৩৬. দীপাবলী এবং অলোক

ব্যাপারটা যেন আচমকাই সহজ হয়ে গেল। অন্তত ওপর থেকে দেখলে মনে হবে নদীটা খুব শান্ত, টলটলে। নিচে, মাটির ওপর পড়ে থাকা নুড়িগুলোকে নিয়ে চোরা স্রোত যদি টালমাটাল হয় তা কারো চোখে পড়ার নয়।

দীপাবলী এবং অলোক এখন অনেক কথাই বেশ সহজ গলায় বলতে পারে। বাড়িতে যে বদ্ধ হওয়া চেপে বসেছিল তা যেন বদলির খবরে জানলা খোলা পেয়ে বেরিয়ে গিয়েছে। দীপাবলী অলোকের সঙ্গে স্বাভাবিক ভঙ্গীতেই আলোচনা করতে পারে পরবর্তী পদক্ষেপ কি হবে। অলোকও এখন অনেক হালকা। কি করে যে ব্যাপারটা ওই রকম জায়গায় পৌঁছেছিল তার কোন সঠিক ব্যাখ্যা নেই। কেউ যদি প্রশ্ন করত কি কারণে এত তাড়াতাড়ি দুজনের সম্পর্কে অমন চিড় ধরল তাহলে তার উত্তর এককথায় বোঝানো যাবে না। প্রশ্নকর্তা ওদের অক্ষমতায় বিরক্ত হতে পারেন। অলোক এবং দীপাবলী দুজনেই জানে, একটি ছোট্ট পিপড়ের কামড় কখনই সমবেদনা পাবে না কিন্তু নিত্য যদি একই জায়গায় কামড় পড়ে তাহলে একদিন বিষ চিকিৎসার বাইরে চলে যাবেই। ব্যাপারটা চট করে কেউ বুঝতে চাইবে না, বোঝনোও মুশকিল।

অবশ্য এখন আর বোঝনোর প্রশ্ন উঠবে না। মানুষজন জানবে দীপাবলী বদলি হয়ে যাচ্ছে কলকাতায়। সরকারি চাকরির নির্মম নিয়মেই স্বামী স্ত্রী আলাদা থাকতে বাধ্য হচ্ছে। অনেক কৌতূহল এর ফলে মুখ লুকোবে। অথচ যাঁরা জানতেন, অলোকের পরিবারের সেই সব মানুষজন কিন্তু একই ঘটনার অন্যরকম ব্যাখ্যা পেলেন। দীপাবলী স্বেচ্ছায় বদলি নিয়েছে বলেই তাঁদের ধারণা হল। এবং এর ফলে কিছু তিক্ততা জন্মালো। আধুনিক মানুষেরাও সিদ্ধান্ত নিলেন এইভাবে হুট করে অজানা অচেনা ভূঁইফোড় কোন মেয়ের সঙ্গে প্ৰেম বা বিবাহ করা নির্বুদ্ধিতার সামিল।

রিলিজ অর্ডার বেরিয়ে গেল। দীপাবলীকে কলকাতার আয়কর ভবনে গিয়ে সি আই টি ওয়ানের সঙ্গে দেখা করতে হবে। মাঝখানে ইন্টারস্টেট ট্রান্সফারের কারণে যে সময়টুকু পাওয়া যায় সেটুকুই হাতে থাকবে। সরকারি অফিসে একজন অফিসার অথবা সাধারণ কর্মচারী কাজ করতে আসেন, কাজ করেন এবং মেয়াদ শেষ হলে চলে যান। ব্যাপারটা এত স্বাভাবিক যে এ নিয়ে কেউ মাথা ঘামায় না। নদীর স্রোতে কোন জল কখন বয়ে যাচ্ছে। সেটা নিয়ে চিন্তা না করে দেখা দরকার স্রোতটা ঠিকঠাক আছে কিনা। দীপাবলীর চেয়ারে তার আগে হয়তো কয়েকটা অফিসার বসেছেন, পরেও অগুণতি বসবেন। অতএব চুপচাপ বেরিয়ে এল সে।

সম্পর্কটা যখন আপাতসহজ তখন অলোকের যোগাযোগে কলকাতার বাসস্থান পেলে নিতে কোন আপত্তি নেই। তবু প্রথমে যে একটু দ্বিধা ছিল না তা নয়। দীপাবলী বলেছিল, সাহায্য নিচ্ছি, তুমি আমার শত্রু নও বলেই নিচ্ছি, কিন্তু সেই সঙ্গে ভয়ও হচ্ছে।

কিসের ভয়?

আমাদের দেশে যখন কেউ কাউকে সাহায্য করি তখন মনে মনে নিজের একটা অধিকার তৈরী করে নিই। যাকে সাহায্য করলাম সে যেন চিরকাল আমার কথা শুনতে বাধ্য থাকবে। এরকম হলে আমার পক্ষে সাহায্য নেওয়া সম্ভব নয়।

ব্যাপারটা আমার মাথায় আসেনি। তুমি বড় জটিল করে ভাবো।

আগেই বলে নেওয়া ভাল। তুমি আমাকে ফ্ল্যাটের ব্যবস্থা করে দিলে। অতএব কলকাতায় গেলেই তুমি আমার কাছে উঠবে এমন হওয়াটা স্বাভাবিক।

তুমি মূল বিষয়টাই ভুলে যাচ্ছ। আমরা পরস্পরকে কোন কোন ক্ষেত্রে সহ্য করতে পারছি না বলেই তো এত অশান্তি। সেই ক্ষেত্রগুলো যতদিন থাকবে ততদিন খুব অল্প সময়ের জন্যেও একত্রিত হওয়া মানে মানসিক অশান্তি ডেকে আনা। আমি আর এমন ভুল করতে রাজী নই, তুমি নিশ্চিত থেকো।

অলোককে বন্ধু বলে মনে হচ্ছিল। বন্ধু যে সে তো মনের কথা বোঝে। ইংরেজি ভাষায় যখন কেউ বলে আই ক্যান রিড ইউ তখন সে কাছের মানুষ হয়ে যায়। কিন্তু বিপদ ওইখানেই। পড়তে অনেকেই পারে না, যারা পারে তাদের কজনই বা পড়ে বোঝে?

অলোক খবর এনেছিল কলকাতার দক্ষিণে লেকের ওপাশে নতুন যে জনপদ তৈরী হয়েছে সেখানে একটি পাঁচতলা বাড়ির তিনতলায় দুটি ফ্ল্যাট কিনেছিলেন এক ভদ্রলোক। ইনি ওর সঙ্গে পরিচিত ছিলেন অফিসের সূত্রে। ভদ্রলোক হঠাৎ মাস তিনেক আগে হৃদরোগে মারা গিয়েছেন। তাঁর বিধবা স্ত্রী এবং ছেলেরা দিল্লীতেই থাকেন। অলোক তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছে। তাঁরা একটি ফ্ল্যাট ভাড়া দিতে পারেন। দ্বিতীয়টি রেখে দেবেন যদি কখনও প্রয়োজন হয় এই ভেবে। ভবিষ্যতে দাম বাড়লে বিক্ৰীও করতে পারেন।

অতএব এক বিকেলে দীপাবলী অলোকের সঙ্গে সেই মহিলার সঙ্গে দেখা করতে গেল। সে একা থাকতে পারে শুনে ভদ্রমহিলা বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। এমন চাকরি করার দরকার কি যদি স্বামীকে ছেড়ে থাকতে হয়। স্বামী কতখানি স্ত্রীর জীবনে তা বিধবা হবার পর তিনি বুঝতে পারছেন। দীপাবলী চুপচাপ শুনছিল। অলোক গম্ভীর মুখে অন্যদিকে তাকিয়ে ছিল। নানান কথার পর দীপাবলী যখন জানিয়েছিল তার সঙ্গে দুজন প্রৌঢ় মহিলা থাকতে পারেন তখন ভদ্রমহিলা রাজী হয়েছিলেন। কোন রকম অ্যাডভান্স বা সেলামি দিতে হবে না। মাসিক ভাড়া পাঁচশো। এসবই অলোকের সঙ্গে পরিচয় থাকার সুবাদে। ভদ্রমহিলা চান তাঁর স্বামীর কেনা ফ্ল্যাটটি ভালভাবে রক্ষিত হোক। কলকাতায় তাদের একটা অ্যাকাউন্ট আছে স্টেটব্যাঙ্কে। সেখানে প্রতি মাসের পাঁচ তারিখের মধ্যে ভাড়া জমা দিলেই চলবে।

প্রয়োজনীয় কাগজপত্র পরের দিনই ভদ্রমহিলার কাছ থেকে এসে গেল। পাঁচশো টাকায় কলকাতা শহরে তিনতলায় তিনখানা ঘর পাওয়া এই সত্তর আশির দশকেও প্রায় অসম্ভব। কৃতজ্ঞতা বোধ মানুষকে দুর্বল করে। দীপাবলীর খারাপ লাগা বাড়ছিল। কিন্তু অলোক এখন এত সহজ যে এই বিষয়ে কথা বলতে সঙ্কোচে পড়ল সে। সঙ্কোচ আর এই জীবনে। কাটিয়ে ওঠা যায়নি।

অলোক চেয়েছিল তাকে কলকাতায় পৌঁছে দিয়ে যায়। দীপাবলী চায়নি প্রথমে। পরে বুঝল। হাজার হোক, স্ত্রী বদলি নিয়ে একা কলকাতায় চলে যাচ্ছে এমন খবর অলোককে পরে দিল্লীতে অজস্র প্রশ্নের সামনে ফেলবে। তাছাড়া, কলকাতা সম্পর্কে যতই দুর্বলতা থাক, সেখানে পৌঁছে কোথায় উঠবে দীপাবলী? ফ্ল্যাটের দখল নিয়ে গুছিয়ে বসতেও তো সময় লাগবে। শেষ বাসস্থান ছিল মায়াদের বাড়ি। দীর্ঘদিন যোগাযোগহীন থাকায় সেখানে পৌঁছে বলা যায় না যে থাকতে এলাম। আর মুসীমা যে আছেনই সেখানে এমন নিশ্চয়তাও নেই। অলোক হোটেলে থেকে সব কিছু সুস্থিত করে ফিরে আসতে চায়। ব্যাপারটা যেমন শোভনীয় তেমনি দীপাবলীর পক্ষে সহায়ক।

