কাঁথা
লতিফ উবু হইয়া বসিয়া হুকা টানিতেছিল। সামান্য খুকখুক কাশির পর স্ত্রী বরু-বিবির উপর তার নজর পড়ে।
—কাইল বন্দরে যাওন দরকার, বরু-বিবি।
—ক্যান?
—আলু-বীজ কেনা লাগব।
—অ।
—কাইল মানুর লগে শুইয়ো।
মানু ইহাদের বালক পুত্র। অনেক আগেই সে মেঝের এক প্রান্তে নিজের বিছানায় শুইয়া পড়িয়াছে। দম্পতির দৃষ্টি তার দিকে নিক্ষিপ্ত হয়। মানু নির্বিবাদে ঘুমাইতেছে। তার গায়ে কাঁথা নাই। তার বদলে রহিয়াছে ফসল বহনের থলি। ইহাই শীত-নিবারণী আবরণ।
—থলি দরকার?
—হ।
মাদুরের উপর পা-তলার দিকে একটা বড়ো ময়লা কাঁথা জড়ো করা ছিল।
বরু-বিবি সেদিকে ইঙ্গিত করিয়া বলিল : ওই কাঁথায় শুমু?
—হ। চারা কি। ওরই ভিতর শুইয়ো। লতিফ ধোঁয়া ছাড়িল আবার, মাথা দোলাইয়া কহিল : হ, উর ভিতর। এক রাতের মামলা, বরু-বিবি। নাচার। শুইয়ো এক রাত।
মানু মার কাছে ঘুমাইবে, ইহা আপত্তির বিষয় নয়। আপত্তির গোড়ার কথা কাঁথাখানি।
গত বর্ষার সময় লতিফের আব্বাজান খাদেম মারা গিয়াছে কাশ রোগে। কাঁথাখানি ফেলিয়া দেওয়া উচিত ছিল। কিন্তু উপায় ছিল না। অন্য আর একখানি কাঁথা লতিফের পিতা হারাইয়া আসে মুর্শীদের দহলিজে ঘুমাইতে গিয়া। দু-খানি ঘর মাত্র পাশাপাশি। বুড়ার চলাফেরার স্বাচ্ছন্দ্য থাকে না। তাই সে কোনদিন ঘরে ঘুমাইত না। বর্তমান কাঁথার মালিকও সে। বোধ হয় লতিফের আব্বা ওয়ারেশ-সূত্রে পূর্ব পুরুষের নিকট হইতে উপহার পাইয়াছিল। কাঁথাখানি ওজনে দশ সেরের কম হইবে না। কত ডজন পুরাতন কাপড় কত বছর ধরিয়া পর পর সংযোজিত হইয়াছে, তার হিসাব কেহ রাখে নাই।
বরু-বিবি কাঁথাখানির নাম দিয়াছিল জগদ্দল। অবশ্য নিতান্ত ক্ষোভে।
মানু এতদিন তাহাদের নিকটে ঘুমাইত। কাশ-রোগীর কাঁথার ভিতর পুত্র ঘুমাক, পিতা তাহা পছন্দ করে নাই। তাই মানুর শয্যা ও লেপ স্বতন্ত্র। লেপ অর্থাৎ মোটা থলি।
বরু-বিবি ছেলের কাঁথা তৈরীর জন্য প্রতিবেশী কত জনের নিকট না পুরাতন ছেঁড়া কাপড় চাহিয়াছে। কিন্তু প্রত্যেকের চাহিদা সমান। ঈষৎ ফাটল ধরা কাপড় এই পল্লীর কেহ অপচয় করিতে পারে না।
—ওই কাঁথার ভিতর শুমু!
—নাচার, বরু বিবি। হালার দিন-কাল কি হৈল!
—থলি ছাড়া কাম চল্ব না?
—আধামণ আলু-বীজ গামছায় বওন যায়, কও দেহি?
বরু-বিবি মাথা দোলাইল। না, তা সম্ভব নয়।
লতিফের মনেও খটকা লাগিতেছিল। এই বংশে সকলের শরীর মজবুত বলিয়া কেহই তেমন কষ্ট পায় না, অন্ততঃ যৌবনে। বৃদ্ধ বয়সের খতিয়ানে লাভ নাই। মানু যদি অল্প বয়সেই এই সব রোগাক্রান্ত হয়। মনে মনে লতিফ প্রার্থনা করে : বাচ্চারে সহি সালামতে রাইখ্যো, খোদা।
মানুকে সে পিতার নিকট ঘেঁষিতে দিত না। ছোঁয়াচে রোগ। লতিফের আব্বা খাদেম এই জন্য কুৎসা রটাইতে ছাড়িত না পুত্র ও পুত্রবধূর।-একদম বিবির ভেড়য়া।
খাদেম কিন্তু পুত্রকে ভয় করিত। প্রতিবেশীর নিকট চড়া গালিগালাজের পর সে অনুনয় শুরু করিত ফিফিস শব্দে : কথাটা লতিফের কানে না ওঠে, দেইখ্যো বাই।
লতিফের অবশ্য পিতার প্রতি কম শ্রদ্ধা ছিল না। কিন্তু শ্বশুর ও পুত্রবধূ ছিল পৃথিবীর দুই প্রান্ত বাসী। মাঝে মাঝে ঝগড়া বাধিত।
লতিফ হুঁকায় টান দিতে দিতে বলে : হালার কবাল দ্যাহো। একডা পোলা, তারও গায় কাঁথা জোড়ে না।
—কবালের দুষ দিলে কি হইব? তোমাগো আক্কলের দুষ।
লতিফ ঈষৎ বিরক্তসুরে বলে : আক্কলের দুষ ক্যান্?
—তোমাগো আক্কল নয়, তোমাগো বাপ্ জানের।
—আমাগো বাপজান!
ঈষৎ রোষপূর্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করিল লতিফ।
—তোমাগো আক্কল না?
—চুপ কইরা যাও। আর কাইজায় কাম নাই।
—বুড়া অইলে আক্কলের মাথা খাইয়্যা বয়ে। কাঁথা ফেইল্যা আইলো। আজ আমাগো পোলা খালি গায় রাত কাডায়।
অবসাদগ্রস্ত লতিফ। সারাদিন জমি তৈয়ারী করিয়াছে। জবাব দেওয়ার ইচ্ছা ছিল না তার। কিন্তু বরু-বিবি ঝাল মিটাইতে লাগিল।
—কত জ্বালাইলো তোমাগো আব্বা।
—জ্বালাইলো কারে?
—ভূত, ভূতরে।
লতিফ ভিতরে ভিতরে গর্জন করিতেছিল। তবু নম্রকণ্ঠে বলিল : তুই চিবি আব্বারে! দ্যাখছিস জোয়ান কালে? কোন্ হালার পুতের বুকের পাটা আছে, তালুকদারের মুখে থাব্বড় দ্যায়?
খাদেম আলি সত্যি যৌবনে খুব ডানপিটে ছিল। তালুকদারের সঙ্গে বিবাদ করিয়া সে দুইবার জেল খাটিয়াছে। বৃদ্ধ বয়সে তেজ অন্তর্হিত, একদা-চোয়াড় মানুষটি নিরীহ জীবে পরিণত হইয়াছিল।
—রাইখ্যা দাও তোমার কিচ্ছা।
—কিচ্ছা কও? জিগা গাঁয়ের মানুষে।
লতিফ পিতার কাহিনীর মধ্যে আনন্দ ও গর্বের অদ্ভুত আস্বাদ পাইত। বরু-বিবি কিন্তু বিপরীতমুখী।
মানু পাশ ফিরিতে থলিখানা স্থানচ্যুত হইল। আদুল শরীর। স্বামী-স্ত্রী দুইজনে দেখিল, কিন্তু পুনরায় ঢাকা দিতে কেহই অগ্রসর হইল না।
—বড় লবাব তোমার আব্বা। এ হাল ক্যান্?
—হালৎ আল্লা বানাইছে।
—আল্লা বানাইছে!
বিদ্রূপের তীক্ষ্ণস্বর ফাটিয়া পড়ে।
—আঁই জানি না? বালা মানুষ! বালা মানুষ অইলে ব্যাডার বউর লগে কাইজ্যা করে?
ধমক দিয়া উঠিল লতিফ : চুপ, হারামজাদী। মুহ্ জুতায়ি লম্বা কইর্যা দিমু।
পিতার মর্যাদায় আঘাত দিলে লতিফ সহ্য করিত না। বিশেষতঃ সেই পিতা যখন মৃত।
—দ্যাও না, দ্যাও, কেমন বাপের ব্যাডা।
লতিফ দ্বন্দ্ব আহ্বানে পিছাইয়া গেল। কিন্তু চীৎকার তার কমে না : হালী, তুই চিনবি আর আব্বারে। দশখান গাঁ’র মানুষে চেনে। চেনে তালুকদার।
—বাপরে কি ত্যাজ! তবু খক্খক্ কাইশতো যমিনে মুখ রাইখ্যা।
কাশির অভিনয় করে বরু-বিবি।
—চুপ কইর্যা যা। আব্বার আক্কল-মুরোদ লয়ে কথা কস্ ত ছিচ্চ্যা ফেমু।
—আক্কল! আহ্ম্মকুল্লাজী, কয় আক্কল! হুঁহ্।
লতিফ ক্রোধ সংযত করিল। সে জানে বরু-বিবির মানসিক অবস্থা। পিতার খবরদারী কি সে কম করিয়াছে? শেষ কয়দিন খাদেম উত্থানশক্তি-রহিত ছিল। মেথরানীর কাজ পর্যন্ত করিয়াছে পুত্রবধূ। শ্বশুরকে অবহেলা করে নাই। তবু বুড়াকে সে দেখিতে পারিত না। বিবাহের একমাস পরেই বরু-বিবি গৃহিণীর অভিষেক পাইয়াছিল, যেহেতু শ্বাশুড়ী আগেই ফৌৎ হইয়াছিলেন। পুত্রবধূ ও শ্বশুরে কোন নিকট সম্বন্ধ গড়িয়া উঠে নাই। অথচ তার জন্য পরিশ্রম করিতে বরু-বিবি পিছ-পাও হইত না।
—তুমি কও আক্কল। আক্কল থাইকলে কাঁথা খোয়ায় না। দ্যাহ বাচ্চার হালৎ।
লতিফ আরো কাবু হইয়া গেল লজী লড়াইয়ে। পিতার বর্তমানে পুত্রের এই দুর্দশা আদৌ গৌরবের কিছু নয়। তাই পিতার শ্রাদ্ধ হইতে থাকিলেও নিজ পিতৃত্বের দিকে চাহিয়া লতিফ আর কোন কথা উচ্চারণ করিল না।
ময়লা কাঁথাখানি টানিয়া লইল সে। ভ্যাশা গন্ধ। একবার শুকিয়া মুখ-কুঞ্চন করিল।
—রোদে দেওয়ার পারো না?
—দিছি ত।
অতঃপর গায়ে কাঁথা জড়াইয়া শুইয়া পড়িল লতিফ।
বরু-বিবি কিছুক্ষণ আপন মনে গজ গজ করিয়া পুত্রের খবরদারী লইল। নিচের মাদুরখানি ছুঁইয়া দেখিল। অনেক সময় ছেলে মানুষ মুতের উপর শুইয়া থাকে সারারাত্রি। পনর দিন আগে খুব ঠাণ্ডা লাগিয়াছিল মানুর। না, আজ কোন গোলমাল নাই।
ডিপা নিভাইয়া দিল বরু-বিবি।
.
গঞ্জ হইতে ফিরিয়া আসিবার কয়েক দিন পর লতিফ দেখিল, মানুর গা ঈষৎ গরম। সর্দি করিয়াছিল তার, খক্খক্ কাশিতেছিল।
লতিফ জিজ্ঞাসা করে : বুকে দরদ লাগে, বাজান?
—না!
মানুকে কোলে তুলিয়া লইল উৎফুল্ল লতিফ। অবেলা হইয়া গিয়াছিল। মানু শুইয়া থাকিতে চায়। লতিফ আপত্তি শুনিল না।
পিতা-পুত্রে সংলাপ আরম্ভ হয়।
—তোমাগো দাদাজান ভয়ানক লোক ছিল, মানু আব্বা।
—সত্যি বা’জান?
—হ। হে’বার ফসল নষ্ট। উনি কইলেন, খাজনা দিতাম না এ-সাল।
মানু পিতামহের কাহিনী শুনিতে উৎকর্ণ হইল।
—খাজনা দিতাম না। গাঁয় এক কথা, খাজনা দিতাম না। তালুকদার ডাইক্যা কয়ঃ একি মিয়া, খাজনা দেবা না? “না হুযুর।” “ক্যান্?” “ক্যান্ আবার কি? কোখন দিমু? গ’রের থালা-বাটা বেছি। মাটির বাসনে খাই।” আমি তহন বাচ্চা। বিলকুল মনে আছে। তালুকদার কয় : জলে ফসল বরবাদ, ও আল্লার মরজী। খাজনা দিবা না ক্যান্? “কোখন দিমু?” “আচ্ছা, দেইখ্যা লইমু।” গাঁয় পুলিশ আইলো। আব্বাজানের নাগাল পায় না। আমারে জিগায় : তোর আব্বা কোথারে, পোলা? জবাবে কই : জানিনা হুযুর। গাঁ তোলপাড়। রাইতে রাইতে আইতেন বা’জান। একদিন দুই পুলিশের মুখে পড়ছে। ধরল আব্বারে। বা’জান কয় : মাফ করেন সা’ব। জেল হোলে বাল-বাচ্চা শুখাইয়্যা মরব। পুলিশে কয় : থানায় চল্। আব্বার দু-পাশে দুগা কনিষ্টবল। খানিক দূর যাইয়্যা আব্বা দুইটারে বগলদাবা কইর্যা দিল দৌড়। ওরা বগল-তলায় বগলদাবা। চিল্লানি শুরু করে।-এক চোট হাসিয়া লইল লতিফ। মানু গম্ভীর হইয়া শুনিতেছে। তার মুখে কথা নাই।
—দু’ ব্যাডার পাগড়ী লাঠি খোন্দলে পইড়াছিল।
—দাদার কি অইল, বা-জান?
—জেল অইছিল। কি আইয়ে-যায় ঐতে? বাপের ব্যাডা।
—দাদাজান কুজা হৈ গিল, কাইশত।
—বুড়াকালে হগ্গলে অমন হয়।
—বা’জান!
—আরো কিচ্ছা আছে, ব্যাডা।
এমন সময় ঘরে ঢুকিল বরু-বিবি।
মানু ডাকে : মা, কিচ্ছা হুনো।
—কিচ্ছা!
−হ’, দাদাজানের।
অগ্নি-মূর্তি, সোজা-সটান বরু-বিবি।
—আর কাম পাওনা? কিচ্ছা-ফের বুড়া বাপের কিচ্ছা! থ্যু!
সমস্ত উৎসাহ নিভিয়া গেল লতিফের। কোন কথা মুখে সহজে যোগান পায় না।
বরু-বিবি চোখের উপর আঙুল নাচাইয়া বলিল : মানুর জ্বর, খেয়াল আছে নি?
ডাক্তার ডাহো। লতিফ আরো মাথা নিচু করিল।
—তোমাগো আব্বার লগে রইছিল মানু।
খোদা করালে কি রাইছেন, খোদারে মঞ্জুর।
—কাইল মুলুবী-সাবে কইমু পানি-দম কইরা দ্যাওনের জন্নি।
—পানি-দম! উতে প’হা লাগে না। উতে অইব কি, গোরার ডিমা?
মানু দম্পতির বাক-যুদ্ধ উপভোগ করিতেছিল।
—আব্বা। আব্বা। আব্বা। হের আছে দশ-কানি যমিন?
—চুপ কইরা যাও, বরু-বিবি। নইলে বালা অইব না।
বরু-বিবি রান্নাঘরের দিকে চলিয়া গেল দুমদাম্ শব্দে।
পিছনে বাক্য-স্রোত স-নাদ ছিট্কাইয়া পড়ে : য্যান পুত্, ত্যান আব্বা। বে- আক্কেল, হগ্গলে বে- আক্কেল,–একজোড়া পাছার কাপড় দিতা পারে না-মরদ, মরদ কয় এরে!
এই চরম সত্যের সম্মুখে নির্বাকতাই শ্রেয়। নীরব লাঞ্ছনা সহ্য করিতে লাগিল লতিফ।
.
আরো একটু রেশ রহিয়া গেল।
দশ বারো দিন পরে দুপুরে ক্ষেতের কাজ সারিয়া লতিফ ঘরে ঢুকিল। বরু-বিবি কাঁথা গায়ে বসিয়া আছে। আলনায় ভিজা কাপড়ের খোঁট বাঁধা। অন্য প্রান্ত বরু-বিবির হাতে, সে কাপড়খানি ঈষৎ দোলাইতেছে। বাতাস লাগুক তাড়াতাড়ি।
—বইয়্যা রইলে যে? জ্বর অইছে?
—হ। জ্বর অইলে তুমার গায়ে হাওয়া লাগে।
গলার আওয়াজে লতিফ আন্দাজ করিল, আর যাই হোক, জ্বর হয় নাই বরু-বিবির।
—বইয়্যা ক্যান্? বা’ত খামু না?
—এহন উইঠতে পারমু না। আপনে খাওগে।
—বরু-বিবি, ভুখ লাগছে।
—চাইয়্যা দ্যাহো না, কাম করত্যাছি।
কাপড়ের খোঁট জোরে দোলাইতে লাগিল বরু-বিবি।
—উডো, বরু-বিবি।
—ন পারতাম।
অনুরোধের ভঙ্গীতেই হঠাৎ লতিফ কাঁথা ধরিয়া টান দিল। একি! বরু-বিবি একদম উলঙ্গ।
বিবস্ত্রার চেয়েও বেশী লজ্জা পাইয়া কাঁথা ছুঁড়িয়া দিল লতিফ স্ত্রীর উপর।
উপরন্তু রসিকতা করে সে : শরম কি? খুকী পুলাপান।
—বুড়া কালে আর সোহাগে কাম নাই, বাইরি যাও।
ভারী অস্বাভাবিক বরু-বিবির চড়া স্বর।
ভিজা কাপড়ে থাকিয়া থাকিয়া কয়েকবার জ্বরে পড়িয়াছে মানুর মা। আর বেশী অত্যাচার সহ্য হইবে না। সংসার ত ওই একটি মেয়েই কায়িক পরিশ্রমে টিকাইয়া রাখিয়াছে।
—শরম নাই। ফের কয় মরদ! কবিলার গায় দশ-হাতা কাপড় জোড়ে না। কয় মরদ!
নীরবে বাহির হইয়া গেল লতিফ।
দুপুরের আহার- কাল সেদিন রাত্রের প্রহর-সীমানায় পৌঁছিল।
.
শীতের শেষাশেষি। মাঝে মাঝে দক্ষিণ বাতাস আচমকা বহিয়া যায়।
লতিফ কয়েকদিন বাড়ী ছিল না। কোন কাজে ভিন্-গ্রামে গিয়াছিল।
দুপুর বেলা ঘরে ঢুকিতেই তার চোখে পড়িল লাল-শাড়ী পরিয়া বরু-বিবি অন্য একটি কাঁথা সেলাই করিতেছে।
ভাল-মন্দ কুশল জিজ্ঞাসাবাদের ধার ধারে না লতিফ।
সোজাসুজি সে বলে : শাড়ী কুই পাইলা?
গাঁয়ের সীমান্তে মিলিটারী ক্যাম্প। ইহাদের কল্যাণে কিষাণ-পল্লীর গরীব মেয়েরা মাঝে মাঝে শাড়ীর মুখ দেখে। লতিফের মনে ক্ষোভ বিদ্যুতের মত খেলিয়া গেল।
বরু-বিবি জবাব দিল : পাইলাম।
—কুই পাইলা?
—মানুর আব্বায় দিছে।
—আমি দিছি?
—হ।
লতিফের মেজাজ তখনও বিগড়ায় নাই।
—আমি দিছি? আমি কুই ছিলাম?
—রাতে আইছিলে না?
—মানুর আব্বা, না তোর লাং?
বরু-বিবি তবু নির্বিকার। হাসিয়া বলিল : তা অইবে। দুষ কি?
—মশকরা বালা না। কও, শাড়ী কই পাইলা?
—কৈলাম না, মানুর আব্বায় দিছে।
—মানুর আব্বা-
ভয়ানক শক্ত হইয়া উঠিল লতিফের চোয়াল। বরু-বিবির লক্ষ্য কাঁথার দিকে।
—মানুর আব্বা, না মিলিটারী হারামীর পুত? তোর-
বাধা দিল বরু-বিবি : বেশ গোরা-গোরা সাব।
—কি ক’স?
মার-মুখী হইয়া উঠিয়াছে লতিফ। চোখে মুখে পাশব কাঠিন্যের ছাপ। বরু-বিবি উপলব্ধি করে, ব্যাপার আর বেশীদূর গড়াইতে দেওয়া উচিত নয়।
—বইয়ো। মাথা ঠাণ্ডা করেন সা’ব। কইছি, মানুর আব্বায় দিছে। না, তোমাগো আব্বায় দিছে।
—আমার আব্বা?
—হ।
—আমার আব্বা?
দাঁত শক্ত করিয়া লতিফ বরু-বিবির দিকে তাকায়।
—বইয়েন সা’ব। তোমাগো আব্বা। হ।
কোন সদুত্তর না পাইয়া লতিফ বসিবে না। বরু-বিবি জড়ো করা কাঁথার দিকে আঙুল দেখাইয়া বলিল : দ্যাহো নি?
—কি দ্যাখমু?
—দ্যাহো। আব্বার হেই কাঁথাডারে খুলছি। তোমাগো আব্বার কাঁথা।
—হ, কি অইছে? শাড়ী কুই পাইলা?
—মাথা ঠাণ্ডা করেন, বইয়েন সা’ব।
তারপর বরু-বিবি ব্যাপার জল করিয়া দিল।
কয়েক বছর আগে বহু আধ-শক্ত পুরাতন কাপড় দিয়া লোকে কাঁথা তৈরী করিত। বর্তমানে পরনের কাপড় জোটে না। তাহা সম্ভব নয়। সে পুরাতন কাঁথার মধ্যে এই শাড়ী পাইয়াছে। খুলিয়া ফেলার উদ্দেশ্য পুরাতন কাপড় সন্ধান।
পুরাতন কাঁথার স্তূপের দিকে চাহিয়া আশ্বস্ত লতিফ জিজ্ঞাসা করে : আর একখান পাওয়া যাবে না?
মাথা দোলাইল বরু-বিবি : না। খুইল্যা দ্যাখছি। শাড়ী ত জোডেনা করালে। তই হউরের (শ্বশুরের) দৌলতে পাইছি একখান।
বরু-বিবির সেলাই থামে না। মুখও না।
—একখান কাপড় ছিল? দুইখান অইলো না?
—আজ ভিজা কাপড়ে থাকন লাগব না।
আত্ম-প্রসাদের চিহ্ন বরু-বিবির মুখে।
সে আবার বলে : আধ-পচা কাপড় কত বসাইছে। কাঁথার ভেতর। তোমাগো আব্বা বসাইছিলো। আজকাল পচা কাপড় পিহন্নে মেলে না। তোমাগো আব্বার দৌলতে-
–হ।
লতিফ এইবার মাদুরের উপর বসিয়া পড়িল। মুখে হাসি ধরেনা তার।
—কি বরু-বিবি? তবে না কইতে, আমাগো আব্বা বে-আক্কেল।
ভয়ানক রসিকতায় ফাটিয়া পড়িতে চায় সে। অপর পক্ষ নীরব। বরু-বিবির দিকে তাকায় লতিফ। স্ত্রী অবনত মুখে ফুঁপাইতেছে। দুই চোখে পানি টইটম্বুর। হাতে সেলাইয়ের কামাই নাই।
—কি অইলো, বরু-বিবি?
—কিছু না।
—কি অইলো?
—মানুর তরে খুইল্ছিলাম। ওর কাঁথা বানামু। শক্ত ছিলো কাপড়খান্। নিজের কামে লাগাইলাম। একডা পুলা। হে’ও থলি গায়ে দি’ রাত কাটায়। আমারে মা কও?
—কাইন্দো না, বরু-বিবি। আল্লা বা’লা দিন দিবো।
বরু-বিবি কান্নার মধ্যেও জ্বলিয়া উঠিল।
—কই না তোমাগো আব্বা বে-আক্কেল। হে’ও ঐ কথা কইতো দিন-রাত। তারই পুত্ তো, আর কি অইবে কও? বে-আক্কেল, হগ্গল বে-আক্কেল।
লতিফ চুপসানো বেলুনের মত খামাখা নখে মাটি খুঁড়িতে লাগিল।