে, কৃষি-পশু সম্পদের অন্যতম অঙ্গ হল-লাঙলকেই তিনি নিজের অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে শিখেছিলেন। যুদ্ধস্থলে বলরাম কীভাবে তাঁর লাঙল আর মুষলের নিজস্ব প্রযুক্তি ব্যবহার করতেন, তারও একটা নমুনা আছে হরিবংশ পুরাণে। সেখানে দেখা যাচ্ছে, জরাসন্ধের যুদ্ধসঙ্গী মহাবলী দরদ রাজা বলরামকে যুদ্ধে আহ্বান করেছেন এবং অনেকক্ষণ যুদ্ধের পর যুদ্ধের চরম মুহূর্তে যে ঘটনাটা ঘটল, সেটাকে আমাদের ছোটবেলার বুড়োদের ছাতার বাঁটের কৌশল বলা যেতে পারে। আমাদের বুড়োরা যেমন ছাতা বা নিজস্ব লাঠির বাঁকানো বাঁট গলায় লাগিয়ে অন্যকে টেনে আনতেন, বলরামকে দেখছি— তিনি যুদ্ধস্থলে দরদের গলায় হল সংযোজন করে নিজের দিকে টেনে এনে— যোজয়িত্বা ততঃ স্কন্ধে— বাঁ-হাতের মুষল দিয়ে তাঁর মাথায় এমন আঘাত করেছেন যে, তাঁর মাথা শরীরের মধ্যে ঢুকে গিয়েছিল— হলেন বলিনাং শ্রেষ্ঠো মুষলেন ব্যপোথয়ৎ।

অসাধারণ এই অস্ত্র-ব্যবহারের কৌশল দেখে আমাদের তাই বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করে যে, অস্ত্র হিসেবে লাঙল আর মুষলের প্রযুক্তিটুকু বলরামের নিজস্ব উদ্ভাবন। তিনি ব্যতিক্রমী মানুষ, শৌখিন এবং রসিক মানুষ। তাঁর জীবনে ঘটে-যাওয়া ঘটনাগুলিও কেমন বেখাপ্পা এবং অন্যদের থেকে আলাদা। জরাসন্ধের সঙ্গে যুদ্ধে জয়-পরাজয় অথবা পলায়ন-বিদ্রাবন যাই হোক, বলরাম কৃষ্ণের সঙ্গে মথুরায় ফিরে এলেন। সেখানে অনেক আদর-অভ্যর্থনা লাভ করার পর বলরামের মনে হল— একবার সেই ব্ৰজপুর বৃন্দাবনে যাওয়া দরকার। যেখানে এতকাল তিনি ছিলেন, সেই নন্দ গোপ, যশোমতী জননী, সেই গোপ-সখা এবং সখীরাও। কৃষ্ণ তাঁদের নামও করছেন না। তাঁর নিজের জননী রোহিণী এখন মথুরাতেই আছেন পিতা বসুদেবের সান্নিধ্যে। কিন্তু যশোমতী তো রয়েই গেছেন— যিনি কৃষ্ণকে মাতার অধিক স্নেহে লালন করেছিলেন। বৃন্দাবনে গোপ-গোপীদের অজস্র সৌহার্দ্য স্মরণ করে বলরাম ঠিক করলেন— একবার তিনি বৃন্দাবনে ঘুরে আসবেন। কৃষ্ণ এখন ব্যস্ততম মানুষ। শহর মথুরার নানান রাজনীতি, জরাসন্ধের আক্রমণ এবং আরও অনেক কিছু তাঁকে ব্যতিব্যস্ত করে রেখেছে। তাঁর দায়ও অনেক, বলরাম এই কূট রাজনীতি নিয়ে মাথা ঘামান না, সাহায্যের দরকার হলে তিনি এগিয়ে আসেন। ফলে অনেক কাল চলে যাওয়ায় তাঁরই মনে বার-বার ভেসে আসে ব্রজভূমি বৃন্দাবনের স্মৃতি, গোপজনের ভালবাসা— কস্যচিত্ত্বথ কালস্য স্মৃত্বা গোপেষু সৌহৃদম্‌। তিনি আর কালবিলম্ব না করে কৃষ্ণের অনুমতি নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন বৃন্দাবনের পথে।

সময় হিসেবে সেটা খুব মধুর সময় ছিল, সেদিন চৈত্র মাস, বৃন্দাবনের আরণ্য পরিবেশে সদ্য যৌবন আসছে। বিষ্ণু পুরাণ কিংবা ভাগবত পুরাণ যেভাবে ঘটনার সন্নিবেশ ঘটিয়েছে তাতে মনে হবে যেন তখন দ্বারকা-পুরী তৈরি হয়ে গেছে এবং বলরাম দ্বারকা থেকেই বৃন্দাবনে এসেছিলেন। দু’-মাস চৈত্র-বৈশাখ বৃন্দাবনে কাটিয়ে আবার যেন দ্বারকাতেই ফিরে গেছেন— দ্বৌ মাসৌ তত্র চাবাৎসীৎ মধুং মাধবমেব চ। কিন্তু অপেক্ষাকৃত প্রাচীন হরিবংশ ঘাঁটলে দেখা যাবে দ্বারকা-পুরী তখনও তৈরি হয়নি। অনেক ঘটনা সংক্ষিপ্ত করে ফেলার ফলে বিষ্ণু এবং ভাগবত পুরাণের কবিকে একেবারে দ্বারকার কথা বলতে হয়েছে। যাই হোক, মথুরা থেকে বৃন্দাবনে এসে বলরামের মতো আপাত শুষ্ক মানুষও মনে মনে যথেষ্ট আপ্লুত বোধ করলেন। পূর্বের যত স্মৃতিকল্প— সেই বিশদ উদার অরণ্যভূমি, সেইসব শান্ত স্নিগ্ধ সরোবর, সেই চেনা-চেনা আরণ্যক সুরভি— ভুক্তপূর্বাণ্যরণ্যানি সরাংসি সুরভীনি চ— বলরাম আর মথুরার নাগর-জনের বেশ-বাস পরে থাকতে পারলেন না। বৃন্দাবনের ব্রজভূমিতে ঘুরে বেড়ানোর যোগ্য বেশ পরিধান করে তিনি সোৎকণ্ঠে ঢুকে পড়লেন চেনা পাড়ায়।

সরল সহজ প্রভু বলরাম ব্রজভূমে প্রবেশ করার আগে তেমন করে অনুভব করেননি যে, এখানে আসার যন্ত্রণা অনেক। আসার আগে তিনি এমন করে বোঝেননি যে, এখানে তাঁর ছোট ভাই কৃষ্ণ কী অসম্ভব মায়া ছড়িয়ে রেখে গেছেন। তথ্যপ্রিয় তথা খানিকটা নির্মোহ হরিবংশ ঠাকুর বলরামের প্রসঙ্গে এই সব আবেগসিক্ত কণ্ঠস্বর সযত্নে এড়িয়ে গেছেন, কিন্তু অতি-প্রাচীন বিষ্ণুপুরাণ এবং ভাগবত পুরাণ অতি-স্বাভাবিক এইসব আলাপন এবং প্রশ্ন-প্রত্যুত্তরগুলি কিছুতেই বাদ দিতে পারেনি। সরল গোপজন, পালক পিতা-মাতা এবং অন্য-অন্যতরা গোপবধূরা— এদের সবার কাছে কৃষ্ণের অনুপস্থিতি যে কতটা— এটা বোধহয় বলরাম বুঝতেও পারেননি। কৃষ্ণ যেখানে আসার সাহসই পেলেন না, সেই মাটিতে পা বাড়াতে গিয়ে বলরাম যে এতটা বিব্রত হবেন, তা বুঝি সত্যিই তিনি বুঝতে পারেননি।

এই যে প্রথম দেখা হল— নন্দ বাবা এবং জননী যশোমতীর সঙ্গে— বলরাম তাঁদের চরণবন্দনা করতেই তাঁরা প্রাথমিক আশীর্বাদ করলেন বটে, কিন্তু ব্রজভূমির আদরের নাম— বলাই-কানাই বলে নন্দ-যশোমতী সম্বোধন করলেন না তাঁকে। সম্বোধন করলেন যদু-বৃষ্ণিকুলের এক সম্মানিত পুরুষের নামে। বললেন— দাশার্হ! অর্থাৎ সেই সেই বিখ্যাত দশার্হ-রাজবংশের ছেলে তুমি। তা তুমি আর তোমার ছোট ভাই— নন্দ-যশোমতী স্বাভিমানে কৃষ্ণের নামটাও উচ্চারণ করলেন না— বললেন তুমি আর তোমার ছোট ভাই, লোকে তা এখন তোমাদের জগদীশ্বর বলে ডাকে— তা তোমরা আমাদেরও একটু সুরক্ষা দিয়ো, আমরাও যেন বেঁচে থাকতে পারি তোমাদের দয়ায়— আবাং নঃ পাতু দাশার্হ সানুজো জগদীশ্বরঃ।

বলরাম এবং কৃষ্ণ— এঁরা যে কোনওদিন বড় হতে পারেন এবং এঁরা যে অনেক কিছু করে দেখাতে পারেন এমন ঈশ্বরবুদ্ধি নন্দ-যশোমতীর মনে-মনেও ছিল না। সেই তাঁদের লোকে বড় বলছে, নেতা বলে লোকে মস্তকে স্থান দিচ্ছে এমনটি তাঁদের পক্ষে ভাবনা করা সম্ভব নয়। বিপুল বাৎসল্য-বোধে নন্দ-যশোমতী শুধু এইরকমই ভেবে এসেছেন যে, বাবা-মায়ের সাহায্য এবং সুরক্ষা ছাড়া কৃষ্ণের মতো আবদারি ছেলে বেঁচে থাকতেই পারবে না। আর সেই কৃষ্ণ কিনা এখন মথুরাবাসী যদু-বৃষ্ণিদের ত্রাতার ভূমিকায়। বলরামকে তবু তাঁরা একটু অন্য চোখে দেখেন, বিশেষত রোহিণী গর্ভবতী অবস্থায় অন্য দেশ থেকে এসেছিলেন বলে তাঁর পরিচয় অজ্ঞাত ছিল না। কিন্তু কৃষ্ণের সঙ্গে বলরামকেও তাঁরা কম স্নেহ দেননি। অথচ আজ তাঁরা কেউ আর ব্রজভূমির বাসিন্দা নন, তাঁরা মথুরাপুরীর নাগর-সভ্যতার নায়ক, রাজনীতির ধুরন্ধর— কোলের ছেলে বড় লায়েক হয়ে গেছে। আর ঠিক সেই জন্যই পিতা-মাতার মনে। এত অভিমানের কথা— ওদের সঙ্গে আমরাও যেন তোমার এবং তোমার ছোটভাইয়ের সুরক্ষা পাই— আবাং নঃ পাতু দাশার্হ সানুজো জগদীশ্বরঃ॥

সরল বলরাম নন্দ-যশোমতীর কথা শুনে কেমন বোকা বনে গেলেন, যাঁরা এই সেদিন গোধন চরিয়ে ঘরে ফিরলে লক্ষ লক্ষ চুম্বনে গাল ভরিয়ে দিতেন, সেই তাঁরা কেমন দূর থেকে কথা বলছেন। মুখে কানাই-বলাই সম্বোধন নেই, বলছেন— দাশার্হ। বলছেন— তোমার ছোট ভাই, সে তো এখন জগদীশ্বর। বলরাম একেবারে স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। নন্দ-যশোমতীও বুঝতে পারলেন বলরামের অবস্থা। আর সত্যিই তো বলরামের কী দোষ, তিনি তো তবু খোঁজ-খবর নিতে চলে এসেছেন প্রাণের টানে। কিন্তু কৃষ্ণ! তার তো কোনও হুঁশও নেই। অতএব স্বাভিমান উক্তির পরেই এই দুই প্রৌঢ় মানুষ বলরামকে কোলে বসিয়ে আদরে, সোহাগে, চোখের জলে ভরিয়ে দিয়েছেন। মুহূর্তের মধ্যে বলরাম বুঝতে পারলেন— কৃষ্ণকে ছাড়া এখানে একা-একা আসা তাঁর ঠিক হয়নি।

নন্দ-যশোমতীর বাষ্পালিঙ্গন থেকে মুক্ত হয়ে বলরাম একে-একে বৃন্দাবনের গোপ-বৃদ্ধদের সঙ্গে দেখা করলেন সসম্মানে, ব্রজের অন্য মানুষ, যাঁরা তাঁর চেয়ে ছোট, তাঁদের অভ্যর্থনার সঙ্গে সঙ্গে বলরাম তাঁর কিশোর বয়সের বন্ধুদের হাতে হাত রেখে জড়িয়ে ধরলেন তাঁদের— সমুপেত্যাথ গোপালান্‌ হাস্যহস্তগ্রহাদিভিঃ! কিন্তু তাঁদের মধ্যে থেকেও কি সেই আগের উষ্ণতা উঠে আসছে? একটু স্থির হয়ে বসতেই— তাঁরা জিজ্ঞাসা করছেন— আমাদের যাদব-কুলের আত্মীয়-স্বজনরা সব ভাল আছেন তো? আর তুমি এবং কৃষ্ণ, তোমরা সব তো এখন বিয়ে-থা করে ছেলেপিলে নিয়ে সুখে আছ, আমাদের কথা মাঝে মাঝে মনে পড়ে তো— ক্বচিৎ স্মরথ নো রাম যূয়ং দারসুতান্বিতাঃ।

কোথায় বিয়ে, কোথায় স্ত্রী, আর কোথায় ছেলেপিলে? বলরাম এবং কৃষ্ণ কেউই এখনও পর্যন্ত বিয়ে-থা করেননি, কিন্তু তবু তাঁর বালক বয়সের বন্ধুরা এত কথা বলে যাচ্ছে। এসব কথার কী উত্তর দেবেন বলরাম? অনেকদিন শহরে কাটিয়ে গ্রামে ফিরলে বুঝি এমন ধরনের কথা শুনতেই হয়। বলরাম কোনও উত্তর করলেন না। ওরা বলেই চলল— ভাগ্যিস কংসের মতো বদমাশ লোকটা মারা পড়েছে তোমাদের হাতে, ভাগ্যিস শত্রুরা সব পরাজিত, আর ভাগ্যিস তোমরা সব মথুরার দুর্গের মধ্যে ছিলে— দিষ্ট্যা কংসো হতঃ পাপো দিষ্ট্যা মুক্তা সুহৃজ্জনাঃ। এসব কথার উত্তরে কী বলবেন বলরাম? সপ্তাঙ্গ রাষ্ট্রের বিশাল রাজনীতির এরা কী বুঝবে! আর কোথায় সব শত্ৰু পরাজিত হয়ে গেল? জরাসন্ধের মতো পরাক্রান্ত নৃপতি তাঁদের সংগ্রামের অনীপ্সিত ক্ষুধাটুকুও মিটিয়ে দিচ্ছেন বারবার। দুই ভাইকে পালিয়ে পালিয়ে বেড়াতে হচ্ছে।

কিন্তু এইসব কূট রাজনৈতিক তত্ত্ব-বিস্তার এই সরল গোপজনেরা বুঝবেন কী করে? বলরামও এ বিষয়ে তেমন কোনও উত্তর করলেন না। বরঞ্চ হরিবংশে ব্রজপুরের স্থবির গোপেরা যেমন বলেছিলেন— তোমাদের সব রাজনৈতিক ক্রিয়াকলাপের খবর আমরা রাখি— কংস-বধ, জরাসন্ধের আক্রমণ— এমনকী দরদ-দেশের রাজাকে যেভাবে তুমি মেরেছ, সব আমরা জানি— এই সব কথা একটু অস্বাভাবিকই বটে, কেন না বৃন্দাবনের গ্রাম্য পরিবেশ মথুরা নগরের রাজনৈতিক ইতিবৃত্ত তেমন কোনও খবর সৃষ্টি করে না। বরঞ্চ এই কথাটা বেশ ভাল— স্থবির-বৃদ্ধেরা বলেছিলেন— আজকে তুমি এখানে এসে আমাদের গৌরব বাড়িয়ে দিয়েছ, ঘরের ছেলে শহরে গিয়ে বড় মানুষ হয়ে গ্রামে ফিরে এলে গ্রাম্যজনের যে গৌরব বোধ হয় সেইরকম। তা ছাড়া এও তো ঠিক— যেখানে জন্ম হয়েছে, যেখানে মানুষ লালিত হয়ে বড় হয়, সেই জায়গায় ফিরে আসতে চায় বারবার— অথবা প্রাণিনস্তত রমন্তে জন্মভূমিষু।

হরিবংশে স্থবির-বৃদ্ধদের কথার উত্তর দিয়ে বলরাম সুবক্তার মতো বলেছিলেন— মথুরার যাদব-বৃষ্ণিরা আমাদের যত বড় কাছের আত্মীয়ই হোন না কেন, আমাদের প্রকৃত আত্মীয় হলেন আপনারা। তা ছাড়া এইখানে আমাদের বাল্যকাল কেটেছে, কত না শৈশব-কৌমারের খেলা এখানে খেলেছি— ইহাবয়োৰ্গতং বাল্যমিহ চৈবায়ো রতম্‌। আপনারা আমাদের বড় করে তুলেছেন এইখানেই এবং আমরাও কিছু অন্যরকম হয়ে যাইনি এখন। বলরাম নিজেকে গ্রাম্যজনের কক্ষাতে নামিয়ে এনে তাঁদেরই মনের মতো করে আরও বললেন— এইখানে আপনাদের ঘরে ঘরে আমরা কত খেয়েছি, আপনাদের গোরুগুলি বন-বনান্তরে চরিয়ে এনেছি আমরা— গৃহেষু ভবতাং ভুক্তং গাবশ্চ পরিরক্ষিতাঃ— আপনারা যেভাবে আমাদের ভালবেসেছেন, তাতে আপনাদেরই পরম আত্মীয় বলে আমরা মনে করি।

হরিবংশ ঠাকুরের জবানীতে গোপ-বৃদ্ধদের সঙ্গে বলরামের এইসব উত্তর-প্রত্যুত্তর শুনছি। এও দেখছি যে, বলরামের সম্বন্ধে গোপজনের আপাতত যে গৌরববোধ আছে, বলরাম তা সবিনয়ে প্রত্যাখ্যান করার চেষ্টা করছেন মাত্র। কিন্তু মহাভারত-পুরাণের বিচিত্র দৃষ্টিতে আমরা যারা ঐতিহাসিক চরিত্রেরও মন বিচার করি, তারা জানি— গ্রাম্য গোপজনের কাছে এইসব ভব্য কথার স্থান নেই, এমনকী এতসব উক্তি-প্রত্যুক্তিও যে প্রায় অসম্ভব, তা চৈতন্যপন্থী ভক্তজনেরাও স্বীকার করবেন। বিশেষত কৃষ্ণ-বিরহিত ব্রজজনের মনোভূমির সম্যক বিচার যদি করা যায়, তবে ভাগবত পুরাণে তথ্যগুলিই সবচেয়ে বেশি সার্থক এবং সপ্রমাণ হয়ে উঠবে। সবচেয়ে বড় কথা— হরিবংশ ঠাকুর কৃষ্ণ-বলরামের ঐশ্বর্যভাবনায় অতিভাবিত ছিলেন বলেই গোপ-বৃদ্ধদের কথায় বলরাম এবং কৃষ্ণ সম্বন্ধে এত গৌরববোধ, এত মাননীয়তা এবং এত বহুমান। অথচ ভাগবত পুরাণে সামান্য যতটুকু প্রশংসা-বাক্য বলরাম এবং কৃষ্ণ সম্বন্ধে উচ্চারিত হয়েছে নন্দ-যশোদার মুখে, তার মধ্যে যতটুকু বহুমান আছে, তার চেয়ে অনেক বেশি আছে অভিমান এবং তির্যক অধিক্ষেপ। সেই স্বাভিমান সপ্রেম তিরস্কারের সামনে দাঁড়িয়ে বলরামের পক্ষে একটি কথাও বলা সম্ভব হয়নি এবং আমরা মনে করি, এইটাই সবচেয়ে স্বাভাবিক।

কতটা স্বাভাবিক এবং কৃষ্ণ ব্যতিরেকে বৃন্দাবনে আসার ফলে কতটা অভিমান-অধিক্ষেপ জুটতে পারে, সে কথা বলরাম বুঝলেন, যখন ব্রজভূমির গোপরমণীদের সঙ্গে দেখা হল তাঁর। এমন একটা দৃশ্যকল্প হরিবংশ ঠাকুর তাঁর প্রতিবেদনী শুষ্কতায় ধরতেও পারেননি, কিন্তু প্রাচীন বিষ্ণু পুরাণ এই মর্মন্তুদ কথালাপটুকু সঠিক বর্ণনা করেছে, আর শ্রীমদ্‌ভাগবতের কবি সেটা পোঁছে দিয়েছেন বক্রোক্তির ব্যঞ্জনায়। দুই পৌরাণিকের সরসতায় ব্যাপারটা এইরকম দাঁড়ায়। বলরাম সহজে সকৌতুকে কথা বলছিলেন হয়তো বা সমান বয়সি গোপজনের সঙ্গে, এমনকী গোপিনীকুলের সঙ্গেও, হাসছিলেনও মাঝে মাঝে প্রসঙ্গত— হাস্যঞ্চক্রে সমং কৈশ্চিদ্‌ গোপৈর্গোপীজনৈস্তথা। কিন্তু গোপীদের মধ্যে নানান ভাগ ছিল, শ্রেণিও ছিল নানারকম বলরামের পুরুষ-বন্ধু বয়স্যরা যখন রসিকতা করছেন তাঁর সঙ্গে, সেই সময়ে গোপিনীকুলের কেউ কেউ— তাঁরা অবশ্যই কৃষ্ণুপ্রিয়া বটে— তাঁরা মনে মনে ক্রুদ্ধ হয়েই রইলেন, কথাই বললেন না কোনও। আর এক দল একটু ঈর্ষা সহকারে কথা বললেন কিছু কিছু। কথাটা এইরকম যে, বলরাম তবু আসার সময় পেলেন, কিন্তু কৃষ্ণের আর সময় হল না— গোপ্যশ্চ প্রেমকুপিতাঃ প্রোচুঃ সেৰ্ষ্যমথাপরাঃ।

এই পর্যন্ত অসহনীয় ছিল না বলরামের কাছে। কিন্তু এইবার কোনও মুখরা গোপিনী— তাঁরা রাধা পক্ষপাতিনী হবেন নিশ্চয়, তাঁরা বললেন— কেমন সুখে আছেন আমাদের কৃষ্ণ? মথুরা-নগরের সেই মেয়েগুলো, যারা চোখ ঘুরিয়ে মন ভোলায়, শহুরে জামাকাপড় পরে উত্তেজক যত, তাদের প্রেমে পড়েছেন নাকি আমাদের কৃষ্ণ? তবে কৃষ্ণ তো! আমাদের অভিজ্ঞতা যথেষ্ট, তাঁকে এখন চঞ্চল প্রেমের একটা ছোট্ট খণ্ড বলে মনে হয়— ক্বচিদাস্তে সুখং কৃষ্ণশ্চলৎপ্রেমলবাত্মকঃ— তবু জিজ্ঞাসা করি— সেই সব মথুরা নাগরীদের সঙ্গরসে ভাল আছেন তো কৃষ্ণ? শহুরে মেয়েদের সঙ্গে মিশে মিশে এখন নিশ্চয়ই আমাদের কথাবার্তা, ব্যবহারগুলি তাঁর গ্রাম্য বলে মনে হয় এবং নিশ্চয়ই সেই নাগরীদের কানে কানে এমন কথা বলেনও যে— কী গেঁয়ো ভূত সব, কাদের সঙ্গে মিশেছি এতকাল— অস্মচ্চেষ্টামুপহসন্‌ ক্বচিন্ন পুরযোষিতাম্‌?

এত অভিমান আর ঈর্ষা জ্ঞাপন করার সঙ্গে সঙ্গেই কিন্তু গোপিকা-সমাজ আপন প্রকৃতিতে ফিরে এলেন। জিজ্ঞাসা করলেন— আচ্ছা! কৃষ্ণ কি এখনও কোনও কথাপ্রসঙ্গে স্মরণ করেন আমাদের? আমরা সেই রাসনৃত্যের সময় কত গান করে ডেকেছিলাম তাঁকে, সে সব কথা কি এতটুকুও মনে আছে তাঁর— কচ্চিৎ স্মরতি নঃ কৃষ্ণো গীতানুগমনং কলম্? গোপীরা লজ্জা পেলেন একটু, ভাবলেন— নিজেদের কথা নাই বা বললাম এবং তার পরক্ষণের প্রশ্ন— আচ্ছা! ছেড়ে দিন আমাদের কথা। কেমন স্বার্থপর মানুষ তিনি? মা-বাবার কথাও তো লোকের মনে পড়ে! কী মনে হয় আপনার, জননী যশোমতীকে দেখার জন্যও কি একবারও তিনি আসতে পারেন না এখানে— অপ্যসৌ মাতরং দ্রষ্ট্রং সকৃদপ্যাগমিষ্যতি?

বলরাম দুঃখবোধ করছেন নিশ্চয়। কৃষ্ণের কাছে অনুমতি নিয়েই তিনি এখানে এসেছিলেন। এ রকম যে পরিস্থিতি হতে পারে, সে কথা ঘুণাক্ষরেও তিনি জানাননি, আর তিনি নিজেও বোধহয় প্রেম-ভালবাসার এইসব দুরূহ সূক্ষ্ম গতি-প্রকৃতি তেমন করে বোঝেন না। হয়তো সেইজন্যই গোপিনীরা এবার একটু কারণ দেখিয়েই বললেন— আমরা মা-বাবা, ভাই-বোন এমনকী স্বামী-পুত্র ছেড়ে যাঁর জন্য পথের ধুলোয় নেমে এসেছিলাম, সেই তিনি আমাদের সমস্ত প্রেম-সৌহার্দ্যের বন্ধন ছিন্ন করে দিয়ে চলে গেলেন মথুরায়। আর আমাদের মতো মেয়েরা, সারা জীবন যারা তাঁর কথায় শুধু বিশ্বাসই করে এসেছে, তারা কী করে তাঁর মুখের কথাগুলি অবিশ্বাস করবে— তিনি তো বলেছিলেন— এই কংস-বধ করেই ফিরে আসব আমি— কী করে অবিশ্বাস করব তাঁর কথা— কথাং তাদৃশং স্ত্রীভির্ন শ্রদ্ধীয়েত ভাষিতম্‌! আমাদের এখন সত্যিই ভাবতে অবাক লাগে যে, মথুরার বুদ্ধিমতী শহুরে মেয়েগুলো এমন কৃতঘ্ন পুরুষের কথা বিশ্বাস করছে কী করে— কথং নু গৃহ্নন্ত্যনবস্থিতাত্মনো/ বচঃ কৃতঘ্নস্য বুধাঃ পুরস্ত্রিয়ঃ। নাকি নগর মথুরার মেয়েগুলোও নিশ্চয় কামুকী, তা নইলে ওই বিচিত্রভাষী কৃষ্ণের মধুর হাসি দেখে ভুলবে কেন তারা?

গোপিকা-সমাজের মধ্যে অনেকেই ছিলেন, যারা এতক্ষণ এই স্পষ্টাস্পষ্টি কথায় অস্বস্তি বোধ করছিলেন। যাঁর সঙ্গে তাঁদের ভালবাসা, সেই মানুষটাই যখন আসেনি তখন তার বড় ভাইকে জিজ্ঞাসা করে কী লাভ! সেইজন্যই বোধহয় এমন একটা ধাক্কা দিয়ে সম্বোধন করলেন তাঁরা। বললেন— কৃষ্ণ ছাড়া বলরাম তুমি? কী মূল্য তোমার আমাদের কাছে! আমাদের অন্য কথা বলাই ভাল। আমাদের ছেড়ে গিয়ে তাঁর যদি সময় কেটে যায়, তবে তাঁকে ছাড়াও আমাদের সময় কেটে যাবে— যাত্যম্মাভিৰ্বিনা কালো যদি তস্য তথৈব নঃ।

বলরাম বুঝলেন— এমন প্রেম তিনি কোনওদিন দেখেননি, এমন প্রেম তিনি তেমন বোঝেনও না। অতএব খুব বেশি কথার মধ্যে না গিয়ে তাঁর ছোট ভাইটি সত্যি কী অবস্থায় আছেন এবং সত্যি কেন তিনি আসতে পারছেন না, তা বুঝিয়ে বললেন সবিস্তারে। সান্ত্বনার কথাও বললেন অনেক এবং হয়তো এও বুঝলেন যে— এদের বুঝিয়ে কোনও লাভ নেই। ঠিক সেই জন্যই বলরামের বাক্যের মধ্যে অনুনয় ছিল, বিনয় ছিল এবং ছিল বিরহ-কাতরা রমণীকুলের প্রতি সহমর্মিতা, সবার শেষে ছিল কৃষ্ণের সম্বন্ধে অফুরান সংবাদ— সন্দেশৈঃ সাম-মধুরৈঃ প্রেমগর্ভৈরগর্বিতৈঃ।

কৃষ্ণের জন্য ব্যাকুল রমণীদের ছেড়ে কোনও ক্রমে সরে এলেন বলরাম। এমন সাংঘাতিক পরিস্থিতিতে তিনি কোনওদিন পড়েছেন বলে মনে পড়ে না তাঁর। বলরামের বাল্যসখা বন্ধুরাই তাঁকে টেনে নিয়ে এলেন নিজেদের পরিসরে। বলরাম ঘুরতে লাগলেন তাঁদের সঙ্গে, বনে বনান্তরে। গাঁয়ের বন্ধুরা শুনেছে— তাঁদের শহুরে নায়ক এখন মদ্যপান অভ্যাস করেছেন। তাঁরা সময় বুঝে মানুষ দেখে উৎকৃষ্ট মদ্যের ব্যবস্থা করলেন, বারুণী মদ্যের ব্যবস্থা— গোপালৈর্দেশকালজ্ঞৈরুপানীয়ত বারুণী। বারুণী তো উৎকৃষ্ট মদ্যের সাধারণ নাম, তার মধ্যেও বিশেষ আছে। বিষ্ণুপুরাণ বলেছে— এই বারুণী হল সেই কাদম্বরীই বটে, যা বৃন্দাবনের কদম্ব-কোটর থেকে তৈরি হয়েছে— বৃন্দাবন-বনোৎপন্ন কদম্ব-তরু-কোটরে। বৃন্দাবনে এসেও পুরাভ্যস্ত মদিরার গন্ধ আঘ্রাণ করে বলরাম আর থাকতে পারলেন না— আঘ্রায় মদিরাতৰ্ষমবাপাথ পুরাতনম্‌। তিনি গোপ-গোপীদের সঙ্গে নিয়ে একের পর এক মদিরা পাত্র গ্রহণ করতে লাগলেন— পপৌ চ গোপ-গোপীভিঃ সমবেতো মুদান্বিতঃ।

একটা প্রশ্ন উঠেছে— বলরামের মদ্যসঙ্গী হিসেবে তাঁর পুরাতন গোপালক বন্ধুরা ছিলেন, তাতে অস্বাভাবিকতা কিছু নেই। কিন্তু এখানে বেশ কিছু রমণীদেরও দেখছি তো, এঁরা কারা? অবশ্যই তাঁরা কৃষ্ণ-সঙ্গিনী সেই রমণীরা নন। বলরামকে দেখছি— এবং স্বয়ং ভাগবত পুরাণ তথ্য দিচ্ছে যে, তিনি ইষ্টা প্রেয়সীদের সঙ্গে একত্রে মদ্য পান করছিলেন— আঘ্রায়োপগতস্তত্র ললনাভিঃ সমং পপৌ। এ-কথাও মানতে হবে যে, এটা শুধুমাত্র মদ নিয়ে বেসামাল হওয়ার বন্য আসর ছিল না। এখানে গান আর সুরের মূৰ্ছনা ছিল, ছিল নৃত্য, গীত, বাদ্যের একত্র বিলাস। সেই সমস্ত গোপবনিতাদের সঙ্গে নৃত্য-গীত বিহারে কী সুন্দর দেখাচ্ছিল ঈষৎ মদবিহ্বল বলরামকে। সেই তাঁর কানে, বলা উচিত— এক কানে বজ্ৰমণির কুণ্ডল— যা এখনও আধুনিকতম কর্ণসজ্জা, গলায় নয় রকম ফুল দিয়ে গাঁথা বৈজয়ন্তী মালা— স্রগ্বী-এককুণ্ডলো মত্তো বৈজয়ন্ত্যা চ মালয়া। বলরাম নৃত্য করছেন গোপিকা-রমণীদের সঙ্গে, সময়টা কিন্তু দিন নয়, বৈকাল নয়, একেবারে রাত্রি। কেন না ভাগবত পুরাণ বলেছে— চৈত্র-বৈশাখ যে দুই মাস বলরাম বৃন্দাবনে ছিলেন, তখন রাত্রিতে তিনি ক্রীড়া করেছেন গোপরমণীদের সঙ্গে— রামঃ ক্ষপাসু ভগবান্ গোপীনাং রতিমাবহন্‌।

বললাম তো— এ সব ব্যাপার নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে এবং প্রচুর আলোচনাও হয়েছে। সারাৎসার যে কথা নির্ধারিত হয়েছে বৈষ্ণব সজ্জনদের বচনে— সেটা হল— কৃষ্ণের মতো বলরামও এক সময়ে রাসক্রীড়ায় মেতেছিলেন। বৈষ্ণব-তত্ত্ব বললাম বলেই কথাটার মধ্যে বিশেষ সম্প্রদায়ের বিশেষ অনুভব আছে বলে মনে হতে পারে। কিন্তু সোজা কথায় বলি— এই ঘটনা লৌকিক দৃষ্টিতেও কিছু অসম্ভব ব্যাপার নয়। বৃন্দাবনের ব্রজভূমি সম্বন্ধে যে বিস্তীর্ণ পরিচয় আমরা হরিবংশ, বিষ্ণুপুরাণ এবং ভাগবত পুরাণে পাই, তার নিরিখেই এইচ. এইচ. ইঙ্গলস্‌ সাহেবের অসাধারণ গবেষণা ছিল। তিনি লিখেছেন— অন্তত প্রাচীন হরিবংশ ঠাকুর যেমন বর্ণনা দিয়েছেন তাতে বৃন্দাবন মানেই আমরা এক ধূসর জগতে প্রবেশ করি। এখানকার পুরুষ-রমণীর ব্যবহারে কোনও ব্রাহ্মণ্য শুদ্ধতা মানা হয়নি। ফলে এটা বেশ হতেই পারে যে, মাঝে মাঝে এখানে রাতের বেলায় জ্যোৎস্না-ধোয়া অরণ্যভূমির মধ্যে পুরুষ-রমণীর অবাধ নৃত্যগীত হত। ভাসের বালচরিত নাটকে দামোদর কৃষ্ণ নাচতে আসবেন বলে মেয়ে-পুরুষদের আহ্বান করা হয়েছে এবং স্বয়ং বলরাম সেখানে বাজনা-বাদ্যির নিয়ন্ত্রণে আছেন। অতএব নাচ হত মাঝে মাঝেই এবং তাতে যদি কৃষ্ণ তাঁর মনের মতো সঙ্গিনী জোগাড় করে থাকতে পারেন, বলরামই বা তা পারবেন না কেন!

ভাগবত পুরাণে যে রমণীদের আমরা বলরামের সঙ্গে নৃত্য করতে দেখেছি, তাঁদের চরিত্র কৃষ্ণপ্রেয়সীদের থেকে পৃথক, ব্যবহারও পৃথক। পরম্পরা-জ্ঞানী টীকাকারেরা বলরামের এই দ্বৈমাসিক নৃত্য-গীতের সঙ্গিনীদের আচার-ব্যবহার নিপুণভাবে লক্ষ করেই লিখেছেন যে, এঁরা কেউ কৃষ্ণের রাসসঙ্গিনী নন, এঁরা পৃথক এবং নির্দিষ্ট এক রমণী-গোষ্ঠী, যাঁরা বলরামের লীলা-স্বয়ম্বরা হয়েছেন অনেক কাল আগে থেকেই। ভাগবত পুরাণেই দেখা যাবে— দশম স্কন্ধের যে পাঁচ অধ্যায় জুড়ে কৃষ্ণের রাসলীলা বর্ণনা হয়েছে, ঠিক তার পরের অধ্যায়ে দেখা যাচ্ছে— গোপরমণীরা শিবরাত্রির ব্রত পালন করে বাসন্তী রাত্রিতে হোলি-রঙ্গে রঙ্গিনী হয়েছেন কৃষ্ণ বলরামের সঙ্গে। সেই সময়ের এক রাত্রিতে কৃষ্ণ এবং বলরাম উভয়কেই ব্রজরমণীদের মধ্যে নৃত্যগীতে মিলিত হতে দেখছি— বিজহ্রতুর্বনে রাত্র্যাং মধ্যগৌ ব্রজমোষিতাম্‌। দেখা যাচ্ছে— কৃষ্ণপ্রেয়সী রমণীরা এবং বলরামের অভীষ্টা রমণীরা উভয় গোষ্ঠীই এখানে প্রায় মিলেমিশে গেছেন। অপিচ নৃত্য-গীতের উদ্দাম বিলাস-কুতুহল এখানে এতটাই ছিল যে, কখন তাঁদের শরীর থেকে উতলা উত্তরীয়গুলি খসে পড়ে গেছে, কখন যে স্রস্ত হয়ে গেছে মাল্যবদ্ধ কেশভার, তা তাঁরা নিজেরাও জানতেন না— স্রংসদ্দুকূলমাত্মানং স্রস্তকেশস্রজং ততঃ।

সেদিন সকলে মিলেমিশে নাচলেও আজকের পরিস্থিতি আলাদা। কৃষ্ণপ্রেয়সীদের আগেই দেখেছি— তাঁরা কতটা উৎকণ্ঠা নিয়ে কৃষ্ণের কথা জিজ্ঞাসা করছেন বলরামকেই। সেই তাঁরাই এখন মদ্যপান করতে করতে বলরামের সঙ্গে নাচতে আরম্ভ করবেন, এটা হতেই পারে না। বিশেষত আমাদের প্রভু বলরামকেও এমন বেরসিক ভাবার কারণ নেই। তবে তাঁর চরিত্র, তাঁর ব্যবহার এবং তাঁর আচার-আচরণ কৃষ্ণের চেয়ে প্রতিবিশিষ্ট বলেই তাঁর প্রেয়সী রমণীগোষ্ঠীও অন্যরকম। আজ এই বসন্তের চৈতি পবনে বলরাম যখন ফিরেই এসেছেন বৃন্দাবনে, তখন বলরামের মতো করেই তাঁরা মদ্যাসব পান করছেন এবং বলরামের নৃত্যসঙ্গী হয়েছেন তন্ময়ী ভঙ্গিতেই। তবে হ্যাঁ, যমুনার কোল-ঘেঁষা কৌমুদী-গন্ধে আমোদিত যেসব অরণ্যভূমিতে বলরাম নৃত্য করলেন তাঁর প্রেয়সীদের সঙ্গে, সেই প্রেয়সীর গোষ্ঠী যেমন পৃথক, তেমনই বলরাম সযত্নে কৃষ্ণের ব্যবহৃত রাসস্থলী পরিহার করেছেন, হয়তো অনুজের প্রতি এবং তাঁর প্রিয়া রমণীদের প্রতি সম্মানবশত এবং তাঁদের প্রেমভাবের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করেই। এই জায়গাটার নাম রামঘাট অর্থাৎ বলরামের নৃত্যস্থলী। টীকাকার বিশ্বনাথ চক্রবর্তী এই কথাই লিখেছেন তাঁর টীকায়, আমরা তার বঙ্গার্থ পরিবেশন করেছি— কুমুদ্বতীনাং গন্ধবায়ুনা সেবিতে যমুনোপবনে শ্রীরামঘট্টতয়া প্ৰসিদ্ধে স্থলে, কিন্তু যত্র শ্রীকৃষ্ণেন রাসক্রীড়া কৃতা তৎস্থলমপি রামেণ দূরতঃ পরিহৃতম্‌।

শ্রীমদ্ভাগবতে বলরামের ব্যবহার প্রায় কৃষ্ণেরই সমতুল্য দেখে চৈতন্যলীলার ব্যাস বৃন্দাবন দাস সেটাকে ‘বলরামের রাস’ নামেই চিহ্নিত করতে উদ্যত হয়েছেন। আমরা ভাগবত থেকে, বিষ্ণুপুরাণ থেকে যে কথাগুলি উদ্ধৃত করে গোপরমণীদের সঙ্গে বলরামের নৃত্যক্রীড়া পরিবেশন করেছি, ঠিক সেই কথাগুলি ধরেই বৃন্দাবন দাস বলেছেন— দুই মাস বসন্ত মাধব-মধু নামে। হলায়ুধ-রাসক্রীড়া কহয়ে পুরাণে। বস্তুত, তত্ত্বগতভাবে বিষ্ণু-নারায়ণের সঙ্গে যেহেতু কৃষ্ণ এবং বলরামের স্বরূপ-সম্বন্ধ প্রায় একই রকম, তাই কৃষ্ণের রাসক্রীড়ার মতো বলরামের রাসক্রীড়াও বৃন্দাবন দাসের কাছে একই মহিমায় সমুজ্জ্বল। বিশেষত চৈতন্যপন্থীরা যেহেতু নিত্যানন্দ এবং চৈতন্যকে যথাক্রমে বলরাম এবং কৃষ্ণের অবতার বলে মনে করেন এবং যেহেতু বৃন্দাবন দাস নিত্যানন্দের অশেষ কৃপাপাত্র, তাই বৃন্দাবন দাস বলরামের সাহায্য সম্বন্ধে অধিক সচেতন। অতএব ভাগবত পুরাণে গোপিনীসঙ্গে বলরামের অপ্রতুল মিলনবর্ণনা দেখে যাঁরা বলরামকে কৃষ্ণের তুল্যশক্তি মনে করেন না, তাঁদের উদ্দেশে বৃন্দাবন দাসের তীক্ষ বক্তব্য হল— কতকগুলো লোক আছে, যারা নপুংসক গোছের, একমাত্র তারাই ‘বলরামের রাস’ কথাটা মানতে চায় না—

এবে কেহো কেহো নপুংসক-বেশে নাচে।

বোলে “বলরাম-রাস” কোন শাস্ত্রে আছে॥

এখানে ভাগবতের প্রমাণে বৃন্দাবন দাসের সমাধান—

মূর্খে দোষে কেহো কেহো না দেখি পুরাণ।

বলরাম-রাসক্রীড়া করে অপ্রমাণ॥

এক ঠাঁই দুই ভাই গোপিকা-সমাজে।

করিলেন রাসক্রীড়া বৃন্দাবন-মাঝে॥

আমরা ভাগবত পুরাণ থেকে এর প্রমাণ আগেই দেখিয়েছি— যেদিন বাসন্তী পূর্ণিমায় হোলির রাত্রে কৃষ্ণ এবং বলরাম একই সঙ্গে নাচতে নেমেছিলেন গোপরমণীদের সঙ্গে। তা ছাড়া আমাদের লৌকিক দৃষ্টিতে ‘রাস’ ‘হল্লীশক’— এগুলি তৎকালে প্রচলিত নৃত্যপদ্ধতি, তাই বৃন্দাবন দাসের সঙ্গে আমাদের স্বর মেলাতে কোনও আপত্তি নেই। অর্থাৎ, বলরামও তাঁর পূর্বপরিচিতা নিজগোষ্ঠীর প্রেয়সীদের নিয়ে মধু-মদ্য-সহযোগেই রাসনৃত্যে প্রবৃত্ত হয়েছিলেন।

এই যে মদবিহ্বল অবস্থায় গোপ-গোপীদের সঙ্গে নৃত্য-গীত আরম্ভ করলেন বলরাম, এখানে কিন্তু তাঁর স্ত্রীবিষয়িনী ভাবনার চেয়েও আরও একটা বড় ভাবনা আছে এবং সেটাকে ভাবনা না বলে একটা বিরাট ঘটনা বলাই ভাল। অন্তত সচেতন গম্ভীর গবেষকের কাছে সেই ঘটনার তাৎপর্য অনেক বেশি। হরিবংশ, বিষ্ণুপুরাণ এবং ভাগবত পুরাণ— এই তিন জায়গাতেই ঘটনাটি নিবদ্ধ আছে, কিন্তু বোধ হয় সবচেয়ে স্বাভাবিক এবং বাস্তবসম্মতভাবে নিবদ্ধ আছে হরিবংশ পুরাণে। সেখানে দেখছি— বলরাম সানুরাগে মদ্যপান করছেন, এবং তখন ঈষৎ-পীত ‘পাণ্ডুর-প্রভ’ মদ্যধারায় আপ্লুত অবস্থাতেই তাঁর বাল্যকালীন আত্মীয় বন্ধুরা তাঁকে বন থেকে বনান্তরে নিয়ে গেল। বিষ্ণু এবং ভাগবত-পুরাণে এইখানেই গোপীসঙ্গে নৃত্যগীতের কথা আছে; কিন্তু হরিবংশ এই সরস বর্ণনা না দিয়ে বলরামের মদ্যোচ্ছল চেহারার বর্ণনা দিয়েছে। সেই এক কানে কুণ্ডলের অত্যাধুনিক প্রসাধন, পীতবাস, বনমালা, চন্দ্রনার্দ তিলক আর মদ্যপানের অতিরেকে কথঞ্চিৎ বিহ্বল— শিশির সময়ের রাত্রিতে স্বেদসিক্ত অলস চাঁদের মতো লাগছে তাঁকে। শরীরটাও মদের তীক্ষ্ণতায় উষ্ণ হয়ে উঠেছে বেশ। ঠিক এই সময়েই বলরামের মনে হল— স্নান করতে হবে। এমন বেখেয়ালি খেয়াল আমরা দেখেছি— শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের মতো কবিকেই কলেজ স্কোয়ারে স্নান করে কফি-হাউসে এসে বসতে দেখেছি একই বিহ্বলতায়।

সেই আরণ্যক প্রদেশে নদী নেই, হ্রদ নেই, সরোবরও নেই যে, বলরাম স্নান করবেন। তিনি প্রবাহিনী যমুনার উদ্দেশে কণ্ঠ ছেড়ে আদেশ করলেন— যমুনা! আমার স্নান করতে ইচ্ছে করছে, তুমি আমার কাছে এসো শিগগির— আগচ্ছ যমুনে স্নাতুমিচ্ছামীত্যাহ বিহ্বলঃ। নদী ভাবল— দেখুন, আমাদের দেশে যমুনা-গঙ্গা-সরস্বতীর প্রাণ আছে, রূপ আছে, শ্রদ্ধেয়তাও আছে, তাঁরা সব স্বর্ণ-সম্বন্ধে ঐশ্বরিক আবেশে আমাদের ভাবনালোকে বাস করেন— অতএব যমুনা ভাবলেন— মদের ঘোরের ঠাকুর আমার প্রভু বলরাম, কী-না-কী বলছেন মদের ঘোরে! এই প্রলাপোক্তি বিশ্বাস করে নিজের খাত পরিবর্তন করে এই মানুষের কাছে যাওয়া যায় নাকি। তিনি সাবহেলে যেমন প্রবাহিনী ছিলেন, সেই খাতেই বয়ে চললেন— সঙ্কৰ্ষণস্য মত্তোক্তাং ভারতীং পরিভূয় সা।

মানুষ মদের ঘোরে আদেশ করলে, সে কথা না শুনলে তার রাগ হয়। যমুনা তাঁর কথা শুনেও আপন খাতে, আপন পথে চলায় তাঁর রাগ হল— ততশ্চুক্রোধ বলবান্‌ রামো মদসমীরিতঃ। তিনি যমুনাকে নিজের দিকে আকর্ষণ করে আনার জন্য আপন হস্তধৃত লাঙলটি অধোমুখ করলেন। লাঙলের অগ্রভাগটুকুর বাঁকা দিকটি যমুনার তীরে লাগিয়ে নদীতমা যমুনাকে নিজের কাছে নিয়ে এলেন বলরাম, যেন কোনও স্বেচ্ছাচারিণী রমণী পরম স্বেচ্ছাচারে নিজের মতো চলছিল, তাকে সঠিক পথে নিয়ে আসার জন্য এ যেন শাস্তা স্বামীর চরম দণ্ড, তাঁকে আকর্ষণ করে নিজের দিকে নিয়ে আসা— চকর্ষ যমুনাং রামো ব্যুত্থিতাং বনিতামিব। হরিবংশ ঠাকুর যমুনার রূপ বর্ণনা করেছেন যুবতী রমণীর প্রতিরূপে, তাঁর শরীর-সংস্থান, স্তন-জঘনও পর্যন্ত নদী-প্রকৃতির বিচিত্র বর্ণনায় চিহ্নিত, ঠিক যেমন কালিদাসের মেঘদূতেও দেখেছি।

সাগরগামিনী যমুনা বলরামের কাছে চলে আসতে বাধ্য হলেন, নদী বলরামের লাঙল-চিহ্নের খাত ধরে গতি পরিবর্তন করে চলে এল বৃন্দাবনের কাছে। হরিবংশের মতে সেই বাস্তবটা হল— যমুনা নদী বৃন্দাবনের মধ্যভাগ দিয়ে চলতে আরম্ভ করল— বৃন্দাবনস্য মধ্যেন সা নীতা যমুনা নদী। সে বলেছিল— প্রভু আমার! আমাকে তো হলকর্ষণে টেনে আনলেন আপনার দিকে, এবার আমি কোন পথে যাব। বলরাম বললেন— আমি লাঙল দিয়ে তোমার পথ কেটে দিয়েছি, তুমি বৃন্দাবনের প্রদেশ আপ্লাবিত করে সেই পথে চলে যাও সাগরের দিকে, সোজা কথা— বৃন্দাবনকে জল দিতে হবে— দেশম্‌ অম্বুপ্রদানেন প্লাবয়স্বাখিলং শুভে। যমুনা নিজের পূর্বপথ ত্যাগ করে বৃন্দাবনের মধ্যে দিয়ে প্রবাহিনী হল, তাতে বৃন্দাবনের অধিবাসীরা বলরামের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করতে লাগল। বলরাম যমুনাকে বললেন— যতদিন এই পৃথিবী থাকবে, ততদিন আমার এই যমুনাকর্ষণের যশ কীর্তিত হবে পৃথিবীতে— যাবৎ স্থাস্যতি লোকোহয়ং তাবৎ তিষ্ঠতু মে যশঃ।

বলরামের এই যমুনাকর্ষণ আপাতদৃষ্টিতে খানিক অলৌকিক লাগতে পারে। কিন্তু এই ঘটনার পৌরাণিক তাৎপর্য যতখানি, তার চেয়েও অনেক বেশি হল লৌকিক তাৎপর্য। বেশিরভাগ পুরাণই এই ঘটনার উল্লেখ করে বলরামের শক্তি-মাহাত্ম্য বোঝাবার চেষ্টা করেছে, কিন্তু পৌরাণিক এই কাহিনির অন্তরালে প্রাচীনদের নিজস্ব প্রণিধানশক্তিও লুকিয়ে আছে। আমি নিজে এই ঘটনার তাৎপর্য বলতে চাই না, কেন না পরশুরাম রাজশেখর বসুর সহোদর গিরীন্দ্রশেখর তাঁর বৈজ্ঞানিক ভাবনা দিয়ে পৌরাণিকের ভাবকূট যেমন সশ্রদ্ধ প্রশস্ততায় ব্যাখ্যা করেছেন, তার ওপরে আর আমার কথা চলে না। বিশেষত গিরীন্দ্রশেখরের কথা আমি অনেক আগেই বলব বলে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম। এখন তার সময় এসেছে। আমি শুধু তাঁর সাধুভাষা চলিতে রূপান্তর করে একটু সংক্ষেপে সেই বিবরণ দেব। গিরীন্দ্রশেখরের বক্তব্য হল—

বিষ্ণুর তামসী তনু থেকে সঙ্কর্ষণ উৎপন্ন। প্রলয়কারী বলেই এই তনু তামসী। এঁকে শেষ বলা হয়, কারণ প্রলয়কালে তিনি জগৎ-ত্রয় শেষ করেন। ইনি নাগবর, কারণ ইনি পাতাল-সমূহের নিম্নে অবস্থান করেন। ইনি অনন্তবীর্যশালী, এঁর গুণের অন্ত নেই বলেই তিনি অনন্ত। এঁর অগ্নিময়ী সহস্র ফণা। সেই ফণামণির জ্যোতিতে পৃথিবীতল উদ্ভাসিত। এঁর সৌন্দর্য ভীষণ এবং চঞ্চল। কান্তি এবং মদিরা তাঁর উপাসিকা। ইনি নীলবাসা ও মদঘূর্ণিত-লোচন। ইনি স্বস্তিকা বা বজ্র, লাঙল এবং মুষল ধারণ করেন। এইসব বিশেষণ থেকে স্পষ্ট বোঝা যায় সঙ্কর্ষণ ভূগর্ভস্থ অগ্নি। ঋষিগণ বহুস্থানে ভূগর্ভস্থ অগ্নুৎপাত দেখেছিলেন বলেই এমন পৌরাণিক কল্পনা। তাঁদের মতে অগ্নিজাত শক্তিই পৃথিবীর উপরিভাগের কঠিন স্তর ধারণ করে আছে। পৃথিবীর অভ্যন্তর অগ্নিময়। অভ্যন্তরস্থ অগ্নির জৃম্ভণে অর্থাৎ ফণার সংকোচন-প্রসারণে ভূমিকম্প ও আগ্নেয়গিরির উৎপাত— উভয়েই হয়— এটাই পৌরাণিক মত। বাসুকি নাগের দ্বারা পৃথিবী ধৃত হবার এবং তাঁর ফণা কম্পনে ভূমিকম্প হওয়ার প্রকৃত অর্থ এটাই।

এখন প্রশ্ন উঠতে পারে— ভারতের ঋষিরা আগ্নেয়গিরির উৎপাত কোথায় দেখেছিলেন। নানা পৌরাণিক প্রমাণ দিয়ে গিরীন্দ্রশেখর দেখিয়েছেন— সপ্তপাতালের নিম্নতম প্রদেশ বলতে পৌরাণিকেরা ভারতবর্ষের প্রত্যন্ত দক্ষিণ-দেশকেই বুঝতেন। মলয়, যবদ্বীপ, সুবর্ণদ্বীপ, বোর্নিও— এই সব দ্বীপগুলি প্রাচীনদের পরিচিত ছিল। যেহেতু এসব জায়গায় আগ্নেয়গিরি ছিল এবং আছে, পৌরাণিক ঋষিরাও তাই অগ্ন্যুৎপাত সম্বন্ধে অবহিত ছিলেন। গিরীন্দ্রশেখর লিখছেন— এখন যেমন বিজ্ঞানীরা বিভিন্ন বিজ্ঞান শাস্ত্রের অধ্যয়ন ও গবেষণায় নিযুক্ত থাকেন, পুরাকালেও বিভিন্ন ঋষি সেইভাবে বিভিন্ন বিজ্ঞান আলোচনা করে নিজের পর্যবেক্ষণলব্ধ জ্ঞান আহরণ করতেন। আমাদের গর্গমুনি সঙ্কর্ষণের আরাধনা করে জ্যোতিঃশাস্ত্র ও নিমিত্তবিদ্যা অর্থাৎ প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের পূর্বলক্ষণসমূহের জ্ঞান লাভ করেন। আধুনিক ভাষায় বলা যায়, গর্গ ভূকম্পবিদ বা seismologist ছিলেন।

সঙ্কর্ষণ ধ্বংসশক্তি বলেই রুদ্র বা রুদ্রের অবতার। পুরাণে সঙ্কর্ষণেরও অবতার কল্পিত হয়েছে। (ধুন্ধুমার বলে আমরা যে শব্দটি ধ্বংস বা লণ্ডভণ্ড হয়ে যাবার অর্থে ব্যবহার করি, তার পূর্বপদ) ধুন্ধু নামে যে অসুর, সে সঙ্কর্ষণের প্রথম অবতার এবং কৃষ্ণের ভাই বলদেব, বলরাম বা বলভদ্র সঙ্কর্ষণের দ্বিতীয় অবতার ধুন্ধু শব্দ ধূম থেকে নিষ্পন্ন। ধু-ধাতুর অর্থ কম্পন। সঙ্কর্ষণ অবতারের সঙ্গে ধূম এবং কম্পনের যোগও বিচিত্র কল্পনা নয়। বলরাম ধ্বংসকারী প্রবল যোদ্ধা ছিলেন, হল বা লাঙল তাঁর অস্ত্র ছিল, কীর্তিসাদৃশ্যেই হলধর বলরাম সঙ্কর্ষণের অবতার। বলরামের পরবর্তী কালেও যেসব ভূমিকম্প হয়েছে, সেগুলিও বলরামের কীর্তি হিসেবে কথিত হয়েছে। বলরামের বহুকাল পূর্বে এক ভূমিকম্প হয়েছিল, পুরাণে উল্লিখিত সেই ভূমিকম্প ধুন্ধুর কীর্তি।

বিষ্ণুপুরাণ এবং বায়ুপুরাণে ধুন্ধু নামের অসুরটি যা কাণ্ড করেছে, তা ভূমিকম্পের সমস্ত লক্ষণ বহন করে। ধুন্ধুর অত্যাচার নিবারণের জন্য ইক্ষ্বাকুবংশীয় কুবলয়াশ্ব তাঁর একুশ হাজার ছেলেকে পাঠান, সেই পুত্রদের মধ্যে তিন জন ছাড়া সকলেই ধুন্ধুর মুখনিঃসৃত আগুনে পুড়ে মারা যান। গিরীন্দ্রশেখর অনুমান করেছেন— রাজা কুবলয়াশ্ব একুশ হাজার লোক নিয়ে ভূকম্পপীড়িত স্থানে উদ্ধারকার্য চালাচ্ছিলেন, তখন আবার ভূকম্প হয় এবং সেই ভূকম্পজনিত জলপ্লাবনে কুবলয়াশ্বের লোকজন সবাই মারা যায়। কুবলয়াশ্ব যোগ বলে ভূকম্পজনিত অগ্নি নির্বাপন করেন এবং সমস্ত জলও পান করে ফেলেন। এইজন্যই তাঁর অন্য নাম ধুন্ধুমার। কুবলয়াশ্বের রাজত্বকাল ৩৬০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ। এর আগে ভূমিকম্পের কোনও প্রামাণিক বিবরণ নেই।

এবারে বৃন্দাবনে মদিরোন্মত্ত বলরাম যেভাবে লাঙলের ডগা দিয়ে যমুনাকে আকর্ষণ করলেন, তার বিবরণ দিয়ে গিরীন্দ্রশেখর লিখেছেন— বলভদ্র পূর্ববর্ণিত সঙ্কর্ষণের ন্যায় নীলবাস, এক কুণ্ডল, মালা, মুষল ও হলধারী। তিনি মদঘূর্ণিত-লোচন। পাছে কেউ বলভদ্রের প্রকৃত কাহিনি বুঝতে না পারে এইজন্য পুরাণকার সঙ্কৰ্ষণ-এর পুরাকল্প ব্যবহার করেছেন, কারণ বলভদ্র সঙ্কর্ষণের অবতার। বলভদ্র কর্তৃক যমুনাকর্ষণের কথায় বোঝা যায়— ভূমিকম্পের ফলে যমুনার গতি পরিবর্তিত হয়েছিল। এই ভূমিকম্পের আগে বৃন্দাবন যমুনা থেকে অনেক দূরে ছিল। অক্রূর কংসপ্রেরিত হয়ে কৃষ্ণ-বলরামকে নিয়ে যখন রথে করে মথুরায় যাচ্ছিলেন, তখন সকালবেলায় রওনা দিয়ে মধ্যাহ্নকালে যমুনাতটে উপস্থিত হয়েছিলেন।

এটা বিষ্ণু-পুরাণের তথ্য। ক্ষিপ্রগামী অশ্বযুক্ত রথ ঘণ্টায় সাত-আট মাইল পথ যেতে পারে। এই হিসেবে বৃন্দাবন থেকে যমুনার দূরত্ব অন্তত চল্লিশ মাইল ছিল বলে আন্দাজ। আরও চল্লিশ মাইল গিয়ে অক্রূর, বলরাম এবং কৃষ্ণ মথুরা পৌঁছান সন্ধ্যা গড়িয়ে যাবার পর। এই হিসেব মনে রেখে যদি এখনকার হিসেব ধরি, তা হলে ধন্দ লাগবে এইখানে যে, মথুরা থেকে এখন খচ্চর-বাহিত টাঙ্গাতেও এক ঘণ্টা লাগে। তা হলে ব্যাপারটা কী? গিরীন্দ্রশেখরের অনুমান— এখনকার বৃন্দাবন প্রাচীন বৃন্দাবন নয়। যমুনার গতি পরিবর্তিত হওয়ায় প্রাচীন বৃন্দাবন যমুনাগর্ভে চলে গিয়েছিল। মথুরার কাছে নতুন বৃন্দাবন স্থাপিত হয়, যদিও তারও প্রাচীনতা খুব কম নয় এবং যমুনার গতি পরিবর্তনের পরেই সেই বৃন্দাবন যমুনার তটবর্তী হয়ে ওঠে— হয়তো তারই কৃতিত্ব চেপে বসেছে বলরামের ওপর। গিরীন্দ্রশেখর গবেষণা করে দেখিয়েছেন— বলরামের জন্মকাল আনুমানিক ১৪৬০ খ্রিস্ট-পূর্বাব্দ। এই ভূমিকম্প বলরামের জীবিতকালেই হয়েছিল কিনা এবং তার ফলে তাঁরই সময়কালে যমুনার গতিপথ পরিবর্তিত হয়ে বৃন্দাবনের কাছে এসেছিল কিনা, সেটা নিশ্চিত করে বলার উপায় নেই, কিন্তু পরবর্তীকালের অনেক ভূমিকম্পই যেহেতু সংকর্ষণের অবতার বলরামের কীর্তি হিসেবেই চিহ্নিত হয়েছে, তাই বলরামের যমুনাকর্ষণের তাৎপর্যটুকু লৌকিক এবং বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিতে কোনও ভূমিকম্প, জলপ্লাবন, অথবা নিছক নদীর গতি পরিবর্তনের ঘটনা হিসেবেই মেনে নেওয়া ভাল।

॥ ৭ ॥

প্ৰবাহিণী যমুনার গতি পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে আমরাও এই প্রবন্ধের গতি পরিবর্তন করেছিলাম। কিন্তু যমুনা-বৃন্দাবন ছেড়ে আমাদের পুনরায় মথুরায় ফিরতে হবে, অথবা বলা উচিত দ্বারকায়। দ্বারকায় বলছি এইজন্য যে পুরাণগুলির অধিকাংশ ঘটনা-সংক্ষেপ করার তাড়নায় মাঝখানের বিরাট একটা ঘটনা— দ্বারকা-পুরীর নির্মাণখণ্ডটিই বাদ দিয়ে দিয়েছে। আর এ প্রসঙ্গ বাদ দিলে হঠাৎই দেখব— যমুনাকর্ষণ সেরে বলরাম দ্বারকায় ফিরে গেছেন এবং তারপরেই নিতান্ত অপ্রাসঙ্গিকভাবে এই নিরাভরণ মন্তব্য— বলরাম বিবাহ করলেন রেবতীকে এবং তাঁর দুই ছেলে হল, যাঁদের নাম নিশঠ এবং উল্মুক।

আমরা বলি এমন হয় নাকি। মানুষটা দু’-দুটো মাস মথুরায় রইলেন। যেখানে এসেছিলেন, সেই বৃন্দাবনের খবরও তো সেই লোকটাকে দিতে হবে, যিনি তার চূড়-বাঁশি আর শিখিপুচ্ছ ন্যাস রেখে এসেছিলেন গোপিকাকুলের অধিকারে। হরিবংশ ঠাকুর সঠিক এবং বাস্তবসম্মতভাবে মন্তব্য করেছেন— দুই মাস বৃন্দাবনে থাকার পর বলরামের একটু দুশ্চিন্তা হল বটে— জরাসন্ধের আক্রমণের পর পরই তিনি চলে এসেছিলেন, সেখানে রাজনীতির খেলা কী হচ্ছে না-হচ্ছে তিনি জানেন না। অতএব আর দেরি না করে বলরাম ফিরে এলেন মথুরায়— পুনঃ প্রতিজগামাশু মথুরাং রোহিণীসূতঃ। বলরাম ফিরেই কৃষ্ণের ঘরে প্রবেশ করতে গিয়ে দেখলেন— তিনি অর্ধজাগ্রত অবস্থায় নিদ্রালু মানুষের মতো বিছানায় পাশ ফিরছেন।

তখনও বৃন্দাবন থেকে ফিরে আসার পথিক-বেশ তিনি ত্যাগ করেননি। বৃন্দাবনের ফুলে গাঁথা মালা তখনও তাঁর গলায়। সেই অবস্থাতেই তিনি জড়িয়ে ধরলেন কৃষ্ণকে। কৃষ্ণ তাড়াতাড়ি করে বসার আসন এগিয়ে দিলেন তাঁকে এবং খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন— কেমন আছেন তাঁর প্রথমাত্মীয়কল্প ব্রজবাসীরা, কেমন আছে সেই বৃন্দাবনের গোরুগুলি যারা একান্তভাবেই তাঁর বশ ছিল। বলরাম তেমন কিছু বললেন না, বিশেষত কৃষ্ণপক্ষা গোপিনীকুল যেভাবে কৃষ্ণের কথা জিজ্ঞাসা করছিল, সে সব কথা এই পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে বলে কোনও লাভ নেই জেনেই বলরাম বেশ একটু নৈর্ব্যক্তিকভাবে কৃষ্ণকে বললেন, যাঁদের যাঁদের কুশল তুমি কামনা করো, তাঁরা সকলেই কুশলে আছেন বৃন্দাবনে— সর্বত্র কুশলং কৃষ্ণ যেষাং কুশলমিচ্ছসি।

আবারও বলছি— বিষ্ণুপুরাণ, ব্রহ্মপুরাণ যেখানেই দেখুন, খেয়াল করবেন— বলরাম যেই ব্রজভূমি থেকে নবনির্মিত দ্বারকাপুরীতে এসে পৌঁছলেন, অমনি তাঁর বিয়ে হয়ে গেল রৈবত-রাজার মেয়ে রেবতীর সঙ্গে। এ ক্ষেত্রে সংবাদ খুব সংক্ষিপ্ত, শুধু এইটুকুই— বলরাম রেবতের মেয়ে রেবতীকে বিয়ে করলেন— রেবতীং নাম তনয়াং রৈবতস্য মহীপতেঃ। খানিকটা আশ্চর্যই লাগে— কৃষ্ণজ্যেষ্ঠ বলরামের বিয়ে বলে কথা! তাতে কোনও আড়ম্বর নেই। পৌরাণিকের মুখে কোনও কাহিনি নেই, কিছুই অস্বাভাবিক ঘটল না, শুধু বিয়ে হল। পৌরাণিকের ঝুলি যেন খালি হয়ে গেছে।

পরে ভেবে দেখেছি— এই সংক্ষিপ্ত সংবাদের একটা কারণ আছে। পৌরাণিকেরা আপাতত কৃষ্ণকে নিয়ে ব্যস্ত। বৈদর্ভী রুক্মিণীর সঙ্গে কৃষ্ণের বিবাহ-ঘটনার সূত্রপাত ইতিমধ্যেই লিখিত হয়েছে। কালযবনের আকস্মিক আক্রমণে সেই বিবাহ বিলম্বিত হয়েছে। ইতিমধ্যে দ্বারকাপুরী নির্মিত হয়েছে এবং দ্বারকাপুরী নির্মাণের পর পৌরাণিকেরা এবার রুক্মিণী-স্বয়ংবরের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। এরই মধ্যে সূত্রাকারে বলরামের বিয়ের খবর দেবার কারণ একটাই— কৃষ্ণ যত বড় অবতার পুরুষই হোন না কেন, মনুষ্যশরীরে লীলায়িত হলে মনুষ্যবিধি মেনে চলতে হয়। অতএব বংশের বড় ছেলে বলরামের বিয়ের খবর না দিয়ে কৃষ্ণকে ত্বরিতে রুক্মিণীর সঙ্গে বিয়ে দিতে পারেন না পৌরাণিক। তাঁর ঘরেও তা ঘটেনি। ফলত ওই অতি সংক্ষিপ্ত সংবাদ— রেবতীর সঙ্গে বলরামের বিয়ে হল।

আসলে পৌরাণিক কৃষ্ণকথার পরম্পরা রক্ষায় উদ্‌যুক্ত হলেও জ্যেষ্ঠ পুত্রের বিবাহ সম্পর্কিত স্মার্ত মর্যাদা লঙঘন করেননি এবং বলরামের বিবাহকাহিনি তিনি অন্যত্র গেয়ে রেখেছেন এবং সে কাহিনি মহামতি রাজশেখর বসু মশায় এমন অনবদ্য ভঙ্গিতে পুনর্নির্মাণ করেছেন যে, আবারও সেই কাহিনির উচ্চারণ বাতুলতামাত্র। কিন্তু আমরাই বা কী করব! কৃষ্ণের বিবাহের আগে পৌরাণিকের মূল বক্তব্য জানাতে আমরা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। অতএব বিষ্ণুপুরাণে পুর্বোল্লিখিত বলরামের পত্নী-সমাগমের কাহিনি আমাদের বলতেই হচ্ছে।