কিন্তু এই যে সাহায্য ক্রমাগত নিয়ে যাওয়া এটা কি তার মনের মধ্যে যে সুবিধেবাদী মন। রয়েছে তার স্বার্থে নয়? যার সঙ্গে আর কোন মনের সম্পর্ক রইল না, স্বামী-স্ত্রী হিসেবে। যখন একটা ছাদের তলায় আর থাকা গেল না তখন এই সব সাহায্য নিয়ে নিজেকে নিরাপদে রাখা কি এক ধরনের নীচতা নয়? প্রতি মুহূর্তের টানাপোড়েনে দীপাবলী কাহিল। সে ভাবনাটা বলেছিল অলোককে। অলোক হেসে বলেছিল, আমরা ভালবেসে বিয়ে করেছিলাম। আমাদের সেই ভালবাসা ছাপিয়ে দৈনন্দিনের সংঘাত এমন জায়গায় পৌঁছাল যে আর একসঙ্গে থাকতে পারছি না। আমি জানি এতে আমার যেমন কষ্ট হচ্ছে তোমারও তেমনি। কিন্তু এও জানি এরপরেও এখনই একসঙ্গে থাকাটা যদি চালিয়ে যাই আরও বড় দুৰ্যোগ ঘটতে পারে। অতএব নিজেদের বাঁচাতে আমাদের সরে যাওয়াটাই ঠিক। কিন্তু আমি অসুস্থ হলে যেমন তুমি মাথার পাশে বসে ভেজা তোয়ালে বোলাতে পার তেমনি তোমার প্রয়োজন আমি কাজে লাগতে পারি। আমাদের মনে যেটুকু এখনও বেঁচে আছে সেটুকুই এটা আমাদের করাচ্ছে। তার সঙ্গে আমাদের আলাদা হবার সিদ্ধান্তের কোন সংঘাত নেই। আমরা আমাদের খারাপ চাই না। বলা উচিত ভাল চাই। এই আলাদা হয়ে যাওয়া যেমন সেই ভাল চাওয়ার কারণে তেমনি তোমার সঙ্গে আমার কলকাতায় যাওয়াটাও একই উদ্দেশ্যে। মন থেকে সব হঠাও।

যাওয়ার দিন ঘনিয়ে এল। অলোকের সঙ্গে এক বিকেলে দীপাবলী শ্বশুরবাড়ি থেকে বিদায় নিয়ে এল। অলোক সঙ্গে না থাকলে কি ঘটত, কি কথা হত তা অনুমান করা যায়। দীপাবলীর কলকাতা বাস সম্পর্কিত প্রতিটি আলোচনায় অলোক অংশ নিচ্ছে, মতামত দিচ্ছে দেখে শাশুড়ি মুখ খুললেন না। শ্বশুর ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইলেন। এমন কি কলকাতায় গেলে সে কোথায় উঠবে এ প্রশ্নের উত্তরটাও অলোক দিল। ভাল করে বুঝিয়ে বলল, ফ্ল্যাটের ব্যবস্থা হয়ে গিয়েছে। সুন্দর ফ্ল্যাট। এ নিয়ে চিন্তার কোন কারণ নেই। একটা কাজের মেয়েকে রেখে দিলেই হবে।

বৃদ্ধর মুখের ভাব দেখে বোঝা যাচ্ছিল তিনি মর্মাহত। বারংবার জানলা দিয়ে বাইরে দৃষ্টি সরিয়ে রাখছিলেন। আসলে তাঁর বোধহয় কিছুই দেখার ছিল না। শাশুড়ি এমন ভঙ্গীতে মাঝে মাঝে কথা বললেন যাতে মনে হয় এই বদলি হয়ে যাওয়াটা খুবই স্বাভাবিক ঘটনা। কলকাতায় অনেকদিন যাওয়া হয় না। আগে তবু তাঁর মামাতো ভাই-এর বাড়িতে অনেক জায়গা ছিল, সেখানে গেলে উঠতেন। ভাই মারা যাওয়ার পর সেই পাট চুকেছে। দিল্লী থেকে তো বেরুনোই হয় না। সেই যে সংসারে ঢুকেছেন তারপর তা দীপাবলী যখন কলকাতায় যাচ্ছে তখন মাঝেমধ্যে যাওয়া যাবে। কলকাতা মানে মিষ্টি। ও হো, সেসব মিষ্টির স্বাদ এখনও মুখে লেগে আছে। প্রায় রসাস্বাদনের মত তিনি কেসিদাস, গাঙ্গুরাম, জলযোগ আর সেনমশাই-এর নাম করে গেলেন। এবার মুখ ফেরালেন বৃদ্ধ, কিছুই জানো না। যদি মিষ্টি খেতে চাও তাহলে যেতে হবে উত্তর কলকাতায়। বিবেকানন্দ রোডের পরে হেদোর উল্টোদিকে বেথুন কলেজের গা ধরে গেলে নকুড়ের দোকান পাবে। ওদের সন্দেশের তুলনা পৃথিবীতে নেই। মহিলা তৎক্ষণাৎ বললেন, কোনদিন নিয়ে গিয়েছ যে জানব? বাড়ি বসে গান শোনাতে তোমার জুড়ি নেই।

যেন এসব কথাবার্তায় দীপাবলীর চলে যাওয়ার প্রাথমিক প্রস্তুতি হয়ে গেল। শাশুড়ি উঠলেন। অলোক অদৃশ্য হল। বড় জা প্রথমে এসে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়েছিল, এখন আর তার সাড়াশব্দ পাওয়া যাচ্ছে না। শশুরের সামনে থেকে উঠতে যাচ্ছিল দীপাবলী, তিনি হাত নেড়ে বসতে বললেন। তারপর নিচু গলায় জিজ্ঞাসা করলেন, এসব কেন হল?

দীপাবলী তাকাল, বদলির ব্যাপারে আমার কোন হাত ছিল না।

তোমাকে বদলি করা হচ্ছে তা আগে আমাকে জানাওনি কেন?

আমি প্রায় শেষ সময়ে জেনেছি। আপনার ছেলেও একই সময়ে জেনেছিল। ইচ্ছে করেই শেষ কথাটা জানাল দীপাবলী। তার মনে এই ঘটনাটা এখন পর্যন্ত স্পষ্ট নয়।

তোমার অফিসের ব্যাপার সে জানল কোথা থেকে?

বাইরেই।

তার মানে তোমার বদলির ব্যাপারে অনেকের ইন্টারেস্ট ছিল?

মনে হয়।

তোমার নিজের ছিল না তো?

না। মাথায় আসেনি।

তুমি আমায় কথা দিয়েছিলে।

এখন পর্যন্ত তার অমর্যাদা করিনি।

বৃদ্ধ চোখ বন্ধ করলেন। দীপাবলীর মনে হঠাৎ কষ্ট এল। এই বৃদ্ধকে এই মুহূর্তে তার পরমাত্মীয় বলে মনে হচ্ছিল। একমাত্র এঁকেই যেন সে মনে মনে স্পর্শ করতে পারছিল। বৃদ্ধ চোখ খুললেন, কি করি বলতো। এতবড় চাকরি তো তোমাকে ছাড়তে বলতে পারি না। যদি বুঝতাম সম্পৰ্কটা চাকরির থেকে অনেক বেশী জরুরী তাহলে হয়তো পারতাম। কিন্তু আমার কষ্ট হচ্ছে। আমি স্পষ্ট বুঝতে পারছি তুমি এবার অনেক দূরে সরে যাবে। আমি কালীবাড়িতে তোমায় দেখেই ঠিক করেছিলাম এ বাড়ির বউ করব। তাই হয়েছে। আজ আমার সবচেয়ে বড় হার হল। অথচ দ্যাখো কিছুই করার নেই আমার। বড় একটা নিঃশ্বাস শব্দ তুলল। দীপাবলী আরও কিছুক্ষণ বসে থাকার পর অলোকের ভাইঝি এসে বলল, কাকিমা, মা তোমাকে ডাকছে। দীপাবলী শ্বশুরকে বলল, আমি একটু আসছি।

বৃদ্ধ সাড়া দিলেন না। মেয়েটিকে অনুসরণ করে দীপাবলী চলে এল তার মায়ের ঘরে। শকুন্তলা একাই ছিল। দেখা মাত্র জিজ্ঞাসা করল, বেঁচে গেলে?

কপালে ভাঁজ পড়ল দীপাবলীর। মুখ ফিরিয়ে মেয়েটিকে দেখে বলল, কি ব্যাপারে?

সব। বসো। শ্বশুরশাশুড়ি তখন থেকে তোমার দখল নিয়ে বসে আছে, কথা বলার উপায় নেই।

দীপাবলী বসল। তার খুব খারাপ লাগছিল। মেয়ের সামনে এভাবে কথা বলতে শকুন্তলা একটুও দ্বিধা করছে না। সে মেয়েটিকে বলল, তোমার কাকু কোথায় দ্যাখো তো?

মেয়েটি বড় হয়েছে। যেন বুঝতে পারল ইঙ্গিতটা। বুঝে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।

শকুন্তলা বলল, তোমার কপালকে আমি খুব হিংসে করি ভাই।

চমকে উঠল দীপাবলী। কোন বাঙালি মেয়ে যদি একথা বলে তাহলে এর চেয়ে হাস্যকর ব্যাপার কিছু হতে পারে না। জন্মমাত্ৰ ঈশ্বর নামক অদেখা শক্তিটি তার কপালে যা লিখে দিয়ে হাত ধুয়ে ফেলেছিলেন তার জের টানতে হচ্ছে একা। সে চুপচাপ শকুন্তলাকে দেখল।

শকুন্তলা বলল, বিয়ের পর পর কেমন আলাদা হয়ে গেলে। এ বাড়ির ছায়া মাড়াতে হল না। মাথার ওপর ওই বুড়ি রইল না টিকটিক করার জন্যে। আর ইনি, এত বছর কান বন্ধ করে ছিলেন আমার দিকটা একবারও ভাবেননি। অথচ দুই ভাই। তোমার ক্ষেত্রে–একরকম আর আমার ক্ষেত্রে অন্যরকম হবে কেন?

একসঙ্গে থাকার সুবিধেগুলো কিন্তু এখন টের পাচ্ছি আমি।

কি সুবিধে? কিস্যু না।

শকুন্তলা এখন বেশ ভালই বাংলা বলে। তার পরিবর্তনও হয়েছে অনেক। নিজের ঘরে বসে এসব কথা গলা খুলে বলতে তার কোন সঙ্কোচ নেই। সে বলল, আলাদা হয়ে থাকলে। কি হবে? ঝগড়া? তা নিজের স্বামীর সঙ্গে যত ঝগড়া হোক সেটা নিজেরই ব্যাপার। ঝগড়া মারপিট কথাবন্ধ যাই হোক না কেন ভাব হতে কতক্ষণ। আর তোমার মত চাকরি করলে আলাদা থাকব, এই যেমন তুমি থাকতে যাচ্ছ।

আমি কিন্তু ইচ্ছে করে আলাদা হচ্ছি না।

সে জানি। শাশুড়ি তো আমাকে কিছু বলে না, শ্বশুরকে বলছিল, আমি শুনে ফেলেছি। সত্যি বলতো, তোমরা কি ডিভোর্স নিচ্ছ?

নিলে আমার কপালটাকে হিংসে করবে?

না। আমি ডিভোর্স করতে পারব না। এখন শরীরের যা হাল তাতে কেউ তো আর বিয়ে করতে আসবে না। এই বয়সে একা একা থাকতে পারবো না। তুমি তো বললে না, ডিভোর্স হচ্ছ নাকি?

এখনও সেসব ভাবিনি।

দোষ কার? ঠাকুরপোকে তো ভালই লাগত আগে।

কারো দোষ নেই।

তাহলে?

তালাটাও ভাল চাবিও খারাপ নয়। তবে ঠিক তালার ঠিক চাবি নয়। তোমার কথার মানে আমি বুঝতে পারি না। শকুন্তলা হাসল, শেষ পর্যন্ত আমরা আলাদা হয়ে যাচ্ছি। ও একটা ফ্ল্যাট পেয়ে গেছে।

ও। দীপাবলী ভেবে পেল না কি বলবে।

অনেক সহ্য করেছি। ভদ্রমহিলা সবসময় লাঠি ঘোরাবেন আমার ওপর সেটা আর সহ্য করব না। নিজের বাড়ি বলে যা ইচ্ছে করতে হলে এবার করুন। তুমি চলে গেলে ঠাকুরপো নিশ্চয়ই ওই ফ্ল্যাট ছেড়ে এখানে চলে আসবে। অতএব বাড়িতে তো লোক রইল। আজও উনি ছেলেকে জিজ্ঞাসা করেছেন কবে এখানে আসছে। বুঝলে, যে যার মত সব গুছিয়ে নেয়, কোন কিছুই কারো জন্যে আটকে থাকে না। এই কথাটাই তোমার দাদা বুঝতে পারছিল না এতদিন।

এই সময় অলোকের দাদা ফিরলেন। দীপাবলীকে দেখে গম্ভীর গলায় জিজ্ঞাসা করলেন, তাহলে তুমি কলকাতায় ফিরে যাচ্ছ?

ফিরে শব্দটা কানে লাগল। সে উত্তর দিল না। ভদ্রলোক বললেন, কি আর করা। যাবে। ওপরতলার সরকারি চাকরিতে এই বিপদ। কোথাও চিরদিন থাকতে দেবে না। আমার এক বন্ধু তো পনের বছরে চারটে জায়গা ঘুরল। ছেলেমেয়ে থাকলে তো আরও বিপদ। তাদের পড়াশুনার বারোটা বেজে যায়।

ভদ্রলোক এমন ভঙ্গীতে কথা বলছেন যেন কিছুই জানেন না। দীপাবলী সরকারি চাকরি করছে এবং বদলিটা নিয়মমাফিক এমনই শান্ত ছিল ব্যাপারটা। দীপাবলী বলল, আমার কিন্তু বদলি ডিউ হয়নি। সেই সময়টা আসতে অনেক দেরি ছিল।

তাই নাকি? তাহলে আউট অফ টার্ন। এরকম হয়। কোথাও তো লিখিত নিয়ম নেই যে এত বছরের আগে বদলি করা চলবে না। নিশ্চয়ই পেছনে কোন কারণ আছে। তা ভালই হল। কলকাতায় গেলে তোমার ওখানে থাকা যাবে। শুনলাম, অলোক তোমাকে, একটা বড় ফ্ল্যাট ব্যবস্থা করে দিয়েছে।

উনি আমাকে নিয়ে গিয়েছিলেন, ভদ্রমহিলা, যিনি ফ্ল্যাটের মালিক অনেকক্ষণ আমার সঙ্গে কথা বলার পর সন্তুষ্ট হয়ে আমায় ফ্ল্যাটটা দিয়েছেন। দীপাবলী বলল, অবশ্য খবরটা উনি আমাকে দিয়েছিলেন।

রাত বাড়ল। চলে আসা গেল না। শাশুড়ি খাইয়ে ছাড়লেন। এর ফাঁকে একা পেলেই শাশুড়ি জানতে চেয়েছেন বড় বউ কি বলছে? দীপাবলী প্রথমবার হেসেছিল। দ্বিতীয় বারে বলেছিল, আপনি যেমন ওকে পছন্দ করেন না, উনিও আপনাকে মানতে পারেন না। তাই উনি যা বলবেন তা তো আপনার বিরুদ্ধে যাবে। এটা জেনেও কেন বার বার তা জানতে চাইছেন? কি দরকার?

ভদ্রমহিলা এরপর থেকে চুপ করে গিয়েছেন।

খাওয়াদাওয়ার পর ওরা বিদায় নিল। শ্বশুর শাশুড়ি দরজা পেরিয়ে বারান্দায় এলেন। দীপাবলীর মনে পড়ল সেই রাত্রের কথা। প্রথম দিন এ বাড়িতে খাওয়াদাওয়া সেরে ট্রেন ধরার জন্যে যখন বেরিয়েছিল তখন এভাবেই এরা বিদায় জানাতে এসেছিলেন। সেদিন অলোক তাকে গাড়িতে স্টেশনে পৌঁছে দিয়েছিল। আজও সেসবের পুনরাবৃত্তি হচ্ছে। শুধু দীপাবলীর মন স্থির করতে পারছিল না। শেষ পর্যন্ত সে সামনে দাঁড়ানো পরেশবাবুকে প্রণাম করল নিচু হয়ে। ভদ্রলোক কাঁপা হাত রাখলেন মাথায়, শান্তি পাও মা।

দীপাবলী নিঃশ্বাস ফেলল। সে উঠে দাঁড়াতেই শাশুড়ির গলা কানে এল, আমাকে প্ৰণাম করতে হবে না। ভাল ভাবে থেকো তাহলেই হল।

দীপাবলী কথা বলল না। অলোক গেটের সামনে গাড়ি এনেছিল, চুপচাপ গেট খুলে তাতে উঠে বসল। গাড়িটা চলতে শুরু করার পর সে মুখ ফেরাল। বারান্দা থেকে। ইতিমধ্যে সবাই চলে গিয়েছে ভেতরে, শুধু পরেশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় একা বেঁকেচুরে দাঁড়িয়ে আছেন। এই বৃদ্ধ এখন কি ভীষণ একা, শূন্য চরাচরে নিষ্পত্র একক গাছের মত নিঃসঙ্গ। দীপাবলী জানলায় মাথা রাখল।

অলোক কথা বলল, কিছু মনে করোনি আশাকরি। আসলে যে যার মত কোন কিছুর ব্যাখ্যা করে। আমরা জানি আসলে কি ঘটেছে। তোমার ফ্ল্যাট আমি দিয়েছি জোগাড় করে। এমন অহঙ্কার কখনও করিনি। ওরা জেনে স্বস্তি পেয়েছেন। এই স্বস্তিটুকু দিতে চেয়েছিলাম। আর তার জন্যে যদি তুমি আঘাত পাও তাহলে আমি ক্ষমাপ্রার্থী।

দীপাবলী চুপ করে রইল। কোন নতুন কথা বলার নেই। যা এতদিন বারংবার বলে এসেছে তা এখন মনে করতেই ক্লান্তিবোধ হচ্ছে। তা ছাড়া কথা বলতে গেলেই তো সেটা তর্কে পৌঁছে যাবে, আজকাল তর্ক করতে গেলেই নার্ভে লাগে। শরীর দেয় না। ব্যক্তিগত কারণে উত্তেজনা এলে বুকে হাঁপ ধরে, নিঃশ্বাসে কষ্ট আসে। সে কোন কথা বলল না। অলোক উত্তরের অপেক্ষা করল কিছুক্ষণ। তারপর আশা ছেড়ে দিল।

অলোকের পা অ্যাক্সিলারেটরের ওপর চাপ বাড়াচ্ছিল। নিৰ্জন রাজপথে গাড়ি ছুটছিল রকেটের মত। দীপাবলী মাথা সোজা করল। এই গতি ক্রমশ তার সহ্যের সীমা অতিক্রম করছে। সে চাপা গলায় জিজ্ঞাসা করল, কি করছ?

অলোক হাসল, কেন? ভয় করছে?

নিশ্চয়ই। অ্যাকসিডেন্ট হয়ে যেতে পারে।

হোক। তবু তো কিছু একটা হবে।

মানে? দীপাবলী হতভম্ব।

স্পিডোমিটারের কাঁটা তখন নব্বই পেরিয়ে গেছে। দুপাশের লাইটপোস্টগুলো সাঁ সাঁ করে পেছনে ছুটে যাচ্ছিল। দু একটা গাড়ি যা সামনে পড়ছিল তাদের পাশ কাটাতে একটুও গতি কমাচ্ছিল না অলোক। সে হেসে বলল, ধরো, এখন একটা অ্যাকসিডেন্ট হল। আমি তোমাকে কথা দিতে পারি এই স্পিডে ধাক্কা মারলে তুমি বা আমি কেউই বেঁচে থাকব না। সমস্ত সমাধান হয়ে যাবে এক মুহূর্তে কি বল?

দরজা আঁকড়ে বসেছিল দীপাবলী। হাঁ হয়ে তাকাল অলোকের দিকে। ড্যাশববার্ডের যেটুকু আলো ওর মুখে পড়ছে তাতে স্বাভাবিক মানুষ বলে মনে হচ্ছে না। সে কোনমতে বলতে পারল, সমাধান তো হয়েই গেছে।

ওটা তোমার মত করে সমাধান। পাবলিক তো ঘাস খায় না। সব্বাই জানতে পারবে অলোক মুখার্জির বউ ভেগেছে। জিভে শব্দ করল অলোক।

গাড়িটা দুলে উঠল। চেঁচিয়ে বলল দীপাবলী, প্লিজ, কথা বল না।

হঠাৎ পেছন থেকে একটা মোটর বাইকের টানা হর্ন ভেসে এল। তীরের মত তার হেডলাইটটা ছুটে আসছে ওদের পেছনে। সেটাকে লক্ষ্য করা মাত্র স্পিড কমাল অলোক। প্রায় পাশে চলে এসে মোটরবাইকের আরোহী গাড়িটাকে থামাতে নির্দেশ দিল। দীপাবলী দেখল লোকটা একজন পুলিশ অফিসার।

অলোক বাঁ পাশ চেপে থামানে মাত্ৰ লোকটা তার বাইক গাড়ির সামনে পার্ক করে এগিয়ে এল জানলার গায়ে। চোস্ত হিন্দিতে জিজ্ঞাসা করল, এই রাস্তায় এত জোরে গাড়ি চালাচ্ছিলে কেন? ড্রাইভিং লাইসেন্স দেখি?

অলোক বিনা বাক্যব্যয়ে সেটা বের করে দিল। অফিসার উঁকি মেরে দীপাবলীকে দেখল। তারপর বলল, আমি তো ভেবেছিলাম কোন ক্রিমিনাল ভাগছে।

অলোক কোন জবাব দিল না। লোকটা একটু ভাবল। তারপর লাইসেন্স ফেরৎ দিয়ে বলল, নর্মাল স্পিডে গাড়ি চালান, যেভাবে চালাচ্ছিলেন তাতে আপনাদের অ্যাকসিডেন্ট হয়ে যেতে পারতো। লোকটা এগিয়ে গিয়ে বাইক চালু করে ফিরে গেল যেদিক থেকে এসেছিল।

অলোক স্টিয়ারিং-এ হাত রেখে চোখ বন্ধ করে বসেছিল। ওইভাবেই বলল, হল না। অ্যাকসিডেন্টটা তো ঘটানো গেল না। অবশ্য প্রমাণ হল, মরতে তুমি ভয় পাও।

কে না পায়?

যে পায় তার বাঁচার ইচ্ছে থাকে। জীবন থেকে পাওয়ার কথা ভাবে।

নিশ্চয়ই। আমি খামোকা মরতে যাব কেন? তুমি যদি আবার ওইরকম ড্রাইভ করো তাহলে নেমে যাব।

ভু ইউ ওয়ান্ট টু ম্যারি এগেইন? হঠাৎ অলোক প্রশ্ন করল।

ভাবিনি। ভাবার অবকাশ পাইনি। তা ছাড়া আমি এখনও বিবাহিত।

তুমিতো ইচ্ছে করলেই ডিভোর্স নিতে পার। আমি তোমাকে কথা দিয়েছি কনটেস্ট করব না। তোমার সেই বন্ধু, অভিনেতা, সেই ভদ্রলোক তো আছেই।

কার কথা বলছ?

আরে যিনি আকাশ ফুড়ে নেমে এসে তোমার বিয়ের সাক্ষী হিসেবে সই করলেন।

ও। এতদিন পরে তার কথা মনে পড়ল?

শুনলাম তিনি এখন ফ্রি আছেন। কলকাতায় অভিনেতা পরিচালক হিসেবে যথেষ্ট নাম করেছেন। ওঁর প্রথম বউ এখন আলাদা থাকে।

এত খবর তুমি জোগাড় করেছ?

তুমি কেন কলকাতায় যাচ্ছ তা জানতে হবে না?

কলকাতায় যাওয়ার পেছনে আমার কোন ইচ্ছে কাজ করেনি।

তা ঠিক।

বাঃ। এতটা একমত হলে কি করে? তুমি জানতে আমি বদলি হব?

জানতাম।

তার মানে?

আমরা কেউ কাউকে সহ্য করতে পারছি না, এ অবস্থায় ওটাই একমাত্র রাস্তা ছিল।

আমি এই রকম একটা সন্দেহ করেছিলাম।

কি? আমি তোমাকে বদলি করেছি? চমৎকার। আমার অত ক্ষমতা কোথায়? তাহলে তুমি কলকাতায় ফিরে গিয়ে কাউকে বিয়ে করতে চাইছ না?

অনেক তো হল। দুবারে যথেষ্ট শিক্ষা হয়েছে।

তুমি কোন পুরুষের সঙ্গে বাস করতে পারবে না।

হয়তো।

হয়তো না। এটাই সত্যি। কাউকে সুখী করার ক্ষমতা তোমার নেই।

এসব কথা বলার সময় আর জায়গা এটা?

আর তো কোনদিন বলব না। বলতে পারব না।

অলোক, তুমি কি চাইছ? এই তো সেদিন পরিষ্কার ঠাণ্ডা মাথায় আমাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে কথাবার্তা বললে! আবার এসব কেন?

আমি সহ্য করতে পারছি না।

ইটস ইওর প্রব্লেম।

তুমি নিষ্ঠুর।

সেটা তুমিই তৈরি করেছ।

না। তোমার মধ্যে একটা বরফের ছুরি লুকোনো ছিল। এইটা আমি বুঝতে পারিনি।

বাড়িতে ফিরে চল।

তুমি মিথ্যুক। মিথ্যেবাদী। নিশ্চয়ই কাউকে ভালবাসতে। তাই এত সহজে এখান থেকে চলে যেতে পারছ। ইউ আর এ ডিজঅনেস্ট ওম্যান।

বেশ তাই। তোমার লজ্জা করছে না?

এতক্ষণ খারাপ লাগছিল। আর লাগছে না। লজ্জা করতে যাবে কেন?

অলোক হঠাৎ ইঞ্জিন চালু করল। তবে আর ঝড় তুলে নয়, স্বাভাবিক গতিতে সে গাড়িটাকে বাড়িতে ফিরিয়ে নিয়ে এল। দীপাবলীর বুকে প্রচণ্ড অস্বস্তি, নিঃশ্বাসে কষ্ট বাড়ছিল। সে নিজের ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে বিছানায় উপুড় হল। কিন্তু শুলে কষ্ট আরও বাড়ে। বাথরুমে ঢুকে মুখে জল দিল। তারপর চেয়ারে শরীর এলিয়ে দিল। হঠাৎ অলোক কেন এমন শুরু করল? ভাবতে গিয়ে মাথার ভেতরটায় কেউ দুরমুশ শুরু করে দিল। উঠে দাঁড়াতে গিয়ে মাথা টলে গেল। আচমকা একটা ভয় ওকে গ্রাস করল। তার কি চরম কিছু হতে যাচ্ছে? হার্ট অ্যাটাক? সে কি মরে যাচ্ছে? কয়েক সেকেন্ড দাঁড়াতেই চোখের সামনে একটা কালো পর্দা নেমে এল। সে কিছু দেখতে পাচ্ছে না। চিৎকার করতে গিয়ে দেখল কোন শব্দ বেরুচ্ছে না। শরীরের নাগালে বিছানাটা পেয়ে গেল এটুকুই শেষ। পর্যন্ত বোধে এল।

চোখ মেলল যখন তখন দিন না রাত বোঝার উপায় নেই। ঘরের জানলা গতরাত্রে খোলা হয়নি। দীপাবলী আবিষ্কার করল সে বেঁচে আছে। মাথাটা দপ দপ করছে, নিঃশ্বাস স্বাভাবিক, বুকের অস্বস্তিটা নেই। চুপচাপ কিছুক্ষণ পড়ে থাকার পর বুঝল ঘরটাকে দেখতে। পাচ্ছে। সেই কালো পর্দাটা এখন উধাও। কোনমতে নিজেকে টেনে বিছানা থেকে নামল। পা ফেলতেই মাথার ভেতরটা ঝনঝন করে উঠল। সেই অবস্থায় বাথরুমে গেল সে। একটু পরিষ্কার হয়ে ঘরের দরজা খুলে বাইরে এসে দেখল টেবিলে কাগজ চাপা আছে। অলোকের হাতের লেখা, কয়েকবার নক্‌ করেছিলাম, তুমি খোলনি। সম্ভবত আমার সঙ্গে কথা বলতে চাও না। ট্রেন ধরতে হলে তিনটের আগে বেরুনো উচিত। আমি আসব। অলোক।

দীপাবলী চিরকুট রেখে দিল। এই ফ্ল্যাটে আজ তার শেষদিন। সে ঠোঁট কামড়াল। এবং হঠাৎ কান্না এল। শূন্য ফ্ল্যাটে একা দাঁড়িয়ে কেঁদে গেল খানিক। তারপর ধীরে ধীরে বিছানায় ফিরে গেল। কান্নার সঙ্গে সঙ্গে তার শরীর আবার খারাপ করতে লাগল। চুপচাপ পড়ে রইল সে।

এগারটা নাগাদ উঠে স্নান করল। খিদের বোধটাই নেই। অথচ সকাল থেকে একফোঁটা চা পর্যন্ত পেটে পড়েনি। জিনিসপত্র নিজের যা, তা একটু একটু করে গোছানো ছিল। গোছাবার সময় সে আবিষ্কার করেছিল তার নিজের বলতে খুব কমই রয়েছে। এতকাল যা ব্যবহার করেছে সব অলোকের দেওয়া। নিজে যা এনেছিল তা ব্যবহার করেছে কদাচিৎ। আজ যাওয়ার সময় সে অলোকের জিনিসগুলোয় হাত দেয়নি। না শাড়ি, না গয়না, না অন্যকিছু। ফলে দুটো সুটকেসেই সব ভরে গেছে।

দুপুরে অলোক এসে গেল। সঙ্গে চাইনিজের প্যাকেট। মুখ দেখে জিজ্ঞাসা করল, কি হয়েছে তোমার? শরীর খারাপ?

না, কিছু হয়নি।

খেয়েছ কিছু?

খিদে নেই।

অলোকের অনুরোধে খেতে হল। খেয়েই বমি বমি পাচ্ছিল। ইতিমধ্যে অলোক সুটকেশ গুছিয়ে নিচ্ছিল। দীপাবলী দরজায় দাঁড়িয়ে বলল, তোমাকে আমার সঙ্গে কলকাতায় যেতে হবে না। আমি একাই যেতে পারব।

তা কি হয়। কথা দিচ্ছি, আর কখনও বিরক্ত করব না। এবারটা ঘুরে আসি।

দীপাবলী কিছু বলল না। বলতে গেলে তর্ক করতে হবে। আর সেটা সহ্য করা সম্ভব নয়। একটু বাদে সমস্ত বাড়িতে তালা চাবি দিয়ে অলোক সুটকেশগুলো একে একে নিচে নামাল। আজ গাড়ি নয়, ট্যাক্সি ডাকা হয়েছে। দরজা খুলে পেছনের সিটে বসতে বসতে দীপাবলী জিজ্ঞাসা করল, তুমি এই ফ্ল্যাট ছেড়ে দেবে?

হ্যাঁ। কি হবে আর রেখে। ফালতু। অলোক ড্রাইভারকে ইঙ্গিত করল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *