০৩. চাইবাসা থেকে মেঘাতুবুরু

চাইবাসা থেকে মেঘাতুবুরু যাওয়ার রাস্তাটাও মোটেই ভাল নয়। টাউনের সীমানা ছাড়ানোর পর প্রথম তিন-চার মাইল তাও চলনসই ছিল, কিন্তু এখন যা শুরু হয়েছে তাকে এককথায় বলে অকহতব্য। একে মালভূমি অঞ্চলের ঢেউ-তোলা পথ, তায় রাস্তা জুড়ে ইয়া ইয়া গর্ত। উহুঁ, গর্ত নয়, গহ্বর। কোথাও কোথাও তো পিচের চিহ্নমাত্র নেই, খোয়া আর স্টোনচিপস ছড়িয়ে রয়েছে রাস্তাময়। আর ধুলো কী, বাপস! জিপের জানলার কাচ একটু সরল কি সরল না, অমনই লাল লাল গুঁড়ো ঝাপটে ঢুকে পড়ছে ভেতরে। কাল হিরনি যাওয়ার রাস্তা এর চেয়ে অনেক ভাল ছিল।

সালোয়ার-কামিজের ওড়না নাকে চেপে আছে মিতিন। ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করল, আপনারা এখানে গাড়ি চালান কী করে? শক অ্যাবজর্বার বসে যায় না?।

জিপ-চালকের নাম নজরুল হোসেন। বছর ষাটেক বয়স। চাইবাসাতেই বাড়ি, একসময়ে দীর্ঘকাল ঝাড়গ্রামে ছিলেন, কথা বলেন ঝরঝরে বাংলায়। নজরুলের জিপেই কাল হিরনি ফলস গিয়েছিল টুপুররা, তখনই নজরুলের সঙ্গে বেশ ভাব জমে গেছে টুপুরদের। ধারা সরু হলেও জঙ্গল জঙ্গল পরিবেশে হিরনি জলপ্রপাত টুপুরদের মন্দ লাগেনি। কাছে হেসাডি গ্রামটিও পটে আঁকা ছবির মতো সুন্দর। তবে সবথেকে বেশি ভাল লেগেছে নজরুলকে। মানুষটি ভারী রগুড়ে, মজার মজার কথা বলেন। তাঁর ভাষাতে সর্বক্ষণই গাড়ি আর গাড়ির কলকব্জার উপমা।

প্রকাণ্ড এক গাড্ডা দক্ষ হাতে কাটিয়ে নিতে নিতে নজরুল বললেন, শুধু গাড়ি কেন দিদি, আমাদের বডির শক অ্যাবজর্বারগুলোর কথাও ভাবুন। পাঁজরার স্প্রিং পাত্তিগুলো তো কবেই বসে গেছে। এখন নাটবল্টু খুলে খুলে পড়ার দশা। এই রাস্তায় আর এক-দুবছর টানতে হলে আমার ইঞ্জিনই পুরো বসে যাবে।

পার্থ সামনের সিটে, নজরুলের পাশে। সে টিপ্পনি কাটল, মেঘাতুবুরু অবধি আমাদের ইঞ্জিনও ঠিকঠাক থাকবে তো?

সহেলি তেতো মুখে বললেন, এসব রাস্তাঘাট সারানো হয় না কেন? গাড়িঘোড়া তো দেখছি এদিকে কম চলে না!

আবেদন-নিবেদন তো চলছে দিদি। গভর্নমেন্টও ভাবনাচিন্তা করছে। নজরুলের ফের সরস উক্তি, তবে নতুন স্টেট, নতুন সরকার… এখনও ভাল করে পিকআপ নেয়নি।

টুপুর বলে উঠল, এটা তো এখন আর বিহার নয়, ঝাড়খণ্ড। তাই না?

হুঁ। মিতিন বলল, ঝাড়খণ্ড মানে কী বল তো?

কী?

