৩৪. প্রাথমিক পর্বে নির্লিপ্ততা

নির্লিপ্ততা প্রাথমিক পর্বে মানুষকে স্বস্তি দেয় না। কিন্তু সেটা যদি অভ্যেসে এসে যায় তাহলে অনেক সমস্যা থেকে সে নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখতে পারে। তখন চারপাশে যা ঘটছে তাকে ঘটতে দাও, জীবন জীবনের মত চলুক, স্রোতের ওপরে নয়, স্রোতের তলায় মাটি আঁকড়ে পাথরের মত ঈষৎ নড়াচড়া ছাড়া তোমার আর কিছু করণীয় নেই।

দীপাবলী এইভাবে জীবনটাকে দেখতে চাইল। বাড়িতে রান্নার লোক পাঠিয়ে দিয়েছেন শাশুড়ি ঠাকরুণ। বোঝা গেল সে সহজ মানুষ নয়। বছর খানেক আগে কলকাতা থেকে যারা তাকে মাসে একশ টাকা মাইনে দিয়ে এনেছিল তারা এখন হাত কামড়াচ্ছে। ইতিমধ্যে, দুই বাড়ি বদলে সে নিজের আয় আড়াইশোতে নিয়ে গিয়েছে। নিক। দীপাবলীর এসবে কিছু আগ্রহ নেই। খাওয়াটা খারাপ হচ্ছে না, অন্তত অলোক পরিতৃপ্ত হচ্ছে।

অফিসে একটা আপাত শান্তি বজায় আছে। কোন ব্যাপারে বাড়তি মাথা ঘামাচ্ছে না সে। পুরনো কেসগুলোর দিকে তাকাচ্ছে না, নতুন কেসগুলো করার সময় আয়কর আইন যা বলছে তাই অনুসরণ করে চলেছে। এর মধ্যে আই এ সি তাকে জানিয়েছেন গত। কয়েকমাসে তার করা কেসগুলোর প্রায় সত্তরভাগের বিরুদ্ধে আপিল ফাইল করেছে। অ্যাসেসিরা। একজন বিশেষ আয়কর অফিসারের কেস করা নিয়ে জনসাধারণ অসন্তুষ্ট, অন্যান্যদের মতামতের বিরুদ্ধে আপিল হচ্ছে না, এটা কর্তৃপক্ষ ভাল নজরে নেবে না। দীপাবলী বোঝাতে চেয়েছিল যারা আপিল করেছে তাদের অ্যাসেসমেন্ট অর্ডারগুলো পড়লেই কর্তৃপক্ষ বুঝতে পারবেন সে ভুল কাজ করেছে কিনা। আই এ সি কোন উত্তর দেননি। দীপাবলী বুঝেছিল এই পরিসংখ্যান দেখলে অবশ্যই যে-কোন লোক তার সম্পর্কে সন্দেহ করবে। কিন্তু তার কিছু করার নেই। ইতিমধ্যে তার কিছু অর্ডারের বিরুদ্ধে আপিলে না গিয়ে পার্টি সোজা কমিশনারের কাছে মার্সি পিটিশন করেছে। কমিশনার সেটি গ্রহণ করে। যে অর্ডার দিয়েছেন তা পড়ে সে অবাক। পার্টির যে ত্রুটির জন্যে সে পেনাল্টি করতে চেয়েছিল তার উল্লেখ না করে কমিশনার কয়েক লাইনের অর্ডারে সেটা নাকচ করে দিয়েছেন। এই অর্ডারের বিরোধিতা করা যাবে না। অতএব হাতে যা কাগজ পাচ্ছে তার বাইরের বিষয় নিয়ে মাথা না ঘামানোর অভ্যস করতে চাইল সে। এখন ডিপার্টমেন্টে তার সম্পর্কে যথেষ্ট দুর্নাম। সে নাকি পার্টিদের বারোটা বাজিয়ে দিচ্ছে। পার্টিরা তাদের উকিলবাবুদের যোগ্যতা নিয়ে সন্দেহ করছে। কেউ কেউ উকিল পাল্টাচ্ছে। আর উকিলবাবুরা বুঝতে পারলো দীপাবলীর ওয়ার্ডে কেস পড়লে তাদের অস্তিত্ব বিপন্ন হবে। ফলে দীপাবলীর হাত থেকে নিষ্কৃতি পাওয়ার জন্যে একটা ব্যবস্থা করতে তাঁরা সচেষ্ট হলেন।

বাড়ির জীবন এখন আরও অদ্ভুত। সকালে ঘুম ভাঙার পর কিছু করার থাকে না। চা এবং ব্রেকফার্স্ট তৈরি করে রান্নার লোকটি। সেগুলোর জন্যে সময় খরচ না হওয়ায় গড়িয়ে গড়িয়ে সকাল কাটান। বিকেলে বাড়ি ফিরেও কিছুক্ষণ এক দশা। তারপর কারো বাড়িতে যাওয়ার থাকলে সেখানে গিয়ে মদ গেলা। শুভ্রা এবং গোবিন্দ এই জীবনে অভ্যস্ত। তবে শুভ্ররা মদ খেত অরেঞ্জ মিশিয়ে, রঙের আড়াল রেখে। ইদানীং দীপাবলীকে দেখে সাহসী হয়েছে ওরা। শুধু গিয়ে খেয়ে আসায় এক ধরনের হীনম্মন্যতা কাজ করে। বাড়িতে করার লোক নেই এই অজুহাতে ঠেকিয়ে রেখেছিল অলোক পাল্টা নিমন্ত্রণের ব্যাপারটা। মাঝে মধ্যে কোন হোটেলে কয়েকজনকে ডাকত সে। সেখানে খরচ বেশি হলেও এক ধরনের মানসিক স্বস্তি পেতে চাইত। এবার সে বাড়িতেই ডাকল। ড্রিংকস ফলোড বাই ডিনার।

