দুঃশাসন

দুঃশাসন

ন্যায্য দাবি আদায়ের জন্য একটি ইউনিয়ন যখন লড়াই করে এবং দাবি আদায়ে সফল হয়, তার মতো গণতান্ত্রিক অথবা সমাজতান্ত্রিক সাফল্য আর কিছু হতে পারে না। কিন্তু ইউনিয়ন যখন ইউনিয়নবাজিতে পরিণত হয়, তখন বামপন্থী, দক্ষিণপন্থী, মধ্যপন্থী, যে কোনও রাজনৈতিক আদর্শ-নির্বিশেষে দেখেছি— সমস্ত ব্যাপারটা কেমন বাধা-বাঁধন, শাসনের বাইরে চলে যায়। ঠিক এই রকম একটা জঙ্গি ইউনিয়নবাজির মধ্যেই সেই মানুষটিকে দেখা যায়, যিনি একাকী থাকলে তাঁর কোনও ব্যক্তিত্ব চোখে পড়বে না, কোনও ক্ষমতা চোখে পড়বে না, এমনকী লিডারশিপ দেবারও কোনও ক্ষমতা নেই তাঁর। কিন্তু যখন দলের মধ্যে থাকেন, একটা অটুট সংঘশক্তি যখন তাঁর পিছনে আছে, তখন একাকী সেই মেষশাবক হঠাৎই সিংহশিশু হয়ে ওঠে। তার ভাষার আগল থাকে না, তার মুষ্টিবদ্ধ হাত মর্যাদা-পুরুষের শরীরে আঘাত না করে প্রতীকীভাবে টেবিলে আঘাত করে, পায়ের লাথি কোনও কারণে বা কোনও ক্রমে ঊর্ধ্বতনের মাথায় না পড়ে প্রতীকীভাবে ভূমিতে আস্ফালিত হয়! দলপতি যতটুকু তাকে বলে দেন তাঁর মাত্রা পঞ্চাশ গুণ বাড়িয়ে নিয়ে তিনি ভাষা ব্যবহার করেন। অথবা যতটুকু দলপতি বলেননি, তাও বুদ্ধিহীন বিবেচনাহীন তাঁর মানসলোকে এমনভাবেই বিস্ফারিত হয় যে, তাঁর আকার ইঙ্গিতে এবং প্রয়াসগুলি শাসনাতিগ হয়ে ওঠে। এই বুদ্ধিহীন, শাসনাতিগ ব্যবহারের প্রতিমূর্তিই দুঃশাসন। ধৃতরাষ্ট্রের তৃতীয় পুত্র— দুর্যোধনের ছায়াসঙ্গী ছোট ভাই; ধৃতরাষ্ট্রের ঔরসজাত বৈশ্যজাতীয়া রমণীর গর্ভজাত যুযুৎসুরও তিনি ছোট ভাই, তাই তৃতীয় পুত্র।

প্রথমে তো মনে রাখতেই হবে যে দুঃশাসন দুর্যোধন নন, আর তা নন বলেই মহাকবির বর্ণনায় যখন তিনি দুর্যোধনের পাশে আছেন, তখন তাঁর একটা আকার-প্রকার দেখা যায়, কিন্তু যে মুহুর্তে তিনি একশো ভাইয়ের একজন, সেই মুহূর্তে মহাকবির বর্ণনায় দুঃশাসন একেবারেই সাধারণীকৃত। এমনকী ধৃতরাষ্ট্রের মতো এক বিরাট চরিত্রের পুত্র বলেই কতগুলি সাধারণ মহাকাব্যিক অতিশায়ন তাঁর ভাগ্যে জুটে যায়। এই যেমন ধৃতরাষ্ট্রের সব ছেলেই খুব ভাল যুদ্ধ জানেন, সব ছেলেই খুব পড়াশুনো করেছেন, সুন্দরী-সুন্দরী সব মেয়েদের সঙ্গে তাঁর সব ছেলেরই বিয়ে দেওয়া হয়েছিল— সর্বেষাম্‌ অনুরূপাশ্চ কৃতা দারা মহীপতে। যুযুৎসুকে নিয়ে ধৃতরাষ্ট্রের একশো-এক ছেলের মধ্যে এইভাবেই দুঃশাসন হারিয়ে যান, ঠিক যেমন ইউনিয়নবাজির অন্যতম সেই জঙ্গি মানুষটিও একাকী বড় অনালোচিত। তার পরেই কথা ওঠে— একশো নয়, ধৃতরাষ্ট্রের অন্তত চারটি ছেলের মধ্যে দুঃশাসনের নাম আসে। কেন আসে? কেন না, দুর্যোধন ছাড়া আর যাঁদের জীবন সম্বন্ধে অল্পও বা একটু জানা যায়, তাঁরা হলেন বিকর্ণ, যুযুৎসু এবং দুঃশাসন। তার মধ্যে বিকর্ণ এবং যুযুৎসুর চরিত্র দুঃশাসনের বিপরীত। ফলত দুঃশাসন যতটুকু আলোকিত হয়ে ওঠেন, সেটা একান্তই দুর্যোধনের দীপ্তিতে এবং তাঁরই কারণে।

দুঃশাসনের জীবনে অবান্তর কিছু সংবাদ আছে। জন্ম থেকে তাঁর বেড়ে ওঠার মধ্যে কোনও গুরুতর সংবাদ না থাকলেও যে মুহূর্তে প্রথম তাঁর নাম উচ্চারণ হচ্ছে, সেই মুহূর্তেই দুর্যোধন-শকুনির গোপন ষড়যন্ত্রে অন্যতম অংশীদার হিসেবে আমরা দুঃশাসনকে দেখতে পাই। বস্তুত দুঃশাসন যে ষড়যন্ত্রের কোনও ‘আইডিয়া’ দিতে পারেন, তাও নয়। ষড়যন্ত্রের ছক কষেন দুর্যোধন অথবা শকুনি, কিন্তু সেই আসরে কর্ণও যেমন থাকেন, তেমনই দুঃশাসনও থাকেন দুর্যোধনের ছায়াসঙ্গী। কর্ণকে তবু মাঝে মাঝে কথা বলতে দেখি, দুঃশাসন কথাও বলেন না। অথচ পাণ্ডবদের বিরুদ্ধে যে দুষ্ট-চতুষ্টয়ের গোপন আলোচনা-চক্র চলে, সেখানে দুঃশাসন কিন্তু অন্যতম সদস্য, তিনি সেই চতুর্থ মানুষটি, যিনি চক্র তৈরি করতে পারেন না, অথচ চক্র বড় ভালবাসেন— দুঃশাসন-চতুর্থাস্তে মন্ত্রয়ামাসুরেকতঃ।

কোনও ঘটনার আগে পর্যন্ত দুঃশাসন মহাভারতে একটি অবান্তর নাম-মাত্র, ধৃতরাষ্ট্রের একশত পুত্রের অন্যতম নামমাত্র। কিন্তু প্রথম ঘটনাতেই দুঃশাসনকে কুচক্রী-চতুষ্টয়ের চতুর্থ স্থানে স্থাপন করে মহাকাব্যের কবি এই চরিত্রের জীবন-সুর বেঁধে দিয়েছেন। বারণাবতে পাণ্ডবদের জতুগৃহে পুড়িয়ে মারার যে ভয়ংকরী পরিকল্পনা, যেখানে দুর্যোধনের ভূমিকা অনেক গুরুত্বপূর্ণ, সেখানে দুঃশাসন বসে-বসে উত্তেজনার আগুন পোহান। অথবা অপেক্ষা করেন কবে তিনি দুর্যোধনের ছত্রচ্ছায়ায় একটি ছায়া-কর্ম সম্পন্ন করবেন। নইলে এই জতুগৃহের ষড়যন্ত্রে বারণাবতের লোক ঠিক করা থেকে আরম্ভ করে লাক্ষাগৃহ বানানোর কাজ, অগ্নিদাহের দিন ঠিক করা— এই এত কর্মকাণ্ডের কোনও একটির মধ্যেও দুঃশাসন নেই, অথচ ষড়যন্ত্রের সহায় হিসেবে তিনি আছেন একান্ত অনুগামীর ভূমিকায়। সাধারণ প্রয়োজন বা অপ্রয়োজনের অবান্তর ক্ষেত্রে দুঃশাসনকে আমরা দ্রৌপদীর স্বয়ংবর-সভায় যেতে দেখেছি। দেখেছি, যুধিষ্ঠিরের রাজসূয় যজ্ঞে তিনি রীতিমতো গুরুত্বপূর্ণ কাজও পেয়েছেন যুধিষ্ঠিরের কাছে। যুধিষ্ঠির অবশ্য জ্ঞাতি-ভাইদের শত্রুতা ভুলতে চেয়েছেন সব সময়। ফলত বিরাট যজ্ঞ এবং অতিথি-সৎকারের প্রয়োজন মেটানোর জন্য দুঃশাসনকে সমস্ত খাদ্য-সরবরাহের পরিচালনায় নিযুক্ত করেছিলেন যুধিষ্ঠির— ভক্ষ্যভোজ্যাধিকারেষু দুঃশাসনমযোজয়ৎ।

বেশ বুঝতে পারি, এটা একটা প্রাণহীন রুটিন কাজ করে এসেছিলেন দুঃশাসন। যুধিষ্ঠির আপন ঔদার্যে সরলভাবে যে-কাজটা করতে বলতে পারেন, সেই সরলতায় দুঃশাসন তাঁর কাজ উদ্ধার করে দিতে পারেন না। পাণ্ডবদের প্রতি যে বিরূপ মানসিকতা দুর্যোধনের অন্তর থেকে দুঃশাসনের অন্তরে সংক্রমিত হয়েছে, তাতে বিপুল ঘৃণা আর হিংসা নিয়ে তিনি কী কাজ করবেন যুধিষ্ঠিরের। বরঞ্চ রাজসূয় যজ্ঞে যুধিষ্ঠিরের আড়ম্বর দেখে দুর্যোধনের মনে যে ঈর্ষা-অসূয়া জন্ম নিয়েছিল, যার পরিণতি হয়েছিল শকুনির পাশাখেলায়, দুঃশাসনও সেই ঈর্ষা-অসূয়ায় চালিত হয়েছিলেন ছায়ার মতো।

দ্যূতক্রীড়ায় পাণ্ডবদের তো হাত-পা বাঁধা ছিল। যুধিষ্ঠিরের প্রতিজ্ঞায় ভীম-অর্জুন সকলে কৌরবদের দাসে পরিণত হয়েছেন এবং শকুনির কূট-কৌশলে যুধিষ্ঠির দ্রৌপদীকেও পণ রেখে হেরেছেন। ঠিক এই মুহূর্তে দুর্যোধনের আস্ফালন এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, তাঁর মান-মর্যাদার বোধ একেবারে শূন্যে গিয়ে পৌঁছেছে। পাশার দানে দ্রৌপদীকে জিতে নেবার পর তিনি আপন গুরুজন এবং অশেষ ধর্মজ্ঞ বিদুরকেই আদেশ দিয়ে বসলেন অন্দরমহল থেকে দ্রৌপদীকে ধরে আনার জন্য। বিদুর সে-কথায় কর্ণপাত করেননি, উলটে দু’চার কথা দুর্যোধনকে শুনিয়ে দিতেই দুর্যোধন সাবজ্ঞ অবহেলায় সারথি-জাতীয় একটি মানুষ প্রতিকামীকে আদেশ দিলেন দ্রৌপদীকে সভায় নিয়ে আসার জন্য। আপনারা জানেন, প্রতিকামীর সাধ্য ছিল না দ্রৌপদীর মতো দৃপ্তা রমণীকে রাজসভায় ধরে আনার। দ্রৌপদীর মুখে আইনের প্রশ্ন শুনেই সে যখন একবার রাজসভা আর একবার অন্দরমহলে যাতায়াত করতে আরম্ভ করল, তখন দুর্যোধন আর ভদ্রতার ধার ধারলেন না। তিনি বুঝলেন, তার মন বুঝে যে কাজ করতে পারে, সে হল তাঁর ছোটভাই দুঃশাসন। দুঃশাসনকে তিনি বললেন— যাও তো ভাই দুঃশাসন! তুমি যাও। এই সারথির পো-টাকে তো দেখছ, ও আসলে পাণ্ডবদের ভয়ে মরছে, ভয় পাচ্ছে ভীমকে। এবার তুমি যাও তো দেখি একবার; আরে! পাণ্ডবদের কী কোনও স্বাধীন সত্তা আছে যে, বাধা দেবে আমাকে। তুমি নিজে যাও তো একবার ধরে নিয়ে এসো দ্রৌপদীকে— স্বয়ং প্রগৃহ্যানয় যাজ্ঞসেনীং/ কিন্তে করিষ্যন্ত্যবশাঃ সপত্নাঃ।

এই হল দুর্যোধনের আদেশ এবং সেই আদেশ পাবার সঙ্গে সঙ্গে দুঃশাসনের চোখ লাল হয়ে উঠল, যেন অগ্রজের সমস্ত ক্রোধ তাঁর মধ্যে সংক্রান্ত সঞ্চারিত হল। তিনি আসন থেকে উঠে অন্দরমহলের দিকে পা বাড়ালেন। সেখানে প্রথম মহলেই দ্রৌপদী দাঁড়িয়ে ছিলেন শঙ্কিত-ভাবে, বুঝি প্রতিকামী রাজসভা থেকে তাঁর সযৌক্তিক প্রশ্নের উত্তর নিয়ে আসবে। কিন্তু প্রত্যুত্তর নিয়ে এলেন দুঃশাসন। তাঁর কোনও লজ্জা নেই, রুচি নেই, মুখের কোনও আগল নেই। এসেই তিনি দ্রৌপদীকে বললেন— আরে পাঞ্চালী কৃষ্ণা! চলো, চলো আমার সঙ্গে। আমরা তো জিতে নিয়েছি তোমাকে। এখন তুমি সমস্ত লজ্জা ত্যাগ করে দুর্যোধনের দিকে তাকাতে পার— দুর্যোধনং পশ্য বিমুক্তলজ্জা। দুঃশাসনের জ্ঞানের নাড়ী যথেষ্ট টনটনে। তাঁর এ-খেয়াল বেশ আছে যে, দ্রৌপদীর পাঁচ-পাঁচটা স্বামী। অতএব একা দুর্যোধন কেন, তিনি অন্যান্য কৌরবভাইদের সঙ্গ দিতে পারেন স্বামী-সংখ্যার যুক্তিতে। অন্তত নিজের কথা স্পষ্ট করে বলা যায় না বলেই দুঃশাসন গৌরবে বহুবচন ব্যবহার করে নৃশংস লাম্পট্যে বলে উঠলেন— পদ্মমুখী সুন্দরী গো! আর দেরি নয়, আমরা ধৰ্মত পাশার পণে জিতেছি তোমাকে। তুমি এবার কৌরবদের গ্রহণ করো তোমার অধিকারী স্বামী হিসেবে। চলো, চলো রাজসভায় চলো লজ্জা ত্যাগ করে— কুরূন্‌ ভজস্বায়ত-পদ্মনেত্রে/ ধর্মেণ লব্ধাসি সভাং পরৈহি৷

এমন নির্লজ্জ কামুকের আবেদন শুনে কী করবেন দ্রৌপদী! ভবিষ্যতের লাঞ্ছনার কথা শঙ্কা করে তাঁর মুখ বিবর্ণ হয়ে গেল। কোনও মতে মুখ ঢেকে তিনি দৌড়লেন বৃদ্ধ ধৃতরাষ্ট্রের স্ত্রী-মহলে। কিন্তু তাতে কী দুঃশাসনের! এত রুচি, এত সম্মানবোধ দুঃশাসনের নেই। তিনি চেঁচাতে চেঁচাতে ততোধিক দৌড়ে অন্দরমহলে প্রবেশ করলেন এবং বহমান নদীর তরঙ্গের মতো দীর্ঘ-কৃষ্ণ দ্রৌপদীর কেশদাম দৃঢ় করে ধরলেন মুষ্টিতে। সেই ঘন-কৃষ্ণ তরঙ্গায়িত কেশদাম, যা এই কিছু দিন আগেই রাজসূয়ের অভিষেক-জলে আর্দ্র হয়েছিল, সেই কেশ আকর্ষণ করে দুঃশাসন রাজসভার দিকে টেনে নিয়ে যেতে থাকলেন দ্রৌপদীকে। দুঃশাসন কোনও বাধা মানার মানুষ নন। দাদা দুর্যোধন তাঁকে আদেশ দিয়েছেন, অতএব সেটা পালন করার জন্য তিনি কোনও রমণীর বাধা মেনে নেবেন না।

চুল ধরে টানতে-টানতে রাজসভার কাছাকাছি দ্রৌপদীকে নিয়ে এসেছেন দুঃশাসন। তাঁর কেশমূল গ্রন্থিগুলি যন্ত্রণায় ক্লিষ্ট হয়ে উঠেছে, পরিধান-বস্ত্রখানি আকর্ষণ এবং বাধায় বিস্রস্ত আলুলায়িত এবং সেই মুহূর্তে মহাভারতের কবির মুখে সেই বিখ্যাত উক্তি— দুঃশাসন তাঁকে টেনে নিয়ে চলেছেন যেন হাওয়া উপড়ে নিয়ে যাচ্ছে কলাগাছ, সুরক্ষা দেবার মতো পাঁচ-পাঁচজন স্বামী থাকতেও দ্রৌপদী এখন অনাথা রমণীর মতো আতুর— দুঃশাসনো নাথবতীম্‌ অনাথবৎ/চকর্ষ বায়ুঃ কদলীমিবার্তাম্‌। রাজসভার কাছাকাছি এসে বিদগ্ধা দ্রৌপদী একটু মিনতি করলেন। লজ্জার মাথা খেয়ে আরও বৃহত্তর লজ্জা থেকে বাঁচবার আশায় দ্রৌপদী বললেন— দুঃশাসন! আমি রজস্বলা অবস্থায় আছি, এই অবস্থায় আমার পরিধানে কাপড়ও মাত্র একখানি; তোমার কেমন বুদ্ধি যে, এখন আমাকে সভায় টেনে নিয়ে যাচ্ছ। তুমি এত অভদ্র— একঞ্চ বাসো মম মন্দবুদ্ধে/সভাং নেতুং নার্হসি মামনার্য।

দুঃশাসন এই সব অনুনয়ে কান দেন না। সবচেয়ে বড় কথা, দুর্যোধন দ্রৌপদীকে সভায় নিয়ে যেতে বলেছেন, সেই বলার মধ্যে দ্রৌপদীর এই লাঞ্ছনাটুকু নিঃশব্দে অনুমোদিত ছিল বলেই দুঃশাসন এতটা অসভ্যতা যেমন কায়িক-ভাবে করলেন, তেমনই করলেন বাচিক-ভাবে। দুঃশাসন বললেন— তুমি রজস্বলাই হও অথবা এক কাপড়েই থাক, এমনকী বিবস্ত্রা হলেও অসুবিধে নেই কোনও— রজস্বলা বা ভব যাজ্ঞসেনি/একাম্বরা বাপ্যথবা বিবস্ত্রা— আমার পাশার পণে তোমাকে জিতেছি। তুমি আমাদের দাসী হয়ে গেছ এখন। আমাদের দাসী-মহলেই তোমার যথাযথ স্থান এবং তোমাকে যা বলব তাই করবে। একজন ভদ্র তথা বিদগ্ধা রমণীর প্রতি এই যে ভাষা— রজস্বলাই হও অথবা বিবস্ত্রাই হও— এই ভাষার মধ্যে লাম্পট্য যেমন সন্দীপিত বাক্য-রমণের রূপ গ্রহণ করেছে, তেমনই দুঃশাসনের নির্মমতা। একটি রমণীকে হাতের মুঠোর মধ্যে পেয়েছেন বলে তাকে নিয়ে গৃহকর্মের সঙ্গে শারীরিক কামনাও পূরণ করানোর মধ্যে যে একটা নির্মম অসঙ্গতি আছে, সেটা বোঝার মতো সাধারণ রুচিও দুঃশাসনের নেই। অবশ্য তা দুর্যোধনেরও নেই বলেই দুঃশাসন শুধুমাত্র দ্রৌপদীকে প্রায় ধর্ষণের সংজ্ঞায় রাজসভায় নিয়ে এসেই ক্ষান্ত হচ্ছেন না, তিনি তাঁর অন্তর্গত যৌন বিকারও তৃপ্ত করছেন নিতান্ত অসঙ্গত বাক্য-রমণের মাধ্যমে। দুঃশাসন দ্রৌপদীকে সভায় এনেই তুললেন।

দ্রৌপদীর কবরী শিথিল হয়ে উঠেছিল টানা-হ্যাঁচড়ায়, পরিধান বিস্রস্ত, তিনি একটু রুখেই উঠলেন এবার। বোঝাতে চাইলেন— সভায় নিয়ে যাচ্ছ আমাকে, সভার সভ্যতা জানো? বললেন— সভায় যাঁরা বসে আছেন তারা প্রত্যেকে সদাচার-সম্পন্ন শাস্ত্রজ্ঞ ব্যক্তি, তাঁদের সামনে এইভাবে আমি দাঁড়াতে চাই না। শুধু নৃশংস কাজ করেই তুমি ক্ষান্ত হও না দুঃশাসন, তুমি নিতান্ত অসভ্য লোক। তোমার এই কাজ আমার বীর স্বামীরা ক্ষমা করবেন না। সভায় সমস্ত গুরুজন, গুরুস্থানীয়দের সামনে তুমি আমার অনিচ্ছা-সত্ত্বেও আমাকে টেনে আনছ, আমাকে প্রায় বিবস্ত্র করে দেবার চেষ্টা করছ, এটা কেমন অসভ্যতা, কেমনতর নৃশংসতা তোমার— নৃশংসকর্মংস্ত্বম্ অনার্যবৃত্ত/ মা মাং বিবস্ত্রাং কুরু মা বিকার্ষীঃ। কুরু-সভায় উপস্থিত, অথচ উদাসীন বৃদ্ধ-গুরুজনদের উদ্দেশেও দ্রৌপদী তীক্ষ্মতা প্রকাশ করলেন এই বুঝিয়ে যে, তাঁরা থাকতেও দুঃশাসন এমন ব্যবহার করছেন কী করে?

দ্রৌপদী বোধ হয় বোঝেননি যে, রাজনৈতিক নিম্নমানে এই সব অপরিশীলিত মানুষ অনেকেই থাকেন, যাঁরা সময়কালে সুযোগ বুঝে দুঃশাসন হয়ে ওঠেন, দুঃশাসন, মানে, তাঁদের শাসন করা যায় না, ‘কনট্রোল’ করা যায় না। এখানেও তো তাই দেখছি। এই সময়ে রাজসভার অবস্থা তো একটু থমথমেই ছিল। কুরু-প্রধানেরা লজ্জায় আড়ষ্ট হয়ে আছেন, পাঁচ পাণ্ডব-ভাই পাশার পণে পরাজিত, তাঁদের কথা বলবার ক্ষমতাও নেই, তার ওপরে দ্রৌপদীর ক্রোধ-কটাক্ষ এবং প্রতিপ্রশ্ন সভাসদ গুরুজনের কাছে। একটু থমকেই গিয়েছিল রাজসভা। এরই মধ্যে দুঃশাসন সচেতন হলেন। পাণ্ডব-ভাইদের অক্ষম অসহায় দৃষ্টিপাত তিনি লক্ষ করছিলেন। লক্ষ করছিলেন— পণজিত পাণ্ডব অথবা দ্রৌপদীর পক্ষ নিয়ে কেউ কথা বলছেন না। এই তো অপরিশীলিত রাজশক্তির সুবর্ণ সময়। দুঃশাসনের মুখে হাসির ফোয়ারা উঠল। লজ্জায়, বিসংজ্ঞকল্পা দ্রৌপদীকে আরও একবার বস্ত্রাঞ্চলের আকর্ষণে টেনে আনলেন দুঃশাসন, এদিকে থেকে ওদিকে টেনে আনলেন, আর উত্তাল উচ্চকিত হাসিতে সভাস্থলী প্রতিধ্বনিত করে দ্রৌপদীকে উদ্দেশ করে বলতে আরম্ভ করলেন— দাসী, আমাদের দাসী তুই— আধূয় বেগেন বিসংজ্ঞকল্পাম্‌/উবাচ দাসীতি হসন্‌ সশব্দম্‌।

দুঃশাসন যদিও নিজেই কাজটা করেছিলেন, অর্থাৎ কিনা দ্রৌপদীকে অন্দর মহল থেকে নিয়ে আসতে হবে এইটুকু তো দুর্যোধনের আদেশ ছিল। কিন্তু তাঁকে যে চুলের মুঠি ধরে, গায়ের কাপড় টানতে-টানতেও যে নিয়ে আসা যায় এবং সেইভাবেই যে দুর্যোধনের— তথা দুঃশাসনের নিজেরও অবদমিত আকাঙ্ক্ষাগুলি চরিতার্থ করা যায়, সে-কথা কি ছাই দুঃশাসন নিজেও অত সচেতনভাবে জানতেন! কিন্তু অন্তরে-অন্তরে দুষ্টের সংস্কার কেমন পূর্বনিহিত থাকে ভাইতে-ভাইতে, সমমনস্ক বন্ধুতে-বন্ধুতে। দুঃশাসন যে সভার মধ্যে দ্রৌপদীকে কাপড় ধরে টানাটানি করছিলেন, হ্যাঁচকা টানে তাঁকে এদিক থেকে ওদিকে নিয়ে আসছিলেন, পাণ্ডব-বধূর এই অসহায়তায় দুঃশাসনের হাসি শুনেই হেসে উঠলেন কর্ণ, হেসে উঠলেন শকুনি। তাঁরা হেসেই তারিফ করতে লাগলেন দুঃশাসনের ব্যবহার এবং দাসী-সম্বোধনের— কর্ণস্তু তদ্‌বাক্যমতীব-হৃষ্টঃ/ সম্পূজয়ামাস হসন্‌ সশব্দম্‌।

এই যে সভ্যেতর অনুমোদন ভেসে আসছে অসভ্যতর লোকদের কাছ থেকে, এই যে অন্তরে-অন্তরে টানাটানি— লক্ষ করে দেখুন, এই মুহূর্তে দুর্যোধনের কথা কিংবা হাসি আমরা শুনতে পাই না, কিন্তু তিনি নিশ্চয়ই অপকর্মের সবচেয়ে বড় অনুমন্তা। নেহাৎ এই পাশাখেলা এবং পণজয়ের প্রয়াস তিনি এবং ধৃতরাষ্ট্রের ভাবনানুসারে সম্পন্ন বলেই দুর্যোধনকে রাজসভায় মধ্যে সামান্য পার্থক্যে রাখতে বাধ্য করেছে, অথবা মহাকাব্যিক দুরত্বে। কিন্তু কর্ণ এবং শকুনি যেভাবে দুঃশাসনের কর্মকাণ্ডে আপ্লুত বোধ করছেন, তাতে বোঝা যায় যে, দুর্যোধনও ততটাই আপ্লুত। তিনি দ্রৌপীদের প্রতি এই অশালীন আচরণ করতে বারণ তো করছেনই না, বরঞ্চ কর্ণ-শকুনির মাধ্যমে অনুমোদন সঞ্চারিত করছেন দুঃশাসনের মধ্যে।

কুরুবৃদ্ধদের তরফ থেকে এই ঘটনার ঠিক প্রতিবাদ হল না। ভীষ্ম দ্রৌপদীর কথার উত্তর দিচ্ছিলেন সাধারণ ভাবে, দ্রৌপদীও প্রত্যুত্তর করছিলেন। কিন্তু এই সভ্য কথোপকথনের মধ্যেই দুঃশাসন তাঁর অসভ্য আচরণগুলি করে যাচ্ছিলেন— খারাপ কথা বলছিলেন, কাপড় ধরে টানাটানি করছিলেন এবং সে-সব ভদ্র গৃহবধূর কোনও রুচিতে সঙ্গত হয় না— দুঃশাসনঃ পরুষাণ্যপ্রিয়াণি/বাক্যান্যুবাচামধুরাণি চৈব। দ্রৌপদীর প্রতি এই অনার্য আচরণ অনেকক্ষণ অসহায়ভাবে দেখছিলেন ক্রোধরক্ত মধ্যম পাণ্ডব ভীমসেন। কাউকে কিছুই বলা যাচ্ছে না দেখে তিনি শেষ পর্যন্ত দাদা যুধিষ্ঠিরকেই খুব খানিকটা কষে গালাগাল দিলেন। কিন্তু ঘটনার মধ্যে দোষটা যে দুর্যোধনেরই অথবা শকুনিরই, এ-কথা তিনি বলতে পারলেন না বলেই শুভবুদ্ধিসম্পন্ন বিকর্ণ— যিনি দুর্যোধনের অন্যতম ভদ্রলোক ভাই, তিনি দ্রৌপদীকে পণে জেতার আইনসঙ্গত যুক্তিটি অথবা দুর্যোধন-সম্মত যুক্তিটি একেবারে উড়িয়ে দিলেন। এটা অবশ্যই দুর্যোধন-শকুনির পছন্দ হবে না, সেটা বুঝেই— যেন তাঁকেই উত্তর দেবার জিম্মাদারি দেওয়া আছে, এইভাবেই দুর্যোধনের প্রাণসখা কর্ণ তীব্র ভাষায় নিন্দা করলেন বিকর্ণকে। তাঁকে কথার মাঝখানে ধমকে বসিয়ে দিয়ে কর্ণ বললেন— দ্রৌপদীকে সভায় নিয়ে আসাটা এক্কেবারে ঠিক হয়েছে— সে এক কাপড়েই থাকুক অথবা বিবস্ত্রই থাকুক, দুঃশাসন তাকে সভায় এনে এক্কেবারে ঠিক কাজ করেছে— একাম্বরধরত্বং বাপ্যথবাপি বিবস্ত্রতা।

লক্ষণীয়, দুঃশাসনও কিন্তু একই কথা দ্রৌপদীকে বলেছিলেন সভায় নিয়ে আসার সময়। তার মানে, মনোভাবটা সকলেরই এক। দুঃশাসন সেটা সোচ্চারে বলেছেন-মাত্র। বরঞ্চ দুঃশাসনের এই অপব্যবহারে কর্ণ এতটাই খুশি যে, তিনি তাঁকে প্রশ্রয় দিয়ে বললেন— তুমি উচিত কাজ করেছে, দুঃশাসন! এই বিকর্ণটা একেবারেই ছেলেমানুষ, বয়সে কম কিন্তু পণ্ডিতি করাটা অভ্যাস হয়ে গেছে। আমি বরঞ্চ তোমাকে একটা নতুন কাজ দিচ্ছি দুঃশাসন! তুমি বরঞ্চ এই পাণ্ডবদের মাথার উষ্ণীষগুলি সব খুলে নিয়ে এসো, আর খুলে নিয়ে এসো দ্রৌপদীর কাপড়— পাণ্ডবানাঞ্চ বাসাংসি দ্রৌপদ্যাশ্চাপ্যুপাহর।

মনে রাখা দরকার, কর্ণের চরিত্র বিভিন্ন মহাকবির মমতা এবং প্রতিভায়, এবং অবশ্যই তাঁর আপন জীবন-যন্ত্রণায় গৌরবান্বিত তথা মহনীয় হয়ে উঠেছে। কিন্তু মূল মহাভারত থেকে তার সমর্থন মেলে না। ভাবুন একবার! দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণের আদেশ আসছে কর্ণের মুখ থেকে এবং তা পালন করছেন দুঃশাসন। আসলে কর্ণ কেন শুধু, দুর্যোধন, দুঃশাসন— তিন জনের মধ্যেই দ্রৌপদীকে লাভ করার উদগ্র বাসনা ছিল সুপ্ত মনের গহনে। কথাটা কর্ণ কিংবা দুঃশাসনের মুখে স্পষ্ট করে শোনা যায় না বটে, কিন্তু যুধিষ্ঠিরের রাজসূয় যজ্ঞের পর দুর্যোধন পরম হতাশায় পিতার কাছে বলেছিলেন— কতবার তো চেষ্টা করলাম ওদের অগ্রগতি আটকাতে, কিন্তু ওরা যেন কপাল ফুঁড়ে বেরিয়ে পড়ে। এমনকী দ্রৌপদীকেও ওরাই পেল স্ত্রী হিসেবে— তৈর্লব্ধা দ্রৌপদী ভার্যা… ভাগধেয়পুরস্কৃতাঃ। এই হতাশা থেকে বুঝতে পারি, দ্রৌপদীর ওপর এঁদের সকলেরই বেশ নজর ছিল। তার মধ্যে মীনচক্ষু ভেদ করার জন্য স্বয়ংবর-সভায় ধনুক তুলেও কর্ণ দ্রোপদীর কাছেই সূতপুত্র-সম্বোধনে প্রত্যাখ্যাত হয়েছিলেন। সে রাগ তিনি ভোলেননি বলেই আজ তিনি দ্রৌপদীকে চরম অপমানিত দেখতে চান। আর রাজসভায় সকলের সামনে এক গৃহবধূকে নগ্ন— বিবস্ত্র করে দেবার চাইতে আর বেশি অপমান কী হতে পারে!

কিন্তু কর্ণ বা দুর্যোধনের এই অবদমিত আকাঙ্ক্ষা পূরণ করার একমাত্র উপকারক সহায় হলেন দুঃশাসন। নিজে হাতে করতে সামান্য যে লজ্জাটুকু হয়েছে, সেটা দুঃশাসনের হাত দিয়ে সম্পন্ন করানোর মধ্যেই তাঁদের সমস্ত সমর্থন। দুঃশাসনের এই অপরিশীলন, অপরিমিতি, অশালীন্য দুর্যোধন-কর্ণের অন্তর্গত আকাঙক্ষা পূরণ করে, আর দুঃশাসন তাঁর আকাঙ্ক্ষা পূরণ করেন এই অসভ্য আচরণগুলি করেই। এই তো কর্ণের আদেশ পাওয়া মাত্রই দুঃশাসন সমস্ত মন-প্রাণ-শক্তি দিয়ে দ্রৌপদীকে বিবস্ত্র করার চেষ্ট করলেন— ততো দুঃশাসনো রাজন্‌ দ্রৌপদ্যা বসনং বলাৎ… ব্যপাক্রুষ্টুং প্রচক্রমে। এই যে দুঃশাসন সকলের সহ্যের সীমা অতিক্রম করে গেলেন, এইখানেই তাঁর নিয়তি নেমে আসে।

দ্রৌপদী কৃষ্ণ-বিষ্ণু-গোবিন্দের নাম উচ্চারণ করে তাঁর লজ্জাবস্ত্র লাভ করলেন অথবা করলেন না, এই অলৌকিক তর্কের মধ্যে আমরা নাই বা গেলাম। কিন্তু দুঃশাসনের এই আচরণে ভয়ংকর সেই প্রতিজ্ঞা নেমে এল মধ্যম পাণ্ডব ভীমসেনের মুখে। ভীম বললেন— শুনুন, শুনুন, এখানে এই রাজসভায় বসে-থাকা রাজারা সব শুনুন! এ-রকম প্রতিজ্ঞা আগে কোনও মানুষ করেনি, পরেও কেউ করবে না— নোক্তপূর্বং নরৈরন্যৈর্ন চান্যো যদ্‌বদিষ্যতি। আমি যদি যুদ্ধকালে এই অসভ্য লোকটার বুক কেটে রক্তপান না করতে পারি, তবে আমি আমার বাপ-পিতামহের বংশধর বলে পরিচয় দেব — ন পিবেয়ং বলাদ্‌ বক্ষো ভিত্ত্বা চেদ্‌রুধিরং যুধি।

ভীমের প্রতিজ্ঞা শুনে সমস্ত রাজসভার মধ্যে শব্দ উঠল চার দিকে। সাধারণ রাজা-রাজড়া আর সাধারণ মানুষের এই এক স্বভাব! এই তাঁরা দুঃশাসনের অসভ্য বাড়াবাড়িতে বেশ মজা পাচ্ছিলেন, তারপর যেই ভীমের ভয়াল প্রতিজ্ঞা নেমে এল, অমনই অনেকেই দুঃশাসনের নিন্দা করতে আরম্ভ করলেন। আর ওদিকে দুঃশাসন! লজ্জাহরণ লোকনাথ কৃষ্ণের কৃপাদত্ত বস্ত্ররাশি টানতে-টানতেই হোক অথবা দ্রৌপদীর প্রাণান্তক ধস্তাধস্তির কারণেই হোক, দুঃশাসন শ্রান্ত, এবং অবশ্যই কৃতকর্মের জন্য খানিকটা লজ্জিত বোধ করেই বসে পড়লেন সভার মধ্যে। তবে কিনা এই লজ্জা দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণের অনুতাপ নয় মোটেই, বরঞ্চ শত চেষ্টায়ও একজন বীরমানী ধর্মকামী পুরুষ-পুঙ্গব যখন স্ত্রী লোকের শক্তিতে পরাভূত হয়ে তাঁকে নগ্ন করতে পারেন না, সেই অক্ষমের লজ্জাটুকু হয়তো বা গ্রাস করল, বিষণ্ণ ক্লান্ত করল দুঃশাসনকে। সভায় গালাগালিও চলল অনেকক্ষণ। ভীমসেনের প্রতিজ্ঞার পর দ্রৌপদীকে পণে জেতার যৌক্তিকতা নিয়ে তর্ক ফিরে এল আবার। বিদুর মুখ খুললেন তীক্ষ্ণভাবে। অন্যদিকে সভার মাঝখানে সমাকৃষ্টবসনা দ্রৌপদী, আর বসন-প্রান্ত হাতে নিয়ে ক্লান্ত দুঃশাসন— তাঁর লজ্জা নেই তবুও। কর্ণ এবার পরিস্থিতি বুঝে নতুন কোনও লজ্জার হাত থেকে মুক্ত হবার জন্য দুঃশাসনকে বললেন— এবার তুমি আমাদের এই দাসী কৃষ্ণাকে ঘরের মধ্যে নিয়ে যাও। আর অমনই দুঃশাসন আবারও দ্রৌপদীকে বস্ত্রাঞ্চল ধরে টান দিলেন— দুঃশাসনঃ সভামধ্যে বিচকর্ষ তপস্বিনীম্।

তবে ব্যাপারটা এবার আর তত সহজ হল না। দ্রৌপদী বুঝে গেছেন যে, এই অসভ্য লোকটার মুরোদ শেষ হয়ে গেছে। তিনি এবার ঠান্ডা মাথায় কুরুসভার বৃদ্ধ প্রধানদের উদ্দেশে নিজের দুরবস্থা নিয়ে প্রশ্ন আরম্ভ করলেন। সদুত্তর যে খুব কিছু মিলল, তা নয়। কিন্তু স্বয়ং দুর্যোধন এবার সভার রাশ ধরলেন নিজের হাতে। কথায়-কথায় তার পারদ এতই চড়ে গেল যে, ছোট ভাই দুঃশাসনের চেয়েও তিনি অসভ্য হয়ে পড়লেন। তিনি নিজের বাম ঊরু দেখিয়ে দ্রৌপদীর প্রতি চরম অশোভন ইঙ্গিত প্রকাশ করলেন। ফলত তাঁরও ঊরুভঙ্গের প্রতিজ্ঞা উচ্চারিত হল ভীমসেনের মুখে। এখানে যে-কথা বলা খুব প্রয়োজন যে, দুর্যোধন হস্তিনাপুরের রাজা প্রতিম ব্যক্তি, তিনি পরবধূর প্রতি লাম্পট্যের ইঙ্গিতে ঊরু প্রদর্শন করছেন— এই ব্যবহার তাঁর কাছে প্রত্যাশিত হোক অথবা নাই হোক, এর তাৎপর্য তাঁর ছোট ভাই দুঃশাসনের ক্ষেত্রে এইটুকুই যে, তাঁরা একই নির্লজ্জ রক্ত শরীরে বহন করেন, নইলে দুঃশাসনের কাছে তো কোনও সংজ্ঞা দেওয়া ছিল না, তিনি কীভাবে, কতটা অসভ্যতা করে দ্রৌপদী কৃষ্ণাকে সভায় নিয়ে আসবেন। কিন্তু দুর্যোধন এবং দুঃশাসন দুই জনেরই কর্মপদ্ধতি দেখলে বোঝা যায় যে, তাঁরা একই ধাতুর অপরিশীলনে সৃষ্ট হয়েছেন অথবা রক্ত সত্যিই বিশ্বাসঘাতকতা করে না। তা ছাড়া অপরিশীলন এমনই এক বস্তু যা পিতৃ-পুত্র-নপ্তৃ-পরম্পরায় আরও বাড়তে থাকে।

আপনারা জানেনই যে, দ্রৌপদী-সহ সমস্ত পাণ্ডব-ভাইদের মুক্ত করতে বাধ্য হয়েছিলেন ধৃতরাষ্ট্র। যুধিষ্ঠির ভাইদের নিয়ে, দ্রৌপদীকে নিয়ে যখন ইন্দ্রপ্রস্থের পথ ধরেছেন, সেই মুহুর্তেই দুঃশাসন ছুটে গেলেন রাজা দুর্যোধনের কাছে— রাজন্‌ দুঃশাসনঃ ক্ষিপ্রং জগাম ভ্রাতরং প্রতি। আসলে যুদ্ধ করে নয়, কোনও পরিশ্রম করে নয়, কোনও কিছুর মূল্যে নয়, শুধুমাত্র শকুনির পাশার চালে এত ধনদৌলত, মণিমাণিক্য, এমনকী রাজ্যটাও পেয়ে গিয়েছিলেন দুর্যোধন-দুঃশাসন যে, সেগুলি ধৃতরাষ্ট্রের নিরুপায় বদান্যতায় আবার যুধিষ্ঠিরের কাছে ফিরে যেতেই দুঃশাসন দৌড়ে গেলেন দাদা দুর্যোধনের কাছে। দুঃশাসন বললেন— অনেক কষ্ট করে এত সব জিনিস আমরা পেয়েছিলাম দাদা! কিন্তু এই বুড়োটার জন্য সব নষ্ট হয়ে গেল— দুঃখেনৈতৎ সমানীতং স্থবিরো নাশয়ত্যসৌ। এই যে ধৃতরাষ্ট্র, দুঃশাসনের শ্রদ্ধেয় জন্মদাতা পিতা, তাকে দুঃশাসন বুড়ো-হাবড়া ‘স্থবির’ বলে কথা বলছেন এবং দুর্যোধন সেটা শুনছেন— এই ‘অ্যাটিট্যুড্‌’, এই ‘কালচার’ দুঃশাসন বহন করছেন তাঁর রক্তের মধ্যে। তাঁর ক্রিয়া-কর্ম, ব্যবহার, এমনকী ব্যক্তিগত জীবনটাও এখনও পর্যন্ত যেন রাজধানীর স্বচ্ছ জীবনের পিছনে চলতে থাকে। নইলে রাজসভা থেকে যাঁরা ধৃতরাষ্ট্রের ছাড়পত্র পাচ্ছেন, তাঁদের গতাগতির সংবাদ আদান-প্রদান হচ্ছে পিছনে এবং তাও সমান্তরাল এক গোষ্ঠীর মধ্যে যাঁরা অস্বচ্ছ উপায়ে ক্ষমতা দখল করতে চাইছেন।

দুঃশাসনের কাছে খবর পেয়েই দুর্যোধন-শকুনি-কর্ণের মিটিং বসল, এবং সেখানে শ্রোতা মাত্র দুঃশাসন, সেই চতুর্থ ব্যক্তিটি, যিনি খবর আনেন, খবর শোনেন, কিন্তু তিনি সিদ্ধান্ত-গোষ্ঠীর বাইরে সেই চতুর্থ ব্যক্তি। কিন্তু তাঁর সংবাদের ভিত্তিতেই দুষ্ট-চতুষ্টয়ের মিটিং বসল, ধৃতরাষ্ট্রকে আবার রাজি করানো হল এবং পাণ্ডবদের ডেকে আনা হল রাস্তার মাঝখান থেকে। পাশাখেলা হল আবার। এবার সেই বিখ্যাত পণ— বারো বছরের বনবাস আর এক বছরের অজ্ঞাতবাস। পাণ্ডব-ভাইরা বুঝেই নিলেন— ছলে, বলে, কৌশলে, যেভাবেই হোক তাঁদের রাজ্যপাট, ধন-সম্পত্তি কেড়ে নিয়ে ধৃতরাষ্ট্র তাঁদের বনে পাঠাবেন এবং দুর্যোধনের বুদ্ধিকে অগ্রাধিকার দেবেন। অতএব বনবাসের জন্য তাঁরা প্রস্তুত হলেন এবার।

বেশ তো, বনবাসে যেতে হবে। যাবেন পাণ্ডব-ভাইরা এবং দ্রৌপদী। কিন্তু এই বনবাসের ক্ষতে ক্ষার নিক্ষেপ করার ভার আবার নিলেন দুঃশাসন। বস্তুত ভদ্রলোক এবং বড় মানুষের ক্ষেত্রে এমনটা দেখেইছি যে, যখন নিয়তির মতো যে কাজটা এসেই পড়ে অর্থাৎ যে দুঃখটা ঘাড়ের ওপর এসেই পড়ে, সেটা তাঁরা ঠান্ডা মাথায় মেনে নেন। কিন্তু এই অবস্থায় যে বা যারা এই নিয়তি নিয়ে পরিহাস করে তারাই আসলে কাটা ঘায়ে নুনের ছিটে দেয়। আর সত্যটা হল এই যে, কাটা ঘায়ে যত না কষ্ট, তার চেয়ে নুনের ছিটে আমাদের লাঞ্ছিত করে বেশি। দুঃশাসনের এটাই কাজ, তিনি কর্ণ-দুর্যোধনের মতো যুদ্ধও করতে পারেন না, আবার শকুনির মতো কৌশলও করতে পারেন না— পাশাখেলারও ক্ষমতা নেই, বুদ্ধিও নেই। কিন্তু বলবত্তর এবং বুদ্ধিমত্তার ব্যক্তির বল এবং বুদ্ধির সুরক্ষার ছায়া ভোগ করতে অভ্যস্ত দুঃশাসন শুধু কটূক্তি করতে পারেন, ক্ষতে ক্ষার নিক্ষেপ করতে পারেন।

পাণ্ডবরা তখনও বনবাসের উপযুক্ত অজিন-উত্তরীয় পরিধান করেননি, কেবলই প্রস্তুত হচ্ছেন সমস্ত দিক ভেবে। ঠিক এই সময়ে দুঃশাসন বলতে আরম্ভ করলেন— এতদিনে ধৃতরাষ্ট্রের ছেলের রাজ আরম্ভ হল এখানে— প্রবৃত্তং ধার্তরাষ্ট্রস্য চক্রং রাজ্ঞো মহাত্মনঃ— ভাগ্য ভাল, দেবতারা সব আমাদের সঙ্গেই আছেন। আমরা গুণেও ওদের চাইতে অনেক বেশি গুণী, মর্যাদাতেও শ্রেষ্ঠতর, অতএব ওদের রাজৈশ্বর্য আমাদের হাতে আসাটা উপযুক্তই হয়েছে। আর বেশ হয়েছে ওদের। পাণ্ডুর ছেলেগুলো সব এমন বিপাকেই পড়েছে যে, ওই নরক থেকে আর ওদের উঠে আসতে হবে না— নরকং পতিতাঃ পার্থা দীর্ঘকালম্‌ অনন্তকম্। ওদের রাজ্য গেছে, সুখ গেছে, সব গেছে। আবার কিনা রাজসূয় যজ্ঞ করে! কত ধন, কত অর্থ, কত নজরানা, ব্যাটারা টাকার গরমে একেবারে পাগল হয়ে গিয়েছিল, আমার দাদা দুর্যোধনকে দেখে হেসেছিল। নে, এবার বোঝ, বনে গিয়ে কেমন লাগে। নে-নে, আর বীর যোদ্ধাদের মতো বর্ম পরে থাকতে হবে না, বর্মগুলো সব খুলে ফ্যাল বুক থেকে। এত সব রং-চঙে জামা-কাপড় পরে আছিস, খুলে ফ্যাল, খুলে ফ্যাল সব। ওরে! কে আছিস? সব খুলে অজিন আর উত্তরীয় ওদের গায়ে দিয়ে দে, তারপর ওরা বিদায় হোক বনে— চিত্রং সন্নাহান্ অবমুঞ্চন্তু চৈষাং/বাসাংসি দিব্যানি চ ভানুমন্তি।

এই যে গণ্যমান্য মহাবীরদের চরম তাচ্ছিল্য করা, তাঁদের অসহায়তার সুযোগ নিয়ে আজীবন হৃদয়-লালিত মর্যাদার সংস্কারটুকু অপবাক্যে ধ্বংস করা— এগুলো কিন্তু এক ধরনের বিশেষ নির্মৰ্যাদ পুরুষের পক্ষেই সম্ভব, যার নিজের কোনও শক্তি নেই, আত্মবোধ নেই, অথচ এক ধরনের কূট মেধা আছে যাকে পণ্ডিতেরা পারিভাষিক ভাষায় পিশুনতা বা পৈশুন্য বলে চিহ্নিত করেন। পৈশুন্য হল অকারণে দোষ আবিষ্কার করার প্রবণতা। যার মধ্যে দোষ নেই তারও দোষ খুঁজে বার করার মতো যে খল স্বভাব, তাকে বলে পৈশুন্য। যুধিষ্ঠির রাজসূয় যজ্ঞ করে এমন কোনও অহংকার কোনও দিন প্রকাশ করেননি যে, তাঁরাই দুনিয়ার শ্রেষ্ঠতম মানুষ, কিংবা শ্রেষ্ঠতম বীর। কিন্তু দুর্যোধন নিজে সেই রাজ্যসভার জাঁকজমক দেখে নিজের অসূয়াতেই এমন জ্বলেপুড়ে মরেছিলেন যে, দুঃশাসন তাঁর অগ্রজের ভাবনাগুলি এখন পাণ্ডবদের ওপরে চাপিয়ে দিয়ে অদ্ভুত কৌশলে দোষী সাজাচ্ছেন। দুঃশাসন বলছেন— এই পাণ্ডবরা আগে ভাবত বুঝি ওদের মতো বড় মানুষ আর পৃথিবীতে কেউ নেই— ন সন্তি লোকেষু পুমাংস ঈদৃশ/ইত্যেব যে ভাবিতবুদ্ধয়ঃ সদা— এখন ব্যাটারা নিজেদের ভাগ্য-বিপর্যয়ের সময় বুঝবে যে, ব্যাটারা সব কতগুলো নপুংসক তিলের বীজ— দেখতে বীজ বটে কিন্তু ওই তিলের বীজ থেকে কোনও দিন গাছ গজাবে না— বিপর্যয়ে ষণ্‌ঢ-তিলা ইবাফলাঃ।

দুঃশাসনের এই বাক্‌-ব্যবহার নীতিশাস্ত্রসম্মত খল-জন বা দুর্জনের স্বভাব। কত বিচিত্র ক্ষেত্রে কত বিচিত্র খলের আবির্ভাব ঘটে, তা নিয়ে বড় প্রবন্ধ লেখা যায়। কবি দেখেছেন— অসূয়া-পরায়ণ খল সুকবির কবিতায় দোষ ধরে নিতান্ত বিদ্বেষবশতই, তারা বিনা কারণে সাধু-সন্ন্যাসী, সচ্চরিত্র মানুষের চারিত্রিক দোষ আবিষ্কার করে, আর অকস্মাৎ যদি কোনও গুণী মানুষের কদর এদের চোখে পড়ে, তা হলে সে গুণকে দোষপক্ষে না নেওয়া পর্যন্ত অক্ষম খলের শান্তি হয় না। দুঃশাসন ঠিক এই রকম। পাণ্ডবরা রাজসূয়-যজ্ঞকালে যজ্ঞের বিধান অনুযায়ী রুরুমৃগের চর্ম পরিধান করেছিলেন, এখন বনবাসের বিধিতেও তাঁদের রৌরব চর্ম পরিধান করতে হচ্ছে। তাতে দুঃশাসনের মন্তব্য— কী অদ্ভুত মজা দ্যাখো। এই পাণ্ডবেরা আগে যজ্ঞে দীক্ষিত হয়ে রৌরব চর্ম পরিধান করেছিল, এখন তো আর যজ্ঞ নেই, অতএব এখন এদের লাগছে ঠিক বন্য কিরাত-শবরদের মতো, তাদের তো আর যজ্ঞদীক্ষা হয় না।

এই পর্যন্ত বলেও যদি দুঃশাসনের কথা থামত। কিন্তু অনর্থক কথা বলার জন্য আরও একটা বড় ‘আইটেম’ তার হাতে রয়ে গেছে, তাঁর নাম দ্রৌপদী— যাঁকে তাঁরা গিলতেও পারেন না আবার ফেলেও দিতে পারেন না, কিন্তু তাঁর সম্বন্ধে যে কোনও বিপরীত কথাই যে এখন অসহায় পাণ্ডবদের মর্মন্তুদ পীড়া তৈরি করবে, সেটা দুঃশাসনের মতো খলজনের মাথায় খুব ভাল আসে। দুঃশাসন বললেন— আর ওই যজ্ঞসেন দ্রুপদ পাণ্ডবদের হাতে নিজের মেয়েটিকে তুলে দিয়ে কী আহাম্মকিই না করেছে! ব্যাটা ভেবেছিল— বড় বুদ্ধির কাজ করেছে এটা, কিন্তু কিছুতেই এটা বুঝল না যে, পাণ্ডবরা সবগুলোই এক-একটা নপুংসক— তাদের ভাল কাজ কিছু নেই অথচ যাজ্ঞসেনী দ্রৌপদীর স্বামী হয়েছে এই নপুংসকগুলোই— ক্লীবাঃ পার্থাঃ পতয়ো যাজ্ঞসেন্যাঃ।

কথার ভাব থেকেই বোঝা যায়, পাণ্ডবদের যতই দুষ্ট-ভ্রষ্ট ভাবুন দুঃশাসন, দ্রৌপদীর ব্যাপারে তাঁর চোখটা কিন্তু অন্য সরসতায় ভরা। অর্থাৎ কিনা দ্রৌপদী বেশ প্রশংসনীয় মহার্ঘ বস্তু, কিন্তু অপাত্রে পড়েছে। দুঃশাসন নিজেকে এ-ব্যাপারে পাত্র বা সুপাত্র ভাবেন কিনা বলা মুশকিল, কিন্তু দুর্যোধনকে সেই উপযুক্ত পাত্রটি ভাবেনই। কিন্তু খোঁচা দেবার সময় সমস্ত কৌরব-ভাইদের একাকার করে বললেও অক্ষম দুঃশাসন বুঝি নিজেকে দ্রৌপদীর অন্যতম গ্রহণযোগ্য পাত্রও ভাবেন। সেটা বোঝাতে এবার দ্রৌপদীর দিকেই তাকিয়ে দুঃশাসন অসভ্য ইঙ্গিতে বললেন— আগে যারা সূক্ষ্ম-সুন্দর কাপড় পরত, তারা এখন পশুচর্ম আর উত্তরীয় পরে বনে-বনে ঘুরবে। এবার বলো তো দ্রৌপদী! এদের মতো মানুষ নিয়ে তোমার কীই সুখটা হবে? তার চাইতে এখানে একটা স্বামী খুঁজে নাও, সেটাই ভাল নয় কি— কা ত্বং প্রীতিং লস্প্যসে যাজ্ঞসেনি/পতিং বৃণীষ্বেহ যমন্যম্ ইচ্ছসি।

দ্রৌপদীর কপালও বটে এটা। তাঁর স্বামীর সংখ্যা বিধিসম্মতভাবেই বেশি, তাতে মাঝে মাঝে মানুষ কিছু ঠাট্টা-ইয়ার্কিও তাঁর সঙ্গে করে। কিন্তু দুঃশাসনের মতো দুর্জনের মুখে এটা আর ঠাট্টার পর্যায়ে থাকে না। নইলে ভাবুন কথাটা— এখানেই একটা স্বামী বেছে নাও। যেন চাইলেই যখন তখন একটা স্বামী বেছে নেওয়া যায়! আসলে খানিক আগেই পথটা দেখিয়েছিলেন কর্ণ। দ্যূতসভায় তিনিই বিকর্ণকে থামিয়ে দিয়ে বলেছিলেন— একটার জায়গায় যার পাঁচ-পাঁচটা স্বামী, তার চরিত্রটাই এমন যে আরও স্বামী থাকলে তার কিছু আসে যায় না। দুঃশাসন ঠিক এই জায়গাটাই ধরেছেন। বলেছেন, এখানেই একটা স্বামী বেছে নাও। আর তারপরেই গৌরবে বহুবচন— এখানে কুরুভাইরা সবাই আছে, প্রত্যেকে ভদ্রলোক, টাকাপয়সাও তাদের প্রচুর। এখানেই একজনকে স্বামী হিসেবে বেছে নাও, তা হলে তুমি অন্তত পাণ্ডবদের ভাগ্যবিপর্যয়ের আঁচ থেকে বাঁচবে— এষাং বৃণীষ্বেকতমং পতিত্বে/ন ত্বাং নয়েৎ কাল বিপর্যয়োহয়ম্‌।

পাণ্ডবদের যেহেতু এখন অর্থসামর্থ্য নেই এবং সবচেয়ে বড় কথা, পাশার পণের শর্তে যেহেতু তাঁরা এই মুহূর্তে কোনও প্রতিক্রিয়াও দেখাতে পারছেন না, তাই পাণ্ডবদের উদ্দেশে দুঃশাসন সেইসব বিশেষণ ব্যবহার করছেন যাতে বোঝা যায়— পাণ্ডবরা নখদন্তহীন খোলসমাত্র। দুঃশাসন বলেছেন— নপুংসক তিলগাছ থেকে যেমন অঙ্কুরোদগম হয় না পাণ্ডবরা হল এখন সেইরকম। অথবা খড় আর ঘাসে ঠাসা পশুচর্মে মোড়া পশুর অবয়ব যেমন প্রকৃত কোনও ভয়ের উদ্রেক করে না, পাণ্ডবরা এখন সেইরকম। এক ধরনের ঘাস আছে যাতে ধানের মতো শস্য পাওয়া যায়, কিন্তু সে শস্য মানুষের কোনও কাজে লাগে না, কিন্তু কাকের কাজে লাগে; পাণ্ডবরা এখন ওইরকম কাকের খাবার, দ্রৌপদী! ওরা তোমার মতো রমণীর কোনও কাজে আসবে না— তথৈব পাণ্ডবাঃ সর্বে যথা কাক-যবা অপি। বারবার, বিভিন্নভাবে দুঃশাসন সেইসব উপমানগুলি পাণ্ডবদের ওপরে চাপাচ্ছেন যাতে বোঝা যায় পাণ্ডবদের আর কোনও উপযোগ নেই। যেন বনবাস-মাত্রেই তাঁদের শক্তি, প্রতাপ, প্রভাব, এমনকী অস্তিত্বও যেন নিরর্থক হয়ে গেছে। তার মধ্যে দ্রৌপদীর মতো বিদগ্ধা রমণীকে এত অগভীর বাক্য-ব্যবসায়ে আকর্ষণ করার চেষ্টা— এ যেমন স্বয়ং দ্রৌপদীর কাছেও অসহ্য ছিল, তেমনই পাণ্ডবদের কাছেও— এবং নৃশংসং পরুষাণি পার্থান্‌/অশ্রাবয়দ্‌ ধৃতরাষ্ট্রস্য পুত্রঃ।

মুশকিল হল, দুঃশাসন শুধু এই মুহূর্তে পাণ্ডবদের অসহায়তার কথা ভাবছেন, তেরো বছর পরের কথা তাঁর ভাবার ক্ষমতা নেই। যুধিষ্ঠির, অর্জুনের মতো গম্ভীর-পদবির মানুষেরা দুঃশাসনের কথার কোনও জবাব দিলেন না বটে, কিন্তু যুধিষ্ঠিরের সত্যবদ্ধতায় হাতে-পায়ে কিছু করার না থাকলেও কথার পৃষ্ঠে কথাটুকু বলা যায় বলেই মহাক্রুদ্ধ ভীম দ্রৌপদীর প্রতি দুঃশাসনের আক্ষিপ্ত বাক্য মেনে নিলেন না। অনেকক্ষণ ধরে শেয়ালের হুক্কা-হুয়া শুনে সিংহ যেমন একবার মাত্র শেয়ালের দিকে সগর্বে এগিয়ে যায়, ঠিক সেইভবেই দুঃশাসনের কাছে এগিয়ে গেলেন ভীম— উবাচ চৈনং সহসৈবোপগম্য/সিংহো যথা হৈমবতঃ শৃগালম্। ভীম বললেন— দুঃশাসন! তুই অসভ্য লোকের পাল্লায় পড়ে অনেক খারাপ কথা বলে যাচ্ছিস তখন থেকে। তোরা কিন্তু যুদ্ধ জিতিসনি কোনও, জিতেছিস পাশার চালে, আর তাতেই রাজসভায় দাড়িয়ে রাজাদের সামনে অনেক কথা বলছিস উলটো-সিধে। মনে রাখিস, যুদ্ধ যখন লাগবে তখন এই কথাগুলো সব একটা একটা করে মনে করিয়ে দেব। তোকে এবং তোর অনুচরদের যখন একটা একটা করে যমের বাড়ি পাঠাব, সেদিন বুঝবি কেমন লাগে।

ভীম, ভীমের আন্দাজে যতটুকু বলেছেন, সেটা প্রতিতুলনায় একেবারেই নগণ্য। কিন্তু সেটা দুঃশাসনের গায়ে লাগল না। যুধিষ্ঠিরের সত্যবদ্ধতার কারণেই ভীম যে এখন শারীরিক শক্তিতে কাজে কিছু করবেন না, সেটা বুঝেই দুঃশাসন এবার চরম ভুলটি করলেন। তিনি ভীমের দিকে তাকিয়ে— ‘আরে এই গোরুটা! ওরে আমার গোরু-রে!’— এইভাবে গোরু গোরু বলে চ্যাঁচাতে লাগলেন— মধ্যে কুরূণাং ধর্মনিবদ্ধমার্গং/ গৌর্গৌরিতি স্মাহ্বয়ন্-মুক্তলজ্জঃ। সভা থেকে বেরিয়ে যাবার মুখে এইসব টিটকিরি শুনে ভীম ভীষণ ভীষণ ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলেন। আবারও সেই প্রাচীন প্রতিজ্ঞা ফিরে এল তাঁর মুখে। তিনি দুঃশাসনকে বললেন— ছল করে পাশায় জিতে এইসব টিটকিরি করে কথা বলছিস। যদি তোর বুক চিরে রক্ত না খাই তবে আমি পৃথা মায়ের ছেলে ভীম নই। ভীমের এই শাসনেও অবশ্য টিটকিরি বন্ধ হল না। ভীম সভা ছেড়ে বেরোচ্ছিলেন, তখন তাঁর হাঁটা নকল করে দুর্যোধন তাঁকে ভ্যাঙাতে লাগলেন সকলের সামনে। ভীম আর বেশি কথা বাড়ালেন না। শুধু ঘাড় ঘুরিয়ে বলে গেলেন— সব, সব কথা মনে করিয়ে দেব ক’ বছর পরেই। যুদ্ধ লাগুক, সব মনে করিয়ে দেব।

বস্তুত দুঃশাসনের মুখে ভীমের উদ্দেশে গোরু গোরু চ্যাচানোর ব্যাপারটা খুব সাধারণ টিটকিরি নয়। আমরা আজকের দিনে একবিংশ শতাব্দীর পরিশীলনে ভেবে যাচ্ছি যে, ভীমের মতো সরল মানুষের উদ্দেশে ‘গোরু গোরু’ বলে ডাকার মধ্যে বুঝিবা গোরুর মতো বুদ্ধি অথবা গোরুর মতো নির্বোধ হাঁটা-চলার ইঙ্গিত আছে। কিন্তু ব্যাপারটা যে এত সহজ নয় এবং সেটা আরও অনেক গভীরে, সেটা বুঝিয়ে দিয়েছেন মহাভারতের বিখ্যাত টীকাকার নীলকণ্ঠ। নীলকণ্ঠ বুঝিয়ে দিয়েছেন যে মহাভারতের ঘটনা বিস্তৃত হচ্ছে বৈদিক যুগের সামান্য ব্যবহিত উত্তর কালে। ফলত বৈদিক যুগের আচার-ব্যবহার, সমাজ-রীতি, নীতি-অনীতি অনেক সময়েই প্রতিফলিত হয়েছে মহাভারতের সমাজে। নীলকণ্ঠ বলছেন— এই যে দুঃশাসনের টিটকিরি, এর মধ্যেও বৈদিক সমাজের রেশটুকু আছে, নইলে ‘গোরু-গোরু’ বলাটা অতটা নিরীহ নয়, যতটা আমরা আজকের যুগের ভাবনায় ভাবছি। ব্যাপারটা একটু বুঝিয়ে বলি।

মনে রাখতে হবে, মহাভারতে শকুনির পাশাখেলাটাকে দু’-চার জায়গায় সনাতন যাগ-যজ্ঞের রূপকে বর্ণনা করা হয়েছে। সেখানে পাশার ঘুটি, পাশার চাল হাঁকা এবং পাশার পণ— সবকিছুই যজ্ঞের এক-একটা অঙ্গ এবং যজ্ঞীয় দ্রব্য হিসেবেও কল্পনা করা হয়েছে। এইদিক থেকে দেখলে— দুর্যোধন-দুঃশাসনরাও কিন্তু একপ্রকার যজ্ঞ করছেন, যেখানে অতিথিরা হলেন দুর্যোধন-পক্ষীয় রাজা-রাজড়ারা যাঁরা দুর্যোধনের ডাকে পাশাখেলা দেখতে এসেছেন। অতিথি বাড়িতে আসলে সেকালে মধুপর্ক দানের রীতি ছিল এবং প্রাচীন বৈদিককালে অতিথিকে মধুপর্ক-দান করার পরেই একটি গোদান করতে হত এবং অতিথির উদ্দেশে এই গোরুটি বধও করা হত। ঠিক এইখানেই নাকি দুঃশাসনের কথার তাৎপর্য, অন্তত টীকাকার নীলকণ্ঠ তাই বলছেন এবং হয়তো ঠিকই বলছেন।

সাধারণত মধুপর্ক-দানের নিয়ম ছিল বিশেষ অতিথি বাড়িতে এলে— যেমন, রাজা, ঋত্বিক, জামাই, আচার্য, স্নাতক ব্রাহ্মণ অথবা অতিপ্রিয় জন। মধুপর্ক বানাতে হত মধু, দই আর ঘি দিয়ে। সেই অতিথি বাড়িতে এলে আসন, পা ধোয়ার জল, সুগন্ধি পানীয়, আচমনের জল, মধুপর্ক এবং একটি গোরু— এই সমস্ত বস্তু অতিথির উদ্দেশে নিবেদন করে তিনবার মধুপর্ক দানের প্রতিজ্ঞা উচ্চারণ করতে হত। গোরু দেবার উদ্দেশ্য একটাই যে, সেটাকে অতিথির উদ্দেশ্যে বধ করা হবে। কারণ মানব গৃহ্যসূত্র, আশ্বলায়ন গৃহ্যসূত্র এবং সাংখ্যায়ন গৃহ্যসূত্র অনুযায়ী অতিথিকে মাংস না খাওয়ালে মধুপর্ক-দানের তাৎপর্যই থাকে না— ন অংমাংসো মধুপর্কো ভবতি। কিন্তু সমস্যা তৈরি হয়েছিল এই গোরুটিকে নিয়েই। অতিথির উদ্দেশে যে গোরুটি বধ করা হত, সেটির সাধারণত সন্তান ধারণের ক্ষমতা থাকত না, দুধ দেবার ক্ষমতাও নয়। কিন্তু শত হলেও সেটা গোরু। প্রাচীন বৈদিককালে যজ্ঞের কারণে এবং অতিথির জন্য গোবধ চালু থাকলেও উত্তর বৈদিককালেই যজ্ঞের কারণেও গোবধ নিন্দিত হতে থাকে এবং ক্রমে তা উঠেও যায়। কিন্তু পরম্পরাগত কারণে অতিথিকে মধুপর্ক দানের সময় গোরু একটা দিতেই হত। দুঃশাসনের বক্তব্যটা এইবার বোঝা যাবে॥

গোবধ উঠে যাবার পর এই যে মধুপর্ক-দানের সময় একটি গোরুকে বেঁধে এনে অতিথিকে দিতেন গৃহস্থ, এই গোরুটিকে স্বস্তিবাচন করে গ্রহণ করার পরেই তাঁর গলার বাঁধন খুলে ছেড়ে দিতেন অতিথি। মহাভারতেই দেখবেন— জনমেজয়ের সর্পযজ্ঞের অন্ত্য মুহূর্তে যখন ব্যাসদেব এসে পৌঁছেছেন জনমেজয়ের রাজগৃহে, তখন তিনি আসন, পাদ্য, অর্ঘ্য নিবেদন করেই নিশ্চয় মধুপর্ক দান করেছিলেন, কেন না সেই দানের সঙ্গেও একটি গোরু ছিল— পাদ্যমাচমনীয়ঞ্চ অর্ঘ্যং গাঞ্চ বিধানতঃ। ব্যাস কী করলেন? ব্যাস জনমেজয়ের সমস্ত পূজাপহার গ্রহণ করে গোরুর গলায় বাঁধা দড়িটি খুলে দিলেন এবং তাতেই তিনি খুশি হলেন— গাঞ্চৈব সমনুজ্ঞাপ্য ব্যাসঃ প্রীতেহভবত্তদা।

এই যে বধের জন্য নিবেদিত এবং উৎসর্গীকৃত গোরুটি, যার প্রাণ যাওয়াটাই নিয়তি ছিল, সে যদি কোনও ক্রমে বেঁচে যায়, সেই বেঁচে যাবার টিপ্পনীর মধ্যেই নীলকণ্ঠের টীকার চমৎকারিতা, নাকি সেটা দুঃশাসনেরই বাক্যাঘাতের চরম কুশলতা, যা মহাভারতের কবিই একমাত্র তাঁর অলোকসামান্য প্রতিভায় ঠিক সময়ে প্রকাশ করতে পারেন। নীলকণ্ঠের মতে দুঃশাসন বোঝাতে চাইছেন— তোদের রাজসূয় যজ্ঞে তোরা আর কী পেলি। আমরা পাশায় ঘুটি সাজিয়ে যে যজ্ঞের আয়োজন করেছিলাম, তাতে সমাগত ঋত্বিক আর রাজাদের উদ্দেশে মধুপর্ক-দানের জন্য গোরু-হিসেবে উৎসর্গ করেছিলাম তোকেই। ওরে ভীম! তুইই ছিলি সেই নিবেদিত পশুটি। ঘটনা হল— বলির জন্য রজ্জুবদ্ধ পশুটিও বোধহয় বুঝতে পারে যে তাঁর প্রাণসংকট আসন্ন। তো সেই গোরু যদি বন্ধন-রজ্জু থেকে মুক্তি পায় কোনও মতে, তা হলে সে যেভাবে পালায়, তুইও সেইভাবেই এই যজ্ঞস্থল থেকে প্রাণভয়ে পালিয়ে গেলি, ভীম! আর ‘গোরু’ তো শুধু তোকেই বলছি না। এত এত রাজা-রাজড়া, এত এত যাজ্ঞিক-ঋত্বিক, তাঁদের সবার উদ্দেশে পাণ্ডব-পশুদের উৎসর্গ করেছিলাম। তো সেই পশুদের গলার ফাঁসের দড়ি খুলে দিয়েছে তোদের নিয়তি। যাতে আবার না ধরে এনে বাঁধে, সেই ভয়েই কেমন পালাচ্ছিস তোরা— আর ঠিক সেই জন্যই তোকে ‘গোরু গোরু’ বলে সম্বোধন করছি। বুঝলি রে ভীম!

দুঃশাসনের আপাত-সরল ‘গোরু’ বলে ডাকাটা যে কতখানি তাৎপর্যপূর্ণ তা পরম্পরা-প্রাপ্ত নীলকণ্ঠের টিপ্পনী ছাড়া আমরা বুঝতেও পারতাম না।

যদি দুঃশাসনের পরিহাসটা এমনই হয়ে থাকে অর্থাৎ ভীম, অর্জুনের মতো মহাবীরেরা মুক্তরজ্জু গোরুর মতো পালিয়ে যাচ্ছেন, তা হলে কিন্তু ‘গোরু-গোরু’ বলে ভীমকে টিটকিরি দেওয়াটা সাধারণ গো-সম্বোধনের চেয়ে অনেক গুরুতর তাৎপর্য বহন করে। মহাবীর ভীমের কাছে এই কটু পরিহাসের প্রতিফল অবশ্যই মৃত্যু। দুর্যোধন তাঁর হাঁটা নকল করায় তাকে হত্যার প্রতিজ্ঞা গ্রহণ করার সঙ্গে সঙ্গেই ভীম বলেছেন— আর এই যে বাক্যশুর এই দুঃশাসন, যুদ্ধের ক্ষমতা নেই শুধু কর্কশ কঠিন অসভ্য কথাগুলো বলে গেলি। তোর মতো খল-স্বভাব দুর্জনের রক্ত আমি সিংহের মতো খাব শুধু যুদ্ধ লাগুক একবার।

এই রক্তপানের প্রতিজ্ঞা বারবার উচ্চারিত হয়েছে ভীমের মুখে এবং ততোধিকবার সমগ্র মহাভারত জুড়ে উদাহৃত এবং উচ্চারিত হয়েছে কৃষ্ণা দ্রৌপদীর বিস্রংশিত কেশরাশির কথা, যা নাকি দুঃশাসন আপন করন্যাসে আলুলায়িত, অবিন্যস্ত করে দিয়েছেন— দুঃশাসন-করোৎসৃষ্ট-বিপ্রকীর্ণ-করোরুহা। দ্রৌপদীর এই কেশচর্চা যুদ্ধের উদ্যোগপর্ব পর্যন্ত মাঝে-মাঝেই আলোচনার বিষয় হয়ে উঠবে, প্রসঙ্গত উচ্চারিত হবে দুঃশাসন-বধের প্রতিজ্ঞা, কিন্তু দুর্যোধন-কৰ্ণরা এবং তাদের সাকরেদ দুঃশাসনও বোধহয় ধরেই নিয়েছিলেন যে, পাণ্ডবরা আর ফিরতে পারবেন না, কেন না অজ্ঞাতবাসের সময় ঠিক তাদের খুঁজে বার করা হবেই। হয়তো এইরকম একটা ভাবনা থেকেই দুর্যোধন কর্ণের কথায় উত্তেজিত হয়ে ঠিক করলেন— একবার দ্বৈতবনে যাবেন এবং পাণ্ডবদের সামনাসামনি সাময়িক ঘরবাড়ি তৈরি করে নিজেদের বিপুল ঐশ্বর্য তাঁদের দেখিয়ে আসবেন, যাতে বনবাসী পাণ্ডবদের অন্তর্দাহ তৈরি হয় ঈর্ষায়, অসূয়ায়। এই পরিকল্পনার মধ্যে দুঃশাসন ছিলেন না, তাঁর থাকার ক্ষমতাও নেই, কিন্তু তিনি সেই চতুর্থ ব্যক্তি, যিনি দুর্যোধনের সমস্ত অন্যায়ের মধ্যে স্বতঃসিদ্ধভাবে অন্তর্গত।

এই দ্বৈতবন-যাত্রার ফল ভাল হয়নি। গন্ধর্ব চিত্রসেনের হাতে মার খেয়ে দুর্যোধন-দুঃশাসন সেদিন বন্দি হয়েছিলেন এবং সঙ্গে তাঁদের স্ত্রীরাও। এই অবস্থায় যুধিষ্ঠিরের হস্তক্ষেপে অর্জুন এবং ভীম গন্ধর্ব চিত্রসেনকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে দুর্যোধন-দুঃশাসন এবং তাঁদের স্ত্রীদের মুক্ত করে আনেন। দুর্যোধনের সেদিন চরম অপমান হয়েছিল। শত্রুর কৃপায় ফিরে পাওয়া প্রাণ তিনি রাখতে চাননি, আত্মহত্যার প্রতিজ্ঞা নিয়ে কর্ণ এবং দুঃশাসনকে তিনি বললেন হস্তিনাপুরে ফিরে যেতে— দুঃশাসনং পুরস্কৃত্য প্রয়াত্ত্বদ্য পুরং প্রতি। দুর্যোধন ধিক্কার দিতে থাকলেন নিজেকে। যাঁদের তিনি পরম শত্রু বলে ভাবেন, তাঁদের দেওয়া প্রাণ তিনি কোন লজ্জায় বহন করবেন। দুর্যোধন শেষ পর্যন্ত রাস্তাতেই থেকে যাবেন বলে মনঃস্থির করলেন। প্রায়োপবেশনে প্রাণ বিসর্জন করার প্রতিজ্ঞায় তিনি শেষ পর্যন্ত ছোট ভাই দুঃশাসনকেই আপন রাজ্যের উত্তরাধিকার দিয়ে বললেন— শোনো দুঃশাসন! আমার অবর্তমানে তুমিই হস্তিনাপুরের রাজা হবে, আমার কথায় তুমি রাজা হিসেবে অভিষিক্ত হবে সিংহাসনে— প্রতীচ্ছ ত্বং ময়া দত্তম্ অভিষেকং নৃপো ভব।

শুধু একটা মৌখিক রাজ্যাভিষেক সম্পন্ন করা নয়। রাজা হবার পর কীভাবে ভাই-বন্ধুদের সহায়তা করতে হবে, জ্ঞাতি-গুরু-সুহৃদবর্গের সঙ্গে কতটা সদাচার-সৎকার পালন করলে দুঃশাসন সকলের চোখে মহনীয় হয়ে উঠবেন, সে-সম্বন্ধে বেশ একটা আঁটো সাঁটো বক্তৃতা দিয়ে দুঃশাসনকে যেন মৃত্যুপূর্ব শেষ অলিঙ্গনে জড়িয়ে ধরলেন দুর্যোধন। বললেন— যাও ভাই এবার, হস্তিনাপুরে গিয়ে নিজের রাজ্য প্রতিপালন করো— কণ্ঠে চৈনং পরিষ্বজ্য গম্যতামিত্যুবাচ হ।

দুর্যোধনের অপমান-দীর্ণ আবেগ এবং জীবন বিসর্জনের প্রতিজ্ঞায় একটা অদ্ভুত আবেগময় পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল। চিরকালের আজ্ঞাপালনকারী চতুর্থ ভূমিকায় থাকা দুঃশাসন দুর্যোধনের কথা শুনে কান্নায় ভেঙে পড়লেন। সাশ্রুকণ্ঠে হাতজোর করে দুর্যোধনের পায়ে লুটিয়ে পড়লেন তিনি। তাঁর চোখের জল দুর্যোধনের পায়ের ওপর পড়ছিল টপ টপ করে— দুঃখিতঃ পাদয়োস্তস্য নেত্রজং জলমুৎসৃজন্। দুর্যোধনকে তিনি বললেন— তুমি যা বলছ, তা কিছুতেই হবে না, দাদা! কিছুতেই হবে না— নৈতদেবং ভবিষ্যতি। আজকে পৃথিবী চৌচির হয়ে ফেটে যাক, আকাশ ভেঙে পড়ুক আমার মাথায়, সূর্য তাঁর কিরণজাল ত্যাগ করুন, বহ্নি হয়ে উঠুক শীতল, তবু তোমাকে ছাড়া আমি কোনওদিন এই বসুন্ধরা পালন করার স্বপ্ন দেখি না— ন ত্বহং ত্বদৃতে রাজন্ প্রশাসেয়ং বসুন্ধরাম্।

হঠাৎ করে হস্তিনাপুরের রাজমুকুট তাঁর মাথায় উঠে যাচ্ছে, এই আকস্মিকতায় নয়, যিনি চিরকাল দুর্যোধনের পরামর্শ-মন্ত্রকে চতুর্থ পুরুষ তিনি আজ্ঞাকারী অগ্রজের সিংহাসনে বসে পড়বেন, এটা দুঃশাসনের পক্ষে ভাবাই সম্ভব নয়। বারবার দুর্যোধনের প্রসন্নতা ভিক্ষা করে দুঃশাসন বললেন— তুমিই আমাদের বংশে চিরকালের রাজা, ভবিষ্যতে একশো বছর ধরে তুমিই রাজা থাকবে— ত্বমেব নঃ কুলে রাজা ভবিষ্যতি ন সংশয়ঃ। তুমি থাকতে আর কেউ সেখানে রাজা হতে পারে না। দুঃশাসন দাদা দুর্যোধনের পা ছেড়ে উঠলেন না। দুঃশাসন-দুর্যোধনের পারস্পরিক এই দৈন্যোক্তি চালাচালি যা চলতে থাকল, তাতে কর্ণ আর সহ্য করতে পারলেন না। যুদ্ধের সময় তিনি গন্ধর্ব চিত্রসেনের হাতে মার খেয়ে পালিয়ে গিয়েছিলেন বটে, কিন্তু এখন যেভাবে দুর্যোধনের মনে অপমান-কর্ষিত আত্মহত্যার ভাবনা আসছে, আর দুঃশাসন যেভাবে অঝোরে কেঁদেই চলেছেন, তাতে কিঞ্চিৎ বাগ্‌জাল বিস্তার করার নিতান্ত প্রয়োজন বোধ করলেন তিনি— তথা তৌ দুঃখিতৌ দৃষ্ট্বা দুঃশাসন-সুযোধনৌ।

কর্ণ বুঝেছিলেন— যে কোনওভাবে হোক, দুর্যোধনের স্বভাবিক অপমানবোধ যদি দূর করা যায়, তা হলেই আর কোনও সমস্যা থাকবে না। তিনি দুঃশাসন এবং দুর্যোধন দু’জনকে উদ্দেশ করেই বললেন— তখন থেকে বসে বসে কী এসব কষ্ট পাচ্ছ দু’জনে, এক্কেবারে বোকার মতো হচ্ছে ব্যাপারটা— বিষীদথঃ কিং কৌরব্যৌ বালিশ্যাৎ প্রাকৃতাবিব— তোমাদের এই দুঃখ যদি চলতেই থাকে তা হলে কি দুঃখ কমবে কিছু? আর তখন থেকে বোকার মতো বলে যাচ্ছ— পাণ্ডবরা, আমার শত্রুরা নিজেদের বিক্রম প্রকাশ করে আমাকে বাঁচিয়েছে। এটা কি কোনও কথা হল? বেশ করেছে বাঁচিয়েছে। বাঁচানোরই তো কথা। রাজার বিপদ হলে প্রজারা বাঁচাবে না? তোমারই রাজ্যের এক প্রান্তভাগে এই পাণ্ডবরা বাস করে। নেহাত বন-বাদার বলে তুমি না হয় আসো না এখানে, তা বলে এটা কি তোমার রাজ্য নয়? অতএব একজন রাজ্যবাসী প্রজা হিসেবে রাজার প্রতি যে কর্তব্য, পাণ্ডবরা তাই করেছে— কর্তব্যং হি কৃতং রাজন্ পাণ্ডবৈশুত্র মোক্ষণম্।

এ-রকম কুযুক্তি দিয়ে অহংকারী মানুষকে মরণ-শয্যা থেকেও তুলে আনতে পারেন কর্ণ। শকুনি এ-ব্যাপারে সমর্থন জানালেন সর্বান্তঃকরণে, কিন্তু দুঃশাসন-ভাই কিন্তু তখনও দাদার পা ছেড়ে ওঠেননি। হয়তো বা তিনিই একমাত্র বুঝেছিলেন অভিমানী দাদার মানসিক অপমান এবং কষ্টের কথা। বুঝেছিলেন— এই অপমানটা তাঁর অহংকারে কতটা আঘাত করেছে। কর্ণ-শকুনির কথায় দুর্যোধনের মনে একটা সাময়িক প্রসন্নতা তৈরি হল বটে এবং হয়তো সেইজন্যই ভূমিলুণ্ঠিত দুঃশাসনকে জড়িয়ে ধরে মাটি থেকে তুললেন এবং সস্নেহে তাঁর শিরশ্চুম্বন করে তাঁকে শান্ত করার চেষ্টা করলেন— উত্থাপ্য সম্পরিষ্কজ্য প্রীত্যাজিঘ্ৰত মূর্ধনি।

দুর্যোধন কিন্তু এত সব ঘটনার পরেও নিজের আত্মহত্যার সংকল্পে অবিচল ছিলেন, কিন্তু পাণ্ডবদের দমনের ব্যাপারে অন্য একটি বহিরাগত আশ্বাস তাঁর মন আবারও সঞ্জীবিত করে এবং শেষ পর্যন্ত সকলেই আবার স্বরাজ্যে ফিরে আসেন। এই সম্পূর্ণ ঘটনার মধ্যে অন্যতম প্রণিধানযোগ্য ব্যাপার হল— দুঃশাসন কীভাবে দেখছেন তাঁর দাদাকে। লক্ষ করে দেখবেন, মহাভারতের ধর্মপক্ষে যিনি প্রধান উদ্দিষ্ট পরুষ, সেই যুধিষ্ঠিরের আজ্ঞাবাহী শিষ্যের মতো ভাই আমরা অর্জুনকে দেখেছি। হয়তো বা অর্জুন নিজেও অত্যন্ত বুদ্ধিমান, ধীর এবং বিচক্ষণ পুরুষ বলেই কখনও কখনও অগ্রজ যুধিষ্ঠিরের সঙ্গে তাঁর মতবিরোধ হয়েছে, কখনও বা বিতর্কও, কিন্তু যুধিষ্ঠিরকে তিনি কখনওই অতিক্রমও করেননি। অর্থাৎ সামগ্রিকভাবে তিনি যুধিষ্ঠিরের আজ্ঞাবাহী ভাই— ভ্রাতা চ শিষ্যশ্চ যুধিষ্ঠিরস্য। অন্যদিকে এই প্রতিপক্ষ নায়কদের সঠিক বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায় যে, ধর্মপক্ষে বা ন্যায়পক্ষে যেমন পরস্পরের হৃদয়-বোঝা একটি ভ্রাতৃ-যুগ্ম থাকে, তেমনই প্রতিপক্ষ নায়কের ক্ষেত্রেও তাঁর হৃদয়-অনুকূল আজ্ঞাবাহী একটি ভাই থাকে, যাঁকে নিয়ে একটি প্রতিপক্ষ-যুগ্ম তৈরি হয়।

ভারতীয় মহাকাব্যে এটা একটা ‘প্যাটার্ন’ বটে। দেখুন, রামায়ণে রাম-লক্ষ্মণের প্রতিপক্ষে রাবণ-কুম্ভকর্ণ, মহাভারতে তেমনই যুধিষ্ঠির-অর্জুনের প্রতিপক্ষে দুর্যোধন এবং দুঃশাসন একটি সমান্তরাল প্রতিপক্ষ-যুগ্ম। তবে যুগ্মতার ক্ষেত্রে ন্যায় বা অন্যায়ের, ধর্মের বা অধর্মের প্রতিপত্তি দেখানোটা মহাকাব্যের কবির যতটা অভিপ্রেত, তার চেয়েও বেশি অভিপ্রেত সৌভ্রাতৃত্বের প্রতিষ্ঠা। ভাবটা এই যে, ধর্মাধর্ম, ন্যায়-অন্যায়, সভ্য-অসভ্য ইত্যাদি বিপরীত যুগ্মতা অতিক্রম করেও ভ্রাতৃ-সৌহার্দের যুগ্ম তৈরি হতে পারে। শব্দটা অসচেতনভাবে মহাভারতের কবি প্রয়োগও করে ফেলেছেন একভাবে। পায়ের ওপর আছড়ে-পড়া দুঃশাসনকে মাটি থেকে ওঠানোর সময় মহাভারতের কবি দুঃশাসনের একটি বিশেষণ দিয়ে বলেছেন— পাদয়োঃ পতিতং বীরং বিকৃতং ভ্রাতৃসৌহৃদম্। টীকাকার নীলকণ্ঠ ওই শেষ শব্দটির ব্যাখ্যায় বলেছেন— ভ্রাতার প্রতি সৌহার্দ বা বাৎসল্য যার মধ্যে আছে, এইরকম দুঃশাসনকে তিনি ভূমি থেকে ওঠালেন। আর ‘বিকৃত’ শব্দের মানে তিনি করেছেন ‘ম্লান’। অর্থাৎ দুর্যোধনের ওপর ভ্রাতৃবাৎসল্যে যিনি ম্লান হয়ে গেছেন এমন দুঃশাসনকে তিনি হাত দিয়ে ধরে ওঠালেন। আমরা অবশ্য ‘বিকৃত’ শব্দের অর্থ ‘ম্লান’ বুঝিনা এখানে। আমরা মনে করি— ‘বি’ উপসর্গের অর্থ এখানে বিশেষ’। অর্থাৎ বিশেষভাবে, অশেষে-বিশেষে যিনি ভাই-দাদা দুর্যোধনের প্রতি সৌহার্দ প্রকাশ করলেন, সেই দুঃশাসনকে দুর্যোধন ভূমি থেকে ওঠালেন। আবার এমনও ভাবতে পারি যে, ন্যায়পক্ষে থাকা যুধিষ্ঠির-অর্জুনের ভ্রাতৃ-সৌহার্দের প্রতিপক্ষে দুর্যোধন-দুঃশাসনের এই ভ্রাতৃ-ব্যবহার অতি বিলক্ষণ এক অন্যতর ভ্রাতৃসৌহার্দই বটে, তবে অন্যায়-অধর্মেই এই ভ্রাতৃ-সৌহার্দ ঘটেছে বলেই তা একধরনের বিকার— হয়তো সেইজন্যই। মহাভারতকার কবির এই মন্তব্য— বিকৃতং ভ্রাতৃসৌহৃদম্।

পাণ্ডবদের দিক থেকে তাঁর প্রাণ বাঁচানোর এই চেষ্টাটাকে দুর্যোধন অপমান হিসেবে গ্রহণ করলেন এবং নিজেদের সাহংকার চেতনায় সে-অপমান যথাসাধ্য ভুলেও গেলেন। তারপরেই যুধিষ্ঠিরের রাজসূয় যজ্ঞের আদলে একটা বৈষ্ণব-যজ্ঞ করে ফেললেন। শুধু এইটুকু করলেও ঠিক ছিল। কিন্তু পূর্বতাড়িত অপমান-বোধে দুঃশাসন একজন দূত ঠিক করে পাণ্ডবদের কাছে পাঠালেন এবং নির্দেশ দিয়ে বললেন— যাও দূত! তুমি গিয়ে ওই বদমাশ পাণ্ডবদের নেমন্তন্ন করে এসো আমাদের যজ্ঞে আসবার জন্য। আর ওদের নেমন্তন্ন করার পর ওখানকার ওই দ্বৈতবনে-থাকা ব্রাহ্মণদেরও নেমন্তন্ন করে এসো— গচ্ছ দ্বৈতবনে শীঘ্রং পাণ্ডবান পাপ-পূরুষান্‌। দূতের মুখে দুঃশাসনের কথা শুনে যুধিষ্ঠির শান্ত গলায় জবাব দিলেন— আমাদের যাবার উপায় নেই কোনও; যেমনটি আমি কথা দিয়েছি, আমাদের তা রাখতে হবে। তেরো বছর পর নিশ্চয়ই যাব সেখানে। যুধিষ্ঠিরের কথা শেষ হলে ভীম ইচ্ছা করেই— যাতে দুর্যোধন দুঃশাসনকে সেটা শোনানো হয়, সেইভাবেই বললেন— যাব যাব নিশ্চয় যাব, মহারাজ যুধিষ্ঠিরও যাবেন— যখন এই তেরো বছর পরে রণ-যজ্ঞ হবে, অস্ত্রশস্ত্রের হানাহানিতে যে আগুন জ্বলবে আর তাতে পড়বে আমার ক্রোধের ঘৃতাহুতি, সেদিন এদের সবাইকে শেষ করার পর যাব তোদের যজ্ঞে।

দূত এসে দুর্যোধনকে যা ঘটেছে সব জানাল, দুঃশাসনও নিশ্চয় জানলেন সব কথা। যজ্ঞকর্ম এবং বীরদর্পে ভীমের কথাটা তাঁদের কাছে হম্বিতম্বি ছাড়া কিছু নয়। আর দুঃশাসনকে খেয়াল করে দেখুন, তাঁর কী প্রয়োজন ছিল বনবাসী পাণ্ডবদের কাছে নিজেদের যজ্ঞ-বৈভব প্রকাশ করার। নাকি, এটাই নিয়ম যে, সব সৎকাজেই জ্ঞাতিদের খবর দিতে হবে, তাঁদের মনে কষ্ট হোক বা না-হোক জানাতে হবেই। আসলে দুঃশাসন এইগুলোই ভাল পারেন। তিনি জানেন যে, এইভাবে ব্যথা দিলে দুর্যোধনের আনন্দ হবেই। অতএব এইসব অন্যায়, ছলনা, বিনা কারণে কষ্ট দেওয়া, দুরুক্তি করা, এগুলিই দুঃশাসনের প্রধান কাজ। মহাভারতকার তাঁর বিশেষণ দিয়েছেন ‘নিকৃতিপ্রজ্ঞ’, অর্থাৎ ছলনা-বঞ্চনার সমস্ত মন্ত্রণাতেই এঁদের প্রজ্ঞা কাজ করে। সেই যে দুর্বাসা মুনি এলেন দুর্যোধনের ঘরে, আর সেবা-পূজা করে তিনি যে তুষ্ট করলেন দুর্বাসাকে, সেখানে পূর্বাহ্নেই দুঃশাসন-কর্ণ-শকুনির সঙ্গে তাঁর আলোচনা হয়ে গিয়েছিল যে, মুনিকে দিয়ে হেনস্থা করতে হবে পাণ্ডবদেব— প্রাগেব মন্ত্রিতং চাসী কর্ণ-দুঃশাসনাদিভিঃ।

আমরা জানি, এই ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ছলনা-বঞ্চনার বুদ্ধিতেই দুঃশাসন বড় দক্ষ পুরুষ, কিন্তু যুদ্ধক্ষেত্রে তাঁর বীরত্বের প্রতিফলন ঘটে না। বিরাট রাজার গোধন হরণ করার জন্য দুর্যোধন সকলকে নিয়ে যুদ্ধে গেলেন, সেখানে দুঃশাসন অনেক সৈন্যব্যূহ সাজিয়ে নির্মমভাবে পরাজিত হলেন বৃহন্নলা-রূপী অর্জুনের কাছে। আর এই তো আরম্ভ সম্পূর্ণ যুদ্ধপর্ব জুড়ে যতদিন না তাঁর মৃত্যু হয়েছে, ততদিন বারবার পরাজিতই হয়েছেন পাণ্ডবদের কাছে। সম্পূর্ণ যুদ্ধ-পর্ব জুড়ে বারবার তাঁর কানে ভীমের সেই ভয়ংকরী প্রতিজ্ঞা ভেসে এসেছে যে, ভীম তার বক্ষ চিরে রক্তপান করবেন, কিন্তু দুঃশাসনের তাতে বোধোদয় হয়নি। দুর্যোধন-দাদা যেভাবে ভাবেন, তিনিও সেইভাবেই ভাবতে শিখেছেন শুধু। কিন্তু এইভাবে দুর্যোধনের প্রতিবিম্বতায় ভাবতে ভাবতে তাঁর মনের মধ্যে এই সংক্রমণ ঘটেছিল যে, জগৎটা দুর্যোধনের ভাবনাতেই চলবে। নইলে ভাবতে পারেন, উদ্যোগ-পর্বে যখন কৃষ্ণ বারবার পাণ্ডবদের হৃতরাজ্য ফিরিয়ে দিয়ে তাঁদের সঙ্গে সন্ধি করতে বলছেন দুর্যোধনকে, তখন দুঃশাসন বেঁকিয়ে বেঁকিয়ে, চিবিয়ে চিবিয়ে দুর্যোধনকে বলছেন— সবকিছু পাণ্ডবদের ফিরিয়ে দাও, দাদা! আর তুমি যদি পাণ্ডবদের সঙ্গে সন্ধি না করো, তা হলে তোমার-আমার কী হবে জানো? ভীষ্ম, দ্রোণ, তোমার মা আর সব কৌরবরা মিলে তোমাকে, আমাকে আর কর্ণকে বেঁধে নিয়ে পাণ্ডবদের হাতে দিয়ে দেবেন— বৈকর্তনং ত্বাঞ্চ মাঞ্চ ত্রীনেতান্ ভরতর্ষভ। পাণ্ডবেভ্যঃ প্রদাস্যন্তি ভীষ্মো দ্রোণঃ মাতা চ তে।

এই যে একটা ক্রুদ্ধ মানুষকে পুনরায় চেতিয়ে দেওয়া, ভাই হিসেবে দুঃশাসন এটাই সবচেয়ে ভাল রপ্ত করেছেন। দুঃশাসনের কথা শোনা মাত্রই দুর্যোধন সভাস্থিত সমস্ত গুরুজনদের অবজ্ঞা করে, এমনকী অনুমতি পর্যন্ত না নিয়ে সভা ছেড়ে গেলেন। অবশ্য পিছন পিছন গেলেন সেই কর্ণ-শকুনি আর দুঃশাসন। গান্ধারীকে দিয়ে বলিয়েও ধৃতরাষ্ট্র দুর্যোধনকে সভায় রাখতে পারলেন না। গান্ধারী অনেক কথার মধ্যে একথাটাও বলেছিলেন— এই কর্ণ নিজেই অত্যন্ত ক্রোধী মানুষ, তোমার ভাই দুঃশাসনও তাই, কিন্তু এদের কথায় কান দিয়ো না। দুর্যোধন কারও কথাতেই কান দেননি; জননী গান্ধারীকে হতবাক্ করে দিয়ে সভা ছেড়ে তিনি বেরিয়ে গিয়েছিলেন। উলটে তাঁদেরই মন্ত্রণা চলল ভবিষ্যতের কর্মপন্থা নিয়ে এবং সেখানেও অন্যতম নীরব সমর্থক হলেন দুঃশাসন— দুঃশাসন-চতুর্থানাম্ ইদমাসীদ্ বিচেষ্টিতম্।

সম্পূর্ণ যুদ্ধপর্বে দুঃশাসনের কোনও অবদান নেই। বস্তুত পাণ্ডবপক্ষের সমস্ত নামী যোদ্ধার হাতেই দুঃশাসন প্রচুর মার খেয়েছেন এবং যুদ্ধে পরাজিত হয়েছেন। অর্জুন, ধৃষ্টদ্যুম্ন, ভীম, সাত্যকি, এমনকী কনিষ্ঠতম অভিমন্যু পর্যন্ত দুঃশাসনকে যুদ্ধে নাজেহাল করে ছেড়েছেন। কি এত হারলেও দুঃশাসন মখে কিছু কম যান না। অভিমন্যুর বয়স কম দেখে তিনি মন্তব্য করেছিলেন— কোনও চিন্তা নেই। আমিই ওকে শেষ করে দেব— অহমেনং হনিষ্যামি মহারাজ ব্রবীমি তে। আসলে ঘটনাটা এইরকম ছিল। দুর্যোধন ঘনিষ্ঠ মহলে বলেছিলেন— আচার্য দ্রোণ তাঁর প্রিয় শিষ্যের ছেলে বলে অভিমন্যুকে মায়া করছেন। ফলত এই বালক নিজেকে নিজে খুব বড় যোদ্ধা বলে ভাবছে। ওকে এবার ঠান্ডা করে দাও তো দেখি— তং প্রমথ্‌নীত্ মা চিরম্। কথাটা বোধহয় দুঃশাসনের দিকেই তাকিয়ে বলেছিলেন দুর্যোধন। দুঃশাসন তাই সঙ্গে সঙ্গে প্রতিক্রিয় হয়ে বললেন— কোনও চিন্তা নেই, আমি শেষ করে দেব এই বালককে। শুধু তাই নয়, সমস্ত পাণ্ডব-পাঞ্চালদের চোখের সামনে এমনভাবে ছেলেটাকে ধরব না— ঠিক যেমন রাহু ধরে সূর্যকে— গ্রযিয্যাম্যদ্য সৌভদ্রং যথা রাহুর্দিবাকরম্। আরও মজা হল— ওটা মরেছে শুনলে কৃষ্ণ আর অর্জুনও শোকে-দুঃখে মরে যাবে, আবার ওই দুটো মরেছে শুনলে অবশিষ্ট পাণ্ডবরাও একে একে মরবে। এমন অবস্থায় তোমার শত্রু বলে যদি কেউ আর থাকে, তারা কেউ আর বাঁচবে না। অতএব, আর কিছু নয়, তুমি এই আমার জন্য, আমার মঙ্গলের জন্য ঠাকুরের কাছে একটু মঙ্গল কামনা করো, আর দ্যাখো, এক সময়ের মধ্যেই কেমন এই বালক-বীরকে হত্যা করে আসি— শিবেন ধ্যাহি মাং রাজন্নেষ হন্মি রিপুং তব॥

প্রথমে অভিমন্যু, তারপর তাঁর কাল্পনিক মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে কৃষ্ণ, অর্জুন এবং অন্যান্য পাণ্ডব-ভাইদের কাল্পনিক মৃত্য-ভাবনার এই যে চিত্র দুঃশাসন এঁকে দিলেন— এর মধ্যে নিজের ক্ষমতার পরিমিতি-বোধ এবং বাস্তবের স্পর্শ-বোধ কোনওটাই নেই। দুঃশাসন অবশ্য আরম্ভ করেছিলেন একটি বালকের হত্যা-কল্পনা দিয়ে— যার বয়সটাই তাঁর কাছে বড় হয়ে উঠেছে, যুদ্ধক্ষমতা নয়; কিন্তু অভিমন্যুকে অল্পপ্রাণ ভাবা ছাড়াও বিনা প্রতিবাদে, বিনা যুদ্ধে কৃষ্ণার্জুনের মৃত্যুকামনা, বিশেষত যে মধ্যম পাণ্ডব প্রায় তিরিশবার একই প্রতিজ্ঞা পুনরুচ্চারণ করে বলেছেন যে, ধরেই নাও ওই দুঃশাসনের রক্তপান করা আজই হয়ে গেছে আমার— দুঃশাসনস্য রুধিরং পীতমদ্যাবধারয়— সেইসব মহাবীরের ক্লীব মৃত্যুকল্পনা (ক্লৈব্যাদ্ ধাস্যন্তি জীবিতম্) দুঃশাসনের আত্ম-সম্ভাবিত ক্ষমতা সম্বন্ধে হাস্যকর প্রতিচ্ছবি প্রকট করে তোলে।

দুঃশাসন অভিমন্যুর দিকে ধেয়ে গিয়েছিলেন, সবেগেও বটে, সাবেগেও বটে, কিন্তু শেষরক্ষা করতে পারেননি। প্রথমত বিভিন্ন কৃতকর্মের জন্য অভিমনুর মতো বালকের মুখেও ঘৃণ্য ধিক্কার-শব্দ শুনেছেন দুঃশাসন, তারপরেই লাভ করেছেন সুতীক্ষ্ণ বাণের আঘাত। এমন মার তিনি খেয়েছিলেন অভিমন্যুর হাতে যে, রথের মধ্যদণ্ড অবলম্বন করে তাঁকে বসে পড়তে হয়েছিল। শরীর এত ক্ষত-বিক্ষত হয়ে গিয়েছিল যে, দুঃশাসনের সারথি তাঁকে কোনও মতে রণপ্রাঙ্গণ থেকে বার করে নিয়ে গেছে— রণমধ্যাদ্‌ অপোবাহ সৌভদ্র-শরপীড়িতম্‌। দুর্যোধন শেষ পর্যন্ত বন্ধু কর্ণকে ডেকে কোনও মতে আটকাতে বলেছেন অভিমন্যুকে। সত্য স্বীকার করে তিনি বলেছেন— দ্যাখো ভাই, দুঃশাসনকে কিন্তু এক্কেবারে কব্‌জা করে নিয়েছে অভিমন্যু— পশ্য দুঃশাসনং বীরম্ অভিমন্যুবশং গতম্।

এই তো দুঃশাসনের বাহুবীর্য। বারবার প্রতিপক্ষের আঘাতে তিনি মাটিতে লুটিয়ে পড়েন, কিন্তু মুখের বড়াই কমে না তাঁর। অর্জন বা ভীমের সঙ্গে প্রাথমিক যে-সব যুদ্ধ হয়েছে দুঃশাসনের, তাতে তিনি ছাড় পেয়ে গেছেন পাণ্ডবদের অন্য প্রয়োজন থাকায়। কিন্তু অভিমন্যু মারা যাবার পর জয়দ্রথ-বধের যে প্রতিজ্ঞা অর্জুনের মুখে উচ্চারিত হয়েছিল, পাণ্ডবরা সেই প্রয়োজনে মনোনিবেশ করলেও অর্জুনের শিষ্য সাত্যকির হাতে দুঃশাসন ভীষণভাবে মার খেলেন। দুর্যোধনের সৈন্যদলের অন্যতম পার্বতীয় এবং নানাদেশীয় যোদ্ধারা সেদিন সাত্যকির সঙ্গে যুদ্ধ করছিল। যুদ্ধে তারা সাত্যকির সঙ্গে পেরে উঠছিল না। অস্ত্রে ক্ষত-বিক্ষত হয়ে তারা পালাচ্ছিল এবং দুঃশাসন তাদের যাচ্ছেতাই করে গালাগালি দিচ্ছিলেন। একেতেই অনার্য বলে এই পার্বত্য প্রজাতিকে লোকে দস্যু বলে, তার মধ্যে তারা পালাচ্ছিল বলে দুঃশাসন তাদের তিরস্কার করে বলছিলেন— পালাচ্ছিস যে বড়। ব্যাটারা যুদ্ধের ধর্ম বলে কিছু জানিস না, ফিরে আয় সব— নিবর্তধ্বম্ অধর্মজ্ঞা যুধ্যধ্বং কিং সৃতেন বঃ। কেউই অবশ্য দুঃশাসনের কথায় প্রাণভয়ে ফিরে এল না সাত্যকির সঙ্গে যুদ্ধ করতে।

দুঃশাসন এবার কাজে লাগালেন সেইসব অদ্ভুত যুদ্ধবাজ মানুষকে যারা পাথর ছুড়ে যুদ্ধ করে এবং সাত্যকি যেহেতু এই অপরিশীলিত যুদ্ধরীতি এতটুকুও জানেন না— অশ্ম-যুদ্ধেষ্ণু কুশলান্ নৈতজ্জানাতি সাত্যকিঃ— অতএব দুঃশাসন ভাবলেন— পাষাণের আঘাতেই সাত্যকি মারা পড়বে। দুঃশাসন সাত্যকির যুদ্ধক্ষমতা সম্বন্ধে নিতান্তই ভ্রান্ত ধারণা পোষণ করেছেন। বিশেষত বাণের প্রথম আঘাতেই যখন পাষাণ-পাণি পার্বতীয় যোদ্ধাদের প্রাণ যায়, তখন বিভীষিকা তৈরি হয়ে যায় সৈন্যদলের মধ্যে। মহাভারত অবশ্য সাত্যকির সঙ্গে তৎকালীন ভারতবর্ষের তখনও অপরিক্ষীণ আর্যেতর জনগোষ্ঠীর যুদ্ধোদ্যোগ প্রদর্শন করার সময় যুদ্ধবিদ্যার পুরাতন পাষাণ-ব্যবহারের ওপর লৌহনির্মিত অস্ত্রের সফলতা নিপুণভাবে বর্ণনা করেছেন। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে এটাও তাঁর প্রদর্শনের বিষয় যে, বিভ্রান্ত এবং যুদ্ধকৌশলহীন দুঃশাসন কাদের ওপর নির্ভর করছেন।

সৈন্য-সামন্তরা দলে দলে পালিয়ে আসছে— এই দৃশ্য চোখে পড়ছিল যুদ্ধের সর্বাধিনায়ক দ্রোণাচার্যের। তিনি লক্ষ করেছেন— দুঃশাসনের সঙ্গে যেসব সৈন্য-সামন্ত সহায় হিসেবে গিয়েছিল, যুদ্ধ-নায়কের নিজস্ব ব্যর্থতায় তারা সব পালিয়ে এসে সর্বাধ্যক্ষ দ্রোণাচার্যের আশ্রয় নিচ্ছে— তে ভীতাস্ত্বভ্যধাবন্ত সর্বে দ্রোণরথং প্রতি। দ্রোণাচার্য অত্যন্ত বিরক্ত হলেন। তাঁর সামনে অনেক সমস্যা, অভিমন্যুর অকালমৃত্যুতে ক্ষুব্ধ অর্জুন কৌরব-জামাতা জয়দ্রথ-বধের প্রতিজ্ঞা নিয়েছেন, অন্যদিকে দুর্যোধনকেও সুরক্ষিত রাখা দরকার, তার মধ্যে শৈনেয় সাত্যকির এই প্রবল পরাক্রম। যুদ্ধপর্বের দায়িত্বে থেকে দ্রোণাচার্য এখন বিধ্বস্ত বোধ করছেন। বিশেষত এক প্রান্তের সৈন্যেরা পালাতে আরম্ভ করলে যুদ্ধক্ষেত্রে যুদ্ধরত অন্যান্য সৈনিকদের ওপরেও তার প্রবল প্রভাব পড়ে। তাদের মধ্যেও পালানোর প্রবণতা দেখা দেয়। দুঃশাসনের সহায় সৈন্যরা দ্রোণাচার্যের আশ্রয় নিচ্ছে দেখে তাঁদের খানিকটা যুদ্ধস্থিত করতেই তিনি দেখতে পেলেন করুণ মুখে দাঁড়িয়ে আছেন দুঃশাসন— রথের মধ্যে নিশ্চেষ্ট, বিভ্রান্ত— দুঃশাসনরথং দৃষ্টা সমীপে পর্যবস্থিতম্।

দ্রোণাচার্য আর থাকতে পারলেন না। এই অকালপক্ক মুখর ব্যক্তিটির অনেক অন্যায় তিনি চোখের সামনে দেখেছেন। যুদ্ধবীর ন্যায়নিষ্ঠ পাণ্ডবদের বঞ্চনা করবার সময় দুঃশাসনের সকল অবাঞ্ছিত মন্তব্যগুলি এখনও তাঁর কানে বাজে। যুদ্ধ থেকে পালিয়ে-আসা দুঃশাসনকে দেখে তিনি আর থাকতে পারলেন না। বললেন— দুঃশাসন! এরা সব পালাচ্ছে কেন? যুদ্ধের রথগুলো সব ফিরে আসছে যে— দুঃশাসন রথাঃ সর্বে কস্মাদেতে প্রবিদ্রুতাঃ? তোমার দাদা মহারাজ দুর্যোধন ঠিক আছে তো? সিন্ধুরাজ জয়দ্রথেরই বা কী অবস্থা, সে বেঁচে আছে তো এখনও? আর তোমার কথা বলি। তুমি না রাজপুত্র, এখন তো রাজার ভাই বলে কথা। তাঁর মধ্যে যুবরাজ পদে বিরাজ করে তোমার এ কী দুরবস্থা! তুমি যুদ্ধ থেকে পালাচ্ছ— কিমর্থং দ্রবসে যুদ্ধে যৌবরাজ্যমবাপ্য হ?

দুঃশাসনের এই পলায়ন-ব্যবহারের সামান্য এই কটু সমালোচনাটুকু করেই ছেড়ে দিলেন না দ্রোণাচার্য। পাণ্ডবদের প্রতি, তাঁদের প্রিয়া পত্নী দ্রৌপদীর প্রতি যে অসভ্যতাগুলি করেছেন দুঃশাসন, সেগুলি তিনি মন থেকে কখনওই সহ্য করতে পারেননি, কিন্তু যে কোনও কারণেই হোক, তিনি উপযুক্ত সময়ে প্রতিবাদও করতে পারেননি। এতদিন ধরে দুঃশাসনের মুখে তিনি অনেক বড়াই শুনেছেন, কিন্তু কৌরবদের অর্থদাসত্বের কারণে সব কথার উত্তর সবসময় দেওয়া হয়নি। আজকে তিনি চোখের সামনে দেখছেন কীভাবে যুদ্ধ থেকে নিজে পালিয়ে এসে সৈন্য-সামন্তদের বিভ্রান্ত করেছেন দুঃশাসন। অতএব এই সুযোগ ছেড়ে দেওয়া যায় না। দ্রোণ শোনালেন— ওহে দুঃশাসন! তুমিই না কুলবধূ দ্রৌপদীকে অপমান করে বলেছিলে— তোমাকে পাশার চালে জিতেছি, তুমি আমাদের দাসী। তুমি এই বাড়িতে যেখানে যে ঘরে ইচ্ছে, তোমার কামনা পূরণ করতে পারো— যথাকামচরী ভব। আমার বড় দাদা দুর্যোধন যখন হেঁটে যাবেন তখন তাঁর বিস্তৃত বসন এবং উত্তরীয়ের প্রান্তগুলি তুমি বয়ে নিয়ে যাবে পিছন পিছন— বাসসাং বাহিকো রাজ্ঞো ভ্রাতুর্জ্যেষ্ঠস্য মে ভব।

দ্রোণাচার্য এখন পলায়নপর দুঃশাসনকে যুদ্ধক্ষেত্রে দাঁড়িয়ে মনে করিয়ে দিয়ে বলেছেন— তুমিই না দ্রৌপদীকে শুনিয়েছিল যে, তোমার স্বামীরা কিছুই করার ক্ষমতা রাখে না, সব এক-একটা নপুংসক তিলগাছের বীজ, গাছ হয়, ফল হয় না। তো এত বড় বড় কথা বলে আজ নিজে তুমি, দুঃশাসন। যুদ্ধ ছেড়ে সবার আগে পালিয়ে এসেছ কেন— দুঃশাসনৈবম্ উক্তা ত্বং পূর্ব কস্মাৎ পলায়সে? পাণ্ডব-পাঞ্চালদের সঙ্গে নিজেরাই তোমরা শত্রুতা সৃষ্টি করেছ, সেখানে এই সাত্যকি তো পাণ্ডবও নয়, পাঞ্চালও নয়, সেই সাত্যকির সঙ্গে একক যুদ্ধেই তুমি পালাচ্ছ, তা হলে পরে কী করবে— একং সাত্যকিমাসাদ্য কথং ভীতোহসি সংযুগে? যখন পাশার চাল চেলে পাণ্ডবদের জিতেছিলে তখন বোঝোনি যে, ওই চালগুলোই একদিন ধনুকের তির হয়ে ফিরে আসবে। অপমানাহত পাণ্ডবদের কীই না তুমি বলেছ, বিশেষত দ্রৌপদীর ওই অপমান! সেদিন তো অনেক তর্জন-গর্জন করেছিলে, কত মেজাজ দেখিয়েছিলে, তো আজ সে-সব কোথায় গেল? এখন তো গলা দিয়ে আওয়াজই বেরোচ্ছে না— ক্ক তে মানশ্চ গর্বশ্চ ক্ক তে তদ্‌বীরগর্জিতম্?

দ্রোণ এবার কাজের কথায় ফিরে এলেন। দুঃশাসনের পলায়নী বৃত্তিতে যুদ্ধের যে ক্ষতি হচ্ছে, সেই দিকটা ধরিয়ে দিয়ে দুঃশাসনকে তিনি বললেন— কেউটে সাপ খেপিয়ে দিয়ে এখন তুমি কোথায় দৌড়চ্ছ, দুঃশাসন! মনে রাখতে হবে তো এই সৈন্য-সামন্তের মনস্তত্ত্ব, মনে রাখতে হবে তোমার দাদা দুর্যোধনের কথা। তুমি তার ভাই হয়ে যুদ্ধ ছেড়ে পালাচ্ছ, এদিকে মুখে তোমার কটকটে কথাগুলো তো বেশ চলে— যস্য ত্বং কর্কশো ভ্রাতা পলায়ন-পরায়ণঃ। যে-সব সৈন্য-সামন্ত ভয়ে পালিয়ে আসছে, তাদের সুরক্ষার ভার তো তোমারই, নিজে পালিয়ে এসে শত্রুপক্ষের মজা বাড়ানোর তো মানে নেই কোনও। যুদ্ধের নায়কটিই যদি ভয়ে মরে, তা হলে সৈন্যরা তার নায়কত্বে যুদ্ধ চালাবে কী করে?

দ্রোণাচার্য এবার নাটকীয় কায়দায় দুঃশাসনকে তিরস্কার করে বললেন— একা এই সাত্যকির সঙ্গে যুদ্ধ করতেই তোমার মনে পালিয়ে বাঁচার ইচ্ছে হয়েছে, এরপরে যখন অর্জুন আর ভীমের সামনে মুখোমুখি যুদ্ধ করবে, সেদিন তুমি কী করবে বাছা— তদা ত্বং কিং করিষ্যসি? দ্রোণাচার্য যেহেতু অর্জুনকেই তাঁর শিষ্যকুলের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ মনে করেন, অতএব গাণ্ডীবধন্থা অর্জুনের ভয় দেখানোটাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠল তাঁর কাছে। বিশেষত যে সাত্যকির ভয়ে দুঃশাসন সসৈন্যে পালাচ্ছেন, তিনি অর্জুনের শিষ্যমাত্র। দ্রোণ তাই তুলনা টেনেই বললেন— অর্জুনের শররাশির সঙ্গে সাত্যকির অস্ত্রপ্রযুক্তির কোনও তুলনাই হয় না, অথচ তার ভয়েই তুমি পালাচ্ছ— ন তুল্যাঃ সাত্যকি-বাণাঃ যেষাং ভীতঃ পলায়সে! আর পালাবেই যদি, যুদ্ধ ছেড়ে যদি পালানোর দিকেই অবশেষে বুদ্ধি হয় তোমার, তা হলে ধর্মরাজ যুধিষ্ঠিরের হাতে পাণ্ডবদের প্রাপ্য রাজ্য ফিরিয়ে দিলেই হত। আমি তো বলব— সাপের বিষের সমান অর্জুনের বাণগুলি যাতে মাথার ওপর না এসে পড়ে, তার আগেই পাণ্ডবদের সঙ্গে তোমরা ঝগড়া-বিবাদ মিটিয়ে ফ্যালো— তাবৎ সংশাম্য পাণ্ডবৈঃ।

বিবাদ মিটিয়ে ফ্যালো— এই শেষ কথাটি ধ্রুবপদের মতো ব্যবহৃত হয়েছে পরপর কয়টি শ্লোকের মধ্যে। অর্থাৎ দুঃশাসনকে সুযোগ পাওয়ামাত্রই দ্রোণাচার্য বুঝিয়ে দিলেন যে, অন্য কেউ নয়, শুধুমাত্র পাণ্ডব-ভাইদের ক্রোধাগ্নি থেকেই দুঃশাসনের সবচেয়ে বড় ভয়। এটা তো ঠিক যে, ধৃষ্টদ্যুম্ন, সাত্যকি, এঁদের সঙ্গেই দুঃশাসন পেরে ওঠেননি, এমনকী অর্জুন-ভীমও অন্য বৃহত্তর যুদ্ধে ব্যস্ত থাকায় মাঝে মাঝে শুধু ছুঁয়ে গেছেন দুঃশাসনকে, কিন্তু এবার সময় হয়ে আসছে। দ্রোণাচার্য এবার ইঙ্গিতে সামান্যাকারে ভীমের দুঃস্বপ্ন স্মরণ করিয়ে দিলেন দুঃশাসনকে। বললেন— রাজ্যের দখল নিতে গিয়ে পাণ্ডবরা তোমাদের একশো ভাইকে যাতে শেষ করে না ফেলেন, তাঁর আগেই তোমরা ঝগড়া-বিবাদ মিটিয়ে ফ্যালো পাণ্ডবদের সঙ্গে— তাবৎ সংশাস্য পাণ্ডবৈঃ। আর মহাধীর যুধিষ্ঠিরকে তো তোমরা দেখছ, যতদিনে তিনি না ক্রুদ্ধ হন এবং যুদ্ধশৌণ্ড কৃষ্ণও যতদিনে না প্রচণ্ড রেগে যান, তার মধ্যেই তোমরা ঝগড়া-বিবাদ মিটয়ে ফ্যালো পাণ্ডবদের সঙ্গে— তাবৎ সংশাম্য পাণ্ডবৈঃ। সবচেয়ে বড় কথা— এই বিরাট সেনাবাহিনী পর্য্যুদস্ত করে যতদিনে না ভীম তোমার সমস্ত ভাইগুলিকেই মেরে ফেলেন, তার মধ্যেই তোমরা ঝগড়া-বিবাদ মিটিয়ে ফ্যালো পাণ্ডবদের সঙ্গে— সোদরাংস্তে ন গৃহ্নাতি তাবৎ সংশাম্য পাণ্ডবৈঃ।

দুঃশাসনের প্রতি দ্রোণাচার্যের সম্পূর্ণ প্রত্যুক্তিগুলি এখানে মেলে ধরলাম এই কারণে যে, দ্রোণের কথার মধ্যে দুঃশাসন-চরিত্রের সমস্ত রহস্যগুলিই সূত্রাকারে উল্লিখিত। দুঃশাসন যুদ্ধবীর বলে প্রসিদ্ধি লাভ করা সত্ত্বেও তিনি তেমন বীর নন। অপছন্দের লোকের সঙ্গে কড়া ভাষায় কথা বলেন বটে, কিন্তু ভবিষ্যৎ বোঝেন না একেবারেই। কূট-কৌশলে পাণ্ডব-ভাইদের বিপদে ফেলে মজা দেখেছেন এবং মজা করেছেন, কিন্তু বাস্তব পরিস্থিতি যখন তাঁর কাছ থেকে দায়িত্বপূর্ণ আচরণ আশা করছে, তখন তিনি পালিয়ে যাওয়া শ্রেয় মনে করছেন। দ্রোণাচার্য দুর্যোধনের পক্ষে যুদ্ধ করছেন বলেই আজ তাঁর ভাই দুঃশাসনকে তিনি পূর্বের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে আত্মোপলব্ধির জগতে এনে ফেলেছেন। বুঝিয়ে দিয়েছেন— তোমার যুদ্ধ করবার ক্ষমতা নেই দুঃশাসন, অথচ যুদ্ধ তুমি ডেকে এনেছ। পূর্বে মহামতি ভীষ্মও তোমার ভাইকে একশোবার বলেছেন এই বিবাদ মিটিয়ে নিতে, কিন্তু তোমার ভাই শোনেনি সে-কথা। অতএব তোমাকে যুদ্ধ এখন করতেই হবে। আর তোমার কথাও বলি, দুঃশাসন! ভীম তো প্রতিজ্ঞা করে রেখেছে তোমার রক্ত খাবে বলে— তবাপি শোণিতং ভীমঃ পাস্যতীতি ময়া শ্রুতং— এবং জেনো, ওর কথা মিথ্যে হবে না। সমস্ত অন্যায় কর্ম করার সময় অন্তত এই ভীমের কথা তোমার ভাবা উচিত ছিল এবং এখনও বুঝি তুমি ভীমকে ঠিক চিনে উঠতে পারোনি, তুমি এতটাই মূর্খ কিং ভীমস্য ন জানাসি বিক্রমং ন সুবালিশ— এতটাই মূর্খ— যে, ওই ভীমের সঙ্গে চরম শত্রুতা করার আগে একবারও ভেবে দ্যাখোনি কিছু। অথচ এখন পালিয়ে বাঁচার চেষ্টা করছ— যত্ত্বয়া বৈরমারব্ধং সংযুগে প্রপলায়িনী।

সব তিরস্কার শেষ করে দ্রোণাচার্য অন্তিম মন্তব্য করলেন— আমি এখন কিছু বুঝব না, দুঃশাসন! যুদ্ধ তোমাকে করতেই হবে। যে রথে বসে আছ, ওই রথ নিয়েই তুমি এখনই সাত্যকির কাছে যাবে— কেন না, তুমি যদি এইভাবে পালানোর চেষ্টা করো, তা হলে সমস্ত সেনাবাহিনী উলটো দিকে দৌড়বে। আর ওরা পালালে তুমি বাঁচবে কীভাবে, দুঃশাসন? অতএব নিজের জন্য, নিজের প্রাণের জন্যই সাত্যকির সঙ্গে আজ লড়তে হবে তোমাকে— আত্মার্থং যোধয় রণে সাত্যকিং সত্যবিক্রমম্। দ্রোণের এই সমস্ত তিরস্কার-বাক্য, যা প্রকৃতপক্ষে দুঃশাসনেরই প্রকৃত চরিত্র উদ্‌ঘাটন করে, কিন্তু সেইসব সত্য তিরস্কার দুঃশাসনকে আরও ক্ষুব্ধ করে তুলল। মহাকাব্যের নিরপেক্ষ কবি মন্তব্য করেছেন— দুঃশাসন আচার্যের একটা কথারও উত্তর দিলেন না এবং তাঁর কথা সব শুনেও এমন একটা ভাব করলেন যেন কিছুই শোনেননি— শ্রুতম্ অশ্রুতবৎ কৃত্বা। সৈন্য-সামন্ত ফিরিয়ে সাত্যকির দিকে যেতে তিনি বাধ্য হলেন যুদ্ধনায়ক দ্রোণের তাড়নায়।

দুঃশাসন বাণ-টান ছুঁড়ে অনেক চেষ্টা করলেন সাত্যকির সঙ্গে যুদ্ধ করার। কিন্তু সাত্যকি অজস্র শররাশির আবর্তে এমনভাবেই বিদ্ধ করলেন দুঃশাসনকে যে, মহাভারতের কবি উপমা দিয়ে বললেন— একটা মশা যদি মাকড়শার জালে এসে পড়ে, তখন উর্ণনাভের রস-জাল-তন্তুতে সে যেমন আবদ্ধ হয়, দুঃশাসনও সেইরকম সাত্যকির শরজালে আবদ্ধ হলেন— মশকং সমনুপ্রাপ্তমুর্ণনাভ ইবোৰ্ণয়া। শেষ পর্যন্ত ত্রিগর্তরাজ সুশর্মার অস্ত্র-হস্তক্ষেপে একবার দুঃশাসন মুক্ত হলেও দ্বিতীয়বার তেজ দেখাতেই সাত্যকি তাঁর রথের ঘোড়া, রথের সারথিকে মেরে রথখানিও এমন চলচ্ছক্তিহীন করে দিলেন যে, ত্রিগর্তরাজ তাঁকে মাঝপথে নিজের রথে না তুলে নিলে দুঃশাসনের প্রাণসংশয় ছিল। সাত্যকি অবশ্য ত্রিগর্তরাজকে ধাওয়া করেও সে যাত্রায় দুঃশাসনকে ছেড়ে দিলেন এই ভেবে যে, দুঃশাসন মধ্যম পাণ্ডব ভীমের বধ্যসূচিতে আছেন, তাঁর প্রতিজ্ঞা বিপর্যস্ত না করাই ভাল— ন জঘান মহাবাহুর্ভীমসেন-বচঃ স্মরন।

ভীমসেন। মধ্যম পাণ্ডব ভীমসেন। জয়দ্রথ-বধের আগেই কৌরবসৈন্যদের মধ্যে তরাস উঠে গিয়েছিল ভীমের জন্য। দুঃশাসন একবারমাত্র তখন অস্ত্র-স্পর্শে ছুঁয়ে দেখেছিলেন ভীমকে। তাঁর অস্ত্র খান খান হয়ে গিয়েছিল। নেহাৎ জয়দ্রথ-বধের প্রয়োজন এবং প্রতিজ্ঞা সামনে ছিল বলেই দুঃশাসনের দিকে ভীম নজরই দেননি তখন। তিনি অর্জুনের যাবার পথ সুগম করছিলেন। অন্ধ ধৃতরাষ্ট্র কিন্তু ভয় পাচ্ছিলেন, বারবার স্বগতোক্তি করছিলেন যুদ্ধদ্রষ্টা সঞ্জয়ের কাছে। বলছিলেন— আমি অর্জুনকে অত ভয় পাই না, এমনকী কৃষ্ণকেও নয়, কিন্তু ভীমের থেকে যত ভয় আমার, এমন ভয় আর অন্য কাউকে পাই না— ন মেহর্জুনাদ্ ভয়ং কিঞ্চিৎ…যাদৃগ্ ভীমাদ্ ভয়ং মম। ভয় তো পাবেনই ধৃতরাষ্ট্র, সময় তো এগিয়ে আসছে। সম্পূর্ণ কুরুক্ষেত্র-যুদ্ধের দশ দিন কেটে গেছে ভীষ্মের নায়কত্বে, আর পাঁচদিন আচার্য দ্রোণের অধ্যক্ষতায়। এর মধ্যে ভীম কিছু করেননি। কিন্তু ভীষ্ম-দ্রোণের মতো বনস্পতি-পতনের পর এখন কর্ণের সময় চলছে। তিনি এখন সেনাপতি।

দ্রোণাচার্য যেদিন মারা গেলেন, সেদিন রাতে বিখ্যাত দুষ্ট-চতুষ্টয়ের চোখে ঘুম এল না। কর্ণ, দুঃশাসন, শকুনি— তিনজনেই বাকি রাত দুর্যোধনের শিবিরে থেকে গেলেন। তাঁদের মনে এখন ভয় ধরেছে। চারজনেই এখন সেই পুরানো কথা বলছেন— কপট পাশা, দ্রৌপদীকে অপমান করা, পাণ্ডবদের বনবাস— সব এখন বিপ্রতীপ আত্মবোধে মনে পড়ছে। তাঁদের চারজনের চোখেই আজ ঘুম নেই— দুঃশাসনশ্চ শকুনির্ন নিদ্রামুপলেভিরে। আর ওদিকে ভীম বোধহয় ইচ্ছে করেই কর্ণের নেতৃত্বকাল বেছে নিলেন দুঃশাসনকে শাসন করার জন্য। কেন না, অগ্রজ দুর্যোধনের কথায় বা আদেশে দুঃশাসন যত অসভ্যতা করেছেন, তার বেশি তিনি করেছেন কর্ণের ইচ্ছায়, আদেশে, দুর্যোধনের অভিন্ন হৃদয়তার প্রতি সম্মানবোধে। ধৃতরাষ্ট্র বারবার প্রশ্ন করছিলেন— দাবাগ্নিসমান ভীম যে আমার ছেলেদের পুড়িয়ে মারতে চাইছে, তো সেখানে কে। আমাদের পক্ষে তাদের সুরক্ষার ভার নিয়েছে— ভীম-বহ্নেঃ প্রদীপ্তস্য মম পুত্রান্ দিধক্ষতঃ। সঞ্জয় বলেছেন— কর্ণ সেই ভার নিয়েছেন— কর্ণোহভ্যপদ্ বলী।

হ্যাঁ, কর্ণই নিয়েছেন। সেই দ্রোণের সময় থেকেই কর্ণ চেষ্টা করে যাচ্ছেন দুর্যোধনের ভাইদের বাঁচাতে। আজ দ্রোণের মৃত্যুর পর তাঁরই নেতৃত্ব চলছে যখন, তখনই একদিন কর্ণের সঙ্গে যুদ্ধ লাগল পাণ্ডব-পক্ষীয়দের। কিছু হতাহতিও ঘটল দু’পক্ষে— কর্ণের এক ছেলে প্রসেন মারা গেল সাত্যকির হাতে, তাঁর উত্তরে পাঞ্চাল রাজকুমার ধৃষ্টদ্যুম্নের দুই ছেলেকে মেরে ফেললেন কর্ণ। এবার কৃষ্ণের প্ররোচনায় অর্জুন এগোলেন কর্ণের দিকে। অর্জুন এগোচ্ছেন দেখেই ভীম তাঁর পিছন পিছন এগোলেন যাতে কর্ণের সঙ্গে যুদ্ধে অর্জুন কোনওদিক থেকেই কোনও বিপদে না পড়েন। ওদিকে সাত্যকিও কিন্তু কর্ণকে ছাড়ছেন না। তিনিও কর্ণকে বিব্রত করছেন বাণাঘাতে। কর্ণও অবশ্য একা ছিলেন না। কৃতবর্মা, কৃপাচার্য, দুঃশাসন— এঁরাও চারদিক থেকে সুরক্ষা দিচ্ছিলেন কর্ণকে। দু’ পক্ষের এই পারস্পরিক তুমুল হানাহানির মধ্যে হঠাৎই দুঃশাসন নির্ভয়ে আক্রমণ করলেন ভীমকে— তথাগতে ভীমমভীস্তবাত্মজঃ/সসার রাজাবরজঃ কিরণচ্ছরৈঃ। কর্ণ আশেপাশে ছিলেন বলেই বোধহয় দুঃশাসনের এত দুঃসাহস। অথবা এই সাহস সেই মূর্খজনোচিত মানসিকতায়, যাতে দুর্বল হওয়া সত্ত্বেও প্রবলতর প্রতিপক্ষের ওপর নির্দ্বিধায় ঝাঁপিয়ে পড়ে।

ভীম তো দুঃশাসনকে দেখেই সবেগে ছুটলেন, ঠিক যেভাবে ক্ষুধার্ত সিংহ ছোটে মাংসল মহারুরু মৃগ দেখলে পরে— মহারুরুং সিংহ ইবাভিপেদিবান্। দু’জনের ভয়ংকর যুদ্ধ আরম্ভ হল। ভীম তখনও তাঁর ভয়ংকরী গদা হাতে নেননি। তিনি ধনুক-বাণ নিয়েই যুদ্ধ করছিলেন। আর দুঃশাসন বোধহয় তাঁর উৎসাহ-তেজের তুঙ্গ বিন্দুতে পৌছে মরিয়া হয়ে ভাবছিলেন— এত ভয় কীসের এই লোকটাকে। সারা জীবন শুধু রক্তপানের ভয় দেখিয়ে গেল, এই ভয়টাই ভেঙে দিতে হবে। বৃকোদর ভীম দুঃশাসনের ধনুকের ছিলা কেটে দিয়ে তাঁর সারথির গলা নামিয়ে দিলেন ধড় থেকে। দুঃশাসনও সেই মুহূর্তে ছাড়ার পাত্র নন। তিনি অন্য একটি ধনুক নিয়ে এমন শরবৃষ্টি করলেন ভীমের ওপর যে, তিনি শোণিত-দিগ্ধ ক্ষত-বিক্ষত অবস্থায় রথের মধ্যেই লুটিয়ে পড়লেন জ্ঞান হারিয়ে। তাঁকে দেখে মনে হচ্ছিল যেন মরেই গেছেন তিনি— স তেন নির্বিদ্ধতর্নুবৃকোদরো/নিপাতিতঃ স্রস্ততনুর্গতাসুবৎ। দুই হাত দু’দিকে অবিন্যস্ত ভঙ্গিতে প্রসারিত করে ভীম দুঃশাসনের চরম আঘাত সহ্য করতে লাগলেন রথ-প্রস্থে লুটিয়ে পড়ে।

যোদ্ধা দুঃশাসনের প্রতি এই বুঝি ভীমের চরম সম্মাননা। একটু পরেই ভীমের সংজ্ঞা ফিরে এল। তর্জন-গর্জনে, বাহুস্ফোটনে আবারও ধনুক-বাণ নিয়ে যুদ্ধ করতে আরম্ভ করলেন ভীম। দুঃশাসন তাকে ক্ষিপ্রতার সুযোগ দিলেন না। তাঁর ধনুক-বাণ নিমেষে কেটে ফেলে দিয়ে বেশ কয়েকটি শরের আঘাতে ভীমকে আহত করলেন দুঃশাসন। নিরুপায় ভীম একটি শক্তি ছুঁড়ে মারলেন দুঃশাসনের দিকে এবং সেই শক্তিও দুঃশাসন টুকরো টুকরো করে কেটে ফেললেন। যুদ্ধে আজ দুঃশাসনের বেশ জোশ দেখা যাচ্ছে। ভীমের সঙ্গে লড়াই বলে কথা, নিজের সর্বশক্তি দিয়ে তিনি আজ ভীমকে প্রতিহত করার চেষ্টা করছেন। কিন্তু ভীম এবার সেই ভয়ংকরী গদা নিলেন হাতে। এতক্ষণ দুঃশাসন পরের পর যেভাবে নাকাল করছিলেন ভীমকে, তাতে কৌরব-পক্ষের অনেকেই তাকে প্রশংসায় ভরিয়ে দিচ্ছিলেন। এমনকী ভীমও তাকে বললেন— ওহে বীর! আজকে তুই অনেক বাণে বিধেছিস আমাকে, এবারে তুই আমার এই গদার বাড়ি সহ্য কর দেখি— বিদ্ধোহস্মি বীরাশু ভৃশং ত্বয়াদ্য/সহস্ব ভূয়োহপি গদা-প্রহারম্।