ঝাড় মানে জঙ্গল, বা ঝোপ। ঝাড়খণ্ড মানে জঙ্গলময় স্থান। এদিকে সর্বত্রই একসময়ে জঙ্গল ছিল। গ্রাম শহর যা গড়ে উঠেছে, সব কিন্তু এই জঙ্গল কেটে কেটে। এখানকার নামগুলোতেও তাই দেখবি জঙ্গলের ছাপ।

পার্থ বলল, যেমন শালবনি, মহুলবনি, কেঁদবনি, কুরচিবনি…

মিতিন বলল, ডালকাটি, হাতিয়াশোল, বাঘুয়াশোল, শিয়ালা…

পার্থ বলল, ভালুকনাচা, ভালুকবিধা, বাঘমারি, বাঘমুণ্ডি…

থাক, থাক, হয়েছে। অবনী থামালেন দুজনকে, খুব তো নাম আওড়াচ্ছ, ঝাড়খণ্ডের টোপোগ্রাফি জানো? ইতিহাস?

পাৰ্থ ঘাড় ঘুরিয়ে বলল, পড়েছি একটু-আধটু। মানভূম ধলভূম সিংভূম বীরভূম ভঞ্জভূম আর রাঁচির খানিকটা পার্ট– এই অঞ্চলটাকে এককালে ঝাড়খণ্ড বলা হত। ভঞ্জভূম চলে গেছে ওড়িশায়। ধলভূমের মেজর পার্ট, মানভূমের কিছুটা, সিংভূম আর রাঁচি ছিল বিহারে, এখন সেটাই ঝাড়খণ্ড স্টেট। বাকিটা আছে আমাদের বেঙ্গলে। বাঁকুড়া, পুরুলিয়া তো মানভূমেরই অংশ। বাই দা বাই, বীরভূম মানে কিন্তু বীরপুরুষদের ভূমি নয়, বীর মানে অরণ্য। ব্রিটিশ গভর্নমেন্টই এদের ভেঙে ভেঙে এক-একটা স্টেটে গুঁজে দিয়েছিল।

অনেকটাই ঠিক বলেছে, তবে পুরোটা নয়। অবনী মাথা দোলালেন, ঝাড়খণ্ডের অতীত কিন্তু খুব ইন্টারেস্টিং। ওই ভাগগুলো হয়েছিল ব্রিটিশরা এখানে পুরোপুরি রাজত্ব কায়েম করার আগেই। সেই ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আমলে। পলাশির যুদ্ধের পরে, সেভেনটিন সিক্সটিফাইভে। বাংলা বিহার ওড়িশার নবাব নাজ-উদ্-দৌল্লা পুরো ঝাড়খণ্ড অঞ্চলটাকেই তুলে দিয়েছিলেন কোম্পানির হাতে। ইচ্ছেমতো খাজনা তোলো, আর ভোগ করো। কিন্তু ঝাড়খণ্ডের মানুষ দারুণ স্বাধীনচেতা। তারা বাইরের মানুষদের বলত দিকু। হাজার হাজার বছর ধরে তারা এখানকার পাহাড়ে জঙ্গলে বাস করছে, খেতে না পেয়ে মরে যাবে, তবু তারা দিকুদের শাসন মানবে না। আদিকাল থেকে তারা এখানকার বাসিন্দা বলেই তো তাদের আমরা বলি আদিবাসী। তা তখন ঝাড়খণ্ডের আদিবাসীদের ছিল অনেক রাজা। ওই ভূমগুলো বলছিলে, ওইসব ভূমেই তখন কোনও-না-কোনও রাজার অখণ্ড প্ৰতাপ। তাঁরা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে ট্যাক্স তো দিলেনই না, উলটে শুরু হয়ে গেল কোম্পানির সঙ্গে যুদ্ধ। সাহেবদের কামান বন্দুকের সামনে সোজাসুজি লড়তে পারবেন না বলে গেরিলা ফাইট করতেন রাজারা। এই রাজাদের সঙ্গে কোম্পানির মোট কত বছর যুদ্ধ চলেছিল, জানো? সতেরোশো সাতষট্টি থেকে আঠারোশো পঞ্চান্ন, মানে প্রায় নব্বই বছর। ধলভূমগড়ের এক রাজা জগন্নাথ ধল তো টানা আট বছর লড়াই চালিয়েছিলেন, নাভিশ্বাস তুলে দিয়েছিলেন কোম্পানির। শেষপর্যন্ত অবশ্য জগন্নাথ ধলকে সারেন্ডার করতে হয়। কোম্পানিকে বার্ষিক চার হাজার দুশো সাতষট্টি টাকা খাজনা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন তিনি। সালটা ছিল সতেরোশো চুয়াত্তর। এবং তখন থেকেই ঝাড়খণ্ড রিজিয়ানে কোম্পানির শাসন প্রতিষ্ঠা শুরু…

অবনীর কথায় ছেদ পড়ল। টুপুর আচমকা চেঁচিয়ে উঠেছে, দ্যাখো, দ্যাখো, ওই মোটরসাইকেলটা কীভাবে আসছে।

একসঙ্গে সব চোখ ঘুরে গেল পিছনে। সত্যিই একটা মোটরসাইকেল তীব্র বেগে ধেয়ে আসছে। খানাখন্দর পরোয়া নেই, লাফিয়ে লাফিয়ে গর্ত পার হচ্ছে। কিছু বোঝার আগেই বিশ্রী ধুলো উড়িয়ে টুপুরদের জিপকে অতিক্রম করে চলে গেল। পিঠে দুই আরোহী, দুজনেরই মাথামুখ হেলমেটে ঢাকা।

সহেলি শিউরে উঠে বললেন, এভাবে কেউ চালায়। এক্ষুনি অ্যাক্সিডেন্ট করবে।

টুপুর বলল, এই মোটরসাইকেলটাকে একটু আগে চাইবাসায় দেখলাম না? সিনেমা হলের সামনে?

পার্থ বলল, তুই বুঝলি কী করে সেইটাই এটা?

ওটাও টুকটুকে লাল ছিল, গায়ে একটা ব্লু বর্ডার।

পার্থ হেসে ফেলল, ওই রঙের একটাই মোটরসাইকেল আছে বুঝি?

না গো, ওটাতেও দুজন লোক ছিল। একজন বসে ছিল মোটরসাইকেলে, আর একজন এস-টি-ডি বুথে ঢুকল। তুমি যখন সিগারেট কিনতে নামলে, তখন।

পার্থ জোরে হেসে উঠল, তাতেও কিসু প্রমাণ হয় না। এবং তুমি তোমার মাসির যতই চেলি বনার চেষ্টা করো, তোমার হবে না।

বুমবুম পাৰ্থর পাশ থেকে দু হাত উঁচু করে কাঁচকলা দেখাল টুপুরকে।

অবনী ছটফট করছিলেন। জিপে বসে বই পড়ার উপায় নেই, ঝাঁকুনির ঠেলায় ঘুমিয়ে পড়াও অসম্ভব, তাই এখন তাঁকে বক্তৃতায় পেয়েছে। অবনীর এমনটাও হয় মাঝে মাঝে, তখন তাঁকে থামিয়ে রাখা দুষ্কর। কলেজের অভ্যেসের মতো টানা পঁয়তাল্লিশ মিনিট ননস্টপ বকে যাবেন, বাধা পড়লেই মুখ হাঁড়ি।

অসহিষ্ণু স্বরে অবনী বললেন, ছাড়ো তো ওই মোটরসাইকেল। যা বলছি শোনো। তা সেই ঝাড়খণ্ড..।

টুপুর কাতর মুখে বলল, বাবা প্লিজ, বইয়ে পড়ে নেব।

বইয়ে কী আছে? কিছু নেই। আছে অচল সিংহের নায়েক বিদ্রোহের কথা? কৰ্ণগড়ের রানি শিরোমণির কাহিনী পাবি তোর বইয়ে? কিংবা মাধব সিংহের বীরত্বের গল্প? জমিদার দুর্জন সিংহ কীভাবে অম্বিকানগর আর সুপুরে কোম্পানির ফৌজের সঙ্গে লড়াই করেছিলেন, তার কথা তোর কোন ইতিহাস বইয়ে আছে? এই সিংভূমে একটা কোল-বিদ্রোহ হয়েছিল সে-খবরই বা কজন জানে?

পাৰ্থর স্বরও করুণ, এই সবকটা গল্পই এখন শুনতে হবে অবনীদা? আমরা কি এখন একটু প্রকৃতি দেখতে পারি না?

সহেলি বললেন, হ্যাঁ, সেই ভাল। তুমি একটু ক্ষ্যামা দাও।

অবনীর মুখ পলকে গম্ভীর।

বাইরে এখন নিসর্গ বলতে তেমন কিছু নেই, তবু তাকিয়ে থাকতে বেশ লাগে। রাস্তার দুপাশেই এবড়োখেবড়ো মাঠ, গাছপালা খুবই কম। কিন্তু এই রুক্ষতারও যেন একটা আলাদা সৌন্দর্য আছে। অনেক দূরে মেঘের মতো পাহাড় দেখা যায়, সম্ভবত ওদিকটাই সারান্ডা। মাঝে-সাঝে পথের ধারে গাছের সংখ্যা বাড়ছে একটু, কমেও যাচ্ছে। ছোট্ট ছোট্ট বসতি আসছে, শুকনো চেহারার গ্রামগুলোকে পেরিয়ে গেলেই আবার রুখসুখু প্রান্তর।

হঠাৎ হঠাৎ চোখে পড়ছে শিমুল পলাশ। পাতা দেখা যায় না, ফুলে ফুলে লাল হয়ে আছে গাছগুলো। এত ঘন লাল যে, চোখ ধাঁধিয়ে যায়।

পার্থ উল্লসিত হয়ে বলল, এই গাছগুলোকে একা একা দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তোর কি একটা গান মনে পড়ছে টুপুর?

কী গান বলো তো?

মিতিন বলল, আমি বলব?

বলো।

লাল পাহাড়ির দেশে যা,
রাঙামাটির দেশে যা,
হিথায় তোরে মানাইছে না রে,
ইক্কেবারে মানাইছে না রে।

ঠিক। ইক্কেবারে ঠিক। গানের কথাগুলো ফ্যান্টাসটিক। এমন টকটকে লাল ফুল কি যেখান-সেখানে মানায়? এই লাল মাটির দেশ ছাড়া?

মিতিন গুনগুন করে গেয়ে উঠল গানটা। টুপুর সহেলি গলা মিলিয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে পার্থও বুমবুম হাততালি সহকারে যোগ দিল কোরাসে। প্রবীণ নজরুল হোসেনের মুখও খুশিতে ভরপুর। তিনিও স্টিয়ারিং হাতে মাথা দোলাচ্ছেন গানের তালে তালে। অনেক চেষ্টা করেও অবনী আর গোমড়া থাকতে পারলেন না, আস্তে আস্তে চোয়ালটা তাঁর আলগা হয়ে গেল। ঠোঁট নড়ছে মৃদু মৃদু, গানের কলিগুলোই আওড়াচ্ছেন তিনি। হাঁটু দুটো নেচে উঠল। দুলছেন অল্প অল্প।

গান চলতে চলতেই একটা ছোট্ট জনপদ। সামান্য কটা দোকানপাট, কুঁড়েঘর, টিনের চালা, একটা-দুটো পাকাবাড়ি।

একটা দোকানের সাইনবোর্ডে ইংরেজিতে জায়গাটার নাম দেখে টুপুর গান থামিয়ে হই হই করে উঠল, মিতিনমাসি, ঝিনিকপানি ঝিনিকপানি! এইখানেই মুকুলবাবুর সেই হাতির পাল…!

একটু আগেই একটা ট্রেনলাইন পার হয়েছে গাড়িটা। ওখানেই বুঝি গজ-সম্মেলন হয়েছিল।

পার্থ বলল, ঝিনিকপানি নামটা কিন্তু বড় সুন্দর। নামটাকে সম্মান জানাতেই এখানে নেমে অন্তত এক কাপ চা খাওয়া উচিত।

সহেলি বললেন, কায়দা করছ কেন ভাই? সত্যি কথা বলো না, চা তেষ্টা পেয়েছে।

যাত্রীদের বাসনা টের পেয়ে নজরুল বললেন, ব্রেক কষি তা হলে? আপনারা তেল মোবিল নিয়ে নিন।

ঝিনিকপানির একেবারে শেষ প্রান্তে ছোট চা মিষ্টির দোকানের সামনে জিপ থামালেন নজরুল। নেমেই টুপুরের চক্ষুস্থির। দোকানের পরেই একটা ঝাঁকড়া গাছ, তার তলায় দাঁড়িয়ে সেই মোটরসাইকেলটা। আরোহীরা নেই, সিটের ওপর শোভা পাচ্ছে জোড়া হেলমেট!

টুপুর টানল মিতিনকে, দেখেছ? দেখেছ?

হুম।

লোক দুটো কোথায় গেল বলো তো?

আছে কোথাও এদিক-ওদিক।

সহেলি পাশে দাঁড়িয়ে কোমর ছাড়াচ্ছিলেন। লম্বা নিশ্বাস ফেলে বললেন, ভগবানের দয়ায় বেঁচে গেছে। যা মিসাইলের মতো ছুটছিল।

পার্থ বুমবুমকে নিয়ে দোকানে ঢুকেছে। হাঁক ছাড়ল, কে কী খাবে? কে কী ভাবে?

অবনী বাইরের সরু বেঞ্চিতে বসেছেন। বললেন, আমি শুধু এক কাপ চা। লিকার হলে ভাল হয়।

নিমকি খেতে পারেন। গরম গরম ভাজা হচ্ছে।

মাথা খারাপ! নিমকি খেয়ে মরি আর কী। অবনী দুহাত ছড়িয়ে আড়মোড়া ভাঙলেন, নজরুলভাই, আমরা জামদা পৌঁছচ্ছি কখন?

নজরুল ঘড়ি দেখলেন, এখন বাজে নটা, জামদা ধরুন আরও দেড় ঘণ্টা।

গোটাটাই এরকম ভাঙাচোরা রাস্তা?

না, না। জগন্নাথপুরের পর থেকে অনেকটা ভাল হবে।

তা হলে জগন্নাথপুর পার হয়ে একটা কলা খাব।

পার্থ চ্যাঙারিতে গোটাদশেক নিমকি নিয়েছে। সঙ্গে এক ডজন রসাল জিলিপি। সকলের সামনে গিয়ে এগিয়ে দিচ্ছে চ্যাঙারি। নজরুল একটা করে নিমকি জিলিপি নিলেন, টুপুর মিতি০ন দুটো করে। বুমবুমও একটা নিমকি তুলে নিল দেখে পাৰ্থ রীতিমতো হতাশ, বেজার মুখে কামড় বসাল জিলিপিতে।

টুপুর নিমকি খেতে খেতে জায়গাটা দেখছিল। স্থানীয় মানুষদেরও। সবাই প্রায় আদিবাসী। মোটা নাক, পুরু ঠোঁট, কৃষ্ণবর্ণ, স্বাস্থ্যবান। পোশাক খেটো ধুতি, দুএকজন ছাড়া বেশিরভাগেরই খালি গা। তবে মহিলাদের শাড়িগুলো দিব্যি রংচঙে। বাচ্চা কোলে একটা বউ হাঁ করে এদিকে তাকিয়ে। কানে মোটা দুল, বাদামি চুলে টেরচা খোঁপা।

চাপা গলায় টুপুর জিজ্ঞেস করল, মিতিনমাসি, এরা কি সাঁওতাল?

মিতিন দুদিকে ঘাড় নাড়ল। বলল, মুণ্ডা, কিংবা ওঁরাও। এদিকে হো উপজাতির লোকও আছে অনেক। তবে এরা বোধহয় হো নয়। আর এই অঞ্চলে সাঁওতাল তো প্রায় নেইই।

কিন্তু সব চেহারাই তো মোটামুটি এক!

না রে, খুঁটিয়ে দেখলে তফাত বোঝা যায়। সকলেই অস্ট্রিক অরিজিন, তবে কিছু ডিফারেন্স আছে। চুলের কালারে, মুখের শেপে…। আমরা আলাদা করতে পারি না, সেটা আমাদের চোখের দোষ।

চা এসে গেছে। অবনীর লিকার-চা হয়নি, সবই দুধ মেশানো। এবং ভয়ঙ্কর গরম।

রয়েসয়ে, ফুঁ দিয়ে দিয়ে গ্লাসে চুমুক দিচ্ছে টুপুর, তখনই মোটরসাইকেলের দুই আরোহীর উদয় হল। ঝাঁকড়া গাছটার গা দিয়ে সরু পায়ে চলা পথ নেমে গেছে গ্রামের দিকে, সেই পথ বেয়েই হঠাৎ উঠে এসেছে লোক দুটো একজন শিস দিতে দিতে আঙুলে চাবির রিং ঘোরাচ্ছে, অন্যজনের দুহাতে ঝুলছে দুখানা জ্যান্ত মুরগি।

দুটো লোকেরই পরনে জিল্স আর টি-শার্ট। চোখে সানগ্লাস। শ্যামবর্ণ, তবে স্পষ্ট বোঝা যায় এরা আদিবাসী নয়। শহুরে কায়দায় কাটা চুল উড়ছে হাওয়ায়। মোটরসাইকেল স্টার্ট দিতে গিয়েও প্ৰথমজন দাঁড়িয়ে গেল। হিপ-পকেট থেকে মোটা পার্স বার করছে। এগিয়ে এসে দোকান থেকে সিগারেট কিনল চার প্যাকেট। হাতের থাবায় প্যাকেটগুলো ধরে সরু চোখে টুপুরদের জরিপ করল ঝলক। তারপর ফিরে গিয়ে মাথায় হেলমেট চড়াচ্ছে। দ্বিতীয় লোটা মোটরসাইকেলের সাইডবক্স থেকে একটা নারকেল দড়ি বার করেছে ইতিমধ্যে। মুরগি দুটোর পা কষে বাঁধল, ঝুলিয়ে দিল মোটরসাইকেলের ব্যাকরেস্টে। প্ৰাণভয়ে পরিত্ৰাহি চিৎকার করছে মুরগিগুলো, ভয়ানক ঝটাপটি করছে।

তখনই প্রথম লোকটা এক অদ্ভুত কাণ্ড ঘটাল। খপ করে চেপে ধরেছে মুরগি দুটোকে। মটমট করে মুচড়ে দিল মুরগি দুটোর গলা। কয়েক সেকেন্ড অপেক্ষা করে দেখল আর ওরা নড়াচড়া করে কি। না। তারপর নিশ্চিন্ত হয়ে লাথি কষাল মোটরসাইকেলে, দুই নিথর মুরগি আর নির্বিকার সঙ্গীকে পিছনে নিয়ে গর্জন তুলে বেরিয়ে গেল।

বুমবুম ভ্যাবাচাকা খেয়ে গেছে। কাঁদো কাঁদো মুখে বলল, মরে গেল মুরগি দুটো?

টুপুর অস্ফুটে বলল, কী নিষ্ঠুর!

মিতিন দোকানদারকে হিন্দিতে জিজ্ঞেস করল, কারা এরা? আপনি চেনেন?

দোকানদারও দেখছিল লোক দুটোকে। বলল, মালুম নেহি। হোগা কোই বাবুলোগ। সায়েদ জঙ্গলমে ঘুমনে আয়া।

আগে দেখেছেন?

দো-তিনবার দেখেছি। কাল ভি এসেছিল, মোরগা নিয়ে চলে গেল।

টুপুর থমথমে মুখে বলল, পেছনের লোকটাকে আমি চাইবাসায় মোটরসাইকেলে বসে থাকতে দেখেছিলাম।

বুমবুম গাল ফুলিয়ে বলল, ওরা পাজি লোক।

মুরগি দুটোর আর্তনাদ টুপুরের কানে লেগে আছে এখনও। মনটা খারাপ হয়ে গেল টুপুরের।

জিপ চলছে আবার। একটা বড়সড় কারখানা পেরোল। সিমেন্ট ফ্যাক্টরি। জগন্নাথপুরের পর সত্যিই খানিকটা উন্নতি হল রাস্তার, স্পিড বাড়ালেন নজরুল। সঙ্গে সঙ্গে অবনীর চোখ বন্ধ। সহেলি টুকটাক কথা বলছেন মিতিন পার্থর সঙ্গে, বুমবুম জানলা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে মাইলস্টোন গুনছে।

একটা বাঁকের মুখে বিশাল এক গর্ত। নজরুল প্রথমটা খেয়াল করেননি, শেষ মুহূর্তে ক্লাচ ব্রেক চাপলেন প্রাণপণে। প্রবল ঝাঁকুনি খেয়ে থরথর কেঁপে উঠল গাড়ি।

ব্যস, তারপর থেকে জিপ আর গতি তুলতে পারে না। গিয়ার বদল করে, অ্যাক্সিলারেটার চেপে চেষ্টা চালাচ্ছেন নজরুল, জিপ তবু হেঁচকি তুলেই চলেছে।

পাৰ্থ উদ্বিগ্ন মুখে জিজ্ঞেস করল, কী প্রবলেম হল নজরুলভাই?

মনে হচ্ছে লাং ইনফেকশান। গাড়ির ফুসফুসটাই গেছে। জামদা পৌঁছে গিয়ারবক্সটা একবার দেখাতে হবে।

ক্লাচপ্লেটের গণ্ডগোল নয় তো?

তাও হতে পারে। প্লেটও ক্ষয়ে যেতে পারে। অবশ্য যদি বলেন মেঘাতুবুরু অব্দি এভাবেই টেনে দিতে পারি। গাড়ি একটু ধুঁকতে ধুঁকতে যাবে, এই যা।

মিতিন বলল, না না, সেটা কিন্তু রিস্ক হয়ে যাবে। মেঘাতুবুরু যেতে প্রায় তিন হাজার ফিট উঠতে হবে। চড়াইয়ের সময়ে গাড়ি যদি সেন্সলেস হয়ে যায়..!

তা হলে জামদাতেই চেক-আপটা করিয়ে নিই, কী বলেন?

সত্যি সত্যি জ্বোরো রুগির মতো ধুঁকতে ধুঁকতে জিপ জামদা পৌঁছল প্রায় মিনিট কুড়ি পর। বেশ বড় টাউনশিপ। রীতিমতো ঘিঞ্জি। দোকানপাট আছে অজস্ৰ, গাড়ি সারানোর গ্যারাজও রয়েছে বেশ কয়েকটা। বাঁয়ে এক সরু গালতে ঢুকে জয় হনুমান মোটর ওয়ার্কসে জিপ নিয়ে গেলেন নজরুল। এই গ্যারাজের মালিক নাকি তাঁর খুব চেনা। মেকানিক গাড়ি পরীক্ষা করে রায় দিল ক্লাচপ্লেট ঠিক আছে, গিয়ারবক্সেরই অবস্থা খারাপ, ঘণ্টাতিনেক সময় লাগবে সারাতে।

পার্থ বলল, চলো, তা হলে আমরা এখানেই দুপুরের খাওয়াটা সেরে নিই।

অবনী চিন্তিত মুখে বললেন, এখানকার হোটেলে কি ডাল আলুসেদ্ধ পাওয়া যাবে?

সহেলি বললেন, তাড়াতাড়ি খেয়ে নিয়ে আমি কিন্তু এখানকার মার্কেটটা ঘুরব।

টুপুর অন্য কথা ভাবছিল। গাড়ি সারাতে বেশি দেরি হলে মেঘাতুবুরুর সূর্যাস্তটা মিস হয়ে যাবে না তো?

মিতিন ফস করে বলল, একবার ওই পুরুষোত্তম সিংহর বাড়িটা ঘুরে এলে হয় না?

পার্থ বলল, যাহ্, আলাপ পরিচয় নেই..

আহা, মুকুলবাবুকে তো চিনি। আর তিনি তো এখন জামদাতেই আছেন।

মাত্র এক দেড় ঘণ্টার আলাপ, তাও ট্রেনে… ওকে কি পরিচয় বলে? তা ছাড়া বাড়িটা ঠিক কোথায় তাও তো জানো না।

জামদায় এসে জামদার সিংহকে খুঁজে বার করতে পারব না? চাইবাসার অনন্তবাবু বলছিলেন পুরুষোত্তম নাকি একটা ক্যারেক্টার। এখানে এসেও তাঁকে একবার চোখে দেখব না? এই ফাঁকে মুকুলবাবুর সঙ্গেও নয় আর একবার দেখা হয়ে যাবে।