দীপাবলী একটু আপত্তি করেছিল পুরোন স্বভাবে, খাওয়াতে চাইছ ভাল কথা, কিন্তু এতগুলো লোককে মদ না খাওয়ালেই কি নয়?

পার্টিতে কেউ শুকনো থাকতে চাইবে না।

অতএব মদ এল। বোতলকে বোতল। সংসার খরচের টাকা থাকে অলোকের কাছে। মাইনে পেয়ে খুব সামান্য নিজের জন্যে রেখে প্রায় পুরোটাই সে তুলে দেয় অলোকের হাতে। প্রথমবার অলোক আপত্তি করেছিল। তখন জীবন অন্যরকম ছিল। অলোকের কথাবার্তায় সবসময় একটা উদারতা ছড়ানো থাকত। এখন অত্যন্ত অল্প কারণে সহ্যের বাঁধ বিপন্ন হচ্ছে।

সন্ধ্যে বেলায় প্রথম এল শুভ্রারা। গোবিন্দকে দেখে মনে হয় পরিশ্রম করা ছাড়া অন্য কিছু তিনি তেমন বিশ্বাস করেন না। পার্টিতে এসেছেন পথে একটা ব্যবসার কাজ সেরে। শুভ্রা তাই নিয়ে অনুযোগ করছিল। গোবিন্দ হাসছিলেন। শুভ্রা দীপাবলীর সঙ্গে ভেতরের ঘরে এল। এসে জিজ্ঞাসা করল, নতুন জীবন কেমন লাগছে?

দীপাবলী হাসল, নতুন আর কোথায়! মাসের পর মাস তো কেটে গেল!

বাবা! এর মধ্যে এই কথা! তাহলে আমার অবস্থায় পৌঁছে যে কি বলবে জানি না। নতুন খবর হচ্ছে?

মানে?

আমাকে তো ভগবান মেরে রেখেছেন। বিজ্ঞান হার মেনে গেল। ছেলেপিলে এলে দেখবে আবার সম্পর্কটা চেহারা বদলাবে। প্ল্যান কি? অকপটে জানতে চাইল শুভ্ৰা।

দীপাবলী মুখ ফেরাল। শারীরিক সম্পর্কের প্রথম রাত্রেই অলোক তাকে জানিয়েছিল সে খুব তাড়াতাড়ি সন্তান চায় না। বিবাহিত জীবনটাকে উপভোগ করতে চায় সে। সন্তানধারণ এবং তার লালনপালন সম্পর্কে দীপাবলীর কোন স্বচ্ছ ধারণা না থাকায় সে-ও ব্যাপারটাকে কিছুটা দূরে সরিয়ে রাখতে চেয়েছিল। তারপর জল গড়িয়েছে জলের মতন। কোন পক্ষই মনে করেনি সময়টা এসেছে। কিংবা মনে এলেও প্রকাশ করেনি। শুভ্রা তাকিয়ে আছে সুতরাং বলতে হল, ভাবিনি কিছু।

আবার কবে ভাববে? এসব তাড়াতাড়ি হয়ে যাওয়াই ভাল! শুভ্রার মুখ থেকে কথাটা বেরুনা মাত্ৰ অলোক ভেতরে ঢুকল, কি হয়ে যাওয়া ভাল?

এই যে মশাই, আফটার অল আমি কনেপক্ষের লোক। আমার বাড়ি থেকেই কনে, বেরিয়েছিল। অতএব জানবার পূর্ণ অধিকার আছে এ বাড়িতে নতুন অতিথি আসতে দেরি হচ্ছে কেন?

দীপাবলী দেখল অলোক কেমন হকচকিয়ে গেল। কোনরকমে সেটাকে সামলে নিয়ে বলল, নিজেরাই থিতোতে পারছি না আবার ওসব ঝামেলা এনে লাভ কি?

ঝামেলা বলছেন? শুভ্রা বিস্মিত।

অগত্যা দীপাবলী কথা ঘোরাল, এসব কথা ছেড়ে দাও। আজ কিন্তু তোমাকে আমার সঙ্গে হাত লাগাতে হবে। মোট বারোজন আসবে।

বারোজন তো নিমন্ত্রিত, রবাহত হিসেবে আরও দু-তিনজনকে যোগ করো।

দীপাবলী দেখল অলোক হুইস্কির বোতল বের করছে। শুভ্রার নজরও পড়ল, একি? আপনারা কি ভর সন্ধ্যে বেলায় এসব নিয়ে বসছেন?

কি করব? আপনার কর্তাকে শুধু মুখে বসিয়ে লাভ কি? হাঁ, দু বোতল ভদকা রাখা আছে। এটা হল দীপার ডিপার্টমেন্ট। আপনাদের জন্যে। অলোক চলে গেল।

শুভ্রা হসিমুখে ফিরে দীপাবলীর দিকে তাকাতেই একটু অবাক হল। দীপাবলী বেশ গম্ভীর। শুভ্রা বলল, আজকাল অলোক খুব বেশি খাচ্ছে, তাই না?

হ্যাঁ। সন্ধে হলেই মদ না পেলে কেমন আনচান করে।

কিন্তু বিশ্বাস করো, বিয়ের আগে ও খুব কম খেত।

শুনেছি।

পার্টি জমে গেল। শুভ্রার কথাই ঠিক। নিমন্ত্রিত না হয়েও দুজন চলে এসেছেন। তাদের উঁচু গলায় ঘর মাত। হাতে হাতে গেলাস চলছে। মেয়েরা বসেছে বারান্দায়। ইচ্ছে করে আজ রঙিন সরবতের ব্যবস্থা করেনি দীপাবলী। ফলে সবাই যেন সঙ্কোচে নুইয়ে পড়ছে। ভদকা শুধু লেমন দিয়ে খাওয়া যায় না। বড় বেশি কিক দেয়—এসব কথাবার্তা। চলছিল। এর মধ্যে দু-পেগ খেয়ে মিসেস সোম গান ধরেছেন, মাঝে মাঝে তব দেখা পাই, চিরদিন কেন পাই না। তাই শুনে ছেলেরা বেরিয়ে এসেছে ঘর ছেড়ে। জিভে শব্দ তুলছে। সমঝদারির প্রমাণ দিতে।

মিসেস সোমের গলা ভাল নয়, দমও নেই কিন্তু এককালে যে গানটান গাইতেন বোঝা যায়। দীপাবলী দেখল মেয়েদের মধ্যে যারা ড্রিংক করছিল তারা ছেলেরা আসামাত্র গ্লাস। নামিয়ে নিয়েছে। গান শেষ হতেই আবার অনুরোধ বাজল। কিন্তু ভদ্রমহিলা বারংবার পুতুলের মত মাথা নাড়তে নাড়তে না বললেন। এবার অনুরোধটা অন্যদের দিকে ফিরল। কেউই রাজী হচ্ছেন না। হঠাৎ গোবিন্দ গ্লাসে আঙ্গুলের শব্দ করে বলল, ঠিক আছে, আমি গাইছি।

হয়ে যাক দাদা, প্যানপ্যানি ছেড়ে আসলি মাল ধরো এবার। একজন চেঁচিয়ে উঠল। গোবিন্দ হিন্দী ফিল্মের গান ধরল। খুব হিট গান। গলা মোটেই স্কেলে বাধা নয় কিন্তু উৎরে যাচ্ছে। আর সেই সঙ্গে সমবেত তাল চলছে। অলোক মিসেস সোমের পাশে বসে পড়েছে। ছেলেরা বসে দাড়িয়ে ছড়িয়ে রয়েছে এপাশে ওপাশে। মিসেস সোমকে আজ প্রথম দেখল দীপাবলী। আর এই সময় শুভ্রা তার কানের কাছে মুখ নিয়ে এসে বলল, তোমার কর্তাকে ওখান থেকে ওঠাও। ললিতলবঙ্গলতা তার কাণ্ড শুরু করে দিয়েছেন। সেম ওল্ড ট্যাকটিস।

দীপাবলী অলোকের দিকে তাকাল। মাঝখানে হাত পাচেকের দূরত্ব। অলোক গ্লাসে চুমুক দিয়ে ঘাড় নাড়ছে গানের তালে। আর মিসেস সোম তাঁর ভারী শরীর প্রায় অলোকের কাধে ছেড়ে দিয়ে ঘাড় বেঁকিয়ে গান শুনছেন তন্ময় হয়ে। আর এরই ফাকে কখন যে তার সিঙ্কি শাড়ির আঁচল বুক থেকে খসে পড়েছে তা তিনি যেন টেরই পাননি।

দীপাবলী নিচু স্বরে জিজ্ঞাসা করল, ভদ্রমহিলা কে?

আছেন একজন। নিজেকে খুব সুন্দরী ভাবেন। ছেলে ধরতে ওস্তাদ। ভাবেন বুকের আঁচল খসিয়ে দিলেই সব ছেলে ওর কোলে গিয়ে মুখ লুকোবে। বদমাস! শুভ্রা রাগত গলায় বলল।

ওঁর স্বামী এসেছেন?

মাথা খারাপ! স্বামী বিজনেস নিয়ে এত ব্যস্ত যে কোন পার্টিতে আসার নাকি সময় পান না। গত দুবছরে তিনজনের মাথা চিবিয়েছে। তোমার কর্তাকে ডাকো না! শুভ্রা শেষ করা মাত্র অলোক ওপাশ থেকে চেঁচিয়ে বলল, সাইলেন্স! গান হচ্ছে! সঙ্গে সঙ্গে মিসেস সোম গলে ঢলে পড়লো হাসিতে: শুভ্রা বলল, দেখলে কাণ্ড।

হিন্দী ছেড়ে গোবিন্দ চলে এসেছে মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের গানে। আমি এত যে তোমায় ভালবেসেছি ধরামাত্র চারধার থেকে সবাই হই হই করে উঠল। আর মিসেস সোম বললেন, ও, অলোক, আমি একটু ল্লুতে যাব; প্লিজ!

