2 of 2

৬৩. অভিশপ্ত আবু জাহলের হত্যার ঘটনা

অভিশপ্ত আবু জাহলের হত্যার ঘটনা

ইবন হিশাম বলেন, : বদর যুদ্ধে আবু জাহল নিম্নলিখিত রণ-সংগীত আবৃত্তি করতে করতে সম্মুখে অগ্রসর হয় :

(সংগীত) বারবার আবর্তিত প্রচণ্ড যুদ্ধও আমার থেকে কোন প্রতিশোধ নিতে পারে না। আমি দু’বছর বয়সী যুবক উটের ন্যায় শক্তিশালী। আর এরূপ কাজের জন্যেই আমার মা আমাকে প্রসব করেছেন।

ইবন ইসহাক বলেন, শক্ৰদের সাথে যুদ্ধ শেষে রাসূলুল্লাহ্ (সা) নিহতদের মধ্যে আবু জাহলের অবস্থা কী, তা জানার জন্যে নির্দেশ দেন। এ সম্পর্কে ছওর ইবন যায়দ … ইবন আব্বাস ও আবদুল্লাহ ইবন আবু বকর সূত্রে বলেন, সর্বপ্রথম যিনি আবু জাহলকে দেখতে পান, তিনি ছিলেন বনু সালামা গোত্রের মুআয ইবন আমর ইবন জামূহ। তিনি বলেন, আমি লোকদের বলাবলি করতে শুনি যে, আবু জাহল সুরক্ষিত অবস্থায় রয়েছে। কেউ তার কাছে ঘেঁষতে সক্ষম হবে না। একথা শুনেই আমি দৃঢ় সিদ্ধান্ত নিলাম যে, আবু জাহলের নিকট যে কোন মূল্যে আমি পৌঁছবই। এরপর আমি সে দিকে অগ্রসর হলাম। যখন আমি তার নিকট পৌঁছে গেলাম, তখন তলোয়ার দিয়ে তার উপর সজোরে আঘাত করলাম। এতে তার পায়ের নালার মধ্যখান থেকে কেটে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। খেজুরের আঁটির উপর পাথরের আঘাত করলে আঁটির যে অবস্থা হয় তার সাথে আমার এ আঘাতের কিছুটা তুলনা করা যায়। পিতার অবস্থা দেখে আবু জাহলের পুত্ৰ ইকরিম আমার কাধে তলোয়ার দিয়ে আঘাত করে। ফলে আমার বাহু গোড়ার দিক থেকে কেটে যায় এবং সামান্য চামড়ার সাথে লেগে বুলিতে থাকে। ঝুলন্ত হাত পেছন দিকে রেখে আমি লড়াই করে চললাম। কিন্তু এতে যুদ্ধ করতে অসুবিধা হওয়ায় ঝুলন্ত হাতটি পায়ের নীচে রেখে এক টানে ছিড়ে ফেললাম।

ইবন ইসহাক বলেন, মুআয ইবন আমর ইবন জামূহ (রা) হযরত উছমান (রা)-এর খিলাফতকাল পর্যন্ত জীবিত ছিলেন। আবু জাহলের পা কাটা যাওয়ার পর মুআওয়ায ইবন আফরা তার কাছে গেল এবং তরবারি দিয়ে তাকে প্রচণ্ড আঘাত করল। তারপর মুআওয়ায যুদ্ধ করতে করতে শহীদ হয়ে যায়। মুআওয়ায্যের আঘাতের পরেও আবু জাহল একেবারে মারা যায়নি— শ্বাস-প্রশ্বাস তখনও অবশিষ্ট ছিল। রাসূলুল্লাহ্ (সা) যখন নিহতদের মধ্যে আবু জাহলকে খোঁজার নির্দেশ দেন, তখন আবদুল্লাহ ইবন মাসউদ এসে আবু জাহলকে এ অবস্থায় দেখতে পান। ইবন ইসহাক বলেন, বর্ণনা সূত্রে আমি জেনেছি যে, রাসূলুল্লাহ (সা) যখন আবু জাহলকে নিহতদের মধ্যে সন্ধান করতে সাহাবাদেরকে নির্দেশ দেন তখন এ কথাও বলে

দিয়েছিলেন যে, আবু জাহলের লাশ শনাক্ত করতে যদি তোমাদের অসুবিধা হয়, তাহলে দেখবে তার একটা হাঁটুতে পুরাতন যখমের চিহ্ন আছে। ঘটনা হচ্ছে, আমি ও আবু জাহল বাল্যকালে একদিন আবদুল্লাহ ইবন জাদ আনের বৈঠকখানায় কোন এক বিষয়ে বিতর্কে লিপ্ত হই। আমি ছিলাম তার থেকে কিছুটা হালকা-পাতলা। বিতর্কের এক পর্যায়ে আমি তাকে ধাক্কা দেই। এতে সে উভয় হাঁটুর উপর উপুড় হয়ে পড়ে যায় এবং এক হাঁটুর চামড়া ছিড়ে যায়। সেই যখমের চিহ্ন আজ পর্যন্ত রয়ে গেছে। আবদুল্লাহ ইবন মাসউদ বলেন, আমি আবু জাহলকে দেখে চিনলাম। তখনও তার প্রাণ শেষ হয়ে যায়নি। আমি তার ঘাড়ের উপর আমার পা রাখলাম। কারণ, সে মক্কায় একবার আমার উপর চড়াও হয়ে আমাকে ঘুষি মারে ও নির্যাতন চালায়। তাকে সম্বোধন করে বললাম, ওহে আল্লাহর দুশমন! আল্লাহ তোমাকে লাঞ্ছিত করেছেন। আবু জাহল বলল, তোমরা একজন নেতৃস্থানীয় লোককে হত্যা করেছ, এতে লাঞ্ছনার কী আছে? আবু জাহল জিজ্ঞেস করল, আজকের জয় কোন দলের? আমি বললাম, আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের।

ইবন ইসহাক বলেন, বনু মািখযুম গোত্রের কিছু লোক জানিয়েছে, ইবন মাসউদ বলতেন : আবু জাহল আমাকে লক্ষ্য করে তখন বলেছিল : এক কঠিন স্থানে আরোহণ করেছে। হে তুচ্ছ মেষ রাখাল! এরপর আমি আবু জাহলের শিরচ্ছেদ করে রাসূল (সা)-এর সম্মুখে পেশ করে বললাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ! এ হচ্ছে আল্লাহর দুশমনের শির। রাসূলুল্লাহ (সা) তখন বললেন, সেই আল্লাহ কি সর্বশক্তিমান নন, যিনি ব্যতীত আর কোন ইলাহ নেই? এটা ছিল আল্লাহর রাসূলের পূর্ব ঘোষিত কসম। আমি বললাম, হ্যা, আল্লাহর কসম, যিনি ব্যতীত আর কোন ইলাহ নেই। এরপর আমি ছিন্ন মস্তকটি রাসূলুল্লাহ্ (সা)–এর সামনে রেখে দিলাম। তিনি আল্লাহর প্রশংসা করলেন। এ হচ্ছে ইবন ইসহাকের বর্ণনা। এ ঘটনা বুখারী ও মুসলিমে ইউসুফ ইবন ইয়াকুব … আবদুর রহমান ইবন আওফ থেকে বর্ণিত হয়েছে। তিনি বলেন, বদর যুদ্ধে আমি সৈন্যদের সারিতে দাঁড়িয়ে আমার ডানে-বামে তাকিয়ে দেখি আমি দু’জন আনসার বালকের মাঝখানে দণ্ডায়মান। তখন আমার মনে এ কামনা জাগল যে, এদের পরিবর্তে যদি দু’জন শক্তিশালী লোকের মাঝখানে থাকতাম। তবে কতই না ভাল হতো। এ সময় তাদের একজন আমাকে ইঙ্গিতে বলল, চাচা! আপনি কি আবু জাহলকে চিনেন? আমি বললাম, হ্যা, তবে তাকে দিয়ে তোমার কি প্রয়ােজন? সে বলল, আমি শুনেছি, সে নাকি আল্লাহর রাসূল (সা)-কে গালাগাল করে। ঐ সত্তার কসম! যার হাতে আমার জীবন, আমি যদি তাকে দেখতে পাই, তবে (তার উপর আক্রমণ করব এবং) ততক্ষণ পর্যন্ত ক্ষান্ত হব না যতক্ষণ না তার ও আমার মধ্যে একজনের মৃত্যু ঘটে। চাই যার মৃত্যুই আগে হোক না কেন? বালকটির কথা শুনে আমি অবাক হয়ে গেলাম। এরপর অপর বালকটিও আমাকে ইঙ্গিতে অনুরূপ কথা বলল। কিছুক্ষণের মধ্যেই দেখলাম, আবু জাহল তার লোকজনের মধ্যে ঘোরাফেরা করছে। তখন আমি বালক দু’টিকে বললাম, দেখ, এই যে সেই ব্যক্তি, যার সম্পর্কে তোমরা আমাকে জিজ্ঞেস করছিলে। এ কথা শুনামাত্র বালক দু’টি দ্রুত ছুটে যেয়ে আবু জাহলকে তরবারি দ্বারা আঘাত করে হত্যা করে ফেললো। এরপর উভয়ে ফিরে এসে নবী করীম (সাঃ)-কে এ সংবাদ পৌঁছিয়ে দিল। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, তোমাদের দু’জনের মধ্যে কে তাকে হত্যা করেছো? দু’জনের প্রত্যেকেই

দাবী করল, আমিই তাকে হত্যা করেছি। রাসূলুল্লাহ (সা) জিজ্ঞেস করলেন, তোমরা কি তোমাদের তরবারি পরিষ্কার করে ফেলেছ? তারা বলল, না। তখন রাসূল (সা) উভয়ের তরবারি পরীক্ষা করে বললেন, এরা দু’জনেই আবু জাহলকে হত্যা করেছে। বালক দুটির নাম (১) মুআয ইবন আমর ইবন জামূহ এবং (২) মুআয ইবন আফরা। তবে নিহত আবু জাহলের যুদ্ধাস্ত্র ও পোশাকাদি তিনি মুআয ইবন আমর ইবন জামূহকে প্রদানের সিদ্ধান্ত দেন।

ইমাম বুখারী বলেন, ইয়াকুব ইবন ইবরাহীম … আবদুর রহমান ইবন আওফ থেকে বণিত। তিনি বলেন, বদর যুদ্ধে আমি সৈন্যদের সারিতে দাঁড়িয়ে তাকিয়ে দেখলাম, আমার ডানে ও বামে দু’জন অল্প বয়সী কিশোর। এরূপ দু’জন কিশোৱেব মাঝখানে থাকায় আমি নিজেকে নিরাপদ মনে করলাম না। এমতাবস্থায় তাদের একজন অন্যজন থেকে গোপন করে আমাকে জিজ্ঞেস করল : চাচা, আবু জাহল লোকটা কে? আমাকে একটু দেখিয়ে দিন না! আমি বললাম, ভাতিজা! তাকে দিয়ে তুমি কি করবে? সে বলল, আমি আল্লাহর সাথে প্রতিজ্ঞা করেছি যে, যদি আবু জাহলের দেখা পাই তা হলে হয় তাকে হত্যা করব, না হয় নিজেই মারা যাব। এরপর দ্বিতীয় কিশোরটিও তার সঙ্গী থেকে গোপন করে আমাকে অনুরূপ জিজ্ঞেস করল! আবদুর রহমান বলেন, এদের কথা শুনে আমি এতই খুশী হলাম যে, এ কিশোরদ্বয়ের স্থলে দু’জন পূর্ণ-বয়স্ক লোকের মাঝে থেকেও আমি এতটা খুশী হতাম না। এরপর আমি তাদেরকে ইঙ্গিতে আবু জাহলকে দেখিয়ে দিলাম। তখন তারা দু’টি বাজপাখীর ন্যায় ক্ষিপ্ৰগতিতে তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়লো এবং সজোরে আঘাত হানল ৷ আবদুর রহমান বলেন, এরা দু’জন হল আফরার দু’পুত্ৰ।

এছাড়া বুখারী ও মুসলিমে হযরত আনাস ইবন মালিক থেকে বর্ণিত। বদর যুদ্ধে রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছিলেন, আবু জাহলের কি অবস্থা, কে তা দেখে আসতে পারে? ইবন মাসউদ বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমি দেখে আসতে প্ৰস্তৃত। এরপর ইবন মাসউদ যেয়ে দেখলেন, আফরার দু’পুত্র তাকে এমনভাবে প্রহার করেছে যে, সে ঠাণ্ডা হয়ে মুমূর্ষ অবস্থায় পৌছে গেছে। ইবন মাসউদ বলেন, আমি তার দাড়ি ধরে বললাম, তুমি কি আবু জাহল? সে বলল : যে ব্যক্তিকে তোমরা হত্যা করেছ কিংবা (রাবীর সন্দেহ) যে ব্যক্তিকে তার নিজের গোত্রের লোকেরা হত্যা করেছে, তাতে আর গৌরব কিসের? বুখারী শরীফে ইবন মাসউদ থেকে অপর এক হাদীছ বর্ণিত হয়েছে। সে বর্ণনায় আছে–তিনি আবু জাহলের নিকট এসে বললেন, আল্লাহ তোমাকে অপদস্থ করেছেন তো? আবু জাহল বলল, একজন লোককে তোমরা হত্যা করেছ, এতে আর আশ্চর্য হওয়ার কি আছে?

আমাশ আবু ইসহাক হতে আবু উবায়দা সূত্রে আবদুল্লাহ ইবন মাসউদ থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, বদর রণাংগনে আমি আবু জাহলের নিকট গেলাম। সে তখন মুমূর্ষ অবস্থায় পড়ে আছে। তার মাথায় শিরস্ত্ৰাণ এবং কাছে উন্নত তরবারি। পক্ষান্তরে আমার কাছে আছে একটি নিম্নমানের তরবারি। এ অবস্থায় আমি তার মাথায় আমার তরবারি দ্বারা আঘাত করতে লাগলাম এবং স্মরণ করতে থাকলাম মক্কার সেই ঘটনাকে যখন আবু জাহল আমার মাথায় আঘাত

১. তার নিজের বক্ষের দিকে ইঙ্গিত করে সে এ কথাটি বলেছিল।

سيبعد 8

করেছিল এবং আঘাত করতে করতে তার হাত দুর্বল হয়ে পড়লে আমি তার তরবারি ধরে বসলাম। সে তখন মাথা উচু করে বলল, বিপর্যয় কাদের, আমাদের, না তোমাদের? তুমি কি মক্কায় আমাদের মেষের রাখাল নও? ইবন মাসউদ বলেন, এরপর আমি আবু জাহলের মস্তক কেটে এনে রাসূল (সা)-এর নিকট এসে বললাম, আমি আবু জাহলকে হত্যা করেছি। তিনি তখন বললেন, ঐ আল্লাহর জন্যে কি সকল প্ৰশংসা নয়। যিনি ব্যতীত কোন ইলাহ নেই? তিনি তিনবার আমার থেকে শপথ নিলেন এবং আমাকে সঙ্গে নিয়ে কাফিরদের লাশের কাছে গেলেন এবং তাদের জন্যে বদ-দুআ করলেন।

ইমাম আহমদ … আবদুল্লাহ ইবন মাসউদ (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, : বদর যুদ্ধে আমি আবু জাহলের নিকট পৌঁছলাম। দেখলাম, তার পায়ে আঘাত এবং নিজের তরবারি দ্বারা লোকজনকে হটিয়ে দিচ্ছে। আমি বললাম, ওহে আল্লাহর দুশমন, আল্লাহ তোমাকে অপদস্থ করেছেন। সে বলল, এক ব্যক্তিকে তার নিজের গোত্রের লোকেরা হত্যা করলে তাতে আবার। অপদস্থ কিসের? এরপর আমি আমার ছোট তরবারি দিয়ে বারবার চেষ্টা করে তার হাতে লাগিয়ে দিলাম। এতে তার হাত থেকে তরবারি পড়ে গেল। আমি সেই তরবারি উঠিয়ে তাকে আঘাত করলাম এবং হত্যা করে ফেললাম। এরপর সেখান থেকে বেরিয়ে আমি এত দ্রুত রাসূলুল্লাহ (সা)–এর নিকট চলে আসলাম, মনে হল যেন যমীন আমার জন্যে সংকুচিত হয়ে গেছে। রাসূলুল্লাহ্ (সা)-কে আবু জাহলের মৃত্যু-সংবাদ জানালাম। তিনি বললেন, সেই আল্লাহর জন্যে কি সকল প্ৰশংসা নয়, যিনি ব্যতীত আর কোন ইলাহ নেই? এ বাক্যটি তিনি তিনবার বললেন। আমিও বললাম, ঐ আল্লাহর জন্যে কি সকল প্রশংসা নয়, যিনি ব্যতীত আর কোন ইলাহ নেই? ইবন মাসউদ বলেন, এরপর রাসূলুল্লাহ্ (সা) আমাকে সাথে নিয়ে চললেন এবং আবু জাহলের লাশের পাশে দাঁড়িয়ে বললেন :

الحمد لله الذى الخزاك الله يا عدو الله هذا كان فرعون هذه الامة

অর্থাৎ, “তাবত প্ৰশংসা সেই আল্লাহর, যিনি তোমাকে লাঞ্ছিত করেছেন হে আল্লাহর দুশমন। এ ছিল এই উম্মতের ফিরআওন।” অপর এক বর্ণনায় ইবন মাসউদ বলেন, রাসূল (সা.) আবু জাহলের তরবারিটি গনীমত হিসেবে আমাকে দান করেন।

আবু ইসহাক ফাযারী … আবদুল্লাহ ইবন মাসউদ থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, বদর যুদ্ধের দিনে আমি রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর নিকট এসে জানালাম, আমি আবু জাহলকে হত্যা করেছি। তিনি বললেন, সেই আল্লাহর জন্যে কি সকল প্ৰশংসা নয়, যিনি ব্যতীত আর কোন ইলাহ নেই? আমি বললাম, সেই আল্লাহর জন্যে কি সকল প্রশংসা নয়, যিনি ব্যতীত আর কোন ইলাহ নেই? দু’বার কিংবা তিনবার এ কথাটি বলা হল। এরপর নবী করীম (সা) বললেন, : আল্লাহ সর্বশ্রেষ্ঠ, যাবতীয় প্রশংসা সেই আল্লাহর, যিনি তাঁর প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন করেছেন, তার বান্দাকে সাহায্য করেছেন এবং শক্ৰ-বাহিনীকে একাই বিধ্বস্ত করেছেন। এরপর রাসূলুল্লাহ্ (সা) বললেন, চল, তুমি আমাকে আবু জাহলের লাশ দেখিয়ে দাও! আমি রাসূলুল্লাহ (সা)-কে নিয়ে তার লাশ দেখিয়ে দিলাম। লাশ দেখে তিনি বললেন :

هذا فرعون هذه الامة

“এ তো এই জাতির ফিরআওন।” আবু দাউদ ও নাসাঈ এ ঘটনাটি আবু ইসহাক সাবীঈ থেকে অনুরূপ বর্ণনা করেছেন। ওয়াকিদী বলেছেন : রাসূলুল্লাহ (সা) আফরার দুই পুত্রের শাহাদাতবরণের জায়গায় দাঁড়িয়ে এই দু’আ করেছিলেন যে, আল্লাহ আফরার দুই পুত্রের উপর রহমত বর্ষণ করুন। কেননা, তারা এই জাতির ফিরআওন ও কাফির নেতৃত্বের মূল নায়ককে হত্যা করেছে। এক ব্যক্তি জিজ্ঞেস করল, ইয়া রাসূলাল্লাহ! এ হত্যা কাজে তাদের সাথে আর কে শরীক ছিল? তিনি বললেন, ফেরেশতা ও ইবন মাসউদ এ হত্যা কাজে শরীক ছিল। বায়হাকী এ ঘটনা বর্ণনা করেছেন।

বায়হাকী … আবু ইসহাক সূত্রে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, বদর যুদ্ধে যে লোকটি আবু জাহলের নিহত হওয়ার সুসংবাদ নিয়ে রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর নিকট আসে, তার থেকে তিনি তিনবার শপথ নেন এবং জিজ্ঞেস করেন। ঐ আল্লাহর কসম, যিনি ব্যতীত আর কোন ইলাহ নেই, তুমি কি সত্যিই তাকে নিহত অবস্থায় দেখেছ? সে তিনবার কসম করে বলল, জী হ্যা, আমি তাকে নিহত অবস্থায়ই দেখেছি। তারপর রাসূলুল্লাহ্ (সা) সিজদায় পড়ে যান। এরপর বায়হাকী আবু নুআয়ম সূত্রে … আবদুল্লাহ ইবন আবু আওফা। সূত্রে বর্ণনা করেন : বদর যুদ্ধে যখন রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর নিকট বিজয়ের সুসংবাদ ও আবু জাহলের কর্তিত মস্তক আনা হয়, তখন তিনি দুরাকাআত সালাত আদায় করেন। ইবন মাজা আবু বিশ্বর বকর ইবন খালফ সূত্রে … আবদুল্লাহ ইবন আবু আওফা থেকে বর্ণনা করেন, যে দিন রাসূলুল্লাহ্ (সা)-কে আবু জাহলের শিরচ্ছেদের সুসংবাদ জানান হয়, সেদিন তিনি দুরাকাআত সালাত আদায় করেন।

ইবন আবৃন্দ দুনিয়া … শা’বী সূত্রে বর্ণনা করেন, জনৈক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ্ (সা)-কে বলল, আমি বদর প্রান্তর দিয়ে যাচ্ছিলাম। হঠাৎ দেখি একজন লোক মাটির নীচ থেকে উপরে উঠে আসছে। তখন আর একজন লোক লোহার হাতুড়ি দ্বারা তাকে এমনভাবে আঘাত করছে যে, সে মাটির নীচে দেবে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে। এরপরও সে আবার উঠছে এবং বারবার এরূপ করা হচ্ছে। এ কথা শুনে রাসূলুল্লাহ্ (সা) বললেন, : সে হল আবু জাহল। কিয়ামত পর্যন্ত তাকে এভাবে শাস্তি দেয়া হবে। উমাবী তাঁর মাগায়ী গ্রন্থে। . আমির সূত্রে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর নিকট এসে জানায় যে, আমি দেখতে পেলাম জনৈক ব্যক্তি বদর প্ৰান্তরে বসে আছে। অন্য একজন লোহার ডাণ্ডা দিয়ে তাকে এমন জোরে আঘাত করছে যে, সে মাটির নীচে তলিয়ে যাচ্ছে। তা শুনে রাসূলুল্লাহ্ (সা) বললেন, বসে থাকা ঐ লোকটি হচ্ছে। আবু জাহল। তার জন্যে একজন ফেরেশতা নিযুক্ত করা হয়েছে। যখনই সে মাটির নীচ থেকে উঠবে, তখনই ঐ ফেরেশতা তাকে এভাবে পিটাতে থাকবেন। এভাবে কিয়ামত পর্যন্ত চলবে।

ইমাম বুখারী উবায়দুল্লাহ ইবন ইসমাঈল সূত্রে … উরওয়া থেকে বর্ণনা করেন যে, তিনি

বলেছেন, আমার পিতা যুবােয়র (রা) বলেছেন, বদর যুদ্ধে উবায়দা ইবন সাঈদ ইবন আস-এর সাথে আমার মুকাবিলা হয়। তার গোটা দেহ বর্ম দ্বারা এমনভাবে আবৃত ছিল যে, দু’টি চোখ ব্যতীত আর কিছুই দেখা যাচ্ছিল না। তাকে আবু যাতিল-কারিশ’ বলে ডাকা হত। সে নিজের পরিচয় দিয়ে বলল, আমি আবু যাতিল-কারিশ। এ কথা শুনে আমি তার উপর বর্শা দিয়ে হামলা করলাম এবং বর্শা তার চোখে বিদ্ধ করে দিলাম। এতে সেখানেই সে মারা গেল। হিশাম, বলেন,

এ ঘটনা প্রসঙ্গে আমি আরও শুনেছি, যুবােয়র বলেছেন, আমি উবায়দার লাশের উপর পা দিয়ে চেপে ধরে বর্শাটি টেনে বের করি। বর্শার দু’পাশ বাঁকা হয়ে গিয়েছিল। উরওয়া বলেন, পরে রাসূলুল্লাহ্ (সা) ঐ বর্শাটি চেয়ে পাঠালে যুবােয়র তাকে তা দিয়ে দেন। রাসূলুল্লাহ (সা)-এর ইনতিকালের পরে যুবােয়র তা নিয়ে আসেন। এরপর হযরত আবু বকর চেয়ে পাঠালে যুবােয়র বর্শাটি তাঁকে প্রদান করেন। হযরত আবু বকরের ইনতিকাল হলে হযরত উমর (রা) বর্শাটি

নিয়ে নেন। এরপর হযরত উছমান (রা) বর্শাটি চান এবং তাকে তা প্ৰদান করেন। হযরত উছমানের শাহাদাতের পর বর্শাটি হযরত আলী (রা)-এর পরিবারের হাতে আসে। এরপর আবদুল্লাহ ইবন যুবােয়র (রা) তা নিয়ে নিজের কাছে রাখেন এবং শহীদ হওয়া পর্যন্ত সেটি তার কাছেই ছিল। ইবন হিশাম, আবু উবায়দা প্রমুখ মাগায়ী বিশেষজ্ঞদের থেকে বর্ণনা করেছেন যে, হযরত উমর ইবন খাত্তাব একদিন সাঈদ ইবন আস-এর কাছ দিয়ে যাওয়ার সময় তাকে বললেন, আমার মনে হয় তোমার মনের মধ্যে এমন একটা ধাৰণা বদ্ধমূল আছে যে, আমি তোমার পিতাকে (বন্দর যুদ্ধে) হত্যা করেছি। যদি আমি তা করতাম, তবে সে জন্যে তোমার নিকট কোন ওযর পেশ করতাম না। আমি সেদিন আমার মামা আস ইবন হিশাম ইবন মুগীরাকে হত্যা করেছিলাম। তোমার পিতা আমার সামনে পড়েছিল বটে কিন্তু তাকে ক্ষিপ্ত ষাঁড়ের ন্যায় হুংকার দিয়ে আসতে দেখে আমি সরে পড়ি। এরপর তার চাচাত ভাই আলী তাকে

হত্যা করে।

ইবন ইসহাক বলেন : বনী আবদে শামস-এর মিত্র বনী আসাদ গোত্রের সন্তান উক্কাশা ইবন মিহসান ইবন হারছান বদর যুদ্ধে এমন তীব্র লড়াই করছিলেন যে, তার তরবারিখানা ভেঙ্গে যায়। তখন তিনি রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর নিকট আসলেন। রাসূলুল্লাহ একখণ্ড কাঠ দিয়ে বললেন, উক্কাশা! যাও এ নিয়ে তুমি যুদ্ধ কর! উক্কাশা। কাঠখণ্ডটি নিয়ে নাড়া দিতেই তা একটি ধারাল লম্বা চকমকে তলোয়ারে পরিণত হয়। মুসলমানদের বিজয় লাভ পর্যন্ত তিনি ঐ তরবারি দ্বারা যুদ্ধ চালিয়ে যান। ঐ তরবারির নাম রাখা হয়েছিল আল আওন” (সাহায্য)। এই তরবারি সব সময় উক্কাশার কাছে থাকত। এ নিয়ে তিনি রাসূলুল্লাহর সাথে প্রতিটি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতেন। অবশেষে মুরতাদদের বিরুদ্ধে জিহাদ করতে গিয়ে ভণ্ড নবী তুলায়হা আসাদীর হাতে তিনি শহীদ হন। এ সম্পর্কে তুলায়হা একটি কবিতা আবৃত্তি করেছিল যার একটি পংক্তির অর্থ নিম্নরূপ :

“সেই সন্ধ্যার কথা স্মরণ করা, যখন আমি যুদ্ধের ময়দানে ইবন আকরাম ও উক্কাশা

তুলায়হা অবশ্য এরপর ইসলাম গ্রহণ করেছিল। পরে এ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হবে। ইবন ইসহাক বলেন, রাসূলুল্লাহ্ (সা) একদা এই মর্মে সুসংবাদ দিয়েছিলেন যে, তাঁর উম্মতের মধ্য হতে সত্তর হাযার লোক বিনা হিসাবে জান্নাতে যাবে–এদের কোন শাস্তি হবে না। ’ তখন এই উক্কাশা বলেছিলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনি দুআ করুন, যাতে আল্লাহ আমাকেও তাদের অন্তর্ভুক্ত করেন। রাসূলুল্লাহ্ (সা) দুআ করলেন, হে আল্লাহ! আপনি উক্কাশাকে তাদের অন্তর্ভুক্ত করুন! এ ঘটনা। সহীহ ও হাসানসহ বিভিন্ন পর্যায়ের হাদীছে বর্ণিত হয়েছে।

ইবন ইসহাক বলেন, আমি জানতে পেরেছি, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছিলেন? আরবের শ্রেষ্ঠ অশ্বারোহী যোদ্ধা আমাদের মধ্যে রয়েছে। সাহাবীগণ জিজ্ঞেস করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! সে লোকটি কে? তিনি বললেন : উক্কাশা ইবন মিহসীন। তখন যিরার ইবন আযওয়ার বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! সে তো আমাদের গোত্রের লোক। রাসূলুল্লাহ (সা) বললেন, : সে তোমাদের লোক নয়। বরং মৈত্রী সূত্রে সে আমাদের লোক। বায়হাকী হাকিম থেকে ওয়াকিদী সূত্রে … . উছমান খাশানীর ফুফু থেকে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, উক্কাশা ইবন মিহসান বলেছেন : বন্দর যুদ্ধে আমার নিজের তরবারিটি ভেঙ্গে যায়। তখন রাসূলুল্লাহ (সা) আমাকে একখানা কাঠ দিলেন। আমার হাতে এলে তা একটি ঝকঝকে লম্বা তরবারিতে রূপান্তরিত হয়ে যায়। আমি এ তরবারি দ্বারা মুশরিকদের পরাজিত হওয়া পর্যন্ত যুদ্ধ করি। মৃত্যু পর্যন্ত এ তরবারি তার কাছেই ছিল। ওয়াকিদী উসামা ইবন যায়দ সূত্রে দাউদ থেকে বর্ণনা করেন। তিনি বনু আবদিল আশহাল গোত্রের কয়েক ব্যক্তি থেকে বারবার শুনেছেন যে, বদর যুদ্ধে সালামা ইবন হুরায়শের তরবারি ভেঙ্গে যায়। তিনি নিরস্ত্র হয়ে পড়েন। তখন রাসূলুল্লাহ্ (সা) তাঁকে একটা ডাল দেন। ইবন তাবের খেজুরবীথি থেকে তিনি এটা সংগ্রহ করেছিলেন। রাসূলুল্লাহ (সা) বললেন, : তুমি এটা দিয়ে শক্রকে আঘাত কর। ডালটি অমনি একটি উত্তম তরবারিতে পরিণত হয়ে যায়। এ তরবারিখানা তার কাছে আবু উবায়দার নেতৃত্বে পরিচালিত “জাসার যুদ্ধ পর্যন্ত অক্ষুন্ন ছিল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *