০৬. আবার আড়াআড়ি বাঁশ

আবার আড়াআড়ি বাঁশ। আবার বনদফতর পথ আটকেছে। করমপদায় থেমে গেল টুপুরদের জিপ।

নজরুল হোসেন প্যাঁ-পোঁ হর্ন বাজিয়েই চলেছেন। জঙ্গলের মধ্যে এত জোরে শব্দ করা উচিত নয়। কিন্তু উপায়ই বা কী, বিট অফিসারের টিকি দেখা যাচ্ছে না যে!

কাছেই একখানা একতলা পাকাবাড়ি। দেখে মনে হয় প্রাইমারি স্কুল। দরজা জানলা বন্ধ, সামনের ফাঁকা জায়গায় আপন মনে ছোটাছুটি করছে গোটাকয়েক বাচ্চা। জিপের দিকে ফিরেও তাকাচ্ছে না বাচ্চাগুলো। সম্ভবত এমন জিপ দেখে দেখে তারা অভ্যস্ত। অদূরে একটি লালচে-দেওয়াল মাটির বাড়ি, মাথায় টিনের চালা। বাড়িটায় লোকজন আছে কি না ঠাহর করা যাচ্ছে না গাড়ি থেকে। যদি কেউ থাকেও, তারা নিৰ্ঘাত কালা। এত আওয়াজেও কেউ একবার উঁকি দিল না?

নজরুল হোসেন স্টিয়ারিং ছেড়ে নামলেন, হল কী? গেল কোথায় সব?

সহেলি ঝটিতি বললেন, মধুবাবার আশ্রমে চলে যায়নি তো?

অবনী ঝেঁঝে উঠলেন, তুমি থামবে? মধুবাবা মধুবাবা করে পাগল হয়ে গেলে!

তুমি বুঝবে কী করে? তোমার তো আর হাঁটু-কোমরে ব্যথা নেই।

মিতিন দুহাত তুলে বলল, শান্তি, শান্তি। জঙ্গলে ঝগড়া করলে জন্তুজানোয়াররা ঘাবড়ে যাবে। তার চেয়ে বরং নামো, হাত-পা ছাড়াই।

সেই কোন ভোরে উঠেছে সকলে। মেঘাতুবুরুর সূর্যোদয়ও আজ জমেনি তেমন। দিগন্তে মেঘ ছিল ছেঁড়া-ছেঁড়া। বেজার মুখে গেস্ট হাউসে ফিরে ঝটপট তৈরি হয়ে নিল টুপুররা। তারপর জলখাবার খেয়েই স্টার্ট। থলকোবাদে কিছুই নাকি পাওয়া যাবে না, তাই বনবাসের রসদ সংগ্রহ করতে হল বাজার থেকে। চাল, ডাল, আলু, আটা, ময়দা, তেল, মশলা, নুন, লঙ্কা…। চা চিনি, বিস্কুট, চানাচুর, গুঁড়ো দুধ। ঝিনিকপানির মুরগিবধের দৃশ্য এখনও টুপুরের চোখ থেকে মোছেনি, সহেলিও জ্যান্ত মুরগি বেঁধে নিয়ে যেতে রাজি নন, তাই মুরগি শেষ পর্যন্ত বাদই দেওয়া হল। তার বদলে নেওয়া হল অফুরন্ত ডিম।

বড় বড় ব্যাগে যজ্ঞিবাড়ির বাজার নিয়ে কিরিবুরুর ঢাল বেয়ে জিপ নেমে গেল জঙ্গলে। তারপর অরণ্য ভেদ করে যাত্রা। কী অপূর্ব যে কাটল সময়টা। চারধারে অগুন্তি শালগাছ, মধ্যিখান দিয়ে রাস্তা, মাঝে-মাঝে শিশু, মহাশিমুল, সেগুন, কেঁদ আর মহুয়াও ডালপালা মেলে দাঁড়িয়ে। সেগুন আর মহুয়া গাছগুলো থোকা থোকা সাদা ফুলে ঢাকা। ভারী মিষ্টি একটা গন্ধে ছেয়ে ছিল গোটা পথ। পাশাপাশি অন্য একটা গন্ধও লাগছিল নাকে। জঙ্গলের গন্ধ। বুনো বুনো। কত যে নাম-না-জানা পাখি ডেকে উঠছিল জঙ্গলে। জিপের যান্ত্রিক শব্দে ফুড়ুত করে উড়ে পালাচ্ছিল তারা, হারিয়ে যাচ্ছিল ঘন পাতার আড়ালে।

সরু নালার মতো একটা নদীও সঙ্গে সঙ্গে চলল অনেকক্ষণ। কখন যেন কোন বাঁকে হারিয়ে গেল। এই নদীটার নামই কি কারো? না কি ওটা নদী নয়, নেহাতই কোনও নালা?

এখন করমপদায় জঙ্গল অনেকটাই ফিকে। তাও সূর্যকিরণ সরাসরি পৌঁছতে পারছে না মাটিতে, নরম সবুজ পাতার ফাঁক দিয়ে উঁকিঝুঁকি মারছে। গাছগাছালির নীচে আবছায়া। জঙ্গলের মাটি ঢেকে আছে চৈত্রের শুকনো পাতায়।

টুপুর অ্যান্ড কোম্পানি নেমে পড়ল জিপ থেকে। পার্থ গাড়ির বনেট ধরে ওঠবোস করে নিল একটু। ব্যায়ামের ভাষায় একে নাকি বলে বৈঠক। অবনীর পরনে আজ পাজামা-পাঞ্জাবি। এতক্ষণ আষ্টেপৃষ্ঠে শালও জড়ানো ছিল। এবার গরম লাগছে, তাই শালখানা রেখে দিলেন গাড়িতে। পায়চারি করছেন। পরীক্ষার হলে গার্ড দেওয়ার ভঙ্গিতে। ছাত্রদের টুকলি আবিষ্কার করার মতো করে সরু চোখে দেখছেন প্রজাপতিদের ওড়াউড়ি। সহেলি জিপের গা ঘেঁষে এমনভাবে দাঁড়িয়ে, যেন বিপদের আশঙ্কা দেখতে পেলেই টুক করে গাড়িতে উঠে পড়বেন। বুমবুম উল্লাসে বিকট শব্দ করতে করতে খানিক স্প্রিন্ট টানল। এবার টুপুরদিদির ক্যারাটের স্টাইল নকল করে হাত-পা ছুড়ছে শূন্যে। গলায় হুহ-হা, হুহ-হা।

নজরুল গেছে বিট অফিসারের সন্ধানে। মিতিন ঘুরে ঘুরে চারদিকটা দেখছিল। আপন মনে বলল, সাড়ে দশটা বাজে, কখনযে থলকোবাদ পৌছব!

সময় নিয়ে সহেলি ভাবিত নন। তিনি বললেন, চল না মিতিন, এই ফাঁকে মধুবাবাকে দর্শন করে আসি।

টুপুর অসহিষ্ণু মুখে বলল, এখন নয়। এখন কোনও মধুবাবা-ফদুবাবা হবে না। ও মিতিনমাসি, বাঁশ ফেলা গেটের দুপাশটাই তো ফাঁকা, গাড়ি সাইড দিয়ে বেরিয়ে যেতে পারে না?

অবনী তৰ্জনী তুললেন, খবরদার, আইন ভাঙবে না। অপেক্ষা করো।

টুপুর মুঠো পাকাল, আর কতক্ষণ?

বেশিক্ষণ অবশ্য দাঁড়াতে হল না। নজরুল পাকড়ে এনেছেন বনকর্মীকে। কেরোসিন কিনতে গিয়েছিল আদিবাসী তরুণটি।

খালি গা, খাকি ট্রাউজার, হাতে কেরোসিনডিব্বা বনকৰ্মীটি অপ্ৰস্তুত মুখে বলল, দুকান মে লাইন ছিল স্যার।

পার্থ কাঁধ ঝাঁকাল, করমপদাতেও কিউ? কত লোক থাকে এখানে?

উত্তর না দিয়ে মৃদু হেসে দ্রুত টিনের চালায় গিয়ে একটা পেল্লাই চাবি নিয়ে এল তরুণটি। চাবি ঘুরিয়ে লোহার আংটা খুলতেই তড়াং করে দাঁড়িয়ে গেছে বাঁশ।

নজরুল ওপারে গাড়ি নিয়ে গেলেন। অবনীই একমাত্র উঠে বসলেন সিটে। নিজস্ব রাষ্ট্রভাষায় সহেলি বনকৰ্মীটিকে জিজ্ঞেস বসলে করলেন, ভাই, করমপদামে মধুবাবার আশ্রম কাঁহা হ্যায়?

বনকর্মী রীতিমতো চমকিত, আপ মধুবাবাকো পহচানতেঁ?

এদিকে আসা ইস্তক নাম শুনছি খুব।

হাঁ, মধুবাবা বহুত বড়া মহারাজ আছেন। যা ছোঁবেন, তাই মিঠা হবে। যা বলবেন, ফলিয়ে যাবে। তরুণটির চোখে আপ্লুত ভাব, হামার বিবির বারবার বুখার হচ্ছিল। দো দিন মধুবাবাকা মিঠা পানি পিয়েছে, ব্যস, বুখার গায়েব। সে এখন বাপ কা ঘর চলিয়ে গেল।

মিঠাপানি খেয়ে সোজা বাপের বাড়ি? পাৰ্থ টিপ্পনি কাটল, তোমার তো তা হলে এখন মহা গেরো, হাত পুড়িয়ে রান্না করে খেতে হচ্ছে?

পাৰ্থর রসিকতা বুঝল না তরুণটি। ফ্যালফ্যাল চোখে তাকাল।

মিতিন জিজ্ঞেস করল, তা ভাই, তোমাদের মধুবাবার আশ্রম এখান থেকে কদ্দূর?

এই তো, সামনেই আছে। ইধার এক হাট লাগতা হ্যায়, উস হাটকা বগলমে এক মন্দির আছে, বাবা ওঁহিপর থাকেন। রেললাইনকে উস পার।

এখানে রেললাইনও আছে নাকি?

স্টিশান ভি আছে। কিরিবুরুসে আসে ট্রেন, বারসেই তক যায়।

বলো কী! বারসোই তো ওড়িশায়?

জঙ্গলের ভিতর দিয়ে লাইন আছে দিদি। লোহাপাথর চালান যায় ট্রেনে। আদমি ভি যায়।

লাইনটা কি কিরিবুরু থেকেই শুরু?

কী আবোল তাবোল ভ্যাজরং ভ্যাজরং করছিস মিতিন? সহেলি অধৈৰ্য হলেন, বলো তো ভাই, এখন গেলে বাবার দর্শন হবে?

আজ তো নেহি হোগা। বাবা তো আভি করমপদামে নেহি হ্যায়।

সে কী! সহেলির মাথায় হাত, মধুবাবা চলে গেছেন?

দো চার দিনকে লিয়ে। রাউরকেলাসে এক চেলা এসে নিয়ে গেল।

ও। ফিরবেন কবে?

কাল। নেহি তো পরশু। এখানে পরশু হাট আছে। হাটের দিন বাবা জরুর বসবেন বলেছেন।

পার্থ বলল, তা হলে আর কী বড়দি, চলুন। পরশুই আসব।

হ্যাঁ, আসেন। আপনারা জঙ্গলমে কতদিন থাকছেন?

থলকোবাদে পাঁচদিনের বুকিং। পূর্ণিমাতে জঙ্গল দেখে তবে ফিরব।

বহুত আচ্ছা। পরশু তবে দুপহরে চলিয়ে আসেন। সিধা আমার কাছে আসবেন। বাবা ফরেস্টের স্টাফদের বহুত খাতির করেন, আমি আপনাদের নিয়ে গিয়ে ইস্পিশাল দৰ্শন করিয়ে দেব।

সহেলি মহা খুশি, আমরা তবে পরশুই আসি, কী বলো?

মিতিনের প্রশ্ন এখনও ফুরোয়নি। জিজ্ঞেস করল, বাবা কি এরকম মাঝে-মাঝেই চেলাদের বাড়ি চলে যান?

ডাকলে যান। একবার কিরিবুরু ভি গিয়েছিলেন।

তা কদিন এখানে এসেছেন মধুবাবা?

জাদা দিন নেহি। বনকৰ্মীটি মনে মনে হিসেব করে নিয়ে বলল, এক মাহিনাসে ভি কম। হোলিকে দিন এসেছিলেন।

স্কুলমাঠের বাচ্চাগুলোর কাছে গিয়ে কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল বুমবুম। বড়দের মতো ছোটদের খেলা নিরীক্ষণ করছিল। পার্থ তাকে ধরে এনে জিপে পুরে দিল। নিজেও উঠতে যাচ্ছিল, কী ভেবে আবার এল বনকৰ্মীটির কাছে, ভাই, শুনলাম জঙ্গলে একটা হাতি নাকি পাগল হয়ে গেছে?

হাঁ। সামটা রেঞ্জের সাহাব কাল এসেছিলেন। সাবধান করিয়ে গেছেন। ফরেস্টগার্ডরা ভি গণেশজী কে ঢুঁড়নে কে লিয়ে জঙ্গলে ঘুরছে।

পাগল হল কেন হাতিটা?

কেয়া মালুম! চোট ওট লাগা হোগা। অ্যায়সা হোতা কভি কভি।

টুপুর সামান্য অবাক হল। হাতির গুলি খাওয়ার কথা কি জানে না বনকৰ্মীটি?

পার্থ জিজ্ঞেস করল, তেমন ভয়ের কিছু নেই তো?

গাড়ি নিয়ে জঙ্গলে বেশি যাবেন না। আর যদি যান তো সুমায়াকে সাথমে লিবেন।

সুমায়া কে?

থলকোবাদ রেস্টহাউসকা চৌকিদারকা বেটা। বহুত চালু লেড়কা। সুমায়া রহনেসে আপনাদের কুছু হবে না।

যাক, একটা কাজের কাজ হল। পাৰ্থ নিশ্চিন্ত, ভাল একটা গাইডও পাওয়া গেল।

জিপ চলতে শুরু করার পরও কিছুক্ষণ মধুবাবা আর সুমায়াকে নিয়ে আলোচনা হল। জঙ্গলের মধ্যে কখন ঢোকা হবে, ঢুকলেও রাত্তিরে একদম নয়, এসব নিয়েও কথা হল খানিক।

থলকোবাদ যাওয়ার রাস্তাটা বেশ জটিল। কখনও জঙ্গল অসম্ভব। ঘন, লতাপাতা গাছগাছালিতে অন্ধকার হয়ে থাকে। কোথাও আবার একেবারেই খোলামেলা, মাঠ-মাঠ। পথে ছোট-ছোট গ্রামও পড়ল এক-আধটা। কখনও রাস্তা দুর্গম হচ্ছে। খাড়া চড়াই ভেঙে অনেকটা উঠতে হচ্ছে জিপকে, গোঁ গোঁ করছে ইঞ্জিন। ঘন ঘন বাঁক। একপাশে জঙ্গল, একপাশে খাদ। নজরুলের মতো হাসিখুশি মানুষেরও চোয়াল শক্ত, এক মুহূর্তের জন্যও উইন্ডস্ক্রিন থেকে চোখ সরাচ্ছেন না। পলকের অসাবধানতা পাহাড়ি রাস্তায় বিপদ ডেকে আনে।

কিছুদূর অন্তর অন্তর শুকনো পাতা আর কাঠকুটোর ডাঁই। সযত্নে জড়ো করা। টুপুর অবনীকে জিজ্ঞেস করল, কারা এভাবে রেখে গেছে বাবা? ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের লোক?

না রে অবনী বললেন, রেখেছে গায়ের লোকজন। এই ফাল্গুন-চৈত্রই তো ওদের কাঠকুটো কুড়ানোর সময়।

কেন?

পোড়াবে। ছাই ছড়িয়ে দেবে চাষের জমিতে। তারপর পাহাড়ের গায়ে ওইসব জমিতে ওরা চাষ শুরু করবে। একে বলে ঝুম চাষ।

পাতাটাতা পোড়ানোর আরও একটা কারণ আছে অবনীদা। পার্থ বিজ্ঞ মতামত দিল, শুকনো পাতা সাফ না করলে মাটিতে রোদ জল পৌঁছবে কী করে?

টুপুর মনে মনে ঠিক করল, এই কথাগুলো আজই ডায়েরিতে লিখে নিতে হবে।

থলকোবাদ পৌঁছতে বারোটা বাজল। গোটা পথ সবাই সতৃষ্ণ নয়নে বাইরে তাকিয়ে ছিল, যদি কোনও জন্তুজানোয়ার দেখা যায়। কোথায় কী! একটা জন্তুকে শেয়াল মনে হল, কাছে গিয়ে বোঝা গেল সেটি একটি নিরীহ কুকুর।

থলকোবাদের বিট অফিসার বেশ প্রবীণ মানুষ। গোলগাল হৃষ্টপুষ্ট চেহারা, মাথায় ছড়ানো টাকা নাম দীননাথ সহায়। দীননাথ কথা বলেন ধীরেসুস্থে, নড়াচড়াও করেন অলস মেজাজে। টুপুররা যখন পৌছল, তিনি তখন নিজস্ব কোয়ার্টারের দাওয়ায় বসে আরাম করে গায়ে সরষের তেল মাখছিলেন। নামেই কোয়ার্টার, আদতে মাটির বাড়িা উঠোনে মুরগি চরে বেড়াচ্ছে, সপরিবারে।

বিট অফিসের ইয়া জাবদা খাতায় নামধাম লিখতে হচ্ছে পার্থকে। বাকিরা পায়ে পায়ে বনবিশ্রামাগারের দিকে এগোল। রেস্টহাউসটা বেশ খানিক উঁচুতে, দীননাথের কোয়ার্টার থেকে শদুয়েক গজ দূরে।

কাছাকাছি আসতেই এক হেঁড়ে গলার গান, আমার যাওয়ার সময় হল, দাও বিদায়…।

টুপুর আর মিতিন মুখ চাওয়াচাওয়ি করল। রেস্টহাউসের কাঁটাতার ঘেরা কম্পাউন্ডে এসে আবিষ্কার করল গায়ককে। এক মধ্যবয়সি ভদ্রলোক। প্ৰকাণ্ড চেহারার মানুষটি গান গাইতে গাইতে জিপে মালপত্র তুলছেন। সঙ্গে আর একজন ভদ্রলোকও আছেন, তিনজন মহিলা।

টুপুরদের দেখেই ভদ্রলোক বললেন, সুস্বাগতম, সুস্বাগতম।

মিতিন বলল, আপনারা…?

ভদ্রলোক মজার ভঙ্গিতে গেয়ে উঠলেন, তোমার হল শুরু, আমার হল সারা…।

অবনী গানটান বেশি বোঝেন না। ভুরু কুঁচকে বললেন, মানে?

আমাদের জঙ্গল দেখা শেষ। থলকোবাদ এবার আপনাদের জিন্মায়।

মিতিন হাসতে হাসতে বলল, কেমন দেখলেন জঙ্গল?

রসিক ভদ্রলোক এককথায় উত্তর দিলেন না। বললেন, ভাল বলব না মন্দ বলব ভেবে পাচ্ছি না। পাক্কা ছদিন রইলাম, নো টাইগার, নো ভালুক, নো হাতি, নট ইভ বুনো শুয়োর…। শুধু একপাল হনুমান এসে কাল রেস্টহাউসের মাথায় দাপাদাপি করেছিল। একদিনই মাত্র তিনটে শম্বর হরিণ দেখেছি। তাও ফর ফিউ সেকেন্ডস। আমাদের দেখে হরিণগুলো এমন লজ্জা পেল…।

অর্থাৎ জঙ্গল-ভ্রমণ ফ্লপ?

পুরোটা নয়। জঙ্গলের বিউটি দেখেছি। মারভেলাস। বলেই ভদ্রলোক ডাকলেন, ব্রতীন, ক রিল যেন ছবি তোলা হল?

ডিগডিগে লম্বা ভদ্রলোকের চটপট জবাব, দু রিল শেষ। প্লাস থার্ড রিলের সাতটা।

অর্থাৎ সেভেন্টিনাইন ফিল্‌মস। বুঝতেই পারছেন, ছ’ছটা দিন দেড়েমুশে এনজয় করেছি। গোটা থলকোবাদ এখন আমাদের ক্যামেরায় বন্দি। হা হা হা।

টুপুর ফস করে জিজ্ঞেস করল, আপনারা পাগলা হাতিটাকেও দেখতে পাননি?

গপ্পোটা এরা বাইরেও চাউর করে দিয়েছে? ভদ্রলোক অবনীর দিকে ফিরলেন, পুরো গাঁজাখুরি কেস মশাই। টুরিস্টদের প্রাণ খুলে বেড়ানোয় বাধা দেওয়ার চেষ্টা। ওই হাতি দেখিয়েই আমাদের পরশু থেকে আটকে রেখেছে। আরে মশাই, সুস্থ হাতিই নজরে এল না, তো পাগলা হাতি!

অবনী বললেন, জঙ্গলে জন্তুদৰ্শন-ভাগ্য সবার সমান হয় না।

এটা হক কথা। ভদ্রলোক মাথা দোলালেন, দেখুন, আপনাদের যদি চোখে পড়ে। খুঁজে পেলে পাগলা হাতিকে পাগলাগারদে দিয়ে আসবেন। কাছেই তো রাঁচি। নিজের রসিকতায় ভদ্রলোক নিজেই হাসছেন ফের, ওসব হাতিযাতি ছাড়ুন। এখানকার আসলি জিনিসটা অবশ্যই দেখে যাবেন।

কী?

করমপদার মধুবাবা। রিয়েল সেন্টলি পারসন। টাকাপয়সার লোভ নেই, হামবড়া ভাব নেই..

সহেলি গদগদ গলায় বলেন, আপনারা বুঝি তাকে দেখে এসেছেন?

দুবার। আসার দিন করমপদার বিট অফিসারের মুখে শুনে খুব কৌতূহল হয়েছিল। বিকেলেই গেছিলাম দেখতে। বিশ্বাস করবেন না, রীতিমতো তাক লেগে গেল। একটা লঙ্কাতে হাত ঘষে দিলেন, অমনই ঝাল লঙ্কা মিষ্টি বনে গেল! প্ৰণামী দিতে গেলাম, হা হা করে আটকে দিলেন। বললেন, টাকা ছুলেই নাকি ওঁর গায়ে ফোস্কা পড়ে। তার পরেও মনটা খুঁতখুঁত করছিল। মনে হচ্ছিল, ভেলকিবাজি দেখিয়ে বোকা বানাচ্ছেন না তো? পরদিনই সকালে আবার গেলাম। আমাকে দেখেই বলে উঠলেন, কী রে, আমায় বিশ্বাস না করে কষ্ট পাচ্ছিস তো? আয়, তোর সব দ্বিধা দূর করে দিই! বলেই আমার হাতে হাত বুলিয়ে দিলেন। কী কাণ্ড, আমার হাত পর্যন্ত মিষ্টি হয়ে গেল! এমন যোগসিদ্ধ সাধু অনেক কপাল করলে দেখা যায় মশাই।

বলছেন?

আলবাত। পারলে একবার দেখা করে আসবেন। সারান্ডা বেড়ানো সত্যিই সার্থক হবে।

ভদ্রলোকের সঙ্গীরা ডাকাডাকি শুরু করেছেন। ভদ্রলোক হাত নেড়ে বিদায় নিলেন।

সহেলি কড়া গলায় বললেন, কী, এবার বিশ্বাস হল তো?

টুপুর ধন্দে পড়ে গেল। সত্যিই কি মানুষের ঐশ্বরিক ক্ষমতা থাকে?