কথাটা অনেকেই শুনল। অলোক সঙ্গে সঙ্গে ব্যস্ত হয়ে উঠে দাড়াল, নিশ্চয়ই, আসুন, এই তো এদিকে। কোনমতে আঁচল তুলে নিতম্ব বহন করে ভদ্রমহিলা অলোককে অনুসরণ করতেই শুভ্রা বলল, যাও, একা ছেড়োনা ওদের।

অথচ দীপাবলীর একটুও উঠতে ইচ্ছে করল না। কেন যাবে সে? অলোককে পাহারা দিতে? এই ফ্ল্যাটে অলোক যদি ওই স্ত্রীলোকটির সঙ্গে কোন ঘনিষ্ঠতা করতে চায় তাহলে কি পাহারা দিয়ে শান্তি পাওয়া যাবে? সম্পর্কের বিশ্বাস যদি ভেঙে যায় তাহলে নিজেকে ছোট করে কি লাভ? আর অলোক যে ওই মহিলার ডাকে সাড়া দিয়ে কিছু করতে পারে এটা ভাবাই তো একধরনের অপরাধ। অন্তত নিজের চোখে প্রমাণ পাওয়ার আগে তো বটেই। আর প্রমাণ পাওয়ার জন্যে আগ বাড়িয়ে সে চোখ দুটোকে ব্যবহার করতে যাওয়ার মত নীচতায় কখনই আক্রান্ত হবে না!

কথা শুনল না দেখে শুভ্রা বোধ হয় বিরক্ত হল। সে উঠে অন্য মহিলাদের সঙ্গে কথা বলা শুরু করল। দীপাবলী বুঝল কথা বলার বিষয় ওই মিসেস সোম এবং অলোক। এবার মেজাজ খারাপ হল দীপাবলীর। অলোকের কি দরকার ছিল মহিলাকে নেমন্তন্ন করা! অত খাতির করে বাথরুমে নিয়ে যাওয়ার কোন প্রয়োজন ছিল না। কিন্তু কিছু করার নেই। অলোকের এক বন্ধু এখন গ্লাস ভরে দিচ্ছে। গলার স্বর এবং হাঁটাচলা সবার পাল্টে যেতে শুরু করেছে। হঠাৎ শুভ্রার গলায় ধমক শোনা গেল, এই যে, এবার চুপ করো। গলায় বেসুর ধাক্কা মারছে সেটা খেয়াল নেই?

গোবিন্দ গান থামিয়ে বোকার মত হাসল। আর গান নয়, এবার আলাদা আলাদা আড্ডা। কারো কথার কোন আঁটো ব্যাপার নেই। দীপাবলীর পাশে এসে বসলেন যিনি তাকে গত একটা পার্টিতে সে দেখেছে। এই লোকটি বাঙালি নয় কিন্তু বাংলা বলে এবং মদ্যপান করে না।

ভদ্রলোক হাসলেন, মিসেস মুখার্জী, ভাল আছেন?

দীপাবলীর অস্বস্তি হল, ঘাড় নেড়ে হাসল।

অলোকবার আপনাকে কিছু বলেছেন?

কি ব্যাপারে?

ওই যা, তাহলে ভুলে গিয়েছেন। আপনি আমাকে চিনতে পারছেন তো?

দেখেছি।

আমার নাম রণজিৎ। অলোকবাবুর কোম্পানিকে আমরা বড় অর্ডার দিই।

ও। দীপাবলী মুখ ফেরাল।

আপনাদের এই পার্টি আমার খুব ভাল লাগে।

তাই? হ্যাঁ, মিসেস মুখার্জী! কিরকম খোলামেলা। লেডিস আর জেন্টস কোন ফারাক নেই। আমাদের জাতের মেয়েরা এখনও এতটা স্মার্ট হতে পারেনি।

হয়ে যাবে, চিন্তা করবেন না।

তদ্দিনে তো আমি বুড়ো হয়ে যাব। হাসল রণজিৎ।

এইসময় অলোক এবং মিসেস সোম ফিরে এল। অলোকের হাতে নতুন গ্লাস। ওদের দেখামাত্র সে বলল, এই যে রণজিৎ, ঠিক ঘাটে নৌকো ভিড়িয়েছ, এখন আর নিশ্চয়ই আমার দরকার নেই, নিজের কাজ গুছিয়ে নাও।

রণজিৎ হাত নাড়ল, আরে দাদা, আপনি ওঁকে কিছু বলেননি?

অলোক হাসল কিন্তু কথা বলল না। কাপা পায়ে গোবিন্দর কাছে চলে গেল। রণজিৎ বলল, আমি দাদাকে একটা রিকোয়েস্ট করেছিলাম। আপনি যদি একটা ফেবার করেন তাহলে খুব উপকার হয়। ইট উইল নট বি ওয়ানসাইডেড। অফ কোর্স।

কি ব্যাপার বলুন তো?