ভীমের ক্রোধ এখন সম্পূর্ণ চেতিয়ে উঠেছে। বিশেষত দুঃশাসনের মতো যোদ্ধা, যাঁকে তিনি কোনওকালে গণনার মধ্যেই আনেননি, সে যখন বাণের আঘাতে তাঁকে রথের ওপর শুইয়েই ফেলল একবার, এবং অন্যরাও তাঁর এই সাহসের প্রশংসা করছে, তখন ভীম বুঝলেন, এবার একক এই দুঃশাসনের শেষ ক্ষমতাটুকু দেখে নেওয়া দরকার। ভীম বললেন— আজকেই এই যুদ্ধক্ষেত্রে আমি, আমি ভীম, তোর রক্তপান করে ছাড়ব, ব্যাটা বদমাশের হাড়!— উবাচ চাদ্যাহম অহং দুরাত্মন/পাস্যামি তে শোণিতমাজিমধ্যে। ভীম তাঁর ভয়ংকরী গদা ছুড়লেন প্রচণ্ড বেগে, শত পাক ঘুরিয়ে। ভীমের কথা শুনেই দুঃশাসন একটি শক্তি-মুষল ছুঁড়ে দিয়েছিলেন তাঁর দিকে। কিন্তু সে শক্তি গদায় লেগে ছিটকে গেল কোথায়, আর সেই বেগবতী গদা সোজা এসে লাগল দুঃশাসনের মাথায়— পুত্রং তবাজো তাড়য়ামাস মূর্ধ্নি। ভীমের নিজস্ব শক্তির বেগ গদায় সঞ্চারিত হওয়ায় গদার আঘাতে দুঃশাসন দশ হাত দূরে গিয়ে পড়লেন। তাঁর ঘোড়া মরল, রথ ভাঙল, আর তাঁর বুকে আঁটা বর্ম খসে পড়ল। পরিধানের বেশ-বাস বিস্রস্ত, গলায়-পরা সোনার মালা খুলে পড়ে গেছে— দুঃশাসন কাঁপতে কাঁপতে যন্ত্রণায় কাতর হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন— তয়া হতঃ পতিতো বেপমানঃ/দুঃশাসনো গদয়া বেগবত্যা।

এক মুহূর্তের মধ্যেই ভীমের মনের মধ্যে শুরু হল অতীতের আলোড়ন। দ্রৌপদীর চুলের মুঠি ধরে নিয়ে এসেছিল এই পাপিষ্ঠ, তাঁকে বিনা কারণে ‘গোরু-গোরু’ বলে উপহাস করেছিল এই দুঃশাসন। ভীমের অন্তরবহ্নি জ্বলে উঠল, যজ্ঞের আগুনে ঘি পড়ার মতো— জজ্বাল কোপাদথ ভীমসেন/আজ্য-প্রসিক্তো হি যথা হুতাশঃ। সমস্ত শরীর প্রসারিত করে ভীম চেঁচিয়ে বললেন— কৃপ-কর্ণ, অশ্বত্থামা কৃতবর্মা এবং অবশ্যই দুর্যোধনের উদ্দেশে। বললেন— মুরোদ থাকে তো আয় সবাই মিলে, এই আমি দুঃশাসনকে মারতে যাচ্ছি, আট্‌কা দেখি, কার কত মুরোদ। ভীম ওঁদের চোখের সামনেই নামলেন রথ থেকে। বেগে ধেয়ে গেলেন দুঃশাসনের দিকে।

দুঃশাসন তখনও জীবিত, যন্ত্রণায় ছটফট করছেন, জ্ঞান নেই বললেই চলে। সেই অবস্থায়। ভীম তাঁর গলার ওপর পা রেখে কণ্ঠনালি ভেঙে দিলেন, হাতে নিলেন সুধার তরবারি, দুঃশাসনের দেহ তখনও কাঁপছে, তখনও তাঁর জীবন যায়নি— অসিং সমুদগৃহ্য শিতং সুধারং/কণ্ঠে পদাক্রম্য চ বেপমানম্। ভীমের মুখে আবারও আরম্ভ হল সেই নির্মম শব্দ-শ্লাঘা। বস্তুত দুঃশাসনকে এইভাবেই তারিয়ে তারিয়ে মারতে চেয়েছেন ভীম, কাউকে কাউকে এইভাবেই তারিয়ে তারিয়ে মারতে হয়। যেদিন রজস্বলা দ্রৌপদীকে রাজসভায় এনে ফেলেছিলেন দুঃশাসন, সেদিন তিনিও তো তারিয়ে তারিয়েই অসভ্যতা করেছিলেন। সত্য এবং পণের শর্তে ভীমকে সেদিন মুখ বূজে সব সহ্য করতে হয়েছিল। সেইসব জমে-থাকা কথা আজ সব বেরিয়ে আসছে ভীমের মুখে, প্রতিশোধের আগুনে তপ্ত হয়ে।

দুঃশাসনের গলায় পা রেখে ভীম বললেন— এই কণ্ঠনালির স্বরেই তুই না আমাকে ‘গোরু গোরু’ বলে উপহাস করেছিলি, আর তোর দাদা দুর্যোধন, বন্ধু কর্ণ তাতে তাল মিলিয়েছিল— উবাচ তদ্‌গৌরিতি যদ্‌ ব্রূবাণো/ হৃষ্টো বদেঃ কর্ণ-সুযোধনাভ্যাং— নে, এবার সেই গলা দিয়ে শব্দ বার কর, দেখি। পা দিয়ে গলার নলি চেপে ধরার তাৎপর্য বুঝি এইখানেই। ভীমের কথায় এবার দুই প্রস্থ হাতের কার্যকারিতা ফুটে উঠল। তিনি বললেন— এবার বল তো, কোথায় সেই হাতটা, যে হাত দিয়ে তুই রাজসূয়ের অভিষেকার্দশির দ্রৌপদীর মাথার চুল ছুঁয়েছিলি, বল সেটা কোন হাত, আমি ভীম— ভীম জিজ্ঞেস করছে— বল সেটা কোন হাত— তে পাণিনা কতরেণাবকৃষ্টা/স্তদ্‌ব্রূহি ত্বাং পৃচ্ছতি ভীমসেনঃ? ভাল করে উত্তর মেলে না, দুঃশাসনের গলার স্বর স্তব্ধ হয়ে আসছে। তাঁর নিথর চোখ শুধু অনিমিষে চেয়ে আছে ভীমের দিকে— দুঃশাসনো ভীমসেনং নিরীক্ষ্য।

দুঃশাসন তো দুর্যোধনেরই ভাই। শক্তি চলে যায়, তবু কথা যায় না। নিথর চোখ তখনও বিস্ফারিত হয়ে এদিক ওদিক ঘুরছে, গলার স্বর অস্ফুট, তবু ভীমের দিকে তাকিয়ে সরোষে দুঃশাসন বললেন— এই সেই হস্তিশুণ্ডের মতো হাত— যে হাত একদিকে রমণীর স্তন-মর্দনের সুখ অনুভব করেছে— অয়ং করিকরাকারঃ পীনস্তন-বিমর্দনঃ— অন্যদিকে সেই হাতই শত্রু ক্ষত্রিয়-গোষ্ঠীর অন্তকাল ঘনিয়ে এনেছে কতবার, আবার এই হাতই ব্রাহ্মণদের উদ্দেশে গোদান করেছে অজস্র। দুঃশাসন স্বীকার করে বললেন— হ্যাঁ, এই সেই হাত, যে হাতে যাজ্ঞসেনী দ্রৌপদীর কেশ আকর্ষণ করেছি আমি— অনেন যাজ্ঞসেন্যা মে ভীমকেশা বিকর্ষিতাঃ— হ্যাঁ, এই হাতেই করেছি এবং তা সবার সামনেই করেছি, সমস্ত কুরুমুখ্যদের সামনে এবং তোমাদেরও চোখের সামনে— পশ্যতাং কুরুমুখ্যানাং যুস্মাকঞ্চ সভাসদাম্।

দুঃশাসনের মুখে এই মুহূর্তে উচ্চারিত এই মরণান্তিক শব্দগুলি নিয়ে রসিক-ভাবুকদের মধ্যে কিছু প্রশ্ন উঠেছে। প্রশ্ন উঠেছে— ভীমের হাতে প্রায় মরণাপন্ন অবস্থায় এই ধরনের গর্বোক্তি দুঃশাসনের মুখ দিয়ে বেরোতে পারে কিনা! যে-কারণে মহাভারতের গৌড়ীয় তথা পূর্ব-ভারতীয় পাঠগুলিতে এই শ্লোকগুলির উচ্চারণ নেই। সেখানে ভীমের সাহংকার আস্ফালনের সঙ্গে সঙ্গেই দুঃশাসনের রক্তপান-অংশ আরম্ভ হয়ে গেছে। কিন্তু মহাভারতের যে পশ্চিমি পাণ্ডুলিপিগুলি আছে, যার প্রাপ্তিস্থল প্রাচ্যবিদ্যার অন্যতম বিদ্যাস্থান মহারাষ্ট্র-মুম্বই, সেই মুম্বই থেকে প্রকাশিত পুস্তকগুলিতে ভীমের প্রত্যুক্তিতে দুঃশাসনের উপরি-উদ্ধৃত গর্বোক্তিগুলিও মূল্যবান সংযোজন। গৌড়ীয় পাঠে এই গর্বোক্তি নেই। আমাদের মনে হয়, দুঃশাসনের সার্বিক চরিত্রের নিরিখে দুঃশাসনের এই মরণোন্মুখ গর্বোচ্চারণগুলি বিবেচিত হওয়া উচিত।

আমাদের মনে হয়, দুই পক্ষেই কিছু যুক্তি আছে। মনে রাখা দরকার যে, দুঃশাসন কিন্তু মহারথ, অতিরথ যোদ্ধার মতো বড় মাপের যোদ্ধা নন। মহাভারতে সাধারণভাবেই বীর যোদ্ধাদের অন্তত তিন প্রকারের শ্রেণি নির্দেশ করা হয়েছে এবং সেটা যোদ্ধাদের ব্যক্তিগত শক্তি, অস্ত্র-নৈপুণ্য এবং সেনাবাহিনী-পরিচালনার ক্ষমতা অনুসারে। এঁরা হলেন অতিরথ, মহারথ এবং রথ। ‘রথ’ অবশ্যই সবচেয়ে ছোট ‘ইউনিট’ যার অভিধেয় অর্থকে অতিক্রম করেই যেমন তার নিজস্ব সংজ্ঞা গড়ে উঠেছে, তেমনই তার উত্তরোত্তর সমৃদ্ধিতে মহারথ এবং অতিরথের সংজ্ঞা তৈরি হয়েছে। ভগবদ্‌গীতার একটি অপ্রচলিত অথচ গুরুত্বপূর্ণ টীকার মধ্যে রথ বা রথীর প্রাচীন একটি সংজ্ঞা উদ্ধার করে বলা হয়েছে— রথ বা রথী হলেন তিনি, যিনি আপন শক্তিতে অন্য একজন বড় যোদ্ধার সঙ্গে একক যুদ্ধ করতে পারেন, অর্থাৎ তিনি ‘ওয়ান-টু-ওয়ান’ যুদ্ধ করেন— রথী ত্বেকেন যে যুধ্যেৎ। আর অস্ত্র-শস্ত্রে প্রবীণ ‘মহারথ’ যোদ্ধা একা দশ হাজার ধনুকধারী যোদ্ধার সঙ্গে যুদ্ধ করতে পারেন। অতিরথ মহাবীরের ক্ষেত্রে শত্ৰুযোদ্ধার সংখ্যা পরিমিত থাকে না। অপরিমিত যোদ্ধার সঙ্গে তিনি একাই যুদ্ধ করতে পারেন— অমিতান্ যোধয়েদ্ যস্তু সম্প্রোক্তোহতিরথস্তু সঃ।

মহাভারতে যুদ্ধের ঠিক আগেই দুর্যোধন স্বপক্ষের বলাবল নিয়ে ভীষ্মের কাছে প্রশ্ন তুললে তিনি কৌরবপক্ষ এবং পাণ্ডব-পক্ষের মহাবীর যোদ্ধাদের মধ্যে কে কে মহারথ, কে কে অতিরথ যোদ্ধা এবং কারাই বা রথ অথবা রথী, সে-ব্যাপারে নিপুণ বিশ্লেষণ করেছিলেন সমস্ত যোদ্ধাদের ব্যক্তিগত গুণ-দোষ মাথায় রেখে। কৌরবপক্ষের রথ-অতিরথ সংখ্যা করতে গিয়ে প্রথমেই ভীষ্ম বলেছিলেন— দুর্যোধন! তুমি এবং তোমার ভাইরা সব রথ-যোদ্ধা অর্থাৎ তোমার সব একা একজনের সঙ্গে লড়তে পারো, তাঁর বেশি নও। তবে হ্যাঁ, একজনের সঙ্গে হলেও তোমাদের অন্যান্য যুদ্ধ-গুণ বেশি থাকায় তোমাদের ওপর রথ-যোদ্ধার থেকেও আরও খানিক অধিক বিশেষত্ব আছে বলেই তোমাদের আমি ‘উদার রথ’ বলে সংজ্ঞিত পারি— ভবানগ্রে রথোদারঃ… দুঃশাসন-প্রভৃতিভিঃ ভ্রাতৃভিঃ শতসম্মিতৈঃ।

এই যে ‘রথে’র সংজ্ঞার মধ্যেই একটু বিস্তার ঘটিয়ে একজন যোদ্ধাকে উদার রথ বলে চিহ্নিত করা এইখানেই দুর্যোধন-দুঃশাসনের কিছু আধিক্য নির্ণয় করা যায়। সত্যিই তো দুঃশাসনকে যুদ্ধে তেমন দৃঢ়-কঠিন দেখিনি তেমন। বারবার তিনি পাণ্ডবপক্ষের বড় বড় যোদ্ধাদের কাছে হার স্বীকার করেছেন, পালিয়েছেন অনেকবার। কিন্তু তাই বলে খুব যে তাঁকে বিচলিত দেখেছি, তা নয়। বিশেষত আজন্ম-লালিত যে স্বভাব, বিশেষত বিপন্ন কালেও সাহংকার বক্তব্য রাখার যে অভ্যাস, সে অভ্যাস অগ্রজ দুর্যোধনের মধ্যেও আমরা যথেষ্ট দেখেছি এবং দুঃশাসনের মধ্যেও তা থাকা স্বাভাবিক। মহাভারতে যেখানে যেখানে এই সাহংকার প্রত্যুক্তি উচ্চারিত হয়েছে, তার সবটাতেই সম্পূর্ণ জুড়ে আছেন দুর্যোধন। মাঝে মাঝে দুর্যোধনের পাশাপাশি কর্ণেরও আক্ষেপ-আটোপ দেখতে পাই বটে, কিন্তু এঁদের পাশে দুঃশাসন প্রায়ই কথা বলেন না, তিনি ঢাকা পড়ে যান। কিন্তু এই গর্বোক্তির সঙ্গে তিনি চির-পরিচিত, অন্যান্যদের সাহংকার গর্বোক্তির তিনি সর্বত্র সাক্ষী এবং কতটা নির্ভয়ে তিনি দ্রৌপদীর বস্ত্র আকর্ষণ করেছিলেন, কতটা নির্ভয়ে তিনি ভীমের মতো ভয়ংকর মানুষকে গোরু গোরু বলে ডেকেছিলেন, সে-কথা আমাদের মনে আছে।

এই নিরিখে যদি ভাবি, তা হলে মুম্বই থেকে প্রকাশিত মহাভারতীয় সংস্করণের ওই অতিরিক্ত শ্লোকগুলি আমাদের কাছে পরবর্তী কোনও সংযোজন নয় বলেই আমাদের মনে হয়। বিশেষত এই সময়ে দুঃশাসনের মরণ-কাল উপস্থিত। তিনি বুঝে গেছেন, আর কোনও বাঁচার রাস্তা নেই তাঁর, কিছু পাবারও নেই, কিছু হারাবারও নেই। অতএব শত্রুপক্ষের মৌখিক আস্ফালন শুনেও দুর্যোধনের ভাবশিষ্য দুঃশাসন হাঁস-মুরগির মতো চিঁহি-চিঁহি করতে করতে বটিতে গলা দেবেন, এমন ত্রস্ত দুঃশাসন নন। সমরশ্লাঘী ভীম তাঁর গলায় পাড়া দিয়ে জিজ্ঞাসা করেছিলেন— তোর কোনটা সেই হাত, যে হাত যজ্ঞজলসিক্ত দ্রৌপদীর কেশ আকর্ষণ। করেছিল? তাঁর উত্তরে দুঃশাসনের ওই আস্ফালন, বিশেষত যজ্ঞ-স্নিগ্ধ পবিত্রতার উত্তরে ওই রমণী-শরীর-ভেদী পৌরুষেয় বাহুপেশির উচ্চারণ বিপ্রতীপভাবে দুঃশাসনের চরিত্রটাকে এক মুহূর্তে মহাকাব্যিক তীক্ষ্ণতায় আবিষ্ট করে।

দুঃশাসন ভীমের কথার উত্তরে সাস্ফালনে বলেছিলেন— হ্যাঁ, এই সেই হাত, হস্তিশুণ্ডের মতো এই মসৃণ হাতেই আমি শত-সহস্র ব্রাহ্মণকে গোদান করেছি, এই হাতেই আমি শত্রু ক্ষত্রিয়দের হত্যা করেছি, আর এই হাতেই আমি প্রিয়তমা রমণীদের পীন-স্তন মর্দন করেছি— অয়ং করিকরাকারঃ পীনস্তন-বিমর্দনঃ— অর্থাৎ কিনা, ধর্ম, অর্থ, কামের সম্যক সাধন করেছি আমি। ব্রাহ্মণদের দান-ধ্যান করে অলৌকিক পুণ্যের মাধ্যমে ‘ধর্মে’র উপাসনা করেছি। শত্রু ক্ষত্রিয়দের ধ্বংস করে রাজ্য-সমৃদ্ধির ‘অর্থ’ ভোগ করেছি এবং একাধিক সুন্দরী যুবতীর শরীর উপভোগ করে ‘কামে’রও পরিতৃপ্তি ঘটিয়েছি। একজন সফল মানুষ যে জীবনকে উপভোগ করতে চায়, তার কাছে এই দুঃশাসনী পরিতৃপ্তিই তো সবচেয়ে কাম্য। মরে যাবার কালে চিরন্তন শত্রুকে এই পরিতৃপ্তির কথা জানানোর মধ্যে এক অপরিমিত সুখ আছে, দুঃশাসন সেই সুখ পাচ্ছেন মরণান্তিক আস্ফালন করে— এবং এই আস্ফালন-সুখও তাঁর অগ্রজ দুর্যোধনেরও মনের কথা। মরণের সময় তিনিও যুধিষ্ঠিরকে নিজের পরিপূর্ণ তৃপ্তিসুখের কথা সোচ্চারে বলেছেন।

দুঃশাসনের এই প্রত্যুক্তির মধ্যে অবশ্য রস-শাস্ত্রের কিছু উচ্ছ্বাসও আছে, যা আলংকারিক রসশাস্ত্রকারদের চোখে ধরা পড়েছে। আমার আশ্চর্য লাগে, মহাকাব্যের কবি কী অদ্ভুত নিপুণতায় প্রতিনায়কের আত্মলাভ ঘটান, মৃত্যুর ঘোরতম বিপদের সামনে প্রতিনায়ককে দাড় করিয়ে দিয়েও তিনি কীভাবে তাঁকে বিপ্রতীপভাবে উজ্জ্বল করে তোলেন। ভীম তো তাঁর এতদিনের সঞ্চিত ক্রোধ উদ্‌গীর্ণ করে সরোষে বলেছিলেন— কোথায় তোর সেই হাত, যে। হাতে তুই যজ্ঞস্নাতা দ্রৌপদীর পবিত্র কেশ আকর্ষণ করেছিলি— যে রাজসূয়াবসথে পবিত্রা/জাতা কচা যাজ্ঞসেন্যা দুরাত্মন্। এর উত্তরে যদি কেউ সাহংকারে রমণীর স্তন-স্পর্শ-তপ্ত হাতের গৌরব করে, তা হলে সেটা একভাবে পঞ্চস্বামীগর্বিতা দ্রৌপদীর কেশাকর্ষণ বা বস্ত্রাকর্ষণের ঘটনাটাকেও অতি সাহসিক লাম্পট্যের ভূমিকায় উত্তরণ করে। বিশেষত দুঃশাসন যখন ভীমকে বলেন— আমি তো কুরুকুলের প্রধান পুরুষ এবং সভায় বসে থাকা তোদের সামনেই এই হাত দিয়েই যাজ্ঞসেনী দ্রৌপদীর কেশ আকর্ষণ করেছি— পশ্যতাং কুরুমুখ্যানাং যুম্মাকঞ্চ সভাসদাম্— তখন বুঝতে পারি দুঃশাসনের এই লাম্পট্য-শব্দের মধ্যে একদিকে ভীম এবং অন্যান্য পাণ্ডবদের বীরত্ব লঙ্ঘন করার অনাদরটুকুও যেমন আছে, ঠিক তেমনই আছে নিজের সাহংকার আত্মঘোষণা। মরণের সামনে দাঁড়িয়েও এই আত্মখ্যাপন মহাকাব্যিক প্রতিনায়কের তামসিক ঔজ্জ্বল্য সূচনা করে।

দুঃশাসনের যে গর্বোক্তি— রমণীর শরীরমর্দী এই সেই হাত— অয়ং করিকরাকারঃ পীনস্তন-বিমর্দনঃ— এইখানে রসশাস্ত্রকারদের টিপ্পনীটা অন্যরকম। বস্তুত মহাভারতের স্ত্রীপর্বে জননী গান্ধারী এবং অন্যান্য বিধবা যুবতীরা যখন কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধভূমিতে দাঁড়িয়ে অস্ত্রকর্তিত বীরদের শব নিরীক্ষণ করছিলেন, তখন কৌরবপক্ষীয় ভূরিশ্রবার দেহচ্ছিন্ন অস্ত্রকর্তিত হাতখানি দেখে তাঁর স্ত্রী সকলের সামনে মন্তব্য করেছিলেন— এই সেই হাত, যা নাকি একদিন যুবতী রমণীর কটি-মেখলা বিস্রস্ত করে তার জংঘা এবং উরুদেশ স্পর্শ করত এবং এই সেই হাত যা একদিন অশেষ রমণীকুলের পীনস্তন মর্দন করত, আজ সেই হাতখানি দেহ থেকে ছিন্ন হয়ে ভূমিতে লুণ্ঠিত হচ্ছে— অয়ং স রশনোৎকর্ষী পীনস্তন-বিমর্দনঃ।

এই মহাভারতীয় শ্লোক দেখে আলংকারিকেরা নানান প্রশ্নে মন্তব্য করেছেন যে, এ তো এক অদ্ভুত বিপরীত কথা। বীর ভূরিশ্রবার স্ত্রীরা স্বামীর ছিন্নভিন্ন দেহ দেখে করুণ বিলাপ করছেন। সেই শোকদিগ্ধকরুণ বিলাপের মধ্যে পূর্বানুভূত এই শৃঙ্গার-সরস উচ্ছ্বাস তো একেবারে বেমানান। প্রধান রস তো এখানে করুণ রস, সেখানে কী এমন শৃঙ্গারের নর্মরহস্য অনধিকার প্রবেশ করতে পারে। পণ্ডিত রসশাস্ত্রকার বুঝিয়ে দিয়েছেন— এটা মহাভারত মহাকাব্য। এখানে বিশালবুদ্ধি ব্যাস সদ্য বিধবার মুখে এই যে পূর্বানুভূত শৃঙ্গারের স্মরণ ঘটাচ্ছেন, তাতে ওই করুণ রসেরই পরিপোষণা হচ্ছে, অর্থাৎ কিনা কারুণ্যের তীব্রতা এই শৃঙ্গারোক্তিতে আরও তীব্রতর হচ্ছে। যে হাতখানি এককালে যুবতী স্ত্রীর উদ্ভিন্ন যৌবন অন্বেষণে ব্যস্ত ছিল, সেই হাত এখন শাণিত তরবারির আঘাতে কর্তিত হয়ে দেহচ্ছিন্ন হয়ে নিস্পন্দ হয়ে আছে— এই পূর্বানুভব-স্মরণ যুবতী-হৃদয়ের কারুণ্য তীব্রতর করেছে।

আমরা অপ্রসঙ্গে এই মহাকাব্যিক শ্লোক উদ্ধার করলাম এই কারণে যে, মহাকাব্যের কবির এমন লেখার অভ্যাস আছে। অথচ দুঃশাসনের এই গর্বোক্তির মধ্যে রসের সংস্থান একেবারেই আলাদা। বিশেষত ভীমের সাহংকার কথার প্রত্যুত্তরে দুঃশাসন মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়েও যে আস্ফালন করছেন, সেটা অবশ্যই বীর-রসের পরিসর। পুনশ্চ সেই আস্ফালনের মধ্যে দুঃশাসনের ওই সামান্য শৃঙ্গার-ভাষ্য তাঁর অন্তর্জাত বীররসেরই পরিপোষণ করে এবং সঙ্গে সঙ্গে ভীমের প্রতি এবং দ্রৌপদীর প্রতিও এমন এক তাচ্ছিল্য ঘোষণা করে, যেটা মুহূর্তের মধ্যে প্রতিনায়ক-চরিত্রের মৌখিকতা বা মুখ সর্বস্বতাই বেশি সপ্রমাণ করে তোলে— কেন না দুঃশাসন তখন মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়ে আছেন, তাঁর কোনও প্রতিরোধ-শক্তি নেই, তাঁর কণ্ঠনালি ভীমের পদস্পৃষ্ট। বীররসের অবতারণার মধ্যে মৌখিকতা-সর্বস্ব এই রসাভাস তৈরি করে বিশালবুদ্ধি মহাভারতের কবি বুঝিয়ে দিলেন— মৌখিকতার ক্ষেত্রেই দুঃশাসন বীরোচিতভাবে উজ্জ্বল হয়ে ওঠেন, কিন্তু যে মুহূর্তে নিজের হাতখানি সম্বন্ধে তাঁর গর্বোক্তি শেষ হয়, সেই মুহূর্তেই ভীম তাঁর ভীমপদ ন্যস্ত করেন দুঃশাসনের বুকের ওপর এবং নিজের দুই হাতে দুঃশাসনের সেই গর্বমুখর হাতখানি চেপে ধরে কৌরবপক্ষের উদ্দেশে বলেন— দেখুন, দেখুন, কী করছি, কারও ক্ষমতা থাকে তো রুখুন আমাকে, দুঃশাসনের ওই হাতখানি আমি ছিঁড়ে নেব, কোনও বাপের ব্যাটা থাকে তো বাঁচাক এই দুঃশাসনকে— উবাচ যস্যাস্তি বলং স রক্ষতু। অসৌ ভবেদদ্য নিরস্তবাহুঃ। যেমন বলা, তেমনই কাজ। ভীম অমানুষী শারীরিক শক্তিতে দুঃশাসনের বুকে পা রেখে তাঁর হাতখানি ছিঁড়ে নিলেন ধড় থেকে— এবং ক্রুদ্ধো ভীমসেনঃ করেণ/উৎপাটয়ামাস ভুজং মহাত্মা।

ভীমের প্রতিজ্ঞাপূরণ হয়নি তখনও। দুঃশাসনের দেহে তখনও প্রাণ আছে। এই অবস্থাতেই ভীম এবার শাণিত তরবারি দিয়ে তাঁর বুক কেটে রক্ত বার করলেন এবং অঞ্জলিতে ধারণ করে সেই কবোষ্ণ রক্ত পান করলেন— উৎকৃত্য বক্ষঃ পতিতস্য ভূমৌ/অথাপিবৎ শোণিতমস্য কোঞ্চম্। তারপর এক কোপে দুঃশাসনের মাথাটা আলাদা করে দিলেন ধড় থেকে। দুঃশাসনের মৃত্যু হল এবং বুঝি ভীমের হাত থেকে তাঁর মুক্তিও হল— ততো নিপাত্যাস্য শিরোইপকৃত্য/ তেনাসিনা তব পুত্রস্য রাজন্।

দুঃশাসনের মৃত্যুটা ঠিক বীরোচিত হল না। তাঁর অগ্রজ দুর্যোধন, যাঁর কথায় তিনি— ধরে আনতে বললে বেঁধে আনতেন— সেই অগ্রজের মৃত্যুর মধ্যেও এক বিরাট মহিমা ছিল। সেখানে প্রতিপক্ষে ভীম থাকলেও দুর্যোধনের গদাযুদ্ধ-গৌরবে তিনি ম্লান, এমনকী মৃত্যুর পরেও ভীম তাঁকে অপমান করায় স্বয়ং যুধিষ্ঠিরের মুখে নিন্দিত হয়েছেন ভীম। কিন্তু দুঃশাসনের ক্ষেত্রে চিত্রটা একেবারেই অন্যরকম। শুধুমাত্র যুদ্ধক্ষমতাই নয়, দুঃশাসনের ব্যক্তিত্বটাই এমন নিম্নমানের যাতে মহাকাব্যের কবি তাঁকে গরিমা দিতে গিয়েও লাঞ্ছিত বোধ করেন। নইলে মৃত্যুকালে প্রত্যেক ক্ষত্রিয়-বীর যে গরিমা লাভ করেন, তা থেকে সম্পূর্ণ বঞ্চিত এই দুঃশাসন। হয়তো সারাজীবন দুর্যোধন-কর্ণের ঈপ্সিত পালন করতে গিয়ে যে হীন আচরণগুলি তিনি করেছেন, তারই ফল তিনি পেয়েছেন মহাকবির লেখনী-ব্যঞ্জনায়।

একে তো গদার আঘাতে ভূপাতিত করে তাঁর কণ্ঠনালিতে পা রেখে বুক চিরে রক্তপান করছেন ভীম এবং সেখানেও কী পরিমাণ তাচ্ছিল্য! এতকালের সঞ্চিত প্রতিহিংসার আগুনে তপ্ত-হওয়া কবোঞ্চ রক্ত অঞ্জলিতে ধারণ করে একবার ভীম তাকে ঠোঁটে ছোয়াচ্ছেন— আস্বাদ্য চাস্বাদ্য চ বীক্ষমাণঃ— আর চারদিকে তাকিয়ে বলছেন— আঃ! কী স্বাদ এই রক্তের। প্রথমজন্মা শিশুর কাছে মায়ের দুধের যে স্বাদ, ঘৃত কিংবা মধুর যে স্বাদ অথবা অমৃতের যে স্বাদ, সেই সব স্বাদকে হার মানায় এই শত্রুর রক্তপান— সর্বেভ্য এবাভ্যধিকো রসোহয়ং/মতো মমাদ্যাহিতলোহিতস্য।

এ কেমন মৃত্যু! যার কবোঞ্চ শোণিতে অঞ্জলি পূরণ করে ভীম বলছেন— তুই এখন শুধু মরে গিয়েছিস বলেই বেঁচে গিয়েছিস— মৃত্যুনা রক্ষিতেহসি— ভাবটা এই, নইলে আরও কত অপমান ছিল তোর কপালে। অপমান তো বটেই এবং সে অপমান এমনই যে, ভীম একবার করে রক্তাস্বাদের তারিফ করেন আর নেচে নেচে সবাইকে শুনিয়ে বলেন— এই তোর গলা কেটে, বুক কেটে রক্ত খাচ্ছি, এবার আমাকে সেই পুরনো গলায় একবার ‘গোরু গোরু’ বলে ডাক দেখি— ব্রূহীদানীং সুসংহৃষ্টঃ পুনর্গেীরিতি গৌরিতি। ভীম একটা একটা করে পুরাতন ষড়যন্ত্রগুলি স্মরণ করিয়ে দিলেন রণভূমির বীক্ষমাণ মানুষদের— সেইসব অপমান, যেগুলির সঙ্গে দুঃশাসন আপাদমস্তক জড়িয়ে ছিলেন। ভীম বললেন— যারা আমাদের দিকে তাকিয়ে যজ্ঞপশুর উপমায় বলেছিলি— আমরা সব বলির পশু গোরু-ছাগল— আমি তাদের উদ্দেশে এই উলটো নেচে বলছি— যজ্ঞের বলি গোরু-ছাগল আসলে তোরাই— তান্ বয়ং প্রতিনৃত্যামঃ পুনগৌরিতি গৌরিতি।

দুঃশাসনের এই নৃশংস অপমানিত মৃত্যুর জন্য ভবিষ্যতে পরম ধৈর্যশীলা গান্ধারীর পর্যন্ত ধৈর্যের বাঁধ ভাঙবে। কুরুক্ষেত্রের শবশায়িত রণভূমিতে দাঁড়িয়ে গান্ধারী যখন দুঃশাসন ইত্যাদি শত পুত্রের ক্ষত-বিক্ষত বিকৃত শরীরগুলি দেখছেন, তখনই যে তাঁর ধৈর্যের বাঁধ ভেঙেছে, তা নয়। তার আগে পাণ্ডব-ভাইরা কৃষ্ণের সঙ্গে হস্তিনাপুরে প্রবেশ করে যখন ধৃতরাষ্ট্র-গান্ধারীর সঙ্গে দেখা করতে এলেন, তখনই তাঁর মনের মধ্যে মাতৃত্বের স্নেহযুক্তি কাজ করছে দুঃশাসন-দুর্যোধনের অনুকূলে। অথচ বারবার তিনি একথা বলছেন, এমনকী স্বীকারও করছেন মনে মনে, অবশেষে মহর্ষি শ্বশুর বেদ-ব্যাসের কাছে তাঁর অকপট স্বীকারোক্তি— আমার সব গেল, মাত্র চারটে লোকের জন্য আজ আমাদের এই কৌরব-বংশ ধ্বংস হয়ে গেল— দুর্যোধন-শকুনির অন্যায় অপরাধ আর কর্ণ-দুঃশাসনের উস্কানির জন্য এই সমস্ত কুরুকুল একেবারে শেষ হয়ে গেল— কর্ণ-দুঃশাসনাভ্যাঞ্চ বৃত্তোহয়ং কুরুসংক্ষয়ঃ।

একই সঙ্গে গান্ধারীর মনে সেই দ্বৈরথ কাজ করছে, যেখানে স্নেহ আর প্রশ্রয়ের রথ তাঁর ধর্মযুক্তিকে অন্যত্র বহন করে নিয়ে যায়। একদিকে তিনি বলছেন— না, না, অর্জুন-ভীমের কোনও দোষ নেই, দোষ নেই যুধিষ্ঠির কিম্বা নকুল-সহদেবের, কৌরবরা নিজেদের অভিমান-অহংকারেই নিজেরা মরেছে। ঠিক এই মুহূর্তেই কিন্তু তিনি বলে ওঠেন— কিন্তু ভীম এটা কী করল! আমার দুর্যোধনকে গদাযুদ্ধে আহ্বান করে তাকে অন্যায়ভাবে ঊরুতে মারল, এবং তাও কৃষ্ণেরই সামনে— কিংনু কর্মাকরোদ্ ভীমো বাসুদেবস্য পশ্যতঃ। এটা কি ধর্ম হল?

জননী গান্ধারীর এই প্রশ্ন শুধু দুর্যোধনের সম্বন্ধে ছিল না, প্রশ্ন ছিল দুঃশাসনের সম্বন্ধেও। গান্ধারীর কথার উত্তরে ভীম তাঁর যুক্তি দিয়েছেন, গদাযুদ্ধে দুর্যোধনের শ্রেষ্ঠত্বের কথা স্বীকার করে নিয়েও যখন তাঁর অন্যায়গুলি এবং তাঁর নিজের প্রতিজ্ঞার কথা স্মরণ করিয়ে দেন, সঙ্গে সঙ্গে গান্ধারী অন্য পথ ধরেন। তিনি বললেন— এটা না হয় বুঝলাম, তুমি আমার ছেলের যুদ্ধশ্রেষ্ঠত্ব স্বীকার করে নিয়েছ, ভীম! কিন্তু এটা কী হল— তুমি অসভ্য বর্বর মানুষের মতো আমার ছেলে দুঃশাসনের শরীর থেকে রক্ত পান করলে— অপিবঃ শোণিতং সংখ্যে দুঃশাসন-শরীরজম। ভীম যুক্তি দেখিয়ে বলেছেন— দুঃশাসনের রক্ত তিনি পান করেননি কখনওই, সে-রক্ত তাঁর দন্ত এবং ওষ্ঠের সীমা অতিক্রম করেনি। কিন্তু সেই পাশাখেলার আসর, সেই অপমান, দ্রৌপদীর চুল ধরে দুঃশাসনের টানাটানি এবং অবশেষে তাঁর প্রতিজ্ঞা— ভীম একটা একটা করে চিত্র তুলে ধরেছেন গান্ধারীর সামনে। তারপর শেষে একটা দামি কথা বলেছেন, যা অন্তত গান্ধারীর সামনে কেউ বলতে পারেনি। ভীম বলেছেন— যা কিছুই বলে থাকি না কেন, তুমি এইভাবে আমাদের বলতে পারো না। তুমি তোমার এই দুঃশাসন-ছেলেকে ভদ্র শাসনের মধ্যে ধরে রাখতে পারোনি কোনওদিন। আমরা কোনও ক্ষতি করিনি তাদের, অথচ এত যে অন্যায় করা হল আমাদের ওপর, কই তখন তো আটকাতে পারোনি ছেলেকে— অনিগৃহ্য পুরা পুত্ৰা অস্মস্বনপরাধিষু— কিন্তু এখন তুমি আমাদেরই দুষ্ছ। এটা কেমন কথা!

হয়তো বা গান্ধারীও মনে মনে জানেন এ-কথা। কোন ভাবনায়, অথবা শিশুকালের কোন কোন অন্যায় অসভ্যতাকে শৈশবোচিত বা বালকোচিত মনে করে এই পুত্রের নাম দুঃশাসন রেখেছিলেন, গান্ধারীর তা মনে নেই। কিন্তু কোনও পুত্রকেই তিনি ঠিকমতো শাসনে রাখতে পারেননি। সেটা তাঁর নিজস্ব অক্ষমতা বোধহয় নয়। তবে স্বামী ধৃতরাষ্ট্রের রাজ্য-লোভ-লালসা এমনভাবেই দুর্যোধন এবং দুঃশাসনের মধ্যে সংক্রমিত হয়েছিল যে, এই দুই পুত্রের উচ্চাকাঙ্ক্ষা নিয়ন্ত্রণ করতে পারেননি গান্ধারী। তবু তিনি যতই ধর্মশীলা হোন, দুর্যোধনের অন্যায় এবং দুঃশাসনের ইন্ধন তিনি আপন ধর্মযুক্তি দিয়ে যতই অনুধাবন করুন, মাতৃস্নেহ এমনই এক বিষম বস্তু যে, সব বোঝা সত্ত্বেও তবু মায়ের মনে এই দ্বন্দ্ব তৈরি হয় যে, তিনি পুত্রহারা হলেন কোন পাপে! আসলে দোষ তো মায়ের নয় এখানে, গান্ধারী তো কোনওদিন চাননি যে, তাঁর দুঃশাসন পুত্র ভ্রাতৃবধূর বস্ত্রহরণ করুক; তিনি তো চাননি যে, তাঁর পুত্র জ্ঞাতিভাইদের বিরুদ্ধে একের পর এক ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়ে তাঁদের জীবনের সমস্ত সুখ থেকে বঞ্চিত করুক এবং অবশেষে প্রবলতর প্রতিপক্ষের হাতে ছিন্ন-ভিন্ন হয়ে মারা যাক।

অথচ বাস্তব এমনই যে, দুঃশাসন তিল তিল করে নিজের জন্য এই নৃশংস অপমৃত্যু তৈরি করেছেন। ভীম বলেছিলেন গান্ধারীকে। সেই সেদিন সেই দ্যূতক্রীড়ার দিনে ভীম যদি বড় ভাই যুধিষ্ঠিরের সত্যরক্ষার অর্গলে আবদ্ধ না থাকতেন তবে দুর্যোধন যেমন দ্রৌপদীকে তাঁর বাম ঊরু দেখিয়ে পার পেতেন না, তেমনই দুঃশাসনও দ্রৌপদীর কেশাকর্ষণ বা বস্ত্রহরণ করে পার পেতেন না। সেদিন সেই মুহূর্তেই পাণ্ডবদের হাতে জীবন যেত তাঁদের— তদৈব বধ্যঃ সো’স্মাকং দুরাচারশ্চ তে সুতঃ। সত্যিই তো দুঃশাসনের মৃত্যু অনেক বিলম্বিত হয়েছে। তিনি দুর্যোধনের মতো শক্তিধর যোদ্ধাও নন, তবু দুর্যোধনের ছত্রচ্ছায়ায় যেমন তাঁর দুষ্কর্ম-দুরাচারগুলি প্রশ্রয় পেয়েছে, তেমনই দুর্যোধনের ছায়াতে তাঁর মৃত্যুও বিলম্বিত হয়েছে অন্তত কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ পর্যন্ত।

কিন্তু তবু শেষরক্ষা হয়নি। দুর্যোধন ছোটভাইকে বাঁচাতে পারেননি। দুর্যোধন-কর্ণ— দু’জনকেই যুদ্ধে ব্যস্ত রেখেছিলেন অর্জুন, মাঝখান থেকে ভীম তাঁদের প্রায় চোখের সামনেই নিজের প্রতিজ্ঞা পূরণ করে গেছেন। মহাভারতে দুঃশাসনের মৃত্যুর অব্যবহিত পরে অবশিষ্ট জনের মধ্যে, বিশেষত দুর্যোধন-কর্ণ বা অন্যান্যদের মধ্যে কোনও তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া দেখতে পাইনি। অবশ্য না পাওয়ার কারণও আছে, কেন না কর্ণের নায়কত্বে যুদ্ধ তো মাত্র দেড় দিন গড়িয়েছে এবং প্রথম দিনের মাঝামাঝি সময়েই দুঃশাসনের এই অপমৃত্যু। যুদ্ধ তখনও চলছে পুরোদমে। কারও শোক করারও সময় নেই। এই অবস্থার খানিকটা পরিবর্তন ঘটেছে ভট্টনারায়ণের বেণীসংহার নাটকে। এখানে দুঃশাসনের মৃত্যু এবং ভীমের রক্তপানের ব্যাপারটা নাটকীয় কারণেই বড় বলে খানিকটা অবসর তৈরি হয়েছে দুর্যোধনের শোকোক্তির জন্য। দুঃশাসনের রক্তপানের ঘটনা শুনে এখানে দুর্যোধনের মনে যে শোক-প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়েছে তাতে দুর্যোধনের আত্মধিক্কারের সঙ্গে সঙ্গে একটা বড় সত্য বেরিয়ে এসেছে। দুর্যোধন বলেছেন— আজকে যে ভাই, এমন একটা কষ্টকর বিপদ ঘটল, তার কারণ আমিই— অস্যাস্তু বৎস তব হেতুরহং বিপত্তেঃ। আমি তোমাকে আমার স্নেহ দিয়ে লালন করেছি বটে, কিন্তু বিষয়ের সুখ উপভোগ করবার কোনও সুযোগ তুমি পাওনি। সবচেয়ে বড় কথা, অন্যায়-অসভ্যতার অনেক কাজই আমি তোমাকে দিয়ে করিয়েছি, অথচ তোমাকে আমি সময়মতো সুরক্ষা দিতে পারলাম না— যৎকারিতোহসি-অবিনয়ং ন চ রক্ষিতোহসি।

রাজনৈতিক মাধ্যমদের এটাই সর্বশেষ গতি। তাদের লালিত করা হয় সযতনে কিন্তু ভোগ-সুখ যত আছে, সেগুলি অগ্রজ দাদা-নেতারাই ভোগ করেন, মাধ্যমকে ভোগ-সুখের সুযোগ বা অধিকার কোনওটাই দেওয়া হয় না— যুক্তো যথেষ্টম্ উপভোগ-সুখেষু নৈব/ত্বং লালিতোহপি হি ময়া বৃথাগ্রজেন। বেণীসংহার-নাটক ওই ‘দাদা’ কথাটাই ব্যবহার করেছে— ত্বং লালিতোহপি হি ময়া বৃথাগ্রজেন। দাদা দুর্যোধন ভাইকে যুবরাজ-পদে বসিয়ে রেখেছিলেন, কিন্তু যৌবরাজ্যের ভোগটুকু তেমন করে দেননি তাঁকে। দুঃশাসন-মাধ্যমেরা এই রকম একটা মৌখিকতায় মুখর পদ লাভ করেই সারাজীবন ভাবতে থাকেন— দাদার মতো আমারও একদিন এমনই প্রতিপত্তি হবে। কিন্তু এইরকমই চিরকাল এক অন্তর্ভ্রান্তি চলতে থাকে অপরিশীলিত তথা রাজনীতির প্রজ্ঞাহীন মধ্যম-অধম আজ্ঞাবর্তী রাজনীতিকের মনে। কিন্তু বাস্তব এই যে, সে ব্যবহৃত হতে হতে একদিন প্রতিপক্ষের হাতে অপমৃত্যু বরণ করে, যেমনটি বরণ করেছেন দুঃশাসন। অন্যায়-অসভ্যতার ওপর তাঁর বিশ্বাস এমনই যে, এই মৃত্যুর জন্য তাঁর বুঝি অনুশোচনাও হয় না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *