১-৩. ত্ৰিবান্দ্ৰাম এক্সপ্রেস

কেরালায় কিস্তিমাত -– সুচিত্রা ভট্টাচার্য

০১.

ত্ৰিবান্দ্ৰাম এক্সপ্রেস এর্নাকুলাম টাউন পেরনোর সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয়ে গেল নামার তোড়জোড়। পার্থ আর মিতিন সিটের তলা থেকে টেনেটেনে জিনিস বের করছে। টুপুরও হাত লাগাল মাসি-মেসোর সঙ্গে। গুনছে লাগেজ, মনে-মনে হিসেব রাখছে সুটকেস আর কিটব্যাগের। বুমবুমও বেজায় ব্যস্ত হঠাৎ। তড়িঘড়ি চিপস শেষ করছে। যেন স্টেশন এসে গেলে কেউ তার হাত থেকে ছিনিয়ে নেবে প্যাকেট। টুপুর একবার হাত বাড়াতেই ঝট করে সরে গেল বুমবুম। চিপসের মতো মহা মূল্যবান খাবার ভাগাভাগিতে সে মোটেই রাজি নয়।

টুপুরের মা বাথরুমে গিয়েছিলেন। ফিরেই বোতল থেকে ঢকঢক করে খানিক জল খেয়ে বললেন, কী রে মিতিন, তোর জামাইবাবু যে দেখি এখনও বসে বসে ঢুলছে! এবার তাকে একটু নড়াচড়া করতে বল।

একটু আগে বাবাকে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে জাগিয়েছে টুপুর। দুপুরে খাওয়াদাওয়ার পর জব্বর এক ঘুম লাগিয়েছিলেন অবনী। ওপরের বার্থ থেকে অবরোহণ করলেন এইমাত্র, এখনও তার ঘোর কাটেনি। হাই তুলতে তুলতে বললেন, আবার আমায় নিয়ে পড়লে কেন?

না বলে পারছি না, তাই। ট্রেনে ওঠার পর থেকে তো কুটোটি নাড়নি। রাত্তিরে তোমার চাদরকম্বল পর্যন্ত পেতে দিতে হয়েছে। এবার অন্তত কিছু করো।

আহা, ওরা করছে তো। কেন মিছিমিছি ওদের ডিসটার্ব করব। জানোনা, অধিক সন্ন্যাসীতে গাজন নষ্ট!

হুঁহ, আলসে লোকের কত যে বাহানা! সহেলি ঠোঁট বেঁকালেন, কুঁড়ের ডিম কোথাকার!

উৎসাহ দেখিয়ে কাজ পণ্ড করার চেয়ে কুঁড়ে হওয়া ঢের ভাল।

লাগসই জবাব দিতে যাচ্ছিলেন সহেলি, মিতিন তাড়াতাড়ি থামাল। সিটে বসে হাত ঝাড়তে ঝাড়তে বলল, অবনীদা, আপনার সেই কেরলাইট ছাত্র আসবে তো স্টেশনে?

অবশ্যই। অবনী মাথা দোলালেন, আমি বলেছি, আর সুনীল আসবে না এ কি হতে পারে? আমাকে সে অসম্ভব অ্যাডমায়ার করে।

দেখব ভক্তিশ্রদ্ধার নমুনা। সহেলি ফের ফোঁস করে উঠলেন, আমি কিন্তু তার সঙ্গে সারাক্ষণ হিন্দি-ইংরিজি চালাতে পারব না, আগে থাকতেই বলে দিচ্ছি।

আহা, কতবার তোমায় বলব নামে কেরলাইট হলেও সুনীল নালিয়াথ প্রায় বাঙালিই। ওর স্কুল কলেজ-ইউনিভার্সিটি সবই তো কলকাতায়। কেরলে চলে এসেছে তো মাত্র বছর পাঁচেক। ওর বাংলা শুনলে তোমার তাক লেগে যাবে। বলতে-বলতে মিতিনের দিকে ফিরলেন অবনী, জানো তো, কলেজে সুনীল একবার বাংলা নাটকে অভিনয় করেছিল। এলেবেলে রোল নয়, দাড়ি-গোঁফ লাগিয়ে একেবারে নরক গুলজারের ব্ৰহ্মা।

টুপুর হেসে ফেলল। কদিন ধরে অবিরাম সুনীল প্রশস্তি শুনছে বাবার মুখে। সুনীল কত গুণী, সুনীল কত নম্র, কত ভদ্র …। সুনীলের মতো মেধাবী ছাত্র নাকি কালেভদ্রে পাওয়া যায়। ইতিহাসের ছাত্র ছিল সে, দারুণ চোস্ত ইংরেজি লিখত, তার লেখা একটা ইংরেজি প্রবন্ধ পড়ে নাকি ডেকে চাকরি দিয়েছিল নামী সংবাদপত্র মর্নিং হেরাল্ড। কলকাতা ছেড়ে চলে এলেও এখনও সে কলকাতাকে ভোলেনি, নিয়মিত যোগাযোগ রাখে পুরনো বন্ধুদের সঙ্গে, অধ্যাপকদের সঙ্গে। বিজয়া-নববর্ষে কার্ড তো পাঠায়ই, ফোনও করে মাঝেমধ্যে।

তা সেই সুনীল নালিয়াথের টুপিতে আর একটা পালক যোগ হল! বাংলা নাটকে অভিনয়! এ হেন সুনীলকে তো তা হলে দেখতেই হয়।

বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হল না। মিনিট দশেকের মধ্যেই এসে পড়ল এর্নাকুলাম জংশন। প্ল্যাটফর্মে নেমে টুপুররা জিনিসপত্র জড়ো করছে, হাঁপাতে-হাঁপাতে হাজির এক বছর তিরিশের যুবক। অবনীকে প্রণাম করে দুদিকে দুহাত মেলে দিল, ওয়েলকাম স্যার। ভগবানের নিজের দেশ কেরলে আপনাদের সুস্বাগতম।

অবনী প্রায় বিগলিত। খুশি-খুশি মুখে আলাপ করিয়ে দিলেন সকলের সঙ্গে। সহেলিকে প্রণাম করল সুনীল, পাৰ্থর সঙ্গে করমর্দন, মিতিনকে হাত জোড় করে নমস্কার। টুপুরকে হাই, বুমবুমকে গাল টিপে হ্যালো। সাত বছর বয়স হয়েছে বুমবুমের, গাল টিপলে সে ভীষণ রেগে যায়, গোমড়া হয়ে অন্য দিকে মুখ ঘুরিয়ে নিল।

মিতিনের পরিচয় পেয়ে সুনীল বেজায় উচ্ছ্বসিত। কোনও মহিলা গোয়েন্দা সে নাকি এই প্রথম দেখছে। কম করে দশবার বলল, আমার কী সৌভাগ্য, আমার কী সৌভাগ্য …।

সুনীলকেও প্রথম দর্শনে মোটামুটি পছন্দ হয়ে গেল টুপুরের। তবে খানিকটা নিরাশও হয়েছে। নাটকের ব্ৰহ্মার চেহারা আর একটু জবরদস্ত হবে বলে কল্পনা করেছিল। সুনীল রীতিমতো ছোটখাটো, রোগাযোগা, গায়ের রং শ্যামলাই বলা যায়, গলার স্বরও মোটেই গমগমে নয়, বরং মিহি-মিহি। তবে হ্যাঁ, সুনীলের মুখ-চোখ ভারী ঝকঝকে। বিশেষ করে চোখ। চশমার আড়ালে কালো মণিদুটো জ্বলজ্বল করছে। কথাবার্তার ধরনও খুব আন্তরিক, যেন তারা সবাই সুনীলের অনেক দিনের চেনা।

সদলবলে স্টেশনের বাইরে এল টুপুররা। সাতটা বাজে, তবে এখানে সন্ধে তেমন গাঢ় হয়নি। ভারতের পশ্চিম প্রান্তে সূর্য অনেকটা দেরিতে ডোবে, টুপুর জানে। রাস্তাঘাটের আলো অবশ্য জ্বলে গেছে, হ্যালোজেনের দ্যুতিতে উজ্জ্বল হয়ে আছে চত্বরটা। অক্টোবরের শেষ, তবে সমুদ্রের ধারে বলে বাতাসে আদৌ ঠান্ডা ভাব নেই। একটু যেন গরম-গরমই লাগছে।

সুনীল গাড়ি এনেছে। টাটা সুমো। একটু খেলিয়ে ছড়িয়েই বসল সকলে। পার্থ আর সুনীল ড্রাইভারের পাশে, পিছনে লটবহরসমেত বুমবুম আর টুপুর, বাকিরা মধ্যিখানে। সুনীলের নির্দেশে গাড়ি স্টার্ট দিল ড্রাইভার।

সিটে শরীর ছেড়ে দিয়ে অবনী বললেন, আমাদের জন্য হোটেল দেখে রেখেছ তো সুনীল?

আজ্ঞে, হ্যাঁ স্যার। সুনীল বাধ্য ছাত্রর মতো ঘাড় নাড়ল, দু তিনটে জায়গায় কথা বলে রেখেছি। আপনাদের যেটা পছন্দ হয় …

কোথায় সেগুলো? কদ্দূর?

এর্নাকুলাম টাউন স্টেশনের কাছে। চিতুর রোডে।

আমরা কি এর্নাকুলামে থাকব? কোচিতে থাকব না?

স্যার, এর্নাকুলাম আর কোচিকে আমরা সেভাবে আলাদা করে দেখি না। সুনীল মৃদু হাসল, অবশ্য তফাত যে একেবারেই নেই, তা নয়। আরব সাগরের পাড়ে মেনল্যান্ডটা এর্নাকুলাম, আর খানদশেক দ্বীপ মিলিয়ে কোচি। তার মধ্যে বোলাঘাট্টি আইল্যান্ড আছে, ভাইপিন আছে, গুন্ডুদ্বীপ, নারাক্কাল…। সবচেয়ে বড় অবশ্য মাট্টানচেরি। মেনল্যান্ড-আইল্যান্ড সব মিলিয়েই এখন কোচি পৌরসভা। ডিস্ট্রিক্টের নাম এর্নাকুলাম।

মিতিন পিছন থেকে প্রশ্ন করল, উইলিংডন বলে আর একটা দ্বীপ আছে না? যেখানে কোচি স্টেশন? এয়ারপোর্ট? কোচি বন্দরও তো উইলিংডনে?

ওটা তো কৃত্রিম দ্বীপ ম্যাডাম। চারের দশকে কোচি বন্দরের নাব্যতা খুব কমে গিয়েছিল। বড় জাহাজটাহাজ ঢোকা নিয়ে সমস্যা হত। তখন রবার্ট ব্রিস্টো নামে এক সাহেব বন্দরের গভীরতা বাড়ানোর জন্য ড্রেজিং চালান। তাতে যে বিপুল পরিমাণ মাটি উঠেছিল, তাই দিয়েই তৈরি হয় উইলিংডন। সাইজ নেহাত ছোট নয় দ্বীপটার। প্রায় হাজার একর। ওই উইলিংডন তৈরি হয়েছিল বলেই ব্রিজ দিয়ে দিয়ে মেনল্যান্ড থেকে মাট্টানচেরি পর্যন্ত জুড়ে দেওয়া গেছে। তবে হোটল বেশিরভাগই মেনল্যান্ডে। উইলিংডনের ওদিকে হোটল খুব কস্টলি, সংখ্যাতেও তত বেশি নয়। থাকার পক্ষে তাই এদিকটাই ভাল।

সুনীল কথা বলে বেশ গুছিয়ে। বাংলা বেশ ঝরঝরে বটে, তবে একটা দক্ষিণী টানও রয়েছে। বাঙালিদের সঙ্গে এখন মেলামেশা কমে গেছে, হয়তো বা সেই জন্যই। সুনীল নালিয়াথের বক্তৃতা শুনতে শুনতে বাইরেটা দেখছিল টুপুর। শহরটা বেশ পরিচ্ছন্ন। চারদিকে ঝকমক করছে দোকানপাট। রাস্তা তেমন চওড়া নয়, তবে যথেষ্ট মসৃণ। কলকাতার মতো পদে-পদে ঝাঁকুনি খেতে হয় না। সবুজও চোখে পড়ে এদিকওদিক, মাঝে-মাঝেই নজরে আসে নারকেল গাছ, কলা গাছ।

হঠাৎই সুনীল বলল, আপনারা কিন্তু বড় কম দিনের জন্য কেরলে এলেন স্যার?

অবনীর বদলে পার্থ উত্তর দিল, উপায় নেই ভাই। কলকাতায় এই অধমের একটা ছোটখাটো ব্যবসা আছে। প্রেস। এক গাদা কাজ নিয়ে বসে আছি, কালীপুজোর আগে ফিরতে না পারলে কারবারে লাল বাতি জ্বলে যাবে।

তা বলে মাত্র এক সপ্তাহ?

 উহুঁ, আট দিন। কাল সানডে টু নেক্সট সানডে তো আছিই। ট্রেনে উঠব আবার সেই সোমবার।

মাত্র আট দিনে কী দেখবেন? কেরল ছোট স্টেট ঠিকই, তবে এখানে পাহাড়-জঙ্গল-সমুদ্র সবই তো আছে। কতটুকু আপনারা কভার করতে পারবেন?

 বেশি ঘোরাঘুরির দরকারই বা কী! অবনী বলে উঠলেন, দু-তিনদিন তোমার সঙ্গে কোচিতে থাকব, তারপর সোজা পাড়ি দেব কোভালাম। সেখান থেকে ফের কোচি হয়ে ব্যাক।

সে কী স্যার? কেরলে এসে মুন্নার পেরিয়ার কোথাও যাবেন না? নীলগিরি হিলস্ না ঘুরলে তো কেরলে বেড়ানোর অর্ধেক আনন্দই মাটি। তারপর আলেপ্পি কুইলন।

আলেপ্পিকে প্রাচ্যের ভেনিস বলে না? পাৰ্থ ফুট কাটল, আলেপ্পিতে নাকি শহরের মধ্যে দিয়ে নৌকো চলে?

চলে তো। আলেপ্পির লেকে নৌকাবিহার একটা দারুণ এক্সপিরিয়েন্স। কুইলনেও আছে অষ্টমুড়ি লেক। সমুদ্রের ব্যাকওয়াটারে তৈরি এরকম ন্যাচারাল লেক কিন্তু আর কোথাও পাবেন না।

টুপুর পুট করে জিজ্ঞেস করে বসল, ব্যাকওয়াটারটা কী?

যে জলটা সমুদ্র থেকে এসে খড়িতে আটকে থাকে কিম্বা যে জল ল্যান্ডে এসে রয়ে যায়। মিতিন ঘাড় ঘুরিয়ে বলল, কেরলে এই ব্যাকওয়াটার ব্যাপারটা খুব ইন্টারেস্টিং। কোথাও সে লেক, কোথাও সরু খালের মতো, সেখানে নৌকো বাওয়া হচ্ছে, লঞ্চ চলছে …।

ইনফ্যাক্ট, কোচি থেকে কুইলন তো ব্যাকওয়াটার ধরে ধরেই চলে যাওয়া যায়। সুনীল সায় দিল, বিদেশিরা এই ভ্ৰমণটা খুব পছন্দ করে। একে বলা হয় ব্যাকওয়াটার ক্রুজ। এই ট্রিপ মিস। করলে কিন্তু স্যার আক্ষেপ থেকে যাবে।

বলছ?

 হা স্যার।

তারপর ধরুন, আলেপ্পি কুইলনে সুন্দর সি বিচ আছে। ভারকালার বিচ তো দুৰ্দান্ত, ওরকম সূর্যাস্ত পৃথিবীতে কোথাও দেখা যায় না।

তুমি তো ভারী মুশকিলে ফেলে দিলে হে। তুমিই তা হলে একটা টুর প্ল্যান ছকে দাও।

এই তো স্যার, এতক্ষণে আপনি লাইনে এসেছেন। সুনীল হো হো হাসল। উল্লসিত মুখে বলল, সে আমি করে দেব। আপনারা গাড়ি নিয়ে ঘুরবেন তো?

 হা, গাড়ি তো লাগবেই। কাঁহাতক বাসে-বাসে ট্যাঙোসট্যাঙোস করা যায়। আমার তো অন্তত পোষাবে না। এই বয়সে।

কথার মাঝেই টাটা সুমো থেমেছে এক হোটেলের দরজায়। চারতলা বাড়ি। মাথার উপর লাল-সবুজ আলোয় ঝিকমিক করছে। নাম, রেবতী ইন্টারন্যাশনাল। লাউঞ্জে পা রেখেই হোটেলটা মনে ধরে গেল সকলের। শ্বেতপাথরের মেঝে, দেওয়ালগুলো আয়নায় মোড়া, মাথার ওপর ঝুলছে পেল্লাই সাইজের ঝাড়বাতি, দামিদামি বেতের সোফা চমৎকার করে সাজানো, নানান রকম পাতাবাহারের টক শোভা পাচ্ছে চতুর্দিকে। রুম চার্জও খুব একটা বেশি নয়, মোটামুটি সাধ্যের মধ্যেই। পাৰ্থ তবু দরাদরি না করে থাকতে পারে না, কেতাদুরস্ত রিসেপশন কাউন্টারের সুট-টাই পরা কর্মচারীটির সঙ্গে মিনিট আট দশ লড়ে আরও খানিকটা কমিয়ে ফেলল ভাড়া নেওয়া হল দুটো ঘর। একটাতে থাকবে সহেলি, মিতিন আর টুপুর, অন্যটায় বুমবুমকে নিয়ে পাৰ্থ, অবনী।

রুমে ঢুকেই বুমবুমের দম শেষ। গাড়িতেই ঢুলছিল, তাকে টিভি চালিয়ে বসিয়ে দেওয়া হল কার্টুন চ্যানেলের সামনে, তবু সে ঘুমিয়ে পড়ছে। পার্থ পড়িমরি দৌড়ল তার খাওয়ার বন্দোবস্ত করতে। সহেলিও কাহিল, শুয়ে পড়লেন মরম গদিওয়ালা বিছানায়। সুনীলকে নিয়ে অবনীদের ঘরে এসে বসল মিতিন। পায়ে-পায়ে টুপুরও। বেয়ারাকে কফি দিতে বলা হয়েছিল, হুকুম করতে না করতে কফিপট হাজির।

টুপুর সবাইকে কফি ঢেলে দিল। মাপ করে দুধ মেশাল কাপে। চিনিও। তার এখন ক্লাস নাইন, এসব টুকিটাকি কাজ সে ভালই পারে। নিজেও এক কাপ কফি নিয়ে বসেছে বিছানায় আধশোওয়া অবনীর পাশটিতে। মিতিন আর সুনীল সোফায়। কথা বলছে টুকটাক।

কাপে চুমুক দিয়ে সুনীল বলল, তা হলে একটা কাজ করা যাক ম্যাডাম। কাল-পরশু দু দিন আপনারা কোচিতে থাকুন। আমি কালকের দিনটা ছুটি নিয়েই রেখেছি, পরশুটা ম্যানেজ করে নেব। যতটা পারি ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখিয়ে দেব আপনাদের। তারপর থার্ড ডে ভরে রওনা হয়ে যান মুন্নার। সেখানে একরাত থাকুন, পেরিয়ারে দু রাত, আলেপ্পিতে এক, কোভালামে এক। তারপর ফিরে কোচি থেকে ট্রেন ধরবেন।

মিতিন বলল, কিন্তু আমার দিদি যে কন্যাকুমারিকাতেও এক রাত থাকতে চায়। কোভালাম থেকে কন্যাকুমারিকা তো কাছেই, তাই না?

হু ঘণ্টা দুয়েক মতো লাগে।

তা হলে কোচিতে দুদিন না থেকে কন্যাকুমারিকাতেও যদি একটা রাত থাকতে পারি… কাল সারাদিনে কোচি ঘোরা হয়ে যাবে না?

পারবেন কি? বড় ধকল পড়বে।

কেন?

ধরুন, একবেলা কোচির দ্বীপগুলো দেখতে গেলেন….। সকাল নটার বোট ধরলেও ফিরতে-ফিরতে একটা-দেড়টা। তক্ষুনি কি আর মিউজিয়াম ছুটতে পারবেন? ভাবছিলাম বিকেলে আবার বটে করে আপনাদের সূর্যাস্ত দেখাতে নিয়ে যাব। সূর্য আরব সাগরে ড়ুবে যাচ্ছে, দৃশ্যটা কী অপূর্ব ভাবুন। তারপর সন্ধেবেলা কথাকলি নাচের প্রোগ্রাম দেখতে তো একবার যাওয়াই উচিত। ওটা কোচির অবশ্য-দর্শনীয় বস্তু। এ ছাড়া একটা হিল প্যালেস আছে, যেখানে কোচির রাজারা থাকতেন… ভাল পাখিরালয়ও আছে। একদিনে এত কিছু কী করে ম্যানেজ করবেন?

অবনী হাত নেড়ে বললেন, কাটছাঁট করো, কাটছাঁট করো। ওই দ্বীপটিপগুলো দেখা হলেই তো যথেষ্ট। ওগুলোর একটা হিস্টরিক্যাল ইম্পট্যান্স আছে।

নাচটা দেখবেন না স্যার? সুনীল ঈষৎ মনঃক্ষুন্ন যেন।

শরীর আর দিচ্ছে না, বুঝলে। টানা চুয়াল্লিশ ঘণ্টার ট্রেন জার্নি, এ কি মুখের কথা? কালকের দিনটা একটু হালকা-হালকা বেড়ানোই ভাল। এর সঙ্গে মিতিন যা বলছে, তাতে তো আবার পরশু ভোরেই যাত্রা। বড়িটাকে তার আগে একটু রেস্ট দিতে হবে না?

যা বলবেন স্যার। সুনীল মাথা নাড়ল, তা হলে কাল সকাল আটটার মধ্যে রেডি থাকুন, নটার বোটে আমরা সাইটসিয়িংএ বেরিয়ে পড়ব।

আটটা? অবনীর মুখ কাঁদো-কাঁদো, তোমাদের এখানে তো সাতটার সময়ে ভোর হয় সুনীল!

একটু দেরিতে হয়, তবে সাতটা নয় স্যার। ছটা-সাড়ে ছটা। আর নটার বোটে না গেলে সেই আবার দুটোয়। ফিরে তো আর সানসেট ট্রিপেও যেতে পারবেন না।

সুনীল…লক্ষ্মী ছেলে… তোমায় একটা অনুরোধ করব?

কী?

ওই দুটোর বোটটাই থাক। সমুদ্রে সূর্যাস্ত দেখে কী এমন হাত-পা গজাবে? ও আমি পুরীতে দেখেছি।

টুপুর আর থাকতে পারল না, বলে উঠল, পুরীতে সানসেট নয় বাবা, সানরাইজ দেখেছ।

ওই হল। দুটোরই তো রং এক।

দ্যাখো সিস্টার, আমার কিন্তু কোনও দোষ নেই। সুনীল হাত উলটে দিল, তোমার বাবার জন্যই কিন্তু তোমার সূর্যাস্ত দেখা হবে না।

তুমি আর ওকে উসকিয়োনা তো। যদি সময় থাকে, ফেরার পথে যখন কোচি আসব, তখন দেখে নেব।

পাৰ্থ ঘরে এসেছে। কাঁধে ঘুমন্ত বুমবুম। তাকে খাটে শুইয়ে কালকের প্রোগ্রামটা শুনল পার্থ। সেও অবনীর সঙ্গে একমত। বেড়াতে এসে নাকি বেশি হুটোপাটি করতে নেই, একটু জিরিয়ে ঘোরাই ভাল। তা সে আটদিনের টুরই হোক, কি আশিদিনের।

অগত্যা হাল ছেড়েছে সুনীল। উঠে পড়ে বলল, বেশ, তাই হোক। আমি দুপুরেই আসব। কিন্তু আমার একটা অনুরোধ আপনাদের রাখতেই হবে।

সন্ধেবেলার কথাকলি নাচ?

সে গেলেন তো ভাল। না গেলেন, তো না গেলেন। তবে রাতে কিন্তু আমাদের বাড়িতে সবাইকে ডিনার করতেই হবে। আমার মা পইপই করে বলে দিয়েছেন।

এটা কি একটু বেশি অত্যাচার হয়ে যাবে না? অবনী অপ্রস্তুত। মুখে বললেন, ছছটা লোক মিলে তোমাদের বাড়ি গিয়ে উপদ্ৰব করব?

কী বলছেন অবনীদা? ভূরিভোজের আমন্ত্রণ পেয়ে পার্থ যথারীতি আহ্লাদিত। চকচকে চোখে বলল, সুনীলের মা আদর করে খাওয়াতে চাইছেন, যাওয়া তো আমাদের কর্তব্য। আমরা অবশ্যই যাব সুনীল।

থ্যাঙ্ক ইউ। থ্যাঙ্ক ইউ।

ধন্যবাদ তো আমাদেরই দেওয়া উচিত। এত দূরে এসে একটা নেমন্তন্ন জুটে গেল…। পার্থ গুছিয়ে বসল, তবে ভাই, আমার দুটো জিজ্ঞাস্য আছে।

কী দাদা?

এক, তোমরা কি নারকোল তেলে রান্না করো?

না দাদা, আমরা বাদাম তেল খাই। সত্যি বলতে কী, আমাদের এখানে এখন বাদাম তেলেরই চল বেশি। বিশেষ করে শহরে।

গুড। দুনম্বর প্রশ্ন, তোমরা কি ভেজিটেরিয়ান?

পাক্কা ননভেজ। সুনীল হেসে ফেলল, আমরা আপনাদের মতোই মৎস্যভুক দাদা। শুধু সমুদ্রের মাছ একটু বেশি খাই, এই যা। তবে কাল আপনাদের জন্য মিঠে জলের মাছই থাকবে।

আমার সব চলে। আর চিংড়ি হলে মিঠে জলেরই বা কী, নোনা জলেরই বা কী!

সুনীলের হাসি আরও চওড়া হল, আপনার জন্য চিংড়িই থাকবে দাদা।

অতি উত্তম। যাও, আজকেই গিয়ে তোমার মাকে আমার প্রণাম জানিয়ে দাও।

আমার মা বাঙালি খানাটাও খুব ভাল বানান। কম দিন তো কলকাতায় ছিলাম না আমরা, প্ৰায় ষোলো বছর। বাবা রিটায়ার করে চলে এসেছেন, কিন্তু এখনও পোস্ত খাওয়াটা ভোলেননি। মাঝে মাঝেই মা ঝাল-ঝাল আলুপোস্ত রান্না করেন।

বাহ, বাহ। কাল তা হলে একটু আলুপোস্তও রেখো।

বেশ, তাও থাকবে। সুনীল হাসতে হাসতে ঘড়ি দেখল, আজ তা হলে আসি। আপনারা টায়ার্ড আছেন, বিশ্রাম করুন। কাল ঠিক দুপুর একটায় আমি হাজিরা দেব।

সুনীল চলে যেতেই টুপুর চোখ পাকিয়েছে, তুমি কী হেংলু গো পার্থমেসো! এভাবে কেউ খাওয়ার কথা বলে?

অন্যায়টা কী আছে? গিয়ে খাবার দেখে নাক সিঁটকোবি, ফিরে এসে নিন্দে করবি, তার চেয়ে আগেই খোলাখুলি কথা হয়ে যাওয়া ভাল নয়? ও বেচারারও আর মেনু নিয়ে কোনও টেনশন থাকল। না।

মিতিনের মুখে চাপা হাসি। বলল, এক দিক দিয়ে তোর মেসো অবশ্য ঠিকই করেছে। পেটে খিদে মুখে লাজ করে তো আমরা অনেক সময়েই ঠকি। তোর মেসোর মুখে যখন দক্ষিণী খানা রোচেই না…

আমার কিন্তু ভালই লাগে।

সে তো আমারও। একদিন কেরলিয়ান ডিশ খেলে একটু অন্য রকম স্বাদও পেতাম।

অবনী বলে উঠলেন, এবার খাওয়ার গল্প একটু থামাবে? যাও, মাসি-বোনঝি এখন কেটে পড়ো তো। ঘরে গিয়ে ফ্রেশ হও। আমি আর পাৰ্থ ততক্ষণ একটু মাথা ছাড়াই।

এখন আপনারা দাবা নিয়ে বসবেন? মিতিন ভুরু কুঁচকোল, ট্রেনে চুয়াল্লিশ ঘণ্টার মধ্যে অন্তত আঠারো ঘণ্টা দাবা খেলেছেন, তাও আশ মিটল না?

দানটা শেষ হয়নি যে। এখনও পার্থর একটা গজ, একটা নৌকো, একটা ঘোড়া জীবিত। আমার একটা নৌকো, দুটো গজ।

পার্থ বলল, বোড়েও আছে আমাদের তিনটে করে। এখনও যে কেউ জিততে পারি।

টুপুর মিতিনমাসির দিকে তাকিয়ে কাঁধ ঝাঁকাল। সত্যি, বাবা আর পার্থমেসো পারেও বটে। এবার বেড়াতে বেরনোর সময়ে বাবাকে মোটা-মোটা বই নিতে দেওয়া হয়নি, তাই প্রতিশোধ নেওয়ার জন্যই যেন বাবা মেতে আছে ওই চৌষট্টি ঘরের খেলায়। প্রথম গেম শুরু হয়েছিল হাওড়া ছাড়ার পরপরই, এখনও চলছে সেটাই। খেলার সময়ে দুজনেরই বাহ্যজ্ঞান লোপ পায়, ডেকে-ডেকে সাড়া পাওয়া যায় না। বাবা তখন ক্রামনিক, তো পার্থমেসো কাসপারভ। একটা চাল দিতে দেড় ঘণ্টা, দুঘণ্টা পর্যন্ত সময় লেগে যায়। আবার চাল দেওয়া মাত্রই তা ফেরত নেওয়ার জন্য বায়না জুড়ে দেয় দুজনে। জোর তর্ক বাধে তখন, দুজনেই মুঠো পাকায়, গরগর করেসে এক দৃশ্য বটে। এবার গোটা ভ্রমণে দুজনে ওই একই গেম চালাবে বলে মনে হয়।

অবনী শয্যা ছেড়েছেন। টেবিলের কাছে গিয়ে লাল কিটব্যাগ খুললেন। হাতড়াচ্ছেন। বিস্ময়ের সুরে বলে উঠলেন, কী ব্যাপার, দাবার বোর্ডটা গেল কোথায়? এখানেই তো রেখেছিলাম।

পার্থ হেসে বলল, ও অবনীদা, ওটা তো আমার ব্যাগ। আপনারটা তো কাবার্ডে।

বলতে বলতে গিয়ে অবনীর কিটসব্যাগখানা বের করেছে পার্থ। দুটো ব্যাগই হুবহু এক। রং, সাইজ, এমনকী মনোগ্রামটাও দুটো টিশার্টের সঙ্গে একটা ব্যাগ ফ্রি দিচ্ছিল বলে চার-চারখানা টি-শার্ট কিনে ফেলেছিল পাৰ্থ, একটা ব্যাগ উপহার দিয়েছে অবনীকে। এবং দুজনেই মাঝে-মাঝে ব্যাগ গুলিয়ে ফেলছে। ক্যামেরা বার করতে গিয়ে অবনীর ছাতা টানছে পাৰ্থ, নিজের টুথব্রাশ ভেবে পার্থর টুথব্রাশে দাঁত মেজে আসছেন অবনী। কেলোর কীর্তি আর কাকে বলে!

ফোল্ডিং বোর্ড বের করে দুই ভায়রাভাই নেমে পড়েছেন রণক্ষেত্রে। মিতিন চলে গেল পাশের ঘরে। টুপুরও উঠল। যেতে গিয়ে আর একবার চোখ পড়ল ব্যাগ দুটোয়।

ফিক করে হেসে ফেলল টুপুর। যমজ ব্যাগ নিয়ে একটা রহস্য কাহিনী ফাঁদলে কেমন হয়? দারুণ জমে যাবে কিন্তু গল্পটা!

.

০২.

সি-লর্ড জেটি থেকে মোটরবোট ছাড়ল দুটো পাঁচে। জনাসত্তর যাত্ৰী নিয়ে তিরতির জল কেটে-কেটে চলেছে আরব সাগর অভিমুখে। দেখতে দেখতে দূরে সরে গেল এর্নাকুলাম।

জলযানটিতে বসার ব্যবস্থা অতি চমৎকার। ডেকে খানচল্লিশেক চেয়ার, নীচের খোলেও বসতে পারে জনাপঞ্চাশ-যাট। খোল মানে বদ্ধ কিছু নয়, চতুর্দিকে জানলা, প্রকৃতি দর্শনে কোনও অসুবিধে নেই। হুহু হাওয়া বইলেও রোদ্র আজ বড় চড়া, তাত এড়াতে বেশিরভাগ যাত্রীই ভিড় করেছেনীচের তলায়। এক কেরলীয় গাইড হাত-মুখ নেড়ে বর্ণনা দিচ্ছে যাত্রাপথের। ভাষাটা ইংরেজি, তবে উচ্চারণের গুণে তামিল-মলয়ালম বলেও চালিয়ে দেওয়া যায়।

একটি বর্ণও বোধগম্য হচ্ছিল না টুপুরের। উশখুশ করছিল। টের পেয়ে সুনীল বলল, কী সিস্টার, ওপরে যাবে নাকি?

বুমবুম তো একপায়ে খাড়া। শুনেই নাচছে, চলো না। চলো না, প্লিজ।

সহেলি জানলার ধারে গুছিয়ে বসেছেন। বললেন, আমি বাপু ছায়া ছেড়ে নড়ছি না।

অবনী বললেন, আমিও এখানে দিব্যি আছি। ফুরফুরে হাওয়া খাচ্ছি।

এক কাজ করো। তোমার ছাতাটা ওদের বের করে দাও। একটু তো রোদ আটকাবে। অবনীর লাল ব্যাগখানা আনা হয়েছে সঙ্গে। তাতে কী আছে আর কী নেই! চিপস, চানাচুর, ফুটকেক, বিস্কুট, ডজনখানেক কলা, লাড়ু, বড় বোতলে জল, ঢাউস কোল্ড ড্রিংক, ঘাম মোছার তোয়ালে, ছাতা, টর্চ, এমনকী পেতে বসার খবরের কাগজও।

মিতিন ব্যাগ খুলে শুধু কোল্ড ড্রিংকের বোলটা তুলে নিল। বলল, এই উথালপাথাল হাওয়ায় ছাতা খোলা যাবে না দিদি। বুমবুমকে তা হলে বেতের টুপিটা অন্তত পরিয়ে দে।

বুমবুমের তর সইছে না। কোনওরকমে টুপি চড়িয়ে টুপুর সুনীলের সঙ্গে লাফাতে লাফাতে চলে গেল উপরে। প্রখর উত্তাপে জনাদশ-বারো যাত্রী রয়েছে ডেকে। বেশিরভাগই বিদেশি। দামি ক্যামেরায় সাহেব-মেমসাহেব ছবি তুলছে পটাপট। পার্থমেসোও ক্যামেরা কাঁধে উঠে এল দোতলায়। রেলিং-এর ধারে দাঁড়িয়ে প্রাকৃতিক দৃশ্য ফোকাস করছে। বুমবুম উত্তেজিত মুখে নির্দেশ দিচ্ছে বাবাকে।

মিতিন আর টুপুর দুজনের পরনেই আজ সালোয়ার কামিজ। রোদ বাঁচাতে ওড়নায় মাথা ঢাকল টুপুর। মিতিনকে জিজ্ঞেস করল, ডান দিকে ওটা কী আইল্যান্ড গো?

বোলঘাট্টি। সুনীল উত্তর দিল, ওখানে যে সাদা মতন বাড়িটা দেখছ, ওটা একটা ডাচ প্যালেস। এখন অবশ্য হোটেল। ওই দ্বীপে একটা গলফ খেলার মাঠও আছে। শীতকালে অনেকে পিকনিক করতে যায় বোলঘাট্টিতে।

আমরা কি ওই ডাচ প্যালেসটাই দেখতে যাচ্ছি?

না না। সেটা তো মাট্টানচেরিতে। সেই প্যালেসের হিস্ট্রি ভারী অদ্ভুত। ডাচ, মানে ওলন্দাজরা মোটেই ওটা তৈরি করেনি। প্রাসাদটা আদতে পর্তুগিজদের বানানো।

এদিকে ডাচ প্যালেস নাম, ওদিকে বানিয়েছে পর্তুগিজ?

ইয়েস সিস্টার। যে সব পর্তুগিজ আমাদের দেশে এসেছিল, তারা বেশিরভাগই তো সুবিধের লোক ছিল না। হয় ছিল জলদস্যু, নয় লুঠেরা, খুনে। তা ওইরকমই এক বজ্জাত পর্তুগিজ একটা হিন্দু। মন্দিরে লুঠপাট চালিয়েছিল। খবর পেয়ে কোচির রাজা তো চটে লাল। তখন রাজাকে শান্ত করার জন্য পর্তুগিজরা আস্ত একখানা। প্ৰাসাদ তৈরি করে রাজাকে উপহার দেয়। প্রায় সাড়ে চারশো বছর। আগে। পনেরোশো পঞ্চান্ন সালে। কোচি তখন ছিল পর্তুগিজদের কলোনি। শখানেক বছর পর ডাচরা এসে পর্তুগিজদের হঠিয়ে দেয় এবং সুন্দর করে সাজিয়ে গুছিয়ে আবার তারা এই প্রাসাদ ভেট দেয় কোচিরাজকে।

 তার মানে একই প্যালেস দুবার উপহার দেওয়া হল?

হল। রাজাকে সন্তুষ্ট করতে ডাচরাও মরিয়া ছিল যে!

গল্পে-গল্পে এগোচ্ছে মোটরবোট। বাঁয়ে এবার উইলিংডন দ্বীপ। জলের ধারে অতিকায় এক হোটল। বিলাসবহুল হোটেলটা দেখে টুপুরের একটু আপশোশ হল মনে-মনে। ইস, ওই হোটেলেই তো তারা উঠতে পারত! দূরে আরব সাগর দেখা যাচ্ছে, হোটেলে বসে সারাদিন বেশ তাকিয়ে থাকত সমুদ্রের দিকে।

উইলিংডন পেরিয়ে, থইথই ব্যাকওয়াটার ছেড়ে মোটরবোট ঘুরল বাঁয়ে। অপেক্ষাকৃত সরু খাঁড়িতে। মিনিট পাঁচ-সাতের মধ্যেই এসে পড়ল মাট্টানচেরির ফেরিঘাট। এখানেই প্রথম বিরতি, এক ঘণ্টা থামবে বোট।

ঘাট থেকে মাট্টানচেরির ডাচ প্যালেস খুব একটা দূরে নয়। পৌঁছে টুপুর হতাশই হল বেশ। প্রাসাদের চেহারাটা যেন কেমনকেমন। দেখে মনে হয় নিতান্তই সাধারণ এক দোতলা বাড়ি। উঁচু পাঁচিলে ঘেরা। যতই বড়সড় হোক, বাড়িটার আভিজাত্যও নেই, জলুসও নেই।

বড় লোহার গেটখানা বন্ধ। লোহার গেটের মধ্যিখানে খুদে। একখানা দরজা, সেখান দিয়েই গলে-গলে ঢুকছে টুরিস্টরা। প্রাসাদের একটা অংশ নিয়ে মিউজিয়াম। দেখতে হলে উঠতে হয় দোতলায়, উঁচু-উঁচু সিঁড়ি ভেঙে।

কোনওক্রমে উঠলেন সহেলি। হাঁপাচ্ছেন। জিরোচ্ছেন। টুপুররা দল বেঁধে ঢুকে পড়ল অন্দরে। প্রথম ঘরে দেওয়াল জোড়া প্রকাণ্ডপ্রকাণ্ড মিউরাল পেন্টিং। নিপুণ হাতে আঁকা রামায়ণ মহাভারতের কাহিনী। দেওয়ালের গায়ে কাঠের কাজও তারিফ করার মতো। বাকি দু-তিনটে ঘরে রাজারাজড়াদের পোশাক, অস্ত্রশস্ত্র, চোখ ধাঁধানো কারুকাজ করা পালকি, পুরনো আমলের দলিল দস্তাবেজ। অবনী অনেকটা সময় নিয়ে চোখ বোলালেন দলিলগুলোয়। এই প্রাসাদেই নাকি অভিষেক হত কোচিরাজার, ছোট-বড় রাজসিংহাসনও সংরক্ষিত আছে প্রাসাদে। বুমবুম দড়ির বেড়া টপকে সিংহাসনে বসে পড়তে যাচ্ছিল, টুপুর খপ করে ধরে ফেলল তাকে। মিতিনমাসির সঙ্গে অন্ধকার সিঁড়ি বেয়ে নীচের মিউজিয়ামও দেখে এল টুপুর। আলাদা করে বিশেষ কিছু দেখার নেই সেখানে। সেই একই ধরনের রাজপোশাক, ঢাল-তলোয়ার, নয়তো কিছু কাগজপত্ৰ।

প্রথম ঘরটা দেখেই নেমে এসেছিলেন সহেলি। নীচের ধাপিতে বসে জল খাচ্ছেন ঢকক। পার্থর মুখও ঈষৎ বেজার। মিউজিয়ামে ফ্ল্যাশগান জ্বালানো মানা বলে একটা ছবি তুলতে পারেনি বেচারা। একমাত্ৰ অবনীই যা তৃপ্ত। এই ধরনের ঐতিহাসিক স্থান তাঁর বড় প্রিয়।

এবার যাত্রা ইহুদিদের সিনাগগের দিকে। ডাচ প্যালেস থেকেই দেখা যাচ্ছিল সিনাগগের চূড়া, মনে হচ্ছিল যেন পাশেই, কিন্তু যেতে হল বেশ খানিক ঘুরে। রাস্তায় পড়ল কোচির মশলাপট্টি। কেরলের ভুবন বিখ্যাত এলাচ, লবঙ্গ, দারচিনি, গোলমরিচ নাকি নিলাম হয় এই বাজারে। আজ রবিবার, নিলামখানা বন্ধ, পাড়াটাও তাই ফাঁকাফাঁকা।

নিলামখানার গায়েই সরু গলি। জু টাউন। দুধারটা দেখতে দেখতে হাঁটছিল টুপুর। ইহুদিপল্লীর বাড়িগুলো অতি প্রাচীন। সুদূর অতীতের গন্ধ যেন লেগে আছে গায়ে। এদিক-ওদিক বেশ কয়েকটা দরজির দোকান, আর কিউরিয়ো শপ। ভ্রমণার্থীদের জন্য খোলা আছে দুর্লভ শিল্পবস্তুর দোকানগুলো, কেনা-বেচা চলছে অল্পবিস্তর।

সহেলি একটা দোকানে দাঁড়িয়ে পড়েছেন। চেঁচিয়ে ডাকলেন, এই মিতিন, দেখবি আয়।

সুনীলের সঙ্গে কথা বলতে বলতে এগিয়ে গিয়েছিল মিতিন। ফিরে এল, কী হল?

পেতলের ঘণ্টাটা কী সুন্দর দ্যাখ! নিয়ে নেব নাকি?

কী করবে নিয়ে?

কেরল টুরের স্মৃতি হিসেবে রাখব। ড্রয়িংরুমের পরদাতেও লাগিয়ে দিতে পারি। পরদা নড়লেই ঢং করে বাজবে। কিম্বা গিফটও করা যায় কাউকে।

টুপুর দুদিকে মাথা নাড়ল। নাহ্, বেড়াতে বেরিয়ে মার বাজার করার বাতিকটা আর গেল না।

সহেলির আগ্রহ টের পেয়ে দোকানদারও উদ্দীপিত। হাত-মুখ নেড়ে বলল, নিয়ে নিন ম্যাডাম। এ সত্যিই অতি দুষ্প্রাপ্য বস্তু। আপনি নিশ্চয়ই এজেকিয়াল রাহাবির নাম শুনেছেন? ওই যে সিনাগগের মাথায় বড় ঘড়িটা দেখছেন, ওটা যিনি তৈরি করিয়েছিলেন। এই ঘণ্টাও সেই রাহাবিরই সম্পত্তি। আপনি যদি নেন, তো জলের দরে দিয়ে দেব। আড়াইশো বছরের পুরনো ঘণ্টা পাবেন মাত্র আড়াই হাজার টাকায়।

মিতিন ফিসফিস করে বলল, কথায় ভুলো না। ঘণ্টাটার বয়স এক বছরও হয়েছে কিনা সন্দেহ। ওটা যেখান থেকে কিনেছে, সেখানকার দামের ট্যাগ সাঁটা ছিল গায়ে। ছিঁড়ে ফেললেও ছাপানো কাগজের কুচি কিন্তু এখনও ঘণ্টায় লেগে আছে।

সুনীলও নিচু গলায় বলল, এরা কিন্তু খুব ঠকায় ম্যাডাম। ঠিকঠাক না চিনে কেনা কিন্তু উচিত হবে না। অগত্যা সহেলিকে নড়তেই হয়। জুলজুল চোখে বাহারি ঘণ্টাটাকে আর একবার দেখে নিয়ে এগোলেন সহেলি। পঁচিশতিরিশ হাত গিয়েই সিনাগগ। ইহুদিদের উপাসনালয়। বহিরঙ্গে তেমন পারিপাট্য নেই বটে, তবে প্রাচীনত্ব বেশ বোঝা যায়। রাহাবির ঘড়িটি ভালই সময় দিচ্ছে। তিনটে কুড়ি।

টিকিট কেটে, জুতো ছেড়ে, সিনাগগে ঢুকেই চক্ষু ছানাবড়া। ভিতরে রঙের কী বাহার! ঝলমল ঝলমল করছে! সহেলি পর্যন্ত ঘণ্টার শোক ভুলে বিমোহিত। দর্শনার্থীদের ভিড়ে এমনিই গিজগিজ করছিল চারদিক, টুপুরদের মোটরবোটের দলটা ঢুকে ঠাঁই নাই ঠাঁই নাই দশা। তার মধ্যেই সব্বাইকে এক জায়গায় জড়ো করেছে গাইড। গড় গড় আউড়ে চলেছে সিনাগগবৃত্তান্ত। সেই দুর্বোধ্য ইংরেজিতে।

টুপুর, মিতিন সরে এল। সুনীলের মতো গাইড থাকতে তারা ওই লোকটার বকবকানি শুনবে কেন।

গলা ঝেড়ে সুনীল বলল, এই সিনাগগ আর ওই ডাচ প্যালেস মোটামুটি সমসাময়িক। এটা তৈরি হয়েছে পনেরোশো আটষট্টিতে। আমাদের কোচির রাজা ভাস্কর প্রথম রবি বর্মা জমিটা দান করেছিলেন ইহুদিদের। ওই দেওয়ালে গাঁথা তামার পাত দেখছেন, ওটাই দানপত্র।

টুপুর জিজ্ঞেস করল, কিন্তু ইহুদিরা কোচিতে এল কী করে?

 সে এক লম্বা স্টোরি। পরে শুনিসখন। মিতিন বলল, এখন ভাল করে সিনাগগটা দ্যাখ।

পাৰ্থ প্ৰাণ ভরে ছবি তুলছিল। কাছে এসে আঙুলে তারিফের মুদ্রা ফুটিয়ে বলল, দেখার মতো জায়গা বটে। কী ঘ্যামচ্যাক সব ঝাড়লণ্ঠন, বাপস্!

আর কত ধরনের ল্যাম্প! গা দিয়ে যেন রামধনুর রং ঠিকরোচ্ছে!

মাঝখানে পেতলের রেলিংওয়ালা গোল জায়গাটা কীসের?

 বুঝতে পারলে না? ওখানে দাঁড়িয়ে রাবি প্রার্থনা করেন।

রাবি মানে তো ইহুদিদের পুরোহিত, তাই না মিতিনমাসি?

কারেক্ট। সুনীল হাসল, আর ওপরে যে ঘেরা ব্যালকনি, ওখানে লাইন দিয়ে দাঁড়ান ভক্তরা।

বুমবুম বিজ্ঞের মতো মেঝের টাইলস পরিদর্শন করছিল। গম্ভীর গলায় প্রশ্ন করল, এই সব রঙিন পাথর কি ইহুদিদের বানানো?

উহুঁ। এই টাইলস আনা হয়েছিল চিন দেশের ক্যান্টন থেকে। ওই যে রাহাবির কথা হচ্ছিল, উনিই আনিয়েছিলেন। টাইলসের উপর নকশাগুলো হাতে আঁকা। চিনাদেরই।

অবনী আর সহেলি দক্ষিণী গাইডের বক্তৃতা শুনছিলেন এতক্ষণ। অবনী হঠাৎ এসে জিজ্ঞেস করলেন, এখানে নাকি একটা দারুণ ইন্টারেস্টিং জিনিস আছে সুনীল?

কী বলুন তো স্যার?

গ্রেট স্ক্রল।

ও হ্যাঁ, ওটার কথা তো বলাই হয়নি। ছাগলের চামড়ার ওপর লেখা একটা ওল্ড টেস্টামেন্ট আছে এখানে। হিব্রু লিপিতে।

তাই নাকি? মিতিন অবাক, পুরো ধর্মগ্রন্থ ছাগলের চামড়ায় লেখা?

ইহুদিদের ধর্মগ্রন্থ তো তালমাদ। তার গোটাটাই আছে কিনা বলতে পারব না ম্যাডাম। তবে আমার এক জু বন্ধু ছিল, তার মুখে শুনেছি, ওদের পবিত্র টোরা, মানে ধর্মীয় অনুশাসনলিপি নাকি রাখা থাকে সিনাগগের দেওয়ালসিন্দুকে।

অনুশাসন মানে কি টেন কমান্ডমেন্টস? অর্থাৎ সিনাই পর্বতে মোজেস যে দৈববাণী পেয়েছিলেন…?

দৈববাণীর গল্পটা জানে টুপুর। সিসিল বি ডি মিলির তৈরি দারুণ জমকালো টেন কমান্ডমেন্টস সিনেমাটা মাত্ৰ কমাস আগে দেখেছে। সে। নন্দনে একটা বিশেষ শো হয়েছিল, নিয়ে গিয়েছিল স্কুল থেকে। ছবিতে সমুদ্র দুভাগ হয়ে যাওয়ার দৃশ্যটা ভাবলে এখনও টুপুরের গায়ে কটা দেয়।

অবনী উৎসুক স্বরে জিজ্ঞেস করলেন, ওই গ্রেট স্ক্রল একবার দেখা যায় না সুনীল?

আমি যতদূর জানি, স্যাবাথের দিন ছাড়া ওটা বের করা হয় না স্যার। মানে শনিবার। যেদিন এঁরা প্রার্থনা-টার্থনা করেন।

দ্যাখো না একবার চেষ্টা করে। তুমি তো প্রেসের লোক, তুমি রিকোয়েস্ট করলে হয়তো…

দেখছি।

গুরুর অনুরোধ রক্ষা করতে কোথায় যেন গেল সুনীল। মিনিট দশেক পর ফিরে এসে বলল, এমনিতে ওঁরা কাউকে দেখান না। অনেক বলে কয়ে ম্যানেজ করলাম। তবে…

কী হবে?

ছটার সময়ে আসতে হবে। সিনাগগে ভিজিটিং আওয়ার শেষ হওয়ার পর। সিনাগগ দেখাশুনো করে একটা ট্রাস্টি বোর্ড। ওই ট্রাস্টি বোর্ডেরই এক সদস্য সিনাগগের কেয়ারটেকার। পাশেই বাড়ি। তিনি বললেন, রাবিকে বলে তখন একটা ব্যবস্থা করতে পারেন।

বাহ। খুব ভাল। এতে সমস্যা কোথায়?

আমাদের মোটরবোট যে চলে যাবে স্যার। তা ছাড়া আরও কিছু সাইটসিয়িং আছে..

মিতিন বলল, আমরা যদি বোটে না ফিরি? এখান থেকে তো ট্যাক্সি নিয়ে যাওয়া যায়? ব্রিজ ক্রস করে?

তা অবশ্য যায়। মোটরবোট তো এর পর মাট্টানচেরিরই আর একটা ঘাটে যাবে, ওখানেই না হয় আমরা পাকাপাকি নেমে যাব। কী, তাই করবেন?

সবাই এক বাক্যে রাজি। একমাত্র সহেলিই যা সামান্য গাঁইগুই করছিলেন। হোটেলে ফিরে, সুনীলদের বাড়ি যাওয়ার আগে, তাঁর টুকটাক মার্কেটিং-এর বাসনা ছিল। সন্ধে অবধি মাট্টানচেরিতে পড়ে থাকলে তা কি আর হবে।

তা যাই হোক, দলের সঙ্গে বেরোলে কিছু সমঝোতা তো করতেই হয়। কেয়ারটেকারকে জানিয়ে মোটরবোটে এল টুপুররা। পরবর্তী ফেরিঘাটে নেমে সাইকেল রিকশা ধরে সোজা সেন্ট ফ্রান্সিস চার্চ। ভারতে ইউরোপিয়ানদের তৈরি প্রথম গির্জা।

জানাই ছিল আজ রবিবার, টুরিস্টদের জন্য গির্জা বন্ধ। তবে এসেছে যখন, জায়গাটা তো দেখতেই হয়। ভাস্কো-দা-গামার সমাধিস্থল বলে কথা!

গির্জায় পৌঁছে টুপুর অবশ্য বেজায় হতাশ। ভাস্কো-দা-গামার সমাধির জায়গাটাও গির্জার ভিতরে। অতএব সেটা দেখারও কোনও সুযোগ নেই।

পার্থ ঠোঁট উলটে বলল, স্যাবাথ ডে-তে গির্জায় আসার ঠেলা বোঝ। পুরো জার্নিটাই বেকার।

বুমবুম ভুরু কুঁচকে বলল, স্যাবাথ ডে মানে কী বাবা?

বিশ্রামের দিন। খ্রিস্টান আর ইহুদিরা বিশ্বাস করেন, ভগবান পৃথিবীটাকে গড়েছিলেন ছদিনে। ব্যাপক খাটুনি গেছিল তো, তাই সপ্তম দিনে তিনি বিশ্রাম নিয়েছিলেন। ভগবানের দেখাদেখি ভক্তরাও তাই সপ্তাহে একটা দিন বিশ্রাম নেয়। সেদিন নো কাজ। একমাত্র প্রার্থনা ছাড়া। ইহুদিরা শনিবারটাকে স্যাবাথ বলে মানেন, খ্রিস্টানরা রবিবার।

বুমবুম আরও গম্ভীর হয়ে বলল, আমিও খ্রিস্টান হয়ে যাব। তা। হলে কেউ আমায় রোববার পড়তে বসতে বলতে পারবে না।

হুহ। বাকি ছদিন তুমি পড়ে যেন উলটে যাচ্ছ।

আমি উলটোই না। সোজাই থাকি।

বুমবুমের কথার ভঙ্গিতে হা-হা হেসে উঠল সবাই। কাগজ পেতে একে-একে বসে পড়েছে গির্জার সামনেটায়। বোটে ফেরার তাড়া নেই, এখন মনের সুখে গুলতানি চলতে পারে ঘণ্টাখানেক। ব্যাগ থেকে বেরিয়ে পড়ল খাবারদাবার। একটু-আধটু মুখ চলছে সকলেরই।

টুপুরেরই শুধু মন খারাপটা কাটছিল না। আনমনে দেখছিল গির্জাটাকে। বিকেলের সূর্য এসে পড়েছে গির্জার মাথায়। সোনালি আলোয় কী ঝকঝক করছে সখানা। আহা, আজ রবিবার না হলে সত্যিই খুব ভাল হত।

বিড়বিড় করে টুপুর বলেই ফেলল, এত দূর এসেও ভাস্কো-দা-গামার সমাধিটা মিস হয়ে গেল! কোনও মানে হয়?

সমাধি আর এখানে কোথায় টুপুর? মিতিন সান্ত্বনা দিল, ভাস্কো-দা-গামা মারা গিয়েছিলেন পনেরোশো চব্বিশে। তার চোদ্দো বছর পরেই তো কফিন এখান থেকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল লিসবনের বেলেম কনভেন্টে।

সুনীল বলল, ইয়েস সিস্টার। এখানে শুধু জায়গাটাকে ঘিরে রাখা আছে। ভেতরে কিছু নেই।

তা হোক, এক সময়ে তো ছিল। ভাস্কো-দা-গামার মতো একজন বিখ্যাত ভূপর্যটক

ভুল বললি টুপুর। ভাস্কো-দা-গামা মোটেই ভূপর্যটক নন। অবনী মেয়েকে শুধরে দিলেন, ভাস্কো-দা-গামা ছিলেন পাক্কা বিজনেসম্যান। কোচিতে এসে তিনি একটা ফ্যাক্টরিও করেছিলেন। জাহাজ-জাহাজ মশলা চালান দিতেন এখান থেকে।

দেখতে দেখতে কেটে গেল সময়। ফাঁকে ফাঁকে লাল ব্যাগের খাবারও শেষ। পাঁচটা নাগাদ উঠে পড়ল সবাই। এবার গুটিগুটি যাওয়া যাক সিনাগগে।

ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য সাইমন পেরেজ বাড়িতেই অপেক্ষা করছিলেন। বছর ষাটেকের মানুষটার চেহারাটা দেখার মতো। পেটা স্বাস্থ্য, হাইট প্রায় ছফুট, কাটাকাটা নাক, চোখ, গায়ের রং দেখে বোঝার উপায় নেই ভারতীয় না বিদেশি। রোদে পুড়ে ঈষৎ তামাটে ভাব এসেছে বটে, তাও দারুণ ফরসা।

সুনীলকে দেখে সাইমন বললেন, তাড়াতাড়ি এসে ভালই করেছ। তোমাদের কাজটা সেরে আমি একবার মেনল্যান্ডে যাব। কোট্টায়াম থেকে আমার এক বন্ধুর আসার কথা আছে।

সুনীল জিজ্ঞেস করল, আপনিই দেখাবেন তা হলে?

 না না। ওটা তো রাবির দায়িত্ব। আমি সঙ্গে থাকব। চলো , আমরা আগে রাবির কাছে যাই।

সিনাগগের রাবি জোস হ্যালেগুয়া থাকেন জু টাউনে, গলিতে। আদ্যিকালের বাড়িটার সদর খোলাই ছিল, এক স্যাঁতসেঁতে অন্ধকার-অন্ধকার ঘরে টুপুরদের বসালেন সাইমন। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই অন্দরমহল থেকে এক বৃদ্ধ দম্পতির আবির্ভাব। বয়স্ক মানুষটি ভারী সৌম্যকান্তি। টকটকে রং, মুখময় সাদা দাড়ি, চোখে সোনালি ফ্রেমের চশমা। তুলনায় মহিলা ছোটখাটো। পরনে লং স্কার্ট, পাকা চুল চুড়ো করে বাঁধা।

ঘরে টিউবলাইট জ্বেলে দিয়েছেন জোস। তাতেও অবশ্য ঔজ্জ্বল্য তেমন বাড়ল না ঘরের, মলিন দেওয়াল যেন শুষে নিল আলো। সোফা, সেন্টার টেবিল, কাচের আলমারি সবই আছে, তবে প্রতিটি আসবাবেরই হতশ্ৰী দশা। কার্পেটটিও যথেষ্ট মলিন। একমাত্র টেলিভিশন সেটটিই যা নতুন।

সুনীলই পরিচয় দি সকলের। জোস হ্যালেগুয়া রীতিমতো বিস্মিত। বললেন, তোমরা সেই সুদূর ওয়েস্ট বেঙ্গল থেকে এসেছ?

পার্থ বলল, হ্যাঁ স্যার। এখানকার সিনাগগ আমাদের মুগ্ধ করেছে।

শুনে সম্মানিত বোধ করলাম। স্পষ্ট উচ্চারণে ইংরেজি বলছেন জোস, কিন্তু তোমরা হঠাৎ গ্রেট স্ক্রল দেখতে চাইছ কেন?

অবনী বললেন, ইতিহাস আমায় খুব টানে। আর প্রাচীন ইতিহাসের সঙ্গে আপনারা, ইহুদিরা তো ভীষণভাবে জড়িয়ে আছেন। আপনাদেরই এক উপাসনালয়ে এসে আপনাদের ধর্মীয় অনুশাসনলিপি দর্শন তত এক পরম সৌভাগ্যের বিষয়।

হুম। তা আমাদের এই সিনাগগ সম্পর্কে আপনার কী জানা আছে?

এই সিনাগগ তৈরি হয়েছিল পনেরোশো আটটিতে। ষোলোশো বাষট্টিতে পর্তুগিজরা এটিকে পুড়িয়ে দেয়। তার দুবছর পরে ডাচরা এই সিনাগগ ফের নতুন করে বানিয়ে দিয়েছিল। অবশ্য আপনাদের এই জু টাউন তৈরি হয়েছে তারও হাজার বছর আগে। ইয়েমেন আর ব্যাবিলন থেকে আসা ইহুদিদের হাতে। আসিরিয়ার সম্রাট নেবুচাদনেজার জেরুজালেম দখল করার পর পালিয়ে এসেছিলেন ওই ইহুদিরা। ঠিক বলছি?

মোটামুটি। তবে আমরা কিন্তু ইয়েমেন বা ব্যাবিলনীয় ইহুদি নই।

সে আপনার চেহারা দেখেই অনুমান করা যায়। আপনারা সম্ভবত এসেছেন স্পেন থেকে। ফিফটিনথ সেঞ্চুরিতে।

এতক্ষণে জোসের ঠোঁটে অনাবিল হাসি, বাহ, আমাদের অনেক খবরই তো রাখেন দেখছি!

পাশ থেকে সাইমন বলে উঠলেন, জানেন তো, এই মাট্টানচেরির অনেকটাই কিন্তু আমাদের হাতে গড়া।

সেই আমরাই এখন মাট্টানচেরি থেকে হারিয়ে যাচ্ছি, মিসেস হ্যালেগুয়া এই প্রথম কথা বললেন, গোটা মাট্টানে আমরা পড়ে আছি মাত্ৰ জনাষাটেক। তাও বেশির ভাগই বুড়োবুড়ি। আমাদের ছেলেমেয়েরা তো আর এ-দেশে থাকতেই চায় না। ভাবতে পারো, এর্নাকুলামের সিনাগগে এখন তালা ঝোলে?

দুঃখ কোরো না শ্যারন। ইহুদিদের জীবনটাই তো এরকম।

জোস হ্যালেগুয়া যেন সামান্য উদাস, এই বিশাল দুনিয়ায় কোথাও কি আমরা থিতু হতে পেরেছি? হয় তাড়া খেয়ে পালিয়েছি, নয় নিজেরাই ছুটছি। পৃথিবীর সব দেশেই আছি আমরা, কিন্তু কোথাও আমাদের স্থায়ী ঠিকানা থাকে কি?

সাইমন ঘড়ি দেখছেন। বললেন, আমরা কি ওঁদের এখন নিয়ে যেতে পারি?

চলুন। তবু মনে রাখবেন আমরা কিন্তু পবিত্ৰ টোরা সহজে কাউকে দেখাই না। নেহাত সাইমন আপনাদের কথা দিয়ে ফেলেছে …

সাইমন তাড়াতাড়ি বলে উঠলেন, আমি কিন্তু আপনার অনুমতি নিয়ে তবেই হ্যাঁ বলেছি।

তুমি বললে আমি কি না করতে পারি সাইমন?

 টুপুরের কেন যেন মনে হল, গ্রেট স্ক্রল দেখানো নিয়ে সাইমন আর জোসে একটা সুক্ষ্ম দ্বন্দ্ব চলছে। জোস কি খুবই অসন্তুষ্ট হয়েছেন?

বেশিক্ষণ অবশ্য কথা চালাচালি চলল না। জুতো গলিয়ে টুপুরদের নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন জোস হ্যালেগুয়া।

সিনাগগে আলো জ্বলছে। টিকিট কাউন্টারের ছেলেটি বসে-বসে হিসেব করছে টাকাপয়সার। সাইমন আর জোসকে অসময়ে দেখে ধড়মড়িয়ে উঠে দাঁড়াল, স্যার, আপনারা …?

সাইমন বললেন, ওয়েস্ট বেঙ্গল থেকে এই অতিথিরা এসেছেন। এঁরা আমাদের গ্রেট স্ক্রল দেখবেন। তুমি বোসো, কাজ করো।

ব্যাগ রেখে জুতো ছেড়ে টুপুররা ঢুকল ভিতরে। বর্ণময় সিনাগগ আলোর ছটায় আরও অপরূপ এখন।

দেওয়ালসিন্দুকটা বেদির ওপারে। পরদায় ঢাকা। পরদা সরিয়ে সিন্দুকের তালা খুললেন জোস হ্যালেগুয়া। পাল্লায় হাত ছোঁওয়ানোর আগে চোখ বুজে বিড়বিড় করে কী যেন মন্ত্ৰ উচ্চারণ করলেন।

সিন্দুক খোলার সঙ্গে সঙ্গে সিনাগগে যেন বাজ পড়ল। আর্তনাদ করে উঠেছেন জোস।

মহামূল্যবান গ্রেট স্ক্রলটা নেই!

.

০৩.

মাট্টানচেরি থানায় ফোন করেছিলেন সাইমন। মিনিট কুড়ির মধ্যে একজন সাব-ইনস্পেক্টর হাজির সঙ্গে আস্ত এক পুলিশবাহিনী। ভারী বুটের শব্দে থরথর কেঁপে উঠল জু টাউনের সরু গলি।

পুলিশ অফিসারটি বেজায় রাশভারী। যেমন তাগড়াই চেহারা, তেমন বাজখাই গলা। গায়ের রং কুচকুচে কালো, নাকের নীচে ইয়া পুরুষ্টু গোঁফ, মাথার কোঁকড়া চুল দক্ষিণী হিরোদের মতো ফাঁপানো। উর্দির বুকপকেটে পেতলের প্লেটে নাম লেখা পি ভি জর্জ।

সুনীল পরিচয় দিয়েছিল মিতিনের, পাত্তাই দিলেন না জর্জ। মানিব্যাগ খুলে নিজের প্রেসকার্ড দেখাল সুনীল, তাতেও জর্জের ভ্রূক্ষেপ নেই। এসেই প্রথমে প্রত্যেকের নাম-ঠিকানা টুকে নিলেন ঝটাঝট। অবনী আর পার্থকে এমন ক্রুর চোখে দেখতে লাগলেন, যেন চোর ধরেই ফেলেছেন, হাতকড়া পরাতেই যা দেরি। সিনাগগে দাঁড়িয়েই ছুড়তে শুরু করেছেন প্রশ্নবাণ। টুপুররা কলকাতা থেকে কবে এসেছে, কী জন্যে এসেছে, কেন তাদের গ্রেট স্ক্রল দর্শনের সাধ জাগল, জানলেন খুঁটিয়ে-খুঁটিয়ে। অবনীর মুখ শুকিয়ে আমশি, সহেলিও কাপছেন ঠকঠক।

সুনীল চাপা স্বরে সাহস জোগাল, ঘাবড়াবেন না স্যার। এখানকার ক্রাইম ব্রাঞ্চের কর্তা সম্পর্কে আমার দাদা। কাজিন। আমি এক্ষুনি তাকে মোবাইলে ধরছি।

এদিকে জর্জ পড়েছেন জোস হ্যালেগুয়াকে নিয়ে। জেরা করছেন কড়া গলায়।

আপনি গ্রেট স্ক্রল শেষ কখন দেখেছেন?

কাল।

কাল কখন?

 সকালে। কাল আমাদের সাপ্তাহিক প্রার্থনাসভা ছিল, তখন।

আপনি কি কাল ওটা বের করেছিলেন?

হ্যাঁ। আমি প্রতি শনিবার টোরা পাঠ করি।

নিজের হাতে বের করেছিলেন?

হ্যাঁ।

 তারপর রেখে দিয়েছিলেন? নিজের হাতে?

অবশ্যই।

 ওই সিন্দুকের চাবি কি আপনার কাছেই থাকে?

রাবির কাছে থাকাটাই নিয়ম।

আমি নিয়ম জানতে চাইনি। আপনার কাছে থাকে কিনা প্রশ্ন করেছি।

প্রবীণ মানুষটিকে এমনিই বড় বিপর্যস্ত দেখাচ্ছিল। জর্জের রূঢ় প্রশ্নের ধাক্কায় আরও যেন বিধ্বস্ত হয়ে পড়ছিলেন তিনি। কাঁপাকাঁপা গলায় বললেন, চাবি আমার কাছেই ছিল।

আপনার বাড়িতে?

হ্যাঁ।

কোথায় রাখেন চাবি?

আমার টেবিলের ড্রয়ারে।

ড্রয়ার নিশ্চয়ই সব সময়ে তালাবন্ধ থাকে?

থাকে। আবার কখনও কখনও থাকেও না।

স্ট্রেঞ্জ! কেয়ারলেসলি চাবিটাকে ফেলে রাখেন?

আমার চাবি তো চুরি যায়নি।

আসল চাবি থেকে ড়ুপ্লিকেট তো বানিয়ে নেওয়া যায়? নাকি যায় না?

থতমত খেয়ে গেলেন জোস। চুপ করে আছেন।

জর্জ ফের তির ছুড়লেন, আপনি ছাড়া বাড়িতে আর কে কে থাকেন?

একজনই আছেন। আমার স্ত্রী শ্যারন।

ছেলেমেয়ে?

 আমার দুটি মেয়ে। দুজনেরই বিয়ে হয়ে গেছে।

বাড়িতে তাদের আসা-যাওয়া আছে নিশ্চয়ই?

আমার বড় মেয়ে বস্টনে থাকে। ছোট তেল আভিভ। এক বছরের মধ্যে মেয়ে-জামাইরা কেউই কোচিতে আসেনি।

বাড়িতে কাজের লোক আছে তো?

না। আমার স্ত্রীই সব করেন। জোস হঠাৎই ফুঁপিয়ে উঠলেন, ভাবতে পারছি না… ভাবতে পারছি না। পেন্টা টিউক যে এভাবে চুরি যাবে এ আমার স্বপ্নেরও অতীত।

পেন্টা টিউক? জর্জের ভুরুতে ভাঁজ, তা হলে যে বললেন গ্রেট স্ক্রল চুরি গেছে?

আমরা ইহুদিরা, পবিত্ৰ অনুশাসনলিপিকে পেন্টা টিউক বলি। আর অনুশাসনগুলোকে বলি টোরা। লিপিটাকে গুটিয়ে রাখা হয় বলে পেন্টা টিউককে গ্রেট স্ক্রল নামে ডাকা হয়।

জ্ঞান দেবেন না।…বাই দ্য বাই, গ্রেট স্ক্রলের সাইজ কীরকম?

ফুটখানেক মতো চওড়া। লম্বায় হাত তিনেক।

 মানে গোটালে ক্যালেন্ডারের সাইজ?

বলতে পারেন।

 দাম কত হতে পারে?

টাকার হিসেবে বলতে পারব না। তবে আমাদের কাছে অমূল্য।

মিতিনমাসির পাশে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞাসাবাদ শুনছিল টুপুর। চুরির সংবাদ পেয়ে ছুটে এসেছেন শ্যারন। তিনিও পাথরের মতো দাঁড়িয়ে। জু টাউনের আরও কয়েকজন বাসিন্দা ভিড় করেছেন দরজায়। প্রত্যেকের মুখেই উদ্বেগের ঘন ছায়া। এক প্রবীণা তো ফুঁপিয়ে উঠলেন। পাশের মানুষটি তাঁকে শান্ত করার চেষ্টা করছেন।

সাইমন ধরা-ধরা গলায় বললেন, পেন্টা টিউক যে কত মূল্যবান, একটা ব্যাপার থেকে আপনি আন্দাজ করতে পারবেন। ওই সিন্দুকে আরও দুটো দামি জিনিস ছিল, চোর কিন্তু দুটোর একটাতেও হাত দেয়নি।

দেখলাম তো। একটা সোনার মুকুট। একটা রুপোর বাতিদান।

সোনার মুকুটখানা ত্রিবাঙ্কুরের মহারাজা স্বয়ং দিয়েছিলেন। রুপোর বাতিদান কর্নেল মেক্‌লের উপহার।

বুঝেছি, বুঝেছি। চোর আসল অ্যান্টিক পিসটাই টার্গেট করেছে। এও বুঝতে পারছি গ্রেট স্ক্রল চুরি হওয়ার পেছনে আপনাদের রাবি মহাশয়েরও যথেষ্ট গাফিলতি আছে।

জোস হ্যালেগুয়া নতমস্তকে দাঁড়িয়ে।

 সাইমন তাড়াতাড়ি বললেন, বৃদ্ধ মানুষটিকে কেন দোষ দিচ্ছেন মিস্টার জর্জ? কুড়ি বছরেরও বেশি উনি দায়িত্ব সামলাচ্ছেন, কখনও তো এরকম ঘটেনি।

চুরি একবারই হয়। জর্জের মুখ গোমড়া। তেরা চোখে সাইমনকে দেখতে দেখতে বললেন, আপনি তো সিনাগগের তত্ত্বাবধায়ক, তাই না?

আজ্ঞে হ্যাঁ।

তা হলে দায়িত্ব তো আপনার উপরও বর্তায়। জর্জ গোঁফে মোচড় দিলেন, আপনাদের রাবি মহাশয় যদি মিথ্যে না বলে থাকেন, তা হলে চুরিটা ঘটেছে কাল সকাল থেকে আজ বিকেলের মধ্যে কোনও এক সময়ে। ঠিক কি না?

সাইমন আমতা-আমতা করে বললেন, হ্যাঁ মানে…সেরকমই তো দাঁড়ায়।

দাঁড়ায় নয়, সেটাই ঘটেছে। জর্জ হুঙ্কার ছাড়লেন, এই দেড় দিন আপনার সিকিউরিটি কি ভেরেণ্ডা ভাজছিল?

আমি অবশ্যই তাদের চার্জ করব। তবে স্যার… আমরা নামী কোম্পানির গার্ড রাখি। তাদের বিরুদ্ধে কোথাও কোনও অভিযোগ নেই।

কী করে এত নিশ্চিত হচ্ছেন? রক্ষী হোক, আর যে-ই হোক, মতিভ্ৰম তাদের হতেই পারে। চুরির সঙ্গে যুক্ত থাকাও মোটেই অসম্ভব নয়।

কিন্তু স্যার…?

দেখুন মিস্টার পেরেজ, হয় আপনার রক্ষীরা জড়িত, নয় তারা একেবারেই অপদার্থ। নইলে তাদের নাকের ডগা দিয়ে চোর ভিতরে ঢুকে পড়ে? সিন্দুক খুলে বেমালুম একটা জিনিস হাপিস করে দেয়? আমার তো মনে হয় ওদের কাউকেই সন্দেহের বাইরে রাখা যাবে না। আপনি প্রত্যেকের নাম আর বায়োডাটা আমায় দিয়ে দেবেন। আমি সব কটাকে থানায় ডেকে পাঠাব।

আচ্ছা স্যার।

সিনাগগে আর কোন কোন কৰ্মী আছে?

তিনজন ঝাড়পোঁছ করে। আর টিকিট কাউন্টারে বসে দুজন। পালা করে। তাদের একজন এখনও আছে। ডেকে দেব?

থাক। নামগুলো দিয়ে দিন। আর হা, আপনাদের রাবি মহাশয়ের বাড়িতে কারা কারা যাতায়াত করে তার তালিকা আমার চাই।

সে তো স্যার, এখানকার সব ইহুদি পরিবারই মিস্টার হ্যালেগুয়ার বাড়িতে যায়। আমরা ছোট্ট কমিউনিটি, মিস্টার হ্যালেগুয়া আমাদের সকলেরই অভিভাবকের মতো। বিপদে আপদে পরামর্শ দেন, সামাজিক অনুষ্ঠানও ওঁর নির্দেশ মতো হয়।

আবার গর্জে উঠতে যাচ্ছিলেন জর্জ, বাইরে জিপের আওয়াজ।

সুনীল উত্তেজিতভাবে বলে উঠল, ওই যে… চেত্তান এসে গেছেন।

কে চেত্তান?

 মানে দাদা। আমরা দাদাকে চেত্তান বলি।

কথার মাঝেই প্রবেশ করেছেন পুলিশকর্তাটি। বছর পঁয়তাল্লিশ বয়স, দোহারা চেহারা, তামাটে রং। উর্দির কাঁধে আই পি এসের ব্যাজ। বুকে নামটাও ঝুলছে সতীশ মেনন।

উৎকণ্ঠিত স্বরে সতীশ বললেন, কী ব্যাপার? কখন হল চুরি?

জর্জ নয়, সুনীলই এগিয়ে গিয়ে মলয়ালম ভাষায় পুরো ঘটনা বর্ণনা করল সতীশকে। মন দিয়ে শুনলেন সতীশ, আলাপ করলেন মিতিন-অবনীদের সঙ্গে। মিতিন একজন গোয়েন্দা শুনে সপ্রশংস দৃষ্টিতে তাকালেন।

সতীশ আসামাত্র থমকে গিয়েছিলেন জর্জ। সুনীলের সঙ্গে সতীশের ঘনিষ্ঠতার বহরে তাঁর হম্বিতম্বিও উধাও। সতীশ অবশ্য তাকেও আলাদা ডেকে কথা বললেন খানিকক্ষণ। তারপর মলয়ালমেই নির্দেশ দিলেন কী সব। বাধ্য অধস্তনের মতো ঘাড় নেড়ে সতীশকে স্যালুট ঠুকলেন জর্জ।

আবার একপ্রস্থ জিজ্ঞাসাবাদের পালা। এবার শুধু জোস সাইমন নন, প্রশ্ন করা হল শ্যারনকেও। টিকিট কাউন্টারের ছেলেটি আর রক্ষীদের ডেকেও জেরা করলেন সতীশ। কোনও সন্দেহজনক লোককে তারা দুচার দিনের মধ্যে দেখেছে কিনা, কে কটায় আসে, কটায় যায়, কাল ছুটির দিনে কে কোথায় ছিল, কে কত দিন কাজে ঢুকেছে, ইত্যাদি ইত্যাদি। কাউন্টারের ছেলেটা উত্তর দেবে কী, ভয়েই সে থরহরিকম্পমান।

জর্জ ইতিমধ্যে জোসের কাছ থেকে সিন্দুকের চাবিখানা চেয়ে নিয়েছিলেন। দেখছিলেন উলটেপালটো আঙুল দিয়ে খুঁটলেন চাবিটাকে। হতাশভাবে মাথা নাড়ছেন।

মিতিন জিজ্ঞেস করল, আপনি কি চাবির গায়ে সাবান আছে কি না পরখ করছেন?

ইয়েস ম্যাডাম। সাধারণত সাবানেই তো চাবির ছাঁচ তোলা হয়।

পেলেন কোনও চিহ্ন?

বোঝা যাচ্ছে না। ফরেনসিক করালে অবশ্যই ধরা পড়বে।

একটা সোজা পদ্ধতিও অ্যাপ্লাই করে দেখতে পারেন। চাবিটাকে জলে ড়ুবিয়ে নাড়ুন। সামান্যতম সাবান থাকলেও ফেনা দেখা দেবে।

এতক্ষণ পরে হাসির রেখা ফুটল জর্জের মুখে, ভাল অ্যাডভাইস দিয়েছেন তো ম্যাডাম।

রিংসুদ্ধ চাবি জলে ফেলা হল। সত্যিই ফুটেছে সাবানের ফেনা। অতি সামান্য হলেও বোঝা যাচ্ছে স্পষ্ট।

সতীশ বললেন, যাক, একটা ব্যাপারে অন্তত নিশ্চিন্ত। সিন্দুকের চাবি কেউ নকল করেছে। নাউ উই হ্যাভ টু ফাইন্ড আউট দ্য কালপ্রিট।

জোস হাউমাউ করে কেঁদে উঠলেন, আমারই দোষ, আমারই দোষ। আপনারা আমাকেই শাস্তি দিন। আমার অসাবধানতার জন্যই…

সতীশ জোসের পিঠে হাত রাখলেন, শান্ত হোন মিস্টার হ্যালেগুয়া। গ্রেট স্ক্রল আপনাদের কাছে যতটা পবিত্র, আমাদের কাছেও ঠিক ততটাই মূল্যবান জাতীয় সম্পদ। গ্রেট স্ক্রল আমরা উদ্ধার করবই।

সিনাগণে কড়া পুলিশ প্রহরা রাখতে বলে বেরিয়ে এলেন সতীশ মেনন। টুপুররাও এসে দাঁড়িয়েছে জু টাউনের গলিতে।

সতীশ সুনীলকে জিজ্ঞেস করলেন, তোমরা এখন যাবে কোথায়?

ভেবেছিলাম মেনল্যান্ডে ফিরে স্যারদের নিয়ে একটু সিটিতে ঘুরব। তা তো আর হল না। আটটা বাজে, স্যারদের আজ ডিনারে ডেকেছি..

তা হলে তো সোজা বাড়ি চলে যাওয়াই ভাল। কিন্তু যাবে কীসে?

ট্যাক্সি ধরে নেব।

আমার জিপেও চলে আসতে পারো। আমি তোমাদের ড্রপ করে দিচ্ছি।

তোমার অসুবিধে হবে না তো চেত্তান?

অসুবিধে তোমার অতিথিদেরই হবে একটু। আমার সঙ্গে দুজন সেপাই আছে, গাদাগাদি হয়ে যাবে।

নো প্রবলেম। পাৰ্থ তড়িঘড়ি বলে উঠল, আমরা ম্যানেজ করে নেব। যেতে যেতে আপনার সঙ্গে জমিয়ে গপ্পোও করা যাবে।

দ্যাটস মাই প্লেজার।

নামে জিপ হলেও মোটামুটি জায়গা আছে গাড়িটায়। চেপেচুপে উঠে পড়ল সবাই।

দীর্ঘক্ষণ চুপ ছিলেন সহেলি, গাড়ি নড়ে উঠতেই গজগজ করে উঠলেন, একজনের একটা বিদঘুটে শখের জন্য গোটা সন্ধেটাই মাটি হল। কী দরকার ছিল ওই গ্রেট স্ক্রল দেখতে চাওয়ার?

অবনী আত্মরক্ষার সুরে বললেন, আহা, আমি জানব কী করে এত কাণ্ড হবে?

ভাগ্যিস মিস্টার মেনন এলেন, নইলে দারোগা তো আমাদেরই হাজতে পুরতেন। আর হাজতে ঢোকালে দু-চার ঘা কি দিত না?

সুনীল হেসে উঠল, অত ভয় পাওয়ার কিছু নেই ম্যাডাম। আমাদের কেরালায় পুলিশ লকআপে যথেচ্ছ মারধোর করা যায় না। জানেন তো, এখানে একটা ছাত্রকে হাজতে পিটিয়ে মারার জন্য সরকারের গদি চলে গিয়েছিল। বলতে বলতে পাশে সতীশের দিকে ঘুরল সুনীল। ইংরেজিতে বলল, আমার স্যারকে কিন্তু তোমার ধন্যবাদ দেওয়া উচিত চেত্তান। স্যারের জন্যই কিন্তু চুরিটা একদিনের মধ্যে ধরা পড়ল। নইলে নেক্সট শনিবারের আগে তো কিছুই জানা যেত না।

ইয়েস। দ্যাটস আ পয়েন্ট। সতীশ মাথা দোলালেন, তবে চুরিটা আমায় খুব চিন্তায় ফেলল, বুঝলে। এ নিয়ে মিনিস্ট্রিতে তো হইচই পড়ে যাবে।

মিতিন বলল, আমি কিন্তু কালপ্রিটের ব্যাপারে একটা হিন্ট দিতে পারি।

কী বলুন তো?

সিন্দুক যে খুলেছে সে মোটেই প্রফেশনাল চোর নয়।

নেহাতই আনাড়ি। তাকে টাকার টোপ দিয়ে কাজটা করানো হয়েছে।

কী করে বুঝলেন?

পেশাদার চোর হলে থোড়াই চাবির গায়ে সাবানের কুচি লেগে থাকত। তবে তার পেছনেও অন্য কোনও পাকা মাথা আছে। যে জিনিসটার দাম সম্পর্কে ওয়াকিবহাল। সামান্য একটা ছাগলের চামড়া সাধারণ চোর চুরি করতে যাবে কেন?

রাইট। যে নিয়েছে সে বুঝেশুনে বড় দাঁও মারার জন্যেই…।

সতীশের চোয়াল শক্ত হল। ফের বলে উঠলেন, ধরে ফেলব। লোকটাকে আমি ধরবই। গ্রেট স্ক্রলও উদ্ধার হবে।

অবনী বললেন, কিন্তু সে জিনিস কি এখন আর কোরি ত্ৰিসীমানায় আছে? জল, স্থল, অন্তরীক্ষ, কোন পথে যে পাচার হয়ে গেছে তার ঠিক কী।

টুপুর ফস করে বলে উঠল, একটা ব্যাপার আমার মাথায় ঢুকছে। না। ওই জিনিস কিনবে কে? কেনই বা কিনবে? প্রকাশ্যে তো রাখতে পারবে না। কাউকে দেখাতেও পারবেনা। নিয়ে তার লাভটা কী হবে?

দুনিয়ায় অনেক ধরনের খ্যাপা থাকে রে। মিতিন মৃদু হাসল, তাদের মধ্যে কেউ কেউ আবার কোটিপতি। তারা জিনিসটা নিয়ে নিজের গোপন ভল্টে লুকিয়ে রেখে দেয়। মনে তার একটাই আনন্দ, আজ থেকে সে ওই দুষ্প্রাপ্য জিনিসটার মালিক। ওই আনন্দের লোভে তারা চোরাই মূৰ্তি কেনে, পেন্টিং চুরি করায়, কোহিনূর-টোহিনূরের মতো বিখ্যাত হিরে পর্যন্ত বাঁকা পথে কিনে নিজের কবজায় রেখে দেয়। চোর কখনও-সখনও হাতেনাতে ধরা পড়ে। কিন্তু এই লোকগুলো চিরকাল আড়ালেই থেকে যায়।

টুকরো টুকরো আলোচনার মধ্যে সতীশ মেননের জিপ মাট্টানচেরি বাজার পেরিয়ে, উইলিংডন দ্বীপ ছুঁয়ে, ভেম্বুরুথি ব্রিজ অতিক্রম করে এসে পড়েছে মূল ভূখণ্ডে। নটা বাজার আগেই গাড়ি সুনীলের বাড়ির দরজায়।

সুনীলের বাবা-মা আদরযত্ন করলেন খুব। শুধু বাঙালি খানাই নয়, দু-একটা কেরলীয় পদও বেঁধেছেন সুনীলের মা। হরেকরকম সবজি দিয়ে অ্যাভিয়ান। ক্যারিমিন পল্লিচাথু বলে এক ধরনের মশলাদার ফ্রাই, সামুদ্রিক মাছের। আর শেষপাতে দুধ, নারকেল আর কলা দিয়ে বানানো কালন। সুনীলের মা-র রান্নার হাত সত্যিই অতুলনীয়। শেষ তিনটে রান্নাই এত সুস্বাদু যে, অবনীর মতো বাতিগ্রস্ত মানুষও চেটেপুটে খেয়ে ফেললেন। খুঁটিয়ে-খুঁটিয়ে কলকাতার খবরাখবর নিলেন সুনীলের বাবা, এখানে অবসরজীবন কেমন কাটছে তাও শোনালেন। সিনাগগের চুরি নিয়েও গবেষণা চলল খানিকক্ষণ। বাড়ি থেকেই চেনা ট্রান্সপোর্ট এজেন্সিতে ফোন করল সুনীল, কাল টুপুরদের জন্য গাড়ি ঠিক করে দিল।

সুনীলদের বাড়ি থেকে বেরোতে-বেরোতে প্রায় এগারোটা। ট্যাক্সি ডেকে ড্রাইভারকে গন্তব্যস্থল বুঝিয়ে দিল সুনীল। বুমবুম ঘুমিয়ে কাদা, তাকে ধরাধরি করে শুইয়ে নেওয়া হল কোলে।

পথ-ঘাট ফাঁকা-ফাঁকা। দোকানপাটের ঝাঁপ পড়ে গেছে বহুক্ষণ, গাড়িঘোড়াও চলছে না বড় একটা। আকাশে ছেঁড়া-ছেঁড়া মেঘ। পলকের জন্য কৃষ্ণপক্ষের চাঁদ উঁকি দিল, পলকে হারিয়ে গেল মেঘের আড়ালে।

পার্থ একটা জাম্বো হাই তুলে বলল, আজ খাওয়াটাই যা লাভ, বাকি গোটা দিনটাই তো ফালতু কাটল।

 টুপুর বলল, সে কী? অমন একটা রোমহর্ষক কাণ্ড ঘটল, তাতেও তোমার মন ভরেনি?

টুরিস্ট হিসেবে আমরা কী পেলাম? সেন্ট ফ্রান্সিস চার্চ বন্ধ, সিনাগগে যাব বলে চাইনিজ ফিশিং নেট দেখা হল না, গ্রেট স্ক্রলের বদলে পড়লাম এক রাগী পুলিশের পাল্লায়…

সহেলি বললেন, মার্কেটিংও হল না।

মিতিন ঘাড় ঘুরিয়ে কী যেন দেখছিল। সোজা হয়ে বলল, ব্যাক ওয়াটারে মোটরবোট চড়া তো হয়েছে। বাজার আর চাইনিজ নেট নয় ফেরার দিনে হবে।

একটা কথা জিজ্ঞেস করব মিতিনমাসি? কোচিতে চাইনিজ মাছ ধরার জাল এল কী করে? এখানে চিনা বসতি আছে নাকি?

এখনকার কথা বলতে পারব না। তবে এক সময়ে তো নিশ্চয়ই ছিল। কোচি নামটাই তো নাকি চিনাদের দেওয়া। অবশ্য লোকাল লোকরা অনেকেই তা মানতে চায় না। বলে কোচি নামটা এসেছে মলয়ালম কোছাজি শব্দ থেকে। কোছাজি মানে ছোট্ট।

অবনী বললেন, আরও একটা মত আছে। মলয়ালমে কোচি মানে বন্দর। তবে এও ঠিক, ওই মাছের জাল নাকি চিনের বাইরে কোচি ছাড়া আর কোথাও মেলে না। সুতরাং কুবলাই খাঁর আমলে এখানে আসা চিনা বণিকরা যদি কোচি নামটা রেখেও থাকে, তাতেও অবাক হওয়ার কিছু নেই।

হোটেল এসে গেছে। ভিতরে ট্যাক্সি ঢুকিয়ে ভাড়া মেটালেন অবনী। ঘুমন্ত বুমবুম এখন বেজায় ভারী, তাকে কোলে নিয়ে হাঁটা সত্যিই কষ্টকর। পার্থ ঝাঁকিয়ে ঝাঁকিয়ে জাগাল তাকে। ঠেলে-ঠেলে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে দোতলায়। নেশাভুর মতো টলছে বুমবুম, দেখে টুপুর হেসে কুটিপাটি।

হাসতে-হাসতেই হঠাৎ নজর গেল মিতিনমাসি হোটেলে ঢোকেনি, নেমেই গেটে গিয়ে ঝুঁকে ঝুঁকে রাস্তায় কী যেন দেখছে।

দৌড়ে মিতিনমাসির পাশে এল টুপুর, কী হয়েছে গো?

মনে হচ্ছে একটা অটো আমাদের পিছন-পিছন আসছিল। মিতিন আঙুল তুলল, ওই যে। ওই চলে যাচ্ছে!

সেকেন্ডের জন্য অটোটাকে দেখতে পেল টুপুর। তারপরই অটোটা ঘুরে গেল বাঁয়ে। বড় রাস্তা ছেড়ে গলির মধ্যে।

টুপুর অবাক হয়ে বলল, অটো আমাদের ফলো করছিল? কোচিতে? কেন?

মিতিন বলল, বুঝতে পারছি না। অবশ্য আমার মনের ভুলও হতে পারে।