ইলেম
—কাষ্টমর জাহাজ আইসসে।
সত্যই রিভার-পুলিশের লঞ্চ আসিতেছিল। নৈশ নদীর ভিতর একটানা যন্ত্রধ্বনির আওয়াজ ক্রমশঃ স্পষ্টতর।
জহির মিয়া সাম্পানের নিবন্ত আলো বাড়াইয়া দিল।
বর্ষার আকাশে ইতঃক্ষিপ্ত মেঘ। সারা দুপুর বৃষ্টি হইয়াছিল। জলস্রাবী মেঘের দল দিগন্তের কোণে ছাউনি ফেলিয়াছে। আপাততঃ নভ অভিযানের কোন সম্ভাবনা নাই।
সাম্পানের ভিতর ঈষৎ হাওয়ায় লণ্ঠন দুলিতেছে। আলোর দিকে পিঠ জহির মিয়ার ছায়া-মূর্তিটুকু আন্দাজ করা যায়। গলুইয়ের মুখে আরো একটি মানুষ বসিয়াছিল। ছায়ার রেখামাত্র।
জহির মিয়া আবার বলিল : কাষ্টমর জাহাজ আইসে।
—আইতে দাও। আঁঅর সাম্মানে আফিমের পা’ড় আছে?
সঙ্গী করিমের জবাব।
—না বা’ই, খামাখা মুকিলে ফেলায়। হেবার মনে আছে, এক্কারে সাম্মান তছনছ করে ছাড়ছিল?
–ডরের কি আছে? আইতে দাও।
নদীর কিনারা হইতে কয়েক শ’ ফিট দূরে নোঙর করিয়াছিল জহির মিয়া। স্রোতের তোড়ে আছাড় খাইতেছে সাম্পানখানি।
—বা’লো হয়ি বইয়ো, মিয়া। পানির মদ্দি যাআঁর চাউ নঅ?
জহির মিয়া আন্মনা বসিয়াছিল। পানির মধ্যে নিশ্চয় সে যাইতে চায় না। সঙ্গী প্রশ্নের কোন উত্তর পাইল না।
—বা’লো হয়ি বইয়ো, মিয়াঁ।
জহির মিয়া এইবার সাম্পানের মাঝখানে সরিয়া বসিল।
অন্ধকার নদীবক্ষে লণ্ঠনের আলো চক্চক্ করিতেছে। সেই দিকে দৃষ্টি ফিরাইল সে।
—চুপ বইয়ে? মন তোয়ার খারাব, অ মিয়া?
করিম পুনরায় জিজ্ঞাসা করিল।
জহির মিয়ার মন খারাপ হওয়ার কথা। কয়েকদিন বাড়ী ছাড়া সে। আজ ফিরিয়া যাওয়ার নির্ধারিত দিন। এখনও বিলম্ব হইতেছে।
—আঁঅর মন আছে? ইডা কি কও, মিয়া? হতা পারায়। গ’রৎ একগুয়া চৈল ন আছিল।
এক সপ্তাহ জহির মিয়া বাড়ী ছাড়িয়াছে। ঘরে একদানা চাউল দিয়া আসে নাই।
—ও বা’বী সা’ব বা’লা মানুষ। ডর কিল্লাই?
জহির মিয়ার স্ত্রীর মত ভাল মানুষ ঘরে থাকিতে কিসের ভয়?
—বা’লা মানুষী দি’ পেট ন ভরৎ।
জহির মিয়া বোঝানোর চেষ্টা করিল, ভালমানুষী দিয়া জঠর-সমস্যার সমাধান হয় না।
বোধ হয় কেরোসিন ছিল না, লণ্ঠনের আলো আরো ক্ষীণ হইয়া আসিল। স্তব্ধ দুই ছায়া-মূর্তি। লঞ্চের ইঞ্জিনের শব্দ নিকটতর হইতেছে। জহির মিয়া চক্ষু বুজিয়া মাথাখানি দুই হাঁটুর উপর রাখিল।
রাত্রির কৃষ্ণচ্ছায়া জিভ মেলিতেছে। মেঘের আনাগোনা শুরু হইয়াছে পুনরায়। বর্ষার অনিশ্চিত আকাশ। ঝড়ের ছোঁয়াচ লাগিতে কতক্ষণ?
দিগন্তে ঘন অন্ধকারের নিঃশব্দ বিস্তার রাঙা মাটির গিরিশ্রেণীর ধূসর স্তব্ধতায় বিভীষিকার প্রলেপ আঁকিতেছে। পাতলা মেঘরাশি পাহাড়ের শীর্ষে; প্রস্তর ও তরুশ্রেণীর কায়ালোক প্রতিবেশীর মমতাসন্ধানী। চকিত ইশারায় সঙ্গীহীন একটি নক্ষত্র অস্তিত্বের পরিচয় দিয়া পুনরায় হাবসী জুলুমের মুখে আত্মসমর্পণ করিল।
সেইদিকে দুই ছায়া-মূর্তির বোবা দৃষ্টি।
বন্দরের আর একদিকে দিনের সূচনা। বিদেশী জাহাজের বাতি, পোর্ট-ইয়ার্ডের আলো, জেটির পাহারাদারের তীক্ষ্ণ সন্ধানী রশ্মি-সব মিলিয়া প্রতিদ্বন্দ্বিতার প্রতীক; ধ্রুপদ, গুরুগম্ভীর কার্গো জাহাজের হুইসেলে স্বতন্ত্র জগৎ থরথর কাঁপিতেছে।
এইদিকে আবার চোখ ফিরাইল জহির মিয়া।
দূর হইতে দেখা যায় নৈশ বন্দরের আলোকাকীর্ণ রূপ। তবু অন্ধকারের জনতা গরীব আত্মীয়ের মত মানবিক দম্ভের প্রাসাদ চত্বরে প্রতীক্ষমান। শীর্ণ-দেহ, সঙ্কোচ-আড়ষ্ট। দুই দিগন্ত দুই ভিনদেশী অরকেস্ট্রার মত মিশিয়া যাইতেছে বিচিত্র গমক ও মূর্ছনায়।
—খুব দেরী হইয়ে, মিয়া।
—দেৱী আলবৎ হৈব। উয়াগোর নাম সদাগর।
—আঁঅর সদাগর বা’লা মানুষ।
—বা’লা! হিতাল্লাই দেরী! কি কও?
সওদাগর ভাল মানুষ! সেইজন্য দেরী হইতেছে!
করিমের কণ্ঠে শ্লেষ-ছড়ানো।
—চৈল আনব?
—ঠিগ্, দেইখ্যো। চুলা ঠিগ্ করিয়ারে-
জহির মিয়া সঙ্গীর কথার মধ্যপথে বলিল, চৈল। অস্পষ্ট বাহির হইয়া আসিল তার ঠোঁট, চৈল। নিরুদিষ্ট পুরাতন বন্ধুর মত সে যেন চাউলের অবয়ব দেখিতেছে মনশ্চক্ষু দিয়া।
সাম্পানের অন্য মাঝি মহাজনের আড়তে গিয়াছে পাওনা টাকা আদায় করিতে। সে চাউল কিনিয়া আনিবে। তারই প্রতীক্ষারত দুইজন।
—বড্ড দেরী হইয়ে।
—ক’লাম না, উয়াগোর নাম সদাগর। টিয়া ন দিইয়ে, বা’ই।
জহির মিয়া প্রতিবাদ জানাইল। মহাজন নিশ্চয় টাকা মিটাইয়া দিবে। চাউলের সওদায় দেরী হইতেছে।
দম্কা ঠাণ্ডা বাতাস শনশন্ বহিয়া গেল। আবার বৃষ্টির সম্ভাবনা। জেলে-পাড়ায় কুকুরগুলি ইন্তার ডাকিয়া যাইতেছে। নদীর কিনারায় নৌকা ও সাম্পানের মাস্তুলের সারি-সারি ছায়ারেখা। অন্যদিকে জ্যোৎস্নার আলো-আঁধারে জাল বোনা ভূমিশায়িত বাঁশের রেখা স্তব্ধ ঝর্ণা মনে হয়, যেন বাতাস দিলেই ঢেউ উঠিবে।
জহির মিয়ার মাথায় কিস্তী টুপী। মগ্রীবের নামাজের পর খুলিতে মনে নাই। নগ্ন দেহ তার। নদীর জলো বাতাসে ঠাণ্ডা লাগে। গামছা সাম্পানের আর এক কোণায় পুঁটলির ভিতর। অলসতার জগদ্দল সম্মুখে। দেহ আবরণের কোন বন্দোবস্ত করিল না জহির মিয়া। বক্ষস্থিত হাত দু’টির মধ্যে উত্তাপ খুঁজিতে লাগিল।
লঞ্চের শব্দ নিকটতর। আলো জ্বালে নাই পুলিশের লোক। শুধু ঘুটঘুট শব্দে মাঝিরা লঞ্চের হাল হকিকৎ বুঝিতে পারে।
সঙ্গী করিমকে সাম্পানের ভিতর যাইতে দেখিয়া জহির মিয়া বলিল : আঁঅর গাম্ছা খান্।
কিন্তু তার চেয়ে শশব্যস্ত হইয়া সে পুটুলি ভালরূপে দেখিবার জন্য অনুরোধ করিল। দুপুরের বৃষ্টির সময় সে এদিকে মনোযোগ দিতে পারে নাই। পুঁটুলির ভিতর একটি শিশুপাঠ্য পুস্তক ছিল। ভিজিয়া গিয়াছে হয়ত।
জহির মিয়ার তর সহিল না। সে নিজেই সাম্পানে ঢুকিয়া পড়িল।
—না, মিয়া বাই, কিতাবের গা’ত পানি ন লাগে।
সঙ্গী বলিল ভিতর হইতে।
তবু ভরসা নাই। জহির মিয়া নিজেই পুঁটুলি পরীক্ষা করিতে লাগিল। অতিকষ্টে সে পুত্রের জন্য পুস্তকখানি খরিদ করিয়াছে। এক টাকায় পাঁচ পোয়া চাউল ত’ হইত। কুলসুমের সঙ্গে ইহা লইয়া বচসা শুরু হইবে। জঠরে অন্ন না দিয়া লেখাপড়া শেখানোর পক্ষপাতী সে নয়। মাইয়া ফুয়ার আক্কেল!
জহির মিয়া তন্নতন্ন করিয়া পুস্তকের পাতা দেখিল।
না, কোথাও স্যাৎসেতে দাগ পর্যন্ত লাগে নাই। করিম হাসিতে লাগিল।
—যা’ করতাছেন, বাই, আঁঅর হাসি মুখত্তন ঝাঁপ দি’ পড়ে।
—ফুয়ার কিতাব, বা’ই।
করিম ভাবিয়াছিল কোন মণি-মাণিক্য। বিদ্রূপ করিয়া সে জানাইল।
—আঁঅর ফুয়ার কিতাব।
জহির মিয়ার পুত্র সমিরুদ্দিনের জন্য পুস্তকখানি।
—ঠিগ্ আছে?
—বেগ্গুয়ান ঠিগ।
দুইজনে সাম্পানের বাহিরে আসিল। লণ্ঠনের শিখা নিবু-নিবু। করিম দোলাইয়া দেখিল, তেল নাই। নিবিয়া গেল লণ্ঠন।
—শলাই আছে? মাচিস-শলাই মিয়াঁ বা’ই?
—হ।
জবাব আসিল, হাঁ।
দেশলাই ভিজিয়া না যায়। সঙ্গী মহাজনের আড়ত হইতে ফিরিয়া আসিলে রান্না চাপাইতে হইবে। এই স্রোতের তোড়। বাড়ী ফেরা মুশকিল। জহির সাবধান করিয়া দিল।
—মিয়াঁ বা’ই, সমিরুদ্দি মকতবে পড়ে?
—হ। খুব জেহেন তেজ। মুলুবী সা’বে কন।
—গরীবের ঘরৎ জেহেন-তেজ ফুয়া। আল্লার রহমত।
—জেহেন তেজ অইলে কি? আঁই লেখাতে পড়াতে পারমু?
—আল্লা মালিক, মিয়াঁ-বা’ই। নিয়ৎ রাইখেন। পুরা হৈব।
—খোদারে ডাকি ডাকি কবাল ছ্যাঁদা করি ফেলছি। আর কত ডাক্?
—ডাকেন ডাকেন। হুনব একদিন আঁঅর নালিশ।
জহির কিছুক্ষণ স্তব্ধ থাকিয়া আবার বলিল : সদাগরর গ’রৎ এত দেরী। আজ আর ন’ আইয়ের। করিম মহাজনদের উদ্দেশে গালি বর্ষণ করিতে লাগিল।
—চুপ, মিয়াঁ। মিছা গাল দি’ হৈব কি?
করিম বিড়বিড় শব্দে আক্রোশ ঝাড়িতে লাগিল। তবু জহির মিয়া গলুয়ের মুখে স্তব্ধ। গায়ে গামছাখানি বেশ উত্তাপ ছড়াইতেছে। আজ বাড়ী ফেরা উচিত ছিল তার। একটি পয়সা দিয়া আসে নাই। কুলসুম কোথায় হাত পাতিবে? ঋণ দেওয়ার লোকই বা কোথায়? স্ব-স্ব বিব্রত প্রতিবেশীবর্গ। সমিরের মকতবে নিয়মিত যাওয়া হইবে না। মৌলবী সাহেব বলিয়াছেন, এমন মেধাবী ছাত্র তিনি জীবনে দেখেন নাই। কোন রকমে পড়ার খরচ যোগাইতে পারিলে এই ছাত্র কালে বড় ‘অপিসার ‘ হইবে। জহির মিয়া ভবিষ্যৎ আশা-মরীচিকায় আনন্দের পাশাপাশি নিরাশা-ক্লিষ্ট বর্তমানের বেদনার কশাঘাত অনুভব করিতেছিল সারা শরীরে। মহাজনের টাকা না পাইলে ক্ষতি নাই। কিছু চাউল লইয়া সে বাড়ী ফিরিত! তার সঙ্গে কিছু টাকা আছে। কিন্তু সঙ্গীটি এমন আহম্মক, দেরী করিতেছে বৃথাই। তিনজন না হইলে উজানে যাওয়া অসম্ভব।
আকাশে চাঁদ নাই। জোয়ারের সময় ঠিক করা যাইবে না। চাঁদের কাঁটায় কাঁটায় জহির মিয়া বলিতে পারে, কখন শুরু হয় জোয়ার ভাটা।
মেঘের দৌরাত্ম্যে কালো ছায়া পড়িয়াছে নদীর আরশির উপর। দিগন্তে পাহাড়ের রেখা অন্তর্হিত শুধু মেঘপুঞ্জ ফেনস্ফীত সমুদ্রের মত গর্জন করিয়া অগ্রসর হইতেছে। তীব্র বাতাস উঠিলে ঘুর্ণী ঝড় শুরু হইতে পারে।
সাম্পানে দুইজনের মনে অবশ্য এই আশঙ্কার কোন ছায়া নাই। সঙ্গীর প্রতীক্ষার পিছনে অন্যান্য চিন্তার বিভীষিকা লোপ পাইয়াছে।
লঞ্চ এবার নিকটতর। নদী সমতল অন্ধকার। তবু ইঞ্জিনের ঘটঘট্ শব্দ ও বাষ্প-নিস্রাবী নলের সুইৎ-সুইৎ রব মাঝিদের আন্দাজে প্রতারণার জাল ফেলিতে পারে না।
—খুব নজদিগ আইয়ে।
—আইতে দাও। আঁঅর কিছু আছে? এত ডর কিল্লাই?
—লণ্ঠন নাই। সন্দ করত না?
—ডর কিল্লাই? আঁরা আফিম বেচি, ন গাঁজা?
করিম আনকোরা যুবক। কণ্ঠে ঝাঁঝ বেশী। আবার জোর দিয়া বলিল : ডর কিল্লাই, জহির বা’ই? জেলে-পাড়ায় ডুগডুগ্ ঢোলক বাজিতেছিল। দানাবাঁধা মেঘ বাতাসের ফুৎকারে উড়িয়া গেল। মৃত চাঁদের প্রেতাত্মা বোধ হয় কোথাও মেঘের কাঁধে সওয়ার। আকাশের ভয়ঙ্কর রূপ ফিকে হইয়া গিয়াছে। শ্যাম-শুভ্র জলধর নৈশ জগতের পটভূমি রচনা করিতেছে।
জহির মিয়া আমনা। এত রাত্রে গ্রামের পথ পিচ্ছল। খানাখোন্দক বৃষ্টির পানিতে ভরা। ব্যাঙের ডাক অনুযায়ী সাপের দল জুটিতেছে। মজিদ এখনও ফিরিল না। না, বাড়ী ফেরা হইবে না আজ। সমির মকতবের পড়া করিতেছে ডিবার আলোয়। তাগিদ দিতেছে কুলসুম-কেরোসিন পুড়িতেছে, তাড়াতাড়ি পড়া সারো, তাড়াতাড়ি….
লঞ্চ খুব নিকটে। কিন্তু কিছু ঠাওর করা চলে না। জহির মিয়া শঙ্কান্বিত বুকে দৃষ্টি তীক্ষ্ণ-সজাগ করিল অন্ধকার সমতলের উপর দিয়া। না, চোখ এখানে পঙ্গু-ইন্দ্ৰিয়।
—কাষ্টমর জাহাজ আইসে।
—হ।
অন্ধকার নদীবক্ষ চিরিয়া হঠাৎ আলোর বর্শা নিক্ষেপ করিতেছে তারা যেন। সন্ধানী-আলোয় চোখে দিশা লাগে। সব স্বচ্ছ হইয়া আসে কিছুক্ষণ পরে। পঞ্চাশ ষাট ফিট দূরে রিভার-পুলিশের লঞ্চ। ডেকে আলো জ্বলিতেছে। টর্চ ফেলিতেছে লঞ্চের মালিকেরা।
নৈশ ডাকে কম্পন জাগে : অ’ সম্মানের মাঝি।
টর্চের আলো পড়িল জহির মিয়ার সাম্পানের উপর। আশপাশে আরো সাম্পান রহিয়াছে। কোন্ মাঝিকে ডাকিতেছে ইহারা?
—অ সাম্মানের মাঝি-ই-ই-ই…..
জহির মিয়ার সঙ্গী চীৎকার করিয়া জবাব দিল : কি ক্কন্?
লঞ্চের ডেকের উপর দু-তিনজন কনেষ্টবল। একজন অফিসার, পরনে হাফ-প্যান্ট, হাফ-শার্ট, ক্রস বেল্ট, রিভলভার ঝুলিতেছে নিতম্ব দেশে। তীক্ষ্ণ বিদ্যুতের আলোয় স্পষ্ট প্রত্যেকটি আরোহী।
কনেষ্টবল চীৎকার করিয়া যাইতে লাগিল : অ সাম্মানের মাঝি।
করিম প্রাণপণে জওয়াব দেওয়ার চেষ্টা করিল প্রতিটি বার। কাহার উপর এই আহ্বান-বাণ বর্ষিত হইতেছিল জানা গেল না। কনেষ্টবল ডাকিয়া চলিল। সমস্ত গাঙের মাঝি ও তাহাদের অনাগত শিশু- মাঝিদের যেন আজ কনেষ্টবলের প্রয়োজন।
কি প্রাণপণ চীৎকার!
জহির মিয়া জবাব দিতে যাইতেছিল, করিম বারণ করিল।
—বইয়ো। হালাগো গলায় কি গিরামোফোনের কল আছে?
—আঁই জবাব দি’।
—না, মিয়াঁ বা’ই। ডর কিল্লাই? বে-আইনী কিছু করিয়ারে ত ডর।
জহির মিয়া মাস্তুলের খুঁটি ধরিয়া দাঁড়াইয়া পড়িল। শঙ্কিত সে। ভয়ের মাত্রা আরো বাড়িয়া গেল। হঠাৎ লঞ্চের আলো নিমেষে নির্বাপিত হইল। ঘড়ঘড় শব্দ, লঞ্চের পাখনা স্রোত কাটিতেছে। নদীর উপর কাজল তমসার আলিঙ্গন ঘনতর ঠেকে এখন।
—বাতি বুজাইল এ্যা?
—হ্।
—হালার মতলব আছে।
সাম্পানের নিকটে আসিয়া লঞ্চের আলো আবার জ্বলিয়া উঠিল। সাম্পান হইতে মাত্র কয়েক হাত দূরে।
ডেকের উপর হইতে কনেষ্টবল জিজ্ঞাসা করিল : অই, এত ডাকি, কানে ছ্যাঁদা নাই? রাও নাই মুখে?
জহির মিয়া জবাব দিল : দিছি ত’ জবাব।
—জবাব দিয়েছ? আমাদের কানে ছ্যাঁদা নাই?
—ঝুট কই না হুজুর।
—নজদিগ আয়।
লঞ্চ হইতে জবাব আসিল
আবার নোঙর তোলার হাঙ্গামা। ইতস্ততঃ করিতেছিল জহির মিয়া।
—হুজুর, লঞ্চ ইন্দি লইয়্যাসেন। পানির জুর বেশী।
কনেষ্টবল অফিসার সকলে গেটের মুখে দাঁড়াইয়া। প্রত্যেকের হাতে টর্চ।
—নোঙর বাড়িয়ে দে।
মন্দ যুক্তি নয়। জহির মিয়া নোঙরের শিকল বাড়াইয়া সাম্পান লঞ্চের গায়ে ভিড়াইল। একজন কনেষ্টবল লাফাইয়া পড়িল সাম্পানের উপর।
অন্য একজন কনেষ্টবল বলিল : এত ডাকলাম, বাতি জ্বালানে কেন? আয় লঞ্চের ওপর। জহির মিয়া লঞ্চের উপর উঠিয়া গেল।
দুই হাত জোড় করিয়া দাঁড়াইল সে অফিসারের সম্মুখে।
—এই মাঝি, সাম্পানে আলো নেই কেন?
—হুজুর, কেরোসিন নাই। গ’রৎ সব আঁদার।
—মিথ্যে কথা।
—আল্লার কিরা হুজুর।
—তোআর আল্লা আঁঅর আল্লা না?
নেপথ্যে বলিল একজন। সত্যি অপরাধ করিয়াছিল জহির মিয়া। আল্লা সকলের, সাধু-সদাশয়, বাপাড়, জোচ্চর, উকীল, পুলিশ, কামলা, মুনাফাখোর-আল্লা সকলের। খোদা ত’ জহির মিয়ার লাখেরাজ সম্পত্তি হইতে পারে না।
—আল্লার কিরা, হুজুর।
—ফের মুখে আল্লার নাম, বেতমীজ।
সিগারেট টানিতেছিল প্যান্ট-বুটধারী। জিজ্ঞাসা করিল : নামাজ পড়ো?
—আঁই?
—হ্যাঁ তুমি, তুমি।
—পাঞ্জেগানা নামাজ কাজা ন কইরি, হুজুর।
বুটধারী হাসিল। পাঞ্জেগানা নামাজ!
—যা হয় হোক, সাম্পানে আফিম রেখেছো?
—না হুজুর, আঁরা বাঁশ বইয়ি।
ধমক দিল প্রশ্নকর্তা : সাম্পানে আফিম আছে?
শঙ্কিত বিহ্বল জহির মিয়া। প্রশ্নকর্তার অবয়বের দিকে দৃষ্টিপাত করিল। নরম চর্বিদার শরীর। এত রুক্ষ কণ্ঠস্বর!
—কথা বলিস না? সাম্পানে আফিম আছে?
—না, হুজুর।
—লঞ্চ দেখে নদীতে ফেলে দিয়েছ, না?
—বিশ্বাস না হয়, দ্যাইখেন সরে-জমীন।
সাম্পানের ভিতর কনেষ্টবল ছিল। তার উদ্দেশে চীৎকার করিয়া সে বলিল : কনেষ্টবল, ঠিক্-সে দেখো।
জবাব আসিল : জী আচ্ছা।
—তোমার লাইসেন্স আছে?
—লাইসিন? জী।
লুঙ্গীর খুঁট হইতে একটি চিরকুট বাহির করিল জহির মিয়া। ইহার ভিতর কোন জুয়াচুরি নাই।
সাম্পান হইতে কনেষ্টবল হাঁকিল : না, কিছু নেই।
বুটধারী মুখ হইতে সিগারেট ছুঁড়িয়া ফেলিয়া ধমক দিল : কনেষ্টবল, সাম্পানের তক্তা ওঁকে দ্যাখ আফিমের গন্ধ আছে কি না।
তর সহিল না তার। নিজে আরো দুইজন কনেষ্টবল সহ সাম্পানের উপর উঠিয়া পড়িল। একজন কনেষ্টবলের জিম্মায় রহিল জহির মিয়া লঞ্চে।
কনেষ্টবলেরা উপুড় হইয়া সাম্পানের তক্তা শুঁকিতে লাগিল। পুলিশের ভয়ে আফিম ফেলিয়া দিলেও গন্ধ সহজে যাইবে না।
স্কটল্যাণ্ড ইয়ার্ডে নাকি একরকম ঘ্রাণ-তীক্ষ্ণ কুকুর ব্যবহার করা হয়। এখানে কোন কুকুর ছিল না।
একটি কনেষ্টবল সানন্দে চীৎকার করিয়া উঠিল : স্যার।
স্যার সাম্পানের বাহিরে ছিলেন। কনেষ্টবলেরা ছাউনির ভিতর ঢুকিয়াছে। পুঁটুলি-হাতে একজন বাহির হইয়া আসিল।
—স্যার, এর ভেতর আফিমের গন্ধ।
—চলো, লঞ্চে খোলা যাক।
কিন্তু তার ধৈর্য অত ঘন নয়। কনেষ্টবলটি পুঁটুলি খুলিতে খুলিতে অগ্রসর হইতে লাগিল। জহির মিয়া বোকার মত এইদিকে চাহিয়াছিল। হঠাৎ সে হাঁ-হাঁ করিয়া উঠিল : আস্তে খোলেন সাব।
—আস্তে!
বুটধারী খুব জোরে এক থাপ্পড় দিল তার গালে। সংঘ-বৃত্তি জাগিয়া উঠিয়াছে। আরো কয়েকজন অংশ গ্রহণ করিল।
—শালা ঝুট্ বাৎ কতা হ্যায়?
কান ধরিয়া দুই ঠোক্কর দিল জহির মিয়ার নিতম্বে।
কিন্তু নিরস্ত হইবার বান্দা নয় জহির মিয়া। তার চোখ নিজের শরীরের দিকে নয়।
—আস্তে খোলেন, সাব। উয়ার ভিতর আঁঅর ফুয়ার কিতাব।
—কিতাব আছে, আর আফিম আছে?
এইবার ব্যঙ্গ-ধমকানি ও লাথি খাইল সে। মোটা বুটের লাথি।
—মারেন আঁঅরে। পানির মদ্দি কিতাব না পড়ে, হুজুর।
করিমকেও ধরিয়া আনা হইল লঞ্চে।
—আঁই আফিম খাই, হুজুর। পেটের অসুগ আফিম খাইয়ারে।
জোরে চীৎকার করিয়া উঠিল জহির মিয়া। চীৎকার-বেশী অসহায় প্রতিবাদ।
পুঁটলি খোলা হইল। জহির মিয়া এইবার মিথ্যা বলে নাই। শালপাতার মোড়কে দু-আনা ওজনের আফিম।
বহুবার অসুখে পড়িয়াছে। ডাক্তার কিছু করিতে পারে নাই। এখন আফিম খাইয়া সে ভাল থাকে। বাংলা দেশে পাড়াগাঁয়ে আফিম ত আফিম নয়, ধন্বন্তরী। রোগে, শোকে ও দুঃখে।
—ঝুট্টা তবে যে বল্লি – কনেষ্টবল, আমার মাফ্লারটা দে, বড়ঠাণ্ডা-আফিম নেই সাম্পানে।
—চোরাই আফিম কণ্ডে, সাব?
জহির কাঁপিতেছিল। হঠাৎ চড়া কথা বলিয়া ফেলিয়াছে সে।
মাফলার পরা শেষ হইল।
—সব ঝুট্টা। চল্ থানায়।
—হুজুর।
একটি কনেষ্টবল করিমকে ইঞ্জিন-রুমের একদিকে লইয়া গেল। আছা অন্ধকার জায়গাটা। নিচে স্রোত তরতর বহিয়া যাইতেছে।
—বন্দোবস্ত করো, মিয়া। হাজার হাঙ্গামা। থানায় যাও, এক দিনের রুজি কামাই। বাঘে ছুঁলে-
–বেকসুর।
—আরে তোর কসুরের নিকুচি। আমি বলব সাব-কে বুঝিয়ে : এইবার ছেড়ে দিন।
নদীর কিনারা হইতে ডাক ভাসিয়া আসিতেছিল : অ সাম্মানের মাঝি-ই….অ সাম্মানের মাঝি, কিনারউ।
মজিদের কণ্ঠস্বর। কে জবাব দিবে এখন?
—ও সাম্মানের মাঝি, কিনার খাড়াই-উ-উ……
কণ্ঠস্বর থামিয়া গেল। জবাব দেওয়ার উপায় নাই। উৎকর্ণ করিম। তাকে কথাবার্তা চালাইতে হইতেছে।
—ও জহির বা’ই, সাম্মান কিনার লাগাইও।
কনেষ্টবল এবার জহিরকে ইঞ্জিন রুমের দিকে লইয়া গেল।
পৌঁছানো মাত্র করিম বলিল : আছে গাঁঠৎ পাঁ’শ টিয়া?
—হ!
.
সাম্পান ঠেলিয়া দিয়া পাটাতনের উপর বসিয়া পড়িল জহির মিয়া। মাথা ঘুরিতেছে তার। হঠাৎ সুপ্তোত্থিতের মত সে বলিল : ও বা’ই। আঁঅর পুঁটুলি, আঁঅর পুঁটুলি।
হাতড়াইতে লাগিল সে।
—উর ভেতর আঁঅর ফুয়ার কিতাব।
জহির মিয়া চাহিয়া দেখিল, লঞ্চ চলিয়া যাইতেছে। নদীর দুপাশে অন্ধকারের পরিখা।
—আঁঅর পুঁটুলি?
—তোঁআর হাথৎ, মিয়া বা’ই।
অন্যসময় হইলে করিম হাসিয়া কুটি কুটি হইয়া যাইত। এমন অন্যমনস্ক, উদ্ভ্রান্ত মানুষ! চুপ করিয়া রহিল সে।
দুইজন কিছুক্ষণ স্তব্ধ বসিয়া রহিল। কি যেন ঘটিয়া গিয়াছে। এখনও স্পষ্ট উপলব্ধির বাহিরে।
হঠাৎ ফুঁপাইয়া উঠিল জহির মিয়া : ব্রিটিশ কুম্বানীর আমলে আঁরা আর কি খারাব ছিলাম?
—অ সাম্মানের মাঝি, কিনারও। আঁই মজিদ। অ…
জহির মিয়া নোঙর খুলিয়া দিল।
.
পরদিন সকালে গ্রামে ঢুকিয়া জহির মিয়ার চোখে পড়িল ঝড়ের আক্রোশ-শান্ত রূপ। গাছ-গাছালির ভাঙা ডালে সড়ক বোঝাই। উঠানের মুখে ভাঙা-মুণ্ড লইয়া সুপারি গাছটা দুলিতেছে। সূর্য উঠিয়াছিল। চিকচিকে রৌদ্র ছড়ানো দাওয়ার উপর। একপাশে বসিয়া সমিরুদ্দিন। সম্মুখে কেতাবের দপ্তর খোলা। হাই তুলিয়া চোখ ফিরাইতে সে সানন্দে চীৎকার করিয়া উঠিল, বা-জান। সমির নিজের জায়গা ছাড়ে নাই। সে জানে, পড়া ছাড়িয়া আবার খাতিরদারী করিতে গেলে বকুনি খাইতে হয়।
—আব্বা, আঁঅর লাই…
কি যেন জিজ্ঞাসা করিতে গেল সমির। ততক্ষণ জহির মিয়া ঘরের ভিতর ঢুকিয়াছে। বাহির হইয়া আসিল সে তখনই
—তোঁআর মা কণ্ডে গেইয়ে?
—বা-জান, কর্জের লাই।
কুলসুম সকালেই কর্জের জন্য বাহির হইয়াছে।
জহির মিয়া আবার ঘরে ঢুকিল। তৃষ্ণা পাইয়াছে তার।
কলসে পানি ছিল না। বাহিরে আসিল তৎক্ষণাৎ।
—আব্বা, আঁঅর লাই কিতাব।
—হারামাজাদা, কিতাব! উডন পারস না?
—আঁই পড়ি, আব্বা।
—পড়স্! পইড়া হৈব কি? উড্ হারামজাদা। ডাক্ তোঁয়ার মারে।
–আঁই পড়ি!
–পইড়্যা হৈব কি?
ভীত সমির বসিয়া রহিল। পিতার এমন মূর্তি সে কোনদিন দেখে নাই।
—আঁই পড়ি!
–উড্।
বিভ্রান্ত সমির!
জহির মিয়া বলিয়া যায় : পইড়্যা হৈব কি? ইলেম-ইলেমের মার-সুই-বুট পাছায়, ফির গু’স চায়। ইলেমের দরকার নাই। উড়। পড়নের কাম্ নাই।
সমির কিছুই উপলব্ধি করিতে পারিতেছিল না। ভয়ে কাষ্ঠ-পুত্তলি বনিয়া গিয়াছে সে।
—উড্। জদি।
সমির এইবার দাঁড়াইল। সঙ্কোচ-আড়ষ্ট।
—হালার পুত্ কাউরে ডাইতে পারস্ না? পইড়্যা হৈব কি? পড়স্ তুই? খাড়া র।
জহির মিয়া তখনই পুঁটুলি খুলিয়া নূতন পুস্তক ফড়ফড় শব্দে ছিঁড়িতে লাগিল। মুখের কামাই নাই : ইলেম-এই ইলেমে হৈব কি?
হঠাৎ তার চোখ পড়িল সমিরের দপ্তরের উপর। কয়েকটি বই খোলা পড়িয়াছিল। সে ছোঁ মারিয়া তুলিয়া লইল এবং শকুন যেমন মৃত পশুর অস্ত্র ছিন্নভিন্ন করে, বইয়ের পাতাগুলি তেমনই নির্দয়ভাবে ছিঁড়িতে লাগিল।
মুখে তুপড়ি ছুটিতেছে তার : হালার ইলেম। সুট বুট আর গু’স। আরে বুট-সুট মারানীর প্রত। তার পর আরো একটি অকথ্য গালি দিয়া বলিল : সুট পাছাৎ, গুস মুখে, এই ইলেমে হৈব কী? বেজম্মার জাত। (সমিরের দিকে ফিরিয়া) তোয়ার মাকে ডাক্। উড্, হারামীর ছাঁউ-উড্।