দাতব্য চিকিৎসালয়ের ইতিহাস
১.
ষ্টীম লঞ্চের আলো অকস্মাৎ নিভে গেল।
নদীর উপর থমথমে ধূসর স্তব্ধতা। ইঞ্জিন ঘরে শুধু খট্ খট্ শব্দ হোতে থাকে।
ডেপুটী মুস্তাফিজ লঞ্চের ছাদে ষ্টিয়ারিং হুইলের পাশে বসেছিল। নিচে নেমে এলো কেবিনের ভেতর।
আদেশ দিল মুস্তাফিজ : ইঞ্জিনটা বন্ধ করে দাও।
ফিস ফিস শব্দ হয় তারপর। কতগুলো মনুষ্যমূর্তি অন্ধকারে ঘোরাফেরা করে।
মুস্তাফিজ আবার উপরে এসে একটা চেয়ারে বসলো। সম্মুখে কনেষ্টবল। অন্ধকারে তার বেশভূষার কোন অস্পষ্ট ছায়াও চোখে পড়ে না।
মুস্তাফিজ আবার চাপা শব্দে বলে : দেখো সিপাহি, নিচে যাও। কিস্তি যব নজদিক আয়েগা, লঞ্চ কা বাতি জ্বালা দো।
সিপাই নেমে গেল কাঠের সিঁড়ি বেয়ে।
মুস্তাফিজ ষ্টিয়ারিং হুইলের ড্রাইভারকে বলে : আমার দিকে একটু খেয়াল রাখবেন। যা বলবো সেইমত কাজ করে যাবেন। স্কাউণ্ডেল গুলোকে আজ জন্মের মত শিক্ষা দেব।
মুস্তাফিজের মুখ দেখা যায় না।–স্কাউন্ড্রেলস্! আর একবার দাঁতে দাঁত চেপে সে উচ্চারণ করে।
নদীর পানি তরতর বয়ে চলেছে। বালু-চড়ার মুখে জলোচ্ছ্বাস বিকট শব্দে ভেঙ্গে পড়ছে। কৃষ্ণপক্ষের অন্ধকার শুধু শব্দের পরিচয় লিখে রাখে বায়ু-মহলের সমতলে।
নৌকার দাঁড়-ফেলার শব্দ হয় মাঝে মাঝে। আবার আকস্মিক স্তব্ধতা নামে নদীর চওড়া প্রাঙ্গণ জুড়ে।
সজাগ তীক্ষ্ণ-দৃষ্টিতে মুস্তাফিজ চেয়ে থাকে।
জলো বাতাসে পোড়া পেট্রোলের গন্ধ।
লঞ্চখানা স্রোতের অনুকূলে গা ভাষায় ধীরে ধীরে।
বহুক্ষণ স্তব্ধতার শাসন লঞ্চের উপর।
নিচে ইঞ্জিন-ঘরে মৃদু কলরব ওঠে। বোধ হয় সিপাইরা আর ইঞ্জিনম্যান কথা বলছে।
মুস্তাফিজ তাও বরদাস্ত করতে পারে না। আবার নিচে নেমে আসে।
—এই সিপাহি, খোদা-কা-ওয়াস্তে আজ চুপ করো।
ডেপুটী সাহেবের হুকুম। দমকা নীরবতা নামে।
মুস্তাফিজ পুনরায় ছাদের উপর। দাঁড়ের শব্দ শোনা গেল।
মুস্তাফিজ অন্ধকারে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে। স্কাউন্ড্রেলদের শিক্ষা দিতেই সে রাত্রে রোঁদে বেরিয়েছে।
নদীর এপার থেকে ধান চাল ওপারে চালান হয়। সরকারী হুকুমের তোয়াক্কা রাখে না বদ্মাস আড়তদার আর চোরা-বাজারীর দল। মুস্তাফিজ তার নিম্নস্থ কর্মচারীদের উপর বিশ্বাস রেখেছিল। সব নেমক-হারামের দল। তাই আজ নিজেই বেরিয়েছে মুস্তাফিজ। আইন অমান্যকারীদের সঙ্গে বোঝা- পড়া আছে তার।
অন্ধকারে উপনিবেশ দিগ-দিগন্তের ওপারেও যেন সীমানার চিহ্ন এঁকে দিয়েছে। নৈশ-বায়ুর অলস লীলা-গতি প্রকৃতির উপর ছড়িয়ে যায় মাদক-তন্দ্রার আবেশ। এত রাত্রি। ঘুমে মুস্তাফিজের দুই চক্ষু ভারী হোয়ে আসে। না, তবু সে জেগে থাকবে। অনেক দায়িত্ব তার। এই মহকুমার চাষী গরীব জনসাধারণের খোরাক তাকে যুগিয়ে যেতে হবে। এক দানা ধান চাল আর নদী পার হোতে দেবে না সে।
মুস্তাফিজ চোখের উপর হাত ফেরায়। ক্লান্ত অবসাদের হাই উঠে এক-এক বার।
নদীর পাড় ছেড়ে মাইলখানেক দূরেই কত না গ্রাম রয়েছে। আর রয়েছে গ্রামের সরল অবোধ মানুষ। কিছুই জানে না তারা। তাদের অসহায় অজ্ঞতার সুযোগে সফল দেশ-দেশান্তরে যায়। মুষ্টি-অন্ন তাদের নিকট পৌঁছায় না। তবু অসন্তোষের আগুন দাউ দাউ জ্বলে উঠে না কেন? মুস্তাফিজ কি সন্তুষ্ট হোতো সেই দাবানল জ্বললে? ডেপুটী সে। সরকারের প্রতিনিধি। আগুন যদি জ্বলবে, তবে তার প্রতিনিধিত্বের কি প্রয়োজন আছে? খামাখা তো সরকার তার মাইনা গোনে না। আমনা মুস্তাফিজ চিন্তার জট খোলে।
ঢাকা বিশ্ব-বিদ্যালয়ের অর্থনীতির সেরা ছাত্র মুস্তাফিজ। মুসলিম হলের ক্ষুরধার বক্তা, ছাত্র আন্দোলনের একচ্ছত্র নায়ক মুস্তাফিজ ভাবে। মার্শালের সূত্রগুলো কণ্ঠনালীর ওপাশে চাড়া দিয়ে উঠে। ডিমাণ্ড আর সাপ্লাই, চাহিদা আর যোগান-এই ত সমাজে ব্যবসার মূলনীতি নিয়ন্ত্রণ করছে। আজ ধান চালের চাহিদা বেশী, যোগান নেই। হু হু করে দাম বেড়ে যাচ্ছে। স্বাভাবিক নিয়ম। তবু, মানুষের দিকে চোখ রেখে, মানবতার দোহাই দিয়ে এই স্বাভাবিকতাকে একটু অন্য পথে চালানো যায় না কি? তবে মানুষ হোয়ে জন্মেছে কেন তারা? মানব দেহের শোণিত-রক্তিম মাংস শাইলকের মত উপড়ে-উপড়ে স্লাইস করে কেটে নিয়ে গৃধ্নতার বুভুক্ষা মেটে! সব ঘুলিয়ে যায় মুস্তাফিজের মস্তিষ্কের কেন্দ্রে। অসহায় মানব-জীবন। কোন উপায় নেই, কোন মুক্তি নেই। মানুষের মধ্যে দু-চার জন শয়তান থাকে। এই আযাযীলের বাচ্চারা না থাকলে কোন গোলমাল দেখা যেতো না দুনিয়ায়। সব চলত ঠিক ঠিক আল্লার পৃথিবীতে। ডিমাণ্ড আর সাপ্লাইয়ের সূত্র যতই না অস্বাভাবিকতা আন্ত, মানুষের মনুষ্যত্বের কাছে তার কোন পাত্তা থাক্ত না। কিন্তু মানুষ যে দেবতা নয়, ফেরেস্তা নয়। তাই এত নৈরাশ্য, এত জুল্ম, এত পঙ্কিলতার বিভীষিকা। মার্শালের ভক্ত মুস্তাফিজ নৈরাশ্যের গোলক ধাঁধায় কোন পথ দেখে না। কোন সাড়া জাগে না মুস্তাফিজের মনে। ছাত্রজীবনে জনগণের কল্যাণের স্বপ্নই রচনা করেছিল। শাসনযন্ত্রের সামান্য অংশ তার হাতে থাকলেই সে দেখিয়ে দেবে জগতকে মানুষ কি করতে পারে। আজ সে ডেপুটী, একটা মহকুমার শাসন ভার হাতে। ক্ষুদ্র সাম্রাজ্য মুস্তাফিজের।
নৈরাশ্য তবু নূতন স্থিতি খোঁজে। পদে পদে দৃশ্য অদৃশ্য বাধার জনতা। মানুষের সংস্পর্শ মাঝে মাঝে তার কাছে তেতো হয়ে উঠে। বন্ধুদের পর্যন্ত হৃদয় দিয়ে গ্রহণ করতে পারে না। অথচ কি সর্বগ্রাসী না হৃদয় ছিল তার। ছাত্র-আন্দোলনে মুকুট-হীন নৃপতিরূপে কত দম্ভ ছিল তার, কত স্বপ্ন ধরা দিয়েছিল চোখে।-All futile, সব বৃথা- সব বৃথা। মুস্তাফিজ হঠাৎ অস্ফুট শব্দ ক’রে চেয়ার ছেড়ে দাঁড়ায়। খামাখা বেরিয়েছে সে এই কৃষ্ণা প্রকৃতির বুকে নিশাচর রূপে। জোহরা তার জন্য অপেক্ষা ক’রে ঘুমিয়ে পড়েছে। আহা, বেচারা জোরা। পৃথিবীর আরো মানুষ আছে, তুমি একা পারো এত অত্যাচার- অবিচার দূর করতে? খামাখা বেরিয়ো না রাত্রে।-জোহরা বলেছিল। দাম্পত্য-জীবনের সুখ-লিপ্সা ছেড়ে সে তবু ঝাঁপ দিয়েছে কর্তব্যের আহ্বানে। উন্মাদ আর কী! সেকেণ্ড অফিসার এতক্ষণ নব-বিবাহিত স্ত্রীর আলিঙ্গনে নিজেকে ডুবিয়ে দিয়ে গাঢ় ঘুমে অচেতন। সার্কেল অফিসার সাদা ধবধবে বিছানায় শুয়ে আছে। যুবতী জায়ার নগ্ন বক্ষ হয়ত তার সিথান। মুস্তাফিজের মেরুদণ্ড শিরশির ক’রে উঠে। সে উন্মাদ ছাড়া আর কী! স্ত্রীকে একা ফেলে বেরিয়েছে বাতাসে দুর্গ রচনায়। এমন মরীচিকার পেছনে আর কতদিন সে ঘুরবে?
—এই কিস্তী রোকো।
হঠাৎ লঞ্চের আলো কটা এক সঙ্গেই জ্বলে উঠল। নদীর বুক থেকে বহু জায়গার অন্ধকার সরে গেছে।
সিপাই হেঁকে উঠল : এই, কিস্তী রোকো। মুস্তাফিজের খোয়াবে আচমকা ঘা লাগে। দুড়-দাড় শব্দে সেও নিচে নেমে এলো।
—সিপাই, কেয়া হুয়া?
—একঠো কিস্তী, হুযুর
মুস্তাফিজ টর্চ ফেলে দেখে, একটা বড় নৌকা নদীর কোল ঘেঁষে অন্ধকারে জোরে দাঁড় টেনে এগিয়ে যাচ্ছে। সম্মুখ ভাগ ছই-ঢাকা।
—ইঞ্জিনম্যান, জোর-সে।
মুস্তাফিজের পরনে হাফ-প্যান্ট আর হাফ-শার্ট। বুটের মচমচ শব্দ হয় আবার সিঁড়ির উপর।
—ষ্টিয়ারিং হুইল, রাইট।
লঞ্চ এগিয়ে যায়, সিপাই আরো জোরে হাঁকে। খুব বড় নৌকা নয়। মাঝারি গোছের মালের নৌকা।
দাঁড়ের ছপছপ শব্দ থেমে গেছে। মাঝি আর মাল্লারা টর্চের আলোয় ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে হাঁকে : সিপাইজী, গুলি ছুঁড়বেন না। আমরা নৌকা থামালাম।
মুস্তাফিজ একজন বাঙালী সিপাইকে বলে : বন্দুক তৈরী রাখো। যদি দরকার হয়।
লঞ্চ এগিয়ে এলো নৌকার কাছে। মুস্তাফিজ ছাদ থেকে বলে : সিপাই, নৌকা দেখে এসো। নৌকার দিকে মুস্তাফিজ চেয়ে থাকে।
দশমিনিট কেটে গেলো।
মুস্তাফিজ পুনরায় হাঁকে : সিপাহি, এত্না দেরী কিঁউ।
মিনিট পনর তল্লাসীর পর সিপাইরা রায় দিল : সব দেখা, হুযুর। কুচ নেহি হ্যায়। বালু-কা কিস্তী।
জবাব দিল মুস্তাফিজ : আচ্ছা, হাম দেখেগা।
—আপ মাৎ তকলীফ উঠাইয়ে।
টর্চ হাতে নৌকার উপর লাফিয়ে পড়ল মুস্তাফিজ। তিন মিনিট পরে গর্জে উঠে সেঃ তব বোলা, কুচ নেহি হ্যায়। ইয়ে সব কেয়া? সব শালে কা নোকরি যায়েগা।
একজন মাঝ-বয়সী মাঝি এগিয়ে আসে : ছেড়ে দিন, হুযুর। এই মাত্র বিশ-তিরিশ মণ চাল।
—চুপ রাও উল্লুক-কা-বাচ্চা।
মুস্তাফিজের মুখে শালীনতার আজ কোন প্রশ্ন উঠে না। সিপাইয়ের দল একদিকে বলির ছাগলের মত দাঁড়িয়ে থাকে।
—এই সিপাহি-লোগ, কেনা রুপেয়া বন্দোবস্ত কিয়া থা?
একজন সিপাই ফুঁফিয়ে কাঁদে : হুযুর বিশ রুপেয়া।
—জমাদার, ইয়ে কিন্তীকা পাহারা মে রহো। হাম থানা- সে আওর সিপাহি ভেজ দেগা কাল সোবেহ। এক আদমী কো ভী মাৎ জানে দো।
অন্য সিপাইয়েরা ভয়ে ভয়ে লঞ্চে উঠে আসে। তারপর শুরু হয় তম্বীর পালা। মুস্তাফিজ সিপাইদের শুধু গুলি করতে বাকী রাখে।
লঞ্চ আবার এগিয়ে যায়। বিজয়-সাফল্যে মুস্তাফিজের বুক ভরে ওঠে। সরকারের সব কর্মচারী যদি তার মত হোত! শুধু এক ফোঁটা মনুষ্যত্ব দরকার। শুধু-
নীল তারাকীর্ণ আকাশ ভেসে চলেছে। হাল্কা মেঘ কোথাও কোথাও থমকে গেছে। নদীর পাড়- ভাঙার শব্দ হয়। প্রকৃতির রহস্যময়ী রূপ চারিদিক কি এক মৌন গম্ভীর পরিবেশে আচ্ছন্ন রাখে। নাটকের অভিনয় চলছে নিচে মানবের পৃথিবীতে। উপরে শান্ত নভোমণ্ডল আদিমতার দুর্জ্ঞেয় শ্লোক- গাথায় সঙ্গীত পরিবেশন করে। ছলাৎছল ঢেউয়ের শব্দ, স্রোতের কল-নিনাদ, নৈশ পাখীদের চীৎকার, হঠাৎ-ডেকে-থামা শ্বেত চিলের অন্ধকার-বিলাস, বাদুড়ের অভিসার রাত্রির তিমির-নিকুঞ্জে বিচিত্র রাগিনীর আসন পাতে।
মুস্তাফিজ কোন স্বোয়াস্তি পায় না। সাদা বালু চরের এক জায়গায় কতগুলো ঝোপ-ঝাড় তার চোখে পড়ে। এখানে অন্ধকার আরো ঘন মনে হয়। শেয়ালের হট্টগোল চলছে। লঞ্চের আলো বন- রাজ্যের সংবাদ দিতে পারে না।
মুস্তাফিজ একজন বাঙালী সিপাইকে জিজ্ঞাসা করে : এ জায়গা চেনো?
—খুব, হুযুর।
—শেয়ালগুলো এমন করছে কেন?
—ওদের মরসুম পড়েছে আজকাল, হুযুর।
বাঙালী সিপাই নৌকার ভেতর তদারকে যায়নি। মুস্তাফিজের চোখে আপাততঃ সাধু। তাই ছাদের উপরে সে পাহারা-রত।
—কি বলছ?
—ওরা ভালই আছে। শেয়ালেরা না খেয়ে মরে না।
—কি খাচ্ছে?
—মানুষের মড়া। এই অঞ্চলে লোক ত কম মরছে না। বেশীর ভাগ কবরও দেয় না। নদীতে ভাসিয়ে দেয়। চরে আকালে শেয়ালেরা ঝোপে তুলে নিয়ে যায়।
মুস্তাফিজ আর কথা বলে না, নিঃশব্দে চুপ করে থাকে।
লঞ্চ নদীর বাঁক পার হোয়ে গেল। ঝোপ-ঝাড় আড়াল হয় ক্রমশঃ। শৃগালের যজ্ঞ-উৎসবের কোলাহল তখনও মুস্তাফিজের কানে ভেসে আসে। সামনে নদীর পাড়ে কয়েকটা বস্তী। এত রাত্রেও কান্নার শব্দ শোনা যায়।
সিপাই বলে : কলেরায় এখানে বহুলোক মরছে। সেদিন স্যানিটেরী বলছিল।
কোন ভাল ডাক্তার পর্যন্ত এই এলাকায় নেই। মুস্তাফিজ তা জানে। এক বছরে মহকুমার বহু জায়গা ঘুরেছে সে।
মুস্তাফিজ সিপাইকে বলে : আর একবার নিচে যাও, আলো নিভিয়ে দিক। লঞ্চের এই পাশে কতগুলো নৌকার গতিবিধি সন্দেহ জনক।
এক মিনিটে আবার লঞ্চের আলো নিভে গেল।
লঞ্চ চলে। ঘটঘট ইঞ্জিনের শব্দ খুব জোর নয়। ঢিমে তেতালা গতি।
মুস্তাফিজের হাই উঠে। আর ভাল লাগে না। তবু একটা আসামী ধরা পড়েছে। অন্যান্যদের পক্ষে শিক্ষার জন্য এটা যথেষ্ট।
সিপাই পাশে বসেছিল। সেও ঘুমে ঢুলছে।
—সিপাই?
—হুযুর।
—ঐ আসামী নৌকাটা কার?
—আব্দুল জলীল তরফদারের।
আব্দুল জলীল তরফদার। মুস্তাফিজের এই নাম ভাল-রূপে মনে আছে। জলীল তরফদার এই অঞ্চলের ডাকসেটে ধনী আর আড়তদার। যমীদারীও আছে তার। তা থাক। লাট-বেলাট হোলেও মুস্ত াফিজের হাতে তার রেহাই নেই
আব্দুল জলীল তরফদার।
অন্যমনস্ক মুস্তাফিজ আর একবার নামটা উচ্চারণ করল।
এগিয়ে যায় লঞ্চ। এইখানে নদীর দুই পারে ঘন বসতি। মুস্তাফিজ দিনের পৃথিবীর কথা স্মরণ করে। অন্ধকারে বহু লোক করাল ব্যাধির কবলে ধুঁকছে। চিকিৎসা নেই, পথ্য নেই। একটা মাত্র স্যানিটেরী ইন্সপেক্টর এই অঞ্চলে। কত কলেরার টাকা সে দিতে পারে? একা মানুষ। সরকারী ডাক্তারখানা যদি একটা থাকত! স্বপ্ন দেখে মুস্তাফিজ। জেলা বোর্ডের কর্তৃপক্ষদের সঙ্গে একবার আলাপ করে সে দেখেছিল। পঁচিশ হাজার টাকা দরকার একটা ভাল ডিস্পেন্সারীর জন্য। পাঁচ হাজার টাকা রিলিফের তহবিলে সংগ্রহ করেছিল। আরো বিশ হাজার টাকা দরকার। নিভে আসে উৎসাহ। উর্ধতন কর্মচারী কমিশনার পর্যন্ত তার ফরিয়াদ এগিয়েছিল। কোন জবাবই আসেনি।
সোনার চাঁদ দেশের ছেলে সব, আত্মবিশ্বাসের ভিতে ঘুন দেখে আজ। বিশ্ব-বিদ্যালয়ের শিক্ষা এমন ব্যর্থতার সম্মুখীন করে মানুষকে, তার পরিচয় আগে জানা থাকলে মুস্তাফিজ সারা জীবন মূর্খ থাকতে স্বীকৃত হোত। চতুর্দিকে ব্যর্থতার হাহাশ্বাস ধ্বনিত হয়। All futile all futile, সব বৃথা সব বৃথা। না, দশ জনের জন্য সে কেন খোঁয়ার হোতে যাবে? জোহরা এতক্ষণ ঘুমিয়ে পড়েছে। তার শূন্য শয্যার উপর এলিয়ে রয়েছে জোহরার স্পর্শাতুর সুঠাম বাহু। নিশাচরের স্ত্রী রাত্রে জেগে থাকে না। স্ববিরোধী সামাজিক জটাজালের মত এটাও আর এক স্ববিরোধী ঘটনা। ব্যঙ্গ হাসি মুস্তাফিজের ওষ্ঠে রেখায়িত হয়। জাহান্নামে বসে পুষ্পের হাসি সাজে না।
মুস্তাফিজ আর একবার হাসে।
সিপাই নিকটে না থাকলে উন্মাদের মত হেসে উঠত সে। মাথা দপদপ করে। মনুষ্যত্বের দিন কী শেষ হোয়ে গেছে?
জোহরা সেদিন অভিযোগ করেছিল : তোমার জন্যে ক’জনের মাথা ব্যাথা আছে? আরো ত অফিসার রয়েছে। তুমি শুধু দিন রাত টইটই ঘুরবে। সি. ওর (সার্কেল অফিসার) বউ দেখনা কেমন মজায় আছে। দু’জনে বিকেলে সিনেমা, সকালে বেড়ানো- কপোত কপোতী। আর তুমি?
—আমরা জালের মাকড়সা আর মাকড়সানী।
—তা ধরে খাওয়ার হোলে এতদিন খেয়ে শেষ করে মুসাফির সেজে বেড়াতে।
—মুসাফিরেরও মুসাফিরনী দরকার হয়।
—দরকার হয়ত সংসার করো।
—অর্থাৎ আঁচল-চাপা আমার ‘নিতান্ত অনুগত ভৃত্য’ হয়ে থাকো।
মুস্তাফিজের কানে সেদিনের হাসির শব্দ ভেঙে পড়ে। না, আর নয়। নিশাচর জীবন চিরদিনের মত শেষ হোক।
গাছ-পালার স্তব্ধ ছায়া দুই তীর ঘেঁষে আরো ঘন অন্ধকার ছড়ায়। বাঁকের মুখে স্রোতের তোড় বেশী। ছোট লঞ্চ ঢেউয়ে টলমল করে।
আবার আলো জ্বলে উঠল। মুস্তাফিজ সচকিত হয়।
—সিপাই, নিচে চলো।
কনেস্টবল নিচে থেকে হাঁকে : হুযুর, আওর একঠো কিস্তি।
মুস্তাফিজের বুটের মচমচ শব্দ হয় সিঁড়ির উপর।
কেউ টর্চ জ্বালে না। লঞ্চের আলোয় একখানা মাঝারি গোছের নৌকা দেখা যায়। একজন মাত্র দাঁড়ী। মাঝি হাল ধরে বসে আছে। তার সম্মুখে পাটাতনের উপর পাঁচ ছয়জন লোক উপবিষ্ট।
সিপাইয়ের কণ্ঠস্বর নিশীথিনীর বুকে ফেটে পড়ে : এই নৌকা, লঞ্চের কাছে নিয়ে আয়।
পুলিশের লঞ্চ, মাঝির বোঝার দেরী হয় না। আর একবার দাঁড়ের ছপ্ছপ শব্দ হয়।
দু-মিনিটের ভেতর নৌকাখানা লঞ্চের গা ঘেঁষে থাম্ল।
মুস্তাফিজ প্রশ্ন করে : এত রাত্রে তোমরা কোথা যাবে?
—ঐ গাঁয়ে যাচ্ছি, হুযুর।
—গাঁয়ের নাম নেই?
ভারী ঝাঁঝালো কণ্ঠ মুস্তাফিজের।
—জলীপুর।
—সে ত নদীর ওপারে। অন্য জেলা।
—জী হুযুর।
—কি আছে তোদের নৌকোয়? ধান-চাল থাকে সত্যি বলবি।
মাঝির সামনে পাঁচ-ছ’জন লোক বসেছিল। তাদের মাঝখানে খালি গা ঝাঁকড়া চুল একজন যুবক দেখা গেল।
সে হাঁটুর ভেতর মুখ গুঁজে বসেছিল। মুস্তাফিজের কণ্ঠস্বর তার কানে যায়।
জবাব দিল সে : ডেপুটি সাহেব, বেশ ধান-চালের নৌকা দেখেছেন।
ব্যঙ্গ-স্বরে মাজা গলা।
মুস্তাফিজ তার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি মেলে।
–কে রে তুই, ছোকরা।
—রাগবেন না, ডেপুটি সাহেব। এটা ধান-চালের নৌকা নয়, দেখছেন না?
নৌকার মাঝখান একটা বড় সাদা চাদরে ঢাকা। ভেতরে কি আছে, কিছু দেখা যায় না।
—কি আছে নৌকার ভেতর চাদর-ঢাকা?
মুস্তাফিজ জিজ্ঞাসা করে।
—লাশ।
—লাশ!
—জী।
—খুন করেছ বুঝি?
যুবক মুস্তাফিজের দিকে তাকায়।
—খুন আমরা করিনি।
—তবে কে খুন করেছে?
—আপনারা।
—আমরা! বেশ ছোকরা ত তুমি।
—হ্যাঁ আপনারা। ঘুষে চোরা কারবারের সহায় হোয়ে আপনারা, যারা মানুষের বাঁচার সব আশ্রয়- কথা বেধে যায় যুবকের কণ্ঠে। শূন্য তারকা খচিত নীল আকাশের দিকে মুখ তুলে সে বলে : আপনারা নন? তবে ঐ আকাশের আল্লা, পরওয়ারদেগার।
দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে যুবক।
রাত্রি এগিয়ে চলেছে। অসহিষ্ণু মুস্তাফিজ।
—ও সব হেঁয়ালি রাখো। ব্যাপারটা কি বলো। খুনোখুনি?
—আমার বিবির লাশ, হুযুর। নদীর এপারে আমার শ্বশুর ঘর। বাপের বাড়ী এসেছিল। কলেরায় আজ মারা গেল।
যুবক আর কথা বলে না। হাঁটুর ভেতর মুখ ঢেকে হঠাৎ সে ফুঁপিয়ে উঠল।
—ঠিক বলেছ? লাশ? অন্য কিছুই নেই?
সমবেতকণ্ঠে নৌকার যাত্রীরা বলে : না, হুযুর
মুস্তাফিজ নিজে টর্চ জ্বালে এবার। নৌকার চারি কোণে আলো ফেলে শ্যেন দৃষ্টি সজাগ করে।
—কিছু নেই? ব্যাসদের ছল আমার জানা আছে। এই সিপাই, চাদর তুলে দ্যাখ্।
নৌকার মাঝি একজন সাদা-দাড়ীওয়ালা বৃদ্ধ লোক।
সে জবাব দিল : না হুযুর, তা হয় না। জানানার লাশ দেখতে চান? মুসলমান তা পারে না। মুস্তাফিজ সামান্যক্ষণ চুপ করে। তার কণ্ঠস্বর আরো কর্কশ-তীক্ষ্ণ হোয়ে উঠে।
—যাও সিপাই, দেখো।
সিপাই ইতস্ততঃ করে।
—যাও।
হাকিমের কণ্ঠস্বর আরো তিক্ত ও তপ্ত।
হাঁটুর মধ্যে মুখ গুঁজে যুবক এতক্ষণ বসেছিল। হঠাৎ যেন সে জেগে উঠেছে। সুপ্তোত্থিত-কণ্ঠে জবাব দিল : ডেপুটি সাহেব,আপনার সিপাই নৌকায় উঠলে ভাল হবে না।
যুবকের আওয়াজ হঠাৎ রোখালো হোয়ে উঠে
—ভাল হবে না, দেখবেন।
—ভাল হবে না! তবে রে ষ্টুপিড-
মুস্তাফিজের কণ্ঠস্বর রুক্ষ কাঠিন্যের প্রতীক।
—সিপাহি …
—আমার কথা শুনুন, ডেপুটি সাহেব।
—সিপাই, যাও।
—ডেপুটি সাহেব, আপনি চাদর তুলে নিজের সন্দেহ দূর করতে চান? চাদর তুলতে পারব না। ঐ চাদরটাই কাফন হবে। আর তো কাপড় নেই। উলঙ্গ লাশ কোনরকমে গোসল করিয়ে সাদা চাদর ঢাকা দিয়ে এনেছি। কবরে ওটাই হবে কাফন। এখন যদি কাফন করি, উলঙ্গ লাশ কি করে নিয়ে যাই। জানেন তিন পর্দা কাপড় চাই।
খুব দ্রুত কথা বলে যুবক। মুস্তাফিজের মুখে আর কথা ফোটে না। হতবাক অপরাধীর মত সে লঞ্চের রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে থাকে।
—আপনি হাকিম, আমাদের মা-বাপ। আসুন, আপনার সন্দেহ রাখব না। লাশের পায়ের দিকটা দেখে যান। জায়েদ চাচা, ওদিকের চাদরটা তোলো তো।
—থাক-না না
মুস্তাফিজের কণ্ঠস্বর আর স্পষ্ট উৎসারিত হয় না।
.
২
মহকুমা হাকিমের কোয়ার্টারের কম্পাউণ্ড।
চারিদিক ফুল আর শাক-সব্জীর উদ্যান মনে হয়। দোপাটী ফুলের কেয়ারি একটা ছোট খণ্ড-জমির সীমানা ঘিরে। মাঝখানে বীট আর শালগমের গাছ। আরো নানা রকমের ক্ষেত বিভিন্ন অংশে।
সকাল বেলা মুস্তাফিজ বাগানের কাজে মত্ত। জোহরা শাড়ীর আঁচল গুটিয়ে মালিনী সেজেছে।
হাতে দাউলী দোপাটী গাছের গোড়ার আগাছা পরিষ্কার করছিল মুস্তাফিজ। একটা ছোট ঝুড়ির ভেতর আগাছা জমা হয়- শতমূলী, দূর্বা আরো নাম-হীন ঘাসের প্রতিবেশী।
জোহরা একঝারি পানি এনে রাখল মুস্তাফিজের সম্মুখে।
—আমার কাছে নয়। ওই দিকে। উত্তর কোণে দুটো ফুলগাছ শুকিয়ে যাচ্ছে, তুমি পানি দিয়ে এসো। আমি এদিকের কাজ শেষ করি।
কোয়ার্টারের মালী আর পিয়নেরা হাকিমের খেয়াল দেখে হাসে। তা হাসুক তারা। মুস্তাফিজ এই কাজে কারো সাহায্য ভালবাসে না এক জোহরার ব্যতীত। মালীরা এগিয়ে এলে ধমক খায়।
—তোমরা যাও, যাও। আমি একাজ একাই ভালবাসি।
কম্পাউণ্ডের মাঝখানে টিউব-ওয়েল। ঝারি ভরে মালীরা পানি আনবে, সে সাহায্যও মুস্তাফিজের না-পছন্দ। জোহরা টিউবওয়েলের হ্যাণ্ডেল টেনে-টেনে অস্থির হয়। কিন্তু সে আরো হাসিমুখে কাজ করে।
চৈত্র মাস। ফাল্গুনীর বিদায়-সঙ্গীত আরম্ভ হোয়েছে পত্রে পত্রে। মুস্তাফিজ সকালে উঠে বাগানের কাজে লাগে। একটু পরেই আসে জোরা। এটা তাদের ধরা-বাঁধা নিয়মে দাঁড়িয়ে গেছে। কোন শিশুর ঝামেলা এখনও এই ঘরে দেখা দেয় নি। জোহরা নির্ঝঞ্ঝাট।
—ও গাছ দুটো বাঁচবে না বোধ হয়।
মুস্তাফিজ একটা শতমূলীর গোড়ায় দাউলী চালিয়ে হাত থামায়। তারপর জোহরার মুখের দিকে চেয়ে থাকে।
—তোর এ বারতা, রে দূত-
তারপর হেসে ফেলে নিজেই। জোরাও যোগ দেয়।
—বাঁচলে ভাল। তবে সন্দেহ আছে।
—আচ্ছা, আমি একবার দেখব।
কম্পাউণ্ডের ভিতর পাতা-ঝরা উলঙ্গ তরুর দল। সূর্যের রক্তিমাভা ছড়িয়ে পড়েছে পূর্ব দিগন্ত ভরে। দোপাটীর কেয়ারি ঝকঝক্ করে। একটা কুটো ঘাস পর্যন্ত আর চোখে পড়ে না। জোহরা প্রজাপতির মত ঘুরে বেড়ায় বাগানের কোণে কোণে।
দাউলী হাতে মুস্তাফিজ উঠে পড়ল।
একটা গন্ধরাজ নুয়ে পড়েছে। জোহরা কঞ্চি দিয়ে দু’টো ডাল বাঁধছিল। ঝাঁকড়া গন্ধরাজের আড়ালে তাকে দেখা যায় না।
মুস্তাফিজ ডাকে : জোহরা।
জোহরা ছুটে এলো।
—চলো, একটু জিরিয়ে নিই লনে বস্।ে আজ বহুৎ মেহনৎ করলাম।
—আমার সাহায্য চাইলে না কেন?
—বহু সাহায্যের দরকার, তাই আজ আর ডাকিনি।
দুইজনে লনের উপর গিয়ে বসে পড়ে।
মৃদু ঠাণ্ডা চৈত্রের প্রভাতী হাওয়া। লনের চারপাশে সজীব পলতে-মাদারের বন। টেনিস কোর্টের সাদা দাগ চক্চক্ করছে।
জোহরার পাশে হাত পা ছড়িয়ে শুয়ে পড়ল মুস্তাফিজ। সত্যি শ্রান্ত সে। হাতের কামাই ছিল না এতক্ষণ।
সংলাপের মাঝখানে শুয়ে শুয়েই মুস্তাফিজ বলে : কয়েকদিন আগে একটা ভারী অন্যায় কাজ করেছি।
কৌতূহলী জোহরা। মুস্তাফিজের মুখের দিকে তাকায়।
—শুনি ব্যাপারটা।
—রাউণ্ডে বেরিয়ে নদীর ভেতর নৌকায় একটা লাশ পাওয়া গেল। চাল-ধানের নৌকা ধরতে গিয়ে পাওয়া গেল লাশ। কলেরায় মারা গেছে মেয়েটা। কাফনের কাপড় নেই। শুধু চাদর-ঢাকা।
জোহরা স্বামীর অনুভূতি বোঝে। চুপ করে থাকে না সে।
—কাফন নেই!
—না। কাফনের বন্দোবস্ত করে দিলাম। কিন্তু লাশ নদীর ওপারে নিয়ে যেতে দিলাম না। আবার ওপারেও কলেরা শুরু হবে হয়তো।
—সেতো ভাল কাজ করেছ।
—ভালো? না।
চুপ করে গেল কিছুক্ষণ মুস্তাফিজ।
—ভাল নয়, জোরা। তার স্বামী নাছোড়বান্দা, কেঁদে ফেলে শেষ পর্যন্ত। বলে, আমার বাড়ীর কাছে কবর দিলে তবু গোরটা রোজ দেখতে পাব। কিছুতেই টল্লাম না। এই পাশে কলেরা লেগেছে। আবার ওদিকে ছড়াক তা ভাল নয়। শক্ত হোয়ে গেলাম। নদীর ধারে কবর দিয়ে ওরা ফিরে গেল।
মুস্তাফিজ আর কথা বলে না। জোহরা তার হাতের আঙুলের ভেতর নিজের আঙুল চালায়।
উল্লাস-মুখর এই সকাল। মুস্তাফিজ অস্বোয়াস্তি বোধ করে। জোহরার চোখ অনেক দূরে গিয়ে মিশেছে। তার বিষণ্ণ কপোলের দিকে চেয়ে মুস্তাফিজ নিস্তব্ধতার হাহাকার আরো নিবিড়ে অনুভব করে। না, আর নয়। বালুচরে ইমারত রচনার সখ সে করবে না। কপোত-কপোতীর মত শান্ত নীড়ে স্বপ্ন দেখার চেয়ে সুখের আর কী আছে?
সূর্যের আলোয় রেঙে উঠেছে জোহরার উদ্ভিন্ন যৌবন-উচ্ছল মুখ। মুস্তাফিজ চেয়ে থাকে। না, দিগন্ত ভ্রমণের নেশা আর নয়।
স্তব্ধতার বেড়াজাল জোর করে ছিঁড়ে দিল মুস্তাফিজ।
—চুপচাপ বসে লাভ নেই। নাস্তা করতে হবে, ক্ষিদে লেগেছে।
—আমি সকালে উঠে সব ঠিক করে রেখেছি। বাকী শুধু রুটি সেঁকা।
—তোফা, তোফা। আজ ধরণী আপন হাতে, অন্ন দিলেন আমার পাতে।
রবীন্দ্রনাথের ভক্ত মুস্তাফিজ শিস দিতে দিতে গান করে।
জোহরার নরম আঙুল তার হাতের ভেতর পীড়িত হোতে থাকে বার বার।
.
৩
মুস্তাফিজের ডায়েরীর দুশো পঞ্চাশ পৃষ্ঠা।
আজ স্বাধীনতা দিবস। এই অঞ্চলে কোন গোলমাল বাধেনি। আজ বাইরে বেরুলাম না। অন্যান্য সহকর্মীদের উপর শান্তিরক্ষার ভার ছেড়ে দিয়েছি। নেমকের সম্মান আজ রাখতে পারলাম না। জোহরার জিদ জীবনে প্রথম বিজয়ী। …
আর কোন জয়ের মাল্য পড়বে না তার গলায়। চৈতন্যদেবের দেশের মেয়ে এরা। লতার মত বিনয়ই এদের প্রাণ। পুতুল, প্রাণ নেই। নিজের অধিকার জোর করে আদায় করতে জানে না। মাথায় তুলে রাখো, সেও ভাল। পায়ে জায়গা দাও, অভিমান করবে না। শুধু একটু ঠাঁই দাও। যদি কিছু নাও পায়, চোখের জল সম্বল করে সারা জীবন চেয়ে থাকবে। রিক্ত মরুভূমির প্রত্যাশা। তবু ওদের তৃষ্ণা শেষে অন্তরস্রোতে কূল খুঁজে পায়। বাংলা দেশের মেয়েদের তুলনা। একমাত্র ফল্গুনদী।…
২৬শে জানুয়ারী, রাত্রি দশটা।
এক হোয়ে যেত ঘর আর প্রান্তর! প্রান্তরের দিকে উধাও-প্রাণ বিবাগী হোতে চায়। ঘর ভেঙে যায় ঝড়ে। গৃহ-কোণে প্রাণ বেঁধে বাতায়ন দিয়ে প্রান্তরকে দেখে মন ভরে উঠত যদি! আমাকে সেই সমাজ দাও, হে খোদা। পাখীর মত আকাশ বিহারের আকাঙ্খা ছিল মানুষের। বাতাসকে আয়ত্তে আনার কৌশল জানা ছিল না। অপূর্ণ সাধ থেকে গেছে মানুষের জন্ম জন্মান্তর। আজ নীল আকাশ আমাদের পায়ে চলার পথ।…শুধু প্রাণের সারল্য বা মহিমার বলে পৃথিবীর সমাজ এগিয়ে যায় না। সেই পৃথিবী গড়ার হেকমত জানা চাই। আমাকে দাও তোমার গোলকধাঁধাঁর জবাব। আমি ঘর আর প্রান্তর এক করে দেব। সমাজ আর গৃহ-কোণ একই প্রাঙ্গণে মিশে থাকবে। বড় আকাঙ্খা যদি দিলে, পূর্ণতার পথের হদিস বলে দাও।…তোমার মহাপুরুষেরা যুগে যুগে একই কথা বলে গেছেন, একই তাঁদের লক্ষ্য। তবে যুগে যুগে তুমি এত মহাপুরুষ কেন পাঠিয়েছিলে? একজন হোলেই তো চলত।…
২৭শে জানুয়ারী।
‘আ’ ‘হ’ ইত্যাদি অফিসারের গতিবিধি সন্দেহজনক। ওদের উপর কড়া নজর রাখা কর্তব্য। ঘুষ ছাড়া এরা কী বাঁচতে পারে না! এরা কি মানুষ নয়! কতদিন কাঁহাতক এদের পেছন-পেছন ঘোরা যায়। আমার মনোবৃত্তি ধীরে ধীরে কোথায় তলিয়ে গিয়েছে আজ বুঝতে পারি। বাঁধন দিয়ে মানুষকে ভাল করা অসম্ভব। যারা বাঁধনের স্রষ্টা, তারাও শেষে এই জালে জড়িয়ে পড়ে। পাকা অফিসার রূপে আমার খ্যাতি বাড়ছে কর্তাদের কাছে, কিন্তু আমি যে তলিয়ে যাচ্ছি। আর কয়েক বছর পরে আমার ঘরেও এই মনোবৃত্তির ছায়া পড়বে। স্ত্রীকে হয় তো আমি সন্দেহ করব, গোটা পৃথিবীকে সন্দেহ করব।… আমার মনুষ্যত্ব টিকে থাকবে তারপর?
৩রা ফেব্রুয়ারী।
আব্দুল জলীল তরফদারের মামলা দায়ের হোয়েছে। কঠোর শাস্তি পাওনা এই শয়তানদের। সাক্ষীরা বেশ জবর। টাকা দিয়ে ওদের ফুলানো মুশ্কিল। এই অঞ্চলের ব্যবসাদার, যারা তৈমুরলঙ্গের মত হাড়ের ইমারতের স্বপ্ন দেখে, তাদের বুঝিয়ে দিতে হবে মানবতার তরুমূল এখনও একেবারে শুকিয়ে যায়নি। মানুষ বেঁচে আছে পৃথিবীতে।
৬ই ফ্রেব্রুয়ারী।
পুলিন সাহার দালাল এসেছিল আজ দপ্তরে। একটা নৌকা গমনাগমনের ‘পারমিট’ লিখে দিতে হবে। দাতব্য চিকিৎসালয়ের উপর আমার ঝোঁক আছে, তারা জানে। সব টাকা দিতে রাজী আছে সাহা। বিশ হাজারের কম নয়। এই একমাত্র সুযোগ। সরকারী প্রত্যাশা করলে কোনদিনই স্বপ্ন সফল হবে না। কিন্তু এই অঞ্চলের চাষী মজুরদের ডাল-চালের অভাব মেটাব কোথা থেকে? একটা মাত্ৰ নৌকা। কত মাল চালান দিতে পারে তার সাহায্যে? কিছু লোকের সামান্য কষ্ট হবে। তা হোক। একটা প্রথম শ্রেণীর দাতব্য চিকিৎসালয় দেবে এই অঞ্চলের বহু মানুষকে নূতন জীবন। বহু মৃত্যুপথ-যাত্রী ফিরে আসবে। ম্যালেরিয়া, কলেরার প্রকোপে গ্রাম এমন অসহায়রূপে উৎসন্ন যাবে না। শঙ্কা জাগে, সাধুতার পথ নয় এটা। সাধুতার কোন পুরস্কার নেই-সেটাও বিস্মৃত হোতে পারিনে। কর্তব্যের তেপান্তর কাঁপে…
৯ই ফেব্রুয়ারী।
অন্যান্য অফিসারেরা দাতব্য চিকিৎসালয় প্রতিষ্ঠা কল্পে পঞ্চমুখ। আর কোনদিন তাঁদের এই উৎসাহ দেখিনি। পুলিন সাহার সঙ্গে সকলের হৃদ্যতা বেশী। তাই কি আমার প্রেরণা খুলবে তাদের নূতন জীবিকার পথ? এত সন্দেহ! না, মনের খেই হারিয়ে ফেলছি দিন দিন। সব মানুষকে এত ছোট করে দেখছি কেন? যাই হোক, তারাও আমার মত নরাকার মানুষ। এত নরাধম হবে কেন?
১১ই ফেব্রুয়ারী রাত্রি দশটা।
দাতব্য চিকিৎসালয়। টাকার কোন অভাব নেই। কমিশনারকে ট্রাষ্ট্রীদের নাম পাঠিয়ে দিলাম আজ। আর বেশী দেরী করব না। দু-সপ্তাহের মধ্যে কাজ শুরু করা যাক। সিমেন্ট এই অঞ্চলে বেশী কাউকে দেওয়া হবে না। অনেকের নিন্দাভাজন হওয়া ছাড়া আর উপায় নেই।
আর এক বিষয়ে বড় দেরী হোয়ে যাচ্ছে। তরফদারের মামলা। সাক্ষীর শুনানি হোয়ে গেছে। আর একজন বোধ হয় বাকী। রায় তারপর। রায় আমার মুখস্থ আছে। এই শয়তানদের শিক্ষা দিতেই হবে।
১৫ই ফেব্রুয়ারী।
এই আমার দেশ। উপরে চুনকাম হয়ত আছে, নিচে ধ্বসে যাচ্ছে বালুর প্রতি কণা।… সেই কণাই সমাজের ব্যষ্টি, আমার দেশের মানুষ, যারা গ্রামে থাকে শহরে থাকে, সমাজের সবচেয়ে নিচে যাদের আসন।…উত্তাল ঢেউয়ের মত বাধা আছড়ে পড়ে চারদিকে। অসহায়ের মত আর কতদিন দীর্ঘশ্বাস ফেলা। তাই কি মহাপুরুষেরা স্বর্গের দেশ রচনা করেছিলেন? দুমড়ে-যাওয়া আকাঙ্খা, অপূর্ণ সাধ, আর নিষ্পিষ্ট প্রাণ-বেগ যে দেশে অনাবিল শান্তির প্রলেপে ঘুমাবার ছুটি পায়। পৃথিবীর কোন মানুষই যদি পৃথিবীর স্বর্গভোগ না করত, কোন সন্দেহ ছিল না সেই মহাপুরুষদের মহত্ত্বে।…অবিশ্বাসী মন আজ অকূলে সাঁতার কাটে শুধু, নিঃসীম ধূ ধূ করে নিরাশার বালুচর।
…জোহরা আমাকে জানে না, চেনে না। তবু আমাদের সাথেই এই মেয়েরা জীবনের গাঁট-ছড়া বাঁধে। এর চেয়ে আর কি কঠিন কৌতুক আছে জীবনের সঙ্গে!…
.
৪
কোয়ার্টারের কম্পাউণ্ডে কৃষ্ণচূড়ার ডালে ডালে আগুন লেগেছে।
চৈত্রের ভৈরবী বাতাসের মাদকতা ছড়িয়ে পড়ে কেয়ারির পাঁজরে পাঁজরে। দোপাটী ফুলেরা হাসে। গন্ধরাজের সবুজ পাতার ভেতর সাদা তারার ঝালর ঝলসে উঠে। অতীতের সহস্র মৃত বসন্ত এক মুহূর্তে পুনরুজ্জীবন লাভ করেছে। বিগত গ্রীষ্মের দগ্ধ দুর্বাদল মোহন-মাধুর্যে লনের চত্বর ছেয়ে ফেলে।
মুস্তাফিজের জীবনে কৈশোরের পর এই বুঝি যৌবন-বসন্তের প্রথম দোলা লাগল।
দাতব্য চিকিৎসালয় গড়ে উঠছে। দিন নেই, রাত নেই। এক শ’ কামীন-মুনীশ মেহনৎ করছে। মুস্তাফিজ নিজে পর্যন্ত রাজমিস্ত্রীদের যোগাড় দিয়েছে। স্বেচ্ছায় বহু গ্রামের যুবক দিন-রাত খাছে। শ্মশানে বাগানের স্বপ্ন কেউ কোনদিন দেখেনি ।
আর মাত্র পনরদিন বাকী। তারপর, শুরু হবে নূতন জীবনাভিসার। ডাক্তার, কম্পাউণ্ডার, নার্স, রোগী, মালী-মানুষের কল-গুঞ্জন নদীর এই নির্জন বাট ভরে তুলবে, ক-মাস আগে সে জানত?
জোহরা লনের ঘাসের উপর বসে বলে : তোমার উদ্যমের সত্যি অন্ত নেই।
—কতটুকু উদ্যম দেখলে? তবু যদি কাজের দোসর পেতাম। কী করা যায় এই হাকিম সেজে? পদে পদে হাত-পা বাঁধা। মানুষের ভাল করবে, তবু হুকুম দরকার- স্যাংকশান, অর্ডার, কত হাঙ্গামা। বেশী ভাল কাজ করো, গালাগাল খাবে। না করো, তারও মজুরি গালাগাল। অথচ আমরাই দেশের মুরুব্বী।
জোহরা চঞ্চল হোয়ে উঠে। তাদের নিজের হাতে-গড়া বাগানে এত ফসল ফলতে পারে! কত রকমের শাক-সব্জী। ফুলের বাহার সবদিক মত্ত করে রেখেছে।
—আমার হাতের গাছগুলো দেখো।
জোহরা বলে।
জিজ্ঞাসা করে মুস্তাফিজ : কোন্ গাছ?
—ঐ দোপাটী গাছগুলো।
—সেটা হাতের মহিমা-গুণ।
—আর তোমার হাত?
মুস্তাফিজ হাসে : আমার হাতে থাকে না। এই হাতেও সামান্য রিনিঠিনি-রব থাকলে বাগানের গাছ রৌদ্রেও জ্বলত না।
জোহরা মুখ লুকায় আঁচলে। চাপা হাসির তরঙ্গ আসন্ন সন্ধ্যার বুকে ঝঙ্কার তোলে।
—চলো, দেখা যাক তোমার দোপাটী গাছ।
মুস্তাফিজের অনুরোধ-ভরা ইঙ্গিত।
দোপাটী গাছের কেয়ারি সরল রেখায় প্রসারিত। জোহরা ফুলভরা গাছের উপর অলস আঙুল রাখে। মুস্তাফিজ কুসুম-শোভায় সন্ধ্যার অস্তরাগ দেখে। ফুল আর জোহরার মুখ তুলনায় সে বার বার দৃষ্টি বদল করে।
বহুদিন পরে অবকাশ পেয়েছে যেন মুস্তাফিজ। আনন্দের বন্যায় গোধূলির অন্ধকার মায়াময়।
নদীর ধারে দাতব্য চিকিৎসালয়ের ইমারত গড়ে উঠছে। জীবনের নূতন সাফল্য ধরা দিয়েছে নূতন মূর্ছনায়।
একটা ঝোপের পাশে দম্পতি বসে পড়ে।
সন্ধ্যার অন্ধকার পুরু পর্দা মেলছে পৃথিবীর মুখের উপর। দূরের আকাশ এখনও লাল-আভায় মহিমান্বিত। বাহির-জগতের কোন বিভীষিকার ছায়া পড়েনি এইখানে। হৃদয়ের অনাবিল সঙ্গীত ব্যাপ্তি সম্মোহন ছড়ায়। নীরব, নিস্তব্ধ দুই জন। কথার কোন আলিঙ্গন নেই। অদৃশ্য যোজনা তাদের রিক্ত প্রাণের ফাঁক ভরে তোলে।
—জোহরা।
অলস ডাক মুস্তাফিজের। শুক্ল-পক্ষে মৌমাছির মত তার ছুটি আজ। অলসতার জোয়ার আসুক চারিদিক থেকে।
লনের উপর আড় হোয়ে শুয়ে পড়ল মুস্তাফিজ। জোহরা তার আঙুল নিয়ে নাড়া-চাড়া করে।
— হুযুর!
কোয়ার্টারের বৈঠকখানা থেকে দরওয়ানের ডাক।
ঘন ঘন ডাক শোনা গেল।
এমন সন্ধ্যা জীবনে কতবারই বা আসবে। মুস্তাফিজ অস্বোয়াস্তি অনুভব করে।
—চলো, জোরা। বোধ হয় কোন জরুরী কাজ পড়েছে।
আসর ভেঙে গেল। তানপুরার তার ছিঁড়ে গেল অকস্মাৎ।
জোহরা স্বামীর অনুগমন করে।
চারিদিকে পাৎলা অন্ধকার।
বারান্দার আলো জ্বেলে দাঁড়িয়ে আছে দরওয়ান।
দূর থেকেই মুস্তাফিজ বলে : কিয়া হুয়া, দরওয়ান।
—হুযুর, আপকা তার আয়া।
—তার! টেলিগ্রাম!
কৌতুহলী মুস্তাফিজ দ্রুত পদক্ষেপে বারান্দার উপর উঠল। জোহরা অন্দর মহলে গেল না, দাঁড়িয়ে রইল বারান্দার এক কোণে।
—দেখি। মুস্তাফিজ হাত বাড়ায় দরওয়ানের দিকে। তাড়াতাড়ি ছিঁড়ে ফেলল ইনভেলাপ ।
টেলিগ্রাম পড়ে স্তব্ধ হোয়ে গেল মুস্তাফিজ। একটা একশ’ পাওয়ারের বিজলী বাতি হঠাৎ যেন নিভে গেল।
দরওয়ান চলে গেছে। জোহরা এখনও দাঁড়িয়ে আছে। স্বামীর মুখের উপর তার দৃষ্টি সজাগ।
—জোহরা!
অস্পষ্ট কণ্ঠস্বর মুস্তাফিজের।
—জোহরা!
বারান্দার কোণ থেকে ছুটে এলো সে।
—জোহরা, আমার ট্রান্সফার, বদলির অর্ডার। কালই চার্জ বুঝিয়ে দিতে হবে।
কাঠ হোয়ে দাঁড়িয়ে রইল মুস্তাফিজ।
দাঁতে দাঁত চেপে মুস্তাফিজ বলে : এই ষড়যন্ত্রের শয়তানদের আজ ভাল করে চেনা হোল আমার। আর চারদিন পরে তরফদারের মামলা শেষ হোত। সব-
কথা অসমাপ্ত রেখেই চেয়ারে বসে বড়ল মুস্তাফিজ। জোহরা স্বামীর পাশে দাঁড়িয়ে থাকে।
মুস্তাফিজ বিষণ্ণ আকাশের দিকে তাকায়। এক মুহূর্ত আগে এই গগনের প্রাঙ্গণে ছিল অসংখ্য তারকার হাতছানি। সব নিভে গেল এক ফুৎকারে।
মার্শালের ভক্ত, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তুখোড় ছাত্র মুস্তাফিজ রহস্যের গোলক ধাঁধাঁয় ঘোরে। অর্থনীতির যুক্তিগুলো তার কাছে ব্যঙ্গের বিদ্যুৎ হেনে যায়। তার মাথায় গোল পেকে উঠে। গম্ভীর, বিষণ্ণ, ধাঁধা গ্রস্ত মুস্তাফিজ।
—স্কাউন্ড্রেলস। মুস্তাফিজ চীৎকার করে উঠল।
—স্কাউন্ড্রেলস।
বদলি হওয়ার অর্ডার বাহী খামটা হাতে ঠুকতে ঠুকতে মুস্তাফিজ হাঁকে : স্কাউন্ড্রেলস, স্কাউঞ্জেল্স…
গলা পঞ্চমে ওঠে।
স্বামীর এমন রূপ কোনদিন দেখেনি জোহরা।
মুস্তাফিজের চুলে আঙুল চালিয়ে দিতে দিতে সে বলে : রাগ করে কি হবে? আল্লার ইচ্ছা।
মুস্তাফিজ জবাব দিতে গিয়ে থেমে গেল। দাঁতে দাঁত চাপার সময় শুধু অস্ফুট আওয়াজ বেরোয়, আল্লারই-
আর কোন বাক্যালাপ হয় না স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে। বাতাস এলো ধীরে ধীরে। কেয়ারির গন্ধ তার অনুসরণে। শব্দের ব্যাপ্তি তবু আচ্ছন্ন করে ফেলছে চারিদিক। হৃদয়ের অনুরণনও তার কাছে লুপ্ত।
.
৫
নূতন বন্দর। নোঙর-ছেঁড়া জাহাজের মত ঢেউয়ের তালেই ভেসে চলা। তবু জোহরা তার দোপাটী ফুলের আগুন-লাগা কেয়ারির কথা ভুলতে পারে না।
মুস্তাফিজ দাতব্য চিকিৎসালয়ের স্বপ্ন দেখে।
একমাস পরে।
মুস্তাফিজ সকাল বেলা দৈনিক কাগজ পড়ছিল।
হঠাৎ স্তম্ভিত হয়ে গেল সে। জলীল তরফদার বেকসুর খালাস।
—খালাস!
মুস্তাফিজ বোবার মত দৃষ্টি ছড়িয়ে দেয় দূরে। সকালের চায়ে বিস্বাদ ছেয়ে আসে। তিক্ততায় তার শরীর কাঁপে। নিরুপায় বন্দীর মত লোহার গরাদে মাথা কুটে মরে তার মানবতা-পূজারী হৃদয়ের সূক্ষ্ম অনুভূতিগুলি।
জোহরা আজও তার পাশে এসে দাঁড়ায়। যন্ত্রায়িত দিনের চাকা ঘোরে শুধু। গোলামীর জিঞ্জির কোথায় যেন শক্ত হোয়ে বসে গেছে তাদের স্কন্ধে। দুঃসহ মনে হোলেও তার ভারে আরাম পাওয়া যায়। এই আহার-বিহার, নিশ্চিন্ত দৈনন্দিনতাকে তারা কী করে উপেক্ষা করবে?
এক বছর পরে আরো অবাক হয় মুস্তাফিজ। পুরাতন মহকুমা থেকে তার নিমন্ত্রণ-পত্র এসেছে। দাতব্য চিকিৎসালয়ের প্রতিষ্ঠা দিবস। সে প্রধান অতিথি।
প্রধান অতিথি!
চাপা, ক্ষুব্ধ ক্রোধ আর আনন্দের সম্বনয় অদ্ভুত লাগে মুস্তাফিজের। পত্রে স্বাক্ষর করেছে পুলিন সাহা, জলীল তরফদার, আরো অনেকে। রাহা-খরচ বাবদ টাকাও তারা টেলিগ্রাফ মণি-অর্ডারে পাঠিয়েছে, চিঠির শিটে এক-কোণে লেখা।
মুস্তাফিজ মানুষের স্মৃতিকে শ্রদ্ধা জানায়।
.
৬
সভার দিন একটু আগেই পৌছল মুস্তাফিজ। হাসপাতালের খোলতাই রং তার কল্পনাকে বিরাম দেয় না। নদীর ঘাটের উপর মানুষের বহু অপূর্ণ কামনা যেন ইট-পাথরে মূর্ত হোয়ে উঠেছে। বহু দুঃখ, ক্লিষ্টতা আর গ্লানি পৃথিবীর বুকে। তবু মানুষ বেঁচে আছে। তার সজীব মানব-হৃদয়ের ঐশ্বর্য এম্নি-ভাবে শুধু আকার খোঁজে। বিরাট কম্পাউণ্ড। ডাক্তারের কোয়ার্টার দোতলা বাড়ী। মানুষের নূতন উপনিবেশ। না, হৃদয়ের নূতন সাম্রাজ্য।
মুস্তাফিজের অভিনন্দনের জন্য বহু গণমান্য ব্যক্তি এসেছে। নৌকা থেকেই কর-মর্দনের পালা শুরু হয়। জলীল তরফদার আজ হাসিমুখে তাকে প্রথম আদাব জানায়। অতীতের বৃশ্চিক মুস্তাফিজের বুকে হুলাঘাত রেখে গিয়েছিল। তা আজ ধীরে ধীরে মিলিয়ে যায় নেপথ্যে।
পৃথিবীর মানুষ ত এরা।
মানব জন্মের পরিচয় কেমন করে তারা ভুলে যাবে?
সভা আরম্ভ হোতে আর এক ঘণ্টা বাকী।
হাসপাতালের কম্পাউণ্ডে গাছের ছায়ায় মুস্তাফিজ কয়েকজন অফিসারের সঙ্গে গল্প জুড়েছিল।
হঠাৎ চারিদিকে আওয়াজ ওঠে : ডেপুটি বাবুর জয়, ডেপুটি সাহেবের জয়, মুস্তাফিজ সাহেব জিন্দাবাদ।
চমকে উঠে মুস্তাফিজ। আত্মশ্লাঘার গৌরব-আসীন সে চেয়ে দেখে, এই ধ্বনির উৎস কোথায়?
মুস্তাফিজ রুমালে চোখ মুছে নিল। বিরাট মিছিল এগিয়ে আসছে। মানুষের মিছিল? না, মানুষ নয়। নরাকার মানুষের ভগ্নাংশেরা শোভাযাত্রা করে এগিয়ে চলছে। বিকলাঙ্গ, ভগ্ন-স্বাস্থ্য পাঁজর-নির্গত গ্রামের মানুষ।
মুস্তাফিজ দাঁড়িয়ে-নিস্তব্ধ হোয়ে গেল। বুকের স্পন্দন দ্রুত হয় ধীরে ধীরে।
এরা কারা, তার অভিনন্দনের জন্য এগিয়ে এসেছে?
মুস্তাফিজ একজন অফিসারকে জিজ্ঞাসা করে : কোথা থেকে এলো এই সব লোক? ম্যালেরিয়া আর আজরাইল দয়া করে এদের রেখে গেছে মনে হয়।
—এরা এই এলাকারই লোক। ধান চাল কি কিছু ছিল যে বাঁচার মত বাঁচবে? বহু মারা গেছে। এরা তার অবশিষ্ট।
অফিসারটি গলার ‘টাই’ একটু শ্লথ করে আবার বলে : খবরের কাগজ পড়েন নি? এত mortality আর কোথাও দেখা যায়নি। সপ্তাহে পাঁচ ছ’শ লোক মরত।
মুস্তাফিজ ‘ওঃ’ বলে থাম্ল।
চেয়ে রইল সে তাদের দিকে, হতভাগা যারা তাকে অভিনন্দন জানাতে এসেছে। অসহায় মানব সন্তানের দল, অজ্ঞতার কুহকে শুধু মানুষের হৃদয়-সৌন্দর্যকে শ্রদ্ধা জানায়। বঞ্চনার ফাঁদ কি, এরা জানে না। গলা বুজে আসে মুস্তাফিজের। নির্জন জায়গা হোলে পাঁজর মুচড়ে কাঁদত শুধু সে-শিশুর মত, গ্রামের অশিক্ষিত পুত্র-শোকাতুর জননীর মত।
যন্ত্রায়িত পুতুলের মত মাথা নিচু করে মুস্তাফিজ চেয়ারে বসল।
একটু পরে আরম্ভ হোলো সভা। সভামঞ্চের আশে-পাশে স্বাস্থ্যবান সুপরিচ্ছদ গুটি কয়েক মানুষ। তারপর শুধু অনাহার রোগক্লিষ্ট মানুষের ক্ষুদ্র সমুদ্র।
বক্তৃতা একটা দিয়েছিল মুস্তাফিজ কয়েক মিনিটের জন্য। সভাশেষে ব্যস্ততার ছুতোয় সে আবার নৌকায় উঠল। তাকে এগিয়ে দিতে গেল পুলিন সাহা, তরফদার ও স্থানীয় কয়েকজন অফিসার।
তীরে সমবেত জনতার জিন্দাবাদ-ধ্বনি। নৌকায় উঠলো মুস্তাফিজ।
সন্ধ্যার অন্ধকার দিগন্ত-প্লাবনে ছুটে আসে।
মুস্তাফিজ দিশাহারার মত আর কোন দিকে চায় না। ঘন অন্ধকার নামে পৃথিবীর উপর কয়েক মুহূর্তে।
নৌকার ছাদে বসে আছে মুস্তাফিজ। আত্মগ্লানির জল্লাদেরা তার চোখের সামনে আজ ভিড় করে না।
মুস্তাফিজ অনুভব করে, তার চারিপাশে শুধু মানুষ। তাকে ঘিরে উল্লাস-ধ্বনি করে-তাদের মুঠি অন্ন নেই মুখে, পরিচ্ছদ নেই রৌদ্রবৃষ্টিস্নাত দেহে; তবু তাদের পর্বতগ্রাসী প্রাণ-বন্যার শক্তি অপরিসীম যার ঢেউ পৃথিবীর গলিত কুষ্ঠ-রূপ নিশ্চিহ্নে মুছে দেবে একদিন। তাদের উদ্দেশ্যে প্রণতি জানাল মুস্তাফিজ বার বার।
জীবনের প্রথম প্রণতি।