আমাদের একটা কেস আপনার কাছে আছে। আই মিন আই টি কেস। আমার উকিল। বলছে ও আপনাকে ম্যানেজ করতে পারছে না। আপনি সেটা ছেড়ে দিন।

কোন কেস?

ড্রিমল্যান্ড প্রমোটার্স।

দীপাবলীর মনে পড়ল। সে মাথা নাড়ল, আপনাদের সোর্স অফ ইনভেস্টমেন্টটা ক্লিয়ার করতে বলবো। বাড়ির যে ভ্যালুয়েশন দিয়ে দেখিয়েছেন তা বাচ্চারাও বিশ্বাস করবে না।

আরে, আমরা রিকগনাইজড ভ্যালুয়ারকে দিয়ে ভ্যালুয়েশন করিয়ে রিপোর্ট দিয়েছি। রণজিৎ প্রতিবাদ করল, আর সোর্স হল আউট অফ পাস্ট সেভিংস। কিছু কিছু ফ্ল্যাট-এর এগেনস্টে অ্যাডভান্স নেওয়া আছে।

সেটা টেন পার্সেন্ট। আর যে ভ্যালুয়েশন দিয়েছেন তার ওপর টেন পার্সেন্ট অ্যাড করে ডিপার্টমেন্ট যদি আপনাদের কাছ থেকে বাড়িটা কিনে নিতে চায় তাহলে নিশ্চয়ই আপনাদের আপত্তি নেই। দীপাবলী উঠে দাড়াতেই রণজিৎ উঠল। সে বলল, মিসেস মুখার্জি, আপনার হাসব্যান্ডের সঙ্গে আমার ভাল সম্পর্ক! একটু ভেবে দেখুন–।

দীপাবলী বলল, দেখুন, ইনকাম ট্যাক্সের ব্যাপারে কথা বলতে হলে আমার অফিসে এসে দেখা করবেন। এখানে আপনি আমাদের গেস্ট। সেইরকম ব্যবহার করলে খুশী হব।

মদ্যপান শেষ করে খাওয়াদাওয়া চুকোতে রাত একটা বাজল। এর মধ্যে তিনজন বেহেড হয়ে গিয়েছে। তাদের দায়িত্ব নিতে কেউই রাজী হচ্ছিল না। যে যার মত গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। অলোক মিসেস সোমকে অনুরোধ করল ওদের পৌঁছে দিতে। তিনি তার বিশাল গাড়িতে একা গিয়েছিলেন। শোনা মাত্ৰ আঁতকে উঠলেন, ওঃ, নো! অলোক, আমি মাতালদের স্ট্যান্ড করতে পারি না। বাই, গুডনাইট।

যে তিনজন এখন বাইরের ঘরে শুয়ে আছেন সোফায়, তাদের সঙ্গে গাড়ি আছে। অথচ এইমুহূর্তে তিনজনেই মুখ হ করে পড়ে আছেন। দীপাবলী দরজা থেকে ফিরে গেল শোওয়ার ঘরে। অলোক এখনও বাইরে। এইসময় কাজের মেয়েটি দরজায় এসে দাড়াল।

আজ সন্ধের পরে ওকে শেষবার দেখেছিল দীপাবলী। তারপর কোথায় ছিল খেয়াল করেনি। এই ফ্ল্যাট এমন কিছু রাজপ্রাসাদ নয় যে লুকিয়ে থাকতে দেখা যাবে না। সে জিজ্ঞাসা করল, কিছু বলবে?

মেয়েটি বলল, আমি আপনাদের বাড়িতে কাজ করব না।

অবাক হল দীপাবলী, কেন?

আপনারা মদ খান। আপনারা মাতাল।

হতভম্ব হয়ে গেল দীপাবলী। সামলে নিয়ে কোনমতে বলতে পারল, কি বলছ তুমি?

ঠিকই বলছি। এ কিরকম ভদ্রলোকের বাড়ি? ব্যাটাছেলে মেয়েছেলে একসঙ্গে বসে মদ খাচ্ছে। এ ওর গায়ে ঢলে পড়ছে। দাদাবাবু যে বইটাকে বাথরুমে নিয়ে গেল তার কাণ্ড দেখলে আমাদের দেশের মেয়েরা লজ্জায় মরে যেত আর আপনার কোন স নেই। না, না, এই রকম বাড়িতে আমি কাজ করতে পারব না। আমার এ কদিনের মাইনে আপনি দিয়ে দিন।

তোমাকে এখানে এনে দিয়েছেন দাদাবাবুর মা। দাদাবাবুকে বল।

দাদাবাবুর তো পা টলছে। ওদিকে বাইরের ঘরে তিনজন পড়ে আছে। মাতালদের আমি ভীষণ ভয় করি। আমি এখন বলতে পারব না।

এখন না পার কাল সকালে বল।

ঠিক আছে, তাই বলব। আমি আজ নিচে শোব। এখানে শুতে পারব না।

নিচে শোবে মানে?

নিচের তলার ফ্ল্যাটে।

হঠাৎ দীপাবলীর খেয়াল হল। সে জিজ্ঞাসা করল, তুমি কি সন্ধের পর থেকে সেখানে গিয়ে বসেছিলে? তোমায় দেখতে পাইনি তো!

মেয়েটা জবাব দিয়ে হন হন করে বেরিয়ে যাচ্ছিল। এইসময় বাইরের ঘরে কেউ জোরে জোরে বলে উঠল, আমি ঠিক আছি। নো প্রব্লেম। জাস্ট স্টিয়ারিংটা দুই হাতের মধ্যে এনে দাও ঠিক রাস্তা চিনে ফিরে যাব।

অলোক বলল, একটু মুখে জল দিয়ে নিন। ওর কথাও জড়ানো।

দীপাবলী ঘর থেকে বের হল না। মেয়েটা ডাইনিং রুমের স্তূপীকৃত প্লেটডিসের পাশে দাড়িয়ে। বাইরের ঘরে যেন কুস্তি চলছে। তারপর একসময় আর কোন শব্দ শোনা গেল না। মেয়েটা উশখুশ করল। শেষ পর্যন্ত ঘুরে দাড়িয়ে বলল, ঠিক আছে, আজকের রাতটা আমি এখানেই শুয়ে পড়ছি। ওরা চলে গিয়েছে।

নিচে গাড়ির শব্দ হল। অলোক ফিরে এল মিনিট তিনেক বাদে। সশব্দে দরজা বন্ধ করে শোওয়ার ঘরে এসে বলল, উঃ, যেন ঝড় গেল। এক মাতাল দুই মাতালকে লিফট দিতে গেল। মাতাল কখনও অ্যাকসিডেন্ট করে না, কি বল?

নিজেকে জিজ্ঞাসা কর।

মানে! আমি মাতাল! স্ট্রেঞ্জ! তাহলে তো তুমিও। আমি তোমাকে খেতে দেখেছি।

আমার কথা জড়িয়ে যাচ্ছে না, পা টলছে না। কেউ আমাকে ভয় পাচ্ছে না।

মাইগড! কে আমাকে ভয় পেল?

তোমার কুক কাম মেড। সে বলেছে এমন মাতালের বাড়িতে কাজ করবে না। এটা ভদ্রলোকের বাড়ি কিনা সেই ব্যাপারে সন্দেহ করেছে। ওকে তোমার সঙ্গে কথা বলতে বলেছিলাম।

হোয়ার ইজ শী? ফোঁস ফোঁস করে উঠল অলোক।

নো! এখন এই মুহূর্তে তুমি কিছু বলতে পারবে না ওকে।

এই রাত্রে বাড়ি থেকে বের করে দিলে না কেন?

তোমার আমার দেওয়া না দেওয়ার ওপর ও ভরসা করে নেই। মনে হচ্ছে নিচের তলার ফ্ল্যাটে ইতিমধ্যে কাজের ব্যবস্থা করে নিয়েছে ও।

অলোক এগোতে গিয়ে বেতের চেয়ারে ধাক্কা খেল। খেয়ে বলল, আঃ, এটাকে আবার সামনে এনে রাখল কে? ননসেন্স! তারপর গলা পাল্টে বলল, খুব জমেছিল আজ, তাই না?

দীপাবলী কোন জবাব দিল না। অলোক তার দিকে তাকাল। তার দৃষ্টি স্বচ্ছ নয়। সে হাসার চেষ্টা করল, অফ মুড কেন? ও, তুমি কি মিসেস সোমের ব্যাপারটা নিয়ে এখনও ভাবছ? আরে না। শী ইজ দ্যাট টাইপ। প্রতিটি পার্টিতে একজন না একজনের সঙ্গে ওই ব্যবহার করেন। সবাই জানে। ইনডিভিজুয়ালি কারো সঙ্গে ইনভলন্ড নন। পার্টিকুলারি আমার সঙ্গে তো নয়ই। এ নিয়ে একটুও দুশ্চিন্তা করো না।

আমি যে কোনরকম দুশ্চিন্তা করছি তা তোমাকে কে বললে?

ও। হ্যাঁ। করছ না। শুভ্রা তাই বলল যাওয়ার সময়। কি স্ত্রী মশাই আপনার, একটুও জেলাসি নেই। মহৎ মানুষের প্রাণ। কিন্তু মেয়েটাকে নিচের দত্ত ম্যানেজ করে নিয়েছে? ইমপসিবল! বেশী মাইনে দেবে? তাহলে তো আমাদের না খেয়ে থাকতে হবে। আই কান্ট টরেট দিস। ওর মাইনে বাড়িয়ে দাও, শী মাস্ট স্টে হিয়ার।

তোমার মা ওকে ভাঙিয়ে এখানে এনেছিলেন।

ডোন্ট ইউজ দ্যাট ওয়ার্ড! কি ল্যাঙ্গুয়েজ! ভাঙিয়ে? ঠিক আছে, আমি কথা বলছি। কি নাম যেন? টলতে টলতে ডাইনিং রুমের দিকে এগিয়ে যেতেই অলোক মেয়েটির দেখা পেল, এই যে! খুব রাগ করেছ? আরে বোকা মেয়ে, এরকম কি রোজ হবে? না, না। শোন তুমি যা পাচ্ছিলে তার ওপর একশ টাকা বাড়িয়ে দেব। ও কে?

মেয়েটি মাথা নাড়ল এত চটপট যে দীপাবলীও অবাক হল। সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠল অলোক, দ্যাটস লাইক এ গুড গার্ল। যাও, শুয়ে পড়। কোন ভয় নেই।

মেয়েটি সরে গেল। অলোক ফিরে এল ঘরে, দেখলে ম্যানেজ হয়ে গেল।

দেখলাম! আমি শুয়ে পড়ছি।

কিছু মনে করো না, তুমি খুব আনসোস্যাল।

আর কিছু?

ওঃ, ডোন্ট টক লাইক দ্যাট।

তুমি আমাকে কথা বলাচ্ছ।

একটা কথা। তুমি আজ রণজিৎকে রিফ্যুজ করে খুব ভাল করেছ।

এবার অবাক দীপাবলী। সে ভেবেছিল এই নিয়ে অলোক তার সঙ্গে ঝামেলা করবে। উল্টে সে তাকে সমর্থন করবে এটাই ভাবতে পারেনি। অলোক বলল, লোকটা ভেবেছিল আমাদের কিছু অর্ডার পাইয়ে দিয়ে মাথা কিনে নিয়েছে। ও যা বলবে আমরা তাই করব? নো! আমি তোমাকে কোনরকম রিকোয়েস্ট করিনি। তাই ওকে ঠিক পথ দেখিয়ে খুব ভাল করেছ।

এতে তোমার কি লাভ হল?

আরও প্রেসারে পড়ুক ব্যটা। জব্দ হোক। তারপর এসে হাতে পায়ে ধরবে তখন না হয় দেখা যাবে। নট বিফোর দ্যাট।

অলোক, আমি আশা করেছিলাম তুমি আমাকে বুঝেছ। আমি আজ যা বলেছি তা থেকে ভবিষ্যতেও সরে আসার কোন কারণ নেই। আর তোমার পরিচিতদের জানিয়ে দেবে অফিস সংক্রান্ত…

খাটে এসে বসল অলোক, হোয়াট ডু ইউ মিন?

খুব সোজা কথা। আমার অফিস এবং আমার বাড়ি আলাদা।

তুমি আমার কথা ভাববে না?

নিশ্চয়ই। বাড়িতে যখন থাকব তখন ভাবব। কিন্তু অফিসের কাজে তোমাকে জড়ানো কেন?

লুক, আমার মাঝে মাঝে মনে হয় কি জানো? মনে হয় আমি একটা নীতিবাগীশ পুতুলকে বিয়ে করেছি। তার শরীরে কোন রক্ত মাংস হৃদয় নেই।

ঠোট কামড়াল দীপাবলী, বিয়ের আগে এটা টের পাওনি?

পেলে নিশ্চয়ই এখন এই কথা বলতাম না।

তোমাদের যে তোক আমার সম্পর্কে খোঁজ খবর করতে জলপাইগুড়িতে গিয়েছিল তার অন্তত উচিত ছিল এটা জানান।

তার মানে?

তোমার মা বাবাকে আমি দোষ দিচ্ছি না। তাঁরা খোঁজ নিতেই পারেন। কিন্তু তোমারও ওই রিপোর্টের ওপর নির্ভর করতে হয়েছে এটাই আমার মাথায় আসছে না। আর কথাটা আমাকে জানাবার মত সাহসও তোমার হয়নি।

তুমি কি বলতে চাও?

কিছু না।

আমার বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ নেই?

অভিযোগ তদ্দিনই থাকে যদ্দিন কিছু আশা করতে পারা যায়!

তার মানে আমি তোমার এতখানি অবহেলার পাত্ৰ?

অলোক, আজ আর কথা বলা ঠিক হবে না। কথায় কথা বাড়ে। হয়তো আমি যা চাই। না তাও বলে ফেলব। প্লিজ এখন চুপ করো।

নো। হয়ে যাক ফাইন্যাল।

ফাইন্যাল? আমরা কি কোন খেলায় মেতেছি?

হ্যাঁ। জীবন নিয়ে খেলা। আমি তোমাকে সরাসরি প্রশ্ন করছি। আর ইউ হ্যাপি উইথ মি?

এ প্রশ্নের জবাব এখন আমি দেব না।

নো। ইউ মাস্ট।

প্রশ্নটা যদি আমি তোমায় করি কি জবাব দেবে।

খুব সোজা। কখনও কখনও হাঁ, কখনও না।

যাক! সত্যি কথা বললে।

কিন্তু তোমার উত্তর কি?

আমি তো বলছি বলব না।

এই মাস্টারনিপনা ছাড়। তুমি আমার মুখ থেকে কথা বের করে নিয়ে বেশ মজা পাও তা আমি জানি। কাম অন, বল?

এখন এই মুহূর্তে তুমি নৰ্মাল নও। এখন বুঝবে না।

বাজে কথা বলে এড়িয়ে যাচ্ছ কেন? গলা উঠল অলোকের।

বেশ। আমারও উত্তর একই। তুমি যা বললে।

তাহলে আমাকে এটা বলনি কেন?

বলার মত নয় বলে। পৃথিবীতে দুটো মানুষ কখনই অবিমিশ্ৰ সুখে বাস করতে পারে না। কোন দম্পতিকে এখন তুমি খুঁজে পাবে না যারা খুব সুখী।

দীপাবলী হাসল, আর তুমিও তো আমাকে কখনও বলনি একথা!

কিন্তু আমার বিরুদ্ধে তোমার অভিযোগ কি?

তুমি আমাকে সহ্য করতে পার না এটা আমি জানি। আর পার না বলে অনেক কথা আমার কাছে লুকিয়ে যাও। তোমার মা বাবা ওই বাড়ির কোন বিষয় নিয়ে আমার সঙ্গে আলোচনা কর না। মিথ্যে বলা আর কিছু না বলে লুকিয়ে রাখা একই অপরাধ। তুমি এতে অভ্যস্ত হয়ে গেছ অলোক। তুমি বলেছিলে মদ খাও কিন্তু কখনই গাড়ি চালাতে গিয়ে তোমার হাত কঁপে না। কিন্তু ইদানীং তুমি রাত্রে স্টিয়ারিং ধরতে পারছ না। বিয়ের আগে যা যা তুমি উদারতা দিয়ে এড়িয়ে গিয়েছিলে তা এখন স্বার্থপরের মত আঁকড়ে ধরেছ। অস্বীকার করতে পার?

আর কিছু?

একটা কাজের মানুষ ভদ্রলোকের বাড়ি নয় বলে অপমান করল। তার মানসিক গঠনের সঙ্গে এই জীবন মেলে না বলে কাজ ছেড়ে দিতে চাইল। তুমি তাকে অনুনয় করে একশ টাকার টোপ দিয়ে এ বাড়িতে রাখতে চাইছ। এটা করে কোথায় নিজেকে নামিয়ে নিয়ে গেলে? শুধু দুটো ভাল রান্নার লোভ তোমার কাছে বড় হল?

ওকে আর একজন ছিনিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল।

যাচ্ছিল। আর তুমি সেটা না দিতে মাথা নোয়ালে। ছিঃ।

এই যদি তোমার ভাবনা তাহলে আমার সঙ্গে আছ কেন? তুমিও তো মদ খাও! তুমিও তো এই জীবন মেনে নিয়েছ।

নিয়েছি। কারণ তুমি এই জীবনে আছ বলে। মদ খাওয়ার সময় তুমি আমাকে ঠাট্টা করে বলেছিলে বিমল মিত্রের চরিত্র হতে হবে না। ভদ্রলোক কত বড় স্ৰষ্টা ছিলেন তা আমি আজ অনুভব করছি। উনি যা সত্যি তাই লিখেছিলেন আর আমরা নিজেদের ঢাকবার জন্যে তাই নিয়ে ব্যঙ্গ করি। কিন্তু মুখোশ তো একদিন খুলে পড়েই, পড়ে না?

তাহলে আমার সঙ্গে আছ কেন?

কারণ আমি আমার জীবনের অনেক অনেকদিন একদম একা কাটিয়েছি। একলা থাকার কি যন্ত্রণা তা আমি ছাড়া কজন জানে জানি না। তুমি তো জানোনা। এই একা থাকা আমার ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল। আমি অন্যায়ের সঙ্গে অ্যাডজাস্ট করতে চাইনি। কিন্তু সেটা করতে গিয়ে ভেতরে ভেতরে ক্ষয়ে ক্ষয়ে যাচ্ছিলাম। তাই তোমাকে মেনে নিতে, তোমার সঙ্গে মানিয়ে নিতে চেষ্টা করেছি। আর যাই হোক, রাত্রে যখন তুমি আমার পাশে শুয়ে ঘুমোও তখন তো আমার মনে হয় আমি একা নই। ইচ্ছে করলে তোমাকে স্পর্শ করতে পারি। অথচ সেই একা থাকার দিনগুলোতে আমার চারপাশে কেউ ছিল না। মাঝরাত্রে ঘুম ভেঙে চমকে উঠলাম। আমি সেই জীবনে আর ফিরে যেতে চাইনি। আমি খুব ভয় পাচ্ছিলাম। হঠাৎ কান্নায় গলা বুজে এল দীপাবলীর। সে হাঁটুতে চিবুক রাখল।

অলোক উঠে বসল। তারপর বাথরুমে চলে গেল। এবং একটু বাদেই সেখানে বমির শব্দ হল। দীপাবলী মুখ তুলল। একটু অপেক্ষা করল। তারপর বাথরুমের দরজার সামনে গিয়ে দাড়াল। অলোক বেসিনে বমি করার চেষ্টা করছে। প্রথমবারের পর আর কিছু বের হচ্ছে না। তার শরীর কাঁপছে।

দীপাবলী অলোককে ধরল, হবে আর?

অলোক মাথা নাড়ল। ওকে ধীরে ধীরে বিছানায় এনে শুইয়ে দিল দীপাবলী। তারপর একটা ভোয়ালে ভিজিয়ে নিয়ে গলায় কপালে ধীরে ধীরে বোলাতে থাকল। হঠাৎ আরামে চোখ বন্ধ হয়ে গেল অলোকের। সে ফিসফিসে গলায় উচ্চারণ করল, থ্যাঙ্কু!

দীপাবলী বলল, কথা বল না। ঘুমাতে চেষ্টা কর।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *