০৫-৬. ভাঙা ক্রুশের সরাইখানা

৫. ভাঙা ক্রুশের সরাইখানা

ভাঙা ক্রুশ নামটা যে যথাযোগ্য এটা প্রমাণ করার জন্যই সরাইখানার বাড়ির গায়ে ষাঁড়ের রক্তে একটা ছবি আঁকা : রুশী ধরনের একটা ডবল ক্রুশ, মাটি থেকে উপড়ে গিয়ে ছড়িয়ে পড়ে আছে। সন্দেহ নেই অতীতের অন্ধকারে হারিয়ে-যাওয়া কোনো ঘটনার কথাই এটা মনে করিয়ে দিতে চাচ্ছে।

সরাইয়ের মালিক হলো জনৈক ক্রোফ। লোকটা স্লাভ নয়, বিপত্নীক, বয়েস পঁয়তাল্লিশ। রিগা-পেরনাউর বড়ো রাস্তায় এই সরাইটা অনেক দিন ধরে আছে। ক্রোফের আগে তার বাপ এটার দেখাশুনো করতো। আশপাশে দু-তিন ভেস্টের মধ্যে না আছে কোনো ঘর বাড়ি, না আছে কোনো পাড়া-গাঁ; ফলে মনে হয় এই ভাঙা কুশ যেন শূন্য ফুঁড়ে বেরিয়ে এসেছে।

খদ্দের বলতে আছে কেবল কোচবাক্সের যাত্রীরা; কেউ কেউ নিয়মিত আসে, কেউ বা কোচবাক্সে যাবার সময় হঠাৎ একদিন নেমে পড়ে;আর আসে আশপাশের খেত-খামারের কাজ করা জনা দশ-বারো চাষী আর কাঠুরে।

কেমন চলে তার ব্যাবসা? ক্রোফ অবিশ্যি কখনোই প্যানপ্যান করে না, নিজের কথা সাতকাহন করে বলা তার ধাতে নেই। তিরিশ বছরের পুরোনো এই সরাই, আগে চালাতে তার বাপ, চোরাই মালের ব্যাবসা আর এর-ওর বাগান ও বনবাদাড় থেকে এটা ওটা চুরি করে ব্যাবসা বেশ ফাঁপিয়ে তুলেছিলো। এখন চালাচ্ছে ক্রোফ-চলে তো যাচ্ছে বেশ। তা থেকে চেনা লোকের ধারণা ক্রোফ হচ্ছে টাকার কুমির, কিন্তু পরের ব্যাপারে নাক গলাতে যাবার কী দরকার?

ক্রোফ বিশেষ বাকতাল্লা করে না, হুঁ-হাঁ দিয়েই কাজ চালিয়ে দেয়। থাকে চুপচাপ নিরিবিলিতে, সরাই ছেড়ে বিশেষ বেরোয় না, মাঝে-মাঝে পেরনাউ-এ যায়, না গেলে অবসর সময়ে নিজের বাগানের শাক-শবজির তদারকি করে। ছেলেপুলে নেই, বউটাও মারা গেছে, একা-একা সে করেই বা কী? জোয়ান মানুষ ক্রোফ, লাল মুখো, ঝোঁপের মতো দাড়ি মুখ ভরে, মাথায় কঁকড়া চুল। কখনও অন্যের ব্যাপারে নাক গলায় না, নিজেও কম কথায় জবাব সারে।

বাড়িটা একতলা, ঢোকবার দরজাটা এক পাল্লার, পাল্লা খুললেই একেবারে মদের আড্ডায় গিয়ে পৌঁছনো যায়–কোনায় একটা জানলা আছে, তাই দিয়েই আলো আসে; বাঁয়ে আর ডান দিকে দুটো ঘর, সে-ঘর দুটোর জানলা রাস্তার দিকে খোলা। ক্রোফের ঘরটা বাড়ির পিছন দিকে, শবজি-বাগানের পাশেই।

সরাইয়ের দরজা-জানলা-খড়খড়ি সব খুব মজবুত আর টেকসই, ভিতর দিক থেকে আটকাতে হয়, খিল আছে, আংটা লাগানো, তার উপর ছিটকিনিও আছে, এদিকটা এমনিতে সরাইওলাদের পক্ষে খুব নিরাপদ নয়; তাই সন্ধে হতে না হতেই সবাই দরজা-জানলা এঁটে বসে যাবে। ভাঙা কুশ অবিশ্যি এমনিতে দশটা অব্দি খোলা থাকে, ছ-সাতজন মক্কেল বসে স্নাস আর ভোদকা গেলে খোশ মেজাজে।

ছোট্ট শবজি-বাগান, ঝোঁপের বেড়া দেয়া চারপাশে; শবজিগুলো বেচে ক্রোফের বেশ লাভই হয়। গাছের ফল তো প্রকৃতি-ঠাকরুনের বদান্যতার। উপরেই নির্ভর করে; মাঝারি জাতের চেরি আর আপেল ফলে, আর আছে কিছু জাম আর জামরুল-লিভভানিয়ায় এ সব ফলের ভারি কদর।

সেদিন সন্ধেবেলায় টেবিলে বসে মদের গেলাশে চুমুক দিতে-দিতে আড্ডা দিচ্ছিলো আশপাশের গ্রামের জন সাত-আট চাষী আর কাঠুরে। রোজ বাড়ি ফেরবার আগে স্নাপস-এর টানে এসে তারা এখানে জড়ো হয়–কেউই অবশ্য রাত কাটায় না। যাত্রীরাও কদাচিই রাত কাটাতে চায়, তবে কোচবাক্সের সহিস আর কনডাকটাররা অবিশ্যি পেরনাউ পৌঁছোবার আগে এখানে একবার গলা ভিজিয়ে নিতে ভালোই বাসে।

নিয়মিত খদ্দেরদের মধ্যে দুজন ছিলো স্বতন্ত্র, তারা একপাশে বসে সকলের উপর নজর রাখতে-রাখতে নিচু গলায় কথা বলছিলো : তারা হলো পুলিশ-সারজেন্ট য়েক আর তার এক সহকারী। পেরনোস্কায় সেই তাড়া দেয়ার পর তারা একটা উড়ো খবর পেয়ে এ তল্লাটে চলে এসেছে–শুনেছে এখানে নাকি কয়েকটা ষণ্ডা-বাটপাড়ের উপদ্রব হয়েছে, তাই বিভিন্ন টহলদারি দলের সঙ্গে যোগাযোগ করে এদিকটায় তারা সরেজমিন তদন্তে বেরিয়েছে।

গত অভিযানটার ব্যর্থতায় য়েক তখনও অসন্তুষ্ট বোধ করছিলো। ভেবেছিলো, সেই পলাতককে জ্যান্ত পাকড়ে নিয়ে মেজর ফেরডেরের হাতে তুলে দেবে, কিন্তু পেরনোস্কোর সেই বরফের মধ্যে তার লাশটা অব্দি সে বার করতে পারেনি।

লোকটা অবিশ্যি ডুবে মরেছে বলেই মনে হয়, য়েক তা সঙ্গীকে বোঝালে।

নিশ্চয়ই তা-ই, পুলিশটি সায় দিলে। 

নিশ্চয়ই ডুবে মরেছে–এটা অবিশ্যি বলা যায় না, কারণ আমরা তার কোনো স্পষ্ট প্রমাণ পাইনি…আর যদি তার জল খেয়ে ঢোল-হওয়া দেহটা খুঁজেও পেতুম, সেই অবস্থায় হতভাগাকে কিছুতেই আবার সাইবেরিয়া পাঠিয়ে দেয়া যেতো না। না, পাজিটাকে জ্যান্ত গ্রেফতার করা উচিত ছিলো আমাদের। পুরো ব্যাপারটায় পুলিশের ভূমিকা মোটেই তারিফ করবার মতো হয়নি।

পরের বারে আমাদের বরাত খুলবে, সারজেন্ট, বেশ দার্শনিকের ভঙ্গিতে বলে অন্য পুলিশটি।

সারজেন্ট য়েক তা শুনে বেশ বিরক্তভাবেই মাথা নাড়লে–ও-সব দার্শনিকতায় তার মন ভেজে না।

হঠাৎ বাইরে ঝড় ভীষণভাবে গর্জে উঠলো। সদর দরজা এমনি ভাবে নড়ে উঠলো যে মনে হলো এক্ষুনি বুঝি কজা ভেঙে পুরো পাল্লাটাই দুম করে খশে পড়বে। মস্ত চুল্লিটা হাওয়ার ঝাঁপটায় একেকবার নিভে আসছে আবার পরক্ষণেই দপ করে জ্বলে উঠছে। আশপাশের গাছপালার ডালে মড়মড় শব্দ হচ্ছে, সরাইখানার ছাদে ভাঙা ডালগুলো আছড়ে পড়ার আওয়াজ শোনা যাচ্ছে।

কেবল কাঠুরেদের সুবিধের জন্যই এ-রকম ঝড় হয়, একজন চাষী বিজ্ঞ মন্তব্য করলে, তাদের আর কী–কেবল ভাঙা কাঠকুটো কুড়িয়ে নিলেই হলো।

চোর-বাটপাড়দেরও ফুর্তির সময় সন্দেহ নেই, পুলিশটি বললে।

তা ঠিক বলেছো, য়েক সায় দিলে, কিন্তু তাই বলে তাদের ছেড়ে দিলে তো চলবে না… আমরা তো জানি একটা মস্ত ডাকাতদল দেশটা ছারখারে দিচ্ছে–এই তো টারফারটে চুরি হয়েছে সেদিন, আর কারকুসে একটা লোক একটু হলেই খুন হয়ে যাচ্ছিলো। তাছাড়া রিগা-পেরনাউর রাস্তাও আজকাল মোটেই নিরাপদ নয়। একটার পর একটা খুন-জখম-রাহাজানির খবর আসছে, অথচ কাউকেই এখন অব্দি পাকড়ানো যায়নি। আর পাকড়াতে পারলেই বা ষণ্ডাগুলোর কী হবে–সাইবেরিয়ায় গিয়ে কেবল মাটি কোপাবে। তাতে তাদের ভারি বয়ে যায়। যদি ফাঁসিতে ঝুলতে হতো, তাহলে একটা কাজ করার আগে পাজিগুলো দু-বার করে ভাবতো।

কী করে যে লোকে মৃত্যুদণ্ড তুলে দেবার কথা বলে, এটা তার একেবারেই অনধিগম্য। এটা ঠিক যে রাজনৈতিক কারণে এখনো কাউকে কাউকে ঝুলিয়ে দেয়া হয়, কিন্তু সাধারণ চুরি বাটপাড়ি রাহাজানির জন্যে কাউকেই আজকাল আর ফাঁসিতে ঝুলতে হয় না। এটা যে রেক-এর কত বড়ো দুঃখ, তা সে কাকে বোঝাবে?

যাক্ গে, এবার আমাদের রওনা হয়ে পড়া উচিত, য়েক উঠে পড়ার জন্যে তাড়া দিলে, পেরনাউতে ফিফথ স্কোয়াডের সারজেন্টের সঙ্গে একবার দেখা করতে হবে, বলে সে টেবিল চাপড়ালে।

ক্রোফ চটপট তাদের টেবিলের পাশে গিয়ে দাঁড়ালে।

কত হয়েছে, ক্রোফ? সারজেন্ট তার পকেট থেকে কিছু খুচরো বার করলে।

কত হয়েছে তা তো আপনি জানেনই সারজেন্ট, সরাইওলা বললে, আমার এখানে সকলের জন্যেই একদর…

এমনকী তাদের জন্যেও একদর, যারা জানে তোমার এখানে এলে তুমি তাদের কাগজপত্তর দেখতে চাইবে না বা এমনকী নামটাও জানতে চাইবে না?

আমি তো আর পুলিশ নই, সোজাসুজি বললে ক্রোফ।

কিন্তু সব সরাইওলা যদি তা করতো তাহলে দেশে খুন-জখমের সংখ্যা অনেক বেড়ে যেতো। দেখো, একদিন যেন এজন্য তোমাকে পাততাড়ি গোটাতে না হয়।

ফেলো কড়ি ভরো গেলাশ, এই হলো আমার নীতি, সরাইওলা বললে, কে কোত্থেকে এসেছে, আর কে কোথায় যেতে চাচ্ছে–তা জানবার আমার কোনো মাথাব্যথা নেই।

ওহে ক্রোফ, আমার কাছে কালা-বোবা সাজার চেষ্টা কোরো না। তুমি ঠিকই জানো, আমি কী বলতে চাচ্ছি। এখনও সাবধান হও, না-হলে একদিন কিন্তু ভীষণ পস্তাতে হবে। আচ্ছা, চলি।

সারজেন্ট য়েক উঠে দাঁড়িয়ে সব দাম চুকিয়ে দিলে, তারপর তার সঙ্গীকে নিয়ে দরজার দিকে এগুলো। অন্য খদ্দেররাও উঠে দাঁড়ালে এক-এক করে–এই বিচ্ছিরি আবহাওয়ায় চটপট বেরিয়ে না পড়লে পরে মুশকিলে পড়তে হবে।

ঠিক সেই সময়ে সশব্দে দরজাটা খুলে গেলো…পরক্ষণেই আবার পাল্লাটা হাওয়ার ঝাঁপটায় বন্ধ হয়ে গেলো।

ঘরে ঢুকেছে দুটি লোক–একজন খোঁড়াচ্ছে, সে অন্যজনের কাঁধে ভর দিয়ে আছে। লোক দুটি আর কেউ নয়, পোখ আর তার সহযাত্রী। আগের মতোই অচেনা যাত্রীটির গা ওভারকোটে মোড়া, টুপিটা একেবারে ভুরু পর্যন্ত নামানেনা বলে তার মুখটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না। সরাইওলার সঙ্গে কথা বললো কিন্তু সে-ই : প্রায় দুশো গজ দূরে আমাদের কোচবাক্সটা ভেঙে পড়েছে। কোচোয়ান আর কনডাকটার সহিসদের নিয়ে পেরনাউ গেছে–সকালে ফিরে এসে তারা আমাদের খোঁজ করবে। রাত্তিরটা কাটাবার মতো দুটো ঘর পাওয়া যাবে কি?

হ্যাঁ, ক্রোফ জানালে।

আমি একটা ঘর নেবো, পোখ বললে, আর যদি ভালো একটা বিছানা থাকে–

পাবেন, ক্রোফ তাকে আশ্বস্ত করলে, চোট লেগেছে না কি?

পা-টা ছড়ে গেছে, তবে তেমন লাগেনি, বললে পোখ।

আমি অন্য ঘরটা নেবো, যাত্রীটি বললে।

য়েক-এর মনে হলো গলাটা তার খুবই চেনা। যার গলা বলে মনে হলো, তাকে এখানে দেখতে পাবে বলে সে আশা করেনি। তবে পুলিশ হিশেবে তার কর্তব্য একেবারে নিঃসন্দেহ হয়ে নেয়া। কেন যেন তার মনে হলো, এটা জানা তার খুবই জরুরি। ইতিমধ্যে পোখ একটা চেয়ারে বসে পড়ে পাশের টেবিলে তার ব্রীফ-কেসটা রেখেছে–সেটা তখনো একটা শেকল দিয়ে তার কোমরবন্ধের সঙ্গে বাঁধা।

ঘর পাওয়া যাবে…উত্তম প্রস্তাব, বললে পোখ, কিন্তু পা ছড়ে গেলেও বেশ খিদে পায়–আমি কিছু খাদ্যও চাই।

তাও পাবেন, ক্রোফ তাকে আশ্বস্ত করলে।

তাহলে যত তাড়াতাড়ি পারেন, দেখুন, পোখ জানালে।

সারজেন্ট য়েক গিয়ে তার পাশে দাঁড়ালো। ভাগ্যি ভালো, হের পোখ যে! আপনার বেশি লাগেনি…

আরে! পোখ খুশিই হলো : সারজেন্ট য়েক! আপনি!

হ্যাঁ, আমি। বেশি জখম হননি তো?

না। মনে হয় না কাল কোনো ব্যথা থাকবে!

ক্রোফ এসে রুটি, ঠাণ্ডা বেকন আর চায়ের পেয়ালা সাজিয়ে দিলে। তারপর অন্য যাত্রীটিকে জিগেশ করলে, আপনিও খাবেন নাকি?

না, আমার খিদে পায়নি, যাত্রীটি জানালে, আমাকে বরং আমার ঘরটা দেখিয়ে দিন…এই ফাঁকে একটু ঘুমিয়ে নেয়া উচিত, কারণ হয়তো কাল কনডাকটাররা ফিরে আসার আগেই আমাকে বেরিয়ে পড়তে হবে। আমি তোর চারটেয় বেরিয়ে পড়তে চাই।

আপনি যা বলবেন,বললে সরাইওলা। পানশালার বাঁ দিকের ঘরটার দিকে সে যাত্রীটিকে নিয়ে গেলো–ডান দিকের ঘরটা রইলো পোখ-এর জন্য।

কিন্তু যাত্রীটি যখন কথা বলছিলো, তখন তার মাথার টুপিটা একদিকে একটু সরে যায়। সারজেন্ট য়েক সারাক্ষণই তার উপর নজর রাখছিলো, যতটুকু দেখতে পেলে, তাই যথেষ্ট। হুম!… ঠিকই আন্দাজ করেছিলুম।…কিন্তু অত সকালে কোচবাক্স ছাড়াই চলে যেতে চাচ্ছে কেন! অত তাড়া কীসের? সত্যি, পুলিশের চোখে অত্যন্ত স্বাভাবিক জিনিশও অনেক সময় অদ্ভুত বলে ঠেকে। আর তাছাড়া যেতেই বা চাচ্ছে কোথায়? কথাগুলো নিজেকেই জিগেশ করছিলে য়েক; কারণ তার মনে হচ্ছিল জিগেশ করলে হয়তো যাত্রীটি তাকে সব কথা নাও বলতে পারে। আর সারজেন্ট যে তাকে খুব মনোযোগ দিয়ে। দেখছিলো, এটা যাত্রীটির যেন চোখেই পড়েনি। সে ক্রোফের সঙ্গে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো। পোখ তখন গোগ্রাসে রুটি বেকন গিলছিলো, য়েক গিয়ে তার কাছে দাঁড়ালো।

ওই যাত্রীটি কি আপনার সঙ্গে কোচবাক্সে করে এলা? য়েক জিগেশ করলে।

হুঁ। বললে পোখ, সারা রাস্তায় তার কাছ থেকে চারটে কথাও বার করতে পেরেছি কি না সন্দেহ।

কোথায় যাচ্ছে, তা জানেন?

না…রিগায় উঠেছিলো, সম্ভবত রেফেল অব্দি যাবে। ব্রোক্স থাকলে সব ঠিক বলতে পারতো।

না না, আমি এমনি জিগেশ করছিলুম।

ক্রোফ অবিশ্যি সব কথাই শুনছিলো, কিন্তু এ-সব কথায় তার কিছু এসে যাচ্ছিলো বলে মনে হচ্ছিলো না। চাষী আর কাঠুরেরা একজন-একজন করে চলে যেতে লাগলো। ক্রোফ সব গোছগাছ করায় ব্যস্ত হয়ে পড়লো। য়েক. এর এখন আর অবিশ্যি খুব তাড়া দেখা গেলো না, সে বেশ চুটিয়ে আড্ডা দিচ্ছে পোখ-এর সঙ্গে। পোখও চেনা লোক দেখে খুব খুশি। কথা কইতে না পারলে তার পেট ফেঁপে যায়, খাবার হজম হয় না।

আপনি বুঝি পেরনাউ যাচ্ছেন? য়েক জিগেশ করলে।

না–আমিও রেফেলই যাচ্ছি, সারজেন্ট য়েক।

হের ইয়োহাউজেন-এর কাজে?

হ্যাঁ, বলে নিজের অজান্তেই পোখ তার ব্রীফ কেসের উপর হাত বুলিয়ে নিলে।

অ্যাক্সিডেন্টটায় তো অন্তত বারো ঘণ্টা দেরি হয়ে গেলো!

সকালবেলায় যদি ব্রোক্স ঠিকঠাক এসে পৌঁছোয়, তাহলে অবিশ্যি চারদিনের মধ্যেই রিগায় ফিরতে পারবো… বিয়ের সময়…

ভজেনাইদা পারেনসোফ-এর সঙ্গে… হ্যাঁ, আমি জানি…

আপনি তো সবই জানেন!

কই আর জানি? আমি কি জানি আপনার সঙ্গী কোথায় যাবেন? অত সকালে যখন ভদ্রলোক বেরিয়ে পড়ছেন, তখন নিশ্চয়ই পেরনাউতে একবার থামবেন…

হ্যাঁ, তা সম্ভব। বললে পোখ, আর হয়তো তার সঙ্গে কখনো দেখাই হবে ।…তা হের য়েক আপনিও কি এই সরাইতে রাত কাটাচ্ছেন নাকি?”

না, হের পোখ। পেরনাউতে একজনের সঙ্গে দেখা করতে হবে, এক্ষুনি বেরিয়ে পড়তে হবে আমাদের। …তা খাওয়াদাওয়ার পর ভালো করে ঘুমিয়ে নেবেন, দেখবেন শরীরটা ঝরঝরে লাগবে…আর ওই ব্রীফ-কেসটা যেন চোখের আড়ালে করবেন না।

পোখ হাসলো, মাথার সঙ্গে যেমন কান থাকে, তেমনি ওটাও আমার কাছে। থাকবে।

চলো, সঙ্গীকে বললে য়েক, ভালো করে বোতাম এঁটে নাও, নইলে হাড়ের মধ্যে দিয়ে ঠাণ্ডা লাগবে।…শুভরাত্রি, হের লোখ!

শুভরাত্রি, সারজেন্ট য়েক!

সারজেন্ট য়েক আর তার সঙ্গী দরজ খুলে বাইরে ঝড়ের মধ্যে বেরিয়ে গেলো। ক্রোফ প্রথমে পাল্লাটা আটকে খিল তুলে দিলে, তারপর মস্ত একটা তালা ঝুলিয়ে চাবি লাগালে। এই রাত্তিরে ভাঙা ক্রুশে আর-কেউ আসবে বলে মনে হয় না। কোচবাক্স না-ভেঙে গেলে এই দুই যাত্রীও এখানে আশ্রয় নিতো কিনা সন্দেহ।

ততক্ষণে পোখ-এর খাওয়া শেষ হয়ে গেছে। পেটে দানাপানি পড়তেই বেশ চাঙ্গা লাগছে–এবার বিছানায় একটু গড়িয়ে নিলেই, বাস, আজকের মতো ঝক্কি-ঝামেলা শেষ হয়ে যাবে।

ক্রোফ তার গনগনে উনুনের পাশে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করেছিলো, পোখ কখন তার ঘরে যায়। মাঝে-মাঝে হাওয়ার ঝাঁপটায় আগুনের শিখা লাফিয়ে-লাফিয়ে উঠছে, ঘরের মধ্যে ধোঁয়া ঢুকে পড়ছে। টেবিলের উপর মোমবাতির আলোগুলো কাঁপছে, দেয়ালে ছায়াগুলো নেচে উঠছে, বাইরে হাওয়া এত জোরে বইছে যে মনে হচ্ছে কে যেন দরজা-জানালায় একটানা ধাক্কা দিচ্ছে।

শুনলেন?হঠাৎ দরজাটা এত জোরে কেঁপে উঠলো যে পোখ জিগেস করে বসলো।

কেউ না।… ও হাওয়া, সরাইওলা বলল, কেউ না…ও আমার অভ্যেস হয়ে গেছে…এবার শীতে প্রায়ই তো আবহাওয়া খারাপ যাচ্ছে।

অবিশ্যি আজ রাত্তিরে পথে-ঘাটে কেউ আছে বলে মনে হয় না–কেবল চোর-পুলিশের কথা আলাদা।

হাঁ। এই আবহাওয়ায় কে আর বেরুবে?

পোখ উঠে দাঁড়ালো নটা নাগাদ, ব্রীফ-কেসটা বগলদাবা করে ক্রোফের দেয়া একটা জ্বলন্ত মোমবাতি নিয়ে সে নিজের ঘরে গিয়ে ঢুকলো।

ক্রোফের হাতে একটা পুরু কাঁচ বসানো লণ্ঠন। পোখ দরজা বন্ধ করতে করতে জিগেশ করলে, আপনি শুতে যাবেন না?

যাবো, ক্রোফ বললে, তবে একবার চারদিক দেখেশুনে নিচ্ছি। রোজই শুতে যাবার আগে চারদিক দেখে নিই। তাছাড়া উঠোনে মুরগির খাঁচা আছে-মুরগিরা সব খাঁচায় ঢুকেছে কিনা দেখা উচিত। মাঝে-মাঝে সকালে একটা-দুটোর পাত্তা মেলে না।

ও, পোখ জিগেশ করলে, খ্যাকশেয়াল?

হ্যাঁ, শেয়াল আছে–নেকড়ে আছে। নেকড়েগুলো মহা বদমাশ, বেড়া ডিঙিয়ে চলে আসে। তবে আমার জানলা থেকে উঠোনটা দেখা যায় কিনা, নেকড়ে দেখলেই গরম শিশে ছুঁড়ে মারি…রাত্তিরে বন্দুকের আওয়াজ শুনলে তাই ঘাবড়ে যাবেন না যেন।

ওঃ, পোখ উত্তর দিলে, একবার ঘুমোলে আমাকে জাগাতে কামান দাগতে হবে। হ্যাঁ, ভালো কথা। আমার অবিশ্যি যাবার খুব তাড়া নেই। আমার সঙ্গী যদি বিচানা ছাড়তে চায় তো সে তার ইচ্ছে। ব্রোক্স পেরনাউ থেকে ফিরে কোচবাক্স মেরামত করবার পর আমাকে ডাকলেই চলবে।

ঠিক আছে, সরাইওলা তাকে আশ্বস্ত করলে, আপনাকে কেউ জাগাবে না। যাত্রীটি যাবার সময় আপনি যাতে উত্ত্যক্ত না-হন, আমি তা লক্ষ রাখবো।

হাই চেপে পোখ ভিতর থেকে দরজাটা বন্ধ করে তালা ঝুলিয়ে দিলে।

মস্ত ঘরটায় ক্রোফই রইলো একা। আবছা আলো জ্বলছে লণ্ঠনের। পোখ-এর টেবিলটা সাফ করে সে ছোটোহাজারি সাজিয়ে রাখলে। বেশ গোছানে তোক ক্রোফ, কোনো কাজই পরদিনের জন্য তুলে রাখা পছন্দ করে না। কাজকর্ম শেষ করে সে উঠোনের দিকের দরজাটা গিয়ে খুললো। সেটা উত্তর-পশ্চিম দিক, ঝড়ের দাপট সেদিকটায় একটু কম, হয়তো বাড়িটার কাঠামো একটু বাঁচিয়েছে। কিন্তু বেড়ার ওপাশে কনকনে হাওয়া সমানে। গর্জাচ্ছে। এই ঠাণ্ডায় তার আর বেরুতে ইচ্ছে করলো না। চৌকাঠে দাঁড়িয়েই সে চারপাশটা দেখে নিলে। না, উঠোনে সন্দেহজনক কিছুই দেখা যাচ্ছে না। ছায়ার মতো নিঃশব্দে কোনো নেকড়ে বা শেয়াল এসে হাজির হয়নি। লণ্ঠনটা নাড়িয়ে চারদিক দেখে নিয়ে সে আবার দরজাটা লাগিয়ে দিলে। এই ঠাণ্ডায় উনুনটাকে নিভতে দেওয়া ঠিক হবে না। কয়েকটা কাঠকুটো গুঁজে দিলে সে চুল্লিতে। চারপাশটা দেখে নিয়ে সে নিজের ঘরে গিয়ে ঢুকে পড়লো।

তার ঘরটা বাগানের একেবারে লাগোয়া। পাশে বারান্দা আছে–বারান্দার ওপাশে পোখ-এর ঘর। পোখ এতক্ষণে অঘোরে ঘুমোচ্ছে। ক্রোফ লণ্ঠন হাতে নিজের ঘরে গিয়ে ঢুকলো।

দু-তিন মিনিট পরে খশখশে শব্দ শুনে বোঝা গেলো জামাকাপড় ছেড়ে সে রাতকাপড় পরে নিচ্ছে–তারপরে অপেক্ষাকৃত জোরালো আওয়াজ শুনে বোঝা গেলো সে তার বিছানায় উঠে পড়লো।

ঘুমন্ত সরাইটাকে ঘিরে ক্ষুধার্ত হাওয়া গর্জাতে লাগালো সারারাত; হাওয়া আর বৃষ্টি আর ঝড়ের গোঙানি-পাতা-ঝরা পাইনগাছের ডালপালার মধ্যে দিয়ে একটানা বয়ে যেতে লাগলো।

ক্রোফ উঠে পড়লো চারটের একটু আগেই। লণ্ঠনটা জ্বালিয়ে নিয়ে বড়ো ঘরটায় হাজির হয়ে দ্যাখে যে রহস্যময় যাত্রীটির ঘরের দরজাও ঠিক তক্ষুনি খুলে গেছে। সারা গায়ে ওভারকোট চাপানো কালকের মতো, টুপিটাও চোখ অব্দি এমনভাবে নামানো যে মুখ দেখা যাচ্ছে না।

এক্ষুনি যাবেন? ক্রোফ জিগেশ করলে। হু।, বলে যাত্রীটি পকেট থেকে দু-তিনটে কাগজের রুবল বার করলে, রাতের জন্য কত ঘরভাড়া দেবো?

এক রুবল।

এই নিন।…দরজাটা খুলে দিন, বেরিয়ে পড়ি।

দিচ্ছি। লণ্ঠনের আলোয় নোটটা উলটে-পালটে দেখে ক্রোফ চাবি বার করে দরজার দিকে এগিয়ে গেলো। জিগেশ করলে, যাবার আগে কিছু চাই নাকি?

না। ভোদকা? বা একফোঁটা স্নাপস।

না। আমার একটু তাড়া আছে। দরজা খুলে দিন।

তা আপনি যদি বলেন…

ক্রোফ খিল নামিয়ে তালা খুলে দিলে।

বাইরে তখনও অন্ধকার। বৃষ্টি ধরে এসেছে, তবে তখনও ঝোড়ো হাওয়া গর্জাচ্ছে অবিরাম-রাস্তায় অজস্র ভাঙা ডালপালা পড়ে আছে।

টুপিটা আরো নামিয়ে চিবুকছুই যেন ঢেকে ফেললে যাত্রীটি, তারপর ওভারকোটের বোতাম আঁটতে-আঁটতে অন্ধকারের মধ্যে মিলিয়ে গেলো। ক্রোফ দরজাটা এঁটে আবার খিল তুলে দিলে।

.

৬. হুলুস্থূল

ট্রাঙ্কেল–ফ্রাঙ্ক ইয়োহাউজেন-এর সে খাশ বেয়ারা–গিয়েছিলো থানায় পঁচিশ ঘা বেত খাবে বলে। ইয়োহাউজেনরা প্রায় সমরবাহিনীর মতো সময়নিষ্ঠ ও নিয়মানুবর্তী। রোজ সকাল নটায় রুটি-মাখন সহযোগে সে-বাড়িতে চায়ের আসর বসে। কিন্তু সেদিন ট্রাঙ্কেলের গাফিলতির জন্যই নটার সময় স্যামোভার কাজ করছিলো না। কর্তামশায়ের কাছে কোনো ওজর-ওজুহাত চলে না। তিনি চটপট একটা চিরকুট লিখে ট্রাঙ্গেলকে থানায় পাঠিয়ে দিলেন; চিরকুটটায় লেখা ছিলো, আমার বেয়ারা ট্রাঙ্কেল কাজের গাফিলতির জন্যে পঁচিশ ঘা বেত খাবে–ফ্রাঙ্ক ইয়োহাউজেন। বেত খেতে যাবার আগে ফ্রাঙ্ক তার খাশ বেয়ারাকে মনে করিয়ে দিলেন, সে যেন থানা থেকে লিখিয়ে আনে বেত্রাঘাতের জন্য কত মজুরি চাই। যে-লোকটা বেত মারবে সে এই বাবদ সব সময়েই ইয়োহাউজেনদের কাছ থেকে মজুরি পায়–বিনি পয়সায় তিনি কাউকেই খাটান না।

খুব যে হুড়মুড় করে থানায় যাবার ইচ্ছে ছিলো ট্রাঙ্কেলের, তা নয়। তবে সে রাস্তায় আর ঢিমে তেতালায় হাঁটলে না। কী জানি, খুব-একটা দেরি হলে যদি আরেক শাস্তি জোটে। তবে যাবার আগে বেতের ঘা শামলাবার জন্যভোদকা-সহযোগে একটু চা গিলে নিলে। তারপর সাহসে পিঠ বেঁধে থানার রাস্তা ধরলো সে।

থানায় তার ভারি খাতির। যেন পুরোনো বন্ধু। হাত-ঝাঁকুনি, স্বাস্থ্য-কামনা ইত্যাদি সব হলো।

একটি পুলিশ বললে, এই যে, ট্রাঙ্কেল! বেশ অনেক দিন পরে দেখা হলো–প্রায় মাসখানেক তো হবেই।

না, অতদিন হবে না।

তা কে পাঠালেন তোমাকে, শুনি?

স্বয়ং কর্তামশাই –হের ফ্রাঙ্ক ইয়োহাউজেন।

হুম… মেজর ফেরডেরের সঙ্গে দেখা করতে চাও, তাই না?

যদি তিনি দয়া করে দেখা করেন।

এইমাত্র আপিশে এসেছেন মেজর। তোমাকে দেখলে উনি খুশিই হবেন।

এ-কথা শুনে ট্রাঙ্কেল সোজা গিয়ে মেজর ফেরডেরের কামরার দরজায় আস্তে টোকা দিলে। অমনি ভিতর থেকে ভারিক্কি চালে ঢুকে পড়বার নির্দেশ এলো।

মেজর তার চেয়ারে বসে-বসে এক বাণ্ডিল কাগজপত্তর উলটে-পালটে দেখছিলেন। ট্রাঙ্কেল ঘরে ঢুকতেই তাকিয়ে বললে, ও, তুমি ট্রাঙ্কেল!

আজ্ঞে হ্যাঁ, হের মেজর।

তুমি এসেছো এখানে?

আজ্ঞে, হের ইয়োহাউজেন পাঠিয়েছেন।

ভীষণ-কিছু ব্যাপারে নাকি?

আজ্ঞে যত নষ্টের গোড়া ঐ স্যামোভার! সকালবেলা সময়মত টগবগ করছিলো না।

কেন? তুমি বুঝি জ্বালাতে ভুলে গিয়েছিলে? মেজর হাসলেন।

আজ্ঞে …

তা ক ঘা, শুনি?

এই যে, কর্তামশাই লিখে দিয়েছেন। ট্রাঙ্কেল হাত বাড়িয়ে চিরকুটটা এগিয়ে ধরলো।

মেজর কাগজটা পড়ে বললেন, ও, মার এই কটা! তা বেশি নয়।

ট্রাঙ্কেল একবার আর্তনাদ করে উঠলো।

মাত্তর পঁচিশ ঘা।

এক-আধ ডজন বেতের ঘা পেলেও ট্রাঙ্কেল এবার কোনোরকমে শামলে নিতে পারতো। পঁচিশ ঘা জানলে আরো-কিছু ভোদকা গলায় ঢেলে আসা যেতো।

তা তোমাকে আর খামকা দেরি করিয়ে দেবো না। চটপট ব্যবস্থা করে দিচ্ছি, বলে তিনি হাঁক পাড়লেন।

একটা লোক এসে গোড়ালি ঠুকে খাড়া হয়ে তাঁকে সেলাম জানালে। পঁচিশ ঘা বেত, মেজর হুকুম গিলেন, খুব জোরে মেরো না কিন্তু … এ কেবল বন্ধুর পিঠে পড়বে। স্লভ হলে অবিশ্যি অন্য কথা ছিলো।… যাও ট্রাঙ্কেল, জামা খুলে গিয়ে ইনাম নাও। যখন ফিরে যাবার মতো অবস্থা হবে, এসে রশিদ নিয়ে যেয়ো।

হের মেজরকে অশেষ ধন্যবাদ জানিয়ে ট্রাঙ্কেল কাঁপতে-কাঁপতে পুলিশের লোকটাকে অনুসরণ করলে। ভাগ্যিশ জার্মানরা ভৃত্যদের পারিবারিক বন্ধু বলে ভাবে, তাই তার আর নালিশ করার মতো কিছু নেই। কামিজ খুলে পিছন ফিরে পিঠ বাঁকিয়ে দাঁড়ালো সে, আর পুলিশের লোকটা বেত তুললো। ঠিক এমন সময়ে থানায় হুলুস্থুল শুরু হয়ে গেলো।

হন্তদন্ত হয়ে একটা লোক ঢুকলো, হাঁফাতে-হাঁফাতে সে চেঁচালে, মেজর ফেরডের! মেজর ফেরডের!

বেতটা আর ট্রাঙ্কেলের পিঠ পড়লো না, কারণ কী ব্যাপার জানবার জন্যে পুলিশের লোকটা তখন দরজা খুলে তাকাচ্ছে। ট্রাঙ্কেলও মুখ বাড়িয়ে সব দেখবার চেষ্টা করলে।

শোরগোল শুনে মেজর ফেরডের তখন তার কামরা থেকে বেরিয়ে এসেছেন। কী ব্যপার?

হন্তদন্ত লোকটা হাঁফাতে-হাঁফাতে তার কাছে গিয়ে একটা তারবার্তা তুলে দিলে। বললে, সাংঘাতিক কাণ্ড হয়েছে! ভীষণ অপরাধ!

কখন?

কাল রাতে।

কী হয়েছে?

খুন! 

খুন? কোথায়?

পেরনাউ-এর রাস্তায়। ভাঙা ক্রূশের সরাইখানায়।

কে খুন হয়েছে?

ব্যাঙ্কের কেরানি–ইয়োহাউজেন ব্যাঙ্কের কেরানি!

অ্যাঁ!…পোখ!ট্রাঙ্কেল চেঁচিয়ে উঠলো, আমাদের পোখ!

খুনের কারণ কিছু জানা গেছে? কোনো মোটিভ? মেজর ফেরডের জিগেশ করলেন।

চুরি– কারণ পোখ-এর ব্রীফ-কেসটা পাওয়া গেছে … মৃতদেহের পাশেই পড়ে ছিলো- ভিতরে কিছু পাওয়া যায়নি।

ভিতরে কী ছিলো বলে অনুমান করছে?

এখনো জানা যায়নি ব্রীফ-কেসে কী ছিলো। তবে ব্যাঙ্কে খবর নিলেই তা এক্ষুনি জানা যাবে।

তারবার্তায় সত্যি এর বেশি কিছু জ্ঞাতব্য ছিলো না। মেজর ফেরডের তার অনুচরদের একজনকে বললেন, তুমি … তুমি গিয়ে জজ কেরস্টোফকে খবর দাও…

এক্ষুনি যাচ্ছি।

আর তুমি গিয়ে ডাক্তার হামিনেকে বলে এসো। বলল যে এক্ষুনি যেন দুজনে ইয়োহাউজেনদের ব্যাঙ্কে চলে আসেন। ওঁদের অপেক্ষায় আমি সেখানে বসে থাকবো।

হন্তদন্ত হয়ে তোক দুটি থানা থেকে বেরিয়ে পড়লো। মেজর ফেরডেরও ইয়োহাউজেন ব্যাঙ্কের উদ্দেশে রওনা হয়ে পড়লেন। আর তালেগোলে ট্রাঙ্কেল বড়ো বাঁচা বেঁচে গেলো। এই হুলুস্থুলুর মধ্যে কেউ খেয়ালই করলে না যে তার পিঠে পঁচিশ ঘা বেত পড়েনি।