০১-২. আনন্দে লাফিয়ে উঠল টুপুর

ঝাও ঝিয়েন হত্যারহস্য – মিতিন মাসি – সুচিত্রা ভট্টাচার্য

টেলিফোনটা রেখেই আনন্দে লাফিয়ে উঠল টুপুর। রোববার সকালে এমন একটা সুসংবাদ! এইমাত্র পার্থমেসো জানাল, এবার মুম্বই যাওয়া হচ্ছে সদলবলে। শুধু তাই নয়, অজন্তা ইলোরা ঘুরে আসার প্ল্যান আছে। বেরোনো হবে লক্ষ্মীপুজোর পরের দিন, ফেরা দেওয়ালির পরে। সব মিলিয়ে প্রায় দুসপ্তাহ। টানা চোদ্দো দিন মিতিনমাসির লেজ হয়ে থাকতে পারবে টুপুর, তার মধ্যে একটাও কি রোমাঞ্চকর ঘটনা ঘটবে না?

অবনী ডাইনিং টেবিলে বসে পাকা পেঁপে খাচ্ছে। সহেলি আর টুপুরের মতো ছুটির সকালে লুচি-পরোটা, ভাজাভুজি খাওয়া তাঁর একদমই পছন্দ নয়। ইদানীং তিনি বেশি করে ফলাহারে মন দিয়েছেন। শশা, আপেল, আনারস, কলা, কমলালেবু, যখন যা পাওয়া যায়।

বেড়ানোর খবরটায় অবনীর তেমন হেলদোল দেখা গেল না। ছোট্ট কাঁটায় এক টুকরো পেঁপে গেঁথে বললেন, অজন্তা ইলোরা আমার দুবার ঘোরা। মুম্বইও গিয়েছি বারচারেক। এবারে মহারাষ্ট্রের দুর্গগুলো দেখে আসতে পারলে কাজের কাজ হয়।

সঙ্গে সঙ্গে সহেলি হাঁ হাঁ করে উঠেছেন, কখনও না। আমি মরে গেলেও কোনও দুর্গে যাব না।

টুপুর অবাক মুখে বলল, কেন মা? দুর্গ তো খুব ইন্টারেস্টিং জায়গা। এক-একটা দুৰ্গ মানে, এক-একটা ইতিহাস। আর মহারাষ্ট্রের অনেক ফোর্টই তো ছত্রপতি শিবাজির তৈরি। ইন্ডিয়ার হিষ্ট্রি জানতে গেলে ওই ফোর্টগুলো তো দেখা দরকার।

নিকুচি করেছে তোর ইতিহাসের। সহেলি ঝেঁঝে উঠলেন, যা উঁচু উঁচু সিঁড়ি হয় কেল্লাগুলোর, বাপস। মনে আছে, রাজস্থানের যোধপুর ফোর্টে গিয়ে আমার কী হাল হয়েছিল? হাঁটু নাড়তে পারছি না, কোমর ঝনঝন, দরদরিয়ে ঘামছি…

অজন্তা ইলোরা গেলেও কিন্তু হাঁটতে হবে, মা। পাহাড়ে চড়তে হবে।

সে আমি রাজি আছি। সুন্দর জিনিস দেখার জন্য কষ্ট করতে আমার আপত্তি নেই।

বা রে, দুর্গে বুঝি সুন্দর সুন্দর জিনিস নেই?

অবনী পেঁপে শেষ করে ন্যাপকিনে মুখ মুছলেন। বললেন, প্রায় প্রতিটি দুর্গেই একটা করে মিউজিয়াম থাকে। সেখানে রাজা রাজড়াদের পোশাক আশাক, সেই সময়কার অস্ত্ৰ, বাহন, পালকি, হাতির পিঠের হাওদা…

খ্যামা দাও। খ্যামা দাও। ওই সব ভারী ভারী ঢাল তলোয়ার দেখে দেখে আমার চোখ পচে গিয়েছে। এবার আর ওসবের ছায়া মাড়াচ্ছি না।

অবনী গোমড়া মুখে বললেন, তোমরা যা খুশি করো। তবে টুরে কেল্লা না থাকলে আমাকে তোমরা বাদ দাও। পুজোর ছুটিটা আমি বাড়িতেই থাকব।

সহেলি বললেন, তা হলে এও শুনে রাখো, তোমাদের কেল্লা ঘোরার মতলব থাকলে আমি নেই। ..টুপুর, এখনই তোর পার্থমেসোকে জানিয়ে দে আমাকে ছাড়াই যেন প্রোগ্রাম করা হয়।

এ তো মহা ফ্যাচাং। কোথায় কোথায় যাওয়া হবে তার এখনও ঠিক নেই, তার আগেই বাবা-মা ফাইট শুরু করে দিলেন? মাঝখান থেকে বেড়ানোটাই না কেঁচে যায়।

দুহাত তুলে টুপুর বলল, ঠান্ডা হও। আগেই মাথা খারাপ কোরো না। একটা-দুটো ফোর্ট তো টুর প্রোগ্রামে থাকতেই পারে। ইচ্ছে যদি না হয়, মা ফোর্টে ঢুকবে না। ওই সময়টায় নিশ্চিন্ত মনে শপিং সারবে।

এই প্রস্তাবটা দুজনেরই মনোমতো হয়েছে। অবনী খানিকটা সন্তুষ্ট হয়ে অজন্তা আবিষ্কারের কাহিনি শোনাতে শুরু করলেন টুপুরকে। কিছু কিছু টুপুরের জানা, অনেকটাই অজানা। সেই ১৮১৯ সালে কীভাবে একদল ব্রিটিশ শিকারির চোখে পড়ে গিয়েছিল গুহাগুলো, তারপর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির পাঠানো শিল্পীরা কত কষ্ট করে কুড়ি বছর ধরে অজন্তা গুহার ছবিগুলোকে নকল করল, আবার সামান্য অসাবধানতার জন্য ইংল্যান্ডের কেনসিংটন প্রাসাদে রাখা সেই ছবিগুলোর বেশিরভাগই কেমন করে আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে গেল… ভারী গুছিয়ে বলছেন অবনী, সহেলিও মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনছেন।

আপন মনেই সহেলি বিড়বিড় করে উঠলেন, কী কাণ্ড বলো তো! ভাগ্যিস ইংরেজ শিকারিদের ঘোড়াগুলো জল খাওয়ার জন্য ছটফট করেছিল! নইলে হয়ত অজন্তা গুহার খবরই পাওয়া যেত না।

অবনী বললেন, অনেক বড় বড় আবিষ্কারই ওরকম হঠাৎ হয়ে যায়। ভীমবেটকা গুহার ছবিগুলোও তো হঠাৎ খুঁজে পাওয়া গিয়েছিল।

টুপুর বলল, তারপর ধরো, কাশ্মীরের অমরনাথ। এক রাখালের ভেড়া হারাল, আর সেই ভেড়া খুঁজতে গিয়ে…।

সহেলি বললেন, সে তো শুনেছি ক্রিস্টোফার কলম্বাসও ভারতে আসার জনা বেরিয়ে, দিক ভুল করে পৌঁছে গিয়েছিলেন আমেরিকায়।

জমে-ওঠা আড্ডায় ছেদ পড়ল আচমকা। ডোরবেল বেজে উঠেছে।

দরজা খুলে একটু অবাকই হল টুপুর। কুশল! সঙ্গে আবার একটা চাইনিজ ছেলে।

কুশল টুপুরের পাড়ার বন্ধু। মোড়ের হলুদ বাড়িটায় থাকে কুশল, বড় একটা আসে না এবাড়িতে, রাস্তাঘাটে দেখা হলে গল্প-আড্ডা হয় টুপুরের সঙ্গে।

তা সেই কুশল এক চীনা ছেলেকে নিয়ে…?

টুপুর কোনও প্রশ্ন করার আগে কুশল বলে উঠল, একটা জরুরি দরকার ছিল রে। আমার এই বন্ধুকে একটু হেল্প করতে হবে।

কী ব্যাপারে?

তোর এক মাসি খুব নামী ডিটেকটিভ না?

হ্যাঁ! মিতিনমাসি। প্রজ্ঞাপারমিতা মুখোপাধ্যায়। ভেরি ভেরি ফেমাস। পুলিশ কমিশনার পর্যন্ত আমার মাসিকে সমঝে চলে।

সেই মাসির সঙ্গে আমার এই বন্ধুর একটু যোগাযোগ করিয়ে দিবি? বলেই জিভ কাটল কুশল, দেখেছিস কাণ্ড! তোর সঙ্গে লিয়াংয়ের আলাপ করিয়ে দিতেই তো ভুলে গিয়েছি।

দুমিতিনটেই আলাপ পরিচয়ের পালা শেষ। লিয়াং নিজেই জানাল, তার পুরো নাম ঝাও লিয়াং, সে কুশলের ক্লাসমেট, থাকে মধ্যকলকাতার ছাতাওয়ালা গলিতে। টুপুরের ভাল নাম ঐন্দ্রিলা শুনে বার কয়েক বিড়বিড় করে নামটা উচ্চারণের চেষ্টা করল লিয়াং, তারপর লজ্জা লজ্জা মুখে বলল সে তাকে তুপুর নামেই ডাকবে।

কুশল আর লিয়াংকে নিজের ঘরে এনে বসাল টুপুর। সহেলি একবার উঁকি দিয়ে গেলেন দরজায়, তাঁর চোখে একরাশ কৌতূহল। ভ্রুকুটি করে মাকে এখন ঘরে আসতে বারণ করল টুপুর।

ফ্যান চালিয়ে দিয়ে টুপুর বলল, হ্যাঁ, এবার ব্যাপারটা আমায় খুলে বল।

তুই? কুশল নাক কুঁচকোল, তোকে বলে কী হবে?

আহা, শুনিই না। আমাকে এত তুচ্ছতাচ্ছিল্য করছিস কেন? অনেক কেসেই আমি মাসির অ্যাসিস্ট্যান্ট থাকি, আমিই হয়তো লিয়াং-এর প্রবলেমটা সলভ করে দিতে পারব।

কুশল হেসে ফেলল। কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল, অলরাইট। লিয়াং, বল তা হলে।

ছোটখাটো চেহারায় লিয়াংয়ের চোখে কালো ফ্রেমের চশমা। সিনেমার হ্যারি পটারের স্টাইলে কাটা চুল। কবজিতে শোভা পাচ্ছে একটা কালো ব্যান্ড। চশমার কাচের আড়াল থেকে ছেলেটার সরু সরু চোখ দুটো পিটপিট করে উঠল। তার পরেই লিয়াং বলতে শুরু করেছে, লাস্ট উইকে আমাদের ফ্যামিলিতে একটা ঘটনা ঘটে গিয়েছে। এ ব্যাড ইন্সিডেন্ট। আমার বো…আই মিন আমার কাকা… একটা কার-অ্যাকসিডেন্টে মারা গিয়েছেন। কিন্তু আমাদের মনে হচ্ছে, কাকাকে কেউ ইচ্ছে করে মেরে দিয়েছে।

টুপুর নড়েচড়ে বসল, কেন? এরকম মনে হচ্ছে কেন?

কারণ, আমার কাকা অত্যন্ত সাবধানি মানুষ ছিলেন। খুব দেখেশুনে রোড ক্রস করতেন। দুদিক ভালভাবে না দেখে তিনি ফুটপাত থেকে নামতেনই না। আমরা তাই নিয়ে কত ঠাট্টারসিকতাও করেছি। এমন একজন লোককে একটা গাড়ি কী করে ধাক্কা দিল, কিছুতেই বুঝতে পারছি না।

কোথায় হয়েছিল অ্যাকসিডেন্টটা?

জায়গাটাও খুব অড। সেই প্রিন্সেপ ঘাটের কাছে। কাকা যে ওখানে সন্ধেবেলা কেন গিয়েছিলেন, সেটাও আমাদের মাথায় ঢুকছে না। কাকার বডিটাও পড়ে ছিল একেবারে ফুটপাতের গা ঘেঁষে। কোনও গাড়ি রাস্তার অতটা ধারে এসে কী করে যে তাঁকে চাপা দিল…!

লিয়াংয়ের কথায় প্রচুর ইংরেজি শব্দ আছে বটে, তবে তার বাংলাটাও মন্দ নয়। উচ্চারণে একটা বিচিত্ৰ টান থাকলেও বুঝতে তেমন অসুবিধে হয় না।

একটু থেমে থেকে লিয়াং ফের বলল, আরও একটা ব্যাপার। কাকার কাছে একটা জিনিস থাকার কথা ছিল। জিনিসটা কিন্তু ডেডবডির কাছাকাছি কোথাও পাওয়া যায়নি। কাকার মোবাইল ফোনটাও মিসিং। অথচ কাকার ঘড়ি, পার্স, টাকাকড়ি কিছু খাওয়া যায়নি। পার্সে আড়াই হাজার টাকা ছিল। টাকাটা নিল না, অথচ একটা পুরনো মোবাইল ফোন আর সেই জিনিসটা ভ্যানিশ হয়ে গেল… এটা কি খুব স্ট্রেঞ্জ নয়? সেই জন্যই আমাদের সন্দেহ, সামওয়ান অথবা কোনও গ্যাং আমার কাকাকে মার্ডার করেছে।

মার্ডার শব্দটা শুনে একটু কেঁপে উঠল টুপুর। অস্ফুটে জিজ্ঞেস করল, জিনিসটা কী জানতে পারি?

সেটা তো আমরাও সঠিক জানি না। তবে কোনও শোপিসটোপিস ধরনের কিছু হবে। মানে, কাকা আমাদের সেরকমই ইঙ্গিত দিয়েছিলেন।

টুপুরের কেমন গুলিয়ে যাচ্ছিল। ঘটেছে কার-অ্যাকসিডেন্ট, অথচ লিয়াংয়ের মনে হচ্ছে খুন! একটা জিনিস লিয়াংয়ের কাকার কাছে থাকার কথা ছিল, কিন্তু জিনিসটা কী তা-ও লিয়াংরা জানে না! অর্থাৎ আসল ক্লুটাই নেই। কেসটা কি টুপুরের পক্ষে একটু বেশি জটিল হয়ে যাচ্ছে না?

মুখে অবশ্য ঘাবড়ানো ভাবটা ফুটতে দিল না টুপুর। মাথা নেড়ে বলল, খুবই ইন্টারেস্টিং। … দাঁড়াও, মাসির সঙ্গে একবার কথা বলে আসি

ফোন করতেই ওপারে পার্থমেসো, কী রে, বেড়ানোর নাম শুনেই লাফঝাঁপ শুরু হয়ে গিয়েছে বুঝি? একটু ধৈর্য ধর, আগে টিকিট-ফিকিট কাটি।

টুপুর বলল, না গো, বেড়ানো নয়, অন্য ব্যাপার। একটু মিতিনমাসিকে ডেকে দেবে?

সে কি এখন তোর সঙ্গে কথা বলবে? সকাল থেকেই যা ব্যস্ত!

কেন?

একটা জাল উইলের কেস সলভ করছে। এখন ফাইনাল স্টেজ। দরজা বন্ধ করে নিজের অফিসরুমে বসে মাথার চুল ছিঁড়ছে।

ও। টুপুর সামান্য মিইয়ে গেল, তা-ও যদি একটু কথা বলা যেত…! এখানেও একটা বেশ মিস্টিরিয়াস কেস…

তুইও আজকাল কেস ধরছিস নাকি?

না গো। আমার এক বন্ধু এসেছে। মিতিনমাসির খোঁজেই। একজন চিনা ভদ্ৰলোক..

ওরে বাবা, চিনেম্যানদের কেস! তা হলে তো রহস্য ঘনীভূত। ধর, ডেকে দিচ্ছি।

মিতিনমাসি ফোনে এল বটে, কিন্তু যেন মন দিয়ে শুনছে না। তবু যেটুকু জেনেছে, তার সবটুকুই উগরে দিল টুপুর। বেশ উত্তেজিতভাবে।

টুপুর থামার পর মিতিন বলল, হুম। কিন্তু আমি তো এখনই ওদের মিট করতে পারব না রে টুপুর। এখনও অন্তত দুতিনটে দিন আমাকে ছোটাছুটি করতে হবে।

তা হলে ওদের কী বলব? তিন দিন পর তোমার সঙ্গে দেখা করতে?

তা কেন। সময় গড়িয়ে যেতে দেওয়াটা ঠিক নয়। তুইই বরং ডিটেলে শুনে নে। যদি কারও সঙ্গে দেখা করার প্রয়োজন হয়, ঘুরেও আয়। গিয়ে কথাবার্তা বল, তারপর দেখা যাক, কী করা যায়।

আমি …? একা-একা ..?

সাহস আন। আত্মবিশ্বাস জোরদার করা ইনভেস্টিগেশনে গিয়ে চোখকান খোলা রাখবি, ফিরে এসে সব স্টেটমেন্ট নোট করবি।

পারব আমি?

কিছুই যদি না পারিস, তোর উপর আমি ভরসা করব কী করে? তোর যে বন্ধুটা লিয়াংকে নিয়ে এসেছে, তাকেই আপাতত অ্যাসিস্ট্যান্ট করে নে। আজ বিকেলেই ছাতাওয়ালা গলিতে চলে যা।

ফোন রেখে টুপুর চিন্তিত মুখে দাঁড়িয়ে রইল একটুক্ষণ। পায়ে পায়ে ঘরে ফিরে দেখল, সহেলি প্লেট-ভরতি সন্দেশ দিয়ে গিয়েছেন, লিয়াং খুঁটে খুঁটে খাচ্ছে, কুশল টপাটপ সাঁটাচ্ছে।

মুখ-ভরতি সন্দেশ নিয়ে কুশল জিজ্ঞেস করল, কী বললেন মাসি?

মাসি এখন অন্য একটা কেস নিয়ে ব্যস্ত রে। আমাকেই তদন্ত শুরু করতে বলল, টুপুর গলায় একটা ভারিক্কি ভাব আনল, লিয়াংয়ের দিকে ফিরে বলল, হ্যাঁ, তোমার কেসটা এবার একটু ডিটেলে শোনা যাক। আমি যা-যা প্রশ্ন করব, ঠিক-ঠিক উত্তর দেবে। কিছু লুকোবে না, কেমন?

লিয়াংয়ের চোখের পাতা আবার পিটপিট কেঁপে উঠল। ঢক করে ঘাড় নাড়ল শ্রীমান ঝাও লিয়াং।

.

০২.

তোমার কাকার নাম কী, লিয়াং?

ঝিয়েন। আই মিন, ঝাও ঝিয়েন। ঝাও আমাদের ফ্যামিলি নেম।

মানে, আমরা যাকে বলি পদবি?

হ্যাঁ। অনেকটা তাই। আমাদের ফ্যামিলি নেমটা আসল নামের আগে থাকে।

ও।… তোমার কাকার বয়স কত হয়েছিল?

ফরটিসেভেন।

তোমার কাকি আছেন তো?

কাকা বিয়ে করেননি। আমাদের জয়েন্ট ফ্যামিলি, কাকা আমাদের সঙ্গেই থাকতেন। টেরিটি বাজারে একটা চাইনিজ স্কুল আছে, অনেক বছরের পুরনো, কাকা ওখানেই পড়াতেন। হিস্ট্রি। পড়াশোনা নিয়েই থাকতেন সারাদিন। আমরা কাকাকে বলতাম বুকওয়ার্ম। উনি আমাদের … মানে বাড়ির ছোটদের কী ভাল যে বাসতেন! কত কিছু কিনে আনতেন আমাদের জন্য। এই তো কদিন আগেই আমার আর মেইলির জন্য হ্যারি পটারের সিডি নিয়ে এলেন ..

মেইলি কে?

আমার বোন। ছোট বোন। শি ইজ ইন ক্লাস সিক্স।

ও।

মেইলি কাকার খুব পেট ছিল। ও এখনও খুব কান্নাকাটি করছে। ইনফ্যাক্ট, কাকার ওভাবে মৃত্যুটা আমরা কেউই মেনে নিতে পারছি না। আমি, বাবা, মা ..

বলতে বলতে লিয়াংয়ের গলা ধরে এল। নাক টানছে। টুপুর ডায়েরিতে নোট নিতে নিতে থমকাল। দেখছে লিয়াংকে। রাস্তায় চিনা ছেলেমেয়েদের দেখলে কেমন ভাবলেশহীন মনে হয়, কিন্তু মোটেই এ তো তা নয়! লিয়াং একেবারে টুপুরদের মতোই আবেগপ্রবণ।

একটু সময় নিয়ে টুপুর আবার কলম ধরল, এবার তা হলে আমরা মেন টপিকে আসি।

কুশলও আর চুপ থাকতে পারল না। বলল, হা, হেঁয়ালিটা স্পষ্ট হওয়া দরকার। লিয়াং বলছে, ওর কাকার কাছে একটা জিনিস থাকার কথা ছিল। অথচ লিয়াংরা জানে না জিনিসটা কী। এটা কীরকম একটু শোনাচ্ছে না?

লিয়াং বলল, সত্যি জানি না রে। তবে কাকা বাড়িতে যা বলে বেরিয়েছিলেন, সেইমতে কাকার কাছে জিনিসটা থাকার কথা।

কিন্তু কী জিনিস?

 তা হলে আর-একটু আগে থেকে বলি। দিন পনেরো আগে কাকা একদিন রাতে বাড়ি ফিরে বললেন, বেকবাগানের এক কিউরিও শপে তিনি অদ্ভুত একটা জিনিস দেখতে পেয়েছেন। জিনিসটা সম্ভবত খুব মূল্যবান। কাকা ঠিক করেছিলেন ওটা তিনি কিনে আনবেন। আর ওই জিনিসটাই নাকি হবে এবারের মুন ফেস্টিভ্যালে আমাদের বাড়ির সবচেয়ে বড় আকর্ষণ।

টুপুর ডায়েরি থেকে চোখ তুলল, মুন ফেস্টিভ্যালটা কী?

কুশল আগ বাড়িয়ে বলে উঠল, মুন ফেস্টিভ্যাল জানিস না? … লিয়াংদের চাইনিজ ক্যালেন্ডার তো আমাদের মতো নয়। ওদের বছর ঘোরে চাঁদের হিসেবে। অমাবস্যা টু অমাবস্যা এক মাস। ফেব্রুয়ারি মাসের অমাবস্যার দিন ওদের নববর্ষ। আর সেই হিসেবে অষ্টম চান্দ্রমাসের ফিফটিনথ ডেতে হয় ওদের মুন ফেস্টিভ্যাল। পূর্ণিমার দিন। ঠিক বলছি তো রে লিয়াং?

হান্ড্রেড পারসেন্ট কারেক্ট।

সেদিন তো তাদের বাড়িতে বাড়িতে কেক বানানো হয়, তাই না? গত বছর তুই স্কুলে এনে খাইয়েছিলি, আমার মনে আছে। দেদার ড্রাই ফুটস ছিল কেকে। দারুণ টেস্ট।

আমরা ওই কেকটাকে বলি মুনকেক। মুন ফেস্টিভ্যালের দিন রাত্তিরবেলা আমরা ওই কেক খাই। … যাই হোক, কাকার কথায় আসি। আমরা তো খুব আশায় আশায় ছিলাম, কাকা একটা দারুণ কিছু আনবেন। কিন্তু পরদিন কাকা ফিরলেন বেশ গোমড়া মুখে। কেন? না কিউরিও শপের মালিক নাকি জিনিসটা বেচবেন না। আবার তার দুতিন দিন পরেই দেখি, কাকার মুখে হাসি দোকানের মালিক নাকি শেষ পর্যন্ত দশ হাজার টাকায় জিনিসটা দিতে রাজি হয়েছেন।

তখনও তোমরা জানতে চাওনি জিনিসটা কী?

জিজ্ঞেস করেছিলাম। মেইলি তো কাকার কানের পোকা বের করে দিয়েছিল প্রায়। কিন্তু কাকা কিছুতেই বলেননি। খালি বলতেন, সারপ্রাইজ, সারপ্রাইজ, ধৈর্য ধরে। … তারপর লাস্ট স্যাটারডে কাকা স্কুল থেকে বাবাকে মোবাইলে জানালেন, ছুটির পর জিনিসটা কিনে তবে উনি বাড়ি ফিরবেন। কাকার কলিগরা তো বাড়িতে এসেছিলেন, তারাও বলেছেন কাকা ওই দিন দুটোতেই বেরিয়ে পড়েছিলেন। আর অ্যাকসিডেন্টটা ঘটেছে সন্ধেবেলায়। এই চার-পাঁচ ঘণ্টার মধ্যে কাকা কি আর জিনিসটা কিনে ফেলেননি?

এটা কিন্তু ঠিকঠাক বলা কঠিন। টুপুর ভুরু কুঁচকোল, কিনতেও পারেন, না-ও কিনতে পারেন। … সেই দোকান কী বলছে? কিউরিও শপ?

লিয়াং যেন থমকাল একটু। ঢোক গিলে বলল, দোকানে তো খবর নেওয়া হয়নি।

সে কী?

হ্যাঁ মানে … আমি তো বেকবাগানের দিকটা ভাল চিনি না .. একা-একা যেতে সাহসও পাইনি। তা ছাড়া পোস্টমর্টেম, কাকাকে সমাধি দেওয়া, এসব করতেও তো চলে গেল দিন চারেক। বাড়িতেও সকলের মনের যা অবস্থা ..

স্ট্রেঞ্জ! জিনিসটা আদৌ কেনা হয়েছিল কিনা সেটা তো আগে জানবে, টুপুর গলা ভারী করল, যাক গে, পুলিশকে বলেছ কাকার মৃত্যুটাকে তোমরা অ্যাকসিডেন্ট বলে মানতে পারছ না?

বাবা বলেছেন।

 কেন মানতে পারছেন না, তা-ও বলেছেন নিশ্চয়ই?

হ্যাঁ।

পুলিশ কী বলছে?

খুব একটা গুরুত্ব দেয়নি। শুধু জিজ্ঞেস করেছিল, কাকার কোনও এনিমি ছিল কিনা। এমন শত্ৰু, যে কিনা কাকাকে গাড়ি চাপা দিয়ে মারতে পারে।

আছে কি তেমন কেউ?

প্রশ্নই আসে না। আমার কাকা নিপাট ভালমানুষ। বললাম তো তোমাকে, কাকা বই আর পড়াশোনাতেই ড়ুবে থাকতেন। আমরা কখনও তাঁকে কারও সঙ্গে ঝগড়া পর্যন্ত করতে দেখিনি।

আর জিনিসটা হারানোর ব্যাপারে পুলিশের কী রিঅ্যাকশন?

দোকানের লোকেশানটা নিয়েছে। বলেছে, খোঁজ করে দেখবে। লিয়াং চশমা ঠিক করল, তবে বাবা বলছিলেন, পুলিশ নিজে থেকে কিছুই করবে না। সারাক্ষণ ওদের পিছনে লেগে থাকতে পারলে, নিয়মিত তাড়া লাগালে, হয়তো একটু নড়াচড়া করবে, নইলে তা-ও করবে না। আর আমার বাবার পক্ষে ওদের পিছনে সব সময়ে ছোটাছুটি করা সম্ভবই নয়।

কেন?

দোকান সামলাতে হয় যে! তা ছাড়া বাবার মনটাও খুব ভেঙে গিয়েছে। বলছেন, আর কাটাছেঁড়া করে কী লাভ, আমার ভাই তো আর ফিরবে না।

তা হলে আমার মাসির খোঁজে এসেছ যে বড়?

সে তো আমি এসেছি। বাবা জানেন না। … আমি ব্যাপারটার শেষ দেখতে চাই। কাকাকে যদি সত্যিই কেউ মেরে থাকে, তাকে শাস্তি না দিয়ে আমি ছাড়ব না।

লিয়াং আবার নাক টানছে। টুপুর তাড়াতাড়ি বলে উঠল, ঠিক আছে, ঠিক আছে, তুমি শান্ত হও লিয়াং। আমি দেখছি কী করা যায়। তবে আমাদের একদম সিস্টেমেটিক্যালি এগোতে হবে। আমাদের প্রথম কাজ হল ..

আগে দোকানটায় যাওয়া। টুপুরের মুখ থেকে কথা কেড়ে নিল কুশল, জানতে হবে জিনিসটা সত্যিই লিয়াংয়ের কাকা কিনেছিলেন কিনা।

এবং জিনিসটা কী ছিল। টুপুর ফের কথা ধরে নিল, যদি সত্যিই জিনিসটা মূল্যবান হয়, তখন তো খুনের আশঙ্কাও উড়িয়ে দেওয়া যাবে না। তখন কিন্তু আমাদের লিয়াংয়ের বাড়িও যেতে হবে, সবাইকে কিছু প্রশ্ন করতে হবে। … তোমার বাবা তখন কিছু মনে করবেন না তো, লিয়াং?

নাক কুঁচকে দুএক সেকেন্ড কী যেন ভাবল লিয়াং। তারপর বলল, নো প্রবলেম। আমি বাবাকে সব বুঝিয়ে বলব।

গুড।টুপুর কুশলের দিকে ফিরল, কাজে তা হলে নেমে পড়া যায়, কী বল?

অবশ্যই। আমিও তোর সঙ্গে আছি, কুশল একগাল হাসল, আমার প্রচুর ডিটেকটিভ বই পড়া আছে। আমার অ্যাডভাইস নিলে তিন দিনে কেস সলভ হয়ে যাবে।

মনে মনে হাসল টুপুর। রহস্যগল্প পড়েই যদি ডিটেকটিভ হওয়া যেত, তা হলে তো মিতিনমাসি নয়, পার্থমেসোই কবে গোয়েন্দা বনে যেত। ডিটেকটিভ হতে গেলে একটা তিন নম্বর চোখ থাকা দরকার। সেই চোখ বই পড়ে গজায় না। যাক গে, তবু কুশল থাকলে ক্ষতি নেই। লোকবলেরও তো মূল্য আছে।

মুখে একটা প্রাজ্ঞ ভাব ফুটিয়ে টুপুর বলল, তা হলে দোকানে।আমরা কবে যাচ্ছি?

কুশল বলল, শুভস্য শীঘ্রম। আজই চল।

দুর, আজ তো রবিবার। দোকান বন্ধ থাকবে। আমরা যাব কাল। বিকেলে। … লিয়াং, তুমি বরং কাল স্কুল থেকে কুশলদের বাড়ি চলে এসো। আমি তোমাদের ডেকে নেব।

লিয়াং বেশ অনুপ্রাণিত হয়েছে। জ্বলজ্বলে চোখে বলল, তাই হবে।

লিয়াং আর কুশল চলে যাওয়ার প্রায় সঙ্গে সঙ্গে ঝাঁপিয়ে এলেন সহেলি। ঘটনাটা অর্ধেক শুনেই হাঁ হাঁ করে উঠেছেন, না না, তোর ওসবের মধ্যে থাকার দরকার নেই। একে খুনখারাপির ব্যাপার, তায় আবার এক চিনাম্যান জড়িত, কোত্থেকে কী হয়ে যায়!

অবনী বললেন, চিনেম্যান তো কী আছে? ওরা কি খুনেবদমাইশ নাকি? তোমার বোধহয় জানা নেই, চিনারাই পৃথিবীর প্রাচীনতম সভ্য জাতি। কত কী যে ওরা আবিষ্কার করেছে, তার ঠিকঠিকানা নেই। এই যে তুমি চা খাচ্ছ, এটাও ওদের অবদান। কাগজ পড়ছ … এটাও ওদের আবিষ্কার। কাগজ কী করে ছাপতে হয়, সেটাও ওরাই শিখিয়েছে। আর চিনে খাবার দেখলে তোমার তো জিভে জল গড়ায়।

থাক, আর চিনাদের গুণ ব্যাখ্যান করতে হবে না। মেয়ের একটা কিছু বিপদ হোক, তখন দেখব তোমার লেকচার কোথায় থাকে!

আহা, আগেই ঘাবড়ে যাচ্ছ কেন? টুপুর তো আর কেসটা করছে না, মাসির হয়ে প্রক্সি দিচ্ছে শুধু। যদি কেসটার মেরিট থাকে, মিতিনই তো মাঠে নেমে পড়বে।

বাবার সমর্থন পেয়ে টুপুরেরও গলার জোর বেড়েছে। সহেলিকে বলল, তোমার সব তাতেই বাড়াবাড়ি, মা। তুমি কি চাও আমি ঘরকুনো হয়ে বসে থাকি?

অবনী বললেন, মাকে ওভাবে বলতে নেই টুপুর। তোর মার ভয় পাওয়ার একটু-একটু কারণও তো আছে। এই যে চিনারা, এরা আমাদের শহরে কতকাল ধরে আছে জানিস? দুশো বছরেরও বেশি। সেই ওয়ারেন হেস্টিংসের আমল থেকে। ভারতের কোনও শহরে এত চাইনিজ নেই। কলকাতায় এখন এদের সংখ্যা প্রায় কুড়ি হাজার। অথচ কী আশ্চর্য, ভাব তুই, এত বছর ধরে এত লোক আমাদের প্রতিবেশী হয়ে থাকা সত্ত্বেও আমরা কিন্তু সেভাবে তাদের চিনিই না। তাদের রীতিনীতি আদবকায়দা, উৎসব-পার্বণ, কোনও কিছুরই খবর রাখি না। আর এই না-চেনা থেকেই তো তৈরি হয় আশঙ্কা, রহস্য, ভয়।

তা অবশ্য ঠিক। এই তো, ওদের মুন ফেস্টিভ্যালের নামই আমি জন্মে কখনও শুনিনি।

আমি অবশ্য খানিকটা জানি। ওদের মুন ফেস্টিভ্যাল অনেকটা আমাদের নবান্নের মতো। ফসল কাটার পরে চিনদেশে এই উৎসবটা হত। এখনও হয়। কলকাতার চিরাও ট্র্যাডিশনটা বজায় রেখেছে। ওই দিন চিনারা যে মুনকেক খায়, তাই নিয়েও একটা ইন্টারেস্টিং গল্প আছে।

তাই নাকি?

হ্যাঁ রে। চেঙ্গিস খাঁর নাতি কুবলাই খাঁ থারটিন্থ সেঞ্চুরিতে চিন দখল করে নিয়েছিল। তখন ওখানকার সাধারণ লোকদের মনে একটা বিদ্রোহের ভাব জেগে ওঠে। এই মুন ফেস্টিভ্যালের দিনই প্রথম মুনকেক বানিয়ে তার মধ্যে কাগজ পুরে পুরে বিপ্লবীরা দেশময় খবর চালাচালি করেছিল। এখনও তাই চিনারা মুনকেককে বিপ্লবের প্রতীক হিসেবে মনে করে।

বাঃ, এটা তো একটা ভাল তথ্য যোগ হল টুপুরের মগজের ভাঁড়ারে। লিয়াংয়ের সঙ্গে আলাপ পরিচয়টা বাড়লে চিনাদের সম্পর্কে আরও কিছু জানা যাবে নিৰ্ঘাত।

কিন্তু লিয়াংদের কেসটা কী? ঝোঁকের মাথায় দায়িত্ব তো নিয়ে ফেলল টুপুর, শেষ পর্যন্ত সামাল দিতে পারবে তো? ইস, কুশল আর লিয়াংয়ের চোখে সে হাসির খোরাক না হয়ে যায়।