৩১. সরকারি চাকরিতে

সরকারি চাকরিতে একই জায়গায় পাঁচ বছরের বেশী থাকতে দেওয়া হয় না। সম্ভবত কাউকে মৌরসীপাট্টা অর্জন করতে দিতে সরকারের অনিচ্ছা আছে। এর একটাই কারণ, সরকারের ধারণা ছিল কর্মচারীরা বেশীদিন এক জায়গায় থাকলে ক্ষমতার অপব্যবহার যেমন করতে পারেন তেমনি কাজে একঘেয়েমিও আসতে পারে। দীপাবলী আবিষ্কার করল। তার পেশকারদের প্রথম দুজনের ওই একই জায়গায় চাকরি করার সময় সাতবছর পেরিয়ে গিয়েছে। অর্থাৎ এদের ওপর সরকারি আইন প্রয়োগ করা হয়নি।

সরকারি চাকরিতে অনেকটা জীবনের মতই বিকল্পের মূল্য আসলের মত হতে পারে না। আর আসল অফিসারটি যেখানে পেশকার-নির্ভর ছিলেন সেখানে বিকল্প হিসেবে সে কি করতে পারে। প্রথম দিনের আলোচনার শেষে সে স্পষ্ট বলে দিয়েছিল পেশকার বা ইন্সপেক্টর তাঁদের ওপর ন্যস্ত দায়িত্ব পালন করবেন তার বেশী যেন নাক না গলাতে যান। হেড পেশকারের নাম রামবিলাস গুপ্তা। অফিসারদের ঘরের পরিধির বাইরে একটা বিরাট হল ঘর কাঠের পার্টিশন দিয়ে ভাগ করে এক একটা ওয়ার্ডের পেশকারদের কাজ করার জায়গা তৈরী হয়েছে। পিওন এই দুই জায়গায় ছোটাছুটি করে কাজ চালু রাখে। যেকোন অফিসারের প্রাথমিক কাজ হল যে সমস্ত অ্যাসেসমেন্ট একত্ৰিশে মার্চ টাইম বারড হয়ে যাচ্ছে সেগুলোর ব্যবস্থা করা। দীপাবলী একটা কাগজে সেই লিস্টটা পাঠিয়ে দেবার জন্যে লিখে পিওনকে দিল। খানিক বাদে পিওন হেড পেশকারের উত্তর নিয়ে এল, লিস্টটা আসল অফিসারকে দিয়ে দেওয়া হয়েছে। অতএব পিওনের সাহায্যে আলমারি এবং দেরাজের কাগজ পত্র ঘেঁটে দেখল দীপাবলী। কোথাও হদিশ পাওয়া গেল না। ওই লিস্ট ছাড়া কোন কাজ করা সম্ভব নয়। আগের অফিসার নিশ্চয়ই সেটা বাড়িতে নিয়ে যাননি। পিওনকে দিয়ে হেড পেশকারকে ডাকিয়ে সেই কথাটাই বলল দীপাবলী।

লোকটার মুখে পান থাকে। অনুমতি নেওয়ার প্রয়োজন বোধ না করে চেয়ার টেনে পা ছড়িয়ে বসে বলল, ম্যাডাম, আপ অফিসার হ্যায়, হামলোগ পেটি ক্লার্ক, আপকি পেপার হাম কাঁহা সে ঢ়ুঁডেগা?

লোকটার বলার ভঙ্গীতে মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। শক্ত মুখে দীপাবলী বলল, ঠিক আছে, আপনি আমাকে এখনই লিস্টটা বানিয়ে দিন।

আরে ম্যাডাম, আভি কেইসা হোগা! টাইম লাগেগা।

কেন? ভ্রূ কোঁচকালো দীপাবলী।

আই এ সিনে মান্থলি প্রগ্রেস রিপোর্ট দেনে বোলা ইমিডিয়েটলি, উও বানানে হোগা।

আপনার অ্যাসিস্টেন্টকে দিয়ে তৈরী করান।

আরে করেগা তো উসলোগ বাকি চেক তো হামকো করনে পড়েগা। এক দো কেস। মিস হো যানেসে কিতনী এক্সপ্লেনাশেন দেনে পড়েগা আপনেহি জানতি হ্যায় ম্যাডাম। রামবিলাস পান চিবোতে লাগল।

ঠিক সেইসময় ঘরের পর্দা সরিয়ে একজন উঁকি মারল, মে আই কাম ইন?

দীপাবলী কিছু বলার আগে রামবিলাস বলে উঠল, আইয়ে আইয়ে ভামা সাহাব, ক্যা। সমাচার? সব কুচ ঠিক হ্যায় না?

আরে রামবিলাসজী, আপ হিঁহা তো প্ৰব্লেম সলভড। সি আই টি আভি ইয়ে রিপোর্ট মাংতা। তুরন্ত দিজিয়ে না। ভার্মা একটা কাগজ ধরিয়ে দিল।

দেউঙ্গা দেউঙ্গা। আপলোগ তো হরবকৎ তুরন্ত বিনা বাত নেহি বোলতা।

আরে নেহি জি, পার্লামেন্টমে কোয়েশ্চন হো গিয়া।

ঠিক হ্যায়, আ রাহা হুঁ, সি আইটিকো কাম করনেই পড়েগা। রামবিলাস উঠে ঘর ছেড়ে চলে গেল। দীপাবলী চুপচাপ ওদের দেখছিল। এবার ভামা তার দিকে তাকিয়ে নমস্কার করল, নমস্তে ম্যাডাম, আপকি বাৎ হাম শুনা। আই অ্যাম ফ্রম সি আই টি অফিস।

ইওর ডেজিগনেশন প্লিজ।

ইন্সপেক্টর।

সিট ডাউন প্লিজ।

ভার্মা বসল। তার মুখের দিকে তাকিয়ে দীপাবলী ইংরেজিতেই জিজ্ঞাসা করল, কমিশনার অফ ইনকামট্যাক্স পালামেন্টের জন্যে যে রিপোর্ট চেয়েছেন তা কি আমার ওয়ার্ডের কোন ব্যাপার?

ভামা মাথা নেড়ে ইংরেজিতে জবাব দিল, হ্যাঁ। গতমাসে যতগুলো সার্চ সিজার কেস হয়েছে সেই বিষয়ে। আপনার ওয়ার্ডেও কেস আছে।

তাহলে সি আই টি নিশ্চয়ই আমার সই করা রিপোর্ট নেবেন?

নিশ্চয়ই।

কিন্তু ওটা আমাকে আপনি দেননি।

আমি ঠিক বুঝতে পারছি না।

আপনি আমার সাব-অর্ডিনেটকে যা বললেন সেটা আমাকে বলা উচিত ছিল। হি ইজ সাপোড, টু ওবে মাই অর্ডার।

জরুর। কিন্তু, রামবিলাসজী মতলব, উনি তো এতদিন সব করে থাকেন। ভেরি ভেরি এফিসিয়েন্ট পেশকার। ইভন সি আই টি ওঁর কাজের প্রশংসা করেন। আপনার আগের আই টি ও যে সব খবর রাখতেন না তা রামবিলাসজী রাখতেন। তাছাড়া হি মোজ ওয়ার্ক। ওঁকে পাওয়ার জন্যে সমস্ত আইটিওরা হেড অফিসে দরবার করে। আপনি চোখ বন্ধ করে ওর ওপর ডিপেন্ড করতে পারেন ম্যাডাম। হি ইজ এ রাইট পার্সন।

উনি যদি এত মূল্যবান কর্মী হন তাহলে এই চেয়ারে একজন অফিসারকে সি আই টি বসাচ্ছেন কেন? উনি তো সব কাজ করতে পারেন।

এরকম কথায় ভার্মা বেশ হকচকিয়ে গেল। সে রুমালে ঘাড় মুছল তারপর বলল, আপনি আমাকে এসব কথা বলছেন কেন? আমার কসুর কোথায়?

উত্তর দেবার আগে রামবিলাস ফিরে এল, লিজিয়ে ভামাসাহাব। বলে খেয়াল হতে কাগজটা দীপাবলীর দিকে এগিয়ে দিল সে।

দীপাবলী কাগজটা দেখল। একটা প্রোফর্মা ভর্তি করেছে রামবিলাস। গত এক মাসে কটা সার্চসিজার কেস হয়েছে, তাদের বাজেয়াপ্ত সম্পদ এবং অর্থের পরিমাণ কত, সেইসব পার্টির এরিয়ার ডিম্যান্ড কত আছে, কি কি কেস এখনও করা হয়নি, তাদের নাম ঠিকানা ইত্যাদি ইত্যাদি জানতে চাওয়া হয়েছে। দীপাবলী মুখ তুলে জিজ্ঞাসা করল, এই রিপোের্টটা আপনি কিভাবে দিলেন?

রামবিলাস হাসল, ম্যাডাম, রিপোর্ট যেভাবে সবাই দেয় সেইভাবে আমি দিয়েছি।

আমি আপনার কথা বুঝতে পারছি না।

দেখুন ম্যাডাম, আমাদের দুটো পার্টির বাড়ি আর অফিসে সার্চ হয়েছে, আমি ফিগারে দুই লিখেছি। কত কি মাল পেয়েছে ডিপার্টমেন্ট তা আমাদের এখনও জানানো হয়নি বলে লিখেছি নট ইয়েট নোন। গত বছরের রেজিস্টারে চালান পোস্টিং করে এখনও নতুন করে লেখা হয়নি বলে এরিয়ার ডিম্যান্ড-এর পজিশন বলা যাচ্ছে না। এটা বললে সি আই টি শুনবে? কেয়া ভামা সাহাব? তাই ফাইলে যে অরিজিন্যাল ডিম্যান্ড ছিল তাই বলিয়ে দিয়েছি। নাম ঠিকানা দিয়ে দিয়েছি আর ব্লুবুকে যে যে কেস পেন্ডিং আছে তা দেখে লিখে দিয়েছি।

কিন্তু পার্টি যদি পেমেন্ট করে দিয়ে থাকে?

ও বাদমে দেখা যায়েগা।

বাঃ, এতে তো ভুল ফিগার দেওয়া হল।

ম্যাডাম রিপোর্ট মানে হল ফিগার। কেউ ভেরিফাই করে না।

তাই বলে আপনি ভুল রিপোর্ট দেবেন?

যেন ছেলেমানুষের মুখে কথা শুনছে এমন ভঙ্গী করল রামবিলাস। তারপর বলল, কোন সরকারি রিপোর্ট কারেক্ট নয় ম্যাডাম। সবাই এমনই দেয়।

দীপাবলী ভামার দিকে তাকাল, আপনি শুনলেন কথাটা?

রামবিলাস এবার সোজা হয়ে বসল, উনি নতুন শুনছেন না। আপনি নতুন এসেছেন। বলে এরকম মনে করছেন। প্রতিমাসে আমরা যে মান্থলি প্রগ্রেস রিপোর্ট দিই তার সঙ্গে ব্লুবুকের কোন মিল আছে? দিতে হয় বলে দিই।

হতভম্ব হয়ে গেল দীপাবলী। লোকটা কি কথা বলল? ধ্ৰুবুক হচ্ছে একটি ওয়ার্ডের হৃদপিন্ড। তাতে যে কটি অ্যাসেসির অ্যাসেসমেন্ট হয় তাদের নাম ঠিকানা, কোন কোন বছরের অ্যাসেসমেন্ট বাকি আছে, শেষ অ্যাসেসমেন্টের ইনকাম কত ধার্য হয়েছে তার বিশদ লেখা থাকে। সে জিজ্ঞাসা করল, রুবুকের সঙ্গে আমাদের মান্থলি প্রগ্রেস রিপোর্টের কোন মিল নেই?

না। শুধু আমাদের নয়, সবার। যেমন ধরুন ব্লুবুকে আছে সাতশো বত্ৰিশটা অ্যাসেসির নাম, মান্থলি প্রগ্রেস রিপোর্টে আটটা বেশী।

সেকি? এই আটটা কোথায় পেলেন?

পাইনি। আমার আগে কিছু ফাইল ট্রান্সফার হয়ে গিয়েছিল। তখনকার পেশকার সেটা রিপোর্ট থেকে ডিডাক্ট করেনি। তার জের চলছে। এখন আমি কমালে আই এ এ সি ধরবে।

বাঃ! পেন্ডিং অ্যাসেসমেন্ট।

ম্যাডাম, সি আই টি চান প্রতিমাসে অন্তত দুই আড়াইশো অ্যাসেসমেন্ট হোক। ঠিকঠাক দেখালে তো আটমাস সব পেন্ডেন্সি খতম। তাই আই টি ও কে বাঁচাতে পেন্ডিং বেশী করে দেখিয়ে প্রতিমাসে আড়াইশো অ্যাসেসমেন্ট করা হয়েছে দেখানো হয়।

রেজিস্টার ভেরিফিকেশন করলে তো ধরা পড়ে যাবে।

না ম্যাডাম। রেজিস্টারে ফাইল কেস লিখে নাম্বার ঠিক করে দিই।

তাহলে তো পুরো ব্যাপারটা মিথ্যে দিয়ে চলছে?

হঠাৎ রামবিলাস ভার্মার দিকে তাকাল, ভামা সাহাব, ডাইরেক্ট আই আর এসদের নিয়ে এই হল মুশকিল। যা শিখে আসে তার সঙ্গে প্র্যাকটিক্যাল কাজের কোন মিল নেই। ম্যাডাম, আমরা যেমন ফলস রিপোর্ট দিচ্ছি আই এ এ সিকে, আই এ এ সি ঠিক তা পাঠাচ্ছেন সি আই টিকে, সি আই টি বোর্ডকে, বোর্ড মিনিস্টারকে, মিনিস্টার পার্লামেন্টকে। কেউ এ নিয়ে মাথা ঘামায় না, আপনিও কিছুদিন পরে এটাকে মেনে নেবেন, চমকাবেন না। উঠে দাঁড়াল রামবিলাস।

