পিঁজরাপোল – শওকত ওসমান
পিঁজরাপোল প্রথম গল্পগ্রন্থ। প্রকাশক : আবদুল কাদির খাঁ- নওরোজ লাইব্রেরী-১ সি. সার্কাস মার্কেট প্লেস- কলিকাতা; মুদ্রাকর: শ্রীরামচন্দ্র দে- ইউনিয়ন প্রেস- ৪এ, রমানাথ মজুমদার স্ট্রীট, কলকাতা- প্রচ্ছদ শিল্পী : খালেদ চৌধুরী- বাইন্ডার্স : হক বাদ্রার্স এন্ড কোং- ১০১ বৈঠকখানা রোড, কলকাতা- প্রথম সংস্করণ : অগ্রহায়ণ ১৩৫৮ (১৯৫১ইং) দাম দুই টাকা। পুস্তকের পৃষ্ঠা সংখ্যা একশ’ সাঁইত্রিশ (১৩৭)।
মোট গল্পসংখ্যা ছয় (৬)। ছটির মধ্যে দুটি গল্প সাধু বাংলায় লেখা : ইলেম ও কাঁথা। যদিও গল্প দুটি একেবারেই নিম্নবিত্ত খেটে খাওয়া মানুষ নিয়ে। সম্ভবত: এই দুটি গল্প প্রথম দিককার লেখা। এর মধ্যে ‘ইলেম’ গল্পটি সম্ভবত চল্লিশের দশকের শেষের দিকের কারণ, মাঝি সাম্পান চালক। একমাত্র চট্টগ্রাম ছাড়া বাংলার অন্য কোন অঞ্চলে সাম্পান নেই। আর শওকত ওসমান ১৯৪৭-এ কলকাতা সরকারী কমার্স কলেজ থেকে চট্টগ্রাম গভর্ণমেন্ট কমার্স কলেজে অপশান দিয়ে যোগ দেন।
প্ৰথম গল্প ‘থুতু’।
ছোট নাগপুরের পটভূমিতে লেখা- নায়ক হলেন ঐ অঞ্চলের ফাদার জোহানেস। কাল ব্রিটিশ ভারত। এই ফাদারের গুণাবলী একজন সৎ ফাদারের যা হয় তা সবই বিদ্যমান। ফাদারের বাবুর্চি মনসুর। মনসুরের বোন আসন্ন প্রসবা অসুস্থ হয়ে পড়ে- ফাদার এই বোনকে দেখে বলে যে তাকে হাসপাতালে নিতে হবে, কিন্তু মনসুর জানায় যে তা হবে না, কারণ পর্দার কারণে হাসপাতালে নেয়া যাবে না।
এই সময় শুরু হয় দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ- ফাদার জোহানেস চালিত টেকনিক্যাল ইনস্টিটিউটের গ্র্যান্ট এক ধাক্কায় সাত হাজার টাকা কমে যায়। এটি তখন চালান দুঃসাধ্য। শেষে ফাদার একটা মেলার আয়োজন করে টাকা ওঠানোর জন্যে। বিশেষ করে টাকা আসতে থাকে জুয়ার আসর থেকে। এই মেলার ব্যবস্থা ফাদার করতে চাননি, কিন্তু চার্চ কাউন্সিল তাকে একরকম বাধ্য করে এই ব্যবস্থা নেবার জন্যে। জুয়ার শেষ দিনে এক বাঙালী যুবক সব পয়সা হেরে মারামারি লাগিয়ে দেয়। চিৎকার করতে থাকে —–সব জ্বালা দেগা—–
আরও তিন বছর কেটে গেছে এই সত্তরোর্ধ বয়সেও জোহানেস কাজে অটল। কিন্তু ইদানিং সামান্য কাজ করেই হাঁপিয়ে ওঠে। তার এক আত্মীয় আসে সপরিবারে তারাও হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ল। এই আত্মীয় একদিন খাবার পরীক্ষা করতে পাঠায়। দেখা গেল কাটলেট আর জুসে থাইসিসের জীবানু মাখা। তারা তখন দোষীকে ধরার জন্যে ওৎ পাতে এবং অপরাধী ধরা পড়ে। ফাদার মনসুরকে ডাকে। তারপর বলেন, তোম মেরা খানামে থুক দেতা?
—কাভি কাভি ফাদার। মনসুর নির্ভীক কণ্ঠে জবাব দিচ্ছে।
—কিউ এয়সা কাম করতা?
—মেরা বহেন কো আপনে দেখা। বেগায়ের খানা মেরা দেশকা বহুৎ আদমী- মেরা মা-
মনসুরের গলা বুজে আসে…
মনসুরের ছুটি হয়ে যায়।
রাত্রে ফাদার অন্ধকার রাত্রীর দিকে চেয়ে আছেন।
গল্পের শেষ বাক্যটি এ-রকম :
…. অরণ্যব্যাপী দাবানলের পূর্বে স্ফুলিঙ্গের জোনাকি দেখতে লাগলেন ফাদার জোহানেস রাত্রির স্তিমিত তরঙ্গে।
দ্বিতীয় গল্প ইলেম।
জহির মিয়া সাম্পানের মাঝি। মাঝে মাঝে রাত্রে কাস্টমের লোকেরা নৌকা চেক করে। বেআইনী কিছু থাকলে ধরা পড়লে ঘুস দিতে হয়। বিশেষ করে আফিমের খোঁজ নেয় বেশি। এই জহির মিয়া ছেলেকে লেখাপড়া শেখাতে চায়, এমন কাজে রাখতে চায় না। ছেলের জন্যে বই কিনে বাড়ি ফিরছে সে এমন এক রাত্রে কাস্টমের লঞ্চ তার নৌকার কাছে ভিড়ল। সে মাঝে মাঝে অসুখে পড়ে তাই দু’আনার আফিং ছিল তার পুঁটলির মধ্যে। তাই দেখে কাস্টমের লোকেরা মার-ধোর করে থানায় নিতে চায়- শেষে একজন ফিসফিস করে বলে পাঁচটা টাকা দিয়ে দিতে। পাঁচটাকাই ছিল জহিরের কাছে দিতে বাধ্য হয়। পরদিন বাড়ি ফিরে লেখাপড়ারত ছেলেকে একগ্লাস পানি দিতে বলে- তার মা গেছে লোকের কাছে ধার-দেনা করতে।
ছেলে বলে সে পড়ছে।
জহির ক্ষিপ্ত হয়ে সমিরের বই সব ছিঁড়ে ফেলে দেয়।
গল্পের শেষ প্যারাটি এরকম :
…হালার ইলেম। সুটবুট আর গুস। আরে বুট-সুট মারানীর পুত। তারপর আরো একটা অকথ্য গালি দিয়া বলিল : সুটপাছাৎ, গুস মুখে, এই ইলেমে হৈব কি? বেদম্মার জাত… তোঁয়ার মারে ডাক্। উড্ হারামীর ছাউ- উড়।
তৃতীয় গল্প পিঁজরাপোল।
একটি পিঁজরাপোল- যেখানে দুস্থ গরু-ছাগলের চিকিৎসা হয়- প্রতিষ্ঠাতা গণ্ডেরীরাম- এখানে মারুমিয়া নামে এক বয়স্ক লোক কাজ করে- স্থান সম্ভবত: বিহার বা ইউপি- কোন উল্ল্যেখ নেই- তবে ঘটনা থেকে তাই মনে হয়- এখানে বিশ বছরের এক যুবক চাকরিতে আসে- নাম বাসেদ – বাঙ্গালী মুসলমান- দিনের বেলা তাকে ঘুমোতে দেখে মারুমিয়া ধমক দেয় যে কেন সে দুপুরে ঘুমোচ্ছে। বাসেদ জবাব দেয় : … বিশ রুপেয়া মে জরু-বাচ্চা খা সাক্তা হ্যায়? জেয়সা পয়সা ঐসা কাম।
এই পিজরাপোলে গরুর গায়ে মশারি দেয়া হয়, কর্মচারীদের মশারি নেই। তাই বাসেদ রাতে মশারি চুরি করে আনে, আবার সকালে যথাস্থানে রেখে দেয়। সে আরো এক কাজ শুরু করে, রাত্রে দুধ দুয়ে নেয় এবং গোপনে বিক্রি করে। এই সব ঘটনা মারুকে খুব বিচলিত করে। বিরক্ত হয়, আবার প্রতিবাদী ছেলেটার ওপর মায়াও হয়।
এই নিস্তরঙ্গ পিঁজরাপোলে হঠাৎ একটা তোলপাড় করা ঘটনা ঘটে- বাবু কোয়ার্টারের পুকুরে তাদেরই একটি মেয়ে আত্মহত্যা করেছে। পরদিন শেষ রাত্রে বাসেদ এই পিঁজরাপোল ছেড়ে চলে যায়। মারুমিয়া তাকে অনেক বুঝিয়েও ব্যর্থ হয়।
চতুর্থ গল্প ‘দাতব্য চিকিৎসালয়ের ইতিহাস’।
ডেপুটি মুস্তাফিজ প্রায় রাত্রে স্টীম বোট নিয়ে বেরয় টহলে। এক রাতে একটা নৌকা ধরা পড়ল- এটা অঞ্চলের ধনীব্যক্তি জলীল তরফদারের।
তার খুব ইচ্ছা অঞ্চলে একটা দাতব্য চিকিৎসালয় খুলবে। রোগ-তপ্ত মানুষের উপকার করবে। কিন্তু পঁচিশ হাজার টাকা দরকার- চেষ্টা করে মাত্র পাঁচ হাজার জোগাড় করেছে।
ক’দিন পর আর এক রাতে আর এক নৌকোর পাশে গিয়ে দাঁড়ায়- নৌকোয় পাঁচ-ছ জন লোক বসে। পাশে এসে বলে, কি আছে তোদের নৌকোয়? ধান-চাল থাকে তো সত্যি বলবি।
একজন যুবক প্রায় ব্যঙ্গ করে ওঠে।
ডেপুটি বলে, কে রে, তুই, ছোকরা!
ছেলেটি জবাব দেয় যে এটা ধান-চালের নৌকো নয় এবং জানায় যে তারা লাশ বহন করছে।
ডেপুটি বলে যে কে খুন করেছে।
ছেলেটি জবাব দেয় : আপনারা।
পরে জানা গেল লাশ যুবকের স্ত্রীর, কলেরায় মারা গেছে এবং সে যাচ্ছে শ্বশুরবাড়ি।
ডেপুটি ছল ভেবে কাপড় তুলে লাশ দেখার নির্দেশ দেয় পুলিশকে- কিন্তু যুবক রুখে দাঁড়ায় এবং ধরা গলায় বলে যে আর কোন কাপড় নেই, কাফন দিয়েই ঢেকে নিয়ে যাচ্ছে লাশ… এ-সব শুনে ডেপুটি মুস্তাফিজ স্তব্ধ হয়ে যায়।
সে চিকিৎসালয় করার কাজে আত্মনিয়োগ করে। প্রায় সব শেষ করে এনেছে এমন সময় তার বদলির হুকুম আসে। আর এর কারণ এখানকার প্রভাবশালী চোরাকারবারি জলিল তরফদারকে সে গ্রেফতার করেছিল। এর একবছর পর আবার তার কাছে পত্র আসে- চিকিৎসালয় উদ্বোধন হবে, তাকে করা হয়েছে প্রধান অতিথি।
চালের অভাবে এ-অঞ্চলে পাঁচ ছ’শ করে মারা যেত তাই শেষ পর্যন্ত এই চিকিৎসালয় উদ্বোধন হচ্ছে। দরিদ্র লোকগুলো, মহকুমা হাকিম মুস্তাফিজ জিন্দাবাদ ধ্বনি দিতে থাকে।
গল্পের শেষ প্যারাটি এ-রকম :
মুস্তাফিজ অনুভব করে, তার চারপাশে শুধু মানুষ।
তাদের মুঠি অন্ন নেই মুখে, পরিচ্ছদ নেই রৌদ্রবৃষ্টি-স্নাত দেহে; তবু তাদের পর্বতগ্রাসী প্রাণ- বন্যার শক্তি অপরিসীম- তাদের উদ্দেশ্যে প্রণত জানাল মুস্তাফিজ বারবার।
জীবনের প্রথম প্রণতি।
পঞ্চম গল্প ‘কাঁথা’।
লতিফ এক গৃহস্থ চাষী। অবস্থা মানব সমাজের অতি নিম্ন প্রান্তে। বাবার ব্যবহৃত একটি কাঁথা সে উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছে। বন্দরে যেতে হবে আলু বীজ কিনতে। তার ছেলে মানু ছালা গায়ে ঘুমোচ্ছে- লতিফ এক রাতের জন্যে ঐ মোটা কাঁথা নিয়ে স্ত্রীকে শুতে বলে- সন্তানকে সঙ্গে নিয়ে।
লতিফের বাবা ছিল যক্ষ্মারোগী তাই লতিফের স্ত্রীর আপত্তি ছেলেকে ওর তলে নেবার। বিশেষ অসুবিধা হয়েছে মানুর গায়ে যে ছালাটা আছে তা নিতে হবে আলু বীজ আনার জন্যে। এখান থেকেই সমস্যার সৃষ্টি।
লতিফ প্রায় তার বাবার গল্প করত… খুব শক্তিধর লোকছিল- একবার দুই বগলে দুই পুলিশকে নিয়ে দৌড় দেয়… মানু এসব খুব মন দিয়ে শোনে, কিন্তু লতিফের স্ত্রী বরুবিবি এসব মোটেই শুনতে চায় না। অভাবের সংসার এ-সব কারই বা ভালো লাগে।
এই সময় গ্রামের অদূরে গোরা সৈন্যের আমদানি হয়। দেশে কাপড়ের অভাব। একদিন লতিফের স্ত্রী পুরোনো কাঁথাটা খুলে ফেলে এবং মাঝখানে একটা পুরনো শাড়ি পায় সেটা পরায় লতিফের মনে সন্দেহ কোথা থেকে এই শাড়ি পেল… বেশ একটা রহস্য রচনা করে তার স্ত্রী… স্ত্রী সব খুলে বললে লতিফের মুখে হাসি ধরে না… শুধু তার স্ত্রী নীরবে ফুঁপিয়ে কাঁদে।
শেষ গল্প ‘আলিম মুয়াজ্জিন’।
আলিম মুয়াজ্জিনের পাগলা খেতাব বহু পুরাতন।
এভাবে গল্প শুরু হয়। যদিও মসজিদ কমিটির কেউ কেউ তাকে বলে, ‘শেয়ান পাগল’…কারণ সে বলে যে মুয়াজ্জিন সবচেয়ে ভালো কাজ করে সুতরাং গভর্ণর জেনারেলের এক লাখ হলে তার মাইনে হবে সোয়া লাখ… এমনি ধারা নানা মন্তব্য তার।
কিন্তু সত্যি আলিম একদিন পাগল হোয়ে গেল… একদম ব্যাধির পাগল।
সে পুরো সংসার সঙ্গে নিয়ে চলত। মাথায় হ্যাট…কখনো তা গাড়ির চাকার তলায় আবার মাথায়… ছেলেরা পেছনে লাগে, “গভর্ণর জেনারিল, গভর্ণর জেনারিল…”
কখনো আলিম সাজে ট্রাফিক পুলিশ… আলিমের স্ত্রী আর দুই সন্তান আছে… একটা হ্যাট ছেলেরা কুড়িয়ে পেয়ে ঘরে এনেছে… তার স্ত্রী ঠাট্টা করে সেটা মাথায় দিলেও আলিম সন্দেহ করে… একদিন আজান দেবার সময় আলিম চীৎকার করতে থাকে, “ছুটটি মিল গিয়া…” আর একজন আজান দিতে গেলে সে চীৎকার করে, “নামো শালা নামো। আমার বিশ বছর হোয়ে গেছে, দখলী স্বত্ব জন্মে গেছে। …একদিন এক ভদ্রলোক আলিমের গলা শুনে বলে যে পাগল না হলে ওকে সে রেডিও-তে নিয়ে যেত।
একদিন আলিম মুয়াজ্জিনের চাকরিটাও যায়।
এই সময় দেশ ভাগ হয়ে গেছে- আলিম একদিন বলতে থাকে যে সে রিফিউজি … এই সময় একদিন সে গাছতলায়বসে আছে এমন সময় শোনে কিশোরদের গলা। তারা মিছিল বের করেছে- ধ্বনি দিচ্ছে : “হিন্দু মুসলমান ভাই ভাই। দেশত্যাগী হবো না। দাঙ্গাবাজ বরবাদ হোক।”
আলিম তাদের দলে গিয়ে দাঁড়ায় এবং সবাইকে বলে : চুপচাপ ক্যান? আজান দিতা আছিলা না? আজান দ্যাও।
কয়েকজন চীৎকার করে ওঠে : “আল্লাহ হো’—
রীতিমত ধমক দিয়ে উঠল আলিম : ও নয়। আজান দাও।
…মিছিলের জোট-বাঁধা আওয়াজ শতধা তরঙ্গ তোলে : হিন্দু-মুসলমান ভাই-ভাই।
হাসল পাগল। “ঠিক হ্যায়” বলে আজানের ভঙ্গি-মাফিক দুই কানে আঙুল ছোঁয়ায়।
মিছিল এগিয়ে চলেছে। তেমনই আছে কানের ডগায় আঙুল। এগিয়ে চলল আলিম।
চলমান মিনার বিশিষ্ট কোন মসজিদের বরখাস্ত পদে আবার যেন বহাল হোয়েছে সে।
কাহিনী এখানেই শেষ। আজ দু’হাজার দু’সালে ভারতবর্ষের গুজরাটে যে-ঘটনা ঘটছে এবং সারা উপমহাদেশে আমরা হিন্দু ও মুসলমানরা যা করছি তাতে সত্যি করে বলা মুস্কিল কে পাগল, আলিম মুয়াজ্জিন? না আমরা এক শো তিরিশ কোটি উপমহাদেশবাসী?
Leave a Reply