বিসাশন – পিয়া সরকার
যারা জীবনের সব আলোতে-আঁধারে সমানভাবে পাশে থেকেছেন তাদের সবাইকে
প্রাককথন
সেই কোন ছোটবেলায়, যখন সবে রাজা-রাণী-রাজপুত্র-রাজকন্যা আর রাক্ষস খোক্ষসের জগত ছেড়ে বেরিয়েছে, ঠিক সেই সময়ে মেয়েটির হাতে এসে পড়েছিল একটি আশ্চর্য গল্প। গল্পের নাম ‘রক্ত-খদ্যোত’। সদ্য কিশোরীবেলায় পৌঁছানো একটি মেয়ে সেই প্রথমবার বুঝতে পারল, ভাঁটার মত চোখ আর হাড়গোড় কাঁপানো অট্টহাসির জগতের পাশাপাশি অন্য আরেকটি ভয়ের দুনিয়া আছে। সেই দুনিয়ায় ভয় খুব ধীরপায়ে আসে, কাঁচের জানালায় মুখ ঠেকিয়ে চুপটি করে অপেক্ষা করে, হিমেল রাতে বাথরুমে যাওয়ার সময় পিছন পিছন ঘোরে। কখনও বাগানের ঝাঁকড়ামাথা গাছগুলোর ফাঁক দিয়ে মেঘঢাকা চাঁদের মুখ দেখতে দেখতে, কখনও বা দূরের দেশে বেড়াতে গিয়ে রাজপ্রাসাদের কালো লম্বা ছায়ার দিকে তাকিয়ে শিউরে উঠত মেয়েটি। মেয়েটি জানত, আসলে আমাদের চার পাশের সেই সব ছবিতেই লুকিয়ে থাকে ভয়। আদিম, অপ্রতিরোধ্য ভয়। ধীরে ধীরে ভয়াল জগতের আঙিনায় ঢুকল সে। শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, মানবেন্দ্র পাল, হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ প্রবাদপ্রতিম কথাশিল্পীর অলৌকিক গল্প গোগ্রাসে পড়তে শুরু করল মেয়েটি। নিজে যখন হাতে কলম তুলে নিল তখন স্বাভাবিকভাবেই অলৌকিক ঘরানার গল্পের দিকেই আকৃষ্ট হল সে। শোনাতে চাইছিল তার নিজস্ব কিছু বিবরণ, ভাগ করে নিতে চাইছিল নিজের কিছু অনুভূতি। তবে শুধু অনুভূতি দিয়ে তো আর গল্প হয় না, গল্পের জন্য একটা কাঠামো দরকার। দরকার জবরদস্ত প্লট। সুযোগ এসে গেল একদিন। ঠাণ্ডা বাতাসের সাথে, অসহ্য শূন্যতার সাথে, বৃষ্টির ঝপ ঝপ শব্দের সাথে তার মনের ভয়গুলিকে মিলিয়ে মেয়েটি তুলে নিল কলম।
সময়টা দুহাজার সতেরো সালের ডিসেম্বর মাস। পরিবারের সাথে বছরশেষের ছুটিতে সে বেড়াতে গিয়েছিল বীরভূম জেলার আকালীপুর গ্রামে। যারা বেড়াতে ভালোবাসেন, তাঁরা জানেন আকালীপুর শ্মশানে, ব্রাহ্মণী নদীর তীরে অধিষ্ঠিত আছেন এক ভয়ংকরী কালীমূর্তি, যাঁকে স্বয়ং মহারাজ নন্দকুমার বারাণসী থেকে সংগ্রহ করে নিয়ে এসেছিলেন আকালীপুরে। মন্দিরটিতে যে সময় পৌঁছেছিলেন ওঁরা, সেইসময় দ্বার প্রায় বন্ধ হয় হয়। সদাব্যস্ত শ্মশানে সেইমুহূর্তে অদ্ভুত নীরবতা। গুটিকয় প্রাণী মন্দির দর্শনের ইচ্ছায় দাঁড়িয়ে আছে। স্থানীয় কিছু মানুষও রয়েছেন ওঁদের আগে। দূরে দক্ষিণে পঞ্চমুণ্ডীর আসনে কটি ধূপদ্বীপ জ্বলছে। সেখানেও কাকপক্ষী নেই। মন্দিরের গঠনটিও ভারী অদ্ভুত। লোকের মুখে নানা কথা শুনতে শুনতে ওঁরা এগিয়ে গেল মন্দিরের ভিতরে। প্রায় দেড় ফুট উঁচু বেদীর উপর সর্পভূষিতা দেবীর দুশ বছরের প্রাচীন বিগ্রহ। উত্তরমুখী দেওয়ালে এক বিরাট ফাটল। জনশ্রুতি, বিশেষ এক কারণে মাতৃমূর্তি প্রতিষ্ঠা করার সময় ফেটে গিয়েছিল মন্দিরের দেওয়াল। পূজার্চ্চনা শেষ হলেও, মেয়েটির মনের মধ্যে যেন প্রশ্নের ঝড় উঠল। কলকাতা ফিরে নানা বই ঘাঁটতে ঘাঁটতে জানতে পারল মন্দির ও মন্দিরের অধিষ্ঠাত্রী দেবী গুহ্যকালীর ইতিহাস। দুশ বছরের পুরোনো ইতিহাসে স্বাভাবিকভাবেই নানা লৌকিক ও অলৌকিক ধারা এসে মিশেছিল। তথ্যপ্রমাণ সুলভ নয়, তাই সঠিক ইতিহাস জানাও কঠিন ছিল। দীর্ঘ ছমাসের পরিশ্রমের পর সেই ইতিহাস ও নিজের কল্পনা মিশিয়ে সে লিখে ফেলল “ওমকারা”। এই বইয়ের ঐটিই প্রথম লিখিত নভেলা, ঐতিহাসিক হরর থ্রিলার।
“ওমকারা” লেখার সময়ে বইয়ের গল্প হিসাবে সে লেখেনি, ভেবেছিল কোনো পত্রিকায় পাঠাবে গল্পটিকে। যারা সে সময় পড়েছিলেন “ওমকারা”, উৎসাহ দিয়ে বলেছিলেন ঐতিহাসিক পটভূমিকায় আরেকটি হরর নভেলা লিখে ফেলতে। ইচ্ছা তো প্রবল ছিলই, তারপর উৎসাহ পেয়ে দিব্যি ইতিহাস ঘাঁটতে শুরু করল মেয়েটি। এইভাবে জন্ম হল বইয়ের দ্বিতীয় নভেলাটির। “রক্তের রঙ বেগুনী”, প্রেক্ষাপট লক্ষ্ণৌ। এটি বইয়ের সবথেকে বড় লেখা, সবথেকে বেশী সময়ও লাগল লিখতে। লক্ষ্ণৌর সুবিখ্যাত বাঈজী ঘরানা, নবাব ওয়াজেদ আলির শাহর পূর্বপুরুষ সাদাত আলি এবং কলকাতা শহরের এক সাধারণ নারীর জীবন ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে এই হরর থ্রিলারটিতে। জড়িয়ে আছেন লা মার্টিনিয়ার স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা ক্লড মার্টিনও। গল্পের মূল প্লটটি নিয়ে ছোট একটি গল্প রংমশাল পত্রিকার ভয় সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল। অনেকেই বলেছিলেন, প্লটটি উপন্যাসের। পাঠকের ভালোবাসা পাওয়ায় গল্পটিকে নভেলার রূপ দেওয়ার ইচ্ছা ছিল খুবই। সেই ইচ্ছা তাঁর পূর্ণ হয়েছে প্রথম প্রকাশিত বইতে।
“ওমকারা” এবং “রক্তের রঙ বেগুনী” এই দুটি গল্প লেখাকালীন একটি ঘটনা ঘটল। আদতে আনাড়ি বইটিতে প্রকাশিত হল “নিশিগন্ধা”। পাঠকের কাছ থেকে অকুণ্ঠ ভালোবাসা পেল গল্পটি। কোথা থেকে যেন অসীম আত্মবিশ্বাস এল, যে কলম ছিল নেহাতই শখের, তাতে বারবার শান দিয়ে চেষ্টা করা হল আরও ভালো, আরও ত্রুটিহীন লেখার। নিজের লেখাকে বারবার কাঁটা ছেড়া করে সে নিঃসংশয় হতে চেয়েছিল। ইতিমধ্যে লেখা হল বিসাশন, এবং হাতছানি। এই দুটি গল্প অপেক্ষাকৃত ছোট। বিসাশন গল্পটিতে নতুন একটি চেষ্টা করা হল, ইতিহাসের উপর ভিত্তি করে একটু এক্সপেরিমেন্টেশন। বিসাশন আদতে বিশ্ববরেণ্য বাঙালী সাহিত্যিকের অত্যন্ত বিখ্যাত একটি গল্পের প্রিক্যুয়েল।
নবীন লেখিকার এই প্রচেষ্টা দুঃসাহসিক নিঃসন্দেহে কিন্তু সার্থক কিনা তা পাঠক নির্ণয় করবেন। তাঁরা নিশ্চিত জানেন, ঐতিহাসিক পটভূমিকায় হরর গল্পগুলি লিখতে গিয়ে সবথেকে বেশি চিন্তিত হতে হয় কোনখানে। গল্পগুলি যেন কোনোভাবেই নীরস ইতিহাসের দলিল না হয়ে ওঠে। আবার অলৌকিকতার ছোঁয়ায় ইতিহাস বিকৃতি যাতে না হয় সেদিকেও প্রথম থেকেই সচেতন হওয়া দরকার। মোট কথা, বই লেখার এই প্রয়াস লেখিকার কাছে সহজ ছিল না। প্লট তৈরী করার পরেও কাঠামো গড়তে দীর্ঘ দুশো থেকে আড়াইশো বছরের ইতিহাস ঘাঁটতে হয়েছিল। সেই ইতিহাসের অলৌকিক আবহ রচনার সময় জাম্প স্কেয়ারের সঙ্গে বা বীভৎস রসের সঙ্গে খুব সাবধানে ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটকে মিলিয়ে দিয়েছেন লেখিকা। এই বাঁধুনি কতটা মজবুত হয়েছে, তা বলবেন আপনারা, প্রিয় পাঠক। এতক্ষণে, প্রচ্ছদগুণে লেখিকার নামটি নিশ্চয়ই আপনারা লক্ষ্য করেছেন? তবে সেই বহুব্যবহৃত ডায়লগটি এখানে হয়ত আবার প্রযোজ্য। “হোয়াট ইস ইন এ নেম?” পিয়া সরকার নয়, শেষ পর্যন্ত তাঁর সৃষ্টি আপনাদের মনে কতটা দাগ কাটতে পারল সেটিই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। বইটিতে আপনাদের পছন্দের বিষয় যেমন পাবেন, অপছন্দের বিষয়ও নিশ্চয়ই থাকবে। গঠনগত সমালোচনা করে লেখিকার ভুল ত্রুটি শুধরে দিলে তিনি চিরকৃতজ্ঞ থাকবেন। নিজেকে বিচক্ষণ প্রমাণ করার কোনো ইচ্ছা তাঁর নেই, তবুও বইয়ের শেষে সহায়ক গ্রন্থতালিকা উল্লেখ করা হল।
সবশেষে বলি, একটি বই তৈরী করার সময় শুধু লেখকের প্রচেষ্টাই তো সব নয়, তার সঙ্গে জড়িত থাকে আরও অনেক মানুষের নাম। লেখালেখিতে নিরন্তর উৎসাহদানের জন্য সম্পাদকদ্বয়, তমোঘ্ন দাশগুপ্ত ও পিউ দাশকে, প্রচ্ছদের জন্য শিল্পী কুশল ভট্টাচার্য্যকে, হরফসজ্জার জন্য ঋতুপর্ণা চক্রবর্তীকে এবং সমস্ত সংশয়ে পাশে থাকার জন্য মেন্টরগ্রুপ আনাড়ি মাইন্ডস টিমকে লেখিকা আন্তরিক ধন্যবাদ জানান। সুদূর পুরুলিয়া থেকে তথ্যসন্ধানে সাহায্য করেছেন সুখেন প্রামাণিক; তাঁর সঙ্গে ধন্যবাদ জানান সহকর্মিণী মৌমিতা নন্দন, কাজরী মুখোপাধ্যায়, তনুমিতা বসাক এবং অপরাজিতা দাশগুপ্তকে। বইয়ের প্রকাশক বেঙ্গল ট্রয়কা তাঁর প্রথম প্রচেষ্টাকে দুই মলাটের মধ্যে আবদ্ধ করে ধন্যবাদার্হ রইলেন।
বিসাশন পাঠকের ভালোবাসা পাক, এই আশা রইল।
পিয়া সরকার
কলকাতা,
এপ্রিল, ২০২০
.
সহায়ক গ্রন্থ তালিকা
১. সম্মোহনবিদ্যা- রাজেন্দ্রনাথ রুদ্র
২. Rasputin: The Untold Story – Joseph T. Fuhrmann – Wiley Publications
৩. Rasputin and the Fall of the Romanovs – Colin Wilson – Granada Publishing
৪.uncommon therapy – Jay Haley
৫.পশ্চিমবঙ্গের লোক সংস্কৃতি বিচিত্রা সনৎকুমার মিত্র
৬. মানভূমের ইতিহাস- শ্রী দিলীপ কুমার গোস্বামী
৭. রংকিনী- কৌশিক দত্ত
৮.বাংলার লৌকিক দেবতা- গোপেন্দ্রকৃষ্ণ বসু
৯.অহল্যাভূমি পুরুলিয়া- ( দ্বিতীয় এবং তৃতীয় খণ্ড) দেবীপ্রসাদ শর্মা।
১০. প্রাচীন লক্ষ্ণৌ- আব্দুল হালিম শবর
১১.The making of colonial Lucknow by Veena Talwar Oldenburg
১২. আখতারনামা- শামিম আহমেদ
১৩. অলৌকিক গল্পসমগ্র- শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়
১৪. নিবার্চিত ভূতের গল্প- রঞ্জিত চট্টোপাধ্যায় সম্পাদিত
১৫. শাস্ত্রমূলক ভারতীয় শক্তিসাধনা- উপেন্দ্রকুমার দাস
১৬. অঘোরী প্রসঙ্গ- নিগূঢ়ানন্দ
১৭. সর্পতান্ত্রিকের সন্ধানে- নিগূঢ়ানন্দ
১৮.তান্ত্রিকদের বিচিত্র কাহিনী- সৌরীন্দ্রমোহন মুখোপাধ্যায়
১৯. অলাতচক্র- তারাদাস বন্দ্যোপাধ্যায়
২০. রাতের শ্মশানে অঘোরী সঙ্গ – সোমব্রত সরকার
২১. অঘোরনাথের তন্ত্রকথা- সব্যসাচী সেনগুপ্ত
.
লেখক পরিচিতি
সামাজিক, থ্রিলার এবং অলৌকিক তিন ঘরানার লেখায় স্বচ্ছন্দ তিনি। বিশ্বাস করেন, যথাযথ পড়াশোনা, পরিশ্রম এবং লেখনীর নিপুণতা যথার্থ সাহিত্য সৃষ্টি করতে পারে।
পেশায় শিক্ষিকা, নেশায় কলমবাজ পিয়া সরকার অবসরে কাটাতে বেছে নেন পাহাড়ের সান্নিধ্য।
বিসাশন তাঁর প্রথম প্রকাশিত একক বই।
পিয়া সরকারের লেখালেখির সূত্রপাত ‘লেখা দিয়ে রেখাপাত’ পত্রিকায়। এরপর ‘আদতে আনাড়ি’ বইতে প্রকাশিত হয় বড় গল্প নিশিগন্ধা।
লিখেছেন রঙমশাল, চিনেপটকা, অন্তরীপ সাহিত্যপত্রিকায়। যুক্ত আছেন লিটল ম্যাগাজিন সম্পাদনায়।
S.r
Onek onek dhonyobad apnader.
Apnar ei kajer jonno,onek manusher doya paben,apnara.
Ei lekhikar,baki boi gulo somvob hole upload korben.
Dipika majumder er boi gulo o din.
Apnader proti ei anurodh rakhlam.