দীপাবলী ভামার দিকে তাকাল, আপনি অন্য অফিসারদের কাছ থেকে রিপোর্ট পেয়ে গিয়েছেন? না পেয়ে থাকলে সেগুলো কালেক্ট করুন, আমি একটু পরে আপনাকে এটা দিচ্ছি।

ব্যাপার স্যাপার দেখে ভামা খুব ঘাবড়ে গিয়েছিল। তার রাজী না হয়ে উপায় ছিল না। দীপাবলী রিপোর্ট নিয়ে সোজা চলে এল আই এ সির ঘরের সামনে। ইনি পদমর্যাদায় আয়কর অফিসারদের ওপরে। একটি শহরকে কয়েকটি এলাকায় ভাগ করা হয়। এক একটি এলাকার কর্তা হলেন এই ইনকামট্যাক্স অ্যাসিস্টেন্ট কমিশনার। ঘরের সামনে লাল আলো জ্বলছে। পিওন বলল, সাহেব বিশ্রাম করছেন।

দীপাবলী ঘড়ি দেখল। এখন টিফিনের সময় নয়। একটা লোক অফিসে এসেই বিশ্রাম নেবে কেন? পিওনটি হেসে বলল, লাঞ্চকো বাদ আইয়ে ম্যাডাম।

দীপাবলী মাথা নাড়ল, সি আই টির অফিস থেকে ইন্সপেক্টর এসেছেন একটা জরুরী। রিপোর্ট নিতে। তুমি গিয়ে বলো এখনই দেখা করা দরকার।

পিওন হেসে বলল, মেরা নোকরি খতম হো যায়েগা।

আমি দায়িত্ব নিচ্ছি, তুমি বলো।

ওর গলার স্বরে পিওন দোনামনা করে এগিয়ে গেল। আই এ সি ভদ্রলোককে এর মধ্যে সে যে কয়েকবার দেখেছে তাতে খুশী হবার কোন কারণ ঘটেনি। ভদ্রলোক কথা বলেন। চিবিয়ে চিবিয়ে, কথা বলতে যেন খুব অসুবিধে হয়। একটু বাদে পিওন এসে জানাল অনুমতি পাওয়া গিয়েছে।

ঘরে ঢুকল দীপাবলী। ইনকাম অ্যাসিস্টেন্ট কমিশনারের ঘর যথেষ্ট বড়। পর্দা কাৰ্পেট এবং টেবিলের চেহারায় পদমর্যাদা স্পষ্ট। দীপাবলী দেখল চেয়ার শূন্য, ঘরের কোণায় একটা লম্বা ইজিচেয়ারে শুয়ে আছেন ভদ্রলোক। চোখাচোখি হতে হাত নেড়ে বসতে বললেন। দীপাবলী বসল।

তিরিশ সেকেন্ড সময় নিলেন আই এ সি, হিন্দীতে টেনেটেনে বললেন, এই সময়ে আমি কারোর সঙ্গে দেখা করি না। আপনি মহিলা বলে অ্যালাউ করলাম। স্পেশাল ফোের। নাউ, হোয়াট ইজ ইওর প্রব্লেম?

দীপাবলী ঘটনাটা সংক্ষেপে বলল।

সঙ্গে সঙ্গে খিচিয়ে উঠলেন আই এ সি, হোয়াট ডু ইউ ওয়ান্ট টু সে। ইফ ইউ ডোন্ট গিভ হিম রিপোর্ট রাইট নাউ, সি আই টি উইল কল মি! ওঁর মুখ আপনি জানেন? লাস্ট টাইম আমার চোদ্দপুরুষ উদ্ধার করে ছেড়েছেন। আর সেটা যদি উনি আমাকে করেন তাহলে আমি আপনাকে ছেড়ে দেব ভেবেছেন? নো, নেভার।

কিন্তু আমার পেশকার যে রিপোর্ট দিচ্ছেন সেটা সম্পূর্ণ ভুল। এর সঙ্গে ঘটনার কোন মিল নেই। সিআইটি এটা পালামেন্টে পাঠালে তা জনসাধারণকে ভুল বোঝাবে তা কি আপনি বুঝতে পারছেন না? দীপাবলী উত্তেজিত হল।

যথেষ্ট বুঝতে পারছি। কয়েকশ ইনকামট্যাক্স অফিসার রিপোর্ট দেবেন ঠিক সময়ে আর আপনি সৎ সেজে আমাকে বিপদে ফেলবেন? আপনার রিপোের্ট আজ না পেলে সি আই টি আমাকে দায়ী করবেন। ডিপার্টমেন্টে চাকরি করতে গেলে এসব ফালতু ব্যাপার উপেক্ষা করতে হয়। যান রিপোর্ট দিয়ে দিন। আই এ সি চোখ বন্ধ করলেন।

বসে থাকার কোন মানে হয় না। কিন্তু তবু দীপাবলী মুখ খুলল, স্যার আপনাকে আর এক মিনিট ডিস্টার্ব করব।

আই এ সি নড়লেন না, মুখে কিছু বলা দূরে থাক চোখও খুললেন না। দীপাবলী বলল, আমি আমার ওয়ার্ডটাকে আপ টু ডেট করতে চাই যাতে ভবিষ্যতে এরকম কোন প্রব্লেমে পড়তে না হয়। সেই কারণেই আমার হেড পেশকারকে ওখানে রাখতে চাই না। আপনি ওকে চেঞ্জ করে দিন।

হু ইজ হি?

রামবিলাস।

মাই গড। ওকে সবাই সেকশনে চায় আর আপনি ট্রান্সফার করতে বলছেন।

হ্যাঁ, আমার এটা বলার কারণ আছে।

হাত ওল্টালেন আই এ সি, ঠিক হ্যায়, আমি আই টি ও অ্যাডমিনকে বলে দেব। আপনাদের নিয়ে কি মুশকিল জানেন? আপনারা অ্যাডজাস্টমেন্ট করতে পারেন না। ইয়েস! আমার বাড়িতেই তো আমি দেখছি।

দীপাবলী নিজের ঘরে ফিরে এল। মিনিট দশেকের মধ্যেই রামবিলাস সামনে এসে দাঁড়াল, থ্যাঙ্ক ইউ ম্যাডাম। আপনি আমার উপকার করলেন।

দীপাবলী অবাক, মানে?

আরে এই ওয়ার্ড একেবারে মরুভূমি হয়ে গিয়েছিল। সার্ভে ওয়ার্ড পেয়ে খুব ভাল হল। সার্ভে ওয়ার্ডের আই টি ও লোক ভাল। তবে প্রয়োজন হলে আমাকে ডাকবেন, আমি নিশ্চয়ই হেল্প করব।

যে লোকটি রামবিলাসের জায়গায় এল তার দিকে তাকিয়ে দীপাবলী হতভম্ব। দেখে মনে হচ্ছে সত্তরের নিচে বয়স নয়। সামনে দাঁড়িয়ে বিড়বিড় করছে।

দীপাবলী তাকে জিজ্ঞাসা করল, আপনি কিছু বলছেন?

মাথা নাড়ল লোকটা, নেহি জি! আপকো হাম দেখা থা।

কোথায়?

সায়গলসাবকো সাথ এক ফিল্মমে।

কি? প্রায় চিৎকার করে উঠে বেল বাজাল সে। পিওন এল মিনিট খানেক বাদে। লোকটা দাঁড়িয়ে রইল নির্বিকার মুখে। পিওনকে দীপাবলী হুকুম করল সুপারভাইজারকে ডেকে আনতে।

সুপারভাইজার প্রবীণ মানুষ। হস্তদন্ত হয়ে ঘরে ঢুকেই নতুন পেশকারের দিকে একবার নজর বুলিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, এনি প্রব্লেম ম্যাডাম?

এই লোকটি কে? রাগত স্বরে জানতে চাইল দীপাবলী।

ইনি একজন সিনিয়র ইউ ডি সি। পবন গুপ্তা। আপনার সেকশনে ওকে দেওয়া হয়েছে। পবনজী, আপনি নাম বাতাননি?

জীনে হি। কোঈ মুঝে নেহি পুছা। বলেই পবন পকেট থেকে প্রচণ্ড ময়লা রুমাল বের করে শূন্যে ঝেড়ে মুখ মুছল তারপর নির্বিকার ভঙ্গীতে গুণগুণ করতে লাগল, মেরে বুলবুল শো রাহি হ্যায়–।

দীপাবলী আঙুল তুলল, দেখুন, এই লোকটা কি করছে দেখুন?

সুপারভাইজার বললেন, ম্যাডাম, ও কিন্তু হার্মলেস। ওই অশোককুমার দেবিকারানী, সায়গল এদের নিয়েই আছে। সবাই ব্যাপারটা ইগনোর করে।

তার মানে? একজন কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মচারী অফিসে এসে তার বসের সামনে দাঁড়িয়ে পুরোন দিনের গান গাইবে আর আপনি সেটাকে ইগনোর করতে বলছেন?

ম্যাডাম আপনি বুঝতে পারছেন না, ওর মাথার এইটি পার্সেন্ট খারাপ জিজ্ঞাসা করলে জবাব দেবে কিন্তু অন্যসময় নিজের মনে বিড়বিড় করবে, নিচু গলায় গান গাইবে আর পুরান দিনের রেফারেন্স দেবে।

এরকম একটা পাগল মানুষকে দিয়ে অফিসের কাজ হয়?

না, করতে বললে সব ভুল করে ফেলে, ফাইলে ছবি আঁকে।

আশ্চর্য। একে স্যাক করছে না কেন ডিপার্টমেন্ট?

কিছুটা হিউম্যানিটিরিয়ান গ্রাউন্ড কিছুটা সলিড গ্রাউন্ড পাওয়া যাচ্ছে না, তাই।

সলিড গ্রাউন্ড মানে?

ম্যাডাম, আমাদের ডিপার্টমেন্টে হাফ পাগল, থ্রিফোর্থ পাগল অনেক আছে। তাদের ফ্যামিলি এই ইনকামের ওপর নির্ভর করে। মাস আটেক আগে একজনকে সাসপেন্ড করা হয়েছিল। লোকটার মাথা খারাপ সবাই জানতাম, কাজকর্ম করত না। কিন্তু হঠাৎ তোয়ালে পরে অফিসে আসতে লাগল। চ্যালেঞ্জ করলে বলত কোথায় লেখা আছে। তোয়ালে পরে আসা চলবে না দেখাও। এইসব পাগলগুলো খুব সেয়ানা হয় ম্যাডাম। একদিন সি আই টি ভিজিট করতে এসেছিলেন এখানে। তাঁর চোখের সামনে পড়ে গেল তোয়ালে পরা অবস্থায়। তাই সাসপেন্ড হয়ে গেল।

দীপাবলী অবাক হয়ে কথাগুলো শুনছিল। এও কি সম্ভব? সে পবনের দিকে তাকাল। উদাসীন মুখে দাঁড়িয়ে আছে। এবার ওর মুখ চোখের দিকে তাকিয়ে মনে হল লোকটা স্বাভাবিক নয়। হঠাৎ যদি ক্ষেপে গিয়ে কিছু করে বসে? সরকারি কর্মচারিদের যে আচরণবিধি এবং চাকরির শর্তাবলী সরকার কাগজে কলমে লিখে রেখেছেন তাতে কি কোথাও আছে যে কেউ সিকি পাগল বা আধাপাগল হলে চাকরি করতে পারবে না? নাকি তাকে অসুস্থ বলে ঘোষণা করে চিকিৎসা করতে পাঠানো হবে? দীপাবলী সুপারভাইজারকে জিজ্ঞাসা করল, আপনি যে একে আমার ওয়ার্ডে পোস্টিং করেছেন, এতে আমার কি লাভ হবে?

কোন লাভ হবে না।

তবে?

আপনি স্বস্তিতে থাকতে পারবেন। এ কোন কাজে ঝামেলা করবে না। আমি শুনেছি রামবিলাসকে নিয়ে আপনি খুব ঝামেলায় ছিলেন।

কিন্তু এত জায়গা থাকতে আপনি একে আমার কাছে কেন দিলেন?

ও সার্ভে ওয়ার্ডে পোস্টেড ছিল। পদমর্যাদায় রামবিলাসের সমান। রামবিলাস ওখানে গেলে ওকে এখানে আসতেই হয় ম্যাডাম।

আপনি কি বলতে চাইছেন? আমার হেডপেশকার পাগল তিনি কোন কাজ করবেন। না। বাকি দুজনকে দিয়ে তিনজনের কাজ করাতে হবে। না, একে আমার দরকার নেই।

কিন্তু আপনাকে তো আমি অন্য কাউকে দিতে পারব না। লোক এমনি কম। আর অন্য আই টি ওরা তাঁদের স্টাফকে ছাড়বেন না। অফিসের ডিসিপ্লিন অনুযায়ী এই পবনকে আমি পোস্টিং দিতে বাধ্য।

কিন্তু আমি তো সি আই টিকে কমপ্লেন করতে পারি যে আমার ওয়ার্ডে একজন পাগলকে পোস্টিং দেওয়া হয়েছে।

নিশ্চয়ই পারেন ম্যাডাম। এতে ওকে সাসপেন্ড করা হবে। কিন্তু আপনি অন্যান্য স্টাফদের কাছে অপ্রিয় হয়ে যাবেন। তারা খারাপ ব্যবহার করবে।

আপনি আমাকে ভয় দেখাচ্ছেন?

না। সত্যি কথাটাই বলছি। একটা কথা চালু আছে, সরকারি চাকরিতে একমাত্র চুরি করে ধরা পড়লেই চাকরি যাওয়ার আশংকা থাকে নইলে কিছুতেই যাবে না। পবনকে সাসপেন্ড করলে ও বাড়িতে বসেই প্রতিমাসে অনেক টাকা পাবে। তিন চার বছর বাদে সাসপেন্সন উঠে গেলে একগাদা এরিয়ার পাবে।

সাসপেন্সন উঠে গেলে মানে?

ম্যাডাম। এই ডিপার্টমেন্টে ঘুষ নিয়ে হাতে হাতে ধরা পড়ায় সাসপেন্ড হওয়া কেও বছর তিনেক ধরে চলার পরে প্রমাণের অভাবে বাতিল হয়ে গিয়েছে। চার বছর বাদে পবন ভাল হয়ে গেলে কি করে প্রমাণ করা যাবে আজ ও পাগল ছিল।

দীপাবলী আবার পবনের দিকে তাকাল। হঠাৎ তার মাথায় একটা উদ্ভট চিন্তা এল। চিন্তাটা যে স্বাভাবিক নয় তা নিজেই বুঝতে পারছিল। সে গম্ভীর গলায় বলল, আপনি ওই চেয়ারে বসুন পবনবাবু।

পবন তাকাল। দীপাবলী দ্বিতীয়বার আদেশ করল। এবার পবন বিড়বিড় করল, কি ঝামেলা। তারপর নিতান্ত অনিচ্ছায় চেয়ার টেনে বসে পড়ল। সুপারভাইজার বললেন, আমি তাহলে চলি ম্যাডাম?

না, একটু বসুন। দীপাবলী পবনকে দেখল। মুখচোখে ক্লান্তির ছাপ স্পষ্ট। সে একটু মোলায়েম করে বলল, পবনবাবু আপনি কি কি কাজ জানেন?

পবন মুখ তুলল। চোখাচোখি হল কিন্তু জবাব দিল না।

দীপাবলী বলল, আপনি তো অনেকদিন কাজ করছেন ডিপার্টমেন্টে, এখন কোন কাজটা করতে আপনার ভাল লাগবে?

পবন চোখ বন্ধ করল। বোঝা যাচ্ছিল সে প্রচণ্ড ভাবছে।তারপর আচমকা মনে পড়ে গেছে এইভাবে বলল, রিফান্ড অডার।

সুপারভাইজার বললেন, হ্যাঁ, একসময় ও রিফান্ড অর্ডার লিখত। হাতের লেখাটা এখনও ভাল আছে।

বাঃ, খুব ভাল হল। ডিম্যান্ড নোটস চালান লিখতে পারবেন না? মাল দেবেন? আচমকা প্রশ্ন করল পবন।

সঙ্গে সঙ্গে কান ঝাঁ ঝাঁ করে উঠল দীপাবলীর। আর পবন সুর করে বলল, না, না, মাল না দিলে ওসব পাবেন না।

আপনি কি বলছেন? দীপাবলীর গলা চড়ায় উঠল। সেটা কানে যাওয়া মাত্র নেতিয়ে পড়ল পবন। তার মুখ দেখে বোঝার উপায় নেই সে একটু আগে কথাগুলো বলেছে। সুপারভাইজার হেসে ফেললেন, কিছু মনে করবেন না ম্যাডাম ও ইচ্ছে করে বলছে না। এতদিন যা শুনেছে তাই উগরে দিল।

শুনেছে মানে? ও আমার কাছে টাকা চাইছে?

আপনার কাছে নয়। আপনি যে অফিসার এটাই ওর খেয়ালে নেই।

আশ্চর্য! ও শুনেছে, মানে, সেকশনে বসে শুনে থাকতে পারে।

এখানকার অফিসে এত স্পষ্ট গলায় টাকা চাওয়া হয় নাকি?

সুপারভাইজার হঠাৎ স্থির হয়ে গেলেন। তারপর অন্যরকম স্বরে বললেন, কিছু মনে করবেন না ম্যাডাম, আমার প্রায় সাঁইত্রিশ বছর চাকরি হয়ে গেছে। আপনার চেয়ে বয়সে অনেক বড়। যদি অভিজ্ঞতার দাম দেন তাহলে কয়েকটা কথা বলতে পারি যা শুনলে আপনার কাজে লাগতে পারে।

বলুন। দীপাবলীর হঠাৎ মনে হল যেন সতীশবাবু তার সামনে বসে আছেন।

সুপারভাইজার বললেন, আপনার পেছন দিকে কি হচ্ছে তা ঘুরে চেয়ে দেখবেন না। পেছনে কে কি বলল তা শোনার প্রয়োজন নেই। আপনি যা করতে চান তা ভালভাবে করে যাবেন। আপনার চারপাশে যদি চোর জোচ্চোর থাকে তাহলে তাদের পাপ দূর করার দায়িত্ব আপনার নয়। এসব কথা বলছি বলে আপনি কিছু মনে করবেন না।

ঠিক আছে। কিন্তু একে নিয়ে আমি কি করব?

একটু আধটু কাজ দিন। রিফান্ড ভাউচার লেখান।

তাহলে আপনি আমার সেকসনে নিয়ে গিয়ে আর যাঁরা আছেন তাঁদের ব্যাপারটা বলে দিন। দীপাবলী অস্বস্তি নিয়ে বলল। সুপারভাইজার পবনকে নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন।

মিনিট দশেক বাদে সেকেন্ড পেশকার ঘরে এল। তার ভাব ভঙ্গীতে বেশ সঙ্কোচ। দীপাবলী জিজ্ঞাসা করল, কিছু বলবেন?

মাথা নাড়ল লোকটা, ম্যাডাম, পবনবাবুকে দিয়ে রিফান্ড ভাউচার লেখানো কি ঠিক হবে? ওটা খুব সিরিয়াস জিনিস।

তার মানে?

পার্টিরা ওটা নিয়ে ব্যাঙ্কে জমা দিলে টাকা পাবে। ফিগারে যদি ভুল করে ফেলে তাহলে গভর্নমেন্টের লোকসান।

দীপাবলীর মনে হল এই কথাগুলো বলার পেছনে লোকটার অন্যকোন উদ্দেশ্য আছে। সে বলল, কি করব, ওকে তো কাজ দিতে হবে।

না স্যার, ইয়ে ম্যাডাম, আমরা বেশী খেটে সব কাজ তুলে দেব। সার্ভে ওয়ার্ডে যেমন ছিল, আসত যেত কাজ করত না, তাই করতে অর্ডার দিন। ওকে কাজ করতে দিলে সব ভুট্টিনাশ করে দেবে।

লোকটা চলে গেল কথাগুলো বলে। বিকেল বেলায় পিওন নিয়ে এল কিছু ফাইল সই করাবার জন্যে, সেইসঙ্গে রিফান্ড অর্ডার। ফাইল মিলিয়ে চেকের অ্যামাউন্ট দেখছিল দীপাবলী। প্রথম দুটোয় কোন ভুল নেই। হাতের লেখাটিও খুব সুন্দর। অডারশিট, আই টি থার্টি এবং চেক বই-এ ঠিকঠাক এন্ট্রি করেছে লোকটা। পাগল হলেও এটুকুতে ঘাটতি নেই।

দেখে শুনে তৃতীয়টিতে সই করতে গিয়ে চমকে উঠল দীপাবলী। টাকার জায়গায় লেখা আছে শূন্য এবং অ্যাসেসির নামের লাইনে স্পষ্ট করে লেখা পবনের নাম। নিজের নামে সরকারি রিফান্ড ভাউচার লিখেছে লোকটা এবং টাকার পরিমাণ শূন্য। লোকটা ঠগ জোচ্চোর নয় এটা তার প্রমাণ কিন্তু পাগলামির প্রকৃষ্ট উদাহরণ। শুধু এটা দাখিল করতেই ওপরওয়ালা ওকে সাসপেন্ড করতে পারে। সে পবনকে ডেকে পাঠাল।

পবন এল। উদাসীন মুখ চোখ। প্রচণ্ড ধমকাল দীপাবলী। হঠাৎ পবন হাসতে লাগল, আপনার হবে।

হাঁ হয়ে গেল দীপাবলী, কি বলছেন আপনি?

ঠিক ধরেছেন, চোখ বন্ধ করে সই করেননি। অন্য আই টি ওদের মত। কত কি খেলা চলছে। চলুক।

আপনাকে সাসপেন্ড করতে পারি জানেন?

হাসতে লাগল, নেহি জী, পারবেন না। সাসপেণ্ডেড হয়ে বাড়িতে বসে সরকারের কাছ থেকে টাকা নেব বলে কত ধান্দা করলাম, হল না। এটা দেখে সি আই টি বলবে আমার মতলব খারাপ ছিল না কারণ অ্যামাউন্ট জিরো। মিসটেক। ওয়ান ফিফটি ফোর।

ভ্রূ কুঁচকে গেল দীপাবলীর, আপনি তো এসব কথা খুব সেন্সে বলছেন। একটুও পাগল বলে মনে হচ্ছে না।

একদম কাজ করতে ইচ্ছে করে না। অথচ টাকাটা দরকার। ব্যাস। আপনি আমাকে সাসপেন্ড করার ব্যবস্থা করুন, বেঁচে যাই। বলেই বিড়বিড় শুরু করল আবার। দীপাবলীর মুখ থেকে কথা সরছিল না। সে তৃতীয় রিফান্ড ভাউচারের ওপর কলম চালিয়ে বড় বড় করে লিখল, ক্যানসেলড্‌।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *