০৪. সেদিন কী কারণে ছুটি ছিল

চতুর্থ পরিচ্ছেদ

সেদিন কী কারণে ছুটি ছিল, সকালে বাহির হইবার তাড়া নাই। কাজল পড়িবাব ঘরে চৌকির উপর আধশোয়া হইয়া খবরের কাগজে চোখ বুলাইতেছিল। সে এমন অনেক লোক দেখিয়াছে যাহারা সকালে উঠিয়া কোনরকমে দাঁতটা মাজিয়া লইয়া হিংস্রভাবে খবরের কাগজকে আক্রমণ করে এবং প্রাণপণে পড়িতে পড়িতে দুইঘণ্টার মধ্যে এমন কী বেহালার পাচনের বিজ্ঞাপন পর্যন্ত নিঃশেষে চিবাইয়া ফেলে। কিন্তু সে নিজে খবরের কাগজ পড়িতে বিশেষ ভালোবাসে না। সমস্ত পাতাগুলি জুড়িয়া কেবল যুদ্ধের খবর, নয়তো আজেবাজে হেঁদো গল্প—আর রাজ্যের বিজ্ঞাপন। এসব খবরের প্রয়োজন নাই এমন কথা সে বলে না, কিন্তু ইহা অপেক্ষাও মহত্তর ঘটনা কোথাও ঘটিতেছে না সে কথাও বিশ্বাস করা কঠিন। ভালো খাওয়া ভালো পরার প্রয়োজনের বাহিরে যে অতিরিক্ত কর্মোৎসাহ মানুষকে একদিন পশুত্বের স্তর হইতে টানিয়া উঠাইয়াছিল, সে সম্বন্ধে সংবাদ কোথায়? এই মুহূর্তে সারা পৃথিবীতে মানুষ কি কেবল যুদ্ধ করিতেছে? কেবল ক্ষমতালাভের চক্রান্ত করিতেছে? কেহ কি গোলাপফুলের নতুন প্রজাতি সৃষ্টির জন্য গবেষণা করিতেছে না? কোনও অখ্যাত, দরিদ্র মানুষ কি গত একবৎসরে কোথাও মহৎ উদ্দেশ্যে আত্মোৎসর্গ করে নাই? জ্যোতির্বিজ্ঞানের কোনও নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয় নাই? একঘেয়ে খবর পড়িয়া মানুষ কী যে আনন্দ পায়। কাজলের তো বিরক্তি ধরিয়া গিয়াছে।

এই সময়েই বাহিরের দরজায় কড়া নড়িয়া উঠিল।

দরজা খুলিয়া কাজল দেখিল ধুতি আর শার্ট পরা চোখে চশমা বছর ত্রিশ বয়েসের এক ভদ্রলোক দাঁড়াইয়া আছেন। হাতে কয়েকখানা বই এবং একটি চামড়ায় বাঁধানো মোটা খাতা। চেহারায় পরিশীলিত বুদ্ধির ছাপ।

কাজল জিজ্ঞাসা করিল—আপনি কাকে চাইছেন? ভদ্রলোক মার্জিত গলায় বলিলেন–এইটে কি সাহিত্যিক অপূর্বকুমার রায়ের বাড়ি?

কাজলের বুকের মধ্যে হঠাৎ কেমন করিয়া উঠিল। কতদিন পরে আবার কেহ বাবার নাম করিয়া বাড়ির খোঁজ করিতেছে। বহুদিন পরে এমনটা হইল।

–আজ্ঞে হ্যাঁ। কী দরকার যদি–

–দরকার সে অর্থে কিছুই না। আমি ওঁর লেখার একজন ভক্ত, পাবলিশারের কাছ থেকে ঠিকানা জোগাড় করে একবার ওঁর স্ত্রী আর ছেলের সঙ্গে কথা বলতে এলাম। শুধু শ্রদ্ধা নিবেদন ছাড়া আমার আর কোনও উদ্দেশ্য নেই। একবার কি–

কাজল ভদ্রলোককে আনিয়া নিজের পড়িবার ঘরে বসাইল। ভদ্রলোক চারিদিকে তাকাইয়া দেয়ালে টাঙানো অপুর বড়ো ছবিখানা কিছুক্ষণ দেখিলেন, তারপর বলিলেন–একটা কথা জিজ্ঞাসা করছি, কিছু মনে করবেন না। ভুল হলে মার্জনা করবেন। আচ্ছা, আপনি কি অপূর্ববাবুর ছেলে?

কাজল হাসিয়া ঘাড় হেলাইয়া জানাইল-হ্যাঁ।

—আমি ঠিকই ধরেছি তাহলে। আপনার বাবার সঙ্গে আপনার চেহারার খুব মিল রয়েছে, জানেন? আমার দেখেই মনে হয়েছিল—আপনার মাও তো এখানে আপনার সঙ্গেই থাকেন, তাই না? ওঁকে একবার প্রণাম করে যাব–

-হ্যাঁ, নিশ্চয়। মা স্নান করছেন, আপনি বসুন। চা খাবেন তো?

–তা চা একটু হলে মন্দ হয় না

ভদ্রলোকের চা-পানের মাঝপথে হৈমন্তী আসিয়া ঘরে ঢুকিল। ভদ্রলোক সম্রমে, ব্যস্ততায় তটস্থ হইয়া খটাখট শব্দে পেয়ালা-পিরিচ টেবিলের উপর রাখিয়া উঠিয়া দাঁড়াইলেন, বলিলেন— আমার নাম জগদীশ চৌধুরী, কলকাতায় ভবানীপুরে থাকি। কলেজে পড়ার সময় থেকেই অপূর্বকুমাব রায়ের লেখা আমার খুব ভালো লাগে। ওঁর সব বই-ই আমি বহুবার করে পড়েছি। আপনাদের সঙ্গে আলাপ করার ইচ্ছে আমার অনেকদিনের। তাই ভাবলাম–

হৈমন্তী বলিল—খুব ভালো করেছেন, ওঁকে যারা ভালোবাসেন তারা সবাই আমার আত্মীয়। বসুন না–

জগদীশ চৌধুরী অগ্রসর হইয়া হৈমন্তীর পায়ের ধুলা লইয়া বলিল—আপনি আমার মাতৃতুল্য, আমাকে তুমি বলবেন। আমার পরম দুর্ভাগ্য, স্বয়ং লেখককে দেখতে পেলাম না। আমি ওঁকে কত শ্রদ্ধা করি তা বলে বোঝাতে পারব না—যদি আজ ওঁর পায়ের ধুলো নিতে পারতাম তাহলে আমার জীবন ধন্য হত–

চেয়ারে বসিয়া বাকি চা-টুকু শেষ করিয়া জগদীশ বলিল—হিসেব করে দেখেছি, যখন প্রথম এর বই পড়ি তখনও উনি জীবিত। সে সময়ে চলে এলেও দেখাটা হত। আসলে তখন আমি সবে কলেজে ঢুকেছি, নিতান্ত লাজুক—এতবড় লেখকের বাড়ি এসে কী ভাবে কথা বলব তাই জানতাম না। পরে বয়েস বাড়বার সঙ্গে সঙ্গে যখন একটু বুদ্ধি হল, তখন বুঝতে পারলাম কী অমূল্য সুযোগ হাত ফসকে গেছে–

তারপর উৎসাহে উজ্জ্বল মুখ হৈমন্তীর দিকে তুলিয়া বলিল—আমার কি মনে হয় জানেন? আমার মনে হয় অপূর্বকুমার রায়ের মতো লেখক শুধু বাংলাভাষায় কেন, পৃথিবীর সাহিত্যে বহু শতাব্দীতে একজনই আসে। গাছপালা আর প্রকৃতির বর্ণনা তো অনেকের লেখাতেই পাওয়া যায়কিন্তু প্রকৃতির সঙ্গে এমন একাত্ম হয়ে যাওয়া কিংবা প্রকৃতিকে সচেতন চরিত্র হিসেবে কল্পনা করা–এ আমরা একমাত্র কবি কালিদাসের অভিজ্ঞানশকুন্তলম্ ছাড়া–

অপরিসীম আবেগে জগদীশ আরও আধঘণ্টা অনেক কিছু বলিয়া গেল। শেষে বলিল–আমি অপূর্ববাবুর অমর স্মৃতির উদ্দেশে একখানা কবিতা লিখেছি। একটু শোনাবো?

হৈমন্তী বলিল—বেশ তো, শোনান না–

জগদীশ চামড়ায় বাঁধানো খাতাটা খুলিয়া পড়িতে লাগিল—চলিয়া গিয়াছে হে কবি, যদিও কবেই অমর ধামে—আমার হৃদয়তন্ত্রী তবু যে বাজিছে তোমার নামে।

কবিতাপাঠ শেষ করিয়া জগদীশ জিজ্ঞাসা করিল–কেমন হয়েছে? ভালো?

হৈমন্তী মাথা নিচু করিয়া নিঃশব্দে কাঁদিতেছিল। কাজলের চোখেও জল আসিয়া গিয়াছিল। অবাক হইয়া দু-জনের দিকে তাকাইয়া অপ্রস্তুত জগদীশ বলিল—এ হে! আপনাদের মনে খামোকা দুঃখ দিলাম, আমাকে মাপ করবেন

আঁচল দিয়া চোখ মুছিয়া হৈমন্তী বলিল–না না বাবা, তোমার কোনও দোষ নেই। খুব সুন্দর হয়েছে তোমার কবিতা-সেজন্যই তো চোখে জল এলো। বোসো, তোমাকে কিছু খেতে দিই—

জগদীশ ব্যস্ত হইয়া বলিল—আমি কিছু খাব না মাসিমা, আপনি উঠবেন না।

—তা কি হয় বাবা? মায়েব কাছে এসেছে, বাড়িতে যা আছে তাই দেব। বোসো তুমি–

হৈমন্তী খাবার আনিতে গেলে জগদীশ মিনিটখানেক লজ্জিতমুখে বসিয়া রহিল, তারপর কাজলের দিকে তাকাইয়া বলিল—আমারই বোঝা উচিত ছিল, এ ব্যাপারে আপনাদের একটা

সেন্টিমেন্ট থাকা খুব স্বাভাবিক। বিনা ভূমিকায় কবিতাটা অমনভাবে পড়া উচিত হয়নি–

কাজল বলিল–ও ব্যাপারে আপনি আর কিছু ভাববেন না। বাবাকে আপনিও ভালোবাসেন বলেই না কবিতা লিখেছেন—এ আমাদের গৌরবের বিষয়।

হৈমন্তী একটা রেকাবিতে চিড়েভাজা আর নারকেলকোবা আনিযা জগদীশের সামনে টেবিলেব উপর রাখিয়া বলিল—সত্যিই বাড়িতে যা ছিল দিলাম। খাও বাবা–

খাইতে খাইতে জগদীশ বলিল—আমি আর একটা কথাও আপনাদের জানাতে এসেছিলাম মাসিমা। অপূর্ববাবুব লেখা ভালোবাসি এমন ক-জন মিলে আমরা একটা গোষ্ঠী তৈবি করতে চলেছি। কলকাতায় বিভিন্ন জায়গায় এই গোষ্ঠীর অনুষ্ঠান হবে। উদ্বোধনের দিন আমবা কিন্তু আপনাকে নিয়ে যাবে। যাবেন তো মাসিমা?

জগদীশ বিদায় লইবার পর মা ও ছেলে অনেকক্ষণ বসিয়া কথা বলিল। অপুকে লইযা কলিকাতায় দল গড়িয়া উঠিতেছে, তাহারা অপুর স্মৃতিসভা করিবে ইহাতে তো আনন্দিত হওয়া উচিত, কিন্তু দুইজনের কেবল কান্না পাইতেছে কেন? কাজল বলিল—বাবা বেঁচে থাকলে খুব খুশি হত, বুঝলে মা? কেউ বাবাকে ভালো বললে বা লেখার প্রশংসা করলে বাবা একেবারে ছেলেমানুষের মতো আনন্দ পেত। তুমি জানো না, একবার আমাদের কলকাতার ভাড়াবাড়িতে এক ভদ্রলোক এলেন। আমি তখন খুব ছোট, মুড়ি খেয়ে ঘরময় ছড়িয়ে মেঝে নোংরা করে রেখেছি। বাবার তখন সবে প্রথম বইখানা বেরিয়েছে। ভদ্রলোক বাবাব বই পড়ে মুগ্ধ, খবর দিতে এসেছেন বিকেলে বিভাবরী পত্রিকার সম্পাদক আসবেন বাবার সঙ্গে দেখা করতে। আমাকে বাবা বকলেন ঘর নোংরা করে রাখার জন্য—আসলে কিন্তু বাবাও আমার সঙ্গে মুড়ি খাচ্ছিলেন, অতিথির সামনে লজ্জায় পড়ে বকেছিলেন। আমার খুব দুঃখ হয়েছিল, আগে তো কখনও বাবার কাছে বকুনি খাইনি। সে লোকটা চলে যাবার পর আমার অভিমান হয়েছে বুঝতে পেরে বাবা আমাকে কত করে আদর করে দিলেন। যাই হোক, যে কথা বলছিলাম—সেদিন বাবার মুখে যে খুশির আলো দেখেছিলাম তা কোনোদিনই ভুলবো না মা। অহংকার বা উদ্ধত গর্ব নয়—বাবা সে ধ জানতেনই না। বাচ্চা ছেলেকে তার আঁকা ছবি বা তার গাওয়া গান সুন্দর হয়েছে বললে সে যেমন সরল আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে—বাবাকে তেমনি হতে দেখেছিলাম।

একটু চুপ করিয়া থাকিয়া সে আবার বলিল–আর আজ বাবাকে নিয়ে সভা হতে চলেছে। সেদিন প্রকাশকের দোকানে দাঁড়িয়ে আছি, একজন লোক বাবার বই কিনতে এসে কি বললো জানো মা? লোকটা বললো—অপূর্ববাবুর বই পড়লে আর অন্য উপন্যাস হাতে নিতে ইচ্ছে করে না। ওঁর যা যা বই আছে আমাকে দিন তো মশাই—

হঠাৎ কাজল হৈমন্তীর দিকে তাকাইয়া ব্যগ্রস্বরে বলিল—মা, তুমি বাবার একটা জীবনী লেখো কেন? তোমার চাইতে ভালো করে আর কে পারবে? আমি বলছি মা, এখনও কিছুই হয়নি, এই তো সবে শুরু—বাবার নাম নিয়ে পৃথিবীর লোক পুজো করবে একদিন, তুমি দেখে নিয়ো। তখন তোমার লেখা বই পড়ে সবাই বাবার কথা জানতে পারবে। লেখো না মা?

কলিকাতার মতো মালতীনগরেও কাজলের একটা বন্ধুর দল আছে। ইহাদের মধ্যে শিবদাস নামে একটি ছেলে একদিন কাজলকে বলিল—আমরা অকারণে জীবনটা ব্যয় করছি তা বুঝতে পারছিস কাজল?

বন্ধুর দলের ভবরঞ্জন ক্লাস এইটে একটি মেয়েকে বাড়িতে পড়ায়। তাহার বাবার বন্ধুর মেয়ে। গতকাল ভবরঞ্জন সিকের পাঞ্জাবি পরিয়া পড়াইতে গিয়াছিল-ছাত্রী নাকি বলিয়াছে, মাস্টারমশাই, এই জামাটাতে আপনাকে খুব সুন্দর দেখাচ্ছে। এই কথার কি গূঢ় অর্থ হইতে পারে তাহা লইয়া এতক্ষণ তুমুল তর্ক চলিতেছিল। একপাশে স্বয়ং ভবরঞ্জন ঘাসের উপর চিৎ হইয়া ধরাশায়ী মহারথীর ন্যায় পড়িয়া ছিল এবং বন্ধুদের বাক্যস্রোতের ফাঁকে ফাঁকে যতিচিহ্নের মতো উদাস দীর্ঘনিঃশ্বাস ত্যাগ করিতেছিল। এই রঙিন আরহাওয়ার মধ্যে শিবদাসের কঠিন দার্শনিক প্রশ্নজাল গানের আসরে মোহমুদগরের শ্লোকের মতো সবাইকে ভয়ানক চমকাইয়া দিল।

কাজল বলিল—তুই কী বলতে চাইছিস?

-আমি বলতে চাইছি যে, এই আড্ডা দেওয়া, মেয়েদের নিয়ে আলোচনা আর নাটক নভেল পড়ে আমরা বৃথা সময় কাটিয়ে দিচ্ছি। একটা কাজের কাজ কিছু করা উচিত। এরপর বুড়ো হয়ে গেলে আর অনুশোচনা ছাড়া কিছু করার থাকবে না—

বার্ধক্যের কথা ভাবিয়া কেহ যে খুব একটা ভয় পাইল এমন নহে। যৌবন সময়টাই এমন, যখন কেবল জীবনের আশাব্যঞ্জক দিকটি চোখে পড়ে। কোনো কিছু যে ফুরাইয়া যাইবার সম্ভাবনাও আছে সেটা চট করিয়া মনে আসে না।

অভয় জিজ্ঞাসা করিল–তোর মাথায় কোনো প্ল্যান আছে?

শিবদাস বলিল—আছে।

—কি?

—আমরা গরিব ঘরের ছেলেমেয়েদের জন্য নাইট স্কুল খুলতে পারি। এই আমাদের শহরেই কত ছেলেমেয়ে ইস্কুলে যায় না, তাদের বাবা-মায়ের ছেলেপুলেকে পড়াশুনো শেখাবার পয়সা নেই। আমরা বন্ধুরা মিলে তাদের লেখাপড়া শেখাতে পারি

কথাটা সবারই মনে ধরিল। বিকালে আড্ডা না দিয়া পড়াইলে মন্দ কি? সবাই মিলিয়া দেশের কাজও করা হইবে, আবার পড়ানোর ফাঁকে ফাঁকে গল্পগুজবও করা যাইবে।

কাজল বলিল—কাজটা ভালো। কিন্তু এর ইনিশিয়েটিভ কে নেবে?

শিবদাস বলিল—আমি নেবো। তুমি এবং অন্যরাও নেবে। আরে, এ কাজ শুরু করতে কী আর এমন হাতিঘোড়া লাগবে? আমরা সবাই দু-টাকা করে চাঁদা দিলেই একগাদা ধারাপাত, ফার্স্টবুক আর খাতা-পেনসিল হয়ে যাবে। ইস্কুলের ছেলেদের কাছে পুরোনো বইপত্রও কিছু চেয়ে নেবো

সুভাষ বলিল—আর ব্ল্যাকবোর্ড? পুরোনো ব্ল্যাকবোর্ড তো আর চেয়ে আনা যায় না!

ম্যাকবোর্ড এখন কি হবে? শুরুতে ওসবের দরকার নেই। তোমরা শুধু বল প্রত্যেকে সপ্তাহে দু-দিন করে সন্ধেবেলা এমদান করতে রাজি কিনা?

সকলেই রাজি। অভয় বলিল—কিন্তু জায়গা কোথায়? পড়াবো কোনখানে?

এটি জরুরি সমস্যা বটে। সেদিন বিতর্ক করিয়া কোনো সমাধান খুঁজিয়া পাওয়া গেল না। দিনপাঁচেক বাদে শিবদাস সান্ধ্যআড্ডায় ঘোষণা করিল—ওহে, নাইটস্কুলের জায়গা পাওয়া গিয়াছে

অভয় বলিল—খুব ভালো কথা, কোথায়?

—সরকারদের বাড়ির বারান্দায়। দোমহলা বাড়ি, লোকজন সব ভেতরে থাকে। সদর বাড়ির বারান্দায় কেবল বুড়ো রামযদু সরকার, নেড়ার বাবা আর কানাই চাটুজ্যে—এরা মিলে দাবার আড্ডা বসায়। তা সে আসর বসে রাত্তির ন-টায়, চলে দেড়টা দুটো অবধি। আমরা স্কুল করবো সন্ধে ছটা থেকে সাড়ে-সাত কি আটটা পর্যন্ত। কাজেই তাদের অসুবিধে হবার কথা নয়। রামযদু সরকারকে বলে-কয়ে রাজি করিয়েছি। সামনের মাসের পয়লা তারিখ থেকে স্কুল চালু করে দাও–

খাতাপত্র ধারাপাত ইত্যাদির ব্যবস্থা হইয়া গেল এবং অচিরেই সরকারবাড়ির বারান্দায় নিয়মিত নাইটস্কুল বসিতে লাগিল।

প্রথম দিন একটি ছোটমতো সভা করিয়া স্কুলের উদ্বোধন হইল। রামদু সরকারের বাড়ি, কাজেই তাঁহাকে সভাপতি করা হইল। আর আসিলেন স্থানীয় বিদ্যালয়ের হেডপণ্ডিত। দু-একজন বিশিষ্ট ভদ্রলোকও আসিলেন। ছেলেরা আরও অনেককে বলিয়াছিল, কিন্তু প্রায় সবাই একটা না একটা কাজ দেখাইয়া এড়াইয়া গেলেন। হেডপণ্ডিত বলিলেন—বিদ্যাদান অতি পুণ্যকর্ম। তিনি স্বয়ং এই পথে বিগত পঁয়ত্রিশ বৎসর ধরিয়া পুণ্যার্জন করিয়া আসিতেছেন। ছেলেরা যে গতানুগতিক প্রমোদে মত্ত না হইয়া দেশের মানুষকে শিক্ষাদানের ব্রত লইয়াছে, ইহাতে তিনি আনন্দিত বোধ করিতেছেন। ইস্কুলটি টিকিয়া থাকুক—ঈশ্বরের কাছে তাঁর এই প্রার্থনা।

রামযদু সরকার জীবনে জনসভায় কিছু বলেন নাই। তিনি বলিলেন—ছেলেগুলিকে তিনি চেনেন, ইহারা সবাই খুব ভালো। কাজেই যে কাজ তাহারা করিতে চলিয়াছে তাহাও যে ভালো তাহাতে তাহার সন্দেহ নাই। তবে রাত্রিতে তাহাদের দাবার আচ্ছাটি বিশ বৎসরেরছেলেরা আড়ার সময় হইবার পূর্বেই যেন বারান্দা ছাড়িয়া দেয়।

সমবেত জনসাধারণকে হরি ময়রার দোকানের সিঙাড়া আর অমৃতি খাওয়াইয়া সভার সমাপ্তি হইল।

কাজল ও তাহার বন্ধুরা শহরের নিম্নবিত্ত অধিবাসীদের পাড়ায় পাড়ায় ঘুরিয়া ইস্কুলের কথা প্রচার করিয়া আসিয়াছিল। প্রথমদিন জনা দশ-বারো ছাত্র-ছাত্রী পড়িতে আসিল। ইহাদের মধ্যে কেহ বর্ণপরিচয়হীন, কেহবা শহরের ফ্রি প্রাইমারি স্কুলে পড়ে, গৃহশিক্ষক রাখিবার সঙ্গতি নাই বলিয়া নাইটস্কুলে পড়া দেখিয়া লইতে আসে।

প্রতি সপ্তাহেই দুই-একজন করিয়া ছাত্র বাড়িতে লাগিল। কাজল হিসাব করিয়া দেখিল এই হারে ছাত্রসংখ্যা বাড়িতে থাকিলে মাস দুয়েকের মধ্যে সরকারদের বারান্দায় আর কুলাইবে না। আচ্ছা, প্রয়োজন হইলে বরং তাহাদের বাড়ির বাহিরের ঘরে স্কুলের একটা ব্রাঞ্চ খোলা যাইবে।

একমাস সগৌরবে স্কুল চলিল।

একদিন সন্ধ্যাবেলা সবে স্কুল বসিয়াছে, কাজল ছাত্রদের কী একটা টস দিয়া একটু পায়চারি করিবে বলিয়া বারান্দা হইতে নামিয়াছে, এমন সময় একজন লোক আসিয়া তাহাকে নমস্কার করিয়া দাঁড়াইল।

লোকটির চেহারা বিশাল, প্রথম দেখিলে মনে হয় একসঙ্গে বুঝি চার-পাচজন মানুষকে বাঁধিয়া রাখা হইয়াছে। পরনে খাটো ও মোটা ধুতি, গায়ে খাকি রঙের ফতুয়া জাতীয় জামা। হাতপাগুলি মোটা শারে গুড়ির মতো। আঙুল দেখিলে মনে হয় যেন একহড়া মর্তমান কলা ঝুলিয়া আহে। মুখে প্রচুর দাড়িগোঁফের জঙ্গল।

লোকটি আবার কাজলকে হাতজোড় করিয়া নমস্কার করি।

কাজল জিজ্ঞাসা করিল–কি চাই ভাই তোমার?

লোকটা ভাঙা ভাঙা হেঁড়ে গলায় বলিল–শুনলাম শহরে লিখাপড়া জানা খোকাবাবুরা ইস্কুল খুলেছে-গরিব আর বুঢ়া লোকেদের পড়া শিখাবে বলে, এইটা কি সেই ইস্কুল?

কাজল একটু অবাক হইল। এসব খোজে এই লোকটার কী প্রয়োজন? সে বলিল–হা, এটাই। তুমি কিছু বলবে?

লোকটা বিনয়ে ঘাড় নিচু করিয়া মৃদুস্বরে (সিংহের পক্ষে তাহার গর্জনকে যতটা মৃদু করা সম্ভব) বলিল—হাঁ বাবু। আমি লেখাপড়া শিখবো।

কাজল বিস্মিত হইয়া লোকটার দিকে তাকাইয়া রহিল। বলে কী! ইহার বয়েস দেখিয়া যতদূর মনে হয়, পঞ্চান্নর কম হইবে না। কথার টানে বোঝা যায় বাঙালিও নয়। তাহার উপর এই মনোহর আকৃতি! ইহাকে পড়াইতে রীতিমত বুকের পাটা দরকার। ছাত্র অবাধ্যতা করিলে পাড়াসুদ্ধ লোক ঠেকাইতে পারিবে কিনা সন্দেহ। সর্বনাশ! লোকটির এরুপ ভয়ানক দুর্বুদ্ধি হইল কেন? আরও কত কাজ তো করিতে পারিত?

কাজল একবার সেঁক গিলিযা বলিল—লেখাপড়া শিখবে? ইয়ে—সে তো খুব আনন্দের কথা। তবে হয়েছে কী—মানে, তোমার আবার একটু বয়েস হয়ে গিয়েছে মনে হচ্ছে কিনা—এই বয়েসে কী—

লোকটা কাজলের দুই হাত ধরিয়া মিনতির স্বরে বলিল—খোখাবাবু, আমি বিনতি করছিআমাকে পড়াও। বেশি না, থোড়া শিখলেই হবে। ভগওয়ান তোমার মঙ্গল করবেন।

কাজলের অদ্ভুত লাগিল। লোকটির বিশাল, কুদর্শন ও বৃঢ় প্রচ্ছদের অন্তরালে একটি সরল এবং কোমল অন্তঃকরণ যেন উঁকি দিতেছে। সে জিজ্ঞাসা করিল—তোমার নাম কী? কোথায় থাকো?

-বাবু, আমার নাম সিংহাসন, বাড়ি চম্পারণ জিলা। এখানে আমি ইস্টেশনে কুলিব কাম করি-থাকি বুড়য়া সিংয়ের বস্তিতে। একা। বাড়ির সবাই থাকে দেশের গ্রামে। আমাকে পড়াও বাবু, আমি ধেয়ানসে পঢ়বে–

কাজল ফাঁপরে পড়িল। অজ্ঞানতিমিরে নিমজ্জিতকে আলোকশিখা দেখাইবার জন্য স্কুল খুলিয়াছে, এখন এই বিদ্যোৎসাহী প্রৌঢ় ছাত্রকে বিমুখ করে কী করিয়া? অথচ ইহার আকার-প্রকার দেখিয়া মনে হয় কাজলের, জীবদ্দশায় বর্ণপরিচয় শেষ হইয়া উঠিবে না।

সে বলিল—আচ্ছা, সে হবে এখন। তুমি এসে এইখানে বোসো আগে, তোমার সঙ্গে একটু আলাপ করি

সিংহাসন বারান্দার একপ্রান্তে সসঙ্কোচে বসিল। কাজল চেয়ারে এবং সিংহাসন মাটিতে বসিয়াছে, তাহা সত্ত্বেও সিংহাসনেব মাথা প্রায় তাহার মাথার কাছে উঠিয়া আসিয়াছে। জোয়ান বটে লোকটা।

কাজল বলিল—তুমি হঠাৎ লেখাপড়া শিখতে চাও কেন?

কিছুক্ষণ কী ভাবিয়া শেষে সিংহাসন বলিল—আপনার কাছে শরম করে আর কী হবে? বলেই ফেলি। আমার দুই শাদি বাবু—পহলা অওরতের বাচ্চাকাচ্চা হল না। তখন আমি করলো কী, এটা একটু খারাপ কাম হয়েছিল—আমি আর একটা শাদি করলো। দুসরা বিবির একটাই লেড়কা, তার বয়েস এখন পহ সাল। হেলেটাকে বাবু আমি বুকে করে মানুষ করলাম, বপন থেকে যা চাইলে তাই দিলাম—কিন্তু মহার পাজি লৌভাদের সঙ্গে মিশে ছেলেটা বিগড়ে গেল। দুমাস আগে মুলুক গিয়েছিলাম। একদিন হেলে আমার সঙ্গে ঝগড়া করে বলল–তোকে বাপ বলতে শরম হয়। তুই তো অপড় কুলি আছিস, ফালতু আদমি! ভাবুন খোখাবাবু, আমার নিজের লেড়কা আমাকে অপড় আর কুলি বলে গালি দিল। গুসসা করে আমি মুলুক থেকে চলে এসেছি। এখন আমি লিখাপড়া শিখে নিজের হাসে ছেলেকে একটা চিঠি লিখতে চাই। উফ্! আমার লিখা চিঠি পেলে ছেলে কেমন অবাক হয়ে যাবে ভাবুন তো বাবু! তখন সে আর আমাকে ফালতু আমি বলতে সাহস পাবে না—

কাজলের অবশ্য মনে হইল সিংহাসন অপেক্ষা তাহার ছেলেরই শিক্ষার প্রয়োজন বেশি এবং সিংহাসন নিজে বিদ্যার্জনের উদ্যোগ না করিয়া উক্ত পুত্রের দুইপাটি দাঁত ভাঙিয়া দিলে শিক্ষাটা সম্পূর্ণ হইত। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে সে এই ভয়ালদর্শন অথচ নিরীহ ও সরল মানুষটির প্রতি কেমন একটা আকর্ষণ অনুভব করিল। সে বলিল–আচ্ছা, আমি তোমাকে পড়াবো। কাল সন্ধেবেলা স্লেট আর পেনসিল নিয়ে চলে আসবে–

সিংহাসন যথার্থ খুশি হইয়া বলিল–রামজী আপনার মঙ্গল করুন। বেশি না বাবু, সির্ফ একটা চিঠি লিখবার মতো শিখালেই হবে—

—তোমাকে কিন্তু বাংলা শিখতে হবে, আমি হিন্দি জানি না

-ঠিক আছে বাবু। মহল্লায় বাঙালি মাস্টরবাবু আছে। ছেলে তাকে দিয়ে পড়িয়ে লিবে। সে আরও ভালো হবে, আমার দেশে কোনো হিন্দুস্তানী বাংলা লিখতে জানে না

পরের দিন হইতে সিংহাসন নিয়মিত স্কুলে আসিতে আরম্ভ করিল। তাহার অধ্যবসায় দেখিলে বিস্মিত হইতে হয়। পুরা দুইঘণ্টা সে একটুও নড়ে না, বসিয়া বসিয়া স্লেটের ক-খ-এর উপর দাগা বুলায়। প্রথমদিকে তাহার অল্পবয়স্ক সহাধ্যায়ীরা ব্যাপার দেখিয়া হাসি চাপিতে পারে নাই। তাহাদের হাসি ও কোলাহলে পড়াশুনার অসুবিধা হয় বলিয়া আজকাল সিংহাসন স্কুলে একঠোঙা সস্তা লজেন্স লইয়া আসে। ছেলেপুলেরা গোলমাল শুরু করিলেই সিংহাসন দরাজ হাতে লজেন্স বিতরণ করিতে থাকে। কোলাহল অচিরেই থামিয়া যায়।

সিংহাসন এক হাঁটু পাতিয়া এবং এক হাঁটু তুলিয়া অদ্ভুত ভঙ্গিতে বসে। সামনে মাটির উপর স্লেট রাখিয়া অবিচলিত ধৈর্যের সঙ্গে বর্ণমালা লেখা অভ্যাস করে। কখনও বা বর্ণপরিচয়ের পাতা খুলিয়া অক্ষরগুলির উপর মোটা মোটা আঙুল রাখিয়া ভারি গলায় পড়িতে থাকে—কো, ক্ষো, গো—

কিন্তু সবার সবকিছু হইবার নহে। কেবলমাত্র আগ্রহ থাকিলেই কেহ ইচ্ছামত শিক্ষালাভ করিতে পারে না—সেক্ষেত্রে প্রবণতার প্রশ্ন আছে। কিছুদিন যাইবাব পর কাজল বুঝিতে পারিল লেখাপড়া জিনিসটা সিংহাসনের হইবার নহে। কিন্তু বেচারার এমন আকুলতা—তাহাকে মুখেব উপর নিষ্ঠুর সত্য কথাটা বলিতে বাধে। বিশেষ করিয়া লজেন্স বিতরণের মাধ্যমে তরুণ সহপাঠীদের নিকট সিংহাসন যেরূপ জনপ্রিয়তা লাভ করিয়াছে তাহাতে সে বিদায় লইলে ইস্কুল টিকিবে কিনা সন্দেহ। বরং যেমন চলিতেছে চলুক। মন্দ কী, ইহাতে কাহারও ক্ষতি নাই। লোকটি নেশাভাঙ না করিয়া অন্তত একটা ভালো জিনিস লইয়া আছে।

একদিন কাজল সিংহাসনের বাড়ি দেখিতে গেল।

রেলওয়ে স্টেশনের পাশ দিয়া ফিডার বোড় বাহির হইয়া জেলাশহরে যাইবার বড়ো রাস্তায় মিশিয়াছে। ফিডার রোডের ধারে বুড়য়া সিংয়ের বস্তি, সেখানে গিয়া,সিংহাসনের নাম করিতেই একজন তাহার ঘরটা দেখাইয়া দিল। সমস্ত বস্তিটা ছোট ছোট নিচু খোর চালের ঘর লইয়া প্রস্তুত, তাহারই একটায় সিংহাসন থাকে।

ঘরের সামনে দাঁড়াইয়া নাম ধরিয়া ডাকিতেই সিংহাসন বাহির হইয়া কাজলকে দেখিয়া অবাক হইয়া গেল।

–খোখাবাবু আপনি! কী ব্যাপার খোখাবাবু?

–কিছু না সিংহাসন, এমনি, তোমার বাড়ি আসতে ইচ্ছে ছিল, চলে এলাম।

সিংহাসন খুশিতে বিপর্যস্ত হইয়া পড়িল। ঘরের ভিতর লইয়া গিয়া সে কাজলকে একটা জলচৌকির উপর বসিতে দিল। বস্তির মধ্যে হইলেও ঘরখানি বেশ পরিষ্কার। একদিকে একটি দড়ির চারপাই, তাহার উপর একটি চাদর ও বালিশ—দুইটিই ফরসা করিয়া কাঁচা। ঘরের অপর প্রান্তে অনুচ্চ কাঠের বেদির উপরে সিরলিপ্ত রামসীতার পট। এককোণে ঝকঝকে করিয়া মাজা একটি পেতলের ঘটি ও কয়েকটি থালাবাসন।

কাজল বলিল–বাঃ, বেশ ঘর তোমার। বেশ পরিষ্কার করে রেখেছো

—আমি নোংরা দেখতে পারে না খোখাবাবু। বাইরেটা যার নোংরা, তার ভেতরটা সাফা হোয়। উ বাত ছোড়ো, কী খাবে বোলো–

-আমি কিছু খাবো না সিংহাসন, তুমি ব্যস্ত হোয়ো না–

সিংহাসন সে কথা শুনিবার পাত্র নহে। ব্রাহ্মণ অতিথি, অন্য কিছু খাইতে আপত্তি করিবে ভাবিয়া পাড়ার একটা ছেলেকে দিয়া খাঁটি গরুর দুধ আনাইয়া নতুন মাটির ভাঁড়ে করিয়া খাইতে দিল। বলিল—আমি গরিব লোক, আজ এই দিলাম। এবার দেশে গেলে তোমার জন্য পেঁঢ়া নিয়ে আসবো–আমাদের দেহাতে খুব আচ্ছা পেঁঢ়া তৈরি হয়–

দুগ্ধপান করিতে কবিতে কাজল বলিল–তুমি রাত্তিরে কী খাবে সিংহাসন?

সিংহাসন একগাল হাসিয়া বলিল–আমি আর কী খাবে? সেরভর আটা দিয়ে ছ-খানা রোটি বানাবো, করেলার ভাজি করবো আর রহড়ের দাল–এই খাবো।

কাজল অবাক হইয়া বলিল—একসের আটায় ছ-খানা রুটি! বলো কী?

—হাঁ বাবু। বাঙালি রোটি না-হামাদের বেহারী রোটি, বহুৎ মোটা আর পয়দাওয়ালা। পাতলা বাঙালি রোটি খেলে হামার পেট ভরে না।

সিংহাসন অবিচল ধৈর্যের সঙ্গে পড়াশুনা চালাইতে লাগিল। দুই-তিনমাস কাটিয়া গেল, এখনও সে ক-খ লিখিতে শিখিল না। কিন্তু তাহার নিষ্ঠা দেখিয়া কাজলের আশঙ্কা হইল, একদিন হয়তো বা সে সত্যই লেখাপড়া শিখিয়া ফেলিবে।

অকস্মাৎ একদিন সিংহাসন পড়িতে আসিল না।

ব্যাপারটা একটু অদ্ভুত, কারণ অসহ্য গরম বা ঝমঝম বৃষ্টি কোনোটাই এতদিন সিংহাসনকে ঠেকাইতে পারে নাই। বগলে স্লেট-পেন্সিল লইয়া সে নির্দিষ্ট সময়ে স্কুলে আসিয়া হাজির হয়। প্রথমদিন কাজল ভাবিল বোধহয় তাহার অসুখ করিয়াছে। কিন্তু পরপর দুই তিনদিন তাহার অনুপস্থিতির পর কাজল চিন্তিত হইয়া পড়িল। কী হইল মানুষটার? একবার খোঁজ করা দরকার।

সেদিন সন্ধ্যায় স্কুলে কাজলের ক্লাস ছিল না, হাঁটিতে হাঁটিতে সে বুড়য়া সিংয়ের বস্তিতে গিয়া হাজির হইল। হ্যাঁ, ওই তো নিজের ঘরের সামনে হাঁটুর উপর থুতনি রাখিয়া সিংহাসন বসিয়া আছে–তাহার গায়ে লাল কুর্তা, লাইসেন্সওয়ালা কুলিদের ইউনিফর্ম। কাছে গিয়া সে বলিল—কী সিংহাসন, পড়তে যাচ্ছ না যে?

সিংহাসন ঘোলাটে লাল চোখে একবার কাজলের দিকে তাকাইয়া আবার পূর্ববৎ বসিয়া রহিল। তাহার দৃষ্টি দেখিয়া মনে হইল না সে কাজলকে চিনিয়াছে।

এ আবার কী কাণ্ড! লোকটা নেশা করিয়াছে নাকি? কিন্তু এ কয়দিনে সে যতটা বুঝিয়াছে তাহাতে সিংহাসন নেশা করিবে বলিয়া বিশ্বাস হয় না। তবে?

আরও দুই-একবার ডাকাডাকি করিয়াও কাজল সাড়া পাইল না।

—বাবুজি!

কাজল দেখিল, বস্তিরই একজন প্রৌঢ় হিন্দুস্থানী অধিবাসী তাহার কাছে আসিয়া দাঁড়াইয়াছে। লোটা বলিল–বাবুজি, আপনি আমার সঙ্গে এদিকে আসুন—

ব্যাপার কিছু বুঝিতে না পারিয়া কাজল তাহার সঙ্গে একটু দূরে গিয়া দাঁড়াইল।

–বাবুজি, আপনি কী সিংহাসনের কাছে এসেছেন?

—হ্যাঁ। কী হয়েছে ওর? কথা বলছে না কেন?

প্রৌঢ় লোকটি মাথা নিচু করিয়া বলিল—সিংহাসনের দেশ থেকে খবর এসেছে। চেচক হয়ে ওর ছেলেটা মারা গিয়েছে। আজ চারদিন ওইরকম বসে আছে বাবুজি, খাচ্ছে না, শুচ্ছে না—

কাজলের বুকের মধ্যে কে যেন হাতুড়ি দিয়া আঘাত করিল। চেচক–মানে বসন্ত হইয়া সিংহাসনের ছেলে মারা গিয়াছে! বেচারা সিংহাসন, প্রৌঢ় বয়েসের সন্তান–এ ধাক্কা সামলাইয়া ওঠা কঠিন হইবে। সে দূর হইতে তাকাইয়া দেখিল—সিংহাসন পাথরের মূর্তির মতো চুপ করিয়া বসিয়া আছে।

কয়েকদিন পরে কাজল খবর পাইল দেশ হইতে লোক আসিয়া সিংহাসনকে বাড়িতে লইয়া গিয়াছে। আর হয়তো তাহার সহিত দেখা হইবে না।

চম্পারণ জেলার অশিক্ষিত হিন্দুস্থানী কুলি। কিন্তু তাহার সারল্য এবং গভীর নিষ্ঠা কাজলকে মুগ্ধ করিয়াছিল। অকারণ সৎ মানুষ ভাগ্যের হাতে এইরূপ নিষ্ঠুর শাস্তি পায় কেন? শোকগ্রস্ত সিংহাসনের কথা ভাবিয়া তাহার ভারি দুঃখ হইল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *