• Skip to main content
  • Skip to header right navigation
  • Skip to site footer

Bangla Library

Read Bengali Books Online (বাংলা বই পড়ুন)

  • নতুন সব বই
  • লেখক
  • সিরিজ
  • বইয়ের ধরণ
  • পুরানো সব ক্যাটাগরি
  • My Account →
  • নতুন সব বই
  • লেখক
  • সিরিজ
  • বইয়ের ধরণ
  • পুরানো সব ক্যাটাগরি
  • My Account →
  • বাংলা ডিকশনারি
  • বাংলা কৌতুক
  • বাংলা লিরিক
  • বাংলা রেসিপি
  • হেলথ টিপস এন্ড নিউজ

বাংলা নতুন/পুরাতন বইয়ের পিডিএফ ডাউনলোড/সন্ধান করতে আমাদের বাংলা পিফিএফ সাইটে ক্লিক করুন।

Bangla PDF

০৫. ঘুম এসেছিল অনেক রাত্রে

লাইব্রেরি » সমরেশ মজুমদার » সমরেশ মজুমদারের উপন্যাস সমগ্র » সাতকাহন (২য় পর্ব) - উপন্যাস - সমরেশ মজুমদার » ০৫. ঘুম এসেছিল অনেক রাত্রে

ঘুম এসেছিল অনেক রাত্রে। এমনিতেই এ বাড়িতে অদ্ভুত অদ্ভুত শব্দ বাজে রাত গড়ালে। গরমের হাত থেকে নিস্তার পেতেও সময় লাগে। ঘরে কেউ থাকলে ওইসব শব্দ উপেক্ষা করতে অসুবিধে হত না দীপাবলীর। কিন্তু এই রাত্রে হয়েছিল।

মাঝখানের দরজাটা বন্ধ করতে গিয়েও পারেনি। অনেক চেষ্টায় নিজেকে সরিয়ে এনেছিল। দরজা বন্ধ করা মানে নিজেকে দুৰ্বল প্রমাণ করা। অন্তত খোলা দরজায় একটা উপেক্ষার আবহাওয়া তৈরী করা যায়। কিন্তু পাশের ঘরে কেউ শুয়ে আছে, যার সঙ্গে কাঁচের সম্পর্ক ছাড়া এখন আর কিছু আপাতত অবশিষ্ট নেই, এটা ভাবলেই ঘুম চোখ থকে উধাও হয়ে যায়। চিন্তা হচ্ছিল তিরিকে নিয়েও। দেশলাই দিতে গিয়ে তিরি যে হেসেছিল তা সে এ ঘর থেকেও শুনতে পেয়েছে। মেয়েটাকে কখনও এমন কারণ অকারণে হাসতে শোনেনি। খাবার পরিবেশন করার সময় শমিত অকারণে বলেছিল, বা, তুমি তো চমৎকার রাঁধে। শোনামাত্র লজ্জায় এমন মুখের ভঙ্গি করেছিল যে দীপাবলী তাজ্জব হয়ে গিয়েছিল। তিরির রান্না আহামরি কিছু নয়। ভাল রান্না শেখার সুযোগও সে পায়নি। বরং এক ধরনের গ্রাম্য গন্ধ থাকে যা মাঝে মাঝে দীপাবলীর কাছেই বিরক্তিকর বলে মনে হয়। কিন্তু এখানে এটুকু কাজ পরিষ্কার করে করার জন্যে মেয়ে পাওয়া মুশকিল। সতীশবাবুকে বললে অনেকেই আসবে কিন্তু তাদের হাতে খেতে ইচ্ছেই হবে না। দীপাবলীর মনে। হয়েছিল শমিত গায়ে পড়ে নেহাত মন রাখতেই প্রশংসা করল। কোন সাধারণ নাটক দেখে শমিত কখনওই এমন কথা বলত না। মানসিকতার বদল কেন স্থান বিশেষে হবে? দীপাবলীর ধারণা হচ্ছিল, শমিত অনেক পালটে গিয়েছে।

কিন্তু রাতটা একসময় ঘুম জড়িয়েই কেটে গেল। স্নান করে তৈরী হয়ে সে যখন বাইরের ঘরে এল তখনও শমিত ঘুমাচ্ছে। বাইরে তখন সবে ভোর হচ্ছে। তাপ বাড়ার আগে পৃথিবীটা এই মুহূর্তে নিরোদ এবং সুন্দর। শমিত ঘুমাচ্ছে একেবারে ছেলেমানুষের মত, দুটো হাটু প্ৰায় বুকের কাছে নিয়ে এসে। দীপাবলী তিরিকে ডেকে বলল, দাদাবাবু উঠলে চা দিবি। আমি অফিসে যাচ্ছি।

শেষ কথাটা সম্ভবত কানে গিয়েছিল, ধড়মড়িয়ে উঠে বসল শমিত। জানলা দিয়ে বাইরেটা দেখে নিয়ে জিজ্ঞাসা করল, কটা বাজে?

এমন কিছু নয়। তুমি ঘুমাতে পারো। কিন্তু আমাকে এখনই অফিসে যেতে হবে।

এই সাতসকালে অফিস?

গরমের জন্যে নিয়মটা করা হয়েছে। দীপাবলী এক মুহূর্ত ভাবল, তোমার কোন দরকার আছে আমার কাছে?

দরকার? এক কথায় এর উত্তর দেওয়া যায়? হাসল শমিত।

ঠোঁট কামড়াতে গিয়ে সামলে নিল দীপাবলী, তোমার জেনে রাখা ভাল, আমার কোন দরকার নেই তোমার কাছে। আমি কাজে যাচ্ছি। দীপাবলী পাশের দরজা দিয়ে অফিস ঘরে চলে এল। ঘর অন্ধকার। সে জানলা খুলে বাইরের ঘরে চলে এল। সতীশবাবুদের এখনও আসার সময় হয়নি। মূল দরজাটা খুলে সিঁড়িতে এসে দাঁড়াল সে। আকাশে লালচে আভা পুরো মাত্রায় কিন্তু পৃথিবী ছায়ায় মাখামাখি। আহা, কি আরামের সময় এখন। এইরকম যদি সারাটা দিন থাকত কি ভালই না হত। সতীশবাবু বলেছেন শীতের সময় নাকি ঠাণ্ডাপ্ৰচণ্ড পড়ে এখানে। সে বরং ভাল।

আর এই শান্ত প্রকৃতির সামনে দাঁড়িয়ে দীপাবলীর মনে হল কাল সে শমিতকে নিয়ে একটা বাড়াবাড়ি ভাবনা করেছে। অন্তত তিরিকে জড়িয়ে ভাবনাটা বড় ছোট মনের পরিচয়। এমনটা সে ভাবল কি করে? মানুষের রাগ কখন যে কোথায় টেনে নামায়, নামবার আগে তা বোঝা যায় না। শমিত আর যাই হোক পড়াশুনা করা সুস্থ নাটকের জন্যে আন্দোলন করিয়ে ছেলে। তার রুচি কখনই অমন স্তরে নামবে না। ভাবনাটা ভেবেছিল বলেই এখন লজ্জিত হল সে।

এইসময় বাবুদের আসতে দেখা গেল। দীপাবলীর মনে পড়ল সতীশবাবুর বাড়িতে অনুষ্ঠানের কথা। কাজের চাপে একদম মনেই ছিল না তার। সে ঠিক করল, এখন কিছু বলবে না, আজ রাত্রে একাই ওঁর বাড়িতে গিয়ে অবাক করে দেবে।

ম্যাডাম, আপনি এখানে? অক্ষয়বাবু জিজ্ঞাসা করলেন।

ইচ্ছে হল এখানে দাঁড়াতে।

শীতকালে রোদ উঠলে এখানে দাঁড়াতে দেখবেন খুব ভাল লাগবে।

সতীশবাবু আসেননি?

না তো! ওঁর বাড়িতে লোকজন আছে, হয়তো দেরিতে আসবেন।

দীপাবলী কিছুতেই মনে করতে পারছিল না অনুষ্ঠান কবে ছিল, গতকাল না আজ? যদি গতকাল হয়ে যায় তা হলে এদের প্রশ্ন করলে অপ্রস্তুত হতে হবে। সে অফিসে ফিরে এসে

অক্ষয়বাবুকে ডেকে পাঠাবে। সতীশবাবুর পরেই অক্ষয়বাবুর অবস্থান।

অক্ষয়বাবু, শুনেছেন নিশ্চয়ই, গতকাল মন্ত্রী এসে নেখালির অবস্থা দেখে গিয়েছেন। আমাদের আজই একটা কাজ করতে হবে। আমাদের ব্লকে যে কয়েকটা গ্রাম আছে তার একটা লিস্ট করে গ্রামপিছু তিনটে কুয়ো আর দুটো নলকূপ বসানোর খরচের একটা এস্টিমেট তৈরী করুন। আমি আজই পাঠাতে চাই, মন্ত্রীর সঙ্গে দেখা হয়েছে।

অক্ষয়বাবু ঘাড় নাড়লেন, ঠিক আছে, ম্যাডাম, একটা কথা।

বলুন।

দুটো আর্জি ছিল। আমাদের এখানেও, মানে অফিসে আর আমাদের পাড়ায় দুটো নলকূপ ওর সঙ্গে জুড়ে দিই। আমাদেরও তো জলের সমস্যা হচ্ছে। আমাদের এখানেও তো সবসময় জল পাওয়া যায় না।

দীপাবলী একটু চিন্তা করল। অনুরোধটা অত্যন্ত সঙ্গত। কিন্তু ওপরওয়ালা যদি মনে করে সে সুবিধে পেয়ে নিজেদের আরাম দেখছে তা হলে কথা উঠবে। উঠুক। এঁরা কাজ করবেন আর একটু আরামে থাকবেন না, তা কি করে হয়?

মাথা নাড়ল, ঠিক আছে, সব শেষে দেবেন। দ্বিতীয়টা কি বলছিলেন? অক্ষয়বাবু বললেন, এদিকে তো ইলেকট্রিক কবে আসবে কে জানে। অথচ মাত্র পাঁচ ক্রোশ দূরে ইলেকট্রিক রয়েছে। যদি লাইন টেনে আনা যায়?

পাঁচ ক্ৰোশ? হতভম্ব দীপাবলী, পাঁচ ক্ৰোশ লাইন করতে কত লাগবে জানেন? এত খরচ সরকার করবে? পাগল!

ওই পাঁচ ক্রোশ দূর পর্যন্ত আনতে অনেক ক্রোশ ডিঙোতে হয়েছিল তো!

কথাটা বোধগম্য হওয়ামাত্র থমকে গেল দীপাবলী। কিছুদিন আগে একটি সরকারি সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বাংলাদেশের যতটা অঞ্চলে সম্ভব হবে বিদ্যুৎ নিয়ে যাওয়া যাবে। সিদ্ধান্ত আর কাজ অবশ্য একসঙ্গে হচ্ছে না। এই অঞ্চলে ইলেকট্রিক এলে অনেক সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। অন্তত পাম্প চালিয়ে জল তোলা যাবে। পাঁচ ক্রোশ দূরত্ব সে ভেবেছিল নিজের অর্থনৈতিক অবস্থার মাপকাঠিতে, চমকে উঠেছিল সেই কারণে। সরকারের কাছে ব্যাপারটা কিছু নয় বরং কর্তব্যের পর্যায়ে পড়ে। বাজেট অনুমোদন করলে সবই করা সম্ভব। সে বলল, ঠিক আছে, দুটো আলাদা প্রোপোজাল করুন। একটার জন্যে দ্বিতীয়টা আবার বানচাল না হয়ে যায়।

ঠিক আছে ম্যাডাম। অক্ষয়ববু চলে গেলেন।

এই ঘরে বসেই দীপাবলী শুনতে পাচ্ছিল অফিসঘরে উত্তেজনা চলছে। খোদ বিভাগীয় মন্ত্রী এই অফিসে এসে একটা দুপুর কাটিয়েছেন এটা যেন স্বপ্নের মত ব্যাপার। অনেকেই এর পর কি কি ভাল কাজ এই অঞ্চলে হবে তার আনুমানিক ফিরিস্তি দিচ্ছিল। ফাইলপত্ৰ ঘাঁটতে ঘাঁটতে দীপাবলীর হঠাৎ অস্বস্তি হল। সতীশবাবু এখনও আসছেন না কেন? ভদ্রলোক জ্বর গায়েও নাকি অফিস করেন। তিনি নিজেই বলেছেন বাড়িতে কাজ থাকলেও তিনি অফিসে আসবেন। অথচ ভদ্রলোক এলেন না।

শেষপর্যন্ত অক্ষয়বাবুকে ডেকে সে জিজ্ঞাসা করল। অক্ষয়বাবু বললেন, আপনাকে বলে যেতে সময় পাননি বোধ হয়, উনি শহরে গিয়েছে স্ত্রীকে নিয়ে।

স্ত্রীকে নিয়ে? কেন?

কাল সন্ধের পর ওঁর স্ত্রীর বুকে ব্যথা শুরু হয়। রাত্রে খুব বেড়ে যায়। আমাদের এখানে তো ডাক্তার নেই। তাই মাঝরাত্রে গরুর গাড়ি যোগাড় করে স্ত্রীকে নিয়ে গিয়েছেন শহরের হাসপাতালে।

গরুর গাড়ি?

তা ছাড়া আর যাওয়ার কোন ব্যবস্থা ছিল না। আমরা বলেছিলাম সকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে। অৰ্জুনবাবুর কাছে গেলে জিপের ব্যবস্থা হত কিন্তু তিনি রাজি হলেন না। অতক্ষণে বিনা চিকিৎসায় যদি কিছু হয়ে যায়।

তা তখনই অৰ্জুনবাবুর কাছে গেলেন না কেন?

অক্ষয়বাবু মুখ নিচু করেছিলেন, যাওয়া হয়েছিল। উনি রওনা হবার পরই কয়েকজন ছুটে গিয়েছিল সাইকেল নিয়ে জিপ পেলে মাইলখানেকের মধ্যেই ওঁদের ধরা ফেলা যেত।

উনি জিপ দিলেন না?

না। তা নয়। উনি বলে দিলেন দুজন মহিলাকে পৌঁছে দিতে হবে খুব ভোরে আগে এই কড়ারে তারা এসেছে অতএব তিনি জিপ শহরে পাঠাতে পারবেন না।

মহিলাকে?

হাঁ ম্যাডাম। ওর এসব অভ্যেসের কথা তো সবাই জানে। উনি নিজেও আজকাল রাখঢাক করেন না। এমন বেপরোয়া লোক বড় একটা দেখা যায় না।

ঠিক আছে, আপনি কাজটা শেষ করুন। দীপাবলী মুখ ফেরাল। অক্ষয়বাবু চলে যেতে ঝিম মেরে বসে রইল সে কিছুক্ষণ। অর্জুন গত রাত্রে এখানে এসেছিল। তার নিশ্চয়ই একাধিক জিপ নেই। তা হলে ওই জিপে দুটি মহিলাকে একত্রের জন্যে আনিয়ে সে তার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল। কিন্তু তাই বা কি করে হবে? অর্জুন মন্ত্রীকে পৌঁছে দিয়ে ফিরে আসতেই তো ওর চেয়ে বেশি সময় লাগার কথা। তা হলে ওই সব মেয়েরা নিজেদের ব্যবস্থায় এসেছে অর্জুনের কাছে। লোকটা এতখানি হৃদয়শূন্য যে একজন মারাত্মক অসুস্থ মানুষের কথা শুনেও নিজের জিপ দিয়ে সাহায্য করতে রাজি হয়নি। তার চেয়ে সেই সব মেয়েদের পৌঁছে দেওয়া বড় হয়েছিল? দীপাবলী স্থির করল কোন অবস্থাতেই ওই লম্পট মানুষটাকে সে সাহায্য করবে না। যতই সে মন্ত্রীর অনুগ্রহ পাক।

অফিসে বসার পর শমিতের কথা একদম ভুলে ছিল দীপাবলী। এর মধ্যে এক ফাঁকে তিরি এসে চা দিয়ে গিয়েছে। তখনও না। নটা নাগাদ জলখাবার দিতে এলে খেয়াল হল। সে জিজ্ঞাসা করল, দাদাবাবু কোথায় রে?

উনি তো সেই চা খেয়ে বেরিয়ে গেছেন ঝোলা নিয়ে।

ঝোলা নিয়ে? চমকে উঠল দীপাবলী, সুটকেস?

না। তিরি ঘন ঘন মাথা নাড়ল, সুটকেস আছে। আমি জিজ্ঞাসা করলাম জলখাবার খাবে কি না তো বলল,না। দুপুরে এলে ভাত খাবে। না এলে সেই ভাত রাত্রে। কি গম্ভীর হয়ে কথা বলছিল দিদি।

ঠিক আছে, তুই ভেতরে যা। শমিত সুটকেস নিয়ে যায়নি শুনে কেন জানে না তার বেশ স্বস্তি হল। এসব জায়গায় বাইরের লোক বড় একটা আসে না। আর গ্রামের দিকে তো নয়ই। তিনটে নির্বাচন হয়ে গিয়েছে তবু ভোটের জন্যেও কেউ প্রচার করতে যায়নি গ্রামে। অতএব ওরা শমিতকে কিভাবে নেবে তা ঈশ্বরই জানেন।

দশটায় ছুটি হবার মুখে একটা জিপের আওয়াজ শুনতে পেল সে। তার মুখ গম্ভীর হল। অকারণে অর্জুন নায়েককে সে এখানে বসতে দেবে না। কিন্তু খানিক বাদেই অক্ষয়বাবু এসে জানালেন, থানার দারোগাবাবু এসেছেন।

নিয়ে আসুন। তৎক্ষণাৎ গত রাত্রে শোনা অর্জুনের কথাগুলো মনে পড়ল। সে শক্ত হল। এইটে এখনও তার অভ্যেসে রয়ে গেল। যা অপছন্দের তার মুখোমুখি হবার মুহূর্তে শরীরে কেমন কাঠ কাঠ ভাব এসে যায়।

বিশাল ভূঁড়ি বেল্টের বাঁধনে থাকতে চাইছে না, চোখের তলায় কমলালেবুর কোয়ার মত মাংসের ঢিবি, মাথায় টাক, বগলে টুপি এবং হাতে লাঠি নিয়ে দারোগাবাবু প্রবেশ করে অনেকটা ঝুঁকে নমস্কার করলেন, গুড মর্নিং ম্যাডাম। আমাকে চিনতে পারছেন?

অবশ্যই। বসুন। গম্ভীর হতে চেষ্টা করল দীপাবলী।

চেয়ার টানলেন দারোগা শব্দ করেই। করে বসলেন, আমার উচিত ছিল অনেক আগেই এখানে এসে আপনার সঙ্গে দেখা করা। কিন্তু থানাটা এমন যে সমস্যা ছাড়া একটাও দিন কাটে না। আর আপনি যখন আমাকে ডেকে পাঠান না তখন বোঝা গেছে এখানে ঝামেলা নেই।

তা নেই কিন্তু আপনার আর আমার নিয়মিত যোগাযোগ রাখা কর্তব্য এবং সেটার দায়িত্ব আপনারই। যাক গে, কেন এসেছেন জানতে পারি?

না, তেমন কিছু না, কাটসি কল আর কি। কোন প্রব্লেম নেই তো?

থাকলে তো আপনি জানতে পারতেন।

হেঁ হেঁ, তা ঠিক। এস ডি ও সাহেব কিন্তু আমাকে খুব ভালবাসেন।

উনি তো আপনার থেকে বয়সে অনেক ছোট।

তা হোক, পজিশনে তো বড়।

দারোগাবাবু, কাল সারাদিন আপনি কোথায় ছিলেন?

ওই কথাটা বলতেই তো আপনার কাছে রোদ ভেঙে এলাম।

রোদ ভেঙে মানে?

আঃ, এখানে দিন হল ঘুমানোর জন্যে আর রাত কাজের। যা শালা, সরি, গরম, দিনে কাজ করবে কে? আমি সারারাত কাজ করি আর দিনটাকে রাতের মত ভেবে নিই। এতে ম্যাডাম বেশি কাজ করা যায়।

কিন্তু কাল দুপুরে আপনি থানায় ছিলেন?

কি করে থাকব বলুন? সবে বডিটা বিছানায় ফেলেছি অমনি মনে পড়ল ঝামেলা অছে। কর্তব্যে গাফিলতি পাবেন না, ছুটে গেলাম।

মন্ত্রীমশাই আমার এখানে এসে নেখালিতে গিয়েছিলেন। ওঁর সঙ্গে শহর থেকে আনা মাত্র তিনচারটে সেপাই ছিল।

ম্যাডাম, একথা শুনে আমি লজ্জায় মরে গিয়েছি। কাল থানায় ফিরেই খবরটা শুনে ছুটে এলাম, ততক্ষণে মন্ত্রীমশাই চলে গিয়েছেন। রাত্রে এস ডি ওর কাছে গেলাম। তিনি বললেন আপনার সঙ্গে কথা বলতে।

এস ডি ও বললেন আমার সঙ্গে কথা বলতে?

আজ্ঞে হ্যাঁ ম্যাডাম। হঠাৎ দারোগাবাবুর গলা ভেঙে মিহি সুর বেরিয়ে আসতে লাগল, আমার সার্ভিস বুক দেখুন, কোথায় একটা কালো দাগ দেখতে পাবেন না। স্বাধীন ভারতবের্ষর সব এস পি অমাকে ভাল সি সি রোল দিয়েছেন। কিন্তু মন্ত্রী যদি খচে যান তা হলে সব দফা রফা হয়ে যাবে।

আপনি কি বলতে এসেছেন?

ম্যাডাম, আপনি আমায় বাঁচান। পাঁচটা মেয়ে আমার, বউটার বয়স কুড়ি, লেট ম্যারেজ, এক বছর বাকি আছে রিটায়ারমেন্টের। এখন চাকরি গেলে ধনেপ্রাণে মরব। মেয়ে পাঁচটার বিয়ে এ জীবনে হবে না। মেয়ে হয়ে মেয়েদের বাঁচান।

আপনি আপনার কথা বলছিলেন।

আমি মানেই আমার মেয়েরা, আমার স্ত্রী।

আমি কিভাবে আপনাকে বাঁচাতে পারি?

শুনলাম নাকি মন্ত্রীমশাই আপনার বাড়িতে ভাত খেয়েছেন, আপনার কথায় তিনি নেখালিতে গিয়েছিলেন। ওঃ, যদি কিছু গোলমাল হত? আমি ভাবতেই পারি না। তাই আপনি যদি কে বুঝিয়ে বলেন তা হলে আর আমার কোন ক্ষতি হবে না।

শুনুন আপনি ঠিক শোনেননি। মন্ত্রীমশাই ডি এম, এস ডি ও-কে জিপ থেকে নামিয়ে দিয়ে অৰ্জুন নায়েকের সঙ্গে শহরে গিয়েছিলেন। আপনি বরং অর্জুনের সঙ্গে যান তাতে কাজ হবে। দীপাবলীর এখন কথা বলতে অসুবিধে হচ্ছে না।

অৰ্জুন। শালা হারামির হাতবাক্স! সরি ম্যাডাম, মুখ ফসকে বেরিয়ে এল। দিনরাত চোরডাকাত ঠ্যাঙাই তো, মুখের উপর কন্ট্রোল হারিয়ে ফেলেছি। ডোন্ট মাইন্ড। যাহোক অৰ্জ্জুনের কাছে গেলে বলবে, তোমাকে আমি বাঁচাতে পারি একটা কণ্ডিশনে। যতদিন বেঁচে থাকবে ততদিন যা মাইনে পাবে তার ওয়ান ফিফথ আমাকে পাঠিয়ে দেবে।

ওয়ান ফিফথ কেন?

তার নিচে রাজি হবে না।

কিছু মনে করবেন না আপনার বাড়তি রোজগার নিশ্চয়ই আছে?

জলে আছি অথচ সাঁতার জানি না বলা মিথ্যে কথা হয়ে যাবে। তা আছে। কিন্তু এলাকাটা তো দেখছেন! একেবারে মরুভূমি যাকে বলে! বাড়তি রোজগার হবে কোত্থেকে?

আপনি সত্যি কথা বলছেন না।

সেন্ট পার্সেন্ট সত্যি।

ঠিক আছে, মন্ত্রী তো সবে গিয়েছেন, যেতে যেতে এসব ভুলেও যেতে পারেন। আপনি আগে থাকতেই এত চিন্তা কেন করছেন?

ঘর পোড়া গরু ম্যাডাম, মেঘ দেখলেই ভয় পাই।

তা হলে শুনুন, আমি কিছুই করতে পারব না।

পারবেন না? ফ্যাসফেসে শোনাল দারোগার গলা।

না। আর কিছু বলার আছে আপনার? দীপাবলী উঠে দাঁড়াল।

ম্যাডাম আমি একদম মরে যাব। ককিয়ে উঠলেন দারোগা।

আপনি এস ডি ও কিংবা ডি এমের সঙ্গে দেখা করুন। আমার মত সামান্য একজন কর্মচারী কিছুই করতে পারে না। এবার আপনি যেতে পারেন।

ম্যাডাম, আমি জানি কিসে আমার উপকার হবে। ঠিক আছে, আপনাকে একটা প্রস্তাব দিচ্ছি। আপনি পুরুষ হলে অবশ্যই আগেই দিতাম। আপনি আমাকে এ যাত্রায় বাঁচিয়ে দিন আপনার ব্যাপারটা আমি দেখব। দারোগা উঠে দাঁড়াল।

আমার ব্যাপারটা মানে? চকিতে ঘাড় ঘোরাল দীপাবলী।

মানে, ইয়ে, বুঝতেই পারছেন, ওই যে তখন জিজ্ঞাসা করলেন বাড়তি রোজগারের কথা, হয় না, খুব বেশী হয় না, তবু যা হয়—হেঁ হেঁ, বুঝতেই পারছেন?

আপনি আমার অফিস থেকে বেরিয়ে যান, এখনই।

ম্যাডাম।

আপনি এই মুহূর্তে চলে না গেলে আপনার নামে রিপোর্ট করতে বাধ্য হব।

ও, আচ্ছা। আমি মনে রাখব ব্যাপারটা। কটমট চোখে তাকিয়ে দারোগা বেরিয়ে গেলেন। সমস্ত শরীরটা কাঁপছিল দীপাবলীর। এমনভাবে অপমানিত হতে হবে সে ভাবতেই পারেনি। লোকটার স্পৰ্ধার কথা ভেবে শরীর জ্বলে যাচ্ছিল।

দারোগার জিপ চলে যাওয়ামাত্র অক্ষয়বাবুরা ছুটে এলেন। অক্ষয়বাবু দীপাবলীর সামনে বাকিরা দরজায়। অক্ষয়বাবু উত্তেজিত হয়ে বললেন, ম্যাডাম, আপনি এখনই মন্ত্রীকে মানে ডি এমকে জানান। লোকটাকে বিশ্বাস করবেন না।

কেন? এঁদের উত্তেজনা দেখে অবাক হল দীপাবলী।

লোকটা কেউটে সাপের চেয়েও ভয়ঙ্কর। একমাত্র অর্জুন নায়েকের কাছেই ঠাণ্ডা থাকে। ও বুঝে গিয়েছে আপনাকে ভেজানো যাবে না, এবার ঠিক আপনার ক্ষতি করবে।

আমার ক্ষতি? ওঁর তো আমার নির্দেশ মেনে কাজ করার কথা।

ম্যাডাম কথা কি সবসময় পালিত হয়। তা ছাড়া এমন জায়গায় কিছু হয়ে গেলে আমাদের পক্ষে সামলানো সম্ভব হবে না। ও কিছু করে ওঠার আগেই ব্যবস্থা নিন।

আপনারা মিছিমিছি ব্যস্ত হচ্ছেন। এটা আমার ওপর ছেড়ে দিন। যান, সময় হয়ে গেছে, রোদও চড়া হচ্ছে, এর পরে বাড়িতে যেতে অসুবিধে হবে। ও হ্যাঁ, অক্ষয়বাবু, এস্টিমেটের ফাইলটা হয়ে গিয়েছে?

হ্যাঁ ম্যাডাম, দিয়ে যাচ্ছি। মুখ গম্ভীর করে ওরা সামনে থেকে সরে গেলেও পাশের ঘরে এই নিয়ে যে গুঞ্জন হচ্ছে তা কানে এল। দীপাবলী ভেবে পাচ্ছিল না তার কোন ক্ষতি দারোগা করতে পারে। একজন সরকারি অফিসার আর একজন সরকারি অফিসারকে বিপদে ফেলার সাহস পাবে কি করে! অক্ষয়বাবু ফাইলটা দিয়ে গেলে সে তাতে চোখ রাখল। মোটামুটি ঠিকই আছে। একটা শব্দ জুড়ল সে। সতীশবাবু থাকলে এটাও করতে হত না। রিপোর্ট এবং আর্জির নিচে সই করে সে ফাইলটা নিয়েই ভেতরে চলে এল। পিওন দাঁড়িয়েছিল তার যাওয়ার অপেক্ষায়। এবার সে বাইরের দরজা এবং জানলা বন্ধ করবে। দীপাবলী তাকে বলল, আমি দুপুরের পর এস ডি ও অফিসে যাব। অক্ষয়বাবুকে বলো সন্ধে পর্যন্ত আমার জন্যে অপেক্ষা করতে।

বেলা সাড়ে বারোটাতেও শমিত ফিরল না। সে ফিরলে একসঙ্গে খাবে ভেবেছিল দীপাবলী। অবশ্য এখন যা রোদ বাইরে, তাতে কোন পাগলও ছাতি ছাড়া হাঁটতে চাইবে। না। দীপাবলীর মনে হল শমিত যদি কোন ছায়ার নিচে থাকে তা হলে তার একবেলা অভুক্ত হয়ে থাকাও ঢের ভাল কিন্তু এই রোদে আসার অ্যাডভেঞ্চার করা ঠিক নয়।

সে তিরিকে খেতে দিতে বলল। তিরি বেশ অবাক হয়ে বলল, দাদাবস্তু আসেনি, তুমি এখনই খেয়ে নেবে?

দাদাবাবু এই রোদে আসবে না। তা ছাড়া আমাকে একটু বাদে বেরুতে হবে।

তুমি এই রোদে বেরুবে?

থমকে গেল দীপাবলী। দাদাবাবু না আসতে পারলে সে নিজে কি করে যাবে। ঠিক কথা। অথচ এটাই তার মাথায় আসেনি। অতএব সে তিরিকে আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে বলল। জানলা দরজা বন্ধ। তিরি কিছুক্ষণ ঘর বারান্দা করল। তারপর বলল, দাদাবাবু জিজ্ঞাসা করল আমি কোন গ্রামের কথা জানি কি না। দাদাবাবু সেখানে গিয়ে আলাপ করবে। আমি আমার গ্রামের কথা বললাম। দাদাবাবু অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করল আমাদের গ্রামে সবাই এমন বাংলা বলে কি না। আমি তো হেসে বাঁচি না। বললাম গ্রামের লোক গ্রামের ভাষায় কথা বলে। আমি তো ছোট্টবেলা থেকে এদিকে আসি আর তার ওপর বাবুদের কাছে কাজ করছি তাই আমি এমন বাংলা বলতে পারি। তাই শুনে দাদাবাবু বলল। আমি যদি ওকে নিয়ে গিয়ে গ্রামের লোকের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিই তা হলে খুব ভাল হয়। আমি যে গ্রামে যাব না তা তো বলতে পারি না তাই মিছে করে বললাম তুমি রাগ করবে গ্রামে গেলে।

দীপাবলী কিছু বলল না। শুধু তার মনে হল এইসব কথা শমিত তার সঙ্গে আলোচনা করতে পারত। সে ইচ্ছে করলে পিওনকে সঙ্গে দিতে পারত। একটু বাদে বারান্দা থেকে ঘুরে এসে তিরি জিজ্ঞাসা করল, আচ্ছা দিদি, দাদাবাবু কি যাত্রা করে?

যাত্ৰা? চমকে গেল দীপাবলী।

ওই যে মুখে রঙ মেখে রাম রাবণ সাজে।

তোকে কি বলেছে ও?

না, বলল, তিরি তোমার মত একটা মেয়েকে যদি কলকাতায় পেতাম তা হলে এমন মানাতো না আমার চরিত্রটার সঙ্গে, আহা! একটু অভিনয় করতে পারলেই হত?

তুই কি বললি?

আমি আবার কি বলব! শুনেই গলা শুকিয়ে কাঠ।

তা গিয়েই দ্যাখ না। এই দাদাবাবু খুব বড় পরিচালক। গাধা পিটিয়ে ঘোড়া বানিয়ে নেয়। তোকেও ঠিক অভিনেত্রী বানিয়ে দেবে। দীপাবলী হাসল।

অভিনেত্রী? তিরি অবাক হয়ে তাকাল।

তুই সিনেমা দেখিসনি?

একবার এখনে পর্দা খাটিয়ে সিনেমা দেখিয়েছিল।

সেই সিনেমায় যেসব মেয়েরা কথা বলে তারা অভিনেত্রী। সবাই খুব খাতির করে, অনেক টাকা পায়।

না বাবা।

কেন? দীপাবলীর খুব মজা লাগছিল।

খারাপ খারাপ মেয়েরা ওসব কাজ করে।

হে হে করে হেসে উঠল দীপাবলী এবং তার পরেই গম্ভীর হয়ে গেল, শোন, খুব দরকার না হলে দাদাবাবুর সঙ্গে কথাবার্তা বলার দরকার নেই।

কেন? খুব অবাক হয়ে গেল তিরি।

থমকে গেল দীপাবলী। এই কথাগুলো সে প্রায় অসাড়ে বলেছে। বলার আগে ভাবেনি। এখন মনে হল না বললেই ভাল ছিল। তিরি তার দিকে এখনও তাকিয়ে আছে। অতএব তাকে বলতেই হল, দাদাবাবুর মাথার ঠিক নেই। এই আমকেই ধরে অভিনয় করাতে চেয়েছিল। তুই এখানকার মেয়ে। তোর ওসবে দরকার নেই।

তিরির মুখ সহজ হল, দীপাবলী হাঁফ ছেড়ে বাঁচল।

তিনটে বাজল। রোদ তখনও সমানে তেজী। কিন্তু আর দেরি করা সম্ভব নয়। আধঘণ্টা আগে খাওয়া শেষ করেছে দীপাবলী। এস ডি ও-র অফিস থেকে ঘুরে আসতে গেলে এখনই রওনা হওয়া দরকার। আজই যদি নেখালির এবং আশেপাশের গ্রামের কুয়ো এবং নলকূপের এস্টিমেট গ্রু প্রপার চ্যানেল পাঠানো যায় তা হলে কাজ হতে বেশি দেরি হবে না। তবু আরও একটু নিশ্চিত হবার জন্যেই দীপাবলী ঠিক করলে এস ডি ওকে বলেই একটা অ্যাডভান্স কপি সে পাঠাবে মন্ত্রীর কাছে। লাল ফিতের বাঁধন টপকে থু প্রপার চ্যানেলের চিঠিটা পৌছবার আগেই তাতে বেশি কাজ হবে।

ছাতা নিয়ে বেরুবার আগে সে তিরিকে পই পই করে বলে গেল শমিত এলে খাবার দিতে। সে রাত আটটার মধ্যেই ফিরবে। লাস্ট বাট ওয়ান বাসটা ওই সময়ের মধ্যেই এখান দিয়ে ফিরে যায়। মাথার ওপরে ছাতি থাকা সত্ত্বেও হাঁটাটা সহজ হচ্ছে না। পা এর মধ্যেই জ্বলতে শুরু করেছে। গরম হলকা লাগছে শরীরে। বাড়ি বা অফিস থেকে মিনিট আটেক হাঁটার পর বাস রাস্তা। এদিকের বাসের একটাই গুণ বা দোষ হল হাত দেখালেই দাঁড়িয়ে যায়। তার ওপর মহিলা হলে কথাই নেই। স্ট্যান্ডে গিয়ে দাঁড়াবার প্রয়োজন হয় না। দীপাবলীর প্রায়ই মনে হয় তার অফিসে যদি একটা গাড়ি থাকত তা হলে কাজের খুব সুবিধে হত। ছেলে হলে সাইকেল চেপে অনেক জায়গায় যাওয়া যায়। মাঝে মাঝেই মনে হয় সরকারি গাড়ি পাওয়ার যখন কোন সম্ভাবনাই নেই তখন সাইকেলটা যদি শিখে নিতে পারে মন্দ হয় না। চা বাগানে থাকতে বেশ কয়েকবার অমরনাথের সাইকেল নিয়ে চেষ্টা করেছিল বিয়ের আগেই। সাইকেলটা সেই বয়সের তুলনায় বড্ড ভারী ছিল। আর বিয়ে এবং বিধবা হবার পর তো জীবনযাত্রাই পালটে গেল।

জীবনযাত্রা শব্দটা মনে হতেই হাসি এল। মানুষ যেভাবে জীবনযাপন করে তাই তার জীবনযাত্রা। একের সঙ্গে অন্যের যেমন মিল নেই তেমনি একের এখনকার সঙ্গে আগামীকালের কোন সাদৃশ্য থাকবে এমন কোনও কথাও নেই। আজকাল মনের ভেতরে এক ধরনের সুখ বুদ্বুদ তোলে, সে নিজের জীবনের অবশ্যম্ভাবী চেহারাটা বদলে ফেলতে পেরেছে।

দুপুরের বাসে ভিড় সামান্য কম থাকে। তাকে দেখে কন্ডাক্টর যে সুবিধে করে দিল তা আজ চুপচাপ গ্রহণ করল দীপাবলী। প্রতিবাদ করে লাভ নেই। তা ছাড়া এই গরমে ভিড়ে প্রতিবাদ করে জেদ ধরে থাকলে অসুস্থ হবার সম্ভাবনাই বেশি। বাসের জানলা তাপের হাত থেকে বাঁচাবার জন্যে এমনিতেই বন্ধ রাখা হয়েছে। বসা অবস্থাতেও কুলকুল করে ঘামতে লাগল সে। বিবেকের ব্যাপারটাই যেন গলে গলে পড়ছিল।

রিকশা নিয়ে এস ডি ওর অফিসে পৌঁছে সে শুনতে পেল ভদ্রলোক ডি এমের কাছে গিয়েছেন। অফিসে কাগজপত্র জমা দিয়ে সে প্রধান কেরানিকে বারংবার অনুরোধ করল যাতে কালকেই কাগজপত্র এস ডি ও নোট দিয়ে পাঠিয়ে দেন ওপরতলায়। কাগজে একবার চোখ বুলিয়ে প্রধান কেরানি অবাক চোখে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, এসবের কথা সাধে জানেন?

হ্যাঁ। মন্ত্রীমশাই যখন নেখালিতে গিয়েছিলেন তখন উনি তো সঙ্গে ছিলেন।

আহা, তারপর কি ওঁর সঙ্গে আলাদা করে কথা বলেছেন?

না। আলাদা কথা বলতে হবে কেন?

বৃদ্ধ ভদ্রলোক মাথা নাড়লেন, তা হলে এটা পাস হবে না।

মানে? মন্ত্রী আমাকে নিজে বলে গিয়েছেন। উত্তেজিত হল দীপাবলী।

অনেক বছর কাজ করছি দিদি, আমার কথা আপনি শুনে রাখুন, ওঁর সঙ্গে কথা না বলে আপনি পাঠালে তা ওপরতলা থেকে পাস হবে না। মাথা নাড়লেন ভদ্রলোক।

আপনি একথা বলছেন কেন?

আপনি যে এস্টিমেট দিয়েছেন, এই যে এতগুলো কয়ো খুঁড়তে এত লাগবে, এতগুলো নলকূপের জন্যে এত, এগুলো তো উনি সার্টিফাই করবেন, তাই না?

হ্যাঁ, নিশ্চয়ই। এসবে একটুও বাড়ানো রেট নেই।

সেটা তো উনি যাচাই না করে বুঝবেন না। যাচাই করতে হলেই আমায় ডেকে বলবেন, হরিহরবাবু একটু বাজারে ঘুরে দেখুন তো।

তাতে অসুবিধে কি হল?

ওঃ, আপনি দেখছি কিছুই বোঝেন না। ওসব করতে গেলে টাইম লাগবে। কাল পাঠানো যাবে না। আবার সাতদিন ধরে দেখার পর আপনার দেওয়া রেটের সঙ্গে একমত নাও হতে পারেন সাহেব। তাই বলছি কি, অনেক টাকার ব্যাপার তো, একবার সাহেবের সঙ্গে কথা বলে নিন, কাল সকালেই সদরে পাঠিয়ে দেব।

অতএব এস ডি ওর সঙ্গে দেখা না করে ফেরার কোন উপায় নেই। অবশ্য এখনও হাতে অনেক সময় আছে। প্রধান কেরানি আশ্বাস দিলেন ভদ্রলোক বিকেলের মধ্যেই ফিরবেন। সে একটু ঘুরে আসছে বলে অফিস থেকে বের হল। বাসের জন্যে অন্তত দু ঘন্টা অপেক্ষা করা যায়। দীপাবলী একটা রিকশা নিয়ে সোজা হাসপাতালে চলে এল। মফস্বলের হাসপাতাল, তার ওপর সাব ডিভিশন শহরের। চেহারা দেখেই ভক্তি আসে না। জলপাইগুড়ির সদর হাসপাতালে এর চেয়ে বেশী শ্রী ছিল?

সতীশবাবুর স্ত্রীর বেড খুঁজে পেতে খুব অসুবিধে হল না। লম্বা হল ঘরে পর পর রুগীরা শুয়ে আছেন। তার একেবারে শেষ বিছানার পাশে সতীশবাবু দু হাতে মাথা ধরে বসে আছেন কুঁজো হয়ে। বিছানায় যে মহিলা পড়ে আছেন তিনি জীবিত না মৃত বোঝা যাচ্ছে না দূর থেকে। কাছে গিয়ে দীপাবলী চাপা গলায় ডাকল, সতীশবাবু!

মুখ থেকে হাত সরিয়ে দীপাবলীকে দেখেও যেন নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারলেন না ভদ্রলোক। দীপাবলী ওর স্ফীত চোখের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করল, কি হয়েছে?

হঠাৎ সতীশবাবু হাউমাউ করে কেঁদে উঠলেন। সেই কান্নার শব্দে পাশের বিছানায় রুগীরা এবং তাদের কাছে আসা মানুষেরা অবাক চোখে তাকাল। দীপাবলী তড়িঘড়ি শক্ত গলায় বলল, আঃ, সতীশবাবু। আপনি বাইরে আসুন।

ঘর থেকে বেরিয়ে বারান্দায় চলে এল সে অস্বস্তি এড়াতে। পিছু পিছু চোখ মুছতে মুছতে সতীশবাবু বেরিয়ে এলেন, ম্যাডাম, আমার সব শেষ হয়ে গেল।

শেষ হয়ে গেল মানে?

ও নেই। আবার হাউ হাউ কান্না।

কি বলছেন আপনি?

একটু আগে, ঠিক পাঁচটা বাজতে পনের মিনিটে প্ৰাণবায়ু বেরিয়ে গেল। কান্না আরও সোচ্চার হল। এবং তার পরেই সেটাকে গিলতে চেষ্টা করলেন ভদ্রলোক।

সেকি! আপনি ডাক্তারকে বলেছেন?

মাথা নেড়ে না বললেন সতীশবাবু, বললেই তো মর্গে নিয়ে যাবে। কত বছর ওর পাশে দু মিনিটও একা চুপচাপ বসিনি। তাই ভাবছিলাম বসে থাকি। যেন ও ঘুমাচ্ছে আর আমি পাশে বসে আছি। এখন আমি কি করব ম্যাডাম? কান্নায় শব্দগুলো জড়িয়ে গিয়ে যেন দলা পাকিয়ে গেল।

দীপাবলী দূরে দাঁড়ানো একটি নার্সকে ডাকল, শুনুন, ওঁর স্ত্রীকে একটু দেখুন।

কোণের বেডটা তো? নার্স দেখতে চলে গেল। তারপরেই ফিরে এল দ্রুত, ছুটে গেল খবর দিতে।

দীপাবলী বলল, আমি তাড়াতাড়ি ফিরে যাচ্ছি। আপনি চিন্তা করবেন না। সবাই খবর পেয়ে যাতে আজকের লাস্ট বাস ধরে আসে তার ব্যবস্থা করছি।

রিকশায় বসে সে দৃশ্যটা ভাবতেই শিউরে উঠল। সারাজীবন যাতে সময় দিতে পারেননি কিংবা দেবার কথা মনে হয়নি তার পাশে কি ভাবে বসেছিলেন সতীশবাবু? অপরাধবোধ না প্ৰেম, কি বলা যায় একে?

Category: সাতকাহন (২য় পর্ব) - উপন্যাস - সমরেশ মজুমদার
পূর্ববর্তী:
« ০৪. অর্জুন নায়েক
পরবর্তী:
০৬. এস ডি ওর অফিসে »

Reader Interactions

Leave a Reply Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

বাংলা লাইব্রেরি : উল্লেখযোগ্য বিভাগসমূহ

লেখক ও রচনা

অনুবাদ সাহিত্য

সেবা প্রকাশনী

ডিকশনারি

কৌতু্ক / জোকস

লিরিক

রেসিপি

কোরআন

হাদিস

ত্রিপিটক

মহাভারত

রামায়ণ

পুরাণ

গীতা

বাইবেল

বিবিধ রচনা

বাংলা ওসিআর

Download Bangla PDF

হেলথ

লাইব্রেরি – ফেসবুক – PDF

top↑