পুরাণকার এখন কল্পারম্ভে বিভিন্ন বিখ্যাতবংশের পরম্পরা বর্ণনা করছিলেন। সেখানে সূর্যবংশীয় শর্যাতি অথবা শর্যাত্ত নামে যে রাজা আনর্তদেশে অর্থাৎ গুজরাট অঞ্চলে কুশস্থলীতে রাজত্ব করতেন, তাঁরই বংশবর্ণনা করতে গিয়ে রেবত রাজার কথা আসে। রেবতের পত্রের নাম রৈবত ককুদ্মী। একশো ভাইয়ের মধ্যে তিনি ছিলেন সবার বড়। এই রৈবতের একমাত্র কন্যা হলেন রেবতী। রেবতী অসাধারণ সুন্দরী। তাঁকে বিয়ে দেবার ব্যাপারে মহারাজ রৈবত ককুদ্মী অত্যন্ত চিন্তান্বিত হলেন। মনে মনে পরিচিত সুপাত্র রাজাদের কল্পনা করে একজনকেও তিনি নিজ কন্যার অনুরূপ বর হিসেবে ভাবতে পারলেন না। তিনি ঠিক করলেন— মেয়েকে নিয়ে তিনি ব্রহ্মলোকে ভগবান ব্রহ্মার কাছে যাবেন। প্রজাপতি বিধাতা যাঁর সঙ্গে যাঁর মিলন ঘটনা করে রেখেছেন— সেই পাত্রের কথা তিনিই বলে দেবেন, অতএব রেবতীকে সঙ্গে নিয়ে রৈবত ককুদ্মী উপস্থিত হলেন ভগবান ব্রহ্মার কাছে।

কিন্তু ব্রহ্মলোকে গিয়ে রৈবত ককুদ্মী নিজেই আর এক মোহে আকুল হয়ে উঠলেন। ব্রহ্মলোকে তখন হাহা আর হূহূ নামে দুই গন্ধর্ব গায়ক অতিতানে সুর লাগিয়ে দিব্য ধ্রুপদী সংগীত গাইছিলেন। হাহা হূহূ নাম করা গন্ধর্ব-গাইয়ে এবং আমার মতো সাধারণ মানুষের ধারণা— এঁদের উচ্চাঙ্গ সংগীতালাপে— ‘হা’ এবং ‘হূ’ শব্দের তান থাকায় লোকে এঁদের হাহা-হূহূ নাম দিয়েছিল। যাই হোক, ব্রহ্মলোকে মেয়ের সম্বন্ধে কথা বলতে গিয়ে রৈবত ককুদ্মী গন্ধর্ব-গাইয়েদের মোহন গানে একেবারে মোহিত হয়ে গেলেন। তাঁর আর দিন-রাত্রির বোধ থাকল না, মেয়ের পাত্র সম্বন্ধে ভগবান ব্রহ্মাকে দুটো প্রশ্ন করার কথাও তাঁর মনে থাকল না। যুগের পর যুগ পার হয়ে যেতে লাগল, গন্ধর্বদের মধুর সুর শুনে বিভোর হয়ে রইলেন রৈবত ককুদ্মী। পৃথিবীর কথা, পৃথিবী ছেড়ে আসার কথা তাঁর মনেই রইল না। গান যখন শেষ হল, তখন তাঁর মনে হল— এত মধুর গান, উদারা-মুদারা-তারার এমন ধ্রুপদী আরোহণ-অবরোহণ— আরও অনেকক্ষণ চললে ভাল হত। বড় সামান্য সময় যেন মুহূর্তে কেটে গেল— তাবচ্চ ত্রিমার্গপরিবর্তৈঃ অনেক যুগ পরিবৃত্তি স্তিষ্ঠন্নপি রৈবতকঃ শৃণ্বন্ মুহূর্তমিব মেনে।

রৈবত ককুদ্মীর এই গীতমোহের সম্পূর্ণ কাহিনি বিষ্ণুপুরাণে যেভাবে আছে মহাভারতে তা নেই, অন্তত কন্যা রেবতীকে নিয়ে যে কারণে তিনি ব্রহ্মলোকে গিয়েছিলেন, সে কাহিনি মহাভারতে নেই। কিন্তু রৈবত ককুদ্মীর গানের মোহ যে কতখানি ছিল, তা মহাভারতেও সূত্রাকারে আছে এবং সেই সূত্র পূরণ করার জন্যই বিষ্ণুপুরাণ সম্পূর্ণ কাহিনিটি জানিয়েছেন। মহাভারতের সেই জায়গায় পূর্বোত্তরাদি দিকসমূহের বৈশিষ্ট্য বলতে গিয়ে দক্ষিণ দিকের কথা আসল এবং সেই প্রসঙ্গে উঠল রৈবত ককুদ্মীর কথা। বলা হয়েছে— এইখানেই এই দক্ষিণ দিকের মন্দরকুঞ্জগুলিতে, বিভিন্ন ঋষি-মুনির আশ্রমে সামগান চলতে থাকে। সেইসঙ্গে গন্ধর্বরা এমন সুরে সংগীতালাপ করে যাতে মন-বুদ্ধি দুইই যেন মূৰ্ছিত হয়ে পড়ে— গায়ন্তি গাথা গন্ধর্বা চিত্তবুদ্ধিহরা দ্বিজ। ঠিক এইরকম কোনও গানের মুহুর্তেই রৈবত ককুদ্মী এসে পড়েছিলেন সেথায়। সাম গানের সঙ্গে গন্ধর্বগীতের মাধুরীতে তাঁর পার্থিব বোধগুলিও সব লুপ্ত হয়ে গেল— অত্র সামানি গাথাভিঃ শ্রুত্বা গীতানি রৈবতঃ। তাঁর আর বাড়ি ফেরা হল না। কত কাল যে গান শুনতে শুনতে চলে গেল— সে কথা তাঁর খেয়ালই রইল না।

গান শুনে তৃপ্ত রৈবত ককুদ্মী যখন আপন পৃথিবীতে ফিরে এলেন তখন তিনি দেখলেন তাঁর স্ত্রী আর বেঁচে নেই, বেঁচে নেই তাঁর পূর্বতন পরিচিত সচিব-অমাত্যরা, এমনকী যে রাজ্যের তিনি রাজা ছিলেন সেই রাজ্যও এখন অন্যের দখলে চলে গেছে— গতদারো গতামাত্যো গতরাজ্যো বনং গতঃ— মহাভারত বলেছে— এমন একটা অবস্থা দেখে রৈবত ককুদ্মী শেষ পর্যন্ত বনেই চলে গেলেন। মহাভারতের এই সূত্র শুনে এক পৌরাণিক অভিধানকার ভেবেছেন— রৈবত ককুদ্মীর গানের মোহ এমনই যে তিনি গান শোনার জন্যই গৃহ-রাজ্য-স্ত্রীকে ছেড়ে বনে চলে গিয়েছিলেন। এক্কেবারে ভুল ভাবনা। মহাভারতের টীকাকার নীলকণ্ঠ মহাভারতের সূত্র পূরণ করার জন্য অন্যান্য পুরাণ-কাহিনির সামঞ্জস্য বজায় রেখে চলেছেন— রৈবত ককুদ্মী গান শুনতে শুনতে বুঝতেই পারেননি কতটা কাল অতীত হল। ফিরে এসে তিনি দেখলেন— তাঁর অতীত হারিয়ে গেছে— রাজ্য, পরিজন-পরিবার কেউ নেই। সেই দুঃখেই তিনি বনে চলে গেলেন— এমনই তো পুরাণ-কাহিনিতে শোনা যায়— গীতানি শ্রুত্বা অতীতং কালমজানন্‌ ভূলোকে আগত্য দারান্নষ্টান্ জ্ঞাত্বা বনং গত ইতি পৌরাণী কথা।

আমরা ইতিহাস-পুরাণে এমন কথা শুনে থাকি যে, এই মর্ত্যভূমির পরে অন্তরীক্ষে, দ্যুলোকে অথবা পৌরাণিক ভাষায় ভুব-স্বঃ-মহঃ-জন-সত্যলোকে আমাদের এই পৃথিবীর সময় কাজ করে না। অধুনাতন বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব সময়ের আপেক্ষিকতা নিশ্চয়ই তাঁদের জানা ছিল না এবং আমাদের তুলনায় পিতৃলোক, ব্রহ্মলোকের অতিমানুষ প্রাণীরা কোনও গতির মধ্যে অবস্থিত ছিলেন কিনা— সে কথাও আমাদের জানা নেই, কিন্তু পৌরাণিকেরা তাঁদের নিজস্ব দার্শনিক-বৈজ্ঞানিক বুদ্ধিতে এক ধরনের সময়ের ফারাক কল্পনা করতেন। যার জন্য এখনও দেখবেন— পিতামাতার শ্রাদ্ধের পর এক বৎসর পর আমরা যে সপিণ্ডকরণ করি— সেটা প্রয়াত পিতৃকুলের এক দিন মাত্র। অর্থাৎ সপিণ্ডকরণের দিনে তাঁদের দৈনন্দিন অন্ন-জল প্রদান করা হয় এই ভাবনায় যে, আমাদের এক বৎসরে তাঁদের এক দিন মাত্র হয়। রৈবত ককুদ্দীর ব্রহ্মলোক বা কোনও পিতৃলোকে গতিশীল ভ্রমণের মধ্যে দিয়ে পুরাণকার এক ধরনের যুগ-পরিবৃত্তির আভাস দিচ্ছেন। এটা একটা পৌরাণিক কনসেপট।

তবে এখানে আরও একটা পৌরাণিক ইঙ্গিতের অবসর আছে, যেটা খুব বাস্তবভাবেই ব্যাখ্যা করা যায় এবং সেই বাস্তবের মধ্যে পুরাতন যুগের পুরাতন রাজার সঙ্গে সম-সাময়িকের ঘটনা মিলিয়ে দেওয়ার কাজটাও একসঙ্গে হয়ে যায়। খেয়াল করে দেখুন— আধুনিক গুজরাটের দ্বারকায় যেখানে কৃষ্ণের নতুন নগরী প্রতিষ্ঠা হল, সেই জায়গাটাই কিন্তু আগে ছিল কুশস্থলী এবং সেখানেই রৈবত ককুদ্মীর পিতা রেবতের নামে চিহ্নিত ছিল রৈবতক পর্বত। তখনকার রৈবতক এখানকার জুনাগড়ের কাছে গিরনার পাহাড়। কৃষ্ণ যখন নতুন নগর স্থাপনের জন্য ভূমি অন্বেষণ করছেন, তখন তাঁর জঙ্গম ভৃত্য গরুড় কিন্তু আগেই বলেছেন— আমি রাজা রৈবতের কুশস্থলী নগরীতে গিয়ে একবার দেখব— দেব যাস্যামি নগরীং রৈবতস্য কুশস্থলীম্‌। সেখানে আছে রৈবতক পাহাড় এবং স্বর্গের নন্দনকাননের মতো এক বন।

অর্থাৎ বাসযোগ্য স্থান এবং তার পরিবেশ সম্বন্ধে এই স্থানের খ্যাতি ছিল। রাজা রৈবত এখানে রাজত্ব করতেন বটে, কিন্তু হরিবংশে দ্বারকাপুরীর ‘সাইট’ খুঁজতে যাওয়া গরুড়ের কথা থেকে বোঝা যায় যে, এখন তিনি সেখানে রাজত্বও করেন না এবং সেখানে বাসও করেন না। গরুড়ের বক্তব্য থেকে আরও বোঝা যায়— অনেককাল অব্যবহৃত থাকার ফলে রৈবতের কুশস্থলীতে আর বাসযোগ্যতা নেই। প্রাকৃতিকভাবে সমুদ্র এবং পর্বতের সহাবস্থানে জায়গাটা সাধারণের পক্ষে দুর্গম এবং বাসযোগ্য নয়, তার মধ্যে বন-জঙ্গল তৈরি হয়ে গেছে। সে জায়গায় মানুষের চেয়ে বন্য পশুর উৎপাত বেশি— গজেন্দ্র-ভূজগাকীর্ণাম ঋক্ষবানরশোভিতাম্‌। রৈবতের কুশস্থলীতে যতই বনজঙ্গল আর বন্য জন্তু থাকুক, তবু গরুড়ের একটা শঙ্কা ছিল। ভেবেছিলেন— রৈবত-বংশের কেউ অথবা অন্য কেউও যদি কুশস্থলীতে এতদিনে নিজের আসন প্রতিষ্ঠিত করে থাকে, তবে কৃষ্ণের ইচ্ছার পথে কাঁটার মতো সেই মানুষটিকে একেবারে উচ্ছেদ করে, তবে গরুড় ফিরবেন— কণ্টকস্যোদ্ধরণং কৃত্বা আগমিষ্যে তবান্তিকম্।

বেশ বোঝা যায় যে, কুশস্থলীতে রৈবত-বংশের পরম্পরা-শাসিত এই নগরী কৃষ্ণের সময়ে পরিত্যক্ত ছিল এবং গরুড় যেহেতু বলেই ছিলেন যে, আমি এটাও দেখে আসব, সে নগরী বসতিযোগ্য করে তৈরি করা যেতে পারে কিনা— তাং সমন্তাৎ সমালোক্য বাসার্থং তে ক্ষমাং ক্ষমা— তাতে আরও বুঝি— মথুরা থেকে সকলকে নিয়ে নতুন জায়গায় এসে কুশস্থলীতে নগরী স্থাপন করতে কৃষ্ণের পক্ষে কোনও অসুবিধেই হয়নি। নগরী স্থাপনও সাড়ম্বরে হয়ে গেছে বিঘ্নহীনভাবে। কিন্তু আশ্চর্য লাগে— নগরী স্থাপনের বিস্তারিত প্রক্রিয়ার মধ্যে পৌরাণিকরা কেউ একবারও রৈবত ককুদ্মীর নামও উচ্চারণ করলেন না, রেবতীর নাম তো নয়ই। অথচ কুশস্থলীতে নগরী স্থাপন যখন শেষ হয়েছে এবং কৃষ্ণজ্যেষ্ঠ বলরাম খানিক দিন আয়েশ করে ব্রজভূমি থেকে ফিরে এসেছেন, ঠিক তখনই তাঁর সঙ্গে রেবতীর বিয়ের কথাটাও এক লাইনে সারা হয়ে গেল বিনা কোনও আড়ম্বরে, বিনা কোনও কাহিনির সূত্রপাতে। আশ্চর্য হল, রৈবত ককুদ্মীর নাম এবং কথা উচ্চারিত হল না এই প্রসঙ্গে।

একদিকে ঠিকই আছে। কারণ কী, পুরাতন রাজবংশের শেষ কীর্তিমান রাজা রেবত, যাঁর নামে নগরী কুশস্থলী এবং রৈবতক পাহাড় বিখ্যাত হয়েছিল, তাঁর পুত্র, নাকি তাঁর অনেক অধস্তন পুরুষ ককুদ্মী— হয়তো রাজ্যে অধিষ্ঠিত ছিলেন না অনেকদিনই। এমনও হতেই পারে যে, গীতব্যসন রৈবত ককুদ্মীকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াত; যেখানেই শুদ্ধ রাগ-লয়-তান, সেখানেই গিয়ে তিনি উপস্থিত হতেন এবং গানের মোহে তাঁর রাজ্যপাট উৎসন্ন হয়ে গিয়েছিল। বহুকাল পরে তিনি যখন ফিরে এসেছেন, তখন তিনি দেখেছেন— তাঁর পরিজন, পরিবার, রাজ্য কেউ নেই, শুধু মেয়েটি আছে— মেয়ের নাম রেবতী। এমনও হতে পারে, তিনি এবং রেবতী দু’জনেই রাজ্যের বাইরে ছিলেন এবং তার গীতমোহ ভঙ্গ হলে ফিরে এসে দেখলেন— তাঁর সাধের কুশস্থলীতে কৃষ্ণের দ্বারকা-নগরী প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ঠিক এইরকম একটা বাস্তব দৃষ্টিভঙ্গি থেকে নিরীক্ষণ করলে বিষ্ণুপুরাণের কাহিনিটিও অনেক প্রমাণসহ হয়ে ওঠে।

কাহিনি বলছে— ব্রহ্মলোকে হাহা-হূহূ-র গন্ধর্বগীত শেষ হলে, রৈবত ককুদ্মী ব্রহ্মাকে প্রশ্ন করলেন— আমি আমার কন্যা রেবতীর জন্য পাত্রের সন্ধানে আপনার কাছে এসেছি। কে আমার কন্যার অনুরূপ পাত্র হবে আপনি বলে দিন। ব্রহ্মা বললেন— কাদের তুমি উপযুক্ত বর মনে কর, বলো। ককুদ্মী কয়েক জনের নাম বলে ব্রহ্মার ওপরেই ভার দিলেন সঠিক নির্ণয়ের জন্য। ব্রহ্মা তাঁকে নিরাশ করে বললেন— যাঁদের কথা তুমি বললে, তারা তো দূরে থাকুক, তাঁদের ছেলেপিলে নাতিপুতিরাও এখন কেউ বেঁচে নেই পৃথিবীতে— নৈতেষাং সাম্প্রতম্‌ অপত্যাপত্য-সন্ততিরপি অবনীতলেহস্তি। গন্ধর্ব-গীত শুনতে শুনতে তোমার চতুর্যুগ কেটে গেছে পৃথিবীতে। এখন পৃথিবীতে অষ্টাবিংশতিতম মনুর কাল চলছে এবং দ্বাপর অতিক্রম করে কলিযুগ এসে গেছে সেখানে— আসন্নো হি তৎকলিঃ। তুমি বরং তোমার মেয়েকে অন্য কোনও গুণবান লোকের হাতে তুলে দাও। আরও দুঃখের কথা পৃথিবীতে ফিরে গেলেও তোমার মন খারাপ হবে। কেন না পুত্র-পরিজন, মন্ত্রী-ভৃত্য, রাজ্যপাট, রাজকোষ, সৈন্য-সামন্ত কিচ্ছুটি এখন নেই॥

রৈবত ককুদ্মী যথেষ্ট ভয় পেয়ে বললেন— তা হলে কী হবে এখন, কার হাতেই বা আমার এই মেয়ে তুলে দেব আমি। ভগবান ব্রহ্মা এবার রেবতীর পাত্রের কথা বলতে গিয়ে প্রথমেই কারণতোয়শায়ী, অনন্ত-শেষনাগের বিভূতিস্বরূপ ভগবান সঙ্কর্ষণের স্তব রচনা করে বললেন— সেই শেষশায়ী সঙ্কর্ষণ এখন কেশবাংশে অবতীর্ণ হয়ে দ্বারকায় বলরামরূপে অবস্থান করছেন এবং দ্বারকা হচ্ছে সেই জায়গাটাই, যেখানে তোমার রাজ্য ছিল, সেই কুশস্থলী যেখানে তুমি অবস্থিত ছিলে— কুশস্থলী যা তব ভূপ রম্যা/পুরী পুরাভূদমরাবতীব। সা দ্বারকা সম্প্রতি তত্র চাস্তে স কেশবাংশে বলদেবনামা। ব্রহ্মা বললেন— এই মনুষ্যরূপী ভগবান সঙ্কৰ্ষণ-বলদেবের হাতেই তোমার কন্যা সম্প্রদান করো। তিনিই কন্যার উপযুক্ত অভিমত পাত্র।

এই কাহিনির মধ্যে দুটি-তিনটি প্রয়োজনীয় কথা আছে। প্রথমত, রৈবত ককুদ্মীর পূর্বাধিবাস কুশস্থলী এখন কৃষ্ণের অধ্যুষিত দ্বারকায় পরিণত। দ্বিতীয়ত, কুশস্থলী-দ্বারকায় নগরীর পরিকল্পনা এবং তার নির্মাণ সম্পন্ন হওয়ার বিস্তীর্ণ কালের মধ্যে রৈবত ককুদ্মীর কোনও ‘ট্রেস’ ছিল না। তৃতীয়ত, এখন তিনি অন্য জায়গা থেকে নিজ ভূমিতে ফিরে এসেছেন একা।

যুগ পরিবর্তনের ক্ষেত্রে অথবা সময়ের বিবর্তনে যে পৌরাণিক কল্প ব্যবহার হয়— যা আমরা মুচুকুন্দের কাহিনিতেও দেখেছি— সেই কল্প ব্যবহার করেই বিষ্ণুপুরাণ বলেছে— রৈবত ককুদ্মী ব্রহ্মলোক থেকে পৃথিবীতে এসে দেখলেন সব মানুষ কেমন বেঁটে বেঁটে হয়ে গেছে, তাদের তেজ-বীর্য কম এবং কলির প্রভাবে সদসৎ-বিবেকও খানিকটা শিথিল। বস্তুত এই কল্প হল চিরন্তন বৃদ্ধের সংলাপ— যে বৃদ্ধ নিজের পূর্বকালের সঙ্গে আধুনিকতা মেলাতে পারেন না। তাঁরা মানুষকে হ্রস্ব দেখেন, নিজের আত্মারাম শক্তি-তেজের তুলনায় পরবর্তী প্রজন্মকে তেজোহীন দেখেন এবং স্বসময়ের ‘ভ্যালুজ’-এর তুলনায় আধুনিক যুবক-যুবতীকে বিবেকহীন দেখেন— দদর্শ হ্রস্বান্‌ পুরুষান্‌ অশেষান্‌/ অল্পেীজসঃ স্বল্প বিবেকবীৰ্যান্‌।

সবচেয়ে বড় কথা— যে কুশস্থলী এককালে ছেড়ে গিয়েছিলেন রৈবত, এতদিন পরে সেখানে ফিরে এসে তিনি বুঝলেন যে, এখন কেউ আর তাঁকে চিনবেও না, মানবেও না। ‘তাঁর’ বলতে এখন আর কিছুই নেই, না রাজ্যপাট, না পরিবার-পরিজন, তিনি এখন একাকী। ভগবান ব্রহ্মা তাঁকে পূর্বেই বলেছিলেন— কোনও উপায় নেই, তোমাকে একাকীই নিজের কন্যাটিকে তুলে দিতে হবে অন্যের হাতে— অন্যস্মৈ কন্যারত্নমিদং ভবতৈকাকিনা দেয়ম্‌। আসলে আমাদের যা মনে হয়, এ হল এক অসহায়তা। বহুকাল পরে স্বভূমিতে ফিরে এসে নিজেকে যখন পরবাসী লাগে, তখন নিজের মধ্যেই যে অভিমান জাগে তাতে আরও রিক্ত হতে ইচ্ছে করে। রৈবত ককুদ্মী কৃষ্ণজ্যেষ্ঠ বলরামের হাতে নিজের মেয়ে রেবতীকে তুলে দিলেন বিনা আড়ম্বরে, তারপর চলে গেলেন হিমালয়ের বনে তপস্যা করতে।

পুরাতন জমিতে পূর্বতন পুরুষের উৎখাত, উৎছিন্ন রাজবংশের সঙ্গে অধুনা প্রতিষ্ঠিত নতুন ভূমিপতির যোগসূত্র রচিত হল রেবতীর সঙ্গে বলরামের বিবাহে। পৌরাণিক চরম এক কৌতুক-কল্প উপস্থিত করেছেন, যার মধ্যে রসিকশেখর রাজশেখর বসু অসাধারণ উপাদান পেয়েছেন নির্মল হাস্যরসের। রৈবত-কন্যা রেবতীর গায়ে পুরাতন-অতীত যুগের গন্ধ মাখিয়ে পৌরাণিক বলেছেন— রেবতী বলরামের চেয়ে অনেক বেশি লম্বা ছিলেন। নিজেকে পত্নীর পাশে উচ্চতার প্রমাণে এমন বেমানান দেখে বলরাম নাকি তাঁর পরিচিত অস্ত্র লাঙলখানি দিয়ে রেবতীকে টেনে নামিয়ে নিজের সমতায় নিয়ে এলেন— উচ্চপ্রমাণামতি তামবেক্ষ্য/ স্বলাঙ্গলাগ্ৰেণ স তালকেতুঃ। আমার নিজের মনে এইমাত্র জাগে যে, সময় এবং যুগপরিবৃত্তির অলৌকিক হিসেবে রেবতী বলরামের চেয়ে অনেক লম্বা ছিলেন— এটা যতখানি উচ্চতার তাৎপর্যে ব্যবহৃত, তার চেয়েও বেশি আমার ধারণা এটা বয়সাধিক্যের তাৎপর্যে ব্যবহৃত। আমরা মনে করি— রেবতী বলরামের চেয়ে বয়সে একটু বড় ছিলেন হয়তো। লাঙলের ফাল দিয়ে বয়সও কমানো যায় না নিশ্চয়, কিন্তু বলরামের লাঙল যদি তাঁর শক্তি, বীর্য অথবা প্রভাবের তাৎপর্যে ব্যবহৃত হয়ে থাকে, তবে বুঝতে হবে— বলরাম তাঁর প্রভাব এবং ব্যক্তিত্বের ক্ষমতায় রেবতীকে অন্য স্ত্রীলোকের মতোই নিয়ন্ত্রিত করে নেবার মাহাত্ম্য প্রকাশ করেছিলেন। হয়তো বয়সাধিকা কোনও রমণীকে আপন বশীভূত করার ব্যাপারটাই রেবতীর শারীরিক দীর্ঘতর হ্রস্বীকরণের তাৎপর্যে ব্যবহৃত— বিনাময়ামাস ততশ্চ সাপি/ বভুব সদ্যো বনিতা যথান্যা।

রেবতীর সঙ্গে বলরামের বিবাহের মাধ্যমে কুশস্থলীর উৎসন্ন, অতীত রাজবংশের সঙ্গে দ্বারকার নতুন প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তিত্বের যোগসূত্রও যেমন স্থাপিত হল, তেমনই প্রতিষ্ঠিত হল কালের যোগসূত্র। বলরাম অনন্তনাগ, শেষনাগের প্রতিরূপণ শক্তিই শুধু নন, তাঁর মধ্যে ভগবান রুদ্রের ধ্বংসস্বরূপতাও আছে। আবার জগতের যিনি স্থিতিকর্তা সেই বিষ্ণুকে তিনি ধারণ করেন আপন কুণ্ডলীকৃত অনন্তশয্যায়। রুদ্রস্বরূপতায় জগৎ বিনষ্ট হয় বটে কিন্তু কাল বিনষ্ট হয় না, তা অন্য রূপ ধারণ করে মাত্র। ব্রহ্মলোক থেকে আসা কালাতীতা এক দীর্ঘাঙ্গী রমণীর সঙ্গে বলরামের মিলনের মধ্যে অলৌকিকতার যে প্রচ্ছন্ন আভাসটুকু আছে, তাতে ‘বেলা-অবেলা কালবেলা’র কবির কথা মনে পড়ে—

আকাশের সপ্রতিভ নক্ষত্রকে চিনে উদীচীর

কোনও জল কী করে অপর জল চিনে নেবে অন্য নির্ঝরের?

তবুও জীবন ছুঁয়ে গেলে তুমি;

দ্বারকায় কৃষ্ণের সমৃদ্ধ রাজধানী প্রতিষ্ঠিত হবার সঙ্গে সঙ্গেই কুশস্থলীর পুরাতনী প্রতিমা রেবতী বৃষ্ণি-অন্ধকদের কুলশেখর বলরামের পাণিগৃহীতী হলেন—

পিছনের পটভূমিকায় সময়ের

শেষনাগ ছিল, নেই;— বিজ্ঞানের ক্লান্ত নক্ষত্রেরা

নিভে যায়; মানুষ অপরিজ্ঞাত সে অমায়; তবুও তাদের একজন

গভীর মানুষী কেন নিজেকে চেনায়!

আহা, তাকে অন্ধকার অনন্তের মতো আমি জেনে নিয়ে, তবু,

অল্পায়ু রঙিন রৌদ্রে মানবের ইতিহাসে কে না জেনে কোথায় চলেছি!

অনন্ত-স্বরূপ বলরামের সঙ্গে বয়সে-বড় রেবতীর মিলন এক অসাধারণ দাম্পত্য-নিদর্শন বলা যায়। বলরাম যেমন পত্নীপ্রেমে একনিষ্ঠ ছিলেন, রেবতীও তেমনই, কোনও দিন কোনও ব্যাপারে আমরা এই দু’জনকে বিচ্ছিন্ন দেখিনি। সময় যত গেছে এই প্রেম আরও বেড়েছে। মানুষ হিসেবে বলরাম যেহেতু একটু হঠাৎ-ক্রোধী, একটু শৌখিন এবং একটু বেশি রকমের মদ্যপানশৌণ্ড ছিলেন, তাই কিছু শঙ্কা ছিল; কিন্তু রেবতী এমনই স্বয়ংসিদ্ধা রমণী যে বলরামের কোনও দোষ তিনি কোনও দিন দেখেননি, বরঞ্চ বলব— বলরাম যে-যে কর্মে অভিরত এবং আসক্ত ছিলেন, রেবতীও সেই সেই কর্মে তাঁর সমান অংশীদার। কোনও পুরাণই এই সহধর্মচারিত্বের কথা সাড়ম্বরে বলেনি, বিভিন্ন কর্ম, নর্ম এবং সমানহৃদয়তায় আমরা রেবতীকে বলরামের পাশে পাশে দেখতে পাব সব সময়। এমনকী কত শত কবিরা যে বলরামকে নিয়ে কবিতা লিখেছেন, তাঁরা একটি-দুটি শ্লোক লিখে থাকলেও রেবতী কিন্তু সেই শ্লোক-চরণের মধ্যে নিজের স্থান করে নিয়েছেন। সবচেয়ে বড় কথা, রেবতীর মতো এমন সহধর্মিণী পতিব্রতা সতী আমি দেখিনি— কারণ, বলরাম সাড়ম্বরে যে মদ্যপানের অভ্যাস তৈরি করেছিলেন, সে অভ্যাস তিনি আপন প্রিয়া পত্নী রেবতীকেও ধরিয়েছিলেন। নইলে মহাকবিরা কোথা থেকে এই মধুর তথ্যটি পেলেন, যাতে মাঝে মাঝেই তাঁদের লিখতে হয়— বলরাম সুপ্রেমে প্রিয়া রেবতীর মুখ চুম্বন করার সময় তাঁরই মুখস্থিত কাদম্বরী সুধা আস্বাদন করতেন নির্দ্বিধায়— প্রেমোন্নামিত-রেবতী-মুখগতাম্‌, আস্বাদ্য কাদম্বরীম্‌। অন্য এক বড় কবির ভাষায়, রেবতী-বদনোচ্ছিষ্টা কাদম্বরী তাঁকে রসশাস্ত্রীয় পবিত্রতা দান করত॥

॥ ৮ ॥

দ্বারকা-পুরীতে রেবতীর সঙ্গে বিবাহের পর পর অনেক ঘটনা ঘটে গেল। প্রথমত, কৃষ্ণের সঙ্গে বিদর্ভনন্দিনী রুক্মিণীর বিবাহ, যেখানে বলরামের বিশিষ্ট অবদান ছিল। রুক্মিণীকে কৃষ্ণ হরণ করেছিলেন রীতিমতো প্রস্তুত হয়ে। মগধরাজ জরাসন্ধ যেহেতু রুক্মিণীর সঙ্গে শিশুপালের বিবাহ-সম্বন্ধ করেছিলেন, ফলে কন্যাপিতা ভীষ্মক এবং রুক্মিণীর ভাই রুক্মী দু’জনেই জরাসন্ধের পক্ষে ছিলেন। এমন একটি কন্যাহরণে যুদ্ধ একরকম নির্ধারিতই ছিল এবং বলরাম সেই যুদ্ধে ত্রাতার ভূমিকায় ছিলেন। কৃষ্ণ প্রধানত দাদা বলরাম এবং সাত্যকির ওপর যুদ্ধ সামলানোর ভার দিয়ে নিজে রুক্মিণীকে নিয়ে পালিয়ে গিয়েছিলেন দ্বারকায়। বলরাম অত্যন্ত নিপুণভাবে এই যুদ্ধ সামলেছেন; যেহেতু বিবাহের কারণে এই যুদ্ধ হয়েছিল, অতএব সাংঘাতিক ক্ষয়-ক্ষতি, এবং হত্যার ব্যাপারটা এড়িয়েই যুদ্ধ করেছিলেন বলরাম। এ বাবদে আমার একটাই দুঃখ আছে— জরাসন্ধপক্ষপাতী শিশুপাল, দন্তবক্র, পৌণ্ড্রক বাসুদেব এই যুদ্ধে বলরামের হাতে অস্ত্রাঘাত লাভ করেছেন— এই যথেষ্ট, কিন্তু মাঝখান দিয়ে আমাদের দেশের এক বঙ্গরাজ, তিনি জরাসন্ধের হয়ে যুদ্ধ করতে এসে নিজের হাতি সহ মারা পড়লেন বলরামের হাতে— জঘান রামঃ সংক্রুদ্ধো বঙ্গরাজঞ্চ সংযুগে। বঙ্গদেশের এই রাজাটি কি জরাসন্ধের ওপর বেশি সরসতা দেখাতে এসে এমন বেঘোরে প্রাণ দিলেন!

যাই হোক, রুক্মিণীর বিবাহের পরে আরও কয়েকটি বৈবাহিক ঘটনা ঘটেছে দ্বারকায়। সত্যভামা, জাম্ববতীর সঙ্গে কৃষ্ণের বিবাহ হয়েছে নানান ঘটনার মধ্য দিয়ে এবং সেখানে যদুবংশের জ্ঞাতি-গোষ্ঠীর স্থিতাবস্থার অন্তরালে যে স্বার্থ-প্রেরণা তৈরি হচ্ছিল বহুদিন ধরে, তাও একটু প্রকট হয়ে উঠল। সেখানে কৃষ্ণজ্যেষ্ঠ বলরামেরও একটা দায় আছে বটে, কিন্তু সেইসব ঘটনা-তরঙ্গে বলরাম যতই ভেসে থাকার চেষ্টা করুন, তার সরল স্বভাব এবং সেই স্বভাবের আকস্মিকতার জন্য মাঝে মাঝে তিনি এমন আচরণ করে ফেলেছেন যে, কৃষ্ণকেও তার জন্য বিব্রত হতে হয়েছে। অনুজ যে ভাইটির সঙ্গে তাঁর কর্ম এবং মর্মে কোনও দিন ভেদজ্ঞান তৈরি হয়নি, যদু-বৃষ্ণিদের জ্ঞাতিগুষ্টির অন্তর্নিহিত স্বার্থৈষণা সেখানে অন্যতর এক খাত সৃষ্টি করেছে। বলরামের পক্ষে বোঝাও সম্ভব হয়নি যে, জ্ঞাতিগুষ্টির স্বার্থপ্রেরণা তাঁর অভিন্নহৃদয় ভাইটির সঙ্গে দূরত্ব তৈরি করে দিচ্ছে। রাজনীতির সূক্ষ্ম-কুটিল গতি-পরিবর্তন কৃষ্ণের মতো করে তিনি কোনও দিনই বুঝতেন না, কিন্তু বুঝতেন না বলেই যে সামগ্রিকভাবে কৃষ্ণের ওপরেই তিনি নির্ভর করে থাকবেন, এতটা ‘ইগো’ তিনি বিসর্জন দিতে পারেননি। বড় ভাই বলেই যেন অনেক কিছুই বোঝেন— এমন একটা স্বাত্মারোপিত অহংভাব সর্বদাই কাজ করত তাঁর মনে। তারই কিছু বিষম ফল ফলেছে পরবর্তী সময় ধরে।

আসলে কংসের মৃত্যু হবার পর মথুরা-শূরসেন অঞ্চলে যদু বৃষ্ণি অন্ধকদের নিয়ে কৃষ্ণ-বলরামের রাজনৈতিক গুরুত্ব যথেষ্টই বেড়ে গেল বটে, কিন্তু মথুরার রাজনীতিতে রাজার চেয়েও যেহেতু কুলসংঘগুলির প্রধানদের মাহাত্ম্য বেশি ছিল, তাই কৃষ্ণের জ্ঞাতিগুষ্টির মধ্যে যাঁরা প্রধান পুরুষ, এমনকী যাঁরা কৃষ্ণ-বলরামের ছোটভাই, কৃষ্ণের ছেলেরা— এঁদেরও রাজনৈতিক গুরুত্ব বাড়তে লাগল। বলা উচিত, এ গুরুত্ব কৃষ্ণ নিজেই বাড়তে দিয়েছেন। সে দিক থেকে দেখতে গেলে দাদা বলরামকেও কৃষ্ণ বাড়তে দিয়েছেন। আসলে কংসের মৃত্যুর পর প্রবল পরাক্রান্ত তথা রাজনৈতিক ক্ষেত্রে অপ্রতিদ্বন্দ্বী মহারাজ মগধেশ্বর জরাসন্ধকে কৃষ্ণ যেভাবে বহুকাল প্রতিহত করে রেখেছিলেন, তাতে কৃষ্ণের রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠা এতটাই ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে গিয়েছিল যে, তাঁর জ্ঞাতিগুষ্টির কারও পক্ষেই সে জায়গায় পৌঁছানো সম্ভব ছিল না বটে, কিন্তু তাই বলে তাঁরা নিজেদের প্রতিপত্তি বিস্তার না করে কৃষ্ণের অনুচ্ছায়ায় বিচরণ করতেন, তা মোটেই নয়। এমনকী একটা ঈর্ষা অসূয়ার ঘটনাও এখানে কাজ করে থাকতে পারে। মথুরা ছেড়ে দ্বারকায় আসার পর জরাসন্ধের প্রত্যক্ষ তথা হঠাৎ আক্রমণের সুযোগ কমে যাওয়ায় কৃষ্ণের জ্ঞাতিজনেরা আরও নিশ্চিন্ত হলেন। ফলে যদু-বৃষ্ণিদের পরিবারতন্ত্রে কৃষ্ণের সাপেক্ষতা আরও একটু যেন ক্ষীণ হল এবং কৃষ্ণ তাঁদের বুঝতেও দিলেন না যে, তাঁরই রাজনৈতিক বুদ্ধিতে তাঁর জ্ঞাতিগোষ্ঠী এবং পরিবারের সমৃদ্ধি ঘটেছে। ঠিক এইখানে বলরামের কথাটাও আসে।

বলরাম নিজে যথেষ্ট শক্তিশালী এবং বিক্রমী পুরুষ। কিন্তু তাঁর রাজনৈতিক চতুরতা কৃষ্ণের ধারে কাছেও যায় না। অথচ তাঁর জ্ঞাতিগোষ্ঠীর অন্যান্য জনের মতো তিনিও তেমন করে সব সময় বোঝেন না যে, কৃষ্ণের বুদ্ধিতেই সকলের গুরুত্ব বেড়েছে। অগ্রজ দাদাকে কৃষ্ণ কোনওদিনই অবজ্ঞা করেননি, তাঁর মুখের ওপরেও তিনি কোনওদিন কথা বলেননি। কিন্তু পরিবারের মধ্যেই সেদিন এমন একটা ঘটনা ঘটল যখন বলরামের মতো মানুষও কৃষ্ণের বিপক্ষতা আচরণ করলেন। অবশ্য তিনি যে এটা খুব বুঝে করেছেন, তা নয়। তিনি এতটাই সরল এবং সহজ যে জ্ঞাতিগোষ্ঠীর পাল্লায় পড়ে তিনিও কৃষ্ণের বিরুদ্ধ আচরণ করলেন এক সময়ে। কথাটা খুব সংক্ষিপ্তভাবে ধরা আছে মহাভারতে এবং বিস্তৃত আলোচিত হয়েছে হরিবংশে, বিষ্ণুপুরাণে এবং ভাগবত পুরাণে॥

ঘটনার বিস্তারেও আমরা যেতে চাই না, যেহেতু তাতে বলরামের চেয়েও কৃষ্ণের কথা বেশি হয়ে উঠবে। কিন্তু মহাভারতে বলরামের সম্বন্ধে কৃষ্ণের ক্ষোভ-দুঃখটুকু না বললে বলরামের চরিত্রও তো অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। মহাভারতের শান্তিপর্বে একেবারে ‘ফ্ল্যাশ্‌-ব্যাক’-এর কায়দায় কথাটা এসেছে। কৃষ্ণ সেখানে দেবর্ষি নারদের মতো রাজনীতি ধুরন্ধর ব্যক্তির কাছে নিজের পারিবারিক রাজনীতির কুট অভিসন্ধিগুলি জানিয়ে পরামর্শ চাইছেন। এই পারিবারিক রাজনীতির কুশীলব অন্য বাড়ির আত্মীয়-স্বজন, তাঁরা একটি-দুটি সমস্যা নিয়ে মাথা গলাতে গলাতে নিজেদের সমস্যাটাকে এমন একটা পর্যায়ে নিয়ে গেছেন যে, কৃষ্ণ সেখানে নিতান্ত অনিচ্ছুকভাবে এবং নিতান্ত ‘ট্যানজেনশিয়ালি’ ঘটনার সঙ্গে জড়িয়ে থাকলেও হঠাৎই তাঁর ওপরে চোরের অপবাদ চলে এল এবং দাদা বলরাম সরলভাবে সেই অপবাদ আরোপণে অন্যের পক্ষে দাঁড়িয়ে গেলেন।

কৃষ্ণ এ-দুঃখ ভুলতে পারেননি। সারা জীবনেও ভুলতে পারেননি। ফলে জীবনের প্রায় শেষ কল্পে দাঁড়িয়ে তিনি সম্পূর্ণ ঘটনার বিবরণ দিচ্ছেন না, অথবা বলা উচিত, দিতে পারছেন না, কিন্তু ঘটনা ঘটার ফলে এক একটা চরিত্র তাঁর কাছে কী রূপ নিয়ে দাঁড়িয়েছে, এবং তাতে তাঁর কী যন্ত্রণা হচ্ছে, সেটা বোঝানোর জন্য কৃষ্ণ অনেক আক্ষেপ করে নারদকে বললেন— নারদমশায়! এই যে দেখছ সব আমার জ্ঞাতি-গুষ্টি— এরা সব আমাকে খুব ক্ষমতাশালী বলে মানে; এমনকী মুখে এমন কথাও বলে, যেন আমি এদের ঈশ্বর এবং প্রভু, কিন্তু আসলে এই জ্ঞাতি-গুষ্টির চাকর হিসেবেই থাকতে হয় আমাকে— দাস্যমৈশ্বর্যবাদেন জ্ঞাতীনাং তু করোম্যহম্‌। ধন-সম্পত্তির যা আদায় উপায় করি, তার অর্ধেক ভোগ করি আমি, আর সব যায় ওই জ্ঞাতি-গুষ্টির ভোগে। আর এ বাবদে আমার লাভ এই যে, তার দরুন যত গালাগালি আর নালিশ— সব সহ্য করতে হয় আমাকে। অক্রূর বলবে— কৃষ্ণ আহুকের পক্ষ নিয়েছে, সেইজন্য আমাকে দেখতে পারে না। আর আহুক (উগ্রসেন) বলবে— কৃষ্ণ অক্রূরের পক্ষ নিয়েছে, সেইজন্যই আমাকে দেখতে পারে না। এদের দুর্বাক্য, গালাগালি সব সময় আমার মনের মধ্যে ধিকি ধিকি জ্বলছে। আর এই যে দেখছ, দাদা বলরাম! তাঁর অনেক শক্তি, অনেক বল— কিন্তু সেই শক্তি আর বলে তিনি নিজেই প্রমত্ত হয়ে আছেন। আর আমার ছোটভাই গদ, সে নিজের চেহারা নিয়েই এত ব্যস্ত— বলং সঙ্কর্ষণে নিত্যং সৌকুমার্যং পুনর্গদে— সবকিছু মিলে আমার যে কী অসহায় অবস্থা, তা কী করেই বা বোঝাব!

বলরাম সম্বন্ধে কৃষ্ণ এখানে একটামাত্র কথা বলেছেন শুধু— তিনি নিজে নিজের শক্তি নিয়ে মত্ত হয়ে আছেন! কৃষ্ণ বোঝাতে চাইছেন যে, এত শক্তি এবং বল থাকা সত্ত্বেও বলরামের এই অসামান্য গুণ তাঁর কোনও কাজে আসছে না। কাজে আসছে না কেন— তার কারণ কৃষ্ণ স্পষ্ট করে বলেননি। শুধু বলেছেন— অক্রূর আর উগ্রসেনের চিরকেলে এক ঝগড়া আমাকে একেবারে পাগল করে দিল। এদের মতো দুটো আত্মীয় যদি কারও থাকে, তবে তার চাইতে দুঃখের বুঝি আর কিছু থাকে না— স্যাতাং যস্যাহুকাক্রূরৌ কি দুঃখতরং ততঃ।

এই যে উগ্রসেন আর অক্রূরের ঝগড়া এবং তার মধ্যে দাদা বলরাম সম্বন্ধে ছোট্ট একটা ‘কমেন্ট’— এর মধ্যেই সমস্ত অশান্তির গল্পটা লুকিয়ে আছে, কিন্তু কৃষ্ণ সেটা পুরোপুরি বললেন না, কিন্তু নারদের কাছে উপদেশ চাইলেন উপযুক্ত সমাধানের জন্য। নারদ উপদেশ দিলেন তাঁর সাধ্যমতো, তাতে সমাধানের সূত্র কতটুকু মিলল, সে বিচার এখানে করা যাবে না, তবে এইটুকু তাতে বোঝা গেল যে, কংস-জরাসন্ধ ইত্যাদি বাহ্যিক শত্রু বিনাশ হয়ে গেলেও যাদব-বৃষ্ণিকুলে যেভাবে ক্ষমতার বিষম বণ্টন ঘটেছে, তাতে উগ্রসেন, অক্রূর এমনকী বলরামও এক একটা ‘ইউনিট হিসেবে কাজ করছেন এবং কৃষ্ণের সেখানে কিছু করার থাকছে না। মথুরা-শূরসেন অঞ্চলে সংঘরাষ্ট্র বা অলিগার্কিক শাসনতন্ত্রে এক একজনের ক্ষমতা প্রদর্শনের যে প্রবণতা ছিল এবং যে প্রবণতা উগ্রসেন বা অক্রূরের মধ্যেও কাজ করছে— এই অভ্যন্তরীণ দোষের জন্য নারদ কৃষ্ণকেই দায়ী করেছেন, যদিও এই দোষের কারণ যা, তা তিনি জানেন এবং সেখানে কৃষ্ণ যে অসহায়, তাও তিনি ভালমতোই জানেন।

আসলে, নিজে ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকলে জ্ঞাতি-গুষ্টির মধ্যে বিভেদ তৈরি হতে পারে, সেই ভয়েই কৃষ্ণ উগ্রসেনের মতো ‘রাজা’ নাম ধারণ করতে চাননি— একথা নারদ জানেন। কিন্তু নারদ যেটা বিস্তারিত জানেন না, সেটা অদ্ভুত একটা ঘটনা, যেখানে কৃষ্ণের কোনও হাত নেই, অথচ কৃষ্ণ সেখানে জড়িয়ে গেছেন এবং দাদা বলরাম তাঁর বিরুদ্ধ পক্ষকে সমর্থন করছেন কিছু না ভেবেই। এই ঘটনার সঙ্গে কৃষ্ণমহিষী বিদগ্ধা সত্যভামার জীবন জড়িয়ে আছে একদিকে, অন্যদিকে স্যমন্তক মণির হরণাহরণ নিয়ে দ্বন্দ্ব এবং দোষারোপ এই ঘটনাকে আরও জটিল করে তুলেছে।

স্যমন্তক মণির ঘটনার মধ্যে একটা অলৌকিক রূপকথার প্রলেপ আছে, কিন্তু সেটুকু বাদ দিলে এই মণি নিয়ে বৃষ্ণি-যাদব কুলে যে একটা বিরাট ভুল বোঝাবুঝি হয়েছিল, সেটা ঐতিহাসিক সত্য। হতে পারে যেমনটি বলা আছে তার সব সত্য নয়, কিন্তু এটা সত্য যে সত্রাজিৎ, কৃষ্ণেরই জ্ঞাতিগুষ্টির একজন, তিনি এই মণি লাভ করেছিলেন। যেমনটি বলা আছে, তেমন ওই সূর্যের কাছ থেকে নাই হোক, অন্য কারও কাছ থেকে। অথবা এই মণি প্রতিদিন আট ভার সুবর্ণ প্রসব করত, সেটা নাই হোক, কিন্তু মণিটি নিজেই যে যথেষ্ট দামি এবং উজ্জ্বল, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। পুরাণ বলেছে— সত্রাজিৎ এই স্যমন্তক মণিরত্ন লাভ করে নিজের কাছে সেটা রাখলেন না। পাছে কৃষ্ণের মতো অসামান্য ব্যক্তি সেটা চেয়ে ফেলেন এবং এমনও প্রবচন আছে যে, কৃষ্ণ সেটা একবার চেয়েই ফেলেছিলেন— নিজের জন্য নাকি নয়, দেশের রাজা উগ্রসেনের জন্য— কিন্তু সেই চাওয়ার ভয়ে সত্রাজিৎ মণিটি নিজের কাছে না রেখে ভাই প্রসেনের কাছে রেখে দেন।

প্রসেন স্যমন্তক মণি নিয়েই একদিন মৃগয়া করতে গিয়ে এক সিংহের হাতে মারা গেলেন। সিংহ মণি নিয়ে কী করবে তা আপাতত বোঝা গেল না বটে, কিন্তু মণিটি খোয়া গেল। সবচেয়ে বড় কথা যদু-বৃষ্ণিকুলে এই নিয়ে কথা চালাচালি আরম্ভ হল এবং লোকে বলতে লাগল— মণিটির ওপর কৃষ্ণের লোভ ছিল তো, অতএব প্রসেনকে মেরে কৃষ্ণই ওই মণি নিয়েছে। কথাটা কৃষ্ণের কানে উঠতে অপবাদ স্খালনের জন্য তিনি মণি উদ্ধার করার জন্য রওনা হলেন। এখানে বিরাট একটা গল্প আছে। সে গল্পের মধ্যে না গিয়েও এই বাস্তব ঘটনাটুকু খেয়াল রাখতে হবে যে, কৃষ্ণ স্যমন্তক মণি উদ্ধার করে এনেছেন এবং এই ঘটনার সমান্তরাল খণ্ডে কৃষ্ণ জাম্ববতীকে বিয়ে করে এনেছেন অপিচ ওই মণি সত্রাজিতের হাতে ফিরিয়ে দেবার পর মুগ্ধ কৃতজ্ঞতায় সত্রাজিৎ নিজের মেয়ে সত্যভামাকেও তুলে দিয়েছেন কৃষ্ণের হাতে।

সমস্ত গোলমালের শুরু এইখান থেকেই। সত্যভামার সঙ্গে কৃষ্ণের বিয়ে হবার পর থেকেই বিশেষত, যাদব-বৃষ্ণিকুলের পারিবারিক রাজনীতি একেবারে জটিল হয়ে উঠল। পুরাণগুলি জানিয়েছে যদু-বৃষ্ণিদের অনেক প্রধান পুরুষেরাই স্যমন্তক মণির ব্যাপারে যেমন লালসাগ্রস্ত ছিলেন, তেমনই তাঁদের চোখ ছিল রমণী-মণি সত্যভামার ওপরেও। যেমন অক্রূর, তাঁর বয়স কৃষ্ণের চেয়ে অনেক বেশি ছিল, কিন্তু সত্যভামার ওপর তাঁর চোখ ছিল অনেকদিন ধরেই। আর স্যমন্তক মণিটিও তাঁর হস্তগত করার ইচ্ছা ছিল, কিন্তু কোনও সুযোগ তিনি এতকাল পাননি। অন্যদিকে কৃতবর্মা, এবং শতধন্বা, যাঁরা যদু-বৃষ্ণিদেরই আর এক জ্ঞাতি ভজমানোর বংশে জন্মেছিলেন, তাঁরাও মনে মনে কামনা করতেন সত্যভামাকে, কিন্তু খুব প্রকটভাবে স্যমন্তকমণির ওপরে এঁদের খুব একটা লোভ ছিল না। এঁদের সবার মধ্যে অবশ্য শতধন্বার বয়সই সবচেয়ে কম এবং তাঁরই হয়তো সবচেয়ে বেশি আকাঙ্ক্ষা ছিল সত্যভামাকে বিয়ে করার।

শতধন্বার এই দুর্বলতার কথা হৃদয়ঙ্গম করেই অক্রূর কৃতবর্মাকে সঙ্গে নিয়ে একদিন শতধন্বাকে বললেন— এই সত্রাজিৎই হল যত নষ্টের গোড়া। ও আমাদের হাতে নিজের মেয়েটাকে তো ছাড়লই না, এমনকী তোমাকেও এতটুকু পাত্তা না দিয়ে নিজের অমন সুন্দর মেয়েটাকে কৃষ্ণের হাতে তুলে দিল! আমাদের তো মনে হয়, এরপরে আর সত্রাজিতের বেঁচে থাকার অধিকার নেই। অক্রূর এবার শতধন্বাকে কুবুদ্ধি দিয়ে বললেন— মেয়েটাকে নিতান্ত যখন পেলেই না, তখন সত্রাজিৎকে মেরে অন্তত স্যমন্তক মণিটা নিতে দোষ কী আছে? তুমি বরং সেই চেষ্টাটাই করো— ঘাতইত্বৈনং তন্মহারত্মং ত্বয়া কিং ন গৃহ্যতে? অক্রূর এবং কৃতবর্মা এমনও বোঝালেন শতধন্বাকে যে, কৃষ্ণ যদি কোনও ঝামেলা করেন, তা হলে তাঁরা শতধন্বাকেই সাহায্য করবেন।

শতধন্বার বয়স কম এবং সত্যভামার ওপর তাঁর দুর্বলতাও যথেষ্ট ছিল। অতএব একদিন। সময় বুঝে— কৃষ্ণ তখন বারণাবতে পাণ্ডবদের জতুগৃহদাহের খবর পেয়ে চলে গেছেন দ্বারকা থেকে— ঠিক সেই সময়ে শতধন্বা নিদ্রিত অবস্থায় সত্রাজিৎকে মেরে ফেললেন। ত্রস্ত-ভীত সত্যভামা একা রথে চড়ে বারণাবতে পৌঁছে কৃষ্ণের কাছে জানালেন পিতার মৃত্যুর কথা। বাহ্যত খুব ক্রোধ দেখিয়ে সাত্রাজিতী সত্যভামাকে কৃষ্ণ এটাই বোঝালেন যে, তিনি প্রতিশোধ নেবেন যথোচিত। কিন্তু স্যমন্তক মণির অধিকারী সত্রাজিৎ মারা যাওয়ায় কৃষ্ণ যেন একটু খুশিও হলেন। এই খুশির কারণ অবশ্য অন্য জায়গায় এবং সত্যভামাকে তা বুঝতেও দিলেন।

বারণাবতে সাত্যকিকে কাজে লাগিয়ে দিয়ে কৃষ্ণ ফিরে এলেন দ্বারকায় এবং ফেরার পরে তাঁর প্রথম কাজ ছিল, দাদা বলরামকে যথাসাধ্য নিজের অনুকূল করে নেওয়া। কৃষ্ণ তাঁকে বললেন— সত্রাজিতের মৃত্যুর পর উত্তরাধিকার সূত্রে সেই স্যমন্তক মণি এখন আমাদেরই হবার কথা— স্যমন্তকো মহাবাহো হ্যস্মাকং স ভবিষ্যতি। অর্থাৎ সত্যভামার সঙ্গে বিবাহ সম্বন্ধে এই মূল্যবান সম্পত্তি যে তাঁদের ঘরেই থাকার কথা— কৃষ্ণ সেটাই বোঝাতে চাইলেন বলরামকে। কৃষ্ণ বললেন— সিংহ প্রসেনকে মেরে ফেলেছে এবং সত্রাজিৎকে মেরেছে শতধন্বা। তা হলে কী দাঁড়াল? স্যমন্তক তো এখন আমারই হওয়া উচিত, কেন না আমিই তো সত্যভামার স্বামী— স্যমন্তকঃ স মদ্‌গামী তস্য প্রভুরহং বিভো। দ্বিতীয় পঙ্‌ক্তিতে এই ‘আমারই হওয়া উচিত’ কথাটা পালটে দিয়ে ‘আমাদের’— এই গৌরব শব্দ ব্যবহার করেছেন কৃষ্ণ এবং তা অবশ্যই বলরামকে পাশে পাবার জন্য।

সত্যি কথা বলতে কী, বলরামকে এত বোঝানোর কোনও দরকার ছিল না। কেন না, যেটা তিনি বোঝেন বা বুঝতে চান, সেটা তিনি বেশ তাড়াতাড়িই বোঝেন, আর যেটা তিনি বুঝতে পারেন না, বা বুঝতে চান না, সেখানে শত অকাট্য যুক্ত দিয়ে বোঝালেও, তিনি সেটা বুঝতে চাইবেন না। আর এ ব্যাপারে তাঁর শত্রু-মিত্র ভেদ নেই। স্বয়ং কৃষ্ণও যদি বোঝান, তবু সেটা তাঁর অন্যরকম লাগে, আর যখন সেটা বোঝেন, তখন বড় দেরি হয়ে যায়। তবে এখন তিনি কৃষ্ণের কথা মেনে নিয়েছেন, ফলত কৃষ্ণ যখন বললেন— তা হলে আর দেরি না করে রথে ওঠো, মারতে হবে ওই ভোজবংশের কুলাঙ্গার শতধন্বাকে— তদারোহ রথং শীঘং ভোজং হত্বা মহাবলম্‌— তখন বলরাম কৃষ্ণের সঙ্গেই রথ চালিয়ে দিলেন শতধন্বাকে ধরার উদ্দেশে।

গোপনে একটা সন্ধি এবং ষড়যন্ত্র আগেই হয়েছিল। দ্বারকার রাজনীতিতে অক্রূর পোক্ত মানুষ, কংসের আমল থেকে তিনি যদুবংশীয়দের পরামর্শদাতার ভূমিকায় আছেন। কিন্তু বিদগ্ধা সত্যভামাকে লাভ করার ইচ্ছেটা যখন কৃষ্ণের জ্বালায় মাঠে মারা গেল, তখন স্যমন্তক মণির জন্য তিনি মরিয়া হয়ে উঠলেন। তরুণ শতধন্বা যখন তাঁরই কথামতো সত্রাজিৎকে হত্যা করে মণি এনে অক্রূরের হাতে দিল, তখন অক্রূর তাঁকে বলেছিলেন— প্রথম কথা হল, তুমি প্রথমে প্রতিজ্ঞা করো যে, তুমি কাউকে বলবে না, আমার কাছে এই মণি আছে। তবে হ্যাঁ, মণির কারণে কৃষ্ণ যদি তোমার পিছনে লাগে, তবে আমরা তোমাকে অবশ্য সাহায্য করব। কেন না সেটুকু ক্ষমতা আমার আছে, দ্বারকাবাসীদের অনেকেই এখন আমার বশে আছে— মমাদ্য দ্বারকা সর্বা বশে তিষ্ঠত্যসংশয়ম্‌।

সংঘরাষ্ট্রের ‘পোলিটিক্স’ বোঝার জন্য আপাতত এই কথাটাই যথেষ্ট। দ্বারকার প্রধান পুরুষদের মধ্যে অক্রূর এতটাই প্রভাব খাটাতে পেরেছেন যে, খোদ কৃষ্ণের বিরুদ্ধে যাবারও সাহস দেখাচ্ছেন তিনি। এবং আমার ধারণা, দাদা বলরামকেও আজ বোঝাতে হচ্ছে। যে কৃষ্ণকে ছাড়া তিনি জীবনে এক পা চলেননি, সেই বলরামও বোধকরি অক্রূরের কূটবুদ্ধিতে খানিকটা প্রভাবিত ছিলেন, নইলে এত তাঁকে বোঝাতে হচ্ছে কেন, কৃষ্ণের ইচ্ছামাত্রেই তিনি তাঁর অনুবর্তী হচ্ছেন না। তবু এই মুহূর্তে বলরাম কৃষ্ণের কথায় তাঁর সঙ্গে থাকতে রাজি হলেন এবং শতধন্বার সঙ্গে কৃষ্ণের তুমুল যুদ্ধ আরম্ভ হল। বিপদ বুঝে শতধন্বা অক্রূরকে খুঁজতে লাগলেন চারদিকে— অবৈক্ষৎ সর্বতো দিশম্‌। কিন্তু ধুরন্ধর অক্রূর কৃষ্ণ-বলরামকে পরম ক্রুদ্ধ দেখে কিছুতেই কৃষ্ণের বিরুদ্ধতা করলেন না; করলে, স্যমন্তক মণির অধিকারী নিয়ে প্রত্যক্ষেই প্রশ্ন উঠত। অতএব শতধন্বার সঙ্গে তিনি শঠতা অবলম্বন করলেন।

যুদ্ধে আসন্ন মৃত্যুর গন্ধ পেয়ে শতধন্বা বেগবান অশ্বে পালিয়ে গেলেন অন্তত চারশো ক্রোশ পথ। তার অশ্ব ক্লান্ত হয়ে শুয়ে পড়ল এক সময়। অন্যদিকে বলরাম এবং কৃষ্ণকে রথে আসতে দেখে শতধন্বা পলায়ন করলেন পদব্রজে। পরিত্যক্ত অশ্বের অনুমানে কৃষ্ণ বলরামকে বললেন— আপনি এখানে অপেক্ষা করুন, আমি পায়ে হেঁটেই ধরে ফেলব শতধন্বাকে, কেন না সে যেখান দিয়ে গেছে সেই পায়ে হাঁটার পথে রথের গতি কমে যাবে। অতএব আপনি এখানে থাকুন, আমি স্যমন্তক মণি কেড়ে নিয়ে আসব শতধন্বার কাছ থেকে। বলরাম অপেক্ষা করতে লাগলেন এবং কৃষ্ণ পায়ে হেঁটেই ধরে ফেললেন শতধন্বাকে, যদিও হাঁটতে হাঁটতে এবং ছুটতে ছুটতে শতধন্বা তখন প্রায় মিথিলা নগরীর কাছাকাছি চলে এসেছেন। মিথিলার উপকণ্ঠেই শতধন্বাকে মেরে ফেললেন কৃষ্ণ, সে শ্বশুরহন্তা বটে, তবে জ্ঞাতিশত্রুর রক্তে কৃষ্ণের হাত রঞ্জিত হল। কিন্তু স্যমন্তক মণি তিনি শতধন্বার কাছে পেলেন না— স্যমন্তকং চ নাপশ্যদ্‌ হত্বা ভোজং মহাবলম্‌।

কৃষ্ণ খালি হাতে ফিরে এলেন এবং বলরাম অসীম কৌতুহলে তাঁকে বললেন— কই দেখি সেই স্যমন্তক মণি, দাও সেটা আমার হাতে— নিবৃত্তং চাব্রবীৎ কৃষ্ণং রত্নং দেহীতি লাঙ্গলী! কৃষ্ণ অধোমুখে বললেন— মণি তো নেই, আমি শতধন্বাকে মেরেও তাঁর কাছে মণিরত্ন পাইনি। বলরাম ক্রুদ্ধ হলেন এক নিমেষে, তিনি যা বিশ্বাস করেছিলেন, সেটা ঘটেনি, কিন্তু কেন তাঁর বিশ্বাস আহত হল, কেন কৃষ্ণ মণি পেলেন না— এইসব কূট যুক্তি বলরাম খেয়ালও করেন না। তিনি এতকালের প্রাণের ভাই কৃষ্ণের ওপরেও বিশ্বাস হারালেন। এমনও ভাবলেন হয়তো, মণিটি কৃষ্ণ পেয়েছেন এবং এতটাই তাঁর কুটিল মন যে, সে কথা তিনি চেপে যাচ্ছেন দাদা বলরামের কাছে। বলরাম নিজের মনে নিজের যুক্তি সাজিয়ে যৎপরোনাস্তি ক্রুদ্ধ হয়ে কৃষ্ণকে বললেন— শুধু আমার অনুজ ভাই বলে তোমার এই কাজ আমি কোনও মতে সহ্য করলাম। তোমার মঙ্গল হোক, এটা আমি চাই, কিন্তু আর আমি এখানে থাকব না— ভ্রাতৃত্বান্‌-মর্ষয়াম্যেষ স্বস্তি তেহস্তু ব্ৰজাম্যহম্‌। যেখানে কৃষ্ণকেই এই মুহূর্তে সহ্য করতে পারছেন না বলরাম, সেখানে আর কাকে তিনি সহ্য করবেন। বস্তুত দ্বারকার নিজ ক্ষেত্রে জ্ঞাতি-গুষ্টির মধ্যে এই কূট রাজনীতি এবং স্বার্থান্বেষিতা বলরামের ভাল লাগছিল না হয়তো। অক্রূর, কৃতবর্মা এবং শতধন্বার ক্রিয়াকলাপ এবং দুষ্ট আবেশগুলি তিনি জানতেন কিনা সন্দেহ, কিন্তু তাঁর মনের মধ্যে সেই সযৌক্তিক কুটিলতাও নেই যাতে করে যুক্তি দিয়েও কৃষ্ণকে বিশ্বাস করতে পারেন। ফলে অত্যন্ত খেদের সঙ্গে তিনি কৃষ্ণকে জানালেন— এই রাজধানী দ্বারকার বিষয়েও আমি মাথা ঘামাতে চাই না, তোমাকেও কোনও প্রয়োজন নেই আমার, প্রয়োজন নেই আমার আত্মীয়-স্বজন বৃষ্ণি অন্ধকদের রাজনীতির মধ্যে থাকার— কৃত্যং ন মে দ্বারকয়া ন ত্বয়া ন চ বৃষ্ণিভিঃ। কৃষ্ণ অনেক বোঝানোর চেষ্টা করলেন বলরামকে। অনেক দেবতার দিব্যি দিয়ে বলার চেষ্টা করলেন— বিশ্বাস করুন, দাদা আমার! ওই মণি পাইনি। মণির জন্যই শতধন্বাকে মেরেছি বটে, কিন্তু তার শরীর এবং কাপড়-চোপড় অনেক তল্লাশি করেও আমি মণিটি পেলাম না। বিশ্বাস করুন, আমি সত্যি বলছি। বলরাম বললেন— আর একটাও দিব্যি কেটো না, একটাও শপথ উচ্চারণ করো না। তোমাকে বিশ্বাস করার কোনও কারণ নেই— অলম্‌ এভি মর্মাগ্রতোহলীকশপথৈঃ। বলরাম সন্নিহিত শহর মিথিলায় চলে গেলেন কৃষ্ণকে একা ছেড়ে দিয়ে। একবারও ভাবলেন না— স্যমন্তক মণিটি গেল কোথায়, আর শতধন্বাকে মারার পর মণি না পেয়ে কৃষ্ণেরই বা কী অবস্থা হবে। অর্থাৎ সরল বুদ্ধিতে তিনি ভেবেই নিলেন— স্বয়ং কৃষ্ণ, তার অনুজ মিথ্যাচরণ করছেন, তাঁকে সঠিক তথ্য জানাচ্ছেন না কৃষ্ণ। অতএব দ্বারকা থেকে বলরামের প্রস্থান।

স্যমন্তক মণি নিয়ে নানান কূট প্রসঙ্গ আরও কয়েক বছর ধরে চলেছে এবং এই মণির কারণে কৃষ্ণের মতো মানুষকেও চোর অপবাদ সহ্য করতে হয়েছে, এমনকী বলরামও এই অভিযোক্তাদের মধ্যে পরোক্ষভাবে জড়িত। বলরাম যে ক্রোধে-অনীহায় মিথিলা নগরীতে চলে গেলেন, তিন-তিনটি বছর আর দ্বারকায় ফেরেননি। এদিকে তিন বছরের মধ্যেও যখন এই লক্ষণ প্রকাশ পেল না যে, কৃষ্ণই মণিটি নিয়েছেন, তখন উগ্রসেন এবং অন্যান্য যদুবীরেরা বলরামকে অনেক বুঝিয়ে-সুজিয়ে দ্বারকায় নিয়ে এলেন। স্যমন্তক মণির সম্পূর্ণ কাহিনি যাঁরা জানেন, তাঁরা একথাও জানেন যে, প্রধানত কৃষ্ণের বুদ্ধিতেই স্যমন্তক মণির গোপন রহস্য শেষ পর্যন্ত উদ্‌ঘাটিত হয়। নানা কূটবুদ্ধির যোগ-বিয়োগ কষে কৃষ্ণ যখন বুঝতে পালেন যে, মণিটি অক্রূরের কাছেই আছে, তখন তিনি নিজের বাড়িতেই একটি জরুরি সভা ডেকে যদু-বৃষ্ণি-অন্ধকদের প্রধান পুরুষদের একত্রিত করলেন। যদু-বৃষ্ণিদের সংঘরাষ্ট্র যেভাবে চলত, তাতে এইরকমই নিয়ম। যা কিছুই সিদ্ধান্ত নিতে হত, তা খানিকটা গণতান্ত্রিকভাবেই পরিচালিত হত এবং কৃষ্ণের মতো প্রভাবশালী ব্যক্তিকেও এই পদ্ধতির মধ্যে দিয়েই কাজ করতে হয়েছে।

সভা আরম্ভ হওয়ার নির্ধারিত সময়ের মধ্যে যাদব-বৃষ্ণিদের কাছে সভা ডাকার উদ্দেশ্যটুকু সম্পূর্ণ পরিষ্কার করে দিলেন কৃষ্ণ। অক্রূর সভায় এলেন সামান্য দেরিতে। অক্রূরের সঙ্গে খানিক হাস্য-পরিহাস বিনিময় করার পরেই কৃষ্ণ বললেন— মহাশয়! আমি জানি, শতধন্বা পলায়ন করার আগেই মণিটি আপনার কাছে রেখে গিয়েছিল। না, না, আপনার সংকুচিত হবার কোনও কারণ নেই, মণিটি আপনার কাছেই থাকুক, কেন না মণির যে সুফল সে তো আমরা সবাই ভোগ করছি। আমার বক্তব্য শুধু একটাই— আমার দাদা বলরাম সন্দেহ করেন যে, মণিটি আমিই লুকিয়ে রেখেছি। আমাকে শুধু এই সন্দেহ এবং অপবাদ থেকে মুক্ত করার জন্য, আপনি একবার মণিটি আমাদের দেখান— কিন্তু এষ বলভদ্রোহম্মান্‌ আশঙ্কিতবান্‌। তদস্মৎপ্রীতয়ে দর্শয়…। অক্রূর বুঝতে পারলেন— আর কোনও উপায় নেই। এখন মণির কথা না বললে কৃষ্ণ অনুসন্ধান-অন্বেষণ করেই মণি খুঁজে বার করবেন। অতএব আর বিলম্ব না করে কিছু ওজর এবং সাফাই গেয়ে অক্রূর মণিটি বার করে সবার সামনে রাখলেন। কৃষ্ণকে বললেন— এই গ্রহণ করুন আপনার স্যমন্তক মণি, ইচ্ছে হলে নিজের কাছে রাখুন, নইলে যাকে ইচ্ছে দিন।

স্যমন্তক মণির কাহিনি বিষয়ে বিষ্ণুপুরাণের বিবরণই আমরা সবচেয়ে প্রাচীন বলে মনে করি। সেই বিষ্ণুপুরাণ বলেছে— অক্রূর মণিটি কৃষ্ণের হাতে দিতেই বলরাম ভাবলেন— শুধু কৃষ্ণ কেন আমিও কৃষ্ণের সঙ্গে এই মণির সমান অংশীদার— মমায়ম্‌ অচ্যুতেনৈব সামান্যঃ সমন্বীন্সিতঃ— অতএব মণির ব্যাপারে তিনিও লালায়িত হলেন। অন্যদিকে কৃষ্ণমহিষী সত্যভামা ভাবলেন— এ মণি আমার বাপের ঘরের জিনিস, বাপের সম্পত্তি তো মেয়েরই পাবার কথা— মমৈবেদং পিতৃধনমিতি— অতএব তিনিও মণিটি পেতে ইচ্ছে করলেন। এই অবস্থায় কৃষ্ণ একবার বলরামের মুখের দিকে তাকান, আরেকবার সত্যভামার মুখের দিকে তাকান এবং তিনি বুঝলেন— এ আরেক বিপদ ঘনিয়ে আসছে। নিজের ঘরে এই আসন্ন বিবাদ ডেকে আনার চেয়ে কৃষ্ণ প্রস্তাব করলেন— মণিটি অক্রূরের কাছেই থাকুক, তাতে রাষ্ট্রেরও উপকার এবং সবার উপকার। স্যমন্তক মণির ব্যাপারে সকলের সন্দেহ কিছুটা হলেও মিটল।

এখানে একটাই কথা, যেটা গুরুত্বপূর্ণ, সেটা হল— বলরামের কী অসাধারণ সরল চরিত্র এই সম্পূর্ণ ঘটনার অন্তরাল থেকে বেরিয়ে আসে। ওই যে সত্যভামা ভেবেছিলেন— স্যমন্তক মণি তাঁর পিতৃধন, সেটাই তো ঠিক, হয়তো সেই সূত্রে কৃষ্ণেরও খানিকটা অধিকার আসে স্ত্রী সত্যভামার উত্তরাধিকারের ওপর। কিন্তু বলরাম কোন যুক্তিতে ভাবলেন, যে, কৃষ্ণের সঙ্গে তিনিও মণির সমান অংশীদার। এইখানেই সরলতা, এই মণির ওপরে কৃষ্ণেরই তেমন আইনগত অধিকার নেই, সেখানে বলরামের অধিকার আসে কোথা থেকে? সরলতা একে বলে। ওই যে, শ্বশুরহন্তা শতধন্বাকে শায়েস্তা করতে গিয়ে কৃষ্ণ বলরামের সাহায্য চাইবার সময় নিজের কথা একবার মাত্র উচ্চারণ করেই গৌরবে কৃষ্ণ বহুবচন ব্যবহার করে বলেছিলেন— মণিটি এখন ‘আমাদেরই’ পাবার কথা— স্যমন্তকো মহাবাহো হ্যস্মাকং স ভবিষতি— কৃষ্ণের মুখে এই গৌরব বচন শুনে বলরাম ভাবলেন— তিনিও সত্যভামার পিতৃসম্পত্তির সমান অংশীদার। এমন সরলতা বলরামের পক্ষেই সম্ভব। অন্যদিকে দেখুন— যে কৃষ্ণের সঙ্গে তিনি অভিন্নহৃদয় ছিলেন, যাদব কুলের অন্তঃকলহের ফলে তিনি সবসময় কিন্তু কৃষ্ণের পক্ষে থাকছেন না। এমনকী অন্য প্রতিকূল ব্যক্তিত্বের দ্বারাও তিনি এমনই প্রভাবিত হয়ে পড়েন মাঝে মাঝে যে, প্রাণের ভাই কৃষ্ণকেও তিনি সন্দেহ করে বসেন, তাঁকে অকথা কুকথা বলে দ্বারকার ভদ্রাসন ছেড়ে চলে যেতেও তাঁর বাধে না।

ঘটনা হচ্ছে, স্যমন্তক মণির দুষ্ট চক্র কৃষ্ণ জীবনের ষাট বছর সময় ধরে বহমান ছিল। ঘটনার শেষ হয়েছে যখন, তার মধ্যে আরও অনেক ঘটনা ঘটে গেছে। এই যেমন বলরাম যখন রাগ করে বিদেহপুর মিথিলায় ছিলেন, তখন সেই তিন বছর নাকি কৌরব দুর্যোধন বলরামের কাছে গদাশিক্ষার উন্নততর কৌশলগুলি শিখে নেন। এই খবরটি অবিশ্বাস করার কোনও কারণ নেই, কেন না স্যমন্তক মণির গল্পাংশের মধ্যে একেবারে অপ্রাসঙ্গিকভাবে সমস্ত পুরাণগুলির মধ্যেই এই টুকরো খবরটি আছে এবং এটাও একেবারে স্বীকৃত সত্য যে কুরুরাজ দুর্যোধন বলরামের কাছে গদাযুদ্ধের বিশেষ পাঠ লাভ করেন। গদাযুদ্ধের ব্যাপারে বলরামের শিক্ষা দুর্যোধনের কাজে লেগেছে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত এবং মহাভারতেও তিনি বলরামের শিষ্য বলেই পরিচিত। কিন্তু দুর্যোধনের এই খবর দিয়েও আমরা প্রমাণ করতে চাই যে, এটাও অনেক পরের ঘটনা। স্যমন্তক মণির কাণ্ড চলতে চলতে বলরামের জীবনে আরও অনেক ঘটনা ঘটে গেছে।

সত্যি কথা বলতে কী, যদি মহাভারতের কথা তুলি, তা হলে বলতে হবে— মহাভারতের রঙ্গমঞ্চে বলরামের প্রবেশই ঘটেছে দ্রৌপদীর স্বয়ংবরের সময় একেবারে কৃষ্ণের সঙ্গেই। কিন্তু রাজনৈতিক কারণে এবং অবশ্যই নিজের অসামান্য প্রভাবের কারণে কৃষ্ণ অনেক বেশি জড়িয়ে গিয়েছিলেন কৌরব-পাণ্ডবের রাজনীতির সঙ্গে, কিন্তু সে অর্থে বলরাম ততটা জড়াননি এই রাজনীতিতে, যদিও নানান ব্যাপারে তাঁর হস্তক্ষেপগুলিও তাঁর নিজস্ব ভঙ্গিমাতেই বড় বেশি স্পষ্ট এবং বিশিষ্ট। সত্যি কথা বলতে কী, কুরু-বাড়ির রাজনীতিতে কৃষ্ণের চেয়ে বলরামেরই জড়িয়ে যাবার কারণ এবং সম্ভাব্যতা বেশি ছিল। পাণ্ডব জননী কুন্তী কৃষ্ণ-বলরামের নিজের পিসি— এ তো সামান্য কারণ। এর চেয়েও বেশি যেটা গুরুত্বপূর্ণ সেটা হল— বলরামের মা রোহিণী এই কুরুবংশেরই মেয়ে। হস্তিনাপুরের রাজা শান্তনুর ছোটভাই ছিলেন বাহ্লিক, তাঁর পাঁচ-পাঁচটি মেয়েরই বিয়ে হয়েছিল বলরামের পিতা বসুদেবের সঙ্গে। এঁদের মধ্যে সবার বড় ছিলেন রোহিণী, বড় ঘটা করে পুরাণে যাঁকে কুরুবংশের মূল জনক পুরুর নামে পৌরবী বলে ডাকা হয়েছে— পৌরবী রোহিণী নাম বাহ্লিকস্য আত্মজাভবৎ। পুরু অথবা কুরুবংশের এই মেয়ের গর্ভেই বসুদেবের ঔরসে বলরামের জন্ম। মাতৃবংশের ঘরের ঝগড়া বলেই কি বলরাম শেষ পর্যন্ত কুরু-পাণ্ডবের যুদ্ধে কোনও অংশ নেননি অথবা সেইজন্যই কি তাঁর প্রচ্ছন্ন পক্ষপাত ছিল কুরুবংশের অধস্তন দুর্যোধনের প্রতি, তিনি তাঁর প্রিয়শিষ্যও বটে। তবু এসব আলোচনা পরে হবে।

মহাভারতের রঙ্গমঞ্চে বলরামের প্রবেশ ঘটেছিল কৃষ্ণের হাত ধরেই। দ্রৌপদীর স্বয়ংবরে। সেই দ্রৌপদী যখন লক্ষ্যভেত্তা পুরুষ অর্জুনের গলায় বরমাল্য পরিয়ে দিলেন এবং সমবেত দ্রৌপদী-কামী রাজারা অর্জুনকে একযোগে আক্রমণ করল, সেই অর্জুন যখন এতগুলি রাজার সঙ্গে একাকী যুদ্ধে প্রবৃত্ত হলেন এবং মহাবলী ভীমসেন গাছ উপড়ে ফেলে এলোপাথাড়ি চালিয়ে দিলেন যুধ্যমান রাজমণ্ডলীর মাথার ওপর দিয়ে, তখন কৃষ্ণ বলরামকে চিনিয়ে দিচ্ছিলেন পাণ্ডব ভাইদের এক এক করে। বলছিলেন— ওই যে ধনুক তুলে বাণ ছুড়ছে, ওই ওই হল অর্জুন। ওই যে গাছ নিয়ে ছুটছে খালি হাতে, ওই হল ভীম। ওই যুধিষ্ঠির, ওই নকুল-সহদেব। কৃষ্ণ বললেন— আমি শুনেছিলাম বটে পাণ্ডবেরা মায়ের সঙ্গে জতুগৃহের আগুন থেকে রক্ষা পেয়েছে। আজ এদের সামনাসামনি দেখে শান্তি হল আমার। কৃষ্ণের কথা শুনে নির্জল সাদা মেঘের মতো গায়ের রং— বলরাম বললেন— ভারী ভাল লাগছে দেখে। আমাদের পিসিমা কুন্তী তাঁর ছেলেদের নিয়ে বিপদ থেকে যে বেঁচে ফিরেছেন, দেখে ভাল লাগছে— প্রীতোহস্মি দৃষ্ট্বা হি পিতৃস্বসারং/পৃথাং বিমুক্তাং সহ কৌরবাগ্র্যৈঃ। লক্ষণীয় মায়ের সম্বন্ধে বলরাম কিন্তু পাণ্ডবদের কুরুবংশের ভূষণ বলে সম্বোধন করতেই ভালবাসতেন। আরও খেয়াল রাখা দরকার, স্যমন্তক মণির ঘটনায় সত্রাজিৎ যখন শতধন্বার হাতে মৃত্যু বরণ করেছেন, তখন বারণাবতে জতুগৃহ দগ্ধ হয়ে গেছে, তখন কেবল সে খবর আমরা পেয়েছি। তার মানে, শতধন্বাকে বধ করে নিহিত মণি না পাবার পর কৃষ্ণের ওপরে বলরামের যে সন্দেহ— এই ঘটনা তখন ঘটে গেছে এবং রাগ-অভিমান নিয়ে বলরামের মিথিলা যাওয়া এবং পুনরায় ফিরে আসা, এ-ঘটনাও বুঝি তখন শেষ হয়ে গেছে।

দ্রৌপদীর বিবাহের পর যে সমস্যা হয়েছিল পঞ্চ স্বামীর বৈবাহিক অধিকার নিয়ে, যুধিষ্ঠিরের হস্তক্ষেপে যে সমস্যা মিটে যাবার পরেই রাতের অন্ধকারে সেখানে এসে পৌঁছলেন কৃষ্ণ এবং বলরাম। এই প্রথম পিতৃষ্বসা কুন্তীর সঙ্গে দুই ভাইয়ের দেখা হল, দেখা হল পাণ্ডব-ভাইদের সঙ্গে। তবু কৃষ্ণ যেমন পিসিমা কুন্তীর সামনে অথবা দাদা যুধিষ্ঠিরের পা জড়িয়ে ধরে সোহাগ দেখিয়ে বলতে পারেন— আমি তোমাদের কৃষ্ণ গো, পিতা বসুদেবের ছেলে— কৃষ্ণোহহমস্মীতি নিপীড্য পাদৌ/যুধিষ্ঠিরস্যাজমীঢ়স্য রাজ্ঞঃ— বলরাম এমনকী প্রত্যক্ষত পারেন না। তাঁর ভিতরে যতই আবেগ থাকুক, তিনি এমন আগ বাড়িয়ে কথা বলতে পারেন না। অনেকক্ষণ সেখানে বসে সবার সঙ্গে কথা বলার পর কৃষ্ণ এবং বলরাম অন্ধকার পথে সকলের অজ্ঞাতে চলে গেলেন আপন শিবিরে— প্রাযাৎ শীঘ্রং বলদেবেন সার্ধম্‌।

অনেককাল চলে গেছে এই ঘটনার পরে, অনেক জল গড়িয়ে গেছে গঙ্গা এবং যমুনা দিয়ে। দ্রৌপদীর বিবাহের পর থেকেই পাণ্ডবদের সঙ্গে কৃষ্ণের সম্বন্ধ গভীর হয়েছে, বিশেষত অর্জুন আর কৃষ্ণের সম্পর্ক এখন যতখানি মামাতো-পিসতুতো ভাইয়ের, তার চেয়ে অনেক বেশি হল অভিন্নহৃদয় বন্ধুর। সেই বন্ধু একদিন বিপন্ন হলেন নিজগৃহের আবাসস্থলেই। এটাকে ‘রোমান্টিক’ বিপর্যয় বলাই সঙ্গত, কেন না এক ব্রাহ্মণের গোরু হারিয়েছে বলে চোর ধরে দেবার জন্য অর্জুনকে প্রবেশ করতে হল অস্ত্রাগারে, যেখানে দ্রৌপদীকে নিয়ে বসেছিলেন যুধিষ্ঠির। পূর্বের শর্ত অনুযায়ী অর্জুনকে বনবাসে-তীর্থযাত্রায় বেড়িয়ে পড়তে হল। প্রথম পরিণীতা পত্নীর সঙ্গ লাভ করা হয়নি। অর্জুনের মনে নিশ্চয়ই অন্যতর এক বিষাদ ছিল, এখনকার ভাষায় তাকে ‘ফ্রাষ্ট্রেশন’ বলাই ভাল। হয়তো এই বিষাদের ফলেই অর্জুনের বনবাস-জীবনে তিন-তিনটি উত্তমা রমণীর পদ্‌সঞ্চার ঘটেছে, উলূপী, চিত্রাঙ্গদা এবং অবশেষে সুভদ্রা। প্রথম দুই রমণী নিয়ে আমাদের কোনও কথা নেই, কিন্তু সুভদ্রাকে নিয়ে কথা আছে। কেন না কৃষ্ণ-জ্যেষ্ঠ বলরামকে এখানে অন্যরূপে দেখব।

দেখুন, রৈবতক পাহাড়ে সেদিন উৎসব চলছিল যাদব-বৃষ্ণিদের। রৈবতক পাহাড়টাকে চেনা উচিত, বলরামের স্ত্রী রেবতীর ঠাকুরদাদা রেবত-রাজার নামে এই পাহাড়। যদু-বৃষ্ণিদের ইচ্ছে হলেই রৈবতক পাহাড়ে চলে আসতেন, সেখানে নাচ-গান-পান-ভোজন চলত, চলত নানারকম হই-হুল্লোড়। এই উৎসবে অনেককেই আমরা আসতে দেখেছি, যদুবংশের কুমার-কিশোরেরা নানা পরিধান পরে উৎসবে মেতেছেন। গায়ক-বাদকেরা বাজনা বাজিয়ে গান গেয়ে বিনোদন বিস্তারের চেষ্টা করছে। বলরামকে দেখতে পাচ্ছি— তিনি আসছেন রেবতীর কাঁধে হাত রেখে ঈষৎ মত্ত অবস্থায় এবং তাঁর পিছন পিছন আসছেন নৃত্য-গীত-পারদর্শী গন্ধর্বেরা— ততো হলধরঃ ক্ষীবো রেবতীসহিতঃ প্রভুঃ।

দেখুন, একটা কথা আমার খুব মনে হয়। মনে হয় যে, বলরাম নৃত্য-গীত-বাদিত্রের বড় রসিক ছিলেন। হরিবংশ বা মহাভারত, যেখানেই আমরা প্রভু বলরামকে উৎসবে মেতে উঠতে দেখেছি, সেখানেই নৃত্যগীতের একটা অনুষঙ্গ বলরামকে জড়িয়ে থাকে। বাইরে থেকে বড় নিয়ত গম্ভীর মানুষ বলে মনে হলেও তাঁর ভিতরে ভিতরে আবেগের একটি অগ্নিকুণ্ড ছিল। যার জন্য মাঝে মাঝেই তাঁর এত রাগ, এত উৎসাহ অথবা এত অভিমান। আর নৃত্যগীতের অনুষঙ্গও তো আবেগ নামক মধুরতার লীলায়িত প্রকাশ। বলরামকে দেখুন— তাঁর শ্বশুরমশাই রৈবত ককুদ্মী গান শুনতে শুনতে কত দৈববর্ষ কাটিয়ে দিয়েছিলেন ব্রহ্মলোকে, সেই গানের আসরে বলরামের স্ত্রী রেবতীও কিন্তু অন্যতম সহৃদয়। হয়তো এই নৃত্য-গীতের অনুষঙ্গও রেবতীর সঙ্গে বলরামের বিবাহ-ঘটনার অন্যতম কারণ। হয়তো সেই অনুষঙ্গেই গীত-নৃত্য-বিশারদ গন্ধর্বদের বলরামের পিছন পিছন যেতে দেখেছি রৈবতকের পাহাড়ি উৎসবে— অনুগম্যমানো গন্ধর্বৈরচরৎ তত্র ভারত।

এই রৈবতক পাহাড়ের বিচিত্র উৎসবের মধ্যেই সখী-পরিবৃতা, সুন্দরী সুভদ্রাকে প্রথম দেখেন অর্জুন। তাঁর দিকে অনিমিষে তাকিয়ে থাকতে দেখেই যদুসিংহ কৃষ্ণ অর্জুনকে প্রস্তাব দেন— বলব নাকি পিতা-ঠাকুরদের, সুভদ্রার একটা সম্বন্ধ হোক তোমার সঙ্গে। আবেগ-স্খলিত অর্জুন যখন সত্যিই সুন্দরী সুভদ্রাকে বিবাহের ইচ্ছা প্রকাশ করলেন, তখন কৃষ্ণ কিন্তু বাবা-মাকে বলে বিবাহ-সম্বন্ধ করার কোনও ইঙ্গিতও দিলেন না। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন নিশ্চয়ই যে, এইরকম বিয়ে, যার মধ্যে ঈষৎ দূরগত হলেও মামাতো বোনের একটা সম্পর্ক আছে, সেখানে এমন একটা বৈবাহিক সম্বন্ধ শেষ পর্যন্ত টেকানো যাবে না। তিনি অর্জুনকে বললেন— তুমি না ক্ষত্রিয়! জোর করে কন্যাহরণ করে নিয়ে গিয়ে বিবাহ করাটা তো তোমার কাছে অধর্ম নয় কিছু— প্রসহ্য হরণঞ্চাপি ক্ষত্রিয়াণাং প্রশস্যতে। কৃষ্ণের কথা শুনে অর্জুন প্রস্তুত হলেন। সুভদ্রা যখন রৈবতক পর্বত থেকে উৎসবান্তে দ্বারকায় ফিরছেন, তখন অর্জুন পূর্ণ যোদ্ধার বেশে সুভদ্রাকে হরণ করে বসালেন রথে। বায়ুবেগে রথ ধেয়ে চলল হস্তিনাপুরের দিকে, কিন্তু যে কোনও মুহূর্তে যুদ্ধের জন্য অর্জুনের পূর্ণ প্রস্তুতি রইল মনে মনে।

এমন একটা কন্যাহরণ দেখে পুরবাসী জন এবং দূতেরা সব খবর দিল যদু-বৃষ্ণিবীরদের কাছে। সুধর্মার সজ্জিত আবাসে জরুরি সভা বসল। সভাপাল চেতনার ভেরী বাজালেন সমস্ত সৈন্য-সামন্তদের যুদ্ধকালীন প্রস্তুতি নেবার জন্য— সমাজঘ্নে মহাঘোষাং ভেরীং সান্নাহিকীং ততঃ। সভাপাল কৃষ্ণ, বলরাম এবং অন্যান্য যদুবীরদের সামনে অর্জুনের ধৃষ্টতার কথা জানাতেই সমস্ত যদু-বৃষ্ণি-বীরেরা রাগে চেঁচাতে লাগলেন— ওরে আমার রথে ঘোড়া জুতে দে, ওরে আমার খড়্গটা নিয়ে আয় তো। কেউ কেউ নিজেরাই চলে গেলেন যুদ্ধের শেষ প্রস্তুতি তদারক করার জন্য। সুধর্মা-সভায় যখন এইরকম তুমুল চেঁচামেচি চলছে, তখন কৃষ্ণ এক্কেবারে চুপ করে বসেছিলেন। আর ঠিক সেইজন্যেই বলরামের একটু সন্দেহ হল, যদিও তখনও তিনি অন্যান্য যদুবীরদের মতোই ক্রোধে আগুন হয়ে বসেছিলেন, তাঁর চোখ তখনও মদ্যপানে আরক্ত— নীলবাসা মদোৎসিক্ত ইদং বচনমব্রবীৎ। বলরাম বললেন— তোমরা সব এত লাফালাফি করছ কেন, কৃষ্ণ কিন্তু এখনও একটাও কথা বলেননি। আগে তাঁর কথাটা শোনো, তাঁর ভাব এবং ইচ্ছে বুঝে তবেই না কাজ করবে— এষ তাবদ্‌ অভিপ্রায়ম্‌ আখ্যাতু স্বং মহামতিঃ।

বলরামের কথা যুক্তিযুক্ত বুঝে সকলেই চুপ করে গেল, বসেও পড়ল সবাই নিজের নিজের জায়গায়। বলরাম এবার কৃষ্ণকে বলতে আরম্ভ করলেন, তবে কতটা রাগ তিনি মনের মধ্যে পুষছিলেন তা বোঝা যায় তাঁর প্রশ্ন করার ভঙ্গি থেকেই। বলরাম বললেন— তুমি যে সব চোখে দেখেও একটি কথা না বলে চুপ করে বসে আছ, এর মানেটা কী— কিম্‌-অবাগ্‌-উপবিষ্টোহসি প্রেক্ষমানো জনার্দন। দেখো, অর্জুন তোমার বন্ধু বটে, আত্মীয়ও বটে। কিন্তু তাঁর প্রতি যে অতিথি-সৎকারের বাহুল্য দেখিয়েছি আমরা, সে তোমার জন্যই প্রধানত— সৎকৃতস্ত্বৎকৃতে পার্থঃ সর্বৈরস্মাভিরচ্যুত। তবে এখন বুঝতে পারছি— ওই কুলাঙ্গারটা আমাদের এতটুকু সমাদরের যোগ্যও ছিল না। আমি ভাবতে পারি না, কেমন ছোটলোক এই ছেলেটা! আরে যে বাড়িতে বসে যে থালাটায় আমাদের অন্নপান খেলি, সেই থালাটাই তো ভেঙে দিয়ে গেলি, এমন কেউ করে— কো হি তত্রৈব ভুক্ত্বান্নং ভাজনং ভেত্তুমর্হতি! এ কি কোনও ভদ্রলোকের কাজ! সে আমাদের সঙ্গে ভাল সম্পর্ক চেয়েছে, আমরাও সেইমতো তাকে সমাদর করেছি। কিন্তু এটা সে কী করল? যার বেঁচে থাকার ইচ্ছে আছে, সে কি কখনও এই কাজ করতে পারে।

সত্যি কথা বলতে কী, যদু-বৃষ্ণিদের যুদ্ধে খুব সুনাম ছিল। যদু-বৃষ্ণিদের সৈন্য-সামন্ত যে রাজার পক্ষ নিয়ে লড়ত, তাদের জয় অনিবার্য ছিল বলেই মনে করা হত সে-সময়ে। প্রধানত সেই যুদ্ধবীরদের ভরসাতেই বলরাম কথা বলছেন, যদিও যে-কৃষ্ণের কথা বা যাঁর সিদ্ধান্ত শোনার জন্য তিনি প্রথম অনুযোগ করেছিলেন, তাঁকে কথা বলতে না দিয়েই তিনি নিজের মনের ঝাল মিটিয়ে চলেছেন এখনও পর্যন্ত। বলরাম কৃষ্ণকে বললেন— সে আমাদের সবাইকে অপমান করেছে, অপমান করেছে তোমাকেও। তবে জেনে রেখো, সুভদ্রাকে সে সঙ্গে করে নিয়ে গেছে মানে সে নিজের মৃত্যুকে সঙ্গে করে নিয়ে গেছে। কেন যে সে নিজের মাথার ওপর আমার লাথি খাওয়ার জায়গা করে রাখল, জানি না— কথং হি শিরসো মধ্যে কৃতং তেন পদং মম— তবে আমি কিছুতেই এ-অপমান সহ্য করব না। আজকে আমি এই পৃথিবী কৌরব-পাণ্ডবহীন করে ছাড়ব। অর্জুনের এই অন্যায় ব্যবহার আমি কিছুতেই সহ্য করব না— ন হি মে মর্ষণীয়োহম্‌ অর্জুনস্য ব্যতিক্রমঃ। বলরামের প্রতিপাদ্য শুনে সমবেত যদু-বৃষ্ণি-প্রধানেরা সম্পূর্ণ সমর্থন করলেন তাঁকে। এবং বলরামের কথাগুলি সুধর্মা-সভায় আলোচনার ভঙ্গিতে উচ্চারিত হয়নি। রাগে তিনি গর্জন করছিলেন— অতএব যারা পূর্বেই অর্জুনের ব্যবহারে ক্ষুদ্ধ হয়েছিলেন, তাঁরা তো সমর্থন করবেনই বলরামকে— তং তথা গর্জমানস্য মেঘদুন্দুভি-নিঃস্বনম্‌— কারণ তাঁরাও অর্জুনের ব্যবহারে আহত এবং ক্রুদ্ধ হয়েছেন।

কৃষ্ণ এরকম নন। কথা বলবার সময় তিনি ক্রুদ্ধ হন না, ক্রুদ্ধ হলেও গর্জন করে কথা বলেন না। তিনি অর্জুনের সঙ্গে নিজেদের ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ, অর্জুনের শক্তি, ক্ষমতা এবং প্রভাব ব্যাখ্যা করে এইটাই বোঝানোর চেষ্টা করলেন যে, অর্জুন এমন কোনও অন্যায় করেননি, যাতে তাঁর বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা করা যায়। বিশেষত যুদ্ধ হলে অর্জুনের মতো মহাবীরের হাতে যদি যদু-বৃষ্ণিরা হেরে যান, তবে সুভদ্রার সঙ্গে তাঁর বিয়েটাও যেমন আটকানো যাবে না, তেমনই যদু-বৃষ্ণিদের ঘাড়ে পরাজয়ের ব্যথা এসে লাগবে। অতএব এইসব যুদ্ধ-টুদ্ধ বাদ দিয়ে শীঘ্রগামী রথে তার পিছন পিছন ধাওয়া করো, তারপর খুশি মনে তাকে ফিরিয়ে আনো দ্বারকায়, এটাই আমার মত— নিবর্তয়ত সংহৃষ্টা মমৈষা পরমা মতিঃ।

আশ্চর্য কী জানেন, এই যে বলরাম এত হম্বিতম্বি করে যদু-প্রধানদের খেপিয়ে তুললেন, এমনকী কৃষ্ণকেও যা নয় তাই বললেন, এমনকী কৃষ্ণ বেশি কথা বলছেন না বলে নিজেই কৃষ্ণকে যা-নয় তাই বলে গালাগালি দিলেন, সেই বলরাম কিন্তু আর একটা কথাও বললেন না। যদু-বৃষ্ণি-প্রধানেরা কৃষ্ণের কথা শুনে অর্জুনকে দ্বারকায় ফিরিয়ে আনলেন। মহাসমারোহে বিবাহের সম্বন্ধ পাকা হয়ে গেল এবং তারপর অর্জুন যখন সুভদ্রাকে নিয়ে ইন্দ্রপ্রস্থে ফিরছেন, তখন বৈবাহিক কুটুম্বেরা যাঁরা অনুগামী হয়েছিলেন অর্জুনের সঙ্গে, তাঁদের মধ্যে আমরা বলরামকেও দেখতে পাচ্ছি নির্বিকার স্ববিরোধিতায়। কৃষ্ণের সঙ্গে তিনিও আসছেন অর্জুনের বৈবাহিক সম্বন্ধের অনুসরণ করে— আজগাম বিশুদ্ধাত্মা সহ রামেণ কেশবঃ। অর্জনের সঙ্গে সুভদ্রার বিয়ে হল সম্পূর্ণ আড়ম্বরে। যদু-বৃষ্ণিদের বাড়ি থেকে কত যে উপহার এল ইন্দ্রপ্রস্থে, তা বলবার নয়। মহাভারতের কবি অথবা তাঁর পরম্পরাপ্রাপ্ত শিষ্যেরা এই সর্গের নাম দিয়েছেন ‘হরণাহরণ পর্ব’, অর্থাৎ সুভদ্রার হরণের সঙ্গে বৈবাহিক উপহারের আহরণও এখানে লক্ষ্য করার মতো। আর বলরামের কথা কী বলব, যিনি এই কয়েক দিন আগে অর্জুনকে মেরে পৃথিবীকে নিষ্পাণ্ডব, নিষ্কৌরব করতে চাইছিলেন, তিনি এই বিবাহ-সম্বন্ধের প্রতি পূর্ণ মর্যাদা জ্ঞাপন করে— সম্বন্ধং প্রতিমানয়ন্‌— অর্জুনকে হাজারো উপহার দিলেন শুধু এই কৃতজ্ঞতায় যে, অর্জুন সুভদ্রার পাণিগ্রহণ করেছেন— রামঃ পাণিগ্রহণিকং দদৌ পার্থায় লাঙ্গলী। এই অসামান্য উপহারের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল সমরহস্তী— সে সব এমন হাতি, যার গুণ বলে শেষ করা যায় না, যুদ্ধে সেসব হাতি কোনওদিন পরাজয় স্বীকার করেনি। এই বিশাল বিশাল হাতির সঙ্গে সোনাদানা এবং বস্ত্ৰ-পরিধানও বলরামেরই দানের বিষয় ছিল। অর্জুনের হয়ে মহারাজ যুধিষ্ঠিরই সমস্ত দান গ্রহণ করলেন। ইন্দ্রপ্রস্থ থেকে ফেরবার সময় কৃষ্ণ থেকে গেলেন যুধিষ্ঠিরের রাজধানীতে অর্জুনের সঙ্গে, কিন্তু বৃষ্ণি-যাদবদের সঙ্গে নিয়ে কন্যাপক্ষের প্রধান প্রতিনিধির মতো দ্বারকায় ফিরে গেলেন বলরাম, এবং যুধিষ্ঠিরও পরম সম্মানে বলরামের সঙ্গে বহুতর উপহার পাঠালেন দ্বারকায়, কুটুম্ব-সম্বন্ধের নিদর্শন হিসেবে।

কেমন বুঝলেন বলরামকে। বড় সরল, বড় সহজ মানুষ। তিনি ক্রোধ জিইয়ে রাখতে পারেন না, রাগ হলে পর মুহূর্তেই তা ভুলে যেতে পারেন নিরাকুল সদ্ভাবনায়। এই সদ্ভাবনা এতটাই যে, ভবিষ্যতে যদি পুনরায় সে ঘটনার উল্লেখ হয়, সেই স্মৃতি যদি মনে করিয়ে দেওয়া হয় তাতেও তিনি রাগ করেন না, বরঞ্চ তা নিয়ে হাসিঠাট্টাও করতে পারেন। আমরা যে একেবারে অমূলক কথা বলছি না, তার প্রমাণ মিলবে হরিবংশ ঠাকুরের জবানীতে। আগেই বলেছিলাম— যাদব-বৃষ্ণিদের মধ্যে উৎসবের চল ছিল খুবই বেশি। হয়তো বিভিন্ন কুলপ্রধানদের নিয়ে একটা সংঘরাষ্ট্র তৈরি হয়েছিল বলেই, তাঁরা মাঝে মাঝেই একত্র হয়ে উৎসবে মেতে উঠতেন। এবারে দেখছি, তাঁরা জলক্রীড়া করতে গেছেন সাগরে। সাগরের পারেই দ্বারবতী নগরী, অতএব সাড়ম্বরে জলক্রীড়ার আয়োজন খুব স্বাভাবিক ছিল এখানে।

নির্দিষ্ট দিনে বৃষ্ণি-যাদবরা সকলেই চলে এলেন সাগরতীরে, কিন্তু হরিবংশ ঠাকুর তাঁর অধ্যায় রচনা আরম্ভ করলেন বলরামকে দিয়ে। বিলাসী বলরাম সারা অঙ্গে চন্দনের অলকা-তিলকা চিত্তির করে, প্রিয় পত্নী রেবতীর কাঁধে নিজের ভার খানিকটা ন্যস্ত করে সাগর-পারে এসে পৌঁছলেন; কারণটা বোঝাই যাচ্ছে, সেই মদ্যপানের ফল— হাত-পা একটু স্খলিত হচ্ছে মাঝে মাঝে— রক্তেক্ষণো রেবতীমাশ্রয়িত্বা/কাদম্বরীপানকলঃ পৃথুশ্রীঃ। আপনারা এতক্ষণে বুঝেই গেছেন নিশ্চয় যে, এমন অবস্থায় বলরামের মতো বিরাট পুরুষকে ভারী সুন্দর দেখায়। অমন ফর্সা, লম্বা চেহারা, পরনে নীল বাস, এক কানে সেই বজ্রমণির কুণ্ডল— সাগরের জলে এসে দাঁড়ালেন বলরাম, যেন মনে হল— সাগর থেকে চাঁদ উঠছে, এতই সুন্দর— ররাজ রামোহম্বুদমধ্যমেত্য/সম্পূর্ণবিম্বো ভগবান্ ইবেন্দুঃ। রেবতী বলরামের সঙ্গে আছেন, মাঝে মাঝে স্বামীর মুখের দিকে তাকিয়ে তির্যকদৃষ্টির ব্যঞ্জনা সৃষ্টি করছেন। রেবতী গান-বাজনার ঘরের মেয়ে, তাঁকে এবং অবশ্যই সুরের রসিক বলরামকেও বিনোদিত করার জন্য কৃষ্ণের আদেশে স্বৰ্গবেশ্যা অপ্সরারা সব নেমে এল নাচতে— তাং রেবতীং চাপ্যথ বাপি রামং/সর্বা নমস্কৃত্য বরাঙ্গযষ্ট্যঃ।

এখানেও ‘রাস’ নৃত্যের কথা পাচ্ছি। তাই আগে বলেছিলাম যে, ‘রাস’ একপ্রকার প্রাচীন নৃত্য এবং তা শুধু ব্রজগোপীদেরই একচেটিয়া নয়। এবারে আসল কথায় আসি— এই যে নৃত্য-গীত চলছিল, তার বিষয় বহুতর অবশ্যই, কিন্তু প্রধানত কৃষ্ণ-বলরামের বিভিন্ন বীরত্বের ঘটনা নিয়েই অপ্সরাদের নৃত্য-গীত এবং অভিনয়ের পালা চলছিল। স্বয়ং নারদমুনি এই নৃত্যগীত পরিচালনা করছিলেন। এখানে লক্ষণীয় বিষয় হল— ওই নৃত্য-গীত-অভিনয়ের মধ্যে অর্জুন যেভাবে সুভদ্রা হরণ করে বিজয় লাভ করেছিলেন, এই অভিনয়টাও অন্তর্ভুক্ত ছিল, আর তা ছিল যখন, তখন বলরাম তাঁর প্রথম প্রতিক্রিয়ায় কী বলেছিলেন এবং পরে তিনি কীভাবে চুপ করে গেছেন, তারও অভিনয়-ক্রিয়া ছিল নিশ্চয়ই— ততঃ সুভদ্রাহরণে জয়ঞ্চ/চিত্রাণি চানেককথাশ্রয়াণি। কিন্তু এতসব নাটক দেখে বলরাম এতটুকু বিড়ম্বিত বোধ করেন না। এতই তাঁর আনন্দ হচ্ছে যে, কাদম্বরীর আবেশে মাঝে মাঝে তিনি আধুনিকের মতোই উ-উ-হু-উ বলে চেঁচিয়ে উঠছেন— কাদম্বরী-পান-মদোৎকটস্তু/বলঃ পৃথুশ্রীঃ স চুকূর্দ রামঃ— আর মাঝে মাঝে প্রিয়া-মহিষী রেবতীর হাতে হাত মিলিয়ে নৃত্য-গীতের সমে গিয়ে তাল ঠুকছেন— সহস্ততালং মধুরং সমঞ্চ/স্বভাৰ্যয়া রেবতরাজপুত্র্যা। বলরামের আনন্দ বর্ধনের জন্য কৃষ্ণকেও এই আসরে সত্যভামার সঙ্গে নাচতে হয়েছে এমনকী, নিমন্ত্রিত অর্জুনকেও নাচতে হয়েছে সুন্দরাঙ্গী সুভদ্রার সঙ্গে, উদ্দেশ্য একটাই— নাচলে-গাইলে বলরাম খুশি হবেন— হর্ষাগমার্থঞ্চ বলস্য ধীমান্।

॥ ৯ ॥

দ্রৌপদীর স্বয়ম্বরেও তিনি এসেছিলেন, সুভদ্রার বিয়ের সময়েও অবশেষে যথেষ্টই মেলামেশা করেছেন পাণ্ডবদের সঙ্গে, এমনকী যুধিষ্ঠিরের রাজসূয় যজ্ঞের আসরেও তাঁকে দেখা গেছে, কিন্তু তবু কেন জানি না, বলরামের সঙ্গে পাণ্ডবদের তেমন গভীর মেলামেশা অথবা তেমন কোনও গভীর ভাব-বিশ্বাসের সম্পর্কও গড়ে ওঠেনি। কর্তব্য এবং দায়িত্বের একান্ত আসনগুলিতে নিতান্ত সপ্রতিভ ভাবেই তিনি পাণ্ডবদের রাজধানীতে উপনিষন্ন বটে, এবং পাণ্ডবরা যথেষ্ট সমীহও লাভ করেন তাঁর কাছে। কিন্তু এটা কখনওই বলা যাবে না যে, অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ আত্মীয়তার সূত্র ধরে অথবা যুধিষ্ঠিরের ধর্মাত্মতায় তিনি এতটা মুগ্ধ ছিলেন যে, কারণে-অকারণে তিনি ইন্দ্রপ্রস্থ বা হস্তিনাপুরের রাজনীতিতে মাথা গলিয়ে দেবেন। অন্যদিকে কৌরব দুর্যোধন গদাযুদ্ধে তাঁর অতিপ্রিয় শিষ্য বটে, কিন্তু তাঁর জন্যও বলরামের এত মায়া-মোহ ছিল না যে, নিরন্তর তিনি তাঁর হয়েই কথা বলবেন। অবশ্য কৃষ্ণের প্রতি তাঁর প্রিয়ত্বের সম্বন্ধও তাঁকে পুরোপুরি দুর্যোধনের পক্ষপাতী হতে দেয়নি। বস্তুত রাজনীতি এবং রাজনৈতিক কূটনীতি, কোনওটাই বলরামের কাছে খুব প্রিয় বস্তু ছিল না। এমনও হতে পারে যে, রাজনীতির ব্যাপারে ছোট ভাই কৃষ্ণের অতিরিক্ত সচেতনতা এবং অতিরিক্ত সক্রিয়তা বলরামের মনকে বিপরীত প্রতিক্রিয়ায় বেশ খানিকটা উদাসীন করে তুলেছিল। ফলত অন্যান্য রাজবংশের উত্থান-পতন এবং সেই তুলনায় নিজেদের অর্থাৎ যদু-বৃষ্ণিদের আপেক্ষিক রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠা নিয়ে বলরাম কখনওই খুব একটা মাথা ঘামাতে চাননি, অথবা মাথা ঘামাতে তাঁর ভালও লাগত না। বিশেষত পাণ্ডব এবং কৌরবদের ঘরোয়া রাজনীতি, যা তখনকার বৈদেশিক রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে যথেষ্ট টানা-পোড়েন তৈরি করেছিল, সেই রাজনীতিতেও বলরাম একান্ত উদাসীন ছিলেন। অন্তত দৃঢ় পক্ষপাত বলতে যা বুঝি, সে-ব্যাপারে বলরাম নিতান্তই মুক্ত ছিলেন। যদিও কখনও কখনও এক পক্ষের জন্য সমবেদনা, অন্য পক্ষের প্রতি উষ্মা— এগুলো যে আমরা টের পাই, সেটা একেবারেই বলরামের নিজস্ব স্বভাবের ব্যাপার এবং সে-স্বভাব আগেই বলেছি— অনেকটাই চঞ্চল, বলা ভাল, এখনই যেরকম, তখনই সেরকম নয়— ধরনের।

যুধিষ্ঠিরের রাজসূয় যজ্ঞারম্ভের আগে এবং পরে যেভাবে জরাসন্ধ এবং শিশুপাল মারা গেলেন, তাতে ভারতবর্ষের রাজনৈতিক ক্ষেত্রে একটা বিরাট পরিবর্তন এসেছিল। জরাসন্ধ এমনই প্রতাপশালী রাজা ছিলেন, যাঁকে অতিক্রম করে দুর্যোধন বা যুধিষ্ঠির কারও পক্ষেই প্রতিষ্ঠা লাভ করা সম্ভব ছিল না। দ্বারকা তথা মথুরা-শূরসেনের বৃষ্ণি-যাদবরা তো তাঁর চিরশত্রু। যাইহোক, কৃষ্ণের বুদ্ধিতে যখন জরাসন্ধ হত হলেন, তখন প্রত্যক্ষত সেটা যুধিষ্ঠিরের শক্তিবৃদ্ধির সহায়ক হলেও পরোক্ষে দুর্যোধন-ধৃতরাষ্ট্রেরও রাজনৈতিক ক্ষমত বাড়িয়ে দিল। এই পরিস্থিতিটা খুব পরিষ্কার হয়ে যায় একটা সাধারণ ঘটনায়।

কৃষ্ণের অন্যতমা স্ত্রী জাম্ববতীর গর্ভজাত কৃষ্ণের পুত্র শাম্ব দেখতে অসাধারণ সুন্দর ছিলেন। হস্তিনাপুরের অধিকর্তা দুর্যোধন নিজের মেয়ে লক্ষণার বিয়ের জন্য স্বয়ম্বর সভার আয়োজন করেছিলেন। স্বয়ম্বর-বেশে সজ্জিতা এই কন্যাটিকে কৃষ্ণপুত্র শাম্ব সবলে হরণ করে বিবাহ করতে চাইলেন। তাঁর প্রচেষ্টা সম্পূর্ণ সফল হবার আগেই কর্ণ-দুর্যোধন, ভীষ্ম-দ্রোণেরা শাম্বকে ধরে এনে বন্দি করে রাখলেন হস্তিনাপুরের বন্দিশালায়। কৃষ্ণপুত্রের প্রতি এই আচরণে যাদব-বৃষ্ণিরা যার-পর-নাই ক্ষুব্ধ হলেন এবং এই ঘটনাকে তাঁরা জাতির অপমান বলে স্থির করলেন। মহাশক্তিধর বলরাম অবশ্য বৃষ্ণি-যাদবদের এই ক্ষুব্ধতায় তেমন কর্ণপাত করলেন না। তিনি মদ্যপান করেছিলেন, ফলে তাঁর চক্ষু দুটি যেমন অর্ধনিমীলিত ছিল, তেমনই কথা বলার সময় অক্ষরগুলিও স্খলিত হচ্ছিল। এই অর্ধনিমীলিত-স্খলিত ভাষণেই তিনি সমবেত যাদব-বৃষ্ণিদের কথার প্রতিবাদ করলেন— নিবাৰ্য্য তান্‌ বলঃ প্রাহ মদ-লোলাকুলাক্ষরম্‌। তিনি বললেন— দেখো কুমার দুর্যোধন আমার গদাযুদ্ধের শিষ্য বলে কথা। আমি গিয়ে সেখানে দাঁড়ালেই কৌরবদের সমস্ত জারিজুরি ঘুচে যাবে। আমি একা সেখানে যাব এবং আমার মুখের একটি কথায় কৌরবরা শাম্বকে ছেড়ে দেবে— মোক্ষ্যান্তি মদ্বচনাদ্‌ যাস্যাম্যেকো হি কৌরবান্‌। তোমরা সব বসে থাকো এখানে।

বলরাম তাঁর বিশ্বাসমতো বক্তব্য স্থাপনা করে একাকী তাঁর লাঙলটি কাঁধে নিয়ে উপস্থিত হলেন হস্তিনাপুরীতে। তবে তিনি রাজধানীর ভিতরে প্রবেশ করলেন না, নগরীর বাইরে এক আরাম-উদ্যানের মধ্যে নিজের আস্তানা বানিয়ে নিলেন— বাহ্যোপবনমধ্যেহভূদ্‌নবিবেশ চ তৎ পুরম্‌। বলরাম নগরীর বাইরে উদ্যান-ভূমিতে অপেক্ষা করছেন শুনে দুর্যোধন-দুঃশাসন-কৰ্ণরা গোরু, জল, পাদ্য-অর্ঘ্যের উপহার নিয়ে উপস্থিত হলেন বলরামের কাছে। সময়োচিত ভদ্রতা দেখে বলরামও স্মিতহাস্যে পাদ্য-অর্ঘ্য স্বীকার করে প্রথম কথাতেই বললেন— মথুরা-দ্বারকার রাজা উগ্রসেন আদেশ দিয়েছেন শাম্বকে এখনই আমার হাতে প্রত্যর্পণ করো— আজ্ঞাপয়ত্যুগ্রসেনঃ শাম্বমাশু বিমুঞ্চত। বলরাম যেভাবে কথা বললেন, তাতে বোঝা গেল— ব্যাপারটা আর ব্যক্তিগত সম্পর্ক বা ব্যক্তিগত মান-অপমানের পর্যায়ে নেই, শাম্বের বিবাহ এবং বন্ধনের ঘটনা এখন পুরোপুরি একটা রাজনৈতিক ‘ইস্যু’ হয়ে দাঁড়িয়েছে। শুধু তাই নয়, এই সমস্যার সমাধান রীতিমতো রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করছে, নির্ভর করছে নাগরিকতার সুরক্ষা-বিধানের ওপর। কৃষ্ণপুত্র শাম্ব কী করেছেন না-করেছেন, সেটা বড় কথা নয়। বড় কথা হল— শাম্ব মথুরা-শূরসেন রাজ্যের নাগরিক, তাঁর নিবাসভূমি দ্বারকা। তাঁকে তুচ্ছ কারণে বন্দি করা হয়েছে, অতএব রাজা উগ্রসেন আজ্ঞা দিচ্ছেন, যাতে বিনা শর্তে হস্তিনাপুরের রাজা শাম্বকে ছেড়ে দেন।

যেভাবে বলরাম কথা বলেছেন, তার রাজনৈতিক তাৎপর্য বুঝতে গেলে যে বিস্তারিত পটভূমিকা রচনা করা দরকার, তার সময় এবং সুযোগ কোনওটাই এই প্রবন্ধে নেই। তবে এটুকু বলতেই হবে যে, কংস এবং জরাসন্ধের মৃত্যুর পর যে রাজনৈতিক মেরুকরণ ঘটেছিল সেখানে হস্তিনাপুরের দুর্যোধন যেমন পাদপ্রদীপের আলোয় আসতে চাইছিলেন, তেমনই একইভাবে যদু-বৃষ্ণিদের সংঘরাষ্ট্রও কংস-জরাসন্ধের মূল বিজেতা হিসেবে ভারতবর্ষের রাজনীতিতে নিজেদের গুরুত্ব প্রতিষ্ঠা করতে চাইছিল। কিন্তু হস্তিনাপুরের রাজা যেহেতু পূর্বে জরাসন্ধের মিত্র গোষ্ঠীর লোক ছিলেন এবং যেহেতু তিনি এবং তাঁর মতো লোকেরা রাজতন্ত্রের ধারক এবং বাহক, অতএব সংঘরাষ্ট্রের কুল-প্রধানদের তাঁরা রাজা বলে মনে করেন না। বিশেষত, কংসপিতা মহারাজ উগ্রসেন, যিনি সংঘরাষ্ট্রের ভাবনা মেনে রাজার পদবি ধারণ করেন মাত্র, তেমন মানুষ যদি আদেশ করেন, আজ্ঞা করেন, তবে একনায়ক তথা রাজতন্ত্রে বিশ্বাসী অভিজাতম্মন্য মানুষের রাগ হয়।

বলরামের কথা শুনে কৌরব পক্ষের যুবক-বৃদ্ধ সবাই ভীষণ ক্রুদ্ধ হলেন— ভীষ্ম-দ্রোণ, দুর্যোধন-কর্ণ, সবাই। তাঁরা উগ্রসেনের কথা ছেড়ে আরও এক কাঠি এগিয়ে গিয়ে বললেন— এসব আপনি কী বলছেন বলরাম? যাদবদের মধ্যে এমন কে আছে, যে এই প্রসিদ্ধ কুরুবংশের জাতক আমাদেরও আদেশ করতে পারে— আজ্ঞাং কুরুকুলোত্থানাং যাদবঃ কঃ করিষ্যতি? বেশ বোঝা যায়, কথাটা শুধু উগ্রসেনের প্রসঙ্গেই থেমে থাকল না, এ-কথার লক্ষ্য স্বয়ং বলরাম তো বটেই, এমনকী কৃষ্ণও। কৌরবরা বললেন— আরে মশাই! উগ্রসেনও যদি কৌরবদের আদেশ দেয়, তা হলে আর এই রাজার যোগ্য রাজছত্র আর চামরগুলো দিয়ে কী হবে— তদলং পাণ্ডরছত্রৈর্নৃপযোগ্যৈর্বিড়ম্বিতৈঃ। উগ্রসেনের হেঁয়ালি ছেড়ে কৌরবরা বলে পাঠালেন— উগ্রসেন কিংবা আপনার ইচ্ছামতো আমরা অন্যায়কারী শাম্বকে ছেড়ে দেব না। এবারে জরাসন্ধ-পরবর্তী রাজনৈতিক অবস্থান জানিয়ে কৌরবরা ততোধিক অপমান করে বললেন— আচ্ছা, আচ্ছা, ঠিক আছে! অন্ধক-যাদব-বৃষ্ণি বংশের লোকেরা আগে যেমন আমাদের প্রণাম-ট্রনাম করতেন, তা নয় নাই করলেন, কিন্তু আমরা যাদের চাকর-বাকরের মতো দেখে এসেছি, তারা আমাদের আদেশ দিচ্ছে— এই ব্যবহার তো আশ্চর্য লাগছে— ননাম সা কৃতা কেয়মাজ্ঞা স্বামিনি ভৃত্যতঃ। এবারে বলরামের ক্ষতস্থানে ক্ষার ক্ষেপণ করে কৌরবরা বললেন— হ্যাঁ, দোষটা আপনাদের নয়, দোষ আমাদেরই। আমরা আপনাদের সঙ্গে সমান আসনে বসেছি এবং একসঙ্গে বসে খাবার-দাবারও খেয়েছি, তার ফলেই এমন মাথায় চড়ে গেছেন আপনারা— গর্বমারোপিতা যূয়ং সমানাসনভোজনৈঃ। সত্যি এতে আপনাদের দোষ নেই, আমাদের আভিজাত্যহেতু প্রীতি দেখিয়ে আপনাদের সঙ্গে যে একসঙ্গে ওঠাবসা করেছি, এতে রাজনীতির ব্যাপারটা আমরা মাথায় রাখিনি বলেই এমন দুরবস্থা ঘটেছে। এবারে ‘পারসোনাল অ্যাটাক’। ওঁরা বলে পাঠালেন— মহাশয় বলভদ্র! আপনাকে যে আমরা গোরুদান করে অর্ঘ্য-টর্ঘ্য দিয়েছি, ওটাও আপনার কুলের প্রতি মর্যাদাবশত দিইনি, দিয়েছি আমাদের আভিজাত্যের চিরাচরিত রীতিটি মাথায় রেখে— প্রেম্নৈতন্‌ নৈতদস্মাকং কুল্যং যুষ্মৎকুলোচিতম্‌। আপনি জেনে রাখুন— শাম্বকে আমরা ছাড়ছি না।

এর পরের ঘটনা নিতান্তই বলদেবোচিত এবং বড় আশ্চর্য লাগে— বিপরীত প্রতিক্রিয়ায় কুরুরা যেভাবে বলরামের কাছে নতি স্বীকার করলেন, সেটা মোটেই কৌরবোচিত নয় এবং যাঁরা একটু আগেই এত বড় বড় কথা বলছিলেন, তাঁরা যেভাবে বিনা বাক্যে বিনা যুদ্ধে বলরামের প্রসাদ ভিক্ষা করলেন, তাতে এটা বুঝি যে, বলরামের তথা কৃষ্ণের আপন প্রভাবেই কৌরবরা শাম্বকে ছেড়ে দিয়েছিলেন। আর বলরাম কৌরবদের কথা শুনে যা করেছিলেন, সেটা নিতান্তই পুরাকল্পের অভিজ্ঞান যা বলরামের ওপর চেপে বসেছে।

কৌরবদের কথা শুনে বলরাম সাতিশয় ক্রুদ্ধ হলেন এবং ক্রোধে প্রমত্তের মতো ঘুরতে ঘুরতে মাটির ওপর পদাঘাত করতে লাগলেন। পুরাণের বর্ণনা অনুযায়ী সেই পাদপ্রহারে পৃথিবী বিদারিত হল। বলরাম কৌরবদের উদ্দেশে প্রচুর তিরস্কার-বাক্য উচ্চারণ করতে লাগলেন। কৌরবদের তিরস্কারের শব্দরাশি মাথায় রেখে বলতে লাগলেন— তোমাদের রাজশাসন স্বতঃসিদ্ধ হয়ে গেল, আর আমাদের রাজ-অভিমান একেবারেই আগন্তুক নাকি! আমরা কি বানের জলে ভেসে এসে রাজা হয়েছি— কৌরবাণাং মহীপত্বম্‌ অস্মাকং কিল কালজম্‌। আরে, আমাদের রাজার চাকর-বউরা পর্যন্ত নন্দনকাননের মন্দারমঞ্জরি খোঁপায় গুঁজে ঘুরে বেড়ায়, সেই উগ্রসেন নাকি রাজা নন— বিভর্তি যস্য ভূত্যানাং… মঞ্জরীর্বনিতাজনঃ। ঠিক আছে দেখাচ্ছি তোদের, আমি একাই এই পৃথিবী কৌরবশূন্য করে দেব।

কৌরব-পাণ্ডব সবার ওপরেই রাগ হল বলরামের। তিনি বললেন— আমি কৌরবদের এই হস্তিনানগরী লাঙলের আগায় টেনে এনে ভাগীরথীর জলে ফেলে দেব। পুরাণের বর্ণনা অনুযায়ী এর পরে বলরাম তাঁর লাঙলখানি অধোমুখ করে হস্তিনার প্রাকার এবং খাতের মাঝখানে লাগিয়ে নিলেন আঁকশির মতো। সারা হস্তিনাপুর কেঁপে উঠল এবং কৌরবরা নির্বিবাদে শাম্বকে প্রত্যর্পণ করলেন বলভদ্রের হাতে। মাঝখানের এই হলাকর্ষণ এবং হস্তিনাপুরের বিদারণ-কম্পনের ঘটনাকে যদি বাস্তবদৃষ্টিতে প্রাকৃতিক কোনও ঘটনা বলে মেনে নিই তা হলে ফলকথা এই দাঁড়ায় যে, বলরামের প্রভাব স্বীকার করে কৌরবরা দুর্যোধনের মেয়ের সঙ্গে শাম্বের বিবাহ-ঘটনা মেনে নিয়েছিলেন এবং শাম্বকে সস্ত্রীক বলরামের হাতে সমর্পণ করতে বাধ্য হয়েছিলেন। কিন্তু পুরাণ বলেছে— হস্তিনাপুরকে সহসা আঘূর্ণিত হতে দেখে তবেই কৌরবরা বলরামের কাছে ক্ষমা চাইতে এসেছিলেন— আঘূর্ণিতং তৎ সহসা ততো বৈ হস্তিনাপুরম্‌। অতএব যতটুকু ক্ষতি হবার ততক্ষণে হয়ে গেছে, বলরাম তাঁর লাঙলের আঁকশি দিয়ে ওই যে একবার টেনেছিলেন হস্তিনাপুর-নগরীকে তাতেই প্রাচীন পুরাণকারের মন্তব্য— সেই কারণেই সেই সময় থেকে আজও হস্তিনাপুর নগরীকে গঙ্গার দিকে ঝুঁকে থাকতে দেখা যায়— অদ্যাপি আঘূৰ্ণিতাকারং লক্ষ্যতে তৎ পুরং দ্বিজ— আর এটাই রুদ্রমূর্তি বলরামের প্রভাব। এই আঘূর্ণনের জন্য বলরামই যে প্রধান কারণ, সেটা প্রবাদ হয়ে গেছে— এষ প্রবাদো রামস্য বলশৌর্যোপলক্ষণঃ।

আগে আমরা বলরামের যমুনাকর্ষণ করার কাহিনি উল্লেখ করে গিরীন্দ্রশেখর বসুর বক্তব্য উপস্থাপন করেছিলাম। তিনি লিখেছিলেন— এটা ভূমিকম্পের ঘটনা এবং ভূমিকম্পের ঘটনা-মাত্রেই সেটা বলরামের কীর্তি বলে চিহ্নিত। গিরীন্দ্রশেখর শাম্বের বিবাহঘটনা উদ্ধার করে হস্তিনাপুরের প্রাকারে বলরামের লাঙল গেঁথে ফেলার উপরি-উক্ত পুরাণ-কাহিনিও বিবৃত করেছেন এবং পুনরায় তাঁর বিজ্ঞানসম্মত মতামত জানিয়ে বলেছেন— “গত ভূমিকম্পের ফলে বিহারের মতিহার নামক নগর বিপর্যস্ত হয়। পণ্ডিত জহরলাল নেহরু সংবাদপত্রে লিখিয়াছেন, মতিহারি শহর ‘twisted’ হইয়া গিয়াছে। পৌরাণিক ভাষায় ইহাই আঘূর্ণিত হওয়া। বলভদ্র হস্তিনাপুরীকে গঙ্গায় নিক্ষেপ করিবেন বলিয়া ভয় দেখাইয়াছিলেন। বাস্তবিকই যুধিষ্ঠিরের সাত পুরুষ পরে নিচক্ষুর রাজত্বকালে হস্তিনাপুরী গঙ্গাগর্ভে চলিয়া যায়। নিচক্ষু রাজধানী কৌশাম্বীতে লইয়া যান। (বিষ্ণুপুরাণে এই বিবরণ আছে— অধিসীমকৃষ্ণাৎ নিচক্ষুঃ, যো গঙ্গয়াপহৃতে হস্তিনাপুরে কৌশাম্ব্যাং নিবৎস্যতি।) নিচক্ষুর রাজত্বকাল আনুমানিক ১২৫১ খ্রিস্টপূর্বাব্দ। পূর্ববর্তী ভূমিকম্পের ফলে পরবর্তীকালে গঙ্গার গতি পরিবর্তিত হইয়া হস্তিনাপুরী ধ্বংস হয় কিনা বলা যায় না। পরীক্ষিতের কালে হস্তিনাপুরী আঘূর্ণিত দৃষ্ট হইত। (তার অর্থ) ভূমিকম্প খ্রিস্টপূর্ব ১৪১৬ সালের আগে ঘটিয়াছিল। কেন না, ১৪১৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দ পরীক্ষিতের জন্মকাল।” হয়তো এরকম কোনও ভূমিকম্পই বলরামের কীর্তি হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে, নইলে শাম্বের বিবাহ নিয়ে যত গোল পাকিয়ে উঠেছিল, তা অত তাড়াতাড়ি শেষ হত না। হয়তো বলরামের আয়ুষ্কালের পরবর্তী যে সময়ে ভূমিকম্প হয়েছিল, সেটা বলরামের নামে উৎসর্গ করার জন্যই পৌরাণিকেরা শাম্বের বিবাহ-কালের ক্ষণিক মনোমালিন্যকে একেবারে হলাকর্ষণের রুদ্রচিহ্নে চিহ্নিত করেছেন। নইলে, পূর্বের তিরস্কার নিঃশব্দে গিলে নিয়ে কৌরব-ধুরন্ধরদের অত শীঘ্র আত্মসমর্পণও প্রামাণিক হয়ে ওঠে না।

আমরা অবশ্য শাম্বের বিবাহ-প্রসঙ্গে কৌরব দুর্যোধন এবং তৎপক্ষীয়দের ওপর বলরামের ক্রোধের ঘটনাকে অন্য তাৎপর্যে দেখাতে চাইছিলাম। আমরা বলেছিলাম— বলরাম কোনও ঘটনাতেই, বিশেষত যে ঘটনার রাজনৈতিক পরিণতি আছে, তেমন কোনও ঘটনাতেই তিনি ‘ইনভলভড’ হতেন না। কৌরব কিংবা পাণ্ডব কারও ওপরেই তাঁর বিশেষ পক্ষপাত ছিল না। পরবর্তীকালে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধশেষে ভীম-দুর্যোধনের গদাযুদ্ধের সময় দুর্যোধনের প্রতি তাঁর দুর্বলতা এবং পক্ষপাত প্রকট হয়ে উঠবে। কিন্তু ক্ষণিকের অন্যায় বিচার করেই তিনি এই পক্ষপাত প্রকট করে তুলেছিলেন, দুর্যোধনের পূর্বের অন্যায়গুলি তিনি মনেই রাখেননি। লক্ষ করে দেখবেন, পাণ্ডবদের প্রতিও তাঁর কম দুর্বলতা ছিল না, কিন্তু সেটাও বড় সাময়িক মনে হয়। সেই অদ্ভুত দুর্বলতার কথাও একটু জানানো উচিত মহাভারতের প্রমাণে। তাতে আরও প্রমাণ হবে— বলরাম কৃষ্ণের মতো দার্শনিক উক্তি করতে পারেন না, তিনি ভগবদগীতার মতো ভারী উপদেশ শোনাতে পারেন না এবং নিজের যুক্তিগুলিকেও তিনি ধর্মদর্শনের উজ্জ্বল মোড়কে বাঁধিয়ে প্রকাশ করতে পারেন না। তিনি সাধারণ মানুষের মতো কথা বলেন, হঠাৎ করে রেগে যান অবশী অজিতেন্দ্রিয় পুরুষের মতো।

ঘটনাটা ঘটেছিল অর্জুন যখন পাশুপত অস্ত্রের জন্য হিমালয়ে তপস্যা করতে গেছেন সেই সময়। যুধিষ্ঠির এবং অন্যান্য সকলে যখন বিমনা হয়ে বসে থাকেন অর্জুনের অনুপস্থিতির কারণে, তখন লোমশ মুনি এসে বলেন— তোমরা তীর্থে তীর্থে ঘুরে বেড়াও। সময় কেটে যাবে। সেই তীর্থ করতে করতে চার পাণ্ডব আর দ্রৌপদী এসে পৌঁছলেন প্রভাস তীর্থে। এই থেকে খুব দূরে নয়। যুধিষ্ঠির প্রভাসে এসে ব্রত-উপবাস করে ধূলি-মলিন শয্যায় শয়ন করছেন এবং যথোচিত কৃচ্ছ্রসাধন করছিলেন জটা-চীর ধারণ করে। খবর পেয়ে কৃষ্ণ, বলরাম, সাত্যকি এমনকী কৃষ্ণের দুই ছেলেও উপস্থিত হলেন যুধিষ্ঠিরের কাছে। যুধিষ্ঠিরের ওই তপঃক্লিষ্ট চেহারা, অনুগামী পাণ্ডবদের দুরবস্থা এবং রাজনন্দিনী দ্রৌপদীর অবস্থা দেখে বৃষ্ণি-যাদবেরা সবাই এত কষ্ট পেলেন যে তাঁদের চোখে জল এসে গেল— অনর্হতীং দ্রৌপদীঞ্চাপি দৃষ্ট্বা/সুদুঃখিতাশ্চুক্রুশুরার্তনাদম্‌। যুধিষ্ঠির নিজেদের অবস্থার কথা জানালেন সমবেত বৃষ্ণি-যাদবদের। জানালেন— দুর্যোধনদের আচরণ, কপট পাশাখেলা এবং দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণের কথা। সব কথা শুনে বৃষ্ণি-যাদবদের বড় বড় মানুষেরা, এমনকী কৃষ্ণ-বলরামও চোখের জল রাখতে পারলেন না— নেত্রোদ্ভবং সংমুমুচুৰ্মহার্হা/দুঃখাৰ্ত্তিজং বারি মহানুভাবাঃ।

প্রভাসতীর্থে বৃষ্ণি-যাদবেরা সবাই পাণ্ডবদের ঘিরে বসেছিলেন। বলরাম আর ধৈর্য রাখতে পারলেন না। সকলের সামনে তিনি কৃষ্ণকে বলতে আরম্ভ করলেন। লক্ষণীয়, তিনি পাণ্ডবদের প্রতি সমবেদনার বাক্য উচ্চারণ করছেন না, বলছেন কৃষ্ণকে। কেন না তিনিই বেশিরভাগ সময় ধর্ম উপদেশ দেন। বলরাম বললেন— দেখো কৃষ্ণ! ধর্মের অনুষ্ঠান করেও মানুষের কিচ্ছু হয় না, আবার অধর্মের আচরণ করেও মানুষের কোনও ক্ষতি হয় না— ন কৃষ্ণ ধর্মশ্চরিতো ভবায়/জন্তোরধর্মশ্চ পরাভবায়। এই দেখো না, মহাত্মা যুধিষ্ঠির জটা-চীর-কৌপীন ধারণ করে বনের মধ্যে কষ্ট পাচ্ছেন। আর দুর্যোধন! সে এখন পৃথিবী শাসন করছে। অথচ পৃথিবীর এমন ক্ষমতা নেই যে, দুর্যোধনকে মাটি ফাটিয়ে গিলে ফেলবে আপন বিবরের মধ্যে— দুর্যোধনশ্চাপি মহীং প্রশান্তি/ ন চাস্য ভূমিৰ্বিবরং দদাতি। কাজেই সাধারণ অল্পবুদ্ধি লোকেরা— যারা অত ধর্ম-দর্শন কপচায় না— তারা যে বলে ধর্ম করার থেকে অধর্ম করাই অনেক ভাল— এটাই ঠিক কথা— ধর্মাদ্‌ অধর্মশ্চরিত গরীয়ান্‌/ ইতীব মন্যেত নরোহল্পবুদ্ধিঃ।

সত্যি, বলরাম যা বলেছেন, আমাদের মতো সাধারণ মানুষের কাছে একেবারে তা চূড়ান্ত বাস্তব কথা। আমরাও তো এই কথাই বলে থাকি। বলি— সত্যিই তো, মন্ত্রী, অমাত্য, নেতা, দালাল, গুন্ডা-বদমাশ— তারাই তো সবচেয়ে ভাল আছে। নীতি, যুক্তি এবং ধর্ম নিয়ে যাঁরা আছেন, তাঁরাই তো দরিদ্র, তাঁরাই তো বঞ্চিত এবং তাঁরাই যশের গরিমাহীন। বলরাম তাইই বলেছেন। বলেছেন— পাপী দুর্যোধনের সর্বাত্মক উন্নতি আর ধর্মরাজ যুধিষ্ঠিরের রাজ্যহানি এই সন্দেহটাই জাগিয়ে তুলেছে যে, পুণ্যের কাজটাই করা উচিত নাকি পাপের কাজটাই করা উচিত— কিম্বত্র কর্তব্যমিতি প্রজাভিঃ/ শঙ্কা মিথঃ সংজনিতা নরাণাম্।

বলরাম এই সব কথা বললেন বলেই এটা ভাবার কোনও কারণ নেই যে, বলরাম ধর্ম বোঝেন না অথবা ধর্মের ইতিকর্তব্যতা সম্বন্ধে তাঁর কোনও সন্দেহ আছে। মনে মনে বলরাম জানেন যে, নীতি এবং ধর্মই মানুষের একান্ত আশ্রয় হওয়া উচিত, অধর্ম নয়, অনীতি নয়। তবু বলরাম যে কথাগুলি বলেছেন, সেগুলি তর্কযুক্তির বাইরে এক হতাশার কথা, ‘ফ্রাষ্ট্রেশন’-এর কথা। এত কথার পরেও তাই যুধিষ্ঠিরের ওপর বলরামের আস্থা আছে। তিনি বলেছেন— যুধিষ্ঠির ধর্মরাজ বলে কথা। রাজ্য এবং ঐহিক সুখের জন্য তিনি এমনটি কখনওই করতে পারবেন না, যাতে ধর্ম নষ্ট হয়ে যায়। ধর্মের হানি ঘটিয়ে যুধিষ্ঠির অন্তত কোনও ঐহিক উন্নতি চাইতে পারবেন না— ধর্মাদপেতস্তু কথং বিবর্ধেৎ।

যুধিষ্ঠিরের প্রতি সমব্যথায় বলরাম তিরস্কারবাণী উচ্চারণ করলেন। বললেন— ধিক এই প্রসিদ্ধ ভরতবংশের বৃদ্ধ মানুষদের প্রতি। এই ভীষ্ম, দ্রোণ, কৃপ এবং ধৃতরাষ্ট্র— কী করলেন এঁরা। সবচেয়ে বড় পাপী তো এই বুড়ো ধৃতরাষ্ট্র। তিনি পুত্রস্থানীয় পাণ্ডবদের বনে পাঠিয়ে দিলেন। দু’দিন পরে মরবার পর যখন পূর্ব পিতৃপুরুষদের সঙ্গে দেখা হবে তাঁর, সেখানে কী বলবেন তিনি? বলতে পারবেন কি যে, আমি সব ছেলের সঙ্গে সমান ব্যবহার করেছি— পুত্রেষু সম্যক্ চরিতং ময়েতি/ পুত্রান্‌ অপাপান্ ব্যবরোপ্য রাজ্যাৎ। ধৃতরাষ্ট্রের ওপরে বলরাম এতটাই বিক্ষুব্ধ হলেন যে তাঁর অন্ধত্ব নিয়েও তিনি বিদ্রূপ করতে ছাড়লেন না। তিনি মনে করেন— পূর্বজন্মের পাপের ফলেই যে ধৃতরাষ্ট্র অন্ধ হয়ে জন্মেছেন, সেই ধৃতরাষ্ট্র একবার ভেবেও দেখলেন না যে, যুধিষ্ঠিরকে বনে পাঠিয়ে পরের জন্মে তিনি কেমন খুঁতো হয়ে জন্মাবেন।

পরজন্মে ধৃতরাষ্ট্রের বিচিত্র বিপন্নতা এবং বিদ্রূপের প্রসঙ্গ ছেড়ে বলরাম এবার বাস্তবে ফিরে এলেন। কথা উঠল মধ্যম পাণ্ডব ভীমসেনের বীরত্ব নিয়ে। দুর্যোধনের মতো ভীমও তাঁর গদাযুদ্ধের শিষ্য। যদিও গদাযুদ্ধের কৌশল ভীমের চেয়ে বেশি জানেন দুর্যোধন। কিন্তু শুধুমাত্র কৌশলই যে দুর্যোধনকে রক্ষা করতে পারবে না, সেটা বিলক্ষণ জানেন বলরাম। কেন না দুর্যোধন যে অন্যায় করেছেন যুধিষ্ঠিরের সঙ্গে, দ্রৌপদীর সঙ্গে, সেটা দুর্যোধনের মানসিক শক্তি বিপর্যস্ত করে দেবে, আর সেইখানেই বেশ খানিকটা এগিয়ে আছেন মহাবলী ভীম। ভবিষ্যতে কুরু-পাণ্ডবের মধ্যে যে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ হবে, সেখানে ভীম যে কতখানি এগিয়ে থাকবেন তার অদ্ভুত একটা মানসিক বিশ্লেষণ করেছেন বলরাম। তিনি মনে করেন— যে লোকটা পাণ্ডবদের বনে তাড়িয়ে দিল, তাঁদের স্ত্রীকে অপমান করল এবং অবশেষে নিঃশত্রুক রাজ্যে নিজের শাসন চালাতে লাগল, সেই মানুষটার মধ্যে এক ধরনের বৈকারিক আত্মতৃপ্তি কাজ করছে। ফলে এই দুর্যোধনের চেয়ে ভীমের মানসিক শক্তি যুদ্ধক্ষেত্রে বেশি সুবিধা দেবে। তিনি বলেছেন— ভীমের মতো শক্তিমান পুরুষ, যাঁর নাম শুনলে শত্রুসৈন্য যুদ্ধক্ষেত্রে মলমূত্র ত্যাগ করে— শ্রুত্বৈব শব্দং হি বৃকোদরস্য/ মুঞ্চন্তি সৈন্যানি শকৃৎ সমূত্রম্‌— সেই ভীম যেদিন থেকে বনের মধ্যে ক্ষিদেতে কষ্ট পাচ্ছেন, পিপাসায় এবং পথ-পরিশ্রমে কৃশ হয়ে যাচ্ছেন, সেই ভীম এই বনবাস-দুঃখ স্মরণ করে যখন যুদ্ধক্ষেত্রে ঝাঁপিয়ে পড়বেন, তখন তাঁর মানসিক শক্তি, দৈহিক বলের সামনে কেউ দাঁড়িয়ে থাকতে পারবে না এই পৃথিবীতে— ন হ্যস্য বীর্যেন বলেন কশ্চিৎ/সমঃ পৃথিব্যামপি বিদ্যতেহন্যঃ। একে একে যুধিষ্ঠির, নকুল, সহদেব এবং দ্রৌপদীর দুর্গতি বর্ণনা করে বলরাম শুধু বিস্ময় প্রকাশ করলেন এই ভেবে যে, এমন অবস্থাতেও দুর্যোধনের শ্রীবৃদ্ধি হচ্ছে কীভাবে আর কেনই বা এমন অন্যায়কারী মানুষকে দেখেও পৃথিবী বিদীর্ণ হয় না।

বলরামের কথা শুনে বৃষ্ণিবীর সাত্যকি তাঁকে বলেছেন যে, এখন বিলাপ করার সময় নয়, বরঞ্চ পরে পাণ্ডবদের সঙ্গে কৌরবদের যুদ্ধ হবার আগেই যাতে বৃষ্ণি-যাদবদের পূর্ণ সহায়তা পাণ্ডবরা পান, সেইদিকে নজর রাখাটা অনেক বেশি প্রয়োজন মনে করেন তিনি। সাত্যকি তখনই যুদ্ধযাত্রায় আগ্রহী ছিলেন, তিনি এমনও বলেছিলেন যে, বলরাম তো একাই পারেন সমবেত কৌরবদের ধ্বংস করে দিতে। তবু সাত্যকি চেয়েছিলেন— বৃষ্ণি-যাদবদের পরবর্তী প্রজন্ম অর্থাৎ বলরামের ছেলেরা, কৃষ্ণের ছেলেরা, অভিমন্যু এবং তিনি নিজে যাবেন যুদ্ধ করতে। কিন্তু যুধিষ্ঠির স্বয়ং তাঁর সত্যরক্ষার জন্য এমন যুদ্ধ চাননি, যুদ্ধ চাননি কৃষ্ণও। তাঁরা উপযুক্ত সময়ের জন্য অপেক্ষা করতে বলেছেন সকলকে।

আমরা সাত্যকির এই উত্তেজনা সম্পূর্ণ বুঝি, এমনকী বলরামের উত্তেজনাও বুঝি। কিন্তু দু’জনের মানসিক পর্বে আকাশ-পাতাল তফাত আছে। সাত্যকি অর্জুনের প্রিয় শিষ্য, পাণ্ডবদের সমস্ত বিপদের সঙ্গে তিনি মানসিকভাবে জড়িত। কিন্তু বলরাম তা নন। প্রভাসক্ষেত্রে যুধিষ্ঠির-ভীম— এঁদের চরম দুর্দশাগ্রস্ত দেখে বলরাম ধৃতরাষ্ট্র-দুর্যোধনের ওপর যতই উষ্মা প্রকাশ করুন, একান্ত ওতপ্রোত মানসিক দুর্বলতায় তিনি বোধহয় কাউকে ভালবাসতে পারেন না, যা কৃষ্ণ পারেন। আসলে আমরা যা বুঝি, তাতে ভালবাসলে পরে বন্ধু বা সুহৃজ্জনের দোষ তেমন চোখে পড়ে না। দোষ যদি থাকেও তা চাপা দিতে চাই, অথবা তাঁর দোষের পক্ষে যুক্তির সমাধান তৈরি করি। সাত্যকি বোধহয় বলরামকে চিনতেন, কেন না একান্ত অনুগত কৃষ্ণের ক্ষেত্রেও যেখানে বলরামের বিচার-বুদ্ধি কাজ করে, সেখানে কৌরব-পাণ্ডবের এই বিরাট জ্ঞাতিশত্রুতার ক্ষেত্রে— বিশেষত সে শত্রুতা নিতান্তই অন্য দেশের বিষয় বলে বলরাম যে ঠিক কীরকম আচরণ করবেন, সে বিষয়ে বুঝি তাঁরও সন্দেহ ছিল। যার জন্য প্রভাসক্ষেত্রে যুধিষ্ঠির-ভীমের দুর্গতির নিরিখে বলরামের ক্ষোভ-প্রকাশ দেখেও সাত্যকির মতো নবীন যুবক কিন্তু বারবার বলেছিলেন— কাজটা পাণ্ডবদেরই আরম্ভ করতে হবে এমন কেন। সহায় এবং সুহৃজ্জনেরাই তো তাঁদের হয়ে যুদ্ধের কাজটা আরম্ভ করতে পারেন। আপনি থাকতে, কৃষ্ণ থাকতে, প্রদ্যুম্ন-শাম্বরা থাকতে পাণ্ডবরা বনে বাস করছেন কেন— কস্মাদিমৌ রাম-জনার্দনৌ চ/ ত্রৈলোক্যনাথান্‌ অধিগম্য পার্থাঃ।

বলরাম কিন্তু এইসব কথার কোনও উত্তর দেননি, এমনকী যুধিষ্ঠিরও— যাঁকে অনেকেই বোকাসোকা মানুষ মনে করেন— তিনিও বলরামের সমবেদনায় তেমন কোনও প্রতিক্রিয়া দেখাননি, অপিচ সরাসরি কোনও উত্তরও দেননি বলরামকে। একেবারে শেষে সাত্যকিকে বলেছেন— এই কৃষ্ণকে আমি যথাযথ চিনি এবং তিনিও আমায় যথাযথ চেনেন— কৃষ্ণস্তু মাং বেদ যথাবদ্‌ একঃ/ কৃষ্ণঞ্চ বেদাহমথো যথাবৎ। তার মানে, বলরাম যতই যুধিষ্ঠিরের প্রতি সমবেদনার কথা বলে ধৃতরাষ্ট্র-দুর্যোধনকে গালাগালি দিন, যুধিষ্ঠির বলরামকে সঠিক চেনেন না এবং বলরামও যুধিষ্ঠিরকে যথাবৎ চেনেন না। যুধিষ্ঠির সিদ্ধান্ত নিয়ে বলেছেন— কৃষ্ণ যখন উপযুক্ত সময় বুঝবেন, তখনই যুদ্ধের উদ্যোগ শুরু হবে, এখন নয়।

যুধিষ্ঠিরের কথা বড় মিথ্যে নয়। কৃষ্ণকে তবু চেনা যায়, কিন্তু কৃষ্ণজ্যেষ্ঠ বলরামকে চেনা যায় না। তিনি বড় ‘আনপ্রেডিক্‌টেব্‌ল্‌’। প্রভাসতীর্থে দেখা হবার পর পাণ্ডবদের বনবাসপর্ব আর কত দিনই-বা ছিল, বেশি নয়। এক বছর অজ্ঞাতবাসের শেষেই তো বিরাটনগরে বিরাটনন্দিনী উত্তরার সঙ্গে অভিমন্যুর বিয়ে হল। তাতে পরমাত্মীয় মাতুল হিসেবে কৃষ্ণ এবং বলরাম দু’জনেই যোগ দিয়েছেন। বিবাহ মিটে গেলে বিরাট রাজার রাজসভায় সভা বসল। দ্রুপদ রাজার কাছাকাছি বসলেন সাত্যকি এবং বলরাম, আর বিরাট রাজার কাছাকাছি বসলেন কৃষ্ণ এবং যুধিষ্ঠির। বসলেন আরও আরও সব বীরেরা ভীম, অর্জুন, প্রদ্যুম্ন, শাম্ব, নকুল, সহদেব, সবাই। সভার রীতি অনুযায়ী পাণ্ডবদের ওপর এতদিন যে অন্যায় হয়েছে— কপট দ্যূতক্রীড়া থেকে দ্রৌপদীর অপমান সবটাই প্রসঙ্গত উত্থাপন করলেন কৃষ্ণ। কিন্তু তাই বলে দুর্যোধনের প্রতিও তিনি সম্পূর্ণ মমতা হারাননি। এমন কথাও বলেছেন— ধর্মনিষ্ঠ যুধিষ্ঠিরের যাতে হিত হয় এবং দুর্যোধনেরও যাতে হিত হয়— আপনারা সেই চিন্তা করে আপনাদের মতামত দিন।

কৃষ্ণের কথা শুনে প্রথম মত দিলেন বলরাম। প্রথমে ভালই বলছিলেন বলরাম— বঞ্চিত যুধিষ্ঠিরের কথা, দুর্যোধন তাঁর প্রাপ্য মিটিয়ে দিন, দু’জনেই ভাল থাকুন ইত্যাদি। আগে কৃষ্ণ বলেছিলেন— দুর্যোধনের মত না জেনে পাণ্ডবরাও তো তাঁদের পরবর্তী কার্যক্রম ঠিক করতে পারছেন না, তাই একজন দূত তাঁর কাছে যাক এবং এই ত্রয়োদশ বৎসরের বনবাসের পর পাণ্ডবদের ব্যাপারে তাঁর মানসিকতাটাও বুঝে আসুক। কৃষ্ণ যেটা বলেছিলেন নিছকই পরবর্তী কার্যক্রম ঠিক করার প্রয়োজনে এবং তা অবশ্যই পাণ্ডবদের স্বার্থ এবং মর্যাদা নিরঙ্কুশ বজায় রেখে, বলরাম কিন্তু সেই কথার গতিটুকু ঘুরিয়ে দিলেন। তিনিও বললেন— অবশ্যই দূতের যাওয়া প্রয়োজন। সে দুর্যোধনের মত জানুক এবং যুধিষ্ঠিরের কথাও তাঁকে বলুক। কিন্তু ভীষ্ম-দ্রোণ-বিদুরের সঙ্গে কথা বলা ছাড়াও সে যেন শকুনি, কর্ণ এবং অন্যান্য ধৃতরাষ্ট্রপুত্রদের সঙ্গেও প্রণিপাত জানিয়ে যুধিষ্ঠিরের প্রয়োজনের কথা বুঝিয়ে বলে— ব্রবীতু বাক্যং প্রণিপাতপূর্বং/কুন্তীসুতস্যাৰ্থকরং যথা স্যাৎ।

কথার এই মাত্রা পরিবর্তন আরও গভীরতর ব্যঞ্জনা নিয়ে এল বলরামের দ্বিতীয় পরামর্শে। তিনি বললেন— সমস্ত অবস্থাতেই আমাদের দূত, অথবা যে কেউই যাক সেখানে, সে যেন দুর্যোধন এবং তাঁর অনুগামীদের ক্ষেপিয়ে না তোলে, কেন না তারাই যুধিষ্ঠিরের রাজ্য গ্রাস করে ফেলেছে— সর্বাস্ববস্থাসু চ তে ন কোপ্যা/ গ্রস্তো হি সোহর্থো বলমাশ্রিতৈস্তৈঃ। লক্ষণীয়, বলরাম দুর্যোধন-কর্ণদের বেশি শক্তিশালী মনে করছেন এবং যুধিষ্ঠিরের রাজ্যহরণের ক্ষেত্রে তাঁদের দোষটাও খুব মাথায় রাখছেন না। পরবর্তী ছত্রে তিনি আর নিজের অভিমত চেপেও রাখতে পারলেন না। বলে ফেললেন— পাশা খেলতে-খেলতে যুধিষ্ঠির একেবারে প্রমত্ত হয়ে উঠেছিলেন আর তেমন প্রমত্ত লোকের কাছ থেকে রাজ্য ছিনিয়ে নিয়েছে দুর্যোধনেরা। এ তো যুধিষ্ঠিরেরই দোষ— প্রিয়াভ্যুপেতস্য যুধিষ্ঠিরস্য/ দ্যূতে প্রমত্তস্য হৃতং হি রাজ্যম্।

আমাদের জিজ্ঞাসা হয়— যুধিষ্ঠিরের কি একবার মনে পড়ল সেই প্রভাসতীর্থে বলরামের সমবেদনার কথাগুলি? তখন তো একবারও তিনি যুধিষ্ঠিরের দোষের কথা বলেননি। বরঞ্চ দুর্যোধন এবং তাঁর পিতা ধৃতরাষ্ট্রের উদ্দেশে তিরস্কার বর্ষণ করে তিনি এমন অবস্থা তৈরি করেছিলেন, যাতে মনে হচ্ছিল, এখনই যুদ্ধে গেলে ভাল হয়। আজকে বনবাস-দুঃখের অন্তে যেই রাজসভায় ইতিকর্তব্য নিয়ে আলোচনা চলছে, তখন বলরাম একেবারে উলটো কথা বলছেন। তার মানে কী, সেই প্রভাসতীর্থে যুধিষ্ঠিরের সঙ্গে বলরামের সাক্ষাৎকারের পর দুর্যোধনের সঙ্গেও তাঁর দেখা হয়েছিল এবং তিনি অন্যভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন। মহাভারতের কবি এই খবর দেননি। নাকি প্রভাসতীর্থে জটাচীরধারী কৌপীনবস্ত্র যুধিষ্ঠির-ভীমকে দেখে বলরামের মনে মায়ার উদ্রেক হয়েছিল, আর এখন রাজসভায় রাজনীতির চাল দেখে যুধিষ্ঠিরের ওপর তাঁর মায়া চলে গেছে। যেখানে ত্রয়োদশ বৎসর কৃচ্ছ্রসাধনের পর যুধিষ্ঠির তাঁর ন্যায্য প্রাপ্য ফিরে চাইছেন তখন কীই না বলছেন বলরাম।

বলরাম বললেন— যুধিষ্ঠির তো পাশাখেলাই জানে না। আর তার বন্ধুরাও তো তাকে পাশা খেলতে বারণ করেছিল। তবু সে পাশা-নিপুণ শকুনিকেই বেছে নিল পাশাখেলার জন্য। সেই পাশাখেলার আসরে আরও তো পাশাড়ে ছিল, যুধিষ্ঠির তাদের সঙ্গে খেলল না, সে বেছে নিল শকুনিকে, সেই জন্যেই সে হেরেছে, এখানে শকুনির অপরাধটা কোথায়— তত্রাপরাধঃ শকুনের্ন কশ্চিৎ। বেশ বোঝা যায়, প্রভাসতীর্থে যুধিষ্ঠিরের সঙ্গে দেখা হবার পর বলরামকে দ্যূতক্রীড়ার সমস্ত বিষয়টিই অন্যরকমভাবে বোঝানো হয়েছে এবং তাতে এখন তাঁর মনে হচ্ছে— যুধিষ্ঠির পাশাখেলার কিছু বোঝেন না এবং বন্ধুরা তাঁকে বারণও করেছিলেন পাশা খেলতে— নিবাৰ্য্যমানশ্চ কুরুপ্রবীরঃ/ সর্বৈঃ সুহৃদ্‌ভিরয়মপ্যতজ্‌জ্ঞঃ— অথচ যুধিষ্ঠির অক্ষজ্ঞ শকুনিকেই বেছে নিলেন পাশা খেলার প্রতিপক্ষ হিসাবে।

বলরাম জানেনও না ভাল করে যে, সত্যি কী ঘটেছিল। যুধিষ্ঠির কখনওই স্বেচ্ছায় শকুনিকে প্রতিপক্ষ হিসেবে চাননি, তাঁর ওপরে শকুনিকে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল। আর শকুনি যা করেছিলেন, তার এতটুকু বিচার না করে বলরাম বলছেন শকুনির কোনও দোষই নেই। আর দোষ নেই বলেই বলরাম বারবার বলছেন— যুধিষ্ঠিরের দূত যেন দুর্যোধন-ধৃতরাষ্ট্রের কাছে মাথা নুইয়ে প্রণিপাত করে মিষ্টিমধুর বাক্য বলে, তা নইলে দুর্যোধনকে কখনওই যুধিষ্ঠিরের প্রয়োজনে ব্যবহার করা যাবে না— তস্মাৎ প্রণম্যৈব বচো ব্রবীতু/ বৈচিত্র্যবীর্যে বহুসাম-যুক্তম্‌। বলরাম একেবারেই চান না দুর্যোধনের সঙ্গে কোনও সংঘর্ষ হোক, বিশেষত দুর্যোধন-শকুনিদের কোনও দোষই তিনি আপাতত দেখতে পাচ্ছেন না বলে তাঁদের বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রাকেও তিনি অন্যায় বলে মনে করছেন। বলছেন— এতে কোনও লাভ হবে না— যুদ্ধেহনয়ো ভবিতা নেহ সোহর্থঃ।

হলধর বলরাম এই সব কথা বলে ভাল করে বসার সময় পাননি, তার আগেই তাঁর পাশে-বসা সাত্যকি তীব্র প্রতিবাদ করলেন বলরামের বিরুদ্ধে। সাত্যকি বলরামের থেকে অনেক ছোট, তিনি পরবর্তী প্রজন্মের মানুষ এবং অর্জুনের শিষ্য। তবু কোনও কথা তাঁর মুখে আটকাল না। হয়তো সংঘরাষ্ট্রের সভায় সকলের মতামত দেওয়া এবং শোনার একটা রেওয়াজ ছিল বলেই সাত্যকি বেশ তির্যক ভঙ্গিতেই বললেন— যার যেমন মন সে সেইভাবেই কথা বলে, কাজেই তোমারও মন যেমন তেমনই তুমি বলেছ— যথারূপোহন্তরাত্মা তে তথারূপং প্রভাষসে। এই কথাটা এমনভাবে ভাবার অবসর ছিল যে, সাত্যকি বলরামকে বেশ সরল মানুষ ভাবছেন এবং তাঁর মন সরল বলেই মিষ্টি-মধুরে বুঝিয়ে দুর্যোধনকে পক্ষে নিয়ে আসার কথা বলছেন। কিন্তু না, তিনি যে এত সরলভাবে কথা বলছেন না, সেটা বোঝা যায় সাত্যকির পরবর্তী ভাষণ থেকেই— যে ভাষণ তির্যক ছিল, তীক্ষ্ণ ছিল। সাত্যকি বললেন— এ জগতে কাপুরুষও আছে, বীরপুরুষও আছে। একই গাছের কতক শাখায় ফল ধরে, কতক শাখায় ধরে না, তেমনই একই বংশে ক্লীব আর বীরপুরুষ দুইই জন্মায়— ফলাফলবতী শাখে যথৈকস্মিন্‌ বনস্পতৌ। সাত্যকি বোধহয় কৃষ্ণের সঙ্গে বলরামের, নাকি নিজের সঙ্গেই বলরামের পরাঙ্মুখ মানসিকতার তুলনা করেছিলেন। সাত্যকি বলরামকে একেবারে সোজাসুজি আক্রমণ না করে আরও তির্যকভাবে সম্বোধন করে বললেন— লাঙ্গলধ্বজ! তুমি এতক্ষণ যেমন বললে তাতে আমি কোনও দোষ দিই না। কিন্তু তোমার কথা শুনেও যারা এখানে চুপ করে বসে আছে, তাদেরই আমি দোষ দিচ্ছি— যে তু শৃণ্বন্তি তে বাক্যং তানসূয়ামি মাধব।

বলরামের লাঙল কী ভয়ংকর হতে পারে সেটা আমরা জানি, কিন্তু এই মুহূর্তে সাত্যকির সম্বোধনে, সেটা ধ্বজামাত্র সার, অর্থাৎ লাঙলের চিহ্নটুকুই অবশিষ্ট আছে, তার কার্যকারিতা নেই। সাত্যকি বললেন— এত বড় একটা সভার মধ্যে তুমি যে যুধিষ্ঠির মহারাজের এতটুকু দোষের কথা বলতে পেরেও এখনও বিকারহীন দাঁড়িয়ে আছ— এটাই আমি ভাবছি— কথং হি ধর্মরাজস্য দোষং স্বল্পমপি ব্রুবন্‌। শকুনি-দুর্যোধনের সাফাই গেয়ে বলরাম যা-যা বলেছিলেন সাত্যকি সযৌক্তিকভাবে তাঁর প্রত্যেকটি কথা অপ্রমাণ করে দিলেন, আর কী আশ্চর্য লাগে— এত ছোট মুখে এত বড় বড় কথা শুনেও বলরাম আর একটি কথাও বলছেন না, কিংবা নিজেকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য আর একটি যুক্তিও দিচ্ছেন না।

আমরা এই ব্যবহার আগেও দেখেছি। সুভদ্রা-হরণের সময় বিরাট শোরগোল তুলে কৃষ্ণের যৌক্তিক উচ্চারণে তিনি সেই যে চুপ করে গেলেন, আর একটি কথাও বললেন না। পৃথিবীতে এমন মানুষও নিশ্চয়ই আছেন, যার চরিত্র বলরামের অংশ দিয়ে তৈরি। প্রথমে প্রচুর ‘ইনভলভমেন্ট’ দেখিয়ে শোরগোল তোলার পর এক্কেবারে চুপ করে যাওয়া মানুষের অভাব নেই আমাদের দেশে। আসলে এও এক বিচিত্র মনুষ্যচরিত্রের প্রতিরূপ। নিজের ব্যক্তিত্ব সম্পূর্ণ প্রসারিত হবার মুহূর্তেই আকস্মিক এই ঔদাসীন্য মানুষটাকে অদ্ভুত বিপ্রতীপ এক অনাসক্ত মাত্রায় পৌঁছে দেয়। এরপরেও তিনি থাকেন, অথচ তাঁর অবস্থিতি টের পাওয়া যায় না, মনুষ্য সংসারের নানাবিধ আত্মীয় সম্বন্ধই এমন ব্যক্তিচরিত্র গড়ে তোলে।

আমি বারবার বলেছি— বলরামের ব্যক্তিচরিত্র গঠনে কৃষ্ণের একটা বিশাল বিপ্রতীপ ভূমিকা আছে। কৈশোরের বৃন্দাবন থেকে আরম্ভ করে মথুরা-দ্বারকায় কৃষ্ণের অতিসক্রিয় মুখর ভূমিকা সব সময় এই জ্যেষ্ঠ ভ্রাতাটিকে হঠাৎ উদাসীন এক বিধুর নায়কে পরিণত করেছে। কৃষ্ণকে তাঁর অতিক্রম করার শক্তি নেই, কৃষ্ণকে ত্যাগ করার মতো মনের জোরও তাঁর নেই। ছোট ভাই কৃষ্ণের ব্যক্তিত্ব এবং প্রভাবের প্রতি অনন্ত মর্যাদাবশতই এটাকে কোনও অভিমান বলতে আমি রাজি নই। কৃষ্ণকে তিনি এতটাই ভালবাসেন যে, সেখানে নিজের ব্যক্তিত্ব খর্ব কর খানিকটা উদাসীন থাকাটাকেও বলরাম শ্রেয় মনে করেন, কিন্তু কৃষ্ণের উজ্জ্বল উপস্থিতি তিনি কখনওই অতিক্রম করেন না। লক্ষ করে দেখবেন দার্শনিকরা এবং অবতারবাদীরাও বলরামের তত্ত্ব সেইভাবেই উপস্থাপনা করেছেন। ভগবান অনন্ত বা শেষনাগ নিজে নারায়ণ-স্বরূপ হয়েও পালনকর্তা বিষ্ণু-নারায়ণের কর্মসহায়তা করেন, তাঁকে অতিক্রম করেন না। অবতারবাদের ক্ষেত্রেও লক্ষ্মণের কাজ রামচন্দ্রকে সহায়তা করা, নিত্যানন্দের কাজ চৈতন্য মহাপ্রভুকে সহায়তা করা এবং বলরামের কাজ কৃষ্ণকে সহায়তা করা— অথচ লক্ষ্মণ, নিত্যানন্দ অথবা বলরামের নিজস্বতাও কিন্তু বিপরীতভাবে উজ্জ্বল।

ওই বিরাটনগরে বিরাট সভা হয়ে গেল, উপপ্লব্য থেকে দ্বারকায় ফিরে গেলেন সবাই। অন্যান্যরা চলে গেলেন নিজের জায়গায়। ওদিকে যুদ্ধ আসন্ন জেনে অর্জুন এবং দুর্যোধন উপস্থিত হলেন দ্বারকায়। তারপরে তো সেই বিখ্যাত গল্প। অর্জুন কৃষ্ণের পায়ের কাছে বসলেন এবং দুর্যোধন বসলেন তাঁর মাথার কাছে। অর্জুন একা নিরস্ত্র কৃষ্ণকে বরণ করে নিলেন স্বপক্ষে, আর দুর্যোধন নারায়ণী সেনা পেয়ে নিজেকে ধন্য মনে করলেন। এরপর যা দেখেছি— দুর্যোধন বেশী খুশি হলেন। নিরস্ত্র কৃষ্ণকে খুব গুরুত্বপূর্ণ মনে করলেন না তিনি। বেশ খুশি মনে এবার তিনি চললেন বলরামের কাছে। তাঁর সৌভাগ্য, অর্জুন বলরামের কাছে গেলেন না, তিনি একা কৃষ্ণকে নিয়েই পরম সন্তুষ্ট রইলেন। দুর্যোধন কৃষ্ণকে ছেড়ে কৃষ্ণজ্যেষ্ঠ বলরামের সমর্থন আদায় করার জন্য স্বশরীরে উপস্থিত হলেন তাঁর গদাযুদ্ধের গুরুর কাছে— ততো অভ্যয়াদ্‌ ভীমবলো রোহিণেয়ং মহাবলম্‌।

দুর্যোধন স্পষ্টতই তাঁর আগমনের হেতু জানালেন— সর্বঞ্চাগমনে হেতুং স তস্মৈ সত্যবেদয়ৎ তিনি বলরামকে স্বপক্ষে যুদ্ধ করার জন্য বরণ করতে চান। সব শুনে বলরাম বললেন— দুর্যোধন! তুমি নিশ্চয়ই শুনে থাকবে যে, বিরাটনগরে উত্তরার বিবাহের পরে যে সভা বসেছিল; সে-সভায় আমি কী বলেছিলাম। আমি তোমার জন্যই কৃষ্ণের কথার বিরুদ্ধে গিয়েও এ-কথা বারবার বলেছিলাম যে, পাণ্ডব এবং কৌরব— দুই পক্ষই আমাদের কাছে সমান, দুই পক্ষের সঙ্গেই আমাদের আত্মীয় সম্বন্ধ বড় নিকট— ময়া সাতন্ধকং তুল্যম্‌ ইতি রাজন্ পুনঃ পুনঃ। আমি বলেছিলাম— পাণ্ডবরা আমাদের পিসতুতো ভাই, আর শাম্বের সঙ্গে দুর্যোধনের মেয়ের বিয়ে হওয়ায়, দুর্যোধন আমাদের নিকট কুটুম্ব। বলরামের কথায় দুর্যোধন বেশ খুশি হলেন নিশ্চয়। হয়তো এই ভেবে খুশি হলেন যে তাঁর পক্ষেও অন্তত একজন বলবার মানুষ আছেন, যিনি কৃষ্ণকেও বাধা দিয়ে কথা বলতে পারেন।

কিন্তু এরপরেই বলরাম যা বললেন, সেটা খুব খেয়াল করার মতো। বলরাম বললেন— কৃষ্ণকে তোমার জন্য অনেক বলেছি, কিন্তু সে আমার কথা কানে নেয়নি। কিন্তু সে যতই অমান্য করুক আমাকে, আমি কৃষ্ণকে ছাড়া এক মুহূর্তও থাকতে পারব না এবং সম্পূর্ণ তাঁর বিরুদ্ধেও যেতে পারব না— ন চাহমুৎসহে কৃষ্ণং বিনা স্থাতুমিতি ক্ষণম্। বলরাম এবার তাঁর সিদ্ধান্ত জানিয়ে বললেন— আমার কথাও যখন রইল না, আর কৃষ্ণকেও যখন আমি ছাড়তে পারব না, সেখানে আমি এই ঠিক করেছি যে, আমি অর্জুনেরও সহায় হব না, দুর্যোধনেরও সহায় হব না— নাহং সহায়ঃ পার্থস্য নাপি দুর্যোধনস্য বৈ— সত্যি কথা বলতে কী, কৃষ্ণের কথা এবং তাঁর ব্যবহার মাথায় রেখেই আমাকে এই বুদ্ধি স্থির করতে হয়েছে।

বলরামের চরিত্র এবং ব্যবহার বিচারে এইটাই হল শেষ কথা। তিনি কৃষ্ণকে ছেড়ে থাকতে পারেন না এবং সর্বশেষ জায়গাটিতেও তিনি তাঁকে অতিক্রমও করেন না। লক্ষণীয়, বলরামের যেটা একান্ত নিজস্ব চরিত্র— তিনি হঠাৎ-ক্রোধী, অনেকটাই এলোমেলো এবং অনেক ক্ষেত্রেই সযৌক্তিকভাবে তিনি বিচার-বিবেচনা প্রয়োগ করেন না— এই চরিত্র কিন্তু মাঝে মাঝেই ফুটে উঠেছে জীবনভর, কিন্তু অন্তিম যে বিন্দুতে সিদ্ধান্ত নিতে হয়, সেখানে কৃষ্ণ ছাড়া তাঁর কোনও গতি নেই। নিজের ক্রোধ, লজ্জা, ঘৃণা গিলে ফেলে তিনি শেষ পর্যন্ত নীলকণ্ঠ হয়ে বরণ করেন কৃষ্ণকে। অবতারবাদীর ক্ষেত্রে রাম-অবতারের লক্ষ্মণ এবং চৈতন্যসঙ্গী নিত্যানন্দও বলরামের মতোই একদিকে স্বতন্ত্র এবং অন্যদিকে চূড়ান্ত অস্বতন্ত্র বলেই বলরামের সঙ্গে লক্ষ্মণ এবং নিত্যানন্দের একাত্মতা সৃষ্টি হয়েছে।

শেষ জায়গায় যে বলরাম নিতান্তই অস্বতন্ত্র এবং কৃষ্ণ-নির্ভর, সেটা আরও একবার প্রমাণ হবে ওই উদ্যোগপর্বেই। দুর্যোধনের সঙ্গে তবু বলরামের কথা হয়েছিল, কিন্তু অর্জুন বা যুধিষ্ঠিরের সঙ্গে বলরাম কথা বলেননি অথবা তাঁরাও নিজে থেকে কোনও কথা বলেননি বলরামের সঙ্গে। এরপর যুদ্ধ থেমে যাবার সব আশাই যখন প্রায় শেষ হয়ে এল, দুই পক্ষেই বিরুদ্ধ পক্ষের বলাবল বিচার চলছে, ঠিক সেই আসন্ন মুহূর্তে হঠাৎ একদিন বলরাম এসে উপস্থিত হলেন যুধিষ্ঠিরের ভবনে— প্রাবিশদ্‌ ভবনং রাজ্ঞঃ পাণ্ডবানাং হলায়ুধঃ। তাঁর সঙ্গে বৃষ্ণি-যাদবদের প্রধানেরা অনেকেই এসেছিলেন— অক্রূর, উগ্রসেন, উদ্ভব— এঁরা সব। তাঁর পরনে সেই নীল কৌষেয় বসনখানি আছে, ঈষৎ মদ্যপানে এখনও আরক্ত তাঁর চক্ষুর প্রান্তভাগ, সেই বিশাল লম্বা চেহারা এবং তেমনই ব্যক্তিত্ব। তিনি প্রবেশ করার সঙ্গে সঙ্গে যুধিষ্ঠির, ভীম, অর্জুন এবং অবশ্যই কৃষ্ণও সসম্মানে উঠে দাঁড়ালেন।

মহারাজ যুধিষ্ঠির হাত দিয়ে স্পর্শ করলেন বলরামের হাত— ততস্তং পাণ্ডবো রাজা করে পস্পর্শ পাণিনা। অন্য সকলেই অভিবাদন করলেন বলরামকে। বলরাম বৃদ্ধ দ্রুপদ এবং বিরাট রাজাকে যথোচিত সম্মান জানিয়ে বসলেন যুধিষ্ঠিরের পাশে। কিন্তু তাঁর সোজাসুজি লক্ষ্য ছিল কৃষ্ণের প্রতি। যুধিষ্ঠিরের পাশে বসে তাঁর হাত ধরে, অথচ কৃষ্ণের দিকে তাকিয়ে তিনি বলতে লাগলেন— এই যে যুদ্ধ আসছে, তাতে লোকক্ষয়ের সীমা থাকবে না। কিন্তু এও এক পরম দুর্দৈব, এই যুদ্ধ কিছুতেই অতিক্রম করা গেল না। বলরাম মনে করেন বোধহয়— ইচ্ছে করলে কৃষ্ণ এই যুদ্ধ আটকাতে পারতেন, কিন্তু যে যুক্তি, অন্যায় এবং অনতিক্রম্যতায় এই যুদ্ধ হচ্ছে, তার বিস্তার বলরাম জানেন না এবং বোধহয় জানতে চানও না। যুধিষ্ঠিরকে তিনি বললেন— আমি আশা করব, এই যুদ্ধশেষে আপনাকে এবং আপনার বন্ধুবর্গকে আমি অক্ষত এবং নীরোগ অবস্থায় দেখতে পাব— অরোগান্‌ অক্ষতৈর্দেহৈদ্রর্ষ্টাস্মীতি মতির্মম।

বলরামের এই হিতৈষণা কিন্তু মিথ্যে নয়। এত বড় শক্তিধর পুরুষ, এত বড় ব্যক্তিত্ব, কিন্তু সেই নিরিখে তিনি কোথাও কোনও বিসম্বাদে তেমন করে জড়িয়ে যাননি কখনও। কূট রাজনীতি এবং অবশেষে যুদ্ধ— এই দুটিই বোধহয় তাঁর চক্ষুশূল। অবিশ্বাস এবং ক্রোধ যখন তাঁকে গ্রাস করেছে, সেই মুহূর্তেও তিনি কিন্তু কোনওদিন শেষ দেখতে চাননি, অদ্ভুত এক ঔদাসীন্যে তিনি স্থান ত্যাগ করে চলে গেছেন সেখান থেকে, তবু বিবাদের শেষ দেখতে চাননি কখনও। একান্ত নৈর্ব্যক্তিক চেতনায় বলরাম বললেন— সমস্ত ক্ষত্রিয়রা বোধহয় আজ মহাক্ষয়ের পক্ষে এসে দাঁড়িয়েছেন, অন্তিমে রক্ত আর মাংসের স্তূপ ছাড়া আর কিছুই থাকবে না। এইজন্যই কৃষ্ণকে আমি নির্জনে বারবার বুঝিয়েছি যে, দেখো ভাই! দুই পক্ষের সঙ্গেই আমাদের আত্মীয় সম্পর্ক আছে, তাদের সঙ্গে আমাদের সমান ব্যবহার করা উচিত— সম্বন্ধিষ্ণু সমাং বৃত্তিং বর্তস্ব মধুসূদন।

আমরা আগেও দেখেছি— অত্যন্ত ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মানুষ হওয়া সত্ত্বেও বলরাম প্রভাবিত হন খুব তাড়াতাড়ি। কুরুরাজ দুর্যোধন বারবার তাঁর কাছে গেছেন, তাঁকে নানারকম বুঝিয়েছেনও, তাতেই বলরামের মনে হয়েছে— দুর্যোধনকেও যথাসাধ্য সাহায্য করার যুক্তি আছে। তিনি পরিষ্কার জানিয়েছেন— এইজন্যই আমি কৃষ্ণকে বলেছিলাম— আমাদের কাছে পাণ্ডবরা যেমন, দুর্যোধনেরাও সেইরকম। অতএব দুর্যোধনকেও তুমি সাহায্য করো। বিশেষত দুর্যোধন বারবার আমার কাছে আসছে— তস্যাপি ক্রিয়তাং সাহ্যং স পৰ্য্যেতি পুনঃপুনঃ। দুর্যোধন কেন রাজনীতির ধুরন্ধর কৃষ্ণের কাছে যাচ্ছেন না এবং কেনই বা তিনি বলরামের কাছেই বারবার আসছেন, সে-কথা বলরামও বুঝি তেমন করে বোঝেন না। অথবা বুঝলেও অত্যন্ত সরলভাবে বোঝেন। পাণ্ডবদের কেউই যে তাঁর কাছে আসেননি, তাতেও তিনি কোনও অপমানিত বোধ করছেন না। বরঞ্চ কেন তিনি পাণ্ডবদের পক্ষে যুদ্ধ করতে আসছেন না, তার সাফাই দিতেই অত্যন্ত সরল এই হঠাৎ উপস্থিতি।

বলরাম যুধিষ্ঠিরকে বললেন— মহারাজ! আপনার জন্যই কৃষ্ণ আমার কথা শোনেনি। বিশেষত অর্জুনের দিকে তাকিয়ে তারই সাহায্যে সর্বভাবে নিজেকে নিয়োগ করেছেন কৃষ্ণ— নিবিষ্টঃ সর্বভাবেন ধনঞ্জয়ম্‌ অবেক্ষ্য চ। আর কৃষ্ণের যেখানে অভিনিবেশ, সেখানে জয় অবশ্যম্ভাবী বলেই আমার মনে হচ্ছে— ধ্রুবং জয়ো পাণ্ডবানাম্‌ ইতি মে নিশ্চিতা মতিঃ। কৃষ্ণের রাজনীতি বলরাম বোঝেন না, তাঁর সরল রাজনীতির বুদ্ধিতে তিনি একমতও হন না কৃষ্ণের সঙ্গে। কিন্তু কী অদ্ভুত এই অন্তিম বিশ্বাস— যে, ছোটভাই কৃষ্ণ যা করছেন, যা বুঝছেন তাই তাঁর মেনে নেওয়া উচিত শেষ পর্যন্ত। অতএব সেই শেষ কথাটা আবারও যুধিষ্ঠিরের উদ্দেশে— কৃষ্ণ ছাড়া আমি এই পৃথিবীর মানুষের দিকে তাকাতেই পারি না— ন চাহমুৎসহে কৃষ্ণমৃতে লোকমুদীক্ষিতুম্‌। অতএব কৃষ্ণ যদি তোমাদের সাহায্যেই মনোনিবেশ করে থাকে, তবে আমাকে সেটাই অবশ্য মানতে হবে— ততোহহমনুবর্তামি কেশবস্য চিকীর্ষিতম্। পরিশেষে নিজের নিরপেক্ষ ভাবটুকুও তিনি রেখে যাচ্ছেন সর্বতোভাবে এবং এই শেষ মুহূর্তে তিনি আর তুল্যমূল্য আত্মীয়-সম্বন্ধ টেনে আনছেন না। বলছেন— ভীম এবং দুর্যোধন— দু’জনেই আমার গদাযুদ্ধের শিষ্য, দু’জনেই বীর এবং দু’জনেই যথেষ্ট কুশল; এদের ওপর আমার স্নেহও সমান— তুল্যস্নেহোহস্ম্যতো ভীমে তথা দুর্যোধনে নৃপে— অতএব এদের দুইজনের একজনের পক্ষে যুদ্ধ করা আমার দ্বারা সম্ভব নয়। তা ছাড়া এই কুলক্ষয়কর যুদ্ধ আমি দেখতেও চাই না, বিশেষত কৌরবদের অনিবার্য ধ্বংস দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখতে পারব না আমি— ন হি শক্ষ্যামি কৌরব্যান্ নশ্যমানান্ অবেক্ষিতুম্‌। আমি তাই এখনই মঙ্গলময় সরস্বতী-তীর্থে যেতে চাই— এই ধ্বংস আমি দেখতে পারব না।

যতই সমানতা থাকুক, যতই বলরাম বলুন— ভীম এবং দুর্যোধন আমার কাছে সমান— তবু অন্তর্হৃদয়ে কোথায় যেন তাঁর দুঃখ ছিল, কোথায় যেন একটা সূক্ষ্ম পক্ষপাত ছিল দুর্যোধনের জন্য। সত্যি বলতে কী, যে ক্ষোভে তিনি সরস্বতী তীর্থে চলে গেলেন, সে ক্ষোভ বোধহয় অনেকটাই কৃষ্ণের ওপর। যেভাবেই হোক বলরাম এটা বুঝে গিয়েছিলেন যে, কৃষ্ণ যে-পক্ষে আছেন তার বিরোধী পক্ষের পরাজয় অবশ্যম্ভাবী। কোনও কাজ কৃষ্ণ না ভেবে করেন না এবং অন্যায় করার সুযোগও তিনি অনেক দেন, কিন্তু শেষে যখন তিনি বিরোধীকে ধরেন, তখন তার আর রেহাই নেই। কংসের মৃত্যু বলরাম দেখেছেন, দেখেছেন জরাসন্ধ এবং শিশুপালের মৃত্যু। এদের অনেক অন্যায় করার সময় দিয়েছেন কৃষ্ণ কিন্তু রাজনীতির আটঘাট বেঁধে কৃষ্ণ যখন শেষ সমরে অবতীর্ণ হয়েছেন, তখন এদের বাঁচাবার জন্য স্বপক্ষে কেউ ছিল না। বলরাম এটা দেখেছেন বলেই জানেন যে, ভীষ্ম, দ্রোণ, কৃপ— যাঁরাই দুর্যোধনের পক্ষে যুদ্ধ করুন, তাঁদের অনেকেই তাঁর জন্য আন্তরিক নন। অথচ দুর্যোধন মানুষটাকে তাঁর ভালই লাগে, বিশেষত দুর্যোধন কাউকে আমল না দিলেও সরলবুদ্ধি বলরামকে তিনি প্রণিপাত এবং বশংবদতায় বশ করে ফেলেছিলেন। দুর্যোধনের প্রতি বলরামের এই পক্ষপাতটুকু বোঝা যায়, যখন তিনি বলেন— আমি কৌরবদের এই সমূহ ধ্বংস দেখতে পারব না। পাণ্ডবদের কথা তিনি বলেননি, কেন না তিনি জানতেন কৃষ্ণের অনুগামিতায় তাঁরা সুরক্ষিতই থাকবেন।

পাণ্ডব-কৌরবের যুদ্ধ যখন প্রায় শেষ হয়ে আসছে, কৌরব-পক্ষের স্বনামধন্য যুদ্ধনায়কেরা— ভীষ্ম, দ্রোণ, কর্ণ যখন নিপাতিত, এমনকী শল্যও যখন কালগ্রহে মৃত্যুমুখে শেষ হয়ে গেছেন, তখনও বলরাম তীর্থে তীর্থে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। বলরাম শুধুমাত্র সরস্বতী-তীর্থে গিয়েই নিজের নির্বিকার ভ্রমণ-পিপাসা মিটিয়ে ফেলেননি। তীর্থের পর তীর্থ তিনি ঘুরেছেন এবং ঋষি-মুনিদের কাছে সেইসব ইতিবৃত্ত-কাহিনিও শুনেছেন— যা তখনকার দিনের বিভিন্ন পর্যটন স্থানগুলির ঐতিহাসিক গুরুত্ব বুঝিয়ে দেয় তখনকার মতো করেই। তীর্থদর্শন করতে করতে বলরাম তখন যুদ্ধভূমি কুরুক্ষেত্রের কাছাকাছিই চলে এসেছিলেন। সেখানেও এক তীর্থ আছে, সেখানে বসে কৌরবদের পূর্বপুরুষ মহারাজ কুরুর কীর্তিকাহিনি শুনে বলরাম হাঁটতে হাঁটতে স্যমন্তপঞ্চকের কাছাকাছি এক আশ্রমে এসে উপস্থিত হলেন। আশ্রমটির পরিবেশ অতি মনোরম। মহুয়া ফুলের গন্ধ ভেসে আসছে, আম-কাঁঠালের বড় বড় গাছ, বট-পাকুড়-বেল গাছের সারি। বলরাম আশ্রমের ইতিবৃত্ত শুনে হিমালয়ের সানুদেশে সন্ধ্যাবন্দনা সেরে পাহাড়ের ওপর দিকে উঠলেন। বস্তুত এইখানেই সরস্বতী নদীর উৎস-স্থান। বলরাম সেখানে এসে পৌঁছলেন। সরস্বতীর উৎস দেখে আস্তে আস্তে সমভূমিতে নেমে যমুনা-নদীর কাছাকাছি এসে উপস্থিত হতেই দেবর্ষি নারদের সঙ্গে তাঁর দেখা হয়ে গেল।

নারদ সদা ভ্রমণশীল মানুষ। কুরুক্ষেত্রের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের সব খবর তিনি রাখেন। বলরাম তাঁর কাছে কৌরব-পাণ্ডবদের শেষ খবর জানতে চাইলেন। নারদ জানালেন— ভীষ্ম, দ্রোণ-কর্ণ-শল্য সকলেই শেষ, কৌরব-পক্ষে বেঁচে আছেন তিনজন— কৃপাচার্য, কৃতবর্মা এবং অশ্বত্থামা— তাঁরাও পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। দুর্যোধন দ্বৈপায়ন হ্রদে গিয়ে লুকিয়ে থাকলেও পাণ্ডবদের গালাগালি এবং তিরস্কারে আহত হয়ে গদা হাতে চলে এসেছেন। হয়তো আজই সেই ভয়ংকর গদাযুদ্ধ হবে, তোমার দুই শিষ্য ভীম আর দুর্যোধনের শেষ যুদ্ধ। নারদ বললেন— তোমার যদি এই যুদ্ধ দেখার ইচ্ছে থাকে, তবে এখনই যাও, এক মুহূর্তও দেরি কোরো না— যদি কৌতূহলং তেহস্তি ব্রজ মাধব মা চিরম্।

তীর্থযাত্রায় প্রসন্নমুখ নির্বিকার বলরাম আবারও সবিকারী হয়ে উঠলেন। দুই শিষ্যের যুদ্ধ দেখার ইচ্ছে মনের মধ্যে প্রবল হয়ে উঠল। হেঁটে গেলে দেরি হয়ে যাবে, অতএব এক শীঘ্রগামী রথে অশ্ব যোজনা করে বলরাম সোজা উপস্থিত হলেন যুদ্ধস্থানে। বলরামকে দেখেই যুধিষ্ঠির গাত্রোত্থান করে অভিবাদন জানালেন। বলরাম দেখলেন যুদ্ধের তোড়জোড় চলছে। প্রস্তুত হচ্ছেন দুইজনেই— ভীম এবং দুর্যোধন। বলরাম যুধিষ্ঠিরকে বললেন— যুদ্ধটা এইখানে না করে, স্যমন্তপঞ্চকে চলো। খুব কাছেই এই জায়গা, আমি আগে দেখে এসেছি। মহাপুণ্যক্ষেত্রে প্রাণ গেলে স্বর্গের পথ এখানে পরিষ্কার। বলরামের কথা কেউ অমান্য করলেন না। হয়তো পাণ্ডবরা রথে করেই যাবার কথা ভেবেছিলেন, কিন্তু বলরামের কথায় পুণ্যস্থানের মর্যাদা দিয়ে দুর্যোধন পায়ে হেঁটে অভীষ্ট যুদ্ধক্ষেত্রের দিকে রওনা দিতেই পাণ্ডবরাও চললেন পায়ে হেঁটে। এ এক অদ্ভুত দৃশ্য, যেটা সেকালেই সম্ভব ছিল। যাঁরা এই একটু পরেই যুদ্ধ করে একজন অন্তত মারা যাবেন, তাঁরা একসঙ্গে চলেছেন নির্দ্বিধায়। পাণ্ডব-ভাইরা, কৃষ্ণ, বলরাম সবাই দুর্যোধনকে ঘিরে ধরে চললেন স্যমন্তপঞ্চকের যুদ্ধভূমিতে— স পাণ্ডবৈঃ পরিবৃতঃ কুরুরাজস্তবাত্মজঃ। সরস্বতী নদীর তীরে অনাবৃত এক সমভূমিতে ভীম আর দুর্যোধনের যুদ্ধ আরম্ভ হল। কী ভয়ংকর সেই যুদ্ধের স্বরূপ, তা আমরা অনুমান করতে পারি। বলরাম যে জায়গায় তীর্থ করার জন্য এসেছিলেন, তারই সন্নিকটভূমিতে আরও এক যুদ্ধতীর্থের নির্মাণ ঘটে গেল ভীম আর দুর্যোধনকে উপলক্ষ করে।

দ্বৈরথ যুদ্ধে পরস্পর পরস্পরকে গালাগালি দিয়ে নিজের উত্তেজনা বাড়িয়ে নেওয়াটা একটা সাধারণ নিয়ম। যুদ্ধের জন্য যখন দু’জনেই প্রস্তুত, তখন দুর্যোধন দাঁড়িয়ে-থাকা সবার উদ্দেশে বললেন— মহাবলী বলরাম ঠিক কথাই বলেছেন। এইখানেই যুদ্ধের উপযুক্ত জায়গা। আপনারা সবাই উপবেশন করুন এবং যুদ্ধ দেখুন। সকলেই বসলেন বটে, কিন্তু সকলের চেয়ে বলরামের ব্যক্তিত্ব এবং প্রভাব এখানে প্রতিবিশিষ্টভাবে উজ্জ্বল লাগছিল— শুশুভে রাজমধ্যস্থো নীলবাসাঃ সিতপ্রভঃ।

সেসব কথা আর বাড়াব না। আপনারা জানেন যে, দুর্যোধন আর ভীমের ভয়ংকর যুদ্ধ হয়েছিল এবং সেই যুদ্ধের শেষ পর্যায়ে দুর্যোধন ভীমকে চরম আক্রমণের জন্য শূন্যে লাফ দিয়ে উঠলে ভীম সুযোগ বুঝে দুর্যোধনের দুই ঊরুর ওপর এমন আঘাত করলেন যে, তাঁর পক্ষে আর দাঁড়িয়ে থাকা সম্ভব হল না। রণভূমিতে শুয়ে পড়লেন দুর্যোধন, যদিও ভীম এবং দুর্যোধনের পারস্পরিক গালাগালি চলতে লাগল। তখনও বুঝি অন্যান্য পাণ্ডবদের সম্যক বোধ ফিরে আসেনি, তখনও বুঝি পরিস্থিতির শেষ গুরুত্ব অনুভব করেননি যুধিষ্ঠির, যুদ্ধদ্রষ্টা হিসেবে যাঁরা বসেছিলেন, তাঁদের মধ্যে থেকে সেই রজতগিরি-সন্নিভ বলরাম ক্রুদ্ধ হয়ে ছুটে এলেন ভীমের দিকে। বললেন— ছিঃ! ছি-ছি! ভীম! শত শত ধিক্কার তোমার উদ্দেশে। ধর্মযুদ্ধের সমস্ত নীতি অতিক্রম করে ভীম নাভির নীচে দুর্যোধনকে প্রহার করেছে। গদাযুদ্ধে এমন অভব্যতা কোনওদিন হয়নি যা ভীম করে দেখাল— নৈতদ্‌ দৃষ্টং গদাযুদ্ধে কৃতবান যদ্‌ বৃকোদরঃ। যুদ্ধশাস্ত্রের কোনও নিয়মে নাভির নীচে প্রহার করাটা একেবারেই সমর্থনযোগ্য নয় এবং ভীমেরও কোনও অধিকার নেই যাতে তিনি স্বেচ্ছাচারে স্বনিয়মে যুদ্ধ করতে পারেন।

মহাক্রোধ হল বলরামের। নিজের একরোখা স্বভাবের জন্যই হোক, উপস্থিত ঘটনার সাময়িক বিচারেই হোক অথবা দুর্যোধনের প্রতি তাঁর সামান্য পক্ষপাতের ফলেই হোক, বলরাম কিন্তু পূর্বের ঘটনা মনে রাখেন না এতটুকু। এই যে ভীমের প্রতি তিনি এত ক্রোধ করছেন, তাঁর প্রতি দুর্যোধন যে অন্যায়গুলো করেছেন— খাবারে বিষ মেশানো থেকে আরম্ভ করে যখন-তখন তাঁকে যথেচ্ছ অপমান করার যেসব ঘটনা ঘটেছে— দুর্যোধনের সেসব অন্যায় এখন তাঁর মনে নেই। যুদ্ধশাস্ত্রের নিয়মে নাভির নীচে প্রহার করাটা অশাস্ত্রীয় লাগছে বলরামের কাছে, কিন্তু উন্মুক্ত রাজসভার মধ্যে যেদিন দুর্যোধন পাণ্ডবকুলবধূ দ্রৌপদীকে নিজের অপাবৃত ঊরুদেশ প্রদর্শন করেছিলেন, সেদিনের সেই আচরণ দুর্যোধনের পক্ষে কতটা অশাস্ত্রীয় ছিল, তা বলরাম এতটুকুও মনে রাখেননি। সামনে যে ঘটনা ঘটেছে, তিনি শুধু তারই বিচার করে ভীষণ ক্রুদ্ধ হলেন। এতটাই ক্রুদ্ধ যে, তিনি তাঁর সেই বিখ্যাত লাঙলটি তুলে নিলেন ভীমকে শাস্তি দেবার জন্য— ততো লাঙ্গলমুদ্যম্য ভীমমভ্যদ্রবদ্‌ বলী।

ছোট ভাই কৃষ্ণ এতক্ষণ সব দেখছিলেন। বলরামের ক্রোধ হলে কী বিষম বিপদ হতে পারে তিনি তা জানেন, কিন্তু প্রথম প্রতিক্রিয়ায় তাঁর ক্রোধ নির্গত হবার সুযোগ দেন তিনি। লাঙল তুলে ঊর্ধ্ববাহু হয়ে বলরাম যখন এগোচ্ছেন ভীমের দিকে, তখন তিনি হাত দিয়ে বলরামকে ধরলেন ভালমতো, শক্ত করে। কৃষ্ণ প্রথমেই বলরামের পূর্বকথিত যুক্তিগুলির পিছনে প্রতিযুক্তি সাজালেন না। প্রথমে তিনি রাজনীতি-শাস্ত্রের চিরাচরিত উক্তিগুলি উচ্চারণ করলেন কূটনৈতিক সম্বন্ধ উত্থাপন করে। বললেন— বৈদেশিক তথা পররাষ্ট্রীয় সম্বন্ধে বিচার করলে নিজের উন্নতি হয় ছয়রকমে। নিজের উন্নতি, বন্ধুরাষ্ট্রের উন্নতি এবং বন্ধুর বন্ধুরাষ্ট্রের উন্নতিতে যেমন নিজেরই উন্নতি হয়, তেমনই শত্রুর ক্ষতি, শত্রুর বন্ধুরাষ্ট্রের ক্ষতি এবং শত্রুর বন্ধুর বন্ধু যদি ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তাতেও নিজের উন্নতি হয়। আমাদের নিজের পিসিমা কুন্তীর ছেলে বলেই পাণ্ডবরা জন্মলগ্নেই আমাদের সহজ মিত্রের মধ্যে পড়ে। তাদের ওপর যে অত্যাচার, নিপীড়ন হয়েছে, তার প্রতিশোধ নিতেই এই কাজ করেছেন ভীম। দ্বিতীয় কথা হল— সেই পাশা খেলার সময় দুর্যোধন যখন ঊরু দেখিয়েছিলেন দ্রৌপদীকে, তখনই ভীম প্রতিজ্ঞা করেছিলেন— যুদ্ধের সময় তাঁর ওই ঊরু-দুটি গদাঘাতে পঙ্গু করে দেবেন। তো ক্ষত্রিয় হয়ে নিজের প্রতিজ্ঞা পালন করবে না? এটা কী বলছেন আপনি? আমি তো এই ঊরু ভঙ্গের মধ্যে কোনও দোষ দেখতে পাচ্ছি না আর আপনিও এত ক্রুদ্ধ হবেন না— অতো দোষং ন পশ্যামি মা ক্রুধস্ব প্রলম্বহন্‌।

বলরাম কূট রাজনীতির কথা বোঝেন না, বৈদেশিক নীতি, পররাষ্ট্রনীতি— এসব তাঁর মাথায় তেমন ঢোকে না এবং পাণ্ডবদের দৈনন্দিন জীবনে দুর্যোধন যে অপব্যবহারগুলি করেছেন, তার সঙ্গেও তিনি মানসিকভাবে তেমন জড়িত নন। কাজেই কৃষ্ণ যেভাবে পাণ্ডবদের ব্যথাগুলি অনুভব করছেন, বলরাম তা করছেন না। তিনি ঘটনার সাময়িক বিচারটুকু নিয়ে ব্যস্ত বলেই কৃষ্ণের কথায় তেমন খুশি হতে পারলেন না, কিন্তু কৃষ্ণের ব্যক্তিত্ব অতিক্রম করে ভীমের মাথার ওপর লাঙলের আঘাত করার সাধ্যও তার নেই। তিনি যুদ্ধনীতিতে ধর্মের প্রসঙ্গ তুলে গজর-গজর করতে লাগলেন। পরিশেষে কৃষ্ণকে বললেন— ভীম মোটেই এটা ঠিক কাজ করেনি, ধর্মের নিয়মে একাজ কখনওই সমর্থন করা যায় না। কিন্তু তুমি যে আবার বলছ ভীম ঠিক কাজই করেছে, তারও হয়তো যুক্তি আছে— তদিদং ব্যাকুলং সর্বং কৃতং ধর্মস্য পীড়নাৎ। ভীমসেনেন গোবিন্দ কামং ত্বন্তু যথাত্থ মাম্‌।

সবকিছুর পরেও বোঝা গেল— সরল বুদ্ধি বলরামকে দুর্যোধন বোধহয় তাঁর নিজের ব্যবহারগুলি বোঝাতে পেরেছিলেন। হয়তো দুর্যোধনের ব্যাপারে তাঁর কিছু পক্ষপাতও ছিল। যার জন্য কৃষ্ণের প্রতিযুক্তিগুলি সব শোনার পরেও বলরাম হৃদয় থেকে তা মানতে পারেননি এবং বলেছেন— তুমি যতই বলল কৃষ্ণ! এমন একটা কাজ করার ফলে ভীমের এই দুর্নামটুকু হবেই যে, সে ছল করে দুর্যোধনকে মেরেছে— জিহ্‌মযোধীতি লোকেহস্মিন্ খ্যাতিং যাস্যতি পাণ্ডবঃ— আর যুদ্ধের নিয়মে অবস্থিত ধর্মাত্মা দুর্যোধন স্বর্গে যাবেন নিশ্চয়ই। এ পর্যন্ত দুর্যোধনকে কেউ ‘ধর্মাত্মা’ বলেননি, ধর্ম অনুসারে কোনওদিন তিনি লোকব্যবহারও করেননি, কিন্তু অন্তিম মুহূর্তে যুদ্ধের নীতিতে মাত্র অবস্থিত থেকেই যে এমন আখ্যা লাভ করা যেতে পারে, তাতে প্রধান শাংসিক হয়ে রইলেন বলরাম। অনেক আশা নিয়েই তীর্থযাত্রার মধ্যেই বলরাম চলে এসেছিলেন তাঁর দুই শিষ্যের যুদ্ধ দেখতে। তিনি জানতেন যে, কৃষ্ণ পাণ্ডবপক্ষে থাকায় তাঁদের জয় অবশ্যম্ভাবী, কিন্তু যুদ্ধ যখন অন্তিম মুহূর্তে শুধু ভীম আর দুর্যোধনের মধ্যে এসে ঠেকেছিল, তখন কি তিনি এই আশা করেছিলেন যে, দুর্যোধনেরই জয় হবে এবং ভীম মারা যাবেন। কেন না দুই শিষ্যকেই গদাযুদ্ধ শেখানোর ফলে বলরাম এটা জানতেন যে, গায়ের শক্তিতে ভীম দুর্যোধনের চেয়ে বেশি বলবান হলেও গদাযুদ্ধের কৌশল দুর্যোধন বেশি জানেন। ফলে সঠিক নিয়মে যুদ্ধ হলে দুর্যোধনই জিতবেন। হয়তো এই আশাতেই তীর্থযাত্রার অন্তিম পর্বে নারদের মুখে সব কথা শুনে বলরাম চলে এসেছিলেন নিজের প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করে।

এটা অবশ্যই আমার অনুমানের সন্ধানমাত্র। বারবার কেমন মনে হয়— বলরামের জীবনে, অন্তত উত্তর জীবনে কৃষ্ণের বিশাল ব্যক্তিত্বের এক বিপরীত প্রতিক্রিয়া হয়েছিল। কৃষ্ণের বুদ্ধি, তাঁর জ্ঞান, কূটবুদ্ধি এবং রাজনৈতিক প্রভাব এতটাই যে তার নাগাল পাওয়া সম্ভব ছিল না বলরামের পক্ষে। অথচ তিনি বড় ভাই, কম শক্তিধরও তিনি নন— কিন্তু এক বিপরীত মানস-লোক গড়ে উঠেছে তাঁর মধ্যে। হয়তো সেইজন্যেই প্রাথমিক প্রতিক্রিয়ায় উত্তেজিত হয়ে তিনি ভীষণ একটা কিছু করে ফেলতে চান, কিন্তু শেষ পর্যন্ত আর সেই প্রতিক্রিয়া বজায় রাখতে পারেন না, কৃষ্ণের ব্যক্তিত্ব তখন চেপে বসে তাঁর ওপর। হয়তো এই চাপের ফলেই দুরাত্মা দুর্যোধনের ওপর তাঁর এক অদ্ভুত বিপরীত মায়া থেকে গেছে এবং তারও মূলে হয়তো আছে কৃষ্ণের বিপ্রতীপ প্রভাব বা ব্যক্তিত্ব।

বলরাম আর এক মুহূর্তও হস্তিনাপুরীর কাছাকাছি থাকলেন না, তীর্থযাত্রায়ও ফিরে যাননি পুনর্বার। রথে চড়ে সোজা তিনি চলে গেছেন দ্বারকায়। পাণ্ডবদের জয়োল্লাস, হস্তিনাপুরীতে প্রবেশ, যুধিষ্ঠিরের রাজ্যপ্রাপ্তি— সব জায়গাতেই কৃষ্ণকে আমরা সক্রিয়ভাবে উপস্থিত দেখেছি, কিন্তু একবারের তরেও বলরাম আর হস্তিনাপুরীতে পদার্পণ করেননি।

তবু এটাকে আমরা অভিমান বলতে রাজি নই। কৃষ্ণ যেখানে উজ্জ্বলভাবে উপস্থিত, আমি সেখানে থাকব না— এমন কোনও কঠিন অভিমান তো নয়ই। কৃষ্ণকে এতটাই ভালবাসেন বলরাম যে, ভালবাসার কারণেই তিনি তাঁকে অতিক্রম করেন না। তবে কিনা রাজনীতি, কূটনীতি, জ্ঞাতিশত্রুতা— এসব ব্যাপারে বলরামের একটা সার্বিক ঔদাসীন্য ছিল বলেই এতকাল যা দেখেছেন, তাতে কিছু নির্বিণ্ণতাও এসেছে সার্বিকভাবেই। মহাভারতের শেষ পর্যায়ে আমরা অনেকেরই খবর পাচ্ছি— কৃষ্ণ, যুধিষ্ঠির, ধৃতরাষ্ট্র, গান্ধারী— সবারই শেষ খবর পাচ্ছি, কিন্তু বলরামের তেমন কোনও খবর নেই। এমনকী মৌষল-পর্বে যদুবংশ ধ্বংসের অব্যবহিত পূর্বে যখন বৃষ্ণি-যাদবেরা সকলেই কৃষ্ণের সামনে অকাতরে মদ্য পান করছেন, তখনও স্বাভাবিক মদমত্ত বলরামকে তেমন সক্রিয় দেখছি না। কৃতবর্মা, সাত্যকি, কৃষ্ণপুত্র প্রদ্যুম্ন— সকলেই মদমত্ত অবস্থায় পরস্পরে হানাহানি করে মরছেন— এই অবস্থায় কৃষ্ণকেও আমরা ক্রুদ্ধ দেখতে পাচ্ছি, কিন্তু বলরামকে দেখছি— তিনি নির্বিণ্ণ, সমাহিত। এই পারস্পরিক হিংসার দিকে তিনি তাকিয়েও দেখলেন না। নিতান্ত ঔদাসীন্যে তিনি দ্বারকা-নগরী থেকে বেরিয়ে গিয়ে এক প্রান্তিক বৃক্ষতলে আশ্রয় নিয়েছেন নির্জনে।

কৃষ্ণ তাঁর বিশ্বস্ত সারথি দারুককে সঙ্গে নিয়ে বলরামের কাছে এসে সব খবর দিলেন, তিনি একটি কথাও বললেন না। কৃষ্ণ বলরামের সামনেই দারুককে আদেশ দিলেন অর্জুনকে খবর দেবার জন্য এবং বলরামকে বললেন— আমি যতক্ষণে পিতা বসুদেবকে দ্বারকার স্ত্রীদের রক্ষা-বিষয়ে অবহিত করে ফিরে না আসছি, ততক্ষণ আপনি আমার জন্য অপেক্ষা করুন এখানে। কৃষ্ণ দ্বারকায় প্রবেশ করে পিতা বসুদেবকে সব জানিয়েছেন, অর্জুনের প্রতি নির্দেশের কথাও বলেছেন তাঁকে, কিন্তু বলরামের কাছে ফিরে আসার পর আর তাঁকে পূর্বাবস্থায় দেখেননি। কৃষ্ণ বসুদেবকে বলেছিলেন— আপনারা থাকলেন, দেখবেন সবাইকে, অর্জুনও নিশ্চয়ই আসবেন, কিন্তু আমি চলে যাচ্ছি। আমি নির্জন বনে দাদা বলরামের সঙ্গে একত্রে তপস্যা করব— তপশ্চরিষ্যামি নিবোধ তন্মে/রামেণ সার্ধং বনমভ্যুপেত্য।

দাদা বলরামের সঙ্গে আর তপস্যা করা হয়নি কৃষ্ণের। চিরকাল রাজনীতি, কূটনীতি, ধর্মনীতি এবং দর্শন নিয়ে ব্যস্ত থেকে যিনি শেষ নির্বিণ্ণতার তপস্যাটুকু করতে চেয়েছিলেন অগ্রজ বলরামের সঙ্গে, তিনি আর সুযোগ পেলেন না। দ্বারকার হিংসাদীর্ণ ভূমি থেকে বেরিয়ে এসে কৃষ্ণ যখন দাদার কাছে পৌঁছলেন, তখন তিনি দেখলেন— বৃক্ষমূলে সমাহিত বলরাম। তাঁর মুখ থেকে এক মহাসর্প বেরিয়ে যাচ্ছে সমুদ্রের দিকে— অনন্তের প্রতিরূপ, জগদ্ধারী শেষনাগের প্রতিরূপ। পাণ্ডব-কৌরবের যুদ্ধধ্বংস, মৌষলপর্বের ধ্বংস-কল্প— এই সমস্ত ধ্বংসের প্রতিনিধি হয়ে বলরামের আত্ম-প্রতিরূপ অনন্তদেব প্রলয়সমুদ্রে সমাহিত হলেন পুনরায় সৃষ্টির তপস্যায় বসার জন্য। বলরামের মতো বিশাল এক অগ্রজ চরিত্রের এই কাহিনিহীন নিরাড়ম্বর বিশ্রাম আমাদের যতখানি আশ্চর্য করে ততখানিই শান্তরস জাগায় এই হিংসাতপ্ত পৃথিবীর বুকে।

***

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *