1 of 2

একটি পুরোন লেখার নতুন পাঠ : কত দীর্ঘ এই লংমার্চ


তেল-গ্যাস রক্ষা জাতীয় কমিটি যখন ঠিক করেছিলো যে তারা বিবিয়ানা লংমার্চ করবে তখনই আমার খুব ইচ্ছে হয়েছিলো যে সেটাতে যোগ দিই, কিন্তু আজকাল এমন একটা জায়গায় পৌঁছে গেছি যে দৈনন্দিন রুটিন থেকে আট আটটি দিন বের করে ফেলা খু্ব সহজ ব্যাপার নয়। তাই ঠিক করে রেখেছিলাম লংমার্চ করে সবাই যখন বিবিয়ানা এলাকায় পৌঁছুবে তখন অন্তত সেখানে গিয়ে আমার কৃতজ্ঞতাটুকু প্রকাশ করে আসবো।

লংমার্চ শুরু হবার সঙ্গে সঙ্গে আমি খবরের কাগজে তাদের অগ্রগতি লক্ষ করতে শুরু করেছিলাম এবং প্রায় সঙ্গে সঙ্গে তিনটি খুব গুরুত্বপূর্ণ জিনি আবিষ্কার করলাম। সেগুলো হচ্ছে- ক) এ ব্যাপারে আওয়ামী লীগের কোনো মাথাব্যথা নেই, খ) সমর্থন দিয়েছে শুধু বামদলগুলো, গ) সংবাদপত্র ও প্রচারমাধ্যমগুলো পুরো লংমার্চটিকে একটা গুরুত্বহীন ব্যাপার হিসেবে বিবেচনা করেছে।

আমাদের দেশের এধরনের একমাত্র সম্পদ রক্ষা করার যে প্রচেষ্টা তা আমাদের কাছে একেবারেই গুরুত্বহীন নয়। তাই তেল-গ্যাস রক্ষা কমিটি যখন তেরোই মার্চ বিবিয়ানা এলাকায় পৌঁছেছে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশ কয়েকজন শিক্ষক মিলে তাদের সঙ্গে আমাদের একাত্মতা প্রকাশ করতে গিয়েছিলাম। সিলেট শহর থেকে ঘন্টা খানেক বাসে গিয়ে শেরপুরে পৌঁছে দেখি পথের পাশে একটা ছোট মঞ্চ করা হয়েছে। মঞ্চে নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিরা বসে আছেন। ওপরে একটা সামিয়ানা টানা আছে। আমার দেখে খুব ভালো লাগল যে যারা বসে আছে তাদের বিশেরভাগই তরুণ তরুণী। এরকম একটি ব্যাপারে আমাদের নতুন প্রজন্ম উৎসাহ দেখাচ্ছে সেটি খুব আশার কথা বলে মনে হলো।

আমরা পৌঁছা মাত্রই কিছু বোঝার আগে আমাকে এবং আমাদের প্রাক্তন উপাচার্য মোঃ হাবীবুর রহমানকে মঞ্চে তুলে দেয়া হলো। সবাই কাঠফাটা রৌদ্রে বসে আছে তার মাঝে আমরা ছায়াতে বসে আছি ভেবে একটু অপরাধবোধে ভুগছিলাম। আশেপাশে যারা এসেছেন, যাদের অনেক নাম শূনেছি, কখনো চোখে দেখিনি তাদের সঙ্গে পরিচয় করছি ঠিক তখন শুনতে পেলাম একজন আমার নাম ঘোষণা করে বলে দিয়েছেন যে, আমি এখন বক্তৃতা দেব। আমরা যে কোনো বিষয়ে পঞ্চাশ মিনিট কথা বলতে পারি (আমাদের ক্লাসগুলো পঞ্চাশ মিনিটের মাঝে মাঝে কোনোরকম প্রস্তুতি ছাড়াই ক্লাস নিয়ে ফেলতে হয়)। কিন্তু আজকের এটি অন্য একটি ব্যাপার। এটি একটি জনসভা, যারা বসে আছে তারা মুহুর্মুহু স্লোগান দিচ্ছে আমি কিছু বলতে চাইলে সেটি স্লোগানের উত্তেজনা ছাপিয়ে বলতে হবে। আমার আগে আরে দু চারজন বক্তৃতা দিয়ে ফেললে তাদের কথা শুনে কিছু একটা বলা যেত। আমার সে সুযোগও নেই। কাজেই বক্তৃতা দিতে দাঁড়িয়ে আমি অন্য কিছু চেষ্টা না করে মনের কথাগুলোই বললাম, দেশের প্রতি গভীল মমতায় যারা সুদূর ঢাকা থেকে ৩০০ কিলোমিটার পথ পায়ে হেঁটে এখানে এসেছেন তাদের প্রতি আমার পক্ষ থেকে এবং দেশের মানুষের পক্ষ থেকে গভীর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলাম। লংমার্চ শুরু হবার পর জ্বালানী প্রতিমন্ত্রী লংমার্চের উদ্যোগক্তাদের আবেগ দিয়ে তাড়িত বলে উপহাস করেছিলেন। আমি শ্রোতাদের বললাম দেশের জন্য ভালোবাসার যে আবেগ সেটিকে নিয়ে উপহাস করা যায় না- বাঙালীর বুকের ভেতর এই গভীর আবেগ আছে বলে উনিশ‌র শ একাত্তর সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছিলো। জ্বালানী প্রতিম্ত্রীর যে বক্তব্যটি আমার সবচেয়ে বেশি খারাপ লেগেছিল সেটি হচ্ছে তেল-গ্যাস রক্ষা কমিটির সদস্যরা নাকি গ্যাস সম্পর্কে কিছুই জানে না। আমি তার প্রতিবাদ করে বললাম জ্বালানী প্রতিমন্ত্রী সত্যিই যদি তাদের এতটা তাচ্ছিল্য করেন তাহলে তার উচিত তেল-গ্যস রক্ষা জাতীয় কমিটির যে কোন একজন সদস্যের সঙ্গে জাতীয় টেলিভিশনে সরাসরি বিতর্কে যোগ দেওয়া। দেশের মানুষ দেখুক কে এসম্পর্কে বেশি জানে। দেশের জন্য কার মমতা বেশি।

আমি ভালো বক্তা নই। অন্যরা আমার থেকে অনেক সুন্দর করে বক্তৃতা দিলেন। আমি খুব আনন্দের সঙ্গে লক্ষ্য করলাম তাদের বেশ কয়েকজন টেলিভিশনে সরাসরি বিতর্কের বিষয়টি গ্রহণ করে সেটিকে একটা সত্যিকারের চ্যালেঞ্জ হিসেবে সরকারের কাছে ছুড়ে দিলেন। (লংসার্চ শেষ করে জাতীয় তেল-গ্যাস রক্ষা কমিটি এই চ্যালেঞ্জের কথা ভোলেননি সংবাদ সম্মেলন করে তারা মন্ত্রী, আমলা, বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, মার্কির রাষ্ট্রদূত এবং তাদের যে কোন অর্থনীতিবিদকে সরাসরি বিতর্কে আহ্বান জানিয়েছিলেন। আমি খুব আগ্রহ নিয়ে দেখার জন্য অপেক্ষা করছি এই বিতর্কে অংশ নেবার মতো কোনো নৈতিক জোর আদৌ তাদের আছে কিনা।)

সভা শেষে সবাই বিবিয়ানার পথে রওনা দিয়েছে। গ্রামের মেঠাপথে সবাই মিছিল করে হাঁটছে। ব্যানার আর পোস্টার, বিশাল ফাঁকা প্রান্তরের মাঝ দিয়ে আঁকাবাকা সড়ক কুশিয়ারা নদীর তীর ঘেঁষে চলে গেছে। আমি হতবাক হয়ে তাকিয়ে দেখি মানুষের সেই মিছিল অন্তত কয়েক কিলোমিটার লম্বা। গ্রামের মানুষজন রাস্তার দুপাশে দাঁড়িয়ে আছে, বউঝিরা গাছের আড়াল থেকে উকি দিচ্ছে, কোথাও হাত তালি দিয়ে উৎসাহ দিচ্ছে, পানি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ছোটছোট শিশুরা পিছু পিছু ছোটাছুটি করছে। তাদের নিস্তরঙ্গ জীবনে হঠাৎ একী উত্তেজনা।

বড় কোনো মিছিলে হাঁটার আমার বিশেষ কোনো অভিজ্ঞতা নেই। এমনিতে হাঁটতে বের হলে ক্লান্ত হলে ছায়ায় বসে বিশ্রাম নেওয়া যায়। কিন্তু এখানে বিশ্রাম নেবার উপায় নেই। সবাই যে ছন্দে হাটছে আমাদেরও সেই ছন্দে হাঁটতে হবে। গ্রামের পথে হাঁটতে গেলে কতটুকু হাঁটা হয়েছে তা বের কর খুব মুশকিল। কোনো এক বিচিত্র কারণে আমাদের গ্রামের মানুষ দুরত্বকে মাইল-কিলোমিটারে প্রকাশ করতে পারে না। তবে আমার পকেটে একটা জিপিএস (গ্লোবাল পজিশনিং সিস্টেম-উপগ্রহের সিগন্যাল ব্যবহার করে অবস্থান বের করার একটি যন্ত্র ছিলো।) সেটার হিসাব অনুযায়ী ঠিক সাড়ে পাঁচ কিলোমিটার হাঁটার পর পুলিশ আমাদের থামিয়ে দিলো। মিছিলটি পুলিশের বেষ্টনী ভেঙে এগিয়ে যাবার চেষ্টা করল না, কাছাকাছি একটা স্কুলের মাঠে একত্র হয়ে মুহুর্মুহু স্লোগানের মাঝে তাদের ঘোষণাপত্র পাঠ করলো। আমি খানিকক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে আবার ফিরে আসতে শুরু করলাম। অন্যরা আট দিনে হেটেছে তিনশ কিলোমিটার। আমরা একদিনে হেটেছি মাত্র এগারো কিলোমিটার। কিন্তৃ তাতে আমার মনে হতে লাগল আমরা বুঝি বিশাল একটা কাজ করে ফেলেছি।

২.
ঘরকনো মানুষ বলে একরকম দক্ষযজ্ঞ মানুষ থেকে আমি দূরে থাকি, তবে গ্যাস রপ্তানীর ব্যপারটি এই দেশের জন্য এমন ভয়ংকর একটি ষড়যন্ত্র যে এখন আর ঘরে বসে থাকার সুযোগ নেই। আমার ধারণা সরকার যদি এটি বন্ধ না করে তাহলে আগে হোক পরে হোক সবাই ঘর থেকে বেরিয়ে আসবে। ব্যক্তিগতভাবে লংমার্চের শেষ অংশটুকুতে থাকতে পারা আমার জন্য খুব চমৎকার একটা অভিজ্ঞতা ছিলো।

আমাদের দেশের সংবাদপত্র পড়ে আমার যে অভিজ্ঞতা হয়েছে সেটা থেকে আমি বলতে পারি সংবাদপত্রের খবর হিসেবে এই লংমার্চটুকু অত্যন্ত একটা চমৎকার বিষয় ছিল। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যপার এই পুরো ব্যাপারটি নিয়ে সংবাদপত্রগুলো ছিল একেবারেই নিস্পৃহ। কয়েক কিলোমিটার দীর্ঘ সেই রঙিন এবং উদ্দীপ্ত তারুণ্যের মিছিলের ছবিটি বেশিরভাগ পত্রপত্রিকায় ছাপা হয়নি। আমি এখনো বিশ্বাস করতে পারি না ডেইলি স্টারের মতো সম্ভান্ত একটি পত্রিকা এই ঘটনার সংবাদটুকুও ছাপেনি।

ব্যাপারটি আমায় খুব ভাবনায় ফেলেছে। সংবাদপত্রের কর্মচারী এবং সাংবাতিকরা নিশ্চয়ই আমার মতো সাধারণ মানুষ, কিন্তু সংবাদপত্রের মালিকরা নিশ্চয়ই বিত্তশালী মানুষ। সাধারণ মানুষ আর বিত্তশালী মানুষের স্বার্থ নিশ্চয়ই এক নয়। আমি নিশ্চিত বিবিয়ানা লংমার্চের এই বিশাল জাতীয় একটি ঘটনাকে বাংলাদেশের মানুষের চোখের আড়ালে সরিয়ে রাখার ব্যাপারটি একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়- এর নিশ্চয়ই কোনো কারণ আছে। যারা খবরের কাগজের মালিক, বিশাল যাদের অর্থবিত্ত, কোনো না কোনোভাবে নিশ্চয়ই এই গ্যাস বিক্রির ব্যাপারটির সঙ্গে, এ সম্পর্কে দেশের মানুষের সচেতনতার সঙ্গে তাদের একটা সম্পর্ক আছে। কাজেই ভবিষ্যতেও নিশ্চয়ই গ্যাস রপ্তানীর ব্যাপারে সাধারণ মানুষের প্রতিবাদের কথা সম্ভবত সংবাদমাধ্যমগুলোতে সেভাবে প্রচার করা হবে না। যারা গ্যাস রক্ষার জন্য পথে নামবেন, তাদের সম্ভবত একটা দুরুহ পথ অতিক্রম করতে হবে, সেই পথে সংবাদপত্রের সাহায্য তারা তেমন পাবে না। জ্বালানী প্রতিমন্ত্রী সম্ভবত সেটি আগে থেকেই জানেন, পুরো ব্যাপারটি নিয়ে তাই বুঝি এত তাচ্ছিল্য।

৩.
বিবিয়ানা লংমার্চে যোগ দিয়ে আরো কয়েকটি ব্যাপার নিয়ে আমি এক ধরনের নস্টালজিয়া অনুভব করেছি। আমাদের চারপাশে ছাত্র রাজনীতির কলুষিত রূপটি দেখে আমাদের সবার মন বিষিয়ে গেছে। ছাত্ররা যখন তাদের তারুণ্যের শক্তি ব্যয় করে কেন্টিনে ‍‌‌ফাও খাওয়ার জন্য, বিকশাওয়ালার থেকে চাদা তোলার জন্য বা ছিনতাই করা ভাগাভাগি করতে মারামারি করার জন্য তখন লজ্জায় আমাদের মাথা হেট হয়ে যায়। কিন্তু এই লংমার্চে এসে আমি অসংখ্য তরুণ তরুণিকে দেখেছি যারা নিশ্চয়ই এই দেশে নানা কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রী। দেশের সম্পদ রক্ষার করার জন্য নিজেদের রাজনৈতিক বিশ্বাস থেকে শক্তি পেয়ে তারা তিনশ কিলোমিটার হেটে চলে এসেছে। আদর্শের পথ ধরে চলে আসার সুশৃংখল একটি দল। আমাদের ছাত্রজীবনে আমরা যেরকমটি দেখেছিলাম। সেটি দেখে আমি এক ধরনের নস্টালজিয়া বোধ করেছি। দেশের পড়াশুনার পরিবেশ ফিরিয়ে আনার জন্য আমি অনেকবার ছাত্ররাজনীতির বিরুদ্ধে কথা বলেছি। কিন্তু লংমার্চে এসে আত্মত্যাগী, পরিশ্রমী, সুশৃংখল দেশের প্রতি গভীর মমত্ববোধ থাকা এই ছাত্রছাত্রীদের দেখে মনে হয়েছে আমরা কি আবার ষাট এবং সত্তরের দশকের আদর্শবান তেজস্বী ছাত্রছাত্রীদের ফিরে পেতে পারি না।

৪.
গ্যাস বিক্রিয় একটা অযৌক্তিক প্রস্তাব তুলে সারাদেশে একটা বিতর্ক সৃষ্টি করা হয়েছে। আমার মনে হয় প্রস্তাবটি যে কত অর্থহীন সেটা বোঝার জন্য সবারই কয়েকটি সংখ্যার কথা জানা উচিত। প্রথম সংখ্যাটি হচ্ছে এক হাজার কোটি। বর্তমান প্রস্তাব অনুযায়ী গ্যাস রপ্তানী করা হলে বাংলাদেশ বছরে এক হাজার কোটি টাকা পাবে। আমরা যারা গুণে গুণে টাকা খরচ করি, দরদাম করে রিকশায় উঠি তাদের কাছে এক হাজার কোটি টাকা অনেক বেশি মনে হতে পারে কিন্তু একটা দেশের জন্য এক হাজার কোটি টাকা ক্ষুদ্র একটি সংখ্যা। সংখ্যাটি কত ছোট বোঝানোর জন্য মনে করিয়ে দেয়া যায় যে, বাংলাদেশে বছরে বিদ্যুৎ আর গ্যাসই চুরি হয় (system loss) এক হাজার একশ কোটি টাকার। সরকার যদি শুধু তার দায়িত্ব পালন করে বিদ্যু আর গ্যাস চুরি বন্ধ করতে পারে তাহলেই বছরে গ্যাস রপ্তানীর এক হাজার কোটি টাকা উঠে গিয়েও একশ কোটি টাকা উদ্বৃত্ত থাকবে। এরকম একটা অবস্থায় যে কাজটি করা উচিত সেটি না করে কেন দেশকে সর্বশান্ত করার একটা ষড়যন্ত্র করতে শুরু করে দেব?

গ্যাস বিক্রি করে যে এক হাজার কোটি টাকার লোভ দেখানো হচ্ছে সেটা যে অত্যান্ত ক্ষুদ্র একাট সংখ্যা সেটা বোঝানোর জন্য সবাইকে আরো মনে করিয়ে দেওয়া যায় যে আমাদের সামরিক আর অন্যান্য অনুৎপাদনশীল খাতে বছরে খরচ হয় প্রায় পনের হাজার কোটি টাকা-সেখানে যদি দশ ভাগের এক ভাগও বাচানো যায় তাহলেই গ্যাস বিক্রির দেড় গুণ টাকা উঠে আসে। শুধু তাই নয়, এদেশে চল্লিশ থেকে পঞ্চাশ হাজার কোটি কালো টাকা তৈরী হয়। সরকার যদি শুধু ভালো ভালো বক্তৃতা না দিয়ে এই কালো টাকার শতকরা দুইভাগও নিয়ন্ত্রণ করতে পারে তাহলেই গ্যাস রপ্তানীর সমান টাকা পাওয়া যাবে। আমি অর্থনীতিবিদ নই- এই সংখ্যাগুলো নিয়েছি ডিসেম্বরের আট তারিখে এলজিইডি ভবনে পঠিত ড. আবুল বারাকাতের প্রবন্ধ থেকে। সেখানে এর চাইতেও চমকপ্রদ তথ্য আছে। দেশের সাধারণ মানুষের সেগুলো জানা খুব দরকার। গ্যাস বিক্রি, গ্যাস বিক্রি বলে সরকার হঠাৎ করে যেভাবে ক্ষেপে উঠেছে সেটা দেখে অনেকের ধারণা হতে পারে ব্যাপারটি বুঝি আমাদের দেশের জন্য একটা বিশাল ব্যাপার।এটি করে টাকায় টাকায় দেশ সয়লাব হয়ে যাবে- আসলে সেটি একেবারেই সত্যি নয়। টাকার পরিমাণটি কম-এত কম যে সেটা নিয়ে আদৌ কেউ মাথা ঘামাচ্ছে সেটাই হচ্ছে আমাদের বিষ্ময় ও সন্দেহের কারণ। তার চাইতেও বড় কথা বাংলাদেশের সঙ্গে বিদেশী কোম্পানিগুলোর যে চুক্তি করা হয়েছে, সেখানে পাইপ লাইন দিয়ে গ্যাস বিক্রি করার কথা লেখা নেই। তাহলে হঠাৎ করে তাদের চুক্তি বাইরে একটা সুবিধা দেয়ার জন্য সবাই উঠেপড়ে লেগেছে কেন?

আমরা ঘরপোড়া গরু- তাই সিদুরে মেঘ দেখলেই ভয় পাই। অতীতে বিদেশী কোম্পানীদের খুশি করার জন্য আমাদের দেশের স্বার্থ পুরোপুরি বিসর্জন দেওয়ার এতগুলো উদাহরণ দেখেছি (সিমিটার, মাগুড়ছড়া, কাফকো) এবং এ ব্যাপারে সকল সরকারই একরকম। তাই আমরা এক ধরনের আতঙ্কের মধ্যে আছি। অতীতে উদাহরণ দেখে বলে দেয়া যায় এই সরকার যদি গ্যাস বিক্রির এই চক্রান্ত সত্যি সত্যি কোনোভাবে কাজে লাগিয়ে ফেলে তাহলে ভবিষ্যতে নতুন কোনো ষড়যন্ত্র হবে না সেটি কে বলতে পারে? আজ থেকে চার পাচ বছর পরে হয়তো বিদেশী তেল কোম্পানির ধুরন্ধর আইনজীবীদের কৌশলী শব্দচয়নের কারণে আমরা গ্যাস বিক্রির কোনো টাকা তো পাবই না; বরং নিজেদের পকেটের ভর্তুকি দিয়ে সেই গ্যাস দিল্লিতে পৌছে দিয়ে আসতে হচ্ছে।

৫.
আমাদের সংবিধান বলেছে বাংলাদেশের এই গ্যাস সম্পদের মালিক দেশের মানুষ, সেই হিসেবে গ্যাস সম্পদে আমারও নিজের একটা মালিকানা আছে। মানুষের বাড়িঘর জমিজিরাত এরকম নানা ধরনের সহায়সম্পদ থাকে। আমার সেরকম কিছু নেই, বলা যেতে পারে গ্যাসের মালিকানায় আমার অংশটুকুই হচ্ছে আমার একমাত্র স্থাবর সম্পত্তি। রাস্তার টোকাইশিশু, রিকশাওয়ালা এবং গ্রামের চাষীরও তাতে সমান অধিকার এবং মাননীয় জ্বালানী প্রতিমন্ত্রীরও তার অংশের বাইরে এক সিএফটি গ্যাস বেশি নেই। সে সম্পদটি আমার সেটি যদি আর কেউ বিক্রি করে দেওয়ার কথা বলে তাহলে আমাদের ক্ষুব্ধ হওয়ার যুক্তিসঙ্গত কারণ আছে। রাস্তা দিয়ে হেটে যাবার সময় একজন দুর্বৃত্ত যদি আমার মানিব্যাগ ছিনতাই করে নেয়, তার সঙ্গে এই গ্যাস বিক্রি করার মৌলিক পার্থক্য নেই। এর মালিক আমরা এবং আমরা অনুমতি দেইনি। কাজেই এই গ্যাস বিক্রি করা হবে জোর করে ছিনিয়ে নিয়ে বিক্রি করা। পাইপ লাইন বসিয়ে গ্যাস বিক্রির কথা নির্বাচনী ইশতেহারে ছিল না। কাজেই এই সরকারের গ্যাস বিক্রি করার কোনো নৈতিক বা আইনগত অধিকার নেই। কিছু ভাড়াটিয়া বিশেষঞ্জের কথায় তারা গ্যাস বিক্রি করতে পারবে না। একান্তই যদি এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে হয় তাহলে তারা গণভোটের ব্যবস্থা করবে। যতদিন এই গণভোটের ব্যবস্থা না করা হচ্ছে অনুগ্রহ করে এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত না নেয়া হবে বুদ্ধিমানের কাজ এবং গ্যাস বিক্রি করার পরিকল্পণাটি পুরোপুরি পরিত্যাগ করা হবে দেশপ্রেমিকের কাজ। গ্যাস বিক্রি বন্ধ করতে একটি দীর্ঘ লংমার্চের ব্যবস্থা করা হয়েছে। এখন আমরা সবাই জানতে চাই কত দীর্ঘ এই বিবিয়ানা লংমার্চ।

প্রথম আলো, ৬ এপ্রিল, ২০০২

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *