০২. অপুর বইগুলি বিক্রি হইতেছে

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ

অপুর বইগুলি বিক্রি হইতেছে মন্দ না। সব বইয়ের একাধিক সংস্করণ হইয়া গিয়াছে, দু-একখানার তো পঞ্চম মুদ্রণ চলিতেছে। মোট বিক্রয়ের দিক হইতে দেখিলে অবশ্য এমন কিছু একটা হৈ-হৈ ব্যাপার নয়—কারণ বাজার-চলতি অনেক সস্তা নাটক-নভেল বা গোয়েন্দাকাহিনী ইহা অপেক্ষা বেশি বিক্রি হইয়া থাকে কিন্তু নতুন একজন লেখকের আত্মপ্রকাশ করিবার সঙ্গে সঙ্গে এমন বাজার পাওয়া একটু অদ্ভুত ব্যাপার বইকি। পৃথিবীর মহৎ উপন্যাসগুলির পটভূমি কাজল পড়িয়া দেখিয়াছে—অজস্র প্রকাশক কর্তৃক প্রত্যাখ্যাত হইবার পর কোনও ক্ষুদ্র সংস্থা অনাদরে ছাপিয়াছে। লেখকের জীবদ্দশাতে হয়তো প্রথম সংস্করণই শেষ হয় নাই। পঞ্চাশ বৎসর পরে সেই বই লইয়া সবাব কী মাতামাতি। কিন্তু সমস্তটা যাহার সাধনার ফল, সেই লেখক ততদিনে দারিদ্র্যে ভুগিয়া অনাহারে কষ্ট পাইয়া মারা পড়িয়াছে। তখন আর তাহার স্মৃতিতে প্রতিবছর সভা করিলে বা রাস্তার মোড়ে একশত ফিট উচ্চ স্তম্ভ প্রতিষ্ঠা করিলে সে বেচারার কী লাভ? কাজল হারম্যান মেলভিল-এর জীবনী পড়িয়া দেখিয়াছে, মেলভিলের ঠিক এরূপ হইয়াছিল। মবি ডিক মেলভিলের জীবৎকালে মাত্র তিন-চারশত কপি ক্রিয় হয়, চরম দারিদ্র্য এবং কষ্টের ভিতর লেখক মারা যান। সরকারের সৎকার সমিতি আসিয়া তার দেহ সমাধিস্থ করিবার ব্যবস্থা করে। অনেকদিন পরে যখন সবাই মবি ডিক-কে পৃথিবীর দশটি শ্রেষ্ঠ উপন্যাসের মধ্যে অন্যতম বলিয়া মত দিল, প্রতিবছর লক্ষ লক্ষ কপি বই বিক্রি হইতে লাগিল, তখন মেলভিলের সমাধিতে মালা দিবার জন্য ব্যস্ত হইয়া ভক্তেরা আবিষ্কার করিল–সমাধিটাই খুঁজিয়া পাওয়া যাইতেছে না! কবর দিবার সময়ে সরকারি লোকেরা তো আর ভাবে নাই যে, একদিন এই ভিখারিটা বিখ্যাত লোক হইবে! তাহারা মেলভিলের নামটা পর্যন্ত সমাধিস্তরে লিখিয়া রাখে নাই।

তুলনামূলক দিক দিয়া পাঠকেরা অপুর রচনাকে প্রথম হইতেই সাদরে গ্রহণ করিয়াছিল। কৃত্রিমতার স্পর্শহীন সরল ও উদার দৃষ্টিভঙ্গি এবং জীবন ও বিশ্বের সহজ ভালোবাসার প্রকাশ সহৃদয় পাঠকদের হৃদয়কে স্পর্শ করিয়াছিল। অপুর অকস্মাৎ মৃত্যু তাহাদের সহানুভূতিকে স্পর্শ করিল। রচনার স্বকীয় গুণ থাকা সত্ত্বেও যে মনোযোগ পাইতে একযুগ সময় লাগিত, মৃত্যুর প্রশান্ত মহিমা এক বৎসরের মধ্যেই বইগুলিকে সেই পরিচিতি দান করিল।

বইগুলি সম্বন্ধে বিভিন্ন প্রয়োজনে কাজলকে মাঝে মাঝেই কলেজ স্ট্রীটে প্রকাশকদের কাছে যাইতে হয়। সেদিন বাবার বইয়ের নতুন এডিশন সম্বন্ধে কথাবার্তা বলিয়া কাজল প্রেসিডেন্সি কলেজের রেলিং-এ পুরাতন বইয়ের বাজারে বই দেখিতে গেল। বেশির ভাগই বাজে বই, কিন্তু ধৈর্য ধরিয়া খুজিতে পারিলে দু-একখানা ভালো বই বাহির হইয়া পড়ে। তবে সস্তায় সওদা করিবার উপায় নাই, দোকানীরা বিশেষ শিক্ষিত না হইলেও কোন বইয়ের কী দাম হইতে পারে তাহা বেশ ভালোই জানে।

একটা দোকানে এডগার ওয়ালেস এবং ওয়েস্টার্ন কিছু বইয়ের ফাঁকে কাজল জ্যোতির্বিজ্ঞান সম্বন্ধে একটা বই দেখিতে পাইয়া টানিয়া বাহির করিল। বইখানা রবার্ট এস. বল্ নামে কোনও লেখকের রচিত। আঠারোশ নিরানব্বই সালে লন্ডনে ছাপা। এ বইয়ের এখন আর খুব মূল্য নাই, কারণ গত চল্লিশ-বেয়াল্লিশ বছরে বিজ্ঞানের জগতে কত নতুন তথ্য আসিয়াছে, কত বৈপ্লবিক পরিবর্তন জানা ছিল না, আরও কত কী ভবিষ্যতের গর্ভে নিহিত ছিল। তবু বইখানার প্রতি কাজল কেমন একটা আকর্ষণ অনুভব করিল। বৈজ্ঞানিক তথ্যের জন্য নহে, বইটির সহিত জড়িত রহস্যের বোধের জন্য। দোকানীকে জিজ্ঞাসা করিল—এটার দাম কত ভাই?

দোকানী অভিজ্ঞ ব্যক্তি, সম্ভবত কাজলের জন্মেব আগে হইতে পুরাতন বই কেনাবেচা করিতেছে। সে কাজলের মুখের দিকে তাকাইয়া তাহার আগ্রহের পরিমাণ আন্দাজ করিবার চেষ্টা করিল, তারপর গম্ভীরভাবে বলিল—ওখানা দেড়টাকা–

কাজল একটু অবাক হইল। এ বিষয়ের উপর নতুন বই-ই তোত দু-টাকা আড়াই টাকায় পাওয়া যায়। লোকটা এমন সৃষ্টিছাড়া দাম হাঁকিতেছে কেন? সে বলিল—এত? বারো আনা দেব?

দোকানদার উদাস ভঙ্গিতে সংস্কৃত কলেজের দিকে তাকাইয়া দেশলাইয়ের কাঠি দিযা কান চুলকাইতে লাগিল।

কাজল ভয়ানক অপমানিত বোধ করিল। কিন্তু বইয়েব লোভ বড়ো লোভ, সে মুখে সপ্রতিভোর ভাব ফুটাইয়া বলিল—আচ্ছা, না হয় একটাকাই পুরো দিচ্ছি—

দোকানদার পৃথিবীর কোনো ভাষায় কথা বলিতে জানে না। বর্তমানে সে চোখ বুজিযা তর্জনী এবং বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠের সাহায্যে কাঠিটাকে কানের ফুটায় কুকুর কব্যি ঘুবাইতেছে। তাহার মুখে জগৎনিরপেক্ষ স্বগীয় তন্ময়তা প্রকাশিত।

পাঁচসিকা দাম উঠিবার পর দোকানী আর দার্শনিক নিবাসক্তি বজায় রাখিতে সাহস পাইল না। বেশি টানাটানিতে দড়ি ছিড়িয়া গেলেই বিপদ। সবাইকেই সংসার চালাইতে হয়।

বিছানায় শুইয়া অনেক রাত্রি অবধি কাজল বইটা পড়িল। ধূমকেতু, নক্ষত্র এবং সৌরজগৎ সম্বন্ধে খুব মামুলি প্রাথমিক তথ্য—এখনকার ক্লাস সেভেন-এইটের ছেলেরাও এসব জানে। প্রথম প্রকাশিত হইবার সময় এই বইটাই লোকে হয়তো কত আগ্রহের সহিত পড়িয়াছে। কিন্তু লেখকের ভাষা এবং মানসিকতা কাজলের ভালো লাগিল। সহজ অথচ কাব্যিক প্রকাশভঙ্গির মাধ্যমে পাঠককে ব্রহ্মাণ্ডের বিশালতার মুখোমুখি দাঁড় করানো হইয়াছে। তথ্যের সঠিকত্ব বড়ো কথা, তাহা অপেক্ষাও বড় কথা হৃদয়ের গভীরে সঠিক প্রশ্নগুলি জাগাইয়া ভোলা।

রাত দেড়টা পর্যন্ত পড়িবার পরও ঘুম আসিল না। একটা সিগারেট খাইলে বেশ হইত। কাজল বই রাখিয়া মশারির বাহিরে আসিয়া বুক-শেলফের পিছনের গোপন স্থান হইতে সিগারেট আর দেশলাই বাহির করিয়া ছাদে চলিয়া গেল। বাড়িতে সে সচরাচর সিগারেট খায় না, কিন্তু অসময়ের ভাণ্ডার হিসাবে বইয়ের তাকের পিছনে ধূমপানের সরঞ্জাম রাখা থাকে। মাঝে মাঝে কাজে লাগিয়া যায়। সিগারেট ধরাইয়া কাজল পাঁচিলে হেলান দিয়া দাঁড়াইল।

সুরপতি মারা যাইবার পর হৈমন্তী বাপের বাড়ির কাইে এই হোট একতলা বাড়িটা বানাইয়াহে। মা ও ছেলের অনাড়ম্বর সংসার চলিতেহে মন্দ নয়।

কালপুরুষ-মণ্ডলী পূব আকাশ বহিয়া অনেকদূর উঠিয়া আসিয়াছে। সমস্ত শহরের নিদ্রামগ্ন নৈশ প্রহরে অতিপরিচিত দৃশ্যেরও যেন অর্থ বদলাইয়া যায়। যে শহর আগামীকাল সকালেই আবার নিত্যদিনের বাঁধা কর্মসূচির মধ্যে জাগিয়া উঠিয়া ভয়ানক বেগে চলিতে থাকিবে, রাত্রির নির্জনতা তাহারই উপর রূপকথার স্পর্শ বুলাইয়া দিয়াছে।

পরিবেশে শীতের আমেজ থাকিলেও আকাশ বেশ পরিষ্কার, কুয়াশার চিহ্নমাত্র নাই। কাজল জানে আরহাওয়া ভালো থাকিলে আকাশের উত্তর-পশ্চিম কোণে আরছাভাবে অ্যান্ড্রোমিডা নীহারিকা দেখিতে পাওয়া যায়, যদিও তাহা বৎসরের এই সময়ে কিনা সে কথা সে মনে করিতে পারিল না। উত্তর-পশ্চিম কোণের সন্ধান করিতে করিতে একটু বাদে দিগন্তের কিছু উপরে হালকা একখণ্ড মেঘের মতো কী চোখে পড়িল। ওই কি অ্যান্ড্রোমিডা? বাইশ লক্ষ আলোকবর্ষ দূরে অবস্থিত ছায়াপথের সর্বাপেক্ষা নিকটস্থ প্রতিবেশী? যদি তাহাই হয়, তাহা হইলে এই মুহূর্তে সে ওই নীহারিকা হইতে বিচ্ছুরিত যে আলো দেখিতেছে, বিশ লক্ষ বৎসর পূর্বে সে আলো অসীম মহাবিশ্বের পথে যাত্রা শুরু করিয়াছিল। পৃথিবীতে পিথেক্যানথুপাস অর্ধবানরেরা তখন সবেমাত্র দুই পায়ে সোজা হইয়া দাঁড়ানো অভ্যাস করিতেছে। যাবতীয় ইতিহাস, সাহিত্য, বিজ্ঞান এবং সংস্কৃতিসহ সমগ্র মানবজাতিটাই সুদূর ভবিষ্যতের ক্রোড়ে শায়িত। তাহার পর দুই-তিনটা হিমযুগ গেল, কত সমুদ্র শুকাইয়া গেল, কত পর্বত মাথা তুলিয়া উঠিল। কত অরণ্য মাটি চাপা পড়িয়া কয়লায় পরিণত হইল, পৃথিবীর চৌম্বকক্ষেত্র কতবার দিকপরিবর্তন করিল–বিপুল কালব্যবধানে অবস্থিত এইসব উত্থানপতনের মধ্য দিয়া এই আলোকরশ্মি মহাকাশপথে বাইশ লক্ষ বছর ধরিয়া ক্রমাগত পৃথিবীর নিকটবর্তী হইতেছিল।

আশ্চর্য অনুভূতিতে তাহার মন ভরিয়া উঠিল। কী বিশাল এই গ্ৰহজগৎ, এই নাক্ষত্রিক বিশ্ব, এই জীবন। অর্থ ও প্রাচুর্যের প্রয়োজন নাই, সাধারণ গৃহস্থের মতো কেবলমাত্র বাঁচিয়া থাকাটাই একটা সুন্দর অভিজ্ঞতা। কিন্তু মন শক্ত করিতে হইবে, পৃথিবীর তাবৎ প্রলোভনকে উপেক্ষা করিতে শিখিতে হইবে। ঐহিক কামনা লইয়া এই আনন্দের ভেজে যোগ দিবার অধিকার লাভ করা যাইবে না।

বিশ্বের একদিক হইতে অন্যদিক পর্যন্ত আনন্দের তরঙ্গ প্রবাহিত হইতেছে। ক্ষুদ্রতা নাই, বন্দীত্ব নাই—এই বিপুল প্রসারে সৌন্দর্যময় মুক্তির অনুভূতি প্রতিমুহূর্তে স্পন্দিত হইতেছে।

সেদিন প্রায় সমস্ত রাত্রি তাহার ঘুম আসিল না।

শীতের মাঝামাঝি কাজল কলেজের বন্ধুবান্ধবের সহিত কলিকাতা হইতে মাইল ত্রিশেক দূরের একটা বাগানবাড়িতে বনভোজন করিতে গেল। প্রভাত তাহার সহিত রিপনে পড়ে, ছেলেটি ভালো-ইংরাজি কবিতা পড়িতে খুব ভালোবাসে, থাকে পটুয়াটোলা লেনে। সেও বনভোজনে যাইবে। কাজলকে ডাকিয়া সে বলিল–অমিতাভ, পিকনিকের আগের দিন রাত্তিরে তুমি বরং আমার বাড়িতে এসে থাকো, নইলে অত সকালে কি তুমি এসে উঠতে পারবে? ভোববেলাই তো রওনা দিতে হবে—

কাজল রাজি হইয়া আগের রাত্রে প্রভাতের বাড়ি চলিয়া আসিল। বাড়ির মানুষেরা খুব ভালো, বিশেষ করিয়া প্রভাতের বাবা কাজলের সহিত সমবয়েসী বন্ধুর মতো ব্যবহার করিলেন।

একতলার কোণের দিকে প্রভাতের ঘর। এইখানে সে পড়াশুনা করে এবং ঘুমায়। রাত্রে খাওয়া-দাওয়া সারিয়া দুইবন্ধু খাটে আধশোয়া হইয়া গল্প শুরু করিল। প্রভাতের বাড়ির অন্যরা দোতলায় থাকেন, কাজেই আড্ডায় বাধা পড়িবার ভয় নাই।

প্রভাত বলিল–সিগারেট খাবে? যাই বলো, সিগারেট না হলে আড্ডা জমে না–

—এখানে খাবো? কেউ আসবে না তো?

–দূর। রাত্তিরে আর কেউ নামবে না। তাছাড়া সিঁড়ির মুখের দরজা বন্ধ করে দিয়ে এসেছি। এই নাও, ধরাও–

দুইজনে সিগারেট ধরাইয়া কোলে একটি করিয়া বালিশ লইয়া বসিল।

প্রভাত বলিল—অনেকদিন থেকেই তোমাকে একটা কথা জিজ্ঞাসা করবো ভাবি, সুযোগ হয়ে ওঠে না। আমাদের ছেলেমানুষির বয়েস কিন্তু ফুরিয়ে এল, ভবিষ্যতে কী করবে কিছু ভেবেছো?

ভবিষ্যতের কথা কাজল কিছু ভাবে নাই। জীবনের যে দিকটায় আলো পড়ে, যে দিকটা জ্ঞানে, বিস্ময়ে এবং আনন্দে উজ্জ্বল, সেই দিকটাকেই সে বড়ো করিয়া দেখিয়াছে। জীবনের অবশ্যম্ভাবী সংগ্রামের বিষয়ে সে কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে নাই। সে বলিল–তুমি কি প্রফেশনের কথা বলছো?

—কিছুটা বটে। মানুষকে তো একটা বৃত্তি অবলম্বন করতেই হয়। কেউ কেউ যে কোনো বৃত্তিতেই নিজেকে বেশ খাপ খাইয়ে নিতে পারে, কিন্তু তুমি বোধহয় তা পারবে না। এখন না ভাবলে পরে কষ্ট পাবে–

কাজল বলিল—তুমি যাকে বৃত্তি বলছে তার একটাও আমার কাছে অনারেল বলে মনে হয়। দেখ আমার জীবনটা আমার নিজের, যে ভাবে ভালো লাগে সেভাবে বাঁচার অধিকার আমার থাকা উচিত, তাই না?

প্রভাত সিগারেটে একটা টান দিয়া বলিল—তোমার কীভাবে বাঁচতে ভালো লাগে?

–আমি বিশুদ্ধ, নির্মল আনন্দ লাভের জন্য বাঁচতে চাই।

—এটা তুমি কিছু নতুন কথা বললে না। আনন্দ হল একধরনের সুখানুভূতি, জীবমাত্রেই সেজন্য বাঁচে।

-সেটা অ্যানিমাল কমফর্ট, আমি সে ধরনের ফিজিক্যাল প্লেজাবের কথা বলছি না। আমি বলছি ইনটেলেকচুয়াল প্লেজারেব কথা—

প্রভাত হাসিয়া বলিল–তুমি একটা হামবাগ, নিজেকেই নিজে ইনটেলেকচুয়াল বলে আঁক করছো?

কাজল লজ্জা পাইয়া বলিল–তুমি বুঝলে না। আমি মোটেও নিজেকে পণ্ডিত বা ওইরকম কিছু বলছি না। আমি বলছি, এই বিরাট ব্রহ্মাণ্ড আর জীবন সম্বন্ধে আমার মনে কতগুলো স্বাভাবিক প্রশ্ন আছে-সেগুলো সম্বন্ধে ভাবতে বা তাদের উত্তর খুঁজতে আমার ভালো লাগে। এটা হচ্ছে joy of pure learning, প্রফেশনের সঙ্গে এর সম্বন্ধ নেই। তাছাড়া নীরস নলেজ-এর কথা বাদ দাও, বিশ্বের অদ্ভুত সৌন্দর্যের দিকটা ভেবে দেখেছো? কে জানে মৃত্যুর পরে আর চেতনা থাকে কিনা, আবার জন্ম হয় কিনা। আমি যতটা সম্ভব এই জন্মেই দেখে যেতে চাই। দিস মে বি মাই অনলি অপরচুনিটি—

–না খেয়ে?

কাজল অন্য জগতে ছিল। বিস্মিত হইয়া বলিল—আঁ?

–বলছি, সেই জ্ঞান এবং সৌন্দর্য আহরণের কাজটা কি না খেয়ে খালি পেটে করবে? সাবসিসটেন্সের দিকটাও তো ভাবা চাই।

কাজল রাগিয়া বলিল—তুমি বড়ো আনরোম্যান্টিক। বাস্তবের বিরাট বাধা তো আছেই, কিন্তু তা সত্ত্বেও কি পৃথিবীতে বড় কাজ হয়নি? তার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করতে হবে

-আমি তো এতক্ষণ সেই কথাই বলছি। সেই প্রস্তুত হর কাজটা তোমার কতদূর এগিয়েছে?

কাজল কোনদিকেই কিছুমাত্র অগ্রসর হয় নাই। সে কেবল পড়াশুনা করিয়াছে এবং মাঠে বেড়াইতে গিয়া গাছের নিচে বসিয়া বই পড়িয়াছে। পৃথিবীর সঙ্গে তার পরিচয় পুথির পাতার ভিতর দিয়া।

কাজলকে চুপ করিয়া থাকিতে দেখিয়া প্রভাত হাসিতে হাসিতে বলিল—back to square ‘A’, কেমন? না অমিতাভ, যাই করতে চাও, তার জন্য জীবনটাকে একটু ছকে নেওয়া দরকার। নইলে তোমার মতো ট্যালেন্টেড ছেলে পরে কষ্ট পাবে।

কাজল কোণঠাসা হইয়া বলিল–তুমি কী ঠিক করেছে?

–আমি? আমার সব ঠিক করা আছে। এম.এ. পাশ করে আমি কলেজে পড়ার।

কাজল বলিল—আমি যা হতে চাই তা কী করে হওয়া যায় জানি নে। তুমি অরেল স্টাইনের জীবনী পড়েছে প্রভাত? ইউরোপ থেকে পিকিং অবধি প্রাচীন যুগে যে সিল রুট ছিল, যে পথে মার্কো পোলো তার বিখ্যাত ভ্রমণে বেরিয়েছিলেন, সেই হারানো সিল বুট নতুন করে খুঁজে বের করার জন্য অরেল স্টাইন প্রায় সারাটা জীবন ব্যয় করেছিলেন। ভাবো তো, মধ্য এশিয়ার সেই গোবি, তাকলামাকান মরুভূমি—পৃথিবীর ছাদ পামির, উত্তর মঙ্গোলিয়ার নিবিড় অরণ্য, কোথাও দিদিশাহীন মরুপ্রান্তরে দুরন্ত বালির ঝড়, কোথাও হাত-পা জমে-যাওয়া কনকনে শীত! সিল রুটের খোজে খোলা প্রান্তরে তাঁবু খাঁটিয়ে থাকা, রাত্তিরে তাঁবুর বাইরে অগ্নিকুণ্ডের পাশে বসে পাইপ খাওয়া-ওঃ! অমন পরিষ্কার আরহাওয়ায় কত নক্ষত্র দেখা যায় জানো? আমি ওইরকম জীবন চাই।

–স্কলার জিপসি হতে চাও? ম্যাথু আর্নল্ডের স্কলার জিপসি—যে জীবনের গভীর রহস্য খোঁজবার জন্য নিজের সমাজ-সংসার ফেলে উধাও হয়ে গিয়েছিল–

–হ্যাঁ, ঠিক বলেছো। স্কলার জিপসি আমার খুব প্রিয় কবিতা। অমন জীবন পেলে আমার আকাঙ্ক্ষা পূরণ হয়

দুই বন্ধুতে গল্প করিয়া প্রায় সারারাত কাটাইয়া দিল। আলোচনা করিতে করিতে প্রভাত ক্রমে স্বীকার করিল তাহারও যে অ্যাভেঞ্চারের স্বপ্ন নাই এমন নয়। বস্তুত একবার সে ভাবিয়াছিল ক্যাপটেন কুক যে পথে সমুদ্রযাত্রা করিয়াছিলেন সেই পথে নৌকা লইয়া ভ্রমণে বাহির হইবে। প্রবেশিকা পরীক্ষা দিবার আগেই সে একটা খাতায় অভিযানের খসড়া পর্যন্ত করিয়া ফেলিয়াছিল। গঙ্গার মোহনা দিয়া বঙ্গোপসাগর, তারপর পোর্ট ব্লেয়ার হইয়া রেঙ্গুন। সেখান হইতে জাভা, বোর্নিও এবং সুমাত্রা ছুঁইয়া নিউজিল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া। ইহার পর উত্তরে ওশিয়ানিয়ার অজস্র ছোট ছোট দ্বীপ, নারিকেলশ্রেণী বেষ্টিত হলুদ তীবভূমি—পথে অবশ্য আঙ্কোর ভাট দেখিয়া লইতে হইবে। সব পরিকল্পনা করা আছে। কিন্তু আর তিনবছর পর তাহার বাবা চাকুরি হইতে অবসর লইবেন। ছোট বোনের বিবাহ এখনও হয় নাই। দিদির বিবাহের দেনার জন্য বাড়ির দলিল মহাজনের নিকট বন্ধক আছে, সেখানা ছাড়াইবার ব্যবস্থা করিতে হইবে। আগামী চার বছরের মধ্যেই সংসারের যাবতীয় ভার তাহাকে লইতে হইবে। এ অবস্থায় পলিনেশিয়াব চন্দ্রালোকবিধৌত দ্বীপভূমির স্বপ্ন না দেখাই ভালো।

কাজল উৎসাহে বিছানায় উঠিয়া বসিল, কেন? এতই কি অসম্ভব? বেশ তো, প্রভাত বোনের বিবাহ দিক, বাড়িখানা মহাজনের হাত হইতে ফিরাইয়া আনুক—ততদিন চাকুরি করিলে ক্ষতি নাই। কত সময়ই বা লাগিবে? পাঁচবছর বড়ো জোর-তখনও তাহারা এমন কিছু বৃদ্ধ হইয়া পড়িবে না। ত্রিশও হইবে না বয়েস। বরং দায়িত্ব মিটাইয়া বাহির হওয়াই ভালো। অভিযান সারিয়া ফিরিতে বছরদেড়েক লাগিবে, তখন তাহারা বিখ্যাত হইয়া পড়িবে, চাকুরি পাওয়ার অসুবিধা থাকিবে না।

দুইজনেই তরুণ, সম্মুখে অনন্ত জীবনের ইশারা। প্রভাতও বেশিক্ষণ নিজের বাস্তববাদী চরিত্র বজায় রাখিতে পারি না। দুইবন্ধুতে অভিযানের বিভিন্ন দিক আলোচনা করিতে করিতে সকাল হইয়া